ডিকটেটর

ডিক্‌টেটর

পুণাতে আমার বাড়ির সামনে রাস্তার ওপারে একটা বড় গোছের মাঠ আছে। এবড়োখেবড়ো খানাখন্দ-ভরা মাঠ; বর্ষাকালে যখন মাঠে কচি সবুজ ঘাস গজায় এবং খানাখন্দ জলে ভরে ওঠে, তখন একটা ছেলে একপাল মোষ নিয়ে এখানে চরাতে আসে।

হাতির মতো প্রকাণ্ড দশ-বারোটা মোষ। যে-ছেলেটা চরাতে আসে তার গায়ের রঙ মোষের মতোই কালো। তার শরীরের খাড়াই দেড় হাত, কোমরে ঘুন্‌সি ছাড়া লজ্জা নিবারণের আর কোনও উপকরণ নেই, হাতে পেন্সিলের মতো একটি লাঠি। বয়স বড় জোর সাত বছর। মারাঠীরা বেঁটে জাত; ছেলেটার বয়সের অনুপাতে শারীরিক দৈর্ঘ্যে কোনও অসঙ্গতি নেই।

আমি বারান্দায় বসে ওই ছেলেটাকে এবং ওর অধীনস্থ মোষগুলোকে দেখি, আর অবাক হয়ে যাই। কী অখণ্ড প্রতাপ ছেলেটার। মোযগুলো যদি বাঁ পায়ে চাট মারে তাহলে ছেলেটা বোধহয় পুণা ডিঙিয়ে মহাবলেশ্বরে পৌঁছে যায়, তাদের ধারালো বাঁকা শিঙ একটু নাড়লে ছেলেটা শূলবিদ্ধ হয়ে পটল তোলে। কিন্তু ছেলেটার প্রাণে ভয়-ডর নেই, মোষগুলো যেন তার খেলার সাথী। আর মোষগুলোর ভাবগতিক দেখে মনে হয় তারা ওর খাস তালুকের প্রজা।

মোষ নামক জন্তুটা দেখতে ভয়ঙ্কর, কিন্তু এমন নিরীহ জীব বোধ হয় পৃথিবীতে নেই। বন্য অবস্থায় ওরা হয়তো ভয়ঙ্কর ছিল, কিন্তু মানুষের সংসর্গে এসে একেবারে বৈষ্ণব হয়ে পড়েছে। তবু দু’ একবার ওদের ক্ষিপ্র রোষ দেখেছি; দুটো মোষ হঠাৎ শিঙে শিঙ আটকে মল্লযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, রক্তারক্তি কাণ্ড। কিন্তু তা এতই বিরল যে সেটা ওদের চরিত্রের ব্যতিক্রম্‌ বলে ধরা যেতে পারে।

আমি বসে বসে ওদের কার্যকলাপ দেখি। ছেলেটা মাঠের মাঝখানে পেন্সিলের মতো লাঠি কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মোষগুলো চরতে চরতে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। দু’ একটা মোষ রাস্তার কিনারার দিকে চলেছে। ছেলেটা অমনি মুখে টক্‌ টক্‌ টকাস্ টকাস্ শব্দ করল। মোষগুলো ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালে, ছেলেটা লাঠি ঘুরিয়ে কী ইশারা করল জানি না, তারা মোড় ফিরে রাস্তার ধার থেকে সরে এল। ছেলেটা তখন নিশ্চিন্ত মনে গুলি-ডাণ্ডা খেলতে লাগল। তার সঙ্গী-সাথী নেই, খেলার দোসর নেই, সারাদিন একলাটি মোষগুলোকে নিয়ে কাটিয়ে দেয়।

দুপুরবেলা মোষগুলো জলে ভরা খানাখন্দের মধ্যে নেমে যায়, গলা বের করে বসে থাকে। পুণায় বর্ষাকালে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি হয় না, কখনো রিমঝিম বৃষ্টি কখনো ফিস্‌ফিস্ ইল্‌শেগুঁড়ি। আকাশ কিন্তু সারাক্ষণ মেঘে ঢাকা থাকে, সূর্যদেব মলমলের ঘোমটার আড়াল থেকে স্নিগ্ধ প্রভা বিকীর্ণ করেন। পুণায় সালিয়ানা বৃষ্টি মাত্র পঁচিশ ইঞ্চি; তাই পুণার বর্ষা এত মধুর।

বিকেলবেলা মোষগুলো জল থেকে বেরিয়ে আসে, আবার মাঠে চরে বেড়ায়। কখনো বা সবাই একজোট হয়ে ঘাসের ওপর বসে, নিশ্চিন্তভাবে রোমন্থন করে। ছেলেটা তখন কোনও একটা মোষের প্রশস্ত পিঠের ওপর গিয়ে শোয়, বোধ হয় একটু ঘুমিয়ে নেয়। অন্য মোষগুলো গলা বাড়িয়ে তার গা চেটে আদর জানায়।

মানুষ ও পশুর মধ্যে নিবিড় সখ্য। আবার একদিকে কঠিন শাসন, অন্যদিকে নির্বিবাদ আনুগত্য। এই সম্পর্কের মুলে কোনও হেতু খুঁজে পাওয়া যায় না; যেমন হেতু খুঁজে পাওয়া যায় না মনুষ্য সমাজে ডিক্‌টেটর নামক জীবের।

গত চল্লিশ বছর ধরে কত ডিক্‌টেটর দেখলাম। মুস্তাফা কামাল, মুসোলিনী, হিটলার, স্টালিন, তাছাড়া ক্ষুদে ডিক্‌টেটর তো অসংখ্য। এরা কিসের জোরে এমন একাধিপত্য করে? কোথায় এদের শক্তির উৎস? কেন দেশসুদ্ধ লোক গড্ডলিকা প্রবাহের মতো এদের অনুসরণ করে, কেন কান ধরে এদের গালে থাবড়া মারে না? আমি আজ পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি। কিন্তু উত্তর যেমনই হোক, এই মেষপালক ছেলেটা যে একজন খাঁটি ডিক্‌টেটর তাতে সন্দেহ নেই। তার এই অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় একদিন হাতে হাতে পেয়েছিলাম বলেই আজ এই কাহিনীর অবতারণা।

আমার দু’নম্বর নাতি বম্বেতে তার মা-বাপ জেঠা-জেঠির কাছে থাকে, মাঝে মাঝে সবাই মিলে পুণায় আসে। মধ্যম নাতির বয়স পাঁচ বছর, অতিশয় ক্ষীণকায় ব্যক্তি। হাত-পা কাঠির মতো। তাই তার নাম রেখেছি কাঠিচরণ।

গত বছর শ্রাবণ মাসে কাঠিচরণ পুণায় এসেছে। পুণায় তখন বেশ ঠাণ্ডা, তার ওপর সে একটু শীত-কাতুরে। তার জেঠাই তাকে গরম জামাকাপড় পরিয়ে দিয়েছে। সে বাগানে কুকুর কালীচরণের সঙ্গে খেলা করছে।

বিকেলবেলা বৃষ্টি থেমেছে, মেঘের আড়ালে সূর্যদেব ঝিক্‌মিক্‌ করছেন; কাঠিচরণ আমাকে বলল, ‘দাদু, আমি পেশোয়া পার্কে হনুমান দেখতে যাব।’

বললাম, ‘হনুমান দেখার জন্যে পেশোয়া পার্কে যাবার কী দরকার?’

বক্রোক্তিটা সে বুঝল কিনা জানি না, গম্ভীর মুখে বলল, ‘পেশোয়া পার্কের হনুমানদের লম্বা লেজ আছে।’

বললাম, ‘তা বটে। চল তবে দেখে আসা যাক।’

বলা বাহুল্য, পেশোয়া পার্কে একটি ছোটখাটো চিড়িয়াখানা আছে। বাঘ, সিংহ, খট্টাস, নানা জাতের বানর, নানা জাতের পাখি, সব আছে। তাই শিশুদের কাছে স্থানটি পরম লোভনীয়।

কাঠিচরণকে নিয়ে বেরুলাম। সামনেই মাঠ, মাঠের ওপারে পেশোয়া পার্ক। রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে একটু ঘুর পড়ে, তাই মাঠের ভিতর দিয়ে চললাম।

মাঠ বেশ ভিজে ভিজে। মোষগুলো এদিক-ওদিক চরে বেড়াচ্ছে। আমি আর কাঠিচরণ সাবধানে খানাখন্দ বাঁচিয়ে মাঠের মাঝামাঝি পৌঁছেছি, হঠাৎ চোখ তুলে একেবারে চক্ষুস্থির। বিভিন্ন দিক থেকে দশ-বারোটা মোষ ঘাড় বেঁকিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের তাকানোর ভঙ্গিটা ভাল নয়। বিরাগপূর্ণ ভাব। যেন আমাদের দেখে তারা চটেছে।

তারপরেই চোখে পড়ল, কাঠিচরণের গায়ে লাল রঙের সোয়েটার। গরু-মোষ যে লাল রঙ দেখলেই চটে যায় এটা আগে খেয়াল করিনি। সর্বনাশ!

মোষগুলো বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। একটা মদ্দা মোষ ‘গোঁ—’ শব্দ করল, তারপর সবাই শিঙ বাগিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ব্যাকুল চক্ষে চারিদিকে তাকালাম। কিন্তু পালাব কোথায়? মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, মহিষ-ব্যুহ ভেদ করে পালাবার রাস্তা নেই। কাঠিচরণ রোগা হলেও বুদ্ধিমান ছেলে, ব্যাপার বুঝতে পেরেছিল। সে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে আমার কাঁধে চড়ে বসল।

নিরুপায় হয়ে মহিষমর্দিনী দুর্গার নাম জপ করছি, কিন্তু কোনও ফল হচ্ছে না। মোষগুলো সপ্তরথীর মতো ঘিরে ধরেছে, দশ-বারো গজের মধ্যে এসে পড়েছে। আর রক্ষে নেই। সবাই মিলে একসঙ্গে শিঙ নাড়বে আর আমরা শিককাবাব হয়ে যাব।

চোখ বুজে প্রতীক্ষা করছি, আর দেরি নেই। হঠাৎ কানে শব্দ এল—টক্ টক্ টকাস্ টকাস্। চোখ খুলে দেখি মোষগুলো দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর এগুচ্ছে না। তারপর মোষগুলোর পিছন দিক থেকে তীক্ষ আওয়াজ হল—‘হিঁ—ইঁ—ইঁ—ইঁ—।’

মোষগুলো একটু ইতস্তত করল। তারপর ফোঁস্ ফোঁস্ নিশ্বাস ফেলে পাশের দিকে ফিরল। সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে দেখছি, তারা আমাদের দিকে পিছন ফিরল, তারপর যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবে ঘাস খেতে খেতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তখন দেখতে পেলাম পেন্সিলের মতো লাঠি হাতে ঘুন্‌সি-পরা ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ গম্ভীর, চোখে র্ভৎসনার দৃষ্টি।

মনে মনে ন্যাংটা ছেলেটাকে তার অলৌকিক শক্তির জন্যে সাধুবাদ জানালাম, মুখে কিছু বলা হল না, কারণ তার ভাষা জানি না।

কাঠিচরণকে কাঁধে নিয়েই বাড়ি ফিরে এলাম। লম্বা ল্যাজওয়ালা হনুমান দেখার উৎসাহ আর নেই, আজ যা দেখেছি আজকের পক্ষে তাই যথেষ্ট।

ডিক্‌টেটরদের আমরা ভালবাসি না। ওরা মানুষ ভাল নয়, জনগণের শক্তি অপহরণ করে ওরা জনগণকেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। ওদের এই শক্তি অপহরণের চাবিকাঠি কোথায় তা জানি না। কিন্তু এই অতিমানুষিক শক্তি মাঝে মাঝে আমার মতো সাধারণ মানুষের খুব কাজে লাগে।

১ মে ১৯৬২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *