১৩.
খাটো বরফ-সুড়ঙ্গে, ভারী ইস্পাতের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে লেফটেন্যান্ট তিশা।
দরজার বুকে জং-ধরা প্রেশার-হুইল। বার কয়েক চেষ্টা করে হুইল ঘোরাতে পারল ও। তিনবার ঘোরাতেই হঠাৎ করেই ভিতর অংশ থেকে এল জোরালো ক্লিক আওয়াজ। সামান্য খুলে গেল দরজা।
দুই হাতে কবাট খুলে ফেলল তিশা। আলো ফেলল ওদিকে। সর্বনাশ, ফিসফিস করে বলল।
ওদিকটা বিমানের হ্যাঙারের মতই বিশাল। এতই প্রকাণ্ড, দূর-প্রান্ত ছুঁলো না ফ্লাশলাইটের বাতি। অবশ্য বোঝা গেল অনেক কিছুই। দেয়াল দেখতে পেয়েছে ও। ওই দেয়াল মানুষের তৈরি।
লোহার দেয়াল সেসব, ভারী রিইনফোর্সড় গার্ডারগুলো উঁচু করে রেখেছে বিশাল অ্যালিউমিনিয়ামের ছাতকে। প্রায়ান্ধকারে দেখল, নীরবে থম মেরে বসে আছে হলুদ রঙের রোবোটিক বাহু। সিলিঙে সারি দিয়ে হ্যালোজেন বাতি। বিদঘুটে ভাবে মেঝেতে কাত হয়ে পড়েছে বেশ কিছু ধাতব গার্ডার। কয়েকটার শেষ মাথা এবড়োখেবড়ো। আসলে মাঝ থেকে ভেঙে পড়েছে। সব কিছুর উপর পাতলা বরফের চাদর।
পায়ের সামনে একটা কাগজ দেখতে পেল তিশা। ওটা তুলে নিল, ওটা জমে গেছে বরফে। কিন্তু লেটারহেড পড়তে পারল। ওখানে লেখা:
হাইটেক লিমিটেড।
আবারও খাটো সুড়ঙ্গে ফিরল তিশা। ফাটলের সামনে থেমে গলা উঁচু করে ডাকল জনি ওয়াকার ও নিনা ভিসারকে।
দুমিনিট পর ফাটলের ভিতর দিয়ে গড়িয়ে এল জনি ওয়াকার, ধুপ করে নামল মেঝেতে। তাকে হাতের ইশারা করল তিশা, ফিরে চলেছে পাতাল হ্যাঙারের দিকে।
ইস্পাতের দরজা দিয়ে ঢুকেই থমকে গেল ওয়াকার, বিস্মিত স্বরে বলল, এটা আবার এখানে কীভাবে?
হ্যাঙারে ঢুকে পড়ল ওরা। দুই ফ্লাশলাইটের বাতি বহু দূর গিয়ে পড়ছে। বামে চলল ওয়াকার, ডানদিকে তিশা।
কিছু দূর যাওয়ার পর বরফ ছাওয়া এক অফিস দেখে ওখানে থামল তিশা। দরজার নবে মোচড় দিতেই জোরালো কটকট আওয়াজ হলো। খুব ধীরে খুলে গেল দরজা, ভিতরে পা রাখল ও।
একটু দূরে মেঝের উপর পড়ে আছে কে যেন।
একটা লোক।
দুই চোখ বোজা, মানুষটা পুরোপুরি উলঙ্গ। নীল হয়ে গেছে ত্বক। মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছে।
অফিসের আরেক পাশে ডেস্ক, তার উপর কী যেন। ডেস্কের সামনে চলে গেল তিশা, জিনিসটা লেদারবাউণ্ড কোনও বই।
ডেস্কে আর কিছুই নেই। তিশার মনে হলো, কেউ যেন ইচ্ছা করেই বইটা ওখানে রেখেছে। আশা করা হয়েছে, কেউ ওটা দেখবে।
বইটা তুলে নিল তিশা। প্রচ্ছদ ঢাকা পড়েছে পাতলা বরফের আস্তরণে। কার্ডবোর্ডের মত মোটা হয়ে উঠেছে পাতাগুলো।
বই খুলল তিশা।
কোনও ডায়েরি মনে হলো।
প্রথম এন্ট্রি পড়তে শুরু করেছে:
৩ জুন, উনিশ শ আটাত্তর।
সবই ভালভাবে চলছে। কিন্তু এখানে বড় শীত! ভাবতে অবাক লাগে, এরা আমাদেরকে এখানে
নিয়ে এসেছে এই অ্যাটাক প্লেন তৈরি করাতে। বাইরের আবহাওয়া ভয়ঙ্কর খারাপ। সর্বক্ষণ চলছে
ব্লিযার্ড। কপাল ভাল যে আমাদের হ্যাঙার বরফের নীচে, নইলে ওই পরিবেশে মরেই যেতাম।
অবাক কাণ্ড, এই শীত খুবই দরকারী। এতে ভাল থাকে প্লুটোনিয়ামের গ্রেড, নইলে ক্ষতিগ্রস্ত
হতো সিস্টেমের প্লুটোনিয়াম কোর…
ডায়েরির শেষ পাতার কাছে চলে গেল তিশা। পড়তে শুরু করেছে:
১৫ ফেব্রুয়ারি, ঊনিশ শ আশি সাল।
কেউ আসছে না। আমি বুঝে গেছি, আর কেউ আসবে না। গতকাল গ্রেগ গুডিং মারা গেল। আর
রন গার্টেনের দুই হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। ফ্রস্টবাইট।
ভূমিকম্প হওয়ার দুই মাসের বেশি পেরুল, আমরা সবাই হতাশ! কেউ আমাদেরকে উদ্ধার করবে
না। কে যেন বলেছিল ডিসেম্বরে ট্রেভল রয়েস আসছে। কই, সে তো আর এল না।
ঘুমাতে গেলে বারবার মনে হয়: এমনও হতে পারে, ট্রেভল রয়েস ছাড়া আর কেউ জানে না যে
আমরা এখানে আছি।
আরও কয়েক পৃষ্ঠা পিছিয়ে এল তিশা, তারপর পেয়ে গেল যা, খুঁজছে।
২০ ডিসেম্বর, উনিশ শ উনআশি
আসলেই জানি না কোথায় আছি। গতকাল হঠাৎ করেই শুরু হলো ওই ভূমিকম্প। আগে কখনও এমন দেখিনি। যেন খুলে গেল পৃথিবীর বুক, আর সব কিছু গিলে ফেলল। আমাদেরসহ।
ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সময় হ্যাঙারে ছিলাম, কাজ করছিলাম কালো পাখির উপর। প্রথমে থরথর করে কাঁপতে লাগল জমিন, তারপর পায়ের নীচ থেকে ছিটকে উঠল বিশাল বরফের দেয়াল। দেখতে না দেখতে দু টুকরো হয়ে গেল হ্যাঙার। আমরা কলের পুতুলের মত পড়ে গেলাম মেঝেতে। মনে হলো নীচের দিকে পড়ছি। পড়তেই থাকলাম। এই বিশাল দালানের চেয়ে অনেক
বড় সব বরফের চাঁই দুপাশ থেকে নামতে লাগল। মাঝে আমরা, যেন বিশাল কোনও গর্তে পড়ছি। উপরে চাইলাম, হ্যাঙারের ছাতে প্রকাণ্ড সব বরফের চাঁই পড়ছে। তুবড়ে গেল ছাত। শুধু বুম! বুম! বুম! আওয়াজে মনে হলো, স্টেশনের নীচে মস্ত কোনও গহ্বর তৈরি হয়েছে। আর আমরা পড়ছি তার ভিতর।
আমরা নীচের দিকে পড়ছি। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে নীচে পড়ছি। প্রকাণ্ড সব রোবোটিক বাহুর একটা ভেঙে পড়ল ডগলাস ক্রেইগের উপর। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল সে। তারপর…
হতবাক হয়ে গেছে তিশা।
এই হ্যাঙার আগে ছিল কোনও আইস স্টেশন।
এখানে খুব গোপনে তৈরি করা হচ্ছিল ওই বিমান। তিশা বুঝতে পারল, ওই বিমানে প্রটোনিয়াম কোর ব্যবহার করা হয়েছে। আগে এই স্টেশন ছিল বরফ-সমতল থেকে সামান্য নীচে, ঠিক যেমন এখন উইলকক্স আইস স্টেশন! তারপর একদিন এই স্টেশনকে এখানে নামিয়ে আনল ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প।
ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় চলে এল তিশা।
১৮ মার্চ, উনিশ শ আশি।
একমাত্র আমিই জীবিত মানুষ। অন্য সবাই মারা গেছে। প্রায় তিন মাস হলো ওই ভূমিকম্প, এরই ভিতর বুঝেছি, আর কেউ আসবে না উদ্ধার করতে। ফ্রস্ট বাইটে নষ্ট হয়ে গেছে ডান হাত। গ্যাংগ্রিনও ধরেছে। এখন আর কোনও সাড়া নেই দুই পায়ে।
এভাবে বাঁচব না। উদ্ধারেরও কোনও আশা নেই। তার চেয়ে এ-ই ভাল, সব পোশাক খুলে শুয়ে পড়ব বরফের মেঝের ওপর। মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে মরতে। ভবিষ্যতে যদি এই লেখা কেউ পড়েন, জানবেন আমার নাম স্যামসন ব্যারিমোর। এভিয়েশন ইলেকট্রনিক্স স্পেশালিস্ট। হাইটেক লিমিটেডে চাকরি করতাম। আমার স্ত্রী মেইমি, লস অ্যাঞ্জেলেসের ড্যাণ্ডিতে থাকে। এক শ তেরো নম্বর বাড়ি। পরেও ওখানে থাকবে কি না জানি না। আপনি এই লেখা পড়লে, দয়া করে ওকে জানাবেন, আমি ওকে খুবই ভালবাসি। ওর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, ওকে বলে আসতে পারিনি কোথায় চলেছি। কাউকে কিছু বলবার উপায় ছিল না।
উহ, এখানে কী ভীষণ ঠাণ্ডা! আর কী আশ্চর্য! ট্রেভল রয়েস লোকটা এলই না!
একবার মেঝেতে শুয়ে থাকা লাশের দিকে চাইল তিশা।
স্যামসন ব্যারিমোর।
একাকী মানুষটার জন্য খুব খারাপ লাগছে তিশার। কী কষ্ট পেয়েই না মরেছে। পাশে কেউ ছিল না। কবর হলো এই শীতল সমাধির ভিতর।
হঠাৎ চমকে গেল তিশা, হেলমেট ইন্টারকমে লেফটেন্যান্ট গোলাম মোরশেদের উত্তেজিত কণ্ঠ: সার্জেন্ট জনি ওয়াকার! লেফটেন্যান্ট তিশা! এখনই চলে আসুন! পানির নীচে শত্রু ডুবুরি! রিপিট করছি! যে-কোনও সময়ে গুহায় উঠে আসবে শত্রু ডুবুরি!
.
সি স্নেডে ভর করে পানির নীচের ওই বরফ-সুড়ঙ্গ বেয়ে উপরে উঠছে এসএএস ডাইভাররা। সংখ্যায় তারা, আটজন। টুইনপ্রপেলার সি স্লেডের কারণে সহজে এগুতে পারছে। প্রত্যেকের পরনে কালো ডুবুরি পোশাক।
ডাইভ টিম বলছি, সাড়া দিন, বেস, হেলমেট কমিউনিকেটারে যোগাযোেগ করল ডুবুরিদের নেতা।
ডাইভ টিম, বেস থেকে বলছি, ইন্টারকমে ভেসে এল। জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনের কণ্ঠ। রিপোর্ট করো।
বেস, সময় এখন ১৯৫৬ ঘণ্টা। ডাইভিং বেল থেকে বেরিয়ে আসার পর ডাইভিং চলছে চুয়ান্ন মিনিট। আমরা উপরের পানি দেখছি। এবার ভেসে উঠব গুহার ভিতর।
খুব সতর্ক থাকবে, ডাইভ টিম। আমরা জেনেছি, গুহার ভিতর তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে চারজন শত্রু। রিপিট করছি, গুহার ভিতর তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে চারজন শত্রু সৈনিক। তাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
শুনেছি, বেস। সতর্ক থাকব। ডাইভ টিম আউট।
.
খাটো সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে তিশা ও ওয়াকার, ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেল লেফটেন্যান্ট মোরশেদের পাশে। তিন ট্রাইপডের এমপি-৫ তাক করা হয়েছে পুলের উপর।
কাচের মত স্বচ্ছ নীল পানির ভিতর দিয়ে দেখা গেল, নীচ থেকে উঠে আসছে কালো বেশ কয়েকটি মূর্তি।
তিনপাশের বোল্ডারগুলোর পাশে এমপি-৫ নিয়ে তৈরি হয়ে গেল গোলাম মোরশেদ, তিশা ও ওয়াকার। শেষের জন নিনা ভিসারকে পিছনে লুকিয়ে থাকতে বলল।
কেউ ধৈর্য হারাবেন না, ইন্টারকমে বলল তিশা। আগে পানির উপর মাথা তুলুক, তার আগে পানিতে গুলি করে বুলেট নষ্ট করার দরকার নেই।
বুঝতে পেরেছি, বলল মোরশেদ।
পানির ভিতর কালো ছায়া দেখল তিশা। উঠে আসছে পুকুরের উপর অংশে।
এক ডুবুরি। সামনে ধরেছে সি স্লেড।
ক্রমেই উঠে আসছে। পানির সমতলে উঠবার আগে থামল।
ভুরু কুঁচকে গেল তিশার।
পানির এক ফুট নীচে থেমেছে লোকটা।
কী করছে?
তারপর হঠাৎ করেই ডুবুরির হাত ছিটকে উঠল পানির উপর। এবার পরিষ্কার তার হাতের জিনিসটা দেখতে পেল তিশা।
নাইট্রোজেন চার্জ! চেঁচিয়ে উঠল ও। সবাই কাভার নিন!
গুহার জমাট বরফের উপর ঠং করে পড়ল নাইট্রোজেন চার্জ। ততক্ষণে তিশা ও অন্যরা আড়াল নিয়েছে বোল্ডারের পিছনে।
বিস্ফোরিত হলো নাইট্রোজেন চার্জ।
চারপাশে ছলাৎ করে লাগল সুপারকুল্ড লিকুইড নাইট্রোজেন। যেন নীল আঠা, ছুটে এসে লাগল আড়াল নেয়া বোল্ডারগুলোর সামনের দিকে। লাগল গুহার নানাদিকের দেয়ালে। কিছু গিয়ে পড়ল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানের উপর।
ভাল ডাইভার্শন তৈরি করেছে ব্রিটিশরা।
নাইট্রোজেন চার্জ ফাটতেই পানি থেকে উঠে আসতে শুরু করেছে প্রথম এসএএস কমাণ্ডো। কাঁধে তার অস্ত্র, টিপে ধরেছে ট্রিগার।
.
পুলের সারফেসের কাছে পৌঁছে গেছে ডাইভিং বেল, এখনও ধীরে? ধীরে উপরে উঠছে।
গুণ্ডারসন বারবার বলেছে, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, যৌক্তিক পথে ভাবতে হবে। রাগী নেতা মানেই বোকা লোক, সে একের পর এক ভুল করে খতম করবে তার নিজের দলকে।
মগজে গুণ্ডারসনের কথা ঘুরছে, কিন্তু ওই লোকের কথা এখন শুনবে না ও, ভীষণ জেদ চেপেছে রানার।
ওর সহযোদ্ধাকে কিলার ওয়েইল দিয়ে খাইয়েছে ওই বদমাশ লোকটা। ওই মানুষ নামের জানোয়ারটাকে ছাড়বে না ও। দুই হাতে ছিড়ে ফেলবে তার বুক, টেনে বের করে আনবে হৃৎপিণ্ড…
কোমরে পেঁচিয়ে রাখা কেবল খুলে ফেলল রানা, ষাট দশকের ভারী ওয়েটসুট ঝেড়ে ফেলল গা থেকে। খপ করে তুলে নিল এমপি-৫, চেম্বারে ভরে নিল রাউণ্ড! দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল, ওই হারামজাদাকে যদি মারতে না পারি, আশপাশে যে কটাকে পাব, সবগুলোকে শেষ করব।
অস্ত্র লোড করতে গিয়ে ডাইভিং বেলের তাকে দেখেছে ছোট স্যামসোনাইট ক্যারি কেস। জিনিসটা খুলল রানা। ভিতরে এক সারিতে নীল নাইট্রোজেন চার্জ। একেকটা যেন নরম ফোমের উপর যত্নে শুইয়ে রাখা ডিম।
পাতাল-গুহায় যাওয়ার সময় এগুলো রেখে গেছে এসএএস, কমাণ্ডোরা, ভাবল রানা। তুলে নিল একটা নাইট্রোজেন চার্জ, রেখে দিল পকেটের ভিতর।
বাইরে চাইল। আপাতত ওদিকে কোনও কিলার ওয়েইল নেই। এক সেকেণ্ড ভাবল, বোধহয় ফিরে গেছে ওগুলো সাগরে।
কী করছেন, ভাই? জানতে চাইল রাশেদ হাবিব।
নিজ চোখেই দেখবেন, ডাইভিং বেলের গোলাকার ছোট পুলে নেমে পড়ছে রানা।
আপনি বাইরে যাবেন? অবিশ্বাস নিয়ে বলল হাবিব। আমাকে এখানে রেখে?
আপনি ভালই থাকবেন, নিজের ডের্ট ঈগল পিস্তল বিজ্ঞানীর দিকে ছুঁড়ে দিল রানা। কেউ যদি আসে, গুলি করে মেরে ফেলবেন।
খপ করে অস্ত্রটা ধরল হাবিব। ওদিকে মন নেই রানার, দ্বিতীয় সেকেণ্ড দেরি না করে নেমে পড়েছে পুলে। চার সেকেণ্ড পর বেরিয়ে এল বাইরের পুলে।
পানি প্রায় জমাট বাঁধবার মত ঠাণ্ডা, কিন্তু পাত্তা দিল না। একহাতে ধরে রেখেছে ডাইভিং বেলের বাইরের একটা পাইপ। এবার ওটা বেয়ে উঠে গেল গোলাকার বেলের ছাতে।
প্রায় পৌঁছে গেছে পানি সমতলে।
এইবার ব্রিটিশ কুকুরের বাচ্চাগুলো দেখবে বাঙালি সৈনিক কীভাবে গুলি করে, গনগনে রাগের ভিতর–ভাবল রানা। একবার ভেসে উঠলেই ব্রাশ ফায়ার শুরু করবে। প্রথমে এক পশলা গুলি বিধবে জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনের বুকে। হারামজাদা…
উপরে উঠছে ডাইভিং বেল। একটু পর ভেসে উঠবে।
আর বড়জোর পাঁচ সেকেণ্ড, ভাবল রানা। শক্ত করে ধরল এমপি-৫-র গ্রিপ।
বড়জোর দুই সেকেণ্ড…
জোরালো ছলাৎ আওয়াজ তুলে ভেসে উঠল ডাইভিং বেল।
একহাতে উইঞ্চ কেবল ধরেছে রানা, ঝরঝর করে সারা শরীর থেকে ঝরছে শীতল পানি। আরেক হাতে উদ্যত এমপি-৫।
কিন্তু কোনও গুলি করল না রানা। যদি আয়না থাকত, টের পেত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ওর মুখ।
ই-ডেকে কমপক্ষে বিশজন এসএএস কমাণ্ডো ঘিরে ফেলেছে ডাইভিং বেল!
প্রত্যেকের অস্ত্র তাক করা ওর বুক লক্ষ্য করে।
দক্ষিণ টানেল থেকে উঁকি দিল কমাণ্ডার, মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন। দাঁত বের করে হাসছে লোকটা, একটু একটু নড়ছে কালো দাড়ি। তার উপর চোখ পড়তেই নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ কয়েকটা গালি দিল রানা। রাগ ওর চরম সর্বনাশ করেছে। গাধার মত গোয়ার্তুমি করেছে ও। হোসেন আরাফাত দবিরের আকস্মিক মৃত্যু পাগল করে দিয়েছিল ওকে। আর সে কারণেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছে।
এবার অস্ত্র ফেলে দাও, রানা, নইলে কিন্তু মরবে, দক্ষিণ টানেল থৈকে বেরুল না গুণ্ডারসন।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল রানা, তারপর ছুঁড়ে ফেলল এমপি-৫। ঠং-ঠনাৎ আওয়াজ তুলে পিছলে গেল ডেকে অস্ত্রটা। একটা দীর্ঘ আঁকশি দিয়ে ডাইভিং বেল ধরল এসএএস কমাণ্ডোরা, নিয়ে এল ডেকের পাশে।
আবারও মগজ খাটাতে শুরু করেছে রানা। এখন ওর মন স্ফটিকের মত পরিষ্কার হয়ে আসছে। পানির উপর উঠেই যখন এসএএস কমাণ্ডোদের হাতে অস্ত্র দেখেছে, এবং সব অস্ত্র ওর দিকেই তাক করা, সমস্ত রাগের ভিতর বালতি বালতি পানি ঢেলে দিয়েছে।
এখন ভাবছে, রাশেদ হাবিব বেরিয়ে না এলেই হয়। লুকিয়ে থাকুক লোকটা ডাইভিং বেলের ভিতর।
ডাইভিং বেল থেকে ধাতব ডেকের উপর রানা লাফিয়ে নামতেই জোরালো ধাতব আওয়াজ হলো। স্বস্তির শ্বাস ফেলল, এসএএস কমাণ্ডোরা ডাইভিং বেল আবারও ছেড়ে দিয়েছে। ওটা চলে গেল পুলের মাঝে। কেউ দেখেনি রাশেদ হাবিবকে।
এসএএস কমাণ্ডোদের বিশালদেহী দুজন দুপাশ থেকে খপ করে ধরল রানার দুই হাত, মুচড়ে পিঠের উপর তুলে দিল। দুই কবজিতে আটকে দেয়া হলো হ্যাণ্ডকাফ। আরেক এসএএস কর্পোরাল ওকে তল্লাসী করল। পকেট থেকে নাইট্রোজেন চার্জ বের করে নিল। বাদ পড়ল না ম্যাগহুকও।
এবার বীরের মত এল গুণ্ডারসন, রানার সামনে থমকে দাড়িয়ে বলল, তা হলে আবারও দেখা হলো আমাদের, মাসুদ রানা। তোমাকে দেখেই মনটা ভাল হয়ে গেছে।
কিছুই বলল না রানা। খেয়াল করেছে, লোকটার পরনে কালো থারমাল ওয়েটসুট।
আরেকদল এসএসএস কমাণ্ডোকে পাতাল-গুহায় নামাবে শালা, ভাবল রানা। সঙ্গে নিজেও যাবে।
তুমি ডাইভিং বেলের ভিতর থেকে আমাদের দেখছিলে, তাই? চওড়া হাসল গুণ্ডারসন। কিন্তু আমরাও তোমাকে দেখছিলাম। পুলের ধারে ছোট এক ধূসর যন্ত্র দেখিয়ে দিল সে। জিনিসটা দেখতে ক্যামেরার মত, সোজা চেয়ে আছে পানির দিকে।
চারপাশ কখনও অরক্ষিত রাখতে নেই, রানা, মিষ্টি করে। বলল গুণ্ডারসন। তোমার এটা বুঝবার কথা।
চুপ করে থাকল রানা।
ওর সামনে পায়চারি শুরু করেছে গুণ্ডারসন। যখন শুনলাম তুমি এই মিশনে এসেছ, মন বলল তোমার সঙ্গে দেখা হলে মন্দ হয় না। কিন্তু যখন এসে পৌঁছলাম, তুমি লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেলে। পায়চারি থামিয়ে রানার দিকে চাইল সে। তারপর শুনলাম, পালাতে গিয়ে ক্লিফের উপর থেকে পড়ে গেছ। তখন মনে হলো, আর বুঝি রানা বাবুর সঙ্গে দেখা হলো না।
একদম নীরব রানা। চুপ করে দেখছে পিশাচটাকে। কিন্তু এখন জানি, তুমি পুরো সুস্থ, মাথা নাড়ল গুণ্ডারসন। আমি খুশি যে ভুল ভেবেছিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে কী যে ভাল লাগছে। আবার খারাপও লাগছে, এমন বাজে পরিস্থিতিতে আমাদের দেখা হলো।
আসলে কী বলতে চাও? প্রথমবারের মত মুখ খুলল রানা।
খারাপ লাগছে, আমাদের এই দুজনের একজনকে মরতেই হবে।
তোমার আত্মীয়-স্বজনকে বুক ভরা সহানুভূতি জানাব, বলল রানা।
বাহ! বলে উঠল গুণ্ডারসন। এই তো চাই। লড়াই তো করতেই হবে। সবসময় আমার ভাল লেগেছে তোমার এই লড়াকু ভাব। তোমার ভিতর যুদ্ধংদেহী ভাব আছে। তুমি হয়তো আমার মত দুনিয়ার সেরা স্ট্রাটেজিক কমাণ্ডার হওনি, কিন্তু চেষ্টা তো করেছ। যা আগে শিখতে পারোনি, পরে শিখতে চেয়েছ, আর তা করতে গিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করেছ। কখনও এক পা পিছালেও হাল ছাড়োনি। আজকাল এ ধরনের মানুষ খুব কম পাওয়া যায়।
চুপ করে আছে রানা।
অন্তর থেকে একটা কথা মেনে নাও, রানা, এই লড়াইয়ে কখনও জিততে না। সেই প্রথম থেকেই ভুল করছ। এমনকী তোমার দলেই বিশ্বাসঘাতক। সে তোমার প্রতি অনুগত ছিল না।
পুলের আরেক পাশের খুঁটিতে পল সিংগারের দিকে চাইল গুণ্ডারসন। লোকটার দৃষ্টি লক্ষ্য করে ওদিকে চাইল রানা।
তুমি ওকে খুন করতে চাও, তাই না? নিষ্পলক চোখে ভাইপারের দিকে চেয়ে আছে গুণ্ডারসন।
নীরব থাকল রানা।
ঘুরে চাইল গুণ্ডারসন, সরু হয়ে গেছে দুই চোখ! সুযোগ পেলে মেরেই ফেলবে, তাই না, রানা?
শিথিল ভাবে দাঁড়িয়ে আছে রানা।
মনে হলো কী যেন ভাবতে শুরু করেছে ব্রিটিশ কমাণ্ডার। একটু পর আবারও চাইল রানার দিকে। জ্বলজ্বল করে উঠেছে দুই চোখ।
বলি কী শোনো, বলল। আমি তোমাকে সুযোগ করে দেব। ব্যাপারটাকে খেলাও বলতে পারো। এটা একটা বড় সুযোগও।
কথা না পেঁচিয়ে যা বলার বলে ফেলো, বলল রানা।
তোমাদের দুজনকে মেরে ফেলব, কিন্তু একটা সুযোগ দেব দুজনকেই। চাইলে প্রাণপণ লড়তে পারো। একজন মরলে দ্বিতীয়জনকে ফেলে দেব সিংহের মুখে। তার সম্মান অনেক বেশি।
প্রাচীন রোমানদের মত খেলতে চাইছে গুণ্ডারসন। ভুরু কুঁচকে গেল রানার, চাইল পুলের দিকে। আবারও ফিরেছে কালো, উঁচু ডরসাল ফিন। কিনারা দিয়ে ঘুরছে কিলার ওয়েইল।
ওর হাত খুলে দাও, ভাইপারের সামনে দাঁড়ানো এসএএস কমাণ্ডোর উদ্দেশে বলল গুণ্ডারসন। জেন্টলমেন, ড্রিলিং রুমে চলো সবাই।
হ্যাণ্ডকাফে পিছমোড়া করে আটকে রেখেছে রানার দুই হাত। দুই এসএএস কমাণ্ডো ঘাড় ধরে ওকে নিয়ে চলল, দক্ষিণ টানেলের দিকে। একমিনিট পেরুবার আগেই গুদাম-ঘর পাশ কাটাল রানা। এক পলক ওদিকে চাইল।
দরজা খোলা। গুদাম-ঘর খালি।
নিশাত ওখানে নেই।
ওর কথা একবারও বলেনি গুণ্ডারসন।
নিশাতকে বোধহয় পায়নি এরা।
দীর্ঘ, সরু টানেল ধরে রানাকে নিয়ে চলেছে দুই কমাণ্ডো। ড্রিলিং রুমের দরজা খোলা। ধাক্কা দিয়ে ওকে ঘরের ভিতর ঠেলে দেয়া হলো। হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নিল রানা, ঘুরে দাড়াল।
কয়েক সেকেণ্ড পর ঘরের ভিতর ঠেলে দেয়া হলো পল সিংগারকে। আগেই তার হ্যাণ্ডকাফ খুলে দেয়া হয়েছে।
ড্রিলিং রুমের চারপাশ দেখে নিতে শুরু করেছে রানা। ঘরের ঠিক মাঝে কালো রঙের মস্ত কোর-ড্রিলিং অ্যাপারেটাস। দেখলে মনে হয় ছোটখাটো অয়েল ওয়েল। কালো কঙ্কালের মত রিগের মাঝে দীর্ঘ, গোলাকার প্লঞ্জার। ওটা বোধহয় ড্রিলের সঙ্গে বহু নীচে বরফের কোরে নামে।
কোর-ড্রিলিং মেশিনের ওপাশে অন্য এক দৃশ্য চোখে পড়েছে। রানার।
একটা দেহ। মেঝের উপর পড়ে আছে।
দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া লাশ, একেবারে রক্তে মাখামাখি ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো-নেতা জ্যাকুস ফিউভিল। নিজেদের পেতে রাখা ক্লেমোর মাইনের বিস্ফোরণে মরেছে লোকটা।
জেণ্টলমেন, দরজা থেকে হঠাৎ করেই গমগমে কণ্ঠে বলে উঠল গুণ্ডারসন। ওই দরজা ঢুকবার বা বেরুবার একমাত্র পথ। তোমরা এখন বাঁচবার জন্য লড়বে। ঠিক পাঁচ মিনিট পর ফিরব আমি। আশা করি তার আগেই যে-কোনও একজন মরবে। আর যদি দেখি কেউ মরোনি, দুজনকেই নিজ হাতে গুলি করে মারব। মন দিয়ে শোনো, যদি ঠিকভাবে লড়ো, আর একজন মরে, অন্যজনকে কিছুক্ষণের জন্য বাঁচতে দেব। তার চেয়ে ঢের বড় কথা, সম্মানজনক ভাবে তাকে বিদায় করে দেব পৃথিবী থেকে। কারও কোনও প্রশ্ন?
আমার হ্যাণ্ডকাফ খুলবে না? জানতে চাইল রানা। ওর দুই কবজি এখনও পিছমোড়া করে আটকানো। ভাইপারের হাত মুক্ত।
আর কোনও প্রশ্ন? জানতে চাই উদাস গুণ্ডারসন।
এবার আর একটা কথাও বলল না রানা।
বেশ, যা করবার ঝটপট, বলল গুণ্ডারসন। দরজা থেকে ঘুরে চলে গেল সে। দড়াম করে বন্ধ হলো দরজা। তালা লাগিয়ে দেয়ার আওয়াজ এল।
দেরি করল না রানা, সিংগারের দিকে চাইল। শোনো, ভাইপার, এবার এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হলে…
বুনো মোষের মত এল পল সিংগার, তার কাঁধের প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পিছনে উড়াল দিল রানা, ধড়াস করে পড়ল দেয়ালে পিঠ দিয়ে। ফুসফুসে ব্যথা পেয়ে প্রায় দুই ভঁজ হয়ে গেল। হা করে শ্বাস নিতে চাইল, তারই ফাঁকে দেখল, ওর মুখ লক্ষ্য করে আসছে ভাইপারের খোলা তালু। ঝট করে বসে পড়ল রানা। লোকটার, প্রচণ্ড থাবড়া পড়ল পিছনের বরফের দেয়ালে।
মাথা খাটাতে শুরু করেছে রানা। স্ট্যাণ্ডার্ড হ্যাণ্ড-টু-হ্যাণ্ড কমব্যাট মুভ নিয়েছে ভাইপার। খোলা হাতে পাঞ্চ করছে। রানার মগজের ভিতর গেঁথে দিতে চায় নাকের হাড়। ওই এক আঘাতেই শেষ হবে ও।
ওকে খুন করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ভাইপার।
এবং সেটা করতে চাইছে পাঁচ মিনিটের ভিতর।
প্রায় মুখোমুখি দুজন, ঝট করে হাঁটু তুলল রানা, পরক্ষণে জোর গুতো বসিয়ে দিল লোকটার তলপেটে। দেয়াল থেকে ছিটকে সরে গেল নিজে। হনুমানের মত লাফিয়ে উঠেছে, দুই পায়ের নীচ দিয়ে বের করে নিল দুই হাত।
এখন হ্যাণ্ডকাফে আটকানো হাত দুটো ওর সামনে।
একের পর এক কিক ও পাঞ্চ করতে করতে আসছে ভাইপার। কাফ পরা দুই হাতে লোকটার কিক বা পাঞ্চ ঠেকাতে শুরু করেছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর আলাদা হয়ে গেল দুজন, ক্ষিপ্ত বাঘের মত ঘুরতে শুরু করেছে পরস্পরকে।
ঝড়ের মত চলছে রানার মগজ। ভাইপার ওকে মেঝের উপর ফেলতে চাইবে। কিন্তু যতক্ষণ দুপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে, বড় কোনও বিপদ হবে না ওর। হ্যাণ্ডকাফ পরা হাতেও হামলা ঠেকিয়ে দেয়া খুব কঠিন নয়। কিন্তু… একবার মেঝেতে পড়লে কয়েক সেকেণ্ডে ওকে মেরে ফেলবে ভাইপার।
পড়লে চলবে না…
কালো ড্রিলিং অ্যাপারেটাসের কাছে, ঘরের মাঝে পরস্পরকে ঘিরে চক্কর কাটছে ওরা।
হঠাৎ করেই মেঝে থেকে একটা রেঞ্চ তুলল ভাইপার, গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল রানার দিকে। চট করে বসে পড়ল রানা, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে, ওর মাথার বাম পাশে লেগে ছিটকে গেল রেঞ্চ। দুই সেকেণ্ডে অজস্র নক্ষত্র দেখল রানা, তার আগেই ভারসাম্য হারিয়েছে।
দুই লাফে এগিয়ে এল ভাইপার, প্রায় উড়ে এসে ট্যাকল করল। আবারও দেয়ালের উপর পিঠ দিয়ে পড়েছে রানা। ওর শিড়দাঁড়া লেগে অন হয়ে গেছে একটা পাওয়ার সুইচ। হঠাৎ করেই চালু হয়েছে ড্রিলিং মেশিনের প্লাঞ্জার, ঘুরতে শুরু করেছে রনবন করে। তীক্ষ্ণ, জোরালো গুঞ্জন ছাড়ছে।
ল্যাং মেরে রানাকে ফেলে দিল ভাইপার, এবার খতম করবে। মেঝেতে পড়েই শরীর গড়িয়ে দিয়েছে রানা। তিন সেকেণ্ড পর ধাক্কা খেল জ্যাকুস ফিউভিলের লাশে, নাকের কাছে এক ইঞ্চি দূরে দেখল মৃত মুখটা।
ক্লেমোর মাইনের বিস্ফোরণে ফালা ফালা হয়ে গেছে লোকটার রক্তাক্ত মুখ।
আর ঠিক তখনই, এক পলকের জন্য রানা দেখল ফিউভিলের জ্যাকেটে কী যেন।
ক্রসবো!
হ্যাণ্ডকাফে আটকানো দুই হাতে ব্যস্ত হয়ে ক্রসবো তুলে নিতে চাইল রানা। এবং খপ করে তুলেও নিল ক্রসবো, কিন্তু উঠে বসবার আগেই ওর উপর নেমে এল ভাইপারের ক্র্যাশ-ট্যাকল। পিচ্ছিল মেঝেতে সরসর করে পিছলে গেল দুজন, ধাক্কা লাগল ড্রিলিং মেশিনে। কানের কাছে জোরালো গুঞ্জন তুলছে ঘুরন্ত প্লাঞ্জার।
মেঝের উপর চিত হয়ে পড়েছে রানা, আর ওর উপর চড়াও হয়েছে ভাইপার। দুপাশে ছড়িয়ে বসেছে দুই পা।
ভাইপার ক্র্যাশ-ট্যাকল করবার সময়েও ক্রসবো ফেলেনি রানা। এক পলকের জন্য দেখল, এখনও ওর হাতে ক্রসবো। এক সেকেন্ড পিটপিট করে চাইল ওদিকে।
ওর নাক লক্ষ্য করে প্রচণ্ড ঘুষি বসাল ভাইপার। হাড় মচকে যাওয়ার মুড়মুড় আওয়াজ পেল রানা। নাক থেকে ছিটকে বেরুল রক্ত, ভেসে গেল মুখ-গলা-বুক। মেঝের উপর ঠাস্ করে পড়েছে। মাথার পিছন দিক।
বনবন করে ঘুরছে সব, এক সেকেণ্ডের জন্য জ্ঞান হারাল রানা। পরক্ষণে চমকে গেল–সত্যি যদি চেতনা হারায়, কেউ বাঁচাতে পারবে না ওকে। আরাম করে ওকে খুন করবে ভাইপার।
চট করে চোখ মেলল রানা, দৃষ্টি গিয়ে পড়ল তিন ফুট উপরে। ওখানে চলছে ড্রিলিং মেশিনের ঘুরন্ত প্লাঞ্জার!
জিনিসটা ঠিক ওর উপরে!
দুরন্ত সিলিণ্ডারের কোনা দেখতে পেল রানা, ওটা দুদিকে ফাটল ধরা–ওদিকটাই জমাট বরফ কেটে নীচে নামে।
রানা হঠাৎ করেই দেখল প্লাঞ্জারের নীচে চলে এসেছে ভাইপার, ভীষণ রাগে ফুঁসছে, দাঁত খিচিয়ে ঘুষি নামিয়ে আনছে ওর মুখ লক্ষ্য করে।
আত্মরক্ষার জন্য মুখের সামনে দুহাত তুলল রানা, হ্যাণ্ডকাফের চেইন দিয়ে ঠেকাবে হামলা।
ওর উপর চড়ে বসেছে ভাইপার, আর উঠতে পারবে না রানা।
এখন যদি চোখে-মুখে-নাকে একের পর এক ঘুষি…
ওর চোয়ালের উপর নামল ঘুষি।
ঝাপসা হয়ে গেল রানার দৃষ্টি। ঘোলাটে আলোর ভিতর দিয়ে পাগলের মত দেখতে চাইল।
হাত আবারও উপরে তুলেছে ভাইপার, এবার শেষ আঘাত হানবে।
ঠিক তখন ডানদিকে এক পলকে অন্য কিছু দেখল রানা।
ওদিকের দেয়ালে ড্রিলিং মেশিন চালু করবার ওই যে সুইচ। সুইচ প্যানেলে গোল তিনটে বড় বাটন।
কালো, লাল ও সবুজ।
এক পলক পরিষ্কার দেখল রানা কালো বাটন। ওটার নীচে লেখা:
লোয়ার ড্রিল।
এক সেকেণ্ডের দশ ভাগ সময়ে ভাইপারের দিকে চাইল রানা, লোকটার মাথা ঠিক ঘুরন্ত প্লাঞ্জারের নীচে।
ক্রসবো দিয়ে ভাইপারকে লাগাতে পারবে না। কিন্তু, সামান্য সরিয়ে নিতে পারবে দুই হাত, তার ফলে হয়তো…
ভাইপার, একটা কথা জানো? বলল রানা।
কী?
আমি তোমাকে খুব নিচু জাতের জানোয়ার মনে করি।
সামান্য নড়ে উঠল রানার দুই হাত, দেয়ালের কালো বাটনের দিকে তাক করেছে ক্ৰসবো, পরক্ষণে ট্রিগার টিপে দিল।
এক সেকেণ্ডের এক শ ভাগ সময়ে দূরত্ব পেরুল তীর, খটাস করে লাগল কালো বাটনের মাঝে। ওখান থেকে ছিটকে গিয়ে লাগল দেয়ালে। ওই একই সময়ে ঝট করে ড্রিলিং মেশিন ও প্লঞ্জারের নীচ থেকে মাথা সরিয়ে নিয়েছে রানা। তীব্র গতি তুলে নেমে এল ঘুরন্ত প্লঞ্জার, সরাসরি নামল ভাইপারের মাথার তালুর উপর।
হাড় ভাঙার অসুস্থকর মড়মড় আওয়াজ পেল রানা, ফচ্ শব্দে ফুটো হলো মগজ, প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে নীচে নামল ভাইপারের দেহ মেঝের উপর ঠাস্ করে পড়ল মাথা। চেপে বসেছে। প্লঞ্জার। ফুটো থেকে গলে পড়ছে থকথকে হলদেটে মগজ। এক সেকেণ্ড পর মাথা ফুটো করে নেমে গেল প্লাঞ্জার বরফের নীচে।
এখনও অবশ লাগছে রানার, কয়েক সেকেণ্ড পর দুই হাঁটুর উপর উঠে বসল। একবার ঘুরে চাইল ভাইপারের দিকে। গেঁথে গেছে মৃতদেহ, মেশিনের চারপাশে ছিটিয়ে পড়েছে রক্ত। আঁশটে গন্ধে মনে হলো, হাজির হয়েছে কসাইখানায়। চট করে থাই পকেটের ভিতর ক্রসবো গুঁজে রাখল রানা। কোনও অস্ত্রের জন্য চোখ বোলাল চারপাশে।
ওর চোখ পড়ল জ্যাকুস ফিউভিলের দেহের উপর। একটু দূরে পড়ে আছে লাশটা। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ওখানে চলে গেল রানা, পাশে বসে হাতড়াতে শুরু করেছে পকেটগুলো।
কয়েক সেকেণ্ড পর একটা পকেট থেকে বের করে নিল গ্রেনেড। ওটার উপর লেখা: এম৮৩-এসটিএন।
ওর বুঝতে দেরি হলো না ওটা কী।
স্টান গ্রেনেড। ফ্লাশার।
আজ সকালে এই জিনিস ব্যবহার করেছে ফ্রেঞ্চ কমান্ডোরা। বুক পকেটে গ্রেনেড রেখে দিল রানা।
ঠিক তখনই, দড়াম করে খুলে গেল ড্রিলিং রুমের দরজা। মেঝেতে চিত হয়ে ধুপ করে পড়ল রানা। ভঙ্গি করছে, ভয়ানক ক্লান্ত এবং গুরুতর আহত।
কালো ড্রিলিং অ্যাপারেটাসের নীচে মৃতদেহ এবং ছিটিয়ে থাকা রক্ত। ভাইপারের মাথার উপর ফুটো। লোকটার লাশ দেখে মুখ কুঁচকে ফেলল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।
ছিহ্, বাচ্চা শাসনের ভঙ্গিতে বলল, এমন করে, রানা?
মেঝেতে শুয়ে এখনও হাঁপিয়ে চলেছে রানা, ওর মুখে ছিটিয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। কোনও কথা বলল না।
আবারও মাথা নাড়ল গুণ্ডারবাচ্চা। মনে হলো ভীষণ হতাশ। যেন ভাইপারের বদলে রানা মরলেই খুশি হতো।
ওকে ওখান থেকে তুলে আনো, নিচু স্বরে বলল গুণ্ডারসন। তাকে পাশ কাটিয়ে এল দুই এসএএস কমাণ্ডে। মিস্টার বোউলস্।
জী, স্যর।
ওকে নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে দাও।
১৪.
দক্ষিণ আমেরিকা, চিলি।
স্যান্টা ইনেস থেকে সামান্য দূরে। স্ট্রেইট অভ ম্যাগেলানের দক্ষিণে এক হাজারেরও বেশি এ ধরনের ছোট দ্বীপ আছে।
অনেক পিছিয়ে থাকা এক জনপদ এটা।
পাঁচ শ মাইল দূরে দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ও ধবল অ্যান্টার্কটিকা।
স্যান্টা ইনেসের সামান্য দূরের এই দ্বীপকে বলা যেতে পারে শেষ জমি, তার দক্ষিণে গেলে সেই বহু দূরের অ্যান্টার্কটিকা, তার আগে আর কোনও জমি নেই।
ছোট ছেলেটার নাম পেদরো, পশ্চিম উপকূলের কাছে খুদে এক জেলে-গ্রামে বাস করে। ওদিকে রয়েছে ছোট এক উপসাগর। নাম দেয়া হয়েছে: রুপালি ঈগলের বাসা।
স্থানীয়রা বলে: ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে ওখানে নেমেছিল বিশাল এক রুপালি পাখি, ওটার পিছনে ছিল লাল আগুন, সোজা গিয়ে ডুব দিয়েছিল উপসাগরের পানিতে।
যে বৃদ্ধা প্রথম ওটা দেখে, সে সবাইকে জানিয়েছিল: ওই পাখি অনেক জোরে উড়তে গিয়ে ঈশ্বরকে রাগিয়ে দেয়। তাছাড়া, দেখতেও ওটা খুব সুন্দর ছিল, সে-কারণে বিরক্ত হন ঈশ্বর। তিনি আগুন দিয়ে দেন পাখির লেজে, ঘাড়টা ধরে ফেলে দেন সাগরে।
এই গল্প কখনও বিশ্বাস করেনি পেদরো। এখন ওর বয়স দশ, শিক্ষিত ছেলে, গ্রামের পাঠশালায়, টু-এ পড়ে। এসব গাঁজাখুরি গল্প শুনলে চলবে? আর সবাই বিশ্বাস করে করুক, ও কখনও এসব মানবে না।
আজ উপসাগরে নামবার দিন ওর। ঝিনুক তুলবে, বিক্রি করবে বাবার কাছে। তাতে ওর পকেট-খরচা উঠবে।
সৈকত পাড়ি দিয়ে সাগরে নেমে পড়ল পেদরো, একটু সাঁতরে দূরে সরে ডুব দিল। অনেক নীচে নামতে পারে ও। এখন ভয়ের কিছু নেই, জোয়ার আসছে সাগর থেকে অনায়াসেই আবারও ফিরতে পারবে তীরে। আশা করছে, অনেক ঝিনুক নিয়ে বাড়ি ফিরবে আজ।
সাগর-তলের বালিতে নেমে পড়ল পেদরো, নীচে চোখ পড়তেই প্রথম ঝিনুক পেয়ে গেল। সঙ্গে আরেকটা জিনিস।
ছোট প্লাস্টিকের একটা টুকরো।
ঝিনুক ও প্লাস্টিকের টুকরো নিয়ে উপরে উঠতে লাগল পেদরো। ভেসে উঠে অদ্ভুত টুকরোটা ভাল করে দেখল। জিনিসটা চারকোনা, ছোট। খুব ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু পেদরো পড়তে পারল নামটা:
ট্রেভল রয়েস।
নামের ব্যাজের দিকে ভুরু কুঁচকে চাইল পেদরো। তারপর বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল প্লাস্টিকের টুকরো। বড় করে শ্বাস নিয়ে নতুন উদ্যমে ডুব দিল ঝিনুকের খোঁজে।
১৫.
পাতাল-গুহার ভিতর অন্য এক লড়াই শুরু হয়েছে।
প্রথম এসএএস ডাইভার পানি থেকে উঠে আসতেই, তার পিছনে দেখা দিয়েছে দ্বিতীয় কমাণ্ডো, অল্প পানিতে চলে এসেছে সে-ও।
উঠে এসেই চারপাশে গুলি শুরু করেছে প্রথমজন। পরের জন হাঁটু পানিতে, কাঁধে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। আর ঠিক তখনই পিছন থেকে এল প্রচণ্ড টান। আবারও ঝপাস করে পানির নীচে তলিয়ে গেল লোকটা।
প্ৰথমজন উঠে এসেছে ডাঙায়, এখনও বুঝতে পারেনি তার। সঙ্গীর কী হলো। জনি ওয়াকারকে দেখতে পেয়েছে সে, ঝট করে ডানদিকে অস্ত্র তাক করল। আর তখনই নিজের বোল্ডারের পিছন থেকে উঠে দাঁড়াল তিশা, বামপাশ থেকে গুলি করে ফেলে দিল লোকটাকে।
দেরি না করে আবারও পুলের দিকে ফিরল তিশা, সি স্নেড় নিয়ে পানিতে ভেসে উঠছে একের পর এক এসএএস ডাইভার।
চোখের কোণে আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছে তিশা।
নড়াচড়া চলছে ওদিকের বরফ-দেয়ালে।
দশ ফুটি সব গর্তের ভিতর থেকে কালো বিশাল, কী যেন মসৃণ ভাবে ঝুপ করে নামছে পুলের ভিতর।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল তিশা।
কোনও ধরনের মস্ত জানোয়ার।
মস্ত বড়… দেখতে সিল মাছের মতই। কোনও ধরনের প্রকাণ্ড। সিল হতে পারে।
ঠিক তখনই, দ্বিতীয় গর্ত থেকে বেরুল আরেকটা। তারপর আরেকটা। তারপর আরেকটা! গর্ত থেকে পিছলে পানির ভিতর পড়ছে একের পর এক ছলাৎছলাৎ আওয়াজ হচ্ছে। এসএএস ডাইভারদের চারপাশে নেমে পড়েছে জানোয়ারগুলো।
অবাক হয়ে চেয়ে রইল তিশা।
পুকুরের পানি উন্মাতাল হয়ে উঠেছে। চারপাশে ফেনা, নানা দিকে ছুটছে ঢেউ। টুপ করে ডুবে গেল আরেক কমাণ্ডো। নিজের তাজা রক্তের ভিতর হারিয়ে গেছে। তার ঠিক পাশের লোকটা জোর ধাক্কা খেয়ে সামনে বাড়ল। তার উপর চেপে বসেছে প্রকাণ্ড এক সিল। পানির উপর এক সেকেণ্ড চকচকে কালো পিঠ দেখল তিশা, তারপর লোকটাকে নিয়ে ডুবে গেল ওটা।
দুএকজন এসএএস ডাইভার উঠে এসেছে ডাঙায়, কিন্তু তাদের পিছু নিয়ে পানি থেকে উঠে আসছে বেশ কয়েকটা সিল। এক ডাইভার হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে চাইছে বরফের ডাঙায়। যেভাবে হোক পানির কাছ থেকে সরবে, কিন্তু তার পিছনে পানি থেকে উঠে এল সাত টনি এক সিল।
বরফের মেঝেতে থপাৎ আওয়াজ তুলল, পিছনের দুই ফ্লিপারের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে! ওটার ওজনে থরথর করে কেঁপে উঠল মেঝে। দ্রুত সামনে বাড়ছে, চোয়ালের ভিতর খপ করে পুরে নিল লোকটার দুই পা, মুড়মুড় করে ভাঙল দুই হাড়। বিকট চিৎকার ছাড়ল লোকটা।
কেউ কিছু বুঝবার আগেই তাকে চিবাতে শুরু করেছে সিল।
বড় বড় গ্রাসে গিলছে মাংস ও হাড়। গুহার ভিতর মাংস ছেড়ার জোরালো আওয়াজ শুরু হলো।
হতবাক হয়ে চেয়ে রইল তিশা।
ভয়ঙ্কর ভয়ে চিৎকার শুরু করেছে এসএএস কমাণ্ডোরা। ঘেউ ঘেউ করছে সিলগুলো। জীবিত কয়েকজনকে চিবিয়ে খেতে শুরু করেছে এসব দানব।
সিলগুলোর দিকে চেয়ে আছে তিশা। একেকটা গণ্ডারের চেয়েও বড়। কিলার ওয়েইল এত বড় হয় না। বইয়ে এদেরকে দেখেছে, বেলুনের মত গোলচে হয় এদের নাক।
কোনও সন্দেহ নেই এগুলো এলিফ্যান্ট সিল।
ওই দলে ছোট দুটো দেখল তিশা। এদের দাঁত অদ্ভুত। নীচের মাড়ি থেকে উঠেছে দুটো শ্বদন্ত। উপরের ঠোঁট চেপ্টে দিয়ে উঠে গেছে নাকের পাশে। বড় সিলগুলোর এমন দাঁত নেই।
এলিফ্যান্ট সিল বিষয়ে সব তথ্য মনে করতে চাইছে তিশা। এলিফ্যান্ট সিল কিলার ওয়েইলের মতই বড় পাল তৈরি করে, দলের নেতা হয় একটা বড় মর্দা সিল। এদেরকে বলা হয় বুল বা বিচমাস্টার। এদের সঙ্গে থাকে আট বা নয়জনের হারেম। এই মাদিগুলোকে বলে কাউ। এরা বুলের চেয়ে বেশ ছোট হয়।
একটু দূরে মস্ত এক সিলের যৌনাঙ্গ দেখতে পেল তিশা।
এগুলো দলের মাদি!
ছোট দুই সিল এদের বাচ্চা!
ছেলে-বাচ্চা ওগুলো, খেয়াল করল তিশা।
ষাঁড় কোথায় গেছে, ভাবল। ওটা এই মাদিগুলোর চেয়ে অনেক বড় হবে। মাদিই যদি এই আকারের হয়, ওটা কত বড়?
নানা চিন্তা আসছে ওর মনে।
এরা হামলা করল কেন? ওর জানা আছে, এলিফ্যান্ট সিল ভয়ঙ্কর হিংস্র, বিশেষ করে যখন আস্তানা আক্রান্ত হয়।
কিন্তু এখন কেন? আর ওদের উপর হামলা করল না কেন? কয়েক ঘণ্টা আগে নিরাপদে এখানে এসেছে ওরা। এসএএস কমাণ্ডোদের উপর খেপে গেল কী কারণে?
হঠাৎ আরেকটা চিকার হলো পুলের ভিতর, তারপর ঝপাৎ আওয়াজ হলো। নিজের বোল্ডারের পিছন থেকে উঁকি দিল তিশা।
আর কোনও আওয়াজ নেই। থমথম করছে চারপাশ। শব্দ বলতে পুলের পারে ঢেউয়ের ছল-ছলাৎ।
এসএএস কমাণ্ডোদের একজনও বাঁচেনি। পাতাল-গুহার ভিতর হাজির হয়েছে বেশির ভাগ সিল। লাশগুলোর পাশে পৌঁছে দেখছে কী জয় করেছে। তারপর রী-রী করা কড়মড়ে আওয়াজ পেল তিশা, ঘুরে চাইল–লাশের মাংস-হাড় ছিড়ে খেতে শুরু করেছে দানব সিল!
সত্যি, সমাপ্ত হয়েছে সবার লড়াই।
.
উইলকক্স আইস স্টেশনের পুল ডেকে দাঁড়িয়ে আছে রানা। দেহের সামনে হ্যাণ্ডকাফে আটকানো দুই হাত। এক এসএএস কমাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে ওর গোড়ালিতে পেঁচিয়ে দিচ্ছে হোসেন আরাফাত দবিরের ম্যাগহুকের কেবল। বামে চাইল রানা, রক্ত মিশ্রিত লাল পানিতে মসৃণভাবে ঘুরছে কিলার ওয়েইলের কালো ফিন।
ডাইভ টিম, রিপোর্ট, একটু দূরের এক পোর্টেবল ইউনিটে বলে উঠল এসএএস রেডিয়ো অপারেটার। রিপিট করছি। ডাইভ টিম, যোগাযোগ করুন।
কিছু বলল ওরা? জানতে চাইল গুণ্ডারসন।
জবাব দিচ্ছে না, স্যর। আগে তো বলেছিল গুহার কাছে পৌঁছে গেছে।
একবার কঠোর চোখে রানার দিকে চাইল গুণ্ডারসন। চেষ্টা করতে থাকো, বলল রেডিয়ো অপারেটারকে। আবারও রানার দিকে ঘুরল ব্রিটিশ কমাণ্ডার। গুহার ভিতর ভালই লড়ছে তোমার লোক।
ওরা ওদের কাজ বোঝে, বলল রানা।
আচ্ছা? নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ করল গুণ্ডারসন। তোমার শেষ কোনও ইচ্ছা, রানা? রুমাল দিয়ে চোখ ঢেকে নিতে চাও? সিগারেট? এক ঢোক ব্র্যাণ্ডি?
প্রথমে কিছুই বলল না রানা, চেয়ে আছে হ্যাণ্ডকাফ পরা দুই কবজির দিকে।
তারপর চট করে মুখ তুলে চাইল।
একটা সিগারেট, প্লিয।
মিস্টার বোউলস্। মাসুদ রানার জন্য একটা সিগারেট।
সামনে বাড়ল বোউলস, রানার দিকে এগিয়ে দিল এক প্যাকেট সিগারেট। একটা শলা নিল রানা, দুহাতে তুলল ঠোঁটে। আগুন জ্বেলে দিল বোউস্। সিগারেটে বড় করে টান দিল রানা।
ঠিক আছে, বলল গুণ্ডারসন। যথেষ্ট হয়েছে। জেন্টলমেন, এবার ওকে ঝুলিয়ে দাও। …রানা, তোমাকে চিনতাম, কথাটা ভেবে ভবিষ্যতে ভাল লাগবে আমার।
এক এসএএস কমাণ্ডো ল্যাং মারল রানাকে। ধুপ করে মেঝের উপর পড়ল ও। পাঁচ সেকেণ্ড পেরুবার আগেই ওকে উপরে তুলল ম্যাগহুক। সিগারেট ফেলেনি রানা, উল্টো ঝুলতে ঝুলতে আরেক টান দিল।
থেমে গেছে ম্যাগহুক। নীচে লালচে পানির দিকে চাইল রানা।
ওই রক্ত হোসেন আরাফাত দবিরের। ওর সহযোদ্ধার।
পুলের মাঝে ভাসছে ডাইভিং বেল। একটা পোর্টহোলের ওপাশে রাশেদ হাবিবের মুখ দেখল রানা। লোকটার চোখে ভীষণ আতঙ্ক। ওর দিকেই চেয়ে আছে।
রক্তিম পানির মাত্র তিন ফুট উপরে ঝুলিয়ে দিয়েছে রানাকে। ঠোঁটে সিগারেট তুলে আরেক টান দিল রানা।
এসএএস কমাণ্ডোরা বোধহয় ধারণা করেছে, লোকটা নিজের সাহস দেখাবার চেষ্টা করছে। ঠোঁট থেকে ঝুলছে সিগারেট, কিন্তু এসএএস কমাণ্ডোরা দেখল না রানার হাত কী করছে।
পরাজিত নায়কের দিকে চেয়ে স্যালিউট দিল জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসন। রুল ব্রিটানিয়া, রানা।
ফাঁক ইয়োর ব্রিটানিয়া! জবাবে বলল রানা।
মিস্টার বোউলস, করমচার মত লাল হয়ে গেল গুণ্ডারসনের গাল, ধমকে উঠল, বেয়াদবটাকে নামিয়ে দাও।
রাং-ল্যাডারের পাশে, ম্যাগহুকের বাটন টিপল বোউলস। লঞ্চারটা দুই ধাপের মাঝে আটকে রাখা। দড়ি ঘুরে এসেছে সিডেকের রিট্রাক্টেবল সেতুর ওপাশ থেকে, রানা ঝুলছে পুলি থেকে। ওটা থেকেই বুলিয়ে দেয়া হয়েছিল হোসেন আরাফাত দবিরকেও।
খুব ধীরে দড়ি ছাড়তে শুরু করেছে ম্যাগহুক।
পানির দিকে নামছে রানা। ওর দুই হাতকে সামনের দিকে আটকে রেখেছে হ্যাণ্ডকাফ। ডানহাতের দুই আঙুলে জ্বলছে সিগারেট।
লালচে পানিতে ডুবতে শুরু করেছে রানার মাথা। তারপর তলিয়ে গেল দুই কাঞ্চ। তারপর বুক। পেট। পানি স্পর্শ করল দুই কনুই। সতর্ক হয়ে উঠল রানা।
দুই সেকেণ্ড পর কবজি ছুঁলো পানি। আর ঠিক তখনই কাজে নামল ও। সিগারেট তাক করেছে হ্যাণ্ডকাফের দিকে। আগেই পুরু শেকলে জড়িয়ে নিয়েছে ম্যাগনেশিয়াম ডেটোনেটার কর্ড।
একটু আগে ডেকের উপর ডেটোনেটার কর্ড ভাল করেই দেখে নিয়েছে। পরিত্যক্ত লিটল আমেরিকা-৪ স্টেশনে জিনিসটা পেয়েছিল, পরে কবজিতে পেঁচিয়ে নিয়েছে। ভুলে গিয়েছিল ওটার কথা। এসএএস কমাণ্ডে যখন ওকে তল্লাশী করল, কেড়ে নিল সব অস্ত্র, তখন লোকটাও ভুল করে ওটা সরিয়ে নেয়নি।
রানার কবজি পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ার এক সেকেণ্ড আগে ডেটোনেটার কর্ডে লেগেছে জ্বলন্ত সিগারেটের ডগা। পরক্ষণে দুই হাত চলে গেছে পানির নীচে।
লালচে পানির নীচে ফস ফস করে জ্বলছে ডেটোনেটার কর্ড, উজ্জ্বল সাদা ঝলকানি বেরুচ্ছে ওটা থেকে। জিনিসটা যেন ধারালো কোনও ছুরি, পানির নীচেও হ্যাণ্ডকাফের চেইন মাখনের মত কাটছে। দু সেকেণ্ড পেরুবার আগেই মুক্ত হয়ে গেল রানার দুই হাত।
ঠিক তখনই রক্তিম পানির ভিতর মস্ত এক চোয়াল দেখল রানা। একবার মাথার চারপাশে ঘুরল বিশাল এক চোখ। সরাসরি ওর দিকে চেয়ে আছে কিলার ওয়েইল। তারপর হঠাৎ করেই উধাও হলো, হারিয়ে গেছে ধোঁয়ার মত লালচে পানির ভিতর।
ধড়াস ধড়াস্ করছে রানার হৃৎপিণ্ড। প্রায় কিছুই দেখছে না। চারপাশে যেন ভাসছে লাল রঙের ঘন কুয়াশা।
পানির ভিতর বিদঘুটে আওয়াজ শুরু হয়েছে। মনে হলো, চারপাশ থেকেই আসছে।
ক্লিক-ক্লিক। ক্লিক-ক্লিক।
ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। ওই আওয়াজ কীসের? কিলার ওয়েইল ওই আওয়াজ ছাড়ছে?
তারপর বুঝল ও।
সোনার।
বিড়বিড় করে কপালকে দোষ দিল রানা।
ঘোলা পানিতে সোনার কাজে লাগিয়ে ওকে খুঁজতে শুরু করেছে কিলার ওয়েইল। স্পার্ম ওয়েইল, নীল তিমি এবং কিলার ওয়েইল এমন সোনার ব্যবহার করে। জিভ দিয়ে জোরালো শব্দ করে ওরা। আর পানির ভিতর ছুটে চলা ওই আওয়াজ কোথাও ধাক্কা খেয়ে ফিরলে, পরিষ্কার বুঝে ফেলে জিনিসটা ঠিক কোথায় আছে। একই পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি সাবমেরিন।
লাল মেঘের মাঝে ব্যস্ত হয়ে তিমি খুঁজতে শুরু করেছে রানা। ঠিক তখনই ঘোলা পানিতে ছুটে এল ওর দিকে এক কিলার ওয়েইল।
দুই হাত দ্রুত নাড়তে শুরু করেছে রানা। তিন সেকেণ্ড পর হাজির হলো কিলার ওয়েইল, কর্কশ চামড়া দিয়ে জোর ঘষা মেরে বেরিয়ে গেল।
রানার মনে পড়ল রাশেদ, হাবিবের বক্তব্য শিকার ধরবার আগে নিজের দাবি জানিয়ে দেয় কিলার ওয়েইল।
ঘষা দিয়ে যায় শিকারের গায়ে।
তারপর ফিরে এসে আক্রমণ করে।
তার আগেই কিছু করতে হবে। ঝুলন্ত রানা সিট-আপ করল। কোমর থেকে ভাঁজ হয়ে উঠে এসেছে পানির উপর। রানা শুনল, ই-ডেকের এসএএস কমাণ্ডোরা হই-হই করে উঠেছে। পাত্তা দিল না ও, বুক ভরে দম নিয়েই আবারও ডুব দিল।
বুঝতে পারছে, হাতে একেবারে সময় নেই। যে তিমি ওকে আপন করে পেটের ভিতর রাখতে চাইছে, ওটা যে-কোনও সময়ে ফিরবে।
রানার চারপাশে লালচে পানিতে শুরু হয়েছে ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ।
ঠিক তখনই হঠাৎ একটা চিন্তা এল রানার।
সোনার…
কপাল যদি ভাল থাকে… ভাবতে শুরু করেছে ও।
ওটা এখনও আছে? পকেট হাতড়াতে লাগল রানা।
হ্যাঁ, এখনও আছে।
মেরি ভিসারের প্লাস্টিকের অ্যাজমার পাফার বের করল রানা। গায়ের জোরে টিপে ধরেছে রিলিজ বাটন। পাফার থেকে বেরিয়ে আসছে ঘন সব বুদ্বুদ।
এবার কোনও ওজন চাপিয়ে দিতে হবে রিলিজ বাটনের উপর।।
এমন কিছু…
গত জন্মদিনে ওকে সুন্দর একটা সোনার চেইন এবং ভারী লকেট দিয়েছে বিসিআই-এর সবাই মিলে, ওটা এখন ওর গলা থেকে নীচের দিকে ঝুলছে। দ্বিধা না করেই চেইন-লকেট খুলে নিল রানা, ব্যস্ত হয়ে পাফারের উপর গিট তৈরি করছে। এমন ভাবে বাঁধছে, যাতে চাপ পড়ে রিলিজ বাটনের উপর।
পাফার থেকে বেরুচ্ছে ভারী বুদ্বুদ।
কাজের ফাঁকে রানা টের পেল, চারপাশের পানি ভীষণ দুলছে। লাল কালির মত পানির ভিতর দিয়ে আসছে কিলার ওয়েইল!
ছোট্ট পাফারের উপর কাজ শেষে ওটা ছেড়ে দিল রানা। নীচের দিকে পড়তে শুরু করেছে জিনিসটা। উপরের দিকে ছাড়ছে বুদ্বুদ। কয়েক সেকেণ্ড পর আর পাফারটা দেখতে পেল না রানা।
এর এক সেকেণ্ড পর লাল মেঘের ভিতর দিয়ে এল কিলার ওয়েইল, হাঁ করেছে মস্ত। হতবাক হয়ে চেয়ে রইল রানা। মনে মনে বলল, ওহে রানা, বারবার বাঁচবে এমন আশা করা কি ঠিক?
ওর দিকে বিরাট চোয়াল খুলে ছুটে আসছে কিলার ওয়েইল। এতই দ্রুত, গতি দেখে চমকে যেতে হয়। তিন সেকেণ্ড পর দুই সারি দাঁত ও লালচে জিভ দেখল রানা। সামনে আর কিছুই দেখা গেল না। আরও বড় হলো কিলার ওয়েইলের হাঁ।
তারপর…
হঠাৎ করেই কাত হয়ে গেল কিলার ওয়েইল, সাঁৎ করে রওনা হয়ে গেল নীচের দিকে। অ্যাজমার পাফার এবং ওটার বুদ্বুদের পিছু নিয়েছে।
মস্ত শ্বাস ফেলল রানা।
মনের গভীরে জানে, কীভাবে কাজ করে সোনার ডিটেকশন সিস্টেম। এটা ভুল ধারণা যে কোনও জিনিসে ধাক্কা খেয়ে ফেরে সোনার তরঙ্গ। আসলে জিনিসটা এবং যেখান থেকে তরঙ্গ ছুঁড়ে দেয়া হলো, তার মাঝের পানির মাইক্রোস্কোপিক বাতাস টের পায় সোনার ব্যবহারকারী।
রানা যখন অ্যাজমার পাফার নীচে ফেলল, ওটা থেকে বেরুতে লাগল বাতাসের বুদ্বুদ, কাজেই সোনার ব্যবহার করে কিলার ওয়েইল পেয়ে গেল নতুন টার্গেট! ক্লিক আওয়াজ তুলে টের পেয়েছে, নীচে রওনা হয়েছে বাতাস। আর তার মানেই, পালাতে শুরু করেছে ওর শিকার। এ কিছুতেই হতে দেয়া যায় না, কাজেই সাধের শিকারকে ধরতে ছুট লাগিয়েছে।
এখন এ নিয়ে ভাবছে না রানা। অন্য কাজে ব্যস্ত।
বুক পকেট থেকে জ্যাকুস ফিউভিলের স্টান গ্রেনেড বের করেছে, টান দিয়ে খুলে ফেলল পিন। তিন পর্যন্ত গুনল, তারপর ঝট করে সিট-আপ দিয়ে উঠে এল পানির উপরে। ছুঁড়ে দিল গ্রেনেড, পরক্ষণে আবারও পানির নীচে নামিয়ে নিল মাথা। শক্ত করে বুজে ফেলেছে চোখ।
পুলের পাঁচ ফুট উপরে উঠল গ্রেনেড, এক সেকেণ্ড ওখানে থেকে আবারও নীচে পড়ছে, আর তখনই বিস্ফোরিত হলো ওটা।
পুলের ভিতর থেকে গ্রেনেড উঠে আসতে দেখেছে জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসন। কী ঘটছে বুঝবার জন্য এক সেকেণ্ড লাগল তার, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
গুণ্ডারসনের লোক, এবং নিজে সে সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজই করেছে, অবাক হয়ে দেখেছে পানি থেকে উঠেছে কী যেন।
গ্রেনেডের দিকে চেয়ে ছিল তারা।
স্টান গ্রেনেড বিস্ফোরিত হওয়ায় প্রকাণ্ড এক ফ্লাশবালব যেন জ্বলে উঠেছে। আপাতত অন্ধ হয়ে গেছে সবাই, ভয়ঙ্কর চমকে গেছে। চোখের ভিতর এক গ্যালাক্সি ভরা তারা ও সানস্পট।
এদিকে আবারও সিট-আপ করল রানা। অবশ্য, এবার উপরে উঠল ক্রসবো হাতে। ওটা রিলোড করা, ট্রিগার টিপলেই চলবে।
এক সেকেণ্ডে টার্গেট খুঁজে নিল রানা, টিপে দিল ট্রিগার।
ই-ডেক মুহূর্তে পেরুল তীর, লেগেছে টার্গেটে। খটাস আওয়াজ তুলল ম্যাগহুক লঞ্চারের উপর। রাং-ল্যাডারের দুই ধাপের ভিতর আটকে ছিল লঞ্চার। ছুটে গেল, ছিটকে এল পুলের দিকে।
ম্যাগহুকের দড়ি ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল সি-ডেকের রিট্র্যাক্টেবল সেতুর উপর দিয়ে। তখন ছিল পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। এখন ম্যাগহুক লঞ্চার রাং-ল্যাডার থেকে খসে আসতেই, এবং রানা পুলের মাঝে ভাসমান থাকায়, এদিকের প্রান্তে বিন্দুমাত্র ওজন নেই। পেণ্ডুলামের মত ঝুলতে ঝুলতে পুলের মাঝে রানার হাতের কাছে এসে পড়ল ম্যাগহুক।
খপ করে ওটা ধরল রানা, একবার সি-ডেকের সেতুর দিকে চাইল। উপর থেকে ঘুরে এসেছে ম্যাকহুকের দুই প্রস্থ দড়ি। দেরি করে শক্ত করে দুই হাতে ধরল ও লঞ্চার, টিপে দিল কালো বাটন। রক্ত মিশ্রিত পানি থেকে উপরের দিকে রওনা হয়ে গেছে ও। সেতুর দিকে ওকে টেনে তুলছে ম্যাগহুক। সরসর করে দড়ি গুটিয়ে নিচ্ছে।
দশ সেকেণ্ডে সেতুর পাশে পৌঁছে গেল রানা, হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে পড়ল উপরে। ঝটপট খুলে ফেলল গোড়ালির বাঁধন। আর ঠিক তখনই প্রথম এসএএস কমান্ডো সাবমেশিন গান তাক করল সেতুর নীচে। অন্যরাও নড়ে উঠেছে অস্ত্র হাতে।
তাদের দিকে ঘুরেও চাইল না রানা, ঝেড়ে দৌড় দিয়েছে। প্রথম এসএএস কমাণ্ডো এক পশলা গুলি পাঠাল সেতুর দিকে।
এদিকে রাং-ল্যাডারের সামনে পৌঁছে গেছে রানা, একেকবারে দুই ধাপ করে টপকে উঠছে বি-ডেকের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর অবশিষ্ট ক্যাটওয়াকে পৌঁছে গেল। তার আগেই রিলোড করে নিয়েছে ক্রসবো।
ছুটতে শুরু করেছে পুব টানেল ধরে, চলেছে লিভিং কোয়ার্টারের দিকে। আগে পেতে হবে মেরিকে, তারপর খুঁজে বের করবে কীভাবে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়।
হঠাৎ সামনের মোড় ঘুরে এল এক এসএএস কমাণ্ডো। চট করে তার দিকে ক্রসবো তাক করল রানা, পরক্ষণে টিপল ট্রিগার। ঝটাং করে পিছনে ঝটকা খেল লোকটার মাথা। কপাল ফুটো করে দিয়েছে তীর। কাটা কলাগাছের মত ধড়াস্ করে মেঝের উপর পড়ল লাশ।
লোকটার পাশে থামল রানা, উবু হয়ে তার অস্ত্রগুলো তুলে, নিতে শুরু করেছে।
এসএএস কমাণ্ডের সঙ্গে ছিল এমপি-৫, গ্লক-৭ পিস্তল ও। দুটো নীল গ্রেনেড। রানা জানে, শেষেরগুলো নাইট্রোজেন চার্জ। জিনিস দুটোর দখল নিল ও।
এ ছাড়া লোকটার সঙ্গে ছিল হালকা ওজনের রেডিয়ো হেডসেট। ওটাও নিল রানা, পরে নিল দুই কানে। নতুন উদ্যমে ছুটতে শুরু করেছে টানেল ধরে।
এখন মেরি ভিসারকে দরকার।
ওকে কোথায় রেখেছে ব্রিটিশরা?
রানার জানা নেই, তবে আন্দাজ করল, বেচারিকে বি-ডেকেই রাখবে। এই লেভেলেই রয়েছে লিভিং কোয়ার্টার।
বাইরের দিকের গোলাকার টানেলে ঢুকে পড়েছে রানা, উড়ে চলেছে। এক সেকেণ্ড পর দেখল উল্টো দিক থেকে আসছে দুই এসএএস কমাণ্ডো। সাবমেশিন গানের নল উঁচু করে ফেলেছে তারা, কিন্তু ওই একই মুহূর্তে এমপি-৫ ও গ্লক-৭ থেকে গুলি করল রানা। ছয় রাউণ্ড গুলিবর্ষণে ছিটকে পিছিয়ে গেল দুই কমাণ্ডো, হুড়মুড় করে পড়ল মেঝেতে। ছুটবার গতি কমল না রানার, লাশ পেরিয়ে বাক নিল টানেলে। ডানে-বামে চোখ বোলাচ্ছে।
হঠাৎ বামদিকের দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক এসএএস কমাণ্ডো, হাতে উদ্যত অস্ত্র। একটা গুলিও পাঠাল সে, কিন্তু বদলে পেল তিনটে গুলি, ক্ষত-বিক্ষত বুক নিয়ে আবারও ছিটকে ঘরের ভিতর গিয়ে পড়ল মৃত শত্রু।
কয়েক সেকেণ্ড পর ঝড়ের গতি তুলে ঘরের সামনে পৌঁছে গেল রানা। ওর জানা আছে, এটা কমন রুম। মাত্র কয়েক ফুট দূরে মেরিকে দেখল। বাচ্চা মেয়েটাকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে দুই এসএএস কমাণ্ডো।
দুই হাতে দুই অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ল রানা কমন রুমে।
.
বিধ্বস্ত রানাকে দেখে হাঁ হয়ে গেছে মেরি। বেচারি ধরেই নিয়েছিল ওর প্রিয় মানুষটা মারা গেছে। এখন ওর মনে হলো, ভূত হয়েই ফিরেছে মহৎ হৃদয় মানুষটা।
চেহারার ভয়ঙ্কর খারাপ অবস্থা। চুপচুপে ভেজা। বাঁকা হয়ে গেছে নাক। মুখে নানা ছড়ে যাওয়ার দাগ। বডি আমার সব তুবড়ে গেছে।
মেরির পিছনে থমকে গেছে দুই কমাণ্ডোর একজন, অবাক হয়ে দেখছে ঘরে ঢুকেছে ভয়ানক খারাপ চেহারার এক পিশাচ। এসএএস কমাণ্ডো খপ করে মেরিকে নিজের সামনে নিয়ে এল। পিস্তলের নল তাক করল মাথার উপর। ওই মেয়ে তার বর্ম।
আমি ওকে মেরে ফেলব, মেইট, শান্ত স্বরে বলল। চুতিয়া যিশুর কিরে! ওর মগজ ছিটিয়ে পড়বে চারদেয়ালে!
মেরি, নরম স্বরে বলল রানা। লোকটার কপালে পিস্তল তাক করেছে, একইসময়ে দ্বিতীয় কমান্ডোর মাথার দিকে চেয়ে আছে ওর এমপি-৫।
জী? করুণ শোনাল মেরির কণ্ঠ।
আস্তে করে বলল রানা, এবার চোখ বন্ধ করো।
চোখ বুজে ফেলল মেরি। চারপাশে শুধু আঁধার।
এবার দুটো বুম! বুম! আওয়াজ পেল। জানে না কার অস্ত্র, গর্জে উঠেছে। তারপর হঠাৎ করেই পিছনে পড়তে লাগল মেরি। বর্ম হিসাবে ওকে ব্যবহার করতে চাওয়া প্রথম এসএএস কমাণ্ডো, এখনও কাঁধ খামচে রেখেছে। একই সঙ্গে মেঝের উপর ধড়াস করে পড়ল ওরা দুজন। আর ঠিক তখনই কাঁধের উপর থেকে সরে গেল ব্রিটিশ লোকটার হাত।
আস্তে করে চোখ মেলল মেরি।
ওর পাশে পড়ে আছে দুই এসএএস কমাণ্ডো। তাদের পা দেখল ও, তারপর কোমর-বুক, তাদের মুখ…
ওদিকে চাইতে নেই, মেরি, বলল রানা। মেয়েটির পাশে, চলে গেল। এসব না দেখলেও চলে।
মুখ ঘুরিয়ে রানার দিকে চাইল মেরি।
ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল রানা, একহাতে আলতো করে ধরে আছে কাঁধ। কোনও কথা বলছে না।
রানার বুকে মুখ গুজল মেরি, নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছে।
ছি, কাঁদে না, তুমি না সাহসী মেয়ে, মেরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রানী চাপা স্বরে বলল, চলো, এবার এখান থেকে বেরিয়ে যাই। ..
ঝটপট অস্ত্রগুলো রিলোড করল রানা, তারপর মেরির হাত ধরে বেরুল কমন রুম থেকে। বাইরের দিকের টানেল ধরে ছুটতে শুরু করেছে দুজন। চলেছে পুবের টানেল লক্ষ্য করে। সামনে মোড় নিল ওরা, ওখানেই হঠাৎ থমকে গেল রানা।
বামের দেয়ালে বড় চারকোনা এক কালো কমপার্টমেন্ট। তার উপর মোটা কালিতে লেখা: ফিউজ বক্স।
সকালে ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডোরা এখান থেকেই নিভিয়ে দিয়েছিল। সমস্ত বাতি।
হঠাৎ পরিকল্পনা খেল গেল রানার মাথায়।
ঘুরে দাঁড়াল, একটু দূরে ফেলে এসেছে বায়োটক্সিন ল্যাব পাশের দরজায় অ্যালিউমিনিয়ামের প্লেটে লেখা: স্টোরেজ ক্লজিট।
ওখানেই যেতে হবে ওকে।
ওই ঘরের সামনে পৌঁছে গেল রানা, খুলে ফেলল দরজা। ভিতরে রয়েছে মপ ও বালতি। একপাশে কাঠের পুরননা তাক, তার উপর রাখা পরিষ্কার করবার নানান ফুইড। চট করে প্লাস্টিকের একটা বোতল তুলে নিল রানা, ভিতরে অ্যামোনিয়া।
ক্লজিট রুম থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ে পৌঁছে গেল ফিউজ বক্সের সামনে। ডালা খুলতেই দেখল, একের পর এক তার, চাকা ও পাওয়ার ইউনিট।
একটু দূরে, পুবের টানেলে দাঁড়িয়ে আছে মেরি। চেয়ে আছে। স্টেশনের সেন্ট্রাল শাফটের দিকে।
জলদি করুন, প্রায় ফিসফিস করে বলল। ওরা আসছে!
নতুন পাওয়া হেডসেটে শুনতে পেল রানা;
…হজিন্স, রিপোর্ট…
..মেয়েটাকে খুঁজছে শালা…
…পেরিমিটার টিম, এক্ষুনি ফিরে এসো স্টেশনের ভিতর। এখানে সমস্যা হয়েছে…
ফিউজ বক্সের ভিতর যে তার খুঁজছে, তা পেয়ে গেছে রানা। টান দিয়ে কেবলের গায়ের প্লাস্টিক পোশাক ছিড়ে বের করে নিল তামার তার। এবার পিস্তলের বাট দিয়ে মেরে অ্যামোনিয়ার প্লাস্টিকের বোতলে ছোট ফাটল তৈরি করল। বোতল ঠিকভাবে বসিয়ে দিল তারের উপর। এক ফোঁটা, এক ফোটা করে বোতল থেকে খোলা তারের উপর পড়ছে অ্যামোনিয়া।
দুই সেকেণ্ড পর পর এক ফোটা করে অ্যামোনিয়া নামছে খোলা তারের উপর।
ছ্যাঁৎ! .. ছ্যাঁৎ! … ছ্যাঁৎ! .. ছ্যাঁৎ!
তারের উপর অ্যামোনিয়া পড়তেই টানেল ও গোটা স্টেশনের সমস্ত বাতি একবার নিভছে আবার জ্বলছে। যেন সুইচ দিয়ে অফ অন করা হচ্ছে সব।
অদ্ভুত সেই আলোয় মেরির হাত ধরল রানা, তারপর ছুটতে শুরু করল সেন্ট্রাল শাফট লক্ষ্য করে। ক্যাটওয়াকে বেরিয়ে আসতেই চলে গেল এ-ডেকে উঠবার রাং-ল্যাডারের সামনে, উঠতে শুরু করল।
দশ সেকেণ্ড পর উঠে এল এ-ডেকের ক্যাটওয়াকে। চলেছে স্টেশনের প্রধান এন্ট্রান্স টানেলের দিকে। গোটা স্টেশনে একবার জ্বলছে বাতি, আবার নিভে যাচ্ছে। একবার আঁধার আবার আলো। আঁধার আবার আলো।
এখন যদি কোনও ব্রিটিশ হোভারক্রাফটের কাছে পৌঁছুতে পারে, ভাবছে রানা, ওটা নিয়ে চলে যেতে পারবে ম্যাকমার্ডো স্টেশনে।
চারপাশে নানা নড়াচড়া চোখে পড়ছে। স্টেশনের ভিতর চিৎকার করে কথা বলছে ব্রিটিশ কমাণ্ডারা। আঁধার ও আলো ভরা ক্যাটওয়াক ধরে ছুটে চলেছে। রানা ও মেরিকে খুঁজছে তারা।
রানা খেয়াল করেছে, কোনও কোমও এসএএস কমাণ্ডো ব্যবহার করবার চেষ্টা করেছে নাইট-ভিশন গগলস্।
কিন্তু ওই জিনিস এখন কোনও কাজে আসবে না। স্টেশনের ভিতর বারবার আলো ও আঁধারের খেলা, কেউ নাইট-ভিশন গগলস চালু করতে চাইলে তাকে বোকা বলতে হবে। বাতি জ্বললেই অন্ধ হয়ে যাবে।
মেরিকে নিয়ে প্রধান এন্ট্রান্স প্যাসেজওয়ের সামনে পৌঁছে গেল রানা। আর ঠিক তখনই ছুটতে ছুটতে ক্যাটওয়াকে এসে হাজির হলো এক এসএএস সৈনিক। রানার সঙ্গে জোর ধাক্কা লাগল তার। আরেকটু হলে ক্যাটওয়াকের রেইলিং টপকে নীচে গিয়ে পড়ত রানা।
ক্যাটওয়াকের উপর আছাড় খেয়েছে এসএএস কমাণ্ডে, পরক্ষণে উঠে হাঁটু গেড়ে অস্ত্র তাক করতে চাইল রানার দিকে। একই সময়ে জোরালো লাথি ঝাড়ল রানা তার মুখ লক্ষ্য করে। খটাস্ করে চোয়ালে লাগল শক্ত জুতোর ডগা, হুড়মুড় করে ক্যাটওয়াকের উপর পড়ল সে।
এক লাফে পাশে পৌঁছে গেল রানা। লোকটা বেহুশ হয়ে গেছে। কাঁধের পাশে পড়ে আছে বড় কালো একটা স্যাচেল ব্যাগ। ওটা তুলে নিল রানা, ভিতরে চোখ পড়তেই দেখল, পাশাপাশি শুয়ে আছে দুটো রুপালি ক্যানিস্টার। সবুজ ব্যাণ্ডে লেখা: ট্রাইটোনাল ৮০/২০ চার্জ।
রানার মনে পড়ল, আগেও ভেবেছে, কী কারণে ব্রিটিশ উইলকক্স আইস স্টেশনে এই মাল এনেছে। ওটা খুবই শক্তিশালী বিস্ফোরক, সাধারণত বাড়ি ধসিয়ে দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।
গুণ্ডারসন কীজন্যে এনেছে এই জিনিস?
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অচেতন লোকটার কাছ থেকে সরে এল রানা। আর তখনই এন্ট্রান্স প্যাসেজওয়ে থেকে হইচই শুনল। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। ক্লিক আওয়াজ তুলে এমপি-৫-র সেফটি সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাইরে এসএএস কমাণ্ডো, পেরিমিটার টিম…
এখন এসে ঢুকছে স্টেশনের ভিতর।
মেরি, বসে পড়ো! চাপা স্বরে বলল রানা। ঘুরেই দুই হাতের অস্ত্র তাক করেছে মেইন এন্ট্রান্সের উপর। আর ঠিক তখনই টানেল থেকে বেরিয়ে এল প্রথম এসএএস কমাণ্ডো।
এক পশলা গুলি রক্তাক্ত বুকে নিয়ে ছিটকে পড়ল লোকটা। দ্বিতীয় ও তৃতীয়জন বুঝেছে, স্টেশনের ভিতর থেকে গুলি আসছে।
এই পথে আর বেরুতে পারব না! তাড়া দিল রানা, ফিরতি পথ ধরতে হবে, মেরি!
একহাতে মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরল ও, ছুটতে শুরু করেছে। পৌঁছে গেল কাছের রাং-ল্যাডারের সামনে। আগেই মেরিকে বলেছে, যেন ওর গলা ধরে ঝুলে থাকে। পিঠে মেরিকে নিয়ে মই বেয়ে নামতে শুরু করল রানা। আবারও চলে এল বিডেকে। ডান চোখের এক ইঞ্চি দূরে ইস্পাতের মইয়ের ধাপে লেগে ছিটকে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট।
ব্রিটিশ হেডসেটে বেশ কয়েকজনের কণ্ঠ শুনল রানা।
..শুয়োরের বাচ্চা গেছে…
..মেয়েটাকে নিয়ে…
..রনসন মারা গেছে। জিভ আর চার্লিও…
…শালাকে এ-ডেকে দেখেছি…
এবার রানা শুনল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনের কণ্ঠ:
বোউলস! বাতি! হয় জ্বেলে রাখো, নইলে বন্ধ করে দাও! খুঁজে বের করো চুতিয়া ফিউজ বক্স!
হুলুস্থুল চলছে স্টেশন জুড়ে। চারপাশে স্থির কোনও বাতি নেই। একবার জ্বলছে আবার নিভছে।
বি-ডেকের আরেক দিকে কালো ছায়া দেখল রানা।
ওদিকে যাওয়া মস্ত ভুল হবে।
মাঝের কুপের ভিতর উঁকি দিল। দপদপে আলো ও নিকষ আঁধারির ভিতর দেখল সি-ডেকে রিট্রাক্টেবল সেতু।
একবার ওখানে যেতে পারলে…
হিসাব কষতে শুরু করেছে রানা।
ওর সঙ্গে একটা গ্লক পিস্তল ও এমপি-৫। এ দিয়ে বিশজন এসএএস কমাণ্ডোকে ঠেকাতে পারবে না।
ওর কাঁধে ঝুলছে এসএএস কমাণ্ডোর কাছ থেকে পাওয়া স্যাচেল ব্যাগ। ওটার ভিতর দুটো ট্রাইটোনাল চার্জ। এ ছাড়া, ম্যাগহুকে চেপে উঠবার পর প্রথম মৃত এসএএস কমাণ্ডোর কাছ থেকে পেয়েছে দুটো নাইট্রোজেন চার্জ।
রানা চেয়ে আছে সরু রিট্রাক্টেবল ব্রিজের দিকে। ওটা মাত্র একতলা নীচে। মনে মনে বলল, এবার দেখা যাক খেলা শেষ করা যায় কি না।
জ্বলে উঠছে বাতি, আবার নামছে গাঢ় আঁধার। দু মিনিট পর মেরিকে নিয়ে সি-ডেকে রিট্রাক্টেবল সেতুর উপর এসে দাঁড়াল রানা।
কেউ যদি ওদেরকে দেখেও থাকে, মনে মনে খুশি হবেএকেবারে খোলা জায়গায় হাজির হয়েছে শত্রু। সেতুর উপর এক হাঁটু গেড়ে বসল রানা, দু মিনিট ধরে কী যেন করল।
কাজ শেষে সুরে গেল মেরির পাশে। উবু হয়ে বসেছে দুজন। কেউ দেখলে ভাববে, ভয়ের চোটে ওখানে গিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পড়েছে লোকটা। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে: অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে রানা।
কয়েক মিনিট, পেরুল, তারপর ফিউজ বক্স খুঁজে নিল ব্রিটিশরা। স্থির ভাবে আবারও জ্বলতে শুরু করেছে বাতি। পুরো স্টেশন জ্বলজ্বল করছে উজ্জ্বল ফ্লুওরেসেন্ট আলোয়।
একমিনিট পেরুল না, তার আগেই রানা ও মেরিকে আবিষ্কার করল এসএএস কমাণ্ডোরা।
সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছে রানা। সি-ডেকে অবশিষ্ট বিশজন এসএএস কমাণ্ডো ঘিরে ফেলেছে ওকে। শাফটের মাঝে সেতুর উপর মেরি-রানা। চারপাশের ক্যাটওয়াকে পজিশন নিয়েছে ব্রিটিশ কমাণ্ডো দল।
এবার একইসঙ্গে অস্ত্র তাক করল তারা।
এক সেকেণ্ড দেরি না করে মাথার উপর ট্রাইটোনাল চার্জ তুলে ধরল রানা।
ভাল স্ট্র্যাটেজি একটা জাদুর মত। শত্রুকে একটা হাত দেখতে দিন, কিন্তু অন্য হাতে কী করছেন তা যেন বুঝতে না পারে।
গুলি করবে না, হেডসেটে গুণ্ডারসনের কণ্ঠ শুনল রানা। কেউ ভুলেও গুলি করবে না। .
পঞ্চাশ ফুট নীচে পুল ডেকে গুণ্ডারসনকে দেখল রানা। লোকটা একা! সে ছাড়া এসএএস প্লাটুন উঠে এসেছে সি-ডেকে, ঘিরে ফেলেছে ওদের দুজনকে
রানা দেখল, গুণ্ডারসনের পাশে পুলের ভিতর এখন কোনও তিমি নেই। ভাল।
আর্ম করেছি ট্রাইটোনাল চার্জ, চেঁচিয়ে বলল ও। দুই আঙুলে চেপে রেখেছি আর্ম বাটন! দুই সেকেণ্ডের টাইমার! গুলি করলে হাত থেকে খসে পড়বে চার্জ, আমরা সবাই মরব!
রিট্রাক্টেবল ব্রিজের মাঝে দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়েছে রানা। ওর দুই পায়ের কাছে উবু হয়ে বসেছে মেরি। মনে মনে বলল রানা, কেউ যেন দেখিস না আমার জুতোয় ফিতে নেই।
এক এসএএস কমাণ্ডো অস্ত্র তাক করেছে মেরির উপর।
মেয়েটাকে গুলি করো, সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে চার্জ ফেলে দেব, হুমকি দিল রানা। কথার ফাঁকে চট করে ক্যাটওয়াকের অ্যালকোভ দেখে নিল।
লোকগুলো যদি সেতু…
রানার উদ্দেশে গলা ছাড়ল গুণ্ডারসন, রানা, এটা খুব দুঃখজনক। তুমি এরই ভিতর কমপক্ষে আমার ছয়জনকে খুন করেছ। মনে কোনও সন্দেহ রেখো না, তোমাকে কষ্ট পেয়ে মরতে হবে।
আমাকে এখান থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
সে-সুযোগ তোমাকে দেয়া হবে না, বলল গুণ্ডারসন।
তা হলে সবাই মিলে মরব।
মাথা নাড়ল গুণ্ডারসন। ভুল, রানা। আমি জানি, প্রাণ দিতে দ্বিধা করবে না তুমি। ওই মেয়ের জন্য মরতে দ্বিধা থাকবে না তোমার।
লোকটা ঠিকই বলেছে, বুঝতে পারছে রানা। গুণ্ডারসন বুঝে গেছে, ধাপ্পা দিচ্ছে ও। আরেকবার অ্যালকোভের দিকে চাইল। ওখানে ব্রিজের কন্ট্রোল।
ওর চোখ অনুসরণ করছে বোউলস।
এটা রানাও খেয়াল করেছে।
কয়েক সেকেন্ড পর বোউলস ফিসফিস করে হেডসেটে বলে উঠল, বোউলস বলছি। লোকটা কয়েকবার ব্রিজ কন্ট্রোলের দিকে চেয়েছে। খুব নার্ভাস মনে হচ্ছে।
শত্রুকে একটা হাত দেখতে দিন, কিন্তু…
ব্রিজ, বলে উঠল, গুণ্ডারসন, ও চায় না সেতু গুটিয়ে নেয়া হোক। মিস্টার বোউলস, সরিয়ে নাও ওই সেতু।
ইয়েস, স্যর।
ব্রাউন, বলে উঠল গুণ্ডারসন।
ইয়েস, স্যর।
সেতু সরে গেলেই গুলি করে ফেলে দেবে ওকে। গুলি যেন মাথায় লাগে।
ইয়েস, স্যর।
হ্যানসন, মেয়েটাকে নেবে।
ইয়েস, স্যর।
রানা দেখল, ধীর পায়ে অ্যালকোভের দিকে রওনা হয়েছে বোউলস। ঢুকে পড়ল ওই দরজা দিয়ে, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্রিজ গুটিয়ে নেয়ার বাটনের দিকে। পুরো সময় চেয়ে রইল রানা। আগে ব্রিটিশদেরকে বোঝাতে হবে, ও খুব চিন্তিত। তারপর…
শিরার ভিতর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ওর রক্ত। যা ঘটবার হঠাৎ করেই ঘটবে।
অন্য হাতে কী করছেন তা যেন বুঝতে না পারে…
অ্যালকোভে ব্রিজের চৌকো বড় বাটন টিপে দিল বোউলস।
তুমি তৈরি, মেরি? চাপা স্বরে বলল রানা।
হ্যাঁ।
অ্যালকোভের মেঝের নীচে ক্লিং ধাতব আওয়াজ বেরুল, ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সেতুর জোড়া, দু দিকে ফিরতে শুরু করেছে সরু পাত।
এক সেকেণ্ড পর রানা ও মেরির দিকে গুলি করল দুই এসএএস কমাণ্ডো। কিন্তু তার আগেই ঝপ করে নীচে পড়তে শুরু করেছে রানা ও মেরি।ওদের মাথার উপর দিয়ে হুইস্ আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল গুলি।
শাফটের মাঝে পড়ছে রানা ও মেরি।
যেন ভারী দুই খণ্ড পাথর।
তারপর নামল পানির ভিতর। ডুবে গেল দেখতে না দেখতে।
সব এত দ্রুত ঘটল, সি-ডেকে কেউ বুঝল না কী ঘটছে।
কোনও সময় পেল না কেউ।
দুই জুতোর ফিতায় রিট্র্যাক্টেবল সেতুর দুই মুখখামুখি প্রান্তে নাইট্রোজেন চার্জ বেঁধেছে রানা। এবং সরু দুই পাত ফিরতি পথ ধরতেই, টান খেয়ে খুলে গেছে দুই গ্রেনেডের পিন–এরপর মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে বিস্ফোরিত হয়েছে বোমা।
সামান্য সাহায্য দরকার ছিল রানার, তা করেছে এসএএস কমাণ্ডো বোউলস। সে সরিয়ে নিয়েছে সেতু।
এসএএস কমাণ্ডোরা ভুলেও ভাবেনি সেতুর উপর নাইট্রোজেন গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে পারে। সবার চোখ ছিল রানার উপর। শক্র মাথার উপর তুলেছে ট্রাইটোনাল চার্জ! তাদের জানবার কথা নয় ওই দুটো : ডিজআর্ম করা। এক সেকেণ্ড পর দেখেছে, মেয়েটাকে নিয়ে নীচে পড়ছে লোকটা।
শত্রুকে একটা হাত দেখতে দিন, কিন্তু অন্য হাতে কী করছেন তা যেন বুঝতে না পারে।
বরফ-ঠাণ্ডা পানিতে পড়েই মৃদু হেসেছে রানা। এই কৌশল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন নিজে শিখিয়েছে ওকে!
১৬.
একইসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়েছে দুই নাইট্রোজেন গ্রেনেড। নানাদিকে ছিটকে গেছে সুপারকুল্ড লিকুইড গ্যাস। চারপাশের এসএএস কমাণ্ডোদের কিছুই করবার ছিল না।
বিস্ফোরণের ফলে ভয়াবহ পরিণতি হলো সবার।
অন্য কোনও গ্রেনেডের মত নয় নাইট্রোজেন চার্জ। ত্বক বা মাংস ভেদ করতে হয় না ওটাকে। করুণ ভাবে মারা পড়ে শত্রু।, ওই গ্রেনেডের মূল পদার্থ পানি। ওটা একমাত্র প্রাকৃতিক জিনিস, যেটা ঠাণ্ডা হলে আকারে বাড়তে থাকে। সুপারকুল্ড–লিকুইড নাইট্রোজেন খুব দ্রুত ঠাণ্ডা করে মানবদেহকে। রক্তের সেল জমাট বাঁধে। শরীরের সত্তর ভাগ পানি বিস্তার পেতে থাকে। ফলে সারাশরীর জুড়ে শুরু হয় ভয়ঙ্কর হেমোরেজ।
যখন প্রতিটি রক্ত-কোষ বিস্ফোরিত হয়, দেখা যায় বিকট দৃশ্য।
এসএএস কমাণ্ডোদের মুখ আবৃত ছিল না, কাজেই সেখানে গিয়ে লেগেছে সুপারকুল্ড লিকুইড নাইট্রোজেন। সবার মুখই ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেটে গেছে ত্বক, পেশি, শিরা ও রক্ত-কোষ–সবই বাইরের দিকে ফেটে বেরিয়ে এসেছে।
সারা চেহারা জুড়ে দেখা দিয়েছে কালো সর ক্ষত, ত্বকের নীচে বিস্ফোরিত হয়েছে রক্ত-কোষ। টকটকে লাল হয়ে গেছে দুই চোখ। মুহূর্তে অন্ধ হয়েছে সবাই। শরীরের রোমকূপ থেকে ছিটকে বেরিয়েছে রক্ত।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে সবাই, প্রাণপণ চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে।
কিন্তু বেশিক্ষণ ভুগতে হবে না তাদেরকে। তিরিশ সেকেণ্ডের ভিতর বিকল হবে মগজ। রক্ত-কোষ জমাট বেঁধে যাওয়ায় মগজে প্রচণ্ড হেমোরেজ হবে।
মরতেই হবে তাদেরকে, কিন্তু তার আগে কয়েক সেকেণ্ড নরক-যন্ত্রণা কী তা জেনে যাবে।
.
ই-ডেকে উপরের দিকে চেয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।
দুই গ্রেনেডের বিস্ফোরণ শেষ করে দিয়েছে তার গোটা ইউনিটের সবাইকে। স্টেশনের চারপাশে ছিটকে লেগেছে নীল রঙা আঠার মত তরল। বরফ-ঠাণ্ডা নাইট্রোজেন লেগে চিড়চিড় করে ফাটতে শুরু করেছে হ্যাণ্ড রেলিং। বরফের ভিতর মুহূর্তে জমে গেছে ডাইভিং বেলের উপরের কেবল। সুপারকুল্ড লিকুইড নাইট্রোজেন মুহূর্তে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে এত শক্ত কেবলে। ধাতুর উপর আরও দ্রুত কাজ করেছে ওটা। এমন কী ডাইভিং বেলের পোর্টহোল জমে গেল নীল রঙের বরফে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না গুণ্ডারসন।
দুই ঢিলে বিশজন যোদ্ধাকে শেষ করে দিয়েছে মাসুদ রানা!
অবশিষ্ট রয়ে গেছে সে।
ঝড়ের মত চলছে তার মগজ।
ভাল কোনও বুদ্ধি বের করো! কীসের জন্য এসেছ এখানে? দখল করতে হবে স্পেসশিপ। ওটা হাতে পেতে হবে। কী করে সেটা পাবে? একমিনিট…..
নীচে অপেক্ষা করছে তার লোক।
কাজেই চলে যেতে হবে পাতাল-গুহায়।
ডাইভিং বেলের উপর চোখ পড়ল গুণ্ডারসনের।
হ্যাঁ..।
আর ঠিক তখনই ডাইভিং বেলের ওপাশে রানা ও পিচ্চি মেয়েটাকে দেখল। এইমাত্র নাইট্রোজেনের তৈরি পাতলা বরফের আস্তর ভেদ করে ভেসে উঠেছে। চলেছে দূরের ডেক লক্ষ্য করে।
এসব পাত্তা দিল না গুণ্ডারসন, খপ করে পাশ থেকে তুলে নিল স্কুবা ট্যাঙ্ক, পরক্ষণে ঝাপিয়ে পড়ল পুলের ভিতর। চলেছে ডাইভিং বেলের দিকে।
মেরিকে পানির উপর উঁচু করে ধরল রানা, নামিয়ে দিল ডেকে।
ঠিক আছ? জানতে চাইল।
আবারও ভিজে গেলাম, বলল মেরি।
আমিও, মৃদু হাসল রানা। ঘুরে গেছে পানির ভিতর। ওর চোখ পড়েছে গুণ্ডারসনের উপর। ডাইভিং বেলের দিকে পাগলের মত সাঁতরে চলেছে লোকটা।
স্টেশনের উপর দিকে চাইল রানা। সব থমথম করছে। বেঁচে নেই কোনও এসএএস কমাণ্ডো। অবশ্য, রয়ে গেছে গুণ্ডারসন। সে ছাড়া নীচের পাতাল-গুহায় আছে তার লোক।
একটা কম্বল জোগাড় করো, মেরিকে বলল রানা। উপরে যেয়ো না। একটু পর ফিরব।
কোথায় চলেছেন?
ওই পিশাচের পিছনে, গুণ্ডারসনকে দেখিয়ে দিল রানা।
.
ডাইভিং বেলের ভিতর ভেসে উঠল গুণ্ডারসন, ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখ। রানার .৪৪ ক্যালিবারের ডেযার্ট ঈগল অটোমেটিক পিস্তল তাক করা হয়েছে তার কপালে।
দুই হাতে পিস্তল ধরেছে রাশেদ হাবিব। বাঁট এত শক্ত ভাবে ধরেছে, রক্ত সরে গেছে দুই হাতের তালু থেকে।
সরবেন না, ধমকে উঠল হাবিব।
খুদে লোকটার দিকে চাইল গুণ্ডারসন। ডাইভিংবেলে আর কেউ নেই। লোকটার পরনে বহু বছর আগের স্কুবা গিয়ার। খুব নার্ভাস মনে হচ্ছে তাকে। পিস্তল হাতে কাঁপছে। হেসে ফেলল গুণ্ডারসন।
পানির নীচে নিজের পিস্তল বের করছে।
ডের্ট ঈগলের ট্রিগার টিপে দিল হাবিব।
ক্লিক!
আগে চেম্বারে গুলি ভরতে হয়, বলল গুণ্ডারসন, উঁচু করে ধরল নিজের পিস্তল।
হাবিব বুঝেছে কী ঘটবে, দেরি না করে গুণ্ডারসনের পাশের পানিতে ঝপাস্ করে নামল সে। স্কুবা গিয়ার এবং অন্য সবকিছু নিয়েই হারিয়ে গেল পানির নীচে।
ডাইভিং বেলের মেঝেতে উঠে এল গুণ্ডারসন। সোজা চলে গেল ডাইভ কন্ট্রোলের সামনে। সময় নষ্ট না করে ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক ভরে নিল। কয়েক সেকেন্ড পর নামতে শুরু করল ডাইভিং বেল।
.
ই-ডেকে রানা দেখেছে, ডাইভিং বেলের ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক ভরে গেছে।
হারামজাদা রওনা হয়েছে, মনে মনে বলল। নিজে চলে গেল রাং-ল্যাডারের সামনে। ঠিক করেছে সি-ডেকে গিয়ে উইঞ্চ কন্ট্রোল ব্যবহার করে থামিয়ে দেবে ডাইভিং বেল।
এক ধাপ উপরে উঠেছে, এমন সময় উগ্র থেকে ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনল।
ঝট-ঝটাং!
লিকুইড নাইট্রোজেনের কারণে বরফ হওয়া কেবল মাঝ থেকে ছিড়ে পড়েছে!
এক সেকেণ্ডে তলিয়ে গেল ডাইভিং বেল।
বিস্ফারিত হলো রানার দুই চোখ, মইয়ের ধাপ থেকে লাফ দিয়ে নেমেই ঝেড়ে দৌড় দিল। পুলের ধারে পৌঁছতে হবে। আগে কখনও এত দ্রুত দৌড় দেয়নি। বুঝতে দেরি হয়নি ওর, ওই ডাইভিং বেল শেষ ট্রিপ শুরু করেছে। পাতাল-সুড়ঙ্গে পৌঁছুতে হলে এখনই. ওটাতে চেপে বসতে হবে। ওর নিজের দলের সবাই মরে গিয়ে থাকলে, এবং গুণ্ডারসন পাতাল-গুহায় পৌঁছে গেলে, কোনও লড়াই ছাড়া দখল করে নেবে স্পেসশিপ? আগে ওর মনে। হয়েছিল, যা খুশি হোক ওই স্পেসশিপের, কিন্তু এখন জানে, জীবন থাকতে গুণ্ডারসনকে জিততে দেয়া যাবে না।
ডেকের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে রানা, দৌড় না থামিয়েই দীর্ঘ ডাইভ দিল। পানিতে পড়বার আগে বড় করে দম নিয়েছে। ওর নীচে হারিয়ে যাচ্ছে ডাইভিং বেল।
তীরের মত পানি ভেদ করল রানা, চার হাত-পায়ে ডুব সাঁতার শুরু করেছে। নেমে চলেছে গভীরে।
উইঞ্চ কেবল নেই, কাজেই আগের চেয়ে দ্রুত নামছে ডাইভিং বেল। অস্বাভাবিক গতিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে টনটন করছে রানার হাত-পায়ের পেশি। ডাইভিং বেলের খুব কাছে চলে গেল ও, তারপর খপ করে ধরেও ফেলল বাইরের দিকের পাইপিং।
.
ডাইভিং বেলের ভিতর হোলস্টারে পিস্তল রেখে দিল গুণ্ডারসন, কোমর থেকে খুলে নিয়েছে ডেটোনেশন ইউনিট। চট করে সময় দেখে নিল:
৮:৩৭
টাইমার চালু করে দিল। নিজের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে দুঘণ্টা। এরই ভিতর পাতাল-গুহায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। এই সময়ের পর উইলকক্স আইস স্টেশনের সামনের সব ট্রাইটোনাল চার্জ ফাটতে শুরু করবে।
এবার পকেট থেকে বের করল ন্যাভিস্টার গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ট্র্যান্সপত্তার, টিপে দিল ট্রান্সমিট বাটন।
পকেটে রেখে দিল ট্র্যান্সপত্তার, খুশি হয়ে হেসে ফেলল। স্টেশনে অনেক লোক হারিয়েছে, কিন্তু পরিকল্পনা বদলে নিতে হয়নি।
একবার আঠারোটা ট্রাইটোনাল চার্জ ফাটলে গোটা উইলকক্স আইস স্টেশন ভেসে যাবে সাগরে। ওটা হবে নতুন একটা আইসবার্গ। আর তখন গুণ্ডারসনের জিপিএস রিসিভার থেকে তথ্য পেয়ে হাজির হবে রেসকিউ ফোর্স। ওই ব্রিটিশ টিম জানবে কোথায় আছে ওই আইসবার্গ, স্টেশন, গুণ্ডারসন, তার চেয়ে বড় কথা, সহজেই মিলবে ওই স্পেসশিপ।
.
পানির নীচে প্রতি পলে নেমে চলেছে ডাইভিং বেল।
ওটার ছাতের কাছে পাইপিং ধরে ঝুলে আছে রানা।
এবার একফুট একফুট করে নামতে লাগল ডাইভিং বেলের পাশে। মনে হলো রকেটের মত নামছে বেল, আস্তে আস্তে দুলছে নানা দিকে। টিকে রইল রানা। একটু পর নেমে পড়ল নীচে, ওদিক দিয়েই ঢুকতে হয় পুল ডেকে।
পাঁচ সেকেণ্ড পর ভুস করে ভেসে উঠল ছোট পুলের পানিতে। গুণ্ডারসনের উপর চোখ পড়েছে ওর। লোকটার হাতে ডেটোনেশন ইউনিট।
একইসময়ে চরকির মত ঘুরল গুণ্ডারসন, ঝট করে বের করল পিস্তল। উবু হয়ে গেল, শত্রুকে গুলি করবার জন্য প্রস্তুত। পানি থেকে উঠে আসতে গিয়েও সে চেষ্টা বাদ দিল রানা। ওর ডানহাতি ঘুষি পড়ল গুণ্ডারসনের কবজির উপর। পিস্তল ধরা তালু খুলে গেল লোকটার। মেঝেতে পড়ে ঝটাং করে ডেকের উপর দিয়ে পিছলে গেল পিস্তল।
পরক্ষণে লাফ দিয়ে পুল থেকে উঠে এল রানা। আর একই সময়ে ক্র্যাশ-ট্যাকল করল গুণ্ডারসন। পিছনের দেয়ালে আছড়ে পড়ল দুজম। লাথি দিয়ে লোকটাকে সরিয়ে দিতে চাইল রানা, কিন্তু গুণ্ডারসন অনেক বেশি চালু লড়াকু আদমি। গায়ের জোরে রানাকে ঠেসে ধরেছে দেয়ালে। পরক্ষণে নিজে সরে গেল, প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দিল রানার চোয়ালে। ইস্পাতের পাত বসানো বুটের লাথি ছিটকে দিল রানাকে পিছনে। ডাইভিং বেলের শীতল জানালার কাঁচে ঠাস্ করে লাগল ওর গাল।
ঠিক তখন চোখের সামনে দেখল, জানালার কাঁচে সরু ফাটল তৈরি হয়েছে। ভালভাবে বুঝবার সময় পেল না, আবারও লাথি হাঁকিয়েছে গুণ্ডারসন। পরক্ষণে আবারও। তারপর আবারও। ধড়াস্ করে মেঝের উপর পড়ল রানা।
তুই হাল ছাড়িস না, নাকি? বলল গুণ্ডারসন। তার পায়ের কাছে পড়ে আছে রানা। কক্ষনো হতাশ হোস না!
আমার কাজ আমি শেষু করি, চাপা স্বরে বলল রানা। এখনও উঠে বসতে পারেনি।
গুণ্ডারসনের আরেকটা লাথি পড়ল। তার ইস্পাতের পাত বসানো বুট লেগেছে রানার পাঁজরে। ওই হাড়ে আগেই চিড় ধরেছিল, এবার বোধহয় মট্ করে ভেঙেই গেল। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল রানা।
তোর এখানে আসাই উচিত হয়নি, দাঁতে দাঁত চেপে বলল গুণ্ডারসন।
আবারও লাথি মারতে চাইল রানার পেটে। কিন্তু ঝট করে দেহ গড়িয়ে দিয়েছে রানা। ওর একটু দূরে গুণ্ডারসনের বুট নামল ইস্পাতের মেঝেতে। ফুলকি উঠল ওখান থেকে।
দুবার গড়িয়ে সরল রানা, পিঠ ঠেকেছে ডাইভিং পুলের ধাতব রিমে। এবার পরিষ্কার দেখতে পেল ওটা।
একটা হার্পুন গান।
লিটল আমেরিকা-৪ স্টেশন থেকে এনেছিল। পাশেই পড়ে আছে।
কাত হয়ে হাপুন গান তুলে নিতে চাইল রানা। আর তখনই লাফিয়ে সামনে বাড়ল গুণ্ডারসন, পরক্ষণে ভয়ঙ্কর সাইড কিক করল।
উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছিল রানা, কাঁধে লাথি খেয়ে হুড়মুড় করে আবারও পড়ে গেল। এবার পড়েছে ডাইভিং বেলের পুলের ভিতর। কয়েক সেকেণ্ড পর টের পেল, ও বেরিয়ে এসেছে বাইরে।
ওকে পাশ কাটিয়ে সামান্য দুলতে দুলতে নামছে ডাইভিং বেল। বাম হাত বাড়িয়ে একটা পাইপ ধরে ফেলল রানা। টান খেয়ে নীচের দিকে রওনা হয়ে গেল। দুই পায়ে জড়িয়ে নিল পাইপ, যেন নারকেল গাছ বেয়ে উঠবে। ডানহাতে রয়ে গেছে হারপুন গান। একবার দেখল চারপাশ। গভীরে নেমে এসেছে। ডাইভিং বেল।
গভীরতা হবে কমপক্ষে এক শ ফুট। নাকি দু শ ফুট?
গোলাকার পোর্টহোলের একটা দিয়ে ভিতরে উকি দিল রানা। এটার কাঁচেও সরু সাদা ফাটল।
এক সেকেণ্ড পর টের পেল, উপরে থাকা সময়ে লিকুইড নাইট্রোজেন ফাটিয়ে দিয়েছে ডাইভিং বেলের কাচ। ওই যে, ধাতব ডেকে দাড়িয়েছে গুণ্ডারসন। রানাকে দেখে একবার স্যালিউট দিল সে, বামহাত তুলে নাড়ল। বুঝিয়ে দিচ্ছে, খেলা শেষ, আমার হাতে ডেটোনেশন ইউনিট। কিন্তু লড়াই এখনও শেষ হয়নি।
পোর্টহোলের ভিতর দিয়ে গুণ্ডারসনের দিকে চেয়ে রইল রানা। এবার পাল্টা হাত নাড়ল ও। সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে আমশি হয়ে গেল গুণ্ডারসনের মুখ।
জানালার কাঁচে রানা তাক করেছে হারপুন গান।
দৌড়ে এল ব্রিটিশ মেজর জেনারেল, ওপাশ থেকে কোনও আওয়াজ এল না, কিন্তু ঠোঁট গোল করতে দেখে বোঝা গেল নো! বলছে লোকটা।
এক সেকেণ্ড তাকে দেখে নিয়ে ট্রিগার টিপে দিল রানা।
মুহূর্তে চুরমার হলো কাচ।
পরক্ষণে জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনের এত বিদ্যা, এত কৌশল সব ব্যর্থ হয়ে গেল। এরপর আর কোনও কায়দা নেই।
কাচকে বিস্ফোরিত করেছে হারপুন গানের ফলা। ডাইভিং বেলের ভিতর ছিল হাই প্রেশার। বদ্ধ পরিবেশ নষ্ট হয়ে যেতেই গোটা সাগরের চাপ এসে পড়েছে ওটার উপর। এত ওজন নেয়ার সাধ্য কোনও ধাতুর নেই।
কাগজের কাপের মত তুবড়ে গেল ডাইভিং বেল। চেপ্টে গেল চারপাশের গোল দেয়াল। হার ম্যাজেস্টির দুর্ধর্ষ এসএএস্বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসন জুতার নীচে পড়া তেলাপোকার মত চ্যাপ্টা হয়ে মরল মুহূর্তে।
বিধ্বস্ত ডাইভিং বেল ধরে ঝুলছে রানা, নেমে চলেছে আবর্জনার সঙ্গে।
ভাবতে ভাল লাগল ওর, হারামজাদা গুণ্ডারসনের গুণ্ডামি শেষ। এসএএস বাহিনীর সবকটাকে শেষ করেছে ও।
এবার ফিরতে হবে স্টেশনে।
পরক্ষণে ধক করে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। মেরুদণ্ড বেয়ে নামল বরফ-ঠাণ্ডা স্রোত। উঠতে হলে শ ফুটের বেশি পেরুতে হবে। ততক্ষণ শ্বাস আটকে রাখা অসম্ভব। কাজেই এবার ও-ও মরবে। একা, নিঃশব্দে মৃত্যু ছিল ওর কপালে। কেউ জানবে না ও এখানে মারা পড়েছে। লাশও পাবে না কেউ।
ঠিক তখন মুখের সামনে নড়ল একটা হাত। রানা এমন বেমক্কা ভয় পেল যে আরেকটু হলে হার্ট-অ্যাটাক হতো। পরক্ষণে বুঝল, ওটাগুণ্ডারসনের হাত। ডাইভিং বেল থেকে কীভাবে যেন বেরিয়ে এসেছে লোকটা। কিন্তু…
না, জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন নয়।
লোকটা বাঙালি বিজ্ঞানী রাশেদ হাবিব।
রানার এক ফুট উপরে ভাসছে, বাতাস নিচ্ছে চল্লিশ বছর আগেরও স্কুবা গিয়ার ব্যবহার করে।
রানার দিকে আগ্রহ নিয়ে মাউথপিস বাড়িয়ে দিল সে।
১৭.
রাত নটায় ই-ডেকে পা রেখেছে রানা।
এখন নয়টা চল্লিশ মিনিট। স্টেশনের উপর থেকে শুরু করে নীচ পর্যন্ত সবখানে এসএএস কমাণ্ডোদেরকে খুঁজেছে ও। জীবিত কাউকে পাওয়া যায়নি। জড় করেছে নানা অস্ত্র। এসবের ভিতর এমপি-৫ ও কয়েকটা নাইট্রোজেন চার্জ নিজের জন্য রেখেছে। রাশেদ হাবিবের কাছ থেকে ফেরত নিয়েছে ডের্ট ঈগল পিস্তল।
নিশাত সুলতানাকে খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি তাকে …
যেন উধাও হয়ে গেছে।
এমন কী খুদে লিফটের ভিতরও খুঁজেছে! কেউ নেই।
সব খোঁজাখুঁজি শেষে পরিশ্রান্ত রান এসে বসেছে পুলের পারে। চব্বিশ ঘণ্টা হলো একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি। এখন ভেঙে আসছে শরীর।
ওর পাশে ডেকের উপর পড়ে আছে লিটল আমেরিকা-৪-র স্কুবা গিয়ার, ওটা এনেছিল রাশেদ হাবিব। এখনও ভেজা, সঙ্গে পেঁচিয়ে রয়েছে দীর্ঘ স্টিলের তার। একমাইল দূরের লিটল আমেরিকা-৪ স্টেশন থেকে এসেছে ওই তার। আইস শেলফের নীচ দিয়ে এসে উঠেছে উইলকক্স আইস স্টেশনে। প্রাচীন স্কুবা গিয়ারের দিকে চাইল রানা, আপন মনে মাথা নাড়ল। ওর পিছনের ডেকে ব্রিটিশদের আনা সি শ্লেড। ওগুলো আলট্রা-মডার্ন জিনিস।
উপরে, বি-ডেকে নিজের ঘরে চলে গেছে রাশেদ হাবিব, রানার ক্ষতের চিকিৎসা করবার জন্য আনবে কয়েকটা ব্যাণ্ডেজ, কাঁচি ও ডিযইনফেকট্যান্ট।
রানার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে পিচ্চি মেরি ভিসার, মনোযোগ দিয়ে ওর নরম মনের দুঃসাহসী বিদেশি বন্ধুকে দেখছে! চিন্তিত হয়ে পড়েছে মানুষটার জন্য। বড় করে শ্বাস ফেলল রানা, বুজে ফেলল দুই চোখ। মচকে যাওয়া নাক আস্তে করে ধরল, ভীষণ ব্যথা করছে। হ্যাঁচকা টানে ঠিক করে নিল নাক।
ইশশ, খুব ব্যথা? জানতে চাইল মেরি।
তা বলা যায়, কিন্তু নাক আছে, এই তো বেশি, হাসতে চাইল রানা।
ঠিক তখন ঝপাৎ আওয়াজ পেল, চরকির মত ঘুরে চাইল ওরা। পুলের ভিতর থেকে লাফিয়ে ই-ডেকে উঠে এসেছে ছোট্ট সিল লিলি। হেলেদুলে রানার সামনে চলে এল ওটা। আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রানা। এতে খুশি হয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল সে ডেকে, এবার ওর পেট চুলকে দিতে হবে।
তাই করল রানা।
ওর পিছনে হাসছে মেরি।
আধ মিনিট পর চট করে হাতঘড়ি দেখল রানা।
সোলার ফ্লেয়ারের কথা মনে পড়ে গেছে। মিস রাফায়লা ম্যাকানটায়ার বলেছিল, সাড়ে সাতটার সময় একটা সোলার ফ্লেয়ার কাটবে। আবারও সুযোগ আসবে রাত দশটায়।
সাড়ে সাতটার সুযোগ হারিয়েছে ও।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে দশটার সময় আরেকটা সুযোগ পাবে। তখন রেডিয়ো ব্যবহার করে ম্যাকমাৰ্ডোয় জানিয়ে দেবে এখানে কী ঘটছে।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল রানা। অবশ্য, রেডিয়ো করবার আগে অন্য একটা কাজ করতে হবে ওকে।
একটু দূরে পড়ে আছে মেরিন এক হেলমেট। বোধহয় ভাইপারের ছিল। হাত বাড়িয়ে ওটা তুলল রানা, চাপিয়ে নিল মাথার উপর। মুখের সামনে আনল মাইক্রোফোন। রানা বলছি। তিশা, জনি ওয়াকার, মোরশেদ তোমরা শুনতে পাচ্ছ?
প্রথমে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর হঠাৎ করেই বলে উঠল নারী কণ্ঠ: স্যর! আপনি?
তিশার কণ্ঠ। আপনি কোথায়, স্যর? জানতে চাইল।
স্টেশনে।
আর এসএএস প্লাটুন?
মরেছে সবাই। আবারও স্টেশন, ফিরে পেয়েছি। তোমাদের কী অবস্থা? দেখলাম, নীচে গেল গুণ্ডারসনের ডাইভার টিম।
বলতে পারেন হঠাৎ ঐশ্বরিক বা নারকীয় সাহায্য পেয়েছি, আমাদের কোনও লোক হারাতে হয়নি। এসএএস কমাণ্ডোরা কেউ বেঁচে নেই। আপনাকে বলার মত অনেক কথা আছে আমার।
.
বরফ-গুহার ওই ফাটলের ভিতর দিয়ে চেয়ে আছে তিশা। ব্রিটিশ কমাণ্ডো দলের সঙ্গে লড়াই শেষে ওরা আশ্রয় নিয়েছে ফাটলের খাটো সুড়ঙ্গে। একটু দূরে পড়ে আছে এসএএস কমাণ্ডোদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। কেউ বেঁচে নেই। লোকগুলোর মাংস-হাড় চিবানোর পর বড় গুহার ভিতর নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাণ্ড সব এলিফ্যান্ট সিল। আপাতত কালো বিমানের আশপাশে গিয়ে বসেছে, ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, ক্যাম্পফায়ারে জমায়েত হয়েছে একদল স্কাউট।
ঠিক কীসের মত বললে? আবারও জানতে চাইল রানা।
স্পেসশিপের মতই, কিন্তু আসলে মানুষের তৈরি অদ্ভুত সুন্দর কালো একটা বিমান, বলল তিশা।
আরও বিশদ বর্ণনা দাও, ক্লান্ত স্বরে বলল রানা।
সংক্ষেপে তিশা জানাল এই পাতাল-গুহায় কী পেয়েছে। স্পেসশিপের পেটের কাছে কিপ্যাড। বলতে ভুল করল না, হ্যাঙার ও ডায়েরির কথা। ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্পে গোটা স্টেশন তলিয়ে যায় দেড় হাজার ফুট নীচে। তিশার মনে হয়েছে, এটা ছিল টপ-সিক্রেট কোনও মিলিটারি প্রজেক্ট। গোপনে ইউএস এয়ার ফোর্সের জন্য তৈরি করা হচ্ছিল বিশেষ কোনও অ্যাটাক বিমান। ডায়েরির বক্তব্য তুলে ধরল, বিমানের ভিতর রয়েছে প্লুটোনিয়াম কোর।
এরপর তিশা জানাল, কীভাবে এসএএস কমাণ্ডোদের উপর হামলে পড়েছে এলিফ্যান্ট সিল। আগেই গুহার ভিতর ছিটিয়ে পড়ে ছিল উইলকক্স আইস স্টেশনের মৃত বিজ্ঞানীরা। এসব সিল বেরিয়ে এসেছে মস্ত বড় গর্ত থেকে। ভয়ঙ্কর হিংস্র তারা। বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে উঠল তিশা।
নীরবে সব শুনল রানা। তিশার কথা শেষে বলল, রাশেদ হাবিবের ঘরে মনিটরে কী দেখেছে। ওই সিলের নীচের মাড়ি থেকে বেরিয়েছে দুটো বিশাল শ্বদন্ত, নাকের পাশ দিয়ে উপরে উঠেছে। কথা বলবার সময় আরেকটা দৃশ্য ফুটে উঠল ওর মনে। ভেসে উঠেছে মৃত কিলার ওয়েইল। পেট-বুক-গলা চেরা। যেন ক্ষুরধার দুটো তলোয়ার ফুটো করে দিয়েছে পেট, তারপর উপরের দিকে চিরে দিয়েছে গলা পর্যন্ত।
এখানেও অমন সিল দেখেছি, বলল তিশা। এগুলো ছোট। কিশোর বয়সী। আপনি বোধহয় দলের মর্দাটাকে দেখেছেন। যা বললেন, এ থেকে মনে হচ্ছে, নীচের দুই দন্ত থাকে শুধু মর্দার। নাকের পাশ দিয়ে উঠেছে।
হতে পারে, বলল রানা। এক সেকেন্ড পর অন্য চিন্তা এল। বোধহয় বুঝতে পারছে, কেন মর্দা এলিফ্যান্ট সিলের অস্বাভাবিক নীচের দন্ত থাকে।
সত্যিই যদি ওই বিমানে প্লটোনিয়াম কোর থাকে, এমন হতেই পারে, ওই কোর থেকে সামান্য প্যাসিভ রেডিয়েশন বেরুচ্ছে। আসলে লিক হচ্ছে না, শুধু আবছা ভাবে রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ছে। যে-কোনও নিউক্লিয়ার ডিভাইসে এমন হয়। হয়তো এসব এলিফ্যান্ট সিল বাসা করেছে বিমানের কাছেই, আর সামান্য পরিমাণের রেডিয়েশন আসছে পুটোনিয়াম কোর থেকে। এর ফলে মর্দাগুলোর উপর প্রভাব পড়ছে।
ওর মনে পড়েছে কুখ্যাত রডরিগ রিপোর্ট। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে পুরনো এক নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স ফ্যাসিলিটি থেকে বেরুচ্ছিল প্যাসিভ রেডিয়েশন। কাছের শহরে দেখা গেল বহু লোক জেনেটিক অস্বাভাবিকতায় ভুগছে। মহিলাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পুরুষরা। আঙুল দীর্ঘ হওয়া কমন মিউটেশন। এ ছাড়া, দেখা গেল মানুষের দাঁত বিদঘুটে হয়ে উঠছে। রিপোর্টে বলা হলো: পুরুষ হর্মোন টেস্টোস্টেরনে জেনেটিক অস্বাভাবিকতা দেখা দিয়েছে।
এসব সিলেরও বোধহয় তাই হয়েছে, ভাবল রানা।
তারপর ওর মনে পড়ল আরেকটা বিষয়। চট করে জানতে চাইল, তিশা, বলো তো, এসএএস কমাণ্ডারা কখন গুহায় পৌছায়?
ঠিক জানি না, তবে আন্দাজ রাত আটটার দিকে।
আর তোমরা? আমরা ডাইভিং বেল ত্যাগ করি দুপুর দুটো দশ মিনিটে।
আরও একঘণ্টা লাগে এখানে উঠে আসতে। ধরুন, তিনটের সময় পৌঁছে যাই।
বিকেল তিনটা। আর রাত আটটা।
জানা নেই উইলকক্স আইস স্টেশনের বাসিন্দারা ঠিক কখন নেমেছিল পাতাল-গুহায়। কিন্তু রানার মন বলছে, এসব সময়ের সঙ্গে হামলার যোগাযোগ আছে। আঙুল তুলে নির্দিষ্ট কিছু দেখাতে পারবে না, কিন্তু কোনও মিল থাকতেই পারে। পরে হয়তো বোঝ যাবে কেন ওই সময়ে হামলা হয়েছে।
ঘড়ির দিকে চাইল রানা।
৯:৫০।
সোলার ফ্লেয়ারের ফাটল তৈরি হওয়ার সময় হয়ে এল।
তিশা, আপাতত অন্য কাজে যাব। দশ মিনিট পর সোলার ফ্লেয়ারের ভিতর ফাটল দেখা দেবে। ওই সুযোগে ম্যাকমার্ডোর সঙ্গে যোগাযোগ করব। তোমরা তো নীচে নিরাপদ, একটা কাজ করো, চারপাশ ঘুরে জানাও হ্যাঙারে আরও কী আছে। ওই বিমান সম্পর্কে কিছু পেলে দেরি না করে জানাবে।
ঠিক আছে, স্যর।
হেলমেট মাইকের সুইচ অফ করে দিল রানা। উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় অনেক উপর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলল, মেজর!
মুখ তুলে উপরে চাইল রানা। রাশেদ হাবিব। বি-ডেকের ক্যাটওয়াকে। এই যে, ভাই! গলা ফাটিয়ে ফেলছে লোকটা।
কী?
বিশ্বাস করবেন না, নিজ চোখে এসে দেখে যান!
তিন মিনিট পর মেরিকে নিয়ে রাশেদ হাবিবের ভাঙা দরজা পেরুল রানা।
কমপিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ হাবিব।
গোটা সন্ধ্যা ধরে পড়ে আছে! রানাকে বলল, কিন্তু মাত্র একটু আগে দেখলাম। নিউ মেক্সিকো থেকে ই-মেইল। পৌচেছে সন্ধ্যা সাতটে বত্রিশ মিনিটে। লোকটার নাম রবিন কার্লটন। আপনাকে চিঠি দিয়েছে।
কী নাম বললেন? ভুরু কুঁচকে গেল রানার।
কী যেন নাম বললাম? …হ্যাঁ, রবিন মিলফোর্ড। তিন গোয়েন্দা বইয়ের নথি রবিন মিলফোর্ড…
ভুরু আরও কুঁচকে গেল রানার।
মনিটরের দিকে আঙুল তুলল রাশেদ হাবিব। একটা লিস্ট পাঠিয়েছে। তার আগে-পরে মেসেজ দিয়েছে।
চিঠি পড়তে শুরু করেছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর একটু সরু হয়ে গেল ওর দুই চোখ। ই-মেইলে লেখা:
রানা, আমি তোমার বন্ধু রবিন কার্লটন। মনে পড়ে আমাকে?
খুব সাবধান! তুমি যেখানে আছ, তা নিরাপদ জায়গা নয়। ইউএসএমসি পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট থেকে জানলাম, তুমি এখন মৃত। ঠিক আমারই মত। দ্বিতীয় টিম রওনা হয়েছে। আসছে তোমাদেরকে শেষ করে দিতে! বাংলাদেশ সরকারকে আগেই জানানো হয়েছে, তুমি মারা গেছ।
তোমার মিশনটাকে টার্গেট করেছে আইসিজি। দ্বিতীয় টিম আসছে তোমাদের শেষ করতে।
চাই না আমার ইউনিটের সবার মত করে মরতে হোক তোমাদের সবাইকেও।
পেরুর কথা মনে পড়ে, রানা?
তোমার সঙ্গে যারা, তাদের ভিতর কেউ আইসিজি থাকলে হয়তো তাকে ঠেকাতে পারবে।
নীচে একটা লিস্ট দিলাম।
এরা আইসিজি।
ট্রান্সমিট নং. ৫৯৭-৯৭১৭-০৮১০১
রেফারেন্স নং. ৪৫৩১
বিষয়: সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের কাছের কয়েকজন ব্যক্তির নাম।
নাম: চাকরিস্থল: ফিল্ড/র্যাঙ্ক:
উইলিয়াম বীব। লিঙ্কন ল্যাব। নিউক্লিয়ার ফিফিলিস্ট।
জর্জ লোবো লার্সেন। বার্কলি। অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
মাইক গোউন্ড। নেভি সিল। লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার।
ন্যাট লেদারউড আর্মি রেঞ্জার্স। কর্নেল।
মার্লা হেয়ে। কলাম্বিয়া। কমপিউটার সায়েন্টিস্ট।
সামান্থা রিভ। হার্ভার্ড। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট।
রাস্টি ফেরিস। মাইক্রোসফট। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
উইলিয়াম ফেল্পস। আইবিএম। হার্ডওয়ার ইঞ্জিনিয়ার।
লেস্টার গ্রিম। ক্রে। হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
ভ্যালেনি ফার্গো। ইউ এসএমসি। কর্পোরাল।
ক্রিস হার্ট। বোয়িং। টেকনিশিয়ান
প্রস্টন স্টোন। ইউএসসি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার।
রিপলি জেনড্রন। জেপিএল। অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
অ্যামি কার্ভেল। লকহিড। অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
জ্যাক বোল্ট। আর্মি রেঞ্জার্স। সিনিয়র সর্জেন্ট।
সুয়েড নিলসেন। ইয়েল। নিউক্লিয়ার ফিস্টি।
নৰ্মা হবসন। অ্যারিয। বয়েটরিন।
মাইক গ্যানন। ইউএসএমসি। গানরি সার্জেন্ট।
নিনা অস্টিন। হার্ভার্ড। ক্যাপ্টেন।
জাড হর্সফল। জন্স হপকিন্স।
কলিন সিম্পসন র্যানডলফ। ইউএনএসসি। সার্জেন্ট মেজর।
জিম বেলিংগার। আর্মালাইট। ব্যালেস্টিক্স।
এনিস কনরাড। ইউ.টেক্স। ইনসেক্টস
জনি ওয়াকার। ইউএসএমসি। সার্জেন্ট।
অ্যাণ্ড্রু লিলিওয়েলেন। আইসিজি সার্জেন্ট মেজর।
লি মন্ট্যানা। ইউ কলোরাডো। কেমিকেল এজেন্ট।
ম্যাক্স ডাব্লিউ কেইন। টেক্সাস ল্যাব। কেমিস্ট।
ফ্রেডারিক সিম্পসন। প্রিন্সটন। ?
জেনি ফেয়ারওয়েল। থার্ড মেরিন কর্পস ?
পল সিংগার। ইউএসএমসি। গানারি সার্জেন্ট।
গুয়েন রাসেল। ইউএসসি। ?
পার্কস আর, শর্ট। নেভি সিল। কমোডর।
পল মর্গান। ইউএসএমসি। সার্জেন্ট।
চাক হ্যালুম। সিসিএ সিএলএও। সায়েন্টিস্ট।
পলি রিগস। উকলা। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার।
অলিভার টার্নার। ইউএসএমসি। মেজর।
জন সিমন। ইউএসএএফ। ক্যাপ্টেন।
—————————————————————————-
ভাল কথা, রানা, তুমি সভ্য জগতে ফিরলেই অ্যাডোনিস ক্যাসেডিন নামের এক লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সে দী ওয়াশিংটন পোস্ট দৈনিক পত্রিকায় কাজ করে। সে জানবে আমি কোথায় আছি।
বিদায়, পারলে শেষ করে দাও ওই কুকুরগুলোকে।
রবিন কার্লটন।
ই-মেইলের দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে আছে রানা।
মেরিন অফিস থেকে একে বলা হয়েছিল রবিন কার্লটন, পেরুতে মারা গেছে।
কিন্তু আসলে ও জীবিত…
ই-মেইলের একটা কপি প্রিন্ট করেছে রাশেদ হাবিব। এটা বাড়িয়ে দিল। দ্বিতীয়বার চিঠিটা পড়ল রানা।
কীভাবে যেন রবিন জেনেছে, ও আছে অ্যান্টার্কটিকায়। এ-ও জেনেছে, দ্বিতীয় দল আসছে উইলকক্স আইস স্টেশন লক্ষ্য করে। এর চেয়েও বিস্ময়কর, আমেরিকান সরকার থেকে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ও মারা পড়েছে।
রবিন ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে আইসিজির দীর্ঘ তালিকা। এরা সবাই বিশ্বাসঘাতক, দরকার পড়লে অন্য যোদ্ধাদেরকে খুন করে ফেলবে।
ই-মেইল করবার সময়টা দেখে নিল রানা। সাতটা বত্রিশ। স্যাটালাইটের মাধ্যমে এসেছে। তার মানে, সাড়ে সাতটার দিকে পাঠানো হয়েছে। ওই সময় সোলার ফ্লেয়ার সরে গিয়েছিল।
তালিকা আবারও পড়তে শুরু করল রানা। কয়েকটা নাম যেন চোখে এসে আঙুল দিয়ে খোঁচা দিল। পল সিংগার। ইউএসএমসি। গৰারি সার্জেন্ট।
ভাইপার। রানা ভাবতে পারেনি লোকটা আইসিজি হতে পারে। তারপর তালিকায় আছে:
জনি ওয়াকার। ইউএসএমসি। সার্জেন্ট।
সর্বনাশ! বিড়বিড় করে বলল রানা।
কী? কী পেলেন? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল রাশেদ হাবিব।
চুপ করে আছে রানা।
জনি ওয়াকারও আইসিজি।
.
হ্যাঙারে অন্যদের সঙ্গে কালো বিমান বিষয়ে তথ্য পাওয়ার জন্য খোঁজাখুঁজি করছে তিশা করিম।
ছোট এক ওঅর্ক শপে নানান স্কিম্যাটিক দেখছে গোলাম মোরশেদ। একটা ডেস্কের পিছনে বসেছে নিনা ভিসার, হাতে পেন্সিল ও কাগজ।
ভাল নাম দিয়েছে, নীরবতা ভাঙল মোরশেদ।
কী? জানতে চাইল নিনা।
ভাল নাম দিয়েছে বিমানের ছায়া বা দ্য শ্যাডো।
হুম, মাথা দোলাল নিনা।
বিমানে ঢুকবার কোড ভাঙতে পারলেন? জানতে চাইল মোরশেদ।
প্রায়, বলল, নিনা। আমরা যে নম্বর পেয়েছি, সেগুলো ২৪১৫৭৮১৭। মনে হচ্ছে এগুলোর ভিতর প্রাইম নম্বর ২, ৪১, ৫, ৭। তারপর পেলাম ৮১৭। ৮৭১কে ভাগ করা যায় ১৯ আর ৪৩ দিয়ে। তার মানে ওটাও প্রাইম নম্বর। আবার, ৮৭১ দুটো নম্বরও হতে পারে। ৮১ এবং ৭। অথবা, তিনটা নম্বরও হতে পারে। এখানে এসেই আটকে গেছি। আগে বুঝতে হবে ২৪১৫৭৮১৭ দিয়ে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছে।
এসব আপনিই বুঝুন, হাসল মোরশেদ। আমার বিদ্যা দিয়ে বেশি দূর যেতে পারব না।
এবার দেখা যাক…
হঠাৎ ওঅর্কশপে এসে ঢুকল জনি ওয়াকার, বলে উঠল, ডক্টর ভিসার?
বলুন?
তিশা পাঠাল। আপনাকে যেতে বলেছে। অফিসে জরুরি কী যেন পেয়েছে। বলছিল, বিমানের কোডবুক হতে পারে।
ঠিক আছে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নিনা, চলে গেল ওঅর্কশপ ছেড়ে।
একা হয়ে গেল মোরশেদ ও ওয়াকার।
বিমানের স্কিম্যাটিকে মন দিয়েছে মোরশেদ। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, জানেন, এই বিমান অন্যরকম। এই টার্বোফ্যান পাওয়ারপ্লান্টের সুপারক্রুজ কেপেবিলিটি আছে। সঙ্গে আছে আটটা ছোট রেট্রো জেট। ওগুলো পেটের কাছে। বিমানটা একই জায়গা থেকে উপরে উঠতে বা নামতে পারে। তবে অবাক লাগছে অন্য কারণে এই দুই পাওয়ারপ্লান্ট চলে সাধারণ জেট ফিউয়েলে।
তো? দরজার কাছ থেকে বলল ওয়াকার।
কাজেই… বোঝা যাচ্ছে না, প্লুটোনিয়াম কোর কীসের জন্য? মুখ তুলে ওয়াকারের দিকে চাইল মোরশেদ।
জনি ওয়াকার জবাব দেয়ার আগেই আবারও স্কিম্যাটিকে মন দিয়েছে। কাগজের নীচ থেকে টেনে বের করল হাতে লেখা কয়েকটা নোট।
আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি, বলল মোরশেদ। আগেই বলেছিলাম তিশাকে। এসব নোটে লেখা: ইঞ্জিনিয়াররা হ্যাঙারে তৈরি করেন নতুন এক ধরনের ইলেকট্রনিক্যালি-জেনারেটেড স্টেলথ মেকানিজম। বিমানের চারপাশে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করা হয়। তার জন্য দরকার ছিল অনেক পাওয়ার। ধরুন দুই দশমিক একাত্তর গেগাওয়াট। কিন্তু তা পেতে হলে লাগবে নিউক্লিয়ার রিয়্যাকশন। কাজেই দরকার প্লটোনিয়াম। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা দোলাল মোরশেদ।
ওর জানা নেই, নিঃশব্দে পিছনে এসে থেমেছে সার্জেন্ট জনি ওয়াকার।
দুর্দান্ত এক মিশন শেষ করলাম আমরা, বলল মোরশেদ। স্পেসশিপ, ফ্রেঞ্চ কমাভো টিম, ব্রিটিশ এসএএস হামলা, গোপন পাতাল ঘাটি, প্রটোনিয়াম কোর… বিশ্বাসঘাতক আইসিজিসর্বনাশ! একেবারে পাগল যে হয়ে যাইনি, তাই বাপের ভাগ্যি। এবার ঘরের ছেলে…
জনি ওয়াকারের ছোরা খচ করে ঢুকে গেল মোরশেদের কানের ভিতর। থামল গিয়ে মগজের গভীরে।
বিস্ফারিত হলো গোলাম মোরশেদের দুই চোখ। তারপর আস্তে করে ডেস্কের উপর পড়ল ওর মাথা। তার আগেই মারা গেছে।
মগজের ভিতর থেকে রক্তাক্ত কলা টেনে নিল ওয়াকার। ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েই টের পেল, কেউ এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
হতবাক হয়ে চেয়ে আছে তিশা করিম। দুই হাতে কাগজপত্র। বিস্ফারিত মেয়েটির দুই চোখ।
১৮.
হেলমেট মাইকে বলে উঠল রানা: তিশা! তিশা, সাড়া দাও! মোরশেদ!
ওদিক থেকে কারও জবাব এল না।
চট করে ঘড়ি দেখল রানা। ৯:৫৮।
আর মাত্র দুমিনিট পর শুরু হবে সোলার ফ্লেয়ারের ফাটল।
তিশা! মোরশেদ! যদি শুনে থাকো, মনোযোগ দাও, জনি ওয়াকার আইসিজি। আবার রিপিট করছি, জনি ওয়াকার বেঈমান! যখন তখন ছুরি বসিয়ে দিতে পারে পিঠে! ওর দিকে পিঠ দিয়ো না! পারলে অস্ত্র কেড়ে নাও! আমাকে অন্য কাজে যেতে হচ্ছে।
রেডিয়ো রুমের দিকে ছুটল রানা।
.
বিশাল হ্যাঙারে ঘুরেই ছুটতে শুরু করেছে তিশা করিম। ওর পিছনে তেড়ে আসছে সার্জেন্ট জনি ওয়াকার। পাশে বরফ-দেয়াল রেখে দৌড়ে চলেছে তিশা, পিছনের দেয়ালে এসে লাগল এক পশলা গুলি।
বালকহেড দরজা দিয়ে ছিটকে ঢুকে পড়ল তিশা, তারই ফাঁকে কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলেছে এমপি-৫। সরু ফাটলের দিকে চলেছে। একবার ঘুরে কয়েকটা গুলি পাঠাল দরজা দিয়ে। পরক্ষণে পৌঁছে গেল সুড়ঙ্গের মুখে, ফাটল দিয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে যেতে চাইল প্রধান গুহায়। পিছন থেকে এল ওয়াকারের কমপক্ষে দশটা গুলি। এইমাত্র দরজা পেরিয়ে এসেছে সে।
তিশার চারপাশের দেয়ালে বিধল গুলি। ওর ব্রেস্টপ্লেটে লাগল দুটো। একটা গুলি ফুটো করে দিল কাঁধ! হেঁড়াখোড়া অবস্থা ওই ক্ষতের।
ভীষণ ব্যথায় কাতরে উঠল তিশা। ফাটল পেরিয়ে বেরিয়ে। এল বড় গুহায়। অন্যহাতে চেপে ধরেছে কঁধ, দাঁতে দাঁত পিষে দেখল, আঙুল থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত। কোনও কারণে এত ব্যথা লাগতে পারে, কখনও ভাবতে পারেনি তিশা।
মুখ বিকৃত করে দেখল, কালো বিমানের কাছে এক পাল সিল। ওকে খেয়াল করেছে ওগুলোর একটা, মাথা উঁচু করল। ওটা মর্দা। বিশাল শরীর। নীচের মাড়ি থেকে উপরে উঠেছে দুই ক্ষুরধার শ্বদন্ত। বোধহয় আধ ইস্টা আগে বাড়ি ফিরে, ভাবল তিশা।
কুকুরের মত ঘেউ-ঘেউ করে উঠল ওটা। তারপর বিশাল শরীর নিয়ে এগুতে শুরু করল। প্রতি পদক্ষেপে থলথল করে উঠছে বিপুল চর্বির পাহাড়।
তিশার কাঁধের ক্ষতটা ভীষণ জ্বলছে।
ফাটলের দিকে মুখ দিয়ে বরফে পিছলে সরতে লাগল তিশা। এক চোখ ফাটলের উপর, অন্য চোখ এলিফ্যান্ট সিলের দিকে।
বরফের মেঝেতে সরু রক্তের চিহ্ন সামনে ফেলে সরছে। ওটাই জানিয়ে দেবে, ও কোথায় আছে।
.
অস্ত্র বাগিয়ে ফাটলের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এল জনি ওয়াকার।
আশপাশে নেই তিশা।
মেঝের উপর রক্তের দাগ চোখে পড়ল। ডানদিকে গেছে মেয়েটা। ওদিকে মস্ত এক বরফের বোল্ডার। বোধহয় ওপাশেই পাওয়া যাবে ছেমড়িকে।
রক্তের চিহ্নের পিছু নিল ওয়াকার, কয়েক লাফে চলে গেল বরফের বোল্ডারের ওপাশে, একটানা ব্রাশ ফায়ার করল। কিন্তু ওদিকে কেউ নেই।
লেফটেন্যান্ট তিশা গেল কোথায়?
বোল্ডারের পিছনে, মেঝের উপর পড়ে আছে এমপি-৫।
চরকির মত ঘুরল জনি ওয়াকার।
গেল কোথায় হারামজাদী?
.
বরফের বোল্ডারের ওদিক থেকে জনি ওয়াকারকে বেরিয়ে আসতে দেখল তিশা। একই সময়ে ওর উপর চোখ পড়েছে লোকটারও।
এখন ফাটলের এক পাশে বসে আছে তিশা, দুই হাতে চেপে ধরেছে ক্ষত। ফুরিয়ে যাচ্ছে সমস্ত শক্তি। একটু আগে ফাটলের বামপাশে সরেছে, মেঝেতে রক্ত পড়তে দেয়নি। তখনই ফাটল থেকে বেরিয়ে এসেছে ওয়াকার। তিশা ভেবেছিল, আবারও ঢুকবে ফাটলের ভিতর, কিন্তু দেহে সে শক্তি নেই।
মুচকি হাসল সার্জেন্ট জনি ওয়াকার, ধীরে ধীরে সামনে বাড়ল। তিশার তিন ফুট আগে থামল, প্রধান গুহার দিকে তার পিঠ।
তোর মা বেশ্যা ছিল, কুকুরের বাচ্চা! চাপা স্বরে বলল তিশা।
কাঁধ ঝাঁকাল ওয়াকার।
ওটা স্পেসশিপ না, তবুও আমাদেরকে মেরে ফেলছিস তুই, চট করে ওয়াকারের পিছন দিক দেখে নিল তিশা।
বিমানের জন্য নয়, লেফটেন্যান্ট তিশা, সমস্যা হচ্ছে তোমরা জেনে গেছ আইসিজি কী। কাজেই তোমাদেরকে বাঁচতে দেয়া হবে না।
ওয়াকারের চোখে চাইল তিশা। যা করার কর!
লোকটা অস্ত্র তাক করল তিশার বুকে, আর ঠিক তখনই রক্ত হিম করা ভয়ঙ্কর এক গর্জন শোনা গেল।
চরকির মত ঘুরল জনি ওয়াকার, হাঁ হয়ে গেছে মুখ। বিকট গর্জন ছাড়তে ছাড়তে একেবারে ঘাড়ের উপর চলে এসেছে প্রকাণ্ড এক মর্দা এলিফ্যান্ট সিল। প্রতি ফ্লিপারক্ষেপে থরথর করে কাঁপছে গোটা বরফ মেঝে।
এই সুযোগে ফাটলের ভিতর দিয়ে আবারও খাটো সুড়ঙ্গে নেমে গেল তিশা। বেকায়দা ভাবে ধুপ করে পড়েছে মেঝের উপর।
অস্বাভাবিক গতি তুলে ওয়াকারের কাছে পৌঁছে গেল মর্দা সিল। কালো বিমান থেকে এদিকে আসতে বড়জোর পাঁচ সেকেণ্ড নিয়েছে।
অস্ত্র তুলেই গুলি শুরু করল ওয়াকার।
কিন্তু দানবীয় সিল অনেক কাছে, এখন গুলি করে ওটাকে ঠেকাবার উপায় নেই কারও।
সুড়ঙ্গের ভিতর উঠে দাঁড়িয়েছে তিশা, দেরি না করে উঁকি দিল ফাটল দিয়ে। এক পলক দেখতে পেল জনি ওয়াকারকে।
পরক্ষণে ভোঁতা ধ্যাপ আওয়াজ হলো। বরফ-দেয়ালে আছড়ে পড়েছে লোকটা। বিপুল ওজন নিয়ে তার উপর চেপে বসেছে মর্দা সিল। নানা দিকে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত।
জনি ওয়াকারের পেটের ভিতর থেকে দুই শ্বদন্ত বের করল মর্দা সিল, পড়পড় করে ছিড়ে গেল ওয়েটসুট। ধুপ করে মেঝের উপর পড়ল লোকটা। গায়ের উপর দাঁড়িয়ে গেল জটা, বিকট জোরে হুঙ্কার ছাড়ল— যুদ্ধে তার জয় হয়েছে।
করুণ গোঙানি শুনল তিশা।
এখনও মরেনি জনি ওয়াকার।
আবারও গুঙিয়ে উঠল।
চুপ করে চেয়ে রইল তিশা! মাথা নিচু করল বিশাল সিল, ওয়াকারের বুক থেকে বড় এক চাকা মাংস ছিড়ে নিল। খুব মজা করে জীবন্ত মানুষ খেতে শুরু করেছে।
.
ঠিক দশটা বাজতেই রেডিয়ো রুমে ঢুকল রানা। পিছনে এল মেরি ও রাশেদ হাবিব। রেডিয়ো কসোলের সামনে বসল রানা, চালু করল মাইক্রোফোন।
অ্যাটেনশান, ম্যাকমার্ডো। অ্যাটেনশান, ম্যাকমার্ডো। আমি মাসুদ রানা। শুনতে পাচ্ছেন?
কোনও সাড়া নেই।
আবারও বার্তা পাঠাল রানা।
ওদিক থেকে কোনও জবাব এল না।
তারপর হঠাৎ করেই খড়মড় করে উঠল স্পিকার বলে উঠল কেউ: মাসুদ রানা, কিং আর্থার বলছি। আপনার বক্তব্য শুনতে পেয়েছি। ওদিকের সিচুয়েশন জানান।
কিং আর্থার?
ভুরু কুঁচকে গেল রানার। কিং আর্থার মানে মেজর রন হিগিন্স, মেরিন ফোর্সের রিকনিসেন্স ইউনিট ফোরের কমাণ্ডিং অফিসার। রবিন এই লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওর নুমা অফিসে। হাসি-খুশি মানুষ। একইসঙ্গে দক্ষ সেনানী। খুব আফসোস করেছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবিন কার্লটনের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে।
কিং আর্থার, সাড়া দিল রানা। সিচুয়েশন জানাচ্ছি। টার্গেট অবজেক্ট আমাদের হাতে। রিপিট করছি, টার্গেট অবজেক্ট আমাদের হাতে। অবশ্য, দলের অনেককে হারিয়েছি। …এবার আপনার বক্তব্য বলুন। …আপনারা কোথায়?
হোভারক্রাফটে। ধরুন, একমাইল দূরে।
চমকে গেল রানা। মাত্র একমাইল দূরে?
অবশ্য, পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত স্টেশনে ঢুকতে মানা করে দিয়েছে। খুবই কড়া নিষেধ।
উইলকক্স আইস স্টেশনের বাইরে পৌঁছে গেছে মেরিন ফোর্স। চট করে একটা কথা মনে পড়ল রানার। চাপা স্বরে জানতে চাইল, আপনারা কতক্ষণ ধরে বাইরে?
আটত্রিশ মিনিট, বলল রন হিগিন্স।
আটত্রিশ মিনিট।
ভুরু আরও কুঁচকে গেল রানার। কথাটা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। কিন্তু মিথ্যা বলবার কোনও কারণও নেই রনের।
রেডিয়ো স্পিকার চুপ, কিন্তু হঠাৎ করেই রানার হেলমেট ইন্টারকমে বলে উঠল চিন্তিত কণ্ঠ। ওই গলা রন হিগিন্সের।
মিস্টার রানা, আমি গোপনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
রেডিয়ো বন্ধ করে দিল রানা, কথা বলে উঠল হেলমেট মাইকে। ক্লোজড-সার্কিট মেরিন চ্যানেল ব্যবহার করছে।
কিং আর্থার, আপনি ওখানে বসে কী করছেন?
জুলিয়াস বি, গুণ্ডারসনের সঙ্গে লড়াই করেছে ও, তারপর স্টেশন জুড়ে এসএএস কমাণ্ডোদেরকে খুঁজেছে, আর পুরো সময় জুড়ে স্টেশনের বাইরে বসে থেকেছে মেরিনরা।
এখানে নাটক চলছে, মিস্টার রানা। মেরিন, গ্রিন ব্যারেট, এমনকী হাজির হয়েছে গোটা একটা আর্মি রেঞ্জার প্লাটুন। শেষের এরা স্টেশনের একমাইলের ভিতর অংশ পাহারা দিচ্ছে। ন্যাশনাল কমাণ্ড আর জয়েন্ট অভ চিফস তাদের সবধরনের ইউনিট পাঠিয়ে দিয়েছে। কারও বাপের সাধ্য নেই স্টেশনে হামলা করবে। কিন্তু এখানে আসার পর আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে: সিল টিম। আসা পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকতে হবে। আমাকে আরও নির্দেশ দিয়েছে: সিল টিম না আসা পর্যন্ত আমার দলের কেউ স্টেশনের দিকে এক পা বাড়ালে, তাকে যেন গুলি করে ফেলে দেয়া হয়।
চমকে গেছে রানা।
কয়েক সেকেণ্ড কোনও কথা বলতে পারল না!
পরিস্থিতি ভাল ভাবেই বুঝতে শুরু করেছে।
ঠিক এ-ই ঘটেছিল রবিন কার্লটনের ভাগ্যে। পেরুতে! ইনকা মন্দিরে। রবিন আগে পৌঁছে গিয়েছিল ওখানে। কী যেন পেয়েছিল ওই মন্দিরে। তারপর ওদের পিছনে পাঠিয়ে দেয়া হলো সিল টিমকে। আর এখন এই স্টেশনে ঢুকবে আরেকটা লি টিম। আমেরিকার সেনাবাহিনীর সেরা এবং নিষ্ঠুর একদল লোক তারা।
হঠাৎ করেই রানার মনে পড়ল রবিন কার্লটনের ই-মেইলের এক অংশ।
ইউএসএমসি পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট রানাকে মৃত ঘোষণা করেছে।
আস্তে করে ঢোক গিলল রান। সবই বুঝতে পারছে এখন!
ওদেরকে শেষ করে দেয়ার জন্য পাঠানো হচ্ছে সিল টিম।
বাঁচবে না কেউ। ছোট্ট মেরিও নয়!
কিং আর্থার, মন দিয়ে শুনুন, নিচু স্বরে বলল রানা। আমার ইউনিটের ভিতর নিজেদের লোক রেখেছিল আইসিজি। আমারই দলের এক মেরিন খুন করে ফেলেছে তার এক আহত সহযোদ্ধাকে। এখন আমাদেরকে মেরে ফেলার জন্য সিল টিম পাঠাচ্ছে। আমাদেরকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন।
রানার মেরুদণ্ড বেয়ে বরফ স্রোত নামছে। মনে পড়েছে, পেরুতে ঠিক এভাবেই সাহায্য চেয়েছিল রবিন কার্লটন।
আমাকে কী করতে বলেন? জানতে চাইল হিগিন্স।
ওদের জানান, এখানে কিছুই পাওয়া যায়নি, বলল রানা। কোনও স্পেসশিপ ছিল না বরফের নীচে। এ-ও বলতে পারেন, এই স্টেশনের নীচে রয়ে গেছে এয়ার ফোর্সের ব্ল্যাক প্রজেক্টের পরিত্যক্ত ঘাঁটি।
এমন কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, মিস্টার রানা। আমি বরফের ভিতর স্পেসশিপ বা এয়ার ফোর্সের ব্ল্যাক প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছুই জানি না।
এই স্পেসশিপের জন্যেই পাগল হয়ে উঠেছে এরা। কিং আর্থার, মন দিয়ে শুনুন: বাধ্য হয়ে ফ্রেঞ্চ প্যারাট্রুপারদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে আমাকে। তারপর এসেছে এসএএস কমাপ্তোদের প্লটুন, তাদের সঙ্গে ছিল মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন। আমেরিকানরা আমাদের কাছে সাহায্য চেয়ে এখন উল্টো খুন করতে চাইছে।
একমিনিট, মিস্টার রানা।
ওদিকে নীরবতা ছাড়া কিছুই নেই।
একমিনিট পর রন হিগিন্স বলল, মিস্টার রানা, এইমাত্র আর্মি রেঞ্জার কর্নেলের সঙ্গে কথা বললাম। লোকটার নাম ন্যাট লেদারউড! আমাকে বলেছে, দরকার পড়লে আমার দলের সবাইকে খুন করবে তার প্লাটুন। সিল টিম স্টেশনে ঢোকার আগে ওদিকে এক পা বাড়ালে মরতে হবে আমাদেরকে।
পকেট থেকে রবিন কার্লটনের ই-মেইলের কপি বের করল রানা, ওটাতে আইসিজি বার্তাবাহকদের নাম আছে।
শেষের দিকের একটা লাইনের উপর স্থির হলো রানার চোখ: ন্যাট লেদারউড আর্মি রের্স। কর্নেল।?
হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা, মনে মনে বলল রানা। ওই একই লোক হাজির হয়েছিল পেরুতে। ন্যাট লেদারউড। আইসিজি।
রন হিগিন্স বলে উঠল, শুনুন, মিস্টার রানা। আমি হয়তো স্টেশনে ঢুকতে পারব না, কিন্তু অন্য একটা কথা জানাতে পারি। আধ ঘণ্টা আগে শুনেছি। উপকূল থেকে তিন শ নটিক্যাল মাইল দূর-সাগরে আছে একটা নুমার জাহাজ। আধঘণ্টা আগে ওখান থেকে যোগাযোগ করে আমার এক বন্ধু। তখন পাশেই ছিল মেরিনদের একটা জাহাজ। ওখান থেকে আকাশে ওঠে চারটে মেরিন হ্যারিয়ার, আড়াই শ নটিক্যাল মাইল দূরের এক ব্রিটিশ ভিসি-১০ ট্যাঙ্কার বিমানকে ফেলে দেয়। ওটা পালাবার চেষ্টা করেছিল।
চুপ করে আছে রানা।
ব্রিটিশ ট্যাঙ্কার বিমান এসেছে অ্যাটাক প্লেনের জন্য ফিউয়েল দিতে। রানা ভাবছে, তাতে আমার কী? পরক্ষণে ভাবল, ওদিকে আরেকটা ব্রিটিশ বিমান থাকতে পারে। ওটাও হয়তো অ্যাটাক প্লেন। কোনও বম্বার বা ফাইটার। তেল নিয়েছে ট্যাঙ্কার থেকে। হয়তো ওই বিমানের পাইলট…
সর্বনাশ! চমকে গেল রানা। ওই বিমান আসলে গুণ্ডারসনের ইরেজার!
সাবমেরিন ছিল ফ্রেঞ্চদের ইরেজার, ঠিক সেভাবেই ব্রিটিশ ফাইটারকে বলে দেয়া হয়েছে: নির্দিষ্ট সময়ে জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন যোগাযোগ না করলে উড়িয়ে দেবে উইলকক্স আইস স্টেশন।
এয়ার ফোর্সকে ডেকে নেয়া হয়েছে, বলল রন হিগিন্স। অ্যাওয়্যাক্স বিমান ও এফ-২২ ফাইটার সাগরের উপর চোখ রাখছে। বলা হয়েছে, সাগরের উপর আকাশে কোনও ব্রিটিশ ফাইটার থাকলে ওটাকে যে-কোনও মূল্যে ফেলে দিতে হবে।
সিটে পিঠ ঠেকাল রানা, কুঁচকে গেছে দুই ভুরু। এক হাতে টিপে ধরল কপাল।
চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে ওদেরকে।
ফাঁদে পড়ে গেছে ওরা। এই ফঁদ থেকে বেরুবার কোনও উপায় ওর জানা নেই। শীঘ্রি সিল ফোর্স পৌঁছবে। তাদের প্রথম কাজই হবে ওদেরকে খুন করে ফেলা। ওরা যদি কোনও ভাবে তাদেরকে ফাঁকি দেয়, তাতেই বা কী? উইলকক্স আইস স্টেশনে এসে পড়বে ব্রিটিশ ফাইটার বিমানের এয়ার-টু-গ্রাউণ্ড মিসাইল, ছাতু হবে সবাই।
অবশ্য একটা পথ এখনও খোলা, ভাবল রানা।
ওরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, সিল টিম আসবার আগেই আত্মসমর্পণ করতে পারে কিং আর্থার ওরফে রন হিগিন্সের কাছে। এ কাজ করলে চট করে ওদেরকে খুন করবে না অন্যরা। আজ সারাদিন ধরে আবারও শিক্ষা নিয়েছে, আগে বাঁচতে হবে, পরে হয়তো কোনও সুবিধা পাওয়া যাবে।
হেলমেট মাইক চালু করল রানা, কিং আর্থার, শুনুন…
আয়হায়, মিস্টার রানা… শালারা পৌঁছে গেছে।
কারা?
সিল টিম। পৌঁছে গেছে। বাইরের পেরিমিটার পেরুতে শুরু করেছে। চারটে হোভারক্রাফট। স্টেশন কমপ্লেক্সে চলেছে।
.
উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে একমাইল দূরে, দীর্ঘ লাইন তৈরি করে ছুটছে চারটে হোভারক্রাফট। স্টেশনের আধ মাইল দূরে একটু ছড়িয়ে গেল চার যান, যেন ঘিরে ফেলবে গোটা স্টেশনকে।
স্টেশন লক্ষ্য করে স্বাভাবিক গতি তুলে চলেছে নেভি ব্লু রঙের চার হোভারক্রাফট। মাত্র কয়েক মিনিট পর স্টেশন কমপ্লেক্সের বাইরের দালানগুলো পাশ কাটাল। তাড়াহুড়ো দেখা গেল না এসব হোভারক্রাফটে।
এসব সিল টিমের।
সামনের হোভারক্রাফটের ভিতর সিল কমাণ্ডার রেডিয়োতে বলল, এয়ার কন্ট্রোল, সিল টিম বলছি, আপনাদের রিপোর্ট দিন। কী করতে হবে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনই স্টেশনে ঢুকছি না। আমরা। আগে নিশ্চিত করুন এখানে অন্য কোনও বিপদ হবে না।
এয়ার কন্ট্রোল থেকে বলছি, সিল টিম, রেডিয়োতে বলল ভারী গলার একজন। স্ট্যাণ্ড বাই থাকুন। যে-কোনও সময়ে আমাদের বিমান থেকে রিপোর্ট পাবেন।
.
একই সময়ে উইলকক্স আইস স্টেশন থেকে দুই শ বেয়াল্লিশ নটিক্যাল মাইল দূরে ছয়টা এফ-২২ ইউএসএএফ ফাইটার উড়ছে দক্ষিণ সাগরের আকাশে।
এফ-২২কে বলা হয় বর্তমানের দুনিয়া-সেরা ফাইটার, ওই বিমান এফ-১৫ ঈগলের রাজার মুকুট কেড়ে নিয়েছে। এফ-২২ দেখতে প্রায় এফ-১৫-র মতই, কিন্তু অন্য বিমানের যা নেই, তা আছে ওটার–রেইডার বা অন্য ডিটেকশন প্রযুক্তিকে হাসতে হাসতে পিছনে ফেলে, গোপনে যে-কোনও জায়গায় হাজির হতে পারে।
এফ-২২-র স্কোয়াড্রন লিডার হেলমেট রেডিয়োতে বক্তব্য শুনছে। ওদিকের লোকটার কথা শেষ হতেই স্কোয়াড্রন লিডার বলল, ধন্যবাদ, বিগবার্ড। বুঝতে পেরেছি।
কম্পিউটারাইযড় ডিসপ্লে স্ক্রিনে খুদে একটা ফোটা দেখছে সে। ওটা পশ্চিমে চলেছে। স্ক্রিনের পাশে ফুটে উঠেছে রিডআউট:
টার্গেট পেয়েছি: ১০৩ এনএম ডাব্লিউএনডাব্লিউ
এয়ারক্রাফট ডেজিগনেটেড: ই-২০০০.।
অর্থাৎ একটা ই-২০০০ যুদ্ধবিমান। বুঝতে দেরি হয়নি স্কোয়াড্রন লিডারের, ওই বিমান ইউরো-ফাইটার ২০০০। দুই ইঞ্জিনের হাই-ম্যানিউরেবল পকেট ফাইটার। ব্রিটিশ, জার্মান, স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান এয়ারফোর্স মিলে তৈরি করেছে।
স্কোয়াড্রন লিডারের স্ক্রিনে যে ফোঁটা, ওটা অলস ভাবে উড়ছে। এটার পাইলট জানে না স্টেলথ আমেরিকান ফাইটার মাত্র এক শ মাইল পিছনে।
ঠিক আছে, বাছারা, আমাদের টার্গেট পাওয়া গেছে, জানাল এফ-২২-র ক্যাপ্টেন! আবারও রিপিট করছি, টার্গেট পাওয়া গেছে। এবার চলো গিয়ে উড়িয়ে দিই ওটাকে।
.
উইলকক্স আইস স্টেশনে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে রানা সিল : টিমের কাছে আত্মসমর্পণ অসম্ভব। তাদের বেশিরভাগ লোক আইসিজি। ওদেরকে দেখামাত্র মেরে ফেলবে। এমনকী ছোট্ট মেয়েটিও মাফ পাবে না।
রানা একবার ভেবেছিল, নেমে পড়বে পাতাল-গুহায়। যদি দরকার পড়ে, কালো ওই বিমানকে মুক্তিপণের মত ব্যবহার করবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়েছে, পাতাল-গুহায় তো নামতেই পারবে না। ওদের সঙ্গে ডাইভিং বেল নেই। ওটা ধ্বংস হয়ে গেছে।
মেরি ও রাশেদ হাবিবকে প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে এ-ডেকের রেডিয়ো রুম থেকে বেরিয়ে এল রানা। সবাইকে নিয়ে নীচের ডেকের দিকে নামতে শুরু করেছে।
বাইরে কী ঘটছে, মেজর রানা? জানতে চাইল হাবিব।
আমাদেরকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা চলছে, বলল রানা। মেশিনের মত কাজ করছে ওর মগজ। এখন বাঁচবার একমাত্র উপায় কোথাও লুকিয়ে পড়া। সিল টিম চলে যাওয়ার পর বেরুতে হবে গোপন জায়গা থেকে।
তারপর কী করব? নিজের কাছে প্রশ্ন করল রানা। হেঁটে বাড়ি ফিরব?
যদি বাঁচতে পারো, পরে কোন সুযোগ বেরিয়ে যাবে।
রাং-ল্যাডার বেয়ে নীচে নামছে রানা, ওর চোখ গিয়ে পড়ল ই-ডেকের পুলে।
ওখানে একটা অদ্ভুত দৃশ্য।
ডেকের উপর আরাম করে ঘুমাচ্ছে মেরির সিল লিলি।
লিলি… ভাবছে রানা।
লিলির ব্যাপারে কী যেন মনে পড়তে চাইছে ওর।
.
হেলমেট মাইকে বলে উঠল এফ-২২ স্কোয়াড্রন লিডার, বিগবার্ড, গোল্ডেন লিডার বলছি। স্টেলথ মোড ব্যবহার করছি। আন্দাজ বিশ মিনিট পর টার্গেট নাগালে পাবে আমাদের মিসাইল।
.
হঠাৎ করে একটা চিন্তা ঢুকেছে রানার মগজে।
ঝট করে মেরির দিকে ফিরল ও। মেরি, লিলি কতক্ষণ শ্বাস আটকে রাখতে পারে?
কাঁধ ঝাঁকাল মেরি। পুরুষ ফার সিল প্রায় এক ঘণ্টা। কিন্তু লিলি ছোট, তা ছাড়া মেয়ে, ও পারে বড়জোর চল্লিশ মিনিট।
চল্লিশ মিনিট… হিসাব কষতে শুরু করেছে রানা।
কী ভাবছেন? জানতে চাইল হাবিব।
স্টেশন থেকে পাতাল-গুহায় পৌঁছুতে লাগে কমবেশি দুই ঘণ্টা, বলল রানা। ডাইভিং বেল দিয়ে তিন হাজার ফুট নামতে একঘণ্টা, আরেক ঘণ্টা বরফের সুড়ঙ্গ দিয়ে উঠে যেতে।
হ্যাঁ, তো… পুরো কথা শেষ করতে পারল না হাবিব।
তার দিকে চেয়ে আছে রানা। তিশারা গুহার দিকে উঠবার সময় অদ্ভুত একটা কথা বলেছে। ওদের সঙ্গে দেখা করেছে এক অতিথি। সে লিলি। তিশা জানায়, ওদের সঙ্গে পাতাল-গুহা পর্যন্ত গেছে লিলি।
হ্যাঁ। তো?
এখন, লিলি যদি দ্বিগুণ গতি তুলেও ওখানে হাজির হয়, তিন হাজার ফুট নীচে নেমে আবারও বরফ-সুড়ঙ্গ বেয়ে উঠতে অনেক সময় লাগার কথা। …অত দম পেল কোথা থেকে?
চুপ করে আছে রাশেদ হাবিব।
পুলের দিকে চাইল রানা। চল্লিশ মিনিট পর দম আটকে লিলির মরার কথা, তা হয়নি। ও জানত মাঝ পথে বাতাস নিতে পারবে।
একবার রাশেদ হাবিব আরেকবার মেরির দিকে চাইল রানা।
অন্য কোনও পথে ওই বরফ-সুড়ঙ্গে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেটা কোনও শর্টকাট পথ!
১৯.
সিল টিম, আমি গোল্ডেন লিভার। টার্গেটের কাছে পৌঁছে গেছি আমরা। আর পনেরো মিনিট পর মিসাইলের আওতায় আসবে টার্গেট।
সিল টিমের হোভারক্রাফটের ভিতর মিলিয়ে গেল কথাগুলো। কেবিনের ভিতর আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে সিল দলের সদস্যরা। কারও চোখে-মুখে বিন্দুমাত্র মায়া-বা অনুভূতির ছাপ নেই।
.
ই-ডেকে দুই সঙ্গীকে লো-অডিবিলিটি বেদিং ট্যাঙ্ক দিয়েছে রানা। এরই ভিতর একটা থারমাল-ইলেকট্রিক ওয়েটসুট পরে ফেলেছে মেরি। ওটা এতই বড়, কবজি ও গোড়ালি গুটিয়ে নিতে হয়েছে, নইলে নড়তেই পারবে না। রাশেদ হাবিব আগে থেকেই নিয়োপ্রেন বডিসুট পরনে, ওয়েটসুট পরবার ঝামেলায় না গিয়ে সরাসরি লাবা গিয়ার পরতে শুরু করেছে।
এবার এগুলো গিলে ফেলুন, মেরি ও হাবিবের দিকে একটা করে নীল ক্যাপসুল বাড়িয়ে দিল রানা। ওগুলো এন-৬৭ডি অ্যান্টি-নাইট্রোজেন ক্যাপসুল। এই একই জিনিস তিশাদের দিয়েছে। অন্য দুজনের মত নিজেও একটা ক্যাপসুল পেটে চালান দিল রানা।
কমব্যাট ফেটিগ খুলে ফেলেছে ও, বডি আর্মার ও গানবেল্ট পরে নিল ওয়েটসুটের উপর। ফেটিগের পকেট হাতড়াতে গিয়ে বেরুল বেশ কিছু জিনিস। সেগুলোর ভিতর জরুরি জিনিস বলতে নাইট্রোজেন চার্জ ও নিনা ভিসারের রুপালি লকেট ও চেইন। এগুলো ওয়েটসুটের পকেটে রাখল রানা। দেরি না করে পিঠে ঝুলিয়ে নিল স্কুবা ট্যাঙ্ক।
তিনজনের জন্য তিনটি ট্যাঙ্ক। ভিতরে চার ঘণ্টা চলবার মত স্যাচিউরেটেড হিলিয়াম-অক্সিজেন মিক্স। ৯৮% হিলিয়াম, ২% অক্সিজেন। পাতাল-গুহায় নেমে যাওয়ার আগে বাড়তি চারটে ট্যাঙ্ক ভরে দিয়ে গিয়েছিল তিশা।
লাবা গিয়ার পরে নিল রানা, রাশেদ হাবিব সাহায্য করল মেরিকে।
সবার আগে পিঠে ট্যাঙ্ক ঝুলিয়ে নিতে পারল রানা, ডেকের উপর চোখ বোলাতে লাগল। ভারী কিছু দরকার। এমন কিছু, যেটা ওদেরকে দ্রুত নীচে নেবে।
যা খুঁজছে, তা পেতে দেরি হলো না।
জ্বলন্ত বি-ডেক থেকে খসে পড়বার সময় ক্যাটওয়াকের বড় এক অংশ এসে পড়েছিল ই-ডেকে, ওটা দৈর্ঘ্যে হবে দশ ফুট। নিরেট ইস্পাতের তৈরি। এখনও সঙ্গে রয়ে গেছে হ্যাণ্ডরেইল।
রাশেদ হাবিব তৈরি হয়ে যেতেই তাকে ডাকল রানা, দুজন মিলে ক্যাটওয়াকের অংশ নিয়ে এল পুলের পাশে। টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় ধাতব ডেকে বিশ্রী আওয়াজ হলো। দুই হাতে দুই কান চেপে রাখল মেরি।
আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে লিলির, লাফ দিয়ে উঠে রানার পাশে চলে এল; মনে হলো পোষা কুকুর, মালিকের সঙ্গে হাঁটতে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত।
লিলি আমাদের সঙ্গে আসবে? জানতে চাইল মেরি।
আশা করি, আসবে, বলল রানা। আমাদেরকে দেখিয়ে দেবে কোন পথে যেতে হবে।
কথাটা শুনে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মেরি, দ্রুত চলে গেল পুলের একদিকের দেয়ালের কাছে, ওখান থেকে নিয়ে এল হার্নেস ও হুক। দেরি না করে লিলির পেটের মাঝে হার্নেস আটকে দিল।
ওটা কী? অন্য কাজের ফাঁকে বলল রানা।
ভাববেন না, বলল মেরি।
তুমি কিন্তু খুব কাছে থাকবে, বলল রানা হাবিব এবং ও এসে দাড়িয়েছে পুলের ধারে, সামনে রেখেছে ক্যাটওয়াকের অংশ। মেরি পাশে এসে রেইলিং ধরবার পর রানা বলল, এবার পানিতে ক্যাটওয়াক ফেলব আমরা। রেইলিং ধরে থাকবে।
ওদের ভঙ্গি এমন, অলিম্পিকের তিন সাঁতারু একইসঙ্গে সুইমিং পুলের শেষমাথায় পৌঁছে গেছে। একবার মেরির কাঁধে হাত রাখল রানা, তারপর যখন বুঝল মেয়েটি পুরোপুরি প্রস্তুত, দুই হাতের তালু দিয়ে ঠেলতে লাগল ক্যাটওয়াকের অংশ।
হেইহা-হেইয়ো! চিকন স্বরে হুঙ্কার ছাড়ল রাশেদ হাবিব।
তিন সেকেণ্ড পর পানিতে ঝপাস করে নামল ক্যাটওয়াকের টুকরো। ওটার সঙ্গে একইসময়ে নেমে পড়েছে তিন সাঁতারু।
ক্যাটওয়াকের হ্যাণ্ডরেইল শক্ত করে ধরে রাখল ওরা।
বেশ গতি তুলে পানির ভিতর নেমে চলেছে ক্যাটওয়াক। ওরা তিনজন তীরের মত নীচের দিকে নামছে। পা আকাশের দিকে।
ওদের পিছনে অনায়াসে আসছে লিলি।
রানা ওর ফ্লাশলাইট জ্বেলে নিল। একবার কবজির সঙ্গে বাঁধা ডেপথ গজ দেখল।
দশ ফুট।
বিশ ফুট।
তিরিশ ফুট।
দ্রুত নেমে চলেছে ওরা। চারপাশ যেন সাদা কোনও দুনিয়া।
নামবার সময় বামদিকের সাদা বরফের দেয়ালে চোখ রেখেছে রানা। একটা গর্ত খুঁজছে ও। ওটা হতে পারে শর্টকাটের প্রবেশপথ। ওদিক দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় বরফ-সুড়ঙ্গে।
দেখতে না দেখতে এক শ ফুট নীচে পৌঁছে গেল ওরা। ওই পিল না খেলে এতক্ষণে ওদের রক্তে প্রচুর নাইট্রোজেন জমে যেত, তার মানেই করুণ ভাবে মরতে হতো।
দুই শ ফুট পেরুল ওরা।
তারপর তিন শ ফুট।
নীচের দিকে মুখ রেখে নেমে চলেছে ওরা। ক্রমেই আঁধার হয়ে আসছে চারপাশ। বেশি দূরে চোখ চলছে না।
চার শ ফুট।
পাঁচ শ ফুট।
এত দ্রুত নেমে চলেছে, নিজেরা বিশ্বাস করতে পারছে না।
ছয় শ ফুট! সাত শ ফুট।
আট শ…।
হঠাৎ ওটা দেখতে পেল রানা।
হ্যাণ্ড রেইলিং ছেড়ে দিন! নির্দেশ দিল। থাবা দিয়ে রাশেদ হাবিব ও মেরির হাত সরিয়ে দিল রেইলিং থেকে।
অন্য দুজন শুনতে পেয়েছে কথা, সরিয়ে নিয়েছে হাত। সবার নীচ থেকে বিদায় নিল ক্যাটওয়াক। দেখতে না, দেখতে হারিয়ে গেল অনেক নীচের সাগরে। আর দেখা গেল না। ওটাকে।
সাঁতরে বরফ-দেয়ালের পাশে চলে গেছে রানা।
ওখানে বড় একটা গোল গর্ত। মনে হলো কোনও ধরনের সুড়ঙ্গ, নেমে গেছে অনেক নীচের অন্ধকারে।
রানার পাশে চলে এসেছে লিলি, চট করে ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গের ভিতর, অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও উঁকি দিল।
দ্বিধায় পড়ে গেল রানা।
রাশেদ হাবিব বোধহয় ওর চোখে দ্বিধা দেখেছে, ইন্টারকমে বলল, ওদিকে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় আছে আমাদের?
না, নেই, বলল রানা। সুড়ঙ্গের ভিতরে আলো ফেলল। পরক্ষণে ঢুকে পড়ল ভিতরে।
এঁকেবেঁকে গেছে সরু সুড়ঙ্গ। কোথাও কোথাও খাড়া ভাবে নীচে নেমেছে। সবার আগে চলেছে রানা। ওর পিছনে মেরি ও শেষে রাশেদ হাবিব।
ওয়েট বেল্টের লিড ব্যবহার করে নীচে নামছে বলে কোনও সমস্যা হচ্ছে না ওদের। প্রায় নিঃশব্দে চলেছে।
কিছুক্ষণ পর আরও সতর্ক হয়ে উঠল রানা। চট করে ওকে পাশ কাটিয়ে গেছে লিলি। কয়েক সেকেণ্ড পর আর দেখাই গেল না।
ডেপথ গজ দেখে নিল রানা।
পুরো এক হাজার ফুট নেমে এসেছে ওরা।
ডাইভ টাইম এগারো মিনিট।
.
বিগবার্ড, গোল্ডেন লিডার বলছি। টার্গেট চলে এসেছে মিসাইলের আওতার, ভিতর। আবারও রিপিট করছি: টার্গেট এখন রেঞ্জের ভিতর। এবার অ্যাম্ৰাম মিসাইল ছুঁড়ব।
আপনারা তৈরি হলে মিসাইল ছুঁড়তে পারেন, গোল্ডেন লিডার।
ঠিক আছে, বিগবার্ড। …শশানো তোমরা, মিসাইল লক। করেছি। মিসাইল বে খোলা হয়েছে। টার্গেট বোধহয় জানে না আমরা হাজির হয়েছি। ঠিক আছে, গোল্ডেন লিডার বলছি, প্রথম মিসাইল ছুঁড়ছি!
স্কোয়াড্রন লিডার জয়স্টিকের ট্রিগারে চাপ দিল।
ফায়ার!
প্রায় একই মুহূর্তে দীর্ঘ পিছলা চেহারার এক এমআইএম১২০ অ্যাম্ৰাম মিসাইল বেরিয়ে এল মিসাইল বে থেকে। এফ-২২ বিমান থেকে বহু দূরে চলে গেল দেখতে না দেখতে।
.
হঠাৎ স্কোপে মিসাইল দেখল ব্রিটিশ ফাইটার পাইলট।
স্টেলথ এয়ারক্রাফটের বড় সমস্যা হচ্ছে, ওই বিমান রেইডার থেকে অদৃশ্য থাকলেও ওটার ডানা থেকে যে মিসাইল ছুঁড়ে দেয়া হয়, তা পরিষ্কার দেখা যায়। কাজেই এফ-২২, এফ-১১৭এ। স্টেথল ফাইটার বা বি-২এ স্টেলথ বম্বার পেটের ভিতর রাখে মিসাইল।
কিন্তু একবার মিসাইল ছুঁড়ে দিলে, তা পরিষ্কার দেখা যায়? রেইডারে। কাজেই এফ-২২ ফাইটার অ্যাম্ৰাম মিসাইল ছুঁড়ে দেয়ার পর মুহূর্তেই তার স্কোপে ই-২০০০ ফাইটার পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে সবই।
ব্রিটিশ পাইলট বুঝে গেছে, আর বড়জোর একমিনিট; তারপর মরতে হবে তাকে। সেজন্য ভয় নেই তার মনে, গলা উঁচু করে বলে উঠল, মেজর জেনারেল গুণ্ডারসন! মেজর জেনারেল গুণ্ডারসন! রিপোর্ট দিন!
ওদিক থেকে কেউ সাড়া দিল না।
এমন হওয়ার কথা নয়। গুণ্ডারসন ভাল করেই জানেন, রাত দশটা থেকে দশটা পঁচিশ মিনিটের ভিতর যোগাযোগ করতে হবে। এই পচিশ মিনিট সময়ে সোলার ফ্লেয়ার কেটে যাবে, তারপর আবারও রেডিয়ো যোগাযোগ বন্ধ হবে। সাড়ে সাতটার সময় রিপোর্ট দিয়েছেন গুণ্ডারসন। তাতে কোনও ভুল ছিল না। এখন কী হলো?
সেকেণ্ডারি ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করতে চাইল ব্রিটিশ পাইলট। ওদিক থেকে কোনও সাড়া নেই। সে সার্জেন্ট ববাউলসের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। না, তারও কোনও জবাব নেই।
মেজর জেনারেল গুণ্ডারসন! অন্ধ ফকির বলছি। আমার ওপর হামলা করা হয়েছে! আবারও বলছি, আমার ওপর হামলা হয়েছে! পরের তিরিশ সেকেণ্ডের ভিতর জবাব না দিলে ধরে নেব আপনি মৃত, সেক্ষেত্রে নির্দেশ পালন করব। অর্থাৎ, ওই স্টেশনের দিকে উড়াল পাখি ফায়ার করব।
মিসাইল লাইটের দিকে চাইল ব্রিটিশ পাইলট। টিপটিপ করছে ওটা। এরই ভিতর এজিএম-৮৮/এইচএলএন ক্রুজ মিসাইলের কো-অর্ডিনেটস তুলে দিয়েছে সে গাইডেন্স কমপিউটারে, ওটা মিসাইল ফেলবে উইলকক্স আইস স্টেশনের উপর।
মিসাইলের ডেজিগনেটার লেটারে পরিষ্কার দেখা গেল সব।
এজিএম মানে এয়ার-টু-গ্রাউণ্ড মিসাইল। ওই মিসাইলের এইচ অর্থাৎ হাই স্পিড, এল লেখা হয়েছে লং রেঞ্জের জন্য, অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য অর্থ এনএর।
ওটা দিয়ে বোঝানো হয়েছে ওই মিসাইল নিউক্লিয়ার।
তিরিশ সেকেণ্ড পেরিয়ে গেল। এখনও গুণ্ডারসনের সাড়া নেই।
মেজর জেনারেল গুণ্ডারসন! অন্ধ ফকির বলছি! লঞ্চ করছি ইরেজার… এখন! এক সেকেণ্ড পর ট্রিগার টিপে দিল ব্রিটিশ পাইলট। ডানা থেকে ছিটকে সামনে বাড়ল ক্রুজ মিসাইল।
রওনা হয়ে গেছে ওটা। দু সেকেণ্ড পেরুল না, ব্রিটিশ পাইলট হাত বাড়াল ইজেকশন লিভারের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে পৌঁছে গেছে আমেরিকান অ্যাম্ৰাম মিসাইল, ছুটে এসে গাঁথল ই-২০০০ ফাইটারের পিছনে, আকাশে নানা দিকে ছিটকে গেল জ্বলন্ত জঞ্জাল।
.
রাতের দিগন্তে উজ্জ্বল কমলা বিস্ফোরণ দেখছে আমেরিকান পাইলট, পরক্ষণে দেখল তার স্কোপে কোনও টিপটিপ করা বিন্দু নেই।
দলের কয়েকজন হৈ-হৈ করে ফুর্তির সুর তুলেছে।
দূর-দিগন্তে কমলা আগুনের গোলক–একবার দেখে নিল তাদের নেতা। সিল টিম, আমি গোল্ডেন লিডার। শত্রু মারা পড়েছে। রিপিট করছি, শত্রুকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। এবার নিশ্চিন্তে স্টেশনে ঢুকতে পারেন।
সিল হোভারক্রাফটের ভিতর, তাদের স্কোয়াড্রন লিডারের কথা বিস্ফোরিত হয়েছে স্পিকারে: শত্রু মারা পড়েছে। রিপিট করছি, শত্রুকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। এবার নিশ্চিন্তে স্টেশনে ঢুকতে পারেন।
সিল কমাণ্ডার বলে উঠল, ধন্যবাদ, গোল্ডেন লিডার। অল ইউনিট, সতর্ক থাকবে। হেলমেট মাইক ও মাইক্রোফোন ক্লোজড-সার্কিট চ্যানেলে নাও। এবার শুরু হচ্ছে স্টেশনের উপর অ্যাসল্ট।
রেডিয়ো বন্ধ করে দিল সে, ঘুরে দেখল নিজ লোকদের। ঠিক আছে, এবার চলো কোন্ শালার মাকে…
.
দক্ষিণ সাগর। এফ-২২ স্কোয়াড্রন লিডার এখনও তার ক্যানোপির ভিতর দিয়ে ব্রিটিশ ই-২০০০ বিমানের ধ্বংসস্তুপ দেখছে। কমলা আগুন ধীরে ধীরে নামছে পৃথিবীর দিকে, যেন সস্তা তারাবাজি জ্বলছে।
ওদিকে খুশি মনে চেয়ে আছে স্কোয়াড্রন লিডার, তার জানা নেই রেইডার স্ক্রিনে খুব ছোট একটা ফোটা দক্ষিণে চলেছে ওটা অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশে তিরিশ সেকেণ্ড পর ওটা খেয়াল করল সে।
আরেশশালা, ওটা কী? বলল সে।
আরেকজন বলে উঠল, হায় যিশু! ওই প্লেন পড়ার আগে একটা মিসাইল ছুঁড়েছে!
আবারও সিল টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইল স্কোয়াড্রন লিডার, কিন্তু ওদিক থেকে কেউ সাড়া দিল না। অ্যান্টার্কটিকার ওরা উইলকক্স আইস স্টেশনে লড়াইয়ের জন্য নিজেরদের ভিতর চালু করেছে ক্লোজড-সার্কিট চ্যানেল।
এর আধ মিনিট পর উইলকক্স আইস স্টেশনের প্রধান দরজা বিস্ফোরিত হলো, ভিতরের দিকে ছিটকে পড়ল সেটা। দুই সেকেণ্ড পর ঝড়ের গতিতে টানেলে ঢুকল সিল টিম সামনের দিকে ছুটে গেল অজস্র গুলি।
এটা টেক্সবুক-পারফেক্ট এন্ট্রি। কিন্তু সমস্যা: স্টেশনে জীবিত কেউ নেই!
২০.
একবার চট করে ডেপৃথ গজ দেখে নিল রানা।
পনেরো শ বিশ ফুট।
দলের অন্য দুজনকে নিয়ে নেমে চলেছে ও। কয়েক মিনিট পর হঠাৎ করেই সরু এক শর্টকাট টানেল দেখল। ওদিক দিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর চওড়া হলো বরফের মাঝের পথ।
আগে কখনও এদিকে আসেনি রানা, কিন্তু বুঝতে দেরি হলো কোথায় চলে এসেছে।
পানির নীচের ওই টানেলে, ওদিকের দেয়ালে একের পর এক গোলাকার মস্ত গর্ত। ব্যাসে হবে কমপক্ষে দশ ফুট। ওগুলোর কথা আগেই বলেছে নিনা ভিসার। পরে গুহার দিকে উঠবার সময় তিশাও জানিয়েছে। ওগুলো এলিফ্যান্ট সিলের গুহা। সবাইকে নিয়ে পাতাল বরফ-সুড়ঙ্গে পৌঁছে গেছে রানা। এখন উপরে উঠলে পাওয়া যাবে কালো বিমানের গুহা।
ঠিক জায়গায় এসেছে, স্বস্তির শ্বাস ফেলল রানা।
বরফ-টানেলে ঢুকে পড়েছে ওরা, এবার উপরে উঠতে শুরু করল। বরফ-দেয়ালের গর্তগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় শিরশির করে উঠছে ওদের মেরুদণ্ড।
অস্বস্তি নিয়ে সাঁতরে চলেছে ওরা। অবশ্য, রানা মোটামুটি ভাবে নিশ্চিত, এখন ওদের উপর হামলা করবে না এলিফ্যান্ট সিল। মনে মনে একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছে ও। একমাত্র তিশার দলের উপর হামলা করেনি ওই দানবীয় সিল। এর একমাত্র কারণ হতে পারে লাবা ট্যাঙ্ক। ওই লো-অডিবিলিটি ব্রিদিং গিয়ার প্রায় কোনও আওয়াজই করে না। উইলকক্স আইস স্টেশনের বিজ্ঞানী বা ব্রিটিশ কমাণ্ডোরা ওই জিনিস ব্যবহার করেনি। কাজেই তাদের উপর হামলা হয়েছে। রানার মনে হয়েছে, এলিফ্যান্ট সিলগুলো আসলে তিশা এবং ওর দলের কারও আওয়াজ পায়নি। সুতরাং হামলাও করতে পারেনি।
কিছুক্ষণ পর উপরে সারফেস দেখতে পেল রানা। মন থেকে এলিফ্যান্ট সিলের কথা মুছে ফেলল, আরেকবার দেখে নিল ডেপথ গজ: ১৪৯০ ফুট।
হাত-ঘড়ি দেখল। এখানে আসতে ওদের লেগেছে মাত্র আঠারো মিনিট। আগে বোধহয় কেউ এত দ্রুত দেড় হাজার ফুট নীচে নামেনি।
পানির ভিতর হঠাৎ করেই শুরু হলো একটা নিচু শিস।
ভাল করেই শুনতে পেয়েছে রানা, আড়ষ্ট হয়ে গেল। ধক করে উঠেছে বুকের ভিতর। বোধহয় ওর সব চিন্তা-ভাবনা ভুল ছিল!
পাশে লিলিকে দেখল রানা। ওটাও সব টের পেয়েছে।
কয়েক সেকেণ্ড পর দ্বিতীয় হুইসল বেজে উঠল। একটা লাফ দিল রানার হৃৎপিণ্ড। প্রকাণ্ড সব সিল জেনে গেছে ওরা এখানে…
হাবিব, তাড়াতাড়ি উঠুন! তাড়া দিল রানা, মেরি, জলদি! পাড়ে উঠতে হবে!
দ্রুত উঠতে শুরু করেছে রাশেদ হাবিব ও রানা। লিলির গায়ে চাপড় দিল মেরি, বিদ্যুৎ খেলে গেল ছোট সিলের দেহে। উপর দিক লক্ষ্য করে তীরের মত ছুটছে।
উপরে সারফেস দেখল রানা। অপূর্ব, কাচের মত পরিষ্কার, শান্ত, ও যেন দেখছে মসৃণ কোনও কাচের লেন্সের ভিতর দিয়ে।
চারপাশের শিস আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। হঠাৎ ঘেউ-ঘেউ শুরু হলো। বড় কোনও পুরুষ কুকুর এমন গর্জন করে। কিন্তু এই শব্দ আরও অনেক গুরুগম্ভীর।
পানির ভিতর চরকির মত ঘুরল রানা, পরক্ষণে সারফেসের দিকে চাইল।
আর ঠিক তখনই, নিথর সারফেস হাজার টুকরো হলো।
চারপাশ থেকে পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একের পর এক দানবীয় সিল। পানির নীচের গর্ত থেকে শিস দিচ্ছে আরও কয়েকটা। তারপর বেরিয়ে এল, ধাওয়া শুরু করল রানা ও তার দলের সবাইকে। তীক্ষ্ণ শিস আর ঘেউ-ঘেউ আওয়াজে ভরে উঠেছে নিমজ্জিত টানেল।
সারফেসের দিকে ছিটকে উঠছে লিলি। ওর হার্নেস ধরে আছে মেরি, যেন রোলার কোস্টারে চেপেছে। এঁকেবেঁকে ছুটছে লিলি, শরীর মুচড়ে এড়িয়ে যাচ্ছে এলিফ্যান্ট সিলের হাঁ করা চোয়াল। চারপাশ থেকে মেরি ও লিলিকে ধরতে চাইছে দানবগুলো।
হঠাৎ করেই এলিফ্যান্ট সিলগুলোর মাঝ দিয়ে উপরের সারফেস দেখল লিলি। ওর হার্নেস শক্ত করে ধরেছে মেরি, কয়েকটা দানবের সামান্য ফাঁক পেয়ে উঠে যেতে চাইল ছোট সিল।
ওদের দুজনকে চারপাশ থেকে কামড়ে ধরতে চাইছে। এলিফ্যান্ট সিলগুলো। কিন্তু অনেক বেশি দ্রুত লিলি, মেরিকে নিয়ে ছিটকে উঠল সারফেসে, পরক্ষণে উঠে গেল বরফের মেঝেতে। ডাঙায় ধপ্ করে আছাড় খেল মেরি, হাত থেকে ছুটে গেল হার্নেস। চোখের সামনে দেখল, পুল থেকে সরে যেতে শুরু করেছে লিলি।
নিজেও দেরি করল না মেরি, লাফ দিয়ে উঠে ঝেড়ে দৌড় দিল। ওর পিছনে থরথর করে কাপছে মেঝে। একবার দৌড়ের ফাঁকে কাঁধের উপর দিয়ে চাইল। পানির নীচ থেকে উঠে এসেছে বিশাল এক সিল, ডাঙায় উঠে তেড়ে আসছে ওর দিকে।
ছুটবার গতি আরও বাড়ল মেরির। আর ঠিক তখনই পা পিছলে পড়ে গেল।
জোরালো থপথপ আওয়াজ তুলে ওর দিকে ছুটে আসছে মাদী একটা এলিফ্যান্ট সিল।
একদম ফাঁকা জায়গায় ধরা পড়েছে মেরি। একবার অসহায় চোখে দেখল ধেয়ে আসা সিলটাকে। আর ঠিক তখনই বুম্! করে উঠল কী যেন!
এলিফ্যান্ট সিলের গোটা মুখ ভরে গেল তাজা রক্তে। চার ফ্লিপার নিয়ে আছড়ে পড়ল ওটা মেঝেতে! আর নড়ছে না। ওটার দেহের উপর দিয়ে দেখা গেল রানাকে। সে আছে পুলের মাঝে, তীর থেকে তিরিশ ফুট দূরে। উঁচু করে রেখেছে পিস্তল। এলিফ্যান্ট সিলের মাথার পিছনে গুলি করেছে।
ভয়ে প্রায় মূৰ্ছা যাওয়ার অবস্থা মেরির, তারই মধ্যে ভাবল ওর অদ্ভুত ভাল ওই ভিনদেশি বন্ধু তীরে উঠতে পারবে তো?
.
লবণাক্ত পানির পুকুরের আরেক দিকে গিয়ে উঠেছে রাশেদ হাবিব, পাশেই সরু কিনারা, সরতে যেতেই হঠাৎ চমকে গেল। ডান গোড়ালিতে শুরু হয়েছে তীব্র ব্যথা। মনে হলো কে যেন পা ধরে খপ্ করে টান দিল। আবারও হুড়মুড় করে পানির ভিতর পড়ল রাশেদ হাবিব।
পানির নীচে দেখল, ওর ডান পা মুখের ভিতর পুরে নিয়েছে এক এলিফ্যান্ট সিল। ওটা অন্যগুলোর চেয়ে আকারে অনেক ছোট, নীচের মাড়ি থেকে বেরিয়েছে দুটো শ্বদন্ত। ওই জিনিস আগেও দেখেছে হাবিব, বিশাল মর্দা সিলের অমন দাত ছিল।
বাম পায়ে জোর কিক ঝাড়ল হাবিব ছোট সিলের নাকে। ব্যখায় ঘোৎ করে উঠল ওটা, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল পা। এই সুযোগ পেয়ে আবারও সারফেসে ভেসে উঠল হাবিব।
এবার ভুল করল না, দুনিয়া-সেরা সাঁতারুর মত তীরের দিকে রওনা হয়ে গেল। দশ সেকেণ্ড পর চট করে ধরে ফেলল কাছের পাথর-খণ্ড, হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে পড়ল ডাঙায়। বড় একটা সিল তীরের খুব কাছে চলে এসেছিল, মস্ত একটা হাঁ করেও রাশেদ হাবিবের পা ধরতে পারল না।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করেছে হাবিব।
.
পুলের কিনারায় পৌঁছবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে রানাও। সাঁতারের ফাঁকে চারপাশের গুহা দেখে নিচ্ছে। পুকুরের এক ধারে মেরি, অন্য পারে রাশেদ হাবিব। কয়েক মুহূর্ত পর দেখতে পেল কালো বিমানটা, সাধারণ ফাইটার বিমানের চেয়ে বড়ই হবে। যেন বিশাল পাতাল-গুহার ভিতর চুপ করে বসে আছে নীরব এক শিকারি পাখি।
প্রাণপণে সাতরে চলেছে রানা, কিন্তু এক সেকেণ্ড পর সামনে দেখল সরে যেতে শুরু করেছে পানি। এক সেকেণ্ড পর সেখানে দেখা দিল প্রকাণ্ড এক চোয়াল। বিরাট হাঁ মেলেছে পালের সর্দার, মর্দা সিল! ওটা আড়াল করে দিয়েছে কালো বিমানকে।
এরই ভিতর জোর গতি তুলে রানার দিকে রওনা হয়ে গেছে মর্দা সিল, চলন্ত গাড়ির মত এসে তো দিল ওকে। ধাক্কা খেয়ে বুক থেকে ভু করে সব দম বেরিয়ে গেল রানার। বুঝবার আগেই তলিয়ে গেছে।
নীচের ওই দুই শ্বদন্ত আবার রানার বুকে গেঁথে দিতে চাইল মর্দা সিল। রানা বুঝে গেছে, খালি গা হলে সঙ্গে সঙ্গে এই আঘাতে মরত, ফুটো হয়ে যেত বুক, কিন্তু ওর তেমন কিছু হলো না। ওয়েটসুটের উপর বডি আর্মার পরে আছে ও।
মর্দা সিলের দুই দাঁতের হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে কেভলার ব্রেস্টপ্লেট।
পানির ভিতর ওকে পুঁতে ফেলতে চাইছে এলিফ্যান্ট সিল। ঠেলে নীচে নিয়ে চলেছে।
সরে যেতে চাইল রানা, কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। ব্রেস্টপ্লেটের বরাতে মরছে না, কিন্তু ওকে ছাড়ছেও না মর্দা সিল।
ওটার নাকের গুতো বুকে নিয়ে পানির ভিতর নামছে তো নামছেই রানা প্রকাণ্ড জানোয়ারের মুখ থেকে বলকে বেরিয়ে আসছে বড় সব বুদ্বুদ, উপরের দিকে যাচ্ছে।
জলদি কিছু করতে হবে, বুঝতে পারছে রানা
কিন্তু কী করবে?
পকেটে হাত পুরল, কাজে লাগতে পারে এমন কিছু আছে?
দুই সেকেণ্ড পর পেয়ে গেল যা চাইছে। ব্রিটিশদের আনা নাইট্রোজেন গ্রেনেড! এক সেকেণ্ড ওটা দেখে নিল রানা; ভাবছে, কাজ করবে তো? আবার ভাবল, করবে না কেন!
হ্যাঁচকা টানে গ্রেনেডের পিন খুলে ফেলল ও, ভয়ঙ্কর বোমা পুরে দিলদানবীয় সিলের হাঁ করা চোয়ালের ভিতর।
পরক্ষণে দেরি করল না, সিলের দুই দাঁত ধরে নিজেকে একপাশে সরিয়ে নিতে চাইল। এক সেকেণ্ড পর সাঁৎ করে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল মর্দা সিল নীচের দিকে।
দুই সেকেণ্ড পর ওটা টের পেল, সাধের শিকারকে হারিয়েছে। দেরি না করে ঘুরতে শুরু করেছে, এমন সময় ফাটল নাইট্রোজেন গ্রেনেড।
বিস্ফোরিত হলো পুরুষ এলিফ্যান্ট সিলের গোটা মাথা। পরক্ষণে ইমপ্লোশনে ফিরতি পথে রওনা হলো সব। ঠিক তখন অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল।
মৃত সিলের দেহ থেকে বরফের একটা স্রোত ছড়িয়ে পড়ল। চারপাশে।
প্রথমে রানা বুঝল না ওটা কী, পরক্ষণে টের পেল। গ্রেনেডের লিকুইড নাইট্রোজেন পানির ভিতর তীব্র গতি তুলে ছড়িয়ে পড়ছে, মুহূর্তে বরফ করে দিচ্ছে পানিকে।
বরফের স্রোত ছুটে আসছে রানার দিকে। ক্রমেই আরও ছড়িয়ে পড়ছে, যেন কোনও জীবিত প্রাণী, পানির ভিতর বড় হয়ে উঠছে।
বিস্ফারিত চোখে ওদিকে চাইল রানা। টের পেল, ওই স্রোত ওকে ঘিরে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে মরবে।
মনে মনে বলল, পালা রে রানা, জান নিয়ে পালা!
ঠিক তখন কী যেন স্পর্শ করল ওর কাঁধ। ঘুরে দাঁড়াল রানা।
লিলি!
খপ করে ওটার হার্নেস ধরল রানা, পরক্ষণে ওকে নিয়ে তীব্র গতি তুলতে চাইল লিলি।
ওদের পিছনে ধেয়ে আসছে হিম শীতল বরফ-দেয়াল, ছড়িয়ে পড়ছে পানির ভিতর, গতি এতই দ্রুত যে অবিশ্বাস্য মনে হয়।
সর্বশক্তি দিয়ে সাঁতরে চলেছে লিলি, টেনে নিয়ে যাচ্ছে রানাকে। কিন্তু রানার ওজন মাঝারি সিলের কমপক্ষে দ্বিগুণ, ছোট্ট সিল এখন আর জোরে ছুটতে পারছে না।
জমাট বরফের মৃত্যু এগিয়ে আসছে ওদের দিকে!
লিলি ও রানার পিছু নিয়েছে আরেকটা এলিফ্যান্ট সিল। ওটা বুঝেছে, প্রায় বিনা পরিশ্রমে খাবার মিলবে। কিন্তু ওটাকে ধরে ফেলল বরফের দেয়াল, মুহূর্তে নিজের শীতল পেটের ভিতর চালান দিল মাদী সিলকে।
সারফেসের দিকে উঠছে লিলি, পথের মাঝে এড়িয়ে চলেছে এলিফ্যান্ট সিলগুলোকে। সারফেস দেখতে পেয়েছে লিলি, রানাকে টেনে নিয়ে চলল ওদিকে।
ওদের পিছনে থেমে গেছে বরফের দেয়াল, এখন আর ছড়িয়ে পড়ছে না গ্রেনেডের নাইট্রোজেন। লিলি ও রানার পিছনে পড়ে রইল শীতল মৃত্যু।
ভুস করে পানির উপর ভেসে উঠেছে লিলি, এখনও ওর হার্নেস ধরে আছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বরফ-মেঝেতে উঠে এল লিলি, ওটার টান খেয়ে ডাঙায় উঠল রানাও। উপুড় হয়ে পড়ে আছে, চট করে চিত হলো। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল পানি থেকে উঠে এসেছে আরেকটা এলিফ্যান্ট সিল!
থপথপ আওয়াজ তুলে ওর দিকে ছুটে আসছে!
শরীর গড়িয়ে দিল রানা, মাত্র দুই সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, সেখানে এসে ধুপ করে হামলে পড়ল এলিফ্যান্ট সিল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, ঘুরেই অন্য দুজনকে খুঁজল ওর চোখ।
মেজর! এদিকে! এদিকে! জলদি! শুনল নিনা ভিসারের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ।
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রানা, ওর চোখ গিয়ে পড়ল সরু এক ফাটলের উপর। পঞ্চাশ গজ দূরে ওটা! ভিতর থেকে হাত নাড়ছে নিনা ভিসার।
এরই ভিতর মেরি, রাশেদ হাবিব ও বাচ্চা-সিল লিলি ওদিকে ছুটতে শুরু করেছে। এবার আর দেরি করল না রানা, প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটতে শুরু করল। দৌড়ের ফাঁকে দেখল, সরু ফাটলের ভিতর গড়িয়ে চলে গেল মেরি। কয়েক সেকেণ্ড পর ওর পিছু নিল লিলি। তার পাঁচ সেকেণ্ড পর উধাও হলো রাশেদ হাবিব।
কানের ভিতর হঠাৎ স্ট্যাটিকের আওয়াজ পেল,রানা। তারপর ভেসে এল জোরালো কণ্ঠ: …আপনি কি ভিতরে? মিস্টার রানা, সাড়া দিন!
ওই কণ্ঠ রন হিগিন্সের।
পানিতে ঝাপটা-ঝাপটি করবার সময় কখন যেন সুইচ অন হয়ে গেছে হেলমেটের।
কী, মেজর হিগিন্স?
হায় যিশু! আপনি ছিলেন কোথায়? গত দশ মিনিট ধরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছি।
অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কিছু বলবেন?
স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসুন। দেরি করবেন না।
এখন আর তা সম্ভব নয়, বলল রানা। ছুটে চলেছে।
আপনি বুঝতে পারছেন না, মিস্টার রানা। একটু আগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এয়ার ফোর্স। এখান থেকে আড়াই শ নটিক্যাল মাইল দূরে একটা ব্রিটিশ ফাইটারকে ফেলে দিয়েছে আমাদের ছয়টা এফ-২২ যুদ্ধবিমান। কিন্তু ওই শত্রু বিমান পড়ে যাওয়ার আগে মিসাইল ছেড়েছে। এক মুহূর্ত থেমে বলল রন হিগিন্স, ওই মিসাইল আসছে উইলকক্স আইস স্টেশন লক্ষ্য করে। স্যাটালাইট স্ক্যান থেকে জানা গেছে, ওই মিসাইল রেডিয়েশন ছড়াচ্ছে। ওটা একটা নিউক্লিয়ার মিসাইল।
কথাটা শুনে চমকে গেছে রানা, কিন্তু দৌড়ের গতি কমল না। ফাটলের সামনে পৌঁছে গেল, শুয়ে পড়ে শরীর গড়িয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। তৈরি ছিল না, পাঁচ ফুট নীচে ধুপ করে পড়ল।
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল, অন্য কারও দিকে খেয়াল নেই। থমথমে কণ্ঠে বলল, ওটা কখন আসছে?
দুই শ তেতাল্লিশ মাইল দূরে ঘণ্টায় চার শ মাইল গতি তুলে আসছে। ওরা বলছে, আপনারা মাত্র সাইত্রিশ মিনিট পাবেন। তারপর ডেটোনেশন হবে। কিন্তু সেটা নয় মিনিট আগের হিসাব। মিস্টার রানা, শুরু থেকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছি, কিন্তু সাড়া দেননি। আপনি মাত্র আটাশ মিনিট পাবেন, তারপর উইলকক্স আইস স্টেশনে এসে পড়বে তাজা নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। আপনি আটাশ মিনিট পাচ্ছেন।
চট করে ঘড়ি দেখে নিল রানা।
সরি, মিস্টার রানা। আমাকে সরে যেতে হচ্ছে। আমার লোকদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেতে হবে। দুঃখিত, কিন্তু আপনাকে আর কোনও সাহায্য করতে পারছি না।
ঠিক আছে, খবরটা জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আরেকবার ঘড়ি দেখল রানা।
রাত দশটা বত্রিশ মিনিট।
আর মাত্র আটাশ মিনিট, তারপর রাত ঠিক এগারোটার সময় এই স্টেশনের উপর পড়বে নিউক্লিয়ার মিসাইল।
সবাই জড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে নিনা ভিসার, মেরি, রাশেদ হাবিব, লিলি। তিশাও আছে, এক মুহূর্ত পর ওকে দেখল রানা। মেয়েটা বরফ-মেঝের উপর বসে আছে। ওর চোখে পড়ল, বেচারির কাঁধে বিশ্রী একটা লাল ক্ষত। প্রায় ছুটে তিশার সামনে চলে গেল রানা।
জনি ওয়াকার? আস্তে করে বলল।
মাথা দোলাল তিশা।
সে কোথায়? জানতে চাইল রানা।
মারা গেছে। এলিফ্যান্ট সিলের কবলে পড়েছিল। কিন্তু আগেই গোলাম মোরশেদকে খুন আর আমাকে আহত করেছে।
এখন কেমন বোধ করছ?
খুব খারাপ,মুখ কুঁচকে ফেলেছে তিশা।
এবার অন্য ক্ষতটা দেখতে পেল রানা। পেটের এক পাশে গুলি খেয়েছে তিশা। বডি আর্মার থেকে একটু দূরে বুলেট গেঁথেছে, দেখে মনে হলো খারাপ ধরনের ক্ষত। পেটে গুলি লাগলে খুব ধীরে ধীরে অনেক ব্যথা পেয়ে মরতে হয়।
একটু ধৈর্য ধরো, বলল রানা। আমরা তোমাকে এখান থেকে…
তিশাকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে রানা। মেয়েটা জোরে ঘষা খেল ওর পায়ে।
রানার গোড়ালি পকেট থেকে কী যেন টুন করে মেঝের উপর পড়ল।
একটা রুপালি লকেট ও চেইন।
নিনা ভিসারের দিয়ে যাওয়া জিনিস। পাতাল-গুহায় আসবার আগে রানাকে দিয়েছিল। উল্টো হয়ে পড়েছে লকেট, ওটা মেঝে থেকে তুলতে যেতেই রানা দেখল, ওখানে খোদাই করা কয়েকটা অক্ষর:
আমাদের প্রিয় কন্যা
নিনা অস্টিনকে
তোমার তেইশতম জন্মদিনে
বুকের ভিতর ঠাণ্ডা বরফের মত অনুভূতি হলো রানার। চট করে পকেট থেকে রবিন কার্লটনের ই-মেইলের কপি বের করল।
আইসিজি গুপ্তচরদের তালিকা পড়তে শুরু করেছে। একটা লাইনের উপর স্থির হলো ওর চোখ।
অস্টিন, নিনা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
ঝট করে নিনা ভিসারের দিকে চাইল রানা। চাপা স্বরে বলল, বিয়ের আগে আপনার কুমারী নাম কী ছিল, নিনা?
নিচু ধাতব আওয়াজ হলো। এইমাত্র একটা অস্ত্র কক করা হয়েছে। প্রায় একই সময়ে দক্ষতার সঙ্গে অস্ত্র তাক করেছে নিনা ভিসার।
একফুট দূরে: ধরেছে পিস্তল, রানার মাথা লক্ষ্য করে। অন্য হাতে বের করে আনল মোরশেদের হেলমেট হেডসেট, ওদিকে না চেয়েই বেল্টের ক্লিপের চ্যানেল পাল্টে নিল। হেডসেটে বলে উঠল, সিল টিম, আমি নিনা অস্টিন। যোগাযোগ করুন।
জবাব নেই কারও। ভুরু কুঁচকে ফেলল নিনা।
সিল টিম, আমি নিনা অস্টিন। সাড়া দিন।
এখন আর উপরে কেউ নেই, নিনা, বলল রানা। দুই হাতে সাবধানে তিশাকে ধরে রেখেছে। সবাই চলে গেছে। স্টেশন এখন ফাঁকা। একটা ক্রুজ মিসাইল আসছে। ওটা নিউক্লিয়ার, নিনা। অনেক আগেই ভেগে গেছে তোমার সিল টিম। এবার আমাদেরকেও সরে যেতে হবে, নইলে মরব।
কথাটা মাত্র শেষ করেছে রানা, এমন সময় নিনা ভিসারের হেডসেটে কর্কশ এক কণ্ঠ বলে উঠল: নিনা অস্টিন; আমি সিল কমাণ্ডার মর্গান ট্রোকি। রিপোর্ট করুন।
প্রচণ্ড তিক্ত হয়ে গেল রানার মন একবার ঘড়ি দেখল।
১০:৩৫
মাত্র পঁচিশ মিনিট বাকি।
রানার জানা ছিল না, হামলা শুরু করবার সময় সিল টিম স্টেশনের ভিতর ক্লোজড-সার্কিট চ্যানেল ব্যবহার করেছে। কাজেই ওই লোকগুলো জানে না স্টেশন উড়িয়ে দেবে নিউক্লিয়ার মিসাইল।
নিনা অস্টিন বলল, সিল কমাণ্ডার, আমার সঙ্গে এই গুহার ভিতর বাংলাদেশি দুই শত্রু আছে। আসলে তিনটা। এদেরকে গ্রেফতার করেছি।
কিছুক্ষণ পর নীচে নামব আমরা, নিনা। আপনাকে প্রয়োজনে খুন করবার অনুমতি দিলাম। সিল টিম, আউট।
নিনা, এসব কী করছ? বলে উঠল রাশেদ হাবিব।
চুপ, শুয়োর! ধমকে উঠল নিনা অস্টিন, তার অস্ত্রের নলের ডগা লাগল হাবিবের নাকে। ওদিকে গিয়ে দাঁড়াও। ইশারা করল সে।
হাবিব ও মেরি চলে এল সুড়ঙ্গের আরেক দিকে, রানার পাশে।
রানা খেয়াল করেছে, নিনা অস্টিন আত্মবিশ্বাস ও কর্তৃত্বের সঙ্গে অস্ত্র ধরেছে। আগেও অস্ত্র ব্যবহার করেছে সে।
তুমি কোথা থেকে এসেছ, নিনা? জানতে চাইল রানা। আর্মি, না নেভি? .
এক মুহূর্ত রানাকে দেখল মহিলা, তারপর বলল, আর্মি।
কোন্ সেকশন থেকে?
রেঞ্জার্স ফোর্স। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পাঠানো হয় আমাকে। প্রতিটা পরীক্ষা খুব ভালভাবে শেষ করে, সেখানেই পড়াতে শুরু করি।
শিক্ষা দেয়ার কাজ শুরু করবার পর আইসিজি যোগাযোগ করো, না আগে?
আগেই, মৃদু হাসল নিনা। অনেক আগে। মিটার রানা, আইসিজি আমাকে পড়াবার কাজ দেয়। পরে বলা হয় আবারও আর্মিতে যোগ দিতে হবে। ওরা আমার সারাজীবনের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করেছে। তারপর আবার পাঠিয়ে দিয়েছে ইউনিভার্সিটিতে।
কী কারণে পাঠাল?
ওরা জানতে চেয়েছিল ওখানে কী ঘটছে। বিশেষ করে আইস কোর রিসার্চ বিষয়ে ওদের আগ্রহ ছিল। মরিস ভিসারের মত লোক বরফের ভিতর নানান গ্যাস পাচ্ছিল, আর এসব কেমিকেল গ্যাস সম্পর্কে ওদের জানার দরকার ছিল। শত শত মিলিয়ন বছর আগের ভয়ঙ্কর টক্সিক পরিবেশের গ্যাস পাওয়া গেছে। কার্বন মনোক্সাইড ভ্যারিয়েন্টস, পিয়োর ক্লোরিন গ্যাস মলিউকিউলার আইসিজি এসব বিষয়ে জানবে না? এসব গ্যাস যুদ্ধে ব্যবহার করা যায়। কাজেই এই ক্ষেত্রে কাজে নামলাম আমি, কিছু দিনের ভিতর চোখে পড়ে গেলাম মরিস ভিসারের।
তথ্য পাওয়ার জন্য ওঁকে বিয়ে করো তুমি? বলল হাবিব।
সুড়ঙ্গের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছে মেরি, মুখ শুকিয়ে গেছে।
সারাজীবন যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি, বলল নিনা। মরিসও বিয়েতে গররাজি ছিল না।
ওঁকে খুন করেছ? জানতে চাইল হাবিব। ওই গাড়ি দুর্ঘটনা?
না, আমি ওকে খুন করিনি, বলল নিনা। আইসিজি। ঠিকই ধরেছ, ওটা সাধারণ দুর্ঘটনা ছিল না। একে তুমি নিয়তি বা ভাগ্য বলতে পারো। সে মরে যাওয়ায় আমার ঢের সুবিধা হয়েছে।
চার্লস মুনকে খুন করেছ? জানতে চাইল রানা।
থমকে গেল নিনা, তারপর বলল, হ্যাঁ। এটা আমি করেছি
কুত্তির বাচ্চি, নিচু স্বরে গাল দিল হাবিব।
কথাটা পাত্তা না দিয়ে হাসল নিনা। চার্লস মুন মিথ্যাবাদী আর চোর ছিল। লোকটা হাবিবের পাওয়া তথ্য নিজের বলে চালাবে ভেবেছিল। তাতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না কিন্তু হাবিব যখন পনেরো শ ফুট নীচে ধাতু পেল, আর মুন আমাকে বলল, এই তথ্যটাও সে ছেপে দেবে সায়েন্টিফিক জার্নালে তখন বুঝলাম, এটা হতে দিতে পারি না। আগে জানাতে হবে আইসিজিকে।
আগে জানাতে হবে, তাই না? তিক্ত শোনাল রানার কণ্ঠ।
আমাদের কাজ সবচেয়ে আগে সবকিছু জানিয়ে দেয়া।
কাজেই তুমি চার্লস মুনকে খুন করলে, বলল রানা। সাগরের সাপের বিষ ব্যবহার করলে। এমন ব্যবস্থা করলে, যাতে সবাই মনে করে রাশেদ হাবিব খুনি।
বেঁটে বিজ্ঞানীর দিকে চাইল নিনা। দুঃখিত, হাবিব, কিন্তু খুব সহজেই তোমাকে ফাঁসিয়ে দেয়া গেছে। মুনের সঙ্গে সারাক্ষণ ঝগড়া করতে। আর সে রাতে যখন ঝগড়া করলে, এরপর ওই সুযোগ আর ছাড়তে পারি?
চট করে ঘড়ি দেখে নিল রানা। নিনা, কথাটা শোনো: জানি তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে চাইবে না, কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নইলে সবাই মরব। একটা নিউক্লিয়ার মিসাইল আসছে আমাদের দিকে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে…
কোনও মিসাইল আসছে না, ধমকে উঠল নিনা। সত্যি যদি আত, সিল টিম এখানে থাকত না।
রানা আরেকবার ঘড়ি দৈখল:
১০:৩৬
হতাশ লাগছে ওর। অনেক সময় নষ্ট করে ফেলছে ওরা। নিনা অস্টিনের হাতের পুতুল হয়ে গেছে। অন্তত সাত ফুট দূর থেকে পিস্তলের মুখে ওদেরকে আটকে রাখবে বদ মেয়েলোকটা, তাৱপর একটা নিউক্লিয়ার মিসাইল এসে শেষ করবে ওদের সবাইকে।
আবারও ঘড়ি দেখল রানা।
স্ক্রিনে এইমাত্র ১০:৩৭ মিনিট হলো।
রানার জানার কথা নয়, ব্রিটিশ কমাণ্ডার, মেজর জেনারেল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন উইলকক্ট আইস স্টেশনকে অর্ধচন্দ্রের মত ঘিরে ফেলেছিল ৮০/২০ ট্রাইটোনাল চার্জ দিয়ে, তার উদ্দেশ্য ছিল এই স্টেশনকে আইসবার্গ বানিয়ে দেয়া।
আজ রাত আটটা সাঁইত্রিশ মিনিটে ডাইভিং বেলের ভিতর ডেটোনেশন ইউনিটে দুই ঘণ্টার জন্য টাইমার সেট করেছে গুণ্ডারসন।
একইসময়ে আঠারোটা ট্রাইটোনাল চার্জ বিস্ফোরিত হয়েছে। এর ফলে চারপাশে শুরু হয়েছে প্রলয়। তিন শ ফুটি তুষারের গেইজার আকাশে উঠল। কান ফাটানো মড়মড় আওয়াজ উঠল বরফের প্রান্তরে। আইস শেলফে অর্ধেক চাঁদের মত একটা বড় জায়গা জুড়ে ফাটল ধরেছে। তারপর বিকট মড়াৎ আওয়াজ তুলে স্টেশন ও নীচের সব কিছু নিয়ে আইস .শেলফ থেকে সরে গেল এদিকের বরফ-জমি। উইলকক্স আইস স্টেশন নিয়ে তিন কিউবিক কিলোমিটার বরফ-খণ্ড সরে গেল সাগরে। কিন্তু এত বড় হিমশৈলকে খুব একটা নাড়াতে পারল না ক্ষিপ্ত চল্লিশ ফুটি ঢেউ।
এদিকে পাতাল-গুহার ভিতর দুনিয়া যেন কাত হয়ে গেছে। চারপাশের দেয়াল ও ছাত থেকে ঝরঝর করে পড়ছে বরফের চাই। আঠারোটা ট্রাইটোনাল চার্জ বিস্ফোরণের আওয়াজটা প্রচণ্ড বজ্রপাতের মত শোনা গেল।
রানা প্রথমে ভাবল, স্টেশনের উপর নিউক্লিয়ার মিসাইল পড়েছে। মস্ত ভুল তথ্য দিয়ে গেছে মেজর রন হিগিন্স, আরও আধঘণ্টা আগেই রওনা হয়েছে ওই মিসাইল। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ওই ভয়ঙ্কর আওয়াজ অন্য কোনও কিছুর। নিউক্লিয়ার বোমা পড়লে এতক্ষণে সবাই ওরা মরত।
হঠাৎ আরও কাত হয়ে গেল খাটো সুড়ঙ্গ। ভারসাম্য হারিয়ে টলে পড়ল নিনা অস্টিন। আর এই সুযোগটা নিল রাশেদ হাবিব, . এক লাফে সামনে বেড়েই ট্যাকল করল মেয়েটাকে। পা পিছলে বরফের মেঝেতে ধুপ করে পড়ল দুজন। কিন্তু পরের সেকেণ্ডে হালকা হাবিবকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলল নিনা লাথি মেরে।
এখনও তিশাকে ধরে আছে রানা, বেচারিকে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আস্তে করে বসিয়ে দিল ও, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই পা বাড়াল নিনা অস্টিনের দিকে। ওই একই সময়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল বিশ্বাসঘাতিনী মেয়েটা, ঘুরেই অস্ত্র তাক করল রানার কপালে।
দুঃখিত, মিস্টার রানা, দাঁতে দাঁত চিপে বলল নিনা, তোমাকে ভাল লেগেছিল।
চারপাশের নানা শব্দের ভিতর খাটো সুড়ঙ্গে কান ফাটানো আওয়াজে গর্জে উঠল পিস্তল।
২১.
নিনা অস্টিনের বুক থেকে ফোয়ারার মত রক্ত ছিটকে বেরুতে দেখেছে রানা। কাঁচাগোল্লা হয়ে গেছে মেয়েটার দুই বিস্ফারিত চোখ, হাঁটু ভেঙে ধুপ করে বসল, ওখান থেকে মেঝেতে শুয়ে পড়ল, মৃত।
ডেযার্ট ঈগলের নল থেকে এখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে, রানার ঊরুতে ঝুলন্ত হোলস্টারে পিস্তলটা রেখে দিল তিশা। অস্ত্র বের করবার সুযোগ হয়নি রানার, কিন্তু সুযোগ ছিল তিশার, হাঁটু গেড়ে বসে আছে ও।
অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছে মেরি, হাঁ হয়ে গেছে মুখ। চট করে ওর পাশে চলে গেল রানা, নরম স্বরে বলর, ঠিক আছ তো? তোমার মা…
ও আমার মা ছিল না, বড় শান্ত স্বরে বলল মেরি।
আমরা না হয় এ নিয়ে পরে আলাপ করব? বলল রানা। বাইশ মিনিট পর গোটা এলাকা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
আস্তে করে মাথা দোলাল মেরি।
মিস্টার হাবিব, বলল রানা, চারপাশের দেয়াল থরথর করে কাঁপতে দেখছে। জানেন কী ঘটছে?
না, বুঝতে পারছি না, বলল রাশেদ হাবিব।
কথাটা মাত্র শেষ করেছে, হঠাৎ কাত হয়ে গেল সুড়ঙ্গ, ডেবে গেল দশ ইঞ্চি।
মনে হচ্ছে মেইন ল্যাণ্ড থেকে খসে পড়েছে আইস শেলফ, বলল হাবিব। এটা আইসবার্গ হয়ে উঠেছে।
আইসবার্গ… বিড়বিড় করল রানা। মগজ খাটাতে শুরু করেছে। কয়েক সেকেণ্ড পর হাবিবের দিকে চাইল। সিলগুলো এখনও রয়ে গেছে গুহার ভিতর? .,
ফাটলের ভিতর দিয়ে উঁকি দিল হাবিব। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, না, নেই। পালিয়েছে।
আবার তিশার সামনে থামল রানা, পাঁজাকোলা করে মেয়েটিতে তুলে নিল, চলে এল ফাটলের সামনে। আমি ধারণা করেছি ওরা থাকবে না। পালের সর্দার মরেছে। ওরা এখন তাকে খুঁজতে গেছে। …
আমরা এখান থেকে বেরুব কী করে? জানতে চাইল হাবিব।
ফাটল দিয়ে তিশাকে বাইরে ঠেলে দিল রানা, মুখ ফেরাল রাশেদ হাবিবের দিকে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে।
আমরা উড়ে বেরুব। মেরি, এসো, এবার বেরুতে হবে।
মেরি চলে আসতেই ওকে ফাটলের কাছে তুলে ধরল রানা।
মেয়েটা ওদিকে চলে যেতেই এবার প্রধান গুহায় উঠল হাবিব। সবার শেষে রানা।
বিশাল, কালো বিমান রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে পাত্তালগুহার মাঝে। নীচে নেমেছে ঈগলের চঞ্চুর মত ওটার নাক। পিছনে কনকর্ডের ডানার মত সংযুক্ত ডানা। গুহার ছাত থেকে পড়ছে বরফ-খণ্ড, ফিউজেলাজে পড়ে নানা দিকে ছিটকে যাচ্ছে।
মেরি ও রাশেদ হাবিবকে এগুতে ইশারা করেছে রানা, নিজে তিশাকে দুই হাতে তুলে পিছু নিয়েছে। থরথর করে কাঁপছে মেঝে। দুই মিনিট পেরুবার আগেই কালো বিমানের পেটের নীচে পৌঁছে গেল ওরা।
তিশা আঙুল তুলে কিপ্যাড দেখিয়ে দিল। এই যে কিপ্যাড।
সবুজ রঙে জ্বলজ্বল করছে এন্ট্রি কোড স্ক্রিন:
২৪১৫৭৮১৭——–
এণ্টার অথারাইযড এন্ট্রি কোড
তোমরা কেউ কোড বুক পেয়েছ? তিশাকে প্রশ্ন করল রানা।
না, কোড ভাঙার চেষ্টা করছিল নিনা অস্টিন, কিন্তু মনে হলো জানে না কিছুই।
তার মানে কোড আমরা জানি না, বলল রানা।
না, জানি না, সায় দিল তিশা।
এখন? বলল রাশেদ হাবিব।
রানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেরি, চোখ রেখেছে স্ক্রিনে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলে উঠল, আরে, এটা তো ফিবোনাচ্চি নাম্বার।
কী নাম্বার? একই সময়ে জানতে চাইল রানা ও তিশা।
গম্ভীর মুখে কাঁধ ঝাঁকাল মেরি ভিসার। ২৪১৫৭৮১৭। এটা ফিবোনাচ্চি নাম্বার।
সেটা কী? জানতে চাইল রানা।
ফিবোনাচ্চি এক ধরনের সিকোয়েন্সের নাম্বার, বলল মেরি। এই সিকোয়েন্সে প্রতিটা সংখ্যা হয় আগের দুটো সংখ্যার যোগ ফল। অবাক চোখে ওকে দেখছে অন্যরা। আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন। কারও কাছে কলম আর কাগজ আছে?
হ্যাঙারে পাওয়া ডায়েরি পকেট থেকে বের করে দিল তিশা। হাবিবের কাছে কলম আছে। প্রথমে ওটা থেকে কালো রঙের পানি বেরুল, তারপর কাজ করতে লাগল কালি। ডায়েরিতে সংখ্যা লিখতে শুরু করেছে মেরি।
কাজের ফাঁকে বলল, এই সিকোয়েন্স হয় এরকম: ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩। এভাবে বাড়তে থাকে সংখ্যা। আগের দুটো সংখ্যা যোগ দিয়ে বের হয় তৃতীয় সংখ্যা। তারপর দ্বিতীয় আর তৃতীয় সংখ্যা থেকে বের হয় চতুর্থ সংখ্যা। দাড়ান, কোড বের করতে আমার একমিনিট লাগবে… অঙ্ক কষতে শুরু করেছে মেধাবী মেয়েটি।
রানা একবার দেখে নিল ঘড়ি: ১০:৪০
আর মাত্র বিশ মিনিট, তারপর আসছে নিউক্লিয়ার মিসাইল।
ডায়েরিতে হিসাব কষছে মেরি। রানাকে হাবিব বলল, আপনি এখান থেকে বিমান নিয়ে বেরুবেন কী করে?
আনমনে বলল রানা, ওদিকের পুকুরের ভিতর দিয়ে। তার আগে গুহার আকাশে ভেসে উঠতে হবে।
কী বললেন? অবাক চোখে রানাকে দেখল হাবিব।
কিন্তু এখন আর তার দিকে মন নেই রানার। মেরির হাতের ডায়েরি দেখছে। সংখ্যাগুলো পড়তে শুরু করেছে:
০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১১৪, ২৩৩, ৩৭৭, ৬১০, ৯৮৭, ১,৫৯৭, ২,৫৮৪, ৪,১৮১, ৬,৭৬৫, ১০,৯৪৬, ১৭,৭১১, ২৮,৬৫৭, ৪৬,৩৬৭, ৭৫,০২৫, ১,২১,৩৯৩, ১,৯৬,৪১৮, ৩,১৭,৮১১, ৫,১৪,২২৯, ৮,৩২,০৪০, ১৩,৪৬,২৬৯, ৩৫,২৪,৫৭৮, ৫৭,০২,৮৮৭, ৯২,২৭,৪৬৫, ১,৪৯,৩০,৩৫২, ২,৪১,৫৭,৮১৭
তা হলে আমরা পেলাম আপনার এই সংখ্যা, ক্লাস টিচারের মত ভঙ্গি করে বলল মেরি: ২,৪১,৫৭,৮১৭।
সিকোয়েন্সের শেষের অন্য সব সংখ্যা? জানতে চাইল রানা। আবারও অঙ্ক কষতে শুরু করল মেরি। ৩,৯০,৮৮,১৬৯, ৬,৩২,৪৫,৯৮৬… কিছুক্ষণ পর নিশ্চিত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, এটাই।
ডায়েরি নিল রানা, সংখ্যাগুলোর দিকে চাইল। সবমিলে মোলোটা সংখ্যা। কিপ্যাডে মোলাটা শূন্যস্থান। কিপ্যাডের বাটন এবার টিপতে শুরু করল রানা। কাজটা শেষ হতেই স্ক্রিনে বিঈপ! আওয়াজ হলো।
স্ক্রিনে এখন চব্বিশটা সংখ্যা:
২৪১৫৭৮১৭৩৯০৮৮১৬৯৬৩২৪৫৯৮৬
এন্ট্রি কোড অ্যাকসেপটেড। ওপেনিং দ্য শ্যাডো
অদ্ভুত সুন্দর কালো বিমানের ভিতর থেকে ইলেকট্রনিক ভ্রম আওয়াজ হলো। রানা দেখতে পেল; বিমানের পেটের কাছ থেকে নেমে আসছে সরু এক সিঁড়ি।
চট করে মেরির কপালে চুমু দিল হাবিব, মৃদু হেসে বলল, কখনও ভাবিনি অঙ্ক আমার প্রাণ বাঁচাবে। জলদি চলো।
অন্য সবাই বিমানের পেটে উঠে যেতে তিশাকে নিয়ে উঠল রানা। চারপাশ দেখে নিল। এটা কোনও মিসাইল বে। দুটো ত্রিকোণ র্যাকের ভিতর ছয়টা মিসাইল। একেক র্যাকে তিনটে করে।
মিসাইল বের একপাশের মেঝেতে তিশাকে শুইয়ে দিল ও।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, বেকায়দা ভাবে থপথপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে লিলি। পাশের দেয়ালে বাটন পেয়ে টিপে দিল রাশেদ হাবিব, নিঃশব্দে উঠে এল কালো সিঁড়ি। সামনে বেড়ে ককপিটের দিকে চলল রানা। তিশা, এই বিমানের নাম কী?
পিছনের মেঝে থেকে বলে উঠল তিশা, কণ্ঠে ব্যথার ছাপ: দ্য শ্যাডো। এটা স্টেলথ বিমান। কীভাবে লুকিয়ে থাকবে জানি, না। বোধহয় পুটোনিয়ামের কারণেই।
ককপিটে ঢুকে চমকে গেল রানা।
ককপিট যেন ভবিষ্যতের কোনও মহাকাশযানের। উনিশ শ ঊনআশি সালের বিমান, বুঝবার উপায় নেই। অবশ্য, যুদ্ধ-বিমান গত কয়েক দশকে খুব উন্নত হয়নি। হয়তো এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলে হাজার হাজার কোটি টাকা লাগে বলেই। ডানদিকে একটা সিট। অন্যটা বামে এবং পিছনে। ওখানে বসবে রেইডার অপারেটার বা গানার। ককপিট বেশ ঝুঁকে আছে নীচের দিকে। গানারের দেড় ফুট নীচে পাইলটের সিট। ওখান থেকে চার পাশ পরিষ্কার দেখবে পাইলট।
দেরি না করে পাইলটের সিটে বসল রানা। ধুপ আওয়াজ শুনল। ছাত থেকে বড় এক খণ্ড বরফ পড়েছে ক্যানোপির উপর।
কন্সোলের দিকে চাইল রানা। চারটে কমপিউটার মনিটর, স্ট্যাণ্ডার্ড কন্ট্রোল জয়স্টিক, সামনে অসংখ্য বাটুন, ডায়াল ও ইণ্ডিকেটার।
ওর মনে হলো হাই-টেক কোনও জিগসও পাযলের ভিতর ঢুকেছে। ভয় পেয়ে গেল, বুঝতে পারছে এই জিনিস চালাতে পারবে না। শিখতে অনেক সময় লাগবে। আঠারো মিনিটে, তা সম্ভব নয়।
অবশ্য, দ্বিতীয়বার মনোযোগ দিয়ে কন্সোলের দিকে চেয়ে বুঝল, বসনিয়ায় যে হ্যারিয়ার নিয়ে আকাশে উঠত, ওটার সঙ্গে অনেক মিল আছে এই বিমানের কন্সোলের। মনে মনে বলল, মানুষ তৈরি করেছে এটা। একেবারে অন্য রকম হবে কেন?
ইগনিশন সুইচ খুঁজে নিতে মোলো সেকেণ্ড লাগল। বিমান চালু করতে চাইল, কিন্তু কিছুই ঘটল না।
ফিউয়েল ফিড, বিড়বিড় করে বলল রানা। ফিউয়েল ফিড পাম্প করতে হবে।
ফিউয়েল ফিড বাটন খুঁজতে শুরু করেছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর পেয়েও গেল। পাম্প করল ওটা! এবার ইগনিশন সুইচ আবারও টিপল।
কিছুই ঘটছে না।
তারপর হঠাৎ করেই বিকট ভ্রুমমমম আওয়াজ শুরু হলো।
দ্য শ্যাডোর দুই টারবাইন ইঞ্জিন গর্জে উঠেছে। রক্তে অ্যাড্রেনালিনের বান টের পেল রানা। ওর মনে হলো, জেট ইঞ্জিনের আওয়াজ আগে কখনও শোনেনি।
ইঞ্জিন রেভ করতে শুরু করল। খুব দ্রুত তপ্ত করে তুলতে হবে ইঞ্জিনগুলোকে।
আর সময় নেই।
হাত-ঘড়ি দেখল: ১০:৪৫
ইঞ্জিন গরম করছে। সাধারণত বিশ মিনিট সময় দিতে হয়, কিন্তু দ্য শ্যাডোর জন্য দশ মিনিট বরাদ্দ করল। মনের ভেতর থেকে তাগিদ: দেরি হলে এখন যে-কোনও সময়ে মরবে ওরা।
ইঞ্জিন তপ্ত হয়ে উঠছে, গুহার এদিকের বরফ-দেয়াল গলতে শুরু করেছে। ঝরঝর করে পানি ঝরে পড়ছে কালো বিমানের উপর। পাঁচ মিনিট রেভ করবার পর ভার্টিকাল টেক-অফ সুইচ খুঁজল রানা।
ভেক্টর থ্রাস্ট কোথায়?
আধুনিক ভার্টিকাল-টেক-অফ হ্যারিয়ারের মত ফাইটার বিমানে ডিরেক্টেবল বা ভেক্টর থ্রাস্টার থাকে।
থ্রাস্টার কই, তিশা? ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইল রানা।
নেই, স্যর, পিছন থেকে বলল আহত মেয়েটি। তার বদলে রেট্রো-ফায়ারিং জেট আছে! রেট্রো চালু করার বাটন খুঁজুন!
খুঁজতে শুরু করেছে রানা। ওর চোখ পড়ল আরেকটা সুইচের উপর। ওখানে লেখা: ক্লোক মোড।
ভুরু কুঁচকে গেল রানার।
জিনিসটা কী?
দু সেকেণ্ড পর অন্য একটা বাটন দেখল। ওটার উপর লেখা: রেট্রোস।
বাটন টিপে দিল রানা।
এক সেকেণ্ড পর ভেসে উঠতে শুরু করল বিমান। কিন্তু পরের সেকেণ্ডে একটা ঝাঁকি খেল। পিছন থেকে গোঙানির মত আওয়াজ এল। আর নড়ছে না বিমান।
ঘুরে ককপিটের ক্যানোপি দিয়ে, চাইল রানা। বিমানের দুই টেইল ফিন ভাল ভাবেই আটকা পড়েছে বরফের দেয়ালের ভিতর।
দশ সেকেণ্ড পর আফটারৰার্নার বাটন পেল। টিপে দিল বাটন।
টুইন থ্রাস্টারের ভিতর থেকে ছিটকে বেরুল তপ্ত বাষ্প। বিমানের পিছনের বরফের দেয়াল গলতে শুরু করেছে।
মৃদু কাঁপছে দ্য শ্যাডো।
খুব দ্রুত গলে গেল পিছনের বরফ-দেয়াল। ছাড়া পেয়ে গেছে বিমান।
আরেকবার ঘড়ি দেখল রানা।
১০:৫৩
আবারও নীচের দিকে কাত হলো গোটা গুহা।
এখনই না! মনে মনে বলল রানা। আর মাত্র কয়েক মিনিট চাই! মাত্র কয়েক মিনিট!
ইঞ্জিন গরম করে তুলছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে রইল: ১০:৫৪
তারপর পেরিয়ে গেল আরেকটা মিনিট।
১০:৫৫
সময় হয়েছে, নিজেকে বলল রানা। এবার…
আবারও রেট্রো বাটন টিপল। বিমানের পেটের নীচে আট রেট্রো জেট একইসঙ্গে চালু হলো। নীচের দিকে ছিটকে দিল দীর্ঘ সাদা গ্যাসের বাম্প।
এবার প্রকাণ্ড পাতাল-গুহার ভিতর বরফ-মেঝে থেকে ভেসে উঠল দ্য শ্যাডো। পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠে থামল রানা। বাইরে মড়মড় আওয়াজ শুরু হয়েছে। থরথর করে কাপছে গুহা। ছাত থেকে খসে পড়ছে বড় বড় বরফের চাই। ধুপধাপ পড়ছে বিমানের উপর।
চারপাশে যেন কেয়ামত শুরু হয়েছে।
রানা ঘড়ি দেখল: ১০:৫৬
দ্য শ্যাডোর টিনটেড-গ্লাস ক্যানোপির ভিতর দিয়ে চেয়ে রয়েছে। মাতালের মত টলছে প্রকাণ্ড গুহা। ওর মনে হলো, গোটা আইস শেলফ গিয়ে পড়েছে সাগরে। সরে গেছে মেইনল্যাণ্ড থেকে
আপনি কী করছেন, ভাই? মিসাইল বে-র পিছন থেকে বলল হাবিব।
আগে উল্টে যাক আইসবার্গ, সেজন্য অপেক্ষা করছি, বলল রানা।
হঠাৎ তিশার গোঙানির আওয়াজ শুনল। প্রায় ধমকে উঠল: ডক্টর হাবিব! ওকে চিকিৎসা দিন! …মেরি! তুমি এখানে চলে এসো! তোমার সাহায্য দরকার
বিমানের ককপিটে এসে ঢুকল মেরি। চেপে বসল গানার সিটে। আমাকে কী করতে হবে, আঙ্কেল?
ওদিকের ওই স্টিক দেখো, বলল রানা। ওটার সঙ্গে ট্রিগার আছে।
সামনেই কন্ট্রোল স্টিক দেখল মেরি। পেয়েছি।
এবার ওটার ট্রিগারে চাপ দাও।
কন্ট্রোল স্টিকের ট্রিগারে চাপ দিল মেরি।
বিমানের দুই ডানার নীচ থেকে অতি উজ্জ্বল দুটো আলো ছিটকে গেল। গুহার সামনের দিকের দেয়ালে লাগল দুটো ট্রেসার বুলেট, ওখান থেকে ছিটকে বেরুল সাদা দুটো মেঘ।
গুড শুটিং, উৎসাহ দিল রানা। সবাই সতর্ক থাকো, শক্ত করে কিছু ধরো, যে-কোনও সময়ে উল্টে যাবে গুহা ..মেরি, আমি বললে ট্রিগার টিপে ধরবে। না বলা পর্যন্ত ছাড়বে না।
জী, ছোট্ট করে বলল মেরি।
ক্যানোপি দিয়ে বাইরে চাইল রানী। ভেঙে পড়ছে বরফের ছাত। ওরা যে সুড়ঙ্গ দিয়ে এখানে এসে উঠেছে, সেই লবণাক্ত
পুকুরের পানি ছলকে গিয়ে লাগছে বরফের দেয়ালে।
মাত্র এক সেকেণ্ড পর অকল্পনীয় ভাবে নীচে নামল গোটা গুহা। সোজা নীচে নামছে সব। নাটকীয়ভাবে কাত হতে লাগল গুহা। ওই মুহূর্তে রানা বুঝল, গোটা উইলকক্স আইস স্টেশন নিয়ে মেইনল্যাণ্ড থেকে আলাদা হয়ে গেছে আইস শেলফ।
ওটা এখন হয়ে উঠছে আইসবার্গ
অপেক্ষা করো, নিজেকে বলল রানা।
এখন যে-কোনও সময়ে।
আবারও কাত হলো গুহা।
এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি কাত হয়েছে। মাত্র তিন সেকেণ্ডে একশ আশি ডিগ্রি উল্টে গেল পুরো গুহা।
মাঝে মৌমাছির মত ভাসছে দ্য শ্যাডো!
পুরো উল্টে গেছে আইসবার্গ!
পুরো ডিগবাজি দিয়েছে পাতাল-গুহা।
হঠাৎ উপরের চওড়া সুড়ঙ্গ দিয়ে নামতে লাগল বিপুল পানি। একটু আগে পাতাল-গুহায় ঢুকতে ওই পথে আসতে হতো।
বরফের সুড়ঙ্গ এখন আর সাগরের সঙ্গে যুক্ত নয়, ওটার মুখ . তাক করা আকাশে। ওই পথেই বেরুতে হবে রানাকে।
বরফ-সুড়ঙ্গ দিয়ে জলপ্রপাতের মত পানি নেমে আসতেই একপাশে বিমান সরিয়ে নিয়েছে। ত্রিশ সেকেণ্ড পর থামল পানির বর্ষণ। দুই ডানার হ্যালোজেন সার্চ লাইট জ্বেলে নিল রানা, জয়স্টিক টেনে নিল নিজের দিকে। সাড়া দিল যুদ্ধ-বিমান, একটু দুলতে দুলতে পিছিয়ে গেল।
ছাতের দিকে বিমানের নাক তাক করেছে রানা।
ঠিক আছে, মেরি! এবার গুলি শুরু করো!
ট্রিগার টিপে ধরল মেয়েটি।
দ্য শ্যাডোর দুই ডানা থেকে ছিটকে বেরুল ধপধপে সাদা। আগুন, অতি উত্তপ্ত ট্রেসার বুলেট ছিড়েখুঁড়ে দিচ্ছে সুড়ঙ্গের দেয়াল। টানেলের ভিতর বরফের বাড়তি অংশ থাকলে তা উড়ে যাবে।
মেরি গুলি শুরু করতেই থ্রাস্টার ব্যবহার করেছে, রান। চড়ুই পাখির মতু সুড়ঙ্গে ঢুকেই আকাশের দিকে নাক তুলেছে যুদ্ধবিমান। ঠিক তখনই পিছনে বিকট আওয়াজে ধসে পড়ল প্রকাণ্ড গুহার বর্তমানের ছাত।
দ্য শ্যাডোর দুই ডানার মেশিনগান থেকে বেরুচ্ছে অজস্র ট্রেসার বুলেট। বরফ-সুড়ঙ্গের বাধা ছিটকে দেবে। মসৃণ হতে হবে সামনের পথ। খাড়া ভাবে উঠছে কালো বিমান।
সুড়ঙ্গের ভিতর রানা পিছনে ফেলছে সাদা মেঘ। সামনের সুড়ঙ্গ চেপে এলেই কাত করছে বিমানকে। আশা করছে, মেরির ট্রেসার বুলেট বাধা দূর করবে।
বিমানের মিসাইল বে-র পিছন-দেয়ালে গুটিসুটি মেরে শুয়েছে তিশা ও হাবিব, কিছুই করবার নেই ওদের। বিমান থেকে ছুটছে অসংখ্য বুলেট। চারপাশে বিস্ফোরণের আওয়াজ। টানেল বেয়ে উঠছে দ্য শ্যাডো। রানা যেন রেসের গাড়ির ড্রাইভার। ভয়ের অনুভূতি হারিয়েছে, চাপা উত্তেজনা নিয়ে ছুটছে প্রচণ্ড গতি তুলে।
হঠাৎ বিমানের পিছনে শুরু হলো সুড়ঙ্গে বিপুল ধস, ভেঙে পড়ছে চারপাশের বরফ-দেয়াল। যে-কোনও সময়ে বিমানটাকে গিলে নেবে ওই বরফ-ধস।
চারপাশে বুম! বুম! বুম! আওয়াজ।
দ্রুতগামী বিমানের পিছনে সুড়ঙ্গ-প্রাচীর থেকে নীচে পড়ছে মস্ত সব বরফের চাই। এদিকে টানেলের উপর অংশে লাগছে বুলেট, পরিষ্কার করছে পথ, কিন্তু পিছন থেকে ধেয়ে আসছে। সুড়ঙ্গের ভয়ঙ্কর ধস।
ককপিটে রানার মনে হলো, কোনও ভিডিয়ো-গেম খেলছে ও। পিছন সিটে চোখ বুজে ট্রিগার টিপে বসে আছে মেরি। সাঁইসাঁই করে পিছনে পড়ছে সুড়ঙ্গ। উপর থেকে বড় চাই পড়তে দেখলে বিমানকে কাত করে নিচ্ছে রানা।
সরু চোখ করে সামনে চেয়ে আছে। সুড়ঙ্গের দেয়াল মসৃণ করছে বুলেট, তৈরি করছে পগ্ন। পরের সেকেণ্ডে দেখা যাচ্ছে ওই পথ পেরিয়ে এল যুদ্ধ-বিমান। হঠাৎ বুম! করে বিকট আওয়াজ হলো। ধসে পড়েছে গোটা সুড়ঙ্গ। আর ওই একই সময়ে রানা দেখল চারপাশে আকাশ।
আইসবার্গের সুড়ঙ্গ থেকে ছিটকে বেরিয়েছে দ্য শ্যাডো, খাড়া ভাবে উঠতে লাগল আকাশে। একবার কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে চাইল রানা। এখন আর উইলকক্স আইস স্টেশন নেই। ওখানে উল্টে যাওয়া প্রকাণ্ড এক আইসবার্গ।
আগে যেটা আইস শেলফ ছিল, এখন তা হিমশৈল। পানির শত শত ফুট তলের বরফের তীক্ষ্ণ সব চূড়া এখন আকাশের দিকে মাথা তুলেছে, যেন পাহাড়ের শৃঙ্গ।
অনেক নীচে কালো এক মস্ত গর্ত। ওটাই সেই সুড়ঙ্গ। ওখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে ওদের যুদ্ধ-বিমান।
হঠাৎ সাগরের কাছে নড়াচড়া দেখল রানা। জিনিসটা সরু এবং সাদা, লেজে দীর্ঘ আগুন নিয়ে ছুটে চলেছে নতুন আইসবার্গ লক্ষ্য করে।
ক্রুজ মিসাইল।
গর্জন ছাড়তে ছাড়তে উঠছে দ্য শ্যাডো, এবার বিমান সোজা করে নিল রানা। নীরবে নীচে চেয়ে রইল। . এক সেকেণ্ড পর আইসবার্গের বুকে গিয়ে বিধল নিউক্লিয়ারটিপড মিসাইল। তিন সেকেণ্ড কিছুই হলো না, তারপর ডেটোনেট করল নিউক্লিয়ার ডিভাইস।
দ্য শ্যাডোর অনেক নীচে বিস্ফোরিত হলো পারমাণবিক বোমা, অত্যুজ্জ্বল আলো ধাধিয়ে দিল ওদের চোখকে।
মুহূর্তে খুঁড়ো হয়ে গেল জমাট-বাঁধা বরফের পাহাড়, ভয়ঙ্কর শক ওয়েভে বাতাসে মিলিয়ে গেল সুড়ঙ্গ। ব্লাস্ট ওয়েভ নেমে গেল সাগরের দিকে। পথে যা পেল, বাষ্প করে দিল। প্রকাণ্ড সব ঢেউ তৈরি হলো সাগরে। তীরের দিকে ছুটল ভয়ঙ্কর বান। ভয়ানক ভাবে দুলিয়ে দিতে লাগল প্রকাণ্ড আইসবার্গকে, যেন ভঙ্গুর খেলনা নিয়ে খেলছে দুই বাচ্চা। মস্ত কোনও নিউক্লিয়ার ব্লাস্ট হয়নি, মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার র্যাডিয়াসের। কিন্তু আসলে ছোট কোনও নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন বলতে কিছুই নেই।
ওটার কাজ শেষ হয়নি।
হঠাৎ প্রকাণ্ড এক ব্যাঙের ছাতা তৈরি হলো নীচে। অস্বাভাবিক দ্রুত গতি তুলে উঠে আসতে লাগল আকাশ বেয়ে। মনে হলো যে-কোনও সময়ে খপ করে ধরবে যুদ্ধ-বিমানকে।
আবারও বিমান খাড়া করে নিল রানা, তীর বেগে উঠতে লাগল উপরে। যেভাবে তোক ওই ব্যাঙের ছাতা পিছনে ফেলতে হবে। তীব্র গতিতে ছুটে আসছে কালো মেঘ। আকাশ চিরে গর্জন ছাড়তে ছাড়তে উঠছে দ্য শ্যাডো। পূর্ণগতি নিয়ে কাজ করছে দুই জেট ইঞ্জিন। রানা বুঝল, ওরা হারতে বসেছে। ভীষণ গতি তুলে উঠছে ব্যাঙের ছাতা, যে-কোনও সময়ে গিলে নেবে ওদেরকে।
তারপর ঘন কালো মেঘের চূড়া শেষসীমায় পৌঁছে গেল। মাত্র পঁচিশ ফুট উপরে রইল বিমান, এখনও উঠছে নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার জন্য।
কয়েক সেকেণ্ড পর বাঁক নিল রানা, সোজা রওনা হয়ে গেল সাগরের দিকে।
২২.
বহু নীচে সাগর রেখে ছুটে চলেছে দ্য শ্যাডো, নাক তাক করেছে উত্তরদিকে। চারপাশে কুচকুচে আঁধার, বহু দূর-দিগন্তে আবছা কমলা আলো। প্রকাণ্ড ব্যাঙের ছাতার মত মেঘ পিছন দিগন্তে ফেলে এসেছে রানা।
কিছুক্ষণ পর অটোপাইলট বাটন পেল, ওটা এনগেজ করে মিসাইল বে-তে ফিরল তিশার খবর নেয়ার জন্য।
ও কেমন আছে? জানতে চাইল রাশেদ হাবিবের কাছে। মেঝেতে শুয়ে আছে তিশা, ভীষণ ফ্যাকাসে মুখ। জলপাইয়ের মত ত্বকের রং কেমন ম্লান। চোখ বুজে আছে।
অনেক রক্ত হারিয়েছে, বলল হাবিব। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি।
ঠিক তখন চোখ মেলল তিশা। আস্তে করে বলল, আমরা জিতলাম তো?
অবাক চোখে ওকে দেখল রানা ও হাবিব।
মৃদু হাসল রানা, হ্যাঁ, আমরাই জিতেছি, তিশা। কেমন বোধ করছ?
ভয়ঙ্কর খারাপ, স্যর, আবারও চোখ বুজে ফেলল তিশা।
চাপা শ্বাস ফেলল রানা। ভাবতে শুরু করেছে কোথায় যাবে। সবচেয়ে ভাল হয় কোনও জাহাজে নামতে পারলে। সেক্ষেত্রে…
হা… সাগরের ওদিকে কোথাও আছে নুমার জাহাজ। ওখানে থাকবেন নুমা চিফ জর্জ হ্যামিলটন। ওখানে ওদের কোনও বিপদ হবে না।
ঘুরে ককপিটের দিকে রওনা হবে, এমন সময় তিশার বুক পকেটে ডায়েরি দেখল রানা।ওটা অর্ধেক বেরিয়ে আছে।
ওটা নিল ও, দ্রুত ফিরে এল ককপিটে। দেরি না করে বসল পাইলটের সিটে। দ্য শ্যাডোর রেডিয়ো চালু করল। নুমা ভেসেল। নুমা ভেসেল। মাসুদ রানা… মাসুদ রানা বলছি। ডু ইউ কপি?
অন্য দিক থেকে কোনও সাড়া নেই।
আবারও রেডিয়ো করল রানা। কোনও জবাব এল না। ডায়েরির উপর চোখ পড়ল ওর। ভাজের ভিতর কয়েকটা আলগা কাগজ। তিশা বোধহয় জরুরি কোনও কাগজ রেখেছে।
একটা পাতা বের করে চোখ বোলাল। ওখানে লেখা:
ডিজাইন প্যারামিটার্স ফর দ্য বি-৭এ দ্য শ্যাডো এই অ্যাটাক এয়ারক্রাফটের রয়েছে সম্পূর্ণ কনভেনশনাল এবং ইলেকট্রনিক ইনভিযিবিলিটির ক্ষমতা। এটি রেট্রোগ্রেড থ্রাস্টার সিস্টেম ব্যবহার করে, অর্থাৎ এসটিভিএল। রয়েছে মালটিপল-লঞ্চ বিভিআর মিডিয়াম-টু-লং-রেঞ্জ (২৫০ এনএম) এয়ার-টু-এয়ার/এয়ার-টু-গ্রাউণ্ড মিসাইল। ঊনিশ শ সাতাত্তর সালের প্রথম দিন এই যুদ্ধ-বিমানের জন্য ২৫৩-৭৭২-১ টেণ্ডারে যোগ দিয়েছে জেনারেল অ্যারোনটিক্স লিমিটেড এবং হাইটেক লিমিটেড।
পাতার নীচে সংক্ষিপ্ত অক্ষরগুলো লিখে দেয়া হয়েছে।
এসটিওভিএল অর্থাৎ, শর্টটেক-অফভার্টিকেল-ল্যাণ্ডিং। বিভিআর অর্থাৎ, বিঅণ্ড ভিশু্যয়াল রেঞ্জ।
বুঝতে দেরি হয়নি রানার, অনেক দূর থেকে মিসাইল পৌঁছবে টার্গেটে, এবং লক্ষ্যভেদ করতে কোনও অসুবিধাও থাকবে না। বিমান অদৃশ্য বলতে বোধহয় রেইডার এই বিমানকে কখনও ধরবে না।
ভুরু কুঁচকে গেল রানার। আবার পড়ল প্রথম লাইন। কনভেনশনাল ইনভিসিবিলিটি বলতে কী বোঝাতে চাইছে?
পরের কাগজে চোখ বোলাল। মনে হলো হাইটেক লিমিটেডের টেণ্ডার পেপার। ওখানে লেখা:
হাইটেক লিমিটেডের দেয়া বিশেষ কিছু সুবিধা
মাঠ পর্যায়ে হাইটেক লিমিটেডের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, রেইডার থেকে অদৃশ্য হওয়ার জন্য নানা কাজ করা যেতে পারে। রেইডার ধরতে পারে না এমন রং ব্যবহার করা যেতে পারে। এফ-১১৭এ স্টেলথ ফাইটারের মত খাড়া ফিউজেলাজ তৈরি সম্ভব। রেইডার ক্রস-সেকশন কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু কনভেনশনাল ইনভিযিবিলিটি অর্জন এখনও পর্যন্ত অসম্ভব। কিন্তু ঠিক তাই করবে যুদ্ধবিমান বি-৭এ দ্য শ্যাডো।
হাইটেক লিমিটেড এমনই একটি সিস্টেম তৈরি করেছে। ওই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড সম্পূর্ণ আড়াল দেবে বিমানকে। মানুষ দেখবে না কিছুই। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড পাল্টে দেবে বিমানের চারপাশের মলিকিউয়াল স্ট্রাকচার, অর্থাৎ নির্দিষ্ট আলোর কারণে নকল দৃশ্য দেখবে সবাই। একইসঙ্গে এই বিমান এড়িয়ে যাবে রেইডার তরঙ্গকে। শুধু তাই নয়, এই বিমান…
চমকে গেছে রানা, চোখ সরু করে পড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর যা খুঁজছে, পেয়ে গেল।
হাইটেক ওটার নাম দিয়েছে, ক্লোকিং ডিভাইস।
এই সিস্টেম ব্যবহার করলে বিমান থাকবে রেইডারের আওতার বাইরে, একইসঙ্গে কেউ দেখবে না এই বিমানকে উড়তে। এতদিন ধরে শত্রু রেইডার ফাঁকি দিয়েছে স্টেলথ বিমান, কিন্তু লোকের চোখ এড়াতে পারেনি। চল্লিশ মাইল দূর থেকেও বিলিয়ন ডলারের স্টেলথ অ্যাওয়্যাক্স দেখা যায় বাড়ির জানালা দিয়েও।
কিন্তু এই বিমান সব উল্টে দেবে। নকল আলো বেরুবে এটা থেকে, পরিষ্কার আকাশ দেখবে মানুষ, কিন্তু পাইলট তখন চোখের সামনে দিয়ে চলেছে নিজের মিশনে।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রানার। কিন্তু মনের গভীরে টের পেল, এই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতেও পারে। অত্যন্ত জোর দিয়ে লেখা হয়েছে টেণ্ডারে।
রেফ্র্যাকশন, মনে মনে বলল রানা। ফিশবাউলে এমন দেখা যায়। আলো ওখানে পড়ে অন্যরকম হয়ে যায়। এটা হয় কারণ
ওই পানির চেয়ে বাতাস অনেক হালকা। বিকৃত হয় আলল, দেখা যায় মাছ আছে অন্য জায়গায়।
কিন্তু বাতাসে রেফ্র্যাকশন?
হয়তো সম্ভব। ভারী বাতাসকে আর্টিফিশিয়ালি ইলেকট্রিসিটি দিয়ে বদলে দেয়া হবে।
কিন্তু করবে কীভাবে?
নিশ্চয়ই কোনও কৌশল বের করেছে।
তারপর ওর মনে পড়ল প্লুটোনিয়াম কোরের কথা।
এই নতুন বৈপ্লবিক সিস্টেমে নিউক্লিয়ার মলিকিউল দিয়ে পাল্টে দেয়া হবে বাতাস?
পরের প্যারাগ্রাফ পড়তে শুরু করল রানা। ওর মনে হলো সরকারী টেণ্ডার জিতে নেয়ার জন্য কথাগুলো লেখা হয়েছে:
এটা মেনে নিতে হবে, দ্য শ্যাডোর ক্লোকিং সিস্টেম ব্যবহার করতে বিপুল পরিমাণ নিজ পাওয়ার লাগবে। জেনারেল অ্যারোনটিক্স লিমিটেড ও হাইটেক লিমিটেডের পরীক্ষায় দেখা গেছে, ছুটন্ত বিমানের চারপাশের বাতাস বদলে নেয়ার জন্য প্রয়োজন দুই দশমিক একাত্তর গেগাওয়াট ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি। এটা পাওয়া সম্ভব শুধু নিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক রিয়্যাকশন থেকে। এই কারণে…
নিচু সুরে শিস বাজাল রানা। জেনারেল অ্যারোনটিক্স আর হাইটেক ইউএস এয়ার ফোর্সের জন্য যে বিমান দিতে চেয়েছে, ওটার ভিতর থাকবে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর। কোনও সন্দেহ নেই বিমানটা তৈরি করেছে অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে।
ডকুমেন্টেশন নামিয়ে রাখল ও, আবারও রেডিয়ো চালু করল।
নুমা শিপ… নুমা শিপ… মাসুদ রানা বলছি। রিপিট করছি, . নুমা শিপ, আমি মাসুদ রানা। দয়া করে…
হঠাৎ করেই ককপিট রেডিয়োতে ভেসে এল একটা কর্কশ কণ্ঠ: আনআইডেন্টিফায়েড এয়ারক্রাফট, আপনি বলছেন নিজের নাম মাসুদ রানা। ধরে নিচ্ছি আপনি ওই বিমানের পাইলট। আমি গোল্ডেন লিডার, ইউএস এয়ার ফোর্স।
রেইডার স্ক্রিনে চাইল রানা। অ্যান্টার্কটিকার উপকূল থেকে প্রায় দুই শ নটিকাল মাইল সরে এসেছে, কিন্তু রেইডার স্ক্রিনে কিছুই নেই।
চমকে গেছে রানা, দূরের ওই বিমান স্টেলথ মোড অপারেট করছে।
গোল্ডেন লিডার; আমি ইউএস এয়ার ফোর্সের আনমার্কড প্রোটোটাইপ ফাইটার-বম্বার নিয়ে উড়ছি। কারও ক্ষতি করব না।
ক্যানোপির বামদিকে চোখ পড়ল ওর। দিগন্তে ছয়টি বিন্দু ভাসছে।
আনআইডেনটিফায়েড এয়ারক্রাফট, আপনি আমাদের এস্কোর্টে ফিরবেন ইউএস নেভি ক্যারিয়ার লিংকনে, ওখানে নামবেন আপনি।
গোল্ডেন লিডার, আমি আপনাদের এস্কোর্ট চাইছি না, বলল। রানা। আমি…
আনআইডেনটিফায়েড এয়ারক্রাফট, সেক্ষেত্রে আমরা মিসাইল ছুঁড়তে বাধ্য হব।
এক সেকেণ্ড দ্বিধা করল রানা, তারপর বলল, গোল্ডেন লিডার, নিজেকে আইডেন্টিফাই করুন।
কী বললেন? ত্যাড়া স্বরে বলল লোকটা।
আপনার নাম কী, গোল্ডেন লিডার?
আমার নাম ক্যাপ্টেন জন সিমন, ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স। এবং হুকুম করছি: আপনি এখনই আত্মসমর্পণ করুন। আমরা আপনাকে ঘিরে ফেলছি।
সিমন, ভাবল রানা। পকেট থেকে কাগজ বের করল। দ্রুত চোখ বোলাতে শুরু করেছে। চোখ আটকে গেল ওর শেষের লাইনে:
জন সিমন।
ইউএসএএফ। ক্যাপ্টেন।?
এটা কি আইসিজিদের কনভেনশন?
বুকের ভিতর হিম হয়ে এল রানার।
আর ঠিক তখনই ছয়টি এফ-২২ ফাইটার বিমান চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল ওকে। দুটো সামনে, দুটো দুপাশে, পিছনে দুটো। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখছে। আন্দাজ দুই শ গজ সরে চলছে সমান্তরালে। রানার রেইডার স্ক্রিনে কোনও ফোঁটা নেই, কিন্তু নিজ চোখে দেখছে ওগুলোকে।
কয়েক সেকেণ্ড পর তীক্ষ্ণ গুঞ্জন এল ককপিট স্পিকার থেকে। একটা এফ-২২ ওর উপর মিসাইল লক করেছে। আপনি কি চান, ক্যাপ্টেন সিমন? জানতে চাইল রানা।
আমাদের কাজ আপনাকে নিরাপদে ইউনাইটেড স্টেটস ক্যারিয়ার লিংকনে পৌঁছে দেয়া।
আপনি কি মিসাইল ছুঁড়বেন?
আমাদের কাজ আরও কঠিন করে তুলবেন না, মিস্টার রানা।
জানতে পারি কেন মিসাইল লক করলেন?
বাধ্য হলে মিসাইল ছুঁড়ব আমরা। কর্কশভাবে হাসছে লোকটা। আপনি শেষ, মাসুদ রানা।
রানার চোখ ফিরল ডিসপ্লের উপর। তিন সেকেণ্ড পর-টিপে দিল ক্লোক মোড।
মনে মনে বলল, আমাদের হারাবার কিছুই নেই।
মাত্র এক সেকেণ্ড পর দুই শ গজ পিছনে একটা এফ-২২, যুদ্ধ-বিমান উগরে দিল মিসাইল।
২৩.
কয়েক সেকেণ্ড পর যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য।
ছয় যুদ্ধ-বিমান বহরের নেতা ক্যাপ্টেন জন সিমন তার এফ২২-র ক্যানোপি দিয়ে সামনে চেয়ে আছে। সাগরের উপরের আকাশে ভোতা কমলা আলো। কালো এয়ারক্রাফটের টেইল থ্রাস্টার জ্বলজ্বল করছে।
জন সিমনের বিমানের ডানা থেকে রওনা হয়েছে বাষ্পের মত সাদা আগুন নিয়ে মিসাইল, চলেছে কালো ফাইটারের দিকে। এবার টার্গেটে গিয়ে লাগবে।
কিন্তু টলমল করে ওঠা আলোয় হঠাৎ করেই নীচে নামতে শুরু করল কালো বিমান। ওটার চারপাশে যেন ভাপ উঠছে। দুপুরের রোদে দূরের পাল্লা সড়কে এমন মরীচিকা দেখা যায়। পরক্ষণে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল কালো বিমানটা। যেন কোনও পর্দা নেমে এসে আড়াল করে দিয়েছে ওটাকে।
এক সেকেণ্ড পর দেখা গেল, ওই বিমান আর ওখানে নেই।
টার্গেট হারিয়ে পাগল হয়ে উঠেছে ক্যাপ্টেন সিমনের মিসাইল।
প্রথম টার্গেট হারিয়ে দ্বিতীয় টার্গেট খুঁজতে শুরু করেছে।
রানার দ্য শ্যাডোর সামনে ভাসছিল দুই এফ-২২-র একটা, সোজা গিয়ে ওটার টেইলপাইপের ভিতর সেঁধে গেল মিসাইল। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো ফাইটার। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে চারপাশে ছিটকে গেল উজ্জ্বল কমলা আগুন।
থতমত খেল সিমন, হেডসেটে চিৎকার করে আলাপ শুরু করেছে অন্যান্য পাইলট।
..স্রেফ মিলিয়ে গেল।
কী করে…।
…গেল কই?
শালা হঠাৎ করে…
নিজের স্কোপ দেখল সিমন। রেইডারে কালো বিমান নেই। ওটা খুঁজতে শুরু করল তার চোখ। আকাশে কালো বিমানকে থাকতেই হবে। কোথায় গেল? কিন্তু কোথাও তো…
তারপর দেখতে পেল সে।
অন্তত ভাবল, দেখতে পেয়েছে।
কমলা রঙের দূর-দিগন্তে মরীচিকার মত কী যেন দুলতে দুলতে হারিয়ে গেল। ওটা যেন ঘষে দেয়া কাচের লেন্স, দিগন্তের উপর। ওখানে বারবার বলকে উঠছে বাতাস।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না জন সিমন।
.
দ্য শ্যাডোর ভিতর এরই ভিতর একের পর এক সুইচ টিপতে শুরু করেছে মাসুদ রানা।
ওই মিসাইল ওকে শেষ করতে পারেনি। রেডিয়োতে শুনতে পেল পাইলটদের বক্তব্য। পাঁচ এফ-২২ ওকে দেখছে না। এবার সময় হয়েছে পাল্টা জবাব দেয়ার।
মিস্টার হাবিব, তিশাকে এখানে নিয়ে আসুন! লিলিকেও!
নুমা শিপ দ্য অরিগন মাত্র পঁচাশি নটিক্যাল মাইল দূরে। বারো মিনিট লাগবে ওখানে পৌঁছুতে।
ঝলমলে সবুজ আলোআসছে ডায়ালগুলো থেকে, কমলারঙা দূর-দিগন্তের দিকে চেয়ে আছে রানা। ক্লোকিং ডিভাইস অফ করে দিল। চালু করল অটোপাইলট। বড় করে শ্বাস ফেলল। ভেঁড়াছেড়া ভাবে মনে পড়ছে গত চব্বিশ ঘণ্টার সমস্ত ঘটনা।
প্রথমে এল ফ্রেঞ্চরা। তারপর ব্রিটিশ। এল আইসিজি। ওর নিজের লোক একে একে মরল। এমন এক মিশনে ওকে পাঠানো হলো, যা কখনও সফল হবার নয়। একের পর এক প্রিয় মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। দবির, নিশাত আপা, মোরশেদ, হাক্সলে…।
এই মানুষগুলো মরল আমেরিকার জনা কয়েক ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের নীচতার কারণে। তাদের চাই এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল টেকনোলজি বন্ধু-শত্রু সবাইকে খুন করে হলেও।
বুকটা ভারী হয়ে উঠল রানার। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল, তারপর সামনে ঝুঁকে কয়েকটা সুইচ টিপল। স্ক্রিনে দপদপ করতে লাগল লেখা:
মিসাইল আমর্ড। টার্গেটিং.
আরেকটা সুইচ টিপল রানা।
ম্যানুয়াল টার্গেটিং সিলেক্টার।
স্ক্রিনে নিজ হাতে ঠিক করে দিল টার্গেট। জয়স্টিকের বাটন টিপে সিলেক্ট নিশ্চিত করল।
স্ক্রিনে আরও কয়েকটা অপশন এসেছে। ঠাণ্ডা মগজে নিজের পছন্দের অপশন সিলেক্ট করল রানা।
এবার টিপে দিল জয়স্টিকের ট্রিগার।
মিসাইল বে-র র্যাক ঘুরতে শুরু করেছে। এক সেকেণ্ড পর ষষ্ঠ মিসাইল নেমে গেল নীচের আকাশে চালু হয়ে গেছে থ্রাস্টার, কয়েক মুহূর্ত পর দূর-দিগন্তের আকাশে হারিয়ে গেল মিসাইল। সোজা উঠে চলেছে কালো মহাশূন্যের দিকে।
.
দক্ষিণ সাগরের মাঝে চুপ করে দুলছে নুমার জাহাজ দ্য অরিগন।
মাঝারি আকারের জাহাজ ওটা। দৈর্ঘ্য পাঁচ শ বিশ ফুট। জাহাজের মাঝে সুপারস্ট্রাকচার। নুমার টেকনিশিয়ানরা ওই অংশের নাম রেখেছে দ্বীপ। পিছনের ডেকে নামতে পারে দুটো কপ্টার। এমনিতে যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে ডেক হ্যারা। কিন্তু আজ গোটা ডেক ফাঁকা। কোথাও কিছু নড়ছে না।
ভুতুড়ে মনে হচ্ছে জাহাজটাকে।
পিছনের হেলিপ্যাডে খুব ধীরে নামছে দ্য শ্যাডো। ডেকের দিকে আগুনের মত গরম গ্যাস ছুঁড়ছে আট রেট্রো। মাত্র এক মিনিটের মাথায় আলতো ভাবে হেলিপ্যাডে নেমে এল কালো যুদ্ধবিমান।
ক্যানোপির ভিতর দিয়ে চাইল রানা।
কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই। যেন সবাই চলে গেছে জাহাজ ত্যাগ করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। এমনই হবে, ভেবেছিল।
ঠিক আছে, এবার নেমে পড়তে হবে, বলল।
রাশেদ হাবিব ও মেরি ককপিট থেকে বেরিয়ে গেল। তাদের পিছু নিয়েছে লিলি। রানা আগেই বলে দিয়েছে, তিশাকে নিয়ে নিজে নামবে।
ককপিট থেকে বেরিয়ে আসবার আগে, কাঁধে ঝুলন্ত স্যাচেল থেকে রুপালি একটা ক্যানিস্টার নিল রানা।
ওই ট্রাইটোনাল চার্জের টাইমার দশ মিনিটে স্থির করল, তারপর রেখে দিল পাইলটের সিটে। এবার পাজাকোলা করে তুলে নিল তিশাকে, ককপিট থেকে বেরিয়ে এল মিসাইল বে-তে। সাবধানে দ্য শ্যাডো থেকে নেমে পড়ল।
জাহাজের ডেকে ওরা এই কজন ছাড়া কেউ নেই।
ম্লান কমলা গোধূলীর আলোয় কালো বিমানের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা। ওদের সঙ্গে যারা উইলকক্স আইস স্টেশনে গিয়েছিল, তাদের কেউ আর নেই।
নাক নিচু করে চেয়ে আছে বিশাল শিকারি পাখির মত দ্য শ্যাডো। কালো ডানা নীচের দিকে নেমে এসেছে। অ্যান্টার্কটিকার ম্লান আলোয় একবার ওটার দিকে চাইল রানা, তারপর দীর্ঘশ্বাস চেপে সবাইকে হাতের ইশারা করল। সুপারস্ট্রাকারের দিকে হাঁটতে শুরু করল মেরি ও হাবিব। তিশাকে বুকে তুলে সাবধানে চলেছে রানা। সবার পিছনে থপথপ করে আসছে লিলি, এদিক ওদিক চেয়ে অবাক হয়ে দেখছে বিশাল জাহাজ।
প্রায় পৌঁছে গেল ওরা দ্বীপ নামের সুপারস্ট্রাকচারের পিছন অংশে। তখনই বড় একটা দরজা খুলে গেল, উজ্জ্বল আলো এসে পড়ল ডেকের উপর। একজন বেরিয়ে এসেছে। ছায়ার মত, তবুও বয়স্ক ভদ্রলোককে চিনতে দেরি হলো না রানার।
নুমার চিফ, অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন।
চার বছর আগে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাঁকে নিজ ভাইস-প্রেসিডেন্ট করতে চেয়েছিলেন। নুমা ত্যাগ করতে রাজি হননি হ্যামিলটন।
রানা সামনে এসে দাঁড়াতেই ক্লান্ত হাসলেন তিনি। তোমাকে নিয়ে আলাপ করছে অনেকে।
ভুরু কুঁচকে গেল রানার। এমন শীতল অভ্যর্থনা আশা করেনি। সাধারণত ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেন হ্যামিলটন। বলেন, মাই বয়, কেমন চলছে?
জাহাজের আর সবাই কোথায়, অ্যাডমিরাল? জানতে চাইল রানা।
ওদেরকে ওরা… বলতে শুরু করেও থেমে গেলেন হ্যামিলটন। হঠাৎ দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক লোক। অ্যাডমিরালকে ঘষা দিয়ে রানার সামনে গিয়ে দাড়াল।
এই লোককে আগে কখনও দেখেনি রানা। মাথা ভরা পাকা চুল, সাদা গোঁফ, ঢালের মত বুক। লোকটার পরনে নেভির নীল ইউনিফর্ম। বুক পকেটের উপর অসংখ্য মেডেল। লোকটার বয়স হবে ষাট মত, আন্দাজ করল রানা।
ও, তা হলে এই সেই মাসুদ রানা, বিধ্বস্ত যুবককে আপাদমস্তক দেখল সে। দুহাতের ভাঁজে তিশাকে রেখেছে রানা।
রানা, আড়ষ্ট স্বরে বললেন হ্যামিলটন, ইনি অ্যাডমিরাল চাক হিউবার্ট, জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফে নেভির রিপ্রেযেন্টেটিভ। চারঘণ্টা আগে জাহাজের কমাণ্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। থমথম করছে হ্যামিলটনের মুখ।
নিঃশব্দে শ্বাস ফেলল রানা।
জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফ, অ্যাডমিরাল ভাল।
আইসিজি সম্পর্কে যা বুঝেছে, ওই সংগঠনের মাথা বা মগজ বলতে জয়েন্ট চিফস। ও এখন চেয়ে আছে আইসিজির এক প্রধান হর্তাকর্তার দিকে।
ঠিক আছে! গলা উঁচু করল অ্যাডমিরাল চাক হিউবার্ট, এবার বেরিয়ে এসো তোমরা!
পরক্ষণে হুড়মুড় করে সুপারস্ট্রাকচারের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একদল লোক। পরনে তাদের নীল কভারল, হাতে উদ্যত অস্ত্র। দ্রুত চলে গেল তারা দ্য শ্যাডোর সামনে, ঘিরে ফেলল।
কড়া চোখে রানাকে দেখল অ্যাডমিরাল হিউবার্ট। দেখা যাচ্ছে এই মিশন সময়ের পুরোপুরি অপচয় নয়। আপনার সঙ্গে এফ-২২-র ডগফাইটের কমেন্টারি শুনেছি। ক্লোকিং ডিভাইস, না? ভালই! বিনিময়ে আপনাদেরকে সহজ মৃত্যু উপহার দেয়া হবে।
পিছনের ডেকের দিকে চাইল রানা। নীল কভারল পরা লোকগুলোর কয়েকজন উঠে গেছে দ্য শ্যাডোর ভিতরে।
মিস্টার হ্যামিলটন, বলল রানা, আমার সঙ্গের এই মেয়েটি গুরুতরভাবে আহত।
আস্তে করে মাথা দোলালেন নুমা চিফ। গলা সামান্য উঁচু করে বললেন, ডেক হ্যাণ্ড, মেয়েটিকে ইনফারমারিতে নিয়ে যাও।
দরজার ওপাশ থেকে এল এক তরুণ নুমা হ্যাণ্ড, রানার হাত, থেকে সাবধানে তুলে নিল তিশাকে, চলে গেল সুপারস্ট্রাকচারের ভিতর।
মেরি ও হাবিবের দিকে চাইল রানা। আপনারা ওর সঙ্গে যান। লিলিকেও নেবেন।
আস্তে করে মাথা ঝাঁকাল হাবিব, মেরিকে নিয়ে ঢুকে পড়ল দ্বীপের বুকে। দরজা পেরুনোর সময় একটু ইতস্তত করল লিলি, তারপর থপথপ আওয়াজ তুলে চলে গেল। নিজেও ওদিকে পা বাড়াল রানা, কিন্তু তখনই দ্য শ্যাডোর নীচ থেকে চিৎকার শোনা গেল।
অ্যাডমিরাল! হেঁড়ে গলায় ডাক দিয়েছে নীল কভারল পরা এক লোক। আঙুল তুলে কালো বিমান দেখাল সে।
কী? দ্রুত পায়ে বিমানের দিকে চলেছে চাক হিউবার্ট।
তার অনুচরের হাতে ট্রাইটোনাল ৮০/২০ চার্জ। ওটা পাইলট সিটে ফেলে এসেছিল রানা। কভারল পরা লোকটার সামনে পৌঁছে গেল অ্যাডমিরাল, মনে হলো না ওই বোমা দেখে বিচলিত হয়েছে। পঞ্চাশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে রানা, ওর দিকে ঘুরে চাইল সে। প্রমাণ নষ্ট করতে চাও, না?
লোকটার হাত থেকে চার্জ নিল অ্যাডমিরাল, প্রেসারাইযড ঢাকনি খুলল, শান্ত ভঙ্গিতে ডিজআর্ম সুইচ টিপে দিল।
রানার দিকে চেয়ে হাসল। বহুবার জিতেছ, মাসুদ রানা, অনেক মানুষ মেরেছ, কিন্তু আমাকে হারানো এত সহজ নয়।
কালো বিমানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাডমিরাল। নিষ্পলক চেয়ে রইল রানা। স্যর, আপনার জাহাজের ডেক নষ্ট করার জন্য দুঃখিত, নিচু স্বরে বলল জর্জ হ্যামিলটনকে।
গভীর ভাবে চিন্তা করছিলেন নুমা চিফ, জানতে চাইলেন, কী যেন বললে, মাই বয়?
জবাব দিল না রানা। ঠিক তখনই তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ শুরু হলো। পরক্ষণে কেউ বুঝবার আগেই দশগুণ বেড়ে গেল আওয়াজ। যেন দুনিয়ার বুকে ভয়ঙ্কর কোনও বজ্র পাঠিয়েছেন। স্বয়ং স্রষ্টা। এর এক সেকেণ্ড পর দ্য শ্যাডোর ষষ্ঠ মিসাইল আকাশ চিরে চার শ মাইল বেগে নেমে এল।
ফেটে পড়ল কালো বিমান, চারপাশে ছিটকে গেল লক্ষ টুকরো। ওটার উপর ওঠা লোক, বা দশ গজের ভিতর যারা ছিল, মুহূর্তে মারা গেল সবাই। দ্বিতীয় বিস্ফোরণ হলো বিমানের ফিউয়েল ট্যাঙ্কের কারণে। লাল আগুনের মস্ত বল উঠে গেল আকাশে। নানাদিকে ছুটতে লাগল আগুনের গোলা। মনে হলো খপ করে গিলে ফেলল অ্যাডমিরাল চাক হিউবার্টকে। আগুনের তাপ এতই বেশি, মুহূর্তে পুড়ে গেল লোকটার সারাশরীরের চামড়া।
মুরগির কাবারের মত ভাজা ভাজা হয়ে ডেকের উপর আছড়ে পড়ল লোকটা, তার আগেই মারা পড়েছে।
২৪.
কিছুক্ষণ আগে অরিগনের ব্রিজে এসেছেন নুমা চিফ, অ্যাডমিরাল (অব.) জর্জ হ্যামিলটন। জাহাজ দক্ষিণ-সাগর চিরে পুরে চলেছে। ওদিক থেকে ভোরের সূর্য ওঠে।
রানার হাতে ধোঁয়া ওঠা কালো কফির মগ, একবার চুমুক দিল।
তিনঘণ্টা হলো নিজ মিসাইলের আঘাতে বিস্ফোরিত হয়েছে কালো বিমান, দ্য শ্যাডো।
ইনফারমারিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তিশাকে। আরও খারাপ হয়েছে ওর শারীরিক অবস্থা। প্রচুর রক্ত হারিয়েছে, আধঘণ্টা হলো কোমার ভিতর চলে গেছে।
নুমা চিফের স্টেটরুমে উঠেছে রাশেদ হাবিব ও মেরি ভিসার, দশমিনিট পেরুবার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে
ডেকের নীচে ডাইভ প্রিপারেশন পুলে মহানন্দে জলকেলী করছে বাচ্চা সিল লিলি।
ডেক থেকে সুপারস্ট্রাকচারে ঢুকে প্রথমেই বাথরুমে গিয়ে হট শাওয়ার নিয়েছে রানা, তারপর ধার পাওয়া ট্রাকসুট পরে বেরিয়ে এসেছে।
নুমা চিফ জর্জ হ্যামিলটনের নির্দেশে অপেক্ষা করছিলেন দক্ষ ডাক্তার, রানাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছেন ইনফারমারিতে। ক্ষতগুলো পরিষ্কার করেছেন, তারপর মেরামত করেছেন পাঁজরের ভাঙা হাড়। রানাকে বলেছেন, উন্নত চিকিৎসা দরকার। একবার হাওয়াই দ্বীপে পৌঁছে গেলেই হাসপাতালে ভর্তি করে দেবেন। আপাতত কয়েকটা পেইন কিলার দিয়েছেন। ওগুলো গিলে নেয়ার কিছুক্ষণ পর রানার মনে হয়েছে, নাহ্, কোথায়, কখনও কোনও সমস্যা ছিল না ওর।
ডাক্তারের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে অচেতন তিশার কটের পাশে থেমেছে রানা। চুপ করে ওখানেই বসে ছিল, তারপর ব্রিজে আসতে খবর পাঠালেন নুমা চিফ।
ব্রিজে পৌঁছে রানা দেখল, নুমা চিফ চেয়ে আছেন দূরসাগরে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ঘুরে দাঁড়ালেন উনি, বললেন, ম্যাকমার্ডো থেকে খবর এসেছে, রানা। প্রায় বিধ্বস্ত এক মেরিন হোভারক্রাফট ওখানে পৌচেছে। পাঁচজন আরোহী ছিল : ড্রাইভার এক বাঙালি সৈনিক, সঙ্গে চারজন বিজ্ঞানী। এঁরা জানিয়েছেন, উইলকক্স আইস স্টেশন থেকেই এসেছেন। …দুজন নুমার বিজ্ঞানী। থ্যাঙ্কস্, রানা।
আস্তে করে মাথা দুলিয়েছে রানা। নাজমুল ওর দায়িত্ব ঠিক ভাবেই পালন করেছে।
নরম স্বরে জর্জ হ্যামিলটন বললেন, অ্যান্টার্কটিকায় কী ঘটেছে খুলে বলবে আমাকে?
মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল রানা, তারপর বলতে শুরু করল। প্রথমে এল ফ্রেঞ্চ কমাণ্ডো, তারপর ব্রিটিশ এসএএস, শেষে হাজির হলো আইসিজি। দ্য শ্যাডোকে খুঁজে পেল ওরা। বাদ দিল না প্রাক্তন মেরিন মেজর রবিন কার্লটনের কথাও।
সব শুনবার পর থেকে চুপ হয়ে গেছেন জর্জ হ্যামিলটন, কী যেন ভাবছেন। থমথম করছে ব্রিজ, কেউ কিছু বলছে না।
আরেক চুমুক কফি নিল রানা। ব্রিজের পিছনে প্যানোরামিক জানালা, ওদিক দিয়ে দূরে চোখ গেল ওর। স্টার্নের ডেকে মস্ত এক কালো গর্ত। দ্য শ্যাডোর উপর ওখানে পড়েছিল মিসাইল। পুড়ে কালো হয়ে গেছে ধাতব ডেক, এখানে ওখানে ঝুলছে তার ও কেবল।
ডেকের দুরবস্থার জন্য নুমা চিফের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছে। রানা! অখুশি মনে হয়নি ভদ্রলোককে। অ্যাডমিরাল চাক হিউবার্ট জোর করে তার জাহাজ দখল করে নিয়েছিল। তারপর যখন হ্যামিলটন শুনলেন রানা এবং ওর দলের সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছে আইসিজি, ওই অ্যাডমিরাল বা আইসিজির জন্য সামান্যতম করুণা আসেনি তাঁর মনে।
হেলিপ্যাডের গর্তটার দিকে চেয়ে আছে রানা। একটু আগে শেষ হওয়া মিশনের কথা আবারও ভাবতে শুরু করেছে। প্রিয় কয়েকজনকে হারাতে হয়েছে। খচখচ করছে ওর মন। ওদের তো এখানে আসবারই কথা ছিল না। আমেরিকাকে নেতৃত্ব দেয়া একদল বদমাসের জন্য সাদা মনের কয়েকজন মানুষ মারা গেল।
স্যর,ডাকল এক তরুণ রেডিয়ো-ম্যান।
একইসঙ্গে ওদিকে ঘুরে চাইলেন হ্যামিলটন ও রানা।
ব্রিজের সঙ্গে সংযুক্ত কমিউনিকেশন রুমে আলোকিত টেবিলের ওপাশ থেকে বলে উঠেছে তরুণ: স্যর, অদ্ভুত একটা তার পেলাম।
কে এবং কী লিখেছে? ওদিকে পা বাড়ালেন হ্যামিলটন, পাশে রানা। আলোকিত টেবিলের সামনে গিয়ে থামল ওরা।
কোনও জিপিএস ট্র্যান্সপণ্ডার সিগনাল, স্যর, বুলল তরুণ। অ্যান্টার্কটিকার একেবারে তীর থেকে আসছে। মেরিন কোড সিগনাল, স্যর।
একটু সামনে ঝুঁকে গেল রানা। আলোকিত টেবিলের উপর কমপিউটার-জেনারেটেড ম্যাপ। একটা লাল বিন্দু টিপটিপ করছে উপকূলের কাছে। পাশে লেখা: ০২।
ভুরু কুঁচকে গেল রানার। ওর মনে পড়ছে, পরিত্যক্ত লিটল আমেরিকা-৪ স্টেশনের কাছে নিজের ন্যাভিস্টার গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ট্রান্সপণ্ডার চালু করেছিল। দলের নেতা হিসাবে ওর জিপিএস ট্র্যান্সপণ্ডারের কোড ছিল ০১। দবির ছিল ০৫। এক সেকেণ্ড পর রানা মনে পড়ল ওই কোড ০২ কার জিপিএস ট্রান্সপণ্ডার।
মিস্টার হ্যামিলটন, উত্তেজিত স্বরে বলল রান। আমার সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড নিশাত সুলতানা বেঁচে আছে!
.
পুবে সূর্যোদয়ের দিকে ছুটে চলেছে দ্য অরিগন।
রানার বক্তব্য শুনে ম্যাকমার্ডো স্টেশনে যোগাযোগ করেছেন নুমা চিফ জর্জ হ্যামিলটন। ওই স্টেশনে তার বিশ্বস্ত মেরিন দল রয়েছে, দেরি না করে তারা একটা প্যাট্রল বোট নিয়ে উপকূলে চলে গেছে নিশাত সুলতানাকে তুলে নেয়ার জন্য।
তার পর দিন প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করল দ্য অরিগন। প্যাট্রল বোট থেকে একটা কল পেল রানা। তারা উপকূল থেকে সামান্য দূরে এক আইসবার্গের উপর পুরনো এক স্টেশনে নিশাতকে পেয়েছে। এই দলের সবার পরনে ছিল এয়ারটাইট রেডিয়েশন সুট।
প্যাট্রল বোটের স্কিপার আরও জানাল, নিশাত সুলতানা প্রচণ্ড হাইপোথারমিয়ায় ভুগছে। সামান্য রেডিয়েশনও লেগেছে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
কথাগুলো শুনছে রানা, এমন সময় তীক্ষ্ণ চিঙ্কার শুনতে পেল। ওদিকে ক্ষেপে উঠেছে কেউ। এক সেকেণ্ড পর কণ্ঠ চিনতে পারল রানা।
কার সঙ্গে কথা বলছেন? মাসুদ রানা? আপনার মাইক্রোফোন আর মাইক দিন?
পাঁচ সেকেও পর লাইনে এল নিশাত।
রানা সুস্থ আছে শুনে খুশিতে কেঁদে ফেলল সে।
রানা জানতে চাওয়ায় বলল, প্রথমে এলিভেটার শাফটে লুকিয়ে ছিল, তারপর চেতনা হারায়। ঘুম ভাঙে গুলির আওয়াজে। সিল টিম চিৎকার করে কথা বলছিল। তারপর শুনতে পেয়েছে কিং আর্থার ওরফে রন হিগিন্সের সঙ্গে রানার কথা। নিউক্লিয়ারটিপড ক্রুজ মিসাইল আসছে উইলকক্স আইস স্টেশন লক্ষ্য করে।
এরপর এলিভেটার শাফট থেকে বেরিয়ে এসেছে নিশাত, তখনও স্টেশনের ভিতর সিল টিম, কিন্তু মস্ত ঝুঁকি নিয়ে চলে গেছে পুল ডেকে। তার আগে স্টোররুম থেকে জোগাড় করেছে কয়েকটা ফ্লুইড ব্যাগ। পুল ডেকে পৌঁছবার পর পেয়ে গেল রাশেদ হাবিবের পুরনো স্কুবা গিয়ার। ওটা ড়ে ছিল পুলের ধারে। ট্যাঙ্কের সঙ্গে তখনও ভাল করেই জড়িয়ে রাখা ছিল কেবল।
ওই কেবল ও শেষ ব্রিটিশ সি স্লেড নিয়ে নেমে পড়ল পুলে। তার অনুসরণ করে একসময় পৌঁছে গেল এক মাইল দূরের লিটল আমেরিকা-৪-এ।
নিশাতের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আপা, এটা শুধু আপনার পক্ষেই সম্ভব।
এবার জানিয়ে দিল, ওদের দেখা হবে পার্ল হারবারে।
নিশাত বলল, আমি আসছি, স্যর!
আপনাকে কিন্তু ঘুমের কড়া ওষুধ দেয়া হয়েছে, ডাক্তারের আপত্তির কণ্ঠ এল। এভাবে না ঘুমালে…।
প্রায় ধমকে উঠল নিশাত, আমার ভাইকে খুঁজে পেয়েছি, এখন ঘুম হবে আমার? আপনি বোঝেন…
অবশ্য ডাক্তারের অনুরোধে, শেষপর্যন্ত রানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লাইন কেটে দিল সে।
২৫.
পাঁচদিন পর হাওয়াই দ্বীপের পার্ল হারবারে ভিড়ল দ্য অরিগন।
টিভি ক্যামেরা নিয়ে ডকে ভিড় করে অপেক্ষা করছে বেশ কয়েকটি চ্যানেলের সাংবাদিকরা। দৈনিক পত্রিকার কলাম ও ফিচার লেখকদের ভিড় কম হয়নি। ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ উঠছে ফটো সাংবাদিকদের ক্যামেরা থেকে। দুদিন আগে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে একটা চার্টার বিমান নিয়ে দ্য অরিগনের পোভা ডেকের ছবি তুলে এনেছে এরা। একজনের সঙ্গে ভিডিয়ো ক্যামেরা ছিল। সে এখন রাজা। নিউজ চ্যানেলগুলো লাখ লাখ ডলারে ওই দৃশ্য কিনে নিয়েছে। এবার নুমার সবর পেট থেকে গল্পটা বের করতে ডকে হাজির হয়েছে সবাই।
গ্যাংওয়ের উপর এসে দাঁড়িয়েছে রানা। দেখছে, দুই মিডশিপমেন স্ট্রেচারে করে সরিয়ে নিয়ে গেল তিশাকে। বেচারি এখনও কোমায়। কাছের এক মিলিটারি হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। ওকে।
রানার পাশে এসে দাঁড়াল রাশেদ হাবিব ও মেরি।
কী খবর, মেরি? বলল রানা।
হাই, হাসল পিচ্চি মেয়ে। বিপদ কেটে যাওয়ায় উচ্ছল। একহাতে ধরে রেখেছে হাবিবের কবজি, যেন বাচ্চার হাত ছাড়বে
মা। মার্লন ব্যাণ্ডোকে নকল করল হাবিব, কে জানত? আমি একদিন সত্যিই গডফাদার হয়ে উঠব!
মৃদু হাসল রানা।
ঝট করে পিছনে ঘুরে চাইল মেরি। আরেহ, গেল কোথায়…
এক সেকেণ্ড পর ডোরওয়েতে দেখা দিল লিলি, থপথপ করে এসে থামল রানার পাশে। নাক গিয়ে গুঁতো দিতে শুরু করেছে হাতে। একেবারে চুপচুপে ভেজা।
জাহাজের ডাইভ প্রিপারেশন পুলে আনন্দে কেটেছে ওর দিন, বলল হাবিব।
তাই তো মনে হচ্ছে, আলতো করে লিলির কান চাপড়ে দিল রানা। খুশিতে জিভ বের করে নাক চেটে নিল লিলি, তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল। আর উপায় নেই, কাজেই এক হাঁটু গেড়ে বসল রানা, পেট চুলকে দিতে লাগল।
অ্যাডমিরাল বলেছেন, ও, আপাতত এখানে থাকতে পারে, পরে ভাল কোনও বাড়ি খুঁজে দেবেন, বলল মেরি।
গুড, সায় দিল রানা। শেষবারের মত লিলির পেট চুলকে দেয়ার পর উঠে দাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল লিলিও, ফিরে চলল পছন্দের পুলের দিকে।
রাশেদ হাবিবের চোখে চাইল রানা। মিস্টার হাবিব, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
বলুন?
স্টেশনের ডুবুরিরা পাতাল-গুহায় যেতে কোন সময়ে ডাইভ দিয়েছিল?
কোন সময়?
হ্যাঁ, সময়টা জানতে চাইছি। তখন দিন ছিল, না রাত?
উমম, যতটা মনে পড়ে রাত! ধরুন, রাত নয়টার দিকে।
আস্তে করে মাথা দোলাল রানা।
বলুন তো কেন জানতে চাইলেন? বলল হাবিব।
আমি বোধহয় জানি কেন ওই সময়ে হামলা করেছিল এলিফ্যান্ট সিল।
বলুন তো দেখি?
মনে আছে আপনার, একমাত্র তিশার দলের কেউ আক্রান্ত হয়নি।
হ্যাঁ। তা ঠিক।
আর আমি তখন বলেছিলাম, ওরা লো-অডিবিলিটি ব্রিদিং গিয়ার ব্যবহার করেছে।
তা আপনি বলেছেন, বলল হাবিব। তো? আমরাও তো ওই, একই জিনিস ব্যবহার করেছি। তারপরও তো হামলা করল।
তা ঠিক, দুষ্টু হাসল রানা। কিন্তু এখন জানি কেন হামলা করেছে। আমরা ডাইভ দিয়েছি রাতে।
তো?
বিজ্ঞানী, গুণ্ডারসনের ডাইভার বা আমরা রাতেই নেমেছি। বিজ্ঞানীরা নয়টার সময়, গুণ্ডারসনের লোক আটটার সময়, কিন্তু তিশার দল নেমেছে দুপুর দুটোয়। শুধু ওরাই দিনে নেমেছে।
বুঝতে শুরু করেছে হাবিব। তা হলে আপনি বলতে চাইছেন ওইসব সিল নকটারনাল?
হ্যাঁ, আমার ধারণা ওরা দিনে ঘুমায়।
আস্তে করে মাথা দোলাল হাবিব। সাধারণত দেখা যায়, হিংস্র বা বিষাক্ত প্রাণী রাতেই জেগে থাকে, দিন কাটিয়ে দেয় ঘুমিয়ে।
ভাল কথাই বলেছেন, বলল হাবিব। আবার কখনও রেডিয়েশন-ইনফেক্টেড এলিফ্যান্ট সিলের ডেরায় গেলে কথাটা মনে রাখব।
হাসছে মেরি। রানা গ্যাংওয়ে বেয়ে নামতে শুরু করতেই ওরা দুজনও পিছু নিল।
সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আছে মাঝ বয়সী এক মেরিন সার্জেন্ট।
রানা নেমে আসতেই খটাস করে স্যালিউট দিল সে। স্যর, আপনার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
সার্জেন্ট, আমি এখন লেফটেন্যান্ট তিশা করিমকে দেখতে হাসপাতালে যাব। কেউ যদি মনে করে অন্য কোথাও যাব, ভুল ভাবছে।
তাতে আমার কোনও অসুবিধে নেই, স্যর, হাসল সার্জেন্ট। আমাকে বলে দেয়া হয়েছে, আপনি, মিস্টার হাবিব আর মিস মেরি কোথাও যেতে চাইলে, আপনাদেরকে পৌঁছে দিতে হবে।
আস্তে করে মাথা দোলাল রানা, চাইল হাবিব ও মেরির দিকে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওরা জানিয়ে দিল, ওদের কোনও আপত্তি নেই।
গাড়ি পেলে তো ভালই, বলল রানা। পথ দেখান, সার্জেন্ট।
ওদেরকে নীল এক বুইকের দিকে নিয়ে চলেছে সার্জেন্ট। ওই গাড়ির জানালা কালো রঙের পৌঁছে গিয়ে দরজা খুলে ধরল লোকটা। ভিতরে ঢুকে পড়ল রানী।
আগেই ওপাশে বসে আছে আরেক লোক। তার হাতে উদ্যত পিস্তল দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল রানা।
চুপ করে বসুন, মিস্টার রানা, চাপা স্বরে বলল সার্জেন্টমেজর অ্যা লিলিওয়েলেন! সাবধানে সিটে বসল রানা। সামনের সিটে উঠেছে রাশেদ হাবিব ও মেরি, লোকটার হাতে পিস্তল দেখে চমকে গেছে ওরা।
বেঁটে লোক লিলিওয়েলেন, ক্লিন-শেভ করা মুখ। ঘন কালো ভুরু দুটো ঝোপের মত। পরনে দিনের খাকি মেরিন ইউনিফর্ম।
যে, সার্জেন্ট রানাদের এখানে এনেছে, সে ড্রাইভিং সিটে বসে। পড়েছে, গাড়ি চালু করে রওনা হয়ে গেল।
মেরিন কর্পসের নন-কমিশণ্ড সর্বোচ্চ পদের অফিসার বলল, আমরা খুবই দুঃখিত, মিস্টার রানা। কিন্তু আপনি বা আপনার সঙ্গে এরা ছেড়া সুতোর মত! আমরা এসব সুতোয় গিঠ দেব।
আসলে কী বলতে চান? জানতে চাইল রানা।
আপনি জানেন আমরা আইসিজি।
আমি নুমার চিফ অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনকে আপনাদের কথা বলেছি, বলল রানা। আপনারা আমাদেরকে মেরে ফেলতে চাইলে সেটা সহজ হবে না।
হয়তো এখনই মেরে ফেলব না, বলল লিলিওয়েলেন। কিন্তু ঠিক সময়ে… হা। ..আবার এদিকটাও ভেবে দেখুন, আপনি আমাদের জন্য মস্ত হুমকি। আমরা চাই না আপনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলুন। আপনি হয়তো বলে দেবেন উইলকক্স আইস স্টেশনে কী ঘটেছে। তা আমরা হতে দিতে পারি না। মিডিয়া সে তথ্য পাবে, যেটা আমরা আইসিজি ওদেরকে দেব।
আমরা তো অন্য দেশের লোক, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, আপনারা নিজেদের লোকই মেরে সাফ করছেন, বলল রানা।
আপনি আমাদের কাজ বোঝেননি, মিস্টার রানা, বলল লিলিওয়েলেন।
বুঝেছি। আপনারা নিজের লোক খুন করে দেশ ও দশের উন্নতি করছেন তিক্ত হাসল রানা।
হা যিশু, আপনার মুখে এসব শুনতে ভাল লাগছে না। আপনার তো ওখানে থাকারই কথা নয়। কর্কশ স্বরে হাসল লোকটা। এভাবে দেখুন, অন্য সবার আগে কীভাবে উইলকক্স আইস স্টেশনে পৌঁছলেন?
চট করে রানার মনে পড়ল, জর্জ হ্যামিলটন ওর বসের মাধ্যমে সাহায্য চেয়েছিলেন নুমার বিজ্ঞানীদেরকে সরিয়ে নেয়ার জন্য। পরে ম্যাকমার্ডো স্টেশনে আণ্ডারসেক্রেটারি অভ ডিফেন্স ব্রিফ করেন ওকে।
যেন ওর মন পড়ছে লিলিওয়েলেন, আবারও হাসল। এসব সিভিলিয়ান কী-ই বা বোঝে, বলুন?
জর্জ হ্যামিলটন আপনাদেরই অ্যাডমিরাল ছিলেন, বলল রানা।
যখন ছিলেন তখন ছিলেন, এখন তো তিনি সিভিলিয়ান। আসলে এসব সিভিলিয়ানরা আপনাকে শেষ করে দিল। আপনি ওই স্টেশনে যাওয়ার ছয়ঘণ্টা পর গোটা স্টেশন দখল করে নিতে পারতাম আমরা আইসিজি ভরা আর্মি রেঞ্জার দিয়ে। অনেক আগেই শেষ করে দিতে পারতাম ফ্রেঞ্চদেরকে। ব্রিটিশরা ওদিকে ভুলেও যেত না। কিন্তু ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে লড়াই শুরু হলে আমাদের আমেরিকান সৈনিক বেশি মরত। সেই ক্ষতির ভিতর পড়তে হলো না। মাথা নাড়ল লোকটা। আপনি আপনার লোক নিয়ে ওখানে ছিলেন। আপনার সঙ্গে আইসিজির লোক দিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। প্রথম কথা, সেরা জিনিস আমাদের হাতে আসতে হবে। তা যদি সম্ভব না হয়, ওই জিনিসের প্রমাণ উধাও করে দিতে হবে। এটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই দরকার।
আপনারা নিজেদের দেশের ছেলেদেরও মেরেছেন, বলল রানা।
সেটা বাধ্য হয়ে। কেউ ভুল জায়গায় ভুল সময়ে চলে গেলে শাস্তি পাবে, এটাই স্বাভাবিক!….যাক, আপনাকে এসব বলছি কেন, একটু পরই তো আপনাকে মেরে ফেলব।
ডক ইয়ার্ডের বাইরের বেড়ার সামনে গার্ড স্টেশন, ওখানে পৌঁছে গেছে বুইক। কিন্তু বুম গেট নামানো। জানালার কাঁচ নিচু করল ড্রাইভার সার্জেন্ট। বুম গেটের গার্ডের সঙ্গে কথা বলল।
কিন্তু তিন সেকেণ্ড পর হঠাৎ করেই লিলিওয়েলেনের ওদিকের দরজা হ্যাঁচকা টানে খুলে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কমপক্ষে দশজন সশস্ত্র নেভাল পুলিশ। প্রত্যেকের অস্ত্র তাক করা দুই আমেরিকানের কপালে।
এই যে স্যর, আপনি বেরিয়ে আসুন দেখি, সামনের লোকটা বলল।
মুখ কালো হয়ে গেল সার্জেন্ট-মেজর লিলিওয়েলেনের। বাছা, তুমি জানো কার সঙ্গে কথা বলছ? ঘড়ঘড় করে উঠল তার কণ্ঠ।
না, ও জানে না, গাড়ির বাইরে পরিচিত কণ্ঠ শুনল রানা। কিন্তু আমি জানি তুমি কে? দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নুমা চিফ জর্জ হ্যামিলটন। রানার চোখে চাইলেন, দৃষ্টিতে স্নেহ। মাই বয়, তুমি ঠিকই বলেছিলে। এবার একটা একটা করে কান ধরে মিলিটারি থেকে এদেরকে বের করার ব্যবস্থা নেব আমরা সবাই।
অ্যাডমিরাল, ও কি এসেছে? গাড়ি থেকে নেমে এল রানা।
রাশেদ হাবিব ও মেরিও নেমে পড়েছে।
ওই যে দেখো! হাসলেন হ্যামিলটন।
তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘুরে গেল রানা। নেভাল পুলিশদের মাঝ দিয়ে হেঁটে আসছে রবিন কাটন, ঠোঁটে চওড়া হাসি।
সার্জেন্ট-মেজর অ্যাণ্ডু লিলিওয়েলেন এবং সঙ্গে আসা সার্জেন্টকে বের করে আনা হলো গাড়ি থেকে। হাতে আটকে দেয়া হলো হ্যাণ্ডকাফ। সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাদেরকে।
বন্ধুর দিকে পা বাড়াল রানা।
অবশ্য তিন পা যেতে না যেতেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল ওরা। ওদের পাশে এসে থেমেছে এক দম্পতি।
এদেরকে আগে কখনও দেখেনি রানা।
ওকে আরেকবার বুকে পিষে ছেড়ে দিল রবিন কার্লটন, বলল, এঁরা অ্যাডোনিস ও সাহু ক্যাসেডিন। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক। আর ইনি মাসুদ রানা।
অ্যাডোনিস হাত বাড়িয়ে দিতেই করমর্দন করল রানা।
আগেই ওদের পরিচয় হয়েছে মোবাইল ফোনে। রানার কাছ থেকে তথ্য পেয়ে একটা চার্টার বিমান ভাড়া নেয় অ্যাডোনিস ও সান্থা, ঘুরে আসে দ্য অরিগনের উপর দিয়ে। ভিডিয়ো করেছে মিসাইলের আঘাত করা জায়গার।
এবার সব ভালভাবে শেষ হলে হয়, বলল অ্যাডোনিস।
মৃদু হাসছেন নুমা চিফ। খারাপ সব কিছুই শেষ হয়, বললেন। রানা আগে থেকে না বললে ওই দুই পীরকে ধরা যেত না। ওদের পেট থেকে অনেক কিছুই বেরুবে। …আর কার্লটন, তোমাকে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে, তারপর আবার যোগ দেবে চাকরিতে।
এবার আপনাদেরকে নিয়ে ফিচার লিখছি আমরা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে, বলল অ্যাডোনিস। আশা করি আপনাদের সাক্ষাৎকার দেবেন।
আমার আপত্তি নেই, বললেন জর্জ হ্যামিলটন। তবে রানার বোধহয় আপত্তি থাকতে পারে। ওর বস্ অনুমতি না দিলে…
আগ্রহ নিয়ে রানার দিকে চেয়ে আছে অ্যাডোনিস।
পরে বসের সঙ্গে আলাপ করে জানাব, বলল রানা। মেরি ও হাবিবকে দেখাল। এরা উইলকক্স আইস স্টেশনের বিষয়ে দারুণ সব তথ্য দিতে পারবে।
খুশি হয়ে হেসে ফেলল দম্পতি।
.
জুলাইয়ের পঁচিশ তারিখে দুনিয়ার সবচেয়ে বিক্রিত–দৈনিক
পত্রিকা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রথম পাতায় ছাপা হলো রানার বন্ধু রবিন কার্লটনের ছবি। বুকের সামনে ধরেছে একটা ছবি, সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কর্পসের দেয়া অফিশিয়াল ডেথ সার্টিফিকেট।
হেডলাইনে লেখা:
ইউএস মিলিটারির বক্তব্য অনুযায়ী, ইনি অফিশিয়ালি মৃত
রাশেদ হাবিব ও মেরির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে উইলকক্স আইস স্টেশনের উপর তিন পাতা লেখা হয়েছে। পরের দুই, পাতা আইসিজি সম্পর্কে। পাঠকদের জানানো হয়েছে, কীভাবে এলিট মিলিটারির ভিতর নিজেদের নোক ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কীভাবে খুন করা হয় সাধারণ অফিসার ও সৈনিকদেরকে।
এই বিশাল ফিচারে ফ্রেঞ্চ বা ব্রিটিশ হামলার কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে।
নানা ট্যাবলয়েডে অবশ্য বলা হয়েছে, উইলকক্স আইস স্টেশনে নিজেদের মিলিটারি পাঠিয়েছিল অন্য কয়েকটি দেশ।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিযোগী এক পত্রিকায় লেখা হলো: দ্য ওয়াশিটন পোস্টের মালিক ক্যাথারিন গ্রাহামের সঙ্গে দেখা করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট স্বয়ং, তিনি অনুরোধ করেছেন, উইলকক্স আইস স্টেশনের কারণে যেন বিশেষ কিছু দেশের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যাহত না হয়, তা দেখবেন।
হয়তো সেকারণেই একবারও ব্রিটেন বা ফ্রান্সের বিষয়ে সামান্যতম মন্তব্য আসেনি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় লেখা হয়েছে, উইলকক্স আইস স্টেশনে তুমুল লড়াই হয়েছে। কিন্তু জানা যায়নি শত্রুপক্ষ কারা ছিল।
মাসুদ রানা সম্পর্কেও একটি লাইনও লেখা হয়নি।
সাংবাদিকরা হিংসা করতে শুরু করেছে অ্যাডোনিস এবং ওর স্ত্রীকে! সবাই বুঝে গেছে, ওই কাহিনি কমপক্ষে দেড় মাস ধরে সেরা কলামে ছাপা হবে। এই সম্মান দশ জনমেও পায় না বেশির ভাগ সাংবাদিক।
.
পরদিন পার্ল হারবার ত্যাগ করল নুমা জাহাজ দ্য অরিগন। সেই দিনই ওয়াশিংটনে শেষ হলো ন্যাটো কনফারেন্স।
প্রতিটি টিভি চ্যানেল ও দৈনিক পত্রিকায় আর্টিকেল বেরুল। আমেরিকান, ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ কূটনীতিকরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপিটল বিল্ডিঙের সিঁড়ির ধাপে। হাসি মুখে করমর্দন করছেন, পাশেই তাঁদের জাতীয় পতাকা। তারা বলেছেন, কমপক্ষে আরও বিশ বছর চলবে এই মহান ন্যাটো সংগঠন।
ফ্রেঞ্চ রিপ্রেসেন্টেটিভ অ্যা পিয়েরে কুই-র কথা কোট করা হয়েছে: দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সংগঠন আমাদের এই ন্যাটো। কেন এই সংগঠন এতদিন টিকবে, জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান: আমরা সবাই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে পরস্পরকে গভীর ভাবে বিশ্বাস করি।
.
পার্ল হারবার নেভাল হসপিটালে প্রাইভেট একটা রুমে নিথর শুয়ে আছে তিশা। বুজে আছে চোখ। জানালা দিয়ে সামান্য রোদ আসছে। তিশা এখনও কোমার ভিতর।
তিশা! তিশা? বলে উঠল এক মহিলা কণ্ঠ।
আবছা কণ্ঠ শুনতে পেল তিশা। খুব ধীরে মেলল চোখ। পাশের কটে শুয়ে ওর প্রিয় নিশাত আপা।
আর ঘুমায় না, তিশা। মিষ্টি করে হাসল নিশাত।
চোখ বুজে এসেছিল, আবারও জোর করে নিশাতের দিকে চাইল তিশা। কেমন আছেন, আপা? আমরা কোথায়?
তার চেয়ে বড় কথা, দেখো কে এসেছে তোমাকে দেখতে, হাসছে নিশাত।
কে?
বামদিকে মাথা কাত করল নিশাত। জানালার পাশে অতিথির চেয়ারে বসে আছে মাসুদ রানা। ঘুমিয়ে কাদা।
ওঁর পাজর মেরামত হওয়ার পর থেকে ঠায় বসে আছেন, নিচু স্বরে বলল নিশাত। বলেছেন, তুমি জেগে না ওঠা পর্যন্ত থাকবেন এখানেই।
রানার দিকে অপলক চেয়ে রইল তিশা। ওর মনে হলো, দুনিয়ার সেরা মিষ্টি একটা শিশু ঘুমাচ্ছে অকাতরে।
মৃদু হেসে ফেলল তিশা।