ডিপ ফ্রিজ

ডিপ ফ্রিজ

আমার বড়মামার বডি ডিপ ফ্রিজে রাখা আছে। আমি বাইরের টানা সিঁড়িতে ফুঁ দিয়ে বসেছি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মামিমার দিকের একজন আত্মীয় মামিমাকে শুনিয়ে বলল ‘আকাশ বাতাস এখন কাঁদছে।’ আমাদের আত্মীয়স্বজনরা সব ভিতরে। ওখানে চেয়ার-টেয়ার রাখা আছে। আমিও বরং ভিতরে যাই, বৃষ্টি লাগছে। হারু এলে সামনে চলে যাব। হারু কি আমাকে জড়িয়ে ধরবে? জড়িয়ে ধরলে আমি ওর গায়ের সাহেবি পারফিউমের গন্ধ পাব। ও কি কাঁদবে? সাহেব কি কাঁদে? হারু যদি কান্নাকাটি করে, আমি বলব, কাঁদিস না হারু…। সবার বাবা কি চিরদিন থাকে? দেখ না, আমার বাবাও তো নেই। যদি চোখের জল মোছাতে হয়? এমা, আমার রুমালটা বোধ হয় নোংরা।

হারুর মেম বউ আর বাচ্চা দুটোও আসছে। আমার ছেলেটাকেও নিয়ে এসেছি। আজ, ওর ইস্কুল কামাই হল। ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, ক্লাস নাইন। পুলিশ-সার্জেন্টের সঙ্গে সেদিন ইংরিজিতে দারুণ ঝগড়া করেছে।

এয়ারপোর্টে ফোন করেছিলাম, দেড়ঘণ্টা লেট। এয়ারপোর্টে আমারই যাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে নিয়ে,ভল্টুর ভাই, আর অর্চনার হ্যাসবান্ড গ্যাঁড়া চলে গেল। অর্চনা বলল, তুই থাক দাদা, এদিকে তোকে দরকার হতে পারে। খিদে পেয়েছে। কচুরি প্যাঁদাব? হাতের ইশারায় ছেলেকে কাছে ডাকি। ওরও তাই ইচ্ছে। কিন্তু ইন দি মিন টাইম যদি ও এসে যায়? বরং পাশের দোকান থেকে বিস্কুট কিনে আনি। ছেলেকে একবার জিজ্ঞাসা করি, কী রে, আমেরিকা যাবি নাকি? ছেলে বলে, হোয়াইন্নট?

বিস্কুট আনতে গিয়ে দেখি মেইন গেটে ভল্টু আর ভল্টুর বউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। সব বুঝি। ওদের গাড়ি এলে প্রথমে দরজা খুলে দেবে। আমি নিজেকে নাদান শো করে বলি, কী গো, তোমরা ভিজছ কেন? ভল্টুর বউ বলল, যা গরম পড়েছিল ক’দিন, ঘামাচি মরবে। ভল্টু বলল, এবারে তো চলে আসা উচিত..।

এই ‘পিস হাভেন’টা আমিই ফিট করি। কেউ জানতই না এরকম ডেড বডি রাখার ফ্রিজও আছে। ভল্টুরা তো তাল-তাল বরফ এনে তার মধ্যে শুইয়ে রেখেছিল, মামিমাকে ওখান থেকে সরানোই যাচ্ছিল না, ঠান্ডা লেগে কাশি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এদিকে হারুর সঙ্গে কনট্যাক্টও করা যাচ্ছিল না, ফোন বেজে যাচ্ছিল, উইক এন্ডে বাইরে ছিল বোধ হয়। বডি খারাপ হতে শুরু করেছিল। ম্যাকসিমাম আর একটা দিন রাখা যেত, তখনই এই ডিপ ফ্রিজটার খবর পাই। আমিই ফিট করি এটা।

ডিপ ফ্রিজ ডিপ ফ্রিজ করছি কেন? অন্য কিছু নাম নিশ্চয়ই আছে, জানি না। বেশ বিরাট আলমারির মতন, প্রতিটি আলমারিতে পাঁচটা করে ড্রয়ার আছে, ড্রয়ারের ভিতরের শীতল শূন্যতায় নীল হয়ে থাকা শুয়ে থাকা বডি। বডি রাখতে হেভি চার্জ। ওই জন্য সানসা পার্টিরাই এখানে আসে। আমরা এসবের খোঁজখবর রাখতে যাব কেন? নেহাত একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার খোঁজটা দিয়েছিল। ওর ট্যাক্সিতে বরফ আনছিলাম। ও জিজ্ঞাসা করেছিল কেন এত বরফ। বলেছিলাম, ডেড বডি…। ও বলেছিল, লাশ রাখনেকে লিয়ে বহুত আচ্ছা বন্দোবস্ত হায়…। ওর কাছ থেকেই খোঁজটা পেয়েছিলাম। আমিই তখন উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থাটা করি।

ওদিকে, দু’দিন পরে হারুর সঙ্গে যখন যোগাযোগ করা গেল, ভল্টুই ফোনটা করেছিল, বলল, এধারের ব্যবস্থা করেছি আমরা, তোর জন্য রেখে দিচ্ছি বডি, তুই এসেই মুখে আগুন দিবি, আমরা খুব ভাল জায়গাতেই বডিটা রেখে দিয়েছি।

‘আমরা’, তাই না? আমড়াগাছি হচ্ছে। আমিই সব ব্যবস্থা করলাম। এখানকার ম্যানেজার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ওর সঙ্গে ইংলিশে কথা বললাম। মামিমাকে রাজি করালাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে শুধু এলাকাটার খোঁজ পেয়েছিলাম, ঠিকানা নয়। কম ঘুরেছি? কম পেট্রোল পুড়েছে আমার গাড়ির? ভগবানের আশীর্বাদে আমাকে ক’লিটার পেট্রোলের জন্য চিন্তা করতে হয় না আর। আমার গাড়িটাই তো এয়ারপোর্ট গেছে ওদের আনতে।

বাইরে মাটাডর রেডি। ফুলও আনা হয়েছে। হারু এলেই বডি বার করব, সিধে বার্নিংঘাট। মামার নাকি ইচ্ছে ছিল রতনবাবুর ঘাট। ওই এলাকাতেই কাটিয়েছেন বহুদিন। তবে হারু যদি নিমতলা নিতে চায়, তাই হবে।

হারুর কি এখন এসব নিমতলা-কেওড়াতলা মনে আছে? পঁচিশ বছর হল দেশ ছেড়েছে। আমি যখন বি কম-এ ধ্যাড়াচ্ছি, ও তখন আমেরিকা চলে গেল স্কলারশিপ নিয়ে। হারুটা যাকে বলে গোবরে পদ্মফুল। আমাদের গুষ্টিতে লেখাপড়ার চল নেই তেমন। আমার দাদামশাই, মানে মামার বাবা ডায়মন্ডহারবার লাইনের গোচারণে থাকতেন শুনেছি। ওখানে কিছু একটা কেলো করে বরানগরের দিকে এসে আস্তানা করেছিলেন। মামাবাড়ির জ্ঞাতিগুষ্টিরা সব গোচারণেই রয়ে গেছে। বরানগরের জেলেপাড়ায় তখনও কয়েকঘর জেলে থাকত। যেমন আমরা। আমার ঠাকুরদাদা নাকি ইলিশ ধরতেন। নিজের নৌকো ছিল। আমার বাবারও খেপলা জাল ছিল। গঙ্গায় জাল মেরে মাঝে মাঝে তপশে-বেলে-চ্যাং-চিংড়ি ধরে আনতেন, তবে সেটা শখে। আমার বাবার ছিল বরানগরে মাছের দোকান। ভোর ভোর বেরিয়ে যেতেন। ফিরতে ফিরতে বেলা একটা। আমার বাবা চুলে মাখতেন জবাকুসুম তেল। বিকেলে মাঝে মাঝেই পাজামা আর গিলে করা পাঞ্জাবি পরে রোয়াকে বসতেন, তাস খেলতেন, জর্দাপান খেতেন, আর গাইতেন সায়গল-রবীন মজুমদারের গান। কে বলবে মাছের কারবার?

একবার কলকাতায় নাকি খুব পাউরুটির ক্রাইসিস। ময়দা ব্ল্যাক হচ্ছে। আমার মামা নাকি ময়দা ব্ল্যাক করতেন। মামার কোন বন্ধু নাকি চুগলি করে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। আমার বাবার তখন মাছের দোকান। থানার ও সি বাবার থেকেই মাছ নেয়। বাবা মাঝে-মধ্যেই ও সি-র ব্যাগে গলদাটা পারশেটা ঢুকিয়ে দিত। ও সি বলত, কী হচ্ছে মদন, এখন তো টাকাপয়সা নেই। বাবা বলত, তাতে কী হয়েছে, পরে দেবেনখনে। ও সি পেমেন্ট দিতে ভুলে যেত, বাবাও চাইতে ভুলে যেত। ফলে বাবার সঙ্গে ও সির একটা ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বাবাই মামাকে ছাড়িয়ে আনে। উনি তখনও আমার মামা হননি। মামা হবার আগে উনি পিসেমশাই হয়েছিলেন। ব্যাপারটা হল বাবা যখন থানা থেকে ছাড়িয়ে আনে ওই মামা আমার বাবার কাছে একেবারে বিলবাট্টা হয়ে যায়। আমার বাবার বড়বোন, মানে আমার বড়পিসিমার ছিল বাঁ পায়ের তিনটে আঙুল জোড়া। তখন মেয়ে দেখতে গেলে প্রথমেই পা দেখার রেওয়াজ ছিল। ফলে বিয়ে হচ্ছিল না। বাবা এই মামাকেই মুরগি করলেন। মানে বাবার ওই বোনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। উনি পিসেমশাই হলেন। কিন্তু বাচ্চা হতে গিয়ে ওই পিসিমা মারা যান। বাচ্চাও। এগুলো সবই শোনা কথা। তবে আমি কখনও পিসেমশাই অবস্থায় দেখিনি। মামাই দেখেছি। গিলে পাঞ্জাবি পরা রবীন মজুমদার সায়গল গুনগুনানো আতরমাখা বাবাকে আমার মা নিজেই পছন্দ করেছিল। কালীঘাটে মালাবদল হয়েছিল। পুরনো পিসেমশাই মামা হয়ে গেল। মামা এর পর বিয়ে করেছিলেন ফের। আলমবাজারের মেয়ে, মামিমা। হারুর মা। মনে আছে মামাবাড়ির কলতলার লাইনে আমার মা কিংবা জবার মা ডাকছে, ওলো-ও হারুর মা তোর বালতি ভরতি হয়ে গেল… হারুর মা এখন ভিতরের সোফায় বসে আছে, ওঁর মাথায় যে বিলি কেটে দিচ্ছে, সেই মেয়েটাকে আমি চিনি না। এই মামারবাড়ি আমার জীবনে অনেকটাই। জেলেপাড়া বস্তির পিছনের দিকে লাইনে একটা মাত্র ঘরে বড়মামারা থাকতেন। মামার ঘরেই আমি জীবনে প্রথম দেখেছিলাম চুম্বক। সড়াত করে টেনে নিচ্ছে আধুলি, টেনে নিচ্ছে সিকি। দেখেছিলাম স্পঞ্জ। টিপে দিলাম আর অমনি ফুলে গেল। আমার মামার এইসব দরকার হত। ময়দা ব্ল্যাকের কেস থেকে ছাড়া পাবার পর আমার মামা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে একটা দোকান করে। কালী মায়ের ছবি, শাঁখা-সিঁদুর-লোহা এসব থাকত। আর স্পঞ্জের কুশনে বসতেন। কুশন ছিড়ে গেলে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আমাকে একটা স্পঞ্জের টুকরো দিয়েছিলেন মামিমা। কতদিন শ্লেট মুছেছি ওটা দিয়ে…। আর চুম্বকটা দরকার হত দোকানদারিতে। তখন খুব নকল সিকি আধুলি বেরোত বাজারে। ওগুলো চুম্বকে টানত না। আজকাল আর নকল সিকি আধুলি দেখা যায় না তেমন। পড়তায় পোষায় না। বাল্যকালের আশ্চর্য হবার স্মৃতিতে বারবার সেই চুম্বক এসে যায়। আজ যখন এখানে আসি, সকালবেলা, আমার বাড়ির অ্যান্টেনার ছাতে দেখেছিলাম, আটকে আছে একটা পেটকাট্টি ঘুড়ি। লালের মধ্যে সাদা। আমার তখন চুম্বক মনে পড়েছিল, সেই জেলেপাড়ার বস্তি, কলতলার শ্যাওলা, জবার মা আমার মায়ের হাঁক, টিনের সিনেমা। আবার পরবর্তী কালে মামার বাড়িতেই জীবনে প্রথম দেখেছি, কমপ্যাক্ট ডিস্ক, হারু পাঠিয়েছিল, পকেট টেলিভিশন দেখলাম মামাবাড়িতেই জীবনে প্রথম। খোসাসমেত পেস্তা-বাদাম মামাবাড়িতেই, টোবাস্কো সস্‌, রোল করা দারুচিনি…।

হারুর কী রকম জ্ঞাতি ভাই, পাজামা আর চকচকে একটা প্রিন্টেড শার্ট পরা, আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা দাদা, মড়া বেরোতে আর কতক্ষণ লাগবে? ছেলেটা গোলাপি পলিথিন থেকে মুড়ি খাচ্ছিল, সঙ্গে কাঁচালংকা। গোচারণ থেকে সপরিবারে এসেছে পরশু দিন, ভাগচাষি। আর একজন এসেছে সকালবেলা। আজ বৈকাল তিনটা থেকে জমিতে জল পড়বে, ডিপ টিউকলের জল…। ও বলল। ও চলে যেতে চায়।

আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা সব এমনিধারাই। হারুটাই কী করে দৈত্যকুলে পেল্লাদ। ও তো আমারই বয়সি ছিল। আমার চেয়ে ছ’ মাসের ছোটই। রামেশ্বর ইস্কুলে আমরা দু’জনে ভরতি হয়েছিলাম একই ক্লাসে। আমরা দু’জনেই রঞ্জন নামে একটি ছেলের খিদমতগিরি করতাম। রঞ্জন বলত ওর মামার প্লেন আছে। টিফিনবেলায় রঞ্জনের বাড়ি থেকে চাকর এসে ওদের দুধ খাইয়ে যেত, আর বাক্সে দিত টিফিন। ও হাতের চেটোর উলটো দিক দিয়ে মুখ মুছে টিফিন বাক্স নিয়ে আসত। রঞ্জন মাখন মাখানো পাউরুটির হাফ আমাকে, হাফ হারুকে দিত। রঞ্জনের মাখন-রুটি খেতে ভাল লাগত না। ও গৌরের ঘুগনি খেত। হারুর ভাল নাম ছিল হারাধন। হারাধন খামারু। ক্লাস সেভেনে যখন সমাস পড়ানো হচ্ছিল, কতগুলো ছেলে বলত, হারাধন—যে ধন হারাইয়া গিয়াছে—বহুব্রীহি সমাস। আসলে মামিমার আগে একটা ছেলে হয়েছিল। রক্ত আমাশা হয়ে এক বছরের মাথায় মারা যায়। তারপর যখন হারু এল, মামিমার বিশ্বাস হয়েছিল ওই ছেলেটাই ফিরে এসেছে। ক্লাসে হারু সেকেন্ড হত। কে জানে কী করে হত।

আমার বাবার মাছের দোকান। আমার জন্য অনিলবাবু স্যার ফিট করা ছিল ক্লাস ফাইভ থেকে। হারুর বাবার মাকালীর ফটোর দোকান। ওর কোনও মাস্টার ছিল না। আমি ক্লাস এইটে গাড্ডূ মারলাম। হারু ফার্স্ট হল। আমার বাবা আমায় খুব প্যাঁদাল। বলত—যা হারুর গু খেয়ে আয়। হারুর সঙ্গে সেই থেকেই বেশি কথা বলতাম না আমি। এমনি এমনি পাশ করলে চলত না? এক্কেবারে ফার্স্ট হতে হবে?

হারু ফার্স্ট হবার পর হারুর বাবা ওকে একটা খুব ভাল সিনেমা কিনে দিয়েছিল। একটা লম্বা মতো টিনের চোং, একদিকে চোখ রেখে অন্যদিকে ফিলিম ঢুকিয়ে দাও, একদম সিনেমা। হারু সিনেমাটা দেখাবার জন্য আমাদের ঘরে এসেছিল। আমি ততদিনে বৈজয়ন্তীমালা চিনে ফেলেছি। দিলীপকুমার, রাজকাপুর, দেবানন্দ চিনেছি। সাধনা-আশা পারেখ-নন্দা-সায়রাবানু চিনে গেছি। ক্লাস কেটে আমি আর রঞ্জন দেখে ফেলেছি সঙ্গম। টেরিলিনের জামা পরে বৈজয়ন্তীমালার টুলের উপরে কী নাচ। বৈজয়ন্তীমালারও ভিতরটা দেখেছিলাম। তারপর কয়েকদিন হারুদের বাড়ির স্পঞ্জ আমার কাজে লেগেছিল। এমন সময় বাড়িতে সিনেমা। কাচের ভিতরে চোখ দিয়ে সাধনা-আশা পারেখ-বৈজয়ন্তীমালা দেখেছি। আর বোল রাধা বোল কিংবা ঝুমকা গিরারে করছি। ওই চোং-সিনেমাটার উপর আমার খুব লোভ হয়েছিল। বাবাকে বলে কোনও লাভ নেই, বাবা আবার প্যাঁদাবে। বাবার কাছ থেকে পয়সা চুরি খুব সোজা নয়। বাবা তো খুব ভোরবেলা বেরিয়ে যেত। তখন ঘুমিয়ে। যখন ফিরত, তখন স্কুলে। রবিবারে দুপুরটায় চৌকির উপর ঝুন ঝুন শব্দ পেতাম। ওই শব্দটা আমার খুব ভাল লাগত। ওটা পয়সা ভাগা দেবার শব্দ। দোকানের বিক্রির টাকা ভাগা দিচ্ছে বাবা আর মা। পাঁচ নয়ার স্তম্ভ, দশ নয়া—বিশ নয়ার। গোনা হয়ে গেলে একটা কাঠের আলমারির মধ্যে চাবি দিয়ে সেই চাবি আঁচলে ঝুলিয়ে রাখত মা। রাত্রে বাবা ফিরত বেশ রাত করে। বাবার পকেট কখনওই পেতাম না।

একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে দুপুরে বাবা ঘুমুচ্ছে। আজ বিকেলে দোকান খুলবে বাবা, কোন বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ। মাসে এরকম দু-একবার সন্ধেবেলা বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে যেতেন বাবা। আমি বাবার পকেটে হাত দিয়ে যা আছে নিয়ে আসি। কিছু খুচরো পয়সা, বেশি না। তিন-চারটে টাকা, আধুলি হলেই কাজ মিটে যেত। খালি দশ নয়া-পাঁচ নয়া। একটা গোল মতো জিনিস পেলাম, সোনালি রাংতায় মোড়া। একে আমরা টাকা লজেন্স বলতাম। ঠিক একটা রুপোর টাকার সাইজ। সোনালি রাংতায় মোড়া। রাংতাটা খুললে ভিতরে একটা টাকা সাইজের চকলেট। এটা নিশ্চয়ই হারুর জন্য এনেছে বাবা। বাবা হারুকে এর আগেও চকলেট দিয়েছে। আমি ওই গোল জিনিসটা পকেটে পুরি। খুচরো চল্লিশ নয়া নি। আর একটা কাগজ ছিল ভাঁজ করা। কে জানে কেন খুললাম। দেখি আমার চেয়েও অনেক বাজে হাতের লেখায় লেখা একটা লাইন ‘আজ সন্ধ্যায় আসিও’। আমি কাগজটা আবার ভাঁজ করে রেখে দি।

বাবা সন্ধের সময় চলে গেলে আমি চকলেটের চাকতিটা খুলি। হালকা কেন? খুলি। দেখি বেলুন। গোলাপি রঙের অনেক বড় বেলুন। ওটা ফোলাই। বস্তির অন্যরা হাসাহাসি করে। একজন জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেলি রে? বললাম, বাবা দিয়েছে। ওরা আরও হাসল।

সেদিন রাত্রে বাবা-মার ঝগড়ায় ঘুম ভেঙে গিয়ছিল। মায়ের কান্নাকাটির শব্দ শুনেছিলাম। পরদিন দোকানে যাবার সময় বাবা বলেছিল কোনও দিন পকেটে হাত ঢুকিয়েছ কি থাপ্পড় মেরে দাঁত ভেঙে দেব।

তারপর একদিন মামার বাড়ি থেকে হারুর টিনের সিনেমাটা চুরি করেছিলাম। হারু খুব দুঃখ পেয়েছিল। আমাকেই সন্দেহ করেছিল। কারণ আমি খুব বেশি ঘুরঘুর করছিলাম সেদিন। হারু ওটা কোথায় রাখত আমি জানতাম। হারুর সেদিন জ্বর। খুব জ্বর। জ্বরে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি ওই সিনেমাটা ঝেড়ে দিয়েছিলাম। হারু জ্বর থেকে উঠে আমায় স্কুলে ডেকে বলেছিল আমার সিনেমাটা দিয়ে দে। আমি বলেছিলাম, মুখ সামলে কথা বলবি। আমি চোর? কী যা-তা বলছিস। আমাদের ব্যাকরণ বই থেকে অনেক প্রবাদ মুখস্থ করতে হয়েছিল। তার মধ্যে একটা ছিল চোরের মায়ের বড় গলা। সেই কথাটার মানেটা খুব ভাল করে বুঝেছিলাম সেদিন।

এর পর থেকেই হারু আমার সঙ্গে কথা বলত না, এড়িয়ে থাকত। আমিও বলতাম না। হারুকে স্যারেরা ভালবাসত। হারু হায়ার সেকেন্ডারিতে স্কলারশিপ পেল, প্রেসিডেন্সিতে ভরতি হল। তারপর আমেরিকা চলে গেল। ও যেদিন আমেরিকা যায়, আমি এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল, আমি গোপনে সেই জল মুছে নিয়েছিলাম হাতের চেটোয়। আমি বলেছিলাম, চিঠি দিস। ও দেয়নি। এর পর তিন বছর পর ও যখন এসেছিল, ওর গায়ে অন্যরকম গন্ধ, অন্যরকম রং। ওর কথা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল। ও নায়েগ্রার ছবি দেখিয়েছিল, শিকাগোর রাস্তা, ওয়াশিংটনের মূর্তি। যখন ফিরব বলে উঠলাম, একটা ডট পেন আর এক মুঠো চকলেট দিয়েছিল। আমি নিইনি, রেখে এসেছিলাম। তখন হারুরা জেলেপাড়া বস্তিতেই থাকে। বস্তির সবার জন্যই নিয়ে এসেছিল একটা করে ডটপেন আর একপাতা চকলেট। আমার জন্যও এই। ও ভুলে গেছে আমার বাবা ওর বাবাকে পুলিশের খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে এনেছিল। আমি দেখতাম, বস্তিতে, বস্তির বাইরে, বড়মামাকে দেখিয়ে লোকে বলত—ওই যে, ওর ছেলে আমেরিকা থাকে।

কিছুদিন পর হারুরা কাঁকুড়গাছিতে ফ্ল্যাট কেনে। চলে যায়। হারু বড়মামাকে চিঠিতে লিখত, ওই দোকানে আর বোসো না। মামা তবুও দোকানে যেতেন। তারপর ছোট্ট একটা হার্ট অ্যাটাক হবার পর দোকান যাওয়া বন্ধ করে দিলেন মামা। মামা একদিন আমাকে বলেছিলেন, হারু বলছে একটা গাড়ি কিনতে। গাড়ি কিনে কী করব বল? ওই দোকানটায় অবশ্য আবার যাওয়া যায়। আমি বলেছিলাম, এটা কি ভাল দেখাবে? গাড়ি করে ওই ছোট্ট দোকানে যাওয়া? শেষ অব্দি বড়মামা দোকানটা বিক্রি করে দিলেন। আমার বন্ধুই কিনেছে। গোপাল। গোপাল ওটাকে স্টেশনারি দোকান করল। ছোটর মধ্যে সাজিয়েছিল ভালই। কাচের জারে ভরতি থাকত বাদাম, কাজুবাদাম, চানাচুর, লজেন্স, কেক। এখন গোপালের দোকানে শূন্য জার। গোপালের জামার বোতাম ছেঁড়া। কাঁচাপাকা বুকের লোমে হাহুতাশের হাওয়া। মন্দিরে বেড়াতে আসা কিশোরীদের ফাউ দিয়ে ফাউ দিয়ে সমস্ত জার শেষ।

কাঁকুড়গাছি যাবার পর মামাবাড়িতে কমই গেছি। মামাবাড়িকে আর মামাবাড়ি মনে হচ্ছিল না। ফ্রিজে বোতল ভরা অরেঞ্জ-পাইনাপেল। পাপোশ থেকে বাথরুম পর্যন্ত কোথাও জেলেপাড়া নেই। মামা-মামিকে হারু আমেরিকা নিয়ে গিয়েছিল। ওখানে মাস তিনেক ছিল। মামিমা ওখান থেকে নিয়ে এসেছিল কাঁড়ি কাঁড়ি সুখের গল্প। এতটা পুত্র-গর্ব আমার মায়ের মনেও ঈর্ষা জাগিয়েছিল, আর আমার মায়ের ঈর্ষা বুঝতে পেরে মামিমা আরও সুখী হয়েছিল। মামিমা খাবার সময় সাবানে হাত ধুয়ে খাওয়া অভ্যেস করেছিল বলে মা হাসাহাসি করত। কথায় কথায় ‘নো প্রবলেম’ রপ্ত করছিল মামিমা। আমার মাকে একটা বিদেশের শাড়ি দিয়েছিল মামিমা। বলেছিল এটা জাপানি সিমপেথিক্‌ শাড়ি। সিনথেটিক বোঝাতে চেয়েছিল মামিমা। আর আমার মামা কোনও কিছু জানি না বোঝাতে দু’ পাশের কাঁধ উঁচু করে দিতেন।

হারু ওখানে চাকরি পালটেছে, আরও বড় চাকরি পেয়েছে খবর পেয়েছি, মেম বিয়ে করেছে সে খবরও পেয়েছি। মেম বউ নিয়ে হারু কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে এসেছে সে খবরও পেয়েছি, মেম বউ নিয়ে মামা-মামি গোচারণে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে এসেছে সে খবরও শুনেছি, কিন্তু আমি হারুর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। কেন যাব? ওইসব কথা শুনতে! মামিমা একদিন বলেছিলেন, আগে তো গোচারণের কেউ আসত না, এখন আসে। হারু পার্সেল পাঠায় তো…. এটা ‘গোচারণ’ বললেও আমার গায়েও লাগে।

আচ্ছা, এটাই কি কারণ ছিল মামাবাড়ি না যাবার? আজ এইখানে মেঘলা দিনে কেমন যেন ভাবতে ইচ্ছে করল। আজ আমার গাড়ি গেছে হারুকে আনতে এয়ারপোর্টে। আমার বাড়ির ছাতের অ্যান্টেনায় আটকায় পেটকাট্টি ঘুড়ি। কেন যেতাম না? আসলে নিজেকে খুব ছোট লাগত, ছোট।

হারুর একটা বোন হয়েছিল। অর্চনা। হারুর চেয়ে দু’বছরের ছোট। অর্চনার যখন ষোলো বছর, শেতলা মন্দিরের পিছনে লেদ মিস্ত্রি গ্যাঁড়ার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। গ্যাঁড়ার সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। হারু তখন প্রেসিডেন্সিতে। ওর তখন খুব মন খারাপ। কিন্তু আমার সঙ্গে কথা নেই, সেই সিনেমাবাক্স চুরির পর থেকে। হারু খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আমি একদিন ওর পিঠে হাত দিয়ে বলি—হারু, যার ভাগ্যে যা আছে…। হারু আমার কাছ থেকে ছিটকে সরে গিয়েছিল। সেই গ্যাঁড়া এখন একটা লেদের কারখানা করেছে নিজের। মিঠুন-জয়াপ্রদা নাইট হলে দুশো টাকা দিয়ে টিকিট, কিংবা দেড়শো টাকা কেজির চিতল মাছের পেটি কেনার গল্প করে।

কাকুড়গাছির ফ্ল্যাটে গ্যাঁড়া আর অর্চনা প্রায়ই যেত। বিজয়ার পর আমি একদিন গেছি, অর্চনা বলল, একটা জিনিস খাবি, কোনও দিন খাসনি। দাদা পাঠিয়েছে, দাঁড়াও করে দিচ্ছি। একটা টিন থেকে নরম, সাদা সাদা একটা জিনিস বার করল। আমি বললাম, কে বলল কখনও খাইনি? এটা তো চিজ।

ততদিনে আমিও মানুষ হয়েছি। আমিও শিখে গেছি স্কুটারের ক্র্যাচ আর গিয়ারের কায়দা। ততদিনে আমি বিমল রায়ের সিমেন্টে গঙ্গামাটি মেশানোর কারবারে ভিড়ে গেছি।

বউ-বাচ্চাকে নিয়ে গেলাম একবার। তখনও অর্চনা। ওর ফোপড়দালালিটা একেবার সহ্য হয় না আমার। অর্চনা বলল-বউদি এসপেডি খাও। দাদা এনেছিল। মা এটাকে দুধ দিয়ে ফুটিয়ে পিঠে করে। ঝাল ঝালও খাওয়া যায়—টোব্যাক্সো সস্‌ দিয়ে খাবে? এই বলে একটা প্যাকেট দেখাল। দেখি লেখা স্পিগেডি। আর সসটা ‘টোব্যাস্কো’। মেড ইন ইটালি। দাঁড়াও, এর সঙ্গে টুনি মাছও দিচ্ছি। এই বলে একটা টিন দেখাল। টুনাফিশ্‌। ওই সব খাওয়াল৷ ভালই খেতে, তবু অনেকটা ফেলে দিলাম। বললাম, ভাল লাগছে না। অর্চনা বলল, টুনি মাছে গন্ধ লাগছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। অর্চনা বলল, অভ্যেস হয়ে গেলে আর গন্ধ লাগে না, বরং ভাল লাগে। তারপর অর্চনা আমার বউয়ের হাতে একটা শিশি গুঁজে দিয়ে বলল, খুব ভাল সেন্ট বউদি, মেড ইন ফ্রান্স।

ততদিনে আমি মামলেটকে ওমলেট আর সেন্টকে পারফিউম বলতে শিখে গেছি। জালখাবারকে কখন স্ন্যাকস বলতে হয়, তাও।

এরপর বহুদিন মামাবাড়ি যাইনি। তবে যোগাযোগটা ছেড়ে দিইনি। আমার বাড়িতে ফোন আসার পর মাঝে-মাঝেই ফোনে খবর নিতাম। তারপর যখন সিমেন্টের লাইন ছেড়ে হাত ধুয়ে ফেলে প্রোমোটারিতে এলাম, গাড়ি কিনলাম, তখন মামিমাই ফোন করতে লাগল আমায়। কেমন আছিস, কী খবর, বহুদিন আসিস না, আয়…। হারুর সঙ্গে কিন্তু দেখা হয়নি আমার আর। সেই যে এয়ারপোর্টে, সেই শেষ!

ভল্টু আমার পাশে এসে বসল। একটা সিগারেট ধরাল। বলল, বহুদিন পর সব আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখাটেখা হচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ।

তুই তো সল্টলেকে বাড়ি করেছিস, তাই না?

সল্টলেক নয়, কেষ্টপুরে—

ওই কাছাকাছিই হল। ভেরি গুড। কদ্দিন হল?

বছর দুই।

জেলেপাড়া ছেড়েছিস তো অনেক দিন…

বাবা মারা যাবার পর। বছর পাঁচ..

তোর বাবার শ্রাদ্ধে তার সঙ্গে লাস্ট দেখা …

হু

খুব খরচ করেছিলি। কিন্তু ক্যাটারার ভাল ছিল না।

হুঁ

গাড়িটা তো জেলেপাড়ায় থাকতেই…

হুঁ। বাবা দেখে গেছেন।

মেশোমশাইয়ের শরীর খারাপের খবর তো তুই আগেই পেয়েছিলি।

হ্যাঁ। মামিমা বাড়িতে ফোন করেছিল…

তুই গিয়ে বেঁচে থাকা অবস্থায়…

দেখেছি। আমিই আমার গাড়িতে নার্সিংহোম নিয়ে যাই।

আমায় কেউ খবর দিল না। আমারও তো ফোন ছিল।

জানি না তো…

নম্বরটা লিখে নে। আচ্ছা, কার্ড দিচ্ছি।

কার্ড পেলাম। চ্যাম্পিয়ান ক্যাটারার। 12/A/2D বেনিয়াপাড়া লেন। ফোন নম্বর…

আমি বললাম এটা তোর কোম্পানি।

হ্যাঁ।

কার্ডে তোর নাম দিসনি কেন?

আমার ভাল নাম জানিস না? ভোলানাথ মণ্ডল।

তো?

লোকে ডাকবে? মণ্ডল দেখলেই এখনও…একচুয়ালি এটা তো ছিল বামুনদেরই কাজ…।

ওই লোকটা এসে গেছে। আমি আজ নিয়ে তিন দিন এখানে এসেছি। তিন দিনই এই লোকটাকে দেখলাম। এরকম দুপুরের দিকটাতেই আসেন। ম্যানেজারের ঘরে দু’ মিনিট বসেন। একটা সিগারেট খান চুপচাপ, তারপর ওই অন্ধকার অন্ধকার ঘরটায় চলে যান, ওই ঠান্ডা মেশিনটার কাছে দাড়ান। ‘জন’ নামের যুবকটি এসে যায়, গালে চাপদাড়ি। জন চাকা ঘোরায়, ড্রয়ারের ঢাকনি খুলে যায়, ড্রয়ারটা এগিয়ে আসে। ঠান্ডায় নীল হওয়া একটি হিম নারী। লোকটি তাকে স্পর্শ করে থাকেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর সেই ঠান্ডা হাতের দিকে ঝুঁকে পড়েন, ঠোঁট ছোঁয়ান। চুম্বন করেন। তারপর ড্রয়ার সরে গেলে, দরজা বন্ধ হয়ে গেলে লোকটির চোখে কাতরতা থেমে থাকে। লোকটির বয়স ষাট ছাড়িয়েছে মনে হয়। জন বলে—প্লিজ রিমুভ ম্যান, শি ইজ ডিকেয়িং। লোকটা বলে, ওয়ান ডে, জাস্ট ওয়ান ডে মোর। প্লিজ।

ছাড়তে চায় না, ছাড়তে চায় না কিছুতেই।

ভন্টুর বউ দুটো সন্দেশ নিয়ে এসেছে। মামিমাকে খাওয়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মামিমা কিছুতেই খাবে না। অর্চনা একটা সোফায় চোখ বুজে আছে, অর্চনার কিশোরী পরিচারিকা অর্চনার মাথা টিপে দিচ্ছে। অর্চনা চোখ খুলল। মেয়েটাকে বলল—আমার ব্যাগটা দে তো জবা, দেখি ওডিকোলন আছে কি না, ওটা হলে মাথা ধরাটা কমত…।

দেখ অর্চনা, আমাকে স্পেগেডির সঙ্গে যে মাছ খাইয়েছিলি, ওটা টুনি নয়, টুনা। অনেক পরে জেনেছি, শোন, দেখে রাখ, এখন আমার বাড়িতে ছাতে টিভির অ্যান্টেনায় ঘুড়ি আটকে যায়।

মামিমা আমাকে ডেকে পাঠালেন ভল্টুর বউমাকে দিয়ে। বললেন, এয়ারপোর্টে আর একবার ফোন করতে। আর বললেন ফুল এনেছি কি না, আর জিজ্ঞেস করলেন কাগজে দিয়েছে কি না!

ফুল তো প্রচুর আনা হয়েছে। মাটাডর ভরতি ফুল। কিন্তু খবরের কাগজে কিছু দেওয়া হয়নি।

মামিমা এখন আমাকেই দায়িত্ব দেন। বলা যায় আমিই এখন গার্জিয়ান। আমি জানি আমার এই ক্ষমতার উৎস আমার টাকা। টাকার গায়ে এক নম্বর দু’নম্বর লেখা থাকে না। মা গঙ্গা আমাকে অনেক টাকা দিয়েছিলেন। সিমেন্টে গঙ্গামাটি পাইল করে অনেক কামিয়েছি। এখন হাত ধুয়ে নিয়েছি আমি। নন্দনকানন এন্টারপ্রাইজ। আমার প্রোমোটারি বিজনেস।

পাঁচ বছর আগে বাবার শোক সংবাদ ছাপার মতো টাকা আমার ছিল। ছাপাইনি। আসলে এসব ব্যাপার মনেই আসেনি।

তো কী লিখি? সমাজসেবীর মৃত্যু। শ্রীপশুপতি খামারু ছিলেন জনদরদী…। জনদরদীই তো। মাঝে মাঝেই কাঁকুড়গাছির ওই সাজানো ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেতেন বরানগরের জেলেপাড়ায়। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে, তাদের সঙ্গে গল্প করতেন, মুড়ি বেগুনি খেতেন। এক কথায় এটাকে কী বলা যায়? দু’জন যক্ষা রোগীকে দুধ খাবার টাকা দিতেন। এটাকে কী বলা যায়? এসব কি আমি পারি? ছেলের দ্বারাও হবে না। ও আবার ইংলিশ মিডিয়াম। বাংলায় উইক। ভাবছি কী করব। দালাল পাওয়া যায় না? লোক পাওয়া যায় না কাগজের অফিসে? পোস্ট অফিসে তো পাওয়া যায়, লিখে দেয়। কোর্টে পাওয়া যায়। কাগজের অফিসে থাকে না?

ভল্টু এল। বলল—সব আত্মীয়স্বজনকে শ্রাদ্ধে বলতে হবে। হারু তো কিছুই জানে না, আমি ঠিকানা জানি কি না…।

একটা পয়েন্ট। শোক সংবাদে যদি বলে দি—অমুক তারিখ অমুক স্থানে শ্রাদ্ধবাসর…

মনে মনে কাটাকুটি অথবা সংশোধন চলছে, এমন সময় ছেলে এল। বলে, বাবা, একটা কোক খাব। খুব তেষ্টা পেয়েছে। দেখ, দেখ হারু, আমার ছেলেও তেষ্টা পেলে কোক খায়। আমি তখন কাগজে ড্রাফট করছি। বললাম, প্লিজ ওয়েট। দিচ্ছি। ও অমনি আমার পকেটে হাত ঢোকাল। খুব রেগে গেলাম। বললাম, বলেছি না আমার জামার পকেটে কক্ষনো হাত দেবে না, নেভার। যা লাগবে আমাকে বলবে।

একবার হয়েছিল কী, আমার জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ও একবার সাট্টার স্লিপ পেয়ে গিয়েছিল। পুরনো অভ্যেস, ছাড়তে পারিনি। ও অবশ্য বোঝেনি। ইংলিশ মিডিয়াম!

আমি ওকে টাকা দিলাম। ভল্টু বলল, সত্যি তোকে দেখে শেখার আছে। এইসব হ্যাবিট কত ভাল। আমাদের ছেলেদের এইসব জানা দরকার। তোর ছেলেকে তুই খুব ভাল ট্রেনিং দিচ্ছিস…।

ভল্টু কি আমাকে তেল দিচ্ছে?

এখানকার টেলিফোনটা কাজ করছে না। ফোন করতে বাইরে যাই। ফোনে জানলাম প্লেন নেমে গেছে। তা হলে আসছে। পঁচিশ বছর পরে দেখব হারুকে। হারুর মেম বউকে দেখব, হারুর সন্তানদেরও। ওর বাচ্চারা আমাকে আংকেল ডাকবে। ওদের কথা কি বুঝব আমি? ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে রাখব। ছেলেকে বলব, হারুর বাচ্চাদের সঙ্গে ফ্লুয়েন্ট ইংলিশে কথা বলবি, মোটে ভয় করবি না , আর হারু, সে তো তোর কাকু। ভাব করে ফেলবি। আমেরিকা গিয়ে পড়াশুনো করতে ইচ্ছে হয় তোর বাপ্পা?

ফুটপাথে খেলনা বিক্রি হচ্ছে। হরেক খেলনা। আমি দাঁড়িয়ে যাই। পেটটেপা পুতুল, ডুগডুগি হাঁস। হি ম্যানও আছে। প্লাস্টিকের কর্ডলেস ফোন, পেজার, ক্যামেরা। আচ্ছা ওটা কী? সিনেমা? সেই সিনেমা? চোখে লাগিয়ে দেখার সেই সিনেমা? হারুরে…। আমি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ি, কাচে চোখ লাগিয়ে দেখি অমিতাভ বচ্চন ঝাঁপ দিচ্ছে।

বাক্সটা টিনের নয়, প্লাস্টিকের। সেই চোখে লাগালে সিনেমা।

কী কী ফিলিম আছে? বলি আমি—ও একটা প্লাস্টিকের বাক্স খুলে সেলুলয়েড সম্ভার দেখায়। আমি রাস্তায় বসে যাই। ভিজে রাস্তার ট্রাক কাদা ছেটায়। আলপনা। আমি সাদা শূন্যতায় ফিলিম গুঁজে দি। মিঠুন। দেখি অমিতাভ, দেখি রেখা, শ্রীদেবী, সঞ্জয়, ডিম্পল…এখনকার সবাইকে চিনি না। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই রাজ কাপুর। ওই তো মেরে মন মে গঙ্গা। ওই তো ডম ডম ডিগা ডিগা। ওই তো জেলেপাড়ার বস্তি , ওই তো বুড়ো হজমিওলা। গৌরের ঘুগনি। হারু ইস্কুলে যাচ্ছে, ঢিলে প্যান্ট, বগলে অঙ্ক খাতা। সব অঙ্ক রাইট। এক পলকে একটু দ্যাখা, আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী। এটা কে? ছবি বিশ্বাস? এটা জহর রায়! ট্রামের হলুদ টিকিট। উত্তরা পূরবী উজ্জ্বলা। লিলি বিস্কুট। জনিওয়াকার না! টুনটুন? শাম্মি কাপুর? চাহে মুঝে কোই জংলি কহে…চেঁচিয়ে উঠলাম ইয়া…হু…

দাও দাও। ওই ফিলিমগুলো সব দাও। ও আমাকে একটা গোলাপি পলিথিনে ভরে দেয়।

আমি পিস হাভেনে ফিরে গিয়ে আমার ছোট্ট এটাচিতে ভরে রাখি ফিলিম সম্ভার। মামিমাকে বলি, ওরা আসছে। অমনি শোরগোল পড়ে যায়। ভল্টুর বউ চুল ঠিক করে। অর্চনা ওর ছেলেকে ডাকে। বলে, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা বলবি, ভয় পাবি না। আমি সিঁড়িতে বসি, সিঁড়িতে ফুঁ দিলাম না।

ভল্টু এল। আমার পাশে বসল। বলল—বৃষ্টি হল, তবু দ্যাখ গরম কমল না। একটা সিগারেট দিল আমায়, তারপর ও নিজে ধরাল। রিং ছাড়ল। তারপর বাঁ হাতে নিজের তৈরি রিং ছত্রাখান করে বলল, শোন তোকে একটা কথা বলি। ভল্টু আমার আরও কাছে সরে আসে। বলে দ্যাখ— শ্রাদ্ধটাদ্ধর ব্যবস্থা তো আমাদেরই করতে হবে। বলছিলাম কী, শ্রাদ্ধের ক্যাটারিং-এর কাজটা আমিই ভালকরে করে দেব। অন্য কাউকে বলার দরকার নেই। আমার বলাটা তো ভাল দেখায় না , তুই যদি…

এতক্ষণ একটা মতলব ডিপ ফ্রিজে শুইয়ে রেখেছিল ভল্টু, এবার বার করল।

আমি মৃদু ঘাড় নাড়ি।

ভল্ট আবার বাইরে দাঁড়াল গেটের সামনে।

আমিও বসে আছি। আমার কোলে অ্যাটাচি। ভিতরে গোলাপি পলিথিন, তার মধ্যে আনন্দ। হারুর নিশ্চয়ই ভি ডি ও ক্যামেরা আছে, ভি সি পি , ভি সি আর, প্রজেকটার সবই আছে। কিন্তু ছোটবেলার সিনেমার বাক্সটা হারানোর দুঃখটাও কি নেই? ও কি যত্ন করে রাখেনি সেই দুঃখ?

কাজটাজ চুকে গেলে ওটা দেব। আমার বাড়ির ছাতে আটকে থাকা পেটকাট্টি ঘুড়িটা খুলে নেব, দু’হাতের উপর বসাব ওই ঘুড়ি, তার উপরে এই সিনেমা বাক্স। বলব, গ্রহণ কর।

তোর চোখে লাগিয়ে দিচ্ছি এই কাচ। তোর গায়ের থেকে মেড ইন ফ্রান্স পারফিউম নয়, ডাংগুলি খেলাফেরত ঘামের গন্ধ পাচ্ছি আমি। আমরা হাফ প্যান্ট পরা দু’ভাই রঞ্জনের মাখম রুটির ভাগ পাই। দ্যাখ দ্যাখ হারু, শাম্মী কাপুর, দ্যাখ দ্যাখ হারু উত্তরা পূরবী উজ্জ্বলা, দ্যাখ দ্যাখ কাঁচি পাগলা, ভূপে দা, পটলার চপের দোকান,জেলেপাড়া দ্যাখ, দ্যাখ, তুই ফার্স্ট হয়েছিস বলে বন্ধুদের বোঁদে খাওয়াচ্ছে বড়মামা। হারু, একবার চিল্লিয়ে বল, বল মাইরি ইয়া—হু।

ওরা এল।

শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৯৯৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *