ড্রইংরুম

ড্রইংরুম

মেট্রোরেলের লাইনে মহিলার ঝাঁপ।’

টিভিতে খবরটা দেখাল রাত আটটার সামান্য কিছু পরে। দেখাল মানে, ফলাও করে কিছু নয়। স্ক্রিনের নীচ দিয়ে নিরীহ ভাবে বাক্যটি চলে গেল।

টিভির পরিভাষায় এভাবে খবর দেখানোকে বলে ‘ক্রল’ করা। সহজ বাংলায় বললে, হামাগুড়ি খবর। সম্ভবত নীচ দিয়ে গুড়গুড় করে চলে বলে হামাগুড়ি। হামাগুড়ি খবরে মূলত মারামারি কাটাকাটি, আগুন লাগা, বাস উলটানো, জলে ডোবার মতো ভয়ংকর ভয়ংকর সব বিষয় থাকে। তবে তাদের মধ্যে কোনও বিচলিত ভাব থাকে না। যতই ভয়ংকর হোক না কেন, তারা সবসময়েই নির্লিপ্ত ভাবে অন্য প্রাোগ্রামের মাঝে স্ক্রিনে অ্যাপিয়ার করে নি:শব্দে, আবার নি:শব্দেই মিলিয়ে যায়। এই খবরের বেলাতেও তাই হয়েছে। খবরটি ভয়ংকর হলেও তার যাতায়াতে কোনও বিচলিত ভাব দেখা যায়নি।

কল্যাণীদেবী টিভি দেখছেন। সোফায় পা তুলে আরাম করে বসেছেন। রোজই আরাম করে বসেন। তবে আজ আরাম বেশি হচ্ছে। এর কারণ শরীর নয়, মন। বিশেষ কারণে আজ কল্যাণীদেবীর মন ভালো। সকালে তিনি তার পুত্রবধূ কাজলকে খুব কঠিন একটা কথা বলতে পেরেছেন এই কারণে মন ভালো। পুত্রবধূকে কঠিন কথা বলার ইচ্ছে তার আজ নয়। বহুদিনের। সুযোগ পেলে টুকটাক দু-একটা বলেওছেন। কিন্তু সেসব কথা কাজল পাত্তা দেয়নি। হয় মিটিমিটি হেসে গা জ্বলিয়ে দিয়েছে, নয় চুপ করে থেকে মাথায় রক্ত তুলেছে। শাশুড়ি হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে কল্যাণীদেবী জেনেছেন, পুত্রবধূরা দু-ধরনের পাজি হয়। ঝগড়ুটে পাজি এবং মিটিমিটি হাসি পাজি। কাজল হল মিটিমিটি হাসি পাজি।

আজ কাজল অফিস বেরোনোর সময় তাকে সিঁড়ির মুখে ডেকেছিলেন কল্যাণীদেবী। ডেকে নীচু গলায় কঠিন কথাটা বলেছেন। আপাত ভাবে দেখলে কঠিন কথার পিছনে বিরাট কিছু নেই। আছে একটা ড্রইংরুম। তার ওপর সেই ড্রইংরুম এখনও তৈরি হয়নি, হব হব করছে। কথাটা জানলে অনেকেই ভুরু কোঁচকাবে। সামান্য ড্রইংরুম নিয়ে কঠিন কথা! কিন্তু কল্যাণীদেবী জানেন এই ড্রইংরুম মোটেই ‘সামান্য’ নয়, ‘ভয়ংকর’। বিষবৃক্ষের বীজ। ডালপালা ছড়াবে। গোটা সংসার গিলে খাবে। পরশুদিন থেকে অনেক ভাবনাচিন্তা করে কল্যাণীদেবীকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কল্যাণীদেবী মনে করেন, এই কথা তার আগেই বলা উচিত ছিল। যাক, বেটার লেট দ্যান নেভার।

কথাটা শুনে ফ্যাকাশে মুখে মাথা নীচু করে কাজল নেমে গেছে।

টিভিতে সিরিয়াল চলছে। সিরিয়ালে রয়েছে দুটি পর্ব। রিলিফ পর্ব এবং টেনশন পর্ব। একদিন অন্তর পর্বদুটি আসে ঢেউয়ের মতো। কান্না, দু:খ, বিচ্ছেদের পর গল্পে থাকে হালকা ধরনের হাসি, ভালোবাসা, মিলনের কাহিনি। গতকাল গল্পে ছিল দু:খ। স্বাভাবিক নিয়মে আজ খুশির কিছু হওয়ার কথা। কল্যাণীদেবী মুখটা সেই কারণে আগাম হাসি হাসি করে রেখেছিলেন। কিন্তু আজকের পর্বটি ছিল মিক্সচার পর্ব। শুরু হয়েছিল খুশি দিয়ে, শেষ পর্যন্ত মোচড় নিয়েছে টেনশনে। এই মোচড়ের জন্য কল্যাণীদেবী প্রস্তুত ছিলেন না। আর ঠিক এরকম একটা টেনশনের সময়ে মেট্রোরেলের লাইনে মহিলার ঝাঁপ দেওয়ার খবরটা পা টিপে টিপে স্ক্রিনের নীচ দিয়ে চলে গেল।

গোপালের মা চা দিয়ে গেছে। কল্যাণীদেবী সারাদিন চায়ে চিনি খান না। শুধু সন্ধেবেলায় খান। খুবই অল্প খান, মোটে আধ চামচ। নইলে ঠিক আয়েস হয় না। খানিক আগে কাপে মুখ দিয়ে কল্যাণীদেবী জানতে পেরেছেন, গোপালের মা চায়ে চিনি দেয়নি। তাকে ডেকে ধমক দেওয়া দরকার। গোপালের মা এ-বাড়ির পুরোনো কাজের লোক। এই ভুল তার হওয়ার কথা নয়। অথচ এই নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে দুদিন সে এই কাণ্ড করল। কল্যাণীদেবীর আজ কেমন সন্দেহ হচ্ছে। গোপালের মা কাজটা ইচ্ছে করে করছে না তো? পিছনে কাজলের কোনও ফন্দি আছে? অসম্ভব কিছু নয়। কাজল লেখাপড়া জানা মেয়ে। পেটে পেটে বুদ্ধি। হয়তো ফন্দি করে শাশুড়ির কব্জা থেকে কাজের লোককে সরিয়ে নিতে চাইছে। প্রথমে চায়ের চিনি দিয়ে শুরু করেছে এরপর বড় ঝামেলা শেখাবে। তখন গোপালের মায়ের সঙ্গে অশান্তি হবে। গোপালের মা কাজ ছাড়বে। চলে যাওয়ার সময় একতলার সিঁড়ির নীচেই কাজল তাকে পাকড়াও করবে। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ‘বাবা বাছা’ বলে নিজের কাছে বহাল করবে। হয়তো পাকড়াও করতেই হবে না। পরিকল্পনা মতো গোপালের মা সটান তার ঘরে ঢুকে যাবে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। তিনদিন আগে যা ঘটেছে তা মারাত্মক। তবে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। মারাত্মক ঘটনা ঘটানোর জন্যই আজ সকালে মেয়েটাকে কঠিন কথা বলা গেছে।

তিনদিন আগে নীচের জন্য একটা রেফ্রিজারেটর এসেছে। কল্যাণীদেবী জানতেন না। গোপালের মায়ের কাছে খবর পেলেন জিনিস বাড়িতে ঢোকার পর। যেহেতু নীচে ছেলে, ছেলে-বউয়ের বেডরুম, সেখানে হুটপাট যাতায়াত একটু কমই করেন কল্যাণীদেবী। বিয়ের প্রথমদিকে কয়েকবার নীচে নেমে ভারি লজ্জার মধ্যে পড়েছিলেন। কাজল তখন ইশানের গলা জড়িয়ে গল্প করছিল। তাকে দেখে ছিটকে যায়। এরপর থেকে আওয়াজ না করে নীচে যান না। পরশু খবর পেয়ে পা টিপে টিপে নীচে গেলেন। নতুন রেফ্রিজারেটর দেখে এলেন।

রাতে খেতে বসে পুত্রবধূকে জিগ্যেস করলেন, ‘কাজল, নীচের জন্য আলাদা রেফ্রিজারেটর কিনেছ?’

কাজল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তরকারির বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘না কিনিনি।’

কল্যাণীদেবী খাওয়া থামিয়ে দিলেন। মেয়েটা এত বড় মিথ্যেবাদী! নিজের চোখে দেখে এলাম তবু বলছে কিনিনি! এখনও প্যাকিং খোলা হয়নি। লুকিয়ে দেখতে যাওয়ার কথাটা গোপন করে কল্যাণীদেবী বললেন, ‘সে কী! গোপালের মা যে বলল, আজ দুপুরে এসেছে! সে কি মিথ্যে বলল?’

কাজল বলল, ‘না মিথ্যে বলেনি। রেফ্রিজারেটর এসেছে ঠিকই, তবে আমি কিনিনি, বাবা পাঠিয়েছে। মাকে সেদিন টেলিফোনে গল্প করছিলাম, তার জামাই মাঝেমধ্যে রাতে ঘুম ভেঙে ঠান্ডা জল খেতে চায়। চিলড ওয়াটার। দোতলা পর্যন্ত উঠে জল আনতে ইচ্ছে করে না। আলিস্যি লাগে। কথাটা শুনে বাবা কাউকে কিছু না বলে দুম করে একটা রেফ্রিজারেটর কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে। কী কাণ্ড বলুন দেখি। কাজটা ঠিক করেনি। আমি বাবার ওপর রাগারাগি করব বলে ভেবে রেখেছি।’

‘ঠিক করেনি’ শুনে কল্যাণীদেবী আশ্বস্ত হয়েছিলেন। একই সংসারে দুটো রেফ্রিজারেটর থাকা যে একটা অপমানের বিষয় মেয়েটা তাহলে বুঝতে পেরেছে। বাবার ওপর রাগারাগি করাটাও উচিত। জামাইয়ের নাম করে কিনলেও এসব আসলে মেয়ের সঙ্গে বাবার আহ্লাদ। মেয়ের সঙ্গে এই ধরনের আহ্লাদ বিয়ের আগে আগে হওয়াই ঠিক। বিয়ের পর আহ্লাদ দেখানোর আগে দশবার ভাবতে হয়। বেয়াই-বেয়ানকে একবার বলতে হয়। কল্যাণীদেবী কাজলের ওপর খুশি হয়ে বললেন, ‘কী আর করবে। শ্বশুরমশাই জামাইয়ের জন্য কিনে ফেলেছেন। এটা নিয়ে আর রাগারাগি কোরো না। আমাকে আর একটা রুটি দাও কাজল।’

কাজল ক্যাসারোল থেকে গরম রুটি বের করে কল্যাণীদেবীর প্লেটে তুলে বলল, ‘আপনি বারণ করলেও আমাকে রাগারাগি করতে হবে মা। বাবার একবার বলা উচিত ছিল। রেফ্রিজারেটরের রংটা আমি বেছে দিতাম। ক্রিমশন রেড বাছা ঠিক হয়নি। ব্লুয়ের কোনও শেড হলে ঠিক হত। নীচের জন্য যে সোফা সেটটার অর্ডার দিয়েছি সেটার কভারও ব্লু করতে দিয়েছি। নীল সোফার পাশে নীল রেফ্রিজারেটর মানাত। ব্লুয়ের পাশে ক্রিমশন রেড কি মানাবে? আপনি বলুন তো মা। আমার খুব রাগ হচ্ছে।’

রুটি ছিড়ে মুখে দিতে গিয়ে থমকে গেলেন কল্যাণীদেবী। বললেন, ‘নীচের জন্য সোফা কিনছ!’

কাজল উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মা। সামনের জায়গা একটু সাজিয়ে নিচ্ছি। একটা ছোট ড্রইংরুম মতো। বেশি কিছু করব না। হালকা একটু ইনটিরিয়র ডেকরেশন করে রেখে দেব।’

কল্যাণীদেবী চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ইনটিরিয়র ডেকরেশন!’

কাজল যেন লজ্জা পেল। বলল, ‘সেরকম কিছু না, সামান্য। খুব সুন্দর একটা আলো দেখে এসেছি। স্ট্যান্ডে বসানো আলো। মাথায় ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা বড় একটা শেড আছে। খুব সুন্দর রং। স্কাই ব্লু। ওই শেডটাই আসল। মাঝখানে মাঝখানে একটু সাদা মেঘ। মেঘ নয় ঠিক, মেঘের সাজেশন। আলো জ্বললে মনে হচ্ছে ঘরে সত্যি সত্যি এক টুকরো আকাশ নেমে এসেছে! কী যে ভালো আপনি না দেখলে বুঝতে পারবেন না মা। আমার এক অফিস কলিগের বাড়িতে জিনিসটা প্রথম দেখি। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। আমি বললাম, এই ল্যাম্প শেড আমার চাই, দোকানের নাম বলো। আমি আজই যাব। কলিগ হেসে বলল, নাম বলব না। এক্সক্লিউসিভ। আমি বললাম, দোকানের নাম না বললে, তোমার বাড়ি থেকে আজ যাবই না। শেষ পর্যন্ত ঠিকানা নিয়ে দোকানে হানা দিলাম। ওরা বলল, ও জিনিস আর নেই, অন্য কিছু দেব? আমি বললাম, না। ওই আকাশটাই আমার চাই। অ্যাডভান্স করে যাচ্ছি, আনিয়ে দিন। আলোটা সোফার পাশে রাখব ঠিক করেছি। ভালো হবে না?’

ড্রইংরুম! কল্যাণীদেবী এতটাই অবাক হলেন যে কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। অনেক কষ্ট করে তিনি কিছু বলতে গেলেন। সেটা কোনও বাক্য হল না বিড়বিড় জাতীয় শব্দ হয়ে মুখ দিয়ে বেরোল।

কাজল বলতে লাগল, ‘কিউরিও সাজানোর জন্য ছোট একটা শো কেসও নিচ্ছি। আপনার নাতনির শখ। পুতুল-টুতুল রাখবে বলছে। তার বাবা আবার দেয়ালে বুককেস চাইছে। আমি বলেছি, এখন হবে না। আগে পরদা কিনব। ঘর রং করব তারপর ওসব। ঘর আর পরদার রং কী হবে বলুন তো মা? নীল। আকাশ আলোর সঙ্গে ম্যাচ করবে। এই কারণেই বাবার রেফ্রিজারেটর নিয়ে আমার বিরক্ত লাগছে। হয় বদলাব, নয় ওটাকে অন্য কোথাও রাখতে হবে।’

কল্যাণীদেবী মুখ তুলে হাঁ করে কাজলের কথা শুনছিলেন। খাওয়ায় ফিরে যেতে যেতে বললেন, ‘কই! আমি তো এসব কিছু জানি না!’

কাজল জিভ কেটে বলল, ‘জানার তো কথা নয়। দেখুন দেখি, বোকার মতো আমি বলে ফেললাম। ঠিক হয়েছে, আপনাকে আর বাবাকে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে। ক’দিন পরেই সোফা, লাইট, পরদা এসে গেলে আমাদের ড্রইংরুম কমপ্টি হয়ে যাবে। আপনারা নতুন সোফায় বসে চা খেয়ে ড্রইংরুম উদ্বোধন করবেন। সন্ধেবেলার চা। আধ চামচ চিনি দেব। একটা টিভি নিচ্ছি। এলসিডি। আপনি যখন ওপরের টিভিতে সিরিয়াল দেখবেন বাবা নীচে গিয়ে নিউজ দেখতে পারবেন। আপনার সঙ্গে আর ঝামেলা হবে না। তাই না? আপনি কিন্তু নাতনিকে বলবেন না আমি সব বলে দিয়েছি। বেচারি কাঁদতে শুরু করবে। মান্তুকে তো জানেন, একবার কাঁদতে শুরু করলে থামতে চায় না।’

কল্যাণীদেবীর ইচ্ছে করছিল জোর একটা ধমক দিতে। এমন জোর যাতে তার নাতনির বদলে নাতনির মা এখনই কেঁদে ফেলে। ঘরে নীল আকাশ নামানোর ফাজলামি বেরিয়ে যায়। ফাজলামি তো নয়, ফন্দি। সংসার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফন্দি। বাড়ি ভাগাভাগির ফন্দি। আকাশ বাতাস হাবিজাবি বলে ছেলে ভুলোতে চাইছে। তিনি শান্ত ভাবে বললেন, ‘ওপরে তো একটা ড্রইংরুম আছে কাজল। সেখানে সোফা আছে, আলো আছে, পরদা আছে। টিভিও আছে। নীচে আর একটার কী প্রয়োজন? একটা বাড়িতে ক’টা ড্রইংরুম থাকবে? নাকি রেফ্রিজারেটরের ঠান্ডা জল খাওয়ার মতো ইশানের মাঝেমধ্যে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে সোফায় গিয়ে বসতে ইচ্ছে করে?’

কাজল মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বলল, ‘মা, আর এক পিস চিকেন দিই? আপনি কিন্তু আজ কম খেলেন।’

কল্যাণীদেবী ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি ড্রইংরুমের কথাটা বললে খুশি হব। বিষয়টা সিরিয়াস। বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটছে অথচ আমার একটা পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করলে না!’

কাজল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অবাক গলায় বলল, ‘ঘটনা! ড্রইংরুম কোনও ঘটনা হল? আমরা তো নীচে নতুন কোনও ঘর বানাচ্ছি না মা। মেইন দরজা দিয়ে ঢুকে যে জায়গাটা পড়ে আছে সেটাই সাজিয়ে নিচ্ছি।’

কল্যাণীদেবী গলা আরও শান্ত করে বললেন, ‘এটা কোনও যুক্তি হল না কাজল। খালি জমিও পড়ে থাকে। সেখানে দশতলা বাড়ি তোলা যায়। যাই হোক, আমাকে একবার জিগ্যেস করলে পারতে।’

কাজল এবার নরম ভঙ্গিতে বলল, ‘সরি। এরজন্য পারমিশন নিতে হবে বুঝতে পারিনি। আসলে আমাদের আলাদা একটা বসার জায়গার খুব প্রয়োজন। ইশানের অফিসের লোকজন আসে, আমার কলিগরা আসে। অন্য বন্ধুরাও আসে। সবাইকে তো ওপরে তুলে আনা যায় না। আপনি টিভি দেখেন, বাবা থাকেন। বাধ্য হয়ে ওদের আমরা নীচের বেডরুমে বসাই। প্রাইভেসি নষ্ট হয়। মান্তু বড় হচ্ছে। তা ছাড়া…তা ছাড়া কেউ না এলেই বা কী…অফিস থেকে ফিরে আমারও তো হাত-পা ছড়িয়ে নিজের মতো একটু থাকতে ইচ্ছে করে…মনে হয় একটু বই পড়ি, একটু গান শুনি…নিজের মতো টিভি দেখি…মোবাইলে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে বকবক করি…এরমধ্যে খারাপ কী আছে!’

কল্যাণীদেবী একটু চুপ করে রইলেন। তারপর কাটা কাটা বাক্যে বললেন, ‘হাত-পা ছড়ানোর জন্য পয়সা খরচ করে একতলার ঘরে আকাশ না বানিয়ে ছাদে গিয়েও তো বসতে পারো। সেখানে তো ন্যাচারাল আকাশ পেতে। এবাড়িতে কি আর কেউ বই পড়ে না, গান শোনে না?’

কাজল মিটিমিটি হেসে বলল, ‘আমিও ছাদে যাই। আপনি জানেন না মা। গরমের সময় অনেক রাত পর্যন্ত আমি আর নিশা ছাদে গল্প করি। আমরা ঠিক করেছি, দুজনে মিলে একটা টেলিস্কোপ কিনব। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখব।’

কল্যাণীদেবী কথা না বাড়িয়ে চুপ করে খেতে লাগলেন। বাড়িতে গ্রহ লাগা শুরু হয়েছে। কল্যাণীদেবী রাতে সবার আগে খান। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় ওষুধ খেতে হয়। খাবার সময় বেশিরভাগ দিনই কাজল উপস্থিত থাকে। আলাদা বেডরুম, আলাদা বাথরুম এসবের একরকম মানে আছে, আলাদা ড্রইংরুমের মানে অন্য। আলাদা বসার জায়গা মানেই আলাদা গুজগুজ ফুসফুস। প্রথমে অফিস কলিগরা আলাদা বসবে, তারপর বাপের বাড়ির লোকেরা আলাদা বসবে। সেখানে শ্বশুরবাড়ির নিন্দে হবে। নানা ধরনের প্যাঁচ হবে। শ্বশুরমশাইকে টিভি দেখানোর নাম করে কানে শাশুড়ির বিরুদ্ধে বিষ ঢাললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই মেয়ে যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে সব পারবে। এতবড় দোতলা বাড়িতে হাত-পা ছড়ানোর জায়গা নেই! মান্তুকে রাখার জায়গা নেই! ফাজলামি হচ্ছে? লাগাম টানতে হবে। খুব দ্রুত লাগাম টানতে হবে। কাজল রাজত্ব বাড়াতে চাইছে। শুধু রাজত্ব নয়, খবর আছে, কাজল নীচে নিজের মতো নিয়মকানুন চালু করছে। যাকে বলে প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। নীচে ঘর মোছার টাইম পালটেছে। ঠিকে লোককে বলে দেওয়া হয়েছে। এবার হয়তো রান্নাঘর, কাজের মেয়ে নিয়ে একেবারে পাকাপাকি আলাদা হতে চায়। সেদিনের পর থেকে অ্যাকশনে নেমেছেন কল্যাণীদেবী।

এই মুহূর্তে কল্যাণীদেবীর চিন্তা হচ্ছে। কাজলকে কঠিন কথা শুনিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। গোপালের মাকে জেরা করে পেটের কথা সব বের করতে হবে। নিশা, ইশানের বাবাকে দিয়ে আর একরকম প্যাঁচ খেলেছেন। সেই প্যাঁচ কাজে লাগবে কিনা কে জানে।

টিভির তলা দিয়ে আবার গুড়গুড়িয়ে খবরটা গেল। এবার বাক্যটা সামান্য বদলেছে এবং বড় হয়েছে—

‘রবীন্দ্রসদন স্টেশনে মেট্রোরেলের লাইনে মহিলার ঝাঁপ। মহিলার বয়স তিরিশ বছরের কাছাকাছি। এখনও পরিচয় জানা যায়নি। পরনে লাল রঙের শাড়ি। সঙ্গে ব্যাগ। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, মহিলা চাকরি করতেন। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই ঘটনায় মেট্রো চলাচল ব্যাহত হয়েছে।’

খবরে পাত্তা দিলেন না কল্যাণীদেবী। হামাগুড়ির মতো ধীরে চলা খবর কেন, হান্ড্রেড মিটার রেসের মতো স্পিডে দৌড়োনো খবর হলেও তিনি পাত্তা দিতেন না। মেট্রোরেলে আত্মহত্যা এখন জলভাত। আকছার ঘটছে। এই খবর নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও কারণ নেই। তার ওপর ‘খবর’ জিনিসটার প্রতি তার বিন্দুমাত্র মায়া-মমতা নেই। উলটে বিরক্তি আছে। এই বিরক্তির জন্য দায়ী তার স্বামী পরিমল মিত্র। খবর নিয়ে অহেতুক উত্তেজনা করা পরিমলবাবুর বহুদিনের স্বভাব। টিভি-তে খবর দেখার সময় এমন ভাব করেন যেন একটু পরেই প্রধানমন্ত্রীর ফোন আসবে। তিনি জিগ্যেস করবেন, ‘নিউজ দেখে কী বুঝলেন পরিমলবাবু? দেশ ঠিকঠাক চলছে তো? কোনও দোষত্রুটি থাকলে জানাবেন। লজ্জা পাবেন না।’ কল্যাণীদেবীর দৃঢ় বিশ্বাস সংসারের পাঁচটা দিকে যাতে মন না দিতে হয় সেই কারণেই মানুষটা বাড়ি ফিরে ছাইপাঁশ খবর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিশাও ঠাট্টা করে, ‘মা, বাপির অবস্থা ভালো নয়। একদিন মাঝরাতে দেখবে ঘুমের মধ্যে খবরও পড়ছে। শোয়া অবস্থাতেই হাতজোড় করে বলছে, নমস্কার, আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল…হি-হি…।’

মেয়ের কথা মনে পড়তে কল্যাণীদেবী নড়েচড়ে বসলেন। গোপালের মায়ের বিষয়টা নিয়ে নিশার সঙ্গে আলোচনা করলে কেমন হয়? চায়ে চিনি না দেওয়ার ব্যাপারটা সে কেমন ভাবে দেখছে? মেয়ের বুদ্ধির প্রতি তার যে আস্থা ছিল এমন নয়। বরং রাগই আছে। মেয়ে তার বউদির ঘনিষ্ঠ। বিয়ের পর থেকেই দুজনের সম্পর্ক ভালো। হাবিজাবি শপিং, ফালতু সিনেমা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, দুমদাম রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া—সবই চলে। প্রথম প্রথম ভালো লাগত। বউদি ননদের ‘মধুর সম্পর্ক’ তাকে আহ্লাদিত করত। পরে এই ‘গলাগলি’ তার গলা চেপে ধরেছে। ‘মধুর সম্পর্ক’ তেতো করার জন্য নানাবিধ চেষ্টা করেছেন কল্যাণীদেবী। বহুবার মেয়েকে সরাসরি বলেছেন। নিশা কানে তোলেনি। কেবল ঝামেলা এড়াতে মায়ের সামনে দহরম-মহরম কমিয়েছে। কল্যাণীদেবীর কাছে খবর আছে, বাড়ির বাইরে দুজনে মিট করে। সিনেমায় যায়। রেস্তোরাঁয় খায়। মন্দের ভালো। অন্তত চোখের সামনের আদিখ্যেতা দেখতে হয় না।

নিশার বুদ্ধির প্রতি সম্প্রতি খানিকটা ভরসা তৈরি হয়েছে কল্যাণীদেবীর। তার কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট বেরোয়নি। কিছুদিন পর বেরোবে। ফল ভালো হবে। যতটা ভালো ফল হলে ছেলেমেয়েরা আরও পড়াশোনা করে বা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যায় ততটাই ভালো হবে। কিন্তু নিশা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে আর লেখাপড়া করবে না। এই সিদ্ধান্ত যে-কোনও বাবা-মায়ের পক্ষে হতাশার। কল্যাণীদেবী খুব খুশি। নিশা এবার বিয়ে করতে চায়। বিয়ে করে সংসার করবে। কল্যাণীদেবী মনে করেন এই সিদ্ধান্ত বুদ্ধির সিদ্ধান্ত। সাধারণ বুদ্ধি নয়, যেসব মেয়ের বেশি বুদ্ধি তারাই একমাত্র এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শেষ পর্যন্ত যখন বিয়ে করে সংসারই করতে হবে, আগেভাগে শুরু করে ফেলা ভালো। লেখাপড়া শিখলেই মেয়েদের বাইরের কাজে ছুটতে হবে এমন কোনও নিয়ম নেই। পেটে বিদ্যে নিয়ে ঘরসংসারও করা যায়। সংসার সহজ জায়গা নয়। অফিস-কাছাড়ির থেকেও জটিল জায়গা। এখানেও লেখাপড়া অ্যাপ্লাই করা প্রয়োজন। অনেক হিসেবনিকেশ, প্যাঁচপয়জার, নরম-গরম জানতে হয়। সু-গৃহকর্ত্রী তৈরির জন্য যদি কলেজ-ইউনিভার্সিটির কোনও কোর্স থাকত, তাহলে তার সিলেবাস নিশ্চয় খুব কঠিন হত। সেদিক থেকে নিশা অবশ্যই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এত পর্যন্ত জেনে কারও মনে হতে পারে, সংসার সম্পর্কে কল্যাণীদেবীর এটা একটা থিওরি। না, এটা কোনও থিওরি নয়। এটা রাগ। কাজলের প্রতি রাগ। আট বছর আগে একমাত্র পুত্র ইশানের জন্য তিনি যখন মেয়ে খুঁজতে শুরু করেছিলেন তখন ঠিক করেছিলেন ঘরে ‘পুতুল বউ’ আনবে। পুতুলের মতো সুন্দর, পুতুলের মতো শান্তশিষ্ট এবং পুতুলের মতো দম দেওয়া। দমের চাবি থাকবে তার হাতে। খোঁজাখুজির পর এমএ পাশ করা কাজলকে খুঁজে বের করেছিলেন। দফায় দফায় ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। ‘সাত চড়ে রা কাটে না’ টাইপ ‘লাজুক মেয়ে’র উত্তর শুনে হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত ছিলেন সংসার এবং শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্নে এই মেয়ে গভীর মনোনিবেশ করবে। বিদ্যাবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সংসার পরিচালনাকে সে শিল্পের পর‌্যায়ে নিয়ে যাবে। কাকভোরে সবার আগে ঘুম থেকে উঠবে, রাতে শুতে যাবে সবাই ঘুমোতে যাওয়ার পর। চব্বিশ ঘণ্টা তার কাছে কম সময় মনে হবে। মনে হবে দিনটা আরও বড় হওয়া উচিত ছিল। তিনি সবাইকে গর্ব করে বলতে পারবেন, ‘ভাগ্যিস, ঘরে লেখাপড়া জানা বউ এনেছিলাম। মুখ্যু হলে কী এমন ভাবে সব সামলাতে পারত? পুত্রবধূ শুধু লক্ষ্মী হলে হয় না সরস্বতীও হতে হয়।’

কল্যাণীদেবীর যাবতীয় আশা জলাঞ্জলি দিয়ে সরস্বতী পুত্রবধূ বিয়ের ঠিক ছ’মাসের মাথায় চাকরিতে জয়েন করেছে। বড় পদ। দায়িত্ব অনেক। সকাল ন’টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, রাত আটটার আগে ফেরে না। কোনও কোনওদিন নিশান তাকে গাড়িতে তুলে আনে। বেশিরভাগ দিন ফেরে মেট্রোতে। এই ঘটনায় কল্যাণীদেবী শোকস্তব্ধ হয়ে গেলেন। ‘পুতুল পুত্রবধূ’ এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে তিনি কল্পনা করতে পারেননি। দুদিন শোকে, রাগে, অপমানে থম মেরে থাকার পর মাথা ঠান্ডা করলেন। একদিন সকালে কাজলকে ডাকলেন।

‘কাজল, তোমার শরীর কেমন?’

কাজল অবাক হয়ে বলল, ‘হঠাৎ শরীরের কথা জিগ্যেস করছেন কেন মা? আমার তো অসুখ-বিসুখ কিছু হয়নি!’

মাথায় রক্ত উঠে যায় কল্যাণীদেবীর। ছ’মাস আগে পর্যন্ত যে মেয়েটিকে দেখলে মন স্নিগ্ধ হত আজ তাকে দেখেই মাথায় আগুন জ্বলছে! নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন কল্যাণীদেবী। শান্ত গলায় বললেন, ‘কাল নিশা বলল, তোমার নাকি মাথা ধরেছে। ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়েছিলে।’

চাকরিতে জয়েন করার আগে পর্যন্ত কল্যাণীদেবী পুত্রবধূকে ‘তুই তোকারি’ করতেন। বিয়ের ক’দিন আগে থেকেই শুরু করেছিলেন। বিয়ের পরপর ব্যাপক চেহারা নিয়েছিল। কথায় কথায় ‘ওরে আয়’, ‘ওরে বস’, ‘ওরে চুলটা বেঁধে নে’, ‘ওরে শাড়িটা বদলা’, ‘ওরে ফলের রসটা খেয়ে নে’, ‘ওরে রান্নাঘরে থাকিস না গায়ের রং কালো হয়ে যাবে’, ‘ওরে আর খাটিস না, এবার রেস্ট নে’। একেবারে পাগল পাগল অবস্থা। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সেই ‘পাগল’ অবস্থা দুম করে কেটে গেল। সম্বোধন বদলে এখন ‘তুমি’। নিশা বলেছিল, ‘মা, একটু সাবধানে।’

কল্যাণীদেবী ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কেন? সাবধানে কেন?’

নিশা স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘না, চিন্তা হচ্ছে, যেভাবে জাম্প দিচ্ছ, খুব শিগগিরই তুমি বউদিকে আপনি আজ্ঞে করে না বসো।’

কল্যাণীদেবী হিসহিসিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার বউদি সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। ক’দিন পরে হাতজোড় করে কথা বলতে হবে। দেখা করতে হলে গোপালের মাকে দিয়ে স্লিপ পাঠাতে হবে। অফিসের বস বলে কথা।’

শাশুড়ির মুখে মাথাব্যথার কথা শুনে কাজল হেসে বলল, ‘মাথা তো ধরেছিল কাল। কাল রাতে। আজ ঠিক হয়ে গেছে।’

অসহ্য। কল্যাণীদেবী মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যে হাসি নিয়ে ক’দিন আগেও প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। মধুবালা না মাধুরী দিক্ষিত? কার মতো? পাশ থেকে দেখলে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে একটা হালকা মিল আছে না? সেই হাসি দেখলে এখন একজনের কথাই মনে পড়ছে। ড্রাকুলা।

‘তোমার খাটাখাটনি বেশি হয়ে যাচ্ছে কাজল।’

কাজল বলল, ‘নতুন চাকরিতে খাটাখাটনি তো একটু বেশি হবেই মা। ক’টাদিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সিস্টেমের মধ্যে এসে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না।’

কল্যাণীদেবী এই জবাবে গা না করে গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন, ‘তুমি কেন চাকরি করছ কাজল? তোমার তো টাকা-পয়সার কোনও অভাব নেই। ইশান বড় চাকরি করে। স্যালারি ভালো। তার ওপর কমিশন, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট, অ্যালাউন্স, হ্যানা ত্যানা কত কী আছে। মিছিমিছি তুমি কেন বাইরে খেটে মরবে? তুমি শুয়ে বসে বিশ্রাম করবে। আমার সঙ্গে গল্প করবে, নিশার সঙ্গে সিনেমা যাবে, ইশানকে নিয়ে মার্কেটিং-এ বেরোবে।’

কাজল পুতুলের মতো সুন্দর হাসল। বলে, ‘আমি অভাবের জন্য চাকরি করছি একথা আপনাকে কে বলল মা?’

‘তাহলে কার জন্য করছ?’ কল্যাণীদেবী ভুরু কোঁচকালেন।

কাজল সহজভাবে বলল, ‘নিজের জন্য। লেখাপড়া শিখেছি, সেটা কাজে লাগাতে ইচ্ছে করছে। তা ছাড়া বাড়িতে বসে থাকলে বোরড হয়ে যাব।’

‘বাড়িতে লেখাপড়া কাজে লাগানো যায় না?’ কল্যাণীদেবীর গলায় ওঠানামা নেই। খুব রাগ হলে মানুষের গলা এমন হয়। সরলরেখায় চলে।

কাজল আবার হাসল। বলল, ‘মা, লেখাপড়া এমন একটা জিনিস যা একসঙ্গে অনেক কাজে লাগানো যায়। ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না।’

কল্যাণীদেবীর ইচ্ছে করল উঠে গিয়ে কাজলের গালে একটা চড় মারতে। প্রাচীন কালে পুত্রবধূ ঠেঙানোর সিস্টেম কেন চালু ছিল এই মেয়েকে দেখলে এখন বোঝা যায়। ভেবেছেটা কী? তার কি ধারণা শাশুড়িকে লেখাপড়া বিষয়ে লেকচার শোনাতে তাকে এ-বাড়ির বউ করে আনা হয়েছে? তিনি নীচু গলায় বললেন, ‘তুমি যদি সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো বিদ্যেবুদ্ধি সংসারের কাজে লাগানোর সময় কী করে পাবে?’

‘টাইম ম্যানেজমেন্টটাও শিক্ষার মধ্যে পড়ে মা। আগের মতো এখনও সকালে উঠে আপনাদের ব্রেকফাস্ট করছি কী করে? মান্তুকে তুলে স্কুলের জন্য রেডি করছি না? রান্নাঘরেও তো ঢুকছি। গোপালের মাকে যতটা পারি হেল্প করছি। আগে সকালে অনেকটা সময় রান্না করতাম, এখন রাতে একটা-দুটো আইটেম করে রাখি। কালই তো প্রণ পালং করেছিলাম। খারাপ হয়েছে? পালং শাক পেস্ট করে…।’

কল্যাণীদেবী বললেন, ‘প্রণ পালং-এর রেসিপি পরে শুনব। তোমার শ্বশুরমশাই অনেক কষ্ট করে এই দোতলা বাড়িটা তৈরি করেছেন। আজ বাদে কাল নিশার বিয়ে হয়ে যাবে। সে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমরাও বুড়ো হচ্ছি। আর কতদিন? তারপর তো এই বাড়ি ঘরদোর সবই তোমাদের দেখতে হবে। সবাই যদি বাইরের কাজ করে তাহলে এতসব সামলাবে কে?’

কাজল আবার হাসল। বলল, ‘মা, ঘরবাড়ি দেখাশোনার জন্য একজন ভালো কেয়ারটেকারই যথেষ্ট। তার জন্য এখন থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোনও কারণ দেখছি না।’

কল্যাণীদেবী আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। চকিতে মুখ তুলে বললেন, ‘আর শ্বশুর-শাশুড়ি? তাদেরও কি কেয়ারটেকার দিয়ে সামলাবে?’

‘হতেই পারে। তবে তখন আর বাড়ির মতো একজন কেয়ারটেকারে হবে না মা। সংখ্যা বাড়বে। ছেলে, ছেলেরবউ, মেয়ে, ভবিষ্যতে মেয়ের জামাইও আসবে—সবাই জয়েন করবে। শিফটিং ডিউটি হবে। আমি আর আপনি মিলে বসে রোস্টার তৈরি করব।’

কল্যাণীদেবীর বিস্ময় রাগকেও ছাপিয়ে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘তাহলে চাকরিটা তুমি ছাড়বে না?’

কাজল বলল, ‘তা কেন? ছাড়তেই পারি। বেটার কোনও চান্স পেলে শিফট করব।’

কল্যাণীদেবী এরপর থেকে কখনও কাজলের চাকরি বিষয়ে আর কোনও কথা বলেননি। রাগ মনে পুষে রেখেছেন। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। নিশার বিয়ে করে সংসার করার সিদ্ধান্তে এতদিন পর সেই সুযোগ এসেছে। প্রতিশোধের সুযোগ। কাজলের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেওয়ার সুযোগ। গোপনে মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করেছেন। তার মেয়ে শুধু লেখাপড়ায় ভালো নয় সুন্দরী এবং স্মার্ট। খুব সহজেই তার জন্য অজস্র ভালো ছেলে পাওয়া যাবে। একটু সময় লাগবে এই যা। অজস্র ভালোর মধ্যে ‘একটা ভালো’ বাছতে সময় লাগে। সেটাই নিয়ম। ছেলে কেমন হবে সে ব্যাপারে নিশার কোনও বক্তব্য নেই। দরকারও নেই। মেয়ের পছন্দ তিনি জানেন। তার টেস্ট উঁচুর দিকে। ছোটবেলা থেকেই হ্যান্ডসাম ছেলেদের তার পছন্দ। দাদার মতো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়র না হলেও চলবে, কিন্তু বড় কম্পানির চাকুরে হতে হবে। মাল্টি ন্যাশনাল হলে সবথেকে ভালো। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে কোনও অবস্থাতেই বিজনেস করা পাত্র চলবে না। বিজনেস করা লোক নিশার দু-চক্ষের বিষ। তারা বউ-ছেলেমেয়েকে একদম সময় দিতে পারে না। সবই জানা আছে কল্যাণীদেবীর। তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, নিশার পাত্র খোঁজার ব্যাপারে কাজলের কোনও পরামর্শ শুনবেন না। ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার এনে দিলেও নয়।

মোবাইলে তুলে নিশার নম্বর টিপতে গিয়ে আবার টিভির দিকে চোখ পড়ল কল্যাণীদেবীর। সিরিয়াল শেষ করে সেখানে গানবাজনা হচ্ছে। নীচের হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া খবরগুলোও বদলেছে। মেট্রোরেলের খবরটা বেশ লম্বা হয়েছে। হামাগুড়ি দিয়েই একটার পর একটা বাক্য আসছে স্ক্রিনে।

‘ঝাঁপ দেওয়া মহিলার পরিচয় খানিকটা জানা গেছে। মহিলার ব্যাগ থেকে যে কাগজপত্র পাওয়া গেছে সেখান থেকে তার অফিস এবং বাড়ির ঠিকানা খোঁজার কাজ চলছে। ব্যাগে একটি বাচ্চা মেয়ের ফটো মিলেছে। সেটি মহিলার মেয়ের ফটো বলে পুলিশ মনে করছে। মহিলার পরনে লাল শাড়ি, কানে লাল পাথর বসানো দুল। মহিলার জ্ঞান এখনও ফেরেনি। চিকিৎসকরা চেষ্টা চালাচ্ছেন, জ্ঞান ফিরলেই পুলিশ তার সঙ্গে কথা বলবে।’

কল্যাণীদেবী থমকে গেলেন। কানে লাল পাথর বসানো দুল? কথাটা খট করে লাগল। লাল পাথর বসানো দুল…লাল পাথর বসানো দুল…কার যেন লাল পাথর বসানো দুল আছে? টিভির দিকে স্থির চোখে তাকালেন কল্যাণীদেবী। খবরটা অনেকক্ষণ ধরে দেখাচ্ছে না? সেই সিরিয়ালের সময় থেকেই তো নীচে ভেসে ভেসে উঠছে। আবছা আবছা মনে পড়েছে। মেট্রোরেলের লাইনে ঝাঁপ দেওয়া খবর। তিরিশ না কত বয়স যেন মেয়েটার। কিন্তু লাল পাথর বসানো দুল কার আছে? কল্যাণীদেবী সোফায় আরাম করে তুলে রাখা পা-দুটো মাটিতে নামালেন। খবরটা ছোট ছোট অনেকগুলো বাক্যে লম্বা হয়ে ফিরে আসছে।

‘মেট্রোরেলের লাইনে মহিলার ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বয়স তিরিশের কাছে। সঙ্গে ব্যাগ। ব্যাগে পাওয়া গেছে অফিসের কাগজপত্র। চাকুরিরতা এই মহিলার পরনে লাল শাড়ি, কানে লাল পাথর বসানো দুল, কপালে লাল টিপ। পুলিশ তদন্ত করছে। মেট্রো চলাচল বিপর্যস্ত হওয়ায় স্টেশনগুলিতে অফিস ফেরত যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়।’

কল্যাণীদেবীর মনে পড়ে গেছে। লাল পাথর বসানো দুল তার নিজেরই আছে। নিজের মনেই হেসে ফেললেন। খবরটা দেখে ফালতু একটা চিন্তায় ঢুকে পড়েছিলেন। চমকে উঠেছিলেন। মনে হচ্ছিল চেনা কেউ…। এই জন্য খবর দেখতে নেই। যত রাজ্যের হাবিজাবি জিনিস দেখায়। যে মেয়ে আত্মহত্যা করতে চায় তার কানের দুল, হাতের বালার খবর দেওয়ার কী আছে? সাংবাদিকরা পারেও বটে! সেন্টার টেবিল থেকে মোবাইল তুলে নিশার নম্বর ডায়াল করলেন কল্যাণীদেবী। ডায়াল করতে করতেই তার মনে পড়ে গেল দুলটা তিনি নিজের কাছে রাখেননি, কাউকে দিয়েছেন। কাকে দিয়েছেন? নিশাকে? কাজলকে নয়তো?

নিশা বসে আছে চায়না টাউনের রেস্তোরাঁয়। উলটো দিকে স্বস্তিক। রেস্তোরাঁ বড় কিছু নয়, মোটামুটি। এই রেস্তোরাঁয় আজ প্রথম আসছে না নিশা, আগেও এসেছে। এখানে পা দিলেই নিশার মেজাজ বিগড়ে যায়। অ্যামবিয়েন্সটা তার একেবারে পছন্দের নয়। সস্তা ধরনের আলো আঁধারি ভাব। মাথার ওপর চিনা লণ্ঠনের নকল কতগুলো আলো ঝুলছে। সেগুলো আদৌ চিনা লণ্ঠনের মতো সুন্দর নয়, কালি পড়া ম্যাড়ম্যাড়ে টাইপ। টেবিল চেয়ারগুলো কেমন যেন পুরোনো পুরোনো। প্লেট বাটি নিয়েও সন্দেহ আছে। নিশা ডবল করে ধোয়ায়। তার পরও নিজে হাতে ন্যাপকিন দিয়ে ঘষে ঘষে মোছে। সবথেকে খারাপ হল, একদিকের দেয়ালে জায়েন্ট সাইজের একটা টিভি লাগানো রয়েছে। দেখতে ইচ্ছে না করলেও চোখ পড়ে যাবে। নিশার মনে হয় স্যুপের বাটি ছুড়ে টিভিটা ভেঙে দিই। তবু এখানে না এসে উপায় নেই। তার কারণ এদের খাবার। এদের মতো খাবার খুব কম জায়গাতেই পাওয়া যায়। চলে যাওয়ার সময় মনে হয়, কুকের পায়ে একটা পেন্নাম ঠুকে যাই। নিশা তার বউদিকে নিয়েও এখানে খেয়ে গেছে। কাজলেরও একমত। ঢুকে মেজাজ বিগড়ে যায়, খেতে দিলে মন ভালো হতে থাকে।

আজ কিন্তু নিশার মন ভালো হচ্ছে না। অথচ তার খাওয়া শেষ হতে চলল। তার কারণ দুটো। প্রথম কারণ তার বিয়ে। স্টার্টার খেতে খেতেই নিশা স্বস্তিককে জানিয়েছে সে খুব শিগগিরই তাকে বিয়ে করতে চায়। স্বস্তিককে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এরকম ভাবে চলতে থাকলে যে-কোনওদিন রাত একটায় সে স্যুটকেস হাতে স্বস্তিকের বাড়ি পৌঁছে যাবে। তার বাবা-মাকে প্রণাম করে বলবে, ‘এসে গেছি।’ এই কথা শুনে স্বস্তিক বিষম-টিষম খেয়ে একাকার কাণ্ড করেছে।

‘এখনই বিয়ে! এখনই? আমি তো রেডি নই নিশা।’

‘রেডি হবে। বিয়ে এমন কোনও যাত্রা নাটক নয় যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মেকআপ করে, কস্টিউম পরে তৈরি হতে হবে।’

স্বস্তিক ঢোঁক গিলে বলে, ‘সে তৈরি নয়, আমি এখনও সে-ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনি। তুমি তো জানো নিশা। সবে বিজনেস শুরু করেছি।’

নিশা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, ‘বিজনেস যারা করে তারা কোনওদিনই পুরোপুরি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। তাদের সবসময় অন্যের পায়ের ওপর ডিপেন্ড করতে হয়। ব্যাঙ্ক লোন, অর্ডার, পার্টির পেমেন্ট, মার্কেট, সেল, রিটার্ন, অনেক কিছু আছে।’

‘প্লিজ নিশা, আমাকে সময় দাও।’

‘ইমপসিবল। আর অপেক্ষা করা যাবে না। মাকে আমি জানিয়ে দিয়েছি, বিয়ে করব। লম্বা-চওড়া হ্যান্ডসাম পাত্র খোঁজা শুরু হয়ে গেছে। ম্যানেজার পাত্র। সেই পাত্র বিয়ের তিনমাসের মাথায় আমাকে নিয়ে পগার পার হবে। সাত সমুদ্র পার হয়ে তেরো নম্বর নদীর পাড়ে বসে ল্যাপটপে আমি মাকে ইংরেজি অক্ষরে টাইপ করে বাংলায় চিঠি লিখব, মাগো, ঠোমার জোন্যো মোন কেমোন করচে গো। বেশি করে গো কথাটা লিখব। ইংরেজিতে গো লেখা সহজ। জি আর ও। তা ছাড়া তোমার মতো কালোকুলো, বেটে বক্কর ছেলেকে কতদিন আমি পছন্দ করব সেটাও একটা বিগ কোয়েশ্চন। আমি একজন হাই টেস্টের মেয়ে। নাক উঁচু। ফট করে মত বদল হয়ে গেলে ঝামেলা। সুতরাং ডিশিসন কুইক নিতে হবে।’

স্বস্তিক কুঁকড়ে গিয়ে বলেছে, ‘কত কুইক?’

নিশা আরও সহজ ভাবে বলল, ‘এখানে খাওয়া শেষ করে বিল দেওয়ার পর। খেতে খেতে ভাবো। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’

স্বস্তিক তারপর থেকে থম মেরে গেছে। এতে নিশার মন খারাপ হয়েছে। এটা কেন হবে? সে খুব আশা করেছিল বিয়ের প্রস্তাব শুনে স্বস্তিক খুশি হবে। তার হাত চেপে ধরবে। বলবে, ‘নিশা এখানে মিষ্টি থাকলে মিষ্টি মুখ করাতাম। কিন্তু এখানে মিষ্টি নেই, তাই নুডলস মুখ করাচ্ছি।’ বলে ফরকে তুলে আদর করে খানিকটা নুডলস খাইয়ে দেবে। স্বস্তিক সে ধরনের কিছুই করেনি, না উলটে চুপ করে গেছে! চুপ করে খাচ্ছে। স্বস্তিক যখনই চিন্তায় পড়ে, বেশি বেশি খায়। সে আর একটা নুডলসের অর্ডার দিয়েছে। এর পরেও নিশার মন খারাপ হবে না?

নিশার মন খারাপ হওয়ার দু-নম্বর কারণ সে নিজে। কাল রাতে ছাদে বউদির সঙ্গে গল্প করার সময় সে একটা বিচ্ছিরি কাজ করেছে। কাজটা করার সময় বুঝতে পারেনি, কিন্তু যত সময় যাচ্ছে কাজটার জন্য তার অনুতাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাজটা শুধু বিচ্ছিরি নয়, অন্যায়ও হয়েছে। বউদি একতলায় ড্রইংরুম করছে শুনে বারণ করেছে। বউদিই তাকে সবটা বলে। এমনকি মায়ের রেগে যাওয়াটাও। নিশা বেশি কিছু না ভেবে দুম করে বলে বসে, ‘কী দরকার বউদি, মা যখন পছন্দ করছে না ছেড়ে দাও। বাড়িতে আর একটা ড্রইংরুম না-ই বা হল। তোমার শখটা আপাতত তোলা থাক।’

বউদি অবাক হয়ে বলে, ‘তুমিও এরকম বলছ নিশা! এর মধ্যে পছন্দ-অপছন্দের কী আছে? এটা তো শুধু শখ নয়, দরকারও।’

নিশা বলল, ‘হয়তো মায়ের প্রেস্টিজে লাগছে। একই বাড়িতে দুটো আলাদা বসার জায়গা দেখে কেউ যদি কিছু ভাবে।’

বউদি বলল, ‘আলাদা শোওয়ার জায়গা থাকলে বসার জায়গা আলাদা হতে সমস্যা কোথায়? বরং ভালোই তো। একটায় ভিড় থাকলে অন্যটা ব্যবহার করা যাবে। ধরো তোমার বন্ধুরা এল। স্বস্তিককে কোথায় বসাবে এই ভেবে তো ওকে কোনওদিন বাড়িতেই আনতে পারো। বাবা-মায়ের সামনে তো আর বয়ফ্রেন্ডকে বসিয়ে কফি খাওয়ানো যায় না। এবার থেকে নীচেই বসবে। বাবা-মা জানতেই পারবেন না।’

নিশা বউদির হাতটা ধরে হেসে বলল, ‘ওরে বাবা, ওসবের দরকার নেই। তুমি প্ল্যানটা বাতিল করো। এমনিতেই সারাদিন বাইরে থাকো বলে মা তোমার ওপর চটে আছে, বাড়ি ফিরেও যদি আলাদা ড্রইংরুমে গিয়ে বসে থাকো…।’

বউদি হেসে বলল, ‘বিয়ের পর যদি শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে সংসার করো, কিছুদিন পর দেখবে তোমারও নিজের একটা ড্রইংরুমের জন্য মন ছটফট করছে। যেখানে হাত-পা এলিয়ে নিজের মতো কিছুক্ষণ বসতে পারবে। টিভি দেখতে ইচ্ছে না করলে, বন্ধ করে গান শুনতে পারবে। সেন্টার টেবিলে পা তুলে গল্পের বই পড়ার মতো মজা কিসে আছে নিশা? সারাক্ষণ কারও পাশে বসে থাকতে থাকতে তো দম বন্ধ হয়ে যায়। একটা সময়ের পর মনে হবে, কথাবার্তা যা হচ্ছে সবটাই বানানো। খাঁটি কথা ফুরিয়ে গেছে। সে শাশুড়িই হোক আর স্বামীই হোক। এমনকি তোমার মতো চমৎকার ননদ কাম বন্ধু হলেও তাই হবে। হবে না?’

নিশা বলল, ‘তোমার কথা সব মানছি বউদি। তবু বলব, প্লিজ কনসিডার। আমার কেমন জানি ভয় হচ্ছে, সামান্য একটা ড্রইংরুম নিয়ে এবাড়িতে বড় ধরনের একটা অশান্তি না হয়ে যায়। তুমি বরং তোমার ওই আকাশ শেডের ল্যাম্পটা বেডরুমে রেখে দিও। সোফার অর্ডারটা ক্যানসেল করো। কিছু টাকার ক্ষতি হলে হোক। এতে মা খুব খুশি হবে।’ এইটুকু বলে নিশা থামল। দম নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘আমার কি মনে হয় জানো বউদি, এটা হলে মা আবার আগের মতো তোমার সঙ্গে তুই-তোকারি শুরু করবে।’

বউদি মাথা নামিয়ে খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর ছাদের পাঁচিলে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘ঠিক আছে তুমি যখন বলছ…মজার কথা কি জানো নিশা বাপের বাড়িতেও অনেকদিন পর্যন্ত আমার আলাদা কোনও ঘর ছিল না। ছাদও নয়। বন্ধুরা এলে সিঁড়িতে বসে গল্প করতাম। ঠিক আছে…চিন্তা কোরো না, একটা সামান্য ড্রইংরুম নিয়ে এবাড়িতে অশান্তি হোক আমি চাইব না।’

কাল কিছু মনে হয়নি, আজ কেন জানি নিশার মনে হচ্ছে, বউদি যে ড্রইংরুমটা সাজাতে যাচ্ছিল সেটা সামান্য নয়। সেটা বউদির কাছে অনেক বড়। হয়তো স্বপ্নের মতো। সব মেয়ের স্বপ্ন। বারণ করাটা ভুল হয়েছে। ছি-ছি। বউদি কি সোফার অর্ডার ক্যানসেল করে দিল? এখনই থামাতে হবে। নিশার প্লেট সরিয়ে রাখা দেখে স্বস্তিক বলল, ‘কী হল খাবে না?’ নিশা উত্তর না দিয়ে মোবাইলটা টেনে নিল। বেজে উঠল ফোনটা। মা। নিশা বিরক্ত হল। বিয়ে করবে জানার পর থেকে মা একটু দেরি হলেই ফোন করতে শুরু করেছে। নিশা ফোন কানে নিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কী হয়েছে? বলেছি তো, আজ আমার এক বান্ধবী ডিনার খাওয়াচ্ছে। ওর সঙ্গে গাড়ি আছে। আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দেবে।’

ওপাশ থেকে কল্যাণীদেবীর কাঁপা গলা ভেসে এল, ‘নিশা, নিশা, নিশা…।’

‘কী নিশা নিশা করছ মা, কী হয়েছে?’ চাপা গলায় প্রায় ধমকে উঠল নিশা। কেন জানি বউদিকে ড্রইংরুম নিয়ে চাপ দেওয়ার জন্য মাকে দায়ী করতে ইচ্ছে করছে!

আরও কাঁপা গলায় কল্যাণীদেবী বললেন, ‘আমার একটা লাল পাথর বসানো দুল ছিল না নিশা? সেই যে আমি যদুনাথের কাছ থেকে বানিয়েছিলাম, এক ভরি সোনা ছিল…।’

‘উফ এসব কী বলছ মা! লাল পাথরের দুল, সোনা, যদুনাথ স্যাকরা…কী হয়েছে বলবে তো? দুলটা তো তুমি বউদিকে দিয়েছিলে। কোন বছর যেন ম্যারেজ অ্যানিভারসরিতে দিলে? কী হয়েছে সেটার? চুরি গেছে? গেলে ভালো হয়েছে। তোমার দেওয়া জিনিস বউদির কানে না থাকাই মঙ্গল। তোমার গা চিড়বিড় করবে।’

ফোনের ওপাশে কল্যাণীদেবী মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বললেন, ‘তুই টিভি দেখেছিস নিশা?’

নিশা এবার খানিকটা চেঁচিয়েই ফেলল। বলল, ‘কেন? তোমার কোনও সিরিয়ালের নায়িকা ওরকম দুল পরেছে নাকি? পরলে পড়ুক, মা এখন ছাড়ো। বাড়ি গিয়ে সব শুনব। নায়িকার অর্নামেন্টসের ডিজাইনগুলো নোট করো।’

জোর করেই ফোন কাটল নিশা। বউদিকে ধরতে হবে। সরি বলতে হবে। বাড়ি গিয়েও বলা যেতে পারত। কিন্তু মনের কাঁটা গলার কাঁটার মতোই। যখন খচখচ করে তখনই তুলতে ইচ্ছে করে।

স্বস্তিক বলল, ‘এক মিনিট নিশা।’

নিশা বলল, ‘দাঁড়াও আগে একটা ফোন করে নিই।’

স্বস্তিক বলল, ‘না, আমারটা আগে শুনতে হবে।’

প্লেটে চামচ রেখে হাত বাড়াল স্বস্তিক। নিশার হাতটা ধরে গাঢ় স্বরে বলল, ‘বাড়িতে আজই বলে দাও। তবে একটা কন্ডিশন আছে, বিয়ের পর কিন্তু তোমাকে পড়াশোনা কনটিনিউ করতে হবে। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট। আমার বিজনেস দেখতে হবে।’

নিশা লজ্জা পাওয়া মুখ তুলল। তুলতেই চোখ পড়ল বিরক্তিকর টিভির দিকে। জায়েন্ট স্ক্রিনের তলা দিয়ে বড় বড় হরফে গুড়িসুড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে খবর। আগুন, দুর্ঘটনা, হাসপাতালে শিশু মৃত্যু। মা টিভির কথা বলছিল না? কেন? নায়িকার গয়না? নাকি অন্য কিছু? হঠাৎই নিশার চোখ আটকে গেল—

‘মেট্রোরেলের লাইনে ঝাঁপ দিয়ে পড়া মহিলার নাম-ঠিকানার খোঁজ পুলিশ পেয়েছে। হাসপাতালে তার জ্ঞান ফিরেছে। মহিলার বয়স তিরিশ বছরের কিছু বেশি। তার ব্যাগ থেকে অফিসের কাগজপত্র, একটি ছোটমেয়ের ফটো এবং কয়েকটি দোকানের বিল পাওয়া গেছে। একটি বিল দক্ষিণ কলকাতার একটি আলোর দোকানের। অন্য রসিদটি ফার্নিচারের কোনও শোরুমের।’

মহিলার নাম ঠিকানা জানানোর আগেই খবর বদলে গেল। নিশার মনে হচ্ছে সে পাথর হয়ে গেছে। আর কোনও দিনই সে এই চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারবে না। মাথার ওপর চিনা লণ্ঠন দুলছে। চারপাশ ঝাপসা। স্বস্তিকের হাত চেপে ধরে সে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘বউদি…বউদি…।’

ইশান ঠিক করেছিল, দু-পেগ খেয়ে উঠে পড়বে। দেবায়ূধ বলল, ‘একটা হাফ নাও ইশানদা। হাফ ফর দ্য রোড।’

ইশানের মদ খাওয়ার বিশেষ অভ্যেস নেই। মাঝেসাঝে খায়। অফিসের পার্টিতে, পুরোনো বন্ধু বা অফিস কলিগরা টানাটানি করলে। আজ অবশ্য সে নিজেই দেবায়ূধের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। দেবায়ূধ তার আগের অফিসের কলিগ। বয়সে ছোট। এখনও বিয়ে থা করেনি। ফূর্তিবাজ ছেলে। কাজল তাকে বিয়ের কথা বললেই বলে, ‘আপনার একজন ক্লোন জোগাড় করে দিন।’

সেই দেবায়ূধকে যখন আজ অফিস থেকে ফোন করে ‘বসবার’ প্রস্তাব দিল তখন বেলা তিনটে বেজে পঁচিশ মিনিট। সময়টা নির্দিষ্ট করে মনে থাকার কারণ কাজল। তিনটে থেকে তিনটে কুড়ি মিনিট পর্যন্ত কাজলের সঙ্গে তার টেলিফোনে কয়েক দফা ঝগড়া হয়েছে। অফিসের কাজ ফেলে কাজলের সঙ্গে টেলিফোনে ঝগড়া এই প্রথম নয়। আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে। তবে তার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল কাজলের বানানো ঝগড়া। একতরফা। ঝগড়ার সময় বোঝা যেত না। ঝগড়া শেষ করে ফোন কেটে দেওয়ার পর আবার রিং করত সে। চাপা গলায় বলত, ‘কী গো, বুঝতে পারলে না?’

ইশান রাগ রাগ করা গলায় বলত, ‘কী বুঝব?’

‘কেমন পা মাড়িয়ে ঝগড়া করলাম বুঝতে পারলে না? আচ্ছা হাঁদা তো!’

ইশান অবাক হয়ে বলত, ‘মানে!’

কাজল গলা আরও চাপা করত। বলত, ‘মানেটা রাতে বুঝবে। ঝগড়া না করলে আদরে টেস্ট হয় না।’

আজকের ঝগড়া অবশ্য বানানো নয়, সত্যি ঝগড়া। ঝগড়ার ইস্যু কাজলের ড্রইংরুম। শেষ পর্যায়ে কাজল থমথমে গলায় বলল, ‘আজ অফিসে আসার সময় তোমার মা আমাকে কী বলেছে জানো?’

ইশান ঝগড়া পারে না। সে শান্ত ধরনের মানুষ। বাবা-মা স্ত্রী কারোর অশান্তিতে ঢোকার ব্যাপারেই তার কোনও উৎসাহ নেই। বলল, ‘জানতে চাই না। একটা সামান্য বিষয় নিজে সামলাতে পারছ না!’

কাজল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘সামলাব কী করে, তোমার মা আমাকে বলেছেন, এবাড়িতে তিনি কিছুতেই আর-একটা ড্রইংরুম করতে দেবেন না। তার চোখের আড়ালে ড্রইংরুম থাকা মানেই বাড়িতে একটা উচ্ছৃঙ্খল হুল্লোড়বাজির জায়গা হবে। নইলে আলসেমি আর ষড়যন্ত্র করবার ঘর। আমি অবাক হয়ে বললাম, কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করব! তোমার মা বললেন, অত কথা জানি না। তবু যদি তোমার মনে হয়, নিজের ড্রইংরুম ছাড়া তোমার চলবে না, তাহলে এবাড়ির বাইরে গিয়ে থাকতে হবে। সেখানে একটা কেন, পাঁচটা ড্রইংরুম বানিয়ে নিও। যাওয়ার সময় বাক্স পেঁটরার সঙ্গে তোমার নতুন ড্রইংরুমটা সঙ্গে নিয়ে গেলে খুশি হব।’

ইশান একটু থমকে গেল। মা একেবারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলল! সে ঢোঁক গিলে বলল, ‘আমি কী করব?’

‘তুমি কিছু করবে না! চুপ করে থাকবে?’

‘মায়ের একথা বলার পথ তো তুমিই করে দিয়েছ কাজল। আকাশের মতো বসার জায়গা করছ, এখন সেই আকাশ থেকে কেমন বাজ পড়ছে দ্যাখো।’

কাজল একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি ওবাড়িতে থাকব না ইশান। আমরা আলাদা থাকব। ফ্ল্যাট নেব।’

‘পাগলের মতো কথা বোলো না। একটা ড্রইংরুমের জন্য গোটা বাড়ি স্যাকরিফাইজ করব? তুমি লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছ কাজল। ড্রইংরুম কোনও ইমারজেন্সি সাবজেক্ট নয়। যা হওয়ার হয়ে গেছে, আমি চাই তুমি ওই ফাইলটা এখন ক্লোজ করো।’

কথাটা বলে ফোন কেটে দেয় ইশান। তারপরেও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে। কাজলের ফোন সুইচড অফ। ইশানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। রাগ হতে থাকে। একবার ভাবে কাজলকে তুলতে সে গাড়ি নিয়ে তার অফিসে যাবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলায়। একটু রাগ দেখানো ভালো। কাজল, মা সবাই বুঝুক। আজ বাড়িতে দেরি করে ঢুকবে। তারপরই দেবায়ূধকে ফোন করে। দেবায়ূধ তাকে সাদর আপ্যায়ন করে নিজের ফাঁকা ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়েছে। আড়াই নম্বর পেগ এগিয়ে দিয়ে খানিক আগে সে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

বেশ ফুরফুরে লাগছে ইশানের। ইতিমধ্যে আরও কয়েকবার সে কাজলকে ধরবার চেষ্টা করেছে। তাকে বলতে চেয়েছে, রাগের মাথায় মা কী বলেছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মায়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু কথাটা বলা যায়নি। কাজল ফোন ধরছে না। ইশান মোবাইলে স্ত্রীকে মেসেজ পাঠাল। ‘আমার ফিরতে একটু দেরি হচ্ছে। ডোন্ট ওয়ারি। আই লাভ ইউ।’ এতে নিশ্চয় মেয়ের মান ভাঙবে। একটু সময় লাগবে কিন্তু ভাঙবে। ‘আই লাভ ইউ’ খুব কঠিন জিনিস। কাজলের পক্ষে এই কঠিন জিনিস অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়। সামনে টিভি চলছে। দেবায়ূধ কোথায় গেল? গ্লাসে চুমুক দিয়ে রিমোট তুলে চ্যানেল বদলাতে লাগল এলোমেলো ভাবে। থমকে গেল সুন্দরী নিউজ রিডারের গমগমে গলা শুনে। এই মেয়েটাকে আগেও দেখেছে অনেকবার। বাবার কল্যাণে বাড়িতে তো সবসময় খবর চলে। মেয়েটা চমৎকার খবর বলে। আজও বলছে—

‘…মেট্রোরেলে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনায় সন্ধের পর ট্রেন চলাচল অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পরে অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে। এদিকে মহিলার পরিচয় জানতে পেরেছে পুলিশ। হাসপাতালে মেয়েটি জানিয়েছে মহিলার নাম কাজল মিত্র…।’

ইশান টলে পড়ে যাওয়ার আগে চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে সামলাল। দেবায়ূধ ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে বলল, ‘কী হল ইশানদা টলছ নাকি? নেশা হয়ে গেল! টু এন্ড হাফেই আউট!’

মান্তু তার পিসির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে সোফায় মাথা এলিয়ে বসে আছেন কল্যাণীদেবী। মুখ পুরো দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে তিনি খানিকটা আগে পর্যন্ত কান্নাকাটি করেছেন। গোপালের মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এখনও ফোঁপাচ্ছে। মাথায় হাত চাপা দিয়ে মুখ নামিয়ে বসে আছেন পরিমল মিত্র। নিশা খেয়ে নেওয়ার জন্য তাকে বেশ কয়েকবার বলেছে তিনি রাজি হননি। তার খিদে নেই। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। গতকাল বিকেলে যা করেছেন সেটা অপরাধ ছাড়া আর কী? তিনি নিতাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাজারের কাছে নিতাই মান্নার বড় ওষুধের দোকান। কোন এক ওষুধ কম্পানির ডিলারশিপও নিয়েছে। বহুদিন ধরে বলছিল, ‘একটা জায়গার ব্যবস্থা করে দিন কাকাবাবু, বাইরে থেকে ওষুধের পেটি আসে, রাখার জায়গা পাই না। চিন্তা করবেন না ভাড়া যা লাগে দেব।’ কল্যাণীকেও বলেছিল। বলেছিল, ‘আপনাদের গ্যারেজটা দেবেন নাকি কাকিমা?’ তারপর তো ইশান গাড়ি কিনল। বহুদিন পরে কাল সকালে কল্যাণী হঠাৎ নতুন করে তাড়া দিল। বলল, ‘একবার নিতাইয়ের সঙ্গে কথা বল না। একতলায় তো খানিকটা জায়গা আছে। বাইরে থেকে একটা দরজা বসিয়ে ওকে যদি গোডাউনের জন্য ভাড়া দেওয়া যায়। দুটো পয়সা আসত।’ বিকেলে ওষুধ কিনতে গিয়ে নিতাইকে কথাটা হালকা করে পাড়তেই সে লাফিয়ে উঠল। রবিবার বাড়িতে ফাইনাল করতে আসবে। তখন বুঝতে পারেননি কল্যাণী কেন অত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আজ সব ঘটনা শোনার পর পারছেন। তারপর থেকেই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কাজল নিশ্চয় খবরটা পেয়েছিল। সে-ও তো ওই নিতাইয়ের দোকানে যাতায়াত করে। ওষুধ কেনে। তখন হয়তো নিতাই বলে দিয়েছে, ‘আপনাদের একতলায় গো ডাউন করব’…মুখ তুলে কারও দিকে তাকাতে পারছেন না পরিমলবাবু।

নিশা ঘুমন্ত মান্তুর চুলে হাত বোলাচ্ছে। সে চট করে কান্নাকাটির করার মেয়ে নয়। বিশেষ করে কারও সামনে সে কখনও কাঁদতে পারে না। তবু রেস্তোরাঁ থেকে স্বস্তিকের মোটরবাইকে বাড়ি ফেরার সময় তার চোখ জলে ভেসে গিয়েছিল। কল্যাণীদেবী মুখ থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে মেয়েকে বললেন, ‘চুপ করে বসে আছিস কেন? তোর দাদাকে একটা ফোন করে দ্যাখ না। এতক্ষণ লাগছে কেন?’

নিশা বলল, ‘দাঁড়াও, এক্ষুনি এসে পড়বে। মা, তুমি গিয়ে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে এসো তো। কেঁদেকেটে মুখটা তো হাঁড়ির মতো করে ফেলেছ। অ্যাই গোপালের মা আর-একবার যদি ফোঁপানির আওয়াজ শুনি তোমার কিন্তু বিপদ আছে।’

কল্যাণীদেবী জলের ঝাপটা দিতে উঠে বাথরুমে গেছেন। পরিমলবাবু মুখ তুলে ধরা গলায় বললেন, ‘একটা ফোন কর নিশা।’

নিশা বলল, ‘উফ, তোমরা এত বিরক্ত করো না। বলছি তো ওরা এখনই এসে যাবে।’

সত্যি ওরা এখনই এসে যাবে। ইশানের গাড়ি বাইপাস ধরে ছুটছে। হুইস্কি খেলেও তার গাড়ি চালানোয় কোনও টালমাটাল ভাব নেই। স্টিয়ারিং একটু এদিক-ওদিক করতে যে ইচ্ছে করছে না এমন নয়। কিন্তু উপায় নেই। কাজল বসে আছে পাশে। টালমাটাল ভাব দেখালে সমস্যা। মদ খাওয়া নিয়ে অশান্তি শুরু করবে। দেবায়ূধের ওখান থেকে নিজের বাড়ির পৌঁছোনোর মিনিট তিনেকের মধ্যে কাজল বাপের বাড়ি থেকে ফোন করেছিল—’আমাকে নিয়ে যাও। মান্তুর জন্য মন কেমন করছে।’ কাজল! চমকে উঠেছিল ইশান। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কাজল ধমক দেওয়া গলায় বলল, ‘কী হল কথা বলছ না কেন? বললাম না লেকটাউন থেকে আমাকে নিয়ে যাও।’

স্টিয়ারিং এক হাতে ধরে ইশান সিগারেট ধরাল। বলল, ‘মুখটা গোমড়া করে রেখেছ কেন? ভাগ্যিস রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলে।’

‘নইলে কী হত?’

ইশান হেসে বলল, ‘জানি না কী হত? জোর একটা ফাঁড়া কাটল। ইস, একবার কারও মনে হল না, কলকাতায় কাজল মিত্র নামে আরও একজন মহিলা থাকতে পারে, তার একটা ছোট মেয়ে থাকতে পারে, তার ব্যাগে ল্যাম্প শেড, পরদা, আর সোফা সেটের বিল থাকতে পারে। হয়তো সেই কাজল মিত্রও তোমার মতো একটা ড্রইংরুম বানাচ্ছিল…মাথায় আসেনি একবারও…আমরা সবাই তোমার কথাই ভেবে নিয়েছিলাম…একটা টেনশন হচ্ছিল তো…যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে।’

কথা শেষ করে বাঁ-হাতটা স্ত্রীর কাঁধে রাখল ইশান। কাজল জানলার বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো কিছুই জানতাম না। বাবা! এত কাণ্ড!’

বাইপাশ ছেড়ে বাড়ির রাস্তায় গাড়ি ঘোরাল ইশান। বলল, ‘ভালোই হয়েছে জানতে না। জানতে হবেও না।’

কাজল মুখ ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে পুতুলের মতো সুন্দর হেসে বলল, ‘না হবে। আমি ওই কাজল মিত্রর সঙ্গে দেখা করব। ড্রইংরুম ওকেও বানাতে হবে। হেরে গেলে চলবে না।’

অনেক রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে নিশা তার বউদিকে চুপিচুপি বলল, ‘ওই আকাশ ল্যাম্প শেডটা যেখান থেকে কিনেছ সেই দোকানের ঠিকানা আমায় দিতে হবে কিন্তু। স্বস্তিকের বাড়িতে গিয়েই আগে একটা আলাদা ড্রইংরুম তৈরি করব ঠিক করেছি।’

কাজল হেসে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *