ডুডুও খাব টামাকও খাব
সেদিন এক সাধুমুখে শুনেছিলাম : “প্রত্যাশা রেখ না। তুমি যাদের জন্যে যা করছ, দুহাতে করে যাও। কোন প্রতিদানের আশা না রাখাই ভাল। তাতে অনেক শান্তি পাবে। কারুর কাছে কিছু আশা করো না। শুধু নিজের ওপর আস্থা রাখ।”
প্রত্যাশা থেকেই হতাশা। মনে মনে অনেকের কাছেই আমাদের অনেক পাওনা। এক চুল এদিক ওদিক হলেই জগৎ বিষণ্ণ। আমরা সকলেই অদ্ভুত এক দেনাপাওনার জগতে বিচরণ করছি। প্রতি মুহূর্তে জগৎকে নিজের মনের মতো করে সাজাচ্ছি। পরমুহূর্তেই বাস্তব এসে সে চেহারা গুঁড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বারে বারে মোহ ভঙ্গ হলেও মোহগ্রস্ত মানুষের চেতনা হয় না।
মানুষ বিচক্ষণ প্রাণী। যুক্তিতর্কে পারঙ্গম। বিচার-বুদ্ধি আছে। তবু পৃথিবী যা নয় তাই ভেবে অকারণে কষ্ট পায়। যা অনিত্য তাকে আঁকড়ে ধরে দীর্ঘ স্বপ্ন দেখার ব্যর্থ চেষ্টায় একদিন ঘুম ভেঙে যায়, তখন আর নামরূপ থাকে না। বর্তমানের পরিচয় বুঝে যায়। আবার নতুন শরীর, নতুন পরিচয়, নতুন পরিবেশ। জীবন্মুক্তি, সে অতি দূরের কথা।
আমার দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, নাক, কান, খাড়া হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি, কিছু গ্রহণের পথ, কিছু বর্জনের পথ, ভাষা, সংলগ্ন চিন্তা, এই দেখিয়েই মানুষের ছাড়পত্র পেয়ে গেছি। প্রকৃত মানুষ কজন? ঠাকুর বলতেন, ‘মানুষ’ শব্দের অর্থ মান হুঁশ। হুঁশ মান তবেই না তুমি মানব। জন্মেই আমরা বেহুঁশ। চারপাশে থরে থরে মায়ার আয়োজন। বর্ণ-বিপুল প্রকৃতি। ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তিহীন চাহিদা। ষড় রিপুর অবিরত টঙ্কার। কে আমি? কোথায় আমি? চলেছি কোথায়? কিছুই জানি না। আমার একটা নাম আছে। একটা পদবী ঝুলছে নামের পিছনে। পিতা, মাতার পরিচয় জানি। বাকিটা বংশগতির ধারায় ভেসে চলা।
ঠাকুর বলতেন : “অন্নগত প্ৰাণ। মৃত্তিকার আকর্ষণে, সংসার বলয়ে বল্গাহারা জীবন ঘুরছে, চোখ বাঁধা কলুর বলদের মতো।” উটের আহার কণ্টকাকীর্ণ পাতা। জিভ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত তবু সেই আহারেও কী আনন্দ! এত দুঃখের, এত হতাশার পৃথিবী তবু ছেড়ে যাবার সময় সে কী আকুলতা! আরেকটু, আরেকটু যদি প্রশ্ন করা হয়, সবই তো হলো, মামলা, মকদ্দমা, পরের উপকার, অপকার, জীর্ণ দেহ, চোখে চালসে, হার্টের কিছু নেই, সংসারে তেমন খাতির নেই, কেউ মানেও না, তবু কী আকর্ষণ! যেতে চাই না, সমন এসে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে।
মানুষ কিছু প্রারব্ধ নিয়ে আসে। কেউ জন্মায় মুখে সোনার চামচ নিয়ে। কেউ এসে হাজির হয় ফুটপাতে উলঙ্গ রাজা হয়ে। কেউ চর্মকারের সন্তান, কেউ কর্মকারের। কেউ জাদুকর, কেউ বাজিকর। বিজ্ঞান প্রারব্ধ-ট্রারব্ধ মানে না। বিজ্ঞান অনেক রহস্যের সমাধান করেছে। করতে পারেনি জন্ম-মৃত্যুর রহস্য। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে এই যে জীবন উপত্যকা, এ স্বপ্ন না বাস্তব, এ-প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। বিজ্ঞানের অহঙ্কার মনে করে, আমরা আপনাকে জেনেছি, প্রাকৃতিক শক্তিকে বশে এনেছি। জীবনদায়িনী ওষুধ আবিষ্কার করেছি। মহাজাগতিক রহস্য হাতের মুঠোয়। সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের অহঙ্কারে থ মেরে যায়। ভাবে মানুষই সব। ঈশ্বর আবার কে? সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ আছেন নাকি? সাধারণ মানুষ এমন ভাবলেও বিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝেই ভাবেন, সত্যিই কি আমরা কিছু করেছি! না, আমরা কারক হয়েছি! আমরা কর্তা না করণ। আমি করেছি, না আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে! অধিকাংশ আবিষ্কারই তো আকস্মিকতায় ভরা। কি করতে কি হয়ে গেছে! ইংরেজীতে বললে ভাবপ্রকাশের সুবিধে হবে, Stumbling on truth। সত্যের ওপর হোঁচট খেয়ে পড়া।
বিজ্ঞান মানেই যে শুধু কলকারখানা, শিল্পজাত সস্তা সামগ্রী, কম শ্রম, একধরনের বিলাসিতা, আত্মবিস্মৃতি, আস্তিকতা থেকে নাস্তিকতা, তা কিন্তু নয়। বিজ্ঞান যে বিশেষ জ্ঞান সেই সত্যটিই আমরা ভুলে বসে আছি। আধুনিক বিজ্ঞান ঈশ্বর না মানলেও জগৎ সৃষ্টির পিছনে বিশাল এক শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস ঊর্ধ্ব একটি স্তরে জমে আছে। নিচের দিকে সাধারণ মানুষের স্তরে নামেনি। সাধারণ মানুষের ধারণা বিজ্ঞান হলো ঈশ্বরহীন এক অস্তিত্ব। শুধু ম্যাটার, সোল বলে কিছু নেই। দেহ একটা হাড়-মাংসের খাঁচা। ধমনী, রক্তপ্রবাহ, হৃদয়, ফুসফুস, যকৃৎ, প্লীহা, মস্তিষ্ক। প্রাণ বস্তুটি আসলে যে কি, মনই বা কাকে বলে, তার গঠন কেমন আজও জানা গেল না। কিন্তু ডেকার্ট যখন বললেন—Cogitoergo sum অর্থাৎ I think, therefore I exist, আমি ভাবি আছি, তাই আমি আছি, তখনই পশ্চিমের মানুষ চেতনায় তার অস্তিত্ব খুঁজে পেল, দেহে নয়। ‘আমার চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ।’ যান্ত্রিক পশ্চিমী চিন্তায় প্রাচ্যের একোহমের ছায়া পড়ল। সেই বিশাল, বিপুল, নিস্তরঙ্গ হলো বিশ্ব বৈচিত্র্য। এক ছাড়া আর যে কিছু নেই। বৌদ্ধ-দর্শন বললেন, মন যখন চঞ্চল, তখন সেই মনে বহুর অস্তিত্ব, মন যখন স্থির তখন একের স্থির প্রতিবিম্ব। [অশ্বঘোষ] বৃহদারণ্যক বললেন, তিনি যিনি বহুর মধ্যে থেকেও অনন্য, স্বতন্ত্র, যাঁকে সবাই জানেন না, অথচ যিনি সকলের শরীর, যিনি সকলের ভিতর থেকে সকলকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনিই তোমার আত্মা, তোমার আভ্যন্তরীণ নিয়ন্তা, অজর, অমর। আধুনিক মানুষকে সব শেখানো হয়। শেখানো হয় না একটি জিনিস—কি করে শান্তি পাওয়া যায়। কি কৌশলে সচ্চিদানন্দ হওয়া যায়! আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী দুঃখ করে বললেন : “How strange is the lot of us mortals! Each of us is here for a brief sojourn; for what purpose he knows not, though he sometimes thinks he feels it.” নশ্বর মানব! হায় কী অদ্ভুত তোমার ভাগ্য! এই ক্ষণপ্রবাসে আমরা কেউই জানলাম না কি করতে এসেছি! কখনো হয়তো মনে হয় জেনে ফেলেছি, নিমেষে সে জানা হারিয়ে যায়। আমাদের সব শিক্ষাই হলো নিজেকে হারাবার শিক্ষা। নিজেকে ভাঙাও, ভাঙিয়ে বিত্তবান হও। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে ভোগ কর। একদিন নিঃশেষ হয়ে মুছে যাও। পড়ে থাক তোমার বংশগতি। কে বলেছে তোমাকে অত শত ভাবতে! শান্তি সে তো সোনার হরিণ। জগতের নেশায় বুঁদ হয়ে থাক। তুমি একটা হিউম্যান মেশিন। যা ধ্যানগ্রাহ্য তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবে কি করে। মন এমনিই কুরঙ্গের মতো চঞ্চল, বাসনার শেষ নেই, সেই মন আধুনিক শিক্ষায় আরো ক্ষিপ্ত। লাও-ৎসি বড় সুন্দর বলেছেন : “ He who pursues learning will increase everyday; he pursues Tao will decrease everyday.” আধুনিক শিক্ষায় অহং বাড়াতে বাড়াতে ইউনাইটেড নেশনস বিল্ডিং-এর মতো সুবৃহৎ হবে, বিশ্ব-শান্তি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হবে না। ক্ষুদ্র হবার বিজ্ঞান ধরা আছে তাও নির্দিষ্ট পথে। চুয়াংসু বললেন : “The still mind of the sage is a mirror of heaven and earth—the glass of all things.”
কোথায় গেল আমাদের সেই প্রাচীন তপোবনের শিক্ষা! ব্রহ্মবিদ্যার পীঠস্থান! ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি আরেকটু গভীরে যাবার ব্যবস্থা। ঋষিকুমার, রাজকুমারের গুরুগৃহে পাশাপাশি অবস্থান। ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের একই যাত্রা। একজন গিয়ে বসবে সিংহাসনে, তলোয়ার হাতে, আরেক জন কলম হাতে চতুষ্পাঠিতে। যে শাস্ত্রকে আজও ফেলা গেল না, সেই হিন্দু ধর্মশাস্ত্ৰ মানব-বিজ্ঞানের শেষ কথা এইভাবে বলেছেন—জীবের চরম লক্ষ্য হলো মোক্ষ। তিনটি তার পথ–কর্ম, জ্ঞান আর ভক্তি। বীরের মার্গ কর্ম, ঋষির মার্গ জ্ঞান, আর সন্ন্যাসীর মার্গ ভক্তি। সকলকেই পেরিয়ে যেতে হবে চতুরাশ্রম। এই চতুরাশ্রম কি কি?
“ব্রহ্মচর্যং সমাপ্য গৃহী ভবেৎ।
গৃহী ভূত্বা বনী ভবেৎ।
বনী ভূত্বা প্ৰব্ৰজেৎ।”
(জাবাল উপনিষদ্)
ব্রহ্মচারী মানে ছাত্র, ছাত্র থেকে গৃহী। গৃহীর পর বনী বা আরণ্যক (anchorite)। শেষ হলো প্রব্রজ্যা। সাতধাম ঘুরে সন্ন্যাসী। এক এক ধরনের জীবের এক এক ভাব। ‘ত্রিবিধ জীব—কেহ বীর, কেহ ধীর, কেহ পীর।’ বীরের জন্য কর্মযোগ, ধীরের জন্যে জ্ঞানযোগ আর পীরের জন্যে ভক্তিযোগ। এর চেয়ে বড় বিজ্ঞান আর কি আছে! এখন আমরা aptitude test, psychological test, IQ, নানা কথা বলি, বলে ভড়কানো মানুষকে আরো ভড়কে দিই। তুমি অমৃতের পুত্র একথা একবারও বলি না। বলি তুমি Thinking animal. Eat, drink and be merry. প্রথমে মানুষের দাস হও, তারপর ইন্দ্রিয়ের দাস। কে তোমার ঈশ্বর? কি তোমার মোক্ষ? পূর্বজন্মও নেই। একদিন মরে যাবে, দেহ তোমার মিশে যাবে পঞ্চভূতে, চুকে যাবে ল্যাঠা।
বর্তমানকালের ইতরজনের বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীর বিজ্ঞানে ধারণাগত বিশাল এক ফারাক দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, quantum theory and relativity theory-both force us to see the world very much in the way a Hindu, Buddhist or Taoist sees it. কোয়ান্টাম থিওরি ও আপেক্ষিক তত্ত্ববিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আবার আড়াই হাজার বছর পিছন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান যে-সত্য আবিষ্কার করে স্তম্ভিত, সে-সত্য বহুকাল আগেই ধরা পড়েছে হিন্দুর বেদে, চীনের আই চিঙ্গ-এ, বৌদ্ধসূত্রে। তাঁরা বলছেন, If physics leads us today to a world view which is essentially mystical, it returns in a way to its beginning 2500 years ago.
সাধুর প্রত্যাশা শূন্যতার কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল। আধুনিক মানুষের জীবন প্রত্যাশার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। ঠাকুর গান গাইতেন : “যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।” “ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন।” আমরা রূপসাগরে না ডুবে গেছি। আমাদের প্রথম প্রত্যাশা পরিবারের কাছে, তারপর সমাজ, দেশ, বিশ্ব। আমাদের প্রত্যাশা শিক্ষার কাছে, রাজনীতির কাছে, প্রাকৃতিক শক্তির কাছে, রোজ যেন রোদ ঝলমলে দিন পাই, মলয় বাতাস পাই। শিক্ষা আর জীবনচর্যা যদি মানুষের ভিতরটাকে বাইরে এনে ফেলে, তারপর যদি মিছরির মতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিয়ে আর সেই টুকরো সমূহে যদি ঝাঁক ঝাঁক লাল পিঁপড়ে ছেঁকে ধরে তাহলে জীবনানন্দ আর থাকে কি করে! কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান কি কোনকালে আমাদের বলবে-
“তদ্দিনং দুর্দিনং মন্যে মেঘাচ্ছন্ন ন দুর্দিনম্।
যদ্দিনং হরিসংলাপকথাপীযুষ-বর্জিতম্।।”
— মেঘাচ্ছন্ন দিন দুর্দিন নয়। সেইদিনই দুর্দিন যেদিন হরিনাম করতে পারছি না। স্বামী বিরজানন্দজীর একটি উপদেশবাণীতে সেই ধ্বনি, “যে আপনি আপনার মিত্র, সে সংসারেরও মিত্র ও সমুদয় সংসারও তার মিত্র।” শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলছেন : “আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।”—শুদ্ধ মনই মানুষের প্রকৃত হিতকারী (মুক্তির কারণ) এবং বিষয়াসক্ত মনই মানুষের পরম শত্রু (বন্ধনের কারণ)।’ মুক্তির শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই—আছে যেখানে, সেখানে যেতে বড় দ্বিধা, কারণ আইডেনটিটি লুপ্ত হবার সম্ভাবনা। আমরা চাই, দুধও খাব, তামাকও খাব।