তরিতা পুরাণ – ৩০

(ত্রিশ)

সকাল আটটায় সৌম্যদা হঠাৎ বারমহলে ওর ঘরে এসে হাজির৷ বললেন, ‘ন’পাড়ায় তৃণাঙ্কুরের বাড়িতে একটা চন্দ্রবোড়া ঢুকেছে৷ ধরে আনতে পারবি?’

অঙ্কুশ তখন পোষ্যপত্তুরদের খাওয়ানোর তোড়জোড় করছে৷ ওকে ঘিরে রয়েছে টিটো আর ওর তুতো ভাই-বোনেরা৷ সাপ কী খায়, কী করে খায়, সবাই দেখবে৷ সৌম্যদার কথা শুনে ওদের উৎসাহে জল পড়ে গেল৷ তৃণাঙ্কুরদা হলেন সৌম্যদার ছোটবেলার বন্ধু৷ একটা সময় কলকাতায় উয়াড়ি বলে একটা ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে ফুটবল খেলতেন৷ তখন পিয়ারা গ্রামের সবাই ওঁকে চিনতেন৷ এখন চাকরি করেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে৷ থাকেন কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে এক নামকরা কমপ্লেক্সে৷ বড় মায়ের শ্রাদ্ধের জন্য ওঁকে নেমতন্ন করেছেন সৌম্যদা৷ সেই কারণ পিয়ারায় এসে ওঁর পৈতৃক বাড়িতে গত দু’তিনদিন ধরে রয়েছেন তৃণাঙ্কুরদা৷ সেই বাড়িতে সাপ ঢুকেছে৷

পোষ্যপুত্তুরদের খাওয়ানোর দায়িত্ব গোলাপির উপর দিয়ে অঙ্কুশ ছুটে এসেছে তৃণাঙ্কুরদার বাড়িতে৷ ওর ছোটবেলাকার হিরো৷ মোটর বাইকের ইঞ্জিনটা বন্ধ করতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তৃণাঙ্কুরদা৷ বললেন, ‘আয়৷ সাপটা সিঁড়ির নীচে পাম্প ঘরের ভিতর কোথায় ঢুকে পড়েছে, দেখতে পাচ্ছি না৷ ভয়ে দোতলা থেকে কেউ নীচে নামতে সাহস পাচ্ছে না৷’

হাতে স্নেকহুক আর ব্যাগটা নিয়ে অঙ্কুশ বাড়ির ভেতর ঢুকে এল৷ এ বাড়িতে আগেও অনেকবার এসেছে৷ তাই ওর সব চেনা৷ অনেকটা জায়গা জুড়ে উঠোন৷ বেশ কয়েকটা আম আর জাম গাছ আছে৷ ফুলের অনেক টব ছিল আগে৷ এখন উঠোনের অনেকটাই আগাছায় ভর্তি৷ বাড়িতে কেউ থাকে না বলে পরিচর্যার অভাব৷ সাপের নিরাপদ বাসস্থান৷ অঙ্কুশ পাম্প ঘরের দিকে এগোচ্ছে, এমন সময় ওর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল৷ পকেট থেকে সেট বের করে, পর্দায় ও দেখল, উষসী৷ সঙ্গেসঙ্গে ওর বুকের ভেতরটা চলকে উঠল৷ এত সকালে উষসীর ফোন ও আশাই করেনি৷

কাল রাতে শ্রাদ্ধবাড়িতে অবশ্য ওর সঙ্গে এক পলকের জন্য দেখা হয়েছিল৷ কিন্তু, কোনও কথা হয়নি৷ উষসী বাড়িতে এলে পিঙ্কি বউদি এখন ওকে আগলে আগলে রাখে৷ কাল উষসী গাড়িতে ওঠার সময় অঙ্কুশ শুনতে পেয়েছিল, পিঙ্কি বউদি জানতে চাইছে, ‘কাল কিন্তু সকাল সকাল চলে আসিস৷ বেলা বারোটার মধ্যে৷ তোকে একজন দেখতে চেয়েছেন৷ উনি থাকেন বেঙ্গালুরুতে৷ ওখান থেকে আজ ফ্লাইট ধরতে পারেননি৷ তাই শ্রাদ্ধে আসতে পারেননি৷ কাল মৎস্যমুখের দিন উনি আসবেন৷’ উষসী কী উত্তর দিয়েছিল, অঙ্কুশ তা শুনতে পায়নি৷

বোতাম টিমে এ প্রান্ত থেকে অঙ্কুশ বলল, ‘গুড মর্নিং উষসী৷’

‘গুড মর্নিং৷ বাবা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছেন৷ সরি অঙ্কুশদা, আমি জানি, বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে বলে আপনি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত৷ কিন্তু, এখন কি দু’ মিনিট কথা বলতে পারবেন?’

‘কী ব্যাপারে উনি কথা বলতে চান, বলবে?’

‘কাগজে জলদস্যুদের নিয়ে লেখাটা এক্ষুণি পড়লাম৷ পালান সরদারের ইন্টারভিউ নিতে আপনিও গেছিলেন দেখলাম৷ পড়ে বাবা খুব এক্সাইটেড৷ সে ব্যাপারেই উনি একটু কথা বলতে চান৷’

ঝড়খালির কাটা জঙ্গল থেকে ফিরে আসার পর … মাঝে প্রায় এগারোটা দিন পেরিয়ে গিয়েছে৷ অঙ্কুশের ধারণা ছিল, লেখাটা বেরিয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু এতদিন পর বেরল কেন, ও বুঝতে পারল না৷ মাঝে জয়কে আর ফোন করা হয়নি৷ লেখায় জয় ওর নামটা দিয়েছে শুনে অঙ্কুশের ভাল লাগল৷ ও বলল, ‘ উষসী আমি এখন সাপ ধরতে বেরিয়েছি৷ তোমার বাবাকে বলো, ঘণ্টাখানেক পর ওঁকে ফোন করছি৷ উনি যেন কিছু মনে না করেন৷’

উষসী বলল, ‘না, না৷ মনে করবেন কেন? আপনাকে ফোন করতে হবে না৷ আমিই ফোন করে আপনাকে ধরে নেব৷’

পাছে উষসী লাইন ছেড়ে দেয়, সেই কারণে অঙ্কুশ আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কখন আসছ আমাদের বাড়িতে?’

‘পিঙ্কিদি তো একটু তাড়াতাড়িই যেতে বলেছেন৷ বাবা আর মাও আজ আমার সঙ্গে যাবেন৷ তিন্নি গাড়ি নিয়ে এসে আমাদের তুলে নেবে৷ বেলা বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যেই মনে হয়, আমরা পৌঁছে যাব৷’

‘ভালই হল৷ তোমার বাবার সঙ্গে তা হলে আলাপ হয়ে যাবে৷ শুনেছি, উনি নাকি শিলচরের কোনও একটা কাগজে সাংবাদিকতা করতেন?’

‘হ্যাঁ৷ ওখানে যুগশঙ্খ বলে একটা কাগজে৷ জয়বাবুর লেখাটা পড়ে বাবাই আমাকে আইডিয়াটা দিলেন৷ যদি পালান সরদারকে নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় একটা আর্টিকেল লেখা যায়, তা হলে ওরা নিশ্চয়ই ছাপবে৷ পালান সরদারের কোনও কন্টাক্ট নাম্বার আছে আপনার কাছে?’

তৃণাঙ্কুরদা ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ আর কথা বাড়াতে চাইল না অঙ্কুশ৷ তাড়াতাড়ি বলল, ‘আছে৷ তুমি বাড়িতে এসো, তখন না হয় কথা বলা যাবে৷ আগে আমার সঙ্গে দেখা কোরো কিন্তু৷ আগে পিঙ্কিদির খপ্পরে পড়লে আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ ছাড়ি তা হলে?’

শুনে ও পাশে খিলখিল করে হাসতে লাগল উষসী৷ জলতরঙ্গ বাজনার আওয়াজের মতো৷ মনটা খুশিতে ভরে গেল অঙ্কুশের৷ লাইন কেটে দিয়ে ও বলল, ‘চলো তৃণাঙ্কুরদা৷ আসামী চন্দ্রবোড়াকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসি৷ ব্যাটা কতক্ষণ আগে তোমার চোখে পড়েছে?’

‘এই আধ ঘণ্টা আগে৷ সঙ্গেসঙ্গে আমি সৌম্যকে ফোন করি৷ কুশ, তুই লাইটলি নিস না ভাই৷ এই চন্দ্রবোড়াটা ডেঞ্জারাস বলে মনে হল৷ একেবারে শঙ্খের মতো সাদা৷ আমি লাঠি দিয়ে একবার খুঁচিয়েছিলাম৷ রেগে ফোঁস ফোঁস করছিল৷ সাবধান ভাই৷’

 সিঁড়ির নীচে পাম্প ঘরের কাছটায় আবছা অন্ধকার৷ পাশে একটা সাইকেলও দাঁড় করানো আছে৷ সাপটা যদি আগে চোখে না পড়ত, আর না- জেনে কেউ যদি সাইকেলটা আনতে যেত, তা হলে নির্ঘাত ছোবল খেত৷ পকেট থেকে টর্চটা বের করে আলো ফেলল অঙ্কুশ৷ সাপটাকে কোথাও দেখতে পেল না৷ কাছাকাছি কোথাও গর্ত আছে কি না, ওর জানা নেই৷ থাকলে সেই গর্তে ঢুকেও যেতে পারে ইঁদুরের সন্ধানে৷ বিষধর সাপেরা সাধারখত, বাধ্য না হলে দিনের আলোয় বেরতে চায় না৷ তৃণাঙ্কুরদা বলছে, চন্দ্রবোড়া৷ ছোটবেলাটা গাঁয়ে কাটিয়েছে৷ তাই সাপ চিনবে, এটাই ধরে নেওয়া স্বাভাবিক৷ কিন্তু, চন্দ্রবোড়া সাধারণত লোকালয়ে বাস করে না৷ এ বাড়িতে হয়তো কোনও কারণে ঢুকে পড়েছে৷ তৃণাঙ্কুরদার কথামতো, যদি সত্যিই চন্দ্রবোড়া হয়, তা হলে পয়েজনাস৷ এর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ মিলিগ্রাম বিষ শরীরে ঢুকলে মৃত্যু হতে পারে৷ তাই দু’তিন ফুট দূরে থাকাই সেফ৷

অঙ্কুশকে দেখে ভরসা পেয়ে দোতলা থেকে নেমে এসেছে তৃণাঙ্কুরদার বউ দীপা বউদি, আর ছেলে চন্দন৷ খানিকটা দূরে জামতলার কাছে ওরা সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ সাপ নিয়ে শহুরে মানুষদের এত ভীতি কেন, অঙ্কুশের মাথায় ঢোকে না৷ সাপ সত্যি এত ভয় খাওয়ার প্রাণী নয়৷ টর্চের আলোর ক্ষমতা বাড়িয়ে খোঁজাখুজি করতেই ওর চোখে পড়ল, ইটের খাঁজে লেজের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে৷ স্নেক হুক বাড়িয়ে অঙ্কুশ লেজ চেপে ধরতেই সাপটা তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এল৷ হুকের বাঁকানো অংশটা পেটের নীচে চালান করে, ও তুলে ধরার চেষ্টা করতেই সাপটা একবার ফোঁস করে উঠল৷ তৃণাঙ্কুরদা ঠিই বলেছে, রাসেলস ভাইপার৷ প্রায় তিন ফুটের মতো লম্বা৷ তবে গায়ের রঙটা অদ্ভুত৷

সাধারণত, চন্দ্রবোড়ার পেটের দিকটা সাদা হয়৷ উপরে কালো ছোপ৷ দেখতে বাদামি, চন্দন বা হলুদ রঙের শিকলের মতো সারি গোলাকার চাকা চাকা দাগ ঘিরে কালো বেড় দেওয়া টাইপের হয়৷ মাথা চ্যাপটা, তেকোণা৷ মাথার উপর উলটো ভি চিহ্ন থাকে৷ কিন্তু, এই সাপটার গায়ের রঙে সাদার প্রাধান্যই খুব বেশি৷ শ্বেতসর্পই বলা যায়৷ এ রকম অদ্ভুত রঙের চন্দ্রবোড়া অঙ্কুশের আগে কখনও চোখে পড়েনি৷ স্নেকহুক দিয়ে সাপটা তুলে ও লেজের দিকটা ধরে ফেলল৷ তার পর উলটো করে ঝুলিয়ে ভাল করে দেখতে লাগল৷ এর একটা ছবি তুলে আজই ফেসবুকে আপলোড করে দিতে হবে৷ যাতে ডিটেল ইনফর্মেশন পাওয়া যায়৷ কেউ না কেউ সন্ধান দেবেই৷ বিশেষ করে সর্পমিত্ররা৷

ঝুলে বন্দী থাকাটা কোনও সাপই পছন্দ করে না৷ তাই সাদা চন্দ্রবোড়া শরীর বাঁকিয়ে ছটফট করতে লাগল৷ চেরা জিভ দুটো বারবার বের করছে৷ দেখে দীপা বউদি বলে উঠল, ‘বাপ রে, দেখে ভয় করছে কুশ৷ তুমি শিগগির ব্যাগে ভরে ফ্যালো৷’

ভয় কাটানোর জন্য অঙ্কুশ বলল, ‘শ্বেতসর্প বাড়িতে আসা খুব ভাল লক্ষণ বউদি৷ শিগগির তোমাদের ভাল কোনও খবর আসবে৷’

‘ভাল খবরের দরকার নেই ভাই৷ তুমি ওটাকে বাড়ি নিয়ে যাও৷ তার আগে কফি খেয়ে যাও৷ এত বড় একটা কাজ করে দিলে…৷’

হাসতে হাসতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অঙ্কুশ সাপটাকে ব্যাগে পুরে ফেলল৷ সাহস করে চন্দন এ বার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে৷ সেদিন বাড়িতে টিটো যখন সমবয়সি অন্য ছেলেদের পাখি চেনাচ্ছিল, তখন চন্দনও তাদের মধ্যে ছিল৷ এটাই ওদের শেখার বয়স৷ প্রকৃতির মধ্যে না এনে ফেললে, এরা জীবজন্তু চিনবে কী করে? বা তাদের ভালবাসবেই বা কী করে? জামগাছতলায় বসার মতো সিমেন্টের বেদি আছে৷ সেখানে বসে অঙ্কুশ বলল, ‘চন্দন, সেদিন টিটো ক’টা পাখি তোদের চেনাল রে?’

‘দশ-বারোটা৷ তুমি আমায় আরও চেনাবে কুশকাকু?’

‘তা হলে তো তোকে শীতকালে আসতে হবে ভাই৷ বছরে একবার করে বাচ্চাদের আমি নেচার স্টাডি করাতে নিয়ে যাই৷ বাবাকে বলিস, তখন যেন তোকে এখানে নিয়ে আসে৷ শুধু পাখি না, তোকে বহু গাছও চিনিয়ে দেবো৷ স্কুলে গিয়ে আন্টিকে তখন তাক লাগিয়ে দিতে পারবি৷’

‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব কুশকাকু? সাপের জিভ চেরা হয় কেন গো?’

দীপা বউদি কফির কাপ নিয়ে এসেছে৷ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এটা আমারও জানার খুব ইচ্ছে৷ অনেকদিন আগে পিঙ্কি একবার আমায় বলেছিল, ভুলে গেছি৷ তুমি বলো তো কুশভাই৷’

কফিতে চুমুক দিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘এর পিছনে অনেক কাহিনি আছে৷ একেবারে পুরাণের আমল থেকে বলি৷ দেবতা আর দানবরা যখন সমুদ্র মন্থন করছিলেন, তখন শেষদিকে সমুদ্রের তলা থেকে অমৃতভাণ্ড উঠে এল৷ এই অমৃত খেলে অমর হওয়া যায়৷ দেবতারা চাইছিলেন না, দানবরা কেউ অমৃত খান৷ তাঁরা দানবদের বোকা বানিয়ে সেই অমৃতভাণ্ড সরিয়ে ফেলে, নিজেরা সবটা খেয়ে নিলেন৷ সমুদ্র মন্থনে অংশ নিয়েছিলেন নাগরাও৷ নাগ মানে সাপেরা৷ অমৃতের ভাগ চাইতে এসে ওরা দেখলেন, একটুও অবশিষ্ট নেই৷ সেই অমৃত ভাণ্ড রাখা হয়েছিল কুশের উপর৷ সাপেরা তখন সেই কুশ চাটতে থাকলেন৷ যদি তাতে কোথাও সামান্য অমৃত পড়ে গিয়ে থাকে, এই ভেবে৷ কুশ চাটতে গিয়ে সাপেদের জিভ চিরে গেল৷ সেই থেকে সাপের জিভ চেরা৷’

চন্দন জিজ্ঞেস করল, ‘সমুদ্র মন্থন কী কুশকাকু?’

দীপা বউদি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘সেই গল্পটা পরে আমি তোকে বলে দেব৷ তার আগে শুনে নিই, বাকি আর কী কাহিনি আছে?’

কুশ বলল, ‘সায়েন্টিফিক রিজন অবশ্য অন্য৷ অ্যারিস্টটল বলতেন, সাপ জিভের সাহায্য নিয়ে সুক্ষ অনুভূতি সঞ্চয় করে৷ জিভ চেরা হওয়ায় সাপ যে কোনও জিনিসের স্বাদ বা গন্ধ দ্বিগুণভাবে পায়৷ অ্যারিস্টটলের এই মতটা এখন সবাই মেনে নিয়েছেন৷ তা ছাড়া, আরও কারণ আছে৷ সাপ বুক দিয়ে হাঁটে বলে ওদের নাকে খুব ময়লা জমে৷ ওরা তাই চেরা জিভ দিয়ে সেই ময়লা পরিষ্কার করে৷ দু’দিকের নাকের গর্তে দুটো জিভ ব্যবহার করতে পারে৷ জিভ চেরা হওয়ায় উড়ন্ত পোকা ধরতেও ওদের সুবিধে হয়৷ অন্য সাপের বাসা খুঁজে বের করতে পারে৷ তারা নিজেদের জাতের কি না, সেটাও বুঝতে পারে৷’

চন্দন জিজ্ঞেস করল, ‘কুশকাকু অ্যারিস্টটল কে?’

দীপা বউদি এ বারও ওকে চুপ করিয়ে দিল, ‘কাকুকে এ বার ছেড়ে দে বাবা৷ ওদের বাড়িতে আজ কাজ৷ কথা বলার সময় নেই৷’

কাপের কফি শেষ করে এ বার অঙ্কুশ উঠে দাঁড়াল৷ দেখে তৃণাঙ্কুরদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘চন্দ্রবোড়াটাকে নিয়ে এখন কী করবি কুশ?’

অঙ্কুশ বলল, ‘আপাতত কয়েকটা দিন পোষ্যপুত্তুর করে রাখব৷ তার পর সল্ট- লেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে জমা দিয়ে আসব৷’ কথাগুলো বলে স্নেকব্যাগটা কাঁধে ফেলে ও মোটর বাইকের দিকে হাঁটতে লাগল৷ চন্দনের জন্য ওর খুব আফসোস হতে লাগল৷ বেচারা! জানার কত আগ্রহ৷ অথচ শহরের ইট-সিমেন্টের জঙ্গলে বড় হচ্ছে৷ আগ্রহ মেটাতে চাইলেও ওর কোনও উপায় নেই৷ মা-বাবা বাধা দেবেন!

ন’পাড়া থেকে ওদের মিত্তিরবাড়ি এমন কিছু দূরে নয়৷ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অঙ্কুশ বাড়িতে পৌঁছে গেল৷ কাজের বাড়ি, তাই লোহার গেট দুটো হাট করে খোলা৷ অনবরত লোকজন যাতায়াত করছে৷ গেটের কাছে দু’তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ তার মধ্যে একটা বিএমডবলিউ৷ এত দামি গাড়ি করে কে এলেন? নিশ্চয় পিসেমশাইদের পরিচিত কেউ হবেন৷ বিদেশে ওঁরা সব বড় বড় চাকরি করেন৷ কেউ দেখা করার জন্য এখানে আসতেই পারেন৷ ও আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর রেখে কী করবে?

মোটর বাইকটা ভিতরে ঢুকিয়ে অঙ্কুশ দেখল, পাঁচ-ছ’জন তুতোভাইয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে টিটো কী যেন বলছে৷ কাছে যেতেই অঙ্কুশ বুঝতে পারল, টিটো বেড়াসাজি গাছ চেনাচ্ছে৷ ওকে দেখে সবাই হই হই করে ছুটে এল৷ কাঁধে স্নেকব্যাগ দেখে টিটো জিজ্ঞেস করল, ‘কী সাপ ধরে আনলে কুশকাকু৷ আমাদের দেখাবে?’

সঙ্গেসঙ্গে অন্যরা আবদার ধরল, ‘দেখান, আঙ্কল দেখান৷’

চন্দ্রবোড়াটাকে বের করে দেখালে ভিড় জমে যাবে৷ কথাটা বাড়ির ভিতরও চলে যাবে৷ বাড়ির ভিতর থেকেও অনেকে ছুটে আসবে৷ কাজের বাড়িতে জেঠা-কাকারা বিরক্ত হতে পারেন৷ এমনিতেই বড়কাকা ওর উপর চটে আছেন৷ সম্পত্তি ভাগাভাগির পরদিন থেকে ওর সঙ্গে কথাই বলছেন না৷ উনি নাকি ভাবতেই পারেননি, বড়মা দয়াপুরের তিরিশ বিঘের জমির পুরোটা ওকে দিয়ে যাবেন৷ ওই জমিটা দেখাশুনো করত গোলাপির বাবা নিবারণদা৷ আয়লার আগের বছর পর্যন্ত ভাগচাষী দিয়ে ফসল ফলিয়েছে৷ এমন সৎ মানুষ, প্রতি বছর জমির পুরো দানসালদা ধান দিয়ে যেত৷ সেই চাল থেকে সুন্দর গন্ধ বেরত৷ ওদের যৌথ পরিবারে সম্বৎসরের চাল বাইরে থেকে কিনতে হত না৷ নিরাবণের কাছ থেকে মরশুমি ফসল সব বুঝে নিতেন বড়কাকা৷ জমিটা উনিই পাবেন, ধরে নিয়েছিলেন৷

কাজের বাড়িতে পাছে ওকে নিয়ে কোনও কথা ওঠে, সেই কারণে বাচ্চাগুলো চুপ করিয়ে দিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘সাপটা এখন ঘুমোচ্ছে রে৷ ওকে তোদের দেখাতে পারব না৷ বদলে তোদের একটা অন্য জিনিস দেখাব৷ বাঘের চোখ, দেখবি নাকি?’

শুনে সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল৷ দেখে হাসি পেল অঙ্কুশের৷ সঙ্গেসঙ্গে বেড়াসাজি গাছ থেকে ও বড় একটা পাতা ছিড়ে নিল৷ পাতাটা ভাঁজ করে চাপ দিতেই মাঝখান থেকে সাদা আঠা বেরিয়ে এল৷ এবার পাতার দুটো অংশ দু’দিকে টানতেই আঠা পাতলা হয়ে চোখের ডিমের মতো হয়ে গেল৷ ছোটবেলায় এই খেলাটা খেলত অঙ্কুশরা৷ পাতলা হওয়া অংশটা বাঘের চোখের মতো দেখাত৷ চারপাশ থেকে সমস্বরে বিস্ময়সূচক আওয়াজ শুনতে পেয়ে, পাতাটা টিটোর হাতে দিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘তোরা চেষ্টা কর৷ তোরাও বাঘের চোখ বানাতে পারবি৷’

কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না অঙ্কুশ৷ চন্দ্রবোড়ার একটা গতি করার জন্য ও বারমহলে চলে এল৷ সাপটা অনেকক্ষণ ব্যাগবন্দি হয়ে রয়েছে৷ সাফোকেশন হতে পারে৷ পলিথিনের চাদর তুলে তুলে ও খাঁচাগুলো দেখতে লাগল৷ কোনও খাঁচা ফাঁকা আছে কি না? নাহ, একটাও নেই৷ সাপটাকে ঝিলের ধারে ছেড়ে দিয়ে এলেই ভাল হত৷ পরক্ষণেই ওর মনে পড়ল, আট নম্বর খাঁচায় একটা চন্দ্রবোড়া রয়েছে৷ একই জাতের দুটো সাপ এক খাঁচায় রাখা যেতে পারে৷ ভেবে চন্দ্রবোড়াটাকে ও সেই খাঁচায় ঢুকিয়ে দিল৷

বেলা দশটা বাজে৷ সকাল থেকে এক কাপ কফি ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি৷ অন্যসময় হলে পিঙ্কি বউদিকে ফোন করে অঙ্কুশ জলখাবার আনিয়ে নিত৷ কিন্তু, দিন কয়েক হল, বউদি নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছে৷ আগে রোজ একবার করে এসে আড্ডা মেরে যেত৷ হাসিঠাট্টা করত৷ এখন দরকার না হলে কথা বলে না৷ মাঝে মাঝে অঙ্কুশের মনে হয়, বউদিও কি চায়নি, দয়াপুরের জমিটা ও পাক? না,না৷ তা কি করে হবে? মনে হয়, পিসিদের জন্য বউদি খুব চাপের মধ্যে আছে৷ বাড়ির ভিতর এমন কিছু ঘটেছে, যা ও জানে না৷ এ সব কথা ভাবতে ভাবতেই অঙ্কুশ দেখল, খাবারের থালা হাতে করে পিঙ্কি বউদি ঘরে ঢুকছে৷ মুখ থমথমে৷ টেবলের উপর থালাটা রেখে বউদি বলল, ‘তোমার হবু শ্বশুর এসেছেন৷ বাপী আর পিসিমণির সঙ্গে উনি কথা বলছেন৷ খাবারটা চট করে খেয়ে একবার তুমি বৈঠকখানায় এসো৷’

বাপী মানে… জেঠামশাই৷ কিন্তু হবু শ্বশুরটি কে, অঙ্কুশ বুঝতে পারল না৷ ও প্রশ্ন করল, ‘কে দেখা করতে এসেছেন বললে?’

‘সুকুমার বাসু৷ তিনটে টি গার্ডেন, একটা স্টিল ফ্যাক্টরি, আর একটা শপিং মলের মালিক৷ যাঁর ছোটমেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে চান তোমার চন্দ্রভানুবাবুর স্ত্রী৷ ভদ্রলোক বোধহয় জানতেন না, এটা এখন শোকের বাড়ি৷ এসে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন৷ চলে যেতেই চাইছিলেন৷ কিন্তু পরিচয় পাওয়ার পর পিসিমণি ওঁকে আদর করে বসালেন৷ কেন, বাইরে দাঁড়ানো বিএমডবলিউ গাড়িটা তোমার চোখে পড়েনি? উনি তো তোমার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য এসেছেন৷’

শুনে অঙ্কুশের মুখ কালো হয়ে গেল৷ ও আশাই করেনি পিঙ্কি বউদি কাটা কাটা কথা শোনাবে৷ অবাক হয়ে ও পিঙ্কি বউদির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ বুঝতেই পারল না, মিথ্যেটা কীভাবে সত্যি হয়ে গেল?

(একত্রিশ)

মাস দুয়েক আগেও যে বাড়িটা ছেড়ে যেতে মন চাইত না, সেই বাড়িতে এখন দমবন্ধ হয়ে আসছে গোলাপির ৷ সত্যি, ও ভাবতেও পারেনি, এই ক’দিনের মধ্যে এত পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে! ছোটবেলা থেকেই ও দেখেছে, বড়মা বলতে বাড়ির ছোট-বড় সবাই অজ্ঞান৷ বড়মা গলা চড়িয়ে কোনও কথা বললে ভয়ে সবাই তটস্থ হয়ে থাকত৷ বড় জেঠামশাই থেকে টিটো পর্যন্ত সবাই৷ কিন্তু, এখন বড়মায়ের কথা উঠলেই অনেকে মুখ বেঁকিয়ে সরে যাচ্ছে৷ উকিলবাবু এ বাড়িতে আসার পর থেকে এই অবস্থা৷ উনি যেদিন সম্পত্তি ভাগাভাগি করলেন, তার পর থেকে বড়কাকা, কাকি আর পিসিদের মুখ ভার৷ সবার রাগ আছড়ে পড়েছে কুশ দাদাবাবুর উপর৷

মৎস্যমুখের পরদিন সকালে কুশ দাদাবাবু কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ ফিরল পরের দিন রাত্তিরে৷ বাড়ির কেউ কোনও প্রশ্ন করেনি, কোথায় গিয়েছিল? আজ সকালে দাদাবাবুর জলখাবার পৌঁছে দেওয়ার সময় গোলাপি দেখে, একটা বড় ট্র্যাক এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটের সামনে৷ কয়েকটা লোক নেমে এসে সাপের খাঁচাগুলো ট্র্যাকে তুলতে শুরু করল৷ অবাক হয়ে গোলাপি তখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এ কী দাদাবাবু, পোষ্যপুত্তুরদের তুমি কোতায় পাটাচ্ছ?’

কুশ দাদাবাবু মুখ শুকনো করে বলেছিল, ‘বাড়িতে আর সাপ পোষা যাবে না রে গোলাপি৷ গভর্মেন্ট থেকে চিঠি পাঠিয়েছে৷ তাই সল্ট লেকের ফরেস্টবাবুদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’

শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল গোলাপির৷ আর কেউ না জানুক, ও তো জানে, পোষ্যপুত্তুররা দাদাবাবুর কাছে কী! পোষ্যপুত্তুরদের ছাড়া দাদাবাবু বাঁচবেই না৷ ও আরও জানে, সাপ পোষার লাইসেন আছে দাদাবাবুর৷ ফি বচর লাইসেন করে আনে৷ এটা আসল কারণ হতে পারে না৷ দাদাবাবু ইচ্ছে করেই সাপগুলো বিলিয়ে দিচ্ছে৷ ভাবতেই ওর বুকটা ধক করে উঠেছিল৷ দাদাবাবু বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে না তো? গত তিন-চার দিন বাড়ির লোকেরা যা খারাপ ব্যবহার করেছে, তাতে দাদাবাবুর অভিমান হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ মুখ ফস্কে ও প্রশ্নটা করে ফেলেছিল, ‘তুমি কি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্চ দাদাবাবু?’

শুনে চমকে উঠেছিল কুশ দাদাবাবু৷ মুখে জোর করে হাসি এনে তখন বলেছিল, ‘তুইও যেমন! বাড়িতে বসে থাকলে কি আমার চলবে? চাকরি -বাকরি করতে হবে না? একদিন না একদিন তো আমাকে চাকরি খুঁজতে বেরতেই হবে৷ তোদের দয়াপুরে একটা চাকরির কথা হচ্ছে৷ ভাবছি, দু’একদিনের মধ্যে ওখানে ইন্টারভিউ দিতে যাব৷ যদি চাকরিটা পাই, তা হলে তো ওখানেই থাকতে হবে৷’

‘কবে যাবে সেখেনে? বাবা বলচেল, এখেন থেকে আমাকে দয়াপুরে নে যাবে৷ ওখেনে দিনকয়েক থাকতি হবে৷ তুমি যকন দয়াপুরে যাচ্চই, তাইলে আমাদিগে নে চলো৷’

‘চল তা হলে৷ তোর বাবাকে তো আমিই দয়াপুরে নিয়ে যাচ্ছি৷ বড়মা-র দেওয়া জমিটা নিজের চোখে দেখে আসব৷ যদি চাকরি-বাকরি কিছু না হয়, তা হলে বুঝলি, তোর বাবা আর আমি চাষবাস করেই জীবনটা কাটিয়ে দেব৷’ কথাগুলো বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠেছিল কুশ দাদাবাবু৷

আগে এ বাড়ির ভাল-মন্দে জড়িয়ে পড়ত গোলাপি৷ দাদাবাবুর নামে কেউ কিছু বললেই ও ফোঁস করে উঠত৷ কিন্তু, মহেশপুরে চলে যাওয়ার পর থেকে ওর সেই টানটা এখন আর নেই৷ ও জানে, ওকে মিত্তিরবাড়িতে আর থাকতে হবে না৷ ভবিষ্যৎ জীবনটা ওকে বাদাবনেরই কোনও একটা গাঁয়ে কাটাতে হবে৷ বাবা উঠে পড়ে লেগেছে পরাণের সঙ্গে ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য৷ দাদাবাবু কথা দিয়েছিল, বিয়েটা আটকে দেবে৷ বাবার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলবে৷ কিন্তু, পিয়ারায় আসার পর থেকে বড়মায়ের শ্রাদ্ধ নিয়ে সবাই এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, বাবার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার সুযোগই পায়নি দাদাবাবু৷

সকালে পোষ্যপুত্তুরদের নিয়ে ট্র্যাকটা চলে যাওয়ার পর কেঁদে ফেলেছিল গোলাপি৷ বারমহলের ঘরটা একেবারে ফাঁকা৷ এই দৃশ্যটা যে ওকে দেখতে হবে, ও তা কোনওদিন ভাবতেও পারেনি৷ সিঁড়িতে কিছু সময় দাঁড়িয়ে ছিল গোলাপি৷ তখনই ‘তুই এখন যা’ বলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল কুশ দাদাবাবু৷ অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধক করে উঠেছিল গোলাপির৷ জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ও দেখেছিল, ডাইনিং টেবলে মুখ গুঁজে কাঁদছে কুশ দাদাবাবু৷ দৃশ্যটা দেখে গোলাপিও কেঁদে ফেলেছিল৷ এ বাড়িতে কেউ কোনওদিন কাঁদতে দেখেনি কুশ দাদাবাবুকে৷ সবসময় হাসিখুশি একটা মানুষ৷ কতটা ভেঙে পড়লে হাউহাউ করে কাঁদতে পারে? বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে গোলাপির মনে হয়েছিল, মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়া উচিত৷

প্রথমে ভেবেছিল, মহেশপুরে গিয়ে ফের দাদার বাড়িতে উঠবে৷ কেননা, ওখানে ওর নিজেরও সাত-আটটা পোষ্যকন্যে আর পুত্তুর আছে৷ তাদের একটার আবার পেটে ডিম ভর্তি৷ এখন যত্নআত্যি করা দরকার৷ কিন্তু, দিন দুয়েক হল, দয়াপুরের তরিতা মা ওকে খুব টানছেন৷ বারবার তাঁর কথাই মনে পড়ছে৷ বাবা যদি দাদাবাবুর সঙ্গে দয়াপুরে যায়, তা হলে ও আর মহেশপুরে যাবে না৷ দয়াপুরে গিয়ে তরিতা মায়ের সঙ্গে দেখা করবে৷ অন্তত কুশ দাদাবাবুর কাছাকাছি তো থাকতে পারবে তা হলে৷

আশ্চর্যের ব্যাপার, কুশ দাদাবাবু যে কেন পোষ্যপুত্তুরদের বাড়ি থেকে সরিয়ে দিল, সে কথা পিঙ্কি বউদি ছাড়া বাড়ির আর কেউ কিন্তু গোলাপিকে জিজ্ঞেসও করেনি৷ ট্র্যাকটা চলে যাওয়ার পর গোলাপি যখন বাড়িতে এসে ঢোকে, তখন বৈঠকখানায় অনেকেই বসে৷ পিঙ্কি বউদি জানতে চেয়েছিল, ‘সাপের খাঁচাগুলো কুশ কোথায় পাঠাল, তুই জানিস গোলাপি?’

তখন সববাই মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়েছিল৷ গোলাপি বলেছিল, ‘সল্ট লেকে৷’

খবরের কাগজে ফের মুখ ডুবিয়ে বড়কাকা বলেছিল, ‘আপদ গেল৷’

দিল্লির ছোটপিসি বলেছিল, ‘সত্যি মেজদা, তোমরা অ্যাদ্দিন অ্যালাউ করেছিলে কেন, সেটা ভেবেই মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যেতাম৷ বারমহলটা তো কুশ চিড়িয়াখানা বানিয়ে রেখেছিল৷’

‘আস্পর্ধাটা পেয়েছিল মায়ের জন্য৷’

‘তুমি দেখো সেজদা, ও ছোড়া কিন্তু এ বাড়িতে আর থাকবে না৷ ভালই হল, সৌম্যর ছেলেটা বেঁচে গেল৷ ছোড়ার সঙ্গে মিশে টিটোটা গোল্লায় যেত৷ সারাদিন সাপ, পাখি আর গাছ নিয়ে পড়ে আছে৷ রাতদিন মুখে কুশকাকু আর কুশকাকু৷ পিঙ্কিটাও শাসন করত না৷’

‘ঠিক বলেছিস৷’

‘আমার কথা পরে মিলিয়ে নিও সেজদা৷ দয়াপুরের পুরো জমিটা কুশ বিক্রি করে দেবে৷ তুমি কিন্তু আটকাও৷ জমিটা একা ভোগ করতে দিও না ওকে৷’

‘তোদের তো বললাম, ওকে প্রোবেট নিতে দেব না৷ আমি মামলা করে ঝুলিয়ে রাখব৷’ এই কথাগুলো বলার পর বড়কাকার হয়তো খেয়াল হয়েছিল, সামনে গোলাপি দাঁড়িয়ে সব শুনছে৷ সেই কারণে ধমকে উঠেছিল, ‘তুই এখানে কী করছিস?’

মুখ কালো করে বৈঠকখানা থেকে সরে এসেছিল গোলাপি৷ ওর সবথেকে খারাপ লেগেছিল, পিঙ্কি বউদিও ছোটপিসিদের দলে ভিড়ে গিয়েছে বলে৷ দাদাবাবুর উপর পিঙ্কি বউদির রেগে যাওয়ার কারণটা অবশ্য ও জানে৷ সেটা উষসীদিদিকে নিয়ে৷ মেয়েমহলের কানাকানিতে গোলাপি জেনে গিয়েছে, কুশ দাদাবাবুর জন্য বড়মা নাকি পছন্দ করে গিয়েছে উষসীদিদিকে৷ কিন্তু, দাদাবাবু নাকি আরও বড়লোকের কোন মেয়েকে বিয়ে করতে চায়৷ উষসীদিদির সঙ্গে দাদাবাবুর বিয়ে হলে খুশি হবে গোলাপি৷ কেননা, দু’জনকে খুব সুন্দর মানাবে৷ কিন্তু, বিয়েটা যে যার নিজস্ব ব্যাপার৷ নিজেকে দিয়েই গোলাপি বুঝতে পারছে৷ তবে ওর মাথায় ঢুকছে না, উষসীদিদিকে দাদাবাবু বিয়ে করতে চাইছে না, এই কথাটা রটাল কে?

মৎস্যমুখের দিন দুপুরে উষসীদিদি এ বাড়িতে এসে প্রথমে বারমহলে দাদাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে ঢুকেছিল৷ তখন আড়াল থেকে ওঁদের কথাবার্তা শুনে গোলাপির মনে হয়েছিল, কুশ দাদাবাবু উষসীদিকে পরে দয়াপুরে নিয়ে যাবে৷ দাদাবাবুর মুখ থেকে আনন্দ ঠিকরে বেরচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল, এমন সুখি মানুষ আর পৃথিবীতে নেই৷ কুশ দাদাবাবুকে তো আর উষসীদিদির কথা জিজ্ঞেস করা যায় না৷ বয়সে অনেক বড়৷ তবুও, দয়াপুরে যাওয়ার সময় কায়দা করে একবার উষসীদিদির প্রসঙ্গ তুলবে, গোলাপি ভেবে রেখেছে৷ কিন্তু, আজ দুপুরের খাবার দিতে গিয়ে ও দেখল, সকালের জলখাবার টেবলের উপর যে কে সেই পড়ে আছে৷ দাদাবাবু মুখে দেয়নি৷ দরজা খুলে দাদাবাবু ব্যস্ততার সঙ্গে তখন জিজ্ঞেস করল, ‘তোরা কি রেডি? আমি কিন্তু বেলা ঠিক তিনটের সময় বেরোব৷’

কাল রাতেই কুশ দাদাবাবু বাবাকে বলে দিয়েছিল, সব গোছগাছ করে রাখতে৷ সেই মতো স্নান করতে যাওয়ার আগে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে গোলাপি৷ বাবা বারান্দায় খেতে বসে গিয়েছে৷ এ বার গিয়ে ও খেতে বসবে৷ থালাটা টেবলে রেখে ও জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি খাবে না? তোমার খাবার নিয়ে এসেছি যে৷’

‘না রে৷ আজ বাদশাহ রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি খেতে খুব ইচ্ছে করছিল৷ তাই আনিয়ে ছিলাম৷ আমার খাওয়া হয়ে গেছে৷ টেবল থেকে তুই প্লেটগুলো নিয়ে যা৷ আর বেরনোর জন্য চটপট তৈরি হয়ে নে৷’

শুনে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠেছিল গোলাপির৷ শ্রাদ্ধের পরদিন থেকে কুশ দাদাবাবু বাড়ির কোনও খাবার মুখে দেয়নি৷ দাদাবাবুকে ও ছোটবেলা থেকে দেখছে৷ ও জানে, অনুরোধ করে কোনও লাভ নেই৷ শুকনো মুখে খাবারের থালা নিয়ে ও বাড়ি ফিরে এল৷ কিচেনে তখন ছোট পিসি আর পিঙ্কি বউদি বসে৷ দু’জনে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল৷ তার পর নীচু গলায় ছোটপিসি বলল, ‘ছোড়া খাবে কোন মুখে? এখন কি এসব খাবার ওর মুখে রুচবে? মাল্টিমিলিওনিয়ারের মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে৷ দেখবি, এর পর হয়তো ওর খাবার আসবে মেনল্যান্ড চায়না থেকে৷’

ছোটপিসির সবকথা গোলাপি বুঝতে পারল না৷ কিন্তু বলার ধরন দেখে ওর গা জ্বলে গেল৷ ইচ্ছে করল, একটা চন্দ্রবোড়া ধরে এনে সামনে ছেড়ে দেয়৷ এঁদের সামনে বসে নিজের খাওয়ার ইচ্ছেটাও ওর চলে গেল৷ কিন্তু, দয়াপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যাবে৷ অতক্ষণ পেট খালি রাখা উচিত হবে না৷ তার উপর যদি নদীতে রোলিং হয়, তা হলে পেট আরও গুলিয়ে উঠবে৷ কোনও রকমে মুখে দুটো ভাত ফেলে, গোলাপি পাতে জল ঢেলে দিল৷ একটু পরে সালোয়ার-কামিজ পরে, বেরোনোর জন্য তৈরি হয়ে যখন বৈঠকখানায় এল, তখন দেখল, কুশ দাদাবাবু বিদায় নিতে এসেছে৷ বড়কাকা ছাড়া বাড়ির সবাই সেখানে হাজির৷ জেঠিমা-কাকিমা আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে৷

বড় জেঠাবাবুকে প্রণাম করে কুশ দাদাবাবু বলল, ‘বারমহলের চাবিটা দিয়ে যাচ্ছি জেঠু৷ কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নেবেন৷’

বড় জেঠাবাবু বললেন, ‘এ তুই ঠিক করছিস না কুশ৷ মায়ের শ্রাদ্ধের পরপরই তুই চলে যাচ্ছিস৷ আত্মীয়স্বজনরা কী ভাববেন, বল তো? সবাই তো আমাদের দোষী ঠাওরাবেন৷ ঠাকুরমা মারা যাওয়ার পর বাপ-মা মরা ছেলেটাকে চারটে দিনও বাড়িতে তিষ্ঠোতে দিল না৷’

‘কেউ কিছু বলবে না জেঠু৷ আমাকে নিয়ে এত ভাবার সময় কারও নেই৷’

‘সত্যি করে বল তো, তুই পার্মানেন্টলি চলে যাচ্ছিস, না কি আবার আসবি?’

‘আপাতত ফেরার কোনও ইচ্ছে নেই৷’

‘কোথায় যাচ্ছিস শুনি?’

‘সুন্দরবনের দিকে৷ সুযোগ পেলে তার পর চেন্নাইতেও চলে যেতে পারি৷’

ছোটপিসি গলায় মধু ঢেলে বলল, ‘দয়াপুরের জমিটার কী হবে বাবা? তুই তো বাইরে চলে যাবি বলছিস৷ ওই জমিটা এমনি এমনি ফেলে রাখবি?’

কুশ দাদাবাবু পাল্টা জিজ্ঞেস করল, ‘কী করা যায় বলো তো পিসিমা?’

‘ও মা, আমি কী বলব? তোর যা ইচ্ছে, করবি৷ আমাকে শুধুমুধু ওতে টানছিস কেন বাবা? জমিটা তোকে কেন মা দিয়ে গেল, সেটাই তো আমার মাথায় ঢুকছে না৷ সাপ-টাপ নিয়ে তোর কারবার৷ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে অ্যাদ্দিন কাটিয়েছিস৷ চাষবাসের তুই কি বুঝিস? আমি হলে জমিটা অবিশ্যি দিয়ে দিতাম মেজদাকে৷ হাজার হোক, অ্যাদ্দিন তো মেজদাই সব দেখাশুনো করেছে৷ জমিটার উপর ওর দাবি সবথেকে বেশি৷ জমিটা মায়ের উচিত ছিল, মেজদাকে দিয়ে যাওয়া৷’

ছোটপিসি খুব তাচ্ছিল্য করে কথা বলছে৷ গোলাপির তা মনঃপুত হল না৷ কে বলল, কুশ দাদাবাবু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে কাটিয়েছে? দাদাবাবু জুতসই একটা জবাব দেবে বলে ওর মনে হচ্ছিল৷ কিন্তু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কুশ দাদাবাবু বলল, ‘ঠিক আছে৷ ভেবে দেখি৷ বড়কাকা যদি জমিটার ভার নেন, তা হলে তো খুবই ভাল হয়৷ নিবারণদা বলছিল, আয়লার জন্য জমিতে যে লোনা ভাবটা হয়েছিল, পরপর কয়েকটা বছরের বৃষ্টিতে সেটা কেটে গিয়েছে৷ এ বার চাষ করা যেতে পারে৷ আমি নিজের চোখে একবার জমিটা দেখে নিতে চাই৷ তারপর আমার ডিসিশনটা বড় জেঠুকে জানিয়ে দেব৷’

সবাইকে প্রণাম করে কুশ দাদাবাবু যখন বাইরে বেরিয়ে আসছে, তখন পিছন থেকে বড় জেঠাবাবু হঠাৎ বলল, ‘আর একটা কথা আছে কুশ৷ মা তোর জন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছিল, সে কথা কি তুই জানিস?’

কুশ দাদাবাবু বলল, ‘ না জেঠু , আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি!’

‘ফ্যামিলির গার্জেন হিসেবে আমার একটা কর্তব্য আছে৷ মায়ের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করা৷ অবশ্য সেই ইচ্ছেটা পূরণ করা নির্ভর করছে পুরোপুরি তোর উপর৷ মেয়েটাকে শ্রাদ্ধের দিন… কাজের বাড়িতে অত লক্ষ করিনি৷ কিন্তু মৎস্যমুখের দিন পিঙ্কি ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল৷ এ রকম একটা মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার৷ তুই কি বুঝতে পারছিস বাবা, আমি কার কথা বলচি?’

বড় জেঠাবাবুর প্রশ্নটা শুনে গোলাপি মনে মনে মা মনসাকে ডাকতে লাগল৷ কুশ দাদাবাবু যেন উষসীদিদিকে চিনতে অস্বীকার না করে৷

উত্তর দেওয়ার আগে দাদাবাবু একবার পিঙ্কি বউদির দিকে তাকাল৷ বউদি জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে দাদাবাবু উত্তর দিল, ‘জানি জেঠু৷ কিন্তু, কেউ কি তাকে জিজ্ঞেস করেছে, সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি কি না? আমার কোনও স্থায়ী রোজগার নেই৷ কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে কেন?’

প্রশ্নটা শুনে বড় জেঠাবাবু মনে হল, একটু যেন দমে গেল৷ মুখে অস্বস্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে বড় জেঠাবাবু জিজ্ঞেস করল, ‘পিঙ্কি, তুমি কি জানো, মেয়েটার কোনও আপত্তি আছে কি না?’

পিঙ্কি বউদি বলল, ‘আমার মনে হয় না৷’

‘না মা৷ তোমার কি মনে হল, সেটা বড় কথা নয়৷ মেয়েটার কাছ থেকে সরাসরি জানতে চাওয়া উচিত৷ আজকালকার দিনে মেয়েদের মতামতটাকে হেলাফেলা করা উচিত নয়৷ বিয়ের মতো একটা ইম্পরট্যান্ট ব্যাপারে কোনও কনফিউশন রাখা অনুচিত৷’

ছোটপিসি কী রকম ত্যাড়াব্যাঁকা টাইপের… বলে উঠল, ‘কনফিউশনটা তো হয়েছে অন্য কারণে বড়দা৷ তোমার কি মনে আছে, মায়ের শ্রাদ্ধের দিন সুকুমার বাসু বলে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে? আরে… যিনি বিএমডবলিউ গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন৷ পিঙ্কি বলছিল, ভদ্রলোক কয়েকশো কোটি টাকার মালিক৷ তিনি মেয়েকে গছাতে চান এ বাড়িতে৷ শুনলাম, কুশ নাকি তাতে রাজি৷’

শুনে চমকে উঠল বড় জেঠাবাবু৷ দাদাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী রে কুশ, সত্যি? তা হলে তো সব মিটেই গেল৷ মায়ের শেষ ইচ্ছেতে কী আসে-যায়৷ না বাবা কুশ, তোর ইচ্ছেই শেষ কথা৷ আয় বাবা, তোকে আর আটকাব না৷ যেখানেই থাকিস, সম্পর্কটা একেবারে ছিন্ন করিস না যেন৷’ কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে এল বড় জেঠাবাবুর৷ কুশ দাদাবাবুর মাথায় একবার হাত রেখে আশীর্বাদ করেই আর দাঁড়াল না৷ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল৷

বৈঠকখানা ঘরটা যেন হঠাৎ গুমঘর হয়ে গিয়েছে৷ কারও মুখে কোনও কথা নেই৷ বড়দের একে একে প্রণাম করে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল কুশ দাদাবাবু৷ সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে৷ বোধহয় শেষবারের মতো মিত্তিরবাড়িটাকে দেখে নিচ্ছে৷ বেলা দেড়টা থেকে বাইরে একটা টাটা সুমো দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ একটু আগে তাতে দাদাবাবুর একটা সুটকেশ তুলে দিয়েছে বাবা৷ টাটা সুমো গদখালিতে ওদের নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে৷ ওখান থেকে লঞ্চে করে দয়াপুরে সন্ধে নাগাদ পৌঁছে যাবে ওরা৷ পিয়ারায় আর কখনও আসা হবে বলে মনে হয় না৷ বাড়ির সবাইকে প্রণাম করে যাওয়া উচিত৷ আগেরবার মহেশপুরে যাওয়ার সময় সববাইকে প্রণাম করে গিয়েছিল গোলাপি৷ কিন্তু, এই মুহূর্তে কারও প্রতি শ্রদ্ধা নেই ওর৷ না, কাউকেই ও প্রণাম করবে না৷ সম্পত্তি ভাগাভাগির পর সববার আসল চেহারাটা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে৷ মিত্তিরবাড়ির কেউ ভাল নয়৷ মুখ শুকনো করে মেঝে থেকে নিজের কিটব্যাগটা তুলে নিল গোলাপি৷ পা চালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ও গেটের দিকে হাঁটতে লাগল৷

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সময় গোলাপি দেখল, সিঁড়িতে পিঙ্কি বউদি ছাড়া আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই৷ দেখেও ও মুখ ফিরিয়ে নিল৷ মিত্তিরবাড়ির সবার উপর ওর রাগ হচ্ছে৷ মনে মনে ও পিতিজ্ঞে করল, আর কখনও ও এই বাড়িতে আসবে না৷ সুমো সোনারপুর স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সামনের সিট থেকে কুশ দাদাবাবু হঠাৎ বলল, ‘টিটোর সঙ্গে দেখা হল না রে গোলাপি৷ কখন যে ছেলেটা স্কুলে চলে গেল, আজ আমার সঙ্গে দেখা করেও গেল না৷’

মাঝের সিটে বাবার পাশে বসে রয়েছে গোলাপি৷ বারুইপুর রেল ক্রশিং পেরনোর সময় হঠাৎ পিছনের সিট থেকে ফিসফিস করে কে যেন বলল, ‘আমি এখানে লুকিয়ে আছি গোলাপিদি৷ মিত্তিরবাড়িতে আমি আর থাকব না৷ আমি কুশকাকুর কাছে থাকব৷ স্কুল থেকে তাই টিফিনের সময় বেরিয়ে এসেছি৷’

ঘাড় ঘুরিয়ে গোলাপি দেখল, মুখে আঙুল দিয়ে টিটো ওকে চুপ করে থাকতে বলছে!

(বত্রিশ)

বাবাইসোনা কেমন আছে, খোঁজ নেওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছিলেন চন্দ্রভানু৷ কাল বিকেলে ওকে নিয়ে যখন কলকাতা থেকে ফিরে আসেন, ছেলেটা তখন কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল৷ গাড়িতে সারাটা পথ সনকার কোলে মুখ গুঁজে রেখেছিল৷ বার কয়েক কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন চন্দ্রভানু৷ বারুইপুরে গাড়ি থামিয়ে বড় দোকান থেকে নামী ব্র্যান্ডের চকোলেটও কিনে ছিলেন ওর জন্য৷ কিন্তু বাবাইসোনা কোনও সাড়া দেয়নি৷ প্রিয় নাতির ওই অবস্থা দেখে মন ভেঙে গিয়েছে চন্দ্রভানুর৷ তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না, কী করবেন৷ স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন৷ কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না তাতে ৷ পাগলদের ডাক্তাররা যদি ভুলভাল ট্রিটমেন্ট করেন, বারোটা বেজে যাবে ছেলেটার৷

কম্পাউন্ডের মধ্যে তিনটে আলাদা আলাদা বাংলো৷ দুটো দুই ছেলের, একটা নিজের জন্য৷ জয়গোপালের বাংলোটা মন্দির ঘেঁষা৷ সেদিকে এগোতেই চন্দ্রভানু দেখলেন, ভানুমতির সঙ্গে মন্দিরের দিক থেকে হেঁটে আসছে সনকা৷ পরনে লাল পাড় গরদের শাড়ি৷ হাতে পূজা উপাচারের থালা৷ ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে নিয়েছে৷ সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদূর৷ গায়ের রঙ ফেটে পড়ছে৷ মন্টু ঠিকই বলে, ‘ঘরে এততো সোন্দর সতীসাদ্ধী একটা বউ থাকতে, তুর মন বাইরে পড়ে থাইক্যে ক্যানে চাঁদ? ই তো ঠিক না ভাই৷’ কথাটা ও বলেছিল সোনাখালিতে, যেদিন দয়াশঙ্করকে দয়াপুর পাঠিয়েছিলেন চন্দ্রভানু, তরিতা বলে মেয়েটাকে তুলে আনতে৷ হারামজাদা কাজটা তো করতে পারলই না৷ উল্টে, তাঁর বদনাম করে দিয়ে এল৷ মেয়েটা জেনে গিয়েছে, অপকর্মটা কার জন্য ও করতে গিয়েছিল!

ভানুমতি ঘোমটা টেনে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছে৷ সনকা এগিয়ে এসে থালা থেকে ফুল তুলে মাথায় আর বুকে ছোঁয়াল৷ তিনি কঙ্কণদীঘিতে থাকলে সনকা প্রতিদিনই সকালে পুজো দিয়ে এসে এটা করে৷ আজ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ঈষৎ অপরাধবোধে ভুগতে লাগলেন চন্দ্রভানু৷ বিষাদ প্রতিমার মতো মুখ৷ তাতে আগের মতো অভিব্যক্তি নেই৷ কিন্তু, কর্তব্যে কোনও ত্রুটি নেই৷ দু’দিন আগে সনকার সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার তিনি করেছেন, তার কোনও ক্ষমা নেই৷ কাজের লোকেদের সামনে তিনি সনকার মাথা হেঁট করে দিয়েছেন৷ কিন্তু তখন মেজাজ সপ্তমে৷ ক্রোধে নিজেকে সেদিন বশে রাখতে পারেননি চন্দ্রভানু৷ তখন মনে হয়েছিল, মনসার ঘট পুজো করে সনকা খুব অন্যায় করেছে৷

কিছু বলতে হয়, তাই যথাসম্ভব নরম গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবাইসোনা কেমন আছে? ঘুম থেকে উঠেছে?’

ভাঙা গলায় সনকা বলল, ‘ হ্যাঁ৷ টিভি দেখছিল৷ বড়বউমার কাছে বসে৷’

বড়বউমা… মানে জয়িতা৷ হিঙ্গলগঞ্জ থেকে চলে এসেছে না কি? দয়াশঙ্করকে কাল বিকেলেই জয়গোপাল আর জয়িতাকে খবরটা জানাতে বলেছিলেন চন্দ্রভানু৷ মনে হয়, বাবাইসোনার অসুস্থতার কথা শুনেই রাতে ওরা চলে এসেছে৷ এখন হিঙ্গলগঞ্জ থেকে কঙ্কণদীঘিতে আসার খুব সুবিধে হয়ে গিয়েছে৷ কয়েকটা নদীর উপর নতুন ব্রিজ হয়েছে বলে৷ যাক, ওরা আসায় একদিক থেকে ভালই হয়েছে৷ আর কোনও প্রশ্ন না করে চন্দ্রভানু বড়ছেলের বাংলোর দিকে পা বাড়ালেন৷

‘অঙ্কুশ বলে ছেলেটাকে একবার ডেকে আনা যায় না?’

সনকার প্রশ্নটা শুনে চন্দ্রভানু ঘুরে দাঁড়ালেন৷ মন্দ বলেনি সনকা৷ পাগলদের ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার আগে ওই ছেলেটার একবার পরামর্শ নেওয়া যেতেই পারে৷ সাপ সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনো করেছে৷ স্নেকফোবিয়া কী করে দূর করা যায়, তা নিয়ে আইডিয়া দিতেই পারে৷ চন্দ্রভানু বললেন, ‘সে কি ডাকলেই চলে আসার মতো লোক? সে খুব ব্যস্ত মানুষ৷’

‘আমার কথা বললে… আসবে৷’

অন্য সময় হলে দ্বিমত শুনে চন্দ্রভানু ধমক দিয়ে উঠতেন৷ কিন্তু এখন কড়া কথা বলা যাবে না৷ একটু অবাক হয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘তা হলে পঞ্চাকে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দাও৷ তার আগে দয়াকে বোলো, ছেলেটার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলে নেয়৷ শুনেছি, সে না কি হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়৷’

‘ছেলেটা এখন বাড়িতেই আছে৷’

‘তুমি জানলে কী করে?’

‘ওর ঠাকুরমা মারা গেছেন৷ দিন কয়েক আগে বড় বেয়াইমশাই একবার পিয়ারা গ্রামে গেছিলেন৷ সেদিন শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান ছিল৷ বেয়াইমশাই ফোন করে খবরটা দিয়েছেন আমাকে৷’

বড় বেয়াইমশাই মানে সুকুমারবাবু৷ কিন্তু তিনি অঙ্কুশের বাড়িতে যাবেন কেন, চন্দ্রভানু বুঝে উঠতে পারলেন না৷ কথাটা জিজ্ঞেস করতেই সনকা বলল, ‘ছোট মেয়ে রণিতার জন্য উনি পাত্তর খুঁজছেন৷ তাই আমিই ওনাকে বলেছিলাম, ছেলেটার কথা৷ ওর সঙ্গে একটা আত্মীয়তার সম্পক্ক হলে আমাদের সুবিধে৷’

মনে মনে কৌতুকবোধ করলেন চন্দ্রভানু৷ বাহ, প্রস্তাবটা তো খারাপ নয়৷ পাত্র হিসেবে নিঃসন্দেহে অঙ্কুশ ভাল৷ ওকে আত্মীয়তার সূত্রে বেঁধে রাখতে পারলে, এই সর্পভীতি থেকে বেরনো যেতে পারে৷ একমাত্র সনকার মাথা থেকেই এই সমাধানটা বেরিয়ে আসা সম্ভব৷ ওর সাংসারিক বুদ্ধির উপর যথেষ্ট ভরসা রাখেন চন্দ্রভানু৷ সেই কারণে সাংসারিক ব্যাপারে তিনি মাথা ঘামান না৷ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা… বেয়াইমশাই কী দেখে এলেন?’

‘বনেদি বাড়ির ছেলে৷ জয়েন্ট ফ্যামিলি৷ ওনার তো খুবই পছন্দ হয়েছে৷ একটাই মুশকিল, এক বছর অশৌচ চলবে ওদের৷ এর মধ্যে বিয়েটা সম্ভব না৷’

কথা বলতে বলতে দু’জনে ঢুকে এলেন বাংলোর ভেতর৷ ড্রয়িং রুমে বসে বাবাইসোনা কার্টুন চ্যানেল দেখছে টিভিতে৷ শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে অ্যানিমেশন ফিল্ম৷ রাখাল বন্ধুদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কোনও দুষ্টুমির সিন চলছে৷ বাবাইসোনা সেই দৃশ্য দেখে হাসছে৷ ওর দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু বিষণ্ণবোধ করলেন৷ চোখের কোণে কালি পড়ে গিয়েছে৷ ওইরকম চনমনে একটা ছেলে ঘরের ভিতর বসে টিভি দেখছে৷ অন্যসময় এ বাড়িতে এলেই লনে দৌড়োদৌড়ি করে খেলে বেড়ায়৷ ওর অস্তিত্ব সর্বত্র টের পাওয়া যায়৷ এখন চৌকাঠের বাইরেই যেতে ভয় পাচ্ছে৷ ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছিস বাবাই?’

‘আমার কী হয়েছে দাদান? স্কুল থেকে তুমি না কি কাল আমায় নিয়ে এসেছ? কখন গেছিলে?’

তার মানে বাবাইসোনা টেরই পায়নি, কলকাতা থেকে ওঁরা নিয়ে এসেছেন ওকে৷ টের পাবেই বা কী করে? প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় হোস্টেল থেকে এনে ওকে গাড়িতে তুলেছিল পঞ্চা৷ সিডেটিভের কল্যাণে বেচারা বুঝতেই পারেনি৷ কী হয়েছে, সেটা তো ওকে বলা যাবে না৷ চন্দ্রকান্ত তাই বললেন, ‘তোর কিচ্ছু হয়নি বাবা৷ এ বাড়িতে পুজো আছে৷ তাই তোকে নিয়ে আসতে গেছিলাম৷’

জয়িতা বোধহয় এতক্ষণ ভিতরে কোনও কাজে ব্যস্ত ছিল৷ ড্রয়িংরুমে খুকে কাছে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রখাম করে বলল, ‘কাল অনেক রাতে আমরা পৌঁছেছি বাবা৷ আবনাকে তাই আর ডিসটার্ব করিনি৷’

ভাল করেছ, মনে মনে বললেন চন্দ্রভানু৷ কাল অনেক রাত পর্যন্ত অবশ্য তিনি নিজেও জেগে ছিলেন৷ দফায় দফায় মন্টুর সঙ্গে কথা বলেছেন৷ সোনাখালিতে গিয়েই মন্টু কাজে নেমে পড়েছে৷ রাত এগারোটায় শেষ খবর ও যা দিয়েছিল, তাতে নদীর নোনা জল বিকেলের মধ্যেই সব বের করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে ফার্ম হাউস থেকে৷ রাতে পাশের রুপোখালির বিল থেকে মিষ্টি জল পাম্প করে ফার্ম হাউসে ঢোকানোর কথা৷ তার জন্য গোটা কুড়ি পাম্প দরকার বলে জানিয়েছিল মন্টু৷ বাসন্তীর ডিলারের কাছে অত পাম্প স্টকে ছিল না৷ তাই সন্ধে বেলায় মন্টু লোক পাঠিয়েছিল বারুইপুরে৷ রাতের মধ্যে সেই পাম্প সোনাখালিতে পৌঁছল কি না, তা আর জানতে পারেননি চন্দ্রভানু৷ নিজের ঘরে বসে একা একাই মদ্যপান করছিলেন৷ চার পেগ হুইস্কি পেটে পড়ে গিয়েছিল৷ তাই ঘুমে ঢলে পড়েছিলেন৷

ভোরবেলার দিকে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছেন চন্দ্রভানু৷ মণি নদীর দিকে দোতলার বারান্দায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন৷ হঠাৎ দেখেন, এক মহিলা ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে তাঁর বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ তাঁর পরনে কোনও পোশাক নেই৷ বিচিত্র বর্ণের সাপ দিয়ে তাঁর সর্বাঙ্গ ঢাকা৷ সারা শরীরে সেই সাপ কিলবিল করছে৷ মহিলার মুখটা উপর থেকে ভালভাবে দেখতে পাননি চন্দ্রভানু৷ আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বিছানায় বসে তিনি অনেকক্ষণ ধরে সেই মুখটা মনে করার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু, সফল হননি৷ বাবাইসোনার পাশে গিয়ে বসার পর সেই স্বপ্নটার কথা মনে হওয়ায় চন্দ্রভানু ঈষৎ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন৷ নাহ, সাগর দ্বীপে গিয়ে একবার মহেশ্বরজির সঙ্গে দেখা করতেই হবে৷ দরকার হলে তিনি নিজেই দু’একদিনের মধ্যে সাগর দ্বীপে চলে যাবেন বাবাইসোনাকে নিয়ে৷ চতুর্দিক থেকে বিপদ ঘনিয়ে আসছে৷ গুরুজির পরামর্শ নেওয়া দরকার৷

সোফায় বসে চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘বড়খোকা বাড়িতে নেই?’

জয়িতা বলল, ‘উনি তো ভোরবেলায় রায়দীঘিতে গেলেন৷ কী একটা প্রবলেম হয়েছে৷ সেটা জানানোর জন্য অঘোরবাবু যেতে বললেন৷ এখুনি এসে পড়বেন৷’

 রায়দীঘিতে আবার কী প্রবলেম হল? শুনে বিরক্ত হলেন চন্দ্রভানু৷ রায়দীঘির মাছের মার্কেট তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন৷ ব্যবসা শুরু করেছিলেন ওই বাজার থেকেই খুব অল্প পুঁজি দিয়ে৷ এখন তাঁর নিজেরই দশটা ট্রলার৷ সারা বছর ধরে সেই ট্রলার গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনে৷ প্রায় পাঁচশো পরিবারের কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন তিনি৷ রায়দীঘির ব্যবসাটা দেখে জয়ব্রত৷ কিন্তু সে এখন সোনাখালিতে ফার্ম হাউস বাঁচাতে ব্যস্ত৷ রায়দীঘির ম্যানেজার অঘোরবাবু৷ ধুরন্ধর লোক৷ থাকেন পশ্চিম জটাতে৷ তিনি যখন সমস্যায় পড়েছেন, তা হলে বুঝতে হবে, সমস্যাটা গুরুতর৷ মাঝে ব্যাঙ্কক-পাটায়া যাওয়ায় মাছের ব্যবসা সম্পর্কে চন্দ্রভানু খোঁজ রাখতে পারেননি৷ তাঁর মনের মধ্যে ক্ষীণ একটা সন্দেহ উঁকি মারল৷ দয়াপুরের মাগীটা কি রায়দীঘিতেও কুনজর দিল? যদি তা হয়, তা হলে শালীকে ধরে নিয়ে এসে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন মণি নদীর পাঁকে৷ কোনও শিষ্টাচারের ধার ধারবেন না৷ বিশ্বস্ত লোক দিয়ে কাজটা এমন গোপনে করাবেন যে, মন্টুও টের পাবে না৷

‘বাবাইসোনাকে ডাক্তার দেখানোর কী ব্যবস্থা করা যায় বাবা?’

জয়িতার প্রশ্ন শুনে চন্দ্রভানু মনটাকে ফিরিয়ে আনলেন দয়াপুর থেকে৷ বললেন, ‘বারুইপুরে ভাল একজন সাইকিয়াট্রিস্ট থাকেন৷ আমাদের দেবাংশু উকিলের খুব জানাশোনা৷’

জয়িতা বলল, ‘মা বলছিলেন, অঙ্কুশ মিত্তির বলে কে একজন আছে৷ তাঁকে কল দিলে না কি বাবাই ভাল হয়ে যাবে?’

‘হ্যাঁ, উনি আমাকেও সেকথা বলেছেন৷ তোমার কি তাকে খেয়াল আছে? বাবাইসোনাকে যেদিন লতায় কেটেছিল, সেদিন ওই অঙ্কুশ না থাকলে তোমার ছেলেকে বাঁচানো যেত না মা৷ মহাদেবের অসীম কৃপা৷ উনিই সেদিন আচমকা ছেলেটাকে আমাদের বাড়িতে পাঠঠেছিলেন৷’

কথাগুলো বলতে বলতে চন্দ্রভানু একবার আড়চোখে তাকালেন বাবাইসোনার দিকে৷ না, এ দিকে ওর মন নেই৷ ওর চোখ টিভি সেটের দিকে৷ স্কুলের হোস্টেলে কার্টুন চ্যানেল দেখার সুযোগ পায় না৷ তাই বাড়িতে এলে সেটা পুষিয়ে নেয়৷ বাবাইয়ের অসুস্থতা সম্পর্কে জয়িতা কী শুনেছে, চন্দ্রভানু তা জানেন না৷ কিন্তু, মনে হয়, গুরুত্বটা তেমন বুঝতে পারেনি৷ বুঝতে পারলে ওর চোখ-মুখের অবস্থাই বদলে যেত৷ মানসিক রোগ যে কী জটিল, গতকাল পর্যন্তও সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না চন্দ্রভানুর৷ ছোট বউমা অহল্যার কাছে কাল রাতেই তিনি শুনেছেন৷ ওর এক মাসতুতো বোনের মেন্টাল ডিসঅর্ডার না কী যেন হয়েছিল৷ কালো কোট পরা কোনও লোককে দেখলেই না কি অজ্ঞান হয়ে যেত৷ ঘরের বাইরেই বেরত না৷ শেষে রোগে ভুগে ভুগে সেই মেয়েটা মারা গিয়েছিল৷

‘একটা কথা বলব বাবা?’

বাড়ির প্রথম বউ৷ শিক্ষিতা, যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, বাধ্য৷ জয়িতাকে চন্দ্রভানু বিশেষ স্নেহ করেন৷ নরম গলায় তিনি বললেন, ‘বলো মা৷ এত সংকোচ করছ কেন?’

‘এ বার মনসামেলায় তরিতা মা বলে একজন আমাদের হিঙ্গলগঞ্জে গিয়েছিলেন৷ তিনি না কি সাক্ষাৎ মনসার অবতার৷ ভেড়ির লোকজন সবাই তরিতা মাকে মেলায় দেখতে গেছিল৷ ফিরে এসে বলেছিল, সাপ নিয়ে তিনি অসাধ্যসাধন করতে পারেন৷ তাঁকে একবার ডেকে নিয়ে এলে হয় না? তিনি দয়াপুর না কোথায় যেন থাকেন৷’

কথাটা শুনেই ভ্রূ কুঁচকে উঠল চন্দ্রভানুর৷ দয়াপুরের মাগীটার নাম তা হলে হিঙ্গলগঞ্জেও ছড়িয়েছে? আগে তো হিঙ্গলগঞ্জের দিকটায় মনসামেলা-টেলা হত না৷ গাজনের মেলাই বড় করে হত৷ মনসামেলা শুরু হল কবে থেকে? দয়াশঙ্কর একবার বলেছিল বটে, মনসা পুজোর জন্য মাগীটা না কি প্রচুর টাকা ছড়াচ্ছে৷ মেলার কথা শুনে মনের মধ্যে রাগটা ফুঁসে উঠল৷ কিন্তু, তা সত্ত্বেও রাগ প্রকাশ করলেন না চন্দ্রভানু৷ মন্টু সাবধান করে দিয়েছে৷ জয়িতার মুখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু বুঝতে পারলেন, লোকমুখে যা শুনেছে, বিশ্বাস করে নিয়েছে৷ তরিতার সঙ্গে তাঁর বৈরিতার কথা জয়িতার জানার কথা নয়৷ সত্যি কথা বলতে কী, মন্টু আর দয়া ছাড়া কেউই জানে না সে কথা৷ তবুও, চট করে একটা সন্দেহ চন্দ্রভানুর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে গেল৷ ভেড়িতে চিংড়ি মাছের গায়ে সাদা দাগের ষড়যন্ত্রে ওই মেয়েমানুষটা জড়িয়ে নেই তো? সন্দেহ নিরসন করার জন্য তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাই না কি? উনি কবে গিয়েছিলেন হিঙ্গলগঞ্জে?’

‘এই তো দিন পাঁচেক আগে৷’

শুনে চন্দ্রভানু কিছুটা স্বস্তি পেলেন৷ নাহ, সন্দেহটা তা হলে অমূলক৷ প্রায় মাসখানেক আগে জাপান থেকে চিঠিটা এসেছিল৷ দয়াপুরের মাগীটা সম্পর্কে জয়িতা আর কী কী শুনেছে, সেটা জানার জন্য চন্দ্রকান্ত বিস্ময়প্রকাশ করে বললেন, ‘তা… উনি কী অসাধ্যসাধন করে দেখালেন, মা?’

জয়িতা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘রমজান মোল্লার ছেলেকে কালাচ-এ কেটেছিল৷ প্রায় মরমর৷ তরিতা মা না কি ওর কাটা জায়গায় স্রেফ হাত বুলিয়ে ছেলেটাকে ভাল করে দিয়েছিলেন৷ অনেকেই সেই মিরাকল নিজের চোখে দেখেছে৷ আরও শুনবেন, তরিতা মা না কি চোখ বুঁজে বলে দিতে পারেন, কার বাড়িতে কোথায় সাপ লুকিয়ে আছে৷ উনি সেই বাড়িতে পা দিলেই পয়েজনাস সাপেরা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ওঁনার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে৷ সবাই বলাবলি করছিল, একটা ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিশ্চয়ই ওঁনার আছে৷ না হলে এসব করেন কী করে?’

শুনতে ভাল লাগছে না চন্দ্রভানুর৷ অন্ধ বিশ্বাস… তিনি উল্টো কথা বললে জয়িতার ভাল লাগবে না৷ যে যার বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকুক৷ তাই ঘুরিয়ে বললেন, ‘মা, আমি শিবের ভক্ত৷ আমার উপর স্বয়ং মহেশ্বরজির কৃপা রয়েছে৷ তুমি তো তাঁর ক্ষমতার কথা জানো৷ মনসা হলেন লৌকিক দেবী৷ আমি তার আশ্রয় নিলে মহাদেব কূপিত হতে পারেন৷ বাবাইসোনাকে নিয়ে আমি একবার মহেশ্বরজির কাছে যাব৷ তোমার শাউড়ি মা আর তুমি… ইচ্ছে হলে আমার সঙ্গে যেতে পারো৷ মহেশ্বরজি যা বলবেন, আমি তা-ই করব৷’

জয়িতা বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় দরজার দিকে চোখ গেল চন্দ্রভানুর৷ দেখলেন, জয়গোপাল হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে আসছে৷ ওর চোখ-মুখে উদ্বেগের ছাপ৷ বড়ছেলেকে বেশ কিছুদিন পর দেখলেন তিনি৷ অসম্ভব ওজন বাড়িয়ে ফেলেছে৷ হাঁটার সময় হাঁসফাঁস করছে৷ ওকে দেখে জয়িতার উত্তরটা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন চন্দ্রভানু৷ কাছে এসে জয়গোপাল প্রণাম করে বলে উঠল, ‘একটা খারাপ খবর আছে বাবা৷’

ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা স্ত্রী বা পত্রবধূদের সামনে হোক, তা চান না চন্দ্রভানু৷ জয়িতার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদের জন্য চা পাঠিয়ে দিতে পারবে বউমা৷ খুব চা তেষ্টা পেয়েছে৷’

‘আমিই নিয়ে আসছি৷’

কথাটা বলে জয়িতা ভিতরে চলে যাওয়ার পর চন্দ্রভানু বড়ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অঘোর কেন ডেকে পাঠিয়েছিল রে তোকে?’

জয়গোপাল বলল, ‘রায়দীঘির ফিশ মার্কেট একেবারে ডাউন বাবা৷ আমাদের ট্রলারগুলো সেই আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সমুন্দরে গেছিল৷ সব ক’টা খালি ফিরে এয়েচে৷’

এমনটা হওয়ার তো কথা নয়! কারণটা কী? ভরা বর্ষায় এই সময়টাতেই তো ইলিশ পাওয়ার কথা৷ এই দু’ তিন মাসের মধ্যে ট্রলারদের বার দুয়েক যাতায়াত করা হয়ে যায়৷ রায়দীঘিতে মাছ এনে ফেলে ফের ট্রলার নিয়ে মাল্লারা সমুন্দরে চলে যায়৷ চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘সর্দাররা কী বলছে?’

‘সমুন্দরে ইন্ডিয়ার দিকটায় না কি বিরাট একটা ইলিশের ঝাঁক আসছিল৷ এখন তাদের দেখা নেই৷ আমাদের ট্রলারগুলো অ্যাঙ্কর করে সব দাঁইড়ে ছিল৷ অঘোরকাকা রোজই সর্দারদের সঙ্গে ওয়ারলেসে যোগাযোগ রাখছিলেন৷ জল থেকে যা উঠছে, সব খোকা ইলিশ৷ বাজারে এনে বিককিরি করলে দাম পাওয়া যাবে না বাবা৷ রায়দীঘির মাছের বাজারে টান পড়েছে৷’

সর্বনাশ! শ্রাবণ-ভাদ্দর মাসের এই সময়টাতেই ইলিশের মরশুম৷ বাজার তেজি থাকে আশ্বিনের শেষ পর্যন্ত৷ দু’তিন বছর আগে বাংলাদেশ সরকার ইলিশ পাঠানো নিয়ে নানা বায়নাক্কা শুরু করেছে৷ ওদের ওখানকার পদ্মার ইলিশ দামে আর ওজনে বেশি৷ এখানকার মধ্যবিত্তদের সাধ্যের বাইরে৷ এ পার বাংলার ব্যবসায়ীরা তাই আমদানী করতে চায় না৷ এদিক থেকেও যদি ইলিশ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে পুরো ব্যবসার মারাত্মক ক্ষতি হবে৷ চন্দ্রভানু ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না, ভরা সমুন্দরে এমন কী হল, ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না৷ মাছের ডিম ভাসতে ভাসতে সমুন্দর থেকে এ দিকে গঙ্গায় বা মিষ্টি জলের নদীতে ঢুকে পড়ে৷ যত উজান বেয়ে এগোয়, ইলিশের সাইজ ততই বাড়ে৷ এক দেড় কেজি ওজনের তো পাওয়া যায় বটেই৷ জয়ব্রতকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই সিচুয়েশনটা হল, অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? অঘোর কি ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের লোকদের সঙ্গে কথা বলেছে?’

‘বলেছেন৷ তাঁরা তো অদ্ভুত কথা বলছেন৷ এদিককার নদীতে পলিউশন খুব বেড়ে গেছে৷ মোহনার এ পাশে পলিউটেড জলের দিকে ইলিশের ঝাঁক আর আসতে চাইছে না৷ তারা সমুন্দরের আরও গভীর জলে চলে যাচ্ছে৷ তাই মাল্লারা জাল ফেলে তাদের ধরতে পারছে না৷ প্রবলেমটা এক আধ দিনে তৈরি হয়নি৷ অনেকদিন ধরেই রিসার্চাররা সাবধান করছিলেন৷ গভর্মেন্ট কানেই তোলেনি৷ ওরা বলছেন, হলদিয়ায় পেট্রো কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি হওয়ার পর থেকে প্রবলেমটা অ্যাকিউট হয়েছে৷ কী হবে বাবা? মাছের ব্যবসা আমাদের গুটিয়ে না দিতে হয়৷’

এমন হতাশ হয়ে জয়গোপাল কথাটা বলল যে, চন্দ্রভানু অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন৷ নিশ্চয়ই উতলা হওয়ার মতো খবর৷ তবে এত ভেঙে পড়ারও কিছু নেই৷ সমুন্দরে নিজে যখন মাছ ধরতে যেতেন, তখন জানতেন, একসঙ্গে পূবালি বাতাস বইলে আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলে ইলিশের ঝাঁক আপনা থেকেই ধরা দেয়৷ আর তা না হলে মাছের ঝাঁক চলে যায় বাংলাদেশের দিকে৷ এ বার সেটাই হল না কি? অসময়ে ছোট ইলিশ ধরার হিড়িক বেড়েছে৷ সেই কারণেও বড় ইলিশের আকাল হতে পারে৷ বাজারে টান পড়লে অবশ্য খবরের কাগজে লেখালেখি শুরু হবে৷ তখনই সরকারের টনক নড়বে৷ দরকার হলে বারুইপুর থেকে প্রেসের লোক ডেকে এনে সমস্যাটার কথা বলতে হবে৷ সেই কথাটাই তিনি জয়গোপালকে বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় চায়ের ট্রে নিয়ে সনকাকে ঘরে ঢুকতে দেখে চন্দ্রভানু চুপ করে গেলেন৷ নিশ্চয়ই কিছু বলার জন্য এসেছে৷ না হলে বড় বউমাকে পাঠিয়ে দিত৷

চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে সত্যিই সনকা বলল, ‘অঙ্কুশের বাড়িতে জয়া ফোন করেছিল৷ ও না কি বাড়িতে নেই৷ কোথায় গেছে, বলে যায়নি৷ তাই ওর বাড়ির লোকেরা বলতে পারলেন না, কবে ফিরবে৷’

চায়ে চুমুক দিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম৷ যাক গে, ওর জন্য ওয়েট করে লাভ নেই৷ আমি বরং উকিলবাবুকে খবর দিচ্ছি৷ যাতে কাল সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোককে উনি ধরে আনেন৷’

সনকার হাতে বানানো চা চন্দ্রভানু খুব পছন্দ করেন৷ শরীরের সব ক্লান্তি এক চুমুকেই যেন দূর হয়ে যায়৷ চায়ে দ্বিতীয় চুমুকটা দেওয়া সময় হঠাৎই তিনি বাবাইসোনার ভয়ার্ত চিৎকার শুনতে পেলেন ‘দাদান বাঁচাও৷’

চমকে সোফার দিকে তাকাতেই সবাই দেখতে পেলেন, আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়েছে বাবাইয়ের মুখ৷ চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে৷ সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে৷ ‘কী হয়েছে তোর’ বলে দৌড়ে গিয়ে সনকা ওকে জড়িয়ে ধরতেই বাবাইসোনা আঙুল দিয়ে টিভি সেটটা দেখাল৷ তার পরই অজ্ঞান হয়ে গেল৷ টিভির দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু দেখলেন, পর্দা জুড়ে বিরাট একটা সাপ৷ উথাল-পাথাল নদীর জলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বশে আনার চেষ্টা করছেন৷ দৃশ্যটা দেখেই চন্দ্রভানু বুঝতে পারলেন, যমুনায় শ্রীকৃষ্ণ কালীয় নাগ দমন করছেন৷

(তেত্রিশ)

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে৷ গত দু’তিন ধরে দয়াপুরে বেশ বাদলা আবহাওয়া৷ বিকেল তিনটে-সাড়ে তিনটে বাজে৷ তবুও মনে হচ্ছে, সন্ধে হয়ে এসেছে৷ রোজ লাঞ্চের পর ডাইনিং হলে বসেই নেত্রা, শান্তি, শোভাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেন তরিতা৷ আজ সবাইকে নিজের ঘরে ডেকেছেন৷ বেশ কয়েকদিন ধরে নেত্রা না কি লক্ষ করছে, লাঞ্চের পর যতক্ষণ তাঁরা ডাইনিং হলে থাকেন, ততক্ষণ বাইরের দু’একজন লোক ঠায় বসে থাকে৷ কী কথাবার্তা হচ্ছে, সম্ভবত তা শোনে৷ পরে তরিতাও বুঝতে পেরেছেন, তাঁদের উপর নজরদারি করা হচ্ছে৷ কে বা কারা করছে, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্যই ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছেন তরিতা৷ তা ছাড়া, আরও একটা কারণ আছে৷ এই রিসর্টে থাকা নিয়েও একটা সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে৷ প্রাথমিক সন্দেহটা গিয়ে পড়েছে, চন্দ্রভানুর উপর৷ লোকটা এখনও পাল্টা আঘাত করেনি৷ তবুও, ষড়যন্ত্র যে করছে না, তা কে বলতে পারে?

রিসর্টের ম্যানেজার উদয়শঙ্করবাবু সকালে এসে জানতে চাইছিলেন, ‘আপনাদের আর ক’দ্দিন এখানে থাকার প্ল্যান আছে ম্যাডাম?’

হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হয়েছিলেন তরিতা৷ তাঁর এভিএস প্রোডাকশনের কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে৷ ডিসেম্বরের মধ্যেই জমি খুঁজে ভিত পুজোর কথা তিনি ভাবছেন৷ টাইগার ক্যাম্প রিসর্টে থাকা-খাওয়ার রেট বেশি হলেও, প্রায় মাস দুয়েক এখানে থাকার দরুণ মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছেন৷ এখান থেকে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার কথা তিনি ভাবেনওনি৷ কলকাতার অফিস থেকে গেস্ট নিয়ে উদয়শঙ্করবাবু যখনই দয়াপুরে আসেন, তখনই জানতে চান, কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না? আচমকা এই প্রশ্নটা শুনে তরিতা পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন বলুন তো?’

‘না… মানে ব্রিটিশ কনসুলেট থেকে একটা ডেলিগেশন আসার কথা দিন পনেরো পর৷ প্রতি বছরই ওঁরা পুরো রিসর্ট বুক করে আসেন৷ ওঁরা চান না, ওঁদের কনফারেন্সের সময় রিসর্টে অন্য কোনও গেস্ট থাকুক৷ মানে সিকিউরিটির কারখেই চান না৷ অপরাধ নেবেন না ম্যাম৷ প্রশ্নটা আমি সেই কারণেই করেছিলাম৷’

শুনে তরিতা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন উদয়শঙ্করবাবুর দিকে৷ ভদ্রলোক কতটা সত্যি বলছেন, সেটা জরিপ করার জন্য৷ তার পর বলেছিলেন, ‘ ব্রিটিশরা ক’দ্দিন এখানে থাকবেন?’

‘দিন সাতেক তো বটেই৷ এক্সটেন্ডও করতে পারেন৷’

‘তা হলে এই ক’টা দিন আমাদের কী হবে?’

‘ম্যাম, আপনি যদি চান, তা হলে পাশের রিসর্টে আপনাদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিতে পারি৷’

শুনে তরিতা প্রথমে ভেবেছিলেন, না করে দেবেন৷ কিন্তু নেত্রার সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি কোনও সিদ্ধান্ত নেন না৷ উদয়শঙ্করবাবু তাঁদের রিসর্ট থেকে বের করে দেওয়ার মতলব আঁটছেন কি না, সেটা অবশ্য পরে বলে দিতে পারবে শান্তি৷ ও ফ্রন্ট ডেস্ক-এ বসে৷ ব্রিটিশদের কোনও বুকিং থাকলে ও-ই বলে দিতে পারবে৷ সেই কারখে তরিতা বলেছিলেন, ‘পরে আপনাকে জানাব৷’

নিজের ঘরে বসে রিসর্ট ছাড়ার প্রসঙ্গটা নিয়ে আলোচনা করার সময় শান্তি বলল, ‘উদয়বাবু ঠিক কথাই বলেছেন ম্যাডাম৷ আমি জানি, ব্রিটিশরা কনফারেন্স করতে আসছেন৷’

তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তা হলে কী করা যায় বল তো? পাশের রিসর্টটা কেমন তুই জানিস?’

‘আমাদের রিসর্টের মতো এতটা কমফর্ট পাবেন না৷’

‘তুই ঠিক জানিস, এর পিছনে কোনও কন্সপিরেসি নেই?’

‘সেটা বলতে পারব না৷ তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি, ডিআইবি-র লোকেরা মাঝে মাঝেই রিসর্টে গেস্ট হিসেবে আসছেন৷ এক দু’দিন থেকে চলে যাচ্ছেন৷’

ডিআইবি… মানে ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চের লোক৷ পুলিশের লোক এমনি এমনি এখানে আসবে না৷ নিশ্চয় কোনও কমপ্লেন গেছে তাঁদের কাছে৷ তরিতা পাশ ফিরে বললেন, ‘নেত্রা তুই খোঁজ নে তো৷ আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে৷ কেউ আমাদের পিছনে লেগেছে৷ শোন, সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি৷ আমাদের মধ্যে যা-ই আলোচনা হোক না কেন, তা যেন বাইরের লোকের কানে না যায়৷’

নেত্রা বলল, ‘দিদি, আমি বলি কি, এখানে যখন আমাদের থাকতেই হবে, তখন পার্মানেন্ট কোনও ডেরার ব্যবস্থা করে নেওয়া যায় না?’

‘করা তো যায়ই৷ কিন্তু সেটা নির্ভর করছে, ফ্যাক্টরি করার জন্য জমিটা কোথায় পাব, তার উপর৷ ধর, আমরা যদি সুধাংশুপুরের জমিটা কিনি, তা হলে দয়াপুর থেকে যাতায়াত করা খুব অসুবিধে হবে৷ সবথেকে ভাল হয়, কাছাকাছি হেড়োভাঙার ওই জমিটা পেলে৷ ওখানে জলের অভাব নেই৷ নেত্রা, কী হল রে, জমির মালিকের কোনও খোঁজ পেলি?’

নেত্রা বলল, ‘অমর মণ্ডল খোঁজ নিয়েছেন৷ উনি একটু পরেই তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন৷’

মহেশপুরের অমর মণ্ডলের যে জেলায় এত পরিচিতি আছে, আগে তরিতা জানতেন না৷ তাঁর কথা প্রথম বলেন হারাধন পালাকার৷ অমর মণ্ডলের সাংগঠনিক ক্ষমতা তরিতা বুঝতে পেরেছেন ওখানে মনসামেলার সময়৷ অত্যন্ত সৎ প্রকৃতির মানুষ৷ মেলার সাতদিনের মাথায় দয়াপুরে এসে উনি পাইপয়সার হিসেব দিয়ে গিয়েছেন৷ শুধু মহেশপুরেই নয়, ভদ্রলোকের পরামর্শ মতো আরও অনেক গ্রামে মনসামেলা হয়েছে৷ তিরিশে ভাদ্র থেকে পয়লা আশ্বিনের মধ্যে… ক্যানিং থেকে হিঙ্গলগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় কুড়িটা গ্রামে৷ ভদ্রলোকের সঙ্গে পুলিশ আর প্রশাসনের যথেষ্ঠ যোগাযোগ আছে৷ না কি মাঝেমধ্যে নবান্ন থেকেও তাঁর ডাক পড়ে৷ এ সব শোনার পর থেকে অমর মণ্ডলকে তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে টেনে নিয়েছেন তরিতা৷

কোথায় কবে মেলা হয়েছে বা হবে, তার বিশদ তথ্যগুলো রাখে শান্তি৷ ওকে একটা ল্যাপটপ দিয়েছেন তরিতা৷ মেয়েটা আগেই কম্পিউটারের কোর্স করে রেখেছিল সরকারের যুব কেন্দ্র থেকে৷ ফলে তরিতার খুব সুবিধে হয়েছে৷ তিনি কিছু জানতে চাইলেই শান্তি চট করে ল্যাপটপ খুলে তথ্যগুলো দিয়ে দেয়৷ অমর মণ্ডলের প্রসঙ্গ ওঠায় তরিতার মনে পড়ল, ভদ্রলোক নানা জায়গায় যাতায়াত করার জন্য কিছু টাকা পাবেন৷ উনি এলে পাওনা টাকা যাতে হাতে হাতে দেওয়া যায়, সেই কারণে শান্তিকে তিনি বললেন, ‘এই দ্যাখ তো, অমরবাবু আমাদের কাছ থেকে কত টাকা পাবেন? আজ যদি উনি টাকাটা না নিতে চান, তা হলে তোরা কিন্তু জোর করে গছিয়ে দিবি৷’

কম্পিউটার না খুলেই শান্তি বলে দিল, ‘ম্যাডাম, উনি চার হাজার সাতশো টাকা পাবেন৷ টাকাটা আমি ব্যাঙ্ক থেকে তুলে রেখেছি৷’

সব হিসেব হাতের তালুর মধ্যে রাখে মেয়েটা৷ এই কারণে শান্তিকে খুব পছন্দ করেন তরিতা৷ প্রত্যন্ত গ্রামে পড়ে থাকা একটা মেয়ে৷ অথচ কত চটপটে৷ এই রিসর্টে না উঠলে তিনি জানতেও পারতেন না, এ রকম করিতকর্মা কত মেয়ে গ্রামেগঞ্জে পড়ে আছে৷ প্রসন্ন হয়ে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর এমন কেউ আছেন, যিনি আমাদের কাছ থেকে টাকা পাবেন?’

‘আছেন৷ হিরন্ময়পুর বিশ্বাস পাড়ার প্রভাবতী মণ্ডল, রানিগড় বরপাড়ার তিলকেশ্বর নস্কর, বিরিঞ্চিবাড়ি জানাপাড়ার রাজীব বেরা, ভরতগড় মন্দিরের দেবানন্দ দাস…’

ল্যাপটপ না খুলেই শান্তি গড়গড় করে নামগুলো বলে যাচ্ছে৷ ওর হোমওয়ার্ক শুনে তরিতা হেসে বললেন, ‘থাম, থাম মা৷ এত লোক আমার কাছ থেকে টাকা পায়! আমি যে দেউলিয়া হয়ে যাব রে৷ এই যে নামগুলো বললি, এঁরা মেলা করার জন্য টাকা পাবে? না কি এঁদের ওখানে মেলা হয়ে গেছে?’

‘দু’রকমই আছে ম্যাডাম৷ তা ছাড়া, হারাধন পালাকারদের মান্থলি স্যালারি পাঠাতে হবে৷ সব মিলিয়ে প্রায় দু’লাখ টাকার ধাক্কা৷’

‘আমায় বল তো, ক্যানিং আর সাগর দ্বীপের মেলা দুটো কবে? এমনভাবে গায়ে গায়ে করবি, যাতে ক্যানিং থেকেই আমি সাগরে গিয়ে তিনদিনের মাথায় দয়াপুরে ফিরে আসতে পারি৷ গোমস সাহেবকে ওই সময়টায় দয়াপুরে আসতে বলব৷’

‘সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে ম্যাডাম৷ মনে হয়, ডেট দুটো সতেরো আর উনিশে কার্তিক৷ দেখে পরে আপনাকে কনফার্ম করব৷’

‘গুড৷ তোদের কি আর কিছু বলার আছে? আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমি এডবেরি সাহেবের সঙ্গে চ্যাট করতে বসব৷ অনেকগুলো ইম্পরট্যান্ট টপিক ওঁর সঙ্গে ডিসকাস করতে হবে৷ এই বৃষ্টির মধ্যে অমর মণ্ডল আসতে পারবেন বলে মনে হয় না৷ যদি আসেন, তা হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি৷’

কথাটা শেষ হতে না হতেই ছাতা মাথায় দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন অমর মণ্ডল৷ পরনে বরাবরের মতো সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি৷ ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি৷ কিন্তু দেখে তা বোঝা যায় না৷ শহরের দূষণ থেকে অনেক দূরে থাকেন৷ তাই শরীর-স্বাস্থ্য এখনও মজবুত রাখতে পেরেছেন৷ আগে রিসেপশন থেকে খবর পাঠাতেন৷ এখন সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেছে বলে সোজাসুজি চলে আসেন বাংলো টাইপের স্যুইটের সামনে৷ বোধহয় নিজের নামটা বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছেন অমরবাবু৷ তাই দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছাতা বন্ধ করে হাসিমুখে বললেন, ‘আমি এসে গেছি মা জননী৷’

তরিতাও হাসিমুখে আপ্যায়ন জানালেন, ‘আসুন৷ আপনি একশো বছর বাঁচবেন৷ এখুনি আমি আপনার নাম করছিলাম মেয়েদের কাছে৷’

‘মা, আপনি যখন আশীর্বাদ করছেন, তখন নিশ্চয়ই অদ্দিন বাঁচব৷ কিন্তু, যদি বাঁচি, তা হলে যেন মানুষের জন্য তদ্দিন কিছু করে যেতে পারি৷’

শান্তি উঠে দাঁড়িয়েছে ভদ্রলোককে বসতে দেওয়ার জন্য৷ তা দেখে হা হা করে উঠলেন অমর মণ্ডল, ‘এ কী, তুমি বোসো মা৷ আমি বরং চেয়ারটা টেনে নিচ্ছি৷’

বলে চেয়ারে বসে অমর মণ্ডল বললেন, ‘নেত্রা আমাকে হেড়োভাঙার একটা জমি সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিলেন৷ সেই খবর আমি জোগাড় করে এনেছি৷’

তরিতা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জমিটা কি পাওয়া যাবে?’

‘পাওয়া যাবে না, এমন কথা আমি বলছি না৷ তবে যাঁর নামে জমিটা ছিল, সেই সুরভি মিত্র সম্প্রতি মারা গেছেন৷ তিনি জমিটা লিখে দিয়ে গিয়েছেন তাঁর এক নাতিকে৷ কিন্তু, ভদ্রমহিলার অন্য ছেলে-মেয়েরা তাতে খুশি নন৷ হয়তো লিটিগেশনে যেতে পারে৷ তাই, যা করার খুব শিগগির করে নিতে হবে৷’

‘সেই নাতির সঙ্গে ইমিডিয়েট কনটাক্ট করা যায় না?’

‘সেই চেষ্টাই করছি৷ একটা যোগাযোগও হয়েছে৷ গোলাপিকে তো নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার মা জননী৷ মেলার সময় যে মেয়েটা সাপের ঘরে থেকে খেলা দেখিয়েছিল৷ সে না কি ওই সুরভি মিত্রের বাড়িতে এই ক’দিন আগেও ডোমেস্টিক হেল্প-এর কাজ করত৷ খবরটা আমি পেলাম, গোলাপির দাদা গণেশের কাছ থেকে৷ সে শোলাশিল্পী, তবে জমির দালালিও করে৷ আমাদের মহেশপুরেই থাকে৷ সে বলল, হেড়োভাঙার ওই জমিটা দেখাশুনো করে ওরই বাবা নিবারণ৷ তাকেও আমি ভালমতন চিনি৷’

তরিতার মনে পড়ল, গোলাপি মহেশপুরে বলেছিল, ওর বাবা দয়াপুরে থাকেন৷ তাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিবারণ কি এখন দয়াপুরে আছে?’

‘না মা জননী৷ এই মুহূর্তে নিবারণ এখানে নেই৷ সুরভি মিত্রের শ্রাদ্ধ উপলক্ষে সে পিয়ারা গ্রামে গিয়েছে৷ তবে, গণেশের মুখে শুনলাম, আজ-কালের মধ্যেই সে দয়াপুরে ফিরবে৷ আমি লোক লাগিয়ে রেখেছি৷ নিবারণ এলেই আমি তাকে ধরে নেব৷’

‘গোলাপিরও তো আমার কাছে আসার কথা৷’

‘জানি৷ আপনার উপর ওর অসীম ভক্তি৷ বাপের সঙ্গে সেও দয়াপুরে আসছে৷ নিবারণকে ধরে আমি আগেই ডিলটা করে ফেলতে চাই মা জননী৷ যাতে চাঁদের লোকেরা ওকে ভাংচি দিতে না পারে৷ অথবা ভয় দেখাতে না পারে৷’

চাঁদ মানে চন্দ্রভানু৷ তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটা লোকজনকে ভয় দেখাচ্ছে না কি?’

‘হ্যাঁ৷ আমার কানে সে খবর এসেছে৷ সাতজেলিয়া ব্লকে কেউ যাতে আপনাকে জমি বিককিরি না করে, সে ভয় অলরেডি সে ছড়িয়ে দিয়েছে৷ বলেছে, যে জমি বিককিরি করবে, তাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে৷’

লোকটার এত সাহস! শুনে রাগে মুখ থমথম করে উঠল তরিতার৷ এই কারণেই বোধহয় কয়েক জন জমি বিক্রি করতে রাজি হয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছে৷ গম্ভীর মুখে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ লোকটাকে কী করে শিক্ষা দেওয়া যায় বলুন তো?’

‘আপনি রিঅ্যাক্ট করবেন না মা জননী৷ সামনাসামনি লড়াই করতে নামবেন না৷ আপনার একটা দেবী দেবী ইমেজ তৈরি হয়েছে গাঁয়ের লোকেদের মধ্যে৷ আপনি চুপ করে বসে থাকুন৷ জমি আপনাকে জোগাড় করে দেবই, আমি কথা দিচ্ছি৷ এখানে একটা ইন্ডাস্ট্রি হবে, লোকজন কাজ কম্ম পাবে৷ এর থেকে বড় কথা আর কী হতে পারে? তাতে কেউ যদি বাগড়া দেয়, তাকে আমরা ছেড়ে দেব না৷ সে যতই পয়সাওয়ালা হোক, অথবা প্রভাবশালী৷ চাঁদের লোকেরা আপনার সম্পর্কে কী রটিয়েছে জানেন?’

তরিতা এই কথাগুলোই শুনতে চাইছেন৷ বললেন, ‘কী রটিয়েছে?’

‘আপনি না কি সিআইএ-র চর৷ আমেরিকা থেকে ওরাই নাকি আপনাকে টাকা পাঠাচ্ছে৷ যাতে এখানকার কিছু বিরল প্রজাতির সাপ আর তাদের বিষ আপনি আমেরিকায় রপ্তানী করতে পারেন৷ এ ব্যাপারে আপনাকে না কি সাহায্য করছেন, কমলেশবাবু বলে একজন জুলজিস্ট৷ তিনিও বেশ কিছুদিন ধরে এই রিসর্টে রয়েছেন সুন্দরবনের বায়ো-ডাইভারসিটি নিয়ে গবেষণা করার জন্য৷’

শুনে রাগবেন না হাসবেন, বুঝে উঠতে পারলেন না তরিতা৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘গাঁয়ের লোকজন সত্যিই কথাটা বিশ্বাস করেছে না কি?’

‘একেবারেই না৷ সিআইএ কী, গাঁয়ের লোকজন তা জানে না৷ জেলার পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে, আপনি কী কারণে এখানে রয়েছেন৷ আমিও ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছি মা জননী৷ এসপি আমার কাছে জানতে চাইছিলেন, চন্দ্রভানুবাবুর সঙ্গে ভদ্রমহিলার প্রবলেমটা আসলে কী, বলুন তো? খোদ হোম ডিপার্টমেন্ট থেকে অর্ডার এসেছে, এনকোয়ারি করার জন্য৷ এস পি-কে যা বলার আমি বলে দিয়েছি৷ জেলায় চাঁদের যেমন লোকজন আছে, তেমনি আমাদেরও আছে৷ ও আপনার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না৷ আপনি নিশ্চিন্ত মনে ল্যাব তৈরির কাজ করে যান৷’

‘বিশাল টাকার ইনভেস্টমেন্ট৷ বুঝতেই পারছেন, একবার কাজে নামার পর যদি কোনও কারণে আটকে যায়, তা হলে পুরো প্রোজেক্টটাই আফ্রিকায় চলে যাবে৷ কাগজে যা পড়ছি, তাতে মাঝে মাঝে…’

‘ও সব মিডিয়ার অপপ্রচার মা জননী৷ সবটা বিশ্বাস করবেন না৷ আমাদের জেলায় তেমন কোনও ইন্ডাস্ট্রি নেই৷ কিছু হলে তো জেলারই লাভ৷ দু’তিনদিন আগে কথা হচ্ছিল ঝন্টু কয়ালের সঙ্গে৷ সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টার, নিশ্চয় নাম শুনে থাকবেন৷ ওকে আমি বলে দিয়েছি, অ্যান্টি ভেনম সিরাম ফ্যাক্টরি যদি কোনও কারণে আটকে যায়, তা হলে নেক্সট মিনিস্ট্রি রিশাফলিংয়ের সময় তুই কিন্তু আর থাকবি না৷ ঝন্টু নিজে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলেছে৷ তবে চাঁদ সম্পর্কে ওকে একটা কথাও কিন্তু বলবেন না৷ ঝন্টু অ্যাসেম্বলি ইলেকশনের সময় প্রচুর ডোনেশন নিয়েছিল চাঁদের কাছ থেকে৷’

‘ঝন্টু কবে আসতে পারে বলে আপনার ধারণা?’

‘ও এখন মথুরাপুরে ফ্লাড রিলিফ ক্যাম্প নিয়ে ব্যস্ত৷ যে কোনওদিন এসে হাজির হতে পারে৷ পারলে ওকে কিছু সাহায্য করবেন ফ্লাড ভিক্টিমদের জন্য৷ একটা কথা জিজ্ঞেস করব মা জননী?’

‘বলুন না৷ এত ইতস্তত করছেন কেন?’

‘আপনার ফ্যাক্টরিতে যতটা এভিএস প্রোডাকশন হবে, তার পুরোটাই কি বিদেশে চলে যাবে? শুনলাম, আপনি স্টেট গভর্মেন্টের কাছে যে অ্যাপ্লিকেশনটা দিয়েছেন, তাতে নাকি এই কথাটা লেখা আছে? আমার অবশ্য তা মনে হয় না৷ ওয়েস্ট বেঙ্গলে আগে এভিএস তৈরি করত বেঙ্গল কেমিক্যাল৷ এখন প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে গেছে৷ সিরাম ভিন রাজ্য থেকে কিনে আনতে হচ্ছে৷ আপনি গ্যারান্টি দিন মা জননী৷ আপনার সিরাম লোকাল ম্যার্কেটেও বিক্রি হবে৷’

শুনে একটু অবাকই হলেন তরিতা৷ মিনিস্ট্রিতে তিনি যে অ্যাপ্লিকেশনটা দিয়েছেন, তাতে কী আছে, সেটা জানার কথা অমর মণ্ডলের নয়৷ তা হলে উনি জানলেন কী করে? মিনিস্ট্রির কারও কাছ থেকে নিশ্চয়ই শুনেছেন৷ তা হলে তো ওঁর হাত অনেক লম্বা৷ ভদ্রলোককে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না৷ পাল্টা প্রশ্ন না করে তরিতা বললেন, ‘জানি না, আপনি কোত্থেকে খবরটা পেয়েছেন৷ আপনাকে অ্যাসিউর করছি, কাউকে সাপে কামড়ালে যাতে কলকাতায় ছুটতে না হয়, তার ব্যবস্থা আমি করব৷ এই জেলার সব ক’টা হেলথ সেন্টারেই যাতে কম দামে আমার সিরাম পাওয়া যায়, তার দিকে লক্ষ রাখব৷ আমি জানি, এখানে স্নেক বাইটের সংখ্যা অনেক বেশি৷’

‘যাক, তা হলে সমস্যাই নেই৷’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন অমর মণ্ডল৷ বললেন, ‘বৃষ্টি থেমে গেছে মা জননী৷ আমাকে এখন উঠতে হবে৷ ও হ্যাঁ, একটা কথা আপনাকে বলতে ভুলে গেছি৷ বিশ্বপতি ভট্টাচার্য ক’দিন আগে আমায় বলছিলেন, ইতিহাসের না কি পুনরাবৃত্তি হবে৷ আপনি কি বিশ্বপতিবাবুর নাম শুনেছেন? নামকরা পুরাতত্ত্ববিদ৷ জয়নগরে থাকেন৷’

‘না শুনিনি৷ কী বলছিলেন উনি?’

‘উনি বলছিলেন, হাজার বছর আগে আমাদের এই জেলায় সমুদ্রের তীরে কোথায় যেন একটা বন্দর ছিল৷ নামটা উনি বললেন বটে, আমার মনে নেই৷ সেই বন্দরে জাহাজ এসে দাঁড়াত ইউরোপ থেকে৷ গ্রিস আর রোম থেকে ব্যাপারীরা এসে সাপের বিষ প্রতিশোধক ওষুধ কিনে নিয়ে যেতেন৷ না কি ভয়ানক ডিম্যান্ড ছিল সেই ওষুধের৷ টয়েনবির লেখায় আছে, ওষুধ কেনার কারণে গ্রিসের রাজকোষ একবার শূন্য হয়ে গেছিল৷ আপনি কি জানেন, এ তথ্যটা?’

টয়েনবির নাম তরিতা শুনেছেন৷ বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক৷ কথাটা শুনে তিনি মনে মনে হাসলেন৷ সুন্দরবনের এই অঞ্চলের কোনও বন্দর থেকে হাজার বছর আগে যে এভিএস টাইপের কোনও ওষুধ বিক্রি হত, তা জেনেই তরিতা এখানে এসেছেন৷ তাঁরই মতো কোনও হারপেটোলজিস্ট বা ওফিওলজিস্ট সম্ভবত এই অঞ্চলে বসবাস করতেন! সাপের বিষ দিয়ে তিনি এমন ওষুধ তৈরি করতেন, যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যেত না৷ মৃতপ্রায় মানুষকে তিনি বাঁচিয়ে দিতে পারতেন বলে, লোকে তাঁর উপর দেবিত্ব আরোপ করেছিল৷ ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তরিতার৷ তবুও, না-জানার ভান করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই বন্দরের কী হল?’

‘বিশ্বপতিবাবু তো বললেন, সেই সময়ে একবার সুনামির মতো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছিল৷ সেই কারণে বন্দরসহ জনপদ কিছুটা সমুদ্র গর্ভে চলে যায়৷ কিছুটা মাটির নীচে চাপা রয়েছে৷ মোহনার দিকে এখনও বেশ কয়েকটা দ্বীপে বিশাল বিশাল ঢিবি রয়েছে মা জননী৷ তার একটা হল মনসা ঢিবি৷ যাবেন না কি সেখানে? তার নীচে নাকি বিশাল মনসা মন্দির আছে৷’

কথাগুলো শুনে নেত্রার দিকে তাকালেন তরিতা৷ স্কুলে পড়ার সময় একবার আশ্রমের মায়েদের সঙ্গে তিনি ওই অঞ্চলে গিয়েছিলেন৷ লঞ্চের ডেক-এ সেবারই প্রথম তিনি মা মনসার দেখা পান৷ অমর মণ্ডলে চলে যাওয়ার অনেক পরে তরিতা স্থির করলেন, ওই মনসা ঢিবিতে তিনি যাবেন৷

(চৌত্রিশ)

বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে অঙ্কুশের মন৷ আজ নিকটজনেরা এত খারাপ ব্যবহার করবে, ও ভাবতেও পারেনি৷ বাড়িতে যার সঙ্গে ওর সবথেকে সুন্দর সম্পর্ক ছিল, সেই পিঙ্কি বউদি পর্যন্ত এতটা বদলে গেল কী করে? টিটোকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বারুইপুর থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ওরা যখন ফের পিয়ারাতে যায়, তখনই অঙ্কুশ বুঝতে পেরেছিল, ঝড়ের মুখে পড়বে৷ লোহার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই ওর চোখে পড়েছিল, তুড়ুকতোবা গাছের নীচে কাকিমা-পিসিমাদের জটলা৷ সবাই দৌড়ে এসেছিল গাড়ির সামনে৷ টিটোকে নিয়ে গোলাপি নীচে নামার পর শুরু হয়েছিল কটু কথার বর্ষণ৷

‘তোর মনে মনে এই ছিল?’

‘তোর স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি কুশ৷’

‘নিজের ভাইপোকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিলি, ছিঃ?’

‘আমরা তো পুলিশে তোর নামে কমপ্লেন করতে যাচ্ছিলাম৷’

‘জানিস, আর দেরি হলে পিঙ্কি হার্টফেল করত?’

‘অ্যাদ্দিন ধরে তোকে খাওয়ালাম পড়ালাম, আর তুই তার এই প্রতিদান দিলি?’

‘ইচ্ছে করছে, তোর গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারি৷’

‘দুধ-কলা দিয়ে অ্যাদ্দিন কাল সাপ পুষেছিলে বউদি৷ তোমাদের আগেই সাবধান করেছিলাম৷ ছোঁড়ার পাল্লায় পড়ে টিটো বিগড়ে যাবে৷’

ড্রাইভারের পাশে বসে শূন্য চোখে অঙ্কুশ তখন তাকিয়ে ছিল অতি পরিচিত মুখগুলোর দিকে৷ টিটোকে আঁকড়ে ধরে পিঙ্কি বউদি হাউহাউ করে কাঁদছিল৷ স্কুল থেকে রোজ টিটো বেলা দুটোর সময় বাড়ি ফেরে৷ আজ নিশ্চয়ই ভ্যান রিকশাওয়ালা এসে বলেছে, ওকে পাওয়া যাচ্ছে না৷ তার পরই হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছে৷ বাড়ি থেকে বেরনোর সময় বড় জেঠাকে দেখে গিয়েছিল অঙ্কুশ৷ জটলায় তাঁকে দেখতে না পেয়ে ও একটু অবাকই হয়েছিল৷ সবথেকে বাঁকা বাঁকা কথা বলেছিলেন ছোট পিসি৷ ‘বাবাটা যেমন কুলাঙ্গার ছিল, ছেলেটাও তেমন হয়েছে৷’ শুনে মারাত্মক চমকে উঠেছিল অঙ্কুশ৷

শেষে আর সহ্য করতে না পেরে গোলাপি বলে উঠেছিল, ‘তোমরা কী গো, আসল কতা না জেনে শুধুমুধু দাদাবাবুকে গাল দিচ্চ?’

কাকিমা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘টিটোকে কোত্থেকে তোরা তুলেছিলি মুখুপড়ি?’

‘আমরা মোট্টেও তুলিনি৷ ও নিজেই গাড়ির ভেতর নুক্কে বসে ছিল৷ ওকে কেউ ধরে নে গেলে কি আমরা ফেরত দিতে আসতুম? ওকেই জিজ্ঞেস করো না৷ তা না করে দাদাবাবুকে ত্যাখন থেকে যা নয়, তাই তোমরা বলে যাচ্চ৷’

শুনে ছোট পিসি ধমকে উঠেছিল, ‘এ্যাই, তুই চুপ কর৷ শুঁড়ি সাক্ষী মাতাল কোথাকার৷’

গোলাপি পাল্টা তড়পে উঠেছিল, ‘এ্যাই বুড়ি, তুই চুপ করে থাক৷ আমি তোর খাই-পড়ি না৷ দাদাবাবু সম্পক্কে আর যদি একটা কতা বলিস, তা’লে তোর ঘেঁটি ধরে গাছের সঙ্গে ঠুকে দেব৷’

ওর রুদ্ররূপ দেখে মুখ হাঁ হয়ে গেছিল সবার৷ আর তখনই অঙ্কুশ গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘ গোলাপি, গাড়িতে উঠে আয়৷ আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’

মহেশপুরে গোলাপির দাদার বাড়িতে বসে অঙ্কুশের সব মনে পড়ছে৷ আজ আর ওদের দয়াপুরে যাওয়া হয়নি ৷ দ্বিতীয়বার বারুইপুর রেল ক্রশিংয়ে পৌঁছে ওরা দেখে রাস্তা জ্যাম৷ কী একটা মিছিল বেরিয়েছে৷ সেই জ্যাম পেরতে সন্ধে নেমে এল৷ ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হল৷ সুমো মালিকের সঙ্গে অঙ্কুশের কথা হয়েছিল, গদখালি অবধি পৌঁছে দিয়ে গাড়ি সোনারপুরে ফিরে যাবে৷ অঙ্কুশ মনে মনে ভাবছিল, বৃষ্টি যদি আরও বাড়ে তা হলে গদখালিতে গিয়ে ওরা মুশকিলে পড়ে যাবে৷ দয়াপুরে যাওয়ার লঞ্চ নাও পাওয়া যেতে পারে৷ তখনই পিছন থেকে নিবারণ বলে উঠেছিল, ‘ছোট দাদাবাবু অপরাধ যদি না নেন, তা হলে একটা কই৷ আইজ-কালের মধ্যে ষাঁড়াষাড়ির বান আসার কতা৷ বৃষ্টি থাইমবে বলে মনে হচ্চে না৷ আমি বলি কী, আজ রাতডা মহেশপুরে গণেশের ওখানে কাটানো যাক৷ কাল দয়াপুরে যাওয়ার কতা ভাবা যাবে৷’

নিবারণের পরামর্শটা মনে ধরেছিল অঙ্কুশের৷ ও চায়নি, বেশি রাতে দয়াপুরের টাইগার ক্যাম্প রিসর্টে পৌঁছতে৷ কাল ফোনে নেত্রা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে নিলেই চলবে৷ সুমো ওদের মহেশপুরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেছে৷ রাতে গণেশের বাড়ির দাওয়ায় বসে অঙ্কুশের মনে হচ্ছে, সিদ্ধান্তটা ঠিকই নিয়েছে৷ গণেশের বাড়িটা মাটির, তবে খুব ঝকঝকে তকতকে অনেকগুলো ঘর৷ ইলেকট্রিকের আলোও রয়েছে প্রত্যেক ঘরে৷ বাড়িতে ঢোকার সময় অঙ্কুশের চোখে পড়েছে, একটা বড় ঘরে দু’তিনজন বসে শোলার কাজ করছে৷ সেই ঘরেই মনে হয়, টিভি সেট আছে৷ কেউ চালিয়ে খবর শুনছে৷ গণেশ আর ওর বউ চামেলির যত্নআত্যির কোনও তুলনা নেই৷ সন্ধেবেলায় মুড়ি, নারকোল আর বাতাসা খাইয়েছে৷ রাতে মুরগির মাংস রান্নার গন্ধ পাচ্ছে অঙ্কুশ৷ গ্রামে গঞ্জে সেমিনার করতে গিয়ে এ রকম মাটির বাড়িতে থাকার অভ্যেস আছে ওর৷ তাই কোনও অসুবিধে বোধ করেনি৷ বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়াটাও বেশ ঠান্ডা৷

মোবাইল ফোনটা ঘরের ভিতর টেবলের উপর রেখে এসেছে৷ দু’তিনবার রিং টোন বাজতে শুনেছে৷ তবুও, উঠে গিয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে না অঙ্কুশের৷ রাত প্রায় আটটা বাজে৷ এর মধ্যেই নিঃঝুম হয়ে গিয়েছে গ্রামটা৷ দূরে কোথাও জলাজমি আছে৷ ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে৷ রায়দীঘির রাস্তা থেকে মহেশপুর গ্রামে ঢোকার সময়ই অঙ্কুশের চোখে পড়েছিল বড় বড় পুষ্করিণী, ঝাঁকড়া বট আর অশ্বত্থ গাছ, দোলতলা, মন্দিরতলা আর ফুলবাগান৷ নিবারণ তখন বলেছিল, গ্রামে না কি কাঠের বিশাল একটা বিষ্ণু মন্দির আছে৷ সেটা দেখার মতো ৷ সময় পেলে কাল সকালে দয়াপুরে যাওয়ার আগে সেটা দেখে নেওয়া যাবে৷ আপাতত, একা বসে অঙ্কুশের সময় কাটছে না৷

অন্যদিন এইসময়টায় পিয়ারার বাড়িতে বসে ও অ্যানিমেল প্ল্যানেট বা ডিসকভারি চ্যানেল দেখে৷ অথবা ল্যাপটপ খুলে চ্যাট করতে বসে যায় সর্পমিত্রদের সঙ্গে৷ কিন্তু বিকেলে বাড়ির লোকদের ওই জ্বালাধরা কথাগুলো কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না ও৷ বিশেষ করে ছোটপিসির কথা৷ উনি বাবাকে কুলাঙ্গার বললেন৷ কিন্তু কেন? বাবা আর মায়ের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানে না অঙ্কুশ৷ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ও চিনত শুধু বড়মাকে৷ বাবা-মা সম্পর্কে জানার আগ্রহ কেন ওর হয়নি, সেটা ভেবেই অবাক হতে লাগল৷ পড়াশুনার কারণে হোস্টেলে হোস্টেলে কাটানোর জন্যও হতে পারে৷ মিত্তির বাড়ির সঙ্গে এরপর কোনও সম্পর্ক রাখার কথা অবশ্য অঙ্কুশ ভাবতে পারছে না৷ ও ঠিকই করে রেখেছে, কেউ ফোন করলে ও লাইন কেটে দেবে৷

‘দাদাবাবু, তুমি কী গো, এতক্ষণ ধরে ফোনটা বাজচে, তুমি কি শুইনতে পারচ না?’

পিছন ফিরে অঙ্কুশ দেখল, ওর মোবাইল সেট ধরে দাঁড়িয়ে গোলাপি৷ মুড়ি-বাতাসা খেয়ে কোথায় উধাও হয়েছিল কে জানে? এতক্ষণে ওর দেখা মিলল৷ হাত বাড়িয়ে সেটটা নিয়ে পর্দার দিকে তাকাতেই অঙ্কুশের শরীরে শিহরণ খেলে গেল৷ উষসী! এতক্ষণ ধরে ও তা হলে ফোন করছিল? সারা দিনে এই প্রথম ওর মনে হল, ভাল কিছু ঘটল৷ সুইচ অন করার আগেই ও ভেবে নিল, ফোনটা চট করে ছাড়বে না৷ মন ভাল করার জন্য ও অনেকক্ষণ ধরে কথা বলবে৷ উষসীর সঙ্গে ওর শেষবার কথা হয়েছিল বাড়িতে মৎস্যমুখের দিন৷ ও যে দয়াপুরে আসবে, সেটা উষসী জানে৷ ফোনের সুইচ অন করে অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘বলো৷’

ও প্রান্ত থেকে উষসী বলল, ‘আপনি আচ্ছা লোক তো মশাই৷ আমাকে ফাঁকি দিয়ে একা একা দয়াপুর চলে গেলেন?’

‘আমি যে দয়াপুরে, তোমাকে কে বলল?’

‘তাই তো শুনলাম পিঙ্কিদির কাছে৷ আজ বিকেলে না কি বাক্স প্যাটরা নিয়ে আপনি বেরিয়ে গেছেন?’

পিঙ্কি বউদি আর কী বলেছে, সেটা জানার ভীষণ কৌতূহল হল অঙ্কুশের৷ কিন্তু, নিজেকে ও সংবরণ করল৷ কী বলতে, মুখ দিয়ে কী বেরিয়ে যাবে কে জানে? ও যে চিরদিনের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেটা জানানোর দরকার নেই উষসীকে৷ ও বলল, ‘আমাকে ফোন করছিলে কেন?’

‘আরে, বাবাকে আপনি পালান সর্দারের যে ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলেন, সেটাতে বেশ কয়েকবার ট্রাই করা সত্ত্বেও ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না৷ কী করা যায় বলুন তো?’

অঙ্কুশ বলল, ‘ওকে ধরা খুব কঠিন৷ ওর ইন্টারভিউ যদি নিতে হয়, তা হলে তোমার বাবাকে ওর ডেরায় যেতে হবে৷’

‘ওরে বাবা৷ সে তো দুর্গম জায়গা৷ এই বয়সে বাবা কি এত স্ট্রেন নিতে পারবেন? আপনি তো জানেন, কিছুদিন ধরে উনি হার্টের প্রবলেমে ভুগছেন৷’

‘তা হলে আইডিয়াটা ড্রপ করাই ভাল৷ এখন তোমার খবর বলো৷ তোমার নেক্সট অ্যাসাইনমেন্ট কী?’

‘যাক, অ্যাদ্দিনে তবুও আপনি আমার সম্পর্কে ইন্টারেস্ট দেখালেন৷’

অঙ্কুশ বলতে যাচ্ছিল, ‘ তোমাকে দেখার দিন থেকেই তোমার সম্পর্কে আমার ভীষণ ইন্টারেস্ট৷’ কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল, ‘আমার প্রশ্নটার কিন্তু উত্তর দিলে না৷’

‘আপাতত কিছু নেই৷ আপনার কাছে ভাল কোনও সাবজেক্ট থাকলে দিতে পারেন৷’

চট করে চন্দ্রভানবাবুর বাড়িতে দুটো পাইথনের কথা মনে পড়ে গেল অঙ্কুশের৷ ও বলল, ‘কঙ্কণদীঘিতে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে দুটো বিরাট পাইথন আছে৷ ফিমেল পাইথনটার বাচ্চা দেওয়ার সময় হয়ে গেছে৷ ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার প্রসেসটা তুমি ছবিতে ধরে রাখতে পারো৷ আমার মনে হয় না, এই ডকুমেন্টেশনটা আগে এ দেশে কেউ করেছেন৷’

ও প্রান্তে উষসী উৎসাহে টগবগ করে উঠল, ‘দারুণ আইডিয়া৷ আমায় কোথায় যেতে হবে বলুন৷ পাইথন দুটো কোন দেশের? ইন ক্যাপটিভ আছে না কি?’

‘ঠিক ধরেছ৷ চন্দ্রভানুবাবু বলে এক মালটিমিলিওনার ভদ্রলোক মায়ানমার থেকে আসা ওই পাইথন দুটোকে পুষছেন৷ তুমি যদি আসো, তা হলে চন্দ্রভানুবাবুর সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি৷’

‘যদি আসো মানে? আমি কালই রওনা হচ্ছি৷ কঙ্কণদীঘি কী করে যেতে হয়, আমায় বলুন৷’

‘সেটা ডিপেন্ড করছে, কিসে তুমি আসতে চাও, তার উপর৷ বাসে করে এলে সোজা রায়দীঘি৷ ওখান থেকে কঙ্কণদীঘি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেবো৷ কিন্তু তুমি তো ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে আসবে৷ বাসে করে এলে সেগুলো আস্ত থাকবে তো? তুমিও কি বাসের ধকল নিতে পারবে?’

‘সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না৷ তিন্নির মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে আমি জন্মাইনি৷ কষ্ট করার খুব অভ্যেস আছে আমার৷’

‘আরে, ভাল কথা মনে করিয়েছ৷ তিন্নিকে সঙ্গে নিয়ে এলেই তো পারো৷ ওর একটা ইউনিক এক্সপিরিয়েন্স হয়ে যাবে৷ তোমাকেও বাসে করে আসার ঝামেলা পোহাতে হবে না৷’

‘দেখি, তা হলে ওর সঙ্গে কথা বলে৷ কিন্তু, আপনি কোথায় আছেন, বলুন তো?’

‘মহেশপুর বলে একটা গ্রামে৷ গোলাপিদের বাড়িতে৷ রায়দীঘির খুব কাছে৷’

‘কিন্তু আপনার তো যাওয়ার কথা দয়াপুরে৷ চাকরির ইন্টারভিউ দিতে৷ তার কি হল?’

‘ভগবান বোধহয়, চান না৷ এ নিয়ে দু’বার আমি বাড়ি থেকে বেরলাম দয়াপুরে যাওয়ার জন্য৷ দু’বারই যাওয়া আটকে গেল৷ চাকরি বোধহয় আমার কপালে লেখা নেই৷’

‘পিঙ্কিদি বলছিল, চাকরি করার দরকারই না কি আপনার নেই৷ কোথাকার এক রাজকন্যা আর রাজত্ব দুটোই না কি আপনার কপালে জুটে গেছে?’

ওহ, পিঙ্কি বউদি তা হলে এই গল্পও উষসীর কাছে করেছে? মেয়েদের পেটে কোনও কথা থাকে না৷ কথায় একটু খোঁচা আছে৷ তবুও, বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘সে কী, এই তো বাড়ি থেকে আসার সময় পিঙ্কি বউদির মুখেই আমি শুনলাম, বড়মা না কি আমার জন্য কোন এক মেয়েকে পছন্দ করে রেখে গেছেন৷ তোমার পিঙ্কিদি সে কথা বলেনি?’

‘বলেছে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনি কী ঠিক করলেন, সেটা কিন্তু ওদের জানাননি?’

‘ভুল কথা৷ আমি বলে এসেছি, বড়মা যাকে পছন্দ করে গেছেন, তাঁর আমাকে পছন্দ কি না, কেউ কি তা জানতে চেয়েছে? যাক গে, তুমি তো এখানে আসছই৷ বেশ কয়েকটা দিন তোমাকে এখানে থাকতেও হবে৷ তখন না হয় ,সামনাসামনি কথা বলে ঠিক করা যাবে৷’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে উষসী জিজ্ঞেস করল, ‘কঙ্কণদীঘিতে কদ্দিন থাকতে হতে পারে বলুন তো অঙ্কুশদা?’

‘খোঁজ নিয়ে বলতে হবে৷ ফিমেল পাইথনটাকে না দেখে আমি বলতে পারব না৷ আর তাকে দেখতে গেলে আমাকে কঙ্কণদীঘি যেতে হবে৷’

‘আমার জন্য এত সময় দেবেন?’

‘তোমার জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে পারি উষসী৷’

‘এই কথাটা আজ পর্যন্ত ক’জনকে বলেছেন অঙ্কুশদা? সত্যি কথাটা বলবেন কিন্তু৷’

‘একজনকেও নয়৷ আজই প্রথম মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল৷’

‘বাববা, আপনি যে এত রোমান্টিক তা তো জানতাম না৷’

‘কেন, আমার গুণপনা নিয়ে পিঙ্কিদি তোমায় আর কিছু বলেনি?’

‘বারবার পিঙ্কিদিকে টানছেন কেন বলুন তো? জানেন, আজ উনি কত দুঃখ করছিলেন আমার কাছে?’

‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷ তা, উনি হঠাৎ দুঃখ করছিলেন কেন?’

‘সেসব কথা আপনাকে শুনতে হবে না৷ দেখা হলে তখন না হয় সামনাসামনি বলা যাবে৷ আপনি কঙ্কণদীঘির ব্যাপারটা আমাকে কবে কনফার্ম করবেন, বলুন৷’

‘কালকের মধ্যেই তোমায় জানিয়ে দেব৷’

‘ছাড়ছি তা হলে? বাই৷’

ও প্রান্ত থেকে লাইনটা কেটে যাওয়ার পর মুখ তুলে অঙ্কুশ দেখল, দরজার আড়ালে গোলাপি দাঁড়িয়ে৷ কী কৌতূহল… এতক্ষখ লুকিয়ে কথাবার্তা শুনছিল৷ মোবাইল সেট এগিয়ে দেওয়ার সময় পর্দায় উষসীর নামটা নিশ্চয়ই দেখেছে৷ বাড়ির মেয়েমহলে উষসীকে নিয়ে কানাকানি নিশ্চয়ই ও শুনে এসেছে৷ আজ গাড়িতে বারদুয়েক গোলাপি উষসীদিদির জন্য হা হুতাশ করেছিল৷ কিন্তু অঙ্কুশ পাত্তা দেয়নি৷ ধরা পড়ে গিয়ে গোলাপি দাওয়ায় নেমে এসে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলব বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷’

অঙ্কুশ বলল, ‘ কী বলবি বল৷’

‘রাতে ডিনার করার পর একবার বিষ্ণুমন্দিরের দিকে যাবে? একটা জিনিস দেখলে দাদাবাবু তুমি কিন্তু তাজ্জব হয়ে যাবে৷’

‘কী জিনিস রে?’

‘আগে বলব না৷ বারতিনেক আমার চোখে পড়েছে৷ ভয়ে পাইল্যে এয়েচি৷’

কথাটা হয়তো শুনতে পেয়েছিল নিবারণদা৷ উঠোন পেরিয়ে দাওয়ার কাছে এসে বলল, ‘না, না দাদাবাবু৷ রাত্তিরে কোত্থাও যেতে হবে না৷ বিষ্ণু মন্দির ভেঙেচুরে গেইচে৷ ওখেনে সাপ-খোপ ঘুইরে বেড়ায়৷ লোগে বলে, মন্দিরের তলায় না কি গুপ্তধন আচে৷ রোজ রাতে এক যক্ষ এসে সেই ধন পাহারা দেয়৷ সে কারুকে রেয়াৎ করে না৷ আবনি গোলাবির কতা শুইনবেন না৷’

কথাটা মনঃপূত হল না গোলাপির৷ পা চালিয়ে ও রান্নাঘরের দিকে সরে গেল৷ উল্টো দিক থেকে নিবারণদা বলল, ‘কালকেও দয়াপুরে যাওয়া হবেনি ছোট দাদাবাবু৷ টিভির খবরে শুনলুম, কালই ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসইবে৷ গভর্মেন্ট থেকে বলে দিইচে, লদীর উপর ওই সময় যেন কুনও লঞ্চ বা লৌকো না থাকে৷ জল এততো ফাঁপে যে, আমাদের পাকা রাস্তা অবধি ভাস্যে দেয়৷’

খবরটা জেনে অঙ্কুশ মনে মনে হাসল৷ ভগবান ঠিক কী চান, ও বুঝতে পারছে না৷ বারবার বাধা পড়ছে দয়াপুর যাওয়ায়৷ কালও যাওয়া সম্ভব হবে না৷ তরিতা ম্যাডাম ওর সম্পর্কে কী ধারণা করবেন, কে জানে?

এভিএস কোম্পানিতে যদি ওর চাকরিটা না হয়, তা হলে চেন্নাইয়ের স্নেক ইন্সটিটিউটেই চলে যাবে৷ জীবনটা হঠাৎই এলোমেলো হয়ে গেল৷ বাড়ির শেঁকড়টা ছিড়ে গেল৷ সেটাই সবথেকে দুঃখের৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অঙ্কুশ বলল, ‘কাল একবার কঙ্কণদীঘি যেতে চাই৷ কী করে যাওয়ায় যায় নিবারণদা?’

‘কোনও অসুবিধে নেই৷ গণেশকে বলে দিচ্ছি৷ ও মোটর বাইকে করে পৌঁচে দিয়ে আইসবে৷ আবনি হাত-মুখ ধুয়ে নেন দাদাবাবু৷ রান্না হইয়ে গেচে৷’

এত তাড়াতাড়ি ডিনার করার অভ্যেস অঙ্কুশের নেই৷ তবুও, ও খেতে বসে গেল৷ আয়োজনের কোনও ত্রুটি নেই৷ ভাত, ডাল, পটলভাজা, পোনা মাছের ঝোল, মুরগির মাংস আর তেঁতুলের চাটনি৷ শোলার কাজ সেরে এসে গণেশ পাশে দাঁড়িয়ে নানা গল্প করতে লাগল৷ ছেলেটা হায়ার সেকেন্ডারি পাস করার পর শোলার কাজ শিখতে মহেশপুরে চলে এসেছিল৷ এখন শোলাশিল্পে খুব নাম করে ফেলেছে৷ বাড়িতে বসেই বিয়ের টোপর, মুকুট, মালা, উৎসবের সাজসজ্জা, চাঁদমালা, প্রতিমার গয়না তৈরি করে৷ সেসব কলকাতার বড় বড় দশকর্মার দোকানে সাপ্লাই দেয়৷ কুমোরটুলি থেকেও লোক এসে ওদের তৈরি জিনিস নিয়ে যায়৷ পুজো মরশুমের আর খুব বেশি নেই৷ গণেশ বলল, এই সময়টায় ওরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ দশ-বারোজন কারিগর নিয়েও অর্ডার শেষ করতে পারে না৷

এই গণেশকে অনেকবার পিয়ারার বাড়িতে দেখেছে অঙ্কুশ৷ তখন অনেক ছোট ছিল৷ সপ্তমীর দিন কাজের লোকের পরিবারকে ডেকে জামা-কাপড় দিতেন বড়মা৷ দয়াপুর থেকে নিবারণদা তখন ওকে নিয়ে যেত৷ সেই ছেলেটা লেখাপড়া শিখে এখন ভালই ব্যবসা করছে৷ শুনে অঙ্কুশের খুব ভাল লাগল৷ ওদের শোলার কাজ না কি বিদেশেও যায়৷ মহেশপুরের মতো ছোট্ট একটা গ্রাম হঠাৎ কেন শোলাশিল্পের জন্য এত বিখ্যাত হয়ে গেল, সেই ইতিহাসটাও গণেশ জানে৷ প্রায় তিনশো বছরের পুরনো ঐতিহ্য৷ ও বলল, গ্রাম যাঁরা পত্তন করেছিলেন, সেই হালদাররা শোলার কাজ জানতেন৷ তাঁদেরই কারোর হাতে তৈরি শোলার হ্যাট ইংরেজদের খুব পছন্দ হয়ে যায়৷ ব্যস, তার পর থেকে না কি মহেশপুরের নাম খুব ছড়িয়ে পড়ে৷

… ডিনার করে এসে বিছানায় মশারির ভিতর বসে অঙ্কুশ যখন ল্যাপটপ খুলে বসেছে, তখনই গোলাপি নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বলল, ‘চলো দাদাবাবু, সেই জিনিসটা দেখবে চলো৷’

অঙ্কুশ বলল, ‘নিবারণদা যে তোকে মানা করে গেল?’

গোলাপি উড়িয়ে দিল সে কথা৷ বলল, ‘বাড়ির সববাই ঘুমিয়ে পড়েচে৷ কেউ টের পাবে না৷ এ জিনিস জীবনেও তুমি দেখতে পাবে না৷’

কৌতূহলে অঙ্কুশ মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল৷ গোলাপির হাতে একটা স্নেকহুক, ব্যাগ আর দুটো টর্চ৷ বাড়ির বাইরে গিয়ে একটা টর্চ ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গোলাপি বলল, ‘ওই পুকুরের পাশ দিয়ে খানিকটা হেঁটে যেতে হবে৷ আমি আগে আগে যাচ্ছি৷ তুমি ভয় পেও না৷’

অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে থাকা নিঃঝুম গ্রাম৷ তারার আলোয় পথ চলতে হচ্ছে৷ মিনিট দশেক হাঁটার পর দূর থেকে একটা ধ্বংসস্তূপ দেখতে পেল অঙ্কুশ৷ এই সেই বিষ্ণু মন্দির নাকি? যাকে নিয়ে নানা কিংবদন্তি আছে!

এই প্রথম টেনশন বোধ করতে লাগল ও৷ গোলাপির কথা শুনে এখানে না এলেই ভাল হত৷ মন্দিরের প্রবেশ পথের ধারে দু’পাশে বড় বড় গাছের সারি৷ সেদিকে টর্চের আলো ফেলে গোলাপি ফিসফিস করে বলল, ‘ওই দ্যাকো দাদাবাবু৷’

টর্চের আলো ফেলে ভাল করে তাকিয়ে দেখতেই অঙ্কুশ চমকে উঠল৷ বিচিত্র বর্ণের কয়েকটা সাপ৷ প্রায় সাত আট ফুট লম্বা তো হবেই৷ গাছের গুঁড়িতে লেজ জড়িয়ে রেখে, শূন্যে পুরো দেহটা টানটান করে মন্দিরের রাস্তা আগলে রেখেছে৷ মাথার দিকটা ফণা ধরে রয়েছে৷ ফোঁস ফোঁস করছে৷ ভঙ্গিটা এমন আক্রমণাত্মক যেন যে কোনও সময় উড়ে এসে আঘাত করতে পারে৷ সাপ প্রজাতিটাকে অঙ্কুশ হাতের তালুর মতো চেনে৷ দেখে ভয় পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷ তবুও ওই রহস্যময় মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ওর গা ছমছম করে উঠল৷ ফিসফিস করে ও বলল, ‘এখানে একমুহূর্ত থাকা আর ঠিক হবে না রে গোলাপি৷ চল, ফিরে যাই৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *