তড়িৎ গতি পর্যটক
ভার্জিনিয়ার উইলিয়ামসবার্গ থেকে সদ্য ফিরলাম আর আমার প্রিয় টাইপরাইটার ও ওয়ার্ড প্রসেসরে বসতে পেরে স্বস্তি, তবু তাতে সূক্ষ্ম ক্ষোভের অবশেষ মিশ্রিত ছিল।
জর্জ এই বাস্তবতা স্বীকার করে না। সে মাত্র রেস্তোরাঁর নৈবেদ্য গোগ্রাসে গিলছে আমারই কষ্টে উপার্জিত অর্থে। আমাকে সহানুভূতি প্রদর্শনের যা এক সঙ্গত কারণ।
দুটো দাঁতের মধ্যে থেকে একটা মাংসের টুকরো বার করে জর্জ বলল,
‘সত্যিই বুঝতে পারি না বন্ধু, তথাকথিত অভিজাত সংস্থা, তোমার একঘণ্টা বক্তৃতার জন্য হাজার ডলার দিতে ইচ্ছুক থাকবে, তাতে দোষ দেখ কেন? আমি ভাবি আরো ভাল হতো যদি তুমি বিনা পারিশ্রমিকে বক্তৃতা দিতে আর হাজার ডলার না দেওয়া পর্যন্ত থামতে চাইতে না।
নিশ্চয়ই শেষেরটা লোকের কাছ থেকে অর্থ শোষণের আরো ভাল পন্থা। যদিও তোমার মনে আঘাত দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই, অবশ্য ধরে নিচ্ছি, তোমার মন আছে।
‘কখন তুমি আমাকে বলতে শুনেছ?’ আমি বলি, ‘তোমার বোঝার মতন অনর্গল বকবকানির ফাঁকে ফাঁকে তুমি আমাকে দুই ডজন শব্দের বেশি এক সাথে বলবার অনুমতি দাও না কখনো, ঠিক বলছি কি না? (স্বভাবতই আমি সতর্ক, যুক্তি খাটাতে ঠিক চব্বিশটা শব্দই ব্যবহার করেছি)
জর্জ আমাকে অবজ্ঞা করল, আমি নিশ্চিত ছিলাম, এমনটাই করবে সে।
‘এটা তোমার আত্মার একটা বিশেষ অপ্রিয় দিক,’ সে বলল, ‘যাকে জঞ্জাল বলতে হয়, সেই অর্থের উন্মাদ আকাঙ্ক্ষায়, ভ্রমণকে ঘৃণা করলেও তোমার সহজে ও প্রায়ই পর্যটকের কষ্ট সহ্য করতে সম্মত হওয়া উচিত।’
এটা আমাকে সোফোক্লেস মস্কোউইটজ এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সতত বিপুল ব্যাংক ব্যালান্স আরো স্ফীত হয়ে ওঠা ছাড়া, আরো, নিজের আরামকেদারা ছেড়ে নড়ে বসতে অনুরূপ অলস অনীহা ছিল তার। এই বিতৃষ্ণাকে সে নরম করে বলত, ভ্রমণ বিমুখতা। এটির পরিবর্তনের জন্যই আজাজেলের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল।
‘তোমার ঐ দুই সে.মি. লম্বা সর্বনাশা জিনকে আমার পিছনে লাগিও না।’ আমি সতর্ক হয়ে বলি, ‘জর্জের অসুস্থ কল্পনার উচ্চারণের প্রকৃতই অস্তিত্ব রয়েছে, এমন চিন্তা করার সঙ্গত কারণ থাকলে, যতটা সতর্ক হওয়া উচিত, আমার সাবধান বাণী ও ততটাই সত্যি ছিল।
জর্জ আবার আমাকে উপেক্ষা করল।
‘এটা আসলে’ (জর্জ বলল), সাহয্যের জন্য যখন আজাজেকে ডাকি, সেই প্রথম দিককার ব্যাপার। বুঝলে, প্রায় ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখন সদ্য সদ্য শিখেছি, কিভাবে আজাজেল্কে তার নিজের জগৎ থেকে ডেকে আনতে হবে, তখনো বুঝতে শিখিনি, তার ক্ষমতা কতটা।
সে ঐ সম্পর্কে গর্ব করত, নিশ্চিত হতে, কোথায় সেই প্রাণী খুঁজবো আমি ছাড়া, যে সর্বদাই নিজের ক্ষমতা ও সামর্থ্যের কথা অতিরঞ্জিত না করে।
সে সময়ে ফিফি নামে এক চমৎকার তরুণীর সঙ্গে আমার যথেষ্ট আলাপ পরিচয় ছিল। বছরখানেক পূর্বে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এক বিশাল সৌভাগ্য তার জন্য, যে ধরনের পতি নির্বাচন করে রেখেছে, সোফোক্লেস মস্কোউইজ্ তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
বিবাহের পরও সে আমার গোপন বান্ধবী ছিল, কিন্তু অবশ্যই ধর্মত। তার ধর্মপরায়ণতা ছাড়াও সব সময়ে তাকে দেখে আমার আনন্দ হতো। যতই হোক তুমি বুঝবে, তার সৌষ্ঠব ছিল এমনই, যা বাড়িয়ে বলা যায় না। তার উপস্থিতিতে আমার সব সময়েই সহর্ষে মনে পড়ত, অতীতে আমরা দুজনে যে চমৎকার অশালীনতা একত্রে উপভোগ করেছিলাম।
তার মঞ্চের নাম ধরে ডাকার অভ্যাস আমার যায়নি। যে নাম সম্ভ্রান্ত দর্শকরা, তার চমৎকার অভিনয় দেখে দিয়েছিল।
বললাম, ‘ব্যুম্ ব্যুম্। তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। একথা বলতে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। আমি তেমনই ছিলাম।
‘ওঃ আচ্ছা!’ ফিফি এমন উদাস স্বরে বলল। আমার নির্লজ্জ জাঁকজমকপূর্ণ নিউইয়র্কের রাস্তার কথা মনে হলো।
‘জানো, আমি ভাল নেই।’
আমি এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে পারলাম না। কারণ যদি স্মৃতিশক্তির ওপর আমার বিশ্বাস থাকে, প্রকৃতই বয়ঃসন্ধিকালের শুরু থেকেই সে সত্যিই খুব ভাল থাকত।
কিন্তু বললাম, ‘তুমি তো স্বভাবতই ভাল থাক সোনা। অসুবিধে কিসের!’
‘এই হচ্ছে সোফোক্লেস, সেই ক্লীব!’
‘তুমি নিশ্চয়ই স্বামীর প্রতি বিরক্ত নও, ব্যুম্ ব্যুম্। এমন একজন ধনী ব্যক্তির ওপর বিরক্ত হওয়া তো অসম্ভব।
‘সে তো তুমি জান। কী সাংঘাতিক প্রতারক। তোমার মনে আছে, বলেছিলে সোফোক্লেস ক্রোয়েসাস নামক ব্যক্তির মতন ধনী। তার নাম আমি কখনো শুনিনি। আচ্ছা, তুমি কেন কখনো বলনি, এই ক্রোয়েসাস নামের ভদ্রলোক একজন শ্রেষ্ঠ কৃপণ। ‘
‘সোফোক্লেস, কৃপণ?’
‘সর্বশ্রেষ্ঠ! তুমি কি তাকে হারাতে পার? একজন ধনী ব্যক্তিকে বিয়ে করার মানে কি, যদি সে এমন কৃপণ হয়?’
‘নিশ্চয়ই ব্যুম্ ব্যুম্। রাতের স্বর্গের ছলনাময় শপথে তুমি তো কিছু টাকা ফুলিয়ে বর করে নিতেই পার।
ফিফির কপাল কুঁচকালো একটু।
‘আমি ঠিক জানি না, তার মানে কি। কিন্তু আমি তোমাকে জানি। অশ্লীল কথা বলো না। তাছাড়া আমি তার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, যদিও সে তা বোঝেইনি। তুমি যা বললে, সে যদি দিলখোলা না হয়, সে যদি আমার থেকে তার ওয়ালেটকেই বেশি আঁকড়িয়ে থাকে; যদি এটা ভাব, তবে সেটা সাংঘাতিক অপমানজনক।’
বেচারি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কম সময়ে আমি যেমন সামলিয়ে নিতে পারি, তেমনই, অভ্রাতৃসুলভ ভঙ্গিতে তার হাতে চাপ দিলাম।
আবেগে সে ভেঙে পড়ল, ‘নিষ্কর্মাটাকে যখন বিয়ে করেছিলাম, ভেবেছিলাম।’- ‘আচ্ছা ফিফি, কোণায় যেতে চাও, প্যারিস, রিভেরা, আর বোয়েন্স এয়ারস এবং কাসাব্লাঙ্কা আরো সে রকমই।’
‘আঃ, কোনো সম্ভাবনাই নেই!’
‘বলো না যে, কুত্তাটা তোমাকে প্যারিসে নিয়ে যাবে না।’
‘সে কোথাও যায় না। সে বলে, সে ম্যানহাট্টান ছাড়তে চায় না। সে বাইরে বা হতে চায় না। সে গাছপালা, জন্তু-জানোয়ার, ঘাস জঙ্গল, বিদেশী অন্য কোলে জায়গার বাড়িঘর পছন্দ করে না। ভালোবাসে শুধু নিউইয়র্কের বাড়িঘর।’
আমি বলি, ‘কেনাকাটা করতে শপিং মল?’
‘না, তাও তার পছন্দ নয়।’
‘ব্যুম ব্যুম। ওকে ছাড়াই চলে যাও না কেন?’
‘তুমি বলতে পার, ওকে ছাড়া মজা বেশিই হবে। কিন্তু কি নিয়ে? লোকটার সব ক্রেডিট কার্ড, প্যান্টের ভিতরের পকেটে সেলাই করা। আমাকে দোকান বাজার করতে হয় রিটেল শপ, ‘মেস্’ি-তে। তার কন্ঠস্বর চিৎকারে পৌঁছাল, ‘মেসি’তে বাজার করার জন্য আমি ঐ আপদটাকে বিয়ে করিনি।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুন্দরী তরুণীর সর্বাঙ্গে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি চালিয়ে অনুতাপ হল, কেন ওর ভার নিতে পারিনি। বিয়ের আগে সে মাঝেমধ্যেই শিল্পকলার খাতিরে দানধ্যানের ইচ্ছা প্রকাশ করত। কিন্তু আমার একটা ধারণা হয়েছিল, বিবাহিতা মহিলা হিসেবে তার উন্নতমানের প্রতিষ্ঠা, এ বিষয়ে তার মতবাদকে কঠিন করে তুলেছে।
সে সময়ে, তুমি নিশ্চয় বুঝবে, আমার এখনকার জীবনের চেয়ে অনেক বেশি উদ্দীপক দিন কাটাতাম, কিন্তু তখন তো আবার এখনকার বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ধারণা ছিল না। আমি বললাম, ‘ধরে নাও, ভ্রমণের ইচ্ছা জাগাতে, আমি যদি তার সঙ্গে কথা বলি।’
‘ওঃ, সোনা, সত্যিই চাই, যদি তা কেউ পারত!’
‘ধরে নাও, আমি পারলাম। তাহলে, তুমি কৃতজ্ঞ থাকবে।’
অতীত স্মৃতিচারণায় তার চোখ আমার প্রতি নিবদ্ধ হল।
‘জর্জ,’ সে বলল, ‘যেদিন ও বলবে, আমাকে নিয়ে প্যারিস যাচ্ছে, তুমি আর আমি অ্যাসবেরী পার্কে যাচ্ছি। মনে আছে অ্যাসবেরী পার্ক?
নিউজার্সির সমুদ্র সৈকতের সেই রিসর্ট, আমার মনে আছে কিনা? আমি কি আমার পেশীর ব্যথা ভুলতে পারি? প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তারপর দুদিন যাবৎ আমি নাড়াতে পারিনি।
.
সুরাসমেত আজাজেলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম, আমার জন্য বড় পেয়ালা, তার জন্য এক ফোঁটা। আজাজেল্ পানীয়টিকে প্রফুল্লকর ও উত্তেজক মনে করল।
সতর্কভাবে তাকে বললাম, ‘আজাজেল্, তোমার ঐসব যাদুশক্তি কি সত্যিই কিছু করতে পারে, যাতে আমি চমৎকৃত হই?’
তরল নেশায় সে আমার দিকে তাকাল ‘শুধু আমাকে বল, কী চাও! শুধু বল, তুমি কী চাও! আমি তোমাকে দেখাব, অপদার্থ হয়ে গেছি কী না, আমি তোমাকে সব দেখাব।
মুহূর্তের জন্য আসবাব্ পালিশের লেবুর গন্ধে সে হতচেতন হচ্ছিল (চাকলা ওঠা পালিসের গন্ধ তার কাছে খুব আকর্ষণীয় আশ্চর্যজনক মনে হল)।
সে বলেছিল, একবার নিজের জগতে সে ঐ ভাবেই অপমানিত হয়েছিল।
আমি তাকে আরেক ফোঁটা বিয়ার দিয়ে, বেখেয়ালে বললাম, ‘আমার এক বন্ধু রয়েছে, যে একেবারে বেড়াতে যেতে চায় না। তোমার মতন প্ৰগতিশীল দক্ষ ব্যক্তির পক্ষে তার এই ভ্রমণে অরুচিকে, পরম ভ্রমণ জ্বরে রূপান্তরিত করাটা কিছুই নয়।’
স্বীকার করতেই হবে, তার কিছুটা আগ্রহ তখনই উবে গেল।
‘আমি যা বলতে চাইছি,’ বাঁশির মতন আওয়াজে ও অদ্ভুত উচ্চারণের কায়দায় সে বলল, ‘যুক্তিপূর্ণ কিছু বল, যেমন আমার ইচ্ছাশক্তির জোরে দেওয়ালের কুৎসিত ছবিটা সোজা হয়ে ঝুলুক।’
বলামাত্রই, ছবিটা অন্যদিকে বিশ্রীভাবে ঝুলে পড়ল।
‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন ওভাবে ছবিটা আমি সোজা ঝোলাব?’ আমি বলি, ‘সঠিক কৌণিক ভঙ্গিতে ওটা ঝোলাতে গেলে, এখন আমাকে কত বেগ পেতে হবে!’
‘আমি যা চাই, তা হচ্ছে তুমি সোফোক্লেসকে ভ্রমণ বাতিকগ্রস্ত হতে অনুপ্রাণিত করবে, দরকার পড়লে পত্নী ছাড়াই!’
এটা আমি যোগ করে দিয়েছিলাম, কেন না মনে হয়েছিল, তা হলে ফিফি শহরে রয়েছে আর সোফোেক্লস শহরের বাইরে, এমন সুবিধা পাওয়া যাবে।
আজাজেল্ বলল, ‘ওটা সহজ নয়। ভ্রমণের প্রতি বদ্ধমূল বিতৃষ্ণা শিশুকালে নানান বিরূপ অভিজ্ঞতার কারণে, মস্তিষ্ককে পীড়িত করে। এর জন্য চাই সর্বোৎকৃষ্ট মানসিক যন্ত্রবিজ্ঞান। কেননা, এটা করা যাবে না, যেহেতু তোমাদের লোকজনদের স্থূলচিত্ত সহজে নষ্ট করা যায় না, তবে আমাকে সেই ব্যক্তিটির প্রতি নির্দিষ্ট করে দাও, যাতে তার মন বিশ্লেষণ করে অনুশীলন করতে পারি।’
সেটা খুব সহজই ছিল। পুরাতন কলেজের সহপাঠী হিসেবে। ফিফি, আমাকে নৈশভোজনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। (কয়েক বছর আগে সে কলেজ ক্যাম্পাসে কিছুদিন কাটিয়েছিল। যদিও আমি মনে করি না, সে ক্লাস করত। সে পাঠক্রম বহির্ভূত ক্রিয়াকর্মে মগ্ন থাকত) আজাজেকে পকেটে করে নিয়ে এলাম। মাঝে মাঝে তার চিঁ চিঁ শুনছিলাম, সে চুপিসারে বিস্তারিত অঙ্কের অনুশীলন করছিল।
ধরেই নিয়েছিলাম, সোফোক্লেস মস্কোউইটজ-এর চিত্ত অনুশীলন করছে সে। তাই যদি হয়, তবে মনে ছাপ ফেলার মতন কৃতিত্ব, কারণ সোফোক্লেসের মন এতটা প্রশস্ত ছিল না, যা বিশেষ বিশ্লেষণের দাবি রাখে, এ সত্য বুঝতে, আমাকে বেশিক্ষণ কথাবার্তা চালাতে হয়নি। বাড়ি ফিরে, আজাজেল্কে বললাম, ‘তাহলে?’
তার আঁশওয়ালা ছোট্ট হাত দুলিয়ে সে বলল, ‘আমি এটা করতে পারি। তোমার কি হাতের কাছে একটা ‘বিবিধমুখী মনোগতিশীল স্নায়ুসন্নিধিকার’ রয়েছে?’
‘না হাতের কাছে নেই।’ আমি বললাম, ‘আমি গতকাল এক বন্ধুর কাছে ফেলে এসেছি, সে অস্ট্রেলিয়া রওনা হচ্ছিল।’
‘যত নির্বোধের মতন কাজ তোমার’।
আজাজেল্ বলল, ‘তার মানে এখন আমায় টেবিলক্লথ হিসেব দিয়ে কাজ সারতে হবে।’
কথা সাফল্যের সঙ্গে শেষ হওয়ার পরও তাকে কলহপ্রিয় দেখাচ্ছিল (যা সে সচরাচর করে) ‘এটা প্রায় অসম্ভবই ছিল,’ সে বলল, ‘আমার মতন উৎকৃষ্ট স্তরের লোকই এটা করতে পারত আর বড় বড় শস্যমঞ্জুরীসহ ওর মনকে আমার বর্তমান নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় নিবিষ্ট করতে হল।’
আমি ধরে নিলাম, সে রূপক ব্যবহার করে বলছে, আর সে কথা বললামও।
তাতে আজাজেল্ বলল, ‘বেশ, এটা বড় বড় শস্যমঞ্জরী হতেই পারত। এর থেকে কেউ ওর মনকে নাড়াতে পারবে না। এবার সে এমন অদম্য দৃঢ়তার সঙ্গে ভ্রমণে যেতে চলেছে যে, সে প্রায় পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবে, আর ভ্রমণ সম্ভব করতে সেটাই চাই। সেটাই দেখাবে- ‘
সে কর্কশ উচ্চনাদবিশিষ্ট শব্দের দীর্ঘমালা তৈরি করে ফেটে পড়ল, নিজের ভাষায়। আজাজেল্ কী বলল, অবশ্যই আমি বুঝলাম না। কিন্তু সুস্পষ্ট ঘটনা হল, পাশের ঘরে ফ্রিজে বরফের কিউব সব গলে গেল, যদিও আজাজেল্ বলেছিল, সেটার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সন্দেহ হয়, তার নিজের জগতের যারা তার চাতুর্যের অভাবের অভিযোগ জানিয়েছিল, সে তাদের ওপর নিন্দাবর্ষণ করছিল।
এর তিনদিন বাদেই, ফিফি ফোন করল (সে ফোনে ততটা সক্রিয় নয়, যতটা সাক্ষাতে। কারণ খুব স্পষ্ট। যদিও হয়তো তুমি বুঝবে না, কারণ তোমার সহজাত অক্ষমতায় তুমি জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো থেকে রসগ্রহণ করতে পার না।
তার কণ্ঠস্বরে সামান্য কাঠিন্য সম্পর্কে একজন সচেতন হতে পারে, যদি সুষমতা বজায় রাখতে, তাকে অন্য কোথাও নম্রতার কথা স্মরণ করিয়ে না দেওয়া হয়।
‘জর্জ,’ ফিফি বক্ করে উঠল, ‘তুমি তো ম্যাজিক! জানি না, সেদিন ডিনারে তুমি কি করেছিলে, কিন্তু কাজ হয়েছে। সোফোক্লেস আমাকে নিয়ে প্যারিস যাচ্ছে। আর, এ বিষয়ে সে ভীষণ উত্তেজিত। বল, দারুণ খবর নয়!’
‘দারুণ! দারুণ খবর,’ বললাম স্বাভাবিক উৎসাহে, ‘এতো পৃথিবী কাঁপানো। আমার কাছে যে ছোট্ট শপথ করেছ, এবার আমরা তা ভাবতে পারি। অ্যাসবেরী পার্কের পুনরাবৃত্তি হতে পারে, আমরা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিতে পারি।’
স্ত্রীলোকেরা যতই হোক, তুমি নিজেও লক্ষ্য করে থাকবে, পবিত্র চুক্তি সম্পর্কে আবেগের অভাব থাকে। তারা এ ব্যাপারে পুরুষদের থেকে একদম আলাদা। কথা রাখার প্রয়োজনীয়তার কোনো ধারাই নেই, না আছে ব্যক্তিবিশেষের মর্যাদার প্রতি অনুভূতি।
সে বলল, ‘আমরা কালই রওনা হচ্ছি জর্জ। কাজেই এখন তো সময় হবে না। ফিরে এসে তোমায় ফোন করবো,’ বলেই ফোন রেখে দিল এবং তারপর ব্যস্। .
তারপর তার যে খবর পেলাম, তার ফেরার পর সে ছয়মাস হয়ে গেছে। সে আমাকে আবার ফোন করল, প্রথমে তার গলার স্বর আমি চিনতে পারিনি। কেমন যেন বিভ্রান্ত, শুকিয়ে যাওয়া।
‘কার সঙ্গে কথা বলছি?’ স্বাভাবিক মর্যাদার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করি। সে ক্লান্ত স্বরে জবাব দিল, ‘ফিফি ল্যাভার্ন মস্কোউইট্ট্জ।
‘ব্যুম -ব্যুম!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘চমৎকার। তুমি ফিরে এসেছো! এক্ষুনি চলে এসো, আর আমরা-’
সে বলল, ‘জর্জ, চুলোয় যাক। এই যদি তোমার ম্যাজিক হয়, তুমি একটা সাংঘাতিক জাল জোচ্চোর। পরে যদি তুমি মাথা নিচু করে ঝুলেও থাক, আর আমি তোমার সঙ্গে অ্যাসবেরী পার্কে যাচ্ছি না।’
আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ‘তোমাকে সোফোক্লেস প্যারিস নিয়ে যায়নি?’
‘হ্যাঁ, নিয়ে গিয়েছিল। এবার জিজ্ঞাসা কর, আমি মনের মতন কেনাকাটা করেছি কিনা!’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কেনাকাটি হয়েছিল?’
‘সে এক মজা! আমি শুরু করতেই পারিনি। সোফোক্লেস কোথাও থামেনি।’ তার স্বর ক্লান্তিতে মিলিয়ে গেল। আর আবেগের তাড়নায় ফোঁপানিতে পরিণত হল।
‘আমরা প্যারিসে পৌঁছে যেতেই থাকলাম। আমরা দুরন্ত গতিতে চলেছি, আর সে বাইরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে করতে চলেছে। একটা ভাঙাচোরা বাড়ি তখনো তৈরি হচ্ছে, সেটা দেখিয়ে বলল, এটা হচ্ছে আইফেল টাওয়ার।’
‘এটা হচ্ছে, নেতারদাম! সে বলল। সে জানেই না, কিসের কথা বলছে।’
দুজন ফুটবল খেলোয়াড় একদা আমাকে নাটকীয়ভাবে নিয়ে গিয়েছিল আর সেটা প্যারিসে নয়, সেটা হচ্ছে, ইন্ডিয়ানার সাউথ বেন্ডে।
‘কিন্তু কে গ্রাহ্য করে? আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট, বার্ন আর ভিয়েনা গেলাম। বোকাটা বলল, ভীন। স্ট্রীট বলে কি কোনো জায়গা আছে!’
‘ট্রিয়েস্টি’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ আছে।’
‘তাহলে আমরা সেখানেও গিয়েছিলাম। আমরা কোনো হোটেলে থামিনি। সব পুরনো ফার্ম হাউসে থেমেছি। সোফোক্লেস বলেছে, বেড়ানোর সেটাই নিয়ম।
সে বলেছে, লোকজন দেখো, প্রকৃতি দেখো। কে লোকজন দেখতে চায়, কিংবা প্রকৃতি। আমরা সাওয়ার দেখিনি, ভাল বাথরুমও নয়। এভাবে চললে গায়ে গন্ধ হয়। আমার চুলে আমি গন্ধ পাচ্ছি। এসে আমি পাঁচবার শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়েছি। তবু সাফ হইনি।’
‘আমার বাড়ি এসে আরো পাঁচটা সাওয়ার নাও,’ আমি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে মিনতি জানালাম, ‘আর আমরা অ্যাসবেরী পার্কেও তা করতে পারি।’
মনে হল, সে আমার কথা শুনতেই পেল না। বুঝতে পারি না, এই সামান্য কারণে, মেয়েরা কেন কালা হয়ে যায়। সে বলল, ‘সোফোক্লেস রওনা হচ্ছে আগামী সপ্তাহে, সে এবার প্রশান্ত মহাসাগর পার হবে। তারপর হংকং যাবে। সে চলেছে এক তৈলবাহী জাহাজে। তার মতে, সমুদ্র দেখার সেটাই পন্থা।’
আমি বলেছি, ‘শোনো, ছিটিয়াল, আমি ঐ ঢিকির ঢিকির নৌকা করে তোমার সঙ্গে চায়না যাচ্ছি না। তোমাকে একাই যেতে হবে।’
‘খুব কাব্যিক!’ আমি বলি।
‘আর জানো, সে কী বলল? সে বলল, ‘বেশ তো সোনা, আমি তোমাকে ছাড়াই চলে যাবো।’ তারপর সে আরো অদ্ভুত কিছু বলছিল, যার কোনো মানেই হয় না।
সে বলেছে, ‘জাহান্নামে যাও বা সিংহাসনেই বসো,
যে একলা ভ্রমণ করে, সে সবচেয়ে দ্রুতগামী।
‘জাহান্নাম আবার কি? কেমন করেই বা ও সিংহাসনে বসবে! ওকি ভেবেছে, ও ইংল্যান্ডের রানী!’
‘ও নিজেকে বিগ্লিঙ্ ভাবছে,’ আমি বলি।
‘পাগলামি করো না। ওসব বুঝলাম না, আমাকে আর বলো না।
সে জনহিতার্থে কদাচিৎ কিছু করবে। আমি বলেছি, আমি তাকে ডিভোর্স করবো, তার ধোলাই করিয়ে ছাড়বো। আর সে বলেছে, ‘নিজে নিজে ঝামেলা করবে তো করগে, গবেট কোথাকার। কিন্তু কোনো কারণ দেখাতে পারবে না, কাজেই কিছুই পাবে না সোনা।’
আমার কাছে এখন ভ্রমণের চেয়ে প্রয়োজনীয় কিছুই নেই। তুমি সেটা নষ্ট করতে চাও? ‘সেই বদমাইসটা ভাব, আমার সঙ্গে আবার মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে চাইছে।’
বন্ধু, তুমি ভুলে গেছ, আমার জন্য এটা আজাজেলের প্রথম দিককার কাজ, আর সে কোনো মাত্রা রাখতে শেখেনি। আর আমি তাকে বলেওছিলাম, সোফোক্লেস যেন মাঝে মাঝে পত্নী ছাড়া ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে, তাতেও সুবিধা ছিল, যা শুরু থেকেই আমার দূরদৃষ্টি বুঝেছিল। ‘ব্যুম-ব্যুম’ আমি বলি, ‘বরং আমরা ডিভোর্স নিয়ে কথা বলি, আর ইতিমধ্যেই অ্যাসবেরী-’
‘আরে তুমি যাচ্ছেতাই, ন্যাক্কারজনক লোক! ম্যাজিক কিংবা যা কিছুই করে থাক, আমার কিছু যায় আসে না। আমার জীবন থেকে দূরে থাক, কারণ আমি একজনকে জানি, তাকে বললেই, সে তোমাকে প্যানকেকের মতন চ্যাপ্টা করে দেবে। সে ম্যাজিক জানে, সব কিছু করতে পারে।’
আমার আশঙ্কা, ব্যুম্-ব্যুম্ চলেই গেছে। উন্নত বক্ষ, যদিও তাকে আমি সেভাবে চাইনি, তবু তার দেহ সৌষ্ঠব আর ভঙ্গিমা আমার পরিচিত থাকায়, প্রত্যাশাও ছিল।
.
আজাজেল্কে ডাকলাম। যদিও সে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে যা করেছে, তাকে ফিরিয়ে নেওয়া তার সাধ্যে ছিল না। আর ব্যুম ব্যুম্ কে আমার সম্বন্ধে আর একটু বিবেচক করার প্রস্তাব। আজাজেল্ সরাসরি নাকচ করল।
সে বলল, সেটা যে কারো পক্ষেই বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে। বুঝি না কেন?
যাই-ই হোক আমার জন্য আজাজেল্ সোফোক্লেসের খবর রেখেছিল। লোকটির বাতিক বেড়েছিল। সে কন্টিনেন্টাল ডিভাইড সাঁতরিয়ে পার হয়েছিল।
নীল নদের ওপরে স্কী করে সরাসরি চলে গিয়েছিল ভিক্টোরিয়া হ্রদে। অ্যান্টার্কটিকা অতিক্রম করেছিল হস্তচালিত গ্লাইডারে চেপে
১৯৬১ তে যখন প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষণা করল, সেই দশকের শেষে চাঁদে পা দেওয়া হচ্ছে, আজাজেল্ বলল, ‘আবার কাজ শুরু করতে, এটা আমারই সৃষ্ট বিন্যাস।’
আমি বলি, ‘তার মানে বলতে চাও, সোফোক্লেসের মস্তিস্কে তুমি প্রেসিডেন্টকেও প্রভাবিত করার ও এই মহাকাশ অভিযানে অংশগ্রহণ করার ক্ষমতা ঢুকিয়ে দিয়েছ?’
‘সে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা করবে না,’ আজাজেল্ বলল, ‘কিন্তু আমি তো বলেইছি, বিন্যাসটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতন শক্তিশালী।’
আর, সোফোক্লেস চাঁদে পাড়ি দিয়েছিল। মনে আছে এপোলো-১৩র কথা? ১৯৭০-এ চাঁদে পাড়ি দেওয়ার পথে, মাঝপথে ভেঙে পড়েছিল। মহাকাশচারী সমেত সেটা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে।
আসলে, সোফোক্লেস, একটা ভাঙা টুকরোয় চেপে চাঁদে পৌঁছে গিয়েছিল, অবশিষ্টাংশ মহাকাশচারীসমেত পৃথিবীতে ফেরত আসে, এটা ছাড়া অন্য ভাল কিছু করা সম্ভবও ছিল না।
সেই থেকে সোফোক্লেস চাঁদেই রয়ে গেছে। বেড়াচ্ছে চন্দ্রপৃষ্ঠে। সেখানে বাতাস নেই, খাবার নেই, জল নেই। কিন্তু তাতে কি! অবিরত ভ্রমণের উপযোগী বিন্যাস ঠিকমতো কাজ করে চলেছে, তার ভালমতন দেখাশোনা করছে। আসলে, আরো কিছু সক্রিয় হয়ে, তাকে হয়তো মঙ্গল গ্রহে বা অন্য কোথাও নিয়ে যাবে।
জর্জ বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল, ‘পরিহাস, অদৃষ্টের পরিহাস!’
‘পরিহাস কেন?’ আমি বলি।
‘দেখতে পাচ্ছ না! বেচারি সোফোক্লেস মস্কোউইটজ ‘ওয়ান্ডারিং জু’-এর নবীন ও উন্নত সংস্করণ আর পরিহাস হল, সে একেবারেই গোঁড়া নয়।’
জর্জ বাঁ হাত দিয়ে চোখ ঢাকল আর ডান হাত দিয়ে ন্যাপকিন খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে দৈবক্রমে সে দশ ডলারের নোটটা তুলে নিল, যেটা আমি বেয়ারাকে বখ্শিশ দেবো বলে টেবিলের ধারে রেখেছিলাম। ন্যাপকিন দিয়ে চোখ মুছল, কিন্তু সেই দশ ডলার নোটের কী হল, জানতে পারলাম না। শূন্য টেবিল রেখে, সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বেরিয়ে গেল।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আরেকটা দশ ডলারের নোট রেখে দিলাম।