ড্রাইভিং ফোর্স
ডেনমার্কের জনসংখ্যা ৬০ লাখ। তার মধ্যে বৃদ্ধ আছে। শিশু আছে। সব বাদ দিলে কিশোর-যুবকের সংখ্যা হবে ৩০ লাখ। আমাদের ঢাকার জনসংখ্যাই ধরা হয় প্রায় দেড়-দুই কোটি। অর্থাৎ আমাদের রাজধানীর জনসংখ্যা ডেনমার্কের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন গুণ। এই ডেনমার্ক গত ৩০০-৪০০ বছর। ধরে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে স্বনির্ভর। শিল্প সাহিত্য ও খেলাধুলায় ভালো। ডেনিশরা জন্ম দিয়েছে দুনিয়াখ্যাত। কিছু বিজ্ঞানীর। তাদের মধ্যে অন্যতম নিলস বোর কুড়ি শতকের শ্রেষ্ঠ এক নায়ক। জন্ম দিয়েছে টাইকো ব্রের মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানীর। তাদের সংগীত, শিল্পকলা, সাহিত্য ইউরোপে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। ডেনিশরা ক্রীড়ায় ভালো। পৃথিবীর ছোট্ট একটা জাতি, ডেইরি ফার্মের জন্য খ্যাত। দুগ্ধজাতীয় পণ্যে নামকরা। কী করে এমন ছোট্ট একটা জাতি সবকিছুতেই এমন স্বনির্ভর ও অগ্রগামী হয়ে থাকে, আমরা কী একটু ভাবি!
একই দৃশ্য দেখা যায় ইউরোপের ছোট ছোট জনসংখ্যার বহু। দেশে। সুইডেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এমন সব দেশ। এই জাতিগুলোর অগ্রসরতার মূল কারণ হলো প্রফেশনালিজম ও প্রতিযোগিতা! ইউরোপের ড্রাইভিং ফোর্স হলো মেধা ও দক্ষতা এবং সেটার নিবিড় পরিচর্যা। আমি প্রায় সাতটি বছর সুইডেনে ছিলাম। সে দেশের সর্বোচ্চ একটি প্রতিষ্ঠানে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের একাডেমিক পড়াশোনা ও গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছি। তাদের ইতিহাস পড়েছি। সমাজের গভীরের কাজগুলো দেখেছি। ইউরোপের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির মেধাবী স্টুডেন্ট ও প্রফেসরদের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে সেখানের অতীত-বর্তমানকে জানার ও পরখ করার সুযোগ হয়েছিল। ইউরোপ মেধাকে পরিচর্যা করে। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রফেশনালিজম। প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করে। প্রফেশনালিজম প্রতিষ্ঠার জন্য লাগে সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা। যে হাইস্কুল পাস করবে, তার সেই লেভেলে সেরা জ্ঞান থাকবে। যে কাঠমিস্ত্রি হবে, সে সেই কাজটায় সেরা হবে। যে দোকানদার হবে, সে তার কাজটা পারফেক্টলি করতে হবে। প্রতিটি কাজের জন্য থাকবে। জবাবদিহি!
আমেরিকায় এই প্রতিযোগিতা সম্ভবত বর্তমান দুনিয়ায় সর্বোচ্চ। এ দেশে যে যার অবস্থান ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয়। কারণ, তার পেছনে তার চেয়ে যোগ্য মানুষের ধাক্কাটা অনেক। আর অবস্থান ধরে রাখার একমাত্র উপায় মেধা ও শ্রম! ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একটা উন্মাদ প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এলেও, কেউ ট্রাম্পের দল করে চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারেন না। সকাল-সন্ধ্যা ট্রাম্পের ছবি ফেসবুকে পূজা করে কিংবা টেবিলের সামনে টানিয়ে রেখে, পদ টিকিয়ে রাখতে পারেন না। আমেরিকার চালিকাশক্তি (Driving Force) হলো প্রতিযোগিতা! তাই এই দেশের অসংখ্য মেধাবী আমেরিকার সন্তান না হয়েও আমেরিকার সেরা সেরা কর্মপদ দখল করে রাখতে পারেন। আর আমার দেশের একটা সন্তান তার নিজ দেশেই জাত, ধর্ম, লিঙ্গ, জেলা, বংশ, বর্ণ কত কিছুর বাছবিচারের শিকার হয়।
একটা জাতিকে দাঁড় করাতে উচ্চ জিডিপি লাগে না। বড় বড় দালানকোঠা লাগে না। একটা জাতিকে দাঁড় করাতে লাখ-লাখ বাহিনী লাগে না। পারমাণবিক বোমা লাগে না। একটা জাতিকে দাঁড় করাতে লাগে মেধার পরিচর্যা। একটা জাতিকে ধড় করাতে লাগে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা। একটা জাতিকে দাঁড় কাবাতে লাগে প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ দক্ষ মানুষ তৈরি করা ও কাদের সুযোগ দেওয়া। ইউরোপের ড্রাইভিং ফোর্স এটাই। আমেরিকার চালিকাশক্তি বা ড্রাইভিং ফোর্স এটাই। প্রাচ্যের চীন জাপান, ইসরায়েলের ড্রাইভিং ফোর্সও তা-ই। কিন্তু আমাদের দেশে এগুলো কখনো হয়নি। আমরা কখনো এগুলো কেয়ার করিনি।
যে দেশের মেধাবী তরুণেরা চাকরিতে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাস্তায় মার খান, সেখানে ড্রাইভিং ফোর্স নেই। যে দেশের মেধাবীদের চাকরিতে সুযোগ পাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়, সেখানে চালিকাশক্তি নেই। সেখানে সবাই পদ টিকিয়ে রাখার ফিকির-ফন্দি করতেই ব্যস্ত। পদ টিকিয়ে রাখতে পদতলে নেমে যেতেও দ্বিধা নেই কারও। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমাদের দেশটিতেও পশ্চিমের মতো এমন ড্রাইভিং ফোর্স তৈরি হবে। এই প্রজন্ম সেটার জন্য লড়ছে। সমাজে যেকোনো বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে যে তারা সোচ্চার। তারা জয়ী হবেই!