১৯. মৃত্যু আর নীরবতা
মৃত্যু আর নীরবতা
বহুদিন ধরে অসুস্থ ডোরা। আমার বাচ্চা-বৌ যে এত সহসা ছেড়ে যাবে আমাকে তা কি আমি জানতাম? ডাক্তাররা বলেছিলেন আমাকে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি।
এক রাতে ও আমাকে বলল যে এটাই হয়তো ভাল। আমি ছিলাম ছোট্ট বাচ্চা। বয়সের দিক থেকে নয়, মনের দিক থেকে। অভিজ্ঞতার দিক থেকে। বৌ। হবার যোগ্যতা আমার ছিল না। কিসে তোমার আনন্দ, কিসে তোমার সুখ তা, বোঝার মত বুদ্ধি আমার ছিল না।
আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ডোরা, প্রিয় ডোরা, তোমাকে নিয়ে আমি অনেক অনেক সুখী হয়েছি। ওরকম কথা তুমি বোলো না।
সে রাতে ডোরা অ্যাগনেসকে দেখতে চাইল। অ্যাগনেসকে সে ভয় করত। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল অ্যাগনেস-এর মত মেয়েকে ফেলে আমি ওকে বিয়ে করলাম কেন। হেসে বলেছিলাম, তোমাকে দেখামাত্রই প্রেমে না পড়ে পারিনি যে! অ্যাগনেস এল খবর পেয়ে। আমি বসে রইলাম নিচে আগুনের ধারে। আমার ভালবাসার দুই নারী আলাপ করতে লাগল একান্তে। জিপ আমার পায়ের কাছে বসে কুঁই কুঁই করতে লাগল ওপরে, ডোরার কাছে যাবার জন্য।
আজ রাতে নয়, জিপ, বললাম তাকে।
কুকুরটি আমার পায়ের কাছে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল…কেঁদে উঠল কেউ করে…তারপর মরে গেল হঠাৎ!
সেই মুহূর্তে অ্যাগনেস নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতে। মুখটা ওর শোকে-দুঃখে কাতর। দুই হাত আকাশের দিকে তোলা। শেষ হয়ে গেছে সব। আমার প্রিয় ডোরা, প্রাণের ডোরা, আমার বাচ্চা-বৌ আর নেই।
ভাবলাম আমার জীবনও শেষ হয়ে গেল। কবরই আমার একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু দাদী বললেন কিছুদিন আমার বিদেশে কোথাও বেরিয়ে আসা উচিত। রাজি। হলাম। কিন্তু হীপ-এর চূড়ান্ত বিনাশ দেখা এবং মিকবার ও পেগোটিদের বিদায়ের আগে গেলাম না।
ক্যান্টারবেরিতে ফিরে এলাম আমরা। উইকফিল্ডদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম খাতাপত্র আর কাগজের স্তুপের পেছনে বসে আছে ট্র্যাডলস। ট্র্যাডলস আমাদেরকে বলল যে মি. ডিক সারাক্ষণ যত্ন নিচ্ছেন মি. উইকফিল্ডের ৷ তিনি। এখন অনেকটা সুস্থ। প্রায় আগের মত হয়ে উঠেছেন। ট্র্যাডলস হিসেব করে দেখেছে নিজের ব্যবসা ও বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করার মত প্রচুর টাকা মি. উইকফিল্ডের থাকবে।
আর, মিস ট্রটউড, মি. মিকবারের মুখেই তো শুনেছেন যে আপনার টাকা লগ্নীও করা হয়নি, হারায়ওনি। উরিয়া গায়েব করে রেখে দিয়েছিল।
উরিয়া হীপ যে বিদায় নিয়েছে এজন্য আমি খোদাকে ধন্যবাদ দিলাম।
ডোরার মৃত্যুর খবর শুনেই ভগ্ন-হৃদয় পেগোটি আমার কাছে চলে এসেছিল কিছুদিন কাটিয়ে যাবে বলে। হ্যামের ব্যাপারে আলাপ হলো আমাদের। সেদিনই সন্ধ্যায় তাকে দেখার জন্য ইয়ারমাউথে যাব বলে স্থির করলাম। সে হয়তো চাইবে আমাকে দিয়ে এমিলিকে একটা চিঠি লেখাতে।
সাগর তীরের শহরটির দিকে যেতে যেতে বাতাসের গতিবেগ বাড়তে লাগল। শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের প্রবল তোড়ে বালি, পাথর উড়তে লাগল। মুষলধারে নামল বৃষ্টি। বিরাট বিরাট উে তুলে সাগর ছুটে আসছে সগর্জনে। বুঝিবা গ্রাস করবে শহরটাকে। তবু দেখলাম, দলে দলে লোক ছুটে চলেছে সাগরতীরের দিকে।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলাম চেঁচিয়ে।
একটা স্কুনার (পালের জাহাজ)! তীরের কাছেই! দেখতে চাইলে শিগগির আসুন! স্পেন থেকে আসছে স্কুনারটি। যে কোন মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে!
ছুটে গেলাম তীরে। দেখলাম স্কুনাবটিকে। বন্দুকের গুলির মত তীব্র বেগে আসছে তীরে আছড়ে পড়ার জন্য।
একটি মাস্তুল ভাঙা। পালগুলো জড়িয়ে গেছে দড়িদড়া আর মাস্তুলে। জাহাজটি দোল খাচ্ছে ভয়ঙ্কর ভাবে। প্রচণ্ড আক্রোশে ফুলে ফেঁপে গর্জে উঠে। সাগর ছুঁড়ে ফেলল স্কুনারটিকে তীরবর্তী ফেনিল তরঙ্গের মধ্যে। জাহাজটি ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। একটি লোককে ক্ষণিকের জন্য দেখা গেল পাল আর দড়িদড়ার স্তূপ থেকে বেরিয়ে আসতে। পরক্ষণেই স্কুনারটি কাৎ হয়ে গেল। ( কারও সাহস হলো না ওই উত্তাল সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়ে ডুবন্ত লোকটিকে বাচাতে এগিয়ে যাবার। তারপর হঠাৎ লক্ষ করলাম হ্যামকে। জনতার ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে সে চলেছে সাগরের দিকে আমি ছুটলাম তার পিছু পিছু। দুহাতে। ধরে চেষ্টা করলাম তাকে আটকাতে। কিন্তু পারলাম না। সে যাবেই। মাস্তুল আঁকড়ে যে লম্বা কালো-চুলো লাল টুকটুকে টুপি পরা লোকটি বাঁচার চেষ্টা করছে ওকে সে উদ্ধার করবেই।
আমার দুহাত ধরে সে বলল, মাস্টার ডেভি, মরণ যদি এসে থাকে তবে আসুক। যদি না এসে থাকে, আমি বাঁচব। খোদা আপনার ভাল করুক!
হ্যামের কোমরে একটা দড়ি বাঁধা। সে ঝাঁপ দিল সাগরে। কিন্তু একটা প্রকাণ্ড ঢেউ তাকে পেছনে ছুঁড়ে দিল। আঘাত পেয়েছে সে। দেখলাম তার মুখে রক্ত। কিন্তু আবার সে ছুটে গেল জাহজ-ডুবির ওই জায়গাটার দিকে। একেবারে কাছাকাছি চলে গেল সে। কিন্তু সেই মুহূর্তে পাহাড়-সমান উঁচু এক ঢেউ এসে। তলিয়ে দিল স্কুনারটিকে! তীরের লোকেরা দড়ি ধরে টেনে হ্যামকে এনে ফেলল আমার পায়ের কাছে। হ্যাম মৃত।
তাকে আমরা নিয়ে গেলাম নিকটবর্তী বাড়িতে। আমি বসে রইলাম হ্যামের প্রাণহীন দেহের পাশে। একজন জেলে এল আমার কাছে। আমি আর এমিলি। যখন বাচ্চা ছিলাম তখন থেকেই আমাকে চেনে নোকটা।
কাঁপা কাঁপা স্বরে সে বলল, স্যার, আমার সঙ্গে একটু বাইরে আসবেন কি?
আমার হঠাৎ মনে পড়ল মাস্তুল আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টায় রত সেই নাবিকটির কথা।
আতঙ্কিত হয়ে জেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি তীরে এসেছে?
হ্যাঁ।
আমার পরিচিত কেউ?
সে জবাব দিল না। কিন্তু আমাকে নিয়ে চলল তীরের দিকে। সাগরতীরের যে জায়গায় শৈশবে আমি আর এমিলি ঝিনুক কুড়াতাম সেখানে দেখলাম একজন লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে বালুর ওপর মাথা রেখে। স্কুলে তাকে আমি প্রায়ই দেখেছি ওভাবে শুয়ে থাকতে। লোকটা জেমস স্টিয়ারফোর্থ!
ওরা একটা খাটিয়া নিয়ে এল। তাকে শুইয়ে দিল খাটিয়ার ওপর। যারা তাকে বয়ে নিয়ে চলল তারা সবাই তাকে চেনে। তার সঙ্গে পাল তুলে সাগরে গেছে। তার হাসি আনন্দে শরিক হয়েছে
সে রাতেই লাশটা আমি নিয়ে গেলাম লণ্ডনে। শুইয়ে দিলাম তার মায়ের ঘরে। মিসেস স্টিয়ারফোর্থ স্থির বসে রইলেন শক্ত হয়ে। দুচোখ মেলে চেয়ে রইলেন ছেলের লাশের দিকে। গোঙাতে লাগলেন অস্ফুট স্বরে। কিন্তু এ ছাড়া তার মধ্যে জীবনের আর কোন লক্ষণ দেখলাম না। আমি তার একটা হাত তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলাম। আমার মনে হলো গোটা পৃথিবী যেন ভরে গেছে মৃত্যু আর নীরবতায়।