১১. আম্মার সন্ধানে
হায়দ্রাবাদ পোঁছে, সেখানকার ডিজি মিস্টার সুন্দরাইয়ার সঙ্গে দেখা করল রিমা। রিমার ডিজি পবিত্র মুখোপাধ্যায় হায়দ্রাবাদের ডিজির ব্যাচমেট , সরকারি চিঠি দিয়েছেন যাতে রিমা ব্যারাইট মাইনসের থানা আর অগ্রমগাগি আউটার এরিয়া অঞ্চলে গিয়ে মায়া পাল ও কংকাল প্রেমিকের মৃত্যুর ক্লু পেতে পারে । রিমা ওনাকে নিজের পরিকল্পনা জানিয়েছে । সিভিল ড্রেসে যাবে গ্রামটায় , শাড়ি পরে, কাঁধে ব্যাগ আর ক্যামেরা ঝুলিয়ে । মিস্টার সুন্দরাইয়া রিমাকে বললেন সতর্ক থাকতে , কেননা অন্যান্য খনিজের খোঁজ পাওয়া গেছে অঞ্চলটিতে । মাইনিং মাফিয়া সম্পর্কে কর্ণাটকের লোকায়ুক্ত জাস্টিস রঙ্গনাথনের পুলিসকর্মীদের অনুসন্ধানের ফলে কর্ণাটকের রাজনীতিতে যথেষ্ট উথাল-পাথাল চলছে। রিমা যেখানে যাবে তা অন্ধ্রপ্রদেশ-কর্ণাটক সীমান্তে, জঙ্গল-ঘেরা উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল । ফলে উগ্র মার্কসবাদী , মাওবাদী আর প্রতিবাদকারী এন জি ওদের সন্দেহ হতে পারে ওকে দেখে। অন্ধ্রপ্রদেশের ডিজি রিমাকে পাঠালেন উপজাতি উন্নয়ন দপতরের সচিবের কাছে , যাঁর কাছ থেকে মাইনস মিনারেলস অ্যান্ড পিপল নামের এন জি ও প্রতিনিধি রুক্মিনী রাও-এর নামে চিঠি নিল রিমা । রুক্মিনীকে সচিব লিখে জানিয়েছেন যে রিমা অগ্রমগাগিন আউটার এরিয়া অঞ্চলে যেতে চাইছে ওর হারিয়ে-যাওয়া কাকা-কাকিমার খোঁজে, যাঁরা দশ বছরেরও বেশি আগে ওই অঞ্চলের উপজাতিদের সঙ্গে থাকতে এসেছিলেন কিন্তু আর বাড়ি ফেরেননি ; তাঁদের সম্পর্কে কানাঘুষা শুনেছেন রিমা যে তাঁরা আর নেই , তাঁদের শেষকৃত্য হয়নি । সচিব ওদের সঙ্গে একজন সরকারী গ্রামকর্মী দিয়েছেন , শিভারামাইয়া, যে দোভাষীরও কাজ করবে ।
রিমার সঙ্গে এসেছে ওর সাবইন্সপেক্টর রজত মণ্ডল । রজতকে নিয়ে রিমা, পুলিসের পোশাকেই, প্রথমে গেল ব্যারাইট খনির থানায় । এখন অবশ্য আকরিক লোহা আর ম্যঙ্গানিজ পাওয়া যাওয়ায় ব্যারাইটের চেয়ে সেগুলোই বেশি তোলা হচ্ছে খনি থেকে। পাঁচ বছরের বেশি পুরানো এফ আই আর রুজু করার রেজিস্টারগুলো ওরা দুজনে, সারা দিন লাইনের পর লাইন দেখেও পেল না কিছু । রিমা রজতকে বলল, এখানেও হয়ত আমাদের মতন মনভোলানো এফ আই আর লেখা হয় , তুই সেইসব লাইনগুলো দ্যাখ যেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে । সচিব যাকে সঙ্গে দিয়েছিলেন, শিভারামাইয়া, তার সাহায্যে ওরা ওই ভাবেই খুঁজতে-খুঁজতে একটা কাটা এনট্রি পেয়ে গেল, একজন মহিলার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার, গ্রাম পঞ্চায়েত অগ্রমগাগি আউটার এরিয়া, ছয় বছর আগের ঘটনা । মায়ালিঙ্গা নামে একজন বাঙালি যুবকের বিরুদ্ধে মহিলাটিকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগ । শুনে রিমা লাফিয়ে উঠল, আরে রজত, এইটাই এইটাই, কংকাল প্রেমিক লিখে গেছে যে ওকে উপজাতিরা সবাই মায়ালিঙ্গা নাম দিয়েছিল।
তারিখ অনুযায়ী মহাফেজখানা থেকে রেকর্ড খুঁজে, নথির ঝুল-ধুলো ঝেড়ে রিমাকে ফাইলের লেখা পড়ে শোনাল শিভারামাইয়া । অগ্রমগাগি আউটার এরিয়া নিবাসী খনি শ্রমিক জনৈক নরসিমহার অভিযোগে পুলিস অগ্রমগাগি গ্রামপঞ্চায়েতের আউটার এরিয়ায় একজন মহিলার আত্মহত্যার সংবাদ পেয়ে সেখানকার শ্মশান থেকে মহিলার শব বাজেয়াপ্ত করে , আর তার স্বামীকে হেফাজতে নেয়। পুলিসের সন্দেহ ছিল যে দম্পতিটি নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এবং লুকিয়ে থাকার জন্যে ওই দুর্গম অঞ্চলে এসেছেন । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ফ্যাক্সে খবর পেয়ে জানা যায় যে তারা দুজনে টার্নওভার ইনকরপোরেটেড নামে একটি বহুজাতিকের উচ্চপদস্হ কর্মী , ইলোপ করে এসেছে , এবং সবায়ের নজর এড়িয়ে সংসার পেতেছে অগ্রমগাগির আউটার এরিয়ায় ; তাদের সঙ্গে রাজনীতির সংস্রব নেই।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টটাও ফাইলে পায় রিমা । ডাকতার লিখেছেন যে কন্ঠের লিগেচার মার্ক গোল না ভি শেপড তা অস্পষ্ট। কন্ঠের সার্ভিকাল ফ্র্যাকচার হয়েছে , যার দরুন স্পাইনাল কর্ডে ট্রম্যাটিক ইনজুরি রয়েছে । শরীরে কোনো আঘাতচিহ্ণ নেই , যদিও সাত-আট ঘন্টা পূর্বের যৌনমিলনের প্রমাণ রয়েছে । পাকস্হলিতে স্বাভাবিক খাবার, কোনো বিষ পাওয়া যায়নি, দেহের বাইরেও কোনো বিষক্রিয়ার চিহ্ণ পাওয়া যায়নি । তিনি সুপারিশ করেছেন যে নাক ও মুখগহ্বরের লালার কেমিকাল অ্যানালিসিস করালে ভালো হয় , কেননা তাঁর সন্দেহ হয়তো কোনো ঘুমের রসায়ন বা ক্লোরোফর্ম পাওয়া যেতে পারে , যদিও অমন বনাঞ্চলে কোনো রসায়ন পাওয়া দুষ্কর । শেষে ডাকতার যোগ করেছেন যে ক্যাডাভার নিয়মানুযায়ী সংরক্ষণ না করার কারণে অটপসি রিপোর্ট সম্পূর্ণ নির্ভুল নয় । সে সময়ের থানা ইনচার্জ, নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা চাপা দিতে লিখেছেন যে ঘটনাটি সুইসাইড , হোমিসাইড নয় ; সেকারণে মিস্টার মায়ালিঙ্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হোক। তাছাড়া পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ডাকতারের সই নিতে ভুলে গিয়েছিলেন থানা ইনচার্জ ।
রিমা রজতকে বলল, এ তো দেখছি আমাদের রাজ্যের চেয়েও কেলো । তারপর বর্তমান থানা ইনচার্জের কাছে জানতে চাইল সেই থানা ইনচার্জ কি বেঁচে আছেন ? তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায় কি ? রিমা জানতে পারল তিনি অবসর নিয়েছেন, অবসর নিয়ে কর্ণাটকে রেড্ডিদের মাইনসে সিকিউরিটি অফিসারের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে রেড্ডিদের দপতরে খোঁজখবর করলে জানা যেতে পারে তিনি এখন কোথায় থাকেন ।
সে আইডিয়া পরিত্যাগ করে রিমা জরুরি কাগজপত্রগুলোর একটা করে সার্টিফায়েড জেরক্স কপি নিল ।
রিমা তাঁতের শাড়িতে আর রজত ধুতি পাঞ্জাবি পরে রুক্মিণী রাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে, তিনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি শুনেছি ঘটনাটা। ওখানে যে মন্দিরটা আছে সেটাই তো আপনার কাকিমা, মানে আম্মার নামে, স্হানীয় লোকেরা বলে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ দেবী । রিমা বলল, শুনেছি আম কলা লেবু পেঁপে ইত্যাদি ফলের বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে হয় , অত্যন্ত সুন্দর প্রাকৃতিক জায়গা ।
রুক্মিণী বললেন, কে বলেছে আপনাকে এই সমস্ত গল্প ? ছিল হয়ত, সেই সময়ে, যখন আপনার কাকা-কাকিমা এখানে থাকতে এসেছিলেন । বাগান-টাগান আর নেই । জঙ্গলও নিশ্চিহ্ণ । নানা খনিজ পাওয়া যাচ্ছে আর উপজাতিদের অঞ্চলগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে । উদারীকরণের উপসর্গ! এখন সোজা গাড়ি করে যাওয়া যায় । শ্রমিকদের জন্যে বাজার দোকান চায়ের স্টল মদের ঠেক ঝুপড়ি গড়ে উঠে জঘন্য হয়ে গেছে এলাকাটা । লোহা-ম্যাঙ্গানিজ মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে এলাকাটা এখন নরক।
ভাড়া-করা প্রায়ভেট গাড়িতে বসে রিমা জিগ্যেস করল , আমার কাকা-কাকিমার গ্রামটা নেই ?
রুক্মিণী জবাবে জানালেন, ওটা গ্রাম কোনো দিনই ছিল না , ওটা গ্রামের আউটার এরিয়া , তুরপু-স্পিকিং ট্রাইবালরা থাকত । এখন এ-আধ ঘর টিকে আছে । বাদবাকি সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে নানা খনিতে শোষিত ও নিপীড়িত হচ্ছে ।
রিমা বোকার ভান করে, যাতে গাড়িতে পথটা গল্প শুনে কাটে, বলল, খনিজের সঙ্গে উপজাতিদের কী করার আছে !
রুক্মিণী স্বরূপে এলেন এবং বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন । ভারতের বনাঞ্চলে বেশিরভাগ থাকেন উপজাতিরা । দুর্ভাগ্যের বিষয় এই সমস্ত অঞ্চল জুড়ে পাওয়া গেছে খনিজ ; ভারতের প্রায় দশ লক্ষ হেক্টরে আছে কয়লা, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, পেট্রলিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, রুপা, ক্রোমিয়াম, লোহা, তামা, সিসা-দস্তা, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, টাইটেনিয়াম, জিক্রনিয়াম, টিন, নিকেল, ফসফেট, জিপসাম, মার্বেল, লাইমস্টোন ইত্যাদি। আপনাদের কলকাতার কতগুণ এলাকা চিন্তা করে দেখুন। আর তা নিয়ে লুটের প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে । অবৈধ খনিতে ছেয়ে গেছে দেশটা এবং এই খনি-মালিকরা এতই শক্তিশালী যে তাদের ঘাঁটাতে গেলে রাজ্য সরকার পড়ে যায় । তাদের লোভ বেড়েই চলেছে ; কোথায় গিয়া থামবে জানি না । চিনের সঙ্গে মুখে-মুখে রাজনৈতিক তুই-তোকারি চলছে অথচ সবায়ের চোখের সামনে দিয়ে ট্রাকের পর ট্রাক খনিজ চোরাচালান হয়ে যাচ্ছে চিনে । সবাই সব কিছু জেনে না জানার ভান করে ঘুমিয়ে আছে ।
রিমা শুনতে শুনতে মাথা নাড়াচ্ছিল ।
রুক্মিণী বলতে থাকলেন, এই খনিগুলোর জন্য দরকার পরিশুদ্ধ করার কারখানা, তার জন্য দরকার বিদ্যুৎ, অর্থাৎ আরও চার লক্ষ হেক্টার । কাগজ খুললেই দেখবেন প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও পুলিস প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে বা খনির যারা ইজারা নিয়েছে তাদের গুণ্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে এদের ওপর । প্রতিবাদকারী কারা ? এই সমস্ত দরিদ্র উপজাতি বা তফসিলি জাতির মানুষ । এই এলাকাটা অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্গত হলেও খনির মাফিয়ারা মূলত কর্ণাটকের — তাও এক প্রশাসনিক সমস্যা ।
আপনাদের ভূমিকা কী , জানতে চাইল রিমা । রুক্মিণী বললেন, আমরা আর কী করব , তিনটি ফ্রন্টে লড়াই করছি । প্রদূষণের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, আর শ্রমিকদের স্বাস্হ্যরক্ষার দেখাশোনার তদারকি করতে । এতো স্ট্রং লবি যে আমরা প্রায় অসহায় ।
অগ্রমগাগি আউটার এরিয়ায় পৌঁছে অনুসন্ধানী সূত্রের মুখ খুলল রিমা । রুক্মিণীকে জিগ্যেস করল, সেই সময়ের কেউ আছেন কি এই অঞ্চলে ? রুক্মিনী বললেন, চলুন খুঁজে দেখি, কয়েকজনকে পাওয়া যাবে নিশ্চয় , যারা তখন কিশোর-কিশোরী ছিল । তবে তারা আপনার কাকা-কাকিমার সংস্পর্শে এসেছিল কিনা তা ওদের দেখা মিললে জানা যাবে ।
পাওয়া গেল বালু আর সিরিসৈলম নামে দুজন শ্রমিককে, অনেককে জিজ্ঞাসা করার পর । তারা এখন যুবক । তাদের মনে আছে মায়াগারু আর আম্মাকে। খনির প্রসার বোধহয় সর্বভারতীয় হিন্দির জগাখিচুড়িরও প্রসার ঘটিয়েছে । ওদের হিন্দি বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না । স্মৃতিচারণ করতে -করতে বস্তুত তারা কেঁদে ফেলল । আম্মা আর মায়ালিঙ্গার যে কাহিনি ওরা চায়ের ঠেকে বসে শোনাতে লাগল, তা রিমার জানা ; তবু ওদের তরফ থেকে গল্পটা শুনল।
বালু বলল, আম্মা বলতেন মাছ-মাংস ডিম দুধ খাওয়া পাপ । প্রকৃতি কত ফলমূল দিয়েছে, তবুও মানুষের আশ মেটে না । আম্মা প্রতিদিন কুয়োতলায় যেতেন বাচ্চাদের কোলে নেবার জন্য , বাচ্চাদের কী ভাবে সুস্হ রাখা যায় তা মা-বউদের বোঝাবার জন্য । মায়েরা ওনার কোলে বাচ্চা দিয়ে জল তুলত ; ওই তো ওই ছেলেটাকে দেখছেন, ও-ও চেপেছে আম্মার কোলে । সে-সব বাচ্চারা কেউ-কেউ বলে যা তারা আম্মার গায়ের গন্ধও মনে রেখেছে আর কখনও ওই গন্ধ পেলে দূর থেকে বলে দিতে পারবে যে আম্মা আছেন কাছে-পিঠে ।
ওরা দুজনে রিমাদের নিয়ে গেল আম্মার মন্দিরে। রিমা দেখল কংকাল প্রেমিক বর্ণিত চালাবাড়ি আর নেই, তার সামনের কাঁঠাল গাছটিও আর নেই । চালার জায়গায় মন্দির ; মাটির ছিল আগে । যিনি আসেপাশের এলাকার খনিগুলোর ঠিকেদারি নিয়েছেন, তিনি দয়া করে ইঁট-সিমেন্ট-পাথর দিয়ে তৈরি করিয়ে দিয়েছেন , চিরাচরিত দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের আদলে : ভেতরে কালো কুচকুচে কোনো দেবীমূর্তি, সিঁদুরে-সিঁদুরে লাল । সিরিসৈলম জানাল, মূর্তির তলায় আম্মার চুল পোঁতা আছে ; জাগ্রত দেবী , দূর-দূর থেকে মানুষ এখানে মানত করতে আসে , কেননা আম্মার কাছে কিছু চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না ।
রিমা মানত করল, কংকাল প্রেমিকের কেসটা যেন তাড়াতাড়ি সুরাহা হয় , জানা যায় যে ওটা সুইসাইড না হোমিসাইড । মন্দিরের, মূর্তির, বালু-সিরিসৈলমের, এলাকার দোকানপাটের কয়েকটা ফোটো তুলে নিল, প্রমাণ হিসাবে কাজে লাগতে পারে ।
কলকাতায় ফিরে রিমা জানতে পারল যে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ থেকে খোঁজখবর করে টার্নওভার ইনকরপোরেটেড কর্মীদ্বয়ের সংবাদ অন্ধ্র পুলিসকে পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার । অন্ধ্র সরকার মৃত মায়া পালের মুখের ফোটো আর কংকাল প্রেমিকের ফোটো পাঠিয়েছিল ফ্যাক্স করে, মায়া পালের মৃত্যুর কেসের তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারই সূত্র ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই দুজনের খবর যোগাড় করেছিল । ফোটোগুলোকে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের নথিতে খুঁজে পেল না। ওদের কমপিউটারে কেবল রেকর্ডটুকু রয়েছে । ভাগ্যিস কমপিউটারে রয়েছে নয়তো খুঁজা বের করা যেত না পচা ফাইলের ধুলোমাখা পাহাড় থেকে । ডিলিং ক্লার্ক জানাল, অত পুরানি নটি রাখা সম্ভব নয়, প্রতিদিন এত খোঁজখবর যোগাড় করতে আর তার রেকর্ড রাখতেই ডিপার্টমেন্ট হিমশিম খাচ্ছে । তাছাড়া এ-ধরণের কেস ওদের ডিপার্টমেন্টের নয় । মিসিং পার্সনস বিভাগ ওটা স্পেশাল ব্র্যাঞ্চে পাঠিয়ে নিজেদের কাজ হালকা করেছিল ।
প্রথম ইনভেসটিগেটিং অফিসার সুমন মিশ্র যদি স্পেশাল ব্র্যাঞ্চে খোঁজ নিতেন তাহলে তদন্তে এগিয়ে যেতে পারতেন । হয়তো ফোটোদুটোও পাওয়া যেত । টার্নওভার ইনকরপোরেটেড অফিসের ঠিকানা টেলিফোন ডিরেকটরিতে পাওয়া গেল না। বাড়িতে বসে গুগল সাচহ করে রিমা জানতে পারল যে মার্কিন কোম্পানিটা কেরানি আন্দোলনের ধাক্কায় কলকাতার পাত্তাড়ি গুটিয়ে দিল্লি চলে গেছে । অগত্যা দিল্লি পাড়ি মারতে হল রিমা আর রজতকে , অনুমোদন নিয়ে।
দিল্লিতে টার্নওভার ইনকরপোরেটেড-এর রিসেপশানিস্ট মিস সিমরন খান্না পুলিসের পোশাক দেখে ওদের দুজনকে দিয়ে রেজিস্টারে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে, গলায় ইলেকট্রনিক এন্ট্রিপাস ঝুলিয়ে, নিয়ে গেলেন লিয়েজঁ অফিসারের কাছে । তিনি বসতে বললেন, চা খাওয়ালেন, কমপিউটারে কিছু পেলেন না, হার্ড ডিস্কে নেই। পাঁচ বছর আগের সিডির গোছা নিয়ে এলেন এবং তা থেকে একটা বেছে নিয়ে, দেখে, এক সময় বললেন, হ্যাঁ, শ্রীমতী মায়া পাল, বিজনেস ডেভেলাপমেন্ট এগজিকিউটিভ আর নিরঞ্জন দত্ত প্রোজেক্ট ফোরকাস্ট অ্যাডভাইজার, দুজনেই ছিলেন কলকাতা অফিসে । মায়া পাল আর রিপোর্ট করেননি ; তাঁকে প্রদত্ত টাকা পাঠানো হয়েছিল বাড়িতে, যা ফেরত আসে ওই ঠিকানায় তিনি না থাকায় ; যাঁরা ওই ঠিকানায় ছিলেন তাঁরা নিতে অস্বীকার করেছিলেন। নিরঞ্জন দত্ত চার বছর পর ডাকযোগে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিলেন , যদিও ওনার সার্ভিসেস ছয় মাস রিপোর্ট না করায় টার্মিনেট করে দেয়া হয়েছিল। ওনাকে ওনার দেয় প্রথমে ফেরত এসেছিল, তা পরে আবার ডাকযোগে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
রিমা দুজনেরই কলকাতার ঠিকানা নিয়ে নিল , মোবাইল নম্বর নিয়ে নিল; ওদের সংগ্রহে ফোটো ছিল, তার কালার জেরক্স তো নিলই, নিজের মোবাইলে ফোটোও তুলে নিল। ঠিকানা থেকে প্রমাণিত যে নিরঞ্জন দত্তই কংকাল প্রেমিক। দুজনের ফোটো দেখে রজত বলল , একেবারে এক দুজেকে লিয়ে জুটি ; এখানেই ঘর করতে পারত, তা নয়, মগজে পোকা ঢুকিয়ে ওনারা চলে গেলেন নন্দনবাগিচায়।
ঠিক বলেছিস, মোটামুটি ভালই দেখতে ছিল মায়া পালকে , আর কংকাল প্রেমিক তো বেশ হ্যান্ডসাম । চুল-দাড়ি বাড়িয়ে একেবারে যিশুখ্রিস্ট হয়ে গিয়েছিল বোধহয়, স্বগতোক্তি করল রিমা ।
কংকাল প্রেমিককে কি সত্যিই ‘চলুন পালাই’ বলেছিলেন মায়া পাল, নাকি ভাবে-চিন্তে অমন একজন নির্ভরযোগ্য স্বাস্হ্যবান যুবককে বাছাই করেছিলেন ? কে জানে ! এর উত্তর তো ইনভেসটিগেশানের বাইরে । অগ্রমগাগি মাইনসের মন্দিরে আম্মার পাশে হিরোকেও মূর্তি করে রাখা উচিত ছিল, শিব-পার্বতী জুটি । প্রেমের খাতিরে জীবনটাই নষ্ট করে ফেলল বেচারা ।
রজত বলল, আরে মায়া পাল এই হিরোকে বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ করে গেঁথে তুলেছিল, দেখছেন না, ওনার বাড়ি সল্ট লেকে আর হিরো থাকত দমদমে । নিশ্চয় শোভাবাজার বা শ্যামবাজার থেকে মেট্রো চেপে দমদমে গিয়ে অপেক্ষা করছিল ; হিরোকে দেখামাত্র হুক করে তুলেছে, ভেবেদেখার সময়টুকুও দেয়নি । প্রিন্টআউট যতটুকু পড়েছি, হিরোবাবু সুশ্রী মেয়ে দেখলেই গলে যেতেন , আর মায়া পাল তো গলিয়ে দেবার সাক্ষাথ আগ্নেয়গিরি । দিয়েছে এক গরম-পরশ, ব্যাস, হিরো গলে ধোঁয়া।
বলেছিস বটে, মন্তব্য করল রিমা ।
কলকাতায় ফিরে, যে ঠিকানা থেকে মায়া পালের মাইনের টাকা টার্নওভার ইনকরপোরেটেডে ফেরত গিয়েছিল, সেখানে শালোয়ার-কুর্তায় একাই ঢুঁ মারল রিমা ; রজত হাতে থাকুক, প্রয়োজন হলে পরে রজতকে আবার পাঠানো যাবে বাড়িটায় । সল্ট লেকের বাড়িটার গেটে সিমেন্টে আর ভেতরে দরজায় পিতলের চকচকে নেমপ্লেটে বিশ্বদেব পালের নাম দেখে আশান্বিত হয়েছিল রিমা । কিন্তু জনৈইক রোগা, পাকাচুল, ঘড়ঘড়ে-গলা বৃদ্ধ বহুক্ষণ পর দরজা খুলে, প্রশ্ন শুনে বললেন, না, মায়া পাল নামে কাউকে চেনেন না তাঁরা। রিমার অপর প্রস্নের জবাবে বৃদ্ধ জানালেন যে, হ্যাঁ, তিনিই বিশ্বদেব পাল । এই বাড়িতে তাঁরা চার বছর হল এসেছেন । ভেতরে ঢুকে বসতেও বললেন না বৃদ্ধ । ওই কটি কথা বলে বন্ধ করে দিলেন দরজা ।
রিমা ফোনে রজতকে বলল, তুই বিধাননগর মিউনিসিপালিটিতে খোঁজ নে বাড়িটা কার নামে । যদি দেখিস বাড়িটা বিশ্বদেব পালের নামে তাহলে ওদের ল্যান্ডলাইনের লাইনটা পো থেকে ডিসকানেক্ট করে দিস , আর পরের দিন সকালে লাইনম্যান সেজে ভেতরে ঢুকে কথায়-কথায় যতটা পারিস পাল পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিস । আমি পুরানো ভোটার লিস্ট থেকে মায়া পালের ওই বাড়িতে থাকার এভিডেন্স নিয়ে নেবো , অবশ্য উনি যদি এনরোল করিয়ে থাকেন। ধনী মহিলারা সাধারণত নাগরিকত্বের ধারে-কাছে যান না , তাঁদের বিদেশ পালাবার পাসপোর্ট হলেই হল।
রজত বিধাননগর মিউনিসিপালিটির কুড়ি বছরের রেকর্ড থেকে জানতে পারল যে বাড়িটা বিশ্বদেব পালের, প্রথম আবন্টনেই জমি পেয়েছিলেন। সল্ট লেকের স্হানীয় পুজো কমিটিতে রজতের পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিস ছিলেন বলে টেলিফোন লাইন ডিসকানেক্ট না করে রিমাকে নিয়ে তাঁর কাছেই গেল রজত। তিনি মিস্টার মৃগাঙ্কশেখর ব্যানার্জি, বললেন, বিশ্বদেব পাল বিশেষ মেশেন না কারোর সঙ্গে, চাঁদা দিয়েই খালাস, ওনার স্ত্রী নাকি কারোর সঙ্গে পালিয়ে যাবার পর থেকে উনি অমন উদাসীন হয়ে গেছেন । না, পলাতকা স্ত্রীর নাম মৃগাঙ্কশেখর জানেন না । কানাঘুষায় তাঁর যতটুকু জানা আছে, মহিলা নাকি ঘোর শাকাহারী ছিলেন এবং তা নিয়ে ওদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত খিটিমিটি লেগে থাকত । মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বেশ চেঁচামেচি করে ঝগড়া হয়েছিল, আর তার পরেই ওনার ম্যাডাম প্রেমিকের সঙ্গে ইলোপ করে । চেঁচামেচির কারণেই প্রতিবেশীদের কাছে ব্যাপারটা আরও বেশি জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ জানি না; কেউ কি আর ওসব অযথা খোঁচায় ! তবে বিশ্বদেব পালের মেয়ে পুজোয় পার্টিসিপেট করে, সে খুব চটপটে । দক্ষিণ কলকাতার কোথাও ওনার মেয়ের নার্সং হোম আছে । ভালো ডাকতার , এম ডি, অথচ আগে যেখানে পলিক্লিনিক খুলেছিল সেখানে কোনো কারণে পশার গড়ে তুলতে পারেনি, দমদমের ওদিকে কোথাও। ওর লিভ-ইন প্রেমিকের সঙ্গে নাকি ছাড়াছাড়ি হবার ফলে ঠাঁই বদল করে চলে এসেছে , এরকম কানাঘুষা শোনা যায় ।
স্যার, ওনাদের বাড়িতে কি পোষা কুকুর ছিল ? মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে জিগ্যেস করল রিমা ।
না, কুকুর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না । ডাকও শুনিনি । বললেন মৃগাঙ্ক।
বিশ্বদেবের বাড়িতে খোঁজ করার সময়ে কোনো ডাকতারের নেমপ্লেট লক্ষ করেনি রিমা । রজতকে বলল, তুই ওই ডাকতার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে আমায় জানাস ।
বিশ্বদেব পাল মিথ্যা বলল কেন, চিন্তায় আক্রান্ত রিমার সন্দেহ হল যে নিরঞ্জন দত্তকে কংকাল প্রেমিকে পরিবর্তন করায় এনার হাত থাকতে পারে । তবে বিশ্বদেব পাল কি করেই বা জানবে যে মায়া পাল কার সঙ্গে পালিয়েছিল । যার বউ পালায় তার পক্ষে তো পালানো বুয়ের খোঁজখবর করা বেশ এমব্যারাসিং । টার্নওভার লিমিটেড-এর লিয়েজঁ অফিসার তো জানালেন মায়া পাল আর নিরঞ্জন দত্ত সম্পর্কে কেউ তাঁদের অফিসে খোঁজ নেয়নি, কেননা যে-ই তাঁদের অফিসে আসে তাকে রিসেপশানের রেজিস্টারে নাম-ঠিকানা সই করে ইলেকট্রনিক এনট্রি পাস নিতে হয় , অটোমেটিকালি ডাটাব্যাংকে রেকর্ড হয়ে যায় ।
পুরানো ভোটার লিস্টে মায়া পালের নাম পাওয়া গেল না ; বিশ্বদেব পালের নাম আছে । চোখ বুলিয়ে পাতা উলটিয়ে ওনার কোনো আত্মীয়ের নাম পেল না ; হয়তো ওনার মেয়ে তখন স্বামীর বাড়িতে ছিল ।
মেয়ে ? মেয়েটা তাহলে মায়া পালের ; দুধের শিশুকে ফেলে রেখেই পালিয়েছিলেন মহিলা, কংকাল প্রেমিকের সঙ্গে । তার মানে অবনিবনা এমন অবস্হায় পোঁছেছিল যে ভাঙন জোড়া লাগার কোনো সম্ভাবনা আর ছিল না । আবার বিয়ে করেছিলেন কি বিশ্বদেব পাল ? করেননি বলেই মনে হয়। করলে ভোটার লিস্টে নাম থাকত , দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেপুলের নাম থাকত । অবশ্য হালের লিস্ট তো দেখা হয়নি । বিশ্বদেব পালের আঙুলের ছাপ নিয়ে মেলাতে হবে , কংকাল প্রেমিকের বাড়িতে পাওয়া আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিল আছে কিনা ।
খগেনকে কুরিয়ার বয় সাজিয়ে বিশ্বদেব পালের বাড়ি পাঠিয়ে একটা ভুয়ো নিবেশ কোম্পানির কমপিউটার-চিঠি খামে ঢুকিয়ে বিশ্বদেব পালের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছিল রিমা । কিন্তু, নাঃ, যে-কটা আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে বাঙলোবাড়িটায়, তার কোনোটার সঙ্গেই মেলেনি বিশ্বদেব পালের আঙুলের ছাপ । রাজ্য ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোয় রাখা কোনো ক্রিমিনালের আঙুলের ছাপের সঙ্গেও মেলেনি ওই বাড়িটায় পাওয়া ছাপগুলোর কোনোটা। মিললে, অনুমান করা যেত কেউ কাউকে দিয়ে খুন করিয়েছে । তবে বউ পালালে কোনো স্বামীই বোধহয় অমন খুন করাবার রিস্ক নেবে না । বউ পালালে বরং আরেকটা নারিদেহ পাবার সুযোগ ঘটে ।
রিমার দিদি, দশ বছরের আগে যারা পিট বুল কুকুরের বাচ্চা কিনেছে, তাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে এনেছেন । যারা ঠিকানা পালটায়নি তাদের কারোর বাড়িতে পিট বুল কুকুর আর নেই , রজত বাড়ি-বাড়ি খোঁজ নিয়ে জেনে এসেছে । সে-প্রজাতির কুকুর কবেই মারা গেছে জানিয়েছেন তাঁরা , এবং অন্য প্রজাতির কুকুর পুষেছেন, পিট বুল পোষার হ্যাপা এড়াতে । ইনটারনেটে টেলিফোন ডিরেকটরি থেকে আরও কয়েকজন ক্রেতের নতুন ঠিকানা সংগ্রহ করেও কুল পাওয়া যায়নি।
একদিন দুপুরে নিচে থেকে পরিচিত কন্ঠস্বরে কারোর রিমাদি রিমাদি হাঁক শুনে বারান্দা থেকে রিমা দেখল জনৈকা বৃদ্ধার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে রেজাউল। ওপরে ডেকে আনতে রেজাউল বলল, আমাদের গ্রামের পিসি, সবাই খালা বলে ডাকে । তুমি বলেছিলে বাঙলোবাড়ি সম্পর্কে খোঁজ নিতে । তা খালা এককালে ওবাড়িতে কাজ করত ।
বলুন খালা, কী জানেন আপনি ? রিমা জিগ্যেস করল, কাচের গ্লাস ভরা চা আর বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে ।
খালা বললেন, আমি ওবাড়িতে অনেককাল কাজ করিচি গো ; পেরথমে বাবু মারা গেল, তাপ্পর মা মারা গেল, দাদাবাবু আমায় কাজ থেকে ছাইড়ে দিলে । তা উনি অনেক ট্যাকা দিইছেল । বলেছেল, একা বাড়িতে তুমায় দিয়ে কাজ করালে তুমাকেই বদনাম করে যদি, তাই। তাপ্পর তো দাদাবাবু মনের দুঃখে কোতায় চলে গেল ; কত বছর সাধু হয়ে ঘুরল । তাপ্পর একবার গিয়ে দেকি দাদাবাবু ফিরেচে, অ্যাগবারে ন্যাড়া, এই আমি যেমন বুড়ো, তারচে আরো বুড়ো। এক ডাকতারনি আসতো ওঁয়াকে স্যাবা করতে, চশমা-পরা, লাল রঙের মটরগাড়ি চেপে ; সেবারো দাদাবাবু ট্যাকা দিইছেল । তা ডাকতারনি আমায় বললে, তুমি বাপু ঘন-ঘন এসোনি, দেকচোনি দাদাবাবুর শরিল খারাপ । ডাকতার বারণ করেচে , আর যাই কি, আর যাই না। সেই শেষ দ্যাখা ।
ঠিক আছে খালা, আপনি আজ আমার বাড়ি থেকে যান , আপনাকে দরকার । রিমা কিছু টাকা দিল খালাকে, বলল, খালা আপনি কি একা ওই বাড়িতে থাকতে পারবেন ? আপনার ভুতের ভয় নেই তো ? আমি জানতে চাই আপনার দাদাবাবু কী ভাবে মারা গেলেন ।
সেলিমা বেওয়া বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন পারবুনি , ওই বাড়িতে রাজত্ব করিচি এককালে, তা ভুত যদি থাকে তো বাবু বা মা বা দাদাবাবুর ভুতই থাগবে ; তাদের সঙ্গে কতা কইব । বাড়িটায় কত ধুলোজালা পড়েছে, পোষ্কারও করে দেব । ও বাড়ির খুঁটিনাটি আমার জানা । আমি তো ছাতের ওপরে যে ঘরটা আছে সেইটেয় থাগতুম গো । অত বড় বাড়িতে কতদিন একা থেকেচি । বাবুরাব বেড়াতে গেলে আমিই তো থাগতুম।
না না, পরিষ্কার টরিষ্কার এখন করতে হবে না , এখন সব জিনিসপত্র যেখানে যেমন আছে তেমনই থাকুক, খালাকে বলল রিমা । রেজাউলের দিকে তাকিয়ে রিমা বলল, কি রে, খালা এই বয়সে একলা থাকতে রাজি আর তুই টাটকা যোয়ান ছেলে হয়ে ভয় পাচ্ছিস ।
রেজাউল: আমি আবার কোথায় ভয় পেইচি। ও তো খগেনদা বলেছি।। আমার ভুতের ভয়টয় নেই।
রিমা খালা আর রেজাউলকে বুঝিয়ে দিল যে কেউ যেন জানতে না পারে যে তারা ওই বাড়িতে রয়েছে। সন্ধ্যা হবার পর আলো না জ্বেলে লক্ষ্য রাখতে হবে যে কোনো লোক বাড়ির কাছাকাছি আসছে কি না ; যদি আসে তাহলে সে কি করছে । এখন আমি কেবল সন্দেহ করছি । পরে দেখা যাবে তাকে বা তাদের ধরা যায় কি না । পরের দিন সকালে এসে আমায় জানালেই হবে ।
খালা আর রেজাউলকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে বাঙলোবাড়িতে পৌঁছে দিল রিমা ; দেখিয়ে দিল কোন ঘরে ওরা থাকবে আর কোন-কোন ঘরে ঢুকবে না ।
তারপর বাড়ি ফিরে ভাবতে বসল । এই ডাকতারকে কি করে খুঁজে বের করা যায় ? লাল রঙের গাড়ি ; কে নাজে , এখন হয়তো বেচে দিয়ে থাকবে । কোনো ডাকতারের নাম পিট বুল ক্রেতার তালিকায় আছে চোখ বোলাতে বোলাতে বিনোদিনী পাল নামে এক ডাকতারের নাম পেল রিমা । কিন্তু কেনেল ক্লাবের রেজিস্টারে দেয়া ঠিকানাগুলোতে ওনার নাম নেই । কোথায় গেলেন ? বিদেশে পাড়ি মারলেন নাকি !
রজতকে দিয়ে মেডিকাল অ্যাসোশিয়েশান থেকে বিনোদিনী পালের চেম্বারের ঠিকানা যোগাড় করে টেলিফোনে বাসন্তী নস্করের নামে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল রিমা । নির্ধারিত দিনে ও সময়ে শাঁখা-সিঁদুর আর সস্তা প্রিন্টেড শাড়িতে গৃহবধু সেজে , রজতকে ধুতি পাঞ্জাবিতে স্বামী সাজিয়ে হাজির হল ডাকতারের কসবাস্হিত নার্সিং হোমে । বাসন্তী নস্করের পিঠে অসহ্য ব্যথা , স্বামীর মুখ কাঁচু-মাচু, কেননা মোটা ফিস আগেই জমা দিতে হয়েছে । ডাকতার পরীক্ষা করলেন বাসন্তী নস্করকে । বাসন্তী আর ওর স্বামী পরীক্ষা করতে লাগল বিনোদিনী পালের চেম্বারটা । ডাকতার তো প্রেসক্রিপশান লেখার সময়ে আঙুলের ছাপ দিয়ে দিয়েছেন ।
বাসন্তী বলল, ডাকতারবাবু, আপনার চুলের ক্লিপটা আমায় দিন না, আমার অনেক দিনের শখ অমন একটা ক্লিপের , ওকে বলি তো কিনে দেয় না ।
বিনোদিনী পাল অবাক-চোখে তাকালেন বাসন্তী নস্করের মুখের দিকে । বললেন, সত্যই চাই ? এটা তো বেশ পুরানো । আচ্ছা নিন, আমার কাছে অন্যান্য রঙের এই রকম ক্লিপ আছে । হাসিমুখে ক্লিপটা দিয়ে দিলেন বিনোদিনী পাল।
দেয়ালে টাঙানো কুকুরের ফোটো দেখে বাসন্তীর স্বামী জানতে চাইল, ডাকতারবাবু, কুকুরটার মুখ চামড়ার জাল দিয়ে বাঁথা কেন ? আপনার কুকুর ? মাদি কুকুর ? বাচ্চা হলে কি করেন ? কেমন যেন বিটকেল চেহারা কুকুরটার !
ফোটোর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে ডাকতার বললেন , হ্যাঁ, আমার কুকুর , ভয়ানক হিংস্র এই পিট বুল কুকুররা , তাই বাড়ির বাইরে বেরোলে মুখে মাজল পরিয়ে বেঁধে রাখতে হয় । তবে কুকুরটা মারা গেছে কয়েকবছর আগে ।
বাসন্তী জানতে চাইল, কুকুরের কী নাম রেখেছিলেন গো ডাকতারবাবু ? কী খেতে দিতেন ?
বিনোদিনী পাল বললেন, ওর নাম রাসকেল , মাংস ছাড়া কিচ্ছু খেতো না ।
রাসকেল ? খুব ভালো নাম তো ! প্রেসক্রিপশানের ওষুধ বুঝে নিয়ে বললে বাসন্তী ।
বিনোদিনী পালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নার্সিং হোমের চত্বরে কোনো লাল গাড়ি দেখা গেল না ।
চত্বরের বাইরে বেরিয়ে লাল-কালো সুজুকি হায়াবুসার পিলিয়নে বসে, রিমা রজতকে হুকুম করল ফরেনসিক ল্যাবে যেতে । রুচিষ্মিতা ঘোষকে ক্লিপটা দিয়ে বলল, এই ক্লিপে লেগে-থাকা এক-দু গাছা চুলের সঙ্গে সেই ব্রাউন খামে রাখা চুলগুলোর ডিএনএ মিলিয়ে দেখতে । মিলে গেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে আসামী পাকড়াও করা গেছে ।
১২. প্রতিশোধ
বিনোদিনী পালের প্রেসক্রিপশানে, যে-প্রেসক্রিপশান গরিব গৃহবধু সেজে যোগাড় করেছিল রিমা, বিশ্বদেব পালের বাড়ির ঠিকানা ছিল, যা থেকে প্রমাণ হয় যে ওই বাড়িতেই থাকেন উনি । বাসন্তী নস্করের নামে যে প্রেসক্রিপশান রিমা নিয়েছিল তার সঙ্গে দীপ্যমান গোস্বামীর মেয়ের প্রেসক্রিপশানের সই আর হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার জন্য রাজ্য হস্তলিপি বিশারদকে দিয়ে একটা রিপোর্ট নিয়েছে রিমা । উনি ওনার রিপোর্টে বিস্তারিত দেখিয়াছেন যে কী ভাবে দুটির হাতের লেখা আর সই যে একই ব্যক্তির তা প্রমাণ হয় ।
প্রেসক্রিপশানে বিনোদিনী পালের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে বাংলোবাড়িতে পাওয়া আঙুলের ছাপগুলো ।
রুচিষ্মিতা ঘোষ ওনার ফরেনসিক রিপোর্টে জানিয়েছেন যে ক্লিপের চুল ও ব্রাউন খামে রাখা চুলের ডিএনএতে বংশগত মিল আছে ।
বাঙলোবাড়ির বাগানে রাতের বেলায় একজন পেস্টিসাইড স্প্রে করতে এসেছিল তা জানা গেছে । রুচিষ্মিতা ঘোষ পিঁপড়ে মারার যে কেমিকাল উল্লেখ করেছেন, সেই কেমিকালের স্প্রে করানো হচ্ছিল। পেস্টিসাইড কোম্পানির সঙ্গে বিনোদিনী পালের কন্ট্র্যাক্টের কপি পাওয়া গেছে ।
বিনোদিনী পাল একটা পিট বুল কুকুর কিনেছিলেন , তার কাগজপত্রের কপি যোগাড় করা হয়েছে।
ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজিস্ট রিপোর্ট দিয়েছেন যে কংকালের দেহের দাগগুলো কুকুরের কামড়ের । কুকুরের কংকালের দাঁতে নিরঞ্জন দত্তের ডিএনএ পাওয়া গেছে ।
প্রাথমিক তথ্যগুলো ডিজির সামনে উপস্হিত করে রিমা অনুরোধ করল যাতে বিশ্বদেব পালের বাড়িতে পুলিসের একটা টিম পাঠিয়ে হত্যা সংক্রান্ত প্রমাণগুলো সংগ্রহ করা যায় ।
সিজার ওয়ারেন্ট নিয়ে থানার বর্তমান ওসি বিশ্বম্ভর শূর আর তাঁর সঙ্গী চারজন কন্সটেবল আর রজতকে সঙ্গে নিয়ে ঢুঁ মারল রিমা । বিশ্বদেব পাল দরোজা খুলে বন্ধ করে দেবার আগেই বিশ্বম্ভর ওয়ারেন্টের কপিটা দিয়ে একপ্রকার জোর করেই ঢুকে পড়ল। বিশ্বম্ভর বিশ্বদেবকে বলল, আসুন বিশ্বদেববাবু, আপনার মেয়ের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আছে , আমরা যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে ফেলেছি।
বিশ্বদেব পাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হ্যাঁ, আমার মেয়ে যে এইরকম কিছু একটা করার জন্যে তৈরি হচ্ছে তা আমি আঁচ করেছিলাম।
রিমা জিগ্যেস করল, তাহলে মায়া পালই আপনার স্ত্রী এবং বিনোদিনী দেবী আপনার আর মায়া পালের মেয়ে ?
হ্যাঁ, স্তিমিতকন্ঠে বললেন বিশ্বদেব।
১৩. বিনোদিনী পাল
বিনোদিনীকে লিখে জানানো হয়েছে যে প্রেমিক কংকালের অতীত সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে গেছে, এবং তিনি সকাল এগারটায় পুলিসের সদর দপ্তরে এলে তাঁকে সেই সমস্ত তথ্য জানানো হবে। রিমা টেলিফোনে অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিল যে বিনোদিনী যদি সময়মত না আসেন তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে । পুলিসের কয়েকজন উচ্চপদস্হ আধিকারিক তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। সেই মত পুলিসের দপ্তরে ঠিক সময়েই পোঁছে গিয়েছিলেন বিনোদিনী পাল, এম ডি। কিন্তু তথ্যসমূহ তাঁকে দেখাবার পরিবর্তে সমবেত পুলিস অফিসারদের কাছে, বিনোদিনীর উপস্হিতিতে রিমা খান শুরুতেই অভিযোগ করেন যে প্রেমিক কংকালের রহস্যের ব্যাপারে বিনোদিনী যথেষ্ট অবগত , এবং রিমার কাছে যে-সমস্ত প্রমাণ রয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রেমিক কংকালের হত্যায় তাঁর হাত আছে।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের উচ্চপদস্হ আধিকারিকরা ছাড়াও সেখানে উপস্হিত ছিলেন অন্ধ্র আর কর্ণাটকের পুলিস ডিজিপি, ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট মনসুর হামিদ, ফরেনসিক অ্যস্টৌলজিস্ট শ্রী উপাধ্যায়, ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ, ডক্টর ওহদেদার, ডক্টর কাকলি সোম, ডক্টর অনিল পাসেলকর প্রমুখ।
বিনোদিনী হঠাৎ উঠে দাঁড়ান, আর মিথ্যা কথা বলে তাঁকে ডেকে আনার জন্য রিমার উর্দির কলার চেপে ধরেন, ইংরেজিতে অশোভন উক্তি করতে থাকেন রিমার উদ্দেশ্যে । প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের আই জি তাঁকে শান্ত হতে বলেন, বিনোদিনী চেয়ারে বসলে এক গ্লাস জল এগিয়ে দেন । এডিজি উপস্হিত দুজন কন্সটেবলকে বলেন দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে ।
এসএসপি ওনার পেশাদার পুলিসি কন্ঠস্বরে বিনোদিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমাদের কাছে আপনার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে আমরা আপনাকে এখনই গ্রেপ্তার করতে পারি, কিন্তু পুলিস চায় না যে আপনার সুনাম ক্ষুন্ন হোক । এই কেসে আপনার ভূমিকা যদি খোলসা করেন তাহলে আপনারই মঙ্গল।
ঘরে প্রায় দশ মিনিটের স্তব্ধতা । রিমা এবং তার উর্ধতন অফিসাররা জানেন যে অপরাধীকে সামলে নেবার জন্য সময় দেয়া উচিত। অপরাধী কী বলে, না-বলে, তা তাকে বুঝে ওঠার জন্য জরুরি । দশ মিনিট পর অর্ধেক গ্লাস জল খেয়ে ডক্টর বিনোদিনী পাল, এম ডি ধীর-স্হির অথচ চাপা গলায় বলা আরম্ভ করলেন, যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন তিনি ।
মিস্টার পালের ভাইরাল ফিভার হয়েছিল বলে আমাকে কল দিয়েছিলেন । ভাইরাল ফিভারের ট্রিটমেন্টের জন্য উনি আমাকে বলেছিলেন প্রতিদিন সকালে এক বার ভিজিট দিতে । উনি সেরে উঠছিলেন, কিন্তু বার্ধক্যেও উনি নারীসঙ্গ চাইছিলেন । নারীসঙ্গ বলতে আমি যৌনতার কথা বলছিনা । উনি নৈকট্য চাইছিলেন। যৌনকর্মের উপযোগী ছিলও না ওনার কাহিল শরীর । তবে উনি ধারণা করে থাকবেন যে আমি ওনার শেষ প্রেমিকা , তাই আমাকে শিষনি বলে ডাকতেন । আমার সঙ্গে উনি ওনার অতীত জীবনের গল্প করতেন । আমার পদবি পাল দেখে উনি প্রথমবার আমার চেম্বারে এসেছিলেন প্রস্টেটের সমস্যা নিয়ে । আমি জেনারাল ফিজিশিয়ান , সবরকম রোগিকে দেখি এবং প্রয়োজন হলে স্পেশালিস্টের কাছে রেফার করি । প্রস্টেটের প্রাথমিক স্তর ছিল, একটা কোর্সেই ওনার উপশম হয় ; সেরে যায় বা বৃদ্ধি থেমে যায় বলা ভাল, যদিও রেগুলার ওষুধও প্রেসক্রাইব করেছিলাম , যাতে আবার না সমস্যা দেখা দেয়। সরকারি দপতরের নোংরাটে চিলতে-ওঠা মেঝের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন বিনোদিনী । ক্রমশ আবেগ তাঁকে ঘিরে ধরছিল, যা তিনি ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে-ঘষে সামলাচ্ছিলেন । রিমা দেখছিল বিনোদিনীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল চটির বাইরে বেরিয়ে রয়েছে , অথচ বাঁ পায়েরটা তত বড় নয়, স্বাভাবিক মাপের ।
আমার হাতে সময় থাকত না । উনি মানসিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীনও ছিলেন । আমি তাই ওনাকে বলেছিলাম নিজের জীবন সম্পর্কে যা মনে আসে তা একটু-একটু করে প্রতিদিন লিখে রাখতে । ওনার জীবনে বেশিরভাগ ঘটনাই বোধহয় লজ্জাজনক । উনি লেখা আরম্ভ করলেন তেলেগু ভাষায় । তেলেগু ভাষায় কেন লিখছেন জানতে চাইলে উনি জানান যে সেখানকার এক গ্রামে তাঁর জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল । সেখানে তিনি এক অবিশ্বাস্য আর অলৌকিক জগতে বাস করছিলেন । এক দিন কথা বলতে-বলতে উনি ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে মায়া পাল নামে একজন মহিলার নাম বলেন।
মায়া পাল আমার মায়েরও নাম । আমি আগ্রহান্বিত হই । ওনার বর্ণিত কাহিনি থেকে জানতে পারি , উনি যে মায়া পালের কথা বলছেন , তিনি আমারই মা। আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই । উনি আমার মাকে ফুসলিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন , অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলের ভিতরকার উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে ; তারপর সেখানে আমার মাকে উনি খুন করে লোপাট করে দিয়েছিলেন। আমি ওনাকে জানতে দিইনি যে উনি যাঁর কাহিনি বলছেন , তিনি আমার মা। আমার তখন মাত্র এক বছর বয়স।, যে সময়ে উনি আমার মাকে নিয়ে ইলোপ করেছিলেন । ওনার কাহিনি আমি পুরোটা শুনতে চাইনি । ঘৃণা হয়েছিল আমার । কিন্তু ওনার ভাইরাল ফিভার আবার রিল্যাপ্স করে । তা থেকে ওনার এডিইএম , মানে অ্যাকিউট ডিসএমিনেটেড এনসেফ্যালোমায়েলাইটিস দেখা দেয় । এই রোগ বিরল। আমার মতে ওনার পাপের উচিত শাস্তি । এই রোগে মস্তিষ্কে আর স্পাইনাল কর্ডে ইনফ্লামেশান হয় । অর্থাৎ ওই দুটি অংশে মায়েলিন—নার্ভ ফাইবারের বাইরে রক্ষাকারী আস্তরণ — নষ্ট হতে থাকে । যেকোনো ভাইরাল ফিভার এডিইএম ট্রগার করতে পারে। কেন করে তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই । রোগি সকলপ্রকার সেনসেশান হারিয়ে ফেলতে থাকেন : অসহ্য ব্যথা এবং ক্র্যাম্প আরম্ভ হয় ;প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় । ক্রমশ কোমরের তলাকার অংশে প্যারালিসিস দেখা দেয়। কয়েক দিনের ভেতর রোগি কোমায় চলে যায়।
—রোগিকে কি কোনো ভাল হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত ছিল না ডক্টর বিনোদিনী পাল ? জিগ্যেস করলেন আইজি, অর্থাৎ রাঘবেন্দ্র সিংহ , যাঁর অধস্তন ইন্সপেক্টর বারিদবরণ মণ্ডল সর্বপ্রথম এই কেসের তদন্তে নেমেছিল আর হাল ছেড়ে কেস বন্ধ করে দেবার প্রস্তাব করেছিল।
—ছিল । কিন্তু সে কাজ তো আমার নয় । আমি কেন নিজের টাকাকড়ি খরচ করে অমন সমাজ-সেবা করব ! তাহলে তো প্রতিটি রোগির দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়। আমি প্রতিদিন প্রচুর রোগি দেখি । সবায়ের জন্য আমি দাতব্য খুলিনি । প্রায় দাঁত চেপে সংলাপ উচ্চারণ করলেন বিনোদিনী।
রিমা খান জিগ্যেস করল, ডক্টর পাল, আমার দুটি প্রশ্ন আছে এই সূত্রে । প্রথম এই যে, যেহেতু এই ফিভার ভাইরাস থেকে হয়, ভাইরাসটি কি কোনোক্রমে অন্যের দেহে চালান করা যায় ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, ওনাকে তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে কি উনি সেরে যেতেন ? রিমার প্রশ্নে ডিজি পবিত্র মুখোপাধ্যায় প্রীত হলেন, ওনার মৃদু মাথা নাড়া দেখে রিমাও বেশ লুকোনো গর্ব বোধ করল।
—যেতেন হয়ত, কিন্তু সে-কাজ আমার নয়, আগেই বলেছি। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন বিনোদিনী পাল। রিমার প্রথম প্রশ্নটা চেপে গেলেন ডাকতার মহাশয়া।
—উনি কোমায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে রইলেন, আর আপনি সদর দরজার গোদরেজ ল্যাচ টেনে বন্ধ করে দিলেন ! তারপর গেটে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন । ততোধিক রাগতস্বরে বললেন, এসপি নারায়ণ ঘোষ । রিমার চোখেমুখেও ক্রোধ । ওর ক্রোধ এই জন্যে যে এই কেসের কেন্দ্রিয় চরিত্র একজন মহিলা , এমন ঞইলা যিনি বাড়ির বাইরে কাজ করেন, গৃহবধু নন, ডাকতারি পেশায় যাঁর পুরুষ ডাকতারদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি নামডাক। প্রথম প্রশ্নের উত্তর না দেয়ায় রিমা আঁচ করল যে বিনোদিনী পাল ভাইরাসটি প্রেমিক কংকালের দেহে ঢুকিয়ে থাকবেন। অন্য কেউ এই ভাইরাসের কারণে এডিইএম রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকবে ; কিংবা রোগের বীজ কোথাও সংরক্ষিত ছিল বা আছে।
—বলুন, চুপ করে রইলেন কেন ? জানতে চাইলেন রাঘবেন্দ্র সিংহ, আইজি, যিনি রিমার কাজের দরুণ এই মুহূর্তে কিঞ্চিদধিক চাকুরিজীবি-সুলভ ঠ্যাংদুলুনি-গোমর বোধ করছেন। পুরুষ পিটিয়ে রিমা ওনাকেও দুর্নামের ভাগিদার করেছে। ইংরেজি মিডিয়া তো রিমাকে ভারতের ‘ডার্টি ফেয়ারি’ নাম দিয়েছিল এক সময় ; দেখাদেখি বাংলা মিডিয়া, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ওর নাম দিয়েছে ‘নোংরা পরি’ । রিমা সম্পর্কে জব্বর একখানা প্রোগ্রামও করেছিল সর্বাধিক প্রচারিত চ্যানেল , বিদেশি চ্যানেলগুলো থেকে রোমাঞ্চকর দৃশ্য চুরি করে ঢুকিয়ে।
রিমা বলল, ডক্টর পাল, প্রেমিক কংকাল আপনার মাকে নিয়ে পালাননি । আপনার মা-ই ওনাকে প্রোপোজাল দেন ইলোপ করার জন্য। আমি নিজে গিয়েছিলাম কর্ণাটকের সীমান্তে অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যারেটাইস মাইনস থানায় , যেখানের লক আপে মায়া পালের আত্মহত্যার পর প্রেমিক কংকালকে হেফাজতে নিয়ে রাখা হয়েছিল। কেননা ওই থানার অফিসার ইনচার্জেরো সন্দেহ ছিল যে আপনার মাকে প্রেমিক কংকাল খুন করে কাঁঠাল গাছে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানকার নথিপত্র দেখে যে তথ্য আমি এনেছি, তা হল যে প্রেমিক কংকাল আর আপনার মা সেখানে সুখি সাংসারিক জীবন কাটাচ্ছিলেন, সাংসারিক মানে ওই অঞ্চলের উপজাতি পরিবার যেভাবে জীবন কাটায়। আপনার মা, যাঁকে অগ্রমগাগি আউটার এরিয়ার তুরপু উপজাতির মানুষ সাক্ষাৎ ঈশ্বরী মনে করতেন, সেখানকার গ্রামবাসীদের সাক্ষ্য এবং থানার নথি অনুযায়ী, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন মায়া পাল।
আরও ক্রুদ্ধ, ডাকতার পাল ফুঁসে উঠলেন, বিশ্বাস করি না আপনাদের বানানো গল্প। আপনাদের যদি আমাকে ক্রিমিনাল বলে মনে হয় তাহলে আমায় গ্রেপ্তার করুন আর ফৌজদারি মামলা করুন খুনের । আমার কিছু এসে যায় না । আমি শেষ পর্যন্ত আমার মাকে খুঁজে পেয়েছিলাম, আর আমার মায়ের হত্যাকারীকেও। আমার জীবনের প্রধান লক্ষ ছিল যে আমি আমার মাকে একদিন খুঁজে বের করবই , মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেবোই। আর দয়া করে ওই স্কাউন্ড্রেলটাকে বার-বার প্রেমিক-প্রেমিক বলে উল্লেখ করবেন না । লোকটা মোটেই প্রেমিক ছিল না । জানেন, আমি ওনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে মায়া পালের সঙ্গে কত বছর তিনি সেই গ্রামে কাটিয়েছিলেন । উনি যা উত্তর দিয়েছিলেন তা মুখে আনতেও আমার লজ্জা করছে।
সবাই নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর বিনোদিনী বললেন, উনি বলেছিলেন, সেখানে কোনো বাড়িতে ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার ছিল না, সম্পূর্ণ অশিক্ষিত দলিতদের বসতি । উনি মাসের হিসাব রাখতেন একটি কাঁঠাল গাছে ছুরি দিয়ে দাগ কেটে । আমার মায়ের প্রতিটি পিরিয়ড বা মেন্স উনি গাছে মার্ক করে রাখতেন । উনি আমার মাকে নিয়ে ওই অঞ্চলে ছিলেন, ওনার মার্কিং অনুযায়ী, সাড়ে তিন বছর।
—কিন্তু আপনি আপনার প্রফেশানাল এথিক্স ভুলে গিয়েছিলেন । ক্রোধে অন্ধ হয়ে মৃত্যুর পথে যেতে দিয়েছিলেন একজন রোগিকে, বললেন ডিজি। তাঁর ভাবপ্রখাশে কোনো তারতম্য নেই। তোরপর যোগ করলেন, প্রেম বা আপনার কোনো প্রেমিক সম্পর্কে তো আমরা জানতে চাইছি না ; কংকালটিকে আইডেনটিফাই করার জন্য ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রিমা খান একটা নম-ডি-প্লুম দিয়েছেন। মানুষটি এবং কংকালটির মধ্যে একটা আইনগত পার্থক্য আছে।
ডক্টর বিনোদিনী পালের ক্ষোভে দুঃখে কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ। শ্লেষ্মামাখা স্বরে বললেন, বললাম তো, গ্রেপতার করুন আমাকে । আমি আমার মায়ের আত্মার শান্তির জন্য যা করণীয় তা-ই করেছি।
ডিজি বললেন, আমরা ইনডিয়ান মেডিকাল অ্যাসোশিয়েশানকে যাবতীয় তথ্য পাঠিয়ে দেবো , আপনার রেজিস্ট্রেশান রদ করার জন্য সুপারিশ করব । যা করার তারাই করবে।
রিমা বলল, স্যার, মাঝখানে কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইছি ; আপনি আমার ফাইনডিংসের প্যারা বত্রিশ আর তেত্রিশ দেখুন স্যার । আরও কয়েকটি জিগ্যাস্য রয়ে গেছে । সে-কটা কি উথ্থাপন করব ?
ডিজি বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, কী সেগুলো ? ইনক্রিমিনেটিং কিছু পেয়েছিস ?
নারায়ণ ঘোষ অনুমোদনের সুরে বললেন, হ্যাঁ স্যার, ওটা তো অনেক বেশি জরুরি ; বিনোদিনী দেবীর কী বলার আছে এ-ব্যাপারে তা তো জানি না । পয়েন্ট দুটো দেখেছি। ইন ফ্যাক্ট, রিমা যে পিঁপড়ের প্রসঙ্গ তুলেছে, সেই সূত্রেই কংকালের কথা জানা গিয়েছিল, মানে পুলিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশান জেনেছিল।
ডিজি বললেন, স্ট্রেঞ্জ, আগের অফিসাররা এই পয়েন্টটা লেখেননি নিজেদের ইনভেস্টিগেশান রিপোর্টে। বোঝা গেল যে ডিজি একই সঙ্গে বিস্মিত, বিব্রত ও ক্রুদ্ধ । ওকে, রিমা, বল, তোর কী বলার আছে ।
ডক্টর বিনোদিনী পালের দিকে তাকিয়ে রিমা খান বলল, অনেকটা জেরার সুরে, ডক্টর পাল, আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে একটি পিকনিক পার্টির ছোট্ট একটি মেয়ে, তখন তার বয়স তিন বছর ছিল, এখন তের বছর, সে তার ভাইয়ের সঙ্গে খেলার সময়ে তাদের বল কুড়োতে প্রেনমিক কংকালের বাংলোর পাঁচিলের ধারে গিয়েছিল। মেয়েটিকে পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করে । তার হাতে আর পায়ে সে-দাগ এখনও আবছাভাবে রয়ে গেছে । ইন ফ্যাক্ট তার পিঁপড়ে-ভীতি সারাতে মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নিতে হয়েছিল পরিবারটিকে । এলাকার লোকেদের মুখে ঘটনাটি শুনে আপনি চেম্বারে রোগিদের বসিয়ে রেখে থানার ওসির ডাকে বাচ্চাটির জন্য তৎক্ষণাত ওষুধ দেবার অছিলায় ছুটে ছিলেন ঘটনাটি চেপে দেবার জন্য। পরিবারটি আপনার দ্রুত ঘটনাস্হলে পোঁছে চেম্বারে এনে ওষুধপথ্য করার কারণে কৃতজ্ঞ হয়েছিল। মনে পড়ছে কি ?
ডক্টর বিনোদিনী পালের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না । কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন রিমার দিকে । যেন প্রতিরোধ কমে আসছে তাঁর।
রিমা বলল, স্যার, রিপোর্টের তেত্রিশ নম্বর প্যারায় দেখুন । ডক্টর পাল কিছিদিন প্রেমিক কংকালের বাগানের পরিচর্যা করার ভার নিয়েছিলেন। প্রেমিক কংকালকে কী বুঝিয়েছিলেন, তা আমরা জানি না। তবে প্রেমিক কংকালের মনে সহানুভূতির ভালোরকম কর্নার তৈরি করে ফেলতে সফল হয়েছিলেন। বাগানের তদারকি ডক্টর পাল কোনো মালিকে দিয়ে করাননি ; নিজেই করতেন । তখনই উনি প্ল্যান আঁটেন । বাগানে উনি ডরিলাস ল্যাবিয়াটাস নামের একপ্রকার কারনিভোর পিঁপড়ের আনাগোনা দেখে পিঁপড়ের কলোনিটার কেন্দ্র খুঁজে পান বাঙলোটার বাইরে । ওগুলো আরও কোনো ভয়ানক জাতের মাংসখোর পিঁপড়েও হতে পারে , আমি কয়েকটা স্যাপল মুখ্য সরকারি এনটোমলোজিস্টকে পাঠিয়েছিলাম ; উনি জানিয়েছেন যে ওগুলো ডরিলাস ল্যাবিয়াটাস , ট্রপিকাল কান্ট্রিজে হয় , এদেশেও হয় । ওনার ফাইনাল রিপোর্ট চার্জশিট দাখিল করা পর্যন্ত পেয়ে যাব । পিঁপড়ের কলোনিটা আর নেই। ডক্টর পাল নিয়মিত পেস্টিসাইড প্রয়োগ করে পিঁপড়েদের নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রমাণ মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছেন । ডক্টর পালের দুর্ভাগ্য যে বাঙলোর বাগানের মধ্যে কয়েকটা পিঁপড়ের অবশেষ মাটির সঙ্গে মিশে থেকে গেছে, সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়নি, দশ বছর পরেও।
এডিজি অধৈর্য হয়ে বললেন, তা না হয় হল, এত ডিটেইলসে যাচ্ছিস কেন ? টু দি পয়েন্ট আয় না ।
রিমা বলল, উনি চিনির আর মুর্গির মাংসের কিমার সাহায্যে পিঁপড়েদের কলোনিটাকে বাঙলোর বাগানের ভেতর পর্যন্ত নিয়ে আসেন। প্রেমিক কংকাল তখন ভাইরাল ফিভারে । পিঁপড়েগুলোকে বিনোদিনী দেবী বাঙলোবাড়িটার আরও ভেতরে প্রবেশের জন্য ব্যবস্হা করেন । ড্রইং রুমের ভেতর পর্যন্ত নিয়ে যান এবং তার পর প্রেমিক কংকালের ঘরে তাদের চালিত করেন। প্রেমিক কংকালকে পিঁপড়ে দিয়ে মারা ওনার উদ্দেশ্য ছিল না , তা সম্ভবও ছিল না , এবং সম্ভব হলেও তা ছিল সময়-সাপেক্ষ। উনি বাজার থেকে মুর্গির ছাঁট মাংসের কিমা করিয়ে প্রেমিক কংকালের ঘরে রাখা আরম্ভ করেন । প্রেমিক কংকাল তখন বিনোদিনী দেবীর ওপর প্রতিটি কাজের জন্য নির্ভর করছেন ; বিছানায় শয্যাশায়ী প্রেমিক কংকালের এ ছাড়া উপায়ও ছিল না । আমার মনে হয় তাঁর মনে হচ্ছিল ডক্টর পাল তাঁর শেষ বয়সের নারী, একজন মহিয়সী সেবিকা । আমার রিডিং অনুযায়ী প্রেমিক কংকালকে একজন নারীসঙ্গ-কাঙাল বলা যায়। উনি লোকজন চাকর-বাকর পছন্দ করতেন না । ডক্টর পালের সুবিধাই হল । পিঁপড়েগুলো মুর্গির ছাঁট মাংসে অভ্যস্ত হলে ডক্টর পাল প্রেমিক কংকালের ভাইরাল ফিভার রিল্যাপ্স করাবার ব্যবস্হা করেন । স্বাভাবিক যে প্রেমিক কংকালের খাবারও উনি নিয়ন্ত্রণ করতেন । প্রেমিক কংকাল যাতে বিছানা থেকে ওঠার সব ক্ষমতা হারিয়ে ফ্যালে সেদিকে ওনার নজর ছিল।
ডক্টর বিনোদিনী পাল মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপম করে থাকলেও বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি ক্রোধ চেপে রাখতে পারছেন না।
ডক্টর ওহদেদার, যিনি সন্মতিসূচক মাথা নাড়ছিলেন, বললেন, আই অ্যাগ্রি, ইট ইজ পসিবল ।
বত্রিশ নম্বর প্যারায় দেখুন স্যার, রিমা বলল সমবেত উর্ধতন অফিসারদের , সেখানে ডক্টর পালের একটি পোষা কুকুরের রেফারেন্স আছে । একজন মহিলা কী করে নিজের বাড়ির পোষা কুকুরের সঙ্গে এভাবে ব্যবহার করতে পারেন, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না । ওনার কুকুরকে উনি আদর করে রাসকেল বলে ডাকতেন। ঠিক না ? ডক্টর পাল ? আপনার চেম্বারে রাসকেলের ফোটো টাঙিয়ে রেখেছেন ।
বিনোদিনী পাল অবাক চোখে মাথা তুলে তাকালেন , রিমার মুখের দিকে।
রিমা বলল, মনে পড়ে কি গরিব, শাঁখা-সিঁদুর পরা, সস্তা প্রিন্টেড শাড়িতে এক যুবতী তার স্বামীকে নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিল, অসহ্য পিঠ ব্যথার যন্ত্রণা নিয়ে ? ভালো করে দেখুন , আমিই সেই ঘোমটা-দেয়া বউ, আর আমার স্বামী সেজে গিয়েছিল আমার সাবইন্সপেক্টর রজন মণ্ডল ।
উর্ধতন অফিসারদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রিমা বলল, সাধারণ কুকুর নয় স্যার, পিট বুল, পিওর ফেরোশাস ব্রিড , ওই ব্রিডের একজন ব্রিডারই আছেন এই শহরে । ডক্টর পাল কর্তৃক তাঁর কাছ থেকে শাদা-কালো পিট বুল কুকুর বাচ্চা কেনার রেকর্ডের কপি আর রেজিস্ট্রেশান নম্বর আমার রিপোর্টের সাতান্ন নম্বর প্যারায় আছে ।
এসএসপি ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন তুললেন, কুকুর ? বেশ ইনটারেসটিং ! কুকুর তো মানুষের বেস্ট ফ্রেন্ড । আমার কুকুরটার শরীর খারাপ হলে আমার ছেলেরও মন ভিষণ খারাপ হয় । ইন ফ্যাক্ট আমরা তো লাভলিকে কখনও বলি না যে সে কুকুর । লাভলির কিছু হলে বাড়িসুদ্ধ সবাই চিন্তিত হই। হোয়াট ডিড শি ডু উইথ দি ডগ ? পিঁপড়ে আর কুকুর ? বল বল, সরি টু ইনটারাপ্ট ।
রিমা বলল, উনি ওনার পিট বুল কুকুরকে প্রথমে অর্ধভূক্ত রাখতে আরম্ভ করেন, তারপর , প্রেমিক কংকাল এডিইএম-এ আক্রান্ত হলে, কুকুরটার খাওয়া আচমকা প্রায় বন্ধ করে দেন। ঠিক বলছি তো ডক্টর পাল ?
বিনোদিনী পালের কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ল না কারোর ।
রিমা ওর বক্তব্য বজায় রাখল , উনি অর্ধভূক্ত মাংসখোর কুকুরটাকে এনে বেঁধে দিলেন কোমায় আক্রান্ত প্রেমিক কংকালের ঘরে । এমন জায়গায় বাঁধলেন যাতে কুকুরটার নাগালের মধ্যে থাকে প্রেমিক কংকাল । রোগিকে পাহারা দেবার জন্য উনি কুকুরটাকে আনেননি সেখানে । তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভয়ানক । নৃশংস বলা যায়। ইতিমধ্যে পিঁপড়েগুলো আক্রমণ করেছিল প্রেমিক কংকালকে , কেননা প্রেমিক কংকালের দেহে ওষুধ মাখাবার নাম করে ডক্টর পাল মিষ্ট রসের আর মুর্গির ছাঁট মাংসের প্রলেপ দেয়া আরম্ভ করেছিলেন। পিঁপড়েরা প্রেমিক কংকালের দেহে ক্ষত তৈরি করে দিচ্ছিল । ক্ষুধার্ত কুকুরটার পক্ষে, জোয়ান পিট বুল কুকুর, টাটকা তাজা মাংসের লোভ সংবরণ করা অসম্ভব ছিল। প্রেমিক কংকাল তো কোমায় ; ছটফট করার ক্ষমতাও তার নেই । কুকুরের আর পিঁপড়ের খাদ্য হতে থাকলেন কংকাল প্রেমিক । তা , বোধহয়, পৈশাচিক আনন্দে উপভোগ করতেন ডক্টর পাল । আমার সন্দেহ, প্রেমিক কংকালের দেহে এমন কিছু মাখানো হচ্ছিল, যে কুকুরটাও ক্রমশ অসুস্হ হয়ে পড়ে । বহুকাল যাবত একই অবস্হায় ধুলোর আস্তরণে প্রেমিকের কংকাল এমন অবস্হায় ছিল যে টক্সিকোলজিস্ট উপরিতলের বায়োকেমিকাল অ্যানালিসিসে কিছু খুঁজে পান নি । দ্বিতীয় ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রমেন বসু কুকুরের দেহাবশেষের একটা রিপোর্ট নিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞ ভেটেরেনারিয়ান ডক্টর কাকলি সোমের , যিনি কুকুরটার নেক্রপসি করেন ; উনি কুকুরের কংকাল আর তার ছালের অবশিষ্টাংশ আমাদের মালখানায় প্রিজার্ভ করার ব্যবস্হাও করেছিলেন। এই যে ইনিই কাকলি সোম, উপস্হিত একজন বৃদ্ধার দিকে নির্দেশ করল রিমা । তারপর বলল, বসু সায়েব রিটায়ার করেছেন তিন বছর আগে । আমি ওনাকে কনসাল্ট করেছিলাম। উনিও আমার ফাইন্ডিংসকে সমর্থন করেছেন । ওনার কাছ থেকে একটা লেটার রিপোর্টের সঙ্গে এনক্লোজার হিসাবে দিয়েছি স্যার । ভেটেরিনারিয়ানের নেক্রপসি রিপোর্টও এনক্লোজার হিসাবে দিয়েছি।
ডক্টর বিনোদিনী পাল বসে আছেন ; মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কী চলছে ওনার মনে ।
এ তো একেবারে রোমহর্ষক ঘটনা বলতে যা বোঝায়, তা-ই , বললেন ডিজি । ডিটেকটিভ নিশীথ রায় কিংবা হৃজু বোসকে বলব তেড়ে একখানা গপপো লিখতে , কোনো পুজো সংখ্যায় । পুলিসের চাকরিতে একটা বিশেষ জ্ঞান হয়েছে আমার । তা হল এই যে ঠান্ডা মাথার খুনিরা সুপার ইনটেলিজেন্ট হয় । ওই ইনটেলিজেন্স সমাজে প্রয়োগ করলে বরং সমাজের উন্নতি হতো। এনি ওয়ে, বল, তারপর ?
এবার রিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, হ্যাঁ স্যার, আধখাওয়া প্রেমিক কংকালকে খেল কুকুর , আর পরে সেই মুমূর্ষু কুকুরকে খেল মাংসাশী পিঁপড়েরা, যেগুলো ইতিমধ্যে প্রেমিক কংকালের মাংসের স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পিঁপড়েদের কলোনিটা নিশ্চিহ্ণ না হলে হয়তো মাংসের ট্রেস পাওয়া যেত তাদের ভাঁড়ার-টানেলে।
ম্যাডাম ইনভেসটিগেটর, রিমাকে উদ্দেশ্য করতে বিনোদিনী দেবী বললেন, আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কি যে কুকুরটা আমার ? কী-ই বা প্রমাণ আছে যে পিঁপড়ের কলোনি বিস্তার আমিই ঘটিয়েছিলাম। অযথা গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদছেন স্রেফ একটা লম্পটকে মহান প্রমাণ করার খাতিরে। হয়তো প্রোমোশান পাবার চেষ্টা করছেন কাল্পনিক ঘটনা জুড়ে জুড়ে ; ক্রিমিনাল না পেয়ে আমাকে ভুল বুঝিয়ে ডেকে এনে আমাকেই দোষারোপ করে ফাঁসাতে চেষ্টা করছেন।
জবাবে রিমা ফাইলের পাতা উল্টে , বিনোদিনীর সামনে মেলে ধরে বলল, আছে, এই যে, আপনি পিট বুলের বাচ্চা কিনেছিলেন , রেজিস্ট্রেশান করিয়েছিলেন, তার রেকর্ডের সার্টিফায়েড কপি । কলকাতায় তো সচরাচর বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে পিট বুল কুকুর পুষতে দেখা যায় না। আপনি হয়তো মনের মধ্যে কোনো এক পুরুষকে পিট বুল দিয়ে আক্রমণ করাবার পরিকল্পনা গড়ে উঠেছিল, যে পুরুষটি আপনার জীবন থেকে আপনার মাকে সরিয়ে নেবার জন্য দায়ি । তাই কি ডক্টর পাল ?
ডিজি বিনোদিনী পালকে প্রশ্ন করলেন, ডক্টর, আপনার মা চলে যাবার পর, আপনি কার কাছে মানুষ ? আই মিন কে আপনার প্রতিপালন করলেন । স্কুল কলেজে পড়ানো, ডাকতারি পড়ানো, এম ডি হবার জন্য পড়ানো , এগুলো তো কেউ আপনার মায়ের বিদায়ের পর দায়িত্ব নিয়ে করে থাকবেন ?
বার বার বলবেন না যে আমার মা স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন । ওই স্কাউন্ড্রেলটা ওনাকে কিডন্যাপ করে বন্দি করে রেখেছিল অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে । যে শাস্তি পাওয়া দরকার তা পেয়েছে ক্রিমিনালটা । অপরাধ তো ওই লোকটার , আমার নয় । আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই । আমাকে মানুষ করেছেন আমার বাবা আর ঠাকুমা-ঠাকুর্দা ।
রিমা খান ঘরের বাইরে গিয়ে একটি কিশোরী আর তার সঙ্গী মহিলাকে নিয়ে পুনঃপ্রবেশ করে বলল, ডক্টর পাল, দেখুন তো এনাদের চেনেন কিনা ? এই কিশোরীকেই জঘন্যভাবে পিঁপড়ের ঝাঁক কামড়ে ছিল । মনে আছে ?
কিশোরীর সঙ্গী মহিলা বললেন, ইনি তো সেই ডাকতার । ওনার সেবায় তখন ঘুণাক্ষরেও ওনার উদ্দেশ্য টের পাইনি। ছি ছি, মানুষ এরকম হয় । একটা বুড়ো অথর্ব লোক, কোথায় তার সেবা-শুশ্রুষা করবে, তা নয় ডাকতার হয়ে তাকে খুন করার পরিকল্পনা করলেন ! ছি-ছি । আমার তো ভাবতেও ঘেন্না করছে।
বিনোদিনী উঠে দাঁড়ালেন । তখন থেকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছেন আপনারা । আমি এই মহিলাকে চিনি না , কোথা থেকে কাউকে ধরে এনে অবিরাম মনগড়া অভিযোগ আরোপ করে যাচ্ছেন।
কিশোরীর সঙ্গী মহিলা বললেন, ডাকতার পাল, অমন অপমানজনক কথা বলবেন না , আমরা পয়সাঅলা নই বটে কিন্তু আত্মসন্মান আছে । এই যে ফাইল, আমার মেয়ের মেডিকাল ফাইল , ওর প্রথম প্রেসক্রিপশানটাই আপনার ।
ফাইলটা নিয়ে রিমা প্রেসক্রিপশানটা দেখাল ডিজিকে । মাথা নাড়লেন ডিজি। মহিলাকে বললেন, যদিও তাঁর লক্ষ্য ছিল বিনোদিনী পাল, আমরা ডক্টর পালের বিরুদ্ধে মেডিকাল নেগলিজেন্স আর মার্ডারের কেস করছি , আপনাকে তাতে সাক্ষ্য দিতে হতে পারে । মহিলা মাথা নাড়লেন , বললেন, হ্যাঁ, দেবো, ওই পিঁপড়ের আতঙ্ক আমার মেয়েকে এখনও ভোগায় । পোকামাকড় দেখলেই ওর ভয়তরাসে শরীর খারাপের অবস্হা হয়।
রিমা বিনোদিনীর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, বিনোদিনী দেবী, আপনি কংকাল প্রেমিকের বাড়ি থেকে তাঁর মোবাইল, কমপিউটার, য়ভক্তিগত টেলিফোনের খাতা, একটি চামড়ার ব্যাগ, নিবেশের কাগজপত্র এবং আরও অনেক কিছু সরিয়েছিলেন। সেগুলো আপনার বাড়িতে আছে কিনা জানার জন্য আপনার বাবার বাড়িতে একটি পুলিস টিম ঠিক এক্ষুনি রেইড করায় ব্যস্ত । যদিও আমরা আপনার বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ সংগ্রহ করেছি । তবু, কংকাল প্রেমিকের যে-কোনো একজন আত্মীয়কে পাওয়া গেলে ওনার উত্তরাধিকারীর হাতে তাঁর কংকালটি এবং স্হাবর-অস্হাবর সম্পত্তি তুলে দেয়া যাবে ।
বিনোদিনী পাল রাগতস্বরে বললেন, আমি ওসব নিবেশের বা অন্যান্য কাগজপত্র সরাইনি, ওধরণের কিছু ছিল না , ওনার ব্যাঙ্ক লকারে হবে। ভবানীপুরের স্টেট ব্যাঙ্কে ওনার লকার আছে একবার বলেছিলেন।
ভবানীপুর ? রিমা নিজেকেই বলে উঠল। আরে, ওখানেই তাহলে মিলি নামের মেয়েটিকে, এখন সে হয়ত যৌবনের পরের বয়সে, পেয়ে যাব তাকে ।
হ্যাঁ, নিরঞ্জনবাবু বলেছিলেন একবার যে মিলি নামের কেউ একজন পদ্মপুকুরের পাশে থাকত, তাঁর স্কুলের বন্ধু, বললেন বিনোদিনী ।
রিমা বলল, যাক, মিলিকে তাহলে পেয়ে যাব , ওনাকে দরকার । এই কেসের ব্যাপারে নয়, অন্য কারণে ।
এডিজি বললেন, আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি ডক্টর পাল । রিমার দিকে ফিরে বললেন, নতুন করে একটা এফ আই আর দর্জ করতে । উর্ধতন অফিসাররা একে-একে বেরিয়ে গেলেন । মহিলাও বেরিয়ে গেলেন কিশোরী মেয়ের সঙ্গে । ডিজি ঘর থেকে বেরোতে-বেরোতে পেছন ফিরে রিমাকে বললেন, তোর সাসপেনশান রিভোকেশান আর প্রোমোশান আর নতুন পোস্টিঙের অর্ডার দিন-পনেরো পরে এসে অফিস থেকে কালেক্ট করে নিস ।
ডিজিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিমা একগোছা জেরক্স কাগজ আর কয়েকটা ফোটোগ্রাফ ডক্টর পালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বিনোদিনী দেবী, এগুলো কংকাল প্রেমিকের তেলেগু লেখার বাংলা, অগ্রমগাগি আউটার এরিয়ায় আপনার মায়ের নামে আম্মা মন্দিরের ফোটো । আপনার কোনো উকিল থাকলে তাঁকে খবর দিন । ম্যাজিস্ট্রেট আপনাকে কত দিনের জন্য হাজতে পাঠাবেন জানি না ; আমরা রিমান্ড চাইব না । হাজতে বা আদালতে বসে এগুলো পড়লে আপনার মায়ের আর প্রেমিক কংকালের অলৌকিক ভালোবাসার কথা জানতে পারবেন । যদি জামিনে ছাড়া পান তাহলে একবার ওই অঞ্চলটি ঘুরে আসবেন , সেখানের মানুষ আজও আম্মা আর মায়ালিঙ্গার প্রেমের গল্প করে । প্রেম ব্যাপারটা যে কী তা আমি জানি না । আপনিও জানেন না বলেই মনে হয়। কিন্তু এই অদ্ভূত কেস থেকে প্রেম সম্পর্কে আমার একটা মোটামুটি ধারণা হয়েছে , আর তা হল আত্মত্যাগের ।
রিমা বলা বজায় রাখল, আপনার দাদু-ঠাকুমা-বাবা কেবল অজানা এক কিডন্যাপারের কাহিনি শুনিয়ে থাকবেন আপনাকে । আপনার মায়ের সম্পর্কে কোনো কথাই কি তাঁরা আপনার সঙ্গে শেয়ার করেননি ? আপনার মা মায়া পাল আপনার প্রথম জন্মদিনের পরের দিনই বাড়ি ছেড়ে চলে যান । কেন জানেন ? আপনার দাদু-ঠাকুমা-বাবা আপনাকে নিজেদের মতো ননভেজিটেরিয়ান তৈরি করতে চাইছিলেন , আর আপনার মা আপনাকে নিজের মতো করে গড়তে চাইছিলেন , একজন বিশুদ্ধ শাকাহারী। আপনার জন্মদিনের উৎসবে আগত নিমন্ত্রিতদের সামনেই তাঁরা আপনার মাকে অকথ্য ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন , অপমান করেছিলেন। সে-শপমান নিশ্চয়ই অসহ্য ছিল, নয়তো নিজের এক বছরের মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে চলেই বা যাবেন কেন ?
পড়ে দেখুন, প্রেমিক কংকালের স্মৃতিচারণ। ওতে লেখা আছে যে আপনার মা বিশুদ্ধ শাকাহারী ছিলেন। তিনি চামড়ার জুতো পরতেন না, ইন ফ্যাক্ট চামড়ার কোনো দ্রব্য ব্যবহার করতেন না ; সিল্কের শাড়ি পরতেন না, কেননা একটা সিল্কের শাড়ি তৈরি হয় অজস্র পলুপোকা মেরে ; মুক্তোর গয়না পরতেন না ; শীতের দিনে সিনথেটিক উলের পোশাক পরতেন ; বোন চায়নার কাটলারি ব্যবহার করতেন না ; মাছ মাংস ডিম দুধ খেতেন না । আর আপনি আপনারই পোষা পেডিগ্রিপ্রাপ্ত কুকুরকে মেরে ফেললেন, পিঁপড়ের কলোনি নিশ্চিহ্ণ করলেন , এবং একজন বৃদ্ধকে পাঠিয়ে দিলেন মৃত্যুর মুখে । তাছাড়া প্রেমিক কংকালকে কুকুর দিয়ে খুবলে খাওয়াবার তো প্রয়োজন ছিল না ; উনি তো বিনা চিকিৎসায় নিজেই মারা যেতেন । বাবা তো বেঁচে আছেন । ওনাকে জিগ্যাস করবেন যে আপনার মায়ের সঙ্গে ওনাদের সূক্ষ্ম সাংস্কৃতিক অবনিবনা হতো কিনা, দৈনন্দিন জীবনে মতের তুমুল সংঘর্ষ হতো কিনা । হয়তো তাঁরা আপনার মাকে মানসিকভাবে অসুস্হ মনে করতেন , খোঁজ নেবেন।
ডক্টর পাল হাত বাড়িয়ে কাগজের গোছাটা নিলেন।
রিমা খান একটা প্যাকেট দিলে ডক্টর পালকে । বলল, এতে আপনার মায়ের একগোছা চুল আছে । আপনি এতই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রতিশোধের স্পৃহায় বাঙলোর স্টাডির দেরাজে সযত্নে রাখা এই প্যাকেটটা আপনার নজরে পড়েনি । প্রেমিক কংকাল এই চুলের গোছা অতি আদরযত্নে সংরক্ষিত রেখেছিলেন , ভালোবাসার পাত্রীর স্মৃতিচিহ্ণ হিসাবে । আমাদের মালখানায় সিজারের আইটেমের সঙ্গে ছিল , তা থেকে কয়েক গাছা আপনার জন্যে এনেছিলাম । আমি চুলের গোছাটা রেখে নিয়েছি, মামলায় দরকার হবে । আপনার মনে আছে নিশ্চয় আপনার ক্লিপের প্রসংশা করে আমি আপনার কাছ থেকে ক্লিপটা চেয়ে নিয়েছিলাম, তাতে দুয়েকটা ছুল ছিল বলে ? প্রেমিক কংকালের শোবার ঘরের ড্রেসিংটেবিলের হেয়ারব্রাশেও আপনার কয়েকটা চুল থেকে গিয়েছিল। আমরা আপনার আর মায়া পালের চুলের ডিএনএ টেস্ট করিয়েছি। ওটা আপনারই মায়ের চুল।
প্যাকেট আর জেরক্সের গোছা নিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন বিনোদিনী পাল, এম ডি ।
১৪. মলয়ের সঙ্গে বিনোদিনী
বহুকাল পর, আমার বন্ধু মলয় রায়চৌধুরী যখন অফিসের কাজে কর্ণাটকের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অন্ধ্রপ্রদেশে জমিহীন কৃষকদের সম্পর্কে একটা স্টাডি করতে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে বিনোদিনী পালের দেখা হয়েছিল, বলতে গেলে আচমকাই । মলয়বাবুর কাছ থেকে বিনোদিনীর দেয়া একপ্রস্হ কাগজ পেয়ে আমি তো থ।
ডিটেকটিভ উপন্যাসটি লেখার আগে , হার্ট স্পেশালিস্ট এক বন্ধুর বাড়িতে বিনোদিনী পালের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারেন যে আমি লেখালিখির ব্যবসা করি ; রিমা খানের সরবরাহ করা তথ্যে নির্ভর করে গল্প-উপন্যাস লিখেছি তাও জানিয়েছিলুম ওনাকে। পুজো সংখ্যার জন্য একটা ডিটেকটিভ উপন্যাসের প্লট খুজছি শুনে তাঁর কাছ থেকে থেকে তাঁর মায়ের অন্তর্ধান এবং মৃত্যুর কাহিনী শুনেছিলুম । রিমা খানের দেয়া তথ্যের সঙ্গে বুনে নিয়েছিলুম ওনার দেয়া তথ্য। ওপরে সেই গল্পটাই আপনারা এতক্ষণ পড়লেন। বিনোদিনী আত্মিক নিরাময়ের জন্য কাহিনীটি বলেছিলেন আমায়।
আমি গল্পটায় একটু মশলাফোড়ন দিয়েছি।
মলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে পারি যে বুড়ি বিনোদিনী পাল বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশের কর্ণাটক সীমান্তে তাঁর মায়ের মন্দিরের পাশে গ্রামবাসীদের জন্য একটা দাতব্য চিকিৎসালয় চালান ; যদিও এলাকাটাকে আর গ্রাম বলা চলে না । তা রুপান্তরিত হয়েছে খনিশহরে । মলয় অন্ধ্রপ্রদেশে খনিশ্রমিকে রূপান্তরিত জমিহীন কৃষকদের পুনর্বাসনের সমস্যা নিয়ে একটা স্টাডি করতে গিয়েছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী আমার বন্ধু শুনে উনি, বিনোদিনী পাল, লোকায়ুক্ত জাস্টিস রঙ্গনাথনের একটি রিপোর্টের কয়েকটি পৃষ্ঠা আমাকে দেবার জন্য দেন। বিনোদিনী অনুরোধ করেছিলেন যে রিপোর্টে দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমি যেন আমার ডিটেকটিভ উপন্যাসটিতে প্রয়োজনীয় রদবদল করে নিই ।
জাস্টিস রঙ্গনাথন তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন যে বিনোদিনী পালের মা মায়া পালকে ষড়যন্ত্র করে খুন করিয়েছিল খনিজবস্তু পাচারকারী মাইনিং মাফিয়ারা । মাইনিংয়ের ঠিকাদাররা গ্রামটাকে আর তার আশেপাশের জঙ্গলকে দখল করতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের চেষ্টা প্রতিহত হচ্ছিল মায়া পালের স্কুলের কারণে। যে লোকটি খুন করে লাশ টাঙিয়েছিল সে লোকায়ুক্তের পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, আর এখন সে জেল খাটছে । মাইনিং মাফিয়ারাই বিনোদিনী পালের মায়ের মৃত্যুর খবর অন্ধ্র পুলিশকে দিয়েছিল বলে অত তাড়াতাড়ি জিপ নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল পুলিশের ইন্সপেক্টর রামাইয়া । রেকর্ডে কারচুপি করার অপরাধে চাকরি খোয়াতে হয়েছে ইন্সপেক্টর রামাইয়াকে । আসল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল রামাইয়ার গ্রামের বাড়িতে ; তাতে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ভ্যাজাইনা সোয়াইব থেকে প্রমানিত হয়েছিল যে অজ্ঞান অবস্হায় মায়া পালকে তিনজন রেপ করেছিল । আজ্ঞান অবস্হাতেই মায়া পালকে তারা কাঁঠাল গাছে টাঙিয়ে দিয়েছিল । ভিসেরা রিপোর্ট অনুযায়ী মায়া পালকে ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল । খুনি নিজের অপরাধের স্বীকৃতি জনৈক ম্যাজিস্ট্রটের সামনে দর্জ করেছিল এবং তাতে সে বলেছিল যে নিরঞ্জন দত্তকেও ক্লোরোফর্ম করেছিল তারা কয়েকজন লোক মিলে । বাদবাকি অপরাধীরা ফেরার ।
ডিটেকটিভ উপন্যাসটার প্রথম সংস্করণ উৎসর্গ করেছিলুম রিমা খানকে । রিমার কাছ থেকে বহু উপন্যাসের প্লট পেতুম। দ্বিতীয় সংস্করণটা আর তাঁকে দেয়া যাবে না। উনি অবসর নেবার বছরেই মারা যান ; অবিবাহিত ছিলেন ।
মাকে খুঁজে বের করতে হবে । ডিলডো কী তা জেনে তোমার কাজ নেই ; ওটা কলেজ-পড়ুয়া মেয়েদের খেলনা, অবশ্য স্কুল-পড়ুয়া মেয়েরাও খেলে হয়তো কেউ কেউ । তোমাদের সময়ে অমন খেলনা ছিল না । আর আশ্চর্য কী জানো ? সব খেলনাই আজকাল চিন থেকে আসে ; কিন্তু এই খেলনাটা আসে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে । চিনে তৈরি হলে কুড়ি-পঁচিশ টাকায় পাওয়া যায় ।