৬. পিট বুল
হরিশচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে পরাশর বর্মাকে দেখতে পেয়ে, মোটর সাইকেল থামিয়ে, পাশে দাঁড় করিয়ে, ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল রিমা । পরাশর বললেন , আরে তুই ? চাকরি ফিরে পেয়ে গেলি নাকি ? তোর বিষয়ে খবর পড়ে আর টিভিতে দেখে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তা এদিকে কি জন্যে ? তোরা তো উত্তরে চলে গেছিস বলে জানি ।
রিমা বলল, হ্যাঁ কাকু, আমরা ওদিকে চলে গেছি । এসেছিলাম কালীঘাটে ; এখানের এক পুজারী আমার ইনফরমারের কাজ করেন , তাঁকে একটা কেসের ব্যাপারে বলে এলাম । আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম , একটা খুনের কেসের কিনারা করার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে ।
পরাশর বললেন, আমি তো, প্রেমেন মারা যাবার পর কাজ ছেড়ে দিয়েছি ; বয়সও হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছিস । তাছাড়া সময়টা বড্ডো খারাপ , যখন-তখন রাস্তায় লাশ পড়ছে, খবরের কাগজ খুললেই প্রথম পাতায় হিসাব দেয়া থাকে কোথায় কজন দলাদলি করে খুন হল । ডিটেকতিভকে এককালে বলা হতো সত্যান্বেষী , আর এখন সত্য যে কাকে বলে তা-ই তর্কসাপেক্ষ । একাধিক সত্য হলে কী অন্বেষণ করবে মানুষ ? সত্য এবং মিথ্যার ফারাকও প্রায় নেই বললেই চলে , তা সে সংসদে বল বা বিধানসভায় । মনটা খারাপ থাকে রে , কীই বা বলি ! প্রেমেনের বাড়িটার স্মৃতি ঝালাই করতে এদিকে এসেছিলাম , কিন্তু কে একজন কেন্দ্রিয় নেতার আগমন হবে বলে ঢোকার বেরোবার কড়াকড়ি দেখে ফিরে যাচ্ছি ।
রিমা জিগ্যেস করল, আপনার হাতে সময় আছে ?
পরাশর বর্মা বললেন, এখন তো সময়ই সময় , সময় কাটানোই কঠিন , টিভি দেখতে ভালো লাগে না । সংবাদপত্র, এক্ষুনি যা বললাম, পড়া মানে নিজেকে কষ্ট দেয়া । আমাদের কালের মতন সরাসরি খবর তো আর পরিবেশন করে না মিডিয়া ; সবেতেই নুন-লঙ্কা মিশিয়ে খবর বানায় , তাতে পদ্য-লিখিয়েরা ওপর থেকে পোঁচ দেয় ।
তাহলে আমার সঙ্গে চলুন, আপনার বিশেষজ্ঞ মতামত দেবেন , তারপর আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব , রিমা বলল ওনাকে ।
কোথায় যেতে হবে রে ? জিগ্যেস করলেন পরাশর, তারপর স্বগতোক্তির সুরে বললেন, মোটর সাইকেলে কি বসতে পারব ? আচ্ছা চল, যাই । তুই মেয়ে হয়ে মোটর সাইকেল চালাচ্ছিস, আমি না হয় মেয়েদের মতন একপাশে পা ঝুলিয়ে যাব, বললেন পরাশর ।
মোটর সাইকেলে পরাশর বর্মাকে বসিয়ে রিমা ওনাকে নিয়ে গেল থানার মালখানায় । হাত ধরে ওসির ঘরে নিয়ে গিয়ে, এক গ্লাস জল খাইয়ে ওনাকে মালখানার ভেতরে নিয়ে গেল । ভেতরটা এমন ধুলো-পড়া যে পরাশর নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বললেন, আমার আজকাল ধুলোর অ্যালার্জি দেখা দিয়েছে । তা কিসের ব্যাপারে জানতে চাস ?
বাঙলোবাড়িতে কুকুরের যে কংকাল পাওয়া গেছে তার ওপর থেকে প্লাসটিকের চাদর তুলে রিমা জিগ্যেস করল, এই কুকুরটা কোন ব্রিডের আর এর বিশেষত্ব কী ? কুকুরের এই কংকালটা পাওয়া গেছে একজন মানুষের পাশে । মানুষটা কে ঠিকমতন আইডেনটিফাই করা যাচ্ছে না । যতটুকু জেনেছি, কংকাল ভদ্রলোক কুকুর পুষতেন না । তাহলে কুকুরটা তাঁর পাশে এলো কোথা থেকে, কোন উদ্দেশে , এবং কুকুর আর মানুষটির রহস্যটা ঠিক কী ? আমার মনে হয় কুকুরটাকে যদি আইডেনটিফাই করতে পারি, তাহলে কুকুরের মালিককেও খুঁজে বের করতে পারব । কুকুরটা দেখুন না কেমন বিদকুটে কাঠামোর ।
কংকালের চারপাশে প্রদক্ষিণ করলেন পরাশর, খুলিটা দেখলেন কাছ থেকে, যেটুকু চামড়া টিকে আছে কুকুরটার তাও খুঁটিয়ে দেখলেন । মাটিতে উবু হয়ে বসে দেখলেন । উঠে দাঁড়িয়ে চিন্তামগ্ন হলেন । নিষ্কর্ষে পোঁছোতে সময় নিলেন মিনিট দশেক । তারপর বললেন, আমি যা বলছি তা তুইম লিখে নিবি তো ? লিখে নিলে ভালো হয় । তুই তা দেখাতে পারবি তোর ভেটেরিনারি দাকতারকে , কেননা কোর্টে তো আমার মতামতের গুরুত্ব নেই , আমি একজন বেসরকারি লোক ।
—আপনি বলুন কাকু, আমি আমার এই ছোট্ট টেপরেকর্ডারে ধরেরাখছি । বলল রিমা ।
পরাশর বললেন, তোদের কত সুবিধা হয়ে গেছে, আমাদের সময়ে এই সমস্ত টেকনিকাল গ্যাজেট ছিল না । হ্যাঁ, শোন, এটা হল পিট বুল প্রজাতির কুকুর , বিদেশ থেকে এনে থাকবে, যে-ই এনে থাকুক , তা সে কোনো ডগ কেনেলের মালিক হোন বা ব্যক্তিগতভাবে কেউ এনে থাকুন । আমাদের দেশে ব্রিটিশরা যা-যা প্রজাতির কুকুর এনেছিল বা আজকাল সচরাচর যেসব কুকুর বাচ্চা কেনেল মালিকরা বিক্রি করে, তাতে পিট বুল পাবি না । ১৯ শতকের আগে ইং।্যান্ডে ব্লাডস্পোর্ট বা রক্তাক্ত-খেলা খেলত রাজতন্ত্রের লোকেরা ; সাধারণ মানুষও খেলত , কিন্তু তারা ছিল দর্শক, এই ধরণের কুকুর পোষার খরচ আর হ্যাপা অনেক । এই কুকুরগুলোকে ষাঁড় বা ভাল্লুকের ওপর ছেড়ে দেয়া হত , ষাঁড়ের মাংস খাবার জন্যে ,ষাঁড়টা বেশ নরম হয়ে যেত অবিরাম কামড় খেয়ে-খেয়ে , টেনডারিং আরকি । জুয়ার বাজিও ধরত দর্শকরা । আইন করে তা যখন বন্ধ করে দেয়া হল তখন কুকুরে-কুকুরে লড়াই লড়াবার খেলা শুরু হল । লোকে পিট বুল কুকুর পোষা আরম্ভ করল , অন্য জাতের কুকুরদের হারাবার জন্যে । এক ধরণের হিংস্র আমোদ বলতে পারিস । ষাঁড় আর ভাল্লুকের সঙ্গে যে পিট বুল কুকুরদের লড়ানো হতো সেগুলো এখনকার পিট বুল কুকুরদের থেকে বড় ছিল । পরে তো বুল ডগ আর টেরিয়ার ক্রস করিয়ে পোষবার মতন কুকুর প্রজনন করানো শুরু হল । এটা ওরকম প্রজনন করানো কুকুর , তবে এর জিনে হয়তো হিংস্রতা বেশি থাকতে পারে । এদের বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলে মুখে চামড়ার মাজল বা বাঁধন পরিয়ে নিয়ে যেতে হয় । ইউরোপ-আমেরিকায় এ-বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি আছে । অনেককে কামড়ে মেরে ফেলেছে এরা । তাই কুকুর-মালিকরা মোটা টাকার বিমা করিয়ে রাখেন, কাউকে কামড়ে দিলে বা অঘটন ঘটলে খেসারত মেটাবার উদ্দেশ্যে । আমাদের দেশে সেসব বালাই নেই , যার যে ব্রিড ইচ্ছে পুষছে, পোষা কুকুরের কামড় খেয়ে মানুষ মরলে কারোর কিছু আসে-যায় না । পাবলিকের মারই তখন একমাত্র উপায় ।
—কাকু, কেনেল সোসাইটির কাউকে চেনেন কি ? কেননা আমি যদি বলে যে পুলিসের তরফ থেকে এসেছি, একটা খুনের তদন্ত করতে, তাহলে ওরা ভয় পেয়ে চেপে যাবে । আপনি একটা ফোন করে দিলে আমি কাউকে ক্রেতা সাজিয়ে পাঠাব, নিজে তো যেতে পারব না । বলল রিমা । লোকে ওকে দেখলেই চিনে যাবে, আরে সেই নোংরা পরি, মোটর সাইকেলে বসে আকাশে ওড়ে ।
—আমার কাছে ফোন নেই , আমো ওসব আর সামলাতে পারি না । বললেন পরাশর ।
রিমা নিজের মোবাইলে কেনেল সোসাইটির নম্বর খুঁজে , ফোন করল তাদের, রিং হওয়া আরম্ভ হলে পরাশরকে দিয়ে বলল, এই নিন কাকু কথা বলুন ।
ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে পরাশর বললেন, কে ব্রততী ? আমি পরাশর বলছি, পরাশর বর্মা ।
…………
—না না, আমার নিজের জন্যে নয় , এ বয়সে কি আর কুকুর পোষা যায় !
…………
—আমি একজনকে পাঠাচ্ছি , মহিলার নাম শারদা পারিখ , বহুকাল কলকাতায় আছেন , ভালো বাংলা জানেন , পাহারা দিতে পারে এমন কুকুর কিনতে চান ।
…………
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওনাকে বিভিন্ন ব্রিডের কথা জানিও , ডগ ব্রিডারদের ঠিকানাগুলো দিও , উনি যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন ।
…………
—উনি বিদেশে ছিলেন কয়েক বছর ।
………….
—লন্ডনে । ওখানে কারোর বাড়ি পিট বুল দেখে ওনার ভালো লেগে গেছে ব্রিডটা ।
…………
—কে ? মাইক সান্যাল ? মানে আমাদের মুকুন্দ সান্যাল ? ও এই ব্রিডের কুকুর ইমপোর্ট করে বুঝি ? নিজে ব্রিড করায় না ?
………….
—ও ! আগে করাতো ? এখন ইমপোর্টও করে আর ব্রিডও করায় ? পেডিগ্রির রেকর্ড পাওয়া যাবে তো ? মানে ধর যাদের বিক্রি করা হয়েছে , মিসেস পারিখ যদি তাদের কারোর সঙ্গে পিট বুল পোষার ব্যাপারে কথা বলতে চান, তাহলে উনি তাঁদের বাড়ি গিয়ে কথা বলতে পারবেন । অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই যাবেন । তুমি মিসেস পারিখকে তাঁদের ফোন নম্বর আর ঙিকানা দিয়ে দিও ।
…………
—ঠিক আছে , রাখছি, ভালো থেকো ।
রিমাকে ওর মোবাইল ফেরত দিতে রিমা বন্ধ করে বলল, ধন্যবাদ কাকু, এবার একটু সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাচ্ছি । চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই ।
পরাশর বললেন, মানুষের কংকালটার রহস্য কি ফাঁস করতে পেরেছিস ? না, কেবল কুকুরটার দিক থেকে এগোতে চাইছিস বলে মনে হল । তাছাড়া এই যে কুকুরের কংকাল দেখালি, এই কুকুরটা কি করে আর কবে মারা পড়ল তা জানার জন্যে তোকে একজন ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্টের মতামত নিতে হবে । মানুষের কংকালটার ক্ষেত্রে যদি ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্টের রিপোর্ট না নিয়ে থাকিস তা-ও নিতে হবে ।
—ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট ? না, আমি সরকারি বিশেষজ্ঞ ডাকতারের মতামত নিয়েছি । ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট কোথায় পাবো । আমাদের রাজ্যে কি আছেন কেউ ? সরকারে তো নেই ।
—না, কেন্দ্রীয় রসায়নাগারে একজন আছেন, মিস্টার মনসুর হামিদ, বিদেশে ছিলেন , শিকাগোতে, ওখান থেকে অবসর নেবার পর ভারতে সেটল করেছেন বটে, তবে বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে সাহাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ওনাকে বিশেঢ় অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন । ডিজিকে বল, ডিজির অনুরোধে উনি সরকারিভাবে দুটো কংকাল দেখে রিপোর্ট দেবেন । ওনার মতামত কোনো আদালত অস্বীকার করতে পারে না । বললেন পরাশর বর্মা ।
—এটা তো জানতামই না । ওঃ এটা তো খুবই প্রয়োজন ছিল । কি বলব আপনাকে । আপনাদের প্রজন্ম চলে যাবার পর আমাদের পথ দেখাবার কেউ নেই । আগে তবু নিতিন মাসি ছিলেন, পি কে বাসু ছিলেন, গোয়েন্দা গর্জন ছিলেন । রিমা পরাশরের পায়ে হাত দিয়ে আবার প্রণাম করল ।
পরাশর জিগ্যেস করলেন , তুই তো দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে গিয়েছিলি ; তা কারা-কারা এসেছিলেন ।
রিমা বলল, দাঁড়ান বলছি, আমি ওনাদের ঠিকানা আর কয়েক জনের ফোন নম্বর , ই-মেল আইডি আমার ডায়রিতে লিখে রেখেছি , কখন কোন কাজে লাগে বলা যায় না । মা বলে এটা আমার বদস্বভাব , এই যা পাই টুকে রাখি ।
—না না, তুই ঠিক কাজই করিস, ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন পরাশর ।
—এই যে, পড়ব ? নামগুলো ?
—হ্যাঁ হ্যাঁ , শোনা ।
—প্রায়ভেট ডিটেকটিভ এসেছিলেন চেন কাও , ডেভিড স্মল, নিও উল্ফ, ভি আই ওয়ারশসস্কি, শন স্পেনসার, স্যাম স্পেড, শার্লক হোমস, কিনসে মিলোনে, এরকিউল পয়েরো, লিউ আর্চার, পল আর্টিজান, লিন্ডসে গর্ডন, জো ক্যানোলি, রেক্স কার্ভার, এলভিস কোল, হ্যারি ড্রেসডেন, ড্যান ফরচুন, ডার্ক জেন্টলি, এলেনি কুইন, এমারসন কড, কেট ব্যানিংগান, ক্লিফ হার্ডি, মাইক হ্যামার, টমাস ম্যাগনাম, ভেরেনিকা মার্স, ফিলিপ মারলো, জিম রকফোর্ড, জন শাফ্ট আর ম্যাথিউ শাডার ।
—বিখ্যাত লোকেরাই এসেছিল দেখছি । কয়েকজন মহিলা ডিটেকটিভও তো এসেছিলেন । যাক তোর মনের জোর বাড়ল ।
—আজ্ঞে হ্যাঁ ।
—সরকারি ডিটেকটিভরা আসেননি ?
—এসেছিলেন তো । দাঁড়ান তাঁদের নাম বলছি , অন্য পাতায় লেখা আছে নামগুলো । হ্যাঁ, এই যে । জঁ ব্যাপটিস্ট অ্যাডেমবার্গ , রডেরিক অ্যালেন , এলা ক্লাহ– ইনি রেড ইনডিয়ান, তারপর অরেলো জেন, থিও কোজাক, রিচার্ড জুকি, বারবারা হ্যাভার্স, এড গ্রিন, রবার্ট গোরেস, রাইনস দ্য গয়ে , জর্জ গিডেন, জ্যাক ফ্রস্ট, ক্রিস্টোফার ফয়েলস, অ্যাডাম ডালগ্লিশ, রে কারলিং, গিদো ব্রুনেতি, মাইক ব্রিজ, হ্যারি ব্রশ, মাইক বোল্ট, জিম বেরাগেরাক, কেট বেকেট, মার্টিন বেক, টম বার্নবি, জন বারোলি আর অ্যালান ব্যাংকস । আরও অনেক পুলিস অফিসার ছিলেন বিভিন্ন দেশের , দ্বিতীয় তালিকাটা শেষ দিন যোগাড় করা হয়ে ওঠেনি ।
—বেশ জমজমাট সেমিনার ছিল তাহলে । মহিলা পুলিস অফিসাররাও এসেছিলেন দেখছি ।
—আজ্ঞে হ্যাঁ । তবে প্রায় সকলেই সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে বলছেলেন যে সরকারিভাবে এত খুনোখুনি হয় যে ডিটেকটিভদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে । এখন কেবল বাচ্চাদের ভোলাবার আর ট্রেনযাত্রীদের ঘুম পাড়াবার কাজে লাগে ডিটেকটিভদের অভিজ্ঞতা । চিন থেকে উন্সপেকটর চেন এসেছিলেন , উনি বলছিলেন যে চিনে প্রতি বছর হাজারখানেক শ্রমিক কেবল কয়লাখনির বিস্ফোরণে মারা যায় , আর কত হাজার মানুষকে যে উন্নতির নামে ঘরছাড়া করা হয় তার হিসাব নেই । প্যালেস্টাইনের ওমার ইউসুফ বলছিলেন যে ইজরায়েলের বোমা খেয়ে রোজই বউ-বাচ্চারা মরছে , সেক্ষেত্রে একটা খুনের তদন্ত করাটা বিলাসিতা ।
—এক দিক থেকে ওনারা ঠিকই বলেছেন । আমাদের পি সি মিটারও সেরকম কথাই আড়ালে-আবডালে বলেন । রাজ্য সরকার কতো লোককে নকশাল, মাওবাদী নাম দিয়ে খুন করে আবার মাওবাদী বা যারা নকশাল করে গেছে এককালে , তাদের নিয়ে পিসি মিটার তাই কখনও মুখ খোলেননি । দেবেন্দ্রবিজয় আর অরিন্দমের সঙ্গে সেদিন যাদবপুরে দেখা হয়েছিল । ওনারাও দুঃখ করছিলেন , এদেশের রাজনীতিকরা কোটি-কোটি টাকা চুরি করে সুইস ব্যাংকে লুকিয়ে রাখছে , সেখানে একটা-আধটা গুপ্তধনের কেস নিয়ে ডিটেকটিভের মাথা ঘামানোর কোনো মানে হয় না , সব পণ্ডশ্রম ।
রিমা বলল, আজ্ঞে ঢাকা থেকে কিশোর পাশা, মাসুদ রাণা আর মুসা আমন এসেছিল। ওরাও বলছিল, খালেদা জিয়ার ছেলে কোটি-কোটি টাকা মেরে দুবাই আর সুইস ব্যাংকে নিয়ে গেছে ; তাছাড়া টিক্কা খান কতোজন বাঙালিকে যে খুন করেছিল তার ইয়ত্তা নেই । বঙ্গবন্ধু আর ওনার পরিবারের সদস্যদের খুন করে কয়েকজন সেনার লোক তো হিরো হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে কতকাল ; হুমায়ুন আজাদ চোখের সামনে খুন হলেন যখন কিনা রাষ্ট্র জানত যে উনি খুন হবেন । এরকম সময়ে শিশুপাঠ্যা বইয়ের খাবার তৈরির নুডলস পাকানো ছাড়া ডিটেকটিভের আর কিছু করার নেই ।
পরাশর বললেন, ব্যোমকেশও অনেকটা এরকম কথাই বলছিল সেদিন আমায় ; ওর সঙ্গে অনেক দিন পর গড়িয়াহাটের বাজারে দেখা হয়েছিল , বেশ বড়ো একটা ইলিশ কিনছিল দু কিলোর কাছাকাছি ওজনের । ও বলছিল ডজনে-ডজনে ঝিন্দের বন্দি তো আমাদের রাজনীতিকরা আকছার বানাচ্ছেন আর কিডন্যাপের পয়সা তুলছেন । বিধানসভায় ভোটাভুটি সামাল দিতে সদস্যদের ঝিন্দের বন্দি বানিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে কড়া পাহারায় রাখা হচ্ছে । সেসব কোটি-কোটি টাকার ব্যাপার । আমাদের সময়ে দু’দশ লাখ হাপিশ করা নিয়ে কত চিন্তায় পড়তেন ডিটেকটিভরা ।
আপনি যা বলছেন, হুকাকাশি, কল্কেকাশি, নিশীথ রায়, ইন্দ্রনাথ রুদ্র সবাই এই সুরেই মতামত দিচ্ছিলেন । এমনকি জয়ন্ত-মাণিক-সিন্দরবাবু জুটি , গুপি-পানু-ছোটোমামা জুটি, গোন্ডালু, কিকিরা, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ট্যাঁপা-মদনা জুটি, গোগোল সব্বাই এই লাইনে কথা বলাবলি করছিলেন । বলছিলেন, সমাজটাই রসাতলে গেল তো ডিটেকটিভরা করবেটা কী , শুধু বিয়ের সময়ে কনে-পার্টি বা বর-পার্টিকে ভেতরের খবর জোগানো । সে-ব্যাপারেও ডিটেকটিভ তো আর যাচাই করে বলতে পারবে না যে বিয়ের বর বা কনে আগে কতজনের সঙ্গে শোয়াশুয়ি করেছে ।
—তা যা বলেছিস । দেখি তো আজকালকার ছেলেমেয়েদের ।
পরাশরকে পেছনে বসিয়ে রিমা প্রথমে ওনাকে বাড়ি পৌঁছে দিল , তারপর গেল দিদি-জামাইবাবুর বাড়ি । দিদিকে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা , যাতে দিদি সীমা নিজেকে শারদা পারিখে বদলে নিতে সময় পান । অন্য কেউ তেমন নেই যাকে বিশ্বাস করে কাজটা দিতে পারবে রিমা ।দিদি এর আগে রিমাকে ওর কাজের ব্যাপারে নানাভাবে সাহায্য করেছেন ; এখন সাসপেন্ড হয়ে রিমা ওর দপতরে তেমন সাহায্য পাবে না তাো জানেন । রিমা নিজে শারদা পারিখ সাজতে পারবে না , কেননা সংবাদপত্র আর টিভির রিপোর্টাররা ওর মুখ চিনিয়ে দিয়েছে জনসাধারণকে । পাবলিকের চোখে রিমা খান এখন নোংরা পরি, একটা বহুল-প্রচারিত দৈনিকে পরির ঢঙে ডানা এঁকে দাখানো হয়েছিল , ভয়ার্ত পুরুষদের ওপর উড়ছে পায়ে ঈগল-নখ বের করে, আর পুরুষেরা কুঁচকিতে হাত চাপা দিয়ে কুঁকড়ে কুঁজো হয়ে রয়েছে, দেখেছেন দিদি, কাটিংটা আছে ওনার কাছে ।
দামি সিল্কের শাড়িতে শারদা পারিখে রূপান্তরিত সীমা ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে মাইক সান্যালের মোবাইল আর অফিসের টেলিফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করতে, মাইক সান্যাল পরশু সকাল দশটার সময় দিলেন ।
নির্ধারিত দিন ও সময়ে সীমা পোঁছে গেল মাইক সান্যালের ডগ ব্রিডিং সেন্টারে । মাইক সান্যালের কেনেলে পিট বুল কুকুরের বাচ্চা ছিল না । বললেন, আনিয়ে দিতে পারে, দক্ষিণ ভারতের সন্মুখানন্দনের পিট বুল বিচ সম্প্রতি তিনটে বাচ্চা দিয়েছে । সীমার অনুরোধে উনি কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র যাদের পিট বুল বিক্রি করা হয়েছে তাদের দশ বছরের খতিয়ান দিলেন । ছোটো বোন যেমন নির্দেশ দিয়েছে , আরও পুরানো রেকর্ড পাওয়া যাবে কি না জেনে নিয়ে সীমা তার একটা তালিকার জেরক্স নিয়ে মাইক সান্যালকে জানাল, এনাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিছুদিনের মধ্যেই ।
ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ ইতিমধ্যে রিমাকে জানিয়েছেন যে পিঁপড়েগুলোকে দুই ধরণের পেস্টিসাইড প্রয়োগ করে মারা হয়েছে । কয়েকটি পিঁপড়েতে পাওয়া গেছে চিনির সঙ্গে মেশানো বোরিকাম অ্যাসিডাম । অন্য কয়েকটি পিঁপড়েতে পাওয়া গেশে এনডোসালফান , যা ওনার মতে মাটিতে ছিল , এবং পিঁপড়েগুলোর গায়ে লেগে থাকা মাটিতে কেমিকালটির অবশেষ থেকে থাকবে । বাড়িটিতে যেহেতু ফুলের বাগান ছিল, হয়তো ফলেরও, মনে হয় বাগানে কখনও এনডোসালফান ছড়ানো হতো। এনডোসালফান অন্যান্য দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়ে থাকলেও ভারতবর্ষে হয়নি । ভারতে হিন্দুস্তান ইনসেকটিসাইডস তা তৈরি করে । পিঁপড়েগুলো মাসখানেক আগে মরেছে । সেকারণে অনুমান করা যায় যে চিনির সঙ্গে মেশানো বোরিকাম অ্যাসিডামই তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে । কোনো পেস্টিসাইডই চিনির সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি হয় না । পিঁপড়ে মারার জন্যেই চিনি মেশানো হয়ে থাকবে । অন্য কীটেদের মিষ্টিমুখ করাবার দরকার হয় না ।
রুচিষ্মিতার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে পর্যন্ত রিমা এমন কাউকে ভেবে পাচ্ছে না যাকে বলবে বাঙলোবাড়িটার দিকে রাতে নজর রাখতে ।ম খগেন-রেজাউলরা ভুতের ভয়ে যাবে না কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে মাসখানেকের ডেরা ডালতে । কোনো ছিঁচকে অপরাধী বা ইনফরমারকে হাজতের ভয় দেখিয়ে যে নজর রাখতে বলবে, তারও উপায় নেই । জানাজানি হলে পরের দিনই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ডানা-ওড়ানো মোটর সাইকেলে নোংরা পরির কার্টুন বেরোবে ।
৭. কংকাল পরিদর্শন
—আমাকে তো বলা হয়েছিল যে একজন পুলিস অফিসার এসে আমাকে পিক আপ করে নেবেন । তা আপনি ? ডাকতার ওহদেদার বললেন রিমাকে । ওহদেদার পুলিস-প্যানেলের একজন খ্যাতিমান শল্যচিকিৎসক ; একটি বেসরকারি হাসপাতালে, যাতে উনি অংশীদারও বটেন, অপারেশান থিয়েটারে মাস্ক পরার জন্যেই পাঁচ অঙ্কের ফিস নেন , সব-সমব তা বিল বহির্ভূত ; বিলে যে চার্জ দেখানো হয় তা আলাদা । স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের শল্যচিকিৎসার ক্লাস নেন । জটিল পুলিস কেস থাকলে ওনার ডাক পড়ে । রিমা খান দৌড়ধুপ করে ওহদেদারের ডাক পড়িয়েছে কংকাল প্রেমিক কেসের জন্য।
—স্যার, আমিই সেই পুলিস অফিসার । আমার নাম রিমা খান । বিরক্তি চাপার অভ্যাস হয়ে গেছে রিমার, এই ধরণের বাতুল প্রশ্ন শুনে-শুনে । কেউই সহজে মেনে নিতে পারে না যে বাঙালি-সমাজে মহিলা পুলিস ইন্সপেক্টর হতে পারে । বড়োজোর আই পি এস অব্দি তাদের কাছে অ্যালাউড । সকলেরই চাই ন্যালা-ক্যাবলা নেকি-নেকি বাঙালি মেয়ে , যে গান গাইবে আর নাচবে, রঙমাখা ফিল্ম বা টিভি স্টারদের ঢঙে , সেই সঙ্গে রান্নাঘরে মিক্সি ঘোরাবে, মাইক্রোওয়েভে দুধ গরম করবে, টোস্টারে ব্রেড ঢোকাবে বের করবে, ওয়াশিং মেশিন চালাবে , পর্দা টাঙাবে, আলো নেভাবে, কনডোম পরিয়ে দেবে, তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে দুর্গন্ধ আর দুর্ব্যবহার সহ্য করবে , ডে ইন ডে আউট । বাইরের কাজ মানেই পুরুষ ।
—খান ? মহিলা পুলিস অফিসার আমাদের দেশে আছেন জানতাম না তো । অথচ সবাই ব্যাড পাবলিসিটি করে যে আমাদের দেশটায় কোনো সামাজিক প্রগতি হয়নি, বাঙালি মুসলমানরা নাকি দেশভাগের পর আরও খারাপ অবস্হায় পড়েছে । অবাক, সত্যিই অবাক, সার্জেন ওহদেদার হেরো-হেরো প্রশ্ন তুললেন ।
—খান আমার পদবি স্যার । আমরা রাঢ়িশ্রেণী ব্রাহ্মণ , ভরদ্বাজ গোত্র । সুলতানি আমলে আমরা ময়মনসিংহে জায়গিরদারি ্রেয়েছিলাম , তার সঙ্গে খান উপাধিও । রিমার এই বাক্যটা ওগরাবারও অভ্যাস হয়ে গেছে , মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে এই ধরণের বোকা-বোকা প্রস্নের জবাব দিয়ে-দিয়ে । যারা উঁচু জাতের তাদের ঠোকরানো যায় ব্রহ্মণ প্রসঙ্গ তুলে আর জায়গিরদারিটা বাড়িতি ক্যাঁৎকা । অবশ্য অবস্হা বুঝে নিজেকে মুসলমান বলেও চালিয়ে দেয় অনেক সময়ে ; কোনো মুসলমানের কাছ থেকে তথ্য পেতে হলে তরকিবটা ভালো কাজ দেয় ।
—গুড গুড । আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল বগুড়ায় । আমার দাদু অবশ্য আগেই চলে এসেছিলেন । আমাদের এই তিনতলা বাড়ি ওনারই তৈরি । আপনি বেশ বোল্ড । এরকম একটা কেস নিলেন , এ তো একেবারে ডেডম্যানস ডেড কেস বলে শুনেছি । ওহদেদার ইঙ্গিতে জানাতে চাইলেন যে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেননি ; সন্মানের সঙ্গে এসেছেন ।
—এই কেসটা আমায় সমাধান করতেই হবে স্যার । ডিজি, মানে, ডায়রেকটর জেনারাল বলেছেন এই কেসটা সমাধান করলে আমি প্রোমোশান পাবো । প্রোমোশান আটকে আছে লক আপ ডেথ কেসের কারণে । কংকালের কেসটা প্রায় ক্লোজ করে দেয়া হয়েছিল । ওনার আদেশে আবার ওন করা হয়েছে । আমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছি । ঘ্যামাঘ্যামা ইনভেসটিগেশান অফিসার তিনচার বার কংকালটা দেখে রিপোর্ট দিয়েছেন যে কোনো ক্লু নেই । নিছক স্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা । আপনার নাম আমি বিশেষ জোর দিয়ে ইনক্লুড করিয়েছি । বুড়োটাকে খোঁচানোর ফল উল্টো হতে পারে অনুমান করে রিমা যৎসামান্য পিছু হাঁটলো । বুড়োটার কানেকশান-টানেকশান নাকি সরকারি-বেসরকারি ওপরে-নিচে সব স্তরে ।
—তাই নাকি । ও আপনিই সেই মহিলা অফিসার যার থানায় বেকসুর লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে পেটানো হয়েছিল । পেপারে পড়েছিলাম , পুলিসের দৌরাত্ম্য এমন অবস্হায় গিয়ে ঠেকেছে যে মহিলা রইসারও পিটিয়ে মেরে ফেললেন কাউনে । টিভিতেও বোধহয় প্রোগ্রাম দেখেছিলুম আপনাকে নিয়ে কী যেন একটা । খোঁচা-খাওয়া ওহদেদার পালটা-খোঁচা দিলেন । ভিজিটের ফিস তো পাবেনই । খোঁচা দেয়াটা উপরি আয় হল–ইগোর মাশুল ।
—পিটিয়ে মারা হয়নি স্যার । অযথা মিডিয়া একটা স্টোরি তৈরি করে আমার বিরুদ্ধে পাবলিসিটি করেছিল । ওদেরও ধারণা ছিল যে আমি মুসলমান এবং অ্যাডিশানালি মহিলা । আপনি কি এখন যাবেন ?
রিমা বলল না যে পিটিয়ে মারেনি, স্রেফ ববিটাইজ করে দেবার ভয় দেখিয়েছিল । মহিলা বলে মাস্তানটা টিটকিরি মেরেছিল , তাও থানার ভেতরে, কন্সটেবলদের সামনে । রিমা বলেছিল, তোরা ছেড়ে দে , একে আমিই বাতলাচ্ছি , রিমার হুড়কো বলতে কী বোঝায় । তারপর ইন্সপেক্টর রিমা খানের চোস্ত এমসিবিসি । কোনও যুবতীর মুখ থেকে যে এরকম গালাগালের ফোয়ারা বেরোতে পারে তা বেচারা পাকতাড়ুয়া অপরাধী অনুমান করতে পারেনি । শুধু অপরাধীদের মনে ভীতি উৎপাদনের জন্য নয় , অধস্তনদের কাছেও একটা ছবি তৈরি করার প্রয়াস কাজ করেছে রিমার মধ্যে , চাকরিতে যোগ দেবার পরই । তাছাড়া পুরুষদের ভয় দেখালে ওর বেশ যৌন আরাম হয় । ববিটাইজ করার ভয় দেখিয়ে যখন শরীরে অরগ্যাজম হবার ঝিলিক ওঠে, তখন পেটানির কাজটা সাবইন্সপেকটর আর হেড কন্সটেবলের হাতে-পায়ে-জুতো-লাঠিতে ছেড়ে দেয় । একবার তো হয়েও গিয়েছিল ; এত ভালো লেগেছিল সেদিনকে ।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, বললেন ডাকতার ওহদেদার, যাব বলেই তো রেডি হয়ে আছি ; আমার জরুরি জিনিসপত্র আগেই গাড়িতে রাখিয়ে দিয়েছি । ওহদেদার চশমার কাঁচ ওপরে তুলে ঝুলন্ত মাকড়সার জাল দেখতে পেলেন । কাজের বউটাকে, ফিরে এসে, ঝুল ঝাড়তে বলতে হবে — কোথা থেকে যে আসে এই ফিনফিনে মাকড়সাগুলো, চশমাপরেও দেখা যায় না ব্যাটাদের । সার্জেনের স্ত্রী বলে মিসেস ওহদেদার কোনো-কিছুর দিকেই তেমন নজর দেন না , আয়নার দিকে ছাড়া , নিজেকে নিঃশব্দে শোনালেন ওহদেদার ।
—আমো মোটর সাইকেলে এগোচ্ছি স্যার , আপনার ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে পথনির্দেশ করে দিয়েছি । আমি এগোচ্ছি । আপনি আসুন তাহলে । একটা সিনপসিস লিখে রেখেছি কেসটার; আপনি গাড়িতে বসেই পড়ে নিতে পারবেন । একটা পুরানো কংকাল দেখে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে হবে আপনাকে , যাতে আমরা একটা নির্ণয় নিতে পারি যে মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক ছিল, অস্বাভাবিক হলে হত্যা না আত্মহত্যা । এই নিন স্যার । বার বার স্যার বলতে হচ্ছে বলে একটু আবছা অপমান বোধ করছিল রিমা । কিছু করার নেই । লোকটা অধ্যাপনাও করে ; ফলে স্যার শুনতে অভ্যস্ত । যদিও কলেজে-কলেজে ছাত্র-ছাট্রীরা আজকাল অধ্যাপকদের অ্যাবরিভিয়েট করে ফেলেছে । লেকচারারকে লেকচু, রিডারকে রেড্ডি, প্রফেসরকে পাফি ।
বিশাল বাঙলোবাড়িটায় আগেই, এক-কালের সাকরেদ এক সাব-ইন্সপেকটরকে দুজন কন্সটেবলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল রিমা খান । কন্সটেবল দুজনকে রিমা ব্যক্তিগত অনুরোধ করে এনেছে । তারা গেট খুলে যে-ঘরে কংকাল প্রেমিক হাসিমুখে দাঁত বের করে শুয়ে আছে , সেখানে মুখ গোমড়া করে বা মুখে গুটকা পুরে অপেক্ষা করছিল। রিমাকে আসতে দেখে স্যালুট ঠুকল । রিমা বলল, তোরা গেটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা কর , বুড়ো ডাকতার এলে খাতির করে একজন নিয়ে আসিস । বেশি কথা বলিসনি । বুড়োটার পয়সার আর অপারেশান টেবিলে রুগি মারার গোমর আছে । কম বয়সে জেলা হাসপাতালে থাকতে ওষুধের হেরফের করত পাবলিকের ঠ্যাঙানিও খেয়েছিল তাই , এখন অগাধ টাকার মালিক ।
সার্জেন ওহদেদারকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে কন্সটেবল দুটো গেটে চলে গেল পাহারা দিতে যাতে কোনো অনুসন্ধিৎসু ঢুকে না পড়ে । এত বেকার দেশটায় যে যারা রাজনীতিকদের পোঁ হতে পারেনি বা বিচি ধরে ঝুলতে পায়নি তারা কোথাও কিছু দেখলেই জুটে যায় ; বাড়ি ফিরবে দুপুরের খাবার সময় । নানা খবর জুটিয়ে বিকালে চায়ের ঠেকে গিয়ে গপপো ফাঁদবে ।। তারপর ক্লাবে গিয়ে এইসান হল, ওইসান হল, গেঁড়া একটা চাদে , কালো, খাতায় লিখে নিস । কালীপুজো বা দুর্গাপুজোর চাঁদা তোলার পর কালো চা-অলার হিসাব হবে । প্রমোদ দাশগুপ্ত অবিবাহিত ছিলেন তো কি ; ক্লাবে-ক্লাবে ওনার বংশধররা অবিবাহের ভোজ খাচ্ছে ।
—আসুন স্যার । কংকালটা যেভাবে ছিল তেমনভাবেই রাখা আছে । কেউ এর ক্লেম করেনি ; কোনো উত্তরাধিকারীরও কংকালটার আছে কি না খোঁজ পাওয়া যায়নি । আমরা ঘরের ভেতরে আরও কয়েকটা জিনিস পেয়েছি , তবে আপনি কেবল কংকালটা সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দেবেন । প্রথম প্রশ্ন হল, কংকালটা পুরুষের না নারীর ?
—কংকালটা যে পুরুষের তা আপনি লে-ম্যান, আই মিন মহিলাদেরও তো লে-ম্যান বলা হয় বোধহয় , লে-উওম্যান তো শুনিনি, এনি ওয়ে, সাধারণ মানুষ হিসাবেও দেখলে বুঝতে পারবেন । তবে যেহেতু এটা পুলিস কেস, আপনারা মনে করছেন সামবডি মাস্ট হ্যাভ অ্যারেঞ্জড ফর হিজ ডেথ, তাই কংকালটার সেক্স আইডেনটিফাই করার পয়েন্টগুলো বলি আপনাকে ।
সকালে ডেড বডি দেখলে ওহদেদার শ্রীহরি শ্রীহরি বলেন, হরি তাঁদের পারিবারিক দেবতা, বগুড়ার সময় থেকে । মনে-মনে বললেন মন্তরটা । এমবিবিএস আর এমএস পাশ করেছেন এই মন্তরের জোরে । স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে এই মন্তরটা কাজে দিচ্ছে । অবশ্য অপারেশান টেবিলে শোয়া কোনো-কোনো রোগির ক্ষেত্রে কেন যে মন্তরটা কাজে দেয় না তার একটা উত্তর উনি নিজেকে বুঝিয়েছেন : ফিসটা কাটাকাটির ঘামের চেয়ে কম ছিল ।
—প্রফেসর ওহদেদার, আমি কংকালের একটা ড্রইং এনেছি । আপনি স্পটগুলো ডিমারকেট করতে থাকুন, আমি ড্রইংটায় সেই জায়গাগুলো মার্ক করে লিখে নেবো । কেসটা যদি শেষ পর্যন্ত আদালতে পৌঁছোয়, তাহলে পাবলিক প্রসিকিউটারকে ব্রিফ দিতে সুবিধা হবে । আপনি যা-যা বলবেন তা-ও রেকর্ড করে নেবো । আমি সঙ্গে টেপ রেকর্ডার এনেছি । কেননা লে-উওম্যান হিসাবে টেকনিকাল ডিটেইলসগুলো মনে রাখতে পারব না ।
—ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ, পুরুষদের কংকাল মাপে বড় , লম্বা আর ভারি হয় । স্ত্রীলোকের বক্ষপিঞ্জর পুরুষের চেয়ে আকারে ছোটো কিন্তু ওপরের অংশ পুরুষের চেয়ে তুলনামূলকভাবে চওড়া । মুচকি হাসি সহযোগে মুচমুচ করে বললেন ওহদেদার সার্জেন । বিদেশ হলে এই কংকালটা নারীর কিনা তা নিয়ে আপনাকে প্রাথমিকভাবে চিন্তা করতে হতো , এর উচ্চতার জন্য । আমাদের দেশে এত দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে হয় না , আই মিন মহিলা হন না । এমনকি এই পুরুষটিও আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দীর্ঘদেহী । বিশেষ করে বাঙালিরা সচরাচর এত লম্বা হন না ।
—আজ্ঞে, আমরা যা এভিডেন্স পেয়েছি, তা থেকে একটা নির্ণয়ে পৌঁছোনো গেছে যে ইনি বাঙালি, ভারতে নানা অঞ্চলে ঘুরেছেন, বিদেশেও ছিলেন , অনেক নরক-স্বর্গের শরবত খেয়েছেন ।
লোকটা যে মাগিবাজ ছিল তা সংগ্রহ করা তথ্যসামগ্রী থেকে জেনে গেছে রিমা । লম্পট পুরুষ শুনলে ওর নিজেরই যৌনতা টনটন করে , দেহে ফুরফুরে অনুভূতি হয় । সমকামী শুনলে অসহ্য লাগে, তা সে নারী হোক বা পুরুষ ; ওর মনে হয়, দিই জানোয়ারগুলোকে অন্তিমযাত্রার খোরাক । রিমা এখনও ভার্জিন ; ভার্জিনত্বের ব্যাখ্যাহীন গর্ব আছে ওর । ওটা ইনট্যাক্ট রেখেছে লিগাল বরের জন্য । যদিও ম্যাস্টারবেট করার দরুণ হাইমেন ছিঁড়ে গিয়ে থাকবে । লিগাল বর কবে জুটবে বা অদৌ জুটবে কি না জানে না । কাউকেই রিমার পছন্দ হয় না । বিয়ের জুন্যে যে-পুরুষেরই ফোটো মা-বাবা গত এক দশক থেকে দেখছেন দেখাচ্ছেন , সবকটাকেই ওর মনে হয় ক্রিমিনাল টাইপের । পুরুষ মাত্রেই সম্ভবত ক্রিমিনাল , ওর আবছে ধারণা । তাছাড়া যাকে বিয়ে করবে তাকে ধরে আচ্ছা করে উত্তম-মধ্যম না দিলে অরগ্যাজম তো হবে না । আর, কোনো পুরুষের নিচে শুয়ে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা প্রাগৈতিহাসিক । সমাজ যখন মাতৃতান্ত্রিক ছিল তখন মেয়েরা থাকত ওপরে আর পুরুষরা নিচে । এক-এক জন নারীনেতার দশ-বারোটা করে বাঁদা থাকত । নাঃ, কী আবোল-তাবোল ভাবনা আসছে মাথায় ।
—হাঃ হাঃ, এই যে বাহুর হাড়, হিউমেরাস বা প্রগণ্ডাস্হি , উলনা বা অন্তঃপ্রকোষ্ঠী আর রেডিয়াস বা বহিঃপ্রকোষ্ঠী , আর এই যে ডাইয়াফাইসিস আর এপিফাইসিস , দেখুন, বেশ মোটা আর লম্বা । সার্জেন জানে এবার তার টেকনিকাল জার্গন হেঁকে মাঠ দখল করার পালা । বড় এসেছেন মহিলা পুলিস, বোঝো এবার ।
—হাতের পাতা ? রিমা টের পেল যে ওহদেদার এবার দেদার জার্গন ঝাড়বেন । ঝাড়ুন । টেপরেকর্ডার আছেই । চিহ্ণগুলো দিয়ে রাখছে , পরে ডিটেইলসে লিখে নিতে পারবে ।
—বলছি, আই অ্যাম কামিং টু দ্যাট । এই যে দেখছেন হাতের পাতার অস্হি, ওসা ক্র্যানাস । এটা করতলাস্হি বা কারপালস ; এগুলো করাঙ্গুলিমূল-শলাকা বা মেটাকারপালস , আর এই অঙ্গুলিফলক যাকে, আপনি জানেন নিশ্চই, আমরা বলি ফ্যালানজেস । পুরুষ বলে এদের মাপ বড়ো । আগেই বলেছি, বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে ইনি দীর্ঘদেহী ছিলেন , এবং এনার বাহুও লম্বা ছিল , যাকে আমরা বাঙালিরা বলি আজানুলম্বিত, হাৎ হাঃ । বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অবশ্য এমন দীর্ঘদেহী লোকজন পাওয়া যাবে । তা তাঁরা তো বাংলাদেশে চলে গেছেন , আই মিন তখনকার পাকিস্তানে । এখানকার বাঙালি মুসলমান, এমনকি কৃষকদের মধ্যেও, এই উচ্চতার মানুষ বিরল । মাঠ দখল করে ফেলায় ওহদেদার খেলতে শুরু করে দিয়েছেন । খেলতে-খেলতে ক্রমে সাবলীল হয়ে গেলেন, যেন ক্লাস নিচ্ছেন ।
—আর তলাকার অংশ ? ড্রইঙে ১, ২, ৩, ৪ এইভাবে নম্বর দিয়ে লিখে নিচ্ছিল রিমা ।
—দেহের নিম্নপ্রান্তে, কংকালে থাকে শ্রোণীবৃত্ত ও নিম্নপ্রান্তের অস্হিগুলো । শ্রোণীবৃত্তের দুদিকে থাকে দুটি প্রসস্ত পেলভিস অস্হি । ত্রিকাস্হি ও অনুত্রিকাস্হির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেলভিস অস্হিগুলো সৃষ্টি করে শ্রোণীচক্র , এই যে, এই অংশে । মুক্ত নিম্নপ্রান্তের অস্হিগুলোর মধ্যে পড়ে উর্বাস্হি , নিম্ন-পায়ের ও চরণের অস্হিগুলো । আর চরণের এই অস্হিগুলোর মধ্যে থাকে গুল্ফাস্হি , পদতলাস্হি ও পদাঙ্গুলিফলক । লিখে নিন, লিখে নিন, ইউ হ্যাভ ইয়োর ওন টাইম ।
—না, স্যার, প্রথমে আমরা ইনি মহিলা না পুরুষ সেই পয়েন্টগুলো আইডেনটিফাই করে নিই । আমি জানি ইনি পুরুষ । কিন্তু কোর্টকে তো জানাতে হবে কি-কি দেখে এনাকে পুরুষ ঘোষণা করা হল , এবং কোন বিশেষজ্ঞ তা করলেন ।
—ফাইন । পুরুষ ও মহিলা কংকালের প্রধান পার্থক্য হল, মহিলাদের দেহে সন্তান জন্ম দেবার ব্যবস্হা থাকে । এই যে এই দিকে নজর দিন , আপনার ড্রইঙে মার্ক করে নিন । মেয়েদের পেলভিস আকারে ছোটো হলেও তা শ্যালো এবং চওড়া ; ক্যাভিটি গোলাকৃতি । এটা দেখছেন , মেয়ে হলে ইলিয়াম অস্হির ডানার অংশ বেশি ছড়ানো হতো , ত্রিকাস্হির প্রমোন্টারি পেলভিসের শূন্যস্হানের ভেতর কম ঢোকা হতো । ইনি পুরুষ বলে দেখুন এনার ক্ষেত্রে সিমফাইসিসের নিচে দুই পিউবিসের নিচের শাখা দুটো নিজেদের মধ্যে যে-কোণ রচনা করেছে তা সমকোণের চেয়ে ছোটো । মহিলাদের ক্ষেত্রে তা স্হুলকোণ আর তা প্রায় ধনুকের মতন । গাইনাকদের তো পেলভিসের মাপ জানা খুবই জরুরি । যাক সার্জেন এবার পুলিসি প্রয়োজনে সিরিয়াস হচ্ছেন ।
—স্যার, আপনারা দেহের ভেতরটা ভাবতেই অভ্যস্ত । আমরা বাইরেটা । মৃদু খোঁচা দিল রিমা । দশজনের ভিড়ের ভেতর কেবল মেয়েদের দিকেই তাকিয়ে দেখে পুরুষগুলো , কি বুড়ো, কি ছোঁড়া ।
—কশেরুকার শেষভাগের খোঁচা-অস্হি বা কচিক্স, মানুষের পূর্বপুরুষদের ল্যাজের অংশ , এই যে, মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা মুভেবল । পুরুষদের হাড়কে আকৃতি দেয় টেসটোসটেরোন হরমোন আর মহিলাদের এসট্রোজেন ।
—মাথাটা সম্পর্কে জানা হয়নি ।
—মাথা ? ইউ মিন করোটি , কৈনিয়াম ? এদিকে আসুন । হাত দেবো কি ? আচ্ছা, বসুন, বসে দেখুন, হাত দেবার দরকার নেই । করোটির পেছন দিকটা দেখছেন , উঁচু একটা বাল্জ , এক্সটারনাল অক্সিপেটাল প্রোট্রুবারেন্স , ইনি পুরুষ বলে এই অংশ বেশ প্রোনাউন্সড । চোয়ালের হাড় দেখুন , আমরা বলি ম্যানডিবল, এটি পুরুষের বলে অ্যাংগুলার আর চৌকো । মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা গোলাকার এবং পয়েন্টেড হয় । প্রকৃতি নারীকে হাড়ের দিক থেকেও সুন্দর রেখেছে । আপনাকে জন্ম নিতে হলে একটি সুন্দর জায়গা থেকেই তো পৃথিবীতে আসতে হবে । আসার পথটা অবশ্য রক্তময় , তা জীবনযুদ্ধে আপনাকে তৈরি করে পাঠাবার জন্যে সুন্দর গৃহে গড়েপিটে তারপর পাঠানো হয় যুদ্ধক্ষেত্রের রক্তভূমিতে । এইবার আপনি জগতে এসে কী করবেন তা আপনাকে নির্ণয় নিতে হবে ।
—করোটিতে কি কোনো আঘাত দেখছেন ?
—না, আঘাত অ্যাজ সাচ, মানে কেউ পিটিয়ে বা ভারি জিনিস দিয়ে মাথায় মেরে খুন করেনি এনাকে । কিন্তু কিছু ব্যাপার স্ট্রেঞ্জ । তা হল হাড়ের সঙ্গে হাড়ের সংযোগগুলো দেখুন । অস্হিসন্ধিগুলো কয়েকটা অংশে খুলে গেছে । আপনারা পুলিসের লোকেরা আর হলিউডের ক্রিমিনালরা শুনি হাত-পা টেনে-টেনে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে কথা আদায় করলে যেমন হবে । কিন্তু সেক্ষেত্রেও এভাবে ডিসজয়েন্টেড হবে না । আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করছি । তা হল দাগগুলো । এরকম আঁচড়ের দাগ কেন হাড়গুলোয় , বিভিন্ন জায়গায়, এবং কেবল একদিকেই বেশি । খাট থেকে ভদ্রলোক কি করে পড়ে গেলেন ? পড়ে মরে গেলেন ? নাকি হঅর্ট অ্যাটাকটা ওনাকে ফেলে দিল ? হ্যাঁ, তাও হতে পারে , ম্যাসিভ একটা হার্ট বা সেরিব্রাল কান্ডিশান হয়ে থাকতে পারে । ভদ্রলোক ডেথ বেডে থাকলে আমি বলতে পারতাম তা ঘটৈছে কিনা । এখন এনার যা অবস্হা , আপনাকে কোনো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে ।
—কোন কোন জয়েন্টগুলো ডিসজয়েন্টেড , তা যদি একটু বিস্তারিত বলেন তো ভালো হয় স্যার ।
—এই দেখুন, স্কন্ধবৃত্তের অস্হিসন্ধি ; অক্ষকাস্হি বা ক্ল্যাভিকুলা তার দুই অন্তভাগ দিয়ে জোড়া থাকবার কথা , একদিকে উরঃফলক বা বক্ষাস্হির ম্যানুব্রিয়ামের সঙ্গে ও অন্যদিকে অংশফলকের অ্যাক্রোমিয়াল উদগত অংশের সঙ্গে , ফলে তৈরি হয় দুটি অস্হিসন্ধি । উরৎফলক-অক্ষকাস্হি সন্ধি আর অ্যাক্রমিয় অক্ষকাস্হি সন্ধি । ভালো করে লক্ষ করুন , সন্ধিগুলো আলগা । এবার ডান হাতের কনুইয়ের অস্হিসন্ধি লক্ষ করুন । এটা তৈরি হয় তিনটি অস্হিসংযোগে : প্রগণ্ডাস্হি , অন্তঃপ্রকোষ্ঠাস্হি আর বহিঃপ্রকোষ্ঠাস্হি । আলগা । খুলে গেছে । জোড় আলগা হয়ে রয়েছে । একইভাবে হাঁটুর, ডান হাঁটুর, অস্হিসন্ধিও ডিসজয়েন্টেড । দেখুন , এটা তিনটে অস্হির সংযোগে তৈরি : উর্বাস্হি , জঙ্ঘাস্হি আর জানুকাপালিক । আমরা ডাকতারি পড়ার সময়ে ডেডবডির এই জয়েন্টগুলো স্টাডি করতুম । কেসটা এরকম ইনটারেসটিং জানলে আমি কয়েকজন ছাত্রকে সঙ্গে আনতুম ।
—কেস শেষ হয়ে গেলে কংকালটা অযথা আমাদের মালখানায় পড়ে থাকবে । তার চেয়ে আপনাদের দেবার জন্যে আমি অনুরোধ করব । আপনিও ডিজি সায়েবকে বলে রাখবেন । আর কোনো জয়েন্টে আছে কি ব্যাপারটা ?
—হ্যাঁ, বক্ষদেশের সংযুক্তি , ডান পায়ের কব্জির অস্হিসন্ধি , রগের ও চোয়ালের অস্হিসন্ধি এবং ডান দিকের উরুসন্ধি । দেখুন, দেখুন, এতক্ষণে তো আপনিও কিছুটা এক্সপার্ট হয়ে গেছেন ।
—ওকে, থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার ।
—আপনারা কি অনুমান করছেন ? আত্মহত্যা না মাডফার ? স্বাভাবিক মৃত্যু যে নয় তা আমি আপনাকে এখনই বলে রাখছি । এনার স্পাইন আর ব্রেনে সম্ভবত ইনফেকশান হয়েছিল । আপনার আগে যিনি তদন্ত করেছিলেন তিনি কিছু খুঁজে পাননি ? অবশ্য কেউ যদি কংকালটা টানাটানি করে থাকেন তাহলে আলাদা কথা ।
—আমরা অস্বাভাবিক মৃত্যু মনে করেই এগোচ্ছি । আসলে প্রবলেম হল যে বাড়িটা আর বাড়ির এই ঘর, দুটোই ভেতর থেকে বন্ধ ছিল । তার আগের তদন্তকারী আধিকারিকদের প্রসঙ্গ ওঠায় বিরক্ত হল রিমা । সুমন মিশ্র , সে তো পুরুষ অফিসার, ফাঁকিবাজ, রাজনীতি নিয়ে কপচানিতে তার দিন কাবার হতো , পার্টি না করলে বাজে জায়গায় পোস্টিঙের ভয় ছিল । এ-সব কেসে তো আর মাল-কড়ি নেই । মাল-কড়ি না থাকলে রিমাও বিশেষ আগ্রহ দেখায় না, মানে দেখাত না, সাস পেন্ড হবার আগে পর্যন্ত । এই কেসটা বাধ্য হয়ে তদন্ত করছে । খুঁজে বের করতেই হবে অপরাধীকে । ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আগের তদন্তকারী অফিসারকে যে রিপোর্ট দিয়েছেন , তা নির্ভুল নয়, কেননা তখন ফরেনসিক দপতরটায় লোকবল আর যন্ত্রপাতি-কেমিকাল ছিল না । তবু উনি যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে আছে যে কংকালটা আনিমানিক দশ বছর পড়ে আছে ; স্পাইনে ইনফেকশান হলেও, তা মৃত্যুর কারণ নয় । যদি কংকালটা অসুখের কারণে কোমায় চলে গিয়ে থাকে , তাও নাকি মৃত্যুর কারণ নয় । কংকালের গায়ে আঁচড়ের দাগ আর অস্হিসংযোগের বিচ্ছিন্নতা সন্দেহ জাগায় । বাড়িটা এতকাল পড়ে আছে অথচ প্রোমোটার বা জবলদখলকারীদের নজরে না পড়ায় কংকালটা শুয়ে আছে দশ বছর হাসি-মুখে । পুলিস সিল করে দিয়েছিল বাড়িটার গেট আর সদর দরজা , সেগুনকাঠের সদর দরজা ।
—তাহলে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন ? আপনাদের তো প্রতিদিনকার ক্রিমিনাল ডাটাই প্রচুর । অপরাধ কম দেখানোতেই যখন আপনাদের স্বার্থ তখন কেন এই কেঁচো খোঁড়া ?
—তার কারণ এই ভদ্রলোক, নিরঞ্জন দতত, যদিও ওটা ওনার প্রকৃত নাম না ছদ্মনাম তা এখনও লিগালি স্পষ্ট নয়, এই লোকটি যে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক তা ঘরগুলোর ডেকোরেশান আর কিউরিও সামগ্রী থেকে স্পষ্ট । স্হাবর সম্পত্তির কাগজ পাচ্ছি না আমরা । অস্হাবর কি-কি ছিল তাও ক্লিয়ার হয়নি এখনও । ব্যাংকের, নিবেশের কাগজ, মোবাইল ফোন, মানে এনার টাকাকড়িউর হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না । সেগুলো গেল কোথায় ? আত্মীয়-স্বজন একেবারেই নেই এরকম মানুষ তো বিরল । আর বৈভবশালীর মৃত্যুতে সাধারণত আত্মীয়দের কিউ লেগে যাবার কথা !
—আচ্ছা, আমি চলি । একটা ক্লাস আছে আজকে । যদি আরো কিছু জানার থাকে কনট্যাক্ট করবেন ।
—চলুন স্যার আপনাকে পৌঁছে দিই ।
—না না, আপনি নিজের ইনভেসটিগেশান কমপ্লিট করুন । আমি তো গাড়ি করে এসেছি । প্রায়ভেট ডিটেকটিভ কেউ আগ্রহ দেখাননি ? কেসটা তো ইনটারেসটিং । ওনারা তো এই টাইপের কেস হিসট্রি থেকে জব্বর একখানা বেস্টসেলার নামিয়ে দেন ।
—আমি নিজেই গিয়েছিলাম ব্যোমকেশ বক্সি, কিরীটি রায় আর পি সি মিটারের কাছে । ব্যোমকেশবাবু বৃদ্ধ হয়েছেন , চোখে দেখতে পান না । ফেলুদা সিনেমা থেকে সময় করে উঠতে পারছেন না , আর কিরীটি রায় তো নীহাররঞ্জন মশায়ের নতুন অমনিবাস সংস্করণ বের করায় ব্যস্ত । তবে তিন জনেই মনে করেন যে ওনারা যখন কেস নিতেন তখন ডিটেকটিভকে বলা হতো সত্যান্বেষী ; বর্তমানকালে সত্য জিনিসটা বলপ্রয়োগের ব্যাপার , যার হাতে ক্ষমতা সে-ই সত্যের মালিক ।
—আমার সঙ্গে একজন অভিজ্ঞ সত্যান্বেষীর পরিচয় আছে । কর্ণেল নিলাদ্রী সরকার । ডিটেকটিভ হিসাবে নাম-ডাক করেছেন । বলেন তো ওনাকে কেসটার কথা বলি ।
—না স্যার, ওনারা বেশ ব্যস্ত লোক । পূজা-পার্বণ লেগেই থাকে পত্রিকার অফিসগুলোয় , জানেনই তো । কর্ণেল সায়েবের সঙ্গে দেখা করেছিলাম । উনি বললেন, ইরাকে আফগানিস্তানে চেচনিয়ায় প্রতিদিন অগুন্তি মানুষ খুন হচ্ছে , তা তো ইতিহাসের পাহাড়ে চাপা পড়ে যায় ; একটা-দুটো হত্যা আর গুপ্তধনের গল্প বইয়ের পাতাতেই শোভা পায় , স্কুলের ছাত্রদেরও কিছুটা টেনশান দূর করে । বললেন, তোর চাকরির ব্যাপার, তুই মাথা ঘামা ।
—তা ঠিক । আরেকজন ছিলেন । আগে বেশ নাম শুনতুম । কিন্তু তিনি আজকাল অ্যাস্ট্রলজির দিকে ঝুঁকেছেন শুনেছি । আপনারা সরকারি ডিটেকটিভরাই সব কেস নিয়ে নিচ্ছেন তো ওনারা কী করবেন বলুন ? ওনাদেরও তো করে-কম্মে খেতে হবে !
—আপনি দীপক চ্যাটার্জির কথা বলছেন তো ? হ্যাঁ, উনি প্রফেশান চেঞ্জ করেছেন । উনি বলছিলেন উত্তরপ্রদেশের ফরেনসিক অ্যাস্ট্রলজিস্ট উপাধ্যায়জির সঙ্গে দেখা করতে । কে খুন করেছে জানলে বা কে খুন হয়েছে জানলে না হয় ফরেনসিক অ্যাস্ট্রলজিস্ট কনসাল্ট করা যেতো । উপাধ্যায়জী, অপরাধী বা সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন আর তার ছক তৈরি করে উত্তর খোঁজেন । কে খুন হয়েছে আর কে খুন করেছে সে-দুটোই তো খুঁজছি । তাছাড়া এনারা সবাই প্যাট্রিয়ার্কাল মাইন্ডসেটের লোক । মহিলা পুলিস অফিসার শুনলে অফেন্ডেড হন , ঘাবড়ে যান ।
—ইজ ইট ? মে বি । বাঙালির সমাজে বিপ্লব-বিদ্রোহ নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ প্লে অ্যাকটিং করেন । প্রকৃত সমাজে তা ঘটতে দেন না । দেখুন না, শতকরা তেত্রিশভাগ মহিলা ক্যান্ডিডেট কোনো দলই দেন না , বিধানসভা বা লোকসভায় সিট দেয়া তো দূরের কথা । কাকাবাবু-সন্তু কী বললেন ? গিয়েছিলেন নাকি তাঁদের কাছে ?
—না স্যার । কাকাবাবুর শুনেছি দুটো হাঁটুই অপারেশান করে পালটাতে হয়েছে । গাড়ি ছাড়া নড়েন না । তাই শান্তিনিকেতনে একটা বাড়ি করেছেন । ওনার ডিটেকটিভ জীবনের যাবতীয় নথিপত্রের একটা সংগ্রহশালা রেখে যাবেন বলে শুনেছি ।
—গুড ডিসিশান । রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ণ তো চোরেরা নিয়ে কোথায় পালিয়েছে আপনারাও জানেন না । নতুন চোরেদের জন্যে নতুন সংগ্রহশালা গড়ে ওঠা প্রয়োজন । গুড গুড ।
ডক্টর ওহদেদারকে গাড়িতে সি অফ করে ফিরে এসে সাবইন্সপেক্টর আর কন্সটেবলদের রিমা খান আদেশ দিল সদর দরজা আর গেট বন্ধ করে সিল করে দিতে । সিল মানে তালায় কাপড় বেঁধে গালা লাগিয়ে চাবির দাগ করে দেয়া । সরকারি সিলের হাজার হ্যাঙ্গাম । পাবলিককে থামাবার জন্যে গালার সিল থাকাটা জরুরি । নয়তি জবরদখল হবে বা প্রোমোটার ঢুকে যাবে । এভিডেন্সগুলো নিয়ে বসতে হবে , ভাবতে হবে, প্রচুর কমপিউটার ডিস্ক পাওয়া গেছে বাড়িটায়, সেগুলো দেখতে হবে । কেননা যেকটা দেখেছে সেগুলো তেলেগু ভাষায় লেখা , অনুবাদ করাতে সময় লাগছে । অক্ষর তেলেগু, লেখা বাংলা ন্যারেটিভ, তাই আরও অসুবিধা । একটা ঘরের খামের ভেতরে মহিলার চুল পাওয়া গেছে । সেটা কার । ড্রেসিং টেবিলের ব্রাশে যে-কটা চুল পাওয়া গেছে, আগের ইনভেসটিগেটিং অফিসার রমেনবাবু লিখেছেন যে সাধারণ চোখে দেখে মনে হয় যে তা একই মহিলার নয় । কুকুরটার দাঁতের ডিএনএ নিয়ে দেখতে হবে যে কংকালটার মাংস কুকুরটাই খেয়েছে কিনা ।
বাড়ির দিকে মোটরসাইকেল হাঁকালো রিমা ।
৮. মায়াবিনী
আমাদের চালাঘরটা, যাকে আমরা বলি কুটির, দুজনে মিলে পুর্ননির্মাণ করে নিয়েছি । ছাত্রছাত্রীরাও সাহায্য করেছিল , তাদের ব্ল্যাকবোর্ড যাতে তাড়াতাড়ি লেপে নিয়ে শুকিয়ে নেয়া যায় । আগের চেয়ে ভালো করে মাটি লেপে নেয়া হয়েছে । মাটি আর পেঁপের গুঁড়ি আনতে বেশ দূরে যেতে হয়েছিল। গাছের ডালে রেখে মশারি শুকোবার আগে আমরা ভিজে মশারি টাঙিয়েই শুয়েছি। আমি এখনও ফোলানো বালিশের অভ্যাস ছাড়তে পারিনি । মায়া এখানে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই বিনা বালিশে শোবার অভ্যাস করে নিয়েছে । আমি অনেক সময়ে আমার বাহুটা এগিয়ে দিই , যাতে বালিশের মত ব্যবহার করতে পারে । মায়া বলে, বদভ্যাস করাবেন না প্লিজ ,বলে জড়িয়ে ধরে । ওকে বলি, ইংরেজি শব্দ থেকে মুক্ত হতে পারছি না আমরা , আপনি তবু চেষ্টা করেন যাতে অসাবধানে বলে না ফেলেন ; আমি পড়েছি গণিত, বাড়িতে ইংরেজিতে কেউই কথা বলতেন না , তবু বলে ফেলি ।
মায়া বলেছিল, আবার অতীতকে টেনে আনছেন ; আমাকে দেখুন , অতীত একেবারে মুছে ফেলেছি , যদিও মস্তিষ্কে অতীতের ঘুণপোকা সহজে মরে না , মারার চেষ্টা করে যাচ্ছি ; একটা ঘুণপোকা মরেনি এখনও । তারপর যোগ করেছিল, দুজনে পরস্পরকে নিয়ে থাকতে পারি, দেখছেন তো ? আধুনিকতার প্রয়োজন একেবারে নেই । আমাদের মধ্যে কোনো মতসংঘর্ষও ঘটেনি ; তার প্রধান কারণ আপনি, আপনার বদান্যতা, উদারচিত্ততা । আমার সব কথাই মেনে নেন ।
—মানব না কেন ? এক ডাকে চলে এসেছি । কত শেখার আছে প্রকৃতিতে । কত কিছু জানেন আপনি । আমাদের চারপাশে এত গাছপালা ঝোপঝাড় , এগুলোর নাম জানি না ; বালু সিরিসৈলমরা শেখায়, অথচ দেখুন, তা সংখ্যায় এত বেশি যে মনে রাখতে পারি না ।
—আমিও তো কত কীট-পতঙ্গ প্রতিদিন দেখছি, সিরিসৈলম, কালেসরম বলেও ওগুলোর নাম, তারপর ভুলে যাই । বাংলায় হলে বোধহয় মনে রাখতে পারতাম।
—লোকে তো কীট বা প্রজাপতি সংগ্রহ করে অ্যালবামে রাখে ।
মায়া উঠে বসল , অত্যন্ত ক্ষুব্ধ । কন্ঠস্বরে বোঝা যাচ্ছিল যে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে বলছে , বলল, আপনাকে বলেছিলাম না , কোনো প্রাণীর ক্ষতি করা যাবে না ; আমাদের অশেষ ভাগ্য যে আমরা এরকম একটা জনবসতি [পেয়েছি যেখানের মানুষ মাছ-মাংস-দুধ-ডিম খাবার সংস্কৃতির বাইরে থাকে ; তার সুযোগ নেই বলেই হয়তো গড়ে উঠেছে এই শাকাহারী অল্পাহারী জীবনযাত্রা । প্রাণী হত্যা আমি বরদাস্ত করতে পারি না । গোরুর দুধ হয় তার বাছুরের জন্য, তাও মানুষ খেয়ে ফেলে , ইনজেকশান দিয়ে গোরুমোষের দুধ বাড়ায়, এতই নির্দয় হয়ে গেছি আমরা । অকল্পনীয় নির্দয়তা নিষ্ঠুরতায় আক্রান্ত হয়েছে মানুষ । তাই জনে-জনে এত ঘৃণা আর দ্বেষ ; দেশে-দেশে যুদ্ধ , মানুষে-মানুষে হানাহানি । সবাইকে না পারি, নিজেকে তো বদলাতে পারি , আপনাকেও তো পারি ।
কি উত্তর দেবো ভেবে পেলুম না । সবকিছু ছেড়েছুড়ে, ‘চলুন পালাই’ ডাক শুনে যখন বেরিয়ে পড়েছিলুম, মনে হয়েছিল অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি । তখন ভাবিনি যে মায়াকে ভালোবেসে থেকে যাব , ওকে ভালোবাসাটাই থেকে যাবার একমাত্র কারণ হবে । অনেক্ষণ চুপচাপ থেকে বলেছিলুম, জানেন, হয়তো জেনে ফেলেছেন, আপনাকে ভালোবাসাটাই আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য এখন , সব সময় মনে হয় হঠাৎ যদি ‘চলুন পালাই’-এর ঢঙে একদিন বলে ওঠেন, ‘আচ্ছা চলি’ , তাহলে কী করব ? নিজের ঠোট দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে মায়া বলেছিল, না, কখনও যাব না, এখানেই মরব, বুড়ি হয়ে ; আপনিও তখন বুড়ো হয়ে যাবেন , আপনার চুল-দাড়ি সব পেকে যাবে । কেমন হবে দেখতে তখন আপনাকে ? নাভি পর্যন্ত পাকা দাড়ি , কাঁধ ছাপিয়ে পাকা চুল । আমার চোখের প্রতিফলনে তো নিজেকে আর দেখতে পাবেন না তখন, কেননা আমার চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, হয়তো ছানি-পড়া ।
আমি জঙ্গলের গভীর অঞ্চলে যেতে চাইলে মায়া বলে, যান, কিন্তু বেশি দূরে যাবেন না , নয়তো কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান । নয়তো বলে, যান, কিন্তু আমি হাঁক পাড়লে চলে আসতে পারেন, এমন দূরত্বেই যাবেন । মায়াও জল ভরতে গিয়ে দেরি হতে থাকলে, আমারও চিন্তা হয়–এই ধরণের চিন্তার অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও এর আগে । কুয়োতলায় ও বেশ সময় কাটায় , জ্ঞান দেয় মহিলাদের, অবিবাহিতা কিশোরীদের— জানতে চাইতে ইচ্ছা হতো যে কীই বা আলোচনা করে তাদের সঙ্গে এতো, কিন্তু মেয়েলি ব্যাপারে নাক গলানোটা উচিত হবে না মনে করে কখনও জানতে চাইনি । একটা চালা থেকে আরেকটা চালা এমন দূরে-দূরে যে কুয়োতলাটাই মহিলাদের মিটিং প্লেস । বালুদের কাছ থেকে যতটা জেনেছি, ওরা নিজেরাই যতটা বলেছে, কুয়োতলাটা মায়ার ভাষা শিক্ষার ক্লাস, সমাজশিক্ষার ক্লাস, আচার-ব্যবহার শেখার ক্লাস । ও অন্তত স্হানীয় বুলি বুঝে ফেলতে, ভাঙা ভাঙা বলতে শুরু করেছে । আমি এখনও বালু-সিরিসৈলমদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল।
কাঁঠাল গাছের দাগ দেখে অনুমান করতে পারি যে আমরা সাড়ে তিন বছরের মতন সময় কাটিয়ে দিয়েছি এখানে । ফেলে-আসা জীবন মনেই পড়ত না প্রায় । আমার গণিত নয় , মায়ার নিজস্ব শারীরিক-গাণিতিক অঙ্কের কারণে ওর গর্ভসঞ্চার হয়নি । কী ভয়ানক বিপদ হতো যদি তা ঘটে যেত । যদিও স্হানীয় বয়স্কা বৃদ্ধারা গর্ভপাতের বনৌষধি হদিশ জানেন, মায়ার মুখেই শুনেছি, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে হতো আমার । প্রকৃতির উচিত ছিল নারীকে এমন একটা ইচ্ছাশক্তি দেয়া যে তারা চাইলেই তাদের মেন্সের দেহপ্রক্রিয়া থেমে যাবে সে যতদিন চায় ।
একদিন ভুলে জিগ্যেস করে ফেলেছিলুম, আপনি গান জানেন ? মায়া মৃদু হেসে বলেছিল, সত্যি অতীত আপনাকে ছাড়তে পারছে না । তারপর অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, আমি বাংলা বা হিন্দি গান জানি না, পাশ্চাত্য গান জানি , জানতুম, বলা উচিত । আমি কিছু জানি কিনা প্রশ্ন করবে না মায়া , জানতুম, তাই যেচে বললুম, আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো লাগত, স্কুল কলেজের ফাংশানে গাইতামও । বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বাংলা-হিন্দি সিনেমার গানও ভালো লাগে ।
এই অঞ্চলে কারোর হাতে ট্র্যানজিসটারও দেখিনি । এরা নিজেদের ভাষায় অনেক সময়ে গেয়ে ওঠে , সে গানগুলো কেমন যেন দুঃখি-দুঃখি লাগে ।
—হ্যাঁ, আপনার কন্ঠস্বর আপনার মতই দরাজ । গণিতবিশেষজ্ঞরা সঙ্গীতে পারদর্শী হন ; সঙ্গীত তো গণিতনির্ভর , ধ্বনির মাপ দিয়ে গড়া । যাকগে, বর্তমানেই বসবাস করুন । কত সুন্দর আমাদের বর্তমান , ভাবুন আপনি, কত শান্তি, আজ পর্যন্ত আমাদের জ্বরজারিও হয়নি । তার কারণ আমরা আধুনিকতার বিষ থেকে মুক্ত ।
আরেক দিন, মায়া শুয়েছিল চাটাইয়ের ওপর, দেখলুম ওর বাঁ পায়ে নুপুরের মতন উলকি আঁকা । বললুম, দেখুন, অতীতের স্মৃতি বহন করছেন শরীরে । দুটো পায়েই করাতে পারতেন । মায়া ফিরে গেল অতীতে, বলল, কলেজের স্মৃতি, ক্লাসের সকলে ট্যাটু আঁকিয়ে নেবার জন্য আমরা দল বেঁধে গিয়েছিলাম ; জনৈক ট্যাটু আর্টিস্ট নতুন স্টুডিও খুলেছিলেন , ফ্রি ট্যাটু এঁকে দেবার প্রস্তাব দিলেন । হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন অতীতের দৃশ্য-অদৃশ্য ভুল বহন করছি শরীরে । তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, মনেও ।
আমি আর প্রস্ন করিনি । চোখ বুজে আমি ওর উলকি-আঙকা পা দেখতে পাই, কী অপূর্ব । দেয়ালে গোবর লেপার সময়ে ওর শাড়ি একটু উঠে গিয়ে উলকি মেলে ধরত , আর মনে হত নৃত্যরতা মায়া ।
মায়া, তুমি এখন কোথায় ? দ্যাখো, আমি চুল-দাড়ি রাখি না । প্রায় প্রতিদিনই শেভার দিয়ে মাথা শেভ করে ন্যাড়া হয়ে থাকি, কেননা আমার চুল বেশ পেকে গেছে , আর আমি মাথাভরা পাকাচুল নিয়ে তোমার অনুপস্হিতির ভার বইতে পারব না । শেষনিকেও বলেছি যে আমি যদি ন্যাড়া হতে ভুলে যাই, কোনোদিন যদি চুল দেখা যায় মাথায়, তাহলে যেন শেভ করে দেয় । শেষনি তোমার গল্প শোনার জন্যে উন্মুখ । শেষনিকে কিন্তু তোমার নাম বলিনি এখনও । তোমার নাম উচ্চারণ করার অধিকার একমাত্র আমার ।
টাইপ করতে বসে কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার , আবেগে আক্রান্ত হয়ে উদ্বেল হয়ে উঠছি । আবার রাতে লিখব বা কাল সকালে লিখব । শেষনি বিকালে আসবে বলেছে , জানতে চায় কতদূর লেখা হল , কোন পর্যায়ে পৌঁছোলুম । ও যখন বাংলায় ট্র্যান্সক্রিপ্ট নিয়ে বা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়বে তখন জানতে পারবে ।
এতটা পড়ে, রিমাও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, স্বগতোক্তি করল, তোমার লাভস্টোরি তাহলে অ্যাবরাপ্টলি থেমে গেল কেন কংকাল প্রেমিক ? যাকগে, আমিও টায়ার্ড তোমার রহস্য নিয়ে । দেখি, তোমায় নরক থেকে উদ্ধার করতে পারি কিনা ! তুমি মরার পর তোমার আত্মার শান্তি-সস্ত্যয়ন আমাকেই করতে হবে বোধহয় , কেননা, তোমায় তো আমরা অমর করে দেব, মেডিকাল ছাত্ররা তোমার কংকাল দেখে-দেখে পড়াশুনা করবে । আর প্রেমিক-প্রেমিকা ছাত্রছাত্রীরা অবাকচোখে তোমায় দেখতে আসবে ।
৯. আচ্ছা চলি
মায়ার সংস্পর্শে আসার আগে জীবনের উদ্দেশ্য আছে না নেই ভাবিনি কখনও । সবই ছিল চলে যাচ্ছে চলে যাচ্ছে চলে যাচ্ছে । ভাবতে শুরু করেছিলুম, মায়াই আমার উদ্দেশ্য , ওকে ভালোবাসাই বেঁচে থাকার প্রাপ্তি ; ভালোবাসা, মনে হচ্ছিল, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা । শহরে থাকলে, এই অভিজ্ঞতা কখনই সম্ভব ছিল না । ও এমনভাবে আমার আত্মপরিচয় নিজের মধ্যে বিলুপ্ত করে দিয়েছিল যে আমি বিলীন হয়ে গিয়েছিলুম মায়ায় ।
মাঝরাতে, পুলিসের মতে রাত একটা থেকে তিনটের মাঝে , পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সেরকমই লেখা, সামনের কাঁঠাল গাছটার ডাল থেকে একটি সিনথেটিক ওড়না গলায় বেঁধে, প্রথমে ছোটো টুল, তারপর উঁচু টুলটায় দাঁড়িয়ে, আত্মহত্যা করেছিল মায়া । ওর এই সিনথেটিক ওড়নাটা কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছিল জানতেও পারিনি ; আমরা তো সবই ফেলে দিয়ে নতুন জামা-কাপড় কিনে এসেছিলুম এখানে !
আমার পাশেই তো ঘুমিয়েছিল , যেমন প্রতিদিন ঘুমোই । কখন ক্যারি ব্যাগ থেকে ওড়নাটা বের করেছে , টুল দুটো নিয়ে গেশে, টুলে উঠে দাঁড়িয়েছে , গলায় ফাঁস তৈরি করেছে , কাঁঠাল গাছের ডালে বেঁধেছে , তারপর উঁচু টুলটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছে । রোদ উঠে যাবার পরও আমি ঘুমোচ্ছিলুম । অদ্ভূত । আমার ভেতরের কুকুরগুলো ওই সময়েই মানুষ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
চেঁচামেচি কান্নাকাটি শুনে ঘুম ভাঙতে, বাইরে বেরিয়ে দেখি, কাঁঠাল গাছ ঘিরে জটলা । গাছের ডাল থেকে মায়া ঝুলছে । মায়া । সত্যিই মায়া । ওফ । মায়া। মায়া সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ঝুলছে । মায়া, সম্পূর্ণ উলঙ্গ , এতগুলো মানুষের চোখের সামনে । মায়া, যাকে নগ্ন দেখার অধিকার একা আমাকে দিয়েছিল মায়া ; সে অধিকারটুকুও মারা যাবার সময়ে ছিনিয়ে নিয়েছে মায়া । কাঁঠাল গাছটা ভরেছিল পাকা আধপাকা কাঁঠালে ; সেগুলোও ঝুলছিল গাছ থেকে , গাছটার একেবারে গোড়া পর্যন্ত কাঁঠালে ভরা, এমন কি আমার দেয়া দাগের ওপরও হয়ে রয়েছে আধপাকা কাঁঠাল । আশ্চর্য, মারা গিয়ে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে মায়া । নিটোল ভরাট বুক, পাতলা কোমর, চেটালো পেট, ছোট্ট নাভি, ঢেউ-খেলানো পাছা । তিন দিন আগে ওর ছোট্ট উদগ্রীব যোনি ধুয়ে পুঁছে দিয়েছিলুম, যখন মায়া বলেছিল, মিস্টার মায়ালিঙ্গা, আজকে আমার পিরিয়ড শেষ হয়েছে , আমার সেক্সুয়াল অর্গান ওয়াশ করে দিন প্লিজ ,ঘড়ায় জল আছে ।
দুই বছরের বেশি হয়ে গেল এই কাজ করার ভার আমার ওপর দিয়েছিল মায়া ।
ঘরে কাগজ-পেনসিল নেই যে , ইচ্ছে হলেও, আত্মহত্যার চিরকুট লিখে যাবে মায়া পাল , এখানকার লোকেদের আম্মা, জীবন্ত ঈশ্বরী । আমার প্রচণ্ড কান্না পেল, আমি নিজেকে কান্নার হাতে ছেড়ে দিলুম ; এভাবে বাঁধনহারা কান্না আমি কখনও কাঁদিনি । মা মারা যেতেও এমনকরে কাঁদিনি । আমি কাঁদতে-কাঁদতে ছুটে গেলুম ঘরের পেছন দিকে, যেদিকের দেয়াল ব্ল্যাকবোর্ড হিসাবে ব্যবহার হয় । কাল, সূর্যাস্তের আগে, মাটির ওই দেয়ালে দুটো বৃত্ত এঁকেছিল মায়া , তাতে ফুটকি দিয়ে চোখ আঁকা, খাড়া লাইন টেনে আঁকা নাক । একটা বৃত্তে ওপর দিকে ঢেউ-খেলানো ঠোঁট, কাঁদো-কাঁদো গোমড়া দেখাবার জন্যে । অন্য বৃত্তটার নিচের দিকে ঢেউ-খেলানো ঠোঁট, যাতে তা হাসুমুখ দেখায় । দুটোর তলায় বাংলায় ‘আ’ লিখে মায়া বলেছিল, মায়াগারু, এই হাসিমুখটার ‘আ’ হল ‘আমি’ আর এই কাঁদো-কাঁদো মুখটার ‘আ’ হল ‘আপনি’ । আমি বলেছিলুম, আমি তো সব সময় হাসিমুখে থাকি , আপনাকে দেখলেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠি , এত আনন্দে থাকিনি কখনও জীবনে ; আপনিই বরং অনেক সময়ে সিরিয়াস থাকেন, কোথায় যেন হারিয়ে যান কোনো স্বপ্নের জগতে ।
মায়া বলেছিল, লাইফ ভিষণ আনপ্রেডিকটেবল মিস্টার মায়ালিঙ্গা , আপনি কি এরকম ওয়র্স্ট নাইটমেয়ারের কল্পনা করেছিলেন কখনও, যে আমার মতন অলমোস্ট অচেনা একজনমানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে অসহ্য জীবন কাটাবেন ? আমি বলেছিলুম, হ্যাঁ, জানতুম, যারা বাবা-মায়ের পছন্দ-করা মেয়ে বিয়ে করে, সেই মেয়েটিও তো তাদের কাছে আরও বেশি স্ট্রেঞ্জার ; আমি আমার সুপরিচিত কাউকে বিয়ে করলে বা তার সঙ্গে লিভটুগেদার করলে, সেও যে আমায় আনন্দিত রাখত, ক্রমশ স্ট্রেঞ্জার হয়ে ্ধঠত না তা তো জোর গলায় বলা যায় না ।
মায়া জবাবে বলেছিল, আমি তো আপনার পছন্দ-করা নই , আপনাকে দেখে আমি স্প্লিট সেকেন্ড ডিসিশান নিয়েছিলাম , তার আগে কিছুই ভাবিনি , আপনাকেও সময় দিইনি ভাববার ।
স্প্লিট সেকেণ্ড ! তা তো নয় মায়া । স্প্লিট সেকেন্ড নির্ণয়ে আত্মহত্যার অমন তোড়জোড় করা যায় না । দেয়ালে মুখ দুটো আঁকার সময়ে আমি কিছুই অনুমান করতে পারিনি । আমি তোমার প্রেমে অন্ধ । সত্যিই মানুষ প্রেমে অন্ধ হয় । অন্ধবিশ্বাস গড়ে ওঠে । জানি না কেন এরকম করেছিলে । কখনও অতীতের কথা বলোনি , কোনো লুকানো ক্ষত-আঘাতের আভাস দাওনি ।
আমি চালায় ঢুকে খুঁজে দেখেছিলুম তুমি হয়তো কোথাও কোনো উত্তর লিখে গেছ মায়া । কিছুই পেলুম না । কেবল তোমার অনুপস্হিতির এক মোহক গন্ধ ছিল ঘরময় , যেন কেউ বিদেশি আতরের সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছে । মৃত্যুর কি সুগন্ধ হয় ? নাকি তা ছিল আত্মহত্যার সুরভি !
কি করব বুঝে উঠতে না পেরে কতক্ষণ বসে-বসে কেঁদেছিলুম জানি না । জানো মায়া,একজনের অতীত তার নিজের কাছে অত মূল্যবান নয়, কিন্তু অন্যের কাছে তা যে কত মূল্যবান তা আমিই জানি ।
কী করব বুঝে উঠতে না পেরে কতক্ষণ বসেবসে কেঁদেছিলুম । অনন্তকাল. অনন্তকাল, অনন্তকাল ।
বালুর বাবা আর অন্যরা যখন আমায় প্রায় ধরাধরি করে চালাঘরের বাইরে নিয়ে গেল, দেখলুম তোমায় গাছের ডাল থেকে নামিয়ে কাঁচা কাঠের মইতে বেঁধে ফেলা হয়েছে, কোনো লতানে গাছ দিয়েই । কেউ তোমায় কাপড় পরিয়ে দিয়ে থাকবে । কোন কাপড় জানো ? সেই দক্ষিণ ভারতীয় শাড়িটা যেটা পরে তুমি প্রথম এখানে এসেছিলে । তালপাতা পোড়া ধোঁয়ার অনুষ্ঠান করে তোমায় সবাই নিয়ে চলল শ্মশানে । তোলার পর কেবল একবার কাঁধ দিয়েছিলুম আমি । কেন জানো ? আমি তোমার ওই মুখ দেখতে চাইনি । তোমার সুশ্রী মুখখানা বীভৎস হয়ে উঠেছিল । শক্ত হয়ে গিয়েছিল বলে তোমার চোখের পাতা বন্ধ করা যায়নি । জিভ বেরিয়ে এসেছিল, দাঁতের পাটি দিয়ে চাপা, তাও ঢুকিয়ে দিতে পারেনি কেউ তোমার মুখের ভেতরে । নাক দিয়ে বেরোনো শ্লেষ্মা-মাখা রক্ত পুঁছে দিয়েছিলুম লুঙ্গির খুঁট দিয়ে । যোনি থেকে রক্ত আর বোধহয় কালকের রাতের সঙ্গমের বীর্য বেরিয়েছিল, তাও সবায়ের সামনে পুঁছে দিতে লজ্জা করেনি । তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি বলে তোমার বুকে চুমো খেয়েছিলুম বারবার ।
মেঠো পথে, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে, খনি শহরে যাবার রাস্তায়, শ্মশান অনেকটা পথ। তোমার প্রিয় আম বাগানের ভেতর ছায়াময় পথ, গাছে-গাছে আম হয়ে আছে , সবুজ, হলুদ , গোলাপি আভা মাখা আম হয়ে আছে , ঠুকরে খাচ্ছে পাখিরা, তোমার মতন সেসব পাখির নামও আমি জানি না , তুমি তাদের নামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে, কিন্তু আমি ভুলে যেতুম। তারপর পাতিলেবুর বাগান, কত সুন্দর গন্ধ যা তোমার ভালো লাগত । আমি কতদিন হাঁটতে-হাঁটতে গিয়ে তোমার জন্যে লেবুপাতা পেড়ে আনতুম, চটকে ঘরে ছড়িয়ে দিতুম তার সুবাস । নকল রাসায়নিক পারফিউমের চেয়ে তুমি পছন্দ করতে প্রাকৃতিক সুগন্ধ , মনে পড়ছিল শ্মশানের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে । তুমি বলতে, পশুদের জগতে বিশেষ সময়ে দেহগন্ধ গড়ে ওঠে আর সেই গন্ধে আকৃষ্ট হয় পুরুষ পশু , বহুদূর থেকে সেই গন্ধে মোহিত হয়ে ছুটে চলে যায় সিংহ বাঘ হাতি গন্ডার হরিণ সেই দিকে মাইলের পর মাইল । মানুষ সেই প্রাকৃতিক সুগন্ধকে নষ্ট করে ফেলেছে ।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক, অন্তত আমার মনে হয়েছিল দু’ঘন্টা, সময় কি করে জানব, ঘড়ি তো তুমি ফেলে দিয়েছিলে, শ্মশানে পোঁছোলুম । তোমাকে যারা ঈশ্বরীতে উন্নীত করে দিয়েছিল, তাদের কয়েকজন আগেই শ্মশানে গিয়ে চিতা সাজাবার ব্যবস্হা করে থাকবে । শুকনো কাঠ আর তালপাতা সংগ্রহ করে আনতে হয়েছে জঙ্গল থেকে । তোমার কেউ আছেন কিনা জানি না , আমি ছাড়া । কাউকে খবর দেবার সময়-সুযোগ নেই । আমরা নিজেদের পরিবারের পিছুটান সম্পর্কে আলোচনা করিনি, তুমি করতে দাওনি, আমার কাছে তোমার পরিবার-স্বজন-জ্ঞাতিদের নাম-সাকিন নেই ।
শবযাত্রীরা সবাই বলছিল, এখানের গরমে মৃতদেহ বেশিক্ষণ রাখা যাবে না । দ্রুত সৎকার করে ফেলাই প্রথা । স্হানীয় বয়স্করা, তাদের তৎপরতা দেখে, অনুমান করতে পারছিলুম, তারা এবিষয়ে অভিজ্ঞ ।
সাজানো চিতায় তোমার দেহ রাখা গেল না মায়া । উন্মুক্ত শ্মশানে এসে আচমকা থামল, ধুলো-ওড়ানো জিপ, সরকারি জিপ, যা দেখলেই টের পাওয়া যায়। কয়েকজন কন্সটেবল আর ব্যাটন হাতে, পরে জেনেছি ইন্সপেক্টর রামাইয়া, দ্রুত জিপ থেকে নেমে, যাকে সামনে পেল, চড়-থাপ্পড় মেরে হুমকি দিতে লাগল । আস্ফালন বুঝতে পারছিলুম, ভাষা নয় । ইন্সপেক্টর আমার সামনে এসে, কোনো কথা না বলে, হাতে কোমরে সজোরে কয়েক ঘা ব্যাটন কষিয়ে দিল । মায়া, তখন আমায় চাবুক মারতে থাকলেও সহ্য করে নিতুম ; মনে হচ্ছিল এটাই আমার প্রাপ্য ।
কাঠকুচির ধুঁয়া-ওঠা হাঁড়ি মাটিতে নামিয়ে রেখে, আমি হাত জোড় করে ইংরেজিতে বললুম, কেননা আমার সীমিত তেলেগু জ্ঞানে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করা সম্ভব ছিল না, যে, স্যার আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে, আমার মন খুবই খারাপ, দাহকর্ম হয়ে যাক, তারপর আপনি যা জানতে চান প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেবো, আপনার কাছে থানাতে যাব, আমার অসাবধানতার খেসারত আমি দেব ।
আশ্চর্য, সেই প্রথম আমি তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে উচ্চারণ করেছিলুম । প্রচণ্ড ভুল হয়ে গিয়েছিল মায়া । তুমি বলেছিলে আমরা স্বামী-স্ত্রী মার্কা জীবন কাটাব না, আমরা মানুষ-মানুষী হয়ে বেঁচে থাকব ।
ইংরেজি ভাষা আরও বিরক্ত, এমনকি অপমানিত করল ইন্সপেক্টরকে । আমি বুঝতে পারলুম, ইন্সপেক্টর এখন প্রশাসনের প্রতিনিধি নয়, সেই রাষ্ট্র । রাষ্ট্রের হুকুমে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে তোলা হল জিপগাড়িতে । দড়ির অপর প্রান্ত একজন পেটমোটা কালো টাকমাথা কন্সটেবলের হাতে । কন্সটেবলগুলো অভিব্যক্তিহীন, এধরণের ডিউটি বহুবার করে-করে যন্ত্রে রুপান্তরিত ; তারাও তো নিজস্ব অস্তিত্বে রাষ্ট্র ।
ইন্সপেক্টর ভালো ইংরেজি বলতে পারে না, হয়তো কোনো দলীয় তদবিরে বা ঘুষের জোরে চাকরি পেয়ে থাকবে । সাধারণ দক্ষিণ ভারতীয়রা গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে ভালো ইংরেজি বলে থাকে । ইন্সপেক্টার যেটুকু ইংরেজি পারে সেটুকু শুনে আমি জানতে পারলুম যে আমিই এই মহিলাকে খুন করে গাছে টাঙিয়ে দিয়েছি। মহিলাটি স্ত্রী কিনা এ-ব্যাপারে রাষ্ট্র নিশ্চিত নয় । রাষ্ট্রের কাছে খবর আছে যে, তারা দুজন যে জীবন এখানে কাটাচ্ছিল, তা থেকে রাষ্ট্রের সন্দেহ যে মিস্টার মায়ালিঙ্গা এই মহিলাকে ভাগিয়ে ফুসলিয়ে এনেছে । ইংরেজি জানা পড়াশুনা করা একটা লোক এরকম একটা দুর্গম এলাকায় এসে পড়ে আছে কেন তাও রাষ্ট্রের বিবেচ্য । রাষ্ট্রর ধারণা যে মিস্টার মায়ালিঙ্গা নিশ্চয় কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কুকর্মে লিপ্ত । থানায় নিয়ে গিয়ে উচিত শাস্তি দিলে মায়ালিঙ্গা কয়েক মিনিটেই সত্য ওগরাবে ।
মায়া, তুমি তো বলে যাওনি সত্য কী, তোমার সত্য ! প্রেম ছাড়া অন্য কোনো সত্যের কথা তো তোমার সংস্পর্শে এসে ঝানিনি মায়া । এখন জানছি যে প্রেমও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের পর্যায়ে পড়ে ।
জিপে বসে, জিপের মেঝেতে শোয়ানো তোমার দেহের দিকে তাকিয়ে রইলুম সারাটা পথ । কন্সটেবলরা যে টিটকিরি মারছে, তাদের ভাষা সঙিক বুঝতে না পারলেও , হেঁচকি-তোলা হাসাহাসি থেকে মায়ার মায়াবী দেহের ওপর কাদার ফোঁটার মতন ঝরে-ঝরে আবহকে পঙ্কিল করে তুলছিল । । এই শেষ সান্নিধ্য অন্তত পাচ্ছি । জিপগাড়ি আমাদের নিয়ে খনিশহরের পথে যেতে কম সময় লাগেনি । অথচ যেদিন প্রথম এসেছিলুম এই অঞ্চলে, সেদিক কত কম সময় লেগেছিল । সেদিনও সঙ্গে ছিল মায়া । আজও মায়া আমার সঙ্গে । তাহলে কতরকম হতে পারে মানুষীর মায়া !
কেই বা খবর দিয়ে থাকবে পুলিশকে ? যাদের দৃষ্টিতে মায়া হয়ে উঠেছিল ঈশ্বরী, তধাদেই কেউ ? সেই সংবাদ-বহনকারীর চোখে আমি নেহাতই একজন সাধারণ মানুষ , সম্ভবত ঈশ্বরীর সেবায়েত ! কেন এ-কাজ করল ঈশ্বরী ? আমার জন্য জীবন নষ্ট করল । যে-ভাবে যে-উচ্চারণে কনভেন্ট স্কুলের ইংরেজি প্রয়োগ করত, আচরণ, শিষ্টতায়, স্পষ্ট ছিল যে শিক্ষিত রুচিশীল পরিবারে প্রতিপালিত যুবতী । স্বাভাবিক, সুখি, গতানুগতিক দাম্পত্যজীবন কাটাতে পারত , শশুর-শাশুড়ি-স্বামী, ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে । আমার পাল্লায় পড়ে নিজে কে ধ্বংস করে ফেলল । কেন যে ওর ডাকে সাড়া দিয়েছিলুম ।
কেন উলঙ্গ হয়ে আত্মহত্যা করল মায়া । অসাধারণ দেহকাঠামো, মৃত্যুর পরেও তা উপজাতি গ্রামবাসীদের দেখাবার জন্য ? যাতে তারা তাদের ঈশ্বরীকে স্বরূপে দেখে নিতে পারে ? এখানকার লোকগুলোকে, যারা নিজেরাই অর্ধনগ্ন থাকে ? পুলিশের লোকেদের, যারা প্রায়ই ল্যাংটো লাশের সমস্যায় পড়ে বিরক্ত হয় ?” নাকি আমাকে ? যাতে একই সঙ্গে মায়ার সুন্দর আর বীভৎস রূপ আমার স্মৃতিতে আজীবন গিঁথে থাকে ? যাতে সারাটা জীবন দুঃস্বপ্নে পীড়িত থাকি, প্রশ্নে-প্রশ্নে জর্জরিত হই , চিন্তার তীরহীন সমুদ্রে ভাসতে থাকি চিরকাল ?
মায়ার মুখের ওপর থেকে আঁচল উড়ে গিয়েছিল । দেখতেই, প্রথমে ফুঁপিয়ে, তারপর জোরে-জোরে কান্না পেয়ে বসল আমায় । চেষ্টা করেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলুম না । চোখে আর ঠোঁটে, ছুটন্ত , ধুলো-ওড়ানো গাড়িতেও, মাছি বসছিল। পাকা আমের স্বাদ ছেড়ে মাছিরাও তোমার স্নেহসুধা শেষবার খেতে এসেছে মায়া । মাছির সংখ্যা বাড়তে থাকলে, রোগাটে ঢ্যাঙা কন্সটেবলটা, জিপে পড়ে থাকা চট তুলে, ঝপ করে ফেলে দিল মায়ার মুখের ওপর । আমি ককিয়ে ‘না না’ চিৎকার করে উঠতে, ড্রাইভারের পাশে-বসা ইন্সপেক্টর বলল, শাট আপ ইউ ব্লাডি মার্ডারার । আমার কান্ন তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে, হাউহাউ পর্যায়ে চলে গেছে ।
পেটমোটা কন্সটেবল, যে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধেছিল, এখনও ধরে আছে ডযির প্রান্ত, বেশ শক্ত করেই ধরে আছে, পরে জেনেছিলুম তার নাম সংক্রান্তিগারু, বলল, বোধহয় আমার মুখ দিয়ে ‘না না’ আর্ত চিৎকার বেরোবার কারণে, জিগ্যেস করেছিল, ‘তুম হিন্দি’ ? কন্সটেবলটার প্রশ্ন শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারলুম । শহরে ইংরেজিতে কথা কইলে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে, তা কেন, রাষ্ট্রকেই, যত ওপর দিকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়, শহরের বাইরে ওই ভাষাটা তাদের ততই নিচে নামিয়ে আনে । যত বড় শহর, রাষ্ট্রের ক্ষমতা যেখানে যত কুক্ষীগত, সেখীআনে কাজকে মসৃণ করে দেয় ইংরেজি ভাষা, গর্বিত করে আধিকারিককে । হিন্দিও এখানে গ্রাহ্য ভাষা নয় । তবু ইংরেজির তুলনায় কম ক্ষতিকর । যেটুকু হিন্দি জানি, তাতে আমার বক্তব্য ও মানসিক দুর্দশাকে আরও বোধগম্য করে তুলতে পারতুম হয়তো।
আমি মাথা নাড়লুম । ভাঙা হিন্দিতে বললুম, আমি বাঙালি । আমি আমার এত সুন্দরী স্ত্রীকে কেনই বা খুন করব ; ও ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই । আমরা এখানে এসেছিলুম নতুনভাবে থাকারজন্যে, শহর থেকে অনেক দূরে , অচেনা জায়গায় , সাধারণ মানুষের মতন , শহরের যাবতীয় সুবিধার বাইরে , যাতে একজন আরেকজনকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি।
ইন্সপেক্টর হায়দ্রাবাদি হিন্দিতে, বোথহয় জেরা করার সূত্রপাত ঘটিয়ে, গম্ভির গলায় প্রশ্ন করেছিল, তাহলে তোমার সোকল্ড ওয়াইফ আত্মহত্যা করল কেন ? মঙ্গলসূত্র নেই, নর্থ ইনডিয়ান সধবাদের মতন বিন্দি-সিন্দুর নেই । তোমরা রাজনৈতিক ফেরারি কিনা তার খোঁজখবরের জন্য আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আগেই জানাতে বলেছি । তোমাদের ওপর আমরা এক বছরের বেশি নজর রাখছি । উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে । তার সুরাহা হল না, এখন তুমি এই নতুন সমস্যা পাকালে । তোমাদের মধ্যে নিশ্চই কিছুদিন যাবত বনিবনা হচ্ছিল না, হয়তো ডিসিজড ফিরে যেতে চাইছিল, তুমি রেজিস্ট করছিলে । সে-কারণেই তোমার স্তী তোমার সঙ্গে তার বিয়ের চিহ্ণও রাখেনি নিজের শরীরে । সুইসাইড না হোমিসাইড তা অটপসি হলেই জানতে পারব ।
আমার মুখ দিয়ে বেরোল, বলে ফেলে টের পেলুম যে বোকামি হয়ে গেল, নিছক মূর্খের মতন, যে, ও একজন মডার্ন মহিলা, বিন্দি-সিন্দুরে বিশ্বাস করত না , ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর । ব্যঙ্গ করল ইন্সপেক্টর, মডার্ন ? এই এলাকায় ? জঙ্গলে ? যেখানে ভালভাবে ছোঁচাতে হলে লোকে ঝর্ণায় যায় ? বছরে একবার কেবল সংক্রান্তির দিন জামা-কাপড় পালটায় , সেখানে ? মুখ খুললেই আবাএ বেফাঁস কিছু বেরিয়ে যাবে এই আশঙ্কায় নিজেকে দুঃখের শামুকের খোলে গুটিয়ে নিলুম । কেন এই দুর্গম অঞ্চলে এসেছিলুম , তার উত্তর তো একমাত্র মায়াই দিতে পারত । আমি এসেছিলুম মায়ার ডাক শুনে ।
একজন কন্সটেবল, দেখে অনুমান হয় ব্যায়াম-করা শরীর, শ্মশানযাত্রীদের এলোপাতাড়ি পেটানোয় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল , ইন্সপেক্টরকে শুধোল, যদিও তেলেগুতে, তবু বুঝতে আমার অসুবিধা হল না, স্যার, আমাদের থানার কাছে শরবতের দোকানটা থেকে বরফের স্ল্যাব যোগাড় করে লাশটাকে সংরক্ষণ করতে হবে, ফার্স্ট ইনফরমেশান রিপোর্ট লিখে নেবার পর পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠাতে হবে মর্গে , সেও তো সতেরো কিলোমিটার দূরে, লাশ খারাপ হয়ে গেলে মুশকিল হবে । কন্সটেবলটা তেলেগুতে বললেও, যতটা তেলেগু আঁচ করতে পারার অভিঞ্জতা হয়েছে এই কয় বছরে, আর কয়েকটা পরিচিত শব্দপ্রয়োগের দরুণ বুঝতে পারলুম ।
লাশ। মায়া, লাশ । লাশ ! অপরিসীম ব্যখ্যাহীনতা ।
থানায় জিপ পোঁছোলে, আমাকে প্রথমে নামিয়ে, ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হল লক আপে । যে লোকগুলো আগে থাকতেই লক আপে ছিল, তারা আমার খালি গায়ে নোংরা লুঙ্গিতে, না-কামানো দাড়ি, আর প্রায় জট-পড়া দীর্ঘ চুলের কারণে , হঠাৎ চুপ করে গেল । যেন মানুষের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে দাঁতালো কোনো অচেনা জীব । অদ্ভুত । ক্রিমিনালরাই আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে । ভাবছে হয়ত আমি একজন সিরিয়াল নারী হত্যাকারী ।
মায়াকে কোথায় নিয়ে গেল জানি না । কোথায়ই বা রেখেছিল জানি না ।
মায়ার কাপড়ে-মোড়া দেহ চিতায় তুলে , ষোল দিন পর, আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুখাগ্নি করার জন্য । আইন আদালত , গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার ভেতর সোপর্দ, কোনো কিছুই হয়তো এই জঙ্গলে প্রযোজ্য নয় । লক আপেই বন্দী ছিলুম । বা এরা হয়তো আদালত থেকে হুকুম এনে ধরে রেখেছে আমায় । মায়া, তোমার মুখাগ্নি করার কথা তুমি একবার বলেছিলে । হাতে আগুন নিয়ে সে কথাই আমার মনে পড়ছিল । ওরা চিতায় শোয়ানো তোমার মুখ আমায় দেখতে দেয়নি । ভালই করেছিল ; এখন এও মনে হয় যে তুমি কোথাও আছো, হয়তো কুয়োতলায় গিয়ে স্হানীয় মহিলাদের উপদেশ দিচ্ছ । তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার কথা বলছ ; পৃথিবীর বিশালতার কথা বলছ কিংবা আরও কোনো জ্ঞানের কথা ভাগ করে নিচ্ছ তাদের সঙ্গে । এবার হঠাৎ তুমি এসে পড়বে কাঁখে প্লাসটিকের কালো ঘড়া নিয়ে । এসে বলবে, আজকে চলুন, ঝর্ণার জলে স্নান করি, কয়েকদিন তো হয়ে গেল স্নান করে । কিংবা বলবে, চলুন, একটা কাঁঠাল পেকেছে , পেড়ে খাই ; আমি ছাড়াব, আপনি ততক্ষণ বালুদের দলটাকে ডেকে আনুন ।
যৌথ লক আপ থেকে বের করে নিয়ে, অন্য একটা ফাঁকা লক আপে, যে-দিন পুলিস ধরে নিয়ে গিয়েছিল , সে-দিন সন্ধ্যায় , আমার লুঙ্গি একটানে খুলে ফেলে রুলের বাড়ি মারা হয়েছিল , কত বার মনে নেই । আমি ক্রুদ্ধ হইনি , অপমানিত বোধ করিনি । কেউ কোনো প্রশ্নও করেনি । জেরা করে প্রস্নের উত্তর না দিলে পুলিস ঠ্যাঙায় জানতুম । কেননা লক আপের বাইরে তো রাষ্ট্র । আমার লিঙ্গকেও ব্যাটন দিয়ে নাড়িয়ে-নাড়িয়ে হাসাহাসি করা হয়েছিল । আমাকে খেতে দেয়া হয়েছিল পরের দিন । আমি খেয়ে নিলুম , মায়া, কেননা এর চেয়েও খারাপ খাবার খাওয়ায় তুমি অভ্যস্ত করে দিয়ে গেছ । আমাকে কোর্টে তোলা হয়নি । মিডিয়ার জগত, খবরের জগত, এখান থেকে বহু দূরে । যে কন্সটেবলের পাহারায় শৌচালয়ে যেতুম, সে জানিয়েছিল যে বরফ না পাওয়া যাওয়ায় লাশ পচে গিয়েছিল, তাই ঠিকমতন অটপসি হয়নি ।
মায়া, তুমি পচে গিয়েছিলে , আর তা আমায় শুনতে হয়েছিল।
থানাতেই আটক ছিলুম । কিছু শহুরে ধরণের লোকজন, শার্ট-বুশশার্ট পরা, আমায় দেখতে এসেছিল মাঝে একদিন । বোধহয় নারী হন্তারকদের কেমন দেখতে হয় তা দেখার জন্য । আমার অনুমান, পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে আমার রাজনৈতিক ক্লিয়ারেন্স আসার পর ছাড়া পাই । টাও হয়তো পেতুম না । ছাড়া পেলুম সেদিন, যেদিন বালুর বাবা আর কয়েকজন গ্রামবাসী থানায় এসে ঘুষ দিয়ে গেল । আশ্চর্য, না ? যারা একবেলা খেয়ে জীবন কাটায় , তারা কী করে টাকা তুলল ? টাকা যে যোগাড় করে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে তা কি থানার লোকেরা গ্রামে গিয়ে বলে এসেছিল ? জানি না । মায়া, টাকার ব্যবস্হা তুমি নিজেই করে গিয়েছিলে । বালুর বাবার কাছ থেকে জেনেছিলুম, শ্মশানে পিটুনি খাবার পর ফিওরে গিয়ে সবাই ভেঙে পড়েছিল । ওরা শেষে একদিন মনস্হির করে যে আমাদের স্মৃতিতে চালাঘরটাকে মন্দিরের পবিত্রতা দেয়া হবে । চালাঘরের ভেতরে তোমার ক্যারিব্যাগে তোমারই পাঁচশ টাকার নোটের তাড়া ছিল , ঝড়ের জলে কিছুটা নোংরা । ওরা সেই নোটের তাড়া নিয়ে থানায় এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
নোটের তাড়াটা কেনই বা রেখেছিলে ? আমার ক্যারিব্যাগে তো কিচ্ছু রাখিনি, শহরকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলুম , অতীতের কোনো স্মৃতি রাখিনি । তুমি কেন রেখেছিলে ? বিপদের আশঙ্কায় ?
আমাদের চালাঘরে আর ফিরিনি মায়া । কী হবে ফিরে ? তুমি নেই । তোমারই ফেলে-যাওয়া টাকায় বালুর বাবা নাপিতের দোকানে নিয়ে গিয়ে আমার চুল কাটিয়ে দাড়ি কামিয়ে জামা-প্যান্ট কিনিয়ে অচেনা এক রেলস্টেশানে পৌঁছে দিয়েছিল, নাম মনে নেই , জানতেও চাইনি কোন স্টেশান । বালুর বাবা আর কি দিয়েছিল জানো ? তোমার চুলের একটা গোছা । ওদের প্রথা অনুযায়ী, ওরা সধবাদের চুলের একটা গোছা কামিয়ে রেখে নেয় । বলেছিল, চুলের কয়েকগাছা ওরা রেখে নিয়েছে, চালাঘরের মাটিতে পুঁতে দেয়ার জন্য ।
আমি কলকাতায় ফিরলুম, পুনরায় নিরঞ্জন দত্তের আত্মপরিচয় ফেরত নিয়ে । এ কোন নিরঞ্জন ? তোমার সঙ্গে বসবাসের নিরঞ্জন নয় , তার আগেরও নয় । এ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন নিরঞ্জন ।
ওহ হো, বলে উঠল রিমা, ওহ হো, বেচারা প্রেমিক । এরকম আত্মবলি দেয়া সত্বেও তাহলে প্রেমিকের এমন অভিশপ্ত মৃত্যু কেন , নিজেকে প্রশ্নটা করে একটা সিগারেট ধরিয়ে টেবিলে ঠ্যাং তুলে চোখ বুজে আত্ম মগ্ন হল রিমা খান । যেতে হবে জায়গাটায় । কলকাতাভ ছেড়ে একজন বাঙাংলি যুবতী আর তার প্রেমিক চলে গেল অজানা অচেনা মানুষে ঘেরা জঙ্গলে বসবাস করতে । থেকে গেল সেখানে । অসাধারণ জায়গা নিশ্চয়ই । যেতে হবে, হুম, যেতে হবে ।
১০. সে নেই
একাগ্র হয়ে নতুন প্রিন্টআউটটা পড়তে আরম্ভ করল ইন্সপেকটার রিমা খান । নেট সার্ফ করে জেলি ডিলডো কিনে আনিয়েছিল । ম্যাস্টারবেট করে এখন একঘেয়েমিটা কেটেছে । নয়তো, এই কংকাল প্রেমিকের গল্পটার খেই হারিয়ে ফেলছিল। খুনিকে অনুসন্ধানের বদলে প্রেমকাহিনির দিকে ঝুঁকে পড়ছিল।
অন্ধ্র থেকে ফিরে এলুম । কোথাও কোনো পরিবর্তন দেখলুম না , আমার জীবনে ছাড়া । অফিসে একটা রেজিগনেশান লেটার পাঠাবার পর ওরা আমার বকেয়া পাঠিয়ে দিয়েছিল, যার কোনো দরকার ছিল না । পরিচিতদের কেবল জানাতে চাইছিলুম যে আমি জীবিত । কিছুই আর ভালো লাগছিল না । মায়া নেই । মায়া যে ছিল , আমি একজন অল্প পরিচিতার সঙ্গে একেবারে দুর্গম বনাঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতুম, তা নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। বসে থাকতুম আর ভাবতুম । মায়া আমার চুল পেকে যাবার কথা বলত , তাই ক্ষোভে এতই উতলা হয়ে উঠলুম যে মনস্হ করলুম ন্যাড়া হয়ে যাই । তারপর ভাবলুম বিদেশে কোথাও চলে যাই। নতুন জায়গায় গেলে অন্তত মায়ার স্মৃতির অ্রহ উপস্হিতি থেকে কিছুটা মুক্ত হতে পারব ।
পাসপোর্টে তো ন্যাড়া নই । ন্যাড়া হবার আইডিয়া স্হগিত রাখলুম। ফিরে এসে দেখা যাবে । কোন দেশে যাব ? রাসেল স্ট্রিটে ঘুরে বেড়াবার সময়ে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির বিরাট সাইনবোর্ড দেখে ঢুকে পড়লুম। ওরাই বলল, শেনজেন দেশগুলোর ভিসা করিয়ে দেবে । বা, চাইলে, ভিসা অন অ্যারাইভাল কোনো দেশে যেতে পারি ; ওদের পেমেন্ট করে দিলে , হোটেল বুকিং করে দেবে । থাইল্যাণ্ড যান স্যার , ভিসা বিভাগের যুবকটি বলল, যৌবন থাকতে-থাকতে একা যাবার অতিঅবশ্য গন্তব্য ।
শেনজেন মানে তো ইউরোপের কয়েকটা দেশ । যৌবনে একা থাকার ও উচ্ছন্নে যাবার সবচেয়ে লোভনীয় শহর হল অ্যাম্সটারডাম । যাই, কোনো দেশ অনুমতি দিলে থেকে যাব ইউরোপের কোথাও , নয়তো থাইল্যাণ্ডের কোথাও । একাই হারিয়ে যাব এবার ।
মায়াকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব । কিন্তু কিই বা করি যাতে মন অন্য দিকে পালিয়ে বাঁচে । এসকেপিজম থেকেও এসকেপ করা কত কঠিন !
বাড়িটাকে মজুর লাগিয়ে পরিষ্কার করালুম , তারপর রঙ করালুম। বাবার পছন্দের গোলাপি রঙ তুলে দিয়ে বাড়ির বাইরেটা ফিকে হলুদ রঙ করালুম। গোলাপি বা পিংক তো প্রেমের রঙ । কোন চেতনাকে প্রশ্রয় দিতে বাবা গোলাপি রঙ করিয়েছিলেন ? ঘরের ভেতরগুলো এশিয়ান পেইন্টসের প্রতিনিধিকে ডেকে ওদের পরামর্শ অনুযায়ী পেইন্ট করালুম। বাবার এবং অন্যান্য ঘরের আসবাব পালিশ করালুম। বাবার দাদুর ঘর পেইন্ট করাইনি ; কেবল পরিষ্কার করিয়েছি , কেননা ওখানে যেকোনো পরিবর্তন ওনাকে অনুপস্হিত করে দেবে ঘরটায় । মায়ের ঘরে বেশি যাই না । এত মনকেমন করে মায়ের জন্যে । এই বয়সে সবায়ের করে কি ! মায়ার জীবনে ঢোকার আগে থাকতেই তো খবরের কাগজে পড়তুম যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে অবহেলা করে । অদ্ভূত ! মা বেঁচে থাকলে আমি মায়ার ডাকে সাড়া দিতুম না । মা বেঁচে থাকলে আমার জীবন এরকম খেইহীন হতো না ।
আমি যদি মায়ার সঙ্গে না যেতুম তাহলে কি মায়া অন্য কারোর হাত ধরে বলে উঠতে পারত, ‘চলুন পালাই ?’
এই প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনও পাবো না ।
বাবা প্রচুর রোজগার করেছেন । জানতেন বোধহয় যে আমি কোনো কম্মের নই । কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ নেই বহুকাল । কে যে কোথায় আছে জানি না । আমরা নিজেদের বলতুম ডগ-স্কোয়াড । আমার কুকুরপনা ছিল বায়বীয় , এক-এক দিন এক-এক প্রজাতির কুকুর । বন্ধদের তা পছন্দ ছিল না । ওরা কুকুর-প্রজাতি বাছাই করে যা যার নিজের কুকুর-বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনীয় করে নিয়েছিল।
বাঁকুড়ার মুরারিমোহন মাজী ছিল বুল টেরিয়ার, বীরভূমের যামিনীরঞ্জন অর্ণব ছিল অ্যালসেশিয়ান । হুগলির রণজয় কর্মকার ছিল ব্লাড হাউন্ড । পুরুলিয়ার নিজামুদ্দিন মুদি ছিল জার্মান শেপার্ড । মুর্শিদাবাদের নগেন্দ্রনাথ সূত্রধর ছিল ককার স্প্যানিয়েল । বর্ধমানের সীতারাম কুণ্ডু ছিল ল্যাবরাডর । মেদিনীপুরের সুকান্ত বেসরা ছিল ডোবারম্যান । জলপাইগুড়ির নিমাই মাইতি ছিল বিগল। কোচবেহারের বেঁটে-বজ্জাত পরমেশহ্বর সাহা ছিল বক্সার । দল বেঁধে কলগার্ল হান্টিং করতুম আমরা । কোনো রিসর্ট ভাড়া নিয়ে কল গার্লদের সঙ্গে যৌনহুল্লোড় । ওই জীবনে ফিরে যেতে পারলে বোধহয় মায়ার ছবিটা অন্তত চোখের আলো থেকে অস্পষ্ট করে তুলতে পারব অন্তত কিছুটা।
একবার আমরা পুরো ডগ-স্কোয়াড গিয়েছিলুম ডায়ামন্ড হারবারের এক রিসর্টে । প্রি-ম্যারেজ পার্টি দিয়েছিল রণজয় । ব্যাচেলরেটদের ধুমধামাকা । পার্টি অরগানাইজার রুমঝুম বিশ্বাসকে কনট্র্যাক্ট দিয়েছিল রণজয় । দিল্লি থেকে স্ট্রিপার আনিয়েছিল রুমঝুম। দুজন স্ট্রিপার । একজন নাইজেরিয়ার কৃষ্ণকলি আর অন্যজন লাটভিয়ার গোলাপি রম্ভা । লাটভিয়ার মেয়েটা না জানত ইংরেজি, না জানত হিন্দি, আর বাংলা জানার তো কথাই নেই –ভারতীয় এজেন্ট দিয়ে নাকি কাজ চালায় , দেহবাণিজ্যে জিভ তো আর কথা বলার কাজে লাগে না , অন্য কাজে লাগে । এজেন্ট বুঝিয়ে দ্যায় ক্লায়েন্ট কী চায় । ওরা সেই অনুযায়ী উলঙ্গ হয় বা নির্দিষ্ট যৌনখেলা খেলে । রুমঝুম জানতে চেয়েছিল কোন শতকের পোশাকে স্ট্রিপাররা আসবে । কেননা যখন স্ট্রিপার মাঝখানের টেবিলের ওপর দাঁড়াবে তখন তো পুরো ঢেকেঢুকে আসবে । রণঝয় বলে দিয়েছিল লাটভিয়ান আসবে জার নিকোলাস ওয়ানের রাজরানির বেশে । অবশ্য সে খরচও রণজয়ের ।
তার আগে কেক কাটা হল । কেকের আকার নারীর যোনির মতন । কেকের দোকানে নাকি ব্যাচেলারেট পার্টির কেক চাই বললে, ওরা হ্যাপিনেস অ্যালবাম দেখায় — রুমঝুমের সৌজন্যে । মেয়েরাও এরকম পার্টি করে — তারা কি তাদের পার্টিকে বিচপার্টি বলে ? গড নোজ । তাদের জন্যে পুরুষের যৌনাঙ্গের আকারের কেক, যে-মাপের চাই, যে রঙের চাই, বীভৎস চাইলে তাও পাওয়া যাবে । পুরুষ স্ট্রিপারও মিলবে । যুবতীদের পার্টির জন্য অবশ্য রুমঝুম নয়, কে একজন মৌসম বানু তার বিশেষজ্ঞ অরগানাইজার । রুমঝুম বলেছিল, যুবতীদের পার্টিগুলো পুরুষদের চেয়েও রসালো হয় । অনেকের মুখ দিয়ে মাতাল অবস্হায় বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়ে ; কবে প্রথমবার করেছিল , চেনা না অচেনা, রেভ পার্টি না হঠাৎ-পরিচিত ; কে কতবার করেছে , ভার্জিনিটি রিপেয়ার করিয়ে নিয়েছে কিনা । কেউ-কেউ ফেসবুকে সেসব খেলাখেলির ফোটোও পোস্ট করে দেয় । ভার্জিন যখন তখন হবু বরের মুখ বন্ধ ।
ইনডিয়ানরা এত ভার্জিন খোঁজে কেন তা নিয়েও জব্বর হাসাহাসি হয় যুবতী মহলে । তাহলে আর স্বর্গে গিয়ে বাহাত্তরটা ভার্জিনের আশায় বোমাবেল্ট-পরা টেরারিস্টদের সঙ্গে ইনডিয়ান বরগুলোর তফাত কোথায় !
রুমঝুমের অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘরে প্রবেশ করলে, রুমঝুমের কন্ঠস্বর শোনা গেল, মেল সেক্স টয়েজ আছে , যে খোকারা এই খেলনা নিয়ে খেলতে চায়, তারা বেছে নিতে পারে, এইডস থেকে বাঁচার এর চায়ে ভালো উপায় আরনেই । আমার কাছেও এলো ট্রে নিয়ে ; উলটে-পালটে দেখলুম সবই বিদেশি ; কোম্পানি অ্যামেরিকান বা ইউরোপীয় কিন্তু প্রতিটি তৈরি হয়েছে চিনে । ভারতীয় টাকায় এক-একটির দাম হাজার টাকার ওপর । দেখতে কিন্তু খুবই সুন্দর । মনে হবে যেন বিদেশিনীর যোনি । পায়ুকামীদের জন্য বিদেশিনীদের পায়ু । নামও মজার ; পকেট পুসি, পকেটে নিয়ে ঘোরার জন্য । মহিলার মুখের আকারের ব্লো জব সিমুলেটর , ওরাল সেক্সের চাহিদা মেটায় , ইলেকট্রিকে বা ব্যাটারিতে চলে । পর্নস্টার ভ্যাজাইনা, আকারে বড়, রন্ধ্রপথে ছোটো, ওটাও বিজলিচালিত । রিয়্যালিস্টিক ভ্যাজাইনা , একেবারে আসল যোনির মত , ইলেকট্রিকে বা ব্যাটারিতে চলে । সিলিকোন ম্যাস্টারবেটার , ভেতরে কিছুই দেয়া নেই , কিন্তু পিচ্ছিলতার অনুভব হবে । কেউ-কেউ কিনল , বোধহয় অন্যান্য বন্ধুদের দেখাবার জন্যে আর দরকারে প্রয়োগ করার খাতিরে । আমি শুধু হাতে নিয়ে জ্ঞান বাড়ালুম । কৃত্রিম নারীঅঙ্গ আমি একেবারেই মেনে নিতে পারি না ।
একটু পরে, কয়েক রাউন্ড হুইস্কির শেষে, অন্ধকার ঘরে জার নিকোলাস ওয়ানের রাজরানি এলো , ঘুর ঘুরে আমাদের সবাইকে উইশ করল , মানে টোপ দিতে থাকল, কে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবার সবচেয়ে বেশি দর হাঁকবে । আমি তো অপেক্ষা করছিলুম কখন টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে স্ট্রিপিং শুরু করবে । আমি এর আগে এই খেলাটা দেখিনি । বন্ধুদের অনেকেই এসব ব্যাপারে আমার চেয়ে দশপা এগিয়ে । বাবার জন্যে আমার ঘুড বয় ইমেজটা ঘোচাতে সময় লেগেছে । গণিতে বেশি নম্বর পাওয়াটাও একটা ফ্যাক্টর । বন্ধুরা ভাবত, নিরঞ্জনটা রসকসহীন, অষ্টপ্রহর শুধু তিনে কত্তে তিন হাতে রইল পেনসিল নিয়েই আছে । খোলস ছাড়ার পর আমিই হয়ে গিয়েছিলুম মধ্যমণি । তার কারণ আমি বেহিসেবি খরচ করতে ওস্তাদ ছিলুম ।
এখন মায়ার কথা মনে এলেই ভাবি কী ছিলুম আর মায়া কী করে দিয়েছিল। আমাকে তাই আগের সেই মায়াবর্জিত জীবনে ফিরতেই হবে । শেষনি, জানি তুমি এসব পড়বে আর তোমার মধ্যবিত্ত পিলে চমকে যাবে , ভাববে বুড়োটা মহাকলম্পট । তাই তোমার জন্য গড়ে তুলছি তেলেগু অক্ষরের ভুলভুলাইয়া ।
লাটভিয়ার স্ট্রিপারে রাজরানিত্ব খসাবার কায়দাটিই ছিল খাসা । প্রথমে বাঁ পায়ের সোনালি জুতো খুলে ছুড়ে দিল মুরারীমোহনের দিকে । তারপর ডান পায়েরটা যামিনিরঞ্জনের দিকে । এই ভাবে নেটের কালো স্টকিংস, পালকদেয়া রাজকীয় টুপির সামনে-ঝোলা মুখঢাকা জাল । মুখ দেখা যেতেই সবায়ের কি চেঁচামেচি, প্রেম জানাবার উচ্ছ্বাস, যেন হাঙরের ঝাঁকে পড়েছে তুলতুল সি-লায়ন । রুমঝুম মুখের ওপরেই তখন কেবল ফোকাস করাচ্ছে আলো । কি একখানা মুখ , একেবারে গোলাপি ; টকটকে রক্তখোর ঠোঁট । নগেন সূত্রধর তখন চেঁচাচ্ছে, ইন হুইচ পার্ট অব আওয়ার বডি ইজ দিস কান্ট্রি নেমড লাটভিয়া পোজিশানড , ইন দি হঅর্ট অর সামহোয়্যার এল্স ?
মাইকে রুমঝুমের কন্ঠস্বর শোনা গেল, দেয়ার আর মোর উওমেন দ্যান মেন ইন লাটভিয়া, ইউ মে গো দেয়ার ইফ ইউ ওয়ান্ট টু ব্রিং এ গার্ল ফ্রম দ্যাট কান্ট্রি অ্যাজ ইওর ওয়াইফ । ইয়োর ব্রিড মে হ্যাভ চান্সেস টু গেট ফেয়ারার ।
কে চেঁচিয়ে উঠল , নিরঞ্জন তুই চলে যা , তুই তো ঝাড়া হাত-পা । নিয়ে আয় গিয়ে, তারপর সবাই মিলে তাকে বিয়ে করে নেব । তোর বাড়ি তো বিরাট, লোকচক্ষের বাইরে, নিয়ায় নিয়ায়, সমাজ-টামাজের তোয়াক্কা করিসনে । । আমি বলেছিলুম, নিয়ে আসব, আপাতত আজকে আমি একেই নিয়ে যাব, তা সে যত টাকাই লাগুক।
ওরা যখন বলল, বিয়ে ! আমার কেমন যেন অদ্ভূত রহস্যময় মনে হয়েছিল শব্দটা সেদিন । কারোর সঙ্গে সারাজীবন একসঙ্গে থাকা ! তখন তো জানতুম না মায়ার মতন কেউ জীবনের কেন্দ্র ভেদ করে ঢুকে আসতে পারে । মায়া, যার সঙ্গে আমি সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিলুম , যে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, রুপোলি চুলদাড়ির বুড়োবুড়ির জীবন । লিখতে বসে, মায়াকেই মনে পড়ছে , অথচ লাটভিয়ার মেয়েটি যখন এক-এক করে ওর পোশাক খুলছে আর ছুঁড়ে-ছুঁড়ে আমাদের দিকে ফেলছে তখন কি কাড়াকাড়ি , তখনও কেউ জানে না যে প্রতিটি জিনিসে দাম লেখা আছে , আর যার কোলে লাটভিয়ার মেয়েটি ছুঁড়েছে তাকে সেই বস্ত্রটির দাম দিতে হবে ; কেউ বোধহয় ফাইনপ্রিন্ট পড়ে দেখেনি । সবচেয়ে বেশি দাম ছিল লনজারির , যেটা রাজরানি ছুঁড়লো না কারোর দিকে ।
রুমঝুমের কন্ঠস্বর শোনা গেল , ওকে চিলড্রেন, স্টার্ট ফ্রম থাউজেন্ড রুপিজ । নিলাম জিতল পরমেশ্বর সাহা , এগারো হাজার দিয়ে । ব্যাটা ইলেট্রনিক্সে এম টেক করতে যাচ্ছে আমেরিকা, ওরই অফিসের টাকায় , আর এখানে জাঙিয়া কিনতে হামলে পড়ল ; আমেরিকা গিয়ে কী করবে কে জানে ! বলেছে, আর ফিরবে না , কেননা ওখানে বারবার ডিভোর্স দেয়া যায় , বউকে কেবল এডালটারির সুযোগ করে দিয়ে চোখ বুজে থাকতে হয় , ব্যাস, কেল্লা ফতে , অ্যালিমনি থেকে মুক্তি ।
লাল টকটকে ফিনফিনে প্যান্টিটা খোলার আগে ঘর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। শোনা গেল রুমঝুমের কন্ঠস্বর , চিলড্রেন অব স্যাটির, ইয়োর অ্যাটেনশান প্লিজ , বি প্রিপেয়ার্ড ফর বিশ্বরূপ দর্শন । আলো জ্বলল, একটিই বিন্দুতে, সারা ঘরে নয় । ফিকে নীলাভ আলো । রাজরানির যৌনাঙ্গে । এতক্ষণের হিচই একেবারে স্তব্ধ । দি বোল্ডেস্ট লেচার মে টাচ ইট ফর থ্রি থাউজেন্ড রুপিজ , বলল রুমঝুমের কন্ঠস্বর । পরমেশ্বরই উঠে দাঁড়াল । রুমঝুমের কন্ঠস্বর বলে উঠল, ওকে, প্রোসিড । হঠাৎ অন্ধকার ।
পরমেশ্বর বলেছিল, হাত দিয়ে ছুঁইনি রে, ঠোঁট দিয়ে অনুভব করেছিলুম , ফেল্ট লাইক স্লিপিং ভলক্যানো ।
রুমঝুম এবার আলোকিত ঘরে প্রবেশ করে বলল, এনি টেকার্স ? এক লাখ টাকা , ক্যাশ ডাউন । আমি পকেট থেকে হাজার টাকার প্যাকেটটা দিয়ে দিলুম ।
রুমঝুম বলেছিল, অন্যান্য আইটেমের জন্য ক্রেডিট কার্ড থাকলেও চলবে , আমি এখানের ম্যানেজমেন্টকে বলে কার্ড সোয়াইপিং করানোর ব্যবস্হা রেখেছি । আমার দিকে কিছুই ছোঁড়েনি মেয়েটা ; আমি বলেছিলুম, আমার ঝাড়া হাত-পা, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি , এখানের কোনো ঘরে ঢুকে কিছু করা নোংরামি মনে হবে ।
রুমঝুম বললে, ওকে, নো প্রবলেম । কালকে দুপুরের ফ্লাইটে ওর দিল্লি যাবার টিকিট, আপনি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবেন ।
নিয়ে গিয়েছিলুম লাটভিয়ার যুবতীটিকে । দাদুর বাবার ঘর দেখে ও ভেবেছিল আমিও এখানকার কোনো জার নিকোলাসের পরিবারের । মেয়েটি নিজের ভাষায় কি যে বলতে থাকল জানি না, ওভাবেই বোথহয় ওদের দেশে প্রেমালাপ করে । ওর হাসি, যাকে গিগল বললে সঠিক বোঝা যাবে, অমন গিগলিং আমি মিলির কন্ঠেও শুনিনি । ননস্টপ গিগল । ওই গিগল শুনতে থাকলে মেজাজ আপনা থেকেই স্বর্গীয় হয়ে ওঠে । দেখলুম সঙ্গে দেহ-ব্যবসার যাবতীয় টুকিটাকি নিয়ে ঘোরে । এর দাদু হয়ত একদা সোভিয়েত বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল ।
বেশ কেটেছিল রাতটা । ঘুমোবার আগে পর্যন্ত গিগল করেছিল । মেয়েটির সবকিছুই বড়-বড় , বুক হাত পাছা পায়ের গোছ উরুর বেড় । যাবার সময়ে চটি জোড়া নিতে ভুলে গিয়েছিল । তা রয়ে গেছে বাথরুমে , এক রাতের ফ্লিং-এর স্মৃতি হিসাবে । আমি ওর গিগল ধরে রেখেছিলুম মোবাইলে । তারপর তুলে নিয়েছি কমপিউটারে । রাতে যখন কেবল ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসে তখন ওর গিগলটার ভল্যুম বাড়িয়ে শুনি বহুক্ষণ । মন হালকা হয়ে যায় ।
মায়া মোবাইল নিয়ে ফেলে দিয়েছিল । নয়তো আমার ঘরে মায়ার কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উঠত , বারবার শুনতুম।
‘চলুন পালাই, বলার আগেই কি মায়া আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে রেখেছিল ? বলত, আমায় ভালোবাসে, অথচ ও আত্মহত্যা করলে আমাকে যে কি হেনস্হা পোয়াতে হবে তা চিন্তা করেনি । আমি বোধহয় ছিলুম ওর কোনো আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যপূর্তির মাধ্যম ! মায়া, তুমি আমাকে ভালোবাসা শেখালে, আর এভাবে হঠাৎ আমার জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে । তোমার নিরুদ্দেশে যেতে চাইবার উদ্দেশ্য আজ আবছাভাবে বুঝতে পারি , কিন্তু তার কারণ জানি না, সেই কারণের উৎসসূত্র জানি না । আমি তোমাকে মিলির কথা, লাটভিয় যুবতীটির কথা, অন্যান্য নারীদের কথা কতবার বলতে চেয়েছি । বলতে দাওনি । তুমি অতীতকে মুছে ফেলার শর্তে জোর দিয়েছ বারবার । তাহলে ঝুলে গেলে কেন গাছ থেকে ? অতীতকে একেবারে নিজের সঙ্গে নিশ্চিহ্ণ করে দিতে ?
এতখানি পড়ার পর রিমা স্বগতোক্তি করল, ওঃ, চটিজোড়া তাহলে জনৈকা বিদেশিনীর । কত লীলেই দেখালে গো কংকাল প্রেমিক ! আর পুরুষদের খেলনার কথা তো জানতুম না । তার ওপর আবার কেক । কেক কাটছেন কে ? না আজ বাদে কাল যার বিয়ে ! ওঃ, খুব বেঁচেছি বিয়ে না করে । এরকমই কোনো সাতঘাটিয়া ছোঁড়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিলেই হয়েছিল আরকি । পুলিস ডিপার্টমেন্ট কি এই যৌথ যৌন কাজ-কারবারের তথ্য রাখছে ? ডিসি ডিডিকে বলে রাখতে হবে ।
প্রিন্টআউট পড়া বজায় রাখল রিমা ।
আমার টেলিফোনের ব্যক্তিগত ডায়েরিটা খুঁজে বের করলুম । ফোনে চেষ্টা করলুম বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে । নিমাই মাইতিকে পেলুম, বিয়ে করে সংসারি , হাগবার পর্যন্ত ফুরসত নেই । ও বললে, প্রায় সবাই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে কেটে পড়েছে , তার মধ্যে বেশির ভাগই বিদেশে । যারা বিদেশে তাদে কোনো খোঁজখবর নেই । সীতারাম বুড়ো মা-বাবাকে ফেলে পালাতে চায়নি বলে রয়ে গেছে , বিয়েথা করেনি , রাজারহাটে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে , তোর বাঙলোর ওদিকেই কোথাও , একদিন দেখা হয়েছিল পার্কস্ট্রিটে, পার্ক হোটেলে । নিজামুদ্দি এসেছে বোধহয়, ওর বাড়িতে ঢুঁ মার, বিয়েটিয়ে করেনি , একটা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল , তুই তো বাঙালি হিন্দুর মেন্টালিটি জানিস, অসাম্প্রদায়িক হবার চেষ্টা করেও ভয়ে পেছিয়ে আসে, বেচারা । নিজামুদ্দিরও সেম কেস ; ইসতামবুলে কায়রোয় আলজিরিয়ায় ছিল । কি করে ওসব দেশে ছিল জানি না , ওসব দেশে তো সেক্স একেবারে নো নো । এত কোয়ালিফায়েড , যেতে পারত কোনো ইউরোপীয় দেশে , মেয়েমানুষ আর ইউরো ভোগ করত, তা নয়, একেবারে মজনু হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে ; শালা এই লায়লা-মজনু রোমিও-জুলিয়েট পারু-দেবদাস গালগল্পগুলোই প্রেমিক-প্রেমিকাদের ডোবল । তুই শান্তনুকে চিনিস ? আমাদের চেয়ে এক বছর সিনিয়ার ? ও তো অ্যামস্টারডামে পোস্টিং পেয়েছে ; একদিন ফোনে বলছিল ওরকম শহর আর হয় না , নেপোলিয়ান নাকি প্রসটিটিউশান লিগালাইজ করে দিয়েছিল সে দেশে, সেই থেকে এদেশে একটা এলাকাই আছে ডি ওয়ালেন নামে । ওই রাস্তার কাছেপিঠে ও ফ্ল্যাট নিয়েছে ; তবে ভিষণ কস্টলি শহর । তোর তো বাপের অফুরন্ত টাকা আছে, বেড়েই চলেছে শুনি । চলে যা । লাটভিয়া গিয়েছিলি ? ও যাসনি । চলে যা , পড়ে পড়ে কি করবি ? চাকরিও করবি না । তাহলে করবিটা কি ? ওকে ছাড়ছি । আবার কথা হবে একদিন । বাইইইইই ।