তরিতা পুরাণ – ৪০

(চল্লিশ)

ডাইনিং হল-এ লাঞ্চ সেরে বেলা তিনটের সময় অঙ্কুশ গেস্ট হাউসে ফিরে আসছে৷ এমন সময় ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দয়াশঙ্করবাবুর৷ অন্য সময় ভদ্রলোক নিজেই এগিয়ে এসে কথা বলেন৷ কিন্তু, অঙ্কুশ লক্ষ করল, ওকে দেখেও দয়াশঙ্করবাবু না-চেনার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন৷ জয়জিৎ কেমন আছে, তা জানার জন্য অঙ্কুশ নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল, ‘আরে, আপনি এখানে? কখন এলেন?’

‘আজ সকালে৷ আপনি এখানে?’

চট করে তরিতা ম্যাডামের সাবধানবাণী মনে পড়ল অঙ্কুশের৷ ম্যাডাম চন্দ্রভানুবাবুদের সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ রাখতে মানা করেছেন৷ দয়াশঙ্করবাবু এসেছেন মানে… হয়তো চন্দ্রভানুবাবুও এসেছেন৷ সেই কারণে ও বলল, ‘আশ্রমে একটা স্নেকবাইটের কেস হয়েছে৷ তাই ট্রিটমেন্ট করতে এসেছি৷ আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, আমাকে চিনতেও পারছেন না৷’

‘আপনাদের মতো লোকজনকে না চেনাই ভাল৷’

‘কী ব্যাপার বলুন তো? এত রেগে রয়েছেন কেন?’

‘এ আপনি কী করলেন অঙ্কুশবাবু? স্যারকে এ ভাবে বেইজ্জত করলেন?’

গলার ধমকের সুর৷ বুঝতে না পেরে অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলছেন দয়াশঙ্করবাবু, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ চন্দ্রভানুবাবুকে আমি বেইজ্জত করতে যাব কেন?’

‘ন্যাকামি করবেন না মশাই৷ কার কাছ থেকে টাকাপয়সা খাচ্ছেন, আমরা সব জানি৷ খবরের কাগজে স্যারের ছবিটা না ছাপালেই আপনার চলছিল না? জানেন কি, ফরেস্টবাবুরা কাল কঙ্কণদীঘিতে গিয়ে জোর করে দুটো পাইথন আর বাচ্চাগুলোকে তুলে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছেন? স্যারের এগেনস্টে ওরা অ্যাকশনও নেবেন, বলে গেছেন৷ স্যারের কত বড় লস অফ ফেস হল, সে সম্পর্কে আপনার আইডিয়া আছে?’

শুনে চুপ করে রইল অঙ্কুশ৷ কয়েকদিন আগে কথায় কথায় জয়কে ও পাইথনের বাচ্চা হওয়ার খবরটা দিয়ে ছিল৷ এও বলেছিল, উষসীর কাছে ছবি পাওয়া যাবে৷ জয় তা হলে খবরটা ওর কাগজে ছেপেছে৷ তার পরই বোধহয়, জু অথরিটির টনক নড়েছে৷ মনে মনে ওর অপরাধবোধ হতে লাগল৷ ইস, খবরটা ও জয়কে না দিলেই পারত৷ জয় কী লিখেছে, অঙ্কুশ তা জানে না৷ নিশ্চয়ই এমন কিছু লিখেছে, যা চন্দ্রভানুবাবুর মনঃপুত হয়নি৷ রিপোর্টারদের নিয়ে এই মুশকিল৷ খবরগুলো ওরা ইচ্ছেমতো ছাপে৷ নাহ, একবার ফোন করে জয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷ পাইথন দুটো হাতছাড়া হওয়ায় চন্দ্রভানুবাবুর ইগোতে লেগেছে৷ নিশ্চয়ই ওর উপর মারাত্মক খেপে আছেন৷ আত্মসমর্থনের জন্য অঙ্কুশ উত্তর খুঁজতে লাগল৷ চন্দ্রভানুবাবুর পুরো পরিবারের সঙ্গে ওর একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল৷ জয়ের জন্য সেটা নষ্ট হয়ে গেল৷ মুখ শুকনো করে ও বলল, ‘অ্যায়াম সরি দয়াশঙ্করবাবু৷ এর বেশি আর কিছু আমার বলার নেই৷’

ফের হুমকির সুরেই দয়াশঙ্করবাবু বললেন, ‘কনসিকোয়েন্সটা কিন্তু আপনার বান্ধবীকে ফেস করতে হবে৷ ওকে বলে দেবেন, এই অঞ্চলে যেন আর পা না দেন৷ স্যারের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা নেই৷ ইচ্ছে করলে উনি গড়িয়া থেকে উষসী ম্যাডামকে তুলে আনতে পারেন৷’

উষসী যে গড়িয়ায় থাকে, সেটা দয়াশঙ্করবাবু জানলেন কী করে? অঙ্কুশ আন্দাজ করতে পারল না৷ একটা ভয় ওর মনের মধ্যে ছড়িয়ে গেল৷ মেয়েটার যেন কোনও ক্ষতি না হয়ে যায়৷ তরিতা ম্যাডামের শর্তটা মুহূর্তে ভুলে গিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘চন্দ্রভানুবাবু কি এখানে এসেছেন? আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই৷ দোষটা আমার, উষসীর নয়৷’

‘স্যার এখন কারও সঙ্গে দেখা করবেন না৷ ওঁর সামনে আপনার না যাওয়াই ভাল৷ একটা ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি অঙ্কুশবাবু৷ তরিতা বলে ওই মহিলার সংস্পর্শ যত তাড়াতাড়ি ত্যাগ করতে পারেন, ততই আপনার পক্ষে মঙ্গল৷ এর বেশি কিছু আপনাকে বলতে চাই না৷’

কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না দয়াশঙ্করবাবু৷ রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলেন৷ হতভম্ব হয়ে অঙ্কুশ গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল৷ দয়াশঙ্করবাবুর কথাবার্তায় একটা জিনিস ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, তরিতা ম্যাডামের সঙ্গে চন্দ্রভানুবাবুর সম্পর্কটা খুব তিক্ত৷ মাত্র দিনদশেক হল, ও চাকরিতে জয়েন করেছে৷ ম্যাডামের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা এখনও তেমন সহজ হয়নি, যাতে ও বিরোধের কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারে৷ পাখিরালায় আর কেউ নেই, যার কাছে ও কারণটা জানতে পারে৷ এভিএস ইউনিটের যিনি চিফ, অ্যান্টনি গোমস বলে সেই টক্সিকোলজিস্ট ভদ্রলোক দিন তিনেক আগে পাখিরালায় এসেছেন৷ মনে হয়, কারণটা তিনিও জানেন না৷ কাজপাগল মানুষ৷ এখানে আসার আগে মিঃ গোমসকে অঙ্কুশ যতটুকু দেখেছে, তাতে ওর মনে হয় না, এভিএস ইউনিটের বাইরে আর কোনও খবর তিনি রাখেন৷

উষসীর জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল অঙ্কুশের৷ কাল রাতেই উষসী ওকে ফোন করেছিল৷ কথায় কথায় বলল, পাইথনের ডিম থেকে সদ্য বাচ্চা বেরিয়ে আসার একটা ছবি ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফিক একজিবিশনে পাঠাবে৷ ছবিটা ও প্রায় ঘণ্টাতিনেক ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তুলেছিল৷ সেদিন রাতে কঙ্কণদীঘির গেস্ট হাউসে ছবিটা দেখানোর সময় উষসী খুব উচ্ছাসিত গলায় বলেছিল, ‘এই রকম ছবি কোনওদিন তুলতে পারব, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি৷ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ অঙ্কুশদা৷ এটা আমার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট হয়ে থাকবে৷’ কিন্তু সেই ছবিই যে ওর লাইফথ্রেটের কারখ হয়ে দাঁড়াবে, কে জানত? রাতের দিকে একবার উষসীকে ফোনে সাবধান করে দিতে হবে৷ চন্দ্রভানুবাবু জয়ের দিকে হাত বাড়াবেন না৷ ওরা রির্পোটার… ওদের হাত অনেক লম্বা৷ তবুও, পুরো ব্যাপারটা জয়কেও জানিয়ে রাখা উচিত৷ দরকার হলে উষসীকে ও প্রোটেকশন দিতে পারবে৷

‘দাদাবাবু, এখানে দাঁইড়ে আচ যে? মা তোমাকে ডাকচে৷’

পিছন দিকে তাকিয়ে গোলাপিকে দেখে অঙ্কুশের চমক ভাঙল৷ চট করে মন্টুর মায়ের কথা ওর মনে পড়ল৷ অলরেডি এভিএস-এর দশটা ভায়াল মন্টুর মাকে দেওয়া হয়ে গিয়েছে৷ তার পরই অঙ্কুশ লাঞ্চ করতে গিয়েছিল৷ এর মধ্যে মন্টুর মায়ের খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠার কথা৷ চিন্তার অবশ্য কিছু নেই৷ হাতে এখনও গোটা কুড়ি এভিএস ভায়াল রয়েছে৷ চেন্নাইয়ে থাকার সময় স্নেক ইনস্টিটিউটে অঙ্কুশ এ রকম অনেক রোগীর ট্রিটমেন্ট দেখেছে৷ ঠিক সময়ে এভিএস দিতে পারলে, কারও কারও দশটা ভায়ালেই কাজ হয়ে যায়৷ আবার কারও ক্ষেত্রে তিরিশটাও লাগতে পারে৷ সেটা নির্ভর করে, কতক্ষণ পরে রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়েছে বা তার শরীরে কতটা বিষ গেছে, তার উপর৷ কোন সাপ কামড়েছে, সেটাও বিচার্য৷ অঙ্কুশের ধারণা, মন্টুর মাকে সুস্থ করার জন্য আরও গোটা দশেক ভায়াল ইউজ করতে হবে৷

গোলাপিকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘মন্টুর মা ঠিক আছে তো রে?’

‘হ্যাঁ৷ চোক মেলে তাক্যেচে৷ তুমি আমার সনে চলো৷ গিয়ে দেকবে, মাকে দেকার জন্যি কত্তলোগ গেস্ট হাউসের কাচে ভিড় করেচে৷’

গেস্ট হাউসের দিকে কয়েক পা এগোতেই গোলাপি বলল, ‘এট্টু আগে তোমার সনে যে লোগটা কতা কইচেল, সে কঙ্কণদীঘির, না? লোগটা ভাল লয় দাদাবাবু?’

‘কেন রে, কী দেখে বুঝলি?’

‘আরে, দুকুরে আমায় নানা কতা জিজ্ঞেস করচেল৷ কার সনে এয়েচ, কদ্দিন থাকবে? তরিতা মায়ের সঙ্গে আর কে আচে? সক্কালে ভিড়ের মধ্যি তোমাকে কিচেনে দেকেচে বোধয়৷ জিজ্ঞেস করচেল, তরিতা মায়ের সনে তোমার কী সম্পক্ক?’

‘তুই সব বলে দিয়েচিস না কি?’

‘না না৷ তোমার মাতা খারাপ? আমিও মুখ ঝামটা দিয়ে কইলাম, এত্ত খপরে আবনার কী দরগার? সাপের ছোবল খাওয়ার ইচ্চে হয়েচে বুঝি৷ ভাল চান তো, গেস্ট হাউসের দিগে পা বাড়াবেন না৷’ বলে হাসতে লাগল গোলাপি৷

ওর সরল মুখটার দিকে তাকিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘শুনে লোকটা কী বলল?’

‘কী আবার কইবে? সরে পড়ল৷’

‘তুই সবাইকে সাপের ভয় দেখাস বুঝি?’

উত্তর না দিয়ে গোলাপি মিটিমিটি হাসতে লাগল৷ কয়েক মিনিট পর গেস্ট হাউসের সামনে ভিড় দেখে অঙ্কুশ অবাক হয়ে গেল৷ এই কয়েকদিনেই অবশ্য ও টের পেয়েছে, তরিতা ম্যাডাম প্রচণ্ড জনপ্রিয়৷ বিশেষ করে, মেয়েদের কাছে উনি সাক্ষাৎ মা মনসার অবতার৷ ক্যানিংয়ের মনসামেলায় ভিড় সামলানোর জন্য একটা সময় পুলিশ ডাকতে হয়েছিল অর্গানইজারদের৷ সবাই ম্যাডামের আশীর্বাদ নিতে চাইছিল৷ পা ছুঁয়ে প্রণাম করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ এখানেও বোধহয় রটে গিয়েছে, মা তরিতা এসেছেন৷ অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে মন্টুর মাকে উনি ভাল করে দেবেন৷ সেই কারণেই ভক্তরা বাইরে দাঁড়িয়ে৷ দেখে অঙ্কুশ মনে মনে হাসল৷ লোকে যদি তাঁকে ভুল বোঝে, তা হলে কী-ই বা করার আছে তরিতা ম্যাডামের? আর কেউ জানুক বা না জানুক, অঙ্কুশ তো জানে, তরিতা ম্যাডাম কোনও রকম বুজরুকি দেখিয়ে লোকদের প্রতারণা করছেন না৷ উনি বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা করেই মন্টুর মাকে বাঁচিয়ে তুলছেন৷

ভিড় সরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে অঙ্কুশ দেখল, মন্টুর মা বিছানায় উঠে বসেছে৷ দয়াশঙ্করের হুমকির কথা ও ভুলে গেল৷ সকালে এভিএস দেওয়ার সময় ও খুব একটা নিশ্চিত ছিল না, মন্টুর মাকে বাঁচাতে পারবে কি না? তরিতা ম্যাডামের কাছে যে সিরামগুলো ছিল, তা দক্ষিণ ভারতের কোনও একটা কোম্পানির৷ অভিজ্ঞতা থেকে অঙ্কুশ দেখেছে, দক্ষিণ ভারত থেকে নিয়ে আসা এভিএস সবসময় এ অঞ্চলে কাজে লাগে না৷ ওখানে ভিন্ন প্রজাতির সাপের বিষ থেকে সিরাম তৈরি হয়৷ যাক, ওখানকার সিরাম তা হলে মন্টুর মায়ের কাজে লেগেছে৷ আশ্রমের কর্মীরা ধরে ধরে মহিলাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন৷ দেখে অঙ্কুশের মনটা ভাল হয়ে গেল৷

ঘর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর তরিতা ম্যাডাম বললেন, ‘বোসো অঙ্কুশ, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে৷’

উল্টো দিকের সোফায় বসে অঙ্কুশ বলল, ‘বলুন ম্যাডাম৷’

‘আর কয়েকদিন পর চিফ মিনিস্টার আসছেন সজনেখালিতে৷ সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট নিয়ে মিটিং করতে৷ অমরবাবু ওঁর সঙ্গে একটা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে রেখেছেন৷ ওঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য মিনিট পনেরো সময় পাওয়া যাবে৷ আমাদের এভিএস প্রোজেক্ট নিয়ে একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করতে চাই৷ তুমি কি এর মধ্যে তৈরি করে দিতে পারবে? পাঁচ থেকে সাত মিনিটের বেশি সময় যেন না লাগে৷’

‘পারব ম্যাডাম৷ কয়েকটা লেটেস্ট স্ট্যাটিস্টিক্স আমাকে জোগাড় করতে হবে৷’

‘কী ধরনের স্ট্যাটিসটিক্স দরকার তোমার?’

‘তেমন কিছু নয়৷ এই মুহূর্তে আমাদের রাজ্যে স্নেক বাইট কেস-এর সংখ্যা কত? কতজন স্নেক বাইটে মারা যান৷ কেন এভিএস ইউনিট এই রাজ্যে তৈরি করা দরকার?’

‘এ সব ইনফর্মেশন আমার কাছেই আছে৷’

‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের জন্য ম্যাডাম আপনার বাইটও দরকার৷ পাখিরালায় ফিরে কালই কিন্তু আমায় একটু সময় দেবেন৷’

‘আমি চাই, এমনভাবে প্রেজেন্টেশনটা তুমি করো, যাতে চিফ মিনিস্টার ইমপ্রেসড হন৷ তা হলে লাইসেন্স পেতে আমার অসুবিধে হবে না৷ ভাবছি, সিএম-কে আমি রিকোয়েস্ট করব, যাতে ইউনিটের ইনঅগরেশনের সময় উনি হাজির থাকেন৷’

‘ম্যাডাম, ওই সময়টায় পার্লামেন্ট ইলেকশন৷ উনি কি সময় দিতে পারবেন?’

‘দরকার হলে ইনঅগরেশনটা আমরা ওঁর সুবিধেমতো পিছিয়ে দেবো৷ অমরবাবু আছেন৷ ওঁর সঙ্গে চিফ মিনিস্টারের সম্পর্ক খুব ভাল বলে শুনেছি৷ ওঁর পরামর্শমতো এগোব৷’

‘ম্যাডাম, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘কী জানতে চাও, বলো৷’

‘চন্দ্রভানুবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা এত বিটার কেন? সেদিন আপনি আমাকে বললেন, ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা চলবে না৷ আজ চন্দ্রভানুবাবুর পিএ খানিক আগে আমাকে থ্রেট করলেন, আপনার সঙ্গে যাতে কোনও সম্পর্ক না রাখি৷ আমি রিয়েলি কনফিউজড৷’

‘ভয় পেয়ে গেছ না কি?’

‘না ম্যাডাম, ভয় পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷ আমি শুধু কারণটা জানতে চাইছিলাম৷’

‘শুনে রাখো, আমার কাছে তুমি যদ্দিন থাকবে, ওই লোকটা কিন্তু তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না৷ ওর দম্ভ আমি গুঁড়িয়ে দিতে চাই৷ কেন জানো? লোকটা মনে করে, মেয়েরা নিছকই ভোগ্যবস্তু৷ তোমার চন্দ্রভানুবাবু আমাদের প্রোজেক্টটা নানাভাবে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ কাকে যেন বলেওছেন, এই জেলায় কাউকে কিছু করতে হলে আগে ওর আশীর্বাদ নিতে হবে৷ কী স্পর্ধা তুমি ভাবো! লোকটা কে, যে আমাকে ওর পুজো করতে হবে? একটা অশিক্ষিত, গাঁইয়া লোক৷ মাসল আর মানি পাওয়ার দেখিয়ে রাজ করে বেরাচ্ছে৷ ওর সামনে আমাকে হাঁটু গেঁড়ে বসতে হবে?’

‘ম্যাডাম, চন্দ্রভানুবাবু কিন্তু সত্যিই পাওয়ারফুল…’

‘তাতে কিছু আসে যায় না৷ ওর গডফাদার কে, তা আমি জানতে পেরে গেছি৷ ওর গডফাদারকেই আজ আমি এমন চমকাব, যেন বুঝতে পারে, নারীশক্তিকে তাচ্ছিল্য করা উচিত না৷’

‘ম্যাডাম, আপনি ডাইরেক্ট একবার কথা বলুন না, চন্দ্রভানুবাবুর সঙ্গে৷ আপনার সঙ্গে তো ওঁর বিজনেস ইন্টারেস্ট ক্ল্যাশ করছে না৷ তা হলে উনি আপনার প্রোজেক্টে বাগড়া দেবেন কেন? আপনি যদি চান, আমি তা হলে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি৷’

‘কোনও দরকার নেই৷ লোকটাকে নেত্রা হ্যান্ডেল করছে৷ ও-ই ওকে শায়েস্তা করতে পারবে৷ তুমি বরং পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন নিয়ে ভাবো৷’

কথাগুলো বলেই তরিতা ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন৷ সৌজন্য দেখানোর জন্য অঙ্কুশও সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়াল৷ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে তরিতা ম্যাডাম বললেন, ‘আরে, আসল কথাটা তো তোমাকে বলতে ভুলেই গেছি৷ তোমার বড়কাকা তো আমার সঙ্গে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে নেমেছেন৷’

বড়কাকার কথা শুনে অঙ্কুশের ভ্রূ কুঁচকে উঠল৷ ও বলল, ‘কেন বলুন তো?’

‘উনি তোমার এগেনস্টে মামলা করছেন৷ দয়াপুরের যে জমিটা তুমি আমাদের দিয়েছ, সেটা নিয়ে না কি ডিসপিউট আছে৷ জমিটা তোমার নয়৷ জমিটা না কি তোমার ঠাকুরমা সুরভি মিত্র দিয়ে গিয়েছিলেন তোমার বড়কাকাদের৷ বারুইপুর কোর্টে দেবাংশুবাবু বলে একজন ল’ইয়ার আছেন৷ তিনি আমাদের অমরবাবুর পরিচিত৷ ভদ্রলোক আজ এখানে এসেছেন৷ একটু আগে তিনিই খবরটা দিয়ে গেলেন৷’

কথাগুলো বলে তরিতা ম্যাডাম ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ অঙ্কুশ বলল, ‘প্রোপার্টি ভাগ বাঁটোয়ারা হওয়ার পর বড়কাকা এই রকম একটা হুমকি দিয়েছিলেন বলে শুনেছি৷ দেবাংশুবাবুকে আমি চিনি ম্যাডাম৷ জমির দলিলটা ওঁরই তৈরি৷ সেদিন এই দেবাংশুবাবুই সবার সামনে আমার হাতে দলিলটা তুলে দিয়েছিলেন৷ বড়কাকার তা মনঃপূত হয়নি৷’

‘আমি জানি অঙ্কুশ৷ তোমার বড়কাকার ব্যাপারে সব ইনফর্মেশন আমি গোলাপির কাছ থেকে পেয়েছি৷ নেত্রা অলরেডি একবার ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলেছে৷ মামলা কোর্টে ওঠার আগেই উনি যাতে উইথড্র করে নেন, তার ব্যবস্থা নেত্রা করছে৷ সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আমাকে আঙুলটা বেঁকাতে হবে৷ কোর্টে যা-ই হোক না কেন, জমিতে পাঁচিল দেওয়ার কাজ আমি বন্ধ করছি না৷’

‘আপনি চিন্তা করবেন না ম্যাডাম৷ এ মামলা ধোপে টিকবে না৷’

‘শোনো, তোমার বড়কাকা মামলায় পার্টি করেছেন তোমার জেঠামশাইকেও৷ ওদের আমি এমন শিক্ষা দেবো, যাতে দৌড়তে দৌড়তে আমার কাছে আসেন৷’

‘ম্যাডাম, আমার জেঠামশাই কিন্তু বড়কাকার মতো নন৷’

‘জানি৷ উনি জেনুইন ভদ্রলোক৷ রিসেন্টলি উনি মানসিক দিক থেকে খুব ভাল নেই৷ ওঁর নাতি নার্সিং হোমে ভর্তি রয়েছে৷ অসুখটা কী, ডাক্তাররা ধরতে পারছেন না৷’

কথাগুলো বলে তরিতা ম্যাডাম আর দাঁড়ালেন না৷ ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন৷ টিটোর অসুখের কথা শুনে অঙ্কুশ ধপ করে সোফায় বসে পড়ল৷ টিটোর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ওর বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠল৷ বাড়ি থেকে চলে আসার দিন টিটো চিৎকার করে কাঁদছিল, ‘আমি কাকুর সঙ্গে যাব৷ তোমাদের কাছে থাকব না৷ আমাকে ছেড়ে দাও৷’

পিঙ্কি বউদি তখন ঠাস করে ওর গালে চড় মেরেছিল৷ দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে কঠিন মুখে অঙ্কুশ তখন বলেছিল, ‘গোলাপি, গাড়িতে উঠে আয়৷’ সেই টিটো এখন নার্সিং হোমে শুয়ে রয়েছে! বাড়ির কেউ ওকে তা জানানোর প্রয়োজনও মনে করল না!

পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে পিঙ্কি বউদিকে ফোন করল অঙ্কুশ৷ ও প্রান্তে রিঙ হতে হতে কেটে গেল৷ সাবস্ক্রাইবার ইজ নট রেসপন্ডিং ইয়োর কল৷ বার পাঁচেক কথাটা শোনার পর অঙ্কুশ বুঝতে পারল, পিঙ্কি বউদি ইচ্ছে করেই ফোনটা ধরছে না৷ বাধ্য হয়ে ও ফোন করল সৌম্যদাকে৷ বার দুয়েক রিঙ হতেই ও প্রান্ত থেকে সৌম্যদা রূঢ়গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ফোন করেছিস কেন, বল৷ তোর আবার কী দরকার পড়ল আমাদের?’

‘টিটোর কী হয়েছে সৌম্যদা?’

‘তুই জেনে কী করবি অঙ্কুশ? ছেলেটার যা সর্বনাশ করার, তা তো তুই করেই দিয়েছিস৷’

‘টিটো কোন নার্সিং হোমে আছে?’

‘কেন, তুই দেখতে আসবি না কি? না, না তোর আসার দরকার নেই৷ মিত্র ফ্যামিলিতে তুই আর এগজিস্ট করিস না৷ তুই হচ্ছিস বিষ৷ তোর ছায়া দেখাও পাপ৷’

সৌম্যদার কথাগুলোয় ক্রোধ আর ঘৃণা মেশানো৷ তিরের মতো এসে বিঁধছে ওর বুকে৷ তবুও অঙ্কুশ বলল, ‘আমি তোমাদের কী ক্ষতি করেছি সৌম্যদা? এ ভাবে কথা বলছ কেন?’

‘ক্ষতি করিসনি? বুকে হাত দিয়ে কথাটা একবার ভাবিস তো? বড়মাকে দিয়ে দলিলে সই করিয়ে দয়াপুরের জমিটা তুই গাপ করে নিসনি? তোর মতো শয়তানকে আমরা অ্যাদ্দিন চিনতে পারিনি কেন, তা নিয়ে আমরা সবাই এখন আফসোস করি৷ এমনিতে তো এমন ভাব দেখাতিস, সাপ নিয়ে পড়ে আছিস, সংসারের কিছু বুঝিস না৷ নেচার স্টাডির নাম করে আমার ছেলেটারও মাথা খারাপ করে দিয়েছিলি৷ পিসি অনেক আগেই আমাকে সাবধান করেছিল, তোর পাল্লায় পড়ে টিটোটা উচ্ছন্নে যাবে৷ তখন গা করিনি৷ এখন বুঝতে পারছি, কী ভুল করেছি৷ না, না, তুই আর এ তল্লাটেই আর আসবি না৷ তোকে দেখলে কিন্তু নিজেকে আমি সামলাতে পারব না৷ গায়ে হাত উঠে যাবে৷’

কথাগুলো বলেই লাইনটা কেটে দিল সৌম্যদা৷ এই সৌম্যদা আগে ওকে নিয়ে কত গর্ব করত৷ বন্ধুরা এলে ডেকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিত, এ আমার ভাই অঙ্কুশ৷ নামকরা হারপেটোলজিস্ট৷ অনেকেই কথাটার মানে বুঝত না৷ সৌম্যদা তখন বলত, তোর পোষ্যপুত্তুরগুলো একবার দেখা না ভাই৷ সেই মানুষ এই ক’দিনের মধ্যে এত বদলে গেল কী করে? ‘তুই হচ্ছিস বিষ৷ তোর ছায়া দেখাও পাপ৷’ ‘মিত্র ফ্যামিলিতে তুই আর এগজিস্ট করিস না৷’ ‘তোর গায়ে হাত উঠে যাবে৷’ কথাগুলো যতবার মনে পড়ল, ততবারই চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল অঙ্কুশের৷

(একচল্লিশ)

ঝড়খালির রিসর্ট নিয়ে কথা বলার জন্য দুই ছেলেকে কঙ্কণদীঘিতে ডেকেছেন চন্দ্রভানু৷ জমির মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল মন্টু ভক্তা৷ জমি কেনার ব্যাপারে কী কথা বলে এল, সেটা জানার জন্যও মন্টুকে হাজির থাকতে বলেছেন তিনি৷ কোন ছেলের উপর রিসর্টের দায়িত্বটা দেবেন, এখনও মনস্থির করতে পারেননি চন্দ্রভানু৷ তাঁর ইচ্ছে অবশ্য দায়িত্বটা ছোট ছেলে জয়ব্রতকে দেওয়ার৷ কেননা, ওর বউ অহল্যার হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রি আছে৷ ইংরেজি স্কুলে পড়া মেয়ে৷ পড়াশুনো করেছে, দিল্লির কোন এক কলেজে৷ অহল্যা সম্পর্কে ধারণা খানিকটা বদলেছে চন্দ্রভানুর৷ না, মেয়েটার ক্ষমতা আছে৷ নিজের চেষ্টায় ফুড চেন-এর ব্যবসাটাকে ও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ ইদানীং ওকে খানিকটা সমীহ করেন চন্দ্রভানু৷ ব্যবসায়িক আলোচনায় বাড়ির মেয়েদের কোনওদিন অংশ নিতে দেননি চন্দ্রভানু৷ কিন্তু, আজ তিনি দুই পুত্রবধূকেও ডেকেছেন৷ সাগর দ্বীপ থেকে ফেরার পর অনেকটাই তিনি বদলে গিয়েছেন৷

মণি নদীর ঘাটের দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছেন চন্দ্রভানু৷ ওই ঘাটটা হাতের তালুর মতো তাঁর চেনা৷ চল্লিশ বছর আগেও ঘাটের কাছে তখন ছিল ঘন জঙ্গল৷ হরিণদের চারণভূমি৷ কঙ্কণদীঘির ঘাট থেকেই চন্দ্রভানুরা মাছ ধরতে বেরতেন৷ দিশি নৌকোয় চলে যেতেন কোনও খাঁড়ির দিকে৷ কত রকমের মাছ তখন জালে উঠত৷ চিতল, ভেটকি, আমুদি, লোটে, গুরজালি, বোয়াল, তপসে, বেলে৷ ভাগ্য ভাল থাকলে ইলিশও৷ খটির (আড়তদার) মালিকদের সেই মাছ দিয়ে দিন গুজরানের জন্য সামান্য টাকাই জুটত৷ তখন কাঁকড়া শিকারেও যেতেন চন্দ্রভানু দলবল নিয়ে৷ চিতি কাঁকড়া, লাল কাঁকড়া, সমুদ্র কাঁকড়া৷ শুক্লা আর কৃষ্ণপক্ষের পূর্ণিমায় অথবা অমাবস্যায় গাঙ ফুলে উঠত৷ সমুদ্র কাঁকড়া তখন ঝাঁকে ঝাঁকে উপরে উঠে আসত৷ কাঁকড়া ধরার জন্য দোন পাততেন ওঁরা কমোটের চার বেঁধে৷ খটির মালিকের শোষণের বিরুদ্ধে মন বিদ্রোহ করত বটে, কিন্তু তখন ওঁরা ছিলেন নিরুপায়৷ মহেশ্বরজির কৃপা না পেলে হয়তো এখনও অনেকের মতো চন্দ্রভানুকে ওই শোষণের শিকার হয়েই জীবন কাটাতে হত৷

সেইদিনগুলোর কথা ভেবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রভানু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ হয়তো আবার ওই কঠিন দিন গুলোতে ফিরে যেতে হবে৷ সাগর দ্বীপে মহেশ্বরজি সেদিন যা বললেন, তাতে এই আশঙ্কাই তাঁর হচ্ছে৷ ‘তোর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এক নারী৷’ মহেশ্বরজি সাবধান করে দিয়েছেন৷ ‘তাঁর অশুভ প্রভাব তোর উপর পড়তে শুরু করেছে৷ তোর ধন সম্পত্তি সব চলে যাবে চাঁদ৷ পুত্রদের জন্যও তোকে শোক পেতে হবে৷ সনকা ছাড়া তোর পাশে আর কেউ থাকবে না৷ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সনকা যদ্দিন তোর পাশে থাকবে, তদ্দিন অন্তত তোর প্রাণ সংশয় হবে না৷ ও রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে৷’

আশ্রমে মহেশ্বরজির ঘরে তখন তিনি ছাড়া আর ছিলেন সনকা৷ কথাগুলো শুনেই সনকা কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পিতিকারের উপায় কি, কয়ে দিন গুরুজি৷’

‘যে নারীর কথা বলছি, তার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়া৷’

‘কার কতা আবনি কইচেন গুরুজি?’

‘ সে কে, চাঁদ নিশ্চয়ই জানে৷ ধ্যানে না বসলে, আমি তার সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না৷ শোন চাঁদ, তুই যদি লড়াইয়ের রাস্তায় যাস, তা হলে তোকে দীর্ঘ কষ্টভোগ করতে হবে৷ কথাটা কিন্তু মনে রাখিস৷’

সনকা বলে উঠেছিল, ‘আমি জানতুম গুরুজি৷ আবনার লকেট হারিয়ে ফেলল… ত্যাকনই বুঝলুম বেপদ আসচে৷’

‘ওই লকেট চাঁদ হারায়নি সনকা৷ ওই লকেট খসে পড়ে গেছে৷ যদ্দিন থাকার, তদ্দিন চাঁদের গলায় ছিল৷ মন্তরের প্রভাব শেষ হয়ে গেছল৷’

সাগর দ্বীপের আশ্রমে মহেশ্বরজি সেদিন কোনও আশ্বাস দেননি৷ প্রতিকারের জন্য শিবপুজো বা যজ্ঞ করার পরামর্শও দেননি৷ মনে মনে সত্যিই খানিকটা দমে গিয়েছেন চন্দ্রভানু৷ কপালে যা লেখা আছে, তাই হবে৷ বিধির বিধান খণ্ডানোর শক্তি তাঁর নেই৷ এই কথা ভেবেই গুরুজির ঘর থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন৷ কিন্তু খানিক পরে দয়াশঙ্কর এসে চমকে দেওয়ার মতো খবর শুনিয়েছিল৷ দয়াপুরের তরিতা না কি দলবল নিয়ে আশ্রমে এসেছে৷ তাদের মধ্যে অঙ্কুশও আছে৷ দয়াশঙ্কর আরও বলেছিল, ‘স্যার, তরিতা আসলে কে জানেন? মহেশ্বরজির মেয়ে!’

শুনে বিশ্বাস হয়নি চন্দ্রভানুর, ‘তুই ঠিক জানিস?’

‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক স্যার৷ বিশ্বাস না হলে দেবিকাকে ডেকে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন৷’

‘মাগীটা কী কারণে এসেছে, খোঁজ নে তো?’

‘নিচ্ছি স্যার৷’ কথাটা বলেই দয়াশঙ্কর চলে গিয়েছিল৷ আর তার পরই মহেশ্বরজির উপর বিশ্বাসের ভিত নড়ে গিয়েছিল চন্দ্রভানুর৷ প্রায় তিরিশ বছর ধরে তিনি সাগর দ্বীপের এই আশ্রমে আসছেন৷ সবাইকে তিনি চেনেন ৷ হঠাৎই তাঁর মনে পড়ল, দশ বারো বছর আগে মহেশ্বরজির মেয়ের খুব ঘটা করে বিয়ে হয়েছিল৷ বিয়েতে তিনি আসতে পারেননি সেইসময় জাপান চলে যাওয়ায়৷ কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার পুরো খরচটাই তিনি দিয়ে ছিলেন৷ এই তরিতাই তা হলে সেই মেয়ে! এই কারণেই কি গুরুজি তাঁকে ভয় দেখাচ্ছিলেন? নিজের মেয়েকে সাপোর্ট করার জন্য?

পরে দয়াশঙ্কর এসে খবর দিয়েছিল, তরিতা গুরুজির অবৈধ মেয়ে৷ বাপ-মেয়ের সম্পর্ক ভাল নয়৷ তিনি যেদিন সাগর দ্বীপে ছিলেন, সেদিনই কী কারণে রাগারাগি হওয়ায় মাঝরাতে দলবল নিয়ে তরিতা আশ্রম ছেড়ে চলে গিয়েছিল৷ বাপ-মেয়ের মনোমালিন্যের কারণটা দয়াশঙ্কর জানতে পারেনি, এমন ইডিয়েট৷ শুনে চন্দ্রভানুর মনে হয়েছিল, গুরুজিকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে যে মেয়েটা, তার মাথায় নিশ্চয়ই অনেক বড় কারও হাত আছে৷ নাহ, মন্টু ঠিকই বলেছে, এ মেয়েকে সহজভাবে নিলে চলবে না৷

মাঝে একদিন মদ্যপান করতে করতে মন্টুর কাছে তাঁর সন্দেহের কথা বলে ফেলেছিলেন চন্দ্রভানু৷ শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল মন্টু, ‘তোর কি হয়েচে চাঁদ? গুরুজির ওপরও বিশ্বেস রাকতে পারচিস না? এই মতিভ্রম তোর হল কী করে?’

কথাটা আর বাড়াননি চন্দ্রভানু৷ পরে অনেক ভেবে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, এ বার থেকে নিজে যা ভাল বুঝবেন, তাই করবেন৷ সেদিন নতুন কোনও ব্যবসায় নামতে মানা করেছিলেন গুরুজি৷ জল সংক্রান্ত ব্যবসায় প্রচুর লোকসান হতে পারে, বলেছিলেন৷ না, না, গুরুজির কোনও কথাই তিনি মানবেন না৷ কিছুতেই তরিতার কাছে মাথা নোয়াবেন না৷ গুরুজির বয়স হয়ে গিয়েছে৷ আগে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যেত৷ আধ্যাত্মিক শক্তির বলে সেটা তিনি করতে পারতেন৷ কিন্তু, ইদানীং মনে হচ্ছে, গুরুজির ভবিষ্যদ্বাণীতে খানিকটা মতলববাজিও ঢুকে পড়েছে৷ গুরুজিকে যাচাই করার কথা এতদিন চন্দ্রভানু ভাবেননি ৷ অন্ধের মতো তাঁর হাত ধরে চলেছেন৷ আশ্রমের জন্য অকাতরে টাকা দিয়ে গেছেন৷ নাহ, এ বার থেকে বুঝেশুনে চলতে হবে৷ যখন তখন হাত উপুড় করবেন না৷

যত ভাবছেন, গুরুজির উপর সন্দেহটা গাঢ় হচ্ছে৷ গতবার লোকসভা নির্বাচনের আগে উনি নিজেই বলেছিলেন, ‘এ বার তুই দাঁড়াস না চাঁদ৷ তোর গ্রহ নক্ষত্র বিচার করে দেখেছি, তুই জিততে পারবি না৷ পরের বার যাতে তুই টিকিট পাস, আমি দেখব৷’ সরল মনে সে কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ পার্টিসূত্রে তাঁর নিজেরও একটা লবি ছিল দিল্লিতে৷ তাদের কাছে প্রসঙ্গটা আর তখন তোলেনইনি৷ মথুরাপুর কেন্দ্র থেকে গত বার দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন ময়ূরী ভট্টাচার্য বলে এক মহিলা৷ অসাধারণ সুন্দরী, ক্যানিংয়ে তিনি এনজিও চালান৷

সেই মহিলার ইলেকশন ফান্ডের জন্য টাকাও দিয়েছিলেন চন্দ্রভানু৷ নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা একটা সময় ভুলেই গেছিলেন৷ বছরখানেক পর দিল্লিতে জনপথ হোটেলে পার্টির এক বড় নেতা মহেশ ভাগবতের সঙ্গে দেখা৷ হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকসভা ইলেকশনে আপনি দাঁড়ালেন না কেন চন্দ্রভানুবাবু? হাই কমান্ড তো আপনাকে টিকিট দিয়েছিল৷ কিন্তু মহেশ্বরজি তখন বললেন, আপনি না কি ইন্টারেস্টেড নন?’ শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেছিলেন চন্দ্রভানু৷

মনে পড়ছে, সাগর দ্বীপ থেকে ফিরে আসার পর যত তলিয়ে ভাবছেন, ততই সব মনে পড়ছে৷ মহেশ ভাগবত রহস্যময় হাসি হেসে সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘দিল্লিতে এলে মহেশ্বরজি এখন কোথায় ওঠেন, জানেন? ময়ূরী ভট্টাচার্যের বাংলোয়৷ নানা বদনাম রটেছে দু’জনকে নিয়ে৷’ গুরুনিন্দা শোনা মহাপাপ৷ তাই তখন বিশদ শুনতে চাননি চন্দ্রভানু ৷ মনের কোণে স্থানও দেননি সে কথা৷ ভদ্রমহিলাকে পরে বেশ কয়েকবার তিনি দেখেছেন সাগর দ্বীপের আশ্রমে৷ ভাগবত বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলেননি৷ ভদ্রমহিলা শুধু সুন্দরীই নন, সেক্সিও৷ রূপের দেমাকের সঙ্গে মিশেছে ক্ষমতার অহংবোধও৷ গুরুজির পা পিছলে যাওয়ারই কথা৷ তবে, গত পাঁচ বছর মথুরাপুর কেন্দ্রের জন্য ময়ূরী ভট্টাচার্য না কি কিছুই করেননি৷ এমএলএ ঝন্টু কয়াল মাঝে মাঝেই মহিলার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যায়৷ ‘পার্টির বদনাম হয়ে যাচ্ছে দাদা৷ ময়ূরীদিকে ফুটিয়ে দিতে হবে৷ আপনি এ বার ইলেকশনে দাঁড়ান৷ আমরা আপনার পিছনে আছি৷’ কথাগুলো অবশ্য বলে ডোনেশন নিতে আসার সময়৷

দিনের আলো ঝপ করে কমে গেছে৷ মণি নদীর উল্টো দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে আসছে৷ তাদের কলকাকলিতে বাগানের দিকটা সরগরম৷ বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে আসার ফাঁকে চন্দ্রভানু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, ঝন্টুকে মনের ইচ্ছেটা দু’একদিনের মধ্যেই জানিয়ে দেবেন৷ লোকসভা ইলেকশনে এ বার তিনি দাঁড়াবেন৷ দরকার হলে দিল্লিতে গিয়ে হাই কম্যান্ডের নেতাদের টাকা পয়সা খাওয়াবেন৷ তবুও গুরুজির দ্বারস্থ হবেন না৷ না, এই লোকটাকে আর বিশ্বাস করা যায় না৷ দিল্লিতে আমলাদের ঘুষ দিতে হবে বলে একটা সময় প্রচুর টাকা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে গেছেন গুরুজি৷ তার কতটা আমলাদের গর্ভে গেছে, কতটা নিজের, তা নিয়ে এখন সন্দেহটা বাড়ছে চন্দ্রভানুর৷

‘স্যার, মন্টুবাবু এসে গেছেন৷ কনফারেন্স রুমে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন৷’

দরজার বাইরে থেকে কথাগুলো বলল দয়াশঙ্কর৷ শুনে চন্দ্রভানু বললেন, ‘বাকিরা সবাই এসে গেছে?’

‘হ্যাঁ স্যার, সববাই৷’

কথাটা বলেই দয়াশঙ্করের চলে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলবি?’

‘আপনার কথামতো রিপোর্টার জয় সেনগুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম৷’

‘কী বলল সে? রাজি?’

‘সরাসরি সে কথা বলেনি৷ তবে একেবারে উড়িয়েও দেয়নি৷’

‘খবরটা কীভাবে করার কথা ওকে বলেছিস?’

‘আপনি যেভাবে বলেছিলেন স্যার৷ পুরোপুরি অ্যান্টি৷ যাতে পুরো এভিএস প্রোজেক্টটার লাইসেন্স দেওয়ার আগে গভর্মেন্ট দু’বার ভাবে৷’

‘কত টাকা ওকে দিতে হবে, আন্দাজ করতে পারলি?’

‘ভালই৷ হাজার পঞ্চাশ তো মিনিমাম৷ ভদ্রলোক বললেন, চিফ মিনিস্টার যখন সজনেখালিতে আসবেন, তখন উনিও রিপোর্ট করার জন্য আসবেন৷ তখনই সামনাসামনি উনি কথা বলতে চান৷’

‘আমার নামটা ওকে জানিয়েছিস না কি?’

‘না স্যার৷ উনি জানতেও চাননি৷ আমি ভাবছি, সজনেখালিতে আসার আগেই ওকে একবার সোনাখালির ফার্ম হাউসে নিয়ে যাব৷ এক রাত্তির খাতিরদারি করে ওখানেই ধীরেসুস্থে কথা বলে নেব৷ স্যার, পয়সা ছড়ালে এই রিপোর্টারগুলোকে কী না করিয়ে নেওয়া যায়৷’

‘সাবধান৷ ছেলেটা যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে, আমি এর পেছনে আছি৷’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার৷’

‘আরও কী একটা কথা যেন তোকে বলব ভাবছিলাম৷ ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে৷ ঝন্টু কয়ালকে কালই একবার আমার কাছে আসতে বলিস তো? ওর সঙ্গে জরুরী দরকার আছে৷ আজই কথা বলে রাখিস৷’

‘বলব স্যার৷ আমি সিকিউরিটিদের রুমে আছি৷ দরকার হলে ডেকে নেবেন৷’

দয়াশঙ্কর নীচে নেমে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর চন্দ্রভানু কনফারেন্স রুমে এসে ঢুকলেন৷ সিকিউরিটির লোকজন বাইরের লনে বাহারি আলোগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে৷ খুব সুন্দর লাগছে লনটা দেখতে৷ কিন্তু কদ্দিন এই সৌন্দর্য্য বজায় রাখতে পারবেন, কে জানে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দ্রভানু ঘরের ভিতর নজর দিলেন৷ দুই ছেলে, ছেলেদের বউরা আর মন্টু… এই পাঁচজনের থাকার কথা৷ অথচ ঘরে বাড়তি একজনকে চোখে পড়ল তাঁর৷ পরনে ধুতি আর ফুলহাতা শার্ট৷ দেখে মনে হল, দোখনে জেলারই লোক৷ ঝড়খালিরও হতে পারে৷ সম্ভবত মন্টু লোকটাকে নিয়ে এসেছে৷ তিনি চেয়ারে বসার আগে মন্টু বলে উঠল, ‘চাঁদ, তোর সনে একডা কতা আচে৷ এগবার বাইরে চল৷’

চেয়ার থেকে মন্টু উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে৷ একটু অবাক হলেও চন্দ্রভানু ওর পিছু পিছু লনের দিকে বেরিয়ে এলেন৷ কী এমন কথা, যা মন্টু সবার সামনে বলতে চায় না? মন্টু ফিসফিস করে বলল, ‘খবরডা তুই শুনেচিস?’

চন্দ্রভানু বললেন, ‘কী খবরের কথা কইছিস?’

‘হিঙ্গলগঞ্জে তোর ভেড়ির সেই সায়েন্টিস্ট মিঃ রামলিঙ্গম কাল রাতে সুইসাইড করেচেন!’

শুনে খুশি হওয়ারই কথা৷ তবুও, খানিকটা অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে চন্দ্রভানু বললেন, ‘তুই খপরটা পেলি কী করে?’

‘তোর একেনে আসার আগে থানা থেকে রমজান আলি আমায় ফোন করেচিল৷ ওর মুক থেকেই শুনলুম৷’

‘খপরটা জয়গোপালের কানে গেছে?’

‘মনে হয়, না৷ ভেড়ির নোকজন নাকি সারাদিন ফোনে ওর সনে কন্টাক্ট করতে পারেনি৷ আমিও বড় খোকাকে কিচু বলিনি৷’

‘কী অপদার্থ লোকজনকে নিয়ে আমার কারবার দেখেছিস মন্টু৷ ঘটনাটা ঘটেছে আঠারো-কুড়ি ঘণ্টা আগে৷ কেউ আমায় জানানোর প্রয়োজন মনে করল না! তা, কিভাবে সুইসাইড করেছে রামলিঙ্গম?’

‘গলায় দড়ি দে৷ দুকুরে ভেড়ি থেকে লাঞ্চ করার জন্য গেস্ট হাউসে গেসল৷ বিকেলের দিগে আপিসে আর আসেনে৷ রাতের দিকে কে যেন গে দেকে, পাখার সনে ঝুলচে৷’

‘কী এমন হল, মানুষটা সুইসাইড করল? বউয়ের সঙ্গে একটা ঝামেলা চলছিল বলে শুনেছি৷ রাগ করে মাস কয়েক আগে ওর বউ দেশেও চলে গেছিল৷ ইসস… আমার চিংড়ির বিজনেস এ বার তুলে দিতে হবে মন্টু৷ এমন বিশ্বস্ত লোক আমি আর পাব কোথায়? একের পর এক বিপদ, আমি সামলাব কী করে?’

‘আসল বেপদের কতা তো তোকে বলিইনি৷ রমজানের কাচে খপর পে আমি হিঙ্গলগঞ্জ থানার ওসিকে ফোন করেচিলাম৷ পোস্ট মর্টেমের জন্য উনি সগালের দিকে বডি পাঠ্যেচিলেন বসিরহাট আসপাতালে৷ পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলচে, সুইসাইড নয়, মার্ডার৷ আগে গলা টিপে খুন করে, তার পর নাকি রামলিঙ্গমকে পাখার সনে ঝুল্যে দেওয়া হয়েচে৷ ভেড়িতে এসে পুলিশ রমজানকে ধরে নিয়ে গ্যাচে৷’

‘পুলিশ ওকে সন্দেহ করছে না কি?’

‘বুঝলুম না৷ মনে হয়, ইন্টারোগেশনের জন্যি নে গ্যাচে৷’

‘ওসি-র সঙ্গে তুই কথা বল৷ আমি চাই না, ভেড়ির কোনও এমপ্লয়ি এর মধ্যে জড়াক৷ দরকার হলে ওসিকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে তুই ম্যানেজ কর৷’

শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল মন্টু৷ কয়েক সেকেন্ড জরিপ করে নিয়ে বলল, ‘সত্যি করে ক’ তো চাঁদ, মার্ডারটা তুই করাসনি তো?’

শুনে বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গি করলেন চন্দ্রভানু, ‘মার্ডারের কথা উঠছে কেন? এই তো বললি সুইসাইড৷’

‘মার্ডারের কতা কইতাম না৷ কিন্তু মিঃ রামলিঙ্গমের ইস্ত্রী এসে থানায় হত্যে দিয়ে পড়ে আছে৷ সে কইচে, মার্ডার৷ পুলিশ যদি এফআইআর না লেয়…অন্নজল ত্যাগ করবে৷’

‘কার এগেনস্টে এফআইআর করতে চাইছে?’

‘বড় খোকার এগেনস্টে৷’

শুনে এই প্রথমবার চিন্তিত হলেন চন্দ্রভানু৷ রামলিঙ্গম ব্যাটাচ্ছেলে বেশ কিছুদিন ধরে গদ্দারি করছিল৷ জাপানে চিংড়ি রপ্তানীর ব্যবসাটা মার খাওয়ানোর জন্য ওকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল বড় খোকা জয়গোপাল ৷ হায়দরাবাদের কোন এক এক্সপোর্ট কোম্পানির হয়ে ও এই সাবোতাজটা করছিল৷ শুনে চন্দ্রভানু বলেই দিয়েছিলেন, শালাকে পুঁতে দে৷ সেটা করলে ব্যাটাচ্ছেলের কোনও ট্রেসই পাওয়া যেত না৷ খামোকা রমজানরা কেন, ওর ডেডবডি পাখার সঙ্গে ঝুলিয়ে দিতে গেল? একটা কাজও কি ছেলেরা নিখুঁত করতে পারবে না? তিনি না থাকলে এত বড় ব্যবসা ওরা চালাবে কী করে? পুলিশ-টুলিশকে ভয় নেই চন্দ্রভানুর৷ সে তিনি ম্যানেজ করতে পারবেন টাকা পয়সা খাইয়ে৷ দরকার হলে পার্টির ওপরতলার লোকদের দিয়ে পুরো কেস ধামাচাপা দিয়ে দেবেন৷ কিন্তু ভয়, খবরের কাগজের লোকদের নিয়ে৷ এই খুনের কথা যদি কোনও কাগজে বেরিয়ে যায়, আর বড় খোকার নামটা জড়ায়, তা হলে খুব মুশকিল হবে৷ পাইথন কেসটার পর চন্দ্রভানু এই সারসত্যটা বুঝেছেন৷

বড় খোকাকে দু’দিন আগেই কঙ্কণদীঘিতে চলে আসতে বলেছিলেন চন্দ্রভানু৷ এও বলে দিয়েছিলেন, ভেড়ি থেকে আসা কোনও ফোন ও যেন না ধরে৷ ও নিজেও যেন ভেড়ির কোনও এমপ্লয়িকে ফোন না করে৷ সব ঠিকঠাকই চলত৷ রামলিঙ্গমের বউটা হায়দরাবাদ থেকে সাত তাড়াতাড়ি চলে না এলে৷ কিন্তু কে ওর মাথায় ঢোকাল, মার্ডার হয়েছে? তা হলে কি রমজানের লোকজনের মধ্যেই কেউ খবরটা ওকে দিয়েছে? অসম্ভব কিছু নয়৷ ডেডবডিটা যাতে বউ হায়দরাবাদে নিয়ে যেতে না পারে, তার ব্যবস্থা আগে করতে হবে৷ মন্টুর পরামর্শ নেওয়া দরকার৷ চন্দ্রভানু তাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করা যায় বল তো মন্টু?’

‘তোর এত চিন্তা করার কিছু নেই৷’ মন্টু বলল, ‘পুলিশ না কি একডা সুইসাইড নোট পেয়েচে ডেডবডির পকেটে৷ তাতে মিঃ রামলিঙ্গম লিকে গ্যাচে, আমার মিত্যুর জন্যি কেউ দায়ী নয়৷ ওসির সনে আমার কতা হয়ে গ্যাচে৷ ওরা সুইসাইড বলেই চালাবে৷ একন চল, কনফারেন্স রুমে যাই৷ ছোট বউমা তোকে কী যেন কইবে বলে অপেক্ষা করে আচে৷’

বুক থেকে পাথর নেমে গেল চন্দ্রভানুর৷

(বিয়াল্লিশ)

রাগে সর্বশরীর জ্বলছে তরিতার৷ দু’দিন হয়ে গেল, সাগর দ্বীপ থেকে ফিরেছেন৷ মহেশ্বরজির উপর এখনও তাঁর রাগ পড়েনি৷ রোজ সকালে প্রাণায়াম করার অভ্যেস৷ এই সময়টায় নেত্রাও ধারে কাছে আসে না৷ কিন্তু, তরিতা আজও কিছুতেই মনোসংযোগ করতে পারছেন না৷ মহেশ্বরজির হুল ফোটানো কথাগুলো সবসময় মনে পড়ছে৷ এই প্রথম তিনি টের পেলেন, তাঁর পিতৃ পরিচয় কত ঠুনকো৷ মহেশ্বরজির মতো মানুষও তাঁকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছেন৷ তাঁর জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারছেন না৷ মহেশ্বরজির কাছে তরিতা গিয়েছিলেন, এভিএস ইউনিট শুরু করার আগে আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য৷ শোনপুরের মেলা থেকে ঘোড়া কেনার ব্যাপারে সাহায্য চাইতে৷ কিন্তু, সাক্ষাৎকারের শুরুটা এত চড়া সুরে হল যে, সে প্রসঙ্গ তরিতা উত্থাপন করার সুযোগই পেলেন না৷

সেদিন রাতে তরিতা যখন মহেশ্বরজির ঘরে যান, তখন সেখানে সুন্দরী, মাঝবয়সি এক মহিলা বসে৷ গুরুজির পদসেবা করছিলেন তিনি৷ মহিলাকে আগে কখনও তরিতা দেখেননি৷ ঘরে ঢোকার সময়ই তরিতা বুঝতে পারেন, দু’জনের মধ্যে তাঁকে নিয়েই কোনও কথা হচ্ছিল৷ সামনাসামনি হতেই মহেশ্বরজি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি? কী মনে করে?’

সম্ভাষণটা মোটেই ভাল লাগেনি তরিতার৷ মহিলার দিকে একবার তাকিয়ে তার পর তিনি বলেছিলেন, ‘কেন, আমার আসার খবরটা কি আপনাকে কেউ দেয়নি?’

‘দিয়েছিল বোধহয়৷ খেয়াল নেই৷’

 ‘আপনার সঙ্গে একা কথা বলতে চাই৷’

‘একা’ কথাটা মহেশ্বরজির পছন্দ হয়নি৷ উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী ব্যাপারে?’

‘যে ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি, আমি চাই না, সেইসময় অন্য কেউ থাকুক৷’

‘তুমি স্বচ্ছন্দে এর সামনে বলতে পারো৷’ মহিলাকে দেখিয়ে মহেশ্বরজি বলেছিলেন, ‘এর সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়নি বোধহয়৷ এ হচ্ছে ময়ূরী৷ মথুরাপুরের এমপি৷ আর ময়ূরী, তুমি নিশ্চয়ই তরিতার কথা শুনেছ৷ আমার দত্তক মেয়ে৷ এই আশ্রমেই বড় হয়েছে৷ এখন ওফিওলজিস্ট৷’

‘দত্তক’ কথাটা খট করে কানে এসে বিঁধেছিল তরিতার৷ মুহূর্তে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল৷ কী কারণে ক্যানিং থেকে সাগর দ্বীপে এসেছেন, তিনি ভুলে গিয়েছিলেন৷ এই কয়েকদিন আগে অমর মণ্ডলের কাছে ময়ূরী ভট্টাচার্যের নাম তিনি শুনেছেন৷ অমরবাবু বিস্তর নিন্দামন্দ করছিলেন৷ সুন্দরবনের লোকজন কেউ নাকি তাঁর উপর খুশি নন৷ গুরুমা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী৷ সেই সুযোগ নিয়ে এই মহিলা আশ্রমে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন৷ আশ্রমে ঢোকার পর দেবিকা একবার বলেছিল বটে, আপনি এসে আশ্রমের দায়িত্ব নিন৷ কথাটাকে তখন তরিতা পাত্তাই দেননি৷ কিন্তু মহিলার হাবভাব দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, আশ্রমেরও অনেকে ময়ূরীর উপর অসন্তুষ্ট৷

‘মনসা পুজোর জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করছ কেন তরিতা?’ আচমকা প্রশ্নটা করেছিলেন ময়ূরী৷ ‘তোমার মতলবটা কী বলো তো?’

কেউ আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করুক, তরিতা ইদানীং তা পছন্দ করেন না৷ ময়ূরীর মতো মহিলাকে তো সেই সুযোগ দেবেনই না৷ ঘুরে বসে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘তাতে আপনার প্রবলেমটা কী?’

‘আমার কোনও প্রবলেম নেই৷ তবে কী না, বাঁদাবনে যেখানেই যাচ্ছি, আজকাল তোমার হোর্ডিং দেখছি৷ ভোটে দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়েছে না কি?’

ঝাঁঝ মেশানো গলায় তরিতা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ না, সেকরম ইচ্ছে আপাতত নেই৷ তবে ভবিষ্যতে হবে কি না, এখনই বলতে পারছি না৷ অমর মণ্ডলবাবুর মুখে আপনার এনজিও-র অনেক কুকর্মের কথা শুনেছি৷ আপনার আসল মতলবটা কী বলুন তো? এই আশ্রমটাকেও আপনার এনজিও-র সঙ্গে জুড়ে দিতে চান না কি?’

‘ত-রি-তা’৷ রাগে গর্জে উঠেছিলেন মহেশ্বরজি, ‘কাকে কী বলছ? মুখ সামলে কথা বলো৷ জানতেই যখন চাইলে, তখন শুনে রাখো৷ আমি ঠিক করেছি, কনখলে চলে গেলে আশ্রমের সব রেসপন্সিবিলিটি এই ময়ূরীর হাতেই তুলে দিয়ে যাব৷ ও-ই হবে অল ইন অল৷ যাক সে কথা, ময়ূরী যা জানতে চাইছে, আগে তার উত্তর দাও৷ ধম্মে তো তোমার কোনওদিন মতিগতি দেখিনি৷ হঠাৎ মনসা পুজো নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করলে কেন? টাকাই বা তোমায় জোগাচ্ছে কে?’

কথায় ধমকের সুর শুনে তরিতা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘জানতেই যখন চাইছেন, তখন আপনিও শুনে রাখুন৷ কিন্তু কোন কারণটা আগে বলব? রিলিজিয়াস না সোশ্যাল?’

‘হেঁয়ালি করছ না কি? তোমার দুঃসাহস দেখে তরিতা আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি৷ বুঝেছি, তোমাকে বোধহয় অমর মণ্ডল ওস্কাচ্ছে, তাই না? তুমি যা চাইছ, তা কিন্তু হবে না৷’

‘ধমকাবেন না৷ আপনার ধমকের আমি পরোয়া করি না৷ আমিও জানি, আমার বিরুদ্ধে কে আপনাকে উসকে দিয়েছে৷ নিশ্চয়ই চন্দ্রভানু, তাই না? আমিও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেলাম৷ ওকে ধনে প্রাণে মারব৷ আপনি তো ওর গডফাদার৷ দেখি, ওকে বাঁচাতে পারেন কি না?’

‘ওহ, চাঁদের এগেনস্টে কন্সপিরেসিটা তা হলে তুমিই করছ!’

‘করতাম না, যদি না ওই অসভ্য বর্বরটা আমার পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করত৷’

‘কিন্তু ওই লোকটা যদি তোমাকে হেল্প না করে, তা হলে যে তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হবে না, সেটা কি তুমি জানো? এটাই তোমার ভবিতব্য৷’

 ‘আই ডোন্ট কেয়ার৷ আপনাকে বলে যাচ্ছি, ওই লোকটা যতদিন না আমার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসবে, ততদিন আমি ওর ক্ষতি করে যাব৷ আপনি যদি ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন, আমি তা হলে আপনাকেও ছেড়ে দেবো না৷’

তর্কাতর্কিটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তরিতা বসে থাকতে পারেননি৷ উঠে চলে আসছিলেন৷ হঠাৎ সুর পাল্টে মহেশ্বরজি বলে ওঠেন, ‘ময়ূরী, তুমি এখন এসো৷ শুনি, তরিতা একা আমাকে কী বলতে চায়৷’

মহেশ্বরজির চোখে ভয়ের রেখা দেখতে পেয়েছিলেন তরিতা৷ তাই কঠিন গলায় বলেছিলেন, ‘সরি, আপনার সঙ্গে আর কোনও কথা বলতে চাই না৷ আপনি আপনার রক্ষিতাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুন৷ আমি যাচ্ছি৷’ কথাটা বলে মহেশ্বরজির দিকে আর ফিরেও তাকাননি তরিতা৷ আধ ঘণ্টার মধ্যেই দলবল নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন আশ্রম থেকে৷

মনে পড়ছে… সেদিনকার সব কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না তরিতা৷ প্রাণায়ামে আর মন বসছে না৷ জানলা দিয়ে রোদ্দুর এসে পড়েছে বিছানায়৷ দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তরিতা দেখলেন, সাতটা বেজে গেছে৷ বারান্দায় পায়ের শব্দ৷ দরজার বাইরে বোধহয় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে৷ এত সকালে নেত্রা বা গোলাপি ছাড়া কারও আসার কথা নয়৷ আসন ছেড়ে উঠে দরজা খুলে তরিতা দেখলেন, গোলাপি৷ ওর পরনে কম দামের তাঁতের শাড়ি৷ মুখে হালকা প্রসাধন৷ অন্য সময় ওর চুল দু’বেণী করা থাকে৷ আজ হালকা খোপা৷ গোলাপির পায়ে চপ্পল দেখে তরিতা কৌতুক বোধ করলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে কোথাও যাচ্ছিস না কি?’

গোলাপি বলল, ‘বাহ রে৷ কাল তো তুমিই বললে দয়াপুরে চলে যেতে৷’

সঙ্গেসঙ্গে কথাটা মনে পড়ল তরিতার৷ হ্যাঁ, ওকে দয়াপুরে গিয়ে কয়েকটা দিন থাকতে বলেছিলেন বটে৷ ওখানে এভিএস ইউনিটের জন্য অঙ্কুশের কাছ থেকে যে জমিটা পেয়েছেন, তার গায়ে দশ কামরার একটা বাড়ি আছে৷ সেটাকে বাসযোগ্য করে তোলা দরকার৷ জমিতে পাঁচিল দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে করে ফেলেছে অনন্ত৷ এখন বাড়ি রিনোভেশনের কাজ শুরু করে দিয়েছে৷ কলকাতা থেকে একজন ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন এক্সপার্টকে নিয়ে এসেছিলেন অমরবাবু৷ সে না কি কথা দিয়েছে, পুরো বাড়ির ভোল পাল্টে দেবে৷ দেখে তখন কর্পোরেট অফিস বলে মনে হবে৷ সাগর দ্বীপ থেকে ফেরার পরদিনই অঙ্কুশ চলে গিয়েছিল দয়াপুরে৷ রিনোভেশনের কাজে তদারকি করার জন্য৷ ওর খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে ওখানে৷ সেটা শোনার পর তরিতা ডিসিশন নিয়েছেন, আপাতত কয়েকটা দিনের জন্য গোলাপি দয়াপুরে ওর বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকুক৷ রান্নাবান্নার কাজে মাকে সাহায্য করতে পারবে৷

উত্তরটা জানেন, তবুও তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার সঙ্গে যাচ্ছিস রে?’

শুনে লজ্জা লজ্জা মুখ করে গোলাপি বলল, ‘বলাইদা নিয়ে যাচ্চে৷ টাইগার মোড়ে লঞ্চ দাঁড়িয়ে আচে৷’

‘হ্যাঁরে… বলাই ছেলেটা কেমন রে?’

শুনে মুখ নীচু করল গোলাপি৷ কথাটার উত্তর না দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর ও বলল, ‘আমি কিন্তু বেশিদিন ওখানে থাকতে পারব না মা৷ তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হবে৷’

যা বোঝার তরিতা বুঝে গেলেন৷ মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘তোর অঙ্কুশ দাদাবাবুর দিকে খেয়াল রাখিস গোলাপি৷ কোনও কারণে ছেলেটার মন খুব খারাপ৷ তিন-চারদিন পরেই আমি একবার দয়াপুরে যাব৷ তখন সামনাসামনি জিজ্ঞেস করব, কেন?’

‘আমি জানি মা, দাদাবাবুর মন কেন খারাপ?’

শুনে ভ্রূ কোঁচকালেন তরিতা৷ বললেন, ‘তুই জানিস?’

‘হ্যাঁ মা৷ কঙ্কণদীঘির খারাপ লোগটা দাদাবাবুকে ভয় দেকিয়েছে৷ উষসী দিদিমণিকে তুলে নিয়ে আসবে৷’

খারাপ লোকটা মানে নিশ্চয়ই চন্দ্রভানু৷ তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই উষসী দিদিমণিটা কে রে?’

‘দাদাবাবুর সনে বিয়ে হওয়ার কতা ছেল যার৷ গড়িয়ার দিকে থাকে৷ ছবি তোলে৷’

মেয়েটা বোধহয় ফোটোগ্রাফার৷ সে কী এমন করেছে যে, চন্দ্রভানু তার উপরও চটেছে? প্রশ্নটা করতেই গোলাপি বলল, ‘দাদাবাবুর সনে কঙ্কনদীঘিতে গিয়ে উষসী দিদিমণি পাইথনের বাচ্চা হওয়ার ছবি তুলেছেল৷ সেই ছবি কাগজে বেরিয়েচে মা৷ দাদাবাবু সেদিন আমায় বলেছেল, আমার দোষে মেয়েটা বিপদে পড়ে গেল৷ আমি কী করব, গোলাপি বুঝতে পারচি না৷’

‘কী বোকা ছেলে বল তো৷ ও আমাকে বললেও তো পারত৷’

‘সাগর থেকে ফেরার পথে সে কতা আমি বলেছিলাম মা৷ দাদাবাবু বলল, না না, সামান্য ব্যাপারে ম্যাডামকে বিরক্ত করা উচিত হবে না৷’

‘উষসী বলে মেয়েটার ফোন নাম্বার তুই জানিস?’

‘পিঙ্কি বউদিমণির কাচে পাওয়া যাবে৷’

‘পিঙ্কি… মানে অঙ্কুশের বউদি? তার ফোন নাম্বারটা কী?’

‘বাড়ির নাম্বারটা জানি৷ কিন্তু বাড়িতে বউদিমণিকে তুমি এখন পাবে না মা৷ দাদাবাবু বলছেল, টিটো নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েচে৷ এখন তখন অবস্থা৷ ও বাড়িতে দাদাবাবু সবথেকে ভালবাসত টিটোকে৷ দাদাবাবু না কি নার্সিং হোমে যেতে চেয়েচেল৷ কিন্তু টিটোর বাবা যেতে বারণ করে দিয়েচে৷’

শুনে খারাপই লাগল তরিতার৷ বাড়ির লোকেদের উপর রাগ করে অঙ্কুশ যে গ্রামে চলে এসেছে, এ কথা তিনি আগে শুনেছেন গোলাপির কাছ থেকে৷ কিন্তু সম্পর্কটা যে এত তলানিতে পৌঁছেছে, তা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি৷ কথা বলতে বলতে তরিতা দেখতে পেলেন, গেটের সামনে রাস্তার উপর এসে দাঁড়িয়েছে বলাই৷ ওরও পরনে সাদা শার্ট আর জিনসের প্যান্ট৷ ওকে বেশ ধোপদুরস্ত লাগছে৷ গোলাপির জন্য ওকে অপেক্ষা করতে দেখে তরিতা বললেন, ‘তুই এখন যা৷ মোবাইল ফোনটা মনে করে নিয়েছিস তো? দয়াপুরে কী হচ্ছে না হচ্ছে দু’বেলা কিন্তু আমায় খবর দিবি৷’

গড় হয়ে প্রণাম করে গোলাপি বারান্দা থেকে নেমে গেল৷

বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার রাখা আছে৷ তরিতা সেখানে আরাম করে বসলেন৷ সকালবেলায় এই সময়টায় সামনের পুকুরে হাঁস চড়ে বেরায়৷ মাঝে মাঝে মাছ ঘাঁই মেরে জলে বৃত্ত তৈরি করে৷ সারা পুকুর জুড়ে পদ্মফুল ফুটে থাকে৷ আশপাশের বাগানের গাছে নানারকম পাখি এসে বসে৷ দয়াপুরের রিসর্টে মর্নিং ওয়াক করে এসে এইসময়টায় তিনি পাখিদের খাবার খাওয়াতেন৷ খুব সুন্দর কাটত সময়টা৷ ওখানকার মতো বড় নয় সলিটারি ন্যুক৷ অত স্পেস এখানে নেই৷ তবুও, রিসর্টের মালিক গোপালবাবুর কাছে তরিতা একবার প্রস্তাব রেখে ছিলেন৷ কিন্তু গোপালবাবু রাজি হননি৷ বলেছিলেন, ‘এখানে কাকের উৎপাত খুব বেশি৷ পাখিদের খাবার দিলে , সেসব কাকের পেটে যাবে৷’ পরে তরিতা লক্ষ করেছেন, গোপালবাবু বেঠিক কিছু বলেননি৷ পাখিরালায় কাকের সংখ্যা খুব বেশি৷ সাইজেও বেশ বড়৷ কাক তো নয়, মহাকাক৷

বারান্দায় বসেই তরিতা দেখতে পেলেন, ইটের রাস্তা দিয়ে গোলাপি আর বলাই হেঁটে যাচ্ছে টাইগার মোড়ের দিকে৷ গোলাপির কিটব্যাগটা বলাইয়ের কাঁধে৷ দু’জনে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে৷ একটু আগে গোলাপির চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, বলাই সম্পর্কে ওর কত লজ্জা৷ এখন অবশ্য তার লেশমাত্র নেই৷ দু’জনই প্রায় কাঁধে কাঁধে, বেশ মানাবে৷ তরিতা নিশ্চিত, গোলাপির পাত্র নির্বাচনে তিনি কোনও ভুল করেননি৷ এবার যখন তিনি দয়াপুরে যাবেন, তখন নিবারণকে বলবেন, মহেশপুরথেকে ওর ছেলে গণেশকে যেন ডেকে আনে৷ ওদের দু’জনের সামনেই তিনি গোলাপির বিয়ের কথাটা তুলবেন৷ বলাইয়ের বাবা নেই৷ ওর মায়ের সম্মতি আদায় করতে কোনও অসুবিধে হবে না৷ অঘ্রান মাসের মধ্যেই চার হাত এক করে দেওয়ার ইচ্ছে তরিতার৷ তার আগে হারাধন পালাকারকে ডেকে বিয়ের তারিখটা ঠিক করে নেবেন৷ কার মুখে তরিতা যেন শুনেছেন, পালাগান করা ছাড়াও হারাধন যজমানিও করে থাকেন৷

বারান্দায় বসেই তরিতা দেখতে পেলেন, ডাইনিং হলের দিক থেকে নেত্রা এদিকে আসছে৷ পরনে গেরুয়া রঙের সিফনের শাড়ি৷ তাতে কালো পাড়৷ স্নান সেরে নিয়েছে৷ রোজ ভোরবেলায় উঠে ও আগে পুজো আচ্চা করে৷ দিন কে দিন ওকে যোগিনী টাইপের দেখতে হয়ে যাচ্ছে৷ নেত্রার বয়স কত তরিতা জানেন না৷ গাড়োয়ালি মেয়েদের দেখে বয়স বোঝা যায় না৷ দিল্লিতে প্রথম দিন মহেশ্বরজির সঙ্গে আসা নেত্রাকে তিনি যেমনটা দেখেছিলেন, এখনও ও সে রকমই আছে৷ মাঝে কিন্তু পনেরোটা বছর কেটে গেছে৷ নেত্রার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আছে৷ সেটা ও শারীরিক গঠনের জন্যই হোক, অথবা মায়াবিদ্যা জানার কারণেও হতে পারে৷

দূর থেকেই নেত্রা বলল, ‘দিদি, অমরবাবু ফোন করেছেন৷ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান৷’

এই সাত সকালে অমর মণ্ডলের ফোন! নিশ্চয় কোনও খবর দিতে চান৷ আর খবরটা নিশ্চয়ই চন্দ্রভানু সম্পর্কে৷ না হলে নেত্রার মুখটা এমন চকচক করত না৷ তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কঙ্কণদীঘির কোনও খবর না কি?’

বারান্দায় উঠে এসে নেত্রা ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিল৷ ‘হ্যালো’ বলতেই ও প্রান্ত থেকে অমরবাবু বললেন, ‘গুড মর্নিং ম্যাডাম৷ চাঁদের বড় ছেলে জয়গোপালকে পুলিশ কাল অ্যারেস্ট করেছে৷’

‘খবরটা আপনি কার কাছে পেলেন?’

‘পার্টির সোর্সে৷ পুলিশ কঙ্কণদীঘিতে গিয়ে জয়গোপালকে তুলে এনেছে৷ তখন চন্দ্রভানু বাড়িতে৷ টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করতে চেয়েছিল৷ পুলিশ রাজি হয়নি৷’

‘কী কারণে ধরে নিয়ে গেল ?’

‘মার্ডার চার্জ৷ ওদের হিঙ্গলগঞ্জের ভেড়িতে রামলিঙ্গম বলে একজন ম্যানেজার ছিলেন৷ তাঁকে মার্ডার করার জন্য জয়গোপাল না কি সুপারি দিয়েছিল৷ রামলিঙ্গম লোকটা হায়দরাবাদের৷ এ নিয়ে ওখানকার কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছিল গত দু’দিন ধরে৷ অন্ধ্র প্রদেশ গভর্মেন্ট থেকে না কি রিকোয়েস্ট এসেছিল আমাদের চিফ মিনিস্টারের কাছে৷ তারপরই উনি সিআইডি-র উপর দায়িত্বটা দেন৷ চাঁদের পতন শুরু হয়ে গেল মা জননী৷ আপনি দেখে নেবেন৷’

‘চন্দ্রভানু এখন কোথায়?’

‘কলকাতায় আছে৷ পার্টি অফিসে গিয়ে লিডারদের হাতে পায়ে ধরছে৷ যাতে ছেলের জামিনটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়৷ শুনলাম, তাতে কোনও লাভ হয়নি৷ সিএম না কি বলে দিয়েছেন, আইন আইনের পথে চলবে৷ পার্টি কোনও রকম ইন্টারফেয়ার করবে না৷ বসিরহাট কোর্ট জয়গোপালকে তিনদিনের জন্য পুলিশ কাস্টোডিতে পাঠিয়েছে৷ চট করে ছাড়া পাবে বলে মনে হয় না৷’

‘চন্দ্রভানু ওর গডফাদারের কাছে যায়নি?’

‘এখানেও একটা ইন্টারেস্টিং টুইস্ট আছে মা জননী৷ শুনলাম, সাগর দ্বীপ থেকে ফেরার পর থেকেই না কি সনকার মন খুব খারাপ৷ মহেশ্বরজি না কি এ বার বলে দিয়েছেন, চাঁদের দুঃসময় শুরু হয়ে গেছে৷ উনি আরও কিছু নেগেটিভ কথা বলেছেন, যা কি না চাঁদের পছন্দ হয়নি৷ ফেরার পথে ও না কি বলে এসেছে, বুজরুকের আশ্রমে আর কোনওদিন পা দেবে না৷’

‘ওয়ান্ডারফুল’৷ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তরিতা৷ ‘এটাই স্ট্রাইক করার রাইট টাইম অমরবাবু৷ খোঁজ নিন, লোকটাকে ট্রাবলে ফেলার জন্য আমরা কী করতে পারি৷ তা হলে মহেশ্বরজিকেও জব্দ করা যাবে৷ আমি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাই৷ আর কী খবর আছে, বলুন৷’

‘লঞ্চের মালিক বিনোদবাবু আজ জানতে চাইছিলেন, আপনি মনসার ঢিবিতে কবে যাবেন?’

ইউনিটের কাজে রোজ এ দিক সেদিক লোক পাঠাতে হচ্ছে৷ সেই কারণে চবিবশ ঘণ্টার জন্য একটা লঞ্চ ভাড়া করে রেখেছেন তরিতা৷ তার মালিক বিনোদবাবু৷ সাগর দ্বীপ থেকে ফিরে আসার পরদিন বিনোদবাবুকে তরিতা বলে রেখেছিলেন, যে কোনওদিন একবার মনসার টিবিতে যেতে পারেন৷ ওই আইল্যান্ডসটা কোর এরিয়ার মধ্যে পড়ে৷ ফলে আগে থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নিয়ে রাখতে হয়৷ অমর মণ্ডল তার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন ঝন্টু কয়ালকে দিয়ে৷ আসলে মহেশ্বরজির সঙ্গে ঝগড়া করে আসার পর থেকে তরিতা তীব্র তাগিদ অনুভব করছেন একটা দিশা পাওয়ার৷ সেটা দিতে পারেন মা মনসা৷ ওই ঢিবিতে বসে ধ্যান করলে না কি তাঁর দেখা পাওয়া যায়৷

অমরবাবুর প্রশ্নটা শুনে তরিতা বললেন, ‘কাল গেলে কেমন হয় ?’

‘কাল? আপনি যাবেন কী করে? ওয়েদার ফোরকাস্ট কিন্তু খুব খারাপ৷ খবরে শুনলাম, সাগরে মারাত্মক ডিপ্রেশন হয়েছে৷ আগামী দু’তিনদিন ঝড়জল হবে৷ কোস্টাল গার্ডরা লঞ্চ নামাতে মানা করেছে৷’

‘ তা হলে না হয়, আকাশ পরিষ্কার হলে যাব৷ শুনুন, পারলে একবার দয়াপুরে আসুন৷ সজনেখালিতে চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে মিটিং নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে হবে৷’

কথাটা বলেই তরিতার মনে পড়ল, চিফ মিনিস্টারকে এভিএস ইউনিট নিয়ে যে পাওয়ার পয়েন্ট প্রোগ্রামটা তিনি দেখাবেন, সেটা অঙ্কুশ তৈরি করে দিয়ে গেছে৷ তিনি দেখার সময়ই পাননি৷ তাতে চোখ বোলানোর জন্যই, ফোনের লাইনটা ছেড়ে তরিতা তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ঢুকলেন৷

(তেতাল্লিশ)

নিবারণদা বলল, ‘দাদাবাবু, দয়াপুরে এলে এই ঘরডায় মেজকর্তা থাইকতেন৷’

শুনে চমকে উঠল অঙ্কুশ৷ মেজকর্তা মানে ওর বাবা দ্বিজেন মিত্র৷ বড়মায়ের মুখে ও শুনেছে, ওর বাবা সুযোগ পেলেই দয়াপুরের এই বাড়িতে না কি চলে আসতেন৷ বাবা-মা সম্পর্কে বড়মা আর কী বলতেন,সেই স্মৃতি ওর ক্ষীণ হয়ে গেছে৷ বহু বছর পর ওর সামনে কেউ এই প্রসঙ্গ তুলল৷ নিবারণদার কথাটাই রিপিট করল অঙ্কুশ, ‘এই ঘরটায়?’ ওর গলা থেকে বিস্ময় ছিটকে বেরল৷

‘মেজগিন্নি এই ঘরডাই পচন্দ করতেন বেশি৷ দোতলায় দক্ষিণ দিকে, হাওয়া-বাতাস ভরা৷ আয়লার পর থেকে অ্যাদ্দিন ঘরডা বন্ধই ছেল৷ আবনার জন্য খুলে, দু’দিন আগে পরিষ্কার করে রেইকেচি৷ কয়েকডা দিন পর অনন্তকে দিয়ে নতুন করে পলেস্তারা লাগ্গে নেবো৷ এই ঘরেই আবনি থাইকবেন৷’

কথাগুলো বলতে বলতে নিবারণদা দক্ষিণ দিকের জানলাটা খুলে দিল৷ সঙ্গেসঙ্গে দমকা বাতাস এসে ঢুকল৷ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে অঙ্কুশ দেখল, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ৷ আগে ধানিজমি ছিল৷ আয়লার পর বহুদিন চাষবাস হয়নি৷ এখন ঘাস গজিয়ে গেছে৷ কাশ ফুল হাওয়া দুলছে৷ নীচের দিকে তাকিয়ে অঙ্কুশ দেখল, ঘাসের গোড়ায় জল জমে আছে৷ গত কয়েকদিন ধরে রোজই এখানে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে৷ জল জমাটা স্বাভাবিক৷ ঘাসের মধ্যে দিয়ে একটা শাখামুটি সাপকে অঙ্কুশ চলে যেতে দেখল৷ তার মানে এ বাড়িতেও সাপখোপের আস্তানা আছে৷ থাকবে না-ই বা কেন? গত কয়েকটা বছর কেউ এসে এ বাড়িতে থাকেনি যে৷

নিবারণদা বলল, ‘ঘরের চাবি অ্যাদ্দিন আমার কাচেই ছেল দাদাবাবু৷ ছোটকর্তা আমার জেবন হাল্লাক করে দেছলেন চাবির জন্যি৷ আমি দেইনি৷’

ছোটকর্তা মানে বড়কাকা৷ এই বাড়ি আর জমি যাতে ও দখল নিতে না পারে, তার জন্য যিনি মামলা ঠুকেছেন৷ পুজোর পরই বারুইপুর কোর্টে প্রথম হিয়ারিং৷ তরিতা ম্যাডাম অবশ্য বলেছেন, অতদিন অপেক্ষা করতে হবে না৷ তার আগেই বড়কাকাকে উনি যা শিক্ষা দেওয়ার, দিয়ে দেবেন৷ বড়কাকার কথা উঠতেই অঙ্কুশের টিটোর কথা মনে পড়ল৷ গত তিনদিন ওর কোনও খবর পায়নি৷ খবর দেওয়ারও অবশ্য কেউ নেই৷ এক উষসীর কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারত৷ কিন্তু কাল রাতে ওকে ফোন করেও অঙ্কুশ ধরতে পারেনি৷ অঙ্কুশ এখন আছে দয়াপুরের টাইগার ক্যাম্প রিসর্টে৷ ওখান থেকে মাঝে মাঝে ফোনের টাওয়ার পাওয়া যায় না৷ দিনে অন্তত বারতিনেক লিঙ্ক ফেলিওর হয়৷

জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে এ বার অঙ্কুশ ঘরের দিকে তাকাল৷ বার্মিজ টিক-এর একটা বড় পালঙ্ক, খুব সুন্দর কারুকার্য করা৷ একপাশে দুটো আলমারি৷ দেওয়ালে সাঁটানো একটা শো কেস৷ চারটে সিঙ্গল সোফা৷ সব আসবাব বোধহয় অ্যাদ্দিন কোনও কিছু দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল৷ তাই খুব একটা ধুলো জমেনি৷ দেওয়ালে তিনটে কুলুঙ্গি৷ একটার গায়ে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা আছে সিঁদূর দিয়ে৷ কুলুঙ্গিতে কোনও ফোটো রয়ে গেছে৷ ধুলোয় ভরা বলে ফোটোটা কার, অঙ্কুশ বুঝতে পারল না৷ মনে হয়, কোনও ঠাকুর দেবতার৷ মা বোধহয় এখানে এলে ধূপধুনো দিত৷ এই ঘরের ওর জন্মদাত্রী মায়ের স্পর্শ সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে৷ সেটা ভেবে ওর মন নরম হয়ে এল৷ ওকে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে দেখে নিবারণদা বলল, ‘বিজলি বাতির আপিসে কাল গেসলাম দাদাবাবু৷ ওঁরা কইলেন, দু’একদিনের মধ্যি লাইন লাগ্গে দেবেন৷ তকন আর আবনার অসুবিধে হবে না৷’

অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিকের লাইন আছে নিবারণদা?’

‘আচে৷ সেই তকন পয়সা খরচা করে লাইন আনিয়েচিলেন মেজকর্তা৷ পোল বসানোর পুরো ট্যাকা ওনাকে দিতে হয়েচেল৷ মেজকর্তা একা আমাদের গাঁয়ের জন্যি যা করে গেচেন, পঞ্চায়েতও করেনি৷’

‘বাবা এখানে আসতেন কেন গো?’

‘ওনার শউরবাড়ি ছেল যে একেনে৷’

শুনে অঙ্কুশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ বাবার শ্বশুরবাড়ি… মানে ওর মামার বাড়ি দয়াপুরে না কি? কই, কেউ তো ওকে কখনও কিছু বলেননি! ও জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় ছিল সেই বাড়ি?’

‘দয়াপুরে বাজারের কাছে৷ সদানন্দ বসুর বাড়ি৷ উনি জ্ঞানীগুণী মানুষ ছিলেন৷ স্কুলের হেড মাস্টার৷ তেনারই ছোটমেয়ে রাজলক্ষী আবনার মা৷ আবনাদের মিত্তিরবাড়ির কেউ এই বে মানেননি৷ তাই আবনার মা বাপের বাড়িতেই থাইকতেন৷ সেই টানেই তো মেজকর্তা বারবার ছুটে ছুটে আইসতেন দয়াপুরে৷’

‘খুলে বলো তো নিবারণদা৷ আমি তা’লে পিয়ারায় বড় হলাম কী করে?’

‘সে অনেক কতা৷ আবনার যকন একবচর বয়েস, তখন বড়মা দয়াপুরে এসে জোর করে আবনার মায়ের কোল থেকে আবনাকে ছিনিয়ে চইলে যান৷ তকন বড়মায়ের কতাই শেষ কতা৷ গাঁয়ের মুরুবিবরা অনেক চেষ্টা করেচেলেন আটকাবার৷ কিন্তু উনি বললেন, মিত্তির বাড়ির নাতি গাঁয়ে মানুষ হবে না৷’

‘বাবা তখন কিছু বলেননি?’

‘উনি ত্যাখন দয়াপুরে ছিলেন না৷ লাহিড়িবাবুর সনে নেতি ধোপানির ঘাটে গেচিলেন৷ পেরায়ই হেথায় যেতেন৷ ’

‘বাবা ফিরে এসে কিছু করেননি?’

‘কী আর করবেন? বড়মায়ের মুকের ওপর ছেলেরা কেউ কতা বলতেন না যে৷ মেজকর্তার দেকাশুনোর ভার ত্যাকন বড়মা আমার উপর দিইচিলেন৷ সর্বক্ষণ আমি তেনার সনে থাইকতাম৷ এই পোড়া চোকে সব দেইকেচি৷ আবনার মায়ের জেবন খুউব দুখখে কেইটেচে দাদাবাবু৷ অত বড় বাড়ির বউ, সাক্ষাৎ সতী লক্ষী৷ অমন রূপ এই সাতজেলিয়া দ্বীপের আর কারও ছেল না৷ অতচ উনি শউরবাড়ির সুক ভোগ কইরতে পাইরলেন না৷’

‘মা কি কোনওদিনই পিয়ারার বাড়িতে ঢোকেননি?’

‘বড়মা একবার নে যেতে রাজি হইচিলেন৷ কিন্তু, আবনার পিসিরা বাধা দেন৷ ত্যাকনও তাদিগের বে হয়নে৷ একেনে চাষবাসের কাজ সব আমার ঘাড়ে বলে, পেরায়ই আমায় যেইতে হত মিত্তির বাড়িতে৷ কখনও ফসল পৌঁচে দিতে৷ কখনও ট্যাকাপয়সা৷ এমন কী, একানকার পুকুরে সাত-আট কেজির মাছ উটলেও আমাকে তা নিইয়ে যেইতে হত পিয়ারাতে৷ ত্যাখন যাতায়াতের খুউব কষ্ট৷ মাছ কেটে হলুদ মাকিয়ে দিনের দিন নে যেতাম৷ নৌকো কইরে গদখালি৷ ওকেনে এক হাঁটু গদ পেইরিয়ে ডাঙায় উইটতে হত৷ ত্যাকন আবনার পিসিদের যা মূত্তি দেকেচি, একনও তা বদলায়নে৷ দাদাবাবু, আবনার সনে তেনারা যা ব্যাভার করেচেন, তা দেকে আমি আর গোলাপি ঠিগ কইরেচি, আর কোনওদিন মিত্তিরবাড়িতে পা দেবো না৷’

নিবারাণদার মুখে অঙ্কুশ এমন সব কথা শুনছে, যা আগে কেউ কোনওদিন ওকে বলেনি৷ অবশ্য বলার মতো ছিলেনই বা কে? জেঠামশাই আর বড়কাকা ছিলেন ওর কাছে দূর গ্রহের মানুষ৷ বড়মায়ের ছত্রছায়ায় ও মানুষ হয়েছে৷ নরেন্দ্রপুরে স্কুল, কলকাতার কলেজে পড়াশুনো, আর তার পর চেন্নাইতে গিয়ে স্নেক ইনস্টিটিউটে গিয়ে ভর্তি হওয়া৷ মাঝে ছুটিতে পিয়ারায় গেলে হু হু করে দিন কেটে যেত৷ জেঠামশাই ওকে খুবই স্নেহ করতেন৷ কিন্তু কেন জানে না, বড়কাকা ওকে কোনওদিনই পছন্দ করতেন না৷ এমন ভাব দেখাতেন যেন, সাপ-টাপ নিয়ে সময় কাটিয়ে ও জীবনটা নষ্ট করছে৷ এই দলে ছিলেন পিসিরাও৷ কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে এলে ওঁরা কখনও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করতেন না৷ হয়তো বড়মাকে ভয় পেতেন বলে৷ আশ্চর্যের কথা, মিত্তিরবাড়িতে কেউ কিন্তু কখনও ওর সামনে ওর বাবা বা মায়ের প্রসঙ্গ তুলতেন না৷ তার কারণটা এখন স্পষ্ট হচ্ছে নিবারণদার কথায়৷

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে নিবারণদা বলল, ‘কতাটা কখনও কইনি কারও কাচে৷ আবনাকেই কইচি দাদাবাবু৷ বড়মা এগবার এগডা নবরতন হার পাট্টেচিলেন মেজগিন্নিকে৷ সেই সোনার হার আবনার মা কিন্তু নেয়নে৷ আমার হাত দে ফেরত পাটান৷ আমি সেই দামি হার দিইয়ে এইসেচিলাম বড়মায়ের হাতে৷’

কথাটা শুনে অঙ্কুশের মনে পড়ল, সম্পত্তি বাঁটোয়ারার দিন একটা নবরত্ন হারের কথা উকিল দেবেশবাবু বলেছিলেন বটে৷ মা নেয়নি, সেই হারটাই তা’লে বড় মা দিয়ে গেছেন ওর হবুস্ত্রীর জন্য৷ হারটা রাখা আছে বারুইপুরের কোনও এক ব্যাঙ্কের লকারে৷ দেবেশবাবু বলেছিলেন, যে কোনওদিন গিয়ে নিয়ে আসতে৷ কিন্তু, অঙ্কুশ রাখবে কোথায়? ওর নিজেরই তো থাকার জায়গা নেই৷ নবরত্ন হারের থেকেও ওর বেশি কৌতূহল জাগল এটা জানার জন্য যে, ওর বাবা কেন বারবার ছুটে যেতেন নেতি ধোপানিতে? ওই অঞ্চলে লোকবসতি নেই৷ সাপ-খোপে ভর্তি, বিপদসঙ্কুল জায়গা৷ চাঁদ সওদাগরের তৈরি একটা মন্দির ভগ্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে৷ এখন কাউকে সেখানে যেতে দেওয়া হয় না৷ কৌতূহল মেটানোর জন্য অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘নেতিধোপানির ঘাটে বাবা কেন যেতেন নিবারণদা?’

‘কেন, তা লাহিড়িমশায় কইতে পারবে৷ আবনি দয়াপুরে এয়ে রয়েচেন শুনে, উনি আবনার সনে দেকা করতে চাইচিলেন৷ আমি সগালের দিগে আসতে বলেচিলাম৷ এই এলেন বলে৷’

‘এই লাহিড়িমশায় ভদ্রলোক কে?’

‘আবনার বাবার বন্ধু কইতে পারেন৷ লাহিড়িপুরের জমিদার বাড়ির৷ উনারা দু’জনে খুউব নেকাপড়া করতেন৷ এই দেরাজের ভেতর উনাদের অনেক বই-খাতা আচে৷ আমি সব যত্ন করে রেকে দিইচি৷ আবনি খুলে দেকলে, নেশ্চয় বুইতে পাইরবেন৷’

‘আলমারিটা খোলো তো একবার দেখি৷’

পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে নিবারণদা আলমারির দরজা খোলার জন্য এগোতেই সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ শুনে বলে উঠল, ‘নেন দাদাবাবু, লাহিড়িমশায় এসে গিইচেন৷’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রবীণ এক ভদ্রলোক৷ পরনে সাদা ধুতি-পঞ্জাবি৷ পক্ককেশ, শান্ত-সৌম্য চেহারা৷ চোখে চশমা, হাতে ছাতা৷ কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝোলানো৷ বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে৷ ঘরে ঢুকে কয়েকবার লম্বা লম্বা শ্বাস নেওয়ার পর উনি বললেন, ‘অঙ্কুশ, নিবারণের মুখে তোমার অনেক কথা শুনেছি বাবা৷ আমি নগেন লাহিড়ি৷ নিবারণ বলেনি?’

অঙ্কুশ বলল, ‘বলেছে৷ কিন্তু আপনি কষ্ট করে অ্যাদ্দূর আসতে গেলেন কেন কাকাবাবু? খবর দিলে আমিই তো লাহিড়িপুরে চলে যেতে পারতাম ৷’

নগেনবাবু বললেন, ‘নিশ্চয়ই পারতে৷ কিন্তু কথাটা কী জানো, এখন আর বাড়ি থেকে বেরনোর ছুঁতো খুঁজে পাই না৷ বাড়ির লোকগুলো একা কোথাও ছাড়তে চায় না যে৷ বিশেষ করে, আমার এক পুত্রবধূ এ ব্যাপারে সাক্ষাৎ মা চণ্ডী৷ পায়ে পাম্প শু-টা ঢোকালেই রে রে করে ওঠে৷’

কথাগুলো নগেনবাবু এমনভাবে বললেন যে, অঙ্কুশ হো হো করে হেসে উঠল৷ পরক্ষণেই ও আবিষ্কার করল, পিয়ারার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর মাসদুয়েক ও হাসেনি৷ ইস, নিবারণদা ভদ্রলোক সম্পর্কে আগে কিছু বলেনি৷ বললে, ও নগেনবাবুকে দয়াপুরের রিসর্টে ডেকে নিত৷ বেলা দশটা বাজে৷ রোদের তেজ বাড়ছে৷ নগেনবাবু দরদর করে ঘামছেন৷ পকেট থেকে সুগন্ধি রুমাল রের করে উনি একবার মুখ মুছে নিলেন৷ রিসর্টে ডেকে নিলে এসি কামরায় আরাম করে উনি খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারতেন৷ দয়াপুর থেকে লাহিড়িপুর অনেকটা রাস্তা৷ নগেনবাবু এলেন কীভাবে, তা জানার ভীষণ কৌতূহল হল অঙ্কুশের৷ নীচে ভ্যান মেশিন বা অন্য কোনও গাড়ির আওয়াজ ওর কানে আসেনি৷

প্রশ্নটা করতেই নগেনবাবু বললেন, ‘আমার দু’চাকার একটা গাড়ি আছে৷ তা, প্রায় তিরিশ বছরের পুরনো৷ এখনও বাতাস পুরে দিয়ে, প্যাডেল করলেই চোঁ চোঁ করে দৌড়য়, বুঝলে৷ তোমার বাবা দ্বিজেনেরও একটা ছিল৷ আমরা দু’জনে মিলে তখন এই বাঁদাবনে হিচ হাইকিং করে বেড়াতাম৷’

নগেনবাবু সাইকেলের কথা বলছেন৷ উনি একটা সোফায় বসে পড়েছেন৷ অঙ্কুশ দেখতে পেল, দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে নিবারণদার ছেলে গণেশের বউ চামেলি৷ কাল বিকেল বিকেল না কি ওরা মহেশপুর থেকে এসেছে৷ তরিতা ম্যাডাম গোলাপির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন৷ তা নিয়ে কী যেন উনি বলতে চান৷ পাখিরালা থেকে দু’একদিনের মধ্যে উনি দয়াপুরে আসবেন৷ সেই কারণেই গণেশদের আসা৷ চামেলির হাতে দুটো গ্লাস, তাতে আম পানার সরবত৷ ওকে দেখতে পেয়ে নিবারণদা গ্লাস দুটো হাতে নিয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলল৷ তার পর নগেনবাবুকে বলল, ‘আবনাকে কিন্তু দুকুরে আমরা ছাড়চি না লাহিড়িমশায়৷ খাওয়া-দাওয়া করে তাপ্পর যাবেন৷’

নগেনবাবু বললেন, ‘কদ্দিন পর এ বাড়িতে এলাম বল তো নিবারণ?’

‘তা বচর পনেরো তো হবেই৷’

‘সিঁড়ি দিয়ে যখন উঠছিলাম, তখন আমার পা থরথর করে কাঁপছিল৷ উফ, সেদিনটার কথা আমি ভুলতে পারিনি রে…৷’

শুনে নিবারণদা যেন প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘ও সব কতা পরে কইবেন লাহিড়িমশায়৷ আম পানা আগে খেয়ে নেন দিনি৷’

আম পানায় এক চুমুক দিয়ে নগেনবাবু বললেন, ‘নিবারণের মুখে শুনলাম, তুমি না কি এখন থেকে দয়াপুরেই থাকবে৷ বিয়ে-থা করোনি?’

অঙ্কুশ বলল, ‘না কাকাবাবু৷ এখনও করা হয়ে ওঠেনি৷ আপনাকে একটা প্রশ্ন করব? মনে হয়, আপনি উত্তরটা দিতে পারবেন৷ বড়মার মুখে শুনেছি, বাই প্রোফেশন আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার৷ কলকাতার কোনও এক হাসপাতালে চাকরি করতেন৷ তা হলে উনি এখানে পড়ে থাকতেন কেন?’

‘গুড কোশ্চেন৷ জগতে এমন কিছু মানুষ থাকে, যারা হিসেব-নিকেশের বাইরে৷ তোমার বাবাও ছিল এমনই একজন৷ খুব ডিটেলে যেতে চাই না৷ সোজা কথায় বলি, দ্বিজেন প্রথমদিকে এখানে আসত গরিবগুর্বোদের চিকিৎসা করার জন্য৷ পরের দিকে, চাকরি ছেড়ে এখানে থেকে যায় মা মনসার টানে৷ কেন জানি না, ওর ধারণা হয়েছিল, মা মনসা স্বর্গের দেবি ছিলেন না৷ উনি ছিলেন তোমার-আমার মতোই একজন মানুষ৷ সাত-আটশো বছর আগে উনি এই অঞ্চলেই বসবাস করতেন৷’

অবাক হয়ে অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ ওঁর এই ধারণা হয়েছিল কেন কাকাবাবু?’

‘সতী বেহুলাকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখার পর থেকে৷ তুমি কি মনসামঙ্গল কাব্য পড়েছ বাবা?’

‘হ্যাঁ, বিজয় গুপ্তের লেখা পড়েছি৷’

‘তা হলে তুমি বুঝতে পারবে৷ মনসামঙ্গলের শেষ দিকে, সর্প দংশনে মৃত লখিন্দরকে নিয়ে ভেলায় ভাসতে ভাসতে বেহুলা একটা সময় এখানকার নেতি ধোপানির ঘাটে এসে পৌঁছলেন৷ এই নেতি ধোপানি কে, তা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে?’

‘হ্যাঁ, উনি স্বর্গের দেবতাদের পোশাক কাচতেন৷’

‘কারেক্ট৷ তো একদিন বেহুলা দেখলেন, নেতি ধোপানি যখন কাপড় কাচছেন, তখন ছোট্ট ছেলে একটা ছেলে তাঁকে খুব বিরক্ত করছে৷ নিশ্চিন্তে কাজ করার জন্য ছেলেটাকে আছড়ে নেতি ধোপানি মেরে ফেললেন৷ তার পর দিনের শেষে মন্ত্রবলে ফের তাকে বাঁচিয়ে তুলে… চলে গেলেন৷ এটা দেখে বেহুলার মনে হল, ধোপানি ইচ্ছে করলে তাঁর লখিন্দরকেও বাঁচিয়ে তুলতে পারেন৷ তাই তিনি নেতি ধোপানির কাছে হত্যে দিয়ে পড়লেন ৷ পরে কী হয়েছিল, সেটাও নিশ্চয় তুমি জানো৷’

‘ধোপানির পরামর্শমতো বেহুলা নেচে স্বর্গের দেবতাদের সন্তুষ্ট করে লখিন্দরকে বাঁচিয়ে তোলেন৷’

‘ইয়েস৷ এইখানেই দ্বিজেনের মনে খটকা লেগেছিল৷ ওর মনে একটা ভ্যালিড প্রশ্ন জেগেছিল, সুন্দরবনের এই অঞ্চলে দেবতাদের সভায় বেহুলা নাচলেন কীভাবে? দেবতাদের তো থাকার কথা স্বর্গে… মানে হিমালয়ে কৈলাসে৷ আরও একটা কথা৷ নেতি ধোপানি দেবতাদের পোশাক অ্যাদ্দূরে এসে কাচতেন কেন? কৈলাসের কাছাকাছি কি কোনও জায়গা ছিল না?’

অঙ্কুশ বলল, ‘খুউব ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন তো! তার পর কী হল?’

‘প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন চলে আসে৷ চাঁদ সওদাগরের বাস ছিল বর্ধমানের মঙ্গলকোটে৷ দেবতাদের আশীর্বাদেই যদি লখিন্দর বেঁচে উঠে থাকেন, তা হলে তো বেহুলা উজানে উত্তরের দিকে কৈলাসে যাওয়ার চেষ্টা করলেন না কেন ? কেন ভেলা বেয়ে উনি ডাউনস্ট্রিমে চলে এলেন৷ আরেকটা বড় প্রশ্ন, লখিন্দর কি আদৌও সাপের কামড়ে মারা গেছিলেন? কেননা, তাকে যে সাপে কামড়েছিল, সেই কালনাগিনীর তো বিষই নেই৷’

‘বাবা কি এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন?’

‘কিছু কিছু উত্তর নিশ্চয়ই পেয়েছিল৷ এই যেমন, লখিন্দরের মৃত্যুর ব্যাপারটা৷ মঙ্গলকাব্যে যেমন লেখা আছে, লোহার বাসর ঘরে লখিন্দরকে সাপে ছোবল মেরেছিল৷ আসলে উনি সেভাবে মারা যাননি৷ উনি সেন্সলেস হয়ে গেছিলেন৷ রাতের তৃতীয় প্রহরে লখিন্দরের খিদে পেয়েছিল৷ উনি কিছু খেতে চাইলেন বেহুলার কাছে৷ বদ্ধ লোহার ঘরে বেহুলা ওঁর জন্য রান্না করতে লাগলেন৷ আগুন জ্বালানোয় ঘরের ভিতরটা কার্বন ডাইআক্সাইডে ভরে গেছিল৷ লখিন্দর তখন মেঝেতে শুয়ে৷ ফলে নিঃশ্বাসের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড নেওয়ার জন্য উনি মূর্চ্ছিত হয়ে পড়েন৷ তখনই বেহুলা কালনাগিনীকে দেখতে পান এবং ধরে নেন, সে লখিন্দরকে কামড়েছে৷’

‘বাবা কি ওঁর ফাইন্ডিংস লিখে রেখে গেছেন?’

‘গুছিয়ে সব লিখতে পেরেছিলেন কি না জানি না৷ তার আগেই তো ওই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল৷’

‘কোন দুর্ঘটনা কাকাবাবু?’

‘দ্বিজেনের কাছে চিকিৎসা করানোর জন্য তখন দূরদূরান্ত থেকে পেসেন্টরা আসত৷ রাতে তারা তাঁবু খাটিয়ে গাছতলায় শুয়ে থাকত৷ একরাতে ডাকাতের দল রোগী দেখানোর নাম করে এই বাড়িতে ঢুকে সব তছনছ করে দিয়ে চলে গেল বাবা৷ রাজলক্ষী বউঠান তখন সাত মাসের প্রেগনেন্ট৷ ডাকাতের সর্দার পালান তাকে লাথি মেরে দোতলা থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিল৷ নীচের উঠোনটায় রক্তের বন্যা বয়ে গেছিল বাবা৷ তারপর গর্ভপাত এবং তোমার মা মারা যান৷ তোমার বাবা বাধা দিতে গিয়েছিল৷ তাকেও ওরা গুলি করে মেরে ফেলে৷’

কথাগুলো বলার সময় নগেনকাকার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল৷ চশমা খুলে রুমাল দিয়ে উনি চোখ মুছতে লাগলেন৷ পালান সর্দারের নামটা শুনে অঙ্কুশ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল! এই লোকটাকে ও নিজের চোখে দেখে এসেছে৷ এই লোকটাকেই তো ওর লেখায় জয় রবিনহুড বানিয়ে দিয়েছিল!

(চুয়াল্লিশ)

 সন্ধে হয় হয়৷ বসিরহাট জেলের ফটকের কাছে চন্দ্রভানু তাঁর স্করপিয়ো গাড়ির ভেতর বসে আছেন৷ মন্টু আর দয়াশঙ্কর বইিরে দাঁড়িয়ে৷ প্রায় আধঘণ্টা ধরে তিনজনই অপেক্ষা করছেন জয়গোপালের জন্য৷ বড় খোকার জেল কাস্টোডি হয়েছে পনেরো দিনের৷ কোর্ট থেকে ওকে নিয়ে আসা হচ্ছে জেলে৷ কোর্ট থেকে জেলের দূরত্ব এমন কিছু নয়৷ বোধহয় কাগজপত্তর তৈরি হতে সময় লাগছে৷ কলকাতা থেকে আজ এক নামী ক্রিমিনাল ল’ইয়ারকে চন্দ্রভানু বসিরহাটে নিয়ে এসেছিলেন৷ তাঁর নাম বিমল মুখার্জি৷ তবুও, জয়গোপালের জামিন করানো সম্ভব হয়নি৷ তার মানে আগামী দু’হপ্তা বড় খোকাকে জেলে চোর-চোট্টাদের সঙ্গে কাটাতে হবে৷ কথাটা ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে চন্দ্রভানুর৷ এমন একটা দিন যে তাঁর জীবনে আসবে, তিনি ভাবতেও পারেননি৷

রাগে ফুঁসছেন চন্দ্রভানু৷ কাঠগড়ায় জয়গোপালের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা যতবার তাঁর মনে পড়ছে, ততবারই রমজানের উপর রাগ ফেটে পড়ছে৷ শূয়ারটা পুলিশকে বলে দিয়েছে, রামলিঙ্গমকে খুন করতে বলেছিল জয়গোপাল৷ বিমল মুখার্জি অবশ্য বলে গেলেন, শুধু অভিযোগ করলেই তো হবে না৷ পুলিশকে প্রমাখ করতে হবে, খুন করতে বলার পিছনে কোনও মোটিভ ছিল৷ কয়েকজন সাদীও জোগাড় করতে হবে৷ উকিলবাবু আরও বলে গেলেন, মার্ডার চার্জের আসামীর না কি চট করে জামিন হয় না৷ বিমলবাবুর কাছে বড় খোকা নিশ্চয়ই কথাটা শুনেছে৷ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দরদর করে ও ঘামছিল৷ মাত্র তিনদিনেই যে কারও চেহারার এত পরিবর্তন হতে পারে, চন্দ্রভানু নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করতেন না৷ ভাগ্যিস, সনকা বা বড় বউমাকে সঙ্গে আনেননি৷ কাঠগড়ায় বড় খোকাকে এই অবস্থায় দেখলে ওরা সহ্য করতে পারত না৷

জেল চত্বরে আলো জ্বলে উঠেছে৷ চন্দ্রভানু দেখতে পেলেন, একটা পুলিশের ভ্যান এসে দাঁড়াল মূল ফটকের সামনে৷ একে একে আসামীরা নেমে আসছে ভ্যান থেকে৷ তাদের মধ্যে জয়গোপালও আছে৷ মন্টু ওর সঙ্গে কথা বলছে৷ রমজানও এক পলক দেখা দিয়ে ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ তার মানে… একই জেলে বড় খোকার সঙ্গে রমজানও থাকবে৷ ভাবতেই গা রি রি করে উঠল চন্দ্রভানুর৷ শুয়ারের বাচ্চাটা রাজসাক্ষী হয়ে যাবে বলে মনে হয়৷ দয়াশঙ্করের মাধ্যমে ওর বউকে অবশ্য একটা প্রোপোজাল দেওয়া হয়েছে৷ সেটা যদি রমজান না মানে, তা হলে ফিরে এসে ওর পরিবারের কাউকে আর দেখতে পাবে না৷ চন্দ্রভানু ঠিক করেই রেখেছেন, সববাইকে ভেড়ির ভিতর জ্যান্ত পুঁতে দেবেন৷ এই কাজটা তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করাবেন৷ সোনাখালির লক্ষণ সর্দারকে দিয়ে৷

একটু পরে আসামীরা জেলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল৷ মূল ফটক বন্ধ হয়ে গেল৷ ফাঁকা চত্বর দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল চন্দ্রভানুর৷ কঙ্কণদীঘিতে গিয়ে সনকা আর বড় বউমার সামনে তিনি দাঁড়াবেন কী করে? বিমল মুখার্জির ভরসায় বাড়িতে খুব দম্ভ করে বলে এসেছিলেন, জয়গোপালকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবেন৷ কোথায় কী? জজ সাহেব কোনও কথাই শুনতে চাইলেন না উকিলবাবুর৷ মামলা মোকদ্দমাকে মোটেই ভয় পান না চন্দ্রভানু৷ ও তিনি জীবনে অনেক করেছেন৷ কিন্তু শালা, দু’চারটে গোঁয়ার গোবিন্দ জজ আছে, যাঁদের টাকা পয়সা দিয়েও কেনা যায় না৷ চন্দ্রভানুর অস্বস্তির একটাই কারণ, তাঁর ছেলে জেল খাটছে, বাঁদাবনে এই কথাটা রটে গেলে, তাঁর প্রতিপত্তি অনেক কমে যাবে৷ শত্তুরদের অনেকেই ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে ৷ যখনই তিনি এই কথাটা ভাবছেন, তখনই মনের মধ্যে কাঁটা বিঁধছে৷

অনেকক্ষণ ধরে স্করপিয়োতে একা বসে রয়েছেন৷ জানলা দিয়ে চন্দ্রভানু দেখলেন, কয়েক হাত দূরে মন্টু আর দয়াশঙ্কর একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছে৷ লোকটা কে, তিনি চিনতে পারলেন না৷ জেলের কেউ হবে, বলে মনে হয়৷ ওরা তিনজন গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল৷ মুখ বাড়িয়ে মন্টু বলল, ‘চাঁদ, তোর কাচে হাজার পাঁচেক ট্যাকা হবে রে?’

চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আছে৷ কী দরকার?’

সঙ্গী লোকটাকে দেখিয়ে মন্টু বলল, ‘ইনি জেলের ওয়ার্ডার দিকপতিবাবু৷ ট্যাকাটা এঁকে দিতে হবে৷ জেলের খাবার বড় খোকা খেইতে পারবে না৷ জেলে থাকার সময় যাতে বড় খোকা ভাল খাবার দাবার পায়, তার ব্যওস্তা ইনি কইরে দেবেন৷’

জেলে এ রকম সিস্টেম আছে না কি! শুনে চন্দ্রভানু একটু অবাকই হলেন৷ মুখ তুলে তিনি দিকপতিবাবুর দিকে তাকাতেই লোকটা বলল, ‘আপনাকে আমি চিনি স্যার৷ আমার বাড়ি হিঙ্গলগঞ্জে৷ আমি জানি, আপনার কী বিশাল ব্যবসা৷ চিন্তা করবেন না স্যার৷ জয়গোপালবাবুর জন্য লোক দিয়ে আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করে দেব৷ উনি বাড়িতে যা খান, তাই এখানে পাবেন৷ হপ্তায় পাঁচ হাজার করে দিয়ে যাবেন৷ আপনার ছেলের কোনও অসুবিধে হবে না৷’

সিটের উপর রাখা অ্যাটাচি কেসে টাকা আছে৷ টাকা বের করে দিকপতিবাবুকে দিতেই উনি বললেন, ‘ছেলের সঙ্গে যদি রোজ কথা বলতে চান, তা হলে আরও হাজার দেড়েক টাকা দিয়ে যান৷ ফোনের ব্যবস্থাও আমি করে দেবো৷ তবে দিনের বেলায় নয় স্যার৷ কথা বলতে হবে রাতের দিকে৷’

কোনও প্রশ্ন না করে টাকাটা বের করে এগিয়ে দিলেন চন্দ্রভানু৷ হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে দিকপতিবাবু বললেন, ‘আপনার ছেলের কেসটা মন্টুবাবুর মুখে শুনলাম৷ এ কেস দাঁড়াবে না৷ আপনি শুধু লক্ষ রাখবেন, যাতে কেউ সাক্ষী দিতে না আসে৷ পাবলিক প্রসিকিউটার আমার খুব চেনাশুনো৷ তাকে বলে দেবো, যাতে কেসটা উইক করে দেয়৷ তবে বোঝেনই তো, কিছু মালকড়ি ছাড়তে হবে৷’

মন্টু বলল, ‘সে নিয়ে আপনি ভাববেন না দিকপতিবাবু৷ থানাতেও আমাদের চেনাজানা আছে৷ কাল সকালে আপনি বরং আমাকে পিপি-র বাড়িতে নিয়ে চলুন৷’

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ‘আচ্ছা আসি স্যার’ বলে দিকপতিবাবু ফটকের দিকে খানিকটা এগিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ তার পর বললেন, ‘যে লোকটা কনফেশনাল স্টেটমেন্ট দিয়েছে, তার নামটা কী যেন বললেন মন্টুবাবু?’

‘রমজান আলি৷’

‘জেলের ভিতর সাজাওয়ালাদের দিয়ে তাকে এমন প্যাদানি খাওয়াব যে, উঠে দাঁড়াতে পারবে না৷ আপনারা নিশ্চিন্ত মনে চলে যান৷’

দিকপতিবাবু ফটকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতেই চন্দ্রভানু হঠাৎ অবসন্নবোধ করলেন৷ জীবনে কোনওদিন এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়বেন, তিনি ভাবতেও পারেননি৷ এতদিন তাঁর ধারণা ছিল, টাকা দিয়ে মানুষ সব কিছুই করতে পারে৷ এখন বুঝতে পারছেন, গ্রহচক্র খারাপ থাকলে, টাকাও কাজে আসে না৷ গুরুজির ভবিষ্যদ্বাণীই কি তা হলে ঠিক হতে যাচ্ছে? কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে চন্দ্রভানুর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল৷ না, না, এত সহজে তিনি হার মানবেন না৷ মন্টুর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে৷ দয়াশঙ্করের সামনে সেটা করা যাবে না৷ ওকে বসিরহাটেই কোনও হোটেলে রেখে যেতে হবে৷ তাই মন্টুকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কি কঙ্কণদীঘিতে ফিরে যাওয়াটা ঠিক হবে?’

হাতঘড়ির দিকে একবার নজর দিয়ে মন্টু বলল, ‘না রে চাঁদ৷ উচিদ হবে না৷ রাত দশটার আগে পৌঁছতে পাইরব না৷ ভাঙড়ের মধ্যি দে যেইতে হবে৷ ওদিকপানের লোগজন ঠিকঠিক না৷ তার চে বরন হিঙ্গলগঞ্জের গেস হাউসেই চল৷ এখেন থেকে ঘণ্টাখানেকের মতোন নাগবে৷ সারাডা দিন যা ধকল গ্যাচে, রাতে রেস না নিলে শরীল আর চইলছে না৷ আমি বরন বউমনিকে এগডা ফোন করে দিচিচ৷’

বউমণি মানে সনকা৷ কথাটা মনে ধরল চন্দ্রভানুর৷ বললেন, ‘তাই কর৷ যেখানে যাকে ফোন করা দরকার, করে নে৷ দয়াশঙ্কর না হয় এখানে কোনও হোটেলে থেকে যাক৷’

মিনিট পাঁচেক পর স্করপিয়োতে ওঁরা দু’জন যখন হিঙ্গলগঞ্জের দিকে রওনা হলেন, তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে৷ অকালবর্ষণ নয়৷ পুজোর আগে এ রকম বৃষ্টি মাঝেমধ্যেই হয়৷ হাসনাবাদ থেকে তাঁদের ইছামতি নদী পেরতে হবে৷ খুব বেশি বৃষ্টি হলে নদীর উপর বার্জার পাওয়া মুশকিল৷ তখন গাড়ি নিয়ে নদীর উল্টো পারে যাওয়া যাবে না৷ সকালবেলায় চন্দ্রভানু যখন কঙ্কণদীঘি থেকে বেরন, তখন ভেবেছিলেন, জয়গোপালকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে পারবেন৷ কিন্তু আজ কোর্টে যা হল, তাতে পুজোর আগে জেল থেকে ওকে বের করে আনা এখন কঠিন বলে মনে হচ্ছে৷ ইস, পুজোর সময় ছেলেটা পড়ে থাকবে চোর-চোট্টাদের সঙ্গে৷ কথাটা ভেবেই চন্দ্রভানু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷

এই বড়খোকা যখন জন্মায়, তখনও তাঁর নুন আনতে পান্তা ফুরোত৷ চন্দ্রভানু ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলেটা তাঁর সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে৷ ওর যখন ছয়মাস বয়স, তখন মহেশ্বরজি মাছ ধরার জন্য ট্রলারের ব্যবস্থা করে দেন৷ তার পর থেকেই চন্দ্রভানুর আর্থিক উন্নতি শুরু৷ প্রথম সন্তান, তাই আদরে মানুষ করেছেন৷ ছেলেটার লেখাপড়া খুব বেশিদূর এগোয়নি৷ বরাবর অনুগত, সহজ সরল৷ কঙ্কণদীঘির স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করার পরই বলে দিয়েছিল, মাছের ব্যবসায় নেমে যাবে৷ সনকা আপত্তি করেছিল, পড়াশুনোটা চালিয়ে যাক৷ কিন্তু, বড়খোকা মায়ের কথা শোনেনি৷ ও অতি অল্প বয়সে ব্যবসায় ঢুকে যাওয়ায় চন্দ্রভানু নিশ্চিন্ত হয়ে যান, পারিবারিক পেশাটা চালিয়ে যেতে পারবেন৷ কে জানত, এই মাছের ব্যবসা করতে গিয়েই একদিন ছেলেটাকে গারদের পিছনে যেতে হবে?

‘তোর ধারণাটাই ঠিক বলে মনে হচ্চে রে চাঁদ৷’

মন্টুর কথায় পাশ ফিরে তাকালেন চন্দ্রভানু, ‘কী কথা রে?’

‘রমজানের গদ্দারির পেচনে কে, আমি জানি ভাই৷’

‘কার কথা কইচিস? খুলে বল৷’

‘কে আবার৷ মা মনসার অবতার৷ যার পায়ে পা লাগিয়ে তুই ঝগড়া করচিস৷’

কানের ভিতর কারেন্ট এসে লাগল৷ মা মনসার অবতার বলতে মন্টু তরিতার কথা বলছে৷ মাগীর এত বড় সাহস! মন্টু না জেনে কিছু বলে না৷ তবুও, কথাটা বিশ্বাস করতে মন চাইল না চন্দ্রভানুর৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘রমজান আলিকে ও মাগী চিনল কী করে?’

প্রশ্নটা মুখ ছিটকে বেরতেই মন্টু বলল, ‘মাসদুয়েক আগে হিঙ্গলগঞ্জে মা মনসার মেলা হয়েছিল খুব ঘটা কইরে৷ মা তরিতা ত্যাখন ওখানে দিনদুয়েক ছেলেন৷ রমজানের ছেলে কালুকে ত্যাখন সাপে কেটেচিল৷ প্রায় মরমর৷ রমজানের বউ আমিনা তাকে নে গেচিল মা তরিতার কাচে৷ উনি মন্তর দিয়ে ছেলেডাকে বাঁচিয়ে দেন৷ সেই থেকে ওঁর উপর আমিনার অগাধ বিশ্বেস৷’

‘তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মন্টু৷ এর সঙ্গে রমজানের গদ্দারির সম্পক্ক কী? আর তুই বা সম্পক্কটা খুঁজে পেলি কী করে?’

‘তোর মনে আচে চাঁদ, মাস দুয়েক আগে তুই আর আমি যেদিন সোনাখালিতে গেচিলাম, সেদিন দয়াশঙ্কর দয়াপুরের একটা ছেলেকে তোর কাছে নে গেচিল?’

মনে পড়ল… চট করে মনে পড়ে গেল চন্দ্রভানুর৷ হ্যাঁ, দয়াশঙ্করকে সেদিন তিনি দয়াপুরে পাঠিয়েছিলেন, বেদনী মাগীটাকে গেস্ট হাউসে তুলে আনার জন্য৷ শুয়ার… কাজটা তো করতেই পারেনি, উল্টে একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছিল, সাফাই গাইবার জন্য৷ চবিবশ-পঁচিশ বছরের ছেলেটার নাম যেন কী? হ্যাঁ, অনন্ত মণ্ডল৷ তার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চন্দ্রভানু বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে আছে৷ সে তো সেদিন তোর মা মনসার গুষ্টি উদ্ধার করেছিল৷’

‘ঠিক ধরেচিস৷ সেই অনন্তই৷ কোর্টে আজ তাকে আমিনার সঙ্গে কথা কইতে দেকে আমার সন্দেহ হল, বুইলি ৷ সাতজেলিয়া থেকে অনন্ত বসিরহাটে কেন? আমিনার সঙ্গে পরে কথা বলে জানলাম, অনন্ত অ্যাখন মা তরিতার ভক্ত হয়ে গ্যাচে৷ রমজানকে যেদিন পুলিশ ধরে নে যায়, তার পরেরদিন আমিনার কাচে খবরডা পেয়ে মা তরিতা এই অনন্তকে হিঙ্গলগঞ্জে পাঠঠেছিলেন৷ তোকে প্যাঁচে ফেলার জন্য উনিই নাকি রমজানকে পরামর্শ দেচেন, বড়খোকার নামডা পুলিশের কাচে কয়ে দিতে৷’

শুনে রাগে জ্বলে উঠলেন চন্দ্রভানু৷ না, আর ধৈর্য ধরা সম্ভব না৷ প্রায় দশ-এগারো বছর এই রমজান আলি কাজ করছে তাঁর ভেড়িতে৷ তার ভাল-মন্দে সব সময় তিনি পাশে থেকেছেন৷ বাংলাদেশের মেয়ে আমিনার সঙ্গে নিকাহ-তেও টাকা পয়সা দিয়ে তিনি সাহায্য করেছিলেন৷ আর সেই মানুষটা হঠাৎ একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল? কেন? চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘রমজান ওর কথা মানল কেন?’

মন্টু বলল, ‘মা তরিতা যে ভয় দেকিয়েচেন৷ ওঁর কথা না শুনলে সাপ পাঠঠে নির্বংশ করে দেবেন৷ গরীব গুর্বো, অশিক্ষিত মানুষজন৷ বুইতেই তো পরিচিস, আমিনা ভয় পেয়ে গ্যাচে৷ রমজানকে নে তুই মাতা ঘামাস না চাঁদ৷ আমার ওপর ছেড়ে দে৷ আমিনাকে আমিও ভয় দেকিয়ে এয়েচি৷ তুই যে বাংলাদেশি, পুলিশের কাছে কয়ে দিলে, তোর কী হবে জানিস? রমজানকে নিজের ঘাড়ে দোষটা নিতে বল৷ তোদের সংসারের যা খাই খরচ, সব সারা জেবন চাঁদবাবু তোদের দে যাবে৷’

জনবিরল রাস্তা দিয়ে স্করপিয়ো ছুটে যাচ্ছে হাসনাবাদের দিকে৷ কোথাও কোথাও দু’একটা দোকান থেকে আলো ছিটকে পড়েছে রাস্তায়৷ বাকি সব ঘন অন্ধকার৷ সারাটা দিন টেনশনে পেটে কিছু দেওয়া হয়নি৷ মনে হতেই শরীরটা হঠাৎ ঝিম মেরে গেল চন্দ্রভানুর৷ হিঙ্গলগঞ্জে পৌঁছেই দু’চার পেগ পেটে না দিলে চলবে না৷ সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, কত দ্রুত সবকিছু বদলে গেল! সাগর দ্বীপে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কত ধরনের স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি৷ ঝড়খালিতে বিশাল রিসর্ট বানাবেন৷ পাটায়ার মতো সারা বিশ্ব থেকে পর্যটক টেনে আনবেন এই বাঁদাবনে৷ সব বিশ বাঁও জলে ডুবতে বসেছে৷ যাবতীয় বিপর্যয় তরিতা বলে ওই মেয়েটার জন্যই৷ কী কুক্ষণেই না মেয়েটাকে নদীর জলে স্নান করতে দেখেছিলেন সেদিন তিনি!

মাথার ভিতরে যেন একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে৷ নাহ, মেয়েটাকে চরম শিক্ষা দেওয়া দরকার৷ মন্টুকে দিয়ে তা হবে না৷ মেয়েটার কথা উঠলেই ওর ভেতর কেমন যেন একটা গদগদ ভাব এসে যায়৷ দয়াশঙ্করও আস্ত একটা পাঁঠা৷ সাপ-টাপের গল্প শুনে বোধহয় ঘাবড়ে গেছে৷ এখুনি পাল্টা একটা আঘাত করতে না পারলে, মেয়েটাকে আর শায়েস্তা করা যাবে না৷ মন্টু সেদিন জিজ্ঞেস করছিল, তুই কী চাস চাঁদ, আগে ঠিক কর তো৷ চুলকে ঘা করতে যাচিচস কেন, ভাই? ঠিক এই জায়গাটাতেই মুশকিলে পড়ে গেছেন চন্দ্রভানু৷ তিনি যে ঠিক কী চান, সেটাই ভেবে উঠতে পারছেন না৷ মেয়েটাকে কি বাঁদাবন থেকে হটিয়ে দিতে চান? না কি বশ করতে চান৷ অনেক ভেবেও চন্দ্রভানু বুঝে উঠতে পারেননি, মেয়েটা বাঁদাবনে থেকে গেলেই বা তাঁর কী ক্ষতি? ও তো এই সুন্দরবনেরই মেয়ে৷

মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে রেখেছেন চন্দ্রভানু৷ হঠাৎ গ্যাঁ গ্যাঁ করে উঠল৷ সেটটা হাতে তুলে নিয়ে তিনি দেখলেন, পর্দায় অহল্যার নাম৷ ছোট বউমা এখন কলকাতায়৷ ঝড়খালির রিসর্ট নিয়ে কথা বলতে গেছে সুশান্ত ঝুনঝুনওয়ালা নামে একজন কনসালটেন্টের সঙ্গে৷ কথাবার্তার পর পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াল, বোধহয় সেটাই জানাতে চায়৷ কিন্তু, রিসর্ট নিয়ে মাথা ঘামানোর মেজাজে নেই এখন চন্দ্রভানু৷ তবুও, ফোনের সুইচ টিপে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো বউমা৷’

‘কোর্টে আজ কী হল বাবা?’

‘বড় খোকার জামিন হয়নি৷’

‘জানতাম, হবে না৷ আমার ড্যাডি আজ সকালেই পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে কথা বলেছেন৷ ডিজি যা বলার, হিঙ্গলগঞ্জ থানায় বলে দিয়েছেন৷ জেল কাস্টোডির পর ফারদার যেদিন বড়দাকে কোর্টে প্রোডিউস করা হবে, ওই দিনই উনি জামিন পেয়ে যাবেন৷ আপনি টেনশন করবেন না৷’

কথাটা শুনে বুকে সামান্য ভরসা পেলেন চন্দ্রভানু৷ অহল্যার বাবা কল্যাণ দাশগুপ্ত বিরোধী পার্টির নামকরা লিডার৷ রুলিং পার্টির রোষে পড়তে পারেন ভেবে, অ্যাদ্দিন চন্দ্রভানু তাঁর সঙ্গে খুব যোগাযোগ রাখতেন না৷ এই প্রথম ভদ্রলোক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল চন্দ্রভানুর৷ শালা, দিনের পর দিন যাঁরা ভিক্ষের ঝুলি হাতে নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াত, তাঁদের কারও সাহায্য কিন্তু এখন পাওয়া যাচ্ছে না৷ গতকাল পার্টি অফিসে সারাটা বিকেল কাটিয়েছেন৷ শেষ পর্যন্ত নেতাদের বাণী শুনে এসেছেন, ‘আইন আইনের পথে চলবে৷ মার্ডার কেস, এর মধ্যে আমাদের ইনভলভ করবেন না৷’ যেন মার্ডার করা মহাপাপ৷ কথাগুলো মনে পড়লে গা জ্বলে যাচ্ছে৷ এর জবাব সুযোগ পেলে তিনি দেবেন৷ অহল্যার কথার পৃষ্ঠে চন্দ্রভানু বললেন, ‘টেনশন কি সাধে করছি মা? বিপদ যে চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে৷ যাক গে, তোমার ওদিকের খবর কী বল? ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে কথা হল?’

‘হয়েছে৷ উনি বললেন, রিসর্ট ঝড়খালিতে করাটা ঠিক হবে না৷’

আরেকটা খারাপ খবর! ঝুনঝুনওয়ালা হলেন ট্যুরিজম কনসালটেন্ট৷ উনি যদি বলে থাকেন, বড় রিসর্ট করার জন্য ঝড়খালি আইডিয়াল জায়গা নয়, তা হলে পা বাড়ানো উচিত হবে না৷ প্রায় বছর ঘুরে গেল, প্ল্যানটা নিয়ে তিনি এগোচ্ছেন৷ এককথায় খারিজ করে দিতে হবে৷ হোটেল ব্যবসায় নামার আগে কনসালটেন্টদের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার, সেই ধারণাই ছিল না চন্দ্রভানুর৷ কথাটা প্রথম মাথায় ঢোকায় অহল্যাই৷ রিসর্ট-এর দায়িত্ব তিনি কার হাতে দেবেন, তা জানানোর জন্য যেদিন মিটিং ডেকেছিলেন, সেদিন৷ ভাগ্যিস, ছোট বউমাকে ডেকে এনেছিলেন! চন্দ্রভানু পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘মিঃ ঝুনঝুনওয়ালা কী সাজেশন দিলেন ছোট বউমা?’

‘উনি চাইছেন, ঝড়খালির বদলে রিসর্ট হোক, হয় হেনরি আইল্যান্ডস, না হয় তো সাগর দ্বীপে৷ সাগর দ্বীপ ওঁর ফার্স্ট প্রেফারেন্স৷ কপিল মুনির আশ্রম আছে বলে, ট্যুরিস্ট টেনে আনা যাবে৷ কিন্তু ওখানে বড় জমি পাওয়া কঠিন৷ সেক্ষেত্রে হেনরি আইল্যান্ডস বেটার চয়েস৷ বছর দশেক আগে মিঃ ঝুনঝুনওয়ালার এক রিলেটিভ প্রায় জলের দরে কুড়ি একর জমি কিনে রেখেছিলেন৷ সী ফিশ নিয়ে কোনও বিজনেস করার জন্য৷ সেই প্ল্যানটা উনি সেলভড করেছেন৷ আমার ড্যাডিদের পার্টি পাওয়ারে ছিল সেইসময়৷ ভদ্রলোককে তখন ড্যাডি অনেক সাহায্য করেন জমি কেনার ব্যাপারে৷ মিঃ ঝুনঝুনওয়ালা বললেন, রিজনেবল প্রাইসে যাতে সেই জমিটা পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা উনি করে দিতে পারবেন৷’

ঝড়খালিতে জমি পাওয়া নিয়ে যখন ঝঞ্ঝাট চলছে, সেইসময় চন্দ্রভানু বিকল্প জায়গা হিসেবে একবার হেনরি আইল্যান্ডসের কথা ভেবেছিলেন৷ বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে মন্টু তখন নার্সিং হোমে শয্যাশায়ী৷ সুস্থ হয়ে উঠে জমির সমস্যাটা ও সামলে নিয়েছিল৷ তার পর আর হেনরি আইল্যান্ডসের কথা চন্দ্রভানুর মনেই পড়েনি৷ অহল্যা মনে করিয়ে দেওয়ায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘একজন হোটেলিয়ার হিসেবে তোমার কী মনে হয় মা? সাগর দ্বীপ, না হেনরি আইল্যান্ডস?’

‘হেনরি আইল্যান্ডস৷ জায়গাটা কোর এরিয়ার খুব কাছে৷ নদীর এ পারে লোকবসতি খুবই কম৷ ওপারে কোর এরিয়ায় ঘন জঙ্গল৷ মাঝেমধ্যেই রয়াল বেঙ্গল টাইগার এই আইল্যান্ডসে চলে আসে৷ যাঁরা বাঘ আর কুমির দেখার টানে সুন্দরবনে যেতে চান, তাঁদের টোপ দেওয়া যেতে পারে৷ দেশ-বিদেশের প্রচুর ট্যুরিস্ট আগ্রহ দেখাবেন৷ ওখানে স্কুবা ডাইভিং, প্যারা গ্লাইডিং, ওয়াটার স্কিয়িংয়ের ব্যবস্থা করা যেতেই পারে৷ গদখালি থেকে যদি হেলিকপ্টারের অ্যারেঞ্জমেন্ট রাখা যায়, তা হলে হোল ওয়ার্ল্ড থেকে ট্যুরিস্ট আসবে৷ মিঃ ঝুনঝুনওয়ালা আরও অনেক কথা বলেছেন৷ সামনাসামনি না বসে ডিসকাস করা যাবে না৷ আপনি এখন ঠিক কোথায় বাবা?’

‘হিঙ্গলগঞ্জের দিকে যাচ্ছি৷ কাল বিকেলের মধ্যে কঙ্কণদীঘি ফিরে যাবে৷ তুমি ওখানে আমার সঙ্গে দেখা কোরো মা৷’

‘ঠিক আছে বাবা৷ কাল দেখা হচ্ছে৷’

কথাটা বলেই ফোন ছেড়ে দিল অহল্যা৷ লাইন কেটে যাওয়ার পরই বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা উদয় হল চন্দ্রভানুর মাথায়৷ ইস, ছোটবউমার কথা আগে কখনও কেন তাঁর মনে পড়েনি? মেয়েটা সবদিক থেকেই ব্যতিক্রমী৷ তুখোড় বুদ্ধিমতি ও স্বাধীনচেতা মেয়ে৷ বড় বউমা তাঁর সামনে মুখ তুলে কথা বলতে সাহস পায় না৷ কিন্তু অহল্যা বরাবর যুক্তি দিয়ে কথা বলে৷ পছন্দ না হলে সরাসরি তা জানিয়ে দিতে পিছুপা হয় না৷ পেশাদার জগতে আছে৷ চোখ-কান খোলা রেখে চলে৷ আজ হঠাৎ চন্দ্রভানুর মনে হল, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এই মেয়েটার সঙ্গে অ্যাদ্দিন তিনি আলোচনা করার কথা কেন ভাবেননি, সেটাই আশ্চর্যের৷ দয়াপুরের ওই মাগীটাকে শায়েস্তা করার জন্য অহল্যাকে তো কাজে লাগানো যেতেই পারে৷ কথাটা মনে হতে, চন্দ্রভানু সারা দিনে এই প্রথমবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *