ম্যাথস
বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশে চড়ার অঙ্কই হোক, কী চৌবাচ্চার জল ফুরোনোর হিসেবের অঙ্কই হোক, কোনো অঙ্কই আমার ঠিক হত না। এমনকী, সামান্য যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগেরও ভুল হত।
অক্ষয়-স্যার আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাই তো ছিলেনই, ম্যাথস-এ কাঁচা বলে বাবা ওঁকে বাড়িতেও পড়াতে বলেছিলেন আমাকে। টকটকে ফর্সা রং ছিল ওঁর। খোঁচা-খোঁচা কালো গোঁফ। ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতেন। গায়ে একটি এণ্ডির চাদর থাকত। পায়ে পাম্প-শু। টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসে আমার খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে অঙ্কের ফল দেখতে দেখতে ওঁর মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠত। ভুরু কুঁচকে যেত। বলতেন, ই-ইটা কী? কখনোবা গম্ভীর গলায় বলতেন, যেন টেবিল-চেয়ারকেই বলছেন, আর কতবার বলতে হবে তোমাকে যে, সংখ্যাকে না বদলে তা কেটে পাশে পরিষ্কার করে লিখবে?
আমি মুখ নীচু করে থাকতাম। ভীষণ কষ্ট হত বুকের মধ্যে! অক্ষয়-স্যার যখন আমাকে বকতেন, মারতেনও কখনো, তখন আমার অত কষ্ট হত না। কিন্তু ওঁর মুখে যখনই বিচ্ছিরি বিরক্তির ভাব। ফুটে উঠত, সেই মুখে আমি স্পষ্টই পড়তে পারতাম, আমি একটি গাধা। এবং উনি আমাকে নিয়ে রীতিমতোই নাজেহাল। অথচ টিউইশানিরও দরকার নিশ্চয়ই ছিল তখন ওঁর। তাই বলতেও পারতে না বাবাকে যে, আমাকে আর পড়াবেন না। ওঁর একমাত্র ছেলে গোপেনদা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন। ওঁর জন্যে অক্ষয়-স্যারের গর্বের অন্ত ছিল না।
উনি চলে গেলে অনেকক্ষণ এক ঘরে আমি বসে থাকতাম। নিজের উপর বড়োই রাগ হত। অথচ কী করব? অঙ্ক আমার একেবারেই ভালো লাগত না। কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে, গান গাইতে ভালো লাগত। কিন্তু ওইসব তো কোনো গুণের মধ্যে পড়ত না। যে-গুণ ভাঙিয়ে টাকা রোজগার না করা যায়, তা কি আর গুণের মধ্যে পড়ে?
বাবা অফিস থেকে ফিরলেই শব্দ পেতাম। গ্যারাজ ছিল একতলাতেই, আমার পড়ার ঘরের পাশেই। অফিস থেকে ফিরেই বাবা একবার আমার ঘরে ঢুকতেনই। বলতেন, খোকন, কেমন হচ্ছে পড়াশোনা? পরীক্ষা তো এসে গেল। কোনোদিন বলতেন, আমি তো জানিই, তুই স্কলারশিপ পাবিই। তবে স্ট্যান্ড করলে আরও খুশি হব।
বাবাকে আমি ভালোবাসতাম খুবই। কিন্তু আমার সম্বন্ধে বাবার এমন উঁচু ধারণায় কুঁকড়ে যেতাম। আপত্তিও করতে পারতাম না। বলতে পারতাম না যে, আমি হয়তো ফার্স্ট ডিভিশনই পাব না।
নিজের ছুঁড়ে-দেওয়া কথাতে নিজেই খুশি হয়ে দোতলায় উঠে যেতেন বাবা আমাদের ফক্স টেরিয়ার কুকুর ম্যাডাকে আদর করতে-করতে। বাবার গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ পর্যন্ত চিনত ম্যাডা। গাড়ি যখন রাস্তায় এবং আর কেউই যখন বুঝতে পর্যন্ত পারত না, ম্যাডা তখন উত্তেজিত গলায় ডাকতে-ডাকতে দোতলা থেকে তার পায়ের নখে খচর-খচর আওয়াজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে তড়িৎগতিতে নেমে এসে গ্যারেজের সামনে ছুটোছুটি করত। বিহারের মধুবনী জেলার এক রং রুট ড্রাইভার সুরজনারায়ণ ঝা, অতি-উত্তেজিত ম্যাডার একটা পায়ের উপর চাকা তুলে দিয়ে সামনের বাঁ-পাটাকে একবার প্রায় ভেঙেই দিয়েছিল।
বাবা উপরে চলে যাওয়ার পর আরও খারাপ লাগত। অক্ষয়-স্যার পড়ালে গোরু-গাধাও নাকি ফার্স্ট ডিভিশন পায়। আমি অন্য সব বিষয়ে খুব ভালো না হলেও অঙ্কের মতো অতটা খারাপ। ছিলাম না। তাই অঙ্কের দায়িত্ব অক্ষয়-স্যারের হাতে তুলে দিয়ে বাবা নিশ্চিন্ত হয়ে যা খুশি তাই ভাবছিলেন।
বন্ধুদের কাছেও শুনতাম যে, তাদের সকলের বাবাও নাকি ওইরকমই বলতেন। প্রত্যেকের মায়েরাই বলতেন, তোর বাবা কোনোদিন ক্লাসে সেকেন্ড হননি। আর তুই?
আমার বন্ধু প্রণব একদিন দুঃখ করে বলেছিল, ভেবে দ্যাখ, সক্কলের বাবাই যদি ক্লাসে ফার্স্ট হতেন, তা হলে ওঁদের সময়ে ক্লাসে সেকেন্ড হতেন কে বল তো?
প্রীতি বলেছিল, আর ফেলই বা করতেন কারা? আমি তো ভেবেই পাই না।
২.
অক্ষয়-স্যার সপ্তাহে তিনদিন আসতেন। তাঁর বিরক্তি আর আমার হতাশা ও অপরাধবোধ ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। একদিন এক টিপ নস্যি নিয়েই উনি আমাকে বললেন, খারাপ-ভালোর। অনেরকম হয়, বুঝেছ? তোমার মতো ছেলে আমি আর দেখিনি। তোমার বাবা মিছেই তোমার পেছনে পয়সা খরচ করছেন। আমি এবার তোমার বাবাকে বলব। তোমার মতো দু-চারটি ছাত্র পেলেই আমার এতদিনের সুনাম ডুববে। এত সোজা অঙ্ক, তাও তুমি…
আমি মাথা নীচু করেই ছিলাম। অনেক ছেলে বাবা-মায়ের কাছে রিপোর্ট লুকোয়, পাছে তাঁরা মারেন, বকেন। আমি কখনোই লুকোইনি। অক্ষয়-স্যার আমার কথা বাবাকে বলে দিলেও বাবা আমাকে কিছুই বলতেন না, কিন্তু বড়ো দুঃখ পেতেন নিশ্চয়ই। বাবাকে ভালোবাসতাম বলে বাবা দুঃখ পান, তাও চাইতাম না। অথচ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠার অঙ্ক বা চৌবাচ্চার জল ফুরোনোর অঙ্ক কিছুতেই করতে পারতাম না। সেই সময় কোনো রবীন্দ্র সংগীতের কলি কানের পাশে ঘুরঘুর করত। চোখের সামনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক-এর রাজা দোবরুপান্না বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির হুসেন মিঞার মুখ ভেসে উঠত। অ্যালজেবরাও একদম ভালো লাগত না। জিওমেট্রি একটু ভালো লাগত। মনে হত ছবি আঁকছি। কিন্তু থিওরি এলেই মাথা একেবারে গোলমাল হয়ে যেত। আমি পরীক্ষায়। ভালো ফল না করলে যে বাবা আরও দুঃখ পাবেন–এই কথাটা।
ভেবেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসত। বাবার দুঃখ পাবার ভয়ে নিজে আগেভাগেই এত দুঃখ পেতাম যে, তা বলবার নয়। বাবার মস্ত কারখানার ভার তাঁর একমাত্র ছেলে নেবে এই-ই ছিল। বাবার ইচ্ছে।
ভালো ছাত্র ছিলাম না বলেই স্কুলের কোনো মাস্টারমশাই বিশেষ চোখে দেখতেন না আমাকে। যদিও ব্যবহার এবং স্বভাবটা পড়াশুনার তুলনায় একটু ভালো ছিল বলে কেউ খারাপ বলতেন এমনও নয়। আমি জানতাম যে, শিশির অথবা অনিমেষ অথবা অন্য কেউ ছাত্র হিসেবে আমার চেয়ে অনেকই ভালো ছিল। কাটু, বান্টা, এরা সব পড়াশুনোতে শিশিরদের মতো ভালো না হলেও খেলাধুলোর জন্যে আলাদা এক ধরনের সম্মান পেত স্যারদের কাছ থেকে। পুরো স্কুলের। ছেলেরাও তাদের হিরো-জ্ঞানে দেখত। কাটুর তো তখন এতই কদর ফুটবলে যে, চার ফুট দশ ইঞ্চি হাইটের ম্যাচ হলেই এক বিকেলে চার-পাঁচ জায়গায় ওকে ভাড়া করে নিয়ে যেত বিভিন্ন ক্লাব। ওর নিন্দুকেরা বলত, ও নাকি এককাপ চা ও একটা বিস্কুট পেলেই ভাড়ায় খেলে দেয়। কাটু বিকেলের প্রথম খেলতে নেমেই গোটা ছয়েক গোল দিয়ে তাদের এগিয়ে রেখে অন্য সব ম্যাচে গিয়ে পটাপট গোল দিয়ে আবার প্রথম ম্যাচের জায়গায় গিয়ে দেখত, প্রতিপক্ষের। স্ট্রাইকাররা গোল শোধ করে দিয়েছে কি না। যদি ছটার বেশি গোল তারাও দিত, তবে কাটু তক্ষুনি আরও গোটা দু-তিন গোল দিয়ে সেই ম্যাচের ইতি টানত।
প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের দিন শিশির এত বই পেত প্রাইজ হিসেবে যে, একা বয়েই নিয়ে যেতে পারত না। তিন-চারজনের সাহায্য লাগত। স্পোর্টস-এর প্রাইজের দিনও অন্যান্য ছেলেরা কত মেডেল, কাপ সব পেত। জীবনে কি পড়াশুনোতে, কি স্পোর্টসে, কোনোদিন একটিও প্রাইজ। পাইনি। রেজাল্ট বেরোবার দিন, প্রাইজের দিন, বড়ো মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরতাম। এই ভেবে সান্ত্বনা দিতাম নিজেকে যে, আমরাই তো দলে ভারী। যারা প্রাইজ পেল, তারা আর ক-জন? তবুও বড়ো ছোটো, সাধারণ, ভিড়ের মধ্যের একজন বলে মনে হত নিজেকে। কোনো কোনোবার প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের অনুষ্ঠানে গান গাইতে বলা হত আমাকে। সে-গান মা-র-মাই শিখিয়ে দিতেন। গানও কিছু আহামরি গাইতাম না। অমন গান সকলেই গাইতে পারত।
কেবলই ভাবতাম, আমি খারাপ। আমি কোনো কিছুতেই ভালো নই। ফার্স্ট বয়দের মতো লাস্ট বয়দেরও একদা আলাদা পরিচয় থাকে, বৈশিষ্ট্য থাকে। আমার তাও ছিল না। যে বয়সে প্রত্যেকেই ইমপর্ট্যান্ট হতে চায়, সেই বয়সে তখন আন-ইমপর্ট্যান্ট হয়ে থেকে মরমে মরে যেতাম।
আমাদের ক্লাসের লাস্ট বয় ছিল গজু। বয়সে সে আমার চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ বছরের বড়ো ছিল। একই ক্লাসে ছিল পাঁচ বছর। গতবার ফাইনাল পরীক্ষায় বাংলা পরীক্ষার দিনে আমার পাশেই সিট পড়েছিল গজুর। ও ঘাড় নীচু করে আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে গরম নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, বিপ্রকর্ষ কী রে?
গার্ড ছিলেন নরু-স্যার। দুষ্টু ছেলেরা তাঁকে ডাকত ঘাড়-ছোটো নরু-স্যার বলে। গজুর কথাতেই আমার দিকে তাকিয়েছিলেন উনি। ওঁর অভ্যাস ছিল ক্লাসের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি পায়চারি করে বেড়ানো। ক্লাসে পড়াবার সময়ও অমনই করতেন। গার্ড দেওয়ার সময়ও তাই করছিলেন। উনি যেই দূরে চলে গেলেন, গজু ফিসফিস করে বলল, তোর পেট যদি আজ ছুরি দিয়ে না ফাঁসাই, তো আমার নাম গজশোভা রায় নয়।
সেকথা শুনেই আমার পিলে চমকে গেল। গলা শুকিয়ে এল। কানাঘুষোয় আমি শুনেছিলাম যে, গিরিশ পার্কের পাশে ও একটি মরচে-পড়া ছুরি দিয়ে একটি ছেলেকে খুন করেছিল। মরচে-পড়া ছিল বলে ছেলেটাকে বাঁচাতে পারেনি ওর মা-বাবা অনেক চেষ্টা করেও। কিন্তু গজুর বাবা ছিলেন পুলিশের দারোগা। তাই কিছুই হয়নি ওর।
ঘাড়-ছোটো নরু স্যার কথাটা শুনে ফেললেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, গজু, কেন ছেলেমানুষকে ভয় দেখাচ্ছ? বিপ্রকর্ষর মানে জানতে চাও তো আমিই বলে দিচ্ছি। কিন্তু ওই একটি প্রশ্নের উত্তর ঠিক লিখলেই কি তুমি পাশ করে যাবে এবারে?
গজু নরু স্যারকে ধমকে বলল, স্যার, আমি অলরেডি চটে আছি। আমাকে আর চটালে কার পেট যে ফাঁসবে তার ঠিক নেই।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। একটু নস্যি নেবে? বলেই ঘাড়-ছোটো নরু স্যার গজুর কাছে গিয়ে ওকে নস্যি অফার করলেন। গজু রেগুলার নস্যি নিত। স্যারের ডিবে থেকে একটিপ নস্যি নিয়ে কিছুটা আমার নাকে উড়িয়ে একটি নোংরা রুমাল বার করে নাক ঝাড়ল।
সেই মুহূর্তে ভালো ছাত্র শিশির সম্পর্কে যেরকম সম্রম ছিল আমার মনে, খুনি এবং ওঁচা ছাত্র গজু সম্পর্কেও, তার দুর্দান্ত প্রতাপ দেখে, ঠিক সেরকম নয়, তবে অন্য একরকম সম্ভ্রম জাগল। সেই। মুহূর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, জীবনে বিশেষ কেউ হতে হলে খুবই ভালো হতে হবে। এখানে মাঝামাঝিদের কোনো পরিচয় নেই, দামও নেই। খুব ভালো যদি না হওয়া যায়, তাহলে খুব খারাপ, গজুর মতো হওয়াও বোধহয় ভালো। কিছু-না-হয়ে-থাকার চেয়ে তবু কিছু একটা। হওয়া হল। আমাদের বন্ধু রাজেন যেমন কিছু হল সেদিন রাস্টিকেটেড হয়ে। বাবার আলমারি ভেঙে টাকা নিয়ে সে বোম্বে যেতে চেয়েছিল সিনেমায় নামবে বলে। খড়গপুরেই পুলিশ পাকড়াও করে নিয়ে আসে তাকে। বোম্বেও যাওয়া হল না, রাস্টিকেটেডও হল।
৩.
যেদিন স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরোল, সেদিন বাথরুমে গিয়ে খুব কাঁদলাম। আমার চেয়ে বেশি কাঁদলেন। এবং মাকে অপদার্থ ছেলের জন্য কাঁদতে দেখে আমার বুক ফেটে যেতে লাগল।
সন্ধ্যের পর অক্ষয়-স্যার এলেন। আমি পড়ার ঘরেই ছিলাম। ট্যাবুলেটরের কাছ থেকে উনি মার্কস জেনে এসেছিলেন। যেহেতু অঙ্কই পড়াতেন, অঙ্কের মার্কসই শুধু জেনেছিলেন। ওঁর মুখে। আমার প্রতি সেই ঘৃণা, বিতৃষ্ণা আর অধৈর্য চিরদিনই ছিল। সেইসব আবারও তীব্র ঝলকে ফুটে উঠল। পথের ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে যেমন নাকে রুমাল চাপা দেন, তেমন করে আমার খারাপত্বর গন্ধও যেন ওঁর নাকে লেগে ওঁকে ভীষণ পীড়িত করছিল। নস্যি মাখা রুমাল দিয়ে নাক চাপা দিলেন উনি।
মুখটি নীচু করেই রইলাম আমি। এ-মুখ কাউকেই দেখানোর নয়।
অক্ষয়-স্যার বললেন, তুমি আমার লজ্জা। তোমার মতো গোটা-দুই ছেলে যদি আমার লিস্টে থাকে, তবে আমার প্রাইভেট টিউটর হিসেবে যে সুনাম, তা একেবারেই উবে যাবে। তোমার বাবাকে বোলো, অন্য টিউটরের খোঁজ করতে। তুমি পঁয়তাল্লিশ পেয়েছ। বুঝেছ? ইয়েস!
পঁয়তাল্লিশ! আর অ্যাডিশনাল ম্যাথস-এ পেয়েছ পঁচিশ। ছোঃ, ছোঃ। অ্যাডিশনাল ম্যাথস! শখ কত্ত! কী স্পর্ধা! আর শোনো, ফার্স্ট ডিভিশনও জোটেনি কপালে। দশ নম্বর কম আছে।
আমি মুখ নীচু করেই রইলাম।
অক্ষয়-স্যার হঠাৎ একটিপনস্যি নিয়ে উঠে পড়েই বললেন, তোমার বাবাকে কোন মুখে ফেস করব? উনি আসার আগেই আমি উঠছি। বাবাকে বোলো, তোমার ব্রিলিয়ান্ট মার্কসের কথা। ছিঃ, ছিঃ! কী বাবার কী ছেলে! লজ্জা, লজ্জা! তুমি আমার ছেলে হলে…।
হলে যে কী করতেন, সেটা না বলেই এগোলেন। গোপেনদা যে আমার চেয়ে কত ভালো তা আমি জানতামই. ও-কথা ওঁর বলার দরকার ছিল না। চলে যেতে গিয়েই ফিরে দাঁড়িয়ে আবার। বললেন, তোমার বাবা আমাকে যদি কিছু বলেন, তা হলে আমি কিন্তু ওঁকে ভালো করেই শুনিয়ে দেব, গাধা পিটিয়ে ঘোড় নিশ্চয়ই করা যায়, কিন্তু তু-তু-তুমি তো…।
চলে গেলেন উনি।
টেবিল-লাইটটা জ্বলছিল। আমি টেবিলের উপরেই দু-হাতের মধ্যে মাথা পেতে শুয়েছিলাম। একটু পরই হঠাৎ ম্যাডার ঘনঘন চিল্কারে চমকে উঠলাম। শুনতে পেলাম বাবার গাড়িটা গ্যারাজে ঢুকল। ড্রাইভার বাহাদুর জিজ্ঞেস করল বাবাকে, কাল সকালে কখন আসবে? তারপর চাবি দিয়ে সেলাম সাহাব, বলে চলে গেল।
ম্যাডা লাফাতে-লাফাতে বাবার পায়ে-পায়ে আমার ঘরে এসে ঢুকল। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। বাবা আমার মুখের দিকে চেয়েই বুঝলেন। বললেন, কী খোকন? মনটা খারাপ মনে হচ্ছে। হলটা কী?
আজ যে স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরোবে তা বাবা জানতেন। কিন্তু আমি যে স্কলারশিপ পাবই, তা যেন উনি ধরেই নিয়েছিলেন। সামান্য অবাক হয়ে বললেন, কী? ভালো হয়নি ফল?
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কোনোরকমে আমি বললাম, সেকেন্ড ডিভিশান।
বলতে চাইলাম, কিন্তু বলতে পারলাম না যে অঙ্ক আমার কোনোদিন ভালো লাগেনি বাবা। তুমি মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করলে অক্ষয়-স্যারকে রেখে।
ও। বাবা বললেন।
তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকেই বললেন, ম্যাথস কীরকম হল?
ম্যাথস-এ পঁয়তাল্লিশ। আর অ্যাডিশনাল ম্যাথস-এ পঁচিশ। বলেই আমি দু-হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। বাবা আমার কাছে এসে পিঠে হাত রাখলেন।
একটুক্ষণ পর গলা তুলে জগুকে ডাকলেন।
জগু গেট ছেড়ে ভেতরে আসতেই বাবা বললেন, মাকে বল, আমি নিউ মার্কেটে যাচ্ছি। মাটন আনব আর গলদা চিংড়ি। পোলাও রাঁধতে বল। তোরা কী রে? খোকন আজ পাশ করেছে। পরীক্ষায়, তোরা জানিস না? এই নে জগু, তুই এই এক-শোটা টাকা রাখ। আজ খুশির দিন। বলেই বললেন, চল থোকন। জণ্ড, তুই ম্যাডাকে ধর। নইলে ঝামেলা করবে।
বাবা নিজেই গাড়ি বের করলেন গ্যারাজ থেকে। সামনের বাঁ-দিকের দরজা খুলে দিলেন। ওই সিটে মা বসেন। আমি বসে পড়েই দরজা বন্ধ করে দিলাম।
জগুদা গেট খুলে দিল। বাবা গাড়ি চালিয়ে চললেন নিউ মার্কেটের দিকে।
বললেন, এই রে! চিংড়ি মাছ তো তোর মা ভালোবাসেন। তুই তো ভালোবাসিস ভেটকি মাছের ফ্রাই। চল, দেখি। পেয়ে যাব ঠিকই। এখন ফ্রাই পিস করে কাটার লোক পাব কি না সেই হচ্ছে কথা!
আমি চুপ করে ছিলাম। আমার ভীষণ জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু চলন্ত গাড়ির মধ্যে কাঁদলে লোকে কী ভাববে?
পার্ক স্ট্রিটে পড়েই বাবা বললেন, তোর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত আমার। উচিত কেন, চাইছিই ক্ষমা। বুঝলি খোকন!
কী বলছ বাবা? আমি হতভম্ব হয়ে বললাম।
হ্যাঁ, তোর ইনক্লিনেশান ছিল আসলে আর্টসেরই দিকে। প্রথম থেকেই লিটারেচারে তুই তো ভালোই। আসলে লিটারেচার হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষদের সাবজেক্ট। আমরা তো হলাম গিয়ে মিস্তিরি। সে ইঞ্জিনিয়ারই বল, আর ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টই বল। জজ বল, ব্যারিস্টার বল, ডাক্তার বল-যিনি সাহিত্য না পড়েছেন বা পড়েন বা সাহিত্যের খোঁজ না রাখেন, তিনি আসলে অশিক্ষিতই। সাহিত্যই হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের মনের সবচেয়ে বড়ো এক্সপ্রেশান।
একটু থেমে বললেন, এত বড়ো ফ্যাক্টরিটা করেছিলাম। তুই ছাড়া আমার আর তো কেউই নেই। একমাত্র সম্বল তুইই। আজকাল কত সব কথা শুনছি। বিদেশে কমপিউটার ব্যবহার হচ্ছে সব। ব্যাপারেই। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি প্রতিদিন কোথায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষকে, মানে, মেটিরিয়াল ওয়ার্ল্ডে। ভেবেছিলাম, সায়েন্স নিয়ে পড়লে তোর পক্ষে…। যাক গে, মাই লাইফ ইজ মাই লাইফ, অ্যান্ড ইওর লাইফ ইজ ইওরস। তুই যা হতে চাস থোকন, তাই-ই হয়ে ওঠ জীবনে। আমি তোকে আর ভুল পথে চালাব না। আই অ্যাম সরি। রিয়েলি আই অ্যাম।
নিউ মার্কেটের সামনেটা তখন ফাঁকা। আলো প্রায় সব নিবে গেছে। ফুলের দোকানগুলো খোলা আছে শুধু। তাও বাইরের ঝাঁপ নামানো। গ্লোব সিনেমার সামনে একটা বিরাট হোর্ডিং। সিনেমার বিজ্ঞাপন। ছবির নাম, আই উইল ক্রাইটুমরো।
বাবা একটু পরেই মুটের মাথায় বাজার নিয়ে ফিরে এলেন। আমি তাড়াতাড়ি নেমে বাবার হাত থেকে চাবি নিয়ে গাড়ির বুটটা খুললাম। মাল সব রেখে, বাবা মুটেকে পাঁচ টাকা দিলেন।
মানুষটি বলল, ফুটা নেহি সাহাব।
বাবা বললেন, আমার ছেলে আজ পরীক্ষায় পাশ করেছে। কলেজে যাবে। তোমাকে বকশিশ দিলাম।
মানুষটি একটু অবাক হয়ে মাথায় হাত ঠেকাল।
গাড়িটা ময়দানের দিকে নিয়ে চললেন বাবা। ময়দানে পৌঁছে বললেন, পোলাও হতে-হতে। আমরা পৌঁছে যাব, কী বল? তোর মা আছেন, নগেন আছে, জগু আছে, রাঁধতে আর কত সময় লাগবে? চল, একটু পায়চারি করি।
বাবা গাড়িটার পাশেই সামনে-পিছনে হাঁটবেন বলে মনে হল। একটু হেঁটে বললেন, নাঃ, চল, তোর মা ভাববেন। যেতে-যেতেই তোকে একটা গল্প বলব। একটু চুপ করে থেকে বললেন, তুই মেন্ডহেলসনের নাম শুনেছিস?
না তো!
সে কী রে? একটি বই আছে ওঁর জীবনী নিয়ে লেখা, বিয়ন্ড ডিজায়ার। পিয়ের ল্যামুর-এর লেখা। তোকে কিনে দেব। পড়িস। সেদিন তুই মোজার্ট-এর রেকর্ড নিয়ে এসেছিলি সম্বিৎদার বাড়ি থেকে। বিটোভেন শুনিস প্রায়ই, আর মেন্ডহেলসনের নামই শুনিসনি?
শুনিনি। আমি বললাম, নির্লজ্জের মতো। পরীক্ষাতে এত বাজে রেজাল্ট করার কথা বেমালুম
ভুলে গিয়েই। ফেলিক্স। নাম ছিল তাঁর ফেলিক্স মেন্ডহেলসন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের ইউনাইটেড জার্মানির সবচেয়ে বড়ো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সবচেয়ে বড়ো ব্যাঙ্কার ছিলেন ওঁর বাবা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়োলোকদের মধ্যে একজন। ফেলিক্সের বাবার নাম কিন্তু ভুলে গেছি। ফেলিক্সও ছিলেন তোরই মতো, তাঁর বাবার একমাত্র সন্তান। ফেলিক্স খুব আর্টিস্টিক ছিলেন। দারুণ পিয়ানো বাজাতেন। ওঁর ইচ্ছে ছিল যে, উনি কম্পোজার হবেন। পিয়ানোতে নতুন নতুন সুর সৃষ্টি করবেন। সে ব্যবসা। দেখবে না এই কথা শুনে বাবার মাথায় তো আকাশই ভেঙে পড়ল। ছেলেও নাছোড়বান্দা। মায়ের কিন্তু খুবই ইচ্ছে ছিল যে, ছেলে কম্পোজার হোক। আসলে মায়েরা সন্তানদের যতখানি বোঝেন, বাবারা কখনোই ততখানি বোঝেন না। তোর মা-ও কিন্তু উচিত ছিল, তোর আসল ভালোলাগা কোনদিকে, তা আমাকে জানানো। জানালে, তোর মন আজ খারাপ হত না। জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষাতে ফল খারাপ করতিস না।
যাই হোক, ফেলিক্সের মায়ের ইচ্ছে যেরকমই হোক, তাঁর বাবার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য? শেষে বাবা তো ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করার ভয়ও দেখালেন। বললেন, তোমাকে আমার সম্পত্তির এক কণাও দেব না, যদি আমার ব্যবসাতে না আসো। সাবধান!
পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে এসে ট্রাফিক লাইটে গাড়িটা দাঁড়াতে বাবা বললেন, ফেলিক্স কিন্তু শুনলেন না। যে একবার গান-বাজনার জগতের ঐশ্বর্যের স্বাদ পেয়েছে, সাহিত্যের রসের আস্বাদ। পেয়েছে, তার কাছে টাকাপয়সা কী? চলে গেলেন সব ছেড়ে। যা হতে চেয়েছিলেন, তাই-ই হতে। রাজার চেয়েও বড়োলোক বাবার ছেলে, অতি অল্প বয়সেই যক্ষ্মা হয়ে মারা গেলেন।
একটি আন-হিটেড ঘরে। ইউরোপের সব জায়গায় তো হিটিং ছিলও না তখন ঘরে-ঘরে। যক্ষ্মারও চিকিৎসা ছিল না বিশেষ। কিন্তু ওই বয়সেই ফেলিক্স যা করে গেলেন, টাকা রোজগার করে নয়, ক্ষমতা একীভূত করে নয়, কিছু করার মতো করে যে, আজ পৃথিবীর মানুষ যদিও ফেলিক্স মেণ্ডহেলসনের বাবাকে বেমালুম ভুলে গেছে, আর যদি-বা মনেও রেখেছে, তাও। ফেলিক্সের বাবা হিসেবেই। প্রচণ্ড পয়সাওয়ালা মস্ত ব্যবসাদার, দারুণ ক্ষমতাবান তো কত মানুষই আসে যায় এই পৃথিবীতে। কিন্তু তাদের মনে রাখে কে? মনে যদি-বা কেউ রাখেও, . ভালোবেসে মনে রাখে, তাদের মধ্যে খুব কম মানুষকেই মনে রাখে ঘৃণায়। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে, বুঝলি না!
আমি যে কোনো কিছুতেই তত ভালো নই বাবা! আমি যে মাঝামাঝি, মিডিওকার। অসহায়ের মতো বললাম আমি।
বাবা আমার কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাই তো জীবনের একমাত্র পরীক্ষা নয়, খোকন। যতদিন মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়, ততদিন, প্রত্যেকদিনই তাকে অনবরত পরীক্ষায় বসতে হয়। যতই দিন যাবে, ততই এই কথা বুঝতে পারবি। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় যারা ফার্স্ট হয় এবং লাস্টও, তাদের মধ্যে বেশিরভাগকেই কিন্তু জীবনের মঞ্চে খুঁজে পাওয়া যায় না। জীবনের বড়ো-বড়ো পরীক্ষাতেও ওপরে উঠে আসে এই মাঝামাঝিদের ভিড়ের ভেতর থেকেই কেউ-কেউ। যারা ননডেসক্রিপ্ট, জনতা বলি আমরা যাদের। বলেই বললেন, চল, ফিরি এবার।
বাবা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করবার পর আমি বললাম, আমি যে এত খারাপ করলাম, তুমি দুঃখ পাওনি? মা খুব কেঁদেছে।
বাবা হেসে বললেন, তোর মা একটুতেই কাঁদেন। কাঁদলে চোখের মণি উজ্জ্বল হয় কিনা! তাই তোর মা কথায়-কথায় কাঁদেন। যাঁরা সুন্দর মানুষ, তাঁরাও ওরকম অনেক কিছু করেন আরও। সুন্দর হওয়ার জন্যে।
আমার কথার উত্তর দিলে না তুমি বাবা?
আমি? না না, দুঃখ পাইনি। তবে অবাক হয়েছি। রেগে গেছি, সেটা তোর ওপরে নয়, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপরে। তোর মাস্টারমশাই অক্ষয়বাবুর ওপরে। আমার নিজেরও ওপরে। আমার উচিত ছিল, তোকে একটা ভালো ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে ভরতি করে দেওয়া। আমার পক্ষে মোটেই তা অসুবিধের ছিল না। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম যে, আমার দেশের লক্ষ-লক্ষ ছেলে মেয়ে যে শিক্ষার সুযোগ পায়, আমার ছেলেই বা তাদের থেকে বেশি সুযোগ পাবে কেন? ছাড়া বাংলা তো আমাদের মাতৃভাষাই। বেশিরভাগ ইংলিংশ-মিডিয়াম স্কুলেই বাঙালিদের সংস্কৃতি, সাহিত্য, গানবাজনা পরোক্ষে নষ্ট করে দেওয়া হয়। তুইও তেমন হয়ে উঠিস তা আমি চাইনি…চেয়েছিলাম বাঙালি হবি।
আমি আসলে বাজে ছেলে। আমার কিছুই হবে না। স্কুল ফাইনালে যে খারাপ করল, তার কাছে তো জীবনের সব দরজাই বন্ধ। এই পরীক্ষাই তো প্রবেশিকা।
হাঃহাঃ করে হাসলেন বাবা। বললেন, তোর নিজের কাছেও কি বন্ধ? আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা তোতাপাখির শিক্ষা। এখানের অধিকাংশ পণ্ডিতদেরই শিক্ষার গুমোর আছে শুধু, দম্ভ আছে, প্রকৃত শিক্ষা নেই। তা ছাড়া শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে গেছে টাকা রোজগার। টাকা যাতে রোজগার করতে পারে, যেসব লাইনে বেশি টাকা আছে, সেই সব লাইনেই ভিড়। আমি চাই না তুই তেমন শিক্ষিত হোস, চাই না যে তুই টাকার অঙ্কের সঙ্গে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে শিক্ষাকে গুলিয়ে ফেলিস। সত্যিই আমি চাই না। আমাদের দেশে টাকাওয়ালারা কোনোদিন সম্মান পায়নি। পাওয়া উচিতও ছিল না। আজ যে পাচ্ছে, তা এই ফালতু শিক্ষার, ভুল চাহিদার দোষেই। সরস্বতীর সাঁকো বেয়ে লক্ষ্মীর দরজায় পৌঁছোতে চাইছে প্রত্যেকেই। আর লক্ষ্মী যেখানে থাকেন, সরস্বতী সেখান থেকে অভিমানে সরে আসেন। আমি কিছু মনে করিনি রে খোকন। তুই আমার ভারি ভালো ছেলে। জীবনে ভালো হোস। মানুষ হোস। সত্যিকারের শিক্ষিত হোস, ডিগ্রি অনেক নাই-ই-বা পেলি। আমি তো আর চিরদিনই বাঁচব না। তোকে এই আশীর্বাদই করে গেলাম। তা ছাড়া আমি নিজে তো কখনো তেমন মেধাবী ছিলাম না। তোর কাছ থেকে আমার প্রত্যাশাটা অন্যায়। এক জেনারেশানে হয় না। মেধাবী যারা, তাদের মা-বাবা ঠাকুরদা দাদু তাঁরাও বোধহয় মেধাবীই হন।
৪.
কলকাতায় এসেছিলাম পুজোর সময়। পরশু দিল্লি ফিরে যাব। আমার একমাত্র ছেলে খোকা এবার দিল্লি বোর্ডের পরীক্ষা দিল। আমি তো ভালো ছাত্র ছিলাম না। খোকাও পড়াশুনোতে। মাঝামাঝিই হয়েছে। ও অভিনেতা হতে চায়। গ্রুপ-থিয়েটারের দলে ঢুকেছে। টিভি-ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করবার ইচ্ছে আছে। আস্ত পাগল।
অনেকগুলো বছর চলে গেছে। সত্যি অনেকই বছর। আজ মা নেই, বাবাও নেই। দক্ষিণ কলকাতার বাড়িও রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে দিয়েছি আমি। দিল্লিতে থাকি এখন। আজ কুড়ি বছর হয়ে গেল। আমার স্টুডিয়ো করেছি ভাড়া বাড়িতে, দিল্লি বাঙালিপাড়া চিত্তরঞ্জন পার্কে। ছবি। আঁকি, মূর্তি গড়ি। প্রদর্শনী এবং এমনিতে কিছু কিছু বিক্রি হয়। বড়োলোক হতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু বাঙালিরা আমাকে চেনেন। দিল্লির বাঙালিরা তো বটেই, ভারতবর্ষ এবং বিদেশের বাঙালিরাও। তাতে আমার কোনো গর্ব নেই। আনন্দ আছে। পয়সার লোভে সকলেইযা করে চারপাশে, যা চায়ঞ্জ, তাদের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে নিজস্বতাকে এখনও খুইয়ে বসিনি যে, এইটেই আনন্দের। বাবার শিক্ষার অমর্যাদা করিনি আমি। আজকের দিনে এটা সম্ভব হত না, যদি-না শ্রাবণী আমাকে সাপোর্ট করত। স্ত্রীদের উপরে স্বামীদের জীবন, জীবনের গন্তব্য অনেকখানিই নির্ভর করে। বাড়িটার দাম পেয়েছিলাম পাঁচ লাখ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকেই বলেছিল যে, নিজের সংসার চলে না, অত দাগিরিতে কাজ নেই। শ্রাবণী কিন্তু বলেছিল, মা-বাবাই যখন নেই, তখন যা আমাদের স্বোপার্জিত নয়, তা দিয়ে সহজ সুখ চাই না আমি। বড়োলোকের ছেলে হলে খোকাও মানুষ হবে না। অত্যন্ত কষ্টকর হলেও বাংলাসাহিত্য, বাংলা গান, বাংলার যা কিছু ভালো তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রবাসে বসে আমরা এখনও রেখে চলি। এই মাঝামাঝি, মিডিওকার, মধ্যবিত্ত বাঙালিরাই এখনও বাঙালির যা-কিছু ভালো তা প্রাণান্তকর কষ্টেই ধরে রেখেছেন বলে মনে হয় আমার। বিত্তবান বাঙালিদের অধিকাংশই বাঙালিত্বকে অসম্মান করেন, ছোটো চোখে দ্যাখেন।
কলকাতায় এসে এবারে উঠেছি আমার শ্যালকের বাড়িতে। খোকা আর শ্রাবণী কলকাতার পুজো দেখতে চেয়েছিল, তাই। ভাইফোঁটার পরই ফিরে যাব আবার দিল্লিতে।
আমাদের স্কুলের উলটো দিকের পার্কে ছেলেবেলায় কত ফুটবল ক্রিকেট খেলেছি। বন্ধুদের সঙ্গে কত গল্প, মজা। আজ তাই প্রথম বিকেলে একটা মিনিবাস ধরে এসেছি এখানে। একজন কিশোরের চোখে এই পার্কটিকেই কত্ত বড়ো বলে মনে হত। ছোটো ছোটো পায়ে এটি পার হতে হতে মনে করতাম, তেপান্তরের মাঠই পেরোলাম বুঝি! আজ পার্কে ঢুকেই মনে হল, পার্কটি খুবই ছোটো। গাছগুলি উধাও হয়ে গেছে। ভিড়, বড়ো ভিড়। ধুলো। ছেলেবেলার সেই চোখ দুটিও তো হারিয়ে গেছে!
মন যদিও খারাপ হয়ে গেল, তবু ভাবলাম, কয়েক পাক হেঁটেই যাই পার্কের চারপাশের পিচ বাঁধানো রাস্তায়।
আধ পাক যেতেই মনে হল যেন একটা বেঞ্চে লাঠি হাতে অক্ষয়-স্যার বসে আছেন। ঠিক। দেখলাম কি? তাঁর সামনে দিয়েই চলে গেলাম। ঠিকই চিনেছি। অক্ষয়-স্যারই। গোঁফ-চুল সব পেকে সাদা হয়ে গেছে। মাথায় বাঁদুরে-টুপি, হাতে লাঠি। মুখে পৃথিবীর সব বিতৃষ্ণা, কষ্ট। খারাপ-ছাত্র পড়ানোর কষ্ট নয়, বার্ধক্যের জরার কষ্ট। গায়ে একটি নস্যিরঙা ছেড়া আলোয়ান। আমাকে চিনতেও পারলেন না। না পারারই কথা। আমার মতো কত খারাপ ছাত্রকেই তো তিনি পড়িয়েছেন। খুব ভালো আর খুব খারাপ ছাত্রদেরই স্যারেরা শুধু মনে রাখেন। মাঝামাঝিরা হারিয়েই যায় তাঁদের স্মৃতিতে। বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠতলে, চলে যায় তারা কলরবে, কৈশোরের কিশলয়, পর্ণে পরিণত হয়, যৌবনের শ্যামল গৌরবে। কালিদাস রায়ের। বিখ্যাত কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল অক্ষয়-স্যারের চোখের ঝাপসা দৃষ্টি দেখে। ওঁকে পেরিয়ে এসেই নতুন করে মনে পড়ল যে, অক্ষয়-স্যারের মতো এতখানি অপমান আমাকে জীবনে আর কেউই করেনি। তাঁর প্রতি আমার বিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু বুঝলাম গভীর এক উদাসীনতা জন্মে গেছে এক ধরনের। বহু বছরের দূরত্ব তা গাঢ় করেছে আরও।
আরও এক পাক ঘুরে আসার পর ওঁর সামনে দাঁড়ালাম আমি। অক্ষয়-স্যারের মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না। প্রণাম করে বললাম, কেমন আছেন স্যার?
ভালো নয়, ভালো নয়। কিন্তু চিনতে পারলাম না তো তোমাকে? কে?
আমি সিদ্ধার্থ স্যার। দক্ষিণ কলকাতায় থাকতাম। অঙ্ক…।
ও, বুঝেছি, বুঝেছি। তা, কী করছ এখন তুমি সিদ্ধার্থ?
ছবি আঁকি স্যার। মূর্তি গড়ি।
পেট চলে তাতে? আর্টিস্টরা তো না খেয়েই থাকে শুনি।
কোনোক্রমে চলে যায় স্যার।
তা ভালোই করেছ। অঙ্ক তোমার লাইন ছিল না। অঙ্কে মাথা লাগে। অঙ্ক…
জানি। একটু চুপ করে থেকে বললাম, গোপেনদা কী করছেন স্যার?
মানে, আমার ছেলে গোপনের কথা বলছ?
হ্যাঁ।
ও? অক্ষয়-স্যারের স্নান করুণ কাতর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, গোপেন তো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। জান তো? ম্যাথমেটিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল। তারপর চলে গেল নতুন করে ফিজিক্সের লাইনে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। এখন আমেরিকার হিউস্টনে আছে। আরে, নেভাদার মরুভূমিতে যে বোমা ফাটাল সেদিন আমেরিকা, সে তো তার একারই হাতে গড়া।
এমন করে বললেন অক্ষয়-স্যার, যেন উড়নতুবড়ি বানানোর কথাই বলছেন। গোপেনদা যেন। একা হাতে মসলা আর লোহাচুর ভরে উড়নতুবড়ি বানিয়েছেন একটা। আলোর ছটার জন্যে নয়, পৃথিবীর যা-কিছু ভালো, সব ফুল, পাখি, প্রজাপতি, অরণ্য, মানুষ সব কিছুকেই ধবংস করার জন্যে।
দারুণ আছে বুঝলে হে। বিরাট বাড়ি। ক্যাডিলাক লিমুজিন গাড়ি। আমেরিকান মেয়ে বিয়ে করেছে। কী ফুটফুটে মেমসাহেব। নাতি-নাতনিরাও সব ফুটফুটে। পাক্কা সাহেব। বাংলা বলতেই পারে না।
গর্ব ঝরল অক্ষয়-স্যারের কথায় বসনতুবড়ির মতো, ঝরনার মতো।
আপনি যাননি? ওঁরা আসেন না?
কী যে বল! আমার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে ইন্ডিয়ান বাথরুম। পায়রার খোপের মতো দু খানা ঘর। জঞ্জালে ভরা। ওখানে ওরা থাকবে কী করে? তুমি যেমন অঙ্কে গবেট ছিলে, ও ছিল তেমনি সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট। জান তো, স্কুল ফাইনালে স্টার পেয়েছিল। অঙ্ক, সংস্কৃত আর ভূগোলে লেটার পেয়েছিল। ইতিহাসেও।
আপনি এখনও কি পড়ান স্যার? আর মাসিমা মানে, গোপেনদার মা কেমন আছেন?
উনি গত হয়েছেন পাঁচ বছর হল।
একমাত্র ছেলের প্রশংসাতে উজ্জ্বল মুখ হঠাৎই নিভে গেল অক্ষয়-স্যারের। বললেন, বড়ো কষ্ট পেয়ে, বিনা শুশ্রুষাতে, বিনা চিকিৎসাতেই প্রায় চলে গেলেন। আমিও তো পা বাড়িয়েই আছি, বুঝলে। টিকিট কাটা হয়ে গেছে। শুধু বার্থটিই রিজার্ভেশন হয়নি। বাত, হাঁপানি, দুটো হার্ট অ্যাটাক। আছি কোনোরকমে। একে থাকা বলে না।
তা হলে এখন আর টিউইশনি করেন না? স্কুল থেকে তো নিশ্চয়ই বহু বছর রিটায়ার করেছেন?
পঁচিশ বছর। টিউইশনি, তা করি নিশ্চয়ই করি। নইলে চালাচ্ছি কী করে? কেন, তোমার ছেলে বুঝি তোমারই মতো অঙ্কে কাঁচা?
আমি হাসলাম। কষ্ট হল অক্ষয়-স্যারের জন্যে।
উনি বললেন, এখন থাকো কোথায়? ওই বাড়িতে তো অন্যরা থাকেন। ওই পাড়াতে আমার একটি টিউইশনি ছিল। তাই জানি। তুমিই বল, সকালে অথবা দুপুরে আমি নিশ্চয়ই গিয়ে পড়াব যত্ন করে। রাতে আর কোথাও যাই না। চোখে তো দেখি না। ছেলের যেমন নাতি আদরের, ছাত্রর চেয়ে ছাত্রর ছেলেও তেমনই!
তা এই বয়সেও এত কষ্ট করেন কেন? গোপেনদা এত বড়ো এবং বড়োেলোক হয়েছেন। আপনাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠান তো নিশ্চয়ই। এসব তো ছেড়ে দিলেই পারেন এই শরীরে। আর কতদিন কষ্ট করবেন?
একটু চুপ করে থেকে অক্ষয়-স্যার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, অভাব আমার কিছুই নেই। তবে একেবারে বসে গেলে শরীরটা আর চলবে না। তাই-ই চালিয়ে যাচ্ছি টুকটুক করে।
আচ্ছা, চলি স্যার।
তোমার ছেলে? পড়বে না সে আমার কাছে?
অঙ্ক ও পড়বে না স্যার। অভিনয় করবে বলছে।
অক্ষয়-স্যারের মুখটি, আমার অঙ্ক দেখে যেমন বিকৃত হয়ে যেত তিরিশ বছর আগে, তেমনই। বিকৃত হয়ে গেল। বললেন, লাইক ফাদার লাইক সান। ও তো তোমারই মতো গাধা হয়েছে তা হলে, অঙ্কে গবেট?
হেসে বললাম, তাই।
সন্ধ্যে হয়ে এল। আলো জ্বলে উঠেছে। পার্ক থেকে বেড়িয়ে আসছি, এমন সময় আমার স্কুলের বন্ধু রাজেনের সঙ্গে দেখা। চিনতেই পারিনি। বুড়ো হয়ে গেছে। সিনেমায় নামবে বলে বাবার আলমারি ভেঙে টাকা নিয়ে এই রাজেনই বোম্বে যাচ্ছিল। পুলিশ ধরে আনার পর স্কুল থেকে রাস্টিকেট করে দিয়েছিল ওকে। ওর নাম ধরে ডাকতেই, আমার নাম বলতেই, বুকে জড়িয়ে ধরল রাজেন। বলল, কী রে সিদু? কীরকম বুড়ো মেরে গেছিস তুই।
আর তুই কি কচি আছিস নাকি? টেকো-বুড়ো। আমি বললাম।
হেসে ও বলল, চল, চল, আমার দোকানে। বিকেলে একটু হাঁটতে বলেছেন ডাক্তার। দোকানে বসে-বসে ডায়াবিটিসে ধরেছে বুঝলি। চল, চল দোকানের পর আমার বাড়িতে। সীমা কত্ত খুশি হবে। বাড়ির একতলাতেই তো দোকান।
কীসের দোকান?
আবার কীসের? স্টেশনারি দোকান দিয়েছি বাড়ির একতলাতে। আমি আর কী করব? সংসার
তো চালাতে হবে।
মেলোমশাই কেমন আছেন?
বাবা নেই। অনেক চেষ্টা করলাম রে। সব সঞ্চয়, মায়ের, এমনকী সীমারও সব গয়না, আমার স্কুটারটা পর্যন্ত বিক্রি করেও তবুও বাঁচাতে পারলাম না।
কী হয়েছিল?
ক্যান্সার।
মাসিমা কেমন আছেন?
বুড়ি হয়ে গেছেন। কিন্তু ভালোই আছেন। চল, চল, তোকে দেখে কত্ত খুশি হবেন। তুই বিজয়ার পর মায়ের হাতের কুচোনিমকি আর নারকোলের নাড়ু খেতে ভালোবাসতিস। চল, এখনও কিছু আছে। আজকাল বিজয়া-টিজয়া তো উঠেই গেছে। আমেরিকান হয়ে গেছি আমরা। কী বলব তোকে, এই শ্রীমান রাজেন দাসের একমাত্র ছেলেও ইংরেজি গান আর ইংরেজি বই ছাড়া পড়ে না। ইংরেজি নাচ নাচে।
কী করছে ও?
চোরের ছেলে আর কী করবে? ডাকাত-টাকাত হবে হয়তো। এখন কবিতা লিখছে। বাবা তো লক্ষপতি। লিটলম্যাগ আন্দোলনে সামিল হয়েছে ছেলে।
আরে তোক হোক। ওর জীবন ওর। বাধা দিস না। আমি বললাম।
দোকানেই আগে নিয়ে গেল রাজেন। খুব মজা লাগল দেখে যে, বোম্বের বৈজয়ন্তিমালার বিরাট একটি ছবি টাঙানো আছে দোকানের দেওয়ালে। তাতে চন্দন-টন্দনের ফোঁটা দেওয়া।
বললাম, এ কী রে? যাকে বিয়ে করবে বলে পালিয়েছিল।
রাজেন হেসে বলল, কী বলিস তুই? যার জন্যে পুলিশঠ্যাঙানি খেয়ে বুকের হাড় ভাঙল, চোর বদনাম হল, তাকে কি বেফলে দিতে পারি? বাবা-মাকে যেমন ফেলে দেওয়া যায় না, একেও তেমনই। বলে নিজেই হো-হো করে হেসে উঠল।
রাজেনের মা খুবই খুশি হলেন। রাজেনের বউ সীমা বলল, আপনাকে আজ না-খেয়ে যেতেই দেব না। যা রান্না হয়েছে গরিবের বাড়ি, তাই খেয়ে যেতে হবে। এত বড়ো আর্টিস্ট আমাদের বাড়ি এসেছেন! আপনাকে কখনো চোখে না দেখলেও আমার স্বামীর বন্ধু বলেই কত্ত মানুষের কাছে গর্ব করি। আপনার গর্বে আপনার বন্ধুর তো মাটিতে পা-ই পড়ে না। বলেই বললেন, দোকানঘরের দেওয়ালগুলো দেখে এসেছেন তো?
হেসে বললাম, দেখিনি আবার!
সীমা হেসে গড়িয়ে বলল, ফোটোর সতীনকে নিয়ে কোনওই ঝামেলা নেই। আমিও ফুলটুল দিই মাঝেমধ্যে।
অক্ষয়-স্যারের সঙ্গে দেখা হল রে, বুঝলি রাজেন। আমি বললাম রাজেনকে।
তাই? আমার সঙ্গে তো রোজই হয়। দোকানেও বলে রেখেছি যে, রোজকার পাউরুটি যেন বিনে। পয়সায় দিয়ে দেয় ওঁকে। গুরু-ঋণ বলে কথা! রাস্টিকেটেড ছাত্ৰই হই আর যাই-ই হই, কী কানমলাই না দিতেন! মনে আছে? ও, তুই তো আমার চেয়ে অনেক ভালো ছিলি অঙ্কে। বাঁ কানটা চিরদিনের মতো হাফ-কালা হয়ে গেছে রে। একেবারে রগে রগে ঘষাঘষি করতেন অক্ষয় স্যার!
গোপেনদা কিন্তু অঙ্কে দারুণ ভালো ছিল। স্যারের কাছে শুনলাম যে, বিরাট নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট হয়েছে আমেরিকার… আমি বললাম।
তা তো হয়েছেন! কিন্তু মা মারা গেলেন বিনা চিকিৎসায়। বিনা ওষুধে। অঙ্কে দারুণ খারাপ ছেলে পাউরুটি দান করে বুড়ো বাবাকে তার বাঁচিয়ে রেখেছে। অমন ভালোর দাম কী বলতে পারিস? একটা টাকা পাঠায়নি বিদেশ যাওয়ার পর থেকে। একবারও আসেনি।
অক্ষয়-স্যারের টিউইশনি তো আছে এখনও কয়েকটা?
ছাড় তো! টিউইশনি! এখনকার দিনে কি আর তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠার অঙ্ক কষতে হয়? না শুভঙ্করীর আর্যা মুখস্থ করতে হয়, কে পড়বে ওঁর কাছে? এখন অঙ্ককে অঙ্ক বলে না। বলে, ম্যাথস। সীমাকেই জিজ্ঞেস কর না। স্যার পটকে যখনই যান, তখন শুশ্রুষা করে সীমাই, ফ্লাস্কে করে পথ্য নিয়ে গিয়ে। যত ঝামেলা এই রাস্টিকেটেড ছাত্ররই। সত্যি! যাকগে, আমিঞ্জযেমন ছাত্র ছিলাম আমার ছেলে-মেয়ে তার তুলনায় অনেকই ভালো। এই-ই স্যাটিসফ্যাকশান!
মাসিমার হাতে বানানো কুচোনিমকি আর নাড়কোল-নাড়ু, সীমার রান্না লুচি-বেগুনভাজা, কুমড়োর হেঁচকি, আর ডিমের ঝোল খেয়ে যখন প্রায় দশটা নাগাদ রাজেনের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে এলাম, তখন ভারি ভালো লাগছিল। অঙ্কে আমরা কেউই যে ভালো ছিলাম না, এটা মনে করে। সত্যিই আনন্দ হচ্ছিল।
রাজেনকেও বললাম, সীমাকেও বলেই এসেছিলাম, আগামী শীতে সবাইকে নিয়ে দিল্লি আয়। মাসিমাকেও নিয়ে আসিস। একটু অসুবিধে হলেও তোদের আনন্দ হবে খুব।
রাজেন বলল, খুব চেষ্টা করব। কী বলব তোকে, বিয়ের পর সীমাকে একবার দিঘা ছাড়া কোথাওই নিয়ে যেতে পারিনি। কত্ত যে ঝামেলা। আর রোজগার তো লবডঙ্কা।
বললাম, থ্রি টায়ারে চলে আয়। স্টেশনে তোদের রিসিভ করার পর থেকে সব দায়িত্ব আমার।
বাস এসে গেল। বললাম, চলি রে।
শীত কিছুই পড়েনি। তবে কলকাতার মানুষেরা তো ক্যালেন্ডার দেখে গরম জামা পরেন। তা ছাড়া ধোঁয়াশা আর ডিজেলের ধোঁয়ায় কলকাতাকে এখন মনে হচ্ছে শীতের লন্ডন। দু-বছর আগে এগজিবিশন নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে। তাই জানি।
পরের স্টপে ঠিক অক্ষয়-স্যারের মতো এক ভদ্রলোক উঠলেন। মাথায় বাঁদুরে-টুপি। হাতে লাঠি। তবে বয়স অত হয়নি। বাস হঠাৎই ছেড়ে দিতেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। উঠে দাঁড়িয়ে ওঁকে আমার সিটে বসালাম। উনি মুখে কিছু বললেন না। কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালেন।
তোতাপাখির থ্যাঙ্ক ইউ আমার দেশের ঐতিহ্য নয়। আমরা চোখ দিয়েই অনেক জরুরি কথা অনেক বেশি গভীরভাবে চিরদিনই বলে এসেছি। ওই বৃদ্ধও তাই করলেন।
আমি বেঁটে লোক। মিনিবাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না।
কলকাতার পাবলিক বাসে দিল্লির পাবলিক বাসের চেয়ে অনেক কম ভিড়। দিল্লি হচ্ছে বড়োলোক-ব্যবসাদারদের সুখের জায়গা। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তদের বিস্তরই অসুবিধে সেখানে। ভাবছিলাম, বাড়িটা দান করে দেওয়া বোধহয় ঠিক হয়নি। কলকাতাতে থাকলেই হত। বাঙালি মধ্যবিত্তের পক্ষে এখনও কলকাতার মতো নিরাপদ ও সুখের জায়গা আর নেই।
কন্ডাকটারকে একজন যাত্রী বললেন, এটা কী হল দাদা? অঙ্কটা কীরকম হল? দিলুম পাঁচ টাকার নোট, যাব শ্যালদা, আর ফেরত দিলেন এই? অঙ্কের জ্ঞানটা একটু ভালো করুন।
অক্ষয়-স্যরের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার। নস্যি নিয়ে, অঙ্ক-কষিয়ে ছাত্রদের কান মলে, গালাগালি করে প্রত্যেককে অঙ্ক-বিশারদ করতেই কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন মানুষটি।