অন্তঃপুরস্থ একটি অট্রালিকার সজ্জিত কক্ষে তারাবাঈ একটি জানালার ধারে বসিয়া গভীর চিন্তাসাগরে নিমগ্ন। তারাবাঈয়ের সখী মঞ্জরীমালা এবং ধাত্রী সারদা উভয়ের গাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত। ছটায় সমস্ত ক আলোকিত করিয়া জাগিয়া জাগিয়া কি যেন চিন্তা করিতেছে। বাতায়ন-পথে হেমস্তের ঈষৎ শীতল সমীরণ ধীর গতিতে প্রবাহিত হইয়া যুবতীর কুঞ্চিত অলকরাজি এবং চেলাঞ্চল লইয়া ক্রীড়া করিতেছে।
যুবতী যেমনি সুন্দর সুঠাম, তেমনি বেশ তেজস্বিনী অথচ মূর্তিবিশিষ্ট। যুবতী শিশিরসিক্ত বালার্কের নব অরুণিমা-রাগ-রঞ্জিত বস্রাই গোলাপের ন্যায় মনোহর! অথবা শারদীয় ঊষার ন্যায় চিত্তহারিণী। সমগ্র মহারাষ্ট্রে তারাবাঈয়ের ন্যায় সুন্দরী যুবতী আর একটি আছে কি-না সন্দেহ। তারাবাঈকে দেখিলে, তাহাকে আদৌ মারাঠা-কন্যা বলিয়া বোধ হইত না। মনে হয়ত, যেন কোনও ইরাণী-সুন্দরী মারাঠী পরিচ্ছদে দেহ সাজাইয়া অন্তঃপুর আলো করিয়া বিরাজ করিতেছে। যৌবনসমাগমে তারা বর্ষার নদীর ন্যায়, বসন্তের গোলাপের ন্যায়, শরতের পদ্মের ন্যায়, ঊষার তারকার ন্যায়, পরিপুষ্ট, কমনীয়, লোভনীয় এবং শোভনীয় হইয়াছে! তাহার অন্তরের চন্দ্রদর্শনে নদনদী সমুদ্রের স্থির জল যেমন স্ফীত হইয়া উঠে, তারাবাঈয়ের স্থির অচঞ্চল হৃদয়ও আজ তেমনি অসাধারণ সৌন্দর্যশালী পুরুষত্ব আফজাল খাঁকে দর্শন করিয়া প্রেমানুরাগে অধীর ও আকুল হইয়া উঠিয়াছে। যে মালোজীর সঙ্গে তারার বিবাহের কথা হইয়াছে, যে মালোজীর বীরত্বের কথা শুনিয়া এবং বীর্যপুষ্ট-দেহ-কান্তি এবং রূপশ্রী দেখিয়া তারাবাঈ মুগ্ধ হইয়াছিল, আজ সেই মালজীর শ্রী ও কান্তি তারার কাছে তেমন চিত্তবিনোদন বলিয়া আর প্রতিভাত হইতেছে না। তারা মনে মনে তাহার ইষ্টদেবতা শঙ্করকে ধন্যবাদ দিতে লাগিল যে, মালোজীর সহিত বিবাহের পূর্বেই সে আফজাল খাঁর ন্যায় পুরুষরত্নের দর্শন পাইয়াছে। আশার সহিত দারুণ নিরাশায় তাহার চিত্ত ঝঞ্জানিল-সন্তাড়িত সরসীর ন্যায় উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছে।
আফজাল খাঁকে দেখিয়া তারা হৃদয়-মন তাঁহার চরণতলে লুটাইয়া পড়িয়াছে। কিন্ত হায়! প্রকাশ্যে তাহা উৎসগ করিবার কোনও উপায় হইবে কি? পিতার শক্রপক্ষীয় সেনাপতির প্রতি অনুরাধ, কি ভয়ানক কথা! কি অসম্ভব ব্যাপার! তারাবাঈ প্রেমোদ্বেল চিত্তকে নানা প্রকারে শান্ত ও সংযমিত করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিল; কিন্তু কৃতকার্যতার অপেক্ষা পরাজয়ের মাত্রাই আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তারা বড়ই বিপদে উজ্জ্বল ও তাঁহার প্রতি প্রেমাশক্তি ততই শত গুণে দৃঢ় বদ্ধমূল হইতে লাগিল। তারার দুই কপোল বহিয়া অশ্রুধারা মুক্তাধারার ন্যায় গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।
তারা যতই পাঠান বীরকে ভুলিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল, মন ততই বলিতে লাগিল, আহা! তাঁহাকে কি ভোলা যায়! কি চমৎকার মোহিনী মূর্তি! মরি! মরি! কি রূপেরই বাহার! কি কান্তির ছটা! কি তেজঃ! কি সাহস! কি স্ফূর্তি! যেন সাক্ষাৎ কার্তিক। কি লাবেণ্যর জোয়ার! কি ভুবনভুলানো অক্ষিযুগল! এমন নব্য যুবক, এমন সুঠাম ও সুশ্রী তিজস্বী পুরুষ! হায়! উহার চরণে আত্মবলিদানেও যে সুখ! উহার কথা স্মরণ করিতেও যে হৃদয় অমৃতরসে সিক্ত হইয়া যায়।
তারাবাঈ আফজাল খাঁকে ভুলিবার জন্য চেষ্টা করিয়া, আফজাল খাঁর প্রেমোম্মাদনায় আরও উন্মুত্ত হইয়া পড়িল। ধৈর্যের বাঁধ একেবারেই ভাঙ্গিয়া গেল! মনে হইতে লাগিল, কিসে যেন হৃৎপন্ডিটাকে আফজাল খাঁর দিকে সবেগে আকর্ষণ করিতেছে! তাহার শরীরের অণু-পরমাণু যেন শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আফজাল খাঁর প্রতি ছুটিয়া যাইতে চাহিতেছে! কি ভীষণ ব্যাপার! কি অভূর্তপূর্ব ঘটনা! যুবতী বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া পড়িল! বস্তুতঃ প্রেমের আকর্ষণের নিকট সকল আকর্ষণই পরাস্ত! প্রেমের প্রভাবের নিকট সকল প্রভাবকেই খর্ব হইতে হয়। মানব ক্ষুদ্র জীব! তাহার হৃদয়টি আরও ক্ষুদ্র! কিন্তু এই ক্ষুদ্র হৃদয়-সঞ্জাত প্রেমের ধারা সারা বিশ্বকে ভাসাইয়া দিতে পারে।
এই প্রথম যৌবনের প্রথম প্রেমের উচ্ছ্বসিত আবেগে তারা অধীর ও আকুল হইয়া উঠিল! তারাবাঈ আকুল প্রাণ লইয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িল। এদিকে সেদিকে, প্রাঙ্গণের ধারে, দীঘির পাড়ে চিন্তা-ভারাক্রান্ত চিত্তে ভ্রমণ করিতে লাগিল! আর পুনঃ পুনঃ তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে আফজাল খাঁর অবস্থান অট্রালিকার দিকে দৃকপাত করিতে লাগিল। তারা বেড়াইতেছে কিন্তু হৃদয়ের উদ্বেগ ও কামনার আগুন তাহাকে উন্মত্ত প্রায় করিয়া রাখায় কিছুতেই সাশন্ত পাইতেছে না। তারা ক্রমশ বেড়াইতে বেড়াইতে আপন মনে বাগানের দিকে চলিল। যাইতে যাইতে ক্রমণ বাগানটির রমণীয় সৌধের নিকটবতী হইল। সৌধ দেখিয়া মনে হইল, এই নির্জন সৌধ আফজাল খাঁকে পাইলে সে অশ্রুজলে তাঁহার পদতল অভিষিক্ত করিয়া দিত। কিন্তু হায়! তাহার গগ্ধ অদৃষ্টে এ সুযোগ কখনও জুটিবে কি? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে সেই নির্জন সৌধের যেমনি নিকটবর্তী হইল, অমনি শুনিতে পাইল “আফজাল খাঁকে সেরূপেই হউক, হত্যা করতে হবে। শক্রকে ছলে-বলে-কৌশলে যেকোনও প্রকারে হত্যা করা পরম ধর্ম।”
সহসা বজ্রাঘাত হইলেও তারাবাঈ কখনও এরূপ চমকিত ও আতঙ্কিত হইত না। তারার প্রেমের পাত্র আফজাল খাঁর হত্যার সিদ্ধান্ত শুনিয়া তাহার হৃদয়ের স্পন্দন যেন রুদ্ধ হইয়া গেল! একজন মহা পরাক্রান্ত মতাশালী সেনাপতিকে প্রবৃত্তি এবং ভীষণ হীনতা যে মানুষের মনে স্থান পাইতে পারে, ইহা কিছুতেই সেই সরলা তরলা প্রেমাবিহবলা কুমারীর পক্ষে বুঝিয়া উঠা বা ধারণা করা সজন ছিল না। তাহার পিতা শিবাজী ডাকাতি করেন বটে, কিন্তু এমনি করিয়া ছলনা-পূর্বক যে ঠগীর ন্যায় নির্দোষ ব্যাক্তির প্রাণবধ করিতেও পটু, তাহা জানিতে পারিয়া পিতার প্রতি বিষম ঘৃণা ও অশ্রদ্বার ভাবে হৃদয়ে ব্যথিত হইয়া উঠিল!
এক্ষণে কিরূপে তাহার হৃদয়-আকাশের শরচ্ছন্দ্রমা, জীবন-উদ্যানের রসালবৃক্ষ আফজাল খাঁকে হত্যাকান্ড হইতে রক্ষা করিবে, তচ্ছিন্তায় শিবাজী-নন্দিনী যৎপরোনাস্তি আকুল হইয়া উঠিল। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়াও তাহার আকাঙ্খিত প্রেম-দেবতা আফজাল খাঁকে দস্যুধর্মী পিতার নিদারুণ ষড়যন্ত্র এবং নৃশংস হত্যাকান্ড বাঁচাইবার জন্য তারাবাঈ ব্যস্ত হইয়া উঠিল।
মানব-হৃদয়ে যখন নবীন প্রেমের সঞ্চার হয়, তখন উহা গিরিগুহা-নির্গত তরঙ্গিণীয় ন্যায় তীব্রবেগে প্রবাহিত হয়। বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া ছুটিতে থাকে। নদীর সম্বন্ধে-
“পর্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?”
ইহা যেমন সত্য, প্রেমের সম্বন্ধেও তেমনি নীচের কবিতাটি অটুট সত্য।
মানস কন্দর হ’তে যৌবন-ঊষায়,
যে প্রেমের মন্দাকিনী কারো পানে ধায়,
কার সাধ্য তার গতি করে অবরোধ?
রোধিতে যে চায়, সেই নিতান্ত নির্বোধ!
বায়ু জল উল্কা তীর কত ধরে বেগ
তাহার অধিক জান প্রেমের উদ্বেগ!
প্রেমের সমুখে হায়! কঠিন পাষাণ
হ’য়ে যায় সুকোমল ফুলের সমান!
সাগর গোস্পদ হয়, মরু হয় বন,
দুঃখে উপজয় সুখ, মরণে জীবন!
যত দুঃখ যত কেশ যত নির্যাতন,
প্রেম করে সকলেরে সুধা-প্রস্রবণ!
বিষেরে অমৃত করে, আঁধারে আলোক,
নরকেরে স্বর্গ করে বিষাদে পুলক,
আপনারে ভুলে যাওয়া পরের কারণ
ইহাই প্রেমের বটে প্রথম লণ।
দ্বিতীয় লণ শুধু স্মরণ, সেবন
প্রেমাস্পদ হেতু শেষে আনন্দে মরণ!
তারাবাঈ নিঃশব্দ পদ-সঞ্চারে প্রাচীরের গায়ে কান লাগাইয়া রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শিবাজীর সমস্ত পরামর্শ শ্রবণ করিল। আফজাল খাঁকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্রের সমস্ত মন্ত্রণা শুনিয়া ব্যাকুল চিত্তে চরণে তথা হইতে প্রস্থান করিল।