ঢাকাই রসিকতা
কলকাতা থেকে যেমন কলকাতিয়া কিংবা কলকাত্তাই, ঢাকা থেকে তেমন ঢাকাই। ঢাকাই মানে ঢাকার, অভিধান বলছে ঢাকা সম্পর্কিত। কিন্তু মানেটা আরও একটু বেশি। ঢাকাই বিশেষণপদটি সম্রমবহ।
দুয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি। আগে কলকাতা দিয়ে শুরু করি। কলকাতিয়া কথা, কলকাত্তাই বোলচাল। বিশেষণ দুটোয় কোথায় যেন একটা হেয়ভাব লুকোনো আছে।
‘ঢাকাই’ শব্দটিতে কিন্তু একটা উৎকর্ষের আভাস আছে। পরতে পরতে মুচমুচে ঢাকাই পরোটা। ঢাকাই শাড়ির কদরও কিছু কম নয়। তা ছাড়া আছে লেজফোলা ঢাকাই বিড়াল, পূর্ববঙ্গে সে বিড়াল কাবুলি বা শ্যামদেশীয় বিড়ালের মতোই বিখ্যাত। বোধহয় কাবুলি বিড়ালেরই বংশোদ্ভব এই বিড়ালকুল কোনও একসময়ে নবাবি আমলে ঢাকা বাসিন্দা হয়েছিল।
সে যা হোক, আমাদের বিষয় হল ঢাকাই রসিকতা। ভূমিকা হিসেবে বলতে পারি, অন্যান্য ঢাকাই দ্রব্যের মতোই ঢাকাই রসিকতাও অতি উচ্চমানের।
হাতে পাঁজি, মঙ্গলবার বলে একটা কথা আছে না? সরাসরি উদাহরণে চলে যাই। তবে একটা কথা বলে রাখি, সাধারণত এসব রসিকতা ঢাকার স্থানীয় ভাষায় বলা হয়। তবে সে ভাষা খুবই জটিল এবং খোদ ঢাকা শহরেই সে রকম ভাষায় কথা বলা লোক এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া এইসব রসিকতার উৎস যে কুট্টি সমাজ তারাও সকলের অগোচরে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
নবাবি জমানায় কুট্টিরা ওই ঢাকাই বিড়ালের মতোই ঢাকায় বাস করতে শুরু করে। তাদের বিষয়ে অনেক রকম উলটোপালটা ইতিহাস আছে। শেষপর্যন্ত এদের পেশা হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি চালানো। ফলের বাজারে ব্যাপারি বা ফেরিওয়ালার কাজও করত। স্বভাবত সুরসিক প্রখর বুদ্ধিমান এই কুট্টিসমাজ পূর্ববঙ্গীয় গালগল্পে অমর হয়ে আছে।
এবার সহজবোধ্য করার জন্যে আমি আমার ভাষায় কুট্টিদের গল্প বলি।
বাজারে এক ভদ্রলোক আম কিনতে গেছেন। আমওয়ালা একজন কুট্টি। যে কোনও ফলওয়ালার মতোই সে পছন্দ করে না যে খদ্দের ফল নিয়ে খুব ঘাঁটাঘাঁটি করুক বা টিপেটিপে পরীক্ষা করে দেখুক।
এই খদ্দের ভদ্রলোক কিন্তু নাছোড়বান্দা। তিনি কুট্টির বাধা সত্ত্বেও ফল টিপে টিপে দেখতে লাগলেন। তখন সেই কুট্টি চেঁচিয়ে অন্য আমওয়ালাদের বলতে লাগল, ‘ওরে তোরা আয়। তোদের আমের কোনও রোগ-বালাই থাকলে এখানে নিয়ে আয়। বাজারে আমের ডাক্তার এসেছে। তাকে দিয়ে টিপিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে যা।’
এর চেয়েও অনেক বেশি মারাত্মক হল কুট্টি মাছওয়ালা।
মাছওয়ালা যে মাছগুলি নিয়ে বাজারে এসেছে সেগুলো বিশেষ তাজা নয়।
এক ভদ্রলোক মাছগুলো উলটেপালটে দেখে অবশেষে কুট্টিকে বললেন, ‘মাছগুলো টাটকা নয় বলে মনে হচ্ছে।’
সঙ্গে সঙ্গে কুট্টির প্রতিবাদ, ‘বলেন কী কর্তা? এই মাছ এখনই খালের জলে ছেড়ে দিলে সাঁতরিয়ে চলে যাবে।’
কিন্তু একথা খদ্দের বিশ্বাস করবেন কেন? তিনি সংশয় প্রকাশ করলেন, ‘মরা মাছ জলে সাঁতরাবে?’
কুট্টি বলল, ‘কর্তা, আপনি ওই খালপারের টিনের বাড়িটায় থাকেন না?’ কর্তা বললেন, ‘তাতে কী হল?’
কুট্টি বলল, ‘আপনি দাম দিয়ে এই মাছটার গায়ে আপনার নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে যান। আমি জলে ছেড়ে দেব। দেখবেন ঠিকানা দেখে সাঁতরিয়ে আপনার বাসায় চলে যাবে।’
সৈয়দ মুজতবা আলি, আমার দেবাদিদেব, মহাগুরু। ঢাকার লোক ছিলেন না। একথাটা বলছি এই কারণে যে পূর্ববঙ্গ বা অধুনাতন বাংলাদেশ কিংবা সেই কায়েদে আজমি পূর্ব-পাকিস্তান বলতে চিরকাল সবাই ভাবেন ঢাকা। ঢাকার নয় শ্রীহট্টের লোক হয়েও কিন্তু সৈয়দ সাহেব একটি স্মরণীয় ঢাকাই রসিকতার উল্লেখ করেছিলেন। রসিকতাটি রাজনৈতিক এবং মর্মান্তিক।
তখন সদ্য পাকিস্তান হয়েছে। দলে দলে হিন্দু ভদ্রলোকেরা ঢাকা ছাড়ছেন, ভারতে চলে আসার জন্যে। অনেক সহৃদয় মুসলমান ছিলেন, যাঁদের হিন্দুদের এই চলে যাওয়াটা ভাল লাগেনি।
স্টিমারঘাটে এক হিন্দু পরিবার কুট্টির ঘোড়ার গাড়িতে চলে এসেছে, মালপত্র নামাচ্ছে। এমন সময় পরিচিত এক মুসলমান ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। হিন্দু পরিবারের কর্তাকে বোঝাতে লাগলেন দেশত্যাগ না করার জন্যে। অনেক অনুরোধ করার পরে বললেন, ‘দেখুন, এ দেশ শুধু মুসলমানদের নয়। পাকিস্তানের পতাকা দেখুন। তিনভাগ সবুজ, একভাগ সাদা। সবুজ হল মুসলমান, সাদা হল হিন্দু। আপনি দেশ ছাড়বেন কোন দুঃখে। আপনার জায়গাও তো এখানে রয়েছে।’
এমন সময় কুট্টি সেই হিন্দু পরিবারের কর্তাকে একটু আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলল, ‘কর্তা, বাঁচতে চান তো পালান। দেখছেন না, ফ্ল্যাগের ওই সাদা জায়গাটিতেই বাঁশটা দিয়েছে।’
পাঠক, একবার পাকিস্তানের পতাকা স্মরণ করুন। চাঁদতারা শোভিত তিনভাগ সবুজ, পাশে একভাগ সাদা— যার মধ্য দিয়ে বংশদণ্ড ঢুকিয়ে পতাকা ওড়ানো হয়। অতঃপর সেই কুট্টির ভবিষ্যৎ জ্ঞানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করুন।
ঢাকাই কুট্টির গল্পগুলির অধিকাংশই কোচম্যান কুট্টিকে নিয়ে। সব উল্লেখ করতে গেলে কাগজ কাবার হয়ে যাবে। আর সবই কি আমি জানি?
যা জানি তার থেকে দুটো গল্পের উল্লেখ করছি।
সে সময় ঢাকা শহরের তদানীন্তন মেয়র সাহেবের উদ্যোগে পশুক্লেশ নিবারণী আইনের খুব কড়াকড়ি। খাকি পোশাক, হাতে ছড়ি নিয়ে ইনস্পেক্টররা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। রাস্তায় কোনও গোরুর গাড়ি বা ঘোড়ার গাড়ি দেখলেই ইনস্পেক্টর সেটাকে দাঁড় করান, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভারবাহী জন্তুটাকে দেখেন; সেটা রুগণ কিনা, দুর্বল কিনা। সেটার কোনও অসুখ আছে কি না। কোনও গাফিলতি ধরা পড়লেই ফাইন, দু’টাকা, পাঁচ টাকা।
এক কুট্টি কোচম্যানের ঘোড়ার গাড়ি আটকিয়েছেন ইনস্পেক্টর। দেখা গেল ঘোড়াটার পিঠের দু’দিকে যেখানে ঘোড়া জুতবার কাঠের দণ্ড দুটো থাকে সেখানে ঘা হয়েছে। এ রকম ঘা কাঠে অনবরত পিঠ ঘষে যাওয়ায় সব ছ্যাঁকরা গাড়ির ঘোড়ার পিঠেই প্রায় থাকে।
এক্ষেত্রে কুট্টি ধরা পড়ে গেছে। তার ফাইন হয় আর কী? কিন্তু কুট্টিকে কায়দা করা অত সহজ নয়। সে বলল, ‘ও পিঠের দু’দিকে ও দুটো মোটেই ঘা নয়। আমার এটা পক্ষীরাজ ঘোড়া। ডানাদুটো ছেঁটে দিয়েছি, তাই ডানার জায়গাটায় ঘায়ের মতো ওই দাগ দুটো হয়েছে।’
এরপরে কী হয়েছিল, এতকাল পরে আমরা আর বলতে পারব না। বরং এবার শেষ গল্পটা বলি।
এটি অবশ্য বহুপ্রচলিত, বহু বিখ্যাত গল্প। খদ্দের কুট্টিকে বলেছে, ‘রমনা যেতে কত লাগবে।’ কুট্টি অবিশ্বাস্য বেশি দর হেঁকে বলল, ‘পাঁচ টাকা’।
খদ্দের ভদ্রলোক পুরনো যাত্রী, তিনি আসল ভাড়া ভালই জানেন, তিনি বললেন, ‘আট আনা’। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সেকালের পুরনো ঢাকায় এ রকম দামদর মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। লোকের হাতে ছিল অঢেল সময়, দামদর করা একটা আর্টের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, এখনও কলকাতার হকার্স কর্নারগুলিতে তার কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়। চিরকালই বেশ কিছু লোক দামদর না করে কেনাকাটা করা পছন্দ করে না।
সে যাক হোক, কুট্টির গল্পটা শেষ করি। পাঁচ টাকার বদলে যখন যাত্রী আট আনা বলল, কুট্টি হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল, ‘আস্তে বলেন স্যার, আমার ঘোড়ায় শুনলে হাসবে।’
কুট্টির এই উক্তিটি ঢাকায় আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে।