ডেভিড কপারফিল্ড – ১৮

১৮. উরিয়া হীপের পতন

উরিয়া হীপের পতন

আমি ফিরে এলাম ইয়ারমাউথ থেকে। ক্যান্টারবেরিতে মি, মিকবারের সঙ্গে রহস্যজনক সাক্ষাৎকারের সময় হল। তাঁর আমন্ত্রণে আমরা চারজন—আমি, দাদী বেটসি, মি. ডিক আর ট্র্যাডলস। পৈৗছলাম হোটেলে। সঙ্গে সঙ্গে মি. মিকবার এসে হাজির হলেন আমাদের সামনে।

আমরা এখন ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাত কিংবা অন্য যে-কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত, বললেন দাদী মি. মিকবারকে।

মি. মিকবার বললেন, আপনারা শীঘ্রি একটা বিস্ফোরণ দেখবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমি কেবল এটুকু বলব যে মি. ট্র্যাডলস-এর সঙ্গে আমি পত্র বিনিময় করেছি, তিনি আমাকে সর্বোত্তম আইনগত পরামর্শ দিয়েছেন এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করছি। আমাকে তৈরি হবার জন্য পাঁচটা মিনিট সময় দিন। তারপর চলে আসুন উইকফিল্ড অ্যাণ্ড হীপ-এর অফিসে।

পাঁচ মিনিট পরেই আমরা গেলাম। পথে একটি কথাও হলো না আমাদের মধ্যে। দেখলাম মি. মিকবার নিচতলার অফিস ঘরে বসে কিছু লিখছেন, অথবা লেখার ভান করছেন।–

কেমন আছেন, মি. মিকবার? বললাম লোক-দেখানোর খাতিরে।

বিস্ময়ের ভান করে মি. মিকবার গম্ভীরমুখে বললেন, মি. কপারফিল্ড যে! ভাল আছেন তো?

মিস উইকফিল্ড বাড়িতে আছেন? জানতে চাইলাম আমি।

মি. উইকফিল্ড বাতের জ্বরে শয্যাশায়ী, তবে মিস উইকফিল্ড যে পুরানো বন্ধুদের দেখে খুশি হবে এতে সন্দেহ নেই। আসুন, স্যার, ভেতরে আসুন, বলে তিনি আমাদেরকে নিয়ে গেলেন ডাইনিং রূমে। সুরেলা গমগমে কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, মিস ট্রটউড, মি. ডেভিড কপারফিল্ড, মি. টমাস ট্র্যাডলস এবং মি. ডিক্সন!

ডাইনিং রূমে তাঁর গলার শব্দ শুনে উরিয়া হীপ এল ব্যাপার কি দেখতে।

ডক্টর স্ট্রং-এর বাড়িতে সেই চড় মারার পর থেকে উরিয়া হীপের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। আমাদেরকে দেখে বিস্মিত হলো সে। ঐ কোঁচকায়নি, কারণ। ভ্র বলতে কিছু তার নেই। তবে কপালটা এমনভাবে কোঁচকাল যেন চোখজোড়া। প্রায় বন্ধ হয়ে গেল তার। ঘামে চটচটে হাতের তালু যেভাবে তাড়াতাড়ি থুতনিতে চাপা দিল এতে মনে হলো বিচলিত হয়েছে সে। মিনিট খানেক পরে সামলে উঠে সে বলল:

তাই তো! কি আনন্দের কথা! পুরানো বন্ধুরা সবাই এসেছেন! মি কপারফিল্ড, আশা করি ভাল আছেন। মিসেস কপারফিল্ডও আশা করি ভাল। আছেন।

আমার হাতটা ধরে ঝাকুনি দিল সে। আমার লজ্জা লাগল তাকে আমার হাত ধরতে দিতে।

মিস ট্ৰটউড, আমি যখন এখানে সামান্য একজন কেরানী ছিলাম, আপনার ঘোড়া ধরে রাখতাম, তার পর থেকে এ অফিসের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তাই না? কিন্তু আমি বদলাইনি, মিসট্রটউড।

আমার দাদী জবাব দিলেন, আপনার মধ্যে তখন থেকে যে উদ্যম দেখা গিয়েছিল সেটা অক্ষুন্ন রয়েছে।

ধন্যবাদ, মিস ট্রটউড। মিকবার! মিস অ্যাগনেস আর মাকে খবর দিন। মা কি খুশিই না হবেন এঁদেরকে দেখে।

আপনি ব্যস্ত নন তো, মি. হীপ? প্রশ্ন করলট্র্যাডলস।

উরিয়া হীপ তার চেয়ারে বসে হাতের তালু দুটি জোড়া করে দুই হাঁটুর মধ্যে রেখে জবাব দিল, না, মি.ট্র্যাডস। তবে জানেন তো, আইনজীবী, হাঙর, আর জোঁক সহজে সন্তুষ্ট হয় না! আমার যে ব্যস্ততা নেই তা নয়। মি. উইকফিল্ড অসুস্থ। তাই আমার ও মিকবারের হাতে প্রচুর কাজ। কিন্তু তার জন্য কাজ করা আমার কর্তব্য। মি. ট্র্যাডল্‌স, আমি বোধহয় এই প্রথম আপনার সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্য লাভ করলাম?

অ্যাগনেস এসে প্রবেশ করল ডাইনিং রূমে। লক্ষ করলাম অ্যাগনেস আসতে হাসি ফুটল উরিয়ার মুখে।

মিকবার, আপনি এখন যেতে পারেন, বলল উরিয়া।

মি. মিকবার উরিয়ার চোখে চোখ রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার মুখে।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন, মিকবার? আপনার থাকার দরকার নেই বলেছি, শোনেননি?

শুনেছি।

তাহলে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?

আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই, বললেন মি. মিকবার গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে।

সবাই জানে আপনি একটা অসংযত লোক। আপনাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে হবে দেখছি। ঠিক আছে, যান, পরে কথা বলব আপনার সঙ্গে, বলল উরিয়া জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে।

প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে মি. মিকবার বললেন, দুনিয়াতে যদি কোন পাষণ্ড থাকে যার সঙ্গে আমি ইতিমধ্যেই বড় বেশি কথা বলে ফেলেছি, সেই পাষণ্ডের নামহীপ!

উরিয়া হেলে পড়ল চেয়ারের পিঠে। যেন কোন বিষাক্ত সাপের ছোবল খেয়ে, বা আকস্মিক আঘাত পেয়ে। তারপর ধীরে ধীরে চারদিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল, ওহ্-হো, এটা তাহলে একটা ষড়যন্ত্র! আগে থেকে পরিকল্পনা করেই আপনারা এখানে এসে মিলেছেন! আমার কেরানীর সঙ্গে যোগসাজশ করেছেন, তাই না, কপারফিল্ড? কিন্তু সাবধান! এতে আপনার কোন লাভ হবে না। আমার উন্নতি দেখে আপনার ঈর্ষা হচ্ছে, তাই না? কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কিছু হবে না। আমি পাল্টা ষড়যন্ত্র করব আপনাদের বিরুদ্ধে মিকবার, চলে যান। পরে আলাপ করব।

মি. মিকবার, এই লোকটার থোতা মুখটা ভোঁতা করে দিন, বললাম আমি।

গলার স্বর একই রকম রেখে উরিয়া বলল, আপনারা তো সাংঘাতিক লোক! আমার কেরানীকে কিনে ফেলা! লোকটা সমাজের আবর্জনা! তুমি ও কপারফিল্ড, অন্যের আশ্রয় পাবার আগে আবর্জনাই ছিলে। কি সাহস তোমার মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমার মানহানি করতে এসেছ? মিস ট্রটউড, এসব থামান। নইলে আমি আপনাকেও দেখে নেব। মিস উইকফিল্ড, বাপের জন্য দয়ামায়া থাকলে এই দলে যোগ দেবেন না! নইলে আপনাকে সর্বস্বান্ত করব আমি। মিকবার! ধ্বংস হয়ে যেতে না চাইলে আরেকবার ভেবে দেখো। এখনও তোমার সময় আছে পিছিয়ে যাবার। একটু পরেই আলাপ হবে আমাদের। মা কোথায়?

হঠাৎ সে লক্ষ করল যে কোন ফাঁকে বেরিয়ে গিয়ে ট্র্যাডলস ওর মাকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে। আঁতকে উঠল সে।

মিসেস হীপ এখানে আছেন, স্যার। আমি নিজেই পরিচয় করে নিয়েছি তাঁর সঙ্গে, বলল ট্র্যাডলস।

আপনি কে পরিচয় করে নেয়ার? কি চান আপনি এখানে? জিজ্ঞেস করল উরিয়া।

ট্র্যাডলস শান্তভাবে বলল, আমি মি. উইকফিল্ডের এজেন্ট এবং বন্ধু। তিনি আমাকে সকল বিষয়ে তার হয়ে কাজ করার জন্য ওকালতনামা (পাওয়ার অভ অ্যাটর্নি) সই করে দিয়েছেন।

বুড়ো গাধাটা মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে আছে। জালিয়াতি করে ওর সই নেয়া হয়েছে, বলল উরিয়া বিশ্রীভাবে মুখ খিচিয়ে।

ট্র্যাডলস বলল, জালিয়াতি করে তার কাছ থেকে যে কিছু নেয়া হয়েছে তা আমিও জানি, আপনিও ভাল করেই জানেন, মি. হীপ। আমরা এ ব্যাপারে মি. মিকবারের বক্তব্য শুনব।

উরিয়া হীপ বরাবর অতি বিনয়ী ও বশংবদ ভাব দেখাত। কিন্তু ওটা ছিল তার মুখোশ। এখন এক মুহূর্তে মুখোশটা সে খুলে ফেলল। তার হিংস্র, উদ্ধত, ঘৃণ্য মূর্তি প্রকাশ পেল।

আমাকে তীব্র হিংসাপূর্ণ দৃষ্টিতে বিদ্ধ করে সে আবার বলল, নিজেকে ভদ্রলোক বলে জাহির করো। লজ্জা করল না আমার কেরানীর সঙ্গে গোপনে যোগসাজশ করতে? ঠিক আছে। আমিও দেখে নেব। ষড়যন্ত্রের অভিযোগে, তোমাকে জড়াব। এখন কি-যে-আপনার নাম, মিকবারকে কি প্রশ্ন করবেন বলেছিলেন। করুন না। চুপ করে আছেন কেন?

মি. মিকবার সামনে এগিয়ে এলেন। তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পকেট থেকে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজে লেখা দলিল বের করে পড়তে লাগলেন। ওটা হচ্ছে একখানা চিঠি। আমার দাদী এবং আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে মি. মিকবার লিখেছেন। এতে তিনি অভিযোগ করেছেন যে উরিয়া হীপ মি. উইকফিল্ডের সই জাল করে তার টাকা সরিয়েছে। হীপের কেরানী হিসেবে মি. মিকবার জানেন যে হীপ মিথ্যে নকল খাতাপত্র ও হিসেব রাখে। ভুয়া বিল তৈরি করে মি. উইকফিল্ডের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। তার চিঠি থেকে আমরা আরও জানলাম যে আমার দাদীর টাকা-পয়সাও হীপই মেরে দিয়েছে। তিনি টাকা দিয়েছিলেন মি. উইকফিল্ডকে, লগ্নী করার জন্য। উরিয়া প্রচার করে, যে ব্যাঙ্কটি ফেল মেরেছে ওটাতে টাকাটা লগ্নী করেছিল। আসলে টাকাটা সে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে।

উরিয়া ঝাপ দিল চিঠিটা মি. মিকবারের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মি. মিকবার বাড়ি মেরে তার হাতটা সরিয়ে দিলেন।

ট্র্যাডলস বলল, চোরাই টাকা ফেরত দাও, হীপ, এবং মি. উইকফিল্ডের সঙ্গে তোমার অংশীদারিত্বের দলিলটি ছিড়ে ফেল।

না, কখনো তা করব না! চিৎকার করে বলল হীপ।

তাহলে তোমাকে হয়তো জেলে যেতে হবে, বলল ট্র্যাডস। কপারফিল্ড, পুলিশ ডেকে আনেনা।

আমি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম, থাম! গর্জন করে বলল হীপ। আমি সবই দিয়ে দেব।

ভাল কথা! বললট্র্যাডলস। এখন নিজের ঘরে যাও। আমরা সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখার আগে বেরুবে না ওখান থেকে।

এতদিনে মি. মিকবার বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত হলেন। হীপের চাকরি করতে এসে বিবেকের দংশনে অস্থির ছিলেন। এ কারণে পরিবারের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করছিলেন তিনি। এখন আবার সুখী মানুষ হিসেবে ফিরে গেলেন পরিবারের কাছে। কাজের সন্ধানে নতুন কোন শহরে চলে যেতে চাইলেন। আমার দাদী তাকে বললেন মি. পেয়গাটি আর এমিলির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যেতে। মি. মিকবারের সততার গুণে দাদী তার খোয়ানো টাকা-পয়সা সব ফেরত পাবেন। তিনি মিকবারদের অস্ট্রেলিয়া যাবার ভাড়াটা দিতে চাইলেন। এতে দারুণ খুশি হলেন মি. মিকবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *