ডিপি

ডিপি

মোবাইল হাতে তুলে টাইম দেখল অঙ্কুর।আরও দশ মিনিট। মানে তারপরেই ও বেরোবে। তারপরে…তারপরেই আর কী হবে জানা নেই। গতকাল রাত আজ ভোরেও উথাল পাতাল ভেবেছে অঙ্কুর। যেটা করতে চলেছে সেটা কি আদৌ ঠিক হচ্ছে? হয়তো চূড়ান্ত ভুল। কিন্তু আর কিছু করার নেই।

কলেজের বন্ধু প্রবাল অঙ্কুরকে বলেছিল—শোন অঙ্কুর, দেখ মানুষের জীবন কখন কেমন থাকবে আমরা কেউ জানি না, সুতরাং যা ঘটে গিয়েছে তার জন্য আজীবন মুখ ঝুলিয়ে থেকে বসে থাকাটা তোর মতো স্পোর্টসম্যানের মানায় না। লাইফে ফিরে আয় ভাই। তুই বেঁচে গিয়েছিস, আর তোর বয়স মাত্র কুড়ি। পুরোটাই বাকি পড়ে রয়েছে। মানুষ কত আঘাত পাওয়ার পরেও কত বড় বড় কাজ করে ফেলছে তুই দেখিস না? পুরোনো কথা সব ভুলে যা। চিয়ার আপ।

বন্ধুদের এমন ক্রমাগত উৎসাহ আসত বটে কিন্তু এন্ড অফ দ্য ডে সেই একাকীত্ব গ্রাস করত অঙ্কুরকে। ভুলে যা বললেই কি সব ভুলে যাওয়া যায়, বিশেষত সেই চিহ্ন যদি সারাক্ষণ সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলতে হয়। চোখ বুজলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সবুজ দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, মাথায় বিশাল চওড়া আকাশ, আর তার নীচে ফুটবল নিয়ে প্রাণপণে ছুটে চলা। ক্লাবের জার্সি পরা নিজেকেই ছুটতে দেখত অঙ্কুর। ডজ করছে, ড্রিবল করছে, প্রতিপক্ষর থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে দৌঁড়চ্ছে গোলপোস্টের দিকে। পেশিবহুল সুগঠিত দুটো পায়ের থাই, কাফ-মাসল দৌড়ের তালে তালে সঙ্কুচিত প্রসারিত হচ্ছে। প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের কাছে এসেই শট। ভয়ঙ্কর শট। ক্লাবের সকলে, এমনকী অন্যান্য ক্লাবের মধ্যেও অঙ্কুরের স্পেশাল কিছু শট নিয়ে আলোচনা করত। ফুটবল অন্ত প্রাণ অঙ্কুর স্বপ্ন দেখত। মস্ত স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের পথ দিয়েই এগোচ্ছিল তরতর করে। সকলের মতো অঙ্কুরও বিশ্বাস করতে শিখে নিয়েছিল ফুটবলই ওর জীবন, আর এই জীবনই ওর সবকিছু। ওর নিজস্ব ঘরে পেলে-মারাদোনা থেকে মেসি সকলেই থাকেন দেওয়ালে পোস্টার হয়ে। দিব্বি চলছিল এইভাবেই। স্কুল থেকে কলেজে ওঠা। কলকাতার কলেজে যাওয়ার জন্য লোকাল ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি, অনেক বন্ধু-বান্ধব। কলেজ সেরে প্র্যাকটিসে যাওয়া। সামান্য একটু ভুল যে এত বড় প্রতিশোধ নিতে পারে…

প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতেই সময় গিয়েছিল প্রায় ছ-সাত মাস। তারপর আবার কলেজে যাওয়া শুরু। তবে আর ট্রেনে-বাসে নয়। বাবার গাড়িতে। মন ঠিক হচ্ছিল না। সেই মাঠ, সেই বল, ক্লাব সবকিছু কোথায় যেন চলে গেল। একদিন বাড়িতে অঙ্কুরের সঙ্গে দেখা করতে এল কলেজের বন্ধু প্রবাল। বলল, এক কাজ কর অঙ্কুর। এবার ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেল। এতদিন তো ভালো লাগে না, সময় নষ্ট, ইত্যাদি বলে এড়িয়ে গিয়েছিস। কিন্তু আমার মনে হয় এবার তোর দরকার রয়েছে।

অঙ্কুরের তবু ইচ্ছে ছিল না। পুরো ব্যাপারটাই অসহ্য লাগে। এইসব ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ হেন তেন ইত্যাদি। মোবাইলটা স্মার্ট হলেও এইসব ওর ছিল না। কারণ একটাই, ওইসব করার সময় ছিল না। কিন্তু তারপর এতটাই সময় বেড়ে গেল যে সময় কাটানোই দুঃসহ। অসহ্য লাগত সারাদিন। কী করবে ভেবে পেত না। কত টিভি দেখা যায়? কত পড়াশোনা করা যায়। কলেজে যাওয়া শুরু করার পর তবু কিছুটা সময় কাটছিল কিন্তু সে-ও আর কতক্ষণ? অঙ্কুরের অনিচ্ছাতেই প্রবাল ওর ফোনটা নিয়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছিল। তারপর বলেছিল, নিজের সময় মতো পাসওয়ার্ড সেট করে নিস।

তারপরেও ইচ্ছে ছিল না। তারপর হঠাৎই একদিন সন্ধেবেলায় কী মনে হতে ফেসবুক খুলেছিল। বেশ কিছুক্ষণ খুটখাট করার পরে দিব্বি লেগেছিল ব্যাপারটা, বেশ কয়েকজন পরিচিত বন্ধুবান্ধবের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে জমা হয়েছিল। সেগুলো অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বন্ধুদের হাই-হ্যালো, কী করছিস, কেমন আছিস ইত্যাদি। বেশ কথা বলা যায় তো! চেনা পরিচিত বন্ধুদের থেকেই তারপর অচেনা বন্ধুদের ডাকে সাড়া। নিজে থেকেও রিকোয়েস্ট পাঠাতে শুরু করেছিল অঙ্কুর। তার মধ্যে প্রোফাইল ফটো বদলে ফেলল, অ্যালবাম থেকে, ডিজি ক্যামেরার মেমরি চিপ থেকে ফটো নিয়ে আপলোড করা। ক্লাবের জার্সি পরে ম্যাচ খেলছে। ওর সেই বিখ্যাত শট মারার মুহূর্তের ছবি। ক্লাবেরই এক বন্ধু তুলে দিয়েছিল। ওটাই ডিপি করেছিল অঙ্কুর।

বেশ চলছিল। হঠাৎই একদিন একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল। দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রোফাইলটা খুলে চমকে গিয়েছিল অঙ্কুর। এত সুন্দর দেখতে কোনও মেয়ে হয় নাকি? এত সুন্দর! পুরো মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। রিকোয়েস্টটা এসেছিল ও ফেসবুক করতে শুরু করার মাস দেড়েকের মাথায়। প্রোফাইলে প্রায় বিশ-পঁচিশটা ছবি। কোনওটা বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘাটশিলা কিংবা কাশ্মীর বেড়াতে যাওয়ার, কোনওটা কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক। দোলার মুখশ্রী যেমন, তেমনই হাসি। একেবারে সুচিত্রা সেনের মতো দাঁতের পাটি। রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার পর করেকদিন ধরে শুধু দোলার ছবিগুলো দেখেই গিয়েছে অঙ্কুর। চ্যাটে সবুজ দেখে হাই লেখার তীব্র ইচ্ছে হলেও আটকেছে নিজেকে। কী দরকার বাবা, রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে অ্যাকসেপ্ট করেছে, এই পর্যন্তই থাকুক। সুন্দরী মেয়েরা নাকি খুব অহংকারী হয়, আর খুব মুডি। সুতরাং বেশি খুঁচিয়ে লাভ নেই। তারপর হয়তো ব্লক করেই দিল।

কিন্তু একদিন রাত এই এগারোটা-সাড়ে এগারোটা হবে, কলেজের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ফেবু মেসেঞ্জারে চ্যাট করছিল। হঠাৎই, হাই।

চমকে উঠেছিল অঙ্কুর। আরে, এ কে! দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়! খুব উত্তেজিত হয়ে অঙ্কুর উত্তর দিয়েছিল, হাই। তারপরেই অনন্ত প্রতীক্ষা। যাহ কলা! তার মানে ভুল করে হাই তুলেছিল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল অঙ্কুরের। কিন্তু এক ঘণ্টা পরেই উত্তর। কেমন আছেন? সরি রিপ্লাই করতে দেরি হয়ে গেল।

অঙ্কুর আবার তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েছিল—না না, ঠিক আছে। আমি ভালো। আপনি?

সেই শুরু। তারপর আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে আরও বেশ কিছুটা।

কথা গড়াতে গড়াতে অনেক দূর। অঙ্কুর জানতে পারে দোলার কথা। দক্ষিণ কলকাতার একটি উয়োম্যান কলেজের ইকনমিক্সে সেকেন্ড ইয়ার। তারপর বাড়ির কথা, বাবা কলেজের অধ্যাপক, মা হাউজওয়াইফ, আর ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে থেকে ওর কী রং পছন্দ, কোন খাবার সব থেকে ভালো লাগে, সবকিছু।

অঙ্কুরও জানাত ওর নিজের ভালো লাগার কথা। ওর ভালোলাগা মানে তো শুধু ফুটবল। সব কথা ওই ফুটবলকে ঘিরেই। একদিন আর কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে অঙ্কুর দোলাকে জিজ্ঞাসাই করে ফেলেছিল, আচ্ছা দোলা, আমাকে একটা কথা বলবে?

কী কথা?

তোমার আর আমার মধ্যে যে কমন ফ্রেন্ড রয়েছে তাকে না তুমি চেনো না আমি, ওই অলোক নন্দী টাইপের বেশ কিছু পাবলিক রয়েছেন যাদের কাজ হল অ্যাট র‌্যান্ডম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে যাওয়া। আর আমার তোমার মতো কিছু মানুষ রয়েছে যারা অনেক সময় আগুপিছু না ভেবেই অচেনা কারও রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে ফেলি। সেইভাবেই ওই লোকটির সূত্রে তুমি আর আমি বন্ধু হয়ে গেলাম। আর আমাদের অনুঘটক এত কাণ্ড জানলই না। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তুমি হঠাৎ বন্ধুত্বের জন্য আমাকে বাছলে কীভাবে? কোনও লিংকই তো ছিল না। মানে কমন ইন্টারেস্ট ইত্যাদি।

কেন ছিল তো, ওই ফুটবল। জানো আমার পুরো বাড়ি ইস্টবেঙ্গল। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখেছি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচ থাকলে আগের দিন থেকে শনিমন্দিরে পুজো থেকে আরও কতকিছু যে কাণ্ড হত। দাদু আর বাবা নিয়মিত কলকাতার মাঠেও খেলা দেখতে যেত। আমি বায়না করতাম বলে আমাকেও কয়েকবার নিয়ে গিয়েছিল জানো।

আরে বাহ, তাই!—চমৎকৃত হয়েছিল অঙ্কুর।

হ্যাঁ। একদিন অলস দিন কাটছিল, আমার ফেসবুকে বন্ধু তো তেমন নেই। তাই কাদের সঙ্গে কথা বলি না সেই প্রোফাইলগুলো খুঁজে দেখতে গিয়ে দেখলাম ওই অলোক নন্দীকে। ওর প্রোফাইল খুলে দেখতে গিয়ে তোমার প্রোফাইল নজরে এল। দেখি একটা সুন্দর দেখতে ছেলে ফুটবলে শট মারছে তার ছবি। কী সুন্দর তার পা দু’খানি। একেবারে যেন রোনাল্ডো। দেখেই রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। আফটার অল ইস্টবেঙ্গেলের মেয়ে আমি। আর তুমিও দিব্বি অ্যাকসেপ্ট করে নিলে। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, তুমিই বা একজন অচেনা অজানা লোকের রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট কেন করেছিলে? তোমার ফ্রেন্ডলিস্ট আমি চেক করেছিলাম, খুব বেশি হলে তখন পঞ্চাশজনও ফ্রেন্ড ছিল না। আর সবই প্রায় ছেলে।

দোলার কথায় হেসে উঠেছিল অঙ্কুর। তারপর বলেছিল সত্যি বলব? আমাকে তোমার আগে কোনও সুন্দর মেয়ে রিকোয়েস্টই পাঠায়নি। আর পাঠাল যখন এমন সুন্দরী একজন পাঠাল যে আমি ভাবতেই পারিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম কোনও ফেক অ্যাকাউন্ট হবে কিন্তু ছবির পাহাড় দেখে শেষে বুঝলাম নাহ সত্যিই একটি প্রকৃত মুক্তখণ্ড ঈশ্বর আমার জন্য স্বেচ্ছায় প্রেরণ করেছেন। ব্যাস আমিও পুরো ‘জয় মা’ বলে ঝাঁপ দিলাম।

এমনই কথা এগোতে থাকল, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। কিন্তু আশ্চর্য কেউ একবারও বলল না, চলো একদিন মিট করি। কিন্তু দেখা না করেও, শুধু ছবিতে একে অপরের যে গভীর আশ্রয় হয়ে উঠল তা একমাত্র অন্তর্যামীই জানেন। একটা মুহূর্তও যেন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারত না। পরস্পরকে না দেখেও একে অপরের নিঃশ্বাসটুকু অনুভব করতে পারত। টের পেত যেন এই মুহূর্তে অন্যজন কী করছে।

কিন্তু তারপর এই কিছুদিন আগেই অঙ্কুরের মনে হল যে মেয়েটি তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, তার ফুটবল খেলার জন্য যে অকৃত্রিম ভালোবাসার আয়োজন করেছে দোলা সেই বিশ্বাসের সামনা সামনি হওয়ার সময় এবার হয়েছে, তা না হলে যতদিন যাবে এই খেলা চলতেই থাকবে। দোলার লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো সুন্দর নিখুঁত মুখখানির দিকে তাকিয়ে প্রতিবার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। শেষদিকে যেন ওই নিষ্পাপ মুখখানির দিকে তাকাতেও কষ্ট হত। নাহ এবার হয়তো বলে দেওয়া উচিত। ভালোবাসা আসলে একটা বিশ্বাসের নাম। বিশ্বাস নষ্ট করা আর ভালোবাসার মানুষকে খুন করা একই কথা। নিজের সঙ্গে অনেক লড়াইয়ের পর গতকাল বিকেলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল অঙ্কুর। দোলাকে পিং করার পর দোলা যখন জানাল ও কলেজে রয়েছে এবং এবারের কলেজ ফেস্টে ওকে অ্যাঙ্কারিং-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা শুনে খুব খুশি হওয়ার কথা ছিল অঙ্কুরের, কিন্তু পারেনি। যদিও দোলার সঙ্গে ওর যতবার ফোনে কথা হয়েছে অঙ্কুরের মনে হয়েছে এমন সুরেলা যার কণ্ঠসম্পদ সে কেন যে গান বা আবৃত্তি বা অন্তত অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার কাজে ব্যবহৃত হয় না তাই নিয়ে অনেকবার অনুযোগ করেছে অঙ্কুর। দোলা হেসে বলেছে আচ্ছা সে কখনও ভেবে দেখবে। কিন্তু গতকাল যখন ও নিজে এই খবরটা দিয়ে বলল, হয়তো তোমার কারণেই আমি স্টেজে উঠব জানো। নইলে তো…

দোলার অসমাপ্ত কথাকে আর পূর্ণ করার সময়ও দেয়নি অঙ্কুর। বলেছিল তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি দোলা।

হ্যাঁ বলো।

আমরা এই ক’মাসে কেউ কেউকে না দেখেও অনেক কাছে এসেছি। আমার মনে হয় এবার হয়তো একবার দেখা হওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। বলে একটু থেমে আবার বলেছিল হয়তো নয়, এবার আমাকে তোমার দেখা প্রয়োজন। তোমার প্রিয় ফুটবলারকে, তোমার স্বপ্নের হিরোকে এইবার দেখার সময় হয়েছে। আসবে তুমি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ ছিল দোলা। তারপর গলা নামিয়ে অদ্ভুত এক কণ্ঠে বলেছিল, আমিও তোমাকে এই কথাটাই ভাবছিলাম বলব। আমাদের মনে হয় এবার দেখা করার সময় হয়েছে।

বেশ তাহলে কাল দেখা হোক। বিকেলে।

আচ্ছা।

কোথায় দেখা করতে চাও বলো।

তুমি বলো।

দুজনের গলাই যেন অসম্ভব ক্লান্ত শোনাচ্ছিল।

ঠিক হল সেন্ট্রাল কলকাতার একটি দুজনেরই পরিচিত কফিশপে দেখা হবে দুজনের।

তারপর গতকাল থেকে আজ বিকেল পর্যন্ত দুজনের কেউ আর কারও সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। অদ্ভুতভাবে চুপ। যেন কীসের অপেক্ষা!

ঘড়ির দিকে তাকাল অঙ্কুর। বিকেল চারটে বাজে। এবার উঠতে হবে। বিছানা থেকে নিজেকে কিছুটা ঘষটে এগিয়ে খাটের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা ক্রাচদুটো ধরল তারপর উঠে দাঁড়াল। কলেজ থেকে ফেরার সময় কানে ইয়ারফোন, লোকাল ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতে গিয়েই হঠাৎ পড়ে যাওয়া। ডান পা-টা লাইনের ওপর পড়েছিল। ছুটন্ত ট্রেনটা ওই পা-টারই হাঁটুর ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল নিশ্চিন্তে। জীবনটাও বদলে গিয়েছিল সেই মুহূর্তেই। সকলে সান্ত্বনা দিয়েছিল, তবু ভালো একটা পা তো বেঁচে গিয়েছে। আদৌ কি আর কিছু বেঁচেছে অঙ্কুরের, কে জানে…কিন্তু দোলাকে আর ঠকানো উচিত নয়, ওর জানা উচিত ওর প্রিয় ফুটবলার আসলে একজন অতীত। এখন যাকে ভালোবাসে সে একজন ফ্রড, মিথ্যেবাদী।

আলনা থেকে ট্রাউজার নিয়ে বিছানায় বসে সেটা পরতে পরতে অঙ্কুর ভাবছিল আজ প্রথমবার যখন দোলা দেখবে অঙ্কুর দুই বগলে ক্রাচ নিয়ে ঢুকছে যার একটা পা হাঁটুর পর থেকে নেই, ট্রাউজারের নীচে শুধুই শূন্যতা, তখন কী করবে দোলা। সকলের সামনে একটা থাপ্পড় মারবে অঙ্কুরের গালে, নাকি কিছুই না বলে চুপচাপ ওর পাশ দিয়ে চলে যাবে অচেনার মতো? কিংবা…কে জানে…কিন্তু তবু জানুক, এই মিথ্যে দিনের পর দিন আর সইতে পারছে না অঙ্কুর।

ফ্ল্যাটের নীচে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সন্তোষকাকু। বাবার গাড়ির পুরনো ড্রাইভার। আজ বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য বাবার গাড়িটা চেয়েছে অঙ্কুর। বাবা পাঠিয়ে দিয়েছে অফিস থেকে।

তৈরি হয়ে আয়নার সামনে নিজেকে একবার দেখল অঙ্কুর। তারপর ক্রাচ হাতে নিজের ঘর থেকে বেরোল।

ঠিক ওই সময়ই নিজের ঘরে সালোয়ার পরতে পরতে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল দোলা। বছর দুয়েক আগে কালীপুজোর রাতে বাড়ির সকলে মিলে বাজি পোড়াচ্ছিল। একটা তুবড়ি কিছুতেই জ্বলতে চাইছিল না। ওটার সামনে মুখ ঝুঁকিয়ে দেখতে গিয়েছিল দোলা। তখনই আচমকা ভুস করে উঠে গিয়েছিল আগুন। কলেজের সবথেকে সুন্দর দেখতে মেয়েটির মুখ যখন নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেয়েছিল তখন সে অচেনা একটি মেয়ে। যার মুখের দিকে তাকাতে ভয় করে, বুক ছাঁৎ করে ওঠে। কী বীভৎস! প্লাস্টিক সার্জারিতে যেটুকু সামলানো গিয়েছিল তা সামান্যই।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটার দিকে একবার তাকাল দোলা। তারপর অভ্যাসমতো মুখ যতটা সম্ভব ওড়নায় আড়াল করে বেরিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *