বরদাচরণ ও টিকটিকি
চোরে ও পুলিশে
ভূত ও গা-ছমছমানি
গায়ে ও গত্তিতে
হাসি ও মজা
কল্পনা ও বিজ্ঞান
1 of 2

ঢেঁকুর

ঢেঁকুর

প্রায় চৌদ্দ পুরুষের বসতবাড়িটা দারুব্রহ্মবাবুকে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। একে তো এত বড় বাড়ি কেনার খদ্দের নেই, তার ওপর যদি বা খদ্দের জোটে তারা ভাল দাম দিতে চায় না। বলে, এই অজ পাড়াগাঁয়ে ও বাড়ি কিনে হবেটা কী? কথাটা সত্যি। তবে বহুকাল আগে এ গ্রাম ছিল পুরোদস্তুর একখানা শহর। এই বাড়িতে দারুব্রহ্মের যে ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ বাস করতেন তিনিই ছিলেন এই অঞ্চলের রাজা। তখনকার আস্তাবল, দ্বাদশ শিবের মন্দির, পদ্মদিঘি, দেওয়ান ই আম, দেওয়ান ই খাস, নহবতখানা, শিশমহল সবই এখনো ভগ্নদশায় আছে। ফটকের দুধারে মরচে পড়া দু’দুটো কামানও। এতদিনে খদ্দের পাওয়া গেছে।

দারুব্রহ্মের অবস্থা খুবই খারাপ। এবেলা ভাত জুটলে ওবেলা খুদও জুটতে চায় না। নিজে বিয়ে করেনি। বাপের একমাত্র সন্তান। বাপ গত হয়েছেন, সুতরাং বুড়ি মা আর তার দুমুঠো জুটে যাওয়ার কথা, কিন্তু বংশের নিয়ম মানতে হয় বলে এক পাল অপোগণ্ড নিষ্কর্মা আত্মীয় স্বজনকে ঠাই দিতে হয়েছে। তারা দিন-রাত চেঁচামেচি করে মাথা ধরিয়ে দেয়। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই দারুব্রহ্মের চুল পাকতে লেগেছে, আশা ভরসা গেছে। বুড়ি-মা বিয়ের জন্য মেয়ে দেখে রেখেছেন। কিন্তু মেয়ের বাপ এই হাড়-হাভাতের হাতে মেয়ে দিতে রাজি নন। অপমানটা খুব লেগেছে দারুব্রহ্মের। বাড়ি কেনার খদ্দের জুটে যাওয়ায় খানিকটা নিশ্চিন্ত। হাজার পঞ্চাশেক টাকা পেলে মায়ে পোয়ে কাশীবাসী হবে, ঠিক করেই রেখেছে।

শেষবার চৌদ্দ পুরুষের বসতবাড়িটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিল দারুব্রহ্ম। উধ্বর্তন ষষ্ঠ পুরুষ সত্যব্রহ্ম ছিলেন দারুণ মেজাজি। একটা মশা সেবার তার নাকে হুল ফোঁটানোয় রেগে গিয়ে তিনি মশা মারতে কামান দাগার হুকুম দেন। কিন্তু তোপদার এসে খবর দিল, কামানের মশলা নেই। সত্যব্রহ্ম তখন বলেন, কুছ পরোয়া নেই। বন্দুক আনো। শোনা যায়, কম-সেকম শতখানেক গুলি চালানোর পর মশাটা বাস্তবিকই মরেছিল। এখনো দরবার ঘরের দেয়ালে সেইসব গুলির জখম রয়েছে। দারুব্রহ্ম সেগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে একটা দুটো তিনটে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফেলল।

উধ্বর্তন নবম পুরুষ পূর্ণব্রহ্মের খুব শিকারের শখ ছিল। তাই বলে জঙ্গলে-টঙ্গলে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে বা মাচানে বসে শিকার করতেন না। খুব আমুদে অলস লোক। দোতলা থেকে নীচে নামতে হলেই গায়ে জ্বর আসত। তিনি দোতলায় একটা আলাদা ছাদ তৈরি করে মাটি ফেলে জঙ্গল বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানে আগে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখা শেকলে-বাঁধা বাঘ থাকত। তিনি জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বাঘের দেখা পেলেই গুলি করতেন। আর বাঘটাও লুটিয়ে পড়ত। অবশ্য সবাই জানত বন্দুকে ভরা গুলিটা আসলে কঁকা গুলি। আর বাঘটা ছিল পোষা। সেই এক বাঘই কত বাঘের মরণ মরেছে। দোতলায় উঠে দারুব্রহ্ম সেই জঙ্গলের ধ্বংসাবশেষের দিকে চেয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাসের ঝড় বইতে থাকে।

ঊর্ধ্বতন তৃতীয় পুরুষ কৃষ্ণব্রহ্ম ছিলেন পালোয়ান। দুহাতে দু’মন ওজনের দুটো মুগুর ঘুরিয়ে রোজ দুবেলা ব্যায়াম করতেন। সেই মুগুর দুটো দোতলার সিঁড়ির মুখেই রাখা। দারুব্রহ্ম মায়াভরে সে দুটোকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে রইল কিছুক্ষণ।

তিনতলার সব ঘর বহুকাল হল তালাবন্ধ। ছাদ ফেটেছে, জানালার শিক আছে তো পাল্লা নেই। পাল্লা থাকলে শিক নেই। বাদুড় চামচিকের বাসা। যত রাজ্যের পুরনো জিনিসের আবর্জনা উঁই করে রাখা। শেষবারের মতো সবকিছু দেখে নেওয়ার জন্য দারুব্রহ্ম তালা খুলে ঢুকে পড়ল। কাঠের সিন্দুক দেয়াল আলমারি, ভাঙা ঝাড়লণ্ঠন, পুরনো নাগরা, ভাঙা খাট, কত কী চারদিকে ছড়ানো।

কাঠের সিন্দুক খুলে এটা-সেটা নাড়াচাড়া করছিল দারুব্রহ্ম আর এটা সেটা ভাবছিল। এমন সময় হাত ফসকে কী একটা যেন মেঝেয় পড়ে গেল। একটু চমকে উঠল দারুব্রহ্ম। চমকাবারই কথা। জিনিসটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ঝলকানি আর সেই সঙ্গে খানিক ধোঁয়া বেরোলো। দারুব্রহ্ম জিনিসটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখে, সেটা একটা প্রদীপ। প্রদীপটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবছে, চোখে পড়ল ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা সামনেই পাকিয়ে পাকিয়ে একটা লম্বা রোগা সুটকো লোকের চেহারা নিচ্ছে।

“কে রে?” দারুব্রহ্ম চেঁচিয়ে ওঠে।

লোকটা গোটা চারেক হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বলল, “আমি? আমি হচ্ছি প্রদীপের দৈত্য।”

দারুব্রহ্ম হাঁ। ব্যাটা বলে কী? সে বলল, “ইয়ার্কির জায়গা পাওনি? দিনে-দুপুরে ব্যাটা চুরির মতলবে বাড়িতে ঢুকে বসে আছ।”

লোকটা ভয় খেয়ে বলে, “সত্যি না। অনেককাল কেউ ডাকাডাকি করেনি বলে বেশ হাজার দেড়েক বছর একটানা ঘুমিয়ে এই উঠলাম। চুরি-টুরি কিছু হয়ে থাকলে আমি কিন্তু জানি না।”

দারুব্রহ্ম সাহসী বংশের লোক। সহজে ভয় খায় না। তবে সে বুঝল, লোকটা গুল দিচ্ছে না। প্রদীপটাও আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হতে পারে। তার বংশের অনেকেরই নানা বিদঘুঁটে জিনিস সংগ্রহের বাতিক ছিল। সে বলল, “বটে? তা তোর কাজটা কী?”

আবার গোটা কয়েক হাই তুলে বিশুদ্ধ বাংলাতেই লোকটা বিরস মুখে বলল, “আমার আবার কাজ কী? দেড় হাজার বছর পরে ঝুটমুট কঁচা ঘুমটা ভাঙালেন, এখন যা করতে বলবেন তাই করতে হবে। কিন্তু আগে থেকেই বলে রাখছি, প্রথমেই শক্ত কাজ দেবেন না, আমার এখনো ঘুমের রেশ কাটেনি। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।”

দারুব্রহ্ম বুঝল, এ ব্যাটা আলাদীনের সেই দৈত্যই বটে, তবে ফাঁকি মারার তাল করছে। সে বলল, “বাপু হে, অত রোয়াব দেখালে কি চলে? বরাবর অনেক বড়-বড় কাজ করে এসেছ, সব খবর রাখি। এখন পিছোলে চলবে কেন?”

লোকটা ব্যাজার হয়ে বলে, “সে করেছি, কিন্তু বহুকাল অভ্যাস নেই কিনা। তাছাড়া ঘুমোলে হবে কী, খাওয়া তো আর জোটেনি। দেড় হাজার বছর টানা উপোস। শরীরটা দেখুন না কেমন শুকিয়ে গেছে। আগে বরং কিছু খাবার-দাবার দিন।”

“তারপর?”

“তারপর যা বলবেন একটু-আধটু করে দেব।”

দারুব্রহ্ম লোক খারাপ নয়। দৈত্যটার সুড়ঙ্গে চেহারা দেখে তার কষ্টও হল। বলল, “চলো, দেখি মুড়িটুড়ি কিছু পাওয়া যায় কিনা।” বলে লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নামল দারুব্রহ্ম। বাড়ির কেউই লোকটাকে দেখে তেমন গা করল না। গা করার মতো কিছু নেই। দারুব্রহ্ম তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে ধামা ভরে মুড়ি আর বাতাসা খাওয়াল। সব শেষে দেড় ঘটি জল খেয়ে লোকটা বলল, “এ যা খাওয়ালেন এতে তো একটা সেঁকুরও উঠবে না। যাকগে, ওবেলা কী রান্না হবে?”

দারুব্রহ্ম একটা শাস ফেলে বলল, “একদিন এ বাড়ির অতিথিরা মাংস-পোলাও খেয়ে একটা করে মোহর দক্ষিণা নিয়ে যেত। সেদিন তো আর নেই। ওবেলা যদি হাঁড়ি চড়ে তবে দুটো ডাল-ভাত জুটতে পারে।”

লোকটা মন খারাপ করে বলল, “ডাল-ভাত। ছোঃ।”

দারুব্রহ্ম হেসে ফেলে বলল, “তুমি দেখি উলটো কথা বলতে লেগেছ। প্রদীপের দৈত্যই কোথায় খাবার-দাবার জোগাড় করে আনবে, তা তুমিই উলটে চাইতে লাগলে।”

লোকটা জবাব দিল না। ধোঁয়া হয়ে প্রদীপের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রাত্রে সকলের খাওয়া হয়ে গেলে দারুব্রহ্ম প্রদীপটা ঠুকে আবার দৈত্যটাকে জাগায়। দৈত্যটা চারজনের খোরাক একা খেয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার খোরাকটা একটু বেশিই। তা ভরপেট না হলেও ক্ষতি নেই কিন্তু একটা চেঁকুর তো উঠবে। এতে তো একটা সেঁকুরও উঠল না।” একটা হাই তুলে “যাই ঘুমোই গিয়ে বলে দৈত্যটা আবার প্রদীপের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল।

পরদিন দেখা গেল, দৈত্যকে একবেলা খাওয়াতে গিয়েই চালের ডোল ফাঁকা হয়ে গেছে। দারুব্রহ্ম ভাবল, আহা বেচারা। কতকাল খায়নি। একদিন তো ব্যাটার কাছ থেকে সুদে-আসলে সবই উশুল করব, কদিন বরং পেট ভরে খাক।

দারুব্রহ্ম পুরোনো সব দলিল-দস্তাবেজ বের করে খুঁজতে-খুঁজতে সন্ধান পেল, চৌমারির চরে তাদের কিছু জমি বহুকাল ধরে আছে, কিন্তু খাজনা বা ফসল আদায় হয়নি। একটা তেলকলের অংশীদারিরও সন্ধান পেল। খুঁজে পেতে দেখল, পুরো একটা তহসিলের খবরও সে এতকাল রাখত না। ছেঁড়া ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ল দারুব্রহ্ম। দাগ-নম্বর ধরে-ধরে খুঁজে-পেতে জমির সন্ধান পেল। প্রজারা তাকে দেখে প্রথমে একটু বেগড়বাঁই করলেও স্বীকার করল যে বহুকাল তারা খাজনা বা ফসল দেয়নি। বাবা-বাছা বলে তুতিয়ে-পাতিয়ে তাদের কাছ থেকে দারুব্রহ্ম কিছু আদায় করার চেষ্টা করছিল। এমন সময় মোড়ল চোখ মুছতে-মুছতে এসে বলল, “জমির মালিককে বঞ্চিত করেছি বলেই আমাদের ঘরে লক্ষ্মী নেই। আপনি যান। আমরা নিজে থেকেই পৌঁছে দেব যা দেওয়ার।”

দারুব্রহ্ম তেলকলে গিয়ে দেখল সেটা বেশ রমরম করে চলছে। দারুব্রহ্ম কাগজপত্র বের করে দাবি-দাওয়া জানাতেই তেলকলের মালিক মুছা গেল। জেগে উঠে বলল, “দলিলে দেখছি আপনি দশ আনার মালিক। তবে আমার থাকবে কী?” যাকগে, এসব তো জানা ছিল না। কবেকার কথা সব। এখন একটা বন্দোবস্ত করা যাবে। আপনি যান।”

তহসিলটাও দারুব্রহ্মকে হতাশ করল না। প্রজারা বলল, আমরা কি জানি ছাই যে, এ-জমিরও মালিক আছে। তবে আমরা নিমকহারাম নই, বঞ্চিত করব না।

দিন দুই বাদে দারুব্রহ্ম বাড়িতে ফিরে দেখে চারটে গরুর গাড়ি বোঝাই ধান, দু কলসি কাঁচা টাকা আর আনাজপাতি, তেল মশলা সব এসেছে। সেদিন দারুব্রহ্ম বাড়তি দশজনের রান্না রাঁধিয়ে প্রদীপ ঠুকে দৈত্যকে বের করে বলল, “খাও বাপু, পেট ভরে খাও। এ-বাড়িতে অতিথির সেঁকুর ওঠে না, এ-কথা শুনলে আমার পূর্বপুরুষরা স্বর্গ থেকে অভিশাপ দেবে।”

কিন্তু উঠল কই? দশজনের ভাত সাবাড় করে দৈত্য করুণ মুখে বলল, “বটে?”

দারুব্রহ্ম হাঁ হয়ে গেল।

রাত্রিবেলা বিশজনের খোরাক শেষ করেও কিন্তু দৈত্য চেঁকুর তুলল না। সাতদিনে চার গরুর গাড়ির চাল শেষ। বাড়িসুদ্ধ লোক জেনে গেছে যে, এত খেয়েও দৈত্যটার ঢেঁকুর উঠছে না। তারা রোজ দুবেলা এসে খাওয়ার সময় দৈত্যকে ঘিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, কবে কখন ঢেঁকুর ওঠে। কিন্তু উঠল না! কিন্তু ঢেঁকুর না উঠলেও পাহাড়-প্রমাণ খাওয়ার ফলে কদিনের মধ্যেই সুড়ঙ্গে দৈত্যটার চেহারা পুরোপুরি ঘটোৎকচের মতো হয়ে উঠল। মুগুরের মতো হাত, পাটাতনের মতো বুক, মুলোর মতো দাঁত, তালগাছের মতো লম্বা।

দারুব্রহ্মেরও জেদ চেপেছে। তাদের এত বড় রাজবংশে একটা পুঁচকে দৈত্য এসে খেয়ে ঢেঁকুর তুলছে না–এ কেমন কথা! এ বাড়িতে ভোজ খেয়ে লোকে পাক্কা দেড়দিন মেঝেয় পড়ে থাকত। দুচারজন ভোজ খেয়ে গঙ্গাযাত্রায় পর্যন্ত গেছে। সেই বাড়ির এই অপমান?

দারুব্রহ্ম নাওয়া-খাওয়া ভুলে আদায় উশুল করতে লাগল । তেলকলের ভার নিজে নিল। আরও সব নতুন নতুন কারবার খুলতে লাগল। গাড়ি গাড়ি চাল আসছে বাড়িতে, বস্তা-বস্তা আনাজ, ঘি, দুধ, দৈ। এ সবই একদিন দৈত্যের ওপর দিয়ে উশুল হবে। আগে ব্যাটা ঢেঁকুরটা তো তুলুক।

এর মধ্যেই একদিন বাড়ির খদ্দের এসে হানা দিয়েছিল। তখন দুপুরবেলা, দারুব্রহ্ম প্রদীপ ঠুকে দৈত্যকে মাত্র খেতে ডেকেছে। দৃশ্যটা দেখে খদ্দের চেয়ারশুদ্ধ উলটে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর থেকে আর আসেনি। কিন্তু বাড়ি বিক্রি এখন মাথায় উঠেছে দারুব্রহ্মের। বিক্রির মানেও হয় না। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপটা যখন হাতে পেয়েছে তখন আর অভাবও থাকবে না। খামোখা পূর্বপুরুষের ভিটে বিক্রি করবে কেন? সে তাই মিস্ত্রি ডেকে বাড়িটা মেরামত করাতে লাগল। সব খরচই উশুল হবে।

মৌরসি পাট্টায় আরও কিছু জমি নিল দারুব্রহ্ম। চাষবাস বাড়িয়ে ফেলল। কারবারগুলোও বেশ ফেঁপে-ফুলে চলছে। গোশালায় গরু, আস্তাবলে ঘোড়া, বাড়ির সামনে জুড়িগাড়ি। শুকনো বাগানে আবার গাছ লাগানো হল, তাতে ফুল ফুটল। বাড়িটা কলি ফেরানোর পর আবার ঝলমল করতে লাগল! এর মধ্যেই দারুব্রহ্মের জন্য যে মেয়েটি দেখা হয়েছিল তার বাবা এসে হাতজোড় করে বলল, “আমার মেয়েটি নিলে ধন্য হই।” তা তিনি হলেনও। নহবতখানায় সানাই বাজল, দারুব্রহ্ম বিয়ে করে এসে বিরাট ভোজ দিয়ে সাত গাঁয়ের লোককে খাওয়াল।

কিন্তু সাত গাঁয়ের লোকের মতো খাবার একা খেয়েও ব্যাটা দৈত্যটা কিন্তু সেঁকুর তুলল না। তবে বলল, ‘খিদেটা এবারে একটু কমেছে। পেটের জ্বলুনিটা তেমন নেই।” বলে ফের ঘুমোতে চলে গেল। নতুন বউয়ের সামনে এই অপমানে কান লাল হয়ে উঠল দারুব্রহ্মের বলতে নেই সে এখন লাখোপতি। একটা দৈত্যের পেট ভরাতে পারবে না? পরদিন থেকে সে কাজকর্ম দ্বিগুণ করে দিল।

মাসখানেক বাদে সে একশো গাঁয়ের লোকের অয়োজন করে দৈত্যটাকে ডাকল। খুবই লজ্জার সঙ্গে প্রকাণ্ড চেহারার বিকট দৈত্যটা এসে বসল আসনে। আচমন করে একটু ভাত মেখে মুখে দিয়েছে কি দেয়নি অমনি একটা বাজ পড়ার আওয়াজে আঁতকে উঠল সবাই। ঘড় ঘড়াত। ঘড় ঘড়াত। ঘড় ঘড়াত। পরপর তিনবার। অমনি চারদিকে হৈ হুল্লোড় ঠেলাঠেলি পড়ে গেল। বাচ্চারা হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল। তুলেছে। তুলেছে। দৈত্য ঢেঁকুর তুলেছে।

মাথা নীচু করে দৈত্যটা উঠে পড়ল। আঁচিয়ে যখন প্রদীপের মধ্যে ঢুকতে যাবে তখনই গিয়ে দারুব্রহ্ম তাকে ধরল, “এই যে বাপু। এই দিনটারই অপেক্ষা করছিলাম। সেঁকুর তো তুললে, এবার তো কাজকর্ম কিছু করতে হয়।”

দৈত্যটা অবাক হয়ে চেয়ে বলল, “আপনি হুকুম করলে সবই করতে হবে মালিক। কিন্তু কাজটা আর বাকি রেখেছেন কী? লোকে আমাকে পেলেই গাড়ি চায়, বাড়ি চায়, ধনদৌলত চায়। আমি দিইও। কিন্তু আপনার যা দেখছি, এর ওপরেও আমাকে কিছু করতে হবে নাকি?”

দারুব্রহ্ম কথাটা আগে ভেবে দেখেনি। এখন দেখল। বাস্তবিকই তার যা আছে তার ওপর আরও কিছু চাওয়ার মানেও হয় না। সে মাথা চুলকে বলল “তা বটে। তবে কিনা–”

দৈত্যটা করুণ মুখ করে বলল, “যে-বাড়িতে খেয়ে আমার ঢেঁকুর ওঠে, বুঝতে হবে সে-বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনো অভাব নেই। ঝুটমুট আমাকে আর খাটাবেন কেন? দেড় হাজার বছরের ঘুমটা আর কয়েক হাজার বছর চালাতে দিন। শরীরটা বড় ম্যাজ-ম্যাজ করছে।”

দারুব্রহ্ম একটা শ্বাস ফেলে বলল, “তাই হোক।”

দৈত্যটা প্রদীপের মধ্যে মিলিয়ে গেল। দারুব্রহ্ম সেটাকে আবার সাবধানে কাঠের সিন্দুকে ভরে রাখল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *