তরিতা পুরাণ – ১

(এক)

টিটো এসে খবর দিল, ‘কুশকাকু, মা তোমাকে ডাকছে৷’

পোষ্যপুত্তুরদের খাবার দেওয়ার জন্য অঙ্কুশ তখন খুব ব্যস্ত৷ অন্য দিকে মন দেওয়ার সময় পর্যন্ত নেই৷ ডায়েরি খুলে ও দেখে নিচ্ছে, কোন বাক্সের ডালা ওকে খুলতে হবে৷ পোষ্যপুত্তুরদের এক একজন সাত-আট দিন অন্তর খায়৷ তাদের খাবার দেওয়ার আগে অঙ্কুশ ভাল করে তারিখ মেলায়৷ দেখে নেয়, স্টমাক ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে কি না৷ নিশ্চিত হলে, তার পর বাক্সের ভিতর ব্যাঙ অথবা ইঁদুর ঢুকিয়ে দেয়৷ কার কী পছন্দ, সেটা ও খুব ভাল করে জানে৷

কাঠের চ্যাপ্টা বাক্সগুলি সারি সারি ওর ঘরের তিন কোণে রাখা৷ একটার উপর একটা, গোটা তিরিশ রয়েছে৷ চোখ বুজে অঙ্কুশ বলে দিতে পারে, কোন বাক্সে কে আছে৷ বাক্সের উপরকার ডালার একটা অংশ পেরেক দিয়ে মারা৷ সেই পেরেক চট করে খুলে নেওয়া যায়৷ খাবার দেওয়ার সময় তো বটেই, পোষ্যপুত্তুরদের স্নান করানোর সময় ওই অংশটা বের করে নেয় অঙ্কুশ৷ ওর পোষ্যপুত্তুররা তখন গোল হয়ে গুটিয়ে থাকে৷ কেউ কিন্তু নিরীহ টাইপের নয়৷ সুযোগ পেলেই ফোঁস করে ওঠে৷ কাউকে একবার ছোবল মারলেই সর্বনাশ! হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সে শেষ৷ বনবাদাড় থেকে এই পোষ্যপুত্তুরদের ধরে এনেছে অঙ্কুশ৷ কাউকে পাঁচ বছর, কাউকে সাত বছর ধরে ও পুষছে৷ আগে খাঁচার ভিতর রাখত৷ কিন্তু, দু’একটা শয়তান পালিয়ে গিয়েছিল৷ ওদের পিয়ারা গ্রামের কয়েকজনকে কামড়ায়ও৷ লোকজন শেষপর্যন্ত তাদের ধরে ফেলে… পিটিয়ে মারে৷ তার পর থেকে অঙ্কুশ সাবধান হয়ে গিয়েছে৷ মন্টু ছুতোরকে দিয়ে মাপমতো কাঠের বাক্স বানিয়ে নিয়েছে৷ দু’পাশে তারের জানলা৷ ফলে বাতাস ঢুকতে অসুবিধে হয় না৷

তিন নম্বর বাক্সের ডালা খোলায় তখন ব্যস্ত অঙ্কুশ৷ গোটা পাঁচেক পেরেক না তুললে খাবার দেওয়া যাবে না৷ খাবার দেওয়ার পরও ও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে৷ স্রেফ এটা দে

খার জন্য, পোষ্যপুত্তুর ঠিকমতো খাচ্ছে কি না৷ না খেলে বুঝতে হবে, কোথাও গণ্ডগোল হয়েছে৷ এমন সময় কেউ ওকে বিরক্ত করুক, অঙ্কুশ সেটা চায় না৷ হাজার হোক, ওর যা কিছু রোজগার, এই পোষ্যপুত্তুরদের জন্যই৷ তাদের ভালমন্দের কথা ওকে ভাবতে হবে বৈকি৷ ও মাত্র গোটা তিনেক পেরেক তুলেছে৷ এমন সময় টিটোর ওই ডাক৷ মুখ ফিরিয়ে অঙ্কুশ দেখল, টিটোর কাঁধে স্কুলের ব্যাগ৷ গেটের বাইরে সাইকেল ভ্যান দাঁড়িয়ে৷ স্কুলে যাওয়ার জন্যই ছেলেটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে৷ টিটো ওর জেঠতুতো দাদা সৌম্যকান্তির ছেলে৷ বয়স দশ বছর, ক্লাস ফাইভে পড়ে৷ ওর খুব ন্যাওটা৷ কুশকাকু বলতে অজ্ঞান৷ লেখাপড়াতেও বেশ ভাল৷ সবথেকে বড় গুণ, জীবজন্তু খুব ভালবাসে৷ টিটোর মধ্যে অঙ্কুশ নিজের ছোটবেলাটাকে খুঁজে পায়৷

মা তোমায় ডাকছে… তার মানে পিঙ্কি বউদি৷ বাড়ির এই একজনের সঙ্গে অঙ্কুশের খুব ভাব৷ প্রায় সমবয়সি৷ দু’জনে একই সাবজেক্ট… জুলজি নিয়ে পড়াশুনো করেছে৷ বউদির ভাল নাম মনোরমা৷ কিন্তু, বিয়ের পরই জেঠিমা বলে দিয়েছিল, ‘ওই চার অক্ষরের নামে তোমায় ডাকতে পারব না বউমা৷ তোমাকে আমরা রমা বলেই ডাকব৷’ সেই থেকে বাড়িতে কেউ ডাকে রমাবউমা, রমাবউদি অথবা কেউ রমাকাকি বলে৷ একমাত্র অঙ্কুশই ডাকে পিঙ্কি বউদি বলে৷ বউদির বাপের বাড়ি গোসাবায়৷ সৌম্যদার বিয়ের পরপর একবার সেখানে বেড়াতে গিয়ে অঙ্কুশ জেনে গিয়েছিল, বউদির ডাকনাম পিঙ্কি৷ ফিরে আসার পর থেকে আড়ালে ও পিঙ্কি বউদি বলে ডাকে৷ শুনলে বউদি রেগে যায়৷

পেরেক তোলা বন্ধ করে…টিটোর মুখের দিকে তাকিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘তোর মা কেন ডাকছে রে? এখনই যেতে হবে, না কি পরে গেলেও চলবে?’

টিটো বলল, ‘এক্ষুনি যাও৷ তোমাকে দরকার৷ গেলেই তুমি বুঝতে পারবে৷’

বাইরে থেকে ভ্যান রিকশাওয়ালা হর্ন দিচ্ছে৷ আরও চার-পাঁচটা ছেলে ভ্যানে বসে রয়েছে৷ স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ কথাটা বলেই তাই আর দাঁড়াল না টিটো৷ ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল অঙ্কুশ৷ ছেলেটা বলে গেল, এক্ষুনি যেতে হবে! কী এমন ঘটল যে, হঠাৎ ওকে দরকার হয়ে পড়ল? এমনিতে বাড়ির কোনও কাজে লাগে না অঙ্কুশ৷ মানে সাংসারিক কোনও কাজে৷ সে সব সামলায় জ্যাঠা-কাকারা৷ অঙ্কুশ সত্যিই খুব লাকি, কেউ ওকে কোনও কাজ করার কথা বলেও না, পিঙ্কি বউদি ছাড়া৷ ইদানীং ওয়াইল্ড লাইফ এক্সপার্ট হিসেবে ওর খুব নাম হয়ে গিয়েছে৷ মিডিয়ার লোক প্রায়ই বুম হাতে নিয়ে ওদের পিয়ারা গ্রামেএসে হাজির হয়৷ ওর ইন্টারভিউ টিভিতে দেখায়৷ সেই কারণে, ওকে নিয়ে বাড়ির সবার খুব গর্ব৷

ওদের এই মিত্তির বাড়িটা বাগানসহ প্রায় দু’একর জমি নিয়ে৷ আগের মতো এখন আর ঠাটবাট নেই, বহু অংশে পলেস্তারা খসে পড়েছে৷ তবুও, গ্রামের লোকে এখনও জমিদারবাড়ি বলে৷ এই বিশাল বাড়িটা করে গিয়েছিলেন অঙ্কুশের ঠাকুর্দার বাবা স্যার সদাশিব মিত্র৷ প্রায় একশো বছরের পুরনো৷ ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি ব্যারিস্টারি করতেন হাইকোর্টে৷ বড়মার মুখে অঙ্কুশ শুনেছে, সেই সময় পিয়ারা গ্রামটা জঙ্গলে ঘেরা ছিল৷ সন্ধের পর বন্দুক ছাড়া বেরতে কেউ সাহস পেতেন না৷ জীবজন্তুর ভয় তো ছিলই, সেইসঙ্গে ডাকাতদেরও৷ স্যার সদাশিব সেইসময় কেন যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে, সাহেব আর্কিটেক্ট দিয়ে এই তিন মহলা বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন, কে জানে?

মূল বাড়ি বেশ খানিকটা ভিতরে৷ গেটের কাছাকাছি বারমহল৷ সাহেবসুবোরা তখন পিকনিক বা পার্টি করতে আসতেন মাঝে মাঝে৷ তাঁদের জন্য অখাদ্য-কুখাদ্য রান্না করতে হত৷ নাচ-গান, নানা স্ফূর্তির ব্যবস্থাও থাকত৷ বাড়িতে রাধামাধবের বিগ্রহ রয়েছে৷ অনাচার যাতে মূল বাড়ি পর্যন্ত না পৌঁছয়, সেই কারণেই মূল বাসস্থানের এত দূরে বারমহল বানিয়েছিলেন স্যার সদাশিব৷ এখন সেটা অঙ্কুশের দখলে৷ মূল বাড়ি থেকে নিজেকে ও সরিয়ে এনেছে৷ বারমহলের নীচের তলায় গোটা দশেক ঘর৷ উপরে একটা বিরাট নাচ মহল৷ ঠিক তার পাশে ডাইনিং হল৷ বেশিরভাগ ঘরই তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে৷ নীচে অঙ্কুশ ওর পোষ্যপুত্তুরদের নিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে আছে৷

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ওর কোনও সমস্যা নেই৷ বাড়ি থেকে দু’বেলা ওকে খাবার পৌঁছে দেয় গোলাপি৷ বংশপরম্পরায় ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে৷ গোলাপিদের বাড়ি সুন্দরবন অঞ্চলে, দয়াপুর গ্রামে৷ ওর বয়স একুশ-বাইশ হবে৷ আর পাঁচটা বাঙালি মেয়েদের থেকে বেশ লম্বা৷ পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির মতো৷ স্বাস্থ্যবতী, প্রচুর খাটতে পারে৷ বাদাবনের মেয়ে, তাই খুব সাহসী৷ রাত-বিরেতেও জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে মেয়েটা গোখরো, কেউটে ধরে আনতে পারে৷ গোলাপিকে নিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নিয়েছে অঙ্কুশ৷ জুলজি কী, মেয়েটা তা জানেই না৷ কিন্তু, জুলজির স্টুডেন্টদের ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিতে পারে৷ বারমহলে নিজের ইচ্ছে হলে, অথবা কখনও কোনও বন্ধুবান্ধব এলে যাতে চা বা কফি বানিয়ে নিতে পারে, তার ব্যবস্থা করে রেখেছে অঙ্কুশ৷ ওর ইচ্ছে না থাকলে, খিদমত খাটতে হাজির হয় গোলাপি৷ মিত্তিরবাড়ির গেটের কাছটাও বেশ জমজমাট৷ অনেক দোকান হয়ে গিয়েছে৷ তার মধ্যে ফাস্ট ফুডের দোকানও আছে৷

জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে পিচের পাকা রাস্তা একদিকে চলে গিয়েছে স্টেশন পর্যন্ত৷ অন্যদিক দিয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় সোনারপুর, এমনকী, বারুইপুর, জয়নগরেও৷ বন্ধুবান্ধব, সরকারী কর্তা বা ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ দেখা করতে এলে অঙ্কুশ বাড়ির লোকদের বিব্রত করে না৷ গোলাপিকে দিয়ে খাবার আনিয়ে নেয়৷ মাসের মধ্যে দশ-বারোদিনই অঙ্কুশকে বাইরে যেতে হয়৷ কখনও সেমিনার, কখনও ওয়ার্কশপ৷ পোষ্যপুত্তুরদের সামলানোর ভার তখন ও দিয়ে যায় গোলাপির উপর৷ ইস, এই সময়টায় যদি গোলাপি কাছে থাকত, তা হলে ওর উপর খাওয়ানোর দায়িত্ব দিয়েই অঙ্কুশ পিঙ্কি বউদির কাছে যেতে পারত৷ রোজ রোজ পোষ্যপুত্তুরদের এই আহার পর্বের সময় গোলাপি হাজির থাকে৷ আজ নেই৷ সকাল থেকেই মেয়েটার পাত্তা নেই৷

গোলাপিকে হেল্প করে তিন্নি বলে একটা মেয়ে৷ জুলজির এমএসসি ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট৷ অঙ্কুশের কাছে হাতেকলমে কাজ শিখতে আসে সপ্তাহে তিনদিন৷ সেই গল্ফগ্রিন থেকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে হাজির হয় মেয়েটা৷ এই বয়সেই ওর নেচার স্টাডি করার স্পৃহা দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় অঙ্কুশ৷ ওর বয়সি আরও দশ-বারোজনকে সঙ্গে জুটিয়েছে তিন্নি৷ নেচার স্টাডির একটা ক্লাব করেছে৷ সবাই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে-মেয়ে৷ কখনও কখনও তাদেরও পিয়ারাতে নিয়ে আসে৷ অঙ্কুশ সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘণ্টা দুই-তিনেকের দূরত্বের কোনও জঙ্গল, ভেড়ি অথবা জলাভূমিতে৷ সারাদিন হইহুল্লোড় করে কাটায়৷ আজ তিন্নির আসার দিন৷ কিন্তু, সেও এসে পৌঁছয়নি৷

তিন্নির কথা মনে হওয়া মাত্র গেটের বাইরে গাড়ি থামার আওয়াজ শুনতে পেল অঙ্কুশ৷ আর তখনই ওর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল৷ বাড়ির ভিতরে যাওয়ার তাড়া, এই সময় কে আবার ফোন করল? পঞ্জাবির পকেট থেকে সেটটা বের করে অঙ্কুশ দেখল, অচেনা নাম্বার৷ সুইচ টিপে ও বলল, ‘কে বলছেন?’

‘মোবারকভাই৷ সালাম আলেকুম৷ আমি আসরফ বইলছি৷ আজ গাঘোরের মধ্যেই আমার দুডা কেউটে চাই৷ আইনতে কখুন লোগ পাঠাব, বইলে দিন৷’

আসরফ বলে কারও কথা মনে পড়ল না অঙ্কুশের৷ ও বলতে যাচ্ছিল ‘রঙ নাম্বার৷’ কিন্তু, ‘গাঘোরের মধ্যেই কেউটে চাই’ কথাটা শুনে ওর কৌতূহল হল৷ গাঘোর মানে গোধূলি আঁধার… মানে বিকেল৷ আসরফ লোকটা বোধহয় সাপ নিয়ে ব্যবসা করে৷ সাপের বিষ চড়া দামে বিক্রি হয়৷ আগে এই কাজটা করত সাপুড়েরা৷ কিন্তু, এখন সরকারের লাইসেন্স ছাড়া সাপ পোষা যায় না৷ অঙ্কুশের এই লাইসেন্স আছে৷ ওকে নিতে হয়েছে চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন-এর কাছ থেকে৷ সল্ট লেকে বিকাশ ভবনে সেই অফিস৷ অ্যান্টি ভেনম সিরাম তৈরি করার জন্য ওর কাছ থেকে সাপের বিষ কিনে নিয়ে যায় ওষুধ কোম্পানির লোকজন৷ কিন্তু, সরকারি নিয়ম মানে কে? এখন সুন্দরবনের গ্রামে গঞ্জে অনেকেই লুকিয়ে সাপ পোষে৷ চোরাগোপ্তা বিষও বিক্রি করে৷ মোবারক, আসরফরা বোধহয় এই ধরনেরই লোক৷ পেট থেকে কথা বের করার জন্য চালাকি করে অঙ্কুশ বলল, ‘আসরফভাই, ওয়ালেকুম সালাম৷ কোথায় লোক পাঠালে আপনার সুবিধে, বলুন৷’

‘জয়নগরে আপনার বাড়িতে পাইঠে দেব?’

‘না, পাঠাবেন না৷ থানার নজর আছে আমার উপর৷ লোকজন সন্দেহ করবে৷ তা, হঠাৎ আজই আপনার কেউটের দরকার হল কেন আসরফভাই?’

‘একডা ভাল পার্টি পেইছি৷ বইলছে, ভাল দাম দিবে৷ আপনাকে আগে যা দাম দিইছি, তার থেকে এ বার কুড়ি ট্যাকা বেশি দেব’খনে৷ কিন্তু, আজগের মধ্যেই আমার দরকার৷’

‘কোথাকার পার্টি মিঞা? আমাদের দোকনে জেলার নাকি?’

‘বইলছে তো দেউলবাড়ির দিকগার৷ ওষুধের ফেকটরি হইছে৷ সিখানে পঁউছে দিতে হবে৷ আপনার কাছে ক’পিস আছে বলেন৷’

মুখ দিয়ে সত্যি কথাটাই বেরিয়ে গেল অঙ্কুশের, ‘কুড়ি বাইশ পিস তো আছেই৷’

কথাটা শুনে বোধহয় ও প্রান্তে আসরফভাইয়ের মনে খটকা লেগেছে৷ একটু চুপ করে থেকে লোকটা বলল, ‘আপনি কি মোবারকভাই বইলছেন?’

গলা পাল্টে অঙ্কুশ ধমক দেওয়ার সুরে বলল, ‘না৷ আমি মোরাবকভাই নই৷ শুনুন, আপনার এই ফোন নাম্বারটা আমি থানায় জানিয়ে দিচ্ছি৷ পুলিশ গিয়ে আপনাকে তুলে আনবে৷ জানেন না, সরকারের লাইসেন্স ছাড়া বাড়িতে কেউটে সাপ রাখা যায় না? আপনার তো জেল হয়ে যাবে৷’

ও প্রান্তের লোকটা তাড়াতাড়ি লাইন কেটে দিল৷ নিশ্চয় সাপুড়ে৷ একটা সময় সাপুড়েদের ওয়েলফেয়ারের জন্য অঙ্কুশ অনেক কিছু করেছে৷ কিন্তু, পরে বুঝতে পেরেছে, শতকরা নিরানববুই ভাগ সাপুড়ে ভয়ানক মিথ্যেবাদী৷ কেউ পার্মানেন্ট জায়গায় থাকতে চায় না৷ লোক ঠকিয়ে বেড়ায়৷ সেইসময় বেদেদের অনেকের কাছেই ওর ফোন নাম্বার থাকত৷ হয়তো ভুল করে আসরফ বলে লোকটা ওর নাম্বার টিপে ফেলেছে৷ পরে লোকটার খোঁজ নিতে হবে৷ মোবাইল সেটে নাম্বারটা সেভ করে রাখল অঙ্কুশ৷ সেটটা পকেটে চালান করার সময়ই ও দেখতে পেল তিন্নিকে৷ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ মুখটা কাঁচুমাচু করে তিন্নি বলল, ‘স্যার, আজকে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল৷ গড়িয়ার কাছে এত জ্যাম, ওখানেই আধ ঘণ্টা নষ্ট হল৷’

গরমে দরদর করে মেয়েটা ঘামছে৷ দেখে অঙ্কুশ বলল, ‘নেভার মাইন্ড৷ এক-আধদিন দেরি হতেই পারে৷ হ্যাঁ, শোনো, পিঙ্কি বউদি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে৷ বাড়ি থেকে চট করে আমি ঘুরে আসছি৷ ততক্ষণে তুমি এই জেরিকেনটায় জল ভরে রাখো৷’

‘কেন স্যার? পোষ্যপুত্তুরদের আজ চান করাবেন?’

‘সবাইকে নয়৷ চন্দ্রবোড়া আর ওর বাচ্চাটাকে৷ আর এই কাজটা আজ তুমি নিজে করবে৷’

‘ঠিক আছে স্যার৷ আমি জল ভরে রাখছি৷ সত্যি, খুব গরম পড়ে গেছে৷ মার্চ মাসের মাঝামাঝি যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে জুন-জুলাইয়ে কী হবে, বলুন তো?’

অন্য সময় হলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে অঙ্কুশ একগাদা কথা বলত৷ আজ সময় নেই৷ ফোনে কথা বলতে গিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ পিঙ্কি বউদি নিশ্চয় রেগে রয়েছে৷ বারমহল থেকে বাড়ির দিকে অঙ্কুশ হাঁটা দিল৷ সকাল থেকে আজ কোনওকিছুই ওর মনোমতো হচ্ছে না৷ কাল অনেক রাত পর্যন্ত হলিউডের একটা ফিল্ম দেখেছে৷ যার গল্পটা একটা কুমির নিয়ে৷ জীবজন্তুদের নিয়ে ছবি দেখতে ও খুব ভালবাসে৷ রাত দশটার সময় টিটো হঠাৎ ফোন করে জানাল, স্টার মুভিজে কুমিরের গল্প নিয়ে ছবি দেখাচ্ছে৷ হয়তো চ্যানেল সার্ফ করার সময় ওর চোখে পড়ে গিয়েছিল৷ টিটো না জানালে ওই সময় অঙ্কুশ টিভি খুলতই না৷ ছবির মেকিং এত ভাল, চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসা সত্ত্বেও পুরো সিনেমাটা ও দেখেছে৷

তাই, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল৷ রোজ জগিং করে এসে আধ ঘণ্টা ওয়েট ট্রেনিং করে অঙ্কুশ৷ আজ ইচ্ছেই করল না৷ আমবাগান পেরিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় অঙ্কুশের চোখে পড়ল এদিক ওদিক অনেক কাঁচা আম পড়ে রয়েছে৷ তখনই ওর তুরুকতোবা কথাটা ওর মনে পড়ল৷ স্যার সদাশিব এক হাজার সুপারি গাছ, আর পঞ্চাশটা করে আম, লিচু, জাম আর কাঁঠাল গাছ লাগিয়েছিলেন বাগানে৷ সব আম যে মিষ্টি তা নয়৷ কয়েকটা গাছের আম ভীষণ টক৷ ছোটবেলায় মায়ের মুখে অঙ্কুশ শুনেছে, গাঁয়ের লোকেরা এক একটা গাছের একেকটা নাম দিয়েছিল৷ যেমন, তুরুকতোবা৷ তখন এদিকে উর্দু বলিয়ে মুসলমানরা থাকতেন৷ টক আম খেয়ে তাঁদেরই কেউ হয়তো বলে ফেলেছিলেন, তোবা তোবা৷ তুরুক মানে তুরস্কের লোক, মুসলমান৷ সেই থেকে সেই আমের নাম হয়ে গিয়েছিল তুরুকতোবা৷ এই রকম আরও নাম রয়েছে গাছের৷ যেমন, কাকদেশান্তরী৷ সেই গাছের টকো আম খেয়ে কাকও নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেত৷ আর কখনও সেই গাছে এসে বসত না৷ তবে ভাল নামও আছে বাগানের কোনও কোনও গাছের৷ যেমন সাহেবপসন্দ৷ গোল গোল হলদেটে আম, চিনির মতো মিষ্টি৷ একবার পিকনিক করতে এসে সেই আম খেয়ে সাহেবরা নাকি মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করে গিয়েছিলেন৷

কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে মূল বাড়ির ভিতর ঢুকতে হয়৷ সিঁড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে অঙ্কুশের মোবাইল ফোনটা ফের বেজে উঠল৷ পকেট থেকে বের করে ও দেখল, পিঙ্কি বউদির ফোন৷ সুইচ অন করতেই ও প্রান্ত থেকে বউদি বলল, ‘কুশ ঠাকুরপো, তুমি কোথায়? যেখানেই থাক, শিগগির নাটমন্দিরের উঠোনে চলে এসো৷’

পিঙ্কি বউদির গলাটা কাঁপা কাঁপা৷ অত্যধিক ভয় পেলে মানুষের গলা যেমনটা হয়৷ এ প্রান্ত থেকে অঙ্কুশ বলল, ‘কেন, কী হয়েছে বউদি?’

‘আরে, গোলাপি কোত্থেকে একটা পাইথন ধরে এনেছে৷ গলায় জড়িয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল ওস্তাদি মারার জন্য৷ পাইথনটা ওর আঙুল কামড়ে ধরেছে৷ কিছুতেই ছাড়ছে না৷’

সর্বনাশ! পিয়ারাতে গোলাপি পাইথন পেল কোথা থেকে? এই অঞ্চলে অজগর সাপ! শুনে অঙ্কুশের বিশ্বাস হল না৷ এই পিয়ারা গ্রামে ওর তিরিশ বছর কেটে গেল৷ খুব ছোটবেলায় বাবার মুখে জঙ্গলে ও বাঘ ধরা পড়ার কথা শুনেছে৷ কিন্তু, কখনও পাইথন বা ময়াল ধরা পড়ার কথা কেউ বলেনি৷ তবে, পিঙ্কি বউদি যখন বলছে, তখন অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই৷ বউদি জুলজিতে এমএসসি৷ পাইথন চিনবে না, এ হতেই পারে না৷ কী হয়েছে, দেখার জন্য অঙ্কুশ লাফিয়ে সিঁড়ি টপকাতে লাগল৷ পাইথনটা গোলাপির আঙুল কামড়ে ধরেছে মানে…সিরিয়াস ব্যাপার৷ আঙুলটা ছাড়ানোর জন্য গোলাপি যত টানাটানি করবে, তত জোরে কামড়ে থাকবে পাইথনটা৷ শরীর দিয়ে পিষে মেরে ফেলবে গোলাপিকে৷ তবে, আগে দেখা দরকার, কী ধরনের পাইথন৷ এমন পাইথনও আছে, খিদে পেলে গোলাপির নির্জীব দেহের পুরোটাই ধীরে ধীরে মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নিতে পারে৷ অঙ্কুশ নিজের চোখে একবার দেখেছে, কীভাবে একটা পাইথন আস্ত ছাগল পেটের ভিতর চালান করে দিয়েছিল৷ পাইথন দেখলে এমনিতেই লোক ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়৷ কিন্তু, সাপ সম্পর্কে গোলাপির জ্ঞানগম্যি আছে বলেই যুঝে যাচ্ছে৷

প্রায় দৌড়েই নাটমন্দিরে পৌঁছে গেল অঙ্কুশ৷ বারান্দায় পা দিয়ে ও যা দেখল, তাতে ওর মতো ওয়াইল্ড লাইফ এক্সপার্টেরও বুক কেঁপে উঠল!

(দুই)

ফাল্গুন মাসে কঙ্কণদীঘির বাড়িতে ঘটা করে শিবরাত্রি ব্রত পালন করেন চন্দ্রভানু৷ মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ করার জন্য তিনি নিয়ে আসেন স্বামী মহেশ্বরজিকে৷ সাগরদ্বীপের আশ্রম থেকে৷ তিনদিন ধরে উৎসব চলে তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ির প্রাঙ্গণে৷ বাইরে মেলা বসে যায় শিবভক্তদের জন্য৷ ঘনঘন বোল ওঠে ‘হর হর মহাদেব’৷ উত্তর দিকে হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, জয়নগর, বারুইপুর থেকে যেমন লোক আসে, তেমনই দক্ষিণ দিকের কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা অঞ্চল থেকেও৷ সারা দিন ধরে প্রসাদি ফল, খিচুড়ি ভোগ, মন্ডা মিঠাই বিতরণ চলে৷ চন্দ্রভানুর কড়া নির্দেশ থাকে, কেউ যেন অভুক্ত অবস্থায় ফিরে না যায়৷ শিবরাত্রির উৎসবে সারা রাত থাকে বিনোদনের ব্যবস্থা৷ পুণ্যার্থীরা দু’চোখের পাতা এক করার সময় পায় না৷ বিস্তীর্ণ মাঠে সাদা পর্দায় ‘বাবা তারকনাথ’, ‘সতীর দেহত্যাগ’ মার্কা বায়োস্কোপ দেখানো হয়৷ এ ছাড়া থাকে যাত্রাপালা, গান৷ ভক্তরা যার যেখানে খুশি, বসে যেতে পারে৷ আয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখেন না চন্দ্রভানু৷ তাঁর দুই ছেলে৷ সম্বৎসর ব্যবসার কাজে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও, তারা সবাই সস্ত্রীক কঙ্কণদিঘির বাড়িতে আসে শিবরাত্রির দিনসাতেক আগে৷ উৎসব যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, তা দেখে৷

কয়েকশো কোটি টাকার মালিক চন্দ্রভানু৷ সুন্দরবন অঞ্চলে সবাই তাঁকে চেনেন৷ মাছের ব্যবসা দিয়ে শুরু করেছিলেন৷ সেই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে বিদেশে গলদা চিংড়ি রপ্তানীর বাজারটা খুলে যাওয়ার পর৷ মীনাখাঁ, হাড়োয়া, হিঙ্গলগঞ্জে কয়েক হাজার বিঘে জমি চাষীদের কাছ থেকে নিয়েছেন চন্দ্রভানু৷ গলদা চাষের জন্য৷ জমিগুলো আগে আবাদি ছিল৷ চাষে লাভ কম৷ চাষীদের বুঝিয়ে সেসব জমি ভেড়িতে বদলে ফেলার সময় চন্দ্রভানুকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল৷ ভেড়ি আর এক্সপোর্টের ব্যবসা দেখাশুনো করার ভার এখন বড় ছেলে জয়গোপালের হাতে৷ ছোট জয়ব্রত সোনাখালিতে ফার্ম হাউস দেখে৷ এই ফার্ম হাউসে নানা ধরনের দুষ্প্রাপ্য ভেষজ গাছ বড় হচ্ছে৷ রায়দিঘিতে মাছের ব্যাবসাটাও দেখে জয়ব্রত৷ তার দায়িত্বে রয়েছে দশটা ট্রলার৷ গভীর সমুদ্রে সেই ট্রলার মাছ ধরতে যায়৷

ব্যবসার কাজে সারা বছর চন্দ্রভানুকে ঘুরে বেড়াতে হয় দেশ-বিদেশে৷ কিন্তু শিবরাত্রি থেকে গাজন… এই চার সপ্তাহ কখনো তিনি কঙ্কখদিঘির বাইরে থাকেন না৷ সদ্য ফিরেছেন থাইল্যান্ডের পাটায়া আর ফুকেত থেকে৷ বকখালিতে একটা টুরিস্ট রিসর্ট খুলতে চান চন্দ্রভানু৷ একেবারে আন্তর্জাতিক মানের রিসর্ট৷ চন্দ্রভানু তাই পাটায়া আর ফুকেতে গিয়েছিলেন, রিসর্ট দেখার জন্য৷ ওই দুটো বিচে কিসের এত আকর্ষণ? কেন সারা পৃথিবী থেকে লোকে ওখানে বেড়াতে যায়? চন্দ্রভানু সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন একজন আর্কিটেক্ট, ইন্টেরিয়র ডেকরেশন কোম্পানির কর্তাকেও৷ ছোট পুত্রবধূ অহল্যার হোটেল ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি আছে৷ তবুও, চন্দ্রভানু তাকে নিয়ে যাননি৷ কেননা, অহল্যাকে তিনি মনে মনে অপছন্দ করেন৷

সুন্দরবনের খ্যাতি সারা বিশ্বে৷ তার কিছুটা যদি ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জন্য হয়, তা হলে বেশিরভাগটাই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের জন্য৷ কিন্তু, বিদেশি টুরিস্টদের থাকার জন্য স্টার ফেসিলিটি রিসর্ট সুন্দরবনে নেই বললেই চলে৷ নিরানববুইভাগ রিসর্ট, গেস্ট হাউস বা হোটেল মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য৷ বিদেশ থেকে তাঁর বিজনেস পার্টনাররা যখন কলকাতায় আসেন, তখন তাঁদের অনেকেই সুন্দরবনে গিয়ে বাঘ দেখতে চান৷ চন্দ্রভানু লজ্জায় তাঁদের কোনও রিসর্টে নিয়ে যেতে পারেন না৷ লঞ্চে করে নদীপথে দু’রাত্তির তাঁদের ঘুরিয়ে আনেন, নেতি ধোপানির ঘাট পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে৷ তাও, ওখানে এখন যেতে হয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নিয়ে৷

চন্দ্রভানু পুরোদমে নেমে পড়েছেন রিসর্ট বানানোর লক্ষে৷ এমন বিলাসবহুল রিসর্ট বানাতে চান যে, একবার এলে বিদেশিরা আর কেউ গোয়ায় যেতে চাইবেন না৷ ওখানে স্পিড বোটিং, ওয়াটার স্কিয়িং, প্যারা গ্লাইডিংও থাকবে৷ কটেজের জন্য জয়পুর থেকে মার্বেল পাথর আনাবেন চন্দ্রভানু৷ ইতিমধ্যেই মায়ানমার থেকে টিক কাঠ আনার অর্ডার দিয়েছেন৷ সড়কপথে সেই কাঠ ট্র্যাক মারফত দু’একদিনের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা কঙ্কণদীঘিতে৷ আর্কিটেক্ট বলেছেন, এক বছরের মধ্যেই রিসর্টের ইনফ্রাস্ট্রাকচার রেডি করে দিতে পারবেন৷

প্রায় একশো কোটি টাকার প্রোজেক্ট৷ ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে কথাবার্তা অনেকটাই এগিয়েছে৷ চন্দ্রভানুর মেজাজ এখন বেশ ফুরফুরে৷ এবার তাই আরও ধুমধাম করে শিবরাত্তির ব্রত পালন করবেন, ঠিক করেছেন৷ ইচ্ছে ছিল, শিবরাত্তিরের দিনই ছেলেদের ডেকে নতুন প্রোজেক্টের কথা বলবেন৷ কিন্তু, আপাতত সেই ইচ্ছেটাকে তিনি দমন করেছেন৷

চন্দ্রভানু জানেন, তাঁর দুই ছেলেই চাইবে, রিসর্ট প্রোজেক্টের ভার নিতে৷ এত বড় দায়িত্ব পালন করার জন্য আলাদা ক্ষমতা থাকা দরকার৷ সবাইকে তা দেওয়া যায় না৷ হোটেল বিজনেসের ধরনটা একেবারে অন্যরকম৷ চন্দ্রভানু মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন, রিসর্টের দায়িত্ব জয়ব্রতর হাতে তুলে দেবেন৷ কিন্তু, এই সিদ্ধান্তের কথা শুনলে বড় ছেলের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে৷ তাতে ব্যাহত হবে শিবরাত্রির উৎসব৷ চন্দ্রভানু ঠিক করেই ফেলেছেন, নতুন প্রোজেক্টের ব্যাপারে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলবেন, অক্ষয় তৃতীয়ার পর৷ তার আগে নয়৷

কঙ্কণদীঘির বাড়িতে সবে দিবানিদ্রা সেরে উঠেছেন চন্দ্রভানু৷ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন৷ পূর্বদিকে মণি নদী বয়ে যাচ্ছে৷ মাছ ধরে ডিঙি নৌকোগুলো খেয়াঘাটের দিকে ফিরে আসছে৷ যাত্রী পারাপার করার জন্য ভটভটিও রয়েছে৷ সামর্থ্যের তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী তোলে মাঝিরা৷ নৌকোডুবির ঘটনা প্রায়ই ঘটে৷ রায়দীঘির বিধায়ককে চন্দ্রভানু অনেকবারই বলেছেন মণি নদীর উপর একটা ব্রিজ তৈরি করে দেওয়ার জন্য৷ সেই সময় সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ আর পূর্ত দফতর ছোট-বড় অনেকগুলি ব্রিজ তৈরি করার উদ্যোগ নিচ্ছিল৷ প্রায় তেত্রিশটা ব্রিজ হয়েওছে৷ কলকাতার দিকে সড়ক পথে এখন দ্রুত যাওয়া-আসা করা যাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে কানেকটিভিটিও বেড়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলের৷ ক্যানিং থেকে মাতলা ব্রিজ পেরিয়ে গাড়িতে এখন সোজা পাথরপ্রতিমা পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়৷ অন্য দিকে যাওয়া যায় হিঙ্গলগঞ্জ পর্যন্ত৷ বছর বারো আগে সেই সময়… সরকারী আমলারা ব্রিজ তৈরির কাজে টেন্ডার দিতে বলেছিলেন চন্দ্রভানুকে৷ সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছয়শো কোটি টাকার প্রোজেক্ট৷ কিন্তু, কনস্ট্রাকশন বিজনেস সম্পর্কে কোনও আন্দাজ না থাকায় সেইসময় চন্দ্রভানু পিছিয়ে যান৷

‘তোমার চা৷’ সনকার গলা শুনে চন্দ্রভানু অত্যন্ত প্রীতবোধ করলেন৷

প্রায় দিন দশেক পর দেখা, চায়ের কাপটা হাতে নেওয়ার আগে একবার তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন৷ বয়স অনেক দিন আগেই পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছে৷ তবু, এখনও সনকা যথেষ্ট সুন্দরী৷ ছেলের বউয়েরা পাশে দাঁড়ালেও সেটা বোঝা যায়৷ গায়ের রঙ এখনও কাঁচা হলুদের মতো, ত্বক টানটান৷ কোমর পর্যন্ত চুল, পাক ধরেনি৷ সুডৌল স্তন, সরু কোমর৷ শরীরে কোথাও এতটুকু মেদ নেই৷ সনকার গায়ে প্রচুর গয়না৷ সবসময় সেজেগুজে থাকতে ভালবাসে৷ কলকাতায় গেলেই নামী দোকান থেকে পছন্দের গয়না কিনে আনে৷ শুধু নিজের জন্য যে কেনে, তা নয়৷ ছেলের বউদের জন্যও একই ডিজাইনের গয়না আনে৷ একটা সময় প্রচুর কষ্ট করেছে৷ সনকার কোনও ইচ্ছেয় তাই বাধা দেন না চন্দ্রভানু৷

চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার পরও চন্দ্রভানু চোখ সরাচ্ছেন না দেখে সলজ্জ ভঙ্গিতে সনকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাঁ করে দেখচটা কী? বাড়িভর্তি লোকজন, খেয়াল আচে?’

শুনে নিজেকে খোলসের ভিতর ঢুকিয়ে নিলেন চন্দ্রভানু৷ তিনি শুধু সনকার স্বামীই নন, পরিবারের সর্বময় কর্তা৷ কয়েকশো পরিবারেরও অন্নদাতা৷ তাঁর আচার-আচরণে যেন এমন কিছু প্রকাশ না পায়, যাতে লোকের চোখে খেলো হয়ে যান৷ নিজেকে সামলে নিয়ে চন্দ্রভানু বললেন, ‘শিবরাত্তির উৎসবের সব অ্যারেঞ্জমেন্ট কি হয়ে গ্যাছে?’

‘তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যই সবাই নাটমন্দিরে বসে আচেন৷ রায়দিঘির থানার ওসি এয়েচেন৷ পঞ্চায়েত মেম্বাররাও আচেন৷ তোমার সঙ্গে কথা না বলে ওরা কিছু ফাইনাল করতে পারচেন না৷’

‘সে কী! আর তিনদিনও যে বাকি নেই৷’

‘তুমি এসে গে’চ৷ সব হয়ে যাবে৷ আমার একটা কতা আচে৷ এ বার কিন্তু ঢালিখেলা হওয়া চাই৷’ আবদারের সুরে সনকা বললেন, ‘বউমারা কেউ ঢালিখেলা দ্যাকেনি৷ সববাই আমাকে ধরেচে৷’

ঢালিখেলা এক অত্যাশ্চর্য ও দুঃসাধ্য তাক লাগানো খেলা৷ ঢাক, খোল আর কাঁসি নিয়ে এই খেলাটা খেলে বাগদি, কাওরা ও ডোম সম্প্রদায়ের লোকেরা৷ ঢাক-ঢোলের ছন্দময় বাজনার সঙ্গে কঠিন শরীরী কসরত৷ গোসাবার দিকে এ রকম অনেক দল আছে৷ সনকার অনুরোধ শুনে মনে মনে হাসলেন চন্দ্রভানু৷ বললেন, ‘মন্টুকে বলে দিলেই তো পারতে৷ আমার জন্য ওয়েট করার কী দরকার ছিল? হ্যাঁগো, মন্টু কোথায়? ওকে দেখছি না কেন বলো তো?’

শুনে একটু অবাক হয়েই সনকা বললেন, ‘তোমাকে কেউ কিছু বলেনিকো? সে মানুষডা তো একন হাসপাতালে৷’

শিবরাত্তির উৎসবের পুরো দায়িত্বে থাকে মন্টু ভক্তা৷ চন্দ্রভানুর বাল্যবন্ধুদের মধ্যে একজন৷ কঙ্কণদীঘিরই বাসিন্দা, খুব সৎ৷ ওর বাবা মনোরঞ্জন ভক্তা ছিলেন মৎসজীবী৷ মন্টুরও মৎসজীবী হওয়ার কথা৷ লেখাপড়ায় খুব বেশিদূর এগোয়নি৷ ছেলেবেলা থেকে ও একটু বাউন্ডুলে টাইপের৷ তখন থেকেই পরোপকার এবং নানা ধরনের রোমাঞ্চকর কাজে জড়িয়ে পড়া ওর অভ্যেস৷ গোসাবায় কারও বাড়িতে বাঘ ঢুকেছে৷ আগুপাছু না ভেবেই মন্টু সেখানে ছুটে যেত৷ বাসন্তীতে কাউকে কুমিরে ধরেছে, দিন দুয়েক পাত্তা নেই মন্টুর৷ কোথায় কোন নদীর বাঁধ ভেঙেছে, সর্বাগ্রে সেখানে হাজির সে৷ বাঁধ মেরামতির কাজে নেমে পড়েছে৷ চন্দ্রভানুরা যখন দুটো পয়সা রোজগারের চিন্তায় মগ্ন, তখন মন্টু কোনওভাবে অন্নসংস্থান করেই সন্তুষ্ট থেকেছে৷ আর্থিক সঙ্গতির দিক থেকে মন্টুর সঙ্গে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, দু’জনের বন্ধুত্বে কখনও ফাটল ধরেনি৷ চন্দ্রভানু অনেকবার চেষ্টা করেছেন, টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে৷ কিন্তু, মন্টু কখনও নিতে রাজি হয়নি৷ ওর বউ সত্যবতীও হয়েছে ওরই মতন বেপরোয়া৷ মন্টুর সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ সেও চলে যায় মোহনায় মাছ ধরতে৷ অথবা মউলেদের সঙ্গে গভীর বনে মধুসংগ্রহে৷

মন্টুর অসুস্থতার কথা শুনে উদ্বেগের সঙ্গে চন্দ্রভানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে মন্টুর?’

‘জেলেদের সঙ্গে গাঙে গেচিল৷ পরশু দুকুরে পারে নৌকো রেখে ওরা কাঁকড়া তুলচেল, সেই সময় নৌকো ডাকচেল৷ একা রান্না করচেল সত্যবতী৷ বুইজতে পারেনেকো৷ বাঘে ওকে তুলে নে গ্যাচে৷’

বাকিটা শোনার আর ধৈর্য দেখালেন না চন্দ্রভানু৷ নৌকো ডাকা মানে… বিপদসঙ্কেত৷ অঘটন ঘটার আগে গাঙে নাকি নৌকো গো গো করে ডাকে৷ মাঝি মাল্লারা তাতেই বুঝতে পারে, কোনও বিপদ আসছে৷ চন্দ্রভানু তা জানেন৷ চায়ের কাপ টেবলের উপর রেখেই তিনি বললেন, ‘আশ্চর্যের ব্যাপার, সক্কালবেলায় আমি এসে পৌঁছেছি, অথচ কেউ বললই না, মন্টুর এই দশা হয়েছে? পঞ্চাকে বলো, গাড়ি বের করতে৷ আমি এখুনি মন্টুর সঙ্গে দেখা করতে যাব৷ কুইক৷ ও কোন হাসপাতালে আছে?’

স্বামীর মেজাজে পরিবর্তন লক্ষ করে সনকা মুখ শুকনো করে বললেন, ‘অত উতলা হয়ো নাকো৷ রায়দীঘির মনোরমা নার্সিং হোমে রয়েচে৷ আমিই ওকে ভর্তি করে দিয়েচি৷’

‘ভাল করেছ৷ শোনো, থানার ওসিকে বলে দাও, কাল সকালের আগে আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারব না৷ আর ছোট খোকাকে বোলো, ওসির হাতে যেন হাজার পাঁচেক টাকা গুঁজে দেয়৷ সেইসঙ্গে ব্যাঙ্কক থেকে আনা একটা মদের বোতলও৷ …ছি ছি, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়৷ আমি জানতাম, একদিন না একদিন মন্টুর এই অবস্থা হবে৷’

পোশাক না বদলেই চন্দ্রভানু নীচে নেমে এলেন৷ এখুনি গিয়ে মন্টুকে একবার দেখা দরকার৷ সত্যবতীকে বাঘে তুলে নিয়ে গিয়েছে মানে…ঘটনাটা মারাত্মক৷ মন্টু যে চরিত্রের মানুষ, বাঘকেও সহজে ছেড়ে দেবে না৷ সত্যবতীকে বাঁচানোর জন্য নিশ্চয়ই ও বাঘের পিছু ধাওয়া করেছে৷ লড়াই চালাতে গিয়ে ও নিজে কতটা ইনজিয়র্ড হয়েছে, কে জানে? লোকে বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা৷ সেই ঘা সারানো খুব কঠিন৷ চন্দ্রভানু মনে মনে ঠিক করে নিলেন, আজই মন্টুকে কলকাতার কোনও বড় নার্সিংহোমে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন৷ মন্টুকে দ্রুত সারিয়ে তোলা দরকার৷ না হলে রিসর্টের কাজ শুরু করা যাবে না৷ বকখালিতে জমিটার সন্ধান দিয়েছিল মন্টুই৷ চাষীদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিল৷ কয়েকজনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজও করে ফেলেছে৷ কিন্তু, এখনও কাগজপত্তরে সই সাবুদ হয়নি৷ এই অবস্থায় মন্টুর যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়, তা হলে পুরো প্রোজেক্ট ভেস্তে যাবে৷ কথাটা মনে হওয়া মাত্তর চন্দ্রভানু ব্যস্ত হয়ে গাড়িতে উঠলেন৷

কঙ্কণদীঘি থেকে রায়দীঘি মিনিট পনেরোর পথ৷ এখন পিচের রাস্তা হয়ে গিয়েছে৷ রাস্তায় উঠে এক-দেড় কিলোমিটার এগোলেই জটার দেউল৷ কত বছরের পুরনো কেউ সঠিক জানে না৷ প্রায় দেড়শো বছর আগে ইংরেজরা যখন কঙ্কণদীঘি অঞ্চলে লোকবসতি পত্তন করছিল, তখন জঙ্গল সাফাই করার সময় পশ্চিম জটা গ্রামে এই মন্দিরটা আবিষ্কৃত হয়৷ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিসাররা এসে মাঝে মাঝেই খননকার্য চালান৷ মন্দিরের ভিতর একটা শিবলিঙ্গ রয়েছে৷ শিবরাত্রির সময় আশপাশের গ্রামের মেয়েরা সেখানেও যায় শিবের মাথায় জল ঢালতে৷ রাস্তায় উঠে চন্দ্রভানু দেখতে পেলেন, জটার দেউলের পাশে ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে৷ তার মানে শিবরাত্তিরের দিন জটার দেউলেও লোক টানার চেষ্টা চলছে৷ অন্য সময় হলে, তিনি খোঁজ নিতে বলতেন ম্যারাপ বাঁধার টাকা কে জোগাচ্ছে? কিন্তু, এখন মাথায় মন্টুর চিন্তা৷ ওকে নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত স্বস্তি পাবেন না চন্দ্রভানু৷

রায়দীঘির তুলনায় কঙ্কণদীঘিতে বরাবরই লোকজনের বসবাস কম৷ লেখাপড়া শেষ করে চন্দ্রভানু যখন মাছের ব্যবসা শুরু করেছেন, তখন তিনি জটা গ্রামে থাকতেন৷ হাতে কিছু টাকাপয়সা জমা হওয়ার পর এই মন্টুর পরামর্শেই তিনি তিন-চার দফায় কয়েকশো বিঘে জমি কিনে ফেলেন কঙ্কণদীঘিতে৷ তখন দামও ছিল খুব অল্প৷ পাঁচশো টাকায় এক বিঘে৷ নদীর দিকে দরমার বেড়া দেওয়া, টালির ছাদের দুটো ঘর তৈরি করে নিয়েছিলেন৷ সেখানেই বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে চন্দ্রভানু থাকতেন৷ সন্ধেবেলায় কঙ্কণদীঘিতে তখন একা যাওয়া যেত না৷ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসত৷ ডাকাতের ভয়ে মাছের আড়ত থেকে দল বেঁধে সাত-আটজন মিলে সাইকেলে করে ওঁরা কঙ্কণদীঘি ফিরতেন৷ তাদের মধ্যে সবার আগে থাকত মন্টু৷ একবার সাদিক আলি বলে এক ডাকাতের পাল্লায় পড়েন ওরা৷ মন্টু সেদিন না থাকলে সর্বস্ব লুট হয়ে যেত৷

নার্সিংহোমে পৌঁছনোর সঙ্গেসঙ্গে চন্দ্রভানু দেখলেন, ম্যানেজার বিনায়ক রাফতান বাইরে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন হাতজোড় করে৷ তার মানে সনকা লোকটাকে ফোন করে খবর দিয়ে রেখেছে৷ রাফতান গলায় মধু ঢেলে বলল, ‘আসুন স্যার, আপনার পেসেন্ট এখন স্টেবল কন্ডিশনে আছে৷’

শুনে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলেন চন্দ্রভানু৷ কেবিনে ঢুকে দেখলেন, মন্টু উঠে বসার চেষ্টা করছে৷ ওর সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ জড়ানো৷ চোখাচোখি হতেই বলল, ‘শুনেচিস তো সব৷ বউটাগে বাঁচাতে পারলুম না রে৷ বাঘটা নিমেষে তুলে নিয়ে গেল উকে৷’

বেড-এর পাশে কে যেন একটা টুল এগিয়ে দিল৷ তাতে বসে চন্দ্রভানু বললেন, ‘কী করে সব হল?’

‘বালিডাঙ্গার জেলেরা কয়েকজন মিলে কাঁকড়া ধরতে গাঙে যাচিচল৷ আমায় বলল, যাবে নাকি? শুনে বউ নেচে উঠল৷ তুই তো জানিস, জাল বঁড়শি শুটকি মাছ, বাঁচে বাঁচায় তাই তো নাচ৷ আম্মিও নেচে উঠলুম৷ গাঙে গে ওই বিপত্তি৷ ভাঁটার সময় খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরচি৷ কারও খেয়াল নেই, ডিঙিতে একা বউকে ফেলে এইচি৷ বাঘটা তক্কে তক্কে ছেল৷ হটাৎ পেচনে তাক্কে দেকি, ঘাড়ের কাচটায় ধরে বাঘ বউকে জঙ্গলের দিকে নে যাচ্চে৷ সঙ্গেসঙ্গে বল্লম, দা নে তাড়া করলুম৷ বাঘটা বউকে ফেলে দে আমাদের অ্যাটাক করল৷ আমায় থাপ্পড় মারল৷ কাঁধের কাচটায় মাংস খুবলে নিল৷’

‘কত বড় ছিল বাঘটা?’

‘তা পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ফুট হবেক৷ জেলেরাও ফাইট করচেল৷ তিন-চার মিনিট পর বাঘ ডাক দে জঙ্গলের দিকে পালাল৷ ত্যাকন দেকি, জেলেদের দু’জন প্রায় মরমর৷ গলগল করে অক্ত বেরুচ্চে৷ আমার বউটাও উবুর হয়ে পড়ে আচে৷ খাঁড়ির কাদায় অক্ত ভেসে যাচ্ছে৷ দেকেই মনে হল বউ আর বেঁচে নেই৷ তাড়াতাড়ি জেলেদের ডিঙিতে তুলে ফেললুম৷ যাতে উদের অন্তত বাঁচানো যায়৷ সবশেষে বউকে আনতে গে দেকি, নেই৷ বাঘটা ওত পেতে বসে ছেল৷ আমাদের ব্যস্ত থাকতে দেকে ফের বউকে তুলে নে গেচে৷’

শুনে অবাক হয়ে গেলেন চন্দ্রভানু৷ চট করে একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ খাঁড়ির পাশে বাঘ৷ নদী মোহনায় কুমীর৷ সাগরের ঢেউ খেয়ে জীবন বাজী রেখে… ডিঙি নৌকোতে একদল জেলে মাছ আর কাঁকড়া ধরতে গিয়েছে৷ জাল দিয়ে মাছ তুলছে৷ সেইসঙ্গে শুটকি মাছ টোপ হিসেবে ব্যবহার করে… কাঁকড়া ধরে তারা নিজেদের জীবিকা অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে৷ সামান্য রোজগারের জন্য কী কঠিন লড়াই! সেইসঙ্গে কী সহমর্মিতা! সবথেকে অদ্ভুত, নিজের বউকে আগে ডিঙিতে তোলেনি মন্টু৷ আহত, রক্তাক্ত সত্যবতীতে ফেলে রেখে ও আগে জেলেদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে! এই বোকামিটা না করলে হয়তো সত্যবতীকে বাঘের পেটে যেতে হত না৷ কে বলতে পারে, ও তখনও বেঁচে ছিল না?

প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ শুনে মন্টু কিছুটা বিরক্ত৷ বলল, ‘কী বইলছিস তুই চাঁদ? আরে, লোগগুলান তো আমার বউকে বাঁচানোর জন্যি বল্লম নে দৌড়েছেল৷ বাঘকে ভয় পায়নেকো৷ উদের বাঁচ্চে আনা আমার কত্তব্য৷ মানবিকতা বলে কিচু নেই৷ উ লোগগুলার কতা আগে ভাবেবানাকো?’

উত্তরটা শুনে থ হয়ে বসে রইলেন চন্দ্রভানু! সত্যবতী আর নেই? জীবনের অর্ধেক আনন্দই তো চলে গেল৷ আর কোনও প্রশ্ন করতে ইচ্ছেই হল না৷ নিজে যদি কখনও এই অবস্থায় পড়তেন, তা হলে কি… সনকাকে ফেলে রেখে কি আগে মন্টুকে উদ্ধার করতে যেতেন? এই প্রশ্নটার কোনও উত্তর চন্দ্রভানু খুঁজে পেলেন না৷

(তিন)

নাটমন্দিরের সিঁড়িতে ওকে দেখামাত্তর গোলাপি ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, ‘শয়তানটা আঙুল কামড়ে রেখেচে দাদাবাবু৷ কিচুতে ছাড়চে না৷’

নিজেকে সামলে অঙ্কুশ বলল, ‘টানাটানি করতে যাস না৷ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক৷ যত টানাটানি করবি, তত জোরে ও কামড়ে ধরবে৷ আমি দেখি, ওর চোয়ালটা খুলতে পারি কি না৷’

কথাগুলো বলেই অঙ্কুশ দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল৷ নাটমন্দিরের বারান্দায় বাড়ির সবাই হাজির৷ এমনকী, আশি বছর বয়সি বড়মাও৷ ঘর ছেড়ে সচরাচর যিনি বেরন না৷ ভয়ে সিঁড়িতে তিনি বসে পড়েছেন৷ ভয় পাওয়ারই কথা৷ বিশাল বড় সাপ! সাপ নিয়েই অঙ্কুশের কারবার৷ কিন্তু, ও কখনও নিজের চোখে এত বড় পাইথন দেখেনি! ধরার আগে গোলাপি বোধহয় ঠিক বুঝতে পারেনি, কাকে ধরছে! অঙ্কুশের পোষ্যপুত্তুরদের মধ্যেও তিনটে ময়াল রয়েছে৷ তবে এত বড় নয়৷ কাঠের ডালা থেকে বের করে মাঝে মাঝে গোলাপি তাদের কাউকে গলায় পেঁচিয়ে শিবঠাকুর সাজে৷ মূল বাড়ির ভিতরে ঢুকে পিঙ্কি বউদিদের তাক লাগিয়ে দেয়৷ এক একটা ময়ালের ওজন কম নয়৷ কুড়ি-বাইশ কেজি তো হবেই৷ কিন্তু, গোলাপির তাতে কিছু আসে-যায় না৷ ওর গায়ে অসম্ভব জোর৷ পাইথন গায়ে জড়িয়ে ও সারা পিয়ারাতে ঘুরে আসতে পারে৷

কাছে যেতেই অঙ্কুশ বুঝতে পারল, রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন৷ এই প্রজাতিটাকে ভারতে দেখা যায় না৷ বছর তিনেক আগে নর্থ ইস্ট থেকে কেউ একজন দাবি করেছিল, সে রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন দেখেছে মণিপুরের জঙ্গলে৷ ফেসবুকে পরে সে একটা ছবিও দিয়েছিল৷ ছবিতে নানা কারচুপি হয়৷ কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য ইদানীং অনেকেই সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে সুপার ইম্পোজ করা ছবিও দেয়৷ তাই অঙ্কুশ বিশ্বাস করেনি৷ রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন পাওয়া যায় মায়ানমার…মানে বর্মা, থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়ার জঙ্গলে৷ ভারতে আসবে কী করে? নিজের চোখকেও অঙ্কুশ বিশ্বাস করতে পারল না৷ ও এ কী দেখছে? এই ছবি যদি আজ ফেসবুকে পোস্ট করে, তা হলে ওকে নিয়ে লোকে হাসাহাসি করবে৷ কিন্তু, বিশ্বাস না করে ওর উপায় নেই৷ এটা সত্যিই রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন৷ একশোভাগ সত্যি৷

বাড়িতে আনার সময় গোলাপি পাইথনটাকে গলায় ঝুলিয়েছিল৷ ওর ভাগ্য ভাল, পাইথনটা ওর গলা পেঁচিয়ে ধরেনি৷ তা হলে গলায় চাপ দিয়ে হয়তো ওকে মেরেই ফেলত৷ পেঁচিয়ে ধরেই এরা শিকারকে কবজা করে৷ তার পর আস্ত গিলে খায়৷ গোলাপি বোধহয় বাড়িতে ঢুকেই বুঝতে পেরেছিল, এটা বাড়ির পাইথনগুলোর মতো নয়৷ তাই ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল৷ কিন্তু, ওর কপাল খারাপ, বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা ততক্ষণে পাইথনটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়েছে৷ ফলে ওকেও উঠোনে বসে পড়তে হয়েছে৷ দরদর করে ও ঘামছে৷ ব্যথায় মুখটা ঈষৎ কুঁচকে রয়েছে৷ এই সময় সত্যি কথাটা বললে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে৷ তাই ওকে সাহস দেওয়ার জন্য কাছে গিয়ে অঙ্কুশ বলল, ‘দারুণ একটা কাজ করেছিস গোলাপি৷ এই রকম পাইথন আমাদের দেশে পাওয়া যায় না৷ দাঁড়া, ব্যাটাকে বস্তাবন্দী করে নিই৷ তার পর আমাদের পোষ্যপুত্তর করে রাখব৷’

ওই অবস্থাতেই গোলাপি বলল, ‘এত বড় বস্তা কোতায় পাবে দাদাবাবু? আমাদের স্নেকব্যাগ এত ছোট যে, মনে হয় এটাকে পোরা যাবে না৷’

‘ঠিক বলেছিস৷’ কথাটা বলেই অঙ্কুশ পিছন ফিরে চিৎকার করে বলল, ‘বউদি, দেখো তো কাছাকাছি কোথাও চালের বস্তা আছে কিনা?’

‘আছে৷ স্টোর রুমে৷ আমি এখুনি এনে দিচ্ছি৷’ বারান্দা থেকে কথাটা বলেই পিঙ্কি বউদি বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল৷

পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে অঙ্কুশ ফোন করল তিন্নিকে৷ রেয়ার স্পিসিস, ওকে দেখানো দরকার৷ ও প্রান্তে হ্যালো শুনে অঙ্কুশ বলল, ‘তিন্নি, পোষ্যপুত্তরদের কি স্নান করানো শুরু করেছ?’

‘না স্যার, চন্দ্রবোড়াটাকে কিছুতেই বাক্স থেকে বের করতে পারছি না৷’

‘ঠিক আছে৷ বাক্সটা বন্ধ করে এখুনি নাটমন্দিরে চলে এসো৷ সঙ্গে স্নেকহুক আর জলের গামলাটা আনতে ভুলো না৷’

‘কেন স্যার?’

‘দরকার আছে৷ গামলায় দেখে নিও, জল আছে কি না৷ কুইক চলে এসো৷ একটা রেয়ার জিনিস তা হলে দেখতে পাবে৷’

তিন্নি বলল, ‘আসছি স্যার৷’

পকেটের ভিতর মোবাইল সেট চালান করে দিয়ে অঙ্কুশ এ বার ভাল করে তাকাল পাইথনটার দিকে৷ জালি জালি সবজেটে হলুদ গায়ের রং৷ মধ্যে বিন্দু বিন্দু কালো আঁশ৷ মাথার মাঝখানে চোয়ালের দু’পাশে কালো লাইন টানা৷ রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন খুব বেশি মোটা হয় না৷ কিন্তু বেশ লম্বা ধরনের হয়৷ মুখের ডগা থেকে লেজ পর্যন্ত চোখ বোলানোর পর অঙ্কুশের মনে হল, পনেরো-ষোলো ফুট তো হবেই৷ ওর হেফাজতে যে ময়াল সাপগুলো রয়েছে, সেগুলির লেনথ বারো-তেরো ফুটের বেশি নয়৷ গোলাপির ধরে আনা পাইথনের মুখটাও বেশ বড়৷ গোলাপি ডান হাতে ঘাড়ের কাছটা তখনও ধরে আছে৷ দেখে অঙ্কুশ বলল, ‘তুই ঘাড়ের কাছটা ছেড়ে দে৷’

কামড় ছাড়ানোর জন্য সবার আগে সাপটাকে সুস্থির হতে দিতে হবে৷ তার পর ওর অ্যাটেনশন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার দরকার৷ মাথায় জল ঢাললেও কাজ দিতে পারে৷ সেই কারণেই তিন্নিকে জলের গামলা নিয়ে আসতে বলেছে অঙ্কুশ৷ ওর চোখের সামনেই ও কামড় ছাড়াতে চায়৷ তা হলে নতুন একটা জিনিস শিখতে পারবে তিন্নি৷ জল ঢালার পরও যদি কাজটা না হয়, তা হলে অন্য উপায় আছে৷ সেটা হল, তীব্র গন্ধ সামনে রাখা৷ কোনও ধরনের উগ্র গন্ধ সহ্য করতে পারে না সাপেরা৷ তখনই পাইথনটা কামড় ছেড়ে দেবে৷ মনে মনে অঙ্কুশ এই কথাগুলি ভাবার সঙ্গেসঙ্গেই পিঙ্কি বউদি এসে বলল, ‘এই নাও, চালের বস্তা৷ মনে হয় এঁটে যাবে৷ কিন্তু কোথাকার পাইথন কুশ? আমাদের দেশে পাইথন এমন লম্বা হয় নাকি?’

পিঙ্কি বউদি ঠিকই ধরেছে৷ অঙ্কুশ বস্তাটা হাতে নিয়ে বলল, ‘পরে বলছি৷ আগে ব্যাটাকে বাগে আনি, তার পর৷ আর একটা কাজ তোমাকে করতে হবে বউদি৷ বাড়িতে যদি ভিনিগারের বোতল থাকে, তা হলে চট করে নিয়ে এসো৷ আমার কাজে লাগবে৷’

বউদি বলল, ‘রান্নাঘরে আছে৷ এখুনি নিয়ে আসছি৷’

বউদি সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে জলের গামলা আর স্নেকহুক নিয়ে তিন্নি হাজির৷ এত বড় পাইথন দেখে ও চমকে উঠেছে৷ দূর থেকে ও বলল, ‘স্যার, এই স্পিসিসটা পেলেন কোত্থেকে?’

উত্তর না দিয়ে অঙ্কুশ পাইথনের মাথায় জল ঢালতে লাগল৷ আগেই জলে বরফের টুকরো ফেলে রেখেছিল৷ ঠান্ডা জল মাথায় পড়ার সঙ্গেসঙ্গে পাইথনটা মুখ আলগা করে দিল৷ এত সহজে কাজটা হয়ে যাবে অঙ্কুশ ভাবতেই পারেনি৷ গোলাপি আঙুল ছাড়িয়ে নিতেই ও দেখল, বুড়ো আঙুলের খানিকটা অংশ নেই৷ তার মানে পাইথনের মুখেই থেকে গিয়েছে৷ আঙুল দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরছে৷ অমন ডাকাবুকো মেয়ে গোলাপি৷ ঘাবড়ে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷ ওকে এখুনি টিটেনাস ইঞ্জেকশন দেওয়া দরকার৷ কিন্তু, তার থেকেও আগে দরকার পাইথনটাকে বস্তাবন্দী করা৷ না হলে বাড়ির যে কোনও কোণে ঢুকে পড়বে৷ এক হাতে বস্তা আর অন্য হাতে স্নেকহুকটা নিয়ে অঙ্কুশ এগোল পাইথনটার দিকে৷ সাপ ধরায় ওর খুব নাম আছে৷ এতদিনে না হলেও হাজার কয়েক বিষধর সাপ ও ধরেছে৷ স্নেকহুক পাইথনের মাথার ভিতর গলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ও পেটের কাছে নিয়ে গেল৷ খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর সযত্নে প্রথমে মুখটা ঢুকিয়ে দিল বস্তার মধ্যে৷ তার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো শরীরটা বস্তার ভিতরে ঢুকিয়ে নিল৷ এত সহজে বন্দী করার কাজটা করতে পারবে, অঙ্কুশ ভাবতেও পারেনি৷

বস্তার মুখ দড়ি দিয়ে বেঁধে অঙ্কুশ বলল, ‘তিন্নি, চট করে তুমি গোলাপিকে নিয়ে ডাক্তারখানায় চলে যাও৷ তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এই বস্তা আমি খুলছি না৷ এই পাইথনটা নিয়ে আজ একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে৷ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাছে পাঠানোর জন্য, বুঝলে?’

‘ঠিক আছে স্যার, যাচ্ছি৷ কিন্তু এখানে ডাক্তারখানাটা কোথায়?’

‘গোলাপি জানে৷ স্টেশনের কাছে৷ ও তোমাকে নিয়ে যাবে৷’

গোলাপিকে নিয়ে তিন্নি গাড়িতে উঠে পড়ার পর জেঠিমা-কাকিমারা রাগারাগি শুরু করলেন৷ সব রাগ গিয়ে পড়েছে গোলাপির উপর৷ ‘ধিঙ্গি মেয়েটাকে ওর বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও৷’ ‘এখানে আর রাখা চলবে না৷’ ‘মেয়েটার অঙ্গহানি হয়ে গেল গো৷’ যদি আরও বিপদ হত, ওর বাবা-মায়ের কাছে আমরা কী জবাবদিহি করতাম৷’ ‘আসুক আজ বাড়ির কর্তারা৷ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে৷’ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ গোলাপিদের বাড়ি সেই সুন্দরবনে…পিচখালি নদীর ধারে৷ আগে ওর মা সন্ধ্যামাসি এ বাড়িতে কাজ করত৷ ওর বাবা নিবারণ দয়াপুরেই অঙ্কুশদের হয়ে চাষবাস করত৷ কিন্তু, বয়স হয়ে যাওয়ায় দু’জনেই বসে গিয়েছে৷ বাবা-মায়ের সঙ্গে গোলাপি দয়াপুরে যেতে চায়নি৷ এর আগেও একবার গোলাপিকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছিল৷ বাজারে কোন একটা ছেলে ওর পিছনে লেগেছিল৷ তাকে ঠাস করে চড় মারে গোলাপি৷ দলবল নিয়ে সেই ছেলেটা হাজির হয় এ বাড়িতে৷ কিন্তু, গোলাপি সেইসময় একটা সাপ গলায় জড়িয়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ তা দেখে ছেলেগুলো পালিয়ে যায়৷

গোলাপির কপালে আজ দুঃখ আছে৷ পাইথনটাকে নিয়ে ও সোজা বারমহলে যেতে পারত৷ বাড়ির ভিতর না ঢুকলে কেউ ওকে দোষারোপই করত না৷ সত্যি, ও একটু ছেলেমানুষি করে ফেলেছে৷ অঙ্কুশ ভাবতেই শিউরে উঠল, যদি কোনও কারণে আজ বাড়িতে না থাকত, তা হলে কী হত? পরক্ষণেই ওর মনে হল, গোলাপি জানবে কী করে এটা রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন? ও পেলই বা কোথায়? ডাক্তারখানা থেকে ফিরে আসার পর ওকে আগে এটা জিজ্ঞেস করতে হবে৷ অবাক কাণ্ড, বিদেশ থেকে বিরল প্রজাতির একটা ময়াল সাপ পিয়ারা গ্রামে হাজির! সেটা সাপটার পক্ষেও খারাপ৷ যে পরিবেশের মধ্যে থাকতে ও অভ্যস্ত, তার বাইরে খুব বেশি দিন বেঁচে থাকা ওর পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে৷ এর একটা ইনভেস্টিগেশন করা দরকার৷ এক হতে পারে, খুব ছোট অবস্থায় সাপটাকে চোরাপথে কেউ নিয়ে এসেছিল৷ বড় হয়ে যাওয়ার পর বিপদ দেখে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে৷ এই তত্ত্বটা নিয়ে মনে মনে অঙ্কুশ অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগল৷ কিন্তু, খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য বলে ওর মনে হল না৷

নাটমন্দিরের বারান্দা থেকে বড়মা চেঁচাচ্ছেন, ‘রমা বউমা, কুশকে বলো সাপটাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে৷ শিবের জীব৷ কী আশ্চয্যির দেখো, কাল শিবরাত্তির৷ হয়তো শিবঠাকুরই ওকে পাঠিয়েছেন৷ কুশকে বলো, সাপটাকে যেন যত্নে রাখে৷ না হলে আমাদের অকল্যাণ হবে৷’

বড়মার কথা শুনে অঙ্কুশ হাসল৷ অযত্নে রাখার কোনও প্রশ্নই নেই৷ ওর পোষ্যপুত্তররা সবাই খুব যত্নে থাকে৷ কিন্তু, বস্তাটা তুলতে গিয়ে ও টের পেল, মারাত্মক ভারী৷ পাইথনটার ওজন পঁচিশ কেজি তো হবেই৷ ওর একার পক্ষে বস্তা বারমহলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না৷ মাঝে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে, নামতেও৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঙ্কুশ ভাবতে লাগল, সাপটাকে নিয়ে কী করা যায়৷ বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে৷ এই মুহূর্তে ওদের ওয়াইল্ড লাইফ কেয়ার-এর কোনও মেম্বারকে বাড়িতে পাওয়া সম্ভব না৷ কেউ অফিসে চলে গিয়েছে, কেউ নিজের দোকানে৷ ফোন করেও কাউকে এখন আনা যাবে না৷ অঙ্কুশের মনে হল, থানার আউটপোস্টে ফোন করলে হয়তো সাহায্য পাওয়া যেতে পারে৷ আউটপোস্ট খুব বেশি দূরেও নয়৷ দু’একজন কনস্টেবলকে পাঠালে, ধরাধরি করে বস্তাটাকে বারমহলে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে৷ কথাটা মনে হওয়া মাত্র অঙ্কুশ পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করল৷

আর তখনই ওর ফোন বেজে উঠল৷ সুইচ অন করতেই ও পাশ থেকে কে যেন বললেন, ‘আমি কি অঙ্কুশ মিত্রের সঙ্গে কথা বলছি?’

অচেনা গলা, দিনে অন্তত এ রকম দশ-বারোটা ফোন অঙ্কুশ পায়৷ পশুপাখি নিয়ে কোনও বিপদে পড়লে লোকে ওকেই প্রথমে ডাকে৷ ও বলল, ‘হ্যাঁ, অঙ্কুশ বলছি৷’

‘স্যার, ক্যানিং থেকে আমি ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার বলছি৷ পিয়ারা থানা থেকে এইমাত্তর একজন অফিসার ফোন করে জানালেন, ওই অঞ্চলে নাকি বিরাট একটা সাপ দেখা গিয়েছে৷ লোকজন নাকি খুব স্কেয়ার্ড হয়ে রয়েছে৷ শুনলাম, আপনি ওই অঞ্চলে থাকেন৷ একটু খোঁজ করে দেখবেন?’

ডিএফও সুপ্রকাশ মণ্ডলকে অঙ্কুশ খুব ভালমতো চেনে৷ এই লোকটার গলা তাঁর মতো নয়৷ কত রকমের চালাকি হয়৷ সত্যি ডিএফও ফোন করেছেন কি না সেটা যাচাই করার জন্য অঙ্কুশ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নামটা বলবেন প্লিজ৷ ওখানে কি সুপ্রকাশবাবু এখন আছেন?’

‘আমার নাম জীবন চক্রবর্তী৷ সপ্তাহখানেক আগে আমি এই অফিসে জয়েন করেছি৷ মিঃ মন্ডল বদলি হয়ে ডুয়ার্সে চলে গিয়েছেন৷ আপনার ফোন নাম্বারটা উনি আমাকে দিয়ে গিয়েছেন৷ ইচ্ছে ছিল, একদিন পিয়ারাতে গিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করে আসব৷ কিন্তু, হয়ে ওঠেনি৷’

ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করার জন্য অঙ্কুশ বলল, ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মিঃ চক্রবর্তী৷ এলে আগে ফোন করে আসবেন৷ আমি নিজেই আপনার অফিসে ফোন করতে যাচ্ছিলাম৷ একটা রেটিকিয়ুলেটেড পাইথন ধরা পড়েছে৷ আমার লোকজনই রেসকিউ করেছে৷ আর সেটা এখন আমার পজেশনে আছে৷’

‘তাই নাকি?’ ও প্রান্তে জীবন চক্রবর্তী খুব উত্তেজিত, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তা হলে আমি কি আপনার কাছে আসতে পারি?’

‘বিকেলের দিকে আসুন৷ ততক্ষণে আশা করি, একটা রিপোর্ট তৈরি করে ফেলতে পারব৷’

‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার৷ আমি তা হলে বিকেল চারটে-সাড়ে চারটের মধ্যে পিয়ারায় পৌঁছচ্ছি৷’

‘আসুন৷’ বলে লাইনটা কেটে দিল অঙ্কুশ৷ ডিএফও আসা মানে পাইথনটাকে হাতছাড়া করতে হবে৷ হাতে অবশ্য অনেক সময় আছে৷ তার মধ্যে পাইথনের ছবি তুলে রাখতে হবে৷ কতটা লম্বা, মাপতে হবে৷ মুখের ভিতরকার কালার, দাঁতের সংখ্যা দেখতে হবে৷ এই ধরনের পাইথনের দাঁতের সংখ্যা একশো বা তারও বেশি হতে পারে৷ উপর-নীচে পরপর তিনটে করে পাটি থাকে৷ এই কারণে এরা যখন কোনওকিছু কামড়ে ধরে, তখন ছাড়ানো মুশকিল হয়ে যায়৷ পাইথনটা বস্তায় ঢোকার আগে একবার হাঁ করেছিল৷ তখন ওই এক পলকের মধ্যেই অঙ্কুশ লক্ষ করেছিল, সামনের পাটির কয়েকটা দাঁত ভাঙা৷ দু’দিন অবজারভেশনে রাখতে পারলে বোঝা যেত, দাঁতগুলো কেন ভেঙে গিয়েছে৷ কিন্তু, অঙ্কুশ জানে সেই সময়টুকু জীবনবাবু ওকে দেবেন না৷ হয়তো পাবলিসিটি নেওয়ার জন্য নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন কোনও রিপোর্টারকে৷ যাতে কাগজে ফলাও করে খবরটা বেরয়৷

খবরের কাগজের কথাটা মাথায় আসার সঙ্গেসঙ্গে জয় সেনগুপ্তের কথা মনে পড়ল অঙ্কুশের৷ দৈনিক বাংলা কাগজের নামকরা সাংবাদিক৷ ওর ইউনিভার্সিটির বন্ধু৷ এই মাসখানেক আগে জয়ের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল গঙ্গাসাগর মেলায়৷ কাগজের হয়ে ও সাগরে গিয়েছিল মেলা কভার করতে৷ দু’দিন সেখানে বেশ আড্ডার মেজাজে কাটিয়েছে দু’জন৷ কথায় কথায় তখনই জয় বলেছিল, ‘তোর কাছে ভাল কোনও স্টোরি থাকলে আমাকে ফোন করিস৷ আজকাল ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে মানুষের খুব আগ্রহ বেড়েছে৷ কাগজের পাতায় জীবজন্তুর ছবি থাকলে লোকে খুব পছন্দ করে৷ ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে তোর মুখে এত গল্প শুনলাম৷ এ সব কাগজে বেরলে লোকে গোগ্রাসে গিলবে রে৷’

অঙ্কুশ তখন বলেছিল, ‘ঠিক আছে, জানা রইল৷ তেমন কোনও খবর থাকলে নিশ্চয়ই জানাব৷’

জয়কে একবার ফোন করা যেতেই পারে৷ মায়ানমার, মালয়েশিয়া অঞ্চলের একটা পাইথন দক্ষিণ চবিবশ পরগণায় কী করে চলে এল, সেটা তো একটা খবর৷ সাংবাদিকরা নিশ্চয়ই কারণ খুঁজে বের করতে পারবে৷ কথাটা মনে হওয়া মাত্রই অঙ্কুশ ফের মোবাইল সেট বের করে জয়ের নাম্বার টিপতে লাগল৷ লাইন লাগতেই ও জিজ্ঞেস করল, ‘জয়, তুই এখন কোথায় রে?’

‘সোনারপুরে৷ চিফ মিনিস্টারের মিটিং কভার করতে এসেছিলাম৷ মিটিং হয়ে গিয়েছে৷ এখন অফিসে ফিরছি৷ কেন রে?’

‘আমার এখানে এখুনি আসতে পারবি?’

‘তোর বাড়ি… মানে পিয়ারাতে? জায়গাটা সোনারপুর থেকে কদ্দূর?’

‘খুব বেশি দূরে নয়৷ স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে কীভাবে পিয়ারায় আসতে হবে৷ তোর সঙ্গে কি কোনও ফোটোগ্রাফার আছে?’

‘হ্যাঁ আছে৷’

‘তাকে নিয়ে চলে আয়৷ আজ তোকে একটা দারুণ খবর দেব৷ একদম এক্সক্লুসিভ৷’

‘খবরটা কি, ফোনে বলা যাবে? ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে না কি?’

‘ফোনে বলতে পারি, কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে গুরুত্বটা তুই বুঝতে পারবি না৷’

‘তাই নাকি?’ জয়ের গলায় প্রচণ্ড আগ্রহ, ‘ঠিক আছে, আমি আসছি৷’

(চার)

ল্যাপটপে বসে তখন চ্যাট করছিলেন তরিতা৷ তাঁর সুইডিশ বন্ধু স্তেফান এডবেরির সঙ্গে৷ খুব নামকরা ওফিওলজিস্ট, থাকেন আমেরিকার মায়ামি শহরের উপকণ্ঠে৷ ওই শহরেই আছে পৃথিবীর সবথেকে বিখ্যাত সার্পেন্টেরিয়াম৷ সেখানকারই রিসার্চ স্কলার এডবেরি৷ আমেরিকার এক একটা শহরের সঙ্গে ভারতের টাইম ডিফারেন্স সাড়ে আট থেকে সাড়ে বারো ঘণ্টা৷ মায়ামিতে এখন রাত ন’টা বাজে৷ ভারত থেকে এই সময়টায় এডবেরিকে রোজ ধরা যায়৷ ল্যাবরেটরি থেকে তখন উনি বাড়িতে ফিরে আসেন৷ এডবেরি হলেন ইউনেস্কো কর্তাদেরও পরামর্শদাতা৷ ইউনেস্কোর হয়ে সাপ সম্পর্কিত সেমিনার, ওয়ার্কশপ করে থাকেন বিশ্বের নানা শহরে৷ বিরাট মাপের মানুষ৷ নানা বিষয়ে যখন তখন উনি ইনফর্মেশন চাইতে পারেন ইউনেস্কো থেকে৷ এবং তিনি সেসব পাঠিয়ে দেন তরিতাকে৷

স্নেক বাইটিংয়ে অর্থাৎ কি না সাপের কামড়ে মৃতের সংখ্যা কেন অস্ট্রেলিয়ায় কম, সে সম্পর্কে লেটেস্ট ইনফর্মেশন এডবেরির কাছ থেকে চেয়েছিলেন তরিতা৷ সে ব্যাপারেই ওঁরা কথা বলছিলেন চ্যাট করার সময়৷ এডবেরি তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলেন, ‘গত বছর স্নেক বাইটিংয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অস্ট্রেলিয়ায় শূন্য৷ অর্থাৎ সাপের কামড়ে কেউ মরেননি৷ অথচ ওদের দেশে পঁচাশি শতাংশ সাপই বিষধর৷ আমেরিকায় স্নেক বাইটিংয়ে প্রতি বছর মারা যান ছয় থেকে সাতজন৷ সেখানে বিষধর সাপ রয়েছে ষাট শতাংশ৷ ভারতে মৃতের সংখ্যা বছরে পঞ্চাশ হাজার৷ অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার, ভারতে যত সাপ আছে, তার মাত্র পনেরো শতাংশ বিষধর৷’

এদিক থেকে তরিতা জানতে চাইলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় মৃতের সংখ্যা এত কম কেন?’

এডবেরি লিখলেন, ‘স্নেকবাইটিং আর তার প্রিকশান নেওয়া নিয়ে অ্যাওয়ারনেস ওখানে বেশি৷ ভারতে এত লোক সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছেন কেন, তার কারণটা আপনাদেরই খুঁজে বের করা উচিত৷ আপনি একটা রিপোর্ট তৈরি করে আমার কাছে পাঠান৷ ইউনেস্কো যাতে আপনাদের সাহায্য করে, সে ব্যাপারে আমি ওদের সঙ্গে কথা বলব৷’

বছর কয়েক আগে অ্যান্টি ভেনম সিরাম… এভিএস তৈরি শেখার জন্য মায়ামিতে একটা কোর্স করতে যান তরিতা৷ সেখানেই তাঁর সঙ্গে এডবেরির আলাপ৷ সেইসময় তরিতা টানা দু’বছর মায়ামির সার্পেন্টেরিয়ামে ছিলেন৷ এডবেরি তখন এক ধরনের অ্যান্টি ভেনম সিরাম নিয়ে রিসার্চ করছিলেন, যা কি না বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের যে কোনও বিষধর সাপের বিষের মোকাবিলা করতে সক্ষম৷ আমেরিকার নামকরা এক ওষুধ কোম্পানি তাঁকে ডলার জোগাচ্ছিল৷ সেই সময় দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়৷ সম্প্রতি দেশে ফিরে আসার পরও তরিতা যোগাযোগ রেখেছেন৷ সাপ সম্পর্কে ভারত থেকে নিয়মিত তথ্য তিনি এডবেরির কাছে পাঠান৷ কিছুদিন আগে আমেরিকারই এক হারপেটোলজিস্ট আবিষ্কার করেছেন, বিশ্বের সবথেকে বিষধর সাপের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে নাকি কালাচ৷ ভারতের সব রাজ্যে আকচারই দেখতে পাওয়া যায়৷ সুন্দরবন অঞ্চলেও প্রচুর রয়েছে৷ কালাচ সম্পর্কে আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার পর থেকেই তরিতার গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে সর্পবিজ্ঞানী মহলে৷

কালাচ খুব বেশি লম্বা নয়, মাত্র দেড়-দু’ হাত৷ কিন্তু, এদের বিষের তীব্রতা মারাত্মক৷ এই সাপটা রাস্তা-ঘাটে কামড়ায় খুব কম৷ অদ্ভুত ব্যাপার হল, উষ্ণতার খোঁজে এরা লোকের বিছানায় ঢুকে যায়৷ ঘুমন্ত অবস্থায় লোককে কামড়াতে ভালবাসে বেশি৷ কিং কোবরার থেকেও কালাচ বেশি ভয়ঙ্কর৷ একজন সুস্থ মানুষকে যদি কিং কোবরা কামড়ায়, তা হলে তার চোদ্দো থেকে ষোলো মিলিগ্রাম বিষ শরীরে না ঢুকলে সেই মানুষের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ কিন্তু, কাউকে মেরে ফেলতে কালাচের পয়েন্ট এইট মিলিগ্রাম বিষই যথেষ্ট৷ এডবেরির খুব আগ্রহ তাই কালাচ নিয়ে৷ সুন্দরবন অঞ্চলে কালাচের বিষ নিয়ে অ্যান্টি ভেনম সিরাম তৈরির একটা ল্যাবরেটরি খুলতে চান তরিতা৷ এডবেরি কথা দিয়েছেন, যা টাকা-পয়সা লাগবে, তার খানিকটা তিনি জোগাড় করে দেবেন আমেরিকার কোনও কোম্পানি থেকে৷

তরিতা ইদানীং তাই রোজ মেল মারফত কথা বলেন এডবেরির সঙ্গে৷ দু’দিন আগে তিনি সুন্দরবনের একটা রিসর্টে এসে উঠেছেন৷ দয়াপুরে এই রিসর্টটার নাম সুন্দরবন টাইগার ক্যাম্প৷ গতকাল লঞ্চে করে বেড়াতে বেরিয়ে নিজের চোখে তরিতা খুব লম্বা একটা কিং কোবরা দেখেছেন৷ চ্যাট করার সময় সেই প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলেন তিনি৷ রিজার্ভ ফরেস্টের পাশ দিয়ে লঞ্চে করে তিনি রিসর্টে ফিরছিলেন৷ বেলা তখন দুটো হবে৷ ঝকঝকে রোদ্দূর৷ সেই সময় কোবরাটা প্রথম নেত্রার চোখে পড়ে৷ কাদার ভিতর গর্তে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে৷ বাকি শরীরটা বাইরে৷ সাপ দেখলে প্রসন্ন হন তরিতা৷ নেত্রাই প্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিল, ‘ওই দেখো দিদি, শঙ্খচূড়৷ কী বিশাল, তাই না?’

কিং কোবরাকে বাংলায় বলা হয় শঙ্খচূড়৷ তরিতা দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, কাদায় মুখ ডুবিয়ে রেখেছে মানে শিকার ধরছে৷ শঙ্খচূড় সাপ খায়৷ সেই কারণেই গর্তে ‘জলের সাপ’ খুঁজছে৷ চেন্নাইয়ের স্নেকপার্কে থাকার সময় তরিতা প্রচুর কিং কোবরা ঘাঁটাঘাটি করেছেন৷ দক্ষিণ ভারতের কিং কোবরার গায়ের রং কালচে ধরনের হয়৷ কিন্তু, বাংলা আর ওড়িশায় দেখা যায় মেটে রঙের৷ গায়ে চাকা চাকা দাগ থাকে৷ নেত্রার চোখ আছে৷ কাদার মধ্যেও শঙ্খচূড়টাকে ওর নজরে পড়েছিল৷ অভিজ্ঞ চোখ তরিতার৷ একবার দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন, দশ থেকে বারো ফুটের মতো লম্বা হবে৷ সঠিক আন্দাজ করার জন্য সারেঙকে তিনি তখন বলেন, কোনও শব্দ না করে লঞ্চটা কাছে নিয়ে যেতে৷

জলের ঢেউ গিয়ে লাগল শঙ্খচূড়ের শরীরের উপর৷ কাদা ধুয়ে গেল জলে৷ তরিতা নিশ্চিত হলেন, ওটা শঙ্খচূড়ই৷ লঞ্চের ডেক-এ একটা সরু লগি পড়েছিল৷ সেটা তুলে নিয়ে শঙখচূড়ের গায়ে স্পর্শ করতেই এক ঝটকায় মুখটা বের করে আনল সাপটা৷ তার পর ফোঁস করে ফণা তুলল৷ প্রায় চার ফুট উচ্চতায় সেই ফণা৷ যে কোনও সময় স্ট্রাইক করতে পারে৷ লঞ্চে আরও কয়েকজন ট্যুরিস্ট ছিলেন৷ দেখে তাঁরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু, গলায় ঝোলানো ক্যামেরা হাতে নিয়ে সেই পোজে কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন তরিতা৷ ঠিক সেই সময় তিনি দেখেন, গর্তের ভেতর থেকে একটা হেলে সাপ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সোজা নদীর জলে গিয়ে পড়ল৷ মারাত্মক ভয় না পেলে কোনও সাপ এমনভাবে লাফায় না৷ এদিকে, শিকার হাতছাড়া হওয়ায় যে, মোটেই খুশি হয়নি শঙ্খচূড়, তা বোঝাতে লাগল আরও জোরে ফোঁস ফোঁস করে৷ তার পর কী যেন হল, হঠাৎই রাগ দমন করে ফণা গুটিয়ে এঁকেবেঁকে পালিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে৷ দেখে মনে মনে হেসেছিলেন তরিতা৷

শঙ্খচূড়ের ছবি মেল-এ মায়ামিতে আজই পাঠিয়েছেন তরিতা৷ দেখে ওপ্রান্তে মোহিত এডবেরি৷ শঙ্খচূড় দর্শনের অভিজ্ঞতার কথাও তরিতা লিখে তাঁকে জানিয়েছেন৷ উত্তরে এডবেরি লিখেছেন, এই ছবিটা তিনি অবশ্যই বন্ধুদের কাছে পাঠিয়ে দেবেন৷ চ্যাট করতে করতে আসল কথায় এলেন এডবেরি, ‘ল্যাবরেটরি তৈরির কাজ আপনার কতদূর এগোল?’

তরিতা উত্তর দিলেন, ‘সাইট দেখার জন্য সুন্দরবনে এসেছি৷ জমির সন্ধান করছি৷’

‘তাড়াতাড়ি করুন৷ আপনার জন্য আমি যে ফান্ড অ্যারেঞ্জ করেছি, দেরি হলে সেটা আফ্রিকায় চলে যেতে পারে৷ প্লিজ, ডিলে করবে না৷’

‘কোনও প্রশ্নই নেই৷ আশা করি, দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে৷’

‘আমি আগামী সপ্তাহে মেলবোর্নে যাচ্ছি৷ একটা কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করার জন্য৷ দিন সাতেক ওখানে থাকতে হবে৷ মনে হয়, সময়টা খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে৷ সবশেষে জিজ্ঞেস করি, আপনার ম্যাজিক কি এখনও কাজ করছে স্নেকলেডি?’

‘করছে৷ কাল কিং কোবরার উপরও কাজ করেছে৷ আমাকে দেখেই মাথা নিচু করে চলে গেল৷ ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে নিয়েই রিসার্চ করতে পারেন৷’

‘মনে হয়, এ বার করতে হবে৷ সর্পকুল আপনাকে যে রকম ভক্তি করে, তাতে মনে হয়, ভারত সত্যিই স্নেকচার্মারদের দেশ৷ কিন্তু, আপনার রেকর্ড যে এখানে একজন ভেঙে দিচ্ছেন স্নেকলেডি৷’

‘রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছেন মানে? কে ভাঙছেন?’

‘সামান্থা জেনকিন্স বলে এক মহিলা৷ সার্পেন্টেরিয়ামের এক্সিবিশন হাউসে উনি একশো কুড়িদিন কাটাবেন বলে মনস্থ করেছেন৷ আজই উনি সাপের ঘরে থাকা শুরু করলেন৷ সামান্থাকে নিয়ে মিডিয়ায় খুব প্রচার হচ্ছে৷ সেইসঙ্গে আপনার নামটাও বারবার উঠে আসছে৷’

‘জেনে খুশি হলাম৷ আমার রেকর্ড ভাঙলে আমার হয়ে আপনি সামান্থাকে অভিনন্দন জানাবেন৷’

‘নিশ্চয়ই জানাব৷ ওকে… বাই, ভাল থাকবেন৷ আগামী সপ্তাহে ফের কথা হবে৷’

… ল্যাপটপ বন্ধ করে শরীরের আড়মোড়া ভাঙলেন তরিতা৷ সকালে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছেন৷ চোখ-মুখে জল দিয়েই ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলেন৷ এডবেরির সঙ্গে চ্যাট করার পর মনটা এখন বেশ প্রফুল্ল৷ প্রতিবারই চ্যাটের শেষে এডবেরি জানতে চান, আপনার ম্যাজিক কি এখনও কাজ করছে? প্রতিবারই তরিতা একই উত্তর দেন৷ আসলে এটা মাজিক কিনা সে সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা নেই৷ কিন্তু, লোকের কাছে ম্যাজিক বলেই মনে হয়৷ ঈশ্বরপ্রদত্ত একটা ক্ষমতা নিয়ে তিনি জন্মেছেন৷ ছোটবেলা থেকে তরিতা দেখে আসছেন, সাপেরা তাঁকে খুব সমীহ করে৷ তাঁর কথা বুঝতে পারে৷ চলে যেতে বললে চলে যায়৷ আসতে বললে কাছে আসে৷ সমবয়সিদের বহুবার তরিতা অবাক করে দিয়েছেন৷ ক্যানিংয়ে যে অনাথ আশ্রমে তিনি বড় হয়েছেন, সেখানকার গুরুমায়েরা অবশ্য এ সব দেখে বিস্মিত হতেন না৷ তাঁরা এমন ভাব করতেন, যেন তরিতার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক৷

আশ্রমের মায়েদের কাছে তরিতা শুনেছেন, তাঁর যখন মাত্র একদিন বয়স, সাগর দ্বীপের জঙ্গলে তখন নাকি তাঁকে কুড়িয়ে পান এক কাঠুরে৷ সেইসময় একটা সাপ নাকি মাথার উপর ফণা ধরে ছিল৷ কাঠুরেকে দেখতে পেয়েই সাপটা সরে যায়৷ কথাটা কতখানি সত্যি, তা বিচার করার কোনও উপায় ছিল না৷ কেননা, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে একবারও তরিতা সেই কাঠুরে রক্ষাকর্তার দেখা পাননি৷ ক্যানিংয়ের অনাথ আশ্রমের মায়েরা তখন বলতেন, ‘তুই আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয় রে তরিতা৷ পূর্বজন্মে সাপেদের সঙ্গে তোর নিশ্চয় একটা সম্পর্ক ছিল৷ কোনও কোনও মানুষ পূর্বজন্মের কিছু সম্পর্ক নিয়ে জন্মায়৷ তোকেই জানতে হবে, কী সেটা?’

আশ্রমের মায়েরাই ওঁর নাম রেখেছিলেন, তরিতা৷ যার মানে… সাপেদের দেবী৷ মায়েরা নিশ্চিত হয়েছিলেন আরও একটা কারণে৷ কেননা, তরিতা জন্মেছিলেন নাভির ঠিক উপরে অদ্ভুত একটা জড়ুল নিয়ে৷ সেই জড়ুল দেখতে একেবারে ফণাধরা সাপের মতো৷ বয়স যত বেড়েছে, সেই জড়ুল ধীরে ততই স্পষ্ট আকার নিয়েছে৷ সাপের লেজটা একেবারে গিয়ে পৌঁছেছে নাভিমূলে৷ এখনও পোশাক বদলানোর সময় যখন জড়ুল তরিতার চোখে পড়ে, তখন তাঁর খুব রহস্যজনক বলে মনে হয়৷ মনে প্রশ্ন জাগে, পূর্বজন্মে কি সত্যিই তিনি সর্পকুলের কেউ ছিলেন? তাই সেই চিহ্ন নিয়ে জন্মেছেন? হতেও পারে৷ না হলে, এত বিষয় থাকতে তিনি জুলজি এবং পরে ওফিওলজি নিয়ে পড়াশুনো করলেন কেন?

ল্যাপটপটা ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে তরিতা উঠে দাঁড়ালেন৷ এডবেরি বহুদিন পর আজ তাঁকে স্নেকলেডি কথাটা মনে করিয়ে দিলেন৷ মায়ামিতে থাকার সময় অনেকেই তাঁকে স্নেকলেডি বলে ডাকতেন৷ নামটা হওয়ার পিছনে একটা কারণও ছিল৷ মায়ামিতে একবার একটা অদ্ভুত জেদ চেপেছিল তরিতার৷ সাপেরা যে তাঁর কথা শোনে, তা প্রমাণ করার জন্য এডবেরির সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন তিনি৷ সার্পেন্টেরিয়ামে সারা পৃথিবীর প্রায় হাজার দুয়েক সাপ রয়েছে৷ খুব বিপজ্জনক সব সাপ৷ র্যাটল স্নেক, অস্ট্রেলিয়ান ইনল্যান্ড তাইপান, টাইগার স্নেক, শঙ্খচূড়, চন্দ্রবোড়া, আফ্রিকান ব্ল্যাক মামবা, ইজিপসিয়ান কোবরা৷ রোজই হাজার হাজার মানুষ ওখানে বিচিত্র সব সাপ দেখতে যান৷ আমেরিকানরা এমনিতেই হুজুগে প্রকৃতির৷ সাপ নিয়ে নানা বিপজ্জনক খেলা দেখানো, কাচের ঘরে সাপের সঙ্গে বসবাস… নানা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় ওখানে৷

মায়ামিতে সেইসময় একজন ঘোষণা করেছিলেন, তিনি একশো দিন সাপের ঘরে কাটিয়ে রেকর্ড করতে চান৷ শুনে তরিতা বলেছিলেন, তিনি একশো দশ দিন সাপের সঙ্গে কাটাতে পারবেন৷ তাঁর সঙ্গে যত বিষধর সাপই থাকুক না কেন৷ এডবেরি বলেছিলেন, ‘আপনি পারবেন না৷ আপনার বডি ইমিউন করা নেই৷’

‘পারলে কী দেবেন বলুন?’

‘ওয়ান মিলিয়ন ডলার৷ আপনার সঙ্গে আমার বাজি রইল৷’

তরিতা তখন হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘কেন ডলারগুলো গচ্চা দেবেন?’

‘আরে, আপনি কি ভেবেছেন, আমি নিজের পকেট থেকে খরচা করব? এটা আমেরিকা, ইন্ডিয়া নয়৷ প্রথম কথা, আমি কোনও অ্যান্টি ভেনম সিরাম কোম্পানির স্পনসরশিপ নেব৷ সেইসঙ্গে, পুরো ইভেন্টটা বিক্রি করে দেব কোনও টিভি চ্যানেলের কাছে৷ আপনি যতদিন সাপের ঘরে থাকবেন, ততদিন এক্সক্লুসিভলি সেই চ্যানেল টেলিকাস্ট করবে৷ তবে হ্যাঁ, ওই চ্যানেল যেভাবে যা করতে বলবে, আপনাকে তা করতে হবে৷ না হলে প্রোগ্রামটা জমবে না৷’

‘আপনি কি সিরিয়াস?’

‘অফকোর্স সিরিয়াস৷ ডিসকভারি বা অ্যানিমেল চ্যানেল দেখেননি? জীবজন্তু নিয়ে যত প্রোগ্রাম ওরা দেখায়, সব ক’টাই তো স্পনসর্ড৷ এক একটা প্রোগ্রামের জন্য ওরা প্রচুর ডলার খরচ করে৷ আর আপনি যদি চান, তা হলে হলিউডের ফিল্ম কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও আমি কথা বলতে পারি৷ দেখবেন, চট করে ওরা কোনও স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলবে৷ তারপর শুটিং শুরু করে দেবে৷ আপনি কি জানেন, সাপ নিয়ে হিসসস… বলে একটা ছবি হয়েছিল৷ তার হিরোইন ছিলেন একজন ভারতীয় অ্যাকট্রেস… মল্লিকা শেরাওয়াত৷’

তরিতা সিনেমাটার নামটাই শোনেননি৷ তাই বলেছিলেন, ‘হিসসস… আমি দেখিনি৷ তবে টিভি চ্যানেল কেন আমার সম্পর্কে ইন্টারেস্ট নেবে, আমি বুঝতে পারছি না৷’

এডবেরি বলেছিলেন, ‘প্রথম কথা আপনি একজন সেক্সি যুবতী৷ সেটাই সেলেবল পয়েন্ট৷ দ্বিতীয় কথা, আজ পর্যন্ত কোনও মহিলা সাপের সঙ্গে বসবাস করেননি৷ এখানে যা কিছু রেকর্ড করেছেন, সব বয়স্ক পুরুষরাই৷

মহিলা হিসেবে আপনি তাঁদের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছেন, এটাই ইউএসপি হয়ে দাঁড়াবে৷ এবার ফাইনালি বলুন, আপনি রাজি কিনা?’

এক মিলিয়ন ডলারের কথা ভেবে তরিতা রাজি হয়ে গিয়েছিলেন৷ সারা আমেরিকা জুড়ে তাঁকে নিয়ে প্রচুর হইচই হয়েছিল সেই সময়৷ চ্যানেলই প্রোগ্রামটার নাম দিয়েছিল স্নেকলেডি৷ বাইরের দর্শকদের প্রবেশাধিকার ছিল না৷ চ্যানেলের লোকজন চবিবশ ঘণ্টা ধরে শুটিং করতেন৷ আর এডিট করে প্রতিদিন রাতে একঘণ্টা করে সেই ছবি দেখাতেন৷ প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভই বলে দিতেন, কবে কী পরতে হবে, করতে হবে৷ পুরো স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সব হত৷ কিন্তু দর্শকরা মনে করত, স্বাভাবিক ভাবেই ঘটনাগুলো ঘটছে৷ একটা দিনের কথা মনে আছে তরিতার৷ ওইদিন প্রোগ্রামের ডিরেক্টর তরিতাকে একটা পাইথন গলায় ঝুলিয়ে স্তন দুটোকে ঢাকতে বলেছিলেন৷ তরিতা প্রথমে রাজি হননি৷ কিন্তু, আমেরিকানরা চুক্তির শর্তের ব্যাপারে খুব কড়া৷ ওঁরা চুক্তির কপি এনে দেখালেন, লেখা আছে, কস্টিউমের ব্যাপারে কোনওরকম আপত্তি করা চলবে না৷ বাধ্য হয়েই তরিতা সেই শট দিয়েছিলেন৷ সেদিনই প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠতে শুরু করে৷ ওই প্রোগ্রাম চলার সময়ই তরিতা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, সাপেরা তাঁর কথা বুঝতে পারে৷

মায়ামির দিনগুলোর কথা চোখের সামনে ভাসছিল৷ এমন সময় নেত্রা এসে বলল, ‘ অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে৷ দিদি স্নান করতে যাবে না? লাঞ্চের আগেই কিন্তু গ্রামের মেয়েরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে৷ মনে আছে?’

তরিতা বললেন, ‘ভাবছি, রিসর্টের বাথরুমে আজ স্নান করব না৷ তোদের সঙ্গে পিচখালি নদীতে নাইতে যাব৷ অনেকদিন সাঁতার কাটা হয়নি৷’

নেত্রা খুশি হয়ে বলল, ‘তাই চলো৷ কিন্তু, মনে রেখো, নদীর জল লোনা৷ ফিরে এসে ফের তোমায় নাইতে হবে৷ কী পরে যাবে দিদি?’

‘চল না, গায়ে শাড়িটা জড়িয়েই নেমে যাব৷’

রিসর্ট থেকে বেরনোর সময় ম্যানেজার স্বরূপ কিন্তু ভয় দেখাল, ‘ম্যাম, নদীর এই দিকটায় প্রায়ই কুমির দেখা যায়৷ ভয়ে কেউ স্নান করতে নামে না৷’

নেত্রা পাত্তাই দিল না৷ বলল, ‘কুমির থাকলেও অসুবিধে নেই৷ কুমির বা সাপ আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষবে না৷ গাঁয়ের মেয়েরা তো শুনলাম, আগে মীন ধরত৷ কুমির থাকলে কি ওরা জলে নামত?’

মিনিট পাঁচেক পর দু’জন যখন নদীতে স্নান করতে নামলেন, তখন জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করেছে৷ বার কয়েক ডুব দিতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেল তরিতার৷ মায়ামিতে রোজ সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতেন সুইম স্যুট পরে৷ ওখানে অত লোকলজ্জার ভয় নেই৷ কিন্তু দয়াপুরে সেটা সম্ভব না৷ ট্যুরিস্টদের কারও চোখে পড়ে গেলে নিন্দে করতে পারেন৷ নদীতে খানিকক্ষণ সাঁতার কাটার পর আরও স্নানসুখ পাওয়ার জন্য গা থেকে ব্লাউজ আর ব্রা খুলে ফেললেন তরিতা৷ সেগুলো নদীর পারে রেখে আসার জন্য জল থেকে উঠতেই হঠাৎ তিনি শব্দ শুনতে পেলেন ইঞ্জিনের৷ সজনেখালির দিক থেকে একটা বড় লঞ্চ এ দিকপানে আসছে৷ সঙ্গে জলের বড় ঢেউ তুলে৷ লঞ্চটা যে কারও ব্যক্তিগত, দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে৷ খুব ঝকঝকে, আর সাজানো গোছানো৷ বিদেশে এ রকম লঞ্চ তিনি অনেক দেখেছেন৷ সুন্দরবনের প্রত্যন্ত জায়গায় দেখতে পাবেন, তরিতা আশাই করেননি৷ হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন, ঢেউয়ের ধাক্কায় গায়ে জড়িয়ে থাকা আঁচলটা বুক থেকে সরে গিয়েছে৷ ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত৷ চট করে শরীরটাকে তিনি জলের নীচে ডুবিয়ে দিলেন৷ এমন অস্বস্তিতে আগে কখনও পড়েননি তরিতা৷

লঞ্চটা পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে জেমসপুরের দিকে৷ উপরের ডেক-এ বসে আছেন মধ্যবয়স্ক একটা লোক৷ ওঁর উন্মুক্ত স্তনের দিকে তাকিয়ে হাসছেন৷ নির্লজ্জতা দেখে রাগে শরীর জ্বলে উঠল তরিতার৷ কে এই অসভ্য লোকটা? পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় লঞ্চের নামটা তিনি মনে রাখলেন৷ এমভি সনকা৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *