ঢাকা জেলা
বজ্রযোগিনী
কর্মমুখর নগরজীবনের এক সন্ধ্যায় সম্ভাষণ এল এক বাল্যবন্ধুর কাছ থেকে। বন্ধু শুধু বন্ধুই নয়, যে আমার শিক্ষাজীবনের সহপাঠী, কর্মজীবনের সহযাত্রী। তার ডাকে পরমআগ্রহ নিয়ে গেলাম তার কাছে। সবেমাত্র সে ফিরে এসেছে আমাদের দুজনেরই জন্ম-গ্রামের কোল থেকে। দেখা হতেই প্রশ্ন : তোমার জন্যে দেশ থেকে এনেছি এক পরমসম্পদ, বলো তো সে কী হতে পারে? ভাবতে চেষ্টা করলাম শতাব্দীর সন্ধিকালে এমন কী সম্পদ সে নিয়ে আসতে পারে দূরান্তরের সেই গ্রাম থেকে। শেষপর্যন্ত সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বন্ধুটি তুলে দিল আমার হাতে এককৌটো মাটি। আমার পিতৃ-পিতামহের আশিস-পূত বসতবাটি ‘বসু বাড়ির ভিটে’-র মাটি। এ মাটি আমার মা। এ মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পূর্বপুরুষের পুণ্যস্মৃতি। আমার কাছে এ শুধু মহামূল্যই নয়–অমূল্য। মাথায় ঠেকালাম সে-মাটি। এ মাটি ধুলো নয়। এ মাটি বাংলার হৃদয়-নিংড়ানো রক্তে সিক্ত আজ। তার দহনজ্বালায় সর্বংসহা ধরিত্রীর চোখ থেকেও ঝরছে অশ্রু-বহ্নি। জলে ঝাপসা হয়ে এল দৃষ্টি। কেঁদে উঠল, অসহায় মন।
উত্তরে ধলেশ্বরী, দক্ষিণে প্রমত্তা পদ্মা। মাঝখানে বহুর মধ্যে এক এই গ্রাম। বর্ষার প্লাবনে খরস্রোতা নদীর ঢেউ দোলন লাগিয়ে যায় আমার গ্রামের স্নিগ্ধ মাটির বুকে। বর্ষার বিক্রমপুরের রূপ অপরূপ! জলে জলময় ছল-ছল সব পল্লি। একবারের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। একেবারে ছেলেবেলাকার কথা। ঘরে ঘরে সাঁকো। এবাড়ি-ওবাড়ি যেতে আসতে নৌকো। তার ওপর বর্ষার জলে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের ভাসিয়ে দেওয়া ছোটো-বড়ো কাগজি নৌকো, কলার মোচা ও কলাগাছের বাকলের নৌকোর ছড়াছড়ি। বাড়ির উঠোনে খেলে যায় ছোটো ছোটো মাছ। সে-মাছ ধরার জন্যে ছোটোবেলায় সে কী মত্ততা! সন্ধে হতেই পাটখেতে ধানখেতে বঁড়শি পেতে রেখে আসার হিড়িক। ঘণ্টা দু-ঘণ্টা পর পর লণ্ঠন হাতে জল ঝাঁপিয়ে যেতে অনেক সময় হাসতে হাসতেই বঁড়শিতে সাপও তুলে নিয়ে এসেছে আমাদের মধ্যে অনেকে মাছের সঙ্গে সঙ্গে। সাপের ভয় ভয়ই নয় যেন! পুল থেকে দল বেঁধে লাফিয়ে পড়ে বর্ষার জলস্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার আনন্দও ভুলে যাওয়া চলে না। এমনি কত কী! শারদ বঙ্গের মাধুর্যও যেন ম্লান এখানে এক হিসেবে। মনে হয় বর্ষার বিক্রমপুরকে যারা দেখেনি, বিক্রমপুরের আসল রূপের সঙ্গেই তারা অপরিচিত।
আরও পরের কথা। আকাশে একটি-দুটি করে সবেমাত্র তারা ফুটতে শুরু করেছে। তারই ছায়া পড়েছে গোয়ালিনির কাকচক্ষু দিঘির জলে। কতকাল আগের কোন গোয়ালিনির স্মৃতি বয়ে চলেছে এ দিঘি জানা নেই। তবে সে অজানা গোয়ালিনির আভিজাত্য অস্বীকারেরও উপায় নেই। আমাদের বাড়ির সমুখ দিয়েই চলে গেছে বজ্রযোগিনী-মীরকাদিমের সড়ক। এই সড়কই আমাদের রাজপথ। রাজপথের ধারে অনেক দিঘির মতো গোয়ালিনি দিঘিরও একদিন মর্যাদা ছিল। কিন্তু আজ সে হৃত যৌবনা, তার কচুরিপানাময় জঞ্জাল রূপ আজ আর হয়তো কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। আমরা ছোটোবেলায় এ দিঘির ঘাটে বসে কত সময় কাটিয়েছি, কত গল্প করেছি, ছুরিতে কেটে, ঘেঁদা ঝিনুকে চেঁছে দিনের পর দিন খেয়েছি কত কড়া-কাঁচা আম! সে সবই আজ স্মৃতি।
দিঘির পাড়ের শ্মশানের আগুনের শিখাও চোখে ভাসে। কিন্তু আমার বাঙাল দেশজুড়ে আজ যে আগুন জ্বলছে তার লেলিহান শিখার, তার দাহিকা শক্তির প্রচন্ডতার বুঝি তুলনা নেই! সে-আগুনে ছাই হয়েছে মরা মানুষের অস্থি-মজ্জা-মেদ, এ আগুনে পূর্ণাহুতি তাজা তাজা হাজারো জীবন।
আমার গাঁয়ে পথচলতি মানুষ দলে দলে চলে উত্তরে দক্ষিণে–কাজ সেরে কেউ বাড়িমুখো, কেউ বাড়ি ছেড়ে কাজে, আবার কেউ বা হয়তো চলেছে আড্ডায়। রাত পড়তেই পথের এপাশে-ওপাশে কোনো-না-কোনো বাড়িতে নিশিকান্ত বা হরলালের কীর্তন আর না হয় শিশরির ‘ত্রিনাথের মেলা’-র গান শুরু হয়েছে বা হয়নি। এমনি ছিল আমার গাঁয়ের প্রায় প্রতিদিনকার সান্ধ্য পরিবেশ। সুখবাসপুরের সুধাকণ্ঠ গায়ক দুর্গামোহন মুখোপাধ্যায় আমাদের বাড়িতে প্রায় রোজই শ্যামাসংগীতের আসর বসাতেন এবেলা-ওবেলা। আর আমার ভক্তপ্রবর ঠাকুরদা স্বর্গীয় রাজমোহন বসু মজুমদার কেঁদে বুক ভাসাতেন সেসব গান শুনে। ভক্তিরসের বাহুল্য দেখে সেই ছোটোবেলায় আমরা হয়তো অনেক সময়ই হেসেছি। কিন্তু দুর্গামোহনের,
মা আছেন আর আমি আছি,
ভাবনা কি আর আছে আমার?
মায়ের হাতে খাই পরি
মা নিয়েছেন আমার ভার।
এসব সুললিত গানের কথা আজও যে ভুলতে পারিনি! কর্মক্লান্ত দিনের অন্যান্য অবকাশে কলকাতার ফুটপাথে চলতে চলতে কতদিন এসব ছায়াছবির মতো ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়।
আজও মনে ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে বিক্রমপুরের সেই গ্রাম, যে গ্রামের নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার নাড়ির যোগ। যখনই চিন্তায় হাতড়াই, কাছে এসে পড়ে বজ্রযোগিনী গ্রামের স্বপ্ন-মাখানো স্নেহভরা সেই স্মৃতি। মায়ের মতো ভালোবেসেছি এই গ্রামকে। আমার প্রায় সব-ভুলে-যাওয়া শৈশব আর সব মনে-থাকা কিশোর-জীবনের কান্না-হাসির দোলায় স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে আমার সেই ছেড়ে আসা গ্রাম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বজ্রযোগিনীর নাম অবিস্মরণীয় সত্তা। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে ও ঐতিহ্যে এ গ্রাম লক্ষ গ্রামের দেশ বাংলায় যেকোনো একটি নয়, স্বমহিমায় এ সবিশেষ। সুদূর অতীতের অন্ধকার যুগে বাংলার সত্যসন্ধানী যে ছেলে একদিন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দূরধিগম্য হিমাচলের দুস্তর গিরিমালা অতিক্রম করে তুষারঘেরা ঘুমের দেশ তিব্বতে উপনীত হয়েছিলেন ভগবান তথাগতের বাণী নিয়ে, সেই জ্ঞান-তাপস দীপংকর শ্রীজ্ঞান অতীশের পুণ্য জন্মভূমি এই গ্রাম। কিন্তু আজ আর পুকুরপাড়ায় সেই দীপংকরের ভিটেয় সন্ধ্যাদীপ জ্বলে না লক্ষ জনের কল্যাণ কামনায়, চলার পথে আজ আর হয়তো কোনো মানুষ সে-মহামানবের অসীম করুণার প্রত্যাশায় মাথাও নোয়ায় না ভক্তিবিনম্রচিত্তে ‘নাস্তিক পন্ডিতের ভিটে’-র সমুখ দিয়ে যেতে যেতে।
পাশের ঐতিহাসিক গ্রাম সেন রাজাদের অধিষ্ঠানভূমি রামপাল আজ শ্রীহীন। তার ভগ্নাবশেষের স্কুপের তলায় আশপাশে অতীত স্মৃতির যেটুকু শুচিতা অবশিষ্ট ছিল তারও সবটাই হয়তো আজ বিনষ্ট। মাইল দীর্ঘ রামপালের সেই বল্লাল দিঘি। প্রজার জলকষ্টে দুঃখপীড়িতা রাজমাতা ছেলের কাছে জানিয়েছিলেন তাঁর মনের বেদনা। পরদিনই দিঘি খননের আদেশ হল। রাজমাতা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যতদূর পথ পায়ে হেঁটে যেতে পারবেন ততদূর দীর্ঘ ও তার অর্ধেক প্রস্থ জলাশয় হবে, বল্লাল রাজার এই হল প্রতিশ্রুতি। প্রজার জলাভাব মোচনে পথ চলায় রাজমাতার বিরাম নেই। রাজ-পারিষদগণের চোখে-মুখে দেখা দেয় উদবেগের ছাপ। শেষটায় কি সারারাজ্য জলময় হয়ে যাবে! পায়ের সামনে অজ্ঞাতে আলতা ঢেলে দিয়ে কৌশলে তখন কে থামিয়ে দেয় রাজমাতাকে পুরো একমাইল পথ হাঁটার পর। রক্তচিহ্ন দেখে ভয়ে থমকে দাঁড়ান মা-রানি। মাইলব্যাপী দিঘির জন্ম হল রাতারাতি। সারারাজ্য মুখর হয়ে উঠল বল্লালরাজ ও রাজমাতার জয়ধ্বনিতে। কিন্তু আজ? আজ আর প্রজার দুঃখে রাজার মন কাঁদে না, এমনকী রাজমাতা, রানি বা রাজ-ভগিনীদেরও নয়। সেখানে আজকের রাজা প্রজারক্ষায় নয়, প্রজাহননে যেন উল্লসিত–রাজপুরুষেরা তারই নানা সাফাই গায় বেতারে, বক্তৃতায়! আজ আর জয়ধ্বনিতে নয়, ক্রন্দন আর্তনাদে সারারাজ্য মুখরিত।
বল্লালদিঘির উত্তর পাড়ের সুদীর্ঘ গজারি গাছ আজও সেন রাজার উদার উন্নত মনের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে কি না জানি না, তবে চার বছর আগেও জীর্ণ সে-গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি প্রায় আটশো বছর আগের গৌরবময় অতীতকে। প্রচলিত ধারণা, রাজার হাতি বাঁধা থাকত এ গাছে। কিন্তু দৈবপ্রভাব ছাড়া শ-শ বছর ধরে কী করে একটা গাছ সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, বিক্রমপুরের মানুষের মনে এ জিজ্ঞাসা অতিপুরাতন। ছেলে-মেয়ের দীর্ঘায়ুর আশায় কত মা এই অমর গাছের শীতল ছায়ায় বসে মানত করেছে, প্রার্থনা জানিয়েছে ভগবানের কাছে। কিন্তু আজকের ভগবানের দরজায় কি মানুষের কোনো প্রার্থনাই পৌঁছোয়? পূর্ববাংলায় আজ যাঁরা ক্ষমতার মালিক তাঁদের দম্ভকে স্বীকার করে আজও কি সেই গজারি গাছ তার অমরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে?
রামপালের হরিশ্চন্দ্রের দিঘির আশ্চর্য কাহিনিও বিস্মৃত হওয়ার নয়। কতবার মাঘী পূর্ণিমার দিনে এ দিঘির অলৌকিক ব্যাপার দেখতে গিয়েছি বড়ো ঠাকুরদার সঙ্গে, আশপাশের গ্রাম থেকে এসেছে দলে দলে নর-নারী আর ছাত্র-শিক্ষকের দল। সারাবছর ধরে যে দিঘির জল থাকে মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে ‘দাম’-বনজংলায় ঢাকা, মাঘী পূর্ণিমায় তার সে কী সজল হাসিমাখানো রূপ! যে দামে’-র ওপর গোরু চরে, ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ায়, পাখি ধরে, সাপ তাড়া করে দৌড়োয় দিনের পর দিন, সে ‘দাম’ এই একটি দিনের জন্যে দিঘির জলের কোন অতল তলায় তলিয়ে যায় কে জানে? পূর্ণিমা পেরিয়ে গেলে আবার ভেসে ওঠে যেমনি তেমনি। ব্রিটিশ সরকার এ বিস্ময়ের যবনিকা উত্তোলনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এ প্রাচীন কীর্তির অবমাননাকারীর দন্ড ঘোষণা করে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ে না, এ প্রবাদ হয়তো শুধু প্রবা দই। তা ছাড়া পুববাংলায় আজ হয়তো কোনো হুকুমেই পরোয়া নেই কারুর। মানুষের জীবনেরই কোনো মূল্য নেই যেখানে, সেখানে অজানা অতীতের হিন্দুকীর্তি রেহাই পাবে অমর্যাদার হাত থেকে এ আশা দুরাশা বই কী! তবু আশা হয়, ভেঙে গেছে যে স্বপ্ন, বাংলার বহ্নি-হৃদয়ে আবার উজ্জ্বল হয়ে আলো দেবে সেই স্বপ্ন।
কলকাতার মানুষ হয়ে গেছি আজ। কিন্তু জন্মেছিলাম যার আঁচলজড়ানো কোমল মাটির নরম ধুলোয় তাকে তো ভুলতে পারিনি। দুঃখ আছে মনে, দিন-রাত্রির খাটুনিতে অবসাদ নামে দেহে, আর্থিক দৈন্যও থেকেই যায়। তবু ছুটি পেলেই একছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে প্রায় তিন-শো মাইল দূরের সেই গ্রামে! বিক্রমপুরের স্বপ্ন-ছোঁয়া সেই শ্যামল গাঁয়ের পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে চলতে চলতে ইচ্ছে করে ছেলেবেলার মতো আবার গলা ছেড়ে সুর ধরি : ‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে। এদেশ জন্মদুখিনী, তবু এই আমাদের সাত রাজার ধন, এক-শো হিরে-মানিক জ্বলে তার আকাশে।
কলকাতা থেকে গাড়ি করে গোয়ালন্দ। সেখান থেকে স্টিমারে পদ্মা পেরিয়ে ধলেশ্বরীর কোলে কমলাঘাট স্টেশন। স্টেশনের পর বন্দর। তারই অদূরে মীরকাদিমের হাট পেরিয়েই শুরু আমার গাঁয়ের রাস্তা, যাকে আগে বলেছি ‘রাজপথ’। খানিক এগিয়ে এলেই আমার গ্রামের মুখে সুখবাসপুরের সেই কড়ই গাছ। এখানে এসে বিশ্রাম-সাধ না জেগেছে এমন লোক বড়ো নেই। সেই কড়ই গাছের তলায় তিনসিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কত দুপুর, কত রাতে প্রার্থনারত মুসলমানদের আজানের ডাক ভেসে এসেছে বাতাসে বাতাসে। মনে হয়েছে এ ডাক বন্ধুত্বের, মৈত্রীর, ভালোবাসার।
আর একটু যেতেই নিবারভাঙার পুল। আমাদের কত আড্ডা জমত সেখানে স্কুলপালানো, ঘরপালানো কৈশোরের ক্লান্তিহীন উল্লাসে। কৈশোরের সেই বাঁধন না-মানা উন্মাদনা নিয়ে গ্রামোন্নয়নের কাজে সেবাদল করেছি, ডন-কুস্তির আখড়া করেছি, আর সেইসবেরই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়েছিলাম শান্তিসুধা লাইব্রেরি। সেসব আজ দূর অতীতের গর্ভে। কিন্তু তা হলেও সে-অতীত একথাই প্রমাণ করে, গ্রামের ছেলেরা একজোট হয়ে কত ভালো কাজ করতে পারে। এসব কাজে আমরা পেয়েছিলাম জীবনদার সাহচর্য। সময়ে-অসময়ে কতদিন কতরকমে পালিয়ে পালিয়ে ছুটে গিয়েছি তাঁর কাছে, তাঁর কর্মকেন্দ্র মহকুমা-শহর মুনসিগঞ্জে। অগ্নিসাধক সেই জীবনদার কাছে দীক্ষা পেয়েছিলাম সেবার, দেশপ্রেমের, বিপ্লবের। আজ তাঁর সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে সরে থাকলেও মুক্তিপাগল শঙ্কাহরণ সেই জীবনদার অকপট আদর্শ-নিষ্ঠার কাছে আজও মাথা নোয়াই।
অসহযোগের যুগে কংগ্রেসনেতা সূর্য সোমের বক্তৃতা শুনেছি, বক্তৃতা শুনেছি নামজানা না জানা আরও অনেক দেশভক্তের। তখন আমি কতটুকু! কিন্তু জ্বলন্ত বিদ্রোহের যে আগুন তাঁরা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন মনে, সে-বহ্নিদাহনে জীবনের সব জড়তা, হীনতা-দীনতা পুড়িয়ে ছাই করে খাঁটি মানুষ হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলাম সেদিন। অনেক চ্যুতি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও বড়ো হয়ে স্নেহ পেয়েছি তাঁদের অনেকের, বিশেষ করে সূর্য সোমমশাইয়ের। বছর বারো আগে শেষদেখা হয়েছিল সোম মশাইয়ের সঙ্গে। অবকাশ যাপনে কিংবা কোনো উপলক্ষ্যে গিয়েছিলেন তিনি দেশের বাড়িতে কর্মস্থল ময়মনসিংহ থেকে। আমিও তখন গ্রামে রয়েছি ছুটিতে। আমার কথা শুনেই খবর পাঠালেন। প্রণাম করতেই পিঠ চাপড়ে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘শেষজীবনটা গাঁয়ের মাটিতেই কাটাব ঠিক করেছি। তোরাও আসিস, যখন ফুরসত পাবি ছুটে আসবি। গ্রামগুলোকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারিস তো দেশ আপনি এগিয়ে যাবে। কথাগুলো সবই ঠিক। কিন্তু শেষজীবনটা গাঁয়ে কাটাবার শখ আর তাঁর মেটেনি। অল্পদিন পরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাঁকে প্রকৃতির আহ্বানে। আজ যে পরিবেশ তাতে আমাদেরই কি আর গ্রামসেবার সে-সুযোগ ঘটবে?
বাংলাদেশের অন্যতম জনবহুল এই গ্রাম। উনিশ-কুড়ি হাজার লোকের বসতি। আঠাশটি তার পাড়া। তিন-তিনটে ডাকঘর আর তিনটে বাজারে সদা জমজমাট এই জনপদ। বছর কুড়ি-একুশ আগে বেশ একটা বড়ো হাসপাতালও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিলতৈল-খ্যাত জি. ঘোষের অর্থে। কিন্তু অর্থ যারই হোক, রোগ চিকিৎসায় কোনো পার্থক্যই কখনো দেখিনি হিন্দু-মুসলমানে।
গ্রামের রাজধানী বলতে গুহপাড়া। বড়ো বাজার, বড়ো ডাকঘর, সাত-শো আট-শো পড়ুয়া ছেলের হাই স্কুল, খেলার মাঠ সব কিছুই এখানে। গ্রামের জমিদার গুহবাবুদেরই কীর্তি অধিকাংশ। জমিদারির প্রতাপ নিঃশেষিত হয়েছে রায়বাহাদুর রমেশচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে। পল্লি আভিজাত্যর ঐতিহ্য তাঁর মধ্যেও লক্ষ করেছি, কিন্তু তাঁর পরে আর নয়। দানে-অপচয়ে প্রায়-নিঃশেষ ভান্ডারও দোল-দুর্গোৎসব ও রথযাত্রার সমারোহে কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। চৈত্রসংক্রান্তিতে বাবুর বাড়ির দরজা থেকে বাজার ও খেলার মাঠজুড়ে বসে ‘গলৈয়া’-র মেলা। অফুরান আনন্দের ঝড় বয়ে যায় ক-দিন ধরে এ উপলক্ষ্যে। চৈত্রমাসে নীলোৎসবে চড়কপুজো ও কালীকাছ’-এর নাচের কথা ভুলে যাওয়া বিক্রমপুরের কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। এই কালীকাছ’-এর নাচে ভট্টাচার্যপাড়ার দলই ছিল সবার সেরা। আর সত্যি নাচে-গানে এ পাড়ার নামই ছিল সবচেয়ে বেশি। সোমপাড়া-ভট্টাচার্যপাড়া ‘অ্যামেচার ড্রামাটিক ক্লাব’ও ছিল এ পাড়াতেই এবং এই নাট্যাভিনয় ক্লাবটি ছিল আমার গাঁয়ের একটি গৌরবের বিষয়।
শ্রাবণ মাস পড়তেই ধুম পড়ে যেত মনসার পাঁচালি গানের। মূল গাইয়ে ছিলেন স্বর্গীয় লালমোহন বসু মজুমদারমশাই। মনসার ভাসান গান সম্পর্কে তাঁর ছিল অদম্য উৎসাহ। তিনি নিজেই তিন খন্ডে এক পাঁচালি লিখে ফেলেছিলেন। আর সারা-শ্রাবণ মাস ধরে সে-পাঁচালির গানই গাওয়া হত। লালমোহন, হরিমোহনের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গান ধরতাম আমরা সব ছেলে-মেয়ের দল, পদ্মে গো পুরাও মনের বাসনা বলে। কীই-বা আমাদের এমন বাসনা ছিল? সাপের কামড় থেকে আত্মরক্ষার জন্যেই তো ছিল আমাদের আকুল আবেদন। দেশবিভাগের যে বিষ-যন্ত্রণা আমরা আজ মর্মে মর্মে অনুভব করছি তার তুলনায় সাপের কামড়ও যে নিতান্তই সামান্য!
পড়ার জীবনের অনেক স্মৃতিই আজ সামনে এসে ভিড় করে। মনে পড়ছে নাহাপাড়ায় হরিমোহন বসুর পাঠশালার আটচালার কথা। হাতেখড়ি হরিমোহনের কাছেই, তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। কতদিন পড়া ফাঁকি দিয়ে পাঠশালা পালাতাম দলবেঁধে ঘুড়ি ওড়াতে কি হাডু-ডু খেলার নেশায়। যখন আকাশ বেয়ে নামত বৃষ্টি আমাদেরও মনের দিগন্তে তখন সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে আসত ছুটির আমন্ত্রণ। হাই স্কুলের ছোটোখাটো মানুষ হেডমাস্টার অম্বিকাবাবুর চলন, চেহারা ও চাহনিতে অধ্যয়নার্থী ছাত্রদের জাগাত হৃৎস্পন্দন। তাঁর চলার পথে দু-শো হাতের মধ্যে যেতে সাহস হত না কারুর। আহা, কী ভালোই না বাসতেন তিনি ছাত্রদের। আদিনাথবাবু, তারাপ্রসন্নবাবু, পন্ডিতমশাই, বিরজাবাবু, এঁরা সবাই ছাত্রবন্ধু। স্নেহে ও শাসনে বাপ-মায়ের মতো আপন। অথচ দেশে গিয়ে এঁদের দেখা পাব এমন ভরসা কি আর আছে?
ধীরেনবাবু ইতিহাস পড়াতেন আমাদের। খুব ভালো লাগত তাঁর মুখে বাঙালির অতীত গৌরবের কথা শুনতে এবং বইয়ে পড়তেও। পরীক্ষার আগে ইতিহাসের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তাম। মধ্যরাত্রে দক্ষিণের বিলে নলখাগড়ার বন থেকে ভূতুমের ডাক শুনে জেগে উঠে আবার শুরু করতাম ধীরেনবাবুর ইতিহাসের পড়া। সেই ধীরেনবাবুই ছিলেন গত কয় বছর ধরে আমাদের জয়কালী হাই স্কুলের হেডমাস্টার। কিছুদিন আগেও শুনেছিলাম, সাহস করে তিনি তখনও আমাদের গ্রামেই আছেন। তাঁর সাহসিকতাকে নমস্কার জানিয়েছিলাম সে কথা শুনে। কিন্তু এ কী, তিনিই হঠাৎ একদিন আমার অফিসে এসে হাজির তাঁর দুঃখের কথা জানাবার জন্যে! তাঁর যে ছাত্র তাঁকে সপরিবারে মানে মানে সরে পড়ার পরামর্শ দিল, গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পথে তারই সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে আটক পড়তে হল তাঁকে সদলবলে। প্রিয় ছাত্রের মধ্যস্থতায় শ-দুই টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে গুরুমশাই ছাড়া পেয়ে কোনোক্রমে পরিজনসহ পদ্মা পেরিয়ে কলকাতায় এলেন বটে, কিন্তু পাড়াগাঁয়ের সরল-মন শিক্ষকের বিস্ময় কাটল না–এ কী হল, কেমন করে হল, এসব প্রশ্ন ঘিরে রইল তাঁর মনকে। একলব্যের কাল অতলান্ত অতীতের গর্ভে, সে আর ফিরে আসবে না জানা কথা। তা হলেও সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে বাংলারই মাটিতে যে গুরুদক্ষিণা দেয় হবে গুরুমশাইয়ের আর ছাত্র হবে গ্রহীতা, এ ছিল অকল্পনীয়। তবু তাই হল এবং তাই পাকাপাকি নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে কি নতুন শরিয়তি রাজত্বে, কে তা বলতে পারে? কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পা দিয়েছি। কলকাতায় এসে খবর পোঁছোল ভুখা বাংলার পঞ্চাশী মন্বন্তরের হিংস্র আক্রমণে বজ্রযোগিনী মুমূর্ষ। বুদ্বুদা, অমিয়দা প্রভৃতির সাহায্যে কলকাতায় বজ্রযোগিনী সমিতি গড়ে উঠল হীরালাল গাঙ্গুলি মশাইকে সভাপতি করে। অর্থ আর অন্নবস্ত্র সাহায্য সঙ্গে করে গ্রামের পথে পা বাড়ালাম।
তখন প্রায় সন্ধে। দিগন্ত ছোঁয়ানো আকাশে ম্লান মেঘের ছায়া। আকাল। আঠাশপাড়ার গ্রাম বজ্রযোগিনী কন্ঠাগতপ্রাণ। বকুলতলার ঘাটে স্নানার্থী জলার্থী মেয়েদের আর ছেলেদেরও ভিড় যেখানে জমে উঠত, সেখানেও বিরলতর হয়ে আসে সন্ধ্যাগুঞ্জন। সোমপাড়ার পুলে কত অক্লান্ত আড্ডা জমিয়ে পথচারীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে পাড়ার ছেলের দল। সে-বছর সেখানেও দুরন্তদের ভিড় নেই। সোমপাড়া আমার শৈশবের স্বপ্নভূমি।
মন্বন্তর সর্বভুক সরীসৃপের মতো গ্রাস করে নিচ্ছিল গ্রাম-হৃদয় বাংলার জীবন। মনের টানে আমাদের সামান্য প্রচেষ্টা নিয়ে সেদিন গিয়েছিলাম গ্রামে। খবর শুনে এলেন এক মাস্টারমশাই। বললেন, মনে রেখেছ বাবা গ্রামকে? গ্রাম যে যায়। আমরা শিক্ষক। আমাদের আর কী আছে, তোমরা ছাত্ররাই আমাদের যা-কিছু সম্পদ। আনন্দে যেন উচ্ছল হয়ে উঠলেন তিনি। আমার স্কুলজীবনের উত্তর-তিরিশের আধা-প্রৌঢ় গুরুমশাইয়ের চোখে-মুখে বার্ধক্যের নামাবলি। সবগুলো চুল গেছে পেকে। সময় যে নিঃশব্দ চরণে এগিয়ে চলেছে এ তারই স্বাক্ষর।
তারপর চলে গেল আরও কত বছর। নাড়ির টানে বার বার ছুটে গিয়েছি গ্রামে। তার মায়ের মতো স্নেহস্পর্শে অবুঝ হয়ে উঠেছে মন। দূর গ্রামের মুসলমানদের এক মেয়ে, ডাকতাম তাকে মধুপিসি বলে। কেউ নাকি ছিল না তার। প্রায়ই আসত আমাদের বাড়ি। আমরাই তার সব, একথা যে কতবার সে আমাদের বলেছে তার লেখাজোখা নেই। কোনোদিন মনে হয়নি মধুপিসি মুসলমান। নিজের বাড়ির এটা-ওটা, মাঠের ফল-মূল-শাক প্রায়ই সে নিয়ে আসত আমাদের জন্যে। আগ্রহে পরমানন্দে মধুপিসির দেওয়া সেসব জিনিস গ্রহণ করতাম।
শুধু কি এই? একদল বিহারি দেহাতি মানুষ–প্রতিবছর পুববাংলার পল্লিতে পল্লিতে যারা এসে সাময়িক আস্তানা গাড়ে, তার একটা বড়ো অংশ একরকম পাকাপাকিভাবেই রয়ে গিয়েছিল এই গ্রামে; আমাদের গ্রামের মানুষই হয়ে গিয়েছিল তারা–আমাদের সঙ্গে একাত্মা। তারা ডুলি-পালকি বইত, অনেকে এমনি আর সব কাজকর্মে রুটি জোগাত নিজেদের। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট রায়বাহাদুরের বাঁধা পালকি ছিল একটা। তাঁর চারজন বেহারাও ছিল নির্দিষ্ট। তারাই ছিল গ্রামের বিহারিদের মোড়ল। আজও কি তারা আমার গ্রামে আছে?
আমার সোনার গ্রাম! সিদ্ধা যোগিনী বরদার নাম-মহিমায় মহিমান্বিত এ গ্রাম। সংস্কৃত শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল এক সময় এ জনপদ। গোবিন্দ বেদাধ্যায়ী, প্রসন্ন তর্করত্ন, শশিভূষণ স্মৃতিরত্ন, শ্রীনাথ শিরোমণি ও দ্বারিকানাথ তর্কভূষণ প্রমুখ ভারত-খ্যাত পন্ডিতেরা এ গ্রামেরই সন্তান। আমার গাঁয়েরই নাহাপাড়ায় জন্মেছিলেন লোককবি আনন্দচন্দ্র মিত্র। আনন্দচন্দ্রের হেলেনাকাব্য, মিত্ৰকাব্য, বিবিধ সংগীত প্রভৃতি রচনা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বড়ো দুঃখেই কবি গেয়েছিলেন–
(এসব) দেখে শুনে এ দুর্দিনে বল মা তারা, যাই কোথা?
মিলে যত ভন্ড ষন্ড দেশটা করলে লন্ডভন্ড;
ধর্মকর্ম থোকার টাটি, (যত) বদমায়েসির ফাঁদ পাতা!
… … … … …
না জানি কি কপাল দোষে হতভাগ্য বঙ্গদেশে
পশুর বেশে অসুর সৃষ্টি কল্লে দারুণ বিধাতা!
দেশ হয়েছে আস্ত নরক! একদিনেতে এসে মড়ক,
গো-বসন্তে উজাড় করলে তবে যায় মনের ব্যথা!!
প্রায় এক-শো বছর আগের বাংলাদেশের অবস্থায় যে কবির কোমল প্রাণে দেখা দিয়েছিল এমনি মর্মপীড়া, আজকের হতভাগ্য বাঙালির অবস্থা দেখতে হলে কী করে তা সহ্য করতেন কবি, তা কি আমরা কল্পনাও করতে পারি?
‘জাতের নামে বজ্জাতি’ যারা করে, তীব্র কশাঘাতে তাদের সংশোধনের কত চেষ্টাই না করেছেন চারণ-সম্রাট মুকুন্দ দাস! তাঁর যাত্রাগানের কথা বাঙালি কি ভুলতে পারে কোনোদিন? ছোটোবেলায় আমাদের গাঁয়েই শুনেছি তাঁর কত পালাগান। বাঙালির অধঃপতনে তাঁরও খেদের অন্ত নেই। তিনিও গেয়েছেন–
মানুষ নাই দেশে
সকল মেকি সকল ফাঁকি, যে যার মজে আপন রসে।
আর তারই প্রতিফল আমরা আজ ভোগ করছি হাতে হাতে। চারণ-সম্রাট আজ আর বেঁচে নেই, তাঁর জন্মগ্রাম বিক্রমপুরের বানারিও কীর্তিনাশা পদ্মার গর্ভে। তার জন্যে দুঃখ করার আর কী আছে! সারা পুববাংলা ছাড়াই তো আমরা। রাজা রাজবল্লভের রাজনগর আর চাঁদ রায়-কেদার রায়ের রাজবাড়ি গ্রাস করেই তো পদ্মা নাম নিয়েছে কীর্তিনাশা পদ্মার কবল থেকে রক্ষা পেলেও পাকিস্তানের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার তো উপায় ছিল না। আজ তাই তো ভাবি, আমার গ্রাম যে থেকেও নেই। সে না-থাকার ব্যথা যে আরও দুঃসহ!।
যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সারাভারতের মুক্তির সাধনায় সর্বত্যাগী, তাঁর পিতৃপুরুষের বাসভূমি আমার গাঁয়ের অদূরবর্তী তেলিরবাগ গ্রাম স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত নয়–সে পুণ্যক্ষেত্র আজ বিদেশে, বিদেশির শাসনাধিকারে, এ ভাবতেও শরীর শিউরে ওঠে। কিন্তু কী হবে ভেবে?
কে জানত এমনি করে ছেড়ে আসতে হবে গ্রামকে। শরণার্থী পরিজন পরিবেশে এই মহানগরীর এক প্রান্তে সংকোচে আজ দিন কাটাই। তবু আশা জাগে, আজ যে দেশ দূর, দুঃশাসনের হাত থেকে সে-দেশকে, সোনার বাংলার হৃৎপিন্ড সে-বিক্রমপুরকে একদিন ফিরে পাব আমার মনের কাছে।
.
সাভার
প্রতি অঙ্গে সে-গাঁয়ের স্পর্শ। বড়ো মিঠে. বড়ো মধুর। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ওখানেই তো চলতে শিখেছি। ওরই হিজলতলায়, পদ্মবিলে, ধলেশ্বরীর উচ্ছল স্রোতে সারাশৈশবটা কেটেছে। বুধু পন্ডিতের পাঠশালা, বুড়ো বটের দিঘল জটা কত স্মৃতির মাধুর্যেই না মধুময়!
ময়ূরপঙ্খির গল্প শুনতে কতদিনই না বসেছি ধলেশ্বরীর ধারে। সন্ধে নেমেছে। চাঁদ উঠেছে কালো গাঁয়ের মাথায়। শত মুক্তোর প্রাচুর্য নিয়ে মাতাল হয়েছে ধলেশ্বরী। এক চাঁদ শত চাঁদ হয়ে আছড়ে পড়েছে ঢেউয়ের দোলায়। চেয়ে রয়েছি, কেবল চেয়ে থেকেছি।
সন্ধের ঝিরঝিরে হাওয়ায় নোঙর খুলে পাল তুলেছে মাঝিমাল্লারা। তাদের কলকন্ঠে খিলখিল করে হেসে উঠেছে যেন জ্যোৎস্নাস্নাত নিবিড় আকাশ। দিগন্ত তুলেছে প্রতিধ্বনি। কিশোর মন সন্ধান করেছে মধুমতীর দেশের, ওই বাঁক পেরিয়ে মাঠ ছাড়িয়ে।
কেষ্ট বৈরাগীকে ভুলতে পারি? কত ভোরেই না ঘুম ভেঙেছে তার সুললিত গানের সুরে। মায়ের আঁচল ধরে কতদিনই না বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। ভোরের হাওয়া আমার সর্বাঙ্গ বুলিয়ে গেছে মায়ের স্নেহের মতো। আমার আঁখির আবেদনে আবার নতুন করে গান ধরেছে কেষ্ট,
সখিগো…ওগো প্রাণসখি! এই করিয়ে তোমরা সকলে, না পুড়াইয়ো রাধা অঙ্গ না ভাসাইয়ো জলে, মরিলে বান্ধিয়া রেইখো তমালেরি ডালে…গো।
বিরহিণীর অশ্রুভেজা এ অন্তিম আবেদনে কৈশোরের অবুঝ মনও কেঁদে উঠেছে। কেষ্ট বৈরাগীর মরমি সুর ধলেশ্বরীর পলিমাটির মতোই নরম।
এমনি কত টুকরো টুকরো স্মৃতি আর স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা আমার গ্রাম সাভার, ঢাকা জেলার একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। বুকে তার কত শতাব্দীর অক্ষয় ইতিহাস, অতীত সভ্যতার বিলীয়মান কঙ্কাল। এখানে রাজ্য ছিল, রাজা ছিল একদিন, ছিল শিক্ষা আর সংস্কৃতির প্রাণবান প্রবাহ। এ দেশের বাণী সেদিন পৌঁছোত দূরদূরান্তে…হিমালয়ের শিখরচূড়া পেরিয়ে। দীপংকরের জ্ঞানের প্রদীপ এখানেই প্রথম জ্বলেছিল–গুরুগৃহে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল এখানে। সেদিনের সাভার ছিল সর্বেশ্বর নগরী, রাজা হরিশ্চন্দ্র পালের রাজধানী, সর্ব-ঐশ্বর্যে মন্ডিত। বৌদ্ধধর্মের বন্যা নেমেছিল এর দিকে দিকে। ধর্মরাজিকা কত বিহার মাথা তুলেছিল এ অঞ্চল ঘিরে। কত ভক্তমনের অন্দরমহলে ঠাঁই করে নিয়েছিল সর্বেশ্বর নগরী…আমার সাভার।
সেদিনের স্মৃতি আজও নিঃশেষ হয়নি। বাজাসনে’ আজ রাজার আসন না থাকলেও সে গৌরবময় দিনের কত স্বপ্ন-কথা এর মাটির অঙ্কে অঙ্কিত রয়েছে। সেদিনের কত অস্পষ্ট স্বাক্ষর দিকে দিকে আজও বর্তমান। কর্ণপাড়ার ভগ্নস্তূপ, ‘বাজাসন’ রাজপ্রাসাদের শেষচিহ্ন কোটবাড়ি আজও তো পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আমরাও কি আর কম ঘুরেছি? কতদিন, কত কাঠফাটা রোদ্দুরে বাড়ি থেকে পালিয়েছি দল বেঁধে। একটা নতুন কিছু যেন আবিষ্কারের ইচ্ছে। দুধসাগর, নিরেমিষ, লালদিঘি এমনি কত পুকুরের ধারে ধারেই না সারাটাবেলা কেটেছে। রবীন্দ্রনাথের সেই খ্যাপার মতো আমরা যেন করে ফিরেছি সেই পরশমণির অনুসন্ধান। আমগাছের ছায়ায় বসে বসে ডাক দিয়েছি রমজানকে, আজমত শেখকে। বাজাসনের এখানে-ওখানে আজ ওদেরই উপনিবেশ। দুধে ধোয়া সাদা-বাবরি নেড়ে রমজান বলেছে কত গল্প, কত পুকুরের ইতিবৃত্ত; ‘নিরামিষ্যিতে মাছ থাহে না কর্তা, ওডা রাজার মা’র পুকৈর।–অবাক হয়েছি। বোবার মতো চেয়ে রয়েছি রমজানের দিকে। কোদাল ধোয়ার ইতিহাস বলেছে রমজান, কোটরাগত চোখ দুটো টেনে টেনে। ওটাই নাকি রাজা হরিশের শেষ পুকুর। শত পুকুর শেষ করে ওখানেই নাকি কর্মীরা কোদাল ধুয়ে উঠেছিল–রমজান তার নানার কাছে থেকে শুনেছে সেসব কথা। সেদিন রমজানের কোনো কথাই অবিশ্বাস করিনি। সাভারের এপাশে-ওপাশে ছড়িয়ে থাকা শত শত পুকুর দেখে বুড়ো রমজানের কথা সত্যি বলেই মনে হয়েছে।
আজ আরও কত কথাই না মনে পড়ে। স্মৃতির মণিকোঠায় বিগত দিনের কত ছবিই না। জ্বলজ্বল করে ওঠে। যখন ভাবি, কিশোরবেলার স্বপ্ন-ছাওয়া সে গ্রামখানি থেকে কত দূরে সরে এসেছি, যখন মনে হয় দেশবিভাগের পাপে আত্মার আত্মীয় সে-গাঁখানি আমার আজকে বুঝি পর হয়ে গেল, তখন সজল চোখের আরশি দু-খানি কত বিচিত্রতর ছবিতেই না ভরে ওঠে! গত দিনের কত কথা ও কাহিনি মনের দোরে এসে বারে বারে ঘা মেরে যায়।
মনে পড়ে নববর্ষের কথা। বৈশাখের রুদ্রদূত নতুনের জয়পত্র নিয়ে আসে। সারাগাঁয়ে পড়ে যায় সাড়া। দোকানিদের দোকানগুলো ফুলেপাতায় সেজেগুজে নতুনকে জানায় অভ্যর্থনা। গাঁয়ের মেঠোপথ মুখর হয়ে ওঠে আনন্দপাগল ছেলে-ছোকরাদের কলকন্ঠে। অপূর্ব হয়ে ওঠে সারা গাঁখানি! অপূর্ব মনে হয় জীবনের স্বাদ।
বিকেলের দিকে মেলা বসে। পাঠানবাড়ির বটের ছায়ায়। নমপাড়ার হীরু সর্দার, বক্তারপুরের জনব আলিরা শুরু করে ছড়ি খেলা। আগ্রহাকুল দর্শকেরা ভিড় করে থাকে চারপাশে। প্রতি বছর প্রতি বৈশাখের প্রথম দিনটি এমনি কত সর্দারের ছড়ির প্যাঁচেই না হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত! বিজয়ীর সর্বাঙ্গে কতজনেরই না উৎসুক দৃষ্টি পিছলে পড়ে!
হীরু সর্দারের নাম আছে। ঝাঁকড়া চুলে ঝাঁকুনি মেরে সে যখন ছড়ি নিয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে নতুন মানুষ বলে মনে হয়। দিঘল দুটি চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে আগুনে দৃষ্টি। নিশ্বাসের তালে তালে বুকের পাটাও যেন ফুলে ফুলে ওঠে। হেই…হেই…সামাল..সামাল..শব্দ করে তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে হীরু সর্দার। পায়ের তলায় মাটি যেন একেবারে কেঁপে ওঠে। উৎসুক জনতার অজস্র করতালির ভেতর খেলা শেষ করে কোমরের গামছা খুলে হীরু বাতাস করতে থাকে। গাঁয়ের মেয়েরা আড়চোখে দেখে যায়।
বর্ষা নেমে আসে। শাওনের ঢল নামে গাঙে। নবযৌবনা ধলেশ্বরী আপন গরবে ফুলে ওঠে। ওপারের কাশবন ডুবে যায়। মজেযাওয়া খালগুলো ছল ছল করে ছোটে; চাষিপাড়ার এক একটি কুটিরকে এক-একটি দ্বীপের মতো দেখায়।
শাওনের অঝোরঝরা রাতের একটি ছবি মনে জেগে ওঠে। গাঙিনীর জলে হেলেদুলে একটি ভেলা ভেসে চলেছে। তালীবন শেষ হল। সমুখে শুধু জল আর জল। বেহুলার অকম্পিত বুক। মা কাঁদছে, ভাই কাঁদছে, কাঁদছে প্রতিবেশীরা। আর বেহুলার সংকল্পে পরিবর্তন নেই!
মনসা পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে এই বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি। পল্লিকবি জিইয়ে রেখেছেন চাঁদবেনের কথা। ভাসান গানের সুরে সুরে বেহুলার অবাধ অশ্রু আজও উছলে ওঠে। সনকার অশ্রুজলে কত সন্ধ্যায় কত মায়ের বুকও ভিজে যায়।
এ অঞ্চলে বহুল প্রচলিত এই গান। রাতের পর রাত গান চলে। বেহুলা-লখিন্দরের প্রথম পরিচয় থেকে বিদ্রোহী চাঁদের অন্তিম পরাজয় পর্যন্ত। হিন্দু-মুসলমান সমান শরিক সে-গানের। মাখন দাঁ, এমনকী কেদার মুনশিও। বেহুলার অটল সংকল্পে ভাই-এর ব্যথা যখন মূর্ত হয়ে ওঠে এ গানে,
না যাইয়ো না যাইয়ো বইন
শুন লো মোর মানা;
তুমি গেলে বইন লো আমার
মায় যে বাঁচব না।
তখন কতদিন লুঙ্গির কোণে ছাবেদালী ব্যাপারীকে চোখের জল মুছতে দেখেছি। হিদুর ‘কেচ্ছা’ সেদিনও মুসলমানের ‘গুণাহ’ বলে বিবেচিত হয়নি। সনকার অশ্রুর আড়ালে তারা যেন তাদের ব্যক্তিক দুঃখেরই ছবি দেখতে পেয়েছে।
শরতের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। এই সময়টির জন্যে সারাবছর ধরে কী বিপুল প্রতীক্ষা! সে কী আয়োজন! প্রবাসীরা ঘরে ফিরছে। ধলেশ্বরীর কূলে রোজই এসে নতুন নতুন নৌকো লাগছে। আমরা ছেলেরা গিয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়েছি। ক-দিনের জন্যে গাঙখালি লোকে ভরপুর। সবার সঙ্গে আবার নতুন করে পরিচয়।
হিন্দুপ্রধান গ্রাম সাভার। পুজো এখানে বেশ কয়েকখানিই হয়। তার মধ্যে দক্ষিণ ও উত্তর পাড়ার বারোয়ারি দুটি প্রধান। আগে উভয়ের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা হত, প্রতিমা তৈরি থেকে আরম্ভ করে গান-বাজনা নিয়েও। দক্ষিণীরা ঢাকা থেকে কারিগর আনালে, উত্তরেরা বিক্রমপুর পর্যন্ত ছুটত। দক্ষিণীরা তিন রাত গানের ব্যবস্থা করলে, উত্তরেরা নট্ট কোম্পানির যাত্রদলের সঙ্গে পাঁচ রাতের চুক্তি করে বসত। সন্ধে থেকে শুরু করে সারারাত চলত গান। এপাড়া হরিশ্চন্দ্র’ বই নির্বাচন করলে ওপাড়ায় আরম্ভ হয়ে যেত রামচন্দ্র।
ছোটোবেলায় দেখেছি দুর্গা পুজোর মুসলমানের আনন্দ কম নয়। হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের ঘরেও আসত নতুন কাপড়। মুসলমান মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় প্রতিমা দেখে বেড়াত। রং বেরঙের লুঙ্গি পরে গলায় গামছা ঝুলিয়ে এগাঁয়ের সেগাঁয়ের মুসলমানেরা সকাল সকাল ঠাঁই করে নিত যাত্রার আসরে। রামচন্দ্র’ কিংবা হরিশ্চন্দ্র’ পালায় হিন্দুর সঙ্গে তারা সমান ভাবেই হেসেছে ও কেঁদেছে। পূর্ববাংলায় দুর্গাপুজো ঠিক এমনি করেই হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন উৎসব।
কোকিল-ডাকা বসন্তে আর একটি উৎসবে এ অঞ্চল মেতে উঠত। এটা যেন সত্যিকারের গণউৎসব। এতে চাষিদেরই উৎসাহ বেশি। ষাট বছরের বুড়ো পাঁচু মন্ডল হলুদবরণ কাপড় পরে পা দুটিতে ঘুঙুর বেঁধে দুলে দুলে নাচতেও লজ্জা করেনি। সারাবছরের দৈন্যেভরা জীবনকে ভুলে তারা যেন কেবল মুঠো মুঠো আনন্দ কুড়িয়েছে।
শিব পুজো বা শিব খাটনাও সাধারণ মানুষের উৎসব। এ অঞ্চলে এর প্রাধান্য কম নয়। অন্তত দশ-বিশ দল তো প্রতিবছরই আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে। শিব ঠাকুরকে মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করেছে এরা। গলায় কয়েকখানি ‘মেডেল’ ঝোলানো ঢাকি হরকেষ্টার ঢাকের তালে তালে বুড়ো-কাঁচায় সমান হয়ে নেচেছে। নাচনার শেষে গান ধরেছে প্রেমানন্দ। উমার গান, নিমাই-সন্ন্যাসের গান। ডান হাতে মাথাটি রেখে প্রেমানন্দ যখন গেয়েছে,
সন্ন্যাসী হইয়ো রে নিমাই
বৈরাগী না হইয়ো,
(ওরে) ঘরে বইসে কৃষ্ণ নামটি
মায়েরে শুনাইয়ো।
তখন মায়ের চোখ দুটি কোন সে ব্যথার অনুভূতিতে যেন টলটল করে উঠেছে।
দিনে ‘খাটনা’, রাতে ‘কাছ’। ‘কাছ’ কথাটি এসময় সম্পূর্ণ এক নতুন অর্থে ব্যবহৃত হয়। নানাপ্রকার রঙ্গরসের ভেতর দিয়ে কাছ’ নাচের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ যেন বাংলার আদিম নৃত্য। জনসাধারণের কাছে অসীম এর আবেদন। ছেলেবেলায় মায়ের বকুনি খেয়ে সারারাত্রি জেগে বাড়ি বাড়ি এ ‘কাছ’ দেখে ফিরেছি। মহাদেবঠাকুর যদি তার দীর্ঘ ত্রিশূলটি হাতে নিয়ে দু-একটি কথা বলেছে, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। হিংসুটে রাধাবল্লভটা অনুতাপে জ্বলে জ্বলে মরেছে। সে-আনন্দ, সে-অনুভূতি আজও উপলব্ধিতে জাগে। ‘মুখা কাছ’ দুর্লভ শীল আজও মনের নিভৃতে অগোচরে উঁকি দিয়ে যায়। তাদের কি ভুলতে পারি?
কত মধুরই না ছিল সে সন্ধেগুলো। তাল-তমালের ফাঁকে ফাঁকে প্রদীপ জ্বলত, শাঁখ বাজত, কর্মক্লান্ত দিনের শেষে সারা-গাঁ-জুড়ে নেমে আসত একটা নিবিড় প্রশান্তির ছায়া। দোকানি ফিরত হাট থেকে, মাঠ থেকে ফিরত রাখালেরা। সন্ধের আঁধারে তলিয়ে যেত সকল বিচ্ছিন্নতা। নীরব নিথর গ্রামখানি দাঁড়িয়ে থাকত পূজারিনির মতো, একক–একনিষ্ঠ।
যেদিন চাঁদ উঠত আকাশে, সেদিনের আর এক ছবি। ফুলকেয়ারির ফাঁকে ফাঁকে শুরু হত আলো-আঁধারের খেলা। জুই ফুলের গন্ধে বাতাস হত মদির, স্বপ্নময় হয়ে উঠত আমার গাঁখানি।
মেয়েমহলে সেদিন যেন মহোৎসব। সকাল সকাল সান্ধ্য আয়োজন শেষ করে দুর্গাখুড়োর পাকা উঠানে সবাই এসে ভিড় করত। প্রিয়দার বউ আসত কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে, মেরুর মা আসত হাতের চেটোয় ‘সাদা’ গুঁড়ো নিয়ে। এমনকী ফুলী আর সুধী বোন, যারা সূর্যসাক্ষী করে পরস্পরের মুখদর্শন পর্যন্ত বন্ধ করেছিল, তারাও এসে পাশাপাশি মুখ ফিরিয়ে বসে থাকত। হায় রে! সে-নিবিড়তা, সে-মাখামাখি চিরকালের মতোই কি শেষ হল?
মতি সাধুকে ভুলব না। কীর্তনীয়া মতি সাধু। সারাতল্লাটে বিদেশে তার নামডাক। অমন মধুর কণ্ঠ, অমন ভাবানুভূতির তুলনা খুঁজে পাইনে–আজও যেন মনে লেগে আছে। অমন প্রাণ দিয়ে গান গাওয়া আর কি শুনতে পাব?
গোপাল আখড়া, হরি আখড়া, বড় আখড়া। গাঁয়ের এক-একটি কেন্দ্র এ আখড়া গুলোতে কতদিন মতির গান শুনেছি। জলকেলি, মাথুর প্রভৃতি পালা! হাতে চামর নিয়ে হেলেদুলে গান করেছে মতি সাধু। গলায় ঝোলানো গাঁদা ফুলের মালা এদিক-ওদিক গড়িয়ে পড়েছে। মাথুর পালায় গান ধরেছে সে এই বলে,
সর্ব অঙ্গ খেয়ো রে কাক
না রাখিয়ো বাকি,
কৃষ্ণ দরশন লাগি
রেখো দুটি আঁখি।
দোহারিরা সুর ধরেছে, তাল রেখেছে। তন্ময় হয়ে মতি সাধু শুরু করেছে কথকতা: ওরে কাক, ওরে তমাল-ডালে বসে থাকা কাক! তুমি আমার সর্বাঙ্গ নষ্ট করো। কিন্তু যে কৃষ্ণের বিরহ-ব্যথায় আমি জ্বলে জ্বলে পুড়ে পুড়ে মরছি, সেই নিঠুর কৃষ্ণের দর্শন-অভিলাষী আমার এই আঁখিযুগল কেবল তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি। এ দুটো তুমি বাকি রেখো।
কথকতার পর আবার সুর ধরেছে মতি সাধু,
বাকি রাখিয়ো,
কৃষ্ণ দরশন লাগি
বাকি রাখিয়ো।
খোল বেজেছে। মাথা নেচেছে। তালে তালে পড়েছে করতালি। কিন্তু মনের অজান্তে। আঁখিপল্লব দুটি কখন যে একেবারে ভিজে উঠেছে–কেউ হয়তো টেরও পায়নি।
বাংলা লোকসংস্কৃতির এক বিশিষ্ট অবদান এই কীর্তনগান–শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পল্লির গৃহকোণে বেজে চলেছে এর সুর, এর আবেদন। বাংলার সাধারণ মানুষের উপলব্ধিতেও এ গান সাড়া জাগিয়েছে। কেবলমাত্র রাধাকৃষ্ণের কথা নয়, রামমঙ্গল, নিমাই সন্ন্যাস, এমনি আরও কত গানের মাধ্যমেই না পল্লির জনমানস রস সংগ্রহ করেছে। কত দিন, কত সন্ধ্যায় এরই আবেদনে কুসীদজীবী অধর ঘোষকেও কৈবর্তপাড়ার ভোলানাথের সঙ্গে কোলাকুলি, গলাগলি করতে দেখেছি। হিসেবি মানুষ অখিল সাহাও কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।
সে-গ্রাম আজ কত দূরে! পদ্মা-মেঘনা পেরিয়ে কোথায় সে ধলেশ্বরী! এত স্মৃতি, এত স্বপ্ন-রঙিন সে-মোহন পরিবেশ থেকে আজ আমি নির্বাসিত। দেশবিভাগের পাপে আমার মতো ছিন্নমূল আরও অনেকে দিগবিদিকে ছড়িয়ে গেছে। ভেঙেছে সমাজ, ভেঙেছে ঘর সংসার। শান্ত সুনিবিড় আমার সে-গাঁখানি আজ বুঝি নির্বাক হয়ে গেছে। পুঁটি পিসিরা কোথায়? অমন অনাবিল স্নেহের উৎসটি আজ কত দূরে! কাজ না-থাকা অলস দুপুরবেলা আজ তো আর কেউ তেমন দরদ দিয়ে ডাকে না, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আজ তো আর কেউ কাছে এসে বসে না। আজ আমি যেন আকাশ থেকে ছিটকেপড়া তারা–স্মৃতির জ্বালায় তিল তিল করে পুড়ে মরছি।
নিশ্চয়ই আমাদের তুলসীতলাটি আজ একেবারে নির্জন। আজ আর সেখানে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে না, কাঁসর-ঘণ্টা বাজে না, সদিবোনের রাধাকৃষ্ণের গানে সান্ধ্য হাওয়াও আর তো সজল হয়ে ওঠে না! পূর্ববাংলার নিভৃতে থাকা আমার সে-গাঁখানি রাতের আঁধারে আজ বুঝি কেবল থমথম-ই করতে থাকে!
ধলেশ্বরী তেমন করেই বয়ে যায় কি? কাশফুলগুলো আজও কি তেমন করেই ফোটে? জ্যোৎস্নাস্নাত বালুচরে রাখালিয়া বাঁশি আজও কি তেমন করেই বেজে ওঠে? গভীর রাতে ঘুম ভেঙে এমনি কত প্রশ্নই না মনে জাগে! চোখের সামনে ভিড় করে আসে ছবির পর ছবি। ব্রহ্মচারীর মাঠ, রজনি সা’র মশান–আরও কত কিছুর কথাই না মনে পড়ে যায়! স্মৃতির জ্বালায় আঁখিপল্লব দুটি বারে বারে ভিজে ওঠে। মনে হয় সে যেন হারিয়ে গেছে। যে ছিল প্রিয়, যে ছিল শ্রেয়, সে যেন আর আমার নয়। আমার স্বপ্নে-থাকা মাটির মাকে মা বলে ডাকবার অধিকারও যেন আজ আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তার আহ্বানের তো শেষ নেই! আজও যেন সে আমায় ঠিক আগের মতোই ডাকে। স্বপ্ন-শিয়রে ধলেশ্বরী আজও যেন আছড়ে পড়ে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলে বার বার–আয়, আয়, ওরে আয়!
.
ধামরাই
আবর্তিত হয়ে চলেছে মহাকালের রথচক্র। সেই রথচক্রের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রথিত হয়ে আছে মানুষের জীবন। এমনি এক মহাকালের ত্রিকালবিধৃত বিগ্রহরূপের সঙ্গে শৈশবেই পরিচিত হয়েছিলাম আমাদের গ্রামে। ধামরাই-এর মাধব ঠাকুরের রথের সেই ঘূর্ণমান চক্র দেখে মহাকালের চিরপ্রবহমান গতিস্রোতের যে বিশাল ব্যাপ্তি উপলব্ধি করেছিলাম ছোটোবেলায়, সে-স্মৃতি আজও অবিস্মরণীয়। প্রথম দৃষ্টি মেলেই যে গ্রামের মাটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে শৈশব ও যৌবনের দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলাম, এক অভাবনীয় ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সে-জন্মভূমি গ্রাম-জননীর মাটি থেকে ছিন্ন হয়ে দূরান্তরের এই জনারণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললেও সেদিনের স্মৃতি আজও আমার লক্ষ্যহীন যাযাবর জীবনের ধূলিধূসর মুহূর্তগুলোকে আশার আলোকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। সে-গ্রাম যে আমার জননী।
বংশাই নদীর এক তীরে ধু-ধু করছে প্রান্তর–যতদূর দৃষ্টি যায়, শ্যামল সবুজ। ধান্যশীর্ষগুলো দু-হাত বাড়িয়ে আকাশের দিকে কীসের প্রত্যাশী যেন–মধ্যাহ্ন-সন্ধ্যায় বাতাসে দুলে দুলে শোঁ শোঁ শব্দে কেন যেন বাঁশি বাজায় ওরা। এপারে মল্লিকঘাটের সামনে ঠক-ঠক হাতুড়ি পেটানোর শব্দ-বড়ো বড়ো মালবাহী নৌকো তৈরি চলছে সেখানে। ঘাট থেকে একটি রাস্তা এঁকে-বেঁকে কিছুদূর গিয়ে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে–একটি গিয়ে মিশেছে বাজারে যাওয়ার সড়কে, আর একটি চলে গেছে তাঁতিপাড়ার দিকে। দ্বিতীয় পথটি ধরে কিছুদূর গেলেই পাঁচিল-ঘেরা বাগান, পেছন দিকে মস্তবড়ো পাকা দোতলা বাড়ি। এ রাস্তার ওপরেই বাড়ির খিড়কি-দোর। সদর দোর বড়ো সড়ক থেকে পুবদিকে বেরিয়ে-আসা একটা গলির ওপর। তামাম দুনিয়ায় এইটেই ছিল আমার মাথা গোঁজবার ঠাঁই। জীবনের এতটা বয়েস এখানেই কেটেছে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে। কোনোদিন দু-মুঠো অন্নের জন্যে কপালে চিন্তার রেখা ঘনিয়ে ওঠেনি। অতিথি এসেছে, কখনো সেবার ত্রুটি হয়নি। আজ আমরাই অতিথি হয়ে পরের অনুগ্রহপ্রার্থী। অদৃষ্টের এ নির্মম পরিহাস!
আমাদের গ্রামটি ছিল প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাষি, জেলে, গোয়ালা, কামার, কুমার, ছুতোর, তাঁতি, ডাক্তার, কবরেজ প্রভৃতি নানারকমের লোকের বসবাস ছিল সেখানে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো সামগ্রীর অভাব সেখানে হত না। প্রত্যহ বসত বাজার। সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার হাট। অত বড়ো হাট এদিকটায় ছিল বিরল। নদীপথে ও উন্নত ধরনের গ্রাম্যপথে দূরদূরান্তের পল্লিগুলোর সঙ্গে সংযোগ ছিল তার, তাই ধামরাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল এ অঞ্চলের একটি বড়ো ব্যবসাকেন্দ্র। শিল্পের মধ্যে তাঁত ও কাঁসার জিনিসপত্রই ছিল প্রধান। শিল্পে-ব্যাবসায়ে সমৃদ্ধ এমন গ্রাম এ অঞ্চলে খুব কমই দেখা যেত।
১৯৪৬ সালে বাংলার বুকে যখন সহসা সাম্প্রদায়িক দাবানল জ্বলে উঠল, রাজধানী থেকে সুদূর শান্তিময় পল্লিতেও যখন তার লেলিহান শিখা বিস্তৃত হল এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র বাংলার বক্ষ দীর্ণ খন্ডিত হয়ে গেল-ধামরাই শ্মশানে রূপান্তরিত হতে চলেছে তখন থেকেই। গ্রামের শেষে কয়েকখানি ঘর মুসলমানদের। তাদের সকলেই প্রায় কৃষক। প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে মিলেমিশে চাষ-আবাদ করে এবং হিন্দু জমিদার-মহাজনের সাহায্য নিয়ে বেশ শান্তিতেই কাটছিল তাদের দিন। তাই বাইরের উসকানি তাদের খুব একটা উৎসাহিত করতে পারেনি। তবু দুর্গের মতো এই হিন্দুপ্রধান গ্রামের আকাশেও দেখা দিল অন্ধকারের অনিশ্চিত আশঙ্কা। পথ চলার সময় আপন ছায়াও সচকিত করে তুলতে লাগল আমার গাঁয়ের মানুষকে।
ত্রস্ত জীবন ও লাঞ্ছনা-গ্লানির অন্ধকূপ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়ে সংসার পাতবার সুযোগ ও সংস্থান যাদের ছিল কিংবা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন ভাগ্য রচনা করার দুর্জয় দুঃসাহসিক মনোবল যাদের ছিল–তারা যতটা সম্ভব বিষয় আশয় বেচে দিয়ে বহুপুরুষের বুকের রক্তেগড়া আবাসভূমিকে প্রণাম করে অশ্রুজলে বিদায় নিল। আপন কর্মশক্তি দ্বারা নতুন কর্মক্ষেত্রে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় শ্রমজীবীদের আছে তারাই গেল সর্বপ্রথম। ধনিক ব্যাবসায়ীরাও ব্যাবসা গুটিয়ে স্থানান্তরে যাওয়ার জন্যে উদ্যোগী হলেন। বিত্তবান জমিদারেরা সরিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের অস্থাবর সম্পদ। ডাক্তারেরাও চলে গেলেন, শহরের ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি না করে গ্রামের দিকে গেলে কোনোরকমে চলে যাবে, এই ধারণা। পড়ে রইল কৃষক-জেলে ও হতভাগ্য মধ্যবিত্তরা! কৃষক-জেলে জানে, গতর খাটালে কোথাও ভাতের অভাব হয় না। তবু শেষপর্যন্ত দেখে যাবে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা কোথায় যাবে?–কোন ভরসায়? যাদের বাগানের শাকসবজি, পুকুরের মাছ আর কিছু ধানি-জমির ধান ও তার আয়ের ওপর দিন চলে– তাদের কী উপায়? ডিঙি নিয়ে নদীতে বা পুকুরে জাল ফেলতে তারা জানে না, গোরু নিয়ে মাঠে লাঙল ঠেলতে পারে না, মাথায় মোট বয়ে উপার্জনও কল্পনার অতীত। যদি সকল সম্পত্তি উচিত মূল্যে বেচা এবং পশ্চিমবাংলায় উচিত মূল্যে অনুরূপ সম্পত্তি কেনা সম্ভব হত, তবেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু উচিত মূল্যে বেচাও হবে না, কেনাও হবে না। কেনা-বেচার কালোবাজারের দাঁড়িপাল্লার দৌরাত্মে সকল সম্পত্তি উজাড় হয়ে যাবে। মধ্যবিত্ত ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীদের অবস্থা তেমনি। সবচেয়ে মর্মান্তিক অবস্থা শিক্ষক ও বেসরকারি চাকুরেদের। নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় এসে পশ্চিমবাংলার দ্বারে দ্বারে আশ্রয় ও জীবিকার সকরুণ আবেদন জানিয়ে মাথা কুটে মরবে তারা। হতভাগ্যদের নাম পুনর্বসতির দফতরে ও এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের পর্বতপ্রমাণ ফাইলের তলায় চাপা পড়ে পড়ে কখন জঞ্জালের ঝুড়িতে স্থান পাবে। এদের ভরসা সরকারের অনুগ্রহ। কিন্তু অদৃষ্টের দোষে প্রায় সবার অবস্থাই যে আমারই মতো দাঁড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ কাউকেই যে আর বিশ্বাস করা যায় না এ সংসারে, কারও কথার ওপরেই যে নির্ভর করা চলে না!
আমার কথাই বলি! পরকে বিশ্বাস করে নিজেকেই যে বিপন্ন করেছি বারে বারে। যারা না জানে এপারে এসে তারাও তো সেই বিপদের পথেই পা বাড়াবে। বাইরের সহানুভূতি দেখে মানুষের অন্তর চেনা যায় না। এ অভিজ্ঞতা অনেক বাস্তুহারা পরিবারেরই হয়েছে কলকাতার শেয়ালদা স্টেশনে, পশ্চিম বাংলার নানা শরণার্থী শিবিরে। এমনি এক শিবির দেখতে এসে মনে পড়ে সেই কবে ধামরাইয়ে আমাদেরই এক প্রতিবেশীর দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায় বসে এক বাউল গেয়েছিল তার একতারা বাজিয়ে,
মনের মানুষ না পেলে সেই মনের কথা কইব না;
মনের মানুষ পাবার আশে
ভ্রমণ করি দেশ বিদেশে
মানুষ মিলে শত শত মন তো মিলে না–
প্রাণ সজনি গো!
সংসারী মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে সংসার-বিবাগি বাউল আরও গেয়েছে,
শিমুল ফুলের রং দেখে ভাই রঙ্গে মেত না;
ও ভাই দেখলে চেয়ে মনের চোখে,
অহরহ পড়বে চোখে
চোরের নায়ে সাউধের নিশানা–
প্রাণ সজনি গো!
কিন্তু কলকাতায় নবাগত আমার গাঁয়ের সর্বহারা সরল-মন মানুষদের কি সে ক্ষমতা সে মনের অবস্থা আছে শিমুল-শিউলি বেছে নেওয়ার! কাজেই পুববাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এ স্বাধীনতার স্বাভাবিক দান–-প্রতারণা থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনো উপায়ই যে দেখছি না আমি।
কলকাতায় এসেছি আত্মরক্ষার পথের সন্ধানে। এই জনকোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে, আমাদের ধামরাইয়েও তো দূরদূরান্ত থেকে সহস্র সহস্র তীর্থযাত্রী আসত মাধব-দর্শনে। মেলা বসত। মাধবঠাকুরের ঘাট থেকে যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত অসংখ্য বিপণি। কতরকম খেলনা, হাঁড়ি-পাতিল, ধামা-কুলো, বাক্স-ট্রাঙ্ক, বাসনপত্র, ছবি-ফোটো, মাটির ঠাকুর প্রভৃতির বিরাট সমাবেশ। কতরকম খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্ট। ম্যাজিক শো, সার্কাস। যাত্রীদের ভিড়ে গ্রামে তিলধারণের স্থান থাকত না। ঠাকুরমন্ডপে, দালানে, প্রতিটি গৃহের বারান্দায়, গাছের তলায়–সর্বত্র যাত্রীদল। সঙ্গে মেলার সওদা। মুড়ি, মুড়কি, ঢেপের খই, বিনি খই, চিনির মট, তিলা-কদমি, তেলেভাজা, দই-জিলিপি দিয়ে তাদের চলছে ফলার ভোজন। তা ছাড়া নুনবিহীন খিচুড়ি প্রসাদ কেনারও ধুম পড়ে যেত বিকেল বেলা। অসংখ্য বিপণির অপূর্ব শোভায়, আলোকসজ্জায়, ম্যাজিক-সার্কাসের ড্রাম-পেটানোর আওয়াজে, যাত্রীদের কোলাহলে, শিশুদের ভেঁপুর শব্দে সমস্ত গ্রামখানা উৎসবমুখর–সর্বত্র উৎসাহ-উদ্দীপনা, মুক্ত প্রাণের আনন্দ-উচ্ছ্বাস। কিন্তু কলকাতার এই হট্টগোলে আনন্দের পরিচয় কতটুকু?
ধামরাইয়ের মাধবঠাকুরের রথ সুবিখ্যাত। অত বড়ো রথ বোধ করি বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। পাঁচতলা উঁচু। বত্রিশটি লোহার বেড়-দেওয়া চাকা। ওপরে ওঠবার চওড়া সিঁড়ি। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি রথটি। পৌরাণিক চিত্র খোদাই ও সুন্দর ভাস্কর্যশিল্পে অনন্য। রথটি রাখা হত গ্রামের মাঝখানে সুবিস্তৃত সড়কের ওপর। গ্রামের বাইরে থেকেও দেখা যেত তার চূড়া। দূর থেকে মনে হত যেন একটি মন্দির। নবাগতদের কাছে ছিল এক বিস্ময়। লক্ষাধিক লোকের সমাগম হত রথ-টানা উপলক্ষে। মেলাও বসত তিন সপ্তাহ ধরে। অপূর্ব দ্রব্যসম্ভার, অতুলনীয় ছিল তার আয়োজন। রথ চলত বিশ হাজার বলিষ্ঠ হাতের যুক্ত টানে। সে-দৃশ্য সত্যই দর্শনীয়। কিন্তু আজ?
দেশবিভাগের পর পাক-নাথের রক্তচক্ষুর দাপটে জগন্নাথের রথ আর এক পা-ও অগ্রসর হয়নি। মেলা-উৎসব শরিয়তি শাসনের ভয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে আত্মগোপন করেছে। যাত্রীদল সারাগ্রামে ভিড় জমিয়ে তুলে তাদের নিদ্রার ব্যাঘাত করতে আর সাহসী হয়নি।
তীর্থক্ষেত্ৰ ধামরাই। সুপ্রাচীনকালে সংস্কৃত নাম ছিল ‘ধর্মরাজিকা। তারপর পালি নাম ধম্মরাই থেকে আমরা পেয়েছিলাম আমাদের আধুনিক গ্রাম ধামরাইকে। বাস্তবিকই ধর্মপাগল ছিল আমার গাঁয়ের লোকগুলো। কিন্তু এত ধর্ম-সাধনার এ কী সিদ্ধি?–ধামরাইয়ের মানুষ হল ধামছাড়া! রথ, মাঘী পূর্ণিমা, উত্থান একাদশী ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষ্যে চিরকাল সেখানে তীর্থের উল্লাস মূর্ত হয়ে উঠত। আর এখন? এখনও সেসব উৎসবের দিন ঘুরে ঘুরে প্রতিবছরই আসে, কিন্তু তারা যেন একে একে এসে স্তব্ধ রাত্রির অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে অতিসন্তর্পণে পালিয়ে যায়।
অতীতের স্মৃতি-তরঙ্গ ভেসে চলেছে দূরে, আরও দূরে, মহাকালের মহাসমুদ্রে। এপারে পুনর্বাসনের প্রার্থনা নিয়ে আমরা যারা ঘুরে বেড়াই এক-একটা পর্বদিন তাদের হৃদয়দোরে নিয়ে আসে অতীত স্বপ্নের দুঃসহ আঘাত। কিন্তু ধ্বনির যেমন প্রতিধ্বনি আছে, আঘাতেরও তো তেমনি আছে প্রত্যাঘাত। এপারে যে প্রতিনিয়ত আঘাত আসছে আমাদের বুকে, তার প্রত্যাঘাত কবে পৌঁছোবে ওপারে?
সাত সাতটি পুরোনো দেবালয়ের আশিসপূত ধামরাই। সর্বক্ষণ সরগরম থাকত সারাগ্রাম। সকাল-সন্ধ্যায় দেবালয়ে দেবালয়ে শঙ্খ-ঘণ্টার আরতি-বাজনায় ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত সমগ্র পল্লি। পূর্ববাংলার শান্ত পল্লি-সন্ধ্যা আজ কি কাঁসর-ঘণ্টার বাজনায় তেমনি চঞ্চল হয়ে ওঠবার সুযোগ পায়? সেদিনও শুনেছি, আমার গাঁয়ের দেবালয়ে এখনও নাকি পূজারতি চলে, কিন্তু নীরবে! বাজনা নিষিদ্ধ না হলেও ভয়ের কারণ, তাই বাজনা বন্ধ। প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকে, ঝিল্লিরব ওঠে–কিন্তু কীর্তনগান আর শোনা যায় না। অথচ এই কীর্তনগান ছিল মাধব-ক্ষেত্র ধামরাই গ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শ্রীমাধবের কৃপার ওপর ভরসা করে আজও যেসব কীর্তনীয়া পড়ে আছে গ্রাম-মায়ের মাটির বুকে তাদের কণ্ঠ আজ রুদ্ধ। সমস্ত ভয়ভীতি ও নিযেধাজ্ঞার বাঁধ ভেঙে কবে সেই রুদ্ধকণ্ঠ আবার নামকীর্তনে মেতে উঠবে কে জানে?
এখনও বংশাই নদীর তীরে প্রতিদিন প্রভাত আসে, সন্ধ্যা নামে। কিন্তু সে-প্রভাত, সে সন্ধ্যার স্নেহ-পরশ তো আর আমার অনুভব করার অবকাশ নেই। বংশাইয়ের বুকে নৌকো পাড়ি দিয়ে মাটির মাকে ছেড়ে এসেছি, বিদায় দিয়ে এসেছি তাঁকে চোখের জলে–আসতে বাধ্য হয়েছি। আমার মতো আরও অসংখ্য মানুষ শরণার্থীর বেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে এই সীমান্তে। তারা জানে না কী তাদের পাপ, কী তাদের অপরাধ। তারাও তো ভালোবাসত তাদের দেশকে, দেশের মাটিকে আর সবারই মতো। দেশ-জননী কেন তাদের তার কোল থেকে ঠেলে ফেলে দিল? আবার কি মা ডেকে নেবে তার এসব নিরপরাধ সন্তানদের?
বাল্য ও কৈশোর-জীবনের কথা মনে আসে অহরহ আর অন্তরখানি ডুকরে কেঁদে ওঠে। ভোজনবিলাসী বাঙালদেশি মানুষ আমরা। খেতে-খাওয়াতে সমান আনন্দ পেত যারা, তারা আজ দু-মুঠো ভাতের জন্যে ঘুরে বেড়ায় দৈন্যের বিষণ্ণতা নিয়ে। অথচ খাওয়া বাঁচিয়ে বাঁচবার কথা পুর্ববাংলার মানুষ কোনোদিন ভাবতে পারেনি। কবিগুরু আমাদের লক্ষ করেই হয়তো রহস্য করে লিখেছিলেন,
খাওয়া বাঁচায়ে বাঙালিদের বাঁচিতে হলে ঝোঁক
এদেশে তবে ধরিত না তো লোক!
অপরিপাকে মরণ ভয়
গৌরজনে করিছে জয়
তাদের লাগি কোরো না কেহ শোক।
কিন্তু রাজনীতির পাপচক্রে আমাদের না খাইয়ে মারার যে ব্যবস্থা হয়েছে তার জন্যে শোক বা দুঃখ করার লোকও তো আজ বড়ো একটা দেখতে পাই না স্বাধীন দেশ এ ভারতবর্ষে!
আঁচলে ঘেরি কোমর বাঁধে,
ঘণ্ট আর হেঁচকি রাঁধো–
পূর্ববাংলার বাস্তুহারা মা-বোনদের শিবির-জীবনে এ দৃশ্য কি সম্ভব?
মনে পড়ে ছোটোবেলার আরও অনেক কথা। একবার পাঠশালা পালিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম বড়দার হাতে। দুষ্টু ছেলের সঙ্গে মিশতে দেখে তিনি যে আমায় শুধু গালমন্দই করেছিলেন তা নয়, কয়েক ঘা চাবুকও পড়েছিল আমার পিঠে। বুড়ো চাষি কদম আলি পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, বাজার ফিরতি তার নিঃশেষিত সবজির ঝাঁকা মাথায় নিয়ে। বড়দার হাতে আমার লাঞ্ছনা দেখে ব্যথায় যেন ভেঙে পড়ল কদম আলি। মাথার ঝাঁকাটি নামিয়ে রেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল বড়দার দু-হাত আর বলল মিনতি করে—’আর মাইরেন না দাদাবাবু, ছাইড়া দেন। আহা, হা! বেতের মাইরে খোকাবাবুর পিঠ ফাটাইয়া দিছেন এক্কেবারে! আর না, দোহাই আপনের, এইবারের মতন ছাইড়া দেন।’ কদম আলির সকরুণ আবেদনে বড়দা সেদিন সাড়া না দিয়ে পারেননি। সেবারের মতো সত্যি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন আমায়। তবে বড়দার কঠোর শাসনের চেয়ে কদম আলির স্নেহস্পৰ্শই কিন্তু চিরকালের জন্যে গভীর দাগ কেটেছে আমার মনের মণিকোঠায়। সেই কদম আলিরা গেল কোথায়? গাঁয়ের মাটিকে প্রণাম করে আমরা যখন চলে এলাম, কই, কোনো মুসলমান ভাই তো সজল চোখে এগিয়ে এল না ‘যেতে নাহি দিব’ বলে! অসীম দুঃখে কদম আলির আত্মা হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠছে– ফেলছে দীর্ঘনিশ্বাস আকাশ থেকে। কিন্তু সে দীর্ঘনিশ্বাসের তীব্র তরঙ্গস্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কি মানুষের সমস্ত অশুভবুদ্ধি সোনার বাংলার বুক থেকে?
বেদে-বেদেনিরা প্রায়ই আসত আমাদের গাঁয়ে সাপের খেলা দেখাতে। বেহুলা-লখিন্দরের পৌরাণিক কাহিনি সুরে সুরে ছড়িয়ে দিয়ে তারা ঘুরে বেড়াত সাপখেলা দেখিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধ হিংস্র সাপের সঙ্গে মানুষের মিত্ৰতা–তার সঙ্গে রহস্য ও রঙ্গরস সেসময় লক্ষ করেছি স্তব্ধ বিস্ময়ে। কিন্তু তখন তো বুঝতে পারিনি যে, মানুষ যদি কখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষপানে সাপের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে তার প্রতিবেশীকে আঘাত হানতে, তার জীবন-মান বিপন্ন করে তুলতে, তাহলে কোনো মন্ত্রেই আর তাকে বশীভূত করা সম্ভব হয় না।
শ্রীমাধবের ধাম ধামরাই মগ্ন আজ রাত্রির তপস্যায়। বংশাইয়ের কালো জলে আরও যেন কালি ঢেলে দিয়েছে রাত্রির অন্ধকার। যতদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকার। কে জানে, কোথায় তার শেষ? এ প্রশ্ন আজ লক্ষ লোকের মনে। কিন্তু কে দেবে তার উত্তর?
.
খেরুপাড়া
ভারতবর্ষের বিশাল ভূমিখন্ডে বিদেশি বণিক-শাসনের অন্তিম লগ্নে মর্মান্তিক অভিনয় হল– ব্যবচ্ছেদের ছুরির ইঙ্গিতে ওরা হত্যার খঙ্গকে আহ্বান জানিয়ে খুশিমনে সরে পড়ল। মানুষের হৃদয়হীন দুর্বুদ্ধি সাপের ফণার চেয়েও সাংঘাতিক, তারই একটি দংশনে সমগ্র দেশ বিষ-জর্জর!
পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলির তীরে তীরে সেই খঙ্গেরই বিদ্যুৎ-ঝিলিক দেখতে পাচ্ছি। মাটি রক্তে লাল, আকাশ লাল অন্তরের আক্রোশে, বাতাস-ভেজা চোখের জলের বাষ্পে–আর এই জল ঝরেছে অসহায় শিশু, বিপন্ন নারী, হাত-পা বাঁধা অক্ষম পুরুষের চোখ থেকে। ভাইয়ের মতো একান্ত আপন, একান্ত বিশ্বাসী যে, অন্ধকারে সে শ্বাপদের মতো লুকিয়ে এসে জ্বালিয়ে দিল ওর ঘর–ওর মাঠের ধান, গোয়ালের গোরু, ঘরের ঐশ্বর্য দস্যুর মতো লুঠ করে নিয়ে গেল চোখের সমুখ দিয়ে।
পূর্ববাংলার গ্রাম, গঞ্জ, জনপদ আজ নির্বাক, নিষ্প্রাণ। কল্পান্তের বিভীষিকায় চেতনা লুপ্ত তার। বারোমাসে তেরো পার্বণ যে দেশে, সেখানে সন্ধ্যার অন্ধকারকে চিহ্নিত করে আজ একটিও শঙ্খধ্বনি ওঠে না, বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মী-সন্ধ্যায় গৃহবধূর আড়ষ্ট কণ্ঠ চিরে ফোটে না উলুধ্বনি। বোষ্টমের আখড়ার একতারা স্তব্ধ, গোপী-যন্ত্রের ছেঁড়া তারে হয়তো মরচে ধরেছে, হরিসভার ভক্তদের খোলের চামড়া কেটে দুরে আর আরশোলা তারমধ্যে এতদিনে সংসার ফেঁদে তুলেছে বুঝি বা!
লক্ষ-গ্রামশোভিত বাংলার এক গ্রামে, তার ধুলো-মাটির আদর-ভরা কোলে বিধি-নির্ধারিত একটি দিনে আমি প্রথম চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম। দেশের ইতিহাসে সে-গ্রাম গর্বে-গৌরবে উজ্জ্বল নয়, কিন্তু আমার কাছে চিরস্মরণীয়, চিরবরণীয়–সে যে আমার মা, স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী। সেই মা আজ লাঞ্ছনায় অহল্যাজননীর মতো পাষাণ হয়ে আছে। আমরা পলাতক, তবু জন্মান্তরের প্রতীক্ষায় দিন গণনা চলে তার। পরিত্রাতার আবির্ভাব কি হবে না, তার রাত্রির তপস্যা কি সূর্যালোকের আশীর্বাদে ধন্য হবে না কোনোদিন?
কত গল্প, কাহিনি, স্মৃতি, উপকথায় জড়ানো আমার সেই মাটির মা–তার বুকজুড়ে আজ নির্জন শ্মশানের স্তব্ধতা! ভাবতেও চোখের কোণ জ্বালা করে জল ছুটে আসে। ঘরের কোলে সেই যে একফালি উঠোন, গণিতের মাপে বিশ-পঁচিশ গজের বেশি প্রশস্ত হবে না হয়তো অথচ সাতসমুদ্র তেরো নদীর চেয়েও তা দুস্তর দুরতিক্রম্য মনে হত, পার হতে গেলে পা ওঠে না–প্রাণ আর মানের দায়ে তাও শেষপর্যন্ত ছেড়ে এলাম, চোখের জলে তার শেষ ছবি এঁকে নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে, শাণিত বিদেশি ছুরির দাগের রক্তাক্ত সীমান্তরেখার ওপারে, যে বাড়ি যে ঘর পড়ে রইল, এখানে অদৃষ্টে নগর-লক্ষ্মীর অকুণ্ঠ দাক্ষিণ্য লাভ যদি ঘটেও, তবু কি আমার মন থেকে মুছে যাবে তার স্মৃতি? লাটসাহেবের বাড়ির নেমন্তন্ন কিংবা মোটা মাইনের সরকারি চাকরির গৌরবে কি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব আমার জননী জন্মভূমিকে? যত দূরেই থাকি, মাইল-ক্রোশের হিসেব-কষা ব্যবধান যতই দীর্ঘ হোক-না কেন, সারাদিনের ব্যস্ততার পর অনেক রাত্রে আলো-নেবানো ঘরের অন্ধকারে বিছানায় যখন আমি একা, তখন সেই দূরান্তে ফেলে-আসা তাল, তমাল, হিজল, জিউল, নারকেল, খেজুর গাছের ছায়ায় ঘোমটা-টানা সেই স্নেহময়ীর জলভরা বিষণ্ণ দৃষ্টির ছায়া মনের ওপর এসে পড়ে। মধ্যরাত্রের মন্থর বাতাসে জড়িয়ে জড়িয়ে ভেসে আসে তার কান্না-করুণ কান্নার সুরে সে যেন আমায় ডাকতে থাকে, টানতে থাকে। চোখের পাতা থেকে কখন ঘুম ঝরে যায়। শিয়রের কাছের খোলা জানলা-পথে বিনিদ্র চোখে উত্তর আকাশে তাকাতে নজর পড়ে, সপ্তর্ষির দৃষ্টির আগুনে কী একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন রাত্রির অন্ধকারকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে। ও যেন আমার মনেরই প্রশ্ন, ঘোর অন্ধকারে আকাশের পটে গৃহপুঞ্জের জ্যোতিতে লেখা।
কলকাতার নগর-বেষ্টনী ছাড়িয়ে প্রায় দু-শো মাইল দূর। শেয়ালদা থেকে আট-দশ ঘণ্টার ট্রেনযাত্রার পর, গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে পদ্মা পার হয়ে ছোট্ট একটা স্টেশন-কাঞ্চনপুর। শালকাঠের তিনখানা তক্তা-ফেলা সিঁড়ি বেয়ে স্টিমার থেকে নেমে বালুর চরে পা দিতেই কী এক আশ্চর্য আনন্দে মনটা কলরব করে উঠত। দেশের আকাশ-আলো-মাটির স্নেহ সমস্ত শরীরে অনুভব করতাম। শিক্ষিত-নিরক্ষর, ভদ্র-অভদ্র পল্লিবাসীর সহজ সৌজন্যসূচক প্রশ্ন আন্তরিকতায় মাখা। অদ্ভুত ছেলেমানুষি খুশিতে বার বার মনে হত, দেশে এলাম তবে, এবার কিছুদিনের জন্যে শহরের গিলটিকরা নকল জীবনের বাইরে অনাবৃত আরামের ছুটি!
গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে ইছামতী–আমার শৈশবের বিস্ময়, কৈশোরের খেলার সঙ্গী। এর পারে দাঁড়িয়ে দূরের আবছা ধু-ধু বাঁকটায় নজর করতে করতে আমার প্রথম বিপুল পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা, এর ওপর দিয়েই গেন্দু ভাইয়ের নৌকোয় চেপে প্রথম আমার কলকাতার উদ্দেশ্যে কাঞ্চনপুর স্টেশনে যাওয়া। ইছামতীর আঁকা-বাঁকা পথ। ছোটো ছোটো বাঁক। শীর্ণ শান্ত নদী, সংযত উচ্ছ্বাসহীন। বর্ষায় কূলে কূলে ভরে ওঠে জল, অথচ কূল ছাপিয়ে যায় না। জোয়ারের জলে তীব্র স্রোত–স্থানীয় লোকে বলে ‘ধার। কিন্তু পাড় ভেঙে ধারালো জিহ্বা বিস্তার করে সে ফসলের খেতের দিকে অগ্রসর হয়ে যায় না, আক্রমণ করে না নিঃস্ব চাষির জীর্ণ কুটির। সে যে এই গাঁয়েরই মেয়ে–মেয়ের মতোই সুখের চেয়ে দুঃখ বোঝে বেশি। গ্রীষ্মে জল শুকিয়ে খরখরে বালি বেরিয়ে পড়ে, কর্দমাক্ত ডাঙা জেগে ওঠে, এদিক-ওদিক। তার ওপরে পলিমাটির স্বাদে নিবিড় হয়ে গজিয়ে উঠে বনতুলসী, কালকাসুন্দি, শেয়ালকাঁটার ঝাড়-কচুরিপানার বেগুনি ফুলে চারদিক আলো হয়ে থাকে। পঙ্কিল জলের ওপর নৌকোর গলুই গলা উঁচু করে রাখে, তার চুড়োয় বসে কচ্ছপ-শিশু রোদে ঝিমোয়। জলের ধারে ধারে ঘোরে বক, বাবলা গাছের ডালে ধ্যানী মাছরাঙার নিঃশব্দ প্রহরগুলো কেটে যায়, পানকৌড়ি সেই পঙ্কিল জলেই অনবরত ডুব খেয়ে চলে।
লেখাপড়ার তাগিদে শহরে আসতে হয়েছিল। স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছি, স্বাভাবিক নিয়মে বয়স বেড়েছে। কিন্তু সেই যে অভ্যেস ছুটি হলেই পড়িমরি করে বাড়িতে ছোটা, তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রবাস-জীবনের দিনগুলোর যাত্রাপথ বরাবর আমার টেবিলের সামনের দেয়ালে টাঙানো ক্যালেণ্ডারের পাতায় চিহ্নিত হয়ে থাকত–প্রতিদিন রাত্রে পড়াশোনা শেষ করে শুতে যাওয়ার আগে সেদিনের তারিখটা আমি কেটে দিতাম। বিছানায় শুয়ে মনে হত, একটা দিন তো কমল, বাড়ি যাওয়ার সময়টা স্পষ্ট পদক্ষেপে চব্বিশ ঘণ্টা সরে এল কাছে। স্কুলে যখন উঁচু মানের ছাত্র, জনৈক সহপাঠী একদিন শ্লেষ করে বলেছিল, ‘ছুটি হলেই বাড়ি ছুটিস, শহর ছেড়ে ভালো লাগে তোর পাড়াগাঁয়ে? কী আছে সেখানে সেই তো বাঁশবন, মশা, ম্যালেরিয়া, ঘেঁটু ফুল আর কানা কুয়ো।
রাগে ব্ৰহ্মর জ্বলে গিয়েছিল, ক্ষোভে দুঃখে জল এসে পড়েছিল চোখে। সেদিন বোকার মতো চুপ করে চলে এসেছিলাম; এত বড়ো মূর্খ প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। পরে ভেবে দেখেছি, সব জিনিস সকলের বুদ্ধি দিয়ে মাপা চলে না। শান্ত ইছামতাঁকে যারা বোনের মতো ভালোবাসেনি, পুজোর দিনের ভোরবেলা শিউলি ফুলের গন্ধ জানলা দিয়ে ঢুকে যাদের ঘুম ভাঙায়নি, একবারও যারা জীবনে দেখেনি সূর্যোদয়ে সোনার এই পুরোনো পৃথিবী আমার গাঁয়ে বিয়ের কনের মতো কেমন সুন্দর মধুর হয়ে দেখা দেয়, তাদের কী করে বোঝাব কী আছে সেই গাঁয়ে। ওরা সিনেমায় গিয়ে দেখে এসেছে গ্রাম, জানে না–সে-গ্রাম, না গ্রামের প্রেতচ্ছবি। অন্য দশটা ফালতু ঘটনার মধ্যে দেখেছে, সিনেমা-স্টার অমুক দেবী গাঁয়ের বধূ সেজে সস্তা আর্ট দেখিয়ে কলসি কাঁখে জল আনছেন নদীর ঘাট থেকে। হলদে পাখির ডানায় রঙের মাধুর্য ওরা বুঝবে কী করে? শীতের দিনে নদীর চরের কাশবনে চড়ইভাতি করার আনন্দ অজ্ঞাত ওদের কাছে। ফির্পো কিংবা গ্র্যাণ্ড হোটেলের খানার ওপারে ওরা তো জানে না কিছু।
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গ্রীষ্মের রূপ অপরূপ। ঝরাপাতা মরাফুল উড়ে যায় দমকা বাতাসের মুখে–নবীনের আবির্ভাবের আভাস পেয়ে জীর্ণজরা খসে পড়ে যেন আসনশূন্য করে দেয় তাকে। মৌমাছিদের অবিশ্রান্ত গুনগুনানি শুনতে শুনতে আমের মুকুল বড়ো হতে থাকে। সড়কের ধারে ঢিলের মতো উঁচু জায়গায় দারা! অসংখ্য অনামি বন্য গাছ সেখানে। সাদা ফুলের ছড়া ঝুলে থাকে রাস্তার ওপর। কী মিষ্টি গন্ধ তার! অবহেলিত সেই বৈশিষ্ট্যহীন। গাছগুলোও বসন্তকালে এমআকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। প্রতিসন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফুটবল খেলা শেষ করে বাড়ি ফেরবার সময় নীচু ডালের ফুলগুলো আমরা পেড়ে নিয়ে আসতাম লাফিয়ে।
চৈত্রের আগুনে মাটি পুড়ে যেত, জ্বলন্ত আকাশ থেকে নিদারুণ গ্রীষ্ম ঝরে পড়ত মাথার ওপর। এদিক-ওদিক শোনা যেত তৃষ্ণার্ত চাতকের জলপ্রার্থনার করুণ সুর-ফটিক জল, ফটিক জল!
তারপর একদিন কালির দাগ লাগত আকাশের দূরতম কোণায়। তীক্ষ্ণ নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠত মহাশূন্যে, কড়কড় শব্দে বজের তরুণ কণ্ঠের হুংকার শোনা যেত। কিছুটা সময় বায়ুলেশহীন স্তব্ধতা। নীড়-প্রত্যাশী পাখিদের শঙ্কিত চিৎকার। চারিদিকে কীরকম একটা থমথমানি–তারপরই মনে হত কারা যেন হাজার হাজার ঘোড়া ছুটিয়ে পদ্মার চরের ধূসর বালিতে চতুর্দিক অন্ধকার করে এই গ্রামের দিকেই আসছে। দক্ষিণ দিকের আকাশ চিরে শোঁ শোঁ শব্দ বেরিয়ে আসত। ঘোড়ার খুরের বাজনা গাছপালার মাথার ওপর দিয়ে দ্রুততালে এগিয়ে আসতে থাকত-কাছে…কাছে…আরও কাছে। অবশেষে এসেই পড়ত তারা–প্রচন্ড ঝড়। আকাশে তখন রোদ থাকত না, অথচ অন্ধকারও নয়–মেঘের গা চুঁইয়ে কী এক অদ্ভুত পিঙ্গল আলো টর্চের ফোকাসের মতো লম্বা রেখায় নেমে আসত এদিক-ওদিক, ঝড়ের প্রহারে আকুল আর্তনাদে কেঁদে উঠত বাঁশবন, মড়মড় শব্দে পথঘাট আটক করে উপড়ে পড়ত গাছ, মত্ত বাতাসের মুখে হালকা তাসের মতো উড়ে যেত চালাঘর, তালগাছের পাতায় ঝলসে উঠত বিদ্যুতের আভা। জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, কেন জানি না, আমার শিশুমনে আশঙ্কা হত, রাস্তার ধারে ওই যে ফাঁকা জায়গায় নিঃসঙ্গ একলা দাঁড়িয়ে নারকেল গাছটা, ওটার মাথায় বজ্রপাত হবে। বড়োমার কাছে গল্প শুনেছি, পদ্মায় যে বছর ঝড়ে কালীগঞ্জের স্টিমার ডুবে গিয়েছিল, সেবার আমাদের পুকুরপাড়ের তেমাথা আমগাছে বাজ পড়ে গাছটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, আর সেই থেকেই ওর তিন মাথা।
ঝড়ের বেগ শান্ত হয়ে এলে আসত বৃষ্টি-স্নিগ্ধ বড়ো বড়ো ফোঁটায় নামত বছরের প্রথম বর্ষণ। বৃষ্টিধারায় স্নান করতে করতে আমাদের সেই করমচার গানের কোরাস চলত-কচু পাতায় করমচা, যা বৃষ্টি উড়ে যা। ধূলিলিপ্ত গাছপালার প্রসাধন হত সেই জলে। ভেজামাটি থেকে সোঁদা গন্ধ উঠত। চাতকের পিপাসা বুঝি ওতেও মিটত না, কারণ একটু পরেই আবার শোনা যেত-‘ফটিক জল, ফটিক জল’!
প্রতিবছর বৈশাখ মাসে বাংলাদেশের মাঠেমাঠে কে এক রক্তচক্ষু, পিঙ্গলজটা, রুদ্র সন্ন্যাসী বহ্নিমান চিতাপের সম্মুখে বসে শান্তিপাঠ করে যান। তাঁর গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠধ্বনি শুষ্ক দগ্ধ তৃণ-প্রান্তরের ওপর দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে যায়। তখন জনমানুষের সাড়া পাওয়া যায় না কোথাও, কেবল তন্দ্রাতুর কপোতের ক্লান্তস্বর কোথা থেকে ভেসে এসে যেন সেই গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে মিশে যায়। গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে শান্তিনিকেতনের শুষ্ক মাঠে এই শান্তিপাঠরত সন্ন্যাসীকে একজন দেখেছিলেন–সিদ্ধকবির দিব্যদৃষ্টি ছিল তাঁর। কিন্তু আমিও দেখেছি এঁকে, আমাদের বাড়ির সীমান্তবর্তী দিগন্ত-ছোঁয়া বিস্তীর্ণ বাল্লার মাঠে।
তখন আমার বয়স কত বলতে পারব না। তবে এটুকু বলা চলে, ‘পথের পাঁচালী’-র অপুর মতো তখন আমি, আমার নিজের জগতে একজন মস্ত বড়ো কবি, একজন আবিষ্কারক। কাজেই সেই শিশু আমি, যাকে সিদ্ধকবির সঙ্গে বিনাদ্বিধায় এক-আসনে বসানো চলে।…হ্যাঁ, সেই সন্ন্যাসীর অস্পষ্ট স্মৃতি আমার মনে আছে। দুপুর বেলা বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, মায়ের বুকের ওপর থেকে কাশীরাম দাসের মোটা মহাভারতখানা একপাশে কাত হয়ে নেমে এলে, পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। খেজুর গাছের তলায় দাঁড়িয়ে, সভয় দৃষ্টিতে মাঠের দিকে তাকিয়ে মনে হত, ওই দূরে মাঠের ঠিক মধ্যিখানে কীসের যেন ধোঁয়া–আবছা, অস্পষ্ট–শীতের দিনের কুয়াশার ধূসরতা। কী একটা উধ্বমুখী হয়ে কাঁপছে– ছোটো ছোটো ঢেউ–আগুনের শিখা বুঝি! রোদের মধ্যে মিশে গেছে তা, ভালো করে বোঝা যায় না। তার ও-পাশে বসে কে যেন একজন–ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মূর্তি, দেখা যায় না, চেনা যায় না, কিন্তু অনুমান করতে গিয়ে নিঃসংশয়ে মনে আসে, সে-এক উগ্রদর্শন সন্ন্যাসী, দু চোখে আগুন তাঁর, দয়া নেই, মায়া নেই, ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে যেন ওই চিতার আগুন একলাথি মেরে সমস্ত গ্রামের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে নিমেষে তিনি সব ধ্বংস করে ফেলতে পারেন… ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকতাম, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করত, শরীর শিউরে উঠত মাঝে মাঝে, কিন্তু এক পা নড়তে সাহস পেতাম না। মনে হত, নড়বার চেষ্টা করলেই তিনি টের পেয়ে যাবেন, আর একবার টের পেলে–!
একদিন অমনি দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে ঝড় উঠেছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, সন্ন্যাসী বুঝি খেপে গেছেন কোনো কারণে। বাতাসে শুকনো মাঠের রাঙা ধুলো উড়ছিল। আমি দেখছিলাম চিতার আগুন পা দিয়ে তিনি লন্ডভন্ড করে দিচ্ছেন। চিৎকার করে বারমুখো ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে বাঁশের কঞ্চির স্থূপের ওপর পড়ে গিয়েছিলাম জ্ঞান হারিয়ে। গলার বাঁ-পাশে অনেকখানি কেটে গিয়েছিল, ক্ষতচিহ্নটা এখনও আছে।
সেসব দিনের ভয়ের কথা মনে পড়লে চোখ সজল হয়ে আসে কেন? ঝাপসা দৃষ্টির সামনে বিস্তীর্ণ বাল্লার মাঠ জলভরা অথই বিলের মতো ছলছলিয়ে ওঠে। আমার ছোটোবেলায় রোজ সন্ধ্যায় আমার গাঁয়ের পোড়োমাঠে আলেয়া জ্বলেছে, ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা আগাগোড়া ভয়ের কাঁথা মুড়ি দিয়ে চিরকাল দাঁড়িয়ে থেকেছে, অমাবস্যার রাত্রে কেউ কেউ নাকি নাড়দের পতিত ভিটেয় মেয়েমানুষের হাসি শুনতে পেয়েছে–এসব ভয়-কাহিনি-স্মৃতির দেশে আর একবার যেতে ইচ্ছে করে; মনে হয়, আর একবার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হিজলগাছের মাথায় সন্ধের প্রথম তারাটা দেখি, ঝিঁঝির ডাক শুনি বেতের জঙ্গলে।
বর্ষার মেঘান্ধকার বিষণ্ণ দিন কেটে গেলে এসেছে শরৎ। কাস্পিয়ান সাগরের ঘন নীল জল দিয়ে কে যেন ধুয়ে দিত আকাশ। সকাল-বিকেলের রাঙা রোদ তার ওপরে সোনা ছড়াত। মাঠেমাঠে পাকা ধান, সোনালি রং, বৈকুণ্ঠ-লক্ষ্মীর অঙ্গ-আভা যেন। ফসল ভালো হলে মুসলমানরাও বলত, মা লক্ষ্মী এবার ভালো দেছেন গোয়
আমার গাঁয়ে বিলের জলকে ঢেকে রাখত পদ্ম আর শাপলা। খালের পারে, নদীর চরে উচ্ছ্বসিত কাশের বন–সাদা ফেনার সমুদ্র যেন। আশ্বিনের ছুটির বাঁশি বাজত জলে-স্থলে স্টিমারঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে একটির-পর-একটি নৌকো এসে ভিড়ত ইছামতীর পারে। গ্রামভরা লোকজন, ঘরে-ঘরে প্রবাস প্রত্যাগতের আনন্দ কলরব। বাংলাদেশের গ্রাম যে চিররূপময়ী কাব্যের নায়িকা নয় তা জানি। সবুজ মাঠ, সোনালি রোদ, পাখির ডাক, পূর্ণিমা রাত্রির জ্যোৎস্নার জলে ধোয়া আকাশের আড়ালে তার যে ঈর্ষা-নিন্দা-দলাদলি, ক্ষুধা-দারিদ্র অকালমৃত্যু পীড়িত বিকৃত বিকারগ্রস্ত রূপ রয়েছে, তাও মিথ্যে নয়। কিন্তু তবু এই পুজোর দিনে একান্ত নিঃস্বের দরজার সমুখেও আঁকা হয় আলপনা, উঠোনে দাঁড়ালে প্রাণখোলা হাসির সঙ্গে কেউ-না-কেউ এসে হাতে দিয়ে যায় দুটো নারকেল-নলেনগুড়ের মিষ্টি। বিজয়ার দিনে ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে বুকে জড়িয়ে সবাই সবাইকে করে আলিঙ্গন। প্রাত্যহিকতার অজস্র গ্লানি বিস্মৃত হয়ে, দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের কালো চিহ্নগুলো মন থেকে মুছে ফেলে, সমস্ত পৃথিবীকে
বিজয়ান্তে একবার হৃদয়ভরে গ্রহণ করা ছিল পূর্ববাংলার চিরাচরিত রীতি। আমার গাঁয়ের তেমনি পরিবেশ আর জীবনে কোনোদিন দেখতে পাব, তা যে কল্পনার অতীত।
আমাদের চন্ডীমন্ডপে প্রতিমা তৈরি হত। একমেটে, দো মেটে, মাজাঘষা–তারপরে রং। পুজোর কাছাকাছি তিনজন কুমোরের অনেক রাত অবধি লণ্ঠন জ্বেলে কাজ চলত। ঘুমের ঘোরে অবস্থা কাহিল হয়ে না পড়া পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের ভিড় কমত না। নানারকম বায়না নিয়ে তারা বসে থাকত।
যোগেন দা, এই যে দেখো, আমার পুরোনো পুতুলটায় একটু রং চড়িয়ে দেবে–তোমার ওই দুর্গার চুড়ার সোনালি রংটা?
আর এই যে আমার ঘোড়াটা যোগেনদা, ঠ্যাংটা ভেঙে গেছে, একটু জুড়ে দাও না ওই এঁটেল মাটি দিয়ে।
যোগেনের কোনোদিকে তাকাবার অবসর নেই, মুখে হু-হ্যাঁ চালিয়ে সে তুলি টানতে থাকত।
এই ছাওয়ালপান, কামের সময় প্যানপ্যান কইরো না।–উঠোনের ওধার থেকে ছেলেদের ধমক দিত ইয়াদ আলি। প্রতিমা-সজ্জা দেখার শখ ছেলেদের অপেক্ষা কিছুমাত্র কম নয় তার। মুসলমানপাড়ার দোর্দন্ড প্রতাপশালী সর্দার সে। পঞ্চাশের ওপরে বয়স। মাথায় কাঁচা-পাকা চুলের বাবরি। প্রচুর পান খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলো সে করেছে পাকা তরমুজের বিচির মতো কুচকুচে কালো। চাষাবাদ আর দস্যুবৃত্তি তার উপজীবিকা। মানুষ খুনের ঐতিহ্যবাহী বংশের অধস্তন পুরুষ সে। দু-চারটে লাশ সে নিজেও যে মাটির নীচে পুঁতে দেয়নি এমন নয়।
তুমি চ্যাংড়াদের কথায় কান দিয়ো না পালমশায়, মন লাগিয়ে চিত্তির করো,-ই সব ভগমানের কাম।–যোগেনকে পরামর্শ দিত ইয়াদ আলি। কিন্তু গ্রামে থাকতেই দেখে এসেছি, সে ইয়াদ পালটে গেছে। আনসার বাহিনীর নায়ক সে। হিন্দুর দেবতার নাম মুখেও আনে না, ইসলামের চমৎকার ব্যাখ্যা করে।
চলতি রাজনীতির সঙ্গে এ গ্রামের বরাবরই যোগ ছিল। পোড়োভিটের গভীর জঙ্গলে বেশি রাতে গোপনে মিটিং হত। তারপরেই শুনতে পাওয়া যেত, আট-দশ মাইল দূরে সাহাদের পাটের আড়তের ক্যাশ লুঠ হয়েছে। মহকুমা শহর মানিকগঞ্জ অনুশীলন পার্টির নেতা বিপ্লবী পুলিন দাসের অন্যতম কর্মকেন্দ্র, আর ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ভূতপূর্ব ম্যনেজিং ডিরেক্টর রজনী দাস ছিলেন মানিকগঞ্জ শাখার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এ গ্রামের কয়েকটি তরুণ সেখানে নিয়ত যাওয়া-আসা করতেন। সেই সূত্রে আমাদের বাড়ি পুলিশে সার্চ করেছে একাধিক বার; কাকাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। সে-সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যায়াম এবং লাঠিচালনা শিক্ষার সমিতি স্থাপিত হয়েছিল অনুশীলন পার্টির নেতৃত্বে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সারাবাংলার লাঠিয়ালদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ গ্রামের ছেলে সুধীর দত্ত অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়নের গৌরব অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘকাল পূর্বে তিনি মারা গেছেন। এ জন্যে আক্ষেপ করি না। সেকালের বিপ্লবীকে আজ শরণার্থীদের মধ্যে দেখতে হচ্ছে না–নিঃসন্দেহে এ সৌভাগ্য নয় কি? বিয়াল্লিশ সালের অগাস্ট মাসেও স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছিল এখানে। নিরুদবিগ্ন পল্লিজীবনের অনাবিল শান্তিতে লেগেছিল প্রচন্ড দোলা। গাঁয়ের কাঁচাসড়ক ধরে ভারী বুটের শব্দ করতে করতে আসতে দেখেছি সঙিনধারী পুলিশ।
গ্রামের লোকের, বিশেষত যুবকদের চেষ্টায় গড়ে উঠেছিল প্রকান্ড পাবলিক লাইব্রেরি, থিয়েটারের ‘এভার গ্রিন’ ক্লাব। ক্লাবের ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব ষ্টেজ। প্রতিবছর পুজোর সময় তিন রাত্রি অভিনয় বাঁধা ছিল, এবং অভিনেতারা প্রায় সকলেই ছিলেন ঢাকা কিংবা কলকাতার কলেজের ছাত্র। ক্লাব-লাইব্রেরি যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা জীবনের জটিলতা আর জীবিকার ধাঁধায় জড়িয়ে পড়লে এর নায়কতা এসেছিল আমাদের হাতে। ভবিষ্যতে একদিন হয়তো আমাদের কাছ থেকে কনিষ্ঠদের হাতে উত্তীর্ণ হয়ে যেত এই নেতৃত্ব। কিন্তু তার আগেই যে গ্রাম ভেঙেছে, কে কোথায় ভেসে গিয়েছে জোয়ারের মুখে কে জানে!
গ্রীষ্মকালে চারদিক যখন শুকনো খটখটে, ক্লাবের সভ্যদের উৎসাহে প্রতিবছরই একবার করে সে-সময়ে গ্রামের স্বাস্থ্যোদ্ধার করা হত। পুকুর থেকে, নদী থেকে কচুরিপানা টেনে তুলে শুকিয়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতাম আমরা। সমবেত আক্রমণের মুখে অবাঞ্ছিত ঝোঁপজঙ্গল নিঃশেষ হয়ে যেত। দুর্গম রাস্তা সংস্কারের উদ্দেশ্যে চুপড়ি-কোদাল নিয়ে অভিযান চলত–মাটির বোঝা বইতে গিয়ে টনটন করত আমাদের মাথার চাঁদি।
দু-বছর আগে এক অপরাহ্নে ইছামতী পাড়ি দিয়ে আমার জন্মভূমি খেরুপাড়া ছেড়ে চলে এসেছি। নিজের বাড়ি বিদেশ হয়েছে, ঘরে ফেরার পথে গজিয়েছে বিষাক্ত কাঁটা। এ জীবনে খেরুপাড়ার কালো মাটির পথে বুঝি আমার পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। কিন্তু যদি এ অনুমান ব্যর্থ হয়, কখনো যদি গঙ্গা-পদ্মা ফের নতুন রাখিবন্ধনে বাঁধা পড়ে, তা হলে কি আমি আবার তেমনিভাবে ফিরে পাব আমার সেই হারানো খেরুপাড়াকে?
অবিশ্বাস গাঢ় হয়ে আসে, সংশয়ে দুলতে থাকে মনটা। আশার সার্থকতায় ফিরে পাওয়া গ্রামে পৌঁছোল কেউ যদি হঠাৎ এসে খবর দেয়, ও পাড়ার যারা প্রাণের মায়ায় সীমান্তপারের দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল, মাঝপথ থেকে তাদের আর খবর নেই কিংবা যদি কেউ বলে, পাশের গ্রামের এক অসহায় গৃহস্থ পরিবারের নতুন বউ কোনো উপায় না দেখে একগোলা আফিম মুখে পুরে ঠাকুরের পটের সামনে চুপচাপ মুখ বুজে শুয়েছিল, সে আর উঠে বসেনি–অথবা যদি শুনতে পাই, আমাদেরই প্রতিবেশীর এক কুমারী মেয়ে, আমাদের পুকুরধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফাল্গুন মাসে যখন অসংখ্য রক্তমঞ্জরিতে লালে লাল হয়ে ওঠে, তারই ডালে চূড়ান্ত অপমান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছিল, তখন আমার চোখ ফেটে যে জল আসবে, সে কি পুনর্মিলনের আনন্দে? আমি যদি অসহ্য চাঞ্চল্যে পথের ধুলোয় লুটিয়ে পড়ি, তা কি অদৃষ্টের দেবতাকে সকৃতজ্ঞ প্রণাম জানাবার জন্যে? সময়ের গতি দুর্বার, জীবন অস্থির–পদ্মপাতায় জলবিন্দু টলমল। যা হারালাম, যা ফেলে এলাম, অনন্ত-অতীত তাকে গ্রাস করে নিল, কোথাও তার আর সন্ধান মিলবে না।
আকাশে বর্ষার মেঘ, বিচ্ছিন্ন কান্নার সুর। কিন্তু সে-সুরে তো হৃদয় ময়ূরের মতো পেখম বিস্তার করে নাচে না। প্রাসাদের শিখর থেকে কারও কালো চুলের ঢেউ আকাশ ঢেকে ফেলেছে–এ কল্পনাতেও মন তো এগোয় না। আমি দেখতে পাচ্ছি, এই মেঘেরই ছায়া পড়েছে ইছামতীর জলে। তারই তীরে দাঁড়িয়ে জনহীন বিপন্ন খেরুপাড়া গ্রাম। অহল্যার পাষাণ-জীবন তার। মুক্তির অপেক্ষায় চলছে অপমৃত্যুর প্রহর গণনা। তবু কেন জানি না, প্রবল প্রত্যয়ে কবিগুরুর সেই অমৃতময়ী আশার বাণী বার বার মনে আসে,
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
তেমনি স্থান কি পাব না আমরা?
সংগ্রামের নায়ক নিয়তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়েছে। তার রথচক্র গ্রাস করেছে মেদিনী, অন্যায় চক্রান্তে বিপর্যস্ত সে। কিন্তু তার পৌরুষ লুপ্ত হয়নি, বীর্যের বিনাশ নেই, আদর্শ অমর। দিগন্তের নিকষ অন্ধকারে দৃষ্টি চলে, কিন্তু কার যেন পদধ্বনি শোনা যায়! অন্ধকারে যবনিকা থরথর করে কেঁপে ওঠে।
.
ধামগড়
‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’–গানটি কত উৎসবে কতবার যে গেয়েছি তার ঠিক নেই। কবিগুরুর মহাবাণী শুনে প্রাণে শক্তি পেয়েছি সত্য, কিন্তু আমাদেরও যে সর্বস্বত্যাগী হয়ে ‘জয় মা’ বলে এমনিভাবেই তরি ভাসাতে হবে অনির্দিষ্টতার পথে তা আগে কি কোনোদিন ভাবতে পেরেছিলাম? ভারত স্বাধীন হবে, আমরা সুখীসচ্ছল হব, বাঙালির ঘর ভরে উঠবে আবার ধন-ধান্যে, পুজো-পার্বণে–এই স্বপ্নই তো দেখেছি রাত জেগে জেগে! কিন্তু তার বদলে আমরা হলাম নির্বাসিত, অসহায় পাখির মতো বিপদগ্রস্ত।
মনে পড়ছে প্রায় বারোবছর আগে আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে একমাত্র পুত্র দেবেন মারা গেলে আমার ঠাকুমা দুঃখ করে বলেছিলেন,–‘আহা, সারদার ভিটেয় আর প্রদীপ দেবার কেউ রইল না!’ কিন্তু আজ সমস্ত পূর্ববাংলার প্রতি হিন্দু-পরিবারে ছেলে থাকতেও প্রায় ভিটেতেই প্রদীপ দেওয়ার কেউ নেই।
নারায়ণগঞ্জ থেকে মাইল তিনেক দূরে আমাদের গ্রাম ধামগড়। স্টিমার বা নৌকো যাতে খুশি যাওয়া যায়। তবে নৌকোতে গেলে দেড় ঘণ্টা আর স্টিমারে গেলে লাগে আধঘণ্টা। ছাত্রাবস্থায় এ দুটোর কোনোটাতেই মন সরত না–সামান্য সময় অপচয়ও ছিল তখন প্রবাসীমনের পক্ষে অসহ্য। বাঁধনছেঁড়া মন মুহূর্তে বাড়ি পৌঁছোবার জন্যে পাগল হয়ে উঠত। স্টিমারে গেলে সারং, সুখানী, ড্রাইভার কর্মচারীদের দেওয়া খাবার জুটত প্রচুর। এ-উপহার জুটত বাবার সম্মানে, তিনি তখন সোনাচোরা ডকের ডাক্তার। তাই ছোটোবাবু (আমি) তাদের আপনার জন, তাকে আদর করার অর্থ তার পিতাকে সম্মান দেখানো। নৌকোতে গেলে যেতাম চারার গোপে। আমাকে দেখামাত্রই জনদশেক মাঝি হুমড়ি খেয়ে এসে দাঁড়াত চারপাশে। তারা সবাই প্রায় মুসলমান। কার নৌকোয় উঠব ভেবে ঠিক করতে পারা যেত না। যাকে প্রত্যাখ্যান করব তারি তো হবে অভিমান! তবুও কেউ কেউ আমার শোচনীয় অবস্থাকে আরও সঙিন করার জন্যেই ছোঁ মেরে নিয়ে যেত বাক্স–বিছানা-সুটকেস। তারপর সমস্বরে আহ্বান জানাত—’আইয়েন ছোড ডাক্তারবাবু আমার নায়ে, ছোত কইরা যাইতে পারবেন!’ পিতার খেতাব আমার কপালে যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই জুটেছিল! এরপর কাঁচুমাচু মুখে একজনের নৌকোয় গিয়ে হয়তো উঠতাম–যারা সুটকেস ও বিছানা নিয়ে গিয়েছিল তখন তারা তা হাসিমুখেই ফিরিয়ে দিয়ে যেত সে-নৌকোতে। আমি সাধারণত যার নৌকোয় যেতাম, মনে পড়ে, সে গান গাইত চমৎকার। রসুল মাঝি বলেই সে পরিচিত ছিল। আমাদের কাছে। নৌকো ছেড়ে সে ডান হাতে দাঁড় টানত আর বাঁ-হাতে হুঁকো ধরে টানত কড়া তামাক। তামাক খাওয়া শেষ হলে ছোট্ট একটা কাশির পর উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরত সে,
গুরু আর কতদিন থাকবা ফারাক, পাইনা তোমার দ্যাহা,
কত দুঃখ সইলাম দরায়, নাইকো ল্যাহ জোহা।
গুরুভজা রসুলমাঝি গান গেয়ে চলেছে আনমনে একটানা। অপূর্ব পরিবেশের মধ্যে দূরে দেখা যাচ্ছে শীতলক্ষ্যার পুবপাড়ে ঢাকেশ্বরী মিলের চিমনি, বসু গ্লাস ওয়ার্কসের কারখানা। পশ্চিম দিকে পাটের কল দু-নম্বর ঢাকেশ্বরী মিলের চোঙা, লক্ষ্মীনারায়ণ মিল আর চিত্তরঞ্জন মিলের খাড়া-উঠে-যাওয়া চিমনির শ্রেণি অবিরাম ধোঁয়া উদগিরণ করে চলেছে যেন মানুষের ইতিহাসকে কলঙ্কমলিন করার উদ্দেশ্যেই!
আজ বেশি করে মনে পড়ছে রসুল মাঝির ভারি খোলা গলার ভক্তিমূলক সেসব গান। শীতলক্ষ্যার জলে তার দাঁড়ের ছপছপ শব্দ আমাকে যেন অন্য কোনো জগতে নিয়ে যেত। সেদিনকার গোধূলিবেলায় বৈরাগীমন যেমন নিমেষে চলে যেত অন্য জগতে আজ রূঢ় বাস্তবময় পরিবেশে দেহও স্থানান্তরিত হয়েছে অন্যদেশে। চিরদিনের জন্যেই কি হারিয়েছি শীতলক্ষ্যার শান্ত করুণ মিনতিভরা রূপকে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা জননী জন্মভূমিকে!
মাতৃভূমিকে ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফেলে এসেছি সমস্ত ঐশ্বর্য ও সম্পদকে। অকৃত্রিমভাবে বুঝতে পেরেছি স্বাধীনতা আমাদের দেশে পরাধীনতার অভিশাপ নিয়েই দেখা দিয়েছে। অমাবস্যার ঘোর কালরাত্রির মধ্যে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি বলেই জীবনেও দেখা দিয়েছে অমাবস্যার করাল ভয়াল মূর্তি! রাত্রি প্রভাতের কত দেরি কে বলে দেবে? মহামনীষীরা স্তোক দিয়েছেন wait for the morning owl! কিন্তু শীতলক্ষ্যার তীরে আবার পূর্বাকাশের সূর্যোদয়ের রক্তরাগরেখায় গোধূলির দেখা পাব কি না জীবনে কে জানে।
সন্ধেবেলায় দেখতাম একহাতে প্রদীপ আর অন্যহাতে ধুনুচি নিয়ে প্রাঙ্গণপাশে তুলসীমঞ্চে মা গলায় আঁচল দিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করছেন। দেবতার কাছে তিনি কী প্রার্থনা করতেন জানি না, কিন্তু আজকের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বচ্ছন্দে বলতে পারি, তাঁর ভীরু হৃদয়ের উজাড় করা প্রণাম এবং প্রার্থনা পূর্ণ হয়নি। জীবনকে বিপদমুক্ত করার সব আবেদনই ব্যর্থ হয়েছে আমাদের। একা একা থাকলেই মনে পড়ে যায়, গ্রামের নিস্তব্ধ দুপুরে জামের ডালের ওপর বসা ঘুঘু দম্পতির একটানা সুর, আজও হয়তো শুনতে পাওয়া যায় সে-সুর, কিন্তু সে ডাকে কটা মানুষের মন সাড়া দেয় এখন?
দুরন্ত দুপুরের ছবি যেন ক্রমাগত চোখের সামনে ভেসে উঠছে আজ। মনে হচ্ছে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সামনে সবুজ মাঠের বিস্তীর্ণ ফসল ফলার ছবি। কোনো জমিতে ধানগাছ বাতাসের সঙ্গে মাথা দুলিয়ে নড়ছে সবুজ যৌবনকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে, আবার কোনো মাঠে অজস্র পাটচারার সমারোহ। সব খেতে উবু হয়ে বসে মাথায় টোকা দিয়ে খেত নিড়িয়ে দিচ্ছে অখন্ড মনোযোগ সহকারে কৃষকের দল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আবার গানও হচ্ছে–কোহিল ডাইক্কো না ডাইক্কো না এই কদম্ব ডালে। জমি থেকে উঠছে কুন্ডলী কেটে ধোঁয়া, খড় পাকিয়ে লম্বা দড়ি করে গোড়ায় আগুন দেওয়া হয়েছে তামাক খাওয়ার জন্যে। সংকীর্ণ আল দিয়ে হেঁটে চলেছে ক্লান্ত ‘বি’ শিফটে ছুটি পাওয়া শ্রমিকদল। কারুর মাথায় ছাতা, কারুর মাথায় বড়ো বড়ো কচুপাতা! কেউ যাবে রানিঝি, কেউ জাঙাল, কেউ বা পুবদিকের নমশূদ্র পাড়ায়। কারুর গন্তব্যস্থল মালিবাগ কারুর বা আরও দূরে লাঙলবন্ধ। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমপাড়ে হিন্দুতীর্থ লাঙলবন্ধ খুব কাছে নয়।
ছোটোবেলায় মায়ের সঙ্গে অষ্টমীস্নান করতে কতবার এই লাঙলবন্ধে গিয়েছি। দূরত্ব ছিল মাইল-দুই পথ। গ্রামের গৃহিণীরা যেতেন পাল্কি চেপে, কিন্তু মাকে কোনোদিন পাল্কিতে যেতে দেখিনি। তিনি বলতেন, “এইটুকু পথ চলতে না পেরে পাল্কিতে চড়ে তীর্থ করতে হয় যদি, তাহলে সে-তীর্থের ফল কী? ওরকম তীর্থ করার চেয়ে না করাই ভালো। তাই মুখ কালো করে আমাকেও হাঁটতে হত তাঁর সঙ্গে। মায়ের হাঁটা বড়ো আস্তে, ভোর চারটের সময় যাত্রা করেও তাই আমরা পৌঁছোতাম রোদ উঠে যাওয়ার পরে। আমাকে হাঁটতে হত না বড়ো একটা, কেননা সঙ্গে থাকত দুজন প্রজা। একজন মামুদ আলি আর একজন কালীচরণ। চলার মাঝখানেই হঠাৎ থেমে বিষণ্ণ মুখে মায়ের আঁচল চেপে কাঁদো কাঁদ স্বরে বলতাম—’মা, পা বড্ড কনকন করছে!’ মা জবাব দেওয়ার পূর্বেই চতুর মামুদ আলি বুঝে ফেলত আমার চালাকি। আকর্ণ হাসিকে বিস্তৃত করে মায়ের হয়ে সে-ই বলত—’আইয়ো আইয়ো, তোমার চালাকি বুঝি বুজি না ছোট্টবাবু!’ এই বলে স্বচ্ছন্দে সে তুলে নিত ঘাড়ে।
মাঠে মাঠে রাস্তা কিছু কম, তাই আমরা আল ধরে এগিয়ে যেতাম। দেখতাম অজস্র ভক্ত তীর্থযাত্রী ভক্তির অর্ঘ্য নিয়ে ছুটে চলেছে তীর্থসলিল স্পর্শ করতে। পুণ্যকামী বাঙালির এই চিত্র সর্বত্রই এক। চলতে চলতে চোখে পড়ত শস্যশ্যামলা মাতৃভূমির লুকোনো সম্পদ। ধান-পাট-মেঠোকুমড়োয় মাঠ পরিপূর্ণ, কোথাও লাল লঙ্কায় লালে লাল। মেলার পথে দোকানদাররা নিয়ে চলেছে ধনে-জিরে-তেজপাতার তৈজসপত্র। আবার কারুর মাথায় খই মুড়কি-ডবল বাতাসার গুরুভার। যাত্রীরা এইসব জিনিস কিনে আনবে বাড়ি ফেরার পথে। মামুদের কাঁধে গদিয়ান হয়ে মনটা বেশ স্ফুর্তি-স্ফুর্তিই ঠেকত।
ভোরের বাতাসে ভেসে আসছে মেলার হট্টগোল, খোলের মিঠে আওয়াজ, কীর্তনের অসমাপ্ত কলি। হঠাৎ শুনতে পেলাম দূর থেকে কে যেন হাঁকছে ‘বিশু বাই’ করে। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি উজ্জ্বল দাঁত বের করে হাসছে গঙ্গা। বাল্যবন্ধু গঙ্গা, সহপাঠী গঙ্গা অবাঙালি গঙ্গা। জন্মেছে আমাদের গ্রামে, বাড়ি মুঙ্গের জেলার এক পল্লিতে। তার বাবা রঙ্গলাল চৌকিদার। গঙ্গার ভাগ্যে কোনোদিন জন্মভূমি দেখার সুযোগ হয়নি, সে আমার গাঁয়েরই ছেলে, তাকে দেখে কাঁধ থেকে নামতে চাইলাম, কিন্তু মামুদ ধমকে বলে উঠল–না ছোটোবাবু আরাইয়া জাইবা, বিরের মইদ্যে লামতে দিমু না– কী করি উঁচু থেকেই গঙ্গার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললাম। মেলায় পৌঁছে দেখি স্নান সেরে মেয়েরা কাঁখে বা মাথায় নতুন হাঁড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহলী শিশু সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল কাঁধের ওপর থেকে—’মামুদ ভাই, হাঁড়ির মধ্যে কী নিয়ে যাচ্ছে ওরা?’ মামুদ বিজ্ঞের মতো কমকথায় উত্তর দিয়েছিল—‘পুইন্যি!’
কলকাতার পথে চলতে চলতে শুনতে পাই বেতার শিল্পীদের ভাটিয়ালি, রামপ্রসাদি, বাউল, শ্যামাসংগীত এবং আরও কতরকম ভক্তিমূলক গান। এসব শুনলেই মনটা আকুলি বিকুলি করে ওঠে শৈশবে দেখা কিশোরী বাউলের কথা ভেবে। কিশোরী বাউলের সেই টানাটানা চোখ দুটো, আজও আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছে যেন! ভুলতে পারিনি তার সৌম্য-সুন্দর ঢলঢলে মুখখানি। পরনে গেরুয়া, এককাঁধে ঝুলি আর এক কাঁধে সারেঙ্গি। মাসান্তে দেখা পেতাম তার ঠিক দুপুরবেলায়। তার গান শোনার জন্যে উদগ্র হয়ে থাকতাম নির্দিষ্ট দিনে। কিশোরী বাউল তার সারেঙ্গির ওপর ছড় ঘষতে ঘষতে ঢুকত লাল সুরকি-ঢালা পথ বেয়ে। বেরিয়ে বারান্দায় আসার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরী প্রণাম করত আমাকে। তারপর একটুখানি বসে গান ধরত—’আলোকের পূর্ণ ছবি আর কতদিন রবে দূরে। আজ কিশোরী কোথায় জানি না, তবে তার সঙ্গে দেখা হতেও পারে একদিন।‘ কারণ কিশোরীই বলেছিল আমাকে—’বাবু, বাংলাদেশের যেখানেই থাকেন না কেন, এই কিশোরীর সঙ্গে আপনাদের দেখা হবেই।‘
কলকাতার বর্ষা দেখে আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের বর্ষার রূপ মনে পড়ে। ডোবা নালা সব জলে টইটম্বুর। পুকুরের পাড় ভেঙে ছুটছে জলের স্রোত–সেই স্রোতের একপাশে বঁড়শি নিয়ে মাছ শিকারে ওত পেতে আমি বসে। শোঁ শোঁ শব্দে জল যাচ্ছে মাঠের ওপর দিয়ে। আজ মনে হয় সেই অশ্রান্ত বাঁধভাঙা জলের কল্লোলধ্বনি আর কিছুই নয়, বিপর্যস্ত মানুষের হাহাকার যেন–জলস্রোতের শিহরন আজকে আমার মনে জনস্রোতের বিহ্বলতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ঘরছাড়া মন জলস্রোতের সঙ্গে জনস্রোতের সাদৃশ্য কী করে খুঁজে পেল জানি না। জল ঝরে পড়ার শব্দে শিশুমন যেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত, আজকে কেন জানি না হৃদয়তন্ত্রীতে সেই শব্দ ব্যথার রেশ লাগায়। হয়তো ব্যথাতুর মন প্রকৃতির মধ্যে বেদনাবিধুর আবেশটিকেই গ্রহণ করে। মেঘের খেয়ায় খেয়ায় মন উদাসী।
বর্ষার জলে মাঠ থই থই করছে, পাটগাছগুলো কাটা হয়ে গেলেও ধানগাছগুলো খাদ্যভারে বাতাসে দোল খাচ্ছে জলস্রাতের মুখে। জলের মধ্যে মাথা তুলে রয়েছে একটা কদম গাছ ফুলসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে। পাতার গা বেয়ে জল ঝরছে টিপ টিপ শব্দে। সামান্য শব্দ সামান্য দৃশ্য যে মনকে এতখানি ভাবিয়ে তুলতে পারে কোনোদিন তা দুঃখ না পেলে বুঝতে পারতাম না। মনকে উৎসুক, উদগ্র করেছে সংকট–আজ বুঝতে পারছি সংকট না এলে ইতিহাস সৃষ্টি হয় না। কিন্তু প্রাণঘাতী এ ইতিহাস আমাদের জীবনকে মূলধন করে না গড়লে কী ক্ষতি হত ভবিষ্যতের?
জীবনকে ঘিরে রয়েছে দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন। রাত্রিকে পাড়ি দেওয়ার শক্তি কোথায় পাব? প্রতি বাস্তুহারার চোখের জল যেন অশান্ত পদ্মার উন্মত্ততার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অহরহ। যাদের ছিল ঘর তারা আজ মুক্ত আচ্ছাদনহীন বিস্তৃত ভূমিতে নিরালম্ব হয়ে রাতের পর রাত কাটাচ্ছে। এক প্রদেশ থেকে এক এক দলকে বিতাড়িত করা হচ্ছে অন্য প্রদেশে। ভয় হয় এ ধরনের বিতাড়নে ক্ষয়িষ্ণু বাঙালি ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের থিসিসের খোরাক হয়ে দাঁড়াবে না তো শেষে? যাযাবর জাতিরা মাটিকে কেন্দ্র করে তবেই সভ্য হয়েছিল একদিন, আর আমরা মাটিকে হারিয়ে হলাম যাযাবর।
.
আনরাবাদ
দেশের কথা নির্জন জীবনে আজ নানাভাবে বেশি করে মনে পড়ছে। মনের ছায়াতলে বিনা ভাষায় বিনা আশায় আমার ছোট্ট নিরালা গ্রামখানি বার বার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পরমুহূর্তে যাচ্ছে মিলিয়ে। দেশজননীর কথা, জন্মভূমির কথার অর্থই হল অজান্তে নিজের কথা। শিশু শুধু নামের নেশাতেই ডাকে, সে যে কথা বলতে শিখেছে এটাই সেখানে বড়ো কথা। সেইরকম আমার গ্রামের কথা বলাও একটা সুখস্মৃতি। আজ প্রাকৃতিক সুষমামন্ডিত আমার সেই ছোটো গ্রামখানিই মনের মণিকোঠায় পূর্ণতা লাভ করেছে।
বসন্তের প্রতীক কচি কিশলয়, ফোঁটা মুকুলের মিষ্টি গন্ধ, লতাগুল্মের ছায়ায় বসা দোয়েল শ্যামার ডাক মনকে কেন জানি না লোভার্ত করে তুলছে এই ইটকাঠ-ঘেরা অকরুণ মহানগরীর কারাগারের মাঝখানে। এখানে রাত্রির কোনো মনোহারিণী রূপ নেই, রাতের কলকাতা ভয়ংকরতারই প্রতীক! কিন্তু আমার সেই ছেড়ে-আসা গ্রামের অন্ধকারের রূপও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ঝিল্লিমুখরিত অন্ধকার রাত্রে শেয়ালের ডাক এক নিমেষেই চমৎকার একটি গ্রাম্য পরিবেশ সৃষ্টি করে তোলে। একথা বুঝতে পারছি অনেক দূরে এসে এবং চিরতরে গ্রামকে প্রণাম করে আসার পর। নগরজীবন বনাম গ্রামজীবন সম্বন্ধে শৈশবে একবার আমাদের মাস্টারমশাই রচনা লিখতে দিয়েছিলেন। স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিন আমি নগরের রূপটির বাইরের চাকচিক্য দেখে তার দিকেই ভোট দিয়েছিলাম। আজ আক্ষেপ হয় গ্রামকে সেদিন অবহেলা করেছি বলে, গ্রামকে সেদিন চিনিনি বলে! শৈশবের সেই বোকামির জন্যে দূর থেকে পরবাসীর মতই ভক্তিভরে তাকে প্রণাম জানিয়েছি এই বলে—’ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।‘
ঢাকা জেলার কুখ্যাত রায়পুরা থানার অন্তর্গত আনরাবাদ আমার গ্রাম। গ্রাম হিসেবে ইতিহাসবর্জিত, অখ্যাত, অজ্ঞাত হয়তো অন্যের কাছে। কিন্তু তবু সে যে আমার আরাধ্য জন্মভূমি! মাইল তিনেক দূরে মেঘনা, একমাইল দূরে রেল স্টেশন, দু-মাইল দূরে থানা আর ষাট মাইল দূরে কাছারিবাড়ি। আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, বাঁশ, বেত আর বর্ণালি গাছের ছায়াঘেরা আনরাবাদ নিস্তব্ধ। কোলাহলমুখর জীবন থেকে মুক্তি চাইলে আনরাবাদ আজকের বিংশ শতাব্দীর কেজো মানুষদের শান্তিময় পরিবেশের সন্ধান দিতে পারে।
আমাদের গ্রামে বাস করতেন অনেক বড়ো বড়ো পন্ডিত। বিদ্যারত্ন, বিদ্যাভূষণ, বিদ্যালংকার, স্মৃতিতীর্থের তীর্থভূমি বললেও এ গ্রামকে বাড়িয়ে বলা হয় না। দূর-দূরান্তর থেকে লোক আসত এই গ্রামের পন্ডিতসমাজের কাছে বিধান নিতে; তাঁদের মুখের কথাকে। আমরা বেদবাক্য মনে করতাম। টোল ছিল অনেকগুলো, ছোটোবেলায় দেখেছি সেখানে বহু বিদ্যার্থী আসত বিদ্যার্জনে। প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের আশ্রমের কথা শুনেছিলাম ঠাকুরমার মুখে, এগুলো দেখে সেই আশ্রম-স্মৃতি যেন চোখের সামনে উঠত ভেসে।
গ্রামবাসীর প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত অল্প, তা ছাড়া, মালিন্য যারা আনে তেমনি সব বড়ো বড় প্রতিষ্ঠান আমাদের গ্রাম থেকে দূরে থাকায় মিথ্যে গোলমালের হাত থেকে আমরা একরকম মুক্তি পেয়েছিলাম। থানা-পুলিশের দূরত্ব, কোর্ট-কাছারির দূরত্ব একটু বেশি হলেও শান্তিভঙ্গ কোনোদিন হয়নি। সেই শান্তি-শৃঙ্খলার কোনো বালাই আজ আর নেই সেখানে। তবু আজও মরুভূমির মধ্যে আমার গ্রামটি দাঁড়িয়ে আছে ওয়েসিসের মতো।
পাকিস্তান হবার কিছুদিন পরে দেখে এসেছি আমার গ্রামকে–মায়ের আমার সে রূপ গেল কোথায়? অশ্রু রোধ করতে পারিনি তাঁর হতশ্রী দেখে। ঝাড়ের বাঁশ বাড়ি ফেলেছে ঘিরে, যে আঙিনায় বারো মাস থাকত আলপনার ছাপ সে ছাপ কবে মুছে গেছে। আঙিনায় গজিয়েছে মানুষ-সমান বুনোঘাস। ঘরদোর খাড়া রয়েছে বটে, কিন্তু সমস্তই শ্রীহীন– প্রেতপুরীর মতো ভয়াবহ হয়ে উঠছে সমস্ত গ্রামটি! বিষাদবিধুর নিস্তব্ধতা শ্বাসরোধ করে তুলছিল আমার। আমার দেশজননীর এমন রূপ কোনোদিন দেখব তা স্বপ্নেও ভাবি নি। এখন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নিশাচর শ্বাপদ এবং দ্বিপদের অভিযান। কোনো উপায় যাদের নেই তারা সেইসব অত্যাচার সহ্য করে আজও মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে সে গাঁয়ে। প্রকৃতির শ্যামচিক্কণ আঁচল দিয়ে যে গ্রাম ছিল ঢাকা তার এ ধরনের শান্তিভঙ্গ যারা করেছে তাদের কি প্রকৃতিদেবী কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেন?
সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর আমি জননীর অঞ্চলতলে ছিলাম নির্বিঘ্নে নির্ভাবনায়। তাই বুঝিনি গ্রামের শান্তি, জননীর স্নেহ কতখানি নিবিড় হতে পারে। বিগত জীবনে সুখে-দুঃখে বিপদে-সম্পদে মায়ের যে অভয়বাণী অথবা স্নেহ-সুনিবিড় শীতল ছায়ার আস্বাদ পেয়েছি তা আজ একসঙ্গে ভেসে এসে বিষাদখিন্ন মনকে শৈশব-কৈশোর-যৌবনের পরমানন্দ রূপটি মনে করিয়ে দিয়ে অসহ্য ব্যথায় হৃদয়তন্ত্রীকে বিকল করে দিচ্ছে যেন। আজ সেদিনের স্মৃতিকে স্পর্শ করতে যাওয়াকেও আমার পক্ষে দোষাবহ মনে হচ্ছে। যেখানে চল্লিশ বছর কাটিয়েছি, যেখানকার বাতাস আমার জীবন বাঁচিয়েছে, যে গ্রামের রূপ দেখে জ্যোৎস্নারাত্রে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছি এক একদিন, যেখানকার বাসিন্দাদের গলা জড়িয়ে ধরে পরস্পরের সুখে-দুঃখে হেসেছি, অশ্রু বিসর্জন করেছি, লজ্জার কথা, সেখানে আমি অনাত্মীয় আজ–নিজের মায়ের ওপর কোনো স্নেহের দাবিই নেই আমার, আইনের চোখে আমরা আজ বিদেশি! দেশে যেতে গেলেও চাই পাসপোর্ট, চাই ভিসা। এরকম লজ্জা বিশ্বের অন্য কোনো জাতি এত নিবিড় করে অনুভব করেনি বোধ হয়।
আজও নিয়মিতভাবেই আসে দুপুর, কিন্তু দেশের মতো ছুটে আমবাগানে গিয়ে দুপুরটা কাটাতে পারি না। গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহর আমাদের কাছে ছিল অত্যন্ত লোভনীয়–সকাল থেকে নুন-লঙ্কা গুঁড়িয়ে কাগজে জড়িয়ে রাখার ইতিবৃত্ত মনে করলে চোখটা সজল হয়ে ওঠে আজও। মা-বাবার তন্দ্রা আসার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তর্পণে খিড়কি খুলে বাগানে পালানো বইপত্র ফেলে, তার তুলনা কোথায়! ছোটো বোনকে পরিবেশ-পরীক্ষক হিসেবে রেখে পালাতাম আমের লোভ দেখিয়ে-বেচারি ঠায় বসে থাকত গুরুজনদের মুখের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের কারুর তন্দ্রা ভাঙবার আগেই সে ছুটে গিয়ে খবর দিত চুপিচুপি–আর আমিও ঠিক আগের মতোই আবার শান্তশিষ্ট ছেলের মতো অখন্ড মনোযোগ দিয়ে বিদ্যাভাসে লেগে যেতাম! বই খাতার নীচে থাকত আমের কুচি। নুন-লঙ্কা সহযোগে যথা সময়ে সেগুলোর সদব্যবহারও আমার পক্ষে ছিল একটা কর্তব্যকাজ! এই ধরনের ফাঁকি দেওয়া অবশ্য রোজ সমান চাতুর্যের সঙ্গে সম্ভব হত না। কোনো কোনো দিন বোনটির অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে রেখে যাওয়ার ফলে বিপদে পড়তে হত। সে দুষ্টুমি করে খবরই দিত না আর সেদিন। আমরা তো অকুতোভয়ে বৃক্ষ থেকে বৃক্ষান্তরে ফলাহারে উন্মত্ত হয়ে উঠতাম সময়ের দিকে না তাকিয়েই! অবসাদ এলে বা পেট ভরতি হয়ে গেলে গাছ থেকে নীচে নেমে দেখতাম সন্ধের আর বেশি দেরি নেই! সেদিন কপালে চড়-চাপড় যে পরিমাণ জুটত তার কথা আর নাই বা বললাম।
সন্ধেবেলায় ব্রাহ্মণপাড়ায় কাঁসর ঘণ্টা বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়ে হাজির হতাম প্রসাদ পাওয়ার লোভে। সেদিনের সে উৎসাহ-উদ্দীপনা আজ যদি কিছুটাও অবশিষ্ট থাকত তাহলে মনে হয় এতখানি মিইয়ে পড়তাম না দুঃখের ভারে। লাঞ্ছনা-অপমান পেয়ে পেয়ে মনের অপমৃত্যু ঘটেছে–সৌন্দর্যের মৃত্যু মানেই মানুষের মৃত্যু। যদি বাঁচতে হয় এগুলোকে আবার জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন, কিন্তু যা প্রয়োজন এবং যা করা কর্তব্য তা সব সময় আমরা করি কোথায়? বাসস্থান, চাকুরিসংস্থান, দৈনন্দিন অনটনের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে কি আমাদের ভবিষ্যৎ তলিয়ে যাবে?
এ কি জীবন না জীবনের অভিনয়? এ প্রসঙ্গে হঠাৎ মনে পড়ে যায়, গ্রীষ্মকালে আমাদের থিয়েটার হত প্রতিবছর মহা ধুমধামের সঙ্গে। গ্রীষ্মবকাশের দিনগুলোকে স্মরণযোগ্য করার উদ্দেশ্যেই হত অভিনয়ের ব্যবস্থা। সচরাচর আমরা অভিনয় করতাম পৌরাণিক নাটক। নরমেধযজ্ঞ, বিল্বমঙ্গল, বনবীর, সগরযজ্ঞ, চন্দ্রগুপ্ত ইত্যাদির অভিনয় একদা মাতিয়ে তুলত সমগ্র গ্রামখানিকে। সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে, এর মূল অভিনেতারা প্রায় সবাই ছিলেন গুরুজনস্থানীয়! বাবা, মামা, মেসো, পিসে, দাদা, ভাই সবাই মিলে পার্ট মুখস্থ করেছি সারা দিনরাত ধরে–একে ওকে হঠাৎ মাঝখান থেকে খানিকটা দরাজ গলায় অভিনয়াংশ শুনিয়ে দেওয়াটা অত্যন্ত মজার ব্যাপার ছিল। এতটুকু আবিলতা ছিল না তার মধ্যে। বাবাকেই হয়তো আমি অভিনয়ের ঘোরে এক ফাঁকে কখন বলে ফেলেছি–দেখো সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ। বাবা শুনে মুচকি হেসেছেন। তাঁর ছেলে রাতারাতি যে আলেকজাণ্ডার বনে গেছে সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি তাঁর। কিন্তু উজ্জ্বল সেই দিনগুলোর ওপর কালবৈশাখীর ঝড় এল কেন? মনের আনন্দে মিলে-মিশে কাজ করতাম, তার বিপক্ষে সুনিপুণ করে জাল পাতল কোন হৃদয়হীন ব্যাধ?
গ্রীষ্মের পরই শুরু হত বর্ষা। কাজলকালো মেঘমেদুর বর্ষা গ্রামটিকে থমথমে করে দিত একনিমেষে। টিপটিপ ইলশে গুঁড়ি থেকে ঝমঝম ধারার মুষলবৃষ্টি সবই লক্ষ করতাম সেই ছোটোবেলায় জানালায় বসে বসে। মাঠ-ঘাট জলে থই থই করত, কৃষকেরা ভিজতে ভিজতে কাজ করে আর গান ধরে মনের খুশিতে। শ্রাবণ দিনে চাষবাস আর রাত্রে মনসার পুথি পড়াই তাদের দৈনদিন কাজ। বানান করে করে অপটু পড়য়ার মতো পুথি পড়লেও তাতে আনন্দ পায় তারা বেশ–সেই সঙ্গে আনন্দ বিতরণও করে পড়শি ভক্তদের মনে। শ্রাবণ মাসের শেষদিনে লখিন্দর উপাখ্যান শেষ করে তারা পদ্মাপুরাণ জড়িয়ে উঠিয়ে রাখে চাঙে।
আজ মনে পড়ে কৃষ্ণকিশোর কীর্তনীয়াকে। বড় ভালো কীর্তন গান করত, সে ছিল গ্রামের প্রাণস্বরূপ। তার পালা-কীর্তনে মুগ্ধ হত না এমন লোক দেখিনি। সুললিত কণ্ঠস্বরে তাল-মান বজায় রেখে অকৃত্রিম ভক্তিভরে চোখ বুজে সে কীর্তন ধরত যখন,
ঘরে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রবোধ দিব কেমনে
বুঝাইলেও বুঝ মানে না নিমাই চান্দ বিনে–
যেমন তৈলবিনে বাতি জ্বলে না,
প্রাণ বাঁচে না জল বিনে।
অথবা
শুয়েছে গো বিষ্ণুপ্রিয়া–
কালঘুমেতে অচেতন
মায়া-নিদ্রা তৈজে নিমাই হল সন্ন্যাসে গমন
আমি বিদায় হলাম, ওগো প্রিয়ে দেখে যাও
জনমের মতন।
তখন অতিবড়ো পাষন্ডেরও চোখে জল দেখেছি। কৃষ্ণকিশোরের গলা আজও মাঝে মাঝে ভেসে আসে বাতাসে, অনেক রাত্রে ধড়মড় করে উঠে বসি মনের ভুলে, কানে বাজে, সেই কৃষ্ণকিশোর যেন সতর্ক করার জন্যে গান ধরেছে—’বিদায় হলাম, ওগো প্রিয়ে দেখে যাও জনমের মতন!’ সত্যি বিদায় হয়েছি জন্মের মতো, কিন্তু সন্ন্যাস নিয়ে নয়, অপরাধীর চরম দন্ড দ্বীপান্তর গ্রহণ করে।
এই বিষাদময় দুঃখের মধ্যেও আনন্দের দিনগুলোকে বাদ দিতে মন সরে না। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত আমাদের গ্রামে। শারদোৎসবই হত সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে। মেঘমুক্ত আকাশ-বাড়ির প্রাঙ্গণে শিউলি ফুলের বন্যা, স্থলপদ্ম, জলপদ্মের সমারোহে মন থাকত এমনিতেই খুশি। মাঠে মাঠে ধানের শিশিরভেজা সোঁদা সোঁদা গন্ধে অনির্বচনীয় মনে হত আনন্দোচ্ছাসকে। শারদীয়ার আগের আর একটা দুষ্টুমির অনুষ্ঠানের কথাও বাদ দেওয়া চলে না। সেটা হল নষ্টচন্দ্র! ভাদ্রের শুক্লা চতুর্থীর রাত্রে এই নষ্টচন্দ্রের কোপে কত গৃহস্থ যে ব্যতিব্যস্ত হয়েছেন তার হিসেব নেই। রাত্রে কত যে চুরি গেছে গৃহস্থের মিষ্টি কুমড়ড়া, শসা, জাম্বুরা (বাতাবিলেবু) আর আখ তা ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা মনে মনে হয়তো একটা হিসেব করে নিতে পারবেন! একে চুরি বললে ভুল করা হবে। গাছের জিনিস ভাগ করে রেখে দেওয়া হত সকলের দরজাগোড়ায়। সকালে উঠে এসব দেখে কেউ বড়ো একটা আশ্চর্য হত না, শুধু যাদের বাগান থেকে ফল খোয়া গেছে তারাই পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের উপলক্ষ করে সামান্য গালিগালাজ করত মনের দুঃখে! সে গালাগালও আজকের বাস্তব গালাগালের চেয়ে মিষ্টি ছিল ঢের। তার ভেতর খানিকটা স্নেহের আমেজও মেশানো থাকত, কেননা অনেকক্ষেত্রে বাড়ির দু-একটি ছেলেও যে সে চুরিতে যুক্ত থাকত।
আর একটা ভোজের মওকা জুটত ভাইফোঁটা উৎসবে। সে আর এক বিরাট ব্যাপার! গ্রাম সম্পর্কে বোন হলেও অনেকেই ফোঁটা দেবার অধিকারী। ফোঁটা নিতেই হবে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে। ফোঁটায় ফোঁটায় সেদিন কপালের অবস্থা হত সঙিন,–একইঞ্চি ‘লেয়ার’ পড়ে যেত পুরু কাজলের আর চন্দনের। বাড়ি ফিরতাম চন্দনচর্চিত বনমালীর ‘পোজে’-নড়তে চড়তেও বড়ো কষ্ট হত সারাক্ষণ ভালোমন্দ খেয়ে খেয়ে। বাঙালি ভাই-বোনের প্রীতি-বন্ধনের সে কী মধুময় স্মৃতি। ভাইয়ের দীর্ঘ-জীবন কামনায় বোনেদের কী সে আকুল আন্তরিকতা! ভাইদের কপালে কাজল-চন্দনের ফোঁটা দিতে দিতে বোনেরা ছড়া কেটে বলত,
প্রতিপদে দিয়া ফোঁটা,
দ্বিতীয়ায় দিয়া নিতা;
যমুনা দেয় যমেরে ফোঁটা
আমরা দেই আমাদের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা।
আজ অবধি ভাইয়ের আমার যম দুয়ারে কাঁটা!
ঢাক বাজে ঢোল বাজে আরো বাজে কাড়া,
যাইয়ো না যাইয়ো না ভাইরে যমেরি পাড়া।
আজ অবধি ভাইয়ের আমার যম দুয়ারে কাঁটা!
পূর্ববাংলার ঢাকা জেলার প্রায় সর্বত্রই ভাইফোঁটার উৎসব চলত দু-দিন ধরে। প্রতিপদে দেওয়া হত ফোঁটা, আর দ্বিতীয়ায় বোনের দেওয়া প্রীতিভোজ। ভাইদের যমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে যে বোনেরা আজন্ম এমনি করে প্রার্থনা জানিয়ে এসেছে বছর বছর, তাদের সেই অকৃত্রিম প্রীতির বিনিময়ে কী করেছি আমরা তাদের জন্যে? দুবৃত্তদের হাত থেকে বোনেদের মান-মর্যাদাটুকু পর্যন্ত রক্ষা করতে পারিনি! ভগিনীর সম্মান আমাদের প্রাণের চেয়েও যে অনেক বড়ো, একথা বিস্মৃত হয়েছিল আত্মবিস্মৃত বাঙালি। তাই তো আজকের এই লাঞ্ছনা!
এরপর থেকেই একনাগাড়ে চলল উৎসব। শীতে কড়কড়ে ভাত, সরপড়া ব্যাঞ্জন আর পিঠে-পায়েসের সমারোহ। পৌষ-সংক্রান্তি, মহা-বিষুব সংক্রান্তি। বাস্তু পুজোর ধুম। হাজার বছরের পূজিত বাস্তু আজ যে এমনিভাবে ত্যাগ করে আসতে হবে তা কে জানত? হায় বাস্তুদেব, অদৃষ্টের কী পরিহাস, তুমিও আমাদের রাখতে পারলে না! মাঘের প্রচন্ড শীতে অনূঢ়া মেয়ের দল সূর্যোদয়ের পূর্বে পুকুরে স্নান করে দুর্বাদল মুঠো করে ধরে আবাহন জানাত প্রাণের প্রতীক সূর্যদেবকে,
উঠো, উঠো সূর্যঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া…
উঠিতে না পারি হিমালয়ের লাগিয়া,
হিমালয়ের পঞ্চকন্যা সূর্যে করল বিয়া–
লও লও সূর্যঠাকুর লও ফুল পানি!…ইত্যাদি।
এই যে কৌমার্যব্রত, এই যে কৃচ্ছসাধন, এই কি তার সফল প্রতিদান? এখানেই শেষ নয়। এরপর চলত উদিত সূর্যের আরাধনা। গোময় প্রলেপিত আঙিনায় ইটের গুঁড়ো, বেলপাতার গুঁড়ো, চালের গুঁড়ো, আবির হলুদের গুঁড়ো, তুষের গুঁড়ো দিয়ে কত বিচিত্র চিত্রাঙ্কন হত বাড়ির উঠানে। মাসান্তে ব্ৰত সাঙ্গ হলে কুমারীরা গ্রামের বিশিষ্ট লোকেদের খাওয়াত নিমন্ত্রণ করে। এই মাঘমন্ডল ব্রত পুর্ববাংলার পল্লিজীবনের এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। এমনি ভুলে-যাওয়া ব্ৰত যে কত ছিল আমাদের গাঁয়ে তার ইয়ত্তা নেই।
গোটা চৈত্র মাসটা ঢাকের বাজনায় মুখরিত থাকত। গ্রামের সব যুবকরা আর প্রৌঢ়রা সন্ন্যাসী সেজে নামত গাজনে। কী কঠোর ছিল সেই ব্রহ্মচর্য! এতে কোনো জাতিভেদের বালাই থাকত না। উচ্চনীচ সবাই একসঙ্গে পূতচিত্তে গুরু-সন্ন্যাসীর অনুশাসন মেনে চলত। ঢাক-পাট নিয়ে তারা গান গাইত মহাখুশিতে–অনেক সময় নিজেরাই বাদক, নিজেরাই গায়ক। শেষের দিকে রাত্রে ‘কালীকাছ’ অনুষ্ঠানটি ছিল বড়ো মজার। কেউ একজন অবিকল মা কালীর সাজে সজ্জিত হয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরত বাজনার তালে তালে। সঙ্গে সঙ্গে চলত দলবল। ঘুমন্ত চোখে ছেলে-মেয়েরা জেগে উঠে সময় সময় ভয়ে শিউরে উঠেছে। চিৎকার করে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে মায়ের আঁচলের তলায়। শেষ দিন হরগৌরীর যুগল মূর্তি গৃহস্থের দুয়ারে দুয়ারে কল্যাণ কামনা করত। রাত্রে হত ব্রহ্মচর্যের কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। নিজের চোখে দেখেছি দশ-বারো হাত দীর্ঘ জ্বলন্ত অগ্নিচুল্লির মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসীরা অবলীলাক্রমে পার হয়ে চলে যেত। সুতীক্ষ খাঁড়ার ওপর উঠে নৃত্য করত হাসিমুখে!
পার্লামেন্ট সভ্যদের মধ্যে লজ্জাকর গালাগালি আর কাদা ছিটানো দেখে মনে পড়ে যায় আমাদের গ্রামের সেই বকুল গাছ-তলার কথা। ওইখানে জমত পার্লামেন্ট! আলোচনা, সমালোচনা, বিচার, বিধান প্রভৃতি সব কিছুরই নিষ্পত্তি হত বকুলতলায়। আমাদের গ্রামে কোনোকালেই পুলিশ আসেনি। এখানকার লোককে কোনোদিন আইন-আদালত কেউ দেখেনি করতে। তারা ছিল নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, শাস্ত্রানুশীলনে রত। মেয়েরা ছিল ব্রত-পূজা পার্বণ নিয়ে ব্যস্ত। অশান্তি দেখিনি গ্রামের কোথাও।
আজ আমরা সবাই গ্রামছাড়া। বকুলতলায় বয়োবৃদ্ধদের মুখে শুনেছি, পূর্বে নদী ছিল এ অঞ্চলটায়। কালক্রমে চরা পড়ে পড়ে এবং মুসলমান আমলে ধীরে ধীরে বসতি হতে হতে গড়ে উঠল এই গ্রাম। আনোয়ার খাঁ বলে কে একজন প্রথম এই জায়গাটি আবাদ করে বলে তারই নাম অনুসারে নাকি গ্রামের নাম হয় আনোয়ারাবাদ বা আনরাবাদ। গ্রামের চতুষ্পর্শেই হিন্দু। একসঙ্গে এত হিন্দু খুব কম জায়গাতেই আছে। কিন্তু কালের গতি চিরকালই কুটিল। গ্রামের চারিদিক কানা বিল, ঘাগটিয়া বিল, গজারিয়া বিল, মহিষা বিল, দিলি বিল, রাজুখালি বিল ও ইনাম বিল দিয়ে ঘেরা। মনে হয় এই সপ্তবিল দিয়ে পরিবেষ্টিত করে প্রকৃতিদেবী শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্যেই আনরাবাদ তৈরি করেছিলেন। দুর্গের মতো চারধারে পরিখা অতিক্রম করে শত্রুর আক্রমণ সত্যিই ছিল এক অসাধ্য ব্যাপার। জানি না আবার আমরা পরিখা পেরিয়ে নিজের বাস্তুভিটেয় স্থান পাব কি না। আর কি কোনোদিন দুই বাংলা এক হয়ে আনন্দোৎসবে মাতবে না! কিপলিঙের ‘East is East and West is West কথাগুলোকে মিথ্যে প্রমাণিত করে আমরা কি জাতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ কোনোদিন আর দিতে পারব না? হিন্দু-মুসলমান আবার আগের মতো নির্ভয়ে মনের সুখে পরস্পরের হাত ধরে বেড়াতে পারবে না, সে-কথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না!
.
শুভাঢ্যা
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!
দৈন্যের দায়ে বেচে আসিনি, প্রাণের মায়ায় ছেড়ে এসেছি আমরা আমাদের সোনার মাকে। কবিগুরুর লক্ষ্মীছাড়া তিরস্কার আমাদের পক্ষে যথেষ্ট নয় জানি, কিন্তু যে ব্যবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে এমনি লক্ষ্মীছাড়া, গৃহহারা হতে হল সে ব্যবস্থার অধিকারীদের বিচারকর্তা কতকাল ঘুমিয়ে থাকবেন? এতগুলো অসহায় মানুষের আর্ত ক্রন্দনে বিশ্ব বিচারকের আসন কি টলে উঠবে না? যদি না ওঠে তাহলে তাঁর অস্তিত্ব নিয়েই যে প্রশ্ন। উঠবে!
কতটুকুই বা তার আয়তন। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মাইলখানেক আর মাইল-দেড়েক মাত্র হবে হয়তো। কিন্তু দশ দশ হাজার লোকের ঘন বসতি ছিল একদা এ গ্রামে। ঢাকা শহরের দক্ষিণ তীরে বাবুর বাজার ও কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে শুরু করে একটা পথ জিঞ্জিরা গ্রামের গোরস্থানের পাশ দিয়ে এবং আর একটি পথ শুভাঢ্যা খাল ঘিরে তার পশ্চিম তীর দিয়ে শ্রীশ্রীগোপীনাথ জিউর আখড়ার নিকট এসে মিলিত হয়েছে। ঢাকা থেকে আসতে হলে এ আখড়া হয়েই আসতে হয় আমাদের গ্রামে। শুভাঢ্যা ছিল হিন্দুপ্রধান গ্রাম।
বাংলার এককালীন বিখ্যাত মল্লবীর স্বর্গত পরেশনাথ ঘোষের (ঢাকার পার্শ্বনাথ) জন্মভূমি, তাঁর শৈশব ও যৌবনের লীলাক্ষেত্র শুভাঢ্যা। এ গ্রাম ক্ষাত্রশক্তির জন্যে চিরকালই ছিল প্রসিদ্ধ। কিন্তু সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার কাছে সে ক্ষাত্রশক্তির পরাক্রম যে অতিসহজেই পরাভব মেনে নিল। এ পরাজয়ের কলঙ্ক আমাদের ভবিষ্যৎ পুরুষ কি মোচন করতে পারবে না কোনোদিন? না তারা শুধু অভিশাপই দেবে তাদের পূর্বপুরুষদের?
নামকরা শিক্ষাবিদ ডা. প্রসন্নকুমার রায় ও কলকাতার এককালের প্রসিদ্ধ ডাক্তার দ্বারকানাথ রায় এ গাঁয়েই হয়েছিলেন ভূমিষ্ঠ। তখনকার দিনে সমগ্র বিক্রমপুর ও নিকটবর্তী অঞ্চলের নৈয়ায়িক পন্ডিত কৃষ্ণচন্দ্র সার্বভৌম এ গাঁয়েরই এক পর্ণকুটিরে বাস করতেন; টোলে সংস্কৃত শাস্ত্র শিক্ষা দিতেন তাঁর ছাত্রদের। তাঁদের স্মৃতিপূত আমার পল্লিজননীকে চোখের জলে বিদায় দিয়ে এসে আমরা আজও বেঁচে আছি। কিন্তু এ বাঁচা যে মরার চেয়েও করুণ, তার চেয়েও বেদনাদায়ক।
কিন্তু চরম আঘাতে ভেঙে পড়লেও, চূড়ান্ত দুঃখের মধ্যে আজও সগৌরবে স্মরণ করি আমার গ্রামের নওজোয়ানদের আর তাদের অভিভাবকদের। বিদেশি চক্রান্তে বার বার ঢাকায় শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর সেই উন্মত্ততা পার্শ্ববর্তী পল্লির শান্ত পরিবেশে করেছে অশান্তি উদগিরণ। আমার গাঁয়ের ওপরও তেমনি হামলা করার উদ্যোগ হয়েছে কয়েকবার। গোপীনাথ জিউর আখড়া অবধি এগিয়ে এসেছে উন্নত্ত জনতা–কিন্তু তার বেশি আর নয়। শুভাঢ্যার শুভবুদ্ধি তার সমগ্র সত্তা ও শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে আর আক্রমণকারী দলের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে প্রতিবার সেই সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে।
সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে পুড়ে। ‘৪৬ সাল। মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর তান্ডবলীলা চলছে কলকাতায়, ঢাকায়, প্রায় সারাবাংলা জুড়ে। বাইরে থেকে শুভাঢ্যার দিকেও এগিয়ে এল মারমুখো হয়ে একদল হাঙ্গামাকারী-সাম্প্রদায়িক ধ্বনি তাদের সুউচ্চ কণ্ঠে, সশস্ত্র তাদের বাহু। কিন্তু সুবিধা হল না। অল্প সময়ের মধ্যেই টের পেল তারা যে, এ বড়ো কঠিন ঠাঁই। দুর্জয় প্রতিরোধে স্তব্ধ হল সমস্ত কলরব, ব্যর্থ হল দূবৃত্তদলের অশুভ প্রবৃত্তি। শুভাঢ্যার জাগ্রত তারুণ্য সেবার শুধু তাদের আপন গ্রাম-জননীকেই রক্ষা করেনি, তাদের ঐক্যবোধ ও সাহসিকতায় রক্ষা পেয়েছে আশপাশের অন্যান্য পল্লিঅঞ্চলও। তবে তার জন্যে দক্ষিণাও বড়ো কম দিতে হয়নি শুভাঢ্যাকে। লিগ সরকারের পুলিশি গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে আমার গাঁয়ের তিন তিনটি বীর জোয়ানকে। সেই গদাধর, ফুলচাঁদ আর ক্ষুদিরামের স্মৃতিতর্পণই কি করে চলেছি আমরা সব-হারানোর তপ্ত আঁখি-জলে? এ তর্পণের শেষ কি নেই?
আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের লীলাক্ষেত্র, পিতৃপুরুষের ভিটে ও অতিআদরের জন্মভূমি সেই শুভাঢ্যা গ্রামটি ছিল কত বিচিত্র! গোপীনাথ জিউর আখড়া থেকে শুরু করে যে দো-পায়া সড়কটা অনেকটা খাল ও নালা ডিঙিয়ে গাঁয়ের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে, তারই একটি শাখা আবার গাঁয়ের পশ্চিমাঞ্চল বেয়ে আঁকাবাঁকাভাবে পশ্চিমপাড়ার খেলার মাঠে মূল সড়কটার সঙ্গে এসে মিশেছে। উত্তরপাড়া, পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়ায় বিভক্ত ছিল আমাদের গ্রামটি। তার প্রত্যেকটি পাড়া ছিল আবার নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের পেশা অনুসারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে ভাগ করা। যেমন কামারহাটি, মাঝিহাটি, বৈদিকহাটি ইত্যাদি। পুজো-পার্বণ, খেলাধুলো, গান-বাজনা প্রভৃতি প্রত্যেক অনুষ্ঠান নিয়ে এ তিন পাড়ায় কত হইচই প্রতিদ্বন্দ্বিতাই না ছিল! পশ্চিমপাড়ার জনবল ও অর্থবল বরাবরই ছিল বেশি। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাকি দু-পাড়াকে হার মানিয়ে দিত তারা। উত্তরপাড়ার জনবল ছিল কম। তাই ওপাড়ার ছেলের দল খেলাধুলো ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিত পশ্চিমপাড়ার সঙ্গেই।
পদ্মা পার হয়ে চলে আসতে হয়েছে। কিন্তু ছেড়ে আসা গ্রামের সেই পুরোনো স্মৃতি কি বিস্মৃত হওয়া যায়? পুজোর দিন ঘনিয়ে আসতেই আমাদের মতো প্রবাসীদের মধ্যে দেশে যাবার কী ধুমই না পড়ে যেত। কাপড়চোপড়, অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র গোছগাছ করে অনেকদিন আগে থেকেই আফিস ছুটির প্রতীক্ষায় দিন গুনতাম। আর দেশে যাবার দিনটিতে গাঁয়ে ফেরার মহানন্দে ঢাকা মেলে সে কী ভিড়! জোর ঠেলাঠেলি–সবাই উঠতে চায় গাড়িতে একসঙ্গে–তর সয় না কারুর। দাঁড়িয়ে তল্পা নিয়ে সবাই চলেছে দেশের বাড়িতে বাদুড়ঝোলা হয়ে। ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে যে কতবার গোয়ালন্দ পর্যন্ত চলে গেছি, তার ঠিক নেই। মনের আনন্দে কখন যে সুর ভাঁজতে শুরু করে দিয়েছি ট্রেন চলার তালে তালে তা নিজেরই হয়তো খেয়াল নেই। কখনো হয়তো বা জেনেশুনে মতলব করেই গেয়ে ফেলেছি,
ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল
আপন ঘরে।
আমার গানে দোলা লেগেছে আর-সব ঘরমুখো যাত্রীদের মনে। কিন্তু আজ পরমুখো হয়ে যেভাবে ঘুরে মরছি আমরা দোরে দোরে তার অবসান কবে ঘটবে, কবে ফিরে পাব আমরা আমাদের জীবনের সেই হারানো সুরকে! আমাদের মতো প্রকান্ড একটা গ্রামের আট-দশখানা দুর্গা পুজোর মধ্যে কেবলমাত্র দু-খানা ছিল সর্বজনীন। ব্যক্তিগত পুজো অপেক্ষা এ দুটি পুজোই হত খুব ঘটা করে ও হইহুল্লোড়ের মধ্যে। ঢাকিদের ঢাক বাজনায় সারাগ্রাম মুখরিত হয়ে উঠত। দশহরার দিন বড়ো বড়ো পেটওয়ালা পাটের নৌকো ভাড়া করে প্রতিমা ভাসান হত। নৌকোগুলোকে নানাস্থান ঘুরিয়ে রাত্রিবেলা বুড়িগঙ্গার অপর পার–ঢাকা শহরের ‘বাকল্যাণ্ড বাঁধে’ ভিড়ানো হত। বিরাট এক মেলা বসত সেখানে এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই আসত প্রতিমা দর্শন করতে। মিঠাই-মন্ডা খেয়ে সারারাত জেগে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর সবাই বাড়ি ফিরত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।
মনে পড়ে আমাদের পশ্চিমপাড়ার খেলার মাঠের কথা। পাঠ্যাবস্থায় গ্রীষ্মের লম্বা ছুটিতে ওইটুকুন চতুর্ভুজ মাঠে ফুটবল খেলার কী বিরাট ধুমই না পড়ে যেত! ওই মাঠেই অনুশীলন করে আমরা আশপাশের–এমনকী বিক্রমপুরস্থ দূর গ্রাম থেকেও কত শিল্ড-কাপ জয় করে নিয়ে এসেছি তার ঠিক নেই।
ছেড়ে-আসা গ্রামের আরও অনেক কিছুই আজ মনে পড়ে। মনে পড়ে, শীতের সময় শিবরাত্রির উৎসবের কথা। রাত্রি জাগরণের নামে সবাই যখন নির্জলা উপবাসে কাতর, আমরা তখন গাঁয়ের গৌর মুদি, আদিত্য ভট্ট আর শরৎ ভট্টদের খেজুর গাছের রস চুরি করে। খেতাম। শীতে ঠকঠক করে কাঁপত সবার শরীর। কিন্তু তাতে কী?
চৈত্র মাসে চড়ক পুজোর কথাও ভুলতে পারা যায় না। গাজন দলের লোকেরা বাড়ি বাড়ি কত সং দেখিয়ে বেড়াত, বেদে-বেদেনির নাচ নাচত। গাঁয়ের কবিয়ালরা চমৎকার নতুন নতুন গান বেঁধে তাদের সহায়তা করতেন। কুমাই মুদি আর ট্যানা সাধু প্রভৃতি সেসব জনপ্রিয় কবিয়ালরা আজ কোথায়?
আমি তখন একেবারেই ছোটো। পাঠশালার নীচের ক্লাসে পড়ি। আমাদের গাঁয়েরই এক বাড়িতে কবিগানের আসর বসেছে। আমিও তার একজন উৎসুক শ্রোতা। ওইটুকু বয়সে সে গানের অর্থ বোঝা দুরূহই ছিল আমার পক্ষে। তবু দু-পক্ষের কবির লড়াই যে খুবই উপভোগ করেছিলাম, সে-কথা আজও বেশ মনে পড়ছে। কী অস্বাভাবিক কবিত্বশক্তি দেখেছি সেকালের কবিয়ালদের। সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় উত্তর-প্রত্যুত্তর চলেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। কখনো চলেছে কেচ্ছা এবং পাল্টা কেচ্ছার তুফান আবার কখনো বা চলেছে ধর্মালোচনা। তার প্রায় সবটাই ছিল আমার উপলব্ধির বাইরে। তবু নেহাত হজুগে মেতে এবং কবিয়ালদের অদ্ভুত কবিত্বশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছি কবিগান শুনে। বড়ো হয়েও কবিগান শুনেছি নতুন নতুন দলের। সেসব গান বুঝেছি, তার অন্তর্নিহিত কথা উপলব্ধি করেছি। সখী-সংবাদের একটি গানের কয়েকটি পদ এখনও ভুলতে পারিনি। শ্যামের আগমন প্রতীক্ষায় সেজেগুজে প্রায় সারারাতই কাটিয়ে দিলেন বিনোদিনী রাধা। কৃষ্ণ যখন এলেন শ্ৰীমতীর কুঞ্জদ্বারে তখনকার পরিবেশ এবং তার প্রতিক্রিয়া কী নিখুঁতভাবেই না বর্ণনা করেছেন পুববাংলার কবিয়াল! দুই দলের বাদ-প্রতিবাদ ও হাস্যপরিহাস চলেছে অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু যখনি আরম্ভ হয়েছে তত্ত্বকথা বা অবতরণ করা হয়েছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের, তখনই সমগ্র জনতা হয়ে গেছে একবারে নীরব নিথর। কবি গেয়েছেন,
শ্যাম আসার আশা পেয়ে, সখিগণ সঙ্গে নিয়ে বিনোদিনী
যেমন চাতকিনী পিপাসায়, তৃষিতা জল আশায়
কুঞ্জ সাজায় তেমনি কমলিনী।।
সাজাল রাই ফুলের বাসর, আসবে বলে রসিক নাগর,
আশাতে হয় যামিনী ভোর, হিতে হল বিপরীত।
ফুলের শয্যা সব বিফল হল, অসময়ে চিকণ কালা এল–
রঙ্গদেবী তায় ধারণ করে দ্বারে গিয়ে।
এর পরেই সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে ধুয়া,
ফিরে যাও হে নাগর, প্যারী বিচ্ছেদে হয়ে কাতর
আছে ঘুমাইয়ে।
ফিরে যাও শ্যাম তোমার সম্মান নিয়ে।
এমনি ভাষায় কৃষ্ণকে সতর্ক করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি কবি। তিনি মুখের ওপর শ্যামকে আরও কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে তরুণী হত্যার দায়ে ফেলারও ভয় দেখিয়েছেন তিনি, বলেছেন শ্যামসুন্দরকে,
ছিলে কাল নিশীথে যার বাসরে।
বঁধু তারে কেন নিরাশ করে, নিশি শেষে এলে রসময়!
বঁধু প্রেমের অমন ধর্ম নয়।
তুমি জানতে পারো সব প্রত্যক্ষে, দুই প্রেমেতে যেজন দীক্ষে
এক নিশিতে প্রেমের পক্ষে, দুই-এর মন কি রক্ষা হয়।
প্যারী ভাগের প্রেম করবে না, রাগেতে প্রাণ রাখবে না,
এখন মরতে চায় যমুনায় প্রবেশিয়ে।
চাঁদোয়ার নীচে গাঁয়ের মাটিতে বসে এমনি সব কবিগান আর হয়তো শোনবার সুযোগ হবে না কোনোদিন!
‘চৈত্র-সংক্রান্তি’র আগের দিন হরগৌরী নৃত্য ও তার সঙ্গে নানাপ্রকার নাচগান হত। যখন ছোটো ছিলাম, স্কুলে পড়তাম–ওদের মতো আমরাও সং সেজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম –পয়সা সংগ্রহ করতাম। আর তার সদ্ব্যবহার করতাম চড়ক-পুজোর মেলায়। এ উপলক্ষে ‘চন্দ্রপিকারা’র মেলা কত নামকরাই না ছিল–দূর দূর গ্রাম থেকে কত লোকই না আসত এ মেলায়!
প্রখর গ্রীষ্মের ভীষণতা অসহ্য মনে হত। কিন্তু বর্ষাকালে আমাদের গাঁয়ের চেহারাই যেত পালটে। সমস্ত মাঠ, ঘাট, খেত-খামার জলে থই থই করতে থাকে বর্ষায়। দূর গাঁয়ের জলে ঘেরা পাড়গুলোকে ছোটো ছোটো দ্বীপ বলে ভুল হত। পায়ে-চলা পথ প্রায় সবটাই হয়ে যেত অদৃশ্য। নৌকোই তখন যাতায়াতের একমাত্র বাহন। ধান আর পাটগাছের সবুজ মাথার ওপর দিয়ে যখন মেঠো হাওয়া হুহু করে বয়ে যেত, সান্ধ্য পরিবেশে কী মনোরমই না লাগত সে দৃশ্য! বিকেলে নৌকো করে রোজ বেড়াতে যেতাম আমরা সে পরিবেশ, সে দৃশ্য উপভোগ করতে।
মনসা ভাসান উপলক্ষে শুভাঢ্যা খালের একপ্রান্তে হরির মঠ-সংলগ্ন বিরাট জলাভূমিতে ‘নৌকোবাইচ’ হত ও মেলা বসত। ছোটো-বড়ো সব ধরনের নৌকোই এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত সুসজ্জিত হয়ে। মাঝি ও দাঁড়িরা তালে তালে বৈঠা ফেলত লোকসংগীতের ঝড় বইত সঙ্গে সঙ্গে। নৌকোয় নৌকোয় ভাসমান মেলাই যেন এক-একটি বসে যেত। তাদের কোনোটাতে থাকত নানা পণ্যসম্ভার, কোনোটাতে ক্রেতা, কোনোটাতে বা দর্শক।
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের দিকে জলে যখন টান ধরত, তখনকার প্রধান আকর্ষণ ছিল মাছ ধরা। জল কমে আসায় তখন পুকুর, ডোবা, নালায় এসে আশ্রয় নিত মাঠের মাছগুলো। ছিপ, পলুই বা জাল ফেলে মাছ ধরার তখন মহাধুম পড়ে যেত চারদিকে। জীবন্ত পুঁটি ‘খোটে, খোটে উঠত বঁড়শিতে। বড়ো বড়ো শোল আর গজাল মাছ ধরারই বা কী আনন্দ! টোপ গেলার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে গিয়ে ছিপ টেনে মাছ তুলতে সে কী ছুটোছুটি! একটু দেরি হলে শিকার হাতছাড়া হবার খুবই সম্ভাবনা। মৎস্য ধরিব খাইব সুখে’–কথাটা পূর্ববাংলার এই নীচু জলাভূমির ক্ষেত্রেই বুঝি বেশি খাটে!
আমাদের ছেড়ে-আসা গ্রামের এমনি কত কথা–এমনি কত স্মৃতি আজ চোখের সামনে এসে ভিড় করে–মানসপটে দেখা দেয় পল্লিমায়ের এমনি কত স্নেহসিক্ত রূপ। জীবনের এতগুলো বছর যার স্নেহক্রোড়ে কেটে গেছে হাসি-কান্না রং-তামাশার মধ্য দিয়ে, তার কোলে ফিরে যেতে আবার যে সাধ যায়–ইচ্ছে হয় পরমপীঠস্থান আমার জন্মভূমিকে আবার আপনার করে ফিরে পেতে!
.
নটাখোলা
রাজনীতি কীর্তিনাশা পদ্মার ওপরেও টেক্কা দিয়েছে বিংশ শতাব্দীর মাঝখানে এসে! পদ্মা এক পাড় ভেঙে অন্য পাড়ে সমৃদ্ধির প্রাসাদ তোলে, কিন্তু ভেজাল রাজনীতি বড়ো নির্মম! পিতৃভূমি ত্যাগ করে আজ কত নিরাশ্রয় মানুষ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাপাত্র সম্বল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের দুঃখ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তার উপলব্ধি অধিকাংশ মানুষের মনকে স্পর্শও করছে না! সমস্ত জীবন সুখে কাটিয়ে শেষজীবনে যাঁরা দুটি ভাত-কাপড় আর একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে হন্যে হয়ে মানসম্মান হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁদের অবস্থার কথা ক-জন ভাবছেন দরদ দিয়ে? স্বাধীনতার জন্যে জীবন বিপন্ন করেছি আমাদের ভয়ে একদিন বিদেশি শক্তিও ভীত হয়েছিল, কিন্তু ভ্রাতৃবিরোধ সেই ঐতিহ্যটুকু হরণ করে সর্বদিক থেকে যেন সমস্ত বাঙালি জাতিকে হীন করে তুলেছে। বাংলার মানুষ আত্মীয়বোধে জীবন দিতে পারে, কিন্তু আজ হীন স্বার্থ বড়ো হয়ে উঠে মানুষের মানবতাবোধকেও যেন বিপর্যস্ত করতে বসেছে। আমাদের এই যে অপমৃত্যু এর জন্যে দায়ী কে? জাতীয় ঐতিহ্য বিসর্জন দেওয়া আর আত্মহত্যা করা দুই-ই যে সমান কথা।
পদ্মার কুলুকুলু ধ্বনি একদিন মনে যে আমেজ আনত আজ আর গঙ্গার কূলে বসে সে অনুভূতি যেন পাই নে। আমাদের অবস্থা যেন সেই ছড়া-বর্ণিত এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর’ গোছের। দুঃখ-লাঞ্ছনা ভোগ করে করে অবস্থা হয়েছে স্যাণ্ডউইচের মতো নিষ্পিষ্ট। গ্রামের মানুষ আমরা, শহরজীবনে অভ্যস্ত নই। তাই পদে পদে কলকাতায় পায়রা খুপি অস্বাস্থ্যকর ঘর নামধেয় বস্তিজীবন আমাদের শ্বাসরোধ করে তুলছে দিন দিন। এই দ্বীপান্তর থেকে কবে মুক্তি পাব তা ঈশ্বরই জানেন। ছেড়ে-আসা গ্রামকে আজ তাই বেশি করে মনে পড়ছে। খুঁটিনাটি জীবনকথা চোখের সামনে ভেসে উঠে মনকে উদাস করে তুলছে। বার বার। মুক্ত জীবন, মুক্ত বাতাস একে উপড়ে নিয়ে এই যে ইটকাঠ-ঘেরা কারাগারে আমাদের জোর করে বন্দি করে রাখা হয়েছে একে কি স্বাধীনতা আখ্যা দিয়ে সম্মানিত করা মৃতপ্রায় মানুষের পক্ষে সম্ভব?
পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ কূল ছাপিয়ে তীরবর্তীদের ভিজিয়ে দিত, আর সেই ঢেউয়ের বুকে দুলে দুলে চলত গাঁয়ের কতরকমের নৌকো। কোনো কোনোটার বুকে আঁকা থাকত ছোটো ছোটো লাল তারকা। গাঁয়ের ছেলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁকে বাঁকে, ডিঙি নৌকোয় মাছ ধরত; কৈবৰ্তরা ঘাটে ঘাটে তাদের ডিঙি ভিড়িয়ে সেই মাছ কিনে নিত। গ্রাম ছেড়ে সে মাছ চলে যেত দূরে–কত দূরে–কলকাতায়। সকাল থেকে সন্ধে নাগাদ পদ্মার বুকে চলত হাজার হাজার নৌকোর আনাগোনা–দেশি, বিদেশি ছোটো ছোটো ডিঙির মাঝখান দিয়ে পাল তুলে চলত বড়ো বড়ো হাজারমনি পাঁচ-শোমনি চালানি নৌকো–দূর থেকে মনে হত ছোটো ছোটো পাতিহাঁসের দলে চলেছে যেন এক-একটা বড়ো বড়ো রাজহংস।
নারায়ণগঞ্জ লাইনের স্টিমারগুলো গোয়ালন্দ বন্দর থেকে ছেড়ে এসে মাঝখানটায় কাঞ্চনপুরে ভিড়ত; সেখান থেকে স্টিমার ছাড়বার ভোঁ পদ্মার বাতাসে ভেসে ভেসে এসে পড়ত আমাদের স্টেশনঘাটে। সে ধ্বনি ইলামোরার মাঠ পেরিয়ে আইড়মাড়া বিলের ওপারেও শোনা যেত ভিন গাঁয়ে। পাটগ্রাম, পাঠানকান্দি, হেমরাজপুর, বাহাদুরপুর–এ পরগনার প্রায় সমস্ত লোকই জানত–শহর কলকাতা থেকে তাদের প্রবাসী কুটুম্ব ওই স্টিমারে আসছে। ভোরের সেই স্টিমারের ভোঁ, আর সন্ধ্যার গোয়ালন্দগামী স্টিমারের বাঁশি এ গাঁয়ের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের নর-নারীর মনে জাগিয়ে তুলত মিলনের আনন্দ, বিচ্ছেদের বেদনা। আজও সকাল-সন্ধ্যায় শোনা যায় সেই স্টিমারের ভোঁ। কিন্তু স্টিমারঘাটে নেই সে ভিড়–নেই আর সেই দোকানপাট। ছেলেরা পালিয়েছে, নয়তো মরেছে না খেয়ে–কৈবৰ্তরা পালিয়ে এসেছে রাণাঘাটে, নয়তো নবদ্বীপে। এখন কি সেই বিরাট চালানি নৌকো তেমনি পাল তুলে চলে? বড়ো বড়ো পানসিগুলো নদীপারের যাত্রী নিয়ে আজ কি পদ্মার বুকে পাড়ি জমায়? ঘাটে ঘাটে গাঁয়ের মেয়েদের কচকচানি, ছেলে-মেয়েদের জলে দাপাদাপি হয়তো ফুরিয়ে গেছে, শাঁখ বাজিয়ে ঘণ্টা পিটিয়ে গঙ্গাপুজোরও হয়ে গেছে হয়তো অবসান!
ছত্রিশ জাতের গ্রাম ছিল আমাদের নটাখোলা। ব্রাহ্মণপাড়ার ভট্টাচার্যদের বাড়িতে বাড়িতে ন্যায়ালংকার, বিদ্যালংকার, তর্কতীর্থ, তর্কতীর্থ, কাব্যতীর্থদের টোলে ঢুকে ঢুকে দেখেছি, টোলের প্রবাসী ছাত্ররা সুর করে পড়ত বেদ-বেদান্ত, স্মৃতি, তর্কশাস্ত্র, কাব্য, দর্শন। গোঁসাইপাড়ার গোস্বামীগণ শোনাতেন চৈতন্যচরিতামৃত। আধুনিক গাঁয়ের একমাত্র মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছেলেরা ইংরেজির দুরূহ উচ্চারণ অভ্যাস করত চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে। তাদের বিজাতীয় বিকৃত উচ্চারণে চমকে চেয়ে থাকত কলসি কাঁখে পদ্মার ঘাটে গমনরতা গাঁয়ের কুললক্ষ্মীরা। গাঁয়ের হাঁটা-পথে ধাবমান বলদজোড়াকে আপন মনে যেতে দিয়ে লাঙল কাঁধে করিমচাচা অথবা মহেন্দ্র বিশ্বাস সেই পড়য়াদের ইংরেজি বুলিতে হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত–ওরা হয়তো মনে করত গুহ, বসু ও মজুমদার বাবুদের ছেলেরা তাদের গালাগাল দিচ্ছে। সেই ব্রাহ্মণপাড়ার কোল ঘেঁষেই মস্তবড়ো দাসপাড়া। এ পাড়ায় থাকত গাবর দাসেরা। এদের কাজ ছিল সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ির কাজ করা–ভিটেয় মাটি তোলা, বাগান তৈরি করা, ধান মাড়াই করা ও ফাইফরমাশ খাটা। এতেই সুখে-দুঃখে পঞ্চাশ-ষাট ঘর দাসেদের চলত অনাবিল জীবনপ্রবাহ।
দাসেদের পাড়া পেরিয়ে গেলেই সাহাদের বাড়িঘর। এরা সবাই ছিল সম্পন্ন, যেমন শ্রী ছিল ঘরদোরের তেমনি ফুটফুটে আঙিনা। তাঁদের অনেকেই করত চালানি কারবার। সেই চালানির পেঁয়াজ, রসুন, তিল, সরষে, খেজুর গুড়, কলাই ছাঁদি-নৌকোয় ভরে গাঁয়ের মাঝিমাল্লারা ‘গাজি পাঁচপীর বদর বদর’ বলে পদ্মার বুকে ভাসিয়ে দিত সপ্তডিঙা মধুকর। এমন পাকা মাঝি ছিল তারা যে, কোনোদিন নৌকো ডুবে যায়নি তাদের, যদিও তারা সুন্দরবন পেরিয়ে এসেছে কলকাতায়, উজান ঠেলে গিয়েছে আসামের ধুবড়ি, তেজপুরে। কলকাতার পর ওরা গিয়েছে পাটনায়, কানপুরে-ফিরে এসেছে সরষের তেল নিয়ে, বিহারি আখিগুড়ে নৌকো ভরতি করে। আর আসাম থেকে ওরা এনেছে ধান আর ধান-কত ধান! এই গাঁয়ের ঘাট থেকেই রপ্তানি হত ঝিটকা বন্দরের প্রসিদ্ধ হাজারি গুড়, কিন্তু পরিমাণ ছিল বড়ো অল্প। আজকালকার ফিটকারি মেশানো নকল হাজারি গুড় সে নয়। আসল হাজারি গুড় বেশি সাদা হয় না–তাতে পায়েস রান্না করলে দুধও জমে যায় না। কাঁচা রসের সুমিষ্ট গন্ধে পদ্মার ঘাট মিষ্টি হয়ে যেত মাত্র দু-এক মন হাজারি গুড়ের সুগন্ধে। কোথায় লাগে তার কাছে। ভীম নাগের সন্দেশ-কলকাতার নলেন গুড়! যা খেয়েছি আজও যে তার আস্বাদ ভুলে যেতে পারছি না। হাজারি শেখ জন্মেছিল ক-পুরুষ আগে জানি না, হাজারি নিজে কিন্তু ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমায় অমর হয়ে রয়েছে–থাকবেও।
সাহাপাড়ার ডান পাশেই পুবের দিকে আইড়মারার মাঠের কোল ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে ছিল তাঁতিপাড়া-মুসলমান কারিগর। মাঝখানটায় একটা মাত্র গেঁয়োপথের ব্যবধান–হিন্দু মুসলমানের সীমান্তরেখা। দিবারাত্র শুনতাম খটাখট শব্দ। তাদের মাকু চালানোর আওয়াজ আইড়মারার বিল পেরিয়ে, পাঠানকান্দির গ্রাম ছাড়িয়ে শোনা যেত ইছামতী নদীর কোলের বন্দরে–লেছড়াগঞ্জে। বন্দরের ব্যাবসায়ীরা সেই তাঁতিদের কাপড়, শাড়ি, চাদর, গামছা বিকিয়ে দিত ঘরে ঘরে। পঞ্চাশের মন্বন্তর এল–সেই তাঁতিকুল সুতোর অভাবে বেকার হয়ে গেল, না খেয়ে শুকিয়ে মরল অনেকে। দুর্ভিক্ষের পরে এল মহামারি! গ্রাম উজাড় হয়ে যায়! আমি নিজে ধরনা দিলুম তৎকালীন চিকিৎসামন্ত্রীর কাছে–ফল হল না কিছু। সামান্য কজন কর্মী যতটা পারি করলাম। স্বাভাবিকভাবেই মরে মরে ফুরিয়ে এল সেই মহামারি। তাঁতিপাড়ার আওয়াজ তখনও বন্ধ হয়নি। দেশ ভাগ হবার পূর্ব পর্যন্ত চলেছে কোনোক্রমে। তারপরে ধীরে ধীরে থেমে গেছে–সাতাশ ঘরের সাতঘর হয়তো টিকে আছে। তাঁত বেচে ফেলেছে–খেতখামারে নিড়ানি দিয়েছে তারা–নিড়ানো ফুরিয়ে গেছে, এখন তারা নিকটের শহরের পথে পথে হেঁটে বেড়ায়,–পাকিস্তানি কোঁদল শোনে–আর ভাবে, এ জীবনের আর কত বাকি!
চাষিরা ছিল দু-জাতের। হিন্দুও ছিল, তবে মুসলমানই বেশি। তারা নির্দিষ্ট কোনো পাড়ায় থাকত না। যেকোনো দিকে হিন্দু-মুসলমানের ঘর পাশাপাশিই ছিল। ব্রাহ্মণ হলেও, আমাদের বাড়িটার ঠিক গা ঘেঁষে তিনদিকেই ছিল মুসলমান প্রতিবেশী–সবাই চাষি। জহিরুদ্দিন শেখের স্ত্রী আমাদের ছিলেন বড়োচাচি, বুধাই শেখের সুন্দরী স্ত্রীকে বলতাম ‘ধলা-ভাবি’ গোপাল শেখের স্ত্রীকে তো ভাবি বলেই ডাকতাম–কারণ গোপাল আমার বাবাকে ‘বাবা’ই বলত। আমার বাবা ডা. হৃদয় ভট্টাচার্যকে সারাপরগনার লোকেই চিনত। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলের প্রথম পর্যায়ের পাশ করা ছাত্র ছিলেন তিনি, পাশ করা হৃদয় ডাক্তার। গোপাল একবার কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর চিকিৎসায় বেঁচে উঠে পিতৃদেবকে বাবা বলে ডেকে চিকিৎসার দক্ষিণা দেয়–সেই থেকে চিরদিনই ছিল সে আমাদের বড়ো ভাই। আমাদের সুখের দিনে বাবরি চুল ঝুলিয়ে লাঠি নিয়ে নাচত আর দুঃখের দিনে–শোকে-সন্তাপে আমাদের উঠোনে গড়াগড়ি দিয়ে সবার সঙ্গে সমানে কাঁদত। ধমক খেয়ে বাগানের আমগাছ কেটে শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থাও করে দিত। মোল্লাপাড়ার মাজুদিদিকে আজও পারি না ভুলতে। আমার মাকে তিনিও মা বলেই ডাকতেন। রাত্রির আঁধারে বোরখা পরে, চাকরের হাতে লণ্ঠন দিয়ে চটিজুতো পায়ে তিনি সপ্তাহে প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়ি-তখনকার দিনে মেয়েদের জুতো পরার রেওয়াজ হয়নি। কাজেই মাজুদিদির ওই অপরূপ মূর্তিটা চোখে বেশি করেই বাজত। দিদির কাজ ছিল ভারি মজার। যত রাজ্যের ভালো ভালো জিনিস চাকরকে দিয়ে বয়ে নিয়ে এসে আমাদের সকল ভাইবোনকে, মা, দিদিকে সামনে বসে খাইয়ে তবে তিনি যেতেন। কোনো নতুন জিনিস তাঁর আগে আমাদের কেউ এনে দিতে পারত না। দিদি ছিলেন নিঃসন্তান–আমাদের কোলে না নিতে পারলে তাঁর ভালো লাগত না। কতদিন পন্ডিত মশাইয়ের মার খাবার ভয়ে পালিয়ে গেছি মাজুদিদির বাড়িতে সেই পতিত জমির ওপারে। মাজুদিদির কোলে বসে কতদিন মজা করে দুধ-ভাত খেয়েছি। মর্তমান কলা দিয়ে আর পুরোনো খেজুরগুড় মিশিয়ে। আমার ব্রাহ্মণত্ব তাতে ঘোচেনি। মা জানতেন, বাবা তো ছিলেন সাহেব। নিষেধের প্রাচীর সেই পুরোনো দিনে আমাদের ভ্রাতা-ভগ্নীর সম্বন্ধটাকে ঘিরে ফেলতে পারেনি। এর সঙ্গেই মনে পড়ে সেই ছোটোবেলার শীতের দিনের কথা। গাছের তলায় সকালের রোদ্দুরটা আগে এসে পড়ত আমাদের বাড়িতে। সেইখানটায় ছেঁড়া চট বিছিয়ে ইস্কুলের পড়া তৈরি করতুম। এক এক ফাঁকে ক্ষেপু শেখের স্ত্রী ‘চাচি’ হাতছানি দিয়ে ডাকতেন। ছুটে গিয়ে কাঁটাল পাতায় করে সদ্য তৈরি নতুন গুড়ের ‘চাঁচি’ নিয়ে মহাআনন্দে রোজ চাখতুম। পঞ্চাশের ধাক্কায়ও বেঁচে ছিলেন চাচি, যদিও তাঁর তিনকুলে কেউ ছিল না। কিন্তু যেই আমরা দেশ ছেড়েছি চাচি আর বেঁচে থাকতে চাইলেন না। শুনেছি তাঁকে পদ্মার ভাঙাপারের ফাটলে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দিয়েছে গাঁয়ের দয়ালু মুসলমানেরা, ছাফন কাফনের খরচা জোটেনি। এই কলকাতায় বসে যতদিন ভেবেছি ছুটে গিয়ে চাচির সেই কবরখানা দেখে আসি, আর ফেলে আসি সেখানে তাঁর দেশছাড়া এক জিম্মি-ছেলের কয়েক ফোঁটা অশ্রু। রাক্ষুসি পদ্মা কি সে কবর এখনও রেখেছে?
গ্রামের একটাই ছিল প্রধান রাস্তা–প্রথমে লোকাল বোর্ডের, পরে উন্নীত হল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে। পদ্মাপার হতে মহকুমার সদর মানিকগঞ্জ পর্যন্ত ষোলো মাইল রাস্তা। সেই পথের পাশ ধরেই থাকত কৈবৰ্তরা। তারা ছিল প্রায় দু-শো ঘর। মাছের চালানি কারবার করত তারা। স্টিমারঘাটে বরফ দিয়ে কলকাতায় এত মাছ তারা পাঠাত যে স্টিমারকে কোনো কোনো দিন তারা দু-ঘণ্টাও আটকে রাখত। এখন তারা আর বেশি কেউ নেই, দু-এক ঘর হয়তো আছে। জেলেরা রাস্তার পারে মেলে দিত কতরকমের জাল-ইলিশধরা, চিংড়িমারা, নদীবেড় দেওয়া। তারা সব দেশ ছেড়ে এসে নবদ্বীপের আশপাশে ‘হা গৌরাঙ্গ’, ‘হা গৌরাঙ্গ’ করছে এখন। কুমোরদের সংখ্যা খুব ছিল না বটে, তবে দুটো বাড়িতে হাঁড়ি-কলসি যা হত তাতে গ্রামের তৈজসপত্রের অভাব মিটে তো যেতই, তারপর তারা নৌকো করে বাড়তি হাঁড়ি-কলসি সুন্দরবনে বিকিয়ে দিয়ে নৌকোভরতি ধান নিয়ে ফিরে আসত ফি-বছর। তারা পাট উঠিয়ে কোথায় গেছে জানি না। এ ছাড়া ছুতোরপাড়া, কামারপাড়া নিয়ে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম আর কোথাও গিয়ে পাব কি না সন্দেহ। অভাব হয়তো ছিল, তবে অভাবের বোধ ছিল না বলেই জিনিসের অপ্রতুলতার কথা শোনা যায়নি সে গাঁয়ে।
বারোমাসে তেরো পার্বণ, আর তার ঘটাও ছিল তেমনি। দেখতে দেখতে কার্তিক মাস পড়ে যেত। ধান ঘরে উঠেছে, পথঘাট কিছু শুকিয়েছে, লেগে গেল বরোয়ারি কালীপুজোর ঘটা এ উপলক্ষে। ভদ্র পাড়ায় হত কালীর আসরে যাত্রাগান, শখের থিয়েটার, কবিগান, জারিগান। হিন্দু-মুসলমান চাঁদা দিয়ে, পান তামাক খেয়ে একত্রে গলাগলি করে রাতের পর রাত গান শুনত–কবিদের গানের লড়াই, ছড়ার কসরত শুনে তারিফ করত। মদন কবিওয়ালা, ছমির বয়াতি উভয়েরই ছিল গ্রামের মহলে মহলে সম্রাটের সম্মান। চৈত্রসংক্রান্তি, রথ ও দোলের মেলায় গ্রামে চলত সস্তা বিপণির বিকিকিনি, কত ভিন গাঁয়ের কত জিনিসের হত আমদানি! চার পয়সা, আট পয়সার পুতুল থেকে এক পয়সার বাঁশি পর্যন্ত কিনে আমরা কত যে সুখী হয়েছি, সে সুখ আর কি ফিরে পাব? দশহরাতে নিজেদের দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে জেলেদের বড়ো বড়ো ছাদি-নৌকোয় বের হতুম আমরা। সাতখানি প্রতিমার সঙ্গে চৌদ্দজন ঢাকি বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে মরাগাঙের স্থির জলে বেদনার মূৰ্ছনা বইয়ে দিত। দু-পারের হিন্দু-মুসলমান গৃহবধূরা সজল চোখে বিদায় দিত দেবী জগন্মাতাকে। বাইরের নৌকোতে ঘুরে ঘুরে খঞ্জনিতে তাল ঠুকে গাইত মুসলমান বয়াতি বিদায়ের বিসর্জন গান। দশহরার পরের দিন সকল বাড়িতেই লেগে যেত তাড়াহুড়ো। মাইলখানেক দূরে বাহাদুরপুরের ঘাটে যেতে হবে ইছামতী নদীর কিনারায়। ওইখানেই হত নৌকোবাইচ–এক-শো হাতের, আশি হাতের লম্বা নৌকোয় পাল্লা দিয়ে বেয়ে আসত কত শত শত নৌকো নীল, লাল, সবুজ নিশান উড়িয়ে। সব নৌকোই মুসলমান মাঝিদের–গলুইয়ের ওপর কালো বাবরি উড়িয়ে, পিতলে বাঁধানো বৈঠা ঘুরিয়ে পঞ্চাশ-ষাট জন বাইচ-খেলোয়াড়কে সমান তালে, সমান জোরে জল টেনে চলতে তারা সংকেত করত। এ যেন মহাযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির ইঙ্গিতে যুদ্ধ করে চলেছে সৈন্যদল–সেনাপতি অলক্ষ্যে নন, পুরোভাগে। প্রতিযোগিতা চলত দেশবিদেশের নৌকোয়, পাল্লা দিত গ্রামে গ্রামে, মহকুমা মানিকগঞ্জের পরগনায় পরগনায়। যে বছরে পাটের দাম যত বেশি মিলত, সেই বছরে তত জোর পাল্লা। হারজিতের সমাধান কোনোদিন দেখতে পেতুম না, কারণ কোথায় যে ওই পাল্লা শেষ হত, কত মাইল দূরে, তা শুধু ইচ্ছামতী নদীই বলতে পারত। আমরা দেখতুম শুধু উল্কাবেগে ছুটে চলেছে এক এক জোড়া নৌকা। নয় তো দেখেছি, ধীরে ধীরে বেয়ে চলেছে একখানি বাইচের নৌকো–চার-পাঁচজন বয়াতি গায়ক ঘুঙুর পরে নেচে নেচে খঞ্জনি বাজিয়ে গেয়ে চলেছে বয়াতি গান–নিজেদের রচনা, বর্তমান যুগধারা ও অতীতের সুখ-দুঃখের ব্যঙ্গ প্রকাশ। দেশ ভাগ হবার পরে শেষ গান শুনেছি বয়াতির কণ্ঠে বিষাদের সুরে,
কলি যুগে জান বুঝি আর বাঁচে না–
কোথায় থেকে তুফান আইল,
ঘর বাড়ি সব উড়াইয়্যা নিল,
মানুষজনে খাইত্যাছে আইজ কুত্তা শিয়ালে।
সেই বয়াতি সুরের বিদায়ক্রন্দন আজও কানে বাজে–কলকাতার সুর-লয় সংযোগে আভিজাত্যমন্ডিত যেসব ভাটিয়ালি গান আজ শুনছি, তার চাইতেও গভীর করে যে সেই বৈঠার তাল, খঞ্জনির মূৰ্ছনা মনেপ্রাণে দাগ কেটে রেখেছে। তেমনটি কি আর শুনব? ছন্দহীন পঙক্তিবিহীন সেই গেঁয়ো কবির মর্মভরা কবিতা, ইচ্ছামতীর জলেই কী চিরকালের মতো বিসর্জন দিয়ে এলাম?
পৌষ মাস এসে পড়ল। এর সময়েই হত আলিজান ফকিরানির দরগায় বছরের উৎসব। সারামুলুকের হিন্দু-মুসলমান ছুটে যেত ফকিরানীর আশীর্বাদ, দোয়া নেবার জন্যে। তার দরগা দুধে দুধে ধুয়ে দিত, তার সর্বজনীন সিন্নির খিচুড়ি মাথায় করে নিয়ে যেত হিন্দু-মুসলমান সবাই। পঙ্গু ফকিরানী তাঁর রুক্ষ জটাজালপূর্ণ মাথাটি নাচিয়ে নাচিয়ে একবার এর আর ওর গলা জড়িয়ে ধরে ‘আল্লার জান, বাঁচো’ বলে ছুটতেন এধার-ওধার। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে এই গেঁয়ো তাপসী রাবেয়া’র আশীর্বাণী মাথায় করে কৃতার্থ হত সবাই। মকিম শেখের কোলে চড়ে কতবার গেছি সেই প্রসাদী সিন্নি খেতে। সেই ফকিরানীও আজ নেই–সিন্নিও ফুরিয়ে গেছে। দরগা নাকি পদ্মার জলে অতলে তলিয়ে গেছে। ভোর হলেই এখনও কানদুটো শুনছে শেষরাতের আজানধ্বনি, উদ্ধব বৈরাগীর উদাসিয়া গান। চৈত্র মাসের কালীকাঁচ আর বুড়ো মোল্লার বহুরূপ এখনও যে চোখের সমুখে নেচে বেড়ায়! ঘোষালের যাত্রার আসরে ভীমের গদা এখনও যে বনবন করে মনের চোখের সামনে ঘুরছে!
কলকাতায় পথে-ঘাটে কতরকমের পাগলই না দেখছি–তবু দিনু পাগলাকে ভুলতে পারি না। সেই দিনু শেখের মেয়েটাও মরে গেল–আগের বছর বউ মরেছে কলেরায়, দিনু পাগল হয়ে গেল। ঘন কালো সুঠাম দেহে, একমাথা ঝাঁকড়া কালো চুলে সে পরত বেছে বেছে ধুতরো ফুল। সুদে ও তস্য সুদে তার ভিটেমাটি আগেই গ্রাস করেছিল মহাজনরা–তাই ছিল না তার কিছুই। কালীতলায় পড়ে থাকত রাতের বেলায়, দিনভর বসে থাকত সে পদ্মার ঘাটে। বউ-ঝিরা তার রক্তচক্ষু দেখে একটুও ভীত হত না–আর দিনুর কড়া পাহারায় একটি বাচ্চাও জলে ডুবতে পারত না। একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে তো–দিনু ডাঙা থেকে লাফিয়ে পড়েছে–জল থেকে তুলেছে ডুবন্তকে। খিদের বেলায় একটা কলাপাতা নিয়ে যেমন খুশি ঢুকে পড়েছে যেকোনো বাড়িতে–পেয়েছে পেটভরা ভাত। স্ফুর্তি করে খেয়ে ‘আল্লাকালী’, ‘আল্লাকালী’ বলে লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেছে বাইরে, দু-চোখের বাইরে। কিছুক্ষণ বাদেই দেখা যেত তাকে, চাষির হাতের লাঙল কেড়ে নিয়ে সে চালাচ্ছে বলদ—’হেঁইও–হট’–ততক্ষণে আইলের ওপর বসে চাষি ভাই একটু তামাক খেয়ে নিচ্ছে। সে আর কতক্ষণ! একটু পরেই দিনু ছুটেছে পদ্মার তীরে।
সেই শান্ত পাগল দিনুই একবার ভীষণ কান্ড করে বসল। শীতের মধ্য রাত্রি, হরি পোদ্দারের খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে সে জোর চেঁচাতে শুরু করল-”ও পোদ্দার মোশাই–দ্যাহেন কত্তা, কী নাল ঘোড়া দাবাড় দিছি। যত লোকজন হই-হুঁল্লোড় করে আগুন নেভায়, দিনু ততই নাচে বগল বাজিয়ে, কী সুকর্মই না সে করেছে। অগ্নি নির্বাপিত হল। তারপরে গাঁয়ের মাতব্বর ব্যক্তিরা বসে গেলেন বিচার করতে। পঞ্চায়েতি বিচার করতে। পঞ্চায়েতি বিচারসভায় হিন্দু-মুসলমান দাস-কৈবর্ত সকলেই থাকতেন। দিনুকে জিজ্ঞাসা করা হল, কেন সে এমন কাজ করল। সাফ উত্তর দেয় দিনুজারা, বড়ো কড়া জারা (শীত)। সেই বছর থেকে যেবারই বেশি শীত পড়েছে, গাঁয়ের লোকে চাঁদা করে দিনুর জন্যে শীতের কম্বল কিনে দিয়েছে, নয় তো জোগাড় করে দিয়েছে। দিনু আর শীতেও কাঁপেনি–লাল ঘোড়াও আর ছুটোয়নি। দিনু আর নেই। কিন্তু কলকাতায় এসে দেখি সেই দিনু পাগলার মৃত্যু হয়নি। সারাদুনিয়ার ঘরে ঘরে দিনু পাগলার জন্ম হয়েছে–তারা ছুটিয়ে আসছে লাল ঘোড়া। এবার হরি পোদ্দারের দলের যে কী দশা হবে ভেবে পাইনে কিছু, তাদের রুখতে হলে যে কম্বলের দরকার, তা দেবে কে?
চৈত্র মাসের খরার দিনে দেখতুম গাঁয়ের চাষি-ছেলেরা মাঙনে বের হত। ঝকঝকে একটা ঘটি হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে, গোরুর দড়ি দিয়ে আম্রপল্লব-বাঁধা পাঁচন বাড়ি কাঁধে নিয়ে ঘরে ঘরে সিন্নির চাল মেগে নিত। বলত একদিলের সিন্নির চাল দেন। কোন আল্লাদেবতা যে এই ‘একদিল’ জানতুম না। এখন বুঝি একদিল মানে একপ্রাণ। এত বড়ো দেবতার কৃপা কুড়োতে হিন্দু ও মুসলমান চাষিদের মধ্যে বিভেদ হত না। সেই ভিক্ষালব্ধ চাল দিয়ে সম্মিলিত যে সিন্নি পতিত ভিটেয় হত–তাতে হিন্দু-মুসলমান সবাই যোগ দিয়ে বৃষ্টির কামনা করত। মন্ত্রতন্ত্র কিছু ছিল না। একপ্রাণের কামনার ফল ফলত বই কী–হয় শীঘ্র, নয় বিলম্বে।
সেই ছেড়ে-আসা অবিখ্যাত আমার গ্রাম! কলকাতার মিলের চিমনি ভোরের বেলাতে ভোঁ করে ওঠে-ঘুম ভাঙতেই শুনি! মনটা রোজই ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ওই গোয়ালন্দের স্টিমার কাঞ্চনপুরঘাট ছেড়ে এসেছে–যাবে নারায়ণগঞ্জে, বাঁশি বাজাচ্ছে–ভোঁ-ভোঁ।
.
সোনারং
খাওয়া পরা দেখছি হল ভার,
মায়ের মুখ কেবল মনে পড়ে;
তাদের কথা বলছ কিবা আর,
দূর থেকেও সঙ্গ নাহি ছাড়ে।
খাওয়াপরা সকল দিছি ছেড়ে,
ছেলেগুলোই সব নিল রে কেড়ে!
কতকাল আগে কোন কবি এ গান গেয়ে গেছেন তা সঠিক না জানলেও তাঁর দুঃখের সঙ্গে আমাদের দুঃখের মিল দেখে আশ্চর্য বোধ করছি। আজ আমরা জন্মভূমি ছাড়া হয়ে নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করেছি, আমরা মাকে ভুলতে চাইলেও তিনি চোখের সামনে উঠছেন ভেসে বার বার। স্মৃতিসঙ্গ কিছুতেই মুক্তি দিচ্ছে না,–তাঁর দুরন্ত ছেলেগুলো তাঁকে কেড়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে! মাকে ছেড়ে প্রবাসী হয়েছি, প্রবাসযাত্রার শেষ কবে হবে জানি না।
বার বার মনে পড়ছে আমার গ্রাম সোনারং-এর কথা। আশা-নিরাশার স্মৃতি মনের মণিকোঠায় ভিড় করে রয়েছে জট বেঁধে, মন হাঁপিয়ে উঠছে চারপাশের দেওয়াল-ঘেরা শহুরে আবহাওয়ায়। এখানে মুক্তি নেই, উদারতা নেই, ছুটি নেই, ফাঁক নেই। আমার গাঁয়ের উন্মুক্ত প্রান্তরের উদার হাতছানি কোথায় পাব শান-বাঁধানো কলকাতার বুকে? হৃদয়বীণার তারে মরচে ধরেছে–তাকে হয়তো আর সুরে বাঁধতে পারব না! সুর কেটে যাচ্ছে তাই বার বার।
আমার গ্রামটির ইতিহাস শান্তির ইতিহাস। ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে সে গ্রাম মহান। আজও সেখানে বৌদ্ধযুগের শান্তির ধ্বজা উড়তে দেখা যায়। সেখানে রয়েছে বৌদ্ধযুগের ধ্বংসাবশেষ। গ্রামের কবি হরিপ্রসন্ন দাশগুপ্ত মশায়ের কাছে শুনেছি সেই আলো-ঝলমল তথাগতের শান্তির ললিত বাণীর মনোরম গল্প। আজও বর্ষার দিনে যেখানে বাঁকাজল খেলা করে তার তলায় বিশ্রাম করে তথাগতের সারিবদ্ধ সোনার দেউল। জন্মভূমি পক্ষবিস্তার করে রক্ষা করছেন বিস্মৃত ইতিহাসকে। ভারতবর্ষের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্যেই চিন-জাপান পর্যন্ত ভারতকে গুরু বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তাঁর শান্তির বাণীকে বর্বর মানুষ আর ব্যর্থ পরিহাস করতে পারবে না–সলিলসমাধি সৌধরেখা আজ জলরেখায় গেছে মিশে! মনে পড়ে প্রথম যেবার ঢাকা শহরে ক্ষুদ্র মিউজিয়ামটি দেখতে যাই, সেবার প্রথমেই দেখতে পাই সুউচ্চ স্কুপের ওপর ভগবান বুদ্ধের স্তব্ধ মূর্তিটি। আপনা আপনিই সেদিন তাঁর পায়ে আমার মাথা পড়েছিল লুটিয়ে। সেখানে দাঁড়াতেই কানে বেজে উঠেছিল কবিরাজ গোস্বামীর গানটি,
উপজিল প্রেমবন্যা, চৌদিকে বাঢ়য়।
জীবজন্তু কীট আদি সকলে ডুবায়।
বুদ্ধের অনন্ত মাধুরীপূর্ণ প্রেম ও দয়ার অমৃত মন্ত্র পুণ্যবতী বাংলা মাকে তো বাঁচাতে পারল না? বর্ষার স্ফীতবক্ষা পূতসলিলা জাহ্নবীধারার মতো হিংসা-দ্বেষকে তো প্রেমবন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারল না মানুষ! হৃদয়-আত্মা বাসনাহীন নির্লোভ হয়ে চিদাকাশে বেলুনের মতো অদৃশ্য হতে পারে না কি? কেন আজ আমাদের পদে পদে পরাজয়ের গ্লানি। সংসারী মানুষ ইন্দ্রিয়সুখের জন্যে আর কত নীচে নামবে? শাক্যসিংহের মতো আজ আমাদের কে বলবেন, ‘সকলই জ্বালাময়। কীসের অগ্নিতে জ্বলিতেছ? আমি তোমাদিগকে বলিতেছি,-ক্রোধের জ্বালায় দগ্ধ হইতেছ,–মোহের শিখায় দগ্ধ হইতেছ!’
সেদিন বুদ্ধমূর্তির সামনে একটি ফলক দেখে চমকে উঠেছিলাম,–মূর্তিটি আমার গ্রামের একটি পুষ্করিণী খননকালে পাওয়া গেছে। জানি না সেই সদাহাস্যময় বুদ্ধদেবের প্রতিমূর্তি আজও ঢাকার জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে কি না! যাঁর চরণতলে একদিন কোটি কোটি মানুষ নিয়েছিল শান্তির পাঠ, আজ তিনিই শান্তিতে আছেন কি না ভাবতে হচ্ছে। সর্বদেশে সর্বকালেই দেশের বুকে জগাই মাধাই মাথা নাড়া দিয়েছে, কিন্তু এরা কি শেষ পর্যন্ত ভুল বুঝতে পারবে? পারবে তো আবার সবাইকে বুকে টেনে নিতে? আমাদের আশা ব্যর্থ হবে কি না জানি না, কিন্তু সেই সুদিনের প্রতীক্ষাই করছি সব সময়।
স্টিমারঘাটে নামতে নামতেই শরীরে জাগত কেমন অনির্বচনীয় একটা রোমাঞ্চ, সোনালি স্বপ্নের আবেশে মন হয়ে উঠত আবেশময়, সেখান থেকেই পেতাম সোনারং-এর পরশ। মাঝিদের আহ্বানে চমক ভাঙত হঠাৎ। কানে এসে বাজত–’আহেন কর্তা, আমার নায়ে আহেন, যাইবেন কৈ?’ দরদস্তুর বা কথাবার্তার মধ্যে না গিয়ে শুভ্র-শ্মশ্রু বৃদ্ধ মাঝির নৌকোয় গিয়ে উঠে পড়তাম বাক্স-বিছানা নিয়ে। আমার নির্লিপ্ত ভাব দেখে মাঝি কী বুঝত জানি না, তবে আশ্বাস দিয়ে বলত, “আমিই যামু কর্তা, ভারা যা অয় দিয়েন অনে!’ নৌকোয় আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসার পর প্রশ্ন করতাম, “সোনারং চিনো?’ হাসতে হাসতে সে জবাব দিত, ‘হোনারং চিনি না? কন কী কর্তা, হেই দিনও আইলাম আপনেগ গেরাম থিঙ্কে। সুতরাং আর চিন্তা কী? পাটাতনে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ি নিশ্চিন্ত আরামে! নৌকো ছাড়া অন্য যান কিছু নেই গ্রামে যাওয়ার। গ্রাম পত্তন যিনি করেছিলেন তিনিও এসেছিলেন এই নৌকো করেই মনের খুশিতে গান গাইতে গাইতে। বেতবন আর হিজলের বুক চিরে নৌকো ঠিকই পথ চিনে বার বার এসেছে গেছে যাত্রী বুকে নিয়ে। আজ ভাবি সে জঙ্গলে যে শয়তান লুকিয়ে ছিল তা কারও নজরেই পড়েনি।
নৌকো ভ্রমণ চুপচাপে হয় না,–পেঁচার মতো মুখ করে আর যাই করা যাক নৌকোতে বেড়ানো যায় না। তাই মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে মাঝির সঙ্গে আলাপে রত হতাম। আলাপ জমাতে মাঝিদের কেউ বলে চাচা, কেউ বলে মামু। আমি মামু বলেই গল্প আরম্ভ করতাম। পেটে তখন পদ্মার বাতাস ক্ষুধার উদ্রেক করেছে, তাই আমার প্রথম কথা ছিল সেদিন, ‘মামু, খুদা তো বড়ো লাগছে, বাজার-টাজার আছে নাকি সামনে?’ আন্তরিকতায় মাঝির মুখও দেখেছি সেদিন ব্যথাতুর হয়ে উঠেছে। আমার খিদে তার বুকেও এনেছে ব্যথার পরশ-ম্লান হয়ে সে জবাব দিয়েছে, আগে কইলেন না ক্যান, এই তো দিগির পারের আটটা ছারাইয়া আইলাম। আইচ্ছা, সামনে পুরার বাজার আছে, চিড়া-মুড়ি কিন্না দিমু অনে!’ কী সহানুভূতি, কত দরদ পেয়েছি সেদিন। মাঝিকে নিজের পরিবারের লোক বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু আজ? কোথায় গেল সে সরল সহজ মামু! প্রাণভরা, দরদভরা সহানুভূতি দিয়ে যারা মানুষকে বুঝত তারা কি চিরবিদায় হয়েছে এই কলুষ-পঙ্কিল পৃথিবী থেকে? না চক্রান্তকারীদের ভয়ে মুখ তারা খুলতে দ্বিধাবোধ করছে? সৌন্দর্যের মৃত্যু হওয়া দেশের পক্ষে চরম লোকসানের কথা–সেই অশুভ দিন কেন নেমে এল কালো পাখা মেলে এই বাংলার ওপর?
সেদিন মাঝির সঙ্গে ভাগ করে চিড়ে-মুড়ির পর খালের জল খেয়ে যে কত আনন্দ পেয়েছি তা ভাষায় বলা যায় না। পদ্মার বাতাস, পদ্মার জল সেদিন কাছে টেনে নিয়ে ভাই-ভাইয়ের একপ্রাণতা একতার সূত্রে বেঁধে দিয়েছিল,–আজও সেই পদ্মা আছে, কিন্তু সে তো আজ চুপচাপ সাক্ষীর মতো ভ্রাতৃবিরোধ দেখে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলে পারে কি সে আমাদের সকলের হাত এক করে দিতে! পদ্মার জলের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের চোখের জল। কীর্তিনাশা বলে তার বদনাম আছে, কিন্তু তার কীর্তিকথার খোঁজ আমরা ক-জন রাখি? মানুষ কি তার চেয়েও বেশি কীর্তিনাশ করেনি? মানবতাবাদের সংহার কে করেছে? মানুষ, না পদ্মা? আজ ঘুমের মধ্যে পদ্মার ঢেউ বুকের ভিতর আছাড় খেয়ে পড়ে সমস্ত অভিমান নিয়ে। সে ঢেউ কি আর কারও বুকে লাগে না?
এক-একটি ভাব মানুষের মনে এক একরকম প্রেরণা জোগায়। তা না হলে যে পদ্মা রবীন্দ্রনাথের মনে কাব্যের প্লাবন এনেছিল সে পদ্মাই কী করে মারণমন্ত্রের প্রেরণা দিল? কবিতার প্রেরণা ও লুণ্ঠনের প্রেরণা কী একই উৎসকেন্দ্র থেকেই উঠছে না? পরস্পরবিরোধী এ ভাব কেন জাগে হৃদয়তন্ত্রীতে? সুকুমার বৃত্তির চিরউচ্ছেদ হতে পারে না মানুষের মন থেকে। এই সাময়িক ক্ষিপ্ততার শেষ হবেই হবে।
শহুরে সন্ধ্যায় চিমনির ধোঁয়া দেখলে আমার সেই মাঝির তামাক খাওয়ার কথা মনে পড়ে। হুঁকো কল্কে সাজিয়ে ধূম্রকুন্ডলীর যে আবর্ত সেদিন তারা সৃষ্টি করেছিল তা থেকেই বোধ হয় আরব্য উপন্যাসের দৈত্যটা প্রবেশ করেছে তাদের মনে! এ দৈত্যের সংহারমন্ত্র কী? তাকে আবার কি বোতলে ঢোকাতে পারা যাবে না?
দু-হাতে বৈঠা মারতে মারতে নৌকো যেত এগিয়ে। ছোটো খালের দু-ধারে কত রকমের গাছ। যোগীর জটাজালের মতো মাটির ওপর দিয়ে শিকড়গুলো এসে নেমেছে খালের জল ঘেঁষে। সেই বিরাট গাছের ধ্যানরত স্তব্ধতা, অনন্ত নীলিমার দিকে চেয়ে থাকার ছবি আজ ভুলতে পারছি না। তাদের ধ্যান বোধহয় আজও ভাঙেনি,তারা শান্তিতে থাকুক, মনে গৈরিক ধূসর বৈষ্ণবতা এনে মানুষকে আবার সুখীসচ্ছল করুক এই প্রার্থনাই করি দূরে বসে।
মাঝে মাঝে বেতের ঝোঁপ। বিক্রমপুর আছে অথচ বেতবন নেই এটা কল্পনাই করা যায় না! ঘন জঙ্গল সৃষ্টি করে কত রকমারি পশু-পাখিকে আশ্রয় দিয়েছে এই বেত। এই খালের ধারের বেত ঝোঁপের বুক থেকেই ভোরের কাকলি ওঠে প্রথম। নির্জন দুপুরে ঘুঘুর ডাক ওঠে এখান থেকেই, এখান থেকেই নিশুতি রাত্রে ককিয়ে ওঠে বক-শিশুরা! জঙ্গলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কচুরিপানার বংশ। বিক্রমপুরের শ্বাসরোধ করার চক্রান্ত এরা কোথা থেকে পেল? বিক্রমপুরের সঙ্গে সমস্ত পুববাংলার লোকের শ্বাসরোধ কি এই রক্তবীজের বংশধরেরাই করেছে?
খালের ঘাটে গৃহস্থ বধূরা জল নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কটাক্ষে দেখে নিত হাট-ফিরতি নৌকোর আরোহীদের। তাদের মুখে খুঁজে পেতাম যেন রাঙা বৌদি, মণিদি, মনোপিসির মুখের আদল! প্রবাসী মন থেকে উৎপাটিত হয়ে তারা নানান দিকে পড়েছে ছড়িয়ে, জানি না তারা আজকে কোথায়। জানি না তাদের ক-জনই বা নির্বিঘ্নে চলে আসতে পেরেছে সম্মান বজায় রেখে। দিকে দিকে মেয়েদের অসম্মান–তাদের আতাঁরবে মা বসুন্ধরার কি ঘুম ভাঙবে? নারীর লজ্জা কি নারী চোখ মেলে দেখেই যাবে শুধু? দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে, সংকুচিত হয়ে আর কতদিন ভারতবর্ষ থাকবে? নারীর সম্মানের জন্যে আগে মানুষ কেমন উত্তেজিত হত, নারীরা আসন পেত সবার ঊর্ধ্বে। নারীর অসম্মান তখন সমগ্র দেশের অসম্মান বলে বিবেচিত হত, সেদিনের সে মনোভাব গেল কোথায়? হিন্দু-মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান চিরদিনই নারীকে সম্মান দেখিয়েছে, অথচ আজ এ কী হল? জাতি-বিচারই কি নারী-বিচারের মাপকাঠি হয়ে মনুষ্যত্ববোধের অধঃপতন ঘটাবে বাংলায়?
রাজ্যের ভাবনা ভাবতে ভাবতে কখন যেন একটু তন্দ্রা এসে যেত। সে তন্দ্রা টুটত বৃদ্ধ মাঝির সস্নেহ ডাকে, ‘উঠেন কর্তা, টংগীবাড়ি আইয়া পড়ছি। টংগীবাড়ি এসে পড়েছি? তাহলে তো এসেই পড়েছি। মনে পড়ে যায় কতদিন এখানে এসেছি হাট করতে; হাট সেরে অকারণ দাঁড়িয়ে থাকতাম ওই পুলের ওপর। গ্রাম-সম্পর্কে মতিকাকার মাল কাঁধে বয়ে পৌঁছে দিয়েছি তাঁর বাড়িতে কতদিন। বাড়ি হাজির হয়ে মতিকাকা বাতাসা দিয়ে জল দিতেন আদর করে। তারপর হেসে বলতেন : “আরে আদা শুকাইলেও ঝাল থাকেরে, তগ মতন বয়সে আমরা দুই মুনি আড়াই মুনি বোঝা লইয়া আইছি টংগীবাড়ির থন। সেদিনের গল্পগুজবের মধ্যে মতিকাকা, মতিকাকিমার সহৃদয়তা আমাদের মুগ্ধ করত। মুড়ি, বাতাসা, নারকেল নাড় আমাদের বারবার টেনে নিয়ে যেত মতিকাকার বাড়ি! জানি না, ঝড় তাঁদের কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে আজ। যেখানেই হোক, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন! বেঁচে থাকলে দেখা হবেই একদিন-না-একদিন। দুঃখ লাগে ভেবে, যারা মুড়ি নাড় বিলি করেছে বেহিসেবিভাবে আজ তারাই করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে খাবার জিনিসের দিকে! কপালের পরিহাস আর কাকে বলে জানি না, কিন্তু নিজেদের দৃষ্টান্ত থেকে তার পরিচয় পাচ্ছি। সামান্য ডালভাতের জন্যে আজ আমাদের স্বার্থপরতা দেখে স্তম্ভিত হচ্ছি।
টংগীবাড়ির পর মনে পড়ছে মুনশিবাড়ির কথা। নবাবি আমলে এই গ্রাম আটকে গিয়েছিল বিলাসের ফাঁসে। চরম মুনশিয়ানা করে গেছে গ্রামবাসীরা। চিহ্নস্বরূপ আজও মঠ-মসজিদ দেখা যায় প্রচুর। মঠে শ্মশানেশ্বর শিব ও মা কালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে সেই নবাবি আমল থেকে। মা কালী ছিলেন এ অঞ্চলের জাগ্রত দেবতা। কত দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসত পুজো দিতে ধন্না দিয়ে অভীষ্টসিদ্ধির জন্যে! দেখেছি মুসলমান ভাইয়েরাও হাতজোড় করে মানত করে যেত। কিছুদিন বাদে রোগমুক্তির পর জোড়া জোড়া পাঁঠা নিয়ে আসত দিকে দিকে আনন্দধ্বনি ছড়াতে ছড়াতে। জাতিধর্মনির্বিশেষে এমনি কালীপূজো আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, কিন্তু মা কালীও কেন বিরূপ হলেন আমাদের ওপর? কেন ভিটে ছেড়ে নির্বাসিত হলাম, অজানা ভবিষ্যতের অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে হল কোন পাপে! ছোটোবেলায় এই মঠবাড়িই ছিল আমাদের আড্ডাখানা। কত দৌরাত্মই না করেছি আম-কাঁঠালের সময়। গভীর রাত্রে খেজুরের রস চুরি করে জলভরতি কলসিটি টাঙিয়ে রাখতাম ভালো মানুষের মতো।
বিজয়া দশমীর দিন কী মাতামাতিই না করতাম এই মঠের ঘাটে। ঢাক-ঢোলের বোলের সঙ্গে চার ধূপতির আরতি দেখে মাঝরাত্রি পর্যন্ত হইহুল্লোড় করে কাটাতাম। দুর্গাপুজো উপলক্ষ করে কোনো বছর ছুটিতে বাড়ি যেতে না পারলে অস্থির হয়ে পড়তাম আগে। এখনও বছরে বছরে যথারীতি পুজো আসে, কিন্তু আমি বাড়ি যেতে পাই না। এ দুঃখের তুলনা দেব কীসের সঙ্গে? অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে চোখ দুটি পূর্ব সুখস্মৃতির কথা ভেবে। আজও সে মঠ আছে, তাকে নিশানা করে লোকেরা হয়তো চলাফেরাও করে ভক্তিনম্রভাবে মা কালীকে প্রণামও হয়তো করে কেউ কেউ, কিন্তু সেদিনের সেই সুখী উজ্জ্বল আবহাওয়া কি আর আছে মুনশিবাড়িতে? একতা, সংঘবদ্ধতাকে নির্বাসন দিয়ে মানুষ আজ যে ভুল করল তার উপলব্ধি কবে হবে কে জানে!
মঠের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না আজ। বহু স্মরণিকা ভিড় করে আসছে–এই মঠই ছিল এ অঞ্চলে অগ্নিযুগের প্রেরণাকেন্দ্র। অনুশীলন পার্টির অন্যতম প্রধান কার্যালয়। পুলিশের অত্যাচার এ কেন্দ্রে ঘূর্ণিবায়ুর মতো নিষ্ঠুর গতিতে বয়ে গেছে এক সময়। সে বর্বরতার কথা মনে করলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। গ্রামের দেশকর্মী ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে কতরকম মর্মান্তিক অত্যাচারই না করেছে অমানুষ অশিক্ষিত মূঢ় সেদিনকার ইংরেজ ভৃত্যরা। তাদের ভয়ে তরুণ যুবকদের গ্রামে থাকাই হয়ে উঠেছিল অসম্ভব। সেই সময় থেকেই নীরব ফন্তুর মতো কাজ হত মঠে–মা কালী তার সাক্ষী। সেদিন বিদেশি শক্তির বিপক্ষে মায়ের খঙ্গ উঠেছিল ঝলসে, মায়ের আশীর্বাণী পেয়েছে সব ভক্ত ছেলের দল। কিন্তু ভ্রাতৃবিরোধের দিনে মা রইলেন নীরবে দাঁড়িয়ে, অথচ তাঁর আশীর্বাদের প্রয়োজন তখনি ছিল বেশি!
মনে পড়ছে এ গ্রামের কৃতী নারী-পুরুষের কথা। এখানকার কেউ হয়েছেন নামকরা অধ্যাপক, কেউ আই. সি. এস., কেউ স্বাধীন ভারতের প্রতিনিধি হয়ে ইয়োরোপ গেছেন। এই গাঁয়ের একটি মেয়ে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন সর্বপ্রথম। তবুও বলব এঁরা গ্রামের মাটি থেকে বহুদিন থেকেই উৎপাটিত–প্রাণের যোগ তাঁদের নেই গ্রামের সঙ্গে। তাঁরা মহীরুহ, সামান্য ক্ষণের জন্যে বসা যায় তাঁদের ছায়ায়, কিন্তু আড্ডা জমাতে হলে যেতে হয় জেলেপাড়ার মহানন্দের বাড়ি, কিংবা প্রসন্ন মুদির দোকানে, না হয় বিশ্বম্ভর পালের হাঁড়ি গড়বার চাকের ধারে! তাদের সুখ-দুঃখই সারাগ্রামের সুখ-দুঃখ। তাদের প্রাণচাঞ্চল্য, তাদের আন্তরিকতা আজও নির্জন জীবনে রোমাঞ্চ জাগায়। মনে পড়ছে, সেবার অনাবৃষ্টি সম্বন্ধে আলাপ করতে করতে আমি বলেছিলাম যে, এবছর শীত যেমন দেরিতে এসেছে, বর্ষাও আসবে তেমনি দেরি করে। আমার কথা শুনে কালী ভুইমালী কারণস্বরূপ বলেছিল, ‘পাঁচ রবি মাসে পায়, ঝরায় কিংবা খরায় যায় সেদিন সত্যিই লজ্জা পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, কতকাল আগের গাণিতিক গবেষণার ওপর প্রতিষ্ঠিত খনার বচনকে যারা প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় অনুসরণ করছে তাদের ওপর পান্ডিত্য ফলাতে গিয়েছিলাম আমি। বাংলার লোকসংস্কৃতি তো এদের ভেতরেই ক্ষীণ হয়ে বেঁচে আছে আজ পর্যন্ত।
যে গ্রামে প্রতিমাসেই উৎসব থাকত লেগে, সেখানে আজ মানুষ খুঁজে বের করতে হয় শুনলাম। বাড়িঘর হয়তো দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঘন জঙ্গল গজিয়েছে উঠোনে, আগাছা জন্মেছে দেওয়ালে দেওয়ালে। সেই তেঁতুলগাছটাও কি আছে? ঝাঁকড়া ওই গাছের নীচে বসত আমাদের আড্ডা। মনে পড়লে হুহু করে প্রাণ, আপনাআপনিই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত অশ্রু। নির্বিঘ্ন জীবন কি আর আমরা ফিরে পাব না, সেইদিনের মতো কি আর আমরা বরুণ পুজোতে মেতে উঠতে পারব না ছেলে-বুড়ো মিলে? চৈত্র মাসে জলের জন্যে প্রার্থনা জানাতাম বরুণদেবের কাছে। চৈত্রের খর রৌদ্রের অবসানের জন্যে জলকাদা মেখে গ্রাম প্রদক্ষিণ করতাম দল বেঁধে। মেঘের দেবতাকে খুশি করবার মন্ত্র আওড়াতাম,
দেওয়ার মাললা মেঘারানি।
খাড়া ধুইয়া ফালা পানি।।
মেঘের উপর পুন্নিমার চান।
ঝপঝপাইয়া বিসটি লাম।।
সেদিনের এই মন্ত্র ছিল যেন অব্যর্থ। পাগলা হাতির মাতন নিয়ে ছুটে আসত মেঘ-বৃষ্টি ঝড়। জীবন হত শান্তিময়, নির্বিঘ্ন। আজকের মানুষের তাপিত প্রাণ কি ঠাণ্ডা হতে পারে না এই মন্ত্রে? আমাদের জীবনে কী নেমে আসতে পারে না আবার সেই আকাঙ্ক্ষিত শান্তিবারি? শান্তিময়, সুখীসচ্ছল দিন কি চিরতরে ছেড়ে গেল আমাদের? আজ বর্ষা নামলে বেলেমাছ ধরার কোনো উৎসাহই পাই না আর, অথচ একদিন রাতদুপুরে ছুটেছি ছিপ হাতে মৎস্য শিকারে! পদ্মা প্রমত্তা নদীর বুকে ডিঙি ভাসিয়ে গেছি মঠবাড়ির বড়োখালে। খালে খালে জেগেছে জীবনের ছোঁয়াচ, মাঠে মাঠে বাধাহীন জলধারা যাচ্ছে ছুটে, সে-ছবি আজও আমায় উতলা করছে! শ্মশানে প্রাণবসন্ত দেখা দিক আবার, আবার ছুটিয়ে নিয়ে যাক আনন্দ নিজের গ্রামে, শান্তিবারি ঝরে পড়ুক প্রতিটি মানুষের মাথায়। ভয় থেকে অভয়ের মধ্যে নতুন করে জন্মলাভ করুক দেশবাসী। জড়তা থেকে নবীন জীবনে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করুক ঈশ্বর! আর শুধু দিনযাপনের প্রাণধারণের গ্লানি সহ্য হয় না–নিশিদিন রুদ্ধঘরে ক্ষুদ্রশিখা স্তিমিত দীপের ধূমাঙ্কিত কালি জীবনের গায়ে কালি লেপন করছে, জীবন খন্ড খন্ড হচ্ছে দন্ডে পলে ভাগ হয়ে! রবীন্দ্রনাথের মতো আজ আমি শুধু প্রার্থনা করি,
শ্যেনসম অকস্মাৎ ছিন্ন করে ঊর্ধ্বে লয়ে যাও
পঙ্ককুন্ড হতে,
মহান মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি করে দাও মোরে
বজ্রের আলোতে।