ডিলেমা
বিপিন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না!
অথচ অফার লেটারটা হাতে পেয়ে কিন্তু বিপিন ভারি খুশিই হয়েছিল। সে কথা বিপিনের স্পষ্ট মনে আছে।
নাহ, গল্পটা প্রথম থেকেই খুলে বলি।
বিপিন, বিপিনচন্দ্র শাসমল আমাদের কলেজে পড়তো। ছেলে হিসেবে চমৎকার, দিলদার বন্ধুঅন্তপ্রাণ। শুধু মা সরস্বতীর সঙ্গে পার্মানেন্ট ফৌজদারি মামলা এই আর কি! তা মা শেষতক সামান্য আড়চোখে কৃপাদৃষ্টিপাত করাতে ছোকরা পাশটাশ করে ভারি খুশি হয়ে আমাদের একদিন খাইয়ে দিল। উঃ, সে কথা মনে পড়লে এখনো জলে জিভ আর কৃতজ্ঞতায় হৃদয় আর্দ হয়ে ওঠে!
যাগগে। বিপিন কলেজ পাশ করে ঢুকলো সেলসের চাকরিতে। তারপর যা হয়, একদিন বিয়েও করে ফেলল বাড়ির কথামত।
টুকটাক করে মন্দ কাটছিল না। শুধু তখনো ছেলেপিলে না হওয়াতে একটু মরমে মরে থাকতো এই আর কি। আমরা বন্ধুরা অবিশ্যি উৎসাহ দিতাম, ‘ এমনি এমনি কি এসব হয় রে পাগলা, এর জন্যে কঠোর পরিশ্রম লাগে, দিনরাত মেহনত করতে হয়’। মুশকিল এই যে আমাদের কথামত দিনরাত মেহনত করতে গেলে বিপিনকে খাবারদাবার ছেড়ে শুধু ইয়াকুতি হালুয়ার ওপরেই থাকতে হয়, খুব স্বাভাবিক কারণেই সেটা শোভনও না সম্ভবও না।
যাই হোক, এদিকওদিক টুকটাক ইন্টার্ভিউ দিতে দিতে একদিন বিপিন দেখলো, ইয়া আল্লা, মার দিয়া কেল্লা!! খোদ হিন্দুস্থান লিভারে চাকরির অফার! ভালো মাইনে, প্রচুর পার্কস ইত্যাদি ইত্যাদি। নাচতে নাচতে বিপিন পুরোন কম্পানিতে রেজিগনেশন দিয়ে অ্যাক্সেপ্টেন্স লেটার পাঠিয়ে আমাদের অলিপাবে বেধড়ক মাল খাওয়ালো। আমরাও যাবতীয় ঈর্ষা বুকে চেপে ‘হেঁ হেঁ, ইউনিলিভার খুউপ ভালো কম্পানি। তেরা তো লাইফ বন গ্যায়া ইয়ার’ ইত্যাদি বলে চোখ, এমন কি কপাল অবধি মাল খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরলুম।
সব গল্প প্রায় শেষ, শুধু মেডিকেল টেস্টটাই বাকি, এমন সময়ে বিপনে পুরো ঘেঁটে গেলো!
মেডিকেল টেস্টের জন্যে অ্যাপোলো থেকে বাড়ি এসে ব্লাড, ইউরিন সব নিয়ে গেছিল। তার পরদিন বাকি টেস্টগুলোর জন্যে হাসপাতালে গেছে, ডাক্তারবাবু নাম শুনেই বিপিনকে বগলদাবা করে সোওওজা নিজের কেবিনে!
‘ক্কি ব্যাপার স্যার?’, বিপিন ভারি আকুল হয়ে শুধোলে।
ডাক্তারবাবু টেস্টের রিপোর্ট পড়তে পড়তে আধখানা রিডিং গ্লাসের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন ‘দিনে কত পেগ হয়?’।
বিপিন ‘ন্না ন্না স্যার, হরলিক্স আর চন্নামেত্ত ছাড়া আর কিচ্চু খাইনা, মাইরি বলছি’ বলতে যাচ্ছিল, শেষে ডাক্তারবাবু খুনে দৃষ্টিতে তাকাতে মিউমিউ করে বলল, ‘ওই আ-আড়াই থেকে তিন পেগ স্যার’।
ডাক্তারবাবু হিমশীতল গলায় বললেন ‘ক্রিয়েটিনিন, ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল তিনটেই মাথা উঁচু করে দেখতে হচ্ছে যে মশাই, টঙে চড়ে বসে আছে যে। কিন্তু যেটা ভয়ের কথা, সেটা হচ্ছে যে ইউরিনে প্রোটিন পাওয়া গেছে’।
খুব খুশি হল বিপিন, ‘সে তো খুউউপ ভালো কথা স্যার, মানে আমার শরীরে হেবি প্রোটিন আচে, নয়?’
ডাক্তারবাবু পেপারওয়েটটা তুলে নিয়েছিলেন খুব সম্ভবত ছুঁড়ে মারবেন বলে। কি মনে হতে সেটা রেখে বললেন, ‘না, নয়। এর মানে আপনার কিডনি ঠিকঠাক কাজ করছে না। এমত অবস্থায় ট্রিটমেন্ট না করিয়ে তো আমি আপনাকে ফিট সার্টিফিকেট দিতে পারছি না মশাই’!!
বিপিন খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে হাঁউমাউ জুড়ে দিল। অলরেডি আগের কম্পানিতে রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছে। এখন এই তুচ্ছ কারণে যদি এইটা হাতছাড়া হয়,ফ্যামিলি নিয়ে পথে বসা ছাড়া বিপিনের আর কি উপায় আছে,সেটা ক্ষমাঘেন্না করে ডাক্তারবাবুই বলে দিন না হয়!
যা হোক, ডাক্তারবাবু বললেন যে সক্কাল সক্কাল ইউরিন নেওয়া হয়েছিল বলে হয়তো একটুখানি প্রোটিন ঘুমচোখে পথ ভুলে ধাঁ করে এসে পড়েছিল। উনি আরেকবার সুযোগ দেবেন। কাল সকালে আরেকবার ইউরিন স্যাম্পল নিতে লোক যাবে। বিপিন যেন খুব করে জলটল খেয়ে ঘুমোতে যায়, ইত্যাদি নানা সদুপদেশ দিয়ে রেহাই দিলেন।
তা সেদিন বিকেলে ঘটনাচক্রে একটু অলিপাবে গেছি গলা ভেজাতে, গিয়ে দেখি সে মক্কেল তুম্বোপানা মুখ করে এক কোণে বসে আছে। গিয়ে পিঠ চাপড়ে বল্লুম ‘কি বে, হাঁড়িপানা মুখ করে বসে আছিস যে বড়? বউ বকেছে?’ বলতেই সে ছোকরা ভেউভেউ করে উঠলো। সে কি কেলেঙ্কারি! কি বলে কিছুই বোঝা যায় না। শেষে জলটল খাইয়ে একটু ঠান্ডা করাতে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল।
আমি অবাক হয়ে বল্লুম, ‘এ আর এমন কি ব্যাপার? কাল সকালে ইউরিন নিতে এলে বউয়েরটা দিয়ে দিস। ওরা তো আর দেখতে যাচ্ছে না টয়লেটে কে যাচ্ছে!’
ছোকরা পাক্কা আড়াই মিনিট হাঁ করে চেয়ে রইলো। তারপর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চুমুটুমু খেয়ে একাকার কান্ড! আমার বিলটাও জোরজার করে ওইই দিল, আমি আর না করতে পারলুম না!
যাই হোক। পরামর্শ মেনে সমস্ত কাজকম্ম সুসম্পন্ন করে, পরের দিন হাসিমুখে বিপিন গেছে অ্যাপোলোতে, রিপোর্ট নিয়ে নতুন অফিসে সাবমিট করেই শ্বশুরবাড়ি যাবে এই প্ল্যান, ডাক্তারবাবু ওকে দেখেই ফের বগলদাবা করে কেবিনে।
‘ইয়ে আবার কি হল স্যার? সব কিচু ঠিকঠাক আচে তো এইবার?’
রিপোর্ট পড়তে পড়তে রিডিং গ্লাসের ওপর দিয়ে ফের তাকালেন ডাক্তারবাবু, বললেন ‘বাকি সব তো ঠিকই আছে, তবে কি না…..’
একটু ভীত স্বরে বিপিন বলল ‘ইয়ে, তবে কি ডাক্তারবাবু?’
‘আপনি কি জানতেন যে আপনি প্রেগন্যান্ট?’
হাসবে না কাঁদবে,বিপিন সত্যিই বুঝে উঠতে পারলো না!