ঢাকাই জামদানি
আমার মাঝে মাঝে বড় বিরক্ত লাগে। এখন যেমন লাগছে সামনে পারমিতাদিকে দেখে। ছেলেকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করে! “ আমার পিঙ্কু এই করেছে, ওই করেছে”। যেদিন থেকে অফিসে জয়েন করেছি পারমিতাদির খালি একই বচন শুনে শুনে কান পচে গেল। আর হলই বা তোর ছেলে বিরাট স্কলার তাতে আমার কি? সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটে ননস্টপ। সামনে পিঙ্কুর বিয়ে। এখন ওই নিয়ে পড়েছে। পিঙ্কুর পছন্দ করা মেয়ে তুহিনা। সে নাকি বিরাট ডাকসাইটে সুন্দরী। ওনার ছেলে মেয়ে তুলেছে তাতেও পারমিতাদির মাটিতে পা পড়ছে না। ব্যালেন্স সীট মেলাতে মেলাতে মাঝে মাঝে মনে হয় দিই আচ্ছা করে ঝেড়ে। কিন্তু সেটা করা যায় না। স্বামী মারা গেছেন বহুদিন। ভদ্রমহিলা ডেথ কেসে চাকরি পেয়েছেন। ছেলেই সব।
মাঝে মাঝে খারাপও লাগে। তবে কাণ্ডকারখানাগুলো বড় বিরক্তিকর। সেদিন একটা পার্কার পেন এনে গোটা অফিসকে দেখিয়ে বেরিয়েছে। সেটা নাকি পিঙ্কুর অফিসের বস ওকে খুশি হয়ে দিয়েছে। এসব দেখে কার মাথার ঠিক থাকে! আমার সাতজনের পরিবার। তিন বোনের বিয়ে বাকি। বাবার পেনশনের আর আমার চাকরির টাকা ভরসা। এত টানাপোড়েনের সংসারের প্রতিনিধিত্ব করতে করতে পারমিতাদির মত ঝাড়া হাত পা টাইপ মহিলা দেখলে মন খারাপ হয়। হিংসা হয়। কি আনন্দে আছে! দুজন পরিবারের সাকুল্যে। দুজনেই চাকরি করে। ছেলে বছরে বারো না তেরো লাখ টাকা পায়। মা সরকারি চাকুরে। আর কি চাই।
পাশের ডেস্কের শিবাজীদা কিংবা ট্যাক্সের সাইদুলও ক্যান্টিনে আমার সাথে বসে পারমিতাদির বাপ- চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে। সাইদুল রোজা করছে। কিছু খায় না। কিন্তু লাঞ্চের সময় ঠিক আমার সাথে চলে আসে। আড্ডা না মারলে নাকি ওর অফিস পানসে লাগে। ওই বলছিল “ আরা পিঙ্কুদিকে নিয়ে সত্যি সমস্যায় পড়া গেছে। আমি গেলাম কালকে ওর ফাইলে কি হয়েছে বলতে। যেতেই বিয়ের মেনু নিয়ে এক লম্বা কাহিনী ফেঁদে বসল। চিকেন মাটন দুটোই নাকি রাখবে বলেছে পিঙ্কু। তা আমি এ ব্যাপারে কি করব বল?” রীতিমত কাঁদো কাঁদো শোনাল সাইদুলের গলা। শিবাজীদার অভিজ্ঞতা অন্য। ও পারমিতাদিকে জিজ্ঞেস করতে গেছিল সামনের বন্ধে অফিসে আসবে নাকি। তাতে পারমিতাদি ওকে সাতপাতা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। পিঙ্কুদের অফিসে দিনরাত কাজ হয়। আমেরিকার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা যোগাযোগ রাখতে হয়, তাতে বন্ধের কোন জায়গা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরক্তির শেষ সীমা যাকে বলে।
আমাদের অফিসের বড়বাবু পর্যন্ত পারমিতাদির জ্বালায় অস্থির। আজকাল কর্পোরেট অফিসগুলো কি রকম এগিয়ে গেছে, তার তুলনায় সরকারি অফিসগুলো কি বিচ্ছিরি। বড়বাবু কেন এখনও টাই পড়েন না পিঙ্কুদের অফিসের বসের মত এই সব কথাও বলা হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে কেচ্ছার একশেষ।
এখন সামনের সপ্তাহে পিঙ্কুর বিয়ে। পারমিতাদিকে আর পায় কে! আমরা অনেক ষড়যন্ত্র করে পারমিতাদিকে বোঝাতে গিয়েছিলাম সামনে ছেলের বিয়ে, এত বড় কাজ, ছুটি নাও না। সমস্ত আশা ব্যর্থ করে পারমিতাদি জানিয়ে দিয়েছে এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপই সব করে। উনি খামোখা ছুটি নষ্ট করবেন কেন? বিরাট বিয়েবাড়ি ভাড়া করেছে পিঙ্কু। সাইদুল ফুট কাটতে গিয়েছিল নলবনে করতে পারতে। আমার রাম চিমটি খেয়ে নিরস্ত হয়েছে।
বিয়ের আগে মোটামুটি খান পঞ্চাশেক বার মেনু আর মেয়ের বাড়ি থেকে কি কি দেওয়া হবে তার ফিরিস্তি পেলাম। বিয়ের পাঞ্জাবী আর বউভাতের স্যুট এমনকি বাসরঘরে পিঙ্কু তুহিনাকে কি ডিজাইনের আংটি দেবে সেটাও জেনে গেলাম। কৌতূহল না থাকলেও জানতে বাধ্য হলাম বলা চলে।
পিঙ্কুর বিয়েটা সত্যিই ভারী ধুমধাম করে হল। আমরা সব দল বেঁধে গেলাম। মোগলাই, চাইনিজ, বাঙালী সব রকম খাবারের আয়োজন। একদিকে মকটেল পার্টি, একদিকে কাবাব বার- মানে চারিদিকে একেবারে অবাধ টাকা খরচ। বউ সত্যিই ভারী সুন্দর হয়েছে। পিঙ্কুর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকেও দেখলাম দামী স্যুট বুট পড়ে ঘোরাফেরা করছে। চোখে ধাধা লেগে গেল। পিঙ্কুর অফিসের লোকেদের কর্পোরেট লুকসের সামনে সত্যিই আমাদের কেমন বেখাপ্পা লাগছিল। আমাদের অফিসের সাইদুল কিংবা আমি লোকাল মেড টেইলারের জামা কাপড় পড়ি। পিঙ্কুদের অফিসের এক একজন যে সব জামা পড়েছে দেখলাম তার কোন কোনটার দাম আমাদের কারও কারও মাস মাইনেকেও ছুঁয়ে ফেলতে পারে।
পারমিতাদি যথারীতি কলকল করে চলেছে। আমার কানে কানে এসে বলে গেল, “ গোলাপজামটা অবশ্যই খাবি। পিঙ্কু স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে।“ বলতে যাচ্ছিলাম, পিঙ্কু নিজে বানায়নি তো? বলার সুযোগ হল না। লোকাল এম এল এ কে অভ্যর্থনা করতে ছুটল পারমিতাদি। খাওয়া দাওয়ার পর বিশাল বিয়েবাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কেন জানি পারমিতাদির জন্য বিরক্তি হিংসা কোনটাই লাগছিল না। বরং ভাল লাগছিল। আমরা সিগারেট ধরিয়ে এই আলোচনাই করছিলাম আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলাম এই নিয়ে এরপর পারমিতাদিকে আর অফিসে ধরে রাখা যাবে না। জ্বালিয়ে পুরিয়ে মারবে। কি পেল কি দিল সব শুনতে হবে। কটা কোলবালিশ, তত্ত্বের সন্দেশের শেপ সব।
যা ভেবেছিলাম সেটা কিন্তু ঘটল না। পিঙ্কুর বিয়ের দুদিন পর জয়েন করল পারমিতাদি। একদম কথা কম। মাথা নিচু করে অফিসে আসে। পিঙ্কুর কোন কথা তো বলেই না উল্টে কিছু বললে এড়িয়ে যায়। শিবাজীদা ক্যান্টিনে ধোঁয়া টানতে টানতে বলল,”ওরে এসব হবারই ছিল। চিরজীবন ছেলেছেলে করে গেছে। ছেলে সুন্দরী বউ পেয়ে কি আর মাকে মনে রাখে? এখন দেখ গে যা বউয়ের পা মালিশ করছে।“
শিবাজীদার কথাগুলো শুনতে খারাপ হলেও বাস্তব। আমাদের পাঁচতলা অফিসের ছাদে ক্যান্টিনটা। তাতে সিগারেটের ধোঁয়ায় বৃষ্টি ধোয়া কলকাতা দেখতে দেখতে শিবাজীদার কথায় আমার মনও সায় দিল। সত্যিই তো। আমি সাতবছর হল এখানে ঢুকেছি। তাতে যা জানতে পেরেছি পারমিতাদি স্বামী মারা যাবার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে না করে চাকরি করে ছেলের পিছনে পুরো জীবন দিয়েছে। ছেলে যেদিন চাকরি পায় গোটা অফিসে শহরের সবচেয়ে বড় রেস্তোরা থেকে দোকানের বিরিয়ানির প্যাকেট বিলি করেছিল পারমিতাদি। পারমিতাদির গোটা দুনিয়াটাই তো পিঙ্কু।
বাড়ি যাবার পথে পারমিতাদিকে ধরি। লঘু স্বরে বলি,” কি ব্যাপার গো? পিঙ্কুর বিয়ের পর তো কোন খবর পেলাম না!” পারমিতাদির চোখ ভরে জল এল। বলল,” শ্যামল তোকে আর কি লুকাব বল, পিঙ্কু বউভাতের পরদিন বউকে নিয়ে ঢাকা চলে গেছে। আমাকে কিছুই বলেনি। মন বড্ড খারাপ ভাই। তুই কাউকে কিছু বলিস না”। আমি চমকালাম। বললাম, “এত জায়গা থাকতে ঢাকা! আজকাল লোকে হনিমুন করতে মরিশাস, মালয়েশিয়া, বালি, সিঙ্গাপুর যাচ্ছে। তোমার ছেলে ঢাকা গেল কি করতে?”
পারমিতাদি কাঁদো কাঁদো স্বরেই বলল,” তুহিনার ঠাকুরদা এখনও ওদেশে থাকে। তাই আশীর্বাদ নিতে গেছে। অথচ আমাকে এ ব্যাপারে পিঙ্কু আগে কিছুই বলেনি। বাসরঘরে নাকি তুহিনা ওকে বলেছে, সে শুনে ঢাকা যাবার ডিশিসান নেয়। আমাকে বলল যাবার দিন। এত ক্যাজুয়ালি যে আমার মনে হল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে।“
আমি আর কি বলব। দু একটা সান্তনার কথা বলে চুপচাপ সরে পড়লাম। যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। ছেলে কচি বউ পেয়ে মাকে ভুলেছে। আমাদের অফিসের ক্যান্টিন আড্ডাও পানসে হয়ে গেছে। পারমিতাদির পিঙ্কুর চর্চাই আমাদের আড্ডার মূল বিষয় হয়ে গেছিল। সেটা বন্ধ হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু কেন জানিনা ঠিক খুশি হতে পারছিলাম না।
বাড়িতে বউকেও ঘটনাটা বললাম। ও অফিসে না গিয়েও আমার মুখে মুখে অফিসের কথা শুনে শুনে মুখস্ত করে ফেলেছে। মুখ ঝামটা মেরে বলল, “ তোমার কি? তোমার সমস্যা তো কমল। লোককে সুখে থাকতে দেখলে তো তোমাদের ভূতে কিলায়”। কি আর করি, মানতেই হল কথাটা।
তবু শেষ হয়েও হইল না শেষ। সেদিন অফিসে গিয়েই দেখলাম পারমিতাদি একটা নতুন শাড়ি পড়ে অফিসে হাজির। বুঝলাম পিঙ্কু সংবাদ এসে গেছে। পারমিতাদি আমাকে দেখেই ঝাপিয়ে এল আগের মত,” এই দেখ শ্যামল, পিঙ্কু বাংলাদেশ থেকে এই শাড়িটা এনে দিয়েছে। ঢাকাই জামদানী। সাড়ে বারো হাজার টাকা তুহিনা নিজে পছন্দ করে কিনেছে। ওর মার জন্য একটা। আমার জন্য একটা।“ আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। একটু শ্লেষের সাথেই বললাম,” তবে আর কি? শাড়ি পেয়ে গেছ।ছেলেও ফিরে এসেছে। তোমার তো পোয়াবারো পারমিতাদি”।
পারমিতাদি হাসতে হাসতেই কেঁদে ফেলল, চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “ পিঙ্কু সামনের মাস থেকে কানাডায় ট্রান্সফার নিয়েছে। তুহিনাকে নিয়ে যাচ্ছে। এটাও ছেলে নিজে বলেনি। বউকে দিয়ে বলিয়েছে।“
আমার চোখের সামনে দিয়ে ফ্ল্যাশব্যাকের মত বিয়ের দিনটা ভেসে উঠছিল। তার সাথে পারমিতাদির পিঙ্কু, স্কলার ছেলে, পে স্কেলের এরিয়ারের টাকা দিয়ে ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেবার গল্প – সব। পারমিতাদির শাড়িটা যেন পারমিতাদিকেই ব্যঙ্গ করছিল।
ঢাকাই জামদানী। কি সহজে সবকিছু ভুলিয়ে দিল!