তরিতা পুরাণ – ২৫

(পঁচিশ)

বারান্দায় পায়চারি করছেন চন্দ্রভানু৷ সারা রাত তিনি ঘুমোতে পারেননি৷ ব্লাড প্রেসার আর সুগারের সমস্যা রয়েছে৷ ডাক্তার বলেছেন, রাতে ঘুমটা তাঁর জরুরি৷ কিন্তু, ভোরের আলো ফোটা সত্ত্বেও, এখনও তাঁর রাগ কমেনি৷ বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে, তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি৷ ভাগ্যিস, বারুইপুর থেকে সোজা কঙ্কণদীঘিতে আসার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন৷ সোনাখালিতে থাকলে তো তিনি জানতেও পারতেন না, বাড়িতে কী হচ্ছে!

বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে চন্দ্রভানু দেখেন, তাঁর বাড়িই উঠোনে ফণী মনসা গাছের তলায় মনসা পুজো হচ্ছে৷ দেখে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল৷ সঙ্গেসঙ্গে পুজোর ঘট তিনি উল্টে দেন৷ পুজোর উপাচার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দেন৷ সনকা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, ‘করছ কী, অকল্যাণ হবে৷’

তাঁকেও রেহাই দেননি চন্দ্রভানু৷ সবার সামনেই সনকার চুলের মুঠি ধরে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোর এত দুঃসাহস! আমার বাড়িতেই কাণি মনসার পুজো করছিস? তোকে আজ মেরেই ফেলব৷’

বলতে বলতে নির্দয়ভাবে মারতে শুরু করেছিলেন সনকাকে৷ খেয়ালই ছিল না, কাজের লোকেরা মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে৷ রাগের মাথায় অনেক খারাপ খারাপ কথাও বলে ফেলেছেন চন্দ্রভানু৷ গাঁয়ের আর পাঁচটা বউ পেটানো লোকের মতো তুই তোকারিতে নেমে এসেছিলেন৷ সনকাকে বাঁচাতে এসেছিল ওঁর খাস ঝি ভানুমতি৷ তাকেও কয়েক ঘা চড়চাপড় দিয়েছেন চন্দ্রভানু৷

পূজারি জগন্নাথ পণ্ডিত ওই রুদ্ররূপ দেখে ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছিলেন৷ হঠাৎ তাঁর দিকে চোখ পড়েছিল চন্দ্রভানুর৷ চিৎকার করে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘আপনি? আপনি কেন পুজো করতে রাজি হলেন পণ্ডিত মশাই? আপনি জানেন না, মনসাকে আমি পছন্দ করি না?’

‘কিন্তু মা জননী যে আমায় আদেশ করেছিলেন বাবা৷’

‘তা হলে মা জননীর মতো আপনিও উচ্ছন্নে যান৷ কাল থেকে আপনি আর আমার মন্দিরে ঢুকবেন না৷ আমি সোমনাথ পণ্ডিতকে ডেকে আনব৷ সোমাই পণ্ডিতকে দিয়ে শিবের পুজো করাব৷’

শেষে মার খেয়ে মন্দিরের চাতালে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান সনকা৷ মন্দির থেকে বেরনোর সময় তাঁর দিকে ফিরেও তাকাননি চন্দ্রভানু৷ সোজা এসে ঢুকেছিলেন বেডরুমে৷ এমন একটা অপ্রিয় কাজ সনকা কেন করতে গেল, অনেক ভেবেও তিনি উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না৷ এ তো পরিষ্কার বিশ্বাসঘাতকতা! হঠাৎ মনে হয়েছিল, কার প্ররোচনায় সনকা মনসা পুজো করছিল, সেটা আগে জানা দরকার৷ তাঁর অবর্তমানে নিশ্চয়ই এই কঙ্কণদীঘির বাড়িতে কেউ এসেছিল৷ সে বুঝিয়ে গিয়েছে, মনসার পুজো না করলে অকল্যাণ হবে৷ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভানুমতিকে ডেকে চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোর মা ঠাকুরনের কাছে কেউ এসেছিল? সত্যি করে বল৷’

অজগরের পেটে যাওয়ার ভয়ে সব কথা উগড়ে দিয়েছিল ভানুমতি৷ স্বর্গ থেকে নেমে আসা সাধুমায়ের কথা ও বলেছিল৷ পুজো হয়ে যাওয়ার পর ফোনে যে, সব খবর দিতে বলেছে৷ সেই ফোন নাম্বারটা হাতে পেয়ে স্তম্ভিত চন্দ্রভানু৷ কী মূর্খ এরা! সেই ভণ্ড মহিলা… নেত্রা না কী যেন নাম…যা বলে গিয়েছে, সব এরা বিশ্বাস করে নিয়েছে৷ হয়তো তরিতাই নাম ভাঁড়িয়ে এখানে এসে দেখা করেছিল সনকার সঙ্গে৷ অস্বাভাবিক কিছু নয়, হতেও পারে৷ যে মেয়ে গুজব রটিয়ে বাদাবনের সর্বত্র মনসার পুজো ছড়িয়ে দিতে পারে, সে ছদ্মবেশে এসে সনকাকে বোকা বানিয়ে যাবে, তাতে অবাক হওয়া কী আছে! চিন্তা করতে করতে চন্দ্রভানু নিশ্চিত হয়েছিলেন, এ তরিতারই কাজ৷ তবুও একটা খটকা তাঁর মনে থেকেই গিয়েছে৷ মনসার পুজো চালু করার পিছনে তরিতার স্বার্থটা কী? এর পিছনে কি কোনও ধর্মীয় উন্মাদনা আছে? নাকি কোনও ব্যবসায়িক স্বার্থ? সাপ নিয়ে মেয়েটার কারবার৷ একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয় আছে৷

ভানুমতির দেওয়া নম্বরে ফোন করেছিলেন চন্দ্রভানু৷ দু’বার রিঙ হওয়ার পরই ও প্রান্ত থেকে মহিলা কণ্ঠ শুনতে পেলেন, ‘বল ভানুমতি৷ পুজো কি শেষ হয়ে গিয়েছে?’

স্পিকার অন করে ফোনটা ভানুমতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চন্দ্রভানু ইঙ্গিত করেছিলেন, তুই কথা বল৷

কাঁপা কাঁপা গলায় ভানুমতি বলেছিল, ‘না৷ পুজো শেষ হয়নে৷ বড়বাবু এসে পুজোর ঘট নাথি মেরে উল্টে দিইচে৷ মা ঠাকুরণকে মারধর কইরেচে৷’

‘তাই নাকি? সনকা যে বলেছিল, চাঁদ থাকবে না৷ সে তো সোনাখালিতে?’

‘ছেল৷ আজ বিকেলে এয়েচে৷ বোধয় কেউ খপর দেচেল৷’

‘সনকা এখন কোথায়? দে, ফোনটা ওকে দে৷ ওর সঙ্গে আমি কথা বলব৷’

‘মা ঠাকুরণ একেনে নেই সাধুমা৷ ঘরে ঢুকে দোর দিইচে৷ আমার বড্ড ভয় নাগছে৷ বড়বাবু জানতি পারলি আমাকে মেইরে ফেলবে৷ বইলেচে, অজগরের পেটে দেবে৷’

‘শোন, শোন৷ তুই ভয় পাস না৷ মা মনসা সব সাপকে ডেকে বলে দেবেন, যাতে কেউ তোর ক্ষতি না করে৷ চাঁদ তোর কিসসু করতে পারবে না৷ ও যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, তা হলে মা মনসাই ওকে নির্বংশ করে দেবেন৷’

‘তুমি একন কোতায় সাধুমা?’

‘মহেশপুরে৷ এখানে ধুমধাম করে মা মনসার পুজো হচ্ছে৷ ফোনে কিছু শুনতে পাচ্ছিস? এই এখুনি মা মনসার পালাগান শুরু হল৷ কত্ত লোক বসে শুনছে! ভেবেছিলাম, লোক পাঠিয়ে সনকাকে এখেনে নিয়ে আসব৷ পালা শুনলে ওর ভাল লাগত৷’

‘আমার কী হবে সাধুমা?’

‘তোকে রক্ষা করার ভার মা মনসার৷’ বলেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে গিয়েছিল নেত্রা৷ তার পর বলেছিল, ‘শোন, স্বর্গ থেকে মা মনসা দেখতে পাচ্ছেন, চাঁদ তোর পাশে দাঁড়িয়েই সব শুনছে৷ ওকে বল, ওর যা সর্বনাশ করার, আজ রাতে তার অর্ধেকটা করে দেব৷ ওকে আমি পথের ভিখিরি করে ছাড়ব৷ আমাকে ও আটকাতে পারবে না৷’

ও দিক থেকে লাইন কেটে দেওয়ার শব্দ হল৷ ভানুমতির হাত কাঁপছে৷ চন্দ্রভানু নিজেও একটু অবাক৷ নেত্রা জানল কী করে, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছেন! নিছক অনুমান, নাকি সত্যিই দৈবীশক্তি? মনসাকে তিনি তাচ্ছিল্য করেন বটে, কিন্তু মনসা পালায় যে নেত্রা বলে একটা চরিত্র আছে, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন৷ এ কি সেই নেত্রা? কিন্তু, তা কী করে হবে? সে তো হাজার বছর আগেকার কথা৷ পালাগানের একটা চরিত্র কী করে এখন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে? পালাগানে তিনি শুনেছেন, মনসার পার্শ্বচরী হল নেত্রা৷ চাঁদ সওদাগরের বিরুদ্ধে যত কুটিল পরামর্শ, তারই দেওয়া৷ সেই পালাগানের গল্প, তাঁর জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কী করে? পালায় চাঁদ সওদাগর মনসার ঘট উল্টে দিয়েছিলেন৷ তিনিও চাঁদ… চন্দ্রভানু! তিনিও আজ মনসার ঘট লাথি মেরে উল্টে দিয়েছেন! কী আশ্চর্য মিল!

বারান্দায় পায়চারি করতে করতে সারা রাত্রি এ সব কথাই ভেবেছেন চন্দ্রভানু৷ তাঁর রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি নিঝুম হয়ে রয়েছে৷ হবে বা-ই না কেন? বাড়ির কর্ত্রী তাঁর ঘরে ঢুকে যে দোর বন্ধ করে দিয়েছে! সনকার কথা মনে হলেই রাগ হচ্ছে৷ অবাধ্যতার একটা সীমা আছে৷ ওর এমন কিছু করা উচিত হয়নি, যা চন্দ্রভানু পছন্দ করেন না৷ সংসার চালানোর ক্ষেত্রে তিনি কোনওদিন হস্তক্ষেপ করেননি৷ অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন, সনকার কোনও অভাবও রাখেননি৷ যখন যা চেয়েছে, এনে দিয়েছেন৷ সেই মানুষ স্বামীর ইচ্ছের মর্যাদা দেবে না কেন? স্বামীর অপমান হয়, এমন কাজ করবে কেন? এই সব ভাবার কারণেই তাকে মারধরের জন্য কোনও অনুতাপবোধ করছেন না চন্দ্রভানু৷

নানা কারণে তাঁর মন বিক্ষিপ্ত৷ কয়েক দিন আগে জগন্নাথ পণ্ডিত ঠিকই বলেছিলেন, দুর্দিন আসছে৷ চিন্তা করতে করতে চন্দ্রভানু হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, পিচখালি নদীতে তরিতা বলে মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই তাঁর জীবনে অশান্তির শুরু৷ নাতি জয়জিৎকে সাপে কাটা, বাগদা চিংড়ি নিয়ে জাপানি কোম্পানির আপত্তি, ঝড়খালিতে জমির মালিকদের গড়িমসি, ফার্ম হাউসে সাপের উৎপাত, মাঝে মোটর দুর্ঘটনা, আজ সনকার সঙ্গে দুর্ব্যবহার… একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে৷ আজ সকালেই বারুইপুরে যাওয়ার সময় দয়াশঙ্কর ফোন করেছিল৷ বলল, অনন্ত ওকে খবর দিয়েছে, মনসা মন্দিরের সমর্থনে দয়াপুর গ্রামের মেয়েরা মিছিল করেছে৷ এমিলিবাড়িতে পঞ্চায়েতের অফিসে গিয়ে মেয়েরা দাবি জানিয়েছে, মনসা মন্দির হবেই৷ কেউ তা আটকাতে পারবে না৷ চন্দ্রভানুকে সবথেকে বেশি পীড়া দিচ্ছে এই খবরটাই৷ সুন্দরবনে তাঁর কর্তৃত্বে ভাগ বসাচ্ছে তরিতা! এটাই তিনি সহ্য করতে পারছেন না৷

‘স্যার, মন্টু ভক্তা এসেছেন৷ এখানে নিয়ে আসব?’

পিছনে তাকিয়ে চন্দ্রভানু দেখলেন দয়াশঙ্কর৷ দোতলার বারান্দায় উঠে এসেছে৷ তাকে দেখেই জ্বলে উঠলেন চন্দ্রভানু৷ অপদার্থ কোথাকার৷ এত টাকা মাইনে দিয়ে এই লোকগুলোকে তিনি পুষছেন৷ অথচ কোনও কাজেই লাগে না৷ বাইরে থেকে একটা মেয়ে এসে সনকাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে গেল৷ কেউ তার খবরও পেল না? তিক্ত স্বরে চন্দ্রভানু বললেন, ‘জিজ্ঞেস করার কী আছে? যা, ওকে নিয়ে আয়৷’

দোতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়েই দাঁড়িয়েছিল মন্টু৷ সঙ্গেসঙ্গে বারান্দায় উঠে এসে বলল, ‘এ সব কী শুইনচি চাঁদ? পাগলের মতো তুই এ সব কী কইরেচিস?’

উত্তর না দিয়ে চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই এখেনে? তোর তো আসার কথা ছিল আজ দুপুরে৷’

‘কাল বিকেলে কাজ হয়ে গেচিল৷ ঝড়খালিতে থাকার প্রয়োজন ছেল না৷ তাই চলে এলুম৷’

‘ঝড়খালিতে জমি নিয়ে কোনও ফয়সালা হল?’

‘জমির কথা অ্যাখন থাক, চাঁদ৷ রেতে বাড়ি ফিরে ভানুমতির মুকে শুনলুম, তুই নাকি বউমণির গায়ে হাত তুইলেচিস? তোর এত দুর্মতি হল কী করে ভাই?’

অন্য কেউ হলে চন্দ্রভানু সঙ্গেসঙ্গে দাবড়ে দিতেন৷ কিন্তু, মন্টু তাঁর বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী৷ তাই খানিকটা অভিযোগ জানানোর সুরেই তিনি বললেন, ‘সে কী করেছে, জানিস?’

হাত তুলে থামিয়ে দিল মন্টু৷ তার পর বলল, ‘সব শুইনেচি৷ কিন্তু, তা’বলে মেইয়েচেলের গায়ে হাত দিবি? আমার সত্যবতী তোর সনে ছেনালি করত৷ আমি সব জানতুম৷ তা’বলে কুনওদিন তাকে মেইরেচি? তাকে কটু কতা কয়েচি? ছিঃ, চাঁদ, তোর সনে আর সম্পক্ক রাখব কিনা, আমাকে ভাইবতে হবে৷’

মন্টুর কথাগুলো শুনে চন্দ্রভানু থমকে গেলেন৷ সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা মন্টু জানত! মুখ দিয়ে আর কোনও কথা বেরল না৷ হাঁ করে তিনি মন্টুর দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ মানুষটা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি? বউ ব্যভিচারে লিপ্ত জানার পরেও এতদিন কেউ চুপ করে থাকতে পারে? চন্দ্রভানু জানেন, সনকাকে মন্টু খুব শ্রদ্ধা করে৷ বউমণি বলে ডাকে৷ ও মার খেয়েছে শুনে বোধহয় বাড়িতে থাকতে পারেনি৷ ভোরবেলাতেই ছুটে এসেছে৷ এই বিপদের সময়ে মন্টুর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না৷ তাই তিনি বললেন, ‘কাল মাথাটা খুব গরম হয়ে গিয়েছিল ভাই৷ নিজেকে সামলাতে পারিনি৷’

‘এটাই তো তোর দোষ, চাঁদ৷ আগুপিচু ভেবে কাজ করিস না৷ ভাব তো, মহেশ্বরজির কানে যদি কথাগুনো যায়, তা’লে কী হবে? মনে নেই, উনি কী বইলেচেলেন? যদ্দিন সনকা তোর কাছে থাইকবে, তদ্দিনই তোর বাড়বাড়ন্ত হবে৷ সেই পয়া মানুষটাকেই তুই সববার সামনে হতচ্ছেদ্দা করলি? ওই যে বলে না, বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ… সেটাই তোর হয়েছে৷ ঘোর দুর্দিন আসচে তোর৷ বুইঝতে পারচি৷’

মন্টু যা বলছে, ঠিক৷ ওর দিকে তাকাতেও ভরসা পেলেন না চন্দ্রভানু৷ নদীর দিকে মুখ ফেরালেন৷ খেয়া পারাপার শুরু হয়ে গিয়েছে৷ নদীর দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে৷ বাতাসের স্পর্শে এবার চন্দ্রভানু ক্লান্তি অনুভব করলেন৷ সারা রাত পেটে কিছু পড়েনি৷ উত্তেজনায় মদ্যপান করতেও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন ৷ গরম চা পেলে হয়তো ক্লান্তিটা কেটে যেত৷ কিন্তু, সনকা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেই-বা বোঝে তাঁর মনের কথা? কাল বিকেলে মারধরের ঘটনা না ঘটলে হয়তো দুই বন্ধুর জন্য চায়ের কাপ নিয়ে এতক্ষণে উঠে আসত সনকা৷ হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়াত৷ কথাটা ভেবে চন্দ্রভানু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ তার পর কয়েক পা হেঁটে গিয়ে বেডরুমে ঢুকলেন৷ অ্যাটাচড বাথরুম আছে, চোখ মুখে জলের ছিটে দেবেন৷

বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়েই চন্দ্রভানু দেখলেন, ট্রে-তে গরম চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হয়েছে ভানুমতি৷ ঘোমটার ফাঁক দিয়ে ও বলল, ‘মা ঠাকুরণ আপনাদের জন্যি চা পাট্টে দেছেন৷’

মন্টু জিজ্ঞেস করল, ‘উনি একন কোতায় ভানুমতি?’

‘রেডি হচ্ছেন৷ বাপের বাড়ি চলি যাবেন৷’

‘কার সনে যাচ্চেন বউ ঠাকুরণ?’

‘পাতানো ভাই ভাতকাপড় নে এয়েচে৷ ভাইয়ের সনে যাচ্চেন৷’

ভাতকাপড় মানে? সেই গুজব… সেই মনসা পুজো! শুনেই মেজাজ গরম হয়ে গেল চন্দ্রভানুর৷ তিনি বলেই ফেললেন, ‘শোন, তোর মা ঠাকুরণের কাছে গিয়ে বল, একবার যদি এ বাড়ি থেকে চলে যায়, তা হলে জীবনেও আর ঢুকতে পারবে না৷’

মন্টু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ফের তুই আবোল তাবোল বকচিস? চুপ কর, চাঁদ৷ যা বলার আমি বলচি৷ এই ভানুমতি শোন, তুই গে বল, এট্টু পরে আমি তাঁর কাচে যাচিচ৷ ততক্ষণ যেন উনি না যান৷’

ভানুমতি চলে যাওয়ার পর সোফায় বসে মন্টু বলল, ‘তোর সমস্যাটা কী বল তো চাঁদ? সোনাখালিতেও দেখলুম, তুই খুব ডিসটার্বড৷ ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে যাচিচস৷ তরিতা বলে মেয়াটার কথা মাতা থেকে সরিয়ে দে৷ না হলে তোর অবস্থাও দেখবি চাঁদ সওদাগরের মতো হবে৷’

কথাটা কাল রাতেও একবার মনে এসেছে চন্দ্রভানুর৷ মন্টুর মুখে সেই একই কথা শুনে তিনি চমকে উঠলেন৷

চায়ে চুমুক দেওয়ায় মেজাজটাও এখন শরিফ৷ মন্টু মনসার পালাগান নিয়ে অনেক কিছু জানে৷ তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাঁদ সওদাগরের মতো হবে, মানে?’

চায়ে চুমুক দিয়ে মন্টু বলল, ‘চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে মা মনসার ঝগড়া নেগেছিল কেন জানিস?’

‘শুনেছি৷ তবে অত মনে নেই৷’

‘শোন তা হলে, চান্দ অধিকারী ছেলেন শিবের কিংকর৷ শিব ছাড়া আর কাউকে তিনি পুজো করতেন না৷ একদিন দেবসভায় মা মনসা উপস্থিত আচেন৷ নাগভূষণা হয়ে… অর্থাৎ সারা অঙ্গে সাপের পোশাক পরে৷ এমন সময় চান্দ অধিকারী হঠাৎ সেখেনে হাজির৷ চান্দকে দেখে ভয় পেয়ে সাপেরা পাইলে গেল৷ ফলে মা মনসা নগ্ন হয়ে গেলেন৷ তখন রেগে মা মনসা শাপ দিলেন, ‘‘দেবতাদের সেবক হয়েও … আমাকে লজ্জিত করতে তোর একটু ভয় হল না রে? আজ থেকে তোর পতন হবে৷ তুই পৃতিবীতে গে মানুষের ঘরে জন্মাবি৷’’ শুনে চান্দ পাল্টা বললেন, ‘‘তুমি চঞ্চল প্রকৃতির৷ তাই সবসময় বিপরীত কাজ কইরে ফেল৷ তোমার জন্মের ঠিক নেই৷ তোমাকে মা উমা পছন্দ করেন না৷ স্বামীর সঙ্গেও তুমি এক রাত্তিরের বেশি থাকতে পারনি৷ বিনা দোষে তুমি কিন্তু আমায় শাপ দিলে৷ তোমার ভাল হবে না৷’’

চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘চান্দ অধিকারী সত্যি সত্যি এত কড়া কথা বললেন?’

‘হ্যাঁ৷ আরও বললেন, ‘‘আমি শিবের সেবক৷ তোমায় ভয় পাই না৷ ঠিক আছে, আমি মানুষের ঘরে জন্ম নেব৷ কিন্তু, তোমাকেও আমি শাপ দিচ্ছি৷ তুমি যত চেষ্টাই করো, আমি যতদিন না তোমার পুজো কইরব, ততদিন পৃতিবীতে তোমার পুজোর প্রচলন হবে না৷ তোমার সাপের গুষ্টি আমার ক্ষেতি কইরতে পাইরবে না৷ মহাদেবের কৃপায় আমি যোগবল জানি৷’’

‘তার পর কী হল?’

‘চান্দ অধিকারী পৃথিবীতে জন্ম নিলেন মানুষের ঘরে৷ তার পর থেকেই মা মনসার সঙ্গে তাঁর লড়াই শুরু৷ নানাভাবে মা মনসা চাঁদ সওদাগরের ক্ষেতি করার চেষ্টা কইরেছেন৷ তাঁর ছয় ছেলেকে মেরে ফেইলছেন৷ তাঁর সপ্তডিঙ্গা ডুবিয়ে দিইয়েছেন৷ তাও মা মনসা পুজো পাননি৷ শেষে ছেলের বউ বেউলার চেষ্টায় চাঁদ মা মনসার পুজো কইরলেন৷ তাও কী, বাঁ হাত দিয়ে ফুল ছুঁড়ে৷ মনসামঙ্গলের আখ্যান তো শুনলি৷ এ বার নিজের জীবনের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দ্যাখ তো? মিল খুঁজে পাস কি না?’

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে চন্দ্রভানু বললেন, ‘তুই কী বলতে চাইছিস মন্টু? এই তরিতা বলে মেয়েটা মনসার রূপ ধরে দয়াপুরে এসেছে? নদীতে নাইবার সময় ওর বুক দেখে ফেলেছি বলে আমার উপর রেগে আছে? কিন্তু, আমার দোষটা কোথায়? লঞ্চের ধাক্কায় ঢেউয়ে যদি ওর বুকের আঁচল খসে যায়, তা হলে আমি কী করতে পারি? আমি কি তখন জানতাম, ও নদীতে নাইতে নেমেছে?’

‘এত কতা তো তোকে আমি কইতে কইনি চাঁদ৷ তরিতা মেয়েটা গাঁয়ের নোককে মা মনসার পুজো করতে কইচে, তাতে তোর এত চুনকোনোর কী হল? বুকে হাত দিয়ে বল তো, মেয়েটাকে তুলে আনার জন্য তুই নোক পাঠাসনি? ওরা নেকাপড়া জানা আধুনিক মেয়ে৷ ওদের বুদ্ধির সনে তুই পেরে উঠবি?’

‘কিন্তু, মেয়েটা যে আমার ক্ষতি করার হুমকি দিচ্ছে মন্টু৷’

‘তুই হলি গে ব্যবসাদার মানুষ৷ তোর কী ক্ষেতি ও করবে? এত ছোটখাটো ব্যাপারে তুই যাবি কেন ভাই? তুই রিসর্ট নিয়ে ভাববি৷ মাচের ব্যবসা নিয়ে ভাববি৷ রায়দিঘিতে গে আজ শুনলুম, ইলিশের ঝাঁক আর মোহনায় পাওয়া যাচ্চে না৷ মহাজনদের সব ট্রলার খালি ফিরে আসচে৷ তোর উচিত, ছোট খোকাকে ডেকে নে এসে মাঝ সমুদ্দরে পাঠানো৷ তোর মতো এত পাওয়ারফুল ট্রলার আর কারও নেই৷ এই বেলা যদি সেখেন থেকে ইলিশ নে আসতে পারিস, তা হলে পুরো মার্কেটটা ক্যাপচার করতে পারবি৷’

কথার মাঝে টেবলের উপর রাখা মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করেছে৷ হাতে তুলে চন্দ্রভানু দেখলেন, সোনাখালি থেকে জয়ব্রত৷ সেটটা কানে দিতেই তিনি শুনতে পেলেন, ‘বাবা, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে৷ কাল রাতে হোগোল নদীর বাঁধ ভেঙেছে৷ ফার্ম হাউসে লোনা জল ঢুকে পড়েছে৷ এখনও হু হু করে জল ঢুকছে৷ কী হবে বাবা? বাগানে এখনই দেড় হাত জল৷ গাছগুলো যে সব মরে যাবে লোনা জলে!’

শুনে বিবশ হয়ে গেলেন চন্দ্রভানু৷ নেত্রার হুমকি মনে পড়ল৷ মেয়েটা বলেছিল, ‘চাঁদকে বল, ওর যা সর্বনাশ করার, আজ রাতে তার অর্ধেকটা করে দেব৷’

(ছাবিবশ)

বড় মায়ের শ্রাদ্ধের দিন কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে৷ স্মৃতির উদ্দেশ্যে৷ তার বয়ানটা লিখছিল পিঙ্কি বউদি৷ মুখ তুলে বলল, ‘অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছেন… কথাটা লিখেছি৷ ঠিক আছে তো ঠাকুরপো? লেখাটা আজই ফাইনাল করে ফেলব৷ তুমি একবার চোখ বুলিয়ে দিও৷’

কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আইডিয়াটা পিঙ্কি বউদির৷ রোজ কাগজ খুললেই সেকেন্ড পেজে এই ধরনের অ্যাড দেখা যায়৷ ছবি দিয়ে ছাপানোর জন্য কত টাকা লাগে অঙ্কুশের সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না৷ জয়কে ফোন করে ও জানতে চেয়েছিল৷ ও বলেছে, হাজার ছয়েক টাকার মতো লাগবে৷ শুনে পিঙ্কি বউদি রাজি হয়ে গিয়েছে, ‘ঠিক আছে, পুরো টাকাটাই আমি দিয়ে দেব৷ জয়ের অফিসে গিয়ে ছবি, লেখা আর টাকাটা দিয়ে আসা তোমার দায়িত্ব৷ ’

ছবির তলায় কী লেখা হবে, দু’দিন ধরে তারই মকশো চলছে বাড়িতে৷ বিজ্ঞাপনে বড়মা-র কোন ছবিটা যাবে, সেটা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি৷ পিঙ্কি বউদি প্রচুর আলোচনা করেছে এ নিয়ে৷ পুরনো ছবি দেবে, না কি কারেন্ট ছবি, তা নিয়ে ডিসিশন নিতে পারেনি৷ বউদির হঠাৎ মনে পড়েছে, মাসখানেক আগে উষসী একদিন শখ করে বাড়ির সবাইকার ছবি তুলেছিল৷ বড় মা-র ছবিটা নাকি ফ্যান্টাস্টিক হয়েছিল৷ সেই ছবিটা বড় জেঠামশাই কোন এক স্টুডিয়ো থেকে অনেক বড় সাইজের করে এনেছে৷ শ্রাদ্ধবাসরে সেই ছবিটাই রাখা হবে৷ ছবিটা জেঠামশাইয়ের জিম্মায় আছে৷ তাই দেখার সৌভাগ্য এখনও অঙ্কুশের হয়নি৷ তবে বাড়ির সবাই নাকি ধন্য ধন্য করেছে উষসীর৷ এমন জীবন্ত সেই ছবি, মডেলদের ফোটোগ্রাফাররাও নাকি তুলতে পারতেন না৷ পিঙ্কি বউদির মুখে অঙ্কুশ শুনেছে, বড় মা-র আরও একটা ভাল ছবি নাকি উষসীর কাছে রয়েছে৷ সেটাই খবরের কাগজে দেওয়া হবে৷

বড় মা-র শ্রাদ্ধ উপলক্ষে নানা জায়গা থেকে আত্মীয়স্বজনরা এসেছেন৷ খাটাখাটনি করার জন্য মহেশপুর থেকে চলে এসেছে গোলাপি আর ওর বাবা নিবারণ ও মা সন্ধ্যামাসি৷ বাগানের এক পাশে ম্যারাপ বাঁধার কাজ চলছে৷ সৌম্যদার বিয়ের পর বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হয়নি৷ জেঠামশাই আর কাকারা একটু ঘটা করেই শ্রাদ্ধের আয়োজন করছেন৷ সবাই কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত৷ শুধু অঙ্কুশই কোনও দায়িত্ব পায়নি৷ কাগজে এই বিজ্ঞাপন দেওয়ার কাজটা ছাড়া৷ হ্যাঁ, আরেকটা অকাজ অবশ্য ওকে করতে হচ্ছে৷ মাঝে মাঝে ওর পোষ্যপুত্তুরদের দেখানোর অকাজ৷ এক দল করে আত্মীয়স্বজন আসছেন৷ আর তাদের আবদার ওকে মেটাতে হচ্ছে, বাক্সের ডালা খুলে৷

পিঙ্কি বউদির লেখা শেষ হয়নি৷ সময় কাটানোর জন্য অঙ্কুশ ল্যাপটপটা নিয়ে বসল৷ দু’তিন দিন মেল খেলা হয়নি৷ গোটা পনেরো মেল এসে পড়ে রয়েছে৷ তার মধ্যে একটা বিরসার কাছ থেকে৷ ওপেন করতেই ও দেখল, বিরসা ঝড়খালির কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে৷ তার মধ্যে একটা পালান সরদারের সঙ্গে ওর৷ দেখেই টিটোকে ডাকার জন্য অঙ্কুশ উঠে দরজার কাছে গেল৷ ছবিটা টিটোকে দেখাতে হবে৷ ওর বয়সি পাঁচ ছ’জন ছেলে-মেয়ে এখন বাড়িতে৷ সবাই ওর তুতো ভাইবোন৷ ওদের সঙ্গে বেশ ভালই দিন কাটাচ্ছে টিটো৷ সারা দিনে ওর টিকিও দেখা যাচ্ছে না৷ দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে অঙ্কুশের চোখে পড়ল, বাগানে ভাইবোনদের পাখি চেনাচ্ছে টিটো৷ পাখির ডাক নকল করছে গাছতলায় দাঁড়িয়ে৷ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ওর শহুরে ভাইবোনেরা খুব আগ্রহের সঙ্গে পাখি চিনছে৷

তুরুকতোবা গাছের নীচে ওরা সবাই দাঁড়িয়ে৷ ওখানে লাউডগা সাপটা আছে৷ মুখ হাঁ করে যদি সাপটা তেড়ে আসে, তা হলে বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে যাবে৷ ওদের সরে যেতে বলবে কি না যখন ভাবছে, তখন দূর থেকেই অঙ্কুশ শুনতে পেল, টিটো বলছে, ‘ আমাদের বাড়ির পিছনের দিকে ওই যে ঝিলটা দেখছিস, ওখানে গেলে তোদের মাছরাঙা পাখি দেখাতে পারতাম৷ কী সুন্দর ওদের গায়ের কালার … দেখলে তাজ্জব হয়ে যাবি৷ সাদা-কালো, বেগুনি-কালো, হলুদ-নীল-লাল ফুটকি ফুটকি৷’

একজন জিজ্ঞেস করল, ‘ ইংরেজিতে এই পাখিগুলোকে কী বলে রে?’

টিটো বলল, ‘কিং ফিশার৷ চড়ুই পাখির থেকে সামান্য বড়৷ জলের ভিতরে ডাইভ দিয়ে মাছ তুলে খায়৷ ওদের অনেক রকম ভ্যারাইটি আছে৷ ঝিলের কাছে তোদের নিয়ে যেতাম৷ কিন্তু কুশকাকু আমায় বকবে৷ সবথেকে ভাল হয় যদি শীতের সময় আসিস৷ ঝিলে প্রচুর পাখি আসে৷ সারা বিলটা ভর্তি হয়ে যায় হাড়গিলা, মদনটাক আর লোহাজং পাখিতে৷ ইয়া বড় বড়৷’

‘ইংলিশ নামগুলো বল না রে? স্কুলে গিয়ে আন্টিকে বলব৷’

‘ইংরেজি নামগুলো আমি বলতে পারব না রে৷ কুশকাকু পারবে৷’

টিটোকে উদ্ধার করার জন্য দরজার গোড়া থেকেই অঙ্কুশ বলল, ‘ হাড়গিলার ইংরেজি হচ্ছে অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক৷ আর মদনটাক হল লেসার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক৷ লোহাজং হল ব্ল্যাকনেকড স্টর্ক৷ এরা সব বকজাতীয় প্রাণী৷ সব সুন্দরবন থেকে আসে৷’

অঙ্কুশকে দেখে বাচ্চাগুলো দৌড়ে এল৷ একজন জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াট ইজ সুন্দরবন, আঙ্কল?’

অঙ্কুশ বলল, ‘আস্ক মি হোয়ার ইজ সুন্দরবন৷ ইট’স ওয়ান হান্ড্রেড টোয়েন্টি কিলোমিটারস ফ্রম দিস প্লেস৷ দ্য বিগেস্ট ম্যানগ্রোভ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড৷’

টিটো আবদেরে গলায় বলল, ‘কুশকাকু, এদের সাপের স্লাইডগুলো দেখাবে? তা হলে এরা সাপ চিনে যাবে৷ জু ছাড়া নাকি এরা কেউ কোথাও সাপ দেখেনি৷’

সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘দেখান আঙ্কল, দেখান৷’ তখন ঘরের ভিতর থেকে পিঙ্কি বউদি বেরিয়ে এসে ধমক দিল, ‘এখন না৷ সন্ধের পর দেখাবে৷ যাও, কাকুকে এখন বিরক্ত কোরো না৷’

বাচ্চাগুলো হতাশ হয়ে বাগানের দিকে চলে যাওয়ার পর পিঙ্কি বউদি বলল, ‘বিজ্ঞাপনের লেখাটা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছে৷ জয়ের অফিসে তুমি কবে যেতে পারবে ঠাকুরপো?’

অঙ্কুশ বলল, ‘যবে তুমি বলবে৷ কিন্তু, ছবির কী হবে?’

‘মনে হয়, আজই উষসী দিয়ে যাবে৷ কাল না হয় জয়ের অফিসে যেও৷ শোনো, বিকেলে কিন্তু, বৈঠকখানায় সেই ইম্পরট্যান্ট মিটিংটা আছে৷ আজ কোথাও বেরিও না যেন৷’

উষসী আসবে শুনেই মনটা খুশিতে ভরে গেল অঙ্কুশের৷ বড়মা যেদিন মারা যান, তার পরদিন উষসী এ বাড়িতে এসেছিল৷ কিন্তু, সেদিন অঙ্কুশ এত মুষড়ে পড়েছিল যে, ওর সঙ্গে কথাই বলতে পারেনি৷ ঝড়খালি থেকে যখন ও পিয়ারাতে পৌঁছয়, তখন ডেডবডি নিয়ে সৌম্যদারা গড়িয়ার শ্মশানে চলে গিয়েছিল৷ বড় মাকে শেষ দেখাটাও অঙ্কুশ দেখতে পায়নি৷ এই আফসোস ওর জীবনেও যাবে না৷ বাড়ি ফিরে ও শুনেছিল, মারা যাওয়ার আগে বড়মা দু’বার জিজ্ঞেস করেছিল, কুশ কোথায়? দয়াপুরে গিয়েছে শুনে বড় জেঠার হাত ধরে তারপর নাকি বলেছিল, ‘ বাপ-মা হারা ছেলেটাকে তোরা দেখিস৷ রমা জানে, ওর জন্য একটা মেয়েকে আমি পছন্দ করে রেখেছিলুম৷ তার সঙ্গেই তোরা ওর বিয়ে দিস৷’

রমা মানে পিঙ্কি বউদি৷ বড়মায়ের শেষ ডায়লগগুলো অঙ্কুশের শোনা পিঙ্কি বউদির কাছ থেকে৷ দাহ করে ফিরে আসার পর নাকি বড় জেঠামশাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মেয়েটা কে?’

তারপর বড়দের মধ্যে আর কী কথা হয়েছে, অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করেনি৷ ও জানে, পিঙ্কি বউদির পেটে কোনও কথা থাকে না৷ শ্রাদ্ধশান্তি কেটে গেলেই সব উগরে দেবে৷ এখন আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে খুব ব্যস্ত৷ পিঙ্কি বউদির সবথেকে বেশি ভয় দুই পিসিকে নিয়ে৷ বড় পিসি কানাডায় থাকেন৷ ছোটজন নয়াদিল্লিতে৷ দুই পিসে খুব বড় চাকরি করেন৷ এঁই দুটো পরিবারের যাতে খাতির যত্নের কমতি না হয়, তার দায়িত্ব বড় জেঠামশাই দিয়েছেন পিঙ্কি বউদির উপর৷ আত্মীয়দের অনেককেই অঙ্কুশ অবশ্য চেনে না৷ মাঝে মাঝে তাদের ডেকে এনে পিঙ্কি বউদি ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে৷ একজন তো ওকে জড়িয়ে কেঁদেই ফেললেন সেদিন৷ ‘তুই রাজলক্ষীর ছেলে! আমি তোর নীলামাসি৷ তোর মা আমার সই ছেল৷ আমরা একই গাঁয়ে থাকতুম৷ অভাগী সাত তাড়াতাড়ি চলে গেল৷ ভাল মানুষ যে বেশিদিন বেঁচে থাকে না রে বাবা৷’

মায়ের নাম যে রাজলক্ষী সেটাই অঙ্কুশ জানত না৷ বাড়ির কেউ কোনওদিন ওকে ওর মায়ের কথা বলেনি৷ নীলামাসির কথা শুনে অঙ্কুশ ঠিক করে রেখেছিল, পরে মায়ের কথা বিশদ জানতে চাইবে৷ কিন্তু সেই সুযোগ পায়নি৷ কখন যে নীলামাসি চলে গেছিলেন, ও জানতেও পাবেনি৷ নীলামাসি যখন ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন মায়ের স্নেহ টের পাচ্ছিল ও৷ নীলামাসির কথাই অঙ্কুশ ভাবছিল৷ এমন সময় পিঙ্কি বউদি জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল, কথার উত্তর দিলে না যে?’

টিটো বলল, ‘কী কথার গো?’

‘বিকেলের দিকে তুমি ফ্রি থাকবে তো?’

‘বিকেলে কোন মিটিংয়ের কথা তুমি বলছিলে বউদি?’

শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল পিঙ্কি বউদি৷ নাত বউ, এতদিন ধরে অশৌচ পালন না করলেও চলে৷ তবুও, বড়মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই জেঠিমা-কাকিমাদের সঙ্গে সব নিয়ম মানছে পিঙ্কি বউদি৷ রঙিন শাড়ি পড়ছে না৷ চুল আঁচড়াচ্ছে না৷ সিঁদূর দিচ্ছে না৷ কেমন যেন যোগিনী টাইপের চেহারা হয়ে গিয়েছে৷ তাতেও, অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে৷ ঘাড় ঘুরিয়ে বউদি বলল, ‘সে কী! সৌম্য তোমাকে কিছু বলেনি? বাপী যে তোমাকে জানিয়ে দিতে বলেছিল! সত্যি, তোমার দাদার যা ভুলো মন হয়েছে, বলার না৷’

‘মিটিংটা কী নিয়ে বউদি? আমাকেই বা থাকতে হবে কেন?’

‘বড় মা সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়ে গিয়েছেন৷ সবার সামনে সেই উইল আজ পড়া হবে৷ বারুইপুর থেকে ল’ইয়ার দেবাংশুবাবু আসছেন৷ তিনিই সবাইকে থাকতে বলেছেন৷’

‘উরি বাস, সেই বিদ্যাসাগরবাবু! তা হলে তো আমাদের সন্ধেটা আজ গেল! উইল পড়ার আগে… উইল প্রথা কবে থেকে শুরু হয়েছিল, ভদ্রলোক সেই বক্তৃতা দিতে থাকবেন৷ আর শেষ করবেন প্রোবেট করার জন্য ওঁকে কতটা দরকার, তা দিয়ে৷ আমি বাবা এর মধ্যে নেই৷ গতবার পুজোর সময় মা দুর্গার পুরো উপাখ্যানটা শুনতে হয়েছিল আমাকে৷ শেষে টিটো বুদ্ধি করে আমায় বাঁচায়৷’

শুনে খিলখিল করে হাসতে লাগল পিঙ্কি বউদি৷ তারপর বোধহয় মনে হল, শোকের বাড়িতে এত হাসাহাসি করতে নেই৷ আত্মীয়দের কারও চোখে পড়লে, বাঁকা চোখে তাকাবে৷ চট করে হাসি থামিয়ে বউদি বলল, ‘যা বলেছ, ঠিক৷ সৌম্যও ভদ্রলোকের কাছে ভিড়তে চায় না৷ তবে, আজ বোধহয় উনি জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ পাবেন না৷ বড়রা মিটিংয়ে থাকবেন৷ মনে হয়, কাজের কথাই হবে৷’

‘এই মিটিংটা তো শ্রাদ্ধের পরেও করা যেতে পারত বউদি৷ সাত তাড়াতাড়ি করার কী দরকার ছিল?’

‘তোমার বড় পিসিমার জন্যই করতে হল ভাই৷ শ্রাদ্ধের পরদিন সকালে ওদের কানাডা ফেরার ফ্লাইট৷ রাতে ওরা কলকাতার কোনও হোটেলে গিয়ে থাকবেন৷ পরে সময় পাওয়া যাবে না৷ সেই কারণেই মিটিংটা আজ করে নিতে হচ্ছে৷’

 ‘কিন্তু আমি আদার ব্যাপারী, আমার কী দরকার জাহাজের খোঁজ করার?’

‘তা বললে তো চলবে না ভাই৷ তোমার হিস্যা তোমাকে বুঝে নিতে হবে৷ আমার খালি ভয় করছে, এই সম্পত্তি ভাগাভাগির পর যেন বাড়ির সবার মুড ভাল থাকে৷ সম্পত্তি খুব খারাপ জিনিস৷ বাপের বাড়িতে ভাগাভাগি হওয়ার পর তা একবার টের পেয়েছি৷ ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷’

‘এখানেও সে রকম সম্ভাবনা আছে না কি?’

‘হতেও পারে৷ তোমার দুই পিসি অলরেডি গুজগুজ শুরু করে দিয়েছেন৷ যাক গে, এ সব নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না ভাই৷ সুবোধ বালকের মতো একটু রেস্ট নাও৷’ কথাগুলো বলে পিঙ্কি বউদি পা বাড়াল বাড়ির দিকে৷

দুপুরে ঘুমনোর অভ্যেস নেই অঙ্কুশের৷ সাপ সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখার থাকলে, এই সময়টায় ও লিখে ফেলে৷ অথবা ল্যাপটপ খুলে বসে৷ কখনও কখনও অ্যানিমেল প্ল্যানেট বা ডিসকভারি চ্যানেল দেখে৷ অন্য কোনও কাজ নেই দেখে আজ দরজা ভেজিয়ে রেখে, সোফায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল অঙ্কুশ৷ পিঙ্কি বউদির ওই কথাটাই ওর মাথায় ঘুরতে লাগল৷ ‘সম্পত্তি ভাগাভাগির পর যেন বাড়ির সবার মুড ভাল থাকে৷’ সম্পত্তি ভাগাভাগির ভূত বড় মা-র মাথায় চাপল কেন, অঙ্কুশ সেটাই বুঝতে পারল না৷ এ বাড়িতে কারও সঙ্গে কারও মনোমালিন্য নেই৷ ওদের বিরাট যৌথ পরিবারে বড় মা-ই ছিলেন শেষ কথা৷ উনি যা বলতেন, মুখ বুজে সবাই তা মেনে নিত৷ সেই দায়িত্বটা এসে পড়ল বড় জেঠার উপর৷

তা হলে ভাগাভাগি কেন? বড় মা কি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিয়ে অশান্তি হতে পারে? অঙ্কুশ অবশ্য সম্পত্তি নিয়ে কোনওদিন মাথা ঘামায়নি৷ তবে শুনেছে, ওর ঠাকুর্দার বাবা স্যার সদাশিব মিত্র প্রচুর সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন৷ ঠাকুর্দা ছিলেন বাউন্ডুলে টাইপের৷ সেই কারণে স্যার সদাশিব সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান ঠাকুরমা অর্থাৎ বড়মায়ের নামে৷ সেই সুবাদেই বড়মা জানতেন, ওদের কোথায় কী আছে৷ মাঝে মাঝে নায়েবরা খেতের ফসল দিতে আসেন৷ সে ফসলের পরিমাণ এত যে, সারা বছর চাল, আলু আর সবজি ওদের কিনতেই হয় না৷ সব হিসেব রাখতেন বড়মা আর বড়কাকা৷

বড়মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে অঙ্কুশ ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ ওর ঘুম ভাঙল টিটোর ডাকে, ‘কুশকাকু, ওঠো৷ মা তোমাকে বড়বাড়িতে যেতে বলছে৷ বৈঠকখানায় সবাই বসে আছে, তোমার জন্য৷’

ধড়মড় করে অঙ্কুশ সোফা থেকে উঠে পড়ল৷ দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও দেখল, ছ’টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি৷ বাপস, প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টা টানা ঘুমিয়েছে! চোখ-মুখে জল দিয়ে তাড়াতাড়ি ও পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিল৷ পা চালিয়ে বৈঠকখানায় পৌঁছে অঙ্কুশ দেখল, উকিল দেবাংশুবাবু মধ্যমণি হয়ে বসে রয়েছেন৷ তাঁর চার পাশে ওর নিকটাত্মীয়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে৷ বসার জায়গা না পেয়ে অঙ্কুশ এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওর দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে, টেবলের উপর রাখা অ্যাটাচি কেস খুলে এক তাড়া কোর্টের কাগজ বের করে আনলেন দেবাংশুবাবু৷

তারপর বলতে লাগলেন, ‘এই লেটেস্ট উইলটা শ্রীমতী সুরভি মিত্র করেছিলেন দু’হাজার দশ সালের বারোই নভেম্বর৷ তার সপ্তাহ দুয়েক আগে আমাকে ফোন করে উনি বললেন, প্লিজ একবার আসবেন৷ আমি নতুন উইল করতে চাই৷ নিয়ম হচ্ছে, আগের উইল যদি কেউ বাতিল করতে চান, তা হলে নতুন উইল কেন করছেন, তার কারণ দর্শাতে হয়৷ তবে আইনের ফাঁকও আছে৷ কেউ যদি নিজের হাতে নতুন উইল লেখেন, তা হলে পুরনো উইল বদলানোর কারণ জানাতে হয় না৷ সেক্ষেত্রে, তার হাতের লেখাটাই যথেষ্ট৷ আর তা প্রমাণ করে, তিনি স্বেচ্ছায় উইল বদলাচ্ছেন৷’

এই পর্যন্ত শুনেই অঙ্কুশ একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল৷ ছ’টা বেজে পঁচিশ৷ প্রায় একশো বছরের পুরনো ঘড়ি৷ ব্রিটিশ আমলের ইস্ট অ্যান্ড ওয়াচ কোম্পানির৷ স্যার সদাশিবের কিনে আনা৷ এখনও নিখুঁত সময় দেয়৷ এক সেকেন্ডও এ দিক ও দিক হয় না৷ সময়টা দেখে রেখে অঙ্কুশ এ বার পিঙ্কি বউদির দিকে তাকাল৷ জেঠিমার ঠিক পিছনে ঘোমটা দিয়ে বসে রয়েছে৷ মাথাটা মেঝের দিকে ঝোঁকানো৷ অঙ্কুশ নিশ্চিত, চোখাচোখি হলে হেসে ফেলবে, সেই ভয়ে পিঙ্কি বউদি মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ ওর মতো পিঙ্কি বউদিও নিশ্চয় ভাবছে, বিদ্যাসাগরবাবু যদি এইভাবে উইল পড়াটা চালিয়ে যান, তা হলে রাত এগারোটার আগে শেষ করা অসম্ভব৷

ও ফের দেবাংশুবাবুর দিকে তাকাল৷ ভদ্রলোক বলছেন, ‘আপনাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, প্রয়াত সুরভি মিত্র তাঁর উইল বদলালেন কেন? আগের উইলে কী ছিল, সে সম্পর্কেও নিশ্চয় আপনাদের মনে কৌতূহল জাগছে৷ দুঃখিত, সেই উইল সম্পর্কে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব না৷ আগের উইলটা রেজেস্ট্রি করা ছিল না৷ হয়তো সেই উইল বদলে প্রয়াত সুরভি মিত্র ভালই করেছেন৷ তবে উইল বদল করার কারণটা উনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন৷ সেটা হল এই…’

বড় কাকার ধৈর্য বরাবরই কম৷ দেবাংশুবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বড় কাকা বলল, ‘আমাদের অন্য কোনও ব্যাপারে ইন্টারেস্ট নেই৷ আমাদের কার ভাগে মা কী দিয়ে গিয়েছে, আপনি সংক্ষেপে সেটাই বলে দিন৷’

বড়কাকার কথা শুনে দেবাংশুবাবু একটু থতমত খেয়ে গেলেন৷ তারপর বললেন, ‘তার আগে বরং শুনে নিন, প্রয়াত সুরভি মিত্র স্থাবর, অস্থাবর কত সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন৷ প্রায় দু’শো ভরির বেশি সোনার গহনা৷ চার পুত্রবধূ আর দুই কন্যার… প্রত্যেককে উনি দিয়ে গিয়েছেন তিরিশ ভরি করে৷ চার পুত্রবধূর মধ্যে একজন জীবিত নেই৷ সেই অংশটি পাবেন, তাঁর পুত্র শ্রীমান অঙ্কুশ মিত্র৷ পৌত্রবধূ মনোরমা মিত্র ওরফে পিঙ্কি মিত্রকে উনি দিয়েছেন দশ ভরি সোনা৷ আপনাদের বড়মা বাঁটোয়ারার কাজটা নিজেই করে গিয়েছেন৷ পারিবারিক সিন্ধুকে উনি আলাদা আলাদা নাম লেখা পুঁটলিতে উনি সব ভরে রেখেছেন৷ ফলে আমার পক্ষে কাজটা খুব সুবিধের হয়ে গিয়েছে৷’

কথাগুলো বলেই দেবাংশুবাবু একটু চুপ করে উইলে চোখ বোলাতে লাগলেন৷ তারপর বললেন, ‘সরি, আর একটা ক্লজও আছে৷ প্রয়াত সুরভি মিত্র লিখে গিয়েছেন, দশভরির একটা নবরত্ন হার উনি উপহার হিসেবে রেখে গিয়েছেন অঙ্কুশ মিত্রের হবু স্ত্রীর জন্য৷ এই হারটি ন’টি রত্ন দিয়ে গড়া৷ উনি পেয়েছিলেন ওঁর শাশুড়ি মাতার কাছ থেকে৷ হারটি উনি সিন্দুকে রেখে যাননি৷ সেটি রয়েছে বারুইপুরের স্টেট ব্যাঙ্কের একটি ভল্টে৷ তার কাগজপত্র রয়েছে আমার কাছে৷ অঙ্কুশ মিত্রর হাতে আমি তা তুলে দিতে চাই৷’

শুনে চমকে উঠল অঙ্কুশ৷ সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ বড়পিসির দিকে চোখ পড়তেই ও টের পেল, রাগে পিসির মুখ থমথম করছে৷ চোখ সরিয়ে ও পিঙ্কি বউদির দিকে তাকাল৷ মিটিমিটি হাসছে৷ সেই সময় জেঠামশাই ওকে বললেন, ‘কুশ, এগিয়ে আয় বাবা৷ ডকুমেন্টটা নিয়ে যা৷’

ভিড়ের মাঝখান দিয়ে দেবাংশুবাবুর কাছে গিয়ে অঙ্কুশ খামটা নিয়ে ফিরছে৷ এমন সময় উনি বললেন, ‘দাঁড়ান অঙ্কুশবাবু৷ আপনার জন্য আরও একটা দলিল আছে৷ সাউথ চবিবশ পরগনার সাতজেলিয়াতে আপনাদের কিছু জমি আছে৷ গ্রামটার নাম দয়াপুর৷ প্রয়াত সুরভি মিত্র দয়াপুরের পুরো জমিটাই আপনাকে দিয়ে গিয়েছেন৷ প্রায় তিরিশ বিঘা জমি৷ এই নিন তার দলিল৷ পরে প্রবেট করে নেবেন৷’

দলিলটা হাতে নিয়ে অঙ্কুশের মাথা ঘুলিয়ে গেল৷ এই খেতি জমি নিয়ে ও কী করবে, ঠিক বুঝতে পারল না!

তখনই ওর চোখে পড়ল, বড়কাকা বড় বড় পা ফেলে বৈঠকখানা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন৷

(সাতাশ)

ভোরবেলায় প্রাণায়াম করছিলেন তরিতা৷ এমন সময় দরজায় টকটক শব্দ৷ ‘দিদি, আসব?’

নেত্রার গলা শুনে কপালভাতি বন্ধ করে তরিতা বললেন, ‘আয়৷’

এত ভোরে নেত্রার কী দরকার পড়ল, তরিতা বুঝে উঠতে পারলেন না৷ কাল অনেক রাত পর্যন্ত ও টেনশনের মধ্যে ছিল৷ বিকেলে ঝড়-জলের মধ্যেই পাঁচ ছ’জনের একটা দলকে পাঠিয়েছিল সোনাখালিতে৷ চন্দ্রভানুর ফার্ম হাউসের সর্বনাশ করার জন্য৷ রাত্তির বারোটার সময়ও তাদের কাছ থেকে খবর পায়নি, হোগোল নদীর বাঁধ কেটে দিতে পেরেছে কি না৷ ঘণ্টাখানেক পর মোবাইলে খবরটা পেয়ে জানিয়ে গিয়েছিল, অপারেশন সাকসেসফুল৷ লোনা জল ঢুকে ফার্ম হাউস ভাসিয়ে দিয়েছে৷ শুনে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান তরিতা ৷ যাক, চন্দ্রভানুকে তা হলে একটা শিক্ষা দেওয়া গেল৷

কিন্তু, মাঝের এই ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে এমন কী হল যে, নেত্রা কথা বলতে এল? সোনাখালিতে ওর লোকেরা কি ধরা পড়ে গিয়েছে? তা হলে তো কেলেংকারির একশেষ৷ নদীর জল গাঁয়ের ভিতর ঢুকে পড়েনি তো? যদি ঢোকে, চাষের জমির ক্ষতি হয়ে যাবে৷ আয়লার সময় যা হয়েছে৷ এই সময়টায় ধান গাছ জলের এক হাত উপরে থাকে৷ নদীর লোনা জলে পুরো ডুবে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে৷ প্রাণায়াম করার সময় ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে রাখেন তরিতা৷ নেত্রা ঘরের ভিতরে ঢুকে এসে বলল, ‘ওদিক থেকে নতুন কোনও খবর নেই দিদি৷ কিন্তু, এদিকে শোভা ফোন করেছিল৷’

‘এত সকালে? অনন্তর কিছু হয়েছে বুঝি?’

‘হ্যাঁ দিদি৷ ওকে সাপে কামড়েছে৷ ’

শুনে তরিতা ব্যঙ্গের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত সকালে সাপে কামড়াল কীভাবে?’

‘ঘুম চোখে মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল৷ তখনই ছোবল মারে৷ শোভা বলল, ও নাকি নিজের চোখে সাপটাকে দেখেওছে৷’

শুনে তরিতা চুপ করে রইলেন৷ অনন্তটা খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল৷ শোভার গায়ে হাত তোলার অপরাধ তো আছেই, কাল দুপুরে শোভার নতুন মোবাইল সেটটা নাকি ভাঙতে গিয়েছিল৷ ল্যাব তৈরির কাজে যারা সাহায্য করছে, তাদের পাঁচজনকে একটা করে মোবাইল সেট আর সাইকেল কিনে দিয়েছেন তরিতা৷ শোভার হাতে নতুন মোবাইল দেখে অনন্ত নাকি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর কোন ভাতার এটা কিনে দিয়েছে?’ প্রশ্ন করার ধরনে চটে গিয়েছিল শোভা৷ তাই কোনও উত্তর দেয়নি৷ তখনই অনন্ত ওর হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নেয়৷ কিন্তু, শোভা ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ের জোরে মোবাইল সেট উদ্ধার করে৷ এই খবরটা শোভা অবশ্য দেয়নি৷ ওর শাউড়ি বাসন্তী রিসর্টে এসে বলে গিয়েছে৷

তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী সাপ কামড়েছে, শোভা কিছু বলল?’

‘না, বলেনি৷ বোধহয় লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছে ওদের বাড়িতে৷ কেননা, হারাণের বউ মালতীও একটু আগে আমাকে ফোন করে বলল, মাকে বলো, অনন্তকে যেন বাঁচিয়ে দেয়৷’

‘কী করা উচিত বল তো নেত্রা?’

‘আমার মনে হয়, তোমার এখনই শোভার বাড়িতে যাওয়া উচিত৷ তোমাকে এখনই কিছু করতে হবে না৷ রগড়টা নিজের চোখে দেখবে চলো৷ পরে না হয় আমরা ম্যাজিক দেখাব৷’

‘চল তা হলে৷ বলাই কি মেশিনভ্যান নিয়ে এসেছে?’

‘হ্যাঁ দিদি৷ ওকে খবর দিয়েছি৷ এতক্ষণে বোধহয় এসে গিয়েছে৷’

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে হালকা প্রসাধন সেরে নিলেন তরিতা৷ তার পর বাইরে বেরিয়ে এলেন৷ ইদানীং জমির ব্যাপারে কথাবার্তা বলার জন্য তাঁকে এ দিক সেদিক যেতে হচ্ছে৷ জমির মালিকরা থাকেন এদিকে জেমসপুর থেকে ওদিকে লাক্সবাগান পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে৷ যাতায়াতের জন্য সবসময় রাস্তায় মেশিনভ্যান পাওয়া যায় না৷ তাই, বলাইয়ের মেশিনভ্যান ভাড়া নিয়েছেন তরিতা৷ সাইকেলভ্যানের সঙ্গে মেশিন লাগানো গাড়ি৷ দরকার পড়লে চট করে এখন ওকে পাওয়া যায়৷ বাইরে বেরিয়ে তরিতা দেখলেন, গাড়ি নিয়ে বলাই অপেক্ষা করছে৷ নেত্রাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মেশিনভ্যানে উঠে পড়লেন৷

বলাই ছেলেটা খুব সহজ সরল৷ চবিবশ-পঁচিশ বছর বয়স৷ ক্লাস টেন পাস৷ এই সেই ছেলেটা যে, শোভাকে নিয়ে গোসাবা হাসপাতালে গিয়েছিল৷ অনন্তর হুমকি সত্ত্বেও ভয় পায়নি৷ ছেলেটার সব ভাল, কিন্তু বকবক করে৷ খবরটা শুনেছে নেত্রার কাছ থেকে৷ মেশিন চালু করে দিয়েই ও বলল, ‘সাপে কেটেচে, বেশ হয়েচে৷ অমন নোকের মরাই ভাল৷ তোমরা কিন্তু ওকে গোসাবায় নে যেতে বলুনিমা ঠাকুরখ৷’

তরিতা বললেন, ‘না, না৷ আগে তুই শোভাদিদির বাড়ি চল৷’

নেত্রা জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ রে বলাই, বিষ্ণুপদ কবিরাজ কোথায় থাকে, তুই জানিস?’

‘সি তো সেই সুধাংশুপুরে৷ পেরায় আধ ঘণ্টা নেগে যাবে৷ আগে একবার গেসলুম৷ তেনার বাড়িতে মস্ত বড় একটা নাটমন্দির আচে মা৷ সেখেনে পনেরো-কুড়ি হাত করে উঁচু এক একটা ঠাকুর৷ তার মধ্যি সাদা রঙের একটা মনসা ঠাকুরও আচেন৷ তাঁর চালায় একশো আটটা সাপ৷’

কথাটা শুনে নেত্রার দিকে আড়চোখে তাকালেন তরিতা৷ মনসা ঠাকুরের গায়ের রঙ সাদা হয় না৷ বিষ্ণুপদ কবিরাজ তার মানে পূর্ববাংলার দিককার লোক নন৷ এই অঞ্চলেরই মানুষ৷ তিনি মনসাভক্ত শুনে প্রসন্ন হলেন তরিতা৷ বিষ্ণুপদ কবিরাজ নাকি এই অঞ্চলে ধন্বন্তরী৷ সাপে কাটা মানুষদের সারিয়ে তুলতে পারেন৷ তরিতার অনেকদিনের ইচ্ছে, তিনি একবার সুধাংশুপুরে যাবেন৷ গিয়ে দেখে আসবেন, কবিরাজ সত্যিসত্যি মায়ের ভক্ত কি না? নাকি সাপে কাটা রোগী টানার জন্য মা মনসার মূর্তি বসিয়েছে! আজ সেই সুযোগ পাওয়া গেল৷ বলাইকে বললেন, ‘শোভাদিদির বরকে নিয়ে তোকে কিন্তু সুধাংশুপুর যেতে হতে পারে৷’

কথাটা মনঃপুত হল না বলাইয়ের৷ শোভাকে ও দিদি বলে ডাকে৷ তাই অনন্তকে পছন্দ করে না৷ ও চুপ করে গেল৷ দয়াপুর বাজারের খানিকটা আগে খালধারে শোভাদের বাড়ি৷ মনসা পালাগানের দিন একবার ওদিকে গিয়েছিলেন তরিতা৷ টাইগার ক্যাম্প রিসর্ট থেকে খুব বেশি দূরে নয়৷ মিনিট সাতেকের মধ্যে শোভার বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে তরিতা দেখলেন, আশপাশের অনেক লোক জুটে গিয়েছে৷ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ভিতর থেকে৷ শুনেই তিনি বুঝতে পারলেন, বিলাপ করছে বাসন্তী৷ মা মনসার কোপে পড়েছে ছেলে৷ মনসা পুজোয় বাধা দিয়ে কেন পাপ করতে গেল, ইনিয়ে বিনিয়ে সে কথাই বলছে৷ বেড়া সরিয়ে তরিতা উঠোনে ঢুকতেই বাসন্তী দৌড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরল৷ ‘মা, তুমি বাঁচাও আমার ছাবালকে৷’

দাওয়ায় চুপচাপ বসে আছে শোভা বাচ্চাটাকে কোলে করে৷ ওর সামনে দাঁড়িয়ে- বসে কয়েকটা লোক৷ তাদের মধ্যে হারাণকে চিনতে পারলেন তরিতা৷ দেখতে পেয়ে সেও ভয়ে হাতজোড় করে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ দাওয়ার অন্য প্রান্তে একটা খাটিয়ায় শুয়ে অনন্ত উঃ আঃ করছে৷ ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে৷ কাছে গিয়ে তরিতা বললেন, ‘কোথায় কামড়েছে, দেখি৷’

খাটিয়ায় উঠে বসে অনন্ত পায়জামা তুলে দেখাল৷ ডান পায়ের ডিমের কাছে সমান্তরাল দুটো দাগ৷ সাপের দাঁত ফোটানোর চিহ্ন বলে মনে হল না তরিতার৷ দাগ দেখে অবশ্য কারও পক্ষে বোঝা খুব কঠিন৷ সাপে কাটার ঘটনা দিনের আলোয় খুব কমই ঘটে৷ শতকরা নববইভাগ সাপ কামড়ায় সন্ধে থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত৷ ঘটনাটাও এমন আকস্মিক ঘটে যে, আক্রান্ত মানুষ দেখার সময়ও পায় না, কোন প্রজাতির সাপ তাকে আক্রমণ করেছে৷ রোগীর মধ্যে কয়েকটা লক্ষখ দেখে অবশ্য আন্দাজ করা যেতে পারে৷ যেমন, চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসছে কি না৷ শরীরে ঝিমুনি বা কথায় জড়তা বোঝা যাচ্ছে কি না৷ মুখ দিয়ে লালা বেরতেও পারে৷ খুব বিষাক্ত সাপ পায়ে কামড়ালে, পা অবশও হয়ে যেতে পারে৷ ভাল করে অনন্তকে দেখে, এই সবের কোনও লক্ষণই তরিতা টের পেলেন না৷ এমনিতে সুন্দরবনে বিষাক্ত সাপের সংখ্যা কম৷ শতকরা বিরানববই ভাগ সাপেরই বিষ নেই৷ তবুও, নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না৷ লক্ষণগুলো সবার ক্ষেত্রে একই রকমভাবে প্রকাশ পায় না৷ সেটা নির্ভর করে, সাপ যাকে কামড়েছে, তার শরীর কতটা মজবুত, অনেকটাই তার উপর৷ সেইসঙ্গে সাপ কতটা পরিমাখ বিষ খেলেছে, সেটাও বিবেচ্য৷

অনন্তর হাঁটুর নীচে কেউ শক্ত বাঁধন দিয়েছে দড়ির৷ সাপে কামড়ালে বাঁধন দেওয়া একেবারেই উচিত না৷ কিন্তু লোকে বিশ্বাস করে, বাঁধন দিলে বিষ মাথায় উঠে না৷ অন্য কেউ হলে দড়ির বাঁধন তরিতা নিজেই খুলে দিতেন৷ কিন্তু, লোকটা অনন্ত৷ পরে খারাপ কিছু হলে হারাণরা বলে বেরাবে, বাঁধন খুলে তিনিই অনন্তকে মেরে ফেলেছেন৷ তখন গাঁয়ে থাকা কঠিন হয়ে যাবে৷ চেন্নাইয়ে থাকার সময় স্নেক বাইটিংয়ের প্রচুর কেস দেখেছেন তরিতা৷ স্নেক ইনস্টিটিউটে রোজ পাঁচ-সাতটা করে রোগী আসত৷ ওখানে ল্যাবরেটরিতে প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট করলেই তাঁরা বুঝতে পারতেন, রোগীকে সত্যিই বিষধর সাপ কামড়েছে কি না৷ রোগীর শরীর থেকে রক্ত বের করে টিউবে রেখে দিলে, মিনিট কুড়ির মধ্যে রেজাল্ট পাওয়া যেত৷ রক্ত জমাট বেঁধে গেলে তাঁরা নিশ্চিত হয়ে যেতেন, হিমোটক্সিক ম্যানিফেস্টেশন শুরু হয়ে গিয়েছে৷ দয়াপুরে তো সেটা করা সম্ভব না৷ তাই শোভাকে তিনি বললেন, ‘অনন্ত নাকি বিষ্ণুপদ কবিরাজের কাছে যেতে চাইছে? ওকে শিগগির মেশিন ভ্যানে তুলে দিতে বল৷ ট্রিটমেন্টে দেরি হলে কিন্তু বাঁচানো যাবে না৷’

ধরাধরি করে ভ্যানের মাঝখানে অনন্তকে শুইয়ে দিল গাঁয়ের লোকেরা৷ ওর দু’পাশে বসে পড়ল শোভা আর হারাণ৷ সামনের দিকে বসেছেন তরিতা ও নেত্রা৷ পিছনের দিকে মালতী আর বাসন্তী৷ ইটের সরু রাস্তা দিয়ে মেশিন ভ্যান ছুটল সুধাংশুপুরের দিকে৷ রাস্তার কোথাও ইট ভাঙাচোরা৷ কোথাও প্রবল বর্ষণে ইট আলগা হয়ে গিয়েছে৷ মেশিন ভ্যান খুব লাফাচ্ছে৷ ইটের রাস্তা ফুরিয়ে পিচের রাস্তা এল৷ লম্বা লম্বা খেতের জমির পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বলাই একটার পর একটা বাঁক নিচ্ছে৷ রাস্তা আর ফুরোয় না৷ দয়াপুর গ্রামটা কত বড়, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই তরিতার৷ বলাই এমনভাবে বলেছিল যেন,খুব কাছেই সুধাংশুপুর৷হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার লিখন মেটে বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে৷ রিসর্টের বাইরে এই প্রথম দয়াপুরকে চেনার চেষ্টা করছেন তরিতা৷

একটা জায়গায় দেখলেন, লেখা আছে— ‘এখানে হেড়োভাঙা খাল সংস্কারের কাজ চলছে’৷ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল, ধারে-কাছে কোথাও একটা বড় জমির সন্ধান দিয়েছিল এক দালাল৷ মালিকরা থাকেন সোনারপুরের কাছে পিয়ারা বলে কোনও গ্রামে৷ সেই জমিতে চাষ হয় না৷ ফাঁকাই পড়ে আছে৷ দয়াপুরের ওই অঞ্চলে লোক বসতি কম৷ এভিএস ল্যাব-এর জন্য ওই জায়গাটা পেলে খুব ভাল হত৷ ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন তরিতা৷ নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হারাণ, মন্দির আর কতদূর?’

‘এইসে পড়েচি মা৷ হুই যে ইসকুল বিল্ডিংটা দেকচেন৷ ওটা এমসি ইসকুল৷ ঠিক তার এট্টু দূরেই কোবরেজ মশাইয়ের মন্দির৷’

প্রায় আধ ঘণ্টা পর গন্তব্যে পৌঁছল বলাই৷ স্কুলের পাশ দিয়ে নাবাল রাস্তায় নেমে খানিকটা দূরে কবিরাজের মন্দির আর বাড়ি পাশাপাশি৷ রাস্তা থেকেই নাটমন্দির চোখে পড়ল তরিতার৷ বলাই ঠিকই বলেছিল৷ খড়ের একচালা ছাউনির নীচে তিনটে বিরাট বিগ্রহ৷ পরপর শিব আর মনসা৷ কিন্তু তৃতীয় বিগ্রহটি কার, ঠিক চিনতে পারলেন না তিনি৷ কুচকুচে কালো পুরুষ মূর্তি, হাতে খড়গ নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ দেখে ভয় লাগতে বাধ্য৷ বলাই গাড়ির মেশিন বন্ধ করতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন বিষ্ণুপদ কবিরাজ৷ বয়স সত্তর-বাহাত্তর হবে৷ ধবধবে সাদা চুল আর গোঁফ- দাঁড়ি৷ শান্ত, সৌম্য চেহারা৷ অনন্তকে তিনি শুইয়ে দিতে বললেন নাট মন্দিরের নীচে চৌকিতে৷ ওর মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর কবিরাজ মশাই বললেন, ‘রুগির নিকটাত্মীয় কে এয়েচেন?’

বাসন্তী এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমি কোবরেজ মশাই৷’

‘রুগির একেবারে এখন তখন অবস্থা৷ গোটা দশেক মুরগি কাটতে হবে৷ চিকিচ্ছের জন্য লাগবে হাজার খানেক টাকা৷ মনসা পুজো নিয়ে মোট দেড় হাজার৷ দিতে পারবি তো?’

‘অ্যাতো ট্যাকা দিতে পারবুনি বাবা৷ আমরা গরীব মানুষ৷ অতো ট্যাকা পাব কোতায়?’

‘তা হলে বাপু রুগি নে যাও৷ আমি হাত ছোয়াব না৷’

সাপে কাটা রোগীকে সারানোর জন্য মুরগির প্রয়োজন হবে কেন, তরিতা বুঝতে পারলেন না৷ রিসর্টের উদয় শঙ্করবাবু কয়েকদিন আগে কথায় কথায় বলছিলেন, সুন্দরবন অঞ্চলে নাকি হাতুড়ে ডাক্তারদের খুব রমরমা৷ গালভরা একটা নাম আছে… অলটারনেটিভ মেডিসিন প্র্যাকটিসনার্স৷ হাসপাতাল ছাড়া নাকি এমবিবিএস ডাক্তার পাওয়া যায় না৷ উপায় নেই বলে, লোকে এই কোয়াক ডাক্তারদের কাছেই যায়৷ বিষ্ণুপদ কবিরাজকে দেখে মনে হচ্ছে, তাঁদেরই একজন৷ লোকটা এমন ধুরন্ধর, ঠাকুর-দেবতাকেও জড়িয়ে নিয়েছে৷ কথাবার্তা শুনে রাগ হল তরিতার৷ কিন্তু, অনন্তকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় নেই৷ ওকে গোসাবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে কমপক্ষে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে৷ সত্যিই যদি বিষধর সাপ ওকে কামড়ে থাকে, তা হলে ততক্ষণ ও কোলাপস করে যাবে৷ রাগটা মনের মধ্যে পুষে রেখে… এগিয়ে এসে তরিতা বললেন, ‘টাকাটা এখনই নেবেন, নাকি পরে দিলেও চলবে কোবরেজ মশাই?’

‘এক্ষুনি দিতে হবে মা৷ মুরগি কেনার জন্য আমাকে লোক পাঠাতে হবে বাজারে৷’

নেত্রা দুটো হাজার টাকার নোট এগিয়ে দেওয়ার পর চিকিৎসা শুরু করলেন বিষ্ণুপদ কবিরাজ৷ খবর রটে গিয়েছে, সাপে কাটা রোগী এসেছে মন্দিরে৷ গাঁয়ের লোক ছুটে এসেছে কবিরাজের হাতযশ দেখার জন্য৷ তিল ধারণের স্থান নেই নাটমন্দিরের চাতালে৷ হারাণ কোত্থেকে একটা চেয়ার এনে দিয়েছে৷ চেয়ারে বসে তরিতা দেখলেন, ধুতি আর ফতুয়ার উপর ডাক্তারদের একটা সাদা অ্যাপ্রন পরে নিয়েছেন কবিরাজ৷ অনন্তর দুটো হাত আর পা চৌকির পায়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলেন তিনি৷ তার পর মাছ কাটার একটা বটি নিয়ে এসে, চৌকির পাশে সেই ধারালো বটিটা বসিয়ে দিলেন৷ কে একজন এক ঝুড়ি জ্যান্ত মুরগি নিয়ে এল৷ তখন ঝোলা থেকে একটা বড় ছুরি বের করে অনন্তর দিকে এগিয়ে গেলেন কবিরাজ৷ অনন্তর পায়ের ডিমে যে জায়গাটায় সাপে কেটেছিল, ছুরি দিয়ে সেই জায়গাটা চিরে দিলেন তিনি৷ গলগল করে রক্ত বেরতে লাগল৷ দেখে অনন্ত যন্ত্রণায় চেঁচাতে শুরু করল৷

নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতেন না তরিতা৷ বিষ্ণুপদ কবিরাজ একটা করে মুরগি ঝুড়ি থেকে তুলে আনছেন৷ মুরগির পিছন দিকটা তিনি বটি দিয়ে কাটছেন৷ তীর বেগে যখন রক্ত বেরিয়ে আসছে, তখন তিনি মুরগির সেই অংশটা চেপে ধরছেন অনন্তর ক্ষতস্থানে৷ ছটফট করতে করতে মুরগিটা মিনিট দুই-তিনেকের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে৷ রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল পুরো চাতাল৷ অনন্তর রক্তে ছড়িয়ে যাওয়া বিষ মুরগির শরীরে টেনে নিতে চাইছেন, নাকি কবিরাজ মুরগির রক্ত অনন্তর শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন… বুঝতে পারলেন না তরিতা৷ এ কী ধরনের পৈশাচিক চিকিৎসা! মুরগির ঝুড়ি খালি হয়ে যাওয়ার পর অনন্তর শরীরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে মন্তর পড়তে শুরু করলেন বিষ্ণুপদ কবিরাজ৷ তার পর রক্তেমাখা হাত পা ধুয়ে নিলেন বালতির জলে৷ তারওপর একটা কালো পাথর ক্ষতস্থানে বসিয়ে দিয়ে অনন্তকে বললেন, ‘ভয় নেই৷ এই পাথরটা এ বার তোর শরীর থেকে বিষ টেনে নেবে৷’

চেন্নাইয়ে থাকার সময় স্নেক স্টোনের কথা শুনেছেন তরিতা৷ মুরগির ডিমের সাইজের কালো পাথর৷ নাকি বিষ টেনে নিতে পারে স্নেক স্টোন৷ তরিতা অবশ্য এই ধরনের বুজরুকিতে বিশ্বাস করেন না৷ অনন্তর দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, ও চৌকির উপর উঠে বসেছে৷ ওর চোখ মুখ দেখেই তরিতা নিশ্চিত হয়ে গেলেন, বিষধর সাপে কামড়ায়নি৷ সত্যিকারের বিষ যদি ওর শরীরে ঢুকত, তা হলে হিমোটক্সিক বা নিউরোটক্সিক এফেক্ট দেখা যেতই৷ কামড় খাওয়ার পর প্রায় ঘণ্টা দুয়েক কেটে গিয়েছে৷ এর মধ্যে বিষ ওর শরীরের কোনও না কোনও অর্গানকে ড্যামেজ করতই৷ তবে ক্ষতি অবশ্য অনন্তর হয়েছে৷ পায়ের ক্ষতটা সারাতে ওর অনেক দিন লেগে যাবে৷ যা রক্তক্ষরণ হয়েছে, তাতে ও মাসখানেকের আগে উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ৷ এই শাস্তিটুকু ওর পাওনা ছিল৷

চাতালের ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছে৷ বিষ্ণুপদ কবিরাজ চিকিৎসা শুরু করার আগে চড়া রোদ ছিল৷ হঠাৎই মেঘের চাদরে পুরো আকাশ ঢাকা পড়েছে৷ ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে৷ বাদাবনে আবহাওয়ার এই পরিবর্তন নতুন কিছু নয়৷ এখুনি বৃষ্টি হতে পারে৷ আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন তরিতা৷ বৃষ্টিতে তিনি ভিজতে চান না৷ দ্রুত ছাউনির তলায় চলে যেতে চান৷ বিষ্ণুপদ অ্যাপ্রন খুলে ফেলছেন দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ট্রিটমেন্ট কার কাছে শিখেছেন কোবরেজ মশাই?’

বিষ্ণুপদ বললেন, ‘আমাকে আর কে শেখাবে মা? স্বয়ং মা মনসা ছাড়া? উনিই স্বপ্নাদেশ দিয়ে আমায় চিকিচ্ছে শিখিয়েছেন৷ আমার এই মন্দিরের সব ক’টি বিগ্রহই জাগ্রত মা৷ শিব, মনসা আর এই দেখুন, মহাকাল৷ আপনি বোধহয় এই অঞ্চলে নতুন৷ না হলে আমায় প্রশ্নটা করতেন না৷’

‘আপনি ঠিকই বলছেন কোবরেজ মশাই৷ আমি এই অঞ্চলে নতুন৷’ কথাটা বলেই তরিতা একবার নেত্রার দিকে তাকিয়ে তারপর বললেন, ‘সত্যিই, আপনার বিগ্রহগুলো জাগ্রত৷ ওই দেখুন, মা মনসার চালা থেকে মাটির সাপগুলো কেমন আপনার দিকে নেমে আসছে৷ এ রকম অলৌকিক ঘটনা আগে কখনও দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি৷’

নেত্রার ম্যাজিক দেখাবে বলেছিল৷ ইশারা বুঝতে পেরে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করেছে৷ চাতালে একশো আটটা সাপ কিলবিল করছে৷ মাঝে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুপদ কবিরাজ থরথর করে কাঁপছেন৷ লোকজন দৌড়ে ইটের রাস্তায় উঠে পড়েছে৷ আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাল৷ কড়কড় করে কোথায় যেন বাজ পড়ল৷ সাপগুলো ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে৷ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয়েছেন বিষ্ণুপদ কবিরাজ৷ কয়েক সেকেন্ড পর হাঁটু গেড়ে বসে, দু’হাত জড়ো করে কাঁপা গলায় তিনি বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করুন মা৷ আপনাকে চিনতে পারিনি৷ আপনার টাকা আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি৷’

তরিতা বললেন, ‘না, তার দরকার নেই৷ টাকাটা আপনি মনসা পুজোয় খরচ করবেন৷’

মিনিট দশেক পর বলাইয়ের মেশিন ভ্যানে দয়াপুরে ফিরে আসছেন তরিতা৷ সামনের দিকে তাঁর পাশেই বসে পড়েছে শোভা৷ অনন্তকে তাঁরা কবিরাজের মন্দিরেই রেখে এসেছেন৷ ধুমধাম করে আজ মা মনসার পুজো হবে৷ তার পর বিকেলের দিকে গিয়ে বলাই ফের নিয়ে আসবে অনন্তকে৷ সাপ জ্যান্ত হওয়ার কথা রটে গিয়েছে আশ পাশের গ্রামগুলোতে৷ তরিতার মন খুবই প্রসন্ন৷ হেড়োভাঙা খালের কাছে এসে হঠাৎই তিনি ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, ‘হ্যাঁরে শোভা, অনন্তকে কি সত্যিই সাপে কেটেছিল?’

ফিক করে হেসে ফেলল শোভা৷ তারপর বলল, ‘না মা৷ ভোরবেলায় শয়তানটাকে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোতে দেখে খুব রাগ হয়েছেল৷ তাই চুলের কাঁটা ওর পায়ে বিঁধিয়ে দিয়ে চেঁচামেচি করেচিলুম, সাপে কেটেচে৷ থাক এখন মাসখানেক বাড়িতে শুয়ে৷ এ বার দেকি, মায়ের পুজো করে কি না৷’

(আঠাশ)

 বিপদ কখনও একা আসে না৷ একটার পর একটা আসে৷ বাঁধ ভেঙে ফার্ম হাউসে লোনা জল ঢুকে গিয়েছে… খবরটা শুনে সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন চন্দ্রভানু৷ মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠল৷ এমনিতেই তাঁর হাই ব্লাড প্রেসার৷ রোজ একটা করে ট্রাইঅলমোজেস্ট ক্যাপসুল খেতে হয়৷ দু’দিন ধরে ওষুধ খাওয়ার কথা তাঁর মনেও হয়নি৷ গাজনের পর থেকে ব্লাড প্রেসারও আর মাপাননি৷ অথচ রায়দিঘির ডাক্তার নিরাপদ সামন্ত প্রতিমাসে একবার করে প্রেসার চেক করতে বলেছেন৷ বাড়িতে থাকলে নিয়মিত ওষুধ দেওয়ার কাজটা করে সনকা৷ ব্রেকফাস্টের পর৷ বাইরে থাকলে দয়াশঙ্কর৷ সে বাস্টার্ডটার দেখা নেই সকালের পর থেকে৷ ঝাড় খাওয়ার ভয়ে সে পালিয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছে৷

মন্টু জিজ্ঞেস করল, ‘কে ফোন কইরেছিল রে চাঁদ?’

চন্দ্রভানু বললেন, ‘সোনাখালি থেকে ছোটখোকা৷ কী বলল জানিস? ফার্ম হাউসের ভেতর নদীর জল ঢুকে গেছে৷ অত দামি সব গাছ, আর বাঁচানো যাবে না৷’

‘কাল বিকেল থেকে ওখানে মারাত্মক ঝড় জল হয়েচে শুনলুম৷ বাঁধ ভেঙেচে বোধহয় সেই কারণেই৷’

‘বাঁধ ভাঙেনি৷ বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে মন্টু৷ ওই তরিতা মাগীর কাজ৷ আমি সিওর৷’

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মন্টু জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মন বইলচেল, এ রকমই কিচু ঘইটবে৷’

‘তুই জানতি? কী করে?’

‘চাঁদ সওদাগরের জেবনে যে ঘইটেচেল৷ মনসাপালায় শুনিস লাই, উনকোটি নাগ লিয়ে গে মা মনসা ভষ্ম কইরে দেচিলেন চাঁদের সাধের উপবন৷ সেই উপবন তো তোর ফার্ম হাউসের মতোনই ছেল৷ কিন্তু মনসা ক্ষেতি করতে পারেন লাই৷ চাঁদ সওদাগর মহাবিদ্যা জপ কইরে উপবন ফিরে পেইচিলেন৷ তোকে বইলেচি না, তোর জেবনে সেই সব ঘটনা ঘইটতেচে, যা চাঁদ সওদাগরের জেবনে ঘইটেচেল৷ আমার আন্দাজ যদি সত্যি হয়, তা’লে তুইও ফার্ম হাউস ফিইরে পাবি ভাই৷ ’

‘ওই মাগীটার জন্য একটা বড় কন্ট্রাক্ট হাতছাড়া হয়ে যাবে৷ ওকে কিন্তু আমি ছাড়ব না৷’

‘মাথা ঠান্ডা কর চাঁদ৷ এ অন্যকে দোষারোপ করার সময় লয়৷ আগে সোনাখালির পরিস্থিতিটা ভাল করে জান৷ তারপর সেখেনে যাওয়ার কথা ভাবা যাবে৷’

পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে মন্টু নম্বর টিপতে লাগল৷ রাগে সারা শরীর জ্বলতে লাগল চন্দ্রভানুর৷ উঠে তিনি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন৷ কপালের দু’পাশটা টিপটিপ করছে৷ অন্য সময় হলে, সনকাকে মাথা টিপে দিতে বলতেন তিনি৷ কিন্তু, কাল বিকেলে ওর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন৷ ও বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে৷ ওকে হাতে-পায়ে ধরে রাখার বান্দা অবশ্য তিনি নন৷ সে যত বড় বিপদই আসুক না কেন! মন্টু লাইনটা পেয়ে গিয়েছে৷ চন্দ্রভানু এদিকে মন দিলেন৷ মন্টু কথা বলছে ছোটখোকার সঙ্গে৷ ‘আমি মন্টুকাকা বইলচি রে৷ কী কইরে বাঁধ ভাঙল, আমাকে খুইলে বল দিনি?’

ফোনের স্পিকার অন করে দিয়েছে মন্টু৷ চন্দ্রভানু শুনতে পেলেন, ছোটখোকা বলছে, ‘রাতে ভরা কোটাল ছেল কাকা৷ বড় বড় ঢেউ এসে ধাক্কা মারছিল৷ তবে কেসটা কী, ঠিক বুঝতে পারছি না৷ সিকিউরিটি গার্ডদের একজন কিন্তু অন্য কথা বলল৷ কাল সন্ধেবেলা থেকে একটা বোট নাকি এসে নাকি লুকিয়ে ছিল সোনাখালি ব্রিজের নীচে৷ তাতে বেশ কয়েকজন লোক ঘাপটি মেরে বসে ছিল৷ আমাদের গার্ড বিমল নাকি বৃষ্টির সময়কোদাল চালানোর শব্দও শুনেছে৷ তা যদি সত্যি হয়, তা হলে বাঁধ কেউ জেনে-বুঝে কেটে দিয়েছে কাকা৷’

‘বোটটা কার, খোঁজ নিইচিস?’

‘কে যেন এসে বলল, বোটটা নাকি গদখালির ইফতিকার আলির৷ শুনেই ওকে আমি ফোন করেছিলুম৷ কেউ ওর কাছে ভাড়া নিয়েছিল কি না, তা জানার জন্য৷ ও বলল, ওর বোট নয়৷’

‘ইফতিকার কি সইত্যি কথা কইচে?’

‘মনে তো হল৷ নদীতে কত আনঅথরাইজড বোট ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ধরার উপায় আছে?’

‘বাসন্তী থানায় খবর দিইচিস? বড়বাবু নরেশ ভূইয়ারে তো তুই চিনিস৷ থানায় গে একডা কমপ্লেন কইরে দে৷ বিমলরে সঙ্গে লিয়ে যাস দিনি৷’

‘খবর পেয়ে বড়বাবু নিজেই এসেছিল কাকা৷ সব দেখে গ্যাছে৷’

‘শোন বাবা, ভাঁটার সময় যত তাড়াতাড়ি পারিস, দশ বারোটা পাম্প চাইলে নোনা জল বের কইরে দে৷ নোনা জল য্যান জমির নীচে বইসে না যায়৷ তা’লে জমিতে নুন ঢুকে যাবে৷ দু’তিন বচরের আগে কোনও গাচ জন্মাবে না৷ একইসঙ্গে, জনা পঞ্চাশ নোক লাগিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজটা চালা৷ চাইর-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই করা চাই৷ ফের জোয়ার আসার আগে৷’

‘পাম্প বসিয়ে দিইচি৷ কিন্তু বাঁধ দেওয়ার মজুর পাওয়া মুশকিল কাকা৷ আপনি তো জানেন, এই সময়টায় লোকাল লোকেরা জন মজুর খাটতে আন্দামান চলে যায়৷ ঠিক পুজোর আগে ফিরে আসে৷ দেখি, নদীর ওপারে বাসন্তী থেকে লোকজন আনতে পারি কি না৷’

‘তাই কর৷ আমরা লাঞ্চের পর তোর ওকানে যাচিচ৷’

কথা শেষ করে মন্টু লাইন কেটে দিল৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলেন চন্দ্রভানু৷ ক্ষিপ্ত বাঘের মতো তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘তোকে বলেছিলাম না, এ ওই হারামজাদির কাজ৷ তুই তখন বিশ্বেস করলি না৷ শুনলি তো ছোটখোকা কী বলল? ও মাগীকে আমি ছাড়ব না৷’

সোফা থেকে উঠে এসে মন্টু কাঁধে হাত রেখে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘তুই এত্ত উত্তেজিত হচিচস ক্যান চাঁদ? আগে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হ, তারপর না হয় শোধ তোলার কতা ভাববি৷’

চন্দ্রভানু আহত স্বরে বললেন, ‘আমার কত্ত টাকা লস হল বল তো? টাকাটা তো তোর নয়৷ তোর টাকা হলে তুই টের পেতি৷ কোথায় ব্যথা লাগে৷’

‘শোন চাঁদ, একনো তোর কোনও লস হয়নে৷ আজগের মধ্যেই নদীর জল যদি বেইরে যায়, তা’লে জানবি তুই বেঁচে গেলি৷ জমি লষ্ট হবে না৷ তোর ফার্ম হাউসের কাছে রুপোখালির অত বড় খাল৷ তাতে বৃষ্টির জল ধরা আচে৷ নদীর জল নাম্মে দে… আমরা খালের জল পাম্প করে নে এসে ফেলব ফার্ম হাউসে৷ এত্ত ঘাবড়ানোর কিচু নেই৷ আয়লার পর দেখলি না, দু’তিন বছরের মধ্যে জমি ক্যামন ফের ফসল দিচ্চে? কেন বল তো? দু’সিজন বৃষ্টির পর জমির নোনাভাব চলে গ্যাচে৷ আম্মি তো আচি৷ অ্যাকন যাই, তোর আসল ক্ষেতিটা যা না হয়, আগে তার ব্যবস্তা করে আসি গে৷ সারারাত ঘুমোসনে৷ অ্যাকন তুই এট্টু রেস্ট নে৷’

কথাগুলো বলে মন্টু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ রেস্ট নিতে বলল বটে, কিন্তু এই বিপদে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবতেই পারছেন না চন্দ্রভানু৷ বিছানায় শুলেই কাঁটা খচখচ করবে গায়ে৷ পরশু রাতে ভাল ঘুম হয়নি৷ বারুইপুর যাবেন বলে ভোর পাঁচটায় লঞ্চে উঠেছিলেন৷ কালও সারা রাত জেগে কাটিয়েছেন৷ একটা বড়ি খেয়ে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারলে সত্যিই ভাল হত৷ কিন্তু, দেবাংশুবাবুর কাছ থেকে একজনের আসার কথা আছে৷ তাকে বলে দিতে হবে, উনি যেন চিঠির বয়ানবদলে দেন৷ কেননা, জার্মান কোম্পানিকে, আজ না হোক কাল, জানিয়ে দিতেই হবে, নিমপাতার কন্ট্রাক্টটা তাঁরা নিতে পারবেন না৷ কথাটা ভাবতেই ফের অস্থির হয়ে উঠলেন চন্দ্রভানু৷ বুকের ভিতরটা জ্বালাজ্বালা করতে লাগল৷ একটা মেয়ের কাছে হার স্বীকার করতে হবে নাকি? না, না, তা হয় না৷

সোফা থেকে উঠে ফের চন্দ্রভানু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন৷ তখনই দেখলেন, দরজার বাইরে মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দয়াশঙ্কর৷ ইডিয়েটটাকে চোখের সামনে থেকে সরে যাওয়ার কথা বলতে যাবেন, তার আগেই ও বলে উঠল, ‘বাবাইসোনার স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ফোন করেছিলেন স্যার৷’

জয়জিতের ডাকনাম বাবাইসোনা৷ তাঁর আদরের নাতি৷ কলকাতার বাইপাসের ধারে এক নামী স্কুলে পড়ে৷ তার স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ফোন করেছিলেন শুনে চন্দ্রভানু ভুলে গেলেন সোনাখালির ফার্ম হাউস আর তরিতার কথা৷ এত সকালে ফোন… মানে নিশ্চয়ই খবর ভাল নয়৷ উদ্বিগ্ন হয়ে চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কখন ফোন করেছিলেন উনি?’

‘তা, আধ ঘণ্টা আগে তো হবেই৷ আপনি তখন মন্টুবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলেন বলে বিরক্ত করিনি৷’

‘কী বললেন?

‘ কী বললেন, আমি বুঝতে পারিনি স্যার৷ আপনি কথা বলবেন?’

ধারে-কাছে কী ইরেস্পনসিবল লোকজন সব! মানী লোকেদের সঙ্গে গুছিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না৷ স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ড. আশুতোষ বাসু খুব পণ্ডিত মানুষ৷ রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পাওয়া শিক্ষক৷ তাঁর ফোনটা না দেওয়ার পিছনে কী যুক্তি দিয়েছে দয়াশঙ্কর, কে জানে? পাছে ভদ্রলোক কিছু মনে করেন, সেই কারণে বিরক্ত হয়ে নিজের মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘লাইনটা শিগগির ধরে দে৷’

দয়াশঙ্কর লাইনটা ধরে দেওয়ার পর চন্দ্রভানু বললেন, ‘গুড মর্নিং স্যার৷ শুনলাম আপনি ফোন করেছিলেন? সরি স্যার, তখন আমি মর্নিং ওয়াক করতে গেছিলাম৷’

‘নেভার মাইন্ড চন্দ্রভানুবাবু৷ ফোনটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম কেননা, জয়জিৎকে নিয়ে ইদানীং আমরা একটা প্রবলেমে পড়েছি৷’

‘কী প্রবলেম স্যর?’

‘ডক্টর বলছেন, স্নেকফোবিয়া৷ দিন দশেক আগে ক্লাসে হঠাৎ জয়জিৎ আনকনশাস হয়ে যায়৷ তখন আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি৷ জ্ঞান হওয়ার পর ও বলে, ক্লাসে যখন টিচার সাপ সম্পর্কে পড়াচ্ছিলেন, সেইসময় সাপের কালার স্লাইড দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে যায়৷ পরে শুনলাম, ডাক্তারকে বলেছে, সামার ভেকেশনে যখন কঙ্কণদীঘি গিয়েছিল, সেইসময় নাকি ওকে সাপে কামড়েছিল৷ এবং সেইজন্য নাকি ওকে নার্সিংহোমেও ভর্তি হতে হয়েছিল৷’

‘ও ঠিকই বলেছে স্যর৷’

‘স্নেকবাইটিংয়ের কথা আমাদের না জানিয়ে আপনি খুব অন্যায় করেছেন৷’

‘সরি স্যার৷ আপনাদের জানানোর কথাটা তখন আমাদের মাথায় আসেনি৷’

‘ফ্যাক্ট রিমেন্স, জয়জিৎ এখন একটা স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে৷ স্কুলের বাইরে বেরতে চাইছে না৷ বিকেলে খেলার মাঠেও যাচ্ছে না৷ সবসময় নাকি ওর মনে হচ্ছে, ওর ধারে কাছে সাপ ফণা তুলে আছে৷ যে কোনও সময় ওকে কামড়ে দেবে৷ ওর রুমমেট বলছে, রাতে নাকি ঘুমের ঘোরেও ভয় পেয়ে চেঁচাচ্ছে৷’

যত শুনছেন, মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ছেন চন্দ্রভানু৷ সেই সাপ… সাপের ভয়! পুরো পরিবারের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এমনকী, কলকাতায় বাবাইসোনাকেও ছাড়েনি৷ চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কী করা উচিত স্যার?’

‘জয়জিৎকে কাউন্সিলিং করানো দরকার৷ আপনাদের অনুমতি ছাড়াওকে আমরা সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যেতে পারি না৷ সেই কারণেই ফোনটা করেছিলাম৷ আর আপনি যদি চান, ওকে কঙ্কণদীঘিতে নিয়ে যেতে পারেন৷ ’

‘আপনি কি সাজেস্ট করেন স্যর?’

‘জয়জিৎকে এখান থেকে নিয়ে যান৷ স্কুলে নানা ধরনের ছেলে আছে৷ বেশি জানাজানি হয়ে গেলে কেউ কেউ ওকে উত্যক্ত করতেও পারে৷ এক ধরনের র্যাগিংয়ের সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না৷ মনে হয়, বাড়ির পরিবেশে কিছুদিন কাটালে, ও ফের নর্মাল হয়ে যাবে৷’

‘ঠিক আছে স্যর, তাই হবে৷ এখন কি একবার ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে?’

‘আয়্যাম অ্যাফ্রেড, নট৷ স্ট্রেস কমানোর জন্য ডক্টর ওকে সিডেটিভ দিয়েছেন৷ এখন বোধহয় হোস্টেলের রুমে ঘুমিয়ে আছে৷ ও কে চন্দ্রভানুবাবু৷ স্কুল আওয়ার্সের মধ্যে আজই তা হলে কাউকে পাঠিয়ে দিন৷’

‘আমি নিজেই আসছি৷’ বলে লাইনটা কেটে দিলেন চন্দ্রভানু৷

একের পর এক খারাপ খবর৷ চন্দ্রভানু আর নিতে পারছেন না৷ বাবাইসোনাকে সিডেটিভ দিতে হয়েছে৷ তার মানে, ও ভাল নেই! মহাদেব এ কী পরীক্ষার মধ্যে ফেললেন তাঁকে! এত দুর্বল করে দিচ্ছেন কেন? আগে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠলেই খানিকক্ষণ মন্দিরে গিয়ে সময় কাটাতেন চন্দ্রভানু৷ মনটা তখন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসত৷ আগের মতো মন্দিরে গিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকলে আজও হয়তো একটা দিশা খুঁজে পাবেন৷ কিন্তু, হাতে সময় নেই৷ বাবাইসোনাকে নিয়ে আসার জন্য তাঁর নিজেরই কলকাতায় যাওয়া উচিত৷ বড়খোকা জয়গোপাল এখন হিঙ্গলগঞ্জের ভেড়িতে৷ বাগদা চিংড়ির কোয়ারেন্টাইন নিয়ে চিন্তিত৷ বাবাইসোনার কথা বলে তাকে ব্যস্ত করার কোনও মানে হয় না৷ তবুও খবরটা তো দিতেই হবে৷

কথাটা মনে উদয় হওয়ামাত্র দয়াশঙ্করকে তিনি বললেন, ‘পঞ্চাকে বড় গাড়িটা বের করতে বল৷ এক্ষুণি আমাকে বাবাইসোনার স্কুলে যেতে হবে৷’

‘বাবাইসোনার কী হয়েছে, স্যর?’

‘খুব অসুস্থ৷ ওকে কঙ্কণদীঘিতে নিয়ে আসতে হবে৷ আমি চট করে স্নান সেরে নিচ্ছি৷ তুইও রেডি হ৷ আমার সঙ্গে যাবি৷’ কথাগুলো বলে ঘরের ভিতর খুকে যাচ্ছিলেন চন্দ্রভানু৷ হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ মন্দিরে কি জগন্নাথ পণ্ডিত পুজো শুরু করে দিয়েছেন?’

‘না স্যার৷ আপনি নাকি কালকে তাঁকে আসতে বারণ করে দিয়েছেন?’

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, হ্যাঁ, ঠিক৷ কাল রাগের মাথায় জগন্নাথ পণ্ডিতকে মন্দিরে আসতে মানা করেছিলেন তিনি৷ এদিকে, সনকাও গোঁসা করে রয়েছে৷ তার মানে… সকাল থেকে কেউ পুজোর উদ্যোগই নেয়নি! কী আশ্চর্য! অসহায় ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘তা হলে পুজোর কী হবে?’

‘সোমাই পণ্ডিতকে কি ধরে আনব স্যর?’

‘না, না৷ তুই যা, এক্ষুণি জগন্নাথ পণ্ডিতকেই ধরে নিয়ে আয়৷ বলবি, আমি ডাকছি৷ যদি আসতে না চায়, তা হলে ওঁকে তুলে আনবি৷ আমি একটু পরেই মন্দিরে যাচ্ছি৷’

ঘড়িতে প্রায় এগারোটা বাজে৷ আজ আর সোনাখালিতে যাওয়া হবে না৷ ফার্ম হাউস বাঁচানোর থেকে তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল বাবাইসোনাকে সুস্থ করে তোলা৷ সোনাখালিতে মন্টু গেলেই চলবে৷ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চন্দ্রভানু বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন৷ আলোগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার পর মনে একটু প্রশান্তি অনুভব করলেন৷ অনেক শখ করে তিনি এই বাথরুমটা বানিয়েছিলেন৷ দিল্লির হায়াত রিজেন্সি হোটেলের এগজিকিউটিভ স্যুটের বাথরুমের অনুকরণে৷ সাত ফুটের বাথটব নিয়ে এসেছেন ইতালি থেকে৷ দেওয়ালের কাচ বেলজিয়ামের, ফিটিংস দুবাই থেকে ৷ অন্যদিন, বাথটবের সুগন্ধি জলে শরীর ডুবিয়ে রেখে চন্দ্রভানু অনেকক্ষণ রিল্যাক্স করেন৷ আজ অত সময় হাতে নেই৷

শাওয়ারের ঠান্ডা জলের স্পর্শে রাত জাগার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল৷ চন্দ্রভানু ক্রমেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে লাগলেন৷ বাবাইসোনার স্নেকফোবিয়ার কথা শুনে তখন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন৷ স্নান করতে করতে তিনি ভাবলেন, আরে সর্পদমনের মন্ত্র তো তিনি নিজেই জানেন৷ ডাক্তার-বদ্যির কাছে যাওয়ার দরকারটা কী? বহু বছর আগে তাঁরা যখন জটা গ্রামে থাকতেন, তখন একবার তাঁর কাকাকে চন্দ্রবোড়ায় কেটেছিল৷ সেইসময় জটার দেউলের চাতালে এক সাধুবাবা এসে অবস্থান করছিলেন৷ কাকাকে তিনি বাঁচাতে পারেননি৷ কিন্তু সর্পদমনের মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বাবাকে৷ সেই মন্ত্র বাবা তাঁকে দিয়ে গিয়েছেন৷ মন্ত্রের এমনই জোর যে, সর্পকুল তাঁর সামনে আসতে সাহস করে না৷ সেই মন্ত্র বাবাইসোনা রোজ একশো আটবার জপলে, সাপই ওকে দেখে পালিয়ে যাবে৷

পোশাক পরে চন্দ্রভানু যখন নীচে নেমে এলেন, তখন দেখলেন মন্দিরে যাওয়ার প্রবেশ পথে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে মন্টু৷ প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে ও নীচে নেমে এসেছিল৷ নিশ্চয়ই সনকার মান ভাঙানোর জন্য৷ চেষ্টা করছিল, যাতে বাপের বাড়ি যাওয়া আটকাতে পারে৷ মেয়েমানুষকে এত তোয়াজ করার দরকারটা কী, চন্দ্রভানু ভেবে উত্তর পান না৷ তিনি পুরুষমানুষ, ইচ্ছে করলে পাঁচটা সনকা পুষতে পারেন৷ মেয়েমানুষের তেজ সহ্য করার মতো দুর্বলচিত্ত তিনি নন৷ সনকা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে কিনা, তা জানার ইচ্ছেও হল না৷ পাছে মন্টু সনকার প্রসঙ্গ তোলে, সেই কারণে আগেভাগেই চন্দ্রভানু বলতে শুরু করলেন জয়জিতের অসুস্থতার কথা৷ তার পর বললেন, ‘তুই ছোটগাড়িটা নিয়ে সোনাখালি চলে যা৷ গিয়ে দ্যাখ, ওখানে কিছু করতে পারিস কি না৷ আমি সন্ধ্যের মধ্যে ঘুরে আসছি৷’

কথাগুলো বলেই চন্দ্রভানু মন্দিরের ভিতর ঢুকে গেলেন৷ জগন্নাথ পণ্ডিত গর্ভগৃহে পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত৷ গৃহদেবতাকে প্রখাম করে চন্দ্রভানু বাইরে বেরিয়ে এলেন৷ পোর্টিকোর নীচে বড় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পঞ্চা৷ জানলার কালো কাচগুলো সব তোলা৷ গাড়িতে ওঠার আগে একবার বাড়ির ভিতরের দিকে তাকালেন তিনি৷ নাহ, সনকাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না৷ যাওয়ার আগে একবার দেখা করেও গেল না৷ চুলোয় যাক সনকা৷ মনটাকে শক্ত করে চন্দ্রভানু গাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লেন৷ গাড়িতে উঠে বসতেই অবশ্য চমকে উঠলেন তিনি৷ পিছনের সিটের ডান দিকে বসে আছে সনকা৷ মুখ-চোখ ফোলা ফোলা৷ বোধহয় সারা রাত্তির ধরে কান্নাকাটি করেছে৷ অন্য সময় গয়নায় ঢাকা ঢাকে বলে ওর শরীরটাই দেখা যায় না৷ এখন ওর শরীরে একটাও গয়না নেই৷ রাগের চোটে মনে হয়, খুলে ফেলেছে৷ সনকার স্তনের খাঁজ দেখে হঠাৎ যৌনতাড়না অনুভব করলেন চন্দ্রভানু৷ কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি!!’

সনকা বলল, ‘বাবাইসোনাকে আনতে আমিও কলকেতা যাব৷ ও যেমন তোমার নাতি, আমারও৷’

(উনত্রিশ)

লাঞ্চের পর ডাইনিং হলের বাইরে গাছতলায় বসে শান্তি আর শোভার সঙ্গে কথা বলছেন তরিতা৷ একটু পরেই পরাণ ছেলেটার আসার কথা৷ দয়াপুরের এই ছেলেটার সঙ্গে গোলাপির বিয়ে ঠিক হয়ে রয়েছে৷ কিন্তু গোলাপি ওকে বিয়ে করতে চায় না৷ পরাণ পেশায় মউলে, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে, মাছ ধরে৷ তাতে অবশ্য আপত্তি নেই গোলাপির৷ কিন্তু, ওর অপছন্দের কারণ, ছেলেটা গেঁজেল, নেশাড়ু৷ মহা মুশকিলে পড়েছেন তরিতা৷ বিয়েটা না হলে গোলাপিকে দয়াপুরে আসতে দেবে না ওর বাবা নিবারণ৷ সেই কারণেই তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন পরাণকে৷ নিজে একবার যাচাই করে নিতে চান ছেলেটা কেমন?

গাছতলায় বসে কথা বলছেন তরিতা৷ হঠাৎ কাঁধের কাছটায় কুটকুট করে উঠল৷ গাছ থেকে কোনও পোকা-টোকা পড়েছে বোধহয়৷ ভেবে বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে টোকা মারলেন তরিতা৷ মেঝেতে পড়তেই দেখলেন, বেশ বড় একটা শুঁয়োপোকা৷ গুটিয়ে গোল হয়ে রয়েছে৷ একটু পরে সোজা হয়ে চলতে শুরু করল৷ শোভা পা দিয়ে চিপে দিতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু শান্তি বাধা দিল, ‘না, মারিস না৷ দু’একদিনের মধ্যেই প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াবে৷’

কাঁধের কাছটায় চিড়বিড় করতে লাগল৷ কথা বলতে বলতে জায়গাটায় চুলকোতে লাগলেন তরিতা৷ চুলকানি ছড়িয়ে গেল, যে আঙুল দিয়ে টোকা মেরেছিলেন, সেখানেও৷ তরিতা বললেন, ‘কী হল দ্যাখ তো শোভা? এত কুটকুট করছে কেন?’

শোভা উঠে এসে বলল, ‘মা, জায়গাটা লাল হয়ে গিয়েছে৷ শুঁয়োপাকার রোঁয়া ঢুকেছে বোধহয়৷ এ তোমাকে খুব জ্বালাবে মা৷’

তরিতা বললেন, ‘এখানে কোথাও চাকচাকুন্ডা পাতা পাওয়া যাবে রে?’

শুনে শান্তি বলল, ‘পাওয়া যাবে ম্যাডাম৷ কিচেনের পিছনেই গাছ আছে৷ দাঁড়ান, আমি এনে দিচ্ছি৷’

ছোটবেলায় ক্যানিংয়ের আশ্রমের থাকার সময় চাকচাকুন্ডা পাতার রস লাগিয়ে দিতেন মায়েরা৷ চুলকানি চলে যেত৷ বহু বছর পর হঠাৎ সেই পাতার কথা মনে পড়ল তরিতার৷ আশ্রমে বর-বউ খেলার সময় তাঁরা এই চাকচাকুন্ডা পাতা দিয়েই বিয়ের গয়না তৈরি করতেন৷ পাতাগুলো গোল, জোড়া জোড়া, সুন্দর দেখতে৷ পাতার মাঝে ফুল দিয়ে তাঁরা মালা গাঁথতেন৷ হাতের বালা তৈরি করে সাজতেন৷ শান্তি দৌড়ে কিচেনের পিছন থেকে চাকচাকুন্ডা গাছের পাতা ছিড়ে নিয়ে এসে, হাতের মুঠোয় ডলতে লাগল৷ তারপর চুলকানির জায়গায় পাতার রস লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটু পরেই আপনার চুলকানি ভ্যানিশ হয়ে যাবে ম্যাডাম৷ এটা হল জ্বালা যন্ত্রণার অব্যর্থ ওষুধ৷ কিন্তু, আপনি কী করে জানলেন?’

‘বাঃ রে, আমি যে অনেক বছর ক্যানিংয়ে ছিলাম৷ তখনই জেনেছি৷ এই, তোরা সাতভাই পাখি চিনিস?’

‘হ্যাঁ মা৷ আমাদের এখেনে সাতারে পাখি বলে৷’

‘সাতভাই পাখি কীভাবে শুঁয়োপোকা খায়, কখনও দেখেছিস? শুঁয়োপোকা ধরে ওরা এমনভাবে নাড়ায়, যাতে সব রোঁয়া ঝরে পড়ে৷ কিন্তু, তাসত্ত্বেও, কখনও যদি রোঁয়া ওদের পেটে চলে যায়, তখন কি করে জানিস? চাকচাকুন্ডা পাতা চিবোতে থাকে৷ ওরা নিজেরাই এইভাবে ডাক্তারি করে৷’

সত্যিসত্যিই, মিনিট দুয়েকের পর কাঁধের জ্বালাটা কমে গেল৷ তরিতা উঠে চেয়ারটা ডাইনিং হলের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসলেন৷ সকালে ব্রেকফাস্ট করে বলাইকে নিয়ে নেত্রা বেরিয়ে গিয়েছে৷ গ্রামের ভিতর যেখানে হেড়োভাঙা খাল সংস্কারের কাজ চলছে, তার কাছাকাছি তিরিশ বিঘে জমি কেনার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে৷ কাল বিকেলে দালাল এসে বলে গিয়েছে, জমির মালিক একজন মহিলা… সুরভি মিত্র৷ সম্প্রতি তিনি মারা গিয়েছেন৷ ভাগ বাঁটোয়ারার পর ওই জমি ছেলেদের কার ভাগে পড়ল, সেটা না জানা পর্যন্ত কথাবার্তা চালিয়ে লাভ নেই৷ নেত্রা ওখানে গিয়েছে, ওই জমি নিজের চোখে একবার দেখে আসতে৷ পছন্দ হলে খুব তাড়াতাড়ি কিনে ফেলতে চান তরিতা৷ কেননা, তিনি কাগজে পড়েছেন, সেন্ট্রাল গর্ভমেন্ট নাকি জমিসংক্রান্ত বিল আনছে৷ গ্রামে জমি অধিগ্রহণ করতে হলে, বাজার দরের চারগুণ দাম দিতে হবে মালিককে৷ সেই বিল পাস হওয়ার আগেই এই জমিটা কিনে ফেলা দরকার৷

নেত্রা এখনও ফেরেনি৷ তাই বসে বসে শান্তি আর শোভার সঙ্গে কথা বলছেন তরিতা৷ হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ রে শোভা, অনন্তর লম্ফঝম্প এখন কি কমেছে? ’

শোভা বলল, ‘কমেছে মানে? আমায় অ্যাখন মাতায় করে রাকছে মা৷ রোজ আমায় ঠেলে ঠেলে মনসাতলায় পাটাচ্চে৷ পুজোর ফুল মাতায় না ছোঁয়ালে রেগে যাচ্চে৷ তোমার কাচে এল বলে৷ ওর ধারণা, তুমি ট্যাকা না দিলে নাকি বাঁচত না৷ অনন্ত জানে না, কোবরেজ মশাই ট্যাকাগুনো ফেরত দিয়েচে৷’ কথাগুলো বলে শোভা হাসতে লাগল৷

‘অনন্তর পায়ের ঘা শুকিয়েছে?’

‘শুকোচ্ছে৷ রায় ডাক্তার কী একটা মলম দিয়েচে৷ সেটাই রোজ নাগাচ্চে৷’

‘বাইরে যাওয়ার কথা আর বলছে না?’

‘কী বলছে জানো? এ বার আর এর্নাকুলুমে যাবে না৷ আন্দামানে যাবে আমাকে নিয়ে৷’

‘সে কী! তুই হ্যাঁ বলেছিস নাকি?’

‘তোমার মাতা খারাপ মা? ওর কতায় বিশ্বেস করে আমি অদ্দূর যাব? আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না৷’

‘আমার উপর তোর এত বিশ্বাস?’

‘আমার কাছে তুমিই মা মনসা৷ যদি সাহস দাও, তা হলে একটা কতা জিজ্ঞেস করব?’

‘কী কথা রে? এত হেজিটেট করছিস কেন? বল৷’

‘বিষ্ণুপদ কোরবেজের বাড়িতে সেদিন সাপগুলোকে তুমি আনলে কী করে মা? তার আগে হারাণটাকেও তুমি শিখখে দিয়েচিলে খাল থেকে সাপ ডেকে এনে৷’

‘হিপনোটাইজ করে৷ নেত্রার কাছ থেকে শিখেছি৷ ও বহুদিন কামাখ্যায় ছিল৷ সেখান থেকে অনেক বিদ্যে শিখে এসেছে৷ তোকেও একদিন শিখিয়ে দেব৷ তখন তোর কথাও সাপেরা মানবে৷ সাপকে কীভাবে বশ করতে হয়, তোদের শেখাব৷ সাপের বিষ কীভাবে বের করতে হয়, সেটাও শিখিয়ে দেব৷ তোদের এই দয়াপুরেই আমি সাপের কামড়ের এমন ওষুধ তৈরি করব, যা কিনতে বিদেশে থেকেও লোকে আসবে৷ দেখবি, তখন কেউ সাপের কামড়ে মরবে না৷ সাপকেও কেউ মারবে না৷’

কথাগুলো বলেই প্রসঙ্গ ঘোরালেন তরিতা৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ‘পরাখ ছেলেটা এলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস৷ তুই যেন বাড়িতে চলে যাস না শোভা৷ তোর সঙ্গে আমার কাজ আছে৷’

কথাগুলো মুখ থেকে খসতে না খসতেই তরিতা দেখতে পেলেন, একটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হারাণ গেট দিয়ে ঢুকছে৷ ওহ, সঙ্গী ছেলেটাই তা হলে পরাণ! গায়ের রঙ রোদে-জলে জ্বলে গিয়েছে৷ মুখটা চোয়াড়ে ধরনের৷ পরনে লাল রঙের একটা টি শার্ট৷ ছেলেটা কাছে আসতেই তরিতা দেখতে পেলেন, চুলে চপচপে তেল দেওয়া৷ চোখ দুটো জন্ডিস রোগীর মতো হলদে৷ ওর শরীরের পেশিগুলো দড়কচা পাকিয়ে গিয়েছে৷ গোলাপির মতো ভরা স্বাস্থ্যের মেয়ের পাশে এই ছেলেটা সত্যিই বেমানান৷ বিয়েটা যে করেই হোক, বানচাল করে দিতে হবে৷ হারাণ গড় হয়ে প্রণাম করল৷ দেখাদেখি, পরাণ হাতজোড় করে নমস্কার জানাল৷ চেয়ারে ফের বসে তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরাণ, তোমাকে কেন ডেকেছি, জানো?’

‘হারাণদা বুইললো, গোলাবিকে বে করা নে কতা কইতে৷’

‘হ্যাঁ, সেই কারণেই৷ নিবারণের সঙ্গে তোমার কথাবার্তা কতদূর এগিয়েছে?’

‘আমি দশ হাজার ট্যাকা আর একডা সাইকেল চেইচি৷’

‘না দিলে তুমি বিয়ে করবে না?’

‘না৷ সারা জেবনের জন্যি তেনার মেয়াকে কাঁধে নিচিচ, এটুকু চাইবুনি?’

‘তুমি কত রোজগার করো পরাণ?’

‘জঙ্গল থেকি রোজগার, ঠিক থাকে নাকি? ফরেস্টবাবুরা আমাদের ঠগায়৷ মউলেদের কাচ থেকে তেনারা মধু কেনেন এক কেজি পঁচাত্তর ট্যাকায়৷ সেই মধু বিককির করেন আড়াইশো ট্যাকায়৷’

‘তোমরা ফরেস্টবাবুদের ঠকাও না?’

‘মিথ্যে কইব না দিদিমণি৷ আমরাও ঠগাই৷ পাস দেবার সময় ওঁরা আমাদের ব্যারেল দ্যান৷ আমরাও নুকিয়ে বাড়তি ব্যারেল নিয়ে যাই৷ সেই ব্যারেল মধু ভর্তি করে বোটে নুকিয়ে রাকি৷ ফিরে এসসে সরকারের ব্যারেল ফরেস্টবাবুদের দেই৷ আর আমাদের ব্যারেলের মধু বাজারে বিককির করি দুশো ট্যাকা করে৷ ক্যানালে কে কারে ধরে? ধরলেও, বিশ-পঁচিশ ট্যাকা দিলে পুলিশ ছেড়ি দ্যায়৷’

‘তোমার এই সামান্য রোজগেরে তুমি সংসার চালাতে পারবে পরাণ?’

‘চালাতি হবে৷ গোলাবি তো আর বইসে বইসে খাবে না৷ ওরেও কাজ করতি হবে৷’

‘তুমি কি জানো, গোলাপি সাপ পোষে? ও বলেছে, শউরবাড়িতে সাপগুলো নিয়ে যাবে৷ তুমি রাজি?’

‘না দিদিমণি৷ নোকের মুকে শুনেচি, উ এক ত্যাড়াব্যাকা মেয়া৷ শরীলে খুঁত আচে৷ সাপের ঘরে থাকে৷ সাপে উর আঙুল খেয়ে লিয়েচে৷ আমার ঘররে উ সব চলবেনি৷ আমি বেদেনি বে করবুনি৷’

‘সাপে এত ভয় কেন তোমার পরাণ?’

‘জঙ্গলে অ্যাকবার আমায় কেউটেয় কেটেছিল৷ যমে টেনে নে যাচিচল৷ কিন্তু, বুদ্ধি করে জগাই কাকা পেটভরে আমায় সরষের তেল আর নুন খেতি দিল৷ ব্যস, বিষ কেইটে গেল৷ তাপ্পর থেইকে… এই যে দেখতিচেন… আমার চোখ দুডা… হলুদ হইয়ে গেল৷ রেতের ঘুম চলি গেল৷ আমার চোকে আর ঘুম আসেনে৷’

‘কখনও জানতে চেয়েছ, গোলাপি তোমাকে বিয়ে করতে চায় কিনা?’

‘জানার কী আচে দিদিমণি? নিবারণকাকা যার সনে বে দেবে, তার সনেই তাকি বে করতি হবে৷’

‘গোলাপি তো তোমাকে বিয়ে করতে চায় না? তুমি গেঁজেল৷ কেনই বা ও তোমায় বিয়ে করবে?’

‘গ্যাঁজা কি সাধে খাই দিদিমণি৷ গাঁজার গন্ধে সাপ কাচে আসেনি৷ গোলাবি আমারে বে করতি চায়নে৷ তা’লি তো আর কতা কয়ে লাভ লাই৷ তারি বলি দেবেন, পরাণের কপালে ভাল মেয়া জুইটবে৷’

‘কথাটা নিবারণকে তুমি বলে দিতে পারবে?’

‘না, পারবুনি৷ নিবারণকাকারে সবাই মান্যিগণ্যি করে৷ তেনারে দুখখো দিতে পারবুনি৷ গোলাবি কলকেতায় ছেল৷ শহুরে মেয়াদের মতো লষ্ট হইয়ে গ্যাচে৷ আমি আসসি দিদিমণি৷ আপনের সনে কথা কয়ে লাভ লাই?’

কথাগুলো বলেই গেটের দিকে হাঁটা দিল পরাণ৷

‘লষ্ট হইয়ে গ্যাচে’ কথাটা শুনে রাগে শরীর চিড়বিড় করে উঠল তরিতার৷ কিন্তু, ধমক দেওয়ার সুযোগটাও দিল না পরাণ৷ একবার ভাবলেন, ডেকে এনে ওকে শান্তি আর শোভার সামনেই ঠাস করে চড় মারেন৷ শেষ মুহূর্তে নিজেকে তিনি সামলে নিলেন৷ চন্দ্রভানু থেকে এই পরাণ… বিত্তবান থেকে বিত্তহীন, সব পুরুষেরই এক রা৷ মেয়েদের সম্পর্কে যা ইচ্ছে ভাবা যেতে পারে৷ যা ইচ্ছে মন্তব্য করা যেতে পারে৷ মেয়েরা যেন পুরুষদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি৷ ভোগ লালসা নিবৃত্তি আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র৷ মেয়েরা মুখ বুজে সব মেনে নেয় কেন, তরিতা বুঝতে পারেন না৷ দীর্ঘদিন তিনি আমেরিকায় ছিলেন৷ নারী স্বাধীনতা কী, নিজের চোখে দেখে এসেছেন৷ দয়াপুরে না এলে হয়তো তিনি জানতেও পারতেন না, দেশের প্রান্তিক সমাজে মেয়েদের অবস্থানটা এখন ঠিক কী? শোভা, শান্তিদের জন্য মাঝে মাঝে দুঃখ অনুভব করেন তিনি৷ চরম দারিদ্র্য আর অবহেলার শিকার৷ অথচ কত সৎ, একনিষ্ঠ আর প্রাণবন্ত! একেক সময় তরিতা ওদের জন্য গর্ববোধ করেন৷ কেননা, পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের বিরুদ্ধে ওরা প্রতিবাদ করতে শিখছে৷

একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হারাণ৷ ওর চোখ-মুখই বলে দিচ্ছে, পরাণের গোঁয়ার্তুমি পছন্দ করেনি৷ তরিতা তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘ পরাণকে তুমি চেনো, হারাণ?’

‘চিনি মা জননী৷ বীণাপানির ঠেনে ওর বাড়ি৷ ও ছাবাল ভাল লয়৷ বাপ-মারি খেতি দ্যায় না৷ লদীর উদিগে জেলিপাড়ায় উর একডা ঘর আচে৷ শুইনেচি, ডালিম বইলে একডা মেয়ারে বে করেচেল৷ সি বউ পাইলে গ্যাচে৷ একডা বচরও ঘর করতে পারেনি৷’

তরিতা চমকে উঠে বললেন, ‘কী বলছ তুমি? পরাণের একটা বউ ছিল?’

‘সি বউ পাইলে গেচিল বালি দ্বীপে৷ গদখালি থেইকে আপনি সজনেখালির দিকে আসতেচেন…ঠিক তার ডাইনদিকে বালি দ্বীপ৷ পাইলে যাবেই বা না ক্যান মা জননী? লদীর জলে মীন ধইরে সি রোজগের করত মাসে দু’ হাজার ট্যাকা৷ সি মেয়া পরাণের কতা শুইনবে ক্যানে? রোজ চুইলোচুলি৷ সহ্যি করতি না পেইরে একদিন ডালিম গে উঠল বালি দ্বীপে বিরিঞ্চি সরদারের ঘরে৷ তার সনে বোধয় পেম-পীরিত হইয়েছেল৷’

‘পরাণ কিছু বলল না?’

‘বইলবে কোন মুকে মা জননী? বালি দ্বীপে উ আর যেতি পারবেনি৷ উকে বিরিঞ্চি বইলেচেল, ডালিম যে তুর বে করা বউ, পেরমাণ দে৷ দেবি কী কইরে? সি যে বোনবীবীর মন্দিরে গে বে করেচেল৷’

‘ডালিম এখন কোথায় তা হলে?’

‘সি কঠিন মেয়া৷ বিরিঞ্চির ঘর থেইকেও পাইলেচে৷ শুইনেচি, কুলতলিতে পেটকূলচাঁদ লদীর ধারে গে সি উটেছেল অধর ঘরামির কাচে৷ কিচুদিন সিখেনেই ছেল৷’

‘অধর ঘরামি ওকে ঠাঁই দিল কেন?’

‘ক্যান দেবি না, বলেন? একে যুবতী মেয়ামানুষ, তায় উকে ঘরে তুললি, মাসে কড়কড়ে দু’হাজার ট্যাকা ঘরে আইসবে৷ দিন-কাইল বইদলে গ্যাচে মা জননী৷ মীন ধরার ট্যাকা মেয়ামানুষরে বদইলে দিয়েচে৷’

‘ডালিমকে একবার আমার কাচে নিয়ে আসতে পারবে হারাণ?’

‘তাকি কোতায় পাব মা জননী? তাকি নে থানা-পুলিশ হইয়ে গ্যাচে৷ বিরিঞ্চি কুলতলি থানায় নালিশ করতি গেচিল৷ খপর পে পরাণ আর অধরও থানায় হাজির৷ তিনজনই বলে, আমার বউ৷ খিচিমিচি দেকে সবাইরে দারোগাবাবু ভাগায়ে দেলেন৷ কইলেন, ডালিম তেনার কাচে থাইকবে৷ তেনার পরিবার থাকেন কলকেতায়৷ ঘর গেরস্থালির কাম সামলানোর জন্যি একডা যুবতী মেয়া দরগার৷ ডালিম একন সিখেনেই আচে৷’

‘দারোগাবাবু কি ওকে আটকে রেখেছেন?’

‘কী আর কইব মা জননী৷ আপনি তো সবই বোঝেন৷ দারোগাবাবুর মুকের উপর কথা কইবে, কে? তবে ভাল হইয়েচে৷ এদানী… লদীতে মীন ধরা মানা কইরে দিয়েচে সরকার৷ দারোগাবাবুর ওখেনে ঠাঁই পেইয়ে ডালিম বেঁইচে গ্যাচে৷ না’লে না খেইতে পেইয়ে মেয়াডা মরত৷ অতবা ক্যানিংয়ে চইলে যেত গতর বেইচতে৷’

‘তোমাদের এখানে সব পুরুষই কি সমান হারাণ? মেয়েদের উপর এত অত্যাচার… কেন?’

 ‘আমি মুখখু মানুষ৷ কী কইরে উত্তরডা দি, বলেন দিনি৷ বাপ-ঠাকুরদারে দেইকে শেকা৷ আর কিচু কইতে পাইরব না৷ তবে, আমি ঠিক কইরেচি মা জননী৷ মালতীর গায়ে আর কখুনও হাত তুলবনি৷ আপনি যা শিককে আমায় দেচেন, সারা জেবনেও ভুইলবনি৷’

‘কয়েকদিন ধরে মালতী আমার কাছে আসছে না কেন হারাণ?’

উত্তর না দিয়ে হারাখ মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল৷ দেখে শোভা ঠাট্টা করল, ‘কিছু বলছ না ক্যান হারাদা? মাকে আমি বলে দেবো নাকি?’

তরিতা বললেন, ‘কী ব্যাপার রে শোভা?’

‘হারাদা যে বাবা হতে যাচ্চে, মা৷ পেরথম সন্তান৷ বাড়িতে তাই মালতীর খুব যত্ন আত্যি করচে৷’

‘তাই নাকি? বাঃ, ভাল খবর৷ শোনো হারাণ, যদি টাকা পয়সা লাগে, আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও৷’

হারাণ বলল, ‘দরকার হবেনি মা জননী৷ অঙ্গনওয়াড়ি দিদিমণি বাড়িতে এইসেচিলেন৷ পঞ্চায়েতের জননী সুরক্ষা ইস্কিমের কতা বইলে গ্যাচেন৷ হাসপাতালে বাচ্চা হলি তেনারা হাজার টাকা দেবি বইলেচেন৷ বাড়িতে ধাই বাচ্চা বিয়োলে সি ট্যাকা পাওয়া যাবেনি৷ তাই মালতীরে নে গে গোসাবা হাসপাতালে দেইককে এনেচি৷ তেনারা যাতায়াতির খরচ দিবেন, বইলেচেন৷ তাপ্পর বাচ্চা হলি আরও ট্যাকা৷ আমার ট্যাকা নাগবেনি মা জননী৷ আজ তা’লে আসি?’

‘আচ্ছা, এখন এসো৷ মালতীকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দিও, কেমন?’

গড় হয়ে প্রণাম করে হারাণ গেটের দিকে চলে গেল৷ ঠিক সেইসময় কিচেনের পিছন থেকে হুটোপাটির শব্দ ভেসে এল৷ একসঙ্গে অনেকগুলো হাঁসের আর্ত ডাক৷ কিচেনের ওদিকে, একটা ছোট জলাশয় মতো আছে৷ সেখানে রিসর্টের পোষা হাঁসগুলো ভেসে বেরায়৷ নিঃঝুম দুপুরে কোনও কোনও দিন হাঁসের ডিমের লোভে গরগিল ঢুকে পড়ে৷ মানে, গোসাপ৷ বোধহয় আজও সে রকমই কিছু ঘটেছে৷ বুঝতে পেরে শান্তি আর শোভা একই সঙ্গে সেদিকে ছুটে গেল৷ গরগিলগুলো বেশ বড় বড়৷ আসে কাছাকাছি ঝিল থেকে৷ রিসর্টের প্রবীণবাবু মানা করে দিয়েছেন, কেউ যেন ওদের না মারে৷ তাতে ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স নষ্ট হয়৷ গরগিলরাও বোধহয় মালিকের মনোভাব টের পেয়ে গিয়েছে৷ সেই কারণে ওদের অত্যাচার দিন কে দিন বাড়ছে৷

ডাইনিং হলে একা চুপ করে বসে রইলেন তরিতা৷ ভাবতে লাগলেন, গোলাপি সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়৷ ডালিমের কথা সম্ভবত গোলাপি জানে না৷ জানলে আরও বেঁকে বসবে৷ ওর জন্য ভাল একটা পাত্তর দেখে রাখতে হবে৷ সে কে হতে পারে, প্রশ্নটা মাথায় নাড়াচাড়া করার ফাঁকে, তরিতা দেখতে পেলেন, জুলজিস্ট কমলেশবাবু যে সুইডিশ ভদ্রলোককে নিয়ে রিসর্টে উঠেছেন, তিনি ক্লাবঘরে একমনে বিলিয়ার্ডস খেলে যাচ্ছেন৷ এত বড় একটা বিলিয়ার্ডস টেবল প্রবীণবাবু এখানে নিয়ে এলেন কী করে, ভেবে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান তরিতা৷ নিশ্চয়ই বিদেশিদের কাছে এই বিলিয়ার্ডস টেবল একটা বাড়তি আকর্ষণ৷ মায়ামিতে থাকার সময় তিনিও বিলিয়ার্ডস খেলে হাত পাকিয়েছেন৷ নেহাত মন্দ খেলেন না৷ একবার তো হাজার পয়েন্টের একটা ব্রেক করে তিনি চমকে দিয়েছিলেন এডবেরিকে৷ এখানে সুইডিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে একদিন একহাত খেললে হয়!

মনের মধ্যে কথাটা উদয় হয়েই মিলিয়ে গেল৷ বাঁ দিকে তাকিয়ে তরিতা দেখলেন, গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসছে নেত্রা৷ ওর ঠিক পিছনেই বলাই৷ ছেলেটার পরনে স্ট্রাইপড টি শার্ট আর জিনসের প্যান্ট৷ ওর দু’হাতে দুটো ব্যাগ৷ বলাইকে দেখা মাত্রই মুচকি হাসলেন তরিতা৷ গোলাপির পাত্র তিনি পেয়ে গিয়েছেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *