তমসান্তরিতা – শোভন সোম
গ্রামের সন্ধ্যা, তার উপর ভরা ভাদ্রের শেষ বর্ষণের ঘটা। মেঘের ছায়ার অন্ধকার চতুর্দিকে তরল হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে। একহাত দূরের মানুষ দেখা যায় না এমনই নিকষ অন্ধকার। গাছগুলি দিনের বেলায় দূরে দূরে স্থাণুর মত দাঁড়াইয়াছিল, সন্ধ্যা হইতে না হইতেই যেন কাছাকাছি ঘেঁষিয়া আসিয়া পরস্পরের ডালে ডাল রাখিয়া নিবিড় আলিঙ্গনে অন্ধকারকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।
থাকিয়া থাকিয়া প্রাঙ্গনের কদম ও কামিনী হওয়ার হাতে করিয়া সুগন্ধ পাঠাইতেছে। ভেকের সঙ্গীতের বিরাম নাই, ঝিল্লিরব মুখরিত হইতেছে। রাত্রিবেলা শব্দগুলা যেন দ্বিগুণ শক্তি লাভ করে, সামান্য আওয়াজ, মর্মর ঘর্ষণ, ধ্বনি কান এড়াইয়া যায় না।
নিশানাথ কবে, কোন লগ্নে দেশ গ্রাম ছাড়িয়া শহরবাসী হইয়াছিলেন, আজ তাহা স্পষ্ট মনেও নাই। মনে রাখিবার কোন প্রয়োজনও তিনি বোধ করেন নাই এতদিন, ব্যবসা ভিন্ন অন্য কোন প্রসঙ্গ—বিশেষ করিয়া হৃদয়-দৌর্বল্যের কোন প্রাক্তন-প্রসঙ্গ তাঁহার চিন্তায় প্রবেশ করিতে পারে না। লোহালক্কড়ের ব্যবসা করিয়া তিনি তিলে তিলে ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠিয়াছেন; লোহার শিকল দিয়াই চঞ্চলা লক্ষ্মীকে বাঁধিয়াছেন। দেশ গ্রামের প্রতি কোন টানও প্রাণে অবশিষ্ট ছিল না। পিতৃপুরুষের কোন একজন সুদূর-পুরুষ এক বিরাট সম্পত্তি ও জমিদারীর সৃষ্টি করিয়াছিলেন, পরবর্তী পুরুষেরা নিষ্কর্মার মত তাহাই ভাঙাইয়া খাইয়াছেন। বাঈজী, মদ, মেম-সাহেবের পার্টি এবং বিলাতসুলভ বিলাসের পিছনে সম্পত্তি ক্ষয় হইতে হইতে যখন কেবলমাত্র ভিটাটুকুতে আসিয়া থামিল, তখন এই বিশাল বিপুলায়তন নির্জন প্রাসাদে বংশের শেষতম বাতি স্বরূপ রহিলেন একমাত্র নিশানাথ। নিশানাথ পিতৃপুরুষের আদর্শ অনুসারে তেমনই বসিয়া বসিয়া বিলাস ব্যসনে অর্থ ব্যয় করিবেন, এমন সঙ্গতি তাঁহার নাই।
যৎসামান্য কুড়াইয়া বাড়াইয়া, ভিটা সংলগ্ন বাগান পূর্বতন নায়েব মুরারিমোহনের নিকট লীজ দিয়া নিশানাথ কলিকাতায় ভাগ্যান্বেষণে আসিলেন। স্ত্রী মল্লিকাকে সঙ্গে নিয়া আসেন, সে উপায় ছিল না; কলিকাতায় সংসার পাতিয়া বসা সহজ কথা নয়, বিশেষত নিশানাথ চাকুরি করেন না, ব্যবসার জগতে ভাগ্য পরীক্ষা করিবার ইচ্ছা পোষণ করেন। নিশানাথ কালিঘাটের সস্তাতম মেস-এ আসিয়া উঠিলেন। মল্লিকাকে বলিলেন, ভাগ্য যদি মুখ ফিরিয়া তাকায়, তবে তোমাকে অবশ্যই কলিকাতায় লইয়া যাইব।
মল্লিকা সজল নেত্রে বলিয়াছিল, ভাগ্য তোমার দিকে মুখ ফিরাইবেন। তাহার অন্ধ চোখে কী মল্লিকা ধরা পড়িবে!
নিশানাথ সস্নেহে তরুণী স্ত্রীর স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিয়াছিলেন, এই ভর ত্রিসন্ধ্যায় এমন অশুভ কথা উচ্চারণ করিতে নাই। এমন কথা কেন ভাবিলে!
মল্লিকা প্রত্যুত্তরে বলিয়াছিল, ওগো, ভাবিয়া চিন্তিয়া বলি নাই, মুখ হইতে নিজেরই অজ্ঞাতে বাহির হইয়া গেল।
কলিকাতায় আসিয়া প্রথম দিকে ব্যবসায় নিশানাথ বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন নাই। দীর্ঘদিন সেই হেতু তাঁহাকে মেস হোটেলে কাটাইতে হইয়াছে। অবশ্য স্ত্রীকে আনাইবার ইচ্ছা যদি সত্যই প্রগাঢ় হইত, তবে তখনই নিশানাথ তাহা করিতে পারিতেন। কিন্তু ব্যবসা বড় নেশা, টাকার নেশা মানুষকে সব কিছু ভুলাইয়া দেয়।
মল্লিকা নিশানাথকে নিয়মিত পত্র লিখিত। ‘শ্রীচরণকমলেষু’ বানানেই দশবার নিব ভাঙিত, বানানের গোলমালে শব্দগুলি উচ্চারণ করার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিত। কিন্তু তাহাতেও চিঠির উত্তাপে এতটুকু ঘাটতি পড়িত না। নিশানাথ কালেভদ্রে কুশল জানাইতেন। আসলে নিশানাথ মল্লিকাকে ভালবাসিতে পারেন নাই। বাল্যে বিবাহ হইয়াছিল, তখন বিবাহ শব্দেরই অর্থ জানিতেন না। মল্লিকার গাত্রে প্রাত্যহিকতার স্পর্শ লাগিয়াছে,—ঘর-বাড়ি, চেনা জিনিসের মত মল্লিকাও অতি সাধারণ হইয়া উঠিয়াছে; যৌবনে উপনীত হইবার পূর্বেই নিশানাথ মল্লিকাকে জানিয়া ফেলিয়াছেন—তাহাতে যৌবনের কৌতূহল পাথর চাপা ঘাসের মত বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। মল্লিকা সংসারের মধ্যে দৈনন্দিন সামান্যতার মধ্যে কবেই নিঃশেষে ফুরাইয়া গিয়াছে। মল্লিকা তাঁহার নিকট একটি কর্তব্য পালন ভিন্ন আর কিছু নহে।
মুরারিমোহনের বিধবা ভগ্নী কমলা মল্লিকা বৌঠানের সঙ্গে থাকিত। নিশানাথ আর কিছু করুন না করুন, মল্লিকার নামে মাসোহারা পাঠাইয়া আপন কর্তব্য পালন করিয়া যাইতেন। মল্লিকার অসুখের সংবাদ পাইয়া নিশানাথ বিশেষ গা করিলেন না, ভাবিলেন ম্যালেরিয়া; দু বড়ি কুইনিন পড়িলেই পালাইবে। কিন্তু মুরারিমোহনের আকস্মিক পত্র তাহার সে ধারণা ভাঙিয়া দিল। মল্লিকার ডবল নিউমোনিয়া হইয়াছিল। সেই গণ্ডগ্রামে উপযুক্ত চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। মল্লিকার মৃত্যু, গ্রামের সহিত নিশানাথের যে সামান্য সম্পৰ্কটুকু কোনক্রমে লাগিয়াছিল, তাহাও ছিন্ন করিয়া দিল। নিশানাথ আর গ্রামে আসেন নাই।
মৃত মানুষের জন্য তো কাহারও দিন বসিয়া থাকে না, তাহার উপর নিশানাথের প্রাণে শোকের ঝাঁঝও আদৌ প্রবল ছিল না। কিছুদিন পর নিশানাথ অর্থের মুখ দেখিলেন, সিন্দুক বাক্স ছাপাইয়া উঠিল। নিশানাথ ভাগ্যবান পুরুষে রূপান্তরিত হইলেন, তাহার প্রতি নানাজনের দৃষ্টি পড়িল। অপুত্রক মৃতদার, ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা। সুতরাং জীবিত লক্ষ্মী আনিবেন না কেন?
এবার নিশানাথ ডাগর ডোগর দেখিয়া তাহারই এক সম-ব্যবসায়ীর কন্যাকে বিবাহ করিলেন। এতদিনে তিনি প্রথম যৌবনের স্বাদ জানিলেন। সেই প্রিয়বালা আজ আর তরুণী সুরসিকা নহেন, শরীরে তাহার গয়নার প্রাচুর্যের সঙ্গে মেদের প্রাচুর্য পাল্লা দিতেছে। বিষয় সম্পর্কে প্রিয়বালার জ্ঞান বুদ্ধি নিশানাথের চেয়েও প্রবল। ব্যবসায়ীর কন্যা, জন্মাবধি ব্যবসার হাওয়ায় বর্ধিত হইয়াছেন। নিশানাথ তাহার পরামর্শ উপেক্ষা করিতে পারেন না। দ্বিতীয় পক্ষ বলিয়া তাহার প্রতি নিশানাথ অধিকতর মনোযোগী। মল্লিকা ছিল নিরীহ, শান্ত, মুখ ফুটিয়া প্রাণের কথা বলিতে পারিত না, সংসারের আবশ্যিক কর্মের গণ্ডীটুকু পার হইয়া স্বামীর উপর আপন অধিকারের হাত বিস্তার করিতে পারিত না; নিশানাথও তাহাকে সেই অধিকার আপনা হইতেই দেয় নাই। সে যেন বিশাল বৃক্ষের সবুজ অন্ধকারের একান্তে অনাদৃত সাধারণ ফুলের মত ফুটিয়াছিল, কোন পূজায় লাগে নাই; একদিন একে একে পাপড়ি খসাইয়া নিঃশেষ হইয়া গেল—দিবার মত গন্ধও তাহার ছিল না।
সরকার মাইল তিনের ভিতর একটি স্থান স্টীল প্ল্যান্টের জন্য মনোনয়ন করিয়াছেন, তাহার চতুর্দিকে গড়িয়া উঠিবে নবীনা নগরী। নিশানাথের গ্রামও যুগযুগান্তরের অন্ধকার হইতে সভ্যতার প্রখর আলোকে জাগিয়া উঠিবে। যে গ্রামকে তিনি এতকাল অবহেলা করিয়াছেন, সে-গ্রামের কপালে এমন বিধিলিপি লিখিত ছিল, কে জানিত? জানিলে তিনি প্রাচীন জমিদারী আওতার সমস্ত জমি কিনিয়া নিয়া পিতৃপুরুষের পাপ স্খলন করিতেন, প্রিয়বালাই উদ্যোগী হইয়া তাহাকে পাঠাইয়াছেন। জ্যেষ্ঠপুত্র প্রাপ্তবয়স্ক পিতার অনুপস্থিতিতে ব্যবসা চালাইবার ক্ষমতা রাখে। তাহার উপর সমস্ত ভার অর্পণ করিয়া নিশানাথ গ্রামে আসিলেন; উদ্দেশ্য: পৈতৃক ভিটা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং যতখানি সম্ভব জমি কেনা।
বাপের আমলেও প্রথম দিকে নায়েব ছিলেন, যদিও তখন জমিদারী বলিতে কিছু ছিল না অথচ ঠাঁট পুরামাত্রায় ছিল। নায়েব মুরারিমোহন এখন বৃদ্ধ হইয়াছেন। তিনিই নিশানাথের নিকট হইতে বাড়ির বাগানটি দীর্ঘমেয়াদে লীজ নিয়াছিলেন। বাগানের খাতিরে এতকাল ধরিয়া তাঁহাকে নিশানাথের পরিত্যক্ত বিশাল বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইতেছে, কেননা বাড়িটি সাপ-খোপের আড্ডা হইলে তাহা বাগানের পক্ষেও বিপদজনক।
নিশানাথের চিঠি পাইয়া তিনি নিচের মহলের একটি সম্মুখবর্তী ঘর পরিষ্কার করাইয়া গুছাইয়া বাসোপযোগী করাইয়া রাখিলেন।
কলিকাতা হইতে বর্ধমানের এই গণ্ডগ্রামে পৌঁছানোও সহজ কথা নহে।
পথ যদিও বেশি নহে কিন্তু যাত্রা দুর্গম।
অবশেষে বিকাল চারিটা নাগাদ গ্রামে আসিয়া পৌঁছানো গেল। ভাদ্র মাস, শরৎকাল; কিন্তু আকাশের মতিগতি বিশেষ সুবিধার নহে, মেঘের ভারে পৃথিবীর উপুর উপুড় হইয়া পড়িতে চায়। বৃষ্টি নামিল।
মুরারিমোহন বলিলেন, এই বাড়িতে রাত্রি যাপন না করিয়া, ছোটকর্তা কী আমার ওখানে থাকিলে ভাল করিতেন না?
হাজার হোক, এককালে তো নায়েব ছিলেন, তাহার বাড়িতে নিজের ভিটা থাকিতে রাত্রি যাপন করা নিশানাথের মর্যাদার পক্ষে হানিকর। মনে মনে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইলেন।
বলিলেন, না কাকা, না।
অতঃপর তিনি বৈষয়িক কথা পাড়িলেন, জমিজমা সম্পর্কে জানিতে চাহিলেন।
মুরারিমোহন বলিলেন, গ্রামের লোকও সম্প্রতি সেয়ানা হইয়া উঠিয়াছে। হাওয়ার গতি তাহারা বুঝিতে পারে। জমির দাম একলাফে দশগুণ বাড়িয়া গিয়াছে আরো যে না বাড়িবে সেকথা বলা যায় না। জমি লইয়া রীতিমত ফাটকাবাজি চলিতেছে।
নিশানাথ হাসিয়া বলিলেন, বটে, বটে। সাপের পাঁচ পা দেখিয়াছে। কত টাকা চায়! জমি কিনিব বলিয়া আসিয়াছি, খালি হাতে ফিরিয়া যাইব না।
মুরারিমোহন—নিশ্চয়ই। খালি হাতে ফিরিবেন না।
নিশানাথ ভণিতা না করিয়া এবার বলিলেন, আপনি আমার বাগানটা ঘড়িতে পারেন না? বাগানের পিছনে তিন বিঘা জমি অনর্থক নষ্ট হইতেছে।
মুরারিমোহন বলিয়া উঠিলেন, সে কী ছোটকর্তা, ইজারার চুক্তির মেয়াদ তো এখনো শেষ হয় নাই!
নিশানাথ—মনে করুন, যদি আমি কিনিয়া লই?
মুরারিমোহন—আমিও তো একদিন টাকা দিয়াই ইজারা লইয়াছিলাম। অমন কথা বলিবেন না। নিশানাথ তাঁহাদের এককালের অধস্তন কর্মীর স্পর্ধা দেখিয়া চটিলেন, কিন্তু কিছু বলিতে পারিলেন না, কোন আইনের ফাঁদে তাহাকে ফেলিবারও অবকাশ নাই।
মুরারিমোহনের বাসা হইতেই খাবার আসিল। উঠিবার পূর্বে মুরারিমোহন কহিলেন, জমিজমার কথাবার্তা কাল সবিস্তারে হইবে। ছোটকর্তা এখন বিশ্রাম গ্রহণ করুন। পথের ধকল তো কম হয় নাই। তবে বলিতেছিলাম কী, ছোটকর্তা বোধ হয় আমার ওখানেই রাত্রি যাপন করিলে ভাল করিতেন।
নিশানাথ এবার উষ্মা মিশ্রিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, বারবার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া একই কথা বলিতেছেন কেন?
মুরারিমোহন বলিলেন, তবে আপনাকে বলিয়াই ফেলি।
নিশানাথ—হ্যাঁ, তাই বলুন।
মুরারিমোহন—আপনার পূর্বেই জানিয়া রাখা উচিত, নচেৎ বিমুঢ় হইবেন। এই ভিটায় ভূত আছে।
নিশানাথ—কী বলিলেন!
মুরারিমোহন—এই ভিটায় ভূত আছে।
নিশানাথ—আপনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন?
মুরারিমোহন—দেখিয়াছি বটে, কিন্তু তাহার চেহারা দেখা যায় না। হাওয়ায় যেন একটি লঘু শীর্ণ, কাপড় পরিহিত নারীমূর্তি এই ভিটায় সন্ধ্যায় রাতে ভাসিয়া বেড়ায়। সে কখনো কাহারও কোন অনিষ্ট করে না। তবু বলিতেছিলাম, ছোটকর্তা তো বহুদিন দেশ গাঁয়ে বাস করেন নাই। যদি—
নিশানাথ—কী সব গাঁজাখুরি বকিতেছেন। উহা আপনাদের দৃষ্টিবিভ্রম। রাতের আলো আঁধারিতে হাওয়ায় যেন কাপড় ভাসিয়া বেড়াইতেছে, অমন মনে হয়। ভূত হইলে তাহার চেহারা দেখিতেন। আমিও গ্রামে মানুষ, ওই সব গল্প শুনিয়া ভয় পাই না।
মুরারিমোহন উঠিয়া দাঁড়াইলেন—দরজাটা দিন ছোটকর্তা। খাটের নিচে কুঁজোয় জল রহিল।
ফের মুরারিমোহন ফিরিয়া আসিলেন,—ছোটকর্তা, আপনার এখানে শুইবার জন্য কি আমার নাতিকে পাঠাইয়া দিব?
নিশানাথ—আপনি আমাকে ভয় দেখাইবার বৃথা চেষ্টা করিতেছেন। যান, কাল অতি ভোরে আসিবেন।
লণ্ঠনটি কমাইয়া খাটের পায়ার কাছে রাখিয়া মশারি গুঁজিয়া দিয়া নিশানাথ শুইয়া পড়িলেন। পাতায় পাতায় বিচিত্র শব্দে বৃষ্টি পড়িতেছে, ডেককুল অনর্থক একঘেয়ে চেঁচাইয়া চলিয়াছে, থাকিয়া থাকিয়া দমকা হাওয়া জানালা গলিয়া বাদল দিনের পুস্পসার পৌঁছাইয়া দিতেছে।
বর্ষা নিশীথের অপূর্ব এক মাদকতাময় রূপ আছে।
চোখে ঘুম আসিতে চাহে না, নিশানাথ বিছানায় শুইয়া শুইয়া সিগারেট টানিতে লাগিলেন। চোখ বন্ধ করিয়া পড়িয়া থাকিয়া বহুদিন পর তিনি স্মৃতির জাবর কাটিতে লাগিলেন। কবে তিনি সব ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কলিকাতায় তাঁহার বৃহৎ সম্পত্তির নিকট তো এখানের ভিটার আয়তন ও মূল্য এতকাল তুচ্ছ ছিল। হঠাৎ সরকারী নেক নজরে পড়িয়া গ্রামের কপাল ফিরিয়া গিয়াছে।
মশারি হইতে হাত বাহির করিয়া নিশানাথ সিগারেটের শেষ টুকরাটি জানালার দিকে ছুঁডিয়া ফেলিলেন। জানালার শিকে ঠোকর খাইয়া সিগারেটের টুকরাটি নিচে পড়িয়া গেল। যদিও পথশ্রমে শরীর ক্লান্ত, তবু চক্ষে ঘুম আসিতে চাহিতেছে না। নিশানাথ এপাশ ওপাশ ফিরিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বাহিরে বৃষ্টি প্রবলতর হইয়া উঠিয়াছে। বৃষ্টি, ভেকের ডাক, ঝিল্লিরব সব মিলাইয়া এক অদ্ভূত ঐক্যতান সৃষ্টি করিয়াছে। মশারির বাহিরে মশককুলের গুঞ্জনও শোনা যাইতেছে। ঘুমের চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া অতঃপর নিশানাথ আরেকটি সিগারেট জ্বালাইলেন। শুইয়া শুইয়া তিনি মুরারিমোহনের কথা ভাবিতে লাগিলেন। মুরারিমোহনের উপর এক বিশ্রী সন্দেহে তাঁহার মন বিষাক্ত হইয়া উঠিল। বাপ-পিতামহ এই ভিটায় জন্মিয়া মরিলেন, নিশানাথের জন্মও এইখানে, তাঁহার যৌবনও এইখানেই অতিবাহিত হইয়াছে; এখানে কস্মিনকালে কেহ ভূতের নাম শোনে নাই—আর আজ কিনা বেটা বুড়া তাঁহাকে ভূতের ভয় দেখাইতেছে। আসলে বেটা বাগান ছাড়িতে চাহে না, ভিটার প্রতিও তাহার লোভ। বাগানটি যে করিয়া হোক, করায়ত্ত করিতেই হইবে। কত ধানে কত চাল হয় বুড়া জানে না। আজ সে কিনা নিশানাথকে টাকার কথা বলে! কার টাকার কত জোর নিশানাথ তাহা পরখ করিয়া দেখিবেন তবে ছড়িবেন। বুড়া নিশানাথকে মারিবার চক্রান্ত তো করে নাই! গ্রামের লোকেদের তিনি ভালো করিয়া চেনেন; ইহাদের অসাধ্য কিছু নাই।
কাছাকাছি কোথাও সাপে ব্যাঙ ধরিয়াছে; বেচারী ব্যাঙ থাকিয়া থাকিয়া গোঙাইতেছে। সিগারেটের পোড়া টুকরাটি এবারও দিকভ্রষ্ট হইয়া জানালার কাছে মেঝেয় পড়িয়া ধোঁয়ার সরু, হালকা রেখা উপরের দিকে উড়াইতে লাগিল। পায়ের দিকে রাখা পাতলা চাদরটি টানিয়া নিশানাথ গায়ে দিলেন।
ঈষৎ তন্দ্রার আমেজ আসিয়াছিল, অকস্মাৎ মনে হইল বুঝি ঘরে বিচিত্র সব কুসুমগন্ধের সমারোহ লাগিয়া গিয়াছে। ব্যাঙের আর্তনাদও আর শোনা যাইতেছে না। রাত ক’টা কে জানে, ঘড়িটা বালিশের পাশে আছে। রাত্রে এক গ্লাস জল খাওয়া তাঁহার নিত্যকার অভ্যাস। চোখ খুলিয়া উঠিয়া বসিতেই মনে হইল, জানালার কাছে ঝাপসা শাদা ধোঁয়া যেন একটি নারীমূর্তির রূপ পরিগ্রহ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। পোড়া সিগারেটের টুকরার ধোঁয়া তাঁহার চক্ষে বিভ্রম ঘটাইয়াছে মনে করিয়া তিনি চোখ রগড়াইয়া ফের তাকাইলেন। মনের ভুলও ত হইতে পারে! বেটা বুড়া মুরারিমোহনের কথা শুনিয়া কি তাঁহার এমন মনে হইতেছে!
না, মনের ভুল নহে। হাওয়ায় যেন শ্বেবসনা এক নারীমূর্তি ভাসিতেছে। মুখ হাত পা কিছুই দেখা যাইতেছে না, অথচ যেন বস্ত্র পরিহিতা নারীমূর্তি! মূর্তিটি এবার যেন নড়িয়া উঠিল। বুড়া মুরারিমোহনের কারসাজি নয় তো?
নিশানাথ বলিয়া উঠিলেন, কে, কে ওখানে?
মূর্তিটি ঈষৎ চঞ্চল হইয়া উঠিল, বলিল,—আমি, আমি। চিনিতে পারিতেছ না।—শুকনো পাতার উপর দিয়া বহিয়া যাওয়া হাওয়ার মত খসখসে, দূরাগত, অপার্থিব সেই স্বর।
নিশানাথের গলা শুকাইয়া আসিল, ঝু কোনক্রমে পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, কে তুমি?
মূর্তিটি সম্মুখের দিকে আগাইয়া আসিতে আসিতে বলিল, ওগো আমি—!!ভুলিয়া গেলে।
সেই স্বর শুনিয়া নিশানাথের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, শুইয়া পড়িয়া আপাদ-মস্তক চাদরে ঢাকিয়া দিলেন। নিশানাথ অনুভব করিলেন, মূর্তিটি একেবারে মশারির নিকট আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। মৃদু নিশ্বাসও শোনা যাইতেছে। নিশানাথ নিশ্চেতন হইয়া শুইয়া রহিলেন।
তেমনই দূরাগত খসখসে অপার্থিব স্বরে মূর্তিটি বলিয়া উঠিল, ওগো, আমি, আমি মল্লিকা! আমায় তুমি ভুলিয়া গেলে!
নিশানাথের জবাব শুনিবার জন্য বোধ হয় মূর্তিটি কিয়ৎকাল নীরব রহিল। নিশানাথ রা-টি কাড়িতেছেন না দেখিয়া পুনরায় বলিয়া উঠিল, ওগো, আমি যে তোমার পথ চাহিয়া এতকাল প্রতীক্ষা করিতেছি। তুমি আমায় শহরে লইয়া যাইবে না?
নিশানাথ নিশ্চুপ।
মূর্তি—ওগো, একবার চোখ মেলিয়া দেখ। আমি মল্লিকা, তোমার পত্নী। আমি জানিতাম, তুমি আসিবে। এতকাল পর তুমি আসিলে। এতকাল পর আমার যাইবার সময় হইল।
নিশানাথ নিরুত্তর।
মূর্তি—কেন কথা কহিতেছ না? ওগো চোখ মেললা, তাকাও।
মূর্তিটি নীরব হইয়া কিছুকাল দাঁড়াইয়া রহিল। নিশানাথ চাদরের নিচে ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন; তাহার শরীর দিয়া দরদর করিয়া ঘাম বহিতে লাগিল।
অধৈর্য হইয়া মূর্তিটি মশারি তুলিয়া ধরিল। নিশানাথ অনুভব করিলেন, মূর্তিটি এইবার তাঁহার মুখের উপর হইতে চাদরটি সরাইবার জন্য হাত বাড়াইয়াছে। নিশানাথের কপালে তাহার হাতের স্পর্শ লাগিল। বরফের চাইতেও তীব্র শীতল সেই হাত। এক নাম-না-জানা আকস্মিক ভয়ে নিশানাথ হঠাৎ আড়ষ্ট হইয়া গেলেন, তাঁহার চেতনা লুপ্ত হইল।
দীর্ঘ ঘুমের পর নিশানাথ জাগিলেন। এতক্ষণ কী-সব আবোল-তাবোল স্বপ্ন দেখিয়াছেন। চোখের পাতা ঘুমের দরুণ ভারী হইয়া উঠিয়াছে। নিশানাথ চোখ মেলিলেন। সমস্ত শরীর যেন দীর্ঘ ঘুমের দরুণ বড় হালকা ঠেকিতেছে। নিশানাথ দেখিলেন, মূর্তিটি তেমনই দাঁড়াইয়া আছে। কিন্তু এ কী, ইহার তো চোখ মুখ সব দেখা যাইতেছে! ঠিক মল্লিকার মত। নিশানাথ হাসিয়া উঠিলেন,—বুড়া মুরারিমোহন ধরা পড়িয়া গিয়াছে। নিশানাথকে ভয় দেখাইবার জন্য কাহাকে না-কাহাকে মল্লিকা সাজাইয়া পাঠাইয়াছে। রোসো, উহাকে কাল মজা দেখাইয়া হাড়িবেন তিনি। বেটা বদমাইশির আর জায়গা পায় নাই! মূর্তিটিকে তিনি ধরিয়া বাঁধিয়া রাখিবেন, কাল সকালে সর্ব সমক্ষে মুরারিমোহনের জারিজুরি ভাঙিয়া দিবেন।
মূর্তিটিকে ধরিবার জন্য তিনি উঠিয়া বসিয়া মশারির বাহিরে হাত বাড়াইলেন। মনে হইল, নিশানাথের সর্বশরীরও কেমন যেন হিমসিক্ত হইয়া গিয়াছে।
মূর্তিটিকে ধরিবার পূর্বেই সে নিশানাথের নাগাল হইতে সরিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, আঃ, লজ্জা করে না। এ বয়সেও…
—তোমাকে ধরিয়া বাঁধিয়া রাখিব। —নিশানাথ কহিলেন।
মূর্তি—ধরিতে হইবে না, আমি আপনিই ধরা দিয়াছি।
নিশানাথ—মানে!
মূর্তি—এখন চলল, ওঠো।
নিশানাথ—কোথায়! রাতবিরেতে এমন ইয়ার্কি সহ্য হয় না।
মূর্তি—ইয়ার্কি!
নিশানাথ—নয় তো কী! মুরারিমোহন বলিয়াছিল, এ ভিটায় ভূত চরিয়া বেড়ায়, তাহার মুখ চোখ কিছুই দেখা যায় না। আমি তো তোমার মুখ চোখ সবই দেখিতে পাইতেছি। তুমি মল্লিকা সাজিয়া আসিয়াছিলে আমাকে ভয় দেখাইতে! রোসো, তোমাকে পুলিশে—
মূর্তিটি জবাব দিল—ওগো, না গো না। মুরারিমোহন ঠিকই বলিয়াছিল। আমি মল্লিকা। জীবিত লোকে আমার মুখ দেখিতে পায় না।
বিস্ময় বিমূঢ় নিশানাথ কহিলেন, কী বলিতেছ?
মূর্তিটি হাসিয়া উঠিয়া বলিল, তুমি তো কুড়ি মিনিট আগেই ভয় পাইয়া মরিয়া গিয়াছ, তাই তোমার মল্লিকার মুখ…নাও, এখন চলল, আমারও প্রতীক্ষার অবসান হইল।