তাওবাদের ইতিবৃত্ত
তাওবাদ চীনের নিজস্ব ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা গত দুই হাজার বছরেরও অধিক কাল যাবত দেশটির সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে এসেছে। তাওবাদকে চীনের লোকজ ঐতিহ্য ও কনফুসীয় ঐতিহ্যের সংযোগকারী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, তাওবাদের মূল ভিত্তি হলো লাওসি নামক চীনা দার্শনিকের লেখনী। এর পাশাপাশি চুয়াং-সু নামক অপর এক চীনা দার্শনিকের রচনাও তাওবাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর চীনে লাওসি’র জন্ম। তিনি পৃথিবীর প্রাচীনতম দার্শনিকদের একজন। লাওসি ‘তাও-তে-চিং’ নামক গ্রন্থে তাঁর নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ সংকলিত করেন। এ গ্রন্থের নাম থেকেই তাওবাদ শব্দটির উৎপত্তি।
‘তাও’ মানে পথ। আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে সে পথে সবকিছ পরিচালিত করা হয়। এ পথ অনাদি, অনন্ত, অপরিবর্তনীয়। তাওকে বিবেচনা করা হয় অতীন্দ্রিয়, রহস্যময়, সর্বব্যাপী সত্ত্বা, নীতি, আকৃতি, বস্তু বা অস্তিত্ব হিসেবে। মহাবিশ্ব, প্রকৃতি বা মানবদেহের বৈশিষ্ট্য বুঝতে একে ব্যবহার করা যায়। ‘ইন’ ও ‘ইয়্যাং’ নামক দু’টি বিপরীতমুখী শক্তি দ্বারা তাওবাদের যুক্তি ব্যাখ্যা করা হয়। এ দু’টি শক্তি একে অপরের পরিপূরক এবং পরস্পর-নির্ভরশীল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও প্রণালীতে ভারসাম্য আনে। ‘ইন’ ও ‘ইয়্যাং’ এর বৈপরীত্য ও ঘাত- প্রতিঘাতের কারণেই প্রকৃতিতে উৎপাদন, প্রজনন ও রূপান্তরের অসীম চক্র নিয়ত প্রবহমান থাকে। তাওবাদ মূলত এ বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতারই ব্যাখ্যা। এর অন্যতম লক্ষ্য হলো মানুষ, প্রকৃতি ও জীবনে তিন-ধরণের উৎকর্ষ আনয়ন করা: যথা সুস্বাস্থ্য, সামাজিক ভারসাম্য এবং গভীরতর আত্মোপলদ্ধি।
লাওসি প্রবর্তিত দার্শনিক মতবাদ খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক পর্যন্ত চীনে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিল। প্রাচীন চীনের উন্নতির মূলে ছিল তাও দর্শন ও এ ধর্মের মূল আদর্শের চর্চা। পরে চীন দেশে বৌদ্ধধর্ম তাও-দর্শনের সংস্পর্শে এসে নতুন রূপ লাভ করে। জাপানের শিন্টো ধর্মেও এর মূল সুত্রগুলোর প্রয়োগ দেখা যায়।
লাওসি’র জীবনকাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। চীনের ‘চৌ’ রাজবংশের রাজ-দরবারে তিনি ছিলেন গ্রন্থাগারিক। তাঁর দীর্ঘদিনের সাধনালদ্ধ ‘তাও’ মতবাদ আজও চীনাবাসীদের জীবনাচারে বিভিন্ন আকার- প্রকার, প্রক্রিয়া ও পন্থায় বহুলাংশে অটুট আছে।