‘তাঁর ইতি করা যায় না’

‘তাঁর ইতি করা যায় না’

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: বাজিকর এসে কত বাজি করে; আমের চারা, আম পর্যন্ত হলো। কিন্তু এ সব বাজি। বাজিকরই সত্য। (২-৯-২) বাজিকর অর্থাৎ ম্যাজিশিয়ান বা যাদুকর। এইরকম ম্যাজিকের কথা আমরা শুনি। একজন ইংরেজ বর্ণনা করেছেন, ভারতীয় যাদুকর কিরকম যাদু দেখায়। বলছেন: আমি নিজের চোখে দেখেছি, প্রথমে একটা আমের আঁটি নিল, মাটিতে পুঁতল, একটু জল দিল, সঙ্গে সঙ্গে গাছ বেরুল। গাছ বড় হল, গাছে ফল হল, সেই ফল পাকল, তারপর সেই ফল সে কেটে একটু একটু করে সবাইকে খেতে দিল। সবাই খেয়ে দেখল সত্যিই আম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল গাছ নেই, কিচ্ছু নেই। ঠাকুর এই ম্যাজিকের কথাই বলছেন। বলছেন: এই যে এতগুলো কাণ্ড হয়ে গেল চোখের সামনে, অসম্ভব অসম্ভব সব ব্যাপার, দেখে মনে হল সত্যি—এর কোনটাই কিন্তু সত্যি নয়। সত্যি একমাত্র সেই লোকটি যে এসব করছে। যাদু সত্যি নয়—যাদুকরই সত্যি। তেমনি ব্ৰহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। (ঐ)

বেদান্তশাস্ত্রে এই যাদুর উপমা অনেক জায়গায় আছে। শঙ্করাচার্যও যাদু এবং যাদুকরের উপমা দিয়েছেন।* বলছেন: বাজিকর সত্য, বাজি মিথ্যা। তেমনি ব্ৰহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। জগৎটা যেন একটা যাদু—রঙীন, পরিবর্তনশীল, ঘটনাবহুল। কিন্তু এইসব যাদু করছে কে? একজন যাদুকর নিশ্চয়ই আছে। কে সেই যাদুকর? ব্রহ্ম, কিংবা সাধারণভাবে বললে, ‘ঈশ্বর’। ‘মায়য়া কল্পিতং জগৎ’—এই যে পরিদৃশ্যমান জগৎ, এ মায়ার দ্বারা কল্পিত। দেখতে দেখতে বদলে যায়। আজ আছে কাল নেই। স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে কত কি করছি—আকাশে উড়ছি, কত দেশ-বিদেশে যাচ্ছি, স্বপ্ন ভাঙলে দেখা যায় যে খাটের উপরেই শুয়ে আছি। জগৎটা ঐ স্বপ্নের মতো। মিথ্যা—কারণ, অ-চিরস্থায়ী। ঠাকুর এক চাষীর গল্প করছেন। চাষীর একমাত্র ছেলে মারা গেছে। স্ত্রী কাঁদছে, সবাই কাঁদছে। কিন্তু চাষী নির্বিকার। চাষীর স্ত্রী বলছে: তোমার কি একটুও দয়ামায়া নেই! একমাত্র ছেলে চলে গেল, আর তোমার চোখে একটুও জল নেই? তখন সেই চাষী বলছে: কেন কাঁদছি না জান? কাল রাতে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম যে, রাজা হয়েছি আর আট ছেলের বাপ হয়েছি। খুব আনন্দে আছি—এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল। এখন আমি ভাবছি—কার জন্য কাঁদব? ঐ আট ছেলের জন্য, না এই একটা ছেলের জন্য? অর্থাৎ ঐ আট ছেলেও যেমন মিথ্যা এই এক ছেলেও তেমনি মিথ্যা। ঠাকুর বলছেন: চাষা জ্ঞানী, তাই দেখছিল স্বপ্ন অবস্থাও যেমন মিথ্যা, জাগরণ অবস্থাও তেমনি মিথ্যা; এক নিত্যবস্তু সেই আত্মা। (১-১৩-৬) যা চিরকাল আছে তা-ই নিত্য—অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, আবার ভবিষ্যতেও যা থাকবে। ‘ত্রি-কাল-অবাধিত’ যা, তা-ই নিত্য। সেইভাবে বিচার করলে দেখা যায়, জাগতিক কোন কিছুই নিত্য নয়। একমাত্র নিত্য হল ব্রহ্ম বা আত্মা বা ঈশ্বর। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। ঈশ্বরই সৎ, কিনা নিত্যবস্তু, আর সব অসৎ, কিনা অনিত্য। (১-১-৫)

ব্রহ্ম সম্বন্ধে বলা হয় সচ্চিদানন্দ। সৎ-চিৎ-আনন্দ। ‘সৎ’ অর্থাৎ তিনি আছেন। ‘চিৎ’ অর্থাৎ তিনি জ্ঞান বা চৈতন্যস্বরূপ। ‘আনন্দ’ অর্থাৎ আনন্দস্বরূপ তিনি। এই হচ্ছে ব্রহ্মের স্বরূপ। স্বামীজী এর ইংরেজি করছেন: Existence Absolute, Knowledge Absolute, Bliss Absolute. ‘Absolute’ কথাটার বাংলা হচ্ছে পারমার্থিক বা আত্যন্তিক। —সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আমি এই মুহূর্তে এই ঘরে আছি—কিন্তু সর্বত্র নেই, সব মুহূর্তে নেই। কাজেই, আমার এই থাকাটা আত্যন্তিক হল না। আমি আছি ঠিকই, কিন্তু আপেক্ষিক অর্থে আছি। আমার অস্তিত্বটা আত্যন্তিক নয়, Absolute নয়। আবার আমাদের সকলের মধ্যেই চৈতন্য বা জ্ঞান আছে। যার জন্য আমি সব কিছু বুঝতে পারছি। সুখ-দুঃখ অনুভব করছি। কিন্তু এই জ্ঞানও আত্যন্তিক জ্ঞান নয়। এটা অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। বাইরের বস্তুর উপর নির্ভরশীল, আবার আমার ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভরশীল। আমি চোখ দিয়ে একটা ফুল দেখছি। ফুল সম্বন্ধে আমার একটা ‘জ্ঞান’ হচ্ছে। এই জ্ঞানটা কিন্তু দুটো জিনিসের উপর নির্ভর করছে—‘চোখ’ আর ‘ফুল’। আমি যদি অন্ধ হই, তাহলে ফুল থাকলেও আমি সেটা দেখতে পাব না। আবার, ফুলটা যদি না থাকে তাহলে চোখ থাকলেও আমি ফুল দেখতে পাচ্ছি না। কাজেই ‘ফুল’ সম্বন্ধে আমার জ্ঞানটা ‘আপেক্ষিক’ জ্ঞান। আত্যন্তিক বা Absolute না। তেমনি, আমরা জাগতিক যেসব আনন্দ অনুভব করি সেগুলোও আপেক্ষিক। আমি রসগোল্লা খেলাম, যতক্ষণ খেলাম, আনন্দ পেলাম। কিছুক্ষণ হয়তো তার রেশ রইল। একটু পরেই সেই আনন্দ শেষ হয়ে যাবে। একটা বিশেষ সময়, বিশেষ বস্তুর অপেক্ষা করছে এই আনন্দ। জাগতিক সব আনন্দই তাই। কোন-না-কোন কিছুর উপর নির্ভর করছে। সেইজন্য সেই আনন্দ আত্যন্তিক নয়, আপেক্ষিক। কিন্তু ব্রহ্ম হচ্ছেন ‘সৎ’—Existence Absolute, নিত্যবস্তু। চিরকাল আছেন। ত্রিকাল-অবাধিত সত্য। ‘চিৎ’—Knowledge Absolute অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ। চৈতন্যবান বা চৈতন্যময় নয়—চৈতন্যই তাঁর স্বরূপ। আর ‘আনন্দ’—Bliss Absolute, আনন্দস্বরূপ। তিনি আছেন বলেই সব আছে। আমরা সবাই অনুভব করি যে, ‘আমি আছি’। জীবনের লক্ষণ এই ‘অস্তিত্ববোধ’। আমার মধ্যে ‘ব্রহ্ম’ আছেন, ‘সৎ’ আছেন—তাই আমি মনে করছি যে, আমি আছি। আমাদের সবার মধ্যে চৈতন্য আছে। কিন্তু তাঁর চৈতন্যে আমরা সব চৈতন্যময়—‘তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি’। কঠোপনিষদে বলছে: অগ্নি তাপ দিচ্ছে, কারণ ব্ৰহ্ম রয়েছেন। সূর্য কিরণ দিচ্ছে, কারণ ব্ৰহ্ম আছেন। সব কিছুর পেছনে তিনি আছেন। সব কিছুতে তিনি অনুস্যূত হয়ে আছেন। জগতে যত চেতন পদার্থ আছে, সবার মধ্যে তাঁরই চৈতন্যের প্রকাশ। তাহলে অচেতন পদার্থের মধ্যে কি তিনি নেই? সেটা কি ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছু? তা নয়। অচেতন পদার্থের মধ্যেও তিনি আছেন। —কিন্তু সেখানে চৈতন্যের প্রকাশটা এত কম যে আমরা ধরতে পারি না। আবার, জগতের সব আনন্দের তিনি উৎস। ‘রসো বৈ সঃ’। রসস্বরূপ তিনি। আনন্দঘন। উপনিষদে দেখছি: ভৃগু ধ্যানে বসে ব্রহ্মের স্বরূপ আবিষ্কার করছেন। ব্রহ্মের স্বরূপ কি আবিষ্কার করলেন তিনি? ‘আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ’—ব্রহ্ম হচ্ছেন আনন্দস্বরূপ। ‘আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে’—আনন্দ থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি হয়েছে। ‘আনন্দেন জাতানি জীবন্তি’—সব কিছু আনন্দেই বেঁচে আছে। আবার যখন তাদের বিনাশ হবে আনন্দেই তারা মিশে যাবে—‘আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি’। জগতের সব আনন্দ ব্ৰহ্ম থেকে আসছে। রসগোল্লা খেলে আমি আনন্দ পাই, সিনেমা দেখে আনন্দ পাই কিংবা একটা মহৎ আদর্শের জন্য জীবন দিয়ে আনন্দ পাই—সব আনন্দ কিন্তু ঐ এক জায়গা থেকে আসছে। বাস্তবিক, তিনি আছেন বলেই সব আছে। এই যে পরিবর্তনশীল জগৎ—এটা যে পরিবর্তনশীল, সেটা বুঝছি কি করে? গতি বুঝতে গেলে তো তার পাশাপাশি স্থির একটা কিছু চাই। ট্রেন ছুটছে বুঝতে পারি কি করে? মাটি স্থির আছে, লাইন স্থির আছে, প্ল্যাটফর্ম স্থির আছে তাই বোঝা যায় যে, ট্রেন ছুটছে। যদি এগুলোও সমান বেগে ছুটত তাহলে আর বোঝা যেত না যে, ট্রেন ছুটছে। তেমনি এই পরিবর্তনশীল জগতের পিছনেও অপরিবর্তনীয় একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে। তাঁকে আমরা বলি ব্ৰহ্ম, আত্মা বা ঈশ্বর। আরও নানা নাম দিয়ে বুঝিয়ে থাকি। এই জগতের তিনিই অধিষ্ঠান। তিনি আছেন বলেই সব আছে।

ঠাকুর ‘কথামৃতে’ একটা গল্প বলছেন: দুই ছেলেকে বাবা গুরুর কাছে পাঠিয়েছেন শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে। যখন তারা গুরুগৃহ থেকে ফিরে এল বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ব্ৰহ্ম কি বল দেখি। এক ছেলে শাস্ত্র থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে বলে গেল, ব্রহ্ম এই, এই তাঁর স্বরূপ। আর এক ছেলে মাথা নীচু করে চুপ করে রইল। যে চুপ করে রইল, বাবা তাকে বললেন: তুমিই ঠিক ঠিক বুঝেছ। অর্থাৎ ব্রহ্ম সম্বন্ধে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। ব্রহ্ম হচ্ছেন অসীম, অনন্ত। ভাষা দিয়ে, শব্দের সাহায্যে কি করে আমি অসীমকে বর্ণনা করব? যখনই আমি ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে কোন বিশেষণ ব্যবহার করি, তখনই তাঁকে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। শুধু ব্ৰহ্ম কেন—একটা গভীর আবেগ, গভীর আনন্দ বা শোক—তাও কি আমরা ভাষা দিয়ে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারি? ভাষা সব সময়ই ‘ভাসা ভাসা’। অর্থাৎ দুর্বল, Superficial। গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। তাই ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে কিছু বলার অর্থই হচ্ছে ভুল বলা, আংশিক বলা। তিনি ‘অবাঙ্মনসগোচরম্‌’ —বাক্য ও মনের অতীত তিনি। ‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ’ —বাক্য সেখানে পৌঁছতে পারে না, মনও সেখান থেকে ফিরে আসে। তাঁর সম্বন্ধে পুরোপুরি কেউ কখনও বলতে পারেনি, পারবেও না।

ঠাকুর সেইজন্য বলতেন যে, সব উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু ব্ৰহ্ম কখনও উচ্ছিষ্ট হয়নি: বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ষড়্‌দর্শন, সব এঁটো হ’য়ে গেছে! মুখে পড়া হ’য়েছে, মুখে উচ্চারণ হয়েছে—তাই এঁটো হয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস কেবল উচ্ছিষ্ট হয় নাই, সে জিনিসটি ব্ৰহ্ম। ব্ৰহ্ম যে কি, আজ পর্যন্ত কেহ মুখে বলতে পারে নাই। (৩-১-৩) ঠাকুর এই উপমাটা বিদ্যাসাগরের কাছে বলেছিলেন। বিদ্যাসাগর শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন: আপনার কাছ থেকে আজ একটা নতুন কথা শুনলাম। ঠাকুরের ঐ কথার সমর্থনে তন্ত্রে একটা শ্লোক পাই:

উচ্ছিষ্টং সর্বশাস্ত্রাণি সর্ববিদ্যা মুখে মুখে।

নোচ্ছিষ্টং ব্ৰহ্মণো জ্ঞানমব্যক্তং চেতনাময়ম্‌॥

—সব শাস্ত্র উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে, সব বিদ্যা আমরা মুখে মুখে আলোচনা করতে পারি, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান উচ্ছিষ্ট হয়নি। ব্রহ্মজ্ঞান ‘অব্যক্ত’—ভাষা দিয়ে ব্রহ্মের স্বরূপ প্রকাশ করা যায় না। যার ব্রহ্মজ্ঞান হয়, সেও পারে না। সে ‘মূক’ হয়ে যায়। ঠাকুর উপমা দিচ্ছেন: কালাপানিতে জাহাজ গেলে আর ফিরে না।(১-৬-২) ‘কালাপানি’ মানে সমুদ্র। আগেকার দিনে যেসব জাহাজ সমুদ্রে যেত, বেশিরভাগই হয়তো ফিরত না। ফিরে এসে সমুদ্রের খবর দিতে পারত না। তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান যার হয় সে খবর দিতে পারে না।(ঐ) ‘মূকাস্বাদনবৎ’। বোবা যদি কোন কিছু খায়, তার স্বাদ যেমন সে বলতে পারে না, যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয় তাঁরও ঠিক ঐ অবস্থা হয়। তাঁর কথা থেমে যায়, বিচার বন্ধ হয়ে যায়। ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে তিনি কিছু বলতে পারেন না। বলতে চানও না। কারণ, তিনি জানেন, যা-ই বলুন না কেন তিনি, অসম্পূর্ণ হবে। যা তিনি উপলব্ধি করেছেন, যা তিনি ‘প্রত্যক্ষ’ করেছেন—তিনি বুঝতে পারেন, ভাষা দিয়ে তা তিনি কিছুতেই প্রকাশ করতে পারবেন না। ‘বোঝে—প্রাণ বোঝে যার।’ তাই তিনি চুপ হয়ে যান। ঠাকুর উপমা দিচ্ছেন: খালি কলসী জলে ডোবালে ভক্‌ ভক্‌ শব্দ হয়, কলসী ভর্তি হলে আর কোন শব্দ নেই। নেমন্তন্ন-বাড়িতে যতক্ষণ পাতায় কিছু পড়েনি, ততক্ষণই নানা গোলমাল। খাওয়া শুরু হলেই কথাবার্তা কমে আসে। আর সকলের যখন পেট ভরে এসেছে, পাতে দই পড়েছে, তখন শুধু সুপ সুপ শব্দ। আহারেব পর নিদ্রা—তখন আর কোন শব্দ নেই। তেমনি যত বিচার যত শাস্ত্রালোচনা—ব্রহ্মজ্ঞানের আগে পর্যন্ত। ব্রহ্মজ্ঞান হলে সব বিচার স্তব্ধ। ঠাকুর বলছেন: শাস্ত্রে ব্রহ্ম সম্বন্ধে অনেক কথা বলা আছে। কিন্তু সেগুলো কিরকম জান? ধর, একজন সমুদ্র দেখে ফিরে এসেছে। তাকে সমুদ্র কেমন বর্ণনা করতে বললে সে কি বলবে? সে বড়জোর বলবে: উঃ, সমুদ্র কী বিরাট! কী হিল্লোল, কী কল্লোল! শাস্ত্রে ব্রহ্ম সম্বন্ধে যত কিছু বলা আছে সে ঐ ‘কী হিল্লোল কী কল্লোল’—এর বেশী কিছু নয়। বাস্তবিক, ব্ৰহ্ম বা ঈশ্বর সম্বন্ধে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। কোন উপমা দিয়ে বা কোন ভাষা দিয়ে তাঁকে পুরোপুরি বর্ণনা করা যায় না। কোন গ্রন্থ, কোন শাস্ত্র বা কোন মানুষই কখনও বলতে পারে না যে, শুধু এগুলিই তাঁর লক্ষণ—এর বেশী আর কিছু নয়।

উপনিষদে ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে বলছে: ‘বিশ্বস্যৈকং পরিবেষ্টিতারম্‌’—সর্বত্র তিনি ছড়িয়ে আছেন। উচ্চে নীচে দেশ দেশান্তে, জলগর্ভে, কি আকাশে। (১-১৭-২)‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বম্‌’—এই জগৎ-সংসারে যা কিছু দেখছি, সব তাঁর দ্বারা আচ্ছাদিত। ‘সর্বতঃ পাণিপাদন্তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্‌ সর্বতঃ শ্রুতিমঁল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি’১০—সর্বত্র তাঁর হাত, সর্বত্র তাঁর পা, সব মুখ তাঁর মুখ, সব চোখ তাঁরই চোখ, সর্বত্র তাঁর কান। সব কিছু পরিব্যাপ্ত হয়ে তিনি রয়েছেন। অন্তরে রয়েছেন, বাইরে রয়েছেন। Immanent আবার Transcendent। এই জগতের সব কিছুতে তিনি অনুস্যূত হয়ে রয়েছেন—Immanent। কিন্তু জগতের মধ্যেই তিনি ফুরিয়ে যাননি। জগতের বাইরেও আবার তিনি আছেন—Transcendent। তিনি ‘নিষ্কলম্‌’—কোন কলা বা অংশ নেই তাঁর। ‘নিষ্ক্রিয়ম্‌’—কোন কিছু করেন না তিনি। ‘নিরবদ্যম্‌’—অনবদ্য, নিখুঁত। ‘নিরঞ্জনম্‌’—কোন অঞ্জন নেই তাঁতে, অজ্ঞান বা মায়ার লেশমাত্র নেই। তিনি নির্গুণ, নিরাকার, নিরবয়ব, নিরঙ্কুশ। এই যে বিশেষণগুলি দেওয়া হচ্ছে, সব কিন্তু নেতিবাচক। কারণ, যাঁরা এই বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছেন—তাঁরা তো সব উপলব্ধিমান্ পুরুষ—তাঁরা নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন ব্রহ্ম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে। ব্রহ্মের সম্বন্ধে তাঁরা বলছেন ঠিকই, কিন্তু সব সময় তাঁরা সচেতন যে, এই বলাই সব নয়। কিছুদূর পর্যন্ত বলা হচ্ছে, হয়তো অনেক দূর পর্যন্ত বলা হচ্ছে—কিন্তু সব বলা হচ্ছে না, সব বলা সম্ভব না কখনও।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌-এ বলছে:১১ ‘যেনেদং সর্বং বিজানাতি তং কেন বিজানীয়াদ্‌ বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ’—যাঁর সাহায্যে লোকে অন্য সব কিছুকে জানে তাঁকে কি করে তুমি জানবে? বিজ্ঞাতাকে তুমি কি করে জানবে? ব্ৰহ্ম স্বয়ং বিজ্ঞাতা, তুমিই সেই বিজ্ঞাতা। তুমি তোমাকে জেনেছ—এ তুমি বলতে পার না। কারণ, সেই জিনিসটাই তোমার জ্ঞেয় হতে পারে যা তোমার থেকে আলাদা। ব্রহ্ম তো তোমার থেকে আলাদা নন। তোমার স্বরূপ ব্রহ্ম। তাঁকে তুমি অন্যান্য জাগতিক জিনিসের মতো ‘জ্ঞেয়’রূপে জানতে পার না। কোন কিছু জানার জন্য দুটো জিনিস দরকার। যে জানছে অর্থাৎ ‘জ্ঞাতা’। যাকে জানছে অর্থাৎ ‘জ্ঞেয়’। ‘জ্ঞেয়’ আর ‘জ্ঞাতা’ থাকলে তখনই ‘জ্ঞান’ সম্ভব হয়। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান হলে ‘জ্ঞান’, ‘জ্ঞেয়’,’জ্ঞাতা’—একাকার হয়ে যায়। কাজেই তখন বলা যায় না যে, ‘ব্রহ্মকে জেনেছি’। সেইজন্য কেনোপনিষদে বলছে:১২ ‘যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ’—যে বলে ব্রহ্মকে আমি জানিনি, সে-ই বস্তুত ঠিক ঠিক জেনেছে। তারই ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে। কারণ সে বুঝেছে: ব্রহ্ম তার স্বরূপ, ‘ব্ৰহ্মকে জেনেছি’ একথা বলার অর্থ স্বীকার করে নেওয়া যে, ব্রহ্ম তার থেকে আলাদা। তাই সে বলে যে, আমি ব্রহ্মকে জানিনি। আর যে বলে যে, ব্রহ্মকে আমি জেনেছি—‘ন বেদ সঃ’, তার ব্রহ্মজ্ঞান হয়নি। সে ব্রহ্মকে নিজের স্বরূপ হিসেবে বুঝতে পারেনি। বাস্তবিক, ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে বা ব্রহ্মজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু বলা খুবই কঠিন। কেউ বলতে পারে না যে, এ সম্বন্ধে এটাই শেষ কথা। যারা অজ্ঞ তারা এরকম বলে ফেলতে পারে, কিন্তু প্রকৃতই যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা কখনও এ ধরনের কথা বলেন না।

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, ‘ব্রহ্ম’ আর ‘ঈশ্বর’ এই শব্দ দুটো আমরা সাধারণত একই অর্থে ব্যবহার করলেও, তাত্ত্বিক দিক দিয়ে কিন্তু দুয়ের মধ্যে তফাৎ আছে। ঠাকুর ‘কথামৃতে’ নিজেই এক জায়গায় এই প্রশ্ন তুলেছেন। একজনকে বলছেন: তুমি শুদ্ধাত্মাকে ঈশ্বর বল কেন? শুদ্ধাত্মা নিষ্ক্রিয়, তিন অবস্থায় সাক্ষিস্বরূপ। (১-১৩-৭) শুদ্ধাত্মা অর্থাৎ ব্রহ্ম। তিনি নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ, নিরুপাধিক, অনপেক্ষ, সাক্ষী, দ্রষ্টা। কিছু করেন না তিনি। জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এই তিন অবস্থারই তিনি সাক্ষিস্বরূপ। জাগ্রৎ অবস্থায় আমাদের সামনে দুটো জগৎ আছে। বাইরের জগৎটা আছে, স্থূল জগৎ যেটা। যেটাকে চোখ দিয়ে দেখছি, কান দিয়ে শুনছি, হাত দিয়ে ছুঁচ্ছি, ইত্যাদি। আর আছে ভেতরের জগৎটা। সূক্ষ্ম জগৎ সেটা। আমি চিন্তা করছি, বুদ্ধি খাটাচ্ছি, মনে মনে কত পরিকল্পনা করছি, এগুলি হচ্ছে সব ভেতরের জগৎ। জাগ্রৎ অবস্থায় বাইরের জগৎ, ভেতরের জগৎ দুটোই থাকে। স্বপ্ন অবস্থায় বাইরের স্থূল জগৎটা থাকে না। ভেতরের জগৎটা থাকে, সূক্ষ্ম জগৎটা থাকে। আর সুষুপ্তি অবস্থায়—অর্থাৎ যখন ঘুম এত গভীর হয়েছে যে স্বপ্ন পর্যন্ত দেখছি না—তখন স্থূল সূক্ষ্ম কোন জগৎই থাকে না। ব্রহ্ম, তিনি সাক্ষিস্বরূপ—জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি তিন অবস্থারই সাক্ষিস্বরূপ। (১-১৩-৬) ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: ধর একটা প্রদীপ জ্বলছে। আর সেই প্রদীপের আলোয় বসে কেউ ভাগবত পাঠ করছে, কেউ আবার হয়তো দলিল জাল করছে। ভাগবত পাঠ করার যে পুণ্য তা যেমন প্রদীপের হবে না, তেমনি দলিল জাল করার জন্য যে পাপ তা-ও প্রদীপের হবে না। যারা ভাগবত পড়ছে বা দলিল জাল করছে তাদেরই হবে। প্রদীপ সব সময় নির্লিপ্ত, দ্রষ্টা, সাক্ষী। ব্রহ্মও তাই। এই জগতে ভালমন্দ, সুখদুঃখ কত কিছু ঘটে যাচ্ছে—কিন্তু ব্ৰহ্ম নির্লিপ্ত, এ সব কিছুর উর্ধ্বে। ব্ৰহ্ম—জ্ঞান-অজ্ঞানের পার, পাপ-পুণ্যের পার, ধর্মাধর্মের পার, শুচি-অশুচির পার। (১-১৮-২) জগতে যা কিছু হচ্ছে তাঁর উপস্থিতিতেই হচ্ছে, কিন্তু ব্ৰহ্ম নিজে নির্লিপ্ত। ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন: যেমন চুম্বকপাথর অনেক দূরে আছে, কিন্তু ছুঁচ নড়ছে—চুম্বকপাথর চুপ করে আছে, নিষ্ক্রিয়। (১-১৩-৭) এই হচ্ছে ব্ৰহ্ম। আর ঈশ্বর কাকে বলি? ব্রহ্মের এক ধাপ নীচে ঈশ্বর। ঈশ্বর হচ্ছেন মায়া-উপহিত ব্রহ্ম, সগুণ ব্ৰহ্ম। বেদান্তসারে বলছে:১৩ ঈশ্বর হলেন বিশুদ্ধসত্ত্বপ্রধান-অজ্ঞান-উপহিত চৈতন্য। ঠাকুর বলছেন: যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কার্য ভাবি তখন তাঁকে ঈশ্বর বলি।(ঐ) অর্থাৎ জগতের ধারণা করলেই জগতের একজন কর্তাকে না ভেবে পারা যায় না। তিনিই ঈশ্বর। ঈশ্বর কিন্তু ব্রহ্মের মতো নিষ্ক্রিয় নন। তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন, দুর্বলকে রক্ষা করেন, দুর্জনের বিনাশ করেন, আমাদের প্রার্থনা শোনেন। অনন্তশক্তি-সম্পন্ন তিনি। সমস্ত শুভগুণের আকর। আমাদের ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা মোটামুটি এই রকম।

সেযুগে একটা প্রশ্ন খুব উঠত যে, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? ঈশ্বর সর্বব্যাপী, তিনি কি করে একটা মূর্তিতে আবদ্ধ হবেন?—এই প্রশ্ন করতেন অনেকে। স্বামী দয়ানন্দ, যিনি আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন, তাঁর সম্বন্ধে একটা গল্প শোনা যায়। তিনি তো নিরাকারবাদী ছিলেন—কিন্তু প্রথমে তিনি সাকার মানতেন। তাঁর যখন অল্প বয়স, তখন তিনি একবার শিবরাত্রির উপোস করেছেন। মন্দিরে তিনি একা আছেন। মাঝ রাত্রি। হঠাৎ দেখেন কি যে, সেই শিবলিঙ্গের গায়ে ইঁদুর উঠেছে আর শিবের জন্য যে ভোগ নিবেদন করা হয়েছে, ইঁদুরে সেটা খাচ্ছে। এই দেখে তাঁর মূর্তিপুজোর প্রতি অশ্রদ্ধা এসে গেল: শিব নিশ্চয়ই ঐ শিলার মধ্যে নেই। থাকলে ইঁদুর এসে এইভাবে তাঁর ভোগ খেয়ে যেতে পারত না। সেই থেকে তিনি নিরাকারবাদী হয়ে গেলেন। কিন্তু ঠাকুর বলছেন যে, সাকার নিরাকার দুই-ই সত্য। কারণ নিরাকারই সাকার হন। ব্ৰহ্ম নিরাকার, কিন্তু ভক্তের জন্য তিনি সাকার হন। বলছেন: তিনি নিরাকার আবার সাকার। ভক্তের জন্য তিনি সাকার। যারা জ্ঞানী অর্থাৎ জগৎকে যাদের স্বপ্নবৎ মনে হয়েছে, তাদের পক্ষে তিনি নিরাকার। (১-৩-৪) একজন অজ্ঞাত গায়ক একটা গানে বলেছেন:

মা ত্বং হি তারা···

আছ সর্বঘটে অক্ষপুটে সাকার আকার নিরাকারা ॥

—মা, তোমার সম্বন্ধে কি বলব আমি? তুমি সর্বত্র আছ। তুমি সাকার, আবার নিরাকার। ঠাকুর গল্প বলছেন: একজন সন্ন্যাসী জগন্নাথ দর্শন করতে গেছেন পুরীতে। জগন্নাথ দর্শন করার পরে তাঁর মনে প্রশ্ন দেখা দিল, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার। তাঁর হাতে একটা লাঠি ছিল। সেই লাঠিটা দিয়ে তিনি দেখতে লাগলেন লাঠিটা জগন্নাথের গায়ে ঠেকে কিনা, সত্যিই যদি জগন্নাথ বলে একটা মূর্তি থাকে, তাহলে তো লাঠিটা ঠেকবেই। লাঠিটা এদিক থেকে ওদিকে নিয়ে দেখলেন, ঠেকল না। তাহলে জগন্নাথ নিরাকার। অবার লাঠিটাকে ওদিক থেকে এদিকে নিয়ে আসাতে ঠেকে গেল। অর্থাৎ জগন্নাথ সাকার। তখন সন্ন্যাসী বুঝল ঈশ্বর নিরাকার, আবার সাকার।(১-১৫-২) ‘সাকার সাধকে তুমি যে সাকার, নিরাকার উপাসকে নিরাকার।’

স্বামী বিবেকানন্দ এই নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। তিনি যখন পাশ্চাত্যদেশে যান, তখন অনেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করত: তোমরা নাকি মূর্তিপূজা কর? স্বামীজী বলতেন: হ্যাঁ, করি। তোমরাও কর। তোমরা স্বীকার কর না, আমরা স্বীকার করি। তোমরা এই যে ক্ৰশকে এত শ্রদ্ধা কর, এটা মূর্তিপূজা নয়? এটা কি জিনিস যে, এত শ্রদ্ধা কর? যীশুখ্রীষ্টের কথা মনে করিয়ে দেয় এ। তাই তোমরা ক্ৰশকে শ্রদ্ধা কর। ক্রশ একটা প্রতীক। তেমনি সব মূর্তিই ঈশ্বরের প্রতীক। ‘মূর্তিপূজা’ কেউ করে না—মূর্তির মধ্য দিয়ে ভগবানকে পুজো করে। স্বামীজীর পরিব্রাজক জীবনে আলোয়ারের মহারাজাও তাঁকে একবার এই প্রশ্ন করেছিলেন। স্বামীজী আছেন মহারাজের দেওয়ানের বাড়িতে আর মহারাজ দেওয়ানের কাছ থেকে তাঁর সম্বন্ধে শুনে নিজেই এসেছেন তাঁর সাথে দেখা করতে। নানা কথাবার্তার পর আলোয়ারের মহারাজা বললেন: দেখুন, স্বামীজী, অনেকে এই মূর্তিটূর্তি পুজো করে, আমার কিন্তু এই মূর্তিপুজোয় মোটেই বিশ্বাস নেই। স্বামীজী সরাসরি কিছু বললেন না—এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন যে, দেয়ালে রাজার একটা ছবি টাঙানো আছে। বললেন: আচ্ছা, ছবিটা কেউ খুলে আমার হাতে দেবেন? তাঁর হাতে দেওয়া হল ছবিটা। সেটা হাতে নিয়ে তিনি বললেন: আপনারা কেউ এসে এই ছবির ওপর থুথু ফেলুন তো! যাঁরা উপস্থিত তাঁরা তো স্তম্ভিত: কী দুঃসাহস! মহারাজের ছবির ওপর থুথু ফেলতে বলছে? স্বামীজী বলছেন: কেন, তাতে দোষ কিসের? এটাতো ছবি—একটা কাগজ ছাড়া আর কিছু নয়। মহারাজ তো সত্যিই এর মধ্যে নেই? —তবুও সবাই চুপ করে আছে। তখন স্বামীজী বললেন: তাহলে বুঝতে পারছেন তো মহারাজ, এই ছবি শুধু একটা কাগজই নয়। এর মধ্যে আপনি নেই আবার আছেনও। কারণ, এই কাগজটা আপনার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ছবি আপনার প্রতীক, আপনার ছবিকে অসম্মান করলে আপনাকেই অসম্মান করা হয়। তেমনি, মূর্তি ঈশ্বরের প্রতীক। আমরা কাঠ পুজো করি না, মাটি পুজো করি না, পাথর পুজো করি না। আমরা সেই পরব্রহ্ম, ঈশ্বর—তাঁরই পুজো করি। তাঁকে তো আমরা মন-বুদ্ধি দিয়ে ধরতে পারি না। তাই আমরা তাঁর একটা রূপ কল্পনা করি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলছে:১৪ ‘ভক্তানুরোধাৎ সাকারো নিরাকারো নিরঙ্কুশঃ।’ —যিনি নিরাকার নিরঙ্কুশ তিনিই ভক্তের অনুরোধে সাকার হয়েছেন। ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য তিনি রূপ পরিগ্রহ করেছেন। ঠাকুর বলছেন: তিনি নানারূপে দেখা দেন, নানাভাবে দেখা দেন··· ভক্ত যে রূপটি ভালবাসে, সেইরূপে তিনি দেখা দেন। (১-৩-৫) বিভিন্ন ভক্ত তাঁকে বিভিন্নরূপে দেখতে ভালবাসে, তাই তাঁর নানারকম সাকার মূর্তি। ‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা’১৫ —সাধকের কল্যাণের জন্যই ব্রহ্মের রূপকল্পনা। যিনি বৃহত্তম—তিনি ইচ্ছে করেই ভক্তের কাছে ছোট হয়ে আসেন। যিনি অসীম, ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য তিনি সসীম হন। ঠকুর বলছেন: কি রকম জান? যেন সচ্চিদানন্দ সমুদ্র। কূল-কিনারা নাই। ভক্তিহিমে সেই সমুদ্রের স্থানে স্থানে জল বরফ হ’য়ে যায়, যেন জল বরফ আকারে জমাট বাঁধে; অর্থাৎ ভক্তের কাছে তিনি সাক্ষাৎ হ’য়ে কখন কখন সাকার রূপ হ’য়ে দেখা দেন। আবার জ্ঞানসূর্য উঠলে সে বরফ গ’লে যায়। (১-১৫-২)

বাইবেলে আমরা দেখতে পাই: God made man in His own image. ভগবান মানুষ সৃষ্টি করেছেন নিজের মূর্তিতে নিজের ছাঁচে। আবার ঠিক উল্টোটাও সত্যি। Man makes God in his own image. এই যে আমরা ভগবানের উদ্দেশে মিষ্টি দিই, ফুল দিই, তাঁকে খুশি করার জন্য গান গাই, এগুলি আমরা নিজের ভালবাসি বলে করি। আমরা ভাবি, আমাদের যেমন রুচি তাঁরও বোধহয় সেই রুচি। স্বামীজী এক জায়গায় বলছেন, যদি একটা মহিষ চিন্তা করে ভগবান কিরকম, সে মনে করবে ভগবানও একটা মহিষ আর তিনি স্বর্গে আছেন অর্থাৎ কাদার মধ্যে আছেন। মাঝে মাঝে কাদাতে লুটোপুটি করছেন। আবার কিছুক্ষণ পরে পাশে কচি ঘাস আছে, সেই ঘাস খাচ্ছেন। বাস্তবিক আমরা আমাদের নিজেদের চশমা দিয়ে ভগবানকে দেখছি। নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁকে বিচার করছি। ‘যা যস্যাহভিমতা পুংসঃ সা হি তস্যৈব দেবতা।’১৬—যার যেমন মত, যার যেমন ভাব সেই ভাবে, সেই রূপে সে ঈশ্বরকে দেখে, নিজের রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দেখে। আমাদের অবস্থা সেই অন্ধের হাতি দেখার মতো। একজন হাতির শুঁড়টা ধরেছে, মনে করছে হাতি একটা মোটা দড়ির মতো। আর একজন হাতির পা-টা ধরেছে, সে বলছে, হাতি একটা থামের মতো। আর একজন হাতির কানে হাত দিয়ে বলছে, হাতি একটা কুলোর মতো। আমরাও তেমনি ভগবানকে আমাদের নিজেদের ভাবে দেখি। আমাদের সীমিত মন-বুদ্ধি দিয়ে তাঁকে বুঝতে চাই। তাঁর সম্বন্ধে আমরা যা বুঝি, আংশিক বুঝি; যা বলি আংশিক বলা হয়। ‘চিদাকাশে যার যা ভাসে তাই তাদের বোধের সীমানা।’

আমি কয়েকবছর আগে আলিপুরদুয়ারে গেছিলাম, সেখানে সবাই বলল, চলুন, ভূটানের সীমানা দেখে আসি। সবাই মিলে গেলাম। ভূটানের সীমানা যেখানে আরম্ভ হচ্ছে, সেখানে ফুন্ট-সো-লিং বলে একটা ছোট্ট শহর আছে। ঐ শহর থেকেই সবাইকে ভূটান যেতে হয়। দর্শনীয় স্থান। পাহাড়, পাহাড়ের উপর বড় গুম্ফা—বৌদ্ধমন্দির। দু-এক জন সাধু সেখানে থাকেন। আমরা সেখানে গিয়ে বুদ্ধমূর্তি দর্শন করলাম। কিন্তু দেখলাম, সেখানকার বুদ্ধমূর্তি একেবারে অন্য রকম। নাকটা খাঁদা, উঁচু চোয়াল আর গালের কাছটা খুব উঁচু। ভূটানীদের যেমন চেহারা হয় সেই রকম। কোন ভূটানী শিল্পী তাঁকে গড়েছে, সেইজন্যই মূর্তি ঐরকম। —Man makes God in his own image.

আমাদের একজন সাধুর কাছে শুনেছিলাম। তিনি ঘুরতে ঘুরতে কেরালার এক গ্রামে গেছেন। গিয়ে দেখেন, সেই গ্রামে এক জেলে পরিবারে শ্রীরামকৃষ্ণের পুজো হচ্ছে। তারা বিশেষ লেখাপড়া জানে না। ঠাকুরের একটা ছবি যোগাড় করে পুজো করছে, ভোগ নিবেদন করেছে। কি ভোগ দিয়েছে ঠাকুরকে? শুঁটকী মাছ—যা হয়তো শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনে কখনও খাননি। তারা শুঁটকী মাছ ভালবাসে, তাই শুঁটকী মাছ ভোগ দিয়েছে ঠাকুরকে। আমাদের সেই সাধুটি ওদের জিজ্ঞেস করলেন: এ তোমরা কার পুজো করছ? কে ইনি? ওরা বলল: ইনি শ্রীরামকৃষ্ণ। সাধুটি আবার প্রশ্ন করলেন: ইনি কোথাকার লোক জান? ওরা বলল: তা ঠিক বলতে পারব না, তবে কেরালারই কোথাও তিনি জন্মেছিলেন। বাস্তবিক, ভগবানকে নিয়ে আমরা তো এই ছেলেখেলাই করি। আমার যাতে সুখ আমার যাতে দুঃখ, ভাবি ভগবানেরও তাতেই সুখ তাতেই দুঃখ। তাঁকে আমরা এইভাবে নিজের ভাবে নিজের রঙে রাঙাই। আর ভগবানও বোধহয় সেটাই পছন্দ করেন। আমরা তাঁকে যে সাজে সাজাই, সেই সাজে সেজে তিনি আমাদের কাছে আসেন।

ঠাকুর বলছেন: তিনি যে শুধু নানা মূর্তিতে ভক্তদের কাছে আসেন তা-ই নয়। নররূপে জন্মগ্রহণও করেন তিনি, অবতার হয়েও আসেন। বলছেন: তিনি ইচ্ছা করলে তাঁর ভিতরের সার বস্তু মানুষের ভিতর দিয়ে আসতে পারে ও আসে। ···প্রেম ভক্তি শিখাবার জন্য ঈশ্বর মানুষ দেহ ধারণ করে সময়ে সময়ে অবতীর্ণ হন। (১-১৪-২) ঠাকুর আর এক জায়গায় বলছেন: ওঁ থেকেই ওঁ কালী, ওঁ শিব, ওঁ কৃষ্ণ। অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মই শিব কালী প্রভৃতি সাকার মূর্তিতে ভক্তকে দর্শন দেন, আবার লোককল্যাণের জন্য কৃষ্ণ প্রভৃতি অবতাররূপেও তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় মানুষের মত দেহ ধারণ ক’রে আসেন, এও সত্য, নানারূপ ধ’রে ভক্তকে দেখা দেন, এও সত্য। ···তাই শ্রীমদ্‌ভাগবতে সব (শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে) স্তব করেছে—ঠাকুর, তুমিই সাকার তুমিই নিরাকার; আমাদের সামনে তুমি মানুষ হয়ে বেড়াচ্ছ, কিন্তু বেদে তোমাকেই বাক্য-মনের অতীত বলেছে। (২-২-৫)

ঠাকুর বলছেন: বেদে তাঁকে সাকার নিরাকার দুই বলেছে, সগুণ বলেছে, নির্গুণও বলেছে। (ঐ) কিন্তু এটা দেখা যায় যে, যতক্ষণ ‘অহংবুদ্ধি’ থাকে, ততক্ষণ ঈশ্বরকে নিরাকার নির্গুণভাবে চিন্তা করা মানুষের পক্ষে কঠিন হয়। যতক্ষণ ‘আমি’ ‘তুমি’ আছে, যতক্ষণ ‘আমি প্রার্থনা কি ধ্যান করছি’ এ জ্ঞান আছে ততক্ষণ ‘তুমি’ (ঈশ্বর) প্রার্থনা শুনছো, এ জ্ঞানও আছে; ঈশ্বরকে ব্যক্তি ব’লে বোধ আছে।(১-১২-৯) আমি যদি একটি ব্যক্তি হই তাহলে ঈশ্বরও একজন ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয়ই আমার চেয়ে অনেক গুণে ভাল অনেক গুণে বড়, কিন্তু তিনিও একজন ব্যক্তি। ততক্ষণ তুমি প্রভু, আমি দাস; তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; তুমি মা, আমি ছেলে; এ বোধ থাকবে।··· আমি একটি, তুমি একটি। এ ভেদ বোধ তিনিই করাচ্ছেন। তাই পুরুষ-মেয়ে, আলো-অন্ধকার, এই সব বোধ হচ্ছে। যতক্ষণ এই ভেদ বোধ, ততক্ষণ শক্তি (Personal God) মানতে হবে। তিনিই আমাদের ভিতর ‘আমি’ রেখে দিয়েছেন। হাজার বিচার কর, ‘আমি’ আর যায় না। আর তিনি ব্যক্তি হ’য়ে দেখা দেন। তাই যতক্ষণ ‘আমি’ আছে—ভেদবুদ্ধি আছে—ততক্ষণ ব্ৰহ্ম নির্গুণ বলবার যো নাই। ততক্ষণ সগুণব্রহ্ম মানতে হবে। (ঐ) যদি আমার ‘অহংবোধ’ না থাকে, শরীরবোধ না থাকে, তখন সম্ভব হতে পারে এই চিন্তা করা যে, ব্ৰহ্ম তিনি নির্গুণ নিরাকার। কিন্তু যতক্ষণ আমার ‘আমি’ বোধ আছে, ততক্ষণ ব্রহ্মকে একজন ব্যক্তি বলে ধারণা হতে বাধ্য। কারণ, আমি আমার সীমিত বুদ্ধি দিয়ে যিনি অসীম, বাক্যমনাতীত তাঁকে কিভাবে ধারণা করব? এক সের ঘটিতে চার সের দুধ কি করে ধরাব? চার সের দুধ থাকলেও এক সের দুধই আমি নিতে পারব। আমার সীমিত মন-বুদ্ধি দিয়ে অসীমকে আমি শুধু সীমিতভাবেই চিন্তা করতে পারব। ঠাকুর বলতে চাইছেন যে, আমরা ঈশ্বর সম্বন্ধে ‘নির্গুণ’, ‘নিরাকার’ এসব কথা ব্যবহার করি বটে, কিন্তু আমাদের মনটা বেশ কিছুটা প্রস্তুত না হলে এগুলি ধারণা করা যায় না। বলছেন: নিরাকারে একেবারে মন স্থির হয় না। প্রথম প্রথম সাকার ত বেশ। (৩-৩-১) যতক্ষণ দেহবুদ্ধি আছে ততক্ষণ নির্গুণ নিরাকার ঈশ্বর এই চিন্তা না করে বরং সগুণ সাকার ঈশ্বর এই চিন্তা করাই ভাল। এই সগুণ ব্রহ্মকে বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে কালী বা আদ্যাশক্তি বলে গেছে। (১-১২-৯)

প্রশ্ন হচ্ছে: এই আদ্যাশক্তি দর্শন আর ঐ ব্ৰহ্মজ্ঞান, কি উপায়ে হ’তে পারে? (ঐ) এর উত্তরে ঠাকুর একেবারে ভক্তির সীমানায় এসে বলছেন: ব্যাকুল হৃদয়ে তাঁকে প্রার্থনা করো। আর কাঁদো। এইরূপে চিত্তশুদ্ধি হয়ে যাবে। নির্মল জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে। (ঐ) ব্ৰহ্মকে সূর্য বলা হচ্ছে। বলছেন: শরীর যেন সরা; এই শরীরমধ্যে মন, বুদ্ধি, অহংকাররূপ জল রয়েছে; ব্ৰহ্ম সূর্যস্বরূপ। তিনি এই জলে প্রতিবিম্বিত হচ্ছেন। (২-১৩-১) জল যদি অশান্ত থাকে, বা ময়লা থাকে তাহলে তার উপরে সূর্যের ছায়া পরিষ্কার পড়বে না। জল শান্ত ও স্বচ্ছ হলে সূর্যের ছায়া পরিষ্কার দেখা যাবে। আমাদের চিত্ত এখন মলিন হয়ে রয়েছে, তাই ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব এর উপরে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছে না। এই মলিনতাটা কি? ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের প্রতি মানুষের যে একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে সেটাই হচ্ছে মলিনতা। ‘বাহ্যবিষয়রাগাদিদোষ-কলুষিতম্‌ অপ্রসন্নম্‌ অশুদ্ধম্‌’—বাহ্য বস্তুর প্রতি আমাদের যে আকর্ষণ সেটাকে দোষ বলা হচ্ছে। এই দোষের ফলে আমাদের চিত্ত ‘কলুষিত’, ‘অপ্রসন্ন’ ও ‘অশুদ্ধ হয়ে আছে। আমাদের মনের অবস্থা এখন ‘মলাবনদ্ধমিবাদর্শং, বিলুলিতমিব সলিলম্‌’—ময়লা আয়নার মতো (আদর্শ=আয়না) বা তরঙ্গায়িত জলের মতো। যার জন্য ‘নাববোধয়তি নিত্যসন্নিহিতমপি আত্মতত্ত্বম্‌’—আত্মতত্ত্ব সর্বদা আমার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও আমি সেটা বুঝতে পারছি না।১৭ কঠোপনিষদে বলছে:১৮ আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি স্বভাবতই বহির্মুখী। যার ফলে অন্তরাত্মাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু ‘কশ্চিদ্ধীরঃ প্রত্যগাত্মানমৈক্ষদ্‌ আবৃত্তচক্ষুরমৃতত্ত্বমিচ্ছন্‌’—কোন কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি অমৃতত্ব লাভ করবেন বলে ‘আবৃত্তচক্ষু’ হয়ে তপস্যা করেন। শুধু চোখ নয়, সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে তাঁরা বহির্বিষয় থেকে সংবরণ করে রাখেন। এইভাবে তাঁরা আত্মদর্শন করেন—নিজের ভিতরে তাঁকে দেখতে পান। আমাদেরও বাহ্যবিষয়ের প্রতি আকর্ষণটা দূর করতে হবে। কারণ সেটাই হচ্ছে মলিনতা। ঠাকুর উপায় বলছেন: ব্যাকুল ভাবে প্রার্থনা কর আর কাঁদ। চোখের জলে চিত্তের মলিনতা ধুয়ে যাবে। তখন নির্মল জলে ব্ৰহ্ম-সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়বে। ভক্তের আমিরূপ আরশিতে সেই সগুণব্রহ্ম আদ্যাশক্তি দর্শন করবে। (১-১২-৯) ভক্তের মধ্যেই ভগবানকে দেখা যাবে। ভক্তের হৃদয় তাঁর বৈঠকখানা। ভক্তের মধ্যেই ভগবানের বেশী প্রকাশ। তাই বলছেন: ‘ভক্তের আমি’ যেন দর্পণ। সেই দর্পণে ঈশ্বরের রূপ ফুটে উঠবে। বলছেন: যতক্ষণ ‘আমি’ জলে সূর্যকে দেখতে হয়, সূর্যকে দেখবার আর কোনরূপ উপায় হয় না। আর যতক্ষণ প্রতিবিম্ব সূর্য বই সত্য সূর্যকে দেখবার উপায় নাই, ততক্ষণ প্রতিবিম্ব সূর্যই ষোল আনা সত্য—যতক্ষণ আমি সত্য ততক্ষণ প্রতিবিম্ব সূর্যও সত্য—ষোল আনা সত্য। (ঐ) প্রতিবিম্ব সূর্য অর্থাৎ সগুণব্রহ্ম—ঈশ্বর। যতক্ষণ দেহবুদ্ধি আছে ততক্ষণ তাঁকে সাকার সগুণ ভাবে চিন্তা করাই ভাল। ততক্ষণ দ্বৈতবাদ। এই দ্বৈতবাদই শেষে গিয়ে অদ্বৈতবাদে পর্যবসিত হবে। প্রথমে ‘আমি’ একজন আর ঈশ্বর আর একজন এই ভেদবোধ থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, আমিও যা ঈশ্বরও তাই। একজন ভক্ত গাইছেন:

আদর্শ তোমারে দেখিব যত,

তোমার স্বভাব পেয়ে হব তোমার মত;

ফুরাবে না তুমি, ফুরাব না আমি,

তোমাতে আমাতে হব একাকার।

—যত আমি তোমার দিকে এগিয়ে যাব ততই আমি তোমার মতো হতে থাকব। শেষকালে আমি তোমার সাথে একাত্ম হয়ে যাব, তোমার সঙ্গে মিশে আমিও অনন্ত হয়ে যাব। তোমাতে আমাতে আর কোন ভেদ থাকবে না তখন। ঠাকুরও তাই বলছেন: ব্রহ্মজ্ঞান যদি চাও—সেই প্রতিবিম্বকে ধ’রে সত্য সূর্যের দিকে যাও। সেই সগুণব্রহ্ম, যিনি প্রার্থনা শুনেন তাঁরেই বলো, তিনিই সেই ব্ৰহ্মজ্ঞান দিবেন। কেননা, যিনিই সগুণব্রহ্ম, তিনিই নির্গুণব্রহ্ম, যিনিই শক্তি, তিনিই ব্রহ্ম। পূর্ণ জ্ঞানের পর অভেদ। (ঐ) সাধারণের পক্ষে সগুণ ব্রহ্মের কল্পনাই ভাল। সগুণ ব্রহ্ম অর্থাৎ ঈশ্বর। তাত্ত্বিক দিক দিয়ে ‘ব্রহ্ম’ আর ‘ঈশ্বর’ এক নয়। আমরা ঈশ্বরকে কিভাবে দেখি? আমরা ভাবি, তিনি অনন্ত শক্তি সম্পন্ন। তাঁর অশেষ দয়া, আমি অন্যায় করলে তিনি আমাকে শাসন করেন আবার আমি অনুতপ্ত হলে তিনি আমাকে ক্ষমাও করেন। আমার সমস্ত প্রার্থনা তিনি শোনেন, আমার বিপদ-আপদ থেকে আমাকে তিনি রক্ষা করেন। আমরা অধিকাংশ লোকই ঈশ্বরকে এইভাবে দেখতে চাই। তিনি আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয় এই ভাবতে চাই। এখন, নির্গুণ-নিষ্ক্রিয়-নিরাকার ব্রহ্মের কথা ভাবলে এই আশ্ৰয়টা আমাদের আর থাকে না। আমি আর তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে পারি না, তাঁর উপর নির্ভর করতে পারি না। কারণ, তাঁর তো কোন ‘গুণ’ নেই—আমি কি করে তাঁর উপর নির্ভর করব? তিনি তো কিছু করেন না—তাহলে কি করে আমি ভাবব যে আমার দুঃখে তিনি শক্তি দেবেন, বিপদে আমাকে সাহস দেবেন? সেইজন্য ঠাকুর বলছেন: সগুণ ব্রহ্মকে ধর—যিনি তোমার প্রার্থনা শোনেন। সগুণ ব্রহ্মই তোমাকে নির্গুণ ব্রহ্মে পৌঁছে দেবেন। ঈশ্বরের কাছে ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা করলে তিনিই তোমাকে ব্ৰহ্মজ্ঞান দেবেন। আর জ্ঞান হলে পরে তুমি দেখবে যে, যিনি সগুণ ব্রহ্ম, তিনিই নির্গুণ ব্রহ্ম। এ যেন এক সোপান থেকে আর এক সোপানে এগিয়ে যাওয়া।

কিন্তু এগুলি ধারণা করা সত্যিই শক্ত। যিনি নিরাকার, তিনিই আবার সাকার কিরূপে হবেন? এ সন্দেহ মনে উঠে। আবার যদি সাকার হন, তো নানা রূপ কেন? (১-১৫-২) এই ধরনের নানা প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে। কিন্তু ঠাকুর বলছেন: তুমি এই তর্ক বিচারের দিকে বেশী জোর দিয়ো না, সাধনভজন করে ঈশ্বর উপলব্ধি করবার চেষ্টা কর। কারণ, ঈশ্বরকে লাভ না করতে পারলে, এ সব বুঝা যায় না। (ঐ) রামপ্রসাদের একটা গানে আছে:

মন কি তত্ত্ব কর তাঁরে যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে।

সে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত, অভাবে কি ধরতে পারে॥

… … …

ষড়্‌দর্শনে না পায় দরশন, আগম নিগম তন্ত্রসারে।

সে যে ভক্তি রসের রসিক, সদানন্দে বিরাজ করে পুরে॥

… … …

প্রসাদ বলে মাতৃভাবে আমি তত্ত্ব করি যাঁরে।

সেটা চাতরে কি ভাঙ্গবো হাঁড়ি, বোঝ না রে মন ঠারে ঠোরে॥

—তাঁকে কি করে জানবে তুমি, কি করে বুঝবে? এ যেন পাগলের মতো অন্ধকার ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছ তাঁকে ধরবার জন্য। কিন্তু তিনি তো কোন স্থূল জিনিস নন। তিনি হচ্ছেন ভাবের জিনিস। ভাব দিয়েই তাঁকে লাভ করা যায়। ‘দর্শন’-ও তাঁর দর্শন পায় না, কারণ তিনি হচ্ছেন ভক্তিরসের রসিক। তিনি ‘পুরে’ বিরাজ করেন, হৃদয়ে বিরাজ করেন। ভক্তি দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়। রামপ্রসাদ বলছেন: আমি তাঁকে মা বলে ডাকি। মা বলে আমি যাঁকে ডাকি, তাঁর স্বরূপ কি করে আমি তোমাদের কাছে বলে বোঝাই? এ এমন জিনিস নয় যে আমি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব, তোমরা সবাই দেখে নেবে। তুমি ‘ঠারে ঠোরে’ তাঁকে বুঝে নাও, নিজের ভাব দিয়ে তাঁকে বোঝবার চেষ্টা কর। তোমার প্রত্যক্ষ অনুভূতি হোক, তাহলেই তুমি তাঁর সম্বন্ধে জানতে পারবে। তার আগে কেউ তোমাকে এ বুঝিয়ে দিতে পারবে না।

ঈশ্বরতত্ত্ব ঈশ্বর লাভ না করলে বোঝা যায় না। ঠাকুর উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন: যদু মল্লিকের কত সম্পত্তি, কত কোম্পানির কাগজ তা নিয়ে তুমি জল্পনা-কল্পনা করছ। তাতে কি তুমি সেসব সম্বন্ধে জানতে পারবে? যদু মল্লিকের সঙ্গে ভাব কর, তখন দেখবে একদিন যদু মল্লিক নিজেই তোমাকে বলে দেবেন, তাঁর কোথায় কত সম্পত্তি আছে। ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হোক, তখন দেখবে ঈশ্বর নিজেই তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তোমার মনের সব প্রশ্নের সমাধান করে দিচ্ছেন তিনি। উপলব্ধির দিকে নজর নেই, শুধু বিচার করে যাচ্ছ—তাতে কখনও কোন ফল হয় না। তাই ঠাকুর বলছেন: বিচার করো না। তাঁকে জানতে কে পারবে?··· হাজরার (প্রতাপচন্দ্র হাজরা) বড় বিচারবুদ্ধি। সে হিসাব করে, এতখানিতে জগৎ হলো, এতখানি বাকি রইল। তার হিসাব শুনে আমার মাথা টন্‌টন্‌ করে। আমি জানি, আমি কিছুই জানি না। কখনও তাঁকে ভাবি ভাল, আবার কখনও ভাবি মন্দ। তাঁর আমি কি বুঝবো?··· আমি কেবল মা বলে ডাকি। মা যা করেন।(২-৯-২) বলছেন: তাঁকে কে জানবে? আমি জানবার চেষ্টাও করি না।(ঐ) তাঁর গুণ কোটি বৎসর বিচার করলেও কিছু জানতে পারবে না। (১-১১-১) পুষ্পদন্তের শিবমহিম্নঃ স্তোত্রে আছে।১৯

অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রে

সুরতরুবরশাখা লেখনী পত্ৰমুর্বী।

লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং

তদপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি॥

—নীল পাহাড় যদি কালি হয়, সমুদ্র যদি দোয়াত হয়, পারিজাত গাছের শ্রেষ্ঠ শাখা যদি হয় কলম আর পৃথিবী যদি হয় কাগজ এবং সেই কাগজে যদি স্বয়ং সরস্বতী অনন্তকাল ধরে লিখে চলেন তবুও, হে ঈশ্বর, তোমার গুণ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। একটা গানে ‘প্রেমিক’ বলছেন:

মা তুমি কে, কেউ জানে না।

তোমায় নানা লোকে বলছে নানা॥

… … …

প্রেমিক বলে গোলেমালে সেরে গেছে সব ক’জনা,

ব্রহ্মা বিষ্ণু শূলপাণি (তোমার) স্বরূপ দেখতে সবাই কানা॥

—তোমার সম্বন্ধে যে যা বলেছে ভুল বলেছে। এমন কি ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তাঁরাও তোমার স্বরূপ বর্ণনা করতে পারেননি। আবার আর একজন ভক্ত বলছেন:

আমার কেমন মা তা কেমন করে বলতে গো পারি।

… … …

প্রতি রোমকূপে কত ব্রহ্মাণ্ড র’য়েছে স্থির,

কত পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদ্র রূপ তাঁহারি॥

—তিনি একদিকে যেমন মহৎ, প্রতি রোমকূপে কত ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে তাঁর, আবার পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র বস্তু, সে-ও তিনি। ‘অণোরণীয়ান্‌ মহতো মহীয়ান্‌’।২০ তিনিই সব হয়েছেন। তাঁর সম্বন্ধে কখনও আমরা বলতে পারি না যে, তিনি এইটুকু, এর বেশী নয়। একটা শ্লোকে ভক্ত বলছে:২১

রূপং রূপবিবর্জিতস্য ভবতো ধ্যানেন যৎ কল্পিতং

স্তুত্যানির্বচনীয়তাখিলগুরো দূরীকৃতা যন্ময়া।

ব্যাপিত্বঞ্চ নিরাকৃতং ভগবতো যত্তীর্থযাত্রাদিনা

ক্ষন্তব্যং জগদীশ তদ্বিকলতাদোষত্ৰয়ং মৎকৃতম্॥

—তোমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমি তিনটি ভুল করে ফেলেছি। কি কি সেই ভুল? ‘রূপং রূপবিবর্জিতস্য ভবতো ধ্যানেন যৎকল্পিতং’—তুমি রূপবর্জিত, অরূপ তুমি, কিন্তু আমি ধ্যানের সময় তোমার একটা রূপ কল্পনা করে নিয়েছি। এই একটা ভুল হয়েছে আমার। আর কি? ‘স্তুত্যানির্বচনীয়তা’—তুমি অনির্বচনীয়। কেউ তোমার বর্ণনা করতে পারে না। অথচ আমি তোমার স্তুতি করে তোমার রূপ বর্ণনা করবার চেষ্টা করেছি। এর দ্বারা আমি প্রকারান্তরে অস্বীকার করেছি যে, তুমি অনির্বচনীয়। আর কি ভুল? ‘ব্যাপিত্বঞ্চ নিরাকৃতং ভগবতো যত্তীর্থযাত্রাদিনা’—তুমি সর্বব্যাপী, অথচ আমি ধরে নিয়েছি তীর্থে তুমি বিশেষভাবে যেন আছ। তাই আমি তীর্থে গেছি। ‘ক্ষন্তব্যং জগদীশ তদ্বিকলতাদোষত্রয়ং মৎকৃতম্‌’—তোমাকে বিকৃতভাবে চিন্তা করে বা বর্ণনা করে আমি এই তিনটি অপরাধ করেছি, আমার এই তিনটি অপরাধ তুমি ক্ষমা কোরো।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ তাই বলছেন: কখনও ভেবো না যে, তাঁর সম্বন্ধে এটাই শেষ কথা। তিনি সাকার আবার নিরাকার, আবার সাকার-নিরাকারেরও পার। (২-২-৫) তিনি ‘এক’ আবার ‘দুই’, আবার এক দুয়ের পার! (১-১৬-৩) তিনি দ্বৈত, তিনি অদ্বৈত, আবার ‘দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্‌’।* তিনি নির্গুণ, তিনি সগুণ, আরও কত কি। তাঁর ইতি করা যায় না। (২-২-৫) তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা উপনিষদে দেখি ব্রহ্মের সম্বন্ধে কিরকম সব পরস্পরবিরোধী কথা বলা হচ্ছে। বলছেন: ‘তদেজতি তন্নৈজতি’ —তিনি চলেন আবার চলেনও না। ‘তদ্দূরে তদ্বন্তিকে’—তিনি দূরে আছেন, আবার কাছেও আছেন। ‘তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ’—সকলের অন্তরে আছেন তিনি, আবার বাইরেও আছেন।২২ ‘অপাণিপাদঃ’—তাঁর হাত-পা কিছুই নেই। কিন্তু ‘জবনো গ্রহীতা’—দ্রুত গিয়ে তিনি সব জিনিস গ্রহণ করতে পারেন। ‘পশ্যত্যচক্ষুঃ’—চোখ নেই অথচ দেখতে পান। ‘শৃণোত্যকর্ণঃ’—কান নেই অথচ শুনতে পান।২৩ কীরকম পরস্পরবিরোধী কথা সব। এগুলির তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, তাঁর সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলা যায় না। সব সম্ভব তাঁর পক্ষে। আমরা শুনি ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্‌’।২৪ তিনি যদি ইচ্ছা করেন, বোবার মুখে কথা ফোটাতে পারেন। পঙ্গুকে দিয়ে গিরি লঙ্ঘন করাতে পারেন। সত্যিই তিনি তা পারেন। ঠাকুর গল্প করছেন: নারদ আসছেন ভগবানের কাছ থেকে। রাস্তায় দুজন লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করছে: তুমি তো ভগবানের কাছ থেকে আসছ—তিনি কি করছেন দেখে এলে? নারদ বলছেন: তাঁকে দেখে এলাম, তিনি সুচের ভিতর দিয়ে একটা হাতী ঢোকাচ্ছেন আর বার করছেন। এই শুনে একজন বলল: দূর, এ কি কখনও হতে পারে—অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আর একজন, সে ভক্ত, সে বলল, তুমি যা দেখেছ ঠিক দেখেছ, তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব। তাঁর রাজ্যে অসম্ভব বলে কিছু নেই। ঠাকুরকে মথুরবাবু বলেছিলেন: ঈশ্বর কি আর যা খুশি করতে পারেন? তাঁকেও তাঁর আইন মেনে চলতে হয়। ঠাকুর বলছেন: সে কী! যিনি আইন সৃষ্টি করেছেন, তিনি কেন আইন মানতে বাধ্য হবেন? তিনি ইচ্ছে করলেই তাঁর আইন ভাঙতে পারেন। মথুরবাবু বলছেন: তা হয় না কখনও। লাল ফুলের গাছে কখনও সাদা ফুল হতে পারে না। ঠাকুর বলছেন: হ্যাঁ, হতে পারে। তিনি যদি চান, তাহলে তাও হতে পারে। তার পরদিন দেখা গেল, একটা লাল জবা গাছে একটা সাদা ফুল ফুটেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ সেটা তুলে এনে মথুরবাবুকে দেখালেন। সেইজন্য ঠাকুর বলছেন যে, সব মানতে হয়—তিনি সাকার, নিরাকার, আবার কত কি; তা আমরা জানি না!··· সব মান্‌তে হয় গো— নিরাকার সাকার সব মান্‌তে হয়। (২-১৮-৩) নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন: কালীঘরে ধ্যান করছিলাম, এমন সময় দেখলাম, মা এক পতিতা রমণীর রূপ ধরে এসেছেন। বললেন: মা তুই এইরূপেও আছিস! তাই বলছি, সব মানতে হয়। তিনি কখন কিরূপে দেখা দেন, সামনে আসেন, বলা যায় না।··· একটু গীতা, একটু ভাগবত, একটু বেদান্ত প’ড়ে লোকে মনে করে, আমি সব বুঝে ফেলেছি! চিনির পাহাড়ে একটা পিঁপড়ে গিছলো। এক দানা চিনি খেয়ে তার পেট ভ’রে গেল। আর এক দানা মুখে ক’রে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। যাবার সময় ভাবছে, এবারে এসে পাহাড়টা সব নিয়ে যাব! (ঐ) আমরা কত সামান্য সে সম্বন্ধে সচেতন নই, তাই আমরা ঈশ্বর সম্বন্ধে বিচার করতে যাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: দেখ, জীবনের উদ্দেশ্যটা তুমি ভুলে যেও না। জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ। সর্বশক্তি দিয়ে তুমি তার জন্য চেষ্টা কর। তা না করে তুমি শুধু শুকনো বিচার করে যাচ্ছ, তাতে তোমার কোন লাভ হবে না। তোমার সীমাবদ্ধতা তুমি জান না, তাই তুমি ভাবছ ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ জেনে নেবে। তা হয় না কখনও। অনন্ত ঈশ্বরকে কি জানা যায়? আর তাঁকে জানবারই বা কি দরকার? (১-৩-৫) আমাদের যতটুকু দরকার, ততটুকু হ’লেই হ’ল। (১-৯-২) যদি আমার এক ঘটি জলে তৃষ্ণা যায়, পুকুরে কত জল আছে, এ মাপবার আমার কি দরকার? আমি আধ বোতল মদে মাতাল হ’য়ে যাই—শুঁড়ির দোকানে কত মণ মদ আছে, এ হিসাবে আমার কি দরকার? (১-৩-৫) বলছেন: চিনির পাহাড়ের কাছে যে পিঁপড়ে গেছিল, তার সব পাহাড়টার কি দরকার? একটা, দুটো দানা হ’লেই হেউ ঢেউ হয়। (১-৯-২) ঈশ্বর ঐ চিনির পাহাড় আর আমরা তাঁর তুলনায় এক একটা পিঁপড়ে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে ঐ ‘একটা-দুটো দানা’ কি করে পেতে পারি। অর্থাৎ যাতে আমার ‘অপরোক্ষানুভূতি’ হয়, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ দর্শন আমি যাতে পেতে পারি, সেই চেষ্টা করতে হবে আমাকে। বলছেন: তুমি আমবাগানে গেছ আম খেতে। সেখানে গিয়ে কি শুধু ‘কটা আম গাছ, প্রতি গাছে কত আম ফলেছে’ এই বিচার করে কাটাবে না কি আম খাবে? বুদ্ধিমান যে, সে প্রথমেই আম খেয়ে নেবে। তেমনি, পৃথিবীতে যারা প্রকৃত বিচক্ষণ, তারা ঈশ্বর সম্বন্ধে শুকনো বিচার করে সময় নষ্ট করে না। তারা চেষ্টা করে, ‘যো সো করে’ ভগবান লাভ করতে। ঠাকুর তাই বলছেন: তুমি আম খেয়ে চলে যাও। (১-১১-১) তুমি এ সংসারে ঈশ্বর সাধন জন্য মানবজন্ম পেয়েছ। ঈশ্বরের পাদপদ্মে কিরূপে ভক্তি হয়, তাই চেষ্টা কর। তোমার এত শত কাজ কি? (১-১৮-৩)

আকর-তালিকা

 । মহানির্বাণ-তন্ত্র, ১৪/১১৩

 । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৬/১৪

 । কঠোপনিষ্‌দ, ২/৩/৩

 । তৈত্তিরীইয়োপনিষদ্‌, ২/৭

 । ঐ, ৩/৬

 । ঐ, ২/৪

 । জ্ঞানসঙ্কলিনীতন্ত্র, ৫২

 । শ্বেতাশ্বতরোপনিষ্‌দ, ৩/৭

 । ঈশোপনিষ্‌দ, ১

১০। শ্বেতাশ্বতরোপনিষ্‌দ, ৩/১৬

১১। বৃহদারণ্যকোপনিষদ্‌, ২/৪/১৪

১২। কোনোপনিষদ্‌, ২/৩

১৩। বেদান্তসার, ৩৬-৭

১৪। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ (কৃষ্ণজন্মখণ্ড), ৭/৫৬

১৫। কুলার্ণবতন্ত্র, ৬/৭৩

১৬। শাক্তানন্দ-তরঙ্গিণী, ৩/১৪

১৭। শঙ্করভাষ্য, মুণ্ডকোপনিষদ্‌, ৩/১/৮

১৮। কঠোপনিষদ্‌, ২/১/১

১৯। শিবমহিম্নঃ স্তোত্র, ৩২

২০। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৩/২০

২১। Quoted from ‘Universal Prayers’ by Swami Yatiswarananda, 1977, Verse no. 309

২২। ঈশোপনিষদ্, ৫

২৩। শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্‌, ৩/১৯

২৪। গীতাধ্যান, ৮

* শঙ্করভাষ্য, ব্ৰহ্মসূত্র, ১/১/১৭ ও ২/১/৯; শঙ্করভাষ্য, গৌড়পাদকারিকা, ১/১৬-১৭ (শঙ্করভাষ্যের উপর শঙ্করানন্দের টীকাও দ্রষ্টব্য); শঙ্করাচার্যের দক্ষিণামূর্তিস্তোত্র, ১-২

* অদ্বৈতং কেচিদিচ্ছন্তি দ্বৈতমিচ্ছন্তি চাপরে।

মম তত্ত্বং ন জানন্তি দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্‌॥

—কেউ আমাকে ‘অদ্বৈত’-ভাবে চায়, কেউ চায় ‘দ্বৈত’-ভাবে। এরা কেউই আমার প্রকৃত তত্ত্ব জানে না। আমি আসলে দ্বৈত-অদ্বৈতের উর্ধ্বে। (কুলার্ণবতন্ত্র, ১/১১০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *