ঢেকুর
প্রায় চোদ্দো পুরুষের বসতবাড়িটা দারুব্রহ্মবাবুকে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভালো। একে তো বড়ো বাড়ি কেনার খদ্দের নেই, তার ওপর যদি বা খদ্দের জোটে, তারা ভালো দাম দিতে চায় না। বলে, এই অজ পাড়াগাঁয়ে ও বাড়ি কিনে হবেটা কী? কথাটা সত্যি? তবে বহুকাল আগে এ গ্রাম ছিল পুরোদস্তুর একখানা শহর। এই বাড়িতে দারুব্রহ্মের যে ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ বাস করতেন, তিনিই ছিলেন এই অঞ্চলের রাজা। তখনকার আস্তাবল, দ্বাদশ শিবের মন্দির, পদ্মদিঘি, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, নহবতখানা, শিশমহল সবই এখনও ভগ্নদশায় আছে। ফটকের দু-ধারে মরচে পড়া দু-দুটো কামানও। এতদিনে খদ্দের পাওয়া গেছে।
দারুব্রহ্মের অবস্থা খুবই খারাপ। এ বেলা ভাত জুটলে ও বেলা খুদও জুটতে চায় না। নিজে বিয়ে করেনি। বাপের একমাত্র সন্তান। বাপ গত হয়েছেন সুতরাং বুড়ি মা আর তার দু-মুঠো জুটে যাওয়ার কথা, কিন্তু বংশের নিয়ম মানতে হয় বলে, একপাল অপোগন্ড নিষ্কর্ম আত্মীয়স্বজনকে ঠাঁই দিতে হয়েছে। তারা দিনরাত চেঁচামেচি করে মাথা ধরিয়ে দেয়। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই দারুব্রহ্মের চুল পাকতে লেগেছে, আশা-ভরসা গেছে। বুড়ি-মা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখে রেখেছেন। কিন্তু মেয়ের বাপ এই হাড়-হাভাতের হাতে মেয়ে দিতে রাজি নন। অপমানটা খুব লেগেছে দারুব্রহ্মের। বাড়ি কেনার খদ্দের জুটে যাওয়ায় খানিকটা নিশ্চিন্ত। হাজার পঞ্চাশেক টাকা পেলে মায়ে-পোয়ে কাশীবাসী হবে, ঠিক করেই রেখেছে।
শেষবার চোদ্দো পুরুষের বসতবাড়িটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিল দারুব্রহ্ম। ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ সত্যব্রহ্ম ছিলেন দারুণ মেজাজি। একটা মশা সেবার তাঁর নাকে হুল ফোঁটানোয় রেগে গিয়ে তিনি মশা মারতে কামান দাগার হুকুম দেন। কিন্তু তোপনার এসে খবর দিল, কামানের মশলা নেই। সত্যব্রহ্ম তখন বলেন, কুছ পরোয়া নেই। বন্দুক আনো। শোনা যায়, কম-সে-কম শত খানেক গুলি চালানোর পর মশাটা বাস্তবিক মরেছিল। এখনও দরবার ঘরের দেওয়ালে সেইসব গুলির জখম রয়েছে। দারুব্রহ্ম সেগুলির ওপর হাত বুলিয়ে একটা-দুটো-তিনটে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফেলল। ঊর্ধ্বতন নবম পুরুষ পূর্ণব্রহ্মের খুব শিকারের শখ ছিল। তাই বলে জঙ্গলে-টঙ্গলে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে বা মাচানে বসে শিকার করতেন না। খুব আমুদে অলস লোক। দোতলা থেকে নীচে নামতে হলেই গায়ে জ্বর আসত। তিনি দোতলায় একটা আলাদা ছাদ তৈরি করে মাটি ফেলে জঙ্গল বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানে আগে থেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে রাখা শেকলে-বাঁধা বাঘ থাকত। তিনি জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে বাঘের দেখা পেলেই গুলি করতেন। আর বাঘটাও লুটিয়ে পড়ত। অবশ্য সবাই জানত, বন্দুকে ভরা গুলিটা আসলে ফাঁকা গুলি। আর বাঘটা ছিল পোষা। সেই একই বাঘই কত বাঘের-মরণ-মরেছে। দোতলায় উঠে দারুব্রহ্ম সেই জঙ্গলের ধ্বংসাবশেষের দিকে চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাসের ঝড় বইতে থাকে।
ঊর্ধ্বতন তৃতীয় পুরুষ কৃষ্ণব্রহ্ম ছিলেন পালোয়ান। দু-হাতে দু-মণ ওজনের দুটো মুগুর ঘুরিয়ে রোজ দু-বেলা ব্যায়াম করতেন। সেই মুগুর দুটো দোতলার সিঁড়ির মুখেই রাখা। দারুব্রহ্ম মায়াভরে সে দুটোকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে রইল কিছুক্ষণ।
তিনতলার সব ঘর বহুকাল হল তালাবন্ধ। ছাদ ফেটেছে, জানলার শিক নেই। বাদুড় চামচিকের বাসা। যত রাজ্যের পুরোনো জিনিসের আবর্জনা ডাঁই করে রাখা। শেষবারের মতো সবকিছু দেখে যাওয়ার জন্য দারুব্রহ্ম তালা খুলে ঢুকে পড়ল ঘরে। কাঠের সিন্দুক, দেয়াল আলমারি, ভাঙা ঝাড়লণ্ঠন, পুরোনো নাগরা, ভাঙা খাট, কত কী চারদিকে ছড়ানো।
কাঠের সিন্দুক খুলে এটা-সেটা নাড়াচড়া করছিল দারুব্রহ্ম, আর এটা-সেটা ভাবছিল। এমন সময় হাত ফসকে কী একটা যেন মেঝেয় পড়ে গেল। একটু চমকে উঠল দারুব্রহ্ম। চমকাবারই কথা। জিনিসটা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই একটা ঝলকানি আর সেইসঙ্গে খানিক ধোঁয়া বেরোলো। দারুব্রহ্ম জিনিসটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখে, সেটা একটা প্রদীপ। প্রদীপটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবছে, চোখে পড়ল ধোঁয়ার কুন্ডলিটা সামনেই পাকিয়ে-পাকিয়ে একটা লম্বা রোগা সুটকো লোকের চেহারা নিচ্ছে।
কে রে! দারুব্রহ্ম চেঁচিয়ে ওঠে।
লোকটা গোটা চারেক হাই তুলে দিয়ে বলল, আমি? আমি হচ্ছি প্রদীপের দৈত্য।
দারুব্রহ্ম হাঁ। ব্যাটা বলে কী? সে বলল, ইয়ার্কির জায়গা পাওনি? দিনে-দুপুরে ব্যাটা চুরির মতলবে বাড়িতে ঢুকে বসে আছ।
লোকটা ভয় খেয়ে বলে, সত্যিই না। অনেককাল কেউ ডাকাডাকি করেনি বলে বেশ হাজার
দেড়েক বছর একটানা ঘুমিয়ে এই উঠলাম। চুরি-টুরি কিছু হয়ে থাকলে আমি কিন্তু জানি না।
দারুব্রহ্ম সাহসী বংশের লোক। সহজে ভয় খায় না। তবে সে বুঝল, লোকটা গুল দিচ্ছে না। প্রদীপটাও আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হতে পারে। তার বংশের অনেকেরই নানা বিদঘুঁটে জিনিস সংগ্রহের বাতিক ছিল। সে বলল, বটে? তা, তোর কাজটা কী?
আবার গোটা কয়েক হাই তুলে বিশুদ্ধ বাংলাতেই লোকটা বিরস মুখে বলল, আমার কাজ কী? দেড় হাজার বছর পরে ঝুটমুট কাঁচা ঘুমটা ভাঙালেন এখন যা করতে বলবেন, তাই করতে হবে। কিন্তু আগে থেকেই বলে রাখছি প্রথমেই শক্ত কাজ দেবেন না। আমার এখনো ঘুমের রেশ কাটেনি। গা ম্যাজম্যাজ করছে।
দারুব্রহ্ম বুঝল, এ ব্যাটা আলাদিনের সেই দৈত্যই বটে, তবে ফাঁকি মারার তাল করছে। সে বলল, বাপু হে অত রোয়াব দেখালে কি চলে? বরাবর অনেক বড়ো-বড়ো কাজ করে এসেছ খবর রাখি। এখন পিলোলে চলবে কেন?
লোকটা ব্যাজার হয়ে বলে, সে করেছি, কিন্তু বহুকাল অভ্যাস নেই কিনা। তা ছাড়া ঘুমোলে হবে কী, খাওয়া তো আর জোটেনি। দেড় হাজার বছর টানা উপোস। শরীরটা দেখুন না কেমন
শুকিয়ে গেছে। আগে বরং কিছু খাবার-দাবার দিন।
তারপর?
তারপর যা বলবেন, একটু-আধটু করে দেব। দারুব্রহ্ম লোক খারাপ নয়। দৈত্যটার সিঁড়িঙ্গে চেহারা দেখে তার কষ্টও হল। বলল, চলো দেখি, মুড়িটুড়ি কিছু পাওয়া যায় কিনা। বলে লোকটাকে সঙ্গে নীয়ে নীচে নামল দারুব্রহ্ম। বাড়ির কেউ লোকটাকে দেখে তেমন গা করল না। গা করার মতো কিছু নেই। দারুব্রহ্ম তাকে নিজের ঘরে নিয়ে ধামা ভরে মুড়ি আর বাতাসা খাওয়াল। সবশেষে দেড় ঘটি জল খেয়ে লোকটা বলল, এ যা খাওয়ালেন, এতে তো একটা সেঁকুরও উঠবে না। যাকগে, ওবেলা কী রান্না হবে?
দারুব্রহ্ম একটা শ্বাস ফেলে বলল, একদিন এ বাড়ির অতিথিরা মাংসপোলাও খেয়ে একটা করে মোহর দক্ষিণা নিয়ে যেত। সেদিন তো আর নেই। ও-বেলা যদি হাঁড়ি চড়ে, তবে দুটো ডাল-ভাত জুটতে পারে।
লোকটা মন খারাপ করে বলল, ডাল-ভাত। ছো:।
দারুব্রহ্ম হেসে ফেলে বলল, তুমি দেখি উলটো কথা বলতে লেগেছ। প্রদীপের দৈত্যই কোথায় খাবার-দাবার জোগাড় করে আনবে, তা না, তুমিই উলটে চাইতে লাগলে।
লোকটা জবাব দিল না। ধোঁয়া হয়ে প্রদীপের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রাত্রে সকলের খাওয়া হয়ে গেলে দারুব্রহ্ম প্রদীপটা ঠুকে আবার দৈত্যটাকে জাগায়। দৈত্যটা চারজনের খোরাক একা খেয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, আমার খোরাকটা একটু বেশিই। তা ভরপেট না হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু একটা ঢেকুর তো উঠবে। এতে তো একটা ঢেকুরও উঠল না। একটা হাই তুলে যাই ঘুমোই গিয়ে বলে দৈত্যটা আবার প্রদীপের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল।
পরদিন দেখা গেল দৈত্যকে একবেলা খাওয়াতে গিয়েই চালের ডোল ফাঁকা হয়ে গেছে। দারুব্রহ্ম ভাবল, আহা বেচারা। কতকাল খায়নি। একদিন তো ব্যাটার কাছ থেকে সুদে-আসলে সবই উশুল করব কদিন বরং পেট ভরে খাক।
দারুব্রহ্ম পুরোনো সব দলিল-দস্তাবেজ বের করে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধান পেল, চৌমারির চরে তাদের কিছু জমি বহুকাল ধরে আছে, কিন্তু খাজনা বা ফসল আদায় হয়নি। একটা তেলকলের অংশীদারিরও সন্ধান পেল। খুঁজে পেতে দেখল, পুরো একটা তহসিলের খবরও সে এতকাল রাখত না। ছেঁড়া ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ল দারুব্রহ্ম। দাগ-নম্বর ধরে-ধরে খুঁজে পেতে জমির সন্ধান পেল। প্রজারা তাকে দেখে প্রথমে একটু বেগড়বাই করলেও স্বীকার করল যে বহুকাল তারা খাজনা বা ফসল দেয়নি। বাবা-বাছা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাঁদের কাছ থেকে দারুব্রহ্ম কিছু আদায় করার চেষ্টা করছিল। এমন সময় মোড়ল চোখ মুছতে মুছতে এসে বলল, জমির মালিককে বঞ্চিত করেছি বলেই আমাদের ঘরে লক্ষ্মী নেই। আপনি যান। আমরা নিজে থেকেই পৌঁছে দেব যা দেওয়ার।
দারুব্রহ্ম তেলকলে গিয়ে দেখল, সেটা বেশ রমরম করে চলেছে। দারুব্রহ্ম কাগজপত্র বের করে তার দাবিদাওয়া জানাতেই তেলকলের মালিক মূৰ্ছা গেল। আর মূৰ্ছা ভেঙে উঠেই বলল দলিলে দেখছি, আপনি দশ আনার মালিক। তবে আমার থাকবে কী? যাকগে এসব তো জানা ছিল না। কবেকার কথা সব। এখন একটা বন্দোবস্ত করা যাবে। আপনি যান।
তহসিলদারটাও দারুব্রহ্মকে হতাশ করল না। প্রজারা বলল, আমরা কি জানি ছাই যে, এ জমিরও মালিক আছে। তবে আমরা নিমকহারাম নই, বঞ্চিত করব না।
দিন দুই বাদে দারুব্রহ্ম বাড়িতে ফিরে দেখে, চারটে গোরুর গাড়ি বোঝাই ধান, দু-কলসি কাঁচা টাকা আর আনাজপাতি তেল মশলা সব এসেছে, সেদিন দারুব্রহ্ম বাড়তি দশজনের রান্না রাঁধিয়ে প্রদীপ ঠুকে দৈত্যকে বের করে বলল, খাও বাপু, পেট ভরে খাও। এ বাড়িতে অতিথির ঢেকুর ওঠে না, একথা শুনলে আমার পূর্বপুরুষেরা স্বর্গ থেকে অভিশাপ দেবে।
কিন্তু উঠল কই? দশজনের ভাত সাবাড় করে দৈত্য করুণ মুখে বলল, বটে?
দারুব্রহ্ম হাঁ হয়ে গেল।
রাত্রিবেলা বিশজনের খোরাক শেষ করেও কিন্তু দৈত্য ঢেকুর তুলল না। সাতদিনেই চার গোরুর গাড়ির চাল শেষ। বাড়িসুদ্ধ লোক জেনে গেছে যে, এত খেয়েও দৈত্যটার ঢেকুর উঠছে না। তারা রোজ দুবেলা এসে খাওয়ার সময় দৈত্যকে ঘিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, কবে কখন ঢেকুর ওঠে। কিন্তু উঠল না। ঢেকুর না উঠলেও পাহাড়-প্রমাণ খাওয়ার ফলে কদিনের মধ্যেই সিঁড়িঙ্গে দৈত্যটার চেহারা পুরোপুরি ঘটোৎকচের মতো হয়ে উঠল। মুগুরের মতো হাত, পাটাতনের মতো বুক, মুলোর মতো দাঁত, তালগাছের মতো লম্বা।
দারুব্রহ্মেরও জেদ চেপেছে। তাদের এত বড়ো রাজবংশে একটা পুঁচকে দৈত্য এসে খেয়ে ঢেকুর তুলছে না–কেমন কথা! এ বাড়িতে ভোজ খেয়ে লোকে পাক্কা দেড়দিন মেঝেয় পড়ে থাকত। দু-চারজন ভোজ খেয়ে গঙ্গাযাত্রায় পর্যন্ত গেছে! সেই বাড়ির এই অপমান?
দারুব্রহ্ম নাওয়া-খাওয়া ভুলে আদায়-উশুল করতে লাগল। তেলকলের ভার নিজে নিল। আরও সব নতুন-নতুন কারবার খুলতে লাগল। গাড়ি-গাড়ি চাল আসছে বাড়িতে, বস্তা-বস্তা আনাজ, ঘি, দুধ, দই। এসবই একদিন দৈত্যের ওপর দিয়ে উশুল হবে। আগে ব্যাটা ঢেকুরটা তো তুলুক।
এর মধ্যেই একদিন বাড়িতে খদ্দের এনে হানা দিয়েছিল। তখন দুপুরবেলা, দারুব্রহ্ম প্রদীপ ঠুকে দৈত্যকে মাত্র খেতে ডেকেছে। দৃশ্যটা দেখে খদ্দের চেয়ারসুদ্ধ উলটে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর থেকে আর আসেনি। কিন্তু বাড়ি বিক্রি এখন মাথায় উঠেছে দারুব্রহ্মের। বিক্রির মানেও হয় না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপটা যখন হাতে পেয়েছে, তখন আর অভাবও থাকবে না। খামোকা পূর্বপুরুষের ভিটে বিক্রি করবে কেন? সে তাই মিস্ত্রি ডেকে বাড়িটা মেরামত করাতে লাগল। সব খরচই উশুল হবে।
মৌরসি পাট্টায় আরও কিছু জমি নিল দারুব্রহ্ম। চাষবাস বাড়িয়ে ফেলল। কারবারগুলিও বেশ ফেঁপে-ফুলে চলছে। গোশালায় গোরু, আস্তাবলে ঘোড়া, বাড়ির সামনে জুড়িগাড়ি। শুকনো বাগানে আবার গাছ লাগানো হল, তাতে ফুল ফুটল, বাড়িটা কলি ফেরানোর পর আবার ঝলমল করতে লাগল। এর মধ্যেই দারুব্রহ্মের জন্য যে মেয়েটি দেখা হয়েছিল, তার বাবা এসে হাতজোড় করে বলল আমার মেয়েটি নিলে ধন্য হই। তা তিনি হলেনও। নহবতখানায় সানাই বাজল, দারুব্রহ্ম বিয়ে করে এসে বিরাট ভোট দিয়ে সাত গাঁয়ের লোককে খাওয়াল।
কিন্তু সাত গাঁয়ের লোকের মতো খাবার একা খেয়েও ব্যাটা দৈত্য কিন্তু ঢেকুর তুলল না! তবে বলল, খিদেটা এবারে একটু কমেছে। পেটের জ্বলুনিটা তেমন নেই। বলে ফের ঘুমোতে চলে গেল। নতুন বউয়ের সামনে এই অপমানে কান লাল হয়ে উঠল দারুব্রহ্মের। বলতে নেই সে এখন লাখোপতি! একটা দৈত্যের পেট ভরাতে পারবে না? পরদিন থেকে সে কাজকর্ম দ্বিগুণ করে দিল।
মাসখানেক বাদে সে একশো গাঁয়ের লোকের আয়োজন করে দৈত্যটাকে ডাকল। খুবই লজ্জার সঙ্গে প্রকান্ড চেহারার বিকট দৈত্যটা এসে বসল আসনে। আচমন করে একটু ভাত মেখে মুখে দিয়েছে কি দেয়নি অমনি একটা বাজ পড়ার আওয়াজে আঁতকে উঠল সবাই। ঘড় ঘড়াত। ঘড় ঘড়াত। ঘড় ঘড়াত। পরপর তিনবার। অমনি চারদিকে হইহুল্লোড়-ঠেলাঠেলি পড়ে গেল। বাচ্চারা হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল। তুলেছে। তুলেছে। দৈত্য ঢেকুর তুলেছে।
মাথা নীচু করে দৈত্যটা উঠে পড়ল। আঁচিয়ে যখন প্রদীপের মধ্যে ঢুকতে যাবে, তখনই গিয়ে দারুব্রহ্ম তাকে ধরল, এই যে বাপু। এই দিনটারই অপেক্ষা করছিলাম। ঢেকুর তো তুললে, তো কাজকর্ম কিছু করতে হয়।
দৈত্যটা অবাক হয়ে চেয়ে বলল, আপনি হুকুম করলে সবই করতে হবে মালিক। কিন্তু কাজটা আর বাকি রেখেছেন কী? লোকে আমাকে পেলেই গাড়ি চায়, বাড়ি চায়, ধনদৌলত চায়। আমি দিইও। কিন্তু আপনার যা দেখছি, এর ওপরেও আমাকে কিছু করতে হবে নাকি?
দারুব্রহ্ম কথাটা আগে ভেবে দেখেনি। এখন দেখল। বাস্তবিকই তার যা আছে তার ওপর আরও কিছু চাওয়ার মানেও হয় না। সে মাথা চুলকে বলল, তা বটে, তবে কিনা–
দৈত্যটা করুণ মুখ করে বলল, যে বাড়িতে খেয়ে আমার ঢেকুর ওঠে, বুঝতে হবে সে বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনো অভাব নেই। ঝুটমুট আমাকে আর খাটাবেন কেন? দেড় হাজার বছরের ঘুমটা আর কয়েক হাজার বছর চালাতে দিন। শরীরটা বড়ো ম্যাজম্যাজ করছে।
দারুব্রহ্ম একটা শ্বাস ফেলে বলল, তাই হোক।
দৈত্যটা প্রদীপের মধ্যে মিলিয়ে গেল। দারুব্রহ্ম সেটাকে আবার সাবধানে কাঠের সিন্দুকে ভরে রাখল।