চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণকলা শশধরের অমল-ধবল জ্যোৎস্না-লহরীতে গগন-ভবন সুখ-তরঙ্গে ভাসিতেছে। কৃষ্ণগড়ের দুর্গ-মধ্যস্থ মনোহর উদ্যানে নানা জাতীয় ফুল ফুটিয়া কৌমুদী-স্নাত হইয়া মৃদু মন্দ পবনে মধুর গন্ধ বিতরণ করিয়া হাসিতেছে, নাচিতেছে এবং খেলিতেছে। সরোবরে জলজ পস্পদাম প্রস্ফুটিত হইয়া মনোহারিণী শোভার সৃষ্টি করিয়াছে। নবপত্রপল্লাবসনে সুখে সমাসীন হইয়া কোকিল ও পাপিয়া সুধামাখা কুজনে অনন্ত শূণ্যবক্ষে যেন কি এক পীযূষ-স্রোত প্রবাহিত করিতেছে! জলে-স্থলে শূন্যে সর্বত্র জ্যোৎস্নার মধুর ও শান্তোজ্জ্বল বিকাশ! মলয়া হওয়ার অবিরাম সুখ-স্পর্শ মৃদু সঞ্চরণ। ফুলে ফুলে হাসির ঢলাঢলি! নীলিম গগন-পটে তারকাবলীর স্নিগ্ধোজ্জ্বল সমাবেশ! এ হেন মধু-যামিনীতে মালেকা আমিনা বানু প্রিয় সহচরী রোকিয়াকে সঙ্গে লইয়া উদ্যান মধ্যস্থ সরোবরে ঘাটে গালিচা পাতিয়া বসিয়া প্রকৃতির চিত্তবিনোদন দৃশ্য উপভোগ করিতেছিলেন। মালেকা এবং রোকিয়া উভয়ে নীরব। কিছুণ পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া রোকিয়া বলিল, “মালেকা! এ মধু-যামিনী এমন করে একেলা ভোগে সুখ কি? হৃদয়-রাজ্যে প্রেমের জ্যোৎস্না না ফুটলে বাইরের জ্যোৎস্নায় কেবল অন্ধকারই বৃদ্ধি করে!”
মালেকাঃ কেন? এই ত তুমি আছ! তোমার সঙ্গেই মধু-যামিনীর জ্যোৎস্না-লহরী পান করছি।
রোকিয়াঃ ঠাট্টা রাখ। দুধের সাধ কি ঘোলে মিটে? এমন ক’রে যৌবন-জীবন যাপন করায় পল কি? বিবাহ করাই সঙ্গত।
মালেকাঃ কথা ত ঠিক্! কিন্তু যাকে-তাকে ত আর স্বামীত্বে বরণ করতে পারি না। বীরপুরুষ না হলে, কা’কেও বিবাহ করব না, এই সংকল্পই ত এখন বাধা হয়ে পড়ছে।
রোকিয়াঃ কেন, মোতামদ খান কি উপযুক্ত নন?
মাঃ মোতামদ খান একজন উপযুক্ত সেনাপতি ব্যতীত আর কিছুই নন। তাঁকে বীরপুরুষ বললে অন্যায় হয় না বটে, কিন্তু আমি যে শ্রেণীর বীরপুরুষ চাই, সে শ্রেণীর নহেন। মোতামদ খান যদি বাহুবলে রাজ্য সংস্থাপন করতে পারতেন অথবা কৃষ্ণগড়কে স্বাধীন করতে পারতেন, তা’ হ’লে তাঁকে বীরপুরুষ বলে স্বীকার করতাম।
রোঃ তবে শিবাজী?
মাঃ বটে! শিবাজী সাহসী পুরুষ এবং রাজ্য সংস্থাপনেরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু অতি নীচ প্রকৃতি বিশিষ্ট। শিবাজীকে বীরপুরুষ বলা কিছুতেই সঙ্গত নহে, দস্যু বল। বীরপুরুষের মহত্ব ও বীরত্ব তাঁতে নাই। ‘পার্বত্যমূষিক’ উপাধিই তাঁর পক্ষে যথার্থ।
রোঃ কেন, আপনার প্রতি ত খুবই উদার ও সদয় ব্যবহার করেছেন।
মাঃ নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর ভিতরে তাঁর মৎলব আছে।
মাঃ মৎলব ছাড়া দুনিয়ার কে কি ক’রে থাকে?
মাঃ তা’ বটে! কিন্তু মৎলবের মধ্যেও পার্থক্য আছে। নিজের স্বার্থসিদ্ধিই যার একমাত্র উদ্দেশ্য, সে মৎলব অতীব ঘৃণিত।
রোঃ শিবাজীর মৎলব ঘৃণিত কিসে?
তাঃ তাঁল এই সদয় ও উদার ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাকে লুব্ধ ক’রে বিবাহ করা। কিন্তু তাঁর জানা উচিত যে, মুসলমান কখনও কাফেরকে পাণিদান করতে পারেন না।
রোঃ তিনি ত আপনার জন্য ইসলাম ধর্ম পর্যন্ত অবলম্বন করতে প্রস্তুত আছেন। আপনি বিবাহে স্থির-নিশ্চয় সম্মতি দিলে তিনি পৈতৃক হিন্দু ধর্ম ত্যাগ ক’রে পবিত্র ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করবেন। এতে তাঁকে নানাবিধ অসুবিধা ও কষ্ট ভোগ করতে হবে বটে; কিন্তু তুবও তিনি আপনার জন্য সে সমস্ত সহ্য এবং বহন করতে প্রস্তুত আছেন। প্রেমের এমন আদর্শ এবং প্রেমের জন্য এরূপ স্বার্থত্যাগ নিতান্তই বিরল নহে কি?
মাঃ নিশ্চয়ই। এরূপ ভন্ডামী এবং এরূপ শয়তানী নিশ্চয়ই নিতান্ত বিরল!
রোঃ ভন্ডামী কিরূপ? হায়! একেই বলে ‘যার কি চুরি সেই বলে চোর!’
মাঃ ভন্ডামী না হয়ত, ষন্ডামী ত বটেই। সাত সাতটি স্ত্রী এবং কয়েক গন্ডা উপপত্নী থাকলেও যাঁর আমার জন্য ঘুম হয় না, সে যদি আদর্শ প্রেমিক হয়, তবে আদর্শ লম্পট এবং পিশাচ আর কে?
রোঃ যে ব্যক্তি যাকে তনুমন সমর্পণ করেছে, সে যদি তা’কে না পায়, তা’ হলে তার ঘুম না হওয়াই ত স্বাভাবিক। এ অবস্থায় ত বেচারা শিবাজীর প্রতি দয়া হওয়াই স্বাভাবিক।
মাঃ বটে, বলিস কি? তুই পাগল নাকি! এরূপ লোকের প্রতি যদি দয়া হয়, তা’ হলে, বাম পদাঘাত করবার প্রবৃত্তি হবে আর কা’কে?
রোঃ ছিঃ! ছিঃ! এমন কথা বলা কি সঙ্গত?
মাঃ যে ব্যক্তি নারী লাভের জন্য পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করতে প্রস্তুত তা’র প্রতি ইহা অপেক্ষা সদুক্তি আর কি হ’তে পারে? যদি শিবাজী আজ ধর্মের জন্যই ধর্ম পরিগ্রহ করতেন, তা’ হলে নিশ্চয়ই মুক্তকণ্ঠে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করতাম। শিবাজী ইসলাম ধর্ম পরিগ্রহ করলেও কদাপি তাতে স্থিরতর থাকবেন না। কোনও রূপে আমার রাজ্য এবং আমাকে হস্তগত করবার জন্যই ইসলাম গ্রহণের ভাণ করা হচ্ছে। শিবাজী ইসলামের পরম শক্রু। তিনি মসজিদগুলি চূর্ণ এবং তাহা শূকর-রক্তে অপবিত্র ক’রে পরম আনন্দ লাভ করছেন। শিবাজীর ন্যায় নৃশংস দস্যু যদি দমিত না হয়, তা’ হলে ইসলামের সমূহ অমঙ্গল বুঝতে হবে। আমি এহেন অস্পৃশ্য পাষন্ড কাফেরের পাণিগ্রহণ করব, এরূপ আশা করা বাতুলের পক্ষেই শোভা পায়। বরং শিবাজী এবিষয়ে যতই চেষ্টা করবেন, আমার ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা ততই বৃদ্ধি পাবে। আমি প্রাণান্তেও এমন ঘৃণিত দস্যু ও জাহান্নামী কাফেরকে কিছুতেই স্বামীত্বে বরণ করতে স্বীকৃত নহি। এমনকি, এ বিষয়ের আলোচনা করতেও আমি ঘৃণা এবং বিরক্তি বোধ ক’রে থাকি।
have you tekchad babur golpo (alaler gorer dual)please