তরুণ অরুণের কনক-কিরণ-রাগে চতুর্দিকে আলোকিত হইয়াছে। প্রভাত-পবন-বনভূমির স্বভাবজাত কুসুমগন্ধ বহন করিয়া মৃদুমন্দ সঞ্চরণ করিতেছে। শিশির-সিক্ত পাতায় পাতায় সূর্যের রশ্মি পতিত হইয়া শ্যামলিমার অঙ্গে লালিমার কি অপূর্ব বাহার খুলিয়াছে! নানাজাতীয় বিচিত্র-বর্ণ-বিচিত্র-পক্ষ সুধাকণ্ঠ বিহঙ্গগণ কুজন-লহরীতে বিশাল আরণ্য প্রকৃতিকে মুখরিত এবং পুলকিত করিয়া তুলিয়াছে! এমন সময়ে কৃষ্ণগড় ও রায়গড়ের সীমানাস্থিত অরণ্যে মৃগয়ার জন্য শিবাজী এবং আফজাল খাঁ কতিপয় শিকারী অনুচর, বহুসংখ্যক কুক্কর, বাজপী ও পালিত চিতা বাঘ সহ প্রবেশ করিলেন। পঞ্চাশটি হস্তী শিকারী ও শিকারের সরঞ্জাম বহন করিয়া নিবিড় অরণ্য তোলপাড় করিয়া ক্রমশঃ গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করিল। হস্তিযুগল ভয়ে বিহঙ্গগণ ত্রাসিত হইয়া চতুর্দিকে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় উড়িতে লাগিল। মৃগ, কৃষ্ণসার ও অন্যান্য আরণ্যজন্ত চতুর্দিকে ভয়ে ছুটিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। শিকারীগণ কেহ তীর, কে বা বন্দুকের দ্বারা মৃগ শিকার করিতে লাগিল।
শিকার করিতে করিতে ক্রমশঃ আফজাল খাঁ এবং শিবাজী একটি ক্ষুদ্র পাবর্ত-নদীর তটে গভীর বনে উপস্থি হইলেন। এই নিবিড় বনের একটানা শ্যামল-শোভা-দেখিয়া আফজাল খাঁ নিতান্তই বিমোহিত হইলেন। এই বনে সিংহ বাস করিত বলিয়া সাধারণ শিকারীরা প্রায় এ-দিকে পদাপর্ণ করিত না। কিন্তু আফজাল খাঁর সিংহ এবং ব্যাঘ্র শিকারের অপরিমিত কৌতূহল ছিল বলিয়া এই বনে স্বেচ্ছায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বনের নিবিড় প্রদেশে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ দুই হস্তে বক্রমুখ ক্ষুদ্রাকৃতি দুইখানি তরবারি ধারণপূর্বক হস্তিপৃষ্ঠ হইতে অবতরণপূর্বক দুইজন অনুচর সহ পদব্রজে বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এই সিংহ-নিবাস বনে প্রবেশ করিতে অনেকেরই অমত ছিল। কিন্তু পাঠান বীর আফজাল খাঁর জ্বলন্ত উৎসাহ এবং দৃঢ়তার নিকট সকলের আপত্তি ও ভীতি প্লাবনের মুখে তৃণগুচ্ছের ন্যায় ভাসিয়া গেল। আফজাল খাঁর পশ্চাতে আরও পাঁচজন বীরপুরুষ তরবারি মাত্র হস্তে ধারণ করিয়া সেই শ্বাপদ-সঙ্কুল ভয়াবহ বনে প্রবেশ করিলেন। শিবাজী এবং তাঁহার অন্যান্য মারাঠা অনুচর এবং আফজাল খাঁর সঙ্গীয় অন্যান্য যোদ্ধা ও শিকারী হস্তিপৃষ্ঠে সেই নিবিড় বনের মধ্যে খাঁ সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রবেশ করিল।
বনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সকলেই প্রকান্ড শাল, গজারী, দেবদারু, তমাল, তাল প্রভৃতি বৃক্ষ দর্শনে স্তম্ভিত হইলেন। বহুকালের বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ হইয়া এই নিবিড় বন যার-পর-নাই গম্ভীর দৃশ ধারণ করিয়াছিল। এই কারণে সূর্যরশ্মি কদাচিৎ প্রবেশ করিত। আফজাল খাঁ অনুচর পঞ্চকসহ সেই নিবিড় বনে সিংহ শিকারের জন্য তরবারি হস্তে ক্রমশঃ ধীরে ধীরে জঙ্গল ভাঙ্গিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অগ্রসর হইতে হইতে এক ক্ষুদ্র পবর্তমূলে একটি গুহার সম্মুখীন হওয়া মাত্র সহসা দুইটি সিংহ ভীষণ গর্জনে অরণ্যভূমি প্রকম্পিত করিয়া উল্লস্ফপূর্বক আফজাল খাঁর উপর পতিত হইবার উপক্রম করিল। তখন মহাবীর আফজাল খাঁ এবং সহচরগণ মুহুর্ত মধ্যে সাবধান হইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে সিংহ লক্ষ্যে তরবারি ধারণ করিলেন। এই সময় বীরবর আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীদের বদনে অপূর্ব দৃঢ়তা এবং বীরত্বের তেজঃ অতি চমৎকাররূপে ফুটিয়া উঠিল। সিংহ আফজাল খাঁর উপরে পতিত হইবার প্রাক্কালে মহাসাহসী আফজাল খাঁ তরবারির প্রচন্ড আঘাতে সিংহের গ্রীবাচ্ছেদন করিয়া লস্ফ প্রদানপূর্বক দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। সিংহিনীও আফজাল খাঁ সরিয়া যাওয়ার তাঁহার উপরে আপতিত হইতে না পারিয়া মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল এবং পর মুহুর্তেই লম্ফ প্রদানপূর্বক বিদ্যুদ্বেগে আফজাল খাঁর বাম বাহুর উপরে পতিত হওয়া মাত্রই খাঁ সাহেব দক্ষিণ হস্তের অসির ভীষণ আঘাতে সিংহিনীর মস্তক বিদ্ধ করিয়া ফেলিলেন।
অর্ধহস্ত পরিমিত তরবারির অগ্রভাগ সিংহিনীর মস্তক মধ্যে প্রবেশ করায় সে ভীষণ হুঙ্কার করিয়া দূরে যাইয়া পতিত হইল। আফজাল খাঁ অসির দ্বিতীয় আঘাতে সিংহিনীটিকেও দ্বিখন্ড করিয়া ফেলিলেন। সকলে আফজাল খাঁর সাহস এবং কৌশল দেখিয়া বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া মুক্তকণ্ঠে ‘সাবাস! সাবাস!’ করিতে লাগিল।
আফজাল খাঁর বাম বাহুতে সিংহিনীটা একটু নখর বসাইয়া দিয়াছিল, সেখানে কিঞ্চিৎ চূর্ণ ঔষধ প্রয়োগ করিয়া পট্রি বাঁধিয়া দেওয়া হইল।
সকলে আফজাল খাঁকে বনপ্রবেশে নিরস্ত হইতে বলিলে, তিনি স্মিত হাস্য করিয়া বিপুল উৎসাহে আরও সম্মুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এদিকে হস্তিপৃষ্ঠে থাকিয়া শিবাজী এবং অন্যান্য বীরপুরুষ ও শিকারীগণ বহু মৃগ, চিতা, বন্য-কুক্কুট, ময়ূর ও অন্যান্য পক্ষী শিকার করিলেন। অতঃপর দ্বিপ্রহর সমাগমে সকলে এক মনোহর উপত্যকায় উপনীত হইয়া আহারের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন।
