ঢোঁড়াই চরিতমানসের ভূমিকা – ড. স্বস্তি মণ্ডল

ভূমিকা (ড. স্বস্তি মণ্ডল)

সতীনাথের সাহিত্যচর্চার প্রমাণ স্কুল ম্যাগাজিন বা পরে বিচিত্রা ১৩৩৮। নবশক্তি পত্রিকায় গান্ধীজীবিষয়ক প্রবন্ধ বা স্যাটায়ার জাতীয় রচনা প্রকাশ পেলেও প্রকৃত অর্থে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রস্তুতি ও উদ্যোগ পর্বের সূচনা ১৯৪২-৪৩-এ ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের নির্জন সেলে। ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনে গান্ধীবাদী এক্স নাম্বার (অর্থাৎ অতি সাংঘাতিক) ডেটিন হয়ে প্রথমে পূর্ণিয়া জেলে ও পরে জেলভাঙ্গা আন্দোলনের অংশীদার সন্দেহে ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি হন। এর আগে ১৯৪০-এ সত্যাগ্রহী রূপে, ১৯৪১-এ ছমাস ও পরে ১৯৪৪-এ ব্যক্তিগত রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য কারাবাস করেন …

জাগরীর পর ঢোঁড়াই চরিতমানস প্রথম ও দ্বিতীয় চরণ। কিন্তু ঠিক পরেই নয়। এর আগে লিখেছেন চিত্রগুপ্তের ফাইল। ঢোঁড়াই চরিতমানস প্রথম চরণ  দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১৩৫৫ সালের ১৫-ই জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে ২৫-এ ভাদ্র সংখ্যায়। নাম ছিল- সটীক ঢোঁড়াই চরিতমানস প্রথম চরণ। পরে ১৯৪৯ সালে, বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে প্রথম চরণটি প্রকাশিত হয়। চিত্রগুপ্তের ফাইল উপন্যাসটির সূচনা ধারাবাহিকভাবে ঢোঁড়াই চরিত রচনার অল্পকাল আগে। এ গ্রন্থটি মাসিক বসুমতী পত্রিকায় ১৩৫৫ সালের মাঘ সংখ্যা থেকে ১৩৫৬ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় মীনাকুমারী নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তার আগে এই উপন্যাসটি মাতৃভূমি পত্রিকায় চিত্রগুপ্তের ফাইল নামে ১৩৫৫ ভাদ্র থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে কিন্তু পত্রিকাটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। চিত্রগুপ্তের ফাইল গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৯-এ। ঢোঁড়াই চরিতমানস দ্বিতীয় চরণ দেশ পত্রিকায় ১৩৫৭, ১৩ই জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা থেকে ৩০-এ ভাদ্র সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ সালে বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

 এই উপন্যাস দুটিতে জাগরীর মতো সতীনাথের রাজনীতি সচেতন অভিজ্ঞতার বিশেষ প্রকাশ ঘটেছে। চিত্রগুপ্তের ফাইল উপন্যাসের চরিত্রগুলি গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে এমন রাজনৈতিক দলের অংশীদার। অভিমন্যু, শিউচন্দ্রিকা এরা রাজনৈতিক কর্মী ও ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা। এ উপন্যাসে শ্রমিকজীবন, সাধারণ মানুষ গুরুত্ব পেয়েছে।

 জাগরীর মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্কট থেকে লেখক ক্রমেই দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থসঙ্কট-সমস্যা, রাজনৈতিক সচেতনার প্রতি বিশেষ মনঃসংযোগ স্থাপন করতে আগ্রহী তা এ উপন্যাস পড়লেই বোঝা যায়। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বিরোধ ধীরে ধীরে উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাচ্ছে তা চিত্রগুপ্তের ফাইল পড়লে স্পষ্ট হয়। অবশ্য এর আগে মোহনা উপন্যাসে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক-সংশয়কে চিত্রিত করেছে। চিত্রগুপ্তের ফাইল-এ সতীনাথের রাজনীতি সচেতন মন বুঝেছিল শ্রমিকের সঙ্গে কৃষকের ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। কৃষক-শ্রমিক ঐক্যশক্তির কল্পনা জনমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাৎপর্য সূচক ঘটনা এবং সে বিষয়ে সতীনাথের চিন্তা অত্যন্ত আধুনিক ভাবনার প্রকাশ বলে মনে করা যেতে পারে। শ্রমিক নেতা অভিমন্যু বলীরামপুর জুটমিলের অসৎ সহকারী ম্যানেজারের মিথ্যা চক্রান্তে অপমানিত হয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে শাস্তি পেয়ে গ্রামে চলে আসে। অভিমন্যু পারত অপমানের উত্তর দিতে কারণ তার সঙ্গে ছিল মীনাকুমারীর চিঠি, কিন্তু তা না করে সে চলে এলো ভিন্ন জীবনে- কৃষিজীনের সংস্পর্শে; এখানে নিজেকে অন্যভাবে গড়ে তুলল। কিন্তু অভিমন্যুর জীবন ব্যর্থতার গ্লানিতে ভরা। কৃষক-পুলিশ বিরোধে জমিদারের লাঠিতে সে জখম হয় ও মারা যায়, তার চিতার আগুনে শিউচন্দ্রিকা পাঠ করল সেই গোপন চিঠি। নিরাপরাধ অভিমন্যুর কথা সকলে জানল। চিত্রগুপ্তের ফাইল উপন্যাসে শ্রমিক জীবনের সঙ্গে সতীনাথের সক্রিয় সাহচর্য ও অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পেয়েছে। যে সময় উপন্যাসটি লিখছেন, সেইসময় কংগ্রেস ত্যাগ করে এসেছেন কারণ সদ্য স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কংগ্রেসকে ঘিরে কপট দেশসেবক ও স্বার্থান্বেষীদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষ, যারা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নিয়ে স্বাধীনতার কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, স্বাধীনতার পরে তারা উপেক্ষিত হয়েছে। এক অর্থে বিপুল জনশক্তি প্রবঞ্চিত হয়েছে। সতীনাথ সাধারণ মানুষের বিপ্লবী ভূমিকাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জাগরী উপন্যাসে ঐ বইটি উৎসর্গ করেছেন যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মীর কর্ম নিধবা ও স্বার্থত্যাগের বিবরণ, জাতীয় ইতিহাসে কোনদিনই লিখিত হইবে না, তাঁহাদের স্মৃতির উদ্দেশে- এই মানবিক সহানুভূতিই দ্রষ্টা সতীনাথকে লেখক বা স্রষ্টা রূপে গড়ে তুলেছে। রাজনৈতিক দল ছেড়ে এসেছেন। সঠিক পথের সন্ধানে ফিরছেন ১৯৪৮-এ। চারমাস কোনোদলেই যোগ দেননি। শেষে অল্পদিনের জন্য কংগ্রেস-সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন অল্পদিনের জন্য। চিত্রগুপ্তের ফাইল-এ যে ট্রেড ইউনিয়নের ছবি এঁকেছেন তা ১৯৪৮ সময়কালে বিহারের কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সে সময় সতীনাথের মনে মনে প্রবল আস্থা সাধারণ মানুষের প্রতি। ভেবেছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যেই রয়েছে সমাজের উন্নতির হাতিয়ার। বুঝতে অসুবিধে হয় না গণ অভ্যুত্থানের আদর্শ, রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন সতীনাথকেও উদ্বুদ্ধ করেছিল। আরো বোঝা যায় কেন তিনি রাশিয়া যাবার জন্য মনে মনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বা রূশ ভাষা লিখছেন। প্রায় দশ বছর আগে কাটহার জুটমিলে শ্রমিক-মালিকের বিরোধে অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই উপন্যাসে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। রাজনীতি-সচেতন সতীনাথ বুঝেছিলেন আধিয়ার-শ্রমিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার গণজাগরণ ঘটাবে। কারখানার মালিকের মিথ্যাচক্রান্তে অপমানিত হয়ে বলীরামপুর জুটমিলের শ্রমিক নেতা অভিমন্যু গ্রামে চলে আসে।

উপন্যাসটিকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে গড়ে তোলার অনেক সম্ভাবনা ছিল। শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক উপাদান। বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত বর্ণনায় কারখানার মালিকের অন্যায় লোভ, ব্যভিচার, হীনচক্রান্ত, অভিমন্যুকে বদনাম দিয়ে সরাবার চেষ্টা-প্রভৃতির বর্ণনা বাস্তবানুগ। মালিক পক্ষের অন্যায় জুলুমের প্রতিবাদে শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, উপযুক্ত নেতৃত্বের প্রয়োজন প্রভৃতি সতীনাথ বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। বলীরামপুর জুটমিলের মালিক ও মজদুর ইউনিয়নেরর দ্বন্দ্ব, বিহার অঞ্চলের জমিদার-আধিয়ার, জোতদার বাটাহারদের সংঘর্ষ, মিল ম্যানেজার ম্যাকলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জয়নারায়ণ; মালিকপক্ষের সঙ্গে পুলিশ, . এস.ডি.ও এবং সরকারি আমলাদের গোপন আঁতাত; মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরাবার জন্য তৃতীয় শক্তিকে সাহায্য; শ্রমিক কল্যাণের খাতে বরাদ্দ টাকা নিজেদের স্বার্থে ব্যয়- এসব বাস্তব ছবি আঁকতে আঁকতেই সতীনাথ নিজেও স্থির করে ফেলেছেন আর কোনো রাজনৈতিক দলে তাঁর পক্ষে আপোস করে থাকা সম্ভব নয়। এই উপন্যাসে শিউচন্দ্রিকাকে তিনি যুক্তিবাদী একরোখা নিষ্ঠাবান শ্রমিক নেতা রূপে এঁকেছেন। অভিমন্যু তুলনায় ভাবপ্রবণ, আদর্শবান প্রেমিক জাগরীর বিলুর অনুরূপ চরিত্র। অভিমন্যু তার ভাবাবেগ, স্বপ্নসন্ধানী মন নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিল। বুঝতে পারেনি সুবিধাবাদী শয়তান মিল মালিকের ব্যূহে প্রবেশ করলেও বেরিয়ে আসা কঠিন। তুলনায় শিউচন্দ্রিকা জাগরী-র নীলুর মতোই আদ্যন্ত কঠোর যুক্তিবাদী সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী। অভিমন্যুর কোমলতা, আত্মত্যাগ, প্রেমের মাধুর্য, গান্ধীজী সম্পর্কে গভীর আনুগত্য পাঠককে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে।

সতীনাথ এই উপন্যাসে অভিমন্যু-মিনাকুমারীর সম্পূর্ণ প্রেমকাহিনী এঁকেছেন। সেখানে লেখকের জীবনরস সন্ধিৎসা স্পষ্ট হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে অভিমন্যু শিউচন্দ্রিকা পরস্পরের সহযোগী হলেও অভিমন্যু একটু আলাদা স্বভাবের। তার। জীবনে মিনাকুমারীকে কেন্দ্র করে গোপন অধ্যায় গড়ে উঠেছিল যার অনেকটাই শিউচন্দ্রিকার কাছে অজানা ছিল। অনাথালয়ে পালিতা মিনাকুমারী বলীরামপুর জুটমিলের ক্যান্টিনে কেশরপার্ক মিষ্টির হিসাব রাখার কাজে নিযুক্ত হয়েছিল। সেখানেই অভিমন্যুর সঙ্গে তার দেখা হয়। সরল সহজ অভিমন্যুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। সে তাকে ভালোবাসে। অনাথা মিনাকুমারী আজন্ম দুঃখের সঙ্গে লড়াই করেছে বলে অভিমন্যুর মতো রাজনৈতিক কর্মীর অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনে জীবযোগ করতে ভয় পায়। ঘর বাঁধতে দ্বিধা করে। কিন্তু আবেগচঞ্চল অভিমন্যু মিনাকুমারীকে নিজের করে পাবার জন্যে মিনাকুমারীর চিঠির উত্তরে চিঠি দেয় এবং তাকে গোপনে দেখা করতে বলে। কিন্তু সে চিঠি জুটমিলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জয়নারায়ণ প্রসাদের হাতে যায় এবং শ্রমিক নেতার চরিত্রহনন করবার জন্য চিঠিটি ম্যাকলীনসাহেবকে দেয়। জয়নারায়ণ প্রসাদ শুধুমাত্র মালিকের কাছে অভিমন্যুকে অপদস্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে শ্রমিকদের কাছেও হেনস্থা করতে চেয়েছে। অভিমন্যুর জনপ্রিয়তা নষ্ট করাই কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য।

অভিমন্যু এ অপমান ফিরিয়ে দিতে পারত কারণ তার ঝোলায় মিনাকুমারীর তাকে লেখা চিঠিগুলি ছিল। কিন্তু সহিষ্ণু রুচিবান, আদর্শবান অভিমন্যু নীরবে শ্রমিক জীবন থেকে সরে এসেছে। গ্রামে আধিয়ারদের সঙ্গে একত্রে ফসলের লড়াইয়ে অংশ নিয়ে কর্মক্ষেত্র বদল করে। সে আহত হয়। আহত অবস্থায় জানতে পারে গান্ধীজীর মৃত্যু হয়েছে। উত্তেজিত অভিমন্যু এ সংবাদে বিপর্যস্ত হয় এবং মারা যায়। রাজনৈতিক বন্ধু শিউচন্দ্রিকা তাকে দাহ করবার সময় ঝোলা থেকে মিনাকুমারীর লেখা চিঠিগুলি পায়। এবং সেখান থেকেই সব সত্য জানতে পারে। শিউচন্দ্রিকা মিনাকুমারীকে চিঠিগুলি পাঠিয়ে দেয়? শুরু হয় মিনাকুমারীর অনুশোচনা ও পরিণামে আত্মহত্যা। এভাবেই শেষ হলো অভিমন্যু- মিনাকুমারীর অসম্পূর্ণ প্রেমের ট্র্যাজেডি। আর শ্রমিক নেতা শিউচন্দ্রিকার ট্র্যাজেডিও এঁকেছেন সতীনাথ। একজন সৎ নিষ্ঠাবান শ্রমিক নেতা শিউচন্দ্রিকা শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হতাশ চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তার ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক জীবনে কোনো বিরোধ ছিল না। প্রচণ্ড নিষ্ঠার সঙ্গে তিল তিল করে সে জুটমিলের শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলেছে। মালিকের অন্যায় জুলুমের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে শ্রমিক সংগঠনকে। আর ব্যক্তিগতভাবে অভিমন্যুকে সে ভালোবাসত। অভিমন্যুর শ্রমিকপ্রীতি, কর্মপ্রচেষ্টা, জনপ্রিয়তা, আত্মত্যাগের আবেগ-প্রভৃতি গুণের জন্যই শিউচন্দ্রিকা শ্রমিকদরদী অভিমন্যুকে ভালোবাসত। একদিকে অতি প্রিয় অভিমন্যুকে হারানোর বেদনা অন্যদিকে শ্রমিক-স্বার্থবিরোধী মালিকের চক্রান্তে রাজনীতির ভয়ঙ্কর বিনষ্টি শিউচন্দ্রিকার মতো আদর্শনিষ্ঠ নেতাকে হতাশ করেছে। সতীনাথ দেখেছেন আদর্শবান অভিমন্যু ও শিউচন্দ্রিকারা স্বাধীনতার অব্যবহিত কালের মধ্যেই রাজনৈতিক জীবনে কিভাবে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো দেখেছেন স্বাধীন ভারতবর্ষে মালিক- জমিদার-থানার দারোগা প্রভৃতির চক্রান্তে কৃষক শ্রমিকের গণআন্দোলন কিভাবে পরাভূত ও ব্যর্থ হয়। স্বাধীন-ভারতের সাধারণ দেশবাসীর এই পর্যদস্ত অবস্থা তাঁর লেখকসত্তাকে জাগিয়েছে। শাণিতবঙ্গ, ক্ষুরধার শ্লেষে তিনি জাগরীর বিলু-নীলু, চিত্রগুপ্তের ফাইল উপন্যাসে অভিমন্যু-শিউচন্দ্রিকা এর্ব। ঢোঁড়াই  চরিমানসের দুটি চরণে ঢোঁড়াইদের মতো সৎ আদর্শবান প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন ও সরকার মাথায় এখন রাজ্যের ঝঞ্ঝাটের বোঝা, পড়ে পাওয়া আজাদীর নানারকম ফ্যাকড়া। কিন্তু এই কমাসে রাজ্যের ঝঞ্ঝাটের বাধা না মেনে এক হাঁটু কাঁদার মধ্যে দাঁড়িয়ে পোঁতা শ্যামলধানের চারাগুলি সোনার বোঝারভারে এলিয়ে পড়েছে আলোর উপর। ধানের ধর্ম ধান মেনেছে। আর জমিদারও তার ধর্ম ভোলেনি। এ পাঁচমাস অযোধিয়া চৌধুরী নিজে সে মঘৈলী থানায় দারোগা সাহেবকে ভেটপাঠাতে ভোলেনি একদিনও। পুলিশ নিমকহারাম নয়, যার নুন খায় তার গুণ গায়। সেই ভরসাতেই অযোধিয়া চৌধুরী জমি থেকে বেদখল করতে সাহস করেছে অগণিত রায়তদের যারা বংশ পরম্পরায় এই জমিতে অশ্রু আর ঘামের রস যুগিয়ে এসেছে।

পুলিশ আর অযোধিয়া চৌধুরীর লেঠেলরা রায়তসহ অভিমন্যুর ওপর আঘাত হেনেছে। আহত অভিমন্যু অজ্ঞান হয়ে ক্ষেত্রে আলের উপর পড়ে গিয়েছিল। এসব ঘটনা থেকেই শিউচন্দ্রিকার মতো সতীনাথও বুঝেছিলেন।

 সতীনাথ নিজে এরপর প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। খুঁজে নিয়েছেন সত্যান্বেষণের অন্য এক পথ। নিবিড় অভিজ্ঞতা তাকে জীবন দ্রষ্টা রূপে সমৃদ্ধ করেছিল। প্রতিটি লেখায় নিজেকে খুঁজেছেন; খুঁজেছেন প্রকাশভঙ্গির নতুন নতুনবাণী।

চিত্রগুপ্তের ফাইল উপন্যাসে রাজনীতি ঘটনা হিসেবে স্থান পেলেও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিমনের অন্তর্মুখী অভিব্যক্তির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ওপরই লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন। সে তুলনায় পরবর্তী উপন্যাস ঢোঁড়াই চরিতমানস প্রথম ও দ্বিতীয়চরণে রাজনীতি অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এই উপন্যাসে রাজনীতি মানুষকে ও তার চির পরিচিত সমাজকে বদলেছে। এই দ্বান্দ্বিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজনীতি ও সমাজনীতির গুরুত্ব অঙ্গাঙ্গি জড়িত; কারণ বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের পর থেকেই ভারতবর্ষের সমাজ ও মানুষ ক্রমে রাজনীতির উত্তাল আবহাওয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। তিরিশ চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক আলোড়ন সমাজের ভিত্তি ভূমিকে আঘাত করেছিল। তাই এ সময়ের সমাজ বলতে রাজনীতি জড়িত বা রাজনীতি নির্ভর সমাজকে বুঝতে হবে। সতীনাথ এই চল্লিশের দশকের সমাজ জীবনের সঙ্গে অভিজ্ঞতাসূত্রে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার মতো দেশ-কাল ব্যক্তি সম্পর্কে সচেতন লেখকের পক্ষে সমকালকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সত্যনিষ্ঠা ও জীবন সন্ধিৎসায় সতীনাথ বাস্তব সচেতন লেখক। তাই স্বাধীনতার পরে রাজনীতির জটিলতায় হতাশ হয়ে রাজনীতি ত্যাগ করে সাহিত্যে সমর্পিত প্রাণ হয়েও বাস্তব জীবন, জন জীবন ও সমকালীন সময় নির্ভর সমাজকে কোনোমতেই অস্বীকার করতে পারেননি। রাজনীতি জনপ্রিয় বিষয় এবং প্রথম উপন্যাসের সাফল্যের পিছনে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ একটা বড়ো কারণ বলেই তার পরের উপন্যাসগুলিতে রাজনীতি প্রসঙ্গ অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে মনে করা এই কারণেই ঠিক হবে না। আরও ঠিক হবে না এই কারণে, যে সতীনাথ কোনোদিনই সস্তা প্রশংসায় আগ্রহী ছিলেন না; বরং তাঁর কাছে তা যে কত অনাদরের ছিল তা বুঝতে পারা যায় চিত্রগুপ্তবাণী প্রতিষ্ঠানের সাহিত্যচর্চায় আকর্ষণ সৃষ্টি সম্পর্কে যে ব্যঙ্গ নির্ভর নির্দেশটি ব্যক্ত হয়েছে তা পড়লে (ক) একটি গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক ঘটনা গল্পের ভিতর ঢুকাইয়া দিবেন।
(খ) খানিকটা রাজনীতি (ফিকা গোছের গল্পের ভিতর যেন স্থান পায়।
(গ) সাধারণ বুদ্ধিতে অবিশ্বাস্য বা অসম্ভাব্য মনে হইলেও স্থূল নাটকীয় উপাদান বহুল পরিমাণে গল্পের ভিতর দিতে ভুলিবেন না।
(ঘ) শোষক ও শোষিতের কথা যেমন করিয়া হউক গল্পের ভিতর আনিতে চেষ্টা করিবেন। (সতীনাথ গ্রন্থাবলী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২৩)।

এই উক্তি থেকে সতীনাথের মনের গতি বোঝা অসম্ভব নয়। রাজনীতি তার কাছে বহিরঙ্গ বিষয় নয়, তা জীবন প্রত্যয়ে সত্য। মানুষকে পরিপূর্ণ সত্যের আলোকে দেখা ও প্রকাশ করাই তাঁর উদ্দেশ্য। ঢোঁড়াই চরিত মানস- এর তো উপন্যাস তাঁকে লিখতেই হতো। রাজনৈতিক কর্মী হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে যে মাটিঘেঁষা সজীব মানুষগুলিকে তিনি দেখেছিলেন তাদের কথা না লিখলে যে তাঁর রাজনৈতিক জীবন পূর্ণতা পেত না তা তিনি বুঝেছিলেন। তাই বোধহয় তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছাড়ার কারণ হিসেবে আপাত এড়ানো কথাটি বলেছিলেন, কংগ্রেসের কাজ স্বাধীনতা লাভ করা ছিল। সে কাজ তো হাসিল হয়ে গেছে। এখন রাজকাজ ছাড়া কোনো কাজ নেই আর। [১] সেই রাজকাজ বড়ো বড়ো কংগ্রেস কর্মীর। সেখানে সতীনাথের পক্ষে মন মেলানো সম্ভব নয়। তাই প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁরও কাজ ছিল। তিনিও দায়বদ্ধ ছিলেন। সে দায় সময়ের সঙ্গে পা ফেলে বদলাচ্ছে যে মানুষ, বিবর্তিত সেই মানুষের কাছে ও সমাজের কাছে। মানুষকে দেখার জীবদর্শনে গভীর আস্থা নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে ঢোঁড়াই  নামের পরিচিত মানুষটিকে তিনি জেনেছিলেন, কাছে পেয়েছিলেন। তাকে বোঝবার ও সকলের কাছে বোঝাবার চেষ্টায় এক নতুন বাণী প্রকরণে লিখলেন, ঢোঁড়াই চরিত মানস দুটি চরণ। নিজেই বলেছেন- আমার কাজ হলো চেনা ঢোঁড়াইকে এমনভাবে বদলানো যাতে সে যাতে সারা দেশের সাধারণ লোকের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তাদের প্রতিবেশের পূর্ণতম সম্ভাবনাটুকু তার চরিত্রের মধ্যে দিতে হবে। …গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার সময় ঐ শ্রেণীর লোকের চরিত্রে, যেখানে যা কিছু ভালো নজরে পড়েছিল, সেই সব সদগুণগুলো দিয়ে তাতমাটুলির ঢোঁড়াইকে সাজাতে আরম্ভ করলাম। [২] শুধু তাই নয়, ঢোঁড়াই  চরিতমানস রচনার জন্য লেখকের মন দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুত হচ্ছিল। নানাভাবে সংগ্রহ করেছিলেন এই জীবন সম্পর্কে তথ্য। তাঁর পরিচিত চোখে দেখা ঢোঁড়াই  নামের মানুষটিকে যত দেখছিলেন ততোই ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠছিল- ইচ্ছা ছিল আমার জ্ঞানে গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ লোকের মন কেমনভাবে বদলাতে দেখেছি, কেমনভাবে তারা ভুল-ভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে মানুষ হিসাবে নিজের অধিকার বুঝে নিচ্ছে, তাই নিয়ে একখান উপন্যাস লিখব। সমগ্র গ্রামীণ সমাজ তুলে ধরবার ইচ্ছা। মানুষ বদলাচ্ছে পরিবেশকে পরিবেশ বদলাচ্ছে মানুষকে। [৩]

এখানে লক্ষণীয়, কেমনভাবে ভুল ভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষ নিজের অধিকার বুঝে নিচ্ছে- এই সামাজিক ও ব্যক্তির অধিকার সচেতনা লেখককে প্রবল প্রেরণা দিয়েছে ঢোঁড়াই -এর পরিবর্তিত জীবন চরিত লিখতে। আর ব্যক্তিজীবন ও সমাজের অব্যাহত চলমান গতির দ্বান্দ্বিক রূপটির মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের অধিকার চেতনাকে চিরন্তন মানবিক গুণে সমৃদ্ধ করে তোলার তাগিদ অনুভব করেই

মানস সরোবরের মতো গভীর ঢোঁড়াই-এর চরিত লিখতে উদ্যোগী হয়েছেন। সারাজীবন জন্ম থেকে শেষবারের মতো পাক্কীর পথ ধরে জাতপাতহীন শ্ৰেণী বর্ণ বিহীন সেই কারান্তরালে নিজেকে সঁপে দেওয়া পর্যন্ত ঢোঁড়াই শুধু পাল্টে গেছে বার বার। আবিষ্কার করেছে নিজের ক্ষমতার ঐশ্বর্যকে। ব্যক্তি ঢোঁড়াই রূপান্তরিত হয়েছে গণপ্রতিনিধি ঢোঁড়ই-এ।

এর পরেও আর একটা চরণ লেখার ইচ্ছে ছিল সতীনাথের। কারণ লেখক তৃপ্ত হতে পারেননি। পারা সম্ভব নয়, মানুষকে দেখার কি শেষ আছে? এই অতৃপ্তির কারণও ব্যক্ত হয়েছে লেখকের নিজের কথায়- এতসব করে, শেষ পর্যন্ত চেড়াই-এর চরিত্র যা দাঁড়াল তাতে আমি মোটেই তৃপ্তি পাইনি। চেষ্টার ত্রুটি আমার ছিল না; কিন্তু যে বিশালতা ও গভীরতা দিতে চেয়েছিলাম সে চরিত্রে, নিজের অক্ষমতার জন্য তা দিতে পারিনি। ঢোঁড়াই-এর চরিত্র মানস সরোবরের ন্যায় বিশাল ও গভীর। সেইটাকে, চেয়েছিলাম এক গণ্ডুষ গল্পের মধ্যে ধরতে পারিনি। এক সময় ভেবেছিলাম যতকাল বাঁচব ঢোঁড়াইদের মনের পরিবর্তনের রূপরেখা এঁকে যাব। মনে মনে এর পরের খণ্ডের নাম হবে ঠিক করেছিলাম উত্তর ঢোঁড়াই চরিত। [৪]

উত্তর ঢোঁড়াই চরিত আর লেখেননি। ঢোঁড়াই  সম্পর্কে জানা তাঁর অতলস্পর্শী হয়নি বলেই নিজের অপর্যাপ্ততার পরিমাণ মেপে লেখা থেকে বিরত হয়েছেন। অবশ্য এ প্রসঙ্গে সতীনাথ অগ্রজ শ্রীভূতনাথ ভাদুড়ী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ৩০ শে জুন, ১৯৭২, চিঠিতে জানিয়েছেন এই না লেখার কারণ নিয়ে সতীনাথ তাঁর স্নেহধন্য ফণীশ্বরনাথ রেণুকে অনেক কথা বলেছেন। জাগরীর মতো ঢোঁড়াই চরিতমানস অভিনন্দিত হয়নি বলে লেখকের মনে ক্ষোভ ছিল। কারণ তাঁর মতে এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। [৫]

সেই চিঠি অনুসরণ করে আরো জানা যায়, তৃতীয় চরণে স্বাধীনোত্তর রাজনৈতিক বিকাশ সম্বন্ধে লিখতে চেয়েছিলেন- স্বাধীনতার পর দেশ শাসনে বিশৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্র, সরকারী অব্যবস্থা, পুরাতন রাজনৈতিক কর্মীদের সরকারী অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা, অর্থলোলুপতা স্বার্থপরতা, রাজপুত-ভূমিহার-কায়স্থ-হরিজন সমস্যা এই সব লেখার ইচ্ছা ছিল ঢোঁড়াই তৃতীয় চরণে। [৬]

লেখক নিজেও এই না লেখার কারণ সন্ধানে নিজের গোপন আমিকে বার বার প্রশ্ন করেছেন; সঠিক উত্তর কি পেয়েছিলেন?

কিন্তু আমরা পাঠকেরা যা পেলাম, যে দুটি চারণে ঢোঁড়াই-এর জীবনের বিবর্তনকে জানলাম, তাই বা কম কিসের! ড়োই চরিত পড়ে পাঠকের কি মনে হবে না বিশ শতকের তিরিশ চল্লিশের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক কিম্বা তার চেয়েও

বেশি মানব বিবর্তনের ইতিহাস উপন্যাসের আঁধারে নতুন পথে জীবনসন্ধিৎসার দ্বার খুলে দিয়েছে!

বিশ শতকের তিরিশের দশকের বাংলা উপন্যাসের প্রায় অধিকাংশ নায়ক চরিত্র জীবন দ্রষ্টা। তারা জীবনকে দেখেছে। দেখার আগ্রহে পথ চলেছে। অপু দেখেছে জীবনকে, প্রকৃতিকে ও মানুষকে। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি ও মানুষকে দেখার অনুরাগের দৃষ্টি অপুর দেখায় ফুটে উঠেছে। সেই দেখায় সে নিজেকে অন্বেষণ করেছে। আর সব পিছনে পড়ে থেকেছে। পুতুল নাচের ইতিকথায় শশী দেখে সেই তাল গাছটার উঁচু ডাঙ্গায় দাঁড়িয়ে জীবনের গতিকে। এই চলমান জীবনধারা থেকেই সে আত্মানুসন্ধানী হয়। ধাত্রী দেবতার শিবনাথ বা গণদেবতা পঞ্চগ্রামের দেবু ঘোষও দেখেছে তার চারপাশের পরিবেশকে জন জীবনকে। সে উপলব্ধি করেছে দেশের মূল শক্তির উৎস কিভাবে ক্রমাগত পরাজিত হচ্ছে প্রকৃতির ভয়ঙ্করতায় আর ক্রুদ্ধ, লোভী মানুষের নিষ্ঠুর স্বার্থপরতায়। শশী, অপু, দেবুঘোষ বা শিবনাথ এই প্রত্যক্ষ দেখা থেকে নিজের মনের মতো জীবনদর্শন গড়ে নিয়েছে। সতীনাথের পেঁড়াই, অপু, শশী ও শিবনাথের মতো মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী মানসিক পরিবেশের সাহায্য পায়নি বা দেবুর মতো সামন্ততান্ত্রিক জীবনধারার মোহময়তায় ও নবসমাজ চেতনায় অভিভূত মানসিকতার পরিবেশ থেকে উঠে আসেনি। বরং সে হাঁসুলিবাঁকের উপকথা-র করালীর মতো আদিম আঞ্চলিক ভৌত জীবনের গোষ্ঠীবদ্ধ সংস্কারের ধারাকে আঁকড়ে এসেছে এতকাল। পদ্মানদীর মাঝির কুবেরের মতো সে আদিম জৈবিক জীবনধারার, দারিদ্র-ক্ষুধা-বঞ্চনা-অসহায়তার মধ্যে আবদ্ধ সমাজের মানুষ। কিন্তু ঢোঁড়াই করালী বা কুবের নয়। করালী কিন্তু ঢোঁড়াই -এর মতো জনপ্রতিনিধি হতে পারেনি, কুবেরের জীবনদ্বন্দ্ব ব্যক্তির জৈব কামনার। ঢোঁড়াই -এর তা নয়। ঢোঁড়াই শুধু দেখে না, শুধু আত্মদর্শন লাভে তৃপ্ত নয়; ঢোঁড়াই-এর ভূমিকা বিদ্রোহীর। তার বিদ্রোহ পরিবর্তিত জীবন ও সমাজের স্বপ্নকে সার্থক করার। সে নিজে এই বদলানোর কাজে শুধু অংশীদার নয়; নেতৃস্থানীয়। তার কাছে সমাজ জীবন স্থাণু নয়। আঘাতে সংঘাতে অভিজ্ঞতায় সে নিজে বদলেছে, সমাজকে বদলাতে সাহায্য করেছে বিদ্রোহ ও প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। কুবেরের মতো ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সে বলে না ময়নাদ্বীপে তাকে আজ হোক, কাল হোক যেতেই হবে। হোসেন মিয়া তার জীবনের বিধাতা, তাকে সে কিছুতেই এড়াতে পারবে না। ঢোঁড়াই অদৃষ্টবাদী নয়। সে শুধু ব্যক্তির পরিবর্তনে শেষ হয়ে যায়নি, সমগ্র জন প্রতিনিধিত্বেই তার পূর্ণতা। তাই ঢোঁড়াইকে তাতমাটুলি থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিতে হয় বিসকান্ধায়। কিন্তু সেখানেও নয়, সংগ্রাম থেমে থাকে না। তাকে এগিয়ে যেতে হয়, আজাদ দস্তায়, ক্রান্তিদলে; রামায়ণের জগতে আত্মস্থ হতে চায়, কিন্তু তাতে তার শেষ হয় না। পাক্কীর পথ ধরে সে কি একবার ফিরতে চেয়েছিল তাতমাটুলিতে রামিয়ার কাছে! কিন্তু যে দেখেছে পথকে সে কি পিছু ফিরতে পারে? এ পথ তার অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানরাজ্যে নিয়ে আসার যোগসূত্রকারী। এ পথ দিয়েই একদিন ঢোঁড়াই পেয়েছিল বৃহৎ জীবনের সন্ধান, গাড়ির চালক ঢোঁড়াই  এসেছিল কৃষিজীবনের পথে। অভিজ্ঞতার বিশাল সঞ্চয় ভাণ্ডার পেয়েছিল এইখানেই। এই পথ দিয়েই এসেছিল ভলেনটিয়ার, এ পথেই ঢোঁড়াই দর্শন লাভ করেছিল মহাৎমাজীর। এ পথেই সে গিয়েছে আজাদ দস্তায়। সবশেষে এই পথ ধরেই সে ফিরে গেছে ভারতবরে শ্রেণী-জাত-বর্ণহীন বিশাল কারাগারে- ভারতবর্ষের বিশাল জন জীবন যেখানে আবদ্ধ হয়ে একত্রিতভাবে তপস্যা করে চলেছে গণমুক্তির, সেইখানে। ঢোঁড়াই পরিবেশ ও মানুষের দ্বান্দ্বিক বিবর্তন থেকে হয়ে উঠেছে ঢোঁড়াইরাম। এই বিশালতা থেকেই ঢোঁড়াই হয়ে উঠেছে অনন্য গণনায়ক। করালী, বা কুবের কেউই এই জন প্রতিনিধিত্ব করেনি। একমাত্র গোরাই পেয়েছে এই বিপুল স্বীকৃতি। সে হয়েছে ভারত সন্ধানী মহানায়ক। কিন্তু গোরার সময়, সমাজ পরিবেশ ও ঢোঁড়াই-এর সময় সমাজ ও পরিবেশ এক নয়। গোরা উনবিংশ শতাব্দীর সমুন্নত ভাবধারায় বিশ্বাসী; জাতীয় জীবনের সামগ্রিক উন্নতির প্রচেষ্টাকে সে করেছে প্রত্যক্ষ। ঐতিহ্যময় ভারতবর্ষের আস্তিকরূপটি তাকে মানস শক্তি সঞ্চয়ে সাহায্য করেছে। পাশ্চাত্য ভাবধারার উদার মুক্তি সে পেয়েছে শিক্ষার সাহায্যে। তাছাড়া সে উচ্চবিত্তসম্পন্ন আদর্শনিষ্ঠ হিন্দু সমাজের জল হাওয়ায় তৈরি করেছে নিজেকে সাহায্য পেয়েছে বন্ধু বিনয়, মানস প্রতিমা সুচরিতার ব্যক্তিত্বময় রুচির সহচার্য আর আনন্দময়ীর মতো যথার্থ ধরিত্রীসমা মাকে। [৭] একেবারে ভিন্ন জীবনধারায় বঞ্চিত মাতৃস্নেহে, দারিদ্র্যে, অজ্ঞতা, অশিক্ষা আর অজস্র আদিম সংস্কারে আবদ্ধ তাৎমাসমাজের মানুষ ঢোঁড়াই। অনিশ্চিত চাঞ্চল্যে বিক্ষিপ্ত বিংশ শতাব্দীর অবক্ষয়জর্জরিত ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বঞ্চিত সমাজের মানুষ ঢোঁড়াই। গোরার লেখকের সমুন্নত মানস ধারা এই শতকের চল্লিশের সক্রিয় রাজনীতি সচেতন লেখকের মধ্যে সন্ধান করা বৃথা। সুতরাং সব অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতা, বাঞ্চনা ও সংশয়ের সঙ্গে অতি সংগ্রামে রত অজ্ঞ অশিক্ষিত হীন দরিদ্র ঢোঁড়াই  বিচিত্র অভিজ্ঞতার দ্বান্দ্বিক বিবর্তনেই পেয়েছে গণ নায়কত্ব। সমস্ত রকমের ভঙ্গুরতা, বিক্ষিপ্তি আর জীর্ণতার মাঝখান থেকে ঢোঁড়াই হয়ে উঠেছে পূর্ণ মানুষ; সমবেত জন জীবনের প্রতিনিধি।

তুলসীদাসের রামচরিত মানসের রীতিতে সতীনাথ রচনা করেছেন ঢোঁড়াই চরিতমানস। জাগরীর মতো শিল্পবৈচিত্র্যেও উপন্যাসটি আকর্ষণীয়। লেখক ঢোঁড়াইকে গড়তে চেয়েছিলেন রামচন্দ্রের আদলে, কারণ দেশের সাধারণ মানুষের ভক্তি রামচন্দ্রের চরণে। উত্তর ভারতের মানুষের মনে রামের চেয়ে বড়ো আদর্শ চরিত্র আর কেউ স্থান পায় না। ঢোঁড়াইকে করতে চেয়েছিলেন এ যুগের রামচন্দ্র, যিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। বাইরের গঠনেও রামায়ণের সাতকাণ্ডের মতো তিনি অংশগুলির নাম করেছিলেন আদি, বাল্য, পঞ্চায়েত, রামিয়া, সাগিয়া, লঙ্কা ও হতাশাকাণ্ড। মহাকাব্যের বিশাল পটভূমিতে, অজস্র ঘটনা কাহিনী ও চরিত্রের সমাবেশে বিশালতা সৃষ্টি হয়ে করুণ ও শান্তরস সংমিশ্রণে যে মহাকাব্যিক রসাস্বাদ (বিশাল রস) আনে তারই প্রকাশ ঘটেছে ঢোঁড়াই চরিতে। কিন্তু এসব প্রকরণসর্বসূ না হয়ে জীবনের আধারে মিলেমিশে একাকার হয়েছে। মহাকাব্যের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্তির গভীরতায় ঢোঁড়াই-এর চরিত্রের বিবর্তন ও সমাজের পরিবর্তন ব্যাপ্তি লাভ করে সমগ্র ভারতবর্ষের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের যথার্থ রূপকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এমনিভাবে পুরনো মহাকাব্যের ফ্রেমে লেখক বাঁধতে চেয়েছিলেন ঢোঁড়াই কে। হয়তো এ গঠনভঙ্গি বর্তমানকালের উপন্যাসের উপযোগ্য নির্মিতি প্রকরণ নয়; কিন্তু উপন্যাসের মানসগঠনে এই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিটির আবেদন আজও একইভাবে রয়েছে। জন কল্যাণকামী জীবনধারার চলমান প্রবাহকে এর চেয়ে আর কোনো ভিন্ন ফ্রেমে লেখক ধরতে পারতেন বা তাতে সফল হতেন? অর্থাৎ, বিষয় বক্তব্যে, চরিত্রচিত্রণে, সমাজ বিবর্তনের রূপরেখা ধারণের উপযুক্ত শৈলী মহাকাব্যিক গঠনকৌশল ছাড়া আর কিছুতেই যথার্থ হয়ে উঠতে পারত না।

ঢোঁড়াই-এর জন্ম তাৎমাটুলিতে বুধনির কোলে। তাৎমারা জিরানিয়া বা জীর্ণারণ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদি বাসিন্দা নয়; অনেকদিন আগে তারা এখানে এসে উঠেছিল। কোনো এক কালে তারা জাতিতে ছিল তাঁতি, আজ সে পরিচয় বিলীয়মান কিন্তু সেই অতীত জীবনের গৌরব আজও তারা স্মরণ করে। তাদের শিল্প নিদর্শনে ঈর্ষান্বিত হয়ে ইংরেজ বাহাদুর পূর্ব-পুরুষের বুড়ো আঙ্গুলগুলো কেটে নিয়েছিল। এখনকার তারা অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝে- এ ব্যবস্থা ভালোই হয়েছে, কেউ আর তাদের ঠকিয়ে টিপসই দিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু জীবনের কাছে তারা তো ঠকেই আছে। আর ঠকতে ঠকতে অসহায় বিপন্ন। দারিদ্র সীমারেখার নীচের বাসিন্দা তারা। আজ একটা সামান্য গোষ্ঠীমাত্র হয়ে টিকে আছে। পুরনো তন্ত্রিমাছত্রীর গৌরব ম্লান হয়ে এসেছে। এদেরই একজন বুধনী আর তার স্বামী। ঢোঁড়াই-এর বাপের প্রয়োজন শুধু ছিল তার জন্মের স্বীকৃতিটুকু সত্য করে রাখায়। তাই লেখক তার নামটুকু পর্যন্ত দেননি। কিন্তু লোকটা ভালো ছিল। তার বিশ্বাস ছিল প্রবল, বুধনিকে সে মেনে চলত; মুসুর ডালের পয়সাটা খরচ করে যুাজের আগমনের জুলুষ দেখে এসে অবধি সংশয় নিয়ে অনেক বানিয়ে বুধনিকে সেদিন ভোলাতে পেরে খুশি হয়েছিল। সদ্যোজাত ঢোঁড়াইকে ঘিরে সে-ই প্রথম দেখেছিল বিশালতার স্বপ্ন। বিশ্বাস করেছিল মোটারগাড়ী হাওয়া পানিতে চলে। কিন্তু মানুষটা ঢোঁড়াই-এর দুবছর বয়স না হতেই মরে গেল। বুধনি.একা ঢোঁড়াইকে নিয়ে পড়ল বিপাকে। ঢোঁড়াই এখন খেতে শিখেছে, দাঁত উঠেছে। অর্থাৎ সহজাত দারিদ্র্য ও ক্ষুধা বুধনিকে দিশাহারা করল। শুধু তাই নয়; তাৎমা মেয়ের যৌবন থাকতে বিধবা থাকবে কি? বাবুলাল চাপরাশির নিত্য যাতায়াতে বুধনি অনুভব করল দেহের ক্ষুধা আর নিরাপত্তা। বাবুলাল তাকে চুমৌনা করবে কিন্তু ঢোঁড়াই-এর ভার নেবে না। ঢোঁড়াইকে বৌকাবাওয়ার মতো প্রায় মৌনীর কাছে রেখে বুধনি চলে গেল বাবুলালের ঘরে। ঢোঁড়াই এমনিভাবে হলো পিতৃহারা-মাতৃ-পরিত্যক্ত। জ্ঞান হতে হতেই সে অনুভব করল মায়ের সঙ্গে মনের দূরত্ব, তাৎমা সমাজের ওপর জন্মাল ক্ষোভ। কিন্তু তাৎমাটুলি সে ছাড়ে নি; তৈরি হলো সমাজের সঙ্গে বিরোধের সম্পর্ক। বৌকাবাওয়া তাকে করল ভিক্ষুক। জিরানিয়ার ধারে বাবুপাড়ায় গিয়ে গান শুনিয়ে সে পয়সা রোজগার করে; কিন্তু বালক ঢোঁড়াই  বুঝতে পারে শহুরে মানুষদের উপেক্ষা আর ঘৃণা; সেখানেও মন তার বিরোধী হয়ে উঠল। সে তার নিজের সমাজকে করল প্রথম আঘাত। প্রতিবেশি ধাঙড়টুলির মানুষদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গাঢ় হলো, সে নিল পাক্কীতে মাটিকাটার কাজ। তাদের জাতব্যবসা ঘরামির কাজ আর কুয়োর বালি ছাঁকা- বছরের অধিকাংশ সময় বসে থেকে কয়েকটা দিন মাত্র এই কাজ নিয়ে অন্ধ আবেষ্টনে দারিদ্র্যকে লালন করার গৌরববোধকে ঢোঁড়াই  আঘাত করল। নিজের তাৎমা সমাজ উঠল ক্ষেপে। ধাঙড় বা কিরিস্তানদের সঙ্গে তাদের চিরকালের বিরোধ। সেই ধাঙড়দলের শুক্রার সন বেটা হলো ঢোঁড়াই; পাক্কীতে কাজ নেওয়া- এসব সহ্য না করে তাৎমা মাহাতোরা চক্রান্ত করে বৌকাবাওয়ার থান জ্বালালো। মনে মনে ঢোঁড়াই ক্ষেপে উঠল। কিন্তু পুলিশের কাছে কারুর নাম না বলে মাহাতো পঞ্চায়েতের ওপর প্রথম আঘাতটা এমনিভাবে ফিরিয়ে দিলে ঢোঁড়াই। লেখক এই অংশের নামকরণ করেছেন ঢোঁড়াই-এর যুদ্ধ ঘোষণা। এ যুদ্ধ জীর্ণ সংস্কার ও সেই গড্ডলিকার স্রোতে যে মা ষগুলো এসে ঠেকেছে মজা জলার ধারে সেই মানুষ ও সমাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিরোধের এই শুরু। এই বিরোধ শুধু তাকে আত্মশক্তি দেয়নি, গোটা তাৎমা সমাজও ঢোঁড়াই-এর কাছে আহত হয়ে নিজেদের ভুল বুঝতে শিখেছে ধীরে ধীরে।

এই নিম্নশ্রেণীর গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষগুলি আবার নিজেদের মধ্যেই বর্ণ বৈষম্যকে সংস্কারের মতো আঁকড়ে থেকেছে। সোনবর্গা থেকে আগত মরগামার তন্ত্রিমাদের সঙ্গে জিরানিয়ার তাৎমাদের করণ-কারণ চলে না। মরগামার তাৎমারা পৈতে ধারণ করেছে জানতে পারে তাৎমাটুলির ছেলের দল। ঢোঁড়াই নিজের সমাজের রীতি ভেঙ্গে পৈতে নিল, ছেলের দলকেও উৎসাহিত করল। এমনিভাবে মাহাতো নায়েবদের অস্বীকার করতে করতে ঢোঁড়াই  হয়ে উঠল তাৎমাটুলির নেতা। এছাড়া তেরোদিনে শ্রাদ্ধের কাজ করেও ঢোঁড়াই আর ছেলের দল গ্রামের বুড়ো পঞ্চায়েত, মাহাতোর আজন্মের সংস্কারকে আঘাত করেছিল। সমাজের প্রাথমিক ওজর আপত্তি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনি। মাহাতোরা তাদের পুরনো তেজ শক্তি ক্ষমতা হারাতে বসেছে। ঢোঁড়াই  বৌকাবাওয়ার মনের ইচ্ছে পূরণ করে ভকত, বা বাওয়া হলো না। গোঁসাইজীর চাদর পেয়েও সে বাওয়া হবার সাধনা করে নি। মাহাতোর খোঁড়া মেয়ে ফুলঝরিয়ার সঙ্গে ঢোঁড়াই-এর বিয়ে দেবার ইচ্ছায় মাহাতোগিন্নির আদর যত্ন বাড়ল, মাহাতত নীরবে সহ্য করে নিল ঢোঁড়াই-এর দেওয়া সামাজিক আঘাত। কিন্তু ঢোঁড়াই কোনো আকর্ষণ বোধ করে নি ফুলঝরিয়ার প্রতি। তাৎমা ধানকাটানিদের সঙ্গে এল পশ্চিমের মেয়ে রামিয়া। পাক্কার পথেই রামিয়ার সঙ্গে ঢোঁড়াই-এর প্রথম সাক্ষাত। তার জাতের তাৎমা ঝোটহাদের মতো নয় রামিয়া; সে পরিচ্ছন্ন, লাস্যময়ী হাস্যমুখী। ঢোঁড়াই মুগ্ধ হলো। নিজের জাতের মধ্যে বিবাহের রীতি লঙ্ঘন করে ঢোঁড়াই রামিয়াকে বিয়ে করল। নতুন জীবনের পথে সাহায্য করল বৌকাবাওয়ার গুলি খেয়ে পাওয়া অনেক টাকা। বাওয়া তাকে ঘর বেঁধে দিল, সে গরু কিনল। পাব্দীর মাটির কাটা কাজ ছেড়ে ঢোঁড়াই  পাক্কীর পথে গরুর গাড়ি চালিয়ে ছুটল অনেকদূরে- আবার ফিরতে লাগল রামিয়ার নিশ্চিত সুখাশ্রয়ে। পাক্কী তাকে দেয় দূর দিগন্তের ইশারা। তাৎমাটুলির ঢোঁড়াই এক পাক্কীর পথেই অনেক কিছু জানল, দেখতে শিখল। কিন্তু গৃহ সুখ ঢোঁড়াই-এর নয়- একদিন বাওয়া চলে গেল অযোধ্যাজীর কাছে তাকে কিছু না জানিয়ে। ঢোঁড়াই -এর অনুপস্থিতিতে ধাঙড়টোলার কিরিস্তান সামুয়েল রামিয়াকে করে তুলল উচছল, ঢোঁড়াই হলো ক্ষুব্ধ। সামুয়েল আর পঞ্চ মাহাতোর চক্রান্তে রামিয়ার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটল। রাগে ক্ষোভে হতাশায় পাগল হয়ে রামিয়াকে প্রহার করে ঢোঁড়াই ছাড়ল তাৎমাটুলি।

ঢোঁড়াই হলো সম্পূর্ণ একাকি নিঃসঙ্গ শিকড় ঘেঁড়া মানুষ। সে হেরে গেছে নিজের কাছে। রামিয়ার প্রতি দুর্বলতায় তার পরাজয়। পশ্চিমের মেয়েটা যে বলেছে তার সঙ্গে ঘর করবে না। এ যে দারুণ পরাজয়। তাই পঞ্চদের বিধানের প্রতিবাদ করেনি, বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। রামিয়ার কাছেও একবার প্রশ্ন করেনি- তার কি ইচ্ছে? রামিয়ার মুখ থেকে উপেক্ষার কথা শুনতে ভয় পেয়ে সে চলে এসেছে সমাজ ছেড়ে। এক দিন রাত-এক বেলা হেঁটে সে পৌঁছলো বিসকান্ধায়। মোসাম্মত সাগিয়ার গৃহে ভূমিদাস রূপে আশ্রয় পেল। গরুর গাড়ির চালক ঢোঁড়াই, মাটিকাটা কাজের মজুর ঢোঁড়াই কোয়েরী-টোলায় এসে হলো নতুন অভিজ্ঞতা। জমির সঙ্গে সম্পর্ক ঘটল। বিলটার বাটিহিয়া গানে সে শুনল- খাজনা, শোষণ-পীড়ণের কথা। নিজে চোখে দেখল বাবুসাহেবের অত্যাচার। দারোগা হাকিমের সঙ্গে বচ্চনসিং, আনোখি বাবুদের যোগাযোগের পরিচয় পেল। কোয়েরিটোলাতেও সহজেই ঢোঁড়াই হয়ে উঠল নেতা। তার মনের গঠনই এই রকম। এখানে সে পরদেশী। নিজের লাভ নয়, সকলের লাভের জন্যই সে বিরোধ শুরু করল বচ্চনসিং, বাবুসাহেবের সঙ্গে। ঢোঁড়াই-এর বিদ্রোহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই তার ভয় নেই। কারণ সে জানে যে সে রামজীর কাছে কোনো পাপ করছে না, অন্যায় করছে না। বাবুসাহেবের গোলার ধান নিতে এসেছে আকালের সময়। তাদেরই শ্রমে এই ধানের গোলাগুলি ভরে উঠেছে। আজ দুর্ভিক্ষের সময় অনাবৃষ্টির দিনে তাদের পাওনা তারা বুঝে নিতে চায় ক্ষেতের চাষের জন্য।

এতদিন ঢোঁড়াই -এর বিরোধ ছিল নিজের সঙ্গে, নিজের সমাজের অসহায়তা ও জড়তার সঙ্গে। সেখানে তার একটা কারণ ছিল- দুঃখিয়ার মা (বুধনি) তাকে ছেড়ে চলে গেছে বাবুলালের ঘরে কিন্তু তার সমাজ কেন তাকে রক্ষা করল না- এই অভিমান ঢোঁড়াইকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল গোটা তাৎমা জাতটার ওপর। তখন ঢোঁড়াই-এর ছিল আত্মভাবনা, সে ছিল আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু তাৎমাটুলি চিরকালের জন্য পিছনে ফেলে এসে, রামিয়াকে পরিত্যাগ করে ঢোঁড়াই -এর ব্যক্তিপরিচয়ের আবরণটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। বাবুসাহেবের সঙ্গে ধান নিয়ে বিরোধে সে আবরণ অপসৃত হয়ে ঢোঁড়াই হয়ে উঠল আধিয়ারদের নেতা। দ্বিতীয় চরণে ঢোঁড়াই এর আচরণ দুটি খাতে বয়ে গেছে। একদিকে সে ধীরে ধীরে জনপ্রতিনিধিত্বের পথে এগিয়েছে, অন্যদিকে সাগিয়ার নীরব জৈব কামনাহীন প্রেমের আকর্ষণ ও পশ্চিমা মেয়েটির প্রেমের স্মৃতির টানাপোড়েনে ঢোঁড়াই-এর অন্তর্লোক উদ্বেল হয়েছে; ব্যক্তি চেড়াই-এর অতৃপ্ত পরিণতির স্বরূপ ও নিরাসক্ত জীবনবোধ গড়ে উঠেছে। এরপর থেকে অসংখ্য ঘটনা উত্তেজনার সঙ্গে ঢোঁড়াই জড়িয়ে পড়েছে। চাষবাদ ও জমির সংস্পর্শে এসে  ঢোঁড়াই  দেখেছে নতুন জীবনকে। এখানে এসেই সে প্রত্যক্ষ করেছে সামন্ততান্ত্রিক জীবনধারার নির্মম শোষণ। এখানে অবসরের গানেও সেই শোষণ পীড়নের চিত্র- জমিদারের সেপাই এসেছে খাজনা নিতে, সে বিদেশিয়া। সকালবেলা ধরে নিয়ে গেছে ভাসুরকে রে বিদেশিয়া। বেঁধে রেখেছে কুঠির খুঁটিতে/ ইত্যাদি। অত্যাচার, পীড়ণ ঢোঁড়াইকে করেছে সজাগ। এখানে বিরোধ জমির জন্য; ফসলের লড়াই। এই সূত্র ধরে সে সকলের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। কোয়েরিটোলার মাটি ঘেঁষা মানুষগুলোর দুঃখে সে অভিভূত। বাবুসাহেবের হাজার হাজার বিঘে জমি, আহারের প্রাচুর্য। অন্যদিকে আধিয়ারদের নিঃস্ব অবস্থা তাকে অন্যায় বিনাশে শক্তি জোগাল। আধিয়ারদের মনে সেই জাগাল বিদ্রোহের মনোভাব- তাদের সচেতন করে তুলল নিজেদের পাওনা বুঝে নিতে।

তাৎমাটুলিতে থাকতেই ঢোঁড়াই শুনেছিল গান্ধীবাওয়ার কথা। তাৎমাদের মতো অন্ধবিশ্বাস নিয়ে সেও বিলিতি কুমড়োর মধ্যে বাওয়ার মূর্তি দর্শন করেছিল। মোহাবিষ্টের মতো সেটি বহন করে নিয়ে গিয়েছিল সে। সেখানকার মাষ্টার সাহেবের মতো বড়ো মানুষ গান্ধীবাওয়ার শিষ্য সুতরাং তিনি বড়ো গোঁসাই সন্নাসী। ভক্তি আরো বেড়েছিল যখন দেখেছিল রেবণ গুণীর মতো মানুষ বা রুখার সময়ে তাৎমা পুরুষেরা যারা নেশা ছাড়া আর কিছু জানে না তারাও মদ ছেড়েছে, গান্ধীবাওয়া মুসলমানদেরও পেঁয়াজ গোস্ত ছাড়িয়েছে। মরণাধারে লবণ তৈরি করতে সকলকে একত্রিত হতে দেখেছে; শুনেছে গান্ধীবাওয়ার আদেশ। আর কোয়েরীটোলায় এসে পেয়েছে বলেনটিয়ারের দেখা, সতি-গরিয়ার উৎসব। সাগিয়াকে নিয়ে সেও গিয়েছিল গান্ধীদর্শনে। আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে গান্ধীজীর বিশাল আহ্বান দেশের মানুষকে অভিভূত করেছিল। নির্দ্বিধায় গান্ধীজীর ভাবদর্শের প্রতি গ্রামের অতি অজ্ঞ মানুষেরও যে তীব্র মোহশক্তি জন্মেছিল তা ঢোঁড়াই চরিতের মতো আর কোনো উপন্যাসে এমনভাবে ব্যক্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষের অন্ধ স্বপ্নচ্ছন্নতায় গান্ধীবাওয়া কখন যে মহাৎমাজী রামজীর সমান হয়ে উঠেছেন তা তারা জানতেই পারে না; শুধু ভক্তি বিনম্র হয়ে তাঁর মতো শোনে তারই শিষ্য আর চেলাদের কাছে। তাই গান্ধীজীর বাণী স্বরূপ চিঠি বহন করে কোয়েরীটোলায় যে ভলেন্টিয়ার আসে তাকে তারা যোগ্য সমাদর জানায়। তার বক্তৃতা, কাজকে তারা বনা দ্বিধায় অনুসরণ করে চলে। কিন্তু তারা বোঝে বলেন্টিয়ারজী তাদের একজন। নয় কাজ ফুরলেই বলেন্টিয়ার চলে যাবে। কিন্তু অভিজ্ঞতাই এদের শেষ সম্পদ। মার বাস্তব অভিজ্ঞতা বারবার ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাদের নিয়ে গেছে নতুন প্রত্যক্ষতার জগতে। তারা বদলেছে- অভিজ্ঞতার আঘাতে তারা নিজেদের গড়ে তুলেছে। ঢোঁড়াইরা ভেবেছিল বাবুসাহেবের ছেলে লাডলীবাবু মাস্টার সাহেবের মতো ভালোমানুষ, ভলেন্টিয়ার বুঝি দেবতা। কিন্তু অভিজ্ঞতাই এদের চিনিয়েছে লাডলীবাবুরা কেমন সুবিধাবাদী; ভলেন্টিয়ার তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করে; তাদের রিলিফের জন্য তোলা চাঁদা আত্মসাৎ করে পালায়। অর্থাৎ ঢোঁড়াইরা শুধু সমকালকে। চেনেনি, সমাজের শোষণ পীড়ণকেই চিনতে শেখেনি, সেই সঙ্গে ভদ্র-শিক্ষিত মানুষগুলোকেও চিনতে শিখেছে। আর তারা বারবার এদের কাছেই ঠকেছে। কিন্তু তাদের বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা ততোই প্রবল হয়। এইসব অসৎ অন্যায়ের সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত হয়। তারা বুঝতে শেখে ন্যায্য অধিকার পেতে গেলে শ্রেণীবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে হবে। হাকিম, বাবুসাহেব, দারোগা, চেয়ারম্যান সকলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই নিজেদের পাওনা বুঝে নিতে হবে। কিন্তু সতীনাথ ঢোঁড়াইদের বিদ্রোহের সাফল্য কোথাও চিত্রিত করেননি। পোড় খাওয়া মানুষগুলো বাঁচার লড়াইয়ে হারতে হারতেই জীবন কাটিয়েছে- এ পরাজয় ও পরাজিতের সংগ্রামের শেষ নেই।

 ঢোঁড়াই পরাজিতদেরই একজন। শুধু এদের নয়, আগামী দিনের এই সব মানুষেরই একজন। সেই আগামী দিন সতীনাথের কাছে কোনো আশায় ভরা ভারতবর্ষ নয়, পূর্ণতায় গঠিত নতুন ভারতবর্ষের চেহারা তাঁর উপন্যাসে স্থান পায়নি। জীবনের যথার্থ স্বরূপ চিনতেই ঢোঁড়াইকে হতে হয়েছিল সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। আজাদ দস্তায় যে যোগ দিয়েছিল। সে বিয়াল্লিশের আন্দোলনের উত্তেজনার স্পর্শে রেশমকুঠি পুড়িয়েছে। কিন্তু জীবনের জন্য তার প্রবল মায়াও অব্যক্ত থাকে না। সে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের বিলু, অভিমন্যুদের রাজনীতিকে জানে না; সাধারণ উপলব্ধি দিয়ে যাকে সত্য বলে জানে তাকেই সে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তার স্বাভাবিক মানবিক প্রাণ তাই গুটিপোকাদের জীবনের মায়ায় বিচলিত হয়, বিলটাদের এত সংগ্রামী সহানুভূতিশীল মন সত্ত্বেও মোসম্মতকে ডাইনি ভেবে অত্যাচারে সে দুঃখকাতর হয়; সাগিয়ার মতো নীরব মমতাময়ীর অন্তর্ধান সহ্য করতে পারে না। আবার সেইরকমই সহ্য করতে পারে না ধনী কৃষাণের অত্যাচার, হাকিম, আর সাহেবদের ক্রোধ, হিংসা, লোভ পীড়ন ও রাজনৈতিক কর্মীদের সুবিধাবাদী মনোভাব। লাডলীবাবুর হাকিমের মতো ক্ষমতা পাওয়া, কলস্টর হওয়ার চেষ্টা তাদের মতো সাধারণদের ক্রমেই অভিজ্ঞ করে তোলে। তারা বুঝতে পারে কাংগ্রিস মন্ত্রিত্ব ছাড়াতে, ছুমন্তরে ফুস বিড়াল হয়ে গিয়েছে সব। লাডলীবাবু যে লাডলীবাবু মহাৎমাজীর অত আদরের চেলা, সে সুদ্ধ তাঁর হুকুম মানলে না, চেরমেন গিরির রোজগারের লোভে! লোকটা যে কেবল মুখেই মালপুয়া ভাজে তা কি কেউ আগে ভাবতে পেরেছিল! আসল কাজের সময় কে কি মেকদারের লোক বোঝা যায়। ঐরু গৈরু নখু খৈরু শুনতে সবাই ভালো গরুর গাড়ি চালায়। …চিরকাল হাকিম পুলিশের দিকে ওরা। দেখে আসছি তো! লড়াইয়ের সময় অংরেজের পা চাটবে না তো কী, চার পেয়ে জানোয়ারগুলো যেদিকে অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি। কিম্বা উত্তেজনায় একত্রিত মানুষগুলি উত্তেজনা শেষে কিভাবে লক্ষ্য ভ্রষ্ট, অসহায় দিন যাপনে ব্যস্ত। এখানে এসে  ঢোঁড়াই  শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতার সাহায্যে জ্ঞান সঞ্চয় করেনি; সে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হয়েছিল।

তার পরিচয় আর তাৎমাটুলির ঢোঁড়াই বা কোয়েরীটোলার ঢোঁড়াই দাস নয়- সে এখন রামায়ণজী। কনিষ্ঠ আজাদ দলের কাছে আলোচিত নাম এই রামায়ণজী। সমস্ত উত্তেজনা শেষে রাজনীতির মধ্যে ব্যর্থতাকে, হতাশাকে প্রত্যক্ষ করে ঢোঁড়াই রামায়ণে আত্মস্থ হতে চেয়েছে। ঢোঁড়াই বুঝতে পেরেছে অপ্রস্তুত আন্দোলনের শেষে সুবিধাবাদী নেতারা নিজেদের স্থান চিনে ফিরে যায়। আর সত্যনিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ঢোঁড়াই-এর মতোই নিজেদের পরিণতির শেষ দেখবার জন্য অভিজ্ঞতার পুঁজি ঘাড়ে করে দিন কাটায়। রামায়ণ শুধু অভিজ্ঞতার যন্ত্রণা ভোলবার একটা আশ্রয় ঢোঁড়াই এর কাছে। রামায়ণের আড়ালে গিয়েও মনের অস্থিরতা কাটে না রামায়ণজীর; ওর। মধ্যে ডুবে থেকেও মনে বল পায় না। স্বাদ পায় না কিছুতে। একটা সর্বগ্রাসী উদাসীনতার ছায়া পড়েছে মনের উপর। মূল শিকড় গিয়েছে। এখন বাঁচতে হলে ছোট ছোট বিধি-নিষেধ, আর বড় কথার মধ্যেই বাঁচতে হবে। প্রাণ বাঁচানোর একঘেয়েমিটুকুকেই ভালোবাসতে হবে। নইলে হবে এই রামায়ণজীর হাল। সে সমান তালে পা ফেলে চলেছে দলের সঙ্গে; কিন্তু হোঁচট খেতে খেতে ছুটেছে একঘেয়েমির থেকে উদাসীনতার পথে, তারপর উদাসীনতা থেকে বিতৃষ্ণার দিকে। পথ ফুরিয়ে এসেছে। তাই আজকাল মিটিনের সময়ও সে বহুদূরে বসে থাকে রামায়ণ খুলে। কিন্তু এভাবে কতদিন একটি শক্তিমান মানুষ বাঁচতে পারে! ঢোঁড়াইও পারেনি। এন্টনিকে দেখে রামিয়া পুত্র ভেবে আশায় বুক বেঁধে দাঁড়াতে চেয়েছিল ঢোঁড়াই। সব ভুল ভ্রান্তিকে আর একবার তলিয়ে দেখে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে অসুস্থ এন্টনিকে নিয়ে তাৎমাটুলিতে ফিরেছিল ঢোঁড়াই। কিন্তু ঢোঁড়াইদের কোনো স্বপ্নই সত্যি হয় না। শ্রেণীর অধিকারের স্বপ্ন, সংগ্রামে জয়ের স্বপ্ন; এমনকি ব্যক্তি জীবনে বাঁচার স্বপ্ন- কোনোটাই সফল হয় না। এন্টনি রামিয়া বা তার সন্তান নয়। সুতরাং ঢোঁড়াইকে ফিরতে হয়; সময়ের ব্যবধান, জীবনের পারস্পরিক ভুলভ্রান্তিতে সৃষ্ট ব্যবধান, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবের চূড়ান্ত পরিণতিতে ব্যবধান ক্রমেই বিশাল হয়- তখন অসহায় বিপন্ন ঢোঁড়াইকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। পাক্কীর পথ ধরে সে চলে জেলের দিকে, সেখানে সাগিয়া আছে ঠিকই, তার চেয়ে আরও কিছু আছে, সাগিয়ার থেকেও বড় কিছু। বিপন্ন ভারতবর্ষের চেহারাটাকে দেখার চেয়ে কারার অন্তরালে বসে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্পর্শ বাঁচিয়ে সম্ভাবনাময় ভারতবর্ষের তপস্যা করা ছাড়া ঢোঁড়াই আর কিই বা করতে পারত!

ঢোঁড়াই চরিতমানস দুটি চরণেই রাজনীতি প্রসঙ্গ এসেছে। জাগরী, চিত্রগুপ্তের ফাইলের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে রাজনীতি এ উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছে। ভারতবর্ষের তিরিশ-চল্লিশের দশক মূলত রাজনৈতিক আন্দোলনের কাল আবার এই দুটি দশক বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তী ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই যে উত্তেজনা ও উদ্দীপনা জন জীবনের স্তরে স্তরে ছড়িয়ে পড়ছিল; সমসাময়িক জীবন ধারা, সমাজধারাকে দ্রুত পালটে ফেলছিল তা তৃতীয় দশক থেকে আরও গতি সম্পন্ন হয়ে উঠতে থাকে। সেই সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ ক্রমেই নিজেদের অজ্ঞতা, বঞ্চনা ও শোষণের যথার্থ চেহারাটাকে ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছিল। এর মানে এই নয় যে এর আগে আর কখনোও তাদের সচেনতার পরিচয় পাওয়া যায়নি, তা নয়। কিন্তু এর আগে এমন সামগ্রিকভাবে এরা নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কটকে উপলব্ধি করেনি। করা সম্ভব ছিল না কারণ অর্থনৈতিক মন্দার তীব্রতা গ্রামের ভূমিজ মানুষগুলোকে এর আগে এত প্রবলভাবে বিচলিত করেনি। কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমেই কমে আসছিল, খাজনা ইত্যাদির চাপে ভূমিহীন হতে হচ্ছিল ভূমি নির্ভর মানুষকে। জমি চলে যাচ্ছিল একশ্রেণীর হাতে যারা ক্রমেই কাঁচা পয়সার লেনদেন ও দেশীয় ব্যবসার সুযোগ নিয়ে অর্থলগ্নী করতে পারছিল। তারাই ক্রমে জাগরীর ধনী কিষাণ, ঢোঁড়াই চরিত্রের রাজাসাহেব বা গণদেবতার কঙ্কণার জমিদার ও চামড়ার ব্যবসায়ী বা ছিরুপালের মতো নিষ্ঠুর শোষকের রূপ নিচ্ছিল। নতুন সামন্ততন্ত্রের এই চেহারা, দেশব্যাপী অত্যাচারের এমন অবস্থা, পুরনো সামন্তশ্রেণীর ক্ষীয়মানতা, রাজনৈতিক দলগুলির আত্মপরতা ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের প্রবল দমননীতি- সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের প্রায় সকল স্থানের অবস্থা তিরিশ চল্লিশের দশকে এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এই সঙ্গে এই পর্বের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথাও মনে আসে- দেশ জুড়ে অজন্ম, ধরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চরমরূপ; ৩৪-এ বিহার জুড়ে ভূমিকম্প, ৪০-এর দশকে দুর্ভিক্ষ ও পরে মন্বন্তর ইত্যাদি একের পর এক ঘটনা দরিদ্র মানুষগুলিকে ক্রমেই বিপন্ন করে তুলছিল।

এছাড়া এইসব সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনও অজস্র অভিশাপ-সংস্কারে ভারাক্রান্ত। এ জনজীবনের সত্তর শংশেরও বেশি মানুষ শুধু শারীরিক অপুষ্টিতে পঙ্গু নয়; মানসিক পুষ্টির অভাব তাদের তার চেয়েও বেশি। সেই মানসিক অন্ধতা নিয়ে তারা নিজেদের করে ফেলছে স্বতন্ত্র গোষ্ঠীবদ্ধ। অজস্র বিভেদনীতি আর বিধিনিষেধের ভারে তারা ক্রমেই জীর্ণ হয়ে পড়েছে। এর ওপর সমাজের ওপরতলার সঙ্গে এই নীচের মানুষগুলির বিভেদ ধনবৈষম্যের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। অশিক্ষা ও শিক্ষিতের বৈষম্য এখানে সভ্য ও আদিম মানুষগুলির মধ্যে আজও দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান হয়ে আছে। গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে শহর শহরতলির মানুষের মনোভাবের ব্যবধান নীচুজাতকে ক্রমেই হীনমন্য করে ফেলছিল। আরো অসংখ্য বর্ণ, শ্রেণী, জাতি-বিভেদ তো বহুকাল ধরে পাষাণের মতো জগদ্দল হয়ে বসে এই দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষগুলিকে অন্ত্যজ করে রেখেছে। এরাও এটা ভগবানের বিধান বলে মেনে নিতে প্রস্তুত। নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে ও সমাজের দূর সীমা পর্যন্ত এই বিভেদনীতি মেনে নিয়ে তারা এতকাল জীবন কাটাতেই অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। তিরিশ-চল্লিশের দশকে এই পুরনো অন্ধ চেতনায় যে কিছুটা তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল সে কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। আর এই তরঙ্গাঘাত সৃষ্টি করবার অনেকটা সাফল্যই গান্ধীজীর। গান্ধীজীই এদেশে জন অভ্যুত্থানের প্রথম সার্থক আহ্বান করেন। অস্পৃশ্যতা মুক্তি, হরিজন আন্দোলনের ডাক এই মানুষগুলিকে মানবিক স্বীকৃতির প্রথম সুর শুনিয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনের আহ্বানে এই সঙ্গে মিশে গিয়ে অতিসাধারণ মানুষগুলির অধিকারবোধকে কিছুটা সজাগ করে তুলেছিল। ১৯২১-এর অসহযোগ আন্দোলনে মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতিনিধি জাগরীর পরিবারটিকে রাষ্ট্রসচেতন হয়ে উঠতে দেখা যায়। দ্বিতীয় দফায় ১৯৩০-এর অসহযোগের ডাক, সত্যাগ্রহ, আইন অমান্য সাধারণ মানুষের সীমানার প্রান্তে যে ঢেউ তুলেছিল তারই বাস্তব আলেখ্য তৈরি হয়েছে ঢোঁড়াই চরিতমানসের প্রথম ও দ্বিতীয় চরণে। সাধারণ মানুষ এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনের যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে কোনো কালেই সচেতন ছিলনা (আজও সম্পূর্ণ নয়), তখনও হয়নি। কিন্তু তাদের অভ্যস্ত সংস্কারবদ্ধ জীবনে একটা ঝড়ের হাওয়ার সংকেত শুনেছিল; তাকে তারা নিজেদের সুবিধে মতো ব্যাখ্যা করে নিয়েছিল ও আন্দোলনের কর্মপদ্ধতিকে নিজেদের মতো করে তৈরি করবার চেষ্টা করেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ তাদের কাছে ইংরেজ রাজা-বাহাদুরের অস্তিত্বের চেয়েও তাদের অধস্তনদের চেহারাটা এত প্রকট ছিল যে সেটাকে সামলাতেই তারা বেশি ব্যস্ত হয়েছিল। হাকিম দারোগা, কলস্টর, চ্যারম্যান, উকিলবাবু বা বচনসিং, রাজাসাহেব, আনোখিবাবু এমনকি বাবুলাল চাপরাসী, ছড়িদার তাদের কাছে। হাওয়াগাড়ি চালানো সাহেবদের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। তাদের উত্তেজনা এদের ঘিরেই; ক্ষোভ বিদ্রোহ এদের প্রতি। বাদশাহী বদল, সার্বিকমুক্তি এসব কথা তারা বোঝে না। এই পর্বে এরা শুধু বুঝেছিল- দিন বদলাচ্ছে, মানুষ বদলাচ্ছে। কোনো কিছু পাওনা আদায় করতে গেলে অনুরোধ আর আত্মসমর্পণে কাজ হবে না; আদায় করতে হবে সংগ্রাম করে; শ্রেণীবদ্ধভাবে প্রতিরোধ তৈরি করেই সফল হওয়া সম্ভব।

 ঢোঁড়াই চরিতে এইভাবে সাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ মানবিক আন্দোলনের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। সতীনাথ এখানে কংগ্রেস, গান্ধীবাদী বা সোস্যালিস্টদের রাজনৈতিক ইতিহাসকে উপন্যাসে রূপায়িত করতে চান নি। প্রচারমূলক রাজনীতি তাঁর উদ্দেশ্য নয়; তিনি মানুষের চেতনার পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই রাজনৈতিক সত্য ঘটনা, বিয়াল্লিশের আন্দোলনকে উপস্থিত করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি স্থানীয় ঢোঁড়াইকে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন, ব্যক্তিজীবন, কৃষি নির্ভর জীবন ও রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিবর্তিত হয়েই গণনায়কত্ব পেতে হবে একথা লেখক মনেপ্রাণে অনুধাবন করেছিলেন।

 ঢোঁড়াই চরিতমানসে সতীনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টি অন্ধ আনুগত্যে আবিষ্ট নয়; বরং সমালোচনায় দীপ্ত। লেখক নিজেও ব্যক্তিজীবনে কখনোও নিজের রাজনীতি সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাসী ছিলেন না অন্যান্য সহকর্মীদের মতো। তিনি গান্ধীবাদী কংগ্রেসকর্মী হয়েও চিন্তায় ভাবনায়, অধ্যয়নে-অনুশীলনে অন্যদলের রাজনৈতিক মতকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন তা জীবন পর্যালোচনা অংশে লক্ষ্য করা গেছে। জাগরী উপন্যাসে যেমন পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী নীলু-বিলু-বাবা আত্মসমালোচনা, অন্যের মতের সমালোচনা সুযোগ পেলেই করেছে; ঢোঁড়াই চরিতমানসেও তেমনি সাধারণ মানুষের মনে রাজনীতির আদর্শের রূপটি কেমনভাবে ধরা পড়েছে তারও সমালোচনামূলক পরিচয় আছে। সাধারণ মানুষের কাছে গান্ধীজীর ও তার দলের ভূমিকা, আজাদ দস্তার আনন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার স্বরূপ ও পরে নিজেদের কাছে। ও সাধারণ মানুষের কাছে কি রকম সমাদৃত হয়েছিল তারও ঐতিহাসিক চিত্র এ উপন্যাসে অতিরিক্ত সম্পদ হয়ে উঠেছে। ঢোঁড়াই দ্বিতীয় চরণে এসে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি ও তার বিরোধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের আবহাওয়া দ্বিতীয় চরণে উদ্দাম উত্তাল। কিন্তু প্রথম চরণে রাজনৈতিক সম্ভাবনা শুরু হয়েছে। সেখানকার রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে ঢোঁড়াই -এর নিজের সমাজ। বিরোধ কখনোও হয়েছে ধাঙড়টোলার মানুষের সঙ্গে তাৎমা পঞ্চ মাহাতোদের আবার জিরানিয়ার শহুরে বাবুদের সঙ্গে ঢোঁড়াই-এর, রামিয়াকে নিয়ে সামুয়েল ও পঞ্চদের রাজনীতির খেলাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। এখানে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর, ব্যক্তির সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের স্বার্থসংঘাতে রাজনৈতিক বাতাবরণ সমাজের নীচু তলার মানুষগুলির আচরণও মানসিকতা পরিবর্তনের দলিল হয়ে আছে। এই সমাজেই আবার ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টাও দেখা যায়- গান্ধীজীর ভাবাদর্শ বিশাল চেতনা নিয়ে তাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে। দল বেঁধে মরণাধারে লবণ আন্দোলনে এগিয়ে যেতে চেয়েছে তখন রাজনৈতিক শক্তি তাদের মধ্যে সঞ্চায়িত হয়েছে। আবার সাধারণ মানুষের ভীতি প্রবণতা তাদের পিছু হটিয়ে দিয়েছে তখন সাহেব দারোগা এসে তাদের মরণাধারের মাঠে যেতে নিষেধ করেছে।

দ্বিতীয় চরণে প্রকৃত আন্দোলনের একটা প্রত্যক্ষ রূপ বিসকান্ধার কোয়ারীটোলার মানুষগুলোকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু শুধু প্রেরণা নয় রাজনীতির কালকূট রূপটিও সতীনাথের পাঠকদের মনকে নাড়া দেয়। শাণিত কৌতুক ব্যঙ্গে তা অসাধারণ উজ্জ্বলতা পায়। বলেন্টিয়ারের সতিগিরিয়াকে ঘিরে বিসকান্ধার লোকের মনে উৎসাহের শেষ নেই। এই উৎসাহের অভিব্যক্তির তুলনা চলে শুধু রামখেলিয়ার নাচ-এর সঙ্গে। আবার লাডলীবাবুর জনসেবার নামে আখের গোছানোর পালাও ব্যঙ্গে সত্যকে উদঘাটিত করেছে। বিহার জুড়ে ভোট হলো যখন, তখন আধিয়ারদের আশা দেওয়া হয়েছিল কাংগ্রিস থেকে আধিয়ারদের জন্য নতুন কানুন হবে। কিন্তু সে তো সফল হলো না। তার পরিবর্তে লাডলীবাবুরা হলেন চেয়ারম্যান। তাদের মতে মন্ত্রীর গদি ছেড়ে কাংগ্রিস ভুল করেছে। আরও করবে যদি ডিস্টিবোড ছাড়ে। ..ন এক পাই, ন এক ভাই বলে জেলে চলে গেলেই অংরেজ হেরে গেল আর কী! আমি তো সাফ বলে দিয়েছি যে, চেয়ারম্যানের পদ থেকে আমি ইস্তাফা দেব না। পাবলিসের ভালোর জন্য এসেছি এখানে যতদিন পারব সাধ্য মতো পাবলিসের উপকার করে যাব। আজাদ দস্তায় এসে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় ঢোঁড়াই-এর মন ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তার মনে হয়েছে এখানে বিভিন্ন সুবিধাবাদী মানুষেরা এসেছিল সুযোগ সন্ধানে আর তার মতো বিশ্বাসের ভূমিতে পা ফেলে পরিবর্তন প্রয়াসী মানুষেরা এসেছিল; তারা আজ ব্যর্থতায় হতাশায় তারই মতো জর্জরিত। ভিনদেশের রঙ বেরঙের পাখি লালমুখো কাকতাড়ুয়া দেখে দিশাহারা হয়ে পালাচ্ছিল, সাঁঝ পড়াতে এক গাছে রাত কাটাচ্ছে। তারই নাম আজাদ দস্তা। বুলি মুখস্ত তোতা আছে, নাচনদার ফিঙে আছে, পাঁকে পাখি কাদা খেচা আছে। সবজান্তা ভুশভী কাক আছে। এদের কাজটা কি? চাঁদা তোলা, অসাধুতাকে প্রশ্রয়, সক্রিয় আন্দোলনের নামে সাধারণ লোককে, ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়; দোষ ত্রুটি চাপিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের ফাইল জ্বালানো; টাকার অংশ ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার তারপর একদিন দলছুট হয়ে বেরিয়ে গিয়ে আদল পালটে ফেলা-এসবই ঢোঁড়াই দেখেছে। দলের শূন্যগর্ভ পরিকল্পনা, বক্তৃতা শুনতে শুনতে  ঢোঁড়াই  হাই তোলে। আদর্শহীন সংগঠনের পরিণতি সত্যনিষ্ঠ কর্মীর কাছে কি দুঃসহ বেদনাদায়ক তা ঢোঁড়াই -এর ক্রান্তিদলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য থেকে যাওয়ার চিত্র থেকে বোঝা যায়। কারণ ঢোঁড়াই এই পরিণতি চায়নি। তার রাজনীতি স্বাধীনতা প্রাপ্তির নয়; তার এ পথে আসার কারণ সত্যের পথে নিজেকে তৈরি করা ও সমাজকে পরিবর্তিত করা। কিন্তু সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। মহাকব্যের বিশাল আঁধারে গণঅভ্যুত্থানের চলিষ্ণু রূপটি ধরতে চেয়েছিলেন লেখক। কিন্তু লেখক তার প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন গান্ধীজীর সর্বাত্মক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলন পর্যায়ে পৌঁছলেও সাধারণ মানুষ এ পথে শুধু উত্তেজিত হয়েছিল; তারা বিশ্বাস করেছিল রামচন্দ্রের অতবার মহাৎমাজী। রামায়ণের লেখার সমান তাঁর কথার ওজন। তারা শুনতে চায় মহাৎমাজীর কথা- মহাৎমাজীর কথা বলুন। ঢোঁড়াইয়ের ইচ্ছা হয় আরও শোনে, সব কথা শোনে। রামায়ণ শোনার পুণ্যি না থাকুক এতে। তবু একথা আরম্ভ হলে বলেনটিয়রের কাছ ঘেঁষে বসতে ইচ্ছা করে। রাবণের চাইতেও অংরেজ সরকারের উপর আক্রোশ আরও জীয়ন্ত হয়ে ওঠে। সমাধানের পথ কিন্তু তারা পায়নি। তাই সমস্যা সেই একই থেকে গেল। সমাজের গভীরে এই আন্দোলনের শেকড় প্রসারিত হওয়ায় উত্তেজনার সমাপ্তিতে ধর পাকড়, দলগুলিকে বেআইনি ঘোষণা করায় ব্যর্থতা প্রচণ্ড আকার নিয়েছিল। গান্ধীর ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেছিল তাঁরই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অনুগতজনেরা। তারা মহাৎমাজীর নামের যে মোহ ছড়িয়েছিল, সে মোহভঙ্গ হতে বেশিদিন লাগল না। আসল কথা গান্ধীজীর আন্দোলন ছিল, ভাববাদী আন্দোলন। সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চেতনার আমূল পরিবর্তন ঘটানোর কোনো চেষ্টা এ আন্দোলনে দেখা যায় না। তিনি অস্পৃশ্যতামুক্তি, জাতিভেদ মোচনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তনে এর প্রয়োজন অবশ্য স্বীকার্য কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা অর্থনৈতিক মুক্তি দারিদ্র্য মোচন করে অর্থনৈতিক বনিয়াদ দৃঢ় করে গড়ে তোলা। স্বাধীনতার আগে বা স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যস্ত তিরিশ-চল্লিশের দশকেও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কোনো বিপ্লব, গণ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এমন মানুষগুলিকে অন্নমুক্তির স্বাদ দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো সক্রিয় সংগঠন প্রচেষ্টা পরিকল্পনা ছিল না কংগ্রেস বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির। বরং এদের অশিক্ষা, অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে গান্ধীবাদী ভলেন্টিয়ার থেকে শুরু করে সামন্ততান্ত্রিক বচনসিং সকলেই জুলুম আর শোষণ করে এসেছে। এরা শুধু ঠকেছে, হার মেনেছে, বিশ্বাস করে ভুল করে মার খেয়েছে, শোষণ আর পীড়নে এরা পেটে ও পিঠে মারের চিহ্ন বহন করে; সবুজ ধানী জতিতে নীলের জন্য দাগ পড়ে বা রেশমগুলির জন্য তাদের অজান্তে বচ্চন সিংরা জমি ইজারা দেয় মোটা টাকার বিনিময়ে। এই মানবিক আর্তির স্বরূপ, ফুটে উঠেছে ঢোঁড়াই চরিতে, আঙটা বাংলা প্রভৃতি গল্পে। [৮] মরণাধারে যার পাশে লবণ তৈরির জন্য মাষ্টার সাহেব এসেছিলেন, তারা এসেছিল সেই মরণাধার শেষ পর্যন্ত জিরানিয়ার মানুষগুলোকে মরণের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করল। নদী যার নাম জীবন, সে সতীনাথের সাহিত্যে হলো মরণাধার, এরই ধারে হৃতসর্বস্ব মানুষগুলো মরীচিৎকার পেছনে ছুটে বারবার, একত্রিত হয়েছে, গান্ধীজীকে বাওয়া বলে জেনেছিল; তার মহাৎমাজীর রূপে তারা শক্তি পেয়েছিল। কিন্তু কি পেল? সত্যকে জানতে গিয়ে, অধিকারকে আদায় করতে গিয়ে তারা তাঁরই আদর্শ পথ অনুসরণ করেছিল। তাদের প্রতিনিধি ঢোঁড়াই রাজনীতির আদর্শে, সাহচর্যে হয়ে উঠল সত্যসন্ধিৎসু; শিক্ষার সাহায্যে হলো রামায়ণজী কিন্তু এখানেই হলো মোহভঙ্গ; দেখল বিপুল আত্মশক্তির ক্ষয়, নেতৃত্বের ত্রুটি। তখন শুধুই যন্ত্রণা, গোপনে পালিয়ে বেড়ানো নিজের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে থাকার যন্ত্রণা ঢোঁড়াই -এর। সে নিজে বদলেছে, তাৎমা সমাজের বদল দেখেছে। দেখেছে মাহাতো গাড়ি চালাচ্ছে, ফুলঝরিয়া ভিক্ষে করছে, পলটন ছাউনি পড়ায় তাৎমারা সাধের তাৎমাটুলি ছেড়ে চলে গেছে। একদিন ধাঙড় টোলা থেকে শনিচরা আর তার বউ চলে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে; যাওয়ার আগে ক্রোধ আর ক্ষোভ প্রকাশ করে ছিল বাঁশঝাড়টাকে ধ্বংস করে। সেদিন ধাঙড় টোলার শুক্রা বলেছিল আজ হোক কাল হোক সবাইকে যেতে হবে। তাই হয়েছে। সমাজের বদল ঘটেছে; সমাজবদ্ধ মানুষের স্থানবদল, জীবিকাবদল, সংস্কার ও চিন্তার বদল হয়েছে কিন্তু এ বদল বড় দ্রুত- যেন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে। এ ভাঙন ঢোঁড়াই-এর সমাজের সেই সঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ভরা ভারতবর্ষের। এ ভাঙনের কথা না লিখে সতীনাথের তো অন্য কোনো উপায় ছিলনা।

ঢোঁড়াই চরিতমানস উপন্যাসের দুটি চরণেই সমাজ তার সামগ্রিক রূপ নিয়ে উঠে এসেছে। বিহারের বিশেষ অঞ্চলের অন্ত্যজবাসীর জীবনধারার সামাজিক দলিল হলেও লেখকের শিল্পক্ষমতার দক্ষতায় শেষপর্যন্ত তা গোটা ভারতবর্ষের অবহেলিত গ্রামীণ জীবনের যথার্থ সত্য ও সার্থক চিত্র হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই গ্রামজীবনের লৌকিক রীতিনীতি, লোকাঁচার সংস্কারের নিখুঁত পরিচয় আর কোনো বাংলাসাহিত্যে এত পুঙ্খনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়নি। এর মূলে আছে লেখকের জীবনদষ্টির গভীরতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা। তার ডায়েরী থেকে জানা যায় যে এ জীবনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কত প্রবল, কল্পনা আর বাস্তবের টানাপোড়েনে ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই আদিম জীবন সম্পর্কে নিবিড় অনুরাগ অনুভব করেছিলেন তাৎমাটুলি ধাঙড়টুলি ছোটবেলা থেকে আমার মনে অজানা স্বপ্নরাজ্যের দুয়ার খুলেছে- ও নিয়ে না লিখে আমার উপায় ছিল না।

আক্ষরিক পরিচয় এ গ্রামজীবন বাংলাদেশের বাইরে বিহারে। বিহার-প্রবাসী সতীনাথের জীবনের সিংহভাগ এখানে অতিবাহিত হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মী হয়ে তিনি জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশায় যে সত্য উপলব্ধি হয়েছে তাকে তুলে ধরেছেন ঢোঁড়াই চরিতমানসে। আগের উপন্যাস জাগরী-তেও পূর্ণিয়া ও তার চারপাশের জনজীবন, সেখানকার সাধারণ মানুষের বিয়াল্লিশের গণ অভ্যুত্থানে যোগদানের ইতিবৃত্ত প্রসঙ্গক্রমে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু ঢোঁড়াই চরিতে প্রসঙ্গ নয়, লোক-জীবন ও তাদের পরিবর্তনের গতিপ্রবাহই লেখকের প্রধান অবলম্বন। ঢোঁড়াই-এর ব্যক্তিজীবনের ট্রাজেডি যেমন উপন্যাসে গভীর ব্যঞ্জনা লাভ করেছে; তেমনি ঢোঁড়াইদের সমষ্টিগত জীবনচেতনার তীক্ষ্ণতায় লেখকের মানুষের দেখা যথার্থই পূর্ণতা পেয়েছে। তাই ঢোঁড়াইকে একক করে সমষ্টিচেতনার পূর্ণরূপের প্রতিনিধি করেছেন। লেখকের মনোভাব শুধু ঢোঁড়াইকে নয় ঢোঁড়াইদের জীবনালেখ্যের যথার্থ পরিচয় দেওয়া- সমগ্র গ্রামীণ সমাজকে তুলে ধরবার ইচ্ছা নিয়েই রাম চরিতমানসের অনুসরণে ঢোঁড়াই চরিত রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঢোঁড়াই চরিত সম্পর্কে সতীনাথ প্রস্থাবলী, ২য় খণ্ড, নিঃসঙ্গদীক্ষা অংশে গ্রন্থ-পরিচিতি দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- এর ঘটনাভূমি আমাদের চির পরিচিত বাংলাদেশ নয়, বিহার। এখানে নেই আমাদের অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত জীবনের কোনো ছবি। এর জগতটা গড়ে উঠেছে অন্ত্যজ ধাঙড় আর তাৎমাদের নিয়ে। তাই সে সমাজের যথার্থ চলচ্চিত্রটির আঁধারে পড়তে হবে ঢোঁড়াই-এর বা ঢোঁড়াইদের জীবনের ট্র্যাজেডি।

 এ উপন্যাসের বাস্তব পরিবেশ, বাস্তব চিত্র, সেখানকার মানুষের আচার কৃষ্টি, জাতকলহ ইত্যাদি প্রসঙ্গে সতীনাথ গবেষক সন্তোষকুমার মজুমদার দেয়া পরিচয়টি উল্লেখ না করলে ত্রুটি থেকে যাবে- ঢোঁড়াই চরিতমানস-এ পূর্ণিয়ার কিছু লোকের প্রতিরূপ স্পষ্টতর। সতীনাথ তো ঢোঁড়াই প্রবন্ধে লিখেই গেছেন যে তাৎমাটুলিতে সত্যি একজন ঢোঁড়াই আছে এবং ঢোঁড়াই জানত যে তাকে নিয়ে একটা বই লেখা হয়েছে। এই উপন্যাসে বাবুসাহেব-এর মধ্যে দেখি পূর্ণিয়ার ধামধাহার ভূমধ্যিকারী স্বৰ্গত বাবুলালচাঁদকে, লাডলীবাবুর মধ্যে দেখি বাবুলালচাঁদের দ্বিতীয় পুত্র মৌলাবুকে। …কেবল নরনারীই নয়, পূর্ণিয়ার নানা জায়গার বর্ণনা তাঁর গল্প ও উপন্যাসে আছে। পূর্ণিয়ার কুশীনদীর শাখা প্রশাখার নানাধার মরণাধার, হীরাধার, নানাস্থান- তাৎমাটুলি ক্রীশ্চানটুলি নানা রাস্তা পাক্কী (কোশী শিলিগুড়ি রোড) তাঁর গল্প উনপ্যাসে স্থান পেয়েছে। লৌকিক জীবনের রূপরেখা পড়েছে জাগরী ও বিশিষ্টভাবে ঢোঁড়াই চরিতমানসে। [৯] কিন্তু এসব চরিত্র, স্থান, লৌকিক জীবনচর্যা ও উপন্যাসের বহিরঙ্গ শোভা হয়ে থাকেনি, সমাজ এখানে রাজনৈতিক সময়াবর্তের দ্রুত চলমানতায় পরিবর্তিত হয়েছে। সামাজিক মানুষ ও তাদের দ্বারা গঠিত সমাজের সামগ্রিক বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত ও উপন্যাসে সমাজতত্ত্বের সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। লেখকের উদ্দেশ্য চলিষ্ণু জীবনধারার প্রবাহের বাস্তব রূপায়ণ। তিনি সে বিষয়ে সার্থক হয়েছেন। তাৎমা, ধাঙড় ও কোয়েরিদের আদিম সমাজচিন্তা কিন্তু অনড় অচল স্থাণু নয়; তা পরিবর্তমান। প্রথম মহাযুদ্ধের পরের দিনগুলিতে এ দেশের জীবনপটে পুরনো জীবনধারার ভাঙ্গন ক্রমেই দ্রুত প্রত্যক্ষগোচর হয়ে উঠছিল। নগর শহরকেন্দ্রিক জীবন বা উন্নত কৃষিনির্ভর গ্রাম পরিবেশে এই সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাঙ্গন যত স্পষ্ট দূর প্রত্যন্ত গ্রামীণ জীবনে তার গতি তত দ্রুত না হলেও তা যে ক্রমেই পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিচ্ছিল- এই চলমান সমাজ জীবনের আদ্যন্ত পরিচয় লক্ষ্য করা যায় ঢোঁড়াই চরিতে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যত কাছে এগিয়ে আসছিল ততই রাজনৈতিক উন্মাদনা, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতি দ্রুত পালাবদলে অভিনিবিষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিরিশের দশক থেকেই সে আঘাতের তরঙ্গ গ্রামের প্রান্তসীমায় পৌঁছতে লাগল, অর্থনৈতিক অবস্থায় ক্রম অবনতি অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোকেও ক্রমে ক্ষিপ্ত করে তুলছিল। ফলে এই সব সমাজও কম বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল। সরল সহজ আদিম বিশ্বাসে ভরপুর মানুষগুলির উত্তেজনার সৎ চিত্র ফুটে উঠেছে এ উপন্যাস। এরা অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলদ্ধি করেছে তাদের বিশ্বাস ও বিশ্বাসভঙ্গের বেদনাকে। বিরোধের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি ও মানসিক পরিবর্তন এই দ্বান্দ্বিক সূত্রটি সারা উপন্যাসের সক্রিয়-সজাগ ও স্পষ্ট করে ধরে রেখেছেন লেখক অসামান্য সমাজসচেতন মনোভঙ্গির সাহায্য।

উপন্যাসের সূচনা ঢোঁড়াই-এর জন্মভূমি তাৎমাটুলি নিয়ে। পূর্ববৃত্তান্তে তাৎমাদের আদি পরিচয় নিয়ে লেখক জাতটার রক্ষণশীল সাবেক জীবনধারার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দিয়েছেন। জিরানিয়া বা জীর্ণারণ্য হলো ঢোঁড়াইদের জীবন প্রবাহের তটভূমি। তাৎমাদের কাছে জিরানিয়া ভারি সাহার বা টৌন (টাউন)। পাকাবাড়ি, পাকা রাস্তা, রাস্তায় চলে টমটম। সেই শহরের প্রান্তে তাদের বাসস্থান- পশ্চিমে বরকহাট্টার মাঠ, দক্ষিণে মজানদী- মরণাধার বা কারীকোশী। মাঠের বুক চিরে চলে গেছে কোশী শিলিগুড়ি পাক্কী রোড। রাস্তার ওপারে ধাঙড়টোলা। মাঝখানে এই রাস্তা শুধু পথ নয়- উভয় সমাজের জাতকলহের বিচ্ছেদরেখা, তাৎমারা কোনোকালে জাতে তাঁতি থাকলেও এখন তাদের কাজ কুয়োর বালি ছাঁকা আর ঘরামির কাজ- ফলে দারিদ্র্য নিত্যসাথী। কবে আঁধি ঝড় হবে, বাবুভাইদের ঘরে শিলাবৃষ্টিতে চাল ভাঙ্গবে তবে তাৎমাদের কাজ হবে, ডাক আসবে বাবুপাড়ায় ঘর ছাইবার; তখন দুটো পয়সা। পাকা বাড়ি ঘরের দৌলতে এ ব্যবসাও নাভিশ্বাসে ধুকছে। ধাঙড়রা নিজেদের জাত ধর্ম ত্যাগ করে ক্রীশ্চান হয়েছে। সাহেবদের বাড়িতে তারা মালির কাজ, সাফাই কাজ বা খানসামার কাজ করে মেয়ে পুরুষে মিলে। তাৎমাদের রাগের কারণ তারা গরীব হলেও জাতধর্ম খোয়ায়নি, তাদের ঝোটোহারা এমনভাবে বাইরে যায় না সচরাচর, তাদের পুরুষেরাও খেতে না পেলেও জাত কাজ ছেড়ে অন্য কাজ নেয়নি। তাদের মেয়েরা বছরে একবার স্নান করার রীতি আজও মেনে চলে। ধাঙড়াদের ঘর বাড়ি দেহ-পোশাকে পরিচ্ছন্নতার ছাপ। কিন্তু তাৎমাপাড়া দিয়ে বাবু ভাইরা ফরসা কাপড় পরে গেলে পাড়ার কুকুরগুলো ডাকতে থাকে; বস্ত্রহীন বুড়ো মানুষ কাপড় টেনে শরীর ঢাকতে ভুলে গিয়ে অবাক হয়ে থাকে- ঠিক পদ্মা নদীর মাঝির জেলে পাড়ার মতো দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপরিচ্ছন্নতা এদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। অথচ তাৎমা মেয়েদের বাবুভাইয়াদের সঙ্গে একটু শিথিল সম্পর্ককে তাৎমা পুরুষেরা ত্রুটি বলে দেখে না বা ধানকাটানীর দেশে যাত্রাকালে সেখানে-অবৈধ মেলামেশাতেও মেয়েদের খুব একটা দোষ হয় না বলে পুরুষেরা মনে করে। আরো মনে করে যৌবন থাকতে তাৎমা মেয়ে বিধবা আবার কি কথা, তাই বুধুনির বাবুলালের সঙ্গে চুমৌনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটাকেই তারা স্বাভাবিক মনে করেছে; একবারও ভাবে নি শিশু ঢোঁড়াই-এর ভাগ্যটা এরপর কোনো পথে চলবে। সমাজের এই আজন্মের সংস্কার তা ভালো কি মন্দ, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে কি না সেটা গ্রামপ্রধান বা পঞ্চদের চিন্তার বিষয় হয় না বরং রীতি রক্ষা করাতেই তাদের উৎসাহ। এদের সমাজে বৌকা তাই জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বাওয়ার মর্যাদা পায়। পাড়ার মাঝে থান গড়ে ওঠে একটা স্বাভাবিকের ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটলেই। তাই গাছ কাটার পরও গুঁড়িটা সোজা হয়ে থাকতে দেখে লোকে বিশ্বাস করে জীবনের কাণ্ড এটা। বৌকাবাওয়াকে গুঁড়ির চারধারে হাতজোড় করে সূর্যপ্রণাম করতে দেখা তারা বিশ্বাস করল গোঁসই-এর কৃপা হয়েছে- সেদিন থেকে সেটা হলো থান বৌকাবাওয়া হলো যোগী- তার গ্রাসাচ্ছাদনের কোনো চিত্তাই রইল না। থানে উঠল চাল ধাঙড় আর তাৎমাদের সহায়তায়- এই হলো তাদের আদিম বিশ্বাসবোধের নিগূঢ় পরিচয়।

আরো অজস্র বিশ্বাস তাদের রক্তের সঙ্গে মিলে মিশে আছে। যেমন তারা বিশ্বাস করে তাৎমা পুরুষরা মুসুর ডাল খেলে তাদের সহ্য হবে না- কুষ্ঠ হবে, কিন্তু প্রসূতি মা খাবে মুসুর ডাল, তাৎমারা সবাই জানে বর্ষার আগে পেয়ারা খেলে জ্বর হয় আর আশ্বিনের পর জ্বর হয় বাতাবিলেবু খেলে। এ জ্বর মরণ জ্বর। শারীরিক অসুস্থতা তাদের কাছে বাই উখড়াননা; শুষনি শাক এর একমাত্র ঔষুধ। ঝোটাহারা যদি তাদের সমাজের রীতি বাৎসরিক স্নান না মেনে ঘন ঘন স্নান ও কাপড় পরিষ্কার করে তাহলে তাৎমা ছেলে বুড়ো অন্য মেয়েরা তাকে ভালো চোখে দেখে না। তাকে তারা নীন বলে উপহাস করে। পশ্চিমের মেয়ে রামিয়ার লোটা হাতে ময়দানে যাওয়া মাহাতো গিন্নীর চোখে অশোভন ঠেকেছে; কারণ তাদের সমাজে মরদ ছাড়া কেউ এ কাজ করে না। এমনি অজস্র সংস্কার সহজাত বিশ্বাস বিশ্বাস রূপে তাৎমা ধাঙড়- এই অন্ত্যজ মানুষগুলিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাব ও আচার আচরণের আদিম প্রথার সঙ্গে মিশে আছে তাদের জীবনচর্যা। তাই রোগ ব্যাধি, শারীরিক ত্রুটি সবকিছুরই একটা আদিম ব্যাখ্যা তারা ঠিক করে রেখেছে মনে মনে, এবং সেই রীতিনীতি মেনে তারা নিশ্চিন্ত; তার জন্য বহু মূল্য দিতেও কুণ্ঠিত নয়। ঢোঁড়াই-এর অসুখ শুনে তার মা বাবুলালের ঘরনী আকুল হয়ে ছুটে গেছে রেবণ গুণীর কাছে, সন্তানের প্রাণ ভিক্ষে চেয়েছে। এর জন্য বুধনিকে যে মূল্য দিতে হয়েছে তার জন্য তার মনে কোনো ক্ষোভ দুঃখ হয়নি কোনোদিন। ঝাড়ফুক, জলপড়া, থানে মানত করা- এসবের প্রতি বিশ্বাসের প্রাবল্য; প্রাকৃতিক শক্তির উল্লাস গোঁসাইয়ের ক্রোধ বা কৃপা মনে করেই তারা নিশ্চিন্ত থাকতে চায়। তারা বিশ্বাস করে আগের জন্মে স্বামীকে দিয়ে পা টেপাবার ফলেই এ জন্মে পঙ্গুত্বের অভিশাপ বহন করতে হয়। শাপ উদ্ধারের উপায়টিও তারা সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে তা বুদ্ধিনির্ভর সমাজে হাস্যকর পন্থা বলে মনে হবে। অথচ তাদের মনে সংস্কারের মতো প্রথিত আছে যে সদ্য মৃত ডুড়ো শেয়ালের গরম নাড়িভূঁড়িতে পা ডুবিয়ে নিয়মিত বসে থাকলে পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি ঘটবে। ফুলঝরিয়ার মা বাবা সময় থাকতে এ উপায় মেনে নিয়ে মেয়ের পা সারাতে উদ্যোগী হয় নি বলে ফুলঝুরিয়া আজীবন পঙ্গু হয়েই থাকল। আর পাগল হয়েও তার এ বিশ্বাস নষ্ট হয়নি বলেই টমিদের সে অনুরোধ করেছে- সাহেব ওটা কি? বন্দুক? একটা ভঁড়ো শিয়াল মেরে দিয়ো তো আমারে বন্দুক দিয়ে।

ধাঙড়টোলার মানুষগুলো জানে বাঙ্গাবাঙ্গীর (দেবতার) নির্দেশ আছে পাড়ার বাঁশঝাড়ে ফুল ফুটলেই বুঝবে যে আকাল না হয় দুঃসময় কাছে। ঐ ফুলের ফসল ছেড়ো না। তাই দিয়ে রুটি তৈরি করে খাবে। তারপর বারো বছরের বেশি, সেখানে থেকো না- বারো বার গাছে তেঁতুল পাকুক। তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে নতুন জায়গায় বসবাস করবার কথা ভাবতে হবে। তাই ধাঙড়পাড়ার মোড়ল এতোয়ারীকে বাঙ্গাবাঙ্গীর নির্দেশ মানতে অনেক খারাপ কাজ করতে হয়। মোড়লের নির্দেশে শনিচরা আর তার বৌটাকে গা ছেড়ে চলে যেতে হয়। এই লৌকিক বিশ্বাসের বশে এরা মনে করে নদীর পানি খেলে গলগণ্ড হয়; জলে ডুবে যে মরে সে হয় পানীভূত। ঠিকমতো শ্ৰাদ্ধশান্তি না হলে মৃত মেয়ে মানুষ হয় শাখড়েল পেত্নী। বিয়ের সময় চাল দান দিলে বিজোড় দান উঠলে বিয়ে স্থায়ী হয় না। ঢোঁড়াই রামিয়ার বিয়ের সময় ঢোঁড়াই চেলেছিল নয়। তখন সে ঠিকই দেখেছিল বেজোড় সংখ্যার চাল। মিশিরজী চেঁচিয়ে জোড় সংখ্যা দশ বললেও ঢোঁড়াই সংকটের দিনে স্থির করে নেয় তার বেজোড় দান চালার জন্যই রামিয়াকে হারাতে হলো। এ ধরনের চিন্তাভাবনা শুধু তাৎমা বা ধাঙড় সমাজেই নয়; একরাত একবেলা পাক্কীর পথ ধরে হেঁটে বিসকান্ধা পৌঁছলেও দেখা যাবে সেখানকার কৃষিনির্ভর মানুষের অন্ধ ভ্রান্ত বিশ্বাস কি প্রবল এবং অনেক সময় কি ভয়ঙ্কর রূপ নেয় তা পাঠককে বিস্মিত না করে পারে না। কোয়েরীটোলার বড়হাদাদার পাঁচ বছরের নাতি হঠাৎ রক্তবমি করে মারা গেলে গিধরমণ্ডল রটালো ডাইনী মোসম্মতের কাজ। সারা গা বিশ্বাস করল কথাটা। বিলটার মতো নিষ্ঠাবান কৃষকও সায় দেয় এই কথায়, বলে- এ জাতের সওয়াল। সকলে একমত হয়ে মোসম্মতকে ডান বলে গ্রাম থেকে উৎখাত করে দেয়। এসব অন্ধবিশ্বাস অন্ত্যজ সমাজের বুকে চেপে মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। আবার প্রথানির্ভর সংস্কারের সুযোগ নিয়ে গিধর মোড়লের মতো ব্যক্তিস্বার্থলোভী মানুষও সরল সামাজিক প্রথাসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষগুলোকে ঠকিয়ে নিজের লাভের কড়ি ঘরে তুলছে- মোসম্মতের জমির প্রতি তার যে দীর্ঘলালিত লোভ ছিল এই সুযোগে তা চরিতার্থ করেছে।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা স্মরণীয়। তাৎমা ধাঙড়রা জিরানিয়াতে জন্মসূত্রে বাসিন্দা নয়। ধাঙড়রা এসে বাসা বেঁধেছিল বহুকাল আগে সাঁওতাল পরগণা থেকে; তারাও তেমনি এসেছিল দ্বারাভাঙ্গা থেকে- উভয়েই এসেছিল পেটের ধান্ধায়। আর্থিক সঙ্গতির উদ্দেশ্যেই এরা বসতি গেঁথেছিল নিয়ে এসেছিল শুধু করণ, কৃত্য আচার আর লৌকিক জীবনধারা। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনধারায় গভীর আনুগত্যের জন্যই স্থানবদলে মানসিক চর্যার পরিবর্তন তেমন হয় নি। কিন্তু একেবারে হয় নি এমন কথাও বলা যাবে না। আমূল প্রথিত জীবনচর্যার রীতিনীতিতে নড়চড় হয়েছে তাও ঐ জৈবিক ক্ষুধার জন্যই। কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য যে শিক্ষালব্ধ সত্য উপলব্ধির প্রয়োজন তার স্পর্শ তারা কম পেয়েছে। তাই শহর ও শহরতলির মানুষগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সমীহের, ভয়ের এবং দূরত্বের। এমন কি নিজেদের সমাজের কেউ যদি ছিটকে গিয়ে তাদের সংস্পর্শে জীবনের চেহারা ফিরিয়েছে, যেমন বাবুলাল চাপরাসীর মতো মানুষকে তারা একটু স্বতন্ত্রভাবে দেখে। এরকম মানুষ তাদের জাতের গৌরব কিন্তু ধাঙড়রা নয়; কারণ তারা সভ্য মানুষের সংস্পর্শে আসতে নিজেদের জাতধর্ম হারিয়েছে তারা কিরস্তান হয়েছে তারা তাদের আর কাছের মানুষ ভাবতে পারেন না। এমনিভাবে নিজেরাই নিজেদের ধারণা গড়ে তুলে নিকট দূর সম্পর্ক স্থাপন করে তার সমর্থনে যুক্তি তৈরি করা রেখেছে।

এত সত্ত্বেও তাদের সমাজের স্বকীয়তার রূপরেখা একটি কারণে প্রত্যক্ষ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাৎমারা অক্ষরজ্ঞানহীন অজ্ঞ হলেও কবচকুণ্ডলের মতো রামায়ণের সঙ্গে তাদের অচ্ছেদ্য বন্ধন রক্ষা করে চলেছে। তাদের নৈমিত্তিক জীবনধারায় রামায়ণ সঞ্চারিত হয়ে গেছে। গভীর বিশ্বাস রাম চরিতমানসে, রামজীর প্রতি। আর এই টোলায় যে রামায়ণ পাঠ করে শোনায়, মিসিরজী, তাকেও তারা সমান ভক্তি করে। আচারে আচরণে, শয়নে জাগরণে অযোধ্যাজী, রামমন্ত্র তাদের উদ্বুদ্ধ করে। সারা উপন্যাস জুড়ে রাম চরিত মানসের উদ্ধার জীবনের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। শিশু ঢোঁড়াইকে থানে শুয়ে থাকতে দেখে বৌকাবাওয়া মনে করেছে তার নিঃসঙ্গ জীবনে রামজীর কৃপা হয়েছে। ঢোঁড়াই-এর নাভি মূলের তিনটি বলিরেখা দেখে তার মনে পড়ে- কটি কিঙ্কিনী উদরত্রয়রেখা।/নাভি গভীর জান জিনহ দেখা। বালক শ্রী রামচন্দ্রজীরও এমন ছিল। ঢোঁড়াই ভিক্ষে করতে বেরিয়ে গান গায় সেও রামজীর গান। মহৎ মানুষের বিরাট আদর্শ তাদের মনে জাগায় রামজীর মহিমা। দুঃখে-সুখে-আনন্দে, দুৎসময়ে, দুর্বিষহ যন্ত্রণায় তাদের স্মরণ-বরণ রামজীই। এমনিভাবেই রামায়ণের প্রবাহ তাদের মনকে এক ধ্রুব বিশ্বাসে দৃঢ় করে রেখেছে।

এই আঞ্চলিক জীবন, গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজধারা কিন্তু পরিবর্তনশীল। অন্ধ সংস্কার আর প্রচলিত প্রথার দাস হলেও এই সমাজের তটে আধুনিক জীবনের চাঞ্চল্য মাঝে মাঝে এসে তাদের নাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বাসে চমক জাগিয়েছে। রাজদরবারের উৎসবের জুলুষ যোগ দিতে পারে নি বলে বুধনির মনে ক্ষোভের সীমা ছিল না। স্বামীর কাছে সেই উৎসবের বিবরণ শুনতে গিয়ে মুসুরডাল না কেনার কারণটা চাপাই পড়ে গেল। কিম্বা বুধনির সেই প্রথমপক্ষের স্বামীর কাছে অসুস্থ বুধনির তাগদের চেয়ে পকেট বাত্তিমারের (সিগারেট) লোভটা বেশি হয়েছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই। আবার এই সরল সাধাসিধে লোকটা হাওয়া আর পানিতে চলা গাড়ি দেখতে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বসেছিল। সেদিন বুধনিও ফৌজী ইঁদারা থেকে জল নিয়ে ছুটে এসেছিল গাড়ির বৃত্তান্ত শুনতে। এমনি অজস্র বাইরের সমাজের আধুনিকতা, উত্তেজনা তাদের জীবনকে নাড়া দিয়ে গেছে। ধীর মন্থর গতিমুখর সমাজে প্রবেশ করেছে, এই শতকের বিশ-তিরিশ দশকের উত্তেজনা। কূপমণ্ডুক, প্রথানির্ভর শ্রমহীন মানুষগুলির স্বেচ্ছাকৃত সমর্থন না থাকলেও নানাভাবে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রতিবেশে এই চলমানতাকে স্বীকার করতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা দিয়ে ধীরে ধীরে তারা হয়ে উঠেছে সময়ের অংশীদার। তাই প্রথমে বর্ণিত রীতি সংস্কার জর্জরিত আপাত স্থাণু সমাজের তলে যে ফন্ধু স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল তা সূযোগ পেয়ে স্বাভাবিক গতিপথরেখা নিয়ে প্রত্যক্ষগোচর হয়েছে। উপন্যাসের প্রথম দিকে ঢোঁড়াই-এর তাৎমা সমাজ ছিল মন্থর গতি। লেখক ঢোঁড়াই-এর জন্মবৃত্তান্ত, মাতৃপরিত্যক্ত-রূপ, ভিক্ষাম্বেষণনির্ভর জীবনধারার সঙ্গে সমাজ জীবন ও পরিবেশের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তখন এক ধরনের ধীরগতি জীবন প্রবাহের ছবি স্পষ্ট হয়েছে। কারণ হিসাবে বলা যায় যে কালপরিধির মধ্যে (প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্ব) ঢোঁড়াই  জন্ম থেকে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠেছে সেই সময়কার গ্রামীণ জীবন মূলত ভারতবর্ষের বৃহৎ অংশের জীবনধারার গতিনির্দেশকারী। সমাজের গতির রূপরেখা গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের জীবনস্রোতে অর্থনীতির সূচকদণ্ডটি তেমন দ্রুত ওঠানামা করেনি। ফলে প্রায় যোগাযোগহীন জাত-জীবিকা নির্ভর মানুষের জীবনে তার ঢেউ বড়ো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারে না। তাৎমা সমাজও এই কারণেই মন্থর ছিল বলে মনে করা অসমীচীন হবে না।

কিন্তু লেখকের উদ্দেশ্য নয় গড্ডলিকাময় জীবনের ও সমাজের কাহিনী রচনা। তাঁর অভিজ্ঞতায় মানুষ ও তার সমাজ সজীব ও গতি সম্পন্ন। দ্বান্দ্বিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে তার প্রবাহ চলেছে কাল থেকে কালান্তরে। কালোত্তরণের চেষ্টায় মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে। নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার। পুরনো সঞ্চিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে মানুষ অর্জন করেছে পরিবর্তন মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। এই শক্তি অর্জনে ও প্রকাশে সাহায্য করেছে ব্যক্তি নিজে এককভাবে আবার সে উদ্বুদ্ধ করেছে সমগ্রকে। ঢোঁড়াই নিজে একা করেছে অনুধাবন ও প্রয়োগ, আবার তারই প্রেরণা প্রচেষ্টায় তাৎমা সমাজের বৃহৎ সংখ্যক মানুষ হয়ে উঠেছে সজাগ সচেতন। স্বভাবতই এর সচেতনতা এসেছে অনেক বাধা-বিপত্তি-বিরোধের মধ্যে দিয়ে। ঢোঁড়াই প্রথম থেকেই পরিবর্তনে নানাভাবে সাহায্য করেছে। বাইরের সমাজের উত্তেজনা তাদের কাছে নতুন করে ব্যাখ্যাত হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনকে তারা নিজেদের মতো করে বুঝতে চেয়েছে, তাদের প্রয়োজনের মতো করে নিয়েছে। অন্ত্যজ সমাজ তার পুরনো মূল্যবোধ-সংস্কার-জীবনধারা-অর্থনৈতিক-সামাজিক ভিত্তির বদল ঘটিয়েছে বাইরের ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ও মানসিকতার পরিবর্তনের সাহায্যে। সেই পরিবর্তনের চিত্রটি স্পষ্ট করলেই সমাজমানসটি তার সম্পূর্ণ চেহারা নিয়ে উঠে আসে।

 বাইরের দিক থেকে যে ঘটনার ঢেউ উপন্যাসের প্রথম চরণে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সে হলো গান্ধীজীর অসহযোগ, আইন অমান্য, সত্যাগ্রহ ইত্যাদি। সাধারণ অজ্ঞ মানুষগুলি নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে নিয়েছে এই উত্তেজনাপূর্ণ দশকটির কার্যকলাপ। এই রাজনৈতিক ঘটনা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ভূমিকাই গ্রহণ করে থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষের জীবন তার প্রভাব যে কি বিচিত্র, আশ্চর্য অথচ পরিপূর্ণ সততায় ভরপুর-তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে ঢোঁড়াই চরিতমানসের পাতায় পাতায়। তাদের মতো করে বোঝার ফলাফল তাদের জীবনকে এরই প্রভাবে যে পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে সেও যে কত বিস্ময়কর তা মননশীল লেখকের জনসংযোগসুলভ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই জানা সম্ভব হতো না।

তাৎমা মানুষগুলোর পরিচিত চৌহদ্দির মধ্যে ছিল স্বাভাবিক মানসিক দূরত্বের শহুরে মানুষগুলি। এদের সঙ্গে তাদের ভাব বিনিময় নেই বললেই চলে। আছে শুধু কায়িকশ্রমের সূত্রে যোগাযোগ- ঘর ছাওয়ার কাজে, তাৎমালা মেয়ে পুরুষ বাবুসমাজে যাতায়াত করলেও কোনোদিন কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। বৈষয়িক সূত্রে উকিল মোক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও সম্পর্কটা সমীহের ও ভয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। ফলে তাদের এত কাছাকাছি সভ্য সমাজ জীবন থাকা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে কোনো হৃদয়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য ঘটিয়ে পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারেনি। তাৎমা প্রভৃতি অন্ত্যজ সমাজ শহর নির্ভর শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে সহজাত বিভেদনীতির মানসিকতায় আপন সমান্তরালতাকে রক্ষা করে চলে আসছিল। এ চেহারা শুধু বিশ শতকের প্রথম দশকগুলির উত্তর বিহারের চিত্র নয়; বলে যেতে পারে গোটা ভারতবর্ষের শহর সংলগ্ন গ্রামীণ জীবনধারায় একই স্বরূপ আজও অপরিবর্তিত আছে। সুতরাং এই সব প্রাচীণ প্রথা বিশ্বাসী সমাজ জীবনে কোনো বিরাট আন্দোলনের, নতুনত্বের ঢেউ যখন এসে পড়ে তখন তার প্রাথমিক চেহারাটা বড়ো উত্তেজনা, বড়ো বিচলিত অবস্থা সৃষ্টি করে। গান্ধীজীর আবির্ভাব, তাঁর জীবন ও কর্মধারায় ঢেউই এই সমাজের কাছে সবচেয়ে বড় উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই সব সরল সাধাসিধে মানুষগুলির আবেগনির্ভর মন প্রবলভাবে নাড়া খেয়েছিল। শিক্ষিত মানুষের যুক্তিবুদ্ধি বিবেচনা ও কার্যধারার অনুসরণ তাদের মধ্যে আশা করা যায় না। তাদের সে পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভবও নয়। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছিল, আন্দোলনকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তার ফলাফলও একটা হয়েছিল। তারা কিন্তু সাময়িক উত্তেজনা কেটে গেলে পুরনো জায়গায়, পুরনো ব্যবস্থায় স্থির থাকতে পারেনি। তাদের নিজেদের মতো করে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। বাইরের ঘটনা তাদের চলিষ্ণু সত্তাকে কিছুটা বেগ দিয়েছিল। তারা সেই পথ ধরে চলতে চেয়েছিল, বাধা পেয়ে পিছিয়ে পড়েছে কিন্তু থেমে থাকেনি। কারণ ভিত্তিমূলে যে নাড়া খেয়েছিল তাতে একই বৃত্তের চারপাশে ঘোরা সম্ভব নয়; কেন্দ্র বিন্দু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। ঢোঁড়াই ও তার সমাজের এমনিভাবেই পথরেখা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

তাৎমা প্রভৃতি অন্ত্যজ মানুষের কাছে সত্যাগ্রহ, আইন অমান্য ও গান্ধীজী একটা বড় ঘটনা ও মহৎ মানুষের রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। গান্ধীজী সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারার প্রকাশ সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের ভাবনার ফসল। গান্ধীজী তাদের কাছে সন্ত, সাধু, রামজীর সমান। বারবারই এই মানুষটির ভাবমূর্তিকে তারা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছে। তাদের সমাজের সম্ভ্রম দূরত্বের মানুষ মাস্টার সাহেব গান্ধীজীর আহ্বানে চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়েছেন, ইংরেজ সরকারকে অস্বীকার করে সভা বক্তৃতা করেছেন এসব তারা শুনেছে বাবুলাল চাপরাসীর কাছে। কিন্তু ব্যাপারটা তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে মাস্টার সাহেবের কর্মপদ্ধতির- নৌকরি থেকে সরকার নিশ্চয়ই বরখাস্ত করেছে। টাকা পয়সার ব্যাপার নিশ্চয়ই কিছু আছে। লক্ষ্য করবার মতো বিষয় এই মানুষগুলির বিশ্বাসবোধ ও ব্যাখ্যার সারল্য বাবুভাইদের স্বাতন্ত্রের সঙ্গে অর্থের এদিক ওদিক ব্যাপারটা জড়িয়ে থাকতে পারে এমন কথা তারা অকপটে বিশ্বাস করে। বাবুলালের মুখেই প্রথম গান্ধীজীর কথা শুনে তাদের কৌতূহল জেগেছে–

গাণহী বাবা কে? গাণহী বাবা?
বড় গুণী আদমী। বৌকাবাওয়া আর রেবণ গুণীর চাইতেও নামী। সিরিদাস বাওয়ার চাইতেও বড়, না হলে কি মাস্টারসাব চেলা হয়েছে। গাণহীবাওয়া মাস-মছলী, নেশা-ভাঙ থেকে পরহেজ (সংযমী)। সাদি বিয়া করেনি। নাঙ্গা থাকে বিলকুল।

 এমনিভাবে পরিচিত মানুষগুলির সাধুতা ও সদবৃত্তির তুল্যমূল্যের অনুষঙ্গে তারা গান্ধীজীকে সেদিন নিজেদের মনের আসনে পরভেজ বা মহাত্মার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে উত্তেজিত, আন্দোলিত, শিহরিত, পুলকিত বোধ করেছিলেন। কিন্তু চেড়াই-এর বাবুলাল সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাসুলভ দীর্ঘ-লালিত মনোভাব গড়ে উঠেছিল। তাই সে সম্পূর্ণভাবে বাবুলালের কথা বিশ্বাস করতে পারেনি। সারাক্ষণই সংশয় সঙ্কটে মনকে আলোড়িত করেছে- গাণহীবাওয়া রেবণগুণীর চাইতেও বড়, বৌকাবাওয়ার চাইতেও বড়, মিলিট্রি ঠাকুর বাড়ির মোহন্তের চাইতেও বড়; এক নম্বরের ধাপ্পাবাজ বাবুলালটা। ঝুটফুস বললেই হল।

সংশয়, বিশ্বাস, উত্তেজনা ও ক্রম উচ্চারিত উল্লিখিত ঘটনার সূত্রেই গান্ধীজী এদের জীবনপ্রবাহে বড় আলোড়ন তুললেন। এরা অদ্ভুত আকর্ষণে বিচলিত ও উত্তেজনায় আংশিকভাবে নাড়া খেল। মনের গভীরে ভাব ভাবনার ধীর পরিবর্তন জীবনধারা ও চেতনাদৃষ্টিকে সজাগ করল। তারা রবিয়ার বাড়ির চালে বিলিতি কুমড়োয় গান্ধীর মূরত দর্শন করল। কিন্তু এ রকম করে তো গাণহী বাওয়াকে হিমে রোদ্দুরে ফেলে রাখ যায় না। ঠাকুরদেবতার ব্যাপার। বালক ঢোঁড়াই বৌকাবাওয়ার থানের ভকত এই অধিকারে সেই মূত স্পর্শ করার অধিকার পেল। ঢোঁড়াই নিজে গৌরবান্বিত বোধ করল। তার আত্মমর্যাদাবোধের প্রথম ধাপটি এমনিভাবে বলিষ্ঠতা পেল সমাজে। সে ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করল উপযুক্ত মর্যাদায় যথাস্থানে গান্ধী মূতকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ঠাকুর বাড়িতে রামসীতার মূর্তির পাশে মহারাজের মূর্তি রাখা ঠিক নয় এটা তারা বোঝে; কারণ রাম সীতা তাদের জীবন পথের প্রথম দিশারী ভগবান। সমস্ত সমাজটার মর্মমূল থেকে দুঃখের উচ্ছ্বাস ব্যক্ত হয়- নহি দরিদ্রসম দুঃখ জগমাহী। কারণ তারা দরিদ্র, বাবুভাইদের মতো টাকা থাকলে এই নতুন সন্ত বা পরভেজ-এর জন্য তারা ঠাকুর বাড়ি করে দিতে পারত। কিন্তু কি দিয়ে তারা পূজা করবে। বাওয়ার চোখে জল আসে স্বাভাবিক কারণে, কারণ তিনি এলেন ভক্তের দুয়ারে; ভক্তের ভিক্ষাবৃত্তি করে চলে; সে তার মর্যাদা দিতে পারছে না। শুধু বাওয়ার নয়- এই বিপদের ঝলকে হঠাৎ যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে সকলের মনে। দারিদ্র্য অনটনে জর্জরিত মানুষগুলির সামনে গান্ধীজী এলেন বিশ্বাস ও সত্যের পূর্ণ মূর্তি নিয়ে; তারা তাঁকে চাইল নিজেদের গোঁসাই রূপে পেতে। আবার রেবনগুণীর মতো আবেগপ্রবণ মানুষটার ঘরে শুধু তাঁর ঠাই হয় না; বিলিতি কুমড়োয় দর্শনধারী গান্ধীমূতি দেখিয়ে রেবণগুণি তার অনেক দিনের মদের খরচ জোগাড় করেছিল। ঢোঁড়াই ভকত হয়েছিল; বাটহীর গানের সঙ্গে গাণহী বাওয়ার গান গাইতে মনের মধ্যে নতুন উন্মাদনা উপলব্ধি করেছিল। তাৎমা সমাজের পঞ্চায়েত একত্রে বসে স্থির করেছিল গাণহীবাওয়া উঁচুদরের সন্ন্যাসী; মুসলমানকেও পিয়াজ গোস্ত ছাড়িয়েছে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে কালালী টোলাতে যাবে না, মদ ছোঁবে না; ঘর দোর সাফসুরৎ রাখবে, ঝোটাহারা একটু পাক সাফ থাকবে। মাহাতো, ছড়িদার গাণহীবাওয়ার আদর্শের সুযোগ নিয়ে পঞ্চায়েতে নিজেদের মর্যাদাকে কায়েম করতে চেয়েছে। বেলগাছের ডালে হুঁকো কলকে বেঁধে প্রত্যেকে সংযম পালন করতে চেয়েছে রবিবারে গাণহীবাওয়ার নামে কাজে না গেলে বেশ হয়। রবিবার তৌহারের দিন। সরকার বাহাদুর পর্যন্ত কাছারী বন্ধ রাখে।

কিন্তু এসব ঘটনার উত্তেজনা বাইরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে মনে করলে ভুল হবে। তলে তলে মানুষগুলিকে পাল্টে দিয়েছে। রবিবার গান্ধীর নামে কাজে না যাওয়াটা মাহাতোদের অভিনব নির্দেশ ও গান্ধী আনুগত্যের প্রকাশ হলেও ঢোঁড়াই-এর মতো বালকের বুঝতে অসুবিধে হয় নি যে এতে তাদের জীবিকার পথটি সংকীর্ণ হয়ে গেল। ঢোঁড়াই পঞ্চায়েতে প্রথম প্রতিবাদ করে আমাদের পেট কেটো না মাহাতো। কারণ রবিবারের ভিক্ষাতেই তার পয়সা রোজগার বেশি; বাবু ভাইরা ঘরে থাকে সেদিন, অনেক পয়সা দেয়। পঞ্চায়েতে ঢোঁড়াই-এর সেদিনের ক্ষীণ প্রতিবাদ অন্যদের আবেগে অবহেলিত হয়েছিল। কিন্তু ঢোঁড়াই সেদিন বুঝতে ভুল করে নি মাহাতত ছড়িদারদের মানসিকতা, স্বার্থসুবিধাকে। গান্ধীজীর নামে তারা ভকত হয়ে। নিজেদের মানুষগুলোর কাছে প্রাধান্য পেতে চাইছে, এমনিই মহতো ছড়িদার, নায়েবদের সম্বন্ধে লোকে কিছুদিন থেকেই অল্প অল্প স্পষ্ট কথা বলতে আরম্ভ করেছে। এ জিনিস আগে ছিল না। ঐ তো সেদিন খোঁড়া চথুরী পঞ্চায়তির মধ্যে চেঁচিয়ে কি সব বলেছিল। খারাপ হওয়ার দিন আসছে। মহতো নিজের জায়গা আরও একটু মজবুত করতে চায়। বছরের একদিন মাছ খাওয়া ছেড়ে যদি লোকের মুখ বন্ধ করা যায়, তাহলে হতোগিরি থেকে বেশ দুপয়সা রোজগার করে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে তার সমাজে প্রসার প্রতিপত্তি বাড়বে। কিন্তু অভিজ্ঞতার নিরিখে এরাই পরে বুঝেছে- না, না, মহতোগিরিতে না আছে আগেকার মতো পয়সা, না আছে সম্মান না আছে এক মুহূর্তের শান্তি।

এইভাবেই সমাজচিত্র ধীরে ধীরে ভিন্নরূপ পেয়েছে। অভ্যস্ত সমাজ জীবনে বাইরের ঘটনা এসে মানুষগুলির মনের গতিকে ভিন্ন খাতে পথ করে দিয়েছে। তারা নিজেদের ব্যাখ্যায়, অভিজ্ঞতায় নিজেদের জীবন ও সমাজের পটপরিবর্তনে সাহায্য করেছে। ঢোঁড়াই এরপর থেকেই এককভাবে পঞ্চায়েতের প্রধানদের সঙ্গে, অভ্যস্ত জীবনধারার সঙ্গে বিরোধ বিসম্বাদের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে। ঝড় ঝঞ্ঝা বিক্ষোভ ও সমর্থন শেষে সকলেই মেনে নিয়েছে নতুন ব্যবস্থা। পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও মানুষগুলো অনেক কিছু মেনে নিতে শিখেছে, সামঞ্জস্যরক্ষা করে অস্তিত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে। এ সমাজের পুরনো মানুষগুলো দেখেছে চোখের সামনে সব কেমন পাল্টে যাচ্ছে অথচ তারা নিরুপায়। প্রথম প্রথম উত্তেজনায় ক্ষোভে ও অধিকারবোধে ক্ষিপ্ত হয়ে দল বেঁধে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের পুরনো যুক্তিগুলো তাদের নিজেদের কাছেই অসাড় প্রতিপন্ন হয়েছে। গ্রামের পঞ্চ মাহাতোকে বলতে হয়েছে- কিছুদিন থেকে দুনিয়া দরকারের চাইতেও বেশি তাড়াতাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে। ঘটনার পর ঘটনার আঘাত লাগছে তাৎমাটুলির সমাজে, তাদের মনে। জিনিসটা আরম্ভ হয়েছে হঠাৎ, কবে থেকে তা ঠিক মহতোর মনে নেই। এই এক সাল দেড় সাল হবে আর কী, লোকের মনে কিসের আগুন লাগছে, কিসের যে স্রোত এসেছে চারিদিকে, মহতো তা বুঝতেই পারে না, তো তার সঙ্গে তাল রাখবে কী করে?

বাইরের রাজনৈতিক ঘটনার ঢেউ এই গোষ্ঠীনির্ভর সমাজের বুকে নানাভাবে আলোড়ন এনেছে। ঢোঁড়াই পাক্কীতে কাজ নিয়ে জীবিকার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। জাতের বাইরে জীবিকা অন্বেষণ সেদিন গোটা তাৎমাসমাজ মেনে নিতে পারেনি, তারা ক্ষেপে উঠেছিল। নানা ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও পরে পুলিশের কাছে ঢোঁড়াই-এর বিশেষ ভূমিকা গ্রহণে সমাজ হার মেনে তাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তারা নতি স্বীকার করেছিল। পরে এই মাহতোই মান মর্যাদার কথা না ভেবে ঢোঁড়াই -এর কাছে এসেছিল নিজের ছেলে গুদরের কাজের জন্য। ঢোঁড়াই যদি মাটি কাটার কাজে ছেলেটাকে লাগাতে পারে এই অনুরোধ করতে হয়েছিল তাৎমা মাহতোকে। কালের এমনই বিচিত্র গতি আর তারই তালে সমাজের এমনি। অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন। অবশ্য এই পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কট। ঢোঁড়াই-এর পাকীতে কাজের ফলে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও পরে বৌকাবাওয়ার টাকায় গাড়োয়ান হয়ে স্বাধীন শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপায়ের আংশিক নিশ্চিন্ততা মাহতোকে যে ঢোঁড়াই-এর কাছে টেনে এনেছে এ কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না। লেখক এই মনোভাবের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। মাহতো ঢোঁড়াইকে বলে- জানই তো আজকালকার রোজগারের বাজার। …তোমার ঐ গ্যাং-এর কাজটা গুদরকে পাইয়ে দাও, তুমি তো ছেড়েই দিলে। ঢোঁড়াই এতোয়ারীকে বলে চেষ্টা করেও পারেনি মাহতোর ছেলেকে কাজ দিতে। মাহতোর সঙ্গে বিরোধ তার অনেক দিনের। মাহতোর আজ ক্ষমতা ফুরিয়েছে, ঢোঁড়াইকে সে পারে না পরাস্ত করতে। কিন্তু ঈর্ষান্বিত তার প্রতি। পুরনো মানসিকতা, সংস্কার নিয়ে এক জায়গায় আড়ষ্ট মাহতো ও তার দলবল। ঢোঁড়াইদের কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে পারে না শক্তির অভাবে, কিন্তু রুষ্ট- ঐ সেদিনের উঁইফোড় ছোকরা ঢোঁড়াই, সেই কিনা গাঁয়ের লোকের মুখিয়া হয়ে আগিয়ে আসে। নতুন পয়সার গরমে ফুলে ভাঁথী হয়েছে ছোঁড়াটা। এই হলো কারণ- মাহতোর ক্ষমতা কমছে, অন্যে মুখিয়া হচ্ছে- আধুনিক কালের গতির সঙ্গে সমান তালে পা ফেলার ক্ষমতা তার নেই, মিথ্যা পঞ্চ-এর আস্ফালন। সমাজ বদলের অভিজ্ঞতায় এমনিভাবে মনের বদলও ঘটছে। অন্য তাৎমারাও নিজেদের দারিদ্রে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতে থাকতে ঢোঁড়াই-এর ব্যক্তিসুখের দিকে তাকিয়েছে একটু বক্র দৃষ্টিতে। শেষ পর্যন্ত ঢোঁড়াইয়ের গাড়ি-বলদ কেনাই ঠিক হয় ভিখনাহাপট্টির মেলা থেকে। পাড়া আবার সরগরম হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে হয়ে উঠল কি তাৎমাটুলি। বড় যখন হয় এমনি করেই হয়। এবেলা ও বেলা বাড়ে। একেবারে বাবুলালের সমান হয়ে গেল ঢোঁড়াই।

ঢোঁড়াই রামিয়াকে বিয়ে করে ঘর বাঁধে। বৌকাবাওয়া ঠিক মেনে নিতে পারেনি মন থেকে। কিন্তু তার তো অন্তর জুড়ে ঢোঁড়াই; তার সুখে সে সুখী, ঢোঁড়াইকে তো রামজীই তার কাছে পাঠিয়েছিলেন, আর বাওয়া তার নিঃসঙ্গ একক জীবনে ঢোঁড়াইকে পেয়ে স্নেহ সিঞ্চনে হয়ে উঠেছিল পূর্ণ। ঢোঁড়াই-এর বিয়ের ফলে বাওয়া মনে মনে হয়ে উঠল নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তিসন্ধানী হয়ে বাওয়া হঠাৎ চলে গেল তাৎমাটুলি থেকে। কিন্তু শুধু কী একাকিত্বের জন্যই বাওয়া চলে গেল? বিবাহিত জীবনেও ঢোঁড়াই  তো বাওয়াকে একই রকম ভালোবেসেছিল; রামিয়াও তো বাওয়াকে অসম্মান করেনি। তবু বাওয়াকে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু শুধু স্নেহ বিভাজনের জন্য নয়; আরও কারণ আছে। গান্ধীজীর আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে লবণ আন্দোলনের সময় তাৎমা সমাজ স্বভাবসিদ্ধভাবে হয়েছিল চঞ্চল; উৎসাহ দানে জিরানিয়ার গান্ধী ভক্ত মাষ্টার সাহেব আর তার সঙ্গীদের আনাগোনায় তাৎমা মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে একত্রিত হয়েছিল মরণাধারের পাড়ে। লবণ তৈরিতে তারা অংশ নিয়েছিল। তাৎমা মেয়েরা রোজ সন্ধেয় গিয়ে প্রদীপ দিয়ে আসে মরণাধারের নতুন থানে। বৌকাবাওয়া এই নতুন স্থানকে ব্যাখ্যা করেছিল নিজের মতো করে; বুঝেছিল এ স্থানের মাহাত্ম ক্রমেই বাড়বে; আর তাৎমাটোলায় বৌকাবাওয়ার গোঁসাইথান ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে- রামিয়া, মাহতো গিন্নী, রবিয়ার বৌ আরও অনেক ঝোটাহা সন্ধ্যাবেলায় মরণাধারের পুলের কাছে ঐ জায়গাটাতে প্রদীপ দিয়ে এসেছে। কাল একদল এসেছিল মহলা দিতে, আজ আবার এসেছে নতুন আর একদল। এরাই সব আবার গাঁয়ে গাঁয়ে চলে যাবে এরপর। কিন্তু মরণাধারের কাছে থেকে যাবে একটা নতুন থান, মহাৎমাজীর থান ঠিক যেখানটিতে আজ জোটাহারা সাঁঝে পিদিপ দিয়েছে, সেই খানটায়। বাওয়া ভাবে সে সত্যি যদি ওখানে আর একটা থান হয়ে যায়, তাহলে তাৎমাটুলিতে গোঁসাই থানের গুরুত্বও কিছুটা টান পড়তে পারে। আর সঙ্গে সঙ্গে হঠাই বাওয়ার স্মৃতিতে ভেসে উঠল মায়ের শেষ কথাটা- অযোধ্যাজীতে গিয়ে থাকি, সেখানে অনেক ভিখ পাওয়া যায়। শুধু বিভক্ত ভালোবাসার বেদনাই বাওয়াকে অযোধ্যাজীর প্রতি আকৃষ্ট করেছে। মনে করা যাবে না, থানের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় তার কর্মের নিঃসঙ্গতা আসবে এ ভয় তাকে চঞ্চল করেছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষান্বেষণে অনিশ্চয়তা তাকে দুর্বিষহ বিপাকে ফেলবে-এই বোধ মনের গভীরে প্রখরভাবে কাজ করেছিল বলেই বাওয়া নীরবে ছেড়ে চলে গেছে তাৎমাটুলি, ঢোঁড়াই, পরিচিত থান সব পেছনে ফেলে রেখে। আরো অনেকেই ছেড়ে চলে গেছে। যেতে বাধ্য হয়েছে এই একই অর্থনৈতিক কারণে। প্রথাবদ্ধ সমাজ যে আঁধারে নিজেকে ধরে রেখেছিল সেই জীবনের কৃত্য করণ, বিশ্বাস ক্রমেই অসাড়; বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বোঝা মাত্র হয়ে উঠল মানুষগুলোর কাছে বহির্সংযোগ, রাজনৈতিক উত্তেজনা; জীবিকাবৃত্তির পরিবর্তন এ সবের ফলেই অন্ত্যজ মানুষগুলি ক্রমেই গোষ্ঠীনির্ভরতা মুক্ত হয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে চাইছিল সচেতন-অসচেতনভাবে। বাবুলাল চাপরাসি, রতিয়া ছড়িদার নিজেদের সমাজবৃত্তের মধ্যে থেকেও মাননীয় ও বিত্তবান ছিল একদিন। তারা সমাজের অন্ত্যজ মানুষগুলির কাছে বিরোধী বলে চিহ্নিত হলো। চৌকিদারী ট্যাক্স ও মামলায় সাক্ষী দেওয়ার ব্যাপারে এরাই ছিল পঞ্চায়েতের প্রধানের মূলশক্তি। ক্রমে এরা সে মর্যাদা হারিয়ে মাহতোকে নির্জীব করে ফেলল। তাৎমার্টলি থেকে লোক চলে যাচ্ছে। রতুয়ার বোনটা মুসলমানের সঙ্গে চলে গেল। হারিয়া মেয়েটার বিয়ে দিয়ে এসেছে মালদা জেলায় টাকার লোভে। আর বলছে যে সেইখানেই চলে যাবে চাষবাসের কাজ করতে। শুধু তাই নয়, মাহতোর নিজের ছেলে সেও জাতকাজ ঘর ছাওয়া আর বালি ছাঁকার কাজ ছেড়ে মুঙ্গেরিয়া তাৎমা রাজমিস্ত্রীদের সঙ্গে কাজে যোগ দিয়েছে। মাহতোর ক্ষোভ মুঠো থেকে সব পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে, কাকে সে আটকাবে? …মহতো থই পায় না; এক বছরের মধ্যে সে এত বুড়ো হয়ে পড়ল নাকি? …যাকগে, মরুক গে যা হবার তা হবেই। তুমহসন মিটহি কি বিধি কে অঙ্কা। তোমার জন্য কি বিধাতার লেখা বদলাবে, …পঞ্চায়তির জরিমানার টাকার হিসাব চায় গাঁয়ের লোকে। আশ্চর্য রাতারাতি বদলে যাচ্ছে তাৎমাটুলি। মরণাধারে বালির মধ্যে যেন তার পা ধসে যাচ্ছে।

ঢোঁড়াইও দেখেছে বদলে। নিজে সে অংশ নিয়েছে বদলের কাজে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সংগ্রাম করেছে সে নিজের সমাজের সঙ্গে, প্রথার সঙ্গে। এক একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে আত্মমর্যাদা ও আত্মসাতন্ত্রের সন্ধান পেয়ে ব্যক্তি ঢোঁড়াই সচেতন হয়ে উঠেছে। সক্রিয় হয়েছে বদলের কাজে- কনিষ্ঠ তাৎমারা তাকে অনুমোদন করে সাহায্য করেছে। তার জীবনধারা দ্বারা সমাজের আর পাঁচজন প্রভাবিত হয়েছে। অথচ ঢোঁড়াইও বৌকাবাওয়ার অন্তর্ধান মুহূর্তে অন্তরের গভীর থেকে অনুভব করেছে- চলে যাওয়ার দিন এসেছে, ঢোঁড়াইয়ের দুনিয়ায়। শনিচরাটা চলে গেল, ধাঙড়টুলি ছেড়ে; সেও যাওয়ার আগে দেখা করে গেল না। ঢোঁড়াই ভাবে যে সকলেই তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, পাড়ার মাতব্বরগুলো পর্যন্ত। সেদিন চৌকিদারি খাজনার কথাটা হাকিমকে বলার পর থেকে বাবুলাল আর দুঃখিয়ার মা তার বাড়িতে আসে না। মহতোর তো কথাই নেই। রতিয়া ছড়িদার আর বাসুয়া নায়েব, সেই পুলিশ আসার দিন থেকে তার সঙ্গে কথা বলে না। থাকার মধ্যে আছে রামিয়া। পৃথিবীর সবকিছু আয়নায় হঠাৎ আলো পড়ার মতো মধ্যে মধ্যে সেখানে ঝলক ফেলে, আবার তখনই কোথায় তলিয়ে যায়। কিন্তু ঢোঁড়াই তো সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সত্যান্বেষণে ব্রতী হয়েছে। পাক্কীর কাজ, গান্ধীজীর জীবনান্দোলনের প্রভাবে, গাড়ীর গাড়োয়ান হয়ে জগৎসন্ধানী হয়েছে। তাৎমাটোলার বাইরের বৃহৎ জগৎ তার বিচিত্র খবরের সঙ্গে সে পরিচিত হয়, পরিচিত করায় তার সমাজের মানুষদের। চিন্তাধারা, ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি মানসভঙ্গির পরিবর্তনে সে সাহায্য করেছে নিজেকে ও সমাজকে বদলাতে। তাকে তো চলে যেতে হবেই সব ব্যক্তিগত বন্ধনসুখ ছেড়ে।

দ্বিতীয় চরণে বিসকান্ধার কৃষিনির্ভর সমাজে জীবনের চিত্র ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। একদিন একরাত হেঁটে জিরানিয়ার অন্য অংশ বিসকান্ধায় পৌচেছে। শুধু পথের দূরত্ব নয়, কালের ব্যবধানেও এখানকার রূপ ভিন্ন সমাজচিত্রের ভিন্ন রকমফের দেখা যাবে। ঢোঁড়াই নিজেও অভিজ্ঞতার চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে জীবনের আবেগময় অংশ রামপিয়ারির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ। অনেক নিস্পৃহ নিরাসক্ত এখন সে। দ্বিতীয় চরণে তার আত্মনিরপেক্ষ সত্তা পেয়েছে ভিন্নক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক উন্মদনার দিনগুলি ততদিনে আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। ঢোঁড়াই সহজেই সেই তরঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছ- আত্মমর্যাদা পেয়েছে। নেতৃত্বের ভূমিকায় বিসকান্ধার কোয়ারীটোলার মানুষগুলির কাছাকাছি এসেছে। কৃষিনির্ভর সমাজের সাধারণ মানুষগুলির মাটির সঙ্গে নিবিড় অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। জীবনের কৃত্য করণ, আচার-আচরণ মৃত্তিকাকেন্দ্রিক। তাৎমাটুলিতে জমির গল্প কেউ করত না। জমিদারের গল্প করত কালে ভদ্রে। কিন্তু এখানকার হাওয়াই অন্যরকম। এখনকার হাসি কান্না গল্প রঙ্গ তামাশা সবই চাষবাস আর জমিদারকে নিয়ে। কিন্তু মাটি ফসল এ সবের প্রতি অধিকার তারা অর্জন করে নি। ভূমিকে ভালোবাসলেও ভূমির ওপর তাদের কোনো জোর নেই। সে সব ভোগ করবে দূরের মানুষ বাবুসাহেব, বচ্চন সিং, আনোখি বাবুরা। আর বিলটা, বুড়হাদাদা যারা ক্ষেতের ফসলের সবুজে বিসকান্ধাকে দেয় নিত্য প্রাণশক্তি তারা খাজনার দায়ে পীড়িত হয়, ফসলের ভাগের জন্য ভিক্ষে করে। দারিদ্র আর শোষণ এদের নিত্যসঙ্গী। তার ওপর সময়টা বড়ো খারাপ। সারা দেশ জুড়ে চলছে আকাল, অনাবৃষ্টি। তার সঙ্গে পয়সার আকাল, শুধু বিসকান্ধায় নয়, সারা জিরানিয়ায়। ঢোঁড়াই -এর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে এরা এদের অবস্থার কথা নিঃসঙ্কোচ ব্যক্ত করেছে- ভালো গাঁ বেছেচ রোজগারের জন্য! আমাদেরই আজকাল খাওয়া জোটে না। যা দিনকাল পড়েছে। দিন দিনই খারাপ হচ্ছে। বিধিগতি বাম সদা সব কাহ। ভগবান সব সময় সকলের উপর নারাজ। দেখা যাক ধানটা পাকলে যদি হালত কিছু বদলায়।

 বিসকান্ধা বড়ো গ্রাম। অনেক দল, মানুষে মানুষে স্বার্থেভেদ বিচিত্র এবং জটিল। তাৎমা সমাজের সঙ্গে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শহরের মানুষের সম্পর্ক ছিল কম। কিন্তু বিসকান্ধার সমাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজপুতরা জমির মালিক আর কোয়েরীটোলার মানুষগুলো তাদের আধিয়ার। রাজপুতদের জমির নিত্য শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। কোয়েরীরা তাদের জমিতে চাষ করে; মেয়েরা ঘরের কাজে ঝি-এর কাজ। রাজপুত বাবু সাহেবই জমিদার, কিন্তু গান্ধী ভাবাদর্শ গ্রহণ করে নিজেকে কিষান বলে পরিচয় দেয়। আধিয়াররা অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝে কিষান বলায় সুবিধে আছে- সব রকমের সহানুভূতি, সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় আবার খাজনার দায়ে দরিদ্র প্রজার জমি সহজেই গ্রাস করাও যায়। এখানকার লড়াই জমির জন্য, ফসলের জন্য ঢোঁড়াই বুঝেছে বাবুসাহেবরা স্বেচ্ছায় বীজধান, ফসলের ভাগ দেবে না। জোর করে তা আদায় করতে হবে। বিসকান্ধায় সাধারণ মানুষ এই সূত্র ধরেই জেগে উঠেছে। এই সূত্র ধরেই গান্ধীজীর শিষ্য ভলেন্টিয়ার তাদের কাছকাছি এসেছে। মাটির আকর্ষণে তারা একজোট হয়েছে। অন্যদিকে বাবু সাহেবও বিরোধী শক্তি গড়ে তুলেছ গিধর মন্ডলের মতো জমি লোভীকে নিয়ে আর দরোগা পুলিশের সঙ্গে সন্তোষের সম্পর্ক বজায় রেখে। ঢোঁড়াই এই সমাজ সত্যকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে- পরিষ্কার সামনাসামনি দুপক্ষের লড়াই জিনিসটা ঢোঁড়াই ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারে। এ কেমন যেন অনেক দলের লড়াই, অনেক লোকের লড়াই, অনেক রকমের ঝগড়ার মুখ জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কে কোন দলে, কোন দল কখন। কোন দিকে বোঝা যায় না। হকের ধন সামলাতে লাগে লড়াই, অথচ এক হাতে লড়া যায় না। তাকে একা পেয়েই না তাৎমাটুলি পঞ্চরা তাকে যা করবার নয় তাই করেছিল। এই একা লড়া যায় না বলেই জাতের দুয়ারে মাথা কোটে। তাই না বচ্চন সিং অন্য রাজপুতদের রোজ সন্ধ্যাবেলায় সিদ্ধির শরবত খাওয়ায়। জাতের বাইরের যে লোকের সাহায্য পাওয়া যায়, তার কাছেই লোকে আপনা ছুটে যায়। তাই বাবু সাহেব যায় মুসলমান ইনসান আলির কাছে; তাই না বাবু সাহেব টানে লালা কায়েত ও রামনেওয়াজ মুন্সিকে তার দিকে। তাই জন্যেই না কায়েরীরা ঢোঁড়াইয়ের মতো রামায়ণ না পড়া লোকেরও সাহায্য চায়।

কিন্তু বিপদের দিনে এই সমাজের মানুষগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই সব ঝগড়া ভুলে এক হয়। ১৯৩৪-এর ভূমিকম্প বিসকান্ধার জীবনে আকালের মতোই দুঃসময় আর দুঃস্বপ্ন নিয়ে এসে সাধারণ মানুষগুলোকে আরো ঘনিষ্ঠ করেছিল। বাবুসাহেবরা, রাজপুতরা এই বিপদের সুযোগে সাধারণ মানুষগুলোর কাছে অন্য চেহারা নিয়ে দেখা দেয় বৃহৎ সুবিধা আদায়ের জন্য। সরল গ্রামীণ মানুষগুলো নতুন করে এদের বিশ্বাস করে হাজার হলেও রাজপুতরা ভালা আদমী। লাডলীবাবুরা ভূমিকম্পে রিলিফের কাজে নেমে পড়ে মহাৎমাজীর কর্মপদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে চায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। ঢোঁড়াইরা লাডলীবাবুদের উৎসাহ বাক্যে দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে বিপদের মুখ থেকে রক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, জমি থেকে বালি সরায়। লাভলীবরা তাদের বোঝান এইতো চাই। নইলে সরকারের ভরসায় বসে থাকলেই হয়েছে। পাক্কীর ফাটল মেরামত হবে তবে আসবেন হাকিম সাহেবরা হাওয়া গাড়িতে। পথ দেখাতে পারলে কি আর সাথে চলা লোকের অভাব হয়? এই কাংগ্রিস আর মহাৎমাজীর হুকুম। এমনিভাবে লাডলীবাবু তাদের সরল দৃষ্টিতে হয়ে উঠেছিল দেবতা। বিসকান্ধার মানুষগুলোর স্থির কর্মময় জীবনে এমনিভাবে মহাৎমাজী কলির মুনাথ বিস্তার করেছিলেন মহরে আসন। রিলিফের কাজে তারা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল; তাদের বোঝানো হয়েছিল তারা ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু সরল মানুষগুলো অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিল এসব আশ্বাসবাক্য। যা কিছু অর্থ সম্পদ তার একচেটিয়া অধিকার ধনী কিষাণদের, আধিয়ারদের নয়। লাভলীবার মতো ভলেন্টিয়ারকেও বিশ্বাস করেছিল। ভোটকে কেন্দ্র করে মানুষগুলো আত্মর্যাদা লাভ করবার উৎসাহে মেতেছিল; ভলেন্টিয়ারের সত্যাগ্রহে অংশ নিয়ে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। কিন্তু আবারও তারা বিশ্বাস করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করল। এমনিভাবে বিসকান্ধার সাধারণ মানুষের সমাজও থেমে থাকেনি এক জায়গায়; তাদেরও চিন্তায় ও জীবনধারায় পরিবর্তন হয়েছে। মানুষগুলো নানা উত্তেজনা, অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও বিশ্বাসভঙ্গের বেদনার মধ্যে দিয়ে বদলেছে নিজেরা, বদল ঘটেছে সমাজের। সত্যসন্ধিৎসা ও জীবনধর্মিতার, সজীব সমাজ আলেখ্য ঢোঁড়াই চরিতমানসের দুটি চরণের সম্পদ।

বিশেষ অঞ্চলের জীবনধারার আলেখ্য, রীতিনীতি কৃষ্টি আচারের অনুপুঙ্খ বিবরণ থাকলেও ঢোঁড়াই চরিতমানস দুটি চরণই অঞ্চলকেন্দ্রিক নয়। অঞ্চল এখানে সব রকমের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে সার্বিক জীবনবোধের গাঢ়তায় সীমাহীন সামগ্রিকতার সত্যে ভারতবর্ষের বৃহত্তর জীবন পরিধিকে স্পর্শ করেছে। আঞ্চলিক ভাষা, আঞ্চলিক জীবনচর্যা তাঁর সাহিত্যে বিশেষ প্রয়োগ রীতি হয়ে আসেনি। এসেছে অত্যন্ত স্বাভাবিক বাস্তব রূপ নিয়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতার মতোই গোটা উপন্যাসে তা সহজভাবে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এ পরিবেশ বাঙালী পাঠকের অভিজ্ঞতার বাইরে হলেও লেখকের সত্যনিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও জীবনবোধের নিবিড়তায় তা কোথায় অসাচ্ছন্দ্য, আড়ষ্টভাব আদৌ সৃষ্টি করেনি। আঞ্চলিকতা শুধু ভাষার জিনিস নয়, ভাবের জিনিস- এ সত্য সতীনাথের লেখায় যত সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত পূর্বের্তী ও পরবর্তী কার উপন্যাসেই তা বোঝা যায় না। সাধারণ আঞ্চলিক উপন্যাসে, মানুষ ও প্রকৃতি সম্পর্কে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা; তাদের ভাব-ভাষা আচার-কৃষ্টি-সংস্কারের সঙ্গে গভীর পরিচয়, সেই সঙ্গে নিবিড় সহানুভূতি ও লেখকের স্বভাবসুলভ নিরাসক্তি লক্ষণীয় গুণ বলে চিহ্নিত হয়। এ সব লক্ষণ সতীনাথের রচনায় বিশিষ্টতা ও সম্পূর্ণতা লাভ করেছে। তাঁর সমকালীন আঞ্চলিক ঔপন্যাসিক অভিধায় খ্যাত লেখকদের তুলনায় তিনি অনেক বেশি পরিমাণে আঞ্চলিক বোধসম্পন্ন ছিলেন।

 তবু সতীনাথ আঞ্চলিক লেখক নন। কারণ আঞ্চলিক উপন্যাসে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অঞ্চল বিশেষের প্রতি আকর্ষণে স্থানিকরুপটি প্রাধান্য পায়। কোনো বিশেষ অঞ্চল তার সম্পূর্ণ সত্তা নিয়ে উপন্যাসে নিজেই একটি চরিত্র বা প্রতীক হয়ে ওঠে। সতীনাথের উত্তরণ এখানেই। ঢোঁড়াই চরিত দেহাতী মাটির গন্ধে, গাছ-লতাপাতার ঘ্রাণে, গ্রাম্য মানুষের চরিত্রে, সরল বিশ্বাস, ধর্মবোধ, সংস্কার, আচার-আচরণে এবং অন্যান্য বহুবিধ গুণে যে পরিমণ্ডল রচনা করেছে তা ভারতীয় জীবনের অকৃত্রিম রূপ। [১১] অঞ্চল এখানে বিশেষায়িত নয়, নির্বিশেষ সত্য জীবনদর্শনে তা সার্থক ও শাশ্বত হয়ে উঠেছে। পূর্ণিয়ার ভৌগোলিক প্রতিবেশ বর্ণনা তাঁর লক্ষ্য নয়। তিনি মানবের চিরন্তন মানবিক সত্তার রূপান্তরের সত্যটিকেই যথার্থভাবে ধরতে চেয়েছেন। তিনি সারা জীবন ধরে মানুষকে দেখেছেন, ভালোবেসেছেন। সাধারণ মানুষের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে শুধু তাদের জীবনধারাকে আবেগময় দৃষ্টিতে দেখেননি। তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছিলেন। ঢোঁড়াই প্রবন্ধে এ সম্পর্কে পরিষ্কার তিনি জানিয়েছেন ধূর্ত অথচ অকপট, নিরক্ষর অথচ জটিল প্রশ্নের সরল সমাধানে সক্ষম; নিজে অন্যায় করে অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় রুখে দাঁড়াবার সাহস রাখে; স্বার্থপর অথচ একটা অসহায় পশুর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত; রঙ্গরসে ভরা বিচিত্র এই ঢোঁড়াই-এর চরিত্র বহুদিন থেকে আমাদের আকর্ষণ করত। [১২] তাহলে দেখা যাচ্ছে, সতীনাথ এই সমাজের মানুষগুলি ও বিশেষ করে ঢোঁড়াই সম্পর্কে বিশ্লেষণাত্মক ছিলেন প্রথম থেকেই। এই সমস্ত মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের গভীরতার সূত্রেই ধরতে চেয়েছিলেন তাদের জীবনের মূল্যবোধকে। জানতে চেয়েছেন কিভাবে নানা ধরনের পারিপার্শ্বিকতার চাপে তাদের চিন্তাধারা, ব্যক্তিগত, সামাজিক চেতনা ও ব্যক্তি চেতনার মধ্যে ক্রমারূপান্তর ঘটেছে। ঢোঁড়াই চরিত-এর দুটি চরণে ঢোঁড়াইকে সেই রূপান্তরের প্রতিনিধি চরিত্র রুপে আঁকতে চেয়েছেন। সুতরাং বিশেষ অঞ্চলের মানুষকে ও তার পরিবেশকে দেখা, বাইরের রূপকে উজ্জ্বল করে তোলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। ভাব-ভাবনায়, ভাষায় ও স্বরূপে সমাজ সংলগ্ন সাধারণ মানুষের জীবনবোধের গভীরতা প্রকাশই ছিল লেখকের উদ্দেশ্য। সতীনাথ রাজনৈতিক জীবনে। এসে বৃহত্তর জন-সংযোগ লাভ করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। রাজনীতির সংস্পর্শে এসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও সাহচর্য গম্ভীর হয়েছিল, একথা ঠিক। কিন্তু রাজনীতি, বৈদগ্ধ এসবের গভীরে ছিল তাঁর সত্যসন্ধিত্স, অন্বেষণধর্মিতা ও অকৃত্রিম জীবনমুখীনতা। এই কারণেই ব্যবহারজীবী রূপে বেশিদিন একা হতে পারেননি। রাজনীতিতে এসেও রাজনীতির সাহ-নীতি তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল কারণ আংশিক দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার জীবনকে সম্পূর্ণ দেখা যায় না। নিজেই নিঃশব্দে সরে এসেছেন এইসব জায়গা থেকে। কিন্তু কাজ তাঁর শেষ হয়নি। আসল কাজ সম্বন্ধে ক্রমেই হয়ে উঠছিলেন সচেতন। অন্তরে তাগিদ অনুভব করেছিলেন সেই কাজকে আকার দেবার। ৪২-এ জেলে বসেই পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। রাজনীতি ছেড়ে বাকি জীবন ধরে সেই কাজেই ছিলেন অনুসন্ধানী ও আত্মমগ্ন। জীবনশিল্পীর চিরন্তন দৃষ্টি দিয়ে জীবনের যথার্থ স্বরূপ সন্ধান করা ও জীবনবোধকে অভিজ্ঞতার আলোকে রূপায়িত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি জীবতী। বৃহত্তর জীবনকে সত্যের আলোকে তুলে ধরার ব্রতচারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জীবন-রসিক। ব্যক্তিজীবনে একক, নিঃসঙ্গ হলেও জীবন-সাধনায় তিনি পেয়েছিলেন সকলকে। জনগণকে। ঢোঁড়াই চরিতের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে মানুষের ও সমাজের পরির্তমান গতিশীল জীবনের রূপ যার মধ্যে দিয়ে গোটা ভারতবর্ষের জনজীবনের চেহারাটা স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষগোচর হয়েছে। আঞ্চলিকতাকে অতিক্রম করে  ঢোঁড়াই  চরিতমানস পেয়েছে মহাকাব্যের বিশাল ভূখন্ডের ব্যাপ্তি।

ঢোঁড়াই চরিতমানস সমাজ সত্যে অন্বিত ব্যক্তি মানুষের সংগ্রামমুখর জীবনের কাহিনী। লেখক চেয়েছিলেন ঢোঁড়াইকে জনপ্রতিনিধি করতে। এ উপন্যাসের দুটি চরণেরই জন জীবন বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে। দুটি চরণেই ব্যক্তির ক্রমিক বিকাশ ও দ্বান্দ্বিক পরিণতিই প্রাধান্য পেয়েছে। সেই সঙ্গে তার সামাজিক ও ব্যক্তিসত্তার দ্বন্দ্বিক বিবর্তনের ক্রমিক ইতিহাসও গুরুত্ব লাভ করেছে। অন্ত্যজ সমাজের অতি সাধারণ ঢোঁড়াই নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসে হয়ে উঠেছে ঢোঁড়াই রাম- শ্রেণী মানুষের প্রতিনিধি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। ব্যক্তিজীবনের আবর্তে। কারণ লেখক জানতেন জন্ম মুহূর্ত থেকে মানুষ একা। একক ব্যক্তির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে তাকে মিলিয়ে হতে হয় বহুর সঙ্গে। সংগ্রাম শেষে আবার তার পরিচয় এককরূপেই। সেই একক মানুষ ব্যক্তি ঢোঁড়াই-ই এ উপন্যাসের নায়ক। তার ট্র্যাজিক জীনকথাই শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব লাভ করেছে। এ চরিত্র সৃষ্টি সম্পর্কে লেখক প্রথম থেকেই ছিলেন অতি সচেতন। তিনি আত্মমুখী মননশীল চেতনার গভীর অনুসন্ধানের সাহায্যে ঢোঁড়াই-এর সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনধারার ক্রম বিকশিত রূপ সম্পর্কে পাঠককে নিশ্চিত প্রত্যয়ে পৌঁছে দিয়েছেন। মানসিক রূপান্তরের প্রতিটি স্তর পেরিয়ে ঢোঁড়াই চরিত্রের বলিষ্ঠ ব্যক্তিসত্তাটি রূপায়িত হয়েছে। ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক বদলের চিত্রটি লেখক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে স্পষ্ট করেছেন। সমাজের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের ফলেই ব্যক্তির মানসিক রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী- এ বিশ্বাস রচয়িতার। এরই ফলে ঢোঁড়াই চরিত্রে ঘটেছে ব্যাপ্তি ও বিস্তার। এ উপন্যাসে এসেছে মহাকাব্যের বিশালতা। ঢোঁড়াই যেন একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল ট্র্যাজিক চরিত্র ও বিশাল মহাকাব্যের লোক নায়ক।

এ চরিত্রটি সতীনাথের বাস্তবের পরিচিত ঢোঁড়াই  বা ঢোঁড়াহাই চরিত্র। এ নামটা অন্ত্যজ সমাজে খুব চলে বলে লেখক জানিয়েছেন। শিক্ষিত, শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে এ নাম পরিবর্তিত হয়ে উচ্চারিত হয়- ঢোঁড়াই; যেন ঢোঁড়া সাপ- নির্বি। বাস্তব ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে লেখকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সে নিজে থেকেই লেখককে তার জীবনের অনেক কথা অকপটে জানিয়েছে। আর লেখকও কল্পনা করেছিলেন এ চরিত্রকে ঘিরে। ব্যক্তি ঢোঁড়াই ছিল বাকপটু, তার সমাজের সকলের মধ্যে সেরা। তিনি তাকে দেখেছেন বহু-মূর্তিতে। লেখক নিজেই বলেছেন- তাকে ভিক্ষা করতে দেখেছি, ঘর ছাইতে দেখেছি, গো গাড়ি চালাতে দেখেছি। ইদানীং সে হয়েছিল রাজমিস্ত্রি-ঠিকেদার। এ ঢোঁড়াই কুয়োর বালি ছাঁকতে, পাড় বাঁধতে ওস্তাদ। আবার ডালি সাজিয়ে চেয়ারম্যানকে ঘুষ দিয়ে ধাঙটুলির সরকারি উঁদারার কাজে ঠিকে কাজটা পেতেও ইতস্তত করে না। শুধু তাই নয়, লেখকের মতে, আমার চেনা ঢোঁড়াই-এর চরিত্রে আর একটা দিকেরও একটু আভাস দেওয়া দরকার। সে একবার একটা দুরমুশ চুরি করে ধরা পড়েছিল। আর একবার টাকা খেয়ে, জাতের পঞ্চায়েতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে একজনের বিবাহিতা স্ত্রীকে অপরের হাতে তুলে দিতে সাহায্য করেছিল। এ ছাড়া আরও অনেক দোষ ছিল ঢোঁড়াই-এর। তার সবগুলোই দারিদ্র্যজনিত নয়। [১৩] এই হলো লেখকের চোখে দেখা বাস্তব ঢোঁড়াইয়ের চরিত্র। অজস্র দোষে ভরা। অথচ একেই, রামায়ণের রাম চরিত্রের মতো করে আঁকতে চাইলেন। কিন্তু কেন? সে উত্তরও সতীনাথ দিয়েছেন- আমার বই-এর নায়ক চরিত্রের আদরা হিসাবে ঢোঁড়াইকে বাছবার কোনো সংগত কারণ ছিল না। চোখের সম্মুখে একটা নকশা থাকলে আঁকবার সুবিধা হয়। পরে সেটার উপর একমেটে কর, দোমেটে কর; প্রয়োজন আর রুচি অনুযায়ী রঙ আর অলঙ্কার দাও। নাইবা থাকল উপলেপের ফলে প্রাথমিক মূর্তির সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য, তবু এই যেন সহজ বলে মনে হয় আমার কাছে।

ধূর্ত অথচ অকপট; নিরক্ষর অথচ জটিল প্রশ্নের সরল সমাধানে সক্ষম; নিজে অন্যায় করে অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় রুখে দাঁড়াবার সাহস রাখে; স্বার্থপর অথচ একটা পশুর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত; রঙ্গরসে ভরা বিচিত্র এই ঢোঁড়াই-এর চরিত্র বহুদিন থেকে আমাকে আকর্ষণ করত। তাই আমার কাজের পক্ষে অনুপযোগী হলেও, রামের খোঁজে বেরিয়ে, তার কথাই আমার সবচেয়ে আগে মনে পড়ছিল। [১৪] ঢোঁড়াইকে লেখক নিজের মতো করে নিয়েছেন, বদলেছেন। ঢোঁড়াই-এর চরিত্রে বিচিত্র সদগুণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন শুধু ব্যক্তি উঁড়াই-এর স্বভাব অনুসরণ করে নয়, গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার সময় লেখক ঢোঁড়াই-এর সমাজের সাধারণ লোকদের চরিত্রে যা কিছু ভালো দেখেছিলেন, সেগুলিরই সমাবেশ ঘটিয়েছেন উপন্যাসের ঢোঁড়াই চরিত্রে। কারণ, শ্রীরামচন্দ্রকে কানা খোঁড়া দেখানো চলে না, আর ঢোঁড়াই কে এ যুগের শ্রীরামচন্দ্র করবার কঠিন কাজ ছিল তাঁর সামনে। তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষদের মধ্যে- এই হলো লেখকের মতামত। তাই ঢোঁড়াই চরিত্রের ত্রুটি, ভয়ঙ্কর দোষগুলি পরিহার করে তাকে গড়ে তুলতে চাইলেন নতুনভাবে- কর্তব্যের পথে অবিচলিত থাকবার দৃঢ়তা ও যে কোনো বাঁধা ঠেলে পথ করে নেবার সাহস তার মধ্যে আনতে হল। তার স্বভাবের হালকা রঙ্গরসের দিকটা যাতে উচ্চারিত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখলাম, কেন না নেতার পক্ষে ও জিনিস বেমানান হতো। [১৫]

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ঢোঁড়াই চরিত্র নিয়ে লেখক অনেক ভেবেছেন। তাকে প্রথম থেকেই বিশেষ, করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব দেবার জন্য তাকে বেছে নিয়েছিলেন লেখক এবং উপন্যাসের দুটি চরণেই ঢোঁড়াই-এর বিচিত্র ধরনের ক্রমিক রূপান্তরের সাহায্যে বাংলা কথাসাহিত্যে এক বিশিষ্ট নায়ক চরিত্র সৃষ্টি করলেন। ঢোঁড়াই আমাদের পরিচিত নায়ক, সমাজের কেউ নয়। আবার অতি সাধারণ চরিত্র যারা ধীরে ধীরে বাংলা উপন্যাসে ক্রমেই নায়কত্ব পাচ্ছিল সেই করালী বা কুবেরও নয়। সে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পথের সূচনা করল যেখানে সে আজও একা ও অনন্য। আবার মাত্রার গুরুত্বে সে গোরার সমগোত্রীয় মহাকাব্যোপম উপন্যাসের নায়ক হবার দাবি রাখে। এই চরিত্রকে নিয়ে আর একটি চরণও লেখবার বাসনা ছিল লেখকের। আবার এমন ভাবনাও সতীনাথের স্বীকারোক্তিতে পাওয়া যায় যতদিন বাঁচব ঢোঁড়াইদের মনের রূপরেখা এঁকে যাব। তাঁর মতে ঢোঁড়াইদের চরিত্র মানস সরোবরের মতো গভীর।

প্রথম থেকেই লেখক ঢোঁড়াইকে করতে চেয়েছিলেন প্রতীক চরিত্র। একই সঙ্গে তাকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন ব্যক্তি ঢোঁড়াই  ও সমগ্র ঢোঁড়াইদের প্রতিনিধিরূপে। সে একই সঙ্গে কমনম্যান আবার সেই সঙ্গে ইনডিভিজুয়াল। কিন্তু লেখার পর অতৃপ্তি জেগেছে। ঢোঁড়াই রামচন্দ্র হয়ে ওঠেনি। তাকে মনে হয়েছে average, typicial Indian character. আবার ডায়েরিতে অন্যত্র বলেছেন ঢোঁড়াই is the type not average।

এ সকল স্বীকারোক্তি থেকে মনে হয়, লেখক মানসে ঢোঁড়াই চরিত্রটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রকাশক্ষম হয়েছে। অতৃপ্ত লেখক তাকে বিচিত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্যে ক্ষুদ্রগণ্ডী থেকে বৃহৎ পটভূমিতে স্থাপন করে আকার দিতে চেয়েছেন। সমস্যা-সঙ্কট, সুখ-দুঃখ আনন্দ ও আর্তিক বিচিত্র অভিব্যক্তির মাধ্যমে ঢোঁড়াইকে লেখক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। কোনো পরীক্ষাই শেষ পর্যন্ত লেখকের কাছে সঠিক মনে হয়নি বলেই ঢোঁড়াই চরিত্রের অন্তর্লোক তন্ন তন্ন করে সন্ধান করেছেন।

 মনননিষ্ঠ, আত্মমুখী লেখকের ক্রমাগত অনুসন্ধিৎসার ফলে বাংলা সাহিত্যে এক অখ্যাত, অবজ্ঞাত, নামের অগৌরবে, অপরিচিতির সহস্র আবরণ ভেদ করে ঢোঁড়াই হয়েছে বিশিষ্ট নায়ক- সতীনাথের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের সার্থকতম নায়ক। এ চরিত্রের বাস্তব জন! যে অযোধ্যা বা জিরানিয়াতেই হোক না কেন; এর প্রকৃত বীজ তো রোপিত হয়েছে জন জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতায় প্রগাঢ় মগ্নচৈতন্যের সাধক সতীনাথের মনোভূমিতে। সেই চেতনালোকের আলোকরশ্মির সঞ্জীবিত শক্তিতে পূর্ণ ঢোঁড়াই চরিত্র। তাই ঢোঁড়াই রোমের আদরায় চিত্রিত হলেও সত্য পূজক, ন্যায় বিচারক ঘুপতি রাঘব রাজা রাম নয়। এ যুগের যন্ত্রণার আঁধার থেকে উঠে আসা এক নিঃসঙ্গ মানবিক চরিত্র।

 ভালোমন্দ, প্রেম-অপ্রেম ও আনন্দে-ক্রোধের বিচিত্র সংঘাতে বাজয় হয়েছে ঢোঁড়াই এর মন। বাইরে বিচিত্র বাঁধায় সংঘাতের প্রাবল্য জেগে ওঠে তার সংগ্রামী চিত্ত বাধা না পেলে ঢোঁড়াইয়ের আসল রূপ খোলে না। [১৬] জন্মের পর থেকেই বিচিত্র বাঁধা বিঘ্নের মধ্যে দিয়ে ঢোঁড়াই এগিয়েছে। দুবছর বয়সের আগেই ঢোঁড়াই হয়েছে পিতৃহারা-মাতৃপরিত্যক্ত। বৌকাবাওয়ার নিঃস্বার্থ স্নেহসিঞ্চন ছাড়া ঢোঁড়াই-এর জীবনে আর সজীব স্পর্শ ছিল না একথা ঢোঁড়াই জ্ঞানোদয় থেকেই অনুভব করেছে। আর যত বড়ো হয়েছে ততই অনুভব করেছে যে এ সংসারে সে একা। জেনেছে বৌকাবাওয়া ভালোবাসলেও ঢোঁড়াই কে রক্ষা করার সামর্থ্য তার নেই। তাই অল্প বয়স থেকেই সে দক্ষ হয়েছে জীবিকা সন্ধানে। ভিক্ষে করতে গিয়ে বালক ঢোঁড়াই যে সব কৌশল প্রয়োগ করেছে অল্পবয়স থেকেই, তা বাওয়াকে পর্যন্ত মুগ্ধ করেছে। বাহির গানে কি করে শহুরে মানুষকে আকৃষ্ট করতে হয়; কি রকম ভঙ্গি করলে সহজে বেশি পয়সা পাওয়া যায় সে জানত। গানের টানে তার ছাতির জোর প্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জৈবিক সংগ্রামের সম্পর্ক। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছে অতি শৈশব থেকেই। আর সংগ্রামের ফলেই সে মনে মনে সমাজের আর পাঁচজনের সঙ্গে নিজের স্বাতন্ত্র্য অনুভব করেছে। অবশ্য এই অনুভবের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়েছিল ঢোঁড়াইয়ের অভিমানবোধ ও ক্ষুব্ধতা। এ ক্ষোভ একাকিত্বের; এর জন্য সে দায়ী করেছে তার মা বুধনিকে এবং তার নিজের তাৎমা সমাজকে। ক্রোধ ও ক্ষোভে সে মায়ের সঙ্গে রচনা করেছে দূরত্বের ব্যবধান। বাবুলাল চাপরাসীর (সত্বপ) ওপর জন্মেছে প্রবল ঈর্ষা ও অবহেলা। আর সমাজের প্রতি জেগেছে প্রতিশোধের স্পৃহা; সকলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বদ্ধপরিকর হয়েছে ঢোঁড়াই। সমাজকে সে ছেড়ে যায় নি, অস্বীকার করেনি। সমাজের মাঝখানে থেকে নিজের পাওনা আদায় করতে চেয়েছে কারণ আত্মরক্ষা করে অস্তিত্ব বজায় রেখে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে ঢোঁড়াই। এ সংগ্রামের আর এক নাম জীবনসংগ্রাম। আত্মমর্যাদার আঘাতে আহত ঢোঁড়াই-এর ব্যক্তিত্ব এমনিভাবেই দৃঢ়তা পেয়েছে উপন্যাসের প্রথম চরণেই। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগ্রামের ভূমিতে একের পর এক বাধা দূর করে এগিয়ে গেছে ঢোঁড়াই। যত বয়স বেড়েছে, ততই সে তার মাকে এড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিক নিয়মে বুধনিও কখন ঢোঁড়াইয়ের মা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে দুখিয়ার মা রূপে। অবশ্য উপন্যাসে ঢোঁড়াই-এর অসুখের সংবাদে বুধনির মাতৃত্বের প্রকাশ ও রোগজীর্ণ ঢোঁড়াইয়ের মাকে আঁকড়ে থাকায় চিরন্তন মানবিক সম্পর্কটি লেখক কৌশলে ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। একটু সুস্থ হতেই ঢোঁড়াই-এর স্বাতন্ত্র্যবোধ স্পষ্ট হয়েছে, সে সরে এসেছে। কিন্তু তার সবচেয়ে রাগ জাত-জীবিকাকে আঁকড়ে থাকা, জীর্ণ সংস্কারের জগদ্দলের প্রতি আনুগত্যে জর্জরিত বলাভকত মাহাতো পঞ্চদের বিরুদ্ধে। সে জানে এদেরই অবিবেচনা অদূরদর্শিতায় তার এই পরিণতি। তার সমস্ত ক্রোধ এদেরই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। সে আঘাত করতে চেয়েছে সমাজকে। জীবিকারীতির প্রথা ভেঙ্গে পাক্কীতে কাজ নিয়ে ক্রীশ্চান ধাঙড়গুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সমাজকে সে বড়ো আঘাত দিয়েছে। শুধু তাই নয় সমাজবদ্ধ বিবাহ প্রথা ভেঙ্গে সে অন্যদেশের মেয়েকে বিয়ে করেছে। জাতের গভী অতিক্রম করেছে পৈতে নিয়ে ও অন্যদের উৎসাহিত করেছে। এসব ঘটনা ঢোঁড়াইয়ের ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিচিত্র স্তর ও তার মানসিক বলিষ্ঠতার প্রকাশ। এই সমস্ত স্তর অতিক্রম করেই সাধারণ ঢোঁড়াই হয়েছে স্বতন্ত্র। তাৎমা সমাজের সমবয়স্কদের কাছে সে কখন নিজেরই অজান্তে হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট জন, পঞ্চ মাহতোরাও ঢোঁড়াইকে সম্পূর্ণ মেনে নিতে না পারলেও অস্বীকার করতে পারেনি। সে নিজে বদলেছে ও সমাজকে বদল হতে সাহায্য করেছে। ব্যক্তিত্ব বিকাশের এই পর্বটিতে ঢোঁড়াই নিজেই সম্পূর্ণ করেছে নিজের বৃত্ত। আত্মপ্রতিষ্ঠার পর্ব সম্পূর্ণতা পেয়েছে রামিয়ার সঙ্গে বিবাহে। যৌবনের সূচনায় সে পেয়েছে অল্পকালের জন্য সুখ, নিশ্চিন্ততা ও আংশিক প্রতিষ্ঠা। পাক্কীর কাজ থেকে গাড়ির গাড়োয়ানে রূপান্তরিত হয়ে সে পেয়েছিল অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও জীবনের একটা অস্ত্যর্থক দিকের সন্ধান। রামিয়াকে ঘিরে তার বঞ্চিত হৃদয় পেয়েছিল উষ্ণ আবেগের স্পর্শ ঢোঁড়াই ভেবেছিল সে পেয়েছে শান্তি ও সুখের স্বাদ। কিন্তু সে জন্ম থেকে ছিন্নমূল, সে কি সুখের শিকড় বিস্তার করতে পারে? ঢোঁড়াই পারেনি তাৎমাটুলিতে নিজের স্থায়ী বাসভূমি গড়ে তুলতে- যখনই ঢোঁড়াইয়ের জীবনটা চলনসই গোছের হয়ে আসে, অমনি একটা করে আঁধি উঠে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। তার জীবনে বরাবর লক্ষ্য করে আসছে ঢোঁড়াই।

প্রথম চরণে ঢোঁড়াই বিরুদ্ধতা ও বিক্ষোভের সাহায্যে সমাজকে আংশিক প্রভাবিত করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে নিজে গ্রাজিত হয়েছে; সামুয়েল ও পঞ্চদের চক্রান্তে ঢোঁড়াই হেরে গিয়েছে নিজের কাছে। রামিয়াকে কেন্দ্র করে যে বিশ্বাঘাতকতার ব্যুহ তৈরি করেছিল তার সমাজ, সেখানে সে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। পঞ্চদের দেওয়া বাইরের আঘাত সে প্রত্যেকবারেই ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রত্যাঘাত করে। কিন্তু রামিয়া তার হৃদয়ের সর্বস্ব বিশ্বাসের সেই বলিষ্ঠভূমি যখন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল তখন তাকে মিথ্যে আঁকড়ে থাকা ঢোঁড়াইয়ের মানসিক গঠনের বিরুদ্ধ কাজ। তাই সে তাৎমাটুলিতে থাকার আর প্রয়োজন বোধ করেনি; বা, বিসকান্ধা আর তাৎমাটুলির ব্যবধান ঘোচাবার চেষ্টা সে করেনি আর কোনোদিন। বরং একটা পরাজয়ের বেদনা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বলেই কোয়েরীটোলার জীবনে অতীতের তিক্ত পর্বটাকে নানাভাবে আড়াল করে রাখতে চেয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাহতোকে তারই গাড়িটা চালিয়ে বিসকান্ধায় আসতে দেখে নিজেই আশ্রয় নিয়েছে পাক্কীর অন্তরালে। এখানেও অভিমান আর ব্যর্থতার ক্ষোভ তাকে সঙ্কুচিত করে রেখেছে। ঢোঁড়াইয়ের বিড়ম্বিত জীবনের ট্র্যাজিক বৃত্তটি প্রথম চরণে এইখানেই সম্পূর্ণতা পেয়েছে। সকল বন্ধন ছিন্ন করে তাৎমাটুলির সীমা পেরিয়ে এসে সে দাঁড়িয়েছে পাক্কীতে। তার স্বপ্নের পাক্কী তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। ঢোঁড়াই ব্যক্তি সম্পর্কের আত্মীয়তার সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আত্নসমর্পণ করেছে নির্বিশেষের মধ্যে। পৌচেছে বিসকান্ধায়। মাটি আর মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় ঢোঁড়াইয়ের শুরু হয়েছে নতুন সংগ্রাম। এইখানেই ফুটে উঠেছে কর্মচঞ্চল ঢোঁড়াইয়ের আর এক দৃঢ় বলিষ্ঠ রূপ।

বৃহৎ জীবনের বিচিত্র পটভূমিতে  ঢোঁড়াই  হয়েছে প্রতিনিধি। দ্বিতীয় চরণেও ঢোঁড়াইয়ের ক্রমিক মানসিক বিবর্তনে ইতিহাস অব্যাহত রয়েছে। এই পর্বে তার জীবনের প্রবাহ সমান্তরাল রেখায় এগিয়ে গেলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সাগিয়াকে কেন্দ্র করে এক ধরনের স্মৃতিসুখ লালন করেছে ঢোঁড়াই। সাগিয়াই ঢোঁড়াই কে ভুলতে দেয়নি তার অতীত জীবনকে- রামিয়ার তিক্ত স্মৃতি আর তাৎমাটোলার প্রতি জন্মসূত্রের আকর্ষণকে। সাগিয়া তার জৈব কামনাহীন প্রেম নিয়ে পুরোনো জীবনের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করে চলেছিল ঢোঁড়াইয়ের অবচেতনে। এই অবচেতনই কার্যকারণ রচনা করেছিল অনেক পরে আজাদ দস্তার ভগ্ন জীবনে যখন ঢোঁড়াই আর একবার ব্যক্তি ঢোঁড়াই হয়ে ছুটে গিয়েছিল স্বর্ণসীতার সন্ধানে। তাছাড়াও সাগিয়ার কামনাহীন প্রেম ঢোঁড়াইকে আধিয়ারদের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হবার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

বৃহত্তর জীবনের আহ্বান ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে জমির লড়াইয়ের ভলেন্টিয়ারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় ও গান্ধী আদর্শে গভীর আস্থা স্থাপনে। ঢোঁড়াই এ পর্বে অত্যন্ত সক্রিয়, কর্মদক্ষ ও কর্মচঞ্চল। অভিজ্ঞতার সাহায্যে আর অজস্র আদর্শ সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ঢোঁড়াই  নিজেরই অজান্তে রাজনীতির আবর্তে প্রবেশ করে। ক্রান্তি দলে যোগ দেয়। এখানেও শ্ৰমতৎপরতায় সে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু তার নিজের মোহ ভঙ্গ হয়। এই মোহ ভঙ্গের জন্য একটা জিনিসের দরকার ছিল তা হলো অক্ষরজ্ঞানের। অশিক্ষিত, অবজ্ঞাত জাতকলহের নাগপাশে আবদ্ধ সমাজের ঢোঁড়াই  শিক্ষার আলোকে হয়ে ওঠে রামায়ণজী। অবশ্য রামায়ণ তার জীবনের সঙ্গে সংস্কারের মতোই জড়িয়েছিল জন্মমুহূর্ত থেকে এবং রামায়ণের আদর্শে বিশ্বাস ও ন্যায়বোধ ঢোঁড়াইয়ের জীবনে প্রথম থেকেই প্রবল অনুপ্রেরণার কাজ করেছে। রামায়ণই তাকে বারবার এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সত্যের পথে। আজাদ দস্তার কৃত্রিমতার মাঝখানেও অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ঢোঁড়াই আশ্রয় পেতে চেয়েছিল রামায়ণে। তাই দলের মধ্যে থেকেও নিজেকে সমর্পণ করেছিল রামায়ণের মধ্যে। কিন্তু ঢোঁড়াই কোনো আদর্শ নয়, সে রক্ত মাংসের মানুষ। তার চলিষ্ণু সত্তা কিছুতেই আত্মস্থ হতে পারেনি। ক্রমাগত সংগ্রামে আর ব্যর্থতায় তার চিত্ত বিক্ষুব্ধ, অস্থির। জীবনের যে অংশকেই সে আপন বলে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে সেখানেই সে লাভ করেছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় চরণে জমির লাড়াইয়ে বা রাজনৈতিক জীবন সংগ্রামে সে জেনেছে বিশ্বাসের ভূমি বড় ভঙ্গুর। পাক্কী আর রামায়ণ- এই দুই ছিল ঢোঁড়াইয়ের জীবনের অবিচল সত্য, আদর্শ ও স্বপ্ন। তার বিশ্বাস ছিল- ক্ষেতের রঙ বদলায়, লোকের মন বদলায়, আজকের ছোট ছেলেটা কাল জোয়ান হয়ে ওঠে, রোজার তাকত কমে, রোজগারের ধারা বদলায়, তাৎমাদের মোড়ল গোরুর গাড়ি চালায়, দুনিয়ার সব জিনিস বললায়। বললায় না কেবল পাকী আর রামায়ণ। এ দুটোর সঙ্গে যে নাড়ি বাঁধা তার। কিন্তু অভিজ্ঞতার আঘাতে ঢোঁড়াই এই দুইয়ের প্রতিই আস্থা হারিয়েছে। তার স্বপ্নের পাকীর চেহারা দেখে সে ভয় পেয়েছে- পাক্কী ঢোঁড়াইয়ের কাছে একটা সজীব জিনিস। তার কোনো রকম সন্দেহ নেই যে পাক্কটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। লোহাতে ঘুণ ধরেছে, সোনাতে মরচে পড়েছে, এ কি কলির শেষ হয়ে এল নাকি, …দুনিয়াটা ঠিক বদলাচ্ছে না, ভেঙ্গে পড়ছে, হুড়মুড় দুমদাম করে। এর খুঁটিগুলো এত পলকা তা আগে জানা ছিল না। পায়ের নিচের শক্ত মাটি, তাতে দাঁড়িয়েও যেন নিশ্চিন্দি নেই,… রোজার রাজ্যে উড়ে এসে বসেছেন রাজা- সরকার বাহাদুর। এতদিন ইনরধনুর আড়ালে ইনরজী মহারাজের মতো ছিল সাত সমুদ্র তের নদীর পারের রাজা সূর্যি ঠাকুরকে সেই রূপকথার রাজা রাখতেন দারোয়ান। সে দারোয়ানের চোখের পলকটুকু পর্যন্ত ফেলবার হুকুম ছিল না। রাজপুত্তুর ঢলাকুমার আর বিজাসিং-এর রূপটা তবু পালা গানের সুরে আর ঢোলকের বোলে ধরা পড়ত। এ রাজাকে জানবার সে উপায়টুকুও ছিল না। সেই রাজা এসে গিয়েছেন কাছে। …পাক্কী আর পাটের দামের রাজা, কাপড় আর কেরোসিনের জা, মাটিতে জমিদার হাকিম দারোগা ফৌজের রাজা, আকাশে হাওয়াই-জাহাজের রাজা, বাতাসে ফৌজি হাওয়া গাড়ির গন্ধর রাজা। রামায়ণে এ রকম রাজার কথা লেখা নেই। বিলাক- এর কথা লেখা আছে? …এসব কথা রামায়ণে থাকে না, থাকে নিলামি ইস্তাহার ওয়ালা মাষ্টার সাহেবের কিতাবে। …বদলায় অথচ বদলায় না। পুরোনো রামায়ণ আর নতুন রামায়ণে জট পাকিয়ে যায়।

সে দেখেছে সর্বত্রই স্বার্থান্ধতার তীব্র প্রতিযোগিতা। আজাদ দস্তাতেও সেই একই রূপ। সুতরাং আদর্শ বারবার প্রতিহত হয়েছে। জীবন জিজ্ঞাসায় জর্জরিত ব্যক্তি মানুষের পক্ষে অন্তঃসার শূন্য জগতের প্রতি আস্থা রাখা অসম্ভব। রামায়ণের আদর্শেও আর স্থির থাকা সম্ভব নয়- ঢোঁড়াই ও পারেনি। ঢোঁড়াই স্মৃতি কণ্টকিত যন্ত্রণায় দীর্ণ প্রথম থেকেই। তাই এন্টনিকে কেন্দ্র করে সে স্মৃতি-সুখে আশ্বস্ত হতে চেয়েছিল। রামিয়ার গর্ভজাত ভেবে এণ্টনিকে নিয়ে সে আর একবার জীবনের পথে ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু নাস্তি আর বৈনাশিকতা কেবলই যার মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছে প্রতি মুহূর্তে, সে কি করে সার্থক হবে? ঢোঁড়াই স্বয়ং নিজেই প্রত্যক্ষ করেছে তার অনিবার্য পরিণাম। চরম শূন্যতা আর অস্তিত্ব বিনাশ একাকিত্বের কাছে . আত্মমর্পণ করেছে ঢোঁড়াই। তাই চিরকালের মতো চলে যাবার সময় রামায়ণটাও সঙ্গে নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি।

ঢোঁড়াই চরিতমানস দুটি চরণ লিখতে গিয়ে লেখকের সামনে আদর্শ ছিল তুলসীদাসের রাম চরিতমানস। শুধু তাই নয় সতীনাথ চেয়েছিলেন মহাকাব্যের বিশাল আঁধারে জনজীবনের দ্বান্দ্বিক বিবর্তন ও বদলের রূপরেখা আঁকবেন। ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে অজস্র কথা উপকথার বৃত্তে, বহু বিচিত্র চরিত্র ও ঘটনার সংঘাতে নাটকীয়তা সৃষ্টি করে এক নতুন মহাকাব্য (নব রামায়ণ) রচনা করবার বাসনাও অগোচর থাকে না। সাধারণ মানুষকে করতে চেয়েছিলেন রামের মতো, কারণ রামের আদর্শ ছাড়া উত্তর ভারতীয়দের মন ভরে না। সাধারণ মানুষের কথা ও সাধারণ মানুষের বাসভূমিকে চিরন্তন করতেই রামায়ণের বিশালতা, মহাকাব্যের ব্যাপ্তি লেখকের শিল্পীমানসে এনেছে বিশাল সচেতনতা। আর ঢোঁড়াই চরিতের পাঠক দুটি চরণ পাঠ শেষে পেয়েছে বিশালতার স্বাদ যা অনেকটাই মহাকাব্য লক্ষণাক্রান্ত অথচ জীবনমুখর উপন্যাসের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার।

উপন্যাস ও মহাকাব্যের গঠন প্রকৃতি এক না হলেও উপন্যাসের প্রাণ লুকিয়ে আছে মহাকাব্যের বিশালতায়। ঢোঁড়াই চরিতে সেই এপিক লক্ষণ একেবারেই অদৃশ্য নয়। কাহিনী, চরিত্র, ভাব, ভাষা এমন কি ফলশ্রুতিতেও ঢোঁড়াই চরিতমানস মহাকাব্য লক্ষণাক্রান্ত, মহাকাব্যোপম উপন্যাস। সমালোচকের মতেও এই পৌরাণিক মহাকাব্যের অনুসরণের পদ্ধতিটা কি পাশ্চাত্য সাহিত্যের আর একটি অনুরূপ প্রয়াসের কথা মনে করিয়ে দেয় না, জেমস জয়েসের ইউলিসিস হোমারের ওডিসির আধুনিক বিকল্প। তার ঘটনাস্থল ডাবলিন, কাল একটি দিন, নায়ক ব্ললাম। সতীনাথের ঢোঁড়াই চরিতমানসের ঘটনাস্থল জিরানিয়া জেলা, কাল অনন্তঃ বিশ-ত্রিশ বছর বা আরও একটু বেশি হতে পারে (১৯২০-১৯৪৫?)। নায়ক ঢোঁড়াই, শ্রীরামচন্দ্রের আধুনিক বিকল্প। [১৭] তবে দেশী বা বিদেশী পৌরাণিক মহাকাব্যের ছায়া নয় ঢোঁড়াই চরিত। কারণ এখানে লেখক সমাজ ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহায়তা বদলের চেহারাটাকে দেখাতে চেয়েছেন। তাই ঢোঁড়াই ব্যক্তি হয়েও একা নয়- প্রতিনিধি, জিরানিয়াও বিশেষস্থান না হয়ে বিশাল ভূখণ্ডের রূপ পেয়েছে। বদলটাও সামগ্রিক বদল।

 মহাকাব্যের মতোই এই উপন্যাসের কাহিনী শেষ পর্যন্ত বিশেষ সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। তাৎমা-ধাঙড়-কোয়েরীসমাজের জীবনধারা শেষপর্যন্ত ভারতবর্ষের বিশাল ভূখণ্ডকে ও ভারতবাসীকে স্পর্শ করেছে যার সঙ্গে তুলনা হতে পারে মহাকাব্যের ত্রিলোকব্যাপী পরিধির। অভ্যস্ত আপাত স্থাণু জীবনধারা কালপ্রবাহে সে বিস্তার লাভ করেছে তা সীমাতীত রূপরেখার ইঙ্গিত দিয়েছে- আঞ্চলিক জীবনচর্যা সমবেত আঁধারে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই জীর্ণারণ্য শেষ পর্যন্ত মূল্যবোধ বিনষ্ট দারিদ্রে জর্জরিত লাঞ্ছনাজীর্ণ ভারত ভূখণ্ডের দ্যোতক হয়ে ব্যাপ্তি লাভ করেছে এ উপন্যাসে।

মহাকাব্যের কাহিনীতে থাকে অলৌকিকত্ব ও বিস্ময় যা পাঠক মনে বিশেষ বিস্ময়ভাব। ও রসের সঞ্চার ঘটাতে সক্ষম। আর সময়ের দিক থেকেও মহাকাব্যের ব্যাপ্তি কালান্তরের সূচক। ঢোঁড়াই চরিতমানসের কাহিনী অতি সাধারণ মানুষের নিয়ত সংগ্রামের ঘাত প্রতিঘাতে, ব্যর্থতায় ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে নিজেকে গড়ে তোলার কাহিনী। সংগ্রামী ঢোঁড়াইয়ের জীবনধারায় গোটা ভারতবর্ষের মানুষের অধিকার সচেতনতা, আত্মরক্ষা ও আত্ম-প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি এই উপন্যাসে বিধৃত হয়ে আছে যা পাঠককে বিস্মিত ও শ্রদ্ধাশীল না করে পারে না। আর সময় ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বাধীনতা পূর্বকালের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ সঙ্কটকালটিকে লেখক বেছে নিয়েছেন। ১৯১৭-১৯৪৫, এই উপন্যাস অনাদিকালের সূচনা করেছে। এত বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের অধ্যায়কে লেখক বেছে নিয়েছেন যার তরঙ্গ সমাজজীবনের সর্বস্তরে কম বেশি তরঙ্গাঘাত সৃষ্টি করে উদ্বেলমুখর করে তুলেছিল। জাতীয় জীবন তার সামগ্রিক সচেতনতা নিয়ে এই বিশেষ সময়টিকে ধরে রেখেছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। অসহযোগ থেকে ভারত ছাড়ো ও পরবর্তী কটা বছর (অর্থাৎ ১৯১৭-১৯৪৫) গোটা ভারতবর্ষের মূল সুর একটা জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে সার্বিক মুক্তির সাধনায় উন্মুখ হয়েছে। এই সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত শুধু কংগ্রেস, গান্ধীবাদী, সোস্যালিস্ট বা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সংগ্রাম হয়ে থাকেনি। সাধারণ মানুষ এই সময়েই সম্পূর্ণভাবে নিজের মতো করে অনুভব করেছিল নিজেদের মুক্তি সংগ্রামের কথা- শোষণ আর পীড়ণ, দারিদ্র্য আর সংস্কার, অজ্ঞতা আর অশিক্ষা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামমুখী হয়েছে সাধারণ মানুষ। তাদের অন্তরে জেগেছে অধিকার সচেতনতা। অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজেদের মতো করে অনুভব করতে শিখেছে। অধিকার আদায় করতে নিতে হবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। ঢোঁড়াই চরিতে এই সত্যটিই ব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং সমবেত জাতির জীবনে বন্ধন মুক্তির কাল (আংশিক) বলে ধরে নিলে এ কাল-পরিধি কালাতীত বলে মনে হয়। সতীনাথের অসামান্য লেখন দক্ষতায় ঢোঁড়াই হয়ে উঠেছে গণনায়ক, জীর্ণারণ্য পেয়েছে ভারতবর্ষের মতো ভূখণ্ডের পূর্ণরূপ; ঢোঁড়াই ও তার সমাজের মানুষের বদলে যাওয়ার স্বরূপ, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত অধিকারবোধ; তাদের রামায়ণের প্রতি তথা সত্যের প্রতি আত্মস্থ ভাব, গভীর বিশ্বাসবোধ পাঠককে এমন একটা জায়গায় উপনীত করে যেখানে স্থান কাল-অনুভূতিতে কেবলই প্রতিভাস হয় ব্যাপ্তি আর বিশালতা।

 স্বাভাবিকভাবেই এরপর আসে মহাকাব্যের নায়কের কথা। ঢোঁড়াই আদৌ মহাকাব্যের সুর বা সুরস্থানীয় নয়। অতি সাধারণ রক্ত মাংসের মানুষ, একান্তভাবেই উপন্যাসের চরিত্র। জন্ম পরিচয় থাকলেও পিতৃহীন, মাতৃপরিত্যক্ত। কিন্তু কর্মদক্ষতায় সে একে একে জন্মের বন্ধন, মাতৃত্বের স্নেহসিঞ্চন, সমাজের বঞ্চনা আর তাচ্ছিল্য অতিক্রম করেছে। সে হয়ে উঠেছে মহাকাব্যের নায়কেরই মতো মহানায়ক; লেখকের বাসনায় রামচন্দ্র-সত্য আদর্শের প্রতীক। সাধারণ ঢোঁড়াই থেকে রামায়ণজীতে রূপান্তরিত হওয়ার পথেই সে অর্জন করেছে মহাকাব্যের, বিশেষত ট্র্যাজেডির নায়কের মতো সার্থকতা। তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জাগে ও সেই সঙ্গে সহানুভূতিতে দ্রবীভূত হই।

মহাকাব্যের নায়ক অসাধারণ। কোনো ক্ষুদ্রতা, নীচতা দ্বারা এই চরিত্র খণ্ডিত নয়। এই ধরনের চরিত্রে একই সঙ্গে ঘটে থাকে বীরত্ব ও ঔদার্যের সমাবেশ। ঢোঁড়াই এই অর্থে নিশ্চয়ই অসাধারণ- তার প্রতিবাদের সাহস ও শক্তি সেই সঙ্গে স্বার্থত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে আছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। মানবিক প্রেমে সে তুলনাহীন তাই বড়কা মাঝিকেও লোহা মানতে হয় তার কাছে যখন গুটি পোকার বাক্সগুলি বাইরে রেখে রেশমকুঠি দহনের কাজে এগিয়ে যায় ঢোঁড়াই। জীবপ্রেমের এমন সজীব উদাহরণ এমন আর কোথায় আছে! বিশ্বাসে আদর্শে মহত্ত্বে ঢোঁড়াই সত্যিই মহৎ- রাময়ণের প্রতি, সত্যের প্রতি, ন্যায়ের প্রতি তার অবিচল বিশ্বাস তাকে একের পর এক বাঁধা অতিক্রমের পথে শক্তি দিয়েছে। সে বিশ্বাস করেছিল মানুষকে। ববাঝেনি রাজনীতির কুটিল চক্রগুলিকে। সে শুধু বুঝেছিল অন্যায় শোষণ আর পীড়ন থেকে উদ্ধারের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। বার বার ঠকে গিয়েছে, পরাজিত হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকেই অর্জন করেছে নতুন করে বাঁচবার জন্য সংগ্রামের শক্তি। নৈতিক চেতনায় সে সরল, অকপট ও দৃঢ়।

 মহাকাব্যে মহত্ত্ব প্রকাশিত হয়। মহৎ ভাব মানবমনকে আলোড়িত করে এবং এর আবেদন সার্বজনীন। তাই ঢোঁড়াই শুধু তাৎমাটুলির ঢোঁড়াই, বৌকাবাওয়া আর রামিয়ার ঢোঁড়াই  হয়েই শেষ হয় নি। তাকে তার চারিত্রিক মহত্ত্ব প্রকাশের জন্য হতে হয়েছে সকলের। তাই সে ছেড়েছে তাৎমাটুলি, বাওয়াকে, রামিয়াকে। পক্ষান্তরে ঢোঁড়াই কে ব্যাপক জীবনের মাঝে আনতে এরাও একে একে ছেড়ে গেছে কোনো না কোনো সূত্র রচনা করে। ঢোঁড়াইকে আনতে হয়েছে সজীব মাটি আর সবুজের সংস্পর্শে মাটি সংলগ্ন মানুষের কাছাকাছি; দেশপ্রেমের বৃহৎ আদর্শে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিম্বা আরও শেষে শ্রেণীভেদহীন, জাতপাতহীন কারাগারে। এই সমস্ত পরিবেশে বিচিত্র পরিস্থিতিতে আত্মোৎসর্গের মাধ্যমেই তার মধ্যে মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে হয়ে উঠেছে জীবনপ্রেমিক।

মহাকাব্য যেমন, মহাকাব্যোপম উপন্যাসেও নৈতিকচেতনা শিল্পকর্মের সঙ্গে এক হয়ে প্রকাশিত হয়। তাই তার ভাষাও হয় তাৎপর্যময়। ঢোঁড়াই চরিতমানসের ভাষার মধ্যেও রয়েছে বিশালতার স্পর্শ। অঞ্চল বিশেষের লোকভাষা লোকজীবনের সঙ্গে মিলে মিশে গিয়ে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের জন জীবনকে একত্রিত করেছে এই উপন্যাসে। এ ভাষার লৌকিক মাধুর্য রামচরিত মানসের উদ্ধৃতি উপমার স্পর্শে সমস্ত সীমাদ্ধতাকে অতিক্রম করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে পঞ্চমাহতোদের চক্রান্তে ঢোঁড়াইয়ের যে রূপ বর্ণনা করেছেন লেখক সে ভাষা মহাকাব্যের বিশালতার দ্যোতক- টাকা খেয়ে সাজস করছে, শালা চোট্টার দল! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে ঢোঁড়াই। তার হিংস্র চোখের মধ্যে দিয়ে ঠিকরে পড়ছে বজ্রের স্ফুলিঙ্গ। বজরঙ্গবলী মহাবীরজীর অসীমশক্তি এসে গিয়েছে তার দেহে আর বাহুতে। অনেক বড় দেখাচ্ছে তাকে। …সারা পৃথিবী তার চোখের সম্মুখ থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। যে পচ্ছিমা সাপটাকে সে পুষেছিল সেটা এতদিনে ছোবল মেরেছে। …পৃথিবীতে আগুন লেগে গিয়েছে- কাঁপছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, ধসে যাচ্ছে পায়ের নিচের মাটি। …থাক, কারও শক্তি নেই সেই সাপটার কাছে যাবার পথে তাকে বাধা দেয়, মহাবীরজীও না, গোসাইও না, খোদ রামচন্দ্রজী এলেও না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের হাওয়া শান্ত হয়ে গিয়েছে, তার প্রতিটি স্নায়ুর উদ্দণ্ড আলোড়ন দেখে। তার হাত মুঠো হয়ে আসছে, প্রচণ্ড শক্তিতে পৃথিবী গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে পারে এখনই, এর প্রতিটি অণু পরমাণু তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে সারাজীবন। আর উপন্যাসের শেষ অংশে নিঃস্ব রিক্ত ঢোঁড়াই যখন জেনেছে রামিয়া মৃতা, এন্টনি রামিয়ার গর্ভজাত সন্তান নয়, তখন তার মনের অবস্থা ব্যক্ত করেছেন লেখক কি অসাধারণ উপমা প্রয়োগে- কথাগুলো ঢোঁড়াই শেষ পর্যন্ত বোধহয় শোনেওনি। কয়েকটা কথার বালি পড়ে তার শরীরের আর মনের যন্ত্রণাগুলো বিকল হয়ে গিয়েছে। জুয়োখেলায় সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে সে। …এই নিঃসীম রিক্ত জগষ্টার মধ্যে পাক্কী নাকী নামের যেন একটা অপরিচিত রাস্তা দিয়ে সে চলেছে। ঠিক অনুতাপ নয়। হাতাশায় গ্লানি তার নিঃসঙ্গতাকে আরও নিবিড়, আরও দুঃসহ করে তুলেছ। একেবারে একা সে আজ দুনিয়াতে। বুকের বোঝার চাপে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আশমানে দিনের চাকা ঘুরোনোর গোঁসাই পশ্চিমে ঝুঁকেছেন। তাঁর কাজের কামাই নেই নিচে গোঁসাইথানের গোঁসাই হাল ছেড়ে দিয়ে ভাঁট বনে উইয়ের ঢিবি হয়ে গিয়েছেন। পশ্চিমে ধুলোর ঝড় জিদ ধরেছে থামবে না বলে। ঝাপসা চোখের মধ্যে একটা আকৃতি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সর্বগ্রাসী শূন্যতার মধ্যে এই পথটা তবু পা রাখবার একটু শক্ত জমি। সিধা চলে গিয়েছে কাছারি, জেলখানা, আরও কতদূরে!

মহাকাব্যের চরিত্রগুলির প্রাণ নাটকীয় ভাব ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এই উপন্যাসে নাটকীয় চমৎকারিত্ব বারবার সৃষ্টি হয়েছে, ফলে একের পর এক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ ও প্রকটতর হয়েছে। আর তারই তীব্র দ্বন্দ্বে নায়ক আলোড়িত, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ঢোঁড়াইয়ের পাক্কীতে কাজ নেওয়ার ফলে থান জ্বালানো, গান্ধীর মূরত দর্শনে নাটকীয় উত্তেজনা, রামিয়ার প্রতি আকর্ষণ-বিবাহ ও বিচ্ছেদে নাটকীয় ভাবাবেগ; দ্বিতীয়চরণে ধানের গোলা আক্রমণ, ভূমিকম্পের ঘটনা, সাগিয়ার অন্তর্ধন, সতিগরিয়ার উৎসব, তিতলিকুঠি দহন, আজাদ দস্তার জীবন, এন্টনির আবির্ভাব ও স্বর্ণসীতার আকর্ষণ ঢোঁড়াইয়ের জীবনের চরম পরিণতি নিঃসন্দেহে নাটকীয় জীবনচর্যার পরিচায়ক।

সবশেষে আসে মহাকাব্যে রসের কথা। মহাকাব্যের অঙ্গীরস- বীররসাত্মক। সংগ্রাম মুখর ঢোঁড়াই চরিতে এই রস সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। আনুষঙ্গিক রসাবেদনও সৃষ্টি হয়েছে সেই সঙ্গে শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য ইত্যাদি সহযোগে। কিন্তু মহাকাব্যের মূল রস বিশাল রস; রবীন্দ্রনাথ ঐতিহাসিকরসকে মহাকাব্যের প্রাণ বলেছেন। ঢোঁড়াই চরিতমানস পড়তে পড়তে পাঠক মনে মহতৃবোধ জাগে বিরাট বস্তুকে আশ্রয় করে তার ভিত্তি সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা ও বিস্ময়। সাধারণ মানুষ ঢোঁড়াই  শেষ পর্যন্ত সত্য ও ন্যায় রক্ষা করতে গিয়ে শূন্যতার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করেছে তা পাঠককে নিশ্চয়ই বিস্ময়াভিভূত ও শ্রদ্ধাবনত করে। কিন্তু ভারতীয় মহাকাব্যের পরিণতি শান্ত রস প্রবাহে। এই উপন্যাসেও চরম দুঃখের কারুণ্যে, শূন্যতার গর্ভে নিমজ্জিত, বিশ্বাসের শেষ বিন্দু রামায়ণখানার প্রতিও যার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এমন হতভাগ্য মহৎ নায়কের প্রতি রুদ্ধ-রোনাবেগে পাঠক চিত্ত হয় বিমূঢ় স্তব্ধ। সর্বরিক্ত ঢোঁড়াই নিঃসঙ্গ যুগমানসের প্রতিনিধির মতো একা দাঁড়িয়ে তার প্রিয় পরিচিত অথচ চির অপরিচিত পাক্কীর ওপর- দূরের ইশারা নিয়ে সামনে অনন্ত মহাপ্রস্থানের পথের মতো পড়ে আছে পাক্কীর সমস্ত রূঢ়তা ক্রূরতা, তামসিকতা, রাজসিকতা ও বহু অশ্রুর শেষে ঢোঁড়াই, চির সংগ্রামমুখর অথচ চির পরাজিত মহানায়ক এগিয়ে চলেছে সেই পথ ধরেই।

[১. ভাদুড়ীজী ফণীশ্বরনাথ রেণু, সতীনাথ-স্মরণে, সুবলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত, পৃ. ৩৬। ২.  গ্রন্থপ্রসঙ্গ সতীনাথ গ্রন্থাবলী, ১ম খণ্ড, অরুণা প্রকাশনী, পৃ. ৪৯৫। ৩. তবেদ, পৃ. ৪৯৪। ৪. তবেদ, পৃ. ৪৯৬। ৫. গ্রন্থপ্রসঙ্গ : ঢোঁড়াই, সতীনাথ গ্রন্থাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৯১ দ্রষ্টব্য। ৬. তবেদ, পৃ. ৪৯১। ৭. নখদর্পণে ভারতবর্ষ : ঢোঁড়াই চরিতমানস, সুমিতা চক্রবর্তী, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, শ্রাবণ আশ্বিন, ১৩৭৮, পৃ. ২৩৮। ৮. ঢোঁড়াই চরিতমানসের প্রায় সমকালে লেখা গল্পে পীড়ণের চিত্রটি তুলে ধরেছেন লেখক—‘সমুদ্রের নীলরং দেখিবার সুযোগ তাহাদের হয় নাই; আকাশের নীলের দিকে তাহারা কোনো দিন তাকাইয়া দেখে নাই: কুঠির বড় বড় চৌবাচ্চায় তাহারা দেখিয়াছে গোলা নীলের সমুদ্র, বহু পরিচিত আত্মীয় স্বজনের দেহে দেখিয়াছেন নীল কালশিরার দাগ’। ‘আংটা বাংলা’ সতীনাথ গ্রন্থাবলী ১ম খণ্ড, পৃ ১৬৯। ৯. সতীনাথ ও পূর্ণিয়া, সন্তোষকুমার মজুমদার, জলার্ক, ৩-৫ সংখ্যা : ১৩৭৮ কার্তিক-আষাঢ় ১৩৮৮, পৃ. ১০-১২। ১৩. গ্রন্থপ্রসঙ্গ; তবেদ। পৃ ৪৯৩। ১৪. তবেদ, পৃ ৪৯৫। ১৫. তবেদ, পৃ ৪৯৫। ১৬. ঢোঁড়াই চরিতমানস:, ২য় চরণ, স. গ্রন্থালী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০। ১৭. সতীনাথ ভাদুড়ী : সাহিত্য ও সাধনা, গোপাল হালদার, পৃ. ৫৯। ঢোঁড়াই চরিতমানস প্রবন্ধ লেখার সময় জলার্ক পত্রিকায় (কার্তিক ১৩৮৭ আষাঢ় ১৩৮৮) প্রকাশিত গুণময় মান্নার ঢোঁড়াই চরিতমানস একটি পুনর্মূল্যায়ন, অনুষ্টুপ, দ্বাদশ বর্ষ ১৩৮৬ ২য়, ৩য়, ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত ইরাবান বসুরায় রচিত সতীনাথ ভাদুড়ী : রাজনীতি ও সাহিত্য প্রবন্ধ এবং সতীনাথ ভাদুড়ী : সাহিত্য ও সাধনা, গোপাল হালদার- গ্রন্থটি থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *