তরুণ মুহাম্মাদ (সাঃ)
কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েরা নানারকম বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেই ভবিষ্যৎ জীবনে চলার পাথেয় কুড়িয়ে নেয়। যারা তা করে তারা পরিণত বয়সে সেগুলো সমাজের সাথে শেয়ার করে।
রাসূল (সাঃ) তরুণ ও যুবক বয়সে তাঁর চাচার পরিবারকে সাহায্য করেছেন। নিজ শহরের বিভিন্ন সংঘাত সমাধানে সামাজিক দক্ষতা ও সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়েছেন। সামাজিকভাবে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তাঁর বেশকিছু বন্ধুবান্ধব ছিল। এরপরও মাঝে মাঝে তিনি একান্ত নিজের জন্য সময় বের করে নিতেন এবং তাতে কোনোরকম একাকী বা একঘেয়ে বোধ করতেন না। প্রযুক্তি আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নিয়ে বেশিরভাগ তরুণ ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝেও সমাজে সক্রিয় থাকার উপায় খুঁজতে হবে। নিজের জন্যও সময় খুঁজে নিতে হবে। ব্যালেন্সটা জরুরি।
সৃষ্টিশীল হোন
গত অধ্যায়ে আমরা কিশোর রাসূল (সাঃ) কে দেখেছি। কীভাবে তিনি চ্যালেঞ্জে মোকাবিলা করেছেন, তাঁর এনার্জিকে প্রোডাক্টিভ উপায়ে ব্যবহার করে কাজ ও সফর থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেগুলো দেখেছি।
এই অধ্যায়ে আমরা দেখব ২০ ও ৩০-এর কোঠার রাসূল (সাঃ) কে। যে বয়সে একজন তার লব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সমাজসেবা করতে পারে। রাসূল (সাঃ) মক্কায় ‘উদীয়মান তারকা’-তে পরিণত হন। সমস্যা সমাধানে তাঁর দক্ষতার কারণে মানুষের নজর কেড়েছিলেন। কাবাঘর নির্মাণ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যকার বিতণ্ডা নিরসনে তিনি চমৎকার এক সমাধান বের করে দেন।
ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সততার খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রাহকদের আস্থা কুড়ান। সে সময়ের মক্কার এক শ্রদ্ধাভাজন ব্যবসায়ী নারী খাদিজার শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তাঁরা দুজনে পরে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে ছিল চার মেয়ে, দুই ছেলে।
বাস্তব মডেল
পরিণত বয়সের রাসূল (সাঃ) এর যে দিকটা সবচেয়ে অনুপ্রেরণা জাগায় তা হচ্ছে, কিশোর বয়স থেকেই দায়িত্ব গ্রহণের মানসিকতা। চাচার পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি রাখাল হিসেবে কাজ করেছেন। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সিরিয়ায় গিয়েছেন। মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলেছেন। ইফেক্টিভলি ডিল করেছেন। কিন্তু তাই বলে অন্যকে খুশি করার জন্য নিজের আদর্শে ছাড় দেননি। তরুণ বয়সে তাঁর মধ্যে এই গুণগুলো স্বাভাবিক ছিল। কেউ কেউ ভাবেন, রাসূল (সাঃ) মনুষ্য ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু কথাটা কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যেতে পারে। যেমন, সেই একই লোক হয়ত কুরআনের এই আয়াত উদ্ধৃত করবেন,
‘আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর মধ্যে তোমাদের জন্য অবশ্যই চমৎকার উদাহরণ আছে। আয যুখরুফ’ : ৭৩
কিন্তু সেই তিনিই হয়ত মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলবেন, রাসূল বলে অমুক অমুক কাজ করতে পেরেছেন। আমরা কি আর পারব?
গভীর ও নিখাদ শ্রদ্ধার কারণে কোনো কোনো মুসলিম ভাবেন তাদের আর তাঁর জীবনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। রাসূল (সাঃ) এর কাহিনি শুধু সমীহ জাগানোর জন্য। এতে কি কোনো বাস্তব উদাহরণ নেই, যা থেকে আমরা আরও ভালো মানুষে পরিণত হতে পারি? আমরা তাঁর জীবনী পড়ি, তাঁর প্রতি ভক্তি জাগে। কিন্তু নিজের জীবনে কীভাবে তাঁর জীবন দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করতে পারি, সেটা দেখি না।
চ্যালেঞ্জটা এখানেই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রেখে কীভাবে তাঁকে আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রয়োগ করব। বিষয়টা এভাবে দেখুন, একজন মানুষ তার মনুষ্য ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যত সেরা হতে পারেন, রাসূল (সাঃ) ছিলেন তা-ই। আমাদের কাজ হলো কত ভালোভাবে আমরা এখন তাকে অনুসরণ করতে পারি, সেই পথ খোঁজা।
এতদিন পর্যন্ত আপনি কী করলেন আর রাসূল (সাঃ) তাঁর এক জীবনে কী করেছেন, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সাধারণ চোখে দেখলে এতে আপনি হতাশ হয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু বিষয়টাকে এভাবে না-দেখে মোটিভেশন হিসেবে নিন। রাসূল (সাঃ) যা করেছেন আপনি কখনো তার কাছাকাছি যেতে পারবেন না, এমনটা ভেবে কখনো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন না।
নবি হওয়ার আগেও কিন্তু তিনি অসাধারণ মানুষ ছিলেন। কুরআন তাঁকে বর্ণনা করছে, নৈতিক চরিত্রের পরাকাষ্ঠা হিসেবে। আল ক্বলাম : ৪
এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হয়, তখনও তিনি কিন্তু মক্কাতেই ছিলেন। বিষয়টা এমন না যে, এই আয়াত অবতীর্ণের পর তার চরিত্র এক রাতের মধ্যে বদলে গেছে; বরং বছরের পর বছর ধরেই তাঁর চরিত্র এমন ছিল। কাজেই আমরা বলতে পারি, নবি হওয়ার আগেই তিনি নীতিবাগিশ ছিলেন। নবি হওয়ার পর সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।
খাদিজাকে বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৫। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছিলেন, তিনি তাঁকে ভালোবাসেন তাঁর দয়া, সততা ও সত্যবাদিতার জন্য। তখন কিন্তু তিনি নবি ছিলেন না।
তরুণ বয়সে রাসূল (সাঃ) কেমন ছিলেন, সেটা বুঝার জন্য আমরা তার শারীরিক অ্যাপিয়ারেন্স দিয়ে শুরু করব। কারণ একজন ব্যক্তির অ্যাপিয়ারেন্স সাধারণত শৈশবে বদলায়। আর তরুণ বয়সে মুখমণ্ডলের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা তার মুখ ও চালচলন দিয়ে শুরু করব। কারণ এ দুটো কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে প্রথম আমাদের নজর কাড়ে।
রাসূল (সাঃ) দেখতে কেমন ছিলেন?
নির্ভরযোগ্য উৎসগুলো থেকে রাসূল (সাঃ) কে যেমন পাওয়া যায়-
তাঁর মুখ ছিল কিছুটা গোলাকৃতির। দীপ্ত সুন্দর চেহারা। লালাভ ফর্সা গায়ের রং। মুখে কোনো দাগ ছিল না। মসৃণ। কালো বড় চোখ। বড় চোখের পাতা। সাদা দাঁত। কণ্ঠ ছিল নরম। ঠাণ্ডায় অনেকের গলা যেমন হয়। তবে অনেকের স্বাভাবিক কণ্ঠও এরকম হয়। চুলগুলো মাঝারি। তা কাঁধ স্পর্শ করেনি। আবার খুব ছোটও ছিল না। তিনি যখন চুল কাটতে দেরি করতেন, তখন তা কাঁধ পর্যন্ত পৌছাত। যখন তিনি তা কাটতেন, তিনি কান পর্যন্ত কাটতেন অথবা কানের লতি পর্যন্ত।
তাঁর উচ্চতা ও গড়ন ছিল মাঝারি। প্রশস্ত কাঁধ। পেটানো শরীর। পেশিবহুল; তবে যথেষ্ট ভারি হাত, মোটা আঙুল। পা ও অন্যান্য অঙ্গগুলো সোজা ও লম্বা। পায়ের পাতার বাইরের বাঁকানো অংশটা মাটিতে লাগত না।
তাঁর হাঁটার মধ্যে একটা কর্মচঞ্চলতা ছিল। সতেজ ভাব ছিল। মাটির সাথে পা ঘেঁষে ঘেঁষে চলতেন না। তাড়া না-থাকলে ধীরস্থিরভাবে হাঁটতেন। শান্তভাবে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতেন, যেন কোনো ঢালু বেয়ে নামছেন।
তার চলাফেরা ছিল দ্রুত। কারও দিকে ফিরলে পুরো শরীর ঘুরিয়ে ফিরতেন। শুধু মাথা ঘোরাতেন না। তাঁর ঘাম ছিল মুক্তোর মতো, এত স্বচ্ছ ছিল সেগুলো। করি ও অম্বরের চেয়ে তাঁর গায়ের ঘ্রাণ সুন্দর ছিল।
বাহ্যিক রূপ জেনে কী হবে? বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে তো আর বুঝা যায় না বইটা কেমন। কাজেই নবি মুহাম্মাদ -এর বাহ্যিক রূপ জানার প্রয়োজন কী?
রাসূল (সাঃ) এর কিছু কিছু ব্যাপার মহান আল্লাহর তরফ থেকে উপহার। তবে কিছু আছে যা রাসূল (সাঃ) এর বাহ্যরূপ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি আপনার জীবনে কাজে লাগাতে পারেন।
তাঁর দাঁতগুলোর মধ্যকার স্বাভাবিক যে ফাঁক ছিল, আপনার হয়ত তেমন না; কিন্তু দাঁতের যত্ন ও সেগুলো সাদা ও পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে আপনি নজর দিতে পারেন। আপনার গায়ের স্বাভাবিক ঘ্রাণ হয়ত কস্তুরির মতো না, যেমনটা রাসূল (সাঃ) এর ছিল (আর এটা কেবল তাঁর বেলাতেই ইউনিক ছিল), কিন্তু আপনি নিয়মিত গোসল করতে পারেন। হাতপা ধুয়ে রাখতে পারেন।
আরও যেসব দিক আপনি খেয়াল রাখতে পারেন-
রাসূল (সাঃ -এর বাহ্যিকরূপ | আপনার বাহ্যিকরূপ |
রাসূল (সাঃ) এর চুল পরিপাটি ছিল। | আপনি চুল আঁচড়ান। |
রাসূল (সাঃ) মোটাসোটা ছিলেন না। | শরীরচর্চা করুন। স্বাস্থ্যকর খাবার খান। |
তাঁর দাঁত সাদা ছিল। | ক্যাভিটি ও হলুদ হয়ে যাওয়া থেকে নিজের দাঁতকে রক্ষা করুন। |
বিষয়গুলো নতুন কিছু না। কিন্তু এগুলো মানুষ খুব সহজেই ভুলে যায়। যেমন ফ্লসিং ও হালকা ব্যায়াম।
রাসূল (সাঃ) এর ব্যক্তিত্ব।
রাসূল (সাঃ -এর ব্যক্তিত্বের যে দিকটা আপনাকে নাড়া দিতে পারে, তা হলো ভারসাম্য বজায় রেখে চলা। তিনি সহজে লোকজনদের সাথে মেলামেশা করতেন, বন্ধুবান্ধবদের সাথে শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন, সমাজকে সাহায্য করার জন্য উদ্ভাবনীমূলক পদক্ষেপ নিতেন। কিন্তু একই সময়ে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যায় পুরোপুরি ডুবে যেতেন না। একাকী চিন্তাভাবনার প্রয়োজনের কথা ভুলে যেতেন না। প্রথমে আমরা দেখব রাসূল (সাঃ) তাঁর স্থানীয় সমাজের সাথে কীভাবে মেলামেশা করেছেন। ৫৯১ সালে বাণিজ্য নগরী মক্কায় একটা ঘটনা বেশ তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। মক্কার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আল আস ইব্ন্ ওয়াইল এক ইয়েমেনি ব্যবসায়ীর থেকে পণ্য নিয়েছিল টাকা শোধ না করে। সেই ইয়েমেনি মক্কার নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনায় আকুতি জানিয়েছিল।
সম্মানীয় নেতারা আল আসের কাছে যেয়ে তাকে টাকা দিতে বাধ্য করে। এরকম অবিচার যেন আবার না-হয় এবং মক্কার বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতিতে যেন বিরূপ প্রভাব না-আসে, নগর নেতারা সেজন্য একটা চুক্তি করেন। এর নাম হিলফুল ফুদূল (মর্যাদাপূর্ণদের মৈত্রী)। ন্যায্য লেনদেন নিশ্চিত করার জন্য এই চুক্তি। বহিরাগত ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষাও এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রাসূল (সাঃ) তখন যদিও মাত্র ২১ বছরের তরুণ, তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন চুক্তি করার জন্য। বিশিষ্ট গোষ্ঠীপ্রধান আবদুল্লাহ জুদআনের বাড়িতে তারা জড়ো হয়েছিলেন। তিনি সেখানে কেবল পর্যবেক্ষণকারী রূপে ছিলেন না; বরং সেই চুক্তির মুখর সমর্থক ছিলেন।
অনেক দশক পর রাসূল (সাঃ) এ ঘটনার উল্লেখ করে বলেন,
‘আবদুল্লাহ জুদআনের বাড়িতে একটি চুক্তিতে আমি সাক্ষী ছিলাম, ইসলামের সময়ও যদি আমাকে এই চুক্তিতে ডাকা হতো, তাহলে আমি সাড়া দিতাম।’
এই ঘটনা থেকে সমাজের ইস্যুগুলো নিয়ে আমরা চিন্তা করতে শিখি। এর আপনার বয়স বা ভূমিকা রাখার ধরন যা-ই হোক, সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখুন। পরিবর্তনের জন্য আপনার বয়স অনেক কম- বেশী এসব সাতপাঁচ না-ভেবে নিজের ব্যক্তিত্ব বিকশিত করুন। তখন আপনি নিজেই আপনাকে সমাজের উঁচুদের মাঝে খুঁজে পাবেন।
সৃজনশীলতা
সমাজের সমস্যা নিরসনে তিনি সৃজনশীল সমাধান নিয়ে এসেছিলেন। মক্কার গোত্রপতিরা মিলে ঠিক করল কাবাঘর পুননির্মাণ করবে। কিন্তু কালোপাথরটা জায়গামতো রাখা নিয়ে সবার মধ্যে লেগে গেল। কারণ, সবাই এই দুর্লভ সম্মান অর্জন করতে চাচ্ছিলেন। পাথরটি জান্নাত থেকে এসেছে। সেই সময়ের আরবের অনেকে এটাকেও পূজো করত। এখান থেকে তাদের তাওয়াফ শুরু করত। ৬০৫ সালের প্রবল বন্যায় কাবাঘরের কাঠামো নষ্ট হয়ে যায়।
উপায়ন্তর না-পেয়ে তারা রাজি হলো যে, আগামীকাল প্রথম যে লোক পবিত্র হারামে প্রবেশ করবে সে-ই বিচারক হবেন এবং সমস্যা নিয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। রাসূল প্রবেশ করলেন প্রথমে। সে সময়ে রাসূল (সাঃ) এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। সমস্যা সমাধানের জন্য আরবদের কাছে এই বয়স যথেষ্টই কম। এর একচেটিয়া দায়িত্ব ছিল গোত্রনেতাদের। যা হোক, যেহেতু সেই প্রথম হারামে এসেছে তাই তারা রাজি হলেন যে, মুহাম্মাদই সমাধান দিক।
রাসূল (সাঃ) দ্রুত সমাধান করলেন। কালো পাথরটাকে একটা কাপড়ের উপর রাখলেন। এরপর প্রত্যেক গোত্রের একজন প্রতিনিধি কাপড়ের একটা অংশ ধরলেন; মাটি থেকে এক মিটার উঁচুতে। সবাই মিলে কালোপাথরটিকে জায়গায় বসালেন। কন্সট্যানটিন গোর্গুয়ের মতে,
‘মুহাম্মাদ (সাঃ) যেভাবে চিন্তা করেছে সেটা তার সৃজনী ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। তার মধ্যে যদি এ ধরনের ক্ষমতা না থাকত, তাহলে সে নবি হতে পারত না’।
রাসূল (সাঃ) এর সমাধান ছিল সৃজনশীল ও তাৎক্ষণিক। এমন সমস্যা আগে কখনো হয়নি, কারণ এবারই প্রথম মক্কাবাসীরা কাবাঘর সংস্কার করছিল। আর এই বিতণ্ডা পাঁচদিন ধরে চলছিল। রাসূল (সাঃ) যদিও কল্পনা করেননি যে, তিনি এতে জড়িয়ে যাবেন, কিন্তু সৃষ্টিশীল চিন্তার মাধ্যমে জায়গায় দাঁড়িয়েই তিনি সেই সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলেন। এখানেই রাসূল (সাঃ) এর প্রতিভার পরিচয়।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাশীল বিশ্বে সৃজনশীলতা আর বাক্সের বাইরে চিন্তাভাবনা করতে পারে এমন লোকদের কদর ভীষণ। নিয়ত পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় যারা কেবল রুটিন কাজে দক্ষ তারা যে টিকে থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যাদের উদ্ভাবনী চিন্তা ভালো, অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনে যারা নতুন করে ভাবতে পারে, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বর্তমান পৃথিবী তাদের জন্যই।
এ কারণে উদ্ভাবনের ওপর বই ও শিক্ষামূলক ম্যাটেরিয়ালের সংখ্যার বান ছুটেছে। বেশিরভাগ আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির অংশ হয়েছে সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ, ক্রিটিকাল থিংকিং ও উদ্ভাবন।
কীভাবে সৃজনশীল হবেন?
- প্রতিটি বিষয়ের মাঝে নতুন সংযোগ খুঁজুন।
- যা শিখেছেন তা যদি আর না-চলে তাহলে তা রেখে দিন। নতুন কিছু শিখতে তৈরি থাকুন।
- দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে নিজেকে অন্যান্য উদ্ভাবকদের কাতারে রাখুন। তাদের অর্জনগুলো শিখুন।
সংঘাত নিরসন
এ ঘটনায় রাসূল (সাঃ) যা করেছেন, তা সহজ ছিল না। যেকোনো সময়ে এখানে একটা সংঘাত বেধে যেতে পারত। তিনি সেটা থামিয়েছেন। পাঁচদিন ধরে এই বিতণ্ডা চলছিল। যেকোনো মুহূর্তে তা সহিংসতায় রূপ নিতে পারত। (অধ্যায় তিন থেকে স্মরণ করুন, কাবাঘরের নিয়ন্ত্রণ কে নেবে এটা নিয়ে কুসাই গোষ্ঠী কিন্তু যুদ্ধে লাগার অবস্থায় চলে গিয়েছিল। অনুরূপভাবে, অতীতে গোষ্ঠী লড়াই প্রায়ই হতো। তবে যারা স্মার্ট সমাধান দিতে পারতেন, তারা চাইলে এগুলো বন্ধ করতে পারতেন)। রাসূল (সাঃ) সেই সংঘাতের স্মার্ট সমাধান দিয়েছিলেন।
কীভাবে সংঘাত নিরসন করবেন?
- সহযোগিতা: এমন সমাধান দিতে হবে যা সবাই মেনে নেয় (যেমন কাবাঘরে কালো পাথর রাখা নিয়ে রাসূল (সাঃ) যে সমাধান দিয়েছিলেন)।
- ছাড় দেওয়া: মীমাংসায় পৌছানোর জন্য সব পক্ষকে কিছু না কিছু ছাড় দেওয়াতে রাজি করাতে হবে।
- পারস্পরিক অর্জন: কোনোকিছুতে লাভ হবে। এটা আপনি যেভাবে বুঝেছেন বা দেখেছেন সেভাবে অন্যদেরকে বুঝিয়ে আশ্বস্ত করুন।
- স্বীকার করা: হাতের সমস্যাটা উপেক্ষা করবেন না বা ফেলে রাখবেন না। খুব তুচ্ছ বা সামান্য বিতণ্ডা হলে ভিন্ন কথা।
কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে সংঘাত নিরসন এখন এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতায় পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের মানবিক ও অর্থনৈতিক খরচ অনেক অনেক বেশি। কিন্তু মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়। কাজেই অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে যেসব লোক সংঘাত নিরসনে দক্ষ তাদের কদর আজ অনেক।
কাজ
বহুদিন ধরে রাসূল (সাঃ) ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেছেন। রাখাল জীবনে সমাজের যেসব নোংরা জিনিস তাকে দেখতে হয়নি, ব্যবসায়ী জীবনে এসে তা প্রতিদিন দেখতে হয়েছে। প্রতারণা, লোক-ঠকানো, নিজের স্বার্থ উদ্ধারে অন্যকে ব্যবহার। এ রকম কত কী।
কিন্তু তাই বলে রাসূল (সাঃ) ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। আবার সমাজের মূলধারার সাথে মিশেও যাননি। সমাজের বিবেকহীন চর্চায় লিপ্ত হননি; বরং তিনি ব্যবসার ভালো দিকটাতে নজর দিয়েছেন। খারাপ থেকে দূরে থেকেছেন। আল-সাইব নামক সৎ ব্যবসায়ীর সাথে সফল ব্যবসায়িক জুটি গড়ে তুলেছেন। নিজের পণ্যের খারাপ দিকে তিনি অবলীলায় বলে দিতেন। এ ব্যাপারে তাঁর সুনাম ছিল। দাম নিয়ে বাদানুবাদ করতেন না। রাসূল (সাঃ) আল-সাইবের কাছ থেকে শিখেছেন দুর্নীতির হাতছানি যে-সমাজে সুলভ, সেখানেও কীভাবে সৎভাবে জীবিকা উপার্জন করা যায়।
ব্যবসায় রাসূল (সাঃ) এর বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে, সফল নারীব্যবসায়ী খাদিজা তাঁকে তার হয়ে ব্যবসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে তাঁর মালামাল সিরিয়াতে বিক্রয় করতে হবে। রাসূল (সাঃ) রাজি হয়েছিলেন। তিনি সিরিয়া থেকে ভালো লাভ করেন। যেটা তাঁর সততা এবং কেনাবেচায় তাঁর দক্ষতার প্রমাণ দেয়। যে-কারণে খাদিজা প্রতি কাফেলা যাত্রায় তাঁর কমিশন বাড়িয়ে দেন ১৬শ দিরহাম পর্যন্ত। ২০-২৫ বছর বয়সী কারও জন্য এটা খুবই আকর্ষণীয় কমিশন ছিল। সে সময়ে পরোটার দাম ছিল ৬ দিরহাম। উটের জিন ১৩ দিরহাম, ভেড়া ৪০ দিরহাম। উট ৪০০ দিরহাম। ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য ব্যবসায়ীর প্রয়োজন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া, দূরদৃষ্টি, অন্যকে অশ্বিস্ত করার সামর্থ্য। এগুলো সবই রাসূল (সাঃ) এর ছিল।
নিজের সমাজের সাথে মিশুন
সমাজের সুযোগ সুবিধাগুলো থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। মানুষের সাথে মিশুন। পরিবেশ ভালো না, এমন অভিযোগ করে দূরে পড়ে থাকবেন না। আপনি আপনার নিজের উন্নতির জন্য উদ্ভাবনীমূলক উপায় খুঁজুন। নিজের উদ্যোগে যতটুকু পারুন আশপাশ বদলে দিন। রাসূল (সাঃ) বাজার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হননি। আবার তাতে ডুবেও যাননি; বরং তিনি তাঁর আদর্শ বজায় রেখেছেন। চলাফেরার জন্য তাঁর মতো মানুষ পেয়েছেন।
বন্ধুবান্ধব
খুব সতর্কতার সাথে রাসূল (সাঃ) তাঁর বন্ধুদের বাছাই করেছেন। সুশিক্ষিত শ্রদ্ধাবান লোকদের বন্ধু হয়েছেন। আমরা এখন রাসূল (সাঃ) এর কিছু বন্ধুবান্ধবদের নিচে তুলে ধরব-
- আবু বকর আস-সিদ্দীক: তিনি কখনো মদ খাননি। মূর্তিপূজা করেননি। তারপরও তিনি সামাজিক ছিলেন। সমাজে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
- হাকিম ইব্ন হিযাম বুদ্ধিমান: দানশীল নেতা যিনি হাজিদের মেহমানদারি করতেন।
- জাব্রা আর-রুমি: সুশিক্ষিত, বহুভাষী খ্রিষ্টান, ধর্মগ্রন্থের প্রতি জ্ঞানের ব্যাপারে যিনি জ্ঞানী ছিলেন। আগেই বলেছি, আল্লাহ তায়ালা তার ব্যাপারে বলেন, তারা বলে, নবিকে তো কেবল একটা লোক এসব শেখায়। আন নাহল : ১০৩
রাসূল (সাঃ) আরব, বিদেশি, মূর্তিপূজারি ও খ্রিষ্টানদের সাথে মিশেছেন। বিভিন্ন বয়সী বন্ধু ছিল তাঁর। যেমন হাকিম তাঁর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিল। আবু বকর ছিল দুবছর ছোট। তাঁর বন্ধুবান্ধব সবাই ছিল সম্মানিত ও ভালো মানুষ।
কাদেরকে বন্ধু বানাবেন সে ব্যাপারে বিচক্ষণ হোন। ভালো লোকদের ভালোভাবে চিনুন। আজকাল বন্ধুবান্ধব বানানোর বিষয়টা বদলে গেছে। মূল আকর্ষণ একই আগ্রহের লোকদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি ফেইসবুক, টুইটার আর লিঙ্কড় ইনের মতো সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো। একজনকে বন্ধু বানালে আরও দশজন বন্ধু হওয়ার দরজা খুলে যায় এখানে। কার সাথে প্রথম দেখা হচ্ছে- শুধু এটাই চ্যালেঞ্জ না। সে যে তার সাথে করে আরও বড় নেটওয়ার্ক নিয়ে আসছে সেটাও চ্যালেঞ্জ। সুতরাং সতর্কতার সাথে আপনার নেটওয়ার্ক বাছাই করুন।
বন্ধু নির্বাচনের সময় যা খেয়াল রাখবেন
- বৈচিত্র্য আনুন। শুধু নিজের বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকবেন না।
- সম্পর্ক বাড়ান। প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যে ভালো-খারাপ সময় যায়। সম্পর্ক বেশি হলে খারাপ সময়ে একাকী মনে হবে না নিজেকে।
- কারও সাথে বন্ধুত্ব রিভিউ করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন এই বন্ধুত্বের কারণে আমি কি আগের চেয়ে ভালো হচ্ছি?
বিয়ে ও পরিবার
আমরা এখন রাসূল (সাঃ) এর বিবাহিত জীবন নিয়ে কথা বলব। মুসলিম পাঠকদের কাছে বিষয়গুলো তুলে ধরব। তবে আমরা এখানে দেখব তাঁর বিবাহিত জীবনের কোন কোন দিকগুলো আমাদের বৈবাহিক জীবনে অনুপ্রেরণা দিতে পারে। সম্পর্কে অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের বিয়েতে স্পার্ক আনতে পারি।
বিয়ের সময় রাসূল (সাঃ) এর বয়স ছিল ২৫। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর বয়স প্রায় ৪০। এরপরও তিনি আকর্ষণীয় ছিলেন। সমাজে সম্মানিত ছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সফল নারী ব্যবসায়ী ছিলেন।
দাদার বাড়িতে রাসূল (সাঃ) দুবছর কাটিয়েছিলেন। ১৭ বছর কাটিয়েছেন চাচার বাসায়। আর বিয়ের পর ২৮ বছর তিনি তাঁর স্ত্রীর বাড়িতে ছিলেন। ৫৩ বছর বয়সে যখন তিনি হিজরত করেন তখন এই বাসা ছাড়েন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর জীবনে যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ থেকে তা বুঝা যায়।
১৯৮৯ সালে খনন করার কারণে, আমরা এখন খাদিজার বাড়ির বিস্তারিত জানি। এক তলা বাড়ি। দুটো বেডরুম। রাসূল (সাঃ) আর তাঁর স্ত্রীর জন্য ২০ ফুট বাই ১৩ ফুট মাস্টার বেডরুম। ২৩ ফুট বাই ১৩ ফুটের আরেকটা বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য। ৩০ ফুট বাই ১৩ ফুটের আরেকটা রুম ছিল অতিথিদের জন্য। সবচেয়ে বড় রুমটা ছিল ৫২ ফুট বাই ২৩ ফুট। ওটা ছিল খাদিজার ব্যবসায়িক মালামাল রাখার জায়গা। রাসূল (সাঃ) ও সেখানে তাঁর মূল্যবান জিনিসপত্র রাখতেন হয়ত।
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর বাসায় ২৮ বছর থাকা অবস্থাতেই তাঁর বেশিরভাগ সন্তানের জন্ম হয়। প্রথম অহী তিনি এখানেই পান। তবে নিজের সন্তান হওয়ার আগেই রাসূল (সাঃ) কে কিন্তু সন্তান পালনের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এর আগে খাদিজার দুবার বিয়ে হয়েছিল। এবং সেখানে তার দুজন ছেলে ছিল। নিজের ছেলের মতো রাসূল (সাঃ) হিন্দকে মানুষ করেছেন। সৎবাবা শুনলে আমাদের সময়ে বাবা নিয়ে যে নেতিবাচক চিত্র মাথায় আসে, তিনি অমনটা ছিলেন না। স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব আর স্ত্রীর অধিকার থেকে তিনি খাদিজার সাথে আচরণ করেননি; বরং ব্যবহার ছিল নিজের পুণ্যগুণে।
বৈবাহিক সম্পর্কের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“তোমাদের মধ্যকার দয়ামমতা ভুলে যেয়ো না”। বাকারা : ২৩৭
দয়াপরবশ হয়েই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূল (সাঃ) এর চাচাতো ভাই আলীকে তাদের সাথে রাখতে রাজি হয়েছিলেন। তিনিও তাকে নিজের ছেলের মতো দেখেছেন। এমনকি ফাতিমার সাথে তার বিয়ে হওয়ার পরও। আলীও তাকে মায়ের মতো দেখেছেন। শাশুড়ির মতো না। শাশুড়ি শব্দটাও আজকাল বেশিরভাগ জায়গায় নেতিবাচক চিত্র দেয়। সুখী বিবাহিত জীবনের রেসিপি হলো ভালোবাসা, সম্মান, পারস্পরিক বুঝাপড়া আর দয়ামায়া।
দম্পত্তিদের মধ্যে ভালো পারস্পরিক বুঝাপড়া সন্তানদের মাঝেও ছড়িয়ে যায়। যখন তারা বিয়ে করে তাদের মধ্যেও এটা কাজ করে। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর স্ত্রী যে-পরিবারে ছিলেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহু তো সে পরিবারেই বড় হয়েছেন। তাদের পরিবারেও ছিল নবি-পরিবারের মতো স্থিতিশীল পরিবেশ। বুঝাপড়া। হাসান ও হুসাইন এমন সুন্দর পরিবেশেই মানুষ হয়েছেন।
হাসান ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন বিয়ে করেছেন, তাদের পরিবারেও ছিল একই চিত্রের প্রতিফলন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক বুঝাপড়া কেবল বারাকাই না, এক অমূল্য উপহার। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, সন্তান থেকে নাতিপুতির মাঝে এই উপহার ছড়িয়ে যায়।
নিচের টেবিল থেকে দেখব কীভাবে আজকালকার দম্পত্তিরা রাসূল (সাঃ) ও খাদিজার বিবাহিত জীবন থেকে শিখতে পারেন, কীভাবে তারা একে অপরের সাথে আচরণ করবেন।
রাসূল (সাঃ) | স্বামী |
রাসূল (সাঃ) ঘরের কাজকর্মে সহযোগিতা করতেন। | স্বামী ঘরের কাজে সাহায্য করুন। এমনটা ভাববেন না যে এতে আপনার পুরুষ পুরুষ ভাব চলে যাবে। |
রাসূল (সাঃ) কিন্তু প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তারপরও সন্তানদের সাথে সম্পর্ক মজবুত করার জন্য অনেক সময় কাটিয়েছেন। | আপনার চাকরি যত চাপেরই হোক না কেন, সন্তানদের সময় দিন। তাদের দেখভালের দায়িত্ব শুধু স্ত্রীর ওপর ছেড়ে দেবেন না। |
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর পরিবার ও আত্মীয়ের প্রতি রাসূ্ল অনেক সহৃদয় ছিলেন। তিনি তার আগের ঘরের সন্তান হিন্দ ও তার বোন হালার দেখভাল করেছেন। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা -এর ভাগ্নে হাকিমের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। | শশুড় বাড়ির আত্মীয়দের সাথে দয়ামায়া রাখুন। আপনি তাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারেন, উপহার দিতে পারেন। ভালো আচরণ করতে পারেন। ইত্যাদি। |
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা | স্ত্রী |
ঘরে তিনি শান্ত ও ভালোবাসাময় পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। আর তাই তো আল্লাহ তাকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, জান্নাতে তার জন্য বিশেষ জায়গা থাকবে। | ঘরে স্বস্তিজনক পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করুন। এটা সবার মধ্যকার সম্পর্ক, মনমানসিকতা আর মেজাজের ওপর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। |
বাসার বাইরে রাসূল (সাঃ) একাকী সময় নিজের জন্য আলাদা সময় কাটাতেন, এটা নিয়ে তিনি সংশয়ী হননি; বরং তাঁকে সহযোগিতা করেছেন। | আপনার স্বামীর প্রয়োজন বুঝুন। তাকে আরও ভালো হতে সাহায্য করুন। স্বামীরও এমন করা উচিত। |
রাসূল (সাঃ) এর পরিবার ও আত্মীয়ের ব্যাপারে তিনিও সহৃদয় ছিলেন। তাঁর চাচাতো ভাই আলী ইব্ন্ আবী তালিবকে নিজের ছেলের মতোই দেখেছেন। | যতটা সম্ভব তার পরিবারের প্রতি সদয় হোন। তার বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করুন। ভালো আচরণ করুন। |
বিশ্বাস ও মূল্যবোধ
আমরা দেখেছি রাসূল (সাঃ) তাঁর সমাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সংঘাত সমাধানে চমৎকার প্রস্তাব দিয়েছেন। বিভিন্ন ধর্ম ও শ্রেণির লোকদের সাথে তিনি বন্ধুত্ব করেছেন। আমরা দেখেছি তিনি ঘরে কেমন ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সাথে। সমাজের চাপে নিজের আদর্শকে জলাঞ্জলি দেননি। নিজের বিশ্বাস নিয়ে তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা! শক্তিশালী মানুষ।
রাসূল (সাঃ) তাঁর সমাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে তাই বলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মবিশ্বাস অন্ধের মতো গ্রহণ করেননি। এমন কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। তিনি মদ খাননি। জুয়া খেলেননি। কুরআন যেমনটা বলেছে তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের পরাকাষ্ঠা। এর ব্যত্যয় ঘটে এমন কিছু করেননি।
আসলে, তাঁর ধর্মবিশ্বাস সেসব সংখ্যালঘু ধার্মিকদের কাছাকাছি ছিল যারা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করত। আবার এটাও কিন্তু অন্ধঅনুকরণের কারণে না। যেমন কিছু মানুষ কৌতূহলবশে অন্যান্য ধর্ম পরখ করে দেখে; বরং কিশোর বয়সে বাহিরা সন্ন্যাসীর সাথে তার সেই কথোপকথন থেকে বুঝা যায়, তখনকার সেই বিশ্বাস বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায় এসেছে।
ধর্মচর্চা
নবি হওয়ার আগে রাসূল (সাঃ) কোনো ধরনের ইবাদত করতেন কিনা সে ব্যাপারে তেমন জানা যায় না। মক্কার একেশ্বরবাদী ও বহুঈশ্বরবাদীরা যেসব উপাসনা করত, তার মধ্যে কিছু ছিল এক। যুগ যুগ ধরে নবি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেসব উপাসনা করতেন সেগুলোরই কিছু রূপ অবশিষ্ট ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল-
- প্রার্থনা: হাঁটুগেড়ে বসা এবং সিজদা করা। একেশ্বরবাদী যাইদ ইব্ন আমর এ ধরনের সিজদা করতেন বলে জানা যায়। সিজদায় তিনি বলতেন, “ইবরাহীম যার কাছে আশ্রয় চাইতেন, আমিও তাঁর কাছে আশ্রয় চাই’।
- উপবাস: কুরাইশরা মুহাররাম মাসের দশ তারিখ উপবাস থাকত।
- হজ্জ: রাসূল (সাঃ) কাবা তাওয়াফ করেছেন। সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে হেঁটেছেন। আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়েছেন। এগুলো সবই হজ্জের অংশ। তবে যেসব ধর্মীয় রীতিগুলো স্পষ্টভাবে কুরাইশদের ছিল, তিনি সেগুলো করেননি।
- নির্জন সময় কাটানো: কুরাইশরা কখনো কখনো নির্জনতায় যেত প্রার্থনা করার জন্য। ইসলামে আসার আগে ওমর ইবনুল খাত্তাব কাবায় যেয়ে নির্জনে সময় কাটাতেন।
যেগুলোকে তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের অংশ দেখেছেন, সেগুলো নিয়েছেন। এগুলো পরে ইসলামে নিয়ে নেওয়া হয়।
চিন্তাভাবনা ও ব্যস্ত জীবন
রাসূল (সাঃ) নিজের জন্য কিছু সময় আলাদা করতেন। পরিবার ও সবার থেকে দূরে, মক্কার প্রান্ত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে এক পর্বত গুহায়। সাথে থাকত শুধু খাবার। সেখানে তিনি প্রতিদিন কী করতেন, তা নিয়ে কোনো রোজনামচা বা ডাইরি নেই। তবে তিনি নিজের ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনা, অনুভূতি নিয়ে ভাবতেন। কখনো কখনো স্থিরদৃষ্টিতে কাবার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
কারণ, অত উঁচু পাহাড় থেকে সহজেই কাবা দেখা যেত। পর্বতগুহাটি হেরা অথবা আলোর পাহাড় নামে পরিচিত। সাগরপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৬২০ মিটার। ছোট একটা ফাটলমুখ দিয়ে গুহায় ঢুকতে হতো। ভেতরে একজন মানুষ দাঁড়ানো তো দূরের কথা, কোনোমতে শুতে পারবে এমন জায়গা। অথচ এমন জায়গাতেই রাসূল (সাঃ) একমাস নাগাদ কাটিয়েছেন। জায়গাটি ছিল নিস্তব্ধ। রাতে আরও বেশি।
নিজের জন্য সময়
ঘুপচি এক গুহায় একাকী দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে থাকা কোনো মজার কাজ বলে বেশিরভাগ লোকেরই মনে হবে না। ঘরে কিংবা মসজিদে নির্জন সময় তা-ও কাটানো যায়। কিন্তু লোকালোয় থেকে এমন জনমানবহীন জায়গায় ভাবাই যায় না এখন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) নিয়মিত তা করেছেন।
একসময় বছরে পুরো এক মাস। ভয় পাননি। একঘেয়ে লাগেনি। কারণ তাঁর মধ্যে গভীর ভাবনায় ডুবে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল।
আজকের যুগে এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ। গোটা দুনিয়া আজ নেটওয়ার্কের আওতায়। এখন একা থাকা মানে কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের ধাঁধানো স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা। চিন্তাভাবনার উদ্দেশ্যে নির্জনে থাকা এর থেকে পুরো আলাদা।
কেউ আবার ভূল বুঝবেন না যে, আপনাদেরকে সমাজ ছেড়ে একঘরে হয়ে যেতে বলা হচ্ছে। রাসূল (সাঃ) বেশ ভালোভাবেই তাঁর সমাজের অংশ ছিলেন। আমরা আগে দেখেছি; বরং, নিজের জন্য নির্জনে কাটানোর সময় বের করুন ভাবনাচিন্তা করার জন্য।
মোবাইল ফোন আমাদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাকে গিলে ফেলেছে। কোথায় নেই সে। গাড়ি দুর্ঘটনার কারণ থেকে শুরু করে মসজিদে সালাতরত অবস্থায় টাং করে বেজে ওঠা। সবজায়গায় সে। গোটা পরিবার এক ছাদের নিচে, কিন্তু সবাই যে যার মতো মুঠোফোন নিয়ে মশগুল।
রাসূল (সাঃ) এর উদাহরণ থেকে অনুপ্রাণিত হোন। কীভাবে তিনি একাকী বা একঘেয়ে না-হয়েও নির্জনতা উপভোগ করেছিলেন। স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের মতো সবধরনের বাগড়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করুন। এরপর কমপক্ষে এক ঘণ্টা ভাবনাচিন্তা করুন। নিজের ভেতরটাকে জানুন।
আমরা এই অধ্যায়ের শেষে চলে এসেছি। আমরা বলেছি কীভাবে তিনি গভীরভাবে সমাজের সাথে জড়িত ছিলেন সমস্যার সমাধানে। খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা -এর সাথে বিয়ের মূল প্রেরণা ছিল মমতা ও দয়া। বলেছি তিনি কেমন স্বাধীনচেতা ও চিন্তাপ্রবণ মানুষ ছিলেন।
নিচের টেবিল আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে রাসূল (সাঃ) এর তরুণ ও যুবক বয়স থেকে আপনি কী কী গুরুত্বপূর্ণ উপকার পেতে পারেন-
যুবক-তরুণ বয়সে রাসূল (সাঃ) এর জীবন থেকে শিক্ষা
রাসূল (সাঃ) এর জীবন | আপনার জীবন |
সমাজ | |
তিনি ইতিবাচক ছিলেন। সমাজে সক্রিয় ছিলেন। সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। যেমন- মর্যাদাবানদের সংঘ’-তে যোগদান। | বয়স যা-ই হোক, ভূমিকা রাখার পরিমাণ যা-ই হোক, ইতিবাচক হোন। উদ্যোগ নিন। |
সমস্যা সমাধানে তিনি ছিলেন বেশ সৃষ্টিশীল যেমনটা আমরা কালো পাথর রাখা নিয়ে দেখেছি। | সৃজনশীল হোন। আপনি যে মহৎ সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন। এটাকে নিচুজ্ঞান করবেন না। |
তিনি ছিলেন খোলা-মনের মানুষ। বিভিন্নজনদের থেকে মর্যাদাবান ও ভদ্র লোকদের সাথে বন্ধু হয়েছেন। | খোলা-মনের হোন। আপনার যোগাযোগের বলয় বাড়ান। যারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে। তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ুন। |
বিয়ে | |
রাসূল (সাঃ) এর সুখী বৈবাহিক জীবনের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক বুঝাপড়া ও মায়ামমতা। | আপনার সঙ্গীর প্রয়োজন ও অনুভূতির কথা বিবেচনা করে বিয়ের জন্য আগান। শুধু অপরের অধিকার ও কর্তব্য ভেবে না। |
রাসূল (সাঃ) | নিজে |
তিনি ভাবনাচিন্তার জন্য নির্জনতা বেছে নিয়েছিলেন। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় জনমানবহীন জায়গায় কাটাতেন। ভাবনাচিন্তা করতেন। | আপনার জীবনের মিশন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করুন। ভাবুন এখন কী অবস্থায় আছেন, আর কী হতে চান। |
.
১. দারুযা, পৃষ্ঠা- ২১১।
২. সালাহি, পৃষ্ঠা- ৪৯।
৩. গর্গিউ, পৃষ্ঠা- ৪১।
৪. দেখুন: গ্যাডওয়েল, বি-ঙ্ক: দ্য পাওয়ার অফ থিঙ্কিং উইদাউট থিঙ্কিং; লেহরার, ইমাজিন: হাউ ক্রিয়েটিভিটি ওয়ার্কস; এক আর্ডেন, দ্য বুক অফ ডুয়িং: এভরিডে অ্যাকটিভিটিস টু আনলক ইয়োর ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড জয়।
৫. রাসূলের ইবাদতের ধরন নিয়ে এখানে বেশিরভাগ তথ্য নেওয়া হয়েছে আরবি ভাষায় লিখিত মুহাম্মাদ ইয্যাত দারুযা’র দ্য এজ অফ দ্য প্রফেট (সাঃ) অ্যান্ড হিজ এনভায়রোনমেন্ট বিফোর দ্য মিশন বই থেকে।