এইস্থলে নির্মল ও বিশুদ্ধ জলের একটি ঝরণা হইতে অতি বেগে জলরাশি উঞ্ছগত হইতেছিল। ছায়াযুক্ত প্রকান্ড প্রকান্ড বৃসমূহ বিরাজমান থাকায় চন্দ্রাতাপের কার্য সাধিত হইল। সঙ্গে তাম্বুর অভাব না থাকিলেও তাহা খাটাইবার কোনও প্রয়োজন বোধ হইল না। মারহাট্টা এবং মুসলমানগণ পৃথক পৃথক স্থানে মৃগয়ালব্দ নানা জাতীয় মৃগ ও পক্ষিমাংসের কাবাব, কোফ্তা এবং কোরমা প্রস্তুতপূর্বক উদরপূর্তি করিলেন। ঝরণার জল পান করিয়া সকলেই তৃপ্ত হইলেন।
কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিবার পরে সূর্যের তেজঃ কিছু মন্দীভূত হইলে, আফজাল খাঁ এবং শিবাজী দলবল সহ হস্তিপৃষ্ঠে কৃষ্ণগড়ের সীমান্তের দিকে মৃগয়া করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সূর্যাস্তের কিঞ্চিৎ পূর্বে এক বনের ভিতর দিয়া যাইবার সময় সহসা একটি প্রকান্ডকায় ভীষণ ব্যাঘ্র একটি উচ্চ ভূখন্ড হইতে লম্ফ প্রদানপূর্বক একেবারেই শিবাজীর উপর পতিত হইল! হঠাৎ ব্যাঘ্রের আক্রমণে শিবাজী যার-পর-নাই আড়ষ্ট এবং হতবুদ্ধি হইয়া হস্তিপৃষ্ঠ হইতে ভূপতিত হইলেন। ব্যাঘ্ররাজ শিবাজীর গ্রীবা ভাঙ্গিয়া রক্তপান করিবার উদ্যোগ করায় চতুর্দিকে একটি ভীতিজনক অস্ফুট রব উত্থিত হইল। শিবাজীর হস্তের তরবারিখানি ভূপতিত হইবার সময়ে দূরে ছিটকাইয়া পড়িয়াছিল। কোষে আর একখানি তরবারি থাকিলেও শিবাজী ভয়ে মূর্চ্ছিত হইয়া আত্মরক্ষার উদযোগ করিতে অসমর্থ ছিলেন।
সকলেই শিবাজীর আসন্নমৃত্যু কল্পনা করিয়া যখন ভীত ও ব্যাকুল হইতেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে সকলে বিস্ময়-বিস্ফোরিত-নেত্রে দেখিতে পাইল যে, মহা সাহসী আফজাল খাঁ হস্তিপৃষ্ঠ হইতে তরবারি হস্তে বেগে লম্ফ প্রদানপূর্বক ভূমিতলে দন্ডায়মান হইবার পূর্বেই প্রচন্ড আঘাতে ব্যাঘ্ররাজকে দ্বিখন্ড করিয়া মূর্চ্ছিত শিবাজীকে ভূমি হইতে উত্তোলন করিলেন। চতুর্দিকে হইতে হর্ষ-রসাপ্লুত কণ্ঠে “সাবাস! সাবাস!” শব্দ উত্থিত হইল।
আফজাল খাঁর সাহস, কার্যতৎপরতা এবং সত্বরতা দেখিয়া সকলেই অবাক হইয়া গেল! শিবাজী ভক্তিগদ্গদ্ কণ্ঠে তাঁহার প্রাণদাতা বীরবরকে পুনঃ পুনঃ মুক্ত কণ্ঠে ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন। নিজের আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা জানিয়াও যিনি পরের প্রাণ রক্ষার জন্য ভীষণ ব্যাঘ্রের মুখে লম্ফ প্রদানপূর্বক পতিত হইতে পারেন, তাঁহার বীরত্ব ও পরহিতৈষণার তুলনা কোথায়?
এই ঘটনার পরে আফজাল খাঁর লোকজন আর অগ্রসর না হইয়া রায়গড়ে ফিরিয়া যাইবার জন্য মত প্রকাশ করিলেও, শিবাজী অত্যন্ত আগ্রহতিশয্যে পুনঃ পুনঃ কৃষ্ণগড়ের প্রান্ত পর্যন্ত যাইবার জন্য জেদ ও উৎসাহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহার উৎসাহে মহাবীর আফজাল খাঁ সাহেব উৎসাহিত হইয়া আরও অগ্রসর হইয়া রাত্রি যাপনের মত প্রকাশ করিলেন, সুতরাং শিকারীর দল আবার অগ্রসর হইতে লাগিল।
বেলাও তখন খুব বেশি ছিল না। খুব দ্রুত গমন করিলেও এক প্রহর রাত্রির পূর্বে কৃষ্ণগড়ের প্রান্ত পর্যন্ত উপস্থিত হইবার কোনই আশা ছিল না। সুতরাং মাহুতেরা হস্তিযুথকে খুব দ্রুত গমনের জন্য বিশেষ তাড়া করিল। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইবার পর সকলেই বিস্মিত দৃষ্টিতে দর্শন করিল যে, নিবিড় অরণ্যানীর মধ্য হইতে সহসা সর্বাঙ্গ-বর্মমন্ডিত একজন অশ্বারোহী এক ক্ষুদ্র পর্বতের পার্শ্ব হইতে আফজাল খাঁর সম্মুখীন হইয়া অভিবাদনপূর্বক এখখানি পত্র প্রদান করতঃ পর মুহূর্তেই বিদ্যুদ্বেগে অশ্বচালনা করিয়া সেই নিবিড় বনের অন্তরালে অদৃশ্য হইয়া গেল। আফজাল খাঁ পত্র পাঠ করিয়া তাহাকেও কিছু না বলিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। জনৈক পার্শ্বচর পত্রের কথা জিজ্ঞাসা করিলে আফজাল খাঁ বলিলেন যে, পত্রখানি বিজাপুর হইতে আসিয়াছে। সোলতান তাঁহাকে শীঘ্রই রাজধানীতে ফিরিবার জন্য লিখিয়াছেন।
শিবাজী সহসা সেই অশ্বারোহীদের আগমন এবং দ্রুত গমনে কিঞ্চিৎ বিচলিত হইয়া কয়েকজন সৈনিককে তাহার অনুসরণ করিবার জন্য ইঙ্গিত করিলেন। কয়েকজন সৈনিককে কয়েকজন মারাটী অশ্বারোহী সেই অশ্বারোহীর পশ্চাদ্ধবনের উপক্রম করায় আফজাল খাঁ কঠোর দৃঢ়তার সহিত তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া বলিলেন যে, অশ্বারোহী বিজাপুর সোলতানের খাস সংবাদবাহক। তাহাকে সন্দেহ করিবার কিছুই নাই। সুতরাং অশ্বারোহীগণ আর তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইল না। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইবার পরে আফজাল খাঁ শিবাজীর পশ্চাতে পড়িবার চেষ্টা করিয়া শিবাজীকে বলিলেন, “এখানের পথ নিতান্তই সঙ্কীর্ণ বিশেষতঃ অন্ধকার হয়ে আসছে, আমার মাহুত ভাল দেখতে পাচ্ছে না, আপনার হাতীটাকে আগে চালান। তা’ হ’লে আমার হাতী তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাওয়ার সুবিধা পাবে।”
শিবাজী অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিলেন, “হায়! তাও কি হায়! আপনাকে পিছে রেখে আমি অগ্রে যাব, তা’ তখনও মনে করবেন না। আমা দ্বারা এরূপ বে-আদবী কখনও হবে না।”
আফজাল খাঁ হস্তী থামাইয়া শিবাজীকে অনেক পীড়াপীড়ি করিলেন; কিন্তু শিবাজী কিছুতেই অগ্রগমনে সম্মত হইলেন না। সুতরাং অগত্যা আফজাল খাঁই পূর্বের ন্যায় অগ্রগামী হইলেন। এক সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ শিবাজীকে আবার অগ্রগমনের জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন। শিবাজী পুনরায় অস্বীকৃত হইলেন। আফজাল খাঁ তখন সেইস্থলে হস্তী হইতে অবতরণপূর্বক সঙ্গী সৈন্যদিগকে আহবান করিয়া বলিলেন, “তোমরা কয়েক খন্ড গুরুভার প্রস্তর এই রাস্তার উপর দিয়ে সাবধানে সম্মুখের দিকে গড়িয়ে লয়ে যাও। এই রাস্তায় ঘোড়াডুবি-গর্ত আছে।”