‘তাঁর প্রেমের সাগরে ঝাঁপ দাও’

‘শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে ?’

আজ রথযাত্রা। বুধবার, ২৫শে জুন, ১৮৮৪; আষাঢ় শুক্লা দ্বিতীয়া। সকালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় ঈশানের বাড়ি নিমন্ত্রণে আসিয়াছেন। ঠন্‌ঠনিয়ায় ঈশানের ভদ্রাসন-বাটী। সেখানে আসিয়া ঠাকুর শুনিলেন যে, পণ্ডিত শশধর অনতিদূরে কলেজ স্ট্রীটে, চাটুয্যেদের বাড়ি রহিয়াছেন।(পণ্ডিত শশধর অর্থাৎ শশধর তর্কচূড়ামণি) পণ্ডিতকে দেখিবার তাঁর ভারী ইচ্ছা। (১-১১-১) বরাবর শ্রীরামকৃষ্ণের এই সাধ। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যাঁরা, তাঁদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ। অযাচিতভাবে তিনি তাঁদের কাছে যাচ্ছেন। কিংবা বলতে পারি তাঁর সেই ‘মা’ তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন এঁদের কাছে। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এসেছেন। তিনি বুঝেছেন, এঁরা তাঁর সহায় হতে পারেন। এঁরা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। এঁদের সকলেরই চরিত্রে অনেক সদ্‌গুণ রয়েছে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা অপূর্ণতা এঁদের মধ্যে রয়ে গেছে। সেই অপূর্ণতাটুকু যদি দূর হয়, তাহলে এঁদের দ্বারা লোকের অনেক কল্যাণ হবে। তাই তিনি সেইসময়কার যাঁরা দিক্‌পাল, তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলছেন না। কিন্তু তাঁদের ভাবের মধ্যে যদি কোন সঙ্কীর্ণতা দেখেন, সেটিকে দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

ব্রাহ্মনেতা কেশব সেনের কথাই ধরা যাক। তিনি দেখেছেন : কেশব সেন বা তাঁর যাঁরা অনুগামী অর্থাৎ ব্রাহ্মরা— তাঁরা শুধু নিরাকার মানেন—মুর্তি মানেন না, শক্তি মানেন না। তিনি ব্রাহ্মসমাজে গিয়ে তাঁদের বলছেন : দেখ, তোমরা ব্রহ্মের উপাসনা কর ভালই, কিন্তু সেই সঙ্গে শক্তিও মানতে হয়। নিরাকারভাবে ঈশ্বরকে দেখছ, তাতে দোষ নেই—কিন্তু মনে রেখো, সাকারও সত্যি। যখন নিষ্ক্রিয়—নিরাকার তখন তিনি ব্রহ্ম ; যখন লীলাচঞ্চল, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কর্তা, তখন তিনি কালী। কালী আর ব্রহ্ম এক ; শক্তি আর শক্তিমান আলাদা নয়। ব্রাহ্মসমাজের অনুদার ভাবটা দূর করতে চেষ্টা করছেন। পরের দিকে দেখা যেত কেশব সেন ‘মা মা’ বলে ভগবানকে ডাকতেন। এ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাবেই সম্ভব হয়েছিল।* বাস্তবিক, তিনি যেন একটা প্লাবন ঘটাতে এসেছিলেন। একটা সর্বগ্রাসী ধর্মচিন্তার প্লাবন—যে ধর্মচিন্তা কোন মত, কোন পথকে বর্জন করবে না। আর তার পথে কোথাও কোন বাধাবিঘ্ন থাকবে তা যেন তিনি চাননি। তাই দেখি, অনেককে তিনি তাঁর কাজের উপযোগী করে নিতে চেষ্টা করছেন। শশধর তর্কচূড়ামণি সেই সময়কার একজন নামকরা পণ্ডিত। তাঁর নাম ঠাকুর সম্ভবত আগে শুনেছিলেন। ঈশানের বাড়িতে এসে শুনলেন যে, তিনি কাছেই এক বাড়িতে আছেন। শুনেই পণ্ডিতকে দেখবার তাঁর খুব ইচ্ছে। বৈকালে পণ্ডিতের বাড়ি যাইবেন, স্থির হইল। (ঐ)

বেলা প্রায় চারটের সময় ঠাকুর গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে উঠিয়া ভাব সমাধিতে মগ্ন হইলেন! তখন টিপ্‌ টিপ্‌ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। বর্ষাকাল—আকাশে মেঘ, পথে কাদা। (১-১১-২) ভক্তেরা গাড়ির পেছনে হেঁটে হেঁটে আসছেন। গাড়ি মানে ঘোড়ার গাড়ি। রথযাত্রা, তাই রাস্তায় দেখা যাচ্ছে ছেলেরা তালপাতার ভেঁপু বাজাচ্ছে। গাড়ি বাটীর সম্মুখে উপনীত হইল। দ্বারদেশে গৃহস্বামী ও তাঁহার আত্মীয়গণ আসিয়া অভ্যর্থনা করিলেন।⋯ উপরে উঠিয়াই শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিলেন যে শশধর তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন। পণ্ডিতকে দেখিয়া বোধ হইল যে তিনি যৌবন অতিক্রম করিয়া প্রৌঢ়াবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন।⋯ তিনি অতি বিনীতভাবে ভক্তিভরে ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। তৎপরে সঙ্গে করিয়া ঘরে লইয়া বসাইলেন। ভক্তগণ পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া আসন গ্রহণ করিলেন।⋯ ঠাকুর পণ্ডিতকে দেখিতে দেখিতে ভাবাবিষ্ট হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই অবস্থায় হাসিতে হাসিতে পণ্ডিতের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন, ‘বেশ ! বেশ !’ (ঐ) এর মানে হল, ঠাকুর তাঁর ভিতরটা সব দেখে নিচ্ছেন। দেখে নিয়ে বোধহয় খুশি হয়েছেন, তাই বলছেন : ‘বেশ ! বেশ !’ তারপরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করছেন : আচ্ছা, তুমি কি রকম লেকচার দাও ? (ঐ) শশধর তর্কচূড়ামণি বলছেন : মহাশয়, আমি শাস্ত্রের কথা বুঝাইতে চেষ্টা করি। (ঐ) ঠাকুর এ কথাটাকে বোধহয় খুব ভালভাবে নিলেন না। বলছেন : কলিযুগের পক্ষে নারদীয় ভক্তি। (ঐ) নারদ যেমন অহরহঃ ঈশ্বরের নামগুণগান করছেন। কোন কিছুর প্রার্থী নন তিনি। নামের নেশায় নাম করে যাচ্ছেন। নারদীয় ভক্তি মানে অহৈতুকী ভক্তি। শাস্ত্রে যে সকল কর্মের কথা আছে, তার সময় কৈ ? (ঐ) মানুষ আজ বড় কর্মব্যস্ত। আগে মানুষের হাতে সময় ছিল বেশী। প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা তখন বিশেষ ছিল না। তখন শাস্ত্রানুমোদিত পূজা, ব্ৰত, যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতি করার সময় মানুষের ছিল। তাছাড়া অর্থও এক্ষেত্রে এখন একটি বড় ব্যাপার। যাগ-যজ্ঞ প্রভৃতি করার মত অর্থ কোথায় এখন লোকের ? ঠাকুর বাস্তব দিকটা দেখেছেন। তাছাড়াও দেখি নিছক শাস্ত্রপাঠ, শাস্ত্রজ্ঞান এবং শাস্ত্রানুসরণের ব্যাপারে ঠাকুর বরাবরই খুব বিমুখ। কারণ, তিনি দেখেছিলেন সেই সময়কার অনেকেরই ধারণা যে, অনেক শাস্ত্র পড়তে হবে, তবে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। ‘কথামৃত’তেই দেখছি, একজন বলছেন : ঈশ্বরলাভ করতে গেলে পড়তেই কত হয় ! অনন্ত শাস্ত্র ! (১-১৩-৩) ঠাকুর বলছেন : না, তা নয়। শাস্ত্র কত পড়বে ? শুধু বিচার করলে কি হবে ? আগে তাঁকে লাভ করবার চেষ্টা কর, গুরুবাক্যে বিশ্বাস ক’রে কিছু কর্ম কর। গুরু না থাকেন, তাঁকে ব্যাকুল হ’য়ে প্রার্থনা কর, তিনি কেমন—তিনিই জানিয়ে দেবেন। (ঐ) শাস্ত্রকে ঠাকুর নিন্দা করছেন না। কিন্তু যাদের ধারণা যে শাস্ত্র পড়লেই আমি ধার্মিক হয়ে গেলাম, তাদের ঠাকুর বুঝিয়ে বলছেন : না, শাস্ত্রজ্ঞান এক জিনিস আর প্রত্যক্ষ অনুভূতি আর এক জিনিস। প্রত্যক্ষ অনুভূতিই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য—শাস্ত্রজ্ঞান নয়।

এই যে শুকনো শাস্ত্রজ্ঞান, এ সম্বন্ধে আমাদের শাস্ত্রেই কত সব কথা আছে। শাস্ত্রই সতর্ক করে দিচ্ছে যে, দেখো, শাস্ত্রের অরণ্যের মধ্যে তুমি হারিয়ে যেও না। শাস্ত্র থেকে তুমি সাহায্য নাও, নিয়ে ঈশ্বর-উপলব্ধির জন্য সাধন-ভজন কর। তোমার লক্ষ্য ঈশ্বর, শাস্ত্র না। বিবেকচূড়ামণিতে আছে : ‘শব্দজালং মহারণ্যং চিত্তভ্রমণকারণম্‌’—শাস্ত্রকে অরণ্যের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। সেই অরণ্যের মধ্যে পড়ে মানুষের মনটা ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়, বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ‘অতঃ প্রযত্নাজ্‌জ্ঞাতব্যংতত্ত্বজ্ঞৈস্তত্ত্বমাত্মনঃ’—‘তত্ত্বজ্ঞ’ যাঁরা অর্থাৎ যাঁরা বিচক্ষণ, প্রকৃতই জ্ঞানপিপাসু তাঁরা শাস্ত্রের শব্দরাশির দিকে তাকাবেন না। তাঁদের কর্তব্য আত্মতত্ত্ব জানবার জন্য প্রয়াসী হওয়া। আবার অন্য একটি শ্লোকে বলছে : ‘ষড়্‌দর্শনমহাকূপে পতিতাঃ পশবঃ প্রিয়ে। পরমার্থং ন জানন্তি পশুপাশনিয়ন্ত্রিতাঃ’—যারা ষড়দ্‌র্শন নিয়ে খুব চর্চা করছে অথচ ঈশ্বরের দিকে মন নেই, পরমার্থ কি জানে না, তারা যেন একটা মহাকূপে পড়ে আছে। পাশবদ্ধ হয়ে আছে তারা। তাদের জীবন ঘৃণ্য—পশুর মতো। পণ্ডিতদের সম্বন্ধে ঠাকুরও এরকম কঠিন কথা বলছেন। কোন পণ্ডিতের কাছে যাওয়ার আগে তিনি খোঁজ করতেন—কেমন পণ্ডিত ? তাঁর কি ঈশ্বরে মন আছে ? তিনি কি চরিত্রবান ব্যক্তি ? একটা উঁচু আদর্শ ধরে তিনি কি চলেন ? তাহলে তিনি তাঁর কাছে যাবেন। নাহলে নয়। বিদ্যাসাগরের কাছে গেলেন, কারণ তাঁর দয়ার কথা শুনেছেন। শশধর তর্কচূড়ামণির কাছে যে এসেছেন, তখনও খোঁজ করে এসেছেন। তাঁকেই বলছেন যে, যখন প্রথমে তোমার কথা শুনলুম, জিজ্ঞাসা করলুম যে, এই পণ্ডিত কি শুধু পণ্ডিত, না, বিবেক বৈরাগ্য আছে। (১-১১-৩) তারপরেই বলছেন কঠোর কথা ; যে পণ্ডিতের বিবেক নাই, সে পণ্ডিতই নয়। (ঐ) শুকনো পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে ঠাকুর বরাবরই নিষ্করুণ। বলছেন : এরা শকুনির মতো। শকুনি কত উঁচু দিয়ে উড়ে যায় কিন্তু দৃষ্টি পড়ে থাকে ভাগাড়ের দিকে। তেমনি, এই পণ্ডিতরা শাস্ত্রচর্চা করছেন, ঈশ্বর সম্বন্ধে আলোচনা করছেন অথচ মন ঈশ্বরের দিকে নেই—মন পড়ে আছে ঈশ্বর থেকে অনেক নীচে, বিষয়ের দিকে। বিবেকচূড়ামণিতে বলছে : এঁদের কাছে শাস্ত্রটা একটা ভোগের উপকরণ।

বাগ্‌বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্‌।

বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বদ্ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে ॥

—এঁদের শাস্ত্রব্যাখ্যার সবটাই হচ্ছে ‘বাগ্‌বৈখরী’—কথার তুবড়ি, শব্দের ঝরনা। এসব লোক-দেখানো জিনিস। এর দ্বারা ভোগ হয়, নামযশ হয়, কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য যে মোক্ষ, তা এর দ্বারা লাভ হয় না। কুলার্ণবতন্ত্রে বলছে :

বেদাগমপুরাণজ্ঞঃ পরমার্থং ন বেত্তি যঃ।

বিড়ম্বকস্য তস্যাপি তৎ সর্বং কাকভাষিতম্ ॥

—একজন লোক বেদ, আগম (অর্থাৎ তন্ত্র) এবং পুরাণ পড়েছে, শাস্ত্র খুব পড়াশুনা করেছে, কিন্তু সব শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য যে ঈশ্বর বা পরমার্থ, তাঁকে জানেনি। এরকম ব্যক্তি পণ্ডিত নয়—‘বিড়ম্বক’ অর্থাৎ অনুকরণকারী, নকলনবিশ। তার কথা কাকের ‘কা কা’ ধ্বনির মতো। সে যা কিছু বলে, অসার। কারও মনে কোন দাগ কাটে না।

সংস্কৃতে একটা কথা আছে ; গণ্ডূষ জলমাত্রেণ সফরী ফরফরায়তে।* সফরী মানে পুঁটি মাছ। অল্প জলে পুঁটি মাছ ফরফর করে বেড়ায়। কিন্তু বড় মাছ বেশী জলে থাকে, গম্ভীর মেজাজে আস্তে আস্তে চলে। যারা ছোট আধার, তারাই বেশী তর্ক-বিচার করে, সবসময় একটা পাণ্ডিত্য দেখাতে চায়। আর যাঁরা বুদ্ধিমান, যাঁরা সত্যি সত্যিই বিচার করার যোগ্যতা রাখেন—সকলে রাখেন না, যাঁরা রাখেন—তাঁরা সেটা বাইরে প্রকাশ হতে দেন না। নিজেদের মধ্যে চেপে রাখেন। অনেক সময় দেখা যায়, পাড়ার দুটি ছেলে হয়তো একই পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসা করা হল :‘কি হে, কেমন পরীক্ষা দিলে ?’ একজন বলল, ‘খুব ভাল দিয়েছি।’ আর একজন বলল, ‘সুবিধের হয়নি।’ যখন ফল বের হল তখন দেখা গেল হয়তো যে বলেছিল ‘খুব ভাল দিয়েছি’ সে কোনরকমে পাস করেছে আর অপরজন প্রথম শ্রেণী পেয়েছে।

অতি সহজ উপমা দিয়ে ঠাকুর বোঝাচ্ছেন : খালি কলসীতে জল ভরছ—প্রথমে খুব ভক্‌ ভক্ করে শব্দ হবে। ছোটবেলায় আমরাও ইংরেজিতে পড়েছি, Empty vessels sound much—খালি পাত্র বেশী শব্দ করে। কিন্তু কলসীতে জল ভরা হয়ে গেলে আর কোনও শব্দ নেই। আবার নেমন্তন্ন বাড়ির উপমা দিচ্ছেন ঠাকুর। খেতে বসে—লুচি নিয়ে এস, ডাল নিয়ে এস, তরকারি নিয়ে এস, খুব চিৎকার। তারপর যখন খাওয়া হয়ে এল, পাতে দই পড়ল তখন শুধু ‘সুপ্‌ সাপ্‌’, পরে নিদ্রা, একেবারে শান্ত। অর্থাৎ আমাদের যত বিচার, যত শাস্ত্র-আলোচনা—ঈশ্বরলাভের আগে পর্যন্ত। ততক্ষণ ঐ ‘কা কা’ ধ্বনি। ঈশ্বরলাভ হলে সমস্ত শুকনো বিচার থেমে যায়। মানুষের চরিত্রটাই পালটে যায়। তখন তিনি যা বলেন : সারগর্ভ। তাঁর মুখ দিয়ে যা বের হয়, ঈশ্বরের বাণী। কারণ, তাঁর মনটা শুদ্ধ হয়ে গেছে। ঠাকুর বলছেন ; শুদ্ধ মনে যা উঠবে, সে ঈশ্বরেরই বাণী।

আমরা মনে করি, খুব গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বললেই বুঝি লোকে নেবে। তা নয়। কথার শক্তি আসে যে বলছে তার কাছ থেকে। স্বামীজী ধর্মমহাসভায় সম্বোধন করলেন : ‘Sisters and brothers of America’—সঙ্গে সঙ্গে দু-মিনিট ধরে হাততালি। সামান্য দুটো কথা—আমেরিকার বোন ও ভাইয়েরা। এ তো আমরাও বলতে পারি। কিন্তু কথাটা তো আসল নয়, কথা জীবন্ত হয়ে ওঠে কথার পেছনে যে মানুষটি আছেন তাঁর জোরে। রোমাঁ রোলাঁ স্বামীজীর বক্তৃতা পড়ে বলেছেন : ‘I cannot touch these sayings of his, scattered as they are through the pages of books at thirty years’ distance, without receiving a thrill through my body like an electric shock.’—স্বামীজী ত্রিশ বছর আগে যা বলেছেন, সেগুলি যখন আমি পড়ি, আমার শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন বিদ্যুৎ-প্রবাহ বয়ে যায়। ‘And what shocks, what transports must have been produced when in burning words they issued from the lips of the hero !’—যারা এই অগ্নিগর্ভ কথাগুলো তাঁর মুখ থেকে সরাসরি শুনেছিল তাদের না জানি কী অনুভূতি হয়েছিল। সত্যিই স্বামীজীর কথা এমন যে, পড়লে উদ্দীপিত না হয়ে উপায় নেই। শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা, শ্ৰীশ্ৰীমার কথাও তাই—আমাদের মনে দাগ কেটে দেয়। অথচ সহজ সরল কথা সব। এর কারণ তাঁদের জীবন, তাঁদের চরিত্র। আসলে উপলব্ধি-প্রসূত কথার আলাদা শক্তি। সেইজন্যে সব ধর্মেই উপলব্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে, অসার পাণ্ডিত্যকে সব ধর্মেই নিন্দা করেছে। যীশুখ্রীষ্ট বলছেন : ‘Beware of the doctors of the law, who love to walk up and down in long robes, receiving respectful greetings in the street; and to have the chief seats in synagogues, and places of honour at feasts.’—পণ্ডিতদের সম্বন্ধে সাবধান। এরা খুব জাঁকজমক করে লম্বা পোশাক পরে রাস্তায় চলাফেরা করে ; পথে সকলে এদেরকে শ্রদ্ধা জানায়, সেটা তারা খুব উপভোগ করে। মন্দিরে এবং অন্যান্য উৎসব-স্থলে গিয়ে সবচেয়ে যে উচ্চাসন সেখানে গিয়ে তারা বসে। কিন্তু—‘These are the men who eat up the property of widows, while they say long prayers for appearance’ sake’—এরাই আবার লম্বা লম্বা প্রার্থনা-বাণী উচ্চারণ করে আর অসহায় বিধবাদের সম্পত্তি গ্রাস করে। শেষে বলছেন তিনি : ‘and they will receive the severest sentence.’ —এইভাবে যারা প্রতারণা করবে, ধর্মের নামে মানুষকে ঠকাবে, তারাই সবচেয়ে কঠিন শাস্তি পাবে। ঠাকুর তাই বারবার করে সতর্ক করে দিচ্ছেন : পাণ্ডিত্যের দিকে বেশী ঝুঁকে পড়ো না, শাস্ত্রের মধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেল না। বলছেন : এখানকার ভাব কি জান ? (‘এখানকার ভাব’ অর্থাৎ তাঁর ভাব। উনি ‘আমি’, ‘আমার’ এই কথাগুলি বলতে চাইতেন না।) বই শাস্ত্র এ সব কেবল ঈশ্বরের কাছে পৌঁছিবার পথ ব’লে দেয়। পথ, উপায়, জেনে লবার পর, আর বই শাস্ত্রে কি দরকার ? (১-১৪-৩)

শাস্ত্রের মূল্য হচ্ছে এইখানে যে, শাস্ত্র পথ বলে দিচ্ছে। কিন্তু সেই পথ দিয়ে যদি না চলি, তাহলে সব বৃথা। শাস্ত্র থেকে পথটা জেনে নিলাম, তখন নিজে কাজ ক’রতে হয়। (ঐ) অর্থাৎ শাস্ত্রে যেরকম বলে দেওয়া আছে সেইভাবে সাধন-ভজন করতে হয় যাতে ভক্তি-বিশ্বাস হয়, ত্যাগ-বৈরাগ্য হয়, ঈশ্বর-উপলব্ধি হয়। উদাহরণ দিয়ে বলছেন : একজন একখানা চিঠি পেয়েছিল, কুটুম বাড়ি তত্ত্ব ক’রতে হবে, কি কি জিনিস লেখা ছিল। জিনিস কিনতে দেবার সময় চিঠিখানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কর্ত্তাটি তখন খুব ব্যস্ত হ’য়ে চিঠির খোঁজ আরম্ভ করলেন। অনেকক্ষণ ধ’রে অনেকজন মিলে খুঁজলে। শেকে চিঠিখানা পাওয়া গেল। তখন আর আনন্দের সীমা নাই। কর্ত্তা ব্যস্ত হ’য়ে অতি যত্নে চিঠিখানা হাতে নিলেন আর দেখ্‌তে লাগলেন, কি লেখা আছে। লেখা এই, পাঁচ সের সন্দেশ পাঠাইবে, একখানা কাপড় পাঠাইবে ; আরও কত কি। তখন আর চিঠির দরকার নাই, চিঠি ফেলে দিয়ে সন্দেশ ও কাপড়ের আর অন্যান্য জিনিসের চেষ্টায় বেরুলেন। চিঠির দরকার কতক্ষণ ? যতক্ষণ সন্দেশ, কাপড় ইত্যাদির বিষয় না জানা যায়। তার পরই পাবার চেষ্টা ।(ঐ) এই পাবার চেষ্টার কথাই বারবার করে ঠাকুর বলছেন। একটা শ্লোকে বলছে : ‘ন বেদাঃ কারণং মুক্তের্দর্শনানি ন কাবণম্‌’—মুক্তির কারণ বেদ নয়, দর্শন নয়। ‘জ্ঞানমেব হি কারণম্‌’— জ্ঞানই হচ্ছে মুক্তির কারণ। ভাষাজ্ঞান নয়, বস্তুজ্ঞান। ভাষা যে বস্তুর সম্বন্ধে বলছে, সেই বস্তুকে জানা। আর এক জায়গায় বলছে : ‘ন গচ্ছতি বিনা পানং ব্যাধিরৌষধশব্দতঃ’—আমার ব্যাধি হয়েছে, ওষুধ না খেয়ে ওষুধের নামটা শুধু কয়েকবার বললাম, তাতে অসুখ সারবে না। তাহলে আর ডাক্তারদের কখনও অসুখ করত না। ম্যালেরিয়া হয়েছে, আমি ‘কুইনাইন, কুইনাইন’ বলতে থাকলাম, তাতে ম্যালেরিয়া সারবে না। ওষুধটা খেতে হবে। তেমনি ‘বিনাহপরোক্ষানুভবং ব্রহ্মশব্দৈর্ন মুচ্যতে’—শুধু ব্রহ্মশব্দ আমি জানলাম, শাস্ত্র পড়লাম, শব্দজ্ঞান হল—এতে মুক্তি হবে না ! অপরোক্ষ-অনুভূতি বিনা মুক্তি হয় না। প্রত্যক্ষ উপলব্ধি চাই। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : শুধু ‘সিদ্ধি সিদ্ধি’ করে গেলে সিদ্ধির নেশা হবে না। সিদ্ধি এনে বাটতে হবে, দুধের সাথে মেশাতে হবে, খেতে হবে —তবেই নেশা হবে। এও হচ্ছে তাই। প্রত্যক্ষ জ্ঞান চাই। আমাদের শাস্ত্র বারবার করে এই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর জোর দিচ্ছে।

ঠাকুর বলছেন : আমি মার মুখের কথার সঙ্গে না মিললে কিছুই লই না। (৩-১৫-২) বলছেন : শাস্ত্রে চিনি আর বালি মেশানো আছে। কিভাবে বুঝব কতটুকু নেব ? যতটুকু ‘মার মুখের কথা’র সঙ্গে মেলে, যতটুকু আমার উপলব্ধির সঙ্গে মেলে। যতটুকু মিলছে না—ততটুকু আমি নিতে পারছি না। আসলে অপরোক্ষ জ্ঞানই হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য। বারবার করে শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করছেন। তাঁর জীবনে দেখি, যা যা অনুভূতি হচ্ছে তাঁর—শাস্ত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। শাস্ত্রের প্রামাণিকতা আমরা যাচাই করে নিতে পারছি তাঁর জীবন থেকে। তাঁকে দেখে বুঝছি, শাস্ত্র মিথ্যে নয়, বুজরুকি নয়। শাস্ত্রে যা আছে, সত্যি। আবার বলছেন তিনি : এখানকার অনুভূতি বেদ-বেদান্ত ছাড়িয়ে গেছে। শাস্ত্র যেন ছোট হয়ে গেছে তাঁর কাছে। যা তিনি উপলব্ধি করেছেন, শাস্ত্র যেন তা বর্ণনা করে উঠতে পারেনি। তাঁর সাথে বিচার করতে এসে পণ্ডিতরা অবাক হয়ে যেত। বলত : শাস্ত্র-টাস্ত্র যা পড়েছি, আপনাকে দেখে সব তুচ্ছ হয়ে গেল। এই সমাধির কথাই ধরা যাক। শাস্ত্রে সমাধির কথা আছে—কিন্তু কটা লোকের সমাধি হয় ? অথচ শ্রীরামকৃষ্ণের মুহুর্মুহুঃ সমাধি হচ্ছে। তাঁর কাছে যাঁরা আসছেন তাঁরা বুঝতে পারছেন : ও, এই তাহলে সমাধি। সমাধি তাহলে সত্যিই কারও হতে পারে। একটা শ্লোকে আছে :

মথিত্বা চতুরো বেদান্‌ সর্বশাস্ত্রাণি চৈব হি।

সারন্তু যোগিভিঃ পীতং তক্রং পিবন্তি পণ্ডিতাঃ ॥

—চারটে বেদ আর শাস্ত্র মন্থন করে যে সার বা মাখন ওঠে, তা কিন্তু সবসময় যোগীরাই পান করেন— যাঁরা সাধনভজন করছেন, বা যাঁরা সিদ্ধ হয়েছেন। আর পণ্ডিতরা শুধু ঘোলটুকু খান। ফাঁকিতে পড়ে যান তাঁরা। ঠাকুরের সমাধি দেখে দয়ানন্দ সরস্বতী ঠিক এই কথাই বলেছিলেন : আমরা এত বেদ বেদান্ত কেবল পড়েছি, কিন্তু এই মহাপুরুষে তার ফল দেখিতেছি ; এঁকে দেখে প্রমাণ হ’লো যে, পণ্ডিতেরা কেবল শাস্ত্র মন্থন ক’রে ঘোলটা খান, এরূপ মহাপুরুষেরা মাখনটা সমস্ত খান। (১-১৩-৫) ঠাকুরের সম্বন্ধে স্বামী বিরজানন্দ বলছেন :১০ ‘সর্বশাস্ত্রমর্মদর্শি-সৰ্ববিদ্-নিরক্ষরম্’। তাঁকে পুরো নিরক্ষর অবশ্য বলা চলে না, কিন্তু প্রচলিত অর্থে তিনি তো অশিক্ষিতই ছিলেন। অথচ ‘কথামৃতে’ দেখি কী তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান। শাস্ত্রের জটিল তত্ত্ব প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করে দিচ্ছেন। সমস্ত শাস্ত্রের সার তাঁর এই ‘কথামৃতে’ রয়েছে। কোথা থেকে পেলেন এত শাস্ত্রজ্ঞান ? কারণ, তিনি সমস্ত শাস্ত্রের ‘মর্ম’ ‘দর্শন’ করেছিলেন, প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিল তাঁর। যাঁকে জানলে সব জানা হয়ে যায়, তাঁকে জেনেছিলেন। তাই তিনি ‘সর্ববিৎ’। প্রায়-নিরক্ষর হলেও ‘সর্ববিৎ’ তিনি। বারবার করে মানুষকে বলছেন তিনি। তাঁকে লাভ কর। সেটাই জীবনের লক্ষ্য। শাস্ত্র নয়, পাণ্ডিত্য নয়। —ঈশ্বরলাভই জীবনের উদ্দেশ্য। উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন ; শাস্ত্রজ্ঞান আর ঈশ্বরজ্ঞানের মধ্যে কতটা পার্থক্য। বলছেন : চিঠির কথা, আর যে ব্যক্তি চিঠি লিখেছে তার মুখের কথা, অনেক তফাত। শাস্ত্র হচ্ছে চিঠির কথা ; ঈশ্বরের বাণী মুখের কথা। (৩-১৫-২) ঐ মুখের কথা শোনবার চেষ্টা করতে হবে। তা নাহলে শুধু শাস্ত্র ঘেঁটেই যদি জীবন যায়, সেই জীবন বৃথা। একটা খুব সুন্দর শ্লোক আছে :১১

পঠন্তি বেদশাস্ত্রাণি বিবদন্তি পরস্পরম্।

ন জানন্তি পরং তত্ত্বং দৰ্বী পাকরসং যথা ॥

—বেদ পড়েছে, অনেক শাস্ত্র পড়েছে। এসব পড়ে পণ্ডিতরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করছে। এদের অবস্থাটা কিরকম ? হাতার মতো। হাতা দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া, পরিবেশন করা হচ্ছে—সবাই খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে ; কিন্তু হাতা কখনও খাবারের স্বাদ কি বুঝতে পারে না। তেমনি পণ্ডিতরা শাস্ত্রচর্চা করে যাচ্ছেন শুধু শাস্ত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, কিন্তু শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় যে ঈশ্বর সেই ঈশ্বরলাভের আনন্দ থেকে নিজেদের তাঁরা বঞ্চিত করে রাখছেন। হতভাগ্য তাঁরা। কতটা যে তাঁরা হারাচ্ছেন, জানেন না। কাজেই, পাণ্ডিত্য আসল নয়—প্রত্যক্ষ উপলব্ধিই আসল। ভক্তি, বিশ্বাস, ত্যাগ, প্রেম, পবিত্রতা এগুলিই হচ্ছে আসল। চৈতন্যচরিতামৃতে বর্ণনা আছে,* একটি লোক অশুদ্ধ উচ্চারণে গীতা পড়ছে। গীতা সংস্কৃতে লেখা, সংস্কৃত শব্দ ভাল করে সে উচ্চারণ করতে পারছে না। অথচ আনন্দে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মহাপ্রভু তাকে জিজ্ঞেস করছেন: কি বুঝছ তুমি যে এত আনন্দ পাচ্ছ? সেই লোকটি বলছে: আমি গীতার শব্দার্থ কিছু বুঝি না। গুরু আদেশ করেছেন তাই গীতা পড়ি। কিন্তু যখন গীতা পড়ি তখন চোখের সামনে ভগবান, শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুনকে আমি দেখতে পাই। আর সেই দৃশ্য দেখে আনন্দে আমার দুচোখ জলে ভরে যায়। এই রকম যে ব্যক্তি, তিনিই ধন্য। শাস্ত্রজ্ঞান নেই তাঁর, কিন্তু তাঁর ভক্তি আছে, বিশ্বাস আছে, ঈশ্বরপ্রেম আছে। যারা শুধুই শাস্ত্রচর্চা করেন, তাঁদের থেকে এঁরা অনেক উন্নত পর্যায়ের মানুষ।

ঠাকুর তাই বলছেন: শাস্ত্র মুখ্য নয়, শাস্ত্র গৌণ। শাস্ত্রে তাঁকে পাবার উপায়ের কথা পাবে। কিন্তু খবর সব জেনে কর্ম আরম্ভ করতে হয়। তবে তো বস্তুলাভ! শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে? অনেক শ্লোক, অনেক শাস্ত্র, পণ্ডিতের জানা থাকতে পারে; কিন্তু যার সংসারে আসক্তি আছে⋯তার শাস্ত্র ধারণা হয় না—মিছে পড়া। পাঁজিতে লিখেছে, বিশ আড়া জল, কিন্তু পাঁজি টিপ্‌লে এক ফোঁটাও পড়ে না। এক ফোঁটাই পড়—কিন্তু এক ফোঁটাও পড়ে, না।⋯পণ্ডিত খুব লম্বা লম্বা কথা বলে, কিন্তু নজর কোথায়? ⋯দেহের সুখ আর টাকায়। (১-১৪-৩) তারপরেই পণ্ডিতদের সম্বন্ধে সেই নিদারুণ কথাটা বলছেন: শকুনি খুব উঁচুতে উড়ে, কিন্তু নজর ভাগাড়ে। (ঐ) আমরা সমস্ত শ্রীরামকৃষ্ণ-লীলার মধ্যে এই দেখি যে, যেটা মেকি যেটা মিথ্য, সেটাকে বর্জন করতে তিনি শেখাচ্ছেন। যখন উনি বালক, তখনই উনি গ্রামের পণ্ডিতদের ব্যঙ্গ করছেন। তারা কি কি অঙ্গভঙ্গি করে, কিভাবে পাঠ করে—সব তিনি অভিনয় করে দেখাচ্ছেন। কেন করছেন? কারণ, তখনই তিনি বুঝেছেন এরা অসার, শ্রদ্ধাযোগ্য নয় এরা। এরা শাস্ত্র পড়ে কিন্তু সেটা তাদের একটা অর্থকরী বৃত্তি। এই যে বলছেন, ‘চালকলাবাঁধা বিদ্যে চাই না’, এই জন্য তাঁর এত আক্রোশ চালকলাবাঁধা বিদ্যের প্রতি। যে বিদ্যা শুধু পুস্তকেই আবদ্ধ, জীবনের সাথে যার যোগ নেই, তাকে তিনি উপেক্ষা করছেন। সত্যিকারের পণ্ডিত যিনি, যাঁর মধ্যে জ্ঞান আছে, ভক্তি আছে, প্রেম আছে—তাঁকে শ্রদ্ধা করছেন। কিন্তু যার তা নেই, তাকে বর্জন করছেন। বলছেন যে, পণ্ডিতের যদি দেখি বিবেক নাই, ঈশ্বরে ভালবাসা নাই, তাহলে তাকে খড়-কুটো মনে হয়। (১-১৭-৩)—তা তিনি যত বিদ্বানই হোন, যত নাম-ডাকই তাঁর থাকুক। তাঁর কাছে মনুষ্যত্বের মাপকাঠি ঐ একটিই—ঈশ্বরপ্রেম। বারবার করে মানুষের দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষণ করছেন।

ঠাকুর বলছেন: বই হাজার পড়, মুখে হাজার শ্লোক বল, ব্যাকুল হয়ে তাঁতে ডুব না দিলে তাঁকে ধরতে পারবে না। শুধু পাণ্ডিত্যে মানুষকে ভোলাতে পারবে, কিন্তু তাঁকে পারবে না। (১-১২-৩) শশধর তর্কচূড়ামণিকে বলছেন: আর একটু বল বাড়াও, আর কিছুদিন সাধন-ভজন কর। গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। (১-১১-৩)—তুমি তো ধর্মপ্রচার কর, লোকশিক্ষা দাও, কিন্তু তার আগে ঈশ্বরে ভক্তি-প্রেম একটু বাড়াও। যেন কত অনুনয় করছেন। এ যে মহাদায় তাঁর, এই দায় নিয়েই তো তিনি এসেছেন—মানুষকে তার জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন করে দিতে। শুধু শশধর তর্কচূড়ামণিকে নয়, সমস্ত ধর্মপ্রচারকদের উদ্দেশ্যেই তিনি বলছেন: আগে একটু বল বাড়াও! তুমি যে ঈশ্বরের কথা বলবে, তুমি যে মানুষের মধ্যে ভক্তি-প্রেম জাগাবে, তার আগে একবার বল তো দেখি, তুমি তাঁকে ভালবাসতে পেরেছ কিনা, তোমার মধ্যে সেই প্রেম জেগেছে কিনা? তোমার মধ্যে যা নেই তা কি তুমি অন্য কাউকে দিতে পার? তুমি হয়তো চেষ্টা করতে পার দিতে, কিন্তু লোকের মনে তা কোন দাগ কাটবে না। তা বলে কি ঠাকুর ধর্মপ্রচার করতে, উপদেশ দিতে নিষেধ করছেন? তা নয়। এই ‘কথামৃত’তেই আর এক জায়গায় দেখি ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুর উপস্থিত আছেন আর সেখানে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী আছেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ব্রাহ্মসমাজের আচার্য, তাঁর ধর্মপ্রসঙ্গ করার কথা। ঠাকুরের সামনে সঙ্কোচ বোধ করছেন তিনি। কিন্তু ঠাকুর তাঁকে বলছেন: যেমন পদ্ধতি আছে তেমন করতে হয়। তুমি ধর্মপ্রসঙ্গ কর। তবে সেসময় তুমি এটা মনে করো না যে, তুমি উপদেশ করছ। তুমি এটা মনে রেখো যে, তিনিই তোমার মধ্য দিয়ে কথা বলছেন। তাঁর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তুমি বলো। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করি। স্বামী বিরজানন্দকে স্বামীজী বক্তৃতা করতে পাঠাবেন ঢাকাতে। কিন্তু বিরজানন্দের খুব আপত্তি: আমি তো ঈশ্ববলাভ করিনি, আমি কি বক্তৃতা করব? স্বামীজী প্রথমে বোঝালেন তাঁকে: তুই তো আচার্যের অভিমান রেখে বলবি না। সেবার ভাবে যেমন অন্যান্য দশটা কাজ করিস, সেইভাবে বক্তৃতা করবি। তবুও তাঁর আপত্তি: আমি কি জানি যে বলব? তখন স্বামীজী বলেছিলেন: ঠিক আছে, উঠে দাঁড়িয়ে এইটেই তাহলে বলবি যে, আমি কিছু জানি না। ‘আমি কিছু জানি না’ এটা বলাই একটা মস্ত উপদেশ। ‘আমি সব জানি’—এই ভাব হচ্ছে অজ্ঞান।

বাস্তবিক, যে এইভাবে নিজেকে মুছে ফেলতে পারে, ঈশ্বর তাঁকেই কৃপা করেন, ঈশ্বরের শক্তি তাঁর ভিতর দিয়ে কাজ করে। স্বামী মাধবানন্দকে দেখেছি, কেউ যদি তাঁর কাছে গিয়ে কোন উপদেশ চাইত—আমরাই অনেক সময় চেয়েছি—তিনি বলতেন: বইতে সব লেখা হয়ে গেছে, এখন নিজে বুঝে নাও। খুব অনুরোধ করলে সামান্য দু-চারটা কথা হয়তো বলতেন। ভাবটা হচ্ছে: আমি কি জানি যে, বলব। অথচ আমাদের অনুরোধে তিনি ঐ যে দু-চারটি কথা বাধ্য হয়ে বলতেন, দেখা যেত, অমূল্য কথা সে সব। খুব ভাল বক্তা ছিলেন, অথচ মোটেই বক্তৃতা করতে চাইতেন না। একবার তিনি মঠে স্বামীজীর উৎসবের দিনে অনেক অনুরোধ-উপরোধের পরে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমি অবশ্য সে বক্তৃতা শুনিনি কিন্তু যাঁরা শুনেছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন যে, একটা খুব অদ্ভুত বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন, এরকম বক্তৃতা সচরাচর শোনা যায় না। তাঁকে আমি দেখেছি, ছোট-বড় যে কোন সভাই হোক না কেন, বলতে যাওয়ার আগে ঠাকুরঘরে বসে ধ্যান করতেন। তারপরে গিয়ে বক্তৃতা করতেন। কি ধ্যান করতেন, কি প্রার্থনা করতেন জানি না। তবে অনুমান করতে পারি যে, নিশ্চয়ই এরকম বলতেন যে, আমি কি বলব, আমি কিছুই জানি না; তুমি আমাকে দিয়ে বলিয়ে নাও, তুমিই বল। ধর্মপ্রচারকদের উদ্দেশে ঠাকুর যেটা বলছেন, সেটা হচ্ছে: অভিমান যেন না থাকে। বক্তৃতা বা কোন রকম উপদেশ দেওয়ার সময় মনে রাখা দরকার যে, আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী। তিনি যদি কৃপা করে আমাকে দিয়ে বলিয়ে দেন, তাহলেই বলব। বাস্তবিক, ঈশ্বরপ্রেম ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ প্রচার করতে পারে না। তিনি যাঁকে নির্বাচন করেন, তিনি তাঁর শক্তি যাঁর মধ্যে ঢেলে দেন, তিনিই ধর্মপ্রসঙ্গ করতে পারেন, তাঁর প্রচারেই কাজ হয়। লোকে দেখে, সে প্রচার করছে—আসলে ঈশ্বর তাঁর মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রচার করছেন। সে যন্ত্র—ঈশ্বর যন্ত্রী। স্বামীজী বলতেন: ১২‘I am a voice without a form.’—আমি দেহহীন এক কণ্ঠস্বর। আমি যা কিছু বলেছি—আমি বলিনি, তিনিই আমার মধ্য দিয়ে কথা বলেছেন। আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী।

ঠাকুর বলছেন: সচ্চিদানন্দ বই আর গুরু নাই। তিনি বিনা আর কোন উপায় নাই। তিনিই একমাত্র ভবসাগরের কাণ্ডারী।(১-১২-৮) বলছেন: যাঁর এই ভুবনমোহিনী মায়া, তিনিই সেই মায়া থেকে মুক্ত করতে পারেন। ⋯যারা ঈশ্বর লাভ করে নাই, যারা তাঁর আদেশ পায় নাই, যারা ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হয় নাই, তাদের কি সাধ্য জীবের ভববন্ধন মোচন করে। (১-৪-৫) আমরা মনে করি, আমরা যদি কোন কথা বলি, তাতেই একটা ভয়ানক পরিবর্তন মানুষের হয়ে যাবে। তা হয় না। আমাদের কথা, শুষ্ক কথা—লোকের মনে কোন দাগ কাটে না। খুব ভাল ভাল কথা বললাম হয়তো—কিন্তু মানুষ একটু পরেই তা ভুলে যায়। সত্যিকারের যিনি জ্ঞানী, যিনি ঈশ্বরদ্রষ্টা তাঁর কোন কথা বলারও প্রয়োজন হয় না। তাঁর স্পর্শ, তাঁর দৃষ্টি—তাতেই মানুষের কল্যাণ হয়, মনের পরিবর্তন হয়। আর তিনি যখন কথা বলেন, তখন যদি একটা সাধারণ কথাও বলেন, তাতেও মানুষের মহা কল্যাণ হয়। সে কথার এমন তেজ, এমন শক্তি—মানুষের মনকে একেবারে অন্য জগতে নিয়ে যায়। অন্য মানুষ হয়ে যায় তাঁর কথা শুনে। আর সেই মানুষের এমনই আকর্ষণী শক্তি যে, লোকে ধর্মপিপাসা মেটাতে দলে দলে তাঁর কাছে ছুটে আসে। কত সাধু মৌন অবলম্বন করে থাকেন, লোকালয় থেকে দূরে হয়তো আছেন। অথচ মানুষ কি করে তাঁদের খবর পেয়ে যায়। যেমন, ত্রৈলঙ্গস্বামী। মৌন ছিলেন। কাশীতে থাকতেন। সবাই আমরা তাঁর কথা জানি। কাশীর মানুষ তাঁকে মনে করতেন ‘সচল বিশ্বনাথ’। মন্দিরে আছেন ‘অচল বিশ্বনাথ’, আর ত্রৈলঙ্গস্বামী সচল বিশ্বনাথ। ঠাকুর তাঁকে দেখতে গেছিলেন, স্বামীজীও গেছিলেন। বাস্তবিক, জীবনই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচার। যাঁর জীবন তৈরি হয়েছে, তাঁর আকর্ষণে মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ছুটে আসে। শশধর তর্কচূড়ামণিকে ঠাকুর বলছেন: প্রদীপ জ্বাললে বাদুলে পোকাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আপনি আসে—ডাকতে হয় না। (১-১১-৩) আমাদের কর্তব্য ঐ প্রদীপ জ্বালা। আমার ভিতরে জ্ঞানের প্রদীপ রয়েছে—সেই আলোয় আলোকিত হওয়া; ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে ওঠা। যে আদেশ পেয়েছে, তার লোক ডাকতে হয় না; অমুক সময়ে লেকচার হবে বলে, খবর পাঠাতে হয় না। তার নিজের এমনি টান যে লোক তার কাছে আপনি আসে। (ঐ) কথাগুলো সব ঠাকুরের সম্বন্ধে প্রযোজ্য। তিনি যেসময় এসেছিলেন, সেসময়টা কলকাতা লেকচারে মেতে উঠেছিল। অথচ শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখছি—লেকচারের প্রতি তাঁর ভয়ানক অনীহা। ‘শ্ৰীম’ তখন নতুন গেছেন তাঁর কাছে, কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুরকে বলে ফেলেছেন: ঈশ্বর সম্বন্ধে এই কথাটা যে আপনি বললেন, এটা তো লোককে ভাল করে জানিয়ে দেওয়া দরকার, তাদের কাছে এটা পৌঁছে দেওয়া দরকার—অর্থাৎ লেকচার দেওয়া দরকার। ঠাকুর বিরক্ত হচ্ছেন। বলছেন: ঐ তোমাদের কলকাতার লোকেদের এক বাতিক—খালি লেকচার আর লেকচার। ঠাকুরের বক্তব্য হচ্ছে: যে ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হতে পারেনি, তার বক্তৃতায় কোন কাজ হয় না। উদাহরণ দিচ্ছেন: ঢ্যামনা সাপ যদি ব্যাঙ ধরে, ব্যাঙেরও যন্ত্রণা, সাপেরও যন্ত্রণা—কারণ ব্যাঙকে সাপটা গিলতেও পারে না ফেলতেও পারে না। ব্যাঙ শুধু চেঁচাতে থাকে। কিন্তু জাত সাপ যদি ব্যাঙ ধরে, ব্যাঙটা একবার চিৎকার করেই চুপ করে যায়। জাত সাপ অর্থাৎ যাঁর ঈশ্বর উপলব্ধি হয়েছে। সেই সদ্‌গুরু। সেই ঠিক ঠিক আচার্য হতে পারে।

ঠাকুর বলছেন: আদেশ পেয়ে যদি কেউ লোকশিক্ষা দেয়, তাকে কেউ হারাতে পারে না। বাগ্বাদিনীর কাছ থেকে যদি একটি কিরণ আসে, তাহলে এমন শক্তি হয় যে, বড় বড় পণ্ডিতগুলো কেঁচোর মত হয়ে যায়।(ঐ) অর্থাৎ মা সরস্বতী যদি তোমার সহায় হন, আর কেউ তোমার কাছে দাঁড়াতে পারবে না। আমরা শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনে সেটাই দেখি। বড় বড় পণ্ডিতরা সত্যি সত্যিই তাঁর কাছে কেঁচো হয়ে যেতেন। একজন পণ্ডিত, তাঁর নাম হচ্ছে গৌরী পণ্ডিত। বর্ধমানের ইঁদেশ গ্রামে থাকেন তিনি—সেই সময়কার খুব বিরাট একজন পণ্ডিত। তাঁর কতগুলি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। যখন তিনি কোন বিচারসভাতে ঢুকতেন বিচার করবার জন্য, তখন তিনি খুব চিৎকার করে ‘হা রে রে রে নিরালম্বো লম্বোদরজননী কংযামি শরণম্’—এই কথাগুলো বলতে বলতে ঢুকতেন। আর কুস্তিগীরদের মতো তাল ঠুকতে ঠুকতে ঢুকতেন। তখন আর কেউ তাঁর সঙ্গে বিচার করে পেরে উঠত না। তিনি যখন প্রথম ঠাকুরের কাছে আসছেন, ঐরকম ‘হা রে রে রে’ করতে করতে ঢুকছেন, আর ঠাকুরও ‘হা রে রে রে’ করছেন। কেউ তাঁকে বলে দেয়নি, আপনা-আপনি তাঁর ভিতর থেকে ঐ চিৎকারটা উঠছে। গৌরী পণ্ডিতের চেয়েও আরও জোরে তিনি ‘হা রে রে রে’ করছেন। এমন কাণ্ড যে, আশেপাশের দারোয়ানরা ডাকাত পড়েছে ভেবে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছুটে এসেছে। কিন্তু সেই পণ্ডিত ‘হা রে রে রে’ করে ঠাকুরের সাথে পেরে উঠলেন না। ঠাকুরের গলা আরও উপরে। তিনি আর কি করবেন, চুপ করে গেলেন, মনটাও একটু খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেল, ঠাকুরের কাছে তিনি একেবারে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছেন। আর একজন পণ্ডিত বৈষ্ণবচরণ—তিনিও খুব বিখ্যাত পণ্ডিত। একদিন ভাবাবিষ্ট হয়ে তাঁর কাঁধে চেপে বসলেন ঠাকুর—আর সেই পণ্ডিত নিজেকে কৃতার্থ মনে করছেন, সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের সম্বন্ধে একটা স্তব রচনা করে বলে যাচ্ছেন মুখে মুখে। কখনও কোন পণ্ডিত হয়তো তাঁর সাথে অনর্থক তর্ক-বিচার করে যাচ্ছে, তিনি বুঝতে পেরেছেন, এ প্রকৃত জিজ্ঞাসু না, শুধু পাণ্ডিত্য দেখানোর চেষ্টা, শুকনো বিচার—তখন তাঁকে একটু স্পর্শ করে দিতেন। ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে সেই পণ্ডিত তাঁর কথা মেনে নিত। এই যে বলছেন ‘কেঁচো হয়ে যায়’, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এই কথা বলছেন।

বাস্তবিক, পৃথিবীতে কত বড় বড় পণ্ডিতই তো এসেছেন-গেছেন। কিন্তু সত্যি করে বলতে গেলে আমাদের জীবনগঠনের যে উপাদান, তা আমরা পাই খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, চৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ—এঁদের মতো মহাপুরুষদের কাছ থেকে। এঁদের অনেকেই হয়তো পণ্ডিত নন, শাস্ত্র পড়েননি। কিন্তু আসল বস্তু তাঁরা লাভ করেছেন, ঈশ্বর-সাক্ষাৎকার করেছেন। কাজেই তাঁরা যখন ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন কথা বলেন, মনের মধ্যে তা একটা আলাদা আলোড়ন এনে দেয়। বস্তুত, শাস্ত্রটা কি? শাস্ত্র তো মনগড়া কিছু নয়। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ যাঁরা, ঋষি যাঁরা, যাঁরা সত্যদ্রষ্টা,তাঁরা যা অনুভব করেছিলেন, সেই অনুভূতি সব লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সেইগুলিই আজকে আমাদের শাস্ত্র। সব দেশেই তাই। সত্য যেন মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমনিতে তা ধরতে পারি না। কিন্তু একটা বিশেষ অবস্থাতে, মনটা যখন খুব অনুভূতিপ্রবণ হয়েছে, কিংবা খুব শুদ্ধ হয়েছে, আমাদের অভিমান হয়তো খুব ক্ষীণ হয়ে গেছে—তখন সেই সত্যের সঙ্গে আমাদের মনের যেন একটা যোগ হয়ে যায়। মনের মধ্যে সত্যটা হঠাৎ ভেসে ওঠে। আর সেই সত্য যখন আমাদের মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয় তখন লোকে তা ফেলতে পারে না। লোকে অনুভব করে যে, সেই কথার একটা আলাদা শক্তি আছে। শাস্ত্রে বলছে: ‘করামলকবৎ’। আমার হাতে একটা আমলকী আছে। এখন বিশ্বসুদ্ধ লোক যদি বলে, আমার হাতে কিছু নেই, আমি তা মানব না। সিদ্ধপুরুষ যাঁরা তাঁরা ‘করামলকবৎ’ সত্যকে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁদের কথার মধ্যে তখন এমন একটা প্রত্যয় থাকে, এমন একটা জোর থাকে যে, অন্যের মনকে নাড়া দেয়। তাঁদের সেই প্রত্যয় অন্যের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: হ্যাঁ, আমি দেখেছি বইকি ঈশ্বরকে! যেমন তোমাকে দেখছি, তার চেয়েও স্পষ্টভাবে। ঠিক ঠিক চাইলে যে-কেউ তাঁকে দেখতে পারে।—যদি তুমি চাও, তোমাকেও দেখাতে পারি। কত বড় একটা আশ্বাসবাণী। যখন সত্যি সত্যিই কেউ এরকম কথা বলতে পারে, তখন তার মধ্যে একটা আলাদা তেজ থাকে। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: দেখ তুমি যো সো করে ভগবান লাভ কর। তখন দেখবে যে, লোকে তোমার কাছে ছুটে আসছে। লোকগুরু কি সবাই হতে পারে?

আমরা দেখি চৈতন্যচরিতামৃতে বলছে:১৩

আপনি না কৈলে ধর্ম শিখান না যায়।

এই ত সিদ্ধান্ত গীতা-ভাগবতে গায় ।।

নিজে যদি ধর্ম-আচরণ না করি, তাহলে অন্যকে কি শেখানো যায়? নিজেকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, তবে অপরকে শেখানো যাবে। শুধু মুখের কথা বললে হবে না। একজন গিয়ে মহম্মদের কাছে বলছেন: আমার ছেলে বড় মিষ্টি খেতে ভালবাসে, আপনি তাকে একটু বুঝিয়ে বলে দিন যে, অত মিষ্টি খাওয়া ভাল না। মহম্মদ তাঁকে বললেন যে, ঠিক আছে, তুমি আসছে সপ্তাহে ওকে নিয়ে আমার কাছে এসো। পরের সপ্তাহে সেই ভদ্রলোক তাঁর ছেলেকে নিয়ে আবার এলেন। মহম্মদ তাঁকে বললেন: দেখ, অত মিষ্টি খেয়ো না, অত মিষ্টি খেলে শরীর খারাপ হয়। —একটা কি দুটো কথা বললেন। সেই ভদ্রলোক মহম্মদকে জিজ্ঞাসা করলেন: আচ্ছা, এ কথা কটা তো আপনি সেদিনই বলতে পারতেন? এর জন্য আবার এক সপ্তাহ পরে আসতে বললেন কেন? মহম্মদ বললেন: তার কারণ, আমি নিজেই যে সে সময় খুব মিষ্টি খেতাম। তখন আমি কি করে তোমার ছেলেকে মিষ্টি না খেতে বলি? সেই জন্য এই সাত দিন সময় নিলাম। এই কদিন আমি মিষ্টি খাইনি। তাই তোমার ছেলেকে বলতে পারলাম যে, মিষ্টি খেও না। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও।’ ঠাকুর বলছেন: যার জীবন তৈরী হয়েছে, ঈশ্বরকে যে সাক্ষাৎ করেছে, তাঁর ‘আদেশ’ যে পেয়েছে, তাকে লোক ডাকতে হয় না। লোক আপনি ছুটে আসে তার কাছে। বলছেন: চুম্বুক পাথর কি লোহাকে বলে, তুমি আমার কাছে এস? এস বলতে হয় না,—লোহা আপনি চুম্বুক পাথরের টানে ছুটে আসে। (ঐ) তারপর ঠাকুর বলছেন, খুব ভাববার মতো কথা—এরূপ লোক, পণ্ডিত নয় বটে। তা’বোলে মনে করো না যে তার জ্ঞানের কিছু কম্‌তি হয়। বই পড়ে কি জ্ঞান হয়? (ঐ) আমরা বই-এর পুজো করি; বই-এ যা নেই, আমরা তা বিশ্বাসই করি না। কিন্তু জ্ঞান বলতে বুঝায় ঈশ্বর-জ্ঞান—ঈশ্বরকে জানা। সেই জ্ঞান বই পড়ে হয় না। যে আদেশ পেয়েছে তার জ্ঞানের শেষ নাই। সে জ্ঞান ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে,—ফুরায় না।(ঐ) ও-দেশে (অর্থাৎ কামারপুকুর অঞ্চলে) ধান মাপবার সময় একজন মাপে, আর একজন রাশ ঠেলে দেয়। (ঐ) সেখানে ধান হয়তো গাদা করা আছে। একজন ধান মাপছে, আর একজন ধানের গাদা থেকে ধানটা ঠেলে দিচ্ছে। তেমনি যে আদেশ পায় সে যত লোকশিক্ষা দিতে থাকে, মা তাহার পেছন থেকে জ্ঞানের রাশ ঠেলে ঠেলে দেন। জ্ঞান আর ফুরায় না। (ঐ) স্বামীজীর জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। যখন ওদেশে ছিলেন, তখন এত বক্তৃতা দিতে হত যে, মাঝে মাঝে তাঁর মনে হত কাল কি বলবেন? নতুন কোন চিন্তা আসছে না। রাত্রিবেলা শুয়েছেন, কে যেন তাঁকে সব বলে দিচ্ছে। কিংবা তাঁর ভিতর থেকেই কে যেন বেরিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে এমন সব বিষয়ে কথাবার্তা বলছে যে, তা থেকে তিনি পেয়ে যাচ্ছেন পরদিন কোন্ বিষয়ে বক্তৃতা করবেন। ঐ যে ঠাকুর বলেছিলেন, নরেন লোকশিক্ষা দেবে, তিনিই সব জ্ঞানরাশি ঠেলে দিচ্ছেন। কত আর বয়স তাঁর—তিরিশ। কত সুন্দর সুন্দর কথা তিনি বলছেন, কত মৌলিক চিন্তা জগৎকে উপহার দিচ্ছেন আর কত পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁর কাছে আসছেন, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে, তর্কবিতর্ক হচ্ছে—আর তাঁরা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন, কত সম্মান করছেন তাঁকে। অথচ যখন গেছিলেন, তখন নগণ্য সন্ন্যাসী, স্টেশনের একটা খালি বাক্সে রাত কাটিয়েছেন—কিন্তু ধর্মমহাসভায় বক্তৃতা দিলেন, রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেলেন। কার শক্তিতে এ সম্ভব হল? শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তিতে। বাবুরাম মহারাজ বলতেন: লাঠির মাথায় যদি ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ লিখে ছেড়ে দাও, তাহলে সেই লাঠি বিশ্বজয় করে আসতে পারে।

আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে দেখি, সত্যিকারের প্রবক্তা তিনি। প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের একটা কথা এখানে উদ্ধৃত করছি।১৪ খুব বিখ্যাত ব্যক্তি প্রতাপ মজুমদার, নিজেও একজন বড় বক্তা। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বসে থাকতেন। তিনি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছেন: ‘What is there common between him and me?’ —তাঁর সঙ্গে আমার কোথায় মিল? মিল তো নেই কোন জায়গায়। আমি একজন ‘Europeanised, civilised, self-centred, semi-sceptical so-called educated reasoner’—আমি তথাকথিত শিক্ষিত যুক্তিবাদীদের একজন, আমি ইউরোপীয় প্রভাবে প্রভাবিত, সভ্যতা-অভিমানী, অত্যন্ত আত্মসচেতন, আর ধর্ম সম্বন্ধে আমার খুব একটা যে বিশ্বাস আছে তাও নয়। আর শ্রীরামকৃষ্ণ? তিনি তো একেবারে এর বিপরীত। ‘a poor, illiterate’—লেখাপড়া কিছু শেখেননি। দরিদ্র ব্রাহ্মণ। ‘unpolished’—কথাবার্তা খুব মার্জিত নয়। অন্তত, তথাকথিত সভ্যতার মাপকাঠিতে তাঁকে খুব সভ্যভব্য বলা চলে না। মাঝে মাঝেই কোমরে কাপড় থাকত না। ‘শালা’ কথাটাও বলতেন অনেক সময়। তাই বলছেন: ‘unpolished’, ‘half-idolatrous’ —অর্ধ-পৌত্তলিক। মূর্তিপূজা করেন। অর্ধ-পৌত্তলিক বোধহয় এই কারণে বলেছেন যে, তিনি মূর্তিপূজা বিশ্বাস করেন আবার নিরাকার-উপাসনা, তা-ও মানেন। তখনকার দিনে পাশ্চাত্য-প্রভাবিত যারা তাদের অনেকেরই চোখে মূর্তিপূজা যেন ভয়ানক একটা অপরাধ। ‘(A) friendlessHindu devotee’—বন্ধুবান্ধবশূন্য একজন হিন্দুভক্ত তিনি। আমার সঙ্গে তাঁর কোন মিলই নেই। তাহলে কেন আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তাঁর কথা শুনি?‘why should I sit long hours to attend to him, I who have listened to Disraeli and Fawcett, Stanley’ —আমি তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যত বড় বড় বক্তা—ডিস্রেলি, ফসেট, স্ট্যানলি এঁদের সবার বক্তৃতা শুনেছি। তবে আমি কেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রীরামকৃষ্ণের মতো ব্যক্তির কথা মুগ্ধ হয়ে শুনি? তারপরে বলছেন; শুধু আমিই নই, আমার মতো আরও অনেকে গিয়ে তাঁর কথা শোনে। এই সাক্ষ্য দিচ্ছেন প্রতাপ মজুমদার। আর একটা বর্ণনা পাচ্ছি। সেখানে অন্য আর একজন বিখ্যাত ব্যক্তি উপস্থিত, কেশব সেন। কেশব সেন স্টীমারে করে এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে, কুচবিহারের মহারাজার স্টীমার। তাঁর সঙ্গে আছেন কুমার গজেন্দ্রনারায়ণ, ত্রৈলোক্য, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং আরও অনেকে। শ্রীরামকৃষ্ণ স্টীমারে উঠতেই সবাই উঠে দাঁড়ালেন। কেশব সেন এগিয়ে এসে শ্রীরামকৃষ্ণকে হাতে ধরে নিয়ে গেলেন, তাঁকে নিয়ে গিয়ে নিজের ঠিক পাশেই বসালেন। সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার—একমাত্র ব্যক্তি যিনি কথা বলে যাচ্ছেন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ। আর সবাই চুপ করে শুনছে, কেশব সেন স্বয়ং। নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত এই সাক্ষাৎকারের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বর্ণনা করছেন: ১৫ ‘Practically all the talking was done by the Paramahansa, and the rest, including Keshub himself, were respectful and eager listeners.’ শ্রীরামকৃষ্ণ বলে যাচ্ছেন, কেশব এবং অন্যান্য সবাই শ্রদ্ধার সাথে, আগ্রহের সাথে তাঁর কথা শুনছেন। নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত স্মৃতিচারণ করে বলছেন: এটা পঁয়তাল্লিশ বছরেরও আগের ঘটনা অথচ সেদিন তিনি যা বলেছিলেন, সে সব কথা আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে। কোনদিনই তা মুছে যাবার নয়। ‘I have never heard any other man speak as he did.’—আমি কোনদিন কাউকে এরকমভাবে কথা বলতে শুনিনি। ‘It was an unbroken flow of profound spiritual truths and experiences, welling up from the perennial spring of his own devotion and wisdom.’ —গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব এবং অভিজ্ঞতার কথা তিনি অনর্গল বলে যাচ্ছেন। সে সব কথা তাঁর নিজের ভক্তি এবং জ্ঞান প্রসূত। —প্রবক্তা তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘সিদ্ধাই’ পছন্দ করতেন না। কিন্তু যদি ‘সিদ্ধাই’ বলা হয় বা অলৌকিকত্ব বলা হয়, এর থেকে বড় অলৌকিক ব্যাপার আর কি হতে পারে? এ সম্ভব হল কিসে? তিনি ঈশ্বর দর্শন করেছেন বলে। তাই তাঁর কথার এত তেজ, তাই তাঁর ব্যক্তিত্বের এত আকর্ষণ।

শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কথাই বলছেন শশধর তর্কচূড়ামণিকে: মার যদি একবার কটাক্ষ হয়, তাহলে কি আর জ্ঞানের অভাব থাকে? তাই জিজ্ঞাসা করছি কোন আদেশ পেয়েছ কি না? (ঐ) শশধর তর্কচূড়ামণি স্বীকার করছেন: আদেশ? তা এমন কিছু পাই নাই। (ঐ) শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: যে আদেশ পায় নাই, তার লেক্‌চার কি হবে? একজন লেক্‌চার দিতে দিতে বলেছিল, ‘ভাইরে, আমি কত মদ খেতুম, হেন্ করতাম্ তেন্ করতাম্।’ এ কথা শুনে, লোকগুলো বলাবলি করতে লাগলো, শালা, বলে কিরে? মদ খেতো! এই কথা বলাতে উল্টো উৎপত্তি হল। তাই ভাল লোক না হলে লেকচা্রে কোন উপকার হয় না। (ঐ) এই ‘হওয়া’-টার উপরে ঠাকুর জোর দিচ্ছেন। স্বামীজী বলছেন: Religion is being and becoming. একটা আদর্শ আমার ভাল লেগেছে। সেই আদর্শটা জীবনে রূপায়িত করতে চেষ্টা করছি। চেষ্টা করতে করতে আমি একদিন আদর্শস্বরূপ হয়ে যাব। আদর্শটা আমার জীবনে মূর্ত হয়ে উঠবে। —এই হচ্ছে ধর্ম। ধর্ম-আচরণ করছি সেটা যেন আমাকে হেঁকে ডেকে বলতে না হয়। ধর্ম আমার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যাবে। আমি নতুন মানুষ হয়ে যাব। আমার জীবন, আমার চরিত্র, আমার খুঁটিনাটি সব চালচলন প্রমাণ করবে যে, আমি ধর্মপথে চলছি। স্বামীজী বলছেন: শিক্ষা মানে ‘information’ নয়। কতগুলো তথ্য, কতগুলো কথা জানলাম তা শিক্ষা নয়। তাহলে তো বিশ্বকোষ সবচেয়ে বড় পণ্ডিত। লাইব্রেরি একজন ঋষি। তা নয়। ‘nervous association’ হতে হবে। একটা আদর্শ আমাকে এমনভাবে আয়ত্ত করতে হবে যে, তার সাথে আমি একাত্ম হয়ে গেছি। ভুলেও আমি অন্যরকম করতে পারি না। আমি ভাল—সবসময় ভাল। পুরস্কারের লোভে বা শাস্তির ভয়ে ভাল না। আমি ভাল এই কারণে যে, আমি ‘ভাল’ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারি না। এরকমভাবে যার চরিত্র তৈরি হয়েছে, সে যখন লোকশিক্ষা দেয় তখন তাতে কাজ হয়। ঠাকুর একটা খুব পরিচিত গল্প বলছেন: ও দেশে (অর্থাৎ কামারপুকুরে) হালদার পুকুর বলে একটি পুকুর আছে। (ঐ) এখনও এই পুকুর আছে। কামারপুকুরে ঠাকুরের বাড়ির কাছেই এই পুকুর। যত লোক তার পাড়ে বাহ্যে করতো। সকাল বেলা যারা পুকুরে আস্‌তো গালাগালে তাদের ভূত ছাড়িয়ে দিত। কিন্তু গালাগালে কোন কাজ হত না; আবার তার পরদিন সকালে পাড়ে বাহ্যে করেছে, লোকে দেখতো। কিছুদিন পরে কোম্পানী থেকে একজন চাপরাসী পুকুরের কাছে একটা হুকুম মেরে দিল; কি আশ্চর্য! একেবারে বাহ্যে করা বন্ধ হয়ে গেল।(ঐ) এই হুকুমনামা চাই, ঠাকুর বলছেন চাপরাস (charter) চাই। অর্থাৎ ভগবান তাঁর দূতকে পাঠান পৃথিবীতে। তিনি তাঁর বাণী বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির মাধ্যমে পৃথিবীতে পৌঁছে দেন। আমরা যেমন মোজেসের জীবনে দেখি, মহম্মদের জীবনে দেখি, ভগবান ডাকছেন: শোন শোন, তোমাকে কয়েকটা কথা বলি, এটা তুমি সকলকে শোনাবে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে এ কথাগুলি বলছেন ভগবান। তাই বলছি, হেঁজি পেঁজি লোক লেক্‌চার দিলে কিছু কাজ হয় না। চাপরাশ থাকলে তবে লোকে মানবে। ঈশ্বরের আদেশ না থাকলে লোকশিক্ষা হয় না। যে লোকশিক্ষা দিবে, তার খুব শক্তি চাই। (ঐ) সেই শক্তি আসবে কোথা থেকে? আগেই পেয়েছি সে কথা—প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে। করামলকবৎ। প্রত্যক্ষ জ্ঞান হলে তবেই মানুষ বলতে পারবে: হ্যাঁ, আমি দেখেছি, আমি জেনেছি—‘বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্।’১৬ সেই মহান পুরুষকে আমি জেনেছি। আমাকে দেখ, আমার জীবন দেখ, আমি যে ঈশ্বর দেখেছি আমার জীবনই তার প্রমাণ। ঠাকুর বলছেন: চৈতন্যদেব অবতার। তিনি যা করে গেলেন তারই কি রয়েছে বল দেখি? (ঐ) সমস্ত দেশে ভক্তির প্লাবন এনেছিলেন তিনি। তাঁর প্রভাব এখনও আছে অবশ্যই—তবে ধীরে ধীরে সেটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। অথচ তিনি তো অবতার ছিলেন। আর যে আদেশ পায় নাই, তার লেক্‌চারে কি উপকার হবে? (ঐ)

সেই সময়টা কলকাতার মোড়ে মোড়ে মিশনারীরা লেক্‌চার দিত। —তোমাদের ধর্ম মিথ্যা, তোমরা মূর্তিপূজা কর, ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার আমাদের যাঁরা ধর্মপ্রচারক বা সমাজ সংস্কারক, তাঁরাও পালটা লেক্‌চার দিতেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের পদ্ধতিটা একেবারে অন্য রকমের। তিনি লেক্‌চার দেননি—অথচ এমন জিনিস তিনি দিয়েছেন, যা লেক্‌চারের চেয়ে অনেক কার্যকরী। আমরা ইংরেজিতে একটা কথা শুনি যে, silence is more eloquent: নীরবতা—কিন্তু আসলে সে বাঙ্ময়। শ্রীরামকৃষ্ণ নীরব ছিলেন। নীরব এই অর্থে যে আত্মপ্রচার করেননি, সভা ডেকে বক্তৃতা করেননি। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে ধনগোপাল মুখার্জীর একটা বই আছে—সেই বই পড়েই রোমাঁ রোঁলা প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে জানতে পারেন। ধনগোপাল মুখার্জী বইটির নাম দিয়েছেন ‘Face of Silence’—মৌনতার রূপ। বড় তাৎপর্যপূর্ণ নামটা—একটা নীরব জীবনকে আমি বর্ণনা করছি। শ্রীরামকৃষ্ণ নীরব ছিলেন। তিনি এলেন, মাকে নিয়ে আপনমনে খেলা করলেন, খেলা শেষে আস্তে আস্তে চলে গেলেন। কিন্তু এই যে তিনি কথা বলেননি, এই না বলার এমন একটা শক্তি যে, সবাইকে তা পাগল করে তুলেছে। তাঁকে নিয়ে আজ কত বই লেখা হচ্ছে, কত গবেষণা হচ্ছে। তাঁর জীবন ও বাণী লোকে আলোচনা করছে, ধ্যান করছে, শান্তি পাচ্ছে। সকলের অন্তরে অন্তরে তিনি কথা বলছেন, সাহস দিচ্ছেন, আশার বাণী শোনাচ্ছেন। নীরব আর নন তিনি—সরব, অত্যন্ত সরব। যে একটু উন্মুখ হয়েছে, তাঁর বাণী তার কাছেই গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে। আমাদের আরও অবাক লাগে সারদাদেবীর কথা ভাবলে। শ্রীরামকৃষ্ণ পুরুষ ছিলেন, অনেকের সাথে মিশতে পেরেছিলেন। কিন্তু সারদাদেবী—তিনি তো চিরকাল অবগুণ্ঠনবতী। দক্ষিণেশ্বরে কেউ বুঝতেও পারত না যে, তিনি সেখানে আছেন। অথচ তাঁর জীবদ্দশাতেই দেখতে পাই, কত লোক তাঁর কাছে আসছে, ধর্মপিপাসা মিটাচ্ছে। তিনি তাদের সামনে একমাথা ঘোমটা টেনে বসে আছেন হয়তো, হয়তো অন্য কোন লোকের মাধ্যমে তাদের সাথে কথা বলছেন। দু-একটা কথা বলছেন, কিংবা কোন কথাও হয়তো বলছেন না, নীরবে চাইছেন। কিন্তু ভক্তের মনের সব সংশয় মিটে যাচ্ছে, পরম তৃপ্তি পাচ্ছে তারা। আজ দেখছি, ক্রমশই শ্রীশ্রীমা যেন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছেন—তাঁর সেই অবগুণ্ঠন তিনি যেন উন্মোচন করে ফেলেছেন। ক্রমশই মানুষ শ্রীশ্রীমা-র প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। অবাক হয়ে ভাবছে: এরকম চরিত্রও সম্ভব? এরকম মানুষও আসে পৃথিবীতে? শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদাদেবী—এঁরা তো লেক্‌চার দেননি! তবে কেন আজ তাঁদের এত সমাদর? কারণ, তাঁদের জীবন, তাঁদের চরিত্র। তাঁরা ঈশ্বর সাক্ষাৎ করেছেন, ঈশ্বর-উপলব্ধি করেছেন। তাই তাঁদের জীবন ও বাণীর যতটুকু আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে—মানুষকে মুগ্ধ করেছে।

আসলে জ্ঞান বাইরে নয়। আমাদের ভিতরেই অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডার। তার যে সন্ধান পায়, তার বই, শাস্ত্র বা পাণ্ডিত্যের দরকার হয় না। আপনা-আপনিই সে জগৎ জয় করে। স্বামীজী বলছেন: ‘তাঁকে কি আর “পূজা কর” বলে পাড়ায় পাড়ায় কেঁদে বেড়াতে হয়? জগদম্বা তাঁর কপালফলকে নিজের হাতে লিখে দেন যে, এই মহাপুরুষকে সকলে পূজা কর, আর জগৎ অবনতমস্তকে শোনে।’ তাঁর এমন একটা সম্মোহনী শক্তি যে, কেউ তাঁর প্রভাব অস্বীকার করতে পারে না। বুদ্ধদেবের যখন শরীর যাচ্ছে, শিষ্যেরা তাঁকে ঘিরে রয়েছেন। আনন্দ তাঁর প্রিয় শিষ্য—কাঁদতে কাঁদতে বুদ্ধদেবকে বলছেন: আপনি চলে যাচ্ছেন, সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কে আর আমাদের আলো দেখাবে? বুদ্ধদেব তখন বলছেন: আত্মদীপো ভব। তোমার মধ্যেই রয়েছে জ্ঞানের বাতি, সেই আলো অনুসরণ কর। বাস্তবিক, নিজের ভিতরের সেই আলোর যে সন্ধান পায়, সে-ই নিজে পথ চলতে পারে, আর যে নিজে পথ চলতে পারে সে-ই পারে অন্যকে পথ দেখাতে। একজন অন্ধ কখনো আর একজন অন্ধকে চালাতে পারে না। ঠাকুর তাই বলছেন: সচ্চিদানন্দসাগরে মগ্ন হও। ঈশ্বরলাভ হলে ভাবনা কি? তখন আদেশও হবে, লোকশিক্ষাও হবে। (ঐ)

আকর-তালিকা

 । বিবেকচূড়ামণি, ৬০

 । কুলার্ণবতন্ত্র, ১/৮৭

 । বিবেকচূড়ামণি, ৫৮

 । কুলার্ণবতন্ত্র,১/৮৯

 । World Thinkers on Ramakrishna-Vivekananda, edited by Swami Lokeswarananda, 1983, p.50

 । New Testament, St. Mark, Chapter 12, Verse 38-40 (The New English Bible, Oxford University Press & Cambridge University Press, 1961)

 । কুলার্ণবতন্ত্র, ১/১০৬

 । বিবেকচূড়ামণি, ৬২

 । জ্ঞানসঙ্কলিনীতন্ত্র, ৫১

১০। স্বামী বিরজানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ষষ্ঠ অধ্যক্ষ। তিনি শ্রীমার কাছে মন্ত্র-দীক্ষা এবং স্বামী বিবেকানন্দ ও অন্যান্য শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ধন্য। উল্লিখিত অংশটি তাঁর রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ – স্তোত্রদশকম্’-এর ষষ্ঠ স্তবকের অন্তর্গত।

১১। কুলার্ণবতন্ত্র, ১/৯৪

১২। পত্রাবলী, পৃঃ ২৩৬

১৩। চৈতন্যচরিতামৃত, আদিলীলা, ৩য় পরিচ্ছেদ

১৪। সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ, পৃঃ ১৯৭

১৫। ঐ, পৃঃ ১০৮

১৬। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ, ৩/৮

* সেকালের বিখ্যাত ব্রাহ্মপত্রিকা ‘ধর্মতত্ত্ব’ লিখেছে : ‘পরমহংসের জীবন হইতেই ঈশ্বরের মাতৃভাব ব্রাহ্মসমাজে সঞ্চারিত হয়। সরল শিশুর ন্যায় ঈশ্বরকে সুমধুর মা নামে সম্বোধন, এবং তাঁহার নিকটে শিশুর মত প্রার্থনা ও আব্দার করা—এই অবস্থাটি পরমহংসে হইতেই আচার্যদেব (অর্থাৎ কেশবচন্দ্র) বিশেষরূপে প্রাপ্ত হন। পূর্বে ব্রাহ্মধর্ম শুষ্ক তর্ক ও জ্ঞানের ধর্ম ছিল, পরমহংসের জীবনের ছায়া পড়িয়া ব্রাহ্মধর্মকে সরস করিয়া তোলে।’ (সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ, পৃঃ ৬১)

* বররুচি বিরচিত একটি শ্লোকের সন্ধান পাওয়া যায় :

অগাধজলসঞ্চারী ন গর্বং যাতি রোহিতঃ।

অঙ্গুষ্ঠোদকমাত্রেণ শফরী, ফর্ফরায়তে ॥

—অগাধজলে বিচরণ করেও রুই মাছ গর্বিত হয় না, অথচ পুঁটি মাছ বৃদ্ধাঙ্গুলি-পরিমাণ জলে (অর্থাৎ, অতি সামান্য জলে) ছটফট করে ঘুরে বেড়ায়। (দ্রষ্টব্য ; উদ্ভট-শ্লোক-মালা, দ্বিতীয় সংস্করণ, সঙ্কলন ও অনুবাদ : পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন উদ্ভটসাগর)

* সম্পূর্ণ কবিতাটির জন্য ‘ভক্তিপথ’ দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *