ডেইজি, দাউদ ও দুর্গম বিপদ
সকাল সকাল আমাকে নিয়ে যেতে পাশা চলে এলো। ওকে জানালাম, আফগান দূতাবাসে একবার যোগাযোগ করা দরকার। কয়েক দিন পরই একদিন সকাল নয়টায় যে ভিসা সংগ্রহের কথা ছিল, সেটাকে এত দিনে স্কচ হুইস্কির মতোই দুর্লভ ও দামি মনে হচ্ছিল। তবে দামি এই বস্তুটার জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই সামনে বসা লোটার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল- আমার কাছে ৫০০ ভিসার আবেদনপত্র জমা আছে এবং কাবুল থেকেই ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। তবে এই মুহূর্তে ভিসা দেওয়া বন্ধ। একই পুরোনো কথার পুনরাবৃত্তি করে আগামী সপ্তাহে আবার দেখা করতে বলল নিরস লোকটি।
একটুও দমে গেলাম না। সরে না গিয়ে আমি বলতে শুরু করি, আমার সত্যিই তোমার দেশে যাওয়া প্রয়োজন। ওখানে কী ঘটছে তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। শুনেছি, কাবুল হাসপাতালে উপজাতি লোকজন দল বেঁধে রক্ত দিচ্ছে বিমান হামলার আশঙ্কায়। একবার যেতে পারলে আমিও এক ব্যাগ রক্ত দান করে আসব।
প্রস্তাব শুনে লোকটা অবিশ্বাস আর সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। হয়তো তিনি ভাবছিলেন, আমি বদ্ধ উন্মাদ অথবা অবিশ্বস্ত বিদেশিদের রক্তের দরকার নেই। আমার অনুরোধে লোকটার চেহারায় কোনো ভাবান্তর ঘটল না। বুঝলাম, দ্রুতই আমার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।
খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে পাশা ফিক করে হেসে দিল। ও খোচা মেরে বলল, আমি নাকি অপরাজেয় মানুষ। এবং এই দৃঢ় মনোভাব পোেষণ করি দেখে আমার নাকি এত দিনে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী পেয়ে যাওয়া উচিত ছিল। জবাবে কার্যসিদ্ধির জন্য একাধিক উপায় বিদ্যমান বলে আমাদের আরও অপেক্ষা করা উচিত বলে ওর মুখ বন্ধ করে দিই।
এরপর একটা সরকারি অফিসে যাই, যেখান থেকে কাশিরের ভিসা ইস্য করা হয়। কয়েক দিনের ছুটি কাটাতে পর্যটক হিসেবে কাশ্মির যেতে চাই বলে অফিসে বসা কর্মকর্তাকে বলি।
তিনি আমার হাত থেকে দ্রুত আবেদনপত্রটা নিয়ে তিন সপ্তাহ পর দেখা করতে বলেন। এরপর তিনি উঠে চলে গেলেন এবং অফিসের কাউন্টারে আর ফিরে আসেননি। তাই একসময় আমারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। আমি কাশ্মিরে যেতে চেয়েছিলাম আল-বদর গ্রুপের ক্যাম্প পরিদর্শন করতে। এরা কাশিরভিত্তিক একটা সন্ত্রাসী দল। খুব সম্ভব আমেরিকান বাহিনী সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আল-বদর ক্যাম্পে বোমা নিক্ষেপ করবে।
পাশাকে পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাই। আমরা দুজন ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে বেশ কয়েকটি অফিস পরিদর্শন করি। এগুলো আল-বদর ও বিভিন্ন মুজাহিদিন গ্রুপের স্থানীয় অফিস। আমি ব্রিটিশ এবং ওদের ঘাঁটি পরিদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করছি, এসব জানার পর অফিসের লোকজন কেমন। অদ্ভুত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাতে থাকে। অবস্থা সামলাতে পাশা এগিয়ে আসে এবং উর্দুতে কথা বলতে শুরু করে। আমি কে ও কী কারণে ওদের সামরিক ঘাঁটি দেখতে চাই, এসব কথা বেশ সময় নিয়ে পাশা ওদের বোঝাতে থাকে।
এক বিন্দু উর্দু না বুঝলেও ওদের কথা শুনে এমনই মনে হচ্ছিল। এক অফিসে তো পাশা ঘন্টাব্যাপী আলোচনা চালিয়ে যায়। বিন্দুবিসর্গ বুঝতে সক্ষম না হলেও অনুমান করি, পাশা বলছিল আমি একদমই নিরীহ গোছের শান্তশিষ্ট মানুষ এবং ইতিবাচক প্রতিবেদনই তৈরি করব। মুজাহিদিন অফিসে মুমতাজ নামের এক তরুণ পাকিস্তানি আমাদের জন্য একটা ভ্রমণের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবে বলে কথা দেয়।
এক ছাপাখানা থেকে নতুন করে কতগুলো বিজনেস কার্ড ছাপিয়ে নিই। লন্ডন থেকে নেওয়া কার্ডগুলোতে এক্সপ্রেস-এর লোগোতে ক্রুশ চিহ্ন ছাপানো ছিল। পাছে ক্রুশ চিহ্ন না আবার কোনো ভুল ধারণা তৈরি না করে, তাই বিখ্যাত কুশ মুছে দিয়ে নতুন কার্ডগুলো বানিয়ে নিই।
কখন আবার এখানকার মুসলমানরা খেপে ওঠে, এ ভয়টা সব সময় কাজ করত। প্রেসিডেন্ট বুশ ইতিমধ্যেই এক বক্তব্যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছেন। তাই কখন আবার আমি ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এই ধারণা জনগণের মাঝে বদ্ধমূল হয়ে বসে, সেই শঙ্কাও ছিল।
দিনটা সব মিলিয়ে ভালো-মন্দের মিশেলে পার হয়ে যায়। সন্ধ্যায় কফি খেতে খেতে আগামী এক সপ্তাহের কাজের ফিরিস্তি সাজাচ্ছিলাম। কাশ্মিরের সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি পরিদর্শনের সুযোগ না পেলে আমার সামনে আফগানিস্তান যাওয়ার পরিকল্পনাই বাকি থাকে। হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যারা তখনো রয়ে গেছে, তাদের অনুভূতি জানাটা খুব জরুরি। এ নিয়ে একটা ভালো প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। কয়েকজন আফগান নারীর সঙ্গেও আমাকে কথা বলতে হবে। জানতে হবে তাদের অন্ধকার জগতের উপাখ্যান।
পাশা কয়েক জায়গায় ফোন করে কথা বলে। একসময় আমার হাতে ফোনটা দিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করে। আলাপের সারমর্ম হচ্ছে, এক হাজার দুই শ ডলারের বিনিময়ে আফগানিস্তানের সীমান্তের কাছে দাউর বাবায় পৌছে যাব।
এক হাজার দুই শ ডলার খরচ করে সীমান্তের কাছ থেকে ঘুরে আসব? আমি প্রায় ধমকের সুরেই বললাম। এ-ও বললাম, জালালাবাদ নিয়ে যেতে পারলে আমি রাজি। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়নি যে, এত টাকা খরচ করে সীমান্ত থেকে ঘুরে আসব। কড়া ভাষায় বললাম, আমি দেশটার একদম ভেতরে ঢুকতে চাই। অথবা কোনো চুক্তি হবে না বলেই ফোনটা পাশাকে দিয়ে দিলাম।
পাশা আরও কিছুক্ষণ লোকটার সঙ্গে কথা বলল। ওর গলাটা আস্তে আস্তে চড়ে যাচ্ছিল। এক বেয়াড়া আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। পেছনে বসে খবরের কাগজ পড়তে থাকা এক নিরীহ গোছের পাকিস্তানি লোকও আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি তার দিকে তাকাতেই তিনি কাগজে কিছু একটা লিখতে শুরু করেন। একটু ভয় পেয়ে যাই।
তৎক্ষণাৎ একটা ছোট কাগজে লিখে পাশার হাতে তুলে দিই। আস্তে কথা বলো। সম্ভাব্য পাকিস্তানি আইএসআইয়ের এজেন্ট পেছনে। পাশা দ্রুত লাইনটা কেটে দেয়। আমরা বিচ্ছিন্নভাবে আলাদা আলাদা পথে বের হয়ে পুনরায় ওর হলুদ ট্যাক্সির কাছে এসে একত্র হই। ট্যাক্সিটা দেখলে ভাঙাচোরা মনে হয়। ভেতরের এসিটা নিজের খেয়াল-খুশিমাফিক চালু হয়।
তবে গাড়ির ইঞ্জিনটা সিংহ হৃদয়ের এবং চমক্কার কাজ করে। না, ক্যাফেতে দেখা হওয়া লোকটা আশপাশে নেই। আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।
ইসলামাবাদের অভিজাত হোটেলগুলোর আশপাশে অনেক আইএসআই ঘুরঘুর করে। গণমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি নিয়ে তারা ব্যাপক সন্দিহান। আমি নিশ্চিত, হোটেলের রেস্তোরার এক বেয়ারা তলে তলে আইএসআইয়ের গোয়েন্দা। চোখের চাহনিটা কেমন যেন সন্দেহজনক। কোনো একটা কাজ করতে বললেই কেমন অখুশি হয় আর হতভম্ব দেখায় ওকে।
যাওয়ার পথে আফগান দূতাবাস পড়ে। বাইরের রাস্তায় অনেক টিভি ভ্যান, সাংবাদিকদের ভিড়। একটা সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে নিশ্চয়ই। অন্দরে প্রবেশ করেই দেখি তালেবান মুখপাত্র বাইরের উঠানে সর্বশেষ পরিস্থিত নিয়ে মতবিনিময় করছেন। সবাই নিচে বসে আছে। ক্যামেরাগুলো উঁচু-নিচু মাঠে সতর্কভাবে দাঁড় করানো।
সিএনএনের প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ক্রিস্টিয়ান আমনপুর খুব জোরে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন। অন্যরাও মাঝেমধ্যে মোল্লা আব্দুস সালাম জায়িফকে প্রশ্ন করছিলেন। তাঁদের কীর্তিকলাপ দেখে মনে হচ্ছিল, সবাইকে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত। আমি উঠানের ডান দিকে সুসুমু বারির পাশে এসে দাঁড়াই। জাপানি দৈনিক ইয়োমিউরি শিমবুন-এর স্থানীয় প্রতিনিধি সে। আমরা একই সঙ্গে আফগানিস্তানের ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম।
ঠিক ওই মুহূর্তে এক থুথুড়ে বুড়ো লোক গাছের মগডাল থেকে ধড়াম করে একজনের মাথার ওপর পড়ে যায়। ব্যাটা এক মগডালে অসতর্কভাবে বসে ছিল। সবাই এক লহমায় ওদিকে ঘুরে তাকায়। হতভম্ব ওই সাংবাদিক উঠে বসে পায়ে হাত বোলাচ্ছিল। আমি চুপ থাকতে পারলাম না। যুদ্ধের প্রথম আহত ব্যক্তি, একটা চাপা হাসির রোল উঠল। লম্বা দাড়িবিশিষ্ট ও বিশাল পাগড়ি পরিহিত কয়েকজন কর্মকর্তা আমার দিকে ক্রুদ্ধভাবে তাকাল। আশ্চর্য এরা কোনটা কৌতুক, তা-ও বোঝে না।
সংবাদ সম্মেলনটা ছিল খুব অদ্ভুত ধরনের। কথার মাঝে মাঝে কোরআনের আয়াত উচ্চারিত হলো। ৪০টা দেশ থেকে সাংবাদিকেরা হাজির হয়েছিলেন এই সম্মেলনে।
উপস্থাপনা, বিষয় এবং বক্তব্য-সবকিছুই ছিল কেমন অর্থহীন। আমার এদের জন্য করুণা হলো। গণমাধ্যমের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই নেই। আমরা হতে পারতাম তাদের অবস্থান বিশ্ববাসীকে জানানোর শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কিন্তু তারা জানে না কীভাবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়। ডেভিড তখন পেশোয়ারে খবরের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তাই আমিই এক্সপ্রেস-এর বিদেশ প্রতিনিধি গ্যাব্রিয়েল মিলাভের কাছে কিছু তথ্য পাঠিয়ে দিই।
দিনটা খুব একটা মন্দ যায়নি। হোটেলে ফেরত এসে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বেশ ভালোই আছে। ইসলামাবাদ মদমুক্ত এলাকা, এটা জানার পর থেকে মা অনেকটা নির্ভার হয়ে যান। আমার মদ্যপান তার দুই চোখের বিষ। ছোট বোন ভিভ যখন মায়ের কাছে কূটনামি করে, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শ্যাম্পেন খাই, তখন মা প্রচণ্ডভাবে রেগে যান। তার কাছে মদ্যপান ভীষণ ক্ষতিকর এবং শুধুই অর্থের অপচয়। বাড়ি গেলে আমি সবাইকে বলে বেড়াই যে বেটি ফোর্ড ক্লিনিক থেকে ঘুরে এসেছি। মদ্যপান নয়, ধূমপান নয়। সবুজ শাকসবজি খাও। প্রচুর ফলমূল খাও, এতে প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল আছে, এইসব হাবিজাবি।
মা পাশার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন এবং আমাকে দেখেশুনে রাখছে বলে তাকে ধন্যবাদ জানাতে চান। পাশার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হবে কি না, মা জানতে চান। কী বিরক্তিকর মহিলা? কে জানে, জন সিম্পসন ও কেট অ্যাডিকেও মনে হয় উনি এমন যন্ত্রণা দিচ্ছেন।
মা আমার পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তেমন কিছুই। ভাবিনি বলে জানাই। সম্ভবত একটা নিশ্চিন্ত সপ্তাহ কেটে যাবে। কিছু না কিছু করার মতো পেয়ে যাব বলে মাকে আশ্বস্ত করি। বাপরে, আফগানিস্তান যাওয়ার দুর্দান্ত সাহসে তিনবার ভিসার আবেদন করেছি, কস্মিনকালেও এটা মাকে জানানোর মতো সাহস আমার নেই। অন্য দুটো গোপন পরিকল্পনা সম্পর্কেও জানাতে পারি না।
মায়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। সুদূর ম্যানচেস্টারে মা টেনশনে ভুগছেন আঁচ করতে পারি। অনুযোগের সুরে বলতেই থাকেন, ‘দেখ মা, আর যা-ই করিস, তুই কাশ্মিরের দিকে পা বাড়াসনে, ওখানে তোকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে আমরা কেউ আর তোর মুখ থেকে দেখতে পাব না। তোর একটা মেয়ে আছে। ওই হতভাগিনীরও একজন মায়ের দরকার আছে। ঠিক মোক্ষম জায়গায় মা হাত দিয়েছেন। এই একটি বিষয়েই আমার মা বা অন্য কারও কাছে মিথ্যা বলার সাহস নেই। তাই নীরবতা অবলম্বনই বাঞ্ছনীয়।
আমি যে ইসলামাবাদে জীবন হাতে নিয়ে ঘুরছি, তা ডেইজিকে এখনো বলার সাহস করে উঠতে পারিনি। আমাকে বিপৎসংকুল নিউ ইয়র্কে যেতে হচ্ছে না, এটা জেনেই ও খুশি ছিল। প্রতিদিন রাতেই ফোনে ওকে বলতে হয় আমি বিছানায় শুয়ে টেলিভিশন দেখছি। ছোট মেয়ে দেখে হয়তো এখনো সন্দেহ করতে পারেনি।
আমার ভয় বেড়েই চলছিল, কারণ আজ হোক কাল হোক, ওকে আমার বলতেই হবে যে আমি ইসলামাবাদে আছি। কারণ, পরের শুক্রবারে স্কুল ছুটি হলেই ওর সঙ্গে একত্রে ছুটি কাটানোর কথা।
বাড়ি এলে বাগানে গাছের পরিচর্যা করা ওর সবচেয়ে আনন্দের কাজ। উঠানে দাদার হাত ধরে ছোটাছুটি কিংবা কুকুরটার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ওর ছুটির দিনগুলো পেরিয়ে যায়। আমি ওই কুকুরসহ পৃথিবীর তাবৎ কুকুরকে ঘৃণা করি। যে প্রাণী যা নিজের শরীরের নিচের অংশ জিহ্বা দিয়ে চেটে আবার তার প্রভুর মুখ চাটতে পারে, ওটাকে আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর বলে মনে হয়। একটা ছোট কুকুরের জন্য ডেইজি কয়েকবার আবদার করেছে বটে, তবে আমার আশা ডেইজি কুকুরের প্রতি আকর্ষণ কাটিয়ে উঠবে। বুধবার সকালে লন্ডন অফিসে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তাই বার্তা প্রতিবেদককে রাতেই একটা মেইল করতে হলো। এতে বিস্তারিতভাবে আমার পরবর্তী সপ্তাহের পরিকল্পনা উল্লেখ করতে হয়।
আমার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাই।
হাই বস, আল-বদরের অফিসে গিয়েছিলাম। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সিএনএনের মতে, আফগানিস্তান ও কাশ্মিরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। ওরা আমাকে লাহোরে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও এটা খুব ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। গত দুই বছর যাবৎ ওখানে কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক ঢুকতে পারে না। তবে আমার মনে হয়, ওদের কাছ থেকে অনুমতি সংগ্রহ করা যাবে।
এরপর হিজবুল মুজাহিদিনের অফিসে যাই। এদেরও কাশ্মিরে অফিস আছে। নতুনভাবে এদের নাম সন্ত্রাসী তালিকায় উঠেছে। তবে এরা নিজেদের স্বাধীনতাযোদ্ধা বলে দাবি করে এবং কথা বলতে প্রচণ্ড আগ্রহী।
আমি ও পাশা ইতিমধ্যে একজন তরুণ মুজাহিদের সঙ্গে খাতির জমিয়েছি। ও আমাদের নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। এতে করে আমাদের সুবিধেই হবে। যদি সব ঠিক থাকে, তাহলে আমাদের ইসলামাবাদে এক দিন থাকতে হবে, পরিবেশ অনুকূলে থাকলে দুই দিন।
পরে আমি ওকে আফগানিস্তান যাওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে যোগ করলাম, আদর্শ দুনিয়ায় সবকিছুই ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে। তবে আমরা এখন পাকিস্তানে আছি, যেখানে তাড়াহুড়ো বা সময়সীমার চেয়েও জীবন অনেক অনিশ্চিত।
আমি দুটো বিষয়ই বেছে নিতে পারি। তবে আপনার নির্দেশই আগে মেনে চলব। ডেভিড স্মিথ এই মুহূর্তে পেশোয়ারে আছে। আজকে এক্সপ্রেস এর জন্য আটটি অনুচ্ছেদে তালেবানদের সম্মেলনের ফিরিস্তি পাঠালাম। স্বেচ্ছায় সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহে গিয়েছিলাম। যতটা সম্ভব ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করেছি। আফগান ভিসার কোনো খবর নেই। তাদের হাতে ৫০০ আবেদনপত্র জমা।
আমি শুনেছি, এক নারী সানডের চিঠিপত্র বিভাগে আমার প্রবন্ধের সমালোচনা করেছে। ওই নারীর যুক্তি যদি এতই সত্য হয়, তাহলে কেন এখনো মানুষ মিছিল করছে এবং গুলি খাচ্ছে।
শেষ অনুচ্ছেদে যেই নারীর কথা উল্লেখ করলাম, তিনি নাকি সম্প্রতি পাকিস্তান ভ্রমণ করে গিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, কেউই নাকি তালেবানদের বিষয়ে মুখ খুলছে না এবং আন্দোলনকে কেউই সহজভাবে নিচ্ছে না। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে সাংবাদিকদের মনও সংবেদনশীল হয়ে থাকে। তাদেরও আবেগে আঘাত লাগে। অনেক পাঠকের ধারণা তাই কোনো সাংবাদিকের লেখনী পছন্দ না হলে তার বিরুদ্ধে চিঠিপত্র বিভাগে লিখতে হবে।
আমি মেইলে আরও লিখি, লন্ডনে আমার সূত্র জানিয়েছে, পোপ চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এবং ব্রিটিশ সচিব স্ট্র ফিরে আসার আগ পর্যন্ত কোনো কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। শুক্রবারে হামলা শুরু হওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ। দিনটি মুসলমানদের কাছে পবিত্র দিন। এতে করে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হতে পারে। প্রেসিডেন্ট বুশ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছেন বলেও দাবি উঠতে পারে। সবাইকে শুভাশিস জানিয়ে। ইভন মেইল পাঠানোর আগে টিভিতে সিএনএনের খবর দেখছিলাম। পোপ দ্বিতীয় জন পল কাজাখস্তান সফরে আছেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভ্রমণ করে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছেন। ৮১ বছরের অশীতিপর এই ধর্মগুরু বলেছেন, অন্তরের অন্তস্থল থেকে আমি প্রার্থনা করি, যেন পৃথিবীতে শান্তি বজায় থাকে। যা ঘটেছে তার জন্য কিছুতেই যেন বিভেদ বৃদ্ধি না পায়, সে লক্ষ্যে আমাদের চেষ্টা করা উচিত। ধর্ম কখনোই সংঘর্ষের অজুহাত হতে পারে না।
একজন জ্ঞানী মানুষের কাছ থেকে খুব হিতকর দামি কথা শুনেছে বিশ্ববাসী। কিন্তু হোয়াইট হাউস বা ডাউনিং স্ট্রিটের অধিবাসীরা এসব কথায় কান দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। যদিও আস্তানার কেন্দ্রীয় মাতৃসংঘ অথবা স্বদেশ চত্বরে বসে তিনি যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, বাইরে তখনো ৫০ হাজার লোক মনোযোগ সহকারে তাঁর কথা শুনছেন।
পৃথিবীর অন্যতম একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের কাজাখস্তান থেকে ভাষণ দেওয়ার দৃশ্যটা ছিল এক পবিত্র মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। কাজাখস্তানে এসে ইউরোপের সঙ্গে এশিয়া মিশে গেছে। আর খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছে ইসলাম ধর্মের। দেশটা আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশ। বিন লাদেনের দেশের পাশেই। পোপ যখন শান্তির জন্য প্রার্থনায় রত, তখন পশ্চিমা শক্তিরা যুদ্ধংদেহী মনোভাবে অস্ত্রভান্ডার মোতায়েন করছে।
পরে যখন জিমের সঙ্গে কথা হয়, ও আমাকে অফিসের বৈঠকের পরিস্থিতি জানায়। আমার পরিকল্পনা শোনার পর বৈঠকে উপস্থিত লোকজন কয়েকবার ঢোক গেলে ও অনেক্ষণ কেউ কোনো কথাই বলেনি। জবাবে আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে জানিয়ে দিই, হয় এই দুটি পরিকল্পনার কোনো একটি বাস্তবায়ন করব অথবা আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে-বসে কাটাব, যত দিন না বোমা হামলা শুরু হচ্ছে। এরপর ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত কিছুই করার থাকবে না।
জিমকে জানাই, আমাকে বসিয়ে রাখতে ও সন্তুষ্ট থাকতে পারলেও আমার পক্ষে নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব নয়। এখানে বসে বুড়ো আঙুল নাচাতে নাচাতে পাগল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। এভাবে সারা দিন বসে আরাম করা পুরোনো দিনের কাহিনি। তবে চাইলে জাতিসংঘ ক্লাবে বসে গ্রামের পর গ্লাস মদ গিলতে পারি।
জিমকে আরও সময় নিয়ে ভাবতে বললাম। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার আগে এখনো দুই দিন সময় আছে। আগামী রাতেই রওনা দেওয়ার উপযুক্ত সময়। ও সম্পাদক মার্টিন টাউনসেন্ডের সঙ্গে কথা বলতে আরও সময় চায়। আমি দোয়া করতে থাকি, ওরা যেন আমাকে বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত না নেয়।
সেদিন রাতে জাতিসংঘের ক্লাবে গিয়ে দুই পেগ মদে গলা ভেজানোর ইচ্ছা করছিল বটে, তবে কারও সঙ্গে কথা বলতে মন টানছিল না। তার চেয়ে বরং যে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য এত লম্ফঝম্ফ করছি, সেটা নিয়ে একটু ভাবা যাক। এই অভিযানটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ। তবে প্রতিটি জিনিসই ঝুঁকিপূর্ণ। রাস্তা পার হতে গেলে ঝুঁকি থাকে, একটা অচেনা ট্যাক্সি ক্যাবেও সাবধানে উঠতে হয়। এমনকি ১১ তারিখের পর থেকে অনেক মানুষই বুঝে গেছে স্বাভাবিক জীবনেরও নিশ্চয়তা কতটুকু। মনে রাখতে হবে, যে প্রতিবেদন তৈরিতে কোনো ঝুঁকি নিতে হয় না, সে প্রতিবেদন কখনোই হৃদয়স্পর্শী বা জনপ্রিয় হয় না।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। আরে আমার অনেক প্রিয় বন্ধু জুলিয়া হার্টলে ব্রেওয়ার। ও গার্ডিয়ান-এর রাজনৈতিক প্রতিনিধি। ও আমার প্রতি অনেক যত্নবান, প্রায়ই খোঁজখবর নেয়। এখন বোধ হয় বার্নারমাউথে হোটেল হাইক্লিফে বসে ঢকঢক করে শ্যাম্পেন গিলছে। ওখানে লিব ডেমের সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহে অনেক বিখ্যাত অখ্যাত মানুষের সঙ্গে আনন্দ করছে।
কথা বলার একপর্যায়ে আমাদের বন্ধুসুলভ দুষ্টুমি শুরু হয়ে যায়। বান্ধবী আমাকে খোঁচা মেরে কোন গোপন মিশনের ফন্দি আঁটছি, তা জানতে চায়। এই বিদেশে বসে ভালো কিছু পান করতে পারছি না বলে ওর দুঃখের শেষ নেই। তাই আমার হয়ে ও একাই আজ সব গিলে নেবে। আমাদের মধ্যে মেয়েলি গল্প জমে উঠতে সময় লাগে না। এখানকার পুরুষদের সম্পর্কে জানতে চাইলে একরাশ হতাশা প্রকাশ করলাম। হোটেল এলাকায় সুদর্শন পুরুষের কদাচিৎ দেখা মেলে বলে ওকে জানাই। বারবার দরজায় টোকা দেওয়া বেয়ারার কাছ থেকে কীভাবে পুরোনো কৌশল ব্যবহার করে রেহাই পেয়েছি, তা-ও জানাতে বাকি থাকে না। আবার কথা হবে বলে জুলিয়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
ফোনটাকে বিশ্রামে দেওয়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই পরিচিত রিংটোনটা আবার বেজে উঠল। মুঠোফোনের পর্দায় টিম শিপম্যানের নাম ভেসে ওঠে। রাজনৈতিক প্রতিবেদক। নিশ্চয় কোনো পার্টিতে আছে। ওদের কাজই হলো বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে অসংলগ্ন মুহূর্তে গোপন খবরে ছোঁ মারা। ফোনটা ধরেই ওর বসের সঙ্গে একটু আগে কথা হয়েছে বলে জানাই। জুলিয়া যেকোনো পানশালায় শ্যাম্পেনের ঝরনার মধ্যে বসে আছে, তা-ও বলে দিই। অন্যদিকে আমি এমন দেশে আছি, যেখানে মদ্যপান নিষিদ্ধ। কী বিচিত্র এই জীবন!
শিপম্যানকে ওর সহকর্মীরা শিপার বলে ডাকে। জুলিয়ার সঙ্গে এখন ও একই জায়গায় আনন্দ করছে। জুলিয়ার মুখে আমার পরিকল্পনার কথা শুনেছে ও। আমার মাথায় বড়সড় গন্ডগোল আছে বলে ওর ধারণা। দুঃসাহসী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য শুভকামনা জানায়।
এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু যেন থেমে গেল। আমি আর আমার পরিচিত সহকর্মীরা দুটি ভিন্ন জায়গায় কাজ করছি। এ বছর লেবার পার্টির সম্মেলনে আর যাওয়া হবে না। এসব সম্মেলনে কত রথী-মহারথীর সঙ্গে দেখা হয়। পরিচয় ঘটে নতুন কারও সঙ্গে। সুরার পেয়ালা হাতে প্রাণভরে আড্ডা দেওয়া সম্ভব।
ইচ্ছে করছে দুদণ্ড জাতিসংঘ ক্লাব থেকে ঘুরে আসি। না, এটা করা যাবে । মনকে কঠোরভাবে বারণ করি। মাথায় বিশাল কাজের ঝক্কি বইতে হবে। ঠান্ডা মাথায় সব পরিকল্পনা শেষ করতে না পারলে সব ভেস্তে যেতে পারে। সম্ভাবনার পাল্লা তখনো আফগানিস্তানের দিকে দুলছিল। কী কী করতে হবে, তার একটা তালিকা বানাই। আমার এক পুরোনো বন্ধু ইশার অক্সফোর্ডের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলেছিলাম। মেয়েটা একটা বই লিখতে ইসলামাবাদে এসে থাকছে। এক সরকারি কার্যালয়ে ওর সঙ্গে মুখখামুখি দেখা হয়ে যায় আচমকা। পরে আমরা দুজন পুরোনো পাপী একসঙ্গে খাবার খাই।
মনের সংকল্পের বৈঠা নড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ইশারের সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকি। পায়চারি করতে করতে ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি বের করি। জীবনে এমন সময় আসবে, যেদিন পানশালায় গিয়ে ঠান্ডা পানির বোতল হাতে নিয়ে সময় কাটাতে হবে, তা কোনো দিন কল্পনাও করিনি। সকালবেলার মাথাধরা আর শরীরের ধকল কাটাতে অবশ্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানিই যথেষ্ট।
আমার মন আফগানিস্তানের পাহাড়ি উপত্যকাতেই ঘুরঘুর করতে লাগল। হিসাব মেলাই- ওখানে যাওয়া আসলে কতটুকু বিপজ্জনক। সব দিক বিবেচনায় এনে আফগানিস্তানের সীমান্ত অতিক্রমের সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো। আচ্ছা, আমার অবস্থানে থাকলে অন্য যে কেউ কী করত? রণাঙ্গনের প্রতিবেদক ম্যারি কলভিনের কথা ভাবার চেষ্টা করলাম। এরূপ অবস্থায় ও সত্যিই আমার মতোই চিন্তাভাবনা করত। যুদ্ধের মাঠ থেকে সরাসরি প্রতিবেদন পাঠানোর দুঃসাহসের জন্য ও সব সাংবাদিকের জন্য প্রেরণাদায়ী। মেয়েটার লেখার হাতও বুলেটের মতোই লক্ষ্যভেদী ও সুচালো। পরিচিত সহকর্মীরা ম্যারিকে একরকম সমীহ করে চলে।
সানডে টাইমস-এ কাজ করতে গিয়ে ওর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। বিখ্যাত দুর্গ ওয়াপিংয়ে বসে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড, সান ও দ্য টাইমস-এর হয়ে অসাধারণ কিছু কাজ করায় সবাই ওকে চিনতে শুরু করে। সে সময় প্রায়ই আমরা একত্রে গল্প করতাম। বিখ্যাত মিডিয়া মোঘল রুপার্ট মারডকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের যুদ্ধ নিয়ে ম্যারির প্রতিবেদন পড়তে পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। ও সম্প্রতি বলেছিল, যুদ্ধ প্রতিবেদকের কখনো ক্লান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আজকে ওর কথাটাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে মনে হলো।
২০০১ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় এক যুদ্ধক্ষেত্রে ম্যারি আহত হয়। তখন ওর নাম প্রথম আলোচনায় আসে। সে সময় শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী ও তামিল টাইগার্সের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। সরকারপক্ষ দাবি করে, বিদ্রোহীদের সীমান্ত ভানুভিনা অতিক্রমের সময় তামিল যোদ্ধারা ওকে গুলি করে বসে। অন্যদিকে তামিলরা এ জন্য সরকারি বাহিনীকে দায়ী করে। তবে তামিলরা সত্য বলছিল। ওর মাথা, বুকে ও হাতে চারটি গুলি বিদ্ধ হয়। ওর আঘাত গুরুতর নয়, এটা জানার আগে আমরা বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তবে এই ঘটনায় ওর বাম চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যায়।
শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ পরে দাবি করে, ম্যারির সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি থাকলেও ও বিদ্রোহীদের অধিকৃত এলাকায় যাওয়ার আগে অনুমতি নেয়নি।
যা-ই হোক, তালেবান দূতাবাসে এসে আমি বুঝে যাই, প্রতিকূল সময়ে সংবাদ প্রতিনিধিরা সহসাই সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি পান না।
ম্যারি অবশ্য পরে তার ওই এলাকা পরিদর্শনের পেছনে যুক্তি তুলে ধরে। সে বলে, এসব এলাকায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল, বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানি নেই, টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন, অথচ এই দুর্যোগ সম্পর্কে বহির্বিশ্বের কেউ অবগত ছিল । আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ছিল বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সরবরাহ।
অনেকের মতে, ম্যারির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা না হলে বিশ্ববাসীর কাছে তামিলদের দুরবস্থার কথা অজানাই রয়ে যেত। ওর সাহসী প্রতিবেদনের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে বাহবা পেলেও আড়ালে অনেকেই ম্যারিকে গণ্ডমূর্খ বলে ডেকেছে। সাংবাদিকদের মধ্যেও বদলোক ঘাপটি মেরে থাকে। এরা কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না, পেছন থেকে ইট পাটকেল ছুড়ে মারতেই এরা বেশি পটু।
দুঃসাহসী পেশাদার নারীরা আমাকে সব সময় প্রেরণা জোগায়। মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণে নারী পেশাজীবীদের সাহসিকতা আমাকেও অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ডেইজি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। চলার পথের বহ্নিশিখা। অথচ ওর পেটে আসার খবর শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যর্থতার মাধ্যমে ডেইজির জন্ম। এমনকি আমি গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছিলাম প্রায়।
ডেইজি গর্ভে আসার পর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গেলে ভয় পেয়ে যাই। গলা কেটে ফেললেও আমার পক্ষে বাচ্চার মা হওয়া সম্ভব নয়। এ কথায় আমার এই ৩৩ বছরের বার্ধক্যে পুনরায় গর্ভধারণ সম্ভব না-ও হতে পারে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাকে সতর্ক করে দেন।
চমক্কার, সব ঠিকঠাক চলছে। চিকিৎসকের সঙ্গে আবার সোমবার দেখা করব বলে বেরিয়ে এলাম। ওই সপ্তাহেই আমাকে থমসন আঞ্চলিক সংবাদ কেন্দ্রে নারী নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য পরিচালিত এক প্রশিক্ষণে যেতে হয়। নারী নির্বাহী কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার সুলুকসন্ধান ও দক্ষতা বৃদ্ধি ছিল এই প্রশিক্ষণের মূল উপপাদ্য।
তখন আমি সানডে সান-এর সহকারী সম্পাদক। তার আগে থমসনের প্রথম নারী সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। আমি প্রধান প্রতিবেদক হলেও সেখানে প্রচুর নারী সহকর্মী ছিলেন। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের অবদান ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। কঠোর পরিশ্রমী ও সৎ নারী কর্মীরা সর্বদাই আমাকে উৎসাহ জোগান এবং থমসনে তাঁদের অভাব ছিল না।
সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে আমি তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলি। গর্ভে একটি নতুন প্রাণ কক্ষনোই কর্মজীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এক সহকর্মী তাঁর মায়ের গল্পও আমাকে বলে বসেন। ভদ্রমহিলার মা দুরারোগ্য ভুলে যাওয়া রোগ আলঝেইমার্সে ভুগছিলেন। তিনি জানান, মাঝেমধ্যেই দিনের বেলায় অফিসে বসে তাকে ফোন ধরতে হয়। কারণ, তার মা হয়তো রাতের পোশাক পরে ভুলোমনে তখন এলাকায় ঘুরে বেড়াচেছন।
থমসনের আরেক সহকর্মী মরিনেরা ছিল দুই যমজ বোন। মেয়েটা তখন সদ্য তালাকপ্রাপ্তা। এই মেয়েটার সঙ্গেও কথা বলি। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন বোধ হয় এডিনবার্গ নিউজ-এর সহকারী সম্পাদক হেলেন মার্টিন।
হেলেনের ফ্লিট স্ট্রিটের এক সাংবাদিক সহকর্মীর সঙ্গেই বিয়ে হয়। এক সন্তানের মালিক হওয়ার পরই হেলেন জানতে পারেন, তাঁর স্বামী এক বছর ধরে পরকীয়া করছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আলাদা হয়ে ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে গ্লাসগোতে চলে যান। সেখানে তিনি মায়ের সঙ্গে থাকা শুরু করেন। চলে যাওয়ার সময় তার পকেটে ছিল মাত্র ৭০০ পাউন্ড। একদম নতুন থেকেই তাঁকে পুনরায় শুরু করতে হয়। বেঁচে থাকার সংগ্রাম হেলেন আবার প্রথম থেকে শুরু করেন। ভাত-কাপড়ের অর্থ, বাচ্চার জন্য একজন পরিচারিকার বেতন ও বাড়িভাড়া মেটাতে হেলেন নতুন চাকরি শুরু করেন। সব ব্যবস্থাপনা করতে কষ্ট হলেও তিনি সফল হয়ে ওঠেন। তার সংগ্রামের কাহিনি বলার ধরন মনে তখন দুর্দান্ত সাহস জুগিয়েছিল।
দুই দিন এত সব বৈঠক শেষে রোববার দিন রাতে নিউক্যাসলে বাড়ি ফিরছিলাম। যাত্রাপথে বসেই যা-ই ঘটুক না কেন, সন্তানের মা হওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলি। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মা হতে না পারলেও আমার কিছু যায় আসে না।
পরদিন রাতে আমি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, এই সাহসী সিদ্ধান্ত একসময় সঠিক বলে প্রতীয়মান হবে এবং আমাকে প্রেরণা জোগাবে। রোগীদের কাছ থেকে তিনি এ রকম কথাই বেশি শুনতে চান বলে জানান। হ্যা, তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল।
আমার ফ্ল্যাটের সাথি ক্যারল আমাকে জড়িয়ে ধরে। কোনো রকম বিজ্ঞ উপদেশ বা চিন্তাভাবনা না করেই সে দারুণ উৎফুল্ল হয়। ও বলেছিল, এই সিদ্ধান্তের জন্য আমি কখনোই হতাশ হব না।
আমি দাউদকে ফোন করে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালে ও গর্ভধারণের ভূত মাথায় চাপানোর পর ওর সঙ্গে একরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বেচারা করুণ বিপদে পড়ে। এমনকি সাইপ্রাসে অবস্থিত ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংঘের অফিস থেকে ইরাক অথবা লিবিয়ার অফিসে বদলি হওয়ারও আবেদন করে বসে। বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থেকে ও দুঃখ ভুলে যেতে চেয়েছিল।
১৯৯১ সালের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে দাউদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সেদিন আমি ইভান মরিসনের সাক্ষাৎকার নিতে নিকোসিয়াতে ছিলাম। অন্য দুজন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংঘের সন্ত্রাসীর সঙ্গে তাকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আশির দশকে সাগরে ভাসমান এক জাহাজে তিনজন মোসাদ এজেন্টকে হত্যার দায়ে তাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়। এই ঘটনা ইতিহাসে লারাক্কা হত্যা নামে পরিচিত।
ইভানের সঙ্গে আমি তিন বছর চিঠি চালাচালি করি। অবশেষে ও আমার সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হয়। দুই সপ্তাহের জন্য আমি নিকোশিয়া চলে যাই। তখন সানডে সান কর্তৃপক্ষের সব খরচ বহন করার সামর্থ্য ছিল না। তাই আমাকে অর্ধেক রাহা খরচ মেটাতে হয়।
তখন জিমের সঙ্গে ডিভোর্সের প্রক্রিয়া চলমান ছিল। কিন্তু আমার পাসপোর্টের নামের শেষে জিমের পদবি ম্যাকিন্টোশ উল্লেখ করা ছিল। ক্রেডিট কার্ডে আমার নাম ছিল রিডলি। সাইপ্রাসের দক্ষিণে পাহোস নামক জায়গায় নতুন আরেকটি নাম ব্যবহার করে আমি বাসা ভাড়া করি।
সাইপ্রাস নামার পর দেখি একটি মাত্র ভাড়া গাড়ি পার্ক করা। আমার সঙ্গে বসে আরও দুজন ব্রিটিশ লোক সাইপ্রাস আসেন। তাদের যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় একরকম বিরক্তি নিয়েই আমি তাদের আমার গাড়িতে উঠতে আহ্বান জানাই। গন্তব্যে যেতে যেতে আমরা ভালো বন্ধুতে পরিণত হই। তাঁরা ছিলেন উত্তর-পূর্ব লিঙ্কনশায়ারের গ্রিম্বসির বাসিন্দা। পেশায় মাছ ব্যবসায়ী। সাইপ্রাসের উত্তর অঞ্চলে মাছ ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজতে এসেছিলেন।
আমি রাতে তাঁদের আমার বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানাই। বাড়িটা ছিল বেশ বড়, তিন কক্ষবিশিষ্ট। পরিদন ওরা আমাকে তুরস্ক এলাকার দিকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালে আমি তাদের সঙ্গে গ্রামে দেখা করব বলে জানাই। এরপরই আমাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করতে জেলখানায় ছুটতে হয়, যেখানে ইভান বন্দী ছিলেন।
পরে রাজধানীর বাইরে ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংঘের কনস্যুলার অফিসে গিয়ে নিজের পরিচয় দিই। উল্লেখ করি, আমি ব্রিটিশ নাগরিক ও সানডে সান-এর একজন সাংবাদিক। ইভান ডেভিসনের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা পরদিন আবার দেখা করতে বলেন।
এরপর সীমান্ত অতিক্রম করতে তুরস্কের অঞ্চলে চলে যাই। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। সীমান্তের পুলিশফাঁড়িতে অতিরিক্ত উত্তেজনা এড়াতে নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখি। পেশাগত কাজের ঘরে তাই নিজেকে চুল পরিচর্যাকারী হিসেবে উল্লেখ করি।
কাইরেনিয়াতে সেদিন গ্রিম্বসির বাসিন্দা দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। বেশ আড্ডা দিই, ওয়াইন গেলি ও সুস্বাদু কাবাব খেতে খেতে সুন্দর বিকেলটা কেটে যায়। পরে কাছের এক পর্যটন অফিসে গিয়ে সেখানকার এক নারী কর্মীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিই। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর মেয়েটার চোখ আনন্দে নেচে ওঠে। ও আমাকে পর্যটনমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিতে চায়। বৃহস্পতিবার স্বয়ং মন্ত্রীই আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সীমান্তে গাড়ি পাঠাবেন। এটা ছিল এক চমত্তার সুযোগ। তাই আমিও এতে রাজি হয়ে যাই এবং পুনরায় সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা জানিয়ে দিই।
পরদিন ইভানের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এর পরের দুই সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই ইভানের সঙ্গে দেখা করি ও সাক্ষাঙ্কার সংগ্রহ করি। এর মাঝে এপিস্কোপি ও আক্রোতিরিতে ব্রিটিশ ঘাঁটিতে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর কর্মরত বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়।
ফিরে আসার কয়েক দিন আগে আবার ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংঘের অফিসে গিয়ে এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে এক বেলা দুপুরে নিমন্ত্রণ জানালে আমরা সেখানকার বিখ্যাত ক্ৰদুস পর্বতমালায় আরোহণ করি। এখানে বিখ্যাত আঞ্চলিক খাবার মেজে পাওয়া যায়।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে ফিরে আসার সময় এক সবুজ চত্বরে গাড়ি থামিয়ে খানিক সময় পায়চারি করি। স্বীকার করি, তখন আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। খোলা মাঠে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের খোসা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। আমরা ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলতে থাকলেও মনে মনে একটা বড় লাঠি খুঁজছিলাম। আমার কাছে আসার চেষ্টা করলেই যেন মাথায় বাড়ি দিতে পারি। ভয় পাচ্ছিলাম, এই লোেক কি আমাকে বন্দী করবে?
যা-ই হোক, কিছুই ঘটল না। আমরা গাড়িতে করে ফিরে আসি। পরে আমি জানতে পারি, এই দ্রলোক ছিলেন একজন গোয়েন্দা। গণমাধ্যমের মুখপাত্র বা এ ধরনের কিছু নয়। আমাকে মোসাদের গোয়েন্দা হিসেবে সন্দেহ করে ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংঘ। আমার দুপুরবেলার খাবারের সঙ্গী আমার বিরুদ্ধে একটি গোপন নথি পাঠান। নথিটা হয়তো বিশ্বাসযোগ্য ছিল। কারণ, যাওয়ার দিন থেকেই তারা আমাকে অনুসরণ করত। গোপন নথিতে উল্লেখ ছিল, ইভন রিডলি ছদ্মনাম ইভন এ্যানি ম্যাকিন্টোশ ব্যবহার করে এখানে এসেছেন। তাঁর ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে দুজন পুরুষসঙ্গী নিয়ে আরেকটি নাম ব্যবহার করে উঠেছেন। তিনি তুরস্কের অঞ্চলের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন এবং আসার পর বেশ সহজেই সেখানে চলাফেরা করেছেন। চার দিন পর গোমড়ামুখো এক চালক সরকারি এক লিমুজিনে করে তাঁকে কোথাও নিয়ে যায়। এ সময় তিনি দ্বিতীয়বারের মতো তুরস্কের অঞ্চলে যান। ব্রিটিশ সার্বভৌম ঘাঁটিতে ঢুকতে ও বেরোতে তিনি একটি অফিশিয়াল পরিচয়পত্র ব্যবহার করেছেন। লন্ডনের সান অফিসে ফোন করে জানা গেছে, তিনি সেখানে কাজ করেন না। ভদ্রমহিলা একটা বিশেষ উচ্চারণে কথা বললেও মাঝেমধ্যে তা গোপন করেন। অন্য নারীদের মতো তাঁর মধ্যে ভয়-ডরের পরিমাণ কম। নির্জন চত্বরে হাঁটার সময় তিনি মুখে বেশ একটা শান্ত ভাব ফুটিয়ে রেখেছিলেন।
অবশ্যই এই প্রতিবেদনের প্রতিটি বিষয়ে আমার ব্যাখ্যা ছিল, তবে এটা জানার পর আমার হাসি পায়। আমার ভ্রমণের পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না। মানুষ ভাবে, ইংল্যান্ডের মহামান্য রানির সঙ্গে কথা বলা খুব সহজ ব্যাপার।
তারা নিশ্চয় কখনোই আঞ্চলিক ইংরেজি উচ্চারণের কারও সঙ্গে কথা বলেনি এবং ভেবেছিল আমি ইসরায়েলের নাগরিক।
এই প্রতিবেদন গোয়েন্দা প্রধান দাউদ জারোরার কাছে পাঠালে তিনি খালিদকে আমার সঙ্গে একটা বৈঠকের আয়োজন করতে নির্দেশ দেন। একটা ভাগ্যনির্ধারণী সিদ্ধান্ত। প্রথম দিন দাউদকে চোখে দেখার পরই আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। বৈঠকটা যেন বিদ্যুৎ গতিতে শেষ হয়ে যায়। ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। তখন আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে ফিলিস্তিনি গোয়েন্দা সংস্থার অর্ধেক লোক আমার পিছু নিয়েছে এবং আমার আসল পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করছে।
বাকি সময়টাতে আমি দিনের বেলা ইভানের সাক্ষাঙ্কার নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম এবং রাতে সময়টা দাউদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দিতাম। তিনি ছিলেন একজন নিপাট ভদ্রলোক। তিনি নিজেকে একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে দাবি করেন এবং অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। আমার কোনো ধারণাই ছিল না আমি কিংবদন্তি আবুল হাকিমের পাশে ঘুরছি। তিনি ছিলেন দক্ষিণ লেবাননে ফাতাহ ভূমির একজন ডাকসাইটে কমান্ডার। এখনো অনেক ফিলিস্তিনি তাঁকে নায়ক হিসেবে মানেন। লেবাননের দক্ষিণ-পূর্বে ১৯৭০ সাল থেকে আট বছর ফাতাহ ভূমির অস্তিত্ব ছিল এবং ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টি এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছে।
নিউক্যাসলে ফিরে এসে আমি একটা অসাধারণ প্রতিবেদন তৈরি করি। সদ্য যোগ দেওয়া যুগ্ম সম্পাদক টনি ক্রস আমার কাজে মুগ্ধ হয়ে তা টেলিভিশনে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। সাংবাদিক হিসেবে এটা ছিল এক বিরাট সফলতা এবং সবাই আমাকে অভিনন্দন জানায়। অফিসের অদূরে একটা পানশালায় গিয়ে সহকর্মীদের নিয়ে হালকা কিছু পান করে সফলতা উদ্যাপন করি।
চলে আসার পরও দাউদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। কয়েক মাস পরে ও নিউক্যাসলে আমার বাড়ি বেড়াতে আসে। আমি তাকে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্টিন শিপটনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। পরে তাদের মধ্যেও বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। মার্টিন তখন নর্দার্ন ইকোর হয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে বেড়াত।
সে সময় দাউদ বোমাটা ফাটায়। নিজের পরিচয় ও উদ্দেশ্য আমার কাছে খুলে বলে। তত দিনে আমি আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। দাউদের গোয়েন্দাগিরির জন্য এখানে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। তবে আমি দেখতে চেয়েছিলাম সম্পর্কটা কত দূর গড়ায়। তাই আমার সিনিয়রদের কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত নিই।
পরের বছর আমি গর্ভবতী হয়ে পড়ি এবং সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত সামরিক অনুশীলনে অংশ নিই। স্থানীয় বালকদের নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন করি। সে সময় ফকল্যান্ডের আবাসিক পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দিতে আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর একটা দল ছয় মাসের জন্য সেখানে যাচ্ছিল। প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক সেনাবাহিনী কোনো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। ফলে এই খবরটার গুরুত্ব বেড়ে যায়।
আমি নিজেও একটি দলের প্রধান ছিলাম। তাই কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সেনাছাউনি থেকে বেরোনোর সুযোগ ছিল। নিকোশিয়ার বাইরে দাউদের আবাসস্থলে প্রায়ই ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। এক রাতে আমি ব্রিটিশ সেনার পোশাক পরে দাউদের বাসায় বিশ্রাম করছিলাম। তখনই খালিদ ওর বসের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে ফোন করে। আমাকে গেরিলা র্যাম্বোর সাজে দেখে খালিদ একরকম ভড়কে যায়। ওর মুখের ভঙ্গিটা ছিল দেখার মতো।
পরে খালিদ দাউদের প্রাক্তন লেবানিজ স্ত্রীকে আমার খবরটা জানিয়ে দেয়। ধারণা করি, ওই দ্রমহিলা ইয়াসির আরাফাতকে জানান, দাউদ মোসাদের একজন এজেন্ট ও ব্রিটিশ গোয়েন্দার খপ্পরে পড়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংঘে তখন আমাকে নিয়ে জল অনেক দূর ঘোলা হয়েছে। তাই আমার নির্দেশদাতা অফিসার কর্নেল ডেভিড ম্যাকিনকে আমার ব্যাপারে সব জানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি ছিলেন একজন অসম্ভব ভালো মানুষ।
সাইপ্রাস থেকে ফিরে এসে আমি কর্নেল ডেভিডের সঙ্গে দেখা করে আমার গর্ভবতী হওয়ার সংবাদটা জানাই। তিনি বিষয়টা বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিলেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তত দিনে সিঙ্গেল মায়েদের ব্যাপারে সহনশীল হয়ে গিয়েছে। তবে স্বভাবসুলভ কৌতূহলে তিনি দ্রুত কুঁচকে আমার গর্ভের সন্তানের পিতার নাম জানতে চাইলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তা হবে হয়তো।
আমি না-বোধক উত্তর দিই। এ-ও বলি, কিছু সমস্যা হতে পারে। কারণ, তিনি একজন সেনা কর্মকর্তা, তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত নন।
কর্নেল সাহেব টেবিলের দিকে উদ্বিগ্নভাবে ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোথাকার সেনাবাহিনী?
একটা লম্বা দম নিই। তাঁকে বলি, আমার অনাগত সন্তানের পিতা একজন ফিলিস্তিনি সেনা ও তাদের গোয়েন্দা দলের প্রধান।
কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে আলোচনার দড়ি ধরে টান দিলেন। নিষেধ করে দেন, এ বিষয়ে যাতে অন্য কারও সঙ্গে কথা না বলি। বিষয়টা আমার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে কি না, এ ব্যাপারে খোজখবর করবেন বলে জানান।
বুঝতে পারি একটা কিছু ঝামেলা হবে। তবে সেনাবাহিনীর কোনো অধীন কর্মকর্তার সঙ্গে রোমান্স করে বেড়াচ্ছি না, এটা জেনে তাঁকে অনেক ভারমুক্ত মনে হলো।
আমার জন্য এটা বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়ে ফিলিস্তিন সংঘের প্রধান কার্যালয়ে দাউদের ডাক পড়ে। এটা তখন তিউনিসিয়ায় অবস্থিত। আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে দেওয়ার কারণ নেই বলে দাউদ যেতে অস্বীকৃতি জানায়।
তার বেতন কাটা পড়ে। তার অফিসের টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আরাফাত ও দাউদের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক অগ্নিগর্ভ যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতির। এই বয়স্ক লোক নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। এদিকে তাঁর প্রিয় মানুষ দাউদ, যাকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে পছন করতেন, কোনো কথাই শুনছিল না। গ্রীষ্মের ছুটিতে দাউদ বেড়াতে আসে।
তখনই জানতে পারলাম ও নিজ দলের ভেতরে কী পরিমাণ তোপের মুখে পড়েছে।
আমরা বিবাহিত ও সন্তানের মুখ দেখতে চলেছি। এই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। এখানেই বিষয়টা থামিয়ে দিয়েছে ডেভিড। পুরো ফিলিস্তিনে এই ঘটনাকে এক রোমান্টিক প্রেমকাহিনি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে আমার মতো অখ্যাত ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, ভাবতেই খুশি খুশি লাগল। অনেক দিনের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক মাইকেল স্কট আমাদের বিয়ের কিছু ছবি তুলে দেয়। পরে এসব ছবি তিউনিসিয়া ও সাইপ্রাসজুড়ে প্রদর্শিত হয়।
আশ্চর্যজনক ঘটনা, এক বিখ্যাত ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে আমিসহ অনেক মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে গেল। সর্বদাই ঝামেলা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও ঝামেলাই আমার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে। মনে পড়ে, একদা সানডে টাইমস-এর বিনোদন প্রতিবেদক নিকোলাস হেলেন বলেছিল, আমি হলাম বিখ্যাত সিনেমার চরিত্র ফরেস্ট গাম্পের সাংবাদিক প্রতিমূর্তি।
আজ ইসলামাবাদে আরেকটি দুঃসাহসী অভিযান শুরু করার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। জানি, পথটা বিপৎসংকুল তবু কেমন যেন শিহরণ লাগছে। একবার মনে হলো, বাবা-মা, নিকটাত্মীয়, ডেইজি ও কাছের বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখি। চিঠি লিখতে অনেক মানুষের নামই মনে এল, এর কোনো শেষ নেই। ভাবনাটা অবাস্তব ও নেতিবাচক। কোনো খেয়ালি আবেগপ্রবণ মনের অনুভূতি নয় সামনের দিনগুলো। মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত মার্টিন ও জিম আমার দুঃসাহসের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। গভীরভাবে চিন্তা করলাম, ফোনটা বন্ধ করে রাখব কি না, এতে করে আমার চাকরিও চলে যেতে পারে। তবে সামনের রহস্যঘেরা পর্বতের পেছনে কী বাস্তবতা অপেক্ষা করছে, তা দেখা থেকে কারও পক্ষেই আমাকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।