তাকদির বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি – স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?
সাজিদের ব্যাগে ইয়া মোটা ডায়েরি থাকে সবসময় ডায়েরিটা প্রাগঐতিহাসিক আমলের কোন নিদর্শনের মত । জায়গায় জায়গায় ছেড়া । ছেড়া জায়গার কোনটাতে সুতো দিয়ে সেলাই করা, কোন জায়গায় আটা দিয়ে প্রলেপ লাগান, কোন জায়গায় ট্যাপ করা ।
এই ডায়েরিতে সে তার জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিখে রাখে । এই ডায়েরির কোন এক মাঝামাঝি জায়গায় সাজিদ আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও লিখে রেখেছে । তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় টি.এস.সি তে ।
সে আমার সম্পর্কে লিখে রেখেছে, –
‘ভ্যাবলা টাইপের একটা ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হল আজ । দেখলেই মনে হবে, জগতের কঠিন বিষয়ের কোন কিছুই সে বুঝে না । কথা বলার পর বুঝলাম, এই ছেলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কিন্তু বোকা । ছেলেটির নাম- আরিফ । ‘
নিচে তারিখ দেওয়া –’০৫/০৩/০৯
এই ডায়েরিতে নানান বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও লেখা আছে ।
একবার কানাডার টরেন্টোতে সাজিদ তার বাবার সাথে একটি অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিল । সেখানে অনেক সেলেব্রিটির সাথে বিল গেটসও আমন্ত্রিত ছিলেন । বিল গেটস সেখানে দশ মিনিটের জন্য বক্তৃতা রেখেছিলেন । সে ঘটনাটি লেখা । জাফর ইকবালের সাথে সাজিদের একবার বইমেলায় দেখা হয়ে যায় । সেবারের বই মেলায় জাফর স্যারের বই’একটুখানি বিজ্ঞান’ এর দ্বিতীয় কিস্তি’আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয় । সাজিদ জাফর স্যারের বই কিনে বের হওয়ার পথে জাফর স্যারের সাথে তার দেখা হয়ে যায় । সাজিদ স্যারের একটি অটোগ্রাফ নিয়ে, স্যারের কাছে হেসে জানতে চাইলো,’স্যার,’একটুখানি বিজ্ঞান’ পাইলাম । এরপর পাইলাম’আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ । এটার পরে’আরো আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ কবে পাচ্ছি ?’
সেদিন নাকি জাফর স্যার মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, -‘পাবে’
নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই ঠাই পেয়েছে সাজিদের ডাইরিতে ।
সাজিদের ডায়েরির আদ্যোপান্ত আমার পড়া ছিল । কিন্তু, সেমিস্টার ফাইনাল সামনে চলে গত বেশ কিছুদিন তার ডায়েরিটা আমার আর পড়া হয়নি । অবশ্য ডায়েরিটা আমি লুকিয়ে লুকিয়েই পড়ি ।
সেদিন থার্ড সেমিস্টারের শেষ পরিক্ষাটি দিয়ে রুমে আসলাম । এসে দেখি সাজিদ ঘরে নেই । তার টেবিলের উপর তার ডায়েরিটা পড়ে আছে খোলা অবস্থায় ।
ঘর্মাক্ত শরীর । কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরেছি । এই মুহূর্তে বসে ডায়েরিটা উলটবো, সে শক্তি বাঁ ইচ্ছা কোনটাই নেই । কিন্তু ডায়েরিটা বন্ধ করতে গিয়ে একটি শিরোনাম আমার চোখে আটকে যায় । আমি সাজিদের টেবিলেই বসে পড়ি । লেখাটির শিরোনাম ছিল –
‘ভাগ্য বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি –স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত ?’
বেশ লোভনীয় শিরোনাম । শারিরিক ক্লান্ত ভুলেই আমি ঘটনাটির প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম । ঘটনাটি সাজিদের ডায়েরিতে যেভাবে লেখা, ঠিক সেভাবেই আমি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি, –
‘কয়েকদিন আগে ক্লাসের থার্ড পিরিয়ডের মফিজুর রহমান স্যার এসে আমাকে দাড় করালেন । বললেন, -‘তুমি ভাগ্যে, আই মিন তাকদিরে বিশ্বাস কর ?’
আমি আচমকা অবাক হলাম । আসলে এই আলাপগুলো হল ধর্মীয় আলাপ । মাইক্রোবায়োলজির একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে এসে এসব জিজ্ঞস করে, তখন খানিকটা বিব্রতবোধ করাটাই স্বাভাবিক । স্যার আমার উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন । আমি বললাম,’জি স্যার । এজ এ মুসলিম আমি তকদিরে বিশ্বাস করি । এটি আমার ইমানের মূল সাতটি বিষয়ের মধ্যে একটি । ‘
স্যার বললেন,’তুমি কি বিশ্বাস করো যে, মানুষ জিবনে যা যা করবে তার সবকিছুই তার জম্মের অনেক অনেক বছর আগে তার তাকদিরে লিখে দেওয়া হয়েছে ?’
-‘জি, স্যার’ আমি উত্তর দিলাম ।
–’বলা হয়, স্রষ্টার ইচ্ছা শক্তি ছাড়া গাছের একটি ক্ষুদ্র পাতাও নড়ে না, তাই না ?’
-‘জি, স্যার’
-‘ধরো, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করলাম । এটা কি আমার তকদিরে পূর্বে নির্ধারিত ছিল না ?’
-‘জি, ছিল’
-‘আমার তাকদির যখন লেখা হচ্ছিলো, তখন কি আমি জীবিত ছিলাম ?’
-‘না, ছিলেন না । ‘
-‘আমার তাকদির কে লিখেছে ? বাঁ কার নির্দেশে লিখিত হয়েছে ?’
-‘স্রষ্টার । ‘
-‘তাহলে, সোজা এবং সরল লজিক এটাই বলে –’আজ সকালে যে খুনটি আমি করেছি, সেটি মূলত আমি করি নি । আমি এখানে একটি রোবটমাত্র । আমার ভেতরে একটা প্রোগ্রাম সেট করে দিয়েছেন স্রষ্টা । সেই প্রোগ্রামে লেখা ছিল যে, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করবো । সুতরাং, আমি ঠিক তাই করেছি, যা আমার স্রষ্টা পূর্বে ঠিক করে রেখেছেন । এতে আমার কোন হাত নেই । ডু ইউ এগ্রি, সাজিদ ?’
-‘কিছুটা’ -আমি উত্তর দিলাম ।
স্যার এবার হাসলেন । হেসে বললেন, -‘আমি জানতাম তুমি কিছুটাই একমত হবে, পুরোটা নয় । এখন তুমি আমাকে নিশ্চয়ই যুক্তি দেখিয়ে বলবে, -স্যার, স্রষ্টা আমাদের একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন । আমরা এটা দিয়ে ভাল মন্দ বিচার করে চলি, রাইট ?’
-‘জি, স্যার’
-‘কিন্তু, সাজিদ, এটা খুব লেইম লজিক, ইউ নো ? ধরো, আমি তোমার হাতে একটি বাজারের লিস্ট দিলাম । লিস্টে যা যা কিনতে হবে, তার সব কিছু লেখা আছে । এখন তুমি বাজার করে ফিরলে । তুমি ঠিক তাই কিনলে যা আমি লিস্টে লিখে দিয়েছে । এবং এটা করতে বাধ্য । ‘
এতটুকু বলে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন,’বুঝতে পারছ ?’
আমি বললাম,’জি, স্যার’
-‘ভেরি গুড । ধরো, তুমি বাজার করে আসার পর, একজন জিজ্ঞেস করলো, সাজিদ কি কি বাজার করেছ ? তখন আমি উত্তর দিলাম, -‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে, তা-ই তা-ই কিনেছে’, তাহলে এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা, না ?’
-‘জি, স্যার’
-‘ঠিক স্রষ্টাও এভাবে মিথ্যা বলেছেন । দুই নাম্বারি করেছেন । তিনি অনেক আগে আমাদের তাকদির লিখে তা আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন । এখন আমরা সেটাই করি, যা স্রষ্টা সেখানে লিখে রেখেছেন । আবার, এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে, এই কাজের জন্য কেউ জান্নাতে যাচ্ছে, কেউ জাহান্নামে । কিন্তু কেন ? এখানে মানুষের তো কোন হাত নেই । ম্যানুয়ালটা স্রষ্টার তৈরি । আমরা তো জাস্ট পারফর্মার । স্ক্রিপ্ট রাইটার তো স্রষ্টা । স্রষ্টা এর জন্য আমাদের কাউকে জান্নাত, কাউকে জাহান্নাম দিতে পারেন না । যুক্তি তাই বলে, ঠিক ?’
আমি চুপ রইলাম । পুরো ক্লাসে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে তখন । স্যার বললেন,’হ্যাভ ইউ এনি প্রপার লজিক অন দ্যাট ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চান, ডিয়ার ?’
আমি কিছুক্ষন চুপ করে থাকলাম ।
স্যার মুচকি হাসলেন । মনে হল – উনি ধরেই নিয়েছেন যে, উনি সত্যি সত্যিই আমাকে কুপকাত করে দিয়েছেন । বিজয়ের হাসি।
আমাকে যারা চিনে তারা জানে, আমি কখন কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিই না। আজকে যেহেতু তার ব্যাতিক্রম ঘটলো, আমার বন্ধুরা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখ করে তাকালো । তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো, এই সাজিদকে তারা চিনেই না । কোন দিন দেখেই নি ।
আর, ক্লাসে আমার বিরুদ্ধ মতের যারা আছে, তাদের চেহারা তখন মুহূর্তেই উজ্জ্বল বর্ণ ধারন করলো । তারা হয়তো মনে মনে বলতে লাগলো, -‘মৌল্লার দৌড় ওই মসজিদ পর্যন্তই । হা – হা –হা’
আমি মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালাম । মুচকি হাসি স্যারের মুখে তখনও বিরাজমান ।
আমি বললাম,’স্যার, এই ক্লাসে কার সম্পর্কে আপনার কি অভিমত ?’
স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন । স্যার জিজ্ঞেস করেছেন কি আর আমি বলছি কি ।
স্যার বললেন,’বুঝলাম না । ‘
-‘মানে আমাদের ক্লাসে কার মেধা কি রকম, সে বিষয়ে আপনার কি ধারণা ?’
-‘ভাল ধারণা । ছাত্রদের সম্পর্কে একজন শিক্ষকের তো সবচেয়ে ভাল জ্ঞান থাকে’
আমি বললাম, -‘স্যার আপনি বলুন তো, এই ক্লাশের কারা কারা ফার্স্ট ক্লাস আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে ?’
স্যার কিছুটা বিস্মিত হলেন । বললেন ,’আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করেছি । তুমি আউট অফ কনট্যাক্সট এ গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছ, সাজিদ ?’
-‘না, স্যার । আমি কন্টেক্সটেই আছি । আপনি উত্তর দেন । ‘
স্যার বললেন,’এই ক্লাশ থেকে রায়হান, মমতাজ, ফারহানা, সজিব, ওয়ারেশ, ইফতি, সুমন, জাবেদ এবং তুমিও ফার্স্ট ক্লাশ পাবে । আর বাকিরা সেকেন্ড ক্লাশ । ‘
স্যার যাদের নাম বলেছেন তারা সবাই ক্লাশের ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট । সুতরাং, স্যারের অনুমান খুব একটা ভুল না ।
আমি বললাম,’স্যার, আপনি এটা লিখে দিতে পারেন ?’
-‘Why not?’ স্যার বললেন ।
এই বলে তিনি খচখচ করে একটা কাগজের একপাশে যারা ফার্স্ট ক্লাশ পাবে তাদের নাম, অন্য পাশে যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে, তাদের নাম লিখে আমার হাতে দিলেন ।
আমি বললাম,’স্যার, ধরে নিলাম যে আপনার ভবিষৎবাণী সম্পূর্ণ সত্য হয়েছে । মানে, আপনি ফার্স্ট ক্লাশ পাবে বলে যাদের নাম লিখেছেন, তারা সবাই ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছে, আর যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে লিখেছেন, তাদের সবাই সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে । ‘
-‘হুম, তো’
-‘এখন স্যার বলন তো, যারা ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছে, আপনি এই কাগজে তাদের নাম লিখেছেন বলেই কি তারা ফাস্ট ক্লাশ পেয়েছে ?’
-‘নাহ তো’
-‘যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে বলে আপনি এই কাগজে লিখেছেন বলেই কি তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে ?’
স্যার বললেন,’একদম না । ‘
-‘তাহলে মূল ব্যাপারটি কি স্যার ?’
স্যার বললেন, -‘মূল ব্যাপার হল, আমি তোমাদের শিক্ষক । আমি খুব ভাল জানি পড়াশুনায় তোমাদের কে কেমন । আমি খুব ভাল করেই জানি, কার মেধা কেমন । সুতরাং, আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কে কেমন রেজাল্ট করবে । ‘
আমি হাসলাম । বললাম,’ স্যার যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা যদি আপনাকে দোষ দেয় ? যদি বলে, আপনি’সেকেন্ড ক্লাশ’ ক্যাটাগরিতে তাদের নাম লিখেছেন বলেই তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে ?’
স্যার কপালের ভাঁজ লম্বা করে বললেন,’ইট উড বি টোট্যালি বুলশিট ! আমি কেন এর জন্য দায়ী হব ? এটাতো সম্পূর্ণ তাদের দায় । আমি শুধু তাদের মেধা, যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা রাখি বলেই অগ্রিম বলে দিতে পেরেছি যে কে কেমন রেজাল্ট করবে । ‘
আমি আবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম । পুরো ক্লাশ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ।
আমি থামলাম । বললাম,’ তকদির তথা ভাগ্যটাও ঠিক এরকম । আপনি যেমন আমাদের মেধা, যোগ্যতা, ক্ষমতা সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখেন, স্রষ্টাও তেমনি তার সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা রাখেন । আপনার ধারণা মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার ধারনায় কোন ভুল নেই । স্রষ্টা হলেন আলিমুল গায়েব । তিনি ভুত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব জানেন । ‘
আপনি যেরকম পূর্বানুমান করে লিখে দিয়েছেন যে, আমাদের মধ্যে কারা ফাস্ট ক্লাস পাবে, আর কারা সেকেন্ড ক্লাশ । এর মানে কিন্তু এই না যে, আপনি বলেছেন বলে আমাদের কেউ ফাস্ট ক্লাশ পাচ্ছি, কেউ সেকেন্ড ক্লাশ ।
স্রষ্টাও সেরকম পূর্বানুমান করে আমাদের তাকদির লিখে রেখেছেন । তাতে লেখা আছে আমরা দুনিয়ায় কে কি করবো । এর মানে কিন্তু এই নে যে, তিনি লিখে দিয়েছেন বলেই আমরা কাজগুলো করছি । বরং, এর মানে হল এই – তিনি জানেন যে, আমরা দুনিয়ায় এই এই কাজগুলো করবো । তাই তিনি অগ্রিম লিখে রেখেছেন তাকদির হিসেবে ।
আমাদের মধ্যে কেউ ফাস্ট ক্লাশ আর কেউ সেকেন্ড ক্লাশ পাবার জন্য যেমন কোনভাবেই আপনি দায়ী নন, ঠিক সেভাবে, মানুষের মধ্যেও কেউ ভাল কাজ করে জান্নাতে, আর কেউ খারাপ কাজ করে জাহান্নামে যাবার জন্যও স্রষ্টা দায়ী নন । স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ সকালে একজনকে খুন করবেন । তাই তিনি সেটা আগেই আপনার তকদিরে লিখে রেখেছেন । এটার মানে এই না যে – স্রষ্টা লিখে রেখেছেন বলেই আপনি খুনটি করেছেন । এর মানে হল – স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ খুনটি করবেন । তাই সেটা অগ্রিম লিখে রেখেছেন আপনার তাকদির হিসেবে ।
স্যার ব্যাপারটা কি এখন পরিষ্কার ?
স্যারের চেহারাটা কিছুটা ফ্যাকাশে মনে হল । তিনি বললেন ,’হুম’
এরপর স্যার কিছুক্ষন চুপ থাকলেন । তারপর বললেন,’আমি শুনেছিলাম তুমি ক’দিন আগেও নাস্তিক ছিলে । তুমি আবার আস্তিক হলে কবে ?’
আমি হা হা হা করে হাসলাম । বললাম,’এই প্রশ্নটা কিন্তু আউট অফ কনট্যাক্সট । ‘
এটা শুনে পুরো ক্লাশ হাসিতে ফেটে পড়লো ।
পিরিয়ডের একদম শেষ দিকে, স্যার আবার আমাকে দাড় করালেন । বললেন,’বুঝলাম স্রষ্টা আগে থেকে জানেন বলেই লিখে রেখেছেন । তিনি যেহেতু আগে থেকেই জানেন কে ভাল কাজ করবে আর কে খারাপ কাজ করবে, তাহলে পরিক্ষা নেওয়ার কি দরকার ? যারা জান্নাতে যাওয়ার তাদের জান্নাতে, যারা জাহান্নামে যাওয়ার দরকার তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো, তাই না ?’
আমি আবার হাসলাম । আমার হাতে স্যারের লিখে দেওয়া কাগজটি তখনো ধরা ছিল । আমি সেটা স্যারকে দেখিয়ে বললাম,’স্যার, এই কাগজে কারা কারা ফাস্ট ক্লাশ পাবে, আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে, তাদের নাম লেখা আছে । তাহলে এই কাগজের ভিত্তিতেই রেজাল্ট দিয়ে দিন । বাড়তি করে পরিক্ষা নিচ্ছেন কেন ?’
স্যার বললেন,’পরিক্ষা না নিলে হয়তো এই বলে অভিযোগ করতে পারে যে, – স্যার আমাকে ইচ্ছা করেই সেকেন্ড ক্লাশ দিয়েছে । পরিক্ষা দিলে হয়তো আমি ঠিকই ফাস্ট ক্লাশ পেতাম । ‘
আমি বললাম,’একদম তাই স্যার । স্রষ্টাও এজন্যই পরিক্ষা নিচ্ছেন, যাতে কেউ বলতে না পারে – দুনিয়ায় পরিক্ষার ব্যাবস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আজকে জান্নাতে থাকতাম । স্রষ্টা ইচ্ছা করেই আমাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে । ‘
ক্লাশের সবাই হাত তালি দিতে শুরু করলো । স্যার বললেন,’সাজিদ, আই হ্যাভ এ লাস্ট কোয়েশ্চান । ‘
-‘ডেফিনেইটলি, স্যার । ‘ আমি বললাম ।
-‘আচ্ছা, যে মানুষ পুরো জীবনে খারাপ কাজ বেশি করে, সে অন্তত কিছু না কিছু ভালো কাজ তো করে, তাই না ?’
-‘জি স্যার’
-‘তাহলে, এই ভালো কাজগুলোর জন্য হলেও তো তার জান্নাতে যাওয়া দরকার, তাই না ?’
আমি বললাম,’স্যার, পানি কিভাবে তৈরি হয় ?’
স্যার আবার অবাক হলেন । হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন যে, এই প্রশ্নটাও আউট অফ কনট্যাক্সট, কিন্তু কি ভেবে যেন চুপসে গেলেন । বললেন,’দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে । ‘
আমি বললাম,’আপনি এক ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন দিয়ে পানি তৈরি করতে পারবেন ?’
-‘কখনোই না । ‘
-‘ঠিক সেভাবে, এক ভাগ ভালো কাজ আর এক ভাগ মন্দ কাজে জান্নাত পাওয়া যায় না । জান্নাত পেতে হলে হয় তিন ভাগই ভালো কাজ হতে হবে, নতুবা দুই ভাগ ভালো কাজ, এক ভাগ মন্দ কাজ হতে হবে । অর্থাৎ, ভালো কাজের পাল্লা ভারী হওয়া আবশ্যক । ‘
সেদিন আর কোন প্রশ্ন স্যার আমাকে করেন নি ।
-এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেললাম । কোথাও একটু থমিনি । পড়া শেষে যেই মাত্র সাজিদের ডায়েরিটা বন্ধ করতে যাবো, অমনি দেখলাম, পেছন থেকে সাজিদ এসে আমার কান মলে ধরেছে । সে বলল,’তুই তো সাংঘাতিক লেভেলের চোর । ‘
আমি হেসে বললাম, -‘হা হা হা । স্যারকে তো ভালো জব্দ করেছিস ব্যাটা । ‘
কথাটা সে কানে নিলো বলে মনে হল না । নিজের সম্পর্কে কোন কমপ্লিমেন্টই সে আমলে নেয় না । গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সে খাটের উপর শুয়ে পড়লো ।
আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম । বললাম,’সাজিদ,………..’
-‘হু’
-‘একটা কথা বলব ?’
-‘বল’
-‘জানিস, এক সময় যুবকেরা হিমু হতে চাইতো । হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে, মরুভূমির গর্ত খুড়ে জ্যোৎস্না দেখার স্বপ্ন দেখত । দেখিস, এমন একদিন আসবে, যেদিন যুবকেরা সাজিদ হতে চাইবে । ঠিক তোর মতো । …’
এই বলে আমি সাজিদের দিকে তাকালাম । দেখলাম, ততক্ষনে সে ঘুমিয়ে পড়েছে । অঘোর ঘুম …………..