2 of 2

ডেডবডি – ইন্দ্রজিৎ রায়

ডেডবডি – ইন্দ্রজিৎ রায়

‘দেখুন মশাই, আপনারা, সাংবাদিকেরা, পুলিশের কোন কোন ক্ষেত্রে সাময়িক ব্যর্থতার ব্যাপার নিয়ে চায়ের পেয়ালায় এমন তুফান তুলে ছাড়েন যে তা বলবার নয়। মনে হয়, অপরাধীটিকে ধরতে না পারার অগৌরবে সৃষ্টি বুঝি রসাতলেই গেল। সমাজ জীবন বুঝি ভেঙে পড়ল। কিন্তু এটা বোঝেন না কেন পাপ আর পারা কোনদিনই চাপা থাকে না ; কোন একদিন কোন এক স্থানে তা ফুটে বেরোবেই।

‘আপনার আমার চর্মচক্ষুকে সে ফাঁকি দিতে পারে, আপনার আমার বুদ্ধিবৃত্তিকে সে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু সবার ওপরে, সবার অলক্ষ্যে যিনি আছেন তাঁকে এড়াতে পারবে না কখনো। সেই নীরব সাক্ষী যেদিন সরব হয়ে উঠবেন, সেদিনই অপরাধীর সব জারিজুরি শেষ।’

গল্পের গন্ধ পেয়ে নড়েচড়ে বসলুম আমি। প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে, একটা ত্রিদিববাবুকে দিয়ে আর একটা নিজে ধরিয়ে, উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ঘটনাটা কী স্যার ? মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে কিছু একটা জানেন আপনি। নিজের কিংবা অপরের জীবনে হয়তো ওই আপ্ত-বাক্যটি নিয়ে এমন কোনও উদাহরণ আপনার জানা আছে, যার ফলে বিষয়টির ওপর আপনি এত ওজন চাপাচ্ছেন। অ্যাম আই রং ?’

হেসে ফেললেন স্বরূপনগরের প্রবীণ পুলিশ প্রধান ত্রিদিব চৌধুরী মশাই। বললেন, ‘আপনি শুধু বুদ্ধিমান নন, সেই সঙ্গে চতুরও। একেবারে ‘বুলস-আই’ হিট করে বসে আছেন। হ্যাঁ, জানা-ঘটনা আমার। শুনবেন ?’

‘শোনালে সত্যিই খুশি হব।’

আগেই বলেছি, ত্রিদিব চৌধুরী স্বরূপনগরের প্রবীণ পুলিশ প্রধান আর আমি একজন সাংবাদিক। এসেছিলুম এই নতুন গড়ে-ওঠা উপনগরীটির ওপর একটি সচিত্র প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই সূত্রে পুলিশ দপ্তরে আসা। এবং কথাসূত্রে এ হেন রোমাঞ্চকর প্রসঙ্গের অবতারণা।

ত্রিদিববাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানকার ইলেকট্রনিকস্ ফ্যাক্টরিটা দেখেছেন?’

‘দেখেছি।’

‘বছর তিরিশেক আগে ওখানে ছিল প্রকাণ্ড এক দীঘি আর আশেপাশে বন। ধারেকাছে লোকবসতি প্রায় ছিলই না বললেই চলে। কাউকে খুন করে, তার লাশ গুম করে ফেলার পক্ষে সে এক আদর্শ জায়গা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই দীঘিটাকে ভরাট করবার সময়েই সহকারী তপন বিশ্বাসকে খুন করার মতলব জেগে ওঠে অনন্ত সেনের মাথায়।’

‘খুনের উদ্দেশ্য?’

‘ব্ল্যাকমেলিং। অনন্ত সেনকে ব্ল্যাকমেল করছিল তপন বিশ্বাস।’

‘কারণ ?’

‘অনন্তর বিধবা যুবতী বৌদি ভ্রষ্টা আর নষ্ট হয়ে কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে দেহ-পসারিণীর ব্যবসা খুলে বসেছিল। অনন্ত রটিয়েছিল যে সে নাকি আবার তার বাপের বাড়িতেই ফিরে গেছে। কিন্তু কীভাবে যেন তপন আসল ব্যাপার জানতে পেরে যায়। সে আরও জানতে পারে বৌদির এই দুর্দশার মূলে নাকি অনন্তই স্বয়ং। বিবাহযোগ্যা দুটি বোন ছিল অনন্তর। পারিবারিক কলঙ্ক আর কেলেঙ্কারির কথা চাউর হয়ে গেলে তাদের বিয়ে দেওয়া শক্ত হয়ে দাঁড়াবে ভেবে তপনের মুখ বন্ধ রাখতে প্রথমে কিছু টাকা খসাতে হয়েছিল অনন্তকে। পরে সেটাই দাঁড়িয়ে যায় মাসিক বরাদ্দে।

‘সরকারের পূর্তবিভাগের মাথায় হঠাৎ একদিন খেয়াল চাপল যে এরিয়াটাকে ডেভেলপ করার আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে দরকার পড়ল আগে ওই দীঘিটাকে বুজিয়ে ফেলার। আশপাশের কলকারখানা আর ফার্মগুলোর কাছে অনুরোধ গেল—এবার থেকে তারা যেন তাদের যাবতীয় রাবিশ ওই দীঘির বুকে এনে ফেলে। সমস্ত খরচ সরকারের।

‘অনন্ত সেন ছিল একজন কনট্রাক্টর। কনট্রাক্ট নিয়ে সে এল স্বরূপনগরে। এল আরো অনেকে। দেখতে দেখতে বহুদিনকার শান্ত সমাহিত জায়গাটা ভারী ভারী লরী জীপ ট্র্যাক্টার⋯বুলডোজার ইত্যাদির আনাগোনায় আর চাকার চাপে পিষ্ট তছনছ হয়ে গেল।

‘যাই হোক, আমি তখন সবে স্বরূপনগর পুলিশ আউটপোস্টে একজন জমাদার-কনস্টেবল হয়ে কাজে লেগেছি। থানায় থাকি আর প্রায় রোজই বেড়াতে যাই দীঘির ধারে। লক্ষ্য করি টন টন রাবিশ ফেলার ব্যস্তবাগীশ কাজকর্ম। দেখি কেমন করে অতবড় দীঘিটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে বুজে বুজে আসছে। দীঘির চারপাশের পাড় ঢালু হয়ে ক্রমশ নেমে গেছিল নিচেয়। ফলে রাবিশ ফেললে তা প্রথমেই ফেলা হতো পাড়ের কাছেই। তারপর তিন চার খেপ পরে ওপর থেকে ফেলা অন্য রাবিশের ভারে আর চাপে শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে যেত দীঘির বুকে।

‘এই পদ্ধতিটুকু নিজের কাজে লাগিয়েছিল অনন্ত। প্রথম ঝুঁকিটুকু কাটিয়ে উঠতে পারলে, পরে লাশের ওপর রাবিশের পাহাড় জমা হয়ে তাকে যে কোন গহ্বরের মধ্যে টেনে নিয়ে ফেলবে, তা কল্পনা করা কঠিন।

‘অনন্ত অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ হলেও তপন বিশ্বাসের চাহিদা ক্রমশ নির্লজ্জ আর অসহনীয় আকার নিচ্ছে দেখে সেও মনে মনে অস্থির হয়ে উঠল তার কবল থেকে মুক্তি পেতে। তাছাড়া কনট্রাক্টরিতে এমন কিছু লাখ টাকার আমদানি হয় না যে, সংসারের হাঁ বুজিয়ে, শ্রমিকদের চাহিদা মিটিয়ে আবার তপন বিশ্বাসের পেট ভরানো যায়। তাছাড়া বোনেদের বিয়ের খরচ আর নিজের ভবিষ্যৎ রয়েছে না।

‘কীভাবে ওই পথের কাঁটাকে দূর করা যায়—সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনায় অনেক বিনিদ্র রজনী উত্তেজনা আর অস্থিরতায় কাটিয়ে অনন্ত শেষ পর্যন্ত স্থির করল, তপন বিশ্বাসকে জন্মের মত সরিয়ে দেবে এই পৃথিবী থেকে। বাঁশও থাকবে না, বাঁশীও বাজবে না।

‘কাজের সুবিধের জন্য অনন্ত সেই বনের ধারে—তখন অবশ্য মানুষ আর যন্ত্রের দাপটে ‘বন’ বলে আর কিছু ছিল না—বনের কঙ্কালটাই ছিল শুধু, অস্থায়ী একটা অফিসগোছের তৈরি করেছিল। পরিকল্পনা ফাঁদা হয়ে গেলে, টাকা দেবার অছিলায় একদিন তাকে ডেকে জানিয়ে দিল—অমুক দিন রাত আটটার মধ্যে তার অফিসে যেতে।

‘সন্দেহ করল না তপন। কারণ এর আগেও বার কয়েক অনন্ত অফিস থেকে ওইভাবে টাকা দিয়েছিল তাকে। তাই এবারেও নিঃসন্দেহ মনে গেল তপন। আর সেই যাওয়াই হল তার শেষ-যাওয়া। অনন্ত ঠাণ্ডা মাথায় তার নিঃসন্দিগ্ধচিত্ততার সুযোগ নিয়ে অবলীলায় খুন করল তাকে।’

এই সময়ে আর্দালী এসে আমাদের দুজনকে দু-কাপ কফি দিয়ে গেল। কফি-পানের বিরতিটুকুতে ত্রিদিববাবু ত্রিশ বছর আগেকার এক বিস্মৃতপ্রায় ঘটনাকে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে সুসংবদ্ধভাবে স্মৃতির সারণিতে আনবার প্রয়াস পেলেন। কফি শেষ করে আবার দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে জুৎসই করে বসলুম চেয়ারে। ত্রিদিববাবুর পি-এ এসে গোটা কতক ফাইল সই করিয়ে নিয়ে যাবার পর তিনি নিজেও গোটা দুই ফোন কল সেরে আবার গল্প বলায় মেতে গেলেন—

‘হ্যাঁ যা বলছিলাম—খুনের পর সনাক্ত করার সব রকম উপায় থেকে তপনকে বঞ্চিত করতে, তার মৃতদেহটাকে টানতে টানতে অফিসঘরের বাইরে নিয়ে এল অনন্ত। মতলব আগেই ভাঁজা ছিল। তারই প্রথম কিস্তি হিসেবে গরু-মোষের জাবনা-খাওয়া কাঠের তৈরি বিরাট একটা পাত্রে চটপট প্লাস্টার অভ প্যারিস গুলে তপনকে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে। ডেথ-ওয়েপনটা—মানে হাতখানেক লম্বা লোহার একটা ভারী রড, সেটাও সেইসঙ্গে পাত্রের ভেতর ঢোকাতে ভুল করল না।

‘কুইক লাইম কিংবা সিমেন্টের চেয়েও অনেক তাড়াতাড়ি জমে ওঠে প্লাস্টার। ওদের চেয়ে কঠিন, ঘন আর হালকাও হয় যথেষ্ট। চাঁইটা জমে যাবার পর পাত্রটা ভেঙে সেটাকে বার করে নিল অনন্ত। তারপর পরিকল্পনা মত, তার অফিসঘরের আশেপাশে জড়ো হয়ে থাকা নানান আকারের, নানান ওজনের সিমেন্ট আর প্লাস্টারের ভাঙা ও গোটা টুকরোর সঙ্গে মিশিয়ে সেটাকেও রেখে দিলে।

‘তার আগে অবশ্য লোকের সন্দেহ এড়াবার উদ্দেশ্যে হাতুড়ির ঘায়ে চাঁইটার চারপাশে বিভিন্ন ক্ষতচিহ্ন এঁকে রাখতে কসুর করল না। যেন কোন কাজের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার পরে পরিত্যক্ত একটি চাঁই। তাছাড়া জাবনা-খাওয়া পাত্রের আকৃতিটাও বিকৃত করে দেওয়া দরকার ছিল তার। লরী ড্রাইভারকে বলাই ছিল, সে এসে পরদিন সকালে এখানকার এই রাবিশগুলোকে নিয়ে যাবে।’

‘এক মিনিট’, ত্রিদিববাবুকে থামিয়ে বললুম আমি, ‘আচ্ছা মিস্টার চৌধুরী, অনন্ত সেন একবারও ভেবে দেখলেন না যে, তপন বিশ্বাসকে সময়মত বাড়ি ফিরতে না দেখলে, তার বাড়ির লোকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবে ? তারপর অস্বাভাবিক রকমের দেরি দেখলে পুলিশে রিপোর্ট করবে ?’

‘ভেবেছিল নিশ্চয়ই এবং ভেবেই সে খুন করেছিল তপনকে। পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি তো একদিনের ছিল না। তপন ছিল ঠিকাদার। মাল কেনা বেচার ধান্দায় তাকে ঘুরতে হত যত্রতত্র। সময়-অসময়ের বাছবিচার ছিল না। আর বাড়ির লোক বলতে স্ত্রী আর ছেলে। কাজে কাজেই তপনের নিরুদ্দেশ নিয়ে খুব যে একটা হৈ-চৈ উঠবে না কোথাও—এটা অনন্ত গোড়া থেকেই ধরে নিয়েছিল মনে হয়। প্র্যাকটিক্যালি ঘটেও ছিল তাই। মাস দুই পরে স্ত্রী অবশ্য স্বামীর নিরুদ্দেশের কথা জানিয়েছিল পুলিশকে। কিন্তু তপন সম্পর্কে অনেক কথা⋯অনেক ঘটনা⋯অনেক সূত্র ও স্মৃতিই তখন ফিকে হয়ে গেছে স্থান-কাল-পাত্র থেকে ; সুতরাং রিপোর্ট ফাইলজাত হয়েই রইল। তদন্ত বিশেষ এগোল না।

‘দেখতে দেখতে দিন-মাস-বছর গড়িয়ে গড়িয়ে মানুষের হিসেবে আড়াই যুগের ওপর সময় কেটে গেল। সারা ভারতবর্ষের চেহারায় আর জনজীবনে অনেক কিছু পরিবর্তনের ছাপ পড়ল একে একে।

‘স্বরূপনগরও নবরূপে, নবীন কলেবরে মাথা তুলে দাঁড়াল একটু একটু করে। সরকারী কেষ্ট-বিষ্টুরা স্থির করলেন—স্বরূপনগরকে একটা লাইট ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে ট্রান্সফার করতে হবে। এর প্রসপেক্ট নাকি অনেক। আর এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ তাঁরা নিলেন একটা বিরাট ইলেকট্রনিক ফ্যাক্টরি তৈরির কাজে হাত দিয়ে। জাপানের সহযোগিতায় এটা গড়ে উঠবে। স্থান নির্বাচন করা হল ভরাট করা সেই দীঘির বুকের জমিটা, যা এতদিন এখানকার ছেলেদের খেলার মাঠ ছিল।

‘অনন্ত সেন আর দেশে ফিরে যায়নি। জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে স্বরূপনগরেই থেকে গেছিল সে। কালক্রমে সে হয়ে উঠেছিল স্বরূপনগরের একজন বিশিষ্ট মান্যগণ্য ব্যক্তি। কনট্রাক্টারি আর বিল্ডিংস মেটিরিয়ালসের ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠে গাড়ি-বাড়ি-সম্পত্তি করেছে। স্ত্রী-ছেলে-ছেলের বউ-মেয়ে নিয়ে জমজমাট সুখের সংসার এখন তার। ভাল কথা, মিস্টার রায়, পাইল ড্রাইভিং কাকে বলে জানেন ?’

‘জানি।’ জবাব দিলুম আমি। ‘বড় বড় ইমারৎ গড়বার সময়ে ভিৎ যাতে নড়বড়ে আর বেমজবুত না হয়, তার জন্যে অনেকগুলো কংক্রিকেটর খোঁটা পুঁতে দেওয়া হয় ভিতের বুকে। তার কথাই বলছেন তো ?’

‘হ্যাঁ। ইউ আর রাইট। ড্রিলিংয়ের সময় দেখা গেল, দীঘির বুকে ফেলা টন টন রাবিশের স্তূপ এই তিরিশ বছরে ওপর ওপর যতই শুকিয়ে শক্ত হয়ে উঠুক, ভেতরে ভেতরে ঠিক মত সলিড হয়ে উঠতে পারেনি। মাঝে মধ্যে একটু আধটু নরম আর ফাঁক-ফোকর থেকেই গেছে। আর এরই জন্যে সেদিন ঘটে গেল এক অঘটন। নিউম্যাটিক ড্রিলটা বেশ স্মূথলিই ঘুরে ঘুরে একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছিল মাটির বুকে। যেন কেউ একটা পাকা কলার গায়ে ছুঁচ ফোটাচ্ছে। হঠাৎই তার গতির ছন্দ নষ্ট হল—তাল কেটে গেল ঘূর্ণনে। ড্রিলিং মেশিনটা থরথর করে কেঁপে উঠল লজ্জাবতী লতার মতন।

‘ভুরু কুঁচকে উঠল মেশিনম্যানের। নিশ্চয়ই বেশ শক্ত কিছু পড়েছে যন্ত্রের সূচীমুখ অগ্রভাগে! পাথর নিশ্চয়ই। জিনিসটাকে তুলে ফেলে দিতে না পারলে ড্রিলের তীক্ষ্ণ তুরপুণটা ভোঁতা হয়ে যাবার ভয় আছে।

‘অতএব ডাক পড়ল কুলিদের। গাঁইতি-শাবল-কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে ছুটে এল তারা। ঘণ্টা চার পাঁচের কঠোর পরিশ্রমেই বেরিয়ে পড়ল কংক্রিটের মত কঠিন সেই প্লাস্টারের চাঁই। সবাই অবাক⋯সকলেই হতভম্ব। কিন্তু পুরোপুরি অবাক আর হতভম্ব হওয়ার তখনো যেন বাকি ছিল খানিকটা। প্লাস্টারের চাঁই ভাঙতেই অবিশ্বাস⋯ভয়⋯বিস্ময় আর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সেখানকার সকলের মধ্যে।

‘দেখা গেল—গোটা একটা মানুষের মৃতদেহ শুকিয়ে কুঁচকে ছোট হয়ে গেলেও তখনো চমৎকার প্রায়-নিখুঁত অবস্থায় রয়েছে। প্লাস্টার অভ প্যারিসের নিশ্ছিদ্র-বায়ুশূন্য খোলে থাকায় একটুও পচ ধরেনি দেহে। এমনকি পরনের কাপড়-চোপড়⋯লোম-চুল-দাঁত-নখ সবই অটুট ছিল স্বাভাবিকের মতই। ইনফ্যাক্ট, এ পারফেক্টলি মমিফায়েড বডি হিসেবে ছিল ওই ডেডবডিটা।

‘ব্যাপারটা যে রীতিমত অস্বাভাবিক, সেটা আরও প্রকট হল লাশের পাশে হাতখানেক লম্বা একটা লোহার রড় পড়ে থাকতে দেখে। সকলেই—বুঝলে ব্যাপারটা খুন ছাড়া আর কিছু নয়।

‘কে এই হতভাগ্য মানুষটি ? তাকে এমন করে এয়ারটাইট কেসিংয়ে পুরে এভাবে কবরই বা দিলে কে? এ তো সাম্প্রতিক কালের কোন ঘটনা নয় ! এখন এ কাজ একেবারেই অসম্ভব! তাহলে এ কীর্তি কবেকার?

‘পুলিশে খবর গেল। আমরা এলাম। তদন্ত শুরু হল। লাশের ফটো তোলা হল। আরও একটা চমকপ্রদ দৃশ্য দেখা গেল : বর্তমানে লাশটা আনুপাতিকভাবে শ্রিঙ্ক করে গেলেও কেসিংয়ে পোরবার সময়ে প্লাস্টার নরম থাকায় তার গোটা দেহের—বিশেষ করে মুখের একটা চমৎকার ন্যাচারাল ছাঁচ গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে। ফলে ডেডবডির আসল আর অকৃত্রিম বডি ফরমেশানের আঁচ পেয়ে গেলাম আমরা। ডেথ-ওয়েপনটার গায়ে আঙুলের কোন ছাপ আছে কি না, পরীক্ষা করতেই প্রাথমিক অবস্থায় সামান্য কিছু চিহ্ন আমরা পেলাম বটে, তবে তা নিয়ে উৎসাহ বোধ করার মত কিছু ছিল না। দীর্ঘ সময় আর কঠোর পরিশ্রম সাপেক্ষ তদন্তের মুখে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে এ খুনের ঘটনা আজকের নয়, এ ঘটনা হল সেই দীঘি ভরাটের সময়কার। অর্থাৎ ১৯৫০ সালের কোন সময়েই ঘটা সম্ভব।

‘অবশ্য গোয়েন্দা দপ্তর খুব ডেফিনিট ছিল না এই হিসেবে। তবে তখনকার পুলিশের মিসিং-পার্সনস ফাইল ঘেঁটে যদি কোন খবর পাওয়া যায়, তবে নিঃসন্দেহে সেটা তাদের কাছে একটা স্ট্রং ক্লু হয়ে দাঁড়াবে।

‘খোঁজাখুঁজি করতেই বেরোল এমনি একটা রিপোর্ট। তপন বিশ্বাস নিরুদ্দেশ হবার দু’মাস পরে তার স্ত্রী যেটা লিপিবদ্ধ করিয়েছিল পুলিশের কাছে। বলতে গেলে ফাইলটা আমিই বার করে দিলাম অনেক পরিশ্রমে। কারণ তখন আমিই ছিলাম স্বরূপনগর থানার জমাদার-কনস্টেবল। স্মৃতি চমক দিয়ে উঠেছিল ভাবতে ভাবতে।

‘গোটা জিনিসটা এবারে বেশ খানিকটা এগিয়ে এল আলোর দিকে। ডেডবডিটা বাস্তবিকই তপন বিশ্বাসের কিনা—সেটা প্রমাণ করাই প্রথম আর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল পুলিশের। কলকাতার এক মর্গে বিশেষ বিশেষ ওষুধ আর আরক দিয়ে সাবধানে সংরক্ষিত করে রাখা হল ডেডবডিটাকে⋯যাতে না চট করে ডিকম্পোজড্‌ হয়ে যায়।

‘তদন্তে জানতে পারলাম খুনের পদ্ধতি⋯ডেথ-ওয়েপন দেখে আন্দাজ করলাম খুনীর অকুপেশান। সে যে কোন বিল্ডার বা বিল্ডিং মেটিরিয়ালসের ব্যবসায়ে নিযুক্ত ছিল সন্দেহ নেই। নইলে বিশেষ ধরণের ওই রড আর একটা গোটা মানুষকে ঢাকা দেবার মত অত প্লাস্টার অভ প্যারিস সে পেল কোথায় ? এ তো সাধারণ মানুষের সব সময়ে ব্যবহার্য বস্তু নয় ! তারপর হাতের নাগালে ট্রান্সপোর্ট বা ট্রান্সপোর্ট চালাবার উপযুক্ত কর্তৃত্ব না থাকলে অতবড় চাঁইটাকে এভাবে দীঘির বুকে এনে ফেলা অন্যের পক্ষে আদৌ সম্ভবপর ছিল না।

‘যাই হোক, পাওয়া সূত্র আর সিদ্ধান্ত হাতড়ে একটা জিনিসই যা বারবার আমাদের—মানে পুলিশের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ালো, তা হল—এত বড় একটা প্লাস্টারের চাঁই নিশ্চয়ই সে খোলাখুলিভাবে কোন খোলা জায়গায়জমাতে যায় নি। কাজটা সেরেছে সংগোপনে—সকলের অলক্ষ্যে। সেখানে সে নিরুদ্বেগে কাজ সেরেছে, তারপর কারোর মনে কোন সন্দেহ না জাগিয়ে নির্বিবাদে তুলে এনে ফেলে দিয়েছে দীঘির বুকে। কোন মাস্টার বিল্ডার ছাড়া এ কাজ আর কার পক্ষেই বা সম্ভব ?

‘কিন্তু এটাও অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মত হয়ে দাঁড়াল। তৎকালীন পি. ডাবলিউ. ডি’র রেকর্ডে পাঁচটি বিল্ডিং ফার্মের নাম লেখা ছিল—যারা সে সময়ে দীঘিটাকে ভরাট করতে রাবিশ ফেলে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল সরকারকে। খবর নিতে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচটি ফার্মের দুটি ফার্ম ইতিমধ্যেই তাদের কারবার কোন কারণে গুটিয়ে ফেলেছে।

‘পুলিশ তা বলে মোটেই পিছিয়ে এল না। তারা ওই তিনটি ফার্মের সম্বন্ধেই তত্ত্ব-তালাস নিতে লাগল। আর তার ফলেই তিনটি ফার্মের অন্যতম একটি ফার্ম ‘রেণুকা বিল্ডার্স’-এর প্রোপ্রাইটর অনন্ত সেনের ওপর গিয়ে তাদের এনকোয়্যারির স্পটলাইট ফোকাসড্‌ হয়ে ধীরে ধীরে তাকে টেনে আনল আলোর বৃত্তে।

‘বর্তমানের প্রভাবশালী ও ধনী ব্যবসায়ী এবং স্বরূপনগরের একজন সম্ভ্রান্ত ও দায়িত্বশীল নাগরিক অনন্ত সেনের পক্ষে তিরিশ বছর আগে তপন বিশ্বাসকে হত্যা করার পেছনে কী মোটিভ থাকতে পারে গোয়েন্দা দপ্তরের বড় বড় ঝানু মাথা ভেবেও তার কোন কূল-কিনারা খুঁজে পেলেন না। ভাবাটাই হাস্যকর—ভাবাটাই অহেতুক।

‘ফোরেনসিক ল্যাব-এর লোকেরা ইতিমধ্যেই প্লাস্টার-কফিন আর লোহার রড নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে আরো একটা সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিল। একটুকরো হলদে কার্ড। ইট ওয়াজ সিম্পলি এ পিস অভ এ টাইম-শীট আর ওয়ার্কস-ডাটা। এ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে প্লাস্টার করার সময়ে কার্ডটা খুনীর পকেট থেকে দৈবাৎ পড়ে গিয়ে থাকবে—যা খুনী জানতে পারেনি।

‘অনন্ত সেনের মুখোমুখি হওয়ার আগে পুলিশ তাদের পায়ের তলায় সর্বপ্রথম শক্ত মাটি পেতে চাইল দাঁড়াতে। কেননা যার বিরুদ্ধে তাদের অভিযান, সে চুনোপুঁটি কেউ নয়! একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পাণ্ডা আর শাসক-মহলে তার বিশেষ প্রতিপত্তির কথাও সুবিদিত। চালের একটু এদিক-ওদিক হলে পুলিশমহল ভীষণ ঝাঁকুনি খাবে তার ফলে। সাসপেনসান-ট্রান্সফার-ডিমোশান ইত্যাদির ছয়লাপ পড়ে যাবে দপ্তরে দপ্তরে। বহু চিন্তা-ভাবনার পর একটা রাস্তা বার করল পুলিশ। এ ট্র্যাপ অভ সাম সর্ট।

‘তপন বিশ্বাসের সম্বন্ধে অনন্ত সেনের জ্ঞান আর ধারণা কতখানি তাই যাচাই করে প্রথমে দেখতে চাইল তারা। কারণ দুজনেই সমসাময়িক।

‘প্রথমেই খুঁজে বার করা হল তপন বিশ্বাসের স্ত্রীকে। ভদ্রমহিলা সৌভাগ্যক্রমে তাঁর সেই পুরোন বাড়িতেই বসবাস করছিলেন। নিজের বাড়ি ছেড়ে আর যাবেনই বা কোথায়? আমিই চেষ্টা-চরিত্র করে যোগাযোগ ঘটালাম তাঁর সঙ্গে। তাঁকে বলা হল, স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিয়ে তিরিশ বছর আগেকার যতগুলি সম্ভব ফলদ শুক্তি তুলে আনতে। মিসেস বিশ্বাস অবশ্য ব্যর্থই হলেন তাতে। যা কিছু তুললেন তা আমাদের কাছে আবর্জনারই সামিল—অকিঞ্চিৎকর। তাতে অনন্ত সেনের ভরাডুবি ঘটানো যাবে না। তবে এটুকু জানালেন, প্রত্যেক মাসেই দালালির টাকা ছাড়াও আরো বেশ কিছু বাড়তি টাকা বাড়িতে আনতেন তাঁর স্বামী। জিজ্ঞাসা করেও জবাব পান নি মিসেস বিশ্বাস। তবে একদিন রহস্য করে বলেছিলেন, তিনি নাকি একটা কল্পতরু বৃক্ষের খোঁজ পেয়েছেন।

‘পুলিশ এবার বুঝল, খুনের মোটিভ কী ? তপন বিশ্বাস ব্ল্যাকমেল করছিল খুনীকে।

‘তারা আরো চাপ দিল মিসেস বিশ্বাসকে—এ ব্যাপারে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বা কথা স্মরণে আনতে।

‘অ-নে-ক-ক্ষ-ণ পরে ভেবে ভেবে মিসেস বিশ্বাস জবাব দিলেন, তাঁর স্বামী একবার অসুস্থ থাকায় চিঠি দিয়ে তাঁকে কিছু টাকা আনতে পাঠিয়েছিলেন একজনের কাছে। পাওনা আছে নাকি। গিয়েও ছিলেন—পেয়েও ছিলেন। পাঁচশো টাকা। বার দুই গিয়েছিলেন।

‘লোকটাকে মনে আছে আপনার ? তার নাম-ধাম ?’

‘কেন থাকবে না। আজ তো তিনি মস্ত মানুষ এ শহরের। আপনারাও তাঁকে চেনেন। তিনি হলেন অনন্ত সেন।’

একটা নিশ্বাস বেরিয়ে বুকটা হালকা হয়ে গেল আমাদের।

‘ইন দ্য মীন টাইম, সেই হলুদ রঙের টাইম-কার্ডটা নিয়ে আর এক ধাপ এগোনো গেল। সৌভাগ্যের বিষয়, প্রিন্টার্সের যে নাম-ঠিকানা ছাপা ছিল তাতে সেটা নষ্ট হয়নি। কার্ডটাই নষ্ট হয়নি। খুঁজে খুঁজে বার করা হল সেই প্রেস। অবশ্য তিরিশ বছর আগেকার সেই চেহারা আর নেই। প্রিন্টার্স বেঁচে ছিল না। তার ছেলে আর জামাই-ই এখন মালিক। ছাপাখানা ও বাঁধাইখানার। তারাই খাতাপত্র, ফাইল ঘেঁটে জানাল যে এ কার্ড ছাপা হয়েছিল তাদের বুড়ো কর্তার আমলে। কাস্টমার জনৈক অনন্ত সেন। পাঁচশো কার্ড ছাপিয়েছিলেন ভদ্রলোক।

‘সব দিক দিয়ে নিজেদের তৈরি করে, এইবার এই প্রথম অনন্ত সেনের সঙ্গে মুখোমুখি হল পুলিশ।

‘স্বাভাবিক ভাবে এবং নিজের পক্ষে সঙ্গত কারণেই তপন বিশ্বাসের বিষয়ে প্রত্যেকটি প্রশ্নই অস্বীকার করল অনন্ত। এমন কি তাকে যে চিনত তাও স্বীকার গেল না সে। পুলিশ আর কিছ না বলে, ক্ষমা চেয়ে চলে এল তখনকার মত।

‘বিখ্যাত পুতুল প্রস্তুতকারক জীন হোয়াইট, ফোরেনসিক ল্যাব আর পুলিশ সমবেতভাবে মিলেমিশে তপন বিশ্বাসের একটা মোমের প্রতিমূর্তি গড়ে ফেলল চটপট। খুবই কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, মিসেস বিশ্বাস এ ব্যাপারে প্রভূত সহায়তা করলেন অক্লান্তভাবে। মোমের মডেল তৈরি শেষ হলে অনন্ত সেনকে আবার একদিন ইনভাইট করা হল হেড-কোয়ার্টার্সে।

‘পুলিশ দপ্তরে ঢুকেই মহা চেঁচামেচি জুড়ে দিল অনন্ত সেন। যার মোদ্দা কথা হচ্ছে এই : তাকে এভাবে মিথ্যে মিথ্যে হয়রাণি করার শোধ তুলে ছাড়বে সে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে দরবার করে যারা তার এই হয়রাণির মূল পাণ্ডা, তাদের প্রত্যেককে দেখে নেবে সে⋯ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘প্রধান তদন্তকারী অফিসার নীরবে এবং একান্ত ধৈর্য ধরে অনন্ত সেনের মনের উত্তাপ জুড়োন পর্যন্ত অপেক্ষা করে অবশেষে সময়মত মুখ খুললেন।

‘তপন বিশ্বাসকে আপনি তবে চেনেন না বলছেন ?’

‘বলছি। একশোবার বলছি। তার নাম শোনা তো দূরের কথা, চর্মচক্ষেই দেখি নি কখনো।’

‘আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। তপন বিশ্বাসকে আপনি খুব ভালমতই চিনতেন ও জানতেন। নইলে অপরিচিত কাউকে কি প্রত্যেক মাসে মোটা টাকা কেউ ভর্তুকি দিতে পারে ?’

‘তার মানে! কী বলতে চাইছেন আপনি?’ অনন্ত সেনের কণ্ঠস্বর রীতিমত রুক্ষ।

‘বলতে চাইছি আপনি প্রতি মাসে তপন বিশ্বাসকে একগাদা করে টাকা দিতেন কেন?’

‘টাকা দিতাম! আমি! কী যা তা বকছেন মশাই? প্রমাণ দেখাতে পারেন?’

‘নিশ্চয়ই। একটা নয়, দু-দুটো প্রমাণ।’ বলেই অফিসার একজনকে ইঙ্গিত করতেই সে একটু পরেই মিসেস বিশ্বাসকে নিয়ে এসে হাজির করল।

‘কে ইনি?’ প্রশ্ন করল অনন্ত।

‘মৃত তপন বিশ্বাসের স্ত্রী। ইনিই আমাদের প্রথম প্রমাণ যে, আপনি এঁর স্বামীকে চিনতেন-জানতেন এবং মাস মাস টাকা দিতেন। ইনি বার দুই নিজেও আপনার কাছ থেকে ওঁর স্বামীর হয়ে টাকা এনেছেন। এবার বলুন, আপনার কী বলবার আছে?’

‘এঁকে আমি চিনি না। কী উদ্দেশ্যে ইনি আমার বিরুদ্ধে বলছেন, তাও জানি না’। একটু থামল অনন্ত,তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমাকে ফাঁসাবার জন্যে এ হল পুলিশের একটা ডার্টি ট্রিকস্‌।’

‘তদন্তকারী অফিসার কয়েক সেকেণ্ড জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন অনন্ত সেনের দিকে, তারপর সহসাই হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আমি জানতাম, আপনি এরকম কিছুই একটা বলবেন। ওয়েল, এবার আমাদের দ্বিতীয় প্রমাণ—’

‘তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে একজন দুটি খাতা এনে তাঁর টেবিলে রাখল। একটা একটু বড়, আরেকটা পকেটবুক সাইজের।

অফিসার খাতা দুটোর বিশেষ পাতা খুলে সেটা অনন্ত সেনের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘হ্যাভ এ লুক মিস্টার সেন। বড় খাতাখানা হল তিরিশ বছর আগের আপনার ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট অভ অ্যাকাউণ্টস ; দ্বিতীয়খানা হল তপন বিশ্বাসের ডায়রী। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে খাতাখানা মিসেস বিশ্বাস তাঁর স্বামীর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এতদিন পরম যত্নে নিজের কাছে প্রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। এই দেখুন, আপনি ব্যাঙ্ক থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত পাঁচশো করে টাকা তুলেছেন যে তারিখে, তপন বিশ্বাসের ডায়রীতে ঠিক সেই তারিখেই তত টাকাই জমা রয়েছে আপনার খাতে। এর মানে কী?’

‘আপনিই বলুন দয়া করে?’ ব্যঙ্গ ভরে বলল অনন্ত।

‘মানে তপন বিশ্বাস আপনাকে ব্ল্যাকমেল করছিল।’

‘ব্ল্যাকমেল! আমাকে?’ সশব্দে হেসে উঠল অনন্ত। ‘কল্পনারও সীমা থাকা দরকার মিস্টার অফিসার। যাকে চিনি না, জানি না, সে কী কারণে ব্ল্যাকমেল করতে যাবে আমায়?’

‘সত্যিই কি কোন কারণ ছিল না সেন মশাই?’ নিষ্পলক চোখে চেয়ে খুব শান্ত কণ্ঠেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন অফিসার।

‘স্পষ্টতই চমকে উঠল অনন্ত। মুখের রং যেন কয়েক সেকেণ্ডের জন্যেই বি-রং হয়ে গেল। কতকটা মরিয়া ভাবেই বলল, ‘ভিত্তিহীন প্রশ্নের কী জবাব দেব আমি?’

‘তাহলে আমিই দিচ্ছি জবাবটা। আপনি মিলিয়ে নিন মনে মনে। আপনারই পরমাত্মীয়া একটি যুবতী মেয়ে কপালদোষে বিধবা হয়ে আপনার সংসারে গলগ্রহ হয়ে বাস করতে থাকে। তার যুবতী শরীর আপনার মনে লালসার ইন্ধন জোগায়। ক্রমশ আপনি কামনার দাস হতে থাকেন। একদিন সুযোগ বুঝে মেয়েটির সর্বনাশ করে ছাড়েন। এবং মাঝে মাঝেই চড়াও হতেন তার ওপর—যেহেতু তাকে খেতে-পরতে দিতেন। মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ল একদিন। কেলেঙ্কারী আর চাপা দেওয়া যাবে না বুঝে তাকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাবার নাম করে সোজা এনে গছিয়ে দিলেন কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লীর এক দালালের হাতে। বিনিময়ে কিছু অর্থ পেয়েছিলেন কিনা তা অবশ্য এখন বলতে পারব না।

‘তপন বিশ্বাস যে কোন রকমেই হোক ঘটনাটা জানতে পারে। আর তারই জের টেনে আপনাকে শুরু করে ব্ল্যাকমেল। আপনি সাময়িক ভাবে তার জালে গিয়ে পড়লেও মনে মনে স্থির করেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার জাল কেটে বেরিয়ে আসতে।

‘আর তারই ফলশ্রুতি স্বরূপ খুন হলো তপন বিশ্বাস। মিস্টার সেন, ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট অভ অ্যাকাউন্টস আর তপন বিশ্বাসের ডায়রী লক্ষ্য করুন। ঠিক এগারো মাসের মাথায়, আপনার উইথড্রয়াল ঠিকই আছে, কিন্তু ওই তারিখে তপন বিশ্বাসের খাতায় টাকা জমা নেই। তার মানে ওই দিনই খুন হয় সে।’

‘হাউ ডেয়ার ইউ সে সো!’ বাঘের মত হাঁকার দিয়ে উঠল অনন্ত সেন। ‘আমায় খুনী সাজাচ্ছেন! আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে—’

‘তাকে থামিয়ে দিয়ে অফিসার বললেন, ‘সে তো পরের কথা আগে এখনকার কথা শেষ হোক। শুনে রাখুন মিস্টার সেন, একজনের সরলতার সুযোগ নিয়ে তার গোটা জীবনটাই নষ্ট করে দিলেন, আর একজনের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার জীবনটাই ধ্বংস করে দিলেন। আপনি শুধু একজনেরই খুনী নন, ইউ আর এ ডাবল কীলার। দুটি প্রাণীকে খুন করেছেন আপনি। ভেবেছিলেন তপন বিশ্বাসের ডেডবডি লুকিয়ে ফেলে আপনি রেহাই পেয়ে গেলেন, না? ভুল, মিস্টার সেন, ভুল। সেই তপন বিশ্বাসই আজ তার সমাধি থেকে উঠে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এসেছে। ওই দেখুন—’

‘সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরে গেল ঘরের আর এক পাশের। দেখা গেল টেবিলে সামান্য ঝুঁকে বসে রয়েছেন তপন বিশ্বাস। সেই মোমের তৈরি ডামি।

‘আঁতকে উঠল অনন্ত সেন। তার প্রায় ভিরমি খাবার যো। চোখ বিস্ফারিত, নাকের পাটা ফোলা, মুখ হাঁ, দরদর করে ঘামছে, ঠোঁটের কষে ফেনা। থরথর করে কাঁপছে।

‘অফিসার বলতে লাগলেন, ‘টাকা দেবার অছিলায় সেই অভিশপ্ত রাতে আপনি তপনকে ডেকে আনেন আপনার অফিসঘরে। এর আগেও সে এসেছে, তাই অবিশ্বাস করতে পারে নি। আপনি ওর সামনে নোটের বাণ্ডিল ধরে দিলেন ; সবই পাঁচ টাকার নোট। ইচ্ছে করেই এনেছেন ব্যাঙ্ক থেকে যাতে গুণতে সময় লাগে তপনের। ওই দেখুন, ও আপনার টাকা গুণছে নিশ্চিন্ত মনে। এই সুযোগ। আপনি চুপি চুপি ওর পেছনে এলেন⋯হাতে নিলেন লোহার রড়⋯তারপর⋯

‘আগেকার নির্দেশ মত একজন বিদ্যুৎবেগে সেই ডামির মাথায় তার হাতের জমাট রবারের তৈরি ব্যাটন চালাল। মুহূর্তের মধ্যে ঘাড় ভেঙে টেবিলের ওপর লুটিয়ে পড়ল সেই ডামি।

‘ঠিক সেই সময়ে⋯প্রায় একই সঙ্গে ‘না আ-আ-আ’ করে একটা আর্ত চিৎকার করে অনন্ত সেনও চেয়ার থেকে টলে পড়ল মাটিতে। জ্ঞান হারাল।

‘জলের ঝাপটা দিয়ে যখন তার জ্ঞান ফেরানো হল, তখন সে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।

‘অতি কষ্টে নির্জীবের মত শুধু বলল, ‘আমি খুনের একরার করছি। আপনারা আমার একরারনামা লিখে নিন।’

‘আসলে লোকটা তো বর্নক্রিমিন্যাল ছিল না। পরিস্থিতিই তাকে ক্রিমিন্যাল সাজতে বাধ্য করেছিল।

‘বাকি অংশটুকু জলবৎ তরলং। তিরিশ বছর আগের এক খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হল অনন্ত সেনকে।’

সিগারেটের শেষ অংশটুকু অ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে ত্রিদিববাবু হেসে বললেন, ‘কেসটাতে খেটেছিলাম খুব। অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছিল আমাকে। সরকার তার পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করেননি আমায়। ইন্সপেক্টারের পোস্ট থেকে এক ধাক্কায় উঠে গেলাম পুলিশ সুপারের পোস্টে। তারপর ধাপে ধাপে আজ এই পদে। এই সঙ্গে এও অভিজ্ঞতা হল—পাপ আর পারা কখনো চাপা থাকে না। সুযোগ ও সুবিধে পেলেই ফুটে বেরোবে। আর সবাইয়ের চোখে ধুলো দিলেও একজনকে এড়ানো কখনো যায় না—তিনি হলেন সেই সর্বনিয়ন্তা নীরব সাক্ষী স্বয়ং ঈশ্বর।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *