ডেজি ফুলের কথা

ডেজি ফুলের কথা

শহর থেকে দূরে, খোলা-মেলা জায়গায়, পথের ধারে একটি ফুল-ঘর। তার সামনে ফুলে ভরা ছোটো বাগান, চারধার ঘিরে সাদা কাঠের বেড়া, বেড়ার খুঁটির মাথায় সবুজ মুটকি বসান। বেড়ার বাইরে তাজা সবুজ ঘাসে ঢাকা খানিকটা ঢালু জমি। সেখানে একটি ডেজি ফুল ফুটে ছিল। বাগানের জমকাল ফুলের উপরেও যেমন উজ্জ্বল উষুম-উষুম রোদ পড়ত, বাগানের বাইরে ছোটো ডেজি ফুলের উপরেও তেমনই পড়ত। ডেজি ফুল তাই দিনে দিনে বেড়ে উঠে, একদিন তার সব পাপড়ি মেলে ধরল। তার একবারও মনে হল না যে ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না ; মনে মনে সে ভারি খুশি । সূর্য রোদ দেয়, তার দিকে সে মুখ ফিরিয়ে দেখে, আকাশে উড়তে উড়তে লার্ক পাখি গান গায়, তাই শোনে। নিজে গাইতে পারে না বলে এতটুকু দুঃখ নেই। ভাবে, ‘আহা সব দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, গায়ের উপর রোদ পড়ছে, বাতাস আমাকে চুমো খাচ্ছে। আহা, আমার কি সৌভাগ্য ’ বেড়ার মধ্যে জমকাল দেখতে, কাঠের মতো আড়ষ্ট কতকগুলো ফুল, তাদের সুবাস যেমন কম, দেমাক তেমন বেশি। গোলাপের চাইতেও যাতে বড়ো দেখায়, তাই পিওনি ফুলরা পাপড়ি ফুলিয়ে বসে আছে। টিউলিপের কি খাসা রঙ আর সে কথা নিজেরাও ভালো করেই জানে তাই মোমবাতির মতো ঠায় খাড়া হয়ে আছে, যাতে সবার চোখে লাগে।

বেড়ার বাইরের ছোটো ফুলটাকে তারা গ্রাহাই করল না। ডেজি কিন্তু তাদের দিকে আরো ভালো করে দেখতে লাগল, ভাবল, ‘আহা, কি জমকাল, কি সুন্দর ওরা। ঐ চমৎকার পাখিটা নিশ্চয়ই ওদের সঙ্গে দেখা করতে নেমে আসবে।

আমি কি সুখী, ওদের এত কাছে থাকতে পাই, ওদের রূপ দেখতে পাই!” ঠিক সেই সময় আকাশ থেকে লার্ক পাখিটা সত্যি সত্যি নেমে এল। কিন্তু সে পিওনিদের কাছে, কিম্বা টিউলিপদের কাছে মোটেই গেল না, এল সোজা উড়ে যেখানে ঘাসের মধ্যে ছোটো ডেজি বেচারি লুকিয়ে ছিল। বেজায় আনন্দের চোটে ডেজির তো প্রাণপাখি প্রায় খাচা ছাড়া, তার উপর এমনই অবাক হয়ে গেল যে কি যে মনে করবে ভেবে পেল না !

ছোটো পাখিটা ঘাসের উপর লাফাতে লাগল, গাইতে লাগল, “আহা, এ ঘাসটি কি নরম । আর কি মিষ্টি ছোটো ফুলটি ফুটেছে, সোনালি বুকটি তার, রুপোলি তার সাজ ।” ডেজি ফুলের হলুদ কেশরকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সোনার তৈরি, আর তার চারধারের ছোটো সাদা পাপড়িগুলোকে মনে হচ্ছে যেন রুপোর তৈরি।

ছোটো ডেজি ফুলটির কি আনন্দ। এত আনন্দের কথা কেউ ভাবতে পারে না ! পাখি এসে ঠোঁট দিয়ে তাকে চুমে খেল, তাকে গান শোনাল, তার পর নীল আকাশে আবার উড়ে চলে গেল। নিজেকে সামলে নিতে ফুলটার সিকি ঘণ্টা লাগল। খানিকটা লজ্জা পেয়ে, আবার বেজায় খুশি হয়ে, সে বাগানের ফুলদের দিকে চেয়ে দেখল। সে যে আজ কত সম্মান কত আনন্দ পেয়েছে, সে কথা নিশ্চয় তারা বুঝতে পেরেছে, নিশ্চয় জানতে পেরেছে আজ সে কত সুখী। কিন্তু দেখে কি-না টিউলিপরা দুগুণ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রাগের চোটে তাদের মুখ সব টক্টকে লাল! আর পিওনিরা এমনিতেই মোটা-মাথা, ভাগ্যিস তারা কথা বলতে পারে না, নইলে সেদিন ডেজি বেচারিকে বেশ দু-চারটে কড়া কথা শুনতে হত !

এমনিতেই সে বুঝতে পারল ওরা ভারি চটেছে, ওর নিজেরও তাতে খুব খারাপ লাগল। একটু পরে একটি চকচকে ধারাল ছুরি হাতে নিয়ে একটি মেয়ে বাগানে এল। সে টিউলিপদের কাছে গিয়ে কুছ কুছ করে একটার পর একটাকে কেটে নিল। ডেজির বুক থেকে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে গেল, “কি ভীষণ ! এবার আর ওদের

কিছু বাকি রইল না।” ফুল নিয়ে মেয়েটি চলে গেল। ডেজি ফুল বড়ো খুশি যে সে বেড়ার বাইরে ঘাসের মধ্যে গজিয়েছে, কেউ তার আদর করে না ! সূর্য ডুবে গেলে, পাতাগুলি মুড়ে ডেজি ফুল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রোদের আর সেই সুন্দর পাখিটার স্বপ্ন দেথতে লাগল।

পর দিন সকালে যখন ঝরঝরে শরীরে, খুশি মনে ছোটো ফুলটি সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আর পরিষ্কার নীল বাতাসে তার সাদা-সাদা পাপড়িগুলোকে মেলে ধরল, তখন আবার পাখিটার গান শুনতে পেল। আজ কিন্তু গানটাকে কেমন করুণ শোনাল। হায়, হায়, পাখির দুঃখের যথেষ্ট কারণও ছিল। কে তাকে ধরে খোলা জানলার ধারে খাচায় পুরে রেখেছে ! তখন কি গান গাইল পাখি ? সে গাইল অবাধ স্বাধীনতার আনন্দের কথা, মাঠে মাঠে কচি সবুজ শস্যর কথা, সীমাহীন খোলা আকাশে ডানায় ভর করে ভেসে বেড়ানোর কথা। তার মনে সে কি দুঃখ, ঐ ছোটো খাঁচায় তাকে কয়েদী হয়ে থাকতে হচ্ছে !

ছোটো ডেজি ফুলের বড়ো ইচ্ছা তাকে সাহায্য করে, কিন্তু কিভাবে করা যায় ? কিছুই ভেবে পেল না, তাই চারদিকটা যে কি সুন্দর, সূর্যের আলো যে কি কোমল কি গরম এসব সে ভুলে গেল। হায়, সেই বন্দী পাখি ছাড়া আর কোনো কথা তার মনে রইল না। হঠাৎ বাগান থেকে দুটি ছোটো ছেলে বেরিয়ে এল। একজনের হাতে একটা ছুরি, যে মেয়েটা টিউলিপ ফুল কেটেছিল তার ছুরিটার মতোই বড়ো আর ধারাল। ওরা সোজা ডেজি ফুলের কাছে এল, সে তো ভেবেই পেল না ওরা কি চায়।

একটা ছেলে বলল, “এই তো এখান থেকে লার্ক পাখির জন্য মাটির চাবড়া কেটে নেওয়া যায়!” এই বলে ডেজি ফুলকে মাঝখানে রেখে, তার চারদিকে অনেকখানি গভীর করে খুড়ে মাটির চাবড়া তুলে নিল। অন্য ছেলেটা বলল, “ফুলটা ছিড়ে ফেলে দাও।” ডেজি বেচারা ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে তো জানে যে ছিঁড়ে ফেললেই সে মরে যাবে ; লার্কের খাচায় তাকে রাখা হবে, তার বাঁচার বড়ো ইচ্ছা।

প্রথম ছেলেটা বলল, “না, ফুল থাক, কি সুন্দর দেখতে বল তো।” কাজেই ফুল ছেড়া হল না, মাটির চাবড়াসুদ্ধ লার্কের খাঁচায় তাকে রাখা হল। পাখি বেচারি স্বাধীনতা হারিয়ে বিলাপ করত, খাঁচার লোহার গরাদে ডানা ঝাপটাত। ফুল তো আর কথা বলতে পারে না, শত ইচ্ছা সত্ত্বেও সে পাখিকে এতটুকু সাস্তুনা দিতে পারত না। এইভাবে সারা সকাল কাটল।

লার্ক বলল, “এখানে জল নেই। ওরা সবাই বেরিয়ে গেছে, আমার কথা ভুলে গেছে। এক ফোটা জল নেই যে পান করব, গলা শুকিয়ে জ্বালা করছে। আমার দেহে বরফ আর আগুন ; বাতাস ভারি হয়ে আসছে। হায়, আমাকে এবার মরতে হবে এই কোমল গরম রোদ, এই শামল সবুজ খেত, সব ছেড়ে যেতে হবে।”

শরীর শীতল করবার জন্য ঘাসের মধ্যে সে ঠোঁট চুকিয়ে দিল। দিতে গিয়েই ডেজি ফুলের উপর চোখ পড়ল ; তাকে নমস্কার করে পাখি বলল, “হায় রে ছোটাে ফুল, তুমিও এখানে শুকিয়ে যাবে। অত বড়ো পৃথিবীটা আমার ছিল, তার বদলে ওরা তোমার চারপাশের ঐ সবুজটুকু আমাদের দিয়েছে। আমার কাছে প্রত্যেকটি ঘাসের ফলক যেন সবুজ মাঠের মতে, তোমার প্রতিটি সাদা পাপড়ি যেন সুগন্ধে ভরা এক-একটি ফুল। হায় রে, তোমাকে দেখে খালি মনে পড়ছে আমি কি হারালাম !” ডেজি ভাবল আহা, যদি ওকে দুটো সান্ত্বনার কথা বলতে পারতাম। সন্ধে হয়ে গেল, তবু পাখি বেচারিকে এক ফোটা জল দিতে কেউ এল না। পাতলা ডান দুটি মেলে সে ফুলের দিকে ঝুকে পড়ল, তেষ্টায় আর মুক্তি পাবার বাসনায় তার বুক ভেঙে গেল। ফুল-ও আজ রাতে পাতা মুড়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারল না। শরীরে গ্লানি, মনে দুঃখ নিয়ে সে মাটিতে নুয়ে পড়ল। তার পরদিন সকালের আগে ছেলেরা বাড়ি ফিরল না। এসে যখন দেখল পাখি মরে গেছে, তাদের সে কি কান্না !

সুন্দর লাল রঙের একটা বাক্সে পাখির দেহটি ভরে, তাকে মাটিতে পুতে দিল। তার পর কবরটাকে ফুল দিয়ে সাজাল । পাখি বেচারার রাজার যোগ্য সমাধি হল। যখন সে বেঁচে ছিল, সুন্দর গান গাইত, তখন তার কথা ভুলে গেল। খাচার ভিতর সে যে কী কষ্টের মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেল আর যেই না বেচারা চোখ বুজল, অমনই তার কি সম্মান, তার জন্য কত বিলাপ !

আর ডেজি ফুলের কি হল ? ডেজি ফুলসুদ্ধ ঘাসের চাবড়াটাকে ছুড়ে রাস্তার ফেলে দেওয়া হল। পাখির জন্য তার এত সহানুভূতি পাখিকে সান্ত্বনা দেবার তার এত ইচ্ছা ছিল, তবু তার কথা কেউ একটু মনেও করল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *