ডুবুরি

ডুবুরি

বুলা পরনের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া সালোয়ার কামিজটার কোমরের কাছটায় পেঁচিয়ে থাকা দড়িটাকে একবার হাত দিয়ে দেখে নিল ঠিকমতো বাঁধা আছে কিনা৷

পুকুরের পাড় থেকে একদম একফালি চাঁদের মতো বেঁকেচুরে একটা নারকেল গাছ রয়েছে৷ সেটার আগাটা পুকুরের ওপর এমনভাবে নুয়ে রয়েছে যে পাতাগুলো মাঝেমাঝেই পুকুরের জলে লেগে ভিজে যাচ্ছে৷

বুলার কোমরের দড়ির অপরপ্রান্তটা বেশ কিছুটা দূরের সেই নারকেল গাছের গুঁড়ির সাথে শক্তভাবে বাঁধা৷ গাছের নীচে একটা হাফপ্যান্ট আর ফুটো ধরা গেঞ্জি গায়ে দাঁড়িয়ে ভুতো৷

ভুতো বুলাকে দেখে জয়ের ভঙ্গিতে বরাবরের মতো এবারেও বুড়ো আঙুলটা উপরে তুলল৷

বুলা মাথার ওয়াটারপ্রুফ টর্চটা টাইট করে নিয়ে বাবার বেঁধে দেওয়া গলার মাদুলিটা আলতো করে স্পর্শ করল কয়েক মুহূর্ত, তারপর হঠাৎ ওই পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমরেশের সাথে একটা চোখাচোখি হয়ে যাওয়ায় আর দেরি না করে হাতদুটোকে উঁচু করে মাথার ওপর তুলে রকেটের ভঙ্গিতে ঝাঁপ দিল কুসুমগ্রামের সবচেয়ে বড় দিঘিটায়৷

ওর পাঁচ ফুট দু-ইঞ্চির রোগাভোগা শরীরটা মুহূর্তে তলিয়ে গেল জলের অতলে৷

বুলা ডুবে যাওয়ার পর কয়েক সেকেন্ড দিঘির শ্যাওলা জমা কালো জলে একটা বুদবুদ শব্দ হল, ছোট ছোট গোলাকার ঢেউ উঠে বলয়ের মতো মিশে যেতে লাগল কালো জলে৷ তারও কিছুক্ষণ বাদে সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল৷

পাড়ে দাঁড়িয়ে তখন প্রায় জনাপঁচিশেক লোক৷ থানার দারোগা, তিনটে কনস্টেবল আর গ্রামের মান্যগণ্য কয়েকজন বাদ দিলে বেশির ভাগই খেটে খাওয়া গরিব মানুষ৷

তারা প্রবল কৌতূহলে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে৷

মিনিটখানেক বাদে সুকুমারবাবু তাঁর ব্যবসার ডানহাত মানিককে ফিসফিস করে শুধোলেন, ‘‘হ্যাঁ রে, মেয়েটা কাজটা ঠিক করতে পারবে তো? মানে আমরা ফেঁসে-টেসে যাব না তো? তুইও বললি আমিও রাজি হয়ে গেলুম, মাথাও কাজ করছে না….!’’

মানিক মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বলল, ‘‘কী যে বলেন কর্তাবাবু, এ কী যে সে ডুবুরি নাকি? হলই বা মেয়েছেলে, এ-তল্লাটের কুড়ি-পঁচিশটা গ্রামে ওর মতো ওস্তাদ ডুবুরি আছে কি না দেখান তো! আর তা ছাড়া মোটা টাকার টোপ দিয়েছি কর্তা, কোনো চিন্তা নেই৷ এ-মেয়ের তো আর এই গ্রামের এঁদো পুকুরে পড়ে থাকার কথা নয়, নেহাত কপাল জোরে…!’’ মানিক হঠাৎ জিভ কেটে চুপ করে গেল৷ আড়চোখে দেখল, নাহ, সুকুমারবাবু তেমন খেয়াল করেননি৷ ও কথা ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি বলল, ‘‘কিন্তু কত্তা, পুলিশকে আগেভাগেই খবর দিলেন কেন, একেই তো এই দারোগাটা ঠিক সুবিধের নয়৷’’

সুকুমারবাবু গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, ‘‘সেইজন্যই তো সাবধানের মার রাখলাম না মানিক! পুলিশকে বলেছি বউটার স্বভাবচরিত্তির ভালো না, এই কালো দিঘির পাড়ে প্রায়ই ওর পুরোনো প্রেমিকের সাথে লটঘট করতে আসত, ধরা পড়ে যেতে লজ্জায় নিজেই…৷’’

মানিক মাঝপথে বলল, ‘‘বুঝেছি বুঝেছি কত্তা৷ এবার চুপ করুন৷ দেওয়ালেরও কান আছে৷ তবে কোনো চিন্তা নেই, একেই টাকা শুনে ওর মাথা ঘুরে গেছে, তার ওপর মেয়েটা পাকা ডুবুরি! আপনি শান্ত হয়ে বসুন৷ নাহলে পুলিশ সন্দেহ করবে যে!’’

কথাটা অবশ্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যি৷ বুলার বয়স মাত্র একুশ-বাইশ হলেও এই বয়সেই সে আচ্ছা আচ্ছা ডুবুরিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে৷ আর পারবে না-ই বা কেন, মানিক মনে মনে ভাবল, কার মেয়ে দেখতে হবে তো! বুলার বাবা কার্তিক তো মানিকেরই বন্ধু ছিল, ছোটবেলায় একসাথে কত খেলাধুলো করেছে৷ ছোট থেকেই কার্তিকও এরকম সারাটা দিন জলেই পড়ে থাকত, নিজে রিকশা চালালেও নিজের অপূর্ণ ইচ্ছেটা মেয়েকে দিয়ে পূর্ণ করবে বলেই বোধ হয় সাঁতারু বুলা চৌধুরীর নামে নাম রেখেছিল বুলা৷ মেয়েটা যখন একরত্তি ছিল, তখন থেকেই ডুবসাঁতার, চিতসাঁতারে কেরদানি দেখে হাঁ হয়ে যেত সারা গ্রামের মানুষ৷ অল্পবয়সে এখানকার ইস্কুলের খেলার মাস্টার অলোকবাবুর চোখেও পড়ে গিয়েছিল মেয়েটা৷

কলকাতার একটা ভালো ক্লাবে যেদিন ভর্তি করে এল মেয়েটাকে, সেদিন খুশিতে জ্বলজ্বল করা কার্তিকের মুখটা মনে পড়ল মানিকের৷ সবাই অল্প-অল্প করে দিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যও করেছিল৷ স্টেট মিটের কী একটা খেলার পর মেয়েটাকে নিয়ে দু-লাইন ছাপাও হয়েছিল কলকাতার কাগজে৷ কার্তিকের তখন কী আনন্দ, সারা গ্রামকে পারলে মিষ্টি খাওয়ায়৷ কিন্তু তারপরেই, মানিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল!

পেছন থেকে কাঁধে কার হাত পড়তেই মানিক চমকে মুখ ফেরাল, সুকুমারবাবুর একমাত্র ছেলে সমরেশ৷ মুখে একরাশ উৎকণ্ঠা, চিন্তায় ফর্সা কুটিল মুখটা লাল হয়ে গেছে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘‘কী হবে গো মানিককাকু? আমার বন্ধু দুটো, তুমি আর বাবা ছাড়া কিন্তু কেউ জানে না!’’

মানিক কিছু না বলে মনে মনে কিছু খিস্তিখেউড় করল, তারপর অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে সমরেশের হাতদুটো চেপে ধরল৷ কপট সহানুভূতি ছাড়া সে আর কী-ই বা দিতে পারে! সে সামান্য দোকানের কর্মচারী বৈ কিছুই নয়, এই সময় কী থেকে কী বলে ফেলবে তার নেই ঠিক, তার থেকে মুখে কুলুপ এঁটে থাকাই ভালো৷ সারাটা জীবনই তো তাই করে এল৷ এই সমরেশ যখন সদ্য বড় হয়ে ওঠা বুলার পেছন পেছন ঘুরত, প্রেমের অভিনয় করত, ভুলিয়ে-ভালিয়ে যেদিন মেয়েটাকে গ্রামের শেষ প্রান্তে ওদেরই বাগানবাড়িটায় নিয়ে গিয়েছিল সেদিনও মানিক মুখে কুলুপই এঁটে ছিল, নিজের চোখে সবটা দেখলেও কাউকে কিছু বলার সাহস হয়নি, ভাবল মানিক৷

 * * * *

বুলার ছোটবেলার অভ্যেস হল, জলে ঝাঁপ দিয়েই লম্বালম্বি ভাবে একদম মাটির তলায় চলে যাওয়া; সেখানকার গাছ, নাম-না-জানা জলের নীচের ফুলগুলোর সাথে মিলেমিশে বেড়াতে ভারী ভালো লাগে ওর৷ নিজের মনে আপন খেয়ালে জলের একদম তলায় নির্ভাবনায় ও ভেসে বেড়ায়, দশ মিনিট দম আটকে রাখা ওর কাছে জলভাত৷ সাধে কি গ্রামের সবাই ওকে জলপরি বলে?

কাজের সময়েও ও সেটাই করে৷ তবে তখন অবশ্য আর ফুল, গাছ এসবের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করে না, কাজের জিনিস খুঁজতেই ব্যস্ত থাকে৷ আজকেও ও সেটাই করছিল৷ তবে আজ থেকে থেকে ভারী আনমনা হয়ে যাচ্ছিল বুলা৷ পাঁচ বছর আগে খিদের জ্বালায় যখন এই পেশাটা ওকে নিতে হয়েছিল, তখনো ও ভাবেনি পেশাটা ওর নেশাও হয়ে যাবে৷ আক্ষেপ যে হয় না একেবারেই তা নয়, বিশেষ করে বাবার মরা মুখটার কথা যখন মনে পড়ে; কিন্তু তারপর ও ভাবে এ-ই বা খারাপ কি! না-ই বা সে বুলা চৌধুরী হতে পারল, আগের মাসে পাশের হরুগ্রামের মিত্রবাবুদের কোলের ছেলেটা যখন পুকুরে ডুবে গিয়েছিল, বুলা যখন তাকে তুলে এনেছিল জল থেকে, প্রচুর জল পেটে গেলেও বাচ্চাটা যখন বেঁচে গিয়েছিল, তখন ওদের বাড়ির সবার মুখে যে হাসি দেখেছিল সেটা সাঁতারের চ্যাম্পিয়ন হলে ও দেখতে পেত কি?

কিন্তু সেরকম খুব কমই হয়৷ একটা বড় গাছের লতার মতো পাতাগুলোকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে ভাবছিল বুলা৷ বেশির ভাগই আসে মামুলি কেস, হয় কারুর কুয়োয় সোনার দুল বা নাকছাবি পড়ে গেছে, কারুর আবার পুকুরে চাবি পড়ে গেছে এইসব৷ রেটও খুবই কম৷ জিনিস খুঁজে দিতে পারলে পাঁচশো নাহলে একশো৷ তাও অর্ধেক সময় সেটাও জোটে না বুলার৷ প্রথম প্রথম মেয়ে ডুবুরি বলে এ-তল্লাটের সবাই বেশ ভিড় করত দেখতে, এখন সেটাও আর নেই৷ সবার গা-সওয়া হয়ে গেছে৷ মানুষজনও এত গরিব, সবসময় টাকা চাইতেও পারে না বুলা৷ বাড়িতে সে আর মা দুটি তো প্রাণী৷ তার এই রোজগার আর মায়ের দু-বেলা ঠিকে কাজ, দুজনের ভালোই চলে যায়৷

কিন্তু আজ সকালে মানিককাকা যখন বাড়িতে ডাকতে গিয়েছিল, তখন মা খেঁকিয়ে উঠেছিল, ‘‘তুই ওই বাড়ির কাজ করতে যাবি? মনে নেই ছেলেটা কী করেছিল তোর?’’

বুলা মনস্থির করতে কিছুক্ষণ সময় নিয়েছিল৷ কোমরের বহু পুরোনো ব্যথার জায়গাটা টনটন করে উঠেছিল, যেখানটায় সমরেশের বন্ধুরা বাঁশ দিয়ে মেরেছিল৷ পিঠের কিছু আঁচড়, কিছু দাগও চোখে পড়েছিল, তারপর দড়িটা নিতে নিতে বলেছিল, ‘‘মা, এটা আমার কাজ৷ এর জন্য আমি টাকা পাই৷’’

মা আরো জোরে মুখঝামটা দিয়েছিল, ‘‘ইইইহ! কত বড় রোজগেরে মেয়ে এলেন আমার রে! মুখ তো আগেই পুড়িয়েছিস, এখন আবার লোক হাসাতে চাস?’’

বুলা উত্তর না দিয়ে মানিককাকার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল৷ কথায় কথা বাড়ে৷ কী দরকার! ওর একমাত্র খুদে শাগরেদ ভুতোকে ডেকে নিয়ে রওনা হয়েছিল এই গ্রামের একদম শেষপ্রান্তের কালো দিঘির দিকে৷

বুলাকে জলের মধ্যে বেশি খুঁজতে হল না৷ দিঘির একটু বাঁ কোণের দিকে যেতেই ও বউটাকে দেখতে পেয়ে গেল৷ পা দুটোকে যতটা সম্ভব দ্রুতগতিতে নাড়াতে নাড়াতে ও বউটার কাছে গেল৷ বাচ্চা মেয়ে৷ শান্তভাবে শুয়ে রয়েছে মাটির তলায়৷ জলের তোড়ে হাল্কা হাল্কা দড়ি বাঁধা ফর্সা পা-দুটো নড়ছে৷ হাতদুটোকেও পিছমোড়া করে পেছনে বাঁধা৷ নাকের কাছটা হাল্কা লাল হয়ে আছে, এ ছাড়া আর কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই৷

বুলার বুকটা মুচড়ে উঠল৷ হোক না সমরেশের বউ, হোক না বুলা যাকে সবচেয়ে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল, যার ছলচাতুরীতে ভুলে গিয়ে নিজের সব শেষ করে দিয়েছিল, তার বউ, তবু মেয়ে তো! সমরেশ কী করে পারল এভাবে মারতে?

জলের নীচে এমনিই অন্ধকার, তার ওপর পেশাদার ডুবুরিদের মতো বুলার সাজসরঞ্জাম কিছুই নেই, একটা ছোট টর্চকে সে মাথার সাথে ভালো করে বেঁধে নিয়ে নামে৷ সেই টর্চের আলোয় ও নিজের বুকে লুকিয়ে রাখা মানিক-কাকার দেওয়া ছোট ছুরিটা সন্তর্পণে বের করল৷ মানিককাকা পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে বলেছে৷ অথচ, কাজটা সেরকম কিছুই নয়৷ খুনটাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে হবে৷ তার জন্য শুধু সমরেশের তাড়াহুড়োতে খুলতে ভুলে যাওয়া দড়িগুলোকে কেটে দিতে হবে৷

বুলার সকালে মানিককাকার বলা কথাগুলো আবার মনে পড়ল৷ বুলাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে শান্তভাবে ধীর গলায় মানিককাকা বলেছিল, ‘‘বুলা মা, একটা কাজ করে দিতে হবে৷ তুই আমাদের গ্রামের মেয়ে, তুই থাকতে আর কাকেই বা বলব! সমরেশকে তো জানিসই, মাথাগরম ছেলে, রাগের মাথায় একটা ভুল করে ফেলেছে৷’’

বুলার সমরেশের নাম শুনেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল৷

বেশ তো আছে সে, অনেক বছর তো হয়ে গেল, আবার সমরেশ কেন! বুলা হাজার বার নিজেকে তো সেজন্য ধিক্কার দিয়েছে, তবু এখনো কেন! ছোট বয়সের সরলতায় সমরেশের শয়তানি ও ধরতে পারেনি৷ অনেকের সাবধান করে দেওয়াতেও ও বুঝতে পারেনি যে গ্রামের সবচেয়ে বড়োলোকের একমাত্র ছেলে সমরেশের কাছে বুলার মতো মেয়েরা খেলা ছাড়া কিছুই নয়৷ তখন বুলা দিনরাত সাঁতার নিয়েই পড়ে আছে, বাবার উৎসাহে তৈরি করছে নিজেকে ন্যাশনাল মিটের জন্য৷ ভোর ভোর উঠে চলে যেত সমরেশদের বাড়ির পেছনদিকের বিশাল পুকুরে৷ বাবা ছিল ওদের বাড়ির বাঁধা রিকশাওয়ালা, মেয়ের প্র্যাকটিসের জন্য এইটুকু অনুমতি বুলার বাবা আদায় করতে পেরেছিল মনিবের কাছ থেকে৷ সেখানেই প্রথম দেখা সমরেশের সাথে৷

দিনের পর দিন সূর্যঠিক মতো ফোটার আগেই বুলা জলে নেমে পড়ত, আর পুকুরপাড়ে হাজির হত সমরেশ৷ প্রথম দিকের আড়ষ্টতা কেটে যেতে বুলার মনে হয়েছিল সমরেশ ওর প্রেমে পাগল৷ কিছুদিনের মধ্যেই ডকে উঠেছিল ভোরবেলার প্র্যাকটিস, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত দুজনে৷ প্রথম প্রথম বুলা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত, তার নিজের বাবা যে বাড়ির রিকশাওয়ালা, গ্রামের সেই সবচেয়ে বড়োলোকের ছেলে তাকে এত ভালোবাসে? এও কি সম্ভব?

কিন্তু সমরেশের দিনের পর দিন প্রেমের কথায় সে ভয়ও কবে ফুৎকারে উড়ে গিয়েছিল বুলার ষোলো বছরের মন থেকে৷ এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিল ও প্রেমে যে কলকাতার একটা ভালো টুর্নামেন্টের দিন যখন সমরেশ আলগোছে ওকে স্টেশন থেকে বাইকে তুলে নিয়ে ওদের বাগানবাড়িটায় নিয়ে গিয়েছিল, তখনো ওর কিছু মনে হয়নি৷ কিন্তু সেখান থেকে বেরোনোর সময় চোখে পড়ে গিয়েছিল বাবার বন্ধু ইরফানচাচার৷

বাবা রাগে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল, বুলাকে বেধড়ক পিটিয়েও শান্ত হয়নি, রাগের মাথায় ছুটেছিল সমরেশদের বাড়ি, ওর বাবাকে সব জানাতে৷ বাবার মাসমাইনের বাঁধা চাকরিটা চলে যাবে জেনেও বাবা থামেনি কারণ সমরেশের মেয়েঘটিত রোগের কথা সারা গ্রাম জানত৷

বুলা স্বাভাবিক স্বরে মানিককাকার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘‘কী কাজ?’’

মানিককাকা গলা আরো খাদে নামিয়ে বলেছিল, ‘‘কাল রাত্তিরে সমরেশের সাথে ওর বউয়ের একটু তর্কাতর্কি হয় বুঝলি! সমরেশ রাগের মাথায় বউটাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে!’’

বুলার আতঙ্কে কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ মানিককাকা একটা ঢোঁক গিলে আবার বলে চলেছিল, ‘‘তোকে পুরোটা বলতেই হবে, তাই বলছি৷ বউটা মরে যেতে সমরেশ আর ওর দুটো চ্যালা লাশটাকে ভোর রাতে কালো দিঘিতে ফেলে এসেছে৷ যাতে পুলিশ এলে বোঝে যে বউটা নিজেই পুকুরে ডুবে মরেছে৷’’

বুলা স্থিরভাবে শুনে যাচ্ছিল৷ মাত্র তিন মাস আগে বিয়ে হওয়া বউটাকে এরকমভাবে মেরে ফেলল? অবশ্য সমরেশ তো এরকমই, সেটা বুলার থেকে ভালো আর কে জানে! সেদিন গিয়ে ওদের বাড়িতে সব কিছু খুলে বলে আসার পর ঠিক দু-দিন বাদে যখন রক্তবমি করতে করতে বাবা মারা গেল, আর তারও ঠিক চারদিন বাদে বুলাকে যখন দ্বিতীয়বারের জন্য সমরেশদের বাগানবাড়িতে ঢুকিয়ে ওর সব চ্যালাচামুন্ডাদের দল নিজেদের লালসা মিটিয়ে নিয়ে বুলাকে পেটাতে পেটাতে ওর কোমরের পেছনদিকের হাড়টাকে ভেঙে দিয়েছিল, তখনো তো সমরেশ এরকমই ছিল৷ বুলার এখনো দিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে, আর মনে পড়লেই ওর শরীরটা কেমন অবসন্ন লাগে! ছেলেগুলো যখন একের পর এক বুলার ওপর অত্যাচার করছিল, মারছিল নির্মমভাবে, দূরের চেয়ারে বসে সিগারেট হাতে সমরেশ তখন নিষ্ঠুর হেসে বলেছিল, ‘‘তোর বাপ আমার কীর্তির কথা সারা গ্রাম রাষ্ট্র করবে বলে ভয় দেখিয়েছিল না? কী ভেবেছিল যে আমি তোকে বিয়ে করব? খুব শখ না?….’’ আরও কত নোংরা অশ্রাব্য কথা৷

বুলা শান্তভাবে একটু বিদ্রূপের হাসি হেসে মানিককাকাকে বলেছিল, ‘‘তো কী হয়েছে! পুলিশ থেকে শুরু করে থানার সবাই তো ওদের কেনা!’’ ঠিক যেমনটা হয়েছিল ওর বেলায়! নেশা না করা ভালোমানুষ বাবাটা যখন রক্তবমি করে মরে গেল, তখন গ্রামের ডাক্তার সাফ জানিয়েছিল বিষ খেয়ে মারা গেছে৷ গলার কাছটা খুব ব্যথা করে উঠেছিল বুলার৷ কিন্তু কিছুই তো করতে পারল না বুলা! বাবার খুন, ওর ওরকম অবস্থা, সব কিছুর জন্য থানায় যেতে পাত্তাই পায়নি ও৷ ওদের গ্রামের দারোগা, যে ফি সন্ধেয় সমরেশদের বাড়ির আড্ডায় হাজির হয়, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ওকে৷

মানিককাকা এবার বলেছিল, ‘‘না রে বুলা, বলছি না, একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে৷ একে তো আগের দারোগা আর নেই, নতুন যে এসেছে, সে ঘুষখোর নয়, তার ওপর তাড়াহুড়োতে বউটার হাত-পায়ের দড়িগুলো ওরা খুলতে ভুলে গেছে৷’’ বুলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে চলেছিল মানিক কাকা, ‘‘আমারই কী কপাল বল! পেটের দায়ে এই বয়সে এইসব নোংরা কাজে সায় দিতে হয়৷ আর এখন তো এমন হয়ে গেছে, আমি বেঁকে বসলে আমায় শেষ করে দেবে৷ ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে থাকি, জলে বাস করে কি আর কুমিরের সাথে বিবাদ করা যায় বল?’’

বুলা বলেছিল, ‘‘আমায় কী করতে হবে?’’

মানিককাকা স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল, ‘‘জানি, তোর অনেক রাগ ওদের ওপর৷ কিন্তু এখনো যদি রাগ দেখাস, তোকে আর তোর মাকে শেষ করে দেবে ওরা৷ তার থেকে যা হবার তো হয়েই গেছে, এখন সামনের দিকে বরং তাকা৷ যদি লাশটা পুকুরে ভেসে ওঠার আগেই গিয়ে দড়িগুলো কেটে দিয়ে আসতে পারিস, পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবি৷ ভাবতে পারছিস? তোর মায়ের বুকের রোগটা পুরো সেরে যাবে!’’ পাঁচটা কড়কড়ে হাজার টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলেছিল মানিককাকা, ‘‘এটা অ্যাডভান্স৷ শিগগির চল আমার সাথে৷’’

বুলা তখনো চেয়ে আছে দেখে মানিককাকা গলা আরেক ধাপ খাদে নামিয়ে বলেছিল, ‘‘তুই কী ভাবছিস? তোকে এতকিছু বললাম, তারপর তুই না গেলে তোকে ওরা ছেড়ে দেবে? তার চেয়ে কাজটা উতরে দে, টাকাটা পেলে তোদের অনেক সুরাহা হবে৷’’

মানিককাকার পিছু পিছু কালো দিঘিতে আসতে আসতে বুলা ভাবছিল, যার জন্য ওর বাবা মরে গেল, যার জন্য ওর কোমরটা ভেঙে যাওয়ায় ওর সাঁতারের কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল, যার জন্য ওর শরীরটা কয়েকটা পশু ক্ষতবিক্ষত করল, তাকেই ও বাঁচাতে যাচ্ছে? প্রকৃতির কী অদ্ভুত পরিহাস! কিন্তু কিছু করার নেই, মনটাকে শক্ত করেছিল বুলা৷

বুলা মেয়েটার মুখটার ওপর পরম মমতায় হাত বোলাল৷ বয়সে ওর থেকে ছোটই হবে৷ কপালে স্বামীর কল্যাণের জন্য পরা সিঁদুর জলে ভিজে সারা কপালে লেপ্টে রয়েছে৷ হাতের শাঁখা-পলাগুলো দু-একটা ভেঙে গেছে৷

কয়েক মাস আগেই প্রচুর যৌতুক দিয়ে যখন মেয়েটার বাবা বিয়ে দিয়েছিল তখনো কি এই দিনটার কথা ভাবতে পেরেছিল? মানিককাকা বলছিল দড়িগুলো খুলে দিলে ওরা চালিয়ে দেবে এটা জলে ডুবে আত্মহত্যা৷ এটা যে বালিশ চাপা দিয়ে খুন তা বুঝতেই পারবে না পুলিশ৷ বুলা ঠোঁট কামড়াল৷ কিন্তু এ যাত্রায় সমরেশকে না বাঁচালে ওর আর ওর মায়ের চরম ক্ষতি করবে ওরা, এটাও পরিষ্কার৷

বুলার এতক্ষণ ধরে রাখা দম শেষ হয়ে আসছিল৷ ও আর বেশি ভাবল না, হাতের ছুরিটাকে দূরের লতানে গাছটার দিকে ছুড়ে ফেলে দিল৷ তারপর পুলিশের নতুন দারোগাটা যেখানটা দাঁড়িয়েছিল সেইদিকটায় আন্দাজ করে করে লাশটাকে ঠেলে নিয়ে চলতে লাগল৷

গভীর পুকুর, তায় সাথে লাশ, তবু বুলা নিজের ভাঙা রুগ্ন শরীরটার সব শক্তি একত্র করে নীচ থেকে ঠেলে উপরে তুলল লাশটাকে৷

টেনে হিঁচড়ে তুলতেই ডাঙার লোকগুলো হইহই করে এগিয়ে এল লাশ তোলার কাজে হাত লাগাতে৷ এক পলকের জন্য ও সমরেশের দিকে সোজাসুজি তাকাল, বউটার হাত-পায়ের দড়িগুলো দিনের আলোয় ঝকঝক করছে আর সেটা দেখে সমরেশের মুখটা সাদা হয়ে গেছে৷ জান্তব একটা ক্রুর হাসি হেসে বুলা আবার ডুব দিল৷

এবার জলের অনেক, অনেক গভীরে৷

ওর জন্য এই জলের তলার পৃথিবীটাই ভালো৷ কী হবে ওপরের নোংরামির জগতে উঠে?

দমটাকে আটকে আর না রেখে ছেড়ে দিল ও৷ কোমরের বাঁধা দড়িটা খুলে ছুড়ে দিল জলের মধ্যে৷ নিঃশ্বাস নিতে পারছে না আর, হাত-পাগুলো কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে, চোখদুটোও যেন ঝাপসা হয়ে আসছে, তবু তার মাঝেই অনুভব করতে লাগল বুলা, ওর শরীরের নীচটা যেন মাছের মতো হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, আশপাশের ছোট ছোট মাছগুলোর সাথে ও নিজেও একটা মাছ হয়ে চু-কিত-কিত খেলতে লাগল, ঠিক ছোট্টবেলার মতো৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *