ঢোঁড়া উপাখ্যান
দু’পাশের সবুজকে ছিঁড়ে রমারম চলে গেছে লাল রাস্তা। রু-রু-রু বাতাস। বংকা দাঁড়িয়ে পড়ে।
—একটা বিড়ি খাবার মন করে।
—ধুস। বিড়ি খাবি করে, চল পা চালিয়ে, স্যারের এখনও চ্যান খাওয়া হয়নি। নস্করীবাবু বলে। নস্করীবাবুর হাতের আঙুলে সিগারেট।
—না বাবু, এট্ট বিড়ি না ছাড়া চইলবে নি। এট্টু রোসো।
— ‘এক পয়সার মুরগি তো চার পয়সার পুদ্গানি’— নস্করীবাবু নিজে নিজে হাওয়া আর ধানগাছের কাছে বলে। আড়চোখে অফিসারের দিকে একবার তাকায়। অফিসার তখন আকাশের মেঘে কুড়িমুড়ি দিয়ে বসা বোতলদৈত্যটাকে দেখছিল।
বংকার মাথা থেকে নস্করীবাবু বেডিংটা নামায়, কালো ট্রাংকটা নামায়। কালো ট্রাংকের গায়ে সাদা রঙে লেখা অমিতাভ মুখার্জি, ল্যান্ড রেভিনিউ অফিসার।
—এখানে বসুন স্যার, এই ট্রাংটার উপর। একটু রেস্ট নিয়ে নিন, নস্করীবাবু বলল। নস্করীবাবু হল ভাসাদেউলে ক্যাম্পের আমিন।
— আপনার দুটো চিঠিই পেয়েছিলাম স্যার, আপনার লাস্ট চিঠিটায়, ডেটেড টোয়েনটি ফিফ্থ অগস্ট, লিখেছিলেন ফোর নুনে জয়েন করবেন। বেলা এগারোটা থেকে বসে আছি স্যার।
— দু’ঘণ্টা তো বসে রইলাম গুস্করায়, কাসেম-নগরের বাস নেই। গলসি থেকে তো স্টার্ট করেছিলাম সকাল সাড়ে সাতটায়।
আবার চলতে শুরু করে ওরা। আর কদ্দূর নস্করীবাবু?
—তা ধরুন আরও তিন কিলোমিটার টাক।
—হুঁ।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে— ওর যেখানে থাকতে হবে, সেখান থেকে নিয়ারেস্ট বাসরাস্তা ৮/৯ কিলোমিটার দূর। কী আজব জায়গায় ট্রানসফার। অমিতাভ ভাবে।
— অফিসে কাজকম্মো হচ্ছে কিছু? অমিতাভ জিজ্ঞাসা করে।
— রাজা নেই তো রাজ্য চালাবেক কে? অফিসার কই?
— অফিসারটা কেমন?
— গেলেই দেকবেন।
— থাকব কোথায়?
— আমরা তো অফিসেই থাকি। আপনি অফিসার মানুষ, দেখুন…
— আচ্ছা, আনন্দ কোঙারের নাম শুনেছেন? গলসির আনন্দ কোঙার!
— মানে হাঁদুবাবু তো? কেন বলুন দেকি!
— না, এমনি। এখানেও ওনাকে চেনে?।
— আমার ভায়ের একটা চাকরি করে দিয়েছিলেন তো, একটা এমেলের চিঠি এনে দিইছিল আমার সোম্বন্ধী। সেই চিঠি নিয়ে ওনার কাছে গেলাম, ব্যবস্থা হয়ে গেল। হাঁদুবাবু লোক খুব ভাল…।
অমিতাভ অনেকক্ষণ আর কোনও কথা বলে না। নস্করীবাবুও ঠিক বোঝে না সাহেব হঠাৎ চুম্ মেরে গেলেন কেন।
অমিতাভ এবার বংকার কাছে যায়।
— তোমার নাম বংকা?
— আজ্ঞা।
— বংকা কী?
— দাস।
গলার তুলসীমালার কষ্ঠি দেখে জিজ্ঞাসা করল, বৈষ্ণব?
— আমরা বলরামি।
— সেটা আবার কী?
— সেটা হল বলরামি।
— থাকা হয় কোথায়?
— থেকেও আছি গো, থেকেও নেই,
যেমন তুমি আর আমি রে ভাই—
চক্ষু মেলিলে সকল পাই।
চক্ষু মুদিলে কিছু নাই।
নঙ্করীবাবু অমিতাভর হাত ধরে মৃদু টান দিল।
— ওকে বকাবেন না স্যার, ও একটা খ্যাপা। নিজেকে ভাবে রামচন্দ্র। আসলে ও জাতে হাড়ি।
— নাম তো বলল বংকা দাস।
— আরে দাস তো সবাই, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসও দাস কালিদাসও দাস আবার বংকা দাসও দাস। ও হল নিরাপদ চ্যাটার্জির মাহিন্দার।
বংকা এবার রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে যায়। অমিতাভর চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠতে নস্করীবাবু বলে— অনেক শর্টকার্ট স্যার, আবার রাস্তাতেই উঠব ফের।
ভাঙা জমি। পতিত। পাথুরে। কাঁটাঝোপ, তাতে হলুদ ফুল, মাঠের মাঝখান দিয়ে টায়ারের গভীর কারুকাজ।
— এটা কীসের দাগ নস্করীবাবু?
— মাটির তলায় তেল আছে ভেবে অনেক লোকজন আর বড় বড় গাড়ি এয়েছেল গত সাল। মাস তিনেক তোলপাড় করে চলে গেল।
মাঝে মাঝে গর্ত। মাটি ফুঁড়ে চাগিয়ে আছে পাথর। বংকা অনেকটা এগিয়ে গেছে। অমিতাভ হুচোট খায়। নস্করীবাবু চেঁচিয়ে ওঠে। লাগেনি তো স্যার? অ্যাই বংকা, কায়দা দেকাচ্ছিস! ফোঁপড়ি করে কে তোকে মাঠ ঠেঙে যেতে বলেছিল? রাস্তা দিয়ে গেলেই তো হত।
বংকা দাড়িয়ে যায়। বলে, আগে হাঁটনি, পাঁঠা কাটনি মাটি নিরোয়, পোয়াতির ধাই, এসব কম্মের যশ নাই।
নস্করীবাবু অমিতাভর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে কিছুটা ঘাড় বেঁকাল। যার মানেটা দাঁড়াল— দেখলেন তো, যা বলেছিলাম…
হলুদ টিনের পাতে কালো কালিতে লেখা— ‘সেটেলমেন্ট হলকা অফিস। ভাসা দেউলে’। পাকা বাড়ি। দেয়ালে সদ্যমারা পোস্টার— কাসেমনগর ফুটবল মাঠে যাত্রাপালা— সিথির সিঁদুর। পরবর্তী আকর্ষণ ফুলনদেবী। টানা বারান্দা, তিনটে ঘর।
— এই যে স্যার অফিস ঘর। পাশের এই ঘরে আমরা কোনওরকমে থাকি, আর এই ঘরে রান্না।
— বাথরুম নেই?
— ওটা স্যার বাইরে যেতে হয়।
অমিতাভর কুঞ্চিত কপালে বিরক্তি চিহ্ন নস্করীবাবুর নজর এড়ায় না।
— আমিন আর নেই?
— আর একজন আছে স্যার, নারায়ণ গড়াই। দেশে গেছে।
— পেসকার?
— দেশে।
— পিওন?
— আসবে স্যার। এখন দেশে।
সকালবেলা উঠতে একটু দেরি হয়ে যায় অমিতাভর। বেশ ঝলমল করছে রোদুর। বারান্দা জুড়ে গোটা দশ-বারো বাচ্চাকাচ্চা। নস্করীবাবুর খালি গা। অমিতাভর বসার চেয়ারটা বার করে বসে পড়াচ্ছে— স্বরে অ খিয় অক্ষ। দ খিয় দক্ষ…।
সকালবেলাটায় সামান্য টিউশনি স্যার।… নস্করীবাবু বলে।
অমিতাভর গায়ে তোয়ালে জড়ানো, হাতে টুথব্রাশ, বাইরে বেরুচ্ছে, এমন সময় ধুতি ও হাফ পাঞ্জাবি পরা ফরসামতো একজন, পাকাচুল, পুরো বডিটাই হাসছেন, হাতজোড় করে বললেন— আপনি বুঝি নতুন সেটেলমেন্ট অফিসার? নমস্কার। আমি নিরাপদ চ্যাটার্জি। অমিতাভ এক হাতের টুথব্রাশ অন্যহাতের সিগারেটের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নিচু করে।
নিরাপদবাবু বলেন— বাহ্য ফিরতে যাচ্ছেন বুঝি? যান। আমি বসছি।
— কিছু দরকার?
— সবসময় কি দরকার-অদরকার বিচের চলে? আমি আসি। খোঁজখপর করি।
— ও। ভাল কথা। আনন্দ কোঙারকে চেনেন? গলসির?
— হাঁদু কোঁয়ার? খুব করিতকর্মা লোক। কেন, কী হয়েছে?
— না, এমনি।
অমিতাভ বাইরে আসে। পর পর দশ-বারোটা কাঁচা ঘরের পরই আকাশের নীল মাঠের সবুজে মিশেছে। মাঠ দাপানো হাওয়া। ওর আর কিছু না। এখন একটু আড়াল চাই।
গলসিতে বেশ তো ছিল অমিতাভ। জি টি রোডের উপরই অফিস। উলটোদিকে বিডিও অফিসের স্টাফ কোয়ার্টার। এক ব্যাচেলর এক্সটেনশন অফিসারের কোয়ার্টারে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ছিল। স্যানিটারি ল্যাট্রিন ছিল, ট্যাপ ওয়াটার ছিল। সন্ধের পর পাশের কোয়ার্টারে গিয়ে, বউদি চা খাব…
গলসির সেটলমেন্ট অফিসে এক দুপুরবেলা এসেছিল আনন্দ কোঙার।
এই একটু আলাপ করতে এলাম, নিন, সিগ্রেট খান।
এক্কেবারে কচি বয়েস আপনার। ফাস্ট পোস্টিং।
কিছুদিন পরই তদন্তের কাজ শুরু হল। মাঠে গেল অমিতাভ।
ডি ভি সি র খাল মাঠ এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে গেছে। সেচের জলে বছরে তিনবার চাষ।
— ৬৭ নম্বর দাগ?
— শালি। দং আনন্দ কোঙার। পিং দীনবন্ধু। ৮০ শতক।
— ৬৯ নম্বর।
— শালি। দং বিভাবতী দেবী। স্বামী আনন্দ কোঙার ৫৫ শতক।
— ৭০ নম্বর?
— নিস্তারিণী দেবী। স্বামী ৺রাধামাধব যশ। সাং বারাণসী। ৬৯ শতক। লিখুন বর্গা দখল আনন্দ কোঙার।
— সে কী কথা আনন্দবাবু, কী বলছেন? আপনি বর্গাচাষি?
আনন্দবাবু হাওয়াই শার্টের তিন নম্বর আর চার নম্বর বোতামের ফাঁকা দিয়ে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন
— আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি বিধবা মামিমার জমি ভাগে চষি।
— আপনি নিজে চষেন?
— অতশত নিকেশ নিচ্ছেন কেন বলুন তো? গভর্নমেন্ট বলছে বর্গা রেকর্ড করতে, আপনি রেকর্ড করুন। যত রেকর্ড করতে পারবেন আপনার প্রমোশনের ভাল হবে।
— আমার প্রমোশন আপনাকে ভাবতে কে বলেছে?
— আচ্ছা, ঠিক আছে মশাই, বর্গা লিখতে হবে না। নিস্তারিণী দেবীর নামটাই লিখে রাখুন।
— আপনার মামিমা কোথায়?
— বললুম তো, কাশীবাসী। চাষ করে আমি ওনাকে টাকা পাঠাই।
— ওনার কত জমি আছে?
— তা বিঘে চল্লিশ হবে।
— টাকা পাঠিয়েছেন এমন মানিঅর্ডার রসিদ আছে?
— সেসব কি যত্ন করে রাখা করেছি?
— আপনার মামিমা ফসলের টাকা পেয়েছে, এমন চিঠিপত্র আছে কিছু?
জামার ভিতর থেকে হাত বের করে আনে আনন্দ কোঙার। সিগ্রেট ধরায়। অমিতাভ বলে, মামির নামের দলিল রয়েছে— তাতে কী হয়েছে? আদৌ আপনার মামিমা আছেন এমন প্রমাণ দেখান।
— তা হলে কাগজের জোরে করবেন না?
অমিতাভ ভিতরে ভিতরে বেশ থ্রিল্ড হচ্ছিল। সিলিং ফাকি দেয়া নিট ১৪ একর জমি বার করে ফেলেছে ও। অমিতাভ শিয়োর নিস্তারিণী দেবী সম্পূর্ণ ফল্স্।
সন্ধ্যাবেলা আনন্দবাবু হাজির। হাতে এক বাক্স মিষ্টি।
— একা একা বসে আছেন, আরে বে-থা করুন ভাই। কেউ ঘরে এলে চা করে দেবারও কেউ নেই।
— ঘরেই এসে গেছেন? তা আপনার মামিমার চিঠিপত্র খুঁজে পেলেন?
— চিঠিপত্র খুঁজে পাওয়া কি খুব শক্ত ব্যাপার নাকি? দরকার হলে কাশী থেকে এক ডজন চিঠি লিখিয়ে আনতে পারি।
আনন্দবাবুর হাতটা ওর বুকপকেটের কাছে যায়। বলে, অতসব ফ্যাচাং-এর দরকার নেই। এটা ধরুন। দু’হাজার আছে।
অমিতাভ উঠে দাড়িয়ে চিৎকার করেছিল— এক্ষুনি বেরিয়ে যান, টাকা দেখাতে এসেছেন!
আনন্দবাবু হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তারপর দাঁতমাজার আঙুলটা নাড়িয়ে বললেন— আমার নাম হাঁদু কোঁয়ার। আগুরির বাচ্চা বটি। আমিও দেখে নেব। কাজটা ভাল করলেন না।
পরে জেনেছিল হাঁদুবাবু একজন বিখ্যাত লোক। চারটে বাস লাইনে খাটে। বর্ধমান বাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। কোল্ডস্টোরেজ আছে একটা। এখানকার গলসির স্কুলের জন্য জমি দান করেছিলেন উনিই, বর্ধমান শহরে থাকেন, ওখানে বাড়ি আছে, এখানে মাঝে মাঝে আসেন।
মাসখানেক পরে অমিতাভ খাকি খামে অশোক স্তম্ভ লাগানো রেজিষ্ট্রি চিঠিতে জেনেছিল— গভর্নর ইজ প্লিজড টু ট্রানসফার শ্রীঅমিতাভ মুখার্জি, কে জি ও গ্রেড ওয়ান টু ভাসাদেউল হলকা অফিস ইন দি ইন্টারেস্ট অফ পাবলিক।
একটু আড়াল খুঁজছিল অমিতাভ। অবশেষে একটা ছোটমতো কালভার্ট পায়। আস্তে জল বইছে। এখানেই একটা পার্মানেন্ট ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? ওর অফিসে কিছু ইট পড়ে থাকতে দেখেছিল, ওখান থেকে দুটো ইট দুই হাতে নিয়ে গেজেটেড অফিসার হাঁটছে কালভার্টের দিকে, তখন বংকার সঙ্গে দেখা…
— কী ছ্যার, আপনার হাতে ইট? দেন দেন, আমার হাতে দেন, কোথায় নে যাব?
অমিতাভর বলতে লজ্জা করে কোথায় নিতে হবে। বলে, তোমার দরকার নেই। তোমার নিজের কাজে যাও।
বংকা যাবার সময় বিড়বিড় করে— আমি যাই তিনি তাই, যা তিনি তাই তুমি, বোবা কালায় কয় কথা, ইন্দুরে খায় বিড়ালের মাথা।
খ্যাপা নাকি? অমিতাভ ভাবে।
ইট দুটো নিয়ে কালভার্টের তলায় চলে গেল অমিতাভ। ইট দুটো পেতে নেয়। তলায় জল। নিরিবিলি। কাশফুল দুলছে।
ক’দিন পরে ওই কালভার্টের ওখানে যাবার সময় দেখে, একটি ১২/১৪ বছরের ছেলে ইট দুটো নিয়ে যাচ্ছে। অমিতাভ ঘাবড়ে যায়।
— আরে আরে এগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
— শান হবে। পা ধুবার শান।
— মানে?
— পা ধুয়া হবে, পায়ে কাদা মোট্টে লাগবে না।
নিরাপদবাবু রোজই প্রাতঃভ্রমণে বের হন। পঁচাত্তরেও সুন্দর স্বাস্থ্য। গোয়ালটা, মরাইটা, দিঘিটা, একটু তদারকি করে অফিসটায় আসেন। আসলে এটা তাঁরই তো বাড়ি। বড় ছেলেটা এখানে ডাক্তারি করবে ভেবে রাস্তার ধারে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন, কিন্তু ছেলে বর্ধমান টাউনেই ডাক্তারি করে। ওখানেই একটা ছোট করে নার্সিংহোম বানিয়েছে।
নিরাপদবাবু জিজ্ঞাসা করেন— কী সাহেব, আপনি নাকি দুটো ইট দু’ হাতে নিয়ে হাঁটছিলেন? ব্যায়াম করছিলেন নাকি?
অমিতাভ একটু হেসে নিয়ে ব্যাপারটা বলে। আর বলে— সব কিছু পারি নিরপদবাবু, মাঠে বসে ওইটে পারি না।
নিরাপদবাবু বললেন— ছ্যাঃ। আমারই তো আগে তত্ত্বতালাশ নেয়া উচিত ছিল। আপনি সিধে আমার বাড়ি চলে যাবেন। কোনও সংকোচ করবেন না।
— হুঃ। তা কি হয় নাকি? আপনার বাড়ি যাব এইটে করার জন্য?
— শুধু ওইটি করার জন্য যেতে কে বলেছে? সবসময় যাবেন। আমার ছোটছেলেটি তো আপনারই বয়সি। বিকাশের সাথে আলাপ হয়েছে?
একদিন নিরাপদবাবুর সঙ্গে ওবাড়ি গেল অমিতাভ। পাঁচিল ঘেরা একতলা বাড়ি, উঠানে বিশাল মরাই, উঠানের কোনায় পায়খানাটাকে আঙুল উঁচিয়ে দেখালেন নিরাপদবাবু। ভালই হল, বাড়ি থেকে বেশ দূরেই আছে। বারান্দায় শস্যের ঘ্রাণ ও ইঁদুরমারার কল। নিরাপদবাবুর স্ত্রী দুধ মেরে ঘরে তৈরি করে ক্ষীরের নাড়ু ও বেশি মিষ্টি দেয়া চা দিলেন। বিকাশের স্ত্রীর চুড়ির শব্দ ও গলার স্বর শুনল। নিরাপদবাবুর ছেলে গোলগাল চেহারার বিকাশ বি কম পরীক্ষা দিয়েছিল, হয়নি। একটা ট্রাক্টরের জন্য ব্যাংক পোন চেয়েছিল, মায়ের দয়ায় হয়ে গেছে। গলায় ঝোলানো সোনার হারের লকেটে মিনে করা মা কালী স্পর্শ করে হাত কপালে ছোঁয়াল। শিগগিরি ট্রেনিংয়ে যেতে হবে হরিয়ানা। বিকাশ বাগানে নিয়ে গেল। সিগারেট বের করল। নিন স্যার। ধরান একটা। বিকাশের পরনে কর্ডের প্যান্ট এবং পলিয়েস্টার গেঞ্জি। আঙুলে প্রবাল।
জানেন স্যার, বাবার খুব আপত্তি, বলছে বামুনের ছেলে চাষ করতে নেই। ট্রাক্টর তো কী হয়েছে, ওটাও তো লাঙল, কলের লাঙল। আমি ওসব মানি না। যত সব কুসংস্কার, আপনার কী ওপিনিয়ন স্যার?
অমিতাভ বলল, পাঞ্জাব-হরিয়ানায় উঁচু জাতের এডুকেটেড ছেলেরাই তো চাষ করছে…
বিডিও সাহেব ঠিক এই কথাই বললেন আমাকে। উনি আমাকে নিজের ছোটভাইয়ের মতো ভালবাসেন। ট্রাক্টর ছাড়া আর উপায় নেই স্যার, মুনিষ মজুররা পলিটিকস করতে শিখে গেছে। আজ এটা দাও, কাল সেটা দাও… আর পড়তা পোয় না। আমার স্যার একটু সুবিধা আছে, জমিগুলো সব একলপ্তে। দু’-একটা এক্সচেঞ্জ করতে হবে। একটু দেখবেন স্যার…
চিঠি পাঠিয়ে দেশে পালানো স্টাফদের অফিসে নেয় অমিতাভ। কুনুর নদীর পাড়ে মাপজোক শুরু করে। বড় আঁকাবাঁকা নদী। বেহুলা নাকি এই নদী বেয়েই লখিন্দরকে নিয়ে ভেলায় ভেসেছিল। মনসার অভিশাপে নদীটা এরকম এঁকেবেঁকে গেছে।
কাজ থেকে ফিরে এসে একটু রিলাক্স করার জো নেই। একটা ঘরে এক গাদা স্টাফ। ওরা কাগজে মোড়ানো বই পড়ে, টুয়েন্টি নাইন খেলে, অমিতাভর বইপত্র ওলোটপালোট হয়। বিদিশার চিঠিও সম্ভবত খুলে পড়েছে…।
— আপনি অফিসার মানুষ, এসব আমিন-পিওনদের সঙ্গে থাকেন কী করে বলুন তো? নিরাপদবাবু একদিন একা পেয়ে বলেন।
— কী করা যাবে, সরকারের তো কোনও ব্যবস্থাই নেই।
— তব্বেই বলুন সরকার কী করে এই অফিসারদের কাছে ভাল কাজ আশা করবে?
অমিতাভ কিছু বলে না।
এক কাজ করুন মুখার্জিবাবু। আমার বাড়িতে একটা বাইরের ঘর এমনি এমনি পড়ে আছে। এটা বাবার আমলে গদিঘর ছিল। নিজের মতো থাকবেন। কেউ ডিসটার্ব করবে না, চলুন দেখবেন ঘরটা।
অমিতাভ দেখল, ধুলো ভরতি তক্তাপোশ আছে, টেবিল আছে, দক্ষিণের জানালা আছে। জানালার ধারেই বক ফুল গাছের পাতার ঝিরঝির। খুব পছন্দ হল ঘরটা। প্রাইভেট এম এ পরীক্ষাটা সামনের বছরই দিয়ে দিতে হবে। অমিতাভ বলল— আপনার ভাড়া নিতে হবে কিন্তু।
— সে দেখা যাবে খন।
আবার বংকার মাথায় চাপল বেডিং আর কালো ট্রাংক।
অমিতাভ নস্করীবাবুদের কাছেই খেতে আসে। খাওয়া খরচ খুব কম পড়ে। নস্করীবাবুর বুদ্ধি অসাধারণ। সবজির মাঠে চেন পিওন নিয়ে যার নস্করীবাবু, বলে মাপ হবে।
— ভরা খেতে লোহার চেন চললে ফসল নষ্ট হয়ে যাবে না?
— তা কী আর করা যাবে, সরকারের কাজ। অবশেষে ফয়সালা হয়। চেন পিওন কুমড়োটা মুলোটা নিয়ে ফিরে আসে৷
— এসব কি ঠিক হচ্ছে? এভাবে মিথ্যে কথা বলে…
নস্করীবাবু বলে— আমরা হচ্ছি স্যার আমিন৷ আহাম্মকের আ, মিথ্যেবাদীর মি আর নিমকহারামের ন মিলে হচ্ছে গে আমিন। আমাদের ছেলেপুলের সংসার। দেশে টাকা পাঠাতে হয়। আমাদের এইভাবেই ম্যানেজ করতে হয়।
বিকাশ একদিন একটা কেরোসিন স্টোভ দিয়ে গেল। ‘চা-টা খাবেন স্যার, যখন ইচ্ছে হবে। একটু চা-চিনি রাখবেন, আমি আধসেরটাক করে দুধ দিয়ে যাব।’
— দুধ-টুঠ দরকার নেই, আমার তো লিকার চা-ই ভাল লাগে। অমিতাভ তাড়াতাড়ি বলে।
বিদিশাকে চিঠিতে জানায়— আগের অসহ্য অবস্থায় আর নেই, একটু বেটার আছি। নিজে রান্না করে খেলে কেমন হয়? সহজ রেসিপি পাঠিয়ে দিয়ো৷ অভ্যেস হয়ে যাওয়া ভাল, পরে অনেক স্ত্রী-স্বাধীনতা হবে।
বিকাশ ট্রেনিং-এ যাবে। দেউলেগড়ে পুজো দেয়া হল। দেউলেগড় মানে একটা ছোটখাটো টিপি। এখানে নাকি একটা দেউল ছিল। কুনুরের বানে সেই মন্দির ভেসে গেছে। তাই এই গ্রামের নাম ভাসা দেউলে। বিকাশের কপালে চন্দন তিলক। ওর মা যাবার সময় কড়ে আঙুল কামড়ে দিল। মাথায় আলতো থুথু দিল। বিকাশের স্ত্রী কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। সে বিকাশকে পা ছুঁয়ে নমস্কার করল। বংকার মাথায় বেডিং। গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে উঠানে। অমিতাভর ঘরে এল বিকাশ। ‘আমার বাবা রইল। বাবাকে দেখবেন স্যার। আর আপনার টুকটাক কাজকর্ম বংকাকে বলবেন, করে দেবে। অ্যাই বংকা, সাহেবের জলটল এনে দিবি।‘
গোরুর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয় অমিতাভ। বিকাশ আস্তে আস্তে বলে— এই বংকাকে নিয়ে খুব ঝামেলা, কাজকম্ম কিছু করে না, খালি খ্যাপামি। পুরনো লোক, তাড়াতেও খারাপ লাগে—। গোরুর গাড়িতে বিকাশের মা, বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাবে বোধহয়। আরও দু’জন মাহিন্দার, ওরা বর্ধমান পর্যন্ত যাবে বোধহয়। আর বিকাশের মামাতো ভাই, হাওড়া পর্যন্ত যাবে বোধহয়। বিকাশের চোখে গগলস। পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দুগ্গা— দুগ্গা।
কুনুর নদীর পাড় থেকে মাপজোক সরে আসছে গ্রামের দিকে। নিরাপদবাবু একদিন সন্ধ্যাবেলা অমিতাভর ঘরে ঢুকলেন। হাতে সামান্য কচলানি ভাব। কিছু অসুবিধে হচ্ছে না তো মুখার্জিবাবু। তার পরে বললেন— আমার জমিতে কোনও গণ্ডগোল পাবেন না মুখার্জিবাবু। কোনও বর্গা চাষ নেই, যা ছিল উঠিয়ে দিয়েছি। মুনিষ-মাহিন্দার দিয়ে চাষ করাই। ছেলেটা তো নিজেই চাষ করবে বলছে। বামুনের ছেলের এই কাজটা কি ভাল হচ্ছে!
তা— খারাপ কী? অনেকেই তো করচে, পাঞ্জাবে টাঞ্জাবে…
আপনারা পাঁচজনে বলচেন বটে, কিন্তু মন সায় দেয় না। পরে তোক পাওয়া যাবে, কী বলুন, ট্রাক্টর চালাতে জানে এমন লোক মাইনে দিয়ে রাখলেই আর নিজেকে চালাতে হবে না কী বলুন। এরপর নিরাপদবাবু বলেন— একটা আমবাগান ছিল আমার, পৈত্রিক, তা বিঘা বিশেক ছিল। আম মোটে হয় না, কেবল জঙ্গল, তাই ওটা কেটে সাফ করে চাষের জমি বানিয়ে ফেলেছি। আগেকার রেকর্ডে ওটা আমবাগান দেখানো ছিল। এখন নতুন রেকর্ডে স্যার ওটাকে আমবাগানই রেখে দেবেন। জমি দেখাবেন না…
ব্যাপারটা বুঝল অমিতাভ। পরিবার পিছু ৫২ বিঘে হল জমির সিলিং। এর বেশি হলে সরকার নিয়ে নেবে। কিন্তু বাগান থাকলে সে জমি রাখা চলে।
নিরাপদবাবু ছেলেদের নামে আলাদা আলাদা জমি সিলিং পর্যন্ত রেখেছেন। এখন আমবাগানটা যদি জমি দেখানো হয়, সেই জমি সরকারের ঘরে চলে যাবার কথা।
কপাল কুঞ্চিত হয় অমিতাভর। বলে— তা কী করে সম্ভব! ওটাকে চাষের জমিই দেখাতে হবে।
অমিতাভর হাত চেপে ধরেন নিরাপদবাবু। বাইরে বকফুল গাছের ঝির ঝির। ঘরের সদ্য চুনকাম হওয়া দেয়াল থেকে উঠে আসা গন্ধের মধ্যে নিরাপদবাবু বললেন,— আপনি আমার ছেলের মতো, এটা করে দিতেই হবে…।
বিদিশাকে চিঠি লেখার জন্য ডাইরির কাগজ ছেঁড়ে অমিতাভ। বেশ কিছুদিন আগেকার লেখা একটা ছড়া পায়।
হাঁদুবাবু হাঁদুবাবু কোথায় তুমি থাকো?
সর্বত্রই থাকি আমি খবরটা কি রাখো?
হাঁদুবাবু হাঁদুবাবু করছ তুমি কী
এই দ্যাখো না পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছি!
হেরে গেলে হেরে গেলে কানুনগো মশাই,
দুয়ো তোমায়, দুয়ো তোমায়, দুয়ো দিয়ে যাই।
আরো যদি হাঁদুবাবু আসে শত শত।
করব না আর করব না আর আবার মাথা নত।
ধুস যত্তসব চাইল্ডিশ ব্যাপার। পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে অমিতাভ। এবার চিঠিতে লেখে… ব্যাড্লাক। কলকাতা গিয়ে এবার তোমার সঙ্গে দেখা হল না। পুরী কেমন কাটালে জানিয়ো। জানো তো এখন নিজেই রান্না করছি। খাঁটি সরষের তেল পাচ্ছি। ঘানিতে ভাঙা, কলকাতায় ভাবাই যায় না। তরকারি ভাতে দিয়ে দিই, দু-চার ফোঁটা সরষের তেল দিয়ে দিই, ব্যস। বংকা নামে এক আজব লোক আমায় জলটল এনে দেয়। সর্বক্ষণ বিড়বিড় করে। চ্যাটার্জিবাবুদের গোয়ালঘরের পাশে থাকে। খড় বিচালিতেই শোয়। বলে ও নাকি বলরামি। অথচ গলায় তুলসী মালা। ব্যাপারটা বুঝি না। এই চাকরিটা ভাল লাগছে না। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন নজরে রেখো। টুকটাক পড়াশুনো করছি। এম এ-টা হয়ে গেলে একটা স্কুলে অন্তত হয়ে যাবে। বলো?
বিকাশ ফিরেছে। গালের দু’পাশে লাল লাল ছোপ। চোখের তলায় কালি। আর একটু ফুলেছে।
একদিন বিকাশ বলে— সে কী, আপনি নিজে বাসন ধুচ্ছেন, আমার কিন্তু চোখ টাট্ছে। খুব খারাপ লাগছে দেখতে। আমি একটা লোকের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বাসন-টাসন মেজে দেবে।
— হ্যারিকেনের চিমনিটা পরিষ্কার করা মহা ঝামেলার…
— ওটাও করে দেবে। সব করে দেবে, যা চাইবেন। বিকাশের চোখ দুটো একটু ছোট ছোট হয়, ঠোটে আঁকাবাঁকা হাসি।
একটা মেয়েকে নিয়ে এল বিকাশ। নাম কুসুম। বংকারই মেয়ে। ছোট বাচ্চা আছে একটা। বাচ্চাটা হবার আগেই লিভার-পচা রোগে মরেছে ওর স্বামী।
ভোর। সারারাত শিশিরের সোহাগ পেয়েছে মাঠ। মাঠের মাটিতে তাই ট্রাক্টর-টায়ারের আলপনা। ট্রাক্টর এসেছে গ্রামে। উঁচু সিটে বসে বসে ঘটঘট চালাচ্ছে বিকাশ। লাল ট্রাক্টর চলছে কেঁপে কেঁপে। চাষ নয়, এমনিই চালাচ্ছে হয়তো, খুশির চালানো হয়তো, গায়ে ছাপ ছাপ গেঞ্জি। মুখে সিগারেট। জানালায় চোখ রেখে তক্তাপোশে শুয়ে আছে অমিতাভ।
কুসুম বাসন মেজে এনে রাখল। অমিতাভর দিকে তাকাল। ভাসা ভাসা চোখের তলায় কালি। চোখ কিছু বলতে চায়।
— কিছু বলবে?
— না।
— তবে?
— কিছু না, বলে কুসুম চলে যায়। শাড়ির আঁশটে গন্ধ বাতাসে লেগে থাকে।
নিরাপদবাবুর বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে এবার জোর করে বিকাশের সঙ্গে অমিতাভকেও ভাইফোঁটা দিয়ে দিয়েছে। নেমন্তন্নও ছিল। মুরগি-টুরগি হল। বিকাশ ওর ঘরে নিয়ে গেল অমিতাভকে। এই প্রথম। বিছানায় সত্য কাহিনি, তদন্ত কাহিনি এইসব। চুলের কাঁটা, ফিতে। মা কালীর বিশাল ছবি ঘরের দেয়ালে।
— একটা জরুরি কথা ছিল অমিতাভদা।
আর স্যার নয়, অমিতাভ মার্ক করে।
— আমাদের জমিতে অনেক সিডুলকাস্ট অনেকদিন ধরে আছে, কিছু বলি না আমরা। কোথায় যাবে ওরা। গাঁয়ে মাপ এলে ওদের কে…
উঠে দাড়ায় অমিতাভ। প্লিজ বিকাশবাবু, এ ব্যাপারে লিখে দেব। কিচ্ছু করার নেই। অমিতাভ পা বাড়ায়।
— আরে তা তো দেবেনই, সে কথা হচ্ছে না, বসুন না! উইলস-এর প্যাকেট বাড়িয়ে ধরে বিকাশ। বলে— পুকুরপাড়ের ঝুপড়ি-টুপড়িগুলোকে আপনি আপনার আইনে যা খুশি করুন, আমি কিছু বলব না। আমার রিকোয়েস্ট হল কুসুমের প্লটটা নিয়ে। কুসুমের শ্বশুর যখন ওখানে থাকত, তখন রাস্তাটা ছিল না। পরে রাস্তাটা হয়েছে। ফলে ওর প্লটটা হয়ে গেছে রাস্তার ধারে। আমি ট্রাক্টরটা উঠোনে নিতে পারি না, স্পেস কই? ত্রিপল দিয়ে রাস্তায় ঢেকে রাখি। কুসুমের প্লটটা পেলে ওখানে একটা শেড় করে ট্রাক্টরটা রাখব। আমার বাড়ির কাছাকাছিও হবে। ওটা আমার পেতেই হবে আমিতাভদা।
— আর কুসুম? কুসুম কোথায় যাবে?
— কুসুম? ওর কথা কি আমি ভাবব না ভেবেছেন? ওকে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেব।
— ব্যবস্থাটা কী করবেন ঠিক করুন, তাতে কুসুম রাজি হোক, পঞ্চায়েতকে বলুন, তারপর দেখা যাবে।
অমিতাভ ওঠে। বিকাশ দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ফিরে আসবার সময় বিকাশের স্বগতোক্তি শোনে।
খুব দরদ হয়েছে দেখছি। ওকে আমিই তো ফিট্ করে দিয়েছিলাম।
মাঠে যাবার পথে নস্করীবাবু অমিতাভর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল— একটা কথা বলছি স্যার, মনে কিছু করবেন না। আপনার ঘরে যে মেয়েছেলেটা কাজ করে, তার একটু উনকুট্টি আছে। মাটির তলার তেল খোঁজার পার্টি এয়েছিল না গ্রামে, তাদের চঞ্চলবাবু নামে একজনের সঙ্গে খুব লটঘট করেছিল। বিয়ের পরই তো ওর স্বামী লিভার পচা রোগে শয্যাশায়ী, অথচ বাচ্চাও একটা হল। লোকে বলে… কিছু ব্যাড মাইন্ড করলেন না তো স্যার, অনেকে আপনাকেও নিন্দেমন্দ করে, আপনাকে ভালবাসি, তাই বললাম।
অমিতাভ কুসুমকে তাড়িয়ে দেয়।
কুসুম চুপচাপ দাড়িয়ে হাত কচলায়। ভাসা ভাসা চোখের দৃষ্টি অমিতাভর দিকে।
— কিছু বলবে?
কুসুম মাথা নাড়ায়।
অমিতাভ টাকাপয়সা হিসেব করে দিয়ে দেয়। দু’ টাকা বেশি।
কুসুম তবু দাঁড়িয়ে থাকে।
— কিছু বলবে?
কুসুম মাথা নাড়ায়।
— তবে যাও।
কুসুম চলে যায়। শাড়ির আঁশটে গন্ধ থাকে।
পরের দিন সকালেই দেখা গেল কুসুমকে ওর ঘরে মরে পড়ে আছে। মুখ থেকে গাঁজলা উঠছে।
অমিতাভ ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। কুসুমকে ছাড়িয়ে দেবার কথা কাউকে বলতে পারে না, নস্করীবাবুকেও নয়। মানুষের চোখ দেখলেই ভয় পায় অমিতাভ। দু-এক জন বেশ কড়া মেজাজেই অমিতাভকে জিজ্ঞাসা করেছে— কুসুমের কী হয়েছিল বলুন। অমিতাভ বলেছিল বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না। কুসুমের বাবা অমিতাভকে কিছু বলেনি। বংকা যেমন বিড়বিড় করে, তেমনি করত, মাঝে মাঝে বলত— মরণ নেকা ছিল। বলাই জানে, বেগুনপোড়ায় মরণ নেকা ছিল, কুসুম করবে কী? তেলের ভিতর মরণ নুইকে থাকলে কুসুম করবে কী?
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এল। কুসুমের পাকস্থলিতে পোকা মারার বিষ পাওয়া গিয়েছিল।
পুলিশ এনকোয়ারিতে এসেছিল— নিরাপদবাবুদের বাড়িতে। দুধ মারা ক্ষীরের নাড়ু ও চা যথারীতি ছিল। অমিতাভর ডাক পড়ল। অমিতাভ চকচক করে জল খেয়ে ওবাড়িতে গেল। ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে থাকলেই হত। ওঘরে ঢুকবার আগেই গলা শুকিয়ে গেল আবার।
— আপনার ঘরে কাজ করত?
— হ্যাঁ।
— কিছু হয়েছিল নাকি?
— না।
— ফ্র্যাংলি বলুন মি. মুখার্জি, ধরুন না গসিপিং হচ্ছে। মেয়েটার শুনেছি ক্যারেকটার ভাল ছিল না। এরকম কোনও ঘটনা হয়েছিল যে ও আপনাকে অ্যাপ্রোচ করেছিল, আপনি রিফিউজ করেছেন।
— না।
— লাস্ট আপনার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল?
বিকাশ তাকাল অমিতাভর দিকে। একটা চোখ টিপল। বিকাশ পুলিশকে বলল— কুসুম মুখার্জিবাবুকে নাকি চঞ্চলবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। বলেছিল— কলকাতায় চঞ্চলবাবু নামে কাউকে চেনে কি না।
— চঞ্চলবাবুটি কে?
— ওই চঞ্চলবাবুর সঙ্গেই কুসুমের গণ্ডগোল ছিল। ওই যে ও ওন জি সির তেল খোঁজার পার্টি এসেছিল, ওদের চঞ্চলবাবু নামে একজনের সঙ্গে খুব লটঘট হয়েছিল। বাচ্চাটা নিয়েও কোশ্চেন আছে।
বিকাশ পুনরায় অমিতাভর দিকে তাকায়।
ন্যাচারালি, মুখার্জিবাবু বলেছিল— ও নামে কাউকে চেনে না।
— কেসটায় বেশ ঘ্যানাপ্যাচা আছে। কমপ্লিকেটেড। আসুন না থানায় আজকালের মধ্যে। ডোন্ট ওরি।
বিকাশ অমিতাভকে পরে বলেছিল— চিন্তা করবেন না স্যার, সব ম্যানেজ হয়ে গেছে।
কুসুমের ননদ থাকে পাশের গাঁয়ে। কুসুমের বাচ্চাটাকে সে নিল। পঞ্চায়েতের মিটিং-এ ঠিক হল— বিকাশবাবু মানবতার খাতিরে পাঁচশো টাকা কুসুমের ননদকে বাচ্চাটা মানুষ করার জন্য দেবে। বিধবা কুসুম যে জমিটায় থাকত ওটার মালিক তো আসলে চ্যাটার্জিরাই, ওদের থাকতে অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কুসুমের মৃত্যুর পর ওই জমির মালিক চ্যাটার্জিরাই। আইন অনুযায়ী এটাই ব্যবস্থা।
একজন চোয়াড় গোছের পঞ্চায়েতের লোক বলেছিল— কুসুম বিষ তো খেইচে, কিন্তু ওই কীটপোকা মারার বিষ সে পেল কোন থে?
বিকাশ বলে— হ্যাঁ। আমাদের বাড়িও ঝাড়পোঁছ করত কুসুম। অন্য বাড়িও কাজ করত। কোত্থেকে বিষ চুরি করেছে কে জানবে, আর চুরি করে খেলে আমরাই বা কী করব?
কুসুমকে ছাড়াই সেবারের নবান্ন হয়ে গেল। ধনে গাছে সাদা ফুল, সরষে গাছে হলুদ ফুল। কৃষ্ণচূড়া শিরিষ আর আমড়া গাছের পাতা ঝরল, আবার নতুন পাতা এল, বসন্তের হাওয়া এল, দু-চারটে কোকিল এল।
ও এন জি সির তেল খোঁজা গাড়ির চাকার দাগ মুছে গিয়ে এখানে ওখানে এখন ট্রাক্টরের চাকার দাগ। কুসুমের ভিটেয় এখন উঁচু অ্যাসবেসটাসের শেডের তলায় বিকাশের লাল ট্রাক্টর দাড়িয়ে থাকে।
আজ অমাবস্যা। সকাল থেকে মাইক বাজছে। বিকাশ আজ কালীপুজো দিচ্ছে। ট্রাক্টরটাকে জবাফুলের মালায় সাজিয়েছে। ওই শেডের তলায় কালীমূর্তি। থানায় ও সি, পঞ্চায়েতের লোকজন সবার নিমন্ত্রণ। অমিতাভদেরও অফিসসুদ্ধ নিমন্ত্রণ। রাত্রে জেনারেটর চালিয়ে ভি ডি ও শো হবে। মুনিষ মজুরেরা, যাঁরা ট্রাক্টরের কারণে অনেকেই কাজ পাবে না, সবাই আজ রাতে ভি ডি ও দেখবে। অমিতাভ আজ কলকাতা যাচ্ছে, দিন পনেরোর ছুটিতে।
ঘর বন্ধ করে চাবিটা দিতে গিয়েছিল নিরাপদবাবুর কাছে। নিরাপদবাবু বললেন— বিকাশটা কী শুরু করেছে দেখেছেন? ট্রাক্টর ট্রাক্টর করে একেবারে পাগলপারা হয়ে গেল। কী করে কিছু ঠিক নেই। ও তো আপনার ভাইয়ের মতো, একটু বোঝান না।
কী বোঝাবে অমিতাভ? অমিতাভ কিছু না বলে চলে আসে।
একটু বসুন মুখার্জিবাবু। আপনার বাড়ির জন্য একটু সরষের তেল নিয়ে যান। নতুবা সরষে উঠেছে, সবে ভাঙা করিয়েছি।
অমিতাভ বলে— না, না, ওসব নেয়া যাবে না।
— কেনে?
— এতটা বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
— সে আমি লোক দিয়ে দেব।
— না-না-না, তা হয় না। লোকে কী ভাববে, নানা, আমি এইসব নিতে পারব না।
নিরাপদ বললেন— তবে আর একটু বসুন, এক্ষুনি আসছি। একটা খাম নিয়ে এলেন। বললেন— সামান্য কিছু আছে, আপিত্য করবেন না। এটা মনে করুন আমার আশীর্বাদ। আপনি আমার ছেলের মতো… আমবাগানের কেসটা আপনি করে দিলেন। কিছু না দিলে অন্যায় হবে।
অমিতাভ চারিপাশে তাকায়। শুধু একটা টিকটিকি আছে দেয়ালে আর মাইকে ‘জিলে লে— জিলে লে—…’অমিতাভ খামটা পকেটে পুরে নেয়।
রাস্তার মুখটাতে বিকাশ। কপালে তেল-সিঁদুরের লাল তিলক। খালি গা। বলল— আজ রাত্রে থেকে যেতে পারতেন অমিতাভদা। ভি ডি ও আনছি। টারজন, শোলে, প্রেমনগর…
অমিতাভ হাঁটছে। কোকিল ডাকল। মাইকের গান। একটা সাপের খোলস পড়ে আছে।
বুকের ভিতরটা খচখচ করে ওঠে অমিতাভর। পকেটের ভিতর থেকে বার করে। গোনে না। চারিদিকের হা— হা— শূন্যতার মাঝে অ্যাটাচি বাক্সটা খোলে। খামটা ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়, সামনের একাকী তালগাছটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
জলতেষ্টা পায় অমিতাভর। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।
আরও তিনটে গ্রাম পেরুলে বাসরাস্তা।
কী বলতে চেয়েছিল কুসুম? বলতে গিয়ে বলেনি?
রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে বংকা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা ছিপি আঁটা পলিথিনের পাত্র। বংকা বলল— আপনার জন্য দাঁড়া হয়ে রইছি। মুনিব পাঠাইলেন। মুনিবের হুকুম— বাসে উঠে দিতে হবে। আর এই চিঠি।
‘ঘানিতে ভাঙা সরষের তেল পাঠাইলাম। আপনার বাবাকে নমস্কার জানাবেন। বংকা বাসে উঠাইয়া দিবে। আপনার চিন্তা নাই।‘
বংকা বলল— আপনি আগে রওনা হয়েছেন, আর আমি মাঠ ঠেঙে দৌড়ে কত আগে এসে গেছি দ্যাখো।
অমিতাভ ভাবে ওকে ফিরিয়ে দেবে। তারপরই মনে হয়, থাক না, এই পাগলটা ছাড়া পৃথিবীতে কেইবা জানছে আর, খাঁটি তেল, দিদির বাচ্চা হবে, খুবই কাজে লাগবে। মাও খুব খুশি হবে। বাবা তেলমুড়ি খেতে ভালবাসে। বিদিশাকেও এক শিশি দেবে। সেবার ডায়মন্ডহারবারের হোটেলে গরম ভাত পেয়ে একটু হলুদবাটা আর সরষের তেল চেয়ে নিয়েছিল বিদিশা। খুব ভালবাসে।
অমিতাভ বংকাকে বলে— আমি এসব একদম পছন্দ করি না, বুঝলে, পাঠিয়ে দিয়েছে কী আর করা যাবে, চলো।
বংকা চলে। চলতে চলতে বলে—বলাইয়ের কেমন চাতুরী,
বাবু আনলেন ধরি।
যে রাঁধে না তাকেও দেয়।
আবার রাঁধুনি নেই তো রান্না হয়। খাও বাবু, ভাল তেল, তোমার তেলে দোষ নাই। তোমার কুসুম পানা গতি নাই। ভাঁড়ার থিকে আনি নিজ্জে ঢেলেছি।
— এসব কী বলছ বংকা?
— বলছি বাবু বলায়ের দহায়। আপনার তেলে বিষ নাই। আপনার কুসুম পানা গতি নাই।
— কুসুমের কী হয়েছিল জানো?
— মরণ হইছিল। মরণ। বলাই ডেকেছিল। গরিবের ঢ্যামনামি হইছিল। বেগুনপোড়া তেল দে মেখে খাবার শখ হইছিল। গরিবের ওই শখ হয় কেন?
— তারপর?
— আর জানি না। গুরুর মানা। না জেনে বলতে নাই। তবে এট্টু তেল চেয়েছিল, বেগুনপোড়া মেখে খাবে বলে আমাদের ছোটবাবুর কাছে, এটু তেল চেয়েছিল সেটা আমি নিজে শুনেছি গ— শুনেছি।
— তা তুমি একথা আগে বলোনি কেন?
— কতই তো বললাম। বোবায় বলল— কালায় শুনল। বাঁজা নারীর ছেল্যা হল। তোমরা আমায় পাগলা বলল, ছাগলা বলো, আমার কথার দাম কী?
বংকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, ভিটেটা ছাড়তে কুসুম, পিরথিমির ভিটেটাই ছাড়লি…
— তা তুমি এ কথা বলোনি কেন?
— তা বোবায় বলবে কালায় শুনবে, বাঁজা নারীর ছেল্যা হবে। আমায় বলে পাগলা ছাগলা, আমার কথার দাম কী?
সামনের গ্রামটা নিকটবর্তী হয়। বংকা বলে— আমার লাতিটার জন্য এটু তেল দেবে বাবু?
— তোমার নাতি?
— হ। আমার লাতি, মানে কুসুমের ছা, এই গাঁয়ে ওর পিসিমার কাছে আছে।
অমিতাভ বলে— নিশ্চয়ই দেব, যতটা খুশি নাও, কীসে নেবে? এই সব সুষ্ঠু নিয়ে নাও।
বংকা বলে— এটু গাঁয়ে চলুন বাবু, এই তো সামনে।
কী আর করা যাবে। বংকার পিছু পিছু চলল অমিতাভ। রাস্তায় শুকনো বিষ্ঠার মধ্যে মরে থাকা কৃমি। সামনে গ্রাম।
এই যে, এই ঘর। ঘরে লতুন খড় দেছে দ্যাকো, আলকাতরা দেছে। পাঁচশো টাকার খেলা। কুসুম মরেছে, এনাদের ঘরে ট্যাকা এসেছে, পাঁচশো ট্যাকাগো বাবু।
বংকা হাঁক দেয়। লাতিটারে একবার হ্যাকা দিনি, চোকের দ্যাকা দেখি এটু। এক মহিলা শিশুকে নিয়ে এল। রোগা গায়ে ছটফটায় বংকার নাতি।
— শিশি দে দেকি একটা, বংকা বলে। ঘর থেকে শিশি আসে। থ্রি এক্স রামের। বংকা বলে— মাটির তলায় তেল খোঁজার বাবুদের।
বাবুর থে তেল চেয়ে নিচ্ছি এটু। রসুন দে ফুট্টে লিবি। খুব দলাইমলাই করবি, বুজলি। বংকা তেল ঢালে শিশিতে।
আর একটু নাও না, ভরতি করে নাও, অমিতাভ বলে।
বংকা হাতের চেটোয় একটু তেল নিয়ে ছেলেটাকে মাখায়। দলমলে হবি ব্যাটা, ভীম হবি, ভীম, দুর্যোধন শালাকে দিব্বি— এক্কেবারে পটকে, হেঁ-হঁ হেঁ… আজকে হল হাপুস হাপুস কালকে হবে ভোজ, কার জিনিস কে লিয়ে পালায় খোঁজরে ব্যাটা খোঁজ… দলমলে হবি ব্যাটা দলমলে হবি…
বংকা আগে আগে চলে। দুটো ফড়িং-এর ভোঁ ভোঁ আর প্লাস্টিক পাত্রে হালকা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আর মাইলটাক পথ। রাস্তায় একটা সাপ। চিৎকার করে ওঠে অমিতাভ। বংকা খুব শান্ত গলায় বলে— ঢোঁড়া। অমিতাভ বলে— এত সাপ কেন বল তো, কত খোলস দেখলাম। বংকা বলে— শীত ঘুমের পর এখন সাপেরা সব জাগতিছে। কিন্তু এটা ঢোঁড়া। সামনে গিয়ে জোরে লাথি মারে বংকা, সাপটা মাঠে গিয়ে পড়ে।
ঢোঁড়া সাপের বিষ নেই, তাই না বংকা?— অমিতাভ বলে।
— না, ঢোঁড়ার বিষ নাই। আগে ছিল। সব সাপের চেয়ে ঢোঁড়ার বিষ ছিল বেশি।
— তারপর?
— মা মনসা তো ঢোঁড়াটাকে পাঠাইলেন লখীন্দরের লোহার বাসরে। ঢোঁড়া সাপ লদী পার হচ্ছে— শুনুন তবে গল্পটা—
আঁকিয়া বাঁকিয়া ঢোঁড়া গাং পার হয়।
গংগা দেবী সে সময় কৌশল করায়।
সিরজিলেন মায়া মৎস্য ঢোঁড়ার সম্মুখে।
মাছের ঝাঁক দেখ্যে ঢোঁড়ার নোলা আসে মুখে।
ক্যানোনা, গংগা দেবী জানতেন, ঢোঁড়ার বিষ আছে বটে কিন্তু লোভটাও আছে বড়, ঢোঁড়া তখন কললে কী—
বিষ দন্ত খুলে ঢোঁড়া পদ্মপাত্রে রাখে
তারপর ছুটে গেল মাছের সম্মুখে।
ঢোঁড়া তখন সব ভুলে গেল বাবু। মা মনসা যে কাজের ভার দেছিলেন সব ভুলে গিয়ে মাছের পিছনে ছুটল ঢোঁড়া।
অমিতাভ বংকার মুখের দিকে তাকায়। বংকা নির্লিপ্ত। দূরের মাঠের দিকে চেয়ে ভাবলেশহীন বংকা বলে যায়—
বহু দূরে চলে গেল ঢোঁড়া। তারপর হল কী মায়া মৎস্য অদৃশ্য হয়ে গেল।
তারপর ফিরে এল ঢোঁড়া। যে পদ্মপাতে বিষদাঁত রেখেছিল, সেখানে গিয়ে দেখে—
বোলতা ভীমরুল চেলা এবং পিঁপড়ি,
মৌমাছি কাঁকড়া বিছা নিছে লুট করি।
সেই বিষদাঁত আর সে পায় না। তারপর কেঁদে পেদে ও মনসার কাছে ফিরে গেল।
মা মনসা বলল— ছি— ছি— ছি, এত লোভ তোর? মাছের লোভে কাজ ভুললি?
অমিতাভ বংকাকে ফেলে এগিয়ে যায়। শুকনো ধানগাছের গোড়া ওর পায়ে খোঁচা দেয়। শূন্য মাঠের হা-হা উত্তপ্ত হাওয়ায় ওর কপালের ঘাম শুকোয়। মাথার মধ্যে হ্যাজাক বাতির শোঁ- শোঁ।
বংকা চেঁচিয়ে বলে— সেই থেকে ঢোঁড়ার আর বিষ নেই গ বাবু। যে মানুষ ঢোঁড়াকে দেখলে ভয়ে পালাত, সে মানুষ এখন ঢোঁড়াকে পায়ে মারে, পিষে মারে।
অমিতাভ মাঠের মধ্যে কিলবিল করে।
পরিচয়, ১৯৮৭