1 of 2

ডুবুরি

ডুবুরি

আঁচিয়ে এসে ঘরে ঢুকতেই থমকে গেল টুনু। বাঁশের মাচার ওপর বিছানায় মাথা গুঁজে মা কাঁদছে। একটু আগে তাদের খেতে দিয়ে মা পুকুরে গিয়েছিলেন স্নান করতে। এখনও মা’র শাড়িটা ভেজা। মাটির মেঝেটা শাড়ির জলে অনেকটা ভিজে গিয়ে কাদা–কাদা হয়ে গিয়েছে। সেই কাদা মা’র হাঁটুর কাছে আর গোঁড়ালিতে লেগে আছে। মেজেতে বসে উঁচু হয়ে ময়লা কাঁথা আর শাড়ির পাড় ছিঁড়ে তৈরি করা চাদরের বিছানায় মুখ গুঁজে মা ফুলে ফুলে কাঁদছে।

মাকে কাঁদতে এই প্রথম দেখছে না টুনু, বাবার সঙ্গে ঝগড়া হলে কিংবা বাবা মারলে মা চিৎকার করে সারা কলোনিকে জানিয়ে কাঁদতে বসে। কিন্তু এইভাবে ফুলে ফুলে নিঃশব্দে কান্নাটা অন্যরকম। টুনু ভয় পেয়ে গেল। বুকের ভিতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠল তার।

টুনু ফিসফিস করে ডাকে–’মা, ওমা, মা।’ মা উত্তর দেয় না। টুনু আস্তে-আস্তে মার কাছে এগোয়–’মা, কান্দ ক্যান গো? কী হইছে?’

কান্নার সঙ্গে-সঙ্গে মা’র খালি পিঠের পাতলা চামড়া ভেদ করে পাঁজরের হাড়গুলো গিরগির করে উঠছে। টুনু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ প্রায় চিৎকার করে ওঠে সে-’কি হইছে কও না ক্যান?’

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে মা’র কান্না থেমে যায়। সোজা হয়ে বসে মা। ভেজা মাথার চুল থেকে কেঁচোর মতো মোটা-মোটা ধারায় জল এঁকে-বেঁকে নেমে চোখের জলের সঙ্গে মিশে হাড়-উঁচু শুকনো মুখের থুতনিতে এসে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে।

টুনু চেয়ে থাকে। মার গলার কাছটা ফুলে ফুলে উঠছে। ফোঁপাতে–ফোঁপাতে চোখের জল হাত দিয়ে মুছে মা বলে–’কিসু হয় নাই, চিকইর দিস না।’

–‘কিসু হয় নাই, তবে কান্দ ক্যান? কী হইছে কও না আমারে।’

–‘কইলাম তো কিছু হয় নাই। খাইছস নি প্যাট ভইরা?’

টুনু এগিয়ে গিয়ে মার কাছে, খুব কাছে দাঁড়ায়। তারপর সোজা হয়ে মা’র চোখের দিকে তাকিয়ে বারো বছরের টুনু বিজ্ঞের মতো বলে–’কী হইছে কও না আমারে।’

–’চুপ–চুপ, আস্তে। কেউ য্যান শোনে না।’ মা তাড়াতাড়ি চাপা গলায় বলে–’তর বাবায় ট্যার পাইলে কিন্তু আস্ত রাখব না। দুলটা পুকুরে হারাইছি।’

টুনু বুঝতে পারে। কেন না, সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, মার বাঁ-কানের লতিটা শূন্য। ওখানে একটু আগেও ঝকঝকে সোনার দুলটা দুলছিল। যদিও মাকে খুব বেমানান লাগছিল। হাড়–উঁচু মুখ, প্রায় ন্যাকড়ার মতো জ্যালজেলে ময়লা শাড়ি আর রুক্ষ তেল–না-দেওয়া চুলের সঙ্গে দুলটার কোনও মিল ছিল না। কাল রাতেও বাবা ঠাট্টা করে বলেছে–’গোবরে পদ্মফুল। মাইনসের যেমুন দুল চাই, দুলেরও হেমুন মানুষ চাই। সাজলেই হয় না গো মাইজ্যা বউ।’ এসব কথায় মা রেগে গিয়েছিল খুব। রাগ করে বলেছে–’হগো হ’ শরীল যে গেছে হেই দোষটা আমারে না দিয়া বুঝি শান্তি পাও না। মাইয়ামানুষ পালতে গেলে মুরাদ চাই, বুঝলানি! কয় ট্যাহা রোজগার করো। তুমি যে, শরীল তুইল্যা কথা কও!’ কিন্তু ঝগড়াটা শেষ পর্যন্ত খুব সাংঘাতিক হয়নি। কারণ, কাল সুভাষ পল্লির হারান জ্যাঠার মেয়ে লতিদির বিয়েতে গিয়েছিল দুজন। তা না হলে কীভাবে মার একটা একটা গয়না নিয়ে বিক্রি করে সংসার খরচ চালিয়েছে বাবা, সে কথা না বলে এবং বুক চাপড়ে না কেঁদে মা থামত না।

কাল রাতে মা তার বহু পুরোনো লাল রঙের ওপর সাদা জরির তারাফুল তোলা বেনারসিটা পরে বাবার সঙ্গে লতিদির বিয়েতে গিয়েছিল। বিয়ের নিমন্ত্রণে গেলেই মা বেনারসিটা পরে আর কানে দুলজোড়া। এছাড়া মা’র আর ভালো পোশাক নেই, গয়নাও নেই, শুধু হাতে কয়েক গোছা ব্রোঞ্জের চুড়ি ছাড়া।

কাল রাতে সুভাষ পল্লিতে হারান জ্যাঠার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে এসে মা আর দুলজোড়া খুলে রাখেনি। কাল রাতে মার মুখটা হাসি-হাসি ছিল। বাবার মেজাজ ভালো ছিল কাল।

কিন্তু আজ? ভাবতেই টুনুর গা–টা শিরশির করে।

রোগা হাড়-বের করা মায়ের দিকে তাকায় টুনু। বলে–’ভালো কইরা খুইজ্যা দ্যাখছানি? অন্য কোনখানে পড়ে নাই তো?’

মা চাপা গলায় বলে–’চুপ। আস্তে কথা কইতে পারস না। বুলকি আর পানু যদি শুইন্যা ফ্যালায়?’

টুনু রান্নাঘরের দিকে তাকায়। দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বেড়াগুলো পুরোনো হয়ে ভেঙে গেছে এদিকটায়। পানুর ডোরাকাটা শার্ট আর বুলকির সবুজ রঙের ফ্রকের অংশ দেখতে পায় সে।

–’না, শুনব না। আরা অখনও পাকঘরে। খাইত্যাছে।’

–’শয়তান দুইটা। শুনলেই বাপের কানে লইয়া তুলব।’

বাবার ভয়ে মা সিঁটিয়ে যাচ্ছে যেন। মার চোখের পাতাগুলো পড়ছেই না। টুনু চুপ করে থাকে।

বাবাকে সে চেনে। খুব ভালো করেই চেনে। চারদিকের সবকিছুর ওপর বাবা যেন সবসময়ে খেপে আছে। টুনু একবারের বেশি দুবার ভাত চাইলেই বাবা চিৎকার করতে থাকে–’হ, সোয়াস্যার গিল্যা খাসি হইতাছ; ল্যাখাপড়ার নামে তো লবডঙ্কা! যাগো ল্যাখন পড়ন হয়, তারা স্যার–সোয়াস্যার চাউলের আহার করে না।’ কিংবা কখনও কেউ কোনও জিনিস ভেঙে ফেললে বাবা বলে—’কিরে বাসি, ঠাকুরদার জমিদারির জিনিস পাইছ নাকি নিব্বইংশো পোড়ারমুখো–’

বাবার রুদ্র মূর্তির কথা মনে পড়তেই টুনু শিউরে উঠল। আস্তে-আস্তে বলল –’আর একবার খুইজ্যা দ্যাখবা না?’

মা বলে–’হ, আর একবার খুজুম। তুইও চ’ দেখি আমার লগে।’ একটু চুপ করে থেকে আবার বলে–’ঘাটে কেউ নাই অখন। একলা ডুব দিতে ডর করে।’

টুনু মনে-মনে হাসে। মা সাঁতার জানে, কিন্তু ডুব দিতে মার ভীষণ ভয়।

.

ঠিক দুপুর। নিস্তরঙ্গ সবুজ জল। কয়েকটা শুকনো পাতা জলের ওপর ভাসছে। খুব নির্জন চারদিকে। কেউ কোথাও নেই।

টুনু বলে–’কোনখানে?’

কাটা সুপুরিগাছ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে পা দিয়ে মা ইতস্তত করে। চারদিকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়।

টুনু আবার বলে–’কোনখানে মা?’

মাঝখানের জলটা সবুজ, আর ঘাটের কাছে ঘোলা। কেউ বাসন মেজে গেছে সেই ছোবড়াগুলো ছাই–কাদার মধ্যে পুকুরপাড়ে পড়ে আছে। কেমন যেন আঁশটে গন্ধ।

ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে মা বলে–’এইখানেই পড়ছে। কিন্তু–’

আঁশটে গন্ধটা এড়াবার জন্যেই টুনু ঘাটের কাছ থেকে সরে এসে টেকির শাক আর কচুর জঙ্গলের ধার ঘেঁষে দাঁড়াল।

মা ঠিক কোমরজলে দাঁড়িয়ে আছে। পা ঘষে–ঘষে খুঁজছে দুলটাকে। টুনু তাকিয়ে রইল। মা আর একধাপ নামল। জলের দিকে নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে আছে মা। কিন্তু জলটা ঘোলা। কিছু দেখতে পাচ্ছে না মা।

–’এমনিই কপাল! দুল কি পাওন যাইব! তিন আনি আর তিন আনি–এই ছয় আনি সোনাই আছিল ঘরে। পোড়ার কপালে ছয় আনির তিন আনি গেল।’ ঠিক গলাজলে দাঁড়িয়ে মা বলে –’ইচ্ছা করে বাকি তিন আনিও উদ্দা মাইরা ফ্যালাইয়া দেই।’

কচুগাছের পাতা হাওয়ায় দুলে টুনুর পায়ে লাগে। কেমন সুড়সুড় করে যেন। খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মাকে দেখে টুনু। জলগুলো গোল চাকতির মতো মার চারদিকে, বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। মা’র কথাটা একটুকরো কাঠের মতো জলের ওপর ভাসছে।

মার থুতনির কাছে জল এখন।

হঠাৎ মা চিৎকার করে–’এই যে, কী জানি একটা পায়ে লাগল রে!’

মা ডুব দেয়। ছলাৎ করে খানিকটা সবুজ জল ফেনা তুলে সরে যায়। টুনু একলাফে ঘাটের কাছে এগোয়। জলের ঠিক ওপরের ধাপে কুঁজো হয়ে হাঁটুতে হাতের ভর দিয়ে তাকিয়ে দেখে মার সাদা শাড়িটা সবুজ জলের ভিতরে মাছের মতো ডুবে যাচ্ছে। টুনু দম বন্ধ করে থাকে।

কিছুক্ষণ জলটা অল্প ঢেউ তুলল। টুনু তাকিয়ে রইল।

হুস করে মাথা তুলল মা! মুঠোকরা হাতটা জলের ওপর তুলে আঙুলগুলো আলগা করে দিল। মার হাতের চেটোয় ছোট্ট একটা লোহার।

হাসি পায় টুনুর, কিন্তু হাসে না।

মা’র মুখটা এখন আরও সাদা, ঠোঁট দুটো চেপে লেগে আছে। মা জোরে–জোরে নিশ্বাস ফেলছে এখন।

স্ক্রুটা খুব জোরে আরও গভীর জলের দিকে  ছুঁড়ে দেয় মা। ক্লান্ত সরে বলে–’দ্যাখ তো বুলকি আর পানু এদিকে আছে নাকি? আইলে কইস কিন্তু। আমি আর একটু খুঁজি।’

–’আইচ্ছা’ জবাব দেয় টুনু। চারদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই।

মার সরু রোগা দেহটা আরও গভীর জলের দিকে সরে যাচ্ছে ঢেউ তুলে। ডিঙি নৌকোর মতো স্বচ্ছন্দ গতি, দুপাশে সরু রেখার মতো ঢেউ তুলে জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। জোড়া হাতে আর পায়ের আঘাতে জলে ছপছপ শব্দ হচ্ছে আর ঢেউ উঠছে জলে। পায়ের কাছে দুটো ট্যাংরা মাছ মুখ তুলল। টুপ করে ডুবে গেল আবার।

–’আর দূরে যাইও না, মা।’ টুনু চিৎকার করে বলে। ভয় করে তার।

–’আরে ডরস ক্যানে।’ গাঙপারের মাইয়া আমি, এত সহজে ডুবুম না।’ মা বলে। জলের ওপর দিয়ে তার গলার স্বরটা কাঁপতে কাঁপতে এল। খুব ক্লান্ত স্বর। জলের জন্যেই বোধহয় ঠিক কাঁসির মতো শব্দ হল।

পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে টুনু দেখে মা টুপ করে ডুবে গেল। জলের নীচে এখন আর মাকে দেখা যাচ্ছে না। তবু টুনু চোখ দুটো স্থির করে পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল। দুপুরের রোদ ওপারে নারকোল গাছের পাতায় লেগে ঝিকমিক করছে।

চোখ দুটো করকর করে তার। চোখে জল আসে। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ ঘষে টুনু তারপর আবার তাকায়।

এবার প্রথমে মা’র হাতদুটো সরু দুটো কাঠির মতো জলের ওপর ভেসে উঠল। তারপর মাকে দেখা গেল। টুনু নিশ্বাস ফেলে নড়ে চড়ে দাঁড়ায়।

মা চিৎ করে পা দিয়ে জল কাটে। চিৎ সাঁতার দিয়ে পাড়ের দিকে এগোতে থাকে। টুনু বুঝতে পারে যে, মা আর দম পাচ্ছে না।

পাড়ে এসে কাদার মধ্যে সুপুরিগাছ আর বাঁশের সিঁড়িতে বসে হাঁফাতে থাকে মা। দুটো হাত দিয়ে ভর দেয় ছাইমাখা ছোবড়া ছড়িয়ে থাকা নোংরা জায়গাটায়। শাড়িটা কাদায় মাখামাখি।

–’আর পারি না।’ ভীষণভাবে হাঁফাতে-হাঁফাতে মা বলে–দম পাই না আর। পোড়া কপাইল্যা দুল! শরীলটায় পিছা মারে।’

–’আমি একবার দেখুম, মা?’

–’দূর! জলে লামলে ঠান্ডা লাগব তর। আরে, কপালে নাই ঘি, ঠক ঠকাইলে হইব কি।’ খুব ক্লান্ত সুরে মা বলে। পা দুটো জলের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে নোংরা মাটিতে হাতের ওপর শরীরের ভার রেখে মাথাটা ডান কাঁধে কাত করে দিয়ে মা বলে। মাথার চুলগুলো একদিকে সরানো। মা’র সরু ঘাড় আর ঘাড়ের ওপর তিনটে ঢিবির মতো উঁচু হাড় দেখতে পায় টুনু। মার জন্য কেন যেন ভীষণ কষ্ট হয় তার।

–’মা’–টুনু মা’র খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে মার পাশেই উবু হয়ে বসে চাপা গায় বলে –’পরাণ মাঝিরে ডাকুম একবার?

–’কী হইব হ্যারে ডাইক্যা?

–’একবার খুইজ্যা দেখব।’

–’পয়সা নিব না? তখন পয়সা পামু কই?’

একটু চিন্তা করে টুনু। বলে–’বেশি লাগব না। দুলটা যদি পাওন যায়–’

–’হু, দে একবার খবর। বেশি জানাজানি হইলে কিন্তু আমার কপালে কষ্ট আছে।’ মা খুব আস্তে-আস্তে বলে। জল থেকে পা দুটো টেনে আনে মা। পা দুটো ভেজা, পায়ের পাতার নীচের দিয়ে বলে–’একবার ধর তো আমারে টুনু। শরীলটা য্যান কাঁপে আমার।’

টুনু মা’কে ধরে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না মা। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। মাথাটা নুয়ে পড়েছে সামনের দিকে।

–’ওয়াক’–হিক্কা ওঠে মা’র। টুনু মাকে জড়িয়ে থেকে টের পায় যে মার শরীরের ভিতরটা গুরগুর করে কাঁপছে। মা’কে শক্ত করে ধরে থাকে সে। মাথার ভেজা চুলগুলো সামনের দিকে দড়ির মতো দুলছে। মুখটা সাদা।

আর একবার হিক্কা তোলে মা। খানিকটা হলুদ জল বেরোয় মুখ দিয়ে। তারপর মা হাঁফাতে থাকে। টুনু চিৎকার করে–’কীগো মা কী হইছে তোমার?

মা এবার তার কাঁধে ভয় দেয়–‘কিছু না, কিছু হয় নাই। সারাদিন খাই নাই তো কিছু। পিত্তি পড়ছে। গিয়া একটু শুইয়া থাকলেই সারব।’

–’হ তোমারও মাথা খারাপ। এই শরীল লইয়া কেউ জলে ডুবায়?’ টুনু বলে। তার চিৎকার করে কাঁদছে ইচ্ছে হয় যেন।

–‘কিন্তু দুলটা’–হাঁফাতে হাঁফাতেই বলে–’আমার বিয়ার দুল। তর বাবায় দিছিল। বড় শখের দুল রে! সব তো গেছে। এই দুলজোড়া আছিল।’ মা কাঁদতে থাকে, আর হাঁফাতে থাকে আর কাঁপতে থাকে।

টুনু ধমক দেয়–’কান্দনের কী হইছে। বাবায় ট্যার পাওনের আগেই দুল পাইয়া যাইবা। অখন গিয়া শুইয়া থাক। আমি পরাণ মাঝিরে একবার খবর দেই।’

মা’কে ধরে খুব সাবধানে আস্তে-আস্তে চলতে থাকে টুনু। মা’র গা থেকে ভিজে জলের আর বমির কটু গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। একটু গা ঘিনঘিন করে তার।

উঠোনের আগলটা হাত বাড়িয়ে ধরে মা বলে–’তুই এইবার মাঝির কাছে যা। আমি একলাই ঘরে যাইতে পারুম।’ তারপর ঘরের দিকে তাকিয়ে দুর্বল স্বরটায় যতদূর সম্ভব জোর দিয়ে মা ডাকে–’বুলকিরে, পানুরে, এদিকে আইয়া ধর দেখি আমারে একটু।’

টুনু বলে–’শয়তান দুইটা পাড়া বেড়াইতে বাইর হইছে বোধ হয়।‘

মাকে ধরে মাটি লেপা দাওয়ায় বসিয়ে রেখে টুনু বলে–’ঘরে গিয়া শুইয়া থাক, আমি পরাণ মাঝিরে খবর দেই।’

.

পরাণ মাঝি পুকুর থেকে চোখ ঘুরিয়ে টুনুর দিকে তাকাল। একটু হেসে বলল –’না কর্তা, আট আনায় হইব না। পুরা একখানা ট্যাহা দিলে লামতে পারি জলে।’

–’ক্যান মাঝি, জল দেইখ্যা ভয় পাইলা নাকি?’ মনে-মনে যেন একটু রাগ করেই বলে টুনু। দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড চেহারা নিয়ে লোকটা হাসছে।

–’ভয়? কত পদ্মা ম্যাঘনা পার হইলাম কর্তা, অখন হালার পুর্ণীরে ভয়! দিয়েন কর্তা, বারো আনাই দিয়েন।’

পরাণ মাঝি মাথার গামছাটা খুলে কোমরে জড়াল। এবার খালি মাথাটা দেখতে পেল টুনু। চুলগুলো প্রায় সাদা হয়ে এসেছে, গালের খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলোও সাদায় কালোয় মেশান। শরীরটা মস্ত বড় পরাণ মাঝির, কিন্তু চামড়াটা ঢিলে, কোঁচকান। খাটো একটা কাপড় আঁট করে। পরা। পায়ের অনেকটা দেখা যাচ্ছে! কেঁচোর মতো শিরাবহুল মোটা গোঁড়ালি। পাগুলো সরু সরু।

খুব আস্তে-আস্তে জলটাকে একটুও ঘোলা না করে মাঝি জলে নামতে লাগল। গলাজলে দাঁড়াল মাঝি। এক আঁটি বিচালির মতো সাদা মাথাটা জলে ভাসছে।

টুনু দেখে মাঝির কালো লম্বা শরীরটা প্রকাণ্ড একটা বোয়াল মাছের মতো নড়ছে জলের নীচে।

হুস করে ডুব দেয় মাঝি। অনেকক্ষণ পর ভেসে ওঠে। টুনুর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। অর্থাৎ পাওয়া যায়নি। মুখ থেকে খানিকটা জল ‘পিড়িক’ করে  ছুঁড়ে দিয়ে আবার ডুব দেয় মাঝি। দুপুরের কড়া রোদে সবুজ, ঘন জলের নীচে অনেক নীচে একটা প্রকাণ্ড মাছের মতো পরাণ মাঝির শরীরটা নেমে যেতে থাকে। তারপর তাকে আর দেখতে পায় না টুনু।

পরাণ মাঝিকে কুশলী ডুবুরির মতো লাগে টুনুর। সে সব ডুবুরি (সে বইতে পড়েছে) একটুও ভয় না করে সমুদ্রের জলে ডুব দিয়ে ঝিনুক তুলে আনে। সেই ঝিনুকের ভিতরে মুক্তো। মুক্তো দেখেনি টুনু, ডুবুরিও না। পরাণ মাঝিকে দেখে শুধু ডুবুরির কথা মনে হয়।

পরাণ মাঝির মাথাটা এবার প্রায় মাঝ–পুকুরে ভেসে ওঠে। হাতের মুঠো থেকে খানিকটা কাঁদা ছুঁড়ে ফেলে পরাণ মাঝি আবার ডুব দেয়। সেই  ছুঁড়ে দেওয়া কাদার মধ্যে কয়েকটা শামুক।

এবার পাড়ের কাছে মুখ তোলে মাঝি। ভীষণভাবে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলে–’না কর্তা, ঠিক কুনখানে পড়ছে হেইরে না জানলে হইব না।’

টুনু মনে-মনে ভয় পায়। ব্যস্ত হয়ে বলে–’এইখানেই পড়ছে। তুমি আর একটু খুইজ্যা দ্যাখো। ছানের সময় বেশি দূরে যায় নাই মা।’

পরাণ মাঝি হতাশভাবে জলের দিকে একবার তাকায়। ঘাটের সিঁড়িতে ভর দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলে–’দেখি আর অ্যাকবার! হালার দমে কুলায় না, না হইলে হালার পুর্ণীরে–’ কথাটা শেষ করেই পিচ্ছিল গতিতে সাপের মতো জলে নামে মাঝি।

এবার পরাণ মাঝিকে স্পষ্ট দেখতে পায় টুনু। ঘাটের খাড়া পাড়ের কাছে জলটা গভীর। পরাণ মাঝি প্রকাণ্ড দুটো হাত মাছের পাখনার মতো নাড়তে-নাড়তে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু গতিটা এবার আর সহজ নয়। খুব আস্তে-আস্তে নামছে মাঝি। সবুজ জলের ভিতরে তার পায়ের সাদা তলাটা নড়ছে। পা দুটো ওপর দিকে আর মাথাটা নীচের দিকে মাঝির।

অনেকটা নেমে প্রায় পুকুরের তলায় মাঝি থেমেছে। টুনু দেখতে পায়, মাঝি খুব সন্তর্পণে মাটিটা দেখছে। একটু পরেই জলটা আস্তে-আস্তে ঘোলা হয়ে গেল। কাদা কাদা হয়ে গেল ওপরটা। মাঝিকে আর দেখতে পেল না টুনু।

অনেকখানি জল ছিটিয়ে মাঝি ভেসে উঠল আবার। এবার পাড়ের খুব কাছে। মুখ তুলে দম নেয় মাঝি। বলে–’আর একটু কর্তা, দেখি একবার। মনে লয় পাইয়া যামু।’ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলতে পারল না মাঝি। হাঁফাতে-হাঁফাতে কেটে-কেটে বলল । বলেই আবার ডুবে গেল। জলের মধ্যে। জলের ওপর সাদা কতগুলো বুদবুদ জমা হল। আরও বুদবুদ উঠে এল জলের ভিতর থেকে। কাঁচের মার্বেলের মতো সেগুলো ভাসতে লাগল জলের ওপর।

টুনু তাকিয়ে দেখে মাঝি উঠে আসছে। টুনু চেয়ে দেখল মাঝির হাতে মুঠো করা কাদা–মাটি।

পরাণ মাঝি ভেসে উঠল জলের ওপর। ক্লান্ত হাতে জলে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। তারপর সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল ওপরে।

‘কর্তা’–দম নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে মাঝি বলে–’দ্যাখেন তো এইগুলির মধ্যে আছে নাকি!’

কাদার মুঠোটা খুলে মাঝি তাকে দেখায়। টুনু কাদার দলাটা হাত বাড়িয়ে নেয়। খানিকটা কাদা কয়েকটা পচা গাছের পাতা, একটু শ্যাওলা শামুক। আর কিছু নেই। টুনু নিশ্বাস ছাড়ল।

–’না মাঝি নাই তো এর মধ্যে।’

কোমরের গামছাটা খুলে মাটিতে বসে সেটা নিংড়োতে থাকে মাঝি। বলে–’দ্যাখলাম য্যান দুলের মতোই। খাংলা দিয়া তু লোমও। কপালে নাই কর্তা, কী করব্যান!’

পরাণ মাঝির গলার স্বরটা যেন অনেক দূর থেকে আসছে ঠিক এমনি ক্ষীণ স্বরে সে বলে –’পারি না কর্তা আর। যখন মাঝি আছিলাম শরীরের জোর আছিল। একদমে নদীর তল থিক্যা মাটি উঠাইতাম। গাঙ পার হইতাম ভরা বর্ষার। হেইদিন গেছে। অখন মাঝির নাম ঘুচাইয়া রিফিউজি হইছি।’

গা মুছতে মুছতে পরাণ মাঝি টুনুর দিকে তাকায়। টুনু মাঝিকে দেখে। প্রকাণ্ড শরীর কড়া পরা হাত। অথচ মাঝির হাত দুটো যেন কাঁপছে।

মাটিতে ফেলে রাখা ময়লা কাদা জামাটার পকেট থেকে বিড়ি বার করে পরাণ মাঝি। সেটা ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া টেনে বলে–’আছিলাম পরাণ মাঝি, একডাকে মাইনষে চিনতে পারত। কুয়ার মইধ্যে লাইম্যা ঘটি বাটি গলার হার তুলছি, অখনে অ্যাক বুক জলে ডুব দিতেই দম শ্যাষ। বয়স বাড়ছে অখন, শরীলে আর হেই তাকত নাই, প্যাটে ভাত নাই কর্তা।’

মাঝি ধোঁয়া ছাড়ে। আর পুকুরপাড়ে ভেজা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে টুনু বাবার কথা ভাবে। বাবা ফিরে এলে যদি জানতে পারে তবে মা আজ আর বেঁচে থাকবে না। গাটা শিরশির করে তার। বড় দুঃখী মা, টুনু ভাবে মা বড় দুঃখী। লোহার মতো শক্ত হাত বাবার, রোমশ বুক, পেট। খালি গায়ে। যখন উঠোনে কিংবা দাওয়ায় বসে তামাক খায় বাবা, তখন তারা কেউ কাছাকাছি যায় না। মাঝে-মাঝে যখন মাকে মারে বাবা, বিশ্রী গালাগাল দেয়, তখন মা কুঁইকুই করে ইঁদুর ছানার মতো কাঁদতে থাকে। বাবার প্রকাণ্ড দেহের দুটো হাতের ভিতর মাকে তখন ইঁদুরের মতোই ছোট্ট আর অসহায় মনে হয় তার।

পরাণ মাঝি উঠে দাঁড়িয়ে জামাটা গায়ে দেয়। বলে ‘চলি কর্তা–কাইল আইয়া আর একবার দেখুম অনে।’

টুনু চেয়ে থাকে। জামরুল গাছটার তলা দিয়ে বিন্দু-পিসির ঘরের বেড়ার কাছ ঘেঁষে আস্তে আস্তে মাথা নীচু করে পরাণ মাঝি চলে গেল। টুনু ভাবে ঠিক তার রোগা, ছোট্ট মায়ের মতোই। পরাণ মাঝিও যেন দুর্বল। খুব দুর্বল।

.

টুনু জলের দিকে তাকায় এবার। সবুজ জল, ঘন শ্যাওলা। দুপুরের সূর্য অনেকটা হেলেছে। পশ্চিমের দিকে। কিন্তু এখনও দুপুর। গরম লাগছে টুনুর। সে আস্তে আস্তে জলের প্রান্তে এসে দাঁড়ায়।

গায়ের শার্টটা খুলে  ছুঁড়ে ফেলে দিল সে ঘাসের ওপর। একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ল জলে। কচু গাছ হাওয়ায় দুলছে। কেমন বিশ্রী একটা আঁশটে গন্ধ। পানা পুকুরে জলে তার ছায়া পড়ল।

টুনু তার ছায়ার দিকে তাকায়। রোগা লম্বাটে একটা ছেলের ছায়া। ছায়াটা জলের ভিতরে। একটু ডুবুরির মতো জলের মধ্যে থেকে ছায়াটা তাকে দেখছে। মায়ের কথা ভাবল সে, পরাণ মাঝির কথাও। আজ সন্ধেবেলা কিংবা অন্য কোনওদিন যখন বাবা টের পাবে তখন মাকে বাবা মারবে। হয়তো এবার মেরেই ফেলবে। কেন না, দুলটা সোনার আর সোনা বলতে তাদের ঘরে ওইদুলজোড়াই।

নীচু হয়ে জলটা দেখতে লাগল টুনু। ইচ্ছে হল একবার পরাণ মাঝির মতো ডুবুরি হয়ে খুঁজে দেখে দুলটাকে। কিন্তু সে সাঁতার জানে না। সাঁতার জানলে পাথর নুড়ি, শ্যাওলা আর গাছের পচা পাতার মধ্যে গিয়ে সবুজ জলে ডুবুরির মতো সে দুলটাকে একবার খুঁজে দেখত।

একটা পা বাড়িয়ে নিয়ে সিঁড়িতে রাখে সে। ঠান্ডা জলটা সুড়সুড়ি দেয় পায়ে। টুনু আর এক ধাপ নামে। আর-এক দাপ। হাঁটুর ওপর জল এবার। টুনু নীচু হয়।

ঘোলা জলটা এবার পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন সেই ঘন সবুজ রং। জলের নীচে অনেকটা দেখা যাচ্ছে। টুনু চোখটা বড়-বড় করে তাকায়। চোখটা সরিয়ে আনে সিঁড়িগুলোর দিকে। একটা, দুটো, তিনটে সিঁড়ি স্পষ্ট এবং তারপর আরগুলো ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে। সিঁড়িগুলো গুনতে শুরু করে টুনু—তারপর—

চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজের মুখে হাতচাপা দেয় টুনু। স্পষ্ট পরিষ্কার জলের নীচে চতুর্থ সিঁড়িটার ঠিক শেষে বাঁকা আর সুপুরি গাছের দড়ির বাঁধনটার কাছে সোনার দুলটার ছোট হুকটা চিকচিক করছে। কী আশ্চর্য! কেউ দেখতে পায়নি। টুনু মস্ত বড়-বড় চোখে চেয়ে থাকে। বুকটা ঢিপঢিপ করে তার।

টুনু ঝপ করে আর এক ধাপ নামল। কোমরের কাছে জল এবার। প্যান্টটা ভিজে গেল। ঠিক এই ধাপে দাঁড়িয়েই রোজ স্নান করে সে। এর বেশি নামতে সে ভয় পায়। সিঁড়িগুলো উঁচু উঁচু। আর এক ধাপ নামলেই গলা জল।

কিন্তু দুলটা সে নিজেই তুলবে। চারদিকে তাকায় টুনু। কেউ নেই। আরও দু-ধাপ নামলে দুলটা।

টুনু পা বাড়ায়। গলা জল।

টুনু নিশ্বাস টানে। পচা শ্যাওলা আর পানাপুকুর আর মাটির গন্ধ। টুনু পা বাড়ায়।

ঝপ করে পরের সিঁড়িটায় পা রাখতে না রাখতেই টুনু ডুব দেয়।

দুলটা! হাতের কাছেই।

কিন্তু নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে টুনুর।

সে মাথা তোলে।

পায়ের নীচেই সিঁড়িটা। ওপরের ধাপ। গলা জলে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস টানে টুনু। বুক ভরে বাতাস নেয়। দুলটা তাকেই তুলতে হবে। টুনু তাকায়। জলে ঢেউ। জল ছলছল করছে গলার কাছে। সেই ঢেউ আর সবুজ শ্যাওলার ভিতর দিয়ে দুলটা চিকচিক করছে।

টুনু নীচু না হলে হাতে পাবে না।

ডুব দেয় সে। জলের ভিতরে অন্ধকার। জলের ভিতরে সবুজ রঙের অন্ধকার। পায়ের তলা দিয়ে একটা কী–যেন সরাৎ করে সরে গেল। বোধহয় মাছ! চমকে উঠে সে।

হাত বাড়ায় সে। আরও এক ধাপ।

মুখ থেকে বুদবুদ বেরিয়ে গাল ঘেঁষে জলের ওপর উঠে যাচ্ছে।

পরের ধাপে পা দেয় টুনু। নীচু, আরও নীচু হয়।

আর মাত্র এক বিঘত দূরে দুলটা! দম পায় না টুনু। বুকটা ফেটে যেতে চাইছে।

কোমরের নীচের দিকটা হালকা হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। তার মাথাটা নীচে। পরাণ মাঝির মতো হাত দুটো দু-দিকে দোলায় টুনু। খুব তাড়াতাড়ি।

দুলের কাছেই হাতটা এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। শেষবারের মতো দাঁতে দাঁত চাপে টুনু।

দুলটা! কাছেই।

দু-আঙুলে মধ্যে হুক-টা!

একটা হ্যাঁচকা টানের সঙ্গে-সঙ্গে দুলটা তার হাতের মুঠো এসে যায়।

যেন অনেক ভার বুকে। টুনু মুঠোকরা হাতটা বুকের কাছে চেপে ধরে। হাতের আঙুল আর চামড়া কেটে দুলটা যেন তার হাতের মধ্যেই বসে যাবে।

সিঁড়িটায় পায়ের চাপ দিয়ে টুনু সরে যায়। কোনদিকে যে সরছে, তা বুঝবার আগেই চোখে সূর্যের আলো লাগে।

বাতাস। আঃ!

হাঁ করে বুক ভরে নিশ্বাস টানে। হাত-পায়ের সমস্ত গ্রন্থিগুলো শিথিল।

কিন্তু তারপরেই আবার টুনু ডুবতে থাকে। এক পলকের জন্য সে দেখতে পায় হাত দশেক দূরে ঘাট। ঘাটে কেউ নেই। সে অনেকখানি সরে এসেছে। হাতের মুঠোয় দুলটা।

প্রাণপণে হাত আর পা দিয়ে জলে আঘাত করে সে। তারপর ডুবে যেতে থাকে। হাতের মুঠোটা শিথিল হয়ে আসছে।

আবার মাথা তোলে। ঘাট এখন হাত–কয়েকের মধ্যেই। কিন্তু টুনুর মনে হল, পুকুরটা যেন বহুবিস্তৃত সমুদ্রের মতো বড় হয়ে গেছে। যেন কূল–কিনারা কিছু নেই পুকুরটার। থই নেই পায়ের নীচে। হাতের মুঠোয় দুলটাকে প্রাণপণে চেপে রাখবার চেষ্টা করে।

গাঁটে গাঁটে অসংখ্য ফোঁড়ার যন্ত্রণা। সমস্ত শরীরটা শিথিল। হাত-পা নাড়তে পারছে না সে। চোখের সামনে সূর্যের আলোটা নিভে গিয়েই জ্বলে উঠছে। কানে শুধু কলকল ছলছল জলের শব্দ।

না, আর জোর নেই শরীরে। আর কিছু নেই। হাতের পেশিগুলো সঙ্কুচিত হচ্ছে না। মুঠোটা আলগা হয়ে আসছে। প্রাণপণে আঙুলগুলোকে বাঁকিয়ে রাখতে চাইছে সে। পারছে না।

প্রাণপণে চিৎকার করতে গেল টুনু। মুখে জল ঢুকল। টুনু ঢোঁক গেলে।

জল তাকে ঘিরে যেন ঘুরছে। তাকে টেনে নিচ্ছে পাতালের দিকে। কত নীচে যে তলিয়ে যাচ্ছে সে! বেঁকানো আঙুলগুলো জট ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। বুক থেকে সমস্ত নিশ্বাস শুষে নিচ্ছে জল। দম নেওয়ার জন্যে সে হাঁ করে। জল ঢোকে মুখে।

মাথাটা ডুবে যাওয়ার আগে হাত চারেক দূরে ঘাট দেখতে পায় সে। দেখতে পায় একপাঁজা বাসন হাতে বিন্দুপিসি আসছে ঘাটের কাছে।

তারপর জল আর পাতাল। ঝাঁকড়া মাথা বিরাট একটা দৈত্যের মতো কার মুখ যেন জলের ভিতরে।…ঝপ করে একটা শব্দ। একটা চিৎকার।

শেষবারের মতো ক্লান্তি, ঘুম আর অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে যেতে-যেতে সে টের পায়, তার শরীরটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। বুকটা হালকা। আর ডান হাতের তেলোয় তার মুঠোর মধ্যে শিথিল আঙুলের ফাঁক থেকে গড়িয়ে পড়বার আগের মুহূর্তে দুলটাকে সে অনুভব করে। দুলটা আছে! হাতেই!

তারপর একটা ছুড়ে–দেওয়া কালো চাদরের মতো অন্ধকারটা তাকে ঢেকে ফেলল।

.

টুনু চোখ মেলে চায়। অল্প অন্ধকার। ঘরে আলো জ্বলছে। অনেক লোক তাকে ঘিরে, তার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। টুনু বুঝতে পারে না কিছু। মার মুখটা সবচেয়ে কাছে। মা কাঁদছে। আর অন্য সকলের ভিড়ের ভিতরে বাবা দাঁড়িয়ে। বাবার পাশেই বিন্দুপিসি। তাকে দেখছে সবাই। সবাইকে একসঙ্গে দেখে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে তার। তারপর আস্তে-আস্তে মাথার ঝিমুনি ভাবটা কেটে যায়। মনে পড়ে যায় আজ দুপুরবেলায়, ঠিক দুপুরবেলায় জলের অনেক নীচে সে আর সোনার দুলটা একই সঙ্গে ডুবে যাচ্ছিল।

টুনু চোখ বোজে। ক্লান্তি আর ঘুম।

অনেকক্ষণ পরে তাকায় সে। তার পাশে বাবা। আর কেউ নেই।

আবছাভাবে লণ্ঠনের অল্প আলোয় বাবার মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে। মুখটা তার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। অল্প দাড়ি বাবার মুখে। কোমল, শান্ত দুটো চোখ। বাবার রোমশ কঠিন একটা হাত আলতোভাবে তার কাঁধের ওপর, আর একটা হাত তার মাথার চুলের ভিতরে আঙুল বুলিয়ে। দিচ্ছে।

খুব নম্র শান্ত গলায় বাবা বলে–’কেমন আছস রে বাবা?’

–’ভালো–ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দেয় টুনু।

–’বাঘের বাচ্চা’বাবা বলে–’বাঘের বাচ্চা তুই।’

সব কথা বুঝতে পারে না টুনু। তবু চুপ করে থাকে।

রান্নাঘর থেকে মা এ-ঘরে এল।

‘টুনু, টুইন্যারে, তর দুধ আনছি’–এই বলে মা তার শিয়রের কাছে বসে। মা’র চুলগুলো ছাড়া। আবছা আলো-আঁধারেতে মা’র মুখটা দেখতে পায় সে। আর দেখতে পায় মা’র বাঁ-কানের লতিটা আর শূন্য নেই। সেখানে ঝকঝক করে জ্বলছে দুলটা। মা’র মুখটা হাসছে। যেন ভাঙাচোরা হাড়–উঁচু মুখটা বদলে গেছে হঠাৎ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মা’কে। মা’র মুখটা অনেক উঁচুতে। দুল দুটো যেন মুক্তো–যে মুক্তো সমুদ্রের অনেক নীচে থেকে কুড়িয়ে আনে ডুবুরিরা।

টুনু নড়ে।

–’না, তুই উঠিছ না’–বাবা বলে।

মা তার কপালের ওপর ঈষৎ তপ্ত একটা হাত দিয়ে চাপা দিয়ে বলে–’উঠিছ না তুই, আমি তরে ঝিনুক দিয়া খাওয়াইয়া দিতাছি।’

টুনু তাকায়। ওপাশের মাচাইয়ে বুলকি আর পানু ঘুমোচ্ছে।

টুনু হাঁ করল। দুটো ঠোঁটের কোণে ঝিনুকটা আর মার কয়েকটা আঙুল। অল্প গরম দুধটা তার জিভ বেয়ে গলার কাছে নেমে এল। হাসি পেল টুনুর, যেন সে অনেক অনেক ছোট হয়ে গেছে। যেন সে মা’র কোলে, আর মা তাকে ঝিনুক দিয়ে দুধ খাইয়ে দিচ্ছে।

শেষবার তার ঠোঁটের পাশ থেকে ঝিনুকটা সরিয়ে নিয়ে নিতে মা বলে–’এই ঝিনুকটা দিয়া ছোটবেলায় তরে দুধ খাওয়াইতাম। তর কি আর মনে আছে? মা’র গলাটা কাঁপছে অল্প অল্প। মা’র চোখে বোধহয় জল।

–’হ অর কি মনে থাকনের কথা!’ বাবা বলে।

বাবা যেন একটা কাঁচের ওপাশ থেকে কথা বলছে। গলার স্বরটা ক্ষীণ। বাবা যেন দুর্বল, কথা বলতে পারছে না। বাবা কাঁদছে? না, বাবা কাঁদছে না। বাবা কোনওদিকে তাকিয়ে নেই। গায়ের চাদরটা দিয়ে দেহটা ঢাকা। চোখ দুটো বন্ধ। ভেজা-ভেজা। অল্প-অল্প দুলছে বাবা। ছবিতে দেখা যিশুখ্রিস্টের মতো মুখ বাবার।

হঠাৎ টুনুর মনে হল, খুব সুন্দর তার বাবা। খুব সুন্দর। বহু-পরিচিত পুরোনো বাবাকে যেন চিনতে পারছে না সে। এখন এই আধো-অন্ধকার ঘরে শিয়রের কাছে মা, আর পাশে খুব কাছেই বাবা। খুব কাছাকাছি দুজন। মা আর বাবা। দুজনেই তাকে ছুঁয়ে আছে।

খুব ক্ষীণ স্বরে, যেন একটা কাঁচের ওপাশ থেকে বাবা বলে–’মধ্যে-মধ্যে মনে লই যে মরি। অখন মরণ হইলেই ভালো। কিন্তু মাইজ্যা বউ, এত সহজে আমরা মরুম মা। আমরা–’

আর শুনতে পায় না টুনু। ঘুমে জুড়ে আসে চোখ। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, মা বাবা আর পরাণ মাঝি যেন একই রকমে দুঃখী, অসহায় দুর্বল। তারা কেউ নিষ্ঠুর নয়।

তারপর সুখী টুনু, তার দুঃখী মা-বাবার মাঝখানে থেকে তাদের শরীর ওম-এর ভিতরে ডুবুরি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে-দেখতে, আর তার দুঃখী মা-বাবা তার ছোট রোগা নরম শরীরে তাদের নিজেদের দেহের তাপ সঞ্চার করে দিতে দিতে একটা বৃহত্তম কূল–কিনারাহীন অথই অন্ধকারের সমুদ্রের ভিতরে পৃথিবীর আরও লক্ষ-লক্ষ কোটি–কোটি মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে একই দুঃখ বেদনায় জ্বলতে–জ্বলতে খুব ছোট্ট সোনার টুকরোর মতো সুখস্বপ্নের দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে ডুবে যেতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *