তবু জীবন অগাধ
তুমি ভুল বুঝলেই নিশ্বাস ভারী হয়।
বারোতলা বাড়ির এগারোতলার ফ্ল্যাটে বসে ঠিক দুপুরবেলায় এই লাইনটা লিখে ফেলল কল্পন। তার টেবিলের সামনে একটা বড় জানলা। চিলগুলো পাক খাচ্ছে জানলার বাইরে। মেঘগুলো বড় কাছে কিন্তু কাছাকাছি নয়। হলে ভালো লাগত না, যে মেঘের শরীর জলে ভেজা নয় তাদের সাহারায় চলে যাওয়া উচিত।
এখন দুপুর। ফ্ল্যাটে কেউ নেই। কল্পন অবাক হয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে কবিতা লেখে না। বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়ে না। বাবা বলেন, ওগুলো ট্র্যাশ। ইংরেজিতে প্রকাশিত পৃথিবীর যাবতীয় সিরিয়াস লেখা নিয়মিত পড়ে বাবা। এ বাড়িতে কোনও বাংলা বই নেই।
মায়ের পড়ার অভ্যেস নেই। কাজ না থাকলে মা টিভির সামনে বসে থাকে। মায়ের প্রিয় চ্যানেল এম। মা কখনও নাচত কিনা কম্পন জানে না, কিন্তু অনবরত শরীর বেঁকিয়ে এবং দেখিয়ে। মেয়েগুলো লাফিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে, মায়ের দেখতে ভালো লাগে। যেদিন টি-এন-টি-তে ছবির বদলে বিকট চেহারার কুস্তিগিররা কুস্তির অভিনয় করে সেদিন মায়ের খুব ভালো কাটে।
কল্পন পড়াশুনা করেছে সেন্ট জেভিয়ার্সে, স্কুল এবং কলেজে। সে ইংরেজিটা ভালো বলে। ওইটেই তার অনার্সের বিষয়। পার্ট ওয়ানে ফার্স্ট ক্লাস ছিল বলে সবাই জেনে নিয়েছে। ফাইনালেও থাকবে। এরপর কল্পন কী করবে তাই নিয়ে বাবা-মায়ের মধ্যে প্রায়ই তর্ক চলে। বাবা তাকে লন্ডনে পাঠাতে চায় মা আমেরিকায়। ওর কোনও ভাইবোন নেই।
তুমি ভুল বুঝলেই নিশ্বাস ভারী হয়।
আচ্ছা, এটা কি বাংলা কবিতার লাইন হয়েছে? কল্পন তাকিয়ে দেখল চিলগুলো সামনের আকাশে নেই। সে অপেক্ষা করল। এখনই টানটান ডানায় ভেসে ফিরে আসবে ওরা। এক, দুই অনেক মুহূর্ত গেল, ওরা ফিরল না। অস্বস্তি হল। কল্পন চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলায় গেল। সারা আকাশে একটাও চিল নেই। এই নগ্ন আকাশ দেখতে কুৎসিত লাগল। নিশ্বাস ভারী হল। সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে এল টেবিলে। লাইনটা পড়ল।
কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়? ওর কলেজের বন্ধুদের মধ্যে খুব কাছাকাছি সন্দীপ। টেলিফোন পেয়েই সন্দীপ বলল, কী ব্যাপার?
শোনো। তুমি ভুল বুঝলেই নিশ্বাস ভারী হয়, এটাকে বাংলা কবিতার লাইন বলা যেতে পারে?
হয়তো। সন্দীপ একটু অবাক হল যেন।
তার মানে তুই জানিস না?
ইন ফ্যাক্ট ব্যাপারটা খুব সিলি লাগছে।
সিলি?
এখন ওসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
কেন?
প্রেম এখন অনেক আধুনিক হয়ে গেছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার দিন শেষ। ওর পেছনে কেউ সময় নষ্ট করে না।
সে কি রে? কয়েকদিন আগে টেলিগ্রাফে পড়লাম একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে কারণ তার প্রেমিকা তাকে রিফিউজ করেছিল।
দ্যাখ, উজবুকটা নিশ্চয়ই বাংলা উপন্যাস পড়ত। বাই!
মাথা নাড়ল কল্পন। সন্দীপকে ফোন করা ভুল হয়েছে। বাবার সঙ্গে ওর কোনও ফারাক নেই। সল বেলো পড়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল।
খুব অস্বস্তি হচ্ছিল কল্পনের। একজন কবিকে যদি পাওয়া যেত তা হলে সে জিজ্ঞাসা করত। লাইনটায় কবিতা আছে কিনা। কিন্তু বাংলা ভাষায় যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের নাম বা টেলি নম্বর তার জানা নেই।
জিনসের ওপর ফতুয়াটা চাপিয়ে চাবি নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হল কল্পন। যে-কোনও বাংলা বই এর দোকানে যেতে হবে তাকে।
এগারোতলা থেকে নামতেই সে মহিলাকে দেখতে পেল। এই বাড়িতেই থাকেন। বেশ মিষ্টি দেখতে। ছেলেবেলা থেকে এঁকে দেখছে সে। কিন্তু তার বেশি সম্পর্ক হয়নি। মা পছন্দ করে না ঘনিষ্ঠতায়।
মহিলা হাসলেন, ভালো?
কল্পন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
তুমি যেন কী পড়ছ?
পার্ট টু দিয়েছি।
আ-চ-ছা! মহিলার চোখ বড় হল।
সঙ্গে-সঙ্গে প্রশ্নটা করে ফেলল কল্পন, আচ্ছা, আপনি বাংলা কবিতা, গল্প পড়েন?
নিশ্চয়ই। রোজ বই না পড়লে আমার ঘুম হয় না।
বাংলা বই?
হ্যাঁ, কেন বলো তো?
আপনি আমাকে একটু হেল্প করবেন?বাংলা ভাষায় এখনকার দুজন বড় কবির নাম এবং ফোন নাম্বার দিতে পারবেন?
ফোন নাম্বার তো জানি না, ওঁদের বই দিতে পারি। তুমি আসবে?
খুশি হয়ে মাথানাড়ল কল্পন।
চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভদ্রমহিলা বললেন, এ ঘরে এসো।
পাশের ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল কল্পন, দেওয়াল জুড়ে স্টিলের ফ্রেমে বাংলা বই সাজানো। ভদ্রমহিলা বললেন, ওগুলো মেজর উপন্যাস, মাঝখানে গল্প, এপাশে কিছু প্রবন্ধ আর ক্লাসিক বই আর এদিকে কবিতা।
ক্লাসিক বই?
হ্যাঁ। রামায়ণ, মহাভারত, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র–তুমি পড়োনি?
মাথা নাড়ল কল্পন, না। বাংলা বই আমাদের বাড়িতে নেই।
তুমি কী পড়ো? ইংরেজি?
হ্যাঁ।
তাহলে বাংলা কবিতার খোঁজ করছ কেন?
কবিতার খোঁজ করছি না। কবির সঙ্গে কথা বলতে চাই।
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কল্পন এখন যুবক কিন্তু তার মুখে কিশোরের সারল্য থেকে গেছে। তিনি একটা বই বের করলেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া যাঁকে আধুনিক বাংলা কবিতার জনক বলা হয় তাঁর নাম জীবনানন্দ দাশ। এঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়লেই তুমি কিছুটা আন্দাজ পাবে!
এঁর টেলিফোন নাম্বার পাওয়া যাবে না?
ইনি অনেককাল আগে মারা গিয়েছেন।
ও। যাঁরা বেঁচে আছেন–। শেষ করল না কল্পন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামীরা আছেন। এঁদের বই-এর প্রকাশকরা। নিশ্চয়ই টেলিফোন নাম্বার দিতে পারবেন। কিন্তু বাংলা না পড়ে বাঙালি কবির সঙ্গে কথা বলতে চাইছ কেন? কিছু দরকার? ভদ্রমহিলার গলায় বিস্ময় স্পষ্ট।
আসলে, মানে, আমি কখনও লেখার কথা ভাবিনি। এখন ছুটি। ফ্ল্যাটে একা ছিলাম। হঠাৎ একটা লাইন লিখে ফেললাম। মনে হল, কেউ যেন আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল। তারপর থেকেই ভাবতে লাগলাম বাংলায় ওই লাইনটাকে কবিতা বলা যায় কি না? কল্পন খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল।
কী লাইন লিখেছ?
আপনি হাসবেন। ব্যাপারটা হয়তো ছেলেমানুষি, পরিচিত কাউকে বলতে চাইনি। যে কখনও সাঁতার শেখেনি সে কী করে সাঁতার কাটবে?
তা তো ঠিকই। সব কিছুই শিখতে হয়, অনুশীলন করতে হয়। তোমার কাছে ইংরেজি থেকে বাংলা শব্দের অভিধান আছে? অথবা বাংলা থেকে ইংরেজির?
অভিধান?
ডিকশনারি।
ওঃ। না, নেই। স্কুলে আমার বাংলা বই ছিল না, হিন্দি পড়েছি।
তাহলে তোমার পক্ষে বাংলা লেখা সম্ভব নয়। তবু কথা দিচ্ছি হাসব না। কী লিখেছ শুনি। মহিলা সিরিয়াস ভঙ্গি করলেন।
কল্পন লাইনটা ভাবতে-ভাবতে দেখল মহিলা চোখ বন্ধ করলেন। সে আবৃত্তির মতো উচ্চারণ করল, তুমি ভুল বুঝলেই নিশ্বাস ভারী হয়।
কল্পন দেখল লাইনটা শোনামাত্রই মহিলার মুখের রং পলকের জন্যে বদলে গেল। অপূর্ব এক আলো খেলা করে গেল ওঁর গালে, ঠোঁটে, চিবুকে। চোখ খুললেন তিনি, এই লাইন তুমি। লিখেছ?
হ্যাঁ।
এর পরের লাইন কী?
তারপর কিছু ভাবিনি।
খুব ভালো, খুব ভালো। আচ্ছা, এইরকম ইংরেজি কবিতা কিছু পড়েছ?
না তো!
এই তুমিটা কে? কার কথা ভাবলে তোমার নিশ্বাস ভারী হয়?
কাউকে ভেবে লিখিনি তো!
তোমার কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই?
না।
ভদ্রমহিলা জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা আর দুটো অভিধান কল্পনকে দিয়ে বললেন, খুব ভালো লাগল। কিন্তু কবিতাটা শেষ করতে হবে তোমাকে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব।
নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে এল কল্পন। টেবিলে বসতেই সে চিলটাকে দেখতে পেল। একলা একটা চিল টানটান ডানা মেলে মেঘেদের শরীর ছুঁয়ে যেন সাঁতার কেটে চলেছে। ওর সঙ্গীরা কোথায়?
কবিতা কী এ-জিজ্ঞাসার কোনও আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় যে কবিতা অনেকরকম।
বই-এর শুরুতেই লাইনটা পড়ে কল্পনের মনে হল এমন সরল কবিতার ব্যাখ্যা কোনও ইংরেজি প্রবন্ধে পড়েনি সে। কিন্তু প্রথম কবিতা, যার শিরোনাম নীলিমা, পড়তে গিয়ে হোঁচট খেল সে। আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা লাইনটার অর্থ বোধগম্য হল না তার। এমন কঠিন বাংলা শব্দ সে কখনও শোনেনি। কষ্ট হল। যাঁরা কবিতা লেখনে এবং পড়েন তাঁরা নিশ্চয়ই খুব পণ্ডিত মানুষ। পাতা ওলটাল সে। হঠাৎই শরীরে বিদ্যুংছড়িয়ে গেল। যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনও সাধ নাই তার ফসলের তরে। উত্তেজিত অবস্থায়। অভিধান খুলল সে। অনুমানে যেটা ধরেছে সেটা যাচাই করতে গিয়ে খুশি হল। শিয়রে শব্দটা বড় কাছের হয়ে গেল। নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার। চোখের সামনে যেন ছবিটা আঁকা হয়ে গেল।
ঠিক-ঠিক। প্রথমটা যদি পণ্ডিতের, দ্বিতীয়টা তাহলে যার অনুভব করার ক্ষমতা আছে তার। কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস–শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়।অভিধান খুলে উৎকৃষ্ট শব্দের মানে দেখল কল্পন।
চোখ তুলতেই কল্পন দেখতে পেল উড়তে উড়তে চিলটা জানালার বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। কখনও-সখনও ওদের বারোতলার কার্নিশে বসে থাকতে দেখা যায়। ওর সঙ্গীরা কী ক্লান্ত হয়ে কোনও কার্নিশে বিশ্রাম নিচ্ছে! হঠাৎই ডেকে উঠল পাখিটা, উড়তে-উড়তে ডাকল। চিলের ডাক বড় কর্কশ শোনায়।
পাতা ওলটাতে-ওলটাতে কবিতাটা চোখ কেড়ে নিল। হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে। বাঃ, সমস্ত পৃথিবীটা যেন আলোকিত হল। একেবারে ওই চিলটাকে নিয়ে লিখেছেন কবি। তাহলে একটু আগে যে ডাকটা সে শুনতে পেয়েছিল সেটা ডাক নয়, কান্না? তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।
বেতের ফল কীরকম দেখতে?কল্পন পাশের ঘরে গিয়ে কর্ডলেসের বোতাম টিপল, সন্দীপ, তুই বেতের ফল দেখেছিস?
না। কেন?
ঠিক আছে। লাইনটা কেটে দিয়ে দ্বিতীয় নাম্বার টিপল সে। বাবার টেলিফোন বেজে চলেছে। অর্থাৎ ভদ্রলোক এখন তাঁর ঘরে নেই। তৃতীয় নাম্বার টিপে নাম বলতেই মাকে পেল কল্পন, মা, বাই এনি চান্স তুমি বেতের ফল দেখেছ?
হোয়াট?কী ফল?
বেত। কেন?
কোনও ইংরেজি উপন্যাসে পেয়েছ বোধ হয়। ওসব আফ্রিকানরা খায়। বাই!
ঠোঁট কামড়াল কঙ্কন। তারপর বই-এর পাতা উলটে প্রকাশকের নাম ঠিকানা দেখল।
নাভানা, সাতচল্লিশ গণেশ অ্যাভিনিউ। টেলিফোন গাইড খুঁজে কোনও হদিশ পেল না সে। তারপরেই খেয়াল হল। নিউ মার্কেটের যে দোকান থেকে মা ফলটল কেনে তারা বলতে পারে। বাবা একবার বলেছিল নিউ মার্কেট এমন একটা জায়গা যেখানে চাইলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়।
লিন্ডসে স্ট্রিট দিয়ে ঢুকে সেই দোকানে পৌঁছাতে সময় লাগল না। এখন পড়ন্ত দুপুর বলে ভিড় শুরু হয়নি। দোকানদার তাকে বেশ কয়েকবার দেখেছে মায়ের সঙ্গে আসতে। জিজ্ঞাসা করল, কী চাই বাবু?
বেতের ফল।
বেতের ফল? আমার কাছে নেই।
কোথায় পাব?
কেউ রাখে বলে শুনিনি।
কীরকম দেখতে হয় জানেন?
আমি তো কখনও দেখিনি।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল কল্পন।
আচ্ছা, আপনি বেতের ফল খুঁজছেন কেন?
প্রশ্নটা পাশ থেকে আসতেই সে মাথা ঘুরিয়ে দেখল একজন তরুণী কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে।
আমার দরকার ছিল। গম্ভীর হল কল্পন।
আমি উত্তরবঙ্গের মেয়ে। আমাদের বাড়িতে বেতের গাছ ছিল।
তাই? মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে গেল কল্পন, কীরকম দেখতে। খুব ডিপ্রেসড দেখতে?
ডিপ্রেসড?
হ্যাঁ। মানে দেখলেই ম্লান চোখ মনে আসে?
মেয়েটি একেবারে সকালের প্রথম রোদ হয়ে গেল, আপনি বুঝি জীবনানন্দ দাশের খুব ভক্ত?
কী করে বুঝলেন?
আপনি হায় চিল কবিতার লাইন বললেন।
আপনার মুখস্থ। কিন্তু জানেন, আজ দুপুরের আগে আমি ওঁর নাম শুনিনি, লেখাপড়া দূরের কথা।
সেকি?
কিন্তু ফলটা কীরকম দেখতে বললেন না।
মনে পড়ছে না। আপনি কবিতা লেখেন?
না। আচ্ছা বলুন তো, এই লাইনটায় কবিতা আছে কি না? কল্পন সরাসরি লাইনটা বলল, তুমি ভুল বুঝলেই নিশ্বাস ভারী হয়।
কবিতার আভাস আছে লাইনটায়। জয় গোস্বামীর লাইন?
উনি বুঝি খুব নামকরা কবি!
মেয়েটি এমন চোখে তাকাল যে সঙ্গে-সঙ্গে বেতের ফলের কথা মনে পড়ল কল্পনের। প্রবল বিস্ময় নয়, কীরকম ম্লান হয়ে গেল ওর চোখ। তারপর ফলের প্যাকেটটা নিয়ে চলে গেল।
বাবা অফিস থেকে বেরিয়ে ক্লাবে যায়। ক্লাব থেকে ফিরে আসে ঠিক নটায়। এসে স্নান করে। তারপর বিদেশি বোতল নিয়ে বসে। কয়েকটা বরফের টুকরো, শসার টুকরো দিয়ে তিন পেগ মদ খায়। ক্লাবে বাবা বিয়ার খায়। দিশি হুইস্কি বাবার চলে না। এসময় কথা বলতে চাইলে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। বাবা স্কচের সঙ্গে বাংলা বলে না। এটাই নিয়ম।
কল্পন চেয়ার টেনে বলল, তুমি যখন ড্রিংক করো তখন কোনও ঘ্রাণ পাও?
ঘ্রাণ? শব্দটা বলেই বাবা কাঁধ নাচাল। তারপর ইংরেজিতে বলল, ওয়েল, স্কচের একটা নিজস্ব ফ্লেবার আছে। পৃথিবীর কোনও হুইস্কিতে সেটা পাওয়া যাবে না। কিন্তু কেন?
ঘাসের ঘ্রাণ তোমার মদে নেই? কল্পন জিজ্ঞাসা করল।
ঘাসের ঘ্রাণ! ওটা একটা গন্ধ হল! গরুর খাদ্য যা তার কখনওই মানুষের ভালো লাগতে পারে না। আজ তোমার কী হল? প্রশ্ন ইংরেজিতে।
মা বেরিয়ে এল তার ঘর থেকে। টেবিলের ধারে শরীর রেখে বলল, তোমার ছেলের কিছু একটা হয়েছে। আজ অফিসে ফোন করে জিজ্ঞাসা করল আমি বেতের ফল দেখেছি কি না?
বাবা বলল, এখন জিজ্ঞাসা করছে স্কচে ঘাসের গন্ধ পাচ্ছি কিনা।
কল্পন বলল, গন্ধ নয় ঘ্রাণ।
বাবা হাত নাড়ল, ওছ, একই হল।
আমারও ইচ্ছে করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে-গেলাসে পান করি। কল্পন। হাসল।
মাই গড! তুমি কবিতা পড়ছ নাকি? বাংলা কবিতা?
হ্যাঁ।
হোয়াট?
পড়ার পর মনে হচ্ছে এতদিন অশিক্ষিত ছিলাম।
কল্পন চেয়ার থেকে উঠে গেল চোয়াল ঝুলে যাওয়া মুখের সামনে থেকে। ঘরে ঢোকার আগে শুনল, কি হল ওর? পাগল হয়ে গেল নাকি?
বাবা বলল, মনে হচ্ছে। কোনও পাতি বাঙালি মেয়ে ওকে ফাঁসিয়েছে। তোমার ছেলের মুন্ডু চিবিয়েছে সে।
মেয়ে? ওর কলেজের কোনও মেয়ের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়নি।
তখন হয়নি, এখন হয়েছে। সে-ই ওকে বাংলা কবিতা পড়াচ্ছে দ্যাখো, এবার হয়তো বলবে বাংলা নিয়ে এমএ করবে। উঃ! আঃ, দাঁড়িয়ে দেখছ কি? নিজের অজান্তেই বাংলায় চলে এলবাবা।
এই জন্যেই আমি ওকে আমেরিকায় পাঠাতে বলেছিলাম।
এমনভাবে কথা বলছ যেন বম্বে দিল্লিতে পাঠাতে চাও। আমেরিকায় যাওয়া খুব সোজা ব্যাপার? ভিসা পাবে ও? কখনও না। তার চেয়ে লন্ডনের ভিসা পাওয়া অনেক সহজ। ওকে জিগ্যেস করো ব্যাপারটা কী?
বাবা খেঁকিয়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে মা বলল, তুমি ওইভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না।
আই অ্যাম সরি। ওকে?
মা এল কল্পনের ঘরে।
কল্পন হাসল, কোনও মেয়ে আমাকে ফাঁসায়নি। তুমি যাও।
তাহলে এ সব কী বলেছিস তুই? মা মমির মতো মুখ করে বলল।
কিছুই না। তুমি টিভি দ্যাখো।
কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে মা ফিরে গেল। কম্পন তাকাল জানলার বাইরে। পরিষ্কার আকাশে অজস্র তারার ভিড়। কোনও রাতে সে কী এত তারা আকাশে দেখেছে? সমস্ত সন্ধে নিংড়ে যে লাইনগুলো বই-এর পাতা থেকে বুকে তুলে নিয়েছিল তার কোনও-কোনওটার সঙ্গে কি এই আকাশের মিল আছে? দ্রুত বই খুলল কল্পন। পাতার-পর-পাতা সরিয়ে-সরিয়ে শেষ পর্যন্ত থামল–আকাশে এক তিলও ফাঁক ছিল না। আশ্চর্য, যে বই ছাপা হয়েছে উনিশশো চুয়ান্ন সালে অর্থাৎ চুয়াল্লিশ বছর আগে তার কবি আজকের আকাশটাকে কি করে দেখলেন! নাকি সে-রাতেও এমনই আকাশ ছিল! নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করল কল্পন। না, তার কোনও প্রিয় মানুষ এখনও মারা যায়নি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে দেখছে বাবা আর মাকে। মাঝে-মাঝে মাসিমণি। ব্যস। এরা কেউ মারা যায়নি। অতএব মৃতদের মুখ নক্ষত্রের ভেতর দেখার কোনও অবকাশ নেই। এই নক্ষত্রেরা কীরকম ঝলমল? অন্ধকার রাতে অশ্বথের চূড়ায় প্রেমিক। চিলপুরুষের শিশির ভেজা চোখের মতো। অভিধান বলছে অশ্বত্থ একটি বৃক্ষ অর্থাৎ বড় গাছ। তার চূড়ায় বসলে নক্ষত্রের একটু কাছাকাছি হওয়া হয়তো সম্ভব কিন্তু প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির ভেজা চোখ কীরকম দেখতে? প্রেমিক চিলপুরুষ কেন? কেন প্রেমিকা চিলনারী নয়? আজ দুপুরে যে চিলটা উড়ে-উড়ে কেঁদে যাচ্ছিল সে কী পুরুষ না নারী?
কল্পন কিছুটা অনুমান করছিল অনেকটাই বোধের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
এ বাড়িতে ডিনার শুরু হয় বাবার স্কচ খাওয়া শেষ হয়ে গেলে। আজ রাতে খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। সেটা জানালে সমস্যা বাড়বে বলে তাকে টেবিলে বসতে হল।
খাওয়া শুরু করে বাবা বলল, তুমি কী টেগোর পড়ছ?
না তো! কেন?
হঠাৎ তোমার পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। ওয়েল, লোকে বলবে বাঙালি হয়ে বাংলা পড়ো না, এটা লজ্জার কথা। আরে, কীসের লজ্জা?ইংরেজি পড়লে পৃথিবীর সমস্ত ভাষার খবর পাওয়া যাবে। বাংলায় যারা লেখে তারা ইংরেজি থেকেই কীভাবে লিখতে হয় শিখেছে। নকল পড়ে কি হবে, পড়তে হলে আসল পড়াই ভালো। স্কচ খাওয়ার পর বাবা যখন কথা বলে তখন গলার স্বরের পরিবর্তন হয়। ক্রিকেট খেলার ঘুমন্ত রিলের মতো মনে হয়।
কম্পন মায়ের দিকে তাকাল, ব্যাবিলনের রানি খুব সুন্দরী ছিলেন?
মা জবাব দেওয়ার আগেই বাবা প্রশ্নটা লুফে নিল, ওছ, ফ্যান্টাস্টিক। কোন বইটা পড়ছিস?
কেন?
ব্যাবিলনের রানির কথা জানতে চাইছিস!
যে সব রূপসিরা এশিরিয়া, মিশর, বিদিশায় মারা গিয়েছিল মাঝে-মাঝে তারা কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায় রাতের আকাশে মৃত্যুকে পরাজিত করতে। এদের মধ্যে ব্যাবিলনের রানিও আছেন। কল্পন আবৃত্তি না করে বলল।
দ্যাটস ইট। বাবা ঘাড় নাড়ল, এইটে হল সময়কে অতিক্রম করা অথবা কী বলা যায়?
তোমাকে কিছু বলতে হবে না। মা বাধা দিল, তাহলে তুই তখন ঘাসের ঘ্রাণটান কী বলছিলি? মাথা খারাপ করে দিস!
বাড়িতে একটা মশারি ছিল না?
মশারি?মশারি কী হবে এই এগারোতলায়! মা অবাক।
কলকাতায় খুব ম্যালেরিয়া হচ্ছে। বাবা গম্ভীর গলায় বলল।
মা মাথা নাড়ল, পাগলের কাণ্ড। কখন কী বলো বুঝতে পারি না।
মশারিটাকে টাঙাল খুব কসরত করে। এ বাড়ির দেওয়ালে পেরেক পোঁতা নেই, দেওয়াল নষ্ট হয়। অতএব মশারি টাঙাতে বুদ্ধি খরচ করতে হল। আলো নিবিয়ে সবকটা জানালা খুলে দিল কল্পন। এগারোতলার এই ঘরটাকে হাওয়া-ঘর বলা যায়। ফ্যান খুলতে হয় না। দুটো জানালা বন্ধ না করলে ঝড় বয়ে যাবে। আজ সব উন্মুক্ত।
মশারির ভেতর শুয়ে নাইলনের মশারির ফাঁক দিয়ে আকাশের নক্ষত্রদের দিকে তাকাতেই মনে হল ওরা যেন অনেকটা নেমে এসেছে। ওদের কারও নাম ক্লিওপেট্রা কারও নাম শিবা। অসংখ্য মৃত রাজকন্যারা তাকিয়ে আছে প্রেমিক চিলের কুয়াশা-ভেজা চোখের দিকে। ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল কল্পন। এবং তখনই বঙ্গোপসাগর ছেড়ে উড়ে এল হাওয়ারা। কল্পনের মনে হল সেইসব বিস্তীর্ণ হাওয়া তার মশারির সঙ্গে খেলা করে চলেছে। মশারিটা ফুলে উঠেছে মৌসুমি সমুদ্রের পেটের মতো। যে-কোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে ছড়িগুলো, মশারিটা উড়ে যাবে নক্ষত্রের দিকে। এই দেখতে-দেখতে চোখ বন্ধ করল কল্পন। তার মনে হল, মাথার ওপর মশারিটা আর নেই। স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে সাদা বকের মতো উড়ে যাচ্ছে। আহা, আজ কী চমৎকার রাত! সেই মশারির ঝুলে থাকা সাদা দড়ি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে নেমে এল জানলা গলে। এ যেন কোনও ঈশ্বরীর পাঠানো প্যারাসুট যা বহন করতে চাইল কল্পনকে। সেই প্রবল টানে বারোতলা বাড়ির এগারোতলার ফ্ল্যাটের জানালা গলে কম্পনের শরীরটা উঠে গেল নক্ষত্রের নিচে।
কল্পন আড়ষ্ট। তার চারপাশে কী নীল! নীলগুলো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে এখন। যেন অজস্র নীলগাই তেড়ে এসে ছুঁস দিয়ে বলের মতো গড়িয়ে দিল তাকে। মশারির খুঁট আঁকড়ে ধরে বাঁচার উপায় নেই। এই নীলের অত্যাচার প্রবল হওয়ায় নিশ্বাস নিতে মশারির খুঁট ছেড়ে দিল। মৃত প্রজাপতির পর তার শরীর নীল ছেড়ে নেমে এল সাঁই-সাঁই করে।
ঘাসের ওপর দিয়ে ভেসে যায় সবুজ বাতাস। অথবা সবুজ বুঝি ঘাস। সেই সবুজে পতিত হয়ে কল্পন নিশ্বাস নিল। তারপর উঠে দাঁড়াল সে। মাথার ওপর রাতের নক্ষত্ররা উধাও। মেঘ নেই, এমনকী সেই মহানীল চোখে পড়ছে না। উলটে থাকা চড়াই-এর চুড়োয় অজস্র সবুজে সে দাঁড়িয়ে আছে একা। কয়েক পা হাঁটতেই অতল খাদ। খাদের নিচে অজস্র মানুষ, মানুষের দু:খ, মানুষের ক্লান্তি ও অধ:পতনের সীমা। তাদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া যার মধ্যে পুঁটি। মাছের মতো ছটফট করছে ঈর্ষা, অহঙ্কার, স্বার্থপরতা। এইসব মানুষের ভিড়ে খুঁজতে-খুঁজতে সে প্রথমেই বাবাকে দেখতে পেল। মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মাকে লুকিয়ে বাবা তার নখগুলো। দস্তানায় ঢেকে রাখছে। সামনে দাঁড়িয়ে মা মিউজিক চ্যানেলের শাকচুন্নির পোজ দিচ্ছে পৃথুলা শরীরে। সে চিৎকার করল, তোমরা শুনতে পাচ্ছ? ওদের ভঙ্গির কোনও পরিবর্তন হল না। শুধু ধোঁয়াগুলো পাক খাচ্ছিল।
কল্পন সরে এল। এই সবুজ, নিথর সবুজের দিকে পৃথিবীর শেষ রাজকুমারের মতো হেঁটে এল অনেকটা। এই সময় কেউ কথা বলল। কী কথা? কল্পনের মনে হল কেউ বলল, তোমাকে চাই। সে চারপাশে তাকাল। তৎক্ষণাৎ ওই সবুজের একপ্রান্তে সন্ধ্যা, আর সেই সন্ধ্যার আধারে ভিজে। একটি অবয়ব চুপচাপ দাঁড়িয়ে, ঠিক শিরীষের ডালের নিচে। হলুদ ফালি চাঁদ এসে আটকে গেল শিরীষের ডালে। অথচ যেখানে কম্পন দাঁড়িয়ে সেই সবুজ আলোর প্রসন্নতা ছড়িয়ে সে এগিয়ে। গেল। অবয়ব স্পষ্ট হচ্ছিল। কল্পন দেখল, দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা। যে পাখির ডানায় বল নেই, জরা তাকে শেষ ঘণ্টা শোনাবে বলে তৈরি, ঘাসের ওপর বসা সেই পাখির রং ছড়িয়েছে কী ওই শরীরে? চোখ তুলল কল্পন। এ কী! কড়ির মতো সাদা মুখ তার, দুইখানা হাত তার। হিম। চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে। এ কেমন নারী? পৃথিবীর উপপাসি। রাজকন্যাদের মৃত ইচ্ছাগুলো একত্রিত হয়েছে ওই শরীরে। কল্পন ছিটকে সরে এল আলোয়। দ্রুত ছুটে গেল অন্য প্রান্তে যেখানে শেষ রোদ এখন মাঠের কোলে খেলা করে নেবে। চারপাশের সবুজে সান্ত্বনার হাত বাড়িয়ে দিল বাতাস। ঘুঘুদের শেষ ডাক, ঝাউফুল ছড়ানো ঘাসে শালিকের শেষ লীলা, লাল বটফল নেমে যায় জলে, চরাচর জুড়ে নিস্তব্ধ শান্তি। এই সময় তাকে দেখতে পেল কল্পন। সূর্য তার শেষ রশ্মি জড়িয়ে তাকে পাঠিয়ে দিল পৃথিবীর পথে। উশখুশ খোঁপা থেকে পায়ের নখটি এই শেষ বিকেলের বাতাসে যেন বড় সচেতন। এই পৃথিবীর রোদ, রাত্রির ঘ্রাণ, নক্ষত্রের শিশির তার শরীরে মুখ ডুবিয়েছে। সে যখন কাছে এল তখন জলের, সহজ জলের আভা স্পর্শ করল কল্পনকে। সে চোখ তুলে কল্পনকে দেখল। কম্পনের মনে হল, কতদিন অপেক্ষার পরে/আকাশের থেকে আজ শান্তি ঝরে–অবসাদ নেই আর শূন্যের ভিতরে। নারী কল্পনের এক হাত তুলে নিয়ে নিজের গালে রাখল, বলল, রোগা হয়ে গেছ এত চাপা পড়ে গেছে যে হারিয়ে পৃথিবীর ভিড়ে তুমি! এতদিন কোথায় ছিলে? কেন চাওনি, ভাবোনি, দ্যাখোনি আমাকে?
কল্পনের ঠোঁট কাঁপল। যেভাবে নীড়ের কোণে ছানা-পাখি মাতৃমুখ থেকে খাদ্যকণা সংগ্রহ করে সেইভাবে বলল সে, তোমাকে দেখার মতো মন ছিল না।
সে হাসল। তারপর বলল, এখন আছে?
কল্পন বলল, তোমার আলোয় আলো হলাম, তোমার জলে জল।
সে বলল, তোমার হৃদয় জেগেছে। এ-জীবন পদ্মপাতায় জল। পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল। জল ঝরে যায় যাক। অনন্তকাল থাকবে যে আশ্বাস তাই আমাদের প্রেম। এসো হাঁটি, পাশাপাশি, ছায়াদের এক করে।
ওরা হাঁটছিল। কম্পনের মনে পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, কবিতা কী?
কী জানি! নারী মাথা নাড়ল।
তুমি ভুল বুঝলে নিশ্বাস ভারী হয়। এ কী কবিতা?
পুবে সূর্য ওঠে, পশ্চিমে যেতে সে বাধ্য। যে মুকুল কাল ফুল হবে সে আজ ফুল নয়। শৈশব না থাকলে যৌবন আসে না কিন্তু শৈশবই যৌবন নয়। এই লাইন সেই পুর্ব সূর্যের মতো, মুকুলের মতো শৈশবের মতো। নিশ্বাস ভারী হয় মাত্র, ভারী হতে-হতে নিশ্বাসে যে কাতরতা তা এখনও বহুদূর। নিম-আমলকী পাতার ঘ্রাণমাখা বাতাসে চুল উড়ে-উড়ে খেলছিল কপালে, দ্রোণ ফুল লেগে আছে তার মেরুন-শাড়িতে। চারপাশের সবুজ গাছগাছালি, পাখি, ফুল যদি প্রকৃতি তাহলে এই নারী দ্বিতীয় প্রকৃতি।
কল্পন কথা বলল না আর, নারীও। তারপর তার সন্ধের কিনারায় এসে দাঁড়াল। নারী জিজ্ঞাসা করল, সরল সত্যি জানে?
না?
একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিল তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিল দশজন মূর্থের বিক্ষোভে। কেন?
জানি না।
সন্ধান করো। দ্যাখো না, এ-জীবনে জানতে পারো কিনা। এই বলে সেই নারী চলে গেল। সাদা ছিট কালো পায়রার ওড়াওড়ি জ্যোৎস্না গায়ে মেখে মায়াবী আলোয় অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙল কল্পনের। পৃথিবীর সবকিছু ঠিকঠাক। এই এগারোতলার ফ্ল্যাট, এই মশারি এবং রাতের আকাশ। কিন্তু এক মহাশূন্যতা বুকের ভেতরে। বৈশাখের মধ্য সাহারার বালিকণা পাক খেয়ে মরে সেখানে। এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ভালোবেসেছিল তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিল দশজন মূর্খের বিক্ষোভে? কেন? করুণ শঙ্খের মতো এই প্রশ্ন বেজে যাবে অনন্তকাল। এই রাত, জীবনের প্রথম এমন রাত, যা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে সারাজীবনের অনেক অজস্র রাতকে নিঃস্ব করে দিল। কল্পন অলোস আঙুলে বইটি খুলল, এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।