০১. শৈশব স্মৃতি
শৈশব স্মৃতি
আমার জন্ম হয় এক শুক্রবার রাত বারোটায়। ঘড়ির ঢং ঢং আর আমার প্রথম কান্নার আওয়াজ মিলে যায় একসাথে।
এর আগে, সেদিন বিকেলে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। ভীত মনে বিষণ্ণ মুখে আমার মা বসেছিলেন আগুনের পাশে। তিনি দেখলেন যে এক অপরিচিত মহিলা এগিয়ে আসছেন আমাদের বাগানের পথে। দরজার বেল না বাজিয়ে মহিলাটি জানালা দিয়ে তাকালেন ভেতরে। কাচের ওপর চাপ পড়ায় তার নাকটা চ্যাপ্টা ও সাদা হয়ে উঠল। মাকে চমকে দিলেন মহিলা। চট করে দাঁড়াতে গিয়ে মূৰ্ছা গেলেন মা।
মা-র মূৰ্ছা ভাঙল সন্ধ্যায়। মহিলাটি তখন দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের মধ্যে, জানালার কাছে। তিনি আমার বাবার ফুফু মিসট্রটউড। মা বলতেন মিস বেটসি। আমার বাবা ছিলেন এক সময় তার খুব প্রিয় ভাইপো। কিন্তু একদিন যেই শুনলেন। যে ভাইপোটি বিশ বছরের কমবয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে-অমনি রেগেমেগে তিনি চলে গেলেন তার সাগরতীরের কটেজ-এ। আর কখনও ভাইপোর মুখ দেখেননি। বেচারা বাবা মারা যান আমার জন্মের ছমাস আগে।
শোনো বাছা, বললেন মিস বেটসি আমার মাকে। এই মেয়েটি জন্মালে…
ছেলেও হতে পারে, আস্তে করে বললেন মা।
না, মেয়েই হতে হবে, বললেন মিস বেটসি। আমি ওর নাম দেব বেটসি ট্রটউড কপারফিল্ড। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমি হব ওর বন্ধু। ওর ধর্ম-মা। ওকে হেলাফেলা করা যাবে না। খুব যত্নে লালন-পালন করতে হবে। সব রকম সুযোগ দিতে হবে। আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করব।
মা-র চেহারা বিবর্ণ হয়ে উঠল। ফিসফিস করে তিনি বললেন, আমার কাঁপুনি ধরবে মনে হচ্ছে। আমি মরে যাব।
না-না-না! চেঁচিয়ে উঠলেন মিস বেটসি। চা খাও একটু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কাজের মেয়েটির নামে কি?
পেগোটি, বললেন মা।
পেগোটি আবার একটা নাম হলো নাকি? খেকিয়ে উঠলেন মিস বেটসি।
ওরকম নাম কেউ রাখে?
ওটা ওর ডাক নাম। ওর আসল নামটা আমার নাম কিনা, তাই মিস্টার কপারফিল্ড ওই নামে ডাকতেন ওকে।
বসার ঘরের দরজা খুলে মিস বেটসি হাঁক দিলেন, পেপগাটি, এদিকে এসো। তোমার মনিব চা খাবেন। চা নিয়ে এসো।
পেগোটি চা আনল। আঁধার ঘনিয়ে আসছে, তাই মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিল ঘরে। মোমের আলোয় মা-র দিকে একবার তাকিয়েই সে ছুটল ডাক্তার ডেকে আনতে।
ডাক্তার চিলিপ এলেন। ঘণ্টা কয়েক পরে ডাক্তার আমার জনের বার্তা নিয়ে মা-র কামরা থেকে বেরিয়ে পা রাখলেন বসার ঘরে। মিস বেটসি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন যে, নবজাত শিশুটি মেয়ে নয়-ছেলে। তার আশা সফল হয়নি। রেগেমেগে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের বনেটটি তিনি ছুঁড়ে মারলেন ডাক্তারের মাথায়। তারপর বেরিয়ে চলে গেলেন হনহন করে। আর কখনও ফিরে আসেননি।
এই হলো আমার জন্মকাহিনি।
মাকে আমার মনে পড়ে। মনে পড়ে তার লম্বা চুল, তন্বীদেহ। মনে পড়ে পেগোটিকে। ওর কালো চোখ, মোটা শরীর, স্নেহমাখা মুখের স্মৃতি আমি ভুলতে পারি না।
মায়ের ঘরে শুতাম। বিছানায় শুয়ে দেখতে পেতাম গির্জার আঙিনা। রাতের বেলা প্রায়ই মনে হত ওখানে আমার বাবার কবরটি বড় নিঃসঙ্গ, একা।
মনে পড়ে, শীতের সন্ধ্যায় বসার ঘরে মায়ের সঙ্গে খেলতাম। নাচানাচি করতাম। দম ফুরিয়ে গেলে মা বসে পড়তেন। বিশ্রাম নিতেন। তাঁর উজ্জ্বল কোঁকড়ানো চুলে চিরুনির মত আঙুল বুলাতেন। আমাকে সব সময় ডাকতেন আমার ছোট্ট ডেভি সোনা। বুকে চেপে ধরে গান গাইতেন। লেখাপড়া শেখাতেন।