ড্রাকুলা (পর্ব ১)

ড্রাকুলা – ব্রাম স্টোকার
বিশ্বের ভয়ঙ্করতম পিশাচ কাহিনী। রূপান্তর : রকিব হাসান। সেবা প্রকাশনী
ড্রাকুলা ১ – প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ১৯৭৯

১.১ জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে

জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে
৩ মে, বিসট্রিজ।

মিউনিক ছেড়েছিলাম পয়লা মে, রাত আটটা পঁয়তিরিশে! সারারাত একটানা চলেও পরদিন ভোরে ভিয়েনায় পৌঁছে দেখা গেল একঘণ্টা লেট করে ফেলেছে ট্রেন। আবার একটানা চলা। ট্রেনের কামরা থেকে একনজর দেখে অপূর্ব লাগল। বুদাপেস্ট। দানিয়ুব নদীর ওপর তুরস্কীয় কায়দায় গড়া পাশ্চাত্যের সবচে সুরম্য চওড়া ব্রিজটা পেরুবার সময়ই টের পেলাম পশ্চিম ইউরোপ ছেড়ে পুবের দিকে পাড়ি জমিয়েছি আমরা। বুদাপেস্টে নেমে খানিকক্ষণ ঘুরেফিরে দেখলাম শহরটা। স্টেশন ছেড়ে বেশিদূর যেতে সাহস পেলাম না, কি জানি যদি ট্রেনটা আবার আমাকে ফেলে রেখেই চলে যায়। স্টেশনে ফিরে দেখলাম ট্রেন ছাড়ে ছাড়ে। আর কয়েক মিনিট দেরি হলেই মিস করতাম ট্রেন। যথাসময়েই অর্থাৎ সন্ধ্যের পরপরই সেনবার্গে পৌঁছে গেল ট্রেন। রাত কাটাবার জন্যে স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে উঠলাম। কার্পেথিয়ানদের জাতীয় খাদ্য প্যাপরিকা-সাংঘাতিক ঝাল দেয়া মুরগীর মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সেরেই শুয়ে পড়লাম। তুলতুলে নরম পালকের বিছানায় শুয়েও কিন্তু ঘুম এল না। গত কয়েকদিনের কথা একসঙ্গে এসে ভিড় জমাল মনে একটা বিশেষ কাজে কার্পেথিয়ান পর্বতমালার ঠিক হৃৎপিণ্ডে অবস্থিত ইউরোপের সবচেয়ে অখ্যাত আর দুর্গম এক জায়গায় চলেছি আমি। লণ্ডন ছাড়ার আগেই ব্রিটিশ মিউজিয়ামে খুঁজেপেতে এ পর্যন্ত ট্রানসিলভেনিয়া সম্পর্কে যে সমস্ত বই বা মানচিত্র বেরিয়েছে তা জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তেমন কিছু পাইনি। দেশটা সম্পর্কে বাইরের লোকে বিশেষ কিছু জানে না দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম। অনেক খোঁজ-খবর করে শুধু এটুকুই জানতে পেরেছিলাম, কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গ, অর্থাৎ যেখানে চলেছি আমি, সে-জায়গাটা ট্রানসিলভেনিয়ার একেবারে পুব প্রান্তে কোন মানচিত্র বা বইপত্রের কোথাও কাউন্ট ড্রাকুলার দুর্গের কোন উল্লেখই নেই। দুএকজন প্রাচীন লোকের মুখে জায়গাটার শুধু নামটা শুনেছি আমি।

সেনবার্গে পৌঁছে দেখলাম কাউন্ট ড্রাকুলার পূর্বপুরুষদের আমলে প্রতিষ্ঠিত শহর বিসট্রিজ এখানকার লোকদের বেশ পরিচিত, কিন্তু কাউন্ট ড্রাকুলা সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে চায় না, কেন বুঝলাম না। এসব ভাবতে ভাবতেই একটু তন্দ্রা মত এল। কিন্তু অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন দেখে সে-তন্দ্রাও ছুটে গেল বার বার। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়েও তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারলাম না। পিপাসা যেন মিটছেই না। ভোর রাতের দিকে বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভাঙল কড়া নাড়ার তীক্ষ্ণ শব্দে। লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে দিতেই পরিচারক জানাল আমার যাত্রার সময় হয়ে এসেছে।

হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে সাতটা বেজে গেল। কিন্তু স্টেশনে এসে দেখলাম তখনও ট্রেন আসেনি, অর্থাৎ এ লাইনের যা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার-ট্রেন লেট। টের পাচ্ছি, যতই পুবে এগোচ্ছি ততই গড়বড় হয়ে যাচ্ছে ট্রেনের সময়-সূচী।

শেষ পর্যন্ত এল ট্রেন, ছাড়লও একসময়। জানালা দিয়ে বাইরের অপূর্ব দৃশ্যপট দেখতে দেখতে চললাম। কখনও চোখে পড়ল প্রাচীন চিত্রকরদের আঁকা ছবির মত পাহাড়চূড়ায় ছোট্ট শহর কিংবা দুর্গ, কখনও দুকূল ভাসিয়ে দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে চলা তীব্র-স্রোতা পাহাড়ী নদী। চলার পথে প্রত্যেকটি স্টেশনে দেখলাম বিচিত্র পোশাক পরা মানুষের ভিড়। অধিকাংশই গেঁয়ো চাষী। পুরুষদের পরনে খাটো কোর্তা আর ঘরে তৈরি পাজামা। মাথায় বিশাল ব্যাঙের ছাতার আকৃতির গোল টুপি। মেয়েদের কাপড়গুলো কিন্তু ভারি সুন্দর। পুরো-হাতা ঝলমলে সাদা পোশাক আর ঘেরওয়ালা লুটানো ঘাঘরা পরা মেয়েদেরকে দেখতে প্রাচীন থিয়েটারের নর্তকীর মত মনে হল।

সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম স্লোভাকদের দেখে। বলতে কি, মনে মনে কিছুটা ভয়ও হল। গরুর গাড়ির চাকার সাইজের বিশাল বারান্দাওয়ালা লোকগুলোর টুপি, ঢলঢলে নোংরা পাজামা, সাদা কোর্তা, আগাগোড়া পিতলের পেরেক আঁটা বিঘতখানেক চওড়া চামড়ার বেল্ট আর উঁচু বুট। ওদের কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা কোঁকড়ানো কালো চুল আর সেই সাথে পাল্লা দেয়া বিরাট গোঁফ দেখে প্রথম দর্শনেই ডাকাত বলে ভুল হয়। অথচ পাশের লোককে জিজ্ঞেস করে জানলাম এ এলাকার লোকদের মধ্যে নাকি ওরাই সবচেয়ে নিরীহ।

এত সব আশ্চর্য আর নতুন নতুন জিনিস দেখতে দেখতে দিনটা কিভাবে ফুরিয়ে গেল টেরই পেলাম না। সন্ধ্যার একটু আগে বিসট্রিজে এসে পৌঁছুলাম। গোধূলির স্নান আলোয় বুদাপেস্টের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হল শহরটাকে। ট্রানসিলভেনিয়ার শেষ সীমান্তে, পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিসট্রিজ। বোর্গো গিরিপথটা এখান থেকেই সোজা চলে গেছে বুকোভিনা পর্যন্ত। বিসট্রিজ শহরের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় অতীতে বহু যুদ্ধের প্রচণ্ড ঝড় ঝাঁপটা বয়ে গেছে এর ওপর দিয়ে। শোনা যায় সপ্তদশ শতকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঁচ পাঁচবার যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার প্রকোপে পড়ে নিশ্চিহ্ন হতে হতে কোনরকমে বেঁচে যায় বিসট্রিজ। প্রথম যুদ্ধের প্রথম তিন সপ্তাহেই মারা যায় প্রায় তেরো হাজার মানুষ, এছাড়া দুর্ভিক্ষ আর মড়ক তো আছেই। এ থেকেই অনুমান করা যায় পরের যুদ্ধগুলোতে কত লোক প্রাণ হারিয়েছিল।

গোল্ডেন ক্রোন হোটেলে ওঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন আমাকে কাউন্ট ড্রাকুলা। প্রাচীন হোটেলটা দেখেই পছন্দ হল আমার, যেন এটাকেই খুঁজছিলাম মনে মনে। হোটেলের সদর দরজার কাছে একজন মাঝ-বয়সী সুন্দরী মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। জায়গায় জায়গায় সাদা কাপড়ের ঝালর দেয়া আঁটসাঁট রঙিন পোশাক পরা মহিলার আর একটু কাছাকাছি পৌঁছতেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কিছু মনে করবেন না, আপনি ইংল্যাণ্ড থেকে আসছেন তো?

হ্যাঁ, উত্তর দিলাম, আমি জোনাথন হারকার–

মৃদু হেসে পাশ ফিরলেন ভদ্রমহিলা। সাথের ভদ্রলোককে মৃদুস্বরে কি যেন বললেন, বুঝতে পারলাম না। মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক, একটু পরই আবার ফিরে এলেন। হাতে একটা চিঠি। ওঁর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করলাম।

বন্ধ,

কার্পেথিয়ানে স্বাগত জানাচ্ছি আপনাকে। বুঝতেই পারছেন, আপনার সাথে সাক্ষাতের আশায় অধীর হয়ে দিন গুনছি আমি। আজ রাতটা কোনমতে হোটেলেই কাটিয়ে দিন। আগামীকাল তিনটের দিকে আবার যাত্রা শুরু হবে আপনার। একটা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়িতে আপনার জন্যে আসন সংরক্ষিত করা আছে। আগামীকাল তিনটায় বুকোভিনার উদ্দেশে রওনা দেবে গাড়িটা। নির্ধিধায় উঠে বসবেন তাতে। বোর্গো গিরিপথের কোন এক জায়গায় ওই ঘোড়ার গাড়ি থেকে আপনাকে তুলে নেবে আমার নিজস্ব টমটম, পৌঁছে যাবেন আমার প্রাসাদ-দুর্গে। আশা করছি আপনার সাথে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের কটা দিন অত্যন্ত আনন্দেই কাটবে।

প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে।

আপনার বন্ধু–
ড্রাকুলা।

৪ মে।

হোটেলের মালিক অর্থাৎ যিনি আমাকে চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছেন, তাকেও একটা চিঠি দিয়েছেন কাউন্ট ড্রাকুলা। আমার যাতে কোন প্রকার অসুবিধা না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখার নির্দেশ আছে সে চিঠিতে। হোটলের মালিক বলতে গেলে কথা প্রায় বলেনই না। আমি স্থানীয় লোকদের কাছে শুনেছিলাম তিনি জার্মান ভাষা জানেন না। কিন্তু তার সাথে কথা বলার পর বুঝলাম তার সম্বন্ধে স্থানীয় লোকদের ধারণাটা ভুল। কারণ তিনি এবং তাঁর স্ত্রী-সেই সুন্দরী ভদ্রমহিলা, আমার দুএকটা ছাড়া, বাকি সব প্রশ্নের উত্তরই যথাযথভাবে দিয়েছিলেন। তবে আমাকে দেখলেই কেমন একটা চাপা উত্তেজনা আর আশঙ্কার ছায়া পড়েছে ওঁদের চোখে-মুখে। প্রশ্ন করে জানলাম আমার রাহা খরচের টাকা আগেই ডাকযোগে হোটেলের মালিকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন কাউন্ট ড্রাকুলা। কাউন্ট ড্রাকুলা আর তার প্রাসাদ-দুর্গ সম্পর্কে কি জানেন জিজ্ঞেস করতেই চমকে উঠে বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। মুখে যদিও বললেন সে-সম্পর্কে ওরা কিছু জানেন না, কিন্তু আমার মনে হল ইচ্ছে করেই কিছু গোপন করছেন তারা। দ্রুত এগিয়ে আসছে রওনা দেবার সময়। আর কারও সাথে পরিচিত হয়ে কাউন্ট ড্রাকুলা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই যাত্রার সময় হয়ে গেল। মনে মনে একটা তীব্র অস্বস্তি নিয়ে হোটেলের কামরা থেকে বেরোতে যাব, এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলেন সুন্দরী মহিলা। কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, সত্যিই আপনি যাচ্ছেন তাহলে?

মানে? অবাক হলাম আমি।

না গেলেই কি নয়?

কেন যাব না? তাছাড়া খামোকা বেড়াতে তো আর সেখানে যাচ্ছি না আমি। অফিস থেকে রীতিমত কাজ নিয়ে দেখা করতে যাচ্ছি কাউন্টের সাথে।

তা যান, একটু যেন হতাশ হলেন ভদ্রমহিলা, আমি বলছিলাম আজকের দিনে…জানেন না আজ চৌঠা মে?

জানব না কেন? আজ চৌঠা মে তো হয়েছে কি?

হয়নি, কিন্তু হবে। আজ সেন্ট জর্জ দিবস। মাঝ রাতের ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর যেখানে যত প্রেতাত্মারা আছে, সব জেগে উঠবে আজ। তাছাড়া, জানেন কার কাছে যাচ্ছেন?

ব্যাপার কি? এবারে সত্যিই আশ্চর্য হলাম আমি। বোধহয় আমাকে কিছুটা টলিয়ে দিতে পেরেছেন ভেবে আমার সামনে হাটু গেড়ে বসলেন ভদ্রমহিলা। হাত জোড় করে বললেন, আমি আপনার কেউ না, আপনাকে জোর করতে পারি না আমি। তবু মিনতি করছি, আরও দুটো দিন অন্তত আপনি এ হোটেল ছেড়ে বেরোবেন না।

এবারে দ্বিধায় পড়লাম। ভাবছি কি করা যায়। যাব, না থাকব। অনিশ্চয়তার দোলায় দুলতে দুলতে নিজের ওপরই খেপে গেলাম, এ কি ছেলেমানুষী হচ্ছে! এসব দুর্বোধ্য কথাবার্তা আর হেঁয়ালি শুনে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়? ওদিকে কত কাজ পড়ে আছে। কথাটা মনে হতেই গম্ভীর হয়ে গেলাম। ভদ্রমহিলাকে বললাম, মাফ করবেন। কাজটা অত্যন্ত জরুরী, আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না বলে দুঃখিত।

আমাকে ঠেকানর কোন উপায় নেই বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ালেন মহিলা। নিজের গলায় ঝোলানো কুশটা খুলে নিয়ে জোর করে খুঁজে দিলেন আমার হাতে। ধর্মের প্রতি কোনদিনই আমার তেমন বিশ্বাস-টিশ্বাস নেই। কাজেই একবার ভাবলাম ফিরিয়ে দিই ওটা, কিন্তু ভদ্রমহিলার মুখের দিকে চেয়ে তা আর পারলাম না, আসলে মমতাময়ী ওই মহিলাকে আঘাত দিতে ইচ্ছে করল না আমার। মনে মনে ঠিক করলাম, মহিলা চোখের আড়াল হলেই টুপ করে ফেলে দেব কোথাও। বোধহয় আমার মনোভাব বুঝতে পেরে মৃদু হাসলেন মহিলা, তারপর আমার হাত থেকে কুশটা নিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, যদি আপনার মা এটা গলায় পরিয়ে দিতেন, তাহলে কি ফেলে দিতে পারতেন?

কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। কি জানি, আমার মনের ভুলও হতে পারে, ঘুরে দাঁড়ানর আগে ভদ্রমহিলার চোখে অশ্রু টলমল করতে দেখেছিলাম।

গলা থেকে খুলে ফেলতে পারলাম না কুশটা। চিন্তিতভাবে হোটেলের কামরা থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। একটু পর চলতে শুরু করল। গাড়ি। মিনা, তখনও কি জানতাম কতটা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমি!

৫ মে, প্রাসাদ-দুর্গ।

পুব আকাশে উঠি উঠি করছে সূর্য। ভোরের সূর্য আমার দারুণ ভাল লাগে, তা তো তুমি জানোই, মিনা, কিন্তু আজ ভাল লাগল না। কেমন যে রোগাটে মলিন দেখাচ্ছে সূর্যটাকে। বিছানায় বার দুয়েক গড়াগড়ি করে উঠে পড়লাম, ডায়েরীটা লিখে ফেলতে হবে।

গতকাল আমি গাড়িতে উঠে বসার পরও গাড়ি ছাড়তে কিছুক্ষণ দেরি করল কোচোয়ান। হোটেলের মালিকের সাথে উত্তেজিতভাবে কিছু বলছে সে, আর বার বার তাকাচ্ছে আমার দিকে। বুঝলাম কথা হচ্ছে আমার সম্পর্কেই। এতক্ষণ আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল হোটেলের কয়েকজন বয় বেয়ারা। আস্তে আস্তে ওরাও হোটেলের মালিক আর কোচোয়ানের সাথে তর্কে যোগ দিল। ওরা কি বলছে ভালমত শুনতে পেলাম না। তবে যে কয়েকটা শব্দ শোনা গেল সেগুলোর মানে জানার জন্যে তাড়াতাড়ি ওই দেশী অভিধানটা বের করলাম। কয়েকটা শব্দের মানে সত্যি রহস্যজনক। যেমন-শয়তান, নরক, ডাইনী ইত্যাদি। আর দুটো শব্দ তো রীতিমত অবাক করল আমাকে। শব্দ দুটো হল নেকড়ে আর রক্ত চোষা বাদুড়। মনে মনে ঠিক করলাম, কাউকে জিজ্ঞেস করে শব্দগুলোর তাৎপর্য জেনে নেব।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর গাড়িতে এসে উঠল কোচোয়ান। ততক্ষণে ছোটখাট একটা ভিড় জমে গেছে হোটেলের গেটের সামনে। আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে চাইতে চাইতে বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকছে সবাই। পাশের সহযাত্রীর দিকে ঝুঁকে মৃদুস্বরে জানতে চাইলাম, এসব কি হচ্ছে? প্রথমে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সে। আমার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত জানাল, অশুভ আত্মার দৃষ্টি থেকে আমাকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যেই অমন করছে ওরা। সম্পূর্ণ অজানা জায়গায় ঠিক তেমনি অচেনা একজন লোকের সাথে দেখা করতে যাবার আগে এ ধরনের কাজ কারবার দেখে মনটা ঘাবড়ে গেল আমার।

ঝাঁকড়া, সবুজ পাতাওয়ালা বাতাবি আর কমলালেবুর গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে হোটেল প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানটায়। তার আশপাশে দাঁড়ানো লোকগুলো আমার মত অচেনা একজন বিদেশীর জন্যে আন্তরিক আশঙ্কা প্রকাশ করে যে হৃদ্যতা দেখাল তা জীবনে ভুলব না আমি।

কোনরকম জানান না দিয়েই হঠাৎ ছুটতে শুরু করল গাড়ি। সহযাত্রীদের ভাষা আমার বোধগম্যের বাইরে বলে তাদের সাথে আলাপে অংশগ্রহণ করতে পারছি না। কিন্তু চারপাশের অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওদের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। বড় বড় গাছে আচ্ছন্ন হয়ে আছে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পাহাড়ের গা। বনের ওপারে সবুজ ঘাসে ছাওয়া তেপান্তর, তারপরেই আবার চলে গেছে পাহাড়ের সারি। এখানে ওখানে জন্মে আছে অজস্র আপেল, পাম, নাশপাতি আর চেরিফলের গাছ। সব কটা গাছের গায়েই ভাবী সন্তানের আগমনের ইঙ্গিত, অর্থাৎ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছগুলো। সন্তান বরণ করার জন্যেই বোধহয় ওগুলোর গোড়ায় জন্মানো সবুজ ঘাসের ঘন জঙ্গলের ওপর আলপনা এঁকেছে ঝরা ফুলের পাপড়ি। পাশের সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম অপূর্ব এই জায়গাটার নাম মিটেল ল্যাণ্ড।

পাহাড়ের গা ঘুরে এঁকেবেঁকে নামতে নামতে হঠাৎ করেই মনে হবে দেবদারু বনের মাঝে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে বুঝি পথটা, কিন্তু আসলে শেষ হচ্ছে না। পথটা অল্পবিস্তর অসমান, তবু ঢালু পথে ঝড়ের বেগে ছুটছে আমাদের গাড়ি। মুহূর্ত মাত্র সময় নষ্ট না করে বোর্গো গিরিপথে পৌঁছনর জন্যে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে কোচোয়ান। কারণ বুঝতে পারলাম না। সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করেও সন্তোষজনক উত্তর পেলাম না।

আরও সামনে এগিয়ে, মিটেল ল্যাণ্ডের সবুজ উপত্যকা পেছনে ফেলে কার্পেথিয়ানের বিশাল প্রান্তরের প্রান্তে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া অরণের কাছে এসে পৌঁছুলাম। আমার ডাইনে-বাঁয়ে তখন শুধু ছোটবড় পাহাড়ের সারি। ওদিকে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। অস্তগামী সূর্যের আলোয় দূরে পাহাড় চূড়াগুলোকে দেখাচ্ছে গাঢ় নীল, আর কাছেরগুলো কমলা। ঘাস প্রান্তর আর পাহাড়ের গোড়ার সঙ্গমস্থলের কোথাও সবুজ, কোথাও বাদামী। আর বহুদূরে, দিগন্তের একেবারে কাছাকাছি তুষার ছাওয়া চুড়াগুলোর সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

একটু পরই পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা ছোট ছোট ঝর্ণার দেখা পেলাম। বিদায়ী সূর্যের সোনালী আলো এসে পড়েছে ওগুলোর ওপর। এখন আর পানির ঝর্ণা বলে মনে হচ্ছে না ওগুলোকে। ঝিরঝির শব্দে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসছে যেন তরল সোনা।

পথটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিতেই হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের উপর এসে পড়লেন পাশের সহযাত্রী। আঙুল দিয়ে বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকতে আঁকতে চোখের ইঙ্গিতে আমাকে দেখালেন, ওই, ও-ই-ই যে, ওখানেই বাস করেন ঈশ্বর। কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না। আঁকাবাকা সর্পিল পথে আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটন্ত সূর্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বহু আগেই, এখন একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। পাহাড়ের ওপারে ডুবছে এখন সে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই সম্পূর্ণ চোখের আড়ালে চলে গেল সূর্য। এতক্ষণ সাহস পায়নি, কিন্তু সূর্য ডুবে যাওয়া মাত্র এদিক ওদিক চাইতে চাইতে মন্থর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকল অন্ধকার। সূর্যের চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না, অথচ আশ্চর্য, তুষার ছাওয়া পাহাড়গুলো তখনও সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। একটা সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু তুষার হাওয়া চূড়াগুলো অসংখ্য সূর্য হয়ে আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে। সেই আলোয় চোখে পড়ল রাস্তার দুধারে ঘাসে ছাওয়া জমির বুক ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য কুশ। যতবার চোখে পড়ছে ক্রুশগুলো ততবার বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকছে আমার সহযাত্রীরা। কখনও কখনও দুএকটা কুশের সামনে নতজানু হয়ে বসে প্রার্থনা করছে কিষাণী বধূ। বোধহয় অকালে হারিয়ে যাওয়া স্বামীর উদ্দেশ্যে জানাচ্ছে তার ব্যথাভরা বুকের গোপন হাহাকার। এতই তন্ময় হয়ে বসে আছে যে আমাদের দিকে একবারের জন্যও মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। যেন আমরা নেই।

গিরিমুখে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গোধূলির শেষ আলোটুকুও মিলিয়ে গেল। সাঁঝ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বাড়তে লাগল ঠাণ্ডা। গাঢ় কুয়াশা নেমে আসতে লাগল বার্চের অরণ্যের উপর। হালকা তুষারের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে পাতাবাহারের কালো কালো ঝোপ। ঢাল বেয়ে দ্রুত নামার সময় মনে হচ্ছে এই বুঝি দেবদারুর গায়ে হমড়ি খেয়ে পড়ছে গাড়ি। সে-ঢালটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের গা বেয়ে আবার খাড়া উঠে গেছে পথটা। অতি ধীরে গাড়িটাকে টেনে টেনে এখন এগোতে হচ্ছে ঘোড়াগুলোকে। ওগুলোর পেছন পেছন হেঁটে যাব ভেবে কোচোয়ানকে বললাম কথাটা। সাথে সাথেই দারুণ চমকে উঠে আমাকে বাধা দিয়ে বলল সে, বলছেন কি, সাহেব? এখানে নামামাত্রই ছিঁড়েখুড়ে খেয়ে নেবে আপনাকে হিংস্র কুকুরের দল। আশপাশে তাকিয়ে একটা কুকুরও চোখে পড়ল না আমার। কানে এল না কুকুরের একটা ডাকও। কোথায় কুকুর? কোচোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই অদ্ভুত ভাবে হাসল সে, কোন উত্তর দিল না।

অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসতেই আলো জ্বালবার জন্যে কয়েক সেকেণ্ড থামল কোচোয়ান। হোটেল ছাড়ার পর এই প্রথমবারের জন্যে থামল সে। আঁধার হবার পরপরই কেন যেন একটু উত্তেজিত মনে হল যাত্রীদের। বার বার কোচোয়ানকে আরও জোরে গাড়ি চালাবার জন্যে ধমকাতে লাগল ওরা। আর ওদের কথার প্রত্যুত্তরেই যেন নির্মম ভাবে হিশিয়ে উঠতে থাকল কোচোয়ানের চাবুক, জান বাজি রেখে ছুটে চলল ঘোড়াগুলো।

জমাট অন্ধকারে প্রায় অন্ধের মত ছুটছে আমাদের গাড়ি। এবড়োখেবড়ো আর আঁকাবাঁকা পথে লাফাতে লাফাতে ছুটছে, স্থির হয়ে বসে থাকা যাচ্ছে না কিছুতেই। একটু পরই অপেক্ষাকৃত মসৃণ হয়ে এল রাস্তা, সাথে সাথে দুপাশ থেকে চেপে এসে আমাদের গিলে নিতে চাইল পাহাড়ের সারি। বুঝলাম, বোর্গো গিরিপথে প্রবেশ করেছি আমরা।

গিরিপথে প্রবেশ করতেই একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল সহযাত্রীদের মধ্যে, যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু আর একটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ কেন যেন আবার গম্ভীর হয়ে গেল ওরা। যেন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার অপেক্ষা করছে। কারণ জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও আমাকে কিছু জানল না কেউ। উত্তেজিত নীরবতায় থমথম করছে গাড়ির ভিতরটা। গাড়ি আরও এগোতেই পুব দিকে খাড়ির মুখটা চোখে পড়ল। আবহাওয়ার পরিবর্তনও টের পেলাম। একে গাঢ় অন্ধকার, তার ওপর আকাশে মেঘ জমায় কালিগোলা অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারদিক। থমথমে বাতাসে ঝড়ের সংকেত।

আর একটু এগোতেই দেখা গেল রাস্তাটা দু ভাগ হয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দুদিকে চলে গেছে। ডান পাশের পথটা বেছে নিল কোচোয়ান। বাঁ দিকের পথটা কোথায় গেছে জানতে চেয়েও উত্তর পেলাম না কারও কাছ থেকে। ইচ্ছে করেই আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সহযাত্রীরা? হ্রমেই বাড়ছে বাতাসের বেগ।

এদিকেরই কোন এক জায়গা থেকে কাউন্টের টমটমে আমাকে তুলে নেবার কথা। উৎকণ্ঠিত ভাবে এদিক ওদিক চেয়ে তার খোঁজ করতে লাগলাম। প্রতিমুহূর্তে আশা করতে লাগলাম এখনই অন্ধকারের বুক চিরে দেখা দেবে কোন লণ্ঠনের আলো। কিন্তু দুর্ভেদ্য অন্ধকারে আমাদের গাড়ির লণ্ঠনের কাঁপা কাঁপা আবছা ভৌতিক আলো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না! সে-আলোয় ধাবমান ক্লান্ত ঘোড়াগুলোকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

বালি বিছানো পথ বেয়ে দ্রুত সামনে এগিয়ে চললাম। এখনও চোখে পড়ছে না কাউন্টের টমটম। তবে কি ওটা আসবে না? যাত্রীদের অস্বস্তি আর উত্তেজিত ভাবটা যেন একটু কমে আসছে। আরও কিছু পর হাতঘড়ি দেখে সবচেয়ে কাছের যাত্রীকে নিচু গলায় কি যেন বলল কোচোয়ান। তেমনি নিচু গলায় উত্তর দিল যাত্রী ভদ্রলোক, ঘণ্টাখানেক বাকি আছে এখনও। কিসের ঘণ্টাখানেক বাকি আছে? সবটা ব্যাপারই কেমন অদ্ভুত আর রহস্যময় ঠেকল আমার কাছে।

আরও কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর আমার দিকে ফিরে ভাঙা ভাঙা জার্মানিতে কোচোয়ান বলল, আজ বোধহয় আর আসবে না কাউন্টের টমটম। তার চেয়ে এক কাজ করুন না, অযথা এই বুনো পথে টমটমের অপেক্ষা না করে আমাদের সাথে বুকোভিনায় চলুন। সেখান থেকে তাল, না-না, পরশু ফিরে আসবেন!

কোচোয়ানের কথা শেষ হবার আগেই তীক্ষ্ণ হ্রেষা ধ্বনিতে চমকে উঠলাম। ভয়ঙ্কর কোন কিছুর গন্ধ পেয়েছে বোধহয় আমাদের ঘোড়াগুলো। ধমকে থেমে দাঁড়িয়ে, নাক তুলে বাতাসে কি যেন শুকছে আর চেঁচাচ্ছে ওগুলো। কোন অজানা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে থেমে গেল দুএকজন যাত্রী।

ঠিক সেই সময় গাড়ির চাকা আয় ঘোড়ার খুরের শব্দে পিছন ফিরে চাইলাম। যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হয়েছে চার ঘোড়ায় টানা সুন্দর একটা ফিটন। আমাদের লণ্ঠনের আলোয় দেখলাম চারটে ঘোড়াই কুচকুচে কালো রঙের, আর আশ্চর্য বলিষ্ঠ এবং সুন্দর। ফিটনটা থেমে দাঁড়াতেই চালকের আসন থেকে নেমে এল লম্বামত একজন লোক। বাদামী দাড়িতে ঢাকা লোকটার মুখ মাথার বিশাল কালো টুপিটা সামনের দিকে টেনে দেয়া, তাতে মুখের প্রায় সবটাই ঢাকা পড়ে গেছে। সোজা আমার দিকে এগিয়ে এল আগন্তুক। মুখ তুলে চাইতেই মণ্ঠনের আলোয় এক পলকের জন্যে দেখলাম লোকটার টকটকে লাল দুটো চোখ। কোচোয়ানের দিকে ফিরে ধরা গলায়, অনেকটা শাসনের সুরে বলল আগন্তুক, আজ এত তাড়া কেন, গলায় কাঁটা আটকেছে নাকি?

যেন ভয়ঙ্কর কোন অপরাধ করে ধরা পড়ে গেছে, তাই দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে এমন ভাবে উত্তর দিল কোচোয়ান, না না, কি যে বলেন। আসলে ওই বিদেশী ভদ্রলোক দ্রুত চালাবার জন্যে কেবলই তাড়া লাগাচ্ছিলেন কিনা, তাই…

তাই তাকে বুকোভিনায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে? কোচোয়ানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ধমকে উঠল আগন্তুক, ফের আমার সঙ্গে চালাকির চেষ্টা করলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব। জানো না আমার শক্তি সম্পর্কে? আমার ওই ঘোড়ার সাথে দৌড়ে পারবে তোমার ঘোড়াগুলো?

একটু অবাক হয়েই আগন্তুকের কথা শুনছি। লণ্ঠনের আবছা আলো এসে পড়েছে ওর চোখে-মুখে। সে আলোয় দেখলাম রুক্ষ কঠিন লোকটার মুখ। কড়া করে লিপস্টিক লাগানো লাল টুকটুকে ঠোঁটের মত দুটো ঠোঁটের ভেতর ঝিকমিক করছে মুক্তোর মত সাদা তীক্ষ্ণ দাত। আগন্তুক কোচোয়ানকে শেষ প্রশ্নটা করতেই আমার কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল পাশের সহযাত্রী, তা বটে, মৃত্যুর ঘোড়া একটু জোরেই ছোটে।

এত আস্তে কথা বলল সহযাত্রী যে কোনরকমে কথাটার মানে বুঝলাম আমি। কিন্তু চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের দিকে চাইল আগন্তুক। আমার মনে হল কথাটা শুনতে পেয়েছে সে। কিন্তু কি করে শুনল? তার শ্রবণশক্তি কি এতই প্রখর? আমার পাশের সহযাত্রীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসল আগন্তুক। সাথে সাথে চমকে বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকল সহযাত্রী। পাত্তা দিল না আগন্তুক। সহযাত্রীর দিকে হাত বাড়িয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, ভদ্রলোকের জিনিসপত্রগুলো দিন।

সঙ্গে এনেছি শুধু একটা স্যুটকেস। সেটাই নিয়ে ফিটনে তুলে রাখল আগন্তুক। তারপর ফিরে এসে আমাকে নামার ইঙ্গিত করল। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ফিটনে উঠলাম আমি। ফিটনে উঠতে আমাকে সাহায্য করল আগন্তুক। তার হাতের ছোঁয়া লাগতেই যেন শির শির করে উঠল আমার গা। ইস্পাতের মত কঠিন আগন্তুকের হাতের আঙুলগুলো। এ থেকেই লোকটার শরীরের আসুরিক শক্তি সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেল আমার।

আমি ফিটনে উঠে বসতেই চালকের আসনে উঠে বসল আগন্তুক। সাপের মত হিস হিস করে উঠল তার হাতের চাবুক। বিদ্যুতের মত লাফিয়ে উঠে একপাক ঘুরে অন্ধকার গিরিপথের দিকে ছুটে চলল ঘোড়াগুলো। ফিটনটা ঘোরার সময়ই আগের গাড়িটার দিকে চোখ পড়েছিল আমার। প্রচণ্ড ভয়ে থর থর করে কাঁপছে ঘোড়াগুলো। আর সমানে বুকে কুশ একে চলেছে যাত্রীরা। ফিটনটা ঘুরে যেতেই ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারল আগের গাড়ির কোচোয়ান। মুহূর্তে প্রাণ ফিরে পেল যেন ঘোড়াগুলো। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলল বুকোভিনার পথ ধরে।

গাড়িটা অন্ধাকারে মিলিয়ে যেতেই একটা একাকীত্ব আর অস্বস্তি চেপে বসল আমার বুকে। প্রচণ্ড শীতে কাটা দিচ্ছে গায়ে। অথচ আগের মতই গায়ে গরম কোট আর গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত গরম কম্বলে জড়ানো। কি করে যেন আমার শীত লাগার ব্যাপারটা টের পেল আগন্তুক। পরিষ্কার জার্মানিতে বলল, প্রচণ্ড শীত পড়েছে আজ। কাউন্ট ড্রাকুলা আপনার সমস্ত সুখ-সুবিধের খেয়াল রাখতে বার বার আদেশ দিয়ে দিয়েছেন আমাকে। আপনার সীটের তলায় একটা দেশী মদের বোতল রাখা আছে, প্রয়োজন মনে করলে বের করে নিয়ে শরীরটা একটু গরম করতে পারেন।

প্রয়োজন মনে করলাম না। তবু ওটা আছে জেনে মনে মনে খুশি হয়ে উঠলাম। আসলে ভয় করছে না আমার, কিন্তু তবু কেমন যেন একটা অস্বস্তির মত ভাব থেকে থেকেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে মনের ভেতর। অত্যন্ত জরুরী কাজ না থাকলে ঝড়ের রাতে এভাবে অজানা বুনো পথে পাড়ি দেয়ার চেয়ে হোটেলের আরামদায়ক কামরায় নিজেকে আটকে রাখতেই বেশি পছন্দ করতাম আমি।

প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে ফিটন। একটু এগিয়ে যাবার পরই মোড় ঘুরে আর একটা পাহাড়ী পথে গাড়ি ছোটাল আগন্তুক। হঠাৎ একটা অদ্ভুত সন্দেহ জাগল আমার মনে। বাকের পর বাঁক ঘুরে মনে হল একই পথে বার বার ঘুরে বেড়াচ্ছে গাড়িটা। সন্দেহটা জাগতেই সতর্ক হলাম। আবার বঁক ঘুরতেই সেটার কয়েকটা বিশেষ চিহ্ন মনে গেঁথে নিলাম। একটু পরই আমার সন্দেহের নিরসন হল, যা ভেবেছিলাম তাই, একই পথে বার বার ঘুরছে গাড়িটা। কেন? একবার ভাবলাম, ব্যাপারটা আগন্তুককে জিজ্ঞেস করে দেখি। কিন্তু পরক্ষণেই বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা।

কোন কারণে হয়ত ইচ্ছে করেই দেরি করছে সে। তাই যদি হয়, তাহলে জিজ্ঞেস করলেও সদুত্তর পাব না। পকেট থেকে দেশলাই বের করে জেলে ঘড়ি দেখলাম। সময় দেখেই একটা কুসংস্কারের কথা মনে পড়ল। নিজের অজান্তেই ধক করে উঠলো হৃদপিণ্ডটা। মাঝ রাত হতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। মাঝ রাতের পরপরই নাকি জেগে ওঠে সমস্ত অশুভ প্রেতাত্মা আর পিশাচেরা। একটু যে ভয় পেলাম না তা নয়, তবু যুক্তি তর্ক দিয়ে জোর করে ভয়টা তাড়াবার চেষ্টা করলাম।

আরও কয়েক মিনিট পরই দূরে কোথাও আর্তস্বরে ডেকে উঠল একটা কুকুর। সেটার প্রত্যুত্তরে আর একটা, তারপর আর একটা। হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠল যেন বুনো পাহাড়ী এলাকা। শত শত কুকুরের ক্রুদ্ধ চিৎকারে খান খান হয়ে ভেঙে গেল আশপাশের নিস্তব্ধতা। পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে শতগুণ বেড়ে গেল সেই শব্দ ঝংকার।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ফিটনের ঘোড়াগুলো। আগন্তুকের শত আশ্বাস সত্ত্বেও আর এক পা এগোল না ওগুলো। মনে হল প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। যে-কোন মুহূর্তে বাঁধন ছিঁড়ে গাড়ি ফেলে পালাতে পারে। হঠাৎ থেমে গেল কুকুরের ডাক। তার পরিবর্তে শোনা গেল হাজার হাজার নেকড়ের রক্ত-পানি করা চাপা গর্জন। ঘোড়াগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমারই ইচ্ছে করতে লাগল গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে পালাই। কিন্তু পালাব কোথায়? ডাক শুনে মনে হচ্ছে আমাদেরকে ঘিরে এগিয়ে আসছে নেকড়ের দল। ঘোড়াগুলোকে আয়ত্তে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল আগন্তুক। ধীরে ধীরে একটু শান্ত হয়ে এল ঘোড়াগুলো, কিন্তু শরীরের কাঁপুনি বন্ধ হল না ওগুলোর। লাফ দিয়ে চালকের আসন থেকে নেমে এল আগন্তুক, ঘোড়াগুলোর কানে কানে কি যেন বলল। সাথে সাথেই স্বাভাবিক হয়ে এল ঘোড়াগুলো। আবার চালকের আসনে উঠে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল আগন্তুক।

আগের মত আর একই জায়গায় ঘুরছে না এখন গাড়িটা। দ্রুত গিরিপথটা পার হয়ে এসে হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ মোড় নিল ডাইনে। একটা অত্যন্ত সংকীর্ণ পথে এসে পড়ল গাড়িটা। দুপাশ থেকে পথের ওপর এসে ঝুঁকে পড়েছে ঝাঁকড়া গাছ। গায়ে গায়ে লেগে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো, আর ওগুলোর ডালপালা এমনভাবে এসে পড়েছে রাস্তার ওপর, মনে হল সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছি। ডাপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাঝে-মধ্যে চোখে পড়ছে এক আধটা পাহাড়ের চূড়ার আবছা অবয়ব। বাইরে তখন প্রচণ্ড বেগে ফুসছে ঝড়, আর প্রচণ্ড বেগেই পরস্পরের গায়ে বাড়ি খাচ্ছে গাছের ডালপালাগুলো। শীতের তীব্রতা আরও বেড়ে গেছে, তার ওপর কুয়াশার মত হালকা তুষারপাতও শুরু হয়েছে। তুষারের চাদরে ঢাকা পড়ে আরও অন্ধকার হয়ে গেছে রাত। হিমেল হাওয়ায় ভর করে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের আর্ত চিৎকার। হঠাৎ আবার শোনা গেল নেকড়ের চাপা গোঙানি। ভেবেছিলাম চলে গেছে নেকড়েগুলো। কিন্তু যায়নি, বরং আমাদেরকে ঘিরে আরও কাছিয়ে এসেছে। প্রচণ্ড ভয় পেলাম এবার। কিন্তু বিন্দুমাত্র ভয় পেল না আগন্তুক। বোধহয় রোজ রাতেই নেকড়ের ডাক শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।

ঠিক এমনি সময় ঘটল ঘটনাটা। আমার বাঁ দিকে দূরে দপ করে জ্বলে উঠল একটা নীলচে আলোর শিখা। আলোটা দেখেই রাশ টেনে ঘোড়া থামাল আগন্তুক। লাফ দিয়ে চালকের আসন থেকে নেমেই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল সে গভীর অন্ধকারে। কোনদিকে যে গেল বুঝতে পারলাম না। ওদিকে ক্রমেই এগিয়ে আসছে নেকড়ের গর্জন।

কয়েক সেকেণ্ড পরই আবার ফিরে এল আগন্তুক। কোন কথা না বলে চালকের আসনে উঠে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল। একবার মনে হল, ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম, না ঠিকই তো আছি! হঠাৎ আবার দেখা গেল সেই নীলচে আলোটা। এবার একেবারে গাড়ির পাশেই। তীব্র উজ্জ্বল আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল চালক আর ঘোড়াগুলোকে। মুহূর্তে গাড়ি থেকে নেমে কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে আলোটাকে তাড়া লাগাল আগন্তুক।

যে-কোন প্রকার আলোর সামনে কোন মানুষ দাঁড়ালে তা তার শরীরের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতে বাধ্য, অথচ আশ্চর্য, এ ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটল না। নীল আলোটার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল আগন্তুক, কিন্তু তার শরীরের আড়ালে ঢাকা পড়ল না আলোর শিখা। আগন্তুকের এপাশে বসে আগের মতই পরিষ্কার আলোর শিখাটা চোখে পড়ছে আমার। আগন্তুক যেন রক্ত-মাংসের মানুষ না, হালকা কাচের তৈরি। এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখা তো দূরের কথা, কখনও কল্পনাও করিনি আমি। একটা শিরশিরে আতঙ্কে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলাম।

কয়েক সেকেণ্ড পরই দপ করে নিভে গেল নীল আগুনের শিখা, আর জ্বলল। ফিরে এসে গাড়ি ছেড়ে দিল আগন্তুক। ওদিকে চারদিক ঘিরে আরও এগিয়ে এসেছে নেকড়ের গর্জন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর গাড়ি থেকে নেমে কোথায় যেন চলে গেল আগন্তুক। সে চলে যেতেই আতঙ্কে থর থর করে কাঁপতে লাগল ঘোড়াগুলো। কারণটা বুঝতে পারলাম না।

হঠাৎ খেয়াল করলাম নেকড়ের ডাক থেমে গেছে। দেবদারুর বন আর পাহাড়ের মাথার ওপরের কালো মেঘের ফাঁক থেকে হঠাৎ করেই বেরিয়ে এল চাঁদ। জীবনে চাদের বহু রূপ দেখেছি, কিন্তু সেদিনের রূপের সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত আমি। অদ্ভুত এক ছায়া ছায়া ভৌতিক আলো ছড়িয়ে পড়েছে দেবদারুর মাথায় আর পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়। সেই আবছা চাঁদের আলোতেই চোখে পড়ল জানোয়ারগুলো। ধূসর লোমশ শরীর, ঝকঝকে সাদা দাঁতে ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসা টকটকে লাল জিভ আর পেশল শরীর নিয়ে আমাদের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার নেকড়ে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল, যে-কোন মুহূর্তে আক্রমণ করে বসতে পারে ওরা। সত্যি কথা বলতে কি, জীবনে এত ভয় পাইনি আমি কখনও।

হঠাৎ কানে তালা লাগানো শব্দ করে একসঙ্গে ডেকে উঠল সব কটা নেকড়ে। আেতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল ঘোড়াগুলো। বহু আগেই গাড়ি ফেলে যে যেদিকে পারত ছুট লাগাত ঘোড়াগুলো, কিন্তু চারপাশ থেকে ঘিরে আছে নেকড়ের দল। কোন দিকে যাবার পথ নেই, তাই যেতে পারছে না।

পাগলের মত চেঁচিয়ে আগন্তুককে ডাকতে শুরু করলাম আমি। হঠাৎ রাস্তার একপাশে চোখ পড়তেই দেখলাম সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। কোন ভাবান্তর নেই তার মধ্যে। আরও কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল আগন্তুক, তারপর দুহাত সামনে বাড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাড়াতে লাগল, বোধহয় দূর হয়ে যেতে বলছে হতচ্ছাড়া নেকড়েগুলোকে। চোখের সামনে দেখলাম লোকটার হাতের ইশারায় গর্জাতে গর্জতেই পিছিয়ে যাচ্ছে নেকড়ের দল। আর ওদের সাথে তাল রেখেই বোধহয় যেমনি আচমকা বেরিয়ে এসেছিল তেমনি আবার মেঘের ফাঁকে ঢুকে গেল চাদ। আবার নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক।

টের পেলাম গাড়িতে উঠে বসেছে আগন্তুক। চলতে শুরু করল গাড়ি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ আগের অদ্ভুত ঘটনাটা মন থেকে তাড়াতে পারলাম না কিছুতেই। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুকের ছাতি। আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপছে হাত-পা। বিমূঢ়ের মত বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকলাম।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল বলতে পারি না। হঠাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তেই চমক ভাঙল। বিশাল এক প্রাসাদ-দুর্গের আঙিনায় এসে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। বিশাল প্রাসাদের তেমনি বিশাল সব জানালার কোথাও আলোর চিহ্নমাত্র চোখে পড়ল না। কখন যে আবার মেঘের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেছে চাঁদ, খেয়াল করিনি। সেই চাঁদের আলোয় দুর্গের মাথায় প্রাচীন কামান বসানর ধাজ-কাটা ভাঙা ফোকরগুলো চোখে পড়ছে। কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ-দুর্গে এসে পৌঁছুলাম শেষ পর্যন্ত।

বিশাল প্রাঙ্গণে এসে গাড়ি থামতেই লাফিয়ে নিচে নামল আগন্তুক। গাড়ির দরজা খুলে হাত ধরে আমাকে নামতে সাহায্য করল সে। দ্বিতীয় বারের মত সেদিন অনুভব করলাম তার হাতের ইস্পাত কঠিন আঙুলের শক্তি। স্যুটকেসটা গাড়ি থেকে নামিয়ে আনল সে। তীক্ষ্ণ লোহার পেরেক গাথা ভারি প্রকাণ্ড দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে কালের কষাঘাতে জর্জরিত রুক্ষ পাথরের দেয়ালগুলো দেখতে লাগলাম। সুটকেসটা আমার পাশে নামিয়ে রেখে আবার গিয়ে গাড়িতে উঠল আগন্তুক, তারপর গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই।

আবছা অন্ধকারে বিশাল এক ভৌতিক বাড়ির প্রাঙ্গণে ভূতের মতই দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। কি করব বুঝতে পারছি না। ঘণ্টা জাতীয় কিছু নেই দরজায়, থাকলে তা বাজিয়ে লোকদের ডাকা যেত। চেঁচিয়েও লাভ নেই, কারণ সারা জীবন এখানে দাঁড়িয়ে চেঁচালেও এই নিরেট পাথরের দেয়াল ভেদ করে আমার কণ্ঠস্বর ওপারে গিয়ে পৌঁছুবে না। ক্রমেই নানারকম সন্দেহ আর ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করেছে মনে। এ কোথায় এসে পড়লাম? কি দরকার ছিল এই সৃষ্টিছাড়া অভিযানের? একজন আইনজীবীর অধীনস্থ কেরানির পক্ষে বহুদূরে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় বাস করা একজন বিদেশীর কাছে লণ্ডনের সম্পত্তি কেনার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করতে আসা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? আসলে আমার এই কেরানিগিরিটাকে মিনা কোনদিনই ভালো চোখে দেখতে পারেনি। প্রায় জোর করে আমাকে দিয়ে এল. এল. বি. পরীক্ষাটা দিইয়েছিল মিনা, এখানে আসার ঠিক আগের দিন জানতে পেরেছি ভালমতই পাস করেছি পরীক্ষায়। ইচ্ছে আছে, এখান থেকে ফিরে গিয়ে পুরোদস্তুর উকিল হয়ে বসব। কিন্তু যে ভূতুড়ে এলাকায় এসে ঢুকেছি, আদৌ কোনদিন লস্তানে ফিরে যেতে পারব কি না কে জানে।

কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাত পাঁচ ভাবছিলাম জানি না। হঠাৎ দরজার ওপারে কার ভারী পায়ের শব্দে চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে এলাম। কপাটের ফাঁক দিয়ে আসা অস্পষ্ট আলোও চোখে পড়ছে এখন। দুএক সেকেন্ড পরই কপাটের ওপারে লোহার ভারী খিল খোলার শব্দ শোনা গেল। তারপর বহুদিনের না খোলা মরচে ধরা তালা খোলার শব্দ। পরক্ষণেই বিশ্রী ঘড় ঘড় আওয়াজ করে খুলে গেল ভারী লোহার পালা।

গলা থেকে পা পর্যন্ত কালো আলখাল্লায় ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন একজন দীর্ঘকায় বৃদ্ধ। হাতে ধরা প্রাচীন আমলের চিমনিবিহীন জাপোর বাতিদানে বসানো মোমর আলোয় প্রথমেই চোখে পড়ল তাঁর নাকের নিচের ধবধবে সাদা পুরু গোঁফ আর পরিষ্কার কামানো চিবুক। ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে আন্তরিকতার সুরে পরিষ্কার ইংরেজিতে আমায় আমন্ত্রণ জানালেন বৃদ্ধ, আপনার জন্যে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি আমি। আসুন!

স্যুটকেসটা তুলে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। জোর করে আমার হাত থেকে স্যুটকেসটা নিয়ে নিলেন বৃদ্ধ, তারপর ইঙ্গিতে এগিয়ে যেতে বললেন। বলেই কি মনে করে, বোধহয় এতক্ষণ হাত মেলাতে মনে ছিল না বলে একটু লজ্জিত ভাবেই আমার ডান হাতটা চেপে ধরলেন তিনি। চমকে উঠলাম। বহুক্ষণ আগে মরে যাওয়া মানুষের মত ঠাণ্ডা ওর হাত। আমার চমকে ওঠাটা বৃদ্ধের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। মৃদু হেসে বললেন তিনি, দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। ওপরে চলুন।

আমার হাত চেপে ধরা আর ঝাঁকুনি দেয়ার ভঙ্গি দেখে চকিতে আগন্তুকে কথা মনে পড়ে গেল আমার। সেই আগন্তুক ভদ্রলোক আর এই বৃদ্ধ একই লোক নয়ত? কথাটা কেন মনে এল বুঝতে পারলাম না, কিন্তু কেন যেন মনে হতে লাগল  দুজন একই লোক। হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলাম, আপনি, কি কাউন্ট ড্রাকুলা?

ঠিক ধরেছেন, বিনয়ে বিগলিত ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালেন বৃদ্ধ, আমিই কাউন্ট ড্রাকুলা। বলেই সচকিত হয়ে উঠলেন কাউন্ট, এখন চলুন তো। বাইরে এই প্রচণ্ড ঠাস্তায় দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে চলুন, সেখানেই আপনার সব প্রশ্নের জবাব পাবেন। তাছাড়া পথশ্রমে নিশ্চয়ই আপনি ক্লান্ত। খাওয়া এবং বিশ্রামেরও দরকার আছে আপনার।

বলতে বলতেই পাশের দেয়ালের তাকে বাতিদানটা রেখে দিয়ে চওড়া গোরানো সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে ওপরে উঠতে শুরু করলেন কাউন্ট। কয়েক তলা উঠে লম্বা টানা বারান্দা। নিঝুম নিস্তব্ধ বারান্দায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমাদের পায়ের ভারী শব্দ। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা ভারী দরজা ঠেলে খুলে আমাকে ভেতরে ঢুকতে আহ্বান জানালেন কাউন্ট। ঘরের ভেতরে ঢুকেই খুশি হয়ে উঠল মনটা আলোয় ঝলমল করছে বিশাল কক্ষটা। বিশাল একটা ডাইনিং টেবিল রাখা আছে ঘরের মাঝখানে। ঘরের কোণের বিরাট ফায়ারপ্লেসে জ্বলছে গনগনে আগুন।

আমি ঢুকতেই সুটকেসটা নামিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে দিলেন কাউন্ট। এগিয়ে গিয়ে ঘরের অন্য পাশের দরজাটা খুললেন। দরজা খুলতেই চোখে পড়ল জানালাশূন্য ছোট্ট একটা আটকোন ঘর, একটি মাত্র, মোমবাতি জ্বলছে সে ঘরে। সে ঘরটাও পেরিয়ে গিয়ে অন্যপাশের দরজাটা খুললেন কাউন্ট, তারপর ইঙ্গিতে ডাকলেন আমাকে। তৃতীয় ঘরটায় গিয়ে ঢুকলাম। চমৎকার করে সাজানো ঘরটা। খাট, ফায়ারপ্লেস ইত্যাদি বেশ কায়দা করে জায়গামত রাখা হয়েছে। নিজে গিয়ে প্রথম ঘরটা থেকে আমার স্যুটকেসটা বয়ে আনলেন কাউন্ট। সেটা জায়গামত রাখতে রাখতে বললেন, বাথরুমে গিয়ে ভালমত হাত-মুখ ধুয়ে নিন, চাইলে গোসলও সেরে নিতে পারেন। গরম পানি আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে ওখানে। কাজ শেষ করে সোজা ডাইনিং রূমে চলে আসুন। আমি অপেক্ষা করব সেখানে, বলেই দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেনকাউন্ট।

কাউন্টের ব্যবহারে সন্দেহ ও আশঙ্কার আর লেশমাত্র থাকল না আমার মনে। মনটা স্বাভাবিক হয়ে আসতেই চেগিয়ে উঠল খিদে। ভাড়ি কাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রূমে গিয়ে ঢুকলাম। ফায়ারপ্লেসের একপাশে পাথরের দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আহেন কাউন্ট। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রাশি রাশি খাবার সাজানো ডাইনিং টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, নিশ্চয়ই খদে পেয়েছে খুব? আপনি আসার আগেই খেয়ে নিয়েছি আমি। সুতরাং হযর্থ? দেরি না করে বসে পড়ুন।

খাওয়ার টেবিলে বসে পড়ে প্রথমে মিস্টার হকিন্সের কাছ থেকে নিয়ে আসি। চিঠিটা পকেট থেকে বের করে কাউন্টের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম আমি। চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করলেন কাউন্ট। পড়া শেষ হতেই নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল কাউন্টের মুখ। চিঠিটা পড়ে দেখার জন্যে আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। চিঠির শেষের খানিকটা পড়ে আমার মনটাও অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল। হকিন্স লিখেছেন, …হঠাৎ বাতে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় আমি নিজে আপনার সাহায্যে হাজির হতে পারলাম না বলে দুঃখিত। কিন্তু যাকে পাঠাচ্ছি তাকেও নির্ধিধায় আমার আসনে স্থান দিতে পারেন। আমার কাজের জন্যে ওর মত যোগ্য লোক আর খুঁজে পাইনি আমি। আপনার প্রাসাদে থাকাকালীন আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার নির্দেশ আমি দিয়ে দিয়েছি ওকে, অতএব কাজ উদ্ধারের ব্যাপারে যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারেন…

আমার পড়া শেষ হতেই এগিয়ে এসে পেটের ঢাকনা তুলে দিয়ে আমাকে খেতে তাড়া লাগালেন কাউন্ট। চমৎকার রান্না করা মুরগীর রোস্ট, সালাদ, পনির আর এক বোতল পুরানো টোকয় মদ দিয়ে খাওয়া সেরে নিলাম। খাওয়ার পর আমার সাথে গল্প করতে বসলেন কাউন্ট। কাউন্টের অনুরোধেই চেয়ারটা ফায়ারপ্লেসের সামনে টেনে এনে তার মুখোমুখি বসলাম আমি। পকেট থেকে চুরুটের বাক্স বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন কাউন্ট। আমি একটা টেনে নিতেই বাক্সটা বন্ধ করে পুরো বাক্সটাই আমাকে দিয়ে দিলেন তিনি। আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইতেই মৃদু হেসে জানালেন ধূমপানে অভ্যস্ত নন কাউন্ট। তাঁর মেহমানদারীতে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। অতিথির আদর আপ্যায়নে কোন দিকেই ত্রুটি রাখেননি তিনি।

চুরুটে টান দিতে দিতে কাউন্টের চেহারা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম অমি। সম্ভান্ত চেহারা, দেখলেই বোঝা যায় কাউন্ট হবার সম্পূর্ণ যোগ্যতা আছে এ লোকের ভরাট মুখে রাজ্যের গাম্ভীর্য, বলিষ্ঠ চিবুক, ঈগলের ঠোঁটের মত বাকানো নাক, চওড়া ঢালু কপাল যেন পাথর কুঁদে বের করে আনা হয়েছে। আশ্চর্য ঘন কালো ভুরু, আর মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চুল আর ভুরু ঘন কালো অথচ গোফ সম্পূর্ণ সাদা, ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো!

টুকটুকে লাল ঠোঁটের প্রান্ত ঠেলে একটু সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে ঝকঝকে সাদা তীক্ষ্ণ দাত, এটাও কেমন যেন বেখাপ্পা লাগল আমার কাছের পাতলা কানের আগাদুটো ছুঁচালো হয়ে উঠে গেছে। সব মিলিয়ে আমার মনে হল এ পৃথিবীর মানুষ নন কাউন্ট, এখানে বাস করা যেন তার সাজে না। কথাটা কেন মনে হল বুঝতে পারলাম না।

হাঁটুর ওপর রাখা কাউন্টের হাতের বেটে রুক্ষ আঙুলগুলোর দীর্ঘ নখগুলো পাশ থেকে কেটে তীক্ষ্ণ করা। হঠাৎ তার হাতের তালু দুটো উল্টাতেই একটা জিনিস দেখে চমকে উঠলাম, দুহাতের তালুতেই কয়েক গোছা করে চুল। ভারি অদ্ভুত তো! কথা বলার জন্যে আমার দিকে একটু ঝুঁকে আসতেই ওঁর দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিলাম আমি। নিঃশ্বাসে ওঁর বোটকা পচা গন্ধ। কোন মানুষের নিঃশ্বাসে অমন পচা গন্ধ থাকতে পারে ভাবিনি কখনও। আমার মুখ বাঁকানো দেখে মুচকে হাসলেন কাউন্ট। হাসার সময় স্পষ্ট দেখা গেল দুপাশের ঠেলে বেরিয়ে আসা দত।

হঠাৎ চারদিকের নিঃসীম নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিয়ে উপত্যকার দিক থেকে ভেসে এল হাজারো নেকড়ের চাপা হিংস্র গর্জন। নিজের অজান্তেই শিউরে উঠে জানালার দিকে চাইতেই দেখলাম বাইরে শেষ হয়ে আসছে রাত। ইতিমধ্যেই ফিকে হতে শুরু করেছে নিকষ কালো অন্ধকার। নেকড়ের গর্জন শুনে চাপা উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠল কাউন্টের দুচোখ। আবেগ জড়িত গলায় বললেন তিনি, শুনেছেন কেমন সুন্দর গান গাইছে ওরা? গাইবেই তো, আসলে ওরা যে আঁধারের সন্তান।

তাঁর কথায় আমার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠতেই মৃদু হেসে বললেন কাউন্ট, আসলে সবাই সব কিছু বোঝে না। তাছাড়া আপনারা শহুরে মানুষ, কিসে শিকারার আনন্দ তা আপনাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি,

ভোর হয়ে আসছে। ভুলেই গিয়েছিলাম পথশ্রমে আপনি ক্লান্ত। যান, আর দেরি না। করে শুয়ে পড়ুনগে। একটা বিশেষ কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে আমাকে। তাই সাঁঝের আগে দেখা পাবেন না আমার। নিজেই এগিয়ে গিয়ে আমার শোবার ঘরের দরজা মেলে ধরলেন কাউন্ট। আমি ঘরে ঢুকতেই দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন তিনি। হঠাৎ নিঃসীম একাকীত্বে পেয়ে বসল আমাকে। অকারণেই ছমছম করে উঠল গা। মন বলছে ভয়ঙ্কর কোন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমি।

৭ মে।

জানালার দিকে চাইতেই দেখলাম অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে। ব্যাপার কি? একদিনে দুবার ভোর হতে পারে না। হঠাৎ বুকতে পারলাম ব্যাপারটা এক কাক ভোরে ঘুমিয়ে আরেক কাক ভোরে জেগে উঠেছি আমি। মাঝখানে পার হয়ে গেছে পুরো একটা দিন আর রাত। বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম। কাপড় জামা পাল্টে নিয়ে ডাইনিং রূমে এসে ঢুকতেই টেবিলে সাজানো নাস্তার দিকে চোখ পড়ল। এক পাশে ঢাকা দেয়া কফির পত্র। এগিয়ে গিয়ে ঢাকন খুলতেই বাষ্প বেরিয়ে এল কফির পাত্র থেকে। বোধহয় মিনিট খানেকও হয়নি পাত্রটা রেখে গেছে কেউ। টেবিলে রাখা বাতিদানে মোমবাতি জ্বলছে। তার একপাশে পেপার-ওয়েট দিয়ে চেপে রাখা একটুকরো কাগজের দিকে চোখ পড়ল। তাতে কি যেন লেখা। এগিয়ে গিয়ে কাগজটা তুলে নিয়ে পড়লামঃ জরুরী কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে আমাকে। আপনাকে একা একা নাস্তা সারতে হচ্ছে বলে দুঃখিত-ড্রাকুলা।

একা একাই নাস্তা সেরে নিলাম। একটা ব্যাপার বড় আশ্চর্য লাগল। এত বড় বাড়িটা এত নিঝুম কেন? চাকর-বাঁকর বা অন্য কোন লোকজন নেই নাকি? চাকরদের ডাকার জন্যে ঘন্টী-টন্টি জাতীয় কিছু পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে শুরু করলাম, কিন্তু সে রকম কিছুই চোখে পড়ল না।

খুঁজতে খুঁজতে বাড়িটার অফুরন্ত প্রাচুর্য চোখে পড়ল। টেবিলে রাখা প্রত্যেকটা বাসন পেয়ালা খাঁটি সোনার তৈরি। এত সুন্দর কারুকাজ করা তৈজসপত্র আজকের দিনে দুর্লভ। আমার বেডরুমের দরজা-জানালার পর্দা আর সোফার কভারগুলো অপূর্ব সুন্দর আর দুর্লভ মখমলের তৈরি। দেখেই বোঝা যায়। কয়েক শতাব্দী আগে তৈরি হয়েছে এসব, অথচ এখনও কি আশ্চর্য সুন্দর আর ঝলমলে। ঘরের কোথাও আয়না জাতীয় কিছু চোখে পড়ল না। এটাও আশ্চর্য। এত বড় বাড়ি আর প্রাচুর্যের মধ্যে চাকর-বাঁকর না থাকার মতই কচি না থাকাও কেমন যেন বেমানান।

এখনও ভাল করে ভোরের আলো ফোটেনি। এসময় বাইরে বেরনো যাবে না, আর কাউন্টের বিনা অনুমতিতে বাইরে বেরোনো উচিত হবে না।

পড়ার মত বই-টই পাওয়া যায় কিনা খুঁজতে শুরু করলাম। ছোট্ট আটকেনা ঘরের তৃতীয় দরজা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। দরজার ওপাশে বেশ বড় একটা ঘর। হ্যাঁ, পড়ার ঘরই। দেয়াল-জোড়া বুক-কেসগুলো চামড়ায় বাঁধানো অজস্র বইয়ে ঠাসা। প্রায় সব বিষয়ের ওপরেই বই আছে সেখানে। অধিকাংশই ইংরেজি। আর আছে আইনের বই। বইগুলো দেখে খুশি হয়ে উঠল মনটা। ডুবে গেলাম বইগুলোর মধ্যে। বাড়ছে বেলা।

গভীর মনোযোগের সাথে বইগুলো দেখছি, এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে এসে ঢুকলেন কাউন্ট। বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে বললেন, চমত্তার, মি. হারকার। আপনিও দেখছি আমার মতই বইয়ের পোকা। একটু থেমে আবার। বললেন, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? বইগুলোর বেশিরভাগই ইংরেজি। আসলে ইংরেজি আর ইংরেজন্তুদের আমার দারুণ ভাল লাগে। আমার জীবনের একটা বড় ইচ্ছা লণ্ডনে বাড়ি করে স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করব, তাই ইংরেজিটা মোটামুটি ভালই আয়ত্ত করে নিয়েছি…

বাধা দিয়ে বললাম, মোটামুটি বলছেন কি, কাউন্ট? আপনি তো ইংরেজদের মতই ইংরেজি বলতে পারেন।

আসলে বাড়িয়ে বলছেন আপনি। তবে হ্যাঁ, গ্রামারটা ভাল মতই আয়ত্ত করে নিয়েছি। আর কাজ চালানো যায় এমন কিছু ইংরেজি শব্দও জানা আছে আমার।

খামোকা বিনয় দেখাচ্ছেন, কাউন্ট। আমার মত যে-কেউই বলবে চমৎকার ইংরেজি জানেন আপনি।

তবুও আপনার কাছে ভাষাটা আর একটু ঝালিয়ে নিতে চাই আমি।

অবশ্যই, আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব আমি। তবে শেখার বাকি নেই খুব একটা। বিষয়টাকে চাপা দেবার জন্যেই বললাম, আচ্ছা, কাউন্ট, আপনার প্রাসাদের ঘরগুলো দেখতে কোন অসুবিধে আছে কি?

অসুবিধে! কিসের অসুবিধে? স্বচ্ছন্দে প্রাসাদের ভেতরে যেখানে আপনার খুশি যেতে পারেন আপনি। তবে একটা কথা, তালা দেয়া ঘরগুলোতে ভুলেও ঢোকার চেষ্টা করবেন না। কারণটা ঠিক বোঝাতে পারব না আপনাকে। তবে এটুকু বলছি, অহেতুক কৌতূহল প্রকাশ করবেন না।

মনে মনে আশ্চর্য হলেও মুখে বললাম, তা আপনি যা বলেন।

আমার কথায় অবাক হবেন না। ট্রানসিলভেনিয়ায় যখন এসেছেন নতুন অনেক কিছুই দেখতে পাবেন, জানতে পারবেন। অবশ্য ইতিমধ্যেই অদ্ভুত অনেক কিছু নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছেন আপনি।

আরও আশ্চর্য হলাম। ইতিমধ্যেই কিছু দেখেছি তা কাউন্ট জানলেন কি করে? একটানা বকবক করে চললেন কাউন্ট। প্রাসাদ-দুর্গ এবং আশেপাশের এলাকা সম্পর্কে তাকে কিছু প্রশ্ন করলাম, অনেক প্রশ্নের জবাবই কৌশলে এড়িয়ে গেলেন তিনি। দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে একসময় জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, একটা কথা কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছি না, কাউন্ট। সেদিন রাতে ঘোড়ার গাড়িতে করে আসার সময় একটা অদ্ভুত নীল আলো চোখে পড়েছিল আমার। এ সম্পর্কে আপনার কিছু জানা আছে কি?

আছে, মুচকি হাসলেন কাউন্ট, এখানকার লোকদের ধারণা বছরের বিশেষ একটা দিনে মাঝরাতের পর সমস্ত প্রেতাত্মারা জেগে ওঠে। ধন-রত্নের পাহারাদার প্রেতাত্মারা যেখানে থাকে সেখানে জ্বলতে শুরু করে ওই অদ্ভুত নীল আলো। আসলে ওদের গা থেকেই বেরোয় ওই আলোর ছটা।

আশ্চর্য!

হ্যাঁ, তাই। গতকালই গেছে সেই বিশেষ দিনটি। যেসব এলাকা পার হয়ে এসেছেন আপনি সেসব এলাকার মাটির নিচে প্রাচীন ধন ভাণ্ডার চাপা পড়ে থাকা খুবই স্বাভাবিক। যুদ্ধের আগে ট্রানসিলভেনিয়ার সমস্ত ধনী ব্যক্তিরা ওই এলাকার পাশেই বসবাস করত।

ওই নীল আলো সম্পর্কে এখানকার লোকেরা জানে, বোধহয় দেখেও থাকবে কেউ কেউ। তা সত্ত্বেও ওই গুপ্তধন এতদিন অনাবিষ্কৃত থাকল কি করে?

জোরে শব্দ করে হাসলেন কাউন্ট। আলোর ছটা ঝিক করে উঠল দুপাশের তীক্ষ্ণধার দাঁত দুটোয়। হাসিটা স্তিমিত হয়ে এলে বললেন, আগেই বলেছি, নীলচে আলো দেখা যায় শুধু বছরের বিশেষ একটা রাতে। ওই রাতে দরজায় শক্ত করে খিল এঁটে ঘরে বসে ইষ্ট নাম জপ করতে থাকে এ এলাকার ভীত গেয়ো মানুষের দল। ভুলেও ঘরের বাইরে পা বাড়াতে সাহস করে না ওরা। আর যদি ঘরের ফঁক-ফোকর দিয়ে কেউ দেখেও ফেলে ওই আলো তাহলেও চোখের ভুল বলে ভুলে যেতে চেষ্টা করে। আসলে আলো দেখা যাওয়া জায়গার ত্রিসীমানায় দিনের বেলাতেও ঘেঁষতে চায় না কেউ।

বুঝলাম।

প্রসঙ্গ বদলে অন্য কথায় চলে গেলেন কাউন্ট। বললেন, যে নো আপনার এখানে আসা সে সম্পর্কেই তো এখন জানা হল না কিছু। আমার কেনার জন্যে নির্দিষ্ট করা বাড়িটা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

আসছি, বলে সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম। স্যুটকেস থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র বের করে নিয়ে আবার পড়ার ঘরে এসে ঢুকলাম। ছোট্ট টেবিলটার সামনের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে এখন ব্রাডসর গাইডের পাতা উল্টাচ্ছেন কাউন্ট। তার পাশে একটা সোফায় বসে পড়ে দলিলের নকল, টাকার হিসেব-পত্র সব বুঝিয়ে বললাম। বাড়ির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং প্রতিবেশীদের সম্পর্কে আমাকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি। মনে হল সব শুনে সন্তুষ্ট হয়েছেন কাউন্ট। স্পষ্টই বোঝা গেল চারধারে উঁচু পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা কুড়ি একর জমির ওপর গাছপালায় ছাওয়া আর গির্জাওয়ালা বহু পুরনো লণ্ডনের ওই নির্জন বাড়িটা কিনতে পেরে খুশি হয়েছেন তিনি। কাউন্টের কথায় মনে হল নির্জনতা আর ছায়া ছায়া অন্ধকারে একা বসে বসে ভাবতে ভাল লাগে ওঁর কারণটা কি? সাংঘাতিক কোন মানসিক আঘাত পেয়েছেন জীবনে? কাউন্টকে দেখার পর থেকে ওর কথা বলার ধরন-ধারণ মোটেই ভাল লাগছে না আমার, আর ওঁকে হাসতে দেখলেই চমকে উঠি, কেমন যেন ভয়ঙ্কর মনে হয় হাসিটা। বুঝতে পারছি না কিসের সাথে এর তুলনা করা চলে।

কি মনে হতেই হঠাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন কাউন্ট, যাবার আগে পেছন থেকে টেনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলেন। সেদিকে একবার চেয়ে আবার বইগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলাম আমি। একটা পাতলা কিন্তু বড় আকারের বইয়ের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল আমার। দেখে মনে হল গত কিছুদিন ধরে বইটা বড় বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। তাক থেকে টেনে নিলাম বইটা। একটা ওয়ার্ল্ডম্যাপ। বইয়ের একজায়গায় পাখির পালক গুঁজে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। পালক গোঁজা পাতাটা খুলে দেখলাম সেটা ইংল্যাণ্ডের মানচিত্র। মানচিত্রের গায়ে কয়েকটা জায়গায় লাল-নীল পেন্সিল দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম জায়গাগুলো। লণ্ডনের পুবদিকে যেখানে ওঁর নতুন বাড়িটা কেনার কথাবার্তা চলছে তার কাছাকাছিই একটা জায়গা চিহ্নিত করা। দ্বিতীয়টা এগজিটার এবং তৃতীয়টা ইয়র্কশায়ার উপকূলের হুইটবি এলাকার কাছাকাছি কোন এক জায়গায়।

কয়েক ঘণ্টা পর আবার ফিরে এলেন কাউন্ট। বললেন, সেরেছে, সারারাত এভাবেই কাটাবেন নাকি? কখন রাত হয়ে গেছে খেয়াল নেই বুঝি? খেতে যেতে হবে না? আসুন, জলদি খেয়ে নিন।

কাউন্টকে অনুসরণ করে ডাইনিং রুমে এসে ঢুকলাম। হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে আমাকে বসিয়ে দিয়ে ফায়ার-প্লেসের কাছের চেয়ারটায় বসলেন কাউন্ট। বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আজও একাই খেতে হচ্ছে আপনাকে। আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।

আমার খাওয়া শেষ হলে গত রাতের মতই একটানা বকবক করে চললেন কাউন্ট। সময় সম্পর্কে আমাদের কারোরই কোন খেয়াল থাকল না। হঠাৎ হিমেল হাওয়ায় ভর করে দূরের কোথাও থেকে ভেসে এল মোরগের ডাক। ভোর হয়ে

সছে তার জানান দিচ্ছে ওরা। রীতিমত চমকে উঠলেন কাউন্ট। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ছিঃ ছি, ভোর হয়ে গেছে। সারাটা রাত আপনাকে আটকে রাখা আমার সত্যিই অন্যায় হয়েছে। আসলে ইংল্যাণ্ডের কথা এসে পড়ায়ই এমনটা ঘটল। ইংল্যাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করতে দারুণ ভাল লাগে আমার। যান, আর দেরি না করে শুয়ে পড়ুনগে, বলেই দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন কাউন্ট।

নিজের ঘরে ফিরে এলাম। জানালার ভারী পর্দাটা সরিয়ে ফেলতেই খোলা আকাশের দিকে চোখ পড়ল। দ্রুত রং বদলাচ্ছে রাতের আকাশ। ইতিমধ্যেই আঁধার কেটে গিয়ে ধূসর হতে শুরু করেছে চারদিক। সারাটা রাত কেটে গেল অথচ এখনও ঘুমের লেশমাত্র নেই আমার চোখে। তাই আবার পর্দাটা টেনে দিয়ে এসে লিখতে বসলাম।

৮ মে।

কাউন্টের প্রাসাদ-দুর্গের কিছু কিছু জিনিস অত্যন্ত রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে আমার। প্রাসাদে পেীছে কাউন্টের সৌজন্যতায় প্রথমে মনে হয়েছিল এখানে আমি নিরাপদ, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তা নয়। সারাটা প্রাসাদে একমাত্র কাউন্ট ছাড়া এ পর্যন্ত অন্য কোন মানুষের ছায়াও চোখে পড়েনি আমার। কাউন্টের ব্যবহারও কেমন যেন অদ্ভুত। দিনের বেলায় ভুলেও দেখা পাওয়া যায় না তার। কোথায় যান, কি করেন বুঝতে পারছি না।

অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে আজ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। সন্ধ্যার পর ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে করে আনা ছোট আয়নাটা আর দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম বের করে নিয়ে জানালার সামনে বসে দাড়ি কামাবার জোগাড় করছি। সবে কামাতে শুরু করেছি এমন সময় কাঁধের ওপর কারও হাতের কঠিন চাপ অনুভব করলাম। ঘুরে তাকাতে যাব এমন সময় কানের কাছে বেজে উঠল কাউন্টের ভারি গলার আওয়াজ, গুড ইভনিং, মি. হারকার।

ঠিক আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন কাউন্ট, অথচ আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছি না আমি। ঘরে ঢোকার সময় তার পায়ের শব্দও আমার কানে যায়নি। ব্যাপারটা কি করে সম্ভব?

আয়নায় কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে চাইলাম। যা ভেবেছিলাম, ঠিক আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন কাউন্ট। সারাটা ঘর এবং ঘরের সমস্ত জিনিসপত্রের প্রতিবিম্ব পড়েছে আয়নায়, অথচ আমার পেছনে দাঁড়ানো কাউন্টকে দেখা যাচ্ছে না কেন? এমন অদ্ভুত কথা তো শুনিনি কখনও! একটা প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম বুঝতে পারলাম না অস্বস্তিটা কিসের, কিন্তু খেয়াল করেছি, কাউন্ট যখনই আমার খুব কাছাকাছি আসেন তখনি এমন বোধ করতে থাকি আমি।

হঠাৎ এমন একটা কাণ্ড করলেন কাউন্ট যে বিস্ময়ে হতবাঁক হয়ে গেলাম আমি। কাউন্ট আমার কাঁধে হাত রাখার পর চমকে উঠে হাত ফসকে গিয়ে গালের খানিকটা জায়গা কেটে গেল আমার। সেখান থেকে বেরিয়ে গাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে রক্ত, টের পাচ্ছি। শুটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে সেটা মুছতে যাব এমন সময় কাউন্টের চোখের দিকে চোখ পড়ল আমার। নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলাম। অস্বাভাবিক ভাবে জ্বলছে কাউন্টের দুটো চোখ। কয়েক মুহূর্ত একভাবে রক্তের দিকে চেয়ে থেকে আচমকা আমার গলাটা চেপে ধরলেন কাউন্ট, মুখটা নিয়ে এলেন চিবুকের খুব কাছে, যেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সেখানে। কিংকর্তব্যবিমঢ়ের মত লাফ দিয়ে পিছিয়ে এলাম! গলা থেকে কাউন্টের হাতটা সরে গিয়ে আমার বুকের ওপর ঝোলানো কুশটায় ঘষা লাগল। একলাফে তিন হাত পিছিয়ে গেলেন কাউন্ট। চোখের পলকে মাবার স্বাভাবিক হয়ে এল ওঁর অবস্থা।

মৃদু হেসে সাফাই গাইবার সুরে বললেন কাউন্ট, দেখুন তো, গালের কতটা কেটে ফেলেছেন! এত অন্যমনস্ক হলে কি চলে? বলেই দাড়ি কামাবার হোট আয়নাটা তুলে নিলেন তিনি। এসব আজেবাজে জিনিস রাখার কোন মানে হয়? ফেলে দিন এটা, বলে আমার অপেক্ষা না করে নিজেই ভোলা জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ওটা। এরপর আর একটাও কথা না বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

মনে মনে দারুণ রেগে গেলাম কাউন্টের ওপর। আয়না ছাড়া দাড়ি কামাব কি করে? শেষ পর্যন্ত পিতলের তৈরি ঝকঝকে ক্ষুরের বাক্সের পিঠেই কোনমতে মুখ দেখে দাড়ি কামানোটা সারলাম। দাড়ি কামিয়ে, বাথরুম সেরে কাপড় পালটে নিয়ে ডাইনিংরূমে এসে ঢুকলাম। টেবিলে যথারীতি খাবার সাজানো রয়েছে, কিন্তু কাউন্ট নেই। অতএব একাই খাওয়া সেরে নিলাম। এখানে আসা অবধি কাউন্টকে কিছু খেতে দেখিনি। খাওয়ার পর একা একা এক জায়গায় ঠায় বসে না থেকে বাতিদান সহ মোমবাতি নিয়ে প্রাসাদটা একটু ঘুরে দেখতে চললাম।

সিঁড়ি বেয়ে অল্পক্ষণেই দক্ষিণমুখো একটা ঘরে এসে পৌঁছুলাম। এ ঘরের জানালার কাছে দাঁড়ালে বাইরের প্রকৃতির অপূর্ব সব দৃশ্য চোখে পড়ে। ওদিকে চাদ উঠেছে। জানালার কাছে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে বাইরের সেই দৃশ্যই দেখতে লাগলাম।

প্রায় খাড়া একটা পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কাউন্টের প্রাসাদদুর্গ। এই জানালা থেকে কোন কিছু ফেলে কোন জায়গায় ঠেকা না খেয়েই পড়বে গিয়ে হাজার ফুট নিচের পাথুরে উপত্যকায়। তারপর থেকে দূর চোখ যায় বন আর বন। চাঁদের আলোয় এই বনকে মনে হল ঢেউ খেলানো উত্তাল সাগর। আসলে অত ওপর আর দূর থেকে ছোট বড় গাছের মাথাগুলোকেই ওরকম দেখাচ্ছে। ওই অদ্ভুত, ধূসর গাছের সাগরের বুক চিরে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে চকচকে রূপালী ফিতে। এগুলো পাহাড়ী নন। চাদের আলোয় ওদের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে শতগুণ। সে-সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

বেশ কিছুক্ষণ সে-দশা দেখে জানালার কাছ থেকে সরে এসে অন্যান্য কক্ষগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম। প্রাসাদ-দুর্গের ভেতরে অজস্র ঘর আর তার দরজা। প্রায় সব কটা ঘরের দরজাতেই তালা মারা। জানালাগুলোতে গরাদ নেই, কিন্তু এমন জায়গায় যে তা গলে বাইরে বেরিয়ে নিচে নামা যাবে না। আর অত ওপর থেকে নিচে নামাটাও সম্পূর্ণ অসম্ভব। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম লোকালয় থেকে বহুদূরে, নির্জন এক রহস্যময় প্রাসাদ-দুর্গে আসলে বন্দী করে রাখা হয়েছে আমাকে। মিনা, সত্যি বলতে কি, ভয় পেয়েছি আমি, টের পাচ্ছি ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আমাকে ঘিরে।

১.২ আমি বন্দী

আমি বন্দী। ব্যাপারটা টের পাবার পরপরই একটা প্রচণ্ড ভয় গ্রাস করে ফেলল আমাকে। পাগলের মত সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। হাতের কাছে যে কটা দরজার সন্ধান পেলাম সব কটা ঠেলে বুলে দেখতে লাগলাম। কিন্তু বৃথা। এ দুর্গ থেকে বেরোবার কোন পথ খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ মনে হল এভাবে পাগলের মত ছুটাছুটি করে লাভ হবে না। মাথাটা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হবে, খুঁটিয়ে দেখতে হবে প্রতিটি সম্ভাবনা। একমাত্র তাহলেই মুক্তি পাওয়ার কোন না কোন উপায় বের করে ফেলতে পারব।

এই সময় নিচে সদর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে বুঝলাম ফিরে এসেছেন কাউন্ট। দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে এসে দেখলাম আমার বিছানা গুছাচ্ছেন তিনি। এ বাড়িতে যে চাকর-বাঁকরের বালাই নেই এটা আরও স্পষ্ট হল আমার কাছে। স্পষ্ট ইতেই আর একটা ভয়ঙ্কর সম্ভানা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মনে। এই দুর্গে যদি আর কেউ না থেকে থাকে তাহলে সেদিন রাতে টমটম চালিয়ে এসেছিল কে? কাউন্ট নিজে? তাই যদি হয় তাহলে তাঁর অঙ্গুলি সঙ্কেতেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল হিংস্র নেকড়ের দল। আতঙ্কে ঘাড়ের কাছটা শিরশির করে উঠল আমার। নিসট্রিজের লোকেরা সেজন্যেই বোধহয় আমার এখানে আসাটা ভাল চোখে দেখছিল না। আর কাউন্টের সম্পর্কে অলৌকিক কোন কথাবার্তা প্রচলিত কয়ই বোধহয় গলা থেকে কুশ খুলে নিয়ে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন হোটলের সেই ভদ্রমহিলা। আগেও বলেছি, এখনও বলছি, ধর্মের প্রতি কোন দিনই আমার তেমন বিশ্বাস নেই। কিন্তু আজ গলার কুশটা স্পর্শ করে যেন কিছুটা সাহস সঞ্চয় করতে পারছি মনে।

এখন থেকে সতর্ক থাকতে হবে আমাকে। আমি যে বন্দী এবং কোন ব্যাপারে কাউন্টকে সন্দেহ করছি তা তাঁকে জানতে দেয়া যাবে না। যার সম্মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জেনে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে তাঁর আসল পরিচয়।

হঠাৎ মধ্যরাতের প্রহর ঘোষণা করল কয়েকটা শেয়াল আর পেঁচা। এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরীতে বসে, মধ্য রাতে শেয়াল আর পেঁচার ডাক হিম করে দেয় বুকের রক্ত। অজানা আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠতে থাকে শরীর।

ঘর পরিষ্কারের কাজ শেষ হলে আমাকে নিয়ে পড়ার ঘরে এসে ঢুকলেন কাউন্ট। একথা-ওকথার মধ্যে দিয়ে ট্রানসিলভেনিয়ার প্রাচীন ইতিহাস এসে পড়ল। যে-ইতিহাস বলতে গিয়ে রীতিমত উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন কাউন্ট। সে-যুগের প্রত্যেকটি ঘটনা, বিশেষ করে যুদ্ধের বর্ণনা এমন ভাবে দিয়ে গেলেন যেন তিনি নিজে সে-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশের প্রতিটা বীরের সম্মানে সম্মানিত, তাদের গৌরবে তিনি গর্বিত, তাদের দুর্ভাগ্য যেন নিজেরই দুর্ভাগ্য। যখনই ওই মৃত্যুপুরী আর তার মারা যাওয়া লোকদের কথা উঠছে তখনি আমরা জেকলিরা শব্দটা এমনভাবে ব্যবহার করছেন যেন কোন গর্বিত সম্রাট তাঁর বিলুপ্ত বংশ গৌরবের কথা বলছেন। তাঁর প্রাঞ্জল বর্ণনার মধ্যে দিয়ে সমস্ত অতীত ইতিহাসটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল আমার। কথা বলতে বলতে ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কাউন্ট। শেষ পর্যন্ত আর বসে থাকতে না পেরে উঠে বাড়িয়ে বিশাল গোঁফের দুপ্রান্ত হাতের আঙুলে পাকাতে পাকাতে ঘরের ভেতরেই পায়চারি শুরু করলেন তিনি। তার বর্ণনা করা ইতিহাস লিখতে গেলে পুরো একটা বই হয়ে যাবে, তাই তা আর লিখলাম না। ওদিকে ভোর হয়ে আসছে, মোরগ ডাকার শব্দ তাই প্রমাণ করছে। আশ্চর্য! গত দিনের মতই মোরগ ডাকার শব্দে চমকে উঠে তড়িঘড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন কাউন্ট। কথাটা শুনলে হয়ত হাসবে, মিনা, তবু বলছি, কাউন্টের ব্যবহার হ্যামলেটের পিতার সেই প্রেতাত্মার মতই মনে হচ্ছে আমার কাছে।

১২ মে।

নিজেকে অকারণ দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে গতকাল সারাটা দুপুর বই-পত্র ঘেঁটেই কাটিয়েছি। অন্যান্য দিনের মতই সারাদিন কাউন্টের টিকির ধোঁজও পাইনি এবং সন্ধ্যার পর ভূতের মত কোত্থেকে এসে উদয় হয়েছেন তিনি। এসেই জিজ্ঞেস করে বসলেন লণ্ডনের একাধিক আইনজীবীকে আমি তার কাজে নিয়োগ করতে পারি কিনা। বললাম, তা করা যাবে, কিন্তু ঝামেলাই বাড়বে তাতে, কাজের তেমন সুবিধে হবে না। বুঝিয়ে বলতেই আমার সাথে একমত হলেন তিনি। কয়েক মিনিট চুপচাপ কি যেন ভেবে বললেন, ব্যস্ত মানুষ আমি। সবদিক একা সামলে উঠতে পারি না। ধরুন, নিউ ক্যাসেল ডারহাম, হারউইচ বা ডোভারের যে-কোন বন্দরে জাহাজে করে মাল পাঠাতে চাই আমি। কারও হাতে সে-দায়িত্ব দিয়ে কি নিশ্চিন্ত হওয়া সম্ভব? পাওয়া যাবে তেমন কাউকে?

পয়সা দিলেই পাওয়া যাবে। তবে আমার মনে হয় বিদেশী কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যে অঞ্চলে মাল পাঠাবেন সেখানকার কাউকে কাজটা দিলেই ভাল হবে।

আমার নির্দেশ অনুযায়ী চলবে সে?

টাকা পাবে আপনার কাছে, অথচ নির্দেশ মানবে না এটা কোন কথা হল নাকি? সারা জীবন এক দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় একাকী জীবন যাপন করে বাইরের পৃথিবীতে মাল পাঠানর ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছেন কাউন্ট, ভেবে একটু অবাক লাগল আমার।

আমার উত্তরে খুশি হলেন কাউন্ট। বললেন, ভাল কথা, আপনি নিরাপদে আমার এখানে এসে পৌঁছেছেন, কথাটা আপনার বস মি. হকিন্সকে নিশ্চয়ই জানিয়েছেন?

কি করে জানালাম? এ পর্যন্ত দিন রাতের প্রতিটি মুহূর্ত তো এ প্রাসাদেই কাটালাম।

আমার কথায় একটু ঝাঁঝ টের পেয়ে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে আমার কাঁধে মৃদু চাপ দিলেন কাউন্ট। বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, এক্ষুণি লিখে দিন। লিখে দিন, আরও প্রায় মাসখানেক এখানে থাকছেন আপনি। আগামীকালই চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থা করব আমি।

মাসখানেক? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম।

তাই, মি. হারকার। অবশ্য যদি আপনার বলার কিছু না থাকে। আর থাকলেই বা কি? আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন আপনি, সেই সুবাদে ইচ্ছে করলে জোর করেও আপনাকে এখানে রেখে দিতে পারি আমি, তাই না?

বুঝলাম, জোর করেও কোন লাভ নেই। আমি যেতে চাইলেও আমাকে যেতে দেবেন না কাউন্ট। কিন্তু তার মতলবটা কি? আমাকে এখানে বন্দী করে রেখে কি লাভ তাঁর? আমি অসহায় এবং কাউন্টের হাতের মুঠোয়, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বোধহয় একটা চাপা উল্লাস ফুটে উঠল তাঁর চোখে-মুখে।

পকেট থেকে তিনটে সাদা কাগজ আর তিনটে বাম বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন কাউন্ট। সুন্দর বিদেশী স্ট্যাম্প আঁটা খাম। আমি হাত বাড়িয়ে কাগজ আর খামগুলো নিতেই বললেন কাউন্ট, চিঠিতে কুশল সংবাদ এবং বৈষয়িক বিষয় ছাড়া আর কিছু লিখবেন না। আপনি নিরাপদে আছেন জেনে খুব খুশি হবেন মি. হকিন্স, না? কাউন্টের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নিঃশব্দ চাপা হাসিতে ভরে গেছে তার মুখ। লাল টুকটুকে ঠোঁটের দু কোণ থেকে তীক্ষ্ণ দাঁত দুটো বেরিয়ে ভয়ঙ্কর কুৎসিত করে তুলেছে সে হাসিকে। হাসির সাহায্যেই বোধহয় আমাকে সাবধান করে দিতে চাইছেন কাউন্ট, বলতে চাইছেন-সাবধান, একটিও আজেবাজে কথা নয়! পরিষ্কার বুঝলাম কোন রকম চালাকি করে লাভ হবে না কিছু।

মিনা, তোমাকে এবং মি. হকিন্সকে দুটো চিঠি লিখে চুপ করে বসে থাকলাম। নিজেও কয়েকটা চিঠি লিখলেন কাউন্ট। চুপচাপ বসে তাই দেখলাম। কাউন্টের লেখা শেষ হলে আমার চিঠি দুটোও তুলে নিলেন তিনি। তারপর লেখার সাজসরঞ্জাম সহ পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বুঝলাম সরঞ্জামগুলো আমার কাছ থেকে সরিয়ে ফেলছেন। টেবিলের ওপর ভোলা পড়ে থাকা ওঁর চিঠিগুলোয় চট করে চোখ বুলিয়ে নিলাম আমি। চিঠিগুলোর ঠিকানা যথাক্রমেস্যামুয়েল এফ বিলিংটন, ৭নং ক্রিসেন্ট, হইটবি; হের লুটনার, ভার্ণা; কটস অ্যাও কোং, লণ্ডন এবং একজন ব্যাঙ্ক অধিকর্তা হেরে ঢোপক, বুদাপেস্ট। দ্বিতীয় এবং চতুর্থ চিঠির মুখ বন্ধ করা হয়নি। সবে খুলে দেখতে যাব, এমন সময় দেখলাম দরজার হাতল ঘুরছে। চট করে আগের জায়গায় ফিরে এসে বসে পড়লাম। নতুন একটা চিঠি হাতে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন কাউন্ট, বোধহয় ও ঘরে বসে লিখে এনেছেন।

টেবিল থেকে চিঠিসুদ্ধ খামগুলো তুলে নিয়ে পাকা হাতে সেগুলোতে ডাক টিকেট লাগালেন কাউন্ট। লাগানো শেষ হলে বললেন, একটা ব্যাপারে কখনও সতর্ক করে দেয়া হয়নি আপনাকে। আপনাকে বার বার অনুরোধ করছি, আপনার নিজের ঘর ছাড়া প্রাসাদের আর কোন ঘরে রাতের বেলা ভুলেও ঘুমাতে যাবেন না। ঘুম পেলেই সোজা, নিজের ঘরে চলে আসবেন। বহু সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়িত একটা অত্যন্ত পুরানো প্রাসাদ এটা। নিজের ঘর ছাড়া অন্য ঘরে ঘুমালে হয়ত ভয়ঙ্কর আর বিশ্রী সব দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেতে পারেন। তাই আপনাকে সতর্ক করে দেয়া, বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তার হেঁয়ালিপূর্ণ কথার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। এখন যে দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাস করছি প্রাসাদের অন্য কোন ঘরে কি তার চেয়ে বেশি দুঃস্বপ্ন দেখব?

ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন-আমার মনে হয় আজেবাজে কথা বলে আমাকে ভয় দেখানর চৈষ্টা করেছেন কাউন্ট, আসলে প্রাসাদের যে-কোন ঘরেই নিরাপদে ঘুমাতে পারি আমি। এখন থেকে ঘুমানর আগে কুশটা যত্ন করে বালিশের নিচে রেখে দেব, এতে বোধহয় অলৌকিক কোন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাব আমি।

পড়ার ঘরে একাকী বসে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মাঝরাত হয়ে গেল, শেয়াল আর চোর ভৌতিক কশ স্বরে ধ্যান ভাঙল আমার, কাউন্ট চলে গেছেন অনেকক্ষণ। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম। অখও নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়েছিল শেয়াল আর পেঁচার ডাক। ওরা চুপ করে যেতেই দ্বিগুণ নিস্তব্ধ মনে হল চারদিক।

বিছানায় শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করেও ঘুম এল না। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে ঘরের বাইরের পাথরের সিঁড়িটার উপর এসে দাঁড়ালাম। দক্ষিণ দিকটা স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। আবছা আঁধারে দূরের বিস্তৃত পাহাড়গুলোকে রূপকথার দৈত্যের মত দেখাচ্ছে। ওগুলোর নিচেই গভীর গিরিখাদ আরও রহস্যময় করে তুলেছে পাহাড়গুলোকে। দেখলেই ছমছম করে ওঠে গা। ভয়ঙ্কর সব অলৌকিক কল্পনা ভিড় করে আসে মনে। আমার কোন পাপের শাস্তিস্বরূপ ঈশ্বর আমাকে এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরীতে এনে ফেলেছেন বুঝতে পারছি না।

দূরের অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে নানান কথা ভাবছি, এমন সময় মেঘের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। রূপালী আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। নিমেষে চেহারা বদলে মাথায় রূপোর মুকুট পরে ফেলল দূরের বরফ ছাওয়া পাহাড়চূড়াগুলো। আরও রহস্যময় হয়ে পড়ল ওগুলোর আশপাশের গভীর গিরিখাদ। স্তব্ধ হয়ে প্রকৃতির এই দৃশ্যপট পরিবর্তন দেখছি, হঠাৎ মনে হল নিচের তলায়, বাঁ দিকে, কাউন্টের ঘরের ঠিক জানালার সামনে কি যেন নড়ছে। চট করে একপাশে সরে গিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে।

গরাদশূন্য জানালা গলে আস্তে করে বেরিয়ে এল কাউন্টের মাথাটা। দূর থেকে ওঁর মুখ দেখা না গেলেও চিনতে পারলাম আমি। অবাক লাগল। গভীর রাতে এভাবে জানালা গলে বেরিয়ে আসছেন কেন কাউন্ট? কয়েক মুহূর্ত পরেই আমার অবাক ভাবটা গভীর আতঙ্কে পরিণত হল। বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল হৃৎপিণ্ডের গতি। জানালা গলে বেরিয়ে এসে নব্বই ডিগ্রী খাড়া মসৃণ দেয়াল বেয়ে টিকটিকির মত এদিকেই উঠে আসছেন কাউন্ট। বাতাসে বিশাল বাদুড়ের ডানার মত উড়ছে কালো আলখাল্লার দুপাশ। ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? জোরে চিমটি কাটলাম গায়ে। ব্যথা লাগল, অর্থাৎ ঘুমোইনি। কাউন্ট কি মানুষরূপী কোন ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা? তাই যদি হয় তাহলে ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতিতে পড়েছি, সন্দেহ নেই। আতঙ্কে চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছে আমার, টের পাচ্ছি চেতনা হারাতে চলেছি। কিন্তু এ-সময় তো চেতনা হারালে চলবে না…

১৫ মে।

কিছুটা উঠেই থেমে পড়লেন কাউন্ট। কি মনে করে নেমে যেতে শুরু করলেন নিচের দিকে। শখানেক ফুট নেমেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি। কোন জানালা গলে বোধহয় ঢুকে পড়েছেন ভেতরে। ভাল করে দেখার জন্যে সামনে বুকে দাঁড়ালাম, কিন্তু এতদূর থেকে বোঝা গেল না কিছু। প্রাসাদ ছেড়ে বোধহয় বাইরে কোথাও গেছেন কাউন্ট। প্রাসাদটা ঘুরে দেখার এই-ই সুযোগ। দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে বাতিটা নিয়ে ফিরে এলাম। তারপর ঘুরে বেড়াতে লাগলাম সিঁড়ি ধরে ধরে। ঢাকা বারান্দা আর ছোট বড় সিঁড়ি বেয়ে অজস্র গলি ঘুপচি পেরিয়ে চললাম। কিন্তু একটা ঘরেও ঢুকতে পারলাম না। সব কটাতে তালা লাগানো। সম্প্রতি লাগানো হয়েছে তালাগুলো, তা একবার পরীক্ষা করেই বুঝতে পারলাম। দুএকটা ছোটখাট কামরা অবশ্য খোলা অবস্থায় পড়ে আছে, কিন্তু তাতে প্রাচীন আমলের জীর্ণ, ধূলি ধূসরিত কিছু আসবাবপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই।

হতাশ না হয়ে খুঁজতেই থাকলাম। শেষ পর্যন্ত প্রধান সিঁড়ি ধরে সবচেয়ে ওপরের তলায় উঠে একটা তালা-ছাড়া দরজা খুঁজে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম এটাও বন্ধ, কিন্তু দরজার গায়ে জোরে একটা ধাক্কা দিতেই বেমক্কা ভাবে খুলে গেল দরজার পালা। আসলে এ দরজাটায়ও তালা দেয়া ছিল, কিন্তু কি করে যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন কজা। আমার ধাক্কায় ভেঙে পড়েছে ওগুলো। চাপ দিয়ে দরজার পাল্লাটা আর একটু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

প্রাসাদের ডান দিকের একেবারে শেষ প্রান্তে এ ঘরটা। ঘরের বিশাল জানালার সামনে দাঁড়ালে প্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিমে সারি সারি ঘরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। এ ঘরে দাঁড়িয়ে আরও ভাল মত বুঝতে পারলাম প্রাসাদের অবস্থান। বিশাল একটা পাথুরে পাহাড়ের ঋজ তিন দিক থেকে দুর্ভেদ্য দেয়ালের মত ঘিরে আছে প্রাসাদটাকে। আর এত উঁচুতে অবস্থিত এটা যে নিচ থেকে প্রাচীন কামানের গোলা বোধহয় এর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারত না। এবং সেভাবেই পরিকল্পনা করা হয়েছে প্রাসাদের অবস্থান। পশ্চিমের বিস্তীর্ণ উপত্যকার ওপারে, এখান থেকে অনেক অনেক দূরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়ের চূড়া।

চাঁদনি রাতে প্রকৃতি দেখার জন্যেই যেন তৈরি হয়েছে এ ঘরটা। পর্দাশূন্য জানালার কাঁচের শার্সি ভেদ করে ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে উজ্জ্বল চাঁদের আলো। পুরু ধুলোর আস্তরণ কাঁচের শার্সির স্বচ্ছতাকে স্নান করে দিয়েছে অনেকখানি, তবু চাদের আলোয় আমার হাতের বাতিটাকে হাস্যকর রকম টিম টিমে দেখাচ্ছে।

চারদিকে বিরাজ করছে অখণ্ড নীরবতা। একটানা এই নিস্তব্ধতা পাগল করে দিতে পারে মানুষকে। তবু এই গা শিরশির করা নীরবতা কাউন্টের উপস্থিতির চাইতে অনেক ভাল মনে হল আমার কাছে। জানালার পাশেই চকচকে কালো রঙ করা মেহগনির ছোট্ট একটা টেবিল এবং চেয়ার। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাতিটা নামিয়ে রাখলাম টেবিলের ওপর। তারপর জানালার একপাশের শার্সি খুলে দিয়ে বসে পড়লাম টেবিলের পাশের চেয়ারটায়। হঠাৎ কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপটা মেরে নিভিয়ে দিয়ে গেল বাতিটাকে। মনে হল শরীরের একটা অঙ্গ বসে পড়ল আমার, এই অলৌকিকতার রাজ্যে যেন বাতিটাই একমাত্র ভরসা ছিল। যদিও আলোর কমতি নেই, তবু বাতিটার দিকে চেয়ে মনটাকে সতেজ রাখতে পারছিলাম।

অল্পক্ষণেই বাতির চিন্তা মুছে গেল মন থেকে। বাইরের অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম। আমি যে চেয়ারে বসে আছি হয়ত এখানে বসেই সামনের টেবিলে কাগজ পেতে প্রিয়তমের কাছে প্রেমের বার্তা পাঠাত কোন সুন্দরী। মিনা, সেই সুন্দরী কি সেদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিল, এই চেয়ারে বসেই জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরীতে লিখে তার প্রেমিকাকে জানাবার চেষ্টা করবে এক অসহায় অবস্থায় বন্দী হয়ে পড়া প্রেমিক-পুরুষ?

এখনও যে পাগল হয়ে যাইনি, সেজন্যে ঈশ্বরকে অজস্র ধন্যবাদ। সেক্সপীয়রের হ্যামলেট যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আমার চোখের সামনে। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ভীষণ ঘুম পেল আমার। ঘুমে জড়িয়ে আসছে দুচোখ, কিছুতেই খুলে রাখতে পারছি না। এই সময়ই হঠাৎ মনে পড়ে গেল কাউন্টের সতর্কবাণী। কিন্তু পাত্তা দিলাম না। এই পরিবেশে কাউন্টের কোন কথাই মানতে ইচ্ছে হল না আমার। ঘুম আসছে, আসুক। কাউন্টের স্মৃতি জড়ানো আমার ঘরের আবছা অন্ধকারে আর ফিরে যাব না আজ।

চেয়ারটা ছেড়ে ঘরের এক কোণে জানালার দিকে মুখ করে ফেলে রাখা একটা ইজিচেয়ারে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, হঠাৎ চমকে উঠে চোখ মেলে চাইলাম। অকস্মাৎ কোন অস্বাভাবিকতা ছাপ ফেলেছে আমার অবচেতন মনে। তাইতেই ঘুম ভেঙে গেছে।

টের পাচ্ছি, এখন আর একা নই আমি। আরও উজ্জ্বল হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে চাদের আলো। সে-আলোয় মেঝেতে বিছানো ধুলোর ওপর আমার পায়ের ছাপগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। ডান পাশে তাকাতেই চোখ পড়ল ওদের ওপর। রাজকীয় পোশাক পরা তিনজন সুন্দরী যুবতী বসে আছে তিনটে চেয়ারে। আমাকে চাইতে দেখেই উঠে দাঁড়াল তিন সুন্দরী। নাচের ছন্দে অতি ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে এগোতে এগোতেই ফিসফিস করে কি যেন আলোচনা করছে নিজেদের মধ্যে। তিনজনের মধ্যে দুজনের রঙ একটু চাপা। কাউন্টের মতই খাড়া নাক ওদের, রক্তাভ কিন্তু মর্মভেদী তীক্ষ্ণ চোখ। হলুদ জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করে জ্বলছে সে চোখ।

তৃতীয়জন অপূর্ব সুন্দরী। মাথায় সোনালী চুল, হরিণীর মত আয়ত চোখ; এই রমণীকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হল আমার। কিন্তু কোথায় তা মনে করতে পারলাম না। হয়ত এ চেহারারই অন্য কোন মেয়েকেও দেখে থাকতে পারি। আমার আর একটু কাছাকাছি এসে একসাথেই ফিক করে হাসল তিনজন। জ্যোৎস্নার আলোয় ঝিকমিক করে উঠল ওদের আশ্চর্য সাদা দাত। লীলায়িত ছন্দে ক্রমেই এগিয়ে আসছে তিন যুবতী। আবার হাসল ওরা। ওদের বক্তলাল ঠোঁটে চুমু খাবার জন্যে ক্রমেই অধীর হয়ে উঠতে লাগলাম। ইচ্ছে করল আলিঙ্গনে আলিঙ্গনে নিষ্পেষিত করে দিই ওদের পেলব কোমল দেহ। মিনা, আমি জানি এসব পড়লে দুঃখ পাবে তুমি, কিন্তু এ নির্মম সত্য এমনভাবে বলতে না পারলে এখনকার আমার মনের সে অনুভূতি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পাবে না তোমার কাছে। আবার একসঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠল তিন যুবতী। হাসিটা কেমন যেন নিষ্প্রাণ মনে হল আমার কাছে। অপূর্ব সুন্দরী ওই যুবতীদের হাসির শব্দে মাধুর্যের লেশমাত্র নেই।

যেমনি শুরু হয়েছিল তেমনি আচমকা থেমে গেল ওদের হাসি। অপেক্ষাকৃত অসুন্দরী মেয়ে দুটো তৃতীয় মেয়েটাকে বলল, তুমিই আগে যাও, সখী। ও তোমারই যোগ্য।

গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মেয়েটি, ও তরুণ, সুপুরুষ। আমাদের তিনজনকেই সন্তুষ্ট করতে পারবে ও।

তা পারবে। কিন্তু তোমার সাথেই ওকে মানাতে ভাল। অতএব আগে তুমিই যাও।

ওদের কথাবার্তা শুনে ভয়ে, আশঙ্কায় কেঁপে উঠল আমার সমস্ত শরীর। ধীরে অতি ধীরে এগিয়ে এসে আমার ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল মেয়েটি। কাঁধের কাছে স্পষ্ট অনুভব করলাম আশ্চর্য মিষ্টি উষ্ণ একটা স্পর্শ। উত্তপ্ত হয়ে দ্বিগুণ বেগে বইতে শুরু করল শরীরের রক্ত স্রোত। চোখ দুটো আধবোজা হয়ে এসেছে, মোহগ্রস্তের মত চেয়ে থাকলাম তরুণীর দিকে।

মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তরুণী। পেলব দুই বাহু দিয়ে মালার মত জড়িয়ে ধরল আমার গলা। কিন্তু আমার মনে হল বিশাল একটা সাপ আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধ করে মারতে যাচ্ছে আমাকে। তীব্র কামনায় হাঁ হয়ে গেছে মেয়েটির মুখ। টুকটুকে লাল ঠোঁটের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেছে তীক্ষ্ণ সাদা দাঁত। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় এত কাছে থেকে পরিষ্কার দেখলাম কাউন্টের মত ওরও ঠোঁটের দুপাশ থেকে বেরিয়ে আছে দুটো তীক্ষ্ণ দাঁত। বুঝতে পারছি কিছু একটা করা উচিত, কিন্তু প্রচণ্ড অবসাদে চোখের পাতাও নড়াতে পারছি না। স্বপ্নের জগতে বাস করছি যেন আমি।

অতি ধীরে মেয়েটার মুখটা নেমে এল আমার মুখের কাছে, ঠোঁট দুটো আমার দুঠোঁটের ওপর। এ তো কামনা মত্ত কোন রূপসীর প্রণয় চুম্বন নয়! মনে হচ্ছে, কোন অজানা দানব দুঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে ছিঁড়ে নিতে চাইছে আমার ঠোঁট দুটো। কয়েক মুহূর্ত পর ওর ঠোঁট দুটো আমার চিবুক বেয়ে পিছলে নেমে চলল গলার কাছে। আগুনের মত তপ্ত নিঃশ্বাসে গলার চামড়া ঝলসে দিতে দিতে আমার রক্তনালী খুঁজতে শুরু করল মেয়েটার মুখ। একসময় রক্তনালী খুঁজে পেল সে। একমুহূর্ত দ্বিধা করেই দাঁত বসিয়ে দিতে লাগল সেখানে। কি ঘটতে চলেছে বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। আমার হাত-পা দড়ি দিয়ে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে কেউ। এক ভয়ঙ্কর পিশাচিনীর হাতে কি আজই আমার জীবনের শেষ? আমার শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলে রেখে যাবে ওরা? আতঙ্কে দুপদাপ লাফাতে লাফাতে বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে হৃৎপিণ্ডটা। তীক্ষ্ণ দাতগুলো আরও, আরও বসে যাচ্ছে আমার ঘাড়ের পাশে রক্তনালীতে। এখুনি ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের মত ঘরে প্রবেশ করল কেউ। প্রচণ্ড এক দমকা হাওয়া যেন ঝাঁপটা দিয়ে গেল আমার শরীরে। চোখ তুলে চেয়ে দেখলাম সুন্দরী মেয়েটার ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছেন কাউন্ট। বলিষ্ঠ হাতে রূপসীর গলাটা পেছন থেকে চেপে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন পেছনে সমস্ত লাবণ্য মুছে গেছে রূপসীর মুখ থেকে। তীব্র আক্রোশে সাপের মত হিস হিস করে ফুসছে সে।

ক্রোধে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কাউন্টের চেহারা। দুটো জ্বলন্ত রুবীর মত লাগছে ওর চোখ দুটো। থমথমে মুখটা দেখে ওঁকে মানুষ বলে মনে হল না আমার কাছে। নরক থেকে যেন উঠে এসেছে সাক্ষাৎ শয়তান। কাউন্টের সে চেহারা জীবনে ভুলব না আমি।

আমার কাছ থেকে সুন্দরী মেয়েটাকে সরিয়ে নিয়েই ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন কাউন্ট, একটা বাচ্চা যেন ছুঁড়ে ফেলে দিল একটা খেলার পুতুল। তারপর ঘুড়ে দাঁড়ালেন অন্য মেয়ে দুটোর দিকে। সেদিন অন্ধকার রাতে প্রাসাদে আসার সময় এমনিভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে দেখেছিলাম কোচোয়ানকে। ক্রমশ আমার বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে, সেই কোচোয়ান কাউন্ট ছাড়া আর কেউ নয়। 

মেয়ে দুটোর দিকে চেয়েই বাঘের মত হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন কাউন্ট, হারামজাদীরা, সেদিন থেকেই না বলছি ও আমার, ওর ধারেকাছে আসবি না কেউ কখনও? কানে যায় না কথা? ফের যদি আমার আদেশ অমান্য করেছিস, সারা জীবন মাথা নিচু করে ওই পাহাড়ের চূড়ায় ঝুলিয়ে রাখব। এখন ভাগ এখান থেকে।

কাউন্টের হুমকিতে বিন্দুমাত্র ভয় পেল না সুন্দরী মেয়েটি। খিল খিল করে হেসে বলল সে, আমরা তো তোমার শিকারের কোন ক্ষতি করতে আসিনি, ওর সাথে একটু প্রেম করতে এসেছিলাম মাত্র।  

সুন্দরীর কথায় সাহস ফিরে পেল বাকি দুজন, হেসে উঠল ওরাও। বলল, হাসালে, সুন্দরী, কাউন্টের কাছে প্রেমের কথা বলহ? প্রেমের কি বোঝে কাউন্ট? জীবনে প্রেম করেছে সে কখনও?

চোখের কোণ দিয়ে আমার দিকে একবার চাইলেন কাউন্ট। তারপর বললেন, করিনি? মনে থাকে না তাদের কিছু?

থাকে না আবার! ট্রিপের ভঙ্গিতে কথাটা বলেই আবার হেসে উঠল সুন্দরী মেয়েটি।

হয়েছে হয়েছে।একটু যেন অপ্রস্তুত মনে হল কাউন্টকে। ওদের সান্ত্বনা দেবার সুরে বললেন, আগে আমার কাজ শেষ করি, তারপর সবাই মিলে চুটিয়ে প্রেম করিস ওর সাথে।

সে না হয় করব, কিন্তু এখন যে বড্ড খিদে পেয়েছে। খাবার এনেছ কিছু? প্রশ্ন করল অপেক্ষাকৃত কম সুন্দরী দুজনের একজন।

এই যে, বলে মেঝে থেকে একটা পোটলা তুলে মেয়েগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিলেন কাউন্ট।

পোঁটলাটা শুন্য থেকেই লুফে নিল একটা মেয়ে। সাথেসাথেই পোঁটলার ভেতর থেকে এল মানব শিশুর কান্না। ভুল শুনলাম? নাকি এত কাণ্ডের পর পাগল হয়ে গেছি আমি? প্রচণ্ড আতঙ্কে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম মেয়েগুলোর দিকে। পোঁটলাটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লাগিয়েছে ওরা। আবার পোটলার ভেতর থেকে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা। আধশোয়া অবস্থা থেকে ওঠার চেষ্টা করলাম, কিন্তু জোর পেলাম না পায়ে। আমার ওঠার আগেই পোটলা সুদ্ধ শিশুটাকে নিয়ে জানালা গলে উধাও হয়ে গেল তিন ডাইনী। পলকের জন্যে চোখে পড়ল উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় গা ভাসিয়ে উড়ে গেল ওরা আকাশে।

ঠিক সেই মুহূর্তে চেতনা হারালাম আমি।

১.৩ চোখ মেলতেই দেখলাম

চোখ মেলতেই দেখলাম আমার ঘরে বিছানার ওপর শুয়ে আছি। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তাহলে কাল রাতে যা দেখেছি সব স্বপ্ন, কিছুই সত্যি নয়! ঠিক এই সময় পরনের জামাকাপড়গুলোর দিকে নজর পড়তেই সন্দেহের নিরসন হল। এ কাপড় নিয়ে কখনও ঘুমোতে যাই না আমি। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই গলায় হাত দিলাম। দিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আছে ক্ষতটা। কাল রাতে দেখা সুন্দরী ডাইনীর দাঁতের ক্ষত। প্রথম থেকে শুরু করে শেষে জ্ঞান হারানো পর্যন্ত গত রাতের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেল আমার। আমি জ্ঞান হারাবার পর কাউন্টই এ ঘরে বয়ে এনেছেন আমাকে। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম থোয়া যায়নি ডায়েরীটা। অর্থাৎ আমি যে ডায়েরী রাখি এটা এখনও জানেন না কাউন্ট। জানলে নিশ্চয়ই সরিয়ে ফেলতেন ওটা। স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে ভাবতে লাগলাম গত রাতের অদ্ভুত ঘটনাগুলোর কথা।

১৮ মে

এসবের মানে আমাকে জানতেই হবে। তবে রাতের বেলা নয়, প্রকাশ্য দিবালোকে। বাথরূম সেরে, কাপড় বদলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলার সেই ঘরে আসতেই দেখলাম দরজা বন্ধ। প্রাণপণ চেষ্টা করেও একচুল নড়াতে পারলাম না বন্ধ দরজার পাল্লা। বাইরে থেকে শেকল ভোলা হয়নি। তাহলে নিশ্চয়ই ভেতর থেকে বন্ধ করা হয়েছে। গতরাতে ভাল মতই লক্ষ্য করেছিলাম এ ঘরে এই একটা মাত্র দরজা। তাহলে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করার পর কোন পথে বেরোলেন কাউন্ট? সেই তিন ডাইনীর মত জানালা গলে উড়ে-গেছেন? ব্যাপারটাকে আর স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারছি না কিছুতেই। প্রতিজ্ঞা করলাম এ রহস্যের সমাধান করতেই হবে আমাকে।

১৯ মে।

পরিষ্কার বুঝতে পারছি ভয়ঙ্কর এক ফাদে জড়িয়ে পড়েছি আমি। গত রাতে আমাকে দিয়ে আরও তিনটে চিঠি লিখিয়ে নিয়েছেন কাউন্ট। প্রথমটায় লিখেছিএখানের কাজ প্রায় শেষ, দিন কয়েকের মধ্যে বাড়ি ফিরছি। দ্বিতীয়টায়আগামীকাল সকালেই প্রাসাদ-দুর্গ ছেড়ে রওনা হচ্ছি। আর তৃতীয়টায়—আমি বিসট্রিজে এসে পৌঁছেছি।

প্রতিবাদ করতে পারতাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউন্টের কথার প্রতিবাদ করা হবে পাগলামিরই নামান্তর। এখন ওঁর সম্পূর্ণ হাতের মুঠোয় আমি, বিরোধিতা করতে গেলেই রেগে গিয়ে যা খুশি করে বসতে পারেন। একমাত্র উপায় সুযোগের অপেক্ষা করা। অবশ্য সেরকম সুযোগ আর আমার জীবনে আসবে কিনা জানি না।

আমার সাথে আর আগের মত মন খুলে আলাপ করেন না কাউন্ট। গম্ভীর গলায় শুধু আদেশ করে যান আমাকে। তিনি ধরে নিয়েছেন তাঁর আদেশ মানতে আমি বাধ্য। চিঠি তিনটে লিখে শেষ করার পর ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একই দিনের তারিখ দেব চিঠিগুলোতে?।

না, গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন কাউন্ট, এখানে নিয়মিত আসে না ডাক পিয়ন। আপনার চিঠিগুলো আমার কাছে থাকল। সময় বুঝে পরপর পাঠিয়ে দেব ওগুলো, মিনিট খানেক চুপ থেকে আবার বললেন তিনি, প্রথমটায় তারিখ দিন ১২ জুন, দ্বিতীয়টায় ১৯ জুন আর তৃতীয়টায় ২৯ জুন।

যাক তবু জানলাম আমার হাতে আর কতদিন সময় আছে। অর্থাৎ ২৯ জুন পর্যন্ত আমাকে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছেন কাউন্ট।

২৮ মে।

কোত্থেকে যেন একদল জিপসী এসে তাঁবু গেড়েছে প্রাসাদ দুর্গের উঠানে। ভারি অদ্ভুত এই জিপসীদের ধরন-ধারণ। নিজেদের সমাজ, নিজেদের রীতিনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকে ওরা। নির্ভীক, দুঃসাহসী এই জাতটা আইনের ধারেকাছেও ঘেঁষে না, ওদের ইচ্ছে মাফিক কাজকারবার করে বেড়ায়।

জানালায় দাঁড়িয়ে আকার ইঙ্গিতে ইতোমধ্যেই ভাব জমিয়ে ফেলেছি আমি। বিচিত্র পদ্ধতিতে আমার ইঙ্গিতের উত্তরে সাড়া দিয়েছে ওরাও। ভাবছি, ওদের মাধ্যমেই বাইরের জগতে কয়েকটা চিঠি পাঠাবার চেষ্টা করতে হবে আমাকে।

দ্রুত দুটো চিঠি লিখে ফেললাম। একটা মি. হকিন্সকে। চিঠিতে মিনার সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছি ওকে। দ্বিতীয়টা মিনার নামে। শর্টহ্যাণ্ডে আমার অসহায়তার কথা সবই জানিয়েছি তাকে। ভয় পেয়ে অনর্থ বাধিয়ে বসতে পারে ভেবে সে-রাতের ডাইনীদের ঘটনা বাদ দিয়েছি শুধু।

পকেট থেকে পয়সা বের করে চিঠি দুটো দিয়ে সেটা মুড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিলাম, ইঙ্গিতে জিপসী সর্দারকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, চিঠি দুটো ডাক্তে দিতে চাই আমি। কি বুঝল সে কে জানে, তবে চিঠি দুটো তুলে নিয়ে আমার উদ্দেশ্যে মাথা নুইয়ে হ্যাটের ভেতর গুঁজে রাখল ওগুলো।

কাউন্ট এলেন সন্ধ্যার একটু পরে। শান্তভাবে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে পকেট থেকে দুটো চিঠি বের করলেন তিনি। মৃদু বিদ্রুপের স্বরে বললেন, জিপসী সর্দার দিয়েছে আমাকে চিঠি দুটো। একটা মি. হকিন্সকে লেখা, অবশ্যই আপনার হাতের, দ্বিতীয়টা মিনা মুর নামের এক মহিলাকে। বলেই রুদ্র মূর্তি ধারণ করলেন কাউন্ট। আমার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আন্তরিক বন্ধুত্ব এবং আতিথেয়তার তাহলে এই প্রতিদান! বলতে বলতে বাম দুটো জ্বলন্ত মোমের আগুনে তুলে ধরলেন তিনি। ধীরে ধীরে পুড়তে শুরু করল খাম দুটো। সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেদিকে চেয়ে রইলেন তিনি, তারপর চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, জানি, অন্যের চিঠি খোলা যোরতর অন্যায়, কিন্তু কি করব, মি. হারকার, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যেই এতটা হুঁশিয়ার হয়ে চলতে হয় আমাকে। বলতে বলতেই একটা নতুন খাম আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি, মিনা মূরের ঠিকানাটা আর একবার লিখে দিন এতে।

যন্ত্রচালিতের মত হাত বাড়িয়ে কাউন্টের হাত থেকে খামটা নিয়ে তাতে ঠিকানা লিখে দিলাম। খামটা হাতে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তারপরই আমার ঘরের দরজায় চাবি লাগানর শব্দ শুনে লাফ দিয়ে ছুটে গেলাম দরজার দিকে। বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দরজা।

ঘণ্টা দুয়েক পর আবার ফিরে এলেন কাউন্ট। একটানা সোফায় বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি মত এসেছিল আমার। তাই কোনদিক দিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছেন তিনি বুঝতে পারিনি। তাঁর পায়ের মৃদু শব্দে তন্দ্রা ছুটে যেতেই দেখলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন কাউন্ট আমাকে চমকে উঠতে দেখেই বললেন, খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন নাকি?

না, বসে থাকতে থাকতে…

হয়েছে, আর বসে থাকতে হবে না। সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। কয়েকটা বিশেষ জরুরী কাজে আমাকে এখুনি একটু বাইরে যেতে হচ্ছে, না হলে আপনার সাথে বসে গল্প করতাম।

কোন কথা না বলে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়লাম গভীর ঘুমে। সবচেয়ে আশ্চর্য, এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও এমন গাঢ় ঘুম আমার এল কি করে।

৩০ মে।

নিবিড় প্রশান্তি নিয়ে ঘুম ভাঙল। চোখ খুলতেই কথাটা মনে হল আমার। তাই তো, প্রয়োজনের সময় কাগজ কোথায় পাব, কিছু কাগজ পকেটে রেখে দিলে হয় না? তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে স্যুটকেস খুললাম। ধুলেই চক্ষুস্থির। কাগজ তো দূরের কথা, প্রাসাদের বাইরে বেরোনর উপযোগী জামাকাপড়, ওভারকোট, কম্বল এমনকি রেল গাইডটা পর্যন্ত স্যুটকেস থেকে উধাও। বাহতের মত সেদিকে চেয়ে বসে থাকলাম। আমার বাইরে যাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছেন কাউন্ট।

৭ জুন।

বিছানার এক কোণে চুপচাপ বসে বসে ভাবছি। ভোর হয়েছে একটু আগে। হঠাৎ প্রাসাদ-দুর্গের পাথর বাঁধানো বিশাল চত্বরে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আর চাবুকের তীক্ষ্ণ শব্দে চমকে উঠলাম। খুশিতে ছেয়ে গেল মনটা। এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ছুটে গেলাম জানালার কাছে। আট ঘোড়ায় টানা বিশাল দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদ দুর্গের প্রাঙ্গণে। লম্বা চাবুক হাতে নিয়ে গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কোচোয়ান দুজন। মাথায় স্লোভাক হ্যাট, কোমরে কাটা মারা চামড়ার চওড়া বেল্ট, গায়ে ভেড়ার লোমের তৈরি নোংরা জামা আর পায়ে হাঁটু পর্যন্ত উঁচু ভারী বুট পরা কোচোয়ান দুজনকে দেখেই ওদের সাথে কথা বলার জন্যে দরজার দিকে ছুটলাম। কিন্তু দরজায় ধাক্কা দিয়ে মুখের হাসি মিলিয়ে গেল আমার। বাইরে থেকে বন্ধ দরজাটা।

ছুটে ফিরে এলাম জানালার কাছে। চেঁচিয়ে ডাকলাম কোচোয়ান দুজনকে। চমকে উঠে মাথা তুলে আমার দিকে চাইল ওরা। সেই মুহূর্তে কোত্থেকে এসে উদয় হল সেই জিপসী সর্দার, ফিসফিসিয়ে ওদের কানে কানে বলল কিছু। জিপসী সর্দারের কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল ওরা। হতাশায় ছেয়ে গেল মনটা।

আমার দিকে আর ভুলেও ফিরে চাইল না কোচোয়ান দুজন। নিজের কাজে মন দিল ওরা। মোটা দড়ির হাতল লাগানো চৌকো মতন বেশ বড় বড় কয়েকটা কাঠের বাক্স ওরা নামিয়ে রাখল মাটিতে। তারপর সেগুলো নিয়ে পর পর সাজিয়ে রাখল প্রাঙ্গণের এক কোণে। বাক্স বয়ে নিয়ে যাবার ভঙ্গি দেখে আর পাথুরে প্রাঙ্গণে নামিয়ে রাখার সময় যে শব্দ হল তা শুনে আন্দাজ করলাম বাক্সগুলো খালি। কাজ শেষ হতেই কোচোয়ানদের ভাড়া মিটিয়ে দিল জিপসী সর্দার। বোধহয় সংস্কারের বশেই পয়সার ওপর থু থু ছিটিয়ে পকেটে পুরে খুশি মনে গাড়িতে ফিরে গেল কোচোয়ানেরা। তারপরই হিশিয়ে উঠল ওদের হাতের চাবুক। চলে গেল কোচোয়ানেরা, আর একাকী বসে বসে নিজের কপাল ধিক্কার দিতে থাকলাম আমি।

২৪ জুন, শেষ রাত।

কেন যেন একটু তাড়াতাড়িই নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন কাউন্ট। তিনি চলে যাবার পরপরই দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম দক্ষিণের সেই ঘরে। নজর রাখতে হবে কাউন্টের ওপর।

গত কদিন ধরেই মনে হচ্ছে আমার অজান্তে প্রাসাদের কোথায় যেন ঘটে চলেছে ভয়ঙ্কর একটা কিছু। জিপসীদের সেই দলটাকে আর দেখা যায় না, কিন্তু প্রাসাদের ভেতরেই কোত্থেকে যেন ভেসে আসে শাবল, কোদাল আর বেলচার অস্পষ্ট বুং ঠাং শব্দ। প্রাসাদের ভেতরেই কি কিছু করছে জিপসীরা?

বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি দক্ষিণের ঘরের জানালার সামনে। হঠাৎ কাউন্টের ঘরের জানালার দিকে নজর পড়তেই চট করে সরে দাঁড়ালাম একপাশে। জানালা গলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছেন কাউন্ট। গায়ে আমার স্যুটকেস থেকে চুরি যাওয়া বেড়ানর পোশাক, কাঁধে একটা থলে, এটাতেই বাচ্চাটাকে ভরে সেদিন রাতে ডাইনীগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন কাউন্ট। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আবার কাছাকাছি গ্রাম বা শহর থেকে বাচ্চা চুরি করতে যাচ্ছেন তিনি, আর তারই শয়তানির জন্যে পরোক্ষভাবে দায়ী হতে হবে আমাকেই। কেউ দেখে ফেললে মনে করবে আমিই চুরি করেছি বাচ্চা। ঘৃণায় ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে লাগল আমার সর্ব শরীর। কিন্তু মনে মনে জ্বলে মরা ছাড়া করার কিছু নেই। এমন অসহায় ভাবে বন্দী থেকে এ ছাড়া আর করবই বা কি?

কাউন্ট ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করব, স্থির করলাম। জানালার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে থাকলাম চুপচাপ। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় হঠাৎ মনে হল ক্ষুদ্র কণিকার মত কি যেন সব উড়ছে বাতাসে। কি ওগুলো? ভাল করে দেখার জন্যে আর একটু সামনে ঝুঁকে দাঁড়ালাম। অকস্মাৎ দূরের উপত্যকার দিক থেকে ভেসে এল কুকুরের হিংস্র চিৎকার। ক্রমেই বাড়ছে সে চিৎকার, সেই সাথে বাড়ছে বাতাসে ভাসমান চকচকে অদ্ভুত কণাগুলোর ঘূর্ণন। ঘুমে দুচোখ বুজে আসতে চাইছে আমার, জোর করে টেনে খুলে রাখতে হচ্ছে চোখের পাতা। ওই কুকুরের ডাক, অদ্ভুত কণিকা আর এই ঘুমের সাথে কি কোন সম্পর্ক আছে? আরও কেটে গেল সময়। চোখের সামনে স্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করেছে এখন কণিকাগুলো। বিস্ময়ে অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে এল আমার গলা থেকে। কণিকাগুলো মিলিয়ে গেছে, তার জায়গায় ভাসছে তিনটে নারী-মূর্তি। সেদিনকার সেই তিন ডাইনী। আতঙ্কে শিউরে উঠলাম, খাড়া হয়ে গেল ঘাড়ের কাছের লোম। একছুটে পালিয়ে এলাম নিজের ঘরে।

আরও প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়ে যাবার পর কাউন্টের ঘর থেকে ভেসে আসা একটা শব্দে স্তব্ধ হয়ে যেতে চাইল আমার হৃৎপিণ্ডের গতি। হিমেল হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছে মানব শিশুর কান্না। কয়েক মুহূর্ত চেঁচিয়েই হঠাৎ থেমে গেল বাচ্চাটার চিৎকার, যেন গলা টিপে ধরে থামিয়ে দিল কেউ ওকে। আর সহ্য করতে পারলাম না। এখনই একটা কিছু করতে হবে ওই কাউন্ট নামক পিশাচের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড আক্রোশে ছুটে গেলাম দরজার দিকে। কাঁধ দিয়ে একটানা ধাক্কা দিয়ে চললাম দরজার গায়ে। কিন্তু ভারী মেহগনি কাঠের দরজা নড়ল না একচুল।

ঠিক সেই সময় প্রাঙ্গণের দিক থেকে ভেসে এল কোন নারীর বুকফাটা ক্রন্দন। একলাফে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। লোহার বিশাল কপাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। এলোমেলো মাথার চুল, গায়ের কাপড় এখানে ওখানে ছেঁড়া, বোধহয় পাগলিনীর মত ছুটে আসতে গিয়েই এ-অবস্থা হয়েছে ওর। কপাটের গায়ে মাথা কুটতে কুটতে বিলাপ করছে সে। হঠাৎ জানালার কাছে আমাকে দেখেই জ্বলে উঠল মহিলার দুই চোখ। তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল সে, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দে, ফিরিয়ে দে। শয়তান! বলেই আবার করুণ বিলাপে ভেঙে পড়ল মহিলা। তার করুণ চিৎকার শুনে অসহ্য বেদনায় বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল আমার।

হঠাৎ মাথার ওপরে, বোধহয় প্রাসাদের ছাত থেকে ভেসে এল কাউন্টের ভয়ঙ্কর রুক্ষ, কর্কশ চিৎকার। কাকে যেন ডাকছে সে। পরমুহূর্তেই তার ডাকের সাড়া দিয়ে চারদিক থেকে হিংস্র গর্জন করে উঠল হাজার হাজার নেকড়ে। একটু পরেই চোখে পড়ল উপত্যকার দিক থেকে ছুটে আসছে নেকড়ের দল। সাথে সাথে ঘন মেঘে ঢেকে গেল চাদ। অন্ধকারে ধক ধক করে জ্বলছে হাজার হাজার রক্তচক্ষু। বিদ্যুতের মত ছুটে এসে হতভাগিনী মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নেকড়ের দল। কয়েক মুহূর্ত পরেই থেমে গেল মায়ের বিলাপ। নিকষ কালো অন্ধকারে চোখে না পড়লেও নেকড়েদের হুটোপুটিতে বুঝলাম মহিলাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে শয়তানের দল। কয়েক মিনিট পরই ডাকতে ডাকতে আবার উপত্যকার দিকে ফিরে গেল নেকড়েগুলো। হা ঈশ্বর, ভয়ঙ্কর এই মৃত্যুপুরীতে এসে এ-ও দেখতে হল আমাকে!

২৫ জুন, ভোর।

সূর্য উঠছে। সারাটা রাত অসহ্য আতঙ্কের ভেতর কাটিয়ে ওই সূর্যকে ঈশ্বর প্রেরিত দেবতা বলে মনে হল আমার কাছে। সমস্ত ভয়, সমস্ত আতঙ্ক আমার মন থেকে ধুয়েমুছে নিয়ে গেল ওই উজ্জ্বল সূর্যালোক। শুধু আজই নয়, এ-প্রাসাদে আসা অবধি সূর্য ওঠা মাত্রই আস্তে আস্তে ভয় কেটে যেতে থাকে আমার মন থেকে। দিনের স্বচ্ছ আলোয় একটু একটু করে ফিরে পাই হারানো সাহস। সাঁঝ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ভয়ের দোদুল দোলায় দুলতে থাকে মন, সিটিয়ে আসতে থাকে হাত-পা।

ইতোমধ্যেই দুটো চিঠি ডাকে ফেলা হয়েছে। বাকি রয়েছে একটা। ভয়ঙ্কর বিপদে আছি। আমার মাথার ওপর ঝুলছে মৃত্যুর খাঁড়া, যে-কোন সময় নেমে আসতে পারে সেটা। কিন্তু কিভাবে আসবে আমার মৃত্যুদূত, কিভাবে মরব আমি?

বাঁচতে হলে মাথাটা সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা রাখতে হবে এখন। গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলোকে তলিয়ে দেখতে শুরু করলাম। একটি জিনিস খেয়াল করেছি, ভয়ঙ্কর যা কিছু ঘটছে সব রাতের বেলায়। আর একটা জিনিস, এ-পর্যন্ত দিনের বেলায় কাউন্টের সাথে সাক্ষাৎ ঘটেনি কখনও। বোধহয় সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে সে তখন জেগে ওঠে, আর সবার জেগে ওঠার সময় সে ঘুমোতে যায়। তাহলে যা কিছু করার, দিনের বেলায় করতে হবে আমাকে। কোনমতে কাউন্টের ঘরে একবার ঢুকতে পারলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যেত। কিন্তু কিভাবে ঢোকা যায়? সব যে তালা বন্ধ।

অনেক ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করে ফেললাম। কাজটায় বিপদের সম্ভাবনা প্রচুর, কিন্তু এছাড়া আর কোন উপায় নেই। জানালা গলে কয়েকবারই কাউন্টকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি, সে-পথে একবার চেষ্টা করে দেখলে হয়। মনস্থির করে নিয়ে বেরিয়েই পড়লাম শেষ পর্যন্ত।

সিঁড়ি বেয়ে দক্ষিণের ঘরে এসে পৌঁছুলাম। ঘরের সামনে থেকে পাথরের এবড়োথেবড়ো একটা সরু কার্নিস সোজা চলে গেছে কাউন্টের ঘরের কাছে দিয়ে। পা থেকে জুতো খুলে ঈশ্বরের নাম নিয়ে এগোতে শুরু করলাম কার্নিস বেয়ে। চলার পথে দেয়ালের মাঝেমধ্যে পলেস্তারা খসে গিয়ে ইটের পাঁজন্তুরা বেরিয়ে পড়েছে। চলতে চলতে হঠাৎ একবার নিচের দিকে চোখ পড়তেই ঘুরে উঠল মাথাটা, তবু থামলাম না। কারণ এমনিতেও দুদিন পরেই মরতে হবে আমাকে, তারচেয়ে বরং একবার চেষ্টা করেই মরা যাক। বার কয়েক পা ফসকে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনমতে এসে পৌঁছুলাম কাউন্টের ঘরের জানালার সামনে। জানালার কাঁচের শার্সি লাগানো পাল্পা দুটোয় ঠেলা দিতেই মসৃণভাবে খুলে গেল ওগুলো।

কোনরকমে প্রচণ্ড উত্তেজনা দমন করে জানালা টপকে ঢুকে পড়লাম ঘরের ভেতরে। কাউন্ট নেই ঘরে। ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম ঘরটা। প্রাসাদের ওপরের তলার ঘরগুলোর মত এ ঘরটাও প্রাচীন আমলের আসবাবপত্রে সাজানো। বহুদিন অব্যবহৃত থাকায় ওগুলোর উপর পুরো ধুলোর আস্তরণ জমেছে। ঘরের কোণে এক জায়গায় প্রায় তিনশো বছর আগের বৃটিশ, রোম, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, গ্রীক আর তুরস্কের স্বর্ণমুদ্রা পাকারে ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়া আছে অজস্র মূল্যবান সোনার গহনাপত্র। এগুলোর ওপরেও পুরু ধুলোর স্তর। উল্টোদিকের দেয়ালে একটা ভারী দরজা। জানি বাইরে থেকে তালা মারা আছে দরজায়, তবু একবার ঠেলে দেখলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে খুলে গেল দরজাটা। তালা দেয়া হয়নি দরজায়। বোধহয় ভুলে গেছেন কাউন্ট।

দরজার সামনেই ছোট্ট একফালি বারান্দা। বারান্দার একপ্রান্ত থেকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে নিচে। অতি সতর্ক পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে চললাম। যতই নিচে নামছি ততই গ্রাস করছে আমাকে নিকষ কালো অন্ধকার। কিছুক্ষণ থেকেই একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধও নাকে এসে লাগছে। মাঝে মাঝে অবশ্য পাথরের জাফরি দিয়ে সামান্য আলো এসে পড়েছে ভেতরে, কিন্তু এত অন্ধকারের কিছুই দূর করতে পারছে না সে-আলো। চলতে চলতে আর একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। সদ্য খোড়া মাটির বিশ্রী সোঁদা গন্ধ, বদ্ধ বাতাসে থমথম করছে। যতোই এগোচ্ছি ততোই তীব্র হয়ে উঠছে গন্ধটা।

সিঁড়ির শেষ মোড়টা ঘুরতেই আবছা আলো চোখে পড়ল। সিঁড়ির শেষ মাথায় দরজাটা খোলা। দরজা পেরিয়ে একটা চ্যাপেলের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম। গির্জা সংলগ্ন মাটির নিচের এই ঘরটাকে নিঃসন্দেহে এক সময়ে পারিবারিক কবরখানা হিসেবে ব্যবহার করা হত। ওপরদিকে তাকিয়ে দেখলাম পলেস্তারা খসে পড়েছে ছাদের। পরপর দুসারি কফিন সাজানো আছে নিচে। সারিগুলোর মাঝখান থেকে গভীর করে মাটি খুঁড়ে বড় বড় বাক্সে ভরা হয়েছে। দেখেই চিনলাম, স্লোভাকদের আনা সেই বাক্স এগুলো।

দুরু দুরু বুকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সেই প্রাচীন কবরখানা। আবছা আলো-আঁধারিতে ভীষণ ভয় করতে লাগল, তবু সাহস করে এগিয়ে গেলাম কফিনগুলোর দিকে। ঈশ্বরের নাম নিয়ে ডালা খুললাম প্রথম কফিনটার। ভেতরে চেয়েই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শুধু মাটি দিয়ে ভর্তি কফিনটা। পরপর দুটো কফিনের ডালা খুলে একই ফল পেলাম। এখন আর ভয় করছে না ডালা খুলতে। কিন্তু ভয় পেলাম তৃতীয় কফিনটার ডালা খুলেই এবং এত ভয় জীবনে কখনও পাইনি। ঘাড় থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে নিচের দিকে নেমে গেল ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত। সজারুর কাঁটার মত খাড়া হয়ে উঠল ঘাড়ের ঢোম। সোজা আমার দিকে তাকিয়ে মাটি ভর্তি বাক্সের মধ্যে চিত হয়ে শুয়ে আছেন কাউন্ট ড্রাকুলা।

ওঁর বিস্ফারিত চোখের মণি দুটো পাথরের মত নিথর, কিন্তু মড়ার মত নিষ্প্রভ নয়। জীবন্ত মানুষের মত সজীব গাল, রক্তলাল পুষ্ট দুটো ঠোঁট। কাউন্ট কি ঘুমিয়ে আছেন? কাঁপা কাঁপা হাতে ছুয়ে দেখলাম ওঁকে। বরফের মত ঠাণ্ডা শরীরে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই! সদর দরজার চাবিটা পাওয়া যাবে কাউন্টের পকেটে, ভেবে ওঁর পকেটে হাত দিতে যেয়েই চমকে উঠলাম। মনে হল তীব্র আক্রোশে যেন ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে উঠল ওর চোখদুটো।

চাবি ধোঁজা আর হল না। সে নিথর চোখের তীব্র চাহনিতে আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হল আমার। ছিটকে কফিনটার কাছ থেকে সরে এসে পড়িমরি করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। আমার ছুটন্ত পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল সেই বদ্ধ জায়গায়। আর সেই শব্দ শুনে আমি ভাবলাম পেছন পেছন আমাকে তাড়া করে আসছেন কাউন্ট।

এভাবেই ছুটতে ছুটতে কাউন্টের ঘরে এসে ঢুকলাম। সেখান থেকে জানালা গলে কার্নিস এবং তারপর নিজের ঘরে। ঘরে ঢুকেই নিজেকে ছুঁড়ে দিলাম বিছানায় বালিশের তলা থেকে টান মেরে বের করে আনলাম কুশটা। যে কাজ মন থেকে কোনদিন করিনি, তাই করে বসলাম আজ। কুশটা ঝুলিয়ে নিলাম গলায়।

২৯ জুন।

দক্ষিণের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আজ আবার পোশাক পরে জানালা গলে বেরিয়ে যেতে দেখলাম কাউন্টকে। টিকটিকির মত বুকে হেঁটে দেয়াল বেয়ে সে নেমে যাবার সময় হাতটা নিশপিশ করছিল আমার। এই মুহূর্তে যদি একটা বন্দুক থাকত আমার হাতে তাহলে আজই একহাত দেখে নিতে পারতাম তাকে। অবশ্য পারতাম কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার মনে। তিন ডাইনীর সাথে দেখা হয়ে যাবার ভয়ে আজ আর বসে থাকলাম না এই ঘরে, নিজের কামরায় ফিরে এলাম।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, ঘুম ভাঙল কাউন্টের ডাকে। কোন প্রকার ভণিতা না করে সোজা-সাপটা রায় দিল সে, আগামীকাল ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাচ্ছেন আপনি। অতএব আপনার সাথে আর দেখা হচ্ছে না আমার। আপনার যাবার সময়ও হাজির থাকতে পারব না আমি, তবে তাতে কোন অসুবিধে হবে না। ভোরে জিপসীরা এসে শ্লোভাক কোচোয়ানদের গাড়িতে কয়েকটা কাঠের বাক্স তুলে দেবে। ওরা চলে যাবার পর আমার ব্যক্তিগত ফিটন বোর্গো গিরিপথ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে আপনাকে। সেখানে বুকোভিনা থেকে আসা কোন গাড়ি ধরে নিশ্চিন্তে পৌঁছে যেতে পারবেন বিসট্রিজে।

তবে তার আগে কাউন্ট ড্রাকার প্রাসাদ সম্পর্কে আপনার আরও বিস্তারিত কিছু জেনে যাওয়া দরকার। আজ রাতেই তা জানতে পারবেন এবং কানে শুনে নয়, স্বচক্ষে দেখে।

কাউন্টের কথার ভঙ্গিতে রাগে ব্ৰহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠল আমার। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, তোর শয়তানি দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আর আমার নেই। আজই, এই মুহূর্তে এই অভিশপ্ত প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে চাই আমি।

বিন্দুমাত্র রাগ প্রকাশ পেল না কাউন্টের চেহারায়। শান্ত স্বরে বলল সে, এখন, এই রাতের বেলা গাড়ি পাবেন কোথায়?

চুলোয় যাক গাড়ি। হেঁটেই যেতে পারব আমি।

কুৎসিত হাসিতে ভরে গেল কাউন্টের মুখ, আপনার জিনিসপত্র?

তোকে দান করে গেলাম, হারামজাদা!

ভাল। তাহলে আর দেরি করে লাভ কি? চলুন, গেটের বাইরে এগিয়ে দিয়ে আসি আপনাকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এভাবে বিদায় নিলে মনে ভীষণ ব্যথা পাব আমি।

এত সহজে আমাকে রেহাই দেবে কাউন্ট ড্রাকুলা ভাবতেও পারিনি। একমুহূর্ত দ্বিধা না করে উঠে দাঁড়ালাম। টেবিল থেকে বাতিটা তুলে নিয়ে রওনা দিল কাউন্ট। আমিও তার পিছু পিছু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল কাউন্ট। তাকে অনুসরণ করে চললাম আমি। নিচে নেমে এসে সদর দরজার কাছে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল কাউন্ট, তার সাথে সাথে আমিও।

কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করল কাউন্ট, তারপর বলল, শুনতে পাচ্ছেন?

শুনতে পেয়েছি আমি। হিংস্র চাপা গর্জন করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে হাজার হাজার নেকড়ে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাঁধ ভাঙা বন্যার মত বাইরে থেকে গেটের ওপর এসে আছড়ে পড়ল ওরা। আরও কয়েক সেকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেকড়েগুলোর হাঁক ডাক শুনল কাউন্ট, তারপর নির্দিধায় এগিয়ে গিয়ে খুলে ফেলল গেটের ভারী লোহার খিল।

ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে ভারী লোহার দরজা। আরও উত্তাল হয়ে উঠেছে নেকড়ের গর্জন। দরজার ফাঁক দিয়ে থাবা ঢুকিয়ে দিয়েছে কয়েকটা নেকড়ে। আর মাত্র আধ সেকেণ্ড, তারপরই আমাদের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে জানোয়ারগুলো। পরিষ্কার বুঝলাম কাউন্টের বিরোধিতা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একটু একটু করে খুলেই চলেছে দরজা। দরজার সামনে পাথরের মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কাউন্ট। মাথা দেখা যাচ্ছে নেকড়েগুলোর। কাউন্টকে দেখামাত্র নিমেষে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল নেকড়ের দল। এক ইঞ্চি এগোল না আর ওরা।

আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল কাউন্ট, যাবেন? যান, গেট তো ভোলাই আছে।

চকিতে বাচ্চা-হারা মায়ের পরিণতি ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। আমি কাউন্টকে পার হয়ে যাওয়া মাত্র টেনে ছিঁড়ে ফেলবে আমাকে নেকড়ের দল। মনে মনে প্রচণ্ড ভয় পেলেও যথাসম্ভব শান্তভাবেই বললাম, না, কাউন্ট, এখন এতরাতে আর যাব না। আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।

সেই ভাল, বলে দরজাটা বন্ধ করে দিল কাউন্ট। সঙ্গে সঙ্গে আবার গর্জন করে উঠল নেকড়ের দল, আওয়াজ শুনে বুঝলাম ফিরে যাচ্ছে ওরা।

ভগ্ন হৃদয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম। হতাশা আর ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে সর্বাঙ্গ। জামা-কাপড় পালটে শুতে যাব এমন সময় দরজার ওপাশে চাপা ফিসফিসানি শুনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে কান পাতলাম দরজার গায়ে। কাকে যেন বলছে কাউন্ট, আর একটা দিন মাত্র ধৈর্য ধরো। আগামীকাল রাতেই ওকে পাবে তোমরা।

কাউন্টের কথা শেষ হবার পরপরই একাধিক নারীকন্ঠের খিল খিল হাসি শুনে চমকে উঠলাম। পরিষ্কার বুঝলাম এ সেই তিন ডাইনী। রাগে তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য আমি। দেখাই যাক হারামজাদীরা কি করে আমার! ঝটকা মেরে খুলে ফেললাম দরজাটা। ঠিক দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আমাকে দেখেই আবার হেসে উঠল ডাইনীরা। হাসি থামলে সুন্দরী মেয়েটা বলল, আর একটা দিন মাত্র অপেক্ষা করো, প্রিয়তম। কালই আমাদের মধুর সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারবে তুমি, বলেই চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।

বুঝতে পারলাম আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আছে আমার আয়ু। কুশটাকে শক্ত করে চেপে ধরে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করলাম।

৩০ জুন।

ঘুম ভাঙতেই উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালাম। পুব আকাশে মেঘের বুকে সবে রঙের ছোপ লাগতে শুরু করেছে। এদিক-ওদিক থেকে কানে এসে বাজছে মোরগের ডাক। ভোর বেলা কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় বলে চিরদিন মোরগকে অভিশাপ দিয়ে এসেছি আমি, আজ কিন্তু সে-ভাক মধুবর্ষণ করল আমার কানে। কারণ আপাতত নিরাপদ আমি। আঁধারের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অভিশপ্ত ডেরায় ফিরে গিয়েছে সমস্ত রক্তলোভী প্রেতাত্মার দল। পালাতে হলে এই সুযোগ।

কাল রাতেই দেখেছিলাম গেটের দরজায় তালা দেয়া নেই। মুহূর্ত মাত্র দেরি করে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে গেটের কাছে পৌঁছে দুহাত দিয়ে টেনে খুলে ফেললাম ভারী লোহার খিল। আনন্দে দুলে উঠেছে বুক। যাক শেষ পর্যন্ত পালাতে পারব তাহলে। দুহাত দিয়ে ধাক্কা দিলাম দরজার পালায়। খুলল না। জোরে, আরও জোরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলতে শুরু করলাম। কিন্তু একচুল নড়ল না কপাট। তালা ছাড়া কি করে আটকে আছে কপাটটা বুঝতে পারলাম না। কারণটা বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। যে করেই হোক আমাকে খুলতেই হবে ওই দরজা।

খুঁজতে খুঁজতে কপাটের গায়ে একটা ছিদ্র চোখে পড়ল, চাবির ছিদ্র। দরজা খুলছে না, তার মানে তালা দিয়ে দিয়েছে কাউন্ট। তালা যখন আছে, চাবিও নিশ্চয় আছে। যেমন করেই হোক সে চাবি খুঁজে বের করতেই হবে আমাকে। দেয়ালের কার্নিস বেয়ে আগের মত কাউন্টের ঘরে এসে ঢুকলাম। যা ভেবেছিলাম, কাউন্ট নেই ঘরে। একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে খুঁজতে শুরু করলাম। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে-ঘরে পাওয়া গেল না চাবি। হয়ত কাউন্টের পকেটেই আছে ওটা। পিশাচটাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানা আছে আমার। মনস্থির করে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চললাম কবরখানার দিকে।

আগের জায়গায়ই পাওয়া গেল বড় কাঠের বাক্সটা। দাঁতে দাত চেপে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গিয়ে তুলে ফেললাম বাক্সের ডালা। মনে মনে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও ভয় পেলাম। চেহারা পালটে গেছে কাউন্টের। এ কি করে সম্ভব! নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। অর্ধেক বয়স যেন কমে গেছে কাউন্টের। ধবধবে সাদা গোফের বেশির ভাগই কালো হয়ে এসেছে। ভাঁজ পড়া কপাল আর গালের চামড়ায় এখন আর তেমন ভাজ দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে আশ্চর্য, ঠোঁটের এক কোণ থেকে গড়িয়ে নেমে এসেছে লাল টুকটুকে রক্তের একটা ধারা। যেন অল্প আগে রক্ত পান করে এসেছে পিশাচটা।

আরও উজ্জ্বল, আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে ওর চোখ দুটো। আজ আর সেচোখকে ভয় পেলাম না আমি। সোজা হাত ঢুকিয়ে দিলাম কাউন্টের জামার পকেটে। নেই চাবি। এ পকেট ও পকেট, সমস্ত পকেট খুঁজেও পাওয়া গেল না চাবি। কাউন্টের চোখের দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই ঘৃণায় রি রি করে উঠল আমার সর্বাঙ্গ। কুৎসিত হাসিতে বিকৃত হয়ে রয়েছে ওর মুখ-চোখ। আমি চাবি খুঁজে না পাওয়াতে যেন দারুণ মজা পাচ্ছে ব্যাটা। রাগে আগুন ধরে গেল যেন আমার শরীরে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বাক্সটার পাশেই মাটিতে পড়ে থাকা একটা শাবল তুলে নিয়ে ধাই করে বসিয়ে দিলাম শয়তানটার মাথায়। সাধারণ মানুষের মাথা হলে ওই এক বাড়িতেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যেত, কিন্তু কিছু হল না ওর। দ্বিগুণ মজা পেয়ে নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল যেন ওর মুখ-চোখ, দুঠোঁটের কোণ ঠেলে বেরিয়ে এল গজদন্ত দুটো। প্রচণ্ড বিস্ময়ে আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল শাবলটা। আর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল সেই মুহূর্তে। দড়াম করে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল বাক্সের ডালা।

কি করা যায় এখন? সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলাম। হঠাৎ কানে এল পাথুরে মেঝেতে চাকার ঘড়ঘড়ানি আর চাবুকের বাতাস কাটার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। চমকে উঠলাম। নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে জিপসীরা। সদর দরজা খুলে নিশ্চয়ই ভেতরে এসে ঢুকবে ওরা এখন।

মুহূর্তে ছুটে বেরিয়ে এলাম কবরখানা থেকে। পাগলের মত অন্ধকার ঢাকা বারান্দা, ঘোরানো সিঁড়ি, কাউন্টের ঘরের জানালা, দেয়ালের গায়ের পাথরের কার্নিস আর দক্ষিণের ঘরের জানালা ডিঙিয়ে প্রাসাদের নিচে নামার প্রধান সিঁড়ির কাছে এসে পৌঁছুলাম। একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে হাঁপাতে হাঁপাতে এক এক লাফে তিন-চারটে করে সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে কোনমতে নিচে এসে নামলাম। সদর দরজার কাছে এসে দেখলাম দরজা আগের মতই বন্ধ, কিন্তু জিপসীরা কোথাও নেই। ওদিকে প্রাসাদের ভেতরে কোত্থেকে যেন ভেসে আসছে ভারী বস্তু টানাহেঁচড়ার শব্দ আর বহু কষ্ঠের মিলিত আওয়াজ। চেঁচিয়ে ডাকলাম, কে আছ, শুনতে পাচ্ছ?

উত্তর নেই। শুধু আমার ডাক চারপাশের পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল আমার কাছেই। বার বার চেঁচিয়ে ডেকে ডেকে গলা ফাটিয়ে ফেললাম, কিন্তু কেউ সাড়া দিল না আমার ডাকে। ঈশ্বরের এ কি পরিহাস!

আরও কিছুক্ষণ পর আবার কানে এল চাবুকের তীক্ষ্ণ শব্দ আর চাকার ঘড়ঘড়ানি। ক্রমেই দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে সে-আওয়াজ। চাকা আর চাবুকের শব্দকে ছাপিয়ে এই সময় দূর থেকে ভেসে এল সম্মিলিত জিপসী সঙ্গীতের সুর। চলে গেল জিপসীরা। আর কোন আশা নেই। এই মৃত্যুপুরীতেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে আমাকে।

কিন্তু এভাবে অসহায়ের মত চুপ করে থেকে তো মরতে পারব না। পারব না সেই তিন ডাইনীর সাথে একাকী রাত কাটাতে। চুষে ছিবড়ে বানিয়ে ছেড়ে দেবে ওরা আমাকে।

মিনা, মুক্তি পাবার চেষ্টা আমি করব। কিন্তু কদূর সফল হব জানি না। যদি বাঁচতে না পারি, আর এ ডায়েরী কখনও তোমার হাতে পৌঁছায় তাহলে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করো। না হলে আমার মত বহু লোককে এভাবে ফাঁকি দিয়ে ভুলিয়ে এনে তিলে তিলে হত্যা করবে ওই রক্তলোভী, নিশাচর পিশাচ কাউন্ট ড্রাকুলা।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই আশার আলো দেখতে পেলাম। হ্যাঁ, এ-যাত্রা বেঁচে গেলেও যেতে পারি। এতক্ষণ মনে হয়নি কেন কথাটা! এখান থেকে বেরোবার গোপন পথ যদি না পাই, ওদেরকে ঠেকাবার অন্তত একটা জিনিস তো আমার সঙ্গে আছে। পরম নির্ভরতায় গলায় ঝোলানো কুশটাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরলাম।

ঈশ্বর, রক্ষা করো আমাকে!

১.৪ লুসি ওয়েস্টেনরা ও মিনা মুর

লুসি ওয়েস্টেনরা ও মিনা মুর, অনেক দিন থেকে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। একসাথেই লেখাপড়া করেছে, একসাথেই বড় হয়েছে ওরা দুজনে। লেখাপড়া শেষ করে মিনা চলে গেল দূরের ছোট্ট এক শহরে, স্কুল মাস্টারির চাকরি নিয়ে। লুসি থেকে গেল হুইটবির সতেরো নং চ্যাথাম স্ট্রীটে, বাবা-মার সঙ্গে। চাকরি করার সময়ই মিনার পরিচয় ঘটে জোনাথন হারকারের সাথে। ক্রমে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হল, হল প্রেম। দুজনেই ঠিক করল বিয়ে করবে একে অন্যকে। যথারীতি আংটি বিনিময় করে বাগদানও হয়ে গেল একদিন। এমন সময় মি. হকিন্সের কাছ থেকে ডাক এল জোনাথনের, এক বিশেষ জরুরী কাজ নিয়ে ট্রানসিলভেনিয়ার এক অখ্যাত দুর্গম এলাকায় যেতে হবে তাকে। এই কাজ করতে গিয়েই কাউন্ট ড্রাকুলার পাল্লায় পড়ে জোনাথন। তবে তা মিনার জানার কথা নয়। সেদিন বিকেলের ডাকে জোনাথনের কাছ থেকে ছোট্ট একটা চিঠি পেল মিনা। দিন সাতেকের মধ্যেই ফিরে আসছে জোনাথন। মনের আনন্দে লুসির কাছে জোনাথনের আসার খবর জানিয়ে চিঠি লিখে ফেলল সে। কিন্তু জোনাথনের ফিরে আসার খবরটা যে কত বড় মিথ্যে তা ঘুণাক্ষরেও যদি জানত মিনা!

মিনার চিঠি পেয়ে লুসিও খুশি। এদিকে তার জীবনেও আমূল পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। বিয়ে হতে যাচ্ছে তারও। একদিনেই তিন তিনটে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে সেদিন লুসির কাছে।

প্রথমটা এল দুপুর। খাওয়া-দাওয়ার একটু আগে। ভদ্রলোক পেশায় ডাক্তার, নাম জন সেওয়ার্ড। অত্যন্ত সম্রাত্ত ঘরে জন্ম জন সেওয়ার্ডের। বয়স ঊনত্রিশ। অথচ এই বয়সেই বিশাল এক পাগলা গারদের ভার দেয়া হয়েছে তার ওপর। সুন্দর চেহাবা, তী বুদ্ধি, দৃঢ়চেতা, অথচ এত শান্ত স্থির মেজাজের মানুষ খুব কমই চোখে পড়ে। বেশ কিছুদিন ধরেই লুসির সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে তার। বলি বলি করেও কথাটা এতদিন বলতে পারেনি জন লুসিকে। কিন্তু সেদিন মনস্থির করে নিয়ে সোজা গিয়ে লুসির ঘরে ঢুকল জন। লুসিকে সামনে পেয়েই ওর হাত দুটো নিজের দুহাতে তুলে নিয়ে চোখে চোখে তাকিয়ে বলে ফেলল সে, লুসি, তোমাকে ভালবাসি আমি। তোমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করব।

লুসি ওকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে সত্য কিন্তু স্বামী হিসেবে কল্পনা করেনি কখনও। তাই মনে মনে জুন দারুণ ব্যথা পাবে জেনেও তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হল সে।

দ্বিতীয় প্রস্তাবটা এল সেদিনই বিকেলে। আমেরিকার টেকসাসে বাড়ি ভদ্রলোকের, নাম কুইনসে মরিস। অভিযানপ্রিয়, হাসিখুশি, উচ্ছল এক দুর্ধর্ষ তরুণ

বিরাট বড়লোকের একমাত্র সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা শেষ করে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পাগল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে পৃথিবীর দুর্গম সব অঞ্চলে। লুসিকে দেখার পর থেকে একটা পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে। বিয়ে করে সংসারী হতে চাইছে সে এখন। বিকেলে বাগানের এক কোণে ঘুরে বেড়াচ্ছিল লুসি। সেই সময় এল মরিস। লুসিকে একলা পেয়ে সোজা বিয়ের প্রস্তাব করে বসল সে। শান্ত এবং ভদ্রভাবে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল লুলি।

লুসির প্রত্যাখ্যানের পরও কিন্তু মরিসের মুখের হাসি একবিন্দু মলিন হল না। বহুদিনের পরিচিত বন্ধুর মত হেসে লুসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল সে।

তৃতীয় প্রস্তাব, এল সন্ধ্যার পর, আর্থার হোমউডের কাছ থেকে। আর্থারের দীর্ঘকায় সুপুরুষ চেহারা, আর মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো কালো চুল দেখলে যে-কোন মেয়েরই মন না টলে পারবে না। স্থানীয় এক কলেজের অধ্যাপক সে, লুসিদের বাড়িতে প্রায়ই বেড়াতে আসে। মনে মনে লুসিও ভালবেসে ফেলেছে তাকে। সেদিন কি যে হল আর্থারের কে জানে। ঝড়ের মত ঘরে ঢুকেই লুসিকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল। আর্থারের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ভীরু কপোতীর মত থরথর করে কাঁপতে লাগল লুসি। কয়েক মুহূর্ত পর আর্থারের আবেগের মাত্রা কিছুটা প্রশমিত হলে তার বিশাল বক্ষে মুখ লুকালো লুসি। অস্ফুটে বলল সে, আর্থার, আমার আর্থার।

জন সেওয়ার্ড, কুইনসে মরিস আর আর্থার হোমউত, তিনজনেই কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধু। লুসির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথাটা কিন্তু আর্থারকে জানাল না জন এবং মরিস। বরং লুসিকে বিয়ে করতে যাচ্ছে শুনে হৈ-হৈ করে স্বাগত জানাল এরা আর্থারকে।

লুসির কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর পাগলা গারদে ফিরে গিয়ে রোগীর সেবায় মন দিল জন সেওয়ার্ড, আর আবার পৃথিবীর ভ্রমনে বেরিয়ে পড়ল কুইনসে মরিস। অবশ্য চিঠিপত্রের মাধ্যমে তিন বন্ধুই যোগাযোগ রাখল তিন বন্ধুর সাথে। বিন্দুমাত্র ফাটল ধরল না ওদের বন্ধুত্বে।

১.৫ ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

২৫ এপ্রিল।

গতকাল কুমারী লুসির অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যানে বুকটা শূন্য হয়ে গেছে আমার। এতটুকু স্বস্তি পাচ্ছি না মনে। বার বার মনে হচ্ছে এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে আর লাভ নেই। অবশ্য যদি কাজের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারি তাহলেই হয়ত এ নিঃসঙ্গতার হাত থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারি। ভয় হচ্ছে মানসিক হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে নিজেই না আবার মানসিক রোগী হয়ে পড়ি।

সাত-পাঁচ ভেবে রোগীদের একটু দেখাশোনা করতে বেরিয়ে পড়লাম। অদ্ভুত আচরণের জন্যে একজন রোগীর প্রতি আগে থেকেই বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখছিলাম আমি। আর সব সাধারণ পাগলদের চাইতে ওর ধরন-ধারণ সবই আলাদা। পাগল বলে মনেই হয় না ওকে। অথচ মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে বসে যা কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।

লোকটার নাম আর. এম. রেনফিউ, বয়স ঊনষাট। আত্মপ্রত্যয়ী মেজাজ, গায়ে শক্তি আর আশ্চর্য রকমের উগ্র ওর স্বভাব। রেনফিল্ডের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করে আমার এইটুকু ধারণাই হয়েছে, অলৌকিক শক্তির প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস। এবং আমার ধারণা এই অলৌকিক শক্তির অধিকারী হবার উদ্দেশ্যেই মাঝে মাঝে উদ্ভট সব কাজ কারবার করে বসে রেনফিল্ড।

মিনা মুরের ডায়েরী থেকে
২৪ জুলাই, হুইটবি।

গতকাল আমাকে নিয়ে যেতে স্টেশনে এসেছিল লুসি। আগের চেয়ে এখন অনেক সুন্দর হয়েছে সে। লুসিদের নতুন বাড়িটা দেখে দারুণ ভাল লাগল আমার। এমন জায়গায় বাড়ি বানিয়েছেন, সত্যি, রুচি ছিল লুসির বাবার। ছোটখাট একটা টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ছবির মত বাড়িটা। সামনের বিস্তীর্ণ উপত্যকার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে সাগরের দিকে চলে গেছে ছোট্ট একটা পাহাড়ী নদী, নদীটার নাম এক। মোহনার মুখের উঁচু খিলানওয়ালা লম্বা সেতুটার ওপর দাঁড়ালে ঢাল হয়ে নেমে যাওয়া ঘন সবুজে ছাওয়া উপত্যকা চোখে পড়ে, আর কেমন যেন স্বপ্নিল মনে হয় দিগন্তকে। উপত্যকার একপাশে ছবির মত করে সাজানো রয়েছে টালির  ছাদ দেয়া পুরানো লাল ইটের বাড়িগুলো। শহরের ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে হুইটবি গির্জার ধ্বংসাবশেষ, এখনও আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব কারুকাজ করা গির্জার চূড়াটা। সম্পূর্ণ শ্বেত পোশাক পরা এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণীকে নাকি চাঁদনী রাতে গির্জায় সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আজও।

শহরের আরেক প্রান্তে, সাগরের একেবারে কোণ ঘেঁষে পড়ে আছে আর একটা বেশ বড় গির্জার ধ্বংসাবশেষ। সেটার বিশাল আঙিনার সবটাই এখন কবরখানায় পরিণত হয়েছে। হুইটবির সবচেয়ে মনোরম জায়গা এটা। ধ্বংসপ্রাপ্ত সারি সারি পুরানো সমাধিগুলোর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে হলদে কাঁকর বিছানো সরু পথ। পথের দুপাশে সুন্দর করে লাগানো বার্চের সারি, এরই মাঝে মাঝে বসার জন্যে পাথর বসানো চওড়া বেদি তৈরি করা হয়েছে। জায়গাটা দারুণ পছন্দ হয়েছে আমার।

এখানটায় বসেই এই ডায়েরী লিখছি, আর মাঝে মাঝে উপভোগ করছি সাগর আর বনের অপূর্ব সৌন্দর্য। বার্চের পাতায় একটানা ঝির ঝির শব্দ তুলে বয়ে চলেছে দখিনা হাওয়া। একটু দূরে ঘাসের বুকে হুটোপুটি লাগিয়েছে কয়েকটা খরগোশ। ওহ, জোনাথন, এ সময়ে তোমাকে কাছে পেতে কি যে ইচ্ছে করছে।

কেন যেন দূরের ওই বন্দরটাকে অত্যন্ত কাছে মনে হয় এখান থেকে। বন্দরের একপাশে চওড়া এ্যানিটের দেয়াল অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে সাগরকে। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাতিঘরটা। বন্দরের ওপাশে, সাগরের বুক থেকে বাড়া উঠে গেছে পাথরের পাহাড়, দেখলে মনে হয় খামোকাই তীর থেকে সাগরের বুকে মাইল খানেক পর্যন্ত একটা দেয়াল খাড়া করে রাখা হয়েছে। পাহাড়টা যেখানে উঠে এসেছে সাগরের বুক থেকে ঠিক সেখানে, পাহাড়ের মাথায় আর একটা বাতিঘর বসানো হয়েছে। এ্যানিটের দেয়াল থেকে দ্বিতীয় বাতিঘরটা পর্যন্ত টেনে নেয়া হয়েছে একটা ঝোলানো সেতু, বাতিঘরে পৌঁছানর জন্যেই তৈরি হয়েছে সেতুটা। বাতিঘরটার সামনে ঘণ্টার বাধা বয়া আছে একটা। ঝড় তুফানের দিনে হাওয়ার ঝাঁপটায় যখন ফুলে ওঠে সাগর, ফুঁসে ওঠা উথালপাতাল ঢেউয়ের বুকে

তখন পাগলের মত দোল খেতে থাকে এই বয়া। ঝোড়ো বাতাসে ভর করে ভেসে আসে ওই ঘণ্টার করুণ আর্তনাদ। মাঝে মাঝে কখনও সুর পাল্টায় ঘণ্টাধ্বনি, কেমন যেন বিষণভাবে একটানা বেজে চলে ওটা। বহুদূর পর্যন্ত শোনা যায় ওই আওয়াজ। হুইটবির প্রাচীন লোকেরা তখন বার বার ক্রুশ চিহ্ন আঁকতে থাকে বুকে। ওরা বলে, দূর সাগরের বুকে কোথাও জাহাজডুবি হলেই ওরকম করুণ ভাবে কেঁদে ওঠে বয়ার ঘণ্টা।

যেটুকু লিখেছি, বসে বসে ভেবেছি তারচেয়ে অনেক বেশি। কখন যে বেলা শেষ হয়ে গেছে টেরও পাইনি। হঠাৎই খেয়াল করলাম দূর পাহাড়ের ওপারে অস্ত যাচ্ছে লাল সূর্য। একটু পরই কবরখানার বুকে নেমে আসবে ঘন অন্ধকার। অকারণেই ছমছম করে উঠল গা-টা। তাড়াতাড়ি কাগজপত্র গুছিয়ে উঠে পড়লাম। ওদিকে হয়ত আমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে লুসি আর তার মা।

২০ জুলাই।

আজও এসেছি এই কবরখানায়, তবে আজ একা নই, লুসি আছে সাথে। বহুদিন পর দুবান্ধবী মিলে মন খুলে আলাপ জমালাম। বেশিরভাগ বকবক করে চলল অবশ্য লুসিই, আবার নতুন করে আর্থার আর ওর প্রেমের কাহিনী শোনাল আমাকে। লুসির কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল, বার বার মনে পড়তে থাকল জোনাথনকে। সেই যে মাস দেড়েক আগে তার কাছ থেকে ছোট্ট একটা চিঠি পেয়েছি তারপর আর কোন সাড়া নেই। অন্য কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে সে? ভুলে গেছে আমাকে? অনেক কষ্টে, ঠেলে বেরিয়ে আসা অশ্রু রোধ করে সুসিকে নিয়ে উঠে পড়লাম।

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

৫ জুন।

ক্রমেই রহস্যজনক হয়ে উঠছে রেনফিল্ডের কাজ-কারবার। স্বার্থপরতা, গোপনীয়তা এবং দুরভিসন্ধি, এই তিনটে জিনিস প্রকট হয়ে উঠেছে ওর মাঝে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার বিশেষভাবে খেয়াল করেছি আমি, পশু পাখি আর পতঙ্গের প্রতি রেনফিল্ডের তীব্র আকর্ষণ। যেমন, হঠাৎ করে মাছি ধরার প্রতি সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকে পড়েছে সে। অল্প কদিনেই এত বেশি সংখ্যক মাছি ধরে ফেলল সে, যে দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গিয়ে রীতিমত বকাঝকা দিতে শুরু করলাম ওকে। আমার ধমকানিতে প্রথমে টু শব্দটি পর্যন্ত করল না রেনফিল্ড, পরে সুযোগ বুঝে আস্তে করে বলল, যদি কিছু মনে না করেন, ডাক্তার, আমাকে অন্তত তিনটে দিন সময় দিন। এই তিন দিনেই মাছির জঞ্জালকে ঝেটিয়ে বিদেয় করব আমি।

ভাবলাম দেখাই যাক না, কি করে ও। তাই বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু ঠিক তিন দিন, মনে থাকে যেন।

ঠিক করলাম সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে ওর ওপর।

১৮ জুন।

আমার শাসানোতে মাছির ওপর থেকে আকর্ষণ হারিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার পরিবর্তে মাকড়সার দিকে ঝুঁকে পড়েছে এখন রেনফিল্ড। ইতোমধ্যেই অনেকগুলো বড় সাইজের মাকড়সা ধরে একটা কাঠের বাক্সে ভরে রেখেছে সে। বাক্সটা আমিই দিয়েছি ওকে। আমার কাছে সে একটা কাঠের বাক্স চাইল, তা দিয়ে ও কি করে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে বাক্সটা ওকে এনে দিয়েছিলাম আমি। বেশ কিছু মাকড়সা ধরে ফেলার পর আবার মাছির দিকে ঝুঁকল রেনফিল্ড। ওর ভাগের অর্ধেক খাবারই ও ঘরের ভেতরে-বাইরে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে রাখে। মাছিরা প্রলুব্ধ হয়ে ওই খাবারে এসে বসলেই কায়দা করে ওগুলোকে ধরে ফেলে সে।

১ জুলাই।

ক্রমশ বেড়েই চলেছে রেনফিল্ডের ধরা মাকড়সার সংখ্যা। ওর পাগলামি আর সহ্য করতে না পেরে আজ গিয়ে সোজা বললাম ওকে, এখুনি ছেড়ে দাও মাকড়সাগুলোকে।

কথা শুনে প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হল রেনফিডের। ওর অবস্থা দেখে মায়া হল আমার। একটু নরম হয়ে বললাম, ঠিক আছে, সবগুলোকে না হোক, অন্তত অর্ধেক ছেড়ে দাও।

একটু যেন খুশি হল রেনফিল্ড। কিন্তু হ্যাঁ-না বলল না কিছু। মাকড়সাগুলোকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে আরও তিনদিন সময় দিলাম আমি ওকে। কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে যাব এমন সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল রেনফিল্ড। ঘরের এক কোণে গোশতের টুকরো ফেলে রেখেছিল সে, আমার নির্দেশেই সরানো হয়নি সেগুলো। পচে যাওয়া ওই গোশতের ওপর থেকে রেনফিল্ডের দিকে উড়ে এল একটা বড় আকারের উঁশ মাছি। অদ্ভুত কায়দায় থাবা মেরে মাছিটাকে ধরে ফেলেই মুখে পুরে দিল সে। পরক্ষণেই চিবিয়ে গিলে ফেলল সে মাছিটাকে। দেখে ঘৃণায় রি রি করে উঠল আমার সমস্ত শরীর।

প্রচণ্ড ধমক লাগালাম আমি রেনফিল্ডকে। আমার ধমকের উত্তরে মৃদু হেসে সে জানাল, আপনার হয়ত জানা নেই, ডাক্তার, একটা জীবন্ত তাজ জীব, তা সে যাই হোক না কেন, অত্যন্ত উপাদেয় এবং তা জীবনীশক্তিকে উজ্জীবিত করে তোলে শতগুণ।

রেনফিল্ডের কথা শুনে হঠাৎ ওর মাছি সংগ্রহের একটা কারণ আন্দাজ করলাম। মাকড়সাগুলোকে কি খাবার জন্যেই ধরেছে রেনফিল্ড? নজর রাখতে হবে, দেখতে হবে মাকড়সাগুলোকে নিয়ে ও কি করে।

আমার দিকে কিন্তু, তখন আর নজর নেই রেনফিল্ডের। বালিশের তলা থেকে একটা ছোট খাতা বের করে গভীর মনোর্যোগের সাথে তাতে লেখা অঙ্কগুলো দেখছে সে। দেখে মনে হয় বেশ বড় আকারের একটা হিসেব লেখা আছে খাতায় কিন্তু কিসের হিসেব? তা-ও জানতে হবে আমাকে।

৮ জুলাই।

রেনফিল্ডের পাগলামিটাকে ঠিক পাগলামি বলে আর ভাবতে পারছি না এখন। সাধারণ পাগলদের চাইতে ওর রকম-সকম সম্পূর্ণ আলাদা। এটাই আরও বেশি চিন্তিত করে তুলল আমাকে। গত কয়েকদিন আড়ালে-আবডালে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি রেনফিল্ডকে। কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই ওর মধ্যে। তবে একটা কাজ সে করেছে, কথামত তিনদিনের মধ্যেই অর্ধেক মাকড়সাকে বিদায় করেছে। কিন্তু কোথায় সরল সে মাকড়সাগুলোকে? ছেড়ে দেয়নি এ-সম্পর্কে আমি স্থির নিশ্চিত, খেয়েও ফেলেনি, তাহলে? ওদিকে কেমন করে জানি একটা চড়ুই ধরে ফেলে ওটার সাথে ইতোমধ্যেই ভাব জমিয়ে ফেলেছে রেনফিল্ড। আজ দুপুরবেলা হঠাৎ আবিষ্কার করলাম মাকড়সার রহস্যটা, আসলে হারানো মাকড়সাগুলো সব গেছে চড়ুইটার পেটে। আর তাইতেই রেনফিন্ডের পোষা হয়ে উঠেছে চড়ুইটা। মাকড়সা ধরা শুরু হবার পর আবার মাছির প্রতি কেন আকৃষ্ট হয়ে উঠেছিল পাগলটা তা-ও বুঝলাম। নিজের খাবার ছড়িয়ে মাছি ধরে রেনফিল্ড, তারপর মাছিগুলোকে ছেড়ে দেয় মাকড়সার খাঁচায়, মাকড়সাগুলোকে আবার খাওয়ায় চড়ুই দিয়ে। এরকম অদ্ভুত পাগলামির কথা জীবনে শুনিনি আমি।

১৯ জুলাই।

ইতোমধ্যেই চড়ুই পাখিদের ছোটখাট একটা বুস্তি গড়ে তুলেছে রেনফিল্ড। মাঝখানে বেশ কদিন ওর সাথে দেখা করিনি আমি। আজ ওর ঘরে ঢুকতেই ছুটে এসে আমার কাছে কেঁদে পড়ল রেনফিল্ড। বলল, যাই বলুন, ডাক্তার সাহেব, ছোট্ট একটা বিড়ালের বাচ্চা চাই আমার। ওর সাথে ভাব করব আমি। সকালসন্ধ্যা খেলব, সময় হলে খেতে না চাইলেও ধমক-ধামক দিয়ে খাওয়াব, দারুণ মজা হবে, তাই না?

কথা শুনে মেজাজটা খিঁচড়ে গেল আমার। কিন্তু তা প্রকাশ করলাম না ওর কাছে। বিড়ালের বাচ্চা কেন চাইছে সে তো আমি জানি। আসলে চড়ুইদের পুরো বস্তিটা বিড়ালের পেট ভরাতে চাইছে রেনফিল্ড। মজা করার জন্যে বললাম, বিড়ালের বাচ্চা পুষলে তো ভালই। তা বাচ্চা হলেই চলবে, নাকি আসলে একটা বড় বিড়াল দরকার তোমার?

ঠিক ধরেছেন আপনি! অত্যন্ত খুশি হয়ে বলল সে, সাধে কি আর এতবড় হাসপাতালের ডাক্তার হয়েছেন আপনি! তা, ডাক্তার সাহেব, বিড়ালটা কিন্তু আজই চাই আমার।

কিন্তু আজ তো হচ্ছে না। অর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে। সত্যি একটা বিড়াল তোমাকে দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে আমাকে।

মুহূর্তে খুশি খুশি ভাবটা চলে গেল রেনফিল্ডের চেহারা থেকে, সে-জায়গায় স্থান নিল একটা ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি। এ অভিব্যক্তি শুধু উন্মাদ খুনীদের মাঝেই দেখেছি আমি। এখন যে-কোন মানুষকে পৈশাচিকভাবে খুন করতে এতটুকু বাধবে না রেনফিল্ডের, ওই চেহারা তাই প্রমাণ করে। বুঝলাম, যতটা সহজ ভেবেছিলাম ওকে তারচেয়ে অনেক, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর সে। এখন থেকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে আমাকে। নাহলে যে-কোন মুহূর্তে, যে-কোন অঘটন বাধিয়ে বসতে পারে রেনফিল্ড।

রাত দশটায় আবার দেখতে গেলাম রেনফিল্ডকে। গালে হাত দিয়ে ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে ও। কিছুক্ষণ আগের ভয়ঙ্কর রূপ এখন আর তার মাঝে নেই। আমি ঘরে ঢুকতেই আবার আমার কাছে একটা বিড়ালের বাচ্চা চাইল সে। পরিষ্কার বলে দিলাম, হবে না। আর একটা কথাও বলল না রেনফিল্ড। হতাশ ভাবে ফিরে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে চেয়ে কি যেন ভাবতে থাকল সে। আমিও আর কোন কথা না বলে ফিরে এলাম।

২০ জুলাই।

নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। প্রচণ্ড কৌতূহল ব্লেনফিন্ডের ঘরের দিকে টেনে নিয়ে চলল আমাকে। ওর ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, খোশ মেজাজেই আছে রেনফিল্ড। বেসুরো কণ্ঠে শুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরের এখানে ওখানে চিনি ছিটাচ্ছে সে। আবার শুরু হয়ে গেছে মাছি শিকার। ঘরের কোথাও একটা চড়ুই চোখে পড়ল না। বিদায় করে দিয়েছে পাখিগুলোকে? জানালা থেকে সরে এসে রেফিন্ডের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম ওকে, পাখিগুলোকে দেখছি না, ছেড়ে দিয়েছ নাকি?

ছাড়ব কেন? পাখা আছে, উড়ে গেছে। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল রেনফিল্ড।

কথাটা বিশ্বাস হল না আমার। হঠাৎই চোখে পড়ল জিনিসগুলো। ঘরের এখানে ওখানে পড়ে আছে কয়েকটা পালক। কয়েক ফোটা রক্তের দাগও লেগে আছে বালিশের কভার আর বিছানার চাদরে। রক্ত এল কোত্থেকে? বেরিয়ে এসে রেনফিন্ডের ওপর কঠোর নজর রাখতে বললাম নার্সকে।

বেলা এগারোটায় ছুটতে ছুটতে এল নার্স। বলল, সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে, স্যার, রেনফিল্ড। বমি করে করে ভরিয়ে ফেলছে ঘরের মেঝে, বিছানার চাদর, একটু থেমে আবার বলল নার্স, বললে বিশ্বাস করবেন না, স্যার, বমির সাথে বেরিয়ে আসছে গাদা গাদা পালক। আমার মনে হয় সব কটা চড়ুইকেই গিলে ফেলেছে হতচ্ছাড়া পাগলটা। ব্যাপারটা দেখার জন্যে ছুটলাম রেনফিন্ডের ঘরে।

রাত দশটায় আবার দেখতে গেলাম রেনফিল্ডকে। অনেকটা ভাল এখন সে, কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আস্তে করে বালিশের তলা থেকে বের করে আনলাম ওর হিসেবের খাতাটা। খাতাটা খুলেই পাগলটার স্বভাবচরিত্র অনেকখানি প্রকাশ হয়ে পড়ল আমার কাছে। এ-ধরনের বিচিত্র পাগল কোটিতে একটা মেলে কিনা সন্দেহ। কোন বই-পুস্তকে পাওয়া যায় না এসব রোগের নাম। তবে কিছু কিছু ভুডু বিশেষজ্ঞের কাছে এসব পাগলদের কথা শুনতে পাওয়া যায়। এদেরকে বলে ওরা জুফাগাউস ম্যানিয়াক, অর্থ আত্মাভুক উন্মাদ। এরা মনে করে অন্যান্য জীবের জীবনকে আত্মসাৎ করে ফেললে সেইসব জীবের জীবনীশক্তি পুঞ্জীভূত ও সঞ্চালিত হয়ে যাবে নিজের মধ্যে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল একটা বিচিত্র পদ্ধতিতে জীবনীশক্তি আত্মসাৎ করে ওরা। প্রথমে যতগুলো সম্ভব প্রাণীকে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের প্রাণী দিয়ে খাওয়ায় ওরা। এর উদ্দেশ্য, ছোট প্রাণীগুলোর সমস্ত জীবনীশক্তি আত্মসাৎ করে নিল অপেক্ষাকৃত বড় প্রাণীটা। তারপর সেই প্রাণীটাকে নিজেই খেয়ে ফেলে ছোট প্রাণীগুলো আর বড় প্রাণীটার জীবনীশক্তি একসঙ্গে আত্মসাৎ করে নেয় জুফাগাউস ম্যানিয়াক। কখনও কখনও এই আত্মসাৎ-এর প্রক্রিয়া তৃতীয়, চতুর্থ এমনকি পঞ্চম স্তর পর্যন্ত পৌঁছায়। রেনফিন্ডের প্রক্রিয়া চতুর্থ স্তরে পৌঁছেছে, অবশ্য বিড়াল পেলে পঞ্চম স্তরেই পৌঁছে যেতে পারত সে।

এ ধরনের অন্যান্য পাগলদের চাইতে আর একটু উন্নত রেনফিল্ড। কটা জীবকে আত্মসাৎ করেছে তা নির্ভুলভাবে খাতায় লিখে রেখেছে সে। কটা মাকড়সাকে কটা মাছি খাওয়াল, সে-মাকাগুলোকে আবার কটা চড়ুই দিয়ে খাওয়াল সবকিছু অত্যন্ত সুন্দরভাবে তারিখ দিয়ে দিয়ে লিখে রেখেছে ও। একটা পাগল কি করে এত সুন্দর এবং নির্ভুলভাবে অঙ্কের হিসেব রাখল ভেবে আশ্চর্য লাগল আমার। জানো লুসি, ভেবেছিলাম, তোমার প্রত্যাখ্যানের পর আর কোন কাজেই মন বসাতে পারব না আমি। জীবনটা অর্থহীন হয়ে যাবে আমার কাছে। কিন্তু এখন দেখছি প্রেমই মানুষের জীবনে সবকিছু নয়। ইচ্ছে করলেই সুস্থ মন নিয়ে বেঁচে থাকার অনেক অবলম্বন খুঁজে বের করতে পারে মানুষ। পাগল রেনফিল্ডের কাছে একটা বড় শিক্ষা পেলাম আমি, যে-কোন কাজে স্থির অবিচলভাবে মনপ্রাণ ডুবিয়ে দিতে পারলে শুধু তাই নিয়ে বেঁচে থাকাটা এমন কঠিন কাজ নয়।

১.৬ মিনা মুরের ডায়েরী থেকে

মিনা মুরের ডায়েরী থেকে

২৬ জুলাই।

গতকাল মি. হকিন্সের কাছে লেখা জোনাথনের একটা চিঠি পেয়েছি। কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ-দুর্গ থেকে লেখা মাত্র এক লাইনের ছোট্ট চিঠি লিখেছে বাড়ি রওনা হচ্ছি। চিঠিটা পড়ে কিছুই বুঝলাম না। সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন খাপছাড়া মনে হচ্ছে আমার কাছে।

লুসিদের বাড়িতেই এখনও আছি আমি। ভালই আছে সুসি, কিন্তু হঠাৎ করেই ঘুমের ঘোরে হেঁটে চলার সেই পুরানো অভ্যাসটা আবার ফিরে এসেছে ওর মাঝে। লুসির মার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে গোপনে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রাতে আমি নিজের হাতে বাইরে থেকে ওর ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়ে তারপর শুতে যাব। এই ঘুমের ঘোরে হাঁটা জিনিসটা ভয়ঙ্কর, এতে কখনও-সখনও প্রাণ সংশয় পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। লুসির মার মতে ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই পাহাড় কিংবা ছাদের কার্নিসের একেবারে প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়ায় নিশিতে পাওয়া মানুষ, তারপর সেই অবস্থায়ই হঠাৎ ঘোর কেটে গিয়ে নিজের অবস্থান দেখে চমকে গিয়ে নিচে পড়ে যায়। লুসির বাবাকেও নাকি প্রায় নিশিতে পেত।

মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন লুসির মা; ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে লুসির বিয়ে। এর মাঝে যদি কোন অঘটন ঘটে যায়, ভাবনার কথাই। শিগগিরই এখানে এস পৌঁছুবে অসুস্থ লর্ড গোডালমিং-এর একমাত্র পুত্র আর্থর হোমউড। আমার মনে হয় নিশি-টিশি কিছু না, আসলে আর্থারের প্রতীক্ষায়ই ক্ৰমে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে সুলি এবং সেই চিন্তায় ঘুম না আসাতে বিছানা ছেড়ে উঠে আপনমনে ভাবতে ভাবতে ঘুরে বেড়ায় সে।

২৭ জুলাই।

আর কোনরকম খবর পাইনি জোনাথনের কাছ থেকে। ওর জন্যে আমার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। ছোট্ট একটা চিঠি যদি শুধু পেতাম ওর কাছ থেকে।

ওদিকে ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস কিন্তু দিনকে দিন বেড়েই চলেছে লুসির। বাইরে থেকে অবশ্য ওর ঘর তালাবদ্ধ করে রাখি আমি, কিন্তু ঘরের ভেতরই ওর হাঁটার শব্দে প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। জোনাথনের কোন খবর নেই, ওদিকে লুসির এই অবস্থা, সব মিলিয়ে দুর্ভাবনার শেষ নেই আমার। বুঝতে পারছি এ-অবস্থা আর বেশিদিন চললে অসুখে পড়ে যাব আমি। একমাত্র সান্ত্বনা, সুসির স্বাস্থ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি এখনও। এই সময় তারবার্তা এল আর্থারের কাছ থেকে, ওর বাবার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটেছে, কাজেই ওর আসতে আরও কদিন দেরি হবে।

৩ আগষ্ট।

আরও সপ্তাহখানেক কেটে গেল। এখন পর্যন্ত কোন খবর নেই জোনাথনের। কি হল ওর? সাংঘাতিক কোন অসুখে পড়েছে? ওর চিন্তায় রাতে ভাল ঘুম হয় না আমার। ঘুমের ঘোরে হাঁটা একটু কমেছে লুসির, কিন্তু নতুন আরেক পরিবর্তন টের পাওয়া যাচ্ছে ওর মাঝে। আগের চেয়ে অনেক শান্ত হয়ে গেছে ও। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটার উত্তর পাওয়া যায়। আর রাতের বেলা ঘর থেকে বেরোবার এক উদগ্র ইচ্ছে জেগে উঠেছে ওর মাঝে, অবশ্য কখনই রাতের বেলা ওকে ঘর থেকে বেরোতে দিই না আমি। এ কি ভয়ঙ্কর কোন বিপদের পূর্বলক্ষণ?

৬ আগস্ট।

দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও তিনটে দিন, অথচ কোন খবর নেই জোনাথনের। শুধু যদি জানতাম কোথায় আছে ও, তাহলে নিজে গিয়ে দেখা করতে পারতাম তার সাথে। জানি না যখন, দুর্বিষহ হলেও অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

লুসির মনের অস্বস্তির ভাবটা আরও বেড়ে গেছে। রাতে বলতে গেলে আর বিছানায় পিঠই লাগায় না সে এখন।

আজ একটা অদ্ভুত কথা শুনলাম স্থানীয় লোকদের মুখে। গত রাতে নাকি প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল দূর সাগরে। কথাটা অবশ্য মিথ্যে ভাববার কোন কারণ নেই। এখন পর্যন্ত কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ, সূর্যের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বিস্মিত হবার কারণ সেটা নয়, কারণ হল আশ্চর্য ঘন কুয়াশায় ছেয়ে গিয়েছিল দিগন্ত। আর বন্দরের কোলাহল ছাপিয়ে ভেসে এসেছিল একটা বিষণ্ণ চাপা গুম গুম শব্দ, সেই বয়ায় বাধা ঘণ্টার শব্দ। জেলেরা বলছে নিশ্চয়ই কোন না কোন জাহাজ ডুবেছে দূর সাগরে।

একটু আগে লুসির মার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন মি. সোয়ালেজ। ঝড়ো বাতাসের ঝাঁপটায় ফুলে ওঠা সাগরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে উঠেছিলেন বৃদ্ধ, জানো, মিনা, কেন যেন মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কোন দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে হুইটবিকে কেন্দ্র করে। বাতাসে পৈশাচিকতার গন্ধ পাচ্ছি। সামান্য ব্ল্যাক ম্যাজিক শিখেছিলাম এক সময়। তাই অদ্ভুত কিছু ঘটতে যাবার আগে তা ঠিকই টের পাই আমি।

কথাগুলো বলতে বলতেই মন খারাপ হয়ে গেল মি. সোয়ালেজের। এরপরই উঠে চলে গেলেন তিনি।

৮ আগস্ট।

অদ্ভুত একটা খবর বেরিয়েছে আজ দি ডেইলিগ্রাফ পত্রিকায়। খবরটা আমার মনকে এত নাড়া দিয়েছে যে খবরের বিষয়বস্তুটুকু লিখে রাখছি ডায়েরীর পাতায়।

মিথ্যে বলেনি জেলেরা, সত্যিই প্রচণ্ড ঝড় হয়েছিল আগের রাতে। ডেইলিগ্রাফ পত্রিকার মতে হুইটবি বা তার আশেপাশের এলাকায় এত প্রচণ্ড ঝড় নাকি আর কখনও হয়নি। সেদিন সকাল থেকেই গুমোট ভাব ছিল আবহাওয়ায়, কিন্তু আগস্ট মাসে তা এমন কিছু অভিনব নয়। বাতাসে গুমোট ভাব থাকলেও আকাশ কিন্তু ছিল পরিস্কার। সেদিন শনিবার, অতএব হইটবির আশপাশের মালগ্রেভ উড, রবিনহুড উপসাগর, রিগ মিল, রানসউইক প্রভৃতি দ্বীপ ভ্রমণে বের হয়ে পড়ে হইটবির অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় লোকেরা। বিকেলের একটু পরই বাতাসের গুমোট ভাবটা কেটে গিয়ে বইতে শুরু করে ঝিরঝিরে দখিনা হাওয়া। কিন্তু সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। হঠাৎ করেই ঘন মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। ভয় পেয়ে তীরে ফিরে আসে অধিকাংশ জেলে নৌকা।

রাত দশটার পরই প্রবল হাওয়া বইতে শুরু করে, ফুসে ওঠে সাগর। পাহাড়ের মত বিশাল সব ঢেউ প্রচও বেগে ছুটে এসে আছড়ে পড়তে থাকে হুইটবির উপকূলে। যে দুএকটা জেলে নৌকা সাঁঝের বেলায় ফিরে না এসে তখন পর্যন্ত খোলা সাগরে মাছ ধরছিল তারা আর ফিরে আসতে পারেনি। গ্রাস করে নিয়েছে তাদের উত্তাল সাগর।

ভয়ঙ্কর সে-ঝড়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে হুইটবির প্রাচীন নাবিকেরা বলেছে এমন ঝড় নাকি জীবনে আর দেখেনি ওরা। এমনকি তাদের বাপ-দাদাদের মুখেও কখনও শোনননি। সূর্য ডোবার পর থেকে যেমন হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল ঝড়, ভোরবেলা মোরগ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তেমনি হঠাৎ করেই থেমে যায় আবার।

সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হল, ভোরবেলা দুইটবির উপকূলে রহস্যজনকভাবে পড়ে ছিল একটি অচেনা পরিত্যক্ত জাহাজ।

৯ আগস্ট।

খবরের শেষ অংশটুকু লিখে রাখছি আজ। খোঁজখবর করে জানা যায় পরিত্যক্ত জাহাজটির নাম ডিমেটার। কিছুদিন আগে ভার্না বন্দর থেকে মাল নিয়ে রওনা দেয় এই ছোট্ট রাশিয়ান জাহাজটি। জাহাজটিতে করে হুইটবির জনৈক আইনজীবী মি. এস, এফ, বিলিংটনের নামে কয়েকটা বড় বড় কাঠের বাক্স পাঠানো হয়। রাশিয়ান বাণিজ্যদূত এবং স্থানীয় বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে। পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ডিমেটারে গিয়ে ওঠে কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক। জাহাজের ভেতরে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে সাংবাদিকরা। শেষ পর্যন্ত এঞ্জিনরূমে একটিমাত্র মৃতদেহ আবিষ্কার করে ওরা। জাহাজের হুইলের সাথে শক্ত করে বাঁধা ছিল লাশের ডান হাতটা, অন্য হাতে ধরা একটা কাঠের কুশ। লাশের সারা মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। পুলিশ সার্জেন জে. এম. কাফিনের মতে দুদিন আগেই মারা গেছে লোকটা। একটা লগবুক পাওয়া গেছে লাশের পকেট থেকে। লগবুকটা পড়ে জানা গেছে ডিমেটার জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন মৃত লোকটা।

লগবুকে অদ্ভুত সব ঘটনার উল্লেখ করে গেছেন ডিমেটারের ক্যাপ্টেন। ভয়ঙ্কর, অবিশ্বাস্য ওই ঘটনাগুলোর যথাযথ বিবরণ ডায়েরীতে লিখে রাখছি আমি।

৬ জুলাই।

কয়েকটা বড় বড় বাক্স ভর্তি বালি আর মাটি নিয়ে দুপুরের দিকে রওনা হল আমাদের মালবাহী জাহাজ ডিমেটার। আবহাওয়া পরিষ্কার। আমি বাদে আর পাঁচজন নাবিক, দুজন খালাসী, একজন বাবুর্চি এবং একজন প্রধান সহকারী সহ আরও মোট নজন লোক আছে জাহাজে।

১১ জুলাই।

তুরস্কের সীমান্ত অঞ্চল বসফরাসে এসে প্রবেশ করলাম ভোর হবার আগেই। একটু পরই তদন্তের উদ্দেশ্যে জাহাজে এসে উঠল শুল্ক বিভাগের কয়েকজন লোক। ওদের তদন্ত শেষ হল বিকেল চারটে নাগাদ। ছাড়পত্র পেয়ে আবার চলতে শুরু করল জাহাজ।

১২ জুলাই।

দারদালেস-এ এসে অল্পক্ষণের জন্যে আরও কবার ঝামেলা পোহাতে হল উপকূলরক্ষী ও জলপুলিশের হাতে। আর্কিপেলাগো পার হয়ে এলাম মাঝরাতে।

১৩ জুলাই।

মাতাপান অন্তরীপ ছাড়িয়ে আসার পরপরই একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত জাহাজে। কেন যেন একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে নাবিকেরা। কারণটা জানতে পারলাম না।

১৪ জুলাই।

ক্রমশ বেড়েই চলেছে উত্তেজনা। বলিষ্ঠ, কর্মঠ ওই লোকগুলোর এই ব্যবহারের সঠিক কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারলাম, জাহাজে অস্বাভাবিক কিছু আছে বলে সন্দেহ করছে নাবিকেরা। কথায় কথায় বুকে কুশ চিহ্ন আঁকছে ওরা। এসব নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে করতে দুজন তো প্রায় মারামারিই বাধিয়ে দিল। কিন্তু অন্যেরা ধরে শান্ত করে দিল ওদের।

১৬ জুলাই।

পেত্রোফস্কি নামে একজন নাবিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মাঝরাতের পর থেকেই। বহু খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান না পেয়ে পুরোপুরি আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে নাবিকেরা। একম কিছু ঘটার আশঙ্কা নাকি আগে থেকেই করছিল তারা। ওদের সন্দেহ, সাংঘাতিক বিপদ ঘনিয়ে আসছে ডিমেটারের ওপর।

১৭ জুলাই।

অদ্ভুত একটা ঘটনার উল্লেখ করেছে গতকাল নাবিক ওলগারেন। আগের রাতে পেছনের ডেকে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল সে। ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছিল তখন। হঠাৎ খেয়াল করল ওলগারেন, কালো আলখালায় ঢাকা ল মত কে যেন একজন সামনের ডেকের দিকে হালকা পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটা জাহাজের কেউ নয় এ-ব্যাপারে নিশ্চিত গুলগারেন। আড়ালে থেকে ওকে লক্ষ্য করতে থাকল নাবিক। ওর চোখের সামনে হঠাৎই কোথাও উধাও হয়ে গেল আগন্তুক। কোথায় গেল লোকটা? সামনের ডেকে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে চট করে লুকিয়ে পড়তে পারে সে। কেন যেন ভয় ভয় করতে লাগল ওলগারেনের। ডিউটি শেষ হবার পরপরই কথাটা আমাকে এসে জানিয়ে গিয়েছিল সে।

ওলগারেনের কথায় জাহাজটাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখার আদেশ দিলাম সবাইকে। প্রথমে আমার সহকারী তো খেপেই গেল কিন্তু ওকে বুঝিয়ে বলতেই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও খুঁজতে গেল সে। জাহাজের প্রত্যেকটি ইঞ্চি খুঁজে দেখার পরও সন্দেহজনক কিছু না দেখে আবার সাহস ফিরে এল নাবিকদের মনে। খুশি মনেই আবার কাজ করতে লাগল ওরা।

২২ জুলাই।

সাংঘাতিক খারাপ আবহাওয়া যাচ্ছে গত তিনদিন ধরে। জাহাজ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে সবাই, অতএব আর ভয় পাবার সময় পায়নি কেউ। বহু কষ্টে জিব্রাল্টার প্রণালী পেরিয়ে আসার পর আবহাওয়ার একটু পরিবর্তন হয়েছে।

২৪ জুলাই।

আবার দ্বিগুণ আতঙ্ক এসে ভর করেছে নাবিকদের মনে। বিসূকে উপসাগরে পড়ার পর থেকেই আর একজন নাবিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এবারও রাতের বেলা জাহাজের ডেকে পাহারা দিতে গিয়ে হারিয়ে গেছে সে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কেউই আর রাতের বেলা ডেকে একলা দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে সাহস পাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই দুজন করে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবার নির্দেশ দিতে হল। এবার কি ঘটবে কে জানে।

২৮ জুলাই।

জিব্রাল্টার প্রণালী পেরোবার পর একটু পরিষ্কার হলেও রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গিয়েছিল আবহাওয়া। সেই থেকে ক্রমেই আবহাওয়ার অবস্থা খারাপের দিকে চলেছিল। আজ এমন অবস্থা, খোলা ডেকে গিয়ে দাঁড়ানই যাচ্ছে না। ক্রমাগত জাহাজের গায়ে এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে ঝড়ো হাওয়া। নিচে ফুসছে অশান্ত সাগর। বিশাল সাগরের বুকে চীনাবাদামের খোসার মত দুলছে ডিমেটার। আতঙ্কে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেছে নাবিকেরা।

২৯ জুলাই।

দুজন করে পাহারা দিয়েও এড়ানো গেল না তৃতীয় দৃর্ঘটনা। গত রাতে একসাথে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল দুজন নাবিক। ভোরের দিকে অল্পক্ষণের জন্যে বাথরূমে গিয়েছিল একজন, ফিরে এসে দেখে অপরজন নেই ডেকে। সাথে সাথেই চেঁচামেচি শুরু করে সে। শুরু হল খোঁজা। কিন্তু সেই পুরানো ইতিহাস। সারা জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না ওকে। বিন্দুমাত্র সূত্র না রেখে গায়েব হয়ে গেল তিন তিনটে লোক। আশ্চর্য!

৩০ জুলাই।

রাত শেষ হবার আগেই ইংল্যাণ্ডের কাছাকাছি এসে পড়ল জাহাজ। আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে সবাই। জাহাজের পালগুলো আবার তুলে দেয়া হয়েছে, তরতর করে পানি কেটে স্বচ্ছন্দ গতিতে ক্রমেই ইংল্যাণ্ডের উপকূলের আরও কাছে চলে যাচ্ছে জাহাজ। সবাই নিশ্চিন্ত, এমন সময় ঘটল চতুর্থ দুর্ঘটনা। আরও একজন নাবিক গায়েব। হারাধনের দশটি ছেলের মত অবস্থা হয়েছে যেন।

১ আগস্ট।

ঝড় থেমেছে ঠিকই। কিন্তু কোত্থেকে এসে হাজির হয়েছে ঘন কুয়াশা। এত ঘন যে দুহাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখা যায় না। এ-অবস্থায় জাহাজ পথ ভুল করতে বাধ্য। কয়েকবারই বিপদে পড়ার সংকেত পাঠালাম বাইরের পৃথিবীতে, কিন্তু কোন কাজ হল না। কেন যেন মনে হচ্ছে এক অজানা ভয়ঙ্করের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে আমাদের কোন অশুভ শক্তি।

২ আগস্ট।

মধ্যরাত্রি-হঠাৎ কার আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। একলাফে উঠে বিছানা থেকে নেমে ছুটে বেরিয়ে এলাম ডেকে। খুব কাছে থেকেই এসেছিল চিৎকারটা, কিন্তু বাইরে এসে কিছুই চোখে পড়ল না। অবশ্য ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে, ঘন কুয়াশার ভেতরে কোনকিছু চোখে পড়াটাই অস্বাভাবিক। চেঁচিয়ে ডাকতেই উত্তর দিল দুজন নবিক। আমার মত ওরাও আর্তচিৎকার শুনেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সারা ডেক খুঁজেও পাহারারত নাবিকটির খোঁজ পাওয়া গেল না। এই নিয়ে হারাধনের দশটি ছেলের পাচটি নিখোঁজ।

৩ আগস্ট।

মধ্য রাত্রি-ক্লান্ত নাবিকটিকে ছুটি দেবার উদ্দেশ্যে এঞ্জিন ঘরে এসে ঢুকলাম। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। গেল কোথায়? এমনিতেই কুয়াশার জ্বালায় অস্থির, ওদিকে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে। এ-অবস্থায় এঞ্জিন ঘরে লোক নেই, ভারি আশ্চর্য তো? এ-সময় তো

এঞ্জিন ঘর ছেড়ে যাবার কথা নয় এঞ্জিন চালকের। চেঁচিয়ে সহকারীকে ডাকলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ক্রু ড্রাইভার হাতে ছুটে এল সে। ওর চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। যেন ভূত দেখেছে সে। আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর দুচোখ। আমাকে দেখেই কানের কাছে ঝুঁকে এল সে। ভয়চকিত দৃষ্টিতে আশপাশটা দেখতে দেখতে ফিসফিস করে বলল, এখানেই কোথাও আছে ও, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। একটু আগে নিজের চোখে দেখেছি আমি ওকে। ঢ্যাঙা, বোগা, মরা মানুষের মত বিবর্ণ পাংশুটে মুখ। পেছন থেকে মাংস কাটার বড় ছুরিটা ওর দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলাম আমি। বললে বিশ্বাস করবেন না, ক্যাপ্টেন, সোজা ওকে ভেদ করে ওপাশের দেয়ালে গিয়ে ঠং করে বাড়ি খেল ছুরিটা, যেন ছায়ার ভেতর দিয়ে ওপারে চলে গেল, বলেই শ্বাস নেবার জন্যে একটু থামল সহকারী। যদি ছুরি ও সত্যিই মেরে থাকে তাহলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার কোন উপায় নেই, এটা ঠিক। কারণ ওকে চিনি আমি। বিশ ফুট দূর থেকে ছুরি ছুঁড়ে মেরে একটা পাখির চোখে বিধিয়ে দেয়াটা ওর পক্ষে কিছুই না।

আবার বলতে শুরু করেছে সহকারী, আমি এখন জানি, ক্যাপ্টেন, কোথায় আছে ও। লোকজনের সাড়া পেলেই ওই বাক্সগুলোর কোন একটায় গিয়ে লুকায় ব্যাটা। কাজেই প্রত্যেকটা বাক্সের ডালা খুলে দেখতে যাচ্ছি আমি এখন, বলেই ঝড়ের বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।

বিমূঢ়ের মত এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। নিচ থেকে ভেসে আসছে হাতুড়ির ঠুকঠাক আর বাক্সের ডালা খোলার মৃদু কাচকোচ আওয়াজ। হঠাৎ তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুনে হৃৎপিণ্ডের গতি স্তব্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল আমার। চেঁচাতে চেঁচাতেই এঞ্জিনরূমে এসে ঢুকল সহকারী। আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে ওর সারা গা। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে এখুনি। হাঁপাতে হাঁপাতে কোনরকমে বলল সে, ক্যাপ্টেন, ওকে খুঁজে পেয়েছি আমি। মানুষ না ও। এ-জাহাজে থাকলে নির্মমভাবে ওর হাতে মরতে হবে আমাকে। তারচেয়ে সত্যিকার নাবিকের মত সাগরে ডুবে মরা অনেক ভাল। তাই করতে যাচ্ছি আমি এখন। বিদায়, ক্যাপ্টেন। আমি ভালমত কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। মুহূর্ত পরে সংবিৎ ফিরে পেয়ে ওর পিছু পিছু ছুটে গেলাম আমিও। কিন্তু ঘন কুয়াশার জন্যে ও কোনদিকে গেল ঠাহর করতে পারলাম না। ঝড়ো বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে কানে এল শুধু ওর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মৃদু ছলাৎ শব্দ।

আমার চোখের সামনেই শেষ হয়ে গেল আর একটা জীবন। কয়েকটা মুহূর্ত এক জায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নাবিকদের কেবিনের দিকে এগিয়ে চললাম। কেবিনের দরজার কাছে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াতে হল। দমকা বাতাসে এদিকওদিক বাড়ি খাচ্ছে খোলা দরজা। ভেতরে কেউ নেই। কেবিনের দেয়ালে ঝোলানো লণ্ঠনটা খুলে নিয়ে খুঁজতে বেরোলাম ওদের। সারাটা জাহাজ খুঁজেও পাওয়া গেল না কাউকে। নিষ্ঠুর সত্যটা আর চাপা থাকল না আমার কাছে। হারাধনের দশটি ছেলের নয়টিই সাগরে ঝাঁপ দিয়েছে।

ওদের ঝাঁপ দেয়ার কারণটা স্পষ্ট না হলেও আবছা মত আন্দাজ করলাম। ভয়ঙ্কর কোনকিছু দেখে আতঙ্কে জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে আমার সহকারীর মতই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ডিমেটারের প্রত্যেকটি নাবিক।

পরিষ্কার বুঝতে পারলাম কোনদিন আর বন্দরে পৌঁছতে পারব না আমিও।

৪ আগস্ট।

ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ হল। কিন্তু গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো পৌঁছতে পারছে না এখানে। গত রাত থেকে ঠায় বসে আছি এঞ্জিনরূমে। শেষে আবার আমার নাবিকের মত বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি এ-ভয়ে হুইলের কাছে কেউ নেই জেনেও এঞ্জিনরুম ছেড়ে যাবার সাহস পাচ্ছি না। বাঁচব না ঠিকই, কিন্তু ক্যাপ্টেনের সম্মানকে ক্ষুন্ন করে জাহাজ ছেড়ে যেতে পারব না আমি।

গত রাতে এঞ্জিন ঘরের এক কোণে অস্পষ্ট আলো-ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি ওকে। এত ভয়ঙ্কর চেহারা জীবনে দেখিনি আমি। ওকে দেখে মনে হয়েছে নরক থেকে উঠে এসেছে যেন সাক্ষাৎ শয়তান।

বার বার মনে হচ্ছে, যাই, ঝাঁপিয়ে পড়ি সাগরে। কারণ এ-চেহারা আর দ্বিতীয়বার দেখার সাহস নেই আমার। জাহাজে থাকলে আজ রাতেও আবার দেখব ওকে, এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু না, পরাজিত হতে পারব না ওর কাছে। জাহাজে থেকেই মরব আমি। অসচেতন মুহূর্তে যাতে কিছু করে বসতে না পারি সেজন্যে ডান হাতটাকে শক্ত করে বেঁধে রাখ হুইলের সাথে।

কিন্তু রাত যতই এগিয়ে আসছে মনে মনে ততই দুর্বল হয়ে পড়ছি। আর দেরি করা যায় না। এখনই হাতটা হুইলের সাথে বেঁধে ফেলা দরকার।

আমার এ-লগবুক যদি কারও হাতে পড়ে তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন কর্তব্যের খাতিরেই হুইলের সাথে হাত বেঁধে রেখেছি আমি। আমার আরও একটা অনুরোধ থাকল তার কাছে, সম্ভব হলে সে যেন দুনিয়ার বুক থেকে ধ্বংস করে দেয় এই রক্তলোভী পিশাচকে। না হলে নিরপরাধ দশজন নাবিকের আত্মা শান্তি পাবে না কোনদিন। বিদায় হে পৃথিবী, বিদায়।

ঈশ্বর,স্বর্গে দ্বার খুলে রাখো আমার জন্যে। তোমার পদপ্রান্তে ঠাই নিতে আসছি আমি।

.

মিনা মুরের ডায়েরী থেকে
১০ আগস্ট।

ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাসটা অনেক কমে এসেছে লুসির, কিন্তু তার পরিবর্তে আরেকটা নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে, ঘুমের মধ্যেই অস্বাভাবিকরকম ছটফট করে সে। গতকাল লুসির সাথে একই ঘরে রাত কাটিয়েছি। ওর ছটফটানিতে একটুক্ষণের জন্যেও দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি আমি। সারারাত ছটফট করে ভোরের দিকে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে লুসি।

ঘুম ভাঙলে ওকে নিয়ে সাগরের ধারে বেড়াতে বেরোলাম। ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশের এখানে-ওখানে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। ভোরের কচি রোদ এসে পড়েছে বিচিত্র রঙা মেঠো ফুলের গায়ে। ফুলগুলোর কোন কোনটায় রাতের ঝরে পড়া দুএক ফোঁটা শিশিরবিন্দু এখনও লেগে আছে। সূর্যের সোনালী আলো পড়ে রামধনুর সাত রঙ সৃষ্টি করছে ওই শিশিরবিন্দুগুলো। সাগরের বুক থেকে বয়ে আসছে ঝিরঝিরে দখিনা হাওয়া। শান্ত ওই সাগরের দিকে চেয়ে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না মাত্র কয়েকদিন আগে ঝড়ের দাপটে ওর বুকেই উথালপাতাল নেচে বেড়িয়েছে পাহাড়-প্রমাণ বিশাল সব ঢেউ।

হাঁটতে হাঁটতে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন গির্জাটার কাছে চলে এলাম গির্জার আঙিনায় লোকের ভিড়। ডিমেটারের সেই হতভাগ্য ক্যাপ্টেনের লাশ দাফন করতে আনা হয়েছে আজ, তার শোকমিছিলে অংশ গ্রহণ করছে আঙিনার ওই লোকগুলো। কি যেন এক অজানা কারণে অস্থির হয়ে আছে লুসি, রাবার জিজ্ঞেস করেও তার কাছ থেকে সদুত্তর পেলাম না আমি। গতরাতের দুঃস্বপ্নের ঘোর বোধহয় এখনও ছায়াপাত করে রেখেছে ওর মনে।

এখানে, এই লোকের ভিড়ে লুসির ভাল লাগছে না ভেবে, পূবের ফাঁকা জায়গাটার দিকে রওনা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে প্রথমদিন যে-বেদিটায় বসে ডায়েরী লিখেছিলাম সেটার কাছে চলে এলাম। এখানেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা। করছে জনাকয়েক লোক। ওদের মাঝে আমার একজন পরিচিত লোকও আছে। আমাদের দেখেই এগিয়ে এসে বলল সে, জানেন, মিস মুর, আজ ভোরে এই বেদির ওপর মরে পড়ে ছিল বৃদ্ধ মি. সোয়ালেজ। ডাক্তার রায় দিয়েছেন, অস্বাভাবিক আতঙ্কজনিত কারণে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন বৃদ্ধ। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবতে ভাবতেই রবিনহুড উপসাগরের পাহাড়ী উপত্যকার দিকে এগিয়ে চললাম আমি আর লুসি।

১১ আগস্ট।

গতকাল শেষ করতে পারিনি লেখাটা, আজ যেভাবেই হোক শেষ করে ফেলব; এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই লিখতে বসেছি। রবিনহুড উপসাগরের কাছাকাছি পৌঁছেই মুখের বিষাদ ভাবটা কেটে গেল লুসির। চারপাশের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে খুশি মনেই এগোতে থাকলাম আমরা।

উপসাগরের একেবারে তীরের কাছের পাহাড়টার কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ছোট্ট একটা সরাইখানা। প্রায় নির্জন সেই সরাইখানার খোলা একটা জানালার ধারে চা খাওয়ার জন্যে বসলাম আমরা। দূরের ঢেউ খেলানো চারণভূমি থেকে ভেসে আসছে পশুর গলায় বাঁধা ঘণ্টার সুরেলা মৃদু টুংটাং আওয়াজ। চা খেয়ে নিয়ে সরাইখানার আশপাশটা ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। ঘুরে ঘুরে সেই পাহাড়ী অঞ্চলেই সারাটা দিন কাটিয়ে দিলাম, খিদে পেলেই এসে খেয়ে নিচ্ছিলাম সেই সরাইখানাটায়।

বিকেল গড়িয়ে আসতেই রওনা দিলাম বাড়ির দিকে। গতরাতের দ্রিাহীনতা আর সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে ভেঙে আসছিল সারা শরীর। বাড়ি ফিরে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল লুসি। ঘুমোলে অদ্ভুত সুন্দর লাগে লুসিকে। হলপ করে বলতে পারি এসময় ওকে দেখলে চুমু খাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে যেত আর্থার।

এই সময় হঠাৎ জোনাথনের কথা মনে পড়ে গেল আমার। অনুভব করছি দুগাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে তপ্ত অশ্রুর ধারা। ঈশ্বর, যেখানে, যে অবস্থায়ই থাকুক ও, তুমি ওকে দেখো।

কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, হঠাৎ অস্ফুট একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। নিজের অজান্তেই চমকে উঠে বসলাম বিছানার ওপর। লুসির বিছানার দিকে চোখ পড়তেই অজানা আশঙ্কায় ধড়ফড় করে উঠল বুক। বিছানা খালি। বিদ্যুৎ বেগে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে চাইলাম, দরজা খোলা। ব্যাপারটা বুঝতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হল না আমার। ঘুমের ঘোরেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেছে লুসি। একলাফে বিছানা থেকে নেমে আলনা থেকে একটা শাল টেনে নিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবলাম এত রাতে নিশ্চয়ই বাড়ির বাইরে কোথাও যাবে না লুসি। তাই নিচে নেমে নিচের সব কটা ঘর খুঁজে দেখলাম। পাওয়া গেল

ওকে। বাগানেও নেই। মাথাটা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হল আমার। কোথায় গেল লুসি? হঠাৎ খেয়াল হল বৈঠকখানার ঘরটা দেখা হয়নি এখনও। একছুটে এসে ঢুকলাম বৈঠকখানায়, নেই লুসি; কিন্তু ঘরের বাইরের দিকের দরজাটা খোলা। যতদূর মনে পড়ে, প্রতিরাতেই শুতে যাবার আগে বৈঠকখানার ওই দরজাটা বন্ধ করে যায় দারোয়ান। আন্দাজ করলাম, ওই পথেই বেরিয়ে গেছে লুসি। কোনকিছু বিবেচনা না করেই ওই দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে পথে এসে নামলাম।

যতদূর চোখ যায় জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়ল না পথের কোথাও। আকাশে পূর্ণ চাদ। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় দূরের গির্জায় চূড়াটা চোখে পড়ছে। ঢং করে একটা বাজার ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল এই সময়, ওটা গির্জার বিশাল ঘড়ির ঘণ্টার আওয়াজ। কেন যেন মনে হল ওই গির্জার দিকেই গেছে লুসি, হয়ত এতক্ষণে গিয়ে শুয়ে পড়েছে ওই প্রাচীন বেদিগুলোর একটায়। বেদিগুলোর প্রতি লুসির আকর্ষণের কথা জানা আছে আমার।

দ্রুত এগিয়ে চললাম গির্জার দিকে। অস্বাভাবিক থমথমে চারদিকটা। একটু ভয় ভয় করতে লাগল। তবু মন্তে মনে সাহস সঞ্চয় করে হাঁটতে থাকলাম। গির্জার সমাধিভূমির কাছে পৌঁছে প্রথম কয়েকটা বেদি পেরিয়ে আসার পরই চোখে পড়ল সেই বেদিটা। যেটায় বসে ডায়েরী লিখেছিলাম আমি, যেটায় মরে পড়ে ছিলেন বৃদ্ধ মি. সোয়ালেজ।

চাঁদের আলোয় দূর থেকেই বেদিটা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বেদিটার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লুসি।

ওর ওপর ঝুঁকে আছে কালো মত কি যেন একটা। ওটা মানুষ না পশু? আশঙ্কায়, ভয়ে ধুকপুক করছে বুকের ভেতরটা। এগিয়ে যাব কি যাব না ভাবছি। শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে না থেকে আর একটু এগিয়ে গিয়ে নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকলাম লুসিকে।

মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়াল কালো মূর্তিটা। মানুষই। কিন্তু মানুষের এমন চেহারা জীবনে দেখিনি আমি। মরা মানুষের মুখের মত পাংশুটে ফ্যাকাসে মুখ, চোখ দুটো রুবী পাথরের মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এক মুহূর্তের জন্যে আমার দিকে চেয়ে থাকল ওই অদ্ভুত মানুষটা, তারপরই দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে গায়ের কালো আলখাল্লার দুটো প্রান্ত ডানার মত করে মেলে বিশাল একটা বাদুড় হয়ে যেন উড়ে গেল আকাশে।

দেখে একটা ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত শিরশির করে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল নিচের দিকে, বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল হৃৎপিণ্ডের গতি। ভুল দেখলাম না তো! কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, পায়ের কাছে সরসর শব্দ হতেই চেঁচিয়ে উঠে লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ালাম। নিচের দিকে চেয়ে দেখলাম আমার চেঁচানিতে আমার চেয়ে দ্বিগুণ ভয় পেয়ে ছুটে পালাচ্ছে একটা মেঠো ইঁদুর।

আর দেরি না করে বেদিটার কাছে এগিয়ে গেলাম। অচেতনের মত বেদির ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে সুসি। অল্প একটু ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট দুটো। লুসিকে নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলাম কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক ওর শ্বাসপ্রশ্বাস। থরথর করে কাঁপছে সারা গা। ভাবলাম শীত করছে লুসির। তাড়াতাড়ি গা থেকে শালটা খুলে নিয়ে ওর গায়ে জড়িয়ে দিলাম। জড়ানর সময় ওর গলার কাছে আমার হাতের চাপ লাগায় মনে হল খানিকটা ব্যথা পেয়েই অস্ফুট শব্দ করে উঠল লুসি। আস্তে করে গায়ে ঠেলা দিয়ে ওর ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করলাম। প্রথমে সাড়া দিল না লুসি, শেষে অচেতন লোকের চেতনা ফিরে পাবার মত ধীরে ধীরে চোখ মেলল সে। আমাকে দেখে একটুও অবাক হল না লুসি, যেন নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে সে, আর আমি ওর ঘুম ভাঙাচ্ছি। কোন কথা না বলে বাচ্চা মেয়ের মত দুহাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আবার চোখ মুদল লুসি। বুঝতে পারলাম, গভীর ঘোরের ভেতর আছে এখন সে।

জোর করে ওকে বেদি থেকে তুলে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। নিঝুম জ্যোৎস্নায় খাঁখাঁ করছে চারদিক। দমকা হাওয়ায় মাথার ওপর এক ধরনের ঝিরঝিরে ভৌতিক শব্দ করছে বার্চের পাতা। এছাড়া বাড়ি ফেরার পথে আর কোনরকম শব্দ বা কোন জীবন্ত প্রাণী চোখে পড়ল না। লুসির জন্যে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। পথ চলতে চলতেই স্থির করলাম লুসি নিজে থেকে না বললে ওর এই নিশীথ অভিসারের কথা কাউকে বলব না, এমনকি ওর মাকেও না। আর চাঁদের আলোয় গির্জার ওই প্রাচীন বেদির কাছে যে ঘটনাটা ঘটল তা তো কাউকেই বলা যাবে না, কারণ বললে বিশ্বাস তো করবেই না কেউ, উল্টে পাগল ঠাওরাবে আমাকে।

ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলাম লুসিকে। সাথেসাথেই ঘুমিয়ে পড়ল ও। আমার কিন্তু সহজে ঘুম এল না। পুবদিকের জানালাটার দিকে চেয়ে চেয়ে একটু আগে দেখা ঘটনাগুলোর কথা ভাবতে লাগলাম আমি। হঠাৎ মনে হল কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে আসছে চাঁদের আলো। বুঝলাম, ভোর হয়ে গেছে।

১২ আগস্ট।

সকাল থেকেই দিনটা আজ ভারি সুন্দর। ভোরের দিকে গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল লুসি। শিশিরভেজা ফুলের পাপড়ির মত চোখ মেলল ও একসময়। সারা মুখে রাত্রি জাগরণের চিহ্নমাত্র নেই। অন্যান্য দিনের চাইতে আজ ওকে বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে, অস্থিরতাও যেন কমে গেছে একটু। ওর গলার কাছে চোখ পড়তেই দেখলাম একপাশে কণ্ঠনালীর খুব কাছে সুচ ফোটানর মত ছোট ছোট দুটো ক্ষতচিহ্ন, ধবধবে সাদা রাতের পোশাকেও দুএক ফোটা রক্ত শুকিয়ে কালছে হয়ে আছে। কেমন করে আঘাত পেল লুসি জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কিছুই বলতে পারল না ও।

নাস্তা সেরে দুজনেই মালগ্রেভ উডের দিকে বেড়াতে বেরোলাম.। সারাটা সকাল আর দুপুর মালগ্রেভ উডের আশপাশে কাটিয়ে বিকেলের দিকে ঘরে ফিরে এলাম। কিছু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আবার। সন্ধ্যায় ক্যাসিনো টেরাসে গিয়ে উপভোগ করলাম ম্যাকেঞ্জির অনন্য সঙ্গীতানুষ্ঠান। ওখান থেকে ফিরে একটু সকাল সকালই খেয়েদেয়ে বেডরূমে এসে ঢুকলাম দুজনেই। লুসি তখন কাপড় বদলাতে ব্যস্ত, ওর অলক্ষ্যে ভেতর থেকে দরজায় তালা আটকে দিয়ে চাবিটা রেখে দিলাম নিজের কাছে।

মাঝ রাতে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই দেখলাম ঘর অন্ধকার। পরিষ্কার মনে আছে বাতি জ্বালিয়ে রেখেই বিছানায় শুতে গিয়েছিলাম, তাহলে বাতিটা নেভাল কে? লুসি? টের পেলাম কে যেন দরজা খোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু তালা মারা থাকায় খুলতে পারছে না। সেদিকে তাকিয়ে সাদা রাত্রিবাস পরা লুসির অবয়ব আবছাভাবে চোখে পড়ল। উঠে গিয়ে ওকে জোর করে দরজার কাছ থেকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলাম, প্রায় সাথেসাথেই ঘুমিয়ে পড়ল লুসি। একটু পরই আবার উঠে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরোনর চেষ্টা করল সে। কিন্তু দরজায় তালা দেয়া থাকায় এবারও বেরোতে পারল না। সারা রাতে দুই দুইবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় ভোরের দিকে ঢলে পড়লাম দুজনেই। ঘুম ভাঙতে দেখলাম জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে সকালের মিষ্টি রোদ।

১৩ আগস্ট।

নিরুদ্বিগ্নভাবেই কেটে গেল আরও একটা দিন। আজও শোবার আগে দরজায় তালা মেরে চাবিটা নিজের কাছে রেখে দিলাম। মাঝরাতে অকারণেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে দেখলাম বিছানায় সোজা হয়ে উঠে বসে জানালার দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লুসি। একটু অবাক হয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে খোলা জানালার দিকে চাইলাম। কিছু চোখে পড়ল না। বিছানা থেকে উঠে ভাল করে দেখার জন্যে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। রূপালী জ্যোৎস্যায় আকাশ আর পৃথিবীটাকে কেমন যেন রহস্যঘন এক নিস্তব্ধ নতুন জগৎ বলে মনে হচ্ছে। ঠিক সেই সময় দেখলাম ওটাকে। আমার ঠিক মাথার ওপরের আকাশে পাক খেতে খেতে উড়ছে একটা প্রকাণ্ড বাদুড়। সাঁ করে হঠাৎ আমার দুহাত দূরে চলে এল বাদুড়টা। এত কাছে থেকে ওর জ্বলজ্বলে লাল অদ্ভুত চোখ দুটো দেখে কেন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। আরও বারদুয়েক আমার কাছাকাছি উড়ে এল বাদুড়টা। মনে হল জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকতে চাইছে ওটা, কিন্তু আমার জন্যে পারছে না। আরও কয়েকবার পাক খেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে গির্জার দিকে গেল বাদুড়টা, তারপর গির্জার চূড়া পেরিয়ে সোজা চলে গেল সাগরের দিকে। বাদুড়টা চলে যেতেই বিছানায় লুটিয়ে পড়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল সি। ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগল আমার কাছে।

১৪ আগস্ট।

বিকেলে ওয়েস্ট পিয়ের থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে সেই বেদিটার ওপর বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। উঁচু-নিচু পাহাড়ী পথে হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা করছিল। হালকা সাদা মেঘগুলোকে রক্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে পশ্চিম আকাশে এখন অস্ত যাচ্ছে সূর্য। মুখ বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে তাই দেখছিলাম। পাশে বসা লুসির হঠাৎ দীর্ঘশ্বাসের শব্দে চমকে উঠে ওর দিকে ফিরে চেয়ে দেখলাম, হুইটবি গির্জার চূড়ার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে সে। গির্জার চূড়ার কাছটায় ছোট্ট জানালার রঙিন কাঁচে অস্তগামী সূর্যের লাল আভা পড়ে এক অপূর্ব বর্ণালীর সৃষ্টি করেছে! আমি লুসির দিকে চাইতেই সেই রঙিন কাঁচের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল সে, ঠিক ওর চোখ দুটোর মতন রঙিন আর জ্বলজ্বলে।

ঠিক বুঝতে পারলাম না লুসির কথা। কার চোখের কথা বলছে সে? অকারণেই দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকলাম।

সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ফিরেই মাথা ধরেছে বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল লুসি, আমি চলে এলাম বাগানে। এই সন্ধ্যা বেলায়ই ঘুম আসবে না আমার, তাছাড়া মন জুড়ে ভিড় করে আছে নানারকম চিন্তা। এগিয়ে গিয়ে কোণের দিকে একটা বেঞ্চিতে বসে জোনাথনের কথা ভাবতে থাকলাম। ততক্ষণ সেখানে বসে বসে ভেবেছি জানি না, চমক ভাঙল যখন মাথার ওপর উঠে এসেছে চাদ। হলুদ জ্যোৎস্নার ঢল নেমেছে সারাটা বাগানে।

লুসিকে একলা ঘরে ফেলে এসেছি। কথাটা মনে হতেই লাফ দিয়ে উঠে ওর ঘরের দিকে ছুটলাম। দূর থেকেই দেখলাম জানালার সামনে চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লুসি, ওর সামনে কালো মত একটা কি যেন বসে আছে। ধক করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে গিয়েও দাঁড়ালাম না। পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম। ওই কালো মত জিনিসটা কী দেখতেই হবে আমাকে। দুগজের ভেতরে চলে যাবার পরেও আমার উপস্থিতি টের পেল না লুসি, কিন্তু নড়ে উঠল কালো জিনিসটা। এবার বুঝলাম আমার অচেনা কালো রঙের একটা বিশাল পাখি ওটা। চেঁচিয়ে ডাকলাম লুসিকে, কোনরকম সাড়া দিল না লুসি, কিন্তু তড়িতাহতের মত লাফ দিয়ে উঠল পাখিটা। পরমুহূর্তে ডানা মেলে ভেসে গেল বাতাসে। স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম পাখিটা একটা বাদুড়। চিরদিন জেনে এসেছি মাথা নিচু করে নিচের দিকে ঝুলে থাকে বাদুড়েরা, কিন্তু আজ নিজের চোখে আর সব সাধারণ পাখিদের মত জানালার চৌকাঠে বসে থাকতে দেখলাম একটা বাদুড়কে। আসলে বাদুড় কিনা ওটা যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। বাদুড়টা চলে যেতেই এগিয়ে গিয়ে লুসির কাঁধে হাত রাখলাম, চমকে আমার দিকে ফিরে চাইল সে। কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর চেহারা। খোলা জানালা দিয়ে হিমেল হাওয়ায় ভর করে হুহু করে ঘরে ঢুকছে হাস্নাহেনার মিষ্টি গন্ধ, সেই গন্ধকে ছাপিয়ে লুসির গা থেকে কেমন যেন একটা বোটকা গন্ধ ছড়াচ্ছে। জীবিত কোন মানুষের গা থেকে আসতে পারে না ওরকম বোটকা পচা গন্ধ। তাহলে? ওই রহস্যময় বাদুড়টাই কি এর কারণ?

১৭ আগস্ট।

কিছু লিখতে পারিনি গত তিনদিন। অবশ্য লেখার মত মানসিকতাও ছিল। আজও নেই, তবু জোর করেই লিখতে বসেছি। জোনাথনের খবর নেই, এদিকে লুসিও দিন দিন কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওর চিন্তায় লুসির মা-ও প্রায় শয্যাশায়ী হতে চলেছেন। ওদিকে লুসির বিয়ের দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে। সবদিকেই কেমন যেন একটা গোল পাকানো ভাব।

সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে লুসি। যতই দিন যাচ্ছে মরা মানুষের মত কেমন যেন বিবর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে ওর গায়ের রঙ, অথচ কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

কাল রাতে জানালার ধারে আবার দেখেছি সেই রহস্যময় বাদুড়টাকে। সেদিনের মত ঠিক তেমনিভাবে জানালার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল লুসি, আর ওর কাছে বসে ছিল বাদুড়টা। আমার সাড়া পেয়েই আকাশে উড়ে যায় ওটা। জানালার কাছ থেকে ধরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম লুসিকে। শোয়ানর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল লুসি। কম্বলটা ওর গায়ে টেনে দিতে গিয়েই ওর গলার পুরানো ক্ষতটার ওপর চোখ পড়ল আমার। ঘা-টা তো শুকোয়ইনি, বরং বেড়েছে। ডাক্তার না দেখালে আর চলছে না।

১৮ আগস্ট।

অকারণেই সকাল থেকে মনটা ভাল লাগছে আজ। লুসিকেও অনেকটা সুস্থ মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে গির্জার সেই বেদিটায় বসে একটানা বকবক করে চললাম দুজনে। গত কয়েক রাতে ওর আশ্চর্য ব্যবহারের কথা জিজ্ঞেস করলাম লুসিকে। প্রথমে সে ভাল মত স্মরণ করতে পারল না কিছু। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরও প্রশ্ন করতেই বলল, ঠিক বলতে পারব না, মিনা, তবে মনে হয় স্বপ্ন ওগুলো। সবকিছুই স্পষ্ট, অথচ কেমন যেন দুর্বোধ্য। সারাক্ষণ খালি মনে হয়, এই বেদিটায় এসে বসি, কিন্তু কেন বলতে পারব না। সব সময় একটা অজানা ভয় ভর করে থাকে আমাকে, অথচ কিসের ভয় বোঝাতে পারব না। রাতের বেলা হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বসি বিছানায়। আশ্চর্য, হাজার হাজার নেকড়ের হিংস্র গর্জন শুনতে পাই তখন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজোড়া লাল টকটকে উজ্জ্বল চোখ, সেদিন সূর্যাস্তের সময় গির্জার রঙিন কাচগুলো যেমন দেখাচ্ছিল, ঠিক তেমনি প্রচণ্ড আকর্ষণে কাছে টানতে থাকে আমায় ওই চোখ দুটো। ওই চোখ দুটোর ডাকে সাড়া দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্নের মত টলতে টলতে এগিয়ে যাই, তারপর আর কিছু মনে থাকে না। হঠাৎই তীব্ৰ নাড়া খেয়ে যোর কেটে যায়, দেখি পাশে দাঁড়িয়ে আছিস তুই।  

মনটা গভীর চিন্তায় ছেয়ে গেলেও ও কিছু না বলে লুসিকে সান্ত্বনা দিলাম আমি। একটু পরে খুশি মনেই বাড়ি ফিরে এলাম দুজনে। আমাদের দুজনকে হাসতে দেখে খুশি হয়ে উঠলেন লুসির মা-ও। বহুদিন পর সন্ধ্যাটা চমৎকারভাবে কাটল আজ।

১৯ আগস্ট।

দারুণ খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে আজ। কারণ একটু আগে জোনাথনের খবর পেয়েছি। যা ভেবেছিলাম তাই, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়েছিল সে। বুদাপেস্টের সেন্ট জোসেফ হাসপাতালের সিস্টার আগাথার লেখা চিঠিটা ঠিকানা পাস্টে লুসিদের বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন মি. হকিন্স। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়ে নাকি গত ছসপ্তাহ ধরেই হাসপাতালে পড়ে আছে জোনাথন, এখন অবশ্য অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। শীঘ্রিই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে যাচ্ছে সে। ছাড়া পাবার পর নাকি সব সময় কাউকে না কাউকে তার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হবে।

বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছি, পোশাকটা শুধু পাল্টানো বাকি আছে। এখান থেকে সোজা যাব লণ্ডনে, সেখান থেকে বুদাপেস্ট। জোনাথন, আমার জোনাথন। ওকে চোখে না দেখা পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাব না এখন। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে, তাই ডায়েরীর পাতায় সেঁটে রাখার আগে আর একবার পড়লাম চিঠিটা।

সেন্ট জোসেফ হাসপাতাল,
বুদাপেস্ট।
১২ আগস্ট।

.

ডিয়ার ম্যাডাম,

মি. জোনাথন হারকারের ইচ্ছানুসারেই জানাচ্ছি আপনাকে, প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়ে গত মাস দেড়েক ধরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে আছেন তিনি। সেন্ট জোসেফ এবং মেরী মায়ের কৃপায় এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তিনি, কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে নিজ হাতে চিঠি লিখেও আপনাকে জানাতে পারছেন না।

অহেতুক বিলম্বের জন্যে মি. হারকার ক্ষমাপ্রার্থী এবং ভারপ্রাপ্ত কাজ বেশ সুষ্ঠুভাবেই পালন করেছেন তিনি, একথা আগেই চিঠি লিখে এগজিটারের মি. হকিন্সকে জানিয়েছি আমি।

মি. হরকারের এই দুঃসময়ে আপনার সাহচর্য বিশেষভাবে কামনা করছেন উনি। অনেক আগেই আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করতাম, কিন্তু মি. হারকারের স্মৃতিশক্তি ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনার ঠিকানা আমরা জানতে পারিনি। অবশ্য জানা সম্ভবও ছিল না, যদিও সম্ভাব্য সব রকম চেষ্টাই আমরা করেছি।

আশা করছি, পত্র পাওয়ামাত্র এখানে চলে আসবেন আপনি। মি. হারকারের রোগমুক্তি এবং আপনার শুভাগমন কামনা করে শেষ করছি।

প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে,
সিস্টার আগাখা।

১.৭ হুইটবির স্যামুয়েল

হুইটবির স্যামুয়েল এফ বিলিংটন এণ্ড সলিসিটরস-এর লেখা একটা চিঠি পায় লণ্ডনের মেসার্স কার্টার প্যাটারসন অ্যাও কোং। চিঠিটা এই রকমঃ

১৭ আগস্ট।

ডিয়ার স্যার,

গ্রেট নরদার্ন রেলওয়ে কর্তৃক প্রেরিত মালপত্রের চালান দলা করে গ্রহণ করুন। মক্কেলের ইচ্ছানুসারে, কিংস ক্রস রেলস্টেশন থেকে কাঠের বাক্সগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে পারফ্লিটের কাছে কারফাক্সে পৌঁছে দেবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওখানকার প্রাচীন গির্জা সংলগ্ন বাড়িটা খালিই পড়ে আছে এখন। চালনের সঙ্গে বাড়ির দুটো চাবির একটা পাঠালাম। পারিশ্রমিক বাবদ দশ পাউণ্ডের চেকের প্রাপ্তিস্বীকার করে চিঠির জবাব দেবেন।

আপনাদের বিশ্বস্ত,
স্যামুয়েল এফ বিলিংটন অ্যান্ড কোং।

চিঠি পাওয়ার পরপরই জবাব পাঠালেন মেসার্স কার্টার প্যাটারসন অ্যাণ্ড কোং।

২১ আগস্ট।

ভিয়ার স্যার,

নির্দেশ মোতাবেক আপনার মক্কেলের পঞ্চাশটা কাঠের বাক্স যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমাদের পারিশ্রমিক রেখে দশ পাউণ্ডের চেক থেকে উদ্ধৃত এক পাউণ্ড সতেরো শিলিং নয় পেন্স ফেরত পাঠালাম।

আপনাদের বিশ্বস্তু, কার্টার প্যাটারসন অ্যান্ড কোং।

.

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে
১৯ আগস্ট।

গতরাত থেকেই অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসেছে রেনফিন্ডের মধ্যে। রাত আটটার পর থেকেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। কুকুরের মত গন্ধ শুকে বেড়াতে থাকে চারদিকে। ওর এই আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তখনকার হাসপাতালে ডিউটিরত নার্স। রেনফিন্ডের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে সে। এমনিতে নার্সদের সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করে না রেনফিল্ড, কিন্তু গতরাতে ডিউটিরত নার্সের সাথে যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করেছে সে। তার দুর্ব্যবহার গায়ে না মেখে বার বার প্রশ্ন করে গেছে নার্স। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছে রেনফিল্ড, দেখ, তোমার সাথে অযথা বকবক করবার এখন সময় নেই আমার। দেখছ না, স্বয়ং প্রভু এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সামনে?

এর পরপরই আমাকে এসে খবর দিল নার্স। নটা নাগাদ রেন-ফিল্ডকে দেখতে গেলাম আমি। পাত্তাই দিল না আমাকে সে। আমিও ওকে না খুঁচিয়ে চুপচাপ ওর ভাবগতিক লক্ষ করতে থাকলাম। আমি যাবার পরও প্রায় আধঘণ্টা পর্যন্ত অস্বাভাবিক উত্তেজিত ভাবটা ছিল রেনফিন্ডের মধ্যে, তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসতে থাকে সে। আলতোভাবে মাথাটা এদিক-ওদিক দোলাতে দোলাতে বিছানার কাছে গিয়ে শান্তভাবে বিছানার এক প্রান্তে বসে পড়ে যোবা দৃষ্টি মেলে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল রেনফিল্ড। কোনকিছুর গতিবিধি লক্ষ্য করছে যেন সে।

ওর সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম, অবশ্য ওর প্রিয় পশু-পাখি পোকামাকড় দিয়েই। কিন্তু খেপে উঠে বলল রেনফিল্ড, বাজে বকবেন না, ডাক্তার।

এখন ওসব কথা শুনতে চাই না আমি।

বলছ কি, রেনফিল্ড। অবাক হবার ভান করে বললাম, এরই মাঝে মাকড়সা আর চড়ুইগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গেলে?

ওদের জন্যে এখন আমার আর কিছুই করার নেই। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জবাব দিল রেনফিল্ড। একটু মুচকে হেসে আবার বলল, আসলে ব্যাপারটা কি জানেন, কনে বিয়ের আসরে না পৌঁছানো পর্যন্ত হাসি আনন্দে উচ্ছল হয়ে থাকে তার সখীরা, কিন্তু কনে পৌঁছামাত্র বিষাদে ভরে যায় তাদের মন।

রেনফিডের এ হেঁয়ালিপূর্ণ কথার মাথামুও কিছুই বুঝলাম না। এখন আর ওর কাছ থেকে কোন সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে নার্সকে ওর প্রতি কড়া নজর রাখতে বলে ফিরে এলাম আমি।

কেন জানি বড় ক্লান্ত, বড় বিষণ্ণ লাগছে আজ, লুসি। বারবার মনে পড়ছে তোমার কথা। বুঝতে পারছি ঘুম না এলে আজও মরফিয়া নিতে হবে, অবশ্য তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর রোজ রাতেই মরফিয়া নিতে হয়, নাহলে দুচোখের পাতা এক করতে পারি না সারারাত। কিন্তু আমি ডাক্তার, আমি জানি এটা অত্যন্ত বাজে অভ্যাস। ভাবছি আজ আর কিছুতেই নেব না ওটা, তাতে যদি ঘুম না আসে না আসুক।

বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করতে করতে দীর্ঘ বিদ্রি প্রহরগুলো কেটে যেতে থাকল। যেন এক এক যুগ পর পর ঘণ্টা বাজিয়ে সময় ঘোষণা করছে দেয়ালঘড়িটা। এভাবেই রাত একটা বাজল, তারপর দুটো। এই সময় এসে খবর দিল নাইট গার্ড, রেনফিল্ড পালিয়েছে। একলাফে বিছানা থেকে উঠে রেনফিল্ডের ওয়ার্ডের দিকে ছুটলাম। আমার জন্যেই অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছিল নার্স। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি, কি করে পালাল রেনফিল্ড?।

মাত্র দশ মিনিট আগেও তার বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছি রেনফিল্ডকে, স্যার। হঠাৎ একটা সন্দেহজনক শব্দ কানে যেতেই সেদিকে তাকিয়ে দেখে নাইট গার্ড, জানালার গরাদ বাঁকিয়ে সে-পথে বেরিয়ে যাচ্ছে রেনফিল্ড, একটু থেমে বলল নার্স, সাথে সাথে আমাকে এসে খবর দিল গার্ড। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ছুট লাগালাম রেনফিল্ড যেদিকে গেছে সেদিকে। বাঁ দিক ঘুরে বাগানের মধ্যে ঢুকে সারি সারি গাছের মাঝখান দিয়ে ছুট লাগাল রেনফিল্ড। প্রাণপণে অনুসরণ করে চললাম ওকে। ছুটতে ছুটতে একসময় হাসপাতাল আর কারফাক্সের বাড়িটার মাঝখানে পাঁচিলের কাছে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল রেনফিল্ড। তারপর দেয়াল বেয়ে উঠে লাফিয়ে পড়ল ওপাশে। ফিরে এসে চার-পাঁচজন লোক নিয়ে নাইট গার্ডকে আমাকে অনুসরণ করতে বলেই আবার ছুটলাম। কোনমতে সেই পাঁচিলটা ডিঙিয়ে ওপারে গিয়ে দেখলাম ধীর পায়ে কারফাক্সের বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে রেনফিল্ড। ওর অজান্তে আমিও অনুসরণ করে চললাম তাকে। পরিত্যক্ত, জীর্ণ বিশাল বাড়িটার শেষপ্রান্তের পুরানো গির্জাটার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল রেনফিল্ড, তার সাথে সাথে আমিও। আরাধনার ভঙ্গিতে গির্জার বিশাল এক কাঠের দরজার কাছে গিয়ে দরজার গায়ে মুখ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে ভেতরের কার সাথে যেন কথা বলছে রেনফিল্ড, একটু দূরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি। ভক্তিভরে মন্ত্রোচ্চারণের মত ভরাট গলায় বলে চলেছে রেনফিলডঃ প্রভু, তোমার আদেশ পেয়েই এখানে এসেছি আমি। তোমার এ দীন-হীন ক্রীতদাসকে কৃতার্থ করো। দীর্ঘদিন ধরে তোমারই সাধনা করেছি আমি। আজ ডেকেছই যদি, পায়ে ঠেলে দিও না। তোমার করুণা ভিক্ষা চাইছি, শুধু তোমার করুণা পেলেই বর্তে যাব আমি।

এতক্ষণে লোজন নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেছে নাইট গার্ড। আমার নির্দেশে দুদিক থেকে গিয়ে রেনফিল্ডকে চেপে ধরল ওরা। কিন্তু কুদ্ধ সিংহের মত গা ঝাড়া দিয়ে ওদের সব কজনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রেনফিল্ড। ওর মত স্বাস্থ্যের একজন লোক এত শক্তি কোথায় পেল বুঝতে পারলাম না।

কিন্তু কোথায় এখন ও? অধৈর্য হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।

হাতে-পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে হাসপাতালের ওদিককার একটা কয়েদখানায় আটকে রেখেছি। আঙুল তুলে ঘরটা আমাকে দেখিয়ে দিল নার্স। তারপর আবার বলল, ওকে বেঁধে নিয়ে আসার সময়ওঃ প্রভু, আমাকে ক্ষমা করো। করুণা করো, যতদিন না তোমার সময় হয় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব আমি।-বলতে বলতে এসেছে রেনফিল্ড।

.

মিনা আরকারের ডায়েরী থেকে

বুদাপেস্ট, ২৪ আগস্ট।

হামবুর্গ পর্যন্ত জলপথে এসে ট্রেন ধরে শেষ পর্যন্ত ভালয় ভালয় বুদাপেস্টে এসে পৌঁছেছি। বুদাপেস্ট হাসপাতালে পৌঁছে জোনাথনের অবস্থা দেখে দুচোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এসেছে আমার। সাংঘাতিক রোগা হয়ে গেছে জোনাথন, শুধু ওর অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটো আমার চেনা না থাকলে চিনতেই পারতাম না ওকে। ওর শরীর আর মনের ওপর দিয়ে যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তা দেখলেই অনুমান করা যায়। অতীতের কোনকিছুই এখন স্পষ্ট স্মরণ করতে পারছে না সে। অভিজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, এখন ওকে জোর করে কিছু ভাবানর চেষ্টা করলে ওর মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রীতে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। হাসপাতালের নার্স সিস্টার আগাথাকে জোনাথনের মানসিক আঘাতের কারণ যতবার জিজ্ঞেস করেছি ততবারই বুকে কুশ এঁকে চোখ বড় বড় করে বলেছেন, কোনকিছুর বিনিময়েই তা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সিস্টার আগাথার মত মিষ্টি স্বভাবের মহিলার এ-আচরণ যথেষ্ট বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

এক সময় একলা পেয়ে ওর এ অবস্থার কারণ জিজ্ঞেস করলে একটা ছোট্ট খাতা আমার হাতে তুলে দিয়ে স্নান কণ্ঠে বলল জোনাথন, মিনা, এটা পড়ে দেবো, অনেক অবিশ্বাস্য অদ্ভুত ঘটনা জানতে পারবে। কিন্তু পড়ে আর সবার মত তুমিও ভুল বুঝো না আমাকে। ইচ্ছে করে ওই ভয়ঙ্কর তিন ডাইনীর সাথে প্রেম করিনি আমি, করেছি শুধু প্রাণের দায়ে। না হলে আমার শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়ে আমাকে ছিবড়ে বানিয়ে নেকড়েদের মুখে ছেড়ে দিত পিশাচ কাউন্ট ড্রাকুলা।

জোনাথনের হাত থেকে ছোট্ট খাতাটা নিয়ে সেখানে বসেই পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠতে থাকলাম। পড়া শেষ হলে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু, জোনাথন, কাউন্ট ড্রাকুলা তোমাকে দিয়ে কি করিয়ে নিতে চেয়েছিল?

চেয়েছিল নয়, মিনা, বলো, করিয়ে নিয়েছে। ওর আকাঙ্ক্ষিত ইংল্যান্ডের সব কটা বাড়ি দালালি করে আমি ওকে কিনে দিয়েছি। ঈশ্বরই জানেন, কোন্ ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে ওই পুরানো পোড়ড়া বাড়িগুলো কিনেছে শয়তানটা। কথাগুলো বলে জিরিয়ে নেবার জন্যে একটু থামল জোনাথন। তারপর হঠাৎ আমার হাত দুটো ধরে বলল, মিনা, আমি আর দেরি করতে চাই না। চলো, তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলি।

জোনাথনের কথায় বেশ কয়েক সেকেণ্ড কোন জবাব দিতে পারলাম না। তারপর ধীরে ধীরে উবু হয়ে চুমো খেলাম ওর রক্তশূন্য শুকনো খসখসে ঠোঁটে।

.

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

২০ আগস্ট।

দিন দিন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে রেনফিল্ডের কেসটা। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে প্রায় সপ্তাহখানেক পরে যখন-তখন সাংঘাতিক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে অসহ্য চেঁচামেচি জুড়ে দিত সে। কিন্তু তারপর গত পূর্ণিমার রাত থেকে হঠাৎ করেই একেবারে চুপ হয়ে গেছে সে, শুধু মাঝে মাঝে আপনমনেই বিড়বিড় করে আর চেঁচাব না আমি, প্রভু, এখন থেকে তোমার নির্দেশের অপেক্ষাই করব। তাতে যদি আমাকে আজীবন অপেক্ষা করতে হয়, তাও সই।

রেনফিল্ডের এই হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়ার খবর শুনে সেদিন তাকে দেখতে গেলাম। আচ্ছন্ন ভাবটা ওর চেহারা থেকে সম্পূর্ণ মুছে গেছে, তার পরিবর্তে সেখানে ফুটে উঠেছে প্রসন্ন উজ্জ্বলতা। ওর এই অবস্থা দেখে খুশি হলাম, ভাবলাম বোধহয় সেরে যাচ্ছে ওর পাগলামি। নার্সকে ডেকে ওর পায়ের শেকল খুলে দিতে বললাম। আমার কথা শুনে রীতিমত আশ্চর্য হল নার্স। কিন্তু বিনা প্রতিবাদে আদেশ পালন করল। শেকল ভোলা হলে শান্ত ধীর পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এল রেনফিল্ড। নার্সের বিস্মিত মুখের দিকে ইঙ্গিত করে মৃদু হেসে বলল, ও ভেবেছে বাঁধন খুলে দিলেই পালাব আমি, ব্যাটা বুদ্ধ কোথাকার।

রেনফিল্ডের মত বদ্ধ পাগল চেহারা দেখে লোকের মনের কথা বলে দিতে পারে ভেবে অবাক লাগল। প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করে বললাম, রেনফিড, বেড়াল চেয়েছিলে না তুমি? ভেবে দেখলাম আসলেই একটা বেড়াল তোমাকে দেয়া দরকার। তা ওটা কি আজই চাও নাকি?

আগের মত মৃদু হেসেই জবাব দিল রেনফিল্ড, না, ডাক্তার, বেড়ালের আর প্রয়োজন নেই আমার। এখন অনেক উর্ধ্বে উঠে গেছি আমি। ওসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভাবার চেয়ে ধৈর্য ধরে শুধু অপেক্ষা করব এখন আমি।

কিসের অপেক্ষা করবে রেনফিল্ড? ভাবলাম, এটাও ওর এক ধরনের পাগলামি। আর কথা না বলে নিজের কামরায় ফিরে এলাম।

দিন দুয়েক আর কোন খবর নেই। তার পরদিন সকালে ছুটতে ছুটতে এল নার্স। আবার পাগলামি শুরু করেছে রেনফিল্ড, এবার আগের চেয়েও খেপে গেছে। জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত একটানা চেঁচিয়ে লাফিয়ে হাসপাতালের কামরায় তুফান তুলে রাখে সে। পর পর তিন দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। ওর এই আকস্মিক মানসিক পরিবর্তনের কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। ক্ষণে ক্ষণে এই রূপ বদলানর পেছনে কি কোন ভয়ঙ্কর অশুভ অদৃশ্য শক্তির হাত আছে? ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি বের করলাম। রেনফিল্ডের সাথে একটু অভিনয় করতে হবে। ওকে পালানর সুযোগ করে দিতে হবে। তারপর আড়ালে থেকে লক্ষ্য রাখতে হবে ও কোথায় যায়, কি করে।

২৩ আগস্ট কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে, পালানর সব রকম সুযোগ পেয়েও পালাল বেনফিল্ড, অথচ হাসপাতাল কক্ষে থেকে থেকে তার উপদ্রব বেড়েই চলল। খোলা দরজা দিয়ে হঠাৎ করেই ধ করে বেরিয়ে এসে ডিউটিরত নার্সকে আক্রমণ করে বসে সে। ওর এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আবার ওকে জানালা বন্ধ করে কয়েদ করে রাখার আদেশ দিলাম। এবং তারপরই আরেক অবাক কাণ্ড করে বসল সে। অপ্রত্যাশিত ঘটনাও কখনও কখনও ঘটে।-ডিসরেইলির এই উক্তি সত্যি প্রমাণিত করে আবার পালাল রেনফিল্ড। এতদিন তাকে পালাবার সমস্ত সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও পালাল না, অথচ এখন জোর করে পালাল। এটাও কি এক ধরনের পাগলামি? নাকি আমরা যে ওকে ইচ্ছে করে পালাবার সুযোগ দিয়ে অনুসরণ করার তালে আছি এটা আগে থেকেই কোন রহস্যময় উপায়ে জেনে যায় সে?

নার্সের কাছে পরে শুনলাম, ঘরের কোণে চুপচাপ তৈরি হয়ে বসে ছিল রেনফিল্ড, নার্স ঘরে ঢুকতেই তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে খোলা দরজা দিয়ে একছুটে বাইরে বেরিয়ে যায় পাগলটা।

রেনফিল্ড পালিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এসে আমাকে খবর দিল নাইট গার্ড। একমুহূর্ত দেরি না করে কয়েকজন লোক নিয়ে রেফিন্ডকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। খুঁজতে খুঁজতে কারফাক্সের সেই পুরানো বাড়িটায় গিয়েই পাওয়া গেল ওকে। আগের বারের মতই গির্জার বিশাল কাঠের দরজায় মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে রেনফিল্ড। আমাদের দেখেই প্রচণ্ড আক্রোশে ফেটে পড়ল সে। দাঁত খিচিয়ে আমাকে আক্রমণ করতে ছুটে আসতেই ওকে ধরে ফেলল আমার লোকেরা। আবার ওর হাতে-পায়ে লোহার শেকল পরিয়ে হাসপাতালে রওনা দিলাম। লাফিয়ে চেঁচিয়ে আমাদের কান ঝালাপালা করতে করতে চলল রেনফিল্ড। চলতে চলতেই হঠাৎ যেন কার অঙ্গুলি হেলনে আচমকা থমকে দাঁড়াল রেনফিল্ড, চেঁচানোও বন্ধ হয়ে গেল ওর। অবাক হয়ে ওর দিকে চাইতেই দেখলাম মাথা তুলে স্থির দৃষ্টিতে আকাশের একদিকে চেয়ে আছে রেনফিল্ড। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় বিশাল একটা বাদুড় পশ্চিম আকাশের দিকে উড়ে চলেছে। রাতের বেলা বাদুড়েরা আকাশে উড়বে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কিন্তু এ বাদুড়টার কাজকারবার অন্যান্য সাধারণ বাদুড়ের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। ডানা। ঝটপট করার মৃদু শব্দ তুলে একেবেঁকে উড়ে যাচ্ছে না ওটা। অনেক উঁচুতে চিল যেভাবে বাতাসে ডানা মেলে ভেসে থাকে তেমনি করে নিঃশব্দে উড়ে চলেছে। বাদুড়টা। আর প্রায় অস্পষ্ট একটা হালকা ধোঁয়ার রেখা রেখে যাচ্ছে পেছনে। এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখা তো দূরের কথা, কখনও কারও কাছে শুনিনি পর্যন্ত। আস্তে আস্তে পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে গেল বাদুড়টা। যতক্ষণ দেখা গেল ওটা, স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল রেনফিল্ড।

আশ্চর্য! তারপর কিন্তু আমাদের সাথে যেতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না রেনফিল্ড। কোন অশুভ শক্তির প্রভাব পড়েছে ওর ওপর, ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হল আমার মনে। চিন্তিতভাবে ফিরে এলাম হাসপাতালে।

১.৮ আর্থার হোমউডের একটা চিঠি

একত্রিশে আগস্ট আর্থার হোমউডের একটা চিঠি পেল ডাক্তার সেওয়ার্ড।

প্রিয় জন,

একটা বিশেষ উপকারের আশায় তোর হাসপাতালে এসেছিলাম। কিন্তু বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও তোক না পেয়ে এই চিঠি লিখে রেখে যাচ্ছি। দিন কয়েক ধরে সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়েছে লুসি। দিনকে দিন কেমন যেন দুর্বল আর রোগা হয়ে যাচ্ছে সে। লুসিকে এর কারণ জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর পাইনি। ওর মা-ও রলতে পারছেন না কিছু। অথচ কিছুতেই ডাক্তার দেখাতে রাজি হচ্ছে না ও। অনেক সাধ্য-সাধনা করে শেষ পর্যন্ত রাজি করানো গেছে ওকে, কিন্তু এক শর্তে, তুই ছাড়া আর কোন ডাক্তারের সাহায্য নেবে না সে। অতএব এবারের মত লুসিকে বাঁচা। হয়ত লুসির সামনে আসতে সঙ্কোচ বোধ করবি তুই, তোর অবস্থায় হলে আমিও তাই করতাম। কিন্তু অন্তত লুসির দিকে চেয়ে একবার আয়। কাল দুপুর নাগাদ তোর আগমন প্রত্যাশা করতে পারি কি?

তোর আর্থার।

পহেলা সেপ্টেম্বর আর্থারের কাছ থেকে আরেকটা ছোট্ট সংবাদ পেল সেওয়ার্ড।

প্রিয় জন,

বাবার অসুখ সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। অতএব এক্ষুণি বাড়ি রওনা হচ্ছি। লুসির ভার রইল তোর ওপর

আর্থার।

যথাসময়েই লুসির বাড়িতে এসে পৌঁছল ডাক্তার সেওয়ার্ড। ভালমত ওকে পরীক্ষা করে দেখার পর সেদিনই আর্থারকে একটা চিঠি লিখে জানাল সে।

১ সেপ্টেম্বর, হুইটবি।

আর্থার,

যথাসময়েই লুসিদের বাড়ি এসে পৌঁছেছি। লুসিকে বার বার পরীক্ষা করেও ওর শরীরে কোন রোগের লক্ষণ আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু তবু কেন জানি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। গতকাল ওকে যেমন দেখে গিয়েছিলাম তেমনটি আর নেই এখন ও। সন্দেহ হচ্ছে ওর রোগটা শরীরে নয়, মনে।

বার বার ওকে প্রশ্ন করে কিছু অদ্ভুত কথা জানতে পারলাম। মাঝে মাঝে শ্বাস নিতে নাকি ভীষণ কষ্ট হয় ওর, ক্লান্তিতে বুজে আসে দুচোখের পাতা। ঘুমের মাঝে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে, কিন্তু কি দেখেছে ঘুম ভাঙার পর তা আর মনে করতে পারে না। ছেলেবেলায় নাকি কখনও কখনও নিশিতে পেত ওকে, মাঝখানে বহুদিন ওটা আর হত না, বলতে গেলে সেরেই গিয়েছিল। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে আবার ফিরে এসেছে পুরানো অভ্যাসটা।

সবদিক ভেবে স্থির করেছি ওকে সুস্থ করে তোলা আমার একার সাধ্যে কুলাবে না। কাজেই আমার ওস্তাদ প্রফেসর ভ্যান হেলসিংকে খবর পাঠাচ্ছি। জানিসই তো, নানারকম জটিল ব্যাধি-বিশেষ করে মানসিক রোগ সারাতে আজকের পৃথিবীতে এর জুড়ি মেলা ভার।

অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ প্রফেসর, তাঁর সময়ের অনেক দাম। কিন্তু আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন উনি, আমি বললে তিনি না এসে পারবেন না, এ বিশ্বাস আমার আছে। কিছু ভাবিস না তুই! এসে যখন একবার পড়েছি চেষ্টার ত্রুটি রাখব না।

তোর জন।

ডাক্তার সেওয়ার্ডের চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব পাঠালেন প্রফেসর আব্রাহাম ভ্যান হেলসিং।

২ সেপ্টেম্বর, আমস্টারডাম।

ডিয়ার জন,

কয়েক মিনিট আগে তোমার চিঠি পেলাম। চিন্তা করো না, এখুনি হুইটবির উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়ছি আমি। ক্রিসেন্টের গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে আমার জন্যে একটা ঘর ঠিক করে রেখো। আশীর্বাদান্তে,

ভ্যান হেলসিং।

৩ সেপ্টেম্বর আর্থারকে আর একটা চিঠি লিখল সেওয়ার্ড।

আর্থার,

বলেছিলাম না, আমি বললে আসবেনই প্রফেসর ভ্যান হেলসিং। আজ এখানে এসে পৌঁছেছেন তিনি, লুসিকে পরীক্ষাও করেছেন। লুসিকে দেখেই তার মুখ কেমন যেন থমথমে গম্ভীর হয়ে গেছে, ফেন ভয়ঙ্কর কোন সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেয়েছেন তিনি। ওঁকে জিজ্ঞেস করলে শুধু বলেছেন লুসিকে আরও ভাল করে পরীক্ষা না করে কিছু বলতে পারবেন না উনি।

তবে আশার কথা, প্রফেসর এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটু সুস্থ মনে হচ্ছে লুসিকে। ডাক্তারের সংস্পর্শে এলেই রোগীর রোগ অর্ধেক সেরে যায়, লুসির ব্যবহার বোধহয় তাই প্রমাণ করছে।

অযথা দুশ্চিন্তা করবি না। তোর আব্বা এখন কেমন আছেন জানাবি।

তোর জন।

প্রথমবারের মত লুসিকে দেখা শেষ করে কিছু জরুরী কাজ সারতে আমস্টারডামে ফিরে গেছেন প্রফেসর হেলসিং। সেওয়ার্ডকে বলে গেছেন, লুসির অবস্থা সম্পর্কে রোজ যেন টেলিগ্রাম করে তাকে জানানো হয়। কর্তব্যকাজে বিন্দুমাত্র গাফিলতি না করে যথারীতি প্রফেসরকে তারবার্তা পাঠিয়েছে সেওয়ার্ড।

পাঠানো তারবার্তাগুলোঃ

৪ সেপ্টেম্বরঃ আজ রোগীর অবস্থা অনেকটা ভাল।

৫ সেপ্টেম্বর ও অবস্থার আরও উন্নতি হয়েছে। ঘুম স্বাভাবিক। ক্রমশ কেটে যাচ্ছে চেহারার বিবর্ণ ভাবটা।

৬ সেপ্টেম্বরঃ হঠাৎ আজ অবস্থার অত্যন্ত অবনতি ঘটেছে। এক্ষুণি চলে আসুন।

এই দিনে আর্থারকেও একটা চিঠি লিখল জন।

আর্থার,

খবর ভাল না। হঠাৎ করে আজ সকাল থেকেই লুসির অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রফেসর হেলসিংকে আসতে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। তোকে কথাটা না জানালেও পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয় অবস্থার চাপ সহ্য করার মত মানসিক শক্তি তোর আছে। ঠিক করেছি, লুসির ব্যাপারে যাই কিছু করি তোকে না জানিয়ে করব না। হাজার হোক, ও তোর ভাবী স্ত্রী। ওর ভালমন্দের দায়িত্ব আমাদের চেয়ে তোর অনেক বেশি।

তোর জন।

১.৯ প্রফেসর ভ্যান হেলসিং

ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে

৭ সেপ্টেম্বর।

ঘরে ঢুকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর ভ্যান হেলসিং, লুসির রোগের কথা বিস্তারিত লিখে জানিয়েছ মি. হোমউডকে?

না। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। তবে লুসি অসুস্থ এ-কথাটা জানিয়েছি ওকে।

বেশ করে। ওকে বিস্তারিত জানানর সময় আসেনি এখনও।

আসলে ব্যাপারটা কি, স্যার?

ব্যাপার একটা নিশ্চয়ই আছে। তবে আগে শিওর হয়ে নিই আমি, তারপর বলব।

এখনই বললে হয় না? আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে প্রফেসরের মুখের দিকে চেয়েই থেমে গেলাম আমি।

দেখো, সবকিছু জানারই একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। তার আগে জানাও যেমন উচিত নয়, পরে জেনেও লাভ নেই। অতএব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে তোমাকে।

বুঝলাম, সময় না এলে সারাক্ষণ চাপাচাপি করেও এর বেশি একটা কথা বের করা যাবে না প্রফেসরের মুখ থেকে। অগত্যা আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকলাম।

কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বললেন প্রফেসর, চলো, লুসিকে এবার দেখে আসি।

সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়লাম। কথা বলতে বলতে লুসিদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম। আমার মুখে সুসির রোগের উপসর্গগুলোর বিস্তারিত বিবরণ শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রফেসর। এরপর সারা পথটায় আর একটা কথাও বললেন না তিনি। গভীর চিন্তাৰিতভাবে পথ চলতে লাগলেন।

লুসির ঘরে পা দিয়েই চমকে উঠলাম ওর চেহারা দেখে। গতকালও তো এমন ছিল না ও। বিবর্ণ পাংশুটে মুখ, শুকনো ম্লান দুটো ঠোঁট, ঠেলে বেরিয়ে এসেছে চিবুকের হাড়। ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ওর। প্রফেসরের দিকে চেয়ে দেখলাম পাথরের মত কঠিন দেখাচ্ছে ওঁর মুখ, লোমশ ভূ দুটো কুঁচকে লেগে রয়েছে একটার সাথে আর একটা। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি লুসির রোগজীর্ণ শরীরটার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড তেমনিভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে ইশারায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন তিনি।

বাইরের বুল-বারান্দাটায় বেরিয়েই নিচু, গম্ভীর গলায় আমাকে বললেন, এক্ষুণি, এই মুহূর্তে ওকে রক্ত দিতে হবে, জন। এখন থেকে যেকোন মুহূর্তে রক্তের অভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে ওর।

এত তাড়াতাড়ি তো বাইরে কোথাও থেকে রক্ত জোগাড় করা যাবে না। আমার রক্তের গ্রুপ ওর সাথে মেলে কিনা একবার দেখে নিন, স্যার।

এটা এমন একটা কেস, জন, যে এসব রোগীকে রক্ত দিতে হলে রক্তের গ্রুপ মেলাবার দরকার পড়ে না। যে-কোন গ্রুপের মানুষের রক্ত হলেই হল। এখন এসো আমার সাথে। যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নিচে রেখে এসেছি।

চলুন।

নিচে নেমেই বুঝলাম কে যেন ড্রইংল্কমে দরজার কড়া নাড়ছে। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েই চমকে উঠলাম, চেহারায় গভীর উৎকণ্ঠার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর্থার। আমাকে দেখেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, খবর কি, জন। লুসি কেমন আছে? বলেই আমার পেছনে দাঁড়ানো প্রফেসরের দিকে চোখ পড়তে বলল, ইনিই বোধহয় প্রফেসর হেলসিং?

আমি সম্মতি জানাতেই প্রফেসরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর একটা হাত চেপে ধরল আর্থার, আঃ, বাঁচালেন আমাকে, প্রফেসর। আপনি এসে পড়ায় সত্যিই নিশ্চিন্ত হচ্ছি আমি। ( ঠিক সময়েই এসে পড়েছ দেখছি তুমি। ভালই হল, বললেন প্রফেসর। কিন্তু মুখ দেখে আমার মনে হল আর্থারের উপস্থিতিতে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারছেন

প্রফেসর। বোধহয় তার কাজে বাধার আশঙ্কা করছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর্থারের উদ্বেগ লক্ষ্য করে বললেন, এসময়ে তোমার সহযোগিতার দরকার আছে লুসির।

কি করতে হবে শুধু আদেশ করুন, প্রফেসর। লুসির জন্যে শরীরের শেষ রক্ত বিন্দুটুকু পর্যন্ত দিতে রাজি আছি আমি।

ভেরি গুড। তবে আপাতত সবটুকু রক্তের দরকার নেই, খানিকটা হলেই চলবে, বলে হাসলেন প্রফেসর।

প্রফেসরের কথাটা ঠিক বুঝেতে পারল না আর্থার। বুঝতে পেরে বললেন প্রফেসর, লুসিকে রক্ত দেয়া প্রয়োজন, আর্থার। একটু আগে জনই রক্ত দিতে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তুমি যখন এসেই পড়েছ…

আমি রাজি। এক্ষুণি কি দরকার?

এক্ষুণি দরকার। চলো, আর দেরি না করে প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে ফেলি।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে আর্থারকে সতর্ক করে দিলেন প্রফেসর, সাবধান, আর্থার। অযথা হৈ-চৈ করে লুসির ঘুম ভাঙাবে না। আর যদি নিজে নিজেই ও জেগে ওঠে তাহলেও উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে এমন কোন কথা বলবে না লুসির সাথে।

নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন আপনি, প্রফেসর।

গুড।

তিনজনেই এসে দাঁড়ালাম লুসির ঘরের সামনের ঝুল-বারান্দায়। প্রফেসরের নির্দেশে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল আর্থার। আমরা দুজনে ঘরে ঢুকলাম। ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে তখন লুসি। আমাদেরকে ঘরে ঢুকতে দেখেও তার চেহারায় কোন ভাবান্তর হল না। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে শুধু আমাদের দিকে চেয়ে থাকল।

ব্যাগ হাতে ধীরেসুস্থে এগিয়ে সুসির বিছানার পাশে বসলেন প্রফেসর। ব্যাগ থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে তাতে ওষুধ ভরে ইঞ্জেক্ট করে দিলেন লুসির শরীরে। কয়েক সেকেও পরই অতি ধীরে চোখের পাতা মুদে ফেলল লুসি। ভারি হয়ে এল ওর শ্বাস-প্রশ্বাস। আবার গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল সে।

আর্থারকে ডাকতে বললেন আমাকে প্রফেসর। আর্থার ঘরে ঢুকতেই বললেন, কোটটা খুলে ফেললা, আর্থার। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, জন, এসো, ওই টেবিলটা ধরে লুসির বিছানার পাশে নিয়ে আসি।

টেবিলটা বিছানার পাশে এনে রাখতেই, আর্থারকে তাতে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন প্রফেসর। আর্থার নির্দেশ পালন করতেই নিপুণ হাতে রক্ত বিনিময়ের পালা শেষ করলেন তিনি। আর্থারের হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে দেখলাম একটা সরু লিকলিকে কালো রেশমী ফিতে লুসির গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছেন প্রফেসর। ফিতেটায় লকেটের মত কি একটা বাঁধা। লকেটটা পরিয়ে দেবার সময় লুসির গলার কাছের কাপড়টা একটু সরিয়ে ছিলেন প্রফেসর। তখন পরিষ্কার চোখে পড়ল লুসির গলার কাছের ছোট্ট দুটো ক্ষত।

লকেটটা ঝোলানো শেষ হবার পরও অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন প্রফেসর, তার সাথে সাথে আমরাও। একটু একটু করে লুসির গালের লালিমা আবার ফিরে আসছে। আরও কিছুক্ষণ পর লুসির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আর্থারের দিকে চেয়ে বললেন প্রফেসর, লুসিকে আজ নতুন জীবন দিলে, আর্থার। এবার পাশের ঘরে গিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নাও। জন, ওকে পৌঁছে দিয়ে এসো।

কিন্তু বিশ্রাম নিল না আর্থার। কারণ রাতের গাড়িতেই আবার অসুস্থ বাবার কাছে ফিরে যাবে ও। আর্থারকে নিচে পৌঁছে দিয়ে আবার লুসির ঘরে ফিরে এসে দেখলাম, তখনও লুসির বিছানার পাশে বসে স্থির দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন প্রফেসর। আমাকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, লুসির গলার ওই দাগগুলো দেখেছ?

দেখেছি, তবে আজই প্রথম।

হুঁ, এবং ওই দাগগুলোর জন্যেই আজ রাতে আমস্টারডামে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। কয়েকটা বই আর দরকারি জিনিসপত্র আনতে হবে। আমি না আসা পর্যন্ত সারাক্ষণ এ-ঘরে থেকে লুসিকে পাহারা দিতে হবে তোমাকে, বিশেষ করে রাতের বেলা।

এক-আধজন নার্সের দরকার আছে?

আছে। তবে সে-কাজটা আপাতত তোমাকেই করতে হবে। তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, রাতের বেলা মুহূর্তের জন্যেও এ-ঘর ছেড়ে কোথাও যাবে না, বা ঘুমুবে না। চোখ-কান খোলা রাখবে। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব আমি। এসেই আবার নতুন করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে লুসির।

আবার নতুন কি করবেন? একটু অবাক হয়েই জানতে চাইলাম।

পরে বলব, বলেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর। দরজার গোড়ায় পৌঁছেই আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, লুসিকে তোমার হাতে রেখে গেলাম, জন। মনে রেখো, লুসির যদি কিছু ঘটে তাহলে আমার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে তোমাকে, বলেই চলে গেলেন প্রফেসর।

৮ সেপ্টেম্বর।

সারাটা রাত লুসির পাশে জেগে বসে থাকলাম। দিন-রাতের প্রায় সারাক্ষণই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল লুসি। শুধু সাঁঝের দিকে একবার একটুক্ষণের জন্যে ঘুম ভেঙেছিল ওর। সে-সময় পরিচারিকাকে ডেকে ওকে রাতের পোশাক পরিয়ে দিতে এবং আমি না ফেরা পর্যন্ত লুসির পাশে থাকতে বলে নিচে নেমে এলাম লুসির মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে। ওর সাথে কয়েক মিনিট কথা বলে লুসির অবস্থা জানিয়ে খাবার ঘরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু খেয়ে নিলাম।

লুসির ঘরে ফিরে আসতেই আশ্চর্য সুন্দর চোখ দুটো মেলে আমার দিকে চাইল ও ওষুধের প্রক্রিয়ায় আবার ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছে ও, চোখের পাতার সঙ্কোচন দেখেই তা আন্দাজ করা যায়। আমাকে দেখে প্রাণপণে চোখের পাতা খুলে রাখার চেষ্টা করল ও। মাথাটাকে এপাশ-ওপাশ নাড়িয়ে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করল বার দুয়েক।

মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না, লুসি?

না, কেন যেন ভয় ভয় করছে।

কিসের ভয়?

ঠিক বোঝাতে পারব না তোমাকে, জন। রাতের বেলা, বিশেষ করে গভীর রাতে ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখি আমি, আশ্চর্য, তখন ওগুলোকে সত্যি বলে মনে হয়।

আরে না, ওসব কিছু না। আসলে দুর্বল হয়ে পড়েছ তো, অল্পতেই ভয় পেয়ে যাও। শরীরে একটু বল ফিরে আসলেই দেখবে দুঃস্বপ্নটা কিছু থাকবে না।

আমার তা মনে হয় না, জন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন ঘুমাও। তোমার পাশে বসেই পাহারা দেব আজ সারারাত। ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলে দেখবে ঠিক তোমার কাছেই বসে আছি আমি।

আহ্, বাঁচালে জন, বলেই ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুদল লুসি। কয়েক সেকেণ্ডেই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে।

তারপর সারারাতে একবারের জন্যেও চোখ মেলেনি লুসি, এমনকি নড়েনি পর্যন্ত। বুঝলাম, সারারাতে একবারও দুঃস্বপ্ন দেখেনি সে।

ভোরবেলা মোরগ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে পরিচারিকা এসে ঘরে ঢুকল। ওর হাতে সুসির ভার দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। প্রথমেই প্রফেসর এবং আর্থারকে দুটো তারবার্তা পাঠালাম। তারপর গোসল করে খেয়ে-দেয়ে কাজে মন দিলাম। কয়েকদিনের জমানো অজস্র কাজ আর নানান টুকিটাকি গোছগাছ করতে করতেই দিনটা কেটে গেল। কয়েকদিন ধরে রেনফিল্ডের খোঁজ নেয়াও হয় না, তাই বিকেলের দিকে একবার দেখতে গেলাম ওকে। মোটামুটি ভালই আছে রেনফিল্ড। রাতে খেতে বসে আমস্টারডাম থেকে পাঠানো প্রফেসরের তারবার্তা পেলাম, আজ রাতেও আমাকে লুসির পাশে বসে কাটাতে অনুরোধ করেছেন তিনি। রাতের গাড়িতেই রওনা দিচ্ছেন প্রফেসর, আগামীকাল ভোর নাগাদ পৌঁছে যাবেন এখানে।

৯ সেপ্টেম্বর।

পরপর দুরাত জেগে কাটিয়ে দারুণ ক্লান্তি বোধ করছি আজ। প্রায় টলতে টলতে এসে পৌঁছুলাম লুসিদের বাড়িতে। আজ বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে লুসিকে। আমার মুখের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন হল লুসি, বলল, আজ অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, জন। আজ আর মিছিমিছি আমার পাশে জেগে বসে থেকে কষ্ট করতে হবে না তোমাকে। তার চেয়ে তুমি ঘুমাও, আমিই বরং তোমার পাশে জেগে বসে থাকি।

ওর কথায় আমার মন থেকে অনেকখানি দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। ওর কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্যে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। বাওয়া-দাওয়ার শেষে পরপর দুকাপ গরম কফি খেয়ে বেশ চাঙা হয়ে ওঠল শরীরটা। আবার ফিরে এলাম লুসির ঘরে। ওর পাশের ঘরটা দেখিয়ে লুসি বলল, ও-ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো তুমি। মাঝখানের দরজাটা খোলাই থাক। দরকার হলে ডাকব তোমাকে।

প্রতিবাদ করলাম না। অবশ্য প্রতিবাদ করার মত মন বা শরীরের অবস্থাও আমার নেই। সোজা পাশের ঘরে এসে একটা বড় সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখের পাতায় নেমে এল রাজ্যের ঘুম।

১০ সেপ্টেম্বর।

ঘুম ভাঙল প্রফেসরের হাতের স্পর্শে। যে-কোন রকম অবস্থায়ই অবাক না হয়ে নিঃশব্দে জেগে ওঠার অভ্যাস আমার বহুদিনের, সেই প্রথম মেন্টাল হাসপাতালে কাজ করার সময় থেকে।

আমাকে চোখ মেলাতে দেখেই উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর, লুসি, লুসির খবর কি?

ভাল।

চলো, ওকে দেখে আসি একবার।

চলুন, বলে উঠে পড়লাম সোফা থেকে। মাঝখানের দরজার পর্দা সরিয়ে লুসির ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘর অন্ধকার। এগিয়ে গিয়ে পর্দাগুলো সরিয়ে জানালার পাল্লা খুলে দিতেই ঘরের মেঝেয় এসে ছড়িয়ে পড়ল ভোরের সোনালী রোদ। এমন সময় প্রফেসরের অস্কুট অথচ ক্রুদ্ধ আর্তস্বরে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম। লুসির দিকে চাইতে ধক করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা, মনে হল হাঁটু ভেঙে পড়ে যাব। লুসির বিছানার পাশে পাথরের মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর। অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেছে ওঁর মুখ।

বিছানার সাথে প্রায় মিশে গেছে লুসি। ঠোঁট দুটো মোমের মত সাদা, ঠেলে বেরিয়ে এসেছে চোয়ালের হাড়। এক রাতের মাঝেই দীর্ঘদিনের রোগজীর্ণ অবস্থা হয়েছে ওর। অবিশ্বাস্য! এমন তো হবার কথা নয়। কাল রাতে তো দিব্যি সুস্থ দেখলাম ওকে।

প্রচণ্ড মানসিক শক্তির বলে কয়েক মুহূর্তেই দুর্দমনীয় ক্রোধকে সামলে নিয়ে আমার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর, জলদি যাও, এখুনি ব্র্যাণ্ডি নিয়ে এসো একটু।

সাথেসাথেই ছুটলাম আমি। একছুটে নিচ থেকে একটা ব্র্যাণ্ডির বোতল এনে প্রফেসরের হাতে তুলে দিলাম। বোতলের মুখ খুলে লুসির রক্তশূন্য ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে ভেতরে একটু ব্র্যান্ডি ঢেলে দিলেন প্রফেসর। তারপর নাড়ি ধরে হৃৎপিণ্ডের কম্পন অনুভব করলেন, অবস্থা খুব খারাপ, তবে এখনও সময় আছে। আবার রক্ত দিতে হবে ওকে। জন, এবার তোমার পালা।

কথা বলতে বলতেই হাতের আস্তিন গুটিয়ে ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে ফেললেন। তারপর আগের দিনের মত টেবিলটা লুসির বিছানার পাশে টেনে এনে আজ আর্থারের পরিবর্তে তাতে শুয়ে পড়লাম আমি। দক্ষ হাতে রক্ত বিনিময়ের কাজ শেষ করলেন প্রফেসর। আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে ক্ষতি হতে পারে, সেআশঙ্কায় আগের মতই লুসিকে একটা মরফিয়া দিলেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে আমার হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বললেন, শরীরের ওপর প্রচণ্ড ধকল গেছে তোমার গত দুদিন। নিচে নেমে নাস্তা সেরে আরেকটু বিশ্রাম নাওগে।

টেবিল থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে দোরগোড়ায় পৌঁছুতেই পেছন থেকে ডাকলেন প্রফেসর, আর্থার যদি আজ এসে পড়ে ওকে কিন্তু আবার এসব কথা বলো না। তাতে লাভ হবে না কিছু, মাঝে থেকে শুধু শুধু ভয় পেয়ে যাবে ও।

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিচে নেমে এলাম। নাস্তা খাওয়া হলে আর বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করল না, তাছাড়া গত পুরো রাতটাই নাক ডেকে ঘুমিয়েছি। তাই আবার ওপরে ফিরে এলাম। মৃদু হেসে বললেন প্রফেসর, তোমাকে না শুয়ে থাকতে বলেছি। এইমাত্র রক্ত দিয়েছ, এখন নড়াচড়া করলে ক্ষতি হবে। যাও, ওঘরে সোফাটায় বসে থাকোগে কিছুক্ষণ। দরকার হলে ডাকব তোমাকে।

প্রায় জোর করেই ঘর থেকে বের করে দিলেন আমাকে প্রফেসর। অবশ্য ওঁর আদেশ অমান্য করার মত সাহসও আমার নেই। অগত্যা পাশের ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু সহজে ঘুম এল না। এক রাতের মধ্যে লুসির দেহের সমস্ত রক্ত নিঃশেষ হল কি করে, ভেবে দারুণ অবাক লাগল। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই একটু তন্দ্রা মত এল, আর তার ঘোরে লুসির গলার দাগটা কেবলই ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগল আমার অবচেতন মনে।

বিকেলে প্রফেসরের ডাকে ঘুম ভাঙল আমার। লুসির ঘরে এসে দেখি ওরও ঘুম ভেঙেছে। অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। লুসিকে আমার জিম্মায় রেখে একটু বেড়াতে বেরোলেন প্রফেসর। নিচের হলঘর থেকে ভেসে এল ওর গলা–পোস্ট অফিসটা কোনদিকে, কাকে যেন জিজ্ঞেস করছেন উনি।

লুসির সাথে আলাপ করতে করতে বুঝতে পারলাম সকালের দুর্ঘটনার কথা জানে না লুসি। একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকলেন লুসির মা আমাকে দেখে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন মহিলা, তোমাকে কিন্তু সত্যি অত্যন্ত ক্লান্ত আর রোগা লাগছে, ডাক্তার, তারপর মৃদু হেসে বললেন, আসলে এখন একটা বিয়ে করা উচিত তোমার, দেখাশোনার তো কেউ নেই।

ওঁর কথায় হেসে উঠেই লুসির দিকে চাইলাম। চকিতে লুসির গালে একটা রক্তিমাভা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। এই রকম হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়েই সব ঘনিয়ে এল। এই সময় বাইরে থেকে ফিরে এলেন প্রফেসর। এসেই বললেন, জন, আজ রাতে তোমার ছুটি। খেয়েদেয়ে ভাল করে ঘুমাওগে। লুসিকে আজ আমিই পাহারা দেব, একটু থেমে বললেন, আর একটা কথা, এই সময়ে তোমাকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কাজেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কাহিল হয়ে পড়ব আমি। আর তুমি ছাড়া আমার গোপন চিকিৎসার কথা কাউকে জানতে দেয়া চলবে না, বুঝেছ? যাও এখন, গুড নাইট।

১২ সেপ্টেম্বর। গত রাত আর আজ সারাটা দিন কষে ঘুমিয়েছি। বিকেলে ঝরঝরে শরীর নিয়ে লুসিদের বাড়িতে এসে হাজির হলাম। লুসির ঘরে ঢুকে দেখলাম লুসির সাথে গল্প করছেন প্রফেসর। আমি ঢুকতেই হেসে অভ্যর্থনা জানালেন আমাকে, এসো, জন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি।

আমি একটা চেয়ারে বসতেই টেবিলের ওপর রাখা একটা কাগজের প্যাকেট খুলে কয়েকটা জিনিস বের করলেন প্রফেসর। ধবধবে সাদা জিনিসগুলো দেখেই লুসি বলল, একটু আগে ওগুলোর কথাই বলছিলেন আমাকে?

হ্যাঁ। চাপা কৌতুকে চিকচিক করছে প্রফেসরের দুই চোখ। কিন্তু ভেবো না এগুলো সাধারণ জিনিস। অবশ্য অসাধারণ বলছি না। কিন্তু তোমার রোগের পক্ষে শুধু অসাধারণই নয়, দুর্মূল্য। এগুলোর একটার সাথে একটা গেঁথে মালা বানিয়ে আজ রাতে তোমার গলায় পরিয়ে রাখব। দেখবে, সমস্ত দুঃস্বপ্ন দূর হয়ে গেছে তোমার।

বাহ, আমার সাথে আবার ঠাট্টা করছেন আপনি। ওই সাধারণ রসুনের মালা গলায় ঝুলিয়ে দিলেই রোগ সেরে যায় নাকি?

কারও সঙ্গেই ঠাট্টা করি না আমি, লুসি। একটু গম্ভীর শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠস্বর। আমার প্রত্যেকটা কাজের কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, আমার কোন কাজকেই হেলার চোখে দেখবে না। তাহলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁর কথায় একটু মনমরা হয়ে গেছে লুসি। হেসে পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করে বললেন প্রফেসর, একটু কঠিন কথাই বলে ফেলেছি, লুসি, কিন্তু পরে বুঝবে তোমার ভালর জন্যেই বলেছি।

না বুঝে বলে ফেলেছিলাম, প্রফেসর, আমাকে মাফ করবেন।

গুড, এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা, বলে আমার দিকে ফিরে বললেন প্রফেসর, জন, তুমি একটু বসে, আমি এক্ষুণি আসছি, বলে রসুনগুলো তুলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

একটু পরই একটা রসুনের মালা বানিয়ে ফিরে এলেন প্রফেসর। নিজ হাতে লুসির গলায় পরিয়ে দিলেন ওটা। জানালাগুলো ভালমত বন্ধ করে চৌকাঠে ছড়িয়ে দিলেন রসুনের কোয়া। শার্সিগুলোতে ঘষে ঘষে লাগিয়ে দিলেন রসুনের রস। কাজ শেষ করে লুসির কাছে ফিরে এসে বললেন, লুসি, রাতের বেলায় দেখবে অত্যন্ত অস্বস্তি লাগছে তোমার। কিন্তু কিছুতেই গলা থেকে মালাটা বা কোন দরজা জানালা সামান্যতম সময়ের জন্যেও খুলবে না। মনে থাকবে?

থাকবে।

 আর কথা না বাড়িয়ে আমাকে সহ লুসির কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর। হোটেলে ফেরার পথে বেশ খুশি খুশি গলায় বললেন তিনি, একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারব আজ রাতে। ট্রেন যাতায়াত, পড়াশুনা আর প্রচণ্ড উদ্বেগের জন্যে গত কয়েকটা দিন চোখের পাতা এক করতে পারিনি।

১৩ সেপ্টেম্বর।

আজ সকালটা ভারি চমৎকার। ভোরের বাতাসে শরতের মিঠে আমেজ। অবশ্য পাতা ঝরার মৌসুম শুরু হতে দেরি আছে এখনও।

সকাল আটটায় হোটেলের কামরা থেকে বেরিয়েই দেখলাম সদর দরজায় গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। গতকালই গাড়ি তৈরি রাখার জন্যে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম হোটেলের মালিককে।

গাড়ি করে অল্পক্ষণেই লুসিদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়িতে ঢুকতেই একগাল হেসে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন লুসির মা। জানালেন, গত রাতে গভীরভাবে ঘুমিয়েছে লুসি। এখন পর্যন্ত ঘুম ভাঙেনি ওর।

মনে হচ্ছে, ওষুধ ধরেছে, বললেন প্রফেসর।

আমারও তাই মনে হয়, প্রফেসর। কাল রাতে লুরিস জন্যে অত্যন্ত ভাবনা হচ্ছিল, তাই মাঝ রাতের দিকে উঠে একবার দেখতে গিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম গভীরভাবে ঘুমাচ্ছে লুসি, আমার পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙল না ওর। ঘরের ভেতর অসহ্য গুমোট, আর রসুনের অসহ্য গন্ধে বমি আসতে লাগল আমার। দরজা জানালাগুলোও দেখলাম সব বন্ধ। চাকর-বাঁকরগুলোর ওপর ভয়ানক রাগ হল আমার। অসুস্থ মেয়েটার ঘরটাও একটু পরিষ্কার রাখতে পারে না ওরা। অগত্যা নিজেই জানালাগুলো খুলে দিয়ে লুসির কপালে চুমো খেতে গেলাম। দেখে আরও বিরক্ত লাগল, একটা রসুনের মালা গলায় পরেছে সে। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার দেখুন তো! মালাটা খুলে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি আমি।

কে যেন এক দোয়াত কালি ঢেলে দিল প্রফেসরের মুখে, লুসির মার কথা শুনে দপ করে নিভে গেল ওর মুখের হাসি। ধপ করে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লেন তিনি। প্রফেসরকে এত ভেঙে পড়তে জীবনে দেখিনি। কয়েক মিনিট গুম মেরে বসে থেকে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর, বুঝেছি, সেই শয়তানই লুসির মার হাত দিয়ে দরজা জানালা খুলিয়েছে। কিন্তু হারামজাদার কাছে তো পরাজয় স্বীকার করতে পারব না আমি। চলো, কাজ শুরু করে দিই আমরা, বলেই এক এক লাফে দুটো করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে ওপরে উঠতে শুরু করলেন তিনি। পেছন পেছন আমিও।

লুসির ঘরে ঢুকে আবার মরার মত রক্তশূন্য অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখলাম লুসিকে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন প্রফেসর, এবার রক্ত দেবার পালা আমার। জন, তৈরি হয়ে নাও।

এবার রক্ত বিনিময়ের কাজ শেষ করলাম আমি। প্রফেসরের হাতটা ব্যাণ্ডেজ করে দিতেই উঠে বসলেন তিনি। উঠেই চোখ পড়ল লুসির মার ওপর। আমরা রক্ত বিনিময় নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়ই কোন এক ফাঁকে ঘরে এসে ঢুকেছেন তিনি। তাকে দেখতে পেয়েই গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন প্রফেসর, দেখুন, মিসেস ওয়েস্টেনরা, যদি মেয়েকে বাঁচাতে চান, তাহলে আমার কথার একটু এদিক-ওদিক করতে পারবেন না। আমার বিনানুমতিতে সুসির ঘরেও ঢুকতে পারবেন না, জানালা দরজা বন্ধ থাকলে তা খুলতে পারবেন না। আর রসুনের মালা কেন, সারা ঘর রসুনে ভরে থেকে অসহ্য গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসলেও তা সরাতে যাবেন না। কারণ ওই রসুনই লুসির রোগের একমাত্র প্রতিষেধক, আর একমাত্র রসুনের গন্ধই দূরে সরিয়ে রাখতে পারে ওই ভয়ঙ্কর পিশাচটাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *