১৭. মি. পেগোটির স্বপ্ন সফল হলো
মি. পেগোটির স্বপ্ন সফল হলো
মি. পেগোটি আর আমি যেদিন মার্থাকে পেয়েছিলাম নদীতীরে তার পরে অনেক মাস চলে গেছে। এমিলিকে জীবিত অবস্থায় খুঁজে পাবার আশা আমি এক রকম ছেড়েই দিতে যাচ্ছি। কিন্তু মি. পেগোটির আশা ও ধৈর্য অটল রয়ে গেল।
একদিন সন্ধ্যায় বাগানে হাঁটছি—এমন সময় মার্থা এসে হাজির হলো গেটের সামনে।
আমার সঙ্গে আসতে পারেন? বলল সে ফিসফিসিয়ে। মি. পেগোটির ওখানে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাকে পাইনি। চিঠি রেখে এসেছি তার টেবিলে। ওতে বলে দিয়েছি কোথায় আসতে হবে। আপনি এখন আসতে পারেন?
সঙ্গে সঙ্গে বাগান থেকে বেরিয়ে গেলাম। ওর সাথে চললাম লণ্ডনের দিকে। একটা খালি কোচ যাচ্ছিল ওখান দিয়ে। ওটা ভাড়া করে ফেললাম। ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিয়ে চুপচাপ পেছনের সীটে বসে রইল মার্থা। গোল্ডেন স্কোয়ারে পৌঁছলাম। এককালের অভিজাত এলাকা এটা। এখন এই এলাকার বাড়িঘরের দাম পড়ে গেছে। গরীবদেরকে কম ভাড়ায় থাকতে দেয়া হয় এখানে। একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল মার্থা। আমাকে ইশারা করল ওর পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে।, আমরা বাড়িটার ওপরতলায় উঠে গেলাম।
কারও কোন সাড়াশব্দ নেই। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে অপেক্ষা করে রইলাম আমরা। তারপর সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ শুনলাম। মি. পেগোটির পায়ের শব্দ। তিনি দ্রুত উঠে এসে আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেলেন ঘরের মধ্যে।
কাকা! বলে উঠল এমিলি নরম স্বরে।
পরক্ষণেই একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল। ঘরের ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম মি, পেগোটি সংজ্ঞাহারা এমিলিকে পাজাকোলা করে দাঁড়িয়ে আছেন।
মাস্টার ডেভি, বললেন তিনি নিচু ভগ্নস্বরে, খোদাকে ধন্যবাদ যে আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে!
অচেতন এমিলিকে বহন করে তিনি নেমে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে।
পরদিন সকালে দাদী আর আমি বাগানে বসে আছি, এমন সময় মি. পেপগাটি এলেন। তিনি আমাকে বললেন কিভাবে এমিলি স্টিয়ারফোর্থের চাকরের হাত থেকে পালিয়ে যায়, সাগরতীরের জেলে পাড়ায় এক দয়ালু নারী কেমন করে ওকে লুকিয়ে রাখে এবং রক্ষা করে। এমিলির জ্বর হয়েছিল। কিন্তু স্ত্রী লোকটি সেবাযত্ন করে ওকে সুস্থ করে তোলে। দেহের শক্তি ফিরে আসার পর ও লণ্ডনের পথে যাত্রা করে। সামান্য টাকা-পয়সা যা ছিল সবই দিয়ে দেয় ওই দয়ালু নারীকে। মি, পেগোটির চোখ দুটি ভরে গেল অশ্রুতে। তবু বলে গেলেন, ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসার ভাড়া জোগাড় করার জন্য ও ইতালী-ফ্রান্সের নানা হোটেলে কাজ করে। কিভাবে আমার সামনে আসবে এই ভয়ে ও অস্থির ছিল। লণ্ডনে আসার পর মার্থা ওকে দেখে ফেলে এবং জানায় যে আমি এখনও ওকে ভালবাসি।
শুনে গেলাম নীরবে। কিন্তু দাদী বেটসি কেঁদে ফেললেন। আমি মি. পেগোটিকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি চিন্তা করছেন?
আমি এমিলিকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে আমরা নতুনভাবে জীবন শুরু করব।
কখন যাবেন ঠিক করেছেন?
ইয়ারমাউথে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া এবং আমার জাহাজ-বাড়িটার একটা বিলি-ব্যবস্থা হয়ে গেলেই যাত্রা করতে পারব, জবাব দিলেন তিনি। মাস্টার ডেভি, আমার সঙ্গে গিয়ে বিষয়-আশয়ের নিষ্পত্তির ব্যাপারে দয়া করে সাহায্য করবেন তো?
রাজি হলাম, যেহেতু ডোরা হাসিখুশিতে আছে এবং দাদী রয়েছেন ওর সঙ্গে।
ইয়ারমাউথে গেলাম। দেখাসাক্ষাৎ হলো পুরানো বন্ধুদের সাথে। পেগোটি আর হ্যামকে বললেন মি. পেগোটি এমিলিকে খুঁজে পাবার কথা—তার অস্ট্রেলিয়া। চলে যাবার সঙ্কল্পের কথা। অস্ট্রেলিয়া বিরাট দেশ। সেখানে কেউ জানবে না তার এমিলির কলঙ্কের কাহিনি। কেউ ওকে গঞ্জনা দিতে পারবে না।
জাহাজবাড়ির দুয়ার খোলা হলো। লণ্ডনের উকে জাহাজে তোলার জন্য বের করা হলো সব আসবাবপত্র। আমি শেষবারের মত দেখে নিলাম আমার পুরানো শোবার ঘরটি। ঘরটা খালি। সব কিছু বের করে ফেলা হয়েছে। সাগরগুল্মে সাজানো সেই ছোট্ট নীল মগটি পর্যন্ত। পুরানো কথা–অতীত স্মৃতি মনে পড়ল। আমার মায়ের বিয়ে হচ্ছিল মি, মার্ডস্টোনের সঙ্গে। পেগোটি ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে নিয়ে এল এখানে। এই ঘরেই আমি ঘুমাতাম। মনে পড়ল এমিলির সঙ্গে সাগরতীরে ছুটে বেড়ানোর কথা। স্টিয়ারফোর্থের কথাও ভাবলাম। ভয় হলো সে হয়তো কাছাকাছি কোথাও আছে, হঠাৎ বুঝি এসে হাজির হবে।