তরিতা পুরাণ – ২০

(কুড়ি)

বারুইপুরের ব্রিজের নীচে ওর জন্য যে এত বড় একটা বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে, অঙ্কুশ তা স্বপ্নেও ভাবেনি৷ সুন্দরবন টাইগার ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য ব্রিজের নীচে ও দাঁড়িয়েছিল৷ এমন সময় সাদা রঙের একটা ইনোভা গাড়ি ওর সামনে হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়াল৷ গাড়ির পিছনের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জয় বলল, ‘এই অঙ্কুশ, তুই এখানে? কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’

গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে ওদেরই বয়সি আর একটা ছেলে৷ মাথায় পনি টেল৷ ছেলেটাকে আগে কোথাও দেখেছে বলে অঙ্কুশের মনে হল৷ তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে জয়কে ও বলল, ‘হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি দয়াপুর বলে একটা জায়গায়৷ কিন্তু, তুই যাচ্ছিস কোথায়?’

‘ঝড়খালির দিকে৷ দারুণ একটা ইন্টারেস্টিং স্টোরি করার জন্য৷ আজ রাতের মধ্যেই ফিরে আসব৷ তোর হাতে যদি খুব জরুরি কোনও কাজ না থাকে, যাবি নাকি আমাদের সঙ্গে?’

‘কী স্টোরি রে?’

‘একজন জলদস্যুর ইন্টারভিউ নিতে যাচ্ছি৷ ইন্ডিয়ান পাইরেট৷ তার নাম পালান সরদার৷ মোহনায় জেলেদের মাছভর্তি ট্রলার ছিনতাই … যার কাছে জল-ভাতের মতো ব্যাপার৷ লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে৷ ভেরি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার৷ পুলিশও বহু বছর তাকে ধরতে পারছে না৷ যাবি নাকি তাকে দেখতে? এই রকম এক্সপেরিয়েন্স কিন্তু তোর সারা জীবনেও হবে না৷’

পুলিশ যাকে ধরতে পারে না, তাকে জয় এত সহজে পাবে কী করে, অঙ্কুশের মাথায় ঢুকল না৷ রিপোর্টারদের পক্ষে হয়তো সবই সম্ভব৷ টিভিতে ‘পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান’ সিরিজের দুটো ছবি ও আর টিটো একসঙ্গে বসে দেখেছে৷ সেই থেকে টিটো জনি ডেপ-এর খুব ফ্যান৷ কিন্তু, সুন্দরবনের নদীতেও পাইরেটস দেখা যায় নাকি? জেনে খুব কৌতূহল হল অঙ্কুশের৷ নিজের চোখে কোনও জলদস্যু দেখে বাড়িতে ফিরে গিয়ে যদি ও গল্প করে, তা হলে টিটোর চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে৷ জয়ের অনুরোধটা শুনে ও দ্বিধায় পড়ে গেল৷ দয়াপুরে আজ না গেলেও চলবে৷ ফোন করে একবার বলে দিলেই হবে, যেতে পারছে না৷ কাল বা পরশু যাবে৷ কিন্তু, জনি ডেপ-এর মতো জ্যান্ত জলদস্যু জীবনেও দেখার সুযোগ পাবে না৷

কী মনে হল, অঙ্কুশ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল, জয়ের সঙ্গে যাবে৷ এক পিঙ্কি বউদি ছাড়া বাড়ির আর কেউ জানে না, ও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে৷ জয়ের সঙ্গে ঝড়খালিতে গেলে পিঙ্কি বউদি খুব চটবে৷ বলবে, ‘তোমার কাণ্ডজ্ঞানের উপর আমি আর ভরসা রাখতে পারছি না ঠাকুরপো৷’ কিন্তু, কে যেন সেদিন বলল, ঝড়খালির বাজারে খুব ভাল মধু পাওয়া যায়৷ খলসি ফুলের সাদা মধু, খুব উপকারী৷ টিটো প্রায় সর্দিকাশিতে ভোগে৷ বড়মা রোজই ওকে তুলসী পাতা আর মধু খাওয়ান৷ টিটোর জন্য সাদা মধু কিনে নিয়ে ফিরলে পিঙ্কি বউদিকে চুপ করানো যাবে৷ কথাটা ভেবে অঙ্কুশ বলল, ‘চল, তোর সঙ্গে যাই৷ সত্যি, চোখের সামনে একজন পাইরেট দেখা ভাগ্যের ব্যাপার৷’ কথাগুলো বলে ও গাড়িতে উঠে পড়ল৷

বেলা আটটার সময় অঙ্কুশ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল৷ সুন্দরবন টাইগার ক্যাম্প রিসর্টের ম্যানেজার স্বরূপ বিট বলেছিলেন, ‘আমাদের বাস ছাড়ে কলকাতার প্রিয়া সিনেমার কাছ থেকে৷ সেটা আসে বারুইপুরের উপর দিয়ে৷ আপনাকে স্যার পিয়ারা থেকে দেশপ্রিয় পার্ক অবধি যেতে হবে না৷ ইচ্ছে করলে আপনি বারুইপুর ব্রিজের নীচ থেকেও উঠতে পারেন৷ পিয়ারা থেকে সেটাই অনেক কাছে হবে৷’

ভদ্রলোক আরও বলেছিলেন, ‘নতুন ব্রিজের তলায় দেখবেন, ‘বউদির চা’ বলে একটা পপুলার দোকান আছে৷ সকাল ন’টা দশ-পনেরো মিনিট নাগাদ সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন৷ আমাদের বাস আপনাকে তুলে নেবে৷’

দয়াপুরের ওই রিসর্টে অঙ্কুশকে যেতে হচ্ছিল তার কারণ, দিন পাঁচেক আগে মায়ামি থেকে ও একটা চিঠি পেয়েছে৷ তাতে স্তেফান এডবেরি বলে এক ভদ্রলোক লিখেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় স্নেকওয়ার্ল্ড পত্রিকায় আপনার একটা প্রবন্ধ পড়ে খুব ভাল লাগল৷ দুটি ভিন্ন প্রজাতির সাপের মিলন ঘটিয়ে আপনি যে নতুন একটা প্রজাতির সাপ জন্ম দেওয়ার কথা ভাবছেন, এটা আমাকে বিস্মিত করেছে৷ প্রায় তিরিশ বছর মায়ামির সার্পেন্টেরিয়ামের সঙ্গে আমি জড়িয়ে রয়েছি৷ শুনেছি, বিশ্বে দু’একজন হারপেটোলজিস্টকে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন৷ কিন্তু, খুব বেশিদূর এগোতে পারেননি৷ আপনি সফল হলে, সেটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা হবে৷’

চিঠিটার এই অংশটুকু পড়ে অঙ্কুশ একটু অবাকই হয়েছিল৷ কেননা, প্রবন্ধটা ও লিখেছিল দিল্লির‘স্নেক’ বলে একটা ম্যাগাজিনে৷ সেটা ‘স্নেকওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায় কী করে প্রকাশিত হল, ও বুঝতে পারছিল না৷ কিন্তু, পরে ওর মনে হয়েছিল, দিল্লির ম্যাগাজিনে পড়ে ভাল লাগায় হয়তো অস্ট্রেলিয়ানরা ছেপেছে৷ তখনই ওর মনে পড়েছিল, হ্যাঁ… স্তেফান এডবেরির নামটা ও ইন্টারনেটে দেখেছে৷ ইউনেস্কোর অ্যাডভাইসার৷ বিশ্ববিখ্যাত হারপেটোলজিস্ট৷ ‘অ্যানাকোন্ডা’ সিনেমাটা করার সময় স্টিভেন স্পিলবার্গ সম্ভবত ওই ভদ্রলোকেরই সাহায্য নিয়েছিলেন৷ কৃতজ্ঞতা স্বীকারে ওঁর নামটা অঙ্কুশ পর্দায় দেখেছে৷

চিঠির পরের অংশটা আরও বিস্ময়কর৷ এডবেরি লিখেছেন, ‘আমার ভারতীয় বন্ধু তরিতা সুন্দরবন বদ্বীপে একটা এভিএস তৈরির সেন্টার করতে চান৷ সেখানে আপনার মতো বিশেষজ্ঞের খুব প্রয়োজন৷ অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি ওই সেন্টারে যোগ দিন৷ আপনার বেতন মাসিক দু’ হাজার ডলারের মতো হবে৷ ওখানে আপনি রিসার্চের কাজও চালিয়ে যেতে পারবেন৷ আরও দু’জন নামকরা সর্পবিজ্ঞানী সেন্টারে যোগ দিচ্ছেন৷ স্নেকওয়ার্ল্ড পত্রিকা থেকে আপনার মেল অ্যাড্রেসটা নিয়ে আপনাকে আমি দিন দুয়েক আগে মেল পাঠিয়েছি৷ তা সত্ত্বেও, একটা হার্ড কপি পাঠালাম৷ সত্বর উত্তর দেবেন৷ তরিতার সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করলে খুশি হব৷’ চিঠিটার তলায় তরিতা দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার ফোন নম্বর আর ঠিকানাটাও ছিল৷

সেদিন চিঠিটা পড়ার সময় কাছেই বসেছিল পিঙ্কি বউদি৷ কী চিঠি, কে পাঠাল… এই দুটো প্রশ্ন পিঙ্কি বউদি করবেই৷ তাই বউদির কৌতূহল আরও বাড়ানোর জন্য অঙ্কুশ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল৷ যেন চিঠিটা পড়ে খুব দুর্ভাবনায় পড়েছে৷ যা ভেবেছিল, ঠিক তাই হল৷ পিঙ্কি বউদি জিজ্ঞেস করল, ‘কার চিঠি গো ঠাকুরপো?’

চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে অঙ্কুশ বলেছিল, ‘ পড়ে দেখো, আমেরিকা থেকে আমাকে চাকরির অফার দিয়েছে৷ মাইনে মাসে দু’হাজার ডলার৷ মানে সোয়া লাখ টাকারও বেশি৷ এখন আমি কী করি বলো তো?’

হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে চট করে চোখ বুলিয়ে পিঙ্কি বউদি বলেছিল, ‘সত্যি তোমার কপাল দেখে আমার হিংসে হচ্ছে ভাই৷ একটু আগে খেতে বসার সময় তোমার ভাঁও ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা৷ খাওয়া ছেড়ে উঠতে না উঠতেই বেড়ে গিয়ে দাঁড়াল সোয়া লাখে! কেউ ঠাট্টা করছে না তো?’

‘তা করুক, কিন্তু আমার প্ল্যান যে সব চৌপাট হয়ে গেল৷’

‘কীসের প্ল্যান গো?’

‘এই… হর্সশু ক্র্যাবের ছবি তোলার জন্য হেনরি আইল্যান্ডস যাওয়ার প্ল্যান৷ তার বদলে আমাকে এখন দয়াপুর গ্রামে যেতে হবে৷ সত্যিই বউদি, আমার কী কপাল দেখো৷ পার্সোনাল লাইফের কথা যখন ভাবছি, তখনই প্রোফেশনাল লাইফ এসে বাগড়া দিচ্ছে৷ কাউকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন… মনে হয় কোনওদিনই আমার সফল হবে না৷’

‘কিন্তু, তোমার প্ল্যান বদলানোর তো কোনও দরকার নেই৷ চিঠিতে দেখলাম, ওঁরা কোথাও বলেননি, কবে গিয়ে তোমায় ইন্টারভিউটা দিতে হবে৷ তুমি জানিয়ে দাও না, এক সপ্তাহ পরে গিয়ে দেখা করবে৷’

‘দেখি তা হলে একবার ফোন করে৷ ইসস, সাউথ সিটির তিরিশ তলায় থাকার সুযোগটা আমার চলে গেল গো৷ সেই সঙ্গে ফস্কে গেল স্করপিও গাড়িটাও৷’

শুনে বউদি রেগেমেগে উঠে দাঁড়িয়েছিল, ‘তুমি যা ইচ্ছে করো৷ তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না৷ ছিঃ৷’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷

সেদিনই সন্ধেবেলায় অঙ্কুশ ফোন করেছিল তরিতা বলে ভদ্রমহিলাকে৷ কিন্তু ফোনটা ধরেছিলেন নেত্রা বলে একজন৷ ভদ্রমহিলা বোধহয় পিএ৷ উনি বলেছিলেন, ‘দয়াপুরে কীভাবে আসতে হবে, তা রিসর্টের ম্যানেজার বুঝিয়ে দেবেন৷’ মনে হয়, ওঁরা খুব পেশাদার৷ কেননা, মিনিট দশেকের মধ্যেই ফোন এসেছিল রিসর্টের ম্যানেজারের৷ তখনই অঙ্কুশ কথাবার্তা সেরে নিয়েছিল৷ কিন্তু, জয়ের গাড়িতে উঠে পড়ার পর ওর মনে হল, খুব অপেশাদারের মতো কাজটা করে ফেলল৷ রিসর্টের গাইড ‘বউদির চা’য়ের দোকানের সামনে ফালতু ওকে খোঁজাখুজি করবে বাস দাঁড় করিয়ে রেখে৷ ক্যানিংয়ের দিকে খানিকটা এগনোর পর অঙ্কুশ আত্মগ্লাণিতে ভুগতে লাগল৷ কথার খেলাপ করাটা ওর একেবারেই উচিত হয়নি৷ এই হঠকারিতার জন্য চাকরিটা নাও হতে পারে৷ যাক গে, যা কপালে আছে, তাই হবে, ভেবে ও জানলার দিকে তাকাল৷

‘তোর সঙ্গে বিরসার আলাপ নেই?’

জয়ের প্রশ্নটা শুনে অঙ্কুশ মুখ ফিরে তাকাল৷ ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা ছেলেটাকে ঈঙ্গিত করে জয় ফের বলল, ‘আরে, আমি ভাবলাম, তুই ওকে চিনিস৷ বিরসা সেন… খুব নামকরা ফোটোগ্রাফার৷ দেশ-বিদেশে প্রচুর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ জিতেছে৷ বিরসা সুন্দরবনেরই ছেলে৷ রিসেন্টলি আমাদের কাগজে জয়েন করেছে চিফ ফোটোগ্রাফার হিসেবে৷ সেই কারখেই ওকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি৷’

বিরসা নমস্কার করায় অঙ্কুশ প্রতি নমস্কার করল৷ এইবার ওর মনে পড়ল, ছেলেটাকে কোথাও দেখেছে৷ তাই বলল, ‘তোমাকে আমি আগে একবার দেখেছি ভাই৷ বাসন্তীতে বইমেলা উৎসবে৷ ওখানে তুমি একটা ফোটো একজিবিশন করেছিলে সুন্দরবনের উপর তোলা ছবি নিয়ে৷ তোমার ছবিগুলো আমার এত ভাল লেগেছিল যে, সব ছবি আমি খুঁটিয়ে দেখেছিলাম৷’

বিরসা বলল, ‘থ্যাঙ্কস৷ আমারও কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল তোমাকে৷ ওখানে তুমি সাপের উপর একটা লেকচার দিয়েছিলে৷ তাই না? তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে, সুন্দরবন থেকে চন্দ্রবোড়া আর শাখামুটি সাপ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে৷ আগে ছোটবেলায় গাঁয়ে আমরা এ ধরনের সাপ প্রচুর দেখতাম৷ এখন চোখেই পড়ে না৷’

অঙ্কুশ বলল, ‘সাপ নিয়ে তোমার আগ্রহ আছে নাকি?’

‘প্রচুর৷ আমার নিজের তোলা সাপের ছবির একটা সিরিজ আছে৷ প্রায় হাজারখানেক ছবি৷ সব রেয়ার মুহূর্ত৷ দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে৷ তোমার হয়তো কাজেও লেগে যেতে পারে৷’

‘কবে দেখাবে আমায় বলো৷ তোমার বাড়িতে গিয়ে আমি দেখে আসব৷ তুমি থাকো কোথায় বিরসা?’

‘গড়িয়ার শেরউড অ্যাপার্টমেন্টে৷ তুমি কোথায় থাকো?’

‘তোমার খুব বেশি দূরে নয়৷ পিয়ারা গ্রামে৷ সাপের এত ছবি তুমি তুললে কোথায়?’

‘তোমাকে বর্ধমানের একটা গ্রামের কথা বলছি৷ কাটোয়া লাইনে দোপাঁচলা বলে একটা গ্রাম আছে৷ সেখানে যত মানুষ থাকে, তার তিনগুণ সাপ তুমি দেখতে পাবে৷ সত্যি, ছবি তুলতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম ৷ সারা গ্রামে সাপ কিলবিল করছে৷ পরে শুনলাম, শুধু দোপাঁচলাতেই নয়, আশপাশে আরও তিনটে গ্রাম আছে, যেখানে মানুষের থেকেও বেশি সাপ বসবাস করে৷’

জয় চুপচাপ কথা শুনছিল৷ ও প্রশ্ন করল, ‘কোন সাহসে লোকগুলো ওই গ্রামে থাকে রে? সাপগুলো ওদের কামড়ায় না?’

বিরসা বলল, ‘কামড়াবে কেন? ওখানে ঝঙ্কেশ্বরী মায়ের মন্দির আছে৷ তাঁর আদেশে কেউ সাপ মারে না৷ ফলে ওদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছেই৷ আমি নিজের চোখে দেখেছি অঙ্কুশ, এক মহিলার হাতের উপর সাপ ফণা তুলে আছে৷ আমি ভাবলাম, এই বোধহয় ছোবল মেরে দেবে৷ কিন্তু, কী আশ্চর্য! মহিলার কাকুতি মিনতি করে যে-ই ঝঙ্কেশ্বরী মায়ের নাম করল, অমনি সাপটা ফণা নামিয়ে নেমে গেল৷ অন্য কারও মুখে শুনলে আমি বিশ্বাস করতাম না৷ সেই ছবি আমার কাছে আছে৷ মায়ামির সার্পেন্টেরিয়ামের ফোটো কনটেস্টে সেই ছবি পাঠিয়ে আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম৷’

সাপ নিয়ে কথা বলতে বলতে গাড়ি বাসন্তীর চৌমাথার মোড়ে পৌঁছে গেল৷ বাঁ দিক দিয়ে গেলে গদখালির ফেরিঘাট৷ ডান দিকের রাস্তাটা এগিয়েছে ঝড়খালি বাজারের দিকে৷ মোড়ে তির চিহ্ন দিয়ে লেখাও আছে৷ সেটা চোখে পড়ায় জয় ড্রাইভারকে বলল, ‘উত্তম, পেট্রোল পাম্পের সামনে গাড়িটা দাঁড় করা৷ একজনকে তুলতে হবে এখান থেকে৷ স্থানীয় লোক, এ সঙ্গে না গেলে পালান সরদার পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে না৷’

বিরসা বলল, ‘তুমি গাড়িতেই থাকো জয়দা৷ আমি রসিক মণ্ডলকে ডেকে আনছি৷ মালটাকে আমি একবার বোধহয় পার্টি অফিসে দেখেছি৷ দেখলেই চিনতে পারব৷’

গাড়ি থেকে বেরিয়ে বিরসা পেট্রোল পাম্পের দিকে হেঁটে গেল৷ প্রায় ছ’ফুট লম্বা ছেলেটা৷ বোধহয়, শরীরর্চ্চা করে৷ ওর হাঁটার ধরন দেখেই বোঝা যায়, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী আর খাটতে পারে৷ চোখ সরিয়ে নিয়ে অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘এই রসিক মণ্ডল লোকটা কে রে?’

‘রাজনীতি করে৷ ঝড়খালির জঙ্গলটা হাতের তালুর মতো চেনে৷ এ জানে, কোথায় গেলে পালান সরদারকে পাওয়া যাবে৷ মিনিস্টার বলে দিয়েছে, তাই রসিক আমায় নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে৷ আন্ডার ওয়ার্ল্ডের লোকজন পলিটিক্যাল পার্টির শেল্টার নেয়, তুই তো জানিস৷ পালানও অ্যাদ্দিন একটা পার্টির শেল্টারে ছিল৷ তাই পুলিশ ওকে ধরেনি৷ জানিস, লোকটাকে নিয়ে একটা মিথ তৈরি হয়ে গেছে ভাঁটির দেশে৷ ওর সম্পর্কে জানার জন্য ভবানী ভবনে পুলিশের দফতরে ঢুঁ মেরেছিলাম৷ ওঁরা বললেন, গত কুড়ি বছরে মাত্র একবারই নাকি পুলিশ ওকে ধরতে পেরেছিল৷ খবর পেয়ে জয়নগরের ফেরিঘাটে ওকে ধরতে গিয়েছিলেন কুলতলি থানার ওসি৷ সঙ্গে একজন কনস্টেবল নিয়ে৷ পালানকে ধরে নিয়ে এসেছেন, শুনে নাকি সেই কনস্টেবল অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল৷ লোকটাকে নাকি সবাই এমন ভয় পায়৷’

‘পালান লোকটা সত্যিই খুব ইন্টারেস্টিং তো!’

‘আরে… সুন্দরবনে লোকের ধারণা, পালানের শরীরে এমন সব শেকড় ঢোকানো আছে, যার জন্য গভীর জঙ্গলে বাঘ ওকে ছোঁয় না৷ সাপ আর কুমির পালিয়ে যায়৷ লোকটা নাকি শূন্যে বসে থাকতে পারে৷ ওর নিজের একটা ডিঙি আছে কালো রঙের৷ সেটা নাকি নদীপথে উড়ে যায়৷ পালান লোকটাও নাকি এমন কালো যে, অন্ধকারে ওকে দেখতেই পাওয়া যায় না৷ এমন অনেক রটনা আছে ওকে নিয়ে৷ একশোটার মতো ডাকাতি করেছে৷ মানুষ মেরেছে আরও বেশি৷ ওকে নিয়ে মিথ তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক৷’

‘সত্যি, তোদের… রিপোর্টারদের কত রকম লোককে নিয়ে লিখতে হয়, তাই না!’

‘আফসোস করিস না ভাই৷ আমরা রিপোর্টাররা জ্যাক অফ অল ট্রেডস, বাট মাস্টার অফ নান, বুঝলি৷ এর থেকে, তোর মতো যে কোনও একটা বিষয়ে এক্সপার্ট হওয়া অনেক ভাল৷’

জয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল৷ এমন সময় রসিক মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বিরসা৷ পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া৷ হাতে একটা লাঠি আর টর্চ৷ ছিপছিপে শরীর, মুখে ছুঁচলো দাঁড়ি৷ বিরসা বলল, ‘জয়দা, শোনো রসিক কী রসিকতা করছে৷ বলছে, রাতের বেলা ছাড়া পালান সরদারের দেখা পাওয়া যাবে না৷ বেকার বেকার এত সকালে বেরলাম৷ লাঞ্চের পর বেরলেই বোধহয় ভাল হত৷’

জয় পাত্তাই দিল না কথাটার৷ বলল, ‘আগে গাড়িতে ওঠ৷ তার পর ও সব নিয়ে ভাবা যাবে৷’

রসিক মণ্ডল সামনের সিটে গিয়ে বসে পড়ল৷ বিরসার কথাটা যে ওর পছন্দ হয়নি, সেটা বোঝানোর জন্য গজগজ করতে করতে ও বলল, ‘সে মেজাজি মানুষ৷ তাঁর দেকা পেতি হলি যেতি হবে সেই কাটা জঙ্গলে৷ দিনের দিনে সে বারয় না৷’

বোঝাই যাচ্ছে, রসিক কার কথা বলছে৷ জয় জিজ্ঞেস করল, ‘কাটা জঙ্গলটা কোথায় গো রসিক? ক’দ্দূর?’

‘ঝড়খালি বাজার থেনে পায়ি হেঁটি যেতি হবে৷ তিন কোরোশ৷’

জয় চমকে উঠে বিরসার দিকে তাকাল৷ বিরসা ফুট কাটল, ‘হয়ে গেল৷ আজ রাতে বোধহয় আর বাড়ি ফেরা হবে না৷’

জয় বলল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে৷ এদের তিন ক্রোশ মানে… মিনিমাম মাইল দশেক৷ এই ঝড় বাদলের দিনে অতটা রাস্তা হাঁটতে হবে! মনটাকে সেইভাবে তৈরি রাখিস৷’

… ঝড়খালি বাজারের পাইস হোটেলে ইলিশ আর পারশে মাছ দিয়ে লাঞ্চ সেরে বিকেল চারটের সময় বেরিয়ে জয় বলল, ‘চল অঙ্কুশ, এটাও তোর একটা অভিজ্ঞতা হবে৷ হন্টন প্রতিযোগিতা৷’

শুনে অঙ্কুশ মৃদু হাসল৷ আকাশে কালো মেঘ৷ যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে৷ কারও সঙ্গে একটা ছাতা পর্যন্ত নেই৷ বৃষ্টি হলে ভিজতে হবে৷ রসিক আগে আগে যাচ্ছে কথা বলতে বলতে৷ ওর ঠিক পিছনে জয়৷ বিরসার পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ, কাঁধে গদার মতো একটা লেন্স৷ ভারী জিনিস বইতে হওয়ায় বিরসা সামান্য পিছিয়ে৷ হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় অঙ্কুশ লক্ষ করল, ডাইনে বাঁয়ে কোথাও লোকালয় নেই৷ জঙ্গল শুরু হয়ে গিয়েছে৷ একদিকে গাছের সারি, অন্য দিকে ভেড়ি৷ কর্দমাক্ত আলের উপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে অতি সাবধানে৷ যে কোনও সময় পিছলে ভেড়িতে নেমে যেতে পারে৷ ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল৷

টর্চ জ্বালিয়ে রাস্তা দেখাচ্ছে রসিক৷ শুরু করল বাঘের গল্প৷ দু’তিনদিন আগে এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা বাঘিনী নাকি হেঁটে গিয়েছে পীরখালির দিকে৷ বছরের এই সময়টা ওরা বাচ্চা বিয়োয়৷ বাচ্চা যাতে বাঘ খেয়ে না ফেলে, সেই কারণে বাঘিনী দূরে কোথাও সরে যায়! রসিক বলল, ‘মামা যাকি টার্গেট করইবে, নিঃশব্দে তাকি তুলি নি যাবে৷ সঙ্গের নোক টেইরও পাবে না৷’

শুনে গা ছমছম করে উঠল অঙ্কুশের৷ জঙ্গলে কেউ বাঘ বলে না৷ বলে, মামা অথবা ফকিরবন্ধু৷ হেঁতাল গাছের ফাঁকে সেই নিঃশব্দ ঘাতক কোথায় লুকিয়ে আছে, কে জানে? অন্ধকারে ও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল, যাতে রসিক আর জয়ের কাছাকাছি থাকা যায়৷ মিনিট পাঁচেক পর পিছনে একবার তাকাতেই, অঙ্কুশের শরীর হিম হয়ে গেল৷ দেখল, বিরসা ধারে-কাছে কোথাও নেই৷ চিৎকার করে ও বলে উঠল, ‘জয়, এই জয়… বিরসা কোথায়? ওকে দেখা যাচ্ছে না রে৷’

(একুশ)

ভোরবেলায় রোজ হাঁটতে বেরন তরিতা৷ এই অভ্যেসটা মায়ামিতে তাঁকে ধরিয়েছিলেন স্তেফান এডবেরি৷ সার্পেন্টেরিয়ামের ক্যাম্পাসে প্রচুর খোলা জায়গা ছিল৷ আবাসিকরা অনেকেই সকাল-সন্ধ্যায় জগিং করতেন৷ দেখাদেখি তরিতাও নেমে আসতেন গেস্ট হাউস থেকে৷ দয়াপুরের ক্যাম্পে এসে সেই অভ্যেসটা ফের চালু করেছেন তিনি৷ টাইগার ক্যাম্পের বাইরে বিশাল ঝিল৷ তার পাশ দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা৷ একদিকে ওয়াক্সপল ফেরিঘাট হয়ে সোজা চলে গিয়েছে দয়াপুর বাজার পর্যন্ত৷ অন্যদিকে, শেষ হয়েছে লাহিড়িপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে৷ পিচখালি নদীর দিকটায় ফ্রেশ অক্সিজেন পাওয়ার জন্য তরিতা রোজ আধ ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করেন৷ তবে কখনও একা যান না৷ কখনও সঙ্গে থাকে নেত্রা, কখনও শান্তি৷

আজ অবশ্য তাঁর সঙ্গে রয়েছে শোভা৷ গোসাবায় ডাক্তার দেখিয়ে কাল অনেক রাতে ফিরেছে শোভারা৷ বৃষ্টি হচ্ছিল বলে ওরা আর গ্রামের বাড়িতে ফিরতে পারেনি৷ রিসর্টের হাট-এ শুয়ে পড়েছিল৷ বাচ্চাটাকে নিয়ে ওর শাশুড়ি বাসন্তী ভোরবেলায় বাড়ি চলে গিয়েছে৷ তরিতা শোভাকে রেখে দিয়েছেন কথা বলার জন্য৷ অনন্তকে শিক্ষা দেওয়ার আগে ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার৷ রিসর্টের গেট থেকে বেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে তিনি দেখলেন, ওয়াক্সপল ফেরিঘাটের সিঁড়িতে কয়েকটা লোক বসে আছে৷ অনেক রাতে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল বোধহয়৷ সদ্য ফিরে এসেছে৷ দূর থেকে বাতাসে বিড়ির গন্ধ পেলেন তরিতা… কেউ ধরিয়েছে৷ কোনও ধরনের কটু গন্ধ তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না৷ তাই ফেরিঘাটের দিকে পা না বাড়িয়ে, তিনি বাঁ পাশে ঝিলের দিকে এগোলেন৷

ঝিলের গায়ে পরপর তিনটে একই ধরনের মন্দির আছে৷ রিসর্টের মালিক প্রবীণ গর্গ বানিয়ে দিয়েছেন এই মন্দিরগুলো৷ সামনে অনেকটা চাতাল৷ বাঁ দিকে প্রথমটা শিবের মন্দির৷ একটা বড় ত্রিশূল রয়েছে ভিতরে৷ গাজনের সময় নাকি প্রচুর লোক আসে এই মন্দিরে৷ মাঝেরটায় বনবিবির বিগ্রহ আছে৷ সকাল-সন্ধ্যা পূজারী এসে পুজো করে দিয়ে যান৷ একেবারে ডানদিকে বজরঙ্গবলী অর্থাৎ কি না হনুমানজির মন্দির৷ অন্যদিন মন্দিরের দিকে যান না তরিতা৷ কোনও মন্দিরে মা মনসার বিগ্রহ নেই বলে৷ আজ শোভার সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলার জন্য বাধ্য হয়েই তিনি এদিকে এসেছেন৷

শিব আর হনুমানজির মন্দিরে প্রণাম সেরে এসে তরিতা বললেন, ‘কী ঠিক করলি শোভা? অনন্তর সঙ্গে আর ঘর করবি না?’

মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি এই প্রশ্নটা আশা করেনি শোভা৷ শূন্যচোখে তাকিয়ে ও বলল, ‘ না ম্যাডাম, আর সম্ভব না৷ দরকার হলে মেয়েটাকে আমি ক্যানিংয়ে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেবো৷ আর নিজে চলে যাবো বালিগঞ্জের সেই দাদুর বাড়িতে৷ তবুও, ওই লোকটার সঙ্গে আর থাকব না৷’

শোভার বাচ্চাকে ক্যানিংয়ের আশ্রমে রাখার কোনও অসুবিধে নেই৷ তবুও তরিতা বললেন, ‘বাচ্চাকে তোকে কোত্থাও পাঠাতে হবে না শোভা৷ তুই দয়াপুরেই থাকবি৷ অনন্তকে আমি এমন শিক্ষা দেবো, দেখবি ও তোর পায়ের তলায় থাকবে৷’

‘ও হচ্ছে কুত্তার দুম ম্যাম৷ কোনও কিছুতেই ওর শিক্ষে হবে না৷ আপনার কপাল ভাল, এমন একটা লোকের পাল্লায় আপনাকে পড়তে হয়নি ম্যাডাম৷’

শুনে কড়া চোখে তাকালেন তরিতা৷ এ ধরনের কথা তিনি পছন্দ করেন না৷ অন্য কেউ হলে ধমক দিতেন৷ কিন্তু, শোভা দুর্গাদির মেয়ে, তাকে কড়া কথা বলতে মন চাইল না৷ পাত্তা না দিয়ে তিনি বললেন, ‘ শুনেছিস নিশ্চয়ই, এখানে আমি একটা ল্যাবরেটরি করছি৷ সাপের বিষ থেকে ওষুধ তৈরি করার ল্যাবরেটরি৷ তবে সেটা করতে পারব কি না, তা নির্ভর করছে জমি পাওয়া না পাওয়ার উপর৷ গাঁয়ের দশটা মেয়েকে আমি ট্রেনিং দেবো৷ তার মধ্যে তুই আছিস৷ কীভাবে সাপের বিষ বের করতে হয়, আমি শেখাব৷ ল্যাবরেটরিটা চালু হলে, তোদের সংসারে কোনও অভাব থাকবে না৷’

‘তা হলে তো খুবই ভাল হয় ম্যাডাম৷ কিন্তু, চাঁদবাবু কি আপনাকে করতে দেবে? মহাশয়তান৷ কাকে যেন অনন্ত বলছিল, চাঁদবাবু নাকি সববাইকে বলে দেবে, কেউ যাতে আপনাকে জমি বিক্রি না করে৷’

‘গাঁয়ের লোকেরা যদি এমন মূর্খামি করে, তা হলে আমার কিছু বলার নেই৷ আমাকে তা হলে অন্য কোথাও জমি দেখতে হবে৷ কোটি কোটি টাকার ব্যাপার৷ আমি চাই না, এমন জায়গায় ল্যাবরেটরিটা করি, যেখানে লোকজন আমাকে সব সময় ডিসটার্ব করবে৷’

‘গাঁয়ের মানুষগুনো এ রকম ছিল না ম্যাডাম৷ আগে অনেক সহজ সরল ছিল৷ ইনকামের জন্য বাইরে বেরিয়ে কেমন যেন জটিল হয়ে গিয়েছে৷ অনন্তও আগে এমন বদমাশ ছিল না৷ এর্নাকুলুমে যাওয়ার পর থেকে একটু একটু করে বদলে গেল৷ এই দেখুন না, এ বার ট্রেনে আসার সময় ও সর্বস্ব খুইয়ে এল৷ তা সত্ত্বেও, ওর মধ্যে কোনও হেলদোল নেই৷ সংসার কীভাবে চলছে, খোঁজও রাখে না৷’

‘সত্যিই, তোদের এখন চলছে কী করে?’

‘শউরমশাই মউলেদের সঙ্গে জঙ্গলে গেছিল৷ কিছু মধু লুকিয়ে স্টক করে রেখেছিল৷ আড়াইশো টাকা করে কেজি৷ সেই মধু বিক্রি করে, কিছুদিন চলল৷ এখন ধান রোঁয়ার সময়৷ শউর,শাউরি দিন-মজুরি করে যা আনছে, তাতেই একবেলা খাওয়া জুটছে৷’

‘অনন্ত ধান রোয়ার কাজ করে না?’

‘করতে চায় না ম্যাডাম৷ সম্মানে লাগবে বলে৷ ও এর্নাকুলুমে চলে গেলে আমি বাঁচি৷ কিন্তু, ওখেনে নাকি এখন ঘোর বরষা৷ বাড়ি-ঘর তৈরির কাজ বন্ধ৷’

আকাশে মেঘ ডাকছে৷ যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে৷ রিসর্টে ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালেন তরিতা৷ সকালের দিকে এই সময়টায় রিসর্টে খাবারের লোভে প্রচুর পাখি আসে৷ টিয়া, দোয়েল, ফিঙে, শালিক, চড়াই, পায়রা, ঘুঘু, জলমুরগি, তিতির৷ পাখিদের আসার সময় হয়ে গিয়েছে৷ রোজ ওদের মুখে খাবার তুলে দেন তরিতা৷ আপেল, কলা, আঙুর, শশা, সূর্যমুখীর দানা, গম৷ কিচেনের পাশে একটা ফাঁকা জায়গা আছে৷ আশপাশের গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি নেমে আসে সেখানে৷ ওদের যাতে থাকতে অসুবিধে না হয়, সেই কারণে গাছে অনেক বাসা তৈরি করে দিয়েছেন রিসর্টের মালিক প্রবীণ গর্গ৷ পাখিদের কথা ভাবতে ভাবতেই মন্দিরের চাতাল থেকে বেরিয়ে এসে তরিতা আলের উপর উঠলেন৷ দু’পাশে দুটো ডোবা, বৃষ্টির জলে কাণায় কাণায় পূর্ণ৷ শোভার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি হাঁটছেন৷ তারই ফাঁকে তরিতা লক্ষ করলেন, ফেরিঘাটের লোকগুলো এসে দাঁড়িয়েছে আলের অন্য প্রান্তে৷ রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷

রিসর্টে ফিরতে হলে ওদের মাঝখান দিয়েই যেতে হবে৷ লোকগুলোর ভাবভঙ্গি দেখে শোভা দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘এদের মতলব ভাল ঠেকছে না ম্যাডাম৷ ফোন করে আপনি রিসর্টের গার্ডদের ডেকে পাঠান৷’

তরিতা বললেন, ‘এরা কারা, তুই চিনিস?’

‘একজনকে চিনি৷ ছেলেটার নাম হারান৷ বাজারে মাছ বিক্রি করে৷ গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার৷ রাতে অনন্তের সঙ্গে নেশা করে৷’

‘ভয় পাস না৷ তুই আমার সঙ্গে আয়৷ এদের আমি শায়েস্তা করছি৷’

শোভাকে শুনিয়ে জোরে জোরে মনসাস্তব শুরু করলেন তরিতা৷ তার পর দু’বার হাত ঘোরালেন৷ ঠিক তখনই দু’পাশের ডোবা থেকে কয়েকটা সাপ আলের উপর উঠে এল৷ গোখরো, কেউটে, কালাচ৷ এঁকেবেঁকে সাপগুলো দ্রুত এগোতে লাগল সামনের দিকে৷ লোকগুলো আলের মাঝামাঝি চলে এসেছে৷ ওরা আশাই করেনি, হঠাৎ এতগুলো সাপ একসঙ্গে ওদের তাড়া করবে৷ আতঙ্কে কয়েকজন পিছন দিকে দৌড় মারল৷ একজন কাদায় পিছলে পড়ে যেতেই তার সামনে গিয়ে দু’তিনটে সাপ ফণা তুলে ধরল৷ দূর থেকে তরিতা বললেন, ‘এই, ওকে এখনই মারিস না৷ আগে আমি কথা বলব৷’

শোভা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে৷ ও বিশ্বাসই করতে পারছে না, চোখের সামনে এই রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে! একটু পরে ধাতস্থ হয়েই আলে পড়ে থাকা ছেলেটাকে দেখিয়ে ও বলল, ‘এরই নাম হারান, ম্যাডাম৷ আমাদের মালতীর বর৷’

কাছে গিয়ে তরিতা বললেন, ‘কী রে হারান, তোরা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিলি, তাই না? এবার তোর কী হবে? সাপগুলোকে বলব নাকি, তোর শরীরে বিষ ঢেলে দিতে?’

হাউমাউ করে কেঁদে উঠল হারান৷ হাতজোড় করে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দিন মা৷ আপনাকে চিনতে পারিনি৷ আপনি সাক্ষাৎ মা মনসা৷ পায়ে পড়ি মা৷ ঘরে বউ-বাচ্চা আছে৷ আমাকে সাপে কাটলে ওরা পথে গিয়ে বসবে৷’

‘ঘরে বউ-বাচ্চা আছে৷’ ভেঙিয়ে উঠল শোভা, ‘বলতে তোর লজ্জা করল না শয়তান?’ মুখ ফিরিয়ে তার পর ও বলল, ‘এর কথা একদম বিশ্বাস করবেন না ম্যাডাম৷ মালতীর উপর এ যে কী রকম অত্যাচার করে, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না৷ মনসাতলায় গেছিল বলে এই ক’দিন আগে মালতীকে মারধরও করেছে৷’

তরিতা বললেন, ‘কী রে, শোভা যা বলছে, ঠিক?’

‘আর কোনওদিন করব না মা৷ মালতীকে মাথায় করে রাখব৷ এবারকার মতো মাফ করে দিন৷’

হারানের চোখ-মুখে মৃত্যুভয় দেখে খুশি হলেন তরিতা৷ বললেন, ‘তোকে মাফ করে দেবো, যদি একটা কাজ করতে পারিস৷ চাঁদের কাছে গিয়ে তোকে বলতে হবে, আমাকে ধরে নিয়ে যেতে হবে না৷ আমি নিজেই একদিন ওর কাছে যাব৷ সেইদিনটার জন্য যেন ও তৈরি থাকে৷’

হাতের ইশারায় সাপগুলোকে চলে যেতে বললেন তরিতা৷ তার পর ফের হারানকে বললেন, ‘মালতীর বর বলে… এবারের মতো তোকে ছেড়ে দিলাম৷ শোন, মালতীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আজই মনসাতলায় গিয়ে তুই ফুল চড়াবি৷ যদি পুজো না দিস, তা হলে রাতে গিয়ে এই সাপগুলোই একসঙ্গে তোকে কাটবে৷ বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে তুই মরবি৷ কথাটা মনে থাকবে তো?’

‘মনে থাকবে মা৷ মনে থাকবে৷’ বলে কাঁপতে কাঁপতে গড় হয়ে প্রণাম করল হারান৷

শুনে আর দাঁড়ালেন না তরিতা৷ দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলেন রিসর্টের দিকে৷ কংক্রিটের রাস্তায় ওঠার পর শোভাকে তিনি বললেন, ‘তোকে আর ভিতরে ঢুকতে হবে না৷ তুই বাড়ি চলে যা৷ বিকেলে মালতীকে সঙ্গে নিয়ে একবার রিসর্টে আসিস৷ আর শোন, আজ যা দেখলি, নিজের ভিতর রাখিস৷ মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে যাস না, কেমন?’

রাস্তার উপরই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল শোভা৷ হাতজোড় করে বলল, ‘এত কাছে থাকা সত্ত্বেও অ্যাদ্দিন তোমাকে চিনতে পারলাম না কেন মা?’

শুনে তরিতা হাসলেন৷ ম্যাডাম বলে ডাকত৷ আজ শোভার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে মা৷ দুর্গাদির মেয়ে হিসেবে ও মা বলে ডাকতেই পারে৷ শোভাকে কোনও উত্তর না দিয়ে, দ্রুত পায়ে রিসর্টের গেটের দিকে এগোতে লাগলেন তরিতা৷ গাছপালার ফাঁক দিয়ে হঠাৎই তাঁর গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল৷ টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷ ইস, বৃষ্টির জন্য পাখিরা মনে হয় আজ আর আসবে না৷ কথাটা ভাবতে ভাবতে গেটের খাল দিয়ে নামতে লাগলেন তিনি৷

নিজের ঘরে ঢুকেও তরিতা সুস্থির হতে পারলেন না৷ শোভার বলা একটা কথাই শুধু কানের কাছে বাজতে লাগল, ‘আপনার কপাল ভাল ম্যাম, এমন একটা লোকের পাল্লায় আপনাকে পড়তে হয়নি৷’ শোভা জানে না, অনন্ত আর হারানের থেকেও খারাপ একটা লোকের পাল্লায় তিনি পড়েছিলেন৷ সে কথা ওর মা দুর্গাদি জানত৷ তবে, না জেনেও একটা সত্যি কথা শোভা বলে ফেলেছে৷ কপালটা সত্যিই ভাল৷ সেই খারাপ লোকটার সঙ্গে তরিতার সম্পর্ক এক রাত্তিরের বেশি টেঁকেনি৷ চোখ বুঁজলে এখনও তরিতা সেই ভয়ানক রাত্তিরটা দেখতে পান৷ ঘটনাগুলো পরতে পরতে মনে পড়ে৷ বিয়ের সেই রাতে সাগর দ্বীপে মহেশ্বরজির আশ্রমে সেই শাঁখ বাজার শব্দ, উলুর আওয়াজ এখনও তাঁর কানে বাজে৷

সেইসময় মহেশ্বরজির আশ্রমে তাঁকে ঘাড় থেকে নামানোর চেষ্টা করছেন সৎমা৷ তাঁর বিয়ের কথাবার্তা চলছে ৷ সম্বন্ধটা এনেছিলেন বারাণসী থেকে আসা এক সাধু৷ মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে স্নান হয়ে যাওয়ার পর সেই সাধু দিনকয়েক মহেশ্বরজির কাছে আতিথ্য নিয়েছিলেন৷ সেখানেই তিনি তরিতাকে দেখেন৷ কথায় কথায় একদিন তিনি মহেশ্বরজিকে বলেন, ‘আপনার কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়েছে৷ আপনি কি তার বিবাহ দিতে ইচ্ছুক? আমার সন্ধানে এক ভাল পাত্র আছে৷’

মহেশ্বরজি জানতে চেয়েছিলেন, ‘পাত্রটি কে মহাত্মন?’

‘জরৎকারু মিশ্র৷ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক৷ অতি উচ্চবংশীয়৷ এই যুগেও অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, সকাল সন্ধ্যা আহ্নিক করেন৷ গঙ্গার তীরে তাঁর নিজস্ব একটা টোলও রয়েছে৷ পাত্রটির তিনকুলে কেউ নেই৷ ফলে সাংসারিক জীবনে তরিতাকে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না৷ তবে…’ বলেই একটু চুপ করে গিয়েছিলেন সেই সাধু৷ তার পর বলেন, ‘একটু বদমেজাজি৷ মা তরিতা আশ্রমে প্রতিপালিতা৷ তার অবশ্য মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে না৷’

সেইদিনই উমা মা আর শিষ্যদের সামনে বিয়ের কথাটা খুলে বলেছিলেন স্বামী মহেশ্বরজি৷ আশ্রমে আনন্দের ঢেউ উঠেছিল৷ বিয়ের উদ্যোগ শুরু হয়ে গিয়েছিল৷ আশ্রিতা মহিলাকুল সবাই একমত হয়েছিলেন, এমন বর পাওয়া ভাগ্যের কথা৷ কিন্তু, তরিতার মনে কাঁটার মতো খচখচ করেছিল ‘বদমেজাজি’ শব্দটা৷ এমন লোকের সঙ্গে তিনি ঘর করবেন কি করে? বিয়ের দিন সকালে জরৎকারুকে চাক্ষুষ করার পর তরিতা মনে মনে আরও আশাহত হয়েছিলেন৷ মুখে একগাদা দাড়ি-গোঁফ৷ আচার-আচরণেও অহংবোধের প্রকাশ৷ যেন চারপাশের সবাই মূর্খ, অশিক্ষিত৷ তরিতার মতো গ্রাম্য মেয়েকে বিয়ে করতে এসে ধন্য করে দিয়েছেন৷ এ জন্যই সবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷ গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানের সময় জরৎকারু না কি একবার মারাত্মক রেগে গিয়েছিলেন৷ মহিলাকুলে সেই কথাটাই পল্লবিত হয়ে তরিতার কানে এসে পৌঁছেছিল৷ তাঁর মনে হয়েছিল, এ কেমন ধরনের মানুষ, অকারণে চটে যায়!

স্নানের আগে ক্ষৌরকার দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল সাফ করে দেওয়ার পর রূপ বদলে গিয়েছিল জরৎকারুর৷ আশ্রমের সবাই চমকে গিয়েছিলেন তাঁর অনিন্দ্যকান্তি রূপ দেখে৷ ক্যানিং আশ্রমের সবাই সাগরদ্বীপে গিয়েছিলেন বিয়ে উপলক্ষে৷ দুর্গাদিও ছিল তাদের মধ্যে৷ বর দেখে এসে দুর্গাদিই এসে প্রথম তাঁর কাছে বলেছিল, ‘তোর সঙ্গে খুব মানাবে রে তরিতা৷ যেন রাজযোটক হচ্ছে৷’

সেই রাতে বিয়ের আসরে যাওয়ার আগে দুর্গাদির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল তরিতার৷ দুর্গাদি বলেছিল, ‘এমন একজন পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে তোর বিয়ে হচ্ছে… চেষ্টা করিস তাঁর যোগ্য হয়ে উঠতে৷ তোর কপাল ভাল, বেনারসের মতো জায়গায় স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারবি৷ আমাদের মতো গাঁয়ে গঞ্জে তোকে পড়ে থাকতে হল না৷’

শুভদৃষ্টির সময় তরিতা নিজেও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন জরৎকারুকে দেখে৷ কিন্তু, সেই মুগ্ধতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি৷ ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল স্বামীর রূঢ় আচরখে৷ বাসর ঘরে যখন দু’জন নিভৃতে মুখোমুখি, সেই সময় জরৎকারু সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, অবাধ্যতা তিনি একবোরেই পছন্দ করেন না৷ আদর করা তো দূরে থাক, উনি বলেছিলেন, ‘যদি কোনও কারণে আমার অবাধ্য হও, আমার ইচ্ছা অনুযায়ী না চলো, তা হলে সেদিনই তোমাকে আমি ত্যাগ করব৷ আর জীবনেও তোমার মুখ দেখব না৷’

কথাগুলো বলেই জরৎকারু পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছিলেন৷ আর বাসরঘরের শয্যায় বসে থেকে নিজের অদৃষ্টকে দোষ দিয়েছিলেন তরিতা৷ এ কেমন মানুষের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল? এই মানুষটা তো তাঁর কোনও ইচ্ছেরই মূল্য দেবেন না! সেই রাতে নিজেকে তিনি শক্ত করে নিয়েছিলেন৷ যা-ই ঘটুক না কেন, কারোর হাতের পুতুল হয়ে থাকবেন না৷ স্বামী যদি তাঁকে পরিত্যাগ করেন, তাতেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই৷ কিন্তু, সেই চরম পরিস্থিতিটা যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আসবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি তরিতা৷ ভোর পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠেই জরৎকারু বলেছিলেন, ‘যাও তরিতা, আমার জন্য নদীর ঘাট থেকে কুশ নিয়ে এসো৷ আমি আহ্নিকে বসব৷’

শুনে চমকে উঠেছিলেন তরিতা৷ তিনি তখনও ক’নের সাজে৷ ওই বেশে তিনি কী করে যাবেন নদীর ঘাটে? ওইসময় আশ্রমিকরা অনেকেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন৷ স্নান সেরে পূজা-আহ্নিক করার জন্য তাঁরা তৈরি হন৷ তাঁদের চোখে যদি তিনি পড়েন, তা হলে লজ্জার ব্যাপার হবে৷ দ্রুত এইসব ভাবার সময়ই জরৎকারু ফের বলেছিলেন, ‘কী হল, আমার কথা কানে যাচ্ছে না? যাও, ঘাট থেকে কুশ নিয়ে এসো৷’

তরিতা বলেছিলেন, ‘আমার পক্ষে এই বেশে নদীর ঘাটে যাওয়া সম্ভব না৷’

শুনে জরৎকারু মারাত্মক রেগে তুইতোকারি শুরু করেছিলেন, ‘তোকে আমি বলেছিলাম না, আমার অবাধ্য হলে, তোকে ছেড়ে আমি চলে যাব? তুই যদি সেটা না চাস, তা হলে শিগগির কুশ নিয়ে আয়৷’

তরিতাও মাথা নীচু করতে চাননি৷ ফের বলেছিলেন, ‘তোমার প্রয়োজন, তুমি যাও৷ বিয়ে করেছ বলে… আমাকে তোমার দাসী মনে কোরো না৷ আমার বাবা আমাকে এমন শিক্ষা দেননি৷’

‘নিজেকে তুই কী মনে করিস তরিতা? কে তোকে বিয়ে করেছ, জানিস? বেনারসের পণ্ডিতকুল যাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সাহস পায় না৷ তোর এত বড় স্পর্ধা, আমাকে অমান্য করছিস! এই শোন, আমার কাছে তুই বাবার গর্ব করিস না৷ তোর বাবা একটা লম্পট৷ কার গর্ভে তোকে জন্ম দিয়েছিল, তা তুইও জানিস না৷ তোর বাবা একজন ভণ্ড, প্রতারক৷ ধর্ম বেচে খায়৷ তোর সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখব না৷ এই আমি চললাম৷ জীবনে আর কোনওদিন তোর মুখ দেখব না৷’

সত্যিই, ভোরবেলায় জরৎকারু চলে গিয়েছিলেন৷ সকালে শয্যাতুলুনি করতে এসে আশ্রমের মেয়েরা কানাকানি শুরু করেছিলেন জরৎকারুকে দেখতে না পেয়ে৷ ঘরের এককোণে বসে নীরবে চোখের জল ফেলছিলেন তখন তরিতা৷ সবাই তাঁকেই দোষারোপ করেছিলেন৷ এমন অভাগী, স্বামীকে একরাত্তিরও বেঁধে রাখতে পারল না৷ না, তাঁর সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হয়নি তরিতার৷ শোভা এসব ঘটনার কথা জানবে কী করে?

(বাইশ)

 সোনাখালির ফার্ম হাউস থেকে আজ সকালে বারুইপুরে আসতে হয়েছে চন্দ্রভানুকে৷ উকিল দেবাংশু গুপ্তর অনুরোধে৷ কোর্টে কী যেন একটা এফিডেফিট করাতে হবে৷ সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে হাজির থাকতে হবে৷ তা ছাড়া, আরও একটা দরকার ছিল৷ জার্মানিতে নিমপাতা পাউডার পাঠানোর চুক্তিপত্রটা চন্দ্রভানু একবার দেখিয়ে নিতে চাইছিলেন দেবাংশুবাবুকে৷ জয়ব্রত বলেছিল, কোনও কারণে চুক্তিভঙ্গ হলে নাকি প্রচুর আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ বিদেশি কোম্পানি তো, চুক্তি মানার ব্যাপারে ওরা খুব কড়াকড়ি করে৷ জাপানিদের সঙ্গে ব্যবসা করার সুবাদে চন্দ্রভানু ইতিমধ্যেই সে ব্যাপারে অবহিত৷ জার্মানি থেকে আসা সব কাগজপত্তর তিনি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন৷ উকিলের কাছ থেকে তিনি আইনি পরামর্শ নিয়ে রাখতে চান৷ চুক্তিপত্রে উল্লেখ রাখতে চান, বাদাবনে কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে যেন তাঁকে ছাড় দেওয়া হয়৷ সুন্দরবনের কথা তো বলা যায় না!

বারুইপুরে ‘নিভৃতে’ বলে একটা গেস্টহাউস আছে৷ জেলা সদরে এলে সেখানেই উঠেন চন্দ্রভানু৷ খুব যে বিলাসবহুল গেস্ট হাউস তা নয়, তবে এখানকার খাবার তাঁর খুব পছন্দের৷ এবার তাঁর সঙ্গে এসেছে জয়ব্রত আর অহল্যা৷ অহল্যার আসার কথা নয়৷ ও কলকাতার দিকে যাচ্ছিল৷ বারুইপুরে নেমে পড়ল, কোর্টের কাজ শেষ হয়ে গেলে জয়ব্রতকে নিয়ে ফুড চেন-এ যাবে বলে৷ ব্যাবসাসংক্রান্ত কোনও কাজের সময় মেয়েরা থাকুক, সেটা চন্দ্রভানু পছন্দ করেন না৷ কিন্তু, অহল্যা নিজেই একটা ব্যাবসা চালায়৷ এবং সেটা তাঁর কোনও সাহায্য ছাড়াই৷ বাড়ির অন্য মেয়েদের থেকে ও আলাদা৷ চন্দ্রভানু তাই মনে মনে অহল্যার বিজনেস ব্রেন-এর তারিফ করেন৷ সেজন্য বারুইপুরে থেকে যাওয়ায় কোনও আপত্তি করেননি৷

কোর্ট থেকে ফিরে এসে তিনজন আলোচনায় বসেছেন দেবাংশু গুপ্তের সঙ্গে৷ ভদ্রলোকের নানা বিষয়ে পড়াশুনা আছে৷ কোনও ব্যাপারে আলোচনায় বসলে আইনি ব্যাখ্যা দিতে দিতে বয়স্ক মানুষটা চলে যান সেই বিষয়ের একেবারে গভীরে৷ কিছুদিন আগে মধু সংগ্রহের লাইসেন্স নিয়ে একটা ঝামেলার ফয়সালা করার জন্য চন্দ্রভানু এসেছিলেন দেবাংশুবাবুর কাছে৷ সেদিন মধু নিয়ে এমন সব কথা উনি বলতে লাগলেন, যা মউলে মন্টু ভক্তাও জানে না৷ সেদিন দিল্লিতে যাওয়ার জন্য প্লেন ধরার তাড়া ছিল৷ তবুও, চন্দ্রভানু উঠতে পারছিলেন না৷ আজ তিনি ঠিকই করে রেখেছেন, আইনি আলোচনা ছাড়া অন্য কোনও প্রসঙ্গ উঠতে দেবেন না৷

চুক্তির কাগজপত্তর খুব খুঁটিয়ে পড়েছেন দেবাংশুবাবু৷ বললেন, ‘কার্লসরুহে শহরের এই কোম্পানিটা পেস্টিসাইড তৈরি করে৷ ওদের ওয়েবসাইট খুলে দেখলাম, ওরা কিন্তু খুব কোয়ালিটি কনসাস চন্দ্রভানুবাবু৷ একটু লক্ষ রাখবেন, যাতে আপনার পাঠানো মাল ঠিকঠাক কোয়ালিটির যায়৷ একটু এদিক ওদিক হলে পুরো মালটাই ওরা ফেরত পাঠাবে৷ এ ব্যাপারে ওদের একতরফা সিদ্ধান্তই আপনাকে মেনে নিতে হবে৷ বুঝতে পারছেন, কী ধরনের রিস্ক?’

শুনে জয়ব্রতর দিকে তাকালেন চন্দ্রভানু৷ ইশারাটা বুঝতে পেরে জয়ব্রত উত্তর দিল, ‘না, না৷ এ নিয়ে কোনও চিন্তা করতে হবে না৷ আমাদের কোম্পানিতে একজন নামী এক্সপার্ট আছেন৷ কোয়ালিটি যাতে মেইনটেন্ড হয়, সেটা উনি লক্ষ রাখবেন৷’

দেবাংশুবাবু বললেন, ‘কথাটা কেন তুললাম জানেন? ইউরোপের লোকেরা খুব খুঁতখুতে টাইপের হয়৷ ওরা কোয়ালিটির ব্যাপারে কোনওরকম কম্প্রোমাইজ করতে চায় না৷ এই রিসেন্টলি একটা কেস হ্যান্ডেল করলাম৷ জাহাজে করে একজন এক্সপোর্টার লেদার গুডস পাঠিয়েছিলেন সুইডেনে৷ প্যাকেজিংয়ের দোষে সেই মালে ফাংগাস ধরে গিয়েছিল৷ ফলে পুরো মালটাই ফেরত এসেছে৷ ব্যস, ভদ্রলোকের হাতে হ্যারিকেন৷ প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো লস হয়ে গিয়েছে৷’

‘জানি৷’ বললেন চন্দ্রভানু, ‘রিসেন্টলি জাপানে চিংড়ি এক্সপোর্টের একটা ডিল-এ আমরা ফেঁসে গিয়েছি৷ আমাদের পুরো কন্ট্রাক্টটাই বাতিল হয়ে যেতে বসেছে৷’

‘একটা জিনিস ঠিক বুঝতে পারলাম না চন্দ্রভানুবাবু৷ আপনাদের কাছ থেকে জার্মানরা কেন নিমপাতার গুঁড়ো চাইছে? কেন নিমপাতা কিনতে চাইছে না?’

অহল্যা বলে উঠল, ‘এটা না বোঝার কী আছে মিঃ গুপ্ত? কস্ট অফ প্রোডাকশনটা কম হবে বলে৷ আমাদের এখানে কস্ট অফ লেবার অনেক কম৷ স্রেফ নিমপাতা নিয়ে গেলে, তা শুকিয়ে, তার পর পাউডার করতে হলে … ওদের দেশে যা খরচ হবে, তাতে ওদের পোষাবে না৷ সেই কারণেই ওরা পাউডার চাইছে৷’

দেবাংশুবাবু একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, বোধহয় সেটাই কারণ হবে৷ কোনও ওয়েবসাইটে পড়ছিলাম, নিমপাতা দিয়ে তৈরি কীটনাশক… জার্মানরা খুব ব্যবহার করে৷ নন টক্সিক বলেই বোধহয়৷ পোকামাকড়ের খুব বেশি ক্ষতি করে না৷ এমনকী, মৌমাছি পর্যন্ত গাছে এসে বসে৷ আমাদের এখানকারই একটা গাছ, অথচ ওরা কত কাজে লাগাচ্ছে!’

চন্দ্রভানু হেসে বললেন, ‘ছোটবেলায় নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করতাম৷ মা তখন বলত, তাতে নাকি দাঁত ঝকঝকে থাকে, মাড়ি শক্ত করে৷ মুখের ভিতর ঘা হয় না৷ কোনওদিন ভাবিনি, সেই গাছেরই পাতা নিয়ে একদিন রপ্তানীর ব্যবসা করতে হবে৷ এখন তো দেখছি, শুধু ডাল আর পাতাই নয়, নিমগাছের ফল আর ছালও রোগ সারানোর কাছে লাগে৷’

দেবাংশুবাবু কী বলতে যাচ্ছিলেন৷ তার আগেই অহল্যা বলে উঠল, ‘ঠিক বলেছেন বাবা৷ আমার দাদু ছিলেন বারুইপুর অঞ্চলের নামকরা আয়ুর্বেদিক ডাক্তার৷ দাদুর বাড়িতে গেলে দেখতাম, নানারকম ভেষজ ওষুধ তৈরি হচ্ছে৷ উনিই বলতেন, নিমের মতো জীবনদায়ী গাছ আর হয় না৷ কত রকমের অসুখ সারে! নিমগাছ মানেই ভিলেজ ফার্মেসি৷ জ্বর জ্বালা সারানো, হাঁজা-পাঁচড়া সারানো৷ কারও পক্স হলে নিমপাতা ছোঁয়াও৷ তখন তো ঘরে ঘরে এত ডায়াবেটিস রোগ ছিল না৷ কারও ওই রোগ হলে শুনতাম, রোজ তিন-চার ফোঁটা করে নিমের রস খেয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে৷ কারও ন্যাবা রোগ হলে… মানে জন্ডিস হলে… মায়েরা খানিকটা নিমরসের সঙ্গে খানিকটা মধু খাইয়ে দিতেন৷ সাত দিন খেলেই ব্যস, জন্ডিস হাওয়া৷ সাইনাসাইটিসে মাথার যন্ত্রণারও উপশম হত৷ সকাল-সন্ধে নাকে দু’ফোঁটা নিমতেল টেনে নিলে৷ দাদামশাই বলতেন, কমপক্ষে চল্লিশটা অসুখের জন্য নিমগাছ খুব উপকারী৷’

শুনতে শুনতে দেবাংশুবাবুর মুখ হাঁ হয়ে গেছে৷ মনে মনে হাসলেন চন্দ্রভানু৷ প্রতিবার তিনি আসেন আইনি ব্যাখ্যা জানতে৷ নানা ব্যাপারে দেবাংশুবাবুর দীর্ঘ ভাষণ তাঁকে শুনতে হয়৷ অহল্যা এবার ভদ্রলোককে চুপ করিয়ে দিচ্ছে৷ বোধহয় আজ তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবেন৷ সোনাখালির ফার্ম হাউসে তিনি আজ ফেরত যাবেন না৷ প্রায় দিন পনেরো তিনি বাড়ির বাইরে৷ তাই এখন কঙ্কণদীঘিতে ফিরে যেতে চান৷ কঙ্কণদীঘি প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ৷ মথুরাপুর, রায়দীঘি হয়ে তার পর কঙ্কণদীঘি৷ মাঝে জয়নগরে একবার তাঁকে ঢুঁ মারতে হবে৷ বারুইপুর থেকে বেলা সাড়ে তিনটের সময় বেরতে না পারলে, সন্ধে হয়ে যাবে বাড়ি পৌঁছতে৷ দয়াশঙ্কর সকালে ফোনে বলল, রোজ বিকেলে কঙ্কণদীঘির দিকটায় মারাত্মক ঝড়জল হচ্ছে৷ রাস্তায় অনেক জায়গায় গাছ-টাছ উপড়ে পড়ছে৷ রাস্তার কোথাও আটকে গেলে, খুব মুশকিল৷

দেবাংশুবাবু বলতে শুরু করেছেন, বেঙ্গালুরুতে কোথায় যেন শুধু একটা নিমগাছেরই ফার্ম হাউস রয়েছে৷ সেই কোম্পানির মালিক নাকি লালে লাল হয়ে গিয়েছেন নিমগাছের তেল, গুঁড়ো আর বড়ি রপ্তানী করে৷ শুনেই অহল্যা বলল, ‘জানি মিঃ গুপ্ত৷ আপনি দেবমণি ব্রাদার্সের কথা বলছেন৷ আফ্রিকা, আমেরিকার দশ-দশটা শহরে ওরা প্রোডাক্ট পাঠায়৷ ওদেরই কোম্পানি নিম পাতা থেকে ক্যান্সার, এইডস আর বাঁত সারানোর ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছে৷’

জয়ব্রতের দিকে একবার তাকিয়ে চন্দ্রভানু বুঝতে পারলেন, সেও মজা পাচ্ছে উকিলবাবু দমে যাওয়ায়৷

তিনি বললেন, ‘দেবাংশুবাবু, আমাকে এ বার উঠতে হবে৷ কন্ট্রাক্ট লেটারটা ফ্রেশ লিখে কালই আমার বাড়িতে চলে আসুন৷ যত শিগগির চিঠিটাকে কার্লসরুহে-তে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল৷ আমি চাই না, অর্ডার আমাদের হাত থেকে ফস্কে যাক৷’

কথাগুলো বলেই তিনি একটা সাদা খাম এগিয়ে দিলেন দেবাংশুবাবুর দিকে৷ আইনি পরামর্শ দেওয়ার জন্য পারিশ্রমিক৷ পলকের মধ্যে খামটা পকেটে চালান করে দিয়ে দেবাংশুবাবু বললেন, ‘কোনও চিন্তা করবেন না চন্দ্রভানুবাবু৷ আজ রাতেই কাগজপত্তর তৈরি করে ফেলব৷ কিন্তু, কাল কঙ্কণদীঘি যেতে পারব কিনা গ্যারান্টি দিতে পারছি না৷’

অহল্যা জিজ্ঞেস করল, ‘কেন মিঃ গুপ্ত? কাল তো কোর্ট বন্ধ৷’

‘তার জন্য নয়৷ কাল আমাদের এখানে মনসা পুজো৷ ধুমধাম করে একটা দশালি পুজো হচ্ছে৷ মেলা বসবে, সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে৷ আমার নাতনি গান গাইবে৷ বুঝতেই পারছেন, কেন আমাকে এখানে থাকতে হবে৷ তা ছাড়া, আরও একটা কারণে যেতে চাইছি না৷ শুনলাম, আপনাদের বাড়িতে নাকি সাপের খুব উৎপাত হয়েছে? আপনার নাতিকে নাকি কামড়েছিল? আমি মশাই, এই প্রাণীটিকে খুব এড়িয়ে চলি৷ আমি বরং কাল আমার মুহুরিকে দিয়ে আপনার সব কাগজপত্তর পাঠিয়ে দেবো৷ ’

আচমকা সাপের প্রসঙ্গ ওঠায় চন্দ্রভানু একটু বিরক্ত হলেন৷ কিন্তু, তা প্রকাশ করলেন না৷ শুনে যেন খুব মজা পেয়েছেন, এমন মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘ভয় পাবেন না৷ বর্ষার এই সময়টায় গাঁয়ে গঞ্জে একআধটা সাপ দেখা যায়ই৷ আমার বাড়িতে এলে কাল আপনাকে দুটো বিরাট সাপ দেখাব৷ মায়ানমারের রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন৷ প্রায় পনেরো-ষোলো ফুট লম্বা৷ ওই দুটো পাইথন আমি পুষছি৷ ভারতের কোনও চিড়িয়াখানায় এ রকম সাপ আপনি দেখতে পাবেন না৷’

‘আপনি তো ভয়ানক লোক মশাই!’

অহল্যা উপযাচক হয়ে বলল, ‘বাদাবনের লোকে তাই বলে৷ জানেন, বাবার খুব ইচ্ছে ছিল, দু’তিনটে রয়াল বেঙ্গল টাইগার পোষার৷ কিন্তু, ফরেস্টবাবুরা কিছুতেই পার্মিশন দিচ্ছেন না৷ সরকারী আইনে নাকি তা করা যায় না৷ উকিলবাবু, আপনি একটু দেখবেন তো, এ নিয়ে কোনও মামলা করা যায় কি না?’

কথাগুলো শুনে মৃদু হেসে চন্দ্রভানু উঠে দাঁড়ালেন৷ সত্যি সত্যিই, এমন একটা ইচ্ছে এখনও তাঁর মনের গভীরে আছে৷ অহল্যা কারও কাছে হয়তো শুনে থাকবে৷ চোখ ছানাবড়া করে তাঁর দিকে দেবাংশুবাবু তাকিয়ে রয়েছেন দেখে চন্দ্রভানু মনে মনে অহল্যার তারিফ করলেন৷ নাহ, মেয়েটা তো ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটা বলতে পারে৷ যে লোকটা কথা বেচে খায়, তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়৷ জয়ব্রত ইতিমধ্যেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে৷ বোধহয় গাড়িটা আগে থেকে বের করে রাখতে চায়৷ পোর্টিকোর নীচে থেকেই যাতে তিনি গাড়িতে উঠে পড়তে পারেন৷ ‘আচ্ছা, আজ তা হলে আসি৷ চলো ছোট বউমা,’ বলে চন্দ্রভানু ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন৷

জয়ব্রতকে নিয়ে অহল্যা কলকাতার দিকে চলে গেল৷ গাড়ি কৃষ্ণমোহন স্টেশনের লেভেল ক্রসিং পেরনো পর্যন্ত চন্দ্রভানু জার্মান কোম্পানির চুক্তি নিয়ে ভাবতে ভাবতে এলেন৷ কিন্তু, জয়নগরের দিকে যাওয়ার সময়ই তিনি অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলেন৷ দেবাংশু গুপ্ত জানলেন কী করে, তাঁর বাড়িতে সাপের উৎপাত হয়েছে? এই কথাটা তো বারুইপুরে বসে ভদ্রলোকের জানার কথা নয়! উনি যে মনসাভক্ত, তা কথাবার্তাতেই বোঝা যাচ্ছিল৷ বোধহয় খুলনার দিকের লোক৷ একটা সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেক লোক এ দিকে চলে এসেছিলেন৷ বাঙালরা মনসা পুজোটা করে শ্রাবণ সংক্রান্তিতে৷ আর বাদাবনে এই পুজোটা হয় প্রায় একমাস বাদে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে৷ আরে হ্যাঁ, কালই তো শ্রাবণ সংক্রান্তি৷ কথাটা মনে পড়ায় চন্দ্রভানু সোজা হয়ে বসলেন৷

জয়নগরের রাস্তায় গাড়ি ঢোকার পর থেকেই চন্দ্রভানু দেখলেন, কয়েক কিলোমিটার পর পর প্যান্ডেলে মাইক বাজছে৷ অর্থাৎ ঘটা করে মনসা পুজো হচ্ছে৷ মনসা পুজোটা হঠাৎ বেড়ে গেল নাকি? হঠাৎই চন্দ্রভানুর দয়াশঙ্করের কথা মনে পড়ল৷ ও বলেছিল, দয়াপুরের রিসর্টের ওই মেয়েটা… তরিতা না কী যেন নাম… নাকি দেদার টাকা খরচ করছে, যাতে চতুর্দিকে মনসা পুজো হয়৷ মেয়েটার হাত বারুইপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেল নাকি? নিশ্চয়ই প্রভাবশালী কেউ রয়েছে ওর পিছনে৷ দয়াশঙ্করকে বলতে হবে, যাতে বিশদ খবর নেয়৷

দয়াশঙ্করকে বলেছিলেন, মেয়েটাকে তুলে আনতে৷ কিন্তু, পরশু সকালে ফোনে ব্যাটাচ্ছেলে একটা মনগড়া কাহিনি শোনাল৷ মেয়েটাকে যারা তুলতে গিয়েছিল, তাদের নাকি সাপে তাড়া করেছিল! বাজে কথা বললেই হল? মেয়েটার কথায় সাপ ভয় দেখাবে! মেয়েটা হারপেটো… না কী একটা বিষয়ে পড়াশুনো করে এসেছে আমেরিকা থেকে৷ সাপের বিষ নিয়ে নাকি কী একটা ওষুধ বানাবে বলে দয়াপুরে আছে৷ আর জায়গা পেল না? ওকে এখানেই আসতে হল? নাহ, দয়াশঙ্করটাকে দিয়ে আর চলবে না৷ আজকাল কাজে ফাঁকি দিচ্ছে৷ একটা সামান্য মেয়েকে ভয় দেখিয়ে বাদাবন থেকে তাড়াতে কতক্ষণ লাগে?

কোনও সময় গাড়িতে চন্দ্রভানু একা ট্রাভেল করেন না৷ শত্রুর তো অভাব নেই৷ বছর কয়েক আগে একবার তাঁর উপর হামলা হয়েছিল৷ বাসন্তী থেকে তিনি গদখালির দিকে যাচ্ছিলেন৷ মাঝে রাস্তায় তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করেছিল কিছু লোক৷ সেদিন ওরা জানেই মেরে ফেলত৷ কিন্তু, ড্রাইভার পঞ্চা ঝুঁকি নিয়ে… গাড়িটা হঠাৎ মারাত্মক স্পিডে তুলে বেরিয়ে আসে৷ পরে পুলিশ জানায়, হামলাবাজরা ছিল ডাকাত৷ কাকদ্বীপের একটা গ্যাং৷ তাদের কাছে খবর ছিল, বাসন্তীর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে, ডিকির ভিতর ট্র্যাঙ্কে দশ লাখ টাকা নিয়ে তিনি বাড়িতে যাচ্ছেন৷ এবং সেটা সঠিক খবরই ছিল৷ তার পর থেকেই চন্দ্রভানু বডিগার্ড সঙ্গে নিয়ে বেরন৷ সঙ্গে পিস্তলও রাখেন৷

বাড়ি ফেরার কথা সনকা জানে না৷ ওকে জানিয়ে দেওয়া দরকার৷ ভেবে চন্দ্রভানু মোবাইলে ফোন করলেন৷ রিং হয়েই যাচ্ছে৷ বার তিনেক ফোন করা সত্ত্বেও কেউ ফোন তুলল না৷ সনকা কি ঘরে মোবাইল ফোনটা ফেলে রেখে কিচেন বা অন্য কোথাও গিয়েছে? বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে৷ এই সময় তো ওর কিচেন বা ডাইনিং হলে থাকার কথা নয়! এই সময়টায় ঘরে ও বিশ্রাম নেয়৷ এত বেলায় মন্দিরের দিকে থাকারও কথা নয়৷ কেননা, বেলা দশটার মধ্যেই মন্দিরের পুজো শেষ হয়ে যায়৷ সনকা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ না হলে ফোনটা তুলত৷ বেচারী, এত বড় সংসারটাকে চালায়৷ এখন থাক, রায়দিঘিতে গিয়ে ফোন করে নিলেই হবে৷ ভেবে চন্দ্রভানু ফোনটা সিটের উপর ফেলে রাখলেন৷

জানলার দিকে তাকিয়ে চন্দ্রভানু দেখলেন, জয়নগরের মোড়ে পৌঁছে গিয়েছেন৷ আকাশে মেঘ এখন নেই৷ ঝকঝকে রোদ্দুর উঠেছে৷ রাস্তার দু’পাশে বেশ কয়েকটা মোয়ার দোকান৷ জয়নগরের উপর দিয়ে যখনই যান, তখনই তিনি পাঁচ বাক্স মোয়া কিনে নেন৷ জয়নগরের মোয়া খুব বিখ্যাত৷ কিন্তু সবথেকে ভাল মোয়া তৈরি হয় পাশের গ্রাম বহরুতে৷ ওখানে বল্লভ বলে এক কারিগর আছে, চমৎকার মোয়া বানায়৷ তার দোকান আছে জয়নগরে৷ পঞ্চাকে তার দোকানের সামনে গাড়িটা দাঁড় করাতে বললেন চন্দ্রভানু৷ তারপর বললেন, ‘বল্লভকে শিগগির দোকান থেকে ডেকে আন তো?’

মিনিটখানেক পর হাতজোড় করে বল্লভ গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল৷ কালো কাচ নামিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘পাঁচটা মোয়ার বাক্স তুলে দে৷ বাসি মাল দিস না যেন৷ বউদিমণি খাবে৷’

কানে হাত দিয়ে জিভে কেটে বল্লভ বলল, ‘কী যে বলেন স্যার৷ মোয়া আজ সকালেই বানিয়েছি৷ একেবারে অমৃতের মতো টেস্ট৷ খেয়ে দেখবেন নাকি?’

‘না, না৷ একটু আগে লাঞ্চ করেছি৷ পেটে জায়গা নেই৷’

‘স্যার অনেকদিন বাদে কিন্তু এদিকে এলেন৷ এবার শিবরাত্তিরের দিন পরিবার নিয়ে আমি কঙ্কণদীঘিতে গেছিলাম৷ কিন্তু, এত ভিড় ছিল, ওখানে আপনার দেখা পাইনি৷ এ বারের মতো ধুমধাম অন্য কোনওবার দেখিনি স্যার৷ খুব পুণ্যি করেও এসেছি৷ স্বয়ং মহাদেব আপনার মন্দিরে তাঁর জীবকে পাঠিয়েছেন৷ ক’জনের সৌভাগ্য হয়, তা দেখার?’

শুনে মনে মনে খুশি হলেন চন্দ্রভানু৷ এ ধরনের অলৌকিক কাহিনি যত ছড়ায়, তত মঙ্গল৷ হাজার টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘তোদের এদিককার খবর কী রে বল্লভ? আগে তো এদিকে এত মনসা পুজোর চল দেখিনি? এত বেড়ে গেল কী করে?’

বল্লভ কাছে এসে বলল, ‘স্বপ্নাদেশ হয়েছে স্যার৷ কচুখালিতে নাকি কোন একটা মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে স্বপ্নে দেখেছে, তাঁর ভাই ভাতকাপড় নিয়ে এসেছে৷ বাড়িতে মনসা পুজো করতে হবে৷ না করলে ভাইকে সাপে কাটবে৷ পরদিন সত্যি সত্যিই তার ভাই শ্বশুরবাড়িতে হাজির কাপড় হাতে নিয়ে৷ সেও নাকি একই স্বপ্ন দেখেছে৷ ব্যস, তার পর থেকে বোনেরা মা মনসার পুজো শুরু করে দিয়েছে৷ বিষহরির পুজো হচ্ছে বাড়ি বাড়ি৷ পুজো না করলে ভাইকে যদি সাপে কাটে… সেই ভয়ে৷’

শুনে হাসি পেল চন্দ্রভানুর৷ গুজবটা নিশ্চয়ই কেউ ছড়িয়েছে৷ গ্রাম-গঞ্জে এই ধরনের গুজব বাতাসের আগে ছোটে৷ তরিতা বলে ওই মেয়েটার কাজ নয়তো? যদি সত্যিই তাই হয়, তা হলে মেয়েটা খুবই বুদ্ধিমতী৷ ওর সঙ্গে গায়ের জোর খাটালে চলবে না৷ বুদ্ধি দিয়ে লড়তে হবে৷ চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘যার ভাই নেই, সে কী করছে?’

‘সে কাউকে ভাই পাতিয়ে নিচ্ছে৷ শুনলাম, নামখানায় কে একজন পুজো করেনি বলে, তার ভাই সাপের কামড়ে মারা গিয়েছে৷ এই অঞ্চলে তো স্যার আগে শুধু শিব আর চণ্ডী মায়ের পুজোই হত৷ স্বপ্নাদেশের পর মা মনসার পুজো অনেক বেড়ে গিয়েছে৷ ইদানি আবার ভাইকাপড়ের সঙ্গেসঙ্গে ভাগ্নেকাপড়ও চালু হয়েছে৷ ’ বলে দু’হাত কপালে ঠেকাল বল্লভ৷ তার পর দোকানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই নিন স্যার, আপনার মাল এসে গিয়েছে৷ সামনের সিটে রেখে দিচ্ছি৷’

সুইচ টিপে জানলার কাচ তুলে দিলেন চন্দ্রভানু৷ জয়নগর থেকে বেরিয়ে আসার পরও স্বপ্নাদেশের কথা তিনি মন থেকে মুছে ফেলতে পারলেন না৷ বল্লভ যা বলল, তাতে গুজবটা ছড়িয়েছিল কচুখালি থেকে৷ সেটা এখন ছড়িয়ে গিয়েছে ওদিকে নামখানা, এদিকে বারুইপুর পর্যন্ত! যে-ই এই গুজবটা ছড়াক না কেন, অত্যন্ত চালাকি করে ছড়িয়েছে৷ নাহ, কিছু একটা করা দরকার৷ মন্টুর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে৷ মন্টু এখন ঝড়খালিতে আছে ৷ সোনাখালি থেকে ওকে চন্দ্রভানু জোর করে কাল ঝড়খালিতে পাঠিয়েছেন৷ রিসর্টের জমি কেনা নিয়ে কথা বলার জন্য৷ কাল সন্ধ্যের মধ্যেই ওর ফিরে আসার কথা৷

মহেশপুরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চন্দ্রভানুর চোখে পড়ল, রাস্তার মোড়ে বিশাল একটা তোরণ বানানো হয়েছে৷ তাতে বড় বড় করে লেখা, মহেশপুরে এক সপ্তাহব্যাপী মনসামেলা হবে৷ উৎসব কমিটির সভাপতি অমর মণ্ডল৷ মন্দিরতলার মাঠে মনসার পালাগান হবে তিনদিন ধরে৷ গাইবেন হারাধন পালাকার৷ হোর্ডিং দেখে চমকে উঠলেন চন্দ্রভানু৷ অমরকে তিনি ভাল করে চেনেন৷ রায়দীঘি মৎসজীবী ইউনিয়নের কর্তৃত্ব নিয়ে তাঁর সঙ্গে অমরের একবার আকচাআকচি হয়েছিল৷ যদ্দূর তিনি জানেন, মহেশপুরের মানুষজন পৌন্ড্রক্ষত্রিয় এবং তারা কেষ্ট ঠাকুরের ভক্ত৷ ওখানকার লোকেরা এতদিন শুধু গোষ্ঠযাত্রা, জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসব, রাসযাত্রা আর দোল উৎসবই করত৷ হঠাৎ তারা মনসা পুজোয় মেতে উঠল কেন?

গাড়ি ঘুরিয়ে চন্দ্রভানু রায়দীঘির রাস্তা ধরলেন৷ আধ ঘণ্টা পর কঙ্কণদীঘির বাড়িতে পৌঁছে তিনি যা দেখলেন, তাতে আর মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না৷ চন্দ্রভানু দেখলেন, তাঁরই বাড়িতে সোনার ঘট পেতে মনসার পুজো করছেন সনকা! কোনও কথা বলার আগে, এক লাথি মেরে সেই ঘট উল্টে দিলেন তিনি৷

(তেইশ)

বেলা চারটের সময় ওরা ঝড়খালির বাজার থেকে রওনা দিয়েছিল৷ হাঁটতে হাঁটতে অঙ্কুশরা কাটা জঙ্গলে পৌঁছল রাত এগারোটার সময়৷ আকাশে বাঁকা চাঁদ৷ গাছপালার জন্য ঘন অন্ধকার, দু’হাত দূর থেকেও কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে৷ হঠাৎ দূরে দু’তিনটে লাল আলোর বিন্দু দেখতে পেল অঙ্কুশ৷ জ্বলছে-নিভছে৷ তার মানে কেউ সংকেত দিচ্ছে৷ তা দেখতে পেয়েই রসিক মণ্ডল বলে উঠল, ‘বইসে পড়েন স্যারেরা৷ না বইসলে গুলি করি দিবে৷’

শুনে জয়, বিরসা আর অঙ্কুশ তিনজনই জঙ্গলের মধ্যে বসে পড়ল৷ কার মুখ দেখে আজ ঘুম থেকে উঠেছিল অঙ্কুশ কে জানে? কাল মনসা পুজো বলে দয়াপুরে আসার ইচ্ছেও ছিল না ওর৷ পিঙ্কি বউদির জোরাজুরিতেই ও বেরিয়ে আসে৷ ভেবেছিল, রাতের মধ্যে পিয়ারায় ফিরে যাবে৷ কিন্তু, কোথা থেকে কোথায় চলে এল৷ কার পাল্লায় পড়েছে, তাও জানে না৷ রসিক মণ্ডল প্রায় সাত ঘণ্টা ওদের হাঁটিয়েছে৷ যতক্ষণ দিনের আলো ছিল, ততক্ষণ দূরে একটা গাছ দেখিয়ে বলেছে, ওটা পেরোলেই কাটা জঙ্গল৷ পরে বিরক্ত হয়ে ওরা প্রশ্ন করা ছেড়ে দিয়েছিল৷ কায়িক পরিশ্রম তো রয়েইছে, তার উপর ঘণ্টা তিনেক আগে বিরসার জন্য মারাত্মক টেনশন৷ উফ, সেই দশ-বারোটা মিনিট ওদের যেভাবে কেটেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব৷

বিরসার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে ওরা পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল৷ কোনও উত্তর নেই৷ রসিক ধরেই নিয়েছিল, বিরসাকে বাঘিনী টেনে নিয়ে গিয়েছে৷ ওর হাবভাব দেখে জয় ঘাবড়ে গিয়ে বলেই ফেলেছিল, ‘কী হবে বল তো? ছেলেটাকে ওর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এলাম৷ আসার সময় ওর মা বলছিল, ভালয় ভালয় ফিরে এসো বাবা৷ বিধবা মা, বাড়িতে একা৷ কী করে আমি মুখ দেখাব তাঁকে?’

কিন্তু, রসিকই প্রথমে খুঁজে বের করেছিল বিরসাকে৷ কর্দমাক্ত আলের উপর দিয়ে হাঁটার সময় খেয়াল করেনি৷ বিরসা পা পিছলে নেমে গিয়েছিল চার-পাঁচ ফুট নীচে ভেড়ির জলে৷ ওর কাঁধ থেকে লেন্স রাখা চামড়ার গোল ব্যাগটা তখন জলে পড়ে যায়৷ অন্ধকারের মধ্যে সেটা খুঁজে পেতে ওর সময় লেগেছিল৷ তার পর ও নিজে নিজেই উঠে আসার চেষ্টা করে৷ কিন্তু, যতবার ব্যাগ আর লেন্স নিয়ে উঠে আসতে চাইছিল, ততবারই পিছলে নেমে যাচ্ছিল ভেড়ির জলে৷ তখনই বিরসা সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি শুরু করে৷ কিন্তু, ততক্ষণে অঙ্কুশরা অনেকটা দূরে চলে এসেছে৷ রসিকের ডাকে শেষ পর্যন্ত ও নীচ থেকে ক্ষীণস্বরে সাড়া দেয়, ‘আমি এখানে৷’ ভাগ্যিস, রসিকের সঙ্গে লাঠিটা ছিল৷ সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বিরসাকে তুলে আনা সম্ভব হয়৷ ওর প্যান্ট আর ব্যাগটা তখন কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছে৷

‘গুলি করি দেবে’ কথাটা শুনে বুক ধকধক করছে অঙ্কুশের৷ মুখ তুলে ও দেখল, রসিক ওর টর্চ জ্বালিয়ে কাকে যেন ইঙ্গিত করছে৷ একটু পরে হঠাৎই দুটো লোক অন্ধকার ফুঁড়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল৷ তাদের হাতে লাল রঙের টর্চ৷ তার মানে একটু আগে এরাই দূর থেকে ইঙ্গিত দিচ্ছিল! লোক দুটোকে দেখে রসিক নিশ্চিন্ত৷ বলল, ‘উঠি দাঁড়ান স্যারেরা৷’

ওরা উঠে দাঁড়াতেই আগন্তুকদের একজন জিজ্ঞেস করল, ‘এরা কারা রসিকভাই? পুলিশের লোক?’

লোক দুটো তা হলে রসিকের চেনা! হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অঙ্কুশ৷ বেঘোরে প্রাণটা দিতে হবে না৷ রসিক উত্তর দিল, ‘না, পুলিশির নোক না৷ দেবনাথবাবু ইদের পাঠ্যেছেন৷ ইরা পালান সরদারের সঙ্গে দেকা করতি এয়েছেন৷’

একজন বলল, ‘পালান সরদার তো ইখেনে নেই৷ তাকি এখন পাওয়া যাবে না৷’

শুনে দমে গেল জয়৷ বলল, ‘আমরা খবরের কাগজের লোক৷ পালান সরদার যেখানে আছেন, সেখানে কি আমাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব? প্লিজ, নিয়ে চলুন৷ সেই বিকেল থেকে হাঁটতে হাঁটতে এখানে এলাম৷ যদি ওঁর ইন্টারভিউ নিতে না পারি, তা হলে দেবনাথবাবুরও খুব খারাপ লাগবে৷’

কথাটা শুনে লোক দুটো মুখ চাওয়াচাওয়ি করল৷ একজন বলল, ‘দেবনাথবাবু ই কতা বলেচেন?’

‘হ্যাঁ, উনি একটা চিঠিও দিয়েছেন৷ মিনিস্টারের কথা আপনাদের রাখা উচিত৷’

‘কিন্তু, চিঠি তো সরদার পড়তি পারেন না৷ চলেন, অফিস ঘরে চলেন৷ দেখি, সরদাররি ডেকি আনা যায় কি না? আমরা ভাবলাম, আপনারা পুলিশের নোক৷ সরদাররি ধরতি এয়েচেন৷’

জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পরই কয়েকটা খড়ের চালের বাড়ি চোখে পড়ল অঙ্কুশের৷ মাঝে একটা বেশ বড় উঠান৷ সেখানে বাঁশের কয়েকটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে৷ সেই বেঞ্চ দেখিয়ে একটা লোক বলল, ‘আপনারা বসেন৷ সরদারের কাছে আমরা নোক পাটাচ্ছি৷’

বাঁশের বেঞ্চগুলো বেশ উঁচু৷ প্রত্যেকের পা ঝুলে রয়েছে৷ প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে রসিক বলল, ‘মাঝে মইধ্যে জমিতে ঠোকবেন৷’

জয়কে ভয় পাওয়ানোর জন্য অঙ্কুশ ফিসফিস করে বলল, ‘লাঠিটা ঠুকতে বলছে কেন, জানিস? তার মানে এখানে প্রচুর সাপ আছে৷ লাঠি ঠুকলে সাপগুলো ধারে কাছে আসবে না৷’ শুনে সঙ্গেসঙ্গে জয় বেঞ্চির উপর পা ভাঁজ করে বসল৷ দেখে মনে মনে হাসল অঙ্কুশ৷ বেচারী জানে না, বাঁশ বেয়ে বেঞ্চে উঠে আসতে সাপের দশ সেকেন্ডও সময় লাগবে না৷

টানা সাত ঘণ্টা পেটে কিছু পড়েনি৷ গলাও শুকিয়ে কাঠ৷ জয় কিটব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে খকখক করে খেতে লাগল৷ তার পর বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নে৷ রাতে পেটে দেওয়ার মতো আর কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না৷ দেখতেই পাচ্ছিস, একটা স্টোরি করার জন্য আমাদের কত খাটতে হয় ? ইস, তোর জন্য আমার খারাপ লাগছে রে অঙ্কুশ৷ তোকে না নিয়ে এলেই পারতাম৷’

উঠোনের একপাশে কুয়ো মতো আছে৷ বালতিতে জল তুলে বিরসা গা-হাত-পা আর ব্যাগের কাদা ধুচ্ছে৷ জয়ের কথা হয়তো ওর কানে গিয়েছিল৷ কাছে এসে তোয়ালে দিয়ে গা-হাত মুছে ও বলল, ‘খিদে পেয়েছে বুঝি৷ দাঁড়াও, আমার কাছে ভাজা চিঁড়ে-বাদামের প্যাকেট আছে৷ অসময়ে কাজে লাগে বলে সবসময় সঙ্গে রাখি৷ পালান সরদার আসার আগে তোমরা ডিনারটা সেরে নাও৷’

যে দু’জন লোক অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল, তাদের একজন পালান সরদারকে ডাকতে গিয়েছে৷ অন্য জনের নাম সুবল৷ সে দুটো লন্ঠন জ্বালিয়ে নিয়ে এসে গল্প করতে বসল৷ পালান সরদার নাকি বাইরের কারো সঙ্গে দেখা করে না৷ দশজনের বলয় সর্বক্ষণ তাকে ঘিরে থাকে৷ নেহাত মিনিস্টার সাহেব পাঠিয়েছেন বলে সুবল দেখা করতে দিচ্ছে৷ চিঁড়েভাজা খেতে খেতে জয় চেষ্টা করছে, ওর পেট থেকে কথা বের করার৷ ঘুরে ফিরে পালান সরদারের কথা তুলছে৷ কিন্তু, সুবল পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে৷ বারবারই বলছে, ‘সরদার এলি তাঁরি জিজ্ঞেস করবেন৷ আমরা কিছু কইতে পাইরব না৷’ অঙ্কুশ লক্ষ করল, পালান সরদার নিয়ে কথা বলার থেকে সুবল অনেক বেশি উৎসাহী, ভেড়ি আর মাছের ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে৷ একবার ও বলেও ফেলল, এই ভেড়ির বাগদা চিংড়ি সব জাপানে যায়৷ তবুও, মালিক ভেড়িটা বিক্রি করে দিতে চাইছে৷

চিংড়ি নিয়ে অঙ্কুশের কোনও আগ্রহ নেই৷ ও চোখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল৷ আধ ফালি চাঁদ মাথার উপর উঠে এসেছে৷ চাঁদের আলোয় এ বার আবছা আবছা সব দেখা যাচ্ছে৷ সামনে খড়ের চাল দেওয়া মাটির বাড়িটা দোতলা৷ এটাই পালান সরদারের আত্মগোপন করার ডেরা নাকি? লোকটাকে দেখার খুব কৌতূহল হল ওর৷ আর একটু পরেই দেখা হবে৷ বাড়ি ফিরে গিয়ে টিটোর কাছে গল্প করতে পারবে৷ টিটোর কথা মনে পড়ায় হঠাৎ অঙ্কুশের খেয়াল হল, আরে… সারাদিন বাড়ির সঙ্গে তো যোগাযোগ করাই হয়নি৷ পিঙ্কি বউদি খুউব রেগে থাকবে৷ বারবার বলে দিয়েছিল, দয়াপুরে পৌঁছেই একটা ফোন করতে৷ সে কথা ভুলেই মেরে দিয়েছে ও৷ তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে অঙ্কুশ পিঙ্কি বউদিকে ধরার চেষ্টা করল৷ কিন্তু, কিছুতেই লাইন পেল না৷

পালান সরদার এল রাত্তির প্রায় একটার সময়৷ এল, না বলে তাকে ধরে নিয়ে আসা হল… বলাই বোধহয় ভাল৷ প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা৷ দশাসই চেহারা৷ মিশমিশে কালো৷ চোখ দুটো লাল৷ পরনে ফতুয়া আর ধুতি৷ লোকটাকে দেখেই অঙ্কুশের মনে হল, আকণ্ঠ মদ গিলে এসেছে৷ ও বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করল৷ পঞ্চাশের কাছাকাছি তো হবেই৷ তিন-চারজন মিলে ধরে পালান সরদারকে নিয়ে গিয়ে বসাল মাটির বাড়িতে৷ পিছু পিছু ওরাও তিনজন বাড়ির ভিতর ঢুকে এল৷ ঘরে কাঠের একটা টেবল রয়েছে৷ তার তিনদিকে চেয়ার৷ পালান সরদার একটা চেয়ারে বসেই জিজ্ঞেস করল, ‘আগে বলুন, আমি কী এমন লোক যে, আমাকে নিয়ে লিখতে হবে?’

গলার স্বরে কোনও জড়তা নেই৷ কথাও বলছে শহুরে ভাষায়৷ পালান সরদারকে একটু তোয়াজ করার ভঙ্গিতে জয় উত্তর দিল, ‘আপনাকে নিয়ে পাবলিকের অনেক কৌতূহল৷ আপনি হচ্ছেন সুন্দরবনের জনি ডেপ৷ পাইরেট অফ সুন্দরবন৷ আপনার সম্পর্কে লোকে খুব জানতে চায়৷’

‘কী জানতে চায়, বলুন৷’

‘এই যেমন…আপনি কোথাকার লোক? আপনাকে নিয়ে একটা মিথ গড়ে উঠল কী করে…?’

‘আমি সাঁওতাল সম্প্রদায়েরলোক৷ আমার ঠাকুরদা ছোটনাগপুর থেকে এখানে এসেছিল… সেই গোরা সাহেবদের আমলে৷ জঙ্গল কেটে বসতি করার জন্য তখন অনেকেই ওই অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিল৷ আমার জন্ম অবশ্য নগেনাবাদে৷’

‘জল ডাকাতিতে নামার আগে কী করতেন?’

‘অন্যের জমিতে দিন মজুরি খাটতাম৷ ভেড়িতে মাছ পাহারা দিতাম৷ একবার ভেড়ি দখল নিয়ে দুই মালিকের মধ্যে লাঠালাঠি হল৷ রক্তারক্তি হয়েছিল৷ পুলিশ আসায় আমি দোবাঁকির জঙ্গলে পালিয়ে গেছিলাম৷ সেই থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷ খাব কী, তাই ডাকাতি শুরু করলাম৷ আগে গাঁয়ের পয়সাওয়ালা লোকের বাড়িতে গিয়ে ডাকাতি করতাম৷ পরে দেখলাম, তার থেকে জলে ডাকাতি করে অনেক লাভ৷ বাংলাদেশি ডাকাতদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল৷ আমরা এরিয়া ভাগাভাগি করে নিলাম৷’

‘জীবনে প্রথম ডাকাতিটা কোথায় করেছিলেন পালান?’

‘দত্তা নদীর ধারে লাক্সবাগান বলে একটা গাঁয়ে৷ একটা ছিপ নিয়ে আমরা পাঁচজন মিলে গিয়েছিলাম৷ সঙ্গে ছিল মাত্তর একটা বন্দুক৷ বাড়ির কর্তার গায়ে দাঁ-এর কোপ মারতেই সিন্দুক খুলে দিয়েছিল৷ সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, খেটে খাওয়ার থেকে ডেঁটে খাওয়া অনেক সোজা৷ ভয় পাওয়ার থেকে ভয় পাওয়ানো অনেক সহজ৷ কিছুদিনের মধ্যে হাত পাকিয়ে ফেললাম৷’

‘মোট কত ডাকাতি করেছেন, আন্দাজ আছে?’

‘সেই রেকর্ড পুলিশের কাছে আছে৷ তা, একশোর উপর তো হবেই৷ ভবানী ভবনে গিয়ে খোঁজ করলেই জানতে পারবেন৷ একশোটার বেশি মার্ডার কেসই আছে আমার নামে৷ পুলিশ অবশ্য একবারের বেশি ধরতে পারেনি আমাকে৷ আর এখন তো ধরার প্রশ্নই নেই৷ ওদের অনেক টাকা দিতে হয় আমাকে৷’

‘ডাকাতি করার সময় এই যে অত্যাচার করেন, মানুষ মেরে ফেলেন… পরে কখনো অনুতাপ হয় না?’

‘কখনো কখনো হয়৷ দয়াপুরে একবার গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে দোতলায় উঠে গেছিলাম৷ ভয় দেখানোর সময় দেখি, বাড়ির অল্পবয়সি একটা বউ বঁটি উঁচিয়ে তেড়ে আসছে৷ দেখে এত রাগ হল, এক লাথি মেরে তাকে দোতলা থেকে ফেলে দিলাম৷ বউটা নীচে পড়ে যেতেই দেখি, রক্তে ভেসে যাচ্ছে উঠোন৷ পরে জানলাম, বউটা সাত মাসের গর্ভবতী ছিল৷ তার সোয়ামীকেও গুলি করে মেরেছিলাম৷ বড় পাপ করেছিলাম সেদিন৷ ভগবান তার শাস্তিও দিয়েছেন৷ আমাকে কোনও সন্তান দেননি৷ তার পর থেকে ডাকাতি করতে গিয়ে কখনো মেয়েছেলের গায়ে হাত দিইনি৷’

‘আপনার আর কে কে আছে পালান?’

‘ঘরে বউ আছে৷ আর দশ-বারোটা ছেলে-মেয়ে৷ অনাথ আশ্রমের মতো করেছি৷ ছোটনাগপুরে থেকে ওই ছেলে মেয়েগুলানকে নিয়ে এসেছি৷ লেখাপড়া শেখাচ্ছি৷ পাপ কাটাচ্ছি বলতে পারেন৷’

জয় ডিক্টোফোনে পুরো ইন্টারভিউটা তুলে নিচ্ছে৷ ঘরে লন্ঠনের আলো৷ বিরসা তাই ফ্ল্যাশ মেরে পালান সরদারের একটার পর একটা ছবি তুলে যাচ্ছে৷ অঙ্কুশ চুপ করে শুনছে জল ডাকাতের গল্প৷ বছরের বেশির ভাগ সময়ই পালান সরদারদের কাটে জলে, জঙ্গলে৷ ওঁরা আত্মগোপন করে থাকেন কোর এরিয়ায় কোনও নির্জন দ্বীপে৷ মাছ ভর্তি কোনও ট্রলারের সন্ধান পেলে, নদীপথে দ্রুত হাজির হন৷ অতর্কিতে আক্রমণ করে সেই ট্রলার দখলে নিয়ে কোনও খাঁড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দেন৷ যাতে কোস্টাল গার্ডদের চোখে না পড়ে৷ তার পর সেই ট্রলারের মালিকের কাছে লোক পাঠান মুক্তিপণ আদায়ের জন্য৷ ট্রলারে যত বেশি টন মাছ, তত বেশি মুক্তিপণ টাকা না দিলে সব মাছ নদীতে ফেলে দেওয়ার হুমকি৷ কোনও মালিকই মাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ার এই ঝুঁকিটা নিতে চান না৷ বাধ্য হয়ে টাকা পাঠিয়ে দেন৷

পালান সরদার বর্ণনা দিচ্ছেন, জঙ্গলে কত লড়াই করে ওঁদের বাঁচতে হয়৷ কতবার ওঁরা বাঘের পাল্লাতেও পড়েছেন ৷ সমুদ্রের কাছাকাছি নাকি প্রচুর রহস্যময় দ্বীপ আছে, যেখানে এখনও মানুষের পা পড়েনি৷ তার মধ্যে একটা হল সাপ-চর৷ কোর এরিয়ার খুব কাছে৷ ছোট্ট সেই দ্বীপে নাকি বিশাল বিশাল সব সাপ থাকে৷ গভীর রাতে সাপ চরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পালান সরদাররা নাকি দেখেছেন, কাসর-ঘণ্টা বাজিয়ে সেখানে পুজো হচ্ছে৷ অঙ্কুশ গোগ্রাসে এই সব কথা গিলছিল৷ মরা কোটালের সময় ওই সব অঞ্চলে নাকি এমন সব জিনিস দেখা যায়, যাতে বোঝা যায়, বহু আগে ওখানে লোকজন বসবাস করত৷

এই সব কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গেলেন পালান সরদার৷ তার পর সুবল বলে লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই তোরা, রিপোর্টারবাবুদের খাবারের কিছু ব্যবস্থা করেছিস?’

সুবলের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে৷ ও ঘাড় নেড়ে না বলতেই, পালান সরদার রাগে জ্বলে উঠলেন৷ সুবলের গালে বিরাশি সিক্কার একটা চড় মেরে উনি বললেন, ‘এঁরা আমার অতিথি৷ আমার কাছে এসে এঁরা রাতে অভুক্ত থাকবেন?’

এক চড়েই ছিটকে মেঝেতে পড়েছে সুবল৷ দরজার বাইরে থেকে লোকজন ঘরে ঢুকে সুবলকে তুলে নিয়ে গেল৷ পালান সরদার হাতজোড় করে বললেন, ‘আমাকে মাফ করবেন বাবুরা৷’ কথায় কথায় রাত তিনটে বেজে গেল৷ জয়ের চোখমুখ দেখে অঙ্কুশের মনে হল, দারুণ খুশি৷ সত্যি, পালান সরদারের জীবনের গল্প যদি ভাল করে ও লিখতে পারে, তা হলে লোকে খুব পড়বে৷ এই লোকটা ভিলেন নয়, রিয়েল লাইফে হিরো৷ বাদাবনের মানুষদের খুব সাহায্য করে৷ একটা রবিনহুড মার্কা ইমেজ আছে৷ এর সঙ্গে একটা ছবি তুলে রাখলে ভাল হত৷ মুখ ফুটে সে কথাটা বিরসাকে বলবে কিনা, তা নিয়ে দোমনা করছিল অঙ্কুশ৷ এমন সময় বিরসা নিজেই বলল, ‘পালান সরদারের পাশে গিয়ে দাঁড়াও অঙ্কুশ৷ তোমাদের একটা ছবি তুলব৷’ ছবিটা তুলে অঙ্কুশ নিশ্চিন্ত হল৷ টিটোকে দেখালে, ও আর অবিশ্বাস করতে পারবে না৷

জয়ের ইন্টারভিউ শেষ হতে না হতেই গরম গরম খিচুড়ি আর বাগদা চিংড়ি ভাজা চলে এল৷ সোনামুগের ডাল দিয়ে খিচুড়ি৷ ভেড়ি থেকে তুলে আনা, সদ্য ভাজা বাগদা৷ সাইজ দেখে অঙ্কুশ অবাক৷ বাড়িতে থাকলে অত রাতে কখনোই কিছু খেত না ও৷ কিন্তু, এখানে না খেলে পালান সরদার কষ্ট পাবেন৷ সে কথা ভেবে ও খুব তৃপ্তি করে খেয়ে নিল৷ ওদের খাওয়া শেষ হতেই পালান সরদার উঠে দাঁড়ালেন৷ তার পর হাতজোড় করে বললেন, ‘দেখবেন বাবুরা, এমন কিছু লিখবেন না, যাতে আমার বদনাম হয়৷’

জয় বলল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন৷’

‘ফেরার সময় আপনাদের আর হেঁটে যেতে হবে না৷ আমার ছেলেরাই আপনাদের বাইকে করে পৌঁছে দেবে ঝড়খালির বাজারে৷ তবে কি না, এখুনি আপনাদের বেরতে হবে৷ যাতে ছেলেরা আলো ফোটার আগেই ফিরে আসতে পারে৷ বুঝতেই তো পারছেন, পুলিশের ভয়৷’

… ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে অঙ্কুশরা যখন ঝড়খালি বাজারে পৌঁছল, তখনও বেশ অন্ধকার৷ কিন্তু, দোকানপাট খুলে গিয়েছে৷ ওদের দেখতে পেয়ে অফিসের গাড়ির ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলল, ‘জয়দা,সারা রাত কোথায় ছিলেন? এখানে তো আমি বিপদে পড়ে গেছিলাম৷’

জয় জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের বিপদ?’

‘আরে, রাত এগারোটার সময় গাড়ির কাঁচ তুলে শুয়ে আছি৷ এমন সময় কয়েকটা ছেলে এসে আমাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল৷ গাড়িতে যারা এসেছে, তারা পুলিশের লোক কি না? আমাকে চড়চাপড়ও মারল৷ যত বলি, আমরা খবরের কাগজের লোক, বিশ্বাসই করে না৷ কাদের সঙ্গে ফোনাফুনি করতে লাগল৷ তার পর রাত একটার সময় ছেলেগুলো চলে গেল৷ ফের চারটের সময় হাজির৷ সঙ্গে বিরাট তিনটে ঝুড়িতে মাছ৷ আর মধুভর্তি তিনটে বোতল৷ জোর করে ডিকিতে সব তুলে দিয়ে গেল৷ দেখবেন নাকি?’

বিরসা বলল, ‘জয়দা, বুঝতে পারলে কিছু?’

জয় বলল, ‘কারা এ সব দিয়ে গেল বল তো?’

‘অবভিয়াসলি পালান সরদারের লোক৷ ঝড়খালিতে ওঁদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক আছে৷ আমাদের সম্পর্কে এখান থেকে কনফার্মড হওয়ার পর পালান সরদার আমাদের সঙ্গে ওখানে দেখা করেছেন৷ যে ছেলেগুলো মাছ আর মধু দিয়ে গিয়েছে, তারা ওঁরই লোকজন৷ বুঝতে পারছ, বাজারে এই নেটওয়ার্কটা ওঁর আছে বলেই পুলিশ ওঁকে ছুঁতে পারে না৷’

ঝড়খালি বাজার থেকে গাড়ি করে ওরা যখন রওনা হল, তখন ভোরের আলো সবে ফুটেছে৷ তখনই অঙ্কুশের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল৷ পর্দায় ও দেখল, পিঙ্কি বউদি৷ এত সকালে ফোন! সেট কানে দিতেই ও দিক থেকে পিঙ্কি বউদি কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘ঠাকুরপো, তুমি কোথায়? কাল রাত থেকে তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি৷ অথচ পাচ্ছি না কেন?’

নিশ্চয় কোনও বিপদ হয়েছে৷ অঙ্কুশ বলল, ‘কী হয়েছে বউদি? তোমার গলাটা এ রকম লাগছে কেন?’

পিঙ্কি বউদি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘যেখানেই থাক, শিগগির চলে এসো৷ বড়মা আর নেই৷’

(চবিবশ)

মহেশপুরে আসার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না তরিতার৷ কিন্তু, শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন মহেশপুরে এসে তিনি বুঝতে পারলেন, না এলে খুব ভুল করতেন!

দয়াপুরে কথা বলতে গিয়ে অমর মন্ডল অনেকবার ওঁকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘প্লিজ ম্যাডাম, মহেশপুরে আপনি একবার পায়ের ধুলো দেবেন৷ মনসামেলার জন্য এতগুনো টাকা আপনি ডোনেশন দিলেন, অথচ লোকে একবার আপনাকে দেখতে পাবে না, তা কি হতে পারে?’

অমর মণ্ডলকে বেশ সজ্জন বলে মনে হয়েছিল তরিতার৷ চন্দ্রভানু সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য লোকটাকে হাতে রাখা দরকার৷ সেই কথা ভেবে বলেছিলেন, ‘সময় পেলে আমি নিশ্চয় যাব৷ তবে সংক্রান্তির দিনই আমাকে ফিরে আসতে হবে৷ আগে একটা কথা বলুন আমাকে৷ গাঁয়ের মানুষের কি আগ্রহ আছে মা মনসাকে নিয়ে?’

‘আগে ছিল না ম্যাডাম৷ কিন্তু, মাসখানেক আগে গাঁয়ের একটা মেয়ে নাকি স্বপ্নে মা মনসাকে দেখেছে৷ সে এক আশ্চর্য মেয়ে৷ গলায় কেউটে ঝুলিয়ে ঘুরে বেরায়৷ লোকের বাড়িতে গিয়ে বোঝায়, সাপ হল মা মনসার সন্তান৷ সাপকে কেউ মেরো না৷’

তরিতা খুব কৌতূহলবোধ করেছিলেন শুনে৷ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কে এই মেয়েটা?’

‘ওর নাম গোলাপি, ম্যাডাম৷ আগে থাকত সোনারপুরের কাছে কোনও একটা জায়গায়৷ মনে হয়, ডোমেস্টিক হেল্প-এর কাজ-টাজ করত৷ কিছুদিন হল মহেশপুরে ভাইয়ের বাড়িতে চলে এসেছে৷ সারাক্ষণ পোষা সাপ নিয়ে পড়ে থাকে৷ স্নান করায়, খাওয়ায়৷ গাঁয়ে ও আসার পর থেকেই মা মনসার উপর লোকের ভক্তি বেড়ে গিয়েছে৷’

গোলাপি বলে মেয়েটার কথা শুনেই তরিতা মহেশপুরে আসার জন্য উদগ্রীব ছিলেন বেশি৷ মেয়েটা নাকি বলে বেরায়, সাপ না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে৷ এত বড় একটা সত্যি কথা মেয়েটা জানল কী করে? ডোমেস্টিক হেল্প-এর কাজ করত, তার মানে লেখাপড়া বেশি শেখেনি৷ কিন্তু, যে কথাটা ও বলে বেরায়, তার অন্তর্নিহিত অর্থ বিশাল৷ সর্পবিশেষজ্ঞ বলেই তরিতা জানেন, পৃথিবীর শস্যভাণ্ডারের অন্তত তিরিশ ভাগ নষ্ট করে দেয় ইঁদুর৷ খেত-খামারের গর্তে তারা বাস করে, খেতের ফসল খেয়ে তারা বাঁচে৷ গবেষণা করে দেখা গিয়েছে, প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ ফসল … এ ভাবেই ইঁদুরের পেটে চলে যায়৷ কিন্তু, ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স বলে একটা কথা আছে৷ অনেক প্রজাতির সাপ আছে, যাদের প্রিয় খাবার হল ইঁদুর৷ যেমন গোখরো, চন্দ্রবোড়া৷ ইঁদুর খেয়ে এইভাবেই সাপ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে৷ কোনও কারণে সাপের সংখ্যা যদি কমে যায়, তা হলে খেত খামারে ইঁদুরের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে৷ কেননা, ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা বেশি৷ তার ফলে আরও বেশি করে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে৷ পৃথিবীর শস্যভাণ্ডারে একদিন টান পড়বেই৷ শস্যের দখল নিয়ে মারামারি, হানাহানিও হবে৷ তরিতা নিজেও মনে করেন, পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সাপকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার৷ সেই কারণেই বেশি দরকার, মা মনসার পুজোর প্রচলন৷

সকাল দশটায় নেত্রা আর শোভাকে সঙ্গে নিয়ে দয়াপুর থেকে বেরিয়েছিলেন তরিতা৷ মহেশপুরে পৌঁছেছেন বেলা দুটোয়৷ পুজোর আয়োজন দেখে মনে মনে তিনি খুশি৷ রাস্তায় বিরাট বিরাট তোরণ৷ মন্দিরতলার মাঠে এক পাশে বিরাট ম্যারাপের নীচে মা মনসার দশ ফুট উঁচু মাটির মূর্তি আনা হয়েছে৷ প্রচুর লোকজনের ভিড় সেখানে৷ শোলার কারুকার্য দিয়ে পুরো মণ্ডপটা সুন্দর করে সাজানো৷ অন্য পাশে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল মঞ্চ৷ সেখানে গতকাল থেকে হারাধন পালাকার মা মনসার পালা শুরু করে দিয়েছেন৷ অমর মন্ডল বললেন, পাঁচ-ছ’হাজার মানুষ বসে নাকি পালাগান শুনেছেন৷ আজ বিকেল চারটে থেকে পালাগানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে৷

ছোটবেলায় ক্যানিংয়ে আশ্রমের মায়েদের সঙ্গে অনেকবার মেলায় গিয়েছেন তরিতা৷ এখন মেলার চরিত্র অনেক বদলে গিয়েছে৷ তখন খাবার আর মেয়েদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দোকানই থাকত বেশি৷ এখন নাগরদোলা, চড়কি, বন্দুকবাজি, ভিডিয়ো গেমস ছাড়াও রয়েছে কাপড়, বেডশিট, বেতের তৈরি আসবাবের দোকান৷ তরিতার সবথেকে ভাল লাগল শোলার তৈরি নানা ধরনের জিনিসের দোকানগুলো দেখে৷ অমর মণ্ডল বললেন, ঘর সাজানোর এইসব শিল্পকলা নাকি বিদেশেও যায়৷

মেলা প্রাঙ্গণে ঘোরার সময় হঠাৎ তরিতার চোখে পড়ল, একটা রঙিন তাঁবুর সামনে প্রচুর মানুষ লাইন দিয়ে টিকিট কিনছেন৷দেখে তরিতা প্রশ্ন করলেন, ‘ওই তাঁবুর ভিতরে কী হচ্ছে অমরবাবু?’

অমর মণ্ডল খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘আগে বলব না ম্যাডাম৷ আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই৷ কী হচ্ছে, নিজের চোখেই দেখবেন চলুন৷’

ভিড় সরিয়ে অমর মণ্ডল তাঁবুর ভিতর নিয়ে যেতেই তরিতা দেখলেন, গ্লাস ফাইবারের ঘরের মধ্যে প্রচুর সাপের মাঝে বসে আছে কুড়ি-একুশ বছরের একটা মেয়ে৷ সাপের খেলা দেখাচ্ছে৷ সঙ্গেসঙ্গে মায়ামির সার্পেন্টেরিয়ামের কথা মনে পড়ে গেল তরিতার৷ একশো দশটা দিন তিনিও কাটিয়েছিলেন সাপেদের মাঝে৷ বাদাবনে এই মেয়েটা সেই একই শো করছে৷ তফাৎ হল, মেয়েটার হাতে রয়েছে কর্ডলেস মাইক৷ সাপের ডেরায় বসে ও সাপ সম্পর্কে সাধারণ লোকের ভয় ভাঙাচ্ছে৷ কী বলছে, মন দিয়ে শুনতে লাগলেন তরিতা৷ ‘সাপকে অযথা ভয় পাবেন না৷’

‘সাপ অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী৷’

‘খুব অল্পসংখ্যক সাপেরই বিষ আছে৷’

 ‘সাপে কাটলে কখনো ওঝা বা গুণিনের কাছে যাবেন না৷ যত শিগগির সম্ভব হাসপাতালে পৌঁছবেন৷’

‘সাপকে মেরে ফেললে মা মনসা খুব রেগে যাবেন৷’

‘মা মনসার পুজো করলে কোনওদিন সাপে কাটবে না৷’ ইত্যাদি, ইত্যাদি৷

দূর থেকে খানিকক্ষণ মেয়েটাকে ভাল করে দেখলেন তরিতা৷ কথাগুলো খুব ধীরে ধীরে বলছে এবং গভীর আত্মবিশ্বাস থেকে৷ সাপ সম্পর্কে এই সব তথ্য মেয়েটা জানল কী করে? নিশ্চয় এমন কারও কাছ থেকে শুনেছে, সাপ সম্পর্কে যার পড়াশুনো আছে৷ তরিতা তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, মেয়েটাকে তিনি দয়াপুরে নিয়ে যাবেন৷ তখনই পাশ থেকে অমর মণ্ডল বললেন, ‘এই গোলাপি মেয়েটার কথাই আপনাকে সেদিন বলেছিলাম ম্যাডাম৷ মেলায় রোজ দুপুর আর সন্ধেবেলায় একঘণ্টা করে ও সাপের ঘরে কাটাবে৷ এমন শো-তো এই অঞ্চলে আগে কখনো হয়নি৷ তাই ওকে দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোক আসছে৷ আজ সন্ধেবেলাতেও ভাল ভিড় হবে৷’

তরিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই শো-এর আইডিয়াটা কার মাথা থেকে বেরল অমরবাবু?’

‘গোলাপি নিজেই এসে আমায় বলেছিল৷ আমি তখন ভাবলাম, তা হলে টিকিট কেটেই না হয় লোকে দেখুক৷ পাঁচ টাকা করে টিকিট৷ কাল প্রায় হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে৷ গোলাপি বলেছে, এই টাকাটা ও সাপেদের পিছনেই খরচ করবে৷’

‘সাপেদের পিছনে খরচ করবে মানে?’

‘বন বাদাড় থেকে ধরে এনে গোলাপি বাড়িতে দশ-বারোটা সাপ পুষেছে৷ তাদের খুব যত্ন করে৷ সাপেদের দেখভালের জন্য কিছু খরচ তো হয়ই৷ এতদিন দাদার কাছে পাততে হত৷ এখন থেকে আর দরকার হবে না৷ কিন্তু, ওর এই শো নিয়ে সমস্যা হয়েছে ম্যাডাম৷ থানার বড়বাবু আমাকে ফোন করেছিলেন৷ বললেন, সাপের শো বন্ধ করে দিতে হবে৷ সরকারের অনুমতি ছাড়া সাপ নিয়ে খেলা দেখানো যায় না৷ আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷’

‘উনি ঠিকই বলেছেন৷ ইচ্ছে করলে ফরেস্ট অফিসাররা এসে সাপগুলো নিয়েও যেতে পারেন৷’

‘এ নিশ্চয়ই চাঁদের বদমাইশি, বুঝলেন ম্যাডাম৷ আমাদের মনসামেলায় যে এত লোক হচ্ছে, এটা ও সহ্য করতে পারছে না৷’

‘কেন সহ্য করতে পারছে না?’

‘মা মনসার নাম শুনলেই জ্বলে ওঠে যে৷ শুনেছি, মা মনসাকে দেবী বলেই ও মানে না৷ কাণি বলে গালগাল দেয়৷ এমন আস্পর্ধা! এখানকার মেলা ভণ্ডুল করার অনেক চেষ্টা করেছিল চাঁদ৷ থানা থেকে পার্মিশন আটকে দিয়েছিল৷ কিন্তু, আমাদের শোলাশিল্প ব্যবসায়ী সমিতির লোকজন থানায় গিয়ে ধরনা দেওয়ার পর বড়বাবু দিনতিনেকের জন্য আনঅফিসিয়ালি পার্মিশন দিয়েছেন৷’

কথা বলতে বলতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন তরিতা৷ নেত্রাকে বললেন, ‘গোলাপির সঙ্গে তুই কথা বল৷ ভাবছি, ওকে দয়াপুরে নিয়ে যাব৷’

নেত্রা বলল, ‘তা হলে তো ওর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷’

মুচকি হেসে তরিতা বললেন, ‘মনে হয়, তার দরকার হবে না৷ শোভাকে নিয়ে তুই ভিতরে যা৷ আমি ততক্ষণ পুজো প্যান্ডেলে ওয়েট করছি৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই ওর শো শেষ হয়ে যাবে৷ তার পর মেয়েটাকে আমার কাছে ধরে আনবি৷ আর হ্যাঁ, কঙ্কণদীঘি থেকে কোনও খবর পেলি?’

‘না, এখনও পাইনি৷ মনে হচ্ছে, বেলা চারটে নাগাদ পেয়ে যাব৷’

নেত্রা আর শোভা তাঁবুর ভিতর ঢুকে যাওয়ার পর অমর মণ্ডলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তরিতা পুজো প্যান্ডেলে এলেন৷ ভিআইপি-দের খাতিরদারি করার জন্য প্যান্ডেলের পাশেই আলাদা একটা জায়গা ঘিরে দিয়েছেন অমর মণ্ডল৷ সোফা-টোফা দিয়ে সাজিয়ে৷ সেখানে তাঁকে বসিয়ে অমর মণ্ডল বললেন, ‘আপনি একটু রেস্ট নিন ম্যাডাম৷ আমি প্রসাদ নিয়ে আসছি৷’

সোফায় বসে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে লাগলেন তরিতা৷ মনে মনে এমন আড়ম্বরই তিনি চেয়েছিলেন৷ যাতে চন্দ্রভানুর বুক জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়৷ মহেশপুর থেকে কঙ্কণদীঘি তো খুব বেশি দূর নয়৷ বলতে গেলে চন্দ্রভানুর বাড়ির উঠোনে তিনি মনসামেলার আয়োজন করেছেন৷ লোকটা এখনও জানে না, আর একটা কত বড় ধাক্কা ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে৷ সোনাখালিতে রয়েছে বলে চন্দ্রভানুর কানে এখনও পৌঁছয়নি, তরিতা ওর অন্দরমহলেও খুকে পড়েছেন৷ ওর অজান্তে, ওরই কঙ্কণদীঘির বাড়িতে আজ ঘটা করে মা মনসার পুজো হচ্ছে৷ পুরোহিত ডেকে সেই পুজো করছে ওরই বউ সনকা৷ আর এই অত্যাশ্চর্য ঘটনাটা ঘটিয়েছে নেত্রা!

দিন কয়েক আগে সন্ন্যাসিনীর ছদ্মবেশে নেত্রা কঙ্কণদীঘিতে চন্দ্রভানুর শিবমন্দিরে গিয়েছিল৷ ওর ওই রূপ দেখে সনকা ভয়ে হোক অথবা ভক্তিতে… হাঁটু গেড়ে প্রণাম করেছিল৷ জল দিয়ে পা ধুইয়ে দিয়েছিল৷ নেত্রার মুখে পরে তরিতা শুনেছেন, সনকাকে বাগে আনতে ওর মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগেনি৷ এমনিতেই নেত্রা বশীকরণের নানা কায়দা জানে৷ মন্ত্রতন্ত্র আঁউড়ে ও নাকি বলেছিল, ‘তোর এই বাড়িতে এক হাজার সাপ লুকিয়ে আছে৷ তুই খুব বিপদে পড়বি৷’ সনকার বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে নাকি নেত্রা চার-পাঁচটা সাপও বের করে এনেছিল৷ ও আরও বলেছিল, স্বয়ং মা মনসা ওকে পাঠিয়েছেন স্বর্গ থেকে৷ শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মা মনসার পুজো করলে সব বিপদ কেটে যাবে৷ আপাতত মূর্তি এনে পুজো করার কোনও দরকার নেই৷ ফণী মনসা গাছের তলায় সোনার ঘট পেতে পুজো করলেই চলবে৷ সবথেকে ভাল হয়, পুজোর ওই সময় গৃহকর্তা যদি হাজির না থাকেন৷

চলে আসার সময় নেত্রা আরও বলে এসেছিল, ‘ আজ চলে যাচ্ছি৷ শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন ফের তোর কাছে আসব৷ পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পর এসে দেখব, মন থেকে তুই মাকে পুজো করেছিস কিনা৷ যদি অন্যথা হয়, নির্বংশ হয়ে যাবি৷’

এই পর্যন্ত শুনে তরিতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুই ফের কঙ্কণদীঘিতে যাবি নাকি?’

‘না, না৷ টাকা দিয়ে লোক ফিট করে এসেছি৷ সনকার কাজের মেয়ে ভানুমতি সরদারকে৷ টাইম টু টাইম সে-ই আমায় সব খবর দিচ্ছে৷ শুনলাম, চন্দ্রভানুকে না জানিয়ে সনকা পুজোর উদ্যোগ নিয়েছে৷’

একা থাকলে অনেক সময় তরিতা ভাবেন, নেত্রা যদি না থাকত, তা হলে তিনি কী করতেন? সঙ্গেসঙ্গে মনটা দৌড়য় অতীতের দিকে৷ সাগর দ্বীপে স্বামী মহেশ্বরজির আশ্রমের সেই দিনগুলোর কথা তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে৷ নেত্রার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগই হত না, যদি না দিল্লিতে গিয়ে তিনি ফের পড়াশুনা শুরু করার সিদ্ধান্তটা নিতেন৷ উফ, কী দুঃসহই না ছিল সেই দিনগুলো! স্বামী জরৎকারু চলে যাওয়ার পর মনের দিক থেকে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলেন তরিতা৷ শেষ পর্যন্ত নিজেই একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আরও পড়াশুনা করতে হবে৷ মহেশ্বরজির কাছে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আশ্রমে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে বাবা৷ আমাকে অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা করুন৷ আমি কলেজে ভর্তি হতে চাই৷’

মহেশ্বরজি সস্নেহে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ আমিও ভাবছিলাম, তোর এখানে আর থাকা উচিত না৷ তুই কী পড়তে চাস মা?’

‘জুলজি৷ দিল্লির জেএনইউ-তে৷ ওদের ওখানে হস্টেলও আছে৷’

‘তুই হোস্টেলে থাকবি কেন? দিল্লিতে আমার এত শিষ্য রয়েছে৷ তাদেরই কারও বাড়িতে তোর থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷’

‘না, আমি কারও বাড়িতে থাকব না৷ ওরা হয়তো মাছ-মাংস খাবে৷ আমার পছন্দ হবে না৷’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ তোর থাকার একটা ব্যবস্থা আমি করে দেবো৷ আগে তুই কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটা পাকা কর৷ ওখানকার কলেজে সিট পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়৷’

‘আমি অন লাইনে অ্যাপ্লাই করে দিয়েছি বাবা৷ মাসখানেকের মধ্যেই দিল্লিতে গিয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিতে হবে৷ এর মধ্যেই আপনি তা হলে একটা ফ্ল্যাটের চেষ্টা করুন৷’

‘তুই একা একা থাকবি কী করে? অত বড় শহর৷ পারবি না মা৷’

ক্যানিং, সাগর দ্বীপের মতো জায়গা থেকে সোজা দেশের রাজধানীতে! তরিতা নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না, মানিয়ে নিতে পারবেন কি না৷ কিন্তু, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও তিনি সরে আসেননি৷ ভর্তির পরীক্ষা দেওয়ার সময় মহেশ্বরজিও তাঁর সঙ্গে দিল্লিতে গিয়েছিলেন৷ তার আগেই তিনি আরকেপুরমে দু’কামরার একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছিলেন৷ জেএনইউ ক্যাম্পাস খুব কাছে, যাতায়াতের অসুবিধে যাতে না হয়৷ দিল্লিতে পৌঁছনোর দিনই বিকেলে নেত্রাকে নিয়ে এসেছিলেন মহেশ্বরজি৷ বলেছিলেন, ‘তোকে যাতে একা থাকতে না হয়, তার ব্যবস্থা করেছি মা৷ এর নাম নেত্রা৷ এও আমার মেয়ের মতো৷ এখানে এ তোর দেখভাল করবে৷ খুব ঠান্ডা মাথার, বিচক্ষণ মেয়ে… ’

‘এ কোথাকার মেয়ে বাবা?’

‘এ থাকত হিমালয়ে মায়াবতীর কাছে এক আশ্রমে৷ এর অনেক গুণ৷ একসঙ্গে থাকলেই সেটা তুই টের পাবি৷ ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে জন্মেছে নেত্রা৷ অলৌকিক কিছু ক্ষমতা নিয়ে৷ এর পরামর্শ ছাড়া তুই এক পাও নড়বি না৷ এ সারা জীবন তোকে গাইড করবে৷’

প্রথম দেখাতেই নেত্রাকে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল তরিতার৷ মেয়েটা সব পারে৷ সব দিকে ওর নজর৷ মায়ামি থেকে তিনি ফিরে আসার পরও নেত্রা তাঁর সঙ্গে রয়েছে৷ সেই থেকে আজও মহেশ্বরজির কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন তরিতা৷ সত্যিই, নেত্রার পরামর্শ ছাড়া কোনও কাজ তিনি করেন না৷ গুণের শেষ নেই মেয়েটার৷ মাথাটা অসম্ভব ঠান্ডা৷ বিপদে পড়লে সব সময় এই নেত্রাই তাঁকে আগলে রেখেছে৷ সর্বদা সাহস জুগিয়েছে৷ নেত্রা পাশে না থাকলে, তরিতা কখনোই হারপেটোলজিস্ট হিসেবে এত সুনাম অর্জন করতে পারতেন না৷ এই যে আজ… তিনি বাদাবনে এসে এভিএস তৈরির ল্যাব বানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটাও নেত্রারই ভরসায়৷ তরিতা নিশ্চিত, গোঁয়ার গোবিন্দ চন্দ্রভানু বুদ্ধির খেলায় ওর সঙ্গে পেরে উঠবে না৷

‘গোলাপিকে ধরে এনেছি দিদি৷’

নেত্রার গলা শুনে বর্তমানে ফিরে এলেন তরিতা৷ সাপের খেলা দেখানোর সময় মেয়েটা সালোয়ার কামিজ পরে ছিল৷ পোশাক বদলে এখন শাড়ি পরে এসেছে৷ শাড়ি পরার ধরন দেখেই তরিতা বুঝতে পারলেন, গোলাপি ঠিক গ্রামের মেয়ে নয়৷ কাছে এসে গোলাপি হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল৷ যেন চোখের সামনে বিস্ময়কর কাউকে দেখছে! তার পর ভক্তিভরে গড় হয়ে প্রখাম করল৷ বেশ খানিকটা সময় পায়ে ওর মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে৷ অস্বস্তিতে হাত ধরে গোলাপিকে টেনে তুললেন তরিতা৷ চোখে জল দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাঁদছিস কেন রে মেয়ে?’

‘জেবন আজ ধন্য হয়ে গেল মা৷ কিচুদিন আগে মা মনসা স্বপ্নে আমায় দেকা দিইচিলেন৷ কইচিলেন, শিগগির তুই দয়াপুরে আয়৷ তোকে খুউব দরকার৷ মায়ের সেই মুখটা এক্কেবারে আপনার মতোন৷ আপনাকে চিনতে পেরেচি৷ আপনার পায়ে ঠাঁই দিন মা৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *