তরিতা পুরাণ – ৩৫

(পঁয়ত্রিশ)

মেঘ না চাইতেই জল৷ ডাইনিং টেবলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছেন চন্দ্রভানু, এমন সময় দয়াশঙ্কর এসে খবর দিল, ‘অঙ্কুশবাবু এসেছেন৷ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান৷’

চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোনে ওকে কখন পেলি?’

‘ফোনে পাইনি৷ উনি নিজেই চলে এসেছেন৷’

মহেশ্বরজির কী অসীম কৃপা! যে ছেলেটাকে কাল সারাদিন ধরার চেষ্টা করা হল, সে নিজে থেকেই উদয় হয়েছে৷ আগ্রহ দেখিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘কখন এসেছে?’

‘ঘণ্টা দেড়েক তো হবেই৷ বাবাইসোনার সঙ্গে এতক্ষণ গপ্প করছিলেন৷ আপনি তখন মন্দিরে স্যার৷’

‘যা, ওকে এখানে নিয়ে আয়৷ আর বড়বউমাকে এখুনি খবরটা দে৷ গিয়ে বল, অঙ্কুশ আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবে৷’

আজ সকালে স্নান সেরে মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে নিষ্ঠাসহকারে শিবের পুজো করেছেন চন্দ্রভানু৷ প্রার্থনা করেছেন, যাতে বাবাইসোনা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে৷ বেলা বারোটার সময় দেবাংশু উকিলের আসার কথা সেই সাইকিয়াট্রিস্টকে সঙ্গে নিয়ে৷ ওঁদের দু’জনকেই বারুইপুর থেকে তুলে আনবেন বেয়াই সুকুমারবাবু৷ বড় বউমার বাবা৷ বাবাইসোনার স্নেকফোবিয়া হয়েছে শুনে বেয়াইমশাইও খুব বিচলিত৷ দফায় দফায় উনি ফোন করছেন কলকাতা থেকে৷ ইন্টারনেট সার্চ করে একেকবার একেক রকম পরামর্শ দিচ্ছেন৷ একবার বললেন, লন্ডনে নিয়ে গেলে কেমন হয়? চন্দ্রভানু ওঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, তার কোনও দরকার নেই৷ মহেশ্বরজির কৃপা পেলে জয়জিৎ এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে৷

অঙ্কুশ ছেলেটাকে মহেশ্বরজিই পাঠিয়েছেন৷ অন্যথা হতেই পারে না৷ উনি যে অন্তর্যামী৷ সাগর দ্বীপে যাবেন বলে গতকাল মহেশ্বরজির অফিসে ফোন করেছিলেন চন্দ্রভানু৷ তখন জানতে পারেন, উনি এখন দিল্লিতে৷ ফিরতে সপ্তাহখানেক লেগে যাবে৷ সেন্ট্রাল মিনিস্ট্রিতে মহেশ্বরজির প্রচুর জানাশোনা৷ দিল্লির অনেক বিগ বস ওঁর আশীর্বাদ পেলে ধন্য হয়ে যান৷ আর মাসছয়েক পর সম্ভবত লোকসভা নির্বাচন হবে৷ সেই কারখেই বারবার দিল্লিতে ডাক পড়বে মহেশ্বরজির৷ গতবার নির্বাচনের সময় একবার উনি বলেও ছিলেন, ‘তুই যদি ইলেকশনে দাঁড়াতে চাস, তো বল৷ ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রের টিকিট তুই যাতে পাস, তার ব্যবস্থা করি৷’ চন্দ্রভানু গররাজি ছিলেন না৷ কিন্তু, পরে গ্রহনক্ষত্র বিচার করে মহেশ্বরজি নিজেই একদিন বলেন, ‘ওই কন্সটিটিউয়েন্সিতে তুই জিততে পারবি না চাঁদ৷ তোর সময় এখনও আসেনি৷’

দয়াশঙ্করের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অঙ্কুশ ডাইনিং রুমের দিকে আসছে৷ ওর সঙ্গে লাফাতে লাফাতে আসছে বাবাইসোনা৷ অঙ্কুশের একটা হাত বাবাইসোনার কাঁধে৷ গত দুটো দিন ছেলেটা ঘর থেকেই বেরয়নি৷ আজ অঙ্কুশকে দেখে একেবারে স্বাভাবিক৷ দৃশ্যটা দেখে চন্দ্রভানু নিশ্চিত হয়ে গেলেন, পারলে এই অঙ্কুশই পারবে বাবাইসোনাকে ভাল করে দিতে৷ ওরা তিনজন ঘরে ঢুকতেই চন্দ্রভানু বললেন, ‘এসো বাবা, এসো৷ ভাল সময়ে এসেছ৷ ব্রেকফাস্ট রেডি৷’

হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘না স্যার, আমাকে এই রিকোয়েস্টটা করবেন না৷ ব্রেকফাস্ট করে এসেছি৷ পেট একেবারে জ্যাম৷ হঠাৎ এসে আপনার অসুবিধে করলাম না তো?’

‘বিন্দুমাত্র না৷ ইন ফ্যাক্ট, কাল থেকে আমার স্ত্রী তোমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন৷’

‘আমায় পাননি তো? না পাওয়ারই কথা৷ আমার মোবাইলে দুটো সিমকার্ড৷ আগেরটা কাল রাতের পর থেকে ইউজ করছি না৷ নতুন নাম্বারটা মাত্র দশ-বারোজনকে দেওয়া আছে৷’

‘এদিকে কি কোনও কাজে এসেছিলে?’

‘না, না৷ আমি হেড়োভাঙায় যাব বলে বেরিয়েছিলাম৷’

‘ওখানে কি কেউ তোমার থাকেন?’

‘না৷ ওখানে আমাদের কিছু জমি আছে৷ সেটা দেখে আসার জন্যই যাচ্ছিলাম৷’

‘সে তো দয়াপুর দিয়ে যেতে হয়৷ ওখানে যাবে কী করে?’

‘এখনও কিছু ঠিক করিনি স্যার৷’

‘তুমি চিন্তা কোরো না৷ আমার লঞ্চ তোমায় সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবে৷ তোমার তো তাড়াহুড়োর কিছু নেই৷ আমার এখানে দু’একটা দিন না হয় কাটিয়ে যাও৷ তোমাকে আমাদের ভীষণ দরকার৷ কথাটা এখনই বলতে পারছি না৷ আমার স্ত্রী পরে তোমাকে বলবেন৷’

বাবাইসোনা গা ঘেঁষে বসে আছে অঙ্কুশের৷ খুশি হয়ে ও বলে উঠল, ‘দাদান ঠিক বলেছে৷ তুমি এখানে থেকে যাও কুশকাকু৷ খুব মজা হবে৷’

বড়বউমা খাবার নিয়ে হাজির হয়েছে৷ মুখে মৃদ হাসি৷ অঙ্কুশকে দেখে এ বার চিনতে পেরেছে৷ চন্দ্রভানু বললেন, ‘তোমার শাশুড়ি মা কোথায় বউমা? উনি কি খবর পেয়েছেন, অঙ্কুশ এসেছে?’

‘উনি এইমাত্তর মন্দির থেকে ফিরলেন বাবা৷ পোশাক বদলে এখুনি আসছেন৷’

অঙ্কুশ কিছু খাবে না৷ বড়বউমাও কিছুতে ছাড়বে না৷ শেষে দুটো মিষ্টি মুখে দিতে রাজি হল অঙ্কুশ৷ এ কথা সে কথার পর হঠাৎ ও জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার পাইথন দুটো কেমন আছে স্যার?’

ব্যাবসার নানা সমস্যার কারণে বেশ কিছুদিন পাইথন দুটোর কোনও খবর রাখতে পারেননি চন্দ্রভানু৷ ওদের দেখাশুনোর ভার দিয়ে রেখেছেন কালু বলে একটা ছেলের উপর৷ বেদেপাড়া থেকে দয়াশঙ্করই ওকে ধরে এনেছিল৷ সপ্তাহে একবার করে এসে কালু পাইথন দুটোকে খাইয়ে যায়৷ মন্দিরে যারা পুজো দিতে আসে, তারা মাঝে মাঝে পাইথনদের এনক্লোজারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়৷ কিন্তু বৃষ্টির কারণে এনক্লোজারের ভিতর এত ঝোপঝাড় বেড়ে গেছে, পাইথনদের না কি তারা কদাচিৎ দেখতে পায়৷ চন্দ্রভানু আন্দাজে বললেন, ‘ওরা ভালই আছে৷ একটা ছেলেকে রেখেছি, ওদের দেখাশুনো করার জন্য৷ দাঁড়াও, তাকে ডেকে পাঠাই৷’

‘ওদের এনক্লোজারে কি একবার যাওয়া যেতে পারে?’ অঙ্কুশ বলল, ‘ফিমেল পাইথনটা সম্ভবত ডিম দিয়েছে৷ একবার চেক করা দরকার ডিমগুলো কী অবস্থায় আছে৷’

‘তুমি জানলে কী করে ডিম দিয়েছে?’

‘ফিমেল পাইথনটাকে আমি যখন ধরেছিলাম, তখনই ওর পেটে ডিম ছিল স্যার৷ ওর ছবি দেখে পরে বুঝতে পারি৷ তাই আপনাকে বলা হয়নি৷ ওরা একসঙ্গে সত্তর-আশিটা করে ডিম দেয়৷ চলুন, গিয়ে একবার দেখে আসা দরকার৷’

চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘সব ডিম ফুটেই কি বাচ্চা বেরয়?’

‘না, অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যায়৷ তবুও সংখ্যাটা খুব খারাপ দাঁড়ায় না৷ তিরিশ হতে পারে, আবার পঞ্চাশও৷ তা হলে বুঝতে পারছেন, আপনার এনক্লোজারের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? ছোট-বড় পাইথনে কিলবিল করবে৷ ফেন্সিংয়ে কোত্থাও যেন ফাঁক-ফোকর না থাকে স্যার৷’

‘সর্বনাশ! তুমি না বললে তো আমি কিছুই জানতে পারতাম না৷ চলো, এখুনি গিয়ে দেখে আসি৷’

চটপট ব্রেকফাস্ট শেষ করে চন্দ্রভানু উঠে দাঁড়ালেন৷ এ এক নতুন অশান্তির কথা শোনাল অঙ্কুশ৷ পাইথনটার পেটে ডিম ছিল গাজনের সময়৷ মাঝে দু’আড়াই মাস পেরিয়ে গিয়েছে৷ এর মধ্যে ডিম ফুটে যদি বাচ্চা বেরিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে কী হবে? আশ্চর্য, কালুর চোখে পড়ল না? হারামজাদা করেটা কী রোজ এখানে এসে? না, না, ব্যাপারটা মোটেই হালকাভাবে নেওয়া উচিত না৷ এনক্লোজারে ফেন্সিংয়ের তলার দিকে কোনও কোনও জায়গায় খানিকটা করে ফাঁক আছে৷ বাচ্চাগুলো যদি বেরিয়ে আসে, তা হলে গাঁয়ের লোকেরা বিপদে পড়বে৷ চন্দ্রভানুর ইচ্ছে হল, কালুকে ডেকে ওর গায়ে জলবিচুটি ঘসে দেন৷ ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে অঙ্কুশকে নিয়ে তিনি মন্দিরের দিকে এগোলেন৷

কাল বিকেলে একপ্রস্থ বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে৷ আজ অবশ্য আকাশ একেবারে পরিষ্কার৷ মণি নদীর পারের দিকে পাইথনদের এনক্লোজার লোহার জাল দিয়ে ঘেরা৷ ভিতরে ঢোকার কোনও প্রশ্নই নেই৷ বাইরে থেকে ওরা দু’জন পাইথন দুটোকে খুঁজতে লাগলেন৷ পুরুষ পাইথনটার খোঁজ চট করে পাওয়া গেল৷ গাছের ডালে ঝুলছে৷ কিন্তু ফিমেল পাইথনটা কোথায়? অঙ্কুশ বলল, ‘চলুন স্যার, এক চক্কর মেরে দেখি৷ মনে হচ্ছে, আমার সন্দেহটাই ঠিক৷’

এনক্লোজারের নদীর দিকটায় সাধারণত লোকের পা পড়ে না৷ সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ফিমেল পাইথনটাকে আবিষ্কার করল অঙ্কুশ৷ বলল, ‘এই দেখুন, কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝোপের আড়ালে পড়ে রয়েছে৷ তার মানে, ডিমগুলো তা দিচ্ছে৷ সঙ্গে বাইনোকুলার থাকলে এখুনি আন্দাজ করা যেত, কত ডিম ওর বডির আড়ালে রয়েছে৷’

‘কুশকাকু আমার কাছে বাইনোকুলার আছে৷ নিয়ে আসব?’

বাবাইসোনার গলা না? বাবাইসোনা যে পিছন পিছন এসেছে, চন্দ্রভানু টেরই পাননি৷ ওকে দেখে তিনি অবাকই হলেন৷ যে ছেলেটা গতকালই টিভিতে সাপের ছবি দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছিল, সে পাইথন দেখার জন্য বাইনোকুলার নিয়ে আসতে চাইছে? অঙ্কুশকে দেখেই ওর সর্পভীতি ভ্যানিশ হয়ে গেল না কি? ধমক দিয়ে ওকে বাড়ি পাঠানোর বদলে চন্দ্রভানু উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, ‘যা, চট করে নিয়ে আয়৷ কপাল ভাল থাকলে বাচ্চা সাপও দেখতে পাবি৷’

খুব মনোযোগ দিয়ে ফিমেল পাইথনটাকে দেখছে অঙ্কুশ৷ জালের ফাঁকে পা দিয়ে কয়েক ফুট উঁচুতে উঠে বলল, ‘মনে হচ্ছে, ফিমেলটার বয়স হয়েছে৷ কুড়ি-বাইশটার বেশি ডিম দেয়নি৷ আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন স্যার৷ ডিমগুলো কেমন থলথলে৷ আপনার যে লোকটা পাইথন দুটোকে দেখাশুনো করে, তাকে কি একবার ডাকা যাবে? কয়েকটা কথা জানা দরকার৷’

দয়াশঙ্করকে ফোন করার জন্য পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করার সঙ্গেসঙ্গে ফোনটা বেজে উঠল৷ দয়াশঙ্করেরই ফোন৷ ও বলল, ‘বড় বেয়াইমশাই ডাক্তারবাবু আর উকিলবাবুকে নিয়ে এসে পড়েছেন স্যার৷ উনি আপনার কাছে যেতে চাইছেন৷’

চন্দ্রভানু বললেন, ‘ওদের আমার অফিস ঘরে নিয়ে বসা৷ আমি এখুনি আসছি৷ আর শোন, কালু হারামজাদাটা এখন কোথায়? ওকে এখুনি পাইথনদের এনক্লোজারে পাঠিয়ে দে৷’

‘কেন স্যার, কোনও গণ্ডগোল করেছে না কি?’

উত্তর না দিয়ে লাইনটা কেটে দিলেন চন্দ্রভানু৷ তখনই নীচে নেমে এসে অঙ্কুশ বলল, ‘ফিমেল পাইথনটা লাস্ট কবে খাবার খেয়েছে, সেটা জানা দরকার স্যার৷ নর্মালি একবার ডিমে তা দিতে বসে গেলে ওরা আর ওঠে না৷ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়৷ সেই কারণেই ঝোপের আড়ালে চলে গিয়েছে৷’

চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত দিন লাগে ডিম থেকে বাচ্চা বেরতে?’

‘সঠিক বলা যায় না৷ ষাট দিন লাগতে পারে, আবার বাহাত্তর দিনও৷’

বাবাইসোনা বাইনোকুলারটা নিয়ে এসেছে৷ দৌড়ে এসেছে বলে হাঁফাচ্ছে৷ দেখে চিনতে পারলেন চন্দ্রভানু৷ এবারই ব্যাঙ্কক থেকে বাইনোকুলারটা ওর জন্য নিয়ে এসেছেন৷ সেটা এগিয়ে দিয়ে বাবাইসোনা বলল, ‘এই নাও কুশকাকু৷ তোমার দেখা হয়ে গেলে আমায় কিন্তু দেখতে দিও৷’

ফের জালের ফাঁক দিয়ে অনেকটা উপরে উঠে গেল অঙ্কুশ৷ খানিকক্ষণ ঝোপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘যা ভেবেছিলাম, তাই৷ ডিমগুলো নড়াচড়া করছে৷ আর দু’একদিনের মধ্যে বাচ্চা ফুটে বেরুবে বলে মনে হচ্ছে৷ আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন, এনক্লোজারের চারদিকে তিন-সাড়ে তিন ফুটের মতো ইটের গাঁথনি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন৷ বাচ্চাগুলো যাতে গলে বাইরে যেতে না পারে৷’

কথাগুলো বলতে বলতেই বাইনোকুলারটা এগিয়ে দিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘চট করে পাইথনটাকে একবার দেখে নাও জয়জিৎ৷ আমার যা দেখার, হয়ে গেছে৷’

তার পরই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পারলে এনক্লোজারের স্পেসটা আরও বাড়ান স্যার৷ আর ক’দিন পর বড্ড ক্রাউডেড হয়ে যাবে৷’

খানিক পরে বাড়ির দিকে হাঁটার সময় অঙ্কুশ ফের বলল, ‘স্যার যে কারণে এখানে এসেছি, সেটা বলি৷ আমার এক বান্ধবী আছে, সে ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার৷ জঙ্গলে জঙ্গলে বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলে বেড়ায়৷ তার কাছে আমি আপনার এই পাইথন দুটোর গল্প করেছিলাম৷ ফিমেল পাইথনটা ডিম দেবে শুনে ও ভীষণ ইন্টারেস্ট নিয়েছে৷ ডিম ফুট বাচ্চা বেরনোর বিভিন্ন স্টেজে ও ছবি তুলতে চায়৷ এই সুযোগটা তো জঙ্গলে খুব একটা পাওয়া যায় না৷ আপনার এখানে তোলার সুযোগ রয়েছে৷ আপনি যদি পার্মিশন দেন, তা হলে ওকে আসতে বলতে পারি৷’

বান্ধবী মানে প্রেমিকা ট্রেমিকা না কি? অঙ্কুশকে আটকে রাখার এই সুযোগ৷ চন্দ্রভানু বললেন, ‘ তা হলে তো ভদ্রমহিলাকে এখানে বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে৷ আপনিও যদি ওর সঙ্গে এখানে থাকেন, তা হলে আমার আপত্তি নেই৷ আমি গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷’

অঙ্কুশ বলল, ‘ ঠিক আছে, ভেবে দেখি৷’

আউট হাউসের একতলায় অফিস ঘরে ঢুকে চন্দ্রভানু দেখলেন দেবাংশুবাবু আর অপরিচিত এক ভদ্রলোক বসে আছেন৷ বেয়াইমশাই সম্ভবত অন্দরমহলে গিয়েছেন৷ সামনাসামনি হতেই দেবাংশুবাবু বললেন, ‘আসুন স্যার পরিচয় করিয়ে দিই৷ ইনি অনুপম মল্লিক, সাইকিয়াট্রিস্ট৷ আর ইনি চন্দ্রভানু৷’

চন্দ্রভানু নমস্কার করে বললেন, ‘সরি, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল৷ আসলে আমার পোষা পাইথন ডিম দিয়েছে৷ সেটাই নিজের চোখে দেখতে গিয়েছিলাম৷’

দেবাংশুবাবু বললেন, ‘আপনি স্যার, পাইথন পেলেন কোত্থেকে?’

চন্দ্রভানু হেঁয়ালি করে বললেন, ‘স্বয়ং মহাদেব আমার কাছে পাঠিয়েছেন৷’

দেবাংশুবাবু হা হা করে হেসে বললেন, ‘গুড জোক৷ পাইথন নিয়ে আমার সামান্য পড়াশুনো আছে৷ বোয়া জাতীয় পাইথনরা তো আমি যদ্দূর জানি, সরাসরি বাচ্চা দেয়৷ আপনার দুটো রেটিকিউলেটেড পাইথন না কি?’

এই রে, দেবাংশুবাবু পাইথন সম্পর্কেও জানেন না কি? জগতে কি এমন কোনও সাবজেক্ট আছে, যা তিনি জানেন না? পাইথনের কথা তোলাটাই ভুল হয়েছে৷ বিষয়টা চাপা দেওয়ার জনাই চন্দ্রভানু বললেন, ‘ হবে হয়তো৷’

কিন্তু দেবাংশুবাবু অত সহজে ছেড়ে দেওয়ার লোক নন৷ বললেন, ‘ঈশ্বরের কী অপূর্ব মহিমা দেখুন স্যার৷ একই প্রজাতির প্রাণী৷ অথচ কেউ ডিম পাড়ে, কেউ বাচ্চা দেয়৷ কেউ কেউ আবার ক্যানিবলও হয়৷ ইউ টিউবে আমি নিজের চোখে দেখেছি৷ একটা বোয়া সাপ অন্য একটা বোয়া সাপকে খাচ্ছে৷’

ক্যানিবল কথাটার মানে জানেন না চন্দ্রভানু৷ তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন৷ দেখে দেবাংশুবাবু বোধহয় ধরে নিলেন, তিনি সাপ সম্পর্কে আরও কিছু শুনতে আগ্রহী৷ তাই উৎসাহভরে বলতে শুরু করলেন, ‘কদিন আগে বারুইপুরে মনসামেলায় এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন স্যার৷ সাপ সম্পর্কে উনি এমন চমৎকার বক্তৃতা দিলেন, শুনে তো আমরা মুগ্ধ৷ কী যেন নাম মহিলার… ও হ্যাঁ তরিতা মা৷ ভদ্রমহিলা আমেরিকায় ছিলেন বহু বছর৷ তবুও মা মনসা সম্পর্কে তাঁর কী অসীম ভক্তি৷ সাপ সম্পর্কে উনি প্রচুর গবেষণা করেছেন৷ উনিই বলছিলেন, অনুমতি ছাড়া সাপ পোষা বেআইনি৷ জেল পর্যন্ত হতে পারে৷ চন্দ্রভানুবাবু, আপনি যে এই সাপ দুটোকে পুষছেন, আপনি কি লাইসেন্স নিয়েছেন? কেউ পিআইএল করলে আপনি কিন্তু ফেঁসে যেতে পারেন৷’

ফের তরিতা মা! দয়াপুরের মাগীটা তো তা হলে পুরো জেলায় চষে বেড়াচ্ছে৷ কী ভেবেছেটা কী? কপালের শিরা হঠাৎ টিপটিপ করতে লাগল চন্দ্রভানুর৷ একটু রূঢ়ভাবেই তিনি বললেন, ‘সাপ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে দেবাংশুবাবু৷ আপাতত, অনুপমবাবুর সঙ্গে কথাটা সেরে নিই৷’

অফিস ঘরের দোরগোড়ায় সনকা আর জয়িতা এসে দাঁড়িয়েছে৷ ওদের সঙ্গে বেয়াইমশাই এসে চেয়ারে বসে পড়েছেন৷ সেদিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘বাবাইসোনা কই? ওকে তো দেখছি না৷’

জয়িতা বলল, ‘ও অঙ্কুশবাবুর সঙ্গে লনের দিকে গেছে৷ ডেকে দেবো?’

চন্দ্রভানু বললেন, ‘ ডাকো, পেসেন্ট না দেখে অনুপমবাবু চিকিৎসে করবেন কী করে?’

অনুপম মল্লিক এতক্ষণ চুপ করে অন্যদের কথা শুনছিলেন৷ এ বার বললেন, ‘গাড়িতে আসার সময় সুকুমার বাসুর কাছে আমি সিম্পটনগুলো শুনেছি৷ আপনারা ভয় পাবেন না৷ স্নেকফোবিয়া সেরে যাবে৷ তবে একটু সময় লাগতে পারে৷’

মাঝখান থেকে দেবাংশুবাবু বলে উঠলেন, ‘ফোবিয়া যে কী মারাত্মক জিনিস, যার হয় সে-ই বোঝে৷ আমারই স্যার এয়ারোফোবিয়া আছে৷ এরোপ্লেনে উঠতে ভীষণ ভয়৷ মনে হয়, এই অ্যাক্সিডেন্ট হবে৷ আর আমি বাঁচব না৷ একবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে মামলা করার জন্য প্লেনে দিল্লিতে গেছিলাম৷ যা ভয়াবহ এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল, তার পর থেকে আমি নাকখত দিয়েছি৷ আর আকাশে উড়ব না৷’

দেবাংশু উকিলকে আর সহ্য হচ্ছে না চন্দ্রভানুর৷ নিজের ক্রোধকে সংবরণ করার জন্য তিনি চোখ বুঁজলেন৷ অন্য কেউ হলে সৌজন্যের ধার ধারতেন না৷ কিন্তু বেয়াইমশাই ঘরের মধ্যে রয়েছেন৷ তাঁর সামনে বেচাল কিছু করা উচিত হবে না৷ চোখ বুঁজে চন্দ্রভানু মন্টু ভক্তার কথা ভাবতে লাগলেন৷ কাল রাতে ওর ফোন করার কথা ছিল৷ আজ সকালেও করেনি৷ তার মানে সোনাখালিতে বিপদ এখনও কাটেনি৷ তরিতা বলে মাগীটা এত বড় ক্ষতি করে দিল৷ অথচ দেবাংশু উকিল বাড়ি বয়ে এসে তার গুণগান করে যাচ্ছে৷ আর সহ্য করা যাচ্ছে না৷

বাইরে থেকে বাবাইসোনার গলা শোনা যাচ্ছে৷ খুব উত্তেজিত অবস্থায় ও দৌড়ে আসছে৷ ঘরে ঢুকেই ও বলল, ‘ দাদান, শিউলি গাছের নীচ থেকে কুশ আঙ্কল কত বড় একটা সাপ ধরেছে দেখবে চলো৷ আমি মেরে ফেলতে বলছি৷ আঙ্কল মারতে চাইছে না৷’

চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন চন্দ্রভানু৷ আবার বাড়ির লনে সাপ! অসম্ভব৷ সাপ যাতে না খোকে তার জন্য নিয়মিত কার্বলিক অ্যাসিড স্প্রে-র ব্যবস্থা করেছেন তিনি৷ তা সত্ত্বেও, বাইরে থেকে সাপ এল কোত্থেকে? দ্রুত পা চালিয়ে লনে যেতেই সাপটাকে তিনি অবশ্য দেখতে পেলেন৷ লেজের দিকটা ধরে অঙ্কুশ ঝুলিয়ে রেখেছে৷ বন্দীদশা বোধহয় ভাল লাগছে না৷ সাপটা ছটফট করছে৷ মুখ হাঁ করে ভয় দেখাচ্ছে৷ কাছে যেতেই অঙ্কুশ বলল, ‘আমার ধারণা ভুল স্যার৷ ফিমেল পাইথনের ডিম থেকে দু’চারটে বাচ্চা অলরেডি বেরিয়ে এসেছে৷ এই দেখুন, একটা বাচ্চা এতটা পথ পেরিয়ে এসে লনে লুকিয়ে ছিল৷ ভাগ্যিস, জয়জিতের চোখে পড়েছিল৷’

মুখ দিয়ে একটা প্রশ্নই বেরিয়ে গেল চন্দ্রভানুর, ‘সাপ দেখে ও ভয় পায়নি?’

অঙ্কুশ হেসে বলল, ‘ভয় পাবে কেন? সাপ ধরার মন্তর যে আমি ওকে শিখিয়ে দিয়েছি৷ সেইসঙ্গে এও বলেছি, সাপ মেরে ফেলতে নেই৷’

(ছত্রিশ)

গোলাপি এসেই হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করে বলল, ‘মা, আমি এসে গেছি৷’

ওকে দেখে মনে মনে খুশি হলেন তরিতা৷ কিচেনের সামনে ফাঁকা জায়গায় পাখিদের খাওয়ানোর কাজটা সদ্য সেরেছেন তিনি৷ শান্তির সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন তখন৷ গোলাপিকে দেখে বললেন, ‘তুই কার সঙ্গে এলি? তোর তো আসার কথা ছিল গত পরশু?’

গোলাপি বলল, ‘বাবার সঙ্গে এলাম মা৷ পরশু আর কাল মহেশপুরে দাদার বাড়িতে ছিলাম৷ ষাঁড়াষাঁড়ির বানের জন্য আমরা আটকে পড়েছিলাম৷’

‘তোর বাবা এখন কোথায় রে? তাকে আমার ভীষণ দরকার৷’

‘বাবা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আচে৷’

‘দূর বোকা, বাবাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? যা, আমার কাছে নিয়ে আয়৷’

‘ এখুনি ডেকে আনচি মা৷ তোমার কাছে আসতে লজ্জা পাচিচল৷’

গোলাপি চলে যাওয়ার পর শান্তি বলল, ‘এই সেই নিবারণ, তাই না? ওর কাছ থেকে জমির ব্যাপারে সব জেনে নিন ম্যাডাম৷ ডিলটা হয়ে গেলে আমাদের ফিফটি পার্সেন্ট কাজ এগিয়ে যাবে৷’

‘সে তো বলবই৷ কিন্তু নেত্রাটা গেল কোথায় বল তো? ও থাকলে কথা বলায় সুবিধে হত৷’

‘নেত্রাদি মুকুন্দ খুটদারকে নিয়ে আসতে গেছে৷ বলাইয়ের ভ্যানরিকশায় গেছে৷ এই এল বলে৷’

সেই রকমই কথা ছিল৷ টাইগার ক্যাম্প রিসর্টের আধ কিলোমিটার দূরে নদীর ধারেই একটা গেস্ট হাউস আছে৷ নাম রিভার সাইড৷ তারই মালিক হলেন মুকুন্দ খুটদার৷ যাতায়াতের পথে গেস্ট হাউসটা চোখে পড়েছে তরিতার৷ খুব বেশিদিনের পুরনো নয়৷ আর দু’তিনদিনের মধ্যেই টাইগার ক্যাম্প ছেড়ে দিতে হবে৷ তাই নেত্রা গিয়ে কথা বলেছিল মুকুন্দ খুটদারের সঙ্গে৷ তরিতা একবছরের জন্য গেস্ট হাউস বুক করতে চান শুনে খুটদার নিজেই দেখা করতে চেয়েছেন৷ তরিতা ঠিক করে রেখেছেন, উদয়শঙ্কর অনুরোধ করলেও আর টাইগার ক্যাম্পে ফিরে আসবেন না৷

এভিএস তৈরির ইউনিট চালু করার কাজ খুব ঢিমেতালে এগোচ্ছে৷ পুরো নকশার দায়িত্ব নিয়েছেন অ্যান্টনি গোমস৷ মাঝে কলকাতা থেকে উনি একবার ফোন করেছিলেন৷ জানিয়েছেন, দয়াপুরে এসে একবার কথা বলতে চান৷ ভদ্রলোক পাকাপাকিভাবে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন৷ কেননা, ওঁর দুই ছেলে ওখান থেকে তাগাদা দিচ্ছেন৷ গোমস অবশ্য কথা দিয়েছেন, এভিএস ইউনিট তৈরি করে দেওয়ার পর তিনি মেলবোর্নে যাওয়ার কথা চিন্তা করবেন৷ ওঁর দুই অ্যাসিস্ট্যান্টের মধ্যে একজন চেন্নাই থেকে আসবেন৷ অন্য জন অঙ্কুশ মিত্রের আসার কথা ছিল দিন পনেরো আগে৷ বারদুয়েক অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করল৷ এই রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলের মধ্যে এডবেরি কী দেখলেন, কে জানে? ছেলেটা এলে তরিতা ঠিকই করেছেন

বলে দেবেন, আপনাকে দরকার নেই৷

গোলাপি ওর বাবা নিবারণকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে৷ সাদা ফতুয়া, হাঁটুর উপর ধুতি পরা সাধাসিধে টাইপের একটা লোক৷ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ প্রথমেই জমির কথা তোলার দরকার নেই৷ তরিতা তাই বললেন, ‘বোসো নিবারণ৷ গোলাপির ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে৷’

কংক্রিটের বেঞ্চে নিবারণ অবশ্য বসল না৷ দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, ‘বলুন, মা৷’

‘গোলাপিকে যদি আমি রেখে দিই, তা হলে কি তোমার কোনও আপত্তি আছে?’

‘আবনার এখেনে ও কী করবে মা? আমার মেয়া নেখাপড়া কিছু জানে না৷ ওর বয়স হয়েচে৷ এ বার বিয়া দিতে হবে৷ পাত্তর ঠিক করা আচে৷’

‘পাত্তরটা কে নিবারণ? পরাণ? তার সম্পর্কে তুমি কি খোঁজ খবর নিয়েছ?’

‘সে দয়াপুরেরই ছেলে মা৷ ওর সনে বিয়া হলে গোলাবি এই গেরামেই থাকতে পারবে৷’

‘পরাণের যে আর একটা বউ আছে, তুমি জানো?’

শুনে নিবারণ চমকে উঠল৷ গোলাপির দিকে একবার তাকিয়ে তার পর বলল, ‘না তো! আবনি জানলেন কী করে?’

‘খোঁজ নিয়ে দ্যাখো৷ তার নাম ডালিম৷ সে বউ বালি দ্বীপে থাকে৷’

‘আবনি ঠিক জানেন মা? কেউ ভাংচি দেয় নে তো?’

‘শোনো নিবারণ, আমি না জেনে কোনও কথা বলি না৷ গোলাপির বিয়ের জন্য তোমায় চিন্তা করতে হবে না৷ ওর বিয়ে আমি দেব৷ পাত্র আমি ঠিক করে রেখেছি৷’

কথাগুলো শুনে নিবারণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ সম্ভবত হজম করতে ওর কষ্ট হচ্ছে৷ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ও বলল, ‘পাত্তর কোথাকার মা?’

‘সেও এই দয়াপুর গ্রামেরই ছেলে৷ তার কথা পরে বলব৷ তুমি কি জানো, পরাণকে গোলাপি পছন্দ করে না? পরাণের মতো গেঁজেলের সঙ্গে বিয়ে হলে ওর জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে৷ তার থেকে বরং গোলাপি আমার কাছে থাকুক৷ আমার এখানে ও চাকরি করবে৷ পাঁচ হাজার টাকা মাইনেও পাবে৷ এবার তোমার মত কী বলো৷’

‘দেকি, ওর দাদার সনে একবার কতা কইতে হবে৷’

‘সে তুমি যা ভাল মনে করো… করতে পারো৷ কিন্তু তোমায় এও বলে দিচ্ছি, গোলাপির ইচ্ছের বিরুদ্ধে যদি কিছু করতে যাও, তা হলে তোমরা সবাই মা মনসার কোপে পড়বে৷’

শুনে নিবারণ ভয় পেল বলে মনে হল তরিতার৷ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে মা৷ আমরা তা’লে আজ যাই৷’

 ‘না৷ তোমার সঙ্গে এখনও আমার কথা শেষ হয়নি৷ এখানে মিত্তির বাড়ির যে জমিটা তুমি দেখাশুনো করো, সেটা কী অবস্থায় আছে বলো তো?’

‘সে জমির মালিক একন ছোটদাদাবাবু৷’

‘তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?’

‘উনি দু’একদিনের মধ্যেই দয়াপুরে আসবেন৷’

‘শুনেছি, ওই জমিতে না কি এখন চাষবাস হয় না৷ তোমার ছোটদাদাবাবু জমিটা নিয়ে কী করতে চান, কিছু বলেছেন?’

‘উনি চাষ করার কতা ভাবচেন৷’

শুনে শান্তির সঙ্গে একবার চোখাচোখি করলেন তরিতা৷ তার পর বললেন, ‘জমিটার দাম কত হতে পারে বলে তোমার মনে হয় নিবারণ?’

‘কইতে পারব না মা৷ আবনি গোলাবির দাদার সনে এগবার কতা কইতে পারেন৷ সে জমির দালালি করে৷ হেড়োভাঙায় শুধু তো জমি লয়, জমির সঙ্গে দশ কামরার একটা বাড়িও আচে৷ কত্তাবাবুরা আগে মাঝে মাঝে সেখানে এইসে থাইকতেন৷’

‘তুমি কি এখন সেই বাড়িতেই থাকো?’

‘ঠিক বাড়ির ভিতরে লয়৷ কত্তারাই এক টুগরো জমি দিয়েচিলেন বাড়ির বাইরে৷ ঘর বাঁধার জন্যি৷’

‘তোমার ছোটদাদাবাবুর ফোন নাম্বার দিতে পারো?’

‘গোলাবির কাছে আচে৷ ওর ঠেনে নিয়ে নিতে পারেন৷’

‘ঠিক আছে নিবারণে৷ তুমি যাও৷ গোলাপি আজ আমার এখানেই থাকুক৷ কাল আমাদের লোক ওকে তোমার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবে৷’

প্রণাম করে নিবারণ বেরিয়ে যাওয়ার পর তরিতা বললেন, ‘হ্যাঁ রে গোলাপি, মিত্তিরদের বাড়িটা কী অবস্থায় আছে রে?’

গোলাপি এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি৷ এ বার বলল, ‘আমি অনেকদিন যাইনি মা৷ আয়লার সময় বাড়িতে জল উটে গেছল৷ অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসে গেচে৷ তিন-চার বচর সে বাড়িতে কেউ থাকেনে৷ বাবা বলচিল, দোতলার ঘরগুনো ঠিগ আচে৷’

‘তোর ছোটদাদাবাবু না কে… কী রকম মানুষ?’

‘খুব ভালমানুষ মা৷’

‘জমিটা যদি আমরা কিনতে চাই, তা হলে কি উনি বিক্রি করবেন?’

‘তুমি কতা বলে দেকো না মা৷ দাদাবাবুর ফোন লম্বরটা কি আমি দেবো?’

‘আমাকে দিতে হবে না৷ নেত্রা মাসি আসুক৷ ওকে দিস৷ এখন বল, সক্কালে কি কিছু খেয়ে এসেছিস? চল, ব্রেকফাস্ট করে আসি৷ আমার খুব খিদে পেয়েছে৷’

কাল দুপুরে রিসর্টে কয়েকজন গেস্ট এসেছেন৷ ডাইনিং হলে পৌঁছে তরিতা দেখলেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ব্রেকফাস্ট সারছেন৷ এঁরা সব দু’রাত্তির তিনদিনের ট্যুরে আসেন৷ শহুরে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ৷ অল্প সময়ের মধ্যেই সুন্দরবন দেখার স্বাদ নিয়ে ফেরেন৷ শান্তি আর গোলাপিকে নিয়ে এক কোণে তিনটে চেয়ারে বসার সময় তরিতা লক্ষ করলেন, তাঁকে নিয়ে ফিসফিসানি হচ্ছে৷ গেস্টদের দু’তিনজন তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন৷ কী শুনেছেন, কে জানে? সেদিকে মন না দিয়ে তরিতা বললেন, ‘শান্তি, সোনার মাকে চট করে আমার খাবারটা এনে দিতে বল৷ আর শোন, তোরা কী খাবি, সেটাও বলে দিস৷’

সকালে কর্নফ্লেক্স, দুধ আর কয়েক টুকরো ফল ছাড়া আর কিছু খান না তরিতা৷ কিচেনের সোনার মাকে তা বলা আছে৷ কোনওমতেই আমিষের ছোঁয়া যেন না লাগে৷ আমেরিকায় থাকার সময় থেকেই নিরামিষে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন তরিতা৷ তাতে শরীর ভাল থাকে৷ এই রিসর্ট আর তিনদিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে, ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তরিতার৷ এখানে রিসর্টের সব কর্মীর সঙ্গে একটা অন্য রকম সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷ রিভার সাইড গেস্ট হাউস কেমন হবে, কে জানে? তখনই নেত্রার কথা মনে হল তরিতার৷ ওর এত দেরি হচ্ছে কেন? এতক্ষণে মুকুন্দ খুটদারকে নিয়ে ওর চলে আসা উচিত ছিল৷

উল্টোদিকের চেয়ারে বসে গোলাপি বোধহয় কিছু বলার জন্য উসখুস করছে৷ মেয়েটাকে মাসখানেক আগে দেখেছিলেন তরিতা৷ অদ্ভুত মায়া মাখানো মুখ৷ দেখে মনেই হয় না, এত সাহসী৷ মেয়েটার হাইটও বেশ ভাল৷ বলাইয়ের সঙ্গে খুব মানাবে৷ এক পলক তাকিয়ে তরিতা নিজেকেই যেন দেখতে পেলেন৷ ক্যানিংয়ের সেই তরিতাকে৷ স্নেক ইউনিটে মেয়েটা কাজে আসবে৷ মহেশপুরে গোলাপি বলেছিল, সাপের বিষ বের করে আনতে পারে৷ বিজ্ঞানসম্মতভাবে পারে কি না, তা তরিতা জানেন না৷ কে ওকে শিখিয়েছে, সেটা পরে জেনে নেবেন৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলবি না কি গোলাপি?’

গোলাপি বলল, ‘তুমি আমাকে বাঁচালে মা৷ পরাণের সঙ্গে বিয়ে হলে আমার জেবনটা হাল্লাক হয়ে যেত৷ বাবা খুব ভয় পেয়ে গেচে৷ বিয়ের ব্যাপারে আর এগোবে না৷’

‘মিত্তিরবাড়িতে তুই কী করতি রে?’

‘সবরকম কাজ করতাম৷ আমার যখন এগারো বচর বয়স, তখন বাবা কাজে লাগিয়ে দেচল৷’

‘সাপের বিদ্যা তুই শিখলি কার থেকে?’

‘ছোটদাদাবাবুর কাচ থেকে৷ ও বাড়িতে দাদাবাবুর অনেক পোষ্যপুত্তুর ছিল৷ চন্দ্রবোড়া, শঙ্খচূড়, কালাচ, গোখরো…৷ জানো মা, পিয়ারায় একবার আমি ময়াল সাপও ধরেছিলাম৷ বিশাল বড়৷ শয়তানটা আমার আঙুল কামড়ে খেয়েছিল৷ এই দেখো, আমার এই আঙুলটা আধখানা৷’

কথাগুলো বলে হাত তুলে দেখাল গোলাপি৷ দেখে বিশ্বাস হল না তরিতার৷ পিয়ারা বলে গ্রামে পাইথন আসবে কোত্থেকে? তিনি বললেন, ‘ময়াল সাপ ওখানে আসবে কী করে রে মেয়ে? সে তো নর্থবেঙ্গলের জঙ্গলে দেখা যায়৷’

‘না মা, আমি ঠিগ বলচি৷ ছোটদাদাবাবুকে তুমি জিজ্ঞেস কোরো৷ সেই পাইথন একন আচে কঙ্কণদীঘিতে এগজনের বাড়িতে৷ বিশাল বড়লোক৷ তাঁর নাম চন্দ্রভানু৷ এগটা নয়, দুটো পাইথন আচে তাঁর বাড়িতে৷ সেকেন্ড যেটা, আমি আর ছোটদাদাবাবু মিলে সেটাকে ধরে দেছলাম৷’

চন্দ্রভানু নামটা শুনে তরিতার ভ্রূ কুঁচকে উঠল৷ কোত্থেকে কী খবর চলে আসে৷ ক্ষমতা আর টাকা আছে বলে লোকটা যা ইচ্ছে তাই করে যাবে না কি? বন্যপ্রাণী আইন বলে একটা জিনিস আছে৷ জু অথরিটিকে জানিয়ে দিলে লোকটা অ্যারেস্ট হয়ে যাবে৷ তথ্যটা মনের কোণে সরিয়ে রেখে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর ছোটদাদাবাবুর সঙ্গে চন্দ্রভানু বলে লোকটার যোগাযোগ আছে না কি?’

‘আচে মা৷ একন তো ছোটদাদাবাবু ওঁনার বাড়িতেই আচে৷ পাইথনের না কি বাচ্চা হয়েচে৷’

তা হলে এই সেই ছেলেটা না কি? যে চন্দ্রভানুর নাতিকে অ্যান্টি ভেনম সিরাম দিয়ে বাঁচিয়েছিল? মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ উঁকি দিল তরিতার৷ গোলাপির ছোটদাদাবাবুর নাম অঙ্কুশ কি না, তিনি জিজ্ঞেস করতে যাবেন, এমন সময় দেখলেন, বলাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নেত্রা এদিকেই আসছে৷ ওরা ডাইনিং রুমে ঢুকতেই তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল রে, মুকুন্দ খুটদারকে দেখছি না যে৷ সে এল না কেন?’

নেত্রা খুব উত্তেজিত৷ বলল, ‘চন্দ্রভানু শয়তানটা পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে দিদি৷ দু’তিনদিন ধরে খুটদার এককথা বলে গেল৷ আজ বলছে, গেস্ট হাউসের সব রুম বুক হয়ে গেছে৷ আমাদের দিতে পারবে না৷’

শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন তরিতা৷ বললেন, ‘তুই চেপে ধরলি না কেন?’

‘ধরেছিলাম৷ ইরেভেলেন্ট কথা বলতে শুরু করল৷ বলল, দিদি আমায় মাফ করে দিন৷ আপনাদের রুম দিলে আমি মার্ডার হয়ে যাব৷ অলরেডি আমার উপর একবার অ্যাটেম্পট হয়ে গেছে৷’

‘খুটদার আসলে কোথাকার লোক, খোঁজ নিয়েছিস?’

‘থাকে বাসন্তীতে৷ রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসা করে পৈলানের দিকে৷ সেই টাকায় গেস্ট হাউস বানিয়েছে এখানে৷ তবে গেস্ট হাউসটা সম্ভবত ওকে ভেঙে ফেলতে হবে৷ নদীর দুশো মিটারের মধ্যে করেছে বলে অলরেডি নোটিশ খেয়েছে৷ গেস্ট হাউসটা ঘুরে দেখলাম দিদি৷ খুব বদনাম আছে৷ সব বাজে লোকের আড্ডা৷ শুক্কুর, শনি, রবি এই তিনদিন লোকে স্ফূর্তি করতে আসে৷ মদ, মেয়েছেলে, জুয়া৷ বাকি দিনগুলোতে ফাঁকা পড়ে থাকে৷ আমার কী মনে হল দিদি জানো, মা মনসা যা করেন, মঙ্গলের জন্য৷ ওখানে শান্তিতে আমরা কাজ করতে পারতাম না৷’

‘কে খুটদারকে ভয় দেখিয়েছে, নামটা বলল?’

‘কিছুতেই বলল না৷ কথায় কথায় অবশ্য বলে ফেলল, দিদি, আমার গেস্ট হাউসে দুটো মার্ডার হয়ে গেছে৷ অনেক কষ্টে পুলিশের হাত থেকে বেঁচেছি৷ আপনাদের আমি অন্য রিসর্টে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷ দয়া করে আপনারা আমায় ছেড়ে দিন৷’

‘সেই রিসর্টটা কত দূরে?’

‘নদীর ও পারে৷ পাখিরালায়৷ আমরা একবার সেখানে গেছিলাম৷ তোমার কি মনে আছে, মিঃ গোমস প্রথমে ওখানেই এসে উঠেছিলেন৷ রিসর্টটার নাম সলিটারি ন্যুক৷’

সঙ্গেসঙ্গে তরিতার মনে পড়ল৷ সাত-আটটা কটেজ আছে৷ বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ অন্তত মাসখানেকের জন্য ওখানে গিয়ে থাকা যায়৷ কিন্তু চন্দ্রভানু যদি সত্যিই কলকাঠি নেড়ে থাকে, তা হলে তো সলিটারি ন্যুকে গিয়েও ওর লোক ভয় দেখাবে৷ নিশ্চয়ই কারো না কারোর কাছ থেকে ও খবর পেয়ে যাচ্ছে৷ গলা নীচু করে তরিতা বললেন, ‘সলিটারি ন্যুকে কথা বলেছিস?’

‘বলাইকে এ পারে রেখে আমি নৌকো ভাড়া করে পাখিরালায় চলে গেছিলাম৷ কপাল ভাল, মালিক গোপাল দাসের সঙ্গেও কথা হয়ে গেল৷ এই ভদ্রলোক থাকেন টালিগঞ্জের দিকে৷ উনি রাজি হয়ে গেছেন৷ পাখিরালায় আমরা একসঙ্গে যাব না৷ একজন দু’জন করে শিফট করে যাব৷’

‘এ তো না হয় টেম্পোরারি সলিউশন হল৷ পার্মানেন্ট কী ব্যবস্থা করা যায়, ভাব তো? আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে৷ হেড়োভাঙার যে জমিটা কেনার কথা হচ্ছে, তার কেয়ারটেকার হল আমাদের গোলাপির বাবা নিবারণ৷ সে বলল, জমির সঙ্গেই নাকি একটা বাড়ি আছে৷ আমার মনে হল, জমিটা যদি পাওয়া যায়, তা হলে বাড়িটা রিনোভেট করে নেওয়া যেতে পারে৷ তা হলে মন্দ হয় না, কী বলিস? গেস্ট হাউসের খরচাটা লাগবে না৷ আবার ইউনিটের লাগোয়া একটা বাড়িতে থাকাও যাবে৷’

‘তা হলে তো খুব ভাল হয় দিদি৷ কিন্তু নিবারণ কী বলল, জমিটা পাওয়া যাবে?’

‘ও তো বলল, মালিক না কি এখানে এসে চাষবাস করার কথা ভাবছে৷ তুই এক কাজ কর৷ গোলাপির কাছে মালিকের মোবাইল নাম্বার আছে৷ কাল তাকে ফোন করিস৷’

নেত্রা এতক্ষণ গোলাপিকে লক্ষই করেনি৷ ওকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে বলল, ‘ যাক, শেষ পর্যন্ত তুই তা’লে মায়ের কাছে এলি৷ আমাদের সঙ্গে থাকবি তো? না কি বাপের কাছে চলে যাবি?’

গোলাপি হঠাৎ কেমন যেন জড়সড় হয়ে গেছে৷ মুখ নীচু করে বলল, ‘একানেই থাকব দিদি৷’

নেত্রা ঠাট্টা করল, ‘তোকে দেখতে এত সুন্দর লাগছে কেন রে গোলাপি?’

শান্তি ফুট কাটল, ‘বিয়ের কথা শুনে৷ ম্যাডাম ওর বিয়ে দেবেন বলছেন৷’

ওদের খুনসুটি শুনে তরিতা মুখ টিপে হাসছেন৷ নেত্রা জিজ্ঞেস করছে, পাত্তরটা কে? নেত্রা তো আর জানে না, পাত্তর উল্টো দিকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ গোলাপিকে আগে কখনও সে দেখেনি৷ হাঁ করে সে গোলাপির দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ তেইশ-চবিবশ বছরের জোয়ান ছেলে৷ বলাইয়ের চোখের ভাষা পড়ে নিতে অসুবিধে হল না তরিতার৷ এর মাঝে চার চোখ এক হয়ে গেছে না কি? গোলাপির লজ্জা অবনত মুখটার দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে হাসলেন৷

(সাঁইত্রিশ)

‘দাদাবাবু, তুমি একেনে?’ সলিটারি ন্যুকে ওকে দেখেই গোলাপি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল৷

গোলাপিকে দেখতে পেয়ে অঙ্কুশও কম অবাক হয়নি৷ ওর তো দয়াপুরে নিবারখদার কাছে থাকার কথা৷ পাখিরালায় এল কী করে? অঙ্কুশ বলল, ‘আগে বল, তুই এখানে কী করে?’

‘আমি তো তরিতা মায়ের একানে চাগরি কচিচ৷’

তরিতা নামটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল অঙ্কুশ৷ এই সেই মহিলা নাকি, যাঁর সঙ্গে চাকরির ব্যাপারে মিঃ এডবেরি দেখা করতে বলেছিলেন? কিন্তু তা কী করে হবে? তিনি তো দেখা করতে বলেছিলেন দয়াপুরের টাইগার ক্যাম্প রিসর্টে৷ গোলাপিকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে মিত্রা ম্যাডাম বলে কে আছে রে?’

গোলাপি উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘মিত্রা নয়৷ নেত্রা মাসি৷ জমির ব্যাপারে কতা বলার জন্য পরশু যে তোমাকে ফোন করেচিল৷ নাম্বারটা আমিই মাসিকে দিয়েচিলাম৷’

‘হ্যাঁ, সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য এসেছি৷’

‘মাসি এখন কিচেনের দিকে আচে৷ ডেকে আনচি৷ ততক্ষণ তুমি ডাইনিং হলে এসে বোসো৷’

কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে গোলাপি ভিতরের দিকে চলে গেল৷ ডাইনিং হলে বসে অঙ্কুশ দেখল, বাহ, রিসর্টটা খুব সুন্দর সাজানো গোছানো৷ মাথার উপর গোল ছাদ৷ সেখান থেকে বাহারি আলো ঝুলছে৷ রট আয়রনের চেয়ার-টেবলগুলোও বেশ আধুনিক৷ সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়, সবুজ ধানের খেত৷ ডিনার বা লাঞ্চ করার সময় মনে হবে, যেন প্রকৃতির মাঝে বসে পিকনিক চলছে৷ গেট দিয়ে ঢুকলেই রাস্তার একপাশে ছোট্ট একটা পুকুর৷ তাতে পদ্মফুল ফুটে আছে৷ হাঁস চরে বেরাচ্ছে৷ পুকুরের ডান পাশে সুন্দর সুন্দর কটেজ৷ দেখে মনে হবে, মাটির বাড়ি৷ কিন্তু আসলে তা নয়৷ কটেজগুলোতে মেটে রঙই করা হয়েছে, সেইভাবে৷ রিসর্টের পিছন দিকে সবজির বাগান৷ এখন খুব বেশি লোকজন নেই বোধহয়৷ কেননা, গোলাপি ছাড়া আর কাউকে অঙ্কুশের চোখে পড়েনি৷

আজ খুব ভোরে চন্দ্রভানুবাবুর দেওয়া গাড়িতে ও আর উষসী কঙ্কণদীঘি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল৷ উষসীকে মথুরাপুর স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে সেই গাড়িতে অঙ্কুশ গদখালি পর্যন্ত এসেছে৷ সেখানে থেকে লঞ্চ ধরে পৌঁছেছে পাখিরালায় টাইগার মোড় খেয়াঘাটে৷ একটা অল্প বয়সি ছেলে সেখানে ওর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ ভ্যান রিকশায় সে-ই সলিটারি ন্যুক বলে এই রিসর্টে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে৷ অবাক কাণ্ড, ছেলেটা উৎসাহ নিয়ে রিসর্টের ভিতরে ঢুকে আসছিল৷ কিন্তু গোলাপিকে দেখার পরই কেমন যেন থমকে গেল৷ কিট ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি যান স্যার৷’ বলেই আর দাঁড়াল না৷

ডাইনিং হলে বসে থাকার সময় অঙ্কুশের একবার মনে হল, ও ঠিক জায়গায় এসেছে তো? ফোনে জমির ব্যাপারে কথা বলার সময় কিন্তু ভদ্রমহিলা নামটা বলেছিলেন, মিত্রা ম্যাডাম৷ কিন্তু গোলাপি বলল, নামটা নেত্রা৷ এই নামে আরও একজনের সঙ্গে অঙ্কুশ ইতিমধ্যেই কথা বলেছে৷ তিনি এভিএস ইউনিট-এর মালকিন তরিতা ম্যাডামের অ্যাসিসট্যান্ট৷ ফোনে কিন্তু তাঁর গলাটা তখন অন্যরকম শুনিয়েছিল৷

এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গোলাপি এগিয়ে আসছে৷ বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মতো হবে৷ পরনে শিফনের রঙিন শাড়ি৷ ভদ্রমহিলাকে দেখে ঠিক বাঙালি বলে মনে হল না অঙ্কুশের৷ চেহারা খানিকটা গাড়োয়ালিদের মতো৷ কিন্তু চোখমুখে অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ৷ ওঁর হাতে একটা ট্রে৷ তাতে চায়ের কাপ থেকে ধুঁয়ো উঠছে৷ ডাইনিং হলে পা দিয়েই মিষ্টি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘গুড মর্নিং অঙ্কুশ৷ আমি নেত্রা৷ পরশু আমিই আপনার সাথে কথা বলেছিলাম৷’

অঙ্কুশ উঠে দাঁড়িয়ে পাল্টা নমস্কার করল৷ নেত্রা বললেন, ‘আমাদেরই আপনার কাছে ছুটে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু, আপনি যেখানে ছিলেন, সেখানে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ আমাদের লোকবলও কম৷ তাই আপনাকে এখানে চলে আসতে বললাম৷’

অঙ্কুশ পাল্টা সৌজন্য দেখিয়ে বলল, ‘এমনভাবে বলার দরকার নেই ম্যাডাম৷ আমি তো দয়াপুরে আসতামই৷ তাই রাজি হয়ে গেলাম৷’

‘আপনার আর দয়াপুরে যাওয়ার দরকার নেই ভাই৷ দয়াপুরে আপনি যাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, তিনি এখন এখানে৷ আপনার তরিতা ম্যাডামসহ আমরা সবাই দয়াপুর থেকে এখানে চলে এসেছি৷’

‘এভিএস ইউনিটটা তা হলে…’

‘হ্যাঁ, আমরাই করছি৷ কিন্তু আপনার তো আসার কথা দিন পনেরো আগে৷ অ্যাদ্দিন কী করছিলেন?’

‘সরি ম্যাডাম৷ প্রথমবার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ফেল করেছিলাম, আমার এক রিপোর্টার বন্ধুর সঙ্গে জলদস্যুর ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে৷ লোভ সামলাতে পারিনি৷ আর এ বার গোলাপি জানে, ষাঁড়াষাঁড়ির বানের জন্য কেন আটকে গেলাম৷’

‘জলদস্যু মানে পাইরেটস? ভেরি ইন্টারেস্টিং৷ সত্যি দেখা পেয়েছিলেন না কি?’

‘হ্যাঁ৷ সে এক রেয়ার এক্সপিরিয়েন্স৷ এখানকার সবথেকে ভয়ঙ্কর জলদস্যু পালান সর্দার৷ তাকে নিয়ে এখানে অনেক মিথ৷ সমুদ্র থেকে ফেরার সময় মাছভর্তি ট্রলার আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করে সে৷’

‘কেন, এখানে পুলিশ বা কোস্টাল গার্ড নেই?’

‘পালানের সঙ্গে তারা পেরে ওঠে না৷ সুন্দরবনে হেলিকপ্টারে চক্কর মেরেও তার খোঁজ পাওয়া যায় না৷ এমন গোপন খাঁড়িতে সে ট্রলার লুকিয়ে রাখে৷’

শুনে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন নেত্রা ম্যাডাম৷ তার পর প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ‘আপনার জন্য রুম বুক করা আছে৷ আপাতত সেখানে গিয়ে রেস্ট নিন৷ ঠিক দশটার সময় তরিতা ম্যাডাম দেখা করবেন৷ জমির ব্যাপারে উনিই কথা বলবেন৷ গোলাপি গিয়ে আপনাকে ডেকে আনবে, কেমন? এখানে রুম সার্ভিস আছে৷ কী ব্রেকফাস্ট করতে চান, ফোন করে বলে দিলেই হবে৷’

কথাগুলো বলে নেত্রা ম্যাডাম ইশারা করলেন গোলাপিকে৷ কিট ব্যাগটা তুলে নিয়ে গোলাপি বলল, ‘এসো দাদাবাবু৷ ল্যাপটপের ব্যাগটাও আমায় দাও৷’

ঘরে ঢুকে অঙ্কুশ সত্যিই অবাক হয়ে গেল৷ ডাবল বেড খাট, চেয়ার-টেবল, ওয়ারড্রোব সব রুচিসম্মত সাজানো৷ অ্যাটাচড বাথরুমও আছে৷ গোলাপি এসি চালিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল অঙ্কুশ৷ ঠাণ্ডা বাতাসে ওর শরীরটা স্নিগ্ধ হয়ে গেল৷ জীবনটা এখন থেকে কোন খাতে বইবে, অঙ্কুশ তা আন্দাজ করতে পারছে না৷ তবে, এটুকু বুঝতে পারছে, আজ থেকে ওর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হল৷ এডবেরি সাহেবের চিঠিতে লেখা ছিল, তরিতা ম্যাডাম এখানে এভিএস ইউনিট তৈরি করতে চান৷ এ রকম একটা ইউনিট বাংলায় এই মুহূর্তে খুব দরকার৷ ওরা বিভিন্ন সেমিনার বা ওয়ার্কশপে বোঝানোর চেষ্টা করে, স্নেকবাইট ভিক্টিমদের কেউ যেন ওঝাদের কাছে নিয়ে না যায়৷ হাসপাতাল বা হেলথ সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার কথাও আবার ওরা জোর দিয়ে বলতে পারে না৷ কেননা, জেলার হাসপাতাল বা হেলথ সেন্টারগুলোয় অ্যান্টি ভেনম সিরামের স্টক থাকে না বললেই চলে৷ সেখানে গিয়ে লাভটা কী?

তরিতা ম্যাডামের উদ্যোগটা নিঃসন্দেহ ভাল৷ নেট সার্চ করে ভদ্রমহিলা সম্পর্কে অঙ্কুশ যা জেনেছে, তাতে ওর শ্রদ্ধা দশগুণ বেড়ে গিয়েছে৷ এদেশে সাপের লেজ নিয়ে টানাটানি করতে পারলেই লোকে নিজেকে হারপেটোলজিস্ট বলে দাবী করে৷ কিন্তু ভদ্রমহিলা দিল্লির ইউনিভার্সিটিতে জুলজি নিয়ে মাস্টার্স করার পর ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে চলে যান৷ সেখানে ওফিওলজি নিয়ে ডক্টরেট করেছেন৷ শুধু তাই নয়, ওখানকার সার্পেন্টেরিয়ামে দীর্ঘদিন কাজও করেছেন৷ এমন একজন সর্পবিজ্ঞানী ইচ্ছে করলে এ দেশে বড় সরকারী চাকরি করতে পারতেন৷ কিন্তু তা না করে উনি এভিএস ইউনিট তৈরি করার কথা ভাবছেন৷ তাও দয়াপুরের মতো এক প্রত্যন্ত গ্রামে! এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? নেটে তরিতা ম্যাডাম নিয়ে আরও অনেক খবর দেখেছে অঙ্কুশ৷ মায়ামিতে উনি না কি একবার বিষাক্ত সাপেদের ঘরে দীর্ঘ সময় থেকে আমেরিকায় রেকর্ড করেন৷ ওখানকার খবরের কাগজ তখন ওঁকে স্নেকলেডি বিশেষণ দিয়েছিল৷

অঙ্কুশ নিজে চেন্নাই ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছিল৷ সরীসৃপ বিদ্যায় ওর অভিজ্ঞতাও কম নয়৷ ও আরও গবেষণা করতে চাইছিল৷ আলিপুর চিড়িয়াখানায় চাকরি পেলে সারা জীবন রেপ্টাইলস নিয়েই পড়ে থাকত৷ কিন্তু ওরা এখনও পর্যন্ত কিছু জানাল না৷ অ্যাপ্লিকেশনে পিয়ারার বাড়ির ঠিকানা দেওয়া ছিল৷ জু থেকে যদি কোনও চিঠি পাঠায়, তা হলে অঙ্কুশ জানতেও পারবে না৷ ও বাড়ির কেউ চিঠির কথা ওকে জানাবে কি না সন্দেহ৷ বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় ও ভাবল, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য৷ মিত্তিরবাড়ির কারোর কথা ও আর মাথাতেই আনবে না৷ টিটো… হ্যাঁ শুধু ওই টিটোর জন্যই মাঝে মাঝে ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়৷ কী আর করা যাবে৷

ঘড়িতে প্রায় সোয়া ন’টা বাজে৷ স্নান করে পোশাক বদলে তরিতা ম্যাডামের কাছে যাবে ভেবে, অঙ্কুশ উঠে দাঁড়াল৷ আর তখনই ওর মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করল৷ সেটটা তুলে ও দেখল, জয়ের ফোন৷ প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ওর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই৷ সুইচ অন করে অঙ্কুশ বলল, ‘ কী ব্যাপার রে, তোর কোনও পাত্তা নেই?’

‘ইন্ডিয়াতে ছিলাম না রে৷ গালফে গিয়েছিলাম৷ ইন্ডিয়ার কয়েকজন জার্নালিস্টকে আমেরিকান গভর্মেন্ট নিয়ে গিয়েছিল৷ গালফে ওদের একটা যুদ্ধজাহাজ দেখাতে৷ ইউনিক এক্সপিরিয়েন্স হল৷ কেন তুই আমাদের কাগজ দেখিসনি৷ কালই তো আমার বিরাট একটা আর্টিকেল ছিল রোববারের পাতায়৷’

গত দু’তিনদিন দৈনিক বাংলা কাগজটায় চোখ বোলানোর সময় পায়নি অঙ্কুশ৷ উষসীর ছবি তোলা নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল৷ ও বলল, ‘না রে৷ পড়ার সুযোগ পাইনি৷ এই ক’দিন আমি ছিলাম কঙ্কণদীঘিতে৷’

‘মানে… চন্দ্রভানুবাবুর বাড়িতে? যাঁর বাড়িতে পাইথন আছে?’

‘হ্যাঁ৷ ফিমেল পাইথনটা বাচ্চা দিয়েছে৷ সেই কারণেই আমি ব্যস্ত ছিলাম৷’

‘আরে, এটা তো বড় খবর৷ বন্দি অবস্থায় ময়াল সাপ বাচ্চা দিয়েছে৷ বাচ্চাসহ পাইথনটার ছবি পাওয়া যাবে? কেউ তুলেছে?’

চট করে উষসীর মুখটা ভেসে উঠল৷ অঙ্কুশ বলল, ‘হ্যাঁ, একজনের কাছে আছে৷ তার কাছে দারুণ সব ছবি পাবি৷’

‘তুই কি এখনও কঙ্কণদীঘিতেই আছিস? তা হলে কালই আমি চলে আসছি৷’

‘না রে, আমি এখন পাখিরালা বলে একটা জায়গায় আছি৷’

‘ওখানে কী করতে গেছিস?’

‘চাকরির ইন্টারভিউ দিতে৷’

শুনে জয় যেন বিরক্ত হল৷ বলল, ‘তোর কি হয়েছে বল তো অঙ্কুশ? তোর মতো হাইলি কোয়ালিফায়েড অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্সড একটা ছেলে, সে কি না গ্রামে একটা সামান্য চাকরি নিয়ে পড়ে থাকবে? জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর অশোক চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার ভাল পরিচয় আছে৷ তাঁকে তোর কথা বলব না কি? তোর মতো ছেলে পেলে ওঁরা লুফে নেবেন৷’

‘এখন থাক৷ এখানে যদি ভাল না লাগে, তা হলে তখন তোকে বলব৷’

‘তোর যেমন মর্জি৷ একটা কাজ কর৷ পাইথনের ছবি যাঁর কাছে পাওয়া যাবে, তাঁর নাম আর ফোন নাম্বারটা তুই এখুনি আমায় মেসেজ করে দে৷ আগে স্টোরিটা করি৷ পরে কথা বলব তোর সঙ্গে৷’

… আধঘণ্টা পর স্নান আর ব্রেকফাস্ট সেরে গোলাপির সঙ্গে অঙ্কুশ যখন তরিতা ম্যাডামের ঘরে ঢুকল, তখন উনি একটা ফাইলে মুখ ডুবিয়ে রয়েছেন৷ উনি মুখ তুলে তাকাতেই অঙ্কুশ চমকে উঠল৷ মুখটা কোথায় যেন দেখেছে৷ ভদ্রমহিলা সম্ভবত চোখে লেন্স ব্যবহার করেন৷ চোখে অদ্ভুত সম্মোহন ক্ষমতা রয়েছে৷ অপূর্ব সুন্দরী তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ উল্টোদিকের চেয়ার দেখিয়ে তরিতা ম্যাডাম বললেন, ‘বোসো৷ তুমি করে বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো?’

তখনই অঙ্কুশের মনে পড়ল, মুখটা কোথায় দেখেছে৷ হঠাৎ ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘ম্যাম, আজ গদখালি দিয়ে আসার সময় খেয়াঘাটে মনসা মন্দিরে প্রণাম করতে গেছিলাম৷ প্রতিমার মুখটার সঙ্গে আপনার মুখের অদ্ভুত মিল আছে৷’

তরিতা ম্যাডাম স্মিত হেসে বললেন, ‘তাই না কি? তুমি কি মা মনসার খুব ভক্ত?’

অঙ্কুশ বলল, ‘আমি সর্পবিদ্যার্চ্চা করি৷ মা মনসার ভক্ত না হয়ে পারি? আমাদের পিয়ারার বাড়িতে খুব ধুমধাম করে মা মনসার পুজো হয়৷ বড়মা পালাগানের আয়োজনও করতেন৷’

‘মা মনসাকে কি তোমার দেবী বলে মনে হয়?’

‘জন্মসূত্রে তো উনি দেবীই৷ কিন্তু দেবিত্ব অর্জন করার জন্য ওঁকে যতটা ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে, লড়াই করতে হয়েছে, আর কোনও দেবদেবীকে তা করতে হয়নি৷ এটাই দুর্ভাগ্যের৷’

‘তুমি কী বলছ, আমি বুঝতে পারছি না৷’

‘ম্যাম, মনসামঙ্গল পড়া থাকলে বুঝতে আপনার কষ্ট হত না৷ ছোটবেলা থেকে পালাগান শুনে আমরা বড় হয়েছি৷ তাই মনসা বৃত্তান্ত জানি৷ মা মনসা হলেন শিবের কন্যা৷ অথচ শিব তাঁর সঙ্গে পিতৃসুলভ আচরণ করেননি৷ মা মনসার জন্ম হয়েছে পাতালে৷ বড় হয়েছেন জনবিরল এক উদ্যানে৷ একটা বয়স পর্যন্ত তিনি পারিবারিক বৃত্তে থাকার সুযোগই পাননি৷ শিব একটা সময় মনসাকে ঘরে নিয়ে এলেন৷ কিন্তু সৎমা চণ্ডী তাঁকে ভাল মনে গ্রহণ করলেন না৷ শিবের অন্য ছেলে-মেয়েরা জন্মসূত্রেই দেব-দেবী৷ অথচ মনসা সেই স্টেটাস পেলেন না৷ আপনার কি মনে হয় না, মা মনসার প্রতি চরম অন্যায় করা হয়েছে?’

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং৷ তুমি আর কী জানো মা মনসা সম্পর্কে?’

‘দেখুন ম্যাম, বাবা হিসেবে শিব কখনই তাঁর কর্তব্য পালন করেননি৷ প্রতিটি ঘটনায় তিনি মা মনসাকে অবজ্ঞা করেছেন৷ পালাগানে যতদূর শুনেছি, তাতে শিবের চরিত্রটাই ন্যাক্কারজনক৷ কখনও তাঁকে সেক্স ম্যানিয়াক বলে মনে হয়৷ কখনও স্ত্রৈণ৷ শিব ও চণ্ডী সবসময় মা মনসাকে হেনস্থা করেছেন৷ মনসার যখন বিয়ের কথা উঠল, তখন দেববংশের কেউ তাঁর কপালে জুটল না৷ নারদের কথায়, শিব তাঁকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন এক মানুষের সঙ্গে৷ হ্যাঁ, জরৎকারু খুব উচ্চবংশীয় ছিলেন৷ তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ তবে কথা হল, দেবকন্যাদের আর কারোর সঙ্গে কিন্তু মানুষের বিয়ে হয়নি৷ মনসাই ব্যতিক্রম৷ মেয়েকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা৷ তবুও এই অন্যায়টা মেনে নিয়েছিলেন মা মনসা৷ কী দুর্ভাগ্যের, বিবাহিত জীবনের সুখ তাঁর কপালে এক রাত্তিরের বেশি জুটল না৷’

‘কিন্তু আমরা তো জানি, মা মনসা ভীষণ কুটিলা, প্রতিহিংসাপরায়ণা ছিলেন৷ মা চণ্ডীকে তিনি মেরে ফেলে ছিলেন৷ স্বামী জরৎকারুকেও বিষে জর্জরিত করে দিয়েছিলেন৷’

‘কথাটা সত্যি৷ কিন্তু কেন মা চণ্ডীকে মেরে ফেলবেন না, বলুন৷ সৎমায়ের অত্যাচার তিনি সহ্য করতে পারেননি৷ তাই ক্রোধে বিষপ্রয়োগ করেন৷ মনসামঙ্গলের এই অংশটা কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না ম্যাডাম৷ আপনিই ভাবুন না, যিনি জগৎজননী, জগতের রক্ষাকারিণী, সেই মা চণ্ডীকে মনসা কী করে মেরে ফেলবেন? তাঁর এত ক্ষমতা কী করে হতে পারে? এটা মঙ্গলকাব্যকারদের বানানো গল্প৷ যাতে মা মনসাকে খলনায়িকা করে দেওয়া যায়৷ কিন্তু, তা তাঁরা করতে পারেননি৷ আমার তো মনে হয়, মা মনসা ঠিকই করেছিলেন৷ মা চণ্ডীর ঝাঁটার আঘাতে তাঁর একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেল৷ তিনিই বা ছেড়ে দেবেন কেন? প্রত্যাঘাত করবেন না কেন? পরে অবশ্য মা চণ্ডীকে উনি বাঁচিয়েও দেন৷ অর্থাৎ তিনি ক্ষমার মনোবৃত্তি দেখিয়েছেন৷’

তরিতা ম্যাডাম বললেন, ‘বাহ, তুমি খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করছ তো?’

অঙ্কুশ বলল, ‘আপনি জরৎকারুর কথা জানতে চাইলেন৷ এক্ষেত্রেও আমার মনে হয় মা মনসা ঠিক কাজ করেছিলেন৷ বাসর ঘরে বসে যদি কোনও স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বলেন, তুমি আমার কথার অবাধ্য হলে তোমাকে ছেড়ে আমি চলে যাব, তা হলে তাঁর এই শাস্তিই প্রাপ্য৷ নারী হিসেবে মা মনসা অনবদ্য৷ প্রথম রাতেই তিনি মাথা তুলে প্রতিবাদ করেছিলেন৷ আমি তো দোষ দেবো শিবকে৷ উনি কেন বদমেজাজি এক পুরুষের হাতে মা মনসাকে তুলে দিয়েছিলেন? জরৎকারুকে যে উগ্রমেজাজের, তা তো নারদ তাঁকে বলেছিলেন৷ এইরকম একজনের হাতে কেউ তাঁর ঔরসজাত মেয়েকে তুলে দেয়, বলুন?’

‘চাঁদ সওদাগরকে তোমার কী রকম মনে হয় অঙ্কুশ?’

‘চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে মা মনসাকে লড়িয়ে দেওয়ার পিছনেও কিন্তু শিব৷ চাঁদ ছিলেন শিবের ভক্ত৷ অবস্থাটা যখন এমন দাঁড়াল যে, চাঁদ আগে পুজো না করলে মা মনসা দেবীত্ব পাবেন না, তখন তো শিব স্বচ্ছন্দে বলে দিতে পারতেন, চাঁদ একবার অন্তত পুজোটা করে দাও৷ তাতে তো শিবের প্রতি ভক্তি কমে যেত না৷ তা না করে শিব আড়ালে বসে দু’জনের লড়াই দেখতে থাকলেন৷ এমনটা নয়, চাঁদ যখন বিপদে পড়েছেন, তখন মা মনসার সঙ্গে সম্মুখসমরে এসে তিনি চাঁদকে উদ্ধার করেছেন৷ উল্টোদিকে, শিবের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে চাঁদকে কিন্তু দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাতে হল৷ হ্যাঁ, মা মনসা চাঁদ সওদাগরের অনেক ক্ষতি করেছিলেন৷ কিন্তু পুজো পাওয়ার পর সবই তিনি চাঁদ সওদাগরকে তিনি ফিরিয়ে দেন৷ এমনকী, মৃত পুত্রসন্তানদেরও৷ আমার তো মনে হয়, মনসাই ঠিক৷ উনি যা কিছু করেছিলেন, তা নিজের অধিকার অর্জনের জন্য৷ সত্যের পথে ছিলেন বলেই মা মনসা বারবার লড়াইয়ে জিতেছেন৷ চণ্ডী, শিব… প্রত্যেকেই তাঁর কাছে হার মেনেছেন৷ মনসার জীবনে যতবার ট্র্যাডেজির ঘটনা ঘটেছে, ততবারই সাকসেসফুলি উনি উইনার হয়ে বেরিয়ে আসেন৷ আমার চোখে উনিই প্রথম ফেমিনিস্ট৷ চাঁদের মতো ক্ষমতাধর এক পুরুষকে উনি বাধ্য করেছিলেন আনুগত্য স্বীকার করতে৷’

‘তোমার মুখে এ সব কথা শুনে ভাল লাগছে অঙ্কুশ৷’

‘জানি না ঠিক বলছি কি না৷ খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি, মনসামঙ্গলে মায়ের চরিত্রচিত্রখটাই তৈরি করা হয়েছে ভয়ের আবরণে৷ উনি সাপের দেবী৷ সাপ মানে, যে প্রাখীটাকে মানুষ প্রচণ্ড ভয় পায়৷ অথচ দেখুন, মা মনসা সাপের দেবী হলেও, তিনি কিন্তু সাপের মতো দেখতে নন৷ তিনি মানুষের মতোই…৷’

ঝোঁকের মাথায় অঙ্কুশ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ল, তরিতা ম্যাডাম মিটিমিটি হাসছেন৷ তখনই ওর মনে হল, ইন্টারভিউ নিতে বসে উনি হঠাৎ মনসা কাহিনি জানতে চাইছেন কেন? ওকে বাজিয়ে নিচ্ছেন না কি? একটু ইতস্তত করেই ও জানতে চাইল, ‘আমি কি কিছু ভুল বললাম ম্যাডাম?’

তরিতা ম্যাডাম বললেন, ‘না না, তুমি ঠিকই বলেছ৷ তোমার অফার লেটারটা কি নিয়ে এসেছ? তা হলে নেত্রা ম্যাডামের হাতে দাও৷ ও তোমাকে কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দেবে৷’

‘ম্যাডাম, আপনি তো আমার প্রোফেশনাল এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে কিছুই জানতে চাইলেন না?’

‘জানার দরকার নেই৷ যা বোঝার আমি বুঝে গিয়েছি৷ তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করার আছে৷ হেড়োভাঙায় তোমার যে জমিটা আছে, সেটা কি আমাদের কাছে বিক্রি করবে? এখানে চাঁদ সওদাগরের মতো কেউ একজন আমাদের পিছনে লেগেছে৷ সে ভয় দেখাচ্ছে বলে কেউ আমাদের জমি দিতে চাইছে না৷ ফলে ল্যাব তৈরির কাজটা এগোচ্ছে না৷ এখন তুমি যদি রাজি হও, তা হলে ইউনিটটা আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে স্টার্ট করতে পারি৷’

অঙ্কুশ বলল, ‘আমার কোনও আপত্তি নেই৷ জমিটা যদি ভাল কোনও কাজে লাগে, আমি বিনে পয়সায় দিতেও রাজি৷ আপনি কাগজপত্তর রেডি করুন ম্যাডাম৷ আমি পুরো জমিটাই দান করে দেবো৷’

‘তুমি আমাকে বাঁচালে অঙ্কুশ৷ তবে একটা কথা, শুনলাম কঙ্কণদীঘির চন্দ্রভানু বলে ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার রিলেশন খুব ভাল৷ আমার এখানে যদি চাকরি করতে হয়, তা হলে কিন্তু তুমি ওই লোকটার সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ রাখতে পারবে না৷’

শর্তটা শুনে অঙ্কুশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ ও জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেল, কেন ম্যাম?

(আটত্রিশ)

কলকাতার কাগজে পাইথন নিয়ে কী একটা খবর বেরিয়েছে৷ সজনেখালির ফরেস্ট অফিস থেকে সে ব্যাপারে কথা বলার জন্য বোধহয় কেউ ফোন করেছিল৷ মন্দিরে তখন সবে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ শেষ করেছেন৷ পুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ফোন ধরতে পারেননি চন্দ্রভানু৷ দয়াশঙ্কর অবশ্য আমতা আমতা করে একবার বলেছিল, ‘ফোনটা ধরলে ভাল হয় স্যার৷’

কিন্তু, চোখ লাল করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন চন্দ্রভানু৷ জোর ধমক দিয়েছিলেন৷ শিবের পুজোর সময় কেউ ডিসটার্ব করুক, তিনি চান না৷ বকুনি খেয়ে দয়াশঙ্কর তখন মুখ শুকনো করে সরে গিয়েছিল৷ ঘণ্টা

খানেক পর মন্দির থেকে বেরিয়েই ফোনের কথা মনে পড়ল চন্দ্রভানুর৷ দয়াশঙ্করকে ডেকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কে ফোন করেছিল রে?’

‘ফরেস্ট অফিসার রবিনবাবু, স্যার৷’

কে রবিনবাবু, চিনতে পারলেন না চন্দ্রভানু৷ সরকারী অফিসে কত লোক যায়-আসে, তাঁদের চিনে রাখতে হবে, তার কোনও মানে নেই৷ বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘ফোন করার আর সময় পেল না? কী বলতে চায় সে?’

‘স্যার, উনি বলছিলেন, পাইথন দুটো আর ওদের বাচ্চাগুলোকে চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দিতে হবে৷ পাইথন না কি বাড়িতে পোষা বেআইনি৷’

‘ওরা জানল কী করে, আমার বাড়িতে পাইথন আছে?’

‘কলকাতার কাগজে খবরটা বেরিয়েছে৷ সেইসঙ্গে বাচ্চা পাইথনদের ছবিও৷ আমার মনে হয়, উষসী ম্যাডাম যে ছবিগুলো তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ছবিই হবে৷’

‘কাগজটা কি তোর কাছে আছে?’

‘না স্যার৷’

‘ রায়দীঘির মার্কেটে কাউকে পাঠিয়ে দ্যাখ তো, কাগজটা পাওয়া যাবে কি না?’

‘দেখছি স্যার৷ তবে, কম্পিউটার খুলে ই-পেপারে খবরটা আমি একটু আগে দেখলাম৷ একদম ড্যামেজ করে দিয়েছে৷ খবরটা যে লিখেছে, তার নাম জয় সেনগুপ্ত৷ সে সেন্ট্রাল জু অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার লোকেদের সঙ্গেও কথা বলেছে৷ মনে হয়, ওই রিপোর্টারটাকে কেউ আমাদের পিছনে লাগিয়েছে৷’

পাইথন পোষা যায় না৷ এই রকম একটা কথা সেদিন বলে গিয়েছিল দেবাংশু উকিল৷ কিন্তু, টাকার বান্ডিল ছুড়ে মারলে, এ দেশে সবই সম্ভব৷ ফরেস্ট অফিসারকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় চন্দ্রভানুর নেই৷ দরকার হলে তিনি ফরেস্ট মিনিস্টারকে ধরে নিতে পারবেন৷ কী মরতে যে তিনি পাইথন দুটোকে পোষার কথা ভেবে ছিলেন, কে জানে? এখন একটা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কে জানত, ওরা অতগুলো বাচ্চার জন্ম দেবে? ভাগ্যিস অঙ্কুশ নিজে থেকেই সেদিন কঙ্কণদীঘিতে এসে হাজির হয়েছিল৷ না এলে তো এই ক’দিনে পাইথনের বাচ্চাগুলো ঘরে ঘরে ঢুকে যেত৷ কী ধৈর্য ছেলেটার! তিন-চারদিন ধরে সব বাচ্চা জড়ো করে আলাদা একটা ঘরে রেখে গিয়েছে৷ আপদগুলো বিদেয় করে দিতে পারলে, এখন বাঁচেন চন্দ্রভানু৷ কথাটা ভেবে তিনি বললেন, ‘আজ দুপুরের দিকে আমি একবার কলকাতার দিকে যাব৷ তার আগে কাগজটা যাতে পাওয়া যায়, দ্যাখ৷’

ডাইনিং হলে ঢুকে চন্দ্রভানু দেখলেন, চা খেতে খেতে মন্টু কথা বলছে সনকার সঙ্গে৷ দু’জনের মধ্যে কথা হচ্ছে পাইথন নিয়ে৷ প্রায় দিনদশেক বাদে দেখা হল মন্টুর সঙ্গে৷ এই ক’দিন সোনাখালিতে পড়ে থেকে ও কোনওরকমে বাঁচিয়েছে ফার্ম হাউসটাকে৷ ফোনে রোজই দিনে দু’বেলা করে ওর সঙ্গে কথা হত চন্দ্রভানুর৷ ফলে খানিকটা নিশ্চিন্ত তিনি৷ চেয়ার টেনে বসে চন্দ্রভানু বললেন, ‘এখানে নতুন কী উৎপাত শুরু হয়েছে, সেটা শুনেছিস মন্টু?’

‘বউঠানের মুকে শুনচিলুম৷ একেনেই নয়, সোনাখালিতেও দেকলুম, সাপের উৎপাত বেড়ে গিইচে৷ ইয়া লম্বা লম্বা সব সাপ৷ আমাদের বাঁদাবনে আগে কক্ষণও দেকিনি ভাই৷ কোত্থেকে জুটল, কে জানে?’

সনকা ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করার জন্য কিচেনের দিকে চলে যাওয়া পর চন্দ্রভানু তেতো গলায় বললেন, ‘মাগীটাকে আর তো সহ্য করা যাচ্ছে না ভাই৷’

মন্টু বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘মেয়েমানুষদের তুই এত অছেদ্ধা করিস কেন চাঁদ? এ তোর পক্ষে শোভা পায় না৷ ওই মহিলা তোর কোতায় চুলকোচ্চে বল তো?’

‘সোনাখালিতে আমার অত বড় সর্বনাশ করল, আর এখনও তুই বলছিস, কোথায় চুলকোচ্ছে?’

‘তোর মনের ভ্রম চাঁদ৷ একনও আমরা পেরমান পাইনে, বাঁধ কেটে ওঁর লোগই ফার্ম হাউসে নোনা জল ঢুক্কেছেল৷ ওই মেয়েমানুষডার ওপর তোর আসল রাগডা কেন, আমায় বোঝা তো ভাই? গেল পরশু আমার সনে সোনাখালিতে দেকা হয়েছেল মহেশপুরের অমর মণ্ডলের৷ তার মুকে যা শুনলুম, তাতে মনে হল, উনি বাঁদাবনের মানুষদের উবগার কত্তে এয়েচেন৷ সাপের বিষ দিয়ে ওষুধ তৈরি করার একডা কারখানা কত্তে চান৷ সে তো ভাল কতা৷ কিচু লোগ কাজকম্ম পাবে৷’

মন্টুর কথাগুলো ভাল লাগছে না চন্দ্রভানুর৷ অমর মণ্ডলকে তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না৷ মন্টু সেটা খুব ভালমতো জানে৷ তার সঙ্গে কথা বলাই উচিত হয়নি ওর৷ বিরক্তি প্রকাশ করে চন্দ্রভানু বললেন, ‘অমর শুয়ারটার সনে তুই আবার কথা বলতে গেলি কেন? মাগীটার সনে ও ভিড়েছে না কি?’

‘অমরের সনে হটাৎ আমার দেকা হল বাসন্তী থানায়৷ ওর মুকেই শুনলুম, তরিতা ম্যাডামের কতা৷ মা জননী বলে সম্বোধন করছেল৷ দেখলুম, ভাল যোগাযোগ আচে৷’

‘ও শুয়ারটা বাসন্তী থানায় কী করছিল?’

‘তিনদিনের জন্যি চিফ মিনিস্টার না কি আসচেন সজনেখালিতে৷ সুন্দরবনে আরও কী করে ট্যুরিস্ট বাড়ানো যায়, তা নিয়ে মিটিন কত্তে৷ অমর থানায় গেচিল সেই ব্যাপারেই পুলিশের সঙ্গে কতা বলতে৷ ওর সনে দেকা না হলে খপরডা তো জানতেই পারতুম না৷ ভালই হল বুঝলি৷ ঝড়খালিতে আমাদের প্রোজেক্টডা অ্যাপ্রুভ করিয়ে নেওয়া যাবে এই সুযোগে৷ আমার মনে হয়, তুই কাগজপত্তর রেডি করে ফ্যাল৷ তুই নিজে গিয়ে দেকা করলে চিফ মিনিস্টার ইন্টারেস্ট নেবেন৷’

বাহ, চমৎকার! ঘরের কাছে চিফ মিনিস্টার আসছেন, অথচ পার্টির কেউ তাঁকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি? শালারা টাকা নেওয়ার সময় হাত বাড়িয়ে বসে থাকে৷ এই ক’দিন আগেও ঝন্টু কয়াল এসে ফ্লাড ভিক্টিমদের জন্য পাঁচ লাখ টাকার তেরপল আর কম্বল নিয়ে গেছে৷ চন্দ্রভানুর মনে পড়ল, গত বছর এইসময় চিফ মিনিস্টার এসেছিলেন সুন্দরবনে৷ ভলেন্টিয়ারদের খাইখরচার সব টাকাই দিয়েছিলেন তিনি৷ টাকার অঙ্কটা কম ছিল না৷ এমিলিবাড়িতে পাবলিক মিটিংয়ের সময় মঞ্চে তিনি বসেছিলেন চিফ মিনিস্টার অভিজিৎ চ্যাটার্জির খুব কাছাকাছি৷ সেই ছবি লোকাল কাগজে বেরিয়েওছিল৷ ভাষণ দেওয়ার সময় চিফ মিনিস্টার একবার তাঁর সম্পর্কে বলেওছিলেন, ‘এই অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর সমাজসেবী’ বলে৷ সেইসময় খুব হাততালি পড়েছিল৷ কিন্তু এ বার হলটা কী? মিনিস্টার হওয়ার পর ঝন্টুর মাথাটা ঘুরে গেল না কি? আসুক এ বার টাকা চাইতে৷ লাথি মেরে বের করে দেবেন ওকে৷ রাগ দমন করে চন্দ্রভানু বললেন, ‘অমর তোকে আর কী বলল রে?’

‘সজনেখালিতে দেড়বেলা কাটিয়ে চিফ মিনিস্টার যাবেন সাগর দ্বীপে৷ ওখানে পাবলিক মিটিন আচে৷ কেন, ঝন্টু তোকে কিচচু জানায়নে? থানায় তাকেও তো দেকলুম অমরের পেচন পেছন ঘুরঘুর কত্তে৷’

ভাঙবেন, তবুও মচকাবেন না চন্দ্রভানু৷ বললেন, ‘ঝন্টু বলেছিল বোধহয়৷ আমার মনে নেই৷ তুই খোঁজ নে তো ভাই, অমর মণ্ডল হঠাৎ এত পাওয়ারফুল হল কী করে? চিফ মিনিস্টারের ট্যুর নিয়ে থানায় কথা বলতে গেছে৷ এ তো ভাল লক্ষখ নয়৷ আমার নামে ও কি কিছু বলছিল?’

‘তেমন কিচু লয়৷ একবার শুদু বলল, চাঁদকে বলিস, তরিতা মা জননীর পেচনে যেন না লাগে৷ আমি আর কতাটা বাড়াইনে৷ তোকে সাবধান করে দিচিচ চাঁদ, মেয়েমানুষডাকে জব্দ কত্তে গে, নিজের মুখ পোড়াসনে৷ আখেরে ক্ষতিডা কিন্তু তোরই হবে৷’

‘তুই ছাড় তো৷’ মন্টুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘তুই নিশ্চয় জানিস, বাঁদাবনে আমার পার্মিশন ছাড়া কিছু হওয়ার উপায় নেই৷ বেশ তো, তরিতা না কে… সে যদি কিছু করতে চায়, আমার কাছে এসে বলুক৷ আমি লোকজন দিয়ে তার কারখানা করিয়ে দেব৷ তবে, মনসা পুজো টুজো সব বন্ধ করে দিতে হবে৷’

‘এ তোর ফালতু গোঁ চাঁদ৷ যার যে দ্যাবতাকে ভাল লাইগবে, সে তাঁর পুজো কইরবে৷ তুই বিধান দেওয়ার কে ভাই? যাগগে, তুই যা ভাল মনে করিস, তাই কর৷ দিনকাল বদলাচ্চে৷ পরে বলিস না যেন, মন্টু তুই আমায় কেন সাবধান করিসনে৷’

খাবারের ডিশ হাতে সনকা ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে৷ দেখে মন্টু চুপ করে গেল৷ মনে মনে গুমরাতে লাগলেন চন্দ্রভানু৷ তাঁর সবথেকে কাছের লোকটাও এখন তরিতার হয়ে তরফদারি করছে৷ আরে, পিছনে লাগার কী দেখেছে অমর মন্ডল? এখনও তো খুন খারাপির দিকে যানইনি তিনি৷ এই জেলার সব ব্লকেই তাঁর ঠাঙাড়ে বাহিনি আছে৷ একটা ফোনেই তারা তরিতা আর ওর সঙ্গীসাথীদের হাপিশ করে দিতে পারে৷ তাদের হাতে প্রচুর আর্মস৷ মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির ইলেকশনে একবার অমর মন্ডলের দলবলকে এমন দাবড়ানি দিয়েছিলেন চন্দ্রভানু, তার পর থেকে ওরা আর রায়দীঘিতে পা মাড়ায়নি৷ দুটো লাশ পড়েছিল ইলেকশনের আগের দিন৷ সেই থেকে অমর শুয়ারটা শত্রুতা করে যাচ্ছে৷

কাচের ডিশে ঘিয়ে ভাজা লুচি, তরকারি আর মিষ্টি৷ ব্রেক ফাস্ট করতে করতে মন্টু বলল, ‘তুই যে বললি কলকেতা যাবি? কখন বেরুবি চাঁদ?’

চন্দ্রভানু বললেন, ‘এই পোশাক বদলেই বেরিয়ে যাব৷ আজ ফিরতে পারব বলে মনে হচ্ছে না৷’ কথাটা তিনি মন্টুকে বললেন বটে, কিন্তু সনকাকে শুনিয়ে৷ এখনও দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়নি৷ অনেক দিন পর কাল রাতে দু’জনে এক বিছানায় শুয়েছেন৷ বলতে গেলে যৌন তাড়নায় চন্দ্রভানুই মেঝে থেকে জোর করে সনকাকে তুলে এনেছিলেন৷ যৌনসম্পর্ক হয়েছে, কিন্তু চন্দ্রভানু তৃপ্ত হননি৷ মন্টুর বউ সত্যবতীর অভাব যেন এখন বেশি করে তিনি অনুভব করছেন৷ সত্যবতী যে আনন্দটা দিতে পারত, তা দেওয়া সম্ভবই নয় সনকার পক্ষে৷ যৌন ছলাকলা… বলতে গেলে জানেই না৷

‘কলকেতায় কার সনে দেকা করতে যাচিচস চাঁদ?’

‘ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে কথা কইতে৷ জাপানে চিংড়ি এক্সপোর্ট করা নিয়ে একটা প্রবলেম হয়েছে৷ তুই কি কিছু শুনেছিস?’

‘জয়গোপালের মুকে শুনেচি৷’

‘জাপানিদের সঙ্গে আমাদের যে কন্ট্রাক্ট হয়েছিল, তাতে একটা ক্লজ ছিল৷ কোনও কারণে মাল রিজেক্টেড হলে আমাদের না কি কমপেনসেশন দিতে হবে৷ জাপানের ফিশারিজ কর্পোরেশন কাল আমাদের ব্যাঙ্কের কাছে ক্ষতিপূরণের টাকা চেয়ে মেল পাঠিয়েছে৷ অ্যামাউন্টটা কম নয়৷ পঞ্চাশ কোটি টাকার মতো৷’

‘সে কী কতা? ক্ষতি তো হয়েচে তোর৷ চিংড়ি সমুন্দরের জলে ফেলে দিতে হবে তোকে৷ ক্ষতিপূরণের টাকা তো তোর পাওয়ার কতা৷ উল্টে, তোকে দিতে হবে কেন?’

‘ওরা বলছে, মাল রিজেক্ট হওয়ার জন্য অনেকের কাছে না কি ওদের কথার খেলাপ হয়েছে৷ সেই কারণেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ কন্ট্রাক্টে এইরকম একটা ক্লজ ছিল, আমি জানতামই না৷ জয়গোপাল বলল, ও না কি জানত৷ ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি৷ হাইল্যান্ড পার্কের ফ্ল্যাটে আজ সন্ধেবেলায় ওকে ডেকে পাঠিয়েছি৷’

ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে হাইল্যান্ড পার্কে একটা ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট আছে চন্দ্রভানুর৷ ওখানে একটা কর্পোরেট অফিসও করেছেন৷ এক্সপোর্ট কোম্পানির হেড অফিস৷ খুব সুন্দর সাজানো গোছানো৷ মাঝেমধ্যে ছোটছেলে জয়ব্রত আর ওর বউ অহল্যা সেই অফিসে বসে৷ খুব দরকার হলে সেখানে যান চন্দ্রভানু৷ অফিসের উপরে গেস্ট হাউস৷ বিজনেসের ব্যাপারে যদি কারও সঙ্গে কথা বলতে হয়, বা ভিন রাজ্য থেকে কেউ আসে, তা হলে ওই গেস্ট হাউসেই তাঁকে ডেকে নেন চন্দ্রভানু৷ মদ্যপানের সঙ্গে ব্যাবসার কথাবার্তা চলে৷ এটা তিনি শিখেছেন বড় বেয়াই সুকুমার বাসুর কাছে৷

খাওয়া শেষ করে মন্টু উঠে দাঁড়িয়েছে৷ ভানুমতি এসে কাচের প্লেট তুলে নিয়ে যাচ্ছে৷ মন্টু হঠাৎ বলল, ‘তোর সময়টা ভাল যাচ্ছে না চাঁদ৷ আমার মনে হয়, তুই গিয়ে গুরুজির সঙ্গে একবার দেখা করে আয়৷ অনেকদিন তুই কিন্তু সাগর দ্বীপে যাসনি৷’

চন্দ্রভানু বললেন, ‘যাব ভেবেছিলাম৷ কিন্তু মহেশ্বরজি অ্যাদ্দিন দিল্লিতে ছিলেন৷ কাল দুকুরের মধ্যে কলকেতা থেকে আমি ফিরে আসব৷ পরশু সকালে যাওয়া যেতে পারে৷ সনকা আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি৷’

মন্টু বলল, ‘তোর মনে আচে কি না, জানি না৷ বহু বচর আগে গুরুজি কিন্তু সনকাকে একবার বলেচিলেন, তোদের দুঃখের দিন আসবে৷ তোরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাবি৷ তবে তার অনেক দেরি আচে৷ আমার মনে হয়, সেই সময়টা তোর এসে গ্যাচে৷ আশ্রমে গিয়ে গুরুজির পায়ে পড়ে যা৷ পুজো স্বস্ত্যয়ন করে উনি রোধ কত্তে পারেন কি না, দ্যাক৷’

গতকাল থেকে মাথায় ক্ষতিপূরণের চিন্তা, ব্যাবসায় মন্দা, সনকার সঙ্গে শীতল সম্পর্ক… সব মিলিয়ে মন অস্থির হয়ে আছে৷ তার উপর মন্টুর নেগেটিভ কথাবার্তা৷ অন্য কেউ কথাগুলো বললে চন্দ্রভানু সহ্য করতেন না৷ কিন্তু মন্টু যা বলে, মন থেকে বলে৷ ও সত্যি কথাটাই বলেছে৷ অনেক আগেই তাঁর উচিত ছিল, সাগর দ্বীপের আশ্রমে যাওয়া৷ গিয়ে মহেশ্বরজির কাছে পরামর্শ নেওয়৷ চন্দ্রভানুর দৃঢ় বিশ্বাস, মহেশ্বরজি তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেনই৷ কথাটা ভেবে তিনি একটু স্বস্তিবোধ করলেন৷ মন্টুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতেই ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ কি তুই বাড়িতেই থাকবি? না কি অন্য কোনও প্রোগাম আছে?’

মন্টু বলল, ‘ভাবচি, বিকেলের দিকে ঘুরতে ঘুরতে একবার ক্যানিংয়ের দিকে যাব৷ ওখানে মনসামেলা হচ্চে৷ অমর বলচেল, তরিতা ম্যাডাম না কি ওকানে থাকবেন৷ গিয়ে দেখে আসি তাঁকে৷ মহিলার মধ্যে কী এমন যাদু আচে? হাজার হাজার লোগ তাঁকে কেন মা বলে ডাকচে? অমর বলচেল, উনি না কি ক্যানিংয়েরই মেয়ে৷ একন একটা অনাথ আশ্রম চালান সেকেনে৷’

কথাটা মনঃপূত হল না চন্দ্রভানুর৷ কিন্তু মন্টু যদি গিয়ে মাগীটাকে দেখতে চায়, তা হলে তিনি বাধা দেওয়ার কে? মন্টু বিনা কারণে ক্যানিং যেতে চাইছে না৷ নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য আছে৷ সিঁড়ি দিয়ে দু’ধাপ নামতেই চন্দ্রভানু দেখতে পেলেন, দয়াশঙ্কর দাঁড়িয়ে আছে৷ ওর হাতে একটা খবরের কাগজ৷ সেটা এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘এই নিন স্যার৷ খবরটা প্রথম পৃষ্ঠাতেই বেরিয়েছে৷ আপনার ছবিও৷’

‘কই দেখি’৷ বলে চন্দ্রভানু হাত বাড়িয়ে কাগজটা টেনে নিলেন৷ পাইথন সম্পর্কে কী খবর বেরিয়েছে, সেটা পড়ার জন্যই খানিক আগে দৈনিক বাংলা কাগজটা তিনি দয়াশঙ্করকে জোগাড় করতে বলেছিলেন৷ ভাঁজ খুলে বাচ্চা পাইথনগুলোর ছবি দেখেই চন্দ্রভানু চমকে উঠলেন৷ এনক্লোজারে কিলবিল করছে৷ ছবি তোলার সময় উষসী একদিন একটা বাচ্চা পাইথন তাঁর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল৷ সেই ছবিটাও বেরিয়েছে৷ তলায় ক্যাপশনে তাঁর নাম৷ হেডিংটাও ক্ষতিকারক, ‘কঙ্কণদীঘিতে ব্যবসায়ীর বাড়িতে বেআইনিভাবে পোষা হচ্ছে জোড়া ময়াল সাপ৷ এলাকায় আতঙ্ক৷’ দ্রুত খবরটায় চোখ বোলালেন চন্দ্রভানু৷ এমনভাবে লেখা, যেন মায়ানমার থেকে চোরাপথে তিনিই নিয়ে এসেছেন সাপ দুটো৷ বাড়িতে পোষার জন্য সরকারী কোনও অনুমতি নেননি৷ কেন তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সে প্রশ্নও তুলেছে রিপোর্টার৷ জু অথরিটির কর্তারা বলেছেন, যত শিগগির সম্ভব, পাইথনগুলো উদ্ধার করতে হবে৷

পড়া শেষ হতেই চন্দ্রভানুর মাথা গরম হয়ে গেল৷ অর্ধেক কথাই সত্যি নয়৷ চোরাপথে পাইথনগুলো তিনি নিয়ে আসেননি৷ স্বয়ং মহাদেবই পুরুষ পাইথনটাকে তাঁর বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন শিবরাত্তিরের রাতে৷ তার সাক্ষী রয়েছেন মহেশ্বরজি নিজে৷ আর হ্যাঁ, মেয়ে পাইথনটাকে তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন বারুইপুরের ফরেস্ট অফিসের কে একজন৷ অন্য কোথাও রাখার জায়গা পাচ্ছিলেন না বলে৷ অঙ্কুশ তাঁকে চেনে৷ তখন চন্দ্রভানু জানতেনও না, মেয়ে পাইথনটা বাচ্চা দেবে৷ এলাকায় আতঙ্ক, কথাটাও সত্যি নয়৷ উল্টে, লোকে সাপ দেখার জন্য প্রায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে৷ চন্দ্রভানুর প্রথম রাগটা গিয়ে পড়ল উষসীর উপর৷ এ কেমনধারার মেয়ে? তখন তো বলেছিল, বিদেশের কোন এক কাগজে ছবিগুলো পাঠাবে৷ এটা তো উষসী ঠিক করেনি৷

স্বভাবসিদ্ধ গলায় চন্দ্রভানু বললেন, ‘ফোটোগ্রাফার মেয়েটার ফোন নাম্বার তোর কাছে আছে, দয়া?’

‘আছে স্যার৷’

‘ফোন করে আজই তুই ওকে ভয় দেখাবি৷ আর অঙ্কুশকেও ফোন করে বলবি, মেয়েটাকে নিয়ে এসে কেন আমার সম্মান নষ্ট করল?’

হাত থেকে কাগজটা আগেই টেনে নিয়ে ছিল মন্টু৷ খবর পড়তে পড়তে মুখ তুলে ও বলল, ‘না, চাঁদ, তুই এমনডা করবি না৷ কালই কাগজে ফের বেরুবে, তুই ভয় দেখ্যেচিস৷ এ নিয়ে তুই কোনও কতাই বলবি না৷ কাগজে দিয়েছে, কলকেতা থেকে কালই পাইথনগুনোকে নিয়ে যাওয়ার জন্যি ফরেস্ট অফিসাররা ট্র্যাক নিয়ে আইসবে৷ ওঁরা এলি নে যেতে দিবি৷ না দিলে ওঁরা তোকে অ্যারেস্টও কত্তে পারেন৷’

উভয়সঙ্কটে পড়ে দয়াশঙ্কর জিজ্ঞেস করল, ‘ তা’লে কী করব স্যার৷ আপনি তো কাল থাকবেন না৷’

একেই অনেক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে রয়েছেন৷ পাইথন নিয়ে তিনি কোনও সমস্যার মধ্যে পড়তে চান না৷ মন্টু ভাল পরামর্শ দিয়েছে৷ চন্দ্রভানু বললেন, ‘কী আর করবি? মন্টু যা বলল, তাই করিস৷ পঞ্চাকে এখন গাড়িটা বের করতে বল৷ আমি এখুনি বেরিয়ে যাব৷’

কথগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না চন্দ্রভানু৷ বেলা প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে৷ আর মিনিট পনেরোর মধ্যে বেরতে না পারলে, হাইল্যান্ড পার্কের গেস্ট হাউসে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যাবে৷ এখান থেকে আগে তিনি যাবেন ট্যাংরায় রুলিং পার্টির মেন অফিসে৷ চিফ মিনিস্টারের সুন্দরবন সফর নিয়ে তাঁকে আগে কেন কিছু জানানো হয়নি, তা নিয়ে অমর মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিষ ঢালবেন নেতাদের কাছে৷ শুয়ারটাকে বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না৷ কিন্তু নেতাদের কখন দেখা পাবেন, কে জানে? মাল নেওয়ার সময় একেকজন ঘাড় নুইয়ে থাকে৷ পার্টি আপিসে তারা সব একেকজন বাঘ৷

নিজের ঘরে ঢুকে চন্দ্রভানু দেখলেন, সনকা দেরাজ থেকে ইস্ত্রি করা জামা-প্যান্ট বের করে বিছানার উপর রেখে দিয়েছে৷ আলমারির সামনে দাঁড় করানো রয়েছে ছোট একটা ট্রলিব্যাগ৷ তার ভিতরও নিশ্চয়ই দু’একদিন বাইরে থাকার মতো পোশাক আছে৷ কী কর্তব্যবোধ! আগে থেকে ঘরে এসে সনকা সব ব্যবস্থা করে রেখেছে৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পোশাক বদলানোর সময় আদুল গায়ে হঠাৎ চন্দ্রভানু লক্ষ করলেন, মহেশ্বরজির দেওয়া ত্রিশূলের লকেটটা তাঁর গলায় নেই! আশ্চর্য, গেল কোথায় লকেটটা? তিরিশ বছর আগে মন্ত্রঃপূত ওই লকেটটা দেওয়ার সময় মহেশ্বরজি বলেছিলেন, ‘সবসময় সঙ্গেসঙ্গে রাখবি৷ তা হলে কোনও বিপদ হবে না৷’ সত্যিই, অ্যাদ্দিন কোনও বিপদ হয়নি৷ লকেটটা হঠাৎ উধাও হল কীভাবে?

গলায় ছোট-বড় তিন-চারটে সোনার চেন পরা চন্দ্রভানুর অভ্যেস৷ তারই মাঝে ত্রিশূলের লকেটটা ঝুলে থাকত৷ স্নান করার সময় কোনও কোনওদিন সোনার হারগুলো খুলে রাখলেও লকেটটায় তিনি কখনও হাত দেননি৷ চন্দ্রভানু মনেই করতে পারলেন না, কবে থেকে লকেটটা তাঁর গলায় নেই! কিছু একটা খোঁজাখুজি করছেন তিনি, সনকা বোধহয় লক্ষ করেছিল৷ জিজ্ঞেস করল, ‘কিচু হারিয়েচে?’

সত্যি কথাটাই বললেন চন্দ্রভানু৷ শুনে ডুকরে উঠলেন সনকা, ‘সববনাশ হয়েচে৷’

(উনচল্লিশ)

মহেশ্বরজির আশ্রমে তাঁর জন্য যে এত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে, তরিতা তা ভাবতেও পারেননি৷ শেষবার এসেছিলেন প্রায় বছর খানেক আগে৷ আমেরিকা থেকে ফেরার পর৷ দু’দিনের বেশি সাগরদ্বীপে ছিলেন না৷ মহেশ্বরজিকে তিনি কলকাতা থেকে খবর পাঠিয়েছিলেন৷ কিন্তু আশ্রমে পৌঁছে দেখেন, তিনি নেই৷ গুরুমাকে নিয়ে দিল্লিতে কোন এক শিষ্যের বাড়িতে গিয়েছেন৷ দিন সাতেকের আগে না কি তাঁর ফেরার সম্ভাবনা নেই৷ শুনে প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল তরিতার৷ মনে হয়েছিল, মহেশ্বরজি ইচ্ছে করেই তাঁকে এড়িয়েগেলেন৷ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করার ইচ্ছেটা সেদিনই তাঁর চলে যায়৷ তরিতা ঠিকই করে নেন, নিজের রাস্তা তিনি নিজেই খুঁজে নেবেন৷

এমনিতে, বাবার সাহায্য তিনি কোনওদিনই পাননি৷ দিল্লির কলেজে ভর্তি করানোর সময়টুকু ছাড়া৷ গত দশটা বছর তরিতা নিজের মর্জিতেই চলেছেন৷ সাগরদ্বীপের আশ্রমে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তার কোনও খোঁজও তিনি রাখেননি৷ আজ অবশ্য ক্যানিং থেকে তিনি সাগরদ্বীপে এসেছেন, নিজেরই একটা দরকারে৷ মহেশ্বরজি ইচ্ছে করলে পারবেন, তাঁর প্রয়োজন মেটাতে৷ তাঁকে দেখে রিসেপশনের মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে৷ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি, আপনি?’

তরিতা বললেন, ‘আমায় চেনো না কি?’

‘চিনব না কেন? আমি দেবিকা৷ আমাকে চিনতে পারছেন না?’

ভাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে তরিতা চিনতে পারলেন৷ গুরুমার ফাইফরমাশ খাটত৷ ডায়মন্ড হারবারের মেয়ে৷ তখন বয়স ছিল তেরো-চোদ্দো৷ এখন পূর্ণবয়স্কা যুবতী৷ দশ বছরে মেয়েদের শরীরে কত কী পরিবর্তন হয়ে যায়৷ চট করে চেনা মুশকিল৷ তরিতা বললেন, ‘হ্যাঁ, এইবার তোমাকে মনে পড়ছে৷ মায়ের জন্য খুব ভোরে উঠে তুমি ফুল পাড়তে যেতে৷’

শুনে মুখটা খুশিতে ভরে উঠল মেয়েটার৷ বলল, ‘এ বার কয়েকটা দিন থাকবেন তো দিদি?’

‘না, মাত্র একদিনের জন্য এসেছি৷ গেস্ট হাউসে আমার কিন্তু চারটে এসি রুম চাই৷ পাশাপাশি হলে ভাল হয়৷ পাওয়া যাবে ?’

‘কী যে বলেন দিদি৷ এ আশ্রম তো আপনারই৷ আপনাকে নিয়ে রোজই আমরা আলোচনা করি৷’ বলেই দেবিকা রেজিস্টার খাতাটা এগিয়ে দিল, ‘কারা থাকবেন, নামগুলো এখানে লিখে দিন৷’

নেত্রা ছাড়াও সঙ্গে রয়েছে অঙ্কুশ, শান্তি আর গোলাপি৷ শেষ দু’জন একঘরে থাকতে পারবে৷ চোখের ইশারায় তরিতা নামগুলো লিখে দিতে বললেন শান্তিকে৷ তার পর শুধুমাত্র কৌতূহল মেটানোর জন্যই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে নিয়ে তোমরা আলোচনা করো কেন?’

‘বারে, আপনি এই অঞ্চলের মেয়েদের জন্য এত কিছু করছেন৷ আলোচনা করব না? সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইটগুলোতে কত পোস্ট হয় আপনাকে নিয়ে৷ আমরা সবই জানতে পারি৷’

শুনে ভাল লাগল তরিতার৷ ফেস বুক ঘাঁটাঘাঁটি করে যে মেয়ে, সে নিশ্চয় কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে৷ আগে আশ্রমে পড়াশুনোর রেওয়াজটা ছিল না৷ মেয়েদের এমন ভাবে রাখা হত, যেন তারা সাধিকা৷ আশ্রমের কাজ কর্ম করেই তাদের জীবন কাটাতে হবে৷ ক্যানিংয়ের স্কুল থেকে পাস করে আসার পর দীর্ঘদিন তরিতাকে আশ্রমে বসে থাকতে হয়েছিল৷ গুরুমা চাননি তিনি পড়াশুনোটা চালিয়ে যান৷ সে কথা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস চেপে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহেশ্বরজি এখন কোথায় বলতে পারো?’

দেওয়াল ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দেবিকা বলল, ‘সাড়ে দশটা বাজে৷ স্বামীজি মনে হয়, এখন নিজের ঘরেই আছেন৷ আপনি চাইলে ওঁর সঙ্গে এখনই দেখা করতে পারেন৷ বেলার দিকে উনি কিন্তু খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বেন ৷ কঙ্কণদীঘি থেকে ওঁর কয়েকজন শিষ্য আসবেন৷’

আশ্রমের গেটের কাছে বিরাট একটা লাক্সারি বাস এসে দাঁড়াল৷ ভক্তরা দলে দলে নেমে আসছেন বাস থেকে ৷ রিসেপশনে হঠাৎ ভিড়৷ আশ্রমে রোজই কোনও না কোনও পার্বণ লেগে থাকে৷ দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন৷ দুপুরে প্রসাদ ভক্ষণ করে, সারাদিন আশ্রম প্রাঙ্গণে কাটিয়ে, ভক্তরা বিকেলের দিকে চলে যান৷ তরিতার মনে পড়ল, একটা সময় ভক্তদের দেখাশুনার দায়িত্ব মহেশ্বরজি দিয়েছিলেন তাঁকে৷ তখন রোজই চার-পাঁচশো লোকের খাবারের আয়োজন করতে হত৷ প্রসাদ খাওয়ার পর দু’হাত তুলে ভক্তরা আশীর্বাদ করতেন৷ প্রায় সারাটা দিনই তরিতাকে কাটাতে হত কিচেনে৷ একবার প্রসাদ খেয়ে কয়েকজন ভক্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ফুড পয়েজনিংয়ের কথা শুনে মহেশ্বরজি প্রচণ্ড রেগে যান৷ পুরো দায় নিতে হয়েছিল তরিতাকে৷ তাঁকে কিচেন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ পরে তরিতা জানতে পারেন, পুরো ব্যাপারটাই ছিল ষড়যন্ত্র৷ তাঁকে বেইজ্জত করার জন্য ফুড পয়েজনিংয়ের পিছনে ছিলেন গুরুমা৷

সেই দিনগুলোর কথা মনে করতে চান না তরিতা৷ আগেরবার আশ্রমে গুরুমায়ের মুখদর্শন করতে হয়নি৷ এ বারও তরিতা ঠিক করে নিয়েছেন, ধারে কাছে ঘেঁষবেন না৷ মহেশ্বরজির সঙ্গে দেখা করে, কাল সকালেই সাগর দ্বীপ থেকে তিনি বেরিয়ে যাবেন৷ তাই দেবিকাকে বললেন, ‘মহেশ্বরজির সঙ্গে আমি সন্ধের পর দেখা করব৷ তুমি কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখো৷’

‘ঠিক আছে দিদি৷ আমি কথা বলে রাখছি৷ ভিড়টা সামলে নিই৷ পরে আপনার কাছে যাচ্ছি৷ আপনি গেস্ট হাউসে চলে যান৷ আপনাদের মালপত্তর আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’

আশ্রমের ভিতর ঢুকে বুকভরা শ্বাস নিলেন তরিতা৷ প্রতিটা কোণ তাঁর চেনা৷ প্রায় বছর পাঁচেক এখানে তিনি কাটিয়ে গিয়েছেন৷ কত স্মৃতি জড়িয়ে এই আশ্রমের সঙ্গে৷ বেশিরভাগটাই দুঃখজনক স্মৃতি৷ তখন অবশ্য এই আশ্রম এত বড় ছিল না৷ চারদিকে ইটের গাঁথনির পাঁচিল ছিল না৷ তিনদিকে বাঁশের বেড়া, শুধু নদীর দিকটা উন্মুক্ত৷ কোনও কারণে কষ্ট পেলে তরিতা হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন বেলাভূমি পর্যন্ত৷ ঢেউগুলো সাক্ষী থাকত তাঁর কান্নার৷ গেস্ট হাউসের দিকে এগোনোর সময় তরিতা ঠিক করে নিলেন, বিকেলের দিকে গোলাপি আর শান্তিকে নিয়ে তিনি একবার নদীর দিকে যাবেন৷ ওরা দু’জন অবশ্য জানে না, মহেশ্বরজির সঙ্গে তাঁর আসল সম্পর্কটা কী? সকালে দু’জনেই অবাক হয়েছিল শুনে, তিনি শিবমন্দিরে আসবেন৷ ওদের ধারণা ছিল, ক্যানিংয়ের মতো এখানেও মনসা মেলা হবে৷

সকাল থেকেই চিটপিটে রোদ্দুর৷ গেস্ট হাউসের এসি রুমে ঢুকে সারা শরীর জুড়িয়ে গেল তরিতার৷ সোফায় বসে তিনি গা এলিয়ে দিলেন৷ সকাল সাতটায় তাঁরা ক্যানিং থেকে বেরিয়েছিলেন৷ সাগর দ্বীপে পৌঁছেছেন প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর৷ আসার সময় গাড়িতে নানা রকম মজার কথা বলছিল নেত্রা৷ তখন পিছনের সিটে অঙ্কুশ ছেলেটা গোমড়া মুখ চুপচাপ বসে ছিল৷ অদ্ভুত টাইপের উদাসীন৷ যেন নেত্রার কোনও কথাই ওর কানে যাচ্ছিল না৷ গাড়িতে সারাক্ষণ কার সঙ্গে যেন ছেলেটা হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট করে গেল৷ গোলাপির মুখে তরিতা জানতে পেরেছেন, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে না কি ওর মনোমালিন্য হয়েছে৷ বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে ছেলেটা বেরিয়ে এসেছে৷ এই রকম একটা ছেলেকেই অবশ্য তরিতার প্রয়োজন ছিল৷ একশো ভাগ পেশাদার একটা ছেলে৷ তরিতা মনে মনে আরও কৃতজ্ঞ এই কারণে যে, মাত্র একবার অনুরোধ করতেই ছেলেটা অত বড় একটা জমি দান করে দিয়েছে৷ হপ্তাখানেক আগে জমি রেজেস্ট্রিও হয়ে গিয়েছে কোম্পানির নামে৷

রিসেপশন থেকেই নেত্রা কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল৷ এতক্ষণে ঘরে ঢুকে বলল, ‘তোমার জন্য দুটো ব্রেকিং নিউজ আছে দিদি৷’

সোফায় সোজা হয়ে বসে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ? ব্রেক ফাস্টের কথা বলে এসেছিস? আমার পেট চুই চুই করছে৷’

‘হ্যাঁ, বলে এসেছি৷ মিনিট দশেকের মধ্যে এল বলে৷’

‘তোর ব্রেকিং নিউজটা কী রে?’

‘কঙ্কণদীঘির চন্দ্রভানু এখানে এসেছে৷ দেবিকার মুখে শুনলাম, বদমাইশটা নাকি তোমার পিতৃদেবের শিষ্য৷ মহেশ্বরজির কথা না শুনে সে এক পাও বাড়ায় না৷’

সত্যি এটা একটা খবর তরিতার কাছে! একটু আগে দেবিকা বলছিল বটে, কঙ্কণদীঘি থেকে স্বামীজির কাছে কয়েকজন শিষ্য আসার কথা আছে দুপুরে৷ তাদের নিয়ে মহেশ্বরজি নাকি খুবই ব্যস্ত থাকবেন৷ ওহ, তা হলে সেই শিষ্যরা হল চন্দ্রভানু আর তার লোকেরা! আচ্ছা, এই কারণে লোকটার এত বাড়বাড়ন্ত? মহেশ্বরজি অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ মানুষ৷ আশ্রমে থাকার সময় তরিতা নিজের চোখে দেখেছেন, মহেশ্বরজি কত বড় ভবিষ্যদ্বক্তা৷ যাকে যা বলেন, মিলে যায়৷ কিন্তু সেই ক্ষমতাটা তাঁর এখনও আছে কি না, মিলিয়ে দেখতে হবে৷ মুহূর্তের মধ্যেই তরিতা ঠিক করে নিলেন, চন্দ্রভানুকে জব্দ করার জন্য যদি তাঁকে বাবার সঙ্গে সন্মুখ সমরেও নামতে হয়, তা হলে নামবেন৷ তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর কি মনে হয় নেত্রা, আমাদের টাইট দেওয়ার জন্য চন্দ্রভানু বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছে?’

‘হতে পারে৷ তুমি চিন্তা কোরো না দিদি৷ সব খবর আমি পেয়ে যাব৷ লোক ফিট করে ফেলেছি৷ এ বার তোমায় দু’নম্বর ব্রেকিং নিউজটা দিই৷’

‘সেটা আবার কাকে নিয়ে?’

‘তোমার শ্রদ্ধেয় গুরুমাকে নিয়ে৷ বিছানায় শুয়ে তিনি মৃত্যুর দিন গুনছেন৷ ক্যান্সারে ভুগছেন৷ ডাক্তাররা জবাব দিয়ে গেছেন৷ মাসখানেক আগে দিল্লির হাসপাতাল থেকে উনি আশ্রমে ফিরে এসেছেন৷ আর আসা ইস্তক আক্ষেপ করে যাচ্ছেন তোমার জন্য৷ তুমি ক্ষমা না করলে না কি প্রাণবায়ু ত্যাগ করতে পারবেন না৷’

‘এ সব গপ্প কে করল তোর কাছে?’

‘দিদি, তোমার প্রচুর ভক্ত আছে এই আশ্রমে৷ তারা চায়, তুমি এসে আশ্রমের হাল ধরো৷ একটু পরেই সেটা তুমি টের পাবে৷ ভক্তরা তোমার কাছে এল বলে৷’

শুনে বিরক্ত বোধ করলেন তরিতা৷ এই আশ্রম নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁর৷ তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মহেশ্বরজি পছন্দ নাও করতে পারেন৷ উল্টে, হিতে বিপরীত হয়ে যাবে৷ যে কাজের জন্য তিনি সাগর দ্বীপে এসেছেন, সেটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে৷ খানিকটা ধমকের সুরেই তিনি বললেন, ‘শোন নেত্রা, কেউ যেন আমাকে ডিসটার্ব না করে৷ অঙ্কুশকে তুই আমার ঘরে পাঠিয়ে দে৷ ওর সঙ্গে জরুরি কিছু আলোচনা আছে৷’

নেত্রা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর গুরুমায়ের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল তরিতার৷ নেত্রা যা বলে গেল, ঠিক? সত্যিই কি গুরুমা অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছেন? বিশ্বাস করতে মন চাইল না তরিতার৷ একটা সময় কী দোর্দণ্ড প্রতাপই না ছিল গুরুমার! সেইসঙ্গে আগুনের মতো রূপ৷ সন্ধ্যা মায়ের মুখে তরিতা শুনেছিলেন, কনখলের কোন এক আশ্রম থেকে গুরুমাকে বিয়ে করে এনেছিলেন মহেশ্বরজি৷ দু’জনকে দেখে তখন না কি মনে হত, সাক্ষাৎ শিব আর উমা৷ সন্তানাদি না হওয়ায় গুরুমা পরের দিকে কেমন যেন বদলে যেতে থাকেন৷ ক্রমেই খিটখিটে আর বদমেজাজি হয়ে ওঠেন৷ ‘গুরুমা তোকে কেন সহ্য করতে পারেন না জানিস? তোর বাবার জন্য৷’ সন্ধ্যা মা তখন বলতেন, ‘গুরুমাকে বিয়ে করার আগে, তোর বাবা যদি তোর বা তোর মায়ের কথা জানিয়ে দিতেন, তা হলে আজ তোর এত দুর্গতি হত না৷ তোর বাবার সঙ্গে তোর মায়ের বিয়ে হয়েছিল কি না, কেউ জানেন না৷ অ্যাদ্দিন পর হঠাৎ এসে তুই হাজির৷ তুই সতীনের মেয়ে, তোকে চট করে উনি মেনে নেবেন কেন, বল?’

এ সব কথা শুনে তরিতার তখন ক্যানিং আশ্রমের সতীমায়ের কথা মনে পড়ত৷ সতীমায়ের সঙ্গে তাঁর কোনও রক্তের সম্পর্ক ছিল না৷ তা সত্ত্বেও, অত ভালবাসতেন কেন? জন্মসূত্রে পাওয়া লকেটটাও সতীমা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন৷ ওটা সঙ্গে না নিয়ে এলে মহেশ্বরজি এই আশ্রমে আশ্রয় দিতেন কি না, সন্দেহ৷ দিল্লি রওনা হওয়ার আগে তরিতা অবশ্য ওই লকেটটা নদীর জলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন৷ সেদিনই তিনি ঠিক করেন, দেশে ফিরে নিজের পরিচিতি, তিনি নিজেই তৈরি করবেন৷ সেই লক্ষেই খানিকটা তিনি এগিয়ে গিয়েছেন৷ একটা মিশন নিয়ে তিনি এগোচ্ছেন৷ নারীশক্তিকে জাগ্রত করার৷ আমেরিকায় থাকার সময় তিনি অনেক কিছু শিখেছেন৷ দেখেছেন, সেখানে নারী পুরুষের সমান অধিকার৷

গুরুমা সম্পর্কে নেত্রা যা বলে গেল, তাতে গুরুত্ব দেওয়ার ইচ্ছে নেই তরিতার৷ তবে মহেশ্বরজি যদি নিজে অনুরোধ করেন, তা হলে একবার তিনি গুরুমায়ের ঘরে যেতে পারেন৷ এভিএস ল্যাব তৈরির কথা আজই প্রথম তিনি মহেশ্বরজিকে জানাবেন৷ ল্যাব-এর জন্য আপাতত তাঁর একডজন ঘোড়া দরকার৷ কেননা, ঘোড়ার সিরাম দিয়ে এভিএস তৈরি করতে হয়৷ শীতকালে শোনপুরে বিরাট একটা মেলা বসে৷ সেখানে হাতি, ঘোড়া, নানা ধরনের জন্তু জানোয়ার বিক্রি হয়৷ ওই শোনপুরে তাতিয়া বাবার আশ্রম৷ মকর সংক্রান্তিতে ওখান থেকে প্রচুর সাধু আর ব্যাপারী আসেন সাগরদ্বীপের এই আশ্রমে৷ ফলে মহেশ্বরজির সঙ্গে ওখানকার অনেকের চেনাজানা৷ ঘোড়া কেনার ব্যাপারে উনি যদি কারও নাম সুপারিশ করে দেন, তা হলে ভাল জাতের ঘোড়া আনানো যাবে৷ দরকার হলে অ্যান্টনি গোমস আর অঙ্কুশকে তিনি ওখানে পাঠিয়ে দেবেন৷

টেবলের উপর মোবাইল ফোনটা বাজছে৷ নিশ্চয় দয়াপুর থেকে শোভার ফোন৷ হেড়োডাঙার জমিতে পাঁচিল তোলার কাজ শুরু করতে বলেছিলেন ওর বর অনন্তকে৷ হেড মিস্তিরি ছিল৷ ও এই কাজটা খুব ভাল পারে৷ ভিতপুজো করে তরিতা পরদিনই রওনা হয়েছেন ক্যানিংয়ের দিকে৷ অনন্তর হাতে পুরো দায়িত্ব সঁপে দিয়ে৷ কাল বিকেলে শোভা ফোন করে হঠাৎ বলল, পাঁচিল তোলার কাজ আটকে গিয়েছে৷ আশপাশের গাঁ থেকে ইমারতির কাজ করার জন্য যারা ভিন রাজ্যে যায়, তারা শুরুতে খুব আগ্রহ দেখিয়েছিল৷ কিন্তু, তাদের নাকি ভয় দেখানো হয়েছে৷ মাটি খোঁড়ার কাজ করার পর থেকে তারা কেউ আর আসছে না৷ তরিতা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, এ চন্দ্রভানুর কাজ৷ অনন্ত বলেছে, পুরুষরা যদি কাজ করতে না চায়, তা হলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়েই ও পাঁচিল তোলার কাজ চালিয়ে যাবে৷ শোভা জানতে চাইছিল, মেয়েদের কাজে লাগিয়ে দেবে কি না?

তরিতা বলেছিলেন, অমর মণ্ডলের সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে৷ উনি যদি লোকজন জোটাতে পারেন, তা হলে কাজটা আটকাবে না৷

গুরুমায়ের কথা ভুলে তরিতা ফোনের সেট হাতে নিয়ে দেখলেন, শোভা নয়, অঙ্কুশ৷ ওর কী এমন দরকার পড়ল, ফোন করেছে! সেট কানে দিয়ে তরিতা বললেন, ‘তুমি এখন কোথায় অঙ্কুশ?’

ও প্রান্ত থেকে অঙ্কুশ বলল, ‘ ম্যাডাম আমি কিচেনে৷ কিচেনের যিনি ইনচার্জ, সেই মহিলা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ দেবিকা ম্যাডাম আমাকে তাই ডেকে নিয়ে এলেন৷’

বিরক্ত হয়েই তরিতা বললেন, ‘তুমি কেন? আশ্রমেই তো একজন ডাক্তার আছেন৷’

‘ম্যাডাম, ডাক্তার দেখে গেছেন৷ মনে হল, উনি কনফিউজড৷ আমার মনে হয়, এটা স্নেকবাইটের কেস৷ কিন্তু ডাক্তার মানতে চাইছেন না৷ এখুনি অ্যান্টিস্নেক ভেনম সিরাম না দিলে মহিলা মারা যেতে পারেন৷’

‘কী সিম্পটন দেখে তুমি বুঝলে, স্নেকবাইটের কেস?’

‘ম্যাডাম, ঘণ্টা দেড়েক পেরিয়ে গিয়েছে৷ মহিলা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন৷ ওনার শরীরের কোথাও স্নেক বাইটের চিহ্ন নেই৷ আমি চেক করে দেখেছি৷ কিন্তু মাড়ি দিয়ে রক্ত বেরচ্ছে৷ এই সিম্পটনটা দেখেই আমার মনে হল, ক্রেট জাতীয় কোনও সাপ ওকে কামড়েছে৷ সেই কারণে শরীরের কোথাও সোয়েলিং নেই, পেন নেই৷ এখুনি হসপিটালে না নিয়ে গেলে… মহিলাকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে৷’

‘তুমি কি কাউকে বলেছ, মহিলাকে সাপের কামড়েছে?’

‘না ম্যাডাম৷ কাউকে বলিনি৷’

‘কাউকে বলার দরকার নেই৷ ক্রেট জাতীয় কোনও সাপ যদি কামড়ায়, তা হলে সে ধারে কাছে কোথাও ঢুকে আছে৷ একটু খোঁজাখুজি করে দেখো৷ আমি আসছি৷’

ক্রেট জাতীয় সাপ মানে… কালাচই হবে৷ এই জেলায় কালাচের উপদ্রব খুব বেশি৷ মহিলা এমন অন্যমনস্ক ছিলেন যে, সাপটাকে দেখতে পাননি৷ ফোনের সুইচ অফ করে, ঘরের দরজা খুলতেই তরিতা দেখলেন, করিডরে শান্তি আর গোলাপি দাঁড়িয়ে গল্প করছে৷ গোলাপি না কি সাপ ধরায় পটু৷ আজ ওর পরীক্ষা নেবেন৷ গোলাপিকে তিনি বললেন, ‘এই মেয়ে, আমার সঙ্গে আয়৷ তোকে আমার দরকার৷’

কিচেনটা কোথায়, তরিতা তা জানেন৷ সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ঠিক করে নিলেন, একশো ভাগ নিশ্চিত না হয়ে বলতে যাবেন না সাপে কামড়েছে৷ গাঁয়ের লোকেদের চিকিৎসা করার এই মুশকিল৷ যাকে কামড়েছে, সে যদি সাপ দেখতে না পায়, তা হলে কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না৷ রোগী মারা গেলে পুরো দোষ গিয়ে পড়ে, যে চিকিৎসা করছে, তার উপর৷ অঙ্কুশ ছেলেটা অভিজ্ঞ৷ হয়তো ঠিকই ধরেছে৷ মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ স্নেকবাইটেরই লক্ষণ৷ এরপর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসবে৷ মাথায় যন্ত্রণা শুরু হবে৷ রোগী জিভ নাড়াতে পারবে না বলে, কথা জড়িয়ে যাবে৷ বমির টেনডেন্সি দেখা দেবে৷ ধীরে ধীরে পুরো বডি কোলাপস করে যাবে৷ ঠিকমতো ডায়গনাইজ করতে না পারলে সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানো কঠিন৷

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কিচেনে পৌঁছে তরিতা দেখলেন, অঙ্কুশের হাতে একটা কালাচ সাপ ঝুলছে৷ লম্বায় প্রায় দু’ ফুট৷ আশ্রমের লোকেরা সভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে৷ কাছে যাওয়া মাত্র হাসিমুখে অঙ্কুশ বলল. ‘আপনার ধারণাই ঠিক ম্যাডাম৷ কিচেনের গায়ে জ্বালানি কাঠের গাদায় এই সাপটা লুকিয়ে ছিল৷ মন্টুর মা উনুন জ্বালানোর জন্য কাঠ আনতে গিয়ে, কামড় খেয়েছেন৷ তখন বুঝতে পারেননি৷ এখন বলছেন, পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছিল৷ চেক করে ওনার পায়ের তলায় হালকা দাগও দেখতে পেলাম৷’

 শুনে মনে মনে অঙ্কুশের প্রশংসা করলেন তরিতা৷ এই ক’দিন আগেই হিঙ্গলগঞ্জে এমন একটা কেস তিনি হ্যান্ডেল করেছেন৷ অঙ্কুশকে তিনি বললেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় নেই৷ একে তোমার ঘরে নিয়ে চলো৷ আমার সঙ্গে স্যালাইন ওয়াটার আর এভিএস ভায়াল রয়েছে গোটা তিরিশের মতো৷ চলো, চট করে ট্রিটমেন্ট শুরু করে দিই৷’

কিন্তু, মন্টুর মাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি যে মহেশ্বরজির মারাত্মক রোষের মুখে পড়বেন, তরিতা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি৷ সেটা তিনি টের পেলেন, রাতে কথা বলতে গিয়ে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *