(১৫)
‘আমার ভীষণ ভয় করছে আবীর!
সৌরীশের গলা কাঁপছিল, ‘প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমার ওপর কেউ নজর রাখছে। সবসময়ই মনে হয় কেউ আমার আশেপাশেই আছে, সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে। আমার রাতে ঘুম হয় না! বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করি, কিছুতেই ঘুমোতে পারি না!’
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল আবীরের বিরক্তিমাখা গলা, ‘তুই বোকার মতো ফোন করলি কেন? পুলিস আমাদের ফোন ট্যাপ করতে পারে।’
‘করুক।’ সৌরীশ বিরক্ত হলেন। এদিকে তার শিয়রে শমন ঘনিয়ে আসছে, ওদিকে আবীরের চিন্তা ফোন ট্যাপ হচ্ছে কি না! তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, ‘একে একে ওরা সবাই মারা গিয়েছে। বাকি আছি তুই, উমা আর আমি। এখন এত আগুপিছু চিন্তা করার সময় নয় আবীর।’
‘মৃত্যুগুলো কো-ইনসিডেন্সও হতে পারে!’
‘কো-ইনসিডেন্স! এতগুলো কো-ইনসিডেন্স!’ সৌরীশ উন্মত্ত রাগে ফেটে পড়েন, ‘এগুলো একটাও কো-ইনসিডেন্স নয়। সব মার্ডার-ড্যাম্ ইট! কেউ বদলা নিচ্ছে…! এবার হয়তো আমার পালা! আমি কী করব? …কী করব?’
‘পাগলামি করিস না সৌরীশ।’ আবীর ধমকে ওঠেন, ‘মাথা ঠান্ডা কর।
‘মাথা ঠান্ডা করার আর সময় নেই।’ উত্তেজনায় সৌরীশের কণ্ঠস্বর কাঁপছে, ‘আমি বরং পুলিসের কাছে সব স্বীকার করি। সব বলে দিই, যে সে রাতে আমরা কী করেছিলাম। তাতে হয়তো শাস্তি হবে, জেলও হবে, কিন্তু প্রাণে বাঁচব…! আমি বেঁচে থাকতে চাই আবীর… মরতে চাই না!’
‘সৌরীশ… চুপ কর!’
আবীরের ধমকেও কোনো কাজ হল না। সৌরীশ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘ওরা সবাই চলে গিয়েছে। এবার আমার পালা! আমি বাঁচতে চাই!… আমি বলে দেব… আমি পুলিসকে সব বলে দেব।’
‘পাগলের মতো কথা বলিস না! সেসব বহু বছর আগেকার ঘটনা…!’
‘যত বছর আগেরই হোক, খুনের কেসের কখনও তামাদি হয় না আবীর! ‘
ওপ্রান্তে আবীর চুপ করে গেলেন। ভয়ের স্রোত শিরশিরিয়ে তার পিঠ বেয়ে নেমে গেল। সৌরীশ কি পাগল হয়ে গিয়েছেন! এত বছর আগেকার ঘটনা যা এতদিন চাপ। পড়েছিল, আবার তাকে বের করে আনতে চাইছেন! তিনি আদৌ জানেন, সেসব কথা প্রকাশ্যে এলে ঠিক কী হবে!
‘তোর কথা শুনে চুপ করে থাকাটাই অন্যায় হয়েছে। তখনই যদি মুখ খুলতাম…!’
‘আর তোরা সব ধোয়া তুলসীপাতা তাই না?’ আবীর ফোঁস করে ওঠেন, ‘যা করার সব কি আমি একাই করেছি? তোরা কিছু করিসনি?’
‘করেছি। অন্যায় করেছি। তার শাস্তি পাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।’ একটু থেমে থেকে ফের যোগ করলেন সৌরীশ, ‘আমি পুলিসকে সব বলে দেব। যদি পুলিস আমায় অ্যারেস্ট করে তবুও প্রাণটা বাঁচবে। তোরা কী করবি ভেবে দ্যাখ।’
‘আর ইউ সিরিয়াস! অন্তত উমার কথা একবার ভাব! এই পরিস্থিতিতে ওর হাতে হাতকড়া পড়লে ওর পক্ষে সেটা মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক হবে।’
‘আই অ্যাম ড্যাম সিরিয়াস।’ তিনি জোরালো স্বরে উত্তর দেন, ‘উমা এমনিতেও মরবে, অমনিতেও মরবে। আর তাছাড়া তোর ওর প্রতি এত কনসার্ন কবে হল? তুই তো নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসিস না! স্বার্থপর!’
‘আমি স্বার্থপর!’ আবীর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘তাহলে তুই কী? বিপদের দিনে বন্ধুকে ছেড়ে একলা বাঁচবার কথাই শুধু চিন্তা করছিস! আর আমায় স্বার্থপর বলিস!’
এবার যেন একটু থমকে গেলেন সৌরীশ। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘তোর যা খুশি কর। আমি পুলিসের কাছে কনফেস করব।’
‘এই তোর ফাইনাল ডিসিশন?’
‘হ্যাঁ।’
আবীর ফোনটা কেটে দিলেন। স্তব্ধ মোবাইল ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন সৌরীশ। মাঝেমধ্যেই সারা দেহে একটা কাঁপুনি বোধ করছেন। কোন্ কুক্ষণে যে তিনি ফোবিয়ান্সের অন্যতম সদস্য হয়ে উঠেছিলেন! সেই অভিশপ্ত রাতটা যদি না আসত তাহলে আজ তাকে প্রতিমুহূর্তে ভয়ে ভয়ে মরতে হত না! সবসময়ই মনে হয় রাতের অন্ধকারে একজোড়া ক্রুর চোখ তাকে মেপে নিচ্ছে! সে যে কেউ হতে পারে। পেপারওয়ালা, দুধওয়ালা কিংবা কোনো প্রতিবেশীর ছদ্মবেশে তার চার পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কালান্তক মৃত্যু। হয়তো তিনি জানেনও না, কোথায় লুকিয়ে রয়েছে সেই কাল! হয়তো পরিচিত মুখের ভিড়ে, অথবা অপরিচিত মুখের পেছনে লুকিয়ে রেখেছে তার হিংস্র দাঁত, নখ। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করবে!
বিশ্বাস নেই… কাউকে বিশ্বাস নেই! এই মুহূর্তে সবাই তার কাছে বিপজ্জনক। বেশ কয়েকদিন হল ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করেছেন সৌরীশ। কাউকে ঘরে ঢুকতেও দিচ্ছেন না। কে বলতে পারে, কার মনে কী আছে! সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে আছে দুষ্কৃতী। একটু ফাঁক পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সৌরীশ অসহায় দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা একবার জরিপ করে নিলেন। এমনিতে এই ফ্ল্যাটটা তার বড় প্রিয়। চতুর্দিক খোলা থাকায় সবসময়ই রোদ হাওয়ার প্রাচুর্য। কিন্তু আজ মনে হল, ফ্ল্যাটটা যেন বড় বেশিই খোলামেলা! থার্ড ফ্লোরে ঠিকই, কিন্তু যে কেউ পাইপ বেয়ে গুঁড়ি মেরে উঠে আসতে পারে ওপরে! তারপর খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢোকাটা জলভাত।
কথাটা মনে হতেই সটান উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর দ্রুত হাতে বন্ধ করতে লাগলেন ফ্ল্যাটের সব জানালা! দরকার নেই তার রোদের, দরকার নেই হাওয়ার! কে বলতে পারে হয়তো এই খোলা জানালা দিয়েই শত্রু তার গতিবিধি লক্ষ্য করছে! কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। তা হোক্। অন্ধকারই ভালো! দিনের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। অন্ধকারের মধ্যে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। কেউ তার ওপর নজরও রাখতে পারবে না!
আপনমনেই হেসে উঠলেন সৌরীশ। এত সহজ নয় তাকে টেক্কা দেওয়া! তিনি আত্মরক্ষা করতে জানেন। প্রয়োজনে পুলিসের শরণাপন্ন হবেন, কিন্তু লড়াই ছাড়বেন না। আসুক খুনী। তিনিও দেখে নেবেন। আগের চারজনের মতো অত সহজ শিকার সৌরীশ নন। তিনিও যথেষ্টই বুদ্ধিমান। মরার আগে কিছুতেই মরবেন না!
আচমকা খুট করে একটা শব্দ হল না! সৌরীশ উৎকর্ণ হয়ে ওঠেন। শব্দটা কোথা থেকে আসছে! কেউ কি জানালাটা খোলার চেষ্টা করল! তার মনে হতে থাকে পাশের ঘর থেকে বুঝি ভেসে আসছে পায়ের শব্দ। কেউ অস্থির পায়ে পায়চারি করছে। কিন্তু কে? আস্তে আস্তে পাশের ঘরে গেলেন সৌরীশ। অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে তাকালেন ঘরের ভেতরের দিকে। কে হাঁটছে? কেমন যেন ধুপ ধুপ শব্দ! যেন কেউ একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে! যেন বলতে চাইছে, ‘দেখো, তোমরা বলেছিলে না কার্ণিশের ওপর দিয়ে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে! আজ আমি হাঁটছি!’
ঘরের ভেতরের জমাট অন্ধকারটাকে দেখে নিজেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন সৌরীশ। ঐ জমাট অন্ধকারের মধ্যে কেউ নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে! একটা অবয়বহীন, কায়াহীন ভয়! যার কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই, আকার নেই—তেমন একটা প্রচণ্ড আতঙ্ক লুকিয়ে আছে ওই ঘরে। চতুর্দিকের অন্ধকার গিলে খেতে আসছে তাকে। ঘরের প্রত্যেকটা শব্দ শুনতে পাচ্ছেন তিনি। তার হৃৎস্পন্দনের শব্দের তালে তালে ঘড়ি টিকটিক করছে, বাথরুমে জল পড়ছে টপ টপ! পাখাটা ঘটাং ঘটাং করে একটা যান্ত্রিক আওয়াজ করছে। যেন সবাই মিলে সোচ্চারে তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। বোধহয় বলতে চাইছে—’পালিয়ে যাও… পালিয়ে যাও এখান থেকে… পালিয়ে যাও…!’
আচমকা তার মনে পড়ে গেল সৌমিত্রর লাশটার ছবি! যন্ত্রণায় সৌমিত্রর ফরসা মুখটা নীল হয়ে গিয়েছিল! খোলা বিস্ফারিত চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। স্বাভাবিক! কিন্তু ওকে মর্গে কে ঢুকিয়ে দিল! কেউ জানল কী করে সে রহস্যের কথা! মৃন্ময়কে পাওয়া গেল এম.আর.আই মেশিনের ভেতরে! মৃন্ময় ছাত্র জীবনে ভিড় বাসে উঠতে পারতেন না! লিফট দেখলেই এড়িয়ে যেতেন! শর্বাণী বজ্র-বিদ্যুৎকে ভীষণ ভয় পেতেন! আর উৎপল কোনোরকম উচ্চতাই সহ্য করতে পারতেন না! অথচ ওরা সবাই একে একে ভয়ের সামনে দাঁড়াল! ওদের মৃত্যু হল প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে! যে ভয়ের একসময় অপর নাম ছিল ফোবিয়ান্স! একতরফা ওরাই জীবনে সবাইকে ভয় দেখিয়ে এসেছেন। কিন্তু কেউ ওদের এভাবে ভয় দেখাবে তা ভাবেননি। অতীত থেকে তবে কে উঠে এল ওদের ভয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাবার জন্য! কে!
সৌরীশ মাথার ভেতরে আঙুল বোলালেন। তালুটা প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে! মাথার ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে! দু-পাশের শিরা দপদপিয়ে উঠছে। তাকে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ লাগছিল। মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা ভীরু মুখ। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল সে, ‘আমি পারব না দাদা। তোমরা আমায় ছেড়ে দাও।’
‘পারবি না মানে?’ আবীর সরোষে এগিয়ে গিয়েছিলেন, ‘আমায় না বলার সাহস এখানে কারোর নেই। চল, ওঠ।’
ভীত, সন্ত্রস্ত, অসহায় মুখটা ওদের প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু সহৃদয়তা, একটু সহানুভূতি খুঁজছিল, ‘আমার ভয় করছে…!’
আবীর হা হা করে হেসে ওঠেন, ‘ভয় পাওয়া তো ভালো! তবে তোর ভয়ের ওষুধও আছে আমার কাছে।’
বলতে বলতেই তিনি বের করে এনেছিলেন সন্দেহজনক চেহারার একটা বোতল। তার ভেতরের তরলটা আর যাই হোক, খুব নিরীহ কিছু যে নয় তা বুঝতে বাকি থাকে না। অসহায় মানুষটা প্রাণপণে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু আবীরকে আটকানো যায়নি। তিনি জোর করে ওর মুখে ঢেলে দিয়েছিলেন সেই তরল। ছেলেটা সহ্য করতে না পেরে বমি করে ফেলেছিল। ও খুব কষ্ট পাচ্ছিল। গোটা দেহটা কুঁকড়ে আসছিল। কোনোমতে বলল, ‘আমি পারব না। ‘
‘পারব না বললেই হল! চল, জামাকাপড় খুলে কার্নিশে উঠে দাঁড়া! তারপর জব্বর একটা আইটেম ডান্স কর।’
অন্যদিকে আরেকটি ছেলে প্রায় উলঙ্গ হয়েই দাঁড়িয়েছিল। শীতে হি হি করে কাঁপছিল বেচারা। কোনোমতে বলল, ‘আর পারছি না দাদা!’
‘ঐ উত্তমকুমার! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক!’ আবীর বলেছিলেন, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে ছাদ থেকে ফেলে দেব!’
ছেলেটা ভয়ে চুপ করে যায়। আবীরের নিষ্ঠুর মুখটা নিষ্ঠুরতর হয়ে ওঠে। সে আগের ছেলেটাকে নিয়ে পড়ে, ‘কী হল! জামা-প্যান্ট খোল!’
‘না!’
একেবারে সরাসরি প্রতিবাদ! ছেলেটার পেটে এক লাথি কষিয়ে দেয় আবীর, ‘শুয়োরের বাচ্চা! পারবি না, তাই না! মৃন্ময়, উৎপল, সৌমিত্র—এটার জামাকাপড় খোল তো! বেশি নখরা করছে…
ছেলেটা আপ্রাণ লড়েছিল। তরলের প্রভাবে ওর মাথা তখন ঘুরছে। মৃন্ময় আর সৌমিত্রর সঙ্গে পেরে ওঠা তখন সম্ভব ছিল না। কয়েক মিনিটের মধ্যে নির্লজ্জ মানুষগুলো তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে ফেলল। ছেলেটা লজ্জায় কোথায় লুকোবে ভেবে পাচ্ছে না! একেই প্রচণ্ড শীত, তার ওপর সামনে একদল নিষ্ঠুর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে—তাদের চোখ থেকে নিজেকে আড়াল করার উপায় নেই! কোনোমতে দয়া ভিক্ষা করার জন্য সে দু-হাত জোড় করল! বৃথাই সে অনুনয়!…
আজ বহু বছর পর সেই মুহূর্তটাকে মনে করেই কেঁপে উঠলেন সৌরীশ! তখন তিনিও ছিলেন ভিড়ের মধ্যে! উৎপল, মৃন্ময় এবং সৌমিত্রর সঙ্গে তিনিও তো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলেন ছেলেটার নাজেহাল অবস্থা। আসলে সবসময়ই নিজেকে শক্তিশালী ভাবতে ভালো লাগে। আর দুর্বলের ওপর অত্যাচার করাটা মানুষের প্রিয় হবি। তারাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না!
আবার সেই ধুপ ধুপ্ শব্দটা কানে এল। তার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কেউ কি আজও কার্নিশের ওপর দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে! কে!
সৌরীশের চোখ বেয়ে টপ টপ্ করে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ছিল। তিনিও অবিকল সেই তরুণের মতো হাত জোড় করেছেন, ‘ক্ষমা করে দাও… মাফ করে দাও আমায়….বুঝতে পারিনি কী ভুল করেছি!… ক্ষমা করে দাও…!’
বলতে বলতেই ভয়ে, অনুতাপে উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আজ ঘটনার মোড় সম্পূর্ণ উলটোদিকে ঘুরে গিয়েছে। এই মুহূর্তে শিকারের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছেন ওরা সবাই। আর শিকারীর ভূমিকায় হয়তো বা স্বয়ং ভয়! আজ ভয় কাকে বলে তা বুঝতে পেরেছেন সৌরীশ! কে জানত এত বছর পর অতীত আবার ফিরে আসবে! সব চুকেবুকেই তো গিয়েছিল!…
হঠাৎই সমস্ত নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে কলিংবেল বেজে উঠল! সৌরীশ চমকে উঠলেন! এখন কে এল! এখন তো কারোর আসার কথা নয়। তবে…?
তিনি সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে উঠে গেলেন। পা টিপে টিপে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এখন তেমন গরম নেই, তা সত্ত্বেও দরদরিয়ে ঘামছেন। কোনোমতে আই হোলে চোখ ঠেকিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বাইরের দিকে তাকাতেই প্রচণ্ড বিস্ময় ধাক্কা মারল তাকে! বাইরে তো কেউ নেই! সব ভোঁ ভাঁ! কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই! তবে বেল কে বাজাল!
ভীষণ ভয়ে দ্বিগুণ বেগে ঘামতে শুরু করেছেন সৌরীশ। তার হাতের তালু পর্যন্ত ভিজে গিয়েছে। একটা ঢোঁক গিলে দরজাটা সামান্য খুললেন। কোনো বাচ্চা ছেলে দুষ্টুমি করছে? কিন্তু এই ফ্লোরে তো কোনো বাচ্চা ছেলে নেই! তবে এ কার অসভ্যতা!
দরজা খুলেও আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি। সতর্ক দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা জরিপ করতে করতেই হঠাৎ চোখ পড়ল পাপোষের ওপর। সেখানে কিছু একটা পড়ে আছে। একটা অদ্ভুত বাক্স! যথেষ্ট সন্দেহজনক! এটা রেখে গেল কে! কেউ তো আশেপাশে নেই। নাকি এখানে বাক্সটা ফেলে রেখে মজা দেখছে? কিন্তু বাক্সের মধ্যে কী আছে? কোনোরকম গিফট না প্র্যাঙ্ক!
দোনামনা করতে করতেই বাক্সটা তুলে নিলেন সৌরীশ। সাধারণ একটা বাক্স। তেমন কোনো কারিকুরি নেই! কেউ তাকে বোকা বানানোর জন্য খালি বক্স ফেলে যায়নি তো? নাঃ, ভেতরে কিছু একটা আছে। তিনি আস্তে আস্তে বাক্সটা খুলে ফেলেন। কিন্তু ভেতরের জিনিসটা চোখে পড়তেই আর্ত চিৎকার করে উঠে ছুঁড়ে ফেললেন বাক্সটা! যেন ওর ভেতরে একটা বিষাক্ত সাপ শুয়ে আছে! অথবা আরও মারাত্মক কোনো প্ৰাণী! …
বাক্সের ভেতরে শুয়ে আছে একটা পুতুল! কিন্তু পুতুলটার চোখ দুটো কেউ উপড়ে নিয়েছে! আর তার ঠোঁটের ওপর বড় বড় সেলাই! কেউ ওর মুখ সেলাই করে দিয়েছে!
(১৬)
আকাশের মাকে দেখে রীতিমতো ভয়ই করছিল অর্ণবের!
ভদ্রমহিলাকে দেখলেই কেমন যেন গা শিরশির করে ওঠে। মনে হয়, তিনি এ পৃথিবীর বাসিন্দা নন। বরং জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে যে নো ম্যানস ল্যান্ডটা আছে, তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। চেহারায় বেশ পৃথুলা, মাথার চুলগুলো সব ধবধবে সাদা, মুখে কোনো এক্সপ্রেশনই নেই! অদ্ভুত এক নির্লিপ্তি মুখে মেখেছেন তিনি। দেখলে মনে হয়, মুখ নয়, আসলে ওটা তাঁর মুখোশ! কোটরাগত চোখে এক অদ্ভুত জ্বালা! নির্লিপ্তির আড়ালে বুঝি ধকধক্ করে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন! অধিরাজ তাদের আসার কারণ বলতেই একটা ব্যঙ্গরসাত্মক হাসি ছুঁয়ে গেল তাঁর অধরপ্রান্ত। মৃদু হেসে বললেন, ‘কী জানতে চান অফিসার? আমরা ওদের খুন করেছি কি না?
প্রথমেই বাউন্সার। অধিরাজ গভীর দৃষ্টিতে তাঁকে দেখছে। এক ঢাল চুল হাওয়ায় ইতস্ততঃ উড়ছে। কপালে একটা বিরাট সিঁদুরের টিপ। চোখের নীচে কালি জমলেও চোখদুটো বড় বেশিই উজ্জ্বল। দু-চোখে প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ!
‘আপনাদের ছেলে আকাশ…!’
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই অধিরাজকে থামিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা। বিরক্তিতিক্ত গলায় বললেন, ‘আকাশ অনেকদিন হল আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাকে নিয়ে আর টানাটানি না-ই বা করলেন!’
বাধা পেয়ে একটু চুপ করে গেল অধিরাজ। তারপর একটু ইতস্ততঃ করে বলল, ‘সৌমিত্র চৌধুরী, মৃন্ময় দত্তরায়, উৎপল মিত্র এবং শর্বাণী ঘোষকে চিনতেন আপনি?’
‘না অফিসার।’ আকাশের বাবা অমর এবার বলে ওঠেন, ‘আমরা ওদের চিনি না…!’
তিনি আরও কিছু বলার আগেই সরীসৃপের মতো হিসহিসিয়ে ওঠেন মায়া, ‘আপনি জানতে চাইছেন যে আমার ছেলের খুনীদের আমি চিনি কি না! চমৎকার!
এতখানি স্পষ্ট উত্তর আশা করেনি অধিরাজ। সে একটু অস্বস্তিতে পড়ে। ভদ্রমহিলার মধ্যে কী যেন আছে যা ভয়ের সৃষ্টি করে! এমনকি অমরও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছেন! কেউ আর কিছু বলার আগেই মায়া ফের বলে ওঠেন, ‘আমি হাড়ে হাড়ে চিনি ওদের! আমার মতো ভালো ওদের আর কেউ চেনে না, বিলিভ মি অফিসার!
‘আপনি ফোবিয়ান্সকে আপনার ছেলের মৃত্যুর জন্য কেন দায়ী করেছিলেন?
‘কারণ ওরাই মেরেছিল ওকে।’ এবার যেন বিস্ফোরণ হল, ‘আপনি আবীরকে চেনেন? এক নম্বরের শয়তান ছেলে! ওর ভয়ে পুরো হস্টেল কাঁপত! আমার ছেলেটা বড্ড নরম সরম ছিল। ভীষণ লাজুক, সেন্টিমেন্টাল! কথায় কথায় অভিমান করত। অত্যন্ত ভদ্র, নম্র ছেলে! আমি ওকে কখনও জোরে কথা বলতে শেখাইনি। কারোর গায়ে হাত তুলতে শেখাইনি। ভুল করেছি!’ মায়ার কণ্ঠস্বরে জ্বালা, ‘আকাশকে আমার গ্যাংস্টারদের মতো করে বড়ো করে তোলা উচিত ছিল। তাহলে ও এইসব অত্যাচারের জবাব দিতে পারত। ওর জানা উচিত ছিল যে কেউ এক গালে চড় মারলে আরেক গাল এগিয়ে দিতে নেই, বরং পালটা দুটো চড় মারতে হয়! মারামারি করতে জানত না আমার ছেলেটা! সেই জন্যই ওকে মরে যেতে হল…
উচ্ছ্বসিত কান্নায় গলা বুজে এল মায়ার। বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। অধিরাজ, অর্ণব ও আত্রেয়ী লজ্জিত মুখে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এক সন্তানহারা মায়ের যন্ত্রণা তাদের সামনে প্রকট হয়ে উঠল! অধিরাজ চুপ করে থেকে মায়াকে নিজেকে সামলানোর প্রয়োজনীয় সময়টুকু দিল। তার এই মুহূর্তে নিজেকে বড়ো নিষ্ঠুর বলে মনে হচ্ছিল। এই যন্ত্রণাকাতর মাকে আর কোনো প্রশ্ন করা, টর্চার করারই সামিল। তবু একরকম বাধ্য হয়েই প্রশ্ন করল সে, ‘কিন্তু আকাশের মৃত্যু তো কার্ডিয়াক ফেইলিওরের ফলে হয়েছিল। সম্ভবত ওর হার্ট দুর্বলও ছিল। তাহলে এটাকে খুন মনে হল কেন আপনার?’
এবার অদ্ভুত রহস্যময় হাসি হাসলেন মায়া। অর্ণবের গা শিরশির করে ওঠে! ভদ্রমহিলার হাসির মধ্যে কী যেন আছে! এক অদ্ভুত রহস্য যা কিছুতেই বুঝে ওঠা যায় না! ফিসফিস করে বললেন তিনি, ‘ওদের মৃত্যুও তো কার্ডিয়াক ফেইলিওরে হয়েছে! দু-জন কার্ডিয়াক ফেইলিওরে মরেছে, একজন সুইসাইড করেছে, আরেকজন অ্যাক্সিডেন্টে মরল! তা সত্ত্বেও এগুলো খুনই—তাই নয়? যা হয়, তা সবসময় দেখা যায় না। আর যা দেখা যায়, তা সবসময় হয় না!’
অধিরাজ আর অর্ণব পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে। মায়ার কথাগুলো রীতিমতো হেঁয়ালি বলে মনে হচ্ছে তাদের। আত্রেয়ী এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরটাকে জরিপ করছিল। আচমকা তার চোখ গেল কতগুলো পুতুলের দিকে। ছোটো ছোটো হাতে গড়া নাক, মুখ, চোখবিহীন মোমের পুতুল। কেউ খুব অযত্নেই বানিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, পুতুলগুলোর গায়ে অসংখ্য পিন ফোটানো! কোনোটার বুকে পিন ফুটে রয়েছে, কোনোটার বা সারা গায়ে! কোনোটার মাথা ভাঙা, আবার কোনোটার হাত পা নেই! এমন পুতুল কেউ ঘরে রাখে! আশ্চর্য!
আত্রেয়ী অর্ণবের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। অর্ণবের দৃশ্যটা দেখেই কেমন যেন ভয় লাগছিল! সচরাচর পুতুল ভারী সুন্দর জিনিস। শৈশবের খেলার সঙ্গী, ঘর সাজিয়ে রাখার আসবাব! পুতুল মানেই একটা অদ্ভুত নিষ্পাপ বস্তু। অথচ এই পুতুলগুলোকে দেখে তার ভয় লাগছে! কী বীভৎস পুতুল! সে ইঙ্গিতে অধিরাজকে দৃশ্যটা দেখাতেই সে নীচু স্বরে বলল, ‘দেখেছি।’
‘ওদের যা মনে হয়, ওরা আদৌ তা নয়।’ মায়া চাপা স্বরেই বললেন, ‘আমার ছেলেটার ওপর ভীষণ অত্যাচার করত ওরা! মৃন্ময় আর উৎপল ওকে এমন মার মেরেছিল যে ঠোঁট, মুখ ফেটে গিয়েছিল। এমনকি গায়ে গরম তেলও ঢেলে দিয়েছিল ওরা! ঠিকমতো খেতে দিত না ওকে! ওর খাবারের থালা টেনে নিয়ে নিজেরাই খেয়ে নিত। কখনও আবার ওর থালায় নিজেদের উচ্ছিষ্ট খাবার, মাটি ফেলত। ছেলেটা দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছে। এমনকি ঘুমিয়ে পড়লে গায়ে জ্যান্ত আরশোলা, মাকড়সা, টিকটিকিও ছেড়ে দিত। আমার ছেলেটাও বড্ড বোকা ছিল। প্রতিবাদ করতে জানত না! পড়ে পড়ে শুধু মারই খেয়ে গিয়েছে!’
অমর চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বুঝেছেন যে মায়াকে আজ থামানো যাবে না। মায়া প্রায় গর্জনই করে উঠলেন, ‘বেশ হয়েছে ওরাও একে একে মরছে! আমার ছেলেটার আত্মা শান্তি পায়নি এতদিন। এবার পাবে। যে ক-টা বাকি আছে, সেগুলোও মরবে। মরুক! মৃত্যুই ওদের উচিত শাস্তি!’
‘এই শাস্তির পেছনে কোনোভাবে আপনাদের হাত নেই তো?’
প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেলেন মায়া। তাঁর মুখে আবার সেই ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসিটা ফিরে এল, ‘বেশ! আপনি জানতে চান তো বলেই ফেলি। আমিই ওদের মেরেছি—কিন্তু প্রমাণ করুন।’
উপস্থিত তিন অফিসারের মাথায় যেন বজ্রপাত হল! কী বললেন ভদ্রমহিলা! উনিই ওদের খুন করেছেন!
‘হ্যাঁ, আমিই ওদের একে একে খুন করেছি। ক্ষমতা থাকলে প্রমাণ করুন!’ মায়া গর্জন করে ওঠেন, ‘পারবেন? আমিও পারিনি! বারবার চিৎকার করে বলেছি ওরা আমার ছেলেটাকে মেরেছে! তখনও আপনারা অন্ধ হয়ে বসেছিলেন! আপনাদের হাতে কোনো প্রমাণ ছিল না। এবার আমার পালা।’
‘কী সব বলছ মায়া! চুপ করো!’ অমর প্রায় মরিয়া হয়ে বলে ওঠেন, ‘অফিসার, ও যা বলছে সবটাই উত্তেজনা আর রাগের মাথায়…!’
‘আমি একদম ঠান্ডা মাথায় বলছি অফিসার।’ মায়ার কণ্ঠস্বরে চ্যালেঞ্জ,’বাকিগুলোকেও মারব। আজই আরেকটা মরবে। পারলে বাঁচান!’
‘চুপ করো! চুপ!’
অমর এবার নিরূপায় হয়ে গর্জন করে উঠলেন। উত্তেজিত গলায় ডাকলেন, ‘পাঞ্চী… পাঞ্চী…!’
ভেতর থেকে এবার একটি বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের মেয়ে বেরিয়ে এল। কোনোরকম বিশেষত্বহীন সাদামাটা চেহারা তার। পরনে একটা লাল রঙের সালোয়ার। স্কুল গার্লদের মতো মাথার দু-দিকে বিনুনি করা। সে অবাক দৃষ্টিতে অমরের দিকে তাকায়।
‘তোর মাসিমণিকে এখান থেকে নিয়ে যা!’
কথাটা শুনেই ফুঁসে উঠলেন মায়া, ‘আমি কোত্থাও যাব না! বেশ করেছি ওদের খুন করেছি। বললাম তো, প্রমাণ করুন!…প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বদলা নিয়েই ছাড়ব… আমিই ওদের খুন করেছি… আমিই খুন করেছি…!’
পাঞ্চী নামক মেয়েটি খানিকক্ষণ বিহ্বলভাবে তাকিয়ে থাকল। যেন কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে মায়ার হাত ধরতে গেল। মায়া তখন রাগে, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলেন। এক জোরালো ধাক্কায় সরিয়ে দিলেন তাকে। ধাক্কাটা বেকায়দায় লাগল। পাঞ্চী সামলাতে না পেরে দেয়ালের ওপর আছড়ে পড়ে! অধিরাজ, অর্ণব ও আত্রেয়ী সবিস্ময়ে দেখল, দেওয়ালে ঠাস্ করে সজোরে মাথা ঠুকে গেল তার। নির্ঘাৎ লেগেছে! অথচ আশ্চর্য! চুঁ শব্দটিও করল না মেয়েটা! সামান্যতম কাতরোক্তিও নেই!
আত্রেয়ী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে পাঞ্চীকে ধরে ফেলে। নম্র স্বরে বলে, ‘বেশি লাগেনি তো আপনার?’
উত্তরে পাঞ্চী ব্যথিত, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। কিছুই বলল না সে। আত্রেয়ী একটু অপ্রতিভ বোধ করে। অমর সম্ভবত সেটা লক্ষ্য করেই শান্ত স্বরে বললেন, কথা বলতে পারে না। কানে শুনতে পায় ঠিকই, কিন্তু কথা বলার শক্তি ঈশ্বর ওকে দেননি! ওর নাম পাঞ্চালী। আকাশের মাসতুতো বোন। ছোটবেলা থেকেই অনাথ। তাই আমাদের সঙ্গেই থাকে। মায়াই ওকে মানুষ করেছে।’
অধিরাজ একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পাঞ্চীর দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে, ‘আই সি!’
সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে হাঁফ ছাড়ল অর্ণব। কিছু কিছু পরিবেশ থাকে যা বুকের ওপর একরকম চাপ তৈরি করে। তেমনই একটা দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বেরোতে পেরে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অধিরাজের মুখ গম্ভীর। তার মনের মধ্যে কী চলছে তা বোঝা দায়। চোখদুটো অন্যমনস্ক। আপনমনেই কিছু একটা ভাবছিল সে। অর্ণবের প্রশ্নে তার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল, ‘কী মনে হয় স্যার? ভদ্রমহিলা যা বলছেন তা সত্যি?’
‘কোন্টা?‘
‘উনিই কি ওদের খুন করেছেন?’
‘অসম্ভব নয়।’ অধিরাজ অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দেয়, ‘খুনগুলো করা তেমন কঠিন কিছু নয় অর্ণব। যে কেউ করতে পারে। এমনকি আকাশের বাবাও করতে পারেন।
‘কিন্তু উনি তো ও চ্যালেঞ্জ দিলেন।’ আত্রেয়ী বলল, ‘একরকম তো স্বীকারই করে নিলেন যে খুনগুলো উনিই করেছেন।’
‘এমনও হতে পারে যে ভদ্রমহিলা কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।’ অধিরাজ আস্তে আস্তে বলে, ‘হয়তো জানেন যে খুনের পেছনে ঠিক কোন্ মস্তিস্কটি আছে। তাই তাকে আড়াল করার জন্য নিজেই এগিয়ে এলেন। ‘
আত্রেয়ীর দু-চোখে প্রশ্ন, ‘অমরবাবু?’
‘এখনই কিছু বলা মুশকিল মিস্…!’
যথারীতি ‘মিস্’ অবধি এসেই অধিরাজ হোঁচট খেয়েছে। পাশ থেকে অর্ণব বাধ্য ছেলের মতো যোগ করে, ‘মিস্ দত্ত’।
‘ইয়েস ইয়েস! মিস্ আত্রেয়ী দত্ত।’ অধিরাজ অপ্রস্তুত হেসে বলল, ‘আপনার নতুন ফ্ল্যাট কেমন লাগছে?’
সম্প্রতি আত্রেয়ী দত্ত নতুন ফ্ল্যাট নিয়েছে। এই ফ্ল্যাটটা তার পক্ষে অত্যন্ত সুবিধাজনক হয়েছে। অফিস থেকে বিশেষ দূরত্বে নয়। বেশ খোলামেলা। সর্বোপরি তার প্রতিবেশিনী আর কেউ নয়, স্বয়ং মিস্ আহেলি মুখার্জি। আহেলি, পবিত্র, অর্ণবরা আত্রেয়ীকে তার ফ্ল্যাট গোছাতে সাহায্য করেছে। এমনিতে একার সংসার। খুব বেশি দায়দায়িত্ব নেই। গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে ওদের সবাইকে রান্না করেও খাইয়েছে আত্রেয়ী। অধিরাজ সেদিন ব্যস্ত ছিল বলে ওর ফ্ল্যাটে যেতে পারেনি। একটু ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতেই সে বলে, ‘আমার আপনার নতুন ফ্ল্যাট দেখা হল না। আসলে এমন আটকে গেলাম…!’
আত্রেয়ী তার হাসি হাসি দুটো চোখ অধিরাজের ওপর ন্যস্ত করে, ‘আমরা আপনাকে খুব মিস করছিলাম স্যার।’
‘আর অর্ণব নিশ্চয়ই চাউমিন মিস করেছে।’
অর্ণব কথাটা শুনে হেসে ফেলে। তার আর আত্রেয়ীর মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হল। অর্ণব কাকে বা কী মিস করেছে তা জানা নেই, কিন্তু ওরা দু-জনেই জানে যে অধিরাজকে ঠিক কতটা মিস করেছে আহেলি। সেদিন সে বিশেষ করেই সেজে গুজে এসেছিল। আর কেউ বোঝেনি, কেন এই সাজগোজ। কিন্তু আত্রেয়ী আর অর্ণবকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। তারা ঠিক লক্ষ্য করেছে যে বারবার আহেলির চোখ চলে যাচ্ছিল দরজার দিকে। অধীর প্রতীক্ষায় ছিল সে। যখন অধিরাজ অর্ণবকে জানাল যে সে আসতে
পারবে না, তখন আহেলির মুখের হতাশামাখা বিষণ্ণতা ওদের নজর এড়ায়নি। ‘মিস্ মুখার্জি সেদিন আমাদের গান শুনিয়েছিলেন স্যার। আপনি মিস্ করলেন। ‘ আত্রেয়ীর কথাটা শুনে তার দিকে সকৌতুকে তাকায় অধিরাজ, ‘মিস্ মুখার্জি গান গেয়েছেন সে তো খুবই ভালো কথা। কিন্তু উনি থেমেছিলেন তো?’
আত্রেয়ী অধিরাজের কথা শুনে হাঁ, ‘সে কী! থামবেন না কেন?’
‘একবার কথা বলতে শুরু করলে তো থামেন না!’ অধিরাজ মৃদু হেসে বলল, জেনে ভালো লাগল যে গান গাইতে শুরু করলে থামেন!’
কথাটা শুনে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না আত্রেয়ী। মাঝেমধ্যে স্যারকে তার বড় নিষ্ঠুর মনে হয়। অমন দুটো চোখে মিনতিভরা আকুতি, অমন আকুল প্রতীক্ষা, অমন শান্ত, নীরব অথচ সপ্রেম চাউনি কি পড়ে উঠতে পারেন না তিনি! যখন অধিরাজের মুখে ‘মিস্ মুখার্জি’র নাম উঠে আসে তখন লজ্জারুণ হয়ে ওঠে সে! তাও কি দেখতে পান না! এত বড়ো বড়ো রহস্যভেদ করতে পারেন, অথচ এক নারীমনের গোপনে কী রহস্য জমাট বেঁধেছে, তা বুঝতে পারেন না! বুঝতে পারেন না না বোঝার চেষ্টা করেন না!
‘এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা স্যার?’
আত্রেয়ী প্রসঙ্গ পালটায়। অধিরাজ ড্রাইভ করতে করতেই বলল, ‘সুজিতের বাড়ি। তবে তার আগে একবার পবিত্রদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। কল ডিটেইল রেকর্ডে কিছু পেল কি না জানা দরকার।’
‘ওকে স্যার।’
অর্ণব পবিত্রকে মোবাইলে ধরে কলটা লাউড স্পিকারে দিল। সি.ডি.আরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে জানায়, ‘কিস্যু নেই! সবার রেকর্ডই ক্লিন! কোনোরকম সন্দেহজনক নাম্বার বা কল, কিছুই নেই। এতক্ষণ ধরে ফালতু খেটে মরলাম।’
‘খবরিদের কাছ থেকে কোনোরকম খবর?’
‘কয়েকটা খবর পেয়েছি। কিন্তু কতটা কাজের তা জানি না।’ পবিত্র বলল, ‘সৌমিত্র চৌধুরী মোটেই সুবিধের লোক ছিলেন না। তাঁর অগণিত অ্যাফেয়ার ছিল। ওঁর ওয়াইফ প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি একবার নাকি স্বামীকে খুন করার প্ল্যানও করেছিলেন। সুপারি কিলারের খোঁজও করেছিলেন। কিন্তু লাস্ট মোমেন্টে পিছিয়ে আসেন। আর মৃন্ময়কে যতটা ভালো লোক মনে হচ্ছে, লোকটা ঠিক ততটাই গোলমেলে। অত্যন্ত বদমেজাজি এবং বাতিকগ্রস্ত। স্ত্রীকে কথায় কথায় সন্দেহ করতেন। সন্দেহ এতটাই বেশি ছিল যে স্ত্রীয়ের পেছনে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরও লাগিয়েছিলেন। কিন্তু স্ত্রীয়ের কোনো অ্যাফেয়ারের অ্যাঙ্গেল পাওয়া যায়নি।’
‘উৎপল মিত্র?’
‘তিনি আবার আরেক অবতার! মিটমিটে ডান। বাইরে থেকে অত্যন্ত ভালোমানুষ। কিন্তু সবাই বলে বাড়ির লোকদের অতিষ্ঠ করে মারতেন। ওঁর স্ত্রী একসময়ে খুব ভালো চাকরি করতেন। কিন্তু গুণধর বাড়িতে এমন অশান্তি করলেন যে স্ত্রীকে চাকরিটা ছাড়তে হল। বুড়ো বাবার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল না। যে ফ্ল্যাটটায় থাকতেন, সেটা বাবার। ফ্ল্যাটটা তাঁর নামে লিখে দেওয়ার জন্য বাবার ওপরে চাপ দিচ্ছিলেন উৎপল। এতটাই প্রেশার ক্রিয়েট করেছিলেন যে বাবা ডিপ্রেশনের রোগী হয়ে যান। একবার তো বাবাকে ফ্ল্যাট থেকে বেরও করে দিয়েছিলেন! বুড়ো মানুষটা তিনদিন সোসাইটির সামনের রাস্তায় কাটিয়ে শেষপর্যন্ত পুলিসের দ্বারস্থ হন!’ পবিত্ৰ একটু থেমে যোগ করে, ‘ওঁর স্ত্রী আরও একটা বিষয় চেপে গিয়েছেন। মিসেস মিত্রর মারাত্মক ডিপ্রেশন আছে। উনি আন্ডার ট্রিটমেন্ট আছেন।’
‘কেয়া বাত!’ অধিরাজ স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘আমরা খুনীকে খামোখাই খুঁজছি। তার নাম শান্তি নোবেলের জন্য নমিনেট করে ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
‘প্রায় তাই।’ পবিত্র জানায়, ‘এদের মধ্যে সৌরীশ তুলনামূলক একটু পদের। বাকিদের মতো ডেঞ্জারাস নয়। শর্বাণীও ঠিকঠাক ছিলেন। উমা সেন সম্পর্কেও খারা প কিছু শুনিনি। তবে ওঁকে খুন করার মতো বোকামি খুনী করবে বলে মনে হয় না। কারণ বড়োজোর টেনেটুনে আর একমাস বাঁচবেন। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে বাড়িতে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মনের জোর খুব। ওঁর দাদুর হোটেলের ব্যবসাটা একার কাঁধেই টেনে নিয়ে গিয়েছেন। ভদ্রমহিলার বুদ্ধিতে বর্তমানে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে।’
‘আর আবীর সেন?
‘ইনি একেবারে বাঁধানো ক্যারেক্টার রাজা! ওঁর সম্পর্কে যতই বলি, কম হবে। অত্যন্ত ক্রুয়েল টাইপের লোক। মদ, মাংস আর মহিলা নিয়েই থাকেন। সবাই বলে, টাকার লোভেই উমাকে বিয়ে করেছিলেন। আসল ইন্টারেস্ট অন্য মহিলায়। পাবলিক তো এ-ও বলে যে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে উমার পা দুটো কাটা পড়ে, সেই অ্যাক্সিডেন্টটা আবীর ইচ্ছাকৃতভাবেই ঘটিয়েছিলেন। মারার ইচ্ছা ছিল স্ত্রীকে, কিন্তু মারা গেল সন্তান! পঙ্গু স্ত্রীয়ের ওপর কোনো মায়াও নেই। উমা অ্যাটেনডেন্টের ওপর নির্ভরশীল। আপাতত অপেক্ষায় আছেন স্ত্রী কবে মারা যাবেন। জাস্ট জানোয়ার একটা!’
‘আন্ডারস্টুড!’
অধিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘রাতের জন্য রেডি থাকো পবিত্র। আমরা আজ সৌরীশ আর আবীর সেনের বাড়ির সামনে ওঁত পাতব।’
‘আজই রাজা?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে।’
ফোনটা কেটে গেল। অর্ণব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় অধিরাজের দিকে, ‘আজই হামলা হবে স্যার?’
‘শুনলে না আকাশের মা কী বললেন? আজই একটা মরবে! এত বড় কথাটা আনতাবড়ি বলেছেন বলে তো মনে হয় না। বলা যায় না, তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যিও হয়ে যেতে পারে। চান্স নেওয়া যাবে না।’ অধিরাজ ড্রাইভ করতে করতেই বিড়বিড় করল, ‘কোনোমতেই চান্স নেওয়া যাবে না।’
সুজিতের বাবা, মা-কে দেখলে সত্যিই দুঃখ হয়! যার অতবড় একটা জোয়ান ছেলে মারা যায়, সে বাবা মায়ের পক্ষে জীবনধারণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। দেওয়ালে টাঙানো সুজিতের ছবির দিকে তাকায় অর্ণব। ভারী ঝলমলে হাস্যমুখ এক তরুণ। চোখে মুখে সপ্রতিভতার ছাপ।
‘দেখুন, এতদিন বাদে আর এ বিষয়ে কিছু বলার নেই।’ সুজিতের বাবা সুদীপ জানালেন, ‘সুজিত বহুদিন হল চলে গিয়েছে। আমরা এখন আর অতীতের কথা আলোচনা করতে ইন্টারেস্টেড নই।’
সুজিতের মায়ের দিকে তাকাল অধিরাজ। তিনি একরকম গুম মেরেই বসে আছেন। মুখে সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না—কোনো কিছুরই ছাপ নেই!
‘আপনারা কি চান না খুনী ধরা পড়ুক?’
‘টু বি ভেরি অনেস্ট…।’ সুদীপের চোখ যেন জ্বলে উঠল, ‘আমি সত্যিই চাই না! সুজিতের মৃত্যুটা আত্মহত্যা হলেও আসলে ওটা খুনই ছিল। ছেলেটার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল। শারীরিকভাবে একবারই ওর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমি জানি, তার আগে প্রতিদিন ও তিলে তিলে মরছিল!’
অধিরাজের দৃষ্টি আরেকবার সুজিতের মাকে ছুঁয়ে গেল। তিনি একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখ সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। জাগতিক কোনো কিছুতেই যেন তাঁর কোনো আগ্রহ নেই! বেদনা বিধুর চোখ দুটো ইতস্ততঃ কী যেন খুঁজে চলেছে।
‘আমার মিসেসের অবস্থা তো দেখছেনই! বহু বছর হয়ে গেল ও ঠিকমতো কথা বলে না। বাইরে কোথাও বেরোয় না। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করে না। শুধু চুপ করে বসে থাকে। আমার ওর সামনে দাঁড়াতে ভয় করে।’ তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, ‘অথচ আমাদের একটা সুখের সংসার ছিল। আমরা চারজন অত্যন্ত সুখে ছিলাম। ছেলেটাও পড়াশোনায় ভালো ছিল। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু…!
কথাটা শেষ করতে পারলেন না সুদীপ। তাঁর কণ্ঠ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে এল। একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, ‘ফোবিয়ান্সের প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ে আসলে একেকটা খুনী! ওরা সবার ওপরে টর্চার করতে ভালোবাসত। সুজিতের সঙ্গে যা করেছিল তা ক্ষমার অযোগ্য! আবীর তো কনডাক্ট ডিজ অর্ডারের পেশেন্ট ছিল! মানুষকে কষ্ট দিতে ভালোবাসত। লোকে যন্ত্রণা পাবে, ছটফট করবে, কষ্ট পাবে—এটাই ছিল ওর মূল এন্টারটেইনমেন্ট! ‘
‘আবীর কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের পেশেন্ট!
‘হ্যাঁ।’ সুদীপ জানালেন, ‘কাউকে বুলি করা, টর্চার করাই ওর প্রিয় হবি। ও আসলে একটা ঠান্ডা মাথার খুনী। তিলে তিলে কী করে একটা মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে মারতে হয় তা ও ভালোই জানে। নিজের বউটাকেও তো মারতেই গিয়েছিল, কিন্তু বরাতজোরে মেয়েটি বেঁচে যায়।’
‘আপনি কি সাইকায়াট্রিস্ট?’
সুদীপ একটু থমকে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘হ্যাঁ’।
কনডাক্ট ডিজ অর্ডারের উল্লেখেই অধিরাজ বুঝতে পেরেছিল যে সুদীপ খুব সাধারণ মানুষ নন। এবার সেটা প্রমাণও হয়ে গেল। সে হালকা চালেই প্রশ্ন করে, ‘আপনার চেম্বার কোথায়?’
‘আমি প্রাইভেট ক্লিনিকে বসি না।’ সুদীপ জবাব দেন, ‘হসপিটালে বসি। ফর ইওর কাইন্ড ইনফর্মেশন, যে হসপিটালের এম.আর.আই মেশিনে মৃন্ময়কে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, আমি সেই হসপিটালের ওপিডিতেই বসি।’
এটাও কি আরেক ধরনের চ্যালেঞ্জ! অন্তত কথার ভঙ্গিতে তো তেমনই মনে হল! অধিরাজ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর ধীর স্বরে বলে, ‘আপনি ফোবিয়ান্সের সদস্যদের বেশ ভালোই খোঁজখবর রেখেছেন দেখছি।’
‘আমি খবর রাখিনি অফিসার।’ স্মার্ট জবাব এল, ‘আমার মেয়ে শ্রুতি অনেক খবর রাখে। ও-ই আমাকে জানিয়েছিল যে আবীরের স্ত্রীয়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আবীরকে কখনোই আমার খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। স্বাভাবিক মানুষ অত ক্রুয়েল হতে পারে না!’
‘থ্যাঙ্কস।’
রজত চৌধুরী আর রূপা বিশ্বাসের ঠিকানা অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন পাঠিয়ে দিয়েছিল। রজত চৌধুরী এমনিতে বেশ হাসি খুশি মানুষ। জেরায় স্বীকার করলেন যে ফোবিয়ান্স তাঁর ওপর যথেষ্ট অত্যাচার করেছিল। এতটাই বাড়াবাড়ি করেছিল যে তাঁকে কলেজ ছাড়তে হয়। ওদের র্যাগিং সহ্য করা মুশকিল ছিল। তার ওপর কথায় কথায় গায়ে হাতও তুলত। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যেত না! একবার, দু-বার নালিশ করেও দেখেছেন। কিছুতেই কিছু হয় না! বরং অত্যাচারের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যেত।
‘আপনার কখনও ওদের ওপর রাগ হয়নি?’
‘ভীষণ রাগ হয়েছিল। তখন অল্পবয়েস। রক্তও গরম ছিল। ইচ্ছে করছিল ওদের সবকটাকে মেরে পাটপাট করি। কিন্তু ক্ষমতা ছিল না। ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না।‘
‘সম্প্রতি যা ঘটেছে তা জানেন?
‘হ্যাঁ, নিউজে দেখেছি।’ ভদ্রলোক আফসোসে মাথা নাড়লেন, ‘মিডিয়া একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। আমার এগুলোকে খুন বলে মনে হয় না। নেহাতই কতগুলো কো-ইনসিডেন্স!’
‘আপনি আকাশ আর সুজিতের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানেন?’
রজত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘হ্যাঁ। শুনেছি। সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু সেই ঘটনার জন্য এখন কেউ প্রতিশোধ নিচ্ছে তা আমার মনে হয় না। মারতে হলে তো আগেই মারতে পারত, এত বছর পরে কেন?’
রজত চৌধুরীর কাছ থেকে আর নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। রূপা বিশ্বাসের ঠিকানায় গিয়ে জানা গেল যে তিনি বিবাহসূত্রে প্রবাসী। স্বামী, সন্তান নিয়ে লন্ডনে সেল্ড। বছরে একবার আসেন। এ বছর করোনার দৌরাত্মে আসতে পারেননি।
‘যাক, অন্তত একজন সাসপেক্ট কমল।’ অধিরাজ ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলে, ‘আমার তো মনে হচ্ছিল সাসপেক্ট লিস্টে শেষে না প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরও নাম চলে আসে!’
‘কিন্তু বাইরে বসেও তো খুন করা যায়। সুপারি দিয়ে?’
আত্রেয়ীর প্রশ্নটা শুনে মুচকি হাসল অধিরাজ, ‘আমার মনে হয় না কালুকে কোনো প্রবাসী লোক সুপারি দিয়েছিল। নয়তো ওর আড্ডার কাছে এসে সুপারির অ্যাডভান্স রেখে যেতে পারত না।’
‘তা ঠিক।’
চাপা গলায় বলল অর্ণব, ‘স্যার, আমরা তো এখনও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি।’
‘না অর্ণব, জটিলতা আরও বেড়েছে।’ অধিরাজের মুখে চিন্তার ছাপ, ‘মায়ার সম্ভবত ব্ল্যাক ম্যাজিকের শখ আছে।’
‘ঐ পুতুলগুলো তবে…!’
অগাধ বিস্ময়ে আত্রেয়ীর মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না! অধিরাজ ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকায়, ‘আপনি লক্ষ্য করেননি, ওখানে ঠিক সাতটাই পুতুল ছিল!’
‘মাই গড!’
‘প্রশ্ন হল, শুধুই কি ব্ল্যাক ম্যাজিক অবধি ব্যাপারটা আটকে আছে, না সুপারির কেসও আছে?’
অর্ণব আস্তে আস্তে বলল, ‘স্যার, অলৌকিক কিছু ঘটছে না তো?’
অধিরাজ ঝরঝরিয়ে হেসে ফেলল, ‘না অর্ণব। যা ঘটছে তা সম্পূর্ণ লৌকিক। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যাপারটা সাজানো হয়েছে বলে এখনও তল খুঁজে পাচ্ছি না। মায়া-অমরের সঙ্গে একটি বোবা মেয়ের উপস্থিতি, সুদীপের সাইকায়াট্রিস্ট হওয়া, ঠিক উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না! তার ওপর কী কো-ইনসিডেন্স দেখো, উনিও সেই হসপিটালের ওপিডিতেই বসেন, যে হসপিটালে মৃন্ময় খুন হলেন! অন্যদিকে মায়ার কথা শুনে মনে হচ্ছিল যে উনি সত্যি কথাই বলছেন!
‘মা–নে!’বিস্ময়ে অর্ণবের চোখ গোল গোল হয়ে যায়, ‘তার মানে উনি সত্যিই খুন করেছেন!’
‘সত্যিই খুন করেছেন কি না জানি না, কিন্তু উনি সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে কথাটা বলেছেন। অর্থাৎ উনি বিশ্বাস করেন যে খুনগুলো উনিই করেছেন।’
আত্রেয়ী একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘এদিকে সৌমিত্র চৌধুরীর স্ত্রীও তাঁকে একবার খুন করার চেষ্টা করেছিলেন।’
‘ঠিক তাই। দ্বিতীয়বার যে করেননি, তার গ্যারান্টি কী? মৃন্ময়ের যা স্বভাব তাতে তাঁর স্ত্রীও তাঁকে খুন করতে পারেন। উৎপলের তো কথাই নেই! যে নিজের বাপকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়, তাঁর শত্রু বাইরের থেকে ঘরেই বেশি! আর আবীর সেনের যা চরিত্র শুনলাম, তার তুলনা তিনি নিজেই। তিনি আবার কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের রোগী! কনডাক্ট ডিজ-অর্ডার কী জানো অর্ণব?’
অর্ণব নিঃশব্দে দু-দিকে মাথা নাড়ল।
‘কনডাক্ট ডিজ-অর্ডার এমন একটা রোগ যেটা মানুষকে রীতিমতো খুনী তৈরি করে ফেলতে পারে। কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের রোগী মানুষকে কষ্ট দিতে ভালোবাসে। এবং তার মধ্যে কোনো অনুতাপ, কোনো পাপ-পুণ্য বোধই থাকে না। বিহারের কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার অমরজিৎ সদা’র এই প্রবলেম ছিল। অমরজিৎ আট বছর বয়েসী একটা বাচ্চা ছেলে! সে তার বয়েসী বা তার থেকে ছোটো শিশুদের মাথায় ইট মেরে মেরে খুন করত! তার জন্য তার কোনোরকম অনুতাপ ছিল না! বরং শিশুগুলোকে কষ্ট পেতে দেখে, তাদের ছটফট করতে দেখে সে আনন্দ পেত। রক্ত দেখতে তার ভালো লাগত। সেই রোগই আছে আবীরের!
‘মানে উনিও মানুষকে টর্চার করে মারতে ভালোবাসেন!’
অর্ণবের প্রশ্নটা শুনে মৃদু হাসল অধিরাজ, ‘মারতে ভালোবাসেন কিনা জানি না, কিন্তু টর্চার করতে ভালোবাসেন। ওঁর র্যাগিঙের বহর শুনে মনে হচ্ছে যে তিনিও অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার সিরিয়াল কিলার হতে পারতেন। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ? অত বড়ো কার অ্যাক্সিডেন্টে ওঁর স্ত্রীর পা কাটা গেল, একমাত্র সন্তানটা মারা গেল, কিন্তু ওঁর কিছুই হল না! সচরাচর কার অ্যাক্সিডেন্টে যে লোকটির জখম হওয়ার স পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে, সে ড্রাইভার। অথচ আবীরের গায়ে আঁচড়টুকুও লাগল না! এটা কী করে সম্ভব!’
‘তাই বলে নিজের স্ত্রী, সন্তানকে মারবেন!’, অর্ণবের ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। একটা মানুষ এতটা নিষ্ঠুর আদৌ হতে পারে!
‘কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের রোগীদের তুমি চেনো না অর্ণব!’ সে স্মিত হাসে, ‘অমরজিৎ সদার প্রথম শিকার ছিল তারই নিজের বোন। কেউ যদি নিজের বোনকেই মারতে পারে তাহলে স্ত্রী, সন্তানকে মারতে অসুবিধে কোথায়?’
‘তবে কি উনিই…? ‘
‘অসম্ভব নয় অর্ণব। এই দুনিয়ায় কিছুই অসম্ভব নয়।’ অধিরাজ বলে, ‘হতে পারে পঙ্গু, অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। এই ধরনের লোকদের মায়া-মমতা নামক কোনো বস্তু থাকে না। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়।‘
‘কী?‘
‘যদি স্ত্রীকেই সরানোর ছিল, তবে বেছে বেছে নিজের পুরনো বন্ধুদের মারার মানে কী! এমনিতেই স্ত্রী আর বেশিদিন বাঁচবেনও না। কিছুদিন অপেক্ষা করলেই তো কাজ হয়ে যায়। খামোখা এতগুলো খুন করার দরকার কী ছিল? আমাদের মিলিড করার জন্য কি?’
‘হতে পারে স্যার…!’ আত্রেয়ী বলল, ‘এতগুলো খুন করলে সিরিয়াল কিলিঙের পেছনে আসল উদ্দেশ্য চাপা পড়ে যাবে। সেজন্যই হয়তো…!’
‘তবে কালুকে সুপারি দিল কে? কেনই বা দিল?’ অধিরাজ একটা শ্বাস টানে, ‘সহজ নয় মাদমোয়াজেল। গোলমাল আছে।’
‘স্যার, এমনও তো হতে পারে যে কালুকে অন্য কেউ সুপারি দিয়েছে, আর খুনগুলো অন্য কেউ করছে!’
‘গুড থিঙ্কিং মিস্ দত্ত’। অধিরাজ বলে, ‘হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্তত কালু একজনকে খুন করত। ও এত অপদার্থও নয় যে একজনকেও মারতে পারবে না।’ বলতে বলতেই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, ‘এদিকে ফোবিয়ার মাধ্যমে খুন হচ্ছে, ওদিকে সুজিতের বাবা আবার সাইকায়াট্রিস্ট! কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। কেউই না!
‘আজ রাতে আমরা কি আবীর আর উমার ফ্ল্যাটের সামনে থাকব?
অর্ণবের প্রশ্ন শুনে অধিরাজ মাথা নাড়ল, ‘তুমি আর আমি সৌরীশের ফ্ল্যাটে নজর রাখব। আর দুই মিস্ ও পবিত্র থাকবে আবীর আর উমার ফ্ল্যাটের সামনে।
‘আপনার মনে হয় আজ কিছু ঘটবে?’
উত্তরে ভাসাভাসা চোখে তাকাল অধিরাজ। তার চোখে জমাট বেঁধেছে রহস্যময় কুয়াশা। আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল দুটো শব্দ, যেন অজ্ঞাত কারোর দিকে ছুঁড়ে দিল চ্যালেঞ্জ, ‘দেখা যাক। ‘
(১৭)
আস্তে আস্তে রাত নেমে এল পৃথিবীর বুকে। চতুর্দিক শুনশান, নিঃঝুম। একসময় কলকাতার নাইট লাইফ ছিল দেখার মতো। রাত হলেও চতুর্দিক সরগরম থাকত। কিন্তু এখন শুধুই নীরবতা! জনমানবহীন রাস্তায় স্রেফ কতগুলো বেওয়ারিশ কুকুর ঘুরঘুর করছে আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে চলেছে। ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলো রাত্রির শূন্যতাকে আরও প্রকট করেছে। অন্ধকারকে ছাপিয়ে আলোর রশ্মি চারিদিকটা উজ্জ্বল করে তোলার চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। মৃত মানুষের চোখের জ্যোতির মতো ম্যাড়ম্যাড়ে আলো পিচের রাস্তার ওপর পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের বিরাট গহ্বরে।
কোথা থেকে একরাশ জোলো হাওয়া হু হু করে এসে আছড়ে পড়ল অধিরাজের মুখে। সৌরীশের বিল্ডিঙের সামনে তারা গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। সে একটু চিন্তিত মুখে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে ঘন কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। সম্ভবত আজও বৃষ্টি হবে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ ঝলসে ঝলসে উঠছে! যেন কোনো এক আসন্ন প্রলয়ের ইশারা।
‘পবিত্র, ওদিককার খবর কী?’
পবিত্র, মিস বোস আর মিস দত্ত আবীর সেনের ফ্ল্যাটের সামনে প্রহরারত। মোবাইলে ওদের সঙ্গে সমান তালে যোগাযোগ রেখে চলছে অধিরাজরা। কনফারেন্স কলের মাধ্যমে দুই পক্ষই পরস্পরকে প্রতিটা মুহূর্তের আপডেট দিয়ে চলেছে। ওদের সতর্ক দৃষ্টি জরিপ করে চলেছে চতুর্দিক। স্নায়ু টানটান। এক মুহূর্তের জন্যও আলগা দেওয়া চলবে না।
‘এদিকে কোনোরকম ডেভলপমেন্ট নেই।’ ও প্রান্ত থেকে পবিত্রর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘সব চুপচাপ ‘
‘আবীরদের ফ্ল্যাটটা দেখতে পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ। অনেকক্ষণ হল আলো নিভে গেছে।’ পবিত্র জবাব দেয়, ‘এখন তো সিকিউরিটি গার্ডটাও ঝিমোচ্ছে দেখছি। মনে হচ্ছে শুধু আমরাই উল্লু মিঞাঁ হয়ে বসে আছি।’
‘সে তো আমরাও আছি।’
বলতে বলতেই অধিরাজ সৌরীশের ফ্ল্যাটের দিকে তাকায়। তার ফ্ল্যাটে এখনও আলো জ্বলছে। জানালায় বারবার কার যেন ছায়া এসে পড়ছে। কেউ যেন বারবার আসছে আর যাচ্ছে। সৌরীশই হয়তো পায়চারি করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভদ্রলোককে আগেই ভয়ার্ত বলে মনে হয়েছিল। চিন্তার চোটে হয়তো চোখে ঘুম নেই তাঁর!
‘লোকটা এখনও ঘুমোয়নি!
অর্ণব সবিস্ময়ে বলে। অধিরাজ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘সেটাই স্বাভাবিক অর্ণব। যেখানে মাথার ওপরে কালান্তক মৃত্যু তান্ডব নাচছে, সেখানে ঘুম আসাটাই বরং অস্বাভাবিক।’ সে একটু চিন্তিত স্বরে বলে, ‘কিন্তু এত ভয়ের মধ্যেও লোকটা আসল কথাটা চেপে গেল।’
‘কী? ‘
‘বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আকাশ আর সুজিতের সঙ্গে আসলে কী হয়েছিল। লোকটা মুখই খুলল না! এ-ও জানতে চেয়েছিলাম, কোনো জিনিসে ভয় পান কি না! তাও বলল না! ওঁর ফোবিয়াটা কীসে আছে তা জানতে পারলে সামান্য এগোনো যেত। কিন্তু পাবলিক একেবারে মুখে কুলুপ এঁটেই বসে রইল।’
অর্ণব আবার সৌরীশের ফ্ল্যাটের দিকে তাকায়। এখনও তার ছায়া ঘরে ছটফটিয়ে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। লোকটা কি আদৌ পায়চারি করছে, না দৌড়ে বেড়াচ্ছে! সে অধৈর্য হয়ে ওঠে। আদৌ কি কিছু ঘটবে আজকে! নাকি পুরোটাই নেহাৎই এক শোকার্ত মহিলার প্রলাপ! আকস্মিকভাবেই মায়ার চেহারাটা ভেসে উঠল অর্ণবের চোখের সামনে। ভদ্রমহিলার মধ্যে কী যেন আছে! শুধু শোক নয়, তার থেকেও বড়ো কিছু! ওঁকে দেখলেই মনের মধ্যে কোথাও একটা ভয় জন্ম নেয়। তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। তবু একধরনের অকারণ একটা শিরশিরে অলৌকিক ভয় জেগে ওঠে। সত্যিই কি প্রত্যেকটা খুনের পেছনে উনি আছেন? ওঁর দাবির মধ্যে কতটা সত্যতা আছে?
অধিরাজের ব্লু টুথ কড়কড় করে উঠল।
‘রাজা, এইমাত্র আবীর সোসাইটি থেকে বেরোলেন!’
‘এত রাতে!’ অধিরাজ বিস্মিত, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বলো তো ফলো করি।’ পবিত্র বলল, ‘তার হাবভাব মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার। কেমন যেন চোর চোর ভাব।’
‘ফলো করো। দেখো কোথায় যাচ্ছেন।’
আকাশে একটা চাপা গুমগুম শব্দ। জোরাল ঝিলিক দিয়ে উঠল বিদ্যুৎ। অধিরাজ একটু আশঙ্কিত কণ্ঠস্বরেই বলে, ‘বৃষ্টি নামবে।’
শুধু বলার অপেক্ষা। পরক্ষণেই একেবারে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। অধিরাজ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘ড্যা-ম ইট! এর মধ্যে পবিত্র আবীরকে ফলো করবে কী করে? এখনই বৃষ্টিটাকে নামতে হল! ‘
মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেল প্রেক্ষাপট! তুমুল বর্ষণের ফলে বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির কাচ বেয়ে জলের ধারা অবিরাম পড়ে চলেছে। নীলাভ জ্যোতি নিয়ে বিদ্যুৎ ক্রমাগতই চমকে চমকে উঠছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে বিদ্যুতের কড়কড় আওয়াজ, মেঘের গর্জনে কানে তালা পড়ার উপক্রম। বাইরের নীল অন্ধকার জমাট বেঁধে যেন অদ্ভুত এক আকার নিচ্ছে। কায়াহীন এক ছায়া যেন আস্তে আস্তে স্বমূর্তি ধারণ করছে!
‘পবিত্র, স্টেটাস কী?’
‘খুব খারাপ রাজা। আবীর কোথায় গেলেন বুঝতে পারলাম না!’ পবিত্রর কণ্ঠস্বরে আফসোস, ‘এই বৃষ্টিটা একটু পরে নামলেই লোকটাকে ধরে ফেলতাম। কিন্তু বৃষ্টিটারও এখনই নামার ছিল! ‘
অধিরাজকে বাইরে থেকে শান্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে অস্থির হয়ে উঠেছে। আবীর সেন এত রাত্রে কোথায় গেলেন! যখন থেকে সে জেনেছে যে তিনি কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের রোগী, তখন থেকেই ভদ্রলোকের প্রতি একটা সন্দেহ মনে কাজ করছে। কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের রোগীরা মানুষের ওপর বুলি করা, টর্চার করা, এমনকি খুন করাকেও অন্যায় বলে মনে করে না। কে বলতে পারে হয়তো তার অতিরিক্ত অত্যাচারের ফলেই আকাশের মৃত্যু হয়েছে! এ ধরনের মানুষেরা অন্যের কষ্ট দেখতে ভালোবাসে! হয়তো সেই তাড়নাতেই একের পর এক খুন করছেন! সিরিয়াল কিলিং কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের রোগীদের পক্ষে অসম্ভব নয়। তবে এগুলো কি একেবারেই মোটিভহীন খুন! অধিরাজের বুকের ভেতরটা ধড়াস্ করে ওঠে। এদিকে ওরা সৌরীশের ফ্ল্যাটের সামনে পাহারা দিচ্ছে, অন্যদিকে আবীর নিজের কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেলেন না তো!
‘পবিত্র, আবীরের ফ্ল্যাটে কোনোরকম মুভমেন্ট দেখতে পাচ্ছ?’
‘না বস্।’
অধিরাজ তার মনের মধ্যে অমঙ্গল আশঙ্কাকে চেপে রাখে। একবার ভাবল পবিত্রকে বলবে মিস্ বোস আর মিস্ দত্তকে নিয়ে আবীরের ফ্ল্যাটে যেতে। দেখা দরকার যে তিনি ঠিক আছেন কিনা। পরক্ষণেই মনে হল, এখন উলটোপালটা ভেবে লাভ নেই। বরং আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। মিসেস সেন এখন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এত রাতে অসুস্থ মানুষটাকে ডিস্টার্ব করার কোনো মানে হয় না। আবীর হয়তো আশেপাশেই কোথাও গিয়েছেন, এখনই ফিরে আসবেন।
সে আপ্রাণ নিজের মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে। উমা সেনের সঙ্গে তো অ্যাটেনডেন্টও আছে। এত চিন্তার কিছু হয়নি।
গাড়ির কাচ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো প্রবল বর্ষণে আরও নিষ্প্রভ। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ কড়কড়িয়ে উঠছে। এই ঝাপসা ঝাপসা ধোঁয়া ধোঁয়ার মধ্যে সোসাইটির গেটটাও স্পষ্ট দেখা যায় না! সামনের বিল্ডিংটা উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। তার মাথার ওপর বিদ্যুতের কাঁটাতার ঝলসে ঝলসে ওঠে। চতুর্দিকে শুধু বৃষ্টিপতনের ঝমাঝম শব্দ। বিল্ডিংটার পাথুরে দেহ চুঁইয়ে সহস্র জলবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ছে। বন্ধ কাচের জানালার ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের পিঙ্গল, বিষণ্ণ আলো।
অধিরাজের সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন সৌরীশের ফ্ল্যাটের দিকে। তার ঘরে এখনও আলো জ্বলছে। তবে ছায়ার নড়াচড়া এখন আর দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য বিষয় তো! ভদ্রলোক কি শুয়ে পড়লেন? তবে এখনও আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন কেন! অত জোরালো আলোর মধ্যে কেউ ঘুমোতে পারে? নাকি অন্য ঘরে গিয়েছেন? পায়চারি থামিয়ে অন্য কোনো কাজ করছেন কি?
অধিরাজ আরও কিছু সম্ভাবনার কথা ভাবতেই যাচ্ছিল। তার আগেই একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠল। জানালায় আবার ছায়া এসে পড়েছে। কিন্তু এবার ছায়াটা সম্পূর্ণ অন্য লোকের! সৌরীশের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা-চওড়া ছায়া। অন্য কেউ ফ্ল্যাটে আছে! এতক্ষণ তো কেউ ছিল না। এবার আবার কে এল!
‘অর্ণব।’ অধিরাজ ফিসফিস করে বলে, ‘আমি একটু সৌরীশকে দেখে আসছি। তুমি এখানেই থাকো। যতক্ষণ না আমি বলছি জমি ছেড়ে নড়বে না। আর গেটের দিকে কড়া নজর রাখবে।
‘এনিথিং রং রাজা?’
ওপ্রান্ত থেকে পবিত্রর কৌতূহলী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। অধিরাজ আস্তে আস্তে বলল, ‘সেটাই দেখতে যাচ্ছি।’
অর্ণবের চোখে একমুহূর্তের জন্য আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে আসে। স্যার একা একা সৌরীশের ফ্ল্যাটে ঢুকবেন! নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন করা তার স্বভাব নয়। সে শুধু গাড়ির ব্যাকসিট থেকে নিজের ছাতাটা তুলে নিয়ে নীরবে অধিরাজের দিকে এগিয়ে দিল।
‘থ্যাঙ্কস অর্ণব।’
এইজন্যই অর্ণব স্পেশ্যাল। প্রয়োজনের মুহূর্তে ঠিক দরকারি জিনিসটাই এগিয়ে দেবে সে। বেশ কিছুদিন ধরে মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। আজকের ফোরকাস্টেও বর্ষণের সম্ভাবনা ছিল। তাই সে ছাতা নিয়েই এসেছে। অধিরাজও চিন্তায় পড়েছিল যে এত বৃষ্টির মধ্যে বিল্ডিং অবধি পৌঁছবে কী করে! নিজের ভুলো স্বভাবমতোই ওয়াটারপ্রুফটাও সে অফিসে ফেলে এসেছে! যা বৃষ্টি হচ্ছে তাতে বাইরে বেরোনোমাত্রই ভিজে চুপচুপে হয়ে যেত! সব সমস্যার সমাধান শেষমেষ অর্ণবই করে দিল।
অধিরাজ লঘু পায়ে একরকম ছুটেই গেল গেটের দিকে। গেটে তখন কেউ নেই! গেটকিপার কোথায় গিয়েছে কে জানে! সে এদিক ওদিক তাকায়। সিকিউরিটির দেখাই নেই! এই বৃষ্টির রাতে নির্ঘাৎ পাউয়া চড়াতে গিয়েছে। গেটটায় সামান্য ধাক্কা দিতেই গেট খুলে গেল! কী আশ্চর্য দায়িত্ববোধ! গেটটা খোলা! এত রাতে মোটেই গেট খোলা থাকা উচিত নয়! চতুর্দিকে যে এত ক্রাইম ঘটছে, তারপরও এদের জ্ঞান হয় না! মনে মনে গেটকিপার এবং সিকিউরিটির মুণ্ডুপাত করতে করতে বিল্ডিঙের দিকে এগোল অধিরাজ।
লিফটটা নীচেই দাঁড়িয়েছিল। যথারীতি লিফটম্যানও হাওয়া! বিরক্তিতিক্ত মুখে অধিরাজ ছাতাটা বন্ধ করে নিজেই লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়ে। তিন নম্বর বোতামটা টিপে দিতেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে লিফটটা চলতে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডের প্রতীক্ষা। তারপরই থার্ড ফ্লোর এসে হাজির।
সৌরীশের ফ্ল্যাটের বাইরে তখন স্তিমিত আলো জ্বলছে। বেশ নীলাভ ঘুম ঘুম আলো। খানিকটা আলো ছড়িয়ে আছে সিঁড়ির ওপর, খানিকটা লিফটের দিকে। গলি খুঁজিগুলোয় অন্ধকার জমেছে। সেই আবছা আলোছায়া গায়ে মেখে সৌরীশের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেল অধিরাজ। এখন কোথাও কোনোরকম শব্দ নেই। শুধু পাশের ফ্ল্যাট থেকে উস্তাদ রাশিদ খাঁয়ের মালকোষ ভেসে আসছে। কেউ এত রাতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনছে!
কিন্তু সৌরীশের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই প্রবল বিস্ময়ের ধাক্কা! এ কী! দরজা খোলা কেন! অধিরাজ আলতো করে দরজার ওপর হাত রাখতেই দরজা মসৃণভাবে খুলে গেল! ভেতরের হলঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার! অথচ একটু আগেই তো আলো জ্বলছিল! কেউ নিভিয়ে দিয়েছে! তার মস্তিষ্ক সঙ্কেত দিয়ে ওঠে, ‘সাবধান! সাবধান!’ সে সতর্ক ভঙ্গিতে সামান্য কাত হয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু ঘরের ভেতরে ঢুকতেই আবার চমক! ঘরের মধ্য দিয়ে কি সাইক্লোন বয়ে গিয়েছে! চতুর্দিকে সব তছনছ! ফার্ণিচারগুলো বিধ্বস্ত! জিনিসপত্র সব এদিকে ওদিকে পড়ে রয়েছে!
অধিরাজ এক পা এগোতেই তার পায়ের তলায় কী যেন পড়ল! পরক্ষণেই একটা শিশুর খলখল হাসির শব্দ নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিল! সে চমকে উঠে পা সরিয়ে নেয়। কে হাসে! এখানে কোনো শিশু থাকার তো কোনো সম্ভাবনা নেই! তবে! এমন খিলখিলিয়ে কে হেসে উঠল! সে তার হাতের ছাতাটা হলঘরের সেন্টার টেবিলের ওপর অতি সন্তর্পণে রেখে দিয়ে মোবাইলের টর্চটা জ্বালল। টর্চ জ্বলে উঠতেই যা দেখল অধিরাজ তাতে তার রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড়! তার ঠিক পায়ের সামনেই পড়ে রয়েছে একটা লাফিং ডল! একটু আগেই ওটার ওপরেই পা পড়েছিল। কিন্তু লাফিং ডলটার চোখদুটো নেই! আর তার মাথার চুলগুলো কে যেন এবড়ো খেবড়ো ভাবে কেটে দিয়েছে। ছোট্ট সুন্দর পুতুলটাকে কী বীভৎস দেখাচ্ছে!
টর্চের আলো ফেলে সাবধানী পায়ে ভেতরের দিকে এগোল অধিরাজ। তার একহাতে টর্চ, অন্যহাতে উঠে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু আরেক পা এগোতে না এগোতেই আবার একটা প্রচণ্ড শব্দ! আঁতকে উঠে একটু পিছিয়ে গেল সে। একটা পুতুল-ভালুক কর্তাল বাজাচ্ছে! কিন্তু ভালুকটারও চোখ নেই! তার গায়ের ফারও ছিন্নভিন্ন! তার ঠিক পাশেই একটা বার্বিডল! বার্বিডলটার মাথা নেই! অধিরাজ সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে একগুচ্ছ পুতুল! কিন্তু একটাও আস্ত নয়! কোনোটার মাথা ভাঙা, কোনোটার হাত নেই! বেশিরভাগ পুতুলেরই চোখ নেই! দেখলে মনে হয় পুতুল নয়, কতগুলো ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে রয়েছে! কী ভয়ংকর দৃশ্য!
‘আঃ!…আঃ!’
একটা অস্ফুট কাতরোক্তিতে সজাগ হয়ে উঠল সে। উৎকর্ণ হয়ে শব্দের উৎসটা খোঁজার চেষ্টা করল। কাতর শব্দটা আসছে পাশের কোনো ঘর থেকে। অধিরাজ আস্তে আস্তে সেদিকেই পা বাড়ায়। এখন কোনো ঘরেই আলো জ্বলছে না! টর্চের জোরালো আলো কিছুটা আলোকিত করে তুলেছে। বাকিটা অন্ধকার। কিছু দেখা যায়, কিছু দেখা যায় না! বাইরে ফের বিদ্যুৎ চমকে উঠল। কাচের জানালার ওপর তার আলো প্রতিফলিত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য গোটা ঘরকে আলোকিত করে ফের ডুবে গেল অন্ধকারে। অধিরাজের বুকের ভেতরটা ঢিঢিব করে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় বিপদ সঙ্কেত দিচ্ছে। সে পা টিপে টিপে অগ্রসর হল!
হলঘরের ডানদিকে বেডরুম। আওয়াজটা এখান থেকেই আসছিল। অধিরাজ আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। ঘরটা নিঃসীম অন্ধকারে ডুবে ছিল। টর্চের আলো পড়তেই সামনের দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যা দেখল অধিরাজ, তাতে তার হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম!
সৌরীশ ঠিক খাটের সামনেই মেঝেতে পড়ে আছেন। তার মুখ যন্ত্রণাবিকৃত। এক হাতে এমনভাবে চেপে ধরেছেন নিজের বুক, যেন বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখদুটো বিস্ফারিত! যেন প্রচণ্ড ভয়ে চোখদুটো ফেটে বাইরে আসতে চাইছে! প্ৰাণ পণ নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ধড়ফড় করছেন। যন্ত্রণায় মুখ নীল! তার চতুর্দিকে শুধু একগাদা পুতুল। হাত-পা-মুণ্ডু-ধরবিহীন একগাদা পুতুলের দল পড়ে আছে তার চারিদিকে!
‘সৌরীশবাবু!’
অধিরাজ তাড়াতাড়ি ছুটে যায় তার দিকে। সৌরীশ কোনোমতে বললেন, ‘ও আমাকে মেরে ফেলবে… ও আমায় মারবে…!’
‘কে?’
অধিরাজের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সৌরীশেরও সম্ভবত কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি তাকে সি.পি.আর দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘কে মারবে আপনাকে?’
‘ও…!’ সৌরীশের দু-চোখে ভয়। তিনি একটা পুতুলের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন, ‘ও… মারবে!’
বলতে বলতেই স্থির হয়ে গেলেন সৌরীশ। তিনি যে পুতুলের দিকে ইশারা করেছিলেন, অধিরাজ সেটার দিকে তাকায়। একটা নিরীহ প্রিন্সেস ডল! কিন্তু তার হাত-পা নেই! পুতুলটার ঠোঁটে কে যেন কালো কালি মাখিয়ে দিয়েছে আর চোখে লাল রং! একটা সুন্দর জিনিসকে যে কীভাবে ভয়ংকর করা যায়, তা আজ বুঝল অধিরাজ! তার নিজের গালেই চড় কষাতে ইচ্ছে করছিল! সৌরীশ এতক্ষণ আদৌ পায়চারি করছিলেন না! বরং দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ঘরের মধ্যেই ছুটে বেড়াচ্ছিলেন! একটু আগে যদি আসতে পারত তবে হয়তো বাঁচানো যেত লোকটাকে!
‘কী হল রাজা?’
উলটোদিক দিয়ে পবিত্রর চিন্তিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। অধিরাজ তার উত্তর দেয় না। তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা! ঘরে যে আরেকটা ছায়া দেখা গিয়েছিল, সেটা তবে কার? অধিরাজ একটা জোরাল শ্বাস টানে। তার মানে খুনী এখনও এখানেই আছে! কোথাও যায়নি সে। এই ফ্ল্যাটের মধ্যেই কোনো তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতি টের পাচ্ছিল অধিরাজ। খুনী যে-ই হোক, সে এখনও পালাতে পারেনি।
সে সৌরীশকে পরীক্ষা করে দেখল। নাকের তলায় হাত রেখে, ঘাড়ে হাত দিয়ে সামান্য হলেও প্রাণের স্পন্দন খুঁজছে। নাঃ, লোকটা বেঁচে নেই! ভাবতেই প্রচণ্ড আফসোস হল অধিরাজের। খুনী একেবারে নাকের নীচ দিয়ে খুন করে বেরিয়ে গেল। তারা বুঝতে পেরেছিল আরেকটা খুন হতে চলেছে। তার জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিল। কিন্তু সমস্ত ব্যর্থ হয়ে গেল!
সে এবার সৌরীশকে ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল! সেই আলোর ঝলক এসে পড়ল এই ঘরে। স্তিমিত রূপোলি আলো এসে পড়ল সামনের আয়নাটায়। আয়নায় অধিরাজের প্রতিবিম্ব পড়েছিল। কিন্তু সে বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল, আয়নায় তার প্রতিফলন ছাড়াও আরও একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে! ঠিক তার পেছনে অন্ধকারেরই মধ্যে লুকিয়ে আছে। বিদ্যুৎ চমকে ওঠার ফলে স্পষ্ট দেখা গেল দুষ্কৃতীর দেহরেখা!
অধিরাজ বিদ্যুৎবেগে পেছনে ফিরল! কিন্তু তার আগেই একরাশ সাদা পাউডারের মতো কী যেন এসে পড়ল তার নাকে, চোখে! ছায়াটা কী যেন ছুঁড়ে দিয়েছে তার মুখে। মুহূর্তের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল অধিরাজ। আর কিছু করার আগেই একদম আকস্মিকভাবে তার চোয়াল ঘেঁষে আছড়ে পড়ল একটা মোক্ষম ঘুষি! সে সামলাতে না পেরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় অধিরাজ কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। ছায়াটা ততক্ষণে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছে বাইরের দিকে!
অধিরাজের মনে হল সে চোখে ঝাপসা দেখছে! প্রাণপণে চেজ করার চেষ্টা করল দুষ্কৃতীকে। কিন্তু এ কী! তার পা এমন ভারী হয়ে আসছে কেন! অধিরাজ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে! এসব কী হচ্ছে! সব কিছু এমন সাদাকালো দেখাচ্ছে কেন! বাইরের প্রবল বৃষ্টির শব্দ, বজ্রপাতের আওয়াজ আস্তে আস্তে যেন ক্ষীণ হয়ে আসে। এখন চতুর্দিকে শান্ত নীরবতা! যেন পিনপতনের শব্দটুকুও শোনা যাবে! অধিরাজের চোখ জ্বালা করছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। সে সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু পারছে না! মাথার মধ্যে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলে! চোখের সামনের দৃশ্যটা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে।
‘রাজা!’
অধিরাজ কেঁপে ওঠে! কে ডাকল! এ কণ্ঠস্বর যে তার পরিচিত! এ কণ্ঠস্বরের মালিককে এগারোটা গুলি মেরেছিল সে। আবার ফিরে এসেছে! কী করে ফিরে এল!
সে দরদরিয়ে ঘামছিল। তার স্খলিত হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ে গেল। পড়ে গেল রিভলভারটাও। অধিরাজের মনে হচ্ছিল, তার গায়ে একবিন্দুও শক্তি নেই! চোখদুটো বুজে আসছে! সে অনুভব করল, চতুর্দিকের জমাট অন্ধকার যেন একত্র হয়ে কায়া নিচ্ছে! এখনই এই অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে সেই বিভীষিকা! তার কানে সেই অমোঘ ঠান্ডা হিসহিসে কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল, ‘রাজা, এসো!’
প্রচণ্ড ভয়ে ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেল অধিরাজ। এই মুহূর্তে তার নিজেকে একটা অসহায় বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে! যেন তার মধ্যে বাধা দেওয়ার শক্তিটুকুও নেই! এই লোকটার সামনে তার নিজেকে অসম্ভব বিপন্ন মনে হয়। সে জানে, লোকটা বেঁচে নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন বারবার ফিরে আসে! কেন বারবার ভয় দেখায়!
‘কী হল? আসবে না?‘
একটা অন্ধকার ছায়ামূর্তি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। অধিরাজের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে! ওঃ ঈশ্বর! এই লোকটা কোথা থেকে এল! সে ভয়ার্ত শিশুর মতো তাকিয়ে থাকে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! বাইরে নীল বিদ্যুৎ আরেকবার ঝলসে উঠতেই স্পষ্ট দেখা গেল দুর্বৃত্তকে! কী বীভৎস চেহারা! সারা শরীর রক্তাক্ত! বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে! প্রত্যেকটা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে! মাথা একপাশটা ভাঙা! চোখদুটোর জায়গায় শূন্য কোটর অট্টহাসি হাসছে! কী ভয়ংকর মূর্তি!
অধিরাজের মনে হল তার দমবন্ধ হয়ে আসছে! বুকের মধ্যে তীব্র একটা ব্যথা! এখনই বুঝি সে হার্টফেল করবে! হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শরীরে একবিন্দু জোরও অবশিষ্ট নেই! এমনই হয় প্রত্যেকবার! যতবার এই লোকটা তার সামনে এসে দাঁড়ায়, ততবারই হেরে যায় অধিরাজ! কিছুতেই অতিক্রম করে উঠতে পারে না এই প্রচণ্ড ভয়কে। তাকে একটা শীতল ভয়ের স্রোত ঘিরে ধরে। এখন কী করবে সে! আজও কি হেরে যেতে হবে!
ভীষণ ভয়ে চোখ বুজে ফেলল অধিরাজ। কিছুতেই দেখবে না ওকে। এটা একটা দুঃস্বপ্ন! যেমন প্রতিবার দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়, আজও তেমনই হবে। শুধু ঘুম ভাঙার অপেক্ষা!
‘এগারোটা গুলি মেরেছিলে আমাকে! ‘
ছায়ামূর্তির কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে! দেওয়ালের প্রতিটি ইঁট থেকে যেন ভেসে আসছে সেই একই শব্দ!
‘তারপরও আমি তোমার অপেক্ষায় আছি রাজা! তুমি আমায় এত ভয় পাও কেন! আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম! এত ঘৃণা কেন? আমি অন্যরকম বলে? এগারোটা গুলিতেও কি সেই ঘৃণা শেষ হয়নি?’
বলতে বলতেই ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে অধিরাজের দিকে এগিয়ে আসে। সে ভয়ে পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে, ‘কাছে আসবে না… একদম কাছে আসবে না… অ-ৰ্ণ–ব!’
‘স্যা–র!’
অধিরাজের কানে লাগানো ব্লু টুথের মাধ্যমে তার আর্ত চিৎকার শুনতে পেয়েছে অর্ণব এবং পবিত্ররা! পবিত্র ব্যাকুল স্বরে বলে, ‘ওখানে কী হচ্ছে রাজা! প্লিজ উত্তর দাও।’
অধিরাজ যেন তার কথা শুনতেই পায় না! লোকটা যত কাছে এগিয়ে আসছে, সে ততই গুটিয়ে যাচ্ছে। ভীষণ ঘৃণায়, দারুণ লজ্জায়, অপমানে তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! ও কি কিছুতেই তার পেছন ছাড়বে না! পিছোতে পিছোতে আক্ষরিক অর্থেই তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল। পালাবার পথ নেই! আর পালাবার পথ নেই!
‘এসো!’
‘না।’
অধিরাজ বুঝতে পারছিল যে লোকটা কিছুতেই তার পেছন ছাড়বে না! প্রত্যেকবারই পালাতে পেরেছে সে। কিন্তু আজ পালাবার উপায়ও নেই! আজ তাকে মোকাবিলা করতেই হবে। নয়তো চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যাবে তার সাহসী সত্ত্বা। এই ভয়ের হাত থেকে বেরোতে হলে তাকে লড়াই করতেই হবে, পিছিয়ে গেলে চলবে না। মনে পড়ে গেল ডঃ চৌধুরীর কথা, ‘লড়াইটা সম্পূর্ণ আপনার একার অফিসার! দুনিয়ায় এমন কোনো ওষুধ নেই যা মানুষকে সাহসী করে তুলতে পারে। এই ভয়ের বিরুদ্ধে তাই আপনাকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।’
সে কোনোমতে টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। লোকটা হাসছে! ওর মুখে একটা শয়তানি হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। অধিরাজের চোখ ক্রমাগতই ঝাপসা হয়ে আসছিল। শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। কিন্তু দাঁতে দাঁত পিষে নিজেকে ধরে রাখল। লোকটা কাছে আসছে… আরও কাছে…!
‘ইউ বা-স্টা-র্ড!’
সমস্ত ভয়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে সব শক্তি দিয়ে সপাটে এক ঘুষি মারল অধিরাজ! লোকটার ছায়া শরীর যেন নিমেষে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল!
‘তোকে আগেও মেরেছি… এবারও মারব!’ গর্জন করে উঠল সে, ‘যতবার সামনে আসবি, ততবার মারব। যাঃ, ভয় পাই না আর তোকে! আর ভয় পাই না! ব্লাডি সো-য়া-ই-ন!’
বলতে বলতেই তার সমস্ত দেহ শিথিল হয়ে আসে। সে কোনোমতে মেঝের ওপরেই বসে পড়ে।
‘এ কী! স্যার!’
অর্ণব তার ব্লু টুথ স্পিকারে অধিরাজের চিৎকার শুনতে পেয়েছিল। তখনই বুঝেছে কিছু গোলমাল হয়েছে। সে আর গাড়িতে বসে না থেকে ছুটে চলে এসেছে সৌরীশের ফ্ল্যাটে। এসে যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ! একদিকে সৌরীশের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে! তার চারপাশে শুধু পুতুলের স্তূপ! অন্যদিকে অধিরাজ কোনো অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যেন পাগলের মতো লড়ে যাচ্ছে! চারপাশে আর কেউ নেই!
‘স্যার।’
অধিরাজ অবশ হয়ে পড়েই যাচ্ছিল, তার আগেই অর্ণব তাকে ধরে ফেলে। ওপ্রান্ত থেকে পবিত্রর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘কী হল? অর্ণব?’
‘অর্ণব… আমি লোকটাকে আবার মেরেছি।’ অধিরাজ বিড়বিড় করে বলে। সে ঘেমে নেয়ে একসা হয়েছে। অর্ণব পরম যত্নে তার মুখ মুছে দেয়। অধিরাজের চোখদুটো ঘোলাটে। ঠিকমতো তাকাতেও পারছে না। সে শুধু একটা কথাই বারবার বলে যাচ্ছে—
‘আমি লোকটাকে মেরেছি… আমি লোকটাকে মেরেছি… আমি লোকটাকে….!’
(১৮)
ডঃ চ্যাটার্জির মুখে দুশ্চিন্তার রেখা। তিনি অধিরাজের পালস দেখছিলেন। অধিরাজ তাঁর টেবিলের ওপরে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। একটু আগেও ছটফট করছিল। আপনমনেই বকবক করে যাচ্ছিল। অর্থহীন প্রলাপ বকছিল। বারবার বলছিল, ‘চুড়ি না চাবি?… চুড়ি না চাবি?’ এখন চুপ করেছে। বেশ কিছুক্ষণ অস্থিরতার পর এবার একদম শান্ত হয়ে গিয়েছে। চোখদুটো বোঁজা। মুখে একটা অসন্তোষের ছাপ। যেন এখনও কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে।
আহেলি একদৃষ্টে অধিরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি করুণ। আইভি-র মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। সে সবার অলক্ষ্যে অধিরাজের একটা হাত ছুঁয়ে আছে। সবার অলক্ষ্যে হলেও অর্ণবের অলক্ষ্যে নয়। সে ঠিকই লক্ষ্য করেছে ব্যাপারটা। কৌশানী বোসের চোখে মুখে স্পষ্ট আফসোস! সে ডঃ চ্যাটার্জির দিকে তাকায়, ‘ঠিক কী হয়েছে স্যার?’
‘কী আর হবে? হি ইজ অন আ ট্রিপ!’ ডঃ চ্যাটার্জি অর্ণবের দিকে তাকালেন, ‘তোমরা বাইরে কিছু খেয়েছিলে?’
‘বাইরে?’ অর্ণব সন্ত্রস্তভাবে মাথা নাড়ে, ‘না তো!’
‘চা-কফি? কোল্ড ড্রিঙ্কস?’
‘না স্যার। আমরা কিছুই খাইনি।’
‘তাহলে মালটা ঢুকল কোন্ পথে! ইন্হেল করেছে?’
ডঃ চ্যাটার্জি খুব মন দিয়ে অধিরাজের নাক পরীক্ষা করে দেখলেন। তাঁর অভ্যস্ত চোখে নাকের আগায় সাদা পাউডারের ট্রেস ঠিকই ধরা পড়ল। তিনি খুব সাবধানে নমুনা সংগ্রহ করলেন। আইভি-র দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ব্লাড স্যাম্পল নাও তো। মনে হচ্ছে খুব স্ট্রং হ্যালুসিনোজেন। প্রব্যাবলি এল.এস.ডি পাউডার। কতখানি গেছে তা টেস্ট না করে বলা যাবে না
এতক্ষণে কিছু একটা করতে পেরে আইভি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে তাড়াতাড়ি সিরিঞ্জ নিয়ে ব্লাড স্যাম্পল নিতে যায়। কিন্তু অর্ণব দেখল তার হাত কাঁপছে। মেয়েটা সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে ফোটাবে কী ফোটাবে না ভাবছিল, তার আগেই একরকম তার হাত থেকে ছিনিয়েই নিল আহেলি। আস্তে আস্তে বলল, ‘হাত কাঁপলে ব্লাড স্যাম্পল কালেক্ট না করাই ভালো।’
আইভি-র মুখ কালো হয়ে যায়। আহেলি অভ্যস্ত হাতে ব্লাড স্যাম্পল কালেক্ট করল। অধিরাজের মুখ এখন শান্ত। কিন্তু এখনও দরদরিয়ে ঘেমে চলেছে সে। ডঃ চ্যাটার্জি সযত্নে তার ঘাম মুছিয়ে দিলেন। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, 13 হ্যালুসিনেট করছিল কি?
অর্ণব ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়ে। অধিরাজ বারবার ওই লোকটার কথাই বলছিল। তার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছিল। সে ঠিকমতো চোখ খুলেও রাখতে পারছিল না। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল। ডঃ চ্যাটার্জির কথাই সম্ভবত ঠিক। কোনোরকমের হ্যালুসিনোজেনই হবে। কিন্তু দিল কী করে?
‘আপাতত আর কিছু করার নেই।’ডঃ চ্যাটার্জি বললেন, ‘ওকে এখন ঘুমোতে দাও। যখন ড্রাগটার কাজ শেষ হবে, তখন ঠিকই উঠে বসবে। স্ট্রং ইয়াংম্যান। এত সহজে হার মানবে না।’
পবিত্র এতক্ষণ পিছন থেকে সবই দেখছিল। এবার এগিয়ে এসে বলল, ‘সৌরীশের ডেডবডিটা দেখেছেন আপনি?’
‘ওঃ ইয়েস!’ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানালেন, ‘তার নাকেও আমি কিছু পাউডারের ট্রেস পেয়েছি। সম্ভবত যে হ্যালুসিনোজেনটা রাজাকে দেওয়া হয়েছে, সেটাই ঐ ভদ্রলোককেও দেওয়া হয়েছে। এই কেসে এই প্রথম কারোর ব্লাডে ড্রাগ পাওয়া যাবে। যদিও এখনই মৃত্যুর কারণ বলতে পারছি না। অনেক সময় ড্রাগের ওভারডোজেও মৃত্যু হয়। কিন্তু এখনই কিছু বলা উচিত হবে না।
অর্ণব আস্তে আস্তে বলে, ‘স্যার, লাশটার চতুর্দিকে শুধু ভাঙা পুতুলের স্তূপ ছিল! যত রাজ্যের পুরনো, ভাঙাচোরা, আধখাওয়া পুতুল! কেন?’
অর্ণবের প্রশ্নটা শুনে মুখ তোম্বা করে ফেললেন ডঃ চ্যাটার্জি, ‘কারণ ওর সম্ভবত পুতুলের মাঝখানে থাকতে ভালো লাগত।’ বলতে বলতেই আহেলি, আইভি এবং কৌশানীর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন, ‘এই যেমন রাজার সুন্দরীদের মাঝখানে থাকতে ভালো লাগে। অবস্থা দেখো! স্যান্ডউইচ বিটুইন থ্রি সুন্দরীজ! একজন মোমের পুতুল, একজন কালো আগুন তো আরেকজন সোনালি! লে পাগলা, খাবি কী ঝাঁঝেই মরে যাবি!’
‘কিন্তু ভদ্রলোক এত কিছু থাকতে নিজের চতুর্দিকে পুতুল কেন সাজিয়ে রাখলেন? তা-ও আবার নতুন নয়, পুরনো, হাত-পা ভাঙা পুতুল!’
‘আমায় ছাত্রবন্ধুটা দিয়ে মরেনি বাপু!’ ফরেনসিক বিশারদ মুখভঙ্গি করেন, ‘ওর শখ হয়েছে, তাই সাজিয়ে রেখেছে। লোকে শোকেসে সাজায়, ও নিজের চারদিকে সাজিয়েছে। ব্যস।’
অর্ণবের কেমন যেন ধাঁধাঁ লাগে। একটা লোক মরার আগে নিজের চতুর্দিকে পুতুল সাজিয়ে রাখবে কেন? ওই পুতুলের মাধ্যমে সে কি কিছু বলতে চেয়েছিল? ওই পুতুলগুলোর মধ্যে কি কোনও ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে!
‘পুতুলগুলো আমি পরীক্ষা করে দেখেছি।’ ডঃ চ্যাটার্জি যেন অর্ণবের মনের কথা জেনে ফেলেছেন, ‘ওর মধ্যে কিছুই নেই। ফিঙ্গারপ্রিন্টও পাওয়া যায়নি। তবে তুমি যা বলছ, পুতুলগুলো ঠিক ততটা পুরনো নয়। বরং সদ্যই কেনা হয়েছে। কিন্তু তারপর সেগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে। হাত পা ভেঙে, চোখ উপড়ে নিয়ে বীভৎস দর্শন করে দেওয়া হয়েছে। এমন সুন্দর পুতুলগুলোর কী অবস্থা! মানুষ ঠিক কতটা নিষ্ঠুর হলে পুতুলগুলোকে এমনভাবে নষ্ট করতে পারে!
অর্ণবের চোখের সামনে আবীরের নিষ্ঠুর মুখটা ভেসে উঠল। কনডাক্ট ডিজ-অর্ডার! নিষ্ঠুরতার চরম নিদর্শন। সে অসহায়ভাবে অধিরাজের দিকে তাকায়। অধিরাজ এখন গভীর ঘুমে ডুবে আছে। তার মুখে এখন নিশ্চিত্ততার ছাপ। হয়তো এই মুহূর্তে আর কোনোরকম দুঃস্বপ্ন সে দেখছে না। যে দুঃস্বপ্ন এতদিন তাকে তাড়া করছিল, সেই দুঃস্বপ্ন থেকে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। লোকটাকে আবার মারতে পেরেছে।
‘তবে দুটো পুতুলের ভাঙা হাত থেকে আমরা সুতোর স্যাম্পল পেয়েছি। আহেলি, প্লিজ।’
আহেলি এতক্ষণ একটু মনমরাই হয়েছিল। এবার শান্ত স্বরে বলল, ‘সুতো ঠিক বলা চলে না। একটা আঁশের মতো। কিন্তু তাতে ফিফটি পার্সেন্ট ন্যাচারাল ফাইবার, থার্টি টু পার্সেন্ট নাইলন, এইট্রিন পার্সেন্ট লাইক্রা, আর এক পার্সেন্ট মতো ন্যানো সিলভার আর ন্যানো কপার আছে।’
বলাই বাহুল্য পুরোটাই অর্ণবের মাথার ওপর দিয়ে গেল। সে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ‘মানে?’
‘মানে বলা একটু মুশকিল। কিন্তু ন্যাচারাল ফাইবারের মধ্যে অ্যালপ্যাকা উল আর মেরিনো উল আছে। তার সঙ্গে আবার নাইলন। দেখে মনে হচ্ছে মোজা বা গ্লাভস গোছের কিছু একটা হবে।
‘মোজা বা গ্লাভস!’
অর্ণবের চক্ষু চড়কগাছ। এই গরমের সময়ে কে মোজা পায়ে দিয়ে বসে থাকে। গ্লাভসই বা পরবে কোন্ পাগলে!
‘আমার মনে হয় জিনিসটা নি-ক্যাপও হতে পারে।’ ডঃ চ্যাটার্জি একটু সদয় হয়েই বললেন, ‘অন্তত ফাইবারটা দেখে তেমনই মনে হচ্ছে।’
‘ওকে।’
অর্ণব আর কথা বাড়ায় না। এসব তার মাথায় কোনোদিন ঢোকেনি। আজও ঢুকবে না। তার চেয়ে যে লোকটা বুঝবে তাকে সুস্থ হতে দেওয়াই ভালো। এসব নি-ক্যাপ, মোজার চক্কর স্যারই বুঝে নেবেন। এখন শুধু তার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা
তুমি কি আজকে এখানে থেকে যাবে অর্ণব?’
পবিত্র অর্ণবের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। অর্ণব ইতিবাচকভাবে মাথা ঝাঁকায়, ‘হ্যাঁ স্যার। যদি কিছুর দরকার পড়ে!
‘দরকার তেমন কিছুর পড়বে না।’ ডঃ চ্যাটার্জি বলেন, ‘কিন্তু আমি বললেই বা শুনছে কে! তবে বাপু এটা ফরেনসিক ল্যাব, গড়ের মাঠ নয়। একজনের বেশি আমি অ্যালাউ করব না।’
‘আমি থাকছি।’ অর্ণব বলল, ‘আমি বাইরেই বসে আছি। প্রয়োজন হলে ডেকে নেবেন।’
‘বাইরে বসে সারা রাত কাটাবে!’ ডঃ চ্যাটার্জি চোখ প্রায় তাঁর টাকে তুলে ফেলেছেন, ‘তুমি তো নিরূপা রায়ের মতো সতী সাধ্বী বউয়ের অ্যাকটিং করছ দেখছি! বাইরে বসে সারা রাত মশার ফলার হওয়ার চেয়ে ভালো তুমি আমার কেবিনেই বসো। আমি এখানে থাকছি। আইভি!’
আইভি অধিরাজের মুখের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়েছিল। ঘুমিয়ে থাকলে লোকটাকে অবিকল একটা শিশুর মতো লাগে! কী মায়াবী তার মুখ! মুখের ছাঁচটা একেবারে নিখুঁত। কাটা কাটা নাক মুখ চোখ যতটাই তীক্ষ্ণ, ঠিক ততটাই লাবণ্যে ভর পুর। কপালে অল্প অল্প স্বেদবিন্দু চিক চিক করছে। তার খুব লোভ হচ্ছিল, ঘামটা মুছিয়ে দেয়। কিন্তু এ ক-দিনে বুঝেছে যে তার একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী আছে এবং তারা মোটেই তাকে পছন্দ করছে না। তাই মনের ইচ্ছে মনেই লুকিয়ে রাখল সে।
‘আইভি!’
অধিরাজের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল আইভি। এবার ডঃ চ্যাটার্জির হাঁকে সম্বিত ফিরল তার।
‘তখন থেকে ডাকছি, কানে যাচ্ছে না? তুমি কি ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছ নাকি?’ ডঃ চ্যাটার্জি ভয়ানক ভ্রূকুটি করেছেন, ‘না তোমাকেও কেউ হ্যালুসিনোজেন দিয়েছে!’
আইভি কোনোমতে সামলে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে, ‘না স্যার… মানে ঐ আর কী…!
আর কিছু বলার আগেই চোখে পড়ল আহেলি মুখার্জি কটমটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে একটা ঢোঁক গিলে বাকি কথাগুলো চেপে যায়।
‘রাজার ব্লাড প্রেশারটা চেক করো।’ তিনি হুংকার দিয়ে ওঠেন, ‘ঘণ্টায় ঘণ্টায় মনিটর করতে থাকো। যদিও আমার মনে হয় না ড্রাগটা খুব বেশি ডোজে ওর শরীরে গিয়েছে। তবু সতর্ক থাকাই ভালো।’
‘ওকে স্যার। ‘
কিন্তু প্রেশার মাপার যন্ত্রটা সে ছোঁয়ার আগেই আহেলি এক খামচা মেরে নিয়ে নিয়েছে। তারপর ডঃ চ্যাটার্জির দিকে ফিরে নম্রস্বরে বলল, ‘আমি দেখছি।’
ইঙ্গিত স্পষ্ট! আইভি-র মনে হল আহেলি তাকে অধিরাজের ধারে কাছে ঘেঁষতেই দেবে না। সে নিজের রাজত্ব কায়েম রাখতে চায়। বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও যে ছাড়বে না তা তার হাবেভাবেই বোঝা যাচ্ছে। আইভি হতাশ হয়ে সেখান থেকে সরে আসে।
আপাতত এত রাতে আর কিছু করার নেই। ফরেনসিক রিপোর্ট আসতেও সময় লাগবে। অগত্যা অর্ণব ডঃ চ্যাটার্জির কেবিনে বসে টাইম পাস করার জন্য টিভিটাই অন করল। এমনিতেই মনে মনে তার আফসোস হচ্ছিল। খুনটা কিছুতেই আটকানো গেল না! যদিও অফিশিয়ালি এদের কাউকেই প্রোটেকশন দেওয়ার উপায় নেই। তবুও সে আশা করেছিল, এবার হয়তো খুনীকে আটকানো যাবে। কিন্তু খুনী তাদের টেক্কা দিয়ে গেল! তার মনে এখনও একটাই প্রশ্ন ঘাঁই মেরে চলেছে। সৌরীশের চতুর্দিকে পুতুলগুলো কী করছিল! তাও আবার ওরকম ভাঙাচোরা পুতুল!
অর্ণব অন্যমনস্কভাবে চ্যানেল সার্ফ করছিল। এই মুহূর্তে তার ফিল্ম দেখার ইচ্ছে নেই। সেজন্যই সে নিউজ চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। কিন্তু টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজ চ্যানেলে চোখ পড়তেই তার চক্ষু চড়কগাছ! টিভির পরদায় ভেসে উঠল শ্রুতি চ্যাটার্জির চেহারা। সে এই মুহূর্তে সৌরীশের ফ্ল্যাটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে! হাতে বুম নিয়ে রিপোর্টিং করতেই ব্যস্ত। অর্ণব টিভির ভলিউম বাড়ায়। শ্রুতির ধারালো কণ্ঠস্বর গোটা কেবিনে গম গম করে ওঠে, ‘ফের রহস্যময় মৃত্যু ঘটল ফোবিয়ান্সের পঞ্চম সদস্যের। আজ রাতে নিজের ফ্ল্যাটেই হার্টফেল করে মারা গেলেন সৌরীশ গাঙ্গুলি।…’
মেয়েটা আবার সবার আগে সৌরীশের মৃত্যুর খবরটা জেনে গিয়েছে!
(১৯)
‘একের পর এক ফোবিয়ান্সের সদস্যদের মৃত্যু প্রশ্ন তুলে ধরছে পুলিস প্রশাসনের কাছে। জেজিইসির এই প্রাক্তনীদের আকস্মিক মৃত্যুর পেছনে আসলে ঠিক কী রহস্য লুকিয়ে আছে? আদৌ কি এই মৃত্যুগুলো ঠিক ততটাই স্বাভাবিক, যতটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়? কো-ইনসিডেন্স না অন্য কিছু? সৌরীশের মৃতদেহের চারপাশে পড়েছিল অসংখ্য পুতুল! তাঁর মৃত্যুতে কি পুতুলগুলোর কোনো ভূমিকা আছে? পুলিস এখনও এসব বিষয়ে নিরুত্তর…!’
টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজ চ্যানেলের বুলেটিনটা মন দিয়ে শুনছিলেন আবীর। আজকাল রাত্রে ঘুম আসে না তার। তাই নিউজ চ্যানেল দেখছিলেন। কিন্তু খবরটা শোনামাত্রই তার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। সৌরীশও তবে…!
এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়। কিছুতেই হতে পারে না! সৌমিত্রর মৃতদেহ পাওয়া গেল মর্গে! মৃন্ময়ের মৃতদেহ এম.আর.আই মেশিনে! উৎপল সতেরো তলা থেকে ঝাঁপ দিল! শর্বাণী ঝড়-বৃষ্টির দিনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল! সৌরীশ হার্টফেল করল ঠিকই, কিন্তু তার চারপাশে পুতুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। অন্য কিছু নয়, স্রেফ কতগুলো নিরীহ পুতুল!
আবীর কাঁপা কাঁপা হাতে রিমোটটা তুলে নিলেন। তারপর টিভিটা অফ করে দিলেন। তার আর খবরটা দেখার কোনো ইচ্ছে নেই! সৌরীশও খুব ভয় পেয়েছিল। পুলিসকে সব বলে দেবে ভেবেছিল। কিন্তু তার আগেই….!
কথাটা মনে হতেই একটু যেন আশ্বস্ত হলেন তিনি। আরেকটু হলেই মুখ খুলছিল বোকাটা! ও পুলিসের কাছে গেলে নির্ঘাৎ হাতে হাতকড়া পড়ত। বাকিরা আর জেলের ভাত খাওয়ার জন্য বেঁচে নেই। উমাও আর কয়েকদিনের অতিথি মাত্র। সব ঝামেলা পোয়াতে হত আবীরকেই! আবীরের বেঁচে থাকার জন্য সৌরীশের মরার প্রয়োজন ছিল। মরেছে, বেশ হয়েছে। আপদ গেছে! এখন আর কেউ কথায় কথায় পুলিসে যাওয়ার হুমকি দেবে না! সৌরীশটা চিরকালই বোকা আর ন্যাকা! এক নম্বরের ভীতুর ডিম….!
ভাবতে ভাবতেই আবীরের ভুরু অসন্তোষে কুঁচকে গেল! কিন্তু সৌরীশকে মারল কে! সত্যিই কেউ মারল, না নিজে থেকেই মরেছে! আর যাই হোক, সে নিজে থেকে তার চারিদিকে পুতুল এনে সাজাবে না। সৌরীশের মারাত্মক পিডিওফোবিয়া ছিল। ও পুতুলকে ভয় পেত! ভাবা যায়! কতগুলো নিরীহ পুতুলকে কেউ ভয় পেতে পারে তা সৌরীশকে না দেখলে জানতেই পারতেন না আবীর। বাঘ নয়, সিংহ নয়, কতগুলো পুতুলমাত্র! তাতেই কী ভয়!
কিন্তু… কিন্তু এরপর কী? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এরপর কে? হারাধনের পাঁচটা ছেলে তো আগেই চলে গিয়েছে। এখন বাকি মাত্র দু-জন। তার মধ্যে একজনকে মারা মানে মুক্তি দেওয়া! আর বাকি থাকলেন একা আবীর! তবে কি এবার তার পালা!
হ্যাঁ, এগুলো একধরনের খুনই। ওরা প্রত্যেকে নিজের নিজের ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। লড়ার সাহস ছিল না। তাই মৃত্যুই অবধারিত। কিন্তু আবীরের ভয়? আবীরের কীসের ভয়? কোনো ভয় নেই! কোনো ভয় নেই…!
আপনমনেই হা হা করে হেসে ওঠেন আবীর। আয়, কে ভয় দেখাবি আয়! আবীর সেন কাউকে ভয় পায় না! সে নির্ভীক। আজ পর্যন্ত কোনো শালাকে ভয় পায়নি সে! না মৃত মানুষে, না উচ্চতায়, না ঝড়-বৃষ্টিতে, না পুতুলে, কিছুতেই ভয় নেই তার। বরং আবীর সেন স্বয়ং সাক্ষাৎ ভয়ের নাম! কলেজ জীবনে তার ভয়ে বাকিরা কাঁপত বাঘের মতো ভয় পেত তাকে! আতঙ্ক কাকে বলে তা অনেককেই বুঝিয়ে ছেড়েছেন তিনি। জুনিয়রদের র্যাগিং করতে খুব ভালোবাসতেন। ওদের দু-চোখে ত্ৰাস, ওদের অসহায় কান্নাকাটি তাকে একরকম তৃপ্তি দিত। মনে হত, তিনি এ পৃথিবীর রাজা!
আজও আবীর সেন অপ্রতিরোধ্য, অদম্য! তাকেই সবাই ভয় পায়, তিনি কাউকে ভয় পান না! চাইলে এখনও অনেক সাহসী মানুষের শিরদাঁড়ায় কম্পন ধরিয়ে দিতে পারে তার নিষ্ঠুর বাঘের মতো চাউনি। কর্মক্ষেত্রে অধস্তনরা তার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। তার ধমকে-চমকে, হাঁক-ডাকে সবাই সর্বক্ষণই সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। এমনকি ওপরওয়ালারাও তাকে সমঝে চলেন। এই দুনিয়াটা আসলে ভয়েই চলে! তাই ভয় পেলে চলে না, ভয় দেখাতে হয়। তবেই এখানে টিঁকে থাকা যায়। আবীরের নিষ্ঠুর চোখদুটো চক চক করে ওঠে। এভাবে হারানো যাবে না তাকে। এত সহজ নয়! ভয়ের সঙ্গে চিরদিনই পাঞ্জা কষেছেন আবীর! চিরদিনই জিতেছেন!
কিন্তু যদি আজ হেরে যান! যদি মৃত্যু ভয়ংকর মূর্তিতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় তবে কী করবেন! আবীরের হাসিমুখ মুহূর্তের মধ্যে ভয়ে শুকিয়ে যায়। মরতে নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট হয়। সেজন্যই তো বলে ‘মরণযন্ত্রণা।’ তাকেও কি সেই যন্ত্রণা পেতে হবে! মৃত্যু তো তাকে ভয় পাবে না!
মনে মনে আফসোস হয় আবীরের। ভারতবর্ষে ফিরে আসাটাই কাল হয়েছে তার! কেন যে মরতে ফিরে এসেছিলেন! বিদেশে থাকলে কেউ তার টিকিটিও ছুঁতে পারত না। কে জানে এতদিন পরে কার মধ্যে আবার প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল। কে জানে কে আড়ালে হিংস্র হাসি হাসছে। বিশ্বাস নেই… কাউকে বিশ্বাস নেই! যে কেউ হতে পারে। মাঝেমধ্যে তার মনে হয়, একজোড়া চোখ গোপনে তার ওপর নজর রাখছে। কেউ তার গায়ে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে…!
হু হু করে একরাশ হাওয়া তাকে ছুঁয়ে গেল। প্রায় আঁতকেই উঠলেন আবীর। হাওয়া নয়, যেন কোনো মৃত মানুষের স্পর্শ! অথবা স্বয়ং মৃত্যুর শীতল ইঙ্গিত! আবীরের হৃৎস্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে যায়। বাইরে গাছের পাতায় কেমন একটা খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে না! বাইরে কার পদশব্দ! কেউ আসছে!
একরকম দৌড়েই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। তাড়াতাড়ি ছিটকিনি এঁটে দিলেন। কাউকে এ ঘরে আসতে দেবেন না। কাউকে না! কাউকে বিশ্বাস নেই! যে কেউ হতে পারে। সে যে কেউ হতে পারে! যে কোনো জায়গায় থাকতে পারে। হয়তো এ ঘরের বাইরেই আছে! অথবা বাইরে কোথায় লুকিয়ে থেকে এদিকেই দেখছে। হয়তো অন্ধকারে তার সবুজ চোখদুটো মেপে নিচ্ছে তাকে। হয়তো ভাবছে ঠিক কতটা কষ্ট দেওয়া যায়, কতটা অত্যাচার করা যায়! ও সবাইকে কষ্ট দিয়ে মেরেছে। তাকে কি আদৌ ছাড়বে? নাঃ, ছাড়বে না। সবার কাল এসেছে, তারও আসবে।
দরদরিয়ে ঘাম ছুটল আবীরের। কোথায় সেই একটু আগের দেখা তথাকথিত ডেয়ার ডেভিল আবীর সেন! এখন তার জায়গায় একটা ভীতু মানুষ বসে আছে! যেন ফাঁসির আসামী! যার ব্ল্যাক ওয়ার্যান্ট সাইন করা হয়ে গিয়েছে। এখন ফাঁসির অপেক্ষায় তিল তিল করে প্রহর গুণতে গুণতে মরছেন তিনি! প্রতিটা নিঃশ্বাস মেপে মেপে নিতে হচ্ছে। আশঙ্কা, এই বুঝি অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়! দমবন্ধ হয়ে আসছে যেন। বুকের মধ্যে অসহ্য একটা ভার! অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে তার! ভীষণ কষ্ট!
যেদিন থেকে এ বাড়িতে পুলিস এসেছে সেদিন থেকেই অসম্ভব ভয় করছে তার। প্রথমে ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে হয়েছিল। ফোবিয়ান্সের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও কিছু কমন ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কানেকশন ছিল। সৌমিত্রর হার্ট অ্যাটাকের কেসটা তাদের কাছ থেকে শুনে মুষড়ে পড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তখনও কিছু মনে হয়নি। তারপরই যখন মৃন্ময়ের মৃত্যুর কথা শোনেন তখনই মনে একটা খটকা লেগেছিল। পরপর দুই বন্ধুর মৃত্যুর খবরটা তখনও কাকতালীয়ই মনে হয়েছিল। শুধু মনে হয়েছিল, ওরা দু-জনেই এত তাড়াতাড়ি চলে গেল! তাও আবার এইভাবে!
কিন্তু উৎপলের মৃত্যুর পরই কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে তার। ফোবিয়ান্সের লিডার হওয়ার দরুণ প্রত্যেকেরই ফোবিয়ার খবর রাখতেন। প্রত্যেকের মৃত্যুর প্যাটার্ন দেখে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আশঙ্কা ফণা তুলতে শুরু করে। এভাবে তো ঠিক ওদের মারা যাওয়ার কথা নয়! সৌমিত্র মৃতদেহ এড়িয়ে চলত। মৃন্ময় বদ্ধ জায়গা। উৎপল উচ্চতা দেখলেই পালিয়ে যেত, অথচ সেই লোকই কি না সতেরোতলা থেকে ঝাঁপ মারল!
তারপর তো কথাই নেই! টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজ চ্যানেল যেদিন প্রকাশ্যে এই কথাটা বলল, সেদিন থেকেই ভয়ে ভয়ে আছেন আবীর। সৌরীশকে ভীতু বললেও আসলে তার নিজের মনেও আশঙ্কার মেঘ গুড়গুড়িয়ে উঠেছিল। যদিও বা মিডিয়ার কথাগুলোকে গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়ার একটা রাস্তা ছিল, কিন্তু মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো পুলিসও এসে পড়ল! সি.আই.ডি হোমিসাইডকে নিজের বাড়িতে দেখেই প্রায় হার্টফেল করতে বসেছিলেন! একদিকে মৃত্যুভয়, অন্যদিকে তদন্তের আতঙ্ক! কে বলতে পারে ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিস কুড়ি বছর আগের মৃত ইতিহাসকে খুঁড়ে বের করবে না! তখন কী হবে!
আবীরের মনটা এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছে। একটা মন বলে, পুলিসের কাছে সব কথা স্বীকার করে প্রোটেকশন নেওয়াই ভালো, নয়তো মৃত্যু অবধারিত। মনের আরেকদিক বলে, স্বীকার করলেই জেলে যেতে হবে! তাহলেই মামলা, মোকদ্দমা, শাস্তি! জীবনটা যেন শাঁখের করাত! যেতেও কাটছে, আসতেও কাটছে! প্রতিটা দিন সকালবেলা চোখ খুললেই বুকের ভেতরে যেন হাতুড়ি পেটা শুরু হয়! মনে হয়, এই দিনটা কাটবে তো! রাত্রে যখন ঘুমোতে যান তখন আবার মনে হয়, এ ঘুম ভাঙবে তো! অদ্ভুত একটা ভয় তাকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ধরছে। কখনোই মনে শান্তি নেই! এ যন্ত্রণার যেন কোনো শেষ নেই! সীমা-পরিসীমা নেই!
অন্যদিকে উমাকে কিছু না বললেও তিনি আবার অনেক কিছুই নীরবে বুঝে ফেলেন। হঠাৎ করেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘আচ্ছা, সত্যিই কি তোমরা আকাশকে কিছু করেছিলে?’
সচরাচর ফোবিয়ান্সের র্যাগিঙের ব্যাপারে উমা থাকতেন না। তার এসব ভালো লাগত না বলে দূরেই থাকতেন। উৎসাহও দিতেন না, বাধাও দিতেন না। তাই সে রাতের কথা একমাত্র উমাই জানেন না। আন্দাজ হয়তো করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছিল তা তার অজানা।
আবীর তার এ প্রশ্নে ঘাবড়ে যান, ‘কেন?’
উমা ক্লান্তভঙ্গিতে বললেন, ‘আকাশের মা অভিশাপ দিয়েছিলেন তোমাদের! ওঁর অভিযোগে সত্যতা কিছু ছিল কি?’
আবীর মনে মনে ভয় পেলেও বাইরের তথাকথিত ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাবটা বজায় রেখেছিলেন, ‘ওসব অভিশাপ-টাপে কিছু হয় না।‘
‘তাহলে এতদিন বাদে এমন কী ঘটল যাতে আমাদের ফোবিয়ান্সের মেম্বাররাই এক এক করে মারা যাচ্ছে! তোমার মনে হয় না, কেউ প্রতিশোধ নিচ্ছে?’
মনে যথেষ্টই হয়। আগেই হয়েছিল। পুলিস এসে পড়ায় তো শিলমোহর পড়ে গেল। কেউ না কেউ শোধ তুলছেই। কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করবেন না আবীর। তিনি আবীর সেন! যার নামে একসময় কাঁপত জেজিইসি। কেন ভয় পাবেন তিনি! ভয় পেতেই পারেন না। তাই অনমনীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘পুরোটাই কো-ইনসিডেন্স।’
‘কো-ইনসিডেন্স!’ উমা একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘তুমি অ্যাট লিস্ট আকাশের মায়ের কথাটা পুলিসকে বললে না কেন? ওন্ থ্রেট দিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা।’
‘ওরকম থ্রেট অনেক দেখেছি। কোনও সা-লার ধ্বক্ নেই।’
আবীর ঠোঁট উলটে অবহেলাভরে কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু তার বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠেছিল। আর যাই হোক, হোমিসাইড যে ঠাট্টা করেনি তা অনস্বীকার্য। হয়তো সত্যিই কেউ বদলা নিচ্ছে! কিন্তু এত বছর পর কেন!
হঠাৎই দরজায় করাঘাত। কেঁপে উঠলেন আবীর। একটা শিরশিরে কাঁপুনি ঘিরে ধরছে তাকে। কোনোমতে বললেন, ‘ক্কে?…কে?’
‘বাবু… আমি!’
বাইরে থেকে রতনের কাতর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘মায়ের শরীর খারাপ করতিছে বাবু, দরজা খোলেন।’
উমার শরীর ভালো কবে ছিল! আবীরের মুখে সামান্য বিরক্তি ভেসে ওঠে। এত রাতে আবার নতুন করে কী হল! তিনি আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন….!
‘মা জোরে জোরে শ্বাস টানতিছে বাবু, দরজা খোলেন।’
আবার প্রবল করাঘাত। কিন্তু দরজার দিকে পা বাড়িয়েই থমকে গেলেন আবীর। তার মনে হল, এটা একটা চালও হতে পারে! রতনকে দেখলেই আজকাল ভয় করে! ওর চোখদুটো যেন খুনীর চোখ! ও নিজের সম্পর্কে যতটুকু জানিয়েছে ঠিক ততটাই জানেন আবীর ও উমা। পুলিস ভেরিফিকেশন করতে যাননি। এখন সেটাই ভেবে আফসোস হল আবীরের। রতনও খুনী হতে পারে! কেউ সন্দেহের বাইরে নয়। কেউ না!
‘বাবু, মা কেমন করতিছে…।’
এবার রতনের গলায় স্পষ্ট হাহাকার! সবটাই এক কুশলী অভিনেতার অভিনয় হতে পারে। বন্ধুর ছদ্মবেশে শত্রু! ওঁত পেতে আছে শুধু সঠিক সময়ের জন্য! দরজা খুললেই হয়তো কাল সামনে এসে দাঁড়াবে!
‘না!’
আবীর চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আমি দরজা খুলব না। কিছুতেই না….’
‘কিন্তুক মা..!’
‘পৃথিবী উলটে গেলেও আমি দরজা খুলব না! যা খুশি হোক!’
বলতে বলতেই আবীর দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েন।