1 of 2

ডিড ইউ ডু ইট?

ডিড ইউ ডু ইট?

অশেষেরও বিয়ে হয়েছিল মুঙ্গেরে। যদিও অনেক করে বলেছিল কিন্তু আমার পক্ষে বরযাত্রী যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে হাজারিবাগে ফিরেছিল।

আমি মৃন্ময়ের বিয়েতে হাজারিবাগ গিয়েছিলাম বরযাত্রী। মৃন্ময়ের বিয়ে রাঁচির ডুরাণ্ডার এক বড়ো ব্যাবসায়ীর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে হয়। বিয়ের পর ওদের সীতাগড়া পাহাড়ের কাছের বাড়িতে ছিলাম। ওরা দুই ভাই। মৃন্ময় আর মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয়দা আমাদের চেয়ে বয়েসে বেশ বড়ো। বড়ো মানে, বছর দশেকের বড়ো। মৃত্যুঞ্জয়দার বিয়ে আগেই হয়ে গেছিল। তার শ্বশুরবাড়ি ছিল পাটনাতে। বউদির নাম সজনি।

মৃন্ময়ের বিয়ের পর ক-দিন খুবই হইচই হল। বউভাত হল ওদের বাড়ির হাতাতে। মস্ত বড়ো হাতা। তারমধ্যে অনেক ইউক্যালিপটাস গাছ। খুব ভালো ল্যাংড়া আমের গাছ। আরও অনেক ফুল-ফলের গাছ ছিল। সেই হাতাতে শামিয়ানা টাঙিয়ে বউভাত হল। সেই শামিয়ানা আমাদের কলকাতার শামিয়ানার মতো নয়। খুব মোটা কাপড়ের শামিয়ানা, যেমন দিল্লিতে ও গোটা উত্তর ভারতে দেখা যায়। তাঁবুও বানানো হয়েছিল। এক তাঁবুতে খাওয়া, অন্য তাঁবুতে পানীয়র বন্দোবস্ত হয়েছিল। অনেক লোক এসেছিল। খুব ধুমধাম করে বউভাত হল।

অনেক দিন পরে হাজারিবাগ গিয়েছিলাম তাই ঠিক করলাম ক-টা দিন থেকেই আসব। ছেলেবেলার একটা সময় আমার কেটেছে হাজারিবাগে। হাজারিবাগের সেন্ট-জেভিয়ার্স স্কুলে পড়তাম। হস্টেলেই থাকতাম। মৃন্ময়ও পড়ত আমার সঙ্গে তবে ও ওদের নিজেদের বাড়িতেই থাকত। হাজারিবাগকে ঘিরে অনেকই স্মৃতি ছিল শেষ-কৈশোর এবং প্রথম যৌবনের সেইসব দামাল দিনের।

অঘ্রান মাস, মিষ্টি ঠাণ্ডা পড়েছে। একদিন নতুন বউকে নিয়ে হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্কে যাওয়া হল। পার্কের মধ্যে গ্রীষ্মকালেই ঠাণ্ডা থাকে। অঘ্রান মাসে তো ঠাণ্ডা ছিলই। একটা বাস ভাড়া করে ন্যাশনাল পার্ক যাওয়া হয়েছিল সকলে মিলে। বাসে অনেক গান, অনেক পুরোনো কথা, অনেক হাসি। খুবই আনন্দের সঙ্গে আমরা ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে এলাম।

মৃন্ময় তখন কলকাতাতে চাকরি করে সি ই এস সি-তে। ও রাঁচিতে একটা ভালো চাকরি খুঁজছিল। অনেকদিন ধরে। কারণ, হাজারিবাগের কাছেই এক গ্রামে ওদের অনেক জমিজমা ছিল। তার দেখাশোনা করছিল। আমি থাকতে থাকতেই ওর একটা ইন্টারভিউ-এর চিঠি এল। ওকে যেতেই হবে। ইন্টারভিউ রাঁচিতে। হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির চাকরি। মৃন্ময় তার স্ত্রীকে নিয়ে রাঁচি চলে গেল। দিন চার-পাঁচের জন্যে। দ্বিরাগমনও হবে, চাকরির ইন্টারভিউও হবে। দুই কাজই সম্পন্ন করা হবে। মৃন্ময়ের শ্বশুরবাড়িও তো রাঁচির ডুরাণ্ডাতে। ইতিমধ্যে মৃত্যুঞ্জয়দার ট্যুর পড়ল বিহারেরই নানা জায়গায়। উনি একটি বড়ো ওষুধ কোম্পানির সেলস ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর হেড কোয়াটার্স ছিল পাটনাতে। এমনিতেই ভাইয়ের বিয়ের জন্য বেশ কয়েক দিন ছুটি নিয়েছিলেন। তাই তাঁকে যেতেই হল। ছুটি আর বাড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। বাড়িতে রইলাম শুধু আমি আর সজনিবউদি।

মৃত্যুঞ্জয়দার বিয়ে হয়েছিল বছর দশেক আগে কিন্তু কোনো ছেলে-মেয়ে হয়নি। কেন হয়নি, সেটা আমার জানার কথা নয়। সেই না হওয়ার দোষ মৃত্যুঞ্জয়দা না সজনিবউদির তাও আমার জানার কথা ছিল না।

সজনিবউদিকে আমার খুবই ভালো লাগত। মৃত্যুঞ্জয়দার বিয়ের সময়ও আমি রাঁচিতে বরযাত্রী গেছিলাম। এবং বিয়ের রাত্তিরেই সজনিবউদিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। কালোর মধ্যে মিষ্টি চেহারা। বেশ ভালো গান গাইতে পারেন। রবীন্দ্রসংগীত, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ। তার চেয়ে বড়ো কথা, গান খুব ভালোবাসতেন উনি।

মৃত্যুঞ্জয়দা বললেন, খুব ভালো হয়েছে। তুই এখন রয়েছিস, তুই সজনির দেখাশোনা কর। আমি ফিরে আসব দিন সাতেকের মধ্যেই। কিন্তু আমার না গেলেই চলবে না। মৃন্ময় ফিরলে তবে তুই যেতে পারিস।

মৃত্যুঞ্জয়দাও চলে গেলেন আর মৃত্যুঞ্জয়দার ভাই, আমার বন্ধুও চলে গেল রাঁচিতে তার স্ত্রীকে নিয়ে।

আমি যে একা থাকব বাড়িতে সজনিবউদির সঙ্গে—এটা ভেবেই আমার ভয় ভয় করতে লাগল। কারণ, আমি ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত বেশি রোমান্টিক এবং বড়ো ঘন ঘন প্রেমে পড়তাম। আর সজনিবউদিকে তো বিয়ের দিন থেকেই দারুণ ভালো লেগেছিল।

যদিও তখন আমার বিয়ের বয়েস হয়ে গেছিল, প্রেম কাকে বলে তা জানতাম না। এখন যেমন ছেলে-মেয়েরা প্রেম বলতে ভাবে শুয়ে পড়া কারোর সঙ্গে, আমাদের সময়ে সেরকম ছিল না। আমরা অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিলাম এবং প্রেম একটা মানসিক সম্পদ অথবা বিপদ বলেই গণ্য হত তখন।

সজনিবউদি বললেন, খুব ভালো হল। চিন্ময়, (মানে, আমি) থাকবে, ওর গান শুনব, আর ও যা খেতে চায় রান্না করে খাওয়াব।

সজনিবউদির রান্নার হাতও খুব ভালো ছিল। রান্না যে মেয়েদের কতবড়ো গুণ সেটা অনেক মেয়েরা নিজেরাও জানেন না। রান্না করে খাইয়ে অনেক নারী অনেক পুরুষের মন জয় করতে পারেন। তখনও পারতেন, এখনও পারেন। নিজে রান্না করার মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা তখনকার দিনে ছিল না। বরং রান্না করাটাই একটা সুন্দর কর্তব্য বলে মনে করতেন অধিকাংশ নারী এবং রান্না করতে খুব ভালোও বাসতেন।

আমি সকালবেলা উঠে সাইকেল নিয়ে চলে যেতাম হাজারিবাগের ‘পার্ল’ মোটর কোম্পানির কাছে জলের ট্যাঙ্কের নীচে। সেখানে মাছ নিয়ে আসত মাছওয়ালারা। তারমধ্যে অধিকাংশই তিলাইয়া ড্যামের মাছ। বড়ো বড়ো রুই, কাতলা। ছোটোমাছ কমই পাওয়া যেত। যতক্ষণে বাজার করে ফিরে আসতাম ততক্ষণে সজনিবউদি আমার জন্যে জলখাবার করে বসে থাকতেন। আমি ফিরলে আমরা একসঙ্গে খাবার ঘরে প্রাতরাশ সারতাম। জানলা দিয়ে সীতাগড়া পাহাড় দেখা যেত। বেশ উঁচু পাহাড়।

হাজারিবাগ শহরের তিন দিকে তিনটি পাহাড় ছিল। সিলওয়ার, সীতাগড়া আর কানহারি। সীতাগড়া পাহাড়ের ওপর একটি পিঞ্জরাপোল ছিল। তাতে অনেক গোরু-বলদ থাকত এবং সেই গোরু-বলদের লোভে একটি বড়ো বাঘ আস্তানা গেড়েছিল তখন সীতাগড়া পাহাড়ে। সে প্রায়ই পিঞ্জরাপোলের গোরু-বলদ মারত এবং আমি যাওয়ার ক-দিন আগেই, সে একটি মানুষও মেরেছিল। আমি যাওয়ার পরে একটি শিশুকে ধরে খেয়েছিল। সেই বাঘ মারার জন্যে নানা শিকারির দল তখন সীতাগড়াতে যাওয়া-আসা করতেন। মাচা বেঁধে বসতেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত সেই বাঘ মারা পড়েনি।

সীতাগড়া পাহাড়ের নীচ দিয়ে চলে গেছে যে লাল কাঁকরের রাস্তা, সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে সীতাগড়া গ্রামে, সেই রাস্তারই পাশে পাহাড়ি নালার ভিজে বালিতে সেই বাঘের পায়ের দাগ দেখেছিলাম আমি আর সজনিবউদি দুজনেই। কারণ, আমরা প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে নিয়ম করে ওই পথে হাঁটতে যেতাম। ঘন জঙ্গলের মধ্যে গিয়েছিল সেই পথ। দু-পাশে হরজাই জঙ্গল। বাঁ-দিকে সীতাগড়া পাহাড় উঠে গেছিল। অল্প-অল্প শীতের মধ্যে সকালের রোদ এবং বিকেলের রোদ এক আশ্চর্য মায়াময় পরিবেশ তৈরি করত। নানা পাখির ডাক এবং তাদের কলকাকলি, বিশেষ করে সন্ধের আগে আমাদের মুগ্ধ করত।

সকালে হেঁটে ফিরে এসে যেতাম মাছ কিনতে। আর সন্ধে নামার আগেই বিকেলের হাঁটা সেরে বাড়িতে ফিরে আসতাম।

একটি কাজের লোক ছিল। তার নাম ছিল ফাগুয়া। তার বাড়ি ছিল সীতাগড়া গ্রামে। সে আসত সকাল আটটা নাগাদ আর চলে যেত রাত আটটা নাগাদ। বাড়ি ফেরার সময় সে খুব ভয়ে-ভয়ে যেত। কারণ সেই রাস্তার দু-পাশেই ছিল সেই, সীতাগড়ার বাঘের আস্তানা। ওর টর্চ ছিল না। সজনিবউদির কাছ থেকে একটা লণ্ঠন চেয়ে নিয়ে হাতে দোলাতে দোলাতে সে চলে যেত গ্রামে।

গ্রামাঞ্চলের মানুষ চিরদিনই ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং শত বিপদ-আপদের মধ্যেও তাদের সেই বিশ্বাসে কোনো চিড় ধরত না। এবং ঈশ্বর-ভরসাতেই তারা বেঁচে থাকত এবং নানান বিপজ্জনক কাজও করত।

ফাগুয়া বলত, বাঘোয়া খা লেনে সে, খা লেগা। কেয়া কিয়া যায়গা? হামারা বাবা ঔর মা বহতই বুঢ্ঢা-বুঢঢি হো গয়া। ঘর যাকে খানা ভি পাকানা হোতা। উন লোঁগোকো দেখভাল করনা পরতা হায়। উসি লিয়ে হামকো যানাই হোগা। যো হোগা সো হোগা।

ফাগুয়ার জন্য আমাদের চিন্তা থাকত কিন্তু যখন পরের দিন সকালবেলায় হাসিমুখে সে আবার এসে হাজির হত তখন তাকে দেখে আমরা খুবই আনন্দিত হতাম এই ভেবে যে, যাক অন্তত কাল রাত্তিরে সে বাঘের হাত থেকে বেঁচেছে।

সজনিবউদি স্নান করে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে বসতেন। রান্নাঘরের লাগোয়া ছিল খাবার ঘর ও একটি খোলা বারান্দা। সেই বারান্দায় একটি কোলাপসেবল গেট ছিল। দিনের বেলা খোলাই থাকত। সেই বারান্দা দিয়ে বহুদূর অবধি দেখা যেত। দূরের পথ দিয়ে ক্বচিৎ ট্রাক বা বাস যেত। বেশিরভাগই গেরুয়া-রঙা টাঁড় জমি। লাল ধুলোয় ভরা। মাঝে মাঝে পুটুস আর লিটপিটিয়ার জঙ্গল। নানা বনজ গন্ধ ভেসে আসত হাওয়াতে। আর যখন হাওয়া থাকত না তখনও সেই গন্ধ থম মেরে থাকত।

মৃত্যুঞ্জয়দা চলে যাওয়ার পরদিনই সজনিবউদি বললেন, গান গাও। আমার ঘরের বিছানার ডান দিকের তাকে গীতবিতান আছে, নিয়ে এসো। তুমি গান গাও, আমি তোমার গান শুনতে শুনতে রান্না করি।

আগেই বলেছি, সজনিবউদির রান্নার হাত ছিল অপূর্ব। এমন ভালো অমলেট বানাতেন যে, সে কী বলব। সে-অমলেটের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় আমাদের টেনিস খেলার ক্যালকাটা সাউথ ক্লাবের আবদুল বেয়ারার অমলেট। ডিম ভেঙে তারমধ্যে কাঁচা দুধ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফেটানোর পর পেঁয়াজ কুচি, কাঁচালঙ্কা কুচি, ধনে পাতা ইত্যাদি দিয়ে সেই অমলেট বানাতেন। সঙ্গে মুচমুচে টোস্ট। কোনোদিন পাটনা থেকে আনানো শিরমাল, তার সঙ্গে আগের রাতের বানানো কাবাব। বেঙ্গল সুইটস-এর মিষ্টি, রাবড়ি। খাওয়া-দাওয়ার কোনো কমতি ছিল না। আর তার চেয়েও বড়ো কথা ছিল সজনিবউদির সান্নিধ্য।

কোনো দিন স্নান করে উঠে খোলা চুল পিঠময় ছড়িয়ে দিয়ে রাঁধতে বসতেন সজনিবউদি। কোনো দিন বা খোঁপা করতেন। বিনুনি করতেন না। কিন্তু আমি খুব পছন্দ করতাম সজনিবউদির বিনুনি করা চেহারাটি। তাই আমার অনুরোধে তিনি মাঝে মাঝে বেণীও বাঁধতেন। বাগান থেকে আমি ফুল নিয়ে আসতাম তুলে। এনে বলতাম, আপনার চুলে একটু গুঁজুন। চুলে ফুল গুঁজলে মেয়েদের মুখের চেহারাটাই পালটে যায়।

সজনিবউদি টিপ পরতেন না। আমি বলতাম, টিপ না পরলে অমন সুন্দর কপালটা যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

আমি একদিন বড়া মসজিদ-এর পাশের বাজার থেকে নানা রঙের টিপ নিয়ে এলাম সজনিবউদির জন্য। এবং বললাম, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে টিপ পরবেন বউদি।

বউদি হেসে বলতেন, এত শখ যদি তোমার দাদার থাকত? সে তো আমার মুখের দিকে ভালো করে তাকায়নি কোনোদিন।

আমি বলতাম, আপনি ভাবেন তাই। দাদা আপনাকে ভীষণই ভালোবাসেন।

কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বউদি বলতেন, তাই বুঝি? তুমি কত বোঝো। ভালোবাসার তুমি কী বোঝো?

আমি বলতাম, ভালোবাসার হয়তো আমি কিছুই বুঝি না কিন্তু ভালো লাগাই তো ভালোবাসা। ভালোলাগা তীব্রতর হলেই তো তা ভালোবাসায় গড়িয়ে যায়। আপনিই বোধ হয় ভালো করে দাদার দিকে তাকাননি। খোঁজেননি আপনার জন্য তাঁর ভালোবাসা আছে কি নেই।

সজনিবউদি বলতেন, কী জানি? সে-ই জানে তার মনের কথা।

স্নান করে ওঠার পর তাঁর গায়ের সাবানের গন্ধ, পারফিউমের গন্ধ ম-ম করত চারদিকে ফুলের গন্ধের সঙ্গে।

বউদি বলতেন, তুমি যাকে বিয়ে করবে সে খুব ভাগ্যবতী।

আমি বলতাম, সে পোড়াকপালি। নইলে আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন? আমার না আছে রূপ, না আছে গুণ, না বড়ো চাকরি করি। আমাকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে?

বউদি হাসতেন আর বলতেন, করবে। করবে। বিয়ের ফুল যখন ফুটবে তখন ঠিকই করবে।

আমি খুবই বুঝতে পারতাম যে, বউদির মনের কোণে আমার জন্যে এক বিশাল ভালোবাসা আছে। কী কারণে আমি জানি না কিন্তু বউদি যে আমাকে বিশেষ পছন্দ করতেন তা তাদের বিয়ের পর পরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবং মৃন্ময়ের বিয়েতে বরযাত্রী আসার পেছনে একটা বিশেষ কারণও ছিল। ইচ্ছে ছিল, কয়েক দিন সজনিবউদির সান্নিধ্যে কাটিয়ে যাব হাজারিবাগে।

বউদি যখন আমার দিকে তাকাতেন তাঁর চোখের মধ্যে কী যেন এক আকুতি দেখতে পেতাম। উনি কী যেন চাইছেন আমার কাছ থেকে। কিন্তু সেই চাওয়াটা যে কী, তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। এই করে দিন যায়। একদিন, দু-দিন, তিনদিন হয়ে গেল। মৃত্যুঞ্জয়দার ফেরার সময় হয়ে আসছে। আর দু-দিন পরেই উনি আসবেন।

সেদিন রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর ফাগুয়া চলে গেলে বউদি আমার ঘরে এসে বসলেন। বসে, বেশি কথা বললেন না। আমার অনুরোধে গানও করলেন না। খালি আমার মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলেন। ফাঁকা বাড়ি। বাড়িতে আর তৃতীয় মানুষ নেই। আমি আর বউদি। সম্পর্কে বড়ো হলেও আমার চেয়ে মাত্র দু-তিন বছরের বড়ো ছিলেন। সেদিন একটা খড়কে-ডুরে শাড়ি পরেছেন। খয়েরি আর সাদা ডুরে শাড়ি। একটা খয়েরি-রঙা ব্লাউজ। খয়েরি-রঙা একগুচ্ছ ফুল গুঁজেছেন চুলে। গলায় একটি টোপাজ অথবা অ্যামেথিস্ট পাথরের মালা। চোখে কাজল, কপালে আমার দেওয়া টিপ। একটি লো-কাট ব্লাউজ পরেছেন। সেই ব্লাউজের মধ্যে দিয়ে তাঁর প্রস্ফুটিত দুটি স্তন উদবেল হয়ে উঠেছে। বউদির দিকে তাকিয়ে আমার যুবনাশ্বর কবিতা মনে পড়ে গেল। সেই বিখ্যাত লাইন দুটি।

বল্কলমুক্ত শুভ্র স্তনদয়সহসা উদ্বেল হল শুভ্র বক্ষময়।

সীতাগড়া পাহাড়তলির নীচের আলো-আঁধারিভরা রহস্যময় প্রান্তরে ঝাঁকি দিয়ে-দিয়ে দুটি টি টি পাখি ডেকে বেড়াচ্ছিল। ডিড ইউ ডু ইট? ডিড ইউ ডু ইট? বলতে বলতে। বউদি বললেন, রাতে বাথরুমে যেতে আমার ভীষণ ভয় করে।

কেন?

ওই বাড়িতে কোনো ঘরেই অ্যাটাচড বাথরুম ছিল না। পুরোনো দিনের বাড়ি। বাথরুমটি একটু দূরেই ছিল। বসার ঘরের লাগোয়া। একটিই বাথরুম ছিল বাড়িতে, যদিও ঘর ছিল তিনটি। বউদির ঘর থেকে সেই বাথরুমে যেতে হলে একটা খোলা বারান্দা দিয়ে যেতে হত। যদিও বারান্দায় কোলাপসেবল গেট ছিল। কিন্তু বারান্দার পরেই বাংলোর হাতা। ঝুপড়ি ঝুপড়ি গাছ। ঝিকমিক করা তারা। চাঁদ থাকলে চাঁদ। ওই পথটি পেরিয়ে কোলাপসেবল গেটটি পার হয়ে পৌঁছোতে হত বাথরুমে।

আমি বললাম, কেন? ভয় করে কেন বউদি?

তিনি বললেন, তুমি জানো না, এ-বাড়িতে ভূত আছে?

সত্যি? এর আগেও তো কতবার থেকেছি এবাড়িতে। কেউ তো বলেনি ভূতের কথা।

আমিই কি সেই ভূত?

বউদি হেসে বললেন, তুমি ভূত হলে তো ভালোই হত। সে ভূতকে আমার ভয় পাওয়ার কী ছিল? কিন্তু এ সে-ভূত নয়। এ ভূত কথা কয় না। ছায়া ফেলে হাঁটে। তাকে দেখা যায় না। তার গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। অতটুকু রাস্তা পেরিয়ে বাথরুমে যেতেই আমার প্রচন্ড ভয় করে। তুমি কি আমার ঘরে শোবে আজ রাতে?

আমি বউদির প্রশ্ন শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই নয় যে আমি সেই প্রস্তাবে প্রচন্ড পুলকিত হইনি। কিন্তু আমার সংস্কার। আমার ন্যায়-অন্যায় বোধ। আমার বিবেক এবং মৃত্যুঞ্জয়দার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা সব মিলেমিশে আমি উত্তরে কী বলব বউদিকে, বুঝতে পারলাম না। তখনকার দিনে কৃতজ্ঞ করার জন্য কোনো মানুষকে বিশেষ কিছু করতে হত না। সম্পর্কের গুণেই সেই কৃজ্ঞতার জন্ম হত। যেহেতু মৃত্যুঞ্জয়দা আমার ছোটোবেলার বন্ধুর দাদা এবং বয়েসের ব্যবধান বেশ বেশি, প্রায় দশ বছর মতো, সেই কারণেই মৃত্যুঞ্জয়দা আমার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম, তাদের বাড়ির প্রত্যেকের কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা আমি পেয়েছি তারজন্যে। যখন আমি হাজারিবাগ সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়তাম এবং হোস্টেলে থাকতাম তখন প্রত্যেক ছুটির দিনে আমাকে মৃত্যুঞ্জয়দাই সাইকেলে করে এসে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। তখন মৃত্যুঞ্জয়দা ও মৃন্ময়ের মা, মাসিমা বেঁচেছিলেন। আমাকে তাঁরা সকলে মিলে খুব আদরযত্ন করতেন। আমাদের পরিবারের সঙ্গে যদিও তাঁদের পরিবারের কোনো রক্তের কিংবা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না। আমার বাবার সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়দার বাবার আলাপ ছিল এইপর্যন্ত। সেইসূত্রে বাবা যখন আমাকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভরতি করেন তখন মৃত্যুঞ্জয়দার বাবাকে অনুরোধ করে গেছিলেন যে ছুটিছাটায় ছেলেকে একটু সঙ্গ দেবেন আপনারা। বাবা, মৃত্যুঞ্জয়দার বাবা মথুর কাকাকেই আমার লোকাল গার্জেনও করে দিয়েছিলেন। যাইহোক সেসব নানা কারণে একটা কৃতজ্ঞতাবোধ আমার মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল। এবং সেইজন্যেই বউদির এই প্রস্তাবে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিলাম। আহ্লাদে আটখানা যেমন হয়েছিলাম, আবার ভয়ে সিঁটিয়েও গিয়েছিলাম।

বউদি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন কী হল? উত্তর দিলে না যে?

চলো আজ রাতে আমরা একঘরে শোব। আমার নতুন বালাপোশ এসেছে জানো, সেজোমামা বহরমপুর থেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

আমি বললাম, বালাপোশ? সে আবার কী জিনিস? কখনো দেখিনি তো?

বালাপোশ দেখোনি? আজকে বালাপোশ আবিষ্কার করবে। আমরা, মানে আমি আর তুমি একই বালাপোশের নীচে শুয়ে থাকব।

শিমুল তুলো পরতে-পরতে ধুনে সেই তুলোর পরতের পর পরত ফিনফিনে মখমলের ওপর জমিয়ে তারও পরতে পরতে আতর লাগিয়ে, ওপরে মুর্শিদাবাদ সিল্কের ময়ূরকন্ঠি-রঙা, অথবা লাল-রঙা, অথবা গাঢ় নীল কিংবা সবুজ-রঙা কাপড় দিয়ে কাঁথার মতো সেলাই করে বালাপোশ বানায় মুর্শিদাবাদের গুণী মানুষেরা। সেইসব শিল্প আতরের শিল্পের মতোই আজকাল আস্তে আস্তে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, তরুণ প্রজন্মের মানুষেরা এসব ব্যাবসায় আসছেনও না আর এইসব জিনিসের ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে দিন দিন। কিছুদিন পরে হয়তো বালাপোশ কিংবা আতর আর পাওয়াই যাবে না। যাইহোক, বালাপোশটি আসা থেকে আমি ব্যবহার করিনি। আজকে রাত্রে ব্যবহার করব, তুমি যখন আমার পাশে শুয়ে থাকবে, আমাকে পাহারা দিয়ে।

আমি কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। এদিকে রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। সেই পাহাড়তলির পাখিগুলো সমানে প্রশ্ন করে যাচ্ছে ডিড ইউ ডু ইট? ডিড ইউ ডু ইট?

একসময় আমি উঠে বউদির সঙ্গে গেলাম বউদির ঘরে। ঘরে ধূপ জ্বলছে। সুন্দর গন্ধ। ফুলদানিতে ফুল রয়েছে। সেই ফুলের গন্ধ, ধূপের গন্ধ এবং বউদির গায়ের পারফিউমের গন্ধ মিলে এক আশ্চর্য আবেশ তৈরি হয়েছে। আমি রীতিমতো রোমাঞ্চিত হলাম। তার পর বউদির খাটেও গিয়ে বসলাম।

বউদি বললেন, তুমি কোন দিকে শোবে? ডান দিকে না, বাঁ-দিকে। তুমি কি কোলবালিশ ব্যবহার করো? করলেও, আজকে তোমার কোলবালিশের দরকার নেই। আমিই তোমার কোলবালিশ হব।

একথাতে আমার আরও উত্তেজনা বাড়ল।

বউদি বললেন, তুমি একটু বোসো, আমি একটু বাথরুম থেকে আসি। এখন যেতে ভয় করবে না। এখন তো বড়ো আলোটাও জ্বলছে বারান্দায়।

বউদি যখন বাথরুমে গেলেন আমি তখন বিবশ হয়ে বউদির খাট থেকে উঠে খাটের পাশে রাখা চেয়ারটিতে গিয়ে বসলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে বউদি ফিরে এলেন। ফিরে আসায় সাবানের গন্ধ আবার তীব্র হল। হয়তো কানের লতিতে ও ঘাড়ে ওডিকোলনও মেখেছিলেন। ওডিকোলনেরও গন্ধ পেলাম যেন, মনে হল। তার পরে আমি বউদির দু-গালে আমার দুই হাতের পাতা রেখে বউদির কপালে এবং দু-চোখে চুমু খেয়ে বউদিকে বললাম, আপনি দুঃখ পাবেন না। আমি অনেক কিছু পারি, আবার পারিও না। তাই আমাকে আপনার সঙ্গে শুতে বলবেন না। এরকমভাবে কিছু পাওয়ার মধ্যে কিছু বাহাদুরি নেই। কারণ, এই পাওয়া আমাকে অর্জন করতে হয়নি। ফাঁকা বাড়িতে দাদা স্থানীয় একজনের স্ত্রীর সঙ্গে শুতে, তাঁরই আহ্বানে, কোনো বাহাদুরির দরকার হয় না, কোনো সাহসেরও দরকার হয় না। কোনো প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হয় না। সেইজন্যেই এই জয় আমার কাছে কোনো জয়ই নয়। আপনি হয়তো দুঃখিত হলেন। আপনার হয়তো অনেক দুঃখ বুকের মধ্যে জমে আছে। আমার মাধ্যমে হয়তো সেই শূন্যতা আপনি ভরাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি অপারগ। আমাকে ক্ষমা করুন বউদি।

তার পর ঘর থেকে চলে আসার সময় বউদির স্তনসন্ধিতে আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে একটি চুমু খেলাম। বউদি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন দু-হাতে। তার পর পাগলের মতো আমার ঠোঁটে চুমুর পর চুমু খেতে লাগলেন। বউদির মুখের জর্দার গন্ধ আমাকে আবিষ্ট করে ফেলল।

তার পর সজনিবউদিকে দু-হাতে ধরে খাটে বসিয়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বললাম, দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিন।

আমি আমার ঘরে ফিরে গেলাম। সেই পাখি দুটো শিশির-ভেজা জ্যোৎস্নাভেজা টাঁড়ে তখন বুকের মধ্যে চমক তুলে ডাকছিল ডিড ইউ ডু ইট? ডিড ইউ ডু ইট?

ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে খোলা জানালার সামনে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বাইরের টাঁড় আর সীতাগড়া পাহাড়ের পাহাড়তলির দিকে চেয়ে বসে রইলাম টি-টি পাখিদের ডাকের মধ্যে।

ভাবছিলাম, অনেক কিছুই করতে খুব ইচ্ছে করলেও করা যায় না। করা উচিত নয়। তা ছাড়া যে একদিন আমার ঘরনি হয়ে আসবে, দেরি করে এলেও আসবে তো নিশ্চয়ই, তার জন্যে কিছু শুদ্ধতা, কিছু বিশ্বাস অবশ্যই রেখে দেওয়া উচিত। নি:স্বতার ওপরে কোনো সম্পর্কই গড়ে তোলা উচিত নয়।

দূরের পাখিগুলোর দিকে চেয়ে, মনে মনে বললাম, বিলিভ মি, আই ডিডনট ডু ইট।

সজনিবউদির জলভরা চোখ দুটি আমার চোখের সামনে ভাসছিল, জানি ভাসবে সারারাত, বাইরের চাঁদের আলোতে ভেসে বেড়ানো পাখিগুলিরই মতো, কিন্তু…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *