মুষ্টিযোগ
পূণায় আমার পাশের বাড়ির একতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছেন, নাম শম্ভুশঙ্কর লেলে। নাগপুরে না কোথায় এক কলেজে প্রিন্সিপাল ছিলেন, পঞ্চাশোর্ধ্বে অবসর পেয়ে আমাদের পাড়ায় বাসা নিয়েছেন। গ্যাঁটাগোঁটা চেহারা, কপালে ভ্রূকুটি, হাঁটুতে বাত; লাঠি ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেন।
একদিন বাড়ির সামনে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। বিকেলবেলা আমি বেড়াতে বেরিয়েছি, উনিও বেরিয়েছেন। মুখোমুখি হতেই ভাবলাম, নতুন পড়শী, আলাপ পরিচয় করা দরকার। কিন্তু সম্বোধন করেই বোকা বনে গেলাম, তিনি ভুরু কুঁচকে এমন রূঢ়ভাবে জবাব দিয়ে চলে গেলেন যে তারপর আর আলাপ পরিচয় করা চলে না। বুঝলাম, লেলে মশায় কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন, পণ্ডিত ব্যক্তি; সামান্য অ-পণ্ডিত পড়শীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না।
যাহোক, পণ্ডিত ব্যক্তিদের অবহেলায় আমি অভ্যস্ত, লেলে মশায়ের রূঢ়তা গায়ে মাখলাম না। পরে জানতে পেরেছিলাম, কারুর প্রতি তাঁর পক্ষপাত নেই, সকলের সঙ্গে তিনি সমান ব্যবহার করেন। আমাদের পাড়াটা যে মূর্খের পাড়া, একথা তিনিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।
এবার দারুণ গরম পড়েছে। অন্যান্য বার এই সময় মাঝে মাঝে ঝড়বৃষ্টি হয়ে গরম চড়তে দেয় না, এবার বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। বিকেলবেলা বাড়ির মধ্যে থাকা যায় না। আমি সাধারণত বেড়াতে বেরুই; কিন্তু আজ একটি বিশেষ কারণে বাড়ির বার হইনি, বাড়ির সামনে বন্ধ ফটকের কাছে চেয়ার পেতে বসেছি।
কারণটি এই। গতরাত্রে পেশোয়া পার্কের চিড়িয়াখানা থেকে একটা হায়েনা খাঁচা ভেঙে পালিয়েছে। খবরটা আজ সকালে রাষ্ট্র হবার পর থেকে এদিকে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, চারিদিকে একটা ছম্ছমে ভাব। এদেশে হায়েনাকে তরস্ বলে। বোধ হয় তরক্ষুর অপভ্রংশ। হায়েনা দেখতে কতকটা বড় জাতের কুকুরের মতো, ঘাড় নিচু করে চলে, খট্খট্ হাসির মতো তার ডাক। অত্যন্ত হিংস্র জন্তু, চেহারা দেখলেই ভয় করে। তাই আজ আর বাড়ি থেকে বেরুইনি, হায়েনার নৈশাহারে পরিণত হবার ইচ্ছে নেই। আমার ফটক বেশ উঁচু, তা ডিঙিয়ে হায়েনা আমাকে খাবে সে-সম্ভাবনা নেই।
একলাটি বসে আছি। আরো কয়েকটি চেয়ার সাজানো রয়েছে; কিন্তু আজ যে কেউ আসবে সে-আশা নেই। আমার কুকুর কালীচরণ প্রায়ই আমার সঙ্গে বেড়াতে বেরোয়, আজ দেখছি একলাই বেরিয়েছে। ব্যাটাকে হায়নায় না ধরে। কালীচরণের স্বভাবটা একটু বেশী মিশুক, হায়েনার সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব পাতাতে যায়—
ফটকের গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখলাম শম্ভুশঙ্কর লেলে লাঠিতে ভর দিয়ে বেড়াতে চলেছেন। একবার ভাবলাম তাঁকে ডেকে হায়েনার কথাটা জানিয়ে দিই, তিনি সম্ভবত জানেন না। তারপরে ভাবলাম, কী দরকার! যে-লোক বিদ্যার অহঙ্কারে মানুষের সঙ্গে কথা কয় না সে অহঙ্কারের ফল ভোগ করুক। আমি মুখ-ঝাম্টা খেতে যাই কেন!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে এমন সময় আমার দুই মারাঠী বন্ধু এলেন। আমারই সমবয়স্ক দু’জন; তাঁদের সমাদর করে বসিয়ে বললাম, ‘একি! আপনাদের প্রাণে কি হায়েনার ভয় নেই?’
অভ্যঙ্কর মশায় বললেন, ‘হালের খবর আপনি শোনেননি, হায়েনা ধরা পড়েছে।’
পাটিল বললেন, ‘রাত্তিরে পালিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিল কিন্তু সেখানে খেতে পায়নি। পেটের জ্বালায় আজ বিকেলবেলা নিজেই খাঁচায় ফিরে এসেছে।’
ইতর প্রাণীদের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে খাবারের দাম বেশী এই কথা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, অভ্যঙ্কর মশায় বললেন যে, মানুষ যদি পেট ভরে নিজের পছন্দসই খাবার খেতে পেত তাহলে সেও স্বাধীনতা চাইত না; এমন সময় দূরে একটা ক্ষীণ চিৎকারের শব্দ শুনে আমরা তিনজন ফটকের বাইরে চোখ ফেরালাম। রাস্তা দিয়ে একটা লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে, আর তার পিছনে বিশ হাতে দূরে লাফাতে লাফাতে আসছে কালো একটা জানোয়ার। রাস্তায় অন্য লোক নেই।
গোধূলির ঘোলাটে আলো সত্ত্বেও পলায়মান লোকটিকে চিনতে দেরি হল না, আমার নবাগত প্রতিবেশী শম্ভুশঙ্কর লেলে। তাঁর লাঠি কোথায় গেছে জানি না, পায়ে বাতের ব্যথারও কোনও লক্ষণ নেই; তিনি ছুটে আসছেন রেস্-এর ঘোড়ার মতো।
আমরা হতভম্ব হয়ে বসে আছি, এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল। আমার ফটকের খাড়াই পাঁচ ফুটের কম নয়; শম্ভুশঙ্কর লেলে সেই ফটক এক লাফে ডিঙিয়ে আমাদের মধ্যে এসে পড়লেন এবং একটা চেয়ারে হাত-পা এলিয়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁপাতে লাগলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘তরস্—হায়েনা—’
কিন্তু কোথায় হায়েনা! ফটকের দিকে চেয়ে দেখি আমার কালীচরণ সমস্ত দাঁত বের করে হাসছে এবং প্রফুল্লভাবে ল্যাজ নাড়ছে। ব্যাপার বুঝতে পারলাম, শম্ভুশঙ্কর কেলোকে হায়েনা মনে করে দৌড় মেরেছিলেন।
শম্ভুশঙ্কর যে মহাপণ্ডিত ব্যক্তি, একথা বোধ হয় অবস্থাগতিকে ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি একটু দম নিয়ে যা বললেন তার মর্ম এই : বেড়াতে বেরিয়ে পেশোয়া পার্কের কাছাকাছি যেতেই একটা অজ্ঞ লোক তাঁকে বলল, ‘রাও, বাড়ি ফিরে যাও, একটা তরস্ ছাড়া পেয়ে আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ শুনেই শম্ভুশঙ্কর তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে ফিরলেন। খানিক দূরে এসে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, একটা কালো জন্তু তাঁর পিছু নিয়েছে। তিনি দৌড়ুতে আরম্ভ করলেন, তারপর আমাদের দেখতে পেয়ে ফটক ডিঙিয়ে এখানে এসেছেন।
অভ্যঙ্কর গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হায়েনা নয়, আপনাকে তাড়া করেছিল—কুকুর।’
‘কুকুর!’ শম্ভুশঙ্কর ভ্রূকুটি করে সোজা হয়ে বসলেন।
পাটিল নীরস স্বরে বললেন, ‘তাড়া করেনি। আপনি দৌড়ুচ্ছেন দেখে আপনার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল।’
শম্ভুশঙ্কর ফটকের কাছে কালীচরণকে দেখলেন, আমাদের দিকে কট্মট্ করে তাকালেন; তারপর নিঃশব্দে উঠে চলে গেলেন।
এই ঘটনার পর শম্ভুশঙ্কর আমাদের ওপর মর্মান্তিক চটে গেছেন। আমরা শুধু মুর্খই নয়, তাঁর আত্মমর্যাদায় ভীষণ আঘাত করেছি। এখন আমাদের দেখলে তিনি মুখ ফিরিয়ে চলে যান।
তবে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে। তাঁর হাঁটুর বাত একেবারে সেরে গেছে। তিনি আর লাঠি ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন না, সোজা দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটেন। দৌড়োদৌড়ি এবং হাই-জাম্প্ করলে হাঁটুর বাত সেরে যায় একথা আগে জানতাম না।
১২ জুলাই ১৯৬২