কলকাতার সাহেবদের ক্রিসমাস ডিনার
শুরুতেই একটা জরুরি কথা বলে রাখি। বড়দিন মানে কিন্তু প্রভু যিশুর জন্মদিন না। সত্যি বলতে কী, যিশুর জন্মগ্রহণের সঠিক দিন-ক্ষণ পাওয়া যায় না। শুরুর দিকে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বড়দিন অন্তর্ভুক্তই ছিল না। দ্বিতীয় শতাব্দীর দুজন খ্রিস্টধর্মগুরু ও ইতিহাসবিদ ইরেনাউস আর তার্তুলিয়ান খ্রিস্টানদের উৎসবের এক তালিকা বানান। তাতে বড়দিন ছিল না। ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিশরে প্রথম বড়দিন পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিক কবি, লেখক ও ইতিহাসবিদ লুসিয়ান তাঁর সময়ে ক্রিসমাস পালিত হত বলে উল্লেখ করেছেন। ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমে সর্বপ্রথম বড়ো আকারে বড়দিন উদযাপন শুরু হয় ‘স্যাটার্নালিয়া’ নামে এক উৎসবকে কেন্দ্র করে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশে। সারা পৃথিবীতে খ্রিস্টানরা এ দিনকে আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসেবে পালন করতে শুরু করেন। ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার রোমান ক্যালেন্ডারে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন উল্লেখ করে দিনটিকে যিশুর জন্মদিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ৪৪০ সালে পোপ একে স্বীকৃতি দেন। সেই থেকেই ২৫ ডিসেম্বর আমরা যিশুর জন্মদিন পালন করি। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পালিত হলেও রাশিয়া, জর্জিয়া, মিশর, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও সার্বিয়া এর ব্যতিক্রম। এ দেশগুলোতে ক্রিসমাস পালিত হয় ৭ জানুয়ারি। এশিয়া মাইনরের দেশগুলোতে আবার ৬ জানুয়ারি, মানে যিশুর ব্যাপ্টিজম বা দীক্ষাস্নান দিবসে এ উৎসব পালন করা হয়।
আমরা অনেক সময় শুভ বড়দিনের ইংরেজি লিখতে গিয়ে লিখে ফেলি ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ বা ‘Happy Xmas।’ কিন্তু ক্রিসমাসের বানানে এমন ‘এক্স’ কেন ব্যবহার করা হয়? আসলে ক্রিসমাস শব্দটিকে গ্রিসে ডাকা হয় Christos নামে। গ্রিক ভাষায় যার বানানটা শুরু হয় এক্সের মতন দেখতে একটি অক্ষর ‘কাই’ দিয়ে। আর সেখান থেকেই ছোটো করে একসময় ক্রিসমাসের বানান হয়ে গিয়েছে Xmas।
ভারতবর্ষে প্রথম ক্রিসমাস উদযাপিত হয় ১৬৬৮ সালে। সে এক অবাক করা গল্প। কলকাতা নগরী গোড়াপত্তনকারী জোব চার্নক তখন প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছিলেন হুগলি ছেড়ে। পিছনে তাড়া করেছেন মোগল সেনারা। চার্নক যাবেন বালেশ্বরে। যেতে যেতে মাত্র সাতাশ মাইল পেরোতেই তাঁর চোখে পড়ল বনজঙ্গলে ঢাকা এক গ্রাম। না আছে ঘরবাড়ি, না দোকানপাট। আছে শুধু এক হাট, নাম সুতানুটি। মোগলদের থেকে পালাতে পালাতে এই জায়গাতেই থেকে গেলেন তিনি। একদিন দুইদিন নয়, টানা দুই মাস। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল হল, আরে! বড়দিন এল বলে! সেই সুতানুটিতে লুকিয়ে থাকার সময়ই বড়দিন পালন করেন চার্নক। কলকাতায় সেই প্রথম বড়দিন পালিত হল।
কলকাতার বড়দিনের একটা বিশেষ ব্যাপার ছিল, যা সারা পৃথিবীতে কোথাও ছিল না। ইংরেজরা তাকে বলত ‘ডলি।’ হিন্দি ডালি শব্দ থেকে এসেছিল সেটি। দুর্গাপুজোতে যেমন ডালি দেওয়া হয়, তেমনি সাহেববাড়ির বেয়ারা, খানসামা ও অন্য কাজের লোকেরা বড়দিনে তাঁদের ইংরেজ মনিবদের ‘ডলি’ বা ভেট পাঠাতেন। তাতে থাকত ফলমূল, কেক, মিষ্টি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস ইত্যাদি। এগুলি দিয়ে কেরানি, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি ও দালালরা সাহেব প্রভুদের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করতেন। ফ্যানি পার্কস এদের কিসমিস-বকশিশ (ক্রিসমাস বক্সেস) নাম দিয়েছিলেন। তবে এই বকশিশ নেবার জ্বালা ছিল। যে কর্মচারী এই ডলি দিত, তাকে ডলির মূল্যের বেশি দামের ফিরতি টাকা বা পার্বণী দেবার নিয়ম। ফলে মেমসাহেব বড়ো দুঃখ করে বলেছেন, ‘এ উপহারে খরচা বড্ড বেশি।’ তবে সেই বড়দিনেই তিনি কী কী উপহার পেয়েছিলেন, তার লিস্টি দেখলে চমকে যেতে হয়— একটা ধূসর ঘোড়া, লর্ড বেন্টিঙ্কের ছবি, হিরের আংটি, পাহাড়ি শাল, দুই বোতল মধু, দুই বোতল জ্যাম, এক থলে আখরোট ইত্যাদি। ভাবা যায়!
বড়দিন উৎসবের আসল আকর্ষণ ছিল পারিবারিক মহাভোজ। সে ভোজের মেনু শুনলে হাঁ হয়ে যেতে হয়। এই ভোজে খাবারের মধ্যে একটা প্রধান জিনিস ছিল ‘বোরস্ হেড’ বা শুয়োরের মাথা, যা রোজমেরি, বে-লিফ (তেজপাতা), আপেল আর অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাজিয়েগুজিয়ে পরিবেশন করা হত। নানারকম খাদ্য, পানীয় থরে থরে টেবিলে রাখা থাকত। থাকত টার্কি, ডাক রোস্ট, প্লাম, পুডিং, যত রাজ্যের জিনিস দিয়ে তৈরি বিরাট ক্রিসমাস পাই, ট্যাঞ্জারিন, লেবু, খেজুর, বাদাম, কিসমিস, চকোলেট, আরও কত কী!! এইদিন সাহেবরা মহা আনন্দ করলেও বেয়ারাদের খাটতে খাটতে হাড় কালি হয়ে যেত। তবে ভালো কাজ করলে ভাগ্যে ভালো খাবার আর বকশিশও জুটত তাদের। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে বা মার্চেন্ট অফিসের সাহেবরা বাড়িতেই বড়দিন পালন করতেন। কিন্তু পরের দিকে কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের একতলার বিরাট হলঘরটাকে বড়দিনের সন্ধ্যায় পৃথিবীর সব দেশের পতাকা দিয়ে করে সাজানো হত। নাম দেওয়া হত ‘হল অফ অল নেশনস।’ মজুত থাকত নানা খাদ্য আর পানীয়। সাহেবরা তাঁদের মেমসাহেবদের নিয়ে সেখানে এসে বড়দিন উদযাপন করতে পারতেন। সেখানে নাকি সাহেবরা এদেশীয়দের মতো কোলাকুলিও করতেন। দেশীয় মানুষদের এই অনুষ্ঠানে ঢুকতেই দেওয়া হত না। এ অনুষ্ঠানকে সাহেবদের বিজয়া সম্মিলনী বললেও ভুল বলা হয় না।
পুরোনো কলকাতার বড়দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভোজ হত বড়োলাটের প্রাসাদে। কলকাতার পাশাপাশি সুবে বাংলার বহু জায়গার রাজকর্মচারী ও সেনাকর্তারা এতে নিমন্ত্রিত থাকতেন। উৎসব শুরু হত ব্রেকফাস্ট দিয়ে আর শেষ হত ডিনার আর বলড্যান্সের পরে। মুশকিল হল লর্ড কর্নওয়ালিস যখন বড়োলাট হলেন। তিনি ছিলেন বড়দিনের এই ফুর্তির ঘোর বিরোধী। মনে করতেন পবিত্র দিনটিতে উপাসনা এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত। ফলে ১৭৮৫ থেকে শুরু করে তাঁর গোটা শাসনকালে তিনি লাটভবনে বড়দিন উৎসব বন্ধ করে দেন। এতে সাহেব-মেমরা বেজায় রাগ করলেও কিছু বলতে পারেননি। কর্নওয়ালিস বিলেত চলে গেলে আবার সেই উৎসব শুরু হয়। সাহেব-মেমরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।
সেকালে বাঙালি ভোজবাড়ির খাওয়া
অষ্টাদশ শতকে ভোজবাড়িতে বিবাহে ফলাহার হত অর্থাৎ চিঁড়ে, দই, খই, ঘি ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতকে বিয়েবাড়িতে লুচির প্রবেশ ঘটে। কলাপাতায় বড়ো বড়ো লুচির সঙ্গে দেওয়া হত আলুনি কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে থাকত সামান্য নুন। অনেক সময় এই নুন আবার অতিথিরা তাদের নিজের বাড়ি থেকে নিয়ে আসত। তাতে জাত যাবার বা নিমকহারাম হবার ভয়ও থাকত না।
মহেন্দ্রনাথ দত্ত, তাঁর লেখায় সেকালের কলকাতার ভোজবাড়ির এক চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন—
‘‘কলাপাতার কোণে একটু নুন দিত। সে আলুনি কুমড়া এখনও বড় মিষ্ট বলিয়া বোধ হইতেছে। সে রান্নার পাকা হাত আর নাই। এখনকার কুমড়ার ঘণ্ট যেন রাবিশ… তারপর আসিত কচুরির সরা। সেটা উঠে গেছে। কড়াই ডালের পুরে আদা মৌরী দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকোগজা, মতিচূর এই রকম সরাতে থাকিত। অন্য খুরিতে সন্দেশ থাকিত। পেনেটির গুঁপো সন্দেশ খুব বিখ্যাত ছিল। তারপর আসিত ক্ষীর, দৈ। খাজা দিয়ে ক্ষীর খাওয়া হইত। ইহাকে ক্ষীরখাজা বলিত। তখনও রাবড়ি উঠে নি। রাবড়ির প্রচলন লক্ষ্ণৌতে হয়। রসগোল্লা, তিলকূট তখনও হয় নাই। ক্রমে ক্রমে শাকভাজার আবির্ভাব হইল। পরে পটলভাজা বাহির হইল। আর বিশেষ উন্নতি হইল না। তারপর ইংরাজি পড়ার ঠেলায় নুন দেওয়া ছোলার ডাল ও নুন দেওয়া আলুর দম প্রকাশ পাইলেন এবং আলুনি ঠান্ডামূর্তি কুমড়ার ছক্কা গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন। ক্রমে সরা সাজানো লোপ পাইল।’’
তাঁর লেখায় বিয়েবাড়িতে মাছ প্রচলনের দারুণ মজার এক বিবরণও পাই—
“আমরা একবার রাত্রে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে উপনয়নের নিমন্ত্রণে গেছি। তখন নুন দেওয়া তরকারি খাবার প্রচলন হইয়াছে। হঠাৎ মালসা খুরি হাতে মাছের তরকারির আবির্ভাবে সকলেই হাঁ হাঁ, কি করেন। জাত গেল, ধর্ম গেল। বোধ হইল সকালেই সকলকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এই তো কটা বুড়োয় রব তুললে। আমরা ছোকরার দল লোলুপ দৃষ্টিতে মালসার দিকে আর পাতের দিকে চাহিতে লাগিলাম, যদি লুচিতে আর মাছেতে সংযোগ হয় ত সাক্ষাৎ বৈকুণ্ঠ তখনই পাই। এমন সময় আমাদের দিকে একটা বুদ্ধিমান লোক বললে, ‘কি জান, আমরা কায়স্থ, তা ব্রাহ্মণের পাতের এঁটো খেলেও জাত যায় না, ব্রাহ্মণের বাটিতে মাছের তরকারি প্রসাদের সামিল কাজেই সেটা রাত্রে বা দিনে সব সময়ই খাওয়া যেতে পারে’ -এইসব স্মৃতির বচন সে আউড়াইল। তখন ‘আমাকে দাও’ ‘আমাকে দাও’ করে গামলা ফুরিয়ে গেল।”
অভিজাতদের ডিনারের মধ্যে আলুর দমপোক্ত, মোচার আমষোল, কাঁচকলার হিঙ্গি, উচ্ছে-পেঁয়াজ ও রসগোল্লার কালিয়ার নাম করা যায়। বাকিগুলো এখন রান্না হলেও মোচার আমষোল বা কাঁচকলার হিঙ্গি বোধহয় এখন আর কেউ রাঁধে না। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী পূর্ববঙ্গের বিয়েবাড়িতে লুচি-পোলাও-কোর্মার চল ছিল না। ভাত হত। শেষপাতে পায়েস দেওয়া হত। ছোটোবেলায় আমিও দেখেছি অঢেল পায়েস বালতি থেকে বড়ো হাতায় পাতে ঢেলে দেওয়া হত, গরমকালে পায়েসের সঙ্গে আমও দেওয়া হত। আম চিপে পায়েসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নিমন্ত্রিতরা সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দে পায়েস খেতেন, কবজি বেয়ে রস গড়াত। এটাকেই বোধহয় প্রকৃত অর্থে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া বলে। বাঙালবাড়ির বিয়েতে মেনু হিসেবে কুমড়োর ঘ্যাঁট, এমনকি মানকচুও থাকত।
ঘটি বাড়ির মেনু ছিল আলাদা। বিয়েবাড়ির ভোজে লুচিই থাকত। সঙ্গে ছোলার ডাল, শাক ভাজা, কখনও কুমড়োর ছোকা ও ছ্যাঁচড়া। ডাঁটাওলা বেগুনভাজা থাকত বেগুনের সময়। মাছের কালিয়া, কখনও পোলাও, খাসির মাংস, দই, দরবেশ, রসগোল্লা বা সন্দেশ। মোটামুটি প্যাটার্নটা এরকমই। বড়লোকের বাড়ির মেনু নিশ্চয়ই আলাদা রকম। চিত্রা দেব কৃষ্ণনগরের মহারাজ সৌরীশ চন্দ্র রায়ের ‘পাকা দেখা’ অনুষ্ঠানের একটা মেনু পেয়েছিলেন। তাতে দেখা যায়— পাঁচ রকমের পোলাও, মাছের আট রকম পদ। যেমন রুই পেটি, ভেটকি ফ্রাই, রুই দমপোক্ত, কই পাতুরি, চিংড়ি মালাইকারি, ভেটকি ক্রুকেড, দই মাছ, মাছের অম্বল।
মাংসের পদ থাকত পাঁচ রকম। মুরগির মাংস বিবর্জিত। উচ্চবর্ণ হিন্দু বাড়িতে সাধারণত মুরগির মাংস ঢুকত না। নিরামিষ তরকারির ছিল বারোটা পদ। কয়েকটা বলি। কুমড়োর হুসেন শা, লাউ রায়তা, ফুলকপির জামাইভোগ, ফুলকপির মোগলাই কারি, বাঁধাকপির বুক ধড়ফড়ি, ফুলকপির রোস্ট, পাঁপড় কারি, মোচার চপ, বাঁধাকপির মির্জাপুরী, আলুর জয়হিন্দ। সেসময় (১৯৪২ থেকে ১৯৫৭) নানা রকমের ‘জয়হিন্দ’ হত। কলকাতার একটা দোকানে ‘জয়হিন্দ’ সন্দেশ সেদিনও পাওয়া যেত। সেই বরফি সন্দেশের তিনটি স্তরে তিনটি রং থাকত। গেরুয়া, সাদা, সবুজ। চিত্রা দেব শেষপাতের মিষ্টির যে তালিকা দিয়েছেন— তাতে দেখি দিগনগরের দেদো মন্ডা, স্বরূপগঞ্জের পানতোয়া, মুড়াগাছার ছানার জিলাপি, বর্ধমানের সীতাভোগ, বহরমপুরের ছানাবড়া, বেলডাঙার মনোহরা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া, দ্বারিকের গোলাপ সন্দেশ, ও কালাকন্দ, নবদ্বীপের বেদানাবোঁদে, শান্তিপুরের নিখুঁতি, কালীগঞ্জের রসকদম্ব।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই, শোভাবাজার রাজবাড়ির ছেলে কেশবেন্দ্র দেবের বিয়ের মেনুকার্ডে ৩৬ রকম খাবার দেখতে পাই। তাদের লিস্টি দেবার লোভ সামলানো গেল না—
১| লুচি ২| ডালপুরি ৩| পদ্মলুচি ৪| গুজরাতি ভর্তা ৫| পুরি ৬| হোসনি কাবাব ৭| ছোঁকা ৮| মোগলাই কোর্মা ৯| চন্দ্রকলা ১০| মুগ মনোহর ১১| কোপ্তা কারি ১২| পাঁপড়ের ডালনা ১৩| মালাইকারি ১৪| কচুরি ১৫| বাদশাহি ভোগ ১৬| খিরের খড়ুই ১৭| রায়তা ১৮| সন্ধানিকা ১৯| ফুলকপির রায়তা ২০| মিঠে গোলাপি চাটনি ২১| বিপ্রভোগ ২২| সোহন মোহন ভোগ ২৩| সমসা ২৪| কমলালেবুর সন্দেশ ২৫| গোলাপী পেঁড়া ২৬| আবার খাবো ২৭| ক্ষীরের মালপো ২৮| সরপুরিয়া ২৯| সরভাজা ৩০| বরফি ৩১| বেসনের লাড্ডু ৩২| বাদামের বরফি ৩৩| পেস্তার বরফি ৩৪| মোরব্বা ৩৫| চাটনি ৩৬| ফল
ঠাকুরবাড়ির লোকেরা যথার্থ ভোজনরসিক ছিলেন। নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হতেন না। ঠাকুরবাড়িতে পাকা আম ভাতে, পাকা পটলের টক, কাঁচা ও কচি তেঁতুলের ঝোল, বেগুন ও কাঁচাকুলের টক, তিল বাটা দিয়ে কচি আমড়ার অম্বল রান্না হত। রবি ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী পাকা আমের মিঠাই বানাতেন। শেষপাতে দই ও সন্দেশ অপরিহার্য ছিল। মিষ্টির নানারকম নামও দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একবার একটি মিষ্টি খেয়ে নাম দেন ‘এলোঝেলো’, পরে বদলে রাখেন ‘পরিবন্ধ’। অবনীন্দ্রনাথ যে লাইব্রেরি থেকে রান্নার বই বার করে রীতিমতো রান্নার ক্লাস খুলেছিলেন, সে কথাও তাঁর দৌহিত্র মোহনলাল লিখে গেছেন। অবন ঠাকুরের রাঁধুনি রাধুকে নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা চলত। প্রচলিত প্রথাকে বদলে দেওয়া হত। পেঁয়াজ প্রথমে ভাজার হলে তাকে শেষে ভাজতেন। শেষে সাঁতলাবার জিনিস প্রথমেই সাঁতলাতেন। যাকে ভাজতে হবে তাকে সিদ্ধ করতেন। এই প্রথাতেই তিনি ‘মুরগির মাছের ঝোল’ আর ‘মাছের মাংসের কারি’ আবিষ্কার করেন। সেই ক্লাসেই একদিন কবি জসীমুদ্দিন এসে অপূর্ব ‘জোসী কাবাব’ বানালেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কয়েকটি রান্না আবিষ্কার করেছিলেন। সে রান্নার কথা একটি খাতায় লেখা হয়ে তাঁর বড়ো মেয়ের কাছে ছিল। বড়ো মেয়ে মারা যাওয়ায় সে খাতাও হারিয়ে যায় চিরকালের মতো। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর রান্নার উৎসাহ ছিল দেখার মতো। তাঁর একটি খাতায় নানা বিদেশের রান্না নিজের হাতে লিখে রাখতেন। সেসব একত্র করে ১৯৮৬ সালে পূর্ণিমা ঠাকুর ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইটি লেখেন।