ভলিউম ১৩ – ঢাকায় তিন গোয়েন্দা – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ ৪ জুলাই, ১৯৯১
০১.
বেশ রহস্যজনক তো! শোনা গেল আরিফ সাহেবের কণ্ঠ।
বাগানে বসে মামার কথাটা কানে গেল কিশোর পাশার। বাংলাদেশী শীতের আমেজ উপভোগ করছে সে। টকটকে লাল গোলাপের ওপর উড়ছে একটা মৌমাছি। তাকিয়ে ছিল সেদিকে, খাড়া হয়ে গেল কান। ঘরের ভেতর থেকে কথা আসছে।– আমার তা মনে হয় না, বললো আরেকটা কণ্ঠ। সব ওর শয়তানী।
হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে কিশোরের। বাংলাদেশে এসেই একটা রহস্য পেয়ে যাচ্ছে না। তো?
একবার দুবার হলে না হয় ধরে নিতাম অ্যাকসিডেন্ট, বলে যাচ্ছে কণ্ঠটা। কিন্তু চার-চারবার একই ঘটনা। বলছে মাল দেয়ার জন্যে কাস্টোমারের বাড়ি ঢুকেছে, বেরিয়ে এসে দেখে উইশীল্ড ভাঙা।
হ্যাঁ, তাই দেখেছি, বললো আরেকটা তরুণ কণ্ঠ। মিথ্যে কথা বলিনি।
মিথ্যে বলছিস, সেটা তো বলছি না আমি, বললো লোকটা। আমি বলতে চাইছি, দোষটা তোর। কারও সাথে ঝগড়া করেছিস, এখন সে শোধ তুলছে…
বিশ্বাস করো, আব্বা, ওরকম কিছুই করিনি আমি!
ঠিক আছে, শান্তকণ্ঠে বললো লোকটা, করিসনি যে প্রমাণ কর। নইলে আমার যা বলার, বলে দিয়েছি। গাড়ি চালানো তোর বন্ধ। সত্যি সত্যি কি হয়েছে, জেনে এসে বলবি, যদি দেখি তোর দোষ নেই, তাহলেই চাবি পাবি।
মাল দিতে অসুবিধে হবে না? সকাল সাতটার মধ্যেই তো মাখন না পেলে রেগে যায় লোকে, ডিম আর দুরে কথা নাহয় বাদই দিলাম…রাতে একবার, সকালে একবার; কবার যাবে তুমি মাল ডেলিভারি দিতে?
সেটা তোর ভাবনা নয়। ঠিক সময়েই মাল পাবে কাস্টোমার। তোর এখন কাজ পিকআপে মাল বোঝাই করা আর কাস্টোমারের ঘরে রেখে আসা, ব্যস। দুই বেলা গাড়ি আমিই চালাতে পারবো।
এনায়েত, আবার শোনা গেল আরিফ সাহেবের কণ্ঠ, আমার এখনও মনে হচ্ছে, রহস্য একটা আছে এর মধ্যে।
তা তো আছেই, স্যার, হেসে বললো ছেলেটার বাবা। আর সেটা কি আমি খুব ভালোই জানি। কারও সঙ্গে নিশ্চয় গোলমাল বাধিয়েছে কচি, সে এখন শোধ তুলছে।…আজ উঠি, স্যার।
বসো, টাকা নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, দুধ-ডিম-মাখন, তিনটেই ডবল করে দিয়ে যেও কদিন। আমার ভাগ্নে এসেছে তার বন্ধুদের নিয়ে, আমেরিকা থেকে। দেখি, বিলটা দেখি, কতো হলো?
খানিক পরে সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষকে। গায়ের রঙ কালো। ভোতা নাক। খাটো করে ছাঁটা চুল। দেখেই কিশোরের মনে হলো, এই লোকটাও একসময় পুলিশে চাকরি করেছে। বাগানের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরানো একটা টয়োটা পিকআপের দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িটার গায়ে সাদা রঙে বড় বড় করে লেখা রয়েছে
এনায়েত উল্লাহ ডেয়ারি ফার্ম।
আমরা সুলভ মূল্যে ডিম, মাখন, দুধ
সরবরাহ করিয়া থাকি।
এনায়েত উল্লাহর পেছনে বেরোলো সতেরো-আঠারো বছরের একটা ছেলে। বাবার মতো কালো না হলেও ফর্সা নয়। গায়ে-গতরে প্রায় মুসার সমান, ভালো স্বাস্থ্য।
গাড়িতে গিয়ে উঠলো লোকটা। ড্রাইভিং সীট থেকে মুখ বের করে বললো, কি হলো, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওঠ।
গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ছেলে। রাগ করে বললো, না, আমি বাসেই যেতে পারবো।
তোর খুশি। তবে যতো যা-ই করিস, চাবি আমি দিচ্ছি না তোকে। আর। একটিবারও ছেলেকে উঠতে সাধলো না এনায়েত উল্লাহ। স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
কিশোরের ওপর চোখ পড়ল ছেলেটার। হাত নেড়ে তাকে ডাকলো কিশোর। এগিয়ে এলো কচি। কি?
আপনার নাম কচি, না?
অবাক হলো ছেলেটা। কি করে জানলে?
ঘরে আপনার কথা বলছিলেন, সব শুনেছি। হাত বাড়িয়ে দিলো কিশোর, আমি কিশোর পশি।
ও, তুমিই চৌধুরী আংকেলের ভাগ্নে। খুব আগ্রহ নিয়ে হাত মেলালো কচি। আর কে কে এসেছে তোমার সঙ্গে?
রবিন আর মুসা। আমার বন্ধু।
এদিক ওদিক তাকালো কচি। নাম তিনটে তাকে অবাক করেছে বোঝা গেল। কোথায় ওরা?
মামার স্টাডিতে পড়ছে রবিন। মুসা হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে খুটুর-খাটুর করছে। ঘুঘুপাখি ধরার ফাঁদ বানাচ্ছে। মামী বলেছেন, মধুপুরের গড়ে নিয়ে যাবেন। ফাঁদ পেতে সেখানে ঘুঘু ধরবে সে। হাহ্ হাহ!…তা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
আমাকে আপনি আপনি করছো কেন? কতো আর বড় হবো তোমার চেয়ে? তুমি করেই বলো। কচি ভাই-টাইয়েরও দরকার নেই। শুধু কচি। একটা চেয়ারে বসলো সে। কবে এসেছো?
এই তো, পরশু রাতে।
ও। তা থাকবে তো কিছুদিন?
থাকবো। এসেছি যখন দেখেই যাবো বাংলাদেশটা। একটা আঙুল মটকালো। কিশোর। আচ্ছা, তোমার আব্বা রাগারাগি করলেন শুনলাম। কি হয়েছে? …বেশি কৌতূহল দেখাচ্ছি না তো?
না না! বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কচি। আর বলো না ভাই। বয়েসে হয় না, বাড়িয়ে দেখিয়ে কত কষ্টে লাইসেন্সটা বাগালাম, অথচ চালাতেই পারলাম না। দুদিন চালাতে না চালাতেই বন্ধ। সহ্য হয়?
হু, বুঝতে পারছি তোমার দুঃখ, সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা দোলালো। কিশোর। কিন্তু ব্যাপারটা কি, বলতে আপত্তি আছে?
চুপ করে রইলো কচি।
বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছি মনে হচ্ছে তো? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি, তাহলেই বুঝতে পারবে। পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিলো কিশোর।
পড়ে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেল কচি। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হলো মুখ। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে কিশোরের একটা হাত খপ করে চেপে ধরে বললো, তোমরা! সত্যি তোমরা এসেছ বাংলাদেশে! উফ, কি যে ভালো লাগছে! নাম শুনেই সন্দেহ হয়েছিলো! ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে আমার, এক্কেবারে সময়মতো পেয়ে গেছি তোমাদের! ইস, বিশ্বাসই করতে পারছি না।
ওই যে, রবিন আর মুসা আসছে, দরজার দিকে হাত তুললো কিশোর।
ওদের কাছে আরেক দফা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো কচি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে যাচ্ছিল ওদের সঙ্গে। হেসে জানিয়ে দিলো কিশোর, ওরা দুজনে বাংলা বোঝে। বলতেও পারে মোটামুটি।
আলাপ পরিচয়ের পালা শেষ হলো।
অদ্ভুত কাণ্ড, বুঝলে,কচি বললো। গভীর রহস্য!
বলেই ফেললো না, হেসে বললো কিশোর। কখন থেকেই তো জানতে চাইছি।
কতোখানি শুনেছো?
ঘরে বসে তোমরা বাপ-বেটায় যতোখানি ঝগড়া করেছে।
আমাদের গাড়ির কাঁচ, বুঝলে, পিকআপটার উইশীল্ড, কচি জানালো, কি করে জানি ভেঙে যায়। একবার না দুবার না, চার চারবরি ভাঙলো। কাস্টোমারের বাড়িতে মাল দিতে ঢুকি, বেরিয়ে এসে দেখি ভেঙে রয়েছে।
কি করে ভাঙে কিছুই আন্দাজ করতে পারো না?
নাহ, এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লো কচি। শেষবার অবশ্য কাঁচ ভাঙার শব্দ কানে এসেছিলো। ছুটে বেরোলাম। কিন্তু গাড়ির কাছে কাউকে দেখতে পেলাম না। এক এক করে তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকালো সে। খুব অবাক। লেগেছে আমার। মনে হলো যেন আপনাআপনি ভেঙে গেল কাঁচটা।
হয় এরকম, আনমনে বললো কিশোর। একে বলে কাঁচের ফ্যাটিগ। আপনাআপনি চুরমার হয়ে যায় কাঁচ। তবে সেটা একআধবার হতে পারে। একই গাড়ির বেলায় চারবার? উঁহু, সেটা সত্ব না।
আমিও তাই বলি, চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়লে কচি। আপনাআপনি ভাঙেনি ওই কাঁচ।
মনে হয় রহস্য একটা পেয়েই গেলাম, বিড়বিড় করলো গোয়েন্দাপ্রধান।
রবিন আর মুসা চুপ করে শুনছে। কিছু বলছে না।
গোড়া থেকে সব খুলে বলো তো, কিশোর বললো। কখন, কোথায় ঘটেছে এই ঘটনা?
নাক চুলকালো কচি। তারপর শুরু করলো, গুলশানের সাত নম্বর রোডের একটা বাড়ির সামনে। রাতের বেলা। পথের পাশে সব সময় যেখানে গাড়ি রাখে। আব্বা, সেখানেই রেখেছিলাম। ডিম আর দুধ সাধারণত রাতে দিয়ে আসি আমরা, মাখন সকাল বেলা। অনেককে দুধও সকালেই দিই। যা-ই হোক, গত দুমাসে রাতের বেলা, সাত নম্বর রোডে কাঁচ ভেঙেছে মোট চারবার।
অন্য একটা প্রশ্ন করি। তুমি আর তোমার আব্বাই কি মাল সাপ্লাই দাও? কোন কর্মচারী-টর্মচারী নেই?
কারখানায় আছে। আমাদের ফার্মটা খুব ছোট। বেশি লোক রাখতে পারি না। ভীষণ খাটতে হয় আব্বাকে। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর আমার ছোট ভাই যতোটা পারি সাহায্য করি।
হু, বলে চুপ করে কি ভাবতে লাগল কিশোর।
মুসার দিকে তাকালো কচি। আচ্ছা, তোমার না একটা কুকুর আছে, সিমবা? শুনলাম, ওকেও নিয়ে আসবে। কই?
আনিনি। হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতালে।
ওটাকে এখানে এনেও কোন লাভ হতো না, কিশোর বললো। বুনো কুকুরের রক্ত শরীরে, কিছুতেই হিংস্রতা ভুলতে পারে না। কখন কার ওপর লাফিয়ে পড়ে টুটি ছিঁড়ে দেবে শহরের রাস্তায় ওটাকে নিয়ে বেরোনোই মুশকিল। ওর জায়গা আফ্রিকা, কিংবা অন্য কোন জঙ্গল-টল…
তারমানে জঙ্গল ছাড়া ওকে সঙ্গে রাখে না? হেসে জিজ্ঞেস করলো কচি।
না রাখাই উচিত। মুসাদের বাসার কাছেই বের করেছিলো একদিন। দিলো এক ছোকরাকে কামড়ে। অনেক কষ্টে পুলিশের ঝামেলা এড়ানো গেছে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার আগের কথা তুললো কিশোর, শেষ বার কবে ভাঙলো তোমাদের গাড়ির কাঁচ?
গত বুদ্বার রাতে। আর কপালটা কি দেখো, চার দিন ভাঙলো, চার দিনই আমি বেরিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। ফলে আব্বাকেও কিছু বোঝাতে পারছি না।
চিন্তিত ভঙ্গিতে কচির দিকে তাকালো কিশোর। ওভাবে আর কোন গাড়ির উইণ্ডশীল্ড ভেঙেছে, জানো?
কি জানি!
কিছু ভাবছে কিশোর, বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো রবিন, কেন?
যদি খালি কচিদেরটাই ভাঙে, জবাব দিলো কিশোর, তাহলে বুঝবো ফ্রেমে দোষ আছে, কিংবা শত্রুতা করে কেউ ভাঙছে। কিন্তু আরও গাড়ির যদি ভেঙে থাকে, তাহলে নিশ্চয় অন্য কারণ।
তা ঠিক, ঘাড় দোলালো মুসা।
এই দাঁড়াও, দাঁড়াও! হাত তুললো কচি। মনে পড়েছে! গুলশানে আমার এক বন্ধু আছে। আমাদেরটা ভাঙার কিছুদিন আগে ওদের গাড়ির কাঁচ ভাঙার কথা কি যেন বলেছিলো। তখন খেয়াল করিনি। এখন মনে পড়ছে। কি করে ভেঙেছিলো, বুঝতে পারছিলো না সে-ও।
হু, মাথা দোলালো কিশোর, তাহলে তো মনে হচ্ছে…
থেমে গেল সে। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তার মামী। মহিলার বয়েস বোঝা যায় না। অনেক কম মনে হয়। খুব সুন্দরী। এক ছেলে আর এক মেয়ে, দুজনেই থাকে আমেরিকায়।
হাত নেড়ে হেসে বললেন তিনি, এই, আর কতো গল্প করবি? সেই কোন। সকালে নাস্তা করেছিস। খিদে পায়নি?
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুসা। একান ওকান হয়ে গেল হাসি। পায়নি মানে, কি যে বলো তুমি, আন্টি। পেটের মধ্যে কখন থেকেই তো ছুঁচো নাচছে, শুধু ভাঙা কাঁচই এতোক্ষণ আটকে রেখেছিলো। নানারকম বাংলাদেশী খাবার খাইয়ে দুদিনেই মুসাকে একেবারে ভক্ত বানিয়ে ছেড়েছেন মামী। ইতিমধ্যেই বহুবার বলে ফেলেছে তাঁকে মুসা, দুনিয়ায় শুধু দুজন মানুষ ঠিকমতো রাঁধতে জানে। একজন তুমি, আরেকজন আমাদের মেরিচাচী।
আবার হাসলেন মহিলা। আয়, খেতে আয়। কচি, তুমি যাওনি তোমার আব্বার সঙ্গে?
না, রাগ করে বললো কচি। ওই গাড়িতে আর উঠবো না। বাসে যাবো বলে রয়ে গিয়েছিলাম, ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল
ভালো হয়েছে। এসো, তুমিও এসো খেতে।
এই পরিবারের সঙ্গে মোটামুটি ভালোই খাতির জমিয়ে ফেলেছে কচি। মহিলার ছেলেমেয়ে এখানে কেউ নেই। এতো বড় বাড়িতে একা একা থাকেন শুধু স্বামীকে নিয়ে। ছেলেমেয়ের বয়েসী কাউকে পেলেই দ্রুত আপন করে নেন।
বিনা প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ালো কচি। জানে খাবো না বলে লাভ হবে না, তাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না নাদিরা খালাম্মা।
মামী যেমন দিলখোলা, হাসিখুশি, মামা তেমনি গম্ভীর। চাকরি করতেন পুলিশে, বড় অফিসার ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। সময় কাটানোর জন্যে সারাক্ষণই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রচুর বই পড়েন, বিশেষ করে গোয়েন্দা গল্প। কিশোরকে তার খুব পছন্দ। সুযোগ পেলেই বলে দেন, দেখ ইয়াং ম্যান, চাকরিই যদি করো, তাহলে পুলিশের। এর বাড়া চাকরি নেই। আর যেহেতু তুমি গোয়েন্দা, রহস্য পছন্দ করো, পুলিশ না হয়ে আর কি হবে? কোথায় গিয়ে আর গোয়েন্দাগিরি করার এমন সুযোগ পাবে?
কথাটা তিনি ঠিকই বলেন, মেনে না নিয়ে পারে না কিশোর। গোয়ন্দাগিরি করতে হলে পুলিশ হওয়াই উচিত। আমেরিকায় অবশ্য শখের গোয়েন্দা সে হতে। পারে, তবে পুলিশের চাকরিতে থেকে এই কাজ করার সুযোগ সুবিধে অনেক বেশি।
খাবার টেবিলে খেতে বসলো সবাই। মাথার কাছে বসেছেন চৌধুরী সাহেব। পুরু পুলিশী গোফ। চোখের দৃষ্টি এতো তীক্ষ্ণ, সরাসরি তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে মুসা, মনে হয় ধারালো ছুরির ফলা তার মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে ফালাফালা করে চিরে দেখছে কিছু লুকানো রয়েছে কিনা।
কচিকে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে দেখে মুচকি হেসেছেন পুলিশের ভূতপূর্ব ডি আই। জি। মামী প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়াতক অপেক্ষা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কি হে গোয়েন্দারা, রহস্য পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে?
মনে হয়, জবাব দিলো কিশোর।
কাঁচ ভাঙার রহস্য তো? আমার কাছেও কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে।
লাগছে, নী? পর পর চারবার একই গাড়ির কাঁচ ভাঙলো। কাউকে গাড়ির কাছে দেখা গেল না। কি করে ভাঙলো, কিছু বোঝা গেল না। অদ্ভুত ব্যাপার!
আলাপটা পরেও করতে পারবি, মুসার প্লেটে চিঙড়ির বিশাল দুটো কাটলেট তুলে দিয়ে বললেন মামী, আগে খেয়ে নে।
হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে এলো খাওয়া।
ইয়া বড় পুডিঙের অর্ধেকটাই মুসার পাতে দিয়ে দিলেন মামী। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল আনতে গেলেন।
হ্যাঁ, কাঁচ ভাঙার কথা হচ্ছিলো, কথাটা আবার তুললেন মামা। একই গাড়ির কাঁচ…
আলট্রাসনিক ওয়েভস! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। শব্দ কাঁচ ভাঙতে পারে।
ঠিক! পুডিঙের চামচ মাঝপথেই থেমে গেল মুসার। জেট প্লেনের শব্দে জানালার কাঁচ ভেঙে যেতে দেখেছি আমি!
এদেশে ওরকম প্লেন আসে না, বললেন চৌধুরী সাহেব। গাড়ি রেখেছিলে যেখানে, তার কাছাকাছি এমন কোনো কারখানা আছে, যেটার যন্ত্রপাতি থেকে। আলট্রাসোনিক ওয়েভ বেরোতে পারে?
না, মাথা নাড়লো কচি।
ভূমিকম্প নয় তো? মুসার প্রশ্ন।
এটা ক্যালিফোর্নিয়া নয়, মনে করিয়ে দিলো কিশোর। এখানে এতো জোরে ভূমিকম্প হয় না যে গাড়ির কাঁচ ভাঙবে।
বাতাস? রবিন বললো। ঝড়টর তো হয় এদেশেও। ঘূর্ণিঝড়?
নাহ, ওসব না।
কোনো ধরনের রশ্মি? মুসা বললো। বুঝেছি বুঝেছি, ডেথ রে!
স্টার ওয়ারস ছবিতে যেমন দেখায়? কচি বললো। হীট রে কিংবা ফোর্স রে?
অসুবিধে কি? রবিন বললো। বাংলাদেশে কি স্পেস শিপ নামতে পারে না?
নিশ্চয়ই! চামচ রেখে দিয়ে টেবিলে চাপড় মারলো মুসা। ভিনগ্রহ থেকে আসা!
অতি বুদ্ধিমান কোনো প্রাণীর কাজ বলে ভাবছো? কচি বললো।
কিংবা…কিংবা… ভয়ে ভয়ে উজ্জ্বল রোদে আলোকিত জানালার দিকে তাকালো মুসা, ভূত-টুত!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে জার্মান ভূত, পোলাটারগাইস্ট। বিরক্ত হয়ে বললো কিশোর। হাত নেড়ে বললো, কি সব ফালতু বকবকানি শুরু করেছো! থামো! মামার দিকে তাকিয়ে দেখলো, তাঁর সদাগম্ভীর মুখেও এখন যেন চিরস্থায়ী হাসি ফুটেছে, খুব উপভোগ করছেন তিনি। ভূত, স্পেস শিপভিসিআর সবার মাথা খারাপ করে দিয়েছে!
তাহলে তোমার কি ধারণা? কিশোরের কথার ধরন পছন্দ হলো না কচির রবিন আর মুসার মতো কিশোরের কড়া কথার সাথে অভ্যস্ত নয় সে।
হ্যাঁ, স্পেস শিপ না হলে কি? রবিনের প্রশ্ন।
আমি বলে দিয়েছি, ভূত, ব্যস, হাত নাড়লো মুসা।
তোমার মাথা, কিশোর বললো। অবাস্তব সব কথাবার্তা। যুক্তিতে এসো। সহজ কোনো ব্যাখ্যা আছে এই কাঁচ ভাঙার। যেটা এখনও জানি না আমরা। জানতে হলে এখন দুটো কাজ করতে হবে।
কী? আগ্রহের সঙ্গে মুখ তুললো কচি।
আড়চোখে কিশোর দেখলো, মামার তীক্ষ্ণ চোখ দুটোও এখন তার ওপর নিবদ্ধ, সে চোখে কৌতূহল।
মামা, তোমার গাড়িটা ধার দেবে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো। রাতের বেলা?
কেন?
ওটা দিয়ে ফাঁদ পাতবো। পথের মোড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবো…।
কেউ কাঁচ ভাঙে কিনা দেখার জন্যে? কিশোরের কথাটা শেষ করে দিলেন মামা। বুদ্ধিটা মন্দ না। দেবো। যদিও রিস্কি হয়ে যায় ব্যাপারটা। আর দ্বিতীয় কাজ কি?
ভূত-থেকে-ভূতে।
টেবিলে পানির বোতল রেখে কি কাজে রান্নাঘরে গিয়েছিলেন মামী। বেরিয়ে আসতেই কানে গেল কথাটা। মামা তিন গোয়েন্দা পড়েন, তিনি পড়েন না। একথার মানেও জানেন না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী?
ভূত-থেকে-ভূতে, বললেন মামা। বুঝিয়ে দিলেন, এটা আমাদের তিন গোয়েন্দার একটা অসাধারণ আবিষ্কার। কোন জিনিস খুঁজতে হলে এর জুড়ি নেই। আমি চাকরি করার সময় এই পদ্ধতিটা যদি জানতাম, কতো যে সুবিধে হতো কি বলবো!
কিছুই বুছতে পারছি না তোমার কথা!
বেশ, বুঝিয়ে দিচ্ছি, বললেন চৌধুরী সাহেব। শুনলে হাঁ হয়ে যাবে। ধরো, তোমার গাড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না। যতো পরিচিত বাড়ি আছে তোমার, ফোন করে ওসব বাড়ির ছেলেমেয়েদের জানিয়ে দাও খবরটা। বলবে, গাড়ির খোঁজ দিতে পারলে ভালো পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। আরও বলবে, ওদের বন্ধুদের যেন খবরটা জানায় ওরা। সবাইকে জানানোর দরকার নেই। ওদের পাঁচজন পাঁচজন করে। বন্ধুকে জানালেই চলবে। কি ঘটবে, বুঝতে পারছো?
কি আর এমন.. বলতে বলতে সত্যিই হাঁ হয়ে গেলেন মামী। বুঝে ফেলেছেন। সর্বনাশ! কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহরের সমস্ত ছেলেমেয়ে জেনে যাবে, যাদের টেলিফোন আছে!
ঠিক! তুড়ি বাজালেন চোধুরী সাহেব। ওরা ছুটবে তখন গাড়ি খুঁজতে। ওদের আরও অনেক বন্ধু আছে, যাদের টেলিফোন নেই। মুখে মুখে তাদের কানেও খটা চলে যাবে। ঢাকা শহরে থাকলে তখন গাড়িটা আর লুকিয়ে রাখা যাবে বেশিক্ষণ?
না, যাবে না! ছেলেদের দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হাসলেন। নাহ্, আছে তোদের। সত্যি
কিন্তু ভূত-থেকে-ভূতে ব্যবহার করে এখন কি লাভ? কচি জিজ্ঞেস করলো। কি খুঁজবে ওরা?
আর কোনো গাড়ির কাঁচ ওভাবে ভেঙেছে কিনা, জবাব দিলো কিশোর।
হু। তা জবাবটা দেবে কার ঠিকানায়? তোমরা এখানে এসেছে জানলে ঢাকা শহরের ছেলেমেয়ে আর থাকবে না। সব এসে ভেঙে পড়বে এই উত্তরায়। তোমাদের দেখার জন্যে পাগল হয়ে যাবে সবাই।
এতোই পপুলার আমরা? গর্ব হচ্ছে মুসার।
টেলিফোন করেই দেখো না, হাসলো কচি।
হোক না পাগল, কিশোর বললো, অসুবিধে কি? ওদের সঙ্গে দেখা করতেই তো এসেছি আমরা। তবে একটা কাজ করা যায়। এখানে এসে ভিড় করার দরকার নেই। শিডিউল করে নিয়ে একেক দিন একেক পাড়ায় আমরাই দেখা করতে যাবো, জানিয়ে দিলেই হবে। কচির দিকে তাকালো সে, তোমাদের ফোন আছে?
আছে।
সারাক্ষণ ওটা ধরার কেউ আছে? মানে, বললে প্রতে পারবে?
পারবে, আমার ভাই, রচি। ইস্কুল এখন ছুটি। সারাদিন বাড়িতেই থাকে।
তাহলে ওর ওপরই দায়িত্বটা চাপানো যাক, কি বলো? এখানে তো সারাদিন। আমরা থাকবো না। নানা জায়গায় যাবো। অনেক ফোন আসবে, বুঝতে পারছি। ধরবে কে?
অসুবিধে হবে না, আশ্বাস দিলো কচি। রচিকে বলে দেবো। খুশি হয়েই কাজটা করবে ও।
.
০২.
রাত্রে মামা বললেন, তিনিও যাবেন সঙ্গে। গাড়ি বের করলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ। কিশোর বললো, নটার মধ্যে জায়গামতো পৌঁছে যাওয়া চাই। মামা আশ্বাস। দিলেন, তাতে অসুবিধে হবে না।
বিকেলেই কচির সঙ্গে গিয়ে জায়গাটা দেখে এসেছে তিন গোয়েন্দা।
গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে এলে কিশোর তার পরিকল্পনার কথা বললো। সাত নম্বর রাস্তার মোড়ে গাড়ি থেকে নেমে যাবে ওরা তিনজন। কচিকে নিয়ে মামা চলে যাবেন সেই জায়গাটায়, যেখানে রোজ পিকআপ পার্ক করে কচি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে মামাকে জোরে জোরে বলবে সে, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, কাজেই দুটাখানেক দেরি হবে। মামা বলবেন, তিনিও গাড়ি রেখে কাছের চা-দোকানে চা খেতে যাচ্ছেন। তারপর কচি চলে যাবে বাড়ির দিকে, মামা চলে যাবেন। রেস্টুরেন্টের দিকে। যে বাড়িতে মাল সরবরাহ করে কচিরা সেখানে ঢুকে ঘণ্টাখানেক বসে থাকার দরকার হলেও অসুবিধে হবে না তার। বাড়ির গিন্নির সঙ্গে ভালো খাতির। কিন্তু সে দিকে গেলেও আসলে বাড়িতে ঢুকবে না সে, অন্ধকারে কোথাও ঘাপটি মেরে থেকে চোখ রাখবে গাড়িটার ওপর। ততোক্ষণে পা টিপে টিপে রাস্তার অন্যপাশে চলে আসবে তিন গোয়েন্দা। লুকিয়ে থেকে ওরাও চোখ। রাখবে গাড়ির ওপর।
সাত নম্বর রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গাড়ি থামালেন মামা। নেমে পড়লো তিন গোয়েন্দা। আবার এগিয়ে গেল গাড়ি, মোড় নিয়ে ঢুকে পড়লো গলিতে।
হেঁটে চললো তিন গোয়েন্দা। বিকেলেই দেখে গেছে লুকানোর অনেক জায়গা আছে এখানে। পথের একপাশে বাড়িঘর খুব পাতলা, ঝোঁপঝাড় আছে বেশ, খাদও আছে। একটা ঝোঁপের আড়ালে এসে বসে পড়লো ওরা। গাড়িটার দিকে চোখ।– দেখলো, একটা বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কচি। মামা চলে যাচ্ছেন মোড়ের। দিকে, চায়ের দোকানে গিয়ে বসে থাকবেন।
ছায়ায় মিলিয়ে গেল কচি।
ওই পথ ধরে প্রথম একজন মহিলাকে আসতে দেখলো ওরা।
আসছে, ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।
বিদেশী মহিলা। মনে হয় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো। বেশ লম্বা। পরনে জিনস, গায়ে গলাবন্ধ সোয়েটার। হাতে একটা চকচকে কালো লাঠি, হাতলটা রূপোয় বাধানো। সঙ্গে সঙ্গে আসছে বিশাল একটা কুকুর। জানোয়ারটা খুব অস্থির। এটা শুঁকছে, ওটা শুঁকছে, এদিকে চলে যাচ্ছে, ওদিকে চলে যাচ্ছে। কাছাকাছি রাখার জন্যে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যাচ্ছে মহিলা।
গাড়িটার কাছে এসে টায়ার হুঁকতে লাগলো কুকুরটা। মহিলাও দাঁড়িয়ে গেল।
সামনের টায়ার ওকে হঠাৎ লাফ দিয়ে জানালার কাছে দুই পা তুলে দিলো। কুকুরটা। ওকে নামতে বললো মহিলা। নামলো না দেখে হাতের লাঠিটা তুলে শাই করে বাড়ি মারলো, তবে গায়ে লাগানোর জন্যে নয়, ভয় দেখানোর জন্যে। সেই সঙ্গে দিলো কড়া ধমক।
পা নামিয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো কুকুরটা। মহিলা লাঠি হাতে চললো পেছনে।
মহা হারামী কুত্তা! মুসা মন্তব্য করলো।
আচ্ছা, রবিন বললো, কুকুরটাকে মারতে গিয়েই জানালার কাঁচে বাড়ি লাগিয়ে দেয়নি তো মহিলা?
মাথা নাড়লো কিশোর। না।
মহিলা চলে যাওয়ার পর পরই এলো দুটো ছেলে। একজনের হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট, আরেকজনের হাতে বল। বলটা বার বার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিচ্ছে। এগোচ্ছে ওভাবেই। গাড়ির কাছে পৌঁছে হাত ঘুরিয়ে ক্রিকেট বল যে ভাবে ছেড়ে তেমনি ভাবে জানালার কাঁচ সই করে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করলো ছেলেটী। কিন্তু মারলো না।
ছেলে দুটো পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর মুসা বললো, কিশোর, ওরা শয়তানী করে ভাঙেনি তো? বল ছুঁড়ে, কিংবা ব্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে?
না, আবার মাথা নাড়লো কিশোর, তা-ও মনে হয় না।
ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর আবার নীরব হয়ে গেল গলি। সময় যাচ্ছে। বাড়িঘরের অনেক জানালার আলোই নিভে যাচ্ছে একে একে। এক ঘণ্টা পেরোলো। এই সময়টায় একেবারে নির্জন রইলো গলিটা। তারপর এলো। লোকটা। লম্বা। মোড়ের দিক থেকে শাঁ শাঁ করে ছুটে এলো একটা টেন-স্পীড সাইকেলে চড়ে।
সতর্ক হয়ে উঠলো গোয়েন্দারা। সাইকেলের আলোটা বেশ উজ্জ্বল, টর্চের আলোর মতো এসে পড়েছে সামনের পথে। আঁটোসাঁটো পোশাক পরেছে। লোকটা, সাইকেল চালানোর সময় স্পোর্টসম্যানেরা যে রকম পরে। বিচিত্র আরও কিছু জিনিস রয়েছে তার শরীরে। পিঠে বাঁধা ব্যাকপ্যাক, মাথায় টুপি-ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা যে রকম পরে, চোখে বিচিত্র গগলস-গোল গোল কাঁচ, কানে। হেডফোন-ওয়াকম্যান কিংবা রেডিওটা দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয় পিঠের ব্যাগের ভেতরে ভরে রেখেছে।
খাইছে! হেসে ফেললো মুসা। ব্যাটাকে দেখে তো মনে হয় ভিনগ্রহ থেকেই নেমেছে। হাহ্ হাহ্! স্টার ট্রেক ছবির দৃশ্য। টুপির বদলে মাথায় হেলমেট থাকলেই হয়ে যেতো।
গাড়িটার কাছে এসে গতি ধীর করলো লোকটা। দম বন্ধ করে ফেললো। ছেলেরা। মুখ এদিকে, যেন ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মনে হলো, এখুনি কিছু ঘটবে। কিন্তু ঘটলো না। ওদেরকে নিরাশ করে আবার গতি বাড়িয়ে দিলো। লোকটা। ঢুকে পড়লো গিয়ে সামনের আরেকটা উপ-গলিতে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মুসা বললো, আমি তো মনে করেছিলাম…
এই ব্যাটাই কাঁচ ভাঙবে, বাক্যটা শেষ করে দিলো রবিন। অন্তত কিছু একটা করবে বলে মনে হচ্ছিলো আমার।
অন্ধকারে বসে ভ্রূকুটি করলো কিশোর, সেটা দেখতে পেলো না কেউ। আসলে সবাইকেই সন্দেহ করছি তো আমরা, ফলে নিরাশ হতে হচ্ছে। ধৈর্য ধরতে হবে।
বসে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঝাড়া। দিয়ে আবার স্বাভাবিক করে নিলো ওরা। অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলো কিশোর। এক ঘন্টা থাকার কথা, যে কোনো মুহূর্তে এখন বেরিয়ে আসতে পারে কচি।
হঠাৎ একটা নড়াচড়া চোখে পড়লো কিশোরের। দূরের একটা কোণ থেকে ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে আসছে একজন মানুষ।
আরও কাছে এলে দেখা গেল মানুষটা ছোটখাটো, হাতে কি যেন রয়েছে।
হাতে কি? ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।
এগিয়েই আসছে লোকটা, গাড়ির দিকে। মাঝে মাঝে পেছনে আর এদিক ওদিক ফিরে তাকাচ্ছে। যেন ভয় পাচ্ছে কোনো কারণে। হাতে একটা ছড়ি।
লাঠি! বেশ জোরেই বলে ফেললো রবিন, উত্তেজনায় আস্তে বলার কথা ভুলে গেছে।
ছড়ি দোলাতে দোলাতে গাড়ির দিকে আসছে লোকটা। ওটার একটা মাত্র বাড়ি লাগলেই চুরমার হয়ে যাবে জানালার কাঁচ।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ছেলেরা।
এগিয়ে আসছে লোকটা..আসছে পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে…এবার একটামাত্র বাড়ি…কিন্তু না, পাশ কাটাচ্ছে সে, দ্রুত এগিয়ে চলেছে যেন তাড়া খেয়ে। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল মোড়ের অন্ধকারে।
হতাশায় গুঙিয়ে উঠলো মুসা।
হতাশ অন্য দুজনও হয়েছে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের নির্জন, নীরব পথের দিকে। আর কেউ আসছে না। কোনো গাড়িও না। এগারোটা বাজলো, তার পরেও কিছু ঘটলো না।
এগারোটায় কচির বাড়ি ফেরার কথা, মনে করিয়ে দিলো মুসা।
সে-ও নিশ্চয় আমাদেরই মতো অপেক্ষা করছে, রবিন বললো, কাঁচ ভাঙার। বেরোচ্ছে না সেজন্যেই।
কিন্তু আর দেরি করে লাভ নেই, উঠে দাঁড়ালো কিশোর। আজ আর ভাঙবে বলে মনে হয় না। চলো।
ঝোঁপের আড়াল থেকে পথে বেরিয়ে এলো ওরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাড়ির ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো কচি। সবাই জড়ো হলো গাড়ির কাছে।
বিষণ্ণ কণ্ঠে কিশোর বললো, হয়তো আমার ধারণা ভুল।
ভুল? কি ভুল? জানতে চাইলে রবিন।
ভেবেছিলাম, কচির বন্ধুর গাড়িরও যখন একটা কাঁচ ভেঙেছে, তারমানে শুধু। কচিদেরটাই নয়, অন্য গাড়ির ওপরও চোখ আছে লোকটার, কাঁচ যে ভাঙে। কিন্তু। এখন মনে হচ্ছে, কোনো কারণে শুধু পিকআপটার ওপরই নজর। দেখা যাক আরও খোঁজ নিয়ে।
তাহলে আবার কাল এসে পিকআপের ফাঁদ পাতলেই পারি, মুসা পরামর্শ দিলো।
ভূত-থেকে-ভূতে কোনো কাজ দিচ্ছে না, রবিন বলে। অন্য গাড়ি কাঁচই যদি না ভাঙা হয়, কি খবর আসবে?
হু, গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালো কিশোর, এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দেখা যাক, কি হয়!
.
০৩.
পরদিন সকালে বাগানে বসে রোদ পোহাচ্ছে তিন গোয়েন্দা, এই সময় ছুটতে ছুটতে এলো কচি। ভীষণ উত্তেজিত। এসেই ধপ করে বসে পড়লো একটা চেয়ারে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, একশো বেয়াল্লিশটা।
কি একশো বেয়াল্লিশটা? মুসা অবাক।
গাড়ি!
গাড়ি?
একশো বেয়াল্লিশটা গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে! রাত একটা পর্যন্ত টেলিফোন এসেছে। ভোর থেকে শুরু হয়েছে আবার!
একশো বেয়াল্লিশটা! বিড়বিড় করলো কিশোর।
হ্যাঁ, কচি বললো। প্রথমটা ভেঙেছে দুই মাস আগে। আমাদেরটা ভাঙারও আগে।
তাহলে কিশোরের ধারণাই ঠিক, রবিন বললো। শুধু তোমাদের গাড়ির পেছনেই লাগেনি লোকটা।
সব কি ঢাকা শহরেই ভেঙেছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কচি।
কোন কোন এলাকার গাড়ি জিজ্ঞেস করেছিলে?
করেছি। ঠিকানাও লিখে নিয়েছি, বলে পকেট থেকে নোটবুক বের করলো। কচি।
সেটা নিয়ে পাতা উল্টে দেখতে লাগলো কিশোর। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে বললো, চলো ঘরে যাই। দেখি, মামার কাছে ঢাকা শহরের কোনও ম্যাপ আছে। কিনা।
না থাকলেও অসুবিধে নেই। জোগাড় করে নেয়া যাবে।
স্টাডিতে পাওয়া গেল চৌধুরী সাহেবকে। একটা গোয়েন্দা গল্পের পেপারব্যাক পড়ছেন। মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই যে গোয়েন্দারা, কি খবর?
বললো কিশোর।
ম্যাপ পাওয়া গেল। বেশ বড় একটা। সেটা নিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো। কিশোর, বন্ধুদেরকে সঙ্গে নিয়ে।
আরিফ সাহেব জানতে চেয়েছেন ম্যাপ দিয়ে কি করবে কিশোর। বলেনি সে শুধু বলেছে, আগে কাজটা শেষ হোক, তারপর সব জানাবে। তিনিও আর জানার জন্যে চাপাচাপি করেননি। মুচকি হেসে শুধু বলেছেন, একেবারে এরকুল পোয়ারো।
তাঁর সঙ্গে একমত রবিন। আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা গল্পের নায়ক এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে স্বভাবের অনেক মিল আছে কিশোর পাশার।
ঘরে এসে ম্যাপটা টেবিলে বিছাতে বিছাতে কিশোর বললো, কচি, ধারে কাছে ভালো স্টেশনারি দোকান আছে?
কেন?
কয়েক বাক্স পিন দরকার। ওই যে, যেগুলোর পেছনে রঙিন প্ল্যাস্টিকের বোতাম লাগানো থাকে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, যে কটা রঙে পাওয়া যায়, সব। লাগবে।
এখানে এই উত্তরায় তেমন দোকান…আচ্ছা, ঠিক আছে, না পেলে টঙ্গি থেকে নিয়ে আসবো। এখুনি লাগবে?
হ্যাঁ, এখুনি।
নিয়ে আসছি আমি।
আমরা আসবো?
দরকার নেই। দরজার দিকে এগোলো কচি।
টাকা নিয়ে যাও।
আছে আমার কাছে, বলে বেরিয়ে গেল কচি। ফিরতে অনেক দেরি করে ফেললো। জানালো, এখানে পাইনি। টঙ্গি যেতে হয়েছে। পিনের বাক্সটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো সে।
সবাইকে নিয়ে কাজে বসলো কিশোর। কচি যখন দোকানে গেছে, বসে থাকেনি সে। চৌধুরী সাহেবের নানা বিচিত্র জিনিসের গুদাম থেকে বড় একটুকরো চারকোণী প্লাইউড জোগাড় করে এনেছে। সেটার ওপর ম্যাপটা ছড়িয়ে টেপ দিয়ে আটকে নিয়েছে।
চার রঙের পিন এনেছে কচি। সবগুলো খুলে বসলো কিশোর। কচিকে বললো, তুমি নোটবুক দেখে এক এক করে ঠিকানা বলো।
বলতে লাগলো কচি। বাক্স থেকে পিন তুলে নিয়ে ঠিকানা মোতাবেক ম্যাপের গায়ে গাঁথতে লাগলো কিশোর। তাকে সাহায্য করলো রবিন আর মুসা।
সময় যে কোনদিকে দিয়ে কেটে গেল, খেয়ালই রইলো না ওদের। দুপুরের খাবার জন্যে যখন ডাকতে এলেন মামী, তখন টনক নড়লো মুসার। প্রচণ্ড খিদে টের পেলো। এই খিদে ভুলে এতোক্ষণ থাকলো কি করে ভেবে নিজেই অবাক হলো।
উত্তেজিত হয়ে আছে চারজনেই। খাবার টেবিলে খুব একটা কথা বললো না। ওরা। তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে আবার পিন গাঁথতে বসলো। আরও ঘণ্টাখানেকের খাটুনির পর শেষ হলো কাজ। হউফ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো কিশোর। বললো, দেখো তো, এবার কিছু বোঝা যায় কিনা?
ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকালো মুসা, পারছি। ঢাকা শহরের কোন কোন এলাকায় ভাঙছে, স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে এখন।
হ্যাঁ। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছো? কচি যখন ঠিকানাগুলো বলে যাচ্ছিলো, তারিখও বলতে বলেছিলাম। কোন তারিখে কোন দিন ভেঙেছে। কাঁচগুলো। শুধু সোম আর বুধবারে। অন্য কোনো বারে একটা কাঁচও ভাঙেনি।
ঠিক ঠিক! বলে উঠলো রবিন। আর কোনো বারের কথা লেখেনি কচি!
আরও একটা ব্যাপার, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বললো কিশোর, যে রাস্তায়ই ভাঙে, মাঝের দু-তিনটে করে গলি বাদ দিয়ে নেয়।
কেন দেয়? জানতে চাইলো মুসা।
সেটা এখনও বলতে পারবো না। তবে জেনে যাবো।
গাড়ি নিয়ে আবার কি ফাঁদ পাততে যাচ্ছি আমরা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
নিশ্চয়ই। তবে আজ বিকেলে বেড়াতে যাচ্ছি, কিশোর বললো। তুরাগ নদীর ধার ধরে হেঁটে চলে যাবো গ্রামের ভেতর। যতদূর যেতে পারি। দূর থেকে দেখে মনে হয়, গ্রামগুলো সুন্দর। ভেতরে ঢুকে দেখতে চাই সত্যি কেমন।
নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা। তিন গোয়েন্দা আর কচি। শীতকাল। শুকনো মৌসুম। অনেক নিচে নেমে গেছে পানি। খুব ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। একেবেঁকে যাওয়া পানির স্রোত। রেললাইন পেরিয়ে হেঁটে চললো ওরা।
একপাশে ছড়ানো ফসলের খেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে সেই কবে, এখন খেত জুড়ে শুধু সাদা মাটির ঢেলা।
নদীর পাড়ে সাদা বালি, পানির ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। জায়গায় জায়গায় অসংখ্য শালিক বসে আছে। ঝগড়া বাধিয়েছে কোনো কোনোটা, কিচির মিচিয়ে কান ঝালাপালা। একখানে দেখা গেল পানির কিনারে এক পা তুলে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে সাদা বক। ওদের এগোতে দেখে ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল তার। চোখের পলকে ডানার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আরেকটা পা। সতর্ক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো ওদেরকে। বোধ হয় লক্ষ করছে হাতে এয়ারগান আছে কিনা। ইদানীং এই বয়েসী ছেলেরা বড় বেশি বিরক্ত করে। এই তো, দিন কয়েক আগেই মেরে নিয়ে গেছে তার সঙ্গিনীকে।
ওদের হাতে কিছু নেই দেখে আশ্বস্ত হলো পাখিটা, তবে সতর্কতা কমলো না। ব্যাপারটা লক্ষ করলো মুসা। বকটা ওরকম করছে কেন জিজ্ঞেস করলো। এয়ারগানের কথা জানালো কচি।
আরও খানিক দূর গিয়ে একটা বড় মাছরাঙা দেখা গেল। পানিতে পড়ে থাকা মরা পচা ডালের ওপর বসে আছে। ওদেরকে দেখে ওটাও সতর্ক হয়ে গেল। ওরা আরও খানিকটা এগোতেই চিড়ড়িক ডাক ছেড়ে উড়ে চলে গেল।
এটারও কি এয়ারগানের ভয়?
চড়ুই থেকে শুরু করে কিছুই তো বাদ দেয় না ছেলেগুলো।
এগিয়ে চলেছে ওরা। পায়ে চলা পথের কিনারে এখন খানিক পর পরই খেজুর গাছ। পথের পাশে খেত আছে এখানেও। তবে ফসলের খেতের মতো শূন্য নয়। শীতকালীন শাকসজিতে সবুজ হয়ে আছে। কোথাও সরষে খেতের হলদে ফুলের শোভা। তার ওপর এসে পড়েছে বিকেলের পড়ন্ত সোনালি রোদ।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেই ফেললো মুসা, কিশোর, তোমাদের দেশটা সত্যিই সুন্দর! এতোদিন তো শুধু শুনেছি, আজ দেখলাম…
জবাব দিলো না কিশোর। শুধু মাথা ঝাঁকালো। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে তার। মায়াময় দুই চোখ। গুনগুন কবে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…
পেছনে সূর্য ডুবছে। খেজুর গাছে শালিক আর শ্যামার ভিড়। বেশির ভাগই ডাকছে নানান সুরে। কোন কোনটা এসে বসেছে রসের কলসের কানায়। রস বেয়ে পড়ার কাঠিতে ঠোঁট ডুবিয়ে রস খাচ্ছে। দূরে কোথায় যেন আপনমনে শিস দিয়ে চলেছে একটা দোয়েল। এক জায়গায় এসে দেখলো, খেজুর গাছে কলসি পাতছে ওদেরই বয়েসী একটা ছেলে।
কলসিতে যে মিষ্টি রস পড়ে, ইতিমধ্যে তা জেনে গেছে মুসা। কচিকে জিজ্ঞেস করলো, কখন খাওয়া যাবে?
সকালে, জানালো কচি।
সকালে কেন?
সারারাত ধরে কুয়াশা পড়বে। কুয়াশা আর রস গিয়ে জমা হবে কলসিতে। সকালে ওগুলো নামিয়ে বেচতে নিয়ে যাবে কৃষক।
ও। সকালে আসাই ভালো ছিলো তাহলে।
কেন, রস খাওয়ার জন্যে? হাসলো কচি। বেশ, আসবো একদিন সকালে।
গাছের ওপর থেকে ওদের কথাবার্তা সবই শুনেছে কৃষকের ছেলেটা। মুসার ভাঙা বাংলা বুঝতেও অসুবিধে হয়নি। স্থানীয় ইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে সে।
কলস পাতা শেষ করে নিচে নামলো ছেলেটা। তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। মুসা আর রবিনের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাতে লাগলো সে। বুঝতে পারছে, বিদেশী। কচির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনেরা কি এখানে নতুন আইলেন?
আমি পুরানোই। এরা নতুন।
ইনিও? কিশোরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।
হ্যাঁ।
কই থাকেন ভাই আপনেরা? এবারের প্রশ্নটা কিশোরকে।
আমেরিকায়। আমার নাম কিশোর পাশ, হাত বাড়িয়ে দিলো সে। ওরা আমার বন্ধু। ওর নাম মুসা আমান। আর ও রবিন মিলফোর্ড।
চকচক করে উঠলো ছেলেটার দুচোখ। দৃষ্টিতে বিস্ময় মেশানো অবিশ্বাস। রাখেন, রাখেন, আপনেদের নাম শুনছি! রকি বীচে থাকেন না আপনেরা?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালে কিশোর। চোখে কৌতূহল।
বুঝেছি, আপনেরাই! কতো পড়ছি আপনেগো কিচ্ছা! খুব ভাল লাগে আমার। আপনেরা তিন গোয়েন্দা, ঠিক কইলাম না? বলে জবাবের অপেক্ষা না করেই কিশোরের হাত দুই হাতে চেপে ধরলো সে। আমার নাম আবদুল করিম। হগগলে ডাকে করিম কইয়া। খালি বাবায় আর হেডস্যারে যখন বেশি রাইগ্না যায়, তখন কয় করিম্মা। নিষ্পাপ হাসি হাসলো সে। এক এক করে মুসা আর রবিনের হাতও ন্টঝাঁকিয়ে দিলো।
ছেলেটার সরলতায় মুগ্ধ হয়ে গেল মুসী আর রবিন। আমেরিকায় এই বয়েসী কোন ছেলের এতোখানি আন্তরিকতা কল্পনাও করা যায় না।
মুসা জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাদের কথা জানো?
হ জানি, আবার হাসলো ছেলেটা। আপনে খালি খাইছে খাইছে করেন না? আর হগল সময় খালি খাওনের লাইগ্যা পাগল হইয়া থাকেন। ভূতের নাম শুনলেই কাছার কাপড় ফালাইয়া দৌড়। ঠিক না?
হ্যাঁ, ছেলেটার সব কথার অর্থ বুঝতে পারছে না মুসা, তবে মানে মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারছে।
গাছের মাথায় থাইক্কাই শুনলাম, রস খাওনের কতা কইতাছেন। অখন তো। অইবো না, বাই, সকালের আগে রস পাওন যাইবো না।
খুব সহজেই ওদেরকে আপন করে নিলো ছেলেটা। বকবক করে চললো। কাছেই ওদের বাড়ি। হাত তুলে দেখিয়ে দিলো।
সূর্য এখন আর চোখে পড়ে না। ডুবে গেছে। কিন্তু তার রেশ ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিম আকাশে সাদা মেঘের ছোট-বড় পাহাড়গুলো এখন রক্তলাল।
ওদেরকে তার বাড়িতে রাতের খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে বসলো করিম। আজ না, আরেক দিন, বলে অনেক কষ্টে এড়ানো গেল।
দ্রুত কমে আসছে গোধূলির কালচে সবুজ আলো। ছায়াঢাকা মেঠোপথ ধরে আবার শহরের দিকে ফিরে চললো ওরা। এক অপূর্ব আনন্দে মন ভরে গেছে। সবারই, বিশেষ করে তিন গোয়েন্দার।
মনে মনে আরেকবার স্বীকার করতে বাধ্য হলো রবিন আর মুসা, বাংলাদেশটা সত্যিই সুন্দর সুন্দর এর মানুষগুলো!
.
০৪.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ঘর থেকে বেরোতেই মামীর সঙ্গে দেখা। মুসার। তাকে ডাকতেই আসছিলেন তিনি। বললেন, উঠেছে। বারান্দায় গিয়ে দেখো কে এসেছে।
কে?
গিয়েই দেখো না, মিটিমিটি হেসে চলে গেলেন তিনি।
ভীষণ কৌতূহল হলো মুসার। চলে এলো বারান্দায়। তাকে দেখেই হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা।
আরে, করিম।
হ। রস লইয়া আইছি। আইজ রাইতে কুয়াশা খুব ভালো পড়ছিলো। ভালো। রস অইছে। সামনে রাখা দুই কলস রস দেখালো করিম। যান, একটা গেলাস লইয়া আয়েন। ঢাইল্লা দেই, খান।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল মুসা। এই কষ্টটা কেন করতে গেলে?-বলে যে সৌজন্যটুকু দেখাবে সেকথাও ভুলে গেল। ভাবতেই পারেনি এভাবে রস নিয়ে হাজির হয়ে যাবে আবদুল করিম।
এই নে, গেলাস, পেছন থেকে মামীর কথায় সংবিৎ ফিরলো যেন তার।
গেলাসটা নিয়ে হাসলো মুসা। বাড়িয়ে দিলো করিমের দিকে। দাও।
কলসের মুখে পরিষ্কার গামছা বাধা। সাদা ফেনা জমে রয়েছে। রস ঢেলে দিলো করিম।
হাতে নিয়ে পানীয়টুকু ভালো করে দেখলো মুসী। এই জিনিস আগে কখনও দেখেনি সে। গন্ধ শুকলো। তারপর চুমুক দিলো গেলাসে। দিয়েই বলে উঠলো, হখাইছে! এতো মিষ্টি! বলেই ঢকঢক করে সবটুকু গিলে ফেলে আবার গেলাসটা বাড়িয়ে দিলো।
গিলে চলেছে মুসা। আর ক্রমেই বাড়ছে করিমের হাসি। দারুণ মজা পাচ্ছে। গ্রামে ওরা বন্ধুরা মিলে বাজি ধরে রস খায়। সবাই প্রচুর খেতে পারে। কিন্তু এখন তার মনে হলো, মুসার ধারে কাছে যেতে পারবে না কেউ।
চলেন, একদিন আমাগো বাড়িত গিয়া বাজি ধইরা খাইবেন? প্রস্তাব দিয়ে ফেলল করিম।
না বুঝেই মাথা কাত করলো মুসা, আচ্ছা। আবার বাড়িয়ে দিলো গেলাস।
একের পর এক গেলাস খালি করে অবশেষে ওটা করিমের হাতে দিতে দিতে। মস্ত ঢেকুর তুলল সে, নাও, আর পারবো না।
একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো মুসা। ঢোল হয়ে যাওয়া পেটে হাত বোলাচ্ছে। কিশোর আর রবিনও এসেছে। ওদেরকে বললো, দারুণ টেস্ট, বুঝলে। খেয়ে দেখো। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলো সে। এতো মজা, লোভ সামলাতে পারিনি। এর সঙ্গে কোথায় লাগে পেপসি-কোক-ফান্টা…
রস খাওয়া শেষ হলো। কিছুতেই পয়সা নিতে চাইলো না আবদুল করিম। কিন্তু তিনজনের কাছ থেকে তিনটে ভনির তাকে নিতেই হলো। আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা। রবিন দিলো ইলেকট্রনিক ঘড়ি বসানো একট বলপেন। কিশোর দিলো একটা পকেট নাইফ। মুসা দিল সুন্দর একটা গেঞ্জি আর একবাক্স চকলেট।
খুব খুশি হলো করিম। ওদেরকে আবারও খাওয়ার দাওয়াত দিলো। একেবারে নাছোড়বান্দা। কথা আদায় না করে যাবেই না।
শেষে কিশোর বলল, ঠিক আছে, যাবো, তবে আজ না। আজ তো বুধবার, যেতে পারবো না। আরেক দিন।
বুধবারে কি অসুবিধা বুঝতে পারলো না করিম। জিজ্ঞেসও করলো না। জানতে চাইলো, আরেক দিন কবে?
কালও হতে পারে। এসো একবার যেতে পারলে চলে যাবো।
আচ্ছা, বলে উঠে পড়লো করিম।
.
দিনের বেলাটা নানা জায়গায় ঘুরে কাটালো তিন গোয়েন্দা। সোনার গাঁ দেখে এলো। বিকেল বেলা ফিরে খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। রাতের খাওয়ার পর বেরোলো আবার, গাড়ি নিয়ে, মামার সঙ্গে।
সোমবার আর বুধবারেই ঘটে কাঁচ ভাঙার ঘটনাগুলো।
আগের বারের মতোই সেদিনও সাত নম্বর রোডের মোড়ে তিন গোয়েন্দাকে নামিয়ে দিলেন চৌধুরী সাহেব। নির্দিষ্ট জায়গায় এনে গাড়ি পার্ক করলেন। কচি নেমে চলে গেল একটা বাড়ির ছায়ার দিকে। তিনি চললেন মোড়ের চায়ের। দোকানে।
আগের দিনের মতোই ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে বসলো তিন গোয়েন্দা।
প্রথমে এলো সেই লম্বা বিদেশী মহিলা। হাতে লাঠি, সঙ্গে কুকুর। সেদিনের। মতোই সব কিছু শুঁকতে শুঁকতে এলো কুকুরটা, লাফ দিয়ে গাড়ির কাঁচে পা তুলে দিলো, ধমক দিয়ে তাকে নামিয়ে নিলো মহিলা।
ফিক করে হেসে ফেললো মুসা।
কুকুরটাকে নিয়ে চলে গেল মহিলা। আবার নীরব হয়ে গেল রাস্তা।
এরপর গোটা দুই গাড়ি হুস হুস করে বেরিয়ে গেল। পার্ক করে রাখা গাড়িটার কাছে এসেও একটু গতি কমালো না।
দ্বিতীয় গাড়িটা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর এলো সেই বিচিত্র পোশাক পরা তরুণ। টেন-স্পীড সাইকেলে করে। সেদিন তো পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গতি কমিয়েছিলো, আজ তা-ও কমালো না। শাই শাই করে সোজা ছুটে গিয়ে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা উপ-গলিতে।
ঝোঁপের আড়ালে অপেক্ষা করে আছে ছেলেরা।
দশটার দিকে মোড়ের কাছে আরেকটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। আরও কাছে এলে দেখা গেল একটা ফোক্স ওয়াগেন। অদ্ভুত রঙ করেছে–ওপরের অংশটা বেগুনী, নিচের অংশ হলুদ। তোবড়ানো ফেনড়ার। সামনের বাম্পারের একপাশ খুলে গেছে, আরেক পাশ ছুটলেই খসে পড়ে যাবে। ইঞ্জিনের ভারি শব্দ আর ঝুলে পড়া বাম্পারের ঝনঝন আওয়াজ তুলে এগিয়ে এলো ওটা। পার্ক করা গাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো কি একটা জিনিস। গিয়ে পড়ল গাড়িটার নিচে।
কি ছুঁড়লো! চেঁচিয়ে বললো মুসা।
চল, দেখি! কিশোর বললো।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো তিনজনে। ছুটে রাস্তা পেরিয়ে এসে উঁকি দিলো গাড়ির নিচে। টর্চের আলোয় জিনিসটা দেখে মুখ বাকলিলা কিশোর।
জিনিসটা বের করে আনলো মুসা। ভীষণ নিরাশ হয়েছে।
সিগারেটের প্যাকেট! বিড়বিড় করলো রবিন। ভেতরে কিছু নেই তো?
খুলে দেখলো মুসা। কিচ্ছু নেই! নিমের তেতো ঝরলো তার কণ্ঠ থেকে, ধুর…
কথা শেষ হলো না তার। হঠাৎ বেজে উঠলো সাইরেন। মোড়ের কাছে দেখা দিলো পুলিশের গাড়ি। হাতের ওপরে লাল-নীল আলো জ্বলছে-নিভছে। পথের আরেক মাথায় একটা উপ-গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একই রকম আরেকটা গাড়ি।
তিন গোয়েন্দাকে ঘিরে ফেললো পুলিশ।
.
পুলিশের গাড়িতে বসানো সার্চ লাইটের আলো এসে পড়লো ওদের গায়ে এগিয়ে এলেন একজন গম্ভীরমুখো সার্জেন্ট। বুকে প্ল্যাস্টিকের ফলক ঝুলছে, তাতে নাম লেখাঃ আবদুল আজিজ। এক এক করে তাকালেন কিশোর, মুসা আর রবিনের মুখের দিকে। শেষ দুজনকে দেখে অবাক হয়েছেন, বোঝা গেল। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের পরিচয়?
কি জিজ্ঞেস করছেন! বলে উঠল রাগত একটা কণ্ঠ, ধরে লাগান না ধোলাই! পথেঘাটে চুরি, ছিনতাই, বোমাবাজি অতিষ্ঠ করে ফেললো!
মোটা একটা বেতের লাঠিতে ভর দিয়ে পুলিশের ভিড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধ। পরনে অবিন্যস্ত পোশাক। পেছন পেছন এলো এক তরুণ আর সতেরো আঠারো বছরের আরেক তরুণী।
চোর কোথাকার! তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে গর্জে উঠলেন বৃদ্ধ, আমার ঈগল কোথায়?
একটা পেট্রল কার থেকে নেমে এলেন পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর। বুকে। ঝোলানো ফলকে নাম লেখা, হাফিজ আলি। তিন গোয়েন্দাকে দেখে সার্জেন্টের মতোই অবাক হলেন তিনিও। কুঁচকে গেল ভুরু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থেকে একই প্রশ্ন করলেন, তোমাদের পরিচয়?
পরিচয়-ফরিচয় পড়ে! ধমকে উঠলেন বৃদ্ধ। আমার ঈগলটা কোথায় আগে জিজ্ঞেস করুন! ধরে পেটান না…
আহ, থামুন তো আপনি, হাত তুলে বললেন পুলিশ অফিসার। আবার তাকালেন ছেলেদের দিকে, এখানে কি করছো তোমরা?
উ…উই… ইংরেজিতে বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। বাংলায় তোতলাতে শুরু করলো, আ-আমরা-চো-চো-চো…,
চোর নই, বাক্যটা শেষ করে দিলো কিশোর। বৃদ্ধকে দেখিয়ে বললো, ইনি ভুল করছেন।
কি বলতে যাচ্ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর, চেঁচিয়ে বললো একজন কনস্টেবল, স্যার, আরেক ব্যাটাকে ধরেছি! লুকিয়ে ছিলো! কচিকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে সে।
চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ, আরি, ওটাকে চিনি তো! তিন-তিনবার দেখেছি একটা পিকআপের কাছে, আর তিনবারই কাঁচ ভেঙেছিলো, গাড়িটার!
ওটা আমাদেরই গাড়ি, কচি বললো। মাল ডেলিভারি দিতে এসেছিলাম। কে জানি ভেঙে রেখে গেছে।
এটা কার? সামনের গাড়িটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সাব-ইন্সপেক্টর।
ওসব কথা বাদ দিন না! খেপে গেলেন বৃদ্ধ। আমার ঈগল কোথায় জিজ্ঞেস করুন!
আপনি স্যার থামুন না! বিরক্ত হয়ে বললেন পুলিশ অফিসার। আমরাই তো করছি যা করার। আপনি চুপ থাকুন, প্লীজ।
গজগজ করতে লাগলেন বৃদ্ধ।
কিশোর বললো, দেখুন, আমরা গাড়ির কাঁচ ভাঙতে আসিনি। চুরি করতেও নয়।
বার বার চোর চোর শুনতে শুনতে অসহ্য হয়ে গেছে মুসা। চমকের প্রথম ধাক্কাটাও কাটিয়ে উঠেছে। রেগে গেল। ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে বললো, ঈগল ভেরি বিগ পাখি। পকেটে ভরে রেখেছি নাকি?
ঠিক, বাংলায় বললো রবিন। পরের কথাটা বললো ইংরেজিতে, পাখি চুরি করতে যাবো কোন দুঃখে?
সেটা আমি কি জানি? চুপ থাকতে পারছেন না বৃদ্ধ। মুখ ভেঙচালেন, এহ্, ভেরি বিগ পাখি! ন্যাকামো হচ্ছে! জানো না কি পাখি…।
আরেকজন কনস্টেবল চেঁচিয়ে উঠলো, স্যরি, এই গাড়িটা চিনি! নাম্বার প্লেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চৌধুরী সাহেবের! আরিফুর রহমান চৌধুরী! ডি আই জি ছিলেন…
হ্যাঁ, আমারই, পেছন থেকে শোনা গেল ভারি কণ্ঠ।
ঝট করে ফিরে তাকালেন সাব-ইন্সপেক্টর। স্যার, আপনি?
অ্যাটেনশন হয়ে গেলেন তিনি আর তার দলের লোকেরা। স্যালুট করলেন।
সালামের জবাব দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন ভূতপূর্ব ডি আই জি, হ্যাঁ। কাঁচ ভাঙে কে ধরতে এসেছি। কিশোরকে দেখিয়ে বললেন, ও আমার ভাগ্নে, কিশোর পাশা। আমেরিকায় থাকে। বেড়াতে এসেছে।…আর এরা ওর বন্ধু। ও মুসা আমান।…ও রবিন মিলফোর্ড। গোয়েন্দাগিরির খুব শখ। নামটাম ভালোই করেছে ওখানে।
আমি ওদের কথা জানি, স্যার, হাসিমুখে বললো একজন কনস্টেবল। পড়েছি। তিন গোয়েন্দা।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন চৌধুরী সাহেব।
ফোন করে ডেকে আনলাম চোর ভেবে, বিড়বিড় করলেন বৃদ্ধ। এখন শুনি গোয়েন্দা। অস্থির ভঙ্গিতে রাস্তায় বেত ঠুকতে ঠুকতে বললেন, আমার ঈগলটা কি পাবো না?
.
০৫.
এরা যে লুকিয়ে আছে, আপনারা খবর পেলেন কোথায়? চৌধুরী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
কথা হচ্ছে বৃদ্ধ আকবর আলি খানের ড্রইংরুমে বসে, তিন গোয়েন্দাকে চোর ভেবে বসেছেন যিনি। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে কিশোর। আসবাবপত্র খুব দামী, কিন্তু পুরানো ধাচের। জমিদারী আমলের জিনিসের মতো ভারি আর নকশা করা। বসার ঘরে দেয়ালে টানানো আকবর আলি খানের তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের একটা ছবি। পরনে কালো স্যুট। ঠিক একই রকম পোশাক পরেন এখনও। কিছুতেই যেন সময়টা পার হয়ে আসতে পারেননি, কিংবা হয়তো চাই না।
দুমাস ধরেই ধরার চেষ্টা করছি, স্যার, সার্জেন্ট জানালেন। অনেকেই খবর। দিচ্ছে, রহস্যময় ভাবে গাড়ির উইণ্ডশীল্ড ভেঙে রেখে যাচ্ছে কেউ। গত হপ্তায় খান। সাহেবও থানায় ডাইরি করে এসেছেন, বৃদ্ধকে দেখালেন তিনি। তাঁর গাড়ির কাঁচ ভেঙে ভেতর থেকে ঈগলটা রে করে নিয়ে গেছে। বাড়ির সামনে তখন ছিলো গাড়িটা। ভুলে ঈগলটা রয়ে গিয়েছিলো গাড়িতে। খানিক পরে মনে পড়তেই ছুটে গিয়ে দেখেন গাড়ির কাঁচ ভাঙা, ঈগল উধাও। তারপর থেকেই রাস্তার ওপর চোখ রাখেন। পরশুদিন রাতেও নাকি তিনজন ছেলেকে বাড়ির সামনের রাস্তায়, ঝোঁপের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখেছেন। আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে রেখেছেন। আজও যখন এদেরকে দেখলেন, তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন আবদুল আজিজ, ফোন করলেন থানায়। আমি তখন চৌরাস্তার মোড়ে ডিউটিতে ছিলাম। অয়্যারলেসে আমাকে জানিয়েছেন সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ আলি।
জানালার কাঁচ ভাঙার পর, রবিন বললো, উড়ে পালিয়েছে হয়তো ঈগলটা।
মুসা বললো, ঈগল ডেঞ্জারাস পাখি। ছেড়ে রাখা হয় না। পালালো কিভাবে?
কড়া চোখে ওদের দিকে তাকালেন আকবর আলি খান। ইচ্ছে করে ন্যাকা সাজছে, না কী? পাখি হবে কেন? আমার জিনিসটা একটা..।
বুঝেছি! বলে উঠলো কিশোর। জ্বলজ্বল করছে চোখ। পাখি নয়, মুদ্রা! একটা দুর্লভ মুদ্রা!
মুদ্রা? অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকালো কচি।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আমেরিকান। সোনার টাকা, দশ ডলারের। আঠারোশো সালের শুরুতে বাজারে ছাড়া হয়েছিলো। এক পিঠে ঈগলের ছাপ মারা, ঈগল বললেই লোকে চিনতো তখন। আরও একটা প্রায় একই রকম মুদ্রা ছিলো তখন, হাফ ঈগল, ছাড়া হয়েছিলো আঠারোশো বাইশ সালে। দুনিয়ার। সবচেয়ে দুর্লভ মুদ্রাগুলোর একটা এখন।
শুনলেন! গর্জে উঠলেন আকবর সাহেব। সব জানে। তার মানে ঈগলটা দেখেছে!
দেখলেই যে জানবে শুধু, না দেখলে জানবে না, এটা কোনো কথা হলো না,। গম্ভীর হয়ে বললেন আরিফ সাহেব। না দেখেও জানা যায়, বই পড়ে। আর আমার। ভাগ্নে প্রচুর বই পড়ে।
আরিফ সাহেবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মেয়েটা বললো, ঠিকই তো। তুমি কিন্তু দুর্ব্যবহার করছ, আব্বা।
কিছু বললেন না আকবর সাহেব। তবে দৃষ্টি কিছুটা নরম হলো।
তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে আবার বললো মেয়েটা, তোমরা কিছু মনে করো না, ভাই। আব্বার মনমেজাজ ভালো নেই। ঈগলটা হারিয়ে ভীষণ অস্থির। উঠে এসে কিশোরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, কোনো জড়তা নেই। আমি ডলি। সোফায় বসা তরুণকে দেখিয়ে বললো, ও আমার চাচতো ভাই, সানি।
সানিও এসে এক এক করে হাত মেলালো তিন গোয়েন্দার সঙ্গে।
এই সময় চা-নাস্তা নিয়ে ঢুকলো বাড়ির কাজের লোক। মেহমানদেরকে সেগুলো পরিবেশন করতে লাগলো ভাই-বোন মিলে।
কি ঈগল আপনাদেরটা? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সানিকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
ডাবল ঈগল।
তার মানে বিশ ডলারের। আঠারোশো ঊনপঞ্চাশ সালে তৈরি। হাফ ঈগলের চেয়েও দুর্লভ। যতদূর জানি, আমেরিকায় এখন একটাই আছে, গভর্নমেন্টের কাছে। দশ লাখ ডলারে কিনতে চেয়েছিলো এক কোটিপতি, তা-ও রাজি হয়নি সরকার।
জানি, সানি বললো। আঠারোশো তিপ্পান্ন সালে নাকি আরও তিনটে তৈরি হয়েছে, যার দুটোর খোঁজ আছে এখন। একেকটার দাম পাঁচ লাখ ডলার।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করলো মুসা। বিশ ডলারের একটা সোনার টুকরোর এতো দাম!।
অ্যানটিক ভ্যালু, কিশোর বললো।
হ্যাঁ, সানি বললো। চাচারটা তৈরি হয়েছে উনিশশো সাত সালে। দাম আড়াই লাখ ডলারে মতো।
গাড়িতে ছিলো কেন ওটা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
ধানমণ্ডিতে পুরানো মুদ্রার একটা একজিবিশন হয়েছিলো, ডলি জানালো, সেখানে দিয়েছিলো আব্বা। ওখান থেকে নিয়ে আসার পর ভুলে গাড়িতেই রয়ে গিয়েছিলো।
দোষটা তোর!
এবার মেয়ের ওপর রেগে গেলেন আকবর আলি। কতোবার মানা করেছি, গাড়ি চালানোর সময় এতো জোরে ক্যাসেট বাজাবি না! ভুলে গেলেন পুলিশের সামনে একথা বলা ঠিক হচ্ছে না, কারণ তাঁর মেয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্সই নেই, ওই বয়সে পাওয়া যায় না। গোপনে চালায়। গান না ছাই! ধুড়ুম ধুড়ুম ঢাকের শব্দ আর চেঁচামেচি, আফ্রিকার জংলীরাও এই কাণ্ড করে না। কি যে শোনে আজকালকার। ছেলেমেয়েগুলো! মাথা ধরে গিয়েছিলো আমার! ওই চেঁচামেচিতেই সব ভুলে গিয়েছিলাম, বাক্স ফেলে এসেছি গাড়িতে। নইলে কি আর ঈগলটা খোয়াতাম!
দুর্লভ জিনিস তো, তাঁকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে সহানুভূতির সুরে বললো। কিশোর, টাকা দিয়েও সব সময় পাওয়া যায় না। এসব জিনিস হারিয়ে গেলে কষ্টটা সে জন্যেই বেশি পায় সংগ্রহকারী।
কিশোর, মুসা বললো, গাড়ির ভেতরের জিনিস চুরি করার জন্যেই কি তাহলে কাঁচ ভাঙে?
মাথা নাড়লো কিশোর। আমার তা মনে হয় না।
আমারও না, মাথা নাড়লো কচি। কারণ আমাদের গাড়ি থেকে একবারও কিছু চুরি যায়নি। চুরি যাওয়ার মতো অবশ্য কিছু ছিলোও না ভেতরে।
তাহলে কাঁচ ভাঙার আর কি কারণ থাকতে পারে? সানির প্রশ্ন।
তাই তো, আর কি কারণ? প্রশ্নটা উলিরও। আমার তো বিশ্বাস চুরিই এর। একমাত্র কারণ। সঙ্ঘবদ্ধ কোনো দলের কাজ।
না আমারও মনে হয় না চুরি এর কারণ, সার্জেন্ট আজিজ বললেন। তোমাদেরটা বাদে আর কোনো গাড়ি থেকেই কোনো কিছু চুরি যায়নি। রিপোর্ট করেনি কেউ। এমন কতোগুলো গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে যেগুলোর দরজা লক করা ছিলো না। যদি আর কোনো উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে বলতে হবে এটা স্রেফ শয়তানী।
কি জানি, কথাটা মানতে পারলো না কচি। শয়তানী করলে তো কোনো দুষ্টু ছেলের কাজ হতো। তাহলে কি ধরে ফেলতে পারতেন না এতোদিনে?
ঠিকই বলেছো, একমত হলো কিশোর। ম্যাপে যা দেখলাম, তাতে মনে হয় বেশ হিসেব করে একেকখানে গিয়ে একেকবার কাঁচ ভাঙে। এটা দুষ্টু ছেলের কাজ হতে পারে না। তাছাড়া সব দিন নয়, ভাঙে দুটো বিশেষ দিনে, সোম আর বুধবার।
তাই নাকি? অবাক মনে হলো সাব-ইন্সপেক্টরকে। এটা তো খেয়াল করিনি!
০৬.
পরদিন সকাল আটটায় ড্রইং রুমে এসে বসলো তিন গোয়েন্দা। আরিফ সাহেব আগে থেকেই আছেন। কচিও এলো। তাকে আসতে বলে দিয়েছিলো কিশোর।
মামা, একটা কাজ করে দেবে? ভূমিকা না করে সরাসরিই বললো কিশোর।
কি কাজ? খবরের কাগজ থেকে মুখ তুললেন আরিফ সাহেব।
থানায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কাঁচ ভাঙার রাতে রাস্তায় ডিউটি ছিলো যাদের, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে।
এক মুহূর্ত ভাবলেন আরিফ সাহেব। তারপর মাথা কঁকালেন, হু, তা অবশ্য করা যায়। গুলশান থানার ওসিকে ফোন করে বলতে পারি। ব্যবস্থা করে দেবে। কখন যেতে চাস?
পারলে এখনই।
আচ্ছা দেখি।
পনেরো মিনিট পর রিসিভার রেখে দিয়ে ফিরে তাকালেন আরিফ সাহেব। মৃদু হেসে বললেন, হয়ে গেছে। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। ওসি কথা দিয়েছে, আমার চিঠি দেখালেই সহযোগিতা করবে পুলিশ।
আরও আধঘণ্টা পর বেরিয়ে পড়লো ওরা। বাসে করে উত্তরা থেকে বনানীতে এসে নামলো।
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর বললো, যেসব রাস্তায় কাঁচ ভেঙেছে, ওসব জায়গায় সোমবার কিংবা বুধবারে যাদের ডিউটি ছিলো তাদেরকে জিজ্ঞেস করবো। গত হপ্তার খবর নিলেই হবে।
কিন্তু জিজ্ঞেসটা করবো কি? মুসার প্রশ্ন।
অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে কিনা। কাকে কাকে দেখেছে, কি রকম লোক, এসব।
মনে আছে কিনা ওদের কে জানে! রবিন বললো। প্রশ্নগুলো সব তুমিই ১ করো। আমরা তো বাংলা ভালো বলতে পারি না।
থানায় ঢুকে পরিচয় দিয়ে ওসি কথা জিজ্ঞেস করতেই তার ঘরে ওদেরকে নিয়ে। এলেন একজন ডিউটিরত পুলিশ। আরিফ সাহেবের চিঠি তাঁকে দেখালো কিশোর। ব্যবস্থা মোটামুটি তিনি আগেই করে রেখেছেন।
একজন তরুণ পুলিশ কনস্টেবলের সাক্ষাৎকার নেয়া হলো প্রথম।
ওই কাঁচ ভাঙা? মাথা নাড়লেন কনস্টেবল। নাহ্ কিচ্ছু দেখিনি। দেখলে তো ধরেই ফেলতাম। সন্দেহজনক মনে হয়নি কাউকে। অযথা সময় নষ্ট করেছি, বুঝলে। আসল চোর-ডাকাত ধরা বাদ দিয়ে কতগুলো দুষ্টু ছেলের পেছনে লেগেছি।
দুষ্টু ছেলেই, আপনি শিওর? কিশোরের প্রশ্ন।
তাছাড়া আর কি? দেখো, চাকরিতে ঢুকেছি সাত বছর হয়ে গেছে। শয়তান লোক তো আর কম দেখলাম না…।
আচ্ছা, কাকে কাকে দেখেছেন, মনে আছে? অনেক লোক?
রাস্তা যখন, লোক তো দেখবোই। আসছে যাচ্ছে, আসছে যাচ্ছে, কেউ দাঁড়ায়নি। কোনো গাড়ির দিকে ইট-পাথর ছুঁড়ে মারেনি কেউ, হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে কাঁচ ভাঙেনি…
যাদেরকে দেখেছেন, তাদের কারও চেহারা মনে আছে?
নিশ্চয়ই আছে। অনেকেরই। সাত বছর কাটিয়ে ফেলেছি, এখন একটা। প্রমোশন দরকার আমার। কাজেই ডিউটিতে ফাঁকি দিই না। আর আমার স্মরণশক্তি খুব ভালো, কাউকে একবার দেখলে সহজে ভুলি না…
দাঁড়ান দাঁড়ান, লিখে নিই। পকেট থেকে তাড়াতাড়ি নোটবুক বের করলো কিশোর।
নোটবুকের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন হঠাৎ কনস্টেবল, অযথাই কেশে গলা পরিষ্কার করলেন, ফালতু কথা আর বলা চলবে না বুঝে গেছেন। কারণ বক্তব্য লেখা হয়ে যাচ্ছে খাতায়। আর সেটা যদি ওসি সাহেব। দেখেন…সর্তক হয়ে কথা বললেন এবার তিনি, দাঁড়াও মনে করি। সে রাতে যে রাস্তায় পাহারা দিয়েছি, সেটাতে বিদেশীদের বাড়ি-ঘর বেশি। বেশির ভাগই এমব্যাসিতে চাকরি করে। একজন আমেরিকান মহিলাকে দেখলাম দামী একটা গাড়ি নিয়ে এসে এক বাড়ির সামনে রাখলো। বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আরেক মহিলা। গাড়িতে উঠলো। চলে গেল ওরা। এরপর…এরপর, হ্যাঁ এরপর এলো আরেক বিদেশী মহিলা। হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো বোধহয়। সাথে একটা কুকুর। এমন পাজি জানোয়ার, আমার হলে পিটিয়ে পাছার চামড়া তুলে ফেলতাম। যেটা দেখে সেটাই শোকে, এখানে লাফ দিয়ে ওঠে, ওখানে লাফ দিয়ে ওঠে… চলে গেল ওরা। তারপর এলো একটা রামছাগল..
রামছাগল?
আরে মানুষই। ছাগলের মতো স্বভাব আরকি। ওই যে দেখেছো না রাস্তায়, কতগুলো ছেলেছোকরা আছে, চুলের ঠিক নেই, কাপড়ের ঠিক নেই, কি যে পরে আর কি যে করে:-ছাগল না ওগুলো? তেমনি একটা আরকি। তোমার তো আরো ভালো জানার কথা। একটা বিদেশী সাইকেলে চড়ে এলো। মাথায় কাপ, চোখে কালো চশমা। আরো দেখো কাণ্ড! পিঠে বস্তার মতো একটা ব্যাগ, সেটার ভেতরে বোধহয় ওয়াকম্যান-টোয়াকম্যান ছিলো, কানে হেডফোন। অনেক দেশেই গাড়ি কিংবা কিছু চালানোর সময় ওসব ব্যবহার করা নিষেধ, অ্যাকসিডেন্ট করে বলে, আমাদের দেশেও মানা করে দেয়া উচিত…এই যে দেখো না, লাজারি কোচগুলো, সারারাত ধরে চলে। দিনেও চলে। কানের পোকা বের করে দিয়ে। সারাক্ষণ ওগুলোর মধ্যে হিন্দি ছবির গান বাজে। ভিসিআর চলে। মাঝে মাঝে ড্রাইভারও গুনগুন করে গলা মেলায়, মাথা দোলায়, অসতর্ক হয়ে যায়। আর অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে..।
তা ঠিক, এক মত হলো মুসা। সব যাত্রী তো ওসব পছন্দও করে না। নিশ্চয়। অসুবিধা হয়। তো, আর কাকে দেখেছেন?
দেখেছি তো অনেককেই। তবে মনে রাখার মতো কাউকে নয়।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, নোটবুক বন্ধ করতে করতে বললো কিশোর।
তোমাকেও ধন্যবাদ। অযথা কষ্ট করছে, বুঝলে। সব দুষ্টু ছেলেদের কাজ।
দেখা যাক, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কি বেরোয়? হেসে বললো গোয়েন্দাপ্রধান।
এরপর কথা হলো সেই সার্জেন্ট আবদুল আজিজের সঙ্গে, সে রাতে যার। সাথে দেখা হয়েছিলো তিন গোয়েন্দার। হেসে স্বাগত জানালেন ছেলেদেরকে। আমার ওপরই তাহলে গোয়েন্দাগিরি চালাতে এসেছো। ভালো। তো কি জানতে চাও?
গত হপ্তায় তো সাত নম্বর রোডের কাছে ডিউটি ছিলো আপনার। কাউকে কাঁচ ভাঙতে দেখেননি। একটা কথা বলুন তো, ওই রোডে এমন কাউকে চোখে। পড়েছে, যার আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে?
তাহলে তো ধরতামই। অন্তত জিজ্ঞেস তো করতাম, ওখানে কি করছে? না, সে রকম কাউকে চোখে পড়েনি।
লোকজন, গাড়ি, নিশ্চয় অনেক গেছে। এমন কাউকে চোখে পড়েছে, যার। কথা মনে আছে এখনও আপনার?
উ! গাল চুলকালেন সার্জেন্ট, মনে করার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু আছে। লাল একটা টয়োটা করোলাতে করে গেছেন দুজন বিদেশী ভদ্রলোক। একটা ধূসর ফোক্স ওয়াগেন চালিয়ে গেছে দাড়িওয়ালা এক লোক। সম্বত ড্রাইভার। খবরের। কাগজের এক হকার ঢুকেছিলো এক বাড়িতে, বোধহয় বিলটিল নিতে। দুজন বয়স্কা মহিলা হেঁটে গেছেন, সাথে একটা ছেলে। ছেলেটার হাতে গুলতি ছিলো। একজন মহিলা গেছেন, সাথে একটা কুকুর নিয়ে…
মহিলার হাতে একটা লাঠি ছিলো, না?
মাথা নাড়লেন আবদুল আজিজ, না, কিছুই ছিলো না। শেকল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন কুকুরটাকে।
বিদেশী?
হা, বিদেশী।
কুকুরটার রঙ সাদা, তার মধ্যে কালো ছোপ, তাই না?
না। সারা শরীর ধূসর।
নিরাশ মনে হলো কিশোরকে। না, তাহলে যার কথা বলছি সে না। আচ্ছা, আর কাকে দেখেছেন?
বয় স্কাউটের পোশাক পরা দুটো ছেলে। লম্বা চুলওয়ালা হিপ্পি মার্কা এক তরুণ। টেন-স্পীড সাইকেলে করে গেছে আরেক তরুণ, মাথায় ক্যাপ, চোখে চশমা। পিঠে ব্যাকপ্যাক, তাতে ওয়াকম্যান ছিলো, কানে লাগানো হেডফোন দেখেই বুঝেছি। মোটর সাইকেলে চড়ে গেছে তিনজন, তাদের কোন কিছুই চোখে। পড়ার মতো নয়। চারজন বয়স্ক লোক গেছেন জগিং করতে করতে, সবার গায়েই গেজ্ঞী, তিনজনের পরনে ফুল প্যান্ট, একজনের হাফফকির-টকির আর সাধারণ কিছু লোক পায়ে হেঁটে গেছে, তাদের কথা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি…
একজন হাবিলদারের সাক্ষাৎকার নিতে গেল তারপর ওরা।
কিছুই ঘটেনি, জবাব দিলেন হাবিলদার। চোখে পড়ার মতো কিছু না। যা জিজ্ঞেস করার তাড়াতাড়ি করো। আমার ডিউটি আছে।
জানি, কাঁচ ভাঙতে কাউকে দেখেননি। সন্দেহজনক কাউকে দেখেছেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
না। ঘড়ি দেখলেন হাবিলদার।
আচ্ছা, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। কাকে কাকে দেখেছেন সে রাতে? মানে, চোখে পড়ার মতো?
অনেককেই।
খুলে বলবেন?
আরেকবার ঘড়ি দেখলেন হাবিলদার। পুরানো একটা টয়োটা পিকআপ ট্রাক। ঢুকতে দেখেছি। পেছনে কতগুলো ছেলে হই-হট্টগোল করে গান গাইছিলো। পিকনিক-টিকনিকে গিয়েছিলো বোধহয়। গলির প্রায় শেষ মাথায় গিয়ে একটা বাড়ির সামনে থামলো গাড়িটা। কয়েকটা ছেলে নেমে যাওয়ার পর বেরিয়ে গেল। আরও অনেককেই দেখেছি। টেবিল থেকে ক্যাপ তুলে নিলেন তিনি।
আরও দু-চারজনের কথা বলুন, প্লীজ!
মোটর সাইকেল নিয়ে তিনটে ছেলেকে যেতে দেখেছি। পাশাপাশি চলেছিলো। নিশ্চয় বন্ধু। গাড়ি গেছে কয়েকটা। তবে মনে রাখার মতো একজনই গেছে।
সে কে? আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এলো কিশোর।
দেখে তো মনে হলো পাগলা গারদ থেকে বেরিয়েছে। একটা সাইকেলে করে। এলো। মাথায় টুপি, চোখে কালো চশমা, পিঠে ব্যাগ, কানে হেডফোন…শাই শাই করে চলে গেল। একবার ভেবেছি, থামাবো। তারপর ভাবলাম মরুকগে। আমার। কি? তৃতীয়বার ঘড়ি দেখলেন হাবিলদার। চলি, আর থাকতে পারছি না। আর কিছু জানার থাকলে অন্য সময় এসো, যখন আমার বাইরে ডিউটি থাকবে না।
ফাইলে মুখ গুঁজে ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর হাফিজ আলি। ছেলেরা অফিসে। ঢুকতে সাড়া পেয়ে মুখ তুললেন। হেসে বললেন, আরে, তিন গোয়েন্দা যে। এসো এসো।
টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো কিশোর। স্যার, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিলো…
বসো, চেয়ার দেখিয়ে দিলেন সাব-ইন্সপেক্টর। জানি। ওসি সাহেব। বলেছেন। খুব বেশি সময় দিতে পারবো না কিন্তু…
বেশি সময় লাগবে না।
বলো, কি জানতে চাও?
.
০৭.
নিশ্চয় সাইকেলওয়ালা! টেবিলে চাপড় মারলো মুসা।
ঠিক! তার সঙ্গে সুর মেলালো কচি। টুপি, গগলস, ব্যাকপ্যাক, হেডফোন!
চারজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছি আমরা, একমত হলো রবিনও। চারজনেই ওকে দেখেছে। আমরা দুবার পাহারা দিয়েছি। দুবারই দেখেছি।
আলোচনা হচ্ছে বসার ঘরে। পুলিশদের কাছ থেকে নতুন কিছুই জানতে পারেনি ওরা।
তবে, কিশোর বললো, কেউই তাকে কিছু করতে দেখেনি। আমরাও না।
না, তা দেখেনি, সায় দিলে অন্য তিন জনেই।
একটা ব্যাপার কিন্তু সন্দেহজনক, আবার বললো কিশোর। তাকে বিভিন্ন রাস্তায় দেখা গেছে। রাতের বেলা। মোটামুটি একটা বিশেষ সময়ে। ওটা লোকের বাড়ি ফেরার সময়, বেরোনোর নয়। হতে পারে তার বাড়ি ওই এলাকায়। একেক দিন একেক রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরে। কতো লোকেরই তো কতো স্বভাব থাকে।
তারমানে বলতে চাইছে, নিরাশ মনে হলো মুসাকে, ব্যাপারটা কাকতালীয়?
একবার দুবার কাকতালীয় হতে পারে। কিন্তু এবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তাকে জানালা ভাঙতে দেখা যায়নি, তারমানে এই নয় যে সে ভাঙেনি। সন্দেহ থেকে বাদ দেয়া যায় না।
তোমার ধারণা, রবিন বললো, পুলিশ দেখেই সতর্ক হয়ে যায় সে? ওই রাস্তায় আর না ভেঙে অন্য যেখানে পাহারা নেই সেখানে গিয়ে ভাঙে?
অসম্ভব কি?
আমরা পাহারা দেয়ার সময়ও ভাঙেনি, মুসা বললো। তাহলে কি আমাদেরও দেখেছে?
দেখে থাকতে পারে। ভাঙতে এলে তা সাবধান হয়েই আসে। দেখেশুনে নেয় সব। আমরা যে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়েছি, সেটা তেমন ঘন নয়। ভালো মতো তাকালে যে কারোই চোখে পড়তে পারে। এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। কিশোর। তারপর বললো, এখন আমাদের বড় সন্দেহ ওই সাইকেলওয়ালা। তাকে অপরাধী প্রমাণ করতে পারলেই হয়।
কি করে করবো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
ভাবছো কিছু? রবিনের প্রশ্ন।
কিশোর জবাব দেয়ার আগেই কচি বললো, কিন্তু ও-ই যদি ভেঙে থাকে, তাহলে আমি দেখলাম না কেন? মানে, আমি তো চোখ রেখেছিলাম। কাঁচ ভাঙতে হলে কোনো কিছু দিয়ে বাড়ি মারতে হবে। গাড়ির কাছে থামতে হবে। কোনোটাই করেনি সে। এমন কি যে রাতে কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনেছি, সে রাতেও তাকে দেখিনি।
কিশোরের দিকে তাকালো রবিন। সাইকেল না থামিয়ে কি করে কাঁচ ভাঙা যায় কিশোর?
কিংবা নাহয় থামলোই, মুসা বললো। কিন্তু কারো চোখে না পড়ে কি ভাবে ভাঙে? কি দিয়ে? অদৃশ্য মানব হয়ে যায় নাকি?
অবাস্তব কোনো কিছু ঘটে না নিশ্চয়ই, কিশোর বললো। সেটা সম্ভবও নয়। কচির দিকে তাকালো সে। সে রাতে কাঁচ ভাঙতে শুনেছো তুমি, গাড়ির কাছে কাউকে দেখোনি। হতে পারে তুমি বেরোতে বেরোতে তোমার চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিলো সে। এমন কিছু কি চোখে পড়েছে তোমার যা মনে করতে পারছে না?
চোখ আধবোজা করে ভাবার চেষ্টা করলো কচি। পিকআপের কাছে কাউকে দেখিনি..রাস্তায়ও না… হঠাৎ সোজা হয়ে বসলো সে। দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা নড়াচড়া বোধহয় দেখেছি! গাড়ির সামনে! দূরে! রাস্তায়!
কি ধরনের নড়াচড়া?
বলতে পারবে না। মনে করতে পারছি না। মনে হলো যেন পলকের জন্যে। দেখেছি।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। হয় এরকম। অনেক কিছুই দেখি আমরা যা মনে রাখার চেষ্টা করি না। ফলে ভুলে যাই। নড়াচড়াটা হয়তো কোনো সাইকেলেরই দেখেছো। কিন্তু যেহেতু কাঁচ ভাঙার সাথে সাইকেলের কোনো সম্পর্ক নেই, অন্তত তখন আমার মনে হয়নি, ওটার কথা মনে রাখার চেষ্টা করোনি তুমি। অথচ দেখেছো ঠিকই। একে বলে সাইকোলজিক্যাল ইনভিজিবিলিটি।
এতো দ্রুত যদি চলেই গিয়ে থাকে, রবিন প্রশ্ন তুললো, তার মানে কাঁচি ভাঙার জন্যে থামেনি সে। চলন্ত সাইকেল থেকে কি করে ভাঙলো?
ঠিক বলতে পারবো না। তবে একটা আইডিয়া আসছে মাথায়। দেখি, পুলিশের সঙ্গে আবার কথা বলতে হবে। কচি, তোমাদের পিকআপটাও পরীক্ষা। করতে চাই।
করবে। যখন খুশি।
কিন্তু কিশোর, রবিন বললো, সাইকেলওয়ালা যে কাঁচ ভাঙে, এটা প্রমাণ করবে কি করে? অবশ্য যদি ও-ই ভেঙে থাকে।
হাতেনাতে ধরবো। আবার ভূত-থেকে-ভূতে ব্যবহার করে।
মানে, শহরের সমস্ত ছেলেমেয়েকে হুঁশিয়ার করে দেবে চোখ রাখার জন্যে? মুসা বললো।
হ্যাঁ, তাই করবো। কিছু তথ্য এখন আমাদের হাতে আছে। ওদেরকে পরিষ্কার করে বলতে পারবো, কার ওপর চোখ রাখতে হবে। এতোগুলো চোখের কড়া নজর এড়িয়ে নিরাপদে কিছুতেই কাজ সারতে পারবে না সে।
যদি সে আগেই জেনে না যায় যে চোখ রাখা হচ্ছে, মুসা বললো। যে ভাবে জেনে যায় পুলিশ নজর রাখছে। এক্সরে ভিশন না তো তার? কিংবা ইনফ্রা রেড চোখ, যে অন্ধকারেও দেখবে! কে জানে হয়তো অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে। শুনেছি এদেশে নাকি ওরকম ক্ষমতাশালী লোকের অভাব নেই, অনেক পীর– ফকির আছে
ওসব কিছু না। অন্য কোনো ভাবে জানে। বাস্তব, সহজ কোনো উপায়ে। রাতেও চোখে কালো চশমা পরে, উদ্ভট চেহারার জিনিস। আমার এখন সন্দেহ। হচ্ছে, ওটা ফীল্ড গ্লাস। ওকে হাতেনাতে ধরতে পারলেই জেনে যাবো সেটা। কিন্তু মুশকিল হলো সেটা জানার জন্যে আগামী সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদেরকে। তার আগে আঘাত হানবে না সে।
ভালোই হয়েছে, মুসা বলল। ঘোরার সময় পেলাম। করিমদের বাড়িতে দাওয়াত খাবো, রাত কাটাবো। ও বললো এদেশে গাঁয়ের বাড়িতে রাতে থাকার মজাই নাকি আলাদা, বিশেষ করে শীতকালে। দেখে আসবো সেটা।
আমার পক্ষে যাওয়া বোধহয় সম্ভব হবে না, কচি বললো। অনেক কাজ। আমি ফার্মে না থাকলে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। বাবা একা কদিক সামলাবে?
হ্যাঁ, তা ঠিক, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তোমাকে আটকাবো না। তবে আমাদের সঙ্গে যেতে পারলে ভালো হতো। থাক, অসুবিধে হবে না। করিম পথঘাট চেনে। তো, এখন কি তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে? পিকআপটা দেখতাম।
চলো।
উঠতে যাবে ওরা, এই সময় বাজলো টেলিফোন। মামা-মামীর কারো হবে মনে করে রিসিভার তুললো কিশোর, হ্যালো।
ইয়ে, পরিচিত একটা কণ্ঠ, অস্বস্তি বোধ করছে বোঝা যায়, আরিফ সাহেরে বাসা?
হ্যাঁ।
কিশোর পাশা আছে?
অবাক হলো কিশোর। বলছি।
ও, কিশোর। আমি সানি। আকবর সাহেবের ভাতিজা। কাল রাতে আমাদের বাসার সামনে দেখা হয়েছিলো।
হ্যাঁ, মনে আছে। কি ব্যাপার?
ডলির মুখে তোমাদের সুখ্যাতি শুনে শুনে চাচার ধারণা হয়েছে, চেষ্টা করলে তোমরা হয়তো তার ঈগলটা খুঁজে বের করে দিতে পারবে। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন আমাদের। তা ফিস কতো তোমাদের?
ফিস-টিস নিই না আমরা। মানুষকে সাহায্য করতে পারলে, রহস্য আর সমস্যার সমাধান করে দিতে পারলেই খুশি।
তাই নাকি? ভালো কথা। চাচাকে বলবো। এখন কি একবার আসতে পারবে? ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যেতো। টেলিফোনে তো সব কথা বলা। যায় না…
এখুনি? এক মুহূর্ত ভাবলো কিশোর। বেশ আসছি।
বাসা চিনবে তো?
নিশ্চয়। রাখলাম।
.
০৮.
বাড়িটা বিশাল। সেদিন রাতের বেলা ঢুকেছিলো গোয়েন্দারা, ভালোমতো দেখতে পারেনি, এখন দেখলো। ভেতরে প্রচুর গাছপালা। গাড়ি বারান্দায় নতুন মডেলের একটা হোণ্ডা সিভিক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ওরা। গ্যারেজে আরেকটা গাড়ি আছে। অনেক পুরানো। গায়ে ধুলো জমে আছে পুরু হয়ে। কোন আদ্যিকাল থেকে। ওটা ওখানে পড়ে আছে কে জানে। হুড আর উইশীল্ড ক্যানভাসে ঢাকা।
গাছপালার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে খোয়া বিছানো পথ। গাছের কারণে। সামনের দরজাটা প্রায় চোখেই পড়ে না।
কাছে এসে কলিং বেলের সুইচ টিপলো কিশোর। দরজা খুললো না।
এখুনি আসতে বলেছিলো? দরজা খুলছে না দেখে সন্দেহ হলো মূসার। ঠিক শুনেছো?
হা, জবাব দিলো কিশোর।
হঠাৎ বাড়ির অনেক ভেতর থেকে শোনা গেল রেগে যাওয়া কণ্ঠস্বর। দ্রুত। আরও কয়েকবার সুইচ টিপলো কিশোর। দরজা এবারও খুললো না, তবে কথা থেমে গেল।
বেলটাই বোধহয় কাজ করে না, রবিন বললো।
পাশে ঢোকার অন্য দরজা থাকতে পারে, মুসার অনুমান।
আবার রাস্তায় ফিরে এসে আশেপাশে উঁকি দিতে লাগলো ওরা। গ্যারেজটা যে পাশে সে পাশে আর কোনো দরজা দেখা গেল না।
ওটা কি? অদ্ভুত একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। পাশের খোলা চত্বরে চিত হয়ে আছে চার ফুট চওড়া একটা ধাতব জিনিস। দেখতে পিরিচের মতো। নিচে তিনটে পা। আকাশের দিকে পেট।
স্যাটেলাইট ডিশ, কিশোর বললো।
মহাকাশের স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো সঙ্কেত ধরে, জানালো রবিন। টেলিভিশন আর রেডিওর সঙ্কেত গিয়ে স্যাটেলাইটে ধাক্কা খেয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। আর আসে বলেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনেক দূর থেকে পাঠানো টেলিভিশনের ছবি দেখি, রেডিও শুনতে পাই আমার। এখানকার আইন জানিনে, তবে আমেরিকায় এই ডিশের মাধ্যমে সঙ্কেত ধরে টিভি দেখলে কিংবা রেডিও শুনলে কেবল কোম্পানিকে পয়সা দিতে হয় না। খরচ বাঁচে।
কিশোর বললো, এখানে ওরকম কোন কোম্পানি নেই। রেডিও, টিভি দুটোই সরকারী। লাইসেন্সের খরচ দিতেই হবে।
তাহলে এটা রেখেছে কেন? মুসার প্রশ্ন।
হয়তো এমনি। কিংবা ওটাকে অ্যান্টেনা হিসেবে কাজে লাগায়। কোনো সময় আমেরিকায় ছিলেন হয়তো ভদ্রলোক, তখন কিনেছিলেন, আসার সময় নিয়ে এসেছেন সাথে করে।
মনে হয়, একমত হলো রবিন।
আবার কথা শোনা গেল। মুসা বলে উঠলো, খান সাহেবের গলা না?
ঘরের ভেতর থেকেই এসেছে বোধহয় কথা, মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না।
এই যে, এসে গেছে, এসো! বাড়ির সামনের দিক থেকে শোনা গেল আরেকটা কণ্ঠ। তাড়াতাড়ি আবার সামনের দরজার কাছে চলে এলো ছেলেরা। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সানি। কেমন যেন দ্বিধান্বিত। এসো, আবার বললো সে।
কয়েকবার বেল বাজালাম, বাড়ির পাশে চলে যাওয়ার কৈফিয়ত দিলো। কিশোর, কেউ খুললো না। ওদিকে আর কোনো দরজা-টরজা আছে কিনা দেখতে গিয়েছিলাম।
সরি, সানি বললো। পেছন দিকে ছিলাম আমরা। চাচার সঙ্গে কথা। বলছিলাম। বেল শুনিনি।
ওদের নিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। বাড়িটা পুরানো, কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। গুলশান-বনানীর আর দশটা আধুনিক বাড়ি থেকে আলাদা, অনেকটা পুরানো ঢাকার বাড়ির মতো। এ
চাচার শরীরটা ভালো নেই আজ, সানি বললো। শুয়ে আছেন। আমাকেই তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। ওই ঈগলটা খুঁজে দেয়ার ব্যাপারে আর
আসলে, রবিন বললো, এই কেসে ইতিমধ্যেই জড়িয়ে গেছি আমরা। কে কাঁচ ভাঙে রার জন্যে কচিকে সাহায্য করছি।
তাই তো। ভুলেই গিয়েছিলাম।
নতুন একটা আঙ্গিক যখন পাওয়া গেল, কিশোর বললো, এদিক থেকেও তদন্ত চালাতে পারি আমরা। হয়তো ঈগল খুঁজতে গিয়েই কাঁচ যে ভাঙে তাকে ধরে। ফেলতে পারবো। চুরি যখন করেছে; নিয়ে গিয়ে নিশ্চয় বিক্রিরও চেষ্টা করবে।
কি করে? মুসা বললো। এতে দামী জিনিস বেচবে কার কাছে? সাধারণ লোকে কিনবে না। টাকা এবং শখ দুটোই যার আছে সে ছাড়া। আর এখন কেনার ঝুঁকিও নিতে চাইবে না কেউ সহজে। চুরির খবর জেনে ফেলেছে অনেকে। এতে টাকা দিয়ে কিনে পুলিশের ঝামেলায় কেউ পড়তে চাইবে না।
এসব জিনিস যারা সংগ্রহ করে তাদেরকে চেনো না তুমি, মুসা, কিশোর বললো। কিছু লোক আছে, যারা রীতিমতো পাগল হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান। থাকে না। যে-কোনো ঝুঁকি নিয়ে বসে। জোগাড় করে লুকিয়ে রেখে দেয়। শুধু নিজে দেখে, কাউকে দেখতেও দেয় না।
মাথা ঝাঁকালো সানি। ও ঠিকই বলেছে। আর এদের টাকাও থাকে প্রচুর। নইলে একটা মুদ্রার জন্যে এতো টাকা কি করে খরচ করবে বলো।
তবে, মুসার কথার খেই ধরলো কিশোর, এটা আমেরিকা নয়। এখানে ওরকম সংগ্রহকারী দু-চারজনও আছে কিনা সন্দেহ। মুদ্রাটা বিক্রি করতে পারবে বলে মনে হয় না।
খুব কঠিন হবে।
আচ্ছা, মুদ্রা, স্ট্যাম্প ঢাকায় যারা সাপ্লাই দেয়, তাদের নিশ্চয় চেনেন আপনারা। নাম-ঠিকানা বলুন, ওদের ওপর চোখ রাখবো আমরা।
আমি? অস্বস্তি ফুটলো সানির চোখে। চুলে হাত চালাতে চালাতে মাথা নাড়লো। নাহ্, আমি চিনি না। ওসব চাচার ব্যাপার। খুব কমই নাক গলাই আমি।
তাহলে তাকেই জিজ্ঞেস করা দরকার।
চোখ মিটমিট করলো সানি। চাচাকে?…ঠিক আছে, করতে পারবে। আগে তোমাদেরকে কাজে নিয়োগ করুক… হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো সে। আরিব্বাবা…
তার দিকে একটা মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইলো কিশোর। তারপর ঘরে চোখ বোলালো। আপনার চাচার নিশ্চয় আরও মুদ্রা আছে। দেখা যাবে? এখানে তো। একটাও দেখছি না।
এখানে রাখে না। পড়ার ঘরে। আবার ঘড়ি দেখলো সে।
দেখা যাবে?
দেখবে? ঠিক আছে, এসো।
লিভিং রুম, তারপর আরেকটা বড় হলঘর পার করিয়ে ওদেরকে পেছনের একটা দরজার কাছে নিয়ে এলো সানি। চাবির গোছা থেকে একটা বেছে নিয়ে তালা। খুললো। ঘরটা ছোট। লাল রঙের পুরু কার্পেট বিছানো। মেহগনি কাঠের ভারি ভারি আসবাব। শেলফগুলো বইয়ে ঠাসা। একধারে সুন্দর করে সাজানো পায়। লাগানো অনেকগুলো সুদৃশ্য কাঁচের বাক্স। ভেতরে গাঢ় নীল মখমলের বিছানায় যেন ঘুমিয়ে রয়েছে নানারকম মুদ্র।
একটা বাক্স দেখিয়ে সানি বললো, ওটাতে আমেরিকান মুদ্রা। ডাবল ঈগল আরেকটা আছে ওতে, দেখো। যেটা চুরি গেছে সেটারই মতো। তবে এটার দাম। চুরি যাওয়াটার তুলনায় কিছুই না।
গা ঘেঁষাঘেষি করে মাথা নিচু করে এসে বাক্স ঘিরে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা। নীল মখমলে শুয়ে আছে সোনার মুদ্রাটা। চকচক করছে। একটা রূপার টাকার প্রায় সমান মুদ্রাটার এক পিঠে একটা উড়ন্ত ঈগল ছাপ মারা। ভোরের আকাশে ডানা মেলে দিয়েছে। সূর্য উঠছে সবে, ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যরশ্মি।
কতো পুরানো এটা? জিজ্ঞেস করলো রবিন। উনিশশো নয় সালের, সানি জানালো। তারিখটা অন্য পিঠে। একই রকম সুন্দর, অথচ দাম মাত্র আট হাজার আমেরিকান ডলার।
শিস দিয়ে উঠলো মুসা। মাত্র! আট হাজার ডলার মাত্র হলো!
মাত্র বলেছি যেটা চুরি গেছে তার তুলনায়। দেখতে যেমনই হোক, সেটা আসল কথা নয়, দাম কম-বেশি অন্য কারণে। যেটা যতো বেশি দুর্লভ সেটার দাম ততো বেশি।
চুরি যাওয়ার সময় কিসের মধ্যে ছিলো জিনিসটা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
কালো চামড়ার একটা গহনার বাক্সে। ওই যে সৌখিন বাক্স আছে না কিছু, মহিলারা আঙটি-টাঙটি রাখে, ওরকম। সিগারেটের প্যাকেটের সমান। ডালার একপাশে দুটো কজা লাগানো, আরেক পাশে হুড়কো। বোতাম টিপলেই লাফ দিয়ে উঠে যায় ডালা। ভেতরে এরকমই নীল কাপড়। চাকচিক্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে প্ল্যাস্টিকে মুড়ে রাখা হয়েছিলো।
সোনার চমৎকার মুদ্রাটার দিকে তাকিয়ে সানির কথা শুনছে তিন গোয়েন্দা। তারপর মুখ তুলে সারা ঘরে চোখ বোলালো কিশোর। নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলো, এ ঘরে তো কোনো টিভি দেখছি না?
টেলিভিশন দুচোখে দেখতে পারে না চাচা, হেসে বললো সানি।
আঙিনায় তাহলে স্যাটেলাইট ডিশ বসানো হয়েছে কেন?
ডিশ? আবার চোখ মিটমিট করলো সে। টিভি একটা আছে। গেম রুমে। আমি আর ডলি দেখি। চাচা এখন শুয়ে আছে ওঘরে, নইলে ডিশটা দিয়ে কি কাজ হয় দেখাতাম।
ও, বলে কি বোঝালো কিশোর বোঝা গেল না। ঠিক আছে, পরে এসে এক সময় নাহয় দেখবো। তা আপনার চাচাকে জিজ্ঞেস করবেন কি, আমাদেরকে…
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হাতে বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আকবর আলি। কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, এখানে কি? লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এলেন তিনি। এরপর কোনটা চুরি করবে সেটা দেখতে এসেছো?
আপনার ভাতিজাই এঘরে নিয়ে এসেছে আমাদের, শান্ত কণ্ঠে বললো কিশোর। চুরি করে ঢুকিনি। ঈগলটা খুঁজতে গেলে আমাদের জানতে হবে দেখতে ওটা কি রকম। এখন…
আমার ঈগল খুঁজবে! ভুরু কুঁচকে গেল খান সাহেবের। ওটার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবো ভেবেছো? বেরোও!
কিন্তু, স্যার, আপনার ভাতিজা… সানিকে দেখালো কিশোর, আমাদেরকে ফোন করে ডেকে এনেছে তদন্ত করার জন্যে! আপনিই নাকি আসতে বলেছেন।
সানি! লাল হয়ে গেছে আকবর আলির মুখ। ও ডেকে এনেছে! আমি আসতে বলেছি! সানি, তুই যে এতো মিথ্যে কথা বলিস জানতাম না তো! ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন খান সাহেব। আমি কিছু বলিনি! বেত তুলে আরেক পা এগোলেন তিনি। ভাতিজাকে বাড়িই মারবেন যেন।
তবে বেতটা যথাস্থানে আঘাত হানার আগেই ঢুকলো ডলি। একটানে বাবার হাত থেকে কেড়ে নিলো ওটা। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আব্বা!
মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধ। বললেন, তোরা ভাইবোনে মিলে যে কি করছিস বুঝতে পারছি না। থাকগে, বোঝার দরকারও নেই আমার। এই ছেলেগুলোকে বের করে দে এখান থেকে।
বেতটা মেয়ের হাত থেকে আবার ফেরত নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে গেলেন আকবর আলি। বিরক্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ভাইবোন।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিন গোয়েন্দাকে বললো সানি, সরি, কিছু মনে করো না। চাচার মন-মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেছে ইদানীং। খিটখিটে হয়ে গেছেন। কথায় কথায় রেগে যান।
হ্যাঁ, ভাইয়ের সঙ্গে সুর মেলালো ডলি, আব্বার কথায় কিছু মনে করো না। তোমাদের ডাকতে বলে নিজেই এখন ভুলে বসে আছে। এরপর আবার ডাকতে বললে লিখে দিতে বলবো।
মাথা ঝাঁকালো সানি। হ্যাঁ, তাই করবো। লিখে না দিলে আর ডাকছি না। তোমাদেরকে। গজগজ করে বললো, অযথা মানুষকে ডেকে এনে অপমান…
বাইরে বেরিয়ে খোয়া বিছানো পথ ধরে গেটের দিকে এগোলো তিন গোয়েন্দা।
আশ্চর্য! আনমনে বললো কিশোর। ডাকতে বলেছেন, সেটাও ভুলে। গেলেন? এতো তাড়াতাড়ি?
আমার কাছেও অবাক লাগছে ব্যাপারটা, রবিন মাথা দোলালো।
পাগল আরকি, সাফ মন্তব্য করে দিলো মুসা। এতো টাকা দিয়ে নইলে একটা সোনার টাকা কেনে?
গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে এখন আরেকটা গাড়ি, লাল ছোট একটা সুজুকি। চিন্তিত ভঙ্গিতে ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে কিশোর বললো, যাকগে, ওসব নিয়ে পরে ভাববো। এখন তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। সন্ধ্যার আগেই কচিদের বাড়ি গিয়ে ওদের পিকআপটা দেখতে চাই।
.
চারজনে মিলে পিকআপটা পরীক্ষা করলো ওরা। সীটের ওপরে, তলায়, সীটের সামনের মেঝেতে, পিকআপের ঘোট কেবিনের ভেতর যতো জায়গা আছে, সবখানে।
কাগজ আটকানোর ক্লিপ দিয়ে নিশ্চয় কাঁচ ভাঙা যায় না।
সীটের নিচ থেকে একটা ক্লিপ বের করে দেখালো মুসা।
না, শুকনো গলায় বললো কিশোর।
কিংবা কয়েকটা খালি দুধের টিন দিয়ে? পিকআপের পেছন থেকে টিনগুলো রে করলে রবিন।
আমি রেখেছি ওগুলো, হেসে বললো কচি। মাঝে মাঝে কাজে লাগে।
এটা কি? জুতোর তলায় চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া মটর দানার চেয়ে ছোট একটুকরো ধাতব জিনিস বের করে দেখালো মুসা।
হাতে নিয়ে দেখলো রবিন। চিনতে পারলো না।
কচিও পারলো না।
যাই হোক, মুসা বললো। বেশি ছোট। এটা দিয়ে ঢিল মেরে কাঁচের কিচ্ছ। করা যাবে না। তবে জিনিসটা চেনা চেনা লাগছে।
লাগবেই, বললো রবিন। সীসা। কোনো জিনিস ঝালাই-টালাই করতে গিয়ে পড়ে থাকতে পারে।
হাতের তালুতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো কিশোর। চিনলো না। ফিরিয়ে দিলো আবার মুসাকে। নিজের অজান্তেই জিনিসটা পকেটে ভরলো মুসা। আবার খোঁজাখুজি চললো। কাঁচ ভাঙা যেতে পারে, ওরকম কিছুই পাওয়া গেল না।
কচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে চললো তিন গোয়েন্দা।
বাগানে ছিলেন মামী। ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলেন বাগানের কিনারে। এসেছিস। যা, হাতমুখ ধুয়ে নে গে। চা দিচ্ছি।…ও, হ্যাঁ, কিশোর, সানি নামে একজন ফোন করেছিলো। আসতে না আসতেই কতোজনের সঙ্গে পরিচয় করে ফেললি। ফোনও করে।
হাসলো কিশোর। কিছু বললো?
বললো তার চাচা নাকি মত পরিবর্তন করেছেন। যা ঘটে গেছে তার জন্যে অনুতপ্ত।
আবার যাবো! মুসা বললো। কিশোর, এবার পয়সা দিতে রাজি না হলে আর যাচ্ছি না আমি। যেমন লোক, তেমনি তার ব্যবস্থা। বিনে পয়সায় কাজটা করে। দিতে চেয়েছিলাম, ভাল্লাগেনি।
হ্যাঁ, ঠিক, তুড়ি বাজালো রবিন। অন্তত মোটা একটা পুরস্কার ঘোষণা না। করা পর্যন্ত ওঁর মোহর আর খুঁজতে যাচ্ছি না।
কিন্তু ওদের কথায় তেমন কান নেই কিশোরের। জিজ্ঞেস করলো, মামী, আজ বাইরে কাউকে অদ্ভুত আচরণ করতে দেখেছো?
অদ্ভুত আচরণ? অবাক হলেন মামী। না তো!
বেশ, অদ্ভুত আচরণ না হয় না-ই করলো, থামের মাথায় উঠেছিল কেউ? যে ধাতব থামটা থেকে টেলিফোনের তার এসে ঢুকেছে এই বাড়িতে সেটার দিকে হাত তুললো কিশোর।
না, মাথা নাড়লেন মামী। দাঁড়া দাঁড়া, দেখেছি। মেকানিক। ফোনের তার। চেক করতে আসে যে, ওদেরই একজন। লোকটা নতুন। চিনি না।
কখন সেটা? আগ্রহ দেখাল কিশোর।
এই তো, তোরা বেরোনোর একটু আগে। বাগানেই ছিলাম আমি তখন, দেখলি না? যা, হাত-মুখ ধো গিয়ে।
কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলো না মুসা। ওরা ওখান থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপারটা কি, কিশোর?
লোকটা কি ছদ্মবেশী? রবিনের প্রশ্ন। আসল মেকানিক নয়? এ বাড়ির ওপর চোখ রাখছিলো?
রাখতেও পারে, দায়সারা জবাব দিলো কিশোর। এ নিয়ে পরে চিন্তা-ভাবনা করবো। সোমবারের আগে অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপাতত হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে চলো চা খাইগে।
.
০৯.
পরদিন করিমদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেল তিন গোয়েন্দা। দাওয়াত রাতে, অথচ নেয়ার জন্যে দুপুরবেলাই এসে বসে রইলো ছেলেটা।
করিমের মায়ের আদর-যত্নে অভিভূত হয়ে গেল ওরা। সম্পন্ন গৃহস্থ করিমের বাবা, বাড়ি-ঘরের অবস্থা দেখেই সেটা আন্দাজ করা গেল।
বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই শুরু হলো খাবার আসা। খানিক পর পরই এটা নিয়ে আসেন করিমের মা, ওটা নিয়ে আসেন। নানা রকম পিঠা, খেজুরের রসে। তৈরি পায়েস, চিড়া-মুড়ির মোয়া। থালায় করে নিয়ে আসেন, আর বলেন, খাও, বাবারা, খাও। আমরা গরীব মানুষ। ভালা জিনিস ত আর খাওয়াইতে পারুম না। এগুলানই খাও।
বৈঠকখানায় ভিড়। প্রায় সবাই করিমের সমবয়েসী গায়ের ছেলে। বিদেশী বন্ধুদের দাওয়াত করে আনছে একথাটা প্রায় ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো। সে। ওদের আঞ্চলিক সব কথা বুঝতে পারে না মুসা, তা-ও ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে।
শীতের রাত। আটটা বাজতে না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে গাঁয়ের লোক, নিঝুম। হয়ে যায় পাড়া। কচিত কারও ঘরে কুপির কাঁপা আলো চোখে পড়ে। তিন গোয়েন্দাকে দেখতে আসা ছেলেরা চলে গেল আটটা বাজার আগেই। সঙ্গে করে নিয়ে আসা কিছু কিছু জিনিস ওদেরকে উপহার দিয়েছে গোয়েন্দারা। খুব খুশি হয়েছে ছেলেগুলো। ঢাকায় তিন গোয়েন্দা–
রসুই ঘরে ভাত বেড়ে দিয়ে খেতে ডাকলেন করিমের মা।
হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো। মাটির মেঝেতে মাদুরের ওপর খেতে বসলো। তিন গোয়েন্দা। এ রকম ভাবে খায়নি আর কখনও। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওদের। আবছা অন্ধকার, খাবারও ঠিকমতো দেখা যায় না। ঘরের ভেতরে কেমন এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ। ওরা জানে না, শুকনো পাট, কাঁচা সরষে, আর অনেক পুরানো তেল চিটচিটে কাঁথা-বালিশের মিশ্র গন্ধ ওটা।
কড়া ঝাল দেয়া মুরগীর মাংস, লাল চালের ভাত, মসুরের ডাল, আর নানা রকম সজী। সেই সাথে প্রচুর কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ।
সাধারণ খাবার। কিন্তু খেতে খেতে মুসার মনে হলো খাবারের এই স্বাদ আগে কমই পেয়েছে। পরিবেশের জন্যেই বোধ হয় ভালো লাগছে এতোটা। মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসা আর আন্তরিকতাও যোগ হয়েছে এর সঙ্গে। রুটি খেতে অভ্যস্ত যে রবিন, তারও খারাপ লাগছে না খেতে। শুধু ঝালটা একটু বেশি লাগছে। খানিক পর পরই পানি গিলতে হচ্ছে। নাক-চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে ঝালের চোটে।
খাওয়া সেরে বাইরে দাওয়ায় এসে বসলো ছেলেরা। রাতে থাকবে। কাজেই কম্বল-টম্বল নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছে।
পরিষ্কার আকাশ। তবু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। কুয়াশার জন্যে। অনেক গাছপালা এখানে। বাড়ির সামনে একটা পুকুর। তিন পাড়ে বাঁশঝাড়। ঘন কালো। দেখাচ্ছে এখন। পুকুরে শব্দ করে ঘাই মারছে কাতলা মাছ। বাঁশ বনে কর্কশ গলায় ডেকে উঠলো একটা পেঁচা। তার পর পরই শোনা গেল ঝাড়ের ওপাশের খেত। থেকে আসা শেয়ালের হুক্কা-হুয়া।
উঠানে নেমে নাড়ার আগুন জ্বাললো করিম। অগ্নিকুণ্ডের পাশে পিড়ি পেতে দিয়ে তিন গোয়েন্দাকে ডাকলো ওখানে গিয়ে বসতে।
গোল হয়ে বসলো সবাই।
বাঁশের ছোট টুকরিতে করে খেত থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে অনেক মটরশুটি। আগুনে সেগুলো পোড়াতে দিয়ে করিম বলল, বিকালে তুইল্লা আইন্না রাখছে আমার ভাই। পোড়াইয়া খাইতে খুব মজা লাগে।
মাথার ওপরে খোলা আকাশ। নিচে অন্ধকার নীরবতার মাঝে আগুনের পাশে গল্প চললো ওদের। কথায় কথায় করিম জানালো, চাঁদ উঠলে নাকি মুন্সী বাড়ির দীঘির পাড়ে শেয়ালের আসর বসে। শেয়ালদের রাজা থাকে, মন্ত্রী থাকে, বিচার আচার চলে অনেক রাত পর্যন্ত। জলসা হয়।
বিশ্বাস করলো না মুসা। মুচকি হাসলো।
রেগে গেল করিম। জেদ ধরে বললো, বিশ্বাস করলা না? দ্যাখতে চাও?
মাথা ঝাঁকালো মুসা।
ঠিক আছে। চান উঠুক। তারপর যামু।
অনেক রাতে বাঁশ বনের মাথা ছাড়িয়ে উঠে এলো হলদে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো করিম। পুরানো চাদরটা ভালোমতো গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো, চল, সময় অইছে।
বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে গেছে পায়ে চলা পথ। সঙ্গে টর্চ এনেছে তিন গোয়েন্দা। করিমের সঙ্গে চলতে অসুবিধে হলো না। এ যেন এক রহস্যময় জগতে এসে পড়েছে ওরা। বাঁশ গাছের নিচে ঘন অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে। জ্যোৎস্না ঢুকতে পারে না।
এমন কি টর্চের আলোয়ও কাটতে চায় না সে অন্ধকার। সামান্য বাতাস। লাগলেই সড়সড় করে বাঁশের পাতা, গাছের ফাঁক দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে যায়। বাতাস, যেন অশরীরী কোনো প্রেতাত্মার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। ধক করে ওঠে বুকের ভেতরটা। ছমছম করতে থাকে গা।
বাঁশবন থেকে বেরোতেই দেখা গেল ধবধবে সাদা মাঠ। ফসল কাটা শেষ। একটা ঘাস নেই কোথাও। সমস্ত খেত জুড়ে পড়ে রয়েছে মাটির ঢেলা। ঘোলাটে চাঁদের আলোয় দূর থেকে দেখলে মনে হয় দিগন্তজোড়া বিশাল এক সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে যেন কেউ। খেতের ওপর দিয়েই কোণাকুণি চলে গেছে পায়েচলা। পথ। সেই পথে নামলো ওরা। কয়েক পা এগোতে এগোতেই জুতোর ওপর মিহি ধুলোর আস্তরণ পড়লো।
বেশ কয়েকটা খেতের পর মুন্সী বাত্রি সীমানা। অনেক বড় এলাকা নিয়ে বাড়ি। বিরাট দীঘির পাড়ে ঘন বাঁশবন। উঁচু হয়ে আছে দীঘির পাড়। কাছে আসতে দেখা গেল কালো কালো অনেক গর্ত।
এই গুলান শিয়ালের গর্ত, জানালো করিম। আমরা বসমু গিয়া দীঘির ঘাটলায়। চুপচাপ।
শান বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ির ওপরে বেশ চওড়া একটা প্ল্যাটফর্ম মতে, তাতে বেশ সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে ইট-সিমেন্টের চেয়ার। পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা। সিঁড়ি যতদিন থাকবে এগুলোও থাকবে, নষ্ট হবে না।
সেই চেয়ারে এসে বসলো ওরা।
এইবার খালি বইয়া থাকো চুপ কইরা, করিম বললো।
কখন আসবে? মুসা জিজ্ঞেস করলা।
আইবো, সময় অইলেই।
সময় যায়। চুপ করে বসে আছে ওরা। ফিসফাস পর্যন্ত করছে না। কানের কাছে মশা পিনপিন করছে। চাপড় মারতে গিয়েও মারছে না। যদি আওয়াজ শুনে শেয়ালেরা আসা বন্ধ করে দেয়।
রাত বাড়ছে। মাথার ওপরে উঠে এসেছে চাঁদ। মস্ত বড়। ঘোলাটে ভাব দূর হয়ে গেছে অনেকখানি, হলদেটে রঙ কেটে গিয়ে সাদা হয়ে উঠেছে। পুকুরের পানির ওপর ধোয়ার মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ছে কুয়াশা।
দূর, আসবে না, আর ধৈর্য রাখতে পারছে না মুসা।
আইবো, আইবো। দ্যাখো না খালি।
রবিন চুপ হয়ে আছে। কিশোরও। করিমের কথা বিশ্বাস করেছে। এতো জোর দিয়ে যখন বলছে, নিশ্চয় আসবে।
আরও কয়েক মিনিট কাটলো। হঠাৎ মুসার বাহু খামচে ধরলো করিম। হাত তুলে দেখালো ঢেলা-খেতের দিকে।
প্রথমে কিছু চোখে পড়লো না। তারপর তিনজনেই দেখলো, দীঘির পাড়ের দিক থেকে খেতের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে একটা জানোয়ার। কুকুরের মতো দেখতে। বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে হেলেদুলে ধীরেসুস্থে চলেছে। গিয়ে বসলো ওটা খেতের একটা আলের ওপর।
পাড়ের কাছ থেকে আরেকটা শেয়াল বেরোলো। বসলো গিয়ে প্রথমটার সামনে, মুখোমুখি, যেন আলাপ করতে বসেছে। তারপর যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হতে লাগলো একের পর এক শেয়াল। কোনোটা একা, কোনোটা জোড়া বেঁধে, আবার কেউ কেউ বাচ্চা-কাচ্চা, পরিবার-পরিজন নিয়ে। দল বেঁধে এগোলো সবাই প্রথম। শেয়াল দুটোর দিকে।
আলে বসা প্রথম শেয়ালটার সামনে গোল হয়ে বসলো ওগুলো। যেন বিচারে বসেছে গাঁয়ের মোড়ল। তার সামনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জড়ো হয়েছে গ্রামবাসী।
দীঘির পাড়ের গর্তে বোধহয় আর একটা শেয়ালও রইলো না। সব গিয়ে। সামিল হয়েছে সভায়। চাঁদের দিকে মুখ তুলে লম্বা হাঁক ছাড়ল প্রথম শেয়ালটা। ওটাই নেতা, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওটার ডাক মিলাতে না মিলাতেই হা-উ উ-উ-উ-উ করে ডেকে উঠলো আরেকটা। সুর মেলালো আরেকটা। তারপর আরও একটা। সমস্বরে চেঁচাতে শুরু করলো সবগুলো। মহা আনন্দে কেউ কেউ করে লাফালাফি শুরু করলো বাচ্চাগুলো।
সে এক বিচিত্র জারি গান। কেউ বলছে হাউ, কেউ বলছে হোউ, কেউ কা-হুঁয়া, কেউ বা আবার হুক্কা-হুঁয়া। দু-একটা আবার তার জের টানছে হুয়া হুয়া হুয়া হুয়া। বলে। থ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। বাস্তবে এ রকম কিছু ঘটতে পারে, তা-ও আবার নিজের চোখে দেখবে, কোনো দিন কল্পনাই করেনি ওরা।
আড়চোখে করিমের দিকে তাকালো মুসা।
মিটিমিটি হাসছে করিম।
শেয়ালের জারি গান একবিন্দু পছন্দ করতে পারেনি গায়ের কুকুরের দল। পাগল হয়ে গেল যেন ওগুলো। চারদিক থেকে ভেসে আসছে এখন ওগুলোর হাঁকডাক।
পাত্তাই দিলো না শেয়ালের দল। আরও কয়েকবার ডেকে খেলা জুড়ে দিলো। তবে সবাই নয়, ছোটগুলো। বড়রা স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো ওদের খেলা। সেই সঙ্গে চললো গুরু-গম্ভীর আলোচনা।
থেকে থেকে জারি গান শুরু করে শেয়ালেরা। শোনামাত্র খেপে উঠে। কুকুরগুলো। যেন ওগুলোকে খেপানোর জন্যেই এমন করে ওরা।
সভা ভাঙলো এক সময়।
আবার দীঘির পাড়ের গর্তের দিকে ফিরে চললো শেয়ালের দল।
খাইছে! বিড়বিড় করে শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পারলো বিস্মিত মুসা।
আশ্চর্য! জোরে বললো না রবিন, যেন আমেজ কেটে যাওয়ার ভয়ে। কয়োট আর নেকড়ে এ রকম সভা করে শুনেছি। শেয়ালেরাও যে করে জানতাম না।
না করার কোনো কারণ নেই, কিশোর বললো। হাজার হলেও জাতভাই। শেয়ালের এ রকম জলসা বসানোর কথা চাচার কাছেও শুনেছি। চাঁদনী রাতে নাকি সুন্দর বনের হরিণেরাও জলসা বসায়, নাচে। বনের মধ্যে মধু জোগাড় করতে যায় যে সব মৌয়াল, তারা এসে এসব কিচ্ছা বলে।
বানিয়ে বলে? মুসার প্রশ্ন।
আগে সে রকমই মনে হয়েছে। কিন্তু এখন আর বলব না সে কথা। চোখের সামনেই যে কাণ্ডটা ঘটতে দেখলাম!
বড় করে হাই তুললো করিম। বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকালো মুসার দিকে। রাইত অনেক অইছে। লও, বাড়িত যাই।
.
১০.
আরেক সোমবার এলো অবশেষে। মাঝখানে কয়েকটা দিন। তবে মোটেও। একঘেয়ে লাগেনি তিন গোয়েন্দার। ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেছে যেন। অনেক দেখেছে ওরা, অনেক ঘুরেছে। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে দাওয়াত খেয়ে এসেছে। হই হট্টগোল আর আনন্দ করেছে। ইতিমধ্যে একদিন মামার সঙ্গে গিয়ে পাখি শিকার করে এসেছে। তবে সব কিছুর মাঝেও বারে বারে ঘুরে ফিরে মনে এসেছে। প্রশ্নগুলোকে কাঁচ ভাঙে? কি করে ভাঙে? কেন ভাঙে? ঈগলের সঙ্গে গাড়ির কাঁচ ভাঙার কি সম্পর্ক? কে চুরি করলো মুদ্রাটা?
সোমবার দুপুর বেলায়ই আরিফ সাহেবের বাড়িতে চলে এলো কচি। কিশোর বললো তাকে, আজই আরেকবার ভূত-থেকে-ভূতে চালান দিতে চাই।
আবার?
হ্যাঁ। কেন, ভুলে গেলে, আরেকবার চালান দেয়ার কথা ছিলো না? ভিনগ্রহের মানুষের খোঁজ চেয়ে?
এবার রবিন আর মুসাও অবাক। সমস্বরে বলে উঠলো, ভিনগ্রহের মানুষ!
তোমরাই তো বললে। টেন-স্পীড যে চালায় তাকে ভিনগ্রহের মানুষের মতো লাগে।
অনেক জায়গায় ফোন করলো কচি, তার বন্ধুদের। বলে দিলো কি করতে হবে। হুঁশিয়ার করে দিলো, যাতে লুকিয়ে থেকে নজর রাখে। সাইকেলওয়ালা যেন টের না পায়। জানিয়ে দিলো, কেউ খবর পেলে যেন ওদের বাড়িতে টেলিফোনে। রচিকে জানায়। বাড়িতে ফোন করে তার ছোট ভাই রচিকে বুঝিয়ে বললো, ভূতদের ফোন যদি আসে, যা যা বলে নোটবুকে লিখে রাখতে। আরিফ সাহেবের ফোন নম্বর দিয়ে বললো নয়টা পর্যন্ত ওই বাড়িতেই থাকবে। ইতিমধ্যে যদি ফোন। আসে, সঙ্গে সঙ্গে সে যেন জানায়।
সকাল সকাল রাতের খাবার খেয়ে নিলো সেদিন ওরা। তারপর বসার ঘরে এসে বসলো। ফোন আসার অপেক্ষা করছে। আটটা বাজলো। এলো না। গেল আরও পনেরো মিনিট সাড়ে আটটায় বেজে উঠলো ফোন। ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিলো কচি। তার ভাইই ফোন করেছে। উত্তেজিত হয়ে বললো, সর্বনাশ। হয়েছে! একগাদা গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে!
দাঁড়া দাঁড়া, কাগজ-কলম বের করি! কচি বললো। আস্তে আস্তে বল!
নোটবুকে লিখে রাখা তথ্য পড়লো ওপাশ থেকে রচি, ক্যাপ, চশমা, হেডফোন আর ব্যাকপ্যাক পরা একটা লোক সাইকেল চালিয়ে গেছে ধানমণ্ডির দশ নম্বর রাস্তা দিয়ে। এইমাত্র একটা গাড়ির কাঁচ ভাঙলো। সাইকেল চালককে কিছু করতে দেখা যায়নি।
মুখ বাঁকালো মুসা। তারমানে ও কিছু করেনি।
তাই তো মনে হয়, ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। কিন্তু সে ছিলো ওখানে।
আট নম্বর রাস্তায় দেখা গেছে সাইকেল আরোহীকে, রচি বললো। কালো একটা টয়োটা প্রিন্টারের কাঁচ ভাঙা হয়েছে। লোকটা গাড়ির কাছে থামেনি।
থামেনি! কচির মুখে শুনে প্রায় চিৎকার করে উঠলো মুসা।
কিন্তু ও যাওয়ার সময়ই তো ভেঙেছে কাঁচ! রবিন বললো। সে না হলে আর কে?
ছয় নম্বর রাস্তায় আর একটা টয়োটার কাঁচ ভেঙেছে। সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে, ভাইয়ের কাছে শুনে বললো কচি। শার্টের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করছিলো।
কী? আবার চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
দাঁড়াও দাঁড়াও, শুনি, হাত তুললো কচি। হ্যাঁ, রচি, বল।
জানা গেল, বারো নম্বর রাস্তায় গগলস পরা টেন-স্পীড সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে। ওই রাস্তায় কোনো গাড়ির কাঁচ ভাঙেনি। চোদ্দ নম্বর রাস্তায়ও সাইকেল আরোহীকে দেখা গেছে। একটা টয়োটা পাবলিকার কাঁচ ভাঙা হয়েছে। শার্টের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করেছিলো সে।
কিন্তু কি রে করছিলো? প্রশ্ন করলো রবিন। গাড়ির কাঁচ ভাঙা যায় এমন কিছু?
ভাঙতে হলে হয় ভারি কিছু দিয়ে পিটাতে হবে, নয়তো ছুঁড়ে মারতে হবে, যুক্তি দেখালো মুসা। আর সে রকম কিছু করে থাকলে চোখে পড়তে বাধ্য। পড়লো না কেন?
রচি জানালো, ষোল নম্বর রাস্তায় দেখা গেছে সাইকেল আরোহীকে। একটা টয়োটা স্টারটেলের কাঁচ ভাঙা হয়েছে। মনে হলো গাড়ির দিকে কোনো কিছু নিশানা করছিল লোকটা। কিন্তু এতো দ্রুত সরে চলে গেল, যে ছেলেটা চোখ রেখেছিলো সে ঠিকমতো দেখতেই পারেনি। রাস্তার কয়েকটা পোস্টে আলোও ছিল না।
নিশানা করেছে, না? বিড় বিড় করে বললো মুসা। পকেট হাতড়াচ্ছে। হ্যাঁ, আছে এখনও। যত্ন করেই রেখেছিলো। দু-আঙুলে ধরে বের করে আনলো। জিনিসটা। চোখের সামনে এনে ভালোমতো দেখলো। চিৎকার করে উঠলো হঠাৎ। বুঝেছি! কিশোর, এয়ার গানের গুলি! গুলি করে গাড়ির কাঁচ ভাঙে! শক্তিশালী কোনো এয়ারগান!
রচির কথা শুনছে আর নোটবুকে লিখে চলছে কচি, আঠারো নম্বর রোডে দেখা। গেছে সাইকেল চালককে। সবুজ রঙের একটা টয়োটার কাঁচ ভেঙেছে। সাইকেল। আরোহীকে কিছু করতে দেখা যায়নি।
এটাই শেষ তথ্য। ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলো কচি।
মুসার কথাটা ভেবে দেখলো কিশোর। বললো, তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছে, সেকেণ্ড। শার্টের নিচে গানটা লুকিয়ে রাখে সে। এয়ার-পিস্তল। গাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় একটানে বের করে গুলি করেই আবার লুকিয়ে ফেলে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার। শব্দ হয় না তেমন। আর যা-ও বা হয় কাঁচ ভাঙার আওয়াজ সেটাকে ঢেকে দেয়, আলাদা করে বোঝা যায় না। অন্ধকারে দেখাও যায় না কিছু। কাঁচে লেগে চ্যাপ্টা হয়ে যায় গুলিটা। যদি জানা না থাকে কি খুঁজছে, তাহলে দেখলেও ওটা চোখে পড়বে না কারো।
এইবার পুলিশকে জানানো যায়! কচি বললো। আমার বাপ জানও এবার বিশ্বাস না করে পারবে না।
না, এখনও সময় হয়নি, কিশোর বললো। আগে হাতেনাতে ধরি ব্যাটাকে, তারপর।
কেন, এখন বললে… বাধা পেয়ে থেমে গেল মুসা। আবার বেজে উঠেছে টেলিফোন।
রিসিভার কানে লাগিয়েই চেঁচিয়ে উঠলো কচি, ধরে ফেলেছে! এই, আরেকবার বল রচি, কোন রাস্তায়!…সাতাশ নম্বর? ঠিক আছে তো? তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে বললো সে, সাইকেলওয়ালাকে ধরে ফেলেছে পুলিশ! যাবে নাকি?
নিশ্চয় যাবো! বলে উঠলো রবিন।
মামা তো ঘরে নেই, কিশোর বললো উত্তেজিত কণ্ঠে। যাবো কিভাবে? এতো দূর যেতে…
গাড়ি নিয়ে যাবো, কচি বললো।
কার গাড়ি?
তোমার মামারটাই। ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে আমার মামীকে রাজি করাও।
প্রথমে রাজি হতে চাইলেন না মামী। পরে কিশোর যখন জোর দিয়ে বললো, বিশ মাইলের বেশি গাড়ির স্পীড ওঠাতে দেবে না কচিকে, তখন রাজি হলেন।
এ সময়ে রাস্তায় গাড়ির ভিড় তেমন নেই। খোলা হাইওয়ে। ইচ্ছে করলে উড়ে। যাওয়া যায়, কিন্তু কিশোরের চাপে ইচ্ছেটা দমন করতে বাধ্য হলো কচি। তবে বিশ মাইল গতিবেগে কিছুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারছে না সে। তিরিশ-পঁয়তিরিশে উঠে যাচ্ছে।
সাতাশ নম্বর রোডের মোড়ে এসে দেখলো পুলিশ নেই। সারা রাস্তায় কোথাও পুলিশ দেখা গেল না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো কচি, একটু আগে এখানে কাউকে কোনো কারণে ধরেছিলো কিনা। কোনো বাড়ির দারোয়ান, কোনো দোকানদার, কিংবা কোনো পথচারীকেউই বলতে পারলো না ওরকম কিছু ঘটেছে এখানে। সবাই একবাক্যে বললো, সন্ধ্যার পর থেকে পুলিশই দেখেনি এই রাস্তায়। এমনকি টহলদার পুলিশও না।
আশ্চর্য! রবিন বললো।
ব্যাপারটা কি? মুসার প্রশ্ন। ঠকানো হয়েছে আমাদেরকে! গম্ভীর হয়ে বললো কচি। চালাকি! শেষ ফোনটা রচি করেনি। করেছে অন্য কেউ। আমাদেরকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে। ইস, তখন বুঝলাম না! গলাটা অন্যরকম লাগছিলো সে জন্যেই!
১১.
কিন্তু কেন? নীরব পথের এমাথা-ওমাথা দেখছে গোয়েন্দা-সহকারী। যেখানে। পুলিশ আর মানুষে গিজগিজ করার কথা সেখানটা এখন পুরোপুরি নির্জন।
রসিকতা করেছে আমাদের সঙ্গে, কিশোর বললো।
কিংবা যাতে পুলিশকে খবর দিতে না পারি সে জন্যে। কে জানে, হয়তো এখনও এখানকারই কোনো পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। কচি, দেখো তো রাস্তাগুলো ঘুরে।
আবাসিক এলাকার রাস্তাগুলো ধরে ধীরে ধীরে গাড়ি চালালো কচি। পথের পাশে কোনো গাড়ি দাঁড়ানো দেখলেই বকের মতো গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে তিন গোয়েন্দা, সেটার কাঁচ ভাঙা কিনা।
ওই যে একটা! আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।
গাড়ি থামাও! সাথে সাথে বললো কিশোর।
ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো কচি। তারপর গাড়ি পিছিয়ে আনলো। একটা লাল টয়োটা করোলার কাঁচ ভাঙা। মালিক এখনও বোধহয় জানে না। পথের পাশে গাড়ি, রেখে গেছে, ফিরে এলে দেখবে। কিংবা হয়তো জানে। কিন্তু কি আর করবে? এখন তো কাঁচ বদলানো সম্ভঘ না। দিনের বেলা যা করার করবে।
তারমানে গাড়ির কাঁচ সত্যি সত্যি ভাঙা হয়েছে এই এলাকায়, আনমনে। বিড়বিড় করে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। সেটা মিথ্যে কথা নয়। ভূত থেকে-ভূতেরা সত্যি কথাই বলেছে। শুধু শেষ ভূতটা ছাড়া।
মানে? মুসার প্রশ্ন।
ওই যে, যে ভূতটা আমাদের বললো সাইকেলওয়ালাকে পুলিশে ধরেছে। হাত নাড়লো কিশোর, কচি, চলো বাড়ি চলো।
.
কাঁচগুলো ভাঙতে দেখলো, রবিন বললো, কিন্তু তাকে যেতে দেখলো না কেন কেউ?, সমস্ত শহরেই ভূত রয়েছে আমাদের। তাদের কারো চোখেই পড়লো না। কেন আর? কাঁচ ভাঙার পর একেবারে উধাও! _ বাড়ি ফিরে বসার ঘরে আলোচনা হচ্ছে ওদের। আরিফ সাহেব এখন ফেরেননি।
গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে রেখে এলো কচি। রবিনের কথা শুনতে পেয়েছে। বললো, ঠিক, পালালো কোথায় ব্যাটা? এতোগুলো চোখকে এভাবে ফাঁকি দিলো। কিভাবে?
দুটো উপায়ে সেটা করতে পারে, দুই আঙুল তুললো গোয়েন্দাপ্রধান। হয় সমস্ত কাপড়-চোপড় বদলে সাইকেলটা কোথাও ফেলে পালিয়েছে। নয়তো কোথাও একটা পিকআপ অপেক্ষা করছিলো তার জন্যে, সাইকেলসহ তুলে নিয়ে গেছে।
কেন এই সাবধানতা? মুসার জিজ্ঞাসা। ছেলেমেয়েরা যে তার ওপর চোখ। রেখেছে, টের পেয়েই কি পালালো?
আমার তা-ই ধারণা।
কিভাবে জানল? কচির প্রশ্ন।
তার ওপর যে চোখ রাখা হয়েছে, এটা বলে দেয়া হয়েছে তাকে। তাড়াতাড়ি কাঁচ ভাঙা বাদ দিয়ে পালিয়েছে যখন, এছাড়া আর কোন কারণ নেই।
কিন্তু সতর্ক করলো কি ভাবে? সন্দেহ যাচ্ছে না কচির।
কোনো ভূত হয়তো চেনে তাকে। বলে দিয়েছে, রবিন অনুমান করলো।
উঁহু, তা নয়, মাথা নাড়লো কিশোর। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে ন্টআসছে। অন্য কোনো ভাবে জেনেহে আমাদের কথা। যেভাবে সব সময় সে জেনে যায় কোন রাস্তায় পুলিশ যাচ্ছে তার ওপর নজর রাখার জন্যে। নিশ্চয় হুঁশিয়ার করা হয় তাকে, হেডফোনের মাধ্যমে।
তার কানে লাগানে হেডফোন?
সিবি রেডিও! বললো মুসা।
নাকি হ্যাম রেডিও! রবিন বললো।
যে রেডিওই হোক, সেটা পুলিশের ওয়্যারলেসে বলা কথা ধরতে পারে, বললো কিশোর। থানার সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখে ডিউটিতে থাকা পুলিশ। অফিসার, রেডিওর মাধ্যমে। ওই ধরনের যন্ত্র আর কারও কাছে থাকলে তার পক্ষেও সেই কথা শোনা সম্ব। একই ওয়েভলেংথে টিউন করে রাখে সে রেডিও। পুলিশের কথাবার্তা সব শোনে। হুঁশিয়ার হয়ে যায়। যে রাস্তায় পুলিশ থাকে সেখানে আর কাঁচ ভাঙতে যায় না। আজ রাতেও রেডিওতেই কেউ তাকে সাহায্য করেছে।
কিন্তু কিশোর, প্রতিবাদ করলো, ভূত-থেকে-ভূতের খবর শুধু আমরা। চারজনই জানি।
ঠিক, একমত হয়ে বললো মুসা। আমাদের সঙ্গে রসিকতা যে করলো সে কিভাবে জানলে? আর কি করেই বা জানলো কোন নম্বরে ফোন করতে হবে। আমাদের?
চলো, বোধহয় দেখাতে পারবো, কিশোর বললো। টর্চ আর একটা মই দরকার। গ্যারেজে লম্বা মই আছে, দেখেছি।
মিনিট কয়েক পর দল বেঁধে চললো চারজনে। টর্চ হাতে কিশোর চলেছে আগে আগে। পেছনে মই বয়ে নিয়ে চলেছে মুসা আর কচি। রবিন সাহায্য করছে। তাদের। সেই টেলিফোনের থামটার কাছে এসে দাঁড়ালো ওরা, যেটা থেকে লাইন। এসেছে আরিফ সাহেবের বাড়িতে।
টেলিফোন বক্সটা থামের মথাির কাছে। সেটা দেখিয়ে মুসাকে নির্দেশ দিলো। কিশোর, যাও, মই লাগিয়ে ওখানে উঠে যাও।
কি করবো উঠে?
বাক্স খুলে দেখো কি আছে। জানাবে আমাদের।
টর্চের পেছনে লাগানো কর্ডটা হাতে ঢুকিয়ে কনুয়ের কাছে ঝুলিয়ে নিয়ে মই বেয়ে উঠে গেল মুসা। বাক্সের দরজা খুলে ভেতরে আলো ফেললো। শুধু তো তার… না না, দাঁড়াও আরেকটা জিনিস আছে!
কী? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
আরো ভালো করে দেখলো মুসা। চিনতে পারছি না। চারকোণা খুব ছোট একটা বাক্সের মতো জিনিস। ধাতুর না প্ল্যাস্টিকের বোঝা যায় না। দুটো তার বেরিয়ে গেছে। বোধহয় টেলিফোনের তারের সঙ্গে জোড়া দেয়া হয়েছে। খুলে আনবো?
না। নেমে এসো।
মাটিতে নেমে আবার ওপরের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বললো মুসা, ওয়্যারট্যাপ, না? চৌধুরী আংকেলের লাইনের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে আমাদের। কথাবার্তা শুনেছে। এভাবেই জেনেছে ব্যাটা ভূত-থেকে-ভূতের কথা।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। এটাই একমাত্র জবাব।
বাক্সটার দিকে রবিনও তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু শোনে কোত্থেকে? বাক্স থেকে তো আর কোনো তার বেরিয়ে যায়নি। মানে, স্বাভাবিক তারগুলো ছাড়া আর কিছু?
নিশ্চয় কোনো ধরনের রিমোট লিসেনিং ডিভাইস। রেডিওর মতো তার ছাড়াই সঙ্কেত পাঠায়। যে এই কাজ করেছে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সম্পর্কে তার অসাধারণ জ্ঞান।
তারমানে আমাদের ওপর সর্বক্ষণ নজর রেখে চলেছে সে, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো রবিন।
রবিনের কথার মানে বুঝতে পারলো মুসা। তার দিকে তাকিয়ে গুঙিয়ে উঠলো।
মইটা নিয়ে আবার ফিরে চললো ওরা।
গ্যারেজে মই রেখে আবার ঘরে এসে বসলো ওরা। আরিফ সাহেব তখনও ফেরেননি। মামী রান্না তৈরীতে ব্যস্ত।
কিশোর বললো, সেদিন যে মামী একটা লোককে খাম্বায় উঠতে দেখেছিলো, আমার ধারণা ওই লোকই যন্ত্রটা লাগিয়েছে ফোন বক্সে।
কে সে? মুসার প্রশ্ন। আমাদের ওপর নজর রাখে কেন? কি চায়? কাঁ
কাচ ভাঙুরার অ্যাসিসট্যান্ট হতে পারে, কচি বললো।
ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। তা পারে।
আসল ব্যাপারটা কি বলো তো? রবিন বললো, এতো আঁটঘাট বেঁধে এভাবে গাড়ির কাঁচ ভাঙার কি মানে? এয়ার পিস্তল, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, পুলিশ ব্যাণ্ড রেডিও, ওয়্যারট্যাপ…নাহ্, এতো সব জিনিসপত্র নিয়ে শুধু শুধু মজা করার। জন্যে কাঁচ ভাঙছে না!
ঠিক, আঙুল নাচালো মুসা। অন্য কোনো কারণ আছে। লাভজনক কিছু। নইলে এতো সব করতে যেতো না।
লাভজনক কাজই তো করে, কচি বললো। গাড়িতে অনেক সময় দামী জিনিস রেখে যায় লোকে। উইশীল্ড ভেঙে সেগুলো চুরি করে চোরটা। ওই যে। ঈগলটা যেমন করলো। অনেক দামী জিনিস। ওই একটা বিক্রি করলেই সারা জীবন। খেতে পারবে।
এদেশে ওই ঈগল বিক্রি করতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিশোরের দিকে তাকালো রবিন। কিশোর, তুমি কি বলো?
বলে আর কি হবে? এই কেস খতম।
হাঁ হয়ে গেল অন্য তিনজন। নীরবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে।
হ্যাঁ, এই কেস শেষ, আবার বললো কিশোর। লোকটাকে হারিয়েছি আমরা।
চুপ করেই রইলো তিন শ্রোতা।
আমরা এখন জানি টেন-স্পীডওলাই কাঁচ ভাঙে, কিশোর বললো। কিন্তু সে কে, জানি না। ওর নাম জানি না, পরিচয় জানি না, ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না। অন্ধকারে তার চেহারাও দেখতে পারিনি ভালোমতো। সে জেনে গেছে, তার পরিচয় ফাস হওয়ার পথে, ফলে ডুব দেবে এখন। আর হয়তো গাড়ির কাঁচ ভাঙবে না। যদি না ভাঙে ধরবো কিভাবে?
হতাশায় গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তাই তো! জানি ওই ব্যাটাই শয়তান, কিন্তু ধরতে পারছি না!
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। রহস্যের সমাধান আমরা করেছি। কিন্তু অপরাধীকে ধরতে পারলাম না।
চুপ করে ভাবতে লাগলো চারজনে।
ঘড়ির দিকে তাকালো মুসা, আর বসে থেকে কি লাভ? চলো, শুতে যাই।
হ্যাঁ,তাই চলো, আফসোস করে বললো রবিন। এই কেস এখানেই শেষ। গাড়ির কাঁচও আর ভাঙবে না, লোকটাকেও ধরতে পারবো না।
তোমাদের তো কিছু হবে না, ক্ষতিটা হলো আমার, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো। কচি। চেহারা দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলতো, লজ্জায় পারছে না। মস্ত ক্ষতি। আব্বাকে কিছুতেই বোঝাতে পারবো না, আমার সঙ্গে শত্রুতা করে নয়, চুরি করার জন্যে গাড়ির কাঁচ ভাঙে একটা চোর! ড্রাইভিং লাইসেন্স করাটাই সার হলো আমার! গাড়ি আর চালাতে পারবো না!
বিদায় নিয়ে বাস ধরতে চললো কচি।
.
১২.
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো এনায়েত। উল্লাহ। চোখে অবিশ্বাস। বললো, বলিস কি? এয়ার পিস্তল দিয়ে কাঁচ ভাঙে?
হ্যাঁ, আব্বা, তাই। কাল রাতে সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে কিশোর। ভূত থেকে-ভূতের সাহায্যে কিভাবে সাইকেলওয়ালার কাঁচ ভাঙার খবর জেনেছে সব কথা বাবাকে খুলে বললো কচি।
ভূত-থেকে-ভূতে! নামটা ভালোই দিয়েছে। আইডিয়াটাও চমৎকার! বুদ্ধি। আছে ছেলেটার, হাসলো এনায়েত উল্লাহ। তা পুলিশের কাছে মুখ খুলেছে। চোরটা?
পুলিশকে বলা হয়নি এখনও।
বলা হয়নি? ভ্রুকুটি করলো এনায়েত উল্লাহ। কেন? তোরা নিজেরাই ধরার চেষ্টা করবি নাকি?
না।
তাহলে?
লোকটা কে তা-ই জানি না আমরা এখনও, আরেক দিকে তাকিয়ে বললো কচি। ওর নাম জানি না, কোথায় থাকে জানি না, বিদঘুঁটে টুপি আর গগলস পরে থাকে বলে চেহারাও দেখতে পারিনি।
জানিসই না লোকটা কে? ভুরু কোঁচকালো এনায়েত উল্লাহ।
না, ধরতে পারলে তবে তো জানবো। তার আগেই পালালো। তবে…তবে, আমার মনে হয় কিশোর যেভাবেই হোক বের করে ফেলবে..পারবে ও! পারবেই!
হু, কচির মতো এতোটা আশা করতে পারলো না এনায়েত উল্লাহ। আবার খাওয়ায় মন দিলো। দেখ, পারে যদি ভালো। তবে যতোক্ষণ আমাকে প্রমাণ দেখাতে না পারছিস, গাড়ির চাবি আমি তোক দিচ্ছি না।
মুখ কালো করে নাস্তা শেষ করলো কচি। তারপর রওনা হলো কিশোরদের ওখানে। সারারাত অনেক ভেবেছে সে। লোকটাকে ধরার মতো কোনো উপায় বের করতে পারেনি। আশা করছে তিন গোয়েন্দার মাথা থেকে কোনো বুদ্ধি বেরোবে।
গেট দিয়ে ঢুকেই দেখলো কচি, বাগানে রোদ পোহাচ্ছে রবিন আর মুসা। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিশোর কই?
সেটা তো আমাদেরও প্রশ্ন, মুসা বললো।
বাড়িতে নেই, রবিন জানালো। ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম নেই। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম। বাইরে যাচ্ছে বলে নাকি বেরিয়ে গেছে কিশোর। কোথায় যাবে বলে যায়নি। তারপর থেকে এই বসেই আছি।
একটা চেয়ারে বসলো কচি। সাইকেলওয়ালাকে পাকড়াও করার কোন উপায় করতে পেরেছো? কোন বুদ্ধি-টুদ্ধি?
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো দুই সহকারী গোয়েন্দা।
আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। তবু কিশোর ফিরলো না।
আরও পাঁচ মিনিট পর দেখা গেল তাকে। ঢুকছে গেট দিয়ে।
কিশোওর! চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুসা।
কোথায় গিয়েছিলে? রবিন বললো। সারাটা সকাল তোমার জন্যে বসে– আছি।
হাসলো কিশোর। আসলে ঠিকমতো আলোচনা করতে পারলে কাল রাতেই সমস্যার সমাধান করে ফেলা যেতো। মাঝরাতে হঠাৎ খিদেয় ঘুম ভেঙে গেল। রাতে কম খেয়েছিলাম। তুমি আর মুসা জিজ্ঞেস করেছিলে না, গাড়ির কাঁচ কেন ভাঙে সাইকেলওয়ালা?
কেন! প্রায় একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো অন্য তিনজন।
সেটাই আলোচনা করবো এখন, হাসলো গোয়েন্দাপ্রধান। এখন আমাদের বুঝতে হবে কেন উইশীল্ড ভাঙে। আর তাহলেই জেনে যাবো লোকটা কে।
নীরবে বসে রইলো তিন শ্রোতা। একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তারপর তাকালো কিশোরের মুখের দিকে।
আমি কিছুই বুঝতে পারবো না, সাফ জানিয়ে দিলো রবিন।
কচি বললো, না হয় কারণটা জানা গেলই, তাতে লোকটাকে চিনবো কিভাবে? যে কেউ এ কাজ করে থাকতে পারে।
জানা যাবে, দৃঢ়কণ্ঠে বললো কিশোর। গাড়ির কাঁচ কেন ভাঙে জানতে পারলে এটাও বুঝে যাবো কোন জায়গায় তাকে খুঁজতে হবে।
কি যে বলো কিছুই বুঝতে পারি না, অনুযোগের সুরে বললো মুসা। ঠিক আছে, তোমার কথাই সই। মেনে নিলাম, উইশীল্ড কেন ভাঙে বুঝতে পারলেই সমস্যার সমাধান হবে। এখন বলো, কেন ভাঙে? গাড়ির কাঁচ পছন্দ করে না বলে?
নাকি সে গাড়িই পছন্দ করে না? হিংসা? কেন লোকে চালাবে, আমি পারবো না, ওরকম কিছু? রবিনের প্রশ্ন। সে জন্যেই গাড়ির ক্ষতি করে?
না, মাথা নাড়লো কিশোর, ওসব নয়। তাহলে গাড়ির শুধু একটা বিশেষ কাঁচই ভাঙতো না। সব ভেঙে দিতো। কিংবা গাড়ির অন্য ক্ষতিও করতো। কিন্তু তা না করে যেন প্ল্যান করে খুব সাবধানে একটা করে কচি ভাঙে। এমন একটা ভাব করে রাখতে চায়, যাতে লোকে মনে করে ব্যাপারটা নিছকই দুর্ঘটনা।
পাগল হতে পারে, মুসা বললো, সেয়ানা পাগল। কাঁচ ভাঙতে ভালোবাসে, আবার ধরাও পড়তে চায় না।
পাগলের অতো সূক্ষ্ম বুদ্ধি হবে না, কিশোর মানতে পারলো না মুসার কথা। হ্যাঁ, বড়লোকের ওপর অনেকের রাগ থাকে, তাদের ক্ষতি করতে পারলে খুশি হয়। আর রেগে গিয়ে মানুষ যখন কোন কাজ করে বুদ্ধি তখন ঘোলা হয়ে যায়। বোকামি। কিংবা ভুল করে বসে। ওরকম কারো কাজ হলে এতোদিনে ধরা পড়ে যেতো।
হ্যাঁ, তা ঠিক, একমত হলো কচি।
আসলে এই লোকটা পাগল-টাগল কিছু না, কিশোর বললো। খুব বুদ্ধিমান। কাঁচও ভাঙছে, আবার অত্যন্ত চালাকির সঙ্গে লুকিয়ে রাখছে নিজেকে।
তাহলে হয়তো প্রতিশোধ, রবিন বললো। কি বলো?
কার ওপর?
গাড়ি কোম্পানির ওপর।
সেটা আমেরিকায় কিংবা জাপানে হতে পারে, যেখানে গাড়ি তৈরি হয়। কোম্পানিতে কোম্পানিতে রেষারেষি থাকলে, প্রতিযোগিতা থাকলে সেটা ভাবা। যেভো, যদিও গাড়ি কোম্পানির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান এতো বাজে কাজ করবে না। আর বাংলাদেশে যেখানে গাড়ি তৈরিরই কোন কোম্পানি নেই, সেখানে। এসবের প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে ওই কথাই ঠিক। গাড়ির মালিকদের ওপরই লোকটার রাগ।
অনেক গাড়ির কাঁচ ভাঙা হয়েছে, নথি, কিশোর বললো। এতোগুলো মানুষের ওপর রাগ কিংবা ঘৃণা কোনটাই থাকতে পারে না একজনের।
তাহলে পাগলই, মুসা বললো।
কিন্তু পাগলের মতো আচরণ তো করছে না, প্রতিবাদ করলো কচি।
তাহলে আমি ফেল, দুহাত নাড়তে নাড়তে বলল মুসা। হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, কেন ভাঙে শয়তানটাই জানে!
কিশোর, সামনে ঝুঁকলো রবিন, ঈগলের ব্যাপারটা এর মধ্যে আনছি না। কেন? এমনও তো হতে পারে সমস্ত সূত্র লুকিয়ে আছে ওটার মাঝেই? অন্য সব গাড়ির কাঁচ ভাঙা তার কাছে একটা বাহানা মাত্র। আসলে ভাঙতে চেয়েছে ওই একটা গাড়িরই কাঁচ, যেটাতে মুদ্রা ছিলো। আর মুদ্রা চুরির ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্যে, মানে, পুলিশের চোখ অন্য দিকে সরানোর জন্যেই এতোগুলো গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালো কিশোর। তোমার কথায় যে যুক্তি একেবারেই নেই তা নয়। তবে সেক্ষেত্রে কাঁচ ভেঙে আরও জিনিস চুরি করতো, যাতে সবাই মনে করে কাঁচ ভাঙাই হয় চুরি করার জন্যে। সাধারণ চুরির মধ্যেই পড়ে গেছে মুদ্রা চুরির ব্যাপারটাও। তাই না?
তাহলে… আবার ভাবতে আরম্ভ করেছে মুসী। কথা শেষ করলো না।
আর কি কারণ হতে পারে? মুসার কথাটাই যেন শেষ করলো কচি।
আমিও আর কিছু ভেবে পাচ্ছি না, মাথা নাড়লো রবিন।
ভাবলে আরও অনেক সম্ভাবনা বেরিয়ে আসতে পারে, কিশোর বললো। তবে মুসার কাল রাতের একটা কথা আমার কাছে খুব মূল্যবান মনে হয়েছে।
আমি বলেছি! মুসা অবাক। কাল রাতে?
হ্যাঁ, বলেছো। তুমি বলেছো, গাড়ির কাঁচ ভেঙে কার কি লাভ?
চোখ মিটমিট করতে লাগলো অন্য তিনজন।
লাভ? ভুরু কুঁচকে বললো কচি। গাড়ির কাঁচ ভেঙে লাভ?
বুঝেছি! তুড়ি বাজিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুসা। তারপর বসে পড়লো। আবার ধীরে ধীরে। ঠিক, লাভ! তাদের লাভ, যারা গাড়ির জানালার কাঁচ বানায়, কিংবা সাপ্লাই দেয়!
ঠিক, ঠিক! রবিনও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে নিশ্চয় ওরকম কাঁচ তৈরির কোন কোম্পানি নেই। বাকি রইলো যারা সাপ্লাই দেয়। বিদেশ থেকে আমদানী করে। আর নিশ্চয় ওই-কাঁচ আমদানী কোন একটা প্রতিষ্ঠানই করে থাকে। একচেটিয়া ব্যবসা।
ঠিক এই কথাটাই আমি বলতে চাইছি, নথি, হাসিমুখে বললো কিশোর। যারা কাঁচ আমদানী করে। গাড়ির কাঁচ ক্রমাগত ভাঙতে থাকলে তাদেরই লাভ। কারণ কাঁচ ছাড়া গাড়ি চালানো সন্ত্র নয়। বাধ্য হয়েই নতুন আরেকটা লাগাতে হবে মালিককে। আরও একটা ব্যাপার কি লক্ষ করেছো? শুধু টয়োটা গাড়িরই কাঁচ ভাঙে। তারমানে শুধু টয়োটার কাঁচই আমদানী করে তারা।
তেমন প্রতিষ্ঠান আছে এদেশে? কচির প্রশ্ন। খোঁজ লাগাতে হয়।
নিশ্চয় আছে। সকালে সেটা খুঁজতেই বেরিয়েছিলাম, কিশোর বললো। কয়েকটা মেকানিক শপে খোঁজ নিয়েছি। সবাই একটা নামই বললো। গাড়ির ওই কাঁচ একটা কোম্পানিই আমদানী করে। মডার্ন গ্লাস কোম্পানি।
.
১৩.
লাল রঙা একটা পাকা বাড়ি। একতলা। পেছনে আরও তিনটে বাড়ি, পাকা দেয়াল, ওপরে টিনের চাল। এক সীমানার মধ্যেই বাড়িগুলো, কাঁটাতারের ছয় ফুট উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। এই হলো মডার্ন গ্লাস কোম্পানি। জায়গাটা শহরের বাইরে, খিলক্ষেত এলাকায়। উত্তরা এবং গুলশানের মাঝামাঝি, দুটো জায়গা থেকেই বেশি দূরে নয়। সামনের দিকে মূল গেট ছাড়াও ডেলিভারি ট্রাক আর কর্মচারীদের ঢোকার জন্যে আরেকটা গেট আছে একপাশে। সামনের বিল্ডিংটায় অফিস আর শো রুম। পেছনের টিনের চালাওয়ালাটা গুদাম। লাল বাড়িটার পাশে বেশ ছড়ানো একটা চত্বর রয়েছে। ওখানে গিয়ে ট্রাক কিংবা অন্য গাড়ি দাঁড়ায়, মাল বোঝাই করার জন্যে। গাড়ি পার্ক করার জায়গাটা এখন অর্ধেক খালি।
কোম্পানির মালিকই কি কাঁচ ভাঙে? প্রশ্ন করলো রবিন।
ঠিক নেই, জবাব দিলো কিশোর। তবে সে সম্ভাবনাও কম।
পাশে ছোট একটা মার্কেট তৈরি হচ্ছে। ওটার হাতে দাঁড়িয়ে কাঁচ কোম্পানির ওপর নজর রেখেছে তিন গোয়েন্দা আর কচি।
সেলসম্যানের কাজও হতে পারে, নিচের চত্বরের দিকে তাকিয়ে বল না কিশোর। যতো বেশি কাঁচ বিক্রি করবে ততো বেশি কমিশন পাবে। কমিশনের লোভেই হয়তো ভাঙে। কিংবা নতুন সেলসম্যান রাখা হয়েছে। মালিককে খুশি করার জন্যে সে এই কাজ করে বা করায়। অন্য কোন কর্মচারীর কাজও হতে পারে। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক কাঁচ বিক্রি না হলে চাকরি খোয়ানোর ভয় আছে। হয়তো তার।
সেটা জানবো কিভাবে? কচি বললো। চেহারাই তো দেখিনি।
চেহারা না দেখলেও শরীর দেখেছি। লম্বা, পাতলা, সম্ভবত কম বয়েসী। বয়স্ক লোকেরা সাধারণত ওরকম টেন-স্পীড সাইকেল চালায় না।
তাকিয়েই রয়েছে ছেলেরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নিচের কাজকর্ম দেখছে। মূল। বাড়িটার মুখ রাস্তার দিকে নয়, ডানের পার্কিং লটের দিকে। বয়ে আরেকটা আছে, সেটাতে শুধু ট্রাক কিংবা ভ্যানগাড়ি ঢোকে, মাল বোঝাইয়ের জন্যে। আর ঢোকে খুচরা খরিদ্দার। নানা রকম গাড়ি আসছে যাচ্ছে সেখানে-পিকআপ, ভ্যান, কার। সব টয়োটা। এবং সবগুলোর কাঁচ ভাঙা।
দেখে তো মনে হয় পাইকারী বিক্রি করে এরা, মুসা বললো কিছুটা অবাক হয়েই। তাহলে ওই গাড়িগুলো আসছে কেন এতো বেশি?
শুধু পাইকারী বিক্রিতে বোধহয় চলছিলো না আর, জবাবটা দিলো কচি। খুচরাও শুরু করেছে।
মূল বাড়িটার সামনের দিকের দেয়াল প্রায় পুরোটাই কাঁচের। ভেতরে অফিস। ডেস্ক, চেয়ার, ফাইলিং কেবিনেট দেখেই বোঝা যায়। গুদাম থেকে বড় বড় চ্যাপ্টা বাক্স এনে তোলা হচ্ছে বায়ের চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাকে। ওটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা ট্রাক, মাল বোঝাই। সেটা থেকে মাল খালাস করে নিয়ে গিয়ে ভরা হচ্ছে গুদামে। দু-তিনজন লোক অফিস থেকে কিছুক্ষণ পর পরই বেরিয়ে। এসে গুদামে ঢুকছে, বাদামী কাগজে মোড়া চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা প্যাকেট বয়ে নিয়ে আবার চলে যাচ্ছে অফিসে। বুঝতে অসুবিধে হয় না প্যাকেটগুলোতে রয়েছে কাঁচ। গাড়ি নিয়ে যারা আসছে তাদের অনেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছে ওই কাঁচ।
কাউকেই কিন্তু সাইকেলওয়ালার মতো লাগছে না, কর্মচারীদের কথা বললো কচি।
না, একমত হলো কিশোর। ওই লোকটা নিশ্চয় অফিসে কাজ করে। কোনো কেবিনে বসে রয়েছে, কিংবা গুদামের ভেতর। গুদাম-কর্মচারীও হতে পারে। আর সেলসম্যান হলে তো অফিসে থাকবে না। নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে দোকানে দোকানে খোঁজ নিতে, কার কি মাল লাগবে।
মাল নামানো হয়ে গেলে বেরিয়ে গেল ট্রাক। যেটাতে বোঝাই হচ্ছিলো, সেটা রইলো, মাল তোলা এখনও শেষ হয়নি।
কি করবো, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করলো। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখবোই?
না, খালি হওয়ার অপেক্ষা করছি, জবাব দিলো কিশোর। ট্রাকগুলো চলে গেলেই গুদামের সামনেটা খালি হয়ে যাবে। মাল খালাস কিংবা বোঝাইয়ের কাজ না থাকলে গুদামের ভেতরেও লোক থাকবে বলে মনে হয় না। তখন কচিকে নিয়ে আমি যাবো অফিসের দিকে। কথা বলার চেষ্টা করবো কর্মচারীদের সঙ্গে। শশী। রুমের জিনিস দেখার ভান করবো। এই সুযোগে তুমি আর মুসা গিয়ে গুদামে ঢুকবে। সূত্র খুঁজবে।
কি সূত্র? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
সাইকেলওয়ালাকে ধরা যায় এরকম কিছু?
আর তোমরা কি জিজ্ঞেস করবে?
আমি না, জিজ্ঞেস করাবো কচিকে দিয়ে। ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। তাছাড়া ওদের গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে চার চারবার। কাঁচের কথাই জিজ্ঞেস করবে। ও দামদর জানবে।
ঠিক আছে, বললো রবিন।
আরও আধ ঘণ্টা কাজ চললো গুদামের সামনের চত্বরে। তারপর বেরিয়ে গেল ট্রাক। চর খালি হয়ে গেল।
সময় হয়েছে, কিশোর বললো অবশেষে। মুসা, রবিন, মনে রাখবে খুব বাজে একটা লোককে নিয়ে কারবার করছি আমরা। বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে যে কোন সময়। সাইকেলওয়ালা এখানে আছে এরকম কোন চিহ্ন দেখলে গুদামের সামনের দরজা কিংবা জানালায় চকের দাগ দিয়ে রাখবে। আশ্চর্যবোধক চিহ্ন। আমি আর কচি সঙ্গে সঙ্গে তখন বাড়ি চলে যাবো। মামাকে বলে পুলিশ নিয়ে ফিরে আসবো।
ছাতের ওপর থেকে নেমে এলো ওরা। অর্ধেক হয়ে বন্ধ হয়ে আছে মার্কেট তৈরির কাজ। বোধহয় টাকা-পয়সার অভাবেই। লোকজন কেউ নেই। ছাতে। উঠতে তেমন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। নামতেও জবাবদিহি করতে হলো না।
গ্লাস কোম্পানির পাশের দরজাটাও খোলা, সামনেরটাও। এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে ঢুকে পড়লো মুসা আর রবিন। গুদামের দিকে এগোলো।
কচিকে নিয়ে কিশোর ঢুকলো শো রুমে। চারজন খরিদ্দার দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলছে তিনজন সেলসম্যান। কাউন্টারের ওপাশে বিরাট ব্রিট তাক নানা রকম কাঁচে বোঝাই। কিছু কাঁচ আছে নকশা করা, কিছু নকশা ছাড়া। সাদা কাঁচ আছে, রঙিন কাঁচ আছে। এসবই বাড়ি-ঘরের জানালার শার্সিতে লাগানো হয়। খরিদ্দাররা দেখে, পছন্দ করে, অর্ডার দেয়।
বাঁয়ের কাঁচের দেয়ালের ওপাশে আরেকটা ঘর। অফিস। একজন মহিলা আর দুজন পুরুষ কর্মচারীকে দেখা যাচ্ছে।
খরিদ্দারদের পেছনে দাঁড়িয়ে সেলসম্যানদের দেখছে কিশোর। তাদের একজন। মোটাসোটা বয়স্ক মানুষ। আরেকজন লম্বা, পাতলা, তরুণ। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল কচি আর কিশোরের। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝাঁকালো। ওরা।
কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে এখন কথা বলছে দুজন খরিদ্দার।
এই সুযোগে চারপাশে চোখ বোলাতে লাগলো কিশোর। কাঁচের দেয়ালের ওপাশের মহিলা তরুণী। যথেষ্ট লম্বা, প্রায় পুরুষের সমান, পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। পুরুষদের একজন লম্বা, মাঝবয়েসী। কোণের দিকে কাঁচে ঘেরা একটা খুপরিমতো ঘরে বসে আছে। একা। খুপরির কাঁচের দেয়ালে লেখা রয়েছে।
শরাফত আহমেদ
ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
তারমানে ওই লোকটাই এই কোম্পানির মালিক। বেশ বড় একটা ডেস্কের ওপাশে বসে আছে লম্বা আরেকজন মানুষ। বয়েস প্রৌঢ়ত্বের কোঠা ছাড়িয়ে গেছে। ডেস্কে তার পদবী লেখা প্ল্যাস্টিকের বোর্ড দাঁড়িয়ে রয়েছেঃ
জেনারেল ম্যানেজার।
কিশোর! কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলো কচির কণ্ঠ।
ঝট করে ফিরে তাকালো কিশোর। সেলসম্যানদের একজন, সেই তরুণ লোকটা হেঁটে যাচ্ছে পাশের দরজার দিকে। গুদামে যাওয়ার চত্বরে বেরোনোর পথ। ওটা।
.
১৪.
কিশোরদেরকে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখলো মুসা আর রবিন। চত্বরে অপেক্ষা করলো আর মিনিট দুয়েক। কাউকে আসতে না দেখে দ্রুতপায়ে এগোলো গুদামের দিকে। নির্জন। কেউ নেই। মূল বাড়িটার পেছনে গুদামের দিকে মুখ করে রয়েছে। একটিমাত্র জানালা। দরজা আছে। সব বন্ধ।
আরেকবার এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে গুদামে ঢুকে পড়লো দুজনে।
ভেতরে অলৌ কম। জানালা নেই। দরজা দিয়ে যা আসছে তাতে ভেতরের অন্ধকার কাটছে না। ফলে সারাক্ষণ বৈদ্যুতিক আলো জ্বেলে রাখতে হচ্ছে। সারি। সারি তাক, ওগুলোতে নানা রকমের প্যাকেট আর বাক্স। মেঝেতে একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে স্কুপ করে রাখা হয়েছে ছোট-বড় কাঠের বাক্স। বাদামী কাগজে মোড়া অনেক কাঁচ,দেখা গেল একটা তাকে। কান পেতে রইলো কিছুক্ষণ দুজনে। নিশ্চিত হয়ে নিলো ভেতরে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই।
লম্বা শেলফগুলোর মধ্যে দিয়ে রয়েছে চলাচলের জন্যে সরু গলিপথ। সে পথে এগোলো ওরা। তাকের মধ্যে ফাঁক দেখলেই উঁকি দেয়, মাথা নিচু করে তাকায় শেলফের নিচের ফাঁকে। সাইকেলওয়ালার ব্যবহৃত জিনিসের চিহ্ন খুঁজছে।
কিছুই পাওয়া গেল না।
গুদামের শেষ প্রান্তে পার্টিশন দিয়ে ছোট একটা অফিস করা হয়েছে। তবে সেটা বোধহয় এখন আর অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। কারণ ওটার ভেতরেও বাক্স বোঝাই করে রাখা হয়েছে। অফিসের জিনিসপত্র রাখার একমাত্র কাঠের আলমারিটা এখন খালি। ব্যবসা বোধহয় খারাপ যাচ্ছে, লোক ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছে মালিক।
আবার গুদামের সামনের দিকে চলে এলো ওরী। ভেতরে আরও খুঁজে দেখার ইচ্ছে আছে। তবে তার আগে দেখে নিশ্চিন্ত হতে চায় যে কেউ আসছে না। আগের মতোই নির্জন চত্বর। সামনের গেট দিয়ে গাড়ি আসা-যাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোন গাড়িই পাশের গেট দিয়ে ঢুকছে না।
কেউ নেই… বলতে গিয়েই থেমে গেল মুসা।
কি হলো! তার পাশে এসে দাঁড়ালো রবিন।
দুজনেই দেখতে পাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে মূল বিল্ডিং থেকে চত্বরে বেরোনোর দরজা।
.
তিন লাফে কাউন্টারের শেষ মাথায় চলে এলো কিশোর। ওদিকেই চত্বরে বেরোনোর দরজাটা। হাত নেড়ে ডেকে বললো, এই যে ভাই, শোনেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। আমার কথাটা খুব জরুরী।
আসছি, দরজা ঠেলে খুলতে খুলতে বললো লোকটা। বেশি দেরি হবে না।
এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, রেগে যাওয়ার ভান করলে কিশোর। কথা বলছেন তো বলছেনই। আমাদের কি চোখে পড়ে না? মালিক কে আপনাদের? তার সঙ্গে কথা বলবো।
দরজার হাতলে হাত রেখেই থমকে গেল সেলসম্যান। দ্বিধা করছে। এ রকম করে যখন কথা বলছে নিশ্চয় হোমড়া চোমড়া কারও ছেলে।
মালিক কে? কড়া গলায় আবার জিজ্ঞেস করলো কিশোর। হাত তুলে কাঁচের অফিসে একলা বসা মানুষটাকে দেখিয়ে বললো, উনি?…এই কচি, এসো, বাবার কথা গিয়ে বলি। বলবো, আমাদেরকে পাত্তাই দেয়নি আপনাদের সেলসম্যান।
চলো, কিশোরের অভিনয় দেখে মনে মনে অবাক না হয়ে পারলো না কচি।
যা বোঝার বুঝে গেল সেলসম্যান। এই ছেলেকে বেশি ঘাটানো উচিত হবে না। চাকরি চলে যেতে পারে তাহলে। দরজার হাতল ছেড়ে দিয়ে কাউন্টারের কাছে ফিলে এলো সে। জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?
একটা রোলস রয়েসের কাঁচ, গম্ভীর মুখে বললো কিশোর। ভেতরে ভেতরে পেট ফেটে যাচ্ছে হাসিতে।
রোলস রয়েস! বিস্ময়ে ভুরু উঁচু হয়ে গেল সেলসম্যানের। এতো দামী গাড়ির কাঁচ পাবো কোথায়?
সেটা আমি কি জানি? বাবা বলে পাঠালো নিয়ে যেতে, নিতে এলাম।
কোন মডেলের? মড়েল জানলে বলতে পারবো। টয়োটার কোন কাঁচ ওটায় লাগে কিনা দেখা যেতে পারে।
ঊনিশশো সাইতিরিশ মডেলের সিলভার ক্লাউড, আমেরিকায় যে গাড়িটাতে চড়ে ওরা, হ্যাঁনসন চালায়, সেটার কথা বলে দিলো কিশোর।
মরা মাছের মতো হাঁ হয়ে গেল সেলসম্যানের মুখ। ঢোঁক গিললো। ফ্যাকাশে মুখে রক্ত ফিরতে সময় লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো, নামই শুনিনি। কখনও, দেখা দূরে থাক। গাড়িটা কি নিয়ে এসেছো?
আপনি করে বলুন, ঝাঝালো কণ্ঠে বললো কিশোর। তুমি শুনতে ভালো লাগে না আমার।…না, গাড়ি আনিনি।
তাহলে দয়া করে যদি ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও..মানে, দেন, তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারি টয়োটার কাঁচ ফিট করে কিনা।
.
দরজা খুলতে দেখে বরফের মতো জমে গেছে রবিন ও মুসা। ওদের মনে হলো। অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা খেলা চত্বরে রোদের মাঝে, আর খুলেই চলেছে দরজাটা। এই খোলার যেন আর শেষ নেই।
তারপর ধীরে ধীরে আবার বন্ধ হয়ে গেল।
হাউফ! করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুসা।
এসো, তাড়া দিলে রবিন। জলদি ঢুকে পড়ি ওটায়। দুই নম্বর গুদামটা। দেখালো সে।
প্রায় দৌড়ে এসে দ্বিতীয় গুদামে ঢুকলো ওরা। এটার ভেতরটাও প্রথমটারই মতো অন্ধকার। আলো জ্বেলে রাখতে হয় সর্বক্ষণ। সারি সারিতাক। তবে তাকগুলোর বেশির ভাগই খালি।
প্রথম ঘরটার মতোই এটাতেও খুঁজতে শুরু করলো ওরা। এখানেও কিছু পেলো। না। আরেকবার এসে উঁকি দিলো দরজায়। কাউকে দেখা গেল না। মূল বাড়ি থেকে বেরোলো না কেউ। চত্বরে বেরিয়ে একছুটে এসে ঢুকলো তৃতীয় এবং সব চেয়ে– ছোট গুদামটায়। অন্য দুটোর মতোই এটাতেও আলো কম। কিছু মালপত্র রয়েছে কয়েকটা তাকে। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল। তার ওপর কাঁচ কাটার যন্ত্রপাতি। পাশে কয়েকটা লম্বা লম্বা টুলও রয়েছে। কাজ হয় ওগুলোতে।
বায়ের শেলফগুলো ধরে পেছনে এগোলো রবিন। মুসা এগোলো ডান পাশ দিয়ে। চোখে লাগার মতো কিছুই দেখতে পেলো না। এই গুদামের পেছনেও পার্টিশন দেয়া একটা ছোট অফিস রয়েছে। জিনিসপত্রে ঠাসা।
রবিন! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
অফিসের পেছনের দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটা বাক্সের ওপর তেরপল টেনে দেয়া। ছিলো। সেটা সরাতেই বেরিয়ে পড়েছে একটা টেন-স্পীড বাইসাইকেল। দেয়াল। ঘেঁষে দাঁড় করানো।
এইটাই? রবিন এলে আবার বললো মুসা।
কি জানি! দ্বিধা করলো রবিন। অন্ধকারে দেখেছি। রঙ-টঙ তো দেখিনি। তবে এ রকম সাইকেলও এ শহরে দেখিনি আর। এটাই হবে।
সীটটা কিন্তু বেশ উঁচু। লম্বা মানুষের মাপে বসানো।
আরও ভাল করে দেখার জন্যে এগোতে গেল মুসা। হাতের ধাক্কায় উল্টে পড়ে গেল ওপরের একটা বাক্স।
রবিন আর মুসা দুজনেই আশঙ্কা করেছিলো ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙবে। কিন্তু তেমন আওয়াজ হলো না। তবে কি কাঁচ নেই ভেতরে?
বাক্সটা সোজা করে বসিয়ে ডালা তুলে দেখলো মুসা। তারপরেই অস্ফুট শব্দ করে উঠলো। কি আছে দেখার জন্যে রবিনও এসে উঁকি দিলো ভেতরে।
পাওয়া গেল একটা ক্যাপ, চশমা, ব্যাকপ্যাক, তার ভেতরে রেডিও, হেডফোন, হলদে রঙের একটা স্পোর্টসম্যানদের জামা, কালো পায়জামা, আর সাইকেল চালানোর উপযোগী একজোড়া কেডস জুতো।
.
সেলসম্যানকে ওদিকে ব্যস্ত রেখেছে কিশোর, বেশ, ধরুন, এখানকার কোন কাঁচ ফিট করলো না। আনিয়ে তো দিতে পারবেন?
তা-ও জানি না, জবাব দিলো লোকটা। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি। অনেক সময় লাগবে। যে মডেলের কথা বলছেন, সিঙ্গাপুরেও পাওয়া যাবে কিনা। যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ফ্যাক্টরিতে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনতে হবে। প্রচুর দাম। পড়ে যাবে তাতে।
পড়লে পড়বে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর। ভাঙা কাঁচ না বদলে তো আর গাড়ি চালানো যায় না।
তা বটে, স্বীকার করলো সেলসম্যান। মুখ দেখেই আন্দাজ করা গেল মনে মনে বলছে, ব্যাটা তোদের টাকা তোরা পানিতে ঢালবি, তাতে আমার কি?।
গুড, লোকটার কথায় খুব যেন সন্তুষ্ট হয়েছে কিশোর, এমন ভঙ্গি করলো। তারপর বললো, আরেকটা গাড়ির কাঁচ লাগবে। ক্যাডিলাক। উনিশশো সাতান্ন…
কিশোর! ডেকে উঠলো জানালায় দাঁড়ানো কচি। উত্তেজনায় শক্ত হয়ে
কী? বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো কিশোর। তারপর যেন নেহায়েত অনিচ্ছার সঙ্গেই এগিয়ে গেল। ধমকের সুরে বললো, কথা বলছি যে দেখো না? কচির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কি দেখে ডাকা হয়েছে তাকে, দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হলো না। কচির মতো সে-ও দেখলো, ছোট গুদামটার জানালায় বড় করে চকে আঁকা আশ্চর্যবোধক।
আহ, জ্বালিয়ে মারলো! বিরক্ত স্বরে বললো সে। সময় অসময় বোঝে না!
সেলসম্যানকে পুরোপুরি অন্ধকারে আর বিস্মিত করে রেখে কচিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো কিশোর।
বাইরে বেরিয়ে আর হাসি চাপতে পারলো না।
কচিও হাসতে হাসতে হাত নেড়ে বললো, যা গুল মারতে পারো না তুমি! রোলস রয়েস, ক্যাডিলাক…এমন করে বলছিলে, আমারই বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। সেলসম্যানের আর কি দোষ? কিশোরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে রসিকতার সুরে জিজ্ঞেস করলো, তা এদেশে তোমার কোটিপতি বাবাটি কে হে?
হেফাজত আলি পাটোয়ারি, হেসেই জবাব দিলো কিশোর। নাম শোনোনি? আগে কাগজ ফেরি করে বেচতো, এখন করে সোনার ব্যবসা, গোল্ড স্মাগলার। শুনতে খুব ভালো লাগে, না? কি গালভরা নাম। মানুষকে বলেও শান্তি। প্রচুর টাকা আছে আব্বা হুজুরের। আর আছে কয়েক ডজন পোষা সন্ত্রাসী। কেউ কিছু বললেই ঠিচু, বলে পিস্তলের ট্রিগার টেপার ভঙ্গি করলো সে। সে জন্যেই তো কাউকে কেয়ার করি না। মুখের ওপর যা খুশি বলে দিই।…নাও, চলো এখন, পুলিশকে খবর দিতে হবে।
.
গুদামের জানালার নিচে ঘাপটি মেরে বসে আছে রবিন আর মুসা। ওরা যে জিনিস। পেয়েছে সেটা বোঝানোর জন্যে জানালায় চিহ্ন আঁকার পর পেরিয়ে গেছে দশটি মিনিট।
আধ ঘণ্টার বেশি লাগবে না, হিসেব করে বললো রবিন। বাসে কিংবা বেবিতে করে বাড়ি যাওয়া, মামাকে দিয়ে থানায় টেলিফোন করানো, তারপর থানা। থেকে পুলিশ নিয়ে আসা…ওই আধ ঘণ্টাই যথেষ্ট।
ওকে যদি আমরা ধরতে পারতাম ভালো হতো, মুসা আফসোস করলো।
হয়তো হতো। তবে তার জন্যে দুঃখ করার কিছু নেই। রহস্যের কিনারা তো। আমরাই করলাম। ধরার চেষ্টা হয়তো এখনও করা যায়, কিন্তু উচিত হবে না। ব্যাটার কাছে পিস্তল-টিস্তল থাকতে পারে। এয়ার পিস্তল তো আছেই।
কিন্তু তার পরেও… বলতে গিয়ে থেমে গেল মুসা।
পাশের গেট দিয়ে ঢুকলো একটা নীল রঙের গাড়ি। তীব্র গতিতে চত্বরে ঢুকে অতো জোরে ব্রেক কষলো, কর্কশ আর্তনাদ করে উঠলো টায়ার। গাড়ি থেকে নেমে গটগট করে এগোলো এক তরুণ।
মুসা, দেখো দেখো! ফিসফিসিয়ে বললো রবিন।
লম্বা, পাতলা শরীর। চেহারা ফ্যাকাশে, যেন রক্তশূন্যতায় ভুগছে। লম্বা লম্বা চুল নেমে এসেছে ঘাড়ের ওপর। গায়ে নীল স্পোর্টস জ্যাকেট। খাড়া পাতলা ঠোঁট। চঞ্চল চোখের তারা, যেন সার্বক্ষণিক দ্বিধায় অস্থির। ধূসর প্যান্ট পরনে, পায়ে কালো চকচকে জুতো। মূল বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে। কেমন একটা কর্তৃত্বময় ভঙ্গি, যেন কোম্পানিটার মালিক সে-ই।
সাইকেলওয়ালার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে, নিচু গলায় বললো রবিন।
বাড়িটায় গিয়ে ঢুকলো সে।
ঘড়ি দেখলো মুসা। গাড়ির নম্বরটা নিয়ে রাখা দরকার। পুলিশ আসার আগেই চলে যেতে পারে।
নোটবুকে নম্বর লিখছে মুসা, এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল চত্বরে বেরোনোর দরজা, প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলো লম্বা লোকটা। দ্রুতপায়ে চত্বর পেরিয়ে এগোলে মূসা আর রবিন যে গুদামটায় লুকিয়ে আছে সেটার দিকে।
আরি, এদিকেই তা আসছে! আঁতকে উঠলো রবিন।
লুকানোর জায়গা খুঁজতে শুরু করলো দুজনেই।
জলদি! মুসা বললো, শেলফের নিচে!
দরজার কাছেই একটা বড় বাক্সের পেছনে শেলফের নিচে কিছুটা খালি জায়গা পাওয়া গেল লুকানোর মতো। হামাগুড়ি দিয়ে কোনোমতে তার মধ্যে গিয়ে ঢুকলো দুজনে।
এতো জোরে দরজা খুললো তরুণ, দড়াম করে গিয়ে পাল্লাটা বাড়ি খেলো দেয়ালের সঙ্গে। কোনো দিকে না তাকিয়ে দুটো শেলফের মাঝখান দিয়ে পেছন– দিকে প্রায় দৌড়ে গেল সে। ওর জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও কানে আসছে গোয়েন্দাদের। আবার যখন বেরিয়ে এলো, মাথায় ক্যাপ পরা, বিচিত্র। চশমাটা ঝুলছে গলায়, সাইকেল চালানোর কাপড়গুলো ঢোকানো ব্যাকপ্যাকে। ব্যাগটা ঝুলছে সাইকেলের হ্যান্ডেলবারে।
সমস্ত প্রমাণ নিয়ে যাচ্ছে! হিসিয়ে উঠলো মুসা। নষ্ট করে ফেললে গেল! আর প্রমাণ করা যাবে না সে-ই কাঁচ ভাঙতো!
থামানো তো যাবে না! যা খুশি করে বসতে পারে!
কিন্তু ততক্ষণে বেরোতে শুরু করে দিয়েছে মুসা। একবার দ্বিধা করে রবিনও তাকে অনুসরণ করলো।
জিনিসগুলো গাড়িতে তুলছে ব্যাটা! আরেকবার হিসিয়ে উঠলো মুসা।
গাড়ির পেছনের বুটে সাইকেলটা ঢোকানোর চেষ্টা করছে ও।
আমার কাছে তো মোটেও ভয়ঙ্কর লাগছে না লোকটাকে, মুসা বললো। অতো ভয় পাচ্ছি কেন? রবিন প্রতিবাদ করার আগেই লাফিয়ে উঠে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
তাকে দেখেই সাইকেলটা ফেলে দিলো লোকটা। তাড়াতাড়ি গিয়ে উঠে বসলো গাড়িতে। ছুটতে শুরু করলো মুসা।
ফিরে তাকালো আবার লোকটা। জানালা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ডান হাত। হাতে ধরা বিকট চেহারার একটা পিস্তল।
মুসার দিকে তাক করেছে!
১৫.
মডার্ন গ্লাস কোম্পানি! ভুরু কুঁচকে বললেন আরিফ সাহেব। অসম্ভব! কিশোর, ওটার মালিককে আমি ভালো করেই চিনি। ভদ্রলোক।
কিন্তু আমাদের কাছে প্রমাণ আছে, জোর গলায় বললো কিশোর। মুসা আর রবিন দেখতে পেয়েছে।
ভুল করছিস না তো?
না।
এক মুহূর্ত গম্ভীর হয়ে রইলেন আরিফ সাহেব। চুপচাপ ভাবলেন। তারপর হাত বাড়ালেন ফোনের দিকে।
তিনি যতোক্ষণ থানার সঙ্গে কথা বললেন, ততক্ষণ অস্থির হয়ে পায়চারি করলো কিশোর। সোফায় বসে উসখুস করছে উত্তেজিত কচি। ঘড়ি দেখছে বার বার। শেষে আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললো, কিশোর, ওরা কোনো বিপদে পড়বে না তো?
এসব কাজে সব সময়ই বিপদ থাকে, ভারি গলায় জবাব দিলো কিশোর। বিশেষ করে যখন কোনো প্রমাণ আটকাতে যাও তুমি। আর সেই সাথে যুক্ত থাকে লাখ লাখ টাকার ব্যাপার।
এই সময় রিসিভার রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আরিফ সাহেব। বললেন, ও রেডি। চলো, থানায় যাবো। আমরা গেলেই ওরা রওনা হবে।
তুমি শিওর তো, কিশোর? কাঁচ কোম্পানির দিকে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন সার্জেন্ট। কোম্পানির কোনো লোকেরই কাজ এসব?
এছাড়া আর কি? শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। ভালোমতো ভাবলে। আপনারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন। ওরাই একমাত্র কোম্পানি, যারা টয়োটা গাড়ির কাঁচ আমদানী করে। কাঁচ ভাঙলে নতুন কাঁচ লাগাতেই হবে, নইলে গাড়ি চালানো যায় না। যতো বেশি কাঁচ বিক্রি করতে পারবে ততো বেশি লাভ কোম্পানির।
শরাফত সাহেব্বে মতো ভদ্রলোক এরকম কাজ করবেন, আমার বিশ্বাস হয় না।
হয়তো তিনি জানেনই না যে এসব ঘটছে। আর হয়তো বলছি কেন, সত্যি তিনি জানেন না। ব্যাপারটা ফাস হয়ে গেল কেলেঙ্কারি হবে, তাঁর ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে। গাড়ির কাঁচ কিছু বেশি বিক্রি হলে লাভ হবে বটে, কিন্তু যেটুকু হবে, জানাজানি হয়ে গেলে ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি। সামান্য ওই লাভের জন্যে তিনি পুরো ব্যবসার ওপর ঝুঁকি নেবেন না।
ঠিকই বলেছিস তুই, কিশোর, আরিফ সাহেব বললেন। জীপে পুলিশের গাড়িতে না বসে আরিফ সাহেরে গাড়িতেই বসেছেন ওসি সাহেব। জীপে অন্যান্য পুলিশদের সঙ্গে রয়েছেন সার্জেন্ট আবদুল আজিজ। রেডিওতে ওসির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন তিনি।
মডার্ন গ্লাস কোম্পানির কাছে চলে এলো ওরা। কিশোর বললো, পাশের দরজাটা দেখছি খোলাই আছে।
মাথা ঝাঁকালেন ওসি। রেডিওতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন সার্জেন্টকে। গ্লাস কোম্পানির পাশের গেটের দিকে ঘুরলো পুলিশের জীপ, এই সময় শাঁ করে বেরিয়ে এলো একটা নীল রঙের টয়োটা। পুলিশ দেখে যেন চমকে গেল। বেসামাল হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্যে, ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। তারপর শাঁই শাই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলে, অনেকখানি রবার ক্ষয় করে না ঘুরিয়ে ফেললো অন্যদিকে।
গেট দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো রবিন। পুলিশের গাড়ি দেখেই বুঝে গেল যা বোঝার। পাগলের মতো চিৎকার করে দুই হাত শূন্যে তুলে নাড়তে শুরু করলো। নীল গাড়িটা দেখিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো, মুসাকে ধরে নিয়ে গেছে! মুসাকে ধরে নিয়ে গেছে!
রেডিওতে চিৎকার করে উঠলেন ওসি, ধরো,ধরো, গাড়িটাকে থামাও!
নীল টয়োটার পেছনে ছুটলো পুলিশের জীপ। যেদিকে গেছে গাড়িটা, সে পথটা শেষ হয়ে গেছে খানিক দূর গিয়েই। তারপরে জলা। একপাশে ফসলের খেত। মাঝে মাঝে নতুন মাটি ফেলা হয়েছে বাড়ি তোলার জন্যে। উঁচু হয়ে আছে ভিটেগুলো।
জলার ধারে গিয়ে থেমে গেল গাড়ি। ভেতর থেকে কামানের গোলার মতো ছিটকে বেরোলো নীল জ্যাকেট পরা এক তরুণ। ভয়ার্ত চোখে একবার পুলিশের গাড়ির দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে গিয়ে নামলো খেতের মধ্যে। এঁকেবেঁকে দিলো দৌড়।
ধরো! ধরো! চেঁচিয়ে আদেশ দিলেন ওসি।
কিন্তু জীপ থামিয়ে পুলিশ নামার আগেই নীল গাড়িটা থেকে ছিটকে বেরোলে। আরেকজন। তাড়া করলো লোটাকে। মুসা আমান। নিয়মিত ব্যায়াম করা শরীর তার, তাছাড়া দৌড়াতে পারে খুব। লাফিয়ে ছুটলে খেতের ওপর দিয়ে। দ্রুত দূরত্ব। কমে আসছে দুজনের মাঝে। দৌড়ানোর অভ্যাস বোধহয় খুব একটা নেই তরুণের, তাছাড়া পায়ে রয়েছে চামড়ার জুতো। চষা-খেতের ওপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে। কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলো।
লোকটার কয়েক ফুট পেছনে থাকতেই মাথা নিচু করে ডাইভ দিলো মুসা। তার বিখ্যাত ফ্লাইং ট্যাক। কায়দাটার একটা গালভরা বাংলা নাম দিয়েছে কিশোরঃ উড়ুক্কু মানব বর্শা।
পিঠে যেন মুগুরের বাড়ি পড়লে তারুণের। মুসার ভীষণ শক্ত খুলির প্রচণ্ড আঘাতে হাত-পা ছড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে থেতের ওপর পড়ে গেল সে। পরমুহূর্তেই হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে বসলো আবার। কিন্তু দাঁড়াতে পারলো না। তার এক পা আঁকড়ে ধরেছে মুসা।
গায়ের জোরে ঝাড়া দিয়ে পা-টা ছাড়িয়ে নিতে না নিতেই আরেক পা ধরে। ফেললো মুসা। হ্যাঁচকা টানে চিৎ করে ফেলে দিলো তাকে। লোকটা আবার উঠে বসার আগেই পৌঁছে গেল পুলিশ। ঘিরে ফেললো।
মাটির ওপরই পা ছড়িয়ে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে মুসা। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলো সার্জেন্ট আজিজের ওপর চোখ পড়তে। হাত তুলে তরুণকে দেখিয়ে বললো, এই যে নিন আপনার কাঁচ ভাঙুরে।
দুদিক থেকে দুহাত চেপে ধরেছে পুলিশ। ঝাড়াঝুঁড়া দিয়ে ছাড়া পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো তরুণ। খেঁকিয়ে উঠলো, মিথ্যে কথা! আমি কিচ্ছু জানি না। আমাকে কেন ধরেছে! কিছুই করিনি আমি এই ব্যাটাই চুরি করতে। ঢুকেছিলো আমাদের গুদামে!।
হাসি মুছলো না মুসার মুখ থেকে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ওর গাড়িতে গিয়ে দেখুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন।
গালাগাল শুরু করলো তরুণ। তাকে জীপের দিকে টেনে নিয়ে চললো পুলিশ। ওখানে নীল টয়োটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রবিন।
গাড়ির মধ্যে পাওয়া গেল ক্যাপ, চশমা, ব্যাকপ্যাক, তার ভেতরে রেডিও আর হেডফোন। সাইকেল চালানোর পোশাকগুলোও রয়েছে ব্যাগে। কিশোরের অনুমান। ঠিক, চশমাটা ফীল্ড গ্লাসই, চোখে লাগালে রাতের অন্ধকারেও সব দেখা যায়।
ওরা ইচ্ছে করে এগুলো আমার গাড়িতে ভরে রেখেছে। চেঁচিয়ে উঠলো তরুণ। আমাকে ফাসানোর জন্যে!
জিনিসগুলো যে আপনার, প্রমাণ করা যাবে সেটা, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। আপনার কোম্পানির লোকই সাক্ষী দেবে আশা করি। সাইকেলটা পড়ে আছে চত্বরে। সেটা আপনার, অফিসের সবাই জানে। ওটাতে, সিরিয়াল নম্বর রয়েছে। কোন দোকান থেকে কিনেছেন, সহজেই বের করা যাবে।
ওসবের দরকারই নেই আসলে, মুসা বললো। বড় প্রমাণটা রয়েছে ওর গাড়ির সামনের সীটের নিচে। ঢুকিয়ে রাখতে দেখেছি। এয়ার-পিস্তলটা। আঙুলের ছাপও পাওয়া যাবে তাতে।
চুপ হয়ে গেল তরুণ।
সীটের নিচ থেকে সাবধানে রুমালে চেপে ধরে পিস্তলটা ব্রে করে আনলেন ওসি। মোটা খাটো নল। নলের নিচে আরেকটা নলের মতো পাইপ। ওটায় চাপ দিয়ে ভেতরের স্প্রিংটাকে ভাঁজ করা যায়। ইস্পাতে তৈরি নীলচে চকচকে অস্ত্রটার ওজন বড়জোর দুই পাউণ্ড। খোদাই করে লেখা রয়েছে কোম্পানির নাম ও দি ওয়েবলি প্রিমিয়ার। তার নিচে অপেক্ষাকৃত ছোট অক্ষরে লেখা, মেড ইন ইংল্যাণ্ড।
হু, পয়েন্ট টু-টু ক্যালিবার, দেখতে দেখতে বললেন আরিফ মামা। এই জিনিস একটা ছিলো আমার। সাংঘাতিক শক্তি ম্প্রিঙের। কাছে থেকে গুলি করলে গাড়ির কাঁচ সহজেই গুঁড়িয়ে দেয়া যায়।
তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালেন ওসি সাহেব। তরুণকে দেখিয়ে পুলিশদের নির্দেশ দিলেন, নিয়ে এসো ওকে। শরাফত আহমেদের সঙ্গে কথা বলবো।
হাঁটতে হাঁটতে জানালো রবিন আর মুসা, কিভাবে গুদামের মধ্যে তরুণের ব্যবহার করা জিনিসগুলো খুঁজে পেয়েছে। কি করে সেগুলো নিয়ে পালানোর চেষ্টাটা করেছিল সে। মুসা বাধা দিতে গেলে কিভাবে তাকে পিস্তল দেখিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়েছে।
পালাচ্ছে দেখে খেপে গিয়েছিলাম, কৈফিয়তের সুরে বললো মুসা। আসলে ওকে দেখে একটুও বিপজ্জনক লোক মনে হয়নি আমার। বরং মনে হচ্ছিলো খুব ভীতু। ধরার জন্যে বেরোলাম। এয়ার পিস্তল দেখিয়ে ঠেকালো আমাকে। গাড়িতে উঠতে বাধ্য করলো। চিনতে পেরেছি তখনি, ওটা এয়ার পিস্তল। জানি, ক্লোজ রেঞ্জে আসল পিস্তলের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি চালিয়ে সহজেই মানুষ মেরে ফেলা যাবে। কি আর করবো, উঠে বসলাম। গেট দিয়ে বেরিয়েই আপনাদের দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল ওর। দিলো আরেক দিকে টান।
হই চই, পুলিশের বাঁশি, সবই শুনতে পেয়েছে গ্লাস কোম্পানির লোকেরা। পাশের গেটের বাইরে বেরিয়ে জটলা করছে। পুলিশের সঙ্গে তরুণকে দেখে ভুরু কুঁচকে গেল কয়েকজনের। ওরা সবাই অফিসের কর্মচারী। একজন ফিরে দৌড় দিলো অফিসের দিকে।
চত্বরে ঢুকলো পুলিশ। এই সময় অফিসের কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন মাঝবয়েসী মানুষটা। এঁকেই কাঁচে ঘেরা ছোট অফিসে একলা বসে থাকতে দেখে কিশোর আর কচি। নাকমুখ কুঁচকে ভারি গলায় জানতে চাইলেন, কি হয়েছে?
আপনি? পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
আমি শরাফত আহমেদ। এই কোম্পানির মালিক।
ও। একে চেনেন?
চিনবো না কেন? আমার ছেলে, রনটু। কি করেছে ও?
টেন-স্পীডটা ঠেলে নিয়ে এসেছে একজন কনস্টেবল। সেটা দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন ওসি, এই সাইকেলটা কি আপনার ছেলের? আর এই ক্যাপ, চশমা…
আব্বা, বলো না, বলো না, কিছু বলো না! চেঁচিয়ে বাধা দিলো রনটু।
ছেলের দিকে অবাক হয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন শরাফত আহমেদ। তারপর ওসির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন, হ্যাঁ, ওরই। কেন? ব্যাপারটা কি? কি করেছে ও?
বাবার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলো ছেলে। তার মুখের দিকে চেয়ে কি বুঝলেন শরাফত সাহেব, কে জানে। হাত নেড়ে সবাইকে ডাকলেন, ভেতরে আসুন। বসে কথা বলি।
শরাফত সাহেব, আরিফ সাহেব বললেন, শুনলে দুঃখ পাবেন। আপনার ছেলে যে কাজ করেছে… এয়ার পিস্তল দিয়ে কিভাবে একের পর এক গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে খুলে বললেন তিনি।
গাঙির কাঁচ ভেঙেছে! বিড়বিড় করলেন শরাফত আহমেদ। হু, বুঝতে পারছি, কেন করেছে এই কাজ। দুঃখের সুরে বললেন তিনি, কলেজে দিয়েছিলাম। পড়ালেখা করলো না। বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে বখে গেল। ভাবলাম, এনে ব্যবসায় লাগিয়ে দিই। কিছু দিন কিছুই করলো না। রেগেমেগে শেষে একদিন। হুঁশিয়ার করে দিলাম, ঠিকমতো কাজ দেখাতে না পারলে বাড়ি থেকেই বের করে। দেবো। সম্পত্তির একটা কানাকড়িও দেবো না। তারপর হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। গত তিনমাস ধরে তো চমৎকার কাজ দেখাচ্ছিলো। সেলস ম্যানেজার বানিয়ে দিয়েছিলাম। এমন ভাবে গাড়ির কাঁচ বিক্রি শুরু করলো, আমি তো ভাবলাম… হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, অথচ…এই কাজ করেছে! নিজেই গাড়ির কাঁচগুলো ভেঙে দিয়ে এসেছে, যাতে মালিকেরা কিনতে বাধ্য হয়। ইস্, রনটু, তুই এভাবে আমার মুখে চুনকালি মাখালি…,
ওদের কথা বিশ্বাস করো না, আব্বা! প্রতিবাদ করলো রনটু। কি বলছে তাই বুঝতে পারছি না। ওরা শত্রুতা করছে আমার সঙ্গে, তিন গোয়েন্দাকে দেখালো সে। আমার জিনিসগুলো চুরি করে নিয়ে গাড়িতে ভরে রেখেছে আমাকে ফাসানোর জন্যে! প্রমাণ করতে পারবে আমি ভেঙেছি? কেউ দেখেছে?
পারবো! জোর দিয়ে বললো রবিন। চোরাই ঈগলটা খুঁজে পেলেই হয়।
চোখ মিটমিট করলেন শরাফত আহমেদ। চোরাই ঈগল! ঈগল পাখিও চুরি করেছে!
পাখি নয়, ব্যাখ্যা করলো কচি, একটা দুর্লভ মুদ্রা। উনিশশো নয় সালে তৈরি। একটা আমেরিকান বিশ ডলারের সোনার মোহর, ডাবল ঈগল বলে ওটাকে। গাড়ির জানালা ভেঙে চুরি করেছে ওটা আপনার ছেলে। অনেক দাম…
মোহর চুরি করেছে! শরাফত আহমেদের গলা কেঁপে উঠলো। আমার ছেলে চোর!
ফ্যাকাশে হয়ে গেছে রনটুর চেহারা। বললো, বিশ্বাস কোরো না, আব্বা! গলায় জোর নেই তার। এটাও আমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। বেশ, স্বীকার করছি, গাড়ির কাঁচ ভেঙেছি আমি। কিন্তু কক্ষনো মোহর চুরি করিনি! খোদার কসম! আমাদের ব্যবসা খারাপ হয়ে গেছে, তাই বাড়াতে চেয়েছিলাম। বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মোহর আমি চুরি করিনি!
অনেকক্ষণ থেকেই একেবারে চুপ হয়ে আছে কিশোর। শুনছে কথাবার্তা। হঠাৎ এখন রনটুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠলো, না, আমারও বিশ্বাস, আপনি চুরি করেননি!
.
১৬.
কিশোরের কথা শুনে হাঁ হয়ে গেল তার বন্ধুরা। প্রথমে কথা খুঁজে পেলো রবিন, ঈগলটা ও চুরি করেনি?
কিশোর? ভুরু কোঁচকালেন আরিফ সাহেব। ব্যাপারটা কি বল তো? তুই জানিস কে চুরি করেছে?
ধীরে ধীরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো কিশোর, আমি এখনও শিওর না।
শিওর না হলে বলা উচিত না।
ঈগলটা যে শরাফত সাহেরে ছেলে চুরি করেনি, এটা শিওর। কে করেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে চেষ্টা করলে হয়তো ধরে ফেলতে পারবো।
তারমানে তুই বলতে চাইছিস যে কাঁচ ভাঙে সে মোহর চোর নয়?
না। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে।
সেটা কি? অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা।
এ ধরনের অপরাধকেই বলে কপিক্যাট ক্রাইম, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর।
কি ক্রাইম! নাকমুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো কচি।
বাংলা মানে বোধহয় করা যাবে না এর, কিশোরের হয়ে জবাবটা দিলেন আরিফ সাহেব। তবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, একই সময়ে দুটো অপরাধ ঘটলো। আগে থেকেই ঘটছে এ রকম একটা অপরাধ আরও একবার ঘটলো। ঠিক ওই সময়ে আরেকজন অপরাধী আরেকটা অপরাধ ঘটালো। এমন ভাবে, যাতে মনে হয় দুটোই একজনের কাজ। দ্বিতীয় কোনো অপরাধী যে আছে এটা সহজে বোঝা যাবে না।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। গাড়ির কাঁচ ভাঙার খবরটা জানা ছিলো আমাদের এই দ্বিতীয় অপরাধীর। কাজেই সুযোগ বুঝে আকবর সাহেবের গাড়ির জানালা ভেঙে ঈগলটা চুরি করেছে সে। আশী করেছে, দোষটা গিয়ে পড়বে যে কাঁচ ভাঙে তার ঘাড়ে।
হ্যাঁ, এ রকম অপরাধ অনেক সময়ই ঘটে, এবার মুখ খুললেন ওসি সাহেব। কিশোরের বুদ্ধি, জ্ঞান আর কথাবার্তা রীতিমতো অবাক করেছে তাকে। কি করে বুঝতে পারলে সেটা?
সবার মুখের দিকে তাকালো একবার কিশোর। তারপর বললো, গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিলো, এই কেসে আরও একজন জড়িত রয়েছে। আড়িপেতে আমাদের কথা শুনেছে। কোন ভাবে আমাদের কথা জেনে গিয়েছিল সে, সে জন্যেই শুনতে চেয়েছে আমাদের কথা। টেলিফোন লাইনে ওয়্যারট্যাপ লাগিয়ে দিয়েছে। হুঁশিয়ার করে দিয়েছে রনটুকে যে সারা শহরে ভূত-থেকে-ভূতে চালু হয়ে গেছে, ভূতেরা শুরু করে দিয়েছে কাজ। ব্যাপারটা সম্পর্কে শিওর হতে পারতাম না আমি, যদি সে ছোট্ট একটা রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারতো। ভেবেছে আমাদের নিয়ে খানিকটা মজা করবে। ফোনে আমাদের খবর দিয়েছে যে কাঁচ ভাঙুরা ধরা পড়েছে। যা-ই হোক, আমাদের ঠকিয়েছে সত্যি, তবে ফাঁকিটাতে সে নিজেই পড়ে নিজেকে ফাস করে দিয়েছে।
অবাক হয়ে কিশোরের কথা শুনছেন ওসি সাহেব। ছেলেটার কিছু কিছু কথা বুঝতে পারছেন না। এই যেমন ভূত-থেকে-ভূতে। তবে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কিশোরের কথা থেকে আন্দাজ করে নেয়ার অপেক্ষায় আছেন।
ওরা কি একসঙ্গে কাজ করতো? রবিন জানতে চাইলো। মানে, পার্টনার?
মাথা নাড়লো কিশোর। না। রনটুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি, ঠিক বলিনি?
মাথা নেড়ে সায় জানালো রনটু।
পার্টনার না হলে, আবার জিজ্ঞেস করলো রবিন, তাকে হুঁশিয়ার করতে গেল কেন দ্বিতীয় লোকটা?
এ তো সহজ কথা, হাত ওল্টালো কিশোর। রনটু ধরা পড়লেই পুলিশ জেনে যাবে ঈগলটা সে চুরি করেনি। আসল চোরকে খুঁজতে শুরু করবে তখন। সেই ভয়েই তাকে ওয়্যারলেসে হুশিয়ার করে দিয়েছে চোর যে, তার ওপর সন্দেহ পড়েছে। প্রমাণ খোঁজা হচ্ছে। ব্যস, তাড়াতাড়ি এসে সেগুলো সরানোর চেষ্টা। করেছে রনটু। তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, তাই না?
আবার মাথা ঝাঁকালো, রনটু। তাজ্জব হয়ে গেছে, তার চোখ দেখেই অনুমান করা যায়।
কে করেছে, নিশ্চয় জানেন না?
না।
ওসি সাহেব বললেন, তাহলে ধরে নেয়া যাচ্ছে, আরেকজন আছে। কে, জানো নাকি? ধরতে পারবে?
সরাসরি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বললো, ইলেকট্রনিকসে তার। অসাধারণ জ্ঞান। মনে হয় ধরতে পারবো। আজ বিকেলেই। যদি আমাকে সাহায্য করেন।
কিশোরের ওপর বিশ্বাস জন্মে গেছে ওসি সাহেবের। তবু দ্বিধা করলেন। আরিফ সাহেবের দিকে তাকালেন একবার। তারপর বললেন, বেশ, করবো। শরাফত আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সরি, শরাফত সাহেব, আপনার ছেলেকে থানায় নিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। জামিন চাইলে হয়তো পাবেন। উকিলের সঙ্গে কথা বলুন।
গম্ভীর হয়ে বললেন শরাফত আহমেদ, নিয়ে যান। যে ছেলে বাপের নাক-কান কাটে, তাকে ছাড়িয়ে আনতে যাচ্ছি না আমি।
কিন্তু আব্বা, মরিয়া হয়ে বললো রনটু, তুমি বুঝতে পারছে না, ব্যবসার উন্নতির জন্যেই আমি একাজ…
ব্যবসার উন্নতির জন্যে এসব করতে বলা হয়নি তোমাকে! কড়া গলায় বললেন শরাফত সাহেব। ওসি সাহেব, নিয়ে যান। যা শাস্তি হয় তোক। ওর শাস্তি হওয়াই উচিত। বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। চোখের কোণে জল।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন আরিফ সাহেব। আস্তে বললেন, জীবনে কতো যে ঘটনা দেখলাম! সন্তান মানুষ না হলে… কথাটা শেষ করলেন না তিনি। কিশোরের দিকে তাকালেন, তা চোরটা কে, বললি না তো?
ডলি খান, বোমা ফাটালো যেন কিশোর। মিস্টার আকবর আলি খানের মেয়ে।
.
১৭.
কিশোরের ওপর ভীষণ রেগে গেল ডলি। আকবর সাহেরে বসার ঘরে বসেছে সবাই-আকবর সাহেব, তাঁর মেয়ে ডলি, তিন গোয়েন্দা, কচি, ওসি সাহেব, আরিফ সাহেব। রনটুকে নিয়ে পুলিশের জীপে করে থানায় চলে গেছেন সার্জেন্ট আজিজ।
কাজটা আপনিই করেছেন, শান্তকণ্ঠে আবার বললো কিশোর। আরো আগেই বোঝা উচিত ছিলো আমার।
কিন্তু একাজ কেন করবে আমার মেয়ে? হাতের লাঠিটা সজোরে মেঝেতে ঠকলেন আকবর সাহেব।
আপনার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করুন।
না, আমি তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
আসলে মেয়ের কোনো খোঁজখবর রাখেন না তো আপনি, আছেন নিজেকে নিয়ে আর আপনার মুদ্রা নিয়ে, নইলে অনেক আগেই বুঝতে পারতেন। কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গেই বললো কিশোর। আকবর সাহেবের দুর্ব্যবহার অনেক সহ্য করেছে সে, আর নয়। ডলির দিকে তাকিয়ে বললো, দয়া করে আপনার কামিজের হাতাটা একটু তুলবেন?
রেগে গেলেন আকবর সাহেব। কেন, কামিজের হাতা তুলবে কেন? ফাজলেমি করার আর জায়গা পাওনি!
আমি ফাজলেমি করছি না। তুলতে বলুন, নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।
কি দেখতে পাবো?
আগে তো তুলুক।
কিন্তু দ্বিধা করতে লাগলো ডলি।
কি হলো? ডলির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো কিশোর। তুলুন।
ধীরে ধীরে ডান হাতের হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটালো ডলি। চোখ নামিয়ে রেখেছে। তার হাতের কালো কালো দাগগুলো সবাই দেখলো। সবাই বুঝতে পারলো কিসের দাগ ওগুলো, শুধু কচি আর আকবর সাহেব ছাড়া। তিনি বললেন, তুললো তো, এখন কি হলো?
ধৈর্য হারালেন ওসি। আকবর সাহেবের কাটা কাটা কথা তারও পছন্দ হচ্ছে না। কঠিন কণ্ঠে বললেন, কেন, বুঝতে পারছেন না?
না, পারছি না! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন আকবর সাহেব।
আরিফ সাহেব বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে আপনার মেয়ের, জানেনই না আপনি! ও ড্রাগ অ্যাডিক্ট। সর্বনাশা নেশার জালে জড়িয়ে পড়েছে আপনার মেয়ে। ওগুলো ইঞ্জেকশনের সুচের দাগ।
হঠাৎ যেন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন আকবর সাহেব। এলিয়ে পড়লেন। সোফায়। বোকার মতো চেয়ে রয়েছেন মেয়ের হাতের দাগগুলোর দিকে। স্তব্ধ হয়ে গেছেন।
এবার কি আর অস্বীকার করবেন, ডলির দিকে চেয়ে কোমল গলায় বললো কিশোর, হেরোইন কেনার টাকার জন্যে ঈগলটা চুরি করেননি আপনি?
জবাব দিলো না ডলি। মাথাটা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর।
আমেরিকায় গিয়ে এই নেশার শিকার হয়েছেন, তাই না?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো ডলি। পড়তে গিয়েছিলাম। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এই সর্বনাশ হয়েছে আমার। আব্বা টাকা পাঠাতে পড়ার জন্যে, আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে খরচ করতাম নেশার পেছনে। তাতেও কুলাতো না। নানান অসুবিধায়। পড়লাম। শেষে বাধ্য হয়ে চলে এসেছি দেশে।
ইলেকট্রনিকসে আপনার অসাধারণ জ্ঞান। ওই স্যাটেলাইট ডিশটা আপনারই, তাই না?
হ্যাঁ। আব্বা আনিয়ে দিয়েছে আমেরিকা থেকে। আমার শখ দেখে। সিবি রেডিও, হ্যাম রেডিও, টিভি, সব কিছুরই অ্যান্টেনা হিসেবে ব্যবহার করি আমি ডিশটা।
আমাদের কথা শোনার জন্যে টেলিফোন লাইনে ওয়্যারট্যাপ আপনিই লাগিয়েছিলেন?
না। সানি লাগিয়ে দিয়েছে। ও আমাকে ভালোবাসে। সে জন্যে যা করতে বলি তা-ই করে। আমার ড্রাগ নেয়ার কথাও জানে। অনেক চেষ্টা করেছে। ছাড়ানোর জন্যে। আমি মানা করেছি, তাই বলেনি আব্বাকে। গোপন রেখেছে।
এখন কোথায় সে?
বাইরে কোথাও গেছে।
আচ্ছা, আপনার আব্বা আমাদেরকে কাজে লাগাতে চান একথা বলে ফোনটা। করেছিলো কেন সানি? জবাবের অপেক্ষা না করে নিজে নিজেই বললো কিশোর, নিশ্চয় নিজেদেরকে সন্দেহমুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। অপরাধী প্রায়ই ভাবে, এই বুঝি কেউ তাকে সন্দেহ করে বসলো। আপনারও হয়েছিলো সেই অবস্থা। আপনি ধরেই নিয়েছিলেন, আমরা আপনাকে সন্দেহ করছি। শিওর হওয়ার জন্যেই আসলে সেদিন ওকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমাদের বাড়িতে ডেকে এনেছিলেন? তাই না?
আস্তে মাথা ঝাঁকালো শুধু ডলি।
মোহর যে রাতে চুরি করেছেন, বলে গেল কিশোর, সে রাতে আপনিই গাড়ি চালিয়েছিলেন। আপনার আব্বা ভুলে বাক্সটা ফেলে রেখে চলে গেলেন। এই ফাঁকে আপনি তুলে নিলেন বাক্সটা। এতোই ছোট ওটা, যে জানে সে ছাড়া অন্ধকারে আর কারও চোখে পড়ার নয়। লুকিয়ে ফেললেন বাক্সটা। তারপর ভাঙলেন গাড়ির কাঁচ। ভাবখানা এমন, যেন অন্য কেউ এসে ভেঙে দিয়ে গেছে। গাড়ির কাঁচ ভাঙা যাচ্ছিলো কয়েক মাস ধরে, সেটা জানা ছিলো আপনার। সময় মতো সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন।
চুপ করে রইলো ডলি।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। এইই হয়। ড্রাগের নেশা এমনই ভয়ঙ্কর সে জিনিস পাওয়ার জন্যে সব কিছু করতে রাজি মানুষ। হিতাহিত জ্ঞান। হারিয়ে ফেলে। নিজের বাপের জিনিসও চুরি করতে বাধেনি আপনার। আপনার
জন্যে সত্যিই দুঃখ হচ্ছে আমার, মিস খান! মুদ্রাটা কি বিক্রি করে ফেলেছেন?
মাথা নাড়লো ডলি। এখনও বিক্রি করতে পারেনি।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, তো, এখন কি জিনিসটা বের করে দেকেন? দেখতাম।
নীরবে উঠে দাঁড়ালো ডলি।
তার পেছনে চললো সবাই।
সোজা পাশের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। এগোলো স্যাটেলাইট ডিশ্নে দিকে। ওটার কাছে এসে থামলো। কারো দিকে না তাকিয়ে ঝুঁকে বসে হাত ঢুকিয়ে দিলো ডিশের নিচে। টেপ দিয়ে আটকানো রয়েছে মুদ্রাটা। টেনে টেপ ছিঁড়ে খুলে আনলো ওটা। বাড়িয়ে দিলো কিশোরের দিকে।
.
১৮.
বিকেলে বাগানে চেয়ার পেতে বসেছে সবাই। আরিফ সাহেব, ওসি সাহেব, তিন। গোয়েন্দা আর কচি। মামী রান্নাঘরে ব্যস্ত। কাঁচ ভাঙার রহস্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বেশির ভাগ কথা কিশোরই বলছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন ওসি সাহেব।
আচ্ছা, কিশোর, জিজ্ঞেস করলেন তিনি, কি ভুলটা করেছিলো ডলি, যে জন্যে তোমার সন্দেহ হলো কচি যে ভাঙে সে মোহর চোর নয়?
দুটো কারণে, জবাব দিলো কিশোর। প্রথমত, পেছনের কাঁচ ভেঙেছে ডলি। আর দ্বিতীয় কারণ, ওদের গাড়িটা টয়োটা নয়। রনটু শুধু টয়োটার কাঁচই ভাঙতো। এ ব্যাপারটা জানা ছিলো না ডলির। ফলে ভুলটা করে বসেছে। বুঝে গেলাম একটা কপিক্যাট ক্রাইম ঘটেছে। পেছনের সীটে রাখা ছিলো বাক্সটা, তাই সেদিকের কাঁচটাই ভেঙেছে সে। কিন্তু রনটু ভাঙতে সামনের কাঁচ, উইগুশীল্ড।
আনাড়ি কপিক্যাট, মুচকি হাসলেন আরিফ সাহেব। বোকার মতো কাজ করে ব্রাটা পড়লো।
আরও একটা বোকামি করেছে আমাদের ফোন করে। এরকম করেই ব্রা পড়ে অপরাধী, এ-তো জানা কথাই। আকবর সাহেবের বাড়ি গিয়ে দুটো ব্যাপার জানলাম। একঃ আকবর সাহেব আমাদেরকে তদন্তে নিয়োগ করতে বলেননি। তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনাই করেনি ডলি আর সানি।
আর দ্বিতীয় ব্যাপারটা? মুসার প্রশ্ন।
হাফ-হাতা ব্লাউজ পরেছিলো সেদিন ডলি, নিশ্চয় মনে আছে তোমাদের?
কি জানি! মাথা চুলকালো মুসা।
মাথা নাড়লো রবিন, না, খেয়াল করিনি। কিন্তু তাতে কি?
গোয়েন্দাগিরি করছ এতোদিন, খেয়াল করা উচিৎ ছিলো, সুযোগ পেয়েই খানিকটা উপদেশ ঝেড়ে দিলো গোয়েন্দাপ্রধান। ডলির হাতে ইঞ্জেকশনের সুচের দাগ। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে সন্দেহ জাগলো। ধীরে ধীরে বুঝে ফেললাম, কে, কেন চুরি করেছে মুদ্রাটা।–
দরজায় দেখা দিলেন মামী। ডেকে বললেন, এই কিশোর, তোর ফোন।
ফোন? ভুরু কুঁচকালো মুসা। এখন আবার কে ফোন করলো?
দেখে আসি, উঠে দাঁড়ালো কিশোর।
কয়েক মিনিট পরে ফিরে এলো হাসিমুখে। চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তার দিকে তাকালো মুসা, রবিন আর কচি।
দাওয়াত, খবরটা জানালো কিশোর। দাওয়াত দিয়েছে গোড়ানের ছেলেরা। একটা ক্লাব করেছে ওরা, নাম দিয়েছে তিন গোয়েন্দা ক্লাব।
কি বলেছো? জানতে চাইলো কচি, যাবে?
নিশ্চয় যাবো। আগামী তেরো-চোদ্দ দিন প্রত্যেকটা পাড়ায় গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করবো। ওরা যে টেলিফোনের মাধ্যমে একটা অন্যায় কাজ বন্ধ করতে সাহায্য করেছে সে গল্প বলতে হবে না ওদেরকে?
কাল আমাকেও নিয়ে যেও, একদিন ফার্মে কাজ না করলে কিছু হবে না, বললো কচি। ওর হাতে শোভা পাচ্ছে পিকআপের চাবি।
নিশ্চয়।
সুখেই আছো, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ওসি সাহেব। ইস, বিশটা বছর যদি কমে যেতো বয়স আমার, ভিড়ে যেতাম তোমাদের দলে! এই কাজকর্ম, দায়িত্ব, টেনশন আর ভালো লাগে না!
তুমি তো তা-ও আরামেই আছো, একই রকম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আরিফ সাহেবও। কাজ করে সময় পার করে দাও। আমার কি অবস্থা ভাবো তো। সময় একদম কাটতে চায় না। কিশোরের দিকে তাকলেন তিনি। অনেকটা অনুরোধের সুরেই বললেন, এই কিশোর, কাল আমাকেও নিয়ে যাস তোদের সঙ্গে। গাড়িও পাবি, বিনা বেতনে একজন ড্রাইভারও। কি, নিবি আমাকে?
নেবো, মামা